2 of 2

৬৯. বদরের বিপর্যয়ের সংবাদ মক্কায় পৌঁছল

বদরের বিপর্যয়ের সংবাদ মক্কায় পৌঁছল

ইবন ইসহাক বলেন, : হায়সুমান ইবন আবদুল্লাহ খুযাঈ বদরে কুরায়শদের বিপর্যয়ের ংবাদ নিয়ে সর্বপ্রথম মক্কায় পৌছে। লোকজন তার নিকট জিজ্ঞেস করল, ওখানকার সংবাদ কী? সে বলল : উত্বা ইবন রাবীআী, শায়বা ইবন রাবী আ, আবুল হাকাম ইবন হিশাম, উমাইয়া ইবন খািলফ, যামআ ইবন আসওয়াদ, নাবীহ, মুনাব্বিহ এবং আবুল বুখতারী ইবন হিশাম— এরা সকলেই নিহত হয়েছেন। হায়সুমান যখন নিহত কুরায়শ নেতাদের নাম একে একে বলে যাচ্ছিল, তখন সাফওয়ান ইবন উমাইয়া বলল, এ লোকটির যদি জ্ঞানবুদ্ধি ঠিক থাকে, তবে ওকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা দেখি! তখন তারা হায়সুমানকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা সাফওয়ান ইবন উমাইয়ার সংবাদ কি? হায়সুমান বলল, এই যে সে তো হাতীমের মধ্যে বসা আছে। আল্লাহর কসম, আমি তার পিতা ও ভাইকে নিহত হতে দেখেছি। মূসা ইবন উকবা বলেন, : বদরে পরাজয়ের সংবাদ যখন মক্কায় পৌঁছল, তারা এর সত্যতা যাচাই করে দেখল। এরপর মহিলারা তাদের মাথার চুল কেটে ফেলল এবং অনেক সওয়ারীও ঘোড়ার পা কেটে দিল। কাসিম ইবন ছাবিত রচিত দালায়েল গ্রন্থের বরাতে সুহায়লী উল্লেখ করেছেন : বদরের যুদ্ধ চলাকালে মক্কাবাসীরা শুনতে পায়, এক অদৃশ্য জিন বলে যাচ্ছে :

(কবিতা)

از ار الحنیفیون بدرا و قیهة +–سینقض منها رکن کسری و قیصرا মক্কার হানীফী বলে দাবীদার কুরায়শরা বদর রণাংগনে এমন এক ঘটনার সমন্মুখীন হল, যার প্রভাবে অচিরেই কিসারা ও কায়সারের সিংহাসন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

সে ঘটনা লুআই বংশীয় পুরুষদেরকে ধ্বংস করে দিল, আর লজ্জাশীল মহিলারা বেরিয়ে এসে অনুশোচনায় বুক চাপড়াতে থাকল।

বড়ই দুর্ভাগা সে, যে মুহাম্মদের শক্রতে পরিণত হয়েছে। সুপথের ইচ্ছা পরিত্যাগ করে সে জুলুম করেছে ও হতাশায় ভুগছে।

থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আযাদকৃত দাস আবু রাফি” বর্ণনা করেছেন, আমি আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবের গোলাম ছিলাম। আব্বাস পরিবারে ইসলামের প্রবেশ ঘটল। ফলে আব্বাস তার স্ত্রী উন্মুলা ফযল ও আমি ইসলাম গ্রহণ করি। আব্বাস তার সম্প্রদায়কে ভয় করতেন, তাদের বিরোধিতা অপসন্দ করতেন এবং নিজের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটা গোপন করে রাখতেন। তিনি ছিলেন অগাধ সম্পদের মালিক। নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের মাঝে তার মাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। আবু লাহাব বদর যুদ্ধে নিজে অংশগ্রহণ না করে তার স্থলে আস ইবন হিশাম ইবন মুগীরাকে প্রেরণ করে। এ ভাবে কুরায়শদের মধ্যে যারা স্বয়ং যুদ্ধে অংশ গ্ৰহণ করেনি, তারা নিজেদের স্থলে একজন করে লোক পাঠায়। এরপর বদর যুদ্ধে কুরায়শদের শোচনীয় পরাজয়ের সংবাদ যখন মক্কায় পৌছে, তখন আল্লাহ আবু লাহাবকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করেন। পক্ষান্তরে আমরা অন্তরে শক্তি ও মর্যাদা অনুভব করি। আবু রাফি” বলেন, আমি ছিলাম দুর্বল প্রকৃতির লোক। আমার পেশা ছিল তীর বানান। যমযম কুপের পাশে একটি তাঁবুতে বসে আমি তীর বানাবার কাঠ চাছতাম। একদিন আমি সেখানে বসে তীর বানানোর কাজ করছিলাম।

উন্মুলা ফযল তখন আমার কাছে বসা ছিলেন। বদর যুদ্ধের সংবাদ পেয়ে আমরা আত্মতৃপ্তিবােধ করছিলাম। এমন সময় আবু লাহাব খুব খারাপ অবস্থায় দু’পা টেনে-হেঁচড়িয়ে সেখানে আসলো এবং তাবুর একটি টানা রশির কাছে আমার পিঠের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসলো। আবু লাহাবের বসার কিছুক্ষণ পর লোকেরা বলল, এই তো আবৃ সুফিয়ান— তাঁর আসল নাম ছিল মুগীরা ইবন হারিছ ইবন আবদুল মুত্তালিব।’ এসে গেছে। তখন আবু লাহাব তাকে বলল, আমার কাছে এসো! তুমি তো সব খবরই জান। সে আবু লাহাবের কাছে গিয়ে বসলো। আর সব লোক পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। আবু লাহাব তাকে বলল, ভাতিজা! সেখানকার ঘটনা কী খুলে বল! সে বলল, আল্লাহর কসম! ঘটনা আর বেশী কিছু না। আমরা যখন মুসলমানদের মুকাবিলায় গেলাম, তখন মনে হল যেন আমরা আমাদের গর্দান তাদের হাতে সঁপে দিয়েছি। আর তারা যেমন ইচ্ছা আমাদের কচুকাটা করেছে এবং যেমন ইচ্ছা আমাদের বন্দী করেছে এতদসত্ত্বেও আল্লাহর কসম, আমি আমাদের লোকদের তিরস্কার করি না। কারণ, আমরা তখন আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে ধূসর বর্ণের ঘোড়ার উপর অসংখ্য শুভ্র রঙের সৈন্য দেখেছি। আল্লাহর কসম, তারা কাউকে ছাড় দেয়নি এবং কেউ তাদের সামনে টিকতে পারেনি।

১. ইনি সে মশহুর কুরায়শ নেতা আবু সুফিয়ান নন।

ছিলেন ফেরেশতা। এ কথা বলতেই আবু লাহাব আমার মুখে এক থাপ্পড় মারলো। আমিও তার উপর ক্ষেপে উঠলাম। এরপর সে আমাকে উপরে তুলে ধরে মাটিতে আছাড় মারলো এবং আমার বুকের উপর বসে আমাকে আঘাত করতে লাগলো। আমি ছিলাম। দৈহিক দিক দিয়ে দুর্বল এ সময় উন্মুলা ফযল তাবুর একটি খুঁটি তুলে নিয়ে আবু লাহাবের মাথায় আঘাত করেন। এতে তার মাথা গুরুতরভাবে যখম হয়। উন্মুলা ফযল আরও বললেন, আবু রাফি’র মুনীব এখানে নেই বলে তাকে দুর্বল ভেবেছ? এরপর আবু লাহাব সেখান থেকে লাঞ্ছিত-অপমানিত হয়ে চলে গেল। আল্লাহর কসম, এখান থেকে চলে যাওয়ার পর তার শরীরে এক প্রকার ফোস্কা (বসন্ত) ওঠে এবং তাতেই সে সাত দিনের মধ্যে মারা যায়।

ইবন ইসহাক থেকে ইউনুস আরো বলেন, আবু লাহাবের মৃত্যুর পর তার দুই পুত্র তাকে দাফন না করে তিন দিন পর্যন্ত ফেলে রাখে। লাশে পচন ধরে। কুরায়শরা বসন্ত রোগকে প্লেগ রোগের মত ভয় পেত। অবশেষে জনৈক কুরায়শী আবু লাহাবের পুত্রদ্বয়কে বললো। তোমরা কি হতভাগ্য নির্লজ্জ! তোমাদের পিতার লাশ ঘরের মধ্যে পচে যাচ্ছে। অথচ তোমরা তাকে দাফন করছ না। তারা বলল, এই রোগ ছোয়াচে বলে আমাদের ভয় হচ্ছে। সে বলল, তোমরা চল, আমি তোমাদের সহযোগিতা করব। আল্লাহর কসম, তারা লাশের কাছেও গেল না, গোসলও করাল না; বরং দূর থেকে পানি ছিটিয়ে দিল। এরপর মক্কার উচ্চ ভূমিতে নিয়ে একটি প্রাচীরের পাশে পাথরচাপা দিয়ে রাখে। ইউনুস ইবন ইসহাকের সূত্ৰে….. হযরত যুবােয়র থেকে বর্ণনা করেন যে, আইশা (রা) আবু লাহাবের এই বাড়ি অতিক্রমকালে কাপড় দ্বারা নিজেকে ভালভাবে আবৃত করে নিতেন।

লোকজনের জন্যে কিছু দিন বিলাপ করে। পরে এ কথা বলে লোকেদের বিলাপ করতে বারণ করে যে, মুহাম্মদ ও তার সাখীরা জানতে পারলে তোমাদেরকে ভৎসনা করবে। তারা কুরায়শদেরকে আরও বলে দিল যে, মুসলমানদের সাথে যোগাযোগ না হওয়া পর্যন্ত বন্দী মুক্ত করার জন্যে কাউকে মদীনায় পাঠিও না। তা না হলে মুহাম্মদ ও তার সাখীরা মুক্তিপণের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেবে। বস্তৃত এটা ছিল তাদের উপর আল্লাহর দেয়া শাস্তির চূড়ান্ত অবস্থা। অর্থাৎ নিহতদের জন্যে কাদা ও শোকতাপ প্রকাশ বন্ধ রাখা। কেননা, মৃত ব্যক্তির জন্যে কান্নাকাটি করলে শোকাহত ব্যক্তির হৃদয় অনেকটা শান্ত হয়। ইবন ইসহাক বলেন : বদর যুদ্ধে আসওয়াদ ইবন মুত্তালিবের তিন পুত্র নিহত হয়। তারা হল যাম’আ, আকীল ও হারিছ। সে তার পুত্রদের শোকে কান্নাকাটি করতে চাচ্ছিল। সে এরূপ চিন্তা-ভাবনা করছিল এমন সময় গভীর রাতে এক শোকাহত নারীর বিলাপধ্বনি তার কানে ভেসে আসে। আসওয়াদ ছিল অন্ধ। তাই সে তার এক ভৃত্যকে বলল, যাও তো দেখে এসো উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে কি না? জেনে এসো, কুরায়শরা তাদের নিহতদের উপর বিলাপ করছে কিনা? তা হলে

আমিও আবু হাকীমা অর্থাৎ যামআর জন্যে বিলাপ করবো। কেননা, আমার কলিজা জ্বলে গেছে। রাবী বলেন, ভৃত্য ফিরে এসে তাকে জানাল : এক মহিলা তার উট হারিয়ে যাওয়ায় এ ভাবে বিলাপ করছে। এ কথা শুনে আসওয়াদ একটি কবিতা আবৃত্তি করলো :

ঐ মহিলা কি এ জন্যে বিলাপ করছে যে, তার একটা উট হারিয়ে গিয়েছে এবং এ ভাবে বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে দিচ্ছে? একটা জওয়ান উট হারানোর জন্যে এরূপ বিলাপ কর না। বরং বন্দরের ঘটনার জন্যে বিলাপ কর। সেখানে আমাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

তুমি বিলাপ কর বদরে নিহত নেতাদের জন্যে; অর্থাৎ বনু হাসীস, বনু মািখযুম ও আবুল ওয়ালীদের সন্তানদের জন্যে।

যদি তুমি বিলাপ করতে চাও, তবে আবু আকীল ও বীরশ্ৰেষ্ঠ হাবিছের জন্যে বিলাপ কর।

এদের সকলের জন্যে তুমি বিলাপ করতে থাক, বিলাপে বিরতি দিও না। আর আবু হাকীমার (যামআ) সাথে তো কারও তুলনাই হয় না।

জেনে রোখ, ওদের মৃত্যুর পর এমন সব লোক নেতা হয়েছে, যদি বদরের যুদ্ধ সংঘটিত না হত, তবে এরা কখনও নেতা হতে পারত না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *