৬. সাইকোকাইনেসিস
নতুন কোনো বৈজ্ঞানিক সত্য তার প্রতিপক্ষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে বিজয় অর্জন করতে পারে না। আবার তত্ত্বটিতে কোনো আলোও দেখতে পায় না তারা। বরং এ সত্যটির প্রতিপক্ষরা ধীরে ধীরে মারা যেতে থাকে এবং নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠতে গিয়ে এই বৈজ্ঞানিক সত্যটির সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে
—ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক
পরম সত্য নিয়ে কেউ কথা বলবে না, সেটি বোকার অধিকার।
—শেক্সপিয়ার
একদিন দেবতারা স্বর্গে মিলিত হয়ে মানুষের দুঃখবোধের অবস্থা নিয়ে অভিযোগ তুললেন। আমাদের মানে মানুষের বাজে, বোকাটে ও অর্থহীন মূর্খতা নিয়ে চরম বিরক্ত ছিলেন তাঁরা। কিন্তু এক দেবতা আমাদের ওপর দয়া করলেন। তাই একটি পরীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। পরীক্ষাটি ছিল খুব সাধারণ। এক ব্যক্তিকে সীমাহীন ক্ষমতা দিলেন তিনি। আসলে তাঁরা দেখতে চাচ্ছিলেন, মানুষ যদি দেবতাদের মতো ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে, তাহলে তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়?
ওই নির্বোধ সাধারণ লোকটি ছিল জর্জ ফোথেরিনগে। ছোটখাটো এক দোকানদার সে। আচমকা নিজের মধ্যে দেবতাদের মতো ক্ষমতা আবিষ্কার করে জর্জ। বাতাসে মোমবাতি ভাসাতে পারল সে। একই সঙ্গে পানির রং বদলে দিতে, সুস্বাদু খাবার তৈরি করতে আর ভেলকি দেখিয়ে স্রেফ শূন্য থেকে হীরাও আনতে পারল সে। শুরুতে সে ক্ষমতাটা বিনোদন আর ভালো ভালো সব কাজের জন্য ব্যবহার করছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে ক্ষমতার লোভে তার অহমিকা বাড়তে লাগল আর লালসায় ডুবে যেতে লাগল লোকটি। এভাবে অনেকগুলো প্রাসাদ আর সীমাহীন ধনী ক্ষমতালোভী স্বেচ্ছাচারী এক মানুষে পরিণত হলো জর্জ। অসীম ক্ষমতায় বুঁদ হয়ে সে বড় একটা ভুল করে বসল একদিন। সে উদ্ধতভাবে পৃথিবীর ঘূর্ণন থামানোর আদেশ দিল। হঠাৎ চতুর্দিকে অকল্পনীয় বিশৃঙ্খলা শুরু হলো। প্রচণ্ড ঝোড়ো বাতাসে সবকিছু ছুটতে লাগল পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগে বা ঘণ্টায় ১০০০ মাইল বেগে। পৃথিবীর সব মানুষ ছিটকে মহাশূন্যে চলে যেতে লাগল। মরিয়া হয়ে, সর্বশেষ ও চূড়ান্ত ইচ্ছা প্রকাশ করল সে। এবার সবকিছু আগের মতো ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিল লোকটি।
দ্য ম্যান হু কুড ওয়ার্ক মিরাকলস (১৯৩৬) চলচ্চিত্রের কাহিনি এ রকম। ছবিটি বানানো হয়েছিল এইচ জি ওয়েলসের এক ছোটগল্প অবলম্বনে। (এই গল্প অবলম্বনে পরে জিম ক্যারি অভিনীত ব্রুস অলমাইটি চলচ্চিত্রটি পুনর্নির্মাণ করা হয়।) এসব ক্ষমতাকে বলা হয় ইএসপি, সাইকোকাইনেসিস বা মাইন্ড ওভার ম্যাটার, কিংবা কোনো বস্তু সম্পর্কে শুধু চিন্তা করে সেই বস্তুটিকে নাড়ানোর ক্ষমতা। অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ার কারণে একে একধরনের দৈবশক্তি বলে ভাবা হয়। ওয়েলস এ ছোটগল্পে বলতে চেয়েছেন, দেবতাদের মতো ক্ষমতা পেতে হলে তাঁদের মতো বিচারবোধ আর প্রজ্ঞারও প্রয়োজন।
সাহিত্যে সাইকোকাইনেসিস বেশ ভালো জায়গা দখল করে আছে। বিশেষ করে শেক্সপিয়ারের দ্য টেমপেস্ট নাটকের কথা বলা যায়। নাটকটিতে জাদুকর প্রোসপেরো, তার মেয়ে মিরিন্ডা আর জাদুকরি ভূত এরিয়েল নিরুপায় ও অসহায় অবস্থায় জনশূন্য একটা দ্বীপে আটকে ছিল। প্রোসপেরোর খলনায়ক ভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকার কারণে অনেকগুলো বছর সেখানে থাকতে হয় তাদের। একবার প্রোসপেরো জানতে পারে তার শয়তান ভাই এক নৌকায় চেপে তাদের কাছাকাছি আসছে। প্রতিশোধ নিতে নিজের সাইকোকাইনেসিস ক্ষমতা কাজে লাগায় প্রোসপেরো। এর মাধ্যমে সে শূন্য থেকে ভয়ংকর ঝড় এনে তার ভাইয়ের জাহাজটি ওই দ্বীপে ধ্বংস করে দেয়। প্রোসপেরো এরপর সাইকোকাইনেসিস ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে দুর্ভাগা যাত্রীদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। এদের মধ্যে ছিল নিষ্পাপ, সুদর্শন তরুণ ফার্দিনান্দ। প্রোসপেরো তার ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে মিরিন্ডার আর ফার্দিনান্দের মনে ভালোবাসার সৃষ্টি করে।
(রুশ লেখক ভ্লাদিমির নভোকভ উল্লেখ করেছেন, দ্য টেমপেস্ট-এ বিজ্ঞান কল্পকাহিনির চরিত্রের বেশ মিল আছে। আসলে প্রায় সাড়ে তিন শ বছর আগে নাটকটি লেখার পর, ১৯৫৬ সালে টেমপেস্টকে ক্ল্যাসিক সায়েন্স ফিকশন হিসেবে নতুন করে লেখা হয়। এর নাম ছিল ফরবিডেন প্ল্যানেট। সেখানে প্রোসপেরোকে দেখানো হয় চিন্তাশীল বিজ্ঞানী মরবিয়াস হিসেবে। জাদুকরি ভূতটি পরিণত হয় রোবি নামের এক রোবটে। আর মিরিন্ডা পরিণত হয় মরবিয়াসের সুন্দরী কন্যা আলটাইরা। অন্যদিকে জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপটি হয়েছিল আলটেয়ার-৪ নামের একটা গ্রহ। স্টার ট্রেক সিরিজের নির্মাতা জিন রোডেনবেরি স্বীকার করেছেন, ফরবিডেন প্ল্যানেট তাঁর জনপ্রিয় টিভি সিরিজ বানানোর পেছনে অন্যতম অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।)
স্টিফেন কিংয়ের ক্যারি (১৯৭৪) উপন্যাসের মূল প্লট ছিল সাইকোকাইনেসিস। সেখানে এক অখ্যাত এক লেখককে একসময় বিশ্বের সেরা হরর ঔপন্যাসিক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠতে হতে দেখা যায়। ক্যারি খুব লাজুক ও সামান্য হাইস্কুলপড়ুয়া বালিকা। সে সামাজিকভাবে বন্ধুহীন। মানসিক ভারসাম্যহীন মায়ের যন্ত্রণায় প্রায়ই অবজ্ঞার শিকার হতে হয় তাকে। একমাত্র সান্ত্বনা তার সাইকোকাইনেসিস ক্ষমতা। দৃশ্যত তা তার পরিবারে সঞ্চালিত হয়। চূড়ান্ত দৃশ্যে, তাকে শত্রুরা এমন ভাব দেখায়, যেন সেই প্রোম কুইন হতে যাচ্ছে। এরপর তার নতুন পোশাকে শূকরের রক্ত ছিটিয়ে দেয় তারা। প্রতিশোধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ক্যারি মানসিক শক্তি দিয়ে সব দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর তাকে যারা যন্ত্রণা দিয়েছিল তাদের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে মেরে ফেলে, স্কুলভবন পুড়িয়ে দেয় ও আত্মঘাতী আগুনঝড় চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। এতে ডাউনটাউনের বেশির ভাগ অংশ পুড়ে যায়। এভাবে একসময় নিজেকেও ধ্বংস করে ফেলে সে।
সাইকোকাইনেসিস ক্ষমতা এক ভারসাম্যহীন মানুষের হাতে পড়ার ঘটনা নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল স্টার ট্রেকের স্মরণীয় একটা পর্ব। এর নাম ছিল চার্লি এক্স। বহু দূরের এক কলোনি থেকে আসা এক ভারসাম্যহীন অপরাধী এক তরুণকে নিয়ে বানানো হয়েছিল পর্বটি। সাইকোকাইনেসিস ক্ষমতা কোনো ভালো কাজে ব্যবহার না করে সে অন্য মানুষদের নিয়ন্ত্রণ করত। নিজের স্বার্থপর ও কুটিল ইচ্ছা চরিতার্থ করতে ওই সব মানুষের ইচ্ছাও পাল্টে দিত সে। এন্টারপ্রাইজের ক্ষমতা যদি সে কোনোমতে দখল করতে পারত আর পৃথিবীতে আসতে পারত, তাহলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে পুরো গ্রহটিই ধ্বংস করে ফেলত। এদিকে স্টার ওয়ার্স সাগার জেডাই নাইট নামের পৌরাণিক সমাজ পরিচালিত ফোর্সেরও সাইকোকাইনেসিস ক্ষমতা ছিল।
সাইকোকাইনেসিস ও বাস্তবতা
বাস্তব জীবনে সাইকোকাইনেসিস নিয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত বিরোধিতার ঘটনাটি সম্ভবত ঘটেছিল জনি কারসনের শোতে। সেই ১৯৭৩ সালে। এই মহাকাব্যিক বিরোধিতায় জড়িত ছিলেন ইসরায়েলি সাইকিক উরি গেলার। তিনি মনের শক্তি ব্যবহার করে চামচ বাঁকিয়ে ফেলার দাবি করেন সেবার। এ ছাড়া পেশাদার জাদুকর অ্যামেজিং র্যান্ডিও জড়িত ছিলেন এতে। তাঁর সাইকিক ক্ষমতা থাকার ভুয়া দাবি করে ক্যারিয়ার গড়ে তোলেন তিনি। (এ তিনজনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো : তাঁদের প্রত্যেকেই জাদুকর হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। হাতসাফাইয়ের কৌশলে তাঁরা এমনই দক্ষ ছিলেন যে তাতে দর্শকদের চোখ কপালে উঠে যেত।)
গেলারের আবির্ভাবের আগে, র্যান্ডির সঙ্গে পরামর্শ করেন কারসন। র্যান্ডি তাঁকে পরামর্শ দেন, জনি নিজেই চামচ সরবরাহ করবে এবং শো টাইমের আগে সেগুলো সবাইকে দেখতে দেবে। অবাক ব্যাপার হলো, সম্প্রচারের সময় গেলারকে তাঁর নিজের চামচের বদলে কারসনের চামচ বাঁকানোর কথা বলেন। বিব্রতকর ব্যাপার হলো, চামচ বাঁকাতে প্রতিবার ব্যর্থ হন গেলার। (পরে র্যান্ডি জনি কারসনের শোতে এসে সফলভাবে চামচ বাঁকানোর কৌশল দেখান। কিন্তু সতর্কভাবে তিনি বলেন, তাঁর আর্ট বিশুদ্ধ ম্যাজিক, সাইকিক ক্ষমতার ফল নয়।)
সাইকিক ক্ষমতা দেখাতে পারবে, এমন কাউকে ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অ্যামেজিং র্যান্ডি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই ১ মিলিয়ন ডলার চ্যালেঞ্জে এখনো কাউকে অংশ নিতে দেখা যায়নি
সাইকোকাইনেসিস ও বিজ্ঞান
বৈজ্ঞানিকভাবে সাইকোকাইনেসিস বিশ্লেষণের কিছু সমস্যা আছে। সমস্যাটি হলো, যাঁরা সাইকিক ক্ষমতা আছে বলে দাবি করেন, তাঁদের কাছে বিজ্ঞানীরা সহজেই বোকা বনে যান। বিজ্ঞানীরা ল্যাবে যা দেখেন, তাতে বিশ্বাস করার প্রবণতা আছে তাঁদের মধ্যে। তবে যাঁরা সাইকিক পাওয়ার থাকার দাবি করেন, সেসব ম্যাজিশিয়ান অন্যদের ভিজ্যুয়াল সেন্সকে বোকা বানিয়ে প্রতারিত করতে পারেন। ফলে সাইকিক ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে হতভাগ্য পর্যবেক্ষকে পরিণত হন বিজ্ঞানীরা। যেমন ১৯৮২ সালে দুই বালককে নিরীক্ষা করতে ডাকা হয়েছিল একদল প্যারাসাইকোলজিস্টকে। মাইকেল এডওয়ার্ড ও স্টিভ শ নামের ওই দুই বালকের অসাধারণ কিছু ক্ষমতা ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছিল। ছেলে দুটি দাবি করত যে তারা ধাতব বস্তু বাঁকিয়ে ফেলতে পারে ও মনে মনে চিন্তা করে ফটোগ্রাফিক ফিল্মে ছবি তুলতে পারে। আবার সাইকোকাইনেসিস ক্ষমতা ব্যবহার করে বস্তু নাড়াতে ও অন্য মানুষের মন পড়তে পারার দাবিও তোলে তারা। প্যারাসাইকোলজিস্ট মাইকেল থালব্রোন ছেলে দুটোর এ ক্ষমতা দেখে এতই মুগ্ধ হয়ে যান যে তাদের ক্ষমতা বর্ণনা করতে ‘সাইকোকাইনেট’ শব্দটি উদ্ভাবন করে বসেন। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরির সেন্ট লুইসে ম্যাকডোনেল ল্যাবরেটরি ফর সাইকিক্যাল রিসার্চের প্যারাসাইকোলজিস্টদেরও ওই ছেলেদের কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক হয়ে যান। প্যারাসাইকোলজিস্টরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে ছেলে দুটোর সাইকিক ক্ষমতার সত্যিকার প্রমাণ তাঁদের হাতের মুঠোয় আছে। এরপর তাদের নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রবন্ধও লিখতে শুরু করেন তাঁরা। মজার ব্যাপার হলো, ঠিক পরের বছর ছেলে দুটো নিজেরাই ঘোষণা করে, তাদের দেখানো কাণ্ডকারখানাগুলো ভুয়া ছিল। ওসব কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি ছিল না, সাধারণ কিছু ম্যাজিকের কৌশল ব্যবহার করে তারা কাজগুলো করে দেখিয়েছিল। (ছেলে দুটোর একজন স্টিভ শ বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান হয়ে উঠতে পারে। তাকে প্রায়ই জাতীয় টেলিভিশনে দেখা যায়। )
ডিউক ইউনিভার্সিটির রাইন ইনস্টিটিউটে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সাইকোকাইনেসিস নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা চালানো হয়েছে। কিন্তু সেখানেও পাওয়া গেছে মিশ্র ফলাফল। এ বিষয়ের একজন পথিকৃৎ নিউইয়র্কের সিটি কলেজের আমার সহকর্মী প্রফেসর গার্টড শিমেইডলার। প্যারাসাইকোলজি ম্যাগাজিনের সাবেক সম্পাদক ও প্যারাসাইকোলজির অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট তিনি। ইএসপি নিয়ে তিনি খুবই আগ্রহী। এ বিষয়ে ওই কলেজে তাঁর নিজের অনেক শিক্ষার্থীর ওপর অনেক গবেষণা করেছেন তিনি। তাঁর পরীক্ষায় আরও অংশগ্রহণকারী সংগ্রহে তিনি বিভিন্ন ককটেল পার্টি চষে বেড়ান। এসব পার্টিতে বিখ্যাত সাইকিকরা ডিনারের অতিথিদের সামনে বিভিন্ন ধরনের সাইকিক ট্রিক দেখান। শতাধিক শিক্ষার্থী আর অসংখ্য মেন্টালিস্ট ও সাইকিককে বিশ্লেষণ করেন তিনি। একসময় আমাকে বলেছিলেন, তিনি এমন একজনকেও পাননি যে চাহিদামতো সাইকোকাইনেটিক কৌশল দেখাতে পারে। বরং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এসব ক্ষমতা দেখাতে পারে তারা। একবার একটি ঘরে বেশ কিছু ক্ষুদ্র থার্মিস্টোর ছড়িয়ে রাখেন শিমেইডলার। সেগুলো ঘরের তাপমাত্রার ভগ্নাংশ ডিগ্রি পরিবর্তনও শনাক্ত করতে পারত। এক মেন্টালিস্ট তীব্র মানসিক চেষ্টার পর ঘরের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রির ১০ ভাগের ১ ভাগ মাত্র বাড়াতে পেরেছিল। কঠোর পরিস্থিতিতে পরীক্ষাটি করতে পারায় সেবার বেশ গর্বিত হন শিমেইডলার। কিন্তু মনের শক্তি ব্যবহার করে চাহিদামতো বড় কোনো বস্তু সরাতে পারেনি কেউ।
সাইকোকাইনেসিস নিয়ে সবচেয়ে কঠিন, কিন্তু বিতর্কিত পরীক্ষাটি চালানো হয় প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্সটন অ্যানোমালিস রিসার্চ (পিইএআর) প্রোগ্রামে। ১৯৭৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন রবার্ট জি জ্যান। তিনি স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সে ডিনের দায়িত্বে ছিলেন। মানুষের মন চিন্তার মাধ্যমে নিজে নিজে দৈবচয়ন ভিত্তিতে কোনো ঘটনায় প্রভাব ফেলতে পারে কি না, তার খোঁজ চালান পিইএআরের প্রকৌশলীরা। যেমন আমরা জানি, কয়েন টস করা হলে হেড বা টেইল পাওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ। কিন্তু পিইএআরের বিজ্ঞানীদের দাবি, মানুষের চিন্তা নিজেই এ দৈবঘটনার ফলাফল প্রভাবিত করতে সক্ষম। ২৮ বছর চলার পর, ২০০৭ সালে প্রোগ্রামটি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত পিইএআরের (PEAR) প্রকৌশলীরা কয়েক হাজার পরীক্ষা চালান। সেখানে ১.৭ মিলিয়ন ট্রায়াল ও ৩৪০ মিলিয়ন কয়েন টস করা হয়। এসব ফলাফলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, সাইকোকাইনেসিসের প্রভাব সত্যিই আছে, তবে তা খুব সামান্য। গড়ে এর প্রভাব ১০ হাজারে মাত্র কয়েক অংশের বেশি নয়। এমন দুর্বল ফলাফলের পরও অন্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করে এটি। বিরোধী বিজ্ঞানী দলের দাবি, এ পরীক্ষায় কৌশলে তাঁদের তথ্য-উপাত্তে পক্ষপাত করে গোপন করেছেন গবেষকেরা।
(প্যারানরমাল অ্যাকটিভিটি তদন্ত করতে মার্কিন সেনাবাহিনী ১৯৮৮ সালে অনুরোধ জানায় ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলকে। সেনাদলের মধ্যে সাইকিক ক্ষমতাসহ অন্যান্য যেকোনো সম্ভাব্য সুবিধাজনক কিছু খুঁজে পেতে উদ্গ্রীব ছিল মার্কিন সেনাবাহিনী। ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তারা সন্ন্যাসী যোদ্ধাদের নিয়ে একটি হাইপোথেটিক্যাল ‘ফাস্ট আর্থ ব্যাটালিয়ন’ গড়ে তুলছিল। কমিটির বিবেচনায় এ যোদ্ধারা প্রায় সব কৌশলেই পারদর্শী ছিল। এসব ক্ষমতার মধ্যে ছিল ইএসপির ব্যবহার, ইচ্ছেমতো নিজের দেহ ওপরে তুলে ধরা, ভাসিয়ে তোলা, সাইকিক চিকিৎসা আর দেয়ালের ওপর দিয়ে হাঁটা। পিএইআরের আগের দাবি তদন্ত করতে গিয়ে ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল দেখেছে, সফল পরীক্ষাগুলোর অর্ধেকই মাত্র একজন ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া গেছে। কিছু সমালোচক বিশ্বাস করেন, ওই ব্যক্তিটি ছিল পরীক্ষকদের ভেতরের একজন এবং তিনি পিইএআরের জন্য কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখেছেন। ‘যে ব্যক্তিটি ল্যাব চালায়, সে নিজেই যদি ফলাফল তৈরি করে, তাহলে আমার জন্য সেটা সমস্যাজনক,’ এ কথা বলেছেন অরিগন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. রে হাইম্যান। পরে প্রতিবেদনে সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে, ‘১৩০ বছর ধরে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় প্যারাসাইকোলজিক্যাল ঘটনার অস্তিত্বের কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যতা পাওয়া যায়নি।’ )
সাইকোকাইনেসিস নিয়ে গবেষণার কিছু সমস্যাও আছে। এর সমর্থকেরাও এ সমস্যার কথা উল্লেখ করে। সেটি হলো, এটা আমাদের জানা পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের সঙ্গে সহজে খাপ খায় না। মহাবিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল বল মহাকর্ষ। এই বল শুধু আকর্ষণ করে, কিন্তু কোনো বস্তুকে বিকর্ষণ বা শূন্যে ভাসিয়ে তুলতে পারে না। অন্যদিকে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ মেনে চলে। এ বলটি বৈদ্যুতিকভাবে নিরপেক্ষ কোনো বস্তুকে ঘরের অন্য দিকে ধাক্কা দেবে, তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। নিউক্লিয়ার বল কাজ করে অতি ক্ষুদ্র পরিসরে। যেমন পারমাণবিক কণাদের মধ্যবর্তী দূরত্বে।
সাইকোকাইনেসিস নিয়ে আরেক সমস্যা হলো শক্তি সরবরাহ। হর্সপাওয়ার বা অশ্বশক্তির পাঁচ ভাগের মাত্র এক ভাগ উৎপাদন করতে পারে মানবদেহ। তারপরও স্টার ওয়ার্স মুভিতে ইউডা শুধু মনের শক্তি দিয়ে পুরো একটা স্টারশিপ শূন্যে ভাসিয়ে তোলে। কিংবা চোখ থেকে শক্তিশালী লেজার রশ্মি ছুড়ে দেয় সাইক্লপস। এগুলো সরাসরি শক্তির সংরক্ষণশীলতার সূত্র লঙ্ঘন করে। এ সূত্রমতে, ইউডার মতো অতি খুদে কারও পক্ষে গোটা স্টারশিপ শূন্যে ভাসানোর মতো শক্তি একত্রে জড়ো করতে পারা সম্ভব নয়। আমরা যত চেষ্টাই করি না কেন, সাইকোকাইনেসিসের অলৌকিক ঘটনা বা কাণ্ডকারখানা করে দেখাতে যথেষ্ট শক্তি জড়ো করা সম্ভব নয়। তাহলে প্রদত্ত এসব সমস্যায়, পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোর সঙ্গে সাইকোকাইনেসিসকে কীভাবে খাপ খাওয়ানো যায়?
সাইকোকাইনেসিস ও মস্তিষ্ক
সাইকোকাইনেসিস যদি আমাদের জানা মহাবিশ্বের বলগুলোর সঙ্গে খাপ না খায়, তাহলে একে ভবিষ্যতে কীভাবে পোষ মানানো সম্ভব? এর একটি ব্লু পাওয়া গিয়েছিল স্টার ট্রেকের ‘হু মোর্ন ফর অ্যাডোনিস?’ শিরোনামের এক পর্বে। এন্টারপ্রাইজের ক্রুরা গ্রিক দেবতাদের মতো দেখতে এক জাতির মুখোমুখি হয় পর্বটিতে। কোনো কিছু শুধু মনে মনে চিন্তা করেই অদ্ভুত সব কাজকারবার করার ক্ষমতা ছিল তাদের। প্রথমে মনে হচ্ছিল, ক্রুরা যেন খোদ অলিম্পাসের দেবতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছে। অচিরেই ক্রুরা বুঝতে পারল, ওরা আসলে দেবতা নয়, সাধারণ জীবসত্তা, যারা মানসিকভাবে কেন্দ্রীয় পাওয়ার স্টেশন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এরপর সেখান থেকে তাদের ইচ্ছা পূরণ হয়ে অলৌকিক কাণ্ডকারখানা ঘটায় তারা। তাদের প্রধান শক্তি কেন্দ্ৰ ধ্বংস করে এন্টারপ্রাইজের ক্রুরা তাদের ক্ষমতা উন্মুক্ত করতে পেরেছিল।
একইভাবে ভবিষ্যতের কোনো ব্যক্তির জন্য পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলোর আওতায় একটা ইলেকট্রনিক সেন্সিং ডিভাইস মানসিকভাবে চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ যন্ত্রটিই তাকে দেবতার মতো ক্ষমতা দিতে পারে। রেডিও-বিবর্ধন কিংবা কম্পিউটার-বিবর্ধনসম্পন্ন সাইকোকাইনেসিসের সত্যিকার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন ইইজি আদিম সাইকোকাইনেসিস যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। নিজের ইইজি মস্তিষ্কের প্যাটার্ন স্ক্রিনে দেখে মানুষ শিখতে পারে, কীভাবে আনাড়ির মতো, কিন্তু সচেতনভাবে তাদের সামনে দেখা মস্তিষ্কের প্যাটার্ন নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। যে পদ্ধতিতে এটা করা হয়, তাকে বলে বায়োফিডব্যাক।
মস্তিষ্কের কোন নিউরন দেহের কোন পেশি নিয়ন্ত্রণ করে, সেটা বলার মতো মস্তিষ্কের কোনো ব্লুপ্রিন্ট এ মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। সে কারণে রোগীদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করিয়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে এসব নতুন প্যাটার্ন নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে।
এভাবে একসময় কোনো ব্যক্তি স্ক্রিনে চাহিদামতো নির্দিষ্ট ধরনের ওয়েভ প্যাটার্ন তৈরি করতে পারবে। এ বিশেষ ওয়েভ প্যাটার্ন শনাক্ত করতে স্ক্রিন থেকে কোনো ছবি পাঠানো যাবে কম্পিউটার প্রোগ্রামেও। এরপর তা দিয়ে সুনির্দিষ্ট কমান্ড কার্যকর করা যাবে (যেমন কোনো পাওয়ার সুইচ অন করা বা মোটর চালু করা)। অন্য কথায়, কোনো ব্যক্তি শুধু চিন্তা করে ইইজিতে বিশেষ ধরনের মস্তিষ্কের প্যাটার্ন তৈরি করতে পারবে। আবার কোনো কম্পিউটার বা কোনো মোটর চালু করা যাবে এর মাধ্যমে।
এভাবে শুধু চিন্তাশক্তি ব্যবহার করে হুইলচেয়ার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে পুরোপুরি পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিও। কিংবা কোনো ব্যক্তি যদি ইইজি স্ক্রিনে ২৬টি শনাক্তযোগ্য প্যাটার্ন তৈরি করতে পারে, তাহলে শুধু চিন্তা করে সে টাইপ করতে পারবে। কারও চিন্তা এভাবে ট্রান্সমিট বা প্রেরণ করা যে অনেক কঠিন একটা পদ্ধতি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে জন্য বায়োফিডব্যাকের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির নিজের মস্তিষ্কের ওয়েভ নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে।
চিন্তা করার মাধ্যমে টাইপিং বাস্তবে রূপদানের বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে জার্মানির টুবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলস বিরবাওমারের গবেষণার কারণে। বায়োফিডব্যাক ব্যবহার করে তিনি স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে আংশিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষদের সহায়তা করছেন। মস্তিষ্কের ওয়েভ পার্থক্যের প্রশিক্ষণ দিয়ে, তাদের কম্পিউটার স্ক্রিনে সরল বাক্য টাইপ করতে শিখিয়েছেন তিনি।
এদিকে বানরের মাথায় ইলেকট্রোড ঢুকিয়ে বায়োফিডব্যাকের মাধ্যমে তাদের কিছু চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করতে শেখানো গেছে। এসব বানর এরপর রোবটের চিন্তা করার প্রক্রিয়ায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে হাত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
এর চেয়ে আরও নিখুঁত পরীক্ষা চালানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার এমরো ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে স্ট্রোকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত এক লোকের মাথায় কাচের ছোট গোলক সরাসরি বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কাচের গোলক তারের মাধ্যমে পিসিতে সংযুক্ত করা হলো। নির্দিষ্ট কিছু চিন্তা তারের মধ্য দিয়ে সিগন্যাল পাঠাতে, এমনকি পিসির স্ক্রিনে কারসরও নাড়াতে পেরেছিল ওই রোগী। বায়োফিডব্যাক ব্যবহার করে চর্চার মাধ্যমে রোগীটি সচেতনভাবে কারসরের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল। তাত্ত্বিকভাবে, স্ক্রিনে কারসরটি ব্যবহার করে মনে মনে চিন্তার মাধ্যমে লেখালেখি, কোনো যন্ত্র চালু করা, ভার্চুয়াল কার, ভিডিও গেম খেলাসহ আরও অনেক কিছু করা সম্ভব।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্টিস্ট জন ডনোঘু সম্ভবত মাইন্ড-মেশিন ইন্টারফেসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সফলতা পেয়েছেন। ব্রেনগেট নামের এক যন্ত্র বানিয়েছেন তিনি। শুধু মনের শক্তি ব্যবহার করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিকে চোখে পড়ার মতো অনেকগুলো দৈহিক কাজ করার সুযোগ এনে দিয়েছে যন্ত্রটি। ডনোঘু তাঁর যন্ত্রটি চারজন রোগীর ওপর পরীক্ষা করে দেখেছেন। তাঁদের দুজন স্পাইনাল কর্ডের জখমে ভুগছিল। তৃতীয় জনের স্ট্রোক আর চতুর্থ জন ভুগছিল এএলএসতে (অ্যামিওট্রোফিক ল্যাটারাল স্কেলেরোসিস, বা লিও গেরিগ ডিজিজে ভুগছিল। কসমোলোজিস্ট স্টিফেন হকিংও একই রোগে ভুগেছেন)।
ডনোঘুর ২৫ বছর বয়সী ম্যাথিউ ন্যাগেল নামের এক রোগী স্থায়ীভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। পুরোপুরি নতুন কম্পিউটারাইজড দক্ষতা শিখতে তার সময় লেগেছিল মাত্র এক দিন। সে এখন শুধু চিন্তা করে দিব্যি টিভির চ্যানেল বদলাতে পারে। শুধু কি তাই ভলিউম ঠিক করতে, কৃত্রিম হাত খুলতে ও লাগাতে, বৃত্ত আঁকতে, কম্পিউটারের কারসর নাড়াতে, ভিডিও গেম খেলতে আর ই-মেইল পড়তে পারে সে। ২০০৬ সালের গ্রীষ্মে তাকে নিয়ে নেচার ম্যাগাজিনে কভার স্টোরি ছাপা হওয়ার পর বিজ্ঞানীদের মধ্যে বেশ সাড়া পড়ে যায়।
ডনোঘুর ব্রেনগেটের মূল অংশ ক্ষুদ্র এক সিলিকন চিপ। এটি ৪ মিলিমিটার চওড়া, যার মধ্যে এক শ অতি ক্ষুদ্র ইলেকট্রোড বসানো থাকে। চিপটি সরাসরি মস্তিষ্কের ওপরে বসানো হয়, যেখানে মোটর কার্যক্রম সমন্বয় হয়। মস্তিষ্কের কর্টেক্সে অর্ধেকটা ঢোকানো থাকে চিপটি, যা প্রায় ২ মিলিমিটার ঘন। সোনার তার সিলিকন চিপটি থেকে সিগন্যাল সিগার বাক্সের আকৃতির এক অ্যামপ্লিফায়ারে বয়ে নিয়ে যায়। পরে ডিশওয়াশার আকারের এক কম্পিউটারে পাঠানো হয় এ সিগন্যাল। বিশেষ কম্পিউটার সফটওয়্যারে সংকেতগুলো প্রসেস করা হয়। এর মাধ্যমে মস্তিষ্কে তৈরি কিছু প্যাটার্ন চিনতে পারে ও সেগুলোকে যান্ত্রিক গতিতে পরিণত করে।
আগের পরীক্ষাগুলোয় বায়োফিডব্যাক ব্যবহার করে রোগীদের ইইজি তরঙ্গ পড়ার পদ্ধতি ছিল ধীরগতির আর কিছুটা ক্লান্তিকর। কিন্তু কম্পিউটারের সহায়তায় নির্দিষ্ট চিন্তার প্যাটার্ন শনাক্তে রোগীর প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া যথেষ্ট কমিয়ে আনা যায়। প্রথম ট্রেনিং সেশনে ন্যাগেলকে হাত নড়াচড়া করতে, হাত ডান থেকে বাঁ দিকে আনা, কবজি নাড়ানো ও হাতের মুঠি খোলা ও বন্ধ করার কথা মনে মনে চিন্তা করতে বলা হয়েছিল। ন্যাগেল যখন হাত ও আঙুল নাড়ানোর কথা কল্পনা করছিল, তখন তার বিভিন্ন নিউরনের উত্তেজনা দেখে ডনোঘু বেশ খুশি হন। ‘ব্যাপারটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। কারণ, আপনি মস্তিষ্কের কোষের কার্যপ্রণালি পরিবর্তন দেখতে পাবেন। এরপর আমি জানতাম, সবকিছু সামনে এগিয়ে যাবে, প্রযুক্তি সত্যি সত্যিই কাজ করবে,’ স্মৃতিচারণা করে বলেন তিনি।
(মাইন্ড-মেশিন ইন্টারফেসের এ অদ্ভুত রূপটি নিয়ে আগ্রহের পেছনে ডনোঘুর ব্যক্তিগত কিছু কারণ ছিল। যন্ত্রণাদায়ক এক রোগের কারণে শৈশবে হুইলচেয়ার বন্দী হয়েছিলেন তিনি। তাই হাঁটা-চলাফেরা হারিয়ে ফেললে যে অসহায়ত্ব আসে, তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল ডনোঘুর। )
ব্রেনগেট নিয়ে বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক পরিকল্পনা আছে ডনোঘুর। যন্ত্রটিকে তিনি মেডিকেল পেশার জন্য অপরিহার্য করে তুলতে চান। যন্ত্রটি এখন একটা ডিশওয়াশার আকারের। কম্পিউটার প্রযুক্তি আরও উন্নতির পর, এটি আরও সহজে বহনযোগ্য হয়ে উঠবে, তাতে সন্দেহ নেই। হয়তো কোনো পোশাকের সঙ্গে একসময় যন্ত্রটি পরে ফেলা যাবে। চিপটি ওয়্যারলেস হিসেবে বানানো সম্ভব হলে তারের জঞ্জালও কমে আসবে। কাজেই তখন যন্ত্রটি নিরবচ্ছিন্নভাবে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে।
মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশ এভাবে সক্রিয় করে তোলা এখন সময়ের ব্যাপার। আমাদের মস্তিষ্কের ওপরের পৃষ্ঠতলের মানচিত্র ইতিমধ্যে বানিয়ে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা। (মস্তিষ্কের কোন নিউরন সাধারণত কোথায় সংযুক্ত, তা দেখাতে আমাদের হাত, পা, মাথা ও পেছনের অংশ মাথার ওপরে চিত্রায়িত করা হলে এমন এক জিনিস পাওয়া যাবে, যাকে বলা হয় হোমানকুলাস বা ছোট্ট মানুষ। আমাদের দেহের অংশের ছবি আমাদের মস্তিষ্কে লিখলে বিকৃত এক মানুষের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। তার আঙুল, মুখ, জিহ্বা সম্প্রসারিত দেখাবে এবং ধড় ও পেছনের অংশ দেখাবে সংকুচিত।)
একসময় মস্তিষ্কের পৃষ্ঠতলের বিভিন্ন অংশে সিলিকন চিপ বসানো সম্ভব হবে। বিভিন্ন অঙ্গ ও উপাঙ্গ চিন্তাশক্তি দিয়ে সক্রিয় করা যাবে এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এ পদ্ধতিতে মানবদেহের যেকোনো দৈহিক কার্যক্রম নকল করা সম্ভব হবে। কল্পনা করা যায়, ভবিষ্যতে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষ সাইকোকাইনেটিক্যালি ডিজাইনকৃত বিশেষ ধরনের বাড়িতে বসবাস করবে। ফলে এয়ারকন্ডিশনার, টিভি ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি স্রেফ চিন্তাশক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তারা।
একই সঙ্গে এটাও কল্পনা করে নেওয়া যায়, কালে কালে কোনো মানুষের দেহ বিশেষ বহিঃকঙ্কালে ঢেকে দেওয়া যাবে। এর মাধ্যমে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের চলাফেরায় পুরোপুরি স্বাধীনতা এনে দেবে। তাত্ত্বিকভাবে এ ধরনের বহিঃকঙ্কাল সাধারণ মানুষের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষমতা এনে দিতে পারবে। ফলে সে বায়োনিক সত্তায় পরিণত হয়ে চিন্তাশক্তি দিয়ে তার সুপারলিম্ব বা বাড়তি অঙ্গ ব্যবহার করে বিপুল যান্ত্রিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
কাজেই মন দিয়ে কোনো কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করা তখন আর অসম্ভব হবে না। কিন্তু এর মানে কী, শুধু চিন্তাশক্তি দিয়ে আমরা কোনো দিন বস্তু নাড়াচাড়া করতে, তাদের শূন্যে ভাসাতে আর তাদের শূন্যে ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারব?
একটা সম্ভাবনা হতে পারে, আমাদের ঘরের দেয়াল কক্ষ তাপমাত্রার সুপারকন্ডাক্টর দিয়ে মুড়ে দিয়ে। ধরে নেওয়া যায়, এ ধরনের যন্ত্র ভবিষ্যতে তৈরি করা সম্ভব। এরপর আমরা যদি অতি ক্ষুদ্র ইলেকট্রোম্যাগনেট বাসার বিভিন্ন জিনিসপত্রের মধ্যে রাখি, তাহলে মেসিয়ার ইফেক্ট (প্রথম অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে) কাজে লাগিয়ে সেগুলো মেঝে থেকে শূন্যে ভাসিয়ে তুলতে পারব। ইলেকট্রোম্যাগনেট কোনো কম্পিউটার দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হলে এবং কম্পিউটারটি যদি তারের মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, তাহলে আমরা ইচ্ছা করলেই বস্তুগুলোকে শূন্যে ভাসিয়ে তুলতে পারব। নির্দিষ্ট চিন্তার মাধ্যমে আমরা কম্পিউটারটিও সক্রিয় করে তুলতে পারব। কম্পিউটারটি এরপর বিভিন্ন ইলেকট্রোম্যাগনেটকে চালু করবে। এ কারণে তাদের শূন্য ভাসানো যাবে। বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করলে বস্তুগুলো নড়ানো ও শূন্যে ভাসিয়ে তোলার ঘটনা ম্যাজিক বলে মনে হবে।
ন্যানোবট
মনের শক্তি দিয়ে কোনো বস্তু নড়াচড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো যদি রূপান্তর করাও সম্ভব হয়, তাহলে কেমন হবে? মানে ম্যাজিকের মতো এক বস্তু থেকে আরেক বস্তু বানানো যদি সম্ভব হয়? এসব কৌশল হাতসাফাইয়ের মাধ্যমে করে দেখান ম্যাজিশিয়ানরা। কিন্তু এ ধরনের ক্ষমতা কি পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো অনুমোদন করে?
আগেই বলেছি, ন্যানোটেকনোলজির একটা লক্ষ্য পরমাণু ব্যবহার করে অতি ক্ষুদ্র যন্ত্র বানানো। খুদে এসব যন্ত্র লিভার, গিয়ার, বলবিয়ারিং ও পুলি হিসেবে কাজ করবে। অনেক পদার্থবিদ স্বপ্ন দেখেন, এসব ন্যানোযন্ত্র কোনো বস্তুর পরমাণুগুলো নতুনভাবে সাজাতে পারবে, যার মাধ্যমে এক বস্তু আরেক বস্তুতে রূপান্তরিত হবে। বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে যেসব রেপ্লিকেটর বা অনুলিপিকারক যন্ত্র দেখা যায়, তার ভিত্তি ন্যানোযন্ত্র। এর মাধ্যমে আপনার ইচ্ছেমতো সহজে যেকোনো বস্তু বানানো সম্ভব। তাত্ত্বিকভাবে একটি রেপ্লিকেটর হয়তো নিমেষেই দারিদ্র্য দূর করতে পারবে, সেই সঙ্গে আমূল পাল্টে দিতে পারবে সমাজের চেহারাটাও। এ যন্ত্র দিয়ে যেকোনো বস্তু যদি ইচ্ছেমতো বানানো যায়, তাহলে মানবসমাজ থেকে অভাব, মূল্য ও শ্রেণিবিভাজনের ধারণা এক লহমায় বদলে যাবে।
(আমার অন্যতম প্রিয় সিরিজ স্টার ট্রেক: দ্য নেক্সট জেনারেশন-এ রেপ্লিকেটর দেখানো হয়েছে। একবার বিশ শতক থেকে আসা প্রাচীন পথ হারানো এক স্পেস ক্যাপসুল মহাকাশে খুঁজে পাওয়া গেল। তার ভেতরে মানুষের জমাটবাঁধা দেহও পাওয়া গেল অনেকগুলো। ভয়ানক এক রোগে ভুগছিল তারা। দেহগুলো থেকে বেশ দ্রুত বরফ গলে যেতে লাগল। উন্নত মানের ওষুধ দিয়ে সুস্থ করা হলো তাদের। এক ব্যবসায়ী বুঝতে পারল, অনেক শতাব্দী পর তার বিনিয়োগ নিশ্চিতভাবে বিপুল পরিমাণে দাঁড়াবে। তাই সে এন্টারপ্রাইজের ক্রুদের দ্রুত তার বিনিয়োগ ও টাকার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু ক্রু সদস্যরা তার কথা শুনে স্রেফ হাঁ হয়ে গেল। টাকা? বিনিয়োগ? জবাবে তারা বলল, ভবিষ্যতে কোনো টাকা নেই। অন্য কিছু দরকার হলে শুধু বলবেন।)
রেপ্লিকেটরের মতো বিস্ময়কর শোনালেও প্রকৃতিতে এ রকম কিছু একটা রয়েছে। তার তাত্ত্বিক প্রমাণও পাওয়া গেছে। প্রকৃতি কাঁচা বা অপরিশোধিত উপাদান নিতে পারে, যেমন মাংস বা সবজি। আর কোনো মানবসত্তাকে ৯ মাসেই জন্ম দিতে পারে। জীবনের অলৌকিকত্ব বলতে আসলে কিছুই নেই, বরং পারমাণবিক পর্যায়ে অসংখ্য ন্যানোফ্যাক্টরি বস্তুর এক রূপ (যেমন খাদ্য) থেকে জীবন্ত টিস্যুতে (একটি শিশু) রূপান্তর করতে পারে।
একটি ন্যানোকারখানা বানাতে তিনটি উপাদান প্রয়োজন : নিৰ্মাণ উপকরণ, এসব উপকরণ কাটতে ও জোড়া লাগাতে সক্ষম কোনো হাতিয়ার আর এই হাতিয়ার ও উপকরণ ব্যবহারের পরিচালনার জন্য একটা নীলনকশা। প্রকৃতিতে নির্মাণ উপকরণ হলো হাজারো অ্যামিনো অ্যাসিড ও প্রোটিন। এগুলো থেকে মাংস ও রক্ত তৈরি হয়। এসব প্রোটিনকে জীবনের নতুন রূপ দিতে হাতুড়ি ও করাতের মতো কাটা ও জোড়া লাগানোর জন্য দরকারি হাতিয়ারটির নাম রাইবোজোম। এরা এমনভাবে নকশাকৃত যে তারা প্রোটিনকে নির্দিষ্ট বিন্দুতে কেটে ও জোড়া লাগিয়ে নতুন প্রোটিন তৈরি করতে বেশ উপযোগী। এতে ব্লুপ্রিন্ট বা নীলনকশার জোগান দেয় ডিএনএ অণুরা। এগুলোতে প্রাণের রহস্য নিউক্লিক অ্যাসিডের নির্দিষ্ট সজ্জায় লিপিবদ্ধ থাকে। এই তিন উপাদান একটা কোষে একত্র অবস্থায় থাকে, যা নিজের প্রতিলিপি তৈরি করার বা স্বপ্রতিলিপি করার ক্ষমতা থাকে। ডিএনএ অণুর আকার ডাবল হেলিক্স বা দ্বিসূত্রক হওয়ার কারণে কাজটি সম্পন্ন হয়। প্রজননের সময়, ডিএনএ অণু দুটি আলাদা হেলিক্স বা সূত্রকে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রতিটি আলাদা সূত্রক এরপর জৈব অণু সংগ্রহ করে নিজের প্রতিলিপি তৈরি করে। আলাদা হয়ে যাওয়া হেলিক্স নতুন করে তৈরি করতেই এমনটি করে তারা।
প্রকৃতিতে পাওয়া এই বৈশিষ্ট্য নকল করতে পদার্থবিদেরা এখন পর্যন্ত খুব সামান্যই সফলতা পেয়েছেন। তবে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, এই সফলতার মূল চাবিকাঠি হলো নিজের প্রতিলিপি করতে পারা অসংখ্য ন্যানোবট তৈরি করা। ন্যানোবটগুলো হবে প্রোগ্রাম করতে সক্ষম পারমাণবিক যন্ত্র, যা বস্তুর মধ্যে পরমাণুগুলো নতুন করে সাজাতে ডিজাইন করা হবে।
ন্যানোবট বাহিনী তৈরির আগে নিষিদ্ধ কিছু বাধা অবশ্যই অতিক্রম করতে হবে। প্রথমত, স্বপ্রতিলিপি করতে পারা রোবট বানানো খুব কঠিন, এমনকি ম্যাক্রোস্কোপিক পর্যায়েও একই কথা সত্য। (এমনকি পারমাণবিক বলবিয়ারিং ও গিয়ারের মতো সরল পারমাণবিক যন্ত্ৰ বানানোও বর্তমানের প্রযুক্তিতে কঠিন।) কাউকে যদি একটা পিসি ও টেবিল ভরা ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ দেওয়া হয়, তাহলে তা দিয়ে নিজের প্রতিলিপি বানাতে পারা যন্ত্র বানানো বেশ কঠিন। তাই স্বপ্রতিলিপি করতে সক্ষম যন্ত্র টেবিলে বানানো যদি কঠিন হয়, তাহলে পারমাণবিক পর্যায়ে এ ধরনের কিছু বানানো আরও কঠিন।
দ্বিতীয়ত, ন্যানোবট বাহিনীকে বাইরে থেকে কীভাবে প্রোগ্রাম করা সম্ভব, তা এখনো পরিষ্কার নয়। অনেকে বলেন, রেডিও সিগন্যাল পাঠিয়ে প্রতিটি ন্যানোবট সক্রিয় করে তোলা যাবে। হয়তো লেজার বিমে ধারণ করা নির্দেশনা ন্যানোবটে ছুড়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু এর মানে এমনও হতে পারে, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ন্যানোবটের প্রতিটির জন্য আলাদা নির্দেশনা পাঠানো দরকার।
তৃতীয়ত, ন্যানোবটগুলো কীভাবে সঠিক সজ্জায় পরমাণুগুলো কাটবে, নতুন করে সাজাবে এবং তাদের জোড়া লাগাবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। মনে রাখতে হবে, এই সমস্যার সমাধান করতে প্রকৃতির প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর লেগেছে। তাই কয়েক দশকের মধ্যে আমাদের পক্ষে এই সমস্যার সমাধান আশা করা কঠিন।
রেপ্লিকেটর বা পারসোনাল ফেব্রিকেটরের (ব্যক্তিগত প্রতিলিপি) এ ধারণাটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন এমআইটির পদার্থবিদ নিল গারশেনফেল্ড। এমআইটিতে তিনি একটি ক্লাস নেন, যার নাম ‘হাউ টু মেক (অলমোস্ট) এনিথিং’। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অন্যতম জনপ্রিয় এক ক্লাস এটি। এমআইটি সেন্টার ফর বিটস অ্যান্ড অ্যাটমসের পরিচালনা করেন গারশেনফেল্ড। পাশাপাশি ব্যক্তিগত প্রতিলিপি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তাভাবনা করেন তিনি। একেই পরবর্তী অসাধারণ ব্যাপার বলে ভাবা হচ্ছে এখন। এমনকি পারসোনাল ফেব্রিকেশন সম্পর্কে তাঁর ভাবনা নিয়ে বইও লিখেছেন, যার শিরোনাম : এফএবি : দ্য কামিং রেভল্যুশন অব ইওর ডেস্কটপ-ফ্রম পারসোনাল কম্পিউটার টু পারসোনাল ফেব্রিকেশন। তাঁর এই ধারণাগুলো ছড়িয়ে দিতে তিনি এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণাগারের সঙ্গে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। কারণ, এসব জায়গাতেই পারসোনাল ফেব্রিকেশন সর্বোচ্চ প্রভাব ফেলবে।
তিনি স্বপ্ন দেখেন, সব কাজের কাজি এই ফেব্রিকেটর যন্ত্রটি এতই ছোট হবে যে তা টেবিলেও রাখা যাবে। এতে লেজার ও মাইক্রো- মিনিয়েচারাইজেশনের সর্বশেষ উন্নয়ন ব্যবহার করে কম্পিউটার স্কিনে দেখে যেকোনো বস্তুকে কাটা, জোড়া লাগানো ও তার আকার দেওয়া সম্ভব। তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র মানুষেরা তাদের খামারের প্রয়োজনীয় নির্দিষ্ট যন্ত্রপাতি এর মাধ্যমে বানিয়ে নিতে পারবে। এই তথ্য একটা পিসিতে দেওয়া হবে। পিসিটি নীলনকশার ও তাত্ত্বিক তথ্যের বিশাল এক লাইব্রেরির সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। প্রত্যেকের সুনির্দিষ্ট চাহিদা অনুযায়ী কম্পিউটার সফটওয়্যার সেখানে থাকা নীলনকশা মিলিয়ে তথ্য প্রসেস করবে। পরে তাদের কাছে ফিরতি ই-মেইল পাঠাবে। এরপর তাদের পারসোনাল ফেব্রিকেটর লেজার ও মিনিয়েচার কাটার যন্ত্র ব্যবহার করে টেবিলের ওপর পছন্দমতো বস্তু বানিয়ে দেবে তাদের।
ব্যক্তিগত কারখানার এই সবকিছুই আসলে প্রথম ধাপ। গারশেনফেল্ড তাঁর আইডিয়াটি ক্রমেই আণবিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান। তাতে মানুষের কল্পনার যেকোনো বস্তুই আক্ষরিক অর্থে বানানো সম্ভব হবে। তবে এ পথের অগ্রগতি বেশ ধীরগতির। কারণ, প্রতিটি পরমাণুকে নিপুণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন।
এ বিষয়ে পথিকৃতের মতো কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যারিসটাইড রেকুইচা। তাঁর বিশেষত্ব হলো, আণবিক রোবটিকস। তাঁর লক্ষ্য ন্যানোবটের এমন এক বাহিনী বানানো, যা ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তিনি লিখেছেন, এ বিষয়ে দুটি পদ্ধতি আছে। প্রথমটি হলো টপ-ডাউন অ্যাপ্রোচ, যেখানে ইঞ্জিনিয়াররা সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের ছাপ দেওয়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করে খুদে সার্কিট তৈরি করবেন। এটিই ন্যানোবটের মস্তিষ্ক হিসেবে কাজ করবে। এই প্রযুক্তি দিয়ে ক্ষুদ্র রোবট বানানো যাবে, যার উপকরণগুলোর আকার হবে ৩০ ন্যানোমিটার। এতে ন্যানোলিথোগ্রাফি ব্যবহার করা যাবে। ক্ষেত্রটি বেশ তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে।
তবে এ ক্ষেত্রে বটম-আপ অ্যাপ্রোচও আছে। এ পদ্ধতিতে ইঞ্জিনিয়াররা একটি পরমাণু দিয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির রোবট তৈরির চেষ্টা করবে। সে জন্য প্রধান হাতিয়ার হবে স্ক্যানিং প্রোব মাইক্রোস্কোপ (এসপিএম)। এতেও স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপের মতো একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিটি পরমাণু শনাক্ত ও নড়ানো যাবে। যেমন জেনন পরমাণু প্লাটিনাম বা নিকেলের পৃষ্ঠতলে নাড়ানোর ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এখন বেশ দক্ষতা অর্জন করেছেন। তবে তিনি উল্লেখ করেন, ‘তারপরও এ কাজে সর্বোচ্চ ৫০টি পরমাণু দিয়ে একটি কাঠামো বানাতে বিশ্বের সেরা দলেরও ১০ ঘণ্টা সময় লাগে।’ একটা পরমাণু হাত দিয়ে সরানো খুব ধীরগতির ও ক্লান্তিকর। তাঁর মতে, এখানে উচ্চপর্যায়ের কাজ করতে সক্ষম নতুন যন্ত্র প্রয়োজন। তাতে শত শত পরমাণু একসঙ্গে ইচ্ছেমতো নড়ানো যাবে। দুর্ভাগ্যক্রমে এ রকম মেশিন এখনো বানানো যায়নি। তাতে অবশ্য অবাক হওয়ারও কিছু নেই। কারণ, বটম-আপ অ্যাপ্রোচ এখনো বলতে গেলে শৈশব অবস্থায় রয়ে গেছে।
কাজেই বেশ বোঝা যাচ্ছে, সাইকোকাইনেসিস বর্তমানের প্রেক্ষাপটে অসম্ভব। তবে ভবিষ্যতে হয়তো ইইজি, এমআরআই ও অন্যান্য পদ্ধতিতে আমাদের মস্তিষ্কের চিন্তার মধ্যে ঢুকে আরও অনেক কিছু বুঝতে পারা যাবে। এ শতাব্দীর মধ্যে মনের চিন্তা-চালিত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করাও সম্ভব হতে পারে। সেগুলো দিয়ে কক্ষ তাপমাত্রার সুপারকন্ডাক্টর নিয়ন্ত্রণও করা যাবে। আবার এগুলো দিয়ে এমন সব কাজও করা যাবে যেগুলোকে ম্যাজিক বা জাদু থেকে আলাদা করা কঠিন। পরের শতাব্দীতে ম্যাক্রোস্কোপিক বা বড় বস্তুর ভেতরের অণুগুলোকে হয়তো নতুন করে সাজানো সম্ভব। সে কারণে সাইকোকাইনেসিসকে প্রথম শ্রেণির অসম্ভাব্যতা হিসেবে ধরা হয়েছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ন্যানোবটই এই প্রযুক্তির চাবিকাঠি বলে দাবি করেছেন বেশ কজন বিজ্ঞানী। তবে অতি ক্ষুদ্র আকৃতির আণবিক রোবট তৈরির আগে আমাদের একটা মৌলিক প্রশ্নের জবাব দিতে হবে : রোবটের অস্তিত্ব কি সত্যিই থাকা সম্ভব?
তথ্যনির্দেশ
ডাবল হেলিক্স : ডিএনএ অণু দ্বিসূত্রক ও প্যাচানো সিঁড়ির মতো। একেই বলে ডাবল হেলিক্স। ডিএনএর ডাবল হেলিক্স হাইড্রোজেন বন্ধনের মাধ্যমে স্থির থাকে, যা দুটি সূত্রের মধ্যে সংযুক্ত থাকে। ডিএনএতে চারটি ক্ষার পাওয়া যায় (এডেনিন, সাইটোসিন, গুয়ানিন ও থায়ামিন)। ১৯৫৩ সালে জেমস ডি ওয়াটসন আর ফ্রান্সিস ক্রিক ডিএনএ অণুর গঠন ডাবল হেলিক্স প্রস্তাব করেন। সে জন্য ১৯৬৩ সালে ওয়াটসন, ক্রিক ও উইলকিন্স নোবেল পুরস্কার পান।
শক্তির সংরক্ষণশীলতার সূত্র : আরেক নাম শক্তির নিত্যতার সূত্র। এ সূত্রমতে, বিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ ধ্রুব। শক্তি অবিনশ্বর, শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। শক্তিকে শুধু এক রূপ থেকে শক্তির অন্য রূপে রূপান্তর করা যায়। যেমন ডিনামাইটের বিস্ফোরণে রাসায়নিক শক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এ সূত্রমতে, পারপিচুয়াল মেশিন বা অবিরাম গতি যন্ত্র তৈরি করা অসম্ভব।