৪. টেলিপোর্টেশন

৪. টেলিপোর্টেশন

খুবই দারুণ ব্যাপার হলো, আমরা প্যারাডক্সের মুখোমুখি হয়েছি। এখন আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কিছুটা আশা করতে পারি।

—নীলস বোর

আমি পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো পরিবর্তন করতে পারব না, ক্যাপ্টেন! —স্কটি, চিফ ইঞ্জিনিয়ার, স্টার ট্রেক

মানুষ বা বস্তুকে শিগগিরই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করার ক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তিই টেলিপোর্টেশন। এ প্রযুক্তি সভ্যতার গতিপথ বদলে দিতে পারে আর সেই সঙ্গে পাল্টে দিতে পারে বিভিন্ন জাতির ভবিষ্যৎ। একই সঙ্গে যুদ্ধের নিয়মকানুনও অপ্রতিরোধ্যভাবে বদলে দিতে পারে টেলিপোর্টেশন। যেমন বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী তাদের সেনাদলকে শত্রুপক্ষের পেছনে টেলিপোর্ট করে পাঠিয়ে দিতে পারবে, কিংবা শত্রুপক্ষের নেতাদের টেলিপোর্ট করে তাদের পাকড়াও করতে পারবে। বর্তমানে প্রচলিত যোগাযোগব্যবস্থা, তথা গাড়ি থেকে শুরু করে জাহাজ, বিমান বা রেলপথ ও এই ব্যবস্থায় সেবাদানকারী অন্যান্য সব ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্রেফ অচল হয়ে যাবে। এর কারণও বেশ সহজ। কারণ, তখন আমরা খুব সহজে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে আর আমাদের মালামাল বাজারে টেলিপোর্ট করতে পারব। সেটি করা গেলে অবসরযাপন হয়ে উঠবে কষ্টহীন। কারণ, নিজেদের টেলিপোর্টে করে বিভিন্ন গন্তব্যে চোখের পলকে পৌঁছে যেতে পারব আমরা। কাজেই এককথায় বলা যায়, টেলিপোর্টেশন সবকিছুই বদলে দেবে।

টেলিপোর্টেশন সম্পর্কে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে। যেমন বাইবেল। সেখানে আত্মারা কোনো ব্যক্তিকে নিমেষে অনেক দূরে নিয়ে যায়। নিউ টেস্টামেন্টের একটি বাক্য দেখে মনে হয় ফিলিপকে গাজা থেকে আজোটাসে টেলিপোর্ট করা হয়েছিল। বাক্যটি হলো : “তারা যখন পানির ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল, তখন আত্মাদের প্রভু হঠাৎ ফিলিপকে অনেক দূরে নিয়ে গেলেন। খোজা লোকটি তাকে আর দেখতে পেল না। কিন্তু যথারীতি আনন্দোৎসব চালিয়ে যেতে লাগল সে। তবে ফিলিপ আজোটাসে হাজির হলো আর ভ্রমণ করতে করতে কাসারিয়ার পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত সব শহরে যিশুর বাণী প্রচার করতে লাগল…’ (অ্যাক্ট ৮ : ৩৬-৪০)।

এদিকে সব ম্যাজিশিয়ানের কৌশল ও ইলিউশনের এক অংশও আসলে টেলিপোর্টেশন। যেমন মাথার টুপি থেকে খরগোশ আর হাতের আস্তিন থেকে তাস বের করে আনে ম্যাজিশিয়ানরা। আবার দর্শকদের কানের ভেতর থেকে কয়েন বের করে আনে তারা। এগুলোর মধ্যে বর্তমানে অন্যতম উচ্চাভিলাষী কৌশলটি হলো, দর্শকদের চোখ ছানাবড়া করে তাদের সামনে থেকে আস্ত একটা হাতি স্রেফ গায়েব করে দেওয়া। এ প্রদর্শনীর শুরুতে কয়েক টন ওজনের বিপুল আকৃতির একটি হাতিকে একটা খাঁচার মধ্যে রাখা হয়। এরপর ম্যাজিশিয়ানের হাতের জাদুদণ্ডের টুসকিতে হাতিটি এক লহমায় গায়েব হয়ে যায়। এতে বিস্ময়ে চোখ কপালে ওঠে দর্শকদের। (নিঃসন্দেহে হাতি গায়েব হয়ে যায় না। আসলে আয়নার মাধ্যমে কৌশলটি খাটানো হয়। লম্বা, পাতলা, খাড়া আয়নার ফালি ফালি গুচ্ছ ওই খাঁচার প্রতিটি বারের পেছনে লাগানো থাকে। একটি গেটের মতো প্রতিটি খাড়া এই আয়নার ফালি দিয়ে সুইভেল বানানো সম্ভব। ম্যাজিকের কৌশলের শুরুতে খাড়া আয়নার সবগুলো ফালি বারের পেছনে সারিবদ্ধ করা হয়। তাতে আয়নাগুলো সামনে দেখা যায় না, কিন্তু হাতিটি দেখা যায়। কিন্তু আয়নাগুলো দর্শকদের দিকে ৪৫ ডিগ্রি ঘোরালে হাতিটি চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। সেই সঙ্গে তখন খাঁচার এক পাশের প্রতিফলিত ছবি দেখতে শুরু করে দর্শকেরা। )

টেলিপোর্টেশন ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনি

বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে প্রথম টেলিপোর্টেশনের কথা উল্লেখ করা হয় এডওয়ার্ড পেজ মিশেলের এক গল্পে, যার শিরোনাম ‘দ্য ম্যান উইদাউট আ বডি’। গল্পটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালে। এতে এক বিড়ালের দেহের সব পরমাণু আলাদা করতে সক্ষম হন এক বিজ্ঞানী। পরমাণুগুলো এরপর টেলিগ্রাফের তার দিয়ে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেন তিনি। বিজ্ঞানী যখন স্বয়ং নিজেকে এভাবে টেলিপোর্ট করার চেষ্টা করছিলেন, তখন দুর্ভাগ্যক্রমে ব্যাটারি ফুরিয়ে যায়। তাতে তার মাথাটাই কেবল টেলিপোর্ট করা সম্ভব হয়েছিল।

শার্লক হোমসের গল্প-উপন্যাসের জন্য বিখ্যাত স্যার আর্থার কোনান ডয়েলও বেশ আগ্রহী ছিলেন টেলিপোর্টেশন নিয়ে। অনেক বছর গোয়েন্দা উপন্যাস ও ছোটগল্প লেখার পর তিনি শার্লক হোমস সিরিজ নিয়ে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে ওঠেন। সে কারণে নিজের সৃষ্ট গোয়েন্দাকে মেরে ফেলেন তিনি এক জলপ্রপাতের ওপর থেকে প্রফেসর মারিয়ার্টির সঙ্গে হোমসকে নিচে ফেলে দেন ডয়েল। কিন্তু জনসাধারণের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ওই গোয়েন্দা চরিত্রকে তিনি আবারও বাঁচিয়ে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন। এভাবে শার্লক হোমসকে হত্যা করতে ব্যর্থ হন তিনি। সে জন্য প্রফেসর চ্যালেঞ্জার নামে নতুন এক সিরিজ লেখার সিদ্ধান্ত নেন ডয়েল। আসলে এটি শার্লক হোমসের প্রতিদ্বন্দ্বী চরিত্র। দুটি চরিত্রই তাৎক্ষণিক বুদ্ধির ঝিলিক ও রহস্য সমাধানে তীক্ষ্ণ চোখের অধিকারী ছিল। তবে জটিল কোনো কেস সমাধানে মি. হোমস যেখানে ঠান্ডা ডিডাকটিভ লজিক বা অবরোহী যুক্তি ব্যবহার করে, সেখানে প্রফেসর চ্যালেঞ্জার আধ্যাত্মিকতা ও প্যারানরমাল ঘটনার অন্ধকার জগতে অভিযান চালান। এ জগতের মধ্যে টেলিপোর্টেশনও রয়েছে। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত দ্য ডিসইন্ট্রিগ্রেশন মেশিন উপন্যাসে প্রফেসর চ্যালেঞ্জার এক ভদ্রলোকের পাল্লায় পড়েন। ওই ভদ্রলোক এমন এক যন্ত্র বানান, যা দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলা যেত মানুষকে। টুকরোগুলো অন্য কোথায় পাঠিয়ে আবার জোড়া লাগানো যেত। কিন্তু ওই উদ্ভাবক একবার বেশ বড়াই করে বলে বসেন, যন্ত্রটি কোনো মন্দ লোকের হাতে পড়লে, সে মাত্র একটা বোতাম টিপেই গোটা এক শহরের লাখ লাখ মানুষ টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারবে। তা শুনে প্রফেসর চ্যালেঞ্জার আতঙ্কিত হন। এরপর ওই উদ্ভাবক ভদ্রলোককে টুকরো টুকরো করতে তারই তৈরি করা যন্ত্রটি কাজে লাগান প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। এরপর তাকে আর জোড়া না লাগিয়ে তার ল্যাবরেটারিতে ফেলে রাখেন তিনি

হলিউডে টেলিপোর্টেশন আবিষ্কারের ঘটনা খুব বেশি দিন আগের নয়। টেলিপোর্টেশন ভেস্তে গেলে কী ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে পারে, তা দেখানো হয়েছে ১৯৫৮ সালে নির্মিত দ্য ফ্লাই চলচ্চিত্রে। এক বিজ্ঞানী সফলভাবে নিজেকে এক ঘরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে টেলিপোর্ট করতে সক্ষম হন। দুর্ঘটনাক্রমে টেলিপোর্টেশন চেম্বারে ঢুকে পড়া এক মাছির সঙ্গে বিজ্ঞানীর দেহের পরমাণু মিশে যায়। তাতে ওই বিজ্ঞানী অর্ধেক মানুষ ও অর্ধেক মাছির মিশ্রণে পরিণত হন কিম্ভূতকিমাকার মিউটেটেড দানবে। (চলচ্চিত্রটি ১৯৮৬ সালে রিমেক করা হয়, যেখানে অভিনয় করেছেন জেফ গোল্ডবাম।) [গল্পটির ছায়া অবলম্বনে মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন দেশীয় পটভূমিতে রূপান্তর করেছেন মাকড়সা শিরোনামে। গল্পটি তিনটি উপন্যাসিকা বইতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।—অনুবাদক]

‘স্টার ট্রেক’ সিরিজের কারণে টেলিপোর্টেশনের ব্যাপারটি জনসাধারণের কাছে প্রথম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্টার ট্রেকের স্রষ্টা জিন রোডেনবেরি সিরিজটিতে টেলিপোর্টেশন আমদানি করেন। কারণ, বহুদূরের কোনো গ্রহে রকেটশিপ ওঠানামার জন্য যে ব্যয়বহুল স্পেশাল ইফেক্টের প্রয়োজন, তার জন্য বাজেট ছিল না প্যারামাউন্ড স্টুডিওর। কিন্তু টেলিপোর্টেশনের মাধ্যমে বেশ কম খরচে এন্টারপ্রাইজের ক্রুদের তাদের গন্তব্য নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল।

অনেক বছর ধরে টেলিপোর্টেশনের সম্ভাবনা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, কাউকে টেলিপোর্ট করতে, তার দেহের প্রতিটি পরমাণুর নিখুঁত অবস্থান জানতে হয়। এটি হয়তো হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি লঙ্ঘন করবে (এ নীতি অনুসারে, ইলেকট্রনের অবস্থান ও ভরবেগ একই সঙ্গে নিখুঁতভাবে জানা সম্ভব নয়)। সে কারণে সমালোচকদের সম্মান জানিয়ে স্টার ট্রেক সিরিজের নির্মাতারা ট্রান্সপোর্টার রুমে ‘হাইজেনবার্গ কমপেনসেটস’ বা ‘হাইজেনবার্গের ক্ষতিপূরক’ নামের একটা ঘটনার আমদানি করেন। এটি ব্যবহার করে যাতে স্থানান্তরের সময় কোনো গ্যাজেটের মাধ্যমে কোয়ান্টাম ফিজিকসের সূত্রগুলো অমান্য করার ক্ষতি পূরণ করা যায়, এটাই ছিল এর উদ্দেশ্য। তবে এই হাইজেনবার্গের কমপেনসেটর তৈরি করা বেশ দ্রুতই সম্ভব হয়ে উঠতে পারে বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এর মাধ্যমে হয়তো আগের সমালোচক ও বিজ্ঞানীরাই ভুল প্রমাণিত হতে পারেন।

টেলিপোর্টেশন ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব

নিউটনিয়ান তত্ত্বমতে, টেলিপোর্টেশন একেবারেই অসম্ভব। পদার্থ হলো বিলিয়ার্ড বলের মতো শক্ত ও অতি ক্ষুদ্র—এ ধারণা নিউটনের সূত্রগুলোর ভিত্তি। কোনো বস্তুকে ধাক্কা না দেওয়া পর্যন্ত সেটি গতিশীল হয় না; আবার কোনো বস্তু হঠাৎ করে হারিয়ে যেতে কিংবা অন্য কোথাও হঠাৎ উদয় হতেও পারে না।

তবে কোয়ান্টাম তত্ত্বে, কণারা নিখুঁতভাবে এ কাজটি করতে পারে। প্রায় ২৫০ বছর রাজত্ব করেছিল নিউটনের সূত্রগুলো। কিন্তু ১৯২৫ সালে কোয়ান্টাম তত্ত্ব গড়ে তোলার পর নিউটনের সূত্রগুলো হটিয়ে দেন ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, আরউইন শ্রোডিঙ্গার আর তাঁদের সহকর্মীরা। পরমাণুর অদ্ভুত ধর্ম বিশ্লেষণ করে পদার্থবিদেরা আবিষ্কার করলেন, ইলেকট্রনও তরঙ্গের মতো আচরণ করে। আবার পরমাণুর মধ্যে তাদের আপাতদৃষ্টিতে বিশৃঙ্খল গতির মধ্যে কোয়ান্টাম লাফ দিতে পারে ইলেকট্রন।

কোয়ান্টাম তরঙ্গের সঙ্গে যে মানুষটি খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, তিনি ভিয়েনার পদার্থবিদ আরউইন শ্রোডিঙ্গার। বিখ্যাত সেই তরঙ্গ সমীকরণটিও লেখেন তিনি। এখন পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ সমীকরণের সঙ্গে তার নামটিও জড়িয়ে গেছে। গ্র্যাজুয়েট স্কুলের পুরো কোর্সগুলোতে তাঁর বিখ্যাত সমীকরণটি সমাধানে ব্যয় করতে হয়। পদার্থবিজ্ঞানের লাইব্রেরিগুলোর দেয়ালে দেয়ালে ঠাসা বইগুলো এ বিষয় দিয়েই ভরা থাকে। এসবই আসলে এই সমীকরণের গভীরতর পরিণতি। তাত্ত্বিকভাবে, রসায়নের সবকিছুর যোগফল কমিয়ে এনে এই সমীকরণের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব।

১৯০৫ সালে আইনস্টাইন প্রমাণ করেন, আলোর তরঙ্গের কণার মতো ধর্মও আছে। অর্থাৎ এদের শক্তির প্যাকেট বা গুচ্ছ হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যায়। শক্তির এ গুচ্ছকে এখন বলা হয় ফোটন। ১৯২০-এর দশকে শ্রোডিঙ্গার বুঝতে পারেন, এর বিপরীতটাও সত্য। মানে হলো, ইলেকট্রনের মতো কণাগুলো তরঙ্গের মতো আচরণ করে। ধারণাটি প্রথম উল্লেখ করেন ফরাসি পদার্থবিদ লুই ডি ব্রগলি। এ অনুমানের জন্য তিনি পরে নোবেল পুরস্কার পান। (আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের কাছে আমরা এটা প্রমাণ করে দেখাই। সাধারণত টিভির মতো দেখতে একটা ক্যাথোড রে টিউবে ইলেকট্রন ফায়ার করা হয়। এসব ইলেকট্রন এক অতি ক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। তাই টিভি স্ক্রিনের যেখানে ইলেকট্রনগুলো আঘাত করে, সেখানে স্বাভাবিকভাবে একটা অতি ক্ষুদ্র ডট দেখার আশা করবেন আপনি। কিন্তু তার বদলে আপনি সেখানে সমকেন্দ্রী, তরঙ্গের মতো রিং দেখতে পাবেন। এটি কেবল তখনই ঘটার আশা করা যায়, যদি ছিদ্রের মধ্য দিয়ে কোনো বিন্দুকণা নয়, বরং তরঙ্গ প্রবাহিত হয়।

এই কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা নিয়ে একদিন এক বক্তৃতা দিচ্ছিলেন শ্রোডিঙ্গার। তাঁর সহকর্মী পদার্থবিদ পিটার ডিবাই তাঁকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে প্রশ্ন করেন : ইলেকট্রনকে যদি তরঙ্গ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, তাহলে তাদের ওয়েভ ইকুয়েশন বা তরঙ্গ সমীকরণ কী?

নিউটন ক্যালকুলাস আবিষ্কার করার পর থেকেই পদার্থবিদেরা ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশনের মাধ্যমে তরঙ্গকে ব্যাখ্যা করতে পারেন। কাজেই ডিবাইয়ের প্রশ্নটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে শ্রোডিঙ্গার ইলেকট্রনের তরঙ্গের জন্য ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন লেখার সিদ্ধান্ত নেন। সে মাসে ছুটি কাটাতে চলে যান শ্রোডিঙ্গার। ছুটি থেকে তিনি ফিরে এলেন সেই সমীকরণটি বগলদাবা করে। তারও অনেক আগে ফ্যারাডের ফোর্স ফিল্ড নিয়ে আলোর জন্য ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ লিখেছিলেন ম্যাক্সওয়েল। একইভাবে ডি ব্রগলির কণাতরঙ্গের ওপর ভর করে ইলেকট্রনের জন্য শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ লিখে ফেলেন শ্রোডিঙ্গার।

(আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের চেহারা চিরদিনের জন্য পাল্টে দেওয়া বিখ্যাত সমীকরণটি শ্রোডিঙ্গার যখন আবিষ্কারে মগ্ন, তখন তিনি কী করছিলেন, তা সঠিকভাবে জানতে বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদদের যথেষ্ট শ্রম দিতে হবে। যত দূর জানা যায়, শ্রোডিঙ্গার মুক্ত প্রেমে বিশ্বাসী ছিলেন। অবকাশযাপনে প্রায়ই তাঁর স্ত্রী ও প্রণয়িনীদের সঙ্গে নিতেন তিনি। এমনকি তাঁর বিপুলসংখ্যক প্রেমিকাদের নিয়ে ডায়েরিতে বিস্তারিত লিখে রাখতেন। প্রত্যেকের সঙ্গে মিলিত হওয়ার বিষয়টি সংকেতে লিখতেন শ্রোডিঙ্গার। ইতিহাসবিদেরা এখন বিশ্বাস করেন, সমীকরণটি আবিষ্কারের সময় বান্ধবীদের একজনকে সঙ্গে নিয়ে আল্পসের ভিলা হারউইগে ছিলেন তিনি।)

হাইড্রোজেন পরমাণুর সমীকরণ সমাধান করতে শুরু করেন শ্রোডিঙ্গার। একরাশ বিস্ময় নিয়ে তিনি দেখলেন, আগের পদার্থবিদদের অতিযত্নে তালিকাভুক্ত করা হাইড্রোজেনের নিখুঁত শক্তিস্তরের সঙ্গে তা মিলে যাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন, নীলস বোরের দেখানো নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘূর্ণমান ইলেকট্রন-সংবলিত পরমাণুর চিত্রটি আসলে ভুল। (আধুনিক বিজ্ঞান প্রতীকায়িত করতে পরমাণুর এ চিত্রটি এখনো বইপত্র ও বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হয়।) নিউক্লিয়াসের চারপাশের এসব কক্ষপথ তরঙ্গ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে।

শ্রোডিঙ্গারের কাজটি পদার্থবিজ্ঞান সমাজের ওপর সৃষ্টি করে প্রচণ্ড আলোড়ন। এর ফলে হঠাৎ করে পরমাণুর ভেতর উঁকি দিতে সক্ষম হন পদার্থবিদেরা। এর মাধ্যমে তাঁরা ইলেকট্রনের শক্তিস্তর সৃষ্টিকারী তরঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত পরীক্ষা করে দেখতে পারলেন। আবার এই শক্তিস্তর সম্পর্কে সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণীও করতে পারলেন তাঁরা, যা প্রাপ্ত ডেটার সঙ্গে মিলে গেল একদম নিখুঁতভাবে।

কিন্তু তারপরও এখানে বিরক্তিকর একটা প্রশ্ন রয়েই গেছে, পদার্থবিজ্ঞান এখনো যার আস্তানা। ইলেকট্রনকে যদি তরঙ্গ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলে তরঙ্গায়িত আন্দোলন কী? এর উত্তর দিলেন পদার্থবিদ ম্যাক্স বর্ন। তিনি বললেন, এসব তরঙ্গ আসলে সম্ভাবনার তরঙ্গ। এসব তরঙ্গ শুধু যেকোনো সময়ে যেকোনো জায়গায় একটি নির্দিষ্ট ইলেকট্রন খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনার কথা জানায়। অন্য কথায়, ইলেকট্রন হলো একটি কণা। কিন্তু এই কণাকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা পাওয়া যায় শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গের মাধ্যমে। তরঙ্গ যত বড় হবে, ওই বিন্দুতে কণাটি খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও ততই বাড়বে।

এই অগ্রগতির পর পদার্থবিদ্যার মর্মমূলে হঠাৎ করে দৈবঘটনা ও সম্ভাবনার সূচনা হলো। অথচ আগে পদার্থবিজ্ঞান আমাদের গ্রহ থেকে শুরু করে ধূমকেতু বা কামানের গোলার মতো বস্তুকণার নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী ও তাদের গতিপথের বিশদ তথ্য জোগান দিত।

এই অনিশ্চয়তা শেষ পর্যন্ত হাইজেনবার্গ তাঁর প্রস্তাবিত অনিশ্চয়তার নীতিতে সংকলন করেন। এ নীতি অনুযায়ী, একই সময়ে কোনো ইলেকট্রনের নির্ভুল ভরবেগ ও নির্ভুল অবস্থান জানা সম্ভব নয়। এমনকি একটি প্রদত্ত সময়ে পরিমাপ করে নির্ভুলভাবে এর শক্তি জানাও সম্ভব নয়। কোয়ান্টাম পর্যায়ে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের সব সাধারণ সূত্র লঙ্ঘিত হয়। যেমন ইলেকট্রন যেকোনো জায়গায় অদৃশ্য ও উদয় হতে পারে এবং ইলেকট্রন একই সময়ে অনেক জায়গায় থাকতে পারে।

[কোয়ান্টাম তত্ত্বের গডফাদার আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে এ বিপ্লব শুরুতে সহায়তা করেন। আর শ্রোডিঙ্গার দিয়েছেন তরঙ্গ সমীকরণ। মজার ব্যাপার হচ্ছে মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানে দৈবঘটনা ঢুকে পড়তে দেখে আতঙ্কিত হলেন তাঁরা। আইনস্টাইন লিখলেন, ‘কোয়ান্টাম মেকানিকস বিপুল মর্যাদার দাবি রাখে। কিন্তু আমার বিবেক বলছে, এটা সত্যি হতে পারে না। তত্ত্বটা অনেক কিছু প্রস্তাব করে, কিন্তু এটি গোপনীয়তার খুব সামান্যই আমাদের কাছে উন্মোচন করে। অন্তত আমার মনে হয়, তিনি (ঈশ্বর) পাশা খেলেন না।]

হাইজেনবার্গের তত্ত্বটি বৈপ্লবিক ও বিতর্কিত হলেও সেটা বেশ কাজে দিত। মাত্র এক ঝাড়ুতেই পদার্থবিদেরা রসায়নের সূত্রগুলোসহ বিপুলসংখ্যক বিভ্রান্তিকর ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলেন এর মাধ্যমে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব কতটা অদ্ভুতুড়ে সেটি দেখাতে আমার পিএইচডি ছাত্রদের মুগ্ধ করতে তাদের প্রায়ই আমি পরমাণুগুলো হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে ইটের দেয়ালের অপর পাশে উদয় হওয়ার সম্ভাবনা গণনা করতে বলি। এ ধরনের কোনো টেলিপোর্টেশন নিউটনিয়ান পদার্থবিজ্ঞানে ঘটা অসম্ভব হলেও কোয়ান্টাম বলবিদ্যা তা অনুমোদন দেয়। তবে কেউ যদি এ ধরনের কিছু ঘটনা ঘটতে দেখতে চায়, তাহলে তাকে মহাবিশ্বের জীবনকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে বসে থাকতে হবে। (আপনি যদি একটা কম্পিউটার ব্যবহার করে আপনার দেহের শ্রোডিঙ্গার তরঙ্গের গ্রাফ বা লেখচিত্র তৈরি করেন, তাহলে দেখতে পাবেন তার সঙ্গে আপনার দেহের সব গঠনের সঙ্গে বেশ মিল আছে। পার্থক্য শুধু এটুকুই যে গ্রাফটি কিছুটা ঝাপসা দেখা যাবে। সেই সঙ্গে আপনার কিছু তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাবে সব দিকে। আপনার কিছু তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়বে নক্ষত্রের মতো দূরদূরান্তে। তাই কোনো দিন ঘুম থেকে উঠে নিজেকে দূরের কোনো গ্রহে দেখতে পারেন আপনি, অবশ্য তেমন সম্ভাবনা খুব কম। )

ইলেকট্রনগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে একই সময়ে অনেক জায়গায় দেখা যায়, এটাই রসায়নের যথার্থ ভিত্তি। আমরা জানি, একটা পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রন ঘোরে, ঠিক যেন সৌরজগতের ক্ষুদ্র সংস্করণ। কিন্তু পরমাণু ও সৌরজগৎ একেবারেই আলাদা। মহাকাশে দুটি সৌরজগতের সংঘর্ষ হলে তাদের পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, আবার গ্রহগুলো হারিয়ে যাবে গভীর মহাকাশে। কিন্তু পরমাণুগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষের মুখে পড়লে তারা প্রায়ই অণু গঠন করে, যা বেশ নিখুঁতভাবে স্থিতিশীল। এ সময় তারা পরস্পরের ইলেকট্রনগুলো ভাগাভাগি করে নেয়। হাইস্কুলের রসায়ন ক্লাসে শিক্ষক মাঝেমধ্যে একে ‘স্মিয়ারড ইলেকট্রন’ (আঠালো প্রলেপের মতো) হিসেবে উল্লেখ করেন (যার সঙ্গে ফুটবলের বেশ মিল আছে), যারা পরমাণুদের পরস্পরকে একসঙ্গে সংযুক্ত করে।

কিন্তু রসায়নের শিক্ষকেরা খুব কম সময়ই শিক্ষার্থীদের বলেন যে ইলেকট্রন পরমাণু দুটির মধ্যে আসলে ‘স্মিয়ারড’ অবস্থায় থাকে না। এই ‘ফুটবল’ আসলে এ সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে যে ইলেকট্রনটি ওই ফুটবলের মধ্যে একই সময়ে অনেকগুলো জায়গায় থাকতে পারে। অন্য কথায়, আমাদের দেহের ভেতরের অণুগুলোকে ব্যাখ্যা করা সব রকমের রসায়নের ভিত্তিগত ধারণাটি হলো : ইলেকট্রন একই সময়ে বিভিন্ন জায়গায় থাকতে পারে। সেই সঙ্গে দুটি পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রনগুলোর এ রকম ভাগাভাগির কারণে আমাদের দেহের অণুগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব ছাড়া দেহের এ অণু ও পরমাণুগুলো চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যেত।

কোয়ান্টাম তত্ত্বের অদ্ভুত কিন্তু গভীর এই ধর্ম কাজে লাগিয়ে দ্য হিচহাইকার’স গাইড টু দ্য গ্যালাক্সি শিরোনামের চমৎকার উপন্যাস লিখেছেন ডগলাস অ্যাডামস। (সেই ধর্মটি হলো এখানে সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে ঘটনা ঘটারও এক সসীম সম্ভাবনা থাকে)। ছায়াপথের মধ্য দিয়ে শাঁই করে চলে যাওয়ার একটা উপযুক্ত উপায়ের দরকার ছিল তাঁর। তাই কাল্পনিক ইনফিনিট ইমপ্রোবাবিলিটি ড্রাইভ উদ্ভাবন করে তিনি। ‘এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ে বিপুল আন্তনাক্ষত্রিক দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার জন্য এটা বিস্ময়কর নতুন এক পদ্ধতি। এর মাধ্যমে হাইপারস্পেসে সব ধরনের ক্লান্তিকর তুচ্ছ কাজ বাদ দিয়েই পাড়ি দেওয়া সম্ভব।’ তাঁর যন্ত্রটি দিয়ে ইচ্ছেমতো কোয়ান্টাম ঘটনার যেকোনো অস্বাভাবিকতা পরিবর্তন করা যায়। তাই উচ্চমাত্রার অকল্পনীয় ঘটনাও এখানে মামুলি ব্যাপার। কাজেই আপনি যদি রকেটে চেপে সবচেয়ে কাছের কোনো নক্ষত্র ব্যবস্থায় যেতে চান, তাহলে নক্ষত্রটিতে নিজেকে পুনরায় বিমূর্ত করে তুলতে হবে। শুধু এই সম্ভাবনাটা পরিবর্তন করতে হবে আপনাকে। ব্যস, কাজ শেষ, চোখের পলক ফেলার আগেই আপনি সেখানে টেলিপোর্ট হয়ে যাবেন।

বাস্তবে পরমাণুর ভেতরে কোয়ান্টাম লাফ এতই সাধারণ ব্যাপার যে তাকে মানুষের মতো কোনো বস্তুর ক্ষেত্রে সহজে বোঝা যায় না। কারণ, এ রকম বড় বস্তুতে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন পরমাণু থাকে। এমনকি আমাদের দেহের ইলেকট্রনও তাদের নিউক্লিয়াসের চারপাশের ভ্রমণের সময় নাচানাচি ও লাফালাফি করছে। সেখানে এত বেশি এ রকম ঘটছে যে তাদের গতিগুলো পরস্পরকে বাতিল করে দেয়। তাই মোটাদাগে বলা যায়, এ কারণে আমাদের পর্যায়ের বস্তুগুলোকে কঠিন ও টেকসই অবস্থায় দেখা যায়।

পারমাণবিক পর্যায়ে টেলিপোর্টেশন বিধিসম্মত হলেও ম্যাক্রোস্কোপিক স্কেলে এই অদ্ভুত প্রভাবের সাক্ষী হতে চাইলে মহাবিশ্বের জীবনকালের চেয়েও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্বের সূত্র ব্যবহার করে এমন কোনো যন্ত্র কি বানানো সম্ভব, যা দিয়ে সায়েন্স ফিকশন গল্পগুলোর মতো ইচ্ছেমতো টেলিপোর্ট করা যাবে যেকোনো কিছু? মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর উত্তরে হ্যাঁ বলা যায়।

ইপিআর এক্সপেরিমেন্ট

কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের মূল চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে ১৯৩৫ সালে আইনস্টাইন এবং তাঁর সহকর্মী বোরিস পডোলস্কি ও নাথান রোজেনের বিখ্যাত এক গবেষণা প্রবন্ধে। মজার ব্যাপার হলো, তাঁরা এই ইপিআর এক্সপেরিমেন্ট (তিন লেখকের নামের আদ্যাক্ষর) প্রস্তাব করেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে সম্ভাব্যতার সূত্রপাত চিরকালের জন্য হত্যা করতে। (কোয়ান্টাম তত্ত্বের অকাট্য পরীক্ষামূলক সফলতায় আক্ষেপ করে আইনস্টাইন লেখেন, ‘কোয়ান্টাম তত্ত্ব যতই সফলতা পাচ্ছে, ততই এটি অর্থহীন হয়ে উঠছে।’)

দুটি ইলেকট্রন যদি প্রাথমিকভাবে ঐকতানে কম্পিত হয় (এ অবস্থাকে বলে কোহেরেন্স বা সংসক্তি), তাহলে তাদের বড় দূরত্বে আলাদা করে রাখা হলেও তারা তরঙ্গের মতো সমলয়ে থাকতে পারে। এ দুটি ইলেকট্রনকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে আলাদা করে রাখা হলেও তাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য শ্রোডিঙ্গার তরঙ্গ পরস্পরকে সংযুক্ত করবে। অনেকটা মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাভিরুজ্জুর মতো। একটা ইলেকট্রনে কিছু ঘটলে, ওই তথ্যের কিছু অংশ সঙ্গে সঙ্গে অন্যটিতে স্থানান্তরিত হবে। একে বলে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলমেন্ট বা কোয়ান্টাম বিজড়ন। এ ধারণামতে, সংসক্তিতে কম্পিত কণাদের পরস্পরের সঙ্গে একধরনের গভীর সংযোগ রয়েছে।

শুরু করা যাক, ঐকতানে দোলায়মান দুটি সংসক্ত ইলেকট্রন দিয়ে এরপর তাদের পরস্পরের বিপরীত দিকে চলে যেতে দেওয়া যাক। প্রতিটি ইলেকট্রন অনেকটা ঘূর্ণমান লাটিমের মতো। ইলেকট্রনের এই স্পিন বা ঘূর্ণনকে আপ বা ডাউন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ধরা যাক, এই সিস্টেমের সর্বমোট স্পিন শূন্য। সুতরাং একটা ইলেকট্রনের স্পিন আপ হলে স্বাভাবিকভাবেই অন্যটির স্পিন হবে ডাউন। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে, পরিমাপ করার আগে, ইলেকট্রনের স্পিন আপ বা ডাউন কোনোটাই থাকে না। তবে একটা নিম্নতম অবস্থায় থাকে, যেখানে এটা একই সঙ্গে আপ ও ডাউন উভয় স্পিনেই থাকে। (আপনি যদি এতে কোনো পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে এর ওয়েভ ফাংশন কলাপস করবে বা ভেঙে পড়বে। তাতে একটা কণা কোনো নির্দিষ্ট অবস্থায় চলে যাবে।)

এবার একটা ইলেকট্রনের স্পিন মাপা যাক। ধরা যাক, এর স্পিন আপ পাওয়া গেল। তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই জানা যাবে যে অন্য ইলেকট্রনের স্পিন ডাউন। অন্য ইলেকট্রনটি বহু আলোকবর্ষ দূরে আলাদা করা থাকলেও প্রথম ইলেকট্রনের স্পিন মেপে মুহূর্তেই দ্বিতীয় ইলেকট্রনটির স্পিন জানা যাবে। আসলে আলোর চেয়েও দ্রুতগতিতে তথ্যটি জানতে পারছেন আপনি। কারণ, ইলেকট্রন দুটি এনট্যাঙ্গেলড বা তাদের ওয়েভ ফাংশন ঐকতানে কম্পিত হয়। তাদের ওয়েভ ফাংশন অদৃশ্য কোনো সুতা বা নাভিরুজ্জ দিয়ে সংযুক্ত। একটিতে যা কিছুই ঘটুক না কেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্যটিতে তার প্রভাব দেখা দেয়। (কিছু ক্ষেত্রে এর অর্থ হলো, আমাদের ক্ষেত্রে যা-ই ঘটুক, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মহাবিশ্বের বহুদূর প্রান্তের কোনো কিছুতে মুহূর্তেই প্রভাব ফেলে। কারণ, আমাদের ওয়েভ ফাংশন সম্ভবত সময়ের সূচনালগ্নে এনট্যাঙ্গেলড। এক অর্থে, সেখানে এনট্যাঙ্গেলমেন্টের জাল বিস্তৃত, যা মহাবিশ্বের দূর প্রান্তের সঙ্গে সংযুক্ত, এমনকি আমরাও এর সঙ্গে সংযুক্ত।) আইনস্টাইন একে উপহাস করে বলেছেন, ‘স্পুকি অ্যাকশন অ্যাট ডিসট্যান্স’ বা দূর থেকে ভুতুড়ে কাণ্ড। এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, কোয়ান্টাম তত্ত্ব ত্রুটিপূর্ণ। কারণ, কোনো কিছু আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে চলতে পারে না।

আইনস্টাইন ইপিআর এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন করেছিলেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের মৃত্যুঘণ্টা বাজাতে। কিন্তু ১৯৮০-এর দশকে ফ্রান্সের অ্যালান অ্যাসপেক্ট ও তাঁর সহকর্মীরা ১৩ মিটার ব্যবধানে দুটি ডিটেক্টর স্থাপন করে পরীক্ষাটি চালিয়ে দেখেন। এতে পাওয়া ফলাফল নিখুঁতভাবে কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে মিলে গেছে। তাই এতে মনে হতে পারে ঈশ্বর হয়তো মহাবিশ্বের সঙ্গে পাশা খেলেন।

প্রশ্ন হলো, কোনো তথ্য কি সত্যিই আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলতে পারে? মহাবিশ্বের গতির সীমা আলোর গতি হিসেবে নির্ধারণে আইনস্টাইন কি ভুল করেছিলেন? তা নয় আসলে। তথ্য আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলতে পারে। তবে এ তথ্য হবে র‍্যান্ডম বা এলোমেলো, তথা অর্থহীন। ইপিআর এক্সপেরিমেন্টের তথ্য আলোর চেয়ে বেশি বেগে চললেও এর মাধ্যমে আপনি কোনো সত্যিকারের মেসেজ, কিংবা কোনো মোর্স কোড ইপিআর পাঠাতে পারবেন না।

মহাবিশ্বের অন্য প্রান্তে একটি ইলেকট্রনের স্পিন ডাউন অবস্থায় আছে, এই তথ্য জানা অর্থহীন। আপনি আজকের স্টক মার্কেটের কোনো তথ্য এ পদ্ধতিতে পাঠাতে পারবেন না। যেমন ধরা যাক, আপনার এক বন্ধু সব সময়

দৈবচয়ন ভিত্তিতে এক পায়ে লাল মোজা আর অন্য পায়ে সবুজ মোজা পরে। ধরে নিই, আপনি তার একটি পা পরীক্ষা করে দেখলেন এবং সেই পায়ে লাল মোজা পরা আছে। তাহলে আলোর চেয়েও বেশি গতিতেই আপনি জানতে পারবেন, তার অন্য পায়ের মোজার রং সবুজ। তথ্য আসলেই আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলতে পারে, কিন্তু সেই তথ্য অর্থহীন। ননর‍্যান্ডম বা দৈবচয়নবিহীন কোনো তথ্য এ পদ্ধতিতে পাঠানো যাবে না।

অনেক বছর ধরে সমালোচকদের মুখে ছাই দিয়ে ইপিআর এক্সপেরিমেন্টকে কোয়ান্টাম তত্ত্বের মোক্ষম বিজয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এ বিজয় আসলে অন্তঃসারশূন্য। এর কোনো ব্যবহারিক পরিণতি নেই। এখন পর্যন্ত এটাই সত্যি।

কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন

তবে সবকিছু বদলে গেল ১৯৯৩ সালে। সেবার চার্লস বেনেটের নেতৃত্বে আইবিএমের বিজ্ঞানীরা প্রমাণ দেখালেন, ইপিআর এক্সপেরিমেন্ট ব্যবহার করে কোনো বস্তুকেও আস্ত টেলিপোর্ট করা সম্ভব। অন্তত পারমাণবিক পর্যায়ে এটা সত্যি। (আরও ভালোভাবে বললে, তাঁরা প্রমাণ দেখালেন, একটা কণার মধ্যে যতগুলো তথ্য থাকে, তার সবই টেলিপোর্ট করা সম্ভব।) এরপর থেকে পদার্থবিজ্ঞানীরা ফোটন ও এমনকি পুরো সিজিয়াম পরমাণুও টেলিপোর্ট করতে পেরেছেন। পরের কয়েক দশকে বিজ্ঞানীরা হয়তো প্রথমবারের মতো কোনো ডিএনএ ও ভাইরাসও টেলিপোর্ট করে দেখাতে পারবেন।

ইপিআর এক্সপেরিমেন্টের খুবই অদ্ভুত কিছু ধর্ম কাজে লাগায় কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন। এ টেলিপোর্টেশন এক্সপেরিমেন্টে পদার্থবিদেরা দুটো পরমাণু বা A ও C নিয়ে কাজ শুরু করেন। ধরা যাক, আমরা A পরমাণু থেকে C পরমাণুতে একটা তথ্য পাঠাতে চাই। তাহলে তৃতীয় আরেকটি পরমাণু B নিতে হবে। এই B আবার পরমাণু C-এর সঙ্গে এনট্যাঙ্গেলড বা বিজড়িত। কাজেই B ও C সংসক্ত। এখন পরমাণু A পরমাণু B-এর কাছে আনা হলো। পরমাণু A পরমাণু B-কে স্ক্যান করল, তাতে পরমাণু A-তে থাকা তথ্য পরমাণু B-তে স্থানান্তরিত হলো। এই প্রক্রিয়া পরমাণু A ও B এনট্যাঙ্গেলড হয়ে যায়। কিন্তু পরমাণু B ও C যেহেতু এনট্যাঙ্গেলড, তাই পরমাণু A-তে থাকা তথ্যগুলো পরমাণু C-তে স্থানান্তরিত হয়ে যাবে। সবশেষে বলা যায়, পরমাণু A এখন পরমাণু C-তে টেলিপোর্ট হয়ে গেছে। অর্থাৎ পরমাণু C-এর ধারণকৃত তথ্য এখন হুবহু পরমাণু A-এর মতো হবে।

এখানে খেয়াল করতে হবে, পরমাণু A-এর তথ্য এখন ধ্বংস হয়ে গেছে (কাজেই টেলিপোর্টেশনের পর আমাদের কাছে একই পরমাণুর দুটি কপি থাকবে না)। তাই তাত্ত্বিকভাবে কাউকে এ পদ্ধতিতে টেলিপোর্ট করলে সে মারা যেতে পারে। কিন্তু তার দেহের তথ্য উদয় হতে পারে অন্য কোথাও। আরেকটি বিষয়ও খেয়াল রাখতে হবে, A পরমাণু নিজের জায়গা ছেড়ে C পরমাণুর কাছে যায়নি। এখানে শুধু A পরমাণুর তথ্য (যেমন তার স্পিন ও পোলারাইজেশন) C পরমাণুতে গেছে। (এর অর্থ এই নয় যে A পরমাণু গলে অদৃশ্য হয়ে দ্রুতবেগে আরেক জায়গায় গেছে। এর অর্থ, A পরমাণুর তথ্য শুধু পরমাণু C-তে স্থানান্তরিত হয়েছে।

বড় ধরনের এই সফলতার ঘোষণার পর, এর উন্নয়ন নিয়ে বিভিন্ন দল এখন তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। একটা দল আরেক দলকে হারিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এভাবে প্রথম ঐতিহাসিক কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের প্রমাণ মিলল ১৯৯৭ সালে। সেবার ইন্সব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিবেগুনি রশ্মির ফোটন টেলিপোর্ট করা হয়। পরের বছর এর ধারাবাহিকতায় ক্যাল টেকের বিজ্ঞানীরা ফোটন টেলিপোর্ট সম্পর্কে আরও নিখুঁত পরীক্ষা চালান।

ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদেরা দানিয়ুব নদীর তলদেশ দিয়ে ৬০০ মিটার দূরত্বে আলোর কণা টেলিপোর্ট করতে সক্ষম হন ২০০৪ সালে। এতে ফাইবার অপটিক কেব্‌ল ব্যবহার করেন তাঁরা। এতে রেকর্ড সৃষ্টি হয়। (কেলটির দৈর্ঘ্য ছিল ৮০০ মিটার। দানিয়ুব নদীর তলদেশের নগরের পয়োনিষ্কাশন সিস্টেমের নিচ দিয়ে নেওয়া হয়েছিল কেব্‌লটা। নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়েছিলেন প্রেরক আর আরেক পাড়ে ছিলেন গ্রাহক।

এ পরীক্ষার একটা সমালোচনা হলো, এগুলো আলোর ফোটন দিয়ে চালানো হয়েছে। তাই সায়েন্স ফিকশনে দেখানো টেলিপোর্টেশনের ধারেকাছেও নেই এগুলো। তবে আরেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ২০০৪ সালে। সেবার কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন করা হয় আলোর কণা ফোটন দিয়ে নয়, সত্যিকার আস্ত এক পরমাণু দিয়ে। এর মাধ্যমে বাস্তবসম্মত টেলিপোর্টেশনের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেকনোলজির পদার্থবিদেরা সফলভাবে তিনটি বেরিলিয়াম পরমাণু এনট্যাঙ্গেলড করেন। এরপর এদের একটা পরমাণুর ধর্ম আরেকটিতে স্থানান্তর করতেও পেরেছেন তাঁরা।

২০০৬ সালে আরেকটি বিস্ময়কর অগ্রগতি দেখা গেল। এবার প্রথম একটি মাইক্রোস্কোপিক বস্তু টেলিপোর্ট করা হয়। কোপেনহেগেনের নীলস বোর ইনস্টিটিউট ও জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের পদার্থবিদেরা এক আলোকরশ্মির সঙ্গে সিজিয়াম পরমাণুর গ্যাসের এনট্যাঙ্গেল করতে সক্ষম হন। গ্যাসে ছিল কয়েক ট্রিলিয়ন পরমাণু। পরে তারা লেজার পালসের ভতরের তথ্য এনকোড করতে ও সে তথ্য প্রায় অর্ধগজ দূরে সিজিয়াম পরমাণুতে টেলিপোর্ট করেন। কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন দলের অন্যতম গবেষক ইউজিন পলজিক বলেন, ‘প্রথমবারের মতো আলো বা তথ্যের বাহক ও পরমাণুর মধ্যে এটি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।’

এনট্যাঙ্গেলমেন্ট ছাড়া টেলিপোর্টেশন

টেলিপোর্টেশনের উন্নয়ন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আরেকটি বড় ধরনের সফলতা পাওয়া গেছে ২০০৭ সালে। পদার্থবিদেরা নতুন আরেকটি টেলিপোর্টেশনের উপায়ের কথা বলেছেন, যেখানে এনট্যাঙ্গেলমেন্টের কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা জানি, এনট্যাঙ্গেলমেন্ট হলো কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের সবচেয়ে কঠিন একটা ধর্ম। এই সমস্যা সমাধান করতে পারলে টেলিপোর্টেশনে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হবে আমাদের সামনে।

‘আমরা এমন একটা রশ্মির কথা বলছি, যেখানে প্রায় ৫০০০ কণা এক জায়গা থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে আর তারপর অন্য কোথাও সেগুলো আবার দেখা যাবে।’ এ কথা বলেছেন অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনের অস্ট্রেলিয়ান রিসার্চ কাউন্সিল সেন্টার অব এক্সেসেলেন্স ফর কোয়ান্টাম অ্যাটম অপটিকসের পদার্থবিদ অ্যাস্টন ব্র্যাডলি। টেলিপোর্টেশনের নতুন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণায় পথিকৃৎ তিনি।

তাঁর দাবি, ‘মনে হয়, আমাদের পরিকল্পনাটি বিজ্ঞান কল্পগল্পের ধারণার মূলনীতির অনেক কাছে।’ তাদের পদ্ধতিতে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা রুবিডিয়াম পরমাণুগুচ্ছের একটা রশ্মি নেন। আসলে এখানে পরমাণুগুচ্ছের সব তথ্য আলোকরশ্মিতে রূপান্তরিত করা হয়। এরপর এক ফাইবার অপটিক কেবলের ভেতর দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এই আলোকরশ্মি। দূরবর্তী কোনো জায়গায় তারপর পরমাণুগুচ্ছের আসল রশ্মিটিকে নির্মাণ করা হয় নতুন করে। তার দাবি সত্য হলে, পদ্ধতিটি টেলিপোর্টেশনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে দিতে পারবে। সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে বড় বস্তুর জন্যও টেলিপোর্টেশনের সম্পূর্ণ নতুন পথ খুলে দেবে।

কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন থেকে আলাদা করতে ড. ব্র্যাডলি নতুন এ পদ্ধতির নাম দিয়েছেন ক্ল্যাসিকেল টেলিপোর্টেশন। (এতে ভুল-বোঝাবুঝি হতে পারে। কারণ, পদ্ধতিটি কোয়ান্টাম তত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল হলেও এনট্যাঙ্গেলমেন্টের ওপর নির্ভর করে না। )

অভিনব এ টেলিপোর্টেশনের মূল চাবিকাঠি পদার্থের নতুন এক অবস্থা, যাকে বলে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট বা বিইসি (বা বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন)। পুরো মহাবিশ্বে এটি অন্যতম শীতলতম বস্তু। প্রকৃতিতে সবচেয়ে শীতল তাপমাত্রা দেখা যায়, মহাকাশের বাইরে। আর তার তাপমাত্রা পরম শূন্যের ওপরে ৩ কেলভিন। (মহাবিস্ফোরণের অবশিষ্ট থেকে যাওয়া উত্তাপের কারণে মহাকাশের তাপমাত্রা এ রকম। এই অবশিষ্টাংশ এখনো পুরো মহাবিশ্ব ডুবে আছে।) তবে বিইসির তাপমাত্রা পরম শূন্য তাপমাত্রার ওপরে ১ ডিগ্রির ১ মিলিয়ন থেকে ১ বিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ মাত্র। এমন তাপমাত্ৰা শুধু গবেষণাগারেই সৃষ্টি করা সম্ভব।

নির্দিষ্ট ধরনের বস্তুকে পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি ঠান্ডা করা হলে তাদের পরমাণুগুলো সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে ভেঙে পড়ে বা জবুথবু হয়ে পড়ে। সে কারণে তাদের সবগুলো পরমাণু একই ঐকতানে কম্পিত হতে থাকে ও পরস্পর সংসক্ত হয়। সবগুলো পরমাণুর ওয়েভ ফাংশন একই হওয়ার কারণে এক অর্থে একটা বিইসি আচরণ অনেকটা বিশাল কোনো সুপার অ্যাটম বা অতিপরমাণুর মতো। এখানে প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন পরমাণুই ঐকতানে কম্পিত হয়। পদার্থের এই অদ্ভুতুড়ে অবস্থাটির কথা আইনস্টাইন ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু অনুমান করেছিলেন সেই ১৯২৫ সালে। তবে পরবর্তী ৭০ বছরেও গবেষণাগারে বানানো সম্ভব হয়নি এটি। অবশেষে ১৯৯৫ সালে সেটি এমআইটি ও কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে বানানো সম্ভব হয়।

ব্র্যাডলি ও তাঁর সহযোগীদের টেলিপোর্টেশন যন্ত্রটি কীভাবে কাজ করে, সেটিই বলছি এবার। প্রথমে তারা অতিশীতল একগুচ্ছ রুবিডিয়াম পরমাণুকে বিইসি অবস্থায় নিয়ে যান। এরপর তাঁরা এই বিইসিতে একটা বস্তুর বিম প্রয়োগ করেন (সেটিও রুবিডিয়াম পরমাণু দিয়ে তৈরি)। বিমের এসব পরমাণুও চলে যেতে চায় সবনিম্ন শক্তিস্তরে। সে জন্য তাদের অতিরিক্ত শক্তি আলোর কম্পন হিসেবে ঝেড়ে ফেলে তারা। এই আলোর বিমকে এরপর একটা ফাইবার অপটিক কেবলে পাঠানো হয়। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এই আলোকরশ্মিতে আসল বস্তুর বিমের সব কটি দরকারি কোয়ান্টাম তথ্য থাকে। (যেমন তার সবগুলোর পরমাণুর অবস্থান ও ভরবেগ)। এবার আলোকরশ্মি আরেকটি বিইসিকে আঘাত করে, সেটি এরপর আলোকরশ্মিকে আসল বস্তুর বিমে রূপান্তরিত করে।

নতুন এ টেলিপোর্টেশন পদ্ধতির সম্ভাবনা বিপুল। কারণ এর সঙ্গে এনট্যাঙ্গেলমেন্টের কোনো সম্পর্ক নেই। তবু এ পদ্ধতিরও কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। এটি বিইসির ধর্মের ওপর চরমভাবে নির্ভরশীল, আর একে ল্যাবরেটরিতে বানানো খুব কঠিন। বিইসির ধর্মও বেশ অদ্ভুত। কারণ, তারা এমন আচরণ করে যেন সবগুলো মিলে অতিদানবীয় একটিমাত্র পরমাণু। তাত্ত্বিকভাবে শুধু পারমাণবিক পর্যায়ে দেখতে পাওয়া অদ্ভুত কোয়ান্টাম ইফেক্টও খালি চোখে দেখা যায় বিইসিতে। অথচ একসময় এটি অসম্ভব বলে ভাবা হতো।

অ্যাটমিক বা পারমাণবিক লেজার বানাতে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট বা বিইসির প্রত্যক্ষভাবে কাজে লাগে। নিঃসন্দেহে ঐকতানে কম্পিত একগুচ্ছ ফোটনের সংসক্তের ওপর নির্ভরশীল লেজার। কাজেই বিইসি পরমাণুদের এমন বিমও তৈরি করা সম্ভব, যারা সবাই সংসক্ত। অন্য কথায়, কোনো বিইসি লেজারের প্রতিরূপ তৈরি করতে পারে, পারমাণবিক লেজার বা বস্তুর লেজার, যা বিইসি পরমাণু দিয়ে তৈরি। লেজারের বাণিজ্যিক ব্যবহার ব্যাপক। পারমাণবিক লেজারের বাণিজ্যিক ব্যবহারও সম্ভাবনাময়। বিইসি যেহেতু শুধু পরম শূন্য তাপমাত্রার সামান্য ওপরে থাকে, তাই ক্ষেত্রটির অগ্রগতি স্থিতিশীল হলেও খুব ধীরগতির।

এসব অগ্রগতির পর, আমরা কবে নিজেদের টেলিপোর্ট করতে পারব? পদার্থবিদদের আশা জটিল অণুর টেলিপোর্ট আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সম্ভব। এরপর ডিএনএ অণু কিংবা ভাইরাসও টেলিপোর্ট করা সম্ভব হবে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে। সায়েন্স ফিকশন মুভির মতোই সত্যিকার কোনো মানুষ টেলিপোর্টে কোনো তাত্ত্বিক বাধা নেই। তবে এ ক্ষেত্রে যান্ত্রিক যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে, সেগুলো সত্যিই বিস্ময়কর। আলোর ফোটন ও নির্দিষ্ট পরমাণুদের মধ্যে সংসক্তি তৈরি করতে বিশ্বের সবচেয়ে ভালো ও সূক্ষ্ম মানসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞান গবেষণাগার প্রয়োজন। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না, মানুষের মতো সত্যিকার কোনো ম্যাক্রোস্কোপিক বস্তুর কোয়ান্টাম কোহেরেন্স তৈরি করতে আরও অনেক দিন লেগে যাবে। হয়তো তার জন্য লাগবে আরও কয়েক শতাব্দী বা তার চেয়েও বেশি দিন। আমাদের চারপাশের দৈনন্দিন বস্তুদের আদৌ যদি টেলিপোর্ট করা সম্ভব হয়, তারপরই কেবল এটা সম্ভব হতে পারে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার

মোদ্দাকথা হলো, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের উন্নয়নের সঙ্গে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। দুটি ক্ষেত্রে একই কোয়ান্টাম ফিজিকস ও একই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। তাই এ দুটি ক্ষেত্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার হয়তো একদিন আমাদের টেবিলে বসে থাকা পরিচিত ডিজিটাল কম্পিউটারকে হটিয়ে দেবে। সত্যি বলতে কি, ভবিষ্যতের অর্থনীতি হয়তো নির্ভর করবে এ রকম কম্পিউটারের ওপর। কাজেই এ প্রযুক্তিতে ব্যাপক বাণিজ্যিক আগ্রহ রয়েছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার থেকে আসা নতুন প্রযুক্তির কারণে সিলিকন ভ্যালি ভবিষ্যতে জং ধরা পরিত্যক্ত একটি এলাকায় পরিণত হতে পারে।

সাধারণ কম্পিউটার গণনা করে ০ ও ১-এর বাইনারি সিস্টেম ব্যবহার করে। এই ০ ও ১-কে বলা হয় বিটস। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। তারা কিউবিটসে গণনা করতে পারে। কিউবিটস ০ থেকে ১-এর মাঝখানের মানগুলো নিয়ে কাজ করতে পারে। একটা চুম্বকীয় ক্ষেত্রে থাকা পরমাণুর কথা কল্পনা করুন। এটি একটা লাটিমের মতো ঘুরছে। কাজেই ঘূর্ণন অক্ষকে আপ অথবা ডাউন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান বলে, পরমাণুর স্পিন হয় আপ হবে অথবা ডাউন হবে—দুটোই একই সঙ্গে হতে পারে না। কিন্তু কোয়ান্টাম জগৎ বড় অদ্ভুত। পরমাণুটিকে ওই দুটি অবস্থার যোগফল বলা হয়। অর্থাৎ একটা পরমাণুর আপ স্পিন ও ডাউন স্পিনের যোগফল। কোয়ান্টামের অধোভুবনে প্রতিটি বস্তুকে সবগুলো সম্ভাব্য অবস্থার যোগফল হিসেবে বর্ণনা করা হয়। (বিড়ালের মতো বড় বস্তুকে এই কোয়ান্টাম কায়দায় বর্ণনা করা হয়। এর অর্থ হলো, একটা জীবন্ত বিড়ালের ওয়েভ ফাংশনের সঙ্গে একটা মৃত বিড়ালের ওয়েভ ফাংশন যোগ করতে হবে। তাতে বিড়ালটির অবস্থা হবে মৃতও নয় আবার জীবিতও নয়। এ বিষয়ে ১৩ অধ্যায়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।)

এখন কল্পনা করুন, পরমাণুর একটি ঝাঁক একটা চুম্বকীয় ক্ষেত্রে সারিবদ্ধ হয়ে আছে, যাদের স্পিনও একই ছন্দে সারিবদ্ধ। একটি লেজার বিম যদি পরমাণুর এই ঝাঁকের ওপর ফেলা হয়, তাহলে লেজার বিমটি পরমাণুর ঝাঁকের ওপর লাফিয়ে উঠবে। তাতে কিছু পরমাণুর ঘূর্ণন অক্ষ ঘুরে যাবে। ভেতরে আসা ও বাইরে যাওয়া লেজার বিমের পার্থক্য মেপে, আমরা একটি জটিল কোয়ান্টাম গণনা করি, যার সঙ্গে অনেক ঘূর্ণনের পাল্টে যাওয়া জড়িত।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার এখনো তাদের শৈশব অবস্থাতেই রয়ে গেছে। কোয়ান্টাম কম্পিটেশনে এ পর্যন্ত বিশ্ব রেকর্ড হলো 3×5=15, যা বর্তমানের সুপারকম্পিউটারকে হটিয়ে দেওয়ার জন্য একেবারে শিশুতোষ। কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন ও কোয়ান্টাম কম্পিউটার উভয়ের একই রকম গুরুতর একটা দুর্বলতা রয়ে গেছে। সেটা হলো বিপুলসংখ্যক পরমাণুর কোহেরেন্স বা সংসক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এই সমস্যা সমাধান করা গেলে দুটো ক্ষেত্রের জন্য সেটা বড় ধরনের ঘটনা বলে বিবেচিত হবে।

সিআইএ ও অন্যান্য গুপ্ত সংগঠনগুলো কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ব্যাপারে ব্যাপকভাবে আগ্রহী। বিশ্বের অনেক গুপ্ত কোড একটি কি-এর ওপর নির্ভরশীল, যা বড় একটি পূর্ণ সংখ্যা হয়। এই কিয়ের ফ্যাক্টর করে তাকে মৌলিক সংখ্যায় নিয়ে আসার ক্ষমতার ওপর এটি নির্ভর করে। কি সংখ্যাটি যদি দুটি সংখ্যার গুণফল হয়, যাদের প্রতিটি ১০০ অঙ্কের, তাহলে এ দুটি ফ্যাক্টরকে খুঁজে বের করতে ডিজিটাল কম্পিউটারের লেগে যেতে পারে এক শ বছরের বেশি সময়। এ রকম কোড এখন অপরিহার্যভাবে শক্তিশালী হতে হয়।

তবে বেল ল্যাবের পিটার শোর ১৯৯৪ সালে দেখিয়েছেন, বড় সংখ্যা ফ্যাক্টর করা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য ছেলেখেলা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এই আবিষ্কার বেশ দ্রুতই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের আগ্রহ জাগিয়ে তুলবে। তাত্ত্বিকভাবে একটা কোয়ান্টাম কম্পিউটার বিশ্বের সব কোড ভেঙে ফেলতে পারবে। সেই সঙ্গে বর্তমানে প্রচলিত কম্পিউটারের নিরাপত্তাকে পুরোপুরি বিশৃঙ্খলার মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিতে পারবে। প্রথম যে দেশ এ ধরনের সিস্টেম গড়ে তুলতে পারবে, তারাই অন্যান্য দেশ ও সংগঠনের অতি গোপনীয়তা উদ্‌ঘাটন করে ফেলতে পারবে।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, ভবিষ্যতে বিশ্বের অর্থনীতি হয়তো কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ওপর নির্ভর করবে। সিলিকনভিত্তিক ডিজিটাল কম্পিউটার একসময় সর্বশেষ ভৌত সীমায় পৌঁছাবে। কম্পিউটারের শক্তি বাড়ার ভিত্তিতে এ ঘটনা ২০২০ সালের কিছু পরেই ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রযুক্তিকে ক্রমান্বয়ে আরও সামনে এগিয়ে নিতে চাইলে তাই নতুন ও আরও শক্তিশালী কম্পিউটারের প্রয়োজন হবে। অনেকে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে মানবমস্তিষ্কের শক্তি পুনরুৎপাদনের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখছেন।

তাই এর জন্য পুরস্কারও রয়েছে অনেক উচ্চ মূল্যের। সংসক্তি-সংক্রান্ত সমস্যাটি সমাধান করা গেলে আমরা টেলিপোর্টেশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারব। শুধু তা-ই নয়, একই সঙ্গে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে হয়তো অপ্রত্যাশিত উপায়ে সব ধরনের উন্নত প্রযুক্তিরও অধিকারী হতে পারব আমরা। আমাদের জন্য এগুলো অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সে কারণে শেষ অধ্যায়ে এ ব্যাপারে আবারও আলোচনা করব আমি।

আগেও বলেছি, ল্যাবে সংসক্তি নিয়ন্ত্রণ করা অতিমাত্রায় কঠিন। ক্ষুদ্রতম কম্পনও দুটি পরমাণুর সংসক্তি নষ্ট করতে পারে ও কম্পিউটেশন ধ্বংস করে দিতে পারে। বর্তমানে গুটি কয়েকের বেশি পরমাণুর সংসক্তি বজায় রাখা খুব কঠিন। আসলে ন্যানোসেকেন্ডের মধ্যে বা সর্বোচ্চ ১ সেকেন্ডের মধ্যে পরমাণুর সংসক্তি নষ্ট হতে শুরু করে। তাই টেলিপোর্টেশন অবশ্যই খুব দ্রুত ঘটাতে হবে, বা পরমাণুদের সংসক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগেই। এটিই কোয়ান্টাম কম্পিউটার ও টেলিপোর্টেশনের ক্ষেত্রে আরেক সীমাবদ্ধতা।

এসব চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড ডুসের বিশ্বাস, এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। তিনি বলেন, ‘ভাগ্য ভালো থাকলে আর সাম্প্রতিক তাত্ত্বিক অগ্রগতির সহায়তা নিয়ে [একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার] হয়তো ৫০ বছরের কম সময় লাগবে। এটি হবে প্রকৃতিকে পোষ মানানোর সম্পূর্ণ নতুন উপায়।’

একটি কার্যকরী কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানাতে আমাদের কয়েক মিলিয়ন পরমাণুকে একই ঐকতানে কম্পিত করতে হবে। সেটি করা এখন আমাদের বর্তমানের ক্ষমতার বাইরে। ক্যাপ্টেন কার্ককে টেলিপোর্ট করা হয়তো ভীষণ কঠিন হবে। আমাদের হয়তো কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলমেন্টের সঙ্গে ক্যাপ্টেন কার্কের যমজ বানাতে হবে। এমনকি এটি কীভাবে সম্পন্ন করা যেতে পারে, তা ন্যানোটেকনোলজি ও উন্নত কম্পিউটার দিয়ে দেখাটাও অনেক কঠিন।

কাজেই টেলিপোর্টেশন এখনো পারমাণবিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। আমরা হয়তো ক্রমান্বয়ে জটিল ও জৈব অণুও টেলিপোর্ট করতে পারব আগামী কয়েক দশকের মধ্যে। কিন্তু বড় ধরনের বস্তুর টেলিপোর্টেশন সত্যি সত্যি কখনো করা সম্ভব হলেও তার জন্য কয়েক দশক থেকে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত কিংবা তারও চেয়ে বেশি সময় অপেক্ষায় থাকতে হতে পারে। কাজেই জটিল অণু বা ভাইরাস বা জীবন্ত কোষ টেলিপোর্ট করাকে প্রথম শ্রেণির অসম্ভাব্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এর মানে, এটা এমন ধরনের অসম্ভব ঘটনা, যা হয়তো এই শতাব্দীর মধ্যেই সম্ভব করে তোলা যাবে। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মানুষকে টেলিপোর্ট করা অনুমোদন করলেও তার জন্য লেগে যেতে পারে কয়েক শতাব্দী বা তার চেয়েও বেশি সময়। তবে ধরে নেওয়া যায়, ভবিষ্যতের কোনো একদিন হয়তো এটা করা সম্ভব। তাই এ ধরনের টেলিপোর্টেশনকে আমি দ্বিতীয় শ্রেণির অসম্ভাব্যতা হিসেবে চিহ্নিত করেছি।

তথ্যনির্দেশ

টেলিপোর্টেশনের বাস্তব চিত্র : সায়েন্স ফিকশন মুভির মতো সত্যিকার কোনো মানুষকে টেলিপোর্ট করার ব্যাপারে কোনো তাত্ত্বিক বাধা না থাকলেও এ ক্ষেত্রে কঠিন সব যান্ত্রিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। একটি হিসাব দিলে বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যাবে। হিসাবে দেখা গেছে, সামান্য এককোষী একটি ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ায় পরমাণুর সংখ্যা ৯×১০১০। মানুষের দেহে কোষের পরিমাণ প্রায় ৩২ ট্রিলিয়ন (৩২-এর পর ১২টি শূন্য)। হিসাবটা বুঝতে সুবিধা হবে, যদি বলি, আমাদের এখন পর্যন্ত জানা মহাবিশ্বে যে পরিমাণ নক্ষত্র আছে, তার চেয়ে মানুষের দেহের কোষ ৩১২ ট্রিলিয়ন বেশি। একটি কোষে যদি ব্যাকটেরিয়ার সমান পরমাণু থাকে, তাহলে মানুষের দেহের মোট পরমাণুর সংখ্যা হিসাব করে দেখুন। যুক্তরাজ্যের লেচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ টেলিপোর্ট করতে গেলে তার প্রতিটি কোষ ভেঙে ডেটায় রূপান্তর করলে তার পরিমাণ হবে প্রায় ২৬×১০৪২ বিট। ফাইবার অপটিক কেবলে এ বিপুল ডেটা পাঠাতে দরকার অতিশক্তিশালী ব্যান্ডউইড আর ১০ ট্রিলিয়ন গিগাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎশক্তি। মজার ব্যাপার হলো, এই শক্তি দিয়ে পুরো যুক্তরাজ্যে ১০ লাখ বছর বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে। এভাবে আস্ত একটা মানুষ টেলিপোর্ট করতে লাগবে কয়েক কোটি বছর।

ম্যাক্রোস্কোপিক : খালি চোখে দেখার জন্য যথেষ্ট বড় কোনো বস্তু। সাধারণত ০.০১ মিলিমিটারের নিচের স্কেলে ব্যবহার করা হয়। এই আয়তনের নিচের স্কেলগুলোকে বলা হয় মাইক্রোস্কোপিক বা অতিক্ষুদ্র।

স্পিন বা ঘূর্ণন : মৌলিক কণাদের অভ্যন্তরীণ ধর্ম। দৈনন্দিন ঘূর্ণন ধারণার সঙ্গে এটি সম্পর্কিত, তবে তা পুরোপুরি এক রকম নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *