১১. আলোর গতি ছাড়িয়ে

১১. আলোর গতি ছাড়িয়ে

খুব সহজেই বোঝা যায়, প্রাণ শেষ পর্যন্ত ছায়াপথ পেরিয়ে আরও দূরে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে প্রাণ এখন মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র ও অগুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে থাকলেও চিরকাল যে এভাবেই থাকবে এমনটা নাও হতে পারে। সত্যি বলতে কী, আমার কাছে একে খুব জোরালো মত বলে মনে হয়।

—অ্যাস্ট্রোনোমার রয়েল স্যার মার্টিন রিস

আলোর চেয়ে বেশি বেগে ভ্রমণ করা অসম্ভব। নিঃসন্দেহে তা প্রত্যাশিতও নয়। কারণ, তাহলে মাথার হ্যাট বাতাসে উড়ে যাবে।

—উডি অ্যালেন

স্টার ওয়ার্স মুভিতে দেখা যায়, ট্যাটুনি নামের ঊষর এক গ্রহ থেকে মিলেনিয়াম ফ্যালকন নভোযান উৎক্ষেপিত হয়ে আমাদের নায়ক লুক স্কাইওয়াকার আর হ্যান সোলোকে বহন করে আনে। কিন্তু গ্রহটির কক্ষপথে ওত পেতে ঘুরছিল শত্রুপক্ষের ইম্পেরিয়াল যুদ্ধজাহাজের এক ভয়ানক সেনাদল। তাদের সঙ্গে ভয়াবহ সংঘর্ষে লিপ্ত হয় নভোজাহাজটি। এম্পায়ারের যুদ্ধজাহাজ একঝাঁক লেজার বিস্ফোরক ছুড়েছিল আমাদের নায়কদের নভোজাহাজ লক্ষ্য করে। নভোযানের বলক্ষেত্রে এসে ক্রমান্বয়ে ভেঙে পড়ে সেগুলো। এভাবে কোনোমতে বেঁচে পালাতে সক্ষম হয় মিলেনিয়াম ফ্যালকন।

বিধ্বংসী লেজার বিস্ফোরণের মুখে স্রেফ ভস্ম হওয়ার উপক্রম হয় নভোযানটি। তখন হ্যান সলো চিৎকার করে বলে ওঠে, তাদের বাঁচার একমাত্র আশা হলো হাইপারস্পেসে ঝাঁপ দেওয়া। তার কথা শেষ হতে না হতেই চোখের পলকে গর্জে ওঠে হাইপারড্রাইভ ইঞ্জিন। চারপাশের সব নক্ষত্র সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভিউ স্ক্রিনের কেন্দ্রের দিকে সংকুচিত হয়ে একত্র হতে থাকে। নিমেষেই দৃষ্টি আচ্ছন্নকারী আলোর গুচ্ছে পরিণত হয় সেগুলো। এরপর শিগগিরই এক গর্ত খুলে যায়। তার মধ্য দিয়ে মিলেনিয়াম ফ্যালকন গুরুগম্ভীর গর্জন করতে করতে দ্রুতবেগে চলতে থাকে। এরপর তা হাইপারস্পেসে পৌঁছে মুক্ত হয়।

এটি কি বিজ্ঞান কল্পকাহিনি? নিঃসন্দেহে তাই। বৈজ্ঞানিক কোনো সত্যের ওপর ভিত্তি করে এ রকম কি ঘটা সম্ভব? হয়তো, পারে। আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলাচল করা বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে সব সময়ই জলভাতের মতো ব্যাপার ছিল। তবে সম্প্রতি এ সম্ভাবনা নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন পদার্থবিদেরাও।

আইনস্টাইনের কথামতো, আলোর বেগই হলো আমাদের মহাবিশ্বের চূড়ান্ত গতিসীমা। এমনকি আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী কণা ত্বরকযন্ত্রও অতিপারমাণবিক কোনো কণাকে আলোর চেয়ে বেশি গতিতে ছুড়ে দিতে পারে না। অ্যাটম স্ম্যাশার বা কণা ত্বরকযন্ত্র যে শক্তি তৈরি করে, তা শুধু বিস্ফোরণোন্মুখ নক্ষত্রের কেন্দ্রে বা মহাবিস্ফোরণের সময় মিলতে পারে। সব দেখে মনে হয়, আলোর বেগই আমাদের মহাবিশ্বের চূড়ান্ত ট্রাফিক পুলিশ। যদি তা-ই হয়, তাহলে বহু দূরের কোনো ছায়াপথে যাওয়ার কোনো আশাই আর থাকে না।

কিন্তু তা যদি না হয়…

ব্যর্থ আইনস্টাইন

আইজ্যাক নিউটনের পর তরুণ পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইনই যে সেরা পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে বিশ্বব্যাপী সুনাম কুড়াবেন, সেটা ১৯০২ সালে কল্পনাও করা যেত না। আসলে ওই বছরটি ছিল আইনস্টাইনের জীবনে সবচেয়ে বাজে সময়। সদ্য পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থী হিসেবে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরির আবেদন করেন তিনি। কিন্তু একে একে সব কটি জায়গা থেকে প্রত্যাখ্যাত হন। (পরে তিনি আবিষ্কার করেন, তাঁকে সুপারিশ করে তাঁর শিক্ষক প্রফেসর হেনরিক ওয়েবার বিভিন্ন জায়গায় ভয়ানক সব চিঠি পাঠিয়েছেন। সম্ভবত তাঁর ক্লাস বাদ দেওয়ার কারণে আইনস্টাইনের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে এটি করেছিলেন তিনি।) এদিকে তাঁর বান্ধবী মেলিভা মেরিকের চরম বিরোধিতা শুরু করেছিলেন আইনস্টাইনের মা। অথচ মিলেভার গর্ভে তখন আইনস্টাইনের সন্তান। তাঁদের প্রথম সন্তান লিসেরেল একসময় জারজ হয়েই জন্ম নেবে।

তরুণ আলবার্ট যেসব ঠিকা চাকরি জোগাড় করেছিলেন, সেগুলোতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছিলেন। এমনকি অতি স্বল্প বেতনে পড়ানোর কাজ থেকেও তাঁকে হঠাৎ ছাঁটাই করা হয়েছিল। এ সময় তিনি জীবন ধারণের জন্য সেলসম্যানের কাজ নেওয়ার কথাও চিন্তা করেছিলেন। সে সময় লেখা বিষণ্ণ কিছু চিঠিপত্রে এসবের উল্লেখ আছে। এমনকি নিজের পরিবারকে তিনি এমনও লিখেছেন, তাঁর জন্ম না হলেই বোধ হয় ভালো হতো। কারণ, তখন নিজের পরিবারেও নিজেকে স্রেফ একটা বোঝা বলে ভাবতে শুরু করছিলেন তিনি। জীবনে কোনো সফলতার মুখ দেখতে না পেয়ে এমন মন্তব্য করেন আইনস্টাইন। বাবা মারা যাওয়ার পর, তিনি বেশ লজ্জা পান। লজ্জার পেছনে ভাবনাটি ছিল, নিজের সন্তানকে পুরোপুরি ব্যর্থ মনে করে মারা গেলেন তাঁর বাবা।

তবে এর পরের বছর আইনস্টাইনের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে। সুইস পেটেন্ট অফিসে তাঁর জন্য একটা ক্লার্কের চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন তাঁরই এক বন্ধু। এরপর এই সবচেয়ে বাজে অবস্থা থেকে আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপ্লবের জন্ম দেবেন আইনস্টাইন। তাঁর টেবিলে জমা হওয়া পেটেন্টগুলো তিনি খুব দ্রুত বিশ্লেষণ করতে পারবেন। তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা পদার্থবিদ্যার সমস্যা নিয়ে মগ্ন থাকবেন, যেগুলো ছোটবেলা থেকেই ধাঁধার মধ্যে ফেলেছিল তাঁকে।

তাঁর প্রতিভার গোপন রহস্য কী? বিশুদ্ধ গণিতের বদলে ভৌত ছবির (যেমন চলমান ট্রেন, ত্বারিত ঘড়ি, প্রসারিত চাদর) মাধ্যমে চিন্তা করার ক্ষমতা ছিল আইনস্টাইনের। এটি হয়তো তাঁর প্রতিভার একটি ব্লু হতে পারে। আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, কোনো শিশুর কাছে কোনো তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে না পারলে সে তত্ত্ব সম্ভবত অর্থহীন, অকেজো। বা যেকোনো তত্ত্বের নির্যাস অবশ্যই ভৌত ছবির মাধ্যমে বর্ণনা করতে হবে। বেশির ভাগ পদার্থবিদ কঠিন গণিতের মধ্যে হাবুডুবু খান, যা তাদের কোনো পথের নির্দেশনা দেয় না। তবে পূর্বসূরি নিউটনের মতো আইনস্টাইনও ভৌত ছবির প্রতি আসক্ত ছিলেন। গাণিতিক বিষয়গুলো আসবে আরও পরে। নিউটনের ক্ষেত্রে ভৌত ছবিখানি ছিল পড়ন্ত আপেল ও একখানি চাঁদ। একটি আপেলকে যে বল মাটিতে ফেলছে, সেই একই বল কি চাঁদকে কক্ষপথে ধরে রাখে? একসময় নিউটন বুঝতে পারলেন, এর উত্তর হ্যাঁ। তখন মহাবিশ্বের জন্য একটি গাণিতিক নকশা প্রণয়ন করলেন তিনি। সেটি হঠাৎ মহাকাশে লুকিয়ে থাকা চরম সব রহস্য উন্মোচন করে বসল। গ্রহগুলোর গতিপথের রহস্য উন্মোচিত হলো এভাবে।

আইনস্টাইন ও আপেক্ষিকতা

আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা বিশেষ আপেক্ষিকতার প্রকাশ করেন ১৯০৫ সালে। তাঁর তত্ত্বটির মর্মমূলে ছিল একটি ছবি, যা যেকোনো শিশুও বুঝতে পারে। আসলে তাঁর তত্ত্বটি ছিল একটি অলীক কল্পনার উপসংহার। ১৬ বছর বয়সে কল্পনাটি করেন তিনি। ওই কিশোর বয়সে তিনি এক ভাগ্যনির্ধারণী প্রশ্ন করেন। তাঁর প্রশ্নটি ছিল : একটা আলোকরশ্মির পিঠে চড়ে বসলে কী ঘটবে? তরুণ বয়সে তিনি জানতেন, নিউটনের বলবিদ্যা পৃথিবীর ও মহাকাশের বিভিন্ন বস্তুর গতির ব্যাখ্যা দেয়। অন্যদিকে ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে আলো। সেকালে এ দুটিই ছিল পদার্থবিদ্যার দুটি ভিত্তি স্তম্ভ।

আইনস্টাইনের প্রতিভার মূল সারবত্তা হলো, এই ভিত্তি দুটি যে পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তা একসময় ঠিকই বুঝে ফেলেন তিনি। কাজেই দুটোর যেকোনো একটাকে সরে দাঁড়াতেই হবে।

নিউটনের তত্ত্বমতে, আপনি দৌড়ে সব সময় কোনো আলোকরশ্মিকে ছাড়িয়ে যেতে পারবেন। কারণ, আলোর গতিতে বিশেষ কোনো ব্যাপার নেই। এর মানে, আপনি যদি কোনো আলোকরশ্মির পাশে আলোর গতিতে দৌড়াতে থাকেন, তাহলে আপনার পাশে আলো স্রেফ স্থির হয়ে দেখা দেবে। কিন্তু একজন তরুণ পদার্থবিদ হিসেবে আইনস্টাইন বুঝতে পারেন, পুরো স্থির অবস্থায় বা জমাট তরঙ্গ হিসেবে কেউই কখনো কোনো আলো তরঙ্গ দেখেনি। তাই তিনি সিদ্ধান্তে এলেন, নিউটনের তত্ত্ব এ ক্ষেত্রে সঠিক কথা বলে না।

জুরিখে কলেজশিক্ষার্থী হিসেবে ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব পড়তে গিয়ে অবশেষে কৈশোরে জাগা প্রশ্নের উত্তর পান আইনস্টাইন। এভাবে তিনি এমন কিছু আবিষ্কার করে বসলেন, খোদ ম্যাক্সওয়েলও যেটি নিশ্চিত ছিলেন না। সেটি হলো : আলোর গতি ধ্রুব। মানে আপনি কত জোরে দৌড়াচ্ছেন, তার ওপর কখনো আলোর গতি নির্ভর করে না। আপনি যদি আলোর দিকে বা আলো থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন, তারপরও আলো একই বেগে চলবে। কিন্তু এই উপলব্ধি আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের সঙ্গে মেলে না। আইনস্টাইন তাঁর কৈশোরে মাথায় জাগা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলেন : আপনি কখনোই কোনো আলোকরশ্মির পাশে দৌড় প্রতিযোগিতায় নামতে পারবেন না। কারণ, আলো সব সময় আপনার কাছ থেকে এক নির্দিষ্ট ধ্রুবগতিতে চলে। আপনি কত জোরে দৌড়াচ্ছেন, তা একে প্রভাবিত করে না।

কিন্তু নিউটনের বলবিদ্যা কঠিনভাবে সংরক্ষিত এক সিস্টেমের মধ্যে ছিল। আপনি যদি এর অনুমানে সামান্য পরিবর্তন করেন, তাহলে ঢিলা কোনো সুতাকে টানার মতো পুরো তত্ত্বটিই ভেঙে পড়তে পারে। নিউটনের তত্ত্বে মহাবিশ্বজুড়ে সময়ের পথ সুষম। পৃথিবীর এক সেকেন্ড হুবহু শুক্র বা মঙ্গল গ্রহে এক সেকেন্ড। একইভাবে, পৃথিবীতে মিটারের দণ্ড রাখলে যে দৈর্ঘ্য পাওয়া যাবে, প্লুটোতেই তা-ই হবে। কিন্তু আলোর গতি সব সময় ধ্রুব হলে আর আপনার বেগের ওপর তা নির্ভর না করলে স্থান ও কাল নিয়ে আমাদের উপলব্ধিতে বড় ধরনের একটা পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে। স্থান ও কালের গভীর বিকৃতি ঘটবে যদি আলোর গতিকে ধ্রুব রাখতে হয়।

আইনস্টাইনের মতে, আপনি যদি কোনো রকেট শিপের গতি বাড়ান, তাহলে রকেটের ভেতরে সময়ের গতিপথ পৃথিবীর সাপেক্ষে ধীরগতির হতে হবে। সময়ও স্পন্দিত হবে ভিন্ন হারে। সেটি নির্ভর করবে আপনি কত দ্রুত চলছেন। আবার রকেট শিপের ভেতরের স্থানও সংকুচিত হয়ে যাবে। কাজেই আপনার গতির ওপর ভিত্তি করে মিটার দণ্ডের দৈর্ঘ্যও যাবে বদলে। আবার রকেটের ভরও বেড়ে যাবে একইভাবে। ওই রকেটের ভেতরটা যদি আমরা টেলিস্কোপ দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে পারতাম, তাহলে দেখা যেত, সেখানে মানুষ ধীরে চলাফেরা করছে। আর সেখানকার মানুষগুলোকে দেখতে পাওয়া যাবে চ্যাপ্টা বা সংকুচিত অবস্থায়।

আসলে রকেটটি আলোর গতিতে চললে রকেটের ভেতরে সময় আপাতভাবে থেমে যাবে। রকেটটিও সংকুচিত হয়ে অজানা কিছু হয়ে যাবে আর তার ভরও হবে অসীম। এই পর্যবেক্ষণগুলো আসলে বোধগম্য কোনো অর্থ প্রকাশ করে না। তাই আইনস্টাইন বললেন, কোনো কিছুই আলোর গতির সীমা অতিক্রম করতে পারবে না। (কারণ, কোনো বস্তু যত দ্রুতবেগে চলবে ততই তা ভারী হতে থাকবে। এর মানে, এই গতিশক্তি রূপান্তরিত হয়ে ভরে পরিণত হয়েছে। এই নির্দিষ্ট শক্তি থেকে পাওয়া ভরের পরিমাণ সহজে পরিমাপ করা যায়। এর কয়েক লাইন পর সেই বিখ্যাত সমীকরণ E=mc^2- এ এসে পৌঁছাই আমরা।)

আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত সমীকরণটি প্রকাশ করার পর আক্ষরিক অর্থেই লাখো পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁর বৈপ্লবিক আইডিয়াটি প্রমাণিত হয়েছে। যেমন পৃথিবীতে আপনার অবস্থান কয়েক ফুটের মধ্যে নির্ণয় করতে ব্যবহৃত জিপিএস সিস্টেমও ভুল ফলাফল দেবে, যদি আপেক্ষিকতা থেকে পাওয়া সংশোধনী এতে যোগ করা না হয়। (সেনাবাহিনীও জিপিএস সিস্টেমের ওপর নির্ভর করে। তাই পেন্টাগনের জেনারেলদেরও আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা সম্পর্কে সংক্ষেপে বোঝান পদার্থবিদেরা।) জিপিএসের ঘড়ি আসলে পৃথিবীর ওপরে গতিশীল অবস্থায় বদলে যায়, ঠিক যেমনটি আইনস্টাইন অনুমান করেছিলেন।

এ ধারণার সবচেয়ে ভালো চিত্রটি পাওয়া যায় কণা ত্বরকযন্ত্রে। সেখানে বিজ্ঞানীরা কণাদের আলোর কাছাকাছি বেগে ত্বরণ ঘটান। সুইজারল্যান্ডে জেনেভা শহরের বাইরে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডর নামে সার্নের বিশালাকৃতির কণা ত্বরকযন্ত্রে প্রোটনকে কয়েক ট্রিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্টে ত্বারিত বা গতিশীল করা হয়। এতে আলোর প্রায় কাছাকাছি বেগে চলে কণা।

রকেট সায়েন্টিস্টদের কাছে আলোর এ বাধা এখনো তেমন সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি। কারণ, রকেট ঘণ্টায় প্রায় কয়েক হাজার মাইল বেগে চলতে পারে। তবে এক বা দুই শতাব্দীর মধ্যে আমাদের কাছের নক্ষত্রে (পৃথিবী থেকে ৪ আলোকবর্ষ দূরে) অনুসন্ধানী নভোযান পাঠানোর কথা ভাবতে শুরু করবেন রকেট সায়েন্টিস্টরা। তখন আলোর এই বাধা ক্রমেই একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।

আইনস্টাইনের তত্ত্বের ত্রুটি

কয়েক দশক ধরে পদার্থবিদেরা আইনস্টাইনের বিখ্যাত তত্ত্বের ফাঁক খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। কিছু ফাঁকফোকর অবশ্য পাওয়াও গেছে, কিন্তু সেগুলোর বেশির ভাগ তেমন কাজের কিছু নয়। যেমন কেউ যদি মহাকাশ এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে একটা ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে, তাহলে তাত্ত্বিকভাবে, আলোকরশ্মির ছবিটি আলোর গতিকেও ছাড়িয়ে যাবে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ফ্ল্যাশলাইটের ছবিটি দিগন্তের এক বিন্দু থেকে বিপরীত বিন্দুতে চলতে থাকবে। এই দূরত্ব কয়েক শ আলোকবর্ষ ছাড়িয়ে যেতে পারবে। কিন্তু এটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়; কারণ, এভাবে কোনো তথ্যই আলোর চেয়ে বেশি বেগে স্থানান্তরিত হতে পারবে না। আলোকরশ্মির এই ছবি আলোর গতিকে ছাড়িয়ে যাবে, তবে ছবিটি কোনো শক্তি বা কোনো তথ্য বহন করবে না।

ধরা যাক, আমাদের কাছে দুটি কাঁচি আছে। ব্লেড দুটিকে সংযোগ বিন্দু থেকে যত দূরে রাখা হবে পারস্পরিক ছেদবিন্দুটি তত দ্রুত চলাফেরা করবে। যদি কল্পনা করি, কাঁচিটির দৈর্ঘ্য এক আলোকবর্ষ লম্বা, তাহলে ব্লেড দুটোকে বন্ধ করলে ছেদ বিন্দুটি আলোর চেয়েও দ্রুতবেগে চলবে। (আবারও যেহেতু ছেদবিন্দু কোনো শক্তি বা তথ্য বহন করে না, তাই এরও কোনো গুরুত্ব নেই।)

একইভাবে চতুর্থ অধ্যায়ে যেমন বলেছি, ইপিআর এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে আলোর চেয়েও দ্রুতবেগে তথ্য পাঠানো যায়। (একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক, এই পরীক্ষায় দুটি ইলেকট্রন সমলয়ে স্পন্দিত হয়। তারপর তাদেরকে বিপরীত দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই ইলেকট্রন পরস্পর সংসক্ত বলেই তাদের মধ্যে তথ্য আলোর চেয়েও দ্রুতবেগে পাঠানো যায়। কিন্তু এই তথ্য এলোমেলো, তাই অকাজের। তাই ইপিআর মেশিন ব্যবহার করে দূরবর্তী কোনো নক্ষত্রে অনুসন্ধানী নভোযান পাঠানো যাবে না।)

পদার্থবিদদের কাছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটিটি এসেছে স্বয়ং আইনস্টাইনের কাছ থেকে। ১৯১৫ সালে জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভি বা সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেন তিনি। তত্ত্বটি বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। শিশুদের নাগরদোলার (মেরি গো রাউন্ড) কথা ভাবতে গিয়ে সাধারণ আপেক্ষিকতার বীজ বোনেন আইনস্টাইন। কিছুক্ষণ আগে দেখেছি, আলোর গতিতে চলতে গেলে বস্তুর আকার সংকুচিত হয়। যত দ্রুতগতিতে চলা যাবে, তত বেশি সংকুচিত হবে। কিন্তু ঘূর্ণমান কোনো ডিস্কে বাইরের পরিধি কেন্দ্রের চেয়ে বেশি জোরে চলে। (আসলে কেন্দ্রটি প্রায় স্থির থাকে।) এর মানে, কোনো রুলার বা পরিমাপক দণ্ডকে পরিধিতে রাখলে তা অবশ্যই সংকুচিত হবে। অন্যদিকে রুলারটিকে কেন্দ্রে রাখা হলে সেটি প্রায় একই রকম থাকবে। তাই নাগরদোলার পৃষ্ঠতল তখন আর সমতল থাকছে না, বক্র হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং সিদ্ধান্ত টানা যায়, নাগরদোলার স্থান ও সময়ের বক্রতায় ত্বরণের প্রভাব রয়েছে।

সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বে, স্থান-কাল এমন এক বুনন বা কাঠামো, যা প্রসারিত ও সংকুচিত হতে পারে। নির্দিষ্ট অবস্থায় এই কাঠামো আলোর চেয়েও দ্রুতবেগে প্রসারিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের কথা ধরা যাক। ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে এক মহাজাগতিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের জন্মকে বলা হয় বিগ ব্যাং। এখানে সহজেই গণনা করে বের করা যায় যে মহাবিশ্ব আসলে আলোর চেয়েও দ্রুতবেগে প্রসারিত হয়েছিল। (এই কর্মটি বিশেষ আপেক্ষিকতা লঙ্ঘন করে না। কারণ, স্বয়ং নক্ষত্ররা নয়, বরং শূন্যস্থান বা নক্ষত্রদের মাঝখানের স্থান প্রসারিত হয়েছিল। প্রসারিত স্থান কোনো তথ্য বহন করে না।)

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিশেষ আপেক্ষিকতা শুধু স্থানীয়ভাবে প্রয়োগ করা যায়। অর্থাৎ আপনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। আপনার স্থানীয় এলাকায় (যেমন সৌরজগৎ) বিশেষ আপেক্ষিকতা কাজ করে। আমাদের মহাকাশ অনুসন্ধানী নভোযান দিয়ে সেটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে বৈশ্বিকভাবে (যেমন মহাজাগতিক পরিসরে, যার সঙ্গে মহাবিশ্ব জড়িত) এর বদলে অবশ্যই সাধারণ আপেক্ষিকতা ব্যবহার করতে হবে। সাধারণ আপেক্ষিকতায় স্থান-কাল একটি বুনন বা কাঠামো। এই বুনন আলোর চেয়েও দ্রুতবেগে প্রসারিত হতে পারে। আবার স্থানের মধ্যে গর্তেরও অনুমোদন দেয় এটি। এই গর্ত দিয়ে স্থান-কালের মধ্য দিয়ে শর্টকাট পথও তৈরি করে নেওয়া যায়।

এই সতর্কবার্তার পর, হয়তো আলোর চেয়ে দ্রুতবেগে ভ্রমণ করার একটি উপায়ের কথা মনে করিয়ে দেয় সাধারণ আপেক্ষিকতা। এখানে আসলে দুটি উপায় আছে, যা দিয়ে এটি ঘটানো সম্ভব।

১. প্রসারিত স্থান : আপনার পেছনের স্থান যদি প্রসারিত আর সামনের স্থান সংকুচিত করতে পারেন, তাহলে এমন বিভ্রান্তি হবে যেন আপনি আলোর চেয়ে দ্রুতবেগে চলছেন। আসলে বাস্তবে মোটেও তা ঘটে না। তবে স্থান বিকৃত হয়ে যাওয়ার কারণে, আপনার কাছে মনে হবে, চোখের পলকে দূরের কোনো নক্ষত্রে চলে গেছেন আপনি

২. বিভক্ত স্থান : ১৯৩৫ সালে ওয়ার্মহোলের মতো এক ধারণার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন আইনস্টাইন। অ্যালিসের লুকিং গ্লাসের কথা একবার মনে করুন। সেটি এমন এক যন্ত্র ছিল, যা অক্সফোর্ডের গ্রাম থেকে ওয়ান্ডারল্যান্ডকে সংযুক্ত করেছিল। ওয়ার্মহোলও এমন এক যন্ত্র, যা দুটি মহাবিশ্বকে সংযুক্ত করে। গ্রেড স্কুলে পড়ার সময় আমরা শিখেছি, দুটি বিন্দুর মধ্যে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ হলো সরলরেখা। কিন্তু অনিবার্যভাবে কথাটি সত্য নয়। কারণ, একখণ্ড কাগজকে যদি গোল করা হয়, যতক্ষণ না দুটি প্রান্ত পরস্পরকে স্পর্শ করছে, তাহলে দেখা যাবে, দুটি বিন্দুর মধ্যে সবচেয়ে ছোট পথ আসলে একটি ওয়ার্মহোল।

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ ম্যাট ভিসার বলেন, ‘আপেক্ষিকতার সমর্থক সমাজ র‍্যাপ ড্রাইভ বা ওয়ার্মহোলের মতো বিষয় বিজ্ঞান কল্পকাহিনির জগতের বাইরে আনার জন্য কী করণীয়, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে।’

এমনকি গ্রেট ব্রিটেনের রাজকীয় জ্যোতির্বিদ স্যার মার্টিন রিস বলেন, ‘ওয়ার্মহোল, অতিরিক্ত মাত্রা ও কোয়ান্টাম কম্পিউটার এমন দূরকল্পনার জগৎ খুলে দিয়েছে যে তা আমাদের গোটা মহাবিশ্বকে একসময় “জীবন্ত এক কসমসে” বদলে দিতে পারে।

আলকুবিরি ড্রাইভ ও ঋণাত্মক শক্তি

প্রসারমাণ স্থানের সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো আলকুবিরি ড্রাইভ। আইনস্টাইনের মহাকর্ষতত্ত্ব ব্যবহার করে এটি ১৯৯৪ সালে উত্থাপন করেন পদার্থবিদ মিগুয়েল আলকুবিরি। এর প্রোপালশন সিস্টেম ঠিক স্টার ট্রেকের মতো। এ ধরনের স্টারশিপের পাইলট একটি বাবল বা বুদের মধ্যে (যাকে বলা হয় র‍্যাপ বাবল) বসে থাকেন। সেখানে সবকিছুই আপাতভাবে স্বাভাবিক বলে মনে হয়। এমনকি নভোযানটি আলোর গতিসীমাও ভাঙতে পারে এখানে। পাইলটের কাছে মনে হবে তিনি স্থির অবস্থায় রয়েছেন। কিন্তু স্থান-কালের চরম বিকৃতি ঘটবে র‍্যাপ বাবলের বাইরে। কারণ, র‍্যাপ বাবলের সামনের স্থান সংকুচিত হয়ে যাবে। এখানে কোনো টাইম ডায়লেশন হবে না। কাজেই র‍্যাপ বাবলের ভেতরে সময় স্বাভাবিকভাবেই প্রবাহিত হবে।

আলকুবিরির মতে, এই সমাধান খুঁজে পাওয়ার পেছনে স্টার ট্রেকের হয়তো একটা ভূমিকা ছিল। তিনি বলেন, “স্টার ট্রেকের কলাকুশলীরা র‍্যাপ ড্রাইভ বা স্থানকে বিকৃত করার ধারণা নিয়ে কথাবার্তা বলত। স্থান কীভাবে বিকৃত হবে বা হবে না, তার জন্য আমাদের কাছে এরই মধ্যে একটিমাত্র তত্ত্বই ছিল। সেটি হলো সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব। আমার মনে হয়েছিল, র‍্যাপ ড্রাইভ কীভাবে কাজ করবে, সেটা দেখতে এ ধারণাটি ব্যবহারের কোনো না কোনো উপায় আছে।’ ইতিহাসে এটিই সম্ভবত প্রথম কোনো ঘটনা, যেখানে একটা টিভি অনুষ্ঠান আইনস্টাইনের কোনো সমীকরণ সমাধানে উৎসাহিত করেছে।

আলকুবিরির ধারণা, তাঁর প্রস্তাবিত স্টারশিপে চড়ে যাত্রার সঙ্গে স্টার ওয়ার্সের মিলেনিয়াম ফ্যালকনের যাত্রার মিল আছে। ‘আমার ধারণা, এদের সম্ভবত কিছু মিল আছে। স্টারশিপের সামনে, নক্ষত্রগুলো লম্বা রেখার মতো হবে। পেছনে, কিছুই দেখা যাবে না, শুধু কালো হয়ে থাকবে। কারণ, নক্ষত্রের আলো স্টারশিপটির পিছু ধাওয়া করার মতো যথেষ্ট দ্রুত চলতে পারবে না।’ বলেন আলকুবিরি।

আলকুবিরি ড্রাইভের মূল চাবিকাঠি প্রয়োজনীয় শক্তি, যা নভোযানকে আলোর চেয়ে বেশি বেগে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সাধারণত স্টারশিপ চালাতে ধনাত্মক শক্তি ব্যবহার করেন পদার্থবিদেরা। এর মাধ্যমে সব সময় আলোর চেয়ে কম বেগে চলা যায়। কিন্তু আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলতে চাইলে এই কৌশল বাদ দিয়ে স্টারশিপের জ্বালানি বদলাতে হবে। এক সহজ গণনায় দেখা গেছে, সে জন্য দরকার ঋণাত্মক ভর কিংবা ঋণাত্মক শক্তি। মহাবিশ্বে যদি এর অস্তিত্ব থাকে, তাহলে এটিই সম্ভবত সবচেয়ে চমকপ্রদ বস্তু। আগের ঐতিহ্যমতো বিজ্ঞান কল্পকাহিনির মতো ঋণাত্মক ভর ও ঋণাত্মক শক্তি থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন পদার্থবিদেরা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলার জন্য এগুলো অপরিহার্য। আবার এদের অস্তিত্ব সত্য হওয়াও সম্ভব।

প্রকৃতিতে অনেক দিন ধরে ঋণাত্মক বস্তুর অনুসন্ধান চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এতে এখনো সফলতা আসেনি। (প্রতিবস্তু এবং ঋণাত্মক বস্তু দুটি আলাদা জিনিস। প্রথমটির অস্তিত্ব আছে ও এদের শক্তি ধনাত্মক হলেও চার্জ বিপরীত। অন্যদিকে নেগেটিভ ম্যাটার বা ঋণাত্মক বস্তু থাকার এখনো কোনো প্রমাণ মেলেনি।) ঋণাত্মক বস্তু অদ্ভুত চরিত্রের হবে। কারণ, অস্তিত্বহীনতার চেয়েও হালকা হবে এটি। আসলে এটি বাতাসে ভাসবে। আদিম মহাবিশ্বে যদি ঋণাত্মক বস্তু থাকত, তাহলে মহাকাশে তার ভেসে বেড়ানোর কথা। গ্রহদের মহাকর্ষে বাধা পড়ে উল্কা বিভিন্ন গ্রহে আছড়ে পড়ে। কিন্তু ঋণাত্মক বস্তু এ রকম হবে না। তারা গ্রহদের স্রেফ এড়িয়ে চলবে। নক্ষত্র বা গ্রহদের মতো বড় বস্তুদের ঋণাত্মক বস্তু বিকর্ষণ করবে, আকর্ষণ নয়। কাজেই ঋণাত্মক বস্তুর অস্তিত্ব থাকলেও তাদের শুধু গভীর মহাকাশেই খুঁজে পাওয়ার আশা করা যেতে পারে; কোনোভাবেই পৃথিবীতে নয়।

গভীর মহাকাশে ঋণাত্মক বস্তু খুঁজে পাওয়ার একটি প্রস্তাব হলো ‘আইনস্টাইন লেন্স’ ব্যবহার করা। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, নক্ষত্র বা ছায়াপথের চারপাশ দিয়ে চলার সময় আলোর গতিপথ মহাকর্ষের প্রভাবে বেঁকে যায়। ১৯১২ সালে (আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তখনো পূর্ণাঙ্গ হয়নি) তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, এ কারণে কোনো ছায়াপথ একটা টেলিস্কোপের লেন্সের মতো আচরণ করতে পারে। বহু দূরের কোনো বস্তু থেকে আসা আলো পার্শ্ববর্তী কোনো ছায়াপথের চারপাশে ঘুরে আবারও একই বিন্দুতে মিলিত হবে, ঠিক লেন্সের মতো। ওই আলো অবশেষে পৃথিবীতে পৌঁছালে তাকে লক্ষণীয় একটা রিংয়ের মতো নকশায় দেখা যাবে। এই ঘটনাকেই বলা হয় আইনস্টাইন রিং।

১৯৭৯ সালে প্রথমবারের মতো গভীর মহাকাশে আইনস্টাইনের লেন্স পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়। এরপর থেকে আইনস্টাইনের লেন্স অপরিহার্য এক হাতিয়ার হয়ে ওঠে জ্যোতির্বিদদের কাছে। (যেমন একসময় ভাবা হতো, গভীর মহাকাশে ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্ত বস্তুর অবস্থান শনাক্ত করা অসম্ভব। [ডার্ক ম্যাটার এক রহস্যময় বস্তু, যা অদৃশ্য হলেও তার ওজন আছে। এগুলো পুরো ছায়াপথে ছড়িয়ে আছে। সম্ভবত মহাবিশ্বে আমাদের দৃশ্যমান সাধারণ বস্তুর তুলনায় এর পরিমাণ ১০ গুণ বেশি।] নাসার বিজ্ঞানীরা ডার্ক ম্যাটারের জন্য একটি মানচিত্র তৈরি করতে পেরেছেন। কারণ, ডার্ক ম্যাটার আলোকে বাঁকিয়ে দেয়। কাচ যেভাবে আলো বাঁকিয়ে দেয়, ঠিক সেভাবে ডার্ক ম্যাটারের পাশ দিয়ে আলো আসার সময় বেঁকে যায়।)

কাজেই আইনস্টাইনের লেন্স ব্যবহার করে গভীর মহাকাশে ঋণাত্মক বস্তু ও ওয়ার্মহোল খুঁজে বের করা হয়তো সম্ভব। এরা আলোকে অদ্ভুতভাবে বাঁকিয়ে দেবে, যা হাবল স্পেস টেলিস্কোপে দেখতে পাওয়ার কথা। তবে আইনস্টাইনের লেন্সের মাধ্যমে গভীর মহাকাশে ঋণাত্মক বস্তু বা ওয়ার্মহোলের ছবি তোলা না গেলেও অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে। কোনো দিন হাবল স্পেস টেলিস্কোপ আইনস্টাইনের লেন্সের মাধ্যমে ঋণাত্মক বস্তু বা ওয়ার্মহোলের অস্তিত্ব শনাক্ত করতে পারলে সেটি হবে পদার্থবিজ্ঞানের জন্য একটা বিশাল ধাক্কা।

ঋণাত্মক বস্তু ও ঋণাত্মক শক্তি একেবারেই আলাদা। ঋণাত্মক শক্তির অস্তিত্ব থাকলেও তার পরিমাণ খুবই সামান্য। কোয়ান্টাম তত্ত্বের সূত্র ব্যবহার করে ১৯৩৩ সালে হেনড্রিক ক্যাসিমির অদ্ভুত এক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি দাবি করেন, দুটি অচার্জিত সমান্তরাল ধাতুর প্লেট পরস্পরকে আকর্ষণ করবে। ব্যাপারটা ঠিক যেন জাদুমন্ত্রের মতো। সাধারণত সমান্তরাল প্লেট স্থির হয়, কারণ, তাদের মধ্যে কোনো চার্জ থাকে না। কিন্তু দুটি সমান্তরাল প্লেটের মধ্যে ভ্যাকুয়াম বা বায়শূন্য অবস্থায় খালি থাকে না, বরং ভার্চুয়াল বা কাল্পনিক কণায় ভরা থাকে। এগুলোর অস্তিত্ব আসে-যায়।

অতি অল্প সময়ের জন্য, ইলেকট্রন ও অ্যান্টি-ইলেকট্রন জোড়া শূন্য থেকে হঠাৎ উদয় হয়। তারপর পরস্পরের সঙ্গে মিলে নিশ্চিহ্ন হয়ে আবারও হারিয়ে যায় শূন্যে। মজার ব্যাপার হলো, একসময় শূন্যস্থানে কিছুই থাকে না বলে ভাবা হতো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এতে কোয়ান্টাম কার্যকারিতা অটুট থাকে। সাধারণত বস্তু ও প্রতিবস্তুর অতি ক্ষুদ্র বিস্ফোরণ শক্তির সংরক্ষণশীলতার নীতির লঙ্ঘন বলে মনে হবে। কিন্তু অনিশ্চয়তার নীতির কারণে এ অতি ক্ষুদ্র লঙ্ঘন অতি সংক্ষিপ্ত কালের ও এতে গড় শক্তি সর্বদা সংরক্ষিত থাকে।

ক্যাসিমির দেখতে পান, কাল্পনিক কণার মেঘ শূন্যস্থানে একটা চাপের সৃষ্টি করে। দুটি সমান্তরাল প্লেটের মাঝখানের স্থান অবরুদ্ধ বা আটকা থাকে। কাজেই এই চাপের পরিমাণ অল্প। কিন্তু প্লেটের বাইরের চাপ তো আর আটকে থাকে না। তাই সেখানে চাপও অনেক বেশি। এতে মোট চাপ প্লেট দুটিকে পরস্পরের দিকে ঠেলে দেবে।

সাধারণত প্লেট দুটি স্থির থাকলে ও পরস্পরের কাছ থেকে অনেকটা দূরে থাকলে শূন্য শক্তি অবস্থা ঘটে। কিন্তু প্লেট দুটো পরস্পরের কাছে এলে তাদের মাঝখান থেকে শক্তি বের করে নেওয়া যায়। তাই প্লেট দুটো থেকে গতিশক্তি বের করে দেওয়ার কারণে, প্লেট দুটোর শক্তি শূন্যের চেয়েও কম হয়।

এই ঋণাত্মক শক্তি গবেষণাগারে সত্যি সত্যিই মাপা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। ফলাফলে ক্যাসিমিরের অনুমান সত্য বলে প্রমাণিত হয়। সুতরাং ঋণাত্মক শক্তি ও ক্যাসিমির ইফেক্ট আর এখন বিজ্ঞান কল্পকাহিনি নয়, প্রতিষ্ঠিত এক সত্য। তবে সমস্যা হলো, ক্যাসিমির ইফেক্টের পরিমাণ খুব অল্প। এটি মাপতে গবেষণাগারে অতি সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির দরকার। (সাধারণভাবে, ক্যাসিমির শক্তি হলো প্লেট দুটোর মাঝখানের দূরত্বের বিপরীত চতুর্থ ঘাতের সমানুপাতিক। এর মানে, প্লেট দুটোর মাঝখানের দূরত্ব যত কম হবে, এই শক্তির পরিমাণ তত বেশি হবে।) ক্যাসিমির ইফেক্ট ১৯৯৬ সালে নিখুঁতভাবে পরিমাপ করেন লস অ্যালামস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির স্টিভেন ল্যামোরেক্স। আর এই আকর্ষণ বলের পরিমাণ পাওয়া গেছে একটি পিঁপড়ার ওজনের ১/৩০,০০০ গুণ।

আলকুবিরি প্রথম তত্ত্বটি উত্থাপনের পর পদার্থবিদেরা কিছু অদ্ভুত ব্যাপার আবিষ্কার করেছেন। স্টারশিপের ভেতরে কোনো মানুষ স্বাভাবিকভাবে বাইরের বিশ্ব থেকে বিছিন্ন থাকবে। এর মানে, আপনি ইচ্ছেমতো কোনো বাটন টিপে আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলতে পারবেন না। বুদের মধ্য দিয়ে আপনি যোগাযোগও করতে পারবেন না। সেখানে স্থান ও কালের মধ্য দিয়ে একটা আগে থেকে ঠিক করে রাখা হাইওয়ে থাকতে হবে। অনেকটা নিয়মিত সময়সূচি অনুযায়ী একগুচ্ছ ট্রেন অতিক্রম করার মতো ব্যাপার। এই অর্থে, স্টারশিপটি ইচ্ছেমতো দিক আর গতি পরিবর্তন করতে পারা কোনো সাধারণ নভোজাহাজ হতে পারবে না। তাহলে স্টারশিপটি হবে অনেকটা সংকুচিত স্থানের মধ্যে আগে থেকে অস্তিত্বশীল তরঙ্গে যাত্রীবাহী গাড়ি চালানোর মতো। সেটি আগে থেকে অস্তিত্বশীল বক্র স্থান-কালের করিডরের মধ্য দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে। আলকুবিরির মতে, ‘হাইওয়ের মতো এ পথে সাধারণের চেয়ে অন্য রকম বস্তু বারবার দরকার হবে। সেগুলোই স্থানকে নিপুণভাবে ব্যবহার করে আপনার জন্য সুষম একটা পথ বানিয়ে দেবে।’

আসলে আইনস্টাইনের সমীকরণে আরও কিছু অদ্ভুত ধরনের সমাধান পাওয়া যায়। আইনস্টাইনের সমীকরণের মতে, নির্দিষ্ট পরিমাণ ভর বা শক্তি দেওয়া হলে ওই ভর বা শক্তি স্থান-কালে কতটুকু বক্রতা তৈরি করবে, তা নির্ণয় করা যাবে (কোনো পুকুরে ঢিল ছোড়া হলে, যে আলোড়ন সৃষ্টি করে, তা নির্ণয় করার মতো)। তবে সমীকরণগুলোকে পেছন দিকেও চালানো যায়। একটি অদ্ভুত স্থান-কাল দিয়ে শুরু করা যায়, দ্য টোয়ালাইট জোন পর্বে যেমন দেখানো হয়েছে সে রকম। (যেমন, মহাবিশ্বে আপনি কোনো দরজা খুললে নিজেকে হয়তো চাঁদে আবিষ্কার করবেন। আপনি গাছের চারপাশে দৌড়ে নিজেকে সময়ের অতীতে আবিষ্কার করতে পারবেন। অবশ্য সেখানে আপনার হৃৎপিণ্ডটি দেহের ডানে দেখা যাবে।) এরপর নির্দিষ্ট স্থান-কালে বস্তু ও শক্তির বণ্টন হিসাব করা যাবে। (এর মানে, কোনো পুকুরে অদ্ভুত ধরনের তরঙ্গ দেওয়া হলে পেছনে গিয়ে এই তরঙ্গ সৃষ্টির জন্য কী ধরনের পাথর বা ঢিলের বণ্টন প্রয়োজন, তা নির্ণয় করা যাবে)। আসলে আলকুবিরি এভাবেই তাঁর সমীকরণে পৌছান। তিনি আলোর চেয়েও দ্রুতবেগে চলতে সক্ষম স্থান-কাল নিয়ে কাজ শুরুর পর পেছনে গিয়ে এর জন্য কী পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন, তা নির্ণয় করেছিলেন।

ওয়ার্মহোল ও ব্ল্যাক হোল

আলোর গতির সীমা ভাঙার জন্য প্রসারণশীল স্থানের পাশাপাশি, দ্বিতীয় সম্ভাব্য উপায়টি হলো ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে স্থানে ছিদ্র বা সুড়ঙ্গ তৈরি করা। গল্প-উপন্যাসে ওয়ার্মহোলের প্রথম উল্লেখ করেন অক্সফোর্ডের গণিতবিদ চার্লস ডজসন। লুইস ক্যারল ছদ্মনামে তিনি থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস লিখেছিলেন। অ্যালিসের লুকিং গ্লাস আসলে ছিল ওয়ার্মহোল। সেটি অক্সফোর্ডের গ্রাম্য এলাকার সঙ্গে জাদুময় বিশ্ব ওয়ান্ডারল্যান্ডকে সংযুক্ত করেছিল। লুকিং গ্লাসের মধ্যে হাত রেখে চোখের পলকে এক মহাবিশ্ব থেকে আরেকটিতে চলে যেতে পারত অ্যালিস। গণিতবিদেরা একে বলেন মাল্টিপলি কানেকটেড স্পেসেস।

ওয়ার্মহোলের ধারণাটি পদার্থবিদ্যার আঙিনায় আসে ১৯১৬ সালে; আইনস্টাইনের মহাকাব্যিক সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশের এক বছর পর। পদার্থবিদ কার্ল শোয়ার্জশিল্ড তখন জার্মানির কাইজারের সেনাবাহিনীতে কাজ করছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বসে একক বিন্দুসম নক্ষত্রের জন্য আইনস্টাইনের সমীকরণ সঠিকভাবে সমাধান করেন তিনি। নক্ষত্র থেকে অনেক দূরে, এর মহাকর্ষক্ষেত্র একটি সাধারণ নক্ষত্রের মতোই দেখা গেল। শোয়ার্জশিল্ডের সমাধান ব্যবহার করেই আসলে নক্ষত্রের চারপাশে আলোর বিচ্যুতি কতটুকু হবে, তা নির্ণয় করেন আইনস্টাইন। শোয়ার্জশিল্ডের সমাধানটি বেশ দ্রুত জ্যোতির্বিদ্যায় গভীরতর প্রভাব ফেলে। এখন পর্যন্ত আইনস্টাইনের সমীকরণের অন্যতম সেরা সমাধান এটাই। পদার্থবিদেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই বিন্দুসম নক্ষত্রের মহাকর্ষ ক্ষেত্রকে একটি আসন্ন মান হিসেবে সসীম ব্যাসসম্পন্ন সত্যি কোনো নক্ষত্রের চারপাশের মহাকর্ষ ক্ষেত্রের জন্য ব্যবহার করছেন।

কিন্তু এই বিন্দুসম সমাধানটি গুরুত্বের সঙ্গে নিলে এর কেন্দ্রে বিন্দুসম দানবীয় একটা বস্তু লুকিয়ে থাকতে দেখা যায়। প্রায় এক শতাব্দীর মতো এটি পদার্থবিদদের একই সঙ্গে বিস্মিত ও স্তব্ধ করে রেখেছিল। একেই বলা হয় ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর। বিন্দুসম একটি নক্ষত্রের মহাকর্ষের জন্য শোয়ার্জশিল্ডের সমাধানটি ছিল একটা ট্রোজান ঘোড়ার মতো। বাইরে থেকে একে স্বর্গ থেকে আসা একটা আকর্ষণীয় উপহারের মতো মনে হলেও ভেতরে ভেতরে যত সব শয়তান আর দানব লুকিয়ে থাকে। তবে একটি মেনে নেওয়া হলে আরেকটিও মেনে নিতেই হবে। শোয়ার্জশিল্ডের সমাধানটি প্রমাণ দেখায়, এই বিন্দুসম নক্ষত্রে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে পারে। এই নক্ষত্রের চারপাশে একটি অদৃশ্য গোলক থাকে (যাকে বলা হয় ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত)। একেই বলে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন। এখানে সবকিছুই ঢুকতে পারবে, কিন্তু কোনো কিছুই আর বেরিয়ে আসতে পারবে না। ঠিক যেন রোচ মোটেল [তেলাপোকা মারার একধরনের ফাঁদ। বাক্সের মতো দেখতে এই ফাঁদের ছিদ্র দিয়ে তেলাপোকা ভেতরে ঢুকলে আর বেরিয়ে আসতে পারে না।—অনুবাদক]। একবার ইভেন্ট হরাইজন অতিক্রম করলে সেখান থেকে আর ফিরে আসা যাবে না। (তবে ইভেন্ট হরাইজনের ভেতরে ঢুকলে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে আপনাকে আলোর চেয়েও বেশি বেগে চলতে হবে, আদতে যা একেবারেই অসম্ভব।)

ঘটনা দিগন্তের যত কাছে যাওয়া যাবে, ততই আপনার দেহের পরমাণুগুলো প্রবল আকর্ষণ বলের কারণে প্রসারিত হতে থাকবে। আপনার মাথার তুলনায় আপনার পায়ে মহাকর্ষ বল বেশি অনুভূত হবে। তাতে আপনি স্প্যাগেটিফাইয়েড বা সেমাইয়ের মতো লম্বা হয়ে যাবেন। এরপর ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে আপনার দেহ। একইভাবে আপনার দেহের পরমাণুগুলোও মহাকর্ষের কারণে প্রবলভাবে প্রসারিত হয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

আপনাকে ঘটনা দিগন্তের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি বাইরের দর্শকের কাছে মনে হবে আপনি সময়ের মধ্যে ধীরগতিতে চলছেন। আসলে আপনি ঘটনা দিগন্তের কাছে চলে গেলে মনে হবে যেন সময় থেমে গেছে।

আবার ঘটনা দিগন্ত পেরিয়ে ভেতরে পড়ে যাওয়ার সময় আলো আটকে গেছে আর কৃষ্ণগহ্বরের চারদিকে কোটি কোটি বছর ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে বলে মনে হবে। যেন কোনো চলচ্চিত্র দেখছেন বলে মনে হবে, কৃষ্ণগহ্বরের পুরো ইতিহাস তার একেবারে জন্মমুহূর্ত থেকে দেখতে পাবেন আপনি।

সবশেষে, আপনি যদি সোজা কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে পড়ে যেতে থাকেন, তাহলে সেখানে অন্য পাশে আরেকটি মহাবিশ্বও থাকতে পারে। একে বলা হয় আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজ। ১৯৩৫ সালে এটি উত্থাপন করেন আইনস্টাইন। এখন একে বলা হয় ওয়ার্মহোল।

আইনস্টাইন এবং আরও কয়েকজন পদার্থবিদ বিশ্বাস করতেন যে কোনো নক্ষত্র প্রাকৃতিকভাবে কখনোই এ রকম দানবীয় বস্তুতে পরিণত হতে পারে না। এ বিষয়ে ১৯৩৯ সালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন আইনস্টাইন। সত্যি বলতে কি, সেখানে তিনি প্রমাণ দেখান, ঘুরপাক খাওয়া গ্যাস ও ধূলির ভর কখনোই সংকুচিত হয়ে কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতে পারে না। কাজেই কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে একটা ওয়ার্মহোল লুকিয়ে থাকলেও তিনি বিশ্বাস করতেন, এ ধরনের অদ্ভুত কোনো কিছু কখনোই প্রাকৃতিকভাবে গঠিত হতে পারে না। জ্যোতিঃপদার্থবিদ আর্থার এডিংটন একবার বলেছিলেন, ‘প্রকৃতিতে এমন কোনো সূত্র থাকা উচিত, যা নক্ষত্রকে এ রকম অদ্ভুতুড়ে আচরণ করা থেকে বিরত রাখবে।’ অন্য কথায়, কৃষ্ণগহ্বর ছিল আইনস্টাইনের সমীকরণের বৈধ সমাধান। কিন্তু সে সময় প্রাকৃতিকভাবে গঠিত হতে পারা অন্য কোনো কৌশল জানা ছিল না।

সবকিছু পাল্টে গেল জে রবার্ট ওপেনহাইমার এবং তাঁর ছাত্র হার্টল্যান্ড স্নাইডারের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশের কারণে। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রে দেখানো হলো, কৃষ্ণগহ্বর প্রাকৃতিকভাবে গঠিত হতে পারে। তাঁরা অনুমান করলেন, একটি মৃত নক্ষত্র তার সব নিউক্লিয়ার জ্বালানি খরচ করে ফেললে নক্ষত্রটি তার নিজের মহাকর্ষ বলের টানে ভেঙে পড়ে বা চুপসে যায়। সুতরাং নক্ষত্রটি তার নিজের ওজনের নিচে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। মহাকর্ষ যদি নক্ষত্রটিকে তার ঘটনা দিগন্তের ভেতর সংকুচিত করতে পারত, তাহলে মহাকর্ষের প্রভাবে নক্ষত্রটিকে চুপসে বিন্দুকণা বা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হওয়া থেকে ঠেকিয়ে রাখতে পদার্থবিদ্যার আর কিছুই করার থাকে না। (চুপসে যাওয়ার এই পদ্ধতি থেকেই হয়তো কয়েক বছর পর নাগাসাকি বোমা বানানোর ক্লু জুগিয়েছিল ওপেনহাইমারকে। বোমাটি প্লুটোনিয়াম গোলকের চুপসে যাওয়ার ওপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছিল।)

এরপরের বড় ঘটনাটি ঘটে ১৯৬৩ সালে। সে সময় নিউজিল্যান্ডের গণিতবিদ রয় কার সম্ভবত কৃষ্ণগহ্বরের সবচেয়ে বাস্তব পরীক্ষাটি করে দেখেন। সংকুচিত বা চুপসে যাওয়ার সময় বস্তু সবচেয়ে দ্রুতবেগে ঘোরে। স্কেটাররা যেমন দ্রুতবেগে ঘোরার সময় হাত দুটোকে দেহের কাছাকাছি আনে, এটাও অনেকটা তেমন। এর ফলে কৃষ্ণগহ্বর এক বিস্ময়কর গতিতে ঘুরতে থাকবে।

রয় কার দেখতে পান, একটি ঘুরপাক খাওয়া কৃষ্ণগহ্বর কোনো বিন্দুসম নক্ষত্রে চুপসে যাবে না। অথচ তেমনই অনুমান করেছিলেন শোয়ার্জশিল্ড। বরং সেটি ঘূর্ণমান রিংয়ের মধ্যে চুপসে যাবে। দুর্ভাগ্যক্রমে কেউ এই রিংয়ে ধাক্কা খেলে মারা যাবে। তবে রিংয়ের মাঝখানে পড়লে মারা যাবে না, বরং ভেতর দিয়ে পড়ে যেতেই থাকবে। রিংয়ের অন্য প্রান্তে শেষ হয়ে যাওয়ার বদলে ওই ব্যক্তি আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজের ভেতর দিয়ে যেতে থাকবে। একসময় অন্য মহাবিশ্বে বেরিয়ে আসবে। অন্য কথায়, ঘুরপাক খাওয়া কৃষ্ণগহ্বর হলো অ্যালিসের লুকিং গ্লাসের রিম বা সীমানা।

ওই ব্যক্তি যদি ঘূর্ণমান রিংয়ের চারপাশে দ্বিতীয় দফায় যায়, তাহলে সে হয়তো আরও একটা মহাবিশ্বে প্রবেশ করবে। আসলে ঘূর্ণমান রিংয়ে বারবার ঢুকলে সে প্যারালাল ইউনিভার্স বা সমান্তরাল মহাবিশ্বে চলে যাবে। অনেকটা এলিভেটরের আপ বাটন টেপার মতো। তত্ত্ব অনুসারে, অসীমসংখ্যক মহাবিশ্ব থাকার সম্ভাবনা আছে, যাদের প্রতিটিই পরস্পরের ওপর গাদাগাদি হয়ে রয়েছে। ‘এই ম্যাজিক রিংয়ের ভেতর দিয়ে গেলে পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের মহাবিশ্বে আবিষ্কার করবেন আপনি। সেখানে ব্যাসার্ধ ও ভর হতে পারে ঋণাত্মক।’ এভাবেই লিখেছিলেন রয় কার।

তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় আছে। কৃষ্ণগহ্বর হলো ননট্রান্সভার্সেবল ওয়ার্মহোলের উদাহরণ। অর্থাৎ ঘটনা দিগন্তের মধ্য দিয়ে এর পথ একমুখী। আপনি যদি একবার ঘটনা দিগন্ত অতিক্রম করে কারের রিংয়ে ঢোকেন, তাহলে ওই রিংয়ের পেছনে যেতে পারবেন না এবং ঘটনা দিগন্ত থেকেও বেরিয়ে আসতে পারবেন না।

তবে কিপ থর্ন আর তাঁর সহকর্মীরা ১৯৮৮ সালে ট্রান্সভার্সেবল ওয়ার্মহোলের একটি উদাহরণ খুঁজে পান। এর মধ্য দিয়ে আপনি সামনে ও পেছনে যাতায়াত করতে পারবেন। আসলে এই সমাধানে ওয়ার্মহোলের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করার ঝক্কি বিমানে চড়ার চেয়ে খুব বেশি খারাপ হবে না।

সাধারণত ওয়ার্মহোলের সুড়ঙ্গের মধ্যে মহাকর্ষ তীব্র। তাই ওয়ার্মহোলের গলাকে চিপে ধরে রাখে। সে কারণে এর ভেতর দিয়ে অন্য প্রান্তে যাওয়ার চেষ্টা করা নভোচারীকে পিষে ধ্বংস করে ফেলবে। এ কারণে ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে আলোর চেয়ে দ্রুতবেগে চলা সম্ভব নয়। কিন্তু ঋণাত্মক শক্তি বা ঋণাত্মক ভরের বিকর্ষণ বল এই সুড়ঙ্গকে নভোচারীর যাওয়ার জন্য যথেষ্ট বড় করে ফেলতে পারবে। অন্য কথায়, ঋণাত্মক ভর বা শক্তি আলকুবিরি ড্রাইভ ও ওয়ার্মহোলের সমাধান দুটোর জন্যই জরুরি।

গত কয়েক বছরে আইনস্টাইনের যেসব সমীকরণ ওয়ার্মহোলের অনুমোদন করে, সেগুলোর বিস্ময়কর সমাধান পাওয়া গেছে। প্রশ্ন হলো, ওয়ার্মহোল কি সত্যিই আছে, নাকি সেগুলো শুধু গাণিতিক বিভ্রান্তি? অবশ্য ওয়ার্মহোল নিয়ে আরও কিছু সমস্যাও রয়েছে।

প্রথমত, ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে ভ্রমণের জন্য স্থান ও কালে চরম বিকৃতি তৈরি করতে হবে। সে জন্য বিপুল পরিমাণ ধনাত্মক ও ঋণাত্মক বস্তু দরকার, যার পরিমাণ বিশাল কোনো নক্ষত্র বা কোনো কৃষ্ণগহ্বরের সমান। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ ম্যাথিউ ভিসার হিসাব করেছেন, ওয়ার্মহোলের ১ মিটার পথ খুলতে প্রয়োজনীয় ঋণাত্মক শক্তির পরিমাণ বৃহস্পতি গ্রহের ভরের সমান। ব্যতিক্রম শুধু এ ভর ঋণাত্মক হতে হবে। তিনি বলেন, “কাজটি করতে আপনার মাইনাস ১ বৃহস্পতি ভর প্রয়োজন। ধনাত্মক বৃহস্পতির ভরের শক্তি ব্যবহারের সাধ্য এখনো আমাদের হয়নি। সুদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমরা তেমন সক্ষমতা অর্জন করতে পারব।’

ক্যালিফোর্নিয়ার ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞানী কিপ থর্নের ধারণা, ‘একসময় হয়তো দেখা যাবে, কোনো ওয়ার্মহোল খুলতে মানুষের সমান এক্সোটিক ম্যাটার ওয়ার্মহোলে দিলেই কাজ হবে। সেটি পদার্থবিদ্যার সূত্র হয়তো অনুমোদনও করবে। তবে এমনও হয়তো দেখা যাবে যে ওয়ার্মহোল বানানোর প্রযুক্তি ও তাদের উন্মুক্ত করার কাজটি মানবসভ্যতার সক্ষমতার কাছে অকল্পনীয়।’

দ্বিতীয়ত, আমরা এখনো জানি না এসব ওয়ার্মহোলের স্থিতিশীলতা কতটুকু। ওয়ার্মহোল থেকে নিঃসৃত বিকিরণ হয়তো এতে প্রবেশ করা কাউকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। কিংবা হয়তো ওয়ার্মহোলগুলো একটুও স্থিতিশীল নয়, বরং খোলার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো আবার বন্ধ হয়ে যায়।

তৃতীয়ত, কৃষ্ণগহ্বরের ওপর পতিত আলোর নীল বিচ্যুতি হওয়া উচিত। অর্থাৎ আলোগুলো ঘটনা দিগন্তের যতই কাছে আসতে থাকবে, ততই তারা আগের তুলনায় বেশি শক্তি অর্জন করতে থাকবে। ঘটনা দিগন্তেও আলোর অসীমভাবে নীল বিচ্যুতি হবে। কাজেই এখান থেকে আসা বিকিরণ রকেটে থাকা সবাইকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট।

সমস্যাটি নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক। স্থান-কালের নকশায় গর্ত করে সেখানে বিপুল পরিমাণ শক্তি জড়ো করাও একটি সমস্যা বটে। কাজটি করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো, কোনো বস্তুকে সংকুচিত করা, যতক্ষণ না পর্যন্ত সেটি ঘটনা দিগন্তের চেয়ে ছোট হচ্ছে। সূর্যের ক্ষেত্রে এ কথার মানে হলো, সূর্যকে মাত্র ২ মাইল ব্যাসে সংকুচিত করে ফেলতে হবে। তাহলে সূর্য চুপসে গিয়ে কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে। (সূর্যের মহাকর্ষ এতই দুর্বল যে প্রাকৃতিকভাবে এটি সংকুচিত হয়ে ২ মাইলে নেমে আসবে না। কাজেই সূর্য কখনো কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে না। তাত্ত্বিকভাবে এর মানে যেকোনো কিছু, এমনকি আপনিও কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতে পারেন, যদি আপনাকে যথেষ্ট পরিমাণ সংকুচিত করা হয়। সে জন্য আপনার দেহের সবগুলো পরমাণু সংকুচিত করে অতিপারমাণবিক দূরত্বের চেয়েও ছোট বানাতে হবে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এখনো এই ক্ষমতা অর্জনের কথা ভাবতেও পারে না। )

আরও প্রয়োগিক উপায় হতে পারে, এক সারি লেজার রশ্মি একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে ছুড়ে দেওয়া। কিংবা বিশালাকৃতির কোনো অ্যাটম স্ম্যাশার বা কণা ত্বরকযন্ত্র বানিয়ে দুটি বিম তৈরি করা। এরপর তাদের পরস্পরকে অতি শক্তিতে সংঘর্ষ ঘটাতে হবে। এর ফলে স্থান-কালের বুননের মধ্যে একটা ছোট ছিদ্র তৈরি করা যাবে।

প্ল্যাঙ্ক শক্তি ও কণা ত্বরকযন্ত্র

স্থান ও কালের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করতে কী পরিমাণ শক্তির দরকার, তা সহজে হিসাব করে বের করা যায়। সেটি হবে প্ল্যাঙ্ক শক্তি অনুসারে বা ১০১৯ বিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট। নিঃসন্দেহে এটি অকল্পনীয় একটি সংখ্যা। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের বাইরে অবস্থিত বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী যন্ত্র বা লার্জ হ্যাড্রন কলাইডরের (এলএইচসি) তুলনায় যা কোয়াড্রিলিয়ন গুণ বেশি শক্তি অর্জন করে। এলএইচসি প্রোটনকে বিশালাকৃতির ডোনাটের মধ্যে দোলাতে পারে, যতক্ষণ না তারা কয়েক ট্রিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্টে পৌঁছায়। মহাবিস্ফোরণের পর এত শক্তি আর কখনো দেখা যায়নি। তারপরও এই দানবীয় যন্ত্রটি যে পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করে, তা প্ল্যাঙ্ক শক্তির তুলনায় অনেক গুণ কম।

এলএইচসির পরের পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর যন্ত্রটি হবে ইন্টারন্যাশনাল লিনিয়ার কলাইডার (আইএলসি)। অতিপারমাণবিক কণাদের গতিপথ বৃত্তাকারে বাঁকানোর বদলে আইএলসিতে কণাদের সোজা পথে ছুড়ে দেওয়া হবে। কণাগুলো এ পথে চলার সময় তাদের মধ্যে শক্তি ঢুকিয়ে দেওয়া হবে, যতক্ষণ না তারা অকল্পনীয় শক্তি লাভ করে। এরপর ইলেকট্রনের একটি বিম প্রতি-ইলেকট্রনের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে। এতে বিপুল পরিমাণ শক্তির বিস্ফোরণ হবে। আইএলসির দৈর্ঘ্য হবে ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার। মানে স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার অ্যাকসিলারেটরের তুলনায় দশ গুণ বড়। সব ঠিক থাকলে পরের দশকের মধ্যে আইএলসির কাজ শেষ হবে।

আইএলসিতে শক্তি উৎপাদিত হবে ৫ থেকে ১০ ট্রিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট। এটি এলএইচসির চেয়ে ১৪ ট্রিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট কম শক্তি। তবে এখানে একটা ফাঁকি আছে। (এলএইচসিতে প্রোটনদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো হয়, ওই প্রোটন যেসব কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি তাদের মাধ্যমে। কাজেই কোয়ার্কদের মধ্যে সংঘর্ষে ১৪ ট্রিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্টের চেয়ে কম শক্তি থাকে। তাই সংঘর্ষের মাধ্যমে এলএইচসির চেয়েও অনেক বেশি শক্তি উৎপাদন করবে আইএলসি।) আবার ইলেকট্রনের যেহেতু কোনো গাঠনিক উপাদানের কথা জানা নেই, তাই ইলেকট্রন আর প্রতি-ইলেকট্রনের মধ্যে গতিশীল সংঘর্ষটি হবে সরল ও স্পষ্ট।

তবে বাস্তবে, স্থান-কালে ছিদ্র তৈরির ক্ষেত্রে আইএলসিও অনেক পিছিয়ে থাকবে। সে জন্য কোয়াড্রিলিয়ন গুণ বেশি শক্তিশালী কণা ত্বরকযন্ত্রের দরকার। আমাদের মতো শূন্য (০) টাইপের সভ্যতা, যারা এখনো জ্বালানি হিসেবে মৃত উদ্ভিদ ব্যবহার করে (যেমন তেল ও কয়লা), তাদের কাছে এই প্রযুক্তি অনেক অনেক দূরের ব্যাপার। তবে এটি সহজে সম্ভব হতে পারে টাইপ থ্রি সভ্যতার জন্য।

মনে রাখতে হবে, টাইপ থ্রি সভ্যতা শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্যালাকটিকল। টাইপ টু সভ্যতার চেয়ে এই সভ্যতা ১০ বিলিয়ন গুণ বেশি শক্তি ব্যবহার করে। তাদের শক্তি ব্যবহারের ভিত্তি হবে নক্ষত্রের শক্তি। অন্য দিকে টাইপ ওয়ান সভ্যতার চেয়ে ১০ বিলিয়ন গুণ বেশি শক্তি ব্যবহার করে টাইপ টু সভ্যতা। এদের শক্তি ব্যবহারের ভিত্তি কোনো গ্রহ। আগামী ১০০ থেকে ২০০ বছরের মধ্যে আমাদের দুর্বল টাইপ জিরো সভ্যতা টাইপ ওয়ান মর্যাদায় পৌঁছাবে।

এই ভবিষ্যদ্বাণীর পর সহজে বোঝা যাচ্ছে, প্ল্যাঙ্ক এনার্জি অর্জন করতে আমাদের আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। অনেক পদার্থবিদ বিশ্বাস করেন, অতি ক্ষুদ্র দূরত্বে বা ১০-৩২ সেন্টিমিটার প্ল্যাঙ্ক দূরত্বে স্থান শূন্য বা মসৃণ নয়, বরং ফেনাময়। এগুলো অতি ক্ষুদ্র বুদের সঙ্গে ফেনায়িত হচ্ছে। এই বুদ অনবরত অস্তিত্বশীল হচ্ছে, অন্য বুদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে, তারপর নিশ্চিহ্ন হয়ে আবারও শূন্যে ফিরে যাচ্ছে। এসব বুদের মধ্যে যেগুলো শূন্য থেকে আসছে-যাচ্ছে সেগুলো ভার্চুয়াল ইউনিভার্স বা কাল্পনিক মহাবিশ্ব। হঠাৎ অস্তিত্বে আসা ও তারপর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া ইলেকট্রন ও প্রতি-ইলেকট্রনের সঙ্গে কাল্পনিক কণার বেশ মিল আছে।

স্বভাবতই, এই কোয়ান্টাম স্থান-কালের ফেনা আমাদের কাছে পুরোপুরি অদৃশ্য। এসব বুদের গঠন এ রকম অতি ক্ষুদ্র দূরত্বে থাকে যে সেগুলো দেখা যায় না। কিন্তু কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান মতে, কোনো একক বিন্দুতে অনেক বেশি শক্তি জমা করা সম্ভব হলে এসব বুদ্বুদ অনেক বড় হয়ে উঠতে পারে। এরপর অতি ক্ষুদ্র বুদ্‌দসহ ফেনায়িত স্থান-কালের দেখা যাবে। সেখানে প্রতিটি বুদে একটি ওয়ার্মহোল সংযুক্ত করবে একটি শিশু মহাবিশ্বকে।

অতীতে এই শিশু মহাবিশ্বকে বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহল বলে বিবেচনা করা হতো। সেটি ছিল বিশুদ্ধ গণিতের অদ্ভুত এক পরিণতি। কিন্তু পদার্থবিদেরা এখন সত্যি সত্যি ভাবছেন যে হয়তো এ রকম কোনো শিশু মহাবিশ্ব থেকে শুরু হয়েছিল আমাদের মহাবিশ্ব।

এ ধরনের ভাবনা নিছক কল্পনা নয়। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র এই সম্ভাবনাকে অনুমোদন করে যে একক কোনো বিন্দুতে যথেষ্ট শক্তি জড়ো করতে পারলে স্থানের মধ্যে একটি গর্ত খুলে যাবে। এর মাধ্যমে আমরা একসময় স্থান- কালের ফেনায় ও আমাদের মহাবিশ্বের সঙ্গে একটি শিশু মহাবিশ্বে সংযুক্ত করা ওয়ার্মহোলের ভেতরে ঢুকতে পারব।

স্থানের মধ্যে একটি গর্ত খুঁড়তে আমাদের অবশ্যই প্রযুক্তিতে বড় ধরনের কিছু ঘটার দরকার। তবে আবারও বলি, সেই প্রযুক্তি হয়তো টাইপ থ্রি সভ্যতার কাছে থাকা সম্ভব। যেমন, তাদের কাছে এমন প্রতিশ্রুতিশীল কোনো প্রযুক্তি থাকতে পারে, যাকে বলা যেতে পারে ওয়েকফিল্ড টেবিলটপ অ্যাকসিলারেটর। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এই কণা ত্বরকযন্ত্র এতই ছোট হবে যে সেটি একটা টেবিলের ওপরে রেখে দেওয়া যাবে। হয়তো কয়েক বিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তি তৈরি করা যাবে এই যন্ত্র দিয়ে। ওয়েকফিল্ড টেবিলটপ অ্যাকসিলারেটর কাজ করবে চার্জিত কণায় লেজার ছুড়ে দিয়ে। স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার অ্যাকসিলারেটর সেন্টার, ইংল্যান্ডের রাদারফোর্ড অ্যাপলটন ল্যাবরেটরি আর প্যারিসের ইকোল পলিটেকনিকে পরিচালিত কিছু পরীক্ষায় দেখা গেছে, শক্তি ঢুকিয়ে দিতে লেজার বিম আর প্লাজমা ব্যবহার করে ছোট দূরত্বে কণার বিপুল ত্বরণ ঘটানো সম্ভব।

এরপরও আরেকটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটেছে ২০০৭ সালে। সেবার স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার অ্যাকসিলারেটর সেন্টার, ইউসিএলএ ও ইউএসসির পদার্থবিদ আর প্রকৌশলীরা এক পরীক্ষায় দেখান, মাত্র ১ মিটার দূরত্বে বিশাল আকৃতির কণা ত্বরকযন্ত্রের দ্বিগুণ শক্তি তৈরি সম্ভব। তারা ইলেকট্রনের বিম নিয়ে কাজটি শুরু করেছিলেন, যা স্ট্যানফোর্ডের ২ মাইল লম্বা এক টিউবে ছুড়ে দেওয়া হয়। সেটি ৪২ বিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তি অর্জন করে। এরপর এসব উচ্চ শক্তির ইলেকট্রনকে আফটারবার্নারের মধ্য দিয়ে চালিত করা হয়, যার মধ্যে মাত্র ৮৮ সেন্টিমিটার লম্বা এক প্লাজমা চেম্বার ছিল। সেখানে ইলেকট্রনগুলো অতিরিক্ত ৪২ বিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট অর্জন করে শক্তিকে দ্বিগুণ করে ফেলে। (এই প্লাজমা চেম্বার লিথিয়াম গ্যাসে ভরা ছিল। এই গ্যাসের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পথে ইলেকট্রনগুলো একটি প্লাজমা ওয়েভ তৈরি করে, যেটি একটি আলোড়ন তৈরি করে। এই আলোড়ন ইলেকট্রন বিমের দিকে প্রবাহিত করা হয়। এরপর একে ধাক্কা দিয়ে সামনে চালিত করা হয়।) এই বিস্ময়কর অর্জনের মাধ্যমে পদার্থবিদেরা প্রতি মিটারে যে পরিমাণ শক্তি দিয়ে ইলেকট্রন বিমে ত্বরণ সৃষ্টি করতে পারতেন, সেই আগের রেকর্ডের ৩ হাজার গুণ সামনে এগিয়ে গেছেন। এ ধরনের আফটারবার্নার যোগ করে বর্তমানের চলমান কণা ত্বরকযন্ত্রের শক্তি তাত্ত্বিকভাবে প্রায় বিনা মূল্যেই দ্বিগুণ করা সম্ভব।

বর্তমানে ওয়েকফিল্ড টেবিলটপ অ্যাসিলারেটরের বিশ্ব রেকর্ড প্রতি মিটারে ২০০ বিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট। একে বড় দূরত্ব পরিসরে নিয়ে গেলে অনেকগুলো সমস্যা দেখা দেয় (যেমন এতে লেজার শক্তি পাম্প করতে গেলে এর স্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়)। তবে যদি ধরে নেওয়া হয়, আমরা প্রতি মিটারে ২০০ বিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তি বজায় রাখতে পারি। তার মানে হবে, প্ল্যাঙ্ক শক্তিতে পৌঁছাতে আমাদের এমন অ্যাসিলারেটর দরকার, যার দৈর্ঘ্য হতে হবে ১০ আলোকবর্ষ লম্বা। টাইপ থ্রি সভ্যতার এ সক্ষমতা বেশ ভালোভাবে অর্জন করতে পারে।

ওয়ার্মহোল ও প্রসারণশীল স্থান হয়তো আলোর গতিসীমা ভাঙতে আমাদের সবচেয়ে বাস্তবসম্মত উপায়ের জোগান দিতে পারে। কিন্তু এই প্রযুক্তি স্থিতিশীল কি না, তা এখনো অজানা। তা হলেও তাদের কার্যকরী করতে ধনাত্মক হোক আর ঋণাত্মকই হোক, আমাদের বিপুল পরিমাণ শক্তি লাগবে।

কোনো টাইপ থ্রি সভ্যতা হয়তো এরই মধ্যে এ ধরনের প্রযুক্তি হাতের মুঠোয় পেয়ে গেছে। তবে এই প্রযুক্তি অর্জন করতে আমাদের হয়তো আরও ১০০ বছর লেগে যেতে পারে। কারণ, এত বিপুল পরিমাণ শক্তিতে লাগাম পরানোর আগে কোনোভাবেই এ বিষয়ে ভাবার অবকাশ নেই। কোয়ান্টাম পর্যায়ে স্থান-কালের বুননসংক্রান্ত মৌলিক সূত্র নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। সে কারণে একে আমি দ্বিতীয় শ্রেণির অসম্ভাব্যতা হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছি।

তথ্যনির্দেশ

কোয়ার্ক : শক্তিশালী বল দ্বারা প্রভাবিত চার্জিত মৌলিক কণা। প্রোটন ও নিউট্রন প্রতিটি তিনটি কোয়ার্ক কণা দিয়ে গঠিত। এ পর্যন্ত ছয় ধরনের বা ফ্লেভারের কোয়ার্ক পাওয়া গেছে। যথা : আপ, ডাউন, স্ট্রেঞ্জ, চার্মড, বটম ও টপ।

প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য : প্রায় ১০-৩৫ সেন্টিমিটার। স্ট্রিং তত্ত্বে একটি সাধারণ স্ট্রিং বা সুতোর আকার।

ঘটনা দিগন্ত : কৃষ্ণগহ্বরের কিনারাই হলো ঘটনা দিগন্ত বা ইভেন্ট হরাইজন। এখান থেকে অসীমের দিকে ফিরে আসা সম্ভব নয়।

স্থান-কাল : সময়সহ একটি চারমাত্রিক স্থান, যার বিন্দুগুলো একেকটি ঘটনা। নিউটনের মহাবিশ্বে স্থান ও কালকে আলাদা বলে ভাবা হতো। কিন্তু আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্বে দেখালেন, এই দুটি আসলে আলাদা কিছু নয়, বরং একক অস্তিত্ব হিসেবে বিরাজমান।

এলএইচসি : বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী কণা ত্বরকযন্ত্র লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার বা এলএইচসি। ইউরোপিয়ান নিউক্লিয়ার গবেষণা সংস্থা বা সার্ন ও ১০০টি দেশের ১০ হাজারের বেশি বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী এটি তৈরিতে কাজ করেছেন। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের কাছে ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড সীমান্তের প্রায় ১৭৫ মিটার মাটির নিচে ২৭ কিলোমিটার পরিধির বৃত্তাকার সুড়ঙ্গের মধ্যে এটি স্থাপন করা হয়েছে। ২০১২ সালে এ কণা ত্বরকযন্ত্রে হিগস-বোসন কণা আবিষ্কৃত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *