2 of 2

৫৮. হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের পূর্বে কিবলা পরিবর্তন প্রসঙ্গে

হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের পূর্বে কিবলা পরিবর্তন প্রসঙ্গে

কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন দ্বিতীয় হিজরীর রজব মাসে এ ঘটনাটি ঘটে। কাতাদা এবং যায়দ ইবন আসলামও একথা বলেন এবং এটা মুহাম্মদ ইবন ইসহাকেরও একটি বর্ণনা। ইমাম আহমদ (র) ইবন আব্বাস (রা) থেকে যা বর্ণনা করেন, তা থেকেও এটা প্রতীয়মান হয়। বারা” ইবন আযিব-এর হাদীছ থেকে, যে সম্পর্কে পরে আলোচনা আসছে এবং ওটাই স্পষ্টতর। আল্লাহই ভাল জানেন।

কেউ কেউ বলেন, ঐ বছর শাবান মাসে এ ঘটনাটি ঘটে। ইবন ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ-এর অভিযানের পর। কেউ কেউ বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মদীনায় আগমনের ১৮ মাসের মাথায় শা’বান মাসে কিবলা পরিবর্তন হয়েছিল। ইবন জারীর সুদী সূত্রে এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন এবং এর সনদ ইবন আব্বাস, ইবন মাসউদ এবং কতিপয় সাহাবী সূত্রের।

জামহুরের মতে হিজরতের ১৮ মাসের মাথায় শা’বান মাসের মধ্য ভাগে কিবলা পরিবর্তন হয়। মুহাম্মদ ইবন সাআদ এবং ওয়াকিদী সূত্রে বর্ণিত আছে যে, মধ্য শা’বানে মঙ্গলবার কিবলা পরিবর্তন হয়। এভাবে সময় নির্দিষ্টকরণ সন্দেহাতীত নয়।

আকাশের দিকে তোমার বারবার তোকানো আমি অবশ্যই লক্ষ্য করি। সুতরাং তোমাকে অবশ্যই এমন কিবলার দিকে ফিরিয়ে দেবো, যা তুমি পসন্দ করবে। অতএব, তুমি মাসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফিরাও। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, সেদিকেই মুখ ফিরাও। আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তারা নিশ্চিতভাবে জানে যে, তা তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে সত্য। তারা যা করে, সে বিষয়ে আল্লাহ গাফিল নন (২ : ১৪৪)।

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আমি তাফসীর গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এর আগে-পরে নিবোঁধ ইয়াহুদী এবং মুনাফিক ও বড় বড় জাহিলদের আপত্তি-অভিযোগেরও আমরা জবাব দিয়েছি। কারণ এটা ছিল ইসলামে সংঘটিত প্রথম নাসখি বা রহিতকরণ এর ঘটনা। আর এটা এজন্য যে, আল্লাহ তা’আলা ইতোপূর্বে —

আমি কোন আয়াত রহিত করলে কিংবা বিস্মৃত হতে দিলে তার চাইতে উত্তম বা তার সমতুল্য কোন আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহই সৰ্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান? (২ : ১০৬)। এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ইঙ্গিত করেন যে, এক আয়াত দ্বারা অপর আয়াতকে রহিত করা জাইয আছে। ইমাম বুখারী আবু নুআয়ম. বারা’ থেকে বর্ণনা করে বলেন, নবী করীম (সা) বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করে ১৬ বা ১৭ মাস নামায আদায় করেন; কিন্তু তিনি পসন্দ করতেন যে, বায়তুল্লাহ তাঁর কিবলা হোক। বায়তুল্লাহর দিকে মুখ করে তিনি প্রথম

নামায আদায় করেছেন এমন এক ব্যক্তি বেরিয়ে যান এবং দেখেন যে, মসজিদে লোকজন নামায আদায় করছেন। তখন তিনি বললেন? আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, আমি নবী (সা)-এর সঙ্গে মক্কার দিকে মুখ করে নামায আদায় করে এসেছি। তারা তখন রুকতে ছিলেন। সে অবস্থায়ই তারা বায়তুল্লাহর দিকে ঘুরে যান। কিবলা পরিবর্তনের আগে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের কি অবস্থা হবে? এর জবাবে আল্লাহ তা’আলা আয়াত নাযিল করেন :

আল্লাহ এমন নন যে, তোমাদের ঈমান পণ্ড করবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মানুষের প্রতি

অবশ্যই অতি দয়ার্দু, মহা দয়ালু। (বলা বাহল্য, উক্ত আয়াতে ঈমান বলতে নামায বুঝানো হয়েছে)। ইমাম মুসলিম ভিন্ন সূত্রে হাদীছটি বর্ণনা করেন। ইবন আবু হাতিম… বারা” (রা) থেকে বর্ণনা করে বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বায়তুল মুকাদাসের দিকে (মুখ করে) ষোল বা সতের মাস নামায আদায় করেন। কা’বার দিকে মুখ করা তার পসন্দনীয় ছিল। তাই আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন?

রাবী বলেন, তাই তিনি কা’বার দিকে মুখ ফিরান, তখন নিবোঁধ ইয়াহুদীরা বললো :।

যে কিবলায় তারা প্রতিষ্ঠিত ছিল, তা থেকে কিসে তাদেরকে ফিরাল? (২ : ১৪২)। তখন আল্লাহ নাযিল করলেন :

বল, পূর্ব-পশ্চিম আল্লাহর, তিনি যাকে ইচ্ছা সিরাতে মুস্তাকীমে চালিত করেন (২ : ১৪২) সারকথা এই যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)মক্কায় বায়তুল মুকাদাসের দিকে মুখ করে নামায আদায় করতেন আর কা’বা থাকতো তার সম্মুখে, যেমন ইমাম আহমদ (র) ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু মদীনায় হিজরত করার পর এটা সম্ভব ছিল না যে, তিনি দু কিবলা পানে এক সঙ্গে মুখ করবেন। তাই মদীনায় আগমনের শুরু থেকে ষোল অথবা সতের মাস কাবাকে পেছনে রেখে নামায আদায় করেন। সে হিসাবে এ ঘটনা হবে হিজরী। দ্বিতীয় সনের রাজব মাসে। আল্লাহই ভাল জানেন। আর নবী করীম (সা) ভালবাসতেন যে, হযরত ইবরাহীম (আ)-এর কিবলা কা’বার দিকে তাঁর কিবলা হোক। এজন্য তিনি আল্লাহর নিকট অতি বিনয়

আর মিনতি সহকারে দু’আ করতেন। তাই তো তিনি হাত তুলে দুআ করতেন আর তাঁর দৃষ্টি থাকতো আসমানের দিকে। তখন আল্লাহ নাযিল করলেন :

কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ এলো রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুসলমানদের উদ্দেশ্যে খুতবা দেন এবং তাদেরকে এটা অবহিত করেন। এ মর্মে নাসাঈতে আবু সাঈদ ইবন মুআল্লা থেকে হাদীছ বর্ণিত আছে। আর এটা ছিল যুহরের সময়। আবার কেউ কেউ বলেন, কিবলা পরিবর্তনের বিধান আসে দু’ নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে। মুজাহিদ প্রমুখ একথা বলেন। আর বুখারী-মুসলিমে বারা’

(রা) থেকে বর্ণিত রিওয়ায়াত দ্বারা এ মতের সমর্থন পাওয়া যায়। এতে বলা হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সা) কাবায় মদীনার দিকে প্রথম যে নামায পড়েন, তা ছিল আসরের নামায। বিস্ময়ের ব্যাপার

এই যে, পরদিন ফজর পর্যন্ত কুবাবাসীদের নিকট এখবর পৌঁছেনি। বুখারী-মুসলিমে ইবন উমর (রা) সূত্রে একথাও প্রমাণিত। তিনি বলেন, ফজরে কুবার লোকেরা নামাযে ছিলেন। এসময় জনৈক আগন্তুক এসে বললেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি আজ রাত্রে কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে, যাতে কা’বার দিকে মুখ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তখন তাঁরা কিবলামুখী হলেন এবং তাদের চেহারা ছিল সিরিয়া তথা বায়তুল মুকাদাসের দিকে, তখন তারা কা’বার দিকে ঘুরে গেলেন। সহীহ মুসলিমে আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে।

আসল কথা এই যে, কা’বার দিকে কিবলা পরিবর্তনের আয়াত দ্বারা আল্লাহ তা’আলা। বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামায পড়ার বিধান রহিত করে দেন। তখন নির্বোধ, অজ্ঞ-মুর্থ আর গবেটের দল টিল্পনি কেটে বলতে শুরু করলো–তারা যে কিবলার অনুসারী ছিল, তাদেরকে তা থেকে ফিরালো কিসে? অথচ আহিলে কিতাবের কাফিররা জানতো যে, এই কিবলা পরিবর্তনটা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়েছে। কারণ, তাদের কিতাবেই তারা মুহাম্মদ (সা)-এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতো যে, মদীনা হবে তার হিজরত স্থল। তারা একথাও জানতো যে, কা’বার দিকে মুখ করার জন্য অনতিবিলম্বে তাঁকে নির্দেশ দেয়া হবে। যেমন আল্লাহ বলেনঃ

وان الذين أوتُوا الكتاب ليعلمون أئة الحق من ربهم

আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তারা নিশ্চিত জানে যে, তা তাদের পালনকর্তার পক্ষ

থেকে আগত সত্য।

এসব সত্ত্বেও আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে বলেন : سيقول السفهاء من الناسر ما ولأهم عن قبلتهم التي كانوا عليها قل للّه

المشرق والمغرب يهدى من يشاء إلى صراط مستقيم অর্থাৎ, আল্লাহ এমন মালিক, কর্তৃত্ব প্রয়োগকারী এবং হুকুমদাতা, যার হুকুম কেউ রদ করতে পারে না। আপনি সৃষ্টির ব্যাপারে তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করেন এবং শরীআতের ব্যাপারেও তিনি যেমনটা ইচ্ছে হুকুম করেন। আর তিনিই যাকে ইচ্ছা সরল পথে চালিত করেন। আর

যাকে ইচ্ছা সুষ্ঠু পথ থেকে বিচ্যুত করেন। এতে রয়েছে তার হিকমত ও রহস্য, সে জন্য সন্তুষ্ট থাকা এবং তা মেনে নেয়া কর্তব্য।

তারপর আল্লাহ তা’আলা বলেন :

এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী (শ্রেষ্ঠ)৷ উম্মতরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাতে তোমরা মানব জাতির জন্য সাক্ষী স্বরূপ হও এবং রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী স্বরূপ হন। (रे 8 S8७)

অর্থাৎ, যেভাবে আমি তোমাদের জন্য নামাযে উত্তম দিক নির্ধারণ করে দিয়েছি। এবং তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ:)-এর কিবলার দিকে তোমাদেরকে চালিত করেছি, যিনি ছিলেন “আবুল আম্বিয়া’ তথা তৎপরবতী নবীগণের পিতা, যে কিবলার দিকে মুখ করে মূসা (আ) এবং তাঁর পূর্ববতী নবীগণ নামায আদায় করতেন, ঠিক সেভাবেই আমি তোমাদেরকে সর্বোত্তম জাতি করেছি, করেছি। সকল জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্মান আর মর্যাদার অধিকারী করেছি। বিশ্বের সারনির্যাস এবং নতুন-পুরান সকলের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সম্মানের অধিকারী, যাতে তোমরা কিয়ামতের দিন মানুষের উপর সাক্ষী হতে পোর, যখন তারা জড়ো হবে তোমাদের নিকট এবং তারা তোমাদের দিকে শ্রেষ্ঠত্বের ইঙ্গিত করতে পারে, যেমন সহীহ বুখারীতে প্রমাণিত আছে। আবু সাঈদ থেকে মারফু’ রূপে বৰ্ণিত আছে যে, কিয়ামতের দিন এ উম্মতের জন্য নূহ (আ:)-কে সাক্ষী রূপে হাযির করা হবে। আর সময়ের দিক থেকে অনেক আগের হওয়া সত্ত্বেও যদি নূহ (আ)-কে এ উম্মতের জন্য সাক্ষীরূপে পেশ করা হয়, তাহলে পরবতীদেরকে তো অতি উত্তমরূপেই পেশ করা হতে পারে। এরপর এ ঘটনায় সন্দেহ পোষণকারীর প্রতি শাস্তি আপতিত এবং এ ঘটনাকে সত্য বলে যে মেনে নেয়, তার প্রতি নিআমত বর্ষণের যুক্তি ও তাৎপর্য বর্ণনা করে আল্লাহ তা’আলা বলেন

و ما ベ a; القبلة التى ག a نليه ينغلم من يتبع الرسول جمان ينقلب

على عقبيله وان کانت لكبيرة. তুমি যে কিবলার অনুসারী ছিলে, তাকে আমি এ জন্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম যাতে আমি জানতে পারি কে রাসূলের অনুসরণ করে (২ : ১৪৩)। ইবন আব্বাস (রা) বলেন, আমরা কেবল দেখতে চাই কে রাসূলের অনুসরণ করে আর কে পেছনে ফিরে যায়।

وان كانت الكبيرة – যদিও তা বড় অর্থাৎ যদিও ঘটনা হিসাবে এটা বড় এবং ব্যাপার হিসাবে কঠিন-কঠোর, তবে তার জন্য নয়, যাকে আল্লাহ হিদায়াত করেন। অর্থাৎ তারা যে ঘটনা বিশ্বাস করে, তা মেনে নেয়, সে সম্পর্কে মনে কোন রকম সন্দেহ-সংশয় পোষণ করে না, বরং সন্তুষ্টচিত্তে ঈমান আনে এবং সে মতে আমল করে। কারণ, তারা মহান বিধানদাতার বান্দা, যিনি মহাশক্তিশালী, পরম ধৈর্যশীল, সূক্ষ্মদশী এবং সর্বজ্ঞ।

وما كان اللّه ليضيع ايمانكُمْ আর আল্লাহ এমন নন যে, তোমাদের ঈমান পণ্ড করবেন, মানে বায়তুল মুকাদাসের দিকে মুখ করার বিধান দিয়ে এবং সেদিকে ফিরে নামায আদায় করা দ্বারা।

إن اللَّه بالنَّاس لرؤف رحيم আর আল্লাহ তো মানুষের প্রতি অবশ্যই অতি দয়াময়, বড় মেহেরবান। এ সম্পর্কে অসংখ্য হাদীছ রয়েছে, তাফসীর গ্রন্থে তা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ততোধিক বিস্তারিত আলোচনা করবো ‘আমার আল-আহকামুল কাবীর’ গ্রন্থে। ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে,

আলী ইবন আসিম… আইশা (রা) সূত্রে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন (আৰ্থাৎ) আহলে কিতাব সম্পর্কে তারা আমাদেরকে জুমুআর দিন এবং কিবলার চাইতে অন্য কোন জিনিসের জন্য বেশী হিংসা করে না— আল্লাহ আমাদেরকে জুমুআর দিন দান করেছেন। আর ইয়াহদীরা এ সম্পর্কে গোমরাহ হয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে কিবলার দিকে হিদায়াত করেছেন, ইয়াহুদীরা কিবলা সম্পর্কে গোমরাহ। ইমামের পিছনে আমীন বলার জন্যও তারা আমাদেরকে হিংসা করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *