৬. পরিনিব্বানা

পরিনিব্বানা

বুদ্ধের আলোকপ্রাপ্তির পঁয়তাল্লিশ বছর পর শাক্যের মেদালুম্পা শহরে একদিন বিকেলে অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর সাথে দেখা করতে এলেন রাজা পাসেনেদি। বৃদ্ধ হয়ে গেছেন তিনি। সম্প্রতি বুদ্ধের কাছে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক জীবন ক্রমেই সহিংস হয়ে উঠেছে। রাজাগণ ‘ক্ষমতা মদমত্ত’ ও ‘লোভে আচ্ছন্ন’ হয়ে আছেন; ক্রমাগত ‘হাতি, ঘোড়া, রথ ও পদাতিক বাহিনী’ ব্যবহার করে যুদ্ধে লিপ্ত।[১] গাঙ্গেয় উপত্যকা যেন বিধ্বংসী অহমবাদে পরিচালিত হচ্ছে। বহু বছর ধরে মগধের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছিল কোসালা। এলাকায় একক শাসন কায়েম করার প্রয়াস পাচ্ছিল মগধ। পাসেনেদি স্বয়ং নিঃসঙ্গ হয়ে পরেছিলেন। সম্প্রতি তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রয়াণ হয়েছে, গভীর বিষণ্নতায় আক্রান্ত ছিলেন তিনি। অন্য মুমূর্ষু মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করলে এমনটাই ঘটে। জগতের কোথাওই স্বস্তি বোধ করতে পারছিলেন না পাসেনেদি: ভবঘুরে সন্ন্যাসীদের ‘গৃহত্যাগে’র অনুকরণে প্রাসাদ ছেড়ে সেনাবাহিনী নিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে এক জায়গা হতে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। এমনি এক উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণের সময় শাক্যে আসার পর জানতে পান যে কাছেই বুদ্ধ অবস্থান করছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সঙ্গ লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা বোধ করেন তিনি। বুদ্ধ, ভাবলেন তিনি, তাঁকে বিশাল মহীরুহের কথা মনে করিয়ে দেয়: শান্ত, বিচ্ছিন্ন, জগতের তুচ্ছ ঝামেলার ঊর্ধ্বে। কিন্তু সংকটে আপনি যেখানে আশ্রয় নিতে পারেন। চট করে মেদালুম্পায় চলে এসেছেন তিনি। পথঘাট দুর্গম হয়ে ওঠায় ঘোড়ার পিঠ হতে নেমে তরবারি আর রাজকীয় পাগড়ি সেনাকর্তা দিঘা কারায়নার হেফাযতে রেখে পায়ে হেঁটে বুদ্ধের কুঁড়ের উদ্দেশে এগিয়েছেন তিনি। বুদ্ধ দরজা খুলে দিলে পাসেনেদি তাঁর পায়ে চুমু খেলেন। ‘এই বৃদ্ধ বেচারাকে কেন এই সম্মান দিচ্ছ?’ জিজ্ঞেস করলেন বুদ্ধ। কারণ আরামা তাঁর জন্যে খুবই স্বস্তিকর, জবাব দিলেন পাসেনেদি: কারণ সংঘ স্বার্থপরতা, সহিংসতা ও রাজ দরবারের লোভ হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু সবার ওপরে, উপসংহার টানেন পাসেনেদি, ‘আশীর্বাদপ্রাপ্ত জনের যেমন আশি বছর বয়স, আমারও তাই।’[২] দুজন বৃদ্ধ মিলিত হয়েছেন, বিষণ্ন এই জগতে পরস্পরের প্রতি মমতা প্রকাশ করা উচিৎ তাঁদের।

দিঘা কারায়নাকে যেখানে রেখেছিলেন কুঁড়ে থেকে বিদায় নিয়ে পাসেনেদি সেখানে ফিরে এসে দেখলেন সেনাপ্রধান রাজকীয় প্রতীকসহ চলে গেছেন। সেনাদল যেখানে শিবির ফেলেছে দ্রুত সেখানে এসে দেখলেন কেউ নেই। কেবল একটা ঘোড়া আর তরবারি নিয়ে পরিচারিকাদের একজন রয়ে গেছে। সাবস্তিতে ফিরে গেছেন দিঘা কারায়না, রাজাকে বলল সে। পাসেনেদির উত্তরসুরি রাজকুমার বিদুদভকে সিংহাসনে বসাতে অভ্যুত্থানের আয়োজন করছেন। জীবনের মায়া থাকলে পাসেনেদি যেন সাবস্তি ফিরে না যান। বৃদ্ধ রাজা মগধে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন, কেননা বৈবাহিক সূত্রে রাজকীয় পরিবারের আত্মীয় ছিলেন তিনি। কিন্তু দীর্ঘ যাত্রা ছিল সেটা। চলার পথে পাসেনেদিকে স্বাভাবিকের চেয়ে নিম্নমানের খাবার ও দুর্গন্ধময় পানি খেতে হলো। রাজাগহে পৌঁছে দেখলেন তোরণ বন্ধ হয়ে গেছে। সস্তা সরাইখানায় ঘুমাতে বাধ্য হলেন তিনি। সেরাতে মারাত্মক পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে ভোর হবার আগেই মারা গেলেন। বৃদ্ধের জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা চালানো পরিচারিকা গোটা শহরকে জাগিয়ে তুলল: ‘দুই দেশের শাসক আমার প্রভু কোসালার রাজা ভিখিরির মতো মারা গেছেন। বিদেশের এক শহরের বাইরে মামুলি ভিখেরির সরাইখানায় পড়ে আছেন এখন!’[৩]

বৃদ্ধ বয়সকে বরাবরই দুঃখের প্রতীক হিসাবে দেখেছেন বুদ্ধ যা সকল মরণশীল সত্তাকে আক্রান্ত করে। পাসেনেদি যেমন মন্তব্য করেছিলেন, তিনি স্বয়ং বুড়িয়ে গেছেন। আনন্দ নিজেও যদি এখন আর তরুণ নেই, প্রভুর মাঝে পরিবর্তন লক্ষ করে সম্প্রতি হতাশা বোধ করেছেন তিনি। তাঁর চামড়া কুঁচকে গেছে, হাত-পা থলথলে হয়ে গেছে, দেহ কুঁজো, অনুভূতি যেন দুর্বল হয়ে আসছে। ‘ঠিক বলেছ, আনন্দ’ সায় দিয়েছেন বুদ্ধ।[৪] বৃদ্ধ বয়স আসলেই নিষ্ঠুর। কিন্তু বুদ্ধের শেষ বছরের কাহিনী বয়সের কারণে কৃচ্ছ্রতা সাধনের বিপর্যয়ের চেয়ে বরং বৃদ্ধ মানুষের নাজুকতার উপরই বেশি আলোকপাত করেছে। উচ্চাভিরাষী তরুণেরা প্রবীনদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, ছেলেরা আপন পিতাদের হত্যা করে। বুদ্ধের জীবনের শেষ পর্যায়ে টেক্সট পবিত্রতার অনুভূতি হারিয়ে যাওয়া সন্ত্রাসের জগৎ নিয়ে আলোচনা করেছে। অহমবাদ পরম শাসক হয়ে দাঁড়িয়েছে; ঈর্ষা, ঘৃণা, লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা সহানুভূতি ও প্রেমময়-দয়ায় প্রশমিত হবার নয়। মানুষের আকাঙ্ক্ষার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ানো যে কাউকে নিষ্ঠুরভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সব রকম শোভনতা ও মর্যাদা অদৃশ্য হয়ে গেছে। প্রায় পঞ্চাশ বছর বুদ্ধ যে বিপদের মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছেন সেই বিপদের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ধর্মগ্রন্থগুলো আমাদের সমাজের সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হতে বাধ্য করে যার বিরুদ্ধে আপন স্বার্থহীনতা ও প্রেমময়-দয়ার সংগ্রাম সূচনা করেছিলেন তিনি।

এমনকি সংঘও এই লৌকিক চেতনা মুক্ত ছিল না। আট বছর আগে আরও একবার সংঘাতের কারণে হুমকির মুখে পড়েছিল সংঘ এবং সাঁইত্রিশ বছর ধরে বুদ্ধের নিবেদিতপ্রাণ অনুসারী আরেক বৃদ্ধ রাজা বিম্বিসারাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিল। কেবল বিনয়াতেই আমরা এই বিদ্রোহের পূর্ণ বিবরণ পাই। এটা সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক নাও হতে পারে, তবে সতর্ক বাণী প্রকাশ করে: এমনকি সংঘের নীতিমালা লঙ্ঘিত হতে পারে এবং মারাত্মক করে তোলা যেতে পারে। বিনয়া অনুসারে নাটের গুরু ছিলেন বুদ্ধের শ্যালক দেবদত্ত। কাপিলাবাস্তুতে বুদ্ধের প্রথম বাড়ি সফরের পর সংঘে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী কালের ধারাভাষ্যসমূহ আমাদের বলে যে দেবদত্ত তরুণ বয়স হতেই বিদ্বেষ পরায়ণ ছিলেন। একসঙ্গে বেড়ে ওঠার সময় থেকেই তরুণ গৌতমের তীব্র প্রতিপক্ষ ছিলেন তিনি। কিন্তু পালি টেক্সট এ সম্পর্কে কিছুই জানে না, দেবদত্তকে ব্যক্রিমহীনভাবে নিবেদিতপ্রাণ সন্ন্যাসী হিসাবে উপস্থাপন করেছে। তিনি মেধাবী বাগ্মী ছিলেন বলে মনে হয়। বুদ্ধ বৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেবদত্ত সংঘে তাঁর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন। নিজস্ব শক্তি বলয় গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ধর্মীয় জীবনের সবরকম অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছিলেন দেবদত্ত। নিষ্ঠুরভাবে আত্মপ্রচারণা শুরু করেছিলেন; তাঁর দৃষ্টি সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল: ভালোবাসায় পৃথিবীর চতুর্কোণে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হওয়ার বদলে সম্পূর্ণ নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন, ঘৃণা ও ঈর্ষার হারিয়ে গেছেন। প্রথমে মগধের সেনাপ্রধান ও রাজা বিম্বিসারার উত্তরসুরি রাজকুমার অজাতাশত্তুর শরণাপন্ন হলেন তিনি। ইদ্ধির চোখ ঝলসানো প্রদর্শনীতে মুগ্ধ করে ফেললেন রাজকুমারকে, আপন যোগির ক্ষমতাকে কলুষিত করার সুস্পষ্ট লক্ষণ। কিন্তু দেবদত্তের পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হলেন রাজকুমার: প্রতিদিন রাজাগহের উপকণ্ঠে শকুন-চূড়ার আরামায় দেবদত্তের কাছে ভিক্ষুদের জন্যে বিপুল খাবারভর্তি পাঁচশো রথ পাঠাতে লাগলেন। আনুকূল্যপ্রাপ্ত রাজ-সন্ন্যাসীতে পরিণত হলেন দেবদত্ত। তোষামোদ তাঁর মাথা খারাপ করে দিয়েছিল, তিনি সংঘের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু শ্যালকের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বুদ্ধকে যখন সতর্ক করা হলো, অবিচলিত রইলেন তিনি। এইয়াত্রার অদক্ষ আচরণ দেবদত্তের জন্যে কেবল তিক্ত পরিসমাপ্তিই ডেকে আনতে পারে।[৫]

বুদ্ধ যখন রাজাগহের বাইরে বাঁশ বনে অবস্থান করছিলেন, সেই সময় প্রথম প্রচেষ্টা চালান দেবদত্ত। ভিক্ষুদের এক বিরাট সমাবেশে দেবদত্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বুদ্ধকে পদত্যাগ করে সংঘের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব রাখেন। ‘আশীর্বাদপ্রাপ্ত জন এখন বৃদ্ধ হয়েছেন, বহু বছরের বয়সের ভারে ক্লান্ত…জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছেন,’ তোষামোদের সুরে বললেন তিনি। ‘এখন তাঁকে বিশ্রাম নিতে দাও।’ প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন বুদ্ধ: এমনকি তাঁর দুই প্রধান অনুসারী সারিপুত্ত ও মগ্গালানার হাতেও সংঘ তুলে দেবেন না তিনি। দেবদত্তের মতো এমন বেপথু মানুষকে কেন এমন পদ দিতে যাবেন? অপমানিত ও হিংস্র হয়ে উঠলেন দেবদত্ত, প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে আরামা ত্যাগ করলেন। সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়ে তেমন একটা উদ্বিগ্ন ছিলেন না বুদ্ধ। তিনি বরাবরই জোর দিয়ে এসেছেন, সংঘের, কোনও কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বপূর্ণ ব্যক্তির প্রয়োজন নেই, কেননা প্রত্যেক সন্ন্যাসী তার নিজের জন্যে দায়ী। কিন্তু বিরোধ সৃষ্টি করার যেকোনও প্রয়াস, দেবদত্ত যেমন করেছেন, অশুভ। অহমবাদ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বৈরিতা ও প্রতিযোগিতার পরিবেশ আধ্যাত্মিক জীবনের সঙ্গে মোটেই মানানসই নয়, সংঘের মূল উদ্দেশ্যকেই তা নাকচ করে দেবে। তো বুদ্ধ প্রকাশ্যে নিজেকে এবং সংঘকে দেবদত্ত হতে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে সারিপুত্তকে রাজাগহে দেবদত্তকে নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন। ‘আগে,’ ব্যাখ্যা দিলেন তিনি, ‘এক রকম স্বভাব ছিল দেবদত্তের, এখন ভিন্ন স্বভাব হয়েছে তার।’ কিন্তু ক্ষতি যা হবার হয়ে গিয়েছিল। শহরবাসীদের কেউ কেউ বিশ্বাস করেছিল যে রাজকুমারের সঙ্গে দেবদত্তের নতুন সখ্যতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছেন বুদ্ধ। কিন্তু অধিকতর বিবেচনা সম্পন্ন ব্যক্তিরা কোনও সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেনি।[৬]

এদিকে রাজপুত্র অজাতাশত্তুর কাছে একটা প্রস্তাব নিয়ে হাজির হলেন দেবদত্ত। আগের দিনে, বললেন তিনি, মানুষের আয়ু এখনকার চেয়ে বেশি ছিল। রাজা বিম্বিসারা এখনও টিকে আছেন। অজাতাশত্তু হয়তো কোনওদিনই সিংহাসনে বসতে পারবেন না। বাবাকে তিনি হত্যা করছেন না কন? দেবদত্ত অন্যদিকে বুদ্ধকে হত্যা করতে পারেন। এই দুই বৃদ্ধ কেন তাঁদের পথে বাধা হয়ে থাকবেন? দেবদত্ত ও অজাতাশত্তু চমৎকার একটা জুটি হতে পারতেন। অসাধারণ সাফল্য অর্জন করা যাবে। বুদ্ধিটা রাজপুত্রের মনে ধরল। কিন্তু ঊরুতে ছুরি বেঁধে রাজার অন্দরমহলে লুকিয়ে ঢোকার সময় আটক করা হয় তাঁকে। তিনি সমস্ত অপরাধ স্বীকার করেন। গুপ্তহত্যার পরিকল্পনায় দেবদত্তের ভূমিকা জানার পর সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা গোটা সংঘকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন,, কিন্তু বিম্বিসারা যুক্তি দেখান যে বুদ্ধ আগেই দেবদত্তকে বহিষ্কার করেছেন, এই দুষ্কৃতকারীর কর্মকাণ্ডের জন্যে তাঁকে দায়ী করা যাবে না। অজাতাশত্তুকে তাঁর সামনে হাজির করার পর রাজা বিষণ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইলেন কেন তিনি তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছেন। আমি রাজত্ব চাই, মহামান্য।’ খোলাখুলি জবাব দিলেন অজাতাশত্তু। অযথা এতদিন বুদ্ধের অনুসারী ছিলেন না বিম্বিসারা। ‘যদি রাজত্ব চেয়ে থাক, রাজকুমার,’ সহজ কণ্ঠে বললেন তিনি। ‘এরাজ্য তোমার।’[৭] পাসেনেদির মতো তিনিও সম্ভবত রাজনীতির জন্যে প্রয়োজনীয় অদক্ষ ও আগ্রাসী আবেগ সম্পর্কে সজাগ ছিলেন, তাই জীবনের শেষ কটি বছর আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করে কাটিয়ে দিতে চেয়েছেন। অবশ্য সিংহাসন ত্যাগ কোনও উপকার হয়নি তাঁর। সেনাবাহিনীর সমর্থনে অজাতাশত্তু বাবাকে গ্রেপ্তার করান এবং উপোস মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

নতুন রাজা এরপর বুদ্ধকে হত্যার দেবদত্তের পরিকল্পনায় মদদ যোগান। সেনাবাহিনী হতে প্রশিক্ষিত গুপ্তঘাতক সরবরাহ করেন তিনি। কিন্তু ওদের একজন তীর-ধনুক নিয়ে তাঁর কাছাকাছি যাবার পরেই আতঙ্কে স্থির হয়ে যায়। ‘এসো, বন্ধু,’ কোমল কণ্ঠে বলেন বুদ্ধ। ‘ভয় পেয়ো না।’ নিজের কাজের ভুল বুঝতে পারায় তার অন্যায় ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। বুদ্ধ এরপর সৈন্যটিকে সাধারণ মানুষের উপযোগি নির্দেশনা দিলেন। খুবই অল্প সময়ের ভেতর অনুতপ্ত ঘাতক একজন শিষ্যে পরিণত হয়েছিল। একের পর এক তার সতীর্থ ষড়যন্ত্রীরা অনুসরণ করল।[৮] এরপর ব্যাপারটা নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হলেন দেবদত্ত। প্রথমে বুদ্ধকে চাপা দেওয়ার জন্যে পাহাড় চূড়া হতে এক বিরাট পাথর গড়িয়ে দিলেন তিনি, কিন্তু বুদ্ধের পায়ে সামান্য আঘাত লাগা ছাড়া অন্য কোনও ক্ষতি হলো না। এরপর নীলগিরি নামে এক হিংস্র হাতি ছেড়ে দিলেন বৃদ্ধের পেছনে। কিন্তু শিকারকে দেখামাত্র বুদ্ধ হতে উৎসারিত প্রেমের তরঙ্গে পরাস্ত হয়ে শুঁড় নামিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে পড়ল নীলগিরি। ওটার কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন বুদ্ধ। ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন, সহিংসতা আগামী জন্মে কোনও উপকারে আসবে না তার। নীলগিরি বুদ্ধের পায়ের কাছ থেকে শুঁড় দিয়ে বালি টেনে নিজের মাথায় ছিটাল, পিছিয়ে গেল তারপর। বুদ্ধ দৃষ্টির আড়ালে না যাওয়া পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে। এরপর শান্ত পায়ে আস্ত বিলের দিকে ফিরে গেল। সেদিন থেকে বদলে যাওয়া এক পশু।[৯]

বুদ্ধ যেন এইসব আক্রমণ হতে সুরক্ষিত, এটা বুঝতে পেরে ষড়যন্ত্রকারীরা কৌশল বদল করল। ক্ষমতা দখলের প্রয়াসে সফল অজাতাশতু দেবদত্তকে ঝেড়ে ফেলে বুদ্ধের একজন সাধারণ শিষ্যে পরিণত হলেন। এবার নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন দেবদত্ত, সংঘের অভ্যন্তরে সমর্থন যোগাড়ের প্রয়াস পেলেন তিনি। বেসালির কিছু তরুণ, অনভিজ্ঞ সন্ন্যাসীর কাছে বুদ্ধের মধ্যপন্থা ঐতিহ্য হতে অগ্রহণযোগ্য বিচ্যুতি বলে প্রচার করলেন। বৌদ্ধদের উচিৎ অধিকতর ঐতিহ্যবাহী সাধকদের কঠোর আদর্শে ফিরে যাওয়া। পাঁচটি নতুন বিধানের প্রস্তাব রাখলেন দেবদত্ত: বর্ষাকালে আরামার বদলে সংঘের সকল সদস্যকে বনে-জঙ্গলে বাস করতে হবে; তাদের অবশ্যই কেবল ভিক্ষার উপর নির্ভর করতে হবে, সাধারণের বাড়িতে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারবে না; নতুন জোব্বার বদলে অবশ্যই রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া ন্যাকড়া পরতে হবে; কুঁড়ে ঘরের বদলে অবশ্যই খোলা জায়গায় ঘুমাতে হবে; এবং তারা কখনও জীবিত প্রাণীর মাংস খেতে পারবে না।[১০] এই পাঁচটি বিধান দেবদত্তের পক্ষত্যাগের ঐতিহাসিক মূল সত্য তুলে ধরতে পারে। রক্ষণশীল ভিক্ষুদের কেউ কেউ হয়তো সংগঠনের ক্রমাবনতিতে উদ্বিগ্ন হওয়ায় মূল সংঘ হতে বেরিয়ে যাবার প্রয়াস পেয়েছিলেন। দেবদত্ত এই সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত থেকে থাকতে পারেন। তাঁর প্রতিপক্ষ বুদ্ধের মধ্যপন্থার পক্ষাবলম্বীরা হয়তো বিনয়ায় প্রাপ্ত নাটকীয় কিংবদন্তী আবিষ্কার করে দেবদত্তের নামে কালিমা লেপন করতে চেয়েছেন।

দেবদত্ত তাঁর পঞ্চবিধান প্রকাশ করে বুদ্ধকে সমগ্র সংঘের জন্যে তা বাধ্যতামূলক করার আহ্বান জানালে যেকোনও সন্ন্যাসীই তাঁর খুশিমতো জীবন যাপনের অধিকারী বলে প্রত্যাখ্যান করলেন বুদ্ধ, এইসব ব্যাপারে জবরদস্তি সংগঠনের চেতনার পরিপন্থী। সন্ন্যাসীদেরই মনস্থির করতে হবে, তাদের কারও নির্দেশনা অনুসরণে বাধ্য করা যাবে না। উল্লসিত হয়ে উঠেছিলেন দেবদত্ত। বুদ্ধ তাঁর ন্যায় অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন! অনুসারীদের কাছে বিজয়ীর সুরে তিনি ঘোষণা দিলেন, বুদ্ধ বিলাসিতার কাছে নতি স্বীকার করে আত্মতুষ্টিতে নিপতিত হয়েছেন। এখন দুর্নীতিগ্রস্ত ভাই হতে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া তাদের দায়িত্ব।[১১] পাঁচশো অনুসারী নিয়ে রাজাগহের উপকণ্ঠে গয়াশিসা পাহাড়ে শিবির গাড়লেন দেবদত্ত, অন্যদিকে বিদ্রোহী ভিক্ষুদের ফিরিয়ে আনতে সারিপুত্ত ও মগ্গালানাকে পাঠালেন বুদ্ধ। তাঁদের আসতে দেখে দেবদত্ত ধরে নিলেন বুদ্ধকে ত্যাগ করে তাঁর দলে যোগ দিতে আসছেন ওরা। উল্লসিত হয়ে শিষ্যদের একটা সভা ডাকলেন তিনি, গভীর রাত পর্যন্ত বক্তব্য রাখলেন। তারপর পিঠ ব্যথার কথা বলে সারিপুত্ত ও মগ্গালানাকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দিয়ে শুতে চলে গেলেন। এই দুজন বিশ্বস্ত নেতা বক্তব্য শুরু করার পর অচিরেই ভিক্ষুদের বুদ্ধের কাছে ফিরে যেতে রাজি করিয়ে ফেললেন। কোনওরকম শাস্তি ছাড়াই তাঁদের বরণ করে নেন বুদ্ধ।[১২] কোনও কোনও টেক্সট আমাদের বলে, দেবদত্ত আত্মহত্যা করেছেন। অন্যগুলোর মতে বুদ্ধের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছার আগেই মারা যান তিনি। এইসব কাহিনীর সত্য যাই হোক, বৃদ্ধ বয়সের ভোগান্তি সম্পর্কে সত্যি কথা জানায়। সতর্কতামূলক কাহিনীও শোনায়। এমনকি সাধারণ জনজীবনে প্রকট স্বার্থপরতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর মতানৈক্য হতে সংঘও মুক্ত ছিল না।

জীবনের শেষ বছরে এই বিপদ নিয়ে আলোচনা করেছেন বুদ্ধ। এখন আশি বছর বয়স্ক তিনি। রাজা অজাতাশত্তু ততদিনে মগধের সিংহাসনে দারুণভাবে অধিষ্ঠিত। প্রায়ই বুদ্ধের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। মাল্লা, বিদেহা, লিচাবি, কোলিয়া ও বাজ্জির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোর পরিকল্পনা করছিলেন তিনি। তাঁর রাজ্যের পুবে অবস্থিত এই রাজ্যগুলো ‘বাজ্জিয়’ নামে একটা প্রতিরক্ষা সংগঠন গড়ে তুলেছিল। তাদের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলে নিজের রাজ্যের অঙ্গীভূত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন রাজা। কিন্তু আক্রমণ শুরু করার আগে বাসাকারা নামে একজন ব্রাহ্মণ মন্ত্রীকে তিনি কী করতে যাচ্ছেন বুদ্ধকে জানাতে ও মনোযোগ দিয়ে বুদ্ধের মন্তব্য শুনবার নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন তাঁর কাছে। বুদ্ধ ছিলেন দুর্বোধ্য, বাসাকারাকে তিনি বললেন বাজ্জীয়রা যতক্ষণ প্রজাতন্ত্রীয় ঐতিহ্য মেনে চলছে, ‘ঘনঘন উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি নিয়ে সভা করছে,’ মতৈক্যের মাঝে জীবন কাটাচ্ছে, প্রবীনদের সমান দেখাচ্ছে, মনোযোগ দিয়ে তাদের পরামর্শ শুনছে, এবং পূর্বসুরিদের আইন ও ধার্মিকতা পালন করছে, ততক্ষণ রাজা অজাতাশত্তু তাদের পরাস্ত করতে পারবেন না। মনোযোগ দিয়ে শুনলেন বাসাকারা, তারপর বুদ্ধকে বললেন বাজ্জীয়রা যেহেতু এখন এই সমস্ত শর্তই মেনে চলছে সেহেতু এখন তারা অপরাজেয়। তিনি রাজাকে এই সংবাদ দিতে ফিরে গেলেন।[১৩] অবশ্য বৌদ্ধিয় কিংবদন্তীতে আছে এর অল্প কিছুদিন পরেই রাজা অজাতাশত্তু বাজ্জকীয়দের পরাস্ত করতে সক্ষম হন। নেতাদের মাঝে অনৈক্যের বীজ বপন করার জন্যে এইসব প্রজাতন্ত্রে গুপ্তচর পাঠিয়ে এই সাফল্য অর্জন করেন তিনি। বাসাকারা বিদায় নেওয়ার পর দরজার আড়ালে বুদ্ধের উচ্চারিত কথায় তাই এক ধরনের তাগিদ ও মর্মস্পর্শী সুর ছিল। সংঘের ক্ষেত্রেও একই শর্ত আরোপ করেন তিনিঃ যতক্ষণ এর সদস্যরা প্রবীন ভিক্ষুদের সম্মান করবে, ঘনঘন সম্মেলন অনুষ্ঠান করবে ও ধম্মের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত থাকবে ততদিন সংঘ টিক থাকবে।

গোত্রীয় প্রজাতন্ত্রগুলো অনিবার্য ধ্বংসের মুখে ছিল। সেগুলো ছিল অতীতের অংশ এবং অচিরেই নতুন উগ্র শাসকদের করতলগত হবে। রাজা পাসেনেদির ছেলে বুদ্ধের নিজ গোত্র শাক্যদের অচিরেই পরাস্ত করে হতালীলা চালাবেন। কিন্তু বুদ্ধের সংঘ ছিল নতুন, হালনাগাদ এবং পুরোনো প্রজাতান্ত্রিক সরকারগুলোর দক্ষ আধ্যাত্মিক রূপ। অধিকতর সহিংস ও নিপীড়ক শাসকগণ যেসব মূল্যবোধ হারানোর হুমকির মুখে ছিল সেগুলোই কঠোরভাবে অনুসরণ করে যাবে সংঘ। কিন্তু এ জগৎ বিপদসংকুল। সংঘ আভ্যন্তরীণ মতানৈক্য, প্রবীনদের অসম্মান, প্রেমময়-দয়ার ঘাটতি ও দেবদত্তের কেলেঙ্কারীর সময় আবির্ভূত অগভীরতা হতে বাঁচতে পারবে না। ভিক্ষু ও ভিক্ষুনিদের অবশ্যই মনোযোগি হতে হবে, আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে সতর্ক আর ধ্যানমূলক অনুশীলনের প্রতি উদ্যমী ও বিশ্বস্ত থাকেত হবে যা আলোক বয়ে আনতে পারে। সন্ন্যাসীরা যতদিন ‘গল্পগুজব, অলস সময় কাটানো আর মেলামেশা’র মতো অদক্ষ কাজ এড়িয়ে যাবেন, ‘যত দিন তাদের নীতিবর্জিত বন্ধু থাকবে না এবং এধরনের মানুষের প্রভাবে পড়া এড়াতে পারবেন, যতদিন তাঁরা সন্ধানের মাঝপথে বিরতি দিয়ে মাঝারি পর্যায়ের আধ্যাত্মিকতায় সন্তুষ্ট হবেন না’[১৪] ততদিন সংগঠনের অবনতি ঘটবে না। তাঁরা এতে ব্যর্থ হলে আর পাঁচটা ধর্ম নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ভিন্ন কিছু থাকবে নাঃ শাসকদের দুর্নীতির শিকারে পরিণত হবে এটা, চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়বে।

বাসাকারার সঙ্গে সভার পর রাজাগহ ছেড়ে বেসালিতে বাস্যা অবকাশ যাপন করবেন বলে উত্তরে রওনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বুদ্ধ। যেন রাজা অজাতাশত্তুর ‘বাজ্জীয়দের নিশ্চিহ্ন করার’ পরিকল্পনার প্রকাশ মুহূর্তের জন্যে বিতৃষ্ণ করে তুলেছিল তাঁকে, অবরুদ্ধ প্রজাতন্ত্রগুলোর প্রতি তাঁর দরদ সম্পর্কে সজাগ করে তুলেছিল। কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় কোসালা ও মগধে কাটিয়েছেন তিনি, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু এখন এই রাজ্যগুলোর রাজনৈতিক জীবনকে চালিতকারী আগ্রাসনের শিকার একজন বৃদ্ধ গাঙ্গেয় উপত্যকার আরও প্রত্যন্ত এলাকার উদ্দেশে চলেছেন।

ধীর গতিতে সন্ন্যাসীদের বিরাট একটা দল নিয়ে মগধ এলাকা হয়ে প্ৰথমে নালন্দা ও তারপর মহান বৌদ্ধ রাজা অশোকের রাজধানী (২৬৯-২৩২ বিসিই) পাটালিগামে (আধুনিক পাটলা) পৌঁছেন তিনি। অশোক এমন এক রাজ্য গড়ে তুলবেন যা সহিংসতাকে এড়িয়ে ধম্মের সহানুভূতির নীতিমালা গ্রহণের প্রয়াস পেয়েছিল। বুদ্ধ বাজ্জীয়দের বিরুদ্ধে আসন্ন যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে মগধের মন্ত্রীদের নির্মাণাধীন সুবিশাল দুর্গ লক্ষ করলেন, শহরের ভবিষ্যৎ খ্যাতির ভবিষ্যদ্বাণী করলেন তিনি। সাধারণ ভক্তরা এখানে গালিচা বিছিয়ে, বড় বড় কুপি জ্বালিয়ে বুদ্ধকে একটা বিশ্রাম ঘর ছেড়ে দিল। সারারাত সাধারণ মানুষের প্রয়োজন উপযোগি করে তোলা ধম্ম ব্যাখ্যা করলেন বুদ্ধ। তিনি উল্লেখ করলেন, দক্ষ আচরণ এই জগতেও একজন শুদ্ধ নারী বা শুদ্ধ পুরুষের জন্যে উপকারী হতে পারে। তাদের তাীবনেও আলোকনের পথে অগ্রসর হওয়া নিশ্চিত করবে।[১৫]

অবশেষে বেসালি পৌঁছলেন বুদ্ধ। প্রথমে সমস্ত কিছু যেমন ছিল বরাবর তেমনই মনে হলো। অন্যতম নেতৃস্থানীয় পতিতা আম্বাপালির আম- বাগানে উঠলেন তিনি। বুদ্ধকে স্বাগত জানাতে রথের বহর নিয়ে হাজির হলো সে। ধম্ম শুনবার জন্যে তাঁর পায়ের কাছে বসল। বুদ্ধকে খাবারের আমন্ত্রণ জানাল। তিনি যখন সম্মতি দিয়েছেন, বেসালিতে বসবাসকারী লিছাবি গোত্রের সদস্যরা চমৎকারভাবে রঙ করা রথের মিছিল নিয়ে দলবেঁধে বুদ্ধকে আমন্ত্রণ জানাতে অগ্রসর হলো। অপূর্ব দৃশ্য ছিল সেটা। দেখে মুচকি হাসলেন বুদ্ধ, ভিক্ষুদের বললেন, স্বর্গের দেবতাদের চমৎকারিত্বের খানিকটা ধারণা আছে ওদের। বুদ্ধের চারপাশে ঘিরে বসল লিছাবিবাসীরা, বুদ্ধ তাদের ধম্মর বাণী দিয়ে ‘উদ্দীপ্ত, অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত’ করলেন। এই আলোচনার শেষে লিছাবিরা তাদের আমন্ত্রণের কথা জানাল। বুদ্ধ যখন বললেন তিনি আগেই আম্বাপালির নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছেন, মনঃক্ষুণ্ণ হলো না তারা, তুড়ি বাজিয়ে চিৎকার করে উঠল, “ওহ, আম্বপালি আমাদের হারিয়ে দিয়েছে, বুদ্ধিতে হারিয়ে দিয়েছে।’ সেরাতে খাবারের সময় বারবণিতা তার আম-বাগানটি সংঘকে দান করে দেয়। বুদ্ধ কিছুদিন সেখানে অবস্থান করে ভিক্ষুদের দীক্ষা দেন। বুদ্ধকে ঘিরে স্বাভাবিক ব্যস্ততা, জাঁক ও উত্তেজনা ছিল, এবং তার মূলে অভিনিবেশ ও ধ্যানের নিবিড় অন্তস্থ জীবনের জন্যে এক অব্যাহত প্রেরণা।[১৬]

কিন্তু তারপর দৃশ্যপট মলিন হয়ে উঠতে শুরু করল। সন্ন্যাসীদের নিয়ে বেসালি ত্যাগ করে নিকটস্থ বেলুভাগামাকা গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করেন বুদ্ধ। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করার পর আকস্মিকভাবে সন্ন্যাসীদের বিদায় করে দিলেন তিনি। তাদের বেসালিতে ফিরে যেতে হবে। যেখানে সম্ভব বর্ষার অবকাশের জন্যে অবস্থান নিতে হবে। তিনি আর আনন্দ বেলুভাগামাকায় রয়ে যাবেন। বুদ্ধের জীবনে এক নতুন নিঃসঙ্গতার পর্যায় প্রবেশ করেছে। এই পর্যায় থেকে তিনি যেন বড় বড় শহর-নগর এড়িয়ে আরও অচেনা অজানা জায়গার খোঁজ করছিলেন। যেন এরই মধ্যে জগৎ ত্যাগ করতে শুরু করেছিলেন। ভিক্ষুরা বিদায় নেওয়ার পর মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন বুদ্ধ। কিন্তু প্রবল আত্মনিয়ন্ত্রণের সাহায্যে যন্ত্রণা আড়াল করে অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠেন। তাঁর পক্ষে এখুনি মৃত্যুবরণ করে পরম নিব্বানা (পরিনিব্বানা লাভ করা ঠিক হবে না, বোধি বুক্ষের নিচে অর্জন করা অলোকন যা পূর্ণাঙ্গ করে তুলবে। সবার আগে সংঘকে বিদায় জানাতে হবে। সুতরাং, সেরে উঠলেন বুদ্ধ, অসুস্থতার কামরা হতে বেরিয়ে যে কুঁড়েতে অবস্থান করছিলেন সেটার বারান্দায় আনন্দের সঙ্গে বসলেন।

বুদ্ধের অসুস্থতা আনন্দের অন্তরাত্মা টলিয়ে দিয়েছিল। ‘আশীর্বাদপ্রাপ্তকে আমি স্বাস্থ্যবান, তরতাজা দেখে অভ্যস্থ,’ বুদ্ধের পাশে বসার সময় কাঁপা কণ্ঠে বললেন তিনি। প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁর শুরু মারা যেতে পারেন। ‘আমার শরীরের আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া টের পেয়েছি,’ বললেন তিনি। ‘আমি ঠিকমতো দেখতে পাই না। আমার মন বিভ্রান্ত।’ কিন্তু একটা কথা ভেবে সান্ত্বনা পেলেন তিনিঃ সংঘের উত্তরাধিকার ও পরিচালনা সম্পর্কে কোনও একটা সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত বুদ্ধ মারা যাবেন না। গুরু বিদায় নেওয়ার পর যা পরিবর্তন হতে বাধ্য। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বুদ্ধ। ‘সংঘ আমার কাছে কী আশা করে, আনন্দ?’ অধৈর্য কণ্ঠে জানতে চাইলেন তিনি। যা শেখানোর ছিল ভিক্ষুরা তার সবই জানেন। কয়েকজন মনোনীত নেতার জন্যে কোনও গোপন মতবাদ নেই। ‘আমাকেই সংঘের পরিচালনা করতে হবে,’ বা ‘আমার ওপর সংঘ নির্ভরশীল,’ এজাতীয় ভাবনা কোনও আলোকপ্রাপ্ত মানুষের মনে আসে না। ‘আমি একজন বৃদ্ধ মানুষ, আনন্দ। আশি বছর বয়স।’ নির্দয় কণ্ঠে বললেন বুদ্ধ। ‘আমার দেহ পুরোনো ঠেলাগাড়ির মতো ঠক্কর ঠক্কর করে চলে। একমাত্র যে কাজটি স্বাচ্ছন্দ ও সতেজতা বয়ে আনে সেটা হচ্ছে ধ্যান, যা তাঁকে নিব্বানার মুক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক ভিক্ষু ও ভিক্ষুনির বেলায়ও তাই হওয়া উচিৎ। ‘তোমাদের প্রত্যেককে নিজেকে নিজের দ্বীপে পরিণত করতে হবে। অন্য কাউকে নয়, নিজেকেই নিজের আশ্রয় পরিণত করতে হবে।’ কোনও বৌদ্ধ অন্য কারও ওপর নির্ভর করতে পারে না। সংগঠনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে কারও প্রয়োজন নেই। ‘ধম্ম, কেবল ধৰ্ম্মই তার আশ্রয়।[১৭] ভিক্ষুরা কেমন করে আত্মনির্ভর হবে? উত্তর আগেই জানা আছে তাদের: ধ্যান, মনোসংযোগ, অভিনিবেশ ও জগৎ হতে শৃঙ্খলাপূর্ণ বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে। সংঘের কাউকে পরিচালনা করার প্রয়োজন নেই, কোনও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ নয়। বৌদ্ধদের জীবনধারার মোদ্দা কথা, এমন এক অন্তস্থ উৎস অর্জন করতে হবে যা এই ধরনের নির্ভরশীলতা সম্পূর্ণ হাস্যকর করে তোলে।

কিন্তু আনন্দ এখনও নিব্বানা লাভ করেননি। দক্ষ যোগি ছিলেন না তিনি। আত্ম-নির্ভরশীলতার এই মাত্রা অর্জন করতে পারেননি। ব্যক্তিগতভাবে মনিবের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন তিনি। এই ধরনের যোগ বীরত্বের জন্যে প্রস্তুত নয়, কিন্তু বুদ্ধের প্রতি আরও শ্রদ্ধা (ভক্তি) প্রয়োজন, এমন বৌদ্ধদের আদর্শে পরিণত হবেন, তিনি তাদের উৎসাহিত করার জন্যে। কয়েক দিন পর আরেকটা ধাক্কা খেলেন আনন্দ। জনৈক নবীশ নালন্দা থেকে সারিপুত্ত ও মগ্গালানার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে এলো। আবারও আনন্দের দিশাহারা অবস্থা দেখে কিঞ্চিৎ উত্তেজিত বোধ করলেন বুদ্ধ। কী প্রত্যাশা করেছিলেন তিনি? এটাই ধম্মের মূল কথা নয় যে কোনও কিছুই চিরকাল টিকে থাকে না এবং আমরা যা এবং যাকে ভালোবাসি তা থেকে সবসময়ই বিচ্ছেদ ঘটে? আনন্দ কি ভেবেছেন যে, বৌদ্ধরা যে বিধি অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে বেঁচে আছে সারিপুত্ত তা সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন বা সৎগুণের বিধান ও ধ্যানের জ্ঞানও সংঘ হতে বিদায় নিয়েছে? ‘না, প্রভু,’ প্রতিবাদ করলেন হতভাগ্য আনন্দ। আসলে সারিপুত্ত যে কত উদার ছিলেন, ধম্মের ক্লান্তিহীন ব্যাখ্যা দিয়ে কীভাবে সবাইকে সমৃদ্ধ ও সাহায্য করেছিলেন সেটা মনে না করে পারছেন না। দুঃসংবাদ বয়ে আনা নবীশের নিয়ে আসা ভিক্ষার পাত্র ও জোব্বা দেখাটা ছিল এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। ‘আনন্দ,’ আবার বললেন বুদ্ধ। ‘তোমাদের প্রত্যেককে যার যার দ্বীপ সৃষ্টি করতে হবে, নিজেকে, অন্য কাউকে নয়, নিজের আশ্রয় নির্মাণ করতে হবে: তোমাদের প্রত্যেককে ধম্মকেই তার দ্বীপে পরিণত করতে হবে, ধম্ম‍ই, অন্য কিছু নয়, তার আশ্রয়।[১৮]

দুই ঘনিষ্ঠ অনুসারীর মৃত্যুতে দুঃখ পাওয়ার বদলে তাঁরা পরিনিব্বানা লাভ করায় আমোদিত হয়ে উঠেছিলেন বুদ্ধ: মরণশীলতার দুর্বলতাসমূহ হতে পরম মুক্তি। গোটা সংঘের ভালোবাসার পাত্র এমন দুজন অনুসারী থাকাটা তাঁর জন্যে আনন্দের ব্যাপার ছিল। কীভাবে বিমর্ষ হবেন তিনি, বিলাপ করবেন, যেখানে তাঁরা তাঁদের অন্বেষার চরম লক্ষ্যে পৌঁছেছেন?[১৯] তা সত্ত্বেও অনলোকিতজনের জন্যে বুদ্ধের এক ধরনের মর্মপীড়া ও বিষণ্নতা ছিল। আনন্দ ছাড়া একান্তদের আর কেউ ছিল না। টেক্সটসমূহ একে আড়াল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু উত্তেজিত জনতা ও বন্ধুদের সঙ্গে বর্ণাঢ্য ভোজ আর হয়নি। তার বদলে দুই বৃদ্ধ বুদ্ধ ও আনন্দ একাকী সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। বেঁচে থাকার ক্লান্তি ও সঙ্গীদের বিদায় প্রত্যক্ষ করেছেন যা বুড়ো বয়সের ট্র্যাজিডি নির্মাণ করে। এমনকি বুদ্ধও হয়তো এর খানিকটা স্বাদ পেয়েছিলেন; জোরালোভাবে বিচ্ছিন্ন বোধ করেছেন, ছায়া-সত্তা মারার শেষবারের মতো অবির্ভূত হওয়া তাই বোঝায়। আনন্দ এবং তিনি বেসালির অসংখ্য মন্দিরের একটায় মাত্র সারাদিন একসঙ্গে কাটিয়েছেন। বুদ্ধ মন্তব্য করলেন, চাইলে তাঁর মতো সম্পূর্ণ আলোকপ্রাপ্ত একজন মানুষের পক্ষে ইতিহাসের অবশিষ্ট অংশ পাড়ি দেওয়া সম্ভব। টেক্সট আমাদের বলছে, তিনি আনন্দকে আভাস দিচ্ছিলেন, তিনি যদি তাঁর নির্দেশনাকাঙ্ক্ষী দেবতা ও মানুষের প্রতি সমবেদনার কারণে মর্ত্যে অবস্থান করার আবেদন জানান, বুদ্ধের বেঁচে থাকার ক্ষমতা আছে। কিন্তু তারপরেও, বেচারা আনন্দ মাথা খাটাতে পারেননি। তিনি বুঝতে না পারায় বুদ্ধকে ঐতিহাসিক পর্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংঘের সঙ্গে অবস্থান করার অনুরোধ জানাননি। এটা এমন এক ভুল ছিল যার জন্যে আদি সংঘের সদস্যগণ আনন্দকে দোষারোপ করেছেন-মনিবের প্রতি বহু বছরের নিবেদিতপ্রাণ সেবার বিনিময়ে অকিঞ্চিৎকর পুরস্কার। স্বয়ং বুদ্ধ যার প্রশংসা করতেন। কিন্তু বুদ্ধ আভাস দেওয়ার পর তার তাৎপর্য বুঝতে পারেননি আনন্দ। কোমল কণ্ঠে মামুলি মন্তব্য করে কাছের একটা খাটের পায়ের কাছে বসতে এগিয়ে যান তিনি।

হয়তো ক্ষণিকের জন্যে হলেও এমনকি বুদ্ধও হয়তো নিজের আয়ু ফুরিয়ে আসছে টের পেয়ে এমন একজন সঙ্গী কামনা করেছিলেন যিনি তাঁর মনের কথা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন। কারণ ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর ছায়া- সত্তা মারা উপস্থিত হলেন। ‘তথাগতকে এবার পরিনিব্বানা লাভ করতে দাও,’ প্রলুব্ধ করার সুরে ফিসফিস করে বললেন মারা। কেন চালিয়ে যাওয়া? চূড়ান্ত বিশ্রাম পাওনা হয়েছে তাঁর: সংগ্রাম অব্যাহত রাখার কোনও যুক্তি নেই। শেষবারের মতো মারাকে প্রত্যাখ্যান করলেন বুদ্ধ। দায়িত্ব সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত পরিনিব্বানায় প্রবেশ করবেন না তিনি; যতক্ষণ না নিশ্চিত হচ্ছেন যে সংগঠন ও পবিত্র জীবন ঠিকমতো প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কিন্তু, যোগ করলেন তিনি, অচিরেই ঘটবে সেটা: ‘তিন মাসের মধ্য,’ মারাকে বললেন তিনি, ‘তথাগত পরিনিব্বানা লাভ করবে।’[২১]

তারপরই ধর্মগ্রন্থসমূহ আমাদের বলছে যে, বেসালির কাঁপালা মন্দিরে বুদ্ধ সচেতন ও ইচ্ছাকৃতভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছা ত্যাগ করেন। এমন এক সিদ্ধান্ত যা গোটা সৃষ্টিজগতে অনুরণিত হয়েছে। ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল পৃথিবী, আনন্দকেও বুঝিয়ে দিয়েছিল যে অশুভ কিছু আসন্ন। গুরুগম্ভীর ডঙ্কা বাজতে শুরু করেছিল স্বর্গে। বেঁচে থাকার আবেদন জানানোর আর সময় নেই, অনুতপ্ত পরিচারক আনন্দকে বললেন বুদ্ধ। এখন তাঁকে অবশ্যই সংঘের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে হবে। সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিতে হবে। বেসালির আরামায় বিশাল রঙিন মিলনায়তনে আশপাশে বাসরত সকল ভিক্ষুর উদ্দেশে বক্তব্য রাখলেন তিনি। তাদের নতুন কিছু বলার ছিল না তাঁর। ‘তোমাদের আমি কেবল সেই সব জিনিসই শিক্ষা দিয়েছি যা আমার নিজের পূর্ণ অভিজ্ঞতা রয়েছে,’ বলেন তিনি। বিশ্বাসের ভিত্তিতে কোনও কিছু মেনে নেননি তিনি। তাদেরও পুরোপুরি তাঁর শিক্ষা দেওয়া সত্য জানতে হবে এবং ধ্যানের সাহায্যে সেগুলোকে জীবন্ত অভিজ্ঞতায় পরিণত করতে হবে, যাতে যোগির ‘প্রত্যক্ষ জ্ঞান’ দিয়ে সেগুলো আত্মস্থ করতে পারে। সবার ওপরে, তাদের অবশ্যই অন্যের জন্যে বাঁচতে হবে। কেবল আলোকপ্রাপ্তির জন্যেই পবিত্র জীবনের উদ্ভাবন করা হয়নি। তাছাড়া, নিব্বানা এমন পুরস্কার নয় যে ভিক্ষু স্বার্থপরের মতো নিজের কাছে লুকিয়ে রাখবেন। তাঁদের অবশ্যই ‘মানুষের জন্যে, জনগণের কল্যাণ ও সুখের জন্যে, জগতের প্রতি সমবেদনা হতে এবং দেবতা ও মানুষের মঙ্গল ও শুভের জন্যে’[২২] ধম্ম পালন করতে হবে।

পরদিন সকালে বুদ্ধ ও আনন্দ শহরে খাবার ভিক্ষা করার পর বুদ্ধ ঘুরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় বেসালির দিকে চেয়ে রইলেন: শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছেন। এরপর ভানদাগামার পথ ধরেন ওঁরা। এই পর্যায় হতে বুদ্ধের ভ্রমণ যেন সত্য জগতের মানচিত্র হতে সরে যাচ্ছিল। ভানদাগামায় কিছুদিন অবস্থান করে সেখানকার ভিক্ষুদের নির্দেশনা দেওয়ার পর আনন্দকে নিয়ে ধীরে ধীরে উত্তরে হস্তিগামা, আম্বাগামা, জাম্বুগামা ও ভোগানাগামা (এগুলোর সবই কোনও চিহ্ন না রেখে হারিয়ে গেছে) হয়ে পাভায় এসে কুণ্ড নামের এক স্বর্ণকারের বাগিচায় অবস্থান গ্রহণ করলেন। বুদ্ধকে শ্রদ্ধা জানালেন কুণ্ড, মনোযোগ দিয়ে নির্দেশনা শুনলেন, তারপর এক অসাধারণ ভোজে নিমন্ত্রণ করলেন তাঁকে যেখানে কিছু সুকারামাদ্দাভা (‘শূকরের নরম মাংস’) ছিল। খাবারটা আসলে কী ছিল নিশ্চিত নয় কেউঃ কোনও কোনও ভাষ্যকার বলেন এটা ছিল বাজারের শূকরের মাংস (বুদ্ধ কখনও তাঁর জন্যে বিশেষভাবে হত্যা করা কোনও প্রাণীর মাংস খাননি): অন্যরা যুক্তি দেখিয়েছেন, এটা হয় কুচিকুচি করে কাটা শূয়োরের মাংস বা শূয়োরের খাবার সুগন্ধী ব্যাঙের ছাতা ছিল। কারও মতে এটা ছিল বিশেষ ধরনের আরক। বুদ্ধ সেরাতে মারা গিয়ে পরিনিব্বানা লাভ করতে পারেন ভেবে কুণ্ড এ খাবার তাঁর জীবন অনির্দিষ্ট কাল প্রলম্বিত করবে বলে ভেবেছিলেন।[২৩] সে যাই হোক, বুদ্ধ সুকারামাদ্দাধা খাওয়ার জন্যে জোর করলেন; অন্য ভিক্ষুদের টেবিলের অন্যান্য খাবার খেতে বললেন। খাবার শেষে পর কুণ্ডকে তিনি বললেন অবশিষ্ট খাবরটুকু মাটি চাপা দিতে, যেহেতু আর কেউ–এমনকি দেবতাও নয়–এটা হজম করতে পারবে না। এটা কুণ্ডের রান্নার নৈপুণ্যের বিপরীত মূল্যায়ন হতে পারে। কিন্তু কোনও কোনও আধুনিক পণ্ডিত মত দিয়েছেন যে, বুদ্ধ বুঝতে পেরেছিলেন সুকারামাদ্দাভায় বিষ মেশানো হয়েছিল: তাঁরা বুদ্ধের দিক থেকে নিঃসঙ্গতা ও জায়গার দূরত্বকে বুদ্ধ ও সংঘের দূরত্বের চিহ্ন হিসাবে দেখেছেন এবং বিশ্বাস করেন যে দুজন বৃদ্ধ রাজার মতো তিনিও সহিংস মৃত্যু বরণ করেছেন।[২৪]

কিন্তু পালি টেক্সট এমনকি এই ভীতিকর সম্ভাবনা বিবেচনায়ও আনেনি I কুণ্ডকে খাবার মাটি চাপা দেওয়ার বুদ্ধের অনুরোধ অদ্ভুত ছিল। কিন্তু কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি। অচিরেই মারা যাবেন বলে প্রত্যাশিত ছিল। সেরাতে রক্তবমি শুরু করেন তিনি, তীব্র, যন্ত্রণায় আক্রান্ত হন, কিন্তু আবারও অসুস্থতা সামলে আনন্দকে নিয়ে কুশিনারার পথ ধরেন। এখন মাল্লা প্রজাতন্ত্রের সীমানায় ছিলেন তিনি। এখানকার অধিবাসীরা বুদ্ধের ধারণার প্রতি তেমন আগ্রহী ছিল বলে মনে হয় না। টেক্সট আমাদের বলছে, সন্ন্যাসীদের স্বাভাবিক দল ছিল তাঁর সঙ্গে, কিন্তু আনন্দ বাদে সংগঠনের কোনও প্রবীন সদস্য তাঁর সঙ্গে ছিলেন না। কুশিয়ানারার পথে ক্লান্ত হয়ে পড়েন বুদ্ধ, পানি খেতে চান। নদী স্থবির ও দুর্গন্ধময় হওয়া সত্ত্বেও বুদ্ধের পাত্র নিয়ে আনন্দ এগিয়ে যাওয়ামাত্র পানি স্বচ্ছ টলটলে হয়ে ওঠে। ধর্মগ্রন্থসমূহ শেষের এই দিনগুলোর মলিন নিঃসঙ্গতা চাপা দিতে এইসব ঘটনার প্রতি জোর দিয়েছে। আমরা জানতে পারি, যাত্রার শেষ পর্যায়ে একজন মাল্লিয় পথিককে দীক্ষা দেন বুদ্ধ। লোকটা মানানসইভাবে তার পুরোনো গুরু আলারা কালামের অনুসারী ছিল। বুদ্ধের মনোসংযোগের মান দেখে মানুষটি এত মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে সেখানেই সে ত্রিসীমা আশ্রয় নির্মাণ করে এবং বুদ্ধ ও আনন্দকে সোনার কাপড়ের দুটো জোব্বা উপহার দেয়। কিন্তু বুদ্ধ তাঁর জোব্বা পরার পর আনন্দ চেঁচিয়ে বলে উঠলেন যে তাঁর উজ্জ্বল চামড়ার তুলনায় ওটাকে একেবারেই মলিন লাগছে: বুদ্ধ ব্যাখ্যা করলেন যে এটা তিনি যে অচিরেই-কুশিনারায় পৌঁছার পর-চূড়ান্ত নিব্বানা লাভ করবেন সেই চিহ্ন। খানিক পরে আনন্দকে বললেন তাঁর মৃত্যুর জন্যে কেউ যেন কুণ্ডকে দায়ী না করে: পরিনিব্বানা লাভের আগে বুদ্ধকে শেষ খাদ্য যোগানো বিরাট পূণ্যের কাজ।[২৫]

এই পরিনিব্বান। আসলে কী? এটা কি স্রেফ বিলুপ্তি? যদি তাই হয়, তাহলে শূন্যতাকে কেন এমন মহৎ অর্জন হিসাবে দেখা হয়েছে? এই ‘চূড়ান্ত’ নিব্বানা বোধি রক্ষের নিচে বুদ্ধ যে প্রশান্তি লাভ করেছিলেন তার চেয়ে আলাদা হবে কেমন করে? স্মরণযোগ্য, ‘নিব্বানা’ শব্দটির মানে ‘শীতল হওয়া’ বা কোনও শিখার মতো ‘নিভে যাওয়া’। টেক্সট বর্তমান জীবনে নিব্বানা অর্জনের পরিভাষা হচ্ছে সা-উপদি-সেসা। একজন আরাহান্ত আকাঙ্ক্ষা, ঘৃণা ও অজ্ঞতার আগুন নিভিয়ে ফেলেছেন, কিন্তু এখনও তার মাঝে ‘জ্বালানি’র (উপদি) ‘অবশিষ্ট’ (সেসা) রয়ে গেছে, যতক্ষণ তিনি দেহে অবস্থান করছেন, মন আর ইন্দ্রিয় কাজে লাগাচ্ছেন ও আবেগ অনুভব করছেন আরও জ্বালানোর একটা সম্ভাবনা রয়ে গেছে। কিন্তু একজন আরাহান্ত যখন মারা যান এই খণ্ড আর জ্বলে উঠতে পারে না, ফলে নতুন অস্তিত্বের শিখা প্রজ্জ্বলিত করতে পারে না।[২৬] সুতরাং আরাহান্ত সামসারা হতে মুক্ত এবং নিব্বানার শান্তি ও প্রতিরক্ষায় পুরোপুরি নিমজ্জিত হতে পারেন।

কিন্তু তার মানে কী? আমরা দেখেছি, বুদ্ধ সব সময়ই নিব্বানার সংজ্ঞা দিতে অস্বীকার করেছেন। কারণ অনুভূতি ও মনের আওতার বাইরের এই অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করার মতো কোনও পরিভাষা আমাদের নেই। ঈশ্বর সম্পর্কে নেতিবাচক সুরে কথা বলে যেসব একেশ্বরবাদী তাদের মতো বুদ্ধ মাঝেমাঝে নিব্বানা কী নয় সেটাই ব্যাখ্যা করতে পছন্দ করতেন। শিষ্যদের তিনি জানিয়েছেন যে এটা একটা অবস্থা।

যেখানে জমিন বা পানি, আলো বা হাওয়া, অসীম বা স্থান কোনওটাই নেই; এটা কারণের অসীমতা নয় আবার পরম শূণ্যতাও নয়…এটা বর্তমান জগৎ বা ভিন্ন জগৎ নয়; এটা চন্দ্র ও সূর্য দুটোই।[২৭]

তার মানে এই নয় যে আসলেই ‘কিছু না’ বুঝিয়েছে এটা। আমরা দেখেছি, নিব্বানায় কোনও আরাহান্তের বিলুপ্তি ঘটার দাবি বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে ধর্মদ্রোহীতায় পরিণত হয়েছিল। তবে এটা সত্তার অতীত এক অস্তিত্ব। স্বার্থপরতা নেই বলে প্রশান্তিময়। আমরা যারা অনালোকিত, যাদের দিগন্ত এখনও অহমবাদে সংকীর্ণ, তারা এই অবস্থা কল্পনা করতে পারবে না। কিন্তু যারা অহমের মৃত্যু অর্জন করেছে, তারা জানে যে স্বার্থহীনতা শূন্যতা নয়। বুদ্ধ শিষ্যদের মনের অন্তস্তলের এই প্রশান্তিময় স্বর্গোদ্যান কী সে সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার প্রয়াসে নেতিবাচক ও ইতিবাচক পরিভাষার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন নিব্বানা, বলেছেন তিনি, ‘লোভ, ঘৃণা ও বিভ্রমের নির্বাপন’; তৃতীয় মহান সত্যি; এটা ‘কলঙ্কহীন,’ অদুৰ্বল,’ ‘অভঙ্গুর,’ ‘অলঙ্ঘনীয়,’ ‘অহতাশ,’ ‘অনাক্রান্ত’ এবং ‘বৈরিতাহীন।’ এইসব বৈশিষ্ট্য জোর দেয় যে নিব্বানা আমরা জীবনে যেসব বিষয় অসহনীয় বলে আবিষ্কার করি তার সবই নাকচ করে। এটা নিশ্চিহ্নতার অবস্থা নয়; এটা ‘মৃত্যুহীন।’ কিন্তু নিব্বানা সম্পর্কে ইতিবাচক কথাও বলা যেতে পারে: এটা ‘সত্যি,’ ‘নিগূঢ়,’ ‘অপর পার,’ ‘চিরন্তন,’ ‘শান্তি, ‘ উৎকৃষ্ট লক্ষ্য,’ ‘নিরাপত্তা’ ‘মুক্তি,’ ‘স্বাধীনতা’, ‘দ্বীপ,’ ‘আশ্রয়,’ ‘পোতাশ্রয়, ‘ ‘শরণ,’ ‘ওপার।’[২৮] এটা দেবতা ও মানুষ উভয়ের পক্ষেই পরম শুভ। এক অনির্বচনীয় শান্তি ও সম্পূর্ণ নিরাপদ আশ্রয়। এইসব ইমেজের অনেকগুলোই ঈশ্বরকে বর্ণনা করার বেলায় একেশ্বরবাদীদের ব্যবহৃত শব্দের স্মারক।

প্রকৃতপক্ষে নিব্বানা অনেকাংশেই খোদ বুদ্ধের মতোই। মহায়না মতবাদের অনুসারী পরবর্তী কালের বৌদ্ধরা দাবি করবে, তিনি নিব্বানায় এমন ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছিলেন তাঁরা হয়ে পড়েছিলেন অবিচ্ছেদ্য। ঠিক ক্রিশ্চানরা যেমন মানুষ জেসাসকে নিয়ে চিন্তা করার সময় ঈশ্বর কেমন হতে পারেন উপলব্ধি করতে পারে, তেমনি বৌদ্ধরাও বুদ্ধকে এই অবস্থার মানবীয় রূপ হিসাবে দেখতে পায়। এমনকি তাঁর জীবনেই মানুষ এর আভাস লাভ করেছে। যে ব্রাহ্মণ বুদ্ধকে কোনও শ্রেণীতে ফেলতে পারেননি, যেহেতু তিনি জাগতিক বা স্বর্গীয় শ্রেণীতে খাপ খাননি, তিনি অনুভব করেছেন যে নিব্বানার মতো বুদ্ধ ‘ভিন্ন কিছু।’ বুদ্ধ তাঁকে বলেছিলেন, তিনি হচ্ছেন ‘যে জেগে উঠেছে,’ এমন একজন মানুষ যিনি ইহজাগতিক মানুষের ভীতিকর, বেদনাময় সীমাবদ্ধতা ঝেড়ে ফেলে বাইরের কিছু অর্জন করেছেন। রাজা পাসেনেদিও বুদ্ধকে আশ্রয়, নিরাপত্তা ও বিশুদ্ধতার একটা স্থান হিসাবে দেখেছেন। গৃহ ত্যাগ করার পর তিনি আপন অন্তরে শান্তির এই নতুন অঞ্চল আবিষ্কার না করা পর্যন্ত মানবীয় প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। কিন্তু তিনি অনন্য ছিলেন না। পবিত্র জীবনে গুরুত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণকারী যে কেউ নিজের মাঝে এই স্বৰ্গীয় প্রশান্তি লাভ করতে পারে। পঁয়তাল্লিশ বছর অহমহীন মানুষ হিসাবে জীবন কাটিয়েছেন বুদ্ধ। সুতরাং, তিনি বেদনার সঙ্গে বসবাসে সক্ষম ছিলেন। কিন্তু এখন জীবনের অন্তিম প্রান্তের দিকে যখন এগিয়ে যাচ্ছেন, বয়সের শেষ অসম্মানটুকুও ঝেড়ে ফেলবেন। তরুণ বয়সে লোভ ও বিভ্রমের কারণে জ্বলন্ত ‘জ্বালানি কাঠ,’ খণ্ড বহুদিন আগেই নির্বাপিত হয়েছে। এখন তা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যাবে। তিনি অপর পারে পৌঁছাতে যাচ্ছেন। তো দুর্বল কিন্তু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অজানা ছোট শহরের দিকে এগিয়ে চললেন তিনি যেখানে পরিনিব্বনা লাভ করবেন।

বুদ্ধ ও আনন্দ, দুজন বৃদ্ধ ভিক্ষুদের মিছিলসহ হিরন্নবতী নদী পেরিয়ে কুশিনারা মুখী পথের এক শালবনে প্রবেশ করলেন। ততক্ষণে বেদনায় আক্রান্ত হয়েছেন বুদ্ধ। শুয়ে পড়লেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ফুলে ফুলে ভরে উঠল শালবন, পাঁপড়ি ঝরাতে শুরু করল, যদিও সেটা ফুল ফোঁটার মৌসুম ছিল না। দেবতায় ভরে গেল জায়গাটা। বুদ্ধ বললেন, তাঁর শেষ বিজয় দেখতে এসেছেন তাঁরা। কিন্তু বুদ্ধকে বেশি সম্মান দিয়েছিল অনুসারীদের তিনি যে ধৰ্ম্ম এনে দিয়েছিলেন তার প্রতি তাদের আনুগত্য।

মৃত্যুপথযাত্রী বুদ্ধ তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সংক্রান্ত নির্দেশনা দান করলেন : তাঁর দেহভষ্মকে চক্কবত্তীর দেহভষ্মের মতো করে দেখতে হবে;মরদেহ কাপড়ে মুড়ে সুগন্ধী কাঠের আগুনে পোড়াতে হবে, তারপর দেহাবশেষ কোনও বৃহৎ নগরের প্রধান চত্বরে কবর দিতে হবে। গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধকে চক্কবত্তীর সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং আলোকন লাভের পর জগতকে নিপীড়ন আগ্রাসনভিত্তিক ক্ষমতার ভিত্তির বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিল। অন্তে ্যষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা এই বিচিত্র বিপরীত বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঙ্গিত করে। তরুণ গৌতম যখন মগধ ও কোসালায় আসেন তখন যে রাজাদের এমন ক্ষমতাধর মনে হয়েছিল, তাঁরা দুজনই শেষ হয়ে গেছেন। তাঁদের মৃত্যুর সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে যে রাজ্যগুলো স্বার্থপরতা, লোভ উচ্চাভিলাষ, হিংসা, ঘৃণা ও ধ্বংস নিয়ে চালিত হয়েছে। সেগুলো সমৃদ্ধি ও সংস্কৃতিক অগ্রগতি বয়ে এনেছিল; উন্নয়নের ধারা তুলে ধরেছে ও বহু মানুষের উপকার সাধন করেছে। কিন্তু অন্য আরেক ধরনের জীবন ছিল যা এমন সহিংসভাবে নিজেকে চাপিয়ে দেয়নি, যা সত্তাকে ক্ষমতাবান করে তোলার জন্যে নিবেদিত ছিল না এবং যা আধুনিক নারী-পুরুষকে আরও সুখী, আরও মানবিক করে তুলেছে।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন আনন্দের সহ্যের অতীত হয়ে পড়েছিল। শেষের এই দিনগুলোয় তাঁর কষ্ট আমাদের একজন অনালোকিত ও আরাহান্তকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা বিপুল দূরত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বৌদ্ধ মতবাদ সম্পর্কে সবই জানতেন আনন্দ। কিন্তু এই জ্ঞান যোগির ‘প্রত্যক্ষ জ্ঞানের’ বিকল্প হতে পারে না। মনিবকে হারানোর বেদনা বোধ করার সময় কোনও কাজে আসবে না তা। সারিপুত্তের মৃত্যুর চেয়েও সীমাহীন খারাপ এই বেদনা। জাগতিক, যৌক্তিক মন দিয়ে ভোগান্তির মহান সত্য বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু সেটা এমনভাবে আত্মস্থ করেননি যে সকল সত্তার সঙ্গে মিশে থাকবে। এখনও তিনি মেনে নিতে পারেননি যে সমস্ত কিছু‍ই ক্ষণস্থায়ী, একসময় হারিয়ে যাবে। কারণ তিনি কুশলী যোগি ছিলেন না। তিনি এইসব মতবাদে ‘প্রবেশ’ করতে পারেননি, জীবিত বাস্তবতায় পরিণত করতে পারেননি এগুলোকে। যোগিদের মতো নিশ্চিন্ত বোধ করার বদলে কেবল তীব্র বেদনা বোধ করেছেন। আপন দেহভষ্ম সম্পর্কে বুদ্ধের নিরাসক্ত নির্দেশনা শোনার পর মনিবের বিছানার পাশ হতে উঠে গেলেন আনন্দ, পালালেন বনের অন্য একটা কুঁড়ের দিকে। দীর্ঘ সময় দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদলেন। সম্পূর্ণ ব্যর্থ মনে হলো নিজেকে; ‘এখনও নবীশ রয়ে গেছি আমি, ‘ কাঁদলেন প্রবীন ভিক্ষু। ‘পবিত্র জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। আমার অনুসন্ধান অপূর্ণ রয়ে গেছে।’ আধ্যাত্মিক মহীরুহদের মাঝে জীবন কাটিয়েছেন তিনি। এখন কে তাঁকে সাহায্য করবে? কে তাঁকে নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবে? ‘আমার মনিব পরিনিব্বানা লাভ করতে যাচ্ছেন-আমরা দরদী মনিব, আমার প্রতি সবসময় দয়া দেখিয়েছেন যিনি।’

আনন্দের কান্নার সংবাদ পেয়ে তাঁকে ডেকে পাঠালেন বুদ্ধ। ‘যথেষ্ট হয়েছে, আনন্দ,’ বললেন তিনি। ‘বিষণ্ন হয়ো না। দুঃখ করো না।’ তিনি কি বারবার ব্যাখ্যা করেননি যে কোনও কিছুই স্থায়ী নয়, বরং বিচ্ছেদই জীবনের বিধান? ‘আর আনন্দ,’ উপসংহার টানলেন বুদ্ধ, ‘বহু বছর অন্তহীন ভালোবাসা ও দরদ দিয়ে আমার সেবা করেছ তুমি। আমার শারীরিক প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রেখেছ। তোমার কথা চিন্তায় সমর্থন যুগিয়েছে। তুমি পূণ্য অর্জন করেছ, আনন্দ। চেষ্টা চালিয়ে যাও। তুমিও শিগগিরই আলোকপ্রাপ্ত হবে।[২৯]

কিন্তু তখনও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন আনন্দ। ‘প্রভু,’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, ‘এই ভয়ঙ্কর ছোট শহরে চূড়ান্ত বিশ্রামে যাবেন না। এখানে মাটির দেয়াল, এই বিধর্মী জংলী, বিরান এলাকায়।’ জীবনের অধিকাংশ সময় রাজাগহ, কোসাম্বি, সাবস্তি ও বারানসির মতো বিরাট শহরে কাটিয়েছেন বুদ্ধ। এখানে একাকী, এই অবিশ্বাসীদের মাঝে মৃত্যুবরণ না করে সেগুলোরই কোনও একটায় ফিরে অভিজাত অনুসারীদের মাঝে অনুসন্ধান শেষ করতে পারবেন না কেন? টেক্সট দেখায়, আদি সংঘ কুশিনারার অস্পষ্টতা ও তাদের গুরুর দূরে জঙ্গলে মারা যাওয়ার ব্যাপারে বিব্রত ছিল। কুশিনারা এককালে সমৃদ্ধ শহর ও একজন চক্কবত্তীর রাজধানী ছিল বলে আনন্দকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করলেন বুদ্ধ। কিন্তু কুশিনারাকে বেছে নেওয়ার পেছনে বুদ্ধের নিশ্চয়ই গভীরতর কোনও কারণ ছিল। কোনও বৌদ্ধ অতীত অর্জনের ওপর নির্ভর করে থাকতে পারে না। সংঘকে সব সময় বিস্মৃত বিশ্বে সাহায্য পৌঁছে দিতে সামনে যেতে হবে। একজন বুদ্ধ কোনও আলোকিত মানুষের দৃষ্টিতে কুশিনারার মতো ছোট হতদরিদ্র শহরকে দেখবেন না। বহু বছর ধরে তিনি তাঁর মুক্ত সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে বাস্তবতাকে দেখার প্রশিক্ষণ দিয়ে এসেছেন। আমাদের অনেকেই সত্তার বোধ ফাঁপিয়ে তোলার জন্যে যে বাহ্যিক মর্যাদার ওপর নির্ভর করি তাঁর সেটা প্রয়োজন ছিল না। তথাগত হিসাবে তাঁর অহমবাদ ‘বিদায় নিয়েছিল।’ একজন বুদ্ধের নিজের কথা ভাববার সময় নেই, মৃত্যু শয্যায়ও না। একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অন্যের জন্যে বেঁচে ছিলেন তিনি। তাঁর বিজয়ের অংশী হতে কুশিনারার মাল্লয়ীদের বনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এক পথচারী ভিক্ষুকেও নির্দেশনা দিতে সময় ব্যয় করেছেন। অন্য গোত্রের অনুসারী হলেও বুদ্ধের শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এই ভিক্ষু, বুদ্ধ অসুস্থ ও ক্লান্ত বলে আনন্দের প্রতিবাদ সত্ত্বেও।

অবশেষে আনন্দের দিকে ফিরলেন তিনি। স্বাভাবিক সহানুভূতি দিয়ে তাঁর চিন্তায় প্রবেশ করেছেন। ‘তুমি হয়তো ভাবছ, আনন্দ’: ‘গুরুর বাণী এখন অতীতের কথা: এখন আর আমাদের কোনও গুরু নেই।’ কিন্তু ব্যাপারটা এভাবে দেখা ঠিক হবে না। আমি বিদায় নেওয়ার পর তোমাকে যে ধম্ম আর অনুশীলন শিক্ষা দিয়েছি তাকেই গুরুর আসনে বসাও।[৩০] সবসময়ই অনুসারীদের তাঁর নয়, বরং ধম্মের মুখাপেক্ষী হতে বলেছেন তিনি। তিনি নিজে কখনও গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। অন্তিম যাত্রার সঙ্গী ভিক্ষুদের দিকে ফিরলেন এরপর। আরও একবার তাদের মনে করিয়ে দিলেন, ‘প্রতিটি জিনিস হারিয়ে যাবে। আন্তরিকতার সঙ্গে তোমাদের মুক্তির অন্বেষণ করো।[৩১]

অনুসারীদের শেষ পরামর্শ দেওয়ার পর অচেতন হয়ে পড়লেন বুদ্ধ। সন্ন্যাসীদের কেউ কেউ চেতনার উচ্চতর স্তর হয়ে তাঁর যাত্রা অনুসরণ করতে সক্ষম হলেন যা তিনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় প্রায়ই করতেন। কিন্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতায় প্রভাবিত মন বিশিষ্ট কারও চেনা অবস্থার অতীতে চলে গিয়েছিলেন তিনি। দেবতাগণ আনন্দ-উল্লাস করার সময় কম্পিত হয়েছে পৃথিবী। আলোকপ্রাপ্ত হননি যেসব ভিক্ষু কেঁদেছেন তারা। এমন এক বিলুপ্তির অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন বুদ্ধ যা বৈপরীত্যমূলকভাবে সত্তার পরম স্তর ও মানুষের মোক্ষ।

দমকা হাওয়ায় নেভা শিখা
যেমন বিশ্রামে যায়, সংজ্ঞায়িত করা যায় না।
তেমনি আলোকপ্রাপ্তজন স্বার্থপরতা হতে মুক্ত
অবকাশে যান, সংজ্ঞায়িত করা যাবে না।
সকল কল্পনার অতীতে–
ভাষার শক্তির অতীতে গমন করেছেন।[৩২]

শেষ

তথ্যসূত্র

১. সাম্যত্তা নিকয়া, ৩: ২৫।

২. মাজহিমা নিকয়া, ৮৯।

৩. ভিক্ষু নানামোলি (অনু. ও সম্পা.), দ্য লাইফ অভ দ্য বুদ্ধা, অ্যাকর্ডিং টু দ্য পালি ক্যানন, কান্ডি, শ্রী লঙ্কা, ১৯৭২, ২৮৫ (ধারাভাষ্যে রয়েছে এই কাহিনী, লিপিতে নয়। )

৪. মাজহিমা নিকয়া, ১০৪।

৫. বিনয়া: কুলাভাগ্য, ৭: ২।

৬. প্রাগুক্ত, ৭: ৩।

৭. প্রাগুক্ত।

৮. প্রাগুক্ত।

৯. প্রাগুক্ত।

১০. প্রাগুক্ত।

১১. প্রাগুক্ত।

১২. প্রাগুক্ত, ৭: ৫।

১৩. দিঘা নিকয়া, ১৬।

১৪. প্রাগুক্ত।

১৫. প্রাগুক্ত।

১৬. প্রাগুক্ত।

১৭. প্রাগুক্ত, সাম্যত্তা নিকয়া, ৪৭: ৯।

১৮. দিঘা নিকয়া, ১৬; আঙুত্তারা নিয়া, ৮: ১০।

১৯. প্রাগুক্ত, ৪৭: ১৪।

২০. দিঘা নিকয়া, ১৬; আঙুত্তারা নিকয়া, ৮: ১০।

২১. দিঘা নিকয়া, ১৬।

২২. প্রাগুক্ত।

২৩. নানামোলি, লাইফ অভ বুদ্ধা, ৩৫৭-৫৮।

২৪. মাইকেল এডওয়ার্ডস, ইন দ্য ব্লোইং আউট অভ আ ফ্লেইম: দ্য ওঅর্ল্ড অভ দ্য বুদ্ধা অ্যান্ড দ্য ওঅর্ল্ড অভ ম্যান, লন্ডন, ১৯৭৬, ৪৫।

২৫. দিঘা নিকয়া ১৬।

২৬. রিচার্ড এফ, গমব্রিচ, থেরাভেদা বুদ্ধজম: আ সোশ্যাল হিস্ট্রি ফ্রম অ্যানশেন্ট বেনারেস টু মডার্ন কলোম্বো, লন্ডন, ও নিউ ইয়র্ক, ১৯৮৮, ৬৫-৬৯।

২৭. উদনা, ৮: ১।

২৮, সাম্যত্তা নিকয়া, ৪৩: ১-৪৪।

২৯. দিঘা নিকয়া, ১৬।

৩০. প্রাগুক্ত, আঙুত্তারা নিকয়া, ৭৬।

৩১. দিঘা নিকয়া, ১৬; আঙুত্তারা নিকয়া, ৪: ৭৬।

৩২. সুত্তা-নিপাতা, ৫: ৭।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *