১৪. অবিরাম গতিযন্ত্র

১৪. অবিরাম গতিযন্ত্র

কোনো তত্ত্ব গ্রহণযোগ্য হওয়ার চারটি ধাপ থাকে :

১. সেটা অকেজো বা অর্থহীন হবে

২. এটি আকর্ষণীয়, কিন্তু বেমানান হবে

৩. এটা সত্যি হলেও অগুরুত্বপূর্ণ হবে

৪. আমি সব সময় তা-ই বলতাম।

—জে বি এস হ্যালডন, ১৯৬৩

আইজ্যাক আসিমভের ক্ল্যাসিক উপন্যাস দ্য গডস দেমসেফলস-এ ২০৭০ সালের পৃথিবীর এক রহস্যময় রসায়নবিদের দেখা পাওয়া যায়। দুর্ঘটনাক্রমে একদিন সর্বকালের সেরা এক আবিষ্কার করে বসেন তিনি। সেটি ছিল এক ইলেকট্রন পাম্প। তা দিয়ে বিনা মূল্যে সীমাহীন শক্তি তৈরি করা যায়। এর ফলাফল ছিল প্রত্যক্ষ ও বেশ গভীর। অফুরান শক্তির জন্য সভ্যতার তৃষ্ণা সর্বকালের। তাই তাঁর আবিষ্কারে এই তৃষ্ণা মিটে যাওয়ার কারণেই তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে অভিনন্দন জানানো হয়। ‘আবিষ্কারটি ছিল গোটা বিশ্বের জন্য সান্তা ক্লজ ও আলাদিনের বাতির মতো’, আসিমভ লিখেছেন। এরপর একটি কোম্পানি খুলে বসেন বিজ্ঞানীরা। অচিরেই সেটি পরিণত হয় এই গ্রহের সবচেয়ে ধনী একটি প্রতিষ্ঠানে। অন্যদিকে তেল, গ্যাস, কয়লা ও নিউক্লিয়ার শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা হারিয়ে শেষমেশ লাটে উঠতে থাকে।

অবাধ শক্তির জোয়ারে ভাসতে থাকে গোটা বিশ্ব। নতুন আবিষ্কৃত এই শক্তিতে ভর করে বিশ্ববাসী উন্মত্ত হয়ে ওঠে। সবাই অসাধারণ এ অর্জন উদ্‌যাপন করতে থাকে। ব্যতিক্রম কেবল নিঃসঙ্গ এক পদার্থবিদ। ভীষণ অস্বস্তিতে ভুগতে থাকেন তিনি। নিজেকেই প্রশ্ন করেন তিনি, ‘এসব অবাধ, অফুরান শক্তি এল কোথা থেকে?’ এই উত্তর খুঁজতে গিয়ে একসময় তিনি এক গুপ্তরহস্য উদ্ঘাটন করেন। বিনা মূল্যের এই শক্তি আসলে আসছিল ভয়ংকর এক মূল্য চুকিয়ে। মহাশূন্যের স্থানের ভেতরে এক গর্ত থেকে এসব শক্তি নিঃসৃত হচ্ছিল। গর্তটি একটি সমান্তরাল মহাবিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিল আমাদের মহাবিশ্বটিকে। আমাদের মহাবিশ্বে আসা হঠাৎ শক্তির প্রবাহের কারণে সেখানে একটি চেইন রিঅ্যাকশন শুরু হয়ে যায়। এর ফলে ক্রমেই সেখানকার নক্ষত্র, ছায়াপথ ধ্বংস হতে শুরু করে, সূর্য পরিণত হতে থাকে সুপারনোভায়। তারপর পৃথিবীও ধ্বংস হয়ে যায়।

লিখিত ইতিহাসে উদ্ভাবক, বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে হাতুড়ে ডাক্তার, ভন্ড ও প্রতারক শিল্পী সবার কাছে অলীক পারপিচুয়াল মোশন মেশিন বা অবিরাম গতির যন্ত্র দেখা যায়। এটি এমন এক যন্ত্র, যা শক্তি ছাড়াই চিরকাল চলতে পারে। আবার এ যন্ত্রের আরেকটি সংস্করণে দেখা যায়, যন্ত্রটি যতটুকু শক্তি ব্যবহার করে, তার চেয়ে বেশি শক্তি উৎপাদন করে। যেমন ইলেকট্রন পাম্প, যেটি অবাধে সীমাহীন শক্তি উৎপাদন করে।

আসন্ন বছরগুলোতে আমাদের শিল্পোন্নত বিশ্বে একসময় সস্তা তেলের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। তখন পরিচ্ছন্ন শক্তির পর্যাপ্ত নতুন উৎস অনুসন্ধানের বিপুল চাপ তৈরি হবে। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে, উৎপাদন কমিয়ে, দূষণ বাড়িয়ে, বায়ুমণ্ডলে পরিবর্তন করে—এ সবগুলো শক্তি পাওয়ার তীব্র আগ্রহে ইন্ধন জোগায়।

উদ্বেগের ব্যাপার হলো, বর্তমানে কয়েকজন উদ্ভাবক অফুরন্ত বিনা মূল্যের শক্তি সরবরাহ করার এই জোয়ারে গা ভাসিয়েছেন। তাঁদের উদ্ভাবনগুলো শত শত মিলিয়ন অর্থের বিনিময়ে বিক্রির প্রস্তাব দিচ্ছেন তাঁরা। বাণিজ্যিক গণমাধ্যমে চাঞ্চল্যকর দাবির কারণে প্রলুব্ধ হয়ে কিছু বিনিয়োগকারীকে তাদের কাছে ভিড় জমাতে দেখা যাচ্ছে। কারণ, গণমাধ্যমে এসব ছিটগ্রস্ত লোককেই পরবর্তী এডিসন হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।

অবিরাম গতির যন্ত্রের জনপ্রিয়তা ব্যাপক। দ্য পিটিএ ডিসব্যান্ডশিরোনামের দ্য সিমসন সিরিজের একটি পর্বে শিক্ষকদের এক ধর্মঘটের সময় নিজের জন্য একটি অবিরাম গতির যন্ত্র বানায় লিসা। এর ফলে হোমার ঘোষণা করতে বাধ্য হয়, ‘লিসা, শোনো, এই বাড়িতে আমরা তাপগতিবিদ্যার সূত্রগুলো মেনে চলি!”

কম্পিউটার গেমস দ্য সিমস, জেনোসাগা এপিসোড ১ ও ২ এবং আলটিমা ৪ : দ্য ফলস প্রফেট, একই সঙ্গে নিকলোডিয়নের ইনভেডার জিমের কাহিনিতে অবিরাম গতির যন্ত্র বেশ সুপরিচিত।

তবে শক্তি যদি এতই মূল্যবান হয়, তাহলে অবিরাম গতির যন্ত্র বানানোর ব্যাপারে আমাদের সম্ভাবনা কতটা? এই যন্ত্র কি সত্যিই বানানো অসম্ভব? নাকি তাদের বানানোর জন্য পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলোর সংশোধন করা দরকার?

শক্তিসম্পর্কিত ইতিহাস ফিরে দেখা

সভ্যতার জন্য শক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সত্যি বলতে কি, মানুষের ইতিহাসের পুরোটাই শক্তির আতশি কাচ দিয়ে দেখা যায়। এককালে ৯৯.৯ শতাংশ মানুষের অস্তিত্বের জন্য আদিম সমাজগুলো ছিল যাযাবর প্রকৃতির। খাদ্যের জন্য তারা সর্বভুকের মতো শিকার করে বেড়াত। তাদের জীবন ছিল নিষ্ঠুরতায় ভরা ও আয়ু ছিল সংক্ষিপ্ত। সেকালে আমাদের কাছে যে শক্তি ছিল, তা অশ্বশক্তির হিসাবে ৫ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। সে শক্তি ছিল আমাদের পেশির। আমাদের পূর্বপুরুষদের হাড় বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি যুদ্ধ আর দুর্ভোগ লেগেই থাকত। তার পেছনের কারণ তাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকা। তাদের গড় আয়ু ছিল ২০ বছরের কম।

তবে গত বরফযুগ শেষে, প্রায় ১০ হাজার বছর আগে কৃষিকাজ ও জীবজন্তু (বিশেষ করে ঘোড়া) পোষ মানানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করি আমরা। এর ফলে ক্রমেই আমাদের শক্তি উৎপাদন বেড়ে এক বা দুই হর্সপাওয়ার বা অশ্বশক্তি দাঁড়ায়। এর মাধ্যমে মানব ইতিহাসে প্রথম বড় ধরনের কোনো বিপ্লব দেখা দেয়। ঘোড়া বা গরুর কারণে একজন মানুষ নিজেই পুরো একটা মাঠ চাষ করতে সক্ষম হতো, দিনে ভ্রমণ করতে পারত প্রায় ১০ মাইল, কিংবা কয়েক শ পাউন্ড পাথর বা শস্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যেতে পারত। এর মাধ্যমেই মানবেতিহাসে প্রথমবার পরিবারগুলোতে বাড়তি শক্তি দেখা গিয়েছিল। ফলে এভাবে আমরা প্রথম শহরের গোড়াপত্তন করতে পারি। অতিরিক্ত শক্তির অর্থ হলো, কোনো সমাজ শিল্পী, স্থপতি, নির্মাতা ও লেখকশ্রেণির সহায়তা দিতে সক্ষম। তাতে প্রাচীন সভ্যতা উন্নতি লাভ করতে থাকে। শিগগিরই বনজঙ্গল ও মরুভূমি থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে লাগল গ্রেট পিরামিড ও অন্যান্য সাম্রাজ্য। তখন গড় আয়ু পৌঁছাল প্রায় ৩০ বছরে।

এরপর ৩০০ বছর আগে মানবেতিহাসে দ্বিতীয়বার বড় ধরনের বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। বিভিন্ন যন্ত্র ও বাষ্পীয় শক্তি আসার সঙ্গে সঙ্গে একজন লোকের জন্য শক্তির পরিমাণ বেড়ে ১০ অশ্বশক্তিতে পৌঁছায়। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের শক্তিতে লাগাম পরিয়ে, মানুষ তখন পুরো মহাদেশ মাত্র কয়েক দিনে অতিক্রম করতে পারত। যন্ত্রের মাধ্যমে পুরো একটি জমি চাষ করা সম্ভব হলো। সেই সঙ্গে একসঙ্গে হাজার হাজার মাইল পরিবহন করা সম্ভব হলো শত শত যাত্রীকে। বানানো সম্ভব হলো বিশাল সুউচ্চ ইমারত। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ১৯০০ সালে গড় আয়ু প্রায় ৫০ বছরে পৌঁছাল।

এখন মানবেতিহাসের তৃতীয় বড় ধরনের বিপ্লবের মাঝখানে আমরা। সেটি তথ্যবিপ্লব। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, বিদ্যুৎ ও শক্তির জন্য আমাদের বুভুক্ষু স্বভাবের কারণে শক্তিচাহিদা এখন আকাশছোঁয়া। কিন্তু শক্তি সরবরাহ সংকুচিত হয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। একজনের ব্যবহারযোগ্য শক্তি এখন মাপা হয় হাজার অশ্বশক্তিতে। আমরা মেনে নিয়েছি, একটি গাড়ি কয়েক শ অশ্বশক্তি উৎপাদন করতে পারে। আরও বেশি শক্তির চাহিদার কারণে অবিরাম গতির যন্ত্রসহ শক্তির উৎসের প্রতি আমাদের আগ্রহী করে তুলেছে।

ইতিহাসে অবিরাম গতিযন্ত্র

অবিরাম গতিযন্ত্রের খোঁজাখুঁজির ধারা অতীতেও বিদ্যমান ছিল। অবিরাম গতিযন্ত্রের বানানোর প্রথম রেকর্ডকৃত প্রচেষ্টা দেখা যায় অষ্টম শতাব্দীতে বেভারিয়ায়। পরবর্তী হাজার বছর ধরে এ ধরনের যন্ত্রের শতাধিক সংস্করণ বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। পরের এসব যন্ত্রের আদিরূপ ছিল আসলে ওই প্রথম যন্ত্রটি। একটি চাকার সঙ্গে অনেকগুলো ছোট ছোট চুম্বক সারিবদ্ধ করে এটি বানানো হয়েছিল। অনেকটা ফেরিস হুইল বা চাকার মতো ছিল যন্ত্রটি। চাকাটি মেঝের ওপর আরও বড় একটি চুম্বকের ওপর বসানো থাকত। চাকায় বসানো প্রতিটি চুম্বক নিচের স্থির চুম্বক পেরিয়ে যাওয়ার সময় সেগুলো বড় চুম্বকটিকে প্রথমে আকর্ষণ আর পরে বিকর্ষণ করত বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। পরিণামে চাকাটিতে ধাক্কা লাগত ও অবিরাম গতির সৃষ্টি হতো।

আরেকটি সুদক্ষ ডিজাইন ১১৫০ সালে তৈরি করেন ভারতীয় দার্শনিক ভাস্কর। তিনি এমন একটি চাকার কথা বলেছিলেন, যার রিমের ওপর কিছু ভর রাখা হলে তা চিরকাল চলতে থাকবে। তাঁর চাকাটি ঘুরেছিল; কারণ, সেটি ভারসাম্যহীন অবস্থায় ছিল। চাকাটি ভরের কারণে ঘুরতে থাকবে এবং তারপর সেটি তার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। এই চক্র বারবার পুনরাবৃত্তি করার মাধ্যমে ভাস্কর দাবি করেন যে এর মাধ্যমে যে কেউ সীমাহীন কাজ বের করে আনতে পারবে একেবারে বিনা মূল্যে।

বেভারিয়ান আর ভাস্করের অবিরাম গতির যন্ত্রের নকশা ও তার পরের উত্তরসূরি যন্ত্রগুলোতে প্রায় একই উপাদান ব্যবহার করতে দেখা যায়। এসব যন্ত্রে এমন একটি চাকা থাকে, যা কোনো অতিরিক্ত শক্তি না নিয়ে একটি আবর্তন শেষ করতে পারে। এভাবে সেগুলো ব্যবহারযোগ্য কাজ করতে পারে। (এসব কৌশলী যন্ত্র সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করে সাধারণত দেখা গেছে, চাকার প্রতিটি চক্রে বা আবর্তনে আসলে শক্তি হারায়, কিংবা এর মাধ্যমে ব্যবহারযোগ্য কোনো কাজ বের করে আনা যায় না।)

মজার ব্যাপার হলো, রেনেসাঁর আসার সঙ্গে সঙ্গে অবিরাম গতিযন্ত্র বানানোর দাবি বাড়তে থাকে। অবিরাম গতিযন্ত্রের প্রথম পেটেন্ট অনুমোদন করা হয় ১৬৩৫ সালে। জোহান বেসলার ১৭১২ সালের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৩০০ নকশা বিশ্লেষণ করে দেখেন। এরপর নিজেই নতুন আরেকটি নকশার দাবি করে বসেন তিনি। (কিংবদন্তি আছে, তাঁর বানানো যন্ত্রটি যে প্রতারণা, তা খোদ তাঁর পরিচারিকাই প্রকাশ করে দেয়।) অবিরাম গতির যন্ত্রে আগ্রহী হয়ে ওঠেন রেনেসাঁ-যুগের মহান চিত্রশিল্পী ও বিজ্ঞানী লেওনার্দো দা ভিঞ্চি। এ যন্ত্র সম্পর্কে তিনি জনসমক্ষে সমালোচনা করেছিলেন। যন্ত্রটিকে অনর্থক পরশপাথর খোঁজার মতো ব্যাপার বলে মন্তব্য করেন তিনি। কিন্তু তা হলে কী হবে, তলেতলে নিজের নোটবুকে সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প, চিমনি জ্যাকসহ স্বচালিত অবিরাম গতির যন্ত্রের নকশা আঁকেন। সেটি আগুনের ওপর রোস্ট বানানোর কাঠিকে ঘোরাতে ব্যবহার করেন তিনি।

১৭৭৫ সালের মধ্যে এত বেশি প্রস্তাব আসতে লাগল যে প্যারিসের রয়্যাল একাডেমি অব সায়েন্স একসময় ঘোষণা দিতে বাধ্য হলো, অবিরাম গতিবিষয়ক কোনো প্রস্তাব আর গ্রহণ করবে না তারা।

পারপিচুয়াল মোশন মেশিন বা অবিরাম গতিযন্ত্রের ইতিহাসবিদ আর্থার অর্ড-হিউম এসব যন্ত্রের উদ্ভাবকদের অক্লান্ত আত্মোৎসর্গ করার কথা লিখেছেন। তাঁরা অবিশ্বাস্য প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন উল্লেখ করে তাঁদের প্রাচীনকালের আলকেমিস্টদের সঙ্গে তুলনা করেছেন তিনি। তবে সেই সঙ্গে এটাও উল্লেখ করেছেন, ‘আলকেমিস্টরাও অন্তত জানতেন, তিনি কখন হেরে গেছেন।’

ধাপ্পাবাজি ও প্রতারণা

একসময় পারপিচুয়াল মোশন মেশিন বানানোর উত্তেজনা এতই বেশি ছিল যে সেখানে ধাপ্পাবাজিও নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। নিউইয়র্কে ১৮১৩ সালে চার্লস রেডহেফার একটি যন্ত্র দেখান। দর্শকদের অভিভূত করে ফেলে সেটি। কারণ, বিনা মূল্যে সীমাহীন শক্তি তৈরি করত যন্ত্রটি। (কিন্তু রবার্ট ফালটন যন্ত্রটি বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন। অনুসন্ধানে আগে থেকে লুকিয়ে রাখা একটি বিড়ালের অস্ত্র দিয়ে বানানো বেল্ট দিয়ে মেশিনটিকে চালাতে দেখতে পান তিনি। ওই তারটি চিলেকোঠায় লুকিয়ে থাকা এক লোকের কাছে সংযুক্ত ছিল। তিনি হাতল ঘুরিয়ে সেটি চালাচ্ছিলেন।)

একসময় বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরাও অবিরাম গতিযন্ত্রের তীব্র স্রোতে ভেসে গিয়েছিলেন। ১৮৭০ সালে সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনের সম্পাদকেরা ই পি উইলসের বানানো একটি যন্ত্র দেখে স্রেফ বোকা বনে যান। এরপর যথারীতি ‘গ্রেটেস্ট ডিসকোভারি এভার ইয়েট মেড’ শিরোনামে ম্যাগাজিনটিতে চাঞ্চল্যকর একটি ফিচার ছাপা হয়। কিন্তু পরে তদন্তকারীরা আবিষ্কার করেন, উইলসের অবিরাম গতির যন্ত্রে গোপন একটি শক্তির উৎস ছিল।

১৮৭২ জন আর্নেস্ট ওরেল কেলি তাঁর সময়ে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ও লাভজনক কেলেঙ্কারির জন্ম দেন। তিনি প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ বাগিয়ে আনেন। সেটা উনিশ শতকের শেষে অনেক বড় অঙ্কের টাকা। তাঁর অবিরাম গতির যন্ত্রের ভিত্তি ছিল টিউনিং ফর্কের কম্পন। এটি ‘ইথার’কে টোকা মারতে পারে বলে দাবি তোলেন তিনি। কেলির বিজ্ঞানবিষয়ক কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। নিজের বাড়িতে ধনী বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ জানাতেন তিনি। সেখানে তিনি তাঁর হাইড্রো-নিউমেটিক-পালসেটিং-ভ্যাকু- -ইঞ্জিন দেখিয়ে চমৎকৃত করতেন। তাঁর যন্ত্রটি বাইরের কোনো শক্তি ব্যবহার না করেই চারদিকে ঘুরত। উৎসাহী বিনিয়োগকারীরা এ স্বচালিত যন্ত্রটি দেখে বিস্মিত হতেন। তারপর কেলির অর্থভান্ডারে দুহাতে টাকা ঢালতেন বিনিয়োগকারীরা।

পরে বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়ে কিছু বিনিয়োগকারী ক্ষুব্ধ হন। প্রতারক হিসেবে অভিযুক্ত করা হয় তাঁকে। সে জন্য তাঁকে কিছুদিন কারাগারে কাটাতে হয়। অবশ্য ধনী হিসেবেই পরে মারা যান তিনি। মৃত্যুর পর বিনিয়োগকারীরা তাঁর যন্ত্রের গোপন একটি কৌশল খুঁজে পান। তাঁর বাড়িটি ভেঙে ফেলার সময় ঘরের মেঝে ও বেজমেন্টের দেয়ালে গোপন কিছু টিউব খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর যন্ত্রটিতে গোপনে সংকুচিত বায়ু সরবরাহ করত টিউবগুলো। আর টিউবগুলোতে এক ফ্লাইহুইলের মাধ্যমে শক্তি সরবরাহ করা হতো।

মার্কিন নৌবাহিনী ও মার্কিন প্রেসিডেন্টকেও একসময় গ্রাস করেছিল এসব যন্ত্র। ১৮৮১ সালে তরল অ্যামোনিয়া যন্ত্র উদ্ভাবন করেন জন জ্যামজি। শীতল অ্যামোনিয়ার বাষ্প প্রসারিত গ্যাস তৈরি করত, যা একটি পিস্টন নাড়াতে পারত। কাজেই শুধু মহাসাগরের তাপ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রে শক্তি সঞ্চালন করা যেত। মহাসাগর থেকে সীমাহীন শক্তি তৈরির এ আইডিয়ায় মার্কিন নৌবাহিনী এতই মুগ্ধ হয় যে তারা যন্ত্রটি অনুমোদন দেয়। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস গারফিল্ডের সামনে তা প্রদর্শনও করা হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, ওই বাষ্পকে আবারও ঠিকমতো জমাট বাঁধিয়ে তরলে পরিণত করা যেত না। কাজেই পুরো চক্রটি শেষে আর কাজ করেনি।

মার্কিন পেটেন্ট ও ট্রেডমার্ক অফিসে (ইউএসপিটিও) অসংখ্য অবিরাম গতির যন্ত্র উপস্থাপন করা হয়েছিল। তাই একসময় এ ধরনের কোনো যন্ত্রের কার্যকর মডেল উপস্থাপন না করা পর্যন্ত অনুমোদন করতে অস্বীকার করে প্রতিষ্ঠানটি। বিরল কিছু পরিস্থিতিতে, পেটেন্ট পরীক্ষকেরা কোনো মডেলে স্পষ্ট কোনো ত্রুটি না পেলেই কেবল সেটি অনুমোদন করা হতো। ইউএসপিটিও ঘোষণা দেয়, ‘অবিরাম গতির সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সাধারণভাবে কোনো মডেলের কার্যপ্রণালি দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (এই ফাঁকটির সুযোগ নিত বিবেকহীন উদ্ভাবকেরা। ইউএসপিটিও কাগজে-কলমে তাদের যন্ত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে দাবি করে সরল বিনিয়োগকারীদের তাদের উদ্ভাবিত যন্ত্রে বিনিয়োগে রাজি করাত তারা।)

তবে অবিরাম গতির যন্ত্রের খোঁজার পালা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে একেবারে বৃথা যায়নি। কারণ, কোনো উদ্ভাবক অবিরাম গতির যন্ত্র বানাতে না পারলেও তারা এ ধরনের অলীক যন্ত্র বানানোর পেছনে বিপুল সময় ও শক্তি খরচ করত। ফলে পদার্থবিদেরা বেশ ভালোভাবে তাপীয় ইঞ্জিনের প্রকৃতি সম্পর্কে গবেষণা করতে পারেন। (একইভাবে আলকেমিস্ট বা কিমিয়াবিদেরা একসময় পরশপাথর খুঁজতে বিপুল সময় ও শ্রম ব্যয় করত। তাদের বিশ্বাস ছিল, পরশপাথরের মাধ্যমে সিসাকে সোনায় রূপান্তর করা সম্ভব। কিন্তু তাদের সেই নিষ্ফল চেষ্টার কারণে একসময় রসায়নের মৌলিক সূত্রগুলো উদ্ঘাটিত হয়েছিল।)

যেমন ১৭৬০-এর দশকে জন কক্স এমন এক ঘড়ি বানান, যা চিরকাল চলতে পারবে। বায়ুমণ্ডলের চাপের তারতম্য থেকে শক্তির জোগান পেত ঘড়িটি। বায়ুচাপের পরিবর্তন একটি ব্যারোমিটারকে চালাত। পরে ঘড়ির হাতল ঘোরাত এই ব্যারোমিটার। ঘড়িটি বেশ ভালোভাবে কাজ করত। এখনো বহাল তবিয়তে আছে সেটি। ঘড়িটি চিরকাল চলতে পারে; কারণ, এটি বায়ুমণ্ডলীয় চাপের পরিবর্তন থেকে বাইরের শক্তি সংগ্রহ করে।

কক্সের মতো পারপিচুয়াল মেশিন একসময় বিজ্ঞানীদের অনুমান করতে অনুপ্রাণিত করল যে বাইরে থেকে শক্তি আমদানি করা গেলে এ ধরনের যন্ত্রকে চিরকাল চালানো সম্ভব। তাতে সর্বমোট শক্তি সংরক্ষিত থাকে। এই তত্ত্বই পরে থার্মোডাইনামিকস বা তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্রের দিকে নিয়ে যায়। এ সূত্র অনুসারে, মোট বস্তু বা শক্তিকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। এভাবে একসময় তাপগতিবিদ্যার তিনটি সূত্র স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে মেনে নেওয়া হয়। দ্বিতীয় সূত্র বলে, এনট্রপির (বিশৃঙ্খলা) সর্বমোট পরিমাণ সব সময় বাড়ে। (মোটাদাগে বলা যায়, এই সূত্র বলে, উত্তপ্ত জায়গা থেকে শীতল জায়গায় তাপ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রবাহিত হয়।) তাপগতিবিদ্যার তৃতীয় সূত্রমতে, পরম শূন্য তাপমাত্রায় কখনো পৌঁছানো সম্ভব নয়।

মহাবিশ্বকে যদি একটা খেলার সঙ্গে তুলনা করা হয় আর এই খেলার লক্ষ্যকে যদি শক্তি বের করে আনার সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে এ তিনটি সূত্রকে এভাবেও লেখা যায় :

‘কোনো কিছু না দিয়ে কিছু পাওয়া যাবে না।’ (প্ৰথম সূত্র ) ‘লাভ বা ক্ষতি কোনোটাই পাওয়া যাবে না।’ (দ্বিতীয় সূত্র ) ‘এই খেলা থেকে বের হয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়।’ (তৃতীয় সূত্র)

(সূত্রগুলো অনিবার্যভাবে সবর্দা পরম সত্য নয়, সে কথা বেশ সাবধানে বলেন পদার্থবিদেরা। তারপরও কোনো বিচ্যুতি এখনো পাওয়া যায়নি। সূত্রগুলো যারা মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা করবে, তারা অবশ্যই কয়েক শতাব্দীর সতর্ক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। এই সূত্রগুলোর সম্ভাব্য বিচ্যুতি নিয়ে কিছুক্ষণ পর আমরা আলাপ করব। )

উনিশ শতকের বড় অর্জনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এই সূত্রগুলো। কিন্তু তা যুগান্তকারী হওয়ার পাশাপাশি এতে বিয়োগান্ত ঘটনাও জড়িয়ে আছে। এগুলো যারা সূত্রবদ্ধ করছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মহান জার্মান পদার্থবিদ লুডভিগ বোলজম্যান। সূত্র তিনটি সূত্রবদ্ধ করতে গিয়ে এক বিতর্কে সৃষ্টি হয়। এর জের ধরে আত্মহত্যা করেন তিনি

লুডভিগ বোলজম্যান ও এনট্রপি

মানুষ হিসেবে বোলজম্যান ছিলেন ক্ষুদ্রকায়, কিন্তু তাঁর দেহের ওপরের অংশ ছিল বিপুলাকৃতির। জঙ্গলের মতো ঘন ও বড়সড় ছিল তাঁর মুখের দাড়ি। তাঁর এই দুর্ধর্ষ আর ভয়ানক দেহাবয়ব দেখে ভুল ধারণা জন্মাতে পারে। কারণ, চেহারা দেখে কোনোভাবেই বোঝা সম্ভব নয় তাঁর আইডিয়াগুলো রক্ষার লড়াই করতে তাঁকে কতটা ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। নিউটনিয়ান পদার্থবিদ্যা উনিশ শতকেও রাজত্ব করছিল বেশ ভালোভাবে। কিন্তু বোলজম্যান একসময় বুঝতে পেরেছিলেন, এই সূত্রগুলোকে কখনোই পরমাণুর মতো বিতর্কিত ধারণায় ব্যবহার করা যাবে না। কারণ, পরমাণুর ধারণা তখনো সেকালের শীর্ষ বিজ্ঞানীরা মেনে নেননি। (আমরা মাঝে মাঝে ভুলে যাই, এক শতাব্দী আগেও বেশ বড়সংখ্যক বিজ্ঞানী জোরের সঙ্গে বলতেন, পরমাণু হলো হিসাবের সুবিধার্থে চতুর এক কৌশলমাত্র, বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। পরমাণু এতই ক্ষুদ্র যে এদের সত্যিকারের কোনো অস্তিত্ব নেই বলে দাবি করতেন তাঁরা।

নিউটন প্রমাণ করেন, কোনো আত্মা বা ইচ্ছাশক্তি নয়, বরং যান্ত্রিক বল সব বস্তুর গতি নির্ধারণের জন্য যথেষ্ট। বোলজম্যান এরপর এক সরল অনুমানের ভিত্তিতে গ্যাসের বেশ কিছু অভিজাত সূত্র প্রতিপাদন করেন। তিনি বলেন, গ্যাস অতি ক্ষুদ্র পরমাণু দিয়ে গঠিত, অনেকটা বিলিয়ার্ড বলের মতো। এসব পরমাণু নিউটনের বলের সূত্রগুলো মেনে চলে। বোলজম্যানের কাছে গ্যাসভর্তি কোনো চেম্বারের অর্থ ছিল ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন অতি ক্ষুদ্র ইস্পাতের বল ভরা একটি বাক্স। এসব বল বাক্সের দেয়ালে ও সেই সঙ্গে পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খায় নিউটনের গতির সূত্র মেনে। বোলজম্যান (আর জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলও স্বাধীনভাবে প্রমাণ করেছেন) গাণিতিকভাবে প্রমাণ করেন, এই সরল অনুমান থেকে কীভাবে চোখধাঁধানো নতুন সূত্র পাওয়া যায়। এটি পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম সেরা মাস্টারপিস। সেই সঙ্গে জন্ম নেয় পদার্থবিজ্ঞানের নতুন একটা শাখা। এ শাখাটির নাম হলো স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিকস বা পারিসংখ্যানিক বলবিদ্যা।

হঠাৎ বস্তুর অনেকগুলো ধর্ম প্রথম নীতি থেকে পাওয়া গেল। নিউটনের সূত্রগুলো বলে, পরমাণুতে প্রয়োগ করতে গেলে শক্তিকে অবশ্যই অপরিবর্তনীয় হতে হবে। পরমাণুদের পরস্পরের মধ্যে সংঘর্ষে শক্তি সংরক্ষিত থাকতে হবে। এর মানে হলো, শক্তি সংরক্ষণ করবে পুরো একটি চেম্বারের ট্রিলিয়নসংখ্যক পরমাণুও। শক্তির সংরক্ষণশীলতা এখন প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। তবে তা পরীক্ষণের মাধ্যমে নয়, বরং প্রথম নীতির মাধ্যমে, অর্থাৎ পরমাণুর নিউটনিয়ান গতিবিদ্যা।

উনিশ শতকে পরমাণুর অস্তিত্ব নিয়ে তখনো ভয়ানক বিতর্ক চলছিল। নামকরা বিজ্ঞানী, যেমন দার্শনিক আর্নেস্ট মাখ তা নিয়ে প্রায়ই বিদ্রূপ করতেন। অভিমানী ও প্রায়ই বিষাদগ্রস্ত মানুষ বোলজম্যান একসময় সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। পরমাণুবাদবিরোধীরা প্রায়ই তাঁকে ভয়ানক আক্রমণ করত। পরমাণুবাদবিরোধীদের মতে, যে জিনিস পরিমাপ করা যায় না, তার কোনো অস্তিত্বও নেই। স্বাভাবিকভাবেই এর মধ্যে ছিল পরমাণু। বোলজম্যানের জন্য আরও ভয়াবহ অবমাননাকর ব্যাপারটা ছিল, তার অনেকগুলো গবেষণাপত্র বাতিল করেন সেকালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞান জার্নালের এক নামকরা সম্পাদক। তার কারণ ছিল, ওই সম্পাদক দাবি করতেন, পরমাণু ও অণু হলো বেশ কার্যকরী তাত্ত্বিক হাতিয়ার, কিন্তু প্রকৃতিতে এ ধরনের কোনো কিছুর সত্যিকার অস্তিত্ব নেই।

একের পর এক ব্যক্তিগত আক্রমণে ভীষণ ক্লান্তি ও তিক্ততায় ১৯০৬ সালে আত্মহত্যা করেন বোলজম্যান। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা তখন সাগরতীরে ছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, তিনি জানতেও পারেননি মাত্র এক বছর আগে আলবার্ট আইনস্টাইন নামের এক বেপরোয়া তরুণ পদার্থবিদ সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন। তিনি পরমাণুর অস্তিত্বের প্রমাণ দেখিয়ে প্রথম এক গবেষণা প্রবন্ধ লিখে ফেলেছেন—কিন্তু সে কথা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলেন না বোলজম্যান।

মোট এনট্রপি সর্বদা বাড়ে

বোলজম্যান ও অন্য পদার্থবিদের কাজের কারণে অবিরাম গতিযন্ত্রের প্রকৃতি স্পষ্ট হতে সহায়তা করে। আবার এ যন্ত্রকে দুটি ধরনে ভাগ করেন তাঁরাই। অবিরাম গতিযন্ত্রের প্রথম ধরনটি থার্মোডাইনামিকস বা তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্রটি লঙ্ঘন করে। অর্থাৎ যন্ত্রগুলো যে পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করে, তার চেয়ে বেশি উৎপাদন করে। সব ক্ষেত্রে পদার্থবিদেরা দেখতে পান, এ রকম অবিরাম গতিযন্ত্র অন্য কোনো গুপ্ত ও বাইরের শক্তি উৎসের ওপর নির্ভরশীল। এটি হয় ধোঁকাবাজি, নয়তো উদ্ভাবকেরা বাইরের শক্তি উৎসের কথা জানেন না।

অবিরাম গতিযন্ত্রের দ্বিতীয় ধরনটি আরও বেশি জটিল। এগুলো শক্তির সংরক্ষণশীলতার সূত্র বা তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র মেনে চলে, কিন্তু দ্বিতীয় সূত্রটি লঙ্ঘন করে। তাত্ত্বিকভাবে দ্বিতীয় ধরনের অবিরাম গতিযন্ত্র অপচয় করার মতো কোনো তাপ তৈরি করে না। কাজেই এটি ১০০ ভাগ সুদক্ষ। কিন্তু দ্বিতীয় সূত্রটি মতে, এ ধরনের কোনো যন্ত্র থাকা অসম্ভব। অর্থাৎ অপচয় করার মতো তাপ অবশ্যই সব সময় তৈরি হবে। তাই সর্বদা বাড়তে থাকবে মহাবিশ্বের বিশৃঙ্খলা বা ক্যাওয়াস বা এনট্রপি। একটা যন্ত্র কতটা দক্ষ, তাতে কিছু যায় আসে না, যন্ত্রটি সর্বদাই কিছু তাপ অপচয় করবেই। মহাবিশ্বের এনট্রপি বেড়ে যাবে তাতে।

সর্বমোট এনট্রপি যে সর্বদা বাড়ে, এই সত্যটা লুকিয়ে আছে মানবজাতির ইতিহাসের গভীর। একইভাবে আছে প্রকৃতির মধ্যেও। দ্বিতীয় সূত্র মোতাবেক কোনো কিছু বানানোর চেয়ে ধ্বংস করা অনেক সহজ। কোনো কিছু তৈরি করতে যদি কয়েক হাজার বছর লাগে (যেমন মেক্সিকোর অ্যাজটেক সাম্রাজ্য), তা মাত্র কয়েক মাসেই ধ্বংস করে ফেলা যায়। ইতিহাস সাক্ষী, স্প্যানিশ বিজেতার একদল লুটেরা সশস্ত্র ঘোড়া নিয়ে অ্যাজটেক সাম্রাজ্য পুরোপুরি ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল।

যতবারই আয়নার দিকে তাকাবেন, ততবারই নতুন কোনো ব্রণ বা একটি সাদা চুল চোখে পড়বে আপনার। এখানেও দ্বিতীয় সূত্রের প্রভাব দেখা যায়। জীববিজ্ঞানীরা বলেন, বয়স হওয়ার প্রক্রিয়াটা হলো, আমাদের কোষ ও জিনের ভেতর জিনগত ত্রুটিগুলো ক্রমান্বয়ে ভিড় করতে থাকে। কোষের কাজ করার সক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে সে কারণে। বয়স হওয়া, মরিচা ধরা, পচে যাওয়া, ক্ষয় হওয়া, খণ্ডিত হওয়া ও চুপসে যাওয়া—সবগুলোই তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের উদাহরণ।

দ্বিতীয় সূত্রের প্রকৃতি উল্লেখ করে জ্যোতির্বিদ আর্থার এডিংটন একবার বলেন, ‘এনট্রপি সর্বদা বাড়ছে, এই সূত্রের অবস্থান প্রকৃতির সব সূত্রের মধ্যে শীর্ষে বলেই আমার ধারণা। আপনার তত্ত্ব যদি তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের বিরোধী প্রমাণিত হয়, তাহলে আপনার জন্য কোনো আশার বাণী শোনাতে পারছি না। কারণ, এ রকম কিছুই থাকতে পারে না। বরং তা গাঢ় কলঙ্কের অতলে তলিয়ে যাবে।’

কিছু উদ্যমী ইঞ্জিনিয়ার (ও চতুর প্রতারক) এখনো অবিরাম গতিযন্ত্র উদ্ভাবনের ঘোষণা দিয়েই যাচ্ছে। সম্প্রতি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল আমাকে এক উদ্ভাবকের ব্যাপারে মন্তব্য করার অনুরোধ জানিয়েছিল। ওই উদ্ভাবক তাঁর বানানো যন্ত্রের পেছনে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ঢালতে বিনিয়োগকারীদের রাজি করিয়ে ফেলেছেন। এ ব্যাপারে চাঞ্চল্যকর প্রবন্ধ প্রকাশ করে শীর্ষ কয়েকটি বাণিজ্যিক পত্রিকা। সেগুলো লিখেছিলেন বিজ্ঞানে কোন অভিজ্ঞতা না থাকা সাংবাদিকেরা। সম্ভাবনাময় উদ্ভাবন যে বিশ্বকে পাল্টে দেবে (আর এই প্রক্রিয়ায় আকর্ষণীয় লাভ আসতে থাকবে), সেটিই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে লেখেন তাঁরা। হেডলাইনে লেখা ছিল, ‘জিনিয়াস অর ক্র্যাকপট?

বিনিয়োগকারীরা কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ঢেলেছিলেন এই যন্ত্রের পেছনে। কিন্তু আমাদের হাইস্কুলে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের যেসব মৌলিক সূত্র শেখানো হয়েছে, তার বেশির ভাগই লঙ্ঘন করে এই যন্ত্র। (একটা লোক জোচ্চুরি করছে, এটা দেখে আমি মর্মাহত হইনি; কারণ, এটা তো কালের শুরু থেকেই হয়ে আসছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপারটি ছিল, ওই উদ্ভাবক কতিপয় ধনী বিনিয়োগকারীকে বোকা বানাতে পেরেছিলেন; কারণ, তাদের মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞানটুকু নেই।) আমি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে সেই আগের প্রবাদটিই শুনিয়েছিলাম, ‘আ ফুল অ্যান্ড হিজ মানি আর ইজিলি পার্টেড।’ এর সঙ্গে ছিল পি টি বারনামের বিখ্যাত সেই উক্তি, ‘দেয়ারস আ সাকার বর্ন এভরি মিনিট।’ ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস, ইকোনমিস্ট এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল—সবাই মিলে অবিরাম গতিযন্ত্র নিয়ে বিভিন্ন উদ্ভাবক যেসব প্রতারণা করেছেন, তা নিয়ে যদি বড় ধরনের ফিচার ছাপত, তাহলে খুব ভালো হতো।

তিনটি সূত্র ও প্রতিসাম্য

এসবই গভীর এক প্রশ্ন উত্থাপন করে : তাপগতিবিদ্যার এই কঠিন সূত্রগুলো কেন মেনে চলতে হয়? এটি এমন এক রহস্য, যা সূত্রগুলো প্রথম প্রস্তাবিত হওয়ার পর থেকেই বিজ্ঞানীদের কৌতূহলী করে আসছে। আমরা যদি এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারি, তাহলে হয়তো সূত্রগুলোর মধ্যে কোনো ফাঁক খুঁজে পেতেও পারি। তারপর তা প্রয়োগের মাধ্যমে দুনিয়া উল্টেপাল্টে যেতে পারে।

শক্তির সংরক্ষণশীলতার নীতির সত্যিকারের জন্ম সম্পর্কে আমি জেনেছিলাম গ্র্যাজুয়েট স্কুলে। সেদিন সত্যি সত্যিই বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম মৌলিক নীতি (আবিষ্কার করেন গণিতবিদ এমি নোয়েথার, ১৯১৮ সালে) হলো, কোনো সিস্টেম সিমেট্রি বা প্রতিসাম্য প্রক্রিয়ার মধ্যে গেলে ফলস্বরূপ সংরক্ষণশীলতার সূত্র পাওয়া যায়। মহাবিশ্বের সূত্রগুলো যদি সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে একটি দারুণ ফলাফল পাওয়া যায়। ফলাফলটি হলো সিস্টেমটি শক্তির সংরক্ষণ করে। (আবার যেকোনো দিকে চলাচল করলেও পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো একই থাকে, তাহলে যেকোনো দিকেই একইভাবে ভরবেগ সংরক্ষিত হয়। আর কোনো ঘূর্ণনের ভেতর পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র যদি একই হয়, তাহলে কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষিত হয়।)

এ বিষয়টি আমাকে বেশ অবাক করেছিল। বুঝতে পারলাম, বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সিগুলো (দৃশ্যমান মহাবিশ্বের প্রায় কিনারার কাছে) থেকে আসা কোনো নক্ষত্রের আলো যখন আমরা বিশ্লেষণ করি, তখন আমরা আলোর যে স্পেকট্রাম বা বর্ণালি পাই, তা পৃথিবীতে পাওয়া বর্ণালির মতো একই রকম। অতীতের আলোর এই ধ্বংসাবশেষ, যা পৃথিবী বা সূর্যের জন্মের কয়েক বিলিয়ন বছর আগে নিঃসৃত হয়েছিল। এই আলোতেও আমরা বর্তমানের পৃথিবীতে পাওয়া হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, কার্বন, নিয়ন ও অন্যান্য মৌলের একই রকম নির্ভুল ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেখতে পাই। তার মানে হলো, গত কয়েক বিলিয়ন বছরে পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক সূত্রগুলোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। এমনকি সূত্রগুলো মহাবিশ্বের বহিঃস্থ প্রান্তদেশেও ধ্রুব সত্য।

আমি বুঝতে পারলাম, সর্বনিম্ন ধরলেও নোয়েথার থিওরেম বা উপপাদ্যের অর্থ হলো, শক্তির সংরক্ষণশীলতা হয়তো আগামী কয়েক বিলিয়ন বছরে টিকে থাকবে। হয়তো চিরকাল তা না-ও থাকতে পারে। আমরা যতটুকু জানি, তাতে মনে হয় না পদার্থবিজ্ঞানের কোনো মৌলিক সূত্র সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। আর এ কারণেই শক্তি সংরক্ষিত থাকে।

আধুনিক পদার্থবিদ্যায় নোয়েথার উপপাদ্যের প্রয়োগ অনেক গভীর। পদার্থবিদেরা যখনই নতুন তত্ত্ব প্রতিপাদন করেন, সেটি মহাবিশ্বের উৎপত্তি, কোয়ার্ক ও অন্যান্য অতিপারমাণবিক কণাদের মিথস্ক্রিয়া কিংবা প্রতিকণা সম্পর্কে কিছু বলুক বা না-বলুক, আমরা প্রথমেই ওই সিস্টেম যে প্রতিসাম্যতা মেনে চলে তা দিয়ে শুরু করি। আসলে সিমেট্রি বা প্রতিসাম্য এখন নতুন তত্ত্ব প্রতিপাদনে মৌলিক পথপ্রদর্শক নীতি হিসেবে পরিচিত। অথচ অতীতে প্রতিসাম্যকে একটি তত্ত্বের উপজাত হিসেবে মনে করা হতো। তখনকার বিশ্বাস ছিল, এটি চমৎকার কিন্তু তত্ত্বের জন্য চূড়ান্তভাবে অপ্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য। এখন আমরা বুঝতে পারি, প্রতিসাম্যগুলো যেকোনো তত্ত্বকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য প্রয়োজনীয় ধর্ম। নতুন তত্ত্ব প্রতিপাদনে, আমরা পদার্থবিদেরা প্রথমে প্রতিসাম্য দিয়ে শুরু করি, তারপর তার চারদিকে তত্ত্বটি গঠন করি।

(দুঃখজনক ব্যাপার হলো, স্বীকৃতির জন্য বোলজম্যানের মতোই এমি নোয়েথারকে চরম লড়াই করতে হয়েছে। নারী গণিতবিদ হওয়ার কারণে শীর্ষস্থানীয় কোনো প্রতিষ্ঠানে তাঁর স্থায়ী পদ একের পর এক প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। নোয়েথারের গুরু ছিলেন গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট। নোয়েথারকে শিক্ষক হিসেবে কোথাও নিশ্চিত পদ দিতে ব্যর্থ হয়ে তিনি খুবই হতাশ হন। সে কারণে তিনি বিস্মিত হয়ে একবার বলেছিলেন, ‘আমরা আসলে কী, বিশ্ববিদ্যালয়, নাকি কোনো বেদিং সোসাইটি।)

এর মাধ্যমে এক বিব্রতকর প্রশ্নের উদয় হয়। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো পরিবর্তন না হওয়ার কারণে শক্তি যদি সংরক্ষিত হয়, তাহলে এই প্রতিসাম্যতা কি বিরল? অস্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতিতে তা কি ভেঙে যেতে পারবে? মহাজাগতিক পরিসরে শক্তির সংরক্ষণশীলতা লঙ্ঘিত হওয়ার এখনো সম্ভাবনা রয়েছে, যদি আমাদের সূত্রগুলোর প্রতিসাম্যতা কোনো বাইরের ও অনাকাঙ্ক্ষিত জায়গায় ভেঙে যায়।

পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিংবা দূরত্বের সঙ্গে পরিবর্তন হলে এটি ঘটতে পারে। (আসিমভের উপন্যাস দ্য গডস দেমসেলভস-এ এই প্রতিসাম্যতা ভেঙে গিয়েছিল। কারণ, স্থানে সৃষ্ট একটি ছিদ্র আমাদের মহাবিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিল অন্য এক সমান্তরাল মহাবিশ্বকে। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো স্থানের মধ্যে ওই ছিদ্রের আশপাশে বদলে দেয়। তাতে ভেঙে পড়ে তাপগতিবিদ্যার সূত্রগুলো। কাজেই শক্তির সংরক্ষণশীলতা লঙ্ঘিত হতে পারে, যদি স্থানে ওয়ার্মহোলের মতো কোনো ছিদ্র থাকে।)

এতে আরেকটি ত্রুটিও আছে, যেটি নিয়ে বর্তমানে বিতর্ক চলছে যে শক্তি হয়তো শূন্য থেকেও আসতে পারে।

শূন্য থেকে শক্তি?

একটি লোভনীয় প্রশ্ন হলো, শূন্য থেকে কি শক্তি নিঃসরণ করা সম্ভব? পদার্থবিদেরা অতি সম্প্রতি বুঝতে পেরেছেন যে ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থান আসলে মোটেও খালি নয়, বরং সেখানে জোড়বদ্ধ সক্রিয়তা বর্তমান।

এই আইডিয়ার অন্যতম প্রস্তাবক হলেন বিশ শতকের পাগলাটে জিনিয়াস নিকোলা টেসলা। টমাস এডিসনের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তিনি। জিরো পয়েন্ট এনার্জি বা শূন্য বিন্দু শক্তিরও অন্যতম প্রস্তাবক টেসলা। ধারণাটি হলো, শূন্যস্থানে হয়তো অকল্পনীয় পরিমাণ শক্তি রয়েছে। সেটি সত্যি হলে শূন্যস্থান হয়ে উঠতে পারে চূড়ান্ত ‘ফ্রি লাঞ্চ’। আক্ষরিক অর্থেই এটি তখন পাতলা বাতাস থেকে সীমাহীন শক্তি সরবরাহ করতে পারবে। শূন্যস্থান শূন্য ও বস্তুহীন হওয়ার বদলে হয়ে উঠবে বিপুল শক্তির আধার।

বর্তমানের সার্বিয়ার ছোট্ট এক শহরে জন্মেছিলেন টেসলা। ১৮৮৪ সালে তিনি যখন যুক্তরাষ্ট্রে এলেন, তখন তাঁর পকেটে বলতে গেলে কোনো ফুটো পয়সাও নেই। বেশ দ্রুতই টমাস এডিসনের সহকারী হলেন তিনি। কিন্তু তাঁর মেধার কারণেই তিনি একসময় টমাস এডিসনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। বিখ্যাত এক প্রতিযোগিতায় (ইতিহাসবিদেরা যাকে বলেন ‘বিদ্যুতের যুদ্ধ’) এডিসনের বিরুদ্ধে জিতে যান টেসলা। এডিসন বিশ্বাস করতেন, ডাইরেক্ট কারেন্ট (ডিসি) মোটর দিয়ে তিনি গোটা বিশ্বকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবেন। অন্যদিকে টেলসা ছিলেন অল্টারনেটিং কারেন্টের (এসি) স্রষ্টা। তিনি বেশ সফলতার সঙ্গে প্রমাণ করতে পারেন যে তাঁর পদ্ধতিটি এডিসনের তুলনায় অনেক বেশি ভালো। আবার তাঁর পদ্ধতিতে দূরবর্তী স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রেই কম শক্তি অপচয় হয়। বর্তমানে আমাদের পুরো গ্রহটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের ভিত্তির পেটেন্ট এডিসনের নয়, বরং টেসলার।

টেসলার উদ্ভাবন ও পেটেন্টসংখ্যা সাত শতাধিক। এর মধ্যে রয়েছে আধুনিক বিদ্যুতের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাইলফলক। ইতিহাসবিদেরা এমন এক বিশ্বাসযোগ্য ঘটনাও হাজির করেছেন যে গুগলিমো মার্কনির (রেডিওর উদ্ভাবক হিসেবে তিনিই সুপরিচিত) আগেই রেডিও উদ্ভাবন করেছিলেন টেসলা। আবার উইলহেম রন্টজেনের আগেই কার্যকরী এক্স-রে আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। (মার্কনি ও রন্টজেন উভয়েই পরে যেগুলোর কারণে নোবেল পুরস্কার পান, সেগুলো উদ্ভাবন সম্ভবত অনেক আগেই করেছিলেন টেসলা।)

টেসলা বিশ্বাস করতেন, শূন্যস্থান থেকে তিনি সীমাহীন শক্তি নিঃসরণ করতে পারবেন। কিন্তু এ দাবি তিনি দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর নোটে প্রমাণ করতে পারেননি। প্রথমেই জিরো পয়েন্ট এনার্জি (কিংবা শূন্যস্থানে থাকা শক্তি) তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র লঙ্ঘন করে বলে মনে হয়। অবশ্য জিরো পয়েন্ট এনার্জি নিউটনিয়ান বলবিদ্যাকে অমান্য করে। জিরো পয়েন্ট এনার্জি ধারণাটি সম্প্রতি অভিনব একটি দিক থেকে নতুন করে উত্থাপিত হয়েছে।

বর্তমানে পৃথিবীর চারপাশে ঘোরা স্যাটেলাইটের (যেমন ডব্লিউএমএপি স্যাটেলাইট) তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিস্ময়কর এক সিদ্ধান্ত পৌঁছাতে বাধ্য হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সিদ্ধান্তটি হলো, মহাবিশ্বের ৭৩ শতাংশ ডাক এনার্জি বা গুপ্তশক্তি দিয়ে তৈরি। অর্থাৎ বিশুদ্ধ ভ্যাকুয়ামের শক্তি। এর অর্থ হলো, গোটা মহাবিশ্বে শক্তির বিপুল আধার হলো শূন্যস্থান, যা মহাবিশ্বে ছায়াপথগুলো আলাদা করে রেখেছে। (গুপ্তশক্তি এতই বেশি যে এরা ছায়াপথগুলোকে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। আবার মহাবিশ্বকে একসময় বিগ ফ্রিজ অবস্থায় নিয়ে যাবে এই গুপ্তশক্তি।)

মহাবিশ্বের সব জায়গাতেই গুপ্তশক্তি ছড়িয়ে আছে। এমনকি আপনার বসার ঘরে আর আপনার দেহের ভেতরেও আছে গুপ্তশক্তি। মহাকাশে গুপ্তশক্তির পরিমাণ প্রকৃত অর্থেই অতিমাত্রায়। সব নক্ষত্র ও ছায়াপথের সব শক্তি একত্র করলেও তার চেয়ে বেশি হবে গুপ্তশক্তি। আমরা পৃথিবীর গুপ্তশক্তির পরিমাণ গণনা করতে পারি। এর পরিমাণ এতই অল্প যে তা দিয়ে অবিরাম গতিযন্ত্রে ব্যবহার করা যাবে না। টেসলা গুপ্তশক্তি সম্পর্কে সঠিক ছিলেন, কিন্তু পৃথিবীতে গুপ্তশক্তির পরিমাণ সম্পর্কে তাঁর ভাবনায় ত্রুটি ছিল।

আসলেই কি তিনি ভুল ছিলেন?

আধুনিক পদার্থবিদ্যায় সবচেয়ে বিব্রতকর ফাঁকটি হলো এখন পর্যন্ত কেউই গুপ্তশক্তির পরিমাণ নির্ণয় করতে পারেনি। স্যাটেলাইট ব্যবহার করে এটা পরিমাপ করা যায়। পারমাণবিক পদার্থবিদ্যার সর্বশেষ তত্ত্ব ব্যবহার করে গুপ্তশক্তির পরিমাণ নির্ণয় করতে গেলে এমন একটি সংখ্যায় পৌঁছায়, যাতে ভুলের পরিমাণের ফ্যাক্টর ১০১২০, অর্থাৎ ১-এর পর ১২০টি শূন্য! পুরো পদার্থবিজ্ঞানে তত্ত্ব ও পরীক্ষার মধ্যে সবচেয়ে বড় ধরনের অসংগতি এটি।

সমস্যাটি হলো, কেউই জানে না ‘শূন্য শক্তি’ কীভাবে গণনা করতে হয়। পদার্থবিজ্ঞানে এটি এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন (কারণ, এটিই ক্রমেই মহাবিশ্বের ভাগ্য নির্ধারণ করবে)। কিন্তু একে কীভাবে গণনা করতে হবে, সে ব্যাপারে বর্তমানে আমরা কোনো হদিস জানি না। কোনো তত্ত্বই ডার্ক এনার্জি বা গুপ্তশক্তিকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। অবশ্য এর অস্তিত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণের ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়া গেছে।

কাজেই টেসলার সন্দেহমতোই শূন্যস্থানে শক্তির অস্তিত্ব আছে। কিন্তু এই শক্তিকে ব্যবহারোপযোগী কোনো শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহারের জন্য তার পরিমাণ হয়তো খুব অল্প। ছায়াপথগুলোর মধ্যে বিপুল পরিমাণ গুপ্তশক্তি থাকলেও পৃথিবীতে এই শক্তি খুবই অল্প। কিন্তু এই শক্তি পরিমাপের পদ্ধতি, কিংবা শক্তিটি কোথা থেকে এল—সেসব সম্পর্কে কেউ এখনো কিছু জানে না। এটিই এখন সবচেয়ে ব্রিবতকর ব্যাপার।

আমার মতে, শক্তির সংরক্ষণশীলতা আসে মহাজাগতিক গভীর কোনো কারণে। এসব সূত্রের লঙ্ঘনের অর্থ, মহাবিশ্বের বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধিতে গভীর পরিবর্তন দরকার। আর গুপ্তশক্তির রহস্য পদার্থবিদদের এ প্রশ্নটি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে।

সত্যিকারের একটা অবিরাম গতিযন্ত্র বানানোর জন্য মহাজাগতিক পরিসরে পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক সূত্রগুলো নিয়ে আমাদের নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে। সে কারণে অবিরাম গতিযন্ত্রকে আমি তৃতীয় শ্রেণির অসম্ভাব্যতা হিসেবে গণ্য করেছি। এর মানে, এটি হয় সত্যি সত্যিই অসম্ভব, নয়তো এ ধরনের যন্ত্র বানানোর জন্য মহাজাগতিক পরিসরে মৌলিক পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধিটি মৌলিকভাবে পরিবর্তন করতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম বড় অসমাপ্ত অধ্যায়ের নাম গুপ্তশক্তি।

তথ্যনির্দেশ

ভাস্কর : আসল নাম ভাস্করাচার্য। তিনি দ্বিতীয় ভাস্কর নামেও পরিচিত। এই গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ ১১১৪ সালে ভারতের বিজাপুরে (বর্তমানে কর্ণাটক জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সেরা কাজের মধ্যে রয়েছে গণিতের বই সিদ্ধান্ত শিরোমণি। ৩৬ বছর বয়সে সংস্কৃত ভাষায় বইটি লেখেন তিনি। বইটির চারটি ভাগের মধ্যে একটির নাম লীলাবতী, যা তাঁর মেয়ের নামে নামকরণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। মৃত্যু ১১৮৫ সালে। ১১৫০ সালের দিকে তিনি এমন একটি চাকার কথা বলেন, যা চিরকাল ঘুরতে থাকবে বলে দাবি করেন।

তাপগতিবিদ্যা : কোনো গতিশীল ভৌত সিস্টেমে শক্তি, কাজ, তাপ এবং এনট্রপির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা। তাপগতিবিদ্যা আসলে গ্যাসের গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান। বড় পরিসরে গ্যাসের অণুগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যে তাপমাত্রা ও চাপের সৃষ্টি হয়, তার ব্যাখ্যা করে এটি। এই বিষয়টি প্রকৃতির একগুচ্ছ সূত্র দিয়ে শুরু হয়, যাদের সঙ্গে তাপমাত্রা, চাপ ও আয়তন জড়িত। তাপগতিবিদ্যার তিনটি সূত্র আছে।

রেডিওর উদ্ভাবক : বিশ্বের সবাই জানে রেডিওর উদ্ভাবক মার্কনি। কিন্তু মার্কনির অন্তত এক বছর আগেই রেডিও উদ্ভাবন করেছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। ১৮৯৪ সালে ভারতের কলকাতায় তিনি জনসমক্ষে রেডিও তরঙ্গের ব্যবহার দেখান। কিন্তু তাঁর যন্ত্রের পেটেন্ট করতে রাজি হননি। অন্যদিকে এর এক বছর পর রেডিও তরঙ্গ নিয়ে কাজ করেন মার্কনি।

গুপ্তশক্তি : কসমোলজি ও জ্যোতির্বিদ্যায় ডাক এনার্জি বা গুপ্তশক্তি হলো অজানা ধরনের কোনো শক্তি। এই শক্তির কারণে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। মহাবিশ্বের আমাদের জানা পদার্থের পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ। আর বাকি ২৩ শতাংশ ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তু, আর ৭২ শতাংশই গুপ্তশক্তি।

ডিসি : ডাইরেক্ট কারেন্ট বা অপরিবর্তনশীল বিদ্যুৎ। এর মান বা দিকের কোনো পরিবর্তন হয় না।

এসি : অল্টারনেটিং কারেন্ট বা পরিবর্তনশীল বিদ্যুৎ। এখানে বিদ্যুৎপ্রবাহের দিক নির্দিষ্ট সময় পরপর বিপরীত দিকে যায়।

এনট্রপি : এনট্রপি হচ্ছে একটি সিস্টেমের এলোমেলো বা বিশৃঙ্খলার পরিমাপ। যে সিস্টেম যত এলোমেলো, তার এনট্রপি তত বেশি। তাপগতিবিদ্যার সূত্রমতে, মহাবিশ্বের সব বস্তুর মধ্যেই কিছু না কিছু এনট্রপি জড়িত। এতে যখনই কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটে, তখনই তার এনট্রপি বেড়ে যায়। এনট্রপি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো, বস্তুর ভেতরের অণু-পরমাণুগুলো আর এলোমেলো বা বিশৃঙ্খল হওয়া। বিজ্ঞানী বোলজম্যানের মতে, এনট্রপি একটি সম্ভাবনা।

বর্ণালি : উপাদানের কম্পাঙ্ক, যা একটি তরঙ্গের সৃষ্টি করে। সূর্যের দৃশ্যমান অংশের বর্ণালি মাঝেমধ্যে রংধনু হিসেবে দেখা যায়।

ইথার : একটি হাইপোথেটিক্যাল অবস্তুগত মাধ্যম, যা পুরো স্থানে বিরাজমান বলে একসময় ধারণা করা হতো। এই মাধ্যমে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বিকিরণের বিস্তারের জন্য এই মাধ্যম প্রয়োজন বলে মনে করা হতো। তবে এই ধারণা এখন বাতিল করা হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *