2 of 2

৬৭. রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বদর থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বদর থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বদর যুদ্ধ। ২য় হিজরীর ১৭ই রমযান শুক্রবারে সংঘটিত হয়। বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে যে, কোন সম্প্রদায়ের উপর জয়ী হলে রাসূলুল্লাহ তথায় তিন দিন অবস্থান করতেন। সে মতে, বদর রণাংগানে তিনি তিন দিন অতিবাহিত করেন। সোমবার রাত্রে সেখান থেকে রওনা হন। তিনি উটে আরোহণ করে বদরের কুয়োয় নিক্ষিপ্ত লাশদের সম্বোধন করেন এবং সেখান থেকে গনীমতের অঢেল মালামাল ও যুদ্ধবন্দীদের সাথে নিয়ে মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেন। মুশরিক কাফিরদের বিরুদ্ধে বিজয় ও সাহায্যের ংবাদ জানানাের জন্যে তিনি পূর্বেই দু’জনকে মদীনায় রওনা করে দেন। তাদের একজন হলেন আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা। তাকে মদীনার উচু এলাকায় পাঠান। দ্বিতীয় জন যায়দ ইবন হারিছ। তাঁকে পাঠান নিচু এলাকায়। উসামা ইবন যায়দা বলেন, আমরা বিজয়ের সুসংবাদ তখন পেলাম যখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কন্যা রুকাইয়ার দাফন কাজ সম্পন্ন করে ফেলেছিা! রুকাইয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তার স্বামী হযরত উছমান ইবন আফফান রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নির্দেশক্রমে যুদ্ধে না যেয়ে মদীনায় থেকে যান। অবশ্য রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে গনীমতের ভাগ দেন এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার ছওয়াব লাভের সুসংবাদও দেন। উসামা বলেন, আমার পিতা যায়দ ইবন হারিছার আগমন সংবাদ পেয়ে আমি তার নিকট গেলাম। দেখলাম, তিনি সালাত আদায় করে বসে আছেন এবং লোকজন তাকে ঘিরে ধরেছে। আর

ইবন আসওয়াদ, আবুল বুখতারী আস ইবন হিশাম, উমাইয়া ইবন খালফ ও হাজাজের দুই পুত্র নাবীহ ও মুনাবিবাহ–এরা সবাই নিহত হয়েছে। আমি বললাম, আব্বা! ঘটনা কি সত্য?

তিনি বললেন, ‘হ্যা বেটা, আল্লাহর কসম?

বায়হাকী হাম্মাদ ইবন সালামা সূত্রে … উসামা ইবন যায়দ থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (সা) হযরত উছমান ও উসামা ইবন যায়দকে তার রোগাক্রান্ত কন্যার সেবা-শুশ্রীষার জন্যে মদীনায় রেখে যান। যুদ্ধ শেষে বিজয়ের সুসংবাদ নিয়ে যায়দ ইবন হারিছ রাসূলুল্লাহর উট আযবার উপরে চড়ে আগমন করেন। উসামা বলেন, আমি এক আশ্চর্যজনক শব্দ শুনে বাইরে এসে দেখি, যায়দ বিজয়ের সুসংবাদ দিচ্ছেন। আল্লাহর কসম, যুদ্ধবন্দীদেরকে স্বচক্ষে না দেখা পর্যন্ত এ সংবাদ আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। রাসূলুল্লাহ (সা) উছমানকে গনীমতের অংশ দিয়েছিলেন। ওয়াকিদী বলেন, বদর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আছীল নামক স্থানে এসে আসরের নামায আদায় করেন। এক রাকাআত আদায়ের পর তিনি মুচকি হাসেন। হাসির কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমি মীকাঈলকে দেখতে পেলাম, তার ডানায় ধুলাবালি লেগে রয়েছে এবং আমার দিকে লক্ষ্য করে মুচকি হেসে বলছেন, আমি এতক্ষণ যাবত শক্ৰদের পিছু ধাওয়া করেছি। এছাড়া বদরের যুদ্ধ শেষে হযরত জিবরাঈল (আ) একটি মাদী ঘোড়ায় চড়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আসেন। ঘোড়াটির কপালের চুল ছিল বাধা এবং তার মুখ ধুলাবালি থেকে ছিল রক্ষিত। জিবরাঈল বললেন, হে মুহাম্মদ! আল্লাহ

আমাকে আপনার নিকট এই নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়েছেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি সন্তুষ্ট না হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আপনাকে ছেড়ে যাবাে না। আপনি কি তাতে সন্তুষ্ট? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘হ্যা’। ওয়াকিদী বলেন, বর্ণনাকারিগণ বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবদুল্লাহ ইবন রওয়াহা ও যায়দ ইবন হারিছাকে আছিল নামক স্থান থেকে অগ্রগামী দল হিসেবে পাঠিয়ে দেন। তারা রবিবারে প্রায় দুপুরের সময় এসে পৌছেন। ‘আকীক নামক স্থানে আসার পর আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা যায়দ ইবন হারিছা থেকে পৃথক হয়ে যান। তারপর আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা তাঁর সওয়ারীর উপর থেকেই ঘোষণা দিলেন, হে আনসার সম্প্রদায়! সুসংবাদ গ্ৰহণ করুন; রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিরাপদে আছেন এবং মুশরিকরা মারা পড়েছে ও বন্দী হয়েছে। রবীআর দুই পুত্র, হাজ্জাজের দুই পুত্র, আবু জাহল, যামআ ইবন আসওয়াদ ও উমাইয়া ইবন খালফ নিহত হয়েছে এবং সুহায়ল ইবন আমরকে বন্দী করা হয়েছে। আসিম ইবন আদী বলেন : আমি উঠে তার কাছে যেয়ে বললাম, হে ইবন রাওয়াহা! যা বলছি তা কি সত্য? তিনি বললেন, হ্যা, আল্লাহর কসম, আগামীকাল রাসূলুল্লাহ (সা) বন্দীদের বেঁধে নিয়ে আসবেন। এরপর তিনি উচু এলাকায় আনসারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সুসংবাদ দিতে থাকেন। আনসারদের ছোট ছোট বালকেরা তার সাথে সুর করে বলতে থাকে ‘নিহত হয়েছে। আবু জাহল ফাসিক’! আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা যখন বনু উমাইয়ার আবাসস্থলের কাছে পৌছেন, তখন যায়দ ইবন হারিছা! রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উটনী কাসওয়ার উপর চড়ে আগমন করেন এবং মদীনাবাসীদেরকে

ংবাদ শুনান। যখন তিনি ঈদগাহের কাছে আসলেন, তখন সওয়ারীর উপর থেকেই উচ্চৈঃস্বরে বললেন, রাবীআর দুই পুত্র উত্বা ও শায়াবা এবং হাজ্জাজের দুই পুত্র নিহত হয়েছে। উমাইয়া ইবন খালফ, আবু জাহল, আবুল বুখতারী এবং যামআ ইবন আসওয়াদ—এরা সকলেই নিহত হয়েছে এবং সুহায়ল ইবন আমার যুল-আনয়াবসহ বহু লোক বন্দী হয়েছে। কেউ কেউ যায়দের কথা সত্য বলে মেনে নিতে পারছিল না। তারা বলাবলি করতে লাগলো, যায়দ ইবন হারিছা তো পরাজিত হয়ে এসেছে। এতে মুসলমানদের মন, ভেঙ্গে গেল এবং তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। আসিম ইবন আদী বলেন, যায়ীদ যখন মদীনায় পৌঁছে, তখন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কন্যা রুকাইয়াকে জান্নাতুল বাকী গোরস্তানে দাফন করে ফিরছিলাম। জনৈক মুনাফিক উসামাকে লক্ষ্য করে বলল, তোমাদের সর্দার (মুহাম্মদ)ও নিহত হয়েছে। সেই সাথে তার অন্যান্য সঙ্গীরাও নিহত হয়েছে। আর এক মুনাফিক আবু লুবাবাকে বলল, তোমাদের সাথী, সঙ্গীরা এমনভাবে ছত্ৰভঙ্গ হয়ে গেছে যে, আর কোনদিনও একত্রিত হবে না। যুদ্ধে যায়দের সাখীরাও নিহত হয়েছে, মুহাম্মদও নিহত হয়েছে। এই তো তার উল্লী, আমরা ওটা চিনি। আর এই যে যায়দ–সে তো ভয়ে ভীত হয়ে কি বলছে না বলছে তা সে নিজেই বুঝতে পারছে না। সে তো পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছে। আবু লুবাবা বললেন, আল্লাহ তোমার কথা মিথ্যা প্রমাণিত করে দিবেন। ইয়াহুদীরা বলতে লাগল, যায়দা— সে তো পরাজিত হয়েই এসেছে। উসামা বলেন, এসব কথাবার্তা শুনে আমি একান্তে আমার পিতা যায়দের সাথে মিলিত হলাম এবং তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি যে সংবাদ দিচ্ছেন তা কি সত্য? তিনি বললেন, হ্যা বেটা! আল্লাহর কসম, আমি যা বলছি তা সবই সত্য। উসামা বলল, আমি এবার নিজেকে শক্ত করে নিলাম এবং ঐ মুনাফিকটির নিকট গিয়ে বললাম, তুমি রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও মুসলমানদের সম্পর্কে

۹ ما

অপপ্রচার চালাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় ফিরে আসলে তোমাকে তাঁর সম্মুখে হাযির করা হবে। তখন তিনি তোমার গর্দান উড়িয়ে দেবেন। মুনাফিকটি বলল, এ কথাগুলো আমি লোকজনকে বলতে শুনেছি, তাই বলছি। এরপর বন্দীদেরকে নিয়ে আসা হয়। রাসূল (সা)-এর আযাদকৃত দাস শাকরানও তাদেরকে নিয়ে আসছিলেন। তিনি বদর যুদ্ধে শরীক হয়েছিলেন। যুদ্ধবন্দীদের মোট সংখ্যা ছিল উনপঞ্চাশজন। ওয়াকিদী বলেন, বন্দীদের প্রকৃত সংখ্যা ছিল সত্তরজন। এর উপর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত, এতে কোন সন্দেহ নেই। বর্ণনাকারী বলেন, মদীনার নেতৃস্থানীয় লোকজন রাওহা নামক স্থানে অগ্রসর হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বিজয় অভিনন্দন জানান। উসয়দ ইবন হুযােয়র বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর— যিনি আপনাকে বিজয়ী করেছেন, আপনার চোখ জুড়িয়েছেন। ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম, আপনি শত্রুর মুকাবিলা করবেন তা বুঝতে পারলে আমি বন্দরে না যেয়ে বাড়িতে থাকতাম না। আমি মনে করেছিলাম, আপনি বাণিজ্য-কাফেলার উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন। শক্রর উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন তা জানলে আমি কিছুতেই বসে থাকতাম না। উসায়েদের কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তুমি যথাৰ্থ বলেছ।

ইবন ইসহাক বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) যুদ্ধবন্দীসহ মদীনার দিকে রওনা হন। বন্দীদের মধ্যে উকবা ইবন আবু মুআয়ত ও নযর ইবন হারিছও ছিল। গনীমতের দায়িত্ব দেন। আবদুল্লাহ ইবন কাআব ইবন আমর ইবন আওফ ইবন মান্বযুল ইবন আমর ইবন গনাম ইবন মাযিনি ইবন নাজ্জার-এর উপর। এ সময় মুসলমানদের মধ্য হতে একজন রণোদ্দীপনামূলক কবিতা আবৃত্তি করেন। ইবন হিশাম, তার নাম বলেছেন আব্দী ইবন আবী যাগবা।

(কবিতা) হে বসবাস! কাফেলার বাহনগুলোকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া অব্যাহত রাখা। যা-তালীহি উপত্যকায় কাফেলা নিয়ে রাত্রি যাপন করা যাবে না এবং উমােয়র প্রান্তরে একে আটকান যাবে না। কেননা, বিজয়ী কাফেলার বাহনের গতি রোধ করা যায় না। সুতরাং রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করে যাওয়ার সুযোগ দেয়াই বুদ্ধিমানের পরিচয়। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সাহায্য করেছেন এবং শয়তান পালিয়ে গেছে।

বর্ণনাকারী বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) সম্মুখে অগ্রসর হন এবং সাফরা গিরিপথ পার হয়ে উক্ত গিরিপথ ও নাযিয়ার মধ্যবতী সায়ার নামক বালুর টিলায় এক প্ৰকাণ্ড বৃক্ষের নিকট অবতরণ করেন। সেখানে বসে তিনি মুশরিকদের থেকে প্রাপ্ত গনীমতের মাল মুসলমানদের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করে দেন। এরপর সেখান থেকে যাত্রা করে যখন রাওহা নামক স্থানে পৌছেন, তখন মুসলমানগণ রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর সাহাবীগণকে আল্লাহ যে বিজয় দান করেছেন সেজন্যে অভিনন্দন জানাতে থাকেন। আসিম সূত্রে বর্ণিত, তখন সালামা ইবন সুলামা বললেন? তোমরা আমাদেরকে কি জন্যে মুবারক বাদ দিচ্ছ? আল্লাহর কসম, আমরা তো কতিপয় টাকওয়ালা বৃক্ষের সাথে যুদ্ধ করেছি–যারা ছিল বাধা উটের মত, আমরা তাদেরকে যবাহ করে দিয়েছি মাত্র। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুচকি হেসে বললেন, : ভাতিজা! ওরাই তো এক সময় সমাজের কর্ণধার ছিল।

ইবন ইসহাক বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন সাফরা নামক স্থানে পৌছেন, তখন নযর ইবন হারিছকে হত্যা করা হয়। মক্কার কয়েকজন আলিমের ভাষ্য অনুযায়ী হযরত আলী ইবন আবু তালিব তাকে হত্যা করেছিলেন। এরপর সেখান থেকে অগ্রসর হয়ে “আরকুয-যাবিয়াতে” পৌছে উকবা ইবন আবু মুআয়তকে হত্যা করা হয়। ইবন ইসহাক বলেন? উকবাকে হত্যা করার নির্দেশ দিলে সে রাসূলুল্লাহকে বলেছিল, হে মুহাম্মদ! আমার ছােট ছেলেমেয়েদের দেখার জন্যে কে রইল? তিনি বললেন, ‘আগুন’। আবু উবায়দা ইবন মুহাম্মদ ইবন আম্মার ইবন ইয়াসিরের বর্ণনা মতে, বনী আমার ইবন আওফ গোত্রের আসিম ইবন ছাবিত ইবন আবুল আফলাহ উকবাকে হত্যা করেন। মূসা ইবন উকবা তার মাগাষী গ্রন্থে এ কথাই বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, উকবা ব্যতীত অন্য কোন বন্দীকে রাসূলুল্লাহ (সা) হত্যা করেননি। বর্ণনাকারী বলেন, আসিম ইবন ছাবিত উকবাকে হত্যা করার জন্যে যখন অগ্রসর হলেন, তখন সে বলেছিল, হে কুরায়শ জনগণ! এখানে যতগুলো লোক আছে, তাদের মধ্য হতে আমাকে কেন হত্যা করা হচ্ছে? আসিম বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে শক্ৰতা করার কারণে। হাম্মাদ ইবন সালামা আতা ইবন সায়িব, শা’বী থেকে বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন উকবাকে হত্যা করার নির্দেশ দেন, তখন সে বলেছিল, মুহাম্মদ! আমি একজন কুরায়শী হওয়া সত্ত্বেও আমাকে হত্যা করছি? তিনি বললেন, হ্যা। এরপর সাহাবীদেরকে লক্ষ্য করে বললেন : তোমরা কি জান, এ লোক আমার সাথে কী আচরণ করেছে? এক দিনের ঘটনা, আমি মাকামে ইবরাহীমের পাশে সালাতে সিজদারত ছিলাম। এ অবস্থায় সে আমার ঘাড়ে পা রেখে সজোরে চাপ দিতে থাকে। অব্যাহত চাপে মনে হচ্ছিল এখনই আমার চোখ দু’টি ফেটে বেরিয়ে যাবে। আর একদিন সিজদারত অবস্থায় সে ছাগলের নাড়িতুড়ি এনে আমার মাথার উপর রেখে দেয়। পরে আমার মেয়ে ফাতিমা এসে সেগুলো ফেলে দিয়ে আমার মাথা ধুয়ে দেয়। ইবন হিশাম বলেন, যুহরী প্রমুখ আলিমগণের বর্ণনা মতে, হযরত আলী ইবন আবু তালিব উকবাকে হত্যা করেছিলেন।

বস্তৃত এই দুই ব্যক্তি ছিল অত্যন্ত জঘন্য প্রকৃতির। অন্যদের তুলনায় কুফরী কাজে হিংসা-বিদ্বেষ, শক্ৰতা, বাড়াবাড়ি এবং ইসলাম ও মুসলমানদের কুৎসা রটনায় সব চাইতে অগ্রগামী। ইবন হিশাম বলেন, : নযর ইবন হারিছের মৃত্যুতে তার বােন কুতায়লা বিনত হারিছ কবিতার মাধ্যমে বিলাপ করে বলেছিল?

ياراكبا إن الأثيل مظنة + من صبح خامسة وأنت موفق – হে আরোহী! আহীিল উপত্যকা সম্পর্কে আমি পাচ দিন ধরে দুশ্চিন্তায় ভুগছি। আর তোমার আগমন আমার সে দুশ্চিন্তাকে নিশ্চিত করে দিল।। ২

তথায় মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিকে আমার আশীৰ্বাদ পৌঁছিয়ে দাও, যাতে তথাকার শরীফ লোকেরা বঞ্চিত না হয়।

(হে ভ্ৰাতা!)। আমার পক্ষ থেকে তোমার প্রতি আশীৰ্বাদ রইল। তোমার জন্যে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। একবার অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, আর একবার বন্ধ হচ্ছে।

আমি যদি নযারকে ডাকি, তবে সে কি আমার ডাক শুনবে? যে মারা গেছে–কথা বলতে পারে না, সে কি করে ডাক শুনবে?

হে মুহাম্মদ! হে আপন জাতির সন্ত্রান্ত মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান! ঐতিহ্যগতভাবে যে সন্ত্রান্ত হয়, সেই প্রকৃত সন্ত্রান্ত। Y

আপনি যদি তার উপর করুণা দেখাতেন, তাতে আপনার কি এমন ক্ষতি হত? অনেক ক্ষেত্রেই তো দেখা যায়, একজন ক্রোধান্বিত বিদ্বেষপরায়ণ যুবক তার প্রতিপক্ষের উপর করুণা করে থাকে।

অথবা আপনি তার মুক্তিপণ গ্রহণ করতেন। কষ্ট করে হলেও তার জন্যে সর্বোচ্চ হারে মুক্তিপণ আদায় করে দেয়া হত।

আপনি যাদেরকে বন্দী করেছিলেন, তাদের মধ্যে নযর তো ছিল আপনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। বন্দীদের মধ্যে যদি কাউকে মুক্তি দেয়া হয়, তবে নযর ছিল তাদের মধ্যে মুক্তি পাওয়ার সর্বাধিক দাবীদার।

নিজের গোত্রীয় সন্তানদের তরবারি তাকে আঘাত হানছিল এবং রক্তের সম্পর্ক সেখানে আল্লাহর হুকুমে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ছিল। তাকে হাত-পা বাধা ও বেড়ি পরান অবস্থায় টেনে-হেঁচড়ে বধ্য-ভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। (হে কুতায়লা তুমি ধৈর্য ধারণ কর।)

ইবন হিশাম বলেন, : কথিত আছে–রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট যখন এ কবিতা পেঁৗছে তখন তিনি বলেছিলেন, তাকে হত্যা করার আগে যদি আমার কাছে। এ কবিতা পৌঁছতো, তবে তার উপর করুণা দেখাতাম।

ইবন ইসহাক বলেন, : এ স্থানে (আরকুয-যাবিয়া) ফারাওয়া ইবন আমার আল-বায়াযি’র আযাদকৃত দাস, রাসূলুল্লাহর ক্ষৌরকার আবু হিন্দ এসে তার সাথে সাক্ষাত করে। সে মদের একটি মশকে ‘হায়স’ (খুরমা, ছাতু ও ঘি মিশ্রিত এক প্রকার খাবার) ভর্তি করে রাসূলুল্লাহর জন্যে হাদিয়া এনেছিল। রাসূলুল্লাহ তা গ্রহণ করলেন এবং তার সাথে উত্তম ব্যবহার করার জন্যে আনসারদেরকে নির্দেশ দিলেন। ইবন ইসহাক বলেন, : এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) যাত্রা শুরু করেন এবং যুদ্ধবন্দীদের মদীনা পৌঁছার একদিন আগেই তিনি সেখানে পৌছেন। ইবন ইসহাক বলেন, : আবদুদ-দার গোত্রের নাবীহ ইবন ওয়াহব আমাকে বলেছেন যে, যুদ্ধবন্দীরা মদীনা পৌছে গেলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদেরকে সাহাবীদের মধ্যে বণ্টন করে দেন এবং বলে দেন। “ওদের সাথে তোমরা উত্তম আচরণ করবে।” বর্ণনাকারী বলেন, মুসআব ইবন উমায়রের সহোদর ভাই আবু আয়ীয। ইবন উমােয়র ইবন হাশিম বন্দীদের মধ্যে ছিল। আবু আর্যীয বলে, আমার ভাই মুসআব ইবন উমােয়র আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় একজন আনসারী আমাকে বন্দী করে রেখেছিল। তখন মুসআব তাকে বলল, একে শক্ত করে বেঁধে তোমার কাছে রেখে দাও! তার মা একজন সম্পদশালী মহিলা। হয়ত বা মুক্তিপণ দিয়ে তোমার নিকট থেকে ওকে ছাড়িয়ে নেবে। আবু আয়ীয বলে, বদর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে আমি একদল আনসারের সাথে ছিলাম। আমাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করার জন্যে রাসূলুল্লাহর নির্দেশ থাকায় তারা সকাল-বিকাল আহার করার সময় আমাকে রুটি দিত এবং নিজেরা খেজুর খেত। তাদের মধ্যে যার কাছেই রুটি থাকত, তা আমাকে দিয়ে দিত। এতে আমি লজ্জিত হয়ে তাদেরকে রুটি ফিরিয়ে দিতাম। কিন্তু তারা তা স্পর্শ না করেই আমাকে পুনরায় দিয়ে দিত। ইবন হিশাম বলেনঃ এই আবু আয়ীয ছিল নযর ইবন হারিছের পরে মুশরিকদের পতাকাবাহী সেনাধ্যক্ষ । মুসআব যখন তার ভাই আবু আয়ীযকে বন্দীকারী আবু ইয়াসারকে শক্ত করে বাঁধার জন্যে বলেছিলেন তখন আবু আয়ীয মুসআবকে বলেছিল, ভাই! আমার সাথে এরূপ করার জন্যে কি তুমি আদিষ্ট ? মুসআব বললেন, তুমি আমার ভাই নও; বরং সে-ই আমার ভাই। এরপর আবু আয়ীয্যের মা জিজ্ঞেস করল, সর্বোচ্চ কত মুক্তিপণ নিয়ে কুরায়শ বন্দীদের ছাড়া হচ্ছে ? বলা হল, চার হাজার দিরহামের বিনিময়ে। সে মতে তার মা চার হাজার দিরহাম পাঠিয়ে দিয়ে তাকে মুক্ত করে নেয়।

ইবন আহীর ‘গাবাতুস-সাহাবা” গ্রন্থে আবু আয়ীয্যের নাম যুরােরা লিখেছেন এবং খলীফা। ইবন খাইয়াত তাকে সাহাবাদের মধ্যে গণ্য করেছেন। তিনি বলেন, আবু আয়ীয ছিল মুসআব ইবন উমায়রের বৈপিত্রেয় ভাই। তাদের আরও একজন বৈপিত্রেয় ভাই ছিল। তার নাম আবুর রূম ইবন উমায়র। যারা বলেছেন, আবু আয়ীয উহুদ যুদ্ধে কাফির অবস্থায় নিহত হয়েছে, তারা ভুল করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ঐ নিহত ব্যক্তির নাম আবু ইযযা”। এ বিষয়ে যথাস্থানে আলোচনা বকর আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে মদীনায় পৌছেন, তখন নবী সহধর্মিণী সাওদা বিনত যামআ আফরা-পরিবারে অবস্থান করছিলেন। আফরার দুই পুত্ৰ আওফ ও মুআওয়ায বদর যুদ্ধে শহীদ হওয়ায় তাদেরকে সান্তুনা দেয়ার জন্যে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। তখনও পর্দার বিধান প্রবর্তিত হয়নি। সাওদা বলেন, আল্লাহর কসম, ঐ বাড়িতে থাকতেই আমি সংবাদ পেলাম যে, যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে আসা হয়েছে। আমি তখন আমার ঘরে ফিরে আসলাম। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় দেখলাম, আবু ইয়ায়ীদ সুহায়ল ইবন আমার কক্ষের একপাশে রয়েছে। আর তার হাত দু’খনি কাঁধের সাথে রশি দিয়ে বাঁধা। সাওদা (রা) বলেন, আল্লাহর কসম, আবু যায়দের এ অবস্থা দেখে আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। বললাম, হে আবু যায়দ! তোমরা আত্মসমর্পণ করলে কেন ? যুদ্ধ করে সম্মানের সাথে মরতে পারলে না ? সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ্ (সা)। ঘর থেকে আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, হে সাওদা! তুমি কি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে উস্কানি দিচ্ছ ? আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম, আবু যায়দকে এরূপ বাধা অবস্থায় দেখে আত্মসম্বরণ করতে পারিনি, তাই এরূপ বলে ফেলেছি। মদীনায় যুদ্ধবন্দীদের অবস্থা মুক্তিপণের পরিমাণ ও ধরন সম্পর্কে সামনে যথাস্থানে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *