2 of 2

৭০. কুরায়শ যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ আদায়

কুরায়শ যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ আদায়

ইবন ইসহাক বলেন, : বদর যুদ্ধের বন্দীদের মধ্যে একজন ছিল আবু ওয়াদাআ ইবন যাবীরাতুস সাহিমী। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, মক্কায় তার এক ছেলে আছে। সে খুব চতুর, ব্যবসায়ী ও সম্পদশালী। মনে হয় সে তার পিতাকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্যে তোমাদের কাছে আসবে। কুরায়শরা যখন বলাবলি করছিল যে, তোমরা বন্দীদের ছাড়াবার জন্যে খুব তাড়াহুড়া করবা না। তা হলে মুহাম্মদ ও তাঁর সংগীরা মুক্তিপণের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেবে, তখন মুক্তালিব ইবন ওয়াদাআ (রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পূর্বকথিত সেই ছেলেটি) বলল, তোমরা ঠিকই বলেছি, তাড়াহুড়া করা যাবে না। কিন্তু এ কথা বলে সে নিজেই রাতের আধারে মক্কা থেকে বেরিয়ে মদীনায় এসে চার হাযার দিরহামের বিনিময়ে তার পিতাকে ছাড়িয়ে নিয়ে

চলে যায়।

এই ওদাআ হচ্ছে প্রথম বন্দী যাকে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছাড়ান হয়। এরপর কুরায়শরা তাদের বন্দীদের মুক্ত করাবার জন্যে পর্যায়ক্রমে মুক্তিপণ পাঠাতে থাকে। তখন মিকরা য ইবন হাফস ইবন আখয়াফ সুহায়ল ইবন আমরের মুক্তির ব্যাপারে আসলো। তাকে বনু সালিম ইবন আওফ গোত্রের মালিক ইবন দাখশাম বন্দী করেছিল। এ প্রসঙ্গে সে নিমের স্বরচিত কবিতা

আবৃত্তি করল?

bbr–

اسرت سهیلا فلا ابتغی +–اسیرابه من جمیع الامم و আমি তো সুহায়লকে বন্দী করেছি। তাকে বাদ দিয়ে দলের অন্য কাউকে বন্দী করতে আমি চাইনি।

খুনন্দুফ গোত্র এ বিষয়ে অবগত আছে যে, যখন তারা অত্যাচারিত হয়, তখন মুকাবিলার জন্যে একমাত্ৰ সুহায়লই বীর পুরুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়।

আমি ঠোঁটওয়ালা (ঠোটকাটা)-কে আঘাত করলে সে নত হয়ে পড়ে এবং ঠোটকাটা চিহ্নধারীর সাথে যুদ্ধ করতে আমি বাধ্য হই।

ইবন ইসহাক বলেন, : সুহায়লের নীচের ঠোঁট কাটা ছিল। ইবন ইসহাক বলেন, : বনু আমির ইবন লুআই গোত্রের মুহাম্মদ ইবন আমর ইবন আতা আমাকে বলেছেন যে, উমর ইবন খাত্তাব (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বললেন, : আমাকে অনুমতি দিন, আমি সুহায়লের সামনের উপর-নীচের দুটো করে চারটা দাঁত উপড়ে ফেলি। এতে তার জিহবা ঝুলে থাকবে। ফলে আর কখনও কোথাও দাঁড়িয়ে আপনার বিরুদ্ধে ভাষণ দিতে পারবে না। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আমি তার মুখ বিকৃত করব না। তা হলে আল্লাহ আমার মুখ বিকৃত করে দেবেন। যদিও আমি নবী হই না কেন।

এ হাদীছটি মুরসাল। বরং মুযাল।” ইবন ইসহাক বলেনঃ আমি আর ও জেনেছি, রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত উমরকে এ প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন যে, ভবিষ্যতে সুহায়াল এমন ভূমিকাও রাখতে পারে যা নিন্দনীয় হবে না। (আমি ইবন কাহীর) বলি, সে ভূমিকা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ইনতিকালের পর যখন গোটা আরবে বহু লোক মুরতাদ হয়ে যায় এবং মুনাফিকরা মদীনায় সংঘবদ্ধ হয়, ইসলামের এ দুর্দিনকালে সুহায়াল মক্কায় ভাষণ বক্তৃতার মাধ্যমে লোকদের সঠিক দীনের উপর অবিচল হয়ে থাকার ব্যপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এ সম্পর্কে শীঘ্রই আলোচনা করা হবে। ”

ইবন ইসহাক বলেন? মিকরায সুহায়লের ব্যাপারে আলোচনা করে যখন তাদেরকে রায়ী করাল, তখন তারা বলল, ঠিক আছে আমাদের পাওনাটা দিয়ে দাও। মিকরা যা বলল, তোমরা তার স্থলে আমাকে বন্দী কর এবং তাকে ছেড়ে দাও। সে গিয়ে তোমাদের মুক্তিপণ পাঠিয়ে দেবে। তার কথামত তারা সুহায়লকে ছেড়ে দিল এবং মুকরিযকে বন্দী করে রেখে দিল। ইবন ইসহাক এ স্থানে মুকরিযের একটি কবিতা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ইবন হিশাম, তা উল্লেখ করেননি। ইবন ইসহাক আবদুল্লাহ ইবন আবু বকর থেকে বর্ণনা করেন : বদর যুদ্ধের বন্দীদের মধ্যে আমর ইবন আবু সুফিয়ান— সাখার ইবন হারবও ছিল। ইবন ইসহাক বলেন তার মা ছিল উকবা ইবন আবু মুআয়তের কন্যা। কিন্তু ইবন হিশাম বলেছেন, তার মা আবু মুআয়তের বােন। ইবন হিশাম বলেন, তাকে বন্দী করেছিলেন আলী ইবন আবু তালিব। ইবন ইসহাক

১. মুযাল হচ্ছে ঐ বর্ণনা, যে বর্ণনার সনদে একাধিক রাবীর নাম অনুল্লিখিত থাকে।

বলেন, : আমার নিকট আবদুল্লাহ ইবন আবু বকর বর্ণনা করেন যে, আবু সুফিয়ানকে বলা হল, তোমার ছেলে আমরকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আন। সে বলল, আমার উপর কি একই সাথে রক্ত ও আমার সম্পদ একত্রিত হবে? তারা হানযালাকে হত্যা করেছে। এখন আবার আমরকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হবে? ওকে তাদের হাতে থাকতে দাও! যতদিন ইচ্ছা তারা ওকে বন্দী করে রাখুক! বৰ্ণনাকারী বলেন, আবু সুফিয়ানের ছেলে আমার মদীনায় বন্দী অবস্থায় ছিল। এরই মধ্যে বনু আমর ইবন আওফের শাখা গোত্র বনু মুআবিয়ার সাআদ ইবন নুমান ইবন আক্কাল উমরা করার উদ্দেশ্যে বের হন। তার সাথে ছিল একটি দুগ্ধবতী উস্ত্রী। বয়সে তিনি ছিলেন একজন বৃদ্ধ মুসলিম। বাকী’ নামক স্থানে তিনি মেষপাল নিয়ে থাকতেন। সেখান থেকেই উমরার জন্যে যাত্রা করেন। উমরা পালন করতে যাচ্ছেন বিধায় তিনি ধারণা করতে পারেননি যে, তাকে মক্কায় আটকে রাখা হবে। কারণ, কুরায়শদের সাথে চুক্তি ছিল, কোন লোক হজ্জ বা উমরা করতে আসলে তার সঙ্গে তারা ভাল ছাড়া মন্দ আচরণ করবে না। কিন্তু সুফিয়ান ইবন হারব তার প্রতি জুলুম করল এবং তার পুত্র আমরের বিনিময়ে তাকে মক্কায় বন্দী করে রাখল। এ প্রসঙ্গে আবু সুফিয়ান নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করে :

হে ইবন আক্কালের দলের লোকেরা! তোমরা এখন তার ডাকে সাড়া দাও। তোমরা তো পরস্পর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলে যে, এই বয়ােবৃদ্ধ নেতাকে শক্ৰদের হাতে অর্পণ করবে না।

কেননা, বনু আমার দুরাচার ও হীন প্রকৃতির বলে ধরা হবে। যদি তারা আটককৃত বন্দীদের মুক্তি না দেয়। হাসসান ইবন ছাবিত (রা) এর জবাবে বলেন?”

সাআদ যদি সেদিন মক্কায় মুক্ত অবস্থায় থাকত, তবে সে নিজে বন্দী হওয়ার আগে তোমাদের অনেককেই হত্যা করতো।

সে হত্যা করতো ধারাল তলোয়ার দিয়ে কিংবা নাবা আ কাঠের তৈরি তীর দিয়ে, যে তীর নিক্ষেপ কালে ধনুক থেকে সশব্দে বেরিয়ে যায়।

বর্ণনাকারী বলেন, বনু আমর ইবন আওফ-এর লোকজন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে সাক্ষাত করে তাকে সাআদ সম্পর্কে সংবাদ জানিয়ে নিবেদন করলো : তিনি যদি আমর ইবন আবু সুফিয়ানকে তাদের হাতে সমর্পণ করেন, তা হলে তার বিনিময়ে তারা তাদের লোককে ছাড়িয়ে আনবে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমরকে তাদের হাতে সমর্পণ করেন। তখন তারা আমরকে তার পিতা আবু সুফিয়ানের নিকট পাঠিয়ে দেয়। ফলে আবু সুফিয়ান সাআদ (রা)-কে মুক্ত করে দেয়। ইবন ইসহাক বলেনঃ বদর যুদ্ধের বন্দীদের মধ্যে রাসূল (সা)-এর জামাতা— তাঁর কন্যা যয়নবের স্বামী আবুল আস ইবন রবী’ ইবন আবদুল উযযা ইবন আবদে শামস ইবন উমাইয়াও ছিলেন। ইবন হিশাম বলেন, : তাকে বন্দী করেছিল বনু হারাম গোত্রের খিরাশ ইবন সাম্মা। ইবন ইসহাক বলেন, : আবুল ‘আস ছিলেন সম্পদে, বিশ্বস্ততায় ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মক্কার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তার মা হালা বিনত খুওয়ায়ালিদ ছিলেন খাদীজা বিনত খুওয়ায়লিদের বোন।

হযরত খাদীজা (রা) তাঁর কন্যা যয়নবকে আবুল আসের সাথে বিবাহ দেয়ার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট প্রস্তাব করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) খাদীজার কোন কথা সাধারণত প্রত্যাখ্যান করতেন না। এ ছিল ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বের ঘটনা। এ ছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা) আবু লাহাবের পুত্ৰ উতবার সাথে তাঁর কন্যা রুকাইয়া মতান্তরে উম্মে কুলছুমকে বিবাহ দেন। (ইসলাম প্রচারের পর) আবু লাহাব কুরায়শদের বলল, তোমরা মুহাম্মদকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রাখার ব্যবস্থা কর। এ উদ্দেশে সে তার পুত্র উতবাকে বলল, তুমি মুহাম্মদের কন্যাকে তালাক দাও! পিতার নির্দেশে উতবা স্ত্রীকে বাসর রাতের পূর্বেই তালাক দিয়ে দেয়। তারপর হযরত উছমান ইবন আফফান তাঁকে বিবাহ করেন। এরপর কুরায়শরা আবুল আসের কাছে গিয়ে বলল, তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক দাও। তা’হলে তুমি কুরায়শদের যে কোন সুন্দরীকে চাও, তার সাথে। তোমাকে বিবাহ দেব। আবুল ‘আস বললেন, আল্লাহর কসম, আমি আমার স্ত্রীকে ত্যাগ করবো না এবং তার স্থলে অন্য কোন কুরায়শী স্ত্রীলোককে বিবাহ করা আমি পসন্দও করি না।

ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) জামাতা হিসেবে আবুল আসের প্রশংসা করতেন। ইবন কাহীর বলেন, আবুল আসের প্রশংসামূলক হাদীছ সহীহ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। পরবতীতে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করব। ইবন ইসহাক বলেন : মক্কায় রাসূলুল্লাহর ক্ষমতা অর্জিত না হওয়ায় তিনি সেখানে হালাল-হারামের বিধান দিতেন না। যয়নবের ইসলাম গ্রহণের ফলে আবুল আসের সাথে তাঁর বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ করে দিতে সক্ষম ছিলেন না। (আমি ইবন কাহীর) বলি, মুশরিকদের সাথে মুসলমানদের বিবাহ হারাম হওয়ার বিধান ৬ষ্ঠ হিজরীতে হুদায়বিয়ার সন্ধির বছরে প্রবর্তিত হয়। এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা হবে। ইবন ইসহাক বলেন, : ইয়াহইয়া ইবন আব্বাদ সূত্রে আইশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মক্কাবাসীরা যখন তাদের বন্দীদের ছাড়াবার জন্যে মুক্তিপণ দিয়ে পাঠাল, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কন্যা যয়নব তার স্বামী আবুল আসের মুক্তির জন্যে মুক্তিপণ হিসেবে কিছু মাল দিয়ে পাঠান। ঐ মালের মধ্যে একটা হারও ছিল। হযরত খাদীজা এ হারটি যায়নবের গলায় পরিয়ে আবুল আসের ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আইশা (রা) বলেন, হারটি দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর হৃদয় অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তিনি লোকদেরকে বললেন, যদি তোমরা ভাল মনে কর, তবে যায়নবের বন্দীকে বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে দাও এবং সে যে মাল পাঠিয়েছে তা তাকে ফেরত দিয়ে দাও। সাহাবাগণ বললেন, জী, হ্যা ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে রকমই করা হবে। এরপর তারা আবুল আসকে মুক্তি দিলেন এবং যয়নবের প্রেরিত সমস্ত মালামাল ফেরত পাঠালেন। ইবন ইসহাক বলেন, : বদরের বন্দীদের মধ্যে যাদের বিনা মুক্তিপণে রাসূলুল্লাহ্ (সা) অনুগ্রহ করে মুক্তি দিয়েছিলেন, তাদের যে নাম আমাদের কাছে পৌছেছে তারা হলেন : বনু উমাইয়ার আবুল ‘আস ইবন রাবী’, বনু মািখযুমের মুত্তালিব ইবন হানতাব ইবন হারিছ ইবন উবায়দ ইবন উমর ইবন মািখযুম। হারিছ ইবন খাযরাজ গোত্রের কোন একজন তাকে বন্দী করে। তাকে তাদের হাতেই ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু তারা তাকে মুক্ত করে দেয়। এরপর সে তার সম্প্রদায়ের কাছে চলে যায়। ইবন ইসহাক বলেন, : রাসূলুল্লাহ্ (সা)

আবুল আসের নিকট থেকে এই ওয়াদা নিয়েছিলেন যে, তিনি মক্কায় ফিরে গিয়ে যায়নবকে মদীনায় আসার সুযোগ করে দিবেন। আবুল ‘আস তার এ ওয়াদা পূরণ করেছিলেন। সামনে এ বিষয়ে আলোচনা আসছে। পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহর চাচা আব্বাস এবং তাঁর দুই ভাতিজা আকীল ও নাওফিলকে একশ’ উকিয়া স্বর্ণের বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হয়। ইবন হিশাম বলেন, : আবুল ‘আসকে যিনি বন্দী করেছিলেন তাঁর নাম আবু আইয়ুব খালিদ ইবন

উমর ইবন মািখযুমকে তার গ্রেফতারকারীদের হাতেই ছেড়ে দেয়া হয়। তারা তাকে এই শর্তে মুক্তি দেন যে, সে ফিরে গিয়ে নিজেই মুক্তিপণ পাঠিয়ে দিবে। কিন্তু ফিরে গিয়ে সে আর মুক্তিপণ পাঠায়নি। এ প্রসঙ্গে হাস্সান ইবন ছবিতের কবিতা :

ماکان صیفی لبوفی، امانة +–قفا ثعلب اعیا ببعخص الوارد “ওয়াদা রক্ষা করার লোক সায়কী নয়। সে হয়তো ক্লান্ত শৃগালের ন্যায় কোন পানির ঘাটে পড়ে রয়েছে।”

হুযাফা ইবন জুমাহ ছিল। অভাবী লোক, অনেক কন্যা সন্তানের পিতা। সে আবেদন করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, আমার কোন সহায়-সম্পদ নেই, আমি অভাবী ও অনেকগুলো সন্তানের পিতা। তাই আমার উপর অনুগ্রহ করুন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তার প্রতি অনুগ্রহ দেখালেন ও এই মর্মে প্রতিশ্রুতি নিলেন যে, সে তাঁর বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করবে: না। আবু ইযযা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর এ অনুগ্রহের কথা স্মরণ করে তাঁর প্রশংসায় বলেন : (কবিতা)

من مبلغ عنى الرسول محمدًا + بأنك حق والمليك حميد “এমন ব্যক্তি কে আছে, যে আমার পক্ষ থেকে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদকে এ বার্তাটি পৌঁছে দিবে যে, আপনি সত্য এবং আল্লাহ প্ৰশংসার অধিকারী।”

আপনি সত্য ও হিদায়াতের দিকে আহবান করে থাকেন। আপনার সত্যতার উপর মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সাক্ষী বিদ্যমান।

আপনি আমাদের মধ্যে এমন উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছেন, যার স্তরসমূহ অতিক্রম করা যেমন সহজ, তেমন কঠিন।

আপনার সাথে যারা যুদ্ধ করে, তারা দুৰ্ভাগা আর যাদের সাথে আপনার সন্ধি হয়, তারা সৌভাগ্যবান।

কিন্তু আমি যখন বদর যুদ্ধ ও তাতে অংশগ্রহণকারীদের কথা স্মরণ করি, তখন হতাশা ও অনুশোচনায় আমি মুহ্যমান হয়ে পড়ি।”

ইবন কাহীর বলেন, : এই আবু ইযযা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে কৃত ওয়াদা ভংগ করে। মুশরিকরা তার জ্ঞান-বুদ্ধি নিয়ে উপহাস করতো। ফলে সে পুনরায় তাদের সাথে যোগ দেয়।

সে মুশরিকদের পক্ষে উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পুনরায় বন্দী হয়। এবারও সে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর একটু অনুগ্রহ প্রার্থনা করে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমাকে এ বার ছাড়া হবে না। তুমি তো অনুগ্রহের কথা ভুলে গিয়ে বলবা যে, আমি মুহাম্মদকে দু’বার ধােকা দিয়েছি। তখন তাকে হত্যা করা হয়। উহুদ যুদ্ধের বর্ণনায় এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে। কথিত আছে, এ ঘটনা প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন, ৬–৬, . … …। :–1,১ ৩.এ. অৰ্থাৎ “মু’মিন একই গর্ত থেকে দু’বার দংশিত হয় না”। এ প্রবাদ বাক্যটি রাসূলুল্লাহর পূর্বে আর কারও থেকে শোনা যায়নি।

ইবন ইসহাক বলেন : মুহাম্মদ ইবন জাফর ইবন যুবােয়র আমার নিকট উরওয়া ইবন যুবােয়র থেকে বর্ণনা করেছেন যে, বদর যুদ্ধে কুরায়শদের বিপর্যয়ের পর উমােয়র ইবন ওয়াহব। জুমাহী এক দিন হাতীমে-কা’বার কাছে সাফওয়ান ইবন উমাইয়ার সাথে বসে ছিল। উমােয়র ছিল কুরায়শদের মধ্যে এক জঘন্য প্রকৃতির দুষ্কৃতকারী নেতা। মক্কায় রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তার সাহাবাগণকে যারা নির্যাতন করত, তাদের সাথে শক্ৰতা পোষণ করত, সে ছিল তাদের অন্যতম। তার ছেলে ওয়াহাব ইবন উমােয়র বদর যুদ্ধে বন্দী হয়। ইবন হিশাম বলেন, : যুরায়ক গোত্রের রিফাআ ইবন রাফি’ তাকে বন্দী করেছিলেন, ইবন ইসহাক বলেন : মুহাম্মদ ইবন জাফর— উরওয়া থেকে বর্ণিত। উমােয়র বদর যুদ্ধে কুয়োয় নিক্ষিপ্তদের মর্মান্তিক পরিণতির কথা আলোচনা করলো। বর্ণনা শুনে সাফওয়ান বলল, আল্লাহর কসম! এদের নিহত হওয়ার পর আমাদের বেঁচে থাকার কোন সার্থকতা নেই। উমােয়র তাকে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। আল্লাহর কসম!! আমার উপর যদি এমন ঋণের বোঝা না থাকতো, যা পরিশোধ করার কোন ব্যবস্থা আমার নেই। আর যদি আমার সন্তানাদি না থাকতো— আমার অবর্তমানে যাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশংকা আছে, তবে আমি গিয়ে অবশ্যই মুহাম্মদকে হত্যা করে দিতাম। আরও কারণ হল, আমার ছেলে তাদের হাতে বন্দী আছে। বর্ণনাকারী বলেন, সাফ ওয়ান ইবন উমাইয়া সুযোগ বুঝে বলল, তোমার ঋণের দায়িত্ব আমার তোমার, পক্ষ থেকে আমি তা পরিশোধ করবো। তোমার সন্তানরা আমার সন্তানদের সাথে থাকবে। যতদিন তারা বেঁচে থাকবে, আমি তাদের দেখাশুনা করবো। আমার থাকবে। আর তারা পাবে না, এমনটি কখনও হবে না। তখন উমায়ার সাফওয়ানকে বলল, তা হলে বিষয়টি আমার ও তোমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাক। সাফওয়ান বলল, তা-ই করবো। বর্ণনাকারী বলেন, “উমােয়র তার তরবারি ধারাল ও বিষাক্ত করে নিল। তারপর মদীনায় গিয়ে পৌঁছল। এ সময় হযরত উমর ইবন খাত্তাব (রা) কতিপয় মুসলমানের সাথে বদর যুদ্ধ সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। এ যুদ্ধে আল্লাহ মুসলমানদের যে সম্মান দান করেছেন এবং শক্ৰদের যে শোচনীয় অবস্থা দেখিয়েছেন, সে বিষয়গুলো তারা স্মরণ করছিলেন। এমন সময় হযরত উমর দেখতে পেলেন, উমায়ার ইবন ওয়াহব মসজিদের দরজায় তার উট থামিয়েছে এবং কাঁধে তার তরবারি ঝুলছে। হযরত উমর (রা) বললেন, এই যে কুকুরটি আল্লাহর দুশমন উমােয়র ইবন ওয়াহব, সে কোন অসৎ উদ্দেশ্য ছাড়া এখানে আসেনি। সেই তো আমাদের মাঝে ফাসাদ সৃষ্টি করেছিল এবং বদর যুদ্ধে আমাদের সৈন্যসংখ্যা সম্পর্কে অনুমান করে শক্ৰদেরকে জানিয়ে দিয়েছিল। এরপর তিনি

রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর নবী! এই যে আল্লাহর দুশমন। উমায়র ইবন ওয়াহব কাঁধে তরবারি ঝুলিয়ে এখানে এসেছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। বর্ণনাকারী বলেন, উমর এসে ঝুলন্ত তরবারি তার ঘাড়ের সাথে চেপে রেখে বুকের কাপড় জড়িয়ে ধরলেন এবং সাখী আনসারদের বললেন, তোমরা রাসূলুল্লাহর কাছে গিয়ে বস এবং এ দুরাচারের ব্যাপারে সতর্ক থাক। কেননা, একে বিশ্বাস করা যায় না। এরপর তিনি তাকে রাসূলুল্লাহর কাছে নিয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন তাকে এ অবস্থায় দেখলেন যে, উমর তার ঘাড়েই তরবারি লাগিয়ে রেখেছেন, তখন তিনি বললেন, : “হে উমর! তাকে ছেড়ে দাও। হে উমায়র! আমার কাছে এসো। উমায়র রাসূলুল্লাহর কাছে গিয়ে বলল, LL.–31 সুপ্ৰভাত! এটাই ছিল তাদের মধ্যে প্রচলিত জাহিলী যুগে পরস্পরের প্রতি সম্ভাষণ। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, হে উমায়ার তোমার সম্ভাষণ অপেক্ষা উত্তম সম্ভাষণের ব্যবস্থা দিয়ে আল্লাহ আমাদের সম্মানিত করেছেন। আর তা হলো “সালাম’ (আসসালামু আল্লায়কুম), যা হবে জান্নাতীদের সম্ভাষণ। সে বলল, হে মুহাম্মদ। আল্লাহর কসম! আমি এ বিষয়ে এখনই অবগত হলাম। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, : “উমােয়র! তুমি কি জন্যে এসেছ? সে বলল, আমি এসেছি আপনাদের হাতে আটক এই বন্দীর মুক্তির জন্যে। তার ব্যাপারে দয়া করুন! রাসূল (সা) বললেন, তবে তোমার কাধে তরবারি কেন? সে বলল, আল্লাহ তরবারির অমঙ্গল করুন। তা কি আমাদের কোন কাজে এসেছে? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, সত্যি করে বল, কী উদ্দেশ্যে এসেছ? সে বলল, ঐ বিষয় ছাড়া আমি আর কোন উদ্দেশ্যে আসিনি। তখন রাসূলুল্লাহ বললেন, কিছুতেই তা নয়, বরং তুমি ও সাফওয়ান ইবন উমাইয়া হাতীমে বসে বদরের কুয়োর নিক্ষিপ্ত কুরায়শদের সম্পর্কে আলোচনা করছিলো। তুমি না বলেছিলে! আমার যদি ঋণের বোঝা এবং সন্তানদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব না থাকতো, তবে আমি অবশ্যই বেরিয়ে গিয়ে মুহাম্মদকে হত্যা করে দিতাম। তখন সাফওয়ান ইবন উমাইয়া তোমার ঋণ ও সন্তানের দায়িত্ব এই শর্তে গ্রহণ করে যে, তুমি আমাকে হত্যা করে দিবে। অথচ আল্লাহ তোমার ও তোমার উদ্দেশ্যের মাঝে অন্তরায় হয়ে আছেন। তখন উমােয়র বলল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর রাসূল। ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আকাশের যে সব সংবাদ আমাদের শুনাতেন এবং আপনার উপর যে সকল ওহী অবতীর্ণ হতো, আমরা তা সবই অবিশ্বাস করতাম। আর এ বিষয়টি আমি ও সাফওয়ান ব্যতীত অন্য কেউ জানে না। সুতরাং আল্লাহর কসম! আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, এ সংবাদ আপনাকে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানায়নি। সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি আমাকে ইসলামের পথ দেখালেন ও এই স্থানে এনে দিলেন। এরপর সে সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করে। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, : তোমরা তোমাদের দীনী ভাইকে দীনের জ্ঞান দান কর, তাকে কুরআন শিক্ষা দাও এবং তার বন্দীকে ছেড়ে দাও! সাহাবাগণ নির্দেশ মতে তাই করলেন। একদা উমােয়র বলল : ইয়া রাসূলাল্লাহ! এতকাল ধরে আমি আল্লাহর নূর নির্বাপিত করার কাজে ছিলাম তৎপর এবং যারা আল্লাহর দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তাদেরকে নির্যাতন করার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। এখন আমি চাই, আমাকে অনুমতি দিন, মক্কায় গিয়ে আমি তাদেরকে আল্লাহর রাসূল ও ইসলামের দিকে আহবান জানাই। হয়তো আল্লাহ তাদেরকে হিদায়াত দান করবেন। আর যদি তারা হিদায়াত না হয়, তবে বাতিল দীনে থাকার কারণে আমি ঐরূপ শাস্তি

দিব, যেরূপ শাস্তি দিতাম আপনার সাথীদেরকে সত্য দীনে থাকার কারণে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে অনুমতি দিলেন। অনুমতি পেয়ে সে মক্কায় চলে যায়। এদিকে উমায়ার ইবন ওহাহব যখন মক্কা থেকে বের হয়ে আসছিল, তখন থেকেই সাফওয়ান মক্কাবাসীদের কাছে বলে আসছিল, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করা, অল্প দিনের মধ্যেই এমন এক ঘটনা জানতে পারবে, যা তোমাদের বদরের ব্যথা-বেদনা তুলিয়ে দেবে। সে মদীনা থেকে আগত প্রতিটি কাফেলার কাছেই উমােয়র সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিচ্ছিল। অবশেষে এক কাফেলা এসে তাকে উমায়রের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে সংবাদ দিল। সাফওয়ান তখন শপথ নিল যে, সে আর কখনও তার সাথে কথা বলবে না এবং কোন প্রকার সাহায্যও তাকে দেবে না। ইবন ইসুহাক বলে : উমােয়র মক্কায় এসে অবস্থান করেন এবং মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করতে থাকেন। কেউ তার বিরোধিতা করলে তাকে কঠোর শাস্তি দিতেন। ফলে তার হাতে অনেকেই ইসলামগ্রহণ করে। ইবন ইসহাক বলেন, : উমােয়র ইবন ওয়াহব অথবা হারিছ ইবন হিশাম যে কোন একজন বদর যুদ্ধের দিনে ইবলীসকে প্রত্যক্ষ ভাবে দেখেছিল, যখন সে পশ্চাদপসরণ করে পালিয়ে যাচ্ছিল এবং এ কথা বলতে বলতে যাচ্ছিল যে, “তোমাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক রইল না, তোমরা যা দেখতে পাও না, আমি তা দেখি।” বদর যুদ্ধে সেদিন ইবলীস মুদলাজ গোত্রের নেতা সুরাকা ইবন মালিক ইবন জুশাম-এর আকৃতি ধারণ করে এসেছিল।

অনুচ্ছেদ এ স্থলে ইমাম মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বদর যুদ্ধ প্রসঙ্গে কুরআনে অবতীর্ণ আয়াত অর্থাৎ সূরা আনফালের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বিশদভাবে এবং সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। আমরা আমাদের তাফসীর গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আগ্রহী পাঠকদের সেখান থেকে অধ্যয়ন করার পরামর্শ দেয়া হল।

অনুচ্ছেদ এ পর্যায়ে এসে ইবন ইসহাক বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের নাম লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি প্রথমে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুহাজিরদের নাম, তারপর অংশগ্রহণকারী আনসার আওস ও খাযরাজদের নাম উল্লেখ করেছেন। শেষের দিকে বলেছেন : মুসলিম মুহাজির ও আনসার যারা সরাসরি যুদ্ধে অং গ্রহণ করেছেন, আর যারা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে যাননি, কিন্তু তাদেরকে গনীমতের অংশ ও পুরস্কার দেয়া হয়েছে, তাদের সর্বমোট সংখ্যা তিনশ’ চৌদ্দ (৩১৪) জন। এঁদের মধ্যে মুহাজির তিরাশি (৮৩), আওস গোত্রের একষট্টি (৬১) এবং খাযরাজ গোত্রের একশ’ সত্তর (১৭০) জন। ইমাম বুখারী তার সহীহ গ্রন্থে বদরী সাহাবীগণের নাম আরবী বর্ণনামালার ক্রম অনুযায়ী উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি প্রথমে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নাম, তারপরে আবু বকর, উছমান ও আলী (রা)-এর নাম লিখেছেন। এই গ্রন্থে বদরী মুসলমানদের নাম আরবী বর্ণমালা অনুযায়ী লেখা হল। তবে হাফিয যিয়াউদ্দীন মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহিদ রচিত ‘আহকামুল কবীর’ গ্রন্থের অনুসরণে সর্বপ্রথম বদরীদের মহান নেতা শ্রেষ্ঠ আদম সন্তান

মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নাম উল্লেখ করা হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *