১০. প্রতিবস্তু ও প্রতি-মহাবিশ্ব

১০. প্রতিবস্তু ও প্রতি-মহাবিশ্ব

নতুন কোনো আবিষ্কারের ঘোষণায় বিজ্ঞানে সবচেয়ে উত্তেজনাময় শব্দটি ‘ইউরেকা’ (আমি পেয়ে গেছি) নয়, বরং ‘এটা অদ্ভুত ব্যাপার’।

-আইজ্যাক আসিমভ

আমরা যেমনটি বিশ্বাস করি, কোনো মানুষ যদি তা না করে, তাহলে তাকে বলা হয় আধপাগলা। আর এতেই সব মিটমাট হয়ে যায়। বলতে চাচ্ছি, এখন এমনটিই ঘটে। কারণ, এখন আমরা তাকে পুড়িয়ে মারতে পারি না।

—মার্ক টোয়েন

কোনো অগ্রদূতকে চেনা যায় তার পিঠে বেঁধা তির দেখে।

—বেভারলি রুবিক

ড্যান ব্রাউনের বেস্টসেলার বই দ্য ডা ভিঞ্চি কোড-এর আগে প্রকাশিত অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডেমনস-এ এক দল উগ্রবাদীকে দেখানো হয়েছে। তারা ইলুমিনাটি। অ্যান্টিম্যাটার বা প্রতিবস্তু বোমা দিয়ে ভ্যাটিকান শহর উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে তারা। সে জন্য জেনেভার বাইরের পরমাণু গবেষণাগার সার্ন থেকে অ্যান্টিম্যাটার চুরি করে এ দলটি। ষড়যন্ত্রকারীরা জানত, বস্তু আর প্রতিবস্তু পরস্পরের কাছে এলে মুহূর্তেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়। আর সেটি হাইড্রোজেন বোমার চেয়েও শতগুণ শক্তিশালী। অবশ্য প্রতিবস্তুর বোমা এখন পর্যন্ত কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ হলেও প্রতিবস্তু পুরোপুরি বাস্তব।

পারমাণবিক বোমা অনেক শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও তা মাত্র ১ শতাংশ কার্যকর। কারণ, খুব সামান্য পরিমাণ ইউরেনিয়াম শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু একটি অ্যান্টিম্যাটার বোমা বানানো সম্ভব হলে একে তার পুরো ভরের ১০০ শতাংশই শক্তিতে রূপান্তর করা যাবে। এভাবে অ্যান্টিম্যাটার বোমা আসলে পারমাণবিক বোমার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর বানানো যায়। (আরও বিশদভাবে বলতে গেলে একটি অ্যান্টিম্যাটার বোমার প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যবহারযোগ্য বিস্ফোরক শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। বাকি অংশ নিউট্রিনো নামের অশনাক্তযোগ্য কণার রূপে বেরিয়ে যায়।

দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবস্তু নিয়ে বেশ জল্পনাকল্পনা চলছে। অবশ্য অ্যান্টিম্যাটার বোমার এখনো কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও পদার্থবিদেরা শক্তিশালী অ্যাটম স্ম্যাশার ব্যবহার করে গবেষণার জন্য খুব সামান্য পরিমাণ প্রতিবস্তু তৈরি করতে পেরেছেন।

প্রতি-পরমাণু ও প্রতি-রসায়ন তৈরি

বিশ শতকের শুরুতে পদার্থবিদেরা বুঝতে পারেন, পরমাণুতে ইলেকট্রন ছাড়াও চার্জিত অতিপারমাণবিক কণা থাকে। এই ইলেকট্রন (ঋণাত্মক চার্জের) একটি ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াসের (ধনাত্মক চার্জের) চারপাশে ঘুরপাক খায়। নিউক্লিয়াসে প্রোটন (যার চার্জ ধনাত্মক) ও নিউট্রন (যা চার্জনিরপেক্ষ) থাকে।

১৯৩০-এর দশকে পদার্থবিদেরা বুঝতে পারলেন, প্রতিটি কণার একটি যমজ আছে। যমজ কণারা প্রতিকণা আর তাদের চার্জ কণার ঠিক বিপরীত। এ আবিষ্কারে পদার্থবিদেরা বেশ একটা ধাক্কাই খেয়েছিলেন। প্রথম আবিষ্কৃত প্রতিকণাটির নাম অ্যান্টি-ইলেকট্রন (যাকে পজিট্রন বলা হয়)। এর চার্জ ধনাত্মক। পজিট্রন সব দিক দিয়ে হুবহু ইলেকট্রনের মতো। একমাত্র ব্যতিক্রম এর চার্জ ইলেকট্রনের বিপরীত। এক ক্লাউড চেম্বারে কসমিক রে-র ফটোতে পজিট্রন প্রথমবার আবিষ্কৃত হয়েছিল। (পজিট্রনের গতিপথ ক্লাউড চেম্বারে খুব সহজেই দেখা যায়। শক্তিশালী চুম্বকীয় ক্ষেত্রে পজিট্রন রাখা হলে তারা সাধারণ ইলেকট্রনগুলোর গতিপথ থেকে বিপরীত দিকে বেঁকে যায়। সত্যি বলতে কি, আমি নিজেও হাইস্কুলে পড়ার সময় এ ধরনের অ্যান্টিম্যাটারের গতিপথের ছবি তুলেছি।)

বার্কলির ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় ১৯৫৫ সালে বেভাট্রন নামের পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর বা কণা ত্বরক যন্ত্র প্রথম অ্যান্টিপ্রোটন তৈরি করে। প্রত্যাশামতোই সেটিও হুবহু প্রোটনের মতো, ব্যতিক্রম শুধু এর চার্জ নেগেটিভ বা ঋণাত্মক। এর মানে, তত্ত্ব অনুসারে, অ্যান্টি-অ্যাটম বা প্ৰতি- পরমাণু তৈরি করা সম্ভব (যেখানে পজিট্রন অ্যান্টিপ্রোটনের চারপাশে ঘুরবে)। আসলে প্রতি-মৌল, প্রতি-রসায়ন, প্রতি-মানুষ, প্রতি-পৃথিবী, এমনকি প্ৰতি-মহাবিশ্বও তাত্ত্বিকভাবে থাকা সম্ভব।

বর্তমানে ইউরোপের সার্নে এবং যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের বাইরে অবস্থিত ফার্মিল্যাবে কণা ত্বরক যন্ত্র দিয়ে অতিসামান্য পরিমাণ প্রতি- হাইড্রোজেন বানানো গেছে। (পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে উচ্চ শক্তির প্রোটনের বিম বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এটি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে একঝাঁক অতিপারমাণবিক কণাও তৈরি হয়। শক্তিশালী চুম্বক দিয়ে অ্যান্টিপ্রোটনগুলো আলাদা করা হয়, যা অতি নিম্ন বেগে ধীরগতির হয়ে পড়ে। এরপর সোডিয়াম-২২ থেকে প্রাকৃতিকভাবে নিঃসৃত হওয়া অ্যান্টিইলেকট্রনের ভেতর এই অ্যান্টিপ্রোটন উন্মুক্ত করা হয়। অ্যান্টি- ইলেকট্রন অ্যান্টিপ্রোটনের চারপাশে ঘুরপাক খেতে শুরু করলে তারা অ্যান্টি- হাইড্রোজেন তৈরি করে। সাধারণ হাইড্রোজেন একটি প্রোটন ও একটি ইলেকট্রনের সমন্বয়ে গঠিত।) প্রকৃত শূন্যস্থানে এই অ্যান্টি-অ্যাটম চিরকাল টিকে থাকতে পারে। কিন্তু দেয়ালের অবিশুদ্ধতা ও দেয়ালের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে অ্যান্টি-অ্যাটম বা প্রতি-পরমাণু ধীরে ধীরে সাধারণ পরমাণুর সঙ্গে সংঘর্ষের মুখে পড়ে। এ সংঘর্ষে নিশ্চিহ্ন হয়ে শক্তি নিঃসৃত করে তারা।

এদিকে ১৯৯৫ সালে এক ইতিহাস সৃষ্টি করে সার্ন। সেবার নয়টি অ্যান্টিহাইড্রোজেন তৈরির ঘোষণা দেয় তারা। ফার্মিল্যাবও শিগগিরই এ ধারাবাহিকতায় ১০০টি অ্যান্টিহাইড্রোজেন তৈরি করে। তাত্ত্বিকভাবে উচ্চ শক্তির প্রতি-মৌল তৈরি করতে কোনো বাধা নেই। এখানে একমাত্র বাধা হলো বিস্ময়কর খরচ। মাত্র কয়েক আউন্স প্রতি-পরমাণু তৈরি করতে গেলেও যেকোনো রাষ্ট্র একেবারে দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। প্রতিবস্তু উৎপাদনের বর্তমান হার বছরে ১ গ্রামের ১ বিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ থেকে ১০ বিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ মাত্র। তবে ২০২০ সালের মধ্যে এই হার তিন গুণ বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হয়। প্রতিবস্তুর অর্থনীতি খুবই দুর্বল। ২০০৪ সালে ১ গ্রামের কয়েক ট্রিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ প্রতিবস্তু তৈরি করতে গিয়ে ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে সার্ন। এই হারে ১ গ্রাম প্রতিবস্তু তৈরি করতে খরচ হবে ১০০ কোয়াড্রিটিলিয়ন মার্কিন ডলার। আবার সে জন্য প্রতিবস্তুর কারখানা ১০০ বিলিয়ন বছর ধরে অবিরত চালু রাখতে হবে। এ কারণে প্রতিবস্তু এখন বিশ্বের সবচেয়ে দামি বস্তু।

সার্নের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সার্নে আমরা এ পর্যন্ত যে পরিমাণ প্রতিবস্তু তৈরি করেছি, তার সবগুলো যদি একত্রে জড়ো করা সম্ভব হয় এবং সেগুলো বস্তুর সঙ্গে নিশ্চিহ্ন করা হয়, তাহলে যে পরিমাণ শক্তি পাওয়া যাবে, তা দিয়ে একটি ইলেকট্রিক লাইট বাল্বকে কয়েক মিনিটের জন্য জ্বালিয়ে রাখা যাবে

প্রতিবস্তু ও বস্তু পরস্পরের কাছে এলে বিস্ফোরণ হয়। তাই প্রতিবস্তু নিয়ে কাজে অস্বাভাবিক সমস্যা আছে। সাধারণ কনটেইনারে প্রতিবস্তু রাখা আত্মহত্যার শামিল। কারণ, প্রতিবস্তু ওই কনটেইনারের দেয়াল স্পর্শ করলেই বিস্ফোরিত হবে। তাহলে এত বিস্ফোরক স্বভাবের প্রতিবস্তু কীভাবে সামলানো যায়? একটি উপায় হলো, প্রতিবস্তু আয়নিত গ্যাসের মধ্যে আয়নিত করে রাখা। এরপর একে সাবধানে একটি চুম্বকীয় বোতলে বন্দী করে রাখা। চুম্বকীয় ক্ষেত্রটি চেম্বারের দেয়াল স্পর্শ করা থেকে প্রতিবস্তুকে বাধা দেবে।

প্রতিবস্তুর ইঞ্জিন বানাতে, প্রতিবস্তুর স্থিতিশীল স্রোত কোনো বিক্রিয়া চেম্বারে নিয়ে যেতে হয়। এই চেম্বারে একে সাধারণ বস্তুর সঙ্গে সতর্কতার সঙ্গে একত্র করে নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। রাসায়নিক রকেটে যেভাবে বিস্ফোরণ ঘটনা হয়, এটাও অনেকটা সে রকম। এই বিস্ফোরণে যে আয়ন তৈরি হয়, সেগুলো অ্যান্টিম্যাটার রকেটের পেছন দিক দিয়ে বাইরে ছুড়ে দেওয়া হয়। এতে রকেট সম্মুখগতি অর্জন করে। অ্যান্টিম্যাটার ইঞ্জিনের দক্ষতা নির্ভর করে বস্তুকে শক্তিতে রূপান্তর করে। তাই তত্ত্ব অনুসারে, ভবিষ্যতের স্টারশিপের জন্য এটিই অন্যতম আকর্ষণীয় নকশার ইঞ্জিন। স্টার ট্রেক সিরিজে এন্টারপ্রাইজের শক্তির উৎস ছিল প্রতিবস্তু। সেখানে ইঞ্জিনগুলো বস্তু ও প্রতিবস্তুর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত সংঘর্ষের মাধ্যমে শক্তি পেত।

অ্যান্টিম্যাটার রকেট

অ্যান্টিম্যাটার রকেটের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা পেনসিলভানিয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ জেরাল্ড স্মিথ। প্রাথমিকভাবে মাত্র ৪ মিলিগ্রামের মতো পজিট্রন দিয়ে এক অ্যান্টিম্যাটার রকেটে চেপে মাত্র কয়েক সপ্তাহে মঙ্গলে যাওয়া যাবে বলে মনে করেন তিনি। তাঁর মতে, রকেটের সাধারণ জ্বালানি থেকে যে শক্তি পাওয়া যায়, তার চেয়ে ১ বিলিয়ন গুণ বেশি শক্তি পাওয়া যাবে প্রতিবস্তু থেকে।

এই জ্বালানি তৈরির প্রথম ধাপ হতে পারে, কণা ত্বরক যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতি-প্রোটনের বিম তৈরি করা। এরপর সেগুলো একটি পেননিং ট্র্যাপের মধ্যে সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। বিশেষ এই পেননিং ট্র্যাপও তৈরি করেছেন স্মিথ। বানানোর পর পেননিং ট্র্যাপের ওজন হবে ২২০ পাউন্ড (যার অধিকাংশই তরল নাইট্রোজেন ও তরল হিলিয়াম)। এতে একটি চুম্বকীয় ক্ষেত্রে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন প্রতি-প্রোটন সংরক্ষণ করা সম্ভব। (অতি অল্প তাপমাত্রায় প্রতি-প্রোটনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য কনটেইনারের দেয়ালের পরমাণুর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তুলনায় কয়েক গুণ বড় হবে। সে কারণে কনটেইনারের দেয়ালের সঙ্গে প্রতি-প্রোটন যুক্ত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার বদলে প্রতিফলিত হবে।) স্মিথ বলেন, পেননিং ট্র্যাপ প্রায় পাঁচ দিন এসব প্রতি-প্রোটন সংরক্ষণ করতে পারবে (সাধারণ পরমাণুর সঙ্গে মিশে শেষ পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত)। প্রায় ১ গ্রামের ১ বিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ প্রতি-প্রোটন সংরক্ষণ করতে পারবে তার তৈরি পেননিং ট্র্যাপ। তিনি এমন ধরনের পেননিং ট্র্যাপ বানাতে চান, যা দিয়ে ১ মাইক্রোগ্রাম প্রতি-প্রোটন সংরক্ষণ করা সম্ভব।

প্রতিকণা পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান হলেও এর মূল্য প্রতিবছর নাটকীয়ভাবে কমে যাচ্ছে (বর্তমানে ১ গ্রামের দাম ৬২.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার)। নতুন পার্টিকেল ইজেক্টর শিকাগো শহরের বাইরে অবস্থিত ফার্মিল্যাবে বানানো হচ্ছে। সেটি প্রতিকণার উৎপাদন ১০ গুণ বাড়িয়ে প্রতিবছরে ১.৫ থেকে ১৫ ন্যানোগ্রামে উত্তীর্ণ করতে পারে। এর মাধ্যমে দাম কমে যাওয়ার কথা। তবে নাসার হ্যারল্ড গেরিশ বিশ্বাস করেন, আরও অগ্রগতির পর প্রতিকণার দাম প্রতি মাইক্রোগ্রামে ৫ হাজার ডলারে নেমে আসবে। নিউ মেক্সিকোর লস অ্যালামসের সিনারজিসটিকস টেকনোলজিসের ড. স্টিভেন হোয়ি বলেন, ‘যোগাযোগব্যবস্থায় ও চিকিৎসাক্ষেত্রে কাজে লাগাতে প্রতিকণাকে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির জগৎ থেকে বের করে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য জগতে নিয়ে আসা আমাদের লক্ষ্য।’

কণা ত্বরকযন্ত্র প্রতি-প্রোটন তৈরি করতে পারলেও তাদের সেভাবে ডিজাইন করা হয় না। তাই তাদের দক্ষতাও কম। এ রকম কণা ত্বরকযন্ত্র শুরুতে গবেষণার জন্য ডিজাইন করা হয়, প্রতিবস্তু বানানোর কারখানা হিসেবে নয়। তাই স্মিথ নতুন একটি কণা ত্বরকযন্ত্র বানানোর পরিকল্পনা করছেন, যা বিশেষভাবে ডিজাইন করা হবে বিপুল প্রতি-প্রোটন তৈরির জন্য। তাতে এর দামও কমে যাবে।

প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আর বিপুল উৎপাদনের কারণে প্রতিবস্তুর দাম আরও ব্যাপকভাবে কমে যেতে পারে। স্মিথের ধারণা, তাহলে তখন এমন সময় আসবে যে আন্তগ্রহ ও সম্ভাব্য আন্তনাক্ষত্রিক ভ্রমণের জন্য প্রতিবস্তুর রকেট প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠবে। তবে প্রতিবস্তুর রকেট তত দিন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে শুধু ড্রয়িংবোর্ডেই।

প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভূত প্রতিবস্তু

প্রতিবস্তু যদি পৃথিবীতে তৈরি করা খুব কঠিন হয়, তাহলে কি গভীর মহাকাশেও প্রতিবস্তু সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে? দুর্ভাগ্যক্রমে, অনুসন্ধানকারীরা মহাবিশ্বে প্রতিবস্তু খুব অল্পই পেয়েছেন, যেটি পদার্থবিদদের কাছে বিস্ময়কর। আসল ব্যাপার হলো, আমাদের মহাবিশ্ব প্রতিবস্তু নয়, প্রধানত বস্তু দিয়ে গঠিত। কিন্তু এর কারণ ব্যাখ্যা করা কঠিন। অনেকে হয়তো সরলভাবে অনুমান করতে পারে যে মহাবিশ্বের শুরুতে বস্তু ও প্রতিবস্তুর পরিমাণ সমান ও প্রতিসম ছিল। কাজেই এখন মহাবিশ্বে প্রতিবস্তুর অভাব একটা ধাঁধার মতোই।

এ ব্যাপারে সম্ভবত সবচেয়ে ভালো সমাধান উত্থাপন করেছিলেন আন্দ্রেই শাখারভ। ১৯৫০-এর দশকে এ মানুষটি সোভিয়েত ইউনিয়নে হাইড্রোজেন বোমার ডিজাইন করেন। শাখারভের অনুমান, মহাবিশ্বের শুরুতে মহাবিস্ফোরণে বস্তু আর প্রতিবস্তুর মধ্যে খুব সামান্য অপ্রতিসমতা ছিল। এই অতি ক্ষুদ্র প্রতিসমতা ভাঙাকে বলা হয় সিপি ভায়োলেশন। এ ঘটনা বর্তমানে বেশ কিছু সক্রিয় গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু। এরপর শাখারভ অনুমান করলেন, বর্তমানে মহাবিশ্বের যত পরমাণু আছে, সেগুলো আসলে বস্তু আর প্রতিবস্তু পরস্পরকে ধ্বংস করার পর যেটুকু বাকি থাকে সেটুকু। মহাবিস্ফোরণের কারণে এই দুইয়ের মধ্যে মহাজাগতিক বাতিলের ঘটনাটি ঘটেছে। অতি ক্ষুদ্র পরিমাণ অতিরিক্ত বস্তু বেঁচে গিয়ে আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব গঠিত হয়েছে। আমাদের দেহের সবগুলো পরমাণু হলো বস্তু আর প্রতিবস্তুর এই বিপুল সংঘর্ষ থেকে বেঁচে যাওয়া অংশ।

শাখারভের তত্ত্বটি এ সম্ভাবনার দ্বারও উন্মুক্ত রেখেছে যে সামান্য প্রতিবস্তুও হয়তো প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভূত হতে পারে। তা ঘটলে সেই উৎসের কারণে প্রতিবস্তুর ইঞ্জিনে ব্যবহারের জন্য প্রতিবস্তুর উৎপাদন খরচ কমিয়ে দিতে পারে ব্যাপকভাবে। তত্ত্বমতে, প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভূত প্রতিবস্তু সহজে শনাক্ত করতে পারার কথা। ইলেকট্রন ও অ্যান্টি-ইলেকট্রন পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে নিজেদের নিশ্চিহ্ন করে গামা রশ্মি নিঃসৃত করে, যার শক্তি হবে ১.০২ মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট বা তার বেশি। কাজেই এই শক্তির গামা রশ্মির জন্য মহাবিশ্ব স্ক্যানিং করার মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভূত প্রতিবস্তুর ‘হাতের ছাপের’ সন্ধান হয়তো পাওয়া যেতে পারে।

সত্যি বলতে কি, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে প্রতিবস্তুর ‘ফোয়ারা’ খুঁজে পেয়েছেন নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ড. উইলিয়াম পুরসেল। সেটি আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সেখানে থাকা প্রতিবস্তুর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের গামা রশ্মির প্রবাহ ১.০২ মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট বিকিরিত হচ্ছে। তা দেখে মনে হয় সেটি সাধারণ হাইড্রোজেন গ্যাসের সঙ্গে সংঘর্ষে তৈরি হয়েছে। প্রতিবস্তুর এই খনি যদি প্রাকৃতিকভাবে টিকে থাকে, তাহলে মহাবিশ্বের অন্যান্য জায়গাতেও প্রতিবস্তুর আরও উৎস রয়েছে। হয়তো সেগুলো মহাবিস্ফোরণের সময় ধ্বংস হয়ে যায়নি।

প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভূত প্রতিবস্তু আরও সুচারুভাবে খুঁজতে ২০০৬ সালে পৃথিবীর কক্ষপথে একটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। এর নাম পামেলা (পেলোড ফর অ্যান্টিম্যাটার-ম্যাটার এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড লাইট- নিউক্লীয় অ্যাস্ট্রোফিজিকস)। মহাবিশ্বের অন্যান্য জায়গায় প্রতিবস্তুর উৎস খুঁজতে যৌথভাবে এই উদ্যোগ নেয় রাশিয়া, ইতালি, জার্মানি ও সুইডেন। প্রতিবস্তু খুঁজতে এর আগের অভিযানগুলোতে উচ্চ আকাশে বেলুন ও স্পেস শাটল ব্যবহার করা হয়েছিল। এগুলোতে যেসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে তার পরিসর এক সপ্তাহ বা তার চেয়ে বেশি নয়। বিপরীত দিকে, পামেলা (PAMELA) অন্তত তিন বছর কক্ষপথে অবস্থান করবে। ইউনিভার্সিটি অব রোমের দলের সদস্য পিয়ারগিওরগিও পিকোজ্জা এক ঘোষণায় জানিয়েছেন, ‘এ পর্যন্ত বানানো সবচেয়ে ভালো ডিটেক্টর এটি। আর এটি দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার করা হবে।’

সাধারণ উৎসগুলো থেকে আসা মহাজাগতিক রশ্মি শনাক্তে ডিজাইন করা হয়েছে পামেলা। যেমন সুপারনোভা। তবে এটি অস্বাভাবিক বা পুরোটা প্রতিবস্তু দিয়ে তৈরি নক্ষত্রও শনাক্ত করতে পারবে। বিশেষ করে, পামেলা অ্যান্টি-হিলিয়ামের চিহ্ন খুঁজবে, এটি হয়তো কোনো প্রতি-নক্ষত্রের ভেতরে তৈরি হয়। শাখারভের মতো বেশির ভাগ পদার্থবিদ বর্তমানে বিশ্বাস করেন, মহাবিস্ফোরণের ফলে বস্তু ও প্রতিবস্তু পরস্পরকে প্রায় নিখুঁতভাবে ধ্বংস করে ফেলেছিল। তবে পামেলা ভিন্ন এক অনুমানের ভিত্তি করে কাজ করছে। অনুমানটি হলো, মহাবিশ্বে প্রতিবস্তুর পুরোটা আসলে এই ধ্বংস প্রক্রিয়ায় শেষ হয়ে যায়নি। তাই বর্তমানে তাদের অস্তিত্ব সম্ভবত প্রতি-নক্ষত্র হিসেবে টিকে রয়েছে।

গভীর মহাকাশে সামান্য পরিমাণেও প্রতিবস্তু থাকলে এই প্রতিবস্তুর কিছু অংশ সংগ্রহ করে স্টারশিপ চালাতে ব্যবহার করা সম্ভব। নাসার ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড কনসেপ্টস প্রতিবস্তু সংগ্রহের একটি ধারণা এতই গুরুত্ব দিয়েছে যে সম্প্রতি তারা এই ধারণার ওপর গবেষণা করতে একটি পাইলট প্রোগ্রামে অর্থ ঢেলেছে। ‘সাধারণত, আপনাকে একটি জাল তৈরি করতে হবে, ঠিক মাছ শিকারের মতো।’ বলেছেন এই প্রজেক্টের সঙ্গে জড়িত নেতৃত্বস্থানীয় প্রতিষ্ঠান এইচবার টেকনোলজির জেরাল্ড জ্যাকসন।

প্রতিবস্তু সংগ্রহের ভিত্তি হবে তিনটি সমকেন্দ্রী গোলক, যার প্রতিটি তারের জালের কাঠামোতে তৈরি। সবচেয়ে বাইরের গোলকটি হবে আড়াআড়িভাবে ১৬ কিলোমিটার ও ধনাত্মক চার্জের। তাই এটি যেকোনো প্রোটনকে বিকর্ষণ করবে। কারণ, প্রোটনের চার্জও ধনাত্মক। তবে অ্যান্টিপ্রোটন ঋণাত্মক চার্জবিশিষ্ট হওয়ায় একে আকর্ষণ করবে। প্রতি-প্রোটন বাইরের গোলক থেকে সংগ্রহ করে, ধীরে ধীরে তারা দ্বিতীয় গোলকের মধ্য দিয়ে গিয়ে অবশেষে সবচেয়ে ভেতরের গোলকে ঢুকবে। আড়াআড়িভাবে ১০০ মিটার হবে এটি। প্রতি-প্রোটন এরপর কোনো চুম্বকীয় বোতলে সংগ্রহ করে তার সঙ্গে প্রতি- ইলেকট্রন যোগ করে প্রতি-হাইড্রোজেন তৈরি করা হবে।

জ্যাকসন হিসাব করে দেখেছেন, কোনো নভোযানের ভেতরে নিয়ন্ত্রিত বস্তু-প্রতিবস্তুর বিক্রিয়ার প্লুটোতে যাওয়ার জন্য একটি সৌরপালের জ্বালানি হিসেবে মাত্র ৩০ মিলিগ্রাম প্রতিবস্তু দরকার হবে। একটি স্টারশিপের আলফা সেন্টুরাইতে যাওয়ার জন্য ১৭ গ্রাম প্রতিবস্তুই যথেষ্ট বলে মনে করেন জ্যাকসন। শুক্র গ্রহ ও মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথের মধ্যখানে ৮০ গ্রাম প্রতিবস্তু থাকতে পারে বলে দাবি করেছেন জ্যাকসন। এগুলো অনুসন্ধানী নভোযান দিয়ে সংগ্রহ করা যাবে বলে ধারণা তাঁর। তবে বিশালাকৃতির অ্যান্টিম্যাটার সংগ্রাহক যন্ত্রের জটিলতা ও খরচ মেটানো সম্ভবত এই শতাব্দী শেষ হওয়ার আগে কিংবা তারও পর ছাড়া সম্ভব নয়।

অনেক বিজ্ঞানী গভীর মহাকাশে কোনো ভাসমান উল্কা থেকে প্রতিবস্তু সংগ্রহ করার স্বপ্ন দেখেন। (ফ্ল্যাশ গর্ডন কমিস স্ট্রিপে একবার দেখানো হয়েছিল, ভয়ানক এক প্রতিবস্তুর উল্কা মহাকাশে ভাসছে। সেটি কোনো গ্রহের সংস্পর্শে এলে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটবে।)

প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট প্রতিবস্তু মহাকাশে না পাওয়া গেলে আমাদের আরও কয়েক যুগ থেকে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, যত দিন পৃথিবীতে যথেষ্ট পরিমাণ প্রতিবস্তু তৈরি না হয়। তবে যদি ধরে নেওয়া হয় প্রতিবস্তু তৈরির প্রযুক্তিগত সমস্যাগুলোর সমাধান করা যাবে, তাহলে এটাও বলা যায়, একদিন প্রতিবস্তুর রকেট আমাদের দূরের কোনো নক্ষত্রে বহন করে নিয়ে যাবে।

প্রতিবস্তু সম্পর্কে আমরা এখন যা জানি ও এ-সম্পর্কিত প্রযুক্তির বিবর্তনের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে, প্রতিবস্তুর রকেট শিপকে আমি প্রথম শ্রেণির অসম্ভাব্যতা হিসেবে শ্রেণিবিভাগ করেছি।

প্রতিবস্তুর প্রতিষ্ঠাতা

প্রতিবস্তু কী? বিষয়টি অদ্ভুত যে প্রকৃতি ভালো কোনো কারণ ছাড়াই মহাবিশ্বে অতিপারমাণবিক কণার সংখ্যা দ্বিগুণ করে দিয়েছে। সাধারণত প্রকৃতি বেশ মিতব্যয়ী। কিন্তু প্রতিবস্তু সম্পর্কে জানার পর, প্রকৃতিকে চরমভাবে অপ্রয়োজনীয় ও অযথা বলে মনে হবে। আর প্রতিবস্তুর অস্তিত্ব যদি থাকে, তাহলে কি প্রতি-মহাবিশ্বের অস্তিত্বও আছে?

এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে প্রতিবস্তুর উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে হবে আগে। প্রতিবস্তুর আবিষ্কার হয় ১৯২৮ সালে। ২০ শতকের অন্যতম মেধাবী পদার্থবিদ পল ডিরাকের বৈপ্লবিক একটা গবেষণার কারণে এটি সম্ভব হয়েছিল। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান চেয়ারে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। একই চেয়ার একসময় আলোকিত করেছিলেন স্বয়ং নিউটন। আবার স্টিফেন হকিংও একসময় এই চেয়ারে অধিষ্ঠিত হন। ডিরাকের জন্ম ১৯০২ সালে। লম্বা ছিপছিপে গড়নের এ মানুষটির বয়স যখন মাত্র বিশের কোঠায়, তখন শুরু হয়ে গেছে ১৯২৫ সালের উত্তাল কোয়ান্টাম বিপ্লব। সে সময় তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তেন। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্বের তীব্র জোয়ারে অদম্য এক কৌতূহল জাগে তাঁর ভেতর। তাই সাতপাঁচ না ভেবে আচমকা সেদিকে ঝুঁকে পড়েন ডিরাক।

কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভিত্তি হলো : ইলেকট্রনের মতো কণাগুলোকে বিন্দুসম কণা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হলেও সেগুলো আসলে একধরনের তরঙ্গ। এটি ব্যাখ্যা করা হয়েছিল শ্রোডিঙ্গারের বিখ্যাত সেই তরঙ্গ সমীকরণ ব্যবহার করে। (কণাটিকে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু, সেটিই জানায় এই তরঙ্গ সমীকরণ। )

তবে ডিরাক একসময় বুঝতে পারলেন, শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণে একটা ত্রুটি আছে। শুধু নিম্ন বেগে চলমান ইলেকট্রনের ব্যাখ্যা করতে পারে সমীকরণটি। কিন্তু উচ্চ বেগে চলমান ইলেকট্রনকে সমীকরণটি ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ। কারণ, এটি উচ্চ বেগে চলমান বস্তুর সূত্র মেনে চলে না। অর্থাৎ আলবার্ট আইনস্টাইনের আবিষ্কৃত আপেক্ষিকতার সূত্রগুলো মেনে চলে না।

তাই আপেক্ষিক তত্ত্বের সঙ্গে শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণকে খাপ খাওয়াতে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেন তরুণ ডিরাক। ১৯২৮ সালে ডিরাক বললেন, শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণের একটি মৌলিক রূপান্তর করলে তা আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব পুরোটা মেনে চলে। এ কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল পদার্থবিজ্ঞান জগৎ। ইলেকট্রনের জন্য ডিরাক তাঁর বিখ্যাত রিলেভিস্টিক সমীকরণটি পেয়েছিলেন উচ্চতর গণিত নিপুণভাবে ব্যবহার করে, যাকে বলা হয় স্পিনোর (spinor)। ফলে হঠাৎ করে গাণিতিক আগ্রহ পুরো মহাবিশ্বের যেন কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো। (তার আগে অনেক পদার্থবিদ পর্যবেক্ষণগত তথ্য-উপাত্ত থেকে বড় ধরনের আবিষ্কারগুলো করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাঁদের থেকে আলাদা ছিলেন তিনি। তাই একেবারে উল্টো পথে হাঁটলেন ডিরাক। তাঁর কাছে বিশুদ্ধ গণিতই সব। গণিত যদি যথেষ্ট সুন্দর হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে বড় ধরনের আবিষ্কারের কাছে নিয়ে যাবে বলে মনে করতেন তিনি। তিনি লিখেছিলেন, ‘কোনো সমীকরণকে পরীক্ষার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেয়ে তার সৌন্দর্যটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেউ যদি তাঁর সমীকরণে সৌন্দর্য আনার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে থাকেন আর তাঁর যদি সত্যিই চমৎকার অন্তর্দৃষ্টি থাকে, তাহলে তিনি নিঃসন্দেহে সামনে এগিয়ে যাবেনই।’)

ইলেকট্রনের নতুন সমীকরণ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ডিরাক একদিন বুঝতে পারলেন, আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E=mc^2, পুরোপুরি সঠিক নয়। ম্যাডিসন অ্যাভিনিউয়ের বিজ্ঞাপনে, শিশুদের টি-শার্টে, কার্টুন, এমনকি সুপারহিরোদের পোশাকে আইনস্টাইনের সমীকরণ শোভা পেলেও তা আংশিক সঠিক। সমীকরণটির সঠিক রূপ হবে E=mc^2। (এখানে বিয়োগ চিহ্নও এসেছে, কারণ, নির্দিষ্ট পরিমাণের বর্গমূল নিয়েছি। যেকোনো পরিমাণের বর্গমূল নিলে সব সময় একটি যোগ ও সন্দেহজনক একটি বিয়োগফল পাওয়া যায়।)

তবে পদার্থবিদেরা বিয়োগবোধক বা ঋণাত্মক শক্তি পছন্দ করেন না। পদার্থবিদ্যায় এক স্বতঃসিদ্ধে বলা হয়, পদার্থ সব সময় সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে থাকতে চায় (এ কারণে পানি সব সময় সর্বনিম্ন স্তর খোঁজে, অর্থাৎ সমুদ্রসীমা)। বস্তু সব সময় তার নিম্নতম শক্তিস্তরে নেমে যাওয়ার কারণে, সম্ভাব্য ক্ষতিকর ব্যাপার হলো ঋণাত্মক শক্তির সম্ভাবনা। তার মানে, সব ইলেকট্রন ক্রমান্বয়ে অসীম ঋণাত্মক শক্তির দিকে নেমে যাবে। সে কারণে ডিরাকের তত্ত্বটি অস্থিতিশীল হবে। ঠিক এভাবে ‘ডিরাক সমুদ্র’ আবিষ্কার করে বসেন পদার্থবিদ ডিরাক। তিনি কল্পনা করে নিলেন, সব ঋণাত্মক শক্তিস্তর এরই মধ্যে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। কাজেই একটি ইলেকট্রন আর ঋণাত্মক শক্তির দিকে নেমে যেতে পারবে না। তাতে মহাবিশ্ব স্থিতিশীল হয়। একটি গামা রশ্মির সঙ্গেও হয়তো মাঝেমধ্যে ঋণাত্মক শক্তিস্তরে থাকা একটি ইলেকট্রনের সংঘর্ষ হতে পারে। এতে ইলেকট্রনটিকে ধাক্কা দিয়ে ধনাত্মক স্তরে তুলে আনতে পারে। এর ফলে আমরা দেখব গামা রশ্মিটি ইলেকট্রনে রূপান্তরিত হয়েছে এবং ডিরাক সমুদ্রে একটি হোল বা গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এই গর্তটি শূন্যস্থানে একটি বুদের মতো আচরণ করতে পারে। অর্থাৎ এর চার্জ হবে ধনাত্মক। আর ভর হবে আসল ইলেকট্রনের মতো। অন্য কথায়, গর্তটি একটি প্রতি-ইলেকট্রনের মতো আচরণ করবে। কাজেই এই চিত্রে প্রতিবস্তুতে ডিরাক সমুদ্রে বুদ্বুদ থাকবে।

ডিরাকের এই বিস্ময়কর ভবিষ্যদ্বাণীর কয়েক বছর পর কার্ল অ্যান্ডারসন সত্যি সত্যিই প্রতি-ইলেকট্রন আবিষ্কার করে বসেন (এ কারণেই ১৯৩৩ সালে ডিরাক নোবেল পুরস্কার পান)।

অন্য কথায়, প্রতিবস্তুর অস্তিত্ব আছে, কারণ, ডিরাক সমীকরণের দুই ধরনের সমাধান পাওয়া যায়। এর একটি বস্তুর জন্য আর অন্যটি প্রতিবস্তুর জন্য। (আর এটি ঘটেছে বিশেষ আপেক্ষিকতার কারণে।)

ডিরাকের সমীকরণ শুধু প্রতিবস্তু থাকার অনুমানই করেনি, এটি ওই ইলেকট্রনের স্পিন বা ঘূর্ণনেরও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। অতিপারমাণবিক কণাদের স্পিন থাকে, অনেকটা ঘূর্ণমান লাটিমের মতো। আধুনিক ইলেকট্রনিকসের ভিত্তি ট্রানজিস্টর ও সেমিকন্ডাক্টরে ইলেকট্রনের প্রবাহ বোঝার জন্য ইলেকট্রনের স্পিন অতিগুরুত্বপূর্ণ।

স্টিফেন হকিং একবার দুঃখ করে বলেছিলেন, ডিরাক তাঁর সমীকরণের পেটেন্ট করেননি। তিনি লিখেছিলেন, “ডিরাক যদি তাঁর ডিরাক সমীকরণের পেটেন্ট করাতেন, তাহলে তিনি বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে পারতেন। তাহলে প্রতিটি টেলিভিশন, ওয়াকম্যান, ভিডিওগেম আর কম্পিউটার থেকে রয়্যালটি পেতেন তিনি।’

বর্তমানে ডিরাকের বিখ্যাত সমীকরণটি ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে একটা পাথরে খোদাই করে রাখা হয়েছে। সেটি আইজ্যাক নিউটনের সমাধি থেকে খুব বেশি দূরে নয়। পুরো বিশ্বে এটিই সম্ভবত একমাত্র সমীকরণ, যেটি এ রকম সম্মান অর্জন করেছে।

ডিরাক আর নিউটন

ডিরাক কীভাবে তাঁর বৈপ্লবিক সমীকরণটিতে এবং প্রতিবস্তুর ধারণায় পৌঁছালেন, তা অনেক দিন ধরে বোঝার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদেরা। তাঁকে মাঝে মাঝে তুলনা করা হয় নিউটনের সঙ্গে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, নিউটন ও ডিরাকের মধ্যে বেশ কিছু ব্যাপারে মিল আছে। দুজনেই তাঁদের ২০ বছর বয়সে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে শুরু করেন। আবার গণিতেও দক্ষ ছিলেন দুজনেই। এ ছাড়া তাঁদের মধ্যে আরেকটি বৈশিষ্ট্যে পুরোপুরি মিলে যায়। সেটি হলো রোগবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের সামাজিক দক্ষতার পুরোপুরি অভাব ছিল। গালগল্প করার ও সাধারণ সামাজিক কমনীয়তার মতো ব্যাপারগুলোতে দুজনের কেউ দক্ষ ছিলেন না। চরম লাজুক ডিরাককে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস না করলে তা কখনোই বলতেন না তিনি। আবার উত্তরে তিনি শুধু ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ অথবা ‘আমি জানি না’ শব্দ ব্যবহার করতেন।

ডিরাক খুবই ভদ্র ছিলেন, আবার জনপ্রিয়তাও অপছন্দ করতেন। তাঁকে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার দেওয়ার পর সেটি ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন তিনি। কারণ, এতে কুখ্যাতি ও ঝামেলার সৃষ্টি হবে বলে মনে হয়েছিল তাঁর। তবে তাঁকে বলা হয়েছিল, নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে দিলেও আরও বেশি লোক জানাজানি হবে। তখন অনেকটা বাধ্য হয়ে পুরস্কারটি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

নিউটনের অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব নিয়েও অনেক লেখালেখি হয়েছে। এসব লেখাতে এমনও হাইপোথিসিস আছে যে তিনি সম্ভবত পারদের বিষক্রিয়ার কারণে মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। সম্প্রতি কেমব্রিজের সাইকোলজিস্ট সাইমন ব্যারন-কোহেন নতুন এক তত্ত্ব প্রস্তাব করেছেন। এটি হয়তো নিউটন ও ডিরাকের অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের ব্যাখ্যা জোগাতে পারবে। ব্যারন-কোহেনের দাবি, এই দুই বিজ্ঞানী সম্ভবত অ্যাসপারগারস সিনড্রোমে ভুগছিলেন, যা কিছুটা অটিজমের মতো। রেইন ম্যান মুভির বোকা সাধুর মতো অ্যাসপারগারসে ভোগা ব্যক্তিরা ভয়াবহ স্বল্পভাষী হন, সামাজিকভাবে লাজুক হন। তবে মাঝেমধ্যে আশীর্বাদের মতো বিস্ময়কর গাণিতিক দক্ষতাও থাকে তাঁদের। কিন্তু অটিস্টিকদের থেকে একটু আলাদা হন তাঁরা। সে কারণে তাঁরা সমাজে কার্যকর থাকেন ও গঠনমূলক কাজে যুক্ত থাকতে পারেন। এ তত্ত্ব সঠিক হলে, নিউটন ও ডিরাকের বিস্ময়কর গাণিতিক দক্ষতা ও সমাজের মানুষ থেকে দূরে থাকার কারণ হয়তো বোঝা যাবে।

প্রতি-মহাকর্ষ ও প্রতি-মহাবিশ্ব

ডিরাকের তত্ত্ব ব্যবহার করে এখন আমরা একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি : মহাকর্ষের মতো কোনো কিছু কি প্রতিবস্তুরও আছে? প্রতি-মহাবিশ্বের অস্তিত্ব কি থাকা সম্ভব?

আগেই বলেছি, প্রতিকণার চার্জ সাধারণ কণার ঠিক উল্টো। তবে সাধারণ কণাদের কোনো চার্জ না-ও থাকতে পারে (যেমন আলোর কণা ফোটন বা মহাকর্ষের কণা গ্র্যাভিটন)। এদের নিজস্ব প্রতিকণাও থাকতে পারে। আমরা দেখছি, মহাকর্ষের নিজস্ব প্রতিবস্তু আছে। অন্য কথায় মহাকর্ষ ও প্রতি- মহাকর্ষ একই জিনিস। কাজেই প্রতিবস্তু মহাকর্ষের টানে নিচে পড়ে, ওপরে ওঠে না। (এটি সর্বজনীনভাবে বিশ্বাস করেন পদার্থবিদেরা। তবে গবেষণাগারে এটি এখনো পরীক্ষা করে দেখা যায়নি)।

ডিরাকের তত্ত্ব আরও গভীরতর কিছু প্রশ্নেরও উত্তর দেয়। সেগুলো হলো : প্রকৃতি প্রতিবস্তুর মতো কিছু একটার অনুমোদন কেন দিল? এর মানে কি প্রতি-মহাবিশ্বও আছে?

কিছু বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে, মহাকাশে পৃথিবীর মতো এক নতুন গ্ৰহ আবিষ্কার করে বসে নায়ক। নতুন গ্রহটি সব দিক দিয়েও পৃথিবীর যমজের মতো হতে দেখা যায়। ব্যতিক্রম শুধু সেটি প্রতিবস্তু দিয়ে তৈরি। গ্রহটিতে আমাদের প্রতিবস্তুর যমজও থাকে, যাদের শিশুরা আসলে প্রতি-শিশু, যাদের বসবাস কোনো এক প্রতি-শহরে। তাদের প্রতি-রসায়নের সূত্রগুলো রসায়নের মতোই হয়, শুধু এর চার্জ উল্টো হয়। সে কারণে এমন কোনো বিশ্বে (নাকি প্রতি-বিশ্বে) বাস করা মানুষেরা কখনো জানবে না যে তারা প্রতিবস্তুর তৈরি। (পদার্থবিদেরা একে বলেন চার্জ-রিভার্সড বা সি-রিভার্সড মহাবিশ্ব। কারণ, প্রতি-মহাবিশ্বে সব চার্জ উল্টো। তবে বাকি সবকিছুই একই রকম। )

কিছু বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে বিজ্ঞানীদের মহাকাশে পৃথিবীর যমজ গ্রহ আবিষ্কার করতে দেখা যায়। একমাত্র ব্যতিক্রম শুধু ওই পৃথিবীটা লুকিং গ্লাস মহাবিশ্ব, যেখানে সবকিছু বাঁহাতি। সেখানের সবার হৃৎপিণ্ড দেহের ডান পাশে থাকে আর বেশির ভাগ মানুষ বাঁহাতি। তারা কখনো জানতেও পারবে না যে তারা বাঁহাতি উল্টো এক লুকিং গ্লাস মহাবিশ্বের বাসিন্দা। (পদার্থবিদেরা এ ধরনের লুকিং গ্লাস ইউনিভার্সকে বলেন প্যারিটি-রিভার্সড বা পি-রিভার্সড ইউনিভার্স।)

এ ধরনের কোনো প্রতিবস্তু ও প্যারিটি-রিভার্সড ইউনিভার্সে অস্তিত্ব কি সত্যিই আছে? পদার্থবিদেরা যমজ মহাবিশ্বের প্রশ্নটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। কারণ, আমাদের অতিপারমাণবিক কণার চার্জ উল্টে দিলে কিংবা ডান-বাঁ সজ্জা উল্টে দিলেও নিউটন আর আইনস্টাইনের সমীকরণ সেখানে একই থাকে। কাজেই সি-রিভার্সড ও পি-রিভার্সড মহাবিশ্ব তাত্ত্বিকভাবে থাকা সম্ভব।

নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান এসব মহাবিশ্ব সম্পর্কে চমৎকার এক প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। ধরা যাক, কোনো একদিন আমরা দূরের কোনো গ্রহের এলিয়েনদের সঙ্গে রেডিও বা বেতার যোগাযোগ স্থাপন করতে পারলাম, কিন্তু তাদের দেখতে পেলাম না। তাঁর প্রশ্ন হলো, তাহলে বেতারের মাধ্যমে তাদের কাছে কি আমরা ডান আর বাঁয়ের মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে পারব? পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো পি-রিভার্সড মহাবিশ্বেও কার্যকর হলে এই ধারণা তাদের বোঝানো অসম্ভব।

কারণ হিসেবে ফাইনম্যান বলেন, নির্দিষ্ট কিছু বিষয় নিয়ে যোগাযোগ করা খুব সহজ। যেমন আমাদের দেহের আকার ও হাতের আঙুলের সংখ্যা, বাহু ও পা। এমনকি আমরা রসায়ন আর জীববিজ্ঞানের ধারণাগুলোও তাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারব। কিন্তু তাদের কাছে ডান ও বাঁয়ের ধারণা (কিংবা ঘড়ির কাঁটার দিকে ও ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে) ব্যাখ্যার চেষ্টা করলে প্রতিবারই আমরা ব্যর্থ হব। তাদের কখনোই বোঝানো যাবে না যে আমাদের হৃৎপিণ্ড দেহের বাঁ দিকে থাকে। আবার পৃথিবী কোন দিকে ঘুরছে, কিংবা ডিএনএ অণুর সর্পিলতা কোন দিকে, তা-ও তাদের বোঝানো যাবে না।

সুতরাং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন বিজ্ঞানী সি এন ইয়াং এবং টি ডি লি সে সময় যখন এই মূল্যবান তত্ত্বটি ভুল বলে প্রমাণ করলেন, তখন নিঃসন্দেহে সেটি ছিল বিস্ময়কর এক ঘটনা। অতিপারমাণবিক কণাগুলোর প্রকৃতি পরীক্ষা করে তাঁরা দেখালেন, লুকিং গ্লাস, পি-রিভার্সড ইউনিভার্সের কোনো অস্তিত্ব নেই। এক পদার্থবিজ্ঞানী এই বৈপ্লবিক ফলাফল জেনে বলেছিলেন, “ঈশ্বর নিশ্চয়ই কোনো ভুল করেছেন।’ এই দুনিয়া পাল্টানো ফলাফলকে বলা হয় ‘ওভারথ্রো অব প্যারিটি’ বা সমতার পরাজয়। এ ফলাফলের জন্য ১৯৫৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে ইয়াং এবং লি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

ফাইনম্যানের জন্য এই উপসংহারের মানে হলো, আপনি যদি এলিয়েনদের সঙ্গে রেডিওতে কথা বলেন, তাহলে এমন এক পরীক্ষার আয়োজন করা সম্ভব, যার মাধ্যমে বাঁহাতি আর ডানহাতি মহাবিশ্বের মধ্যকার পার্থক্য শুধু রেডিওর মাধ্যমেই বোঝানো সম্ভব। (যেমন, তেজস্ক্রিয় কোবাল্ট ৬০ থেকে নিঃসৃত ইলেকট্রনের স্পিন সমানভাবে ঘড়ির কাঁটার দিকে কিংবা ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে থাকে না। বরং তাদের স্পিন ইচ্ছেমতো দিকে থাকে, এতে প্যারিটি বা সমতা ভেঙে যায়। )

তাহলে ফাইনম্যান কল্পনা করতে পারতেন যে এলিয়েন ও মানবজাতির মধ্যে একটি ঐতিহাসিক আলোচনা শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথম সাক্ষাতের সময় আমরা এলিয়েনদের তাদের ডান হাত বাড়িয়ে দিতে বলব এবং তাদের সঙ্গে হাত মেলাব। এলিয়েনরা যদি সত্যি সত্যিই তাদের ডান হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে আমরা তাদের সঙ্গে সফলভাবে যোগাযোগ করে বাঁ- ডানের ও ঘড়ির কাঁটার দিকে আর বিপরীত দিকের ধারণা বোঝাতে পেরেছি।

কিন্তু তাহলে ফাইনম্যান আরেকটি যন্ত্রণাদায়ক ভাবনা তুলে ধরতেন। এলিয়েনরা যদি তাদের বাঁ হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে কী হবে? এর অর্থ হবে, আমরা একটা বড় ধরনের ভুল করেছি। অর্থাৎ আমরা তাদের বাঁ ও ডানের ধারণা বোঝাতে পারিনি। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার। কারণ, এর মানে হবে, এই এলিয়েনরা প্রতিবস্তু দিয়ে তৈরি আর তারা সব পরীক্ষাই উল্টোভাবে করে। কাজেই আমাদের চেয়ে তাদের বাঁ ও ডান উল্টো। কাজেই তাদের সঙ্গে হাত মেলালে আমরা বিস্ফোরিত নিশ্চিত হব!

১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত আমরা এ রকমই জানতাম। আমাদের মহাবিশ্ব ও সবকিছুই প্রতিবস্তু দিয়ে তৈরি কোনো মহাবিশ্ব আর প্যারিটি-রিভার্সড মহাবিশ্বের মধ্যকার পার্থক্য বলা অসম্ভব ছিল। প্যারিটি ও চার্জ উল্টো করলে ওই মহাবিশ্বও পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো মেনে চলবে। প্যারিটি নিজেই নিজেকে বাতিল করেছে। কিন্তু চার্জ ও প্যারিটি ওই মহাবিশ্বের জন্য ভালো প্রতিসাম্যতা ছিল। সে কারণে সিপি-রিভার্সড মহাবিশ্ব এখনো থাকা সম্ভব।

মানে আমরা যদি এলিয়েনের সঙ্গে ফোনে কথা বলি, তবে সাধারণ মহাবিশ্ব এবং যে মহাবিশ্ব একই সঙ্গে প্যারিটি ও চার্জ রিভার্সড, তাদের ভেতরে পার্থক্য করতে পারব না (যেমন বাঁ ও ডান পরস্পর প্রতিস্থাপনযোগ্য এবং সব বস্তু প্রতিবস্তুতে পরিণত হয়)।

১৯৬৪ সালে পদার্থবিদেরা দ্বিতীয়বার ধাক্কা খেলেন। দেখা গেল, সিপি- রিভার্সড মহাবিশ্বেরও অস্তিত্ব নেই। অতিপারমাণবিক কণার ধর্ম বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, আরেকটি সিপি-রিভার্সড মহাবিশ্বের সঙ্গে রেডিওতে কথা বলে বাঁ-ডান আর ঘড়ির কাঁটার দিকে ও বিপরীত দিকের পার্থক্য বলা সম্ভব। এ ফলাফলের কারণে জেমস ক্রোনিন আর ভ্যাল ফিটচ ১৯৮০ সালে নোবেল পুরস্কার পান।

(সিপি-রিভার্সড মহাবিশ্বকে পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলোর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ দেখানোর পর অনেক পদার্থবিদ হতাশ হন। কিন্তু তারপরও এই আবিষ্কারের পেছনে ভালো বিষয় আছে। সে বিষয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। সিপি-রিভার্সড মহাবিশ্ব থাকা সম্ভব হলে প্রকৃত মহাবিস্ফোরণকালে নিখুঁতভাবে একই পরিমাণ বস্তু ও প্রতিবস্তু থাকত। তাহলে মহাবিশ্বের ১০০ ভাগই পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। তাতে কোনোভাবেই আমাদের পরমাণুর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব হতো না। সমপরিমাণ বস্তু ও প্রতিবস্তুর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর বেঁচে যাওয়া বস্তু থেকে আমাদের অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে, এই চরম সত্যটিই সিপি লঙ্ঘনের নিশ্চিত প্রমাণ। )

কোনো উল্টো প্রতি-মহাবিশ্ব কি থাকা সম্ভব? এর উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, সম্ভব। প্যারিটি-রিভার্সড আর চার্জ-রিভার্সড মহাবিশ্ব থাকা সম্ভব না হলেও প্রতি- মহাবিশ্ব থাকা সম্ভব। কিন্তু সেটি হবে অদ্ভুতুড়ে। আমরা যদি চার্জ, প্যারিটি বা সমতা আর সময়ের প্রবাহ উল্টে দিই, তাহলে যে মহাবিশ্ব পাওয়া যাবে, সেটি পদার্থবিজ্ঞানের সব সূত্র মেনে চলবে। অর্থাৎ সিপিটি-রিভার্সড মহাবিশ্ব থাকা সম্ভব।

সময় উল্টে দিলে অদ্ভুতুড়ে প্রতিসাম্য পাওয়া যায়। টি-রিভার্সড মহাবিশ্বে ডিনারের প্লেট থেকে ভাজা ডিম লাফিয়ে কড়াইয়ে নেমে গঠন বদলে যাবে। সেটি লাফিয়ে ডিমের ভেতরে ঢুকে ভাঙা ডিমটা ঠিকঠাকমতো লাগিয়ে দেবে। মৃতাবস্থা থেকে আচমকা উঠে বসবে লাশ, তারপর ক্রমে তরুণ হতে হতে একসময় শিশুতে পরিণত হবে এবং হঠাৎ লাফ দিয়ে তাদের মায়ের জঠরে প্রবেশ করবে।

সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান আমাদের বলে, এই টি-রিভার্সড মহাবিশ্ব থাকা সম্ভব নয়। তবে অতিপারমাণবিক কণাদের গাণিতিক সমীকরণ আমাদের অন্য কথা বলে। নিউটনের সূত্রগুলো পেছন দিক কিংবা সামনের দিকে দুই দিকেই নিখুঁতভাবে কাজ করে। ভিডিওতে ধারণ করা একটি বিলিয়ার্ড খেলার কথা কল্পনা করুন। বলের প্রতিটি সংঘর্ষ নিউটনের গতির সূত্র মেনে চলে; কোনো অদ্ভুত গেমের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো ভিডিও রিভার্স করে চালানো হলেও সেখানে নিউটনের সূত্রগুলো কার্যকর থাকবে।

কোয়ান্টাম তত্ত্বে বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূত্রগুলো অমান্য করে টি-রিভার্স নিজেই। তবে সম্পূর্ণ সিপিটি- রিভার্সড মহাবিশ্ব সেখানে অনুমোদন করে। এর মানে, কোনো মহাবিশ্বে যেখানে বাঁ ও ডান উল্টো, সেখানে বস্তু পরিণত হবে প্রতিবস্তুতে এবং সময় চলবে পেছন দিকে। আর পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো মেনে চলবে এ রকম মহাবিশ্ব!

(মজার ব্যাপার হলো, আমরা এমন সিপিটি-রিভার্সড মহাবিশ্বের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারব না। এই মহাবিশ্বের গ্রহগুলোতে সময় পেছন দিকে চলার মানে হলো, তাদের আমরা যেটাই বলব সেগুলো আসলে তাদের ভবিষ্যতের অংশ। কাজেই তাদের যে কথাই বলা হোক না কেন, তারা সবই বেমালুম ভুলে যাবে। কাজেই পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র সিপিটি-রিভার্সড মহাবিশ্বের অনুমোদন দিলেও আমরা রেডিওর মাধ্যমে কোনো সিপিটি- রিভার্সড এলিয়েনদের সঙ্গে বলা বলতে পারব না।)

সংক্ষেপে বলা যায়, প্রতিবস্তুচালিত ইঞ্জিন হয়তো দূর ভবিষ্যতে আমাদের স্টারশিপের জন্য জ্বালানি জোগাতে পারে। অবশ্য পৃথিবীতে যদি যথেষ্ট পরিমাণ প্রতিবস্তু তৈরি করা যায়, কিংবা মহাকাশে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়, তবেই সেটি সম্ভব। সিপি ভায়োলেশনের কারণে বস্তু ও প্রতিবস্তুর মধ্যে সামান্য ভারসাম্যহীনতা ছিল। এর ফলে হয়তো গভীর মহাকাশে প্রতিবস্তুর কিছু উৎস এখনো টিকে থাকতে পারে। কে জানে কোনো দিন সেগুলো সংগ্রহ করাও সম্ভব হবে।

কিন্তু প্রতিবস্তুর ইঞ্জিনের প্রযুক্তিগত জটিলতার কারণে এই প্রযুক্তি হাতের মুঠোয় পেতে আরও এক শতাব্দী বা তার চেয়ে বেশি সময় লাগতে পারে। সে কারণে একে প্রথম শ্রেণির অসম্ভাব্যতা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

চলুন, আরেকটি প্রশ্ন নিয়ে ভাবা যাক। ভবিষ্যতের হাজার বছরের মধ্যে আলোর চেয়ে দ্রুতগতির কোনো স্টারশিপ বানানো কি সম্ভব? আইনস্টাইনের বিখ্যাত মতবাদ ‘কোনো কিছুই আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলতে পারে না’—এই ধারণায় কি কোনো ত্রুটি আছে? বিস্ময়কর হলেও সত্য, এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ।

তথ্যনির্দেশ

বিশেষ আপেক্ষিকতা : বিজ্ঞানের নিয়মকানুন সব পর্যবেক্ষকের জন্য একই হবে। মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের অনুপস্থিতিতে পর্যবেক্ষকের গতিবেগ যা-ই হোক না কেন, সব ক্ষেত্রেই নিয়মকানুন একই হবে। এসব ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আইনস্টাইনের তত্ত্ব।

নিউট্রিনো: একটি চার্জহীন কণা। খুবই হালকা কণা, যা শুধু দুর্বল বল দিয়ে প্রভাবিত হয়।

সিপিটি : পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলোতে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে পার্থক্যসূচক কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে, C, P, T নামে পরিচিত কিছু কার্যক্রমের অধীনে পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলো সব সময় অপরিবর্তিত থাকে। এখানে C অর্থ প্রতিকণার কারণে কণাতে পরিবর্তন। P-এর অর্থ দর্পণে প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব নেওয়া, যাতে বাঁ ও ডান পরস্পরের সঙ্গে অদলবদল করতে পারে। আর T-এর অর্থ সবগুলো কণার গতির দিক উল্টো দিকে আনা, যাতে কণাদের গতিপথ পেছন দিকে হয়। পদার্থবিদ্যার যেসব সূত্র সব রকম সাধারণ অবস্থায় বস্তুর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলো C ও P-এর অধীনে কার্যক্রমেও একই থাকে। অন্য কথায়, অন্য কোনো গ্রহের অধিবাসী, যারা আমাদের দর্পণ প্রতিবিম্ব ও যারা প্রতিকণা দিয়ে তৈরি, তাদের জীবনও ঠিক আমাদের মতোই হবে। তারা হয়তো প্রতিকণা দিয়ে তৈরি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *