৫. ব্ৰত

ব্ৰত

বৌদ্ধ শিল্পকর্মসমূহ সাধারণত দেখায় যে, বুদ্ধ নিঃসঙ্গ ধ্যানমগ্ন অবস্থায় একাকী বসে আছেন। কিন্তু বাস্তবে ধম্ম প্রচার শুরু করার পর থেকে তাঁর জীবনের সিংহভাগ সময়ই কেটে গেছে বিশাল কোলাহলময় জনতার ভীড়ে। ভ্রমণের সময় সাধারণত শত শত ভিক্ষু সঙ্গী হতেন তাঁর। তাঁরা এত জোরে কথাবার্তা বলতে চাইতেন যে অনেক সময় নীরব থাকার জন্যে আবেদন জানাতে বাধ্য হতেন বুদ্ধ। তাঁর সাধারণ অনুসারীরা প্রায়শঃই রথ ও ঠেলাগাড়ি ভর্তি রসদপত্র নিয়ে রাস্তার সন্ন্যাসীদের মিছিল অনুসরণ করত। প্রত্যন্ত বনের কুড়ে ঘরে নয়, শহর ও নগরে বাস করতেন বুদ্ধ। কিন্তু জীবনের শেষ পঁয়তাল্লিশটি বছর সাধারণ মানুষের চোখের সামনে কেটে গেলেও টেক্সটসমূহ এই দীর্ঘ ও গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়টিকে কিছুটা উপেক্ষাই করেছে। জীবনাকারের কাজে লাগার মতো তেমন কিছু রাখেনি। জেসাসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি একেবারেই উল্টো। গস্পেলসমূহ জেসাসের প্রথম জীবন সম্পর্কে আমাদের প্রায় কিছুই জানায় না, বরং মিশন শুরু করার পরই গুরুত্বের সঙ্গে তাঁর কাহিনী বলা শুরু করেছে। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থসমূহ বুদ্ধের হিতোপদেশসমূহ সংরক্ষণ করেছে এবং তাঁর দীক্ষা প্রদানের প্রথম পাঁচটি বছরের মোটামুটি বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে। অথচ এরপরই দৃষ্টি হতে হারিয়ে যান বুদ্ধ। তাঁর জীবনের শেষ বিশটি বছর প্রায় সম্পূর্ণই অসংকলিত রয়ে গেছে।

এই ধরনের সংযম হয়তো সমর্থন করতেন বুদ্ধ। আর যাই হোক ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাল্ট আশা করেননি তিনি, সব সময়ই জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি নন, ধম্মই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যেমন উল্লেখ করেছি, তিনি বলতেন, ‘যে আমাকে দেখতে পায় সে ধম্মকেই দেখে।’[১] এছাড়াও, আলোপ্রাপ্তির পর বাস্ত বিক আর কিছু ঘটতে পারত না তাঁর। কোনও ‘সত্তা’ ছিল না তাঁর, অহমবাদ নির্বাপিত হয়েছে; ‘তথাগত’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি, অর্থাৎ যিনি স্রেফ ‘বিদায়’ নিয়েছেন। এমনকি পালি টেক্সটসমূহ তাঁর মিশনের গোড়ার দিকের বছরগুলোর বর্ণনা দেওয়ার সময়ও ঐতিহাসিক তথ্যের চেয়ে বরং তাদের গল্পের প্রতীকী অর্থের প্রতিই বেশি আগ্রহী। আধ্যাত্মিক জীবনের আদর্শ, ধম্ম ও নিব্বানার মূর্ত প্রতাঁকে পরিণত হয়েছিলেন বুদ্ধ। নতুন ধরনের মানুষ ছিলেন তিনি; লোভ ও ঘৃণার নিপীড়নে আবদ্ধ নন। অহমবাদ হতে মুক্ত হয়ে বাঁচার জন্যে নিজের মনকে পরিচালিত করতে শিখেছিলেন তিনি। এই পৃথিবীতেই বাস করলেও ভিন্ন এক মাত্রায় ছিল তাঁর আবাস, একেশ্বরবাদীরা যাকে স্বর্গীয় উপস্থিতি বলবে। সুতরাং, দীক্ষা দানের গোড়ার দিকের বছরগুলোর বর্ণনায় পালি টেক্সটগুলো বুদ্ধের চিন্তা ও অনুভূতি সম্পর্কে আমাদের কিছুই বলে না, কিন্তু উত্তর ভারতের শহর, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি ও ধর্মীয় জগতের সঙ্গে আদি বৌদ্ধদের সম্পর্ক দেখতে তাঁর কর্মকাণ্ডকে ব্যবহার করে।

ধর্মগ্রন্থসমূহ বলে, এপ্রিলের শেষে বা মে-র প্রথম দিকে নিব্বানা লাভ করেন বুদ্ধ। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কোন বছর ঘটেছিল সেটা প্রকাশ করে না। দীর্ঘদিন ধরে ৫২৮ বিসিইকেই প্রচলিত সন হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে আসছিল, যদিও কোনও কোনও আধুনিক পণ্ডিত একে ৪৫০-এর শেষ দিকের ঘটনা মনে করেন।[২] আমরা পালি টেক্সটের সম্ভাব্য ত্বরান্বিত ঘটনাক্রমপঞ্জী অনুসরণ করলে বুদ্ধ সম্ভবত বর্ষা ঋতুর শেষে, সেপ্টেম্বরে ষাট জন সন্ন্যাসীকে দীক্ষা দানের উদেশ্যে প্রেরণ করে থাকবেন। অন্যান্য সংঘের মতো বুদ্ধের নতুন সংগঠনও শিথিল ও ভ্রমণশীল সংস্থা ছিল। যেখানে পারতেন কোনওমতে ঘুমিয়ে থাকতেন সন্ন্যাসীরা: ‘জঙ্গল, গাছপালার নিচে, ঝুলন্ত পাথরের নিচে, গিরিখাতে, পাহাড়ী গুহায়, শ্মাশানে, বনে, প্রকাশ্য স্থানে, খড়ের গাদায়।’[৩] কিন্তু প্রতিদিন ধ্যানে সময় কাটাতেন তাঁরা আর যাদের প্রয়োজন সেইসব মানুষকে, বিশেষ করে সময়ের অস্থিরতা সবচেয়ে তীব্রভাবে অনুভূত হওয়া নতুন শহরগুলোর বাসিন্দাদের ধম্ম দীক্ষা দিতেন। তাঁদের শিক্ষা সফল হয়েছিল: কেবল সাধারণ অনুসারীই সংগ্রহ করেননি তাঁরা বরং সংঘের নতুন সদস্যও পেয়েছিলেন। ষাট সন্ন্যাসীকে নতুন নবীশ সংগ্রহ করে পূর্ণাঙ্গ সন্ন্যাসী হিসাবে দীক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছিলেন বুদ্ধ।[৪]

আরও একবার একাকী হওয়ার পর উরুবেলায় ফিরে এলেন বুদ্ধ। চলার পথে স্থানীয় এক বারবনিতার পিছু ধাওয়াকারী তিরিশজন উচ্ছৃঙ্খল তরুণকে ধম্ম দীক্ষা দেন তিনি। মেয়েটি ওদের টাকা নিয়ে সটকে পড়েছিল। ‘তোমাদের জন্যে কোনটা ভালো?’ জিজ্ঞেস করেন বুদ্ধ, ‘একজন নারীর সন্ধান করা, নাকি নিজেদের খুঁজে পাওয়া?’[৫] ঘটনাটি মানুষের আনন্দের পেছনে অর্থহীন ছুটোছুটি করার একটা স্পষ্ট উপমা, যা কেবল হতাশ ও নিঃস্ব করে তুলতে পারে।

বুদ্ধের কথা শোনার পর তরুণদের সবাইই ‘স্রোতে প্রবেশকারীতে পরিণত হয়ে সংঘে যোগ দেয়। কিন্তু উরুবেলায় পৌঁছার পর উরুবেলা, গয়া ও নিরঞ্জরা নদীর পাশের বনে সাফল্যের সঙ্গে তিন কশ্যপ ভাইদের নেতৃত্বে বসবাসকারী হাজার সদস্যের গোটা একটা সংঘকে দীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে আরও চমকপ্ৰদ ধর্মান্তর অর্জন করেন তিনি। কাহিনীটিকে সম্ভবত বৈদিক ট্র্যাডিশনের সঙ্গে আদি বৌদ্ধদের মোকাবিলা তুলে ধরা উদাহরণ হিসাবে পড়া উচিত।[৬] এই ব্রাহ্মণরা ‘অগ্রসর হয়েছেন’ ও সাধারণ সমাজের স্থির, শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনধারা প্রত্যাখ্যানের প্রতীক হিসাবে চুল বড় হতে দিয়ে জট পাকাতে দিয়েছেন। কিন্তু তখনও তাঁরা প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠান পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করতেন। তিনটি পবিত্র অগ্নিকুণ্ডের যত্ন নিচ্ছিলেন তাঁরা।

পুরো শীতলকাল উরুবেলা সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাটান বুদ্ধ। এখানে বেশ কিছু লক্ষণীয় অলৌকিক কাণ্ড ঘটান। জনপ্রিয় স্বর্গীয় প্রতীক এক ভয়ঙ্কর গোখরা সাপকে বশ মানান, ব্রাহ্মণরা যাকে তাঁদের পবিত্র অগ্নিকুণ্ডে স্থাপন করতেন। সমস্ত বনকে অপার্থির ঔজ্জ্বলো ভরিয়ে দিয়ে রাতে তাঁর আস্তানায় বেড়াতে আসা দেবতাদের আনন্দ যোগান তিনি। অগ্নি উৎসের জন্যে অলৌকিক উপায়ে গাছের গুঁড়ি চিরেছেন তিনি, স্বর্গে আরোহণ করে স্বর্গীয় ফুল নিয়ে এসেছেন। উরুবেলা সম্প্রদায়ের নেতা কশ্যপকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি তার অন্তর পড়তে পারেন। পালি টেক্সট ও পরবর্তীকালের জীবনী, উভয়ই প্রথমদৃষ্টিতে যা বিস্ময়কর বুদ্ধের এই ধরনের নিদর্শন ও কেরামতির বিবরণ ধারণ করে। যোগের অনুশীলন দক্ষ যোগিদের বস্তুর ওপর মনের আধিপত্য সৃষ্টির ক্ষমতা (ইদ্ধি) দেওয়ার কথা। কিন্তু তরুণ যোগিদের সাধারণত ইদ্ধির চর্চার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়, কারণ এতে একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তির সামান্য বুজরুকে পরিণত হওয়াটা খুবই সহজ হয়ে পড়ে। স্বয়ং বুদ্ধই এই ধরনের প্রদর্শনবাদীতার তীব্র সমালোচক ছিলেন। প্রকাশ্যে ইদ্ধির চর্চা করার ব্যাপারে অনুসারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন তিনি। কিন্তু পালি টেক্সট রচনাকারী সন্ন্যাসীগণ বিশ্বাস করে থাকবেন যে, এই ধরনের কেরামতি সম্ভব ছিল। সম্ভবত ধর্মীয় যুক্তি হিসাবে তাঁরা এইসব কাহিনী ব্যবহার করেছেন। শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে টেক্সট রচনাকারী থেরাভেদীয় সন্ন্যাসীগণ হয়তো বুদ্ধের এইসব আকর্ষণীয় ক্ষমতা থাকার কথা বলা সুবিধাজনক মনে করে থাকতে পারেন। এছাড়া, ব্রাহ্মণ ও বৈদিক ধর্মের কর্তাদের সঙ্গে বিতর্কের সময় বুদ্ধ প্রাচীন দেবতাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন (আগ্নিকক্ষের পবিত্র গোখরার মতো) বর্ণনা করতে পারাটা উপকারী ছিল; সামান্য ক্ষত্রিয় হলেও ব্রাহ্মণদের ঢের বেশি শক্তি ছিল তাঁর, তিনি তাদের অনায়াসে পরাস্ত করেছেন। পরবর্তীকালে টেক্সট আমাদের বলছে, সমগ্ৰ গোত্ৰ প্রথাকেই চ্যালেঞ্জ করেছেন বুদ্ধ: ‘কেবল জন্মই কাউকে ব্রাহ্মণ বা অস্পৃশ্য করে তোলে না বরং সেটা আমাদের কর্মকাণ্ড (কম্ম)’,[৮] জোর দিয়ে বলেছেন তিনি। ‘নৈতিক আচরণের ওপর ধর্মীয় মর্যাদা নির্ভর করে, জন্মগত দুর্ঘটনার উপর নয়।’ যথারীতি অ্যাক্সিয়েল যুগের অন্য সব মহান সাধুর মতো বুদ্ধ যুক্তি দেখিয়েছেন, বিশ্বাসকে নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে হবে, এটা ছাড়া আচার-আচরণ অর্থহীন।

বুদ্ধের অলৌকিক কর্মকাণ্ড নয়, বরং নৈতিকতাই শেষ পর্যন্ত কশ্যপের বিশ্বাস যুগিয়েছিল। এখানেও টেক্সট হয়তো বোঝাতে চেয়ে থাকতে পারে যে, ইদ্ধির জাঁকাল প্রদর্শনী উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে: একজন সংশয়বাদীকে অবশ্যই মুগ্ধ করতে পারেনি। প্রতিটি অলৌকিক ঘটনার পর কশ্যাপ স্রেফ আপন মনে বলেছেন: ‘এই মহান সন্ন্যাসী আকর্ষণীয় ও শক্তিশালী। কিন্তু আমার মতো আরাহান্ত নয়।’ শেষ পর্যন্ত বুদ্ধ তাঁকে অহংকার ও আত্মতুষ্টি হতে বের করে এনেছেন। ‘কশ্যপ,’ বলেছেন তিনি, ‘তুমি আরাহান্ত নও। এভাবে চলতে থাকলে কোনওদিনই আলোকপ্রাপ্ত হতে পারবে না।’ এমন অবাধ অহমবাদ আধ্যাত্মিক জীবনের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। ভর্ৎসনা আঘাত হানল তাঁকে। বিখ্যাত সাধু হিসাবে এজাতীয় আত্মমর্যাদাবোধের বিপদ সম্পর্কে জানা থাকার কথা কশ্যপের। জমিনে আসন পেতে বসে সংঘের সদস্যপদ প্রার্থনা করলেন তিনি। তাঁর অন্য দুভাই ও এক হাজার অনুসারীর প্রত্যেকে তাঁকে অনুসরণ করল। বিপুল সংখ্যক নবীশ দেখা গেল এবার, জটা কামিয়ে পবিত্র তৈজষপত্র ফেলে পরিণত হলো ‘স্রোতে প্রবেশকারী’তে।[৯] এরপর বুদ্ধের তৃতীয় মহান হিতোপদেশ শুনবার জন্যে গয়ায় সমবেত হলো তারা।

‘ভিক্ষুগণ,’ শুরু করলেন বুদ্ধ, ‘সমস্ত কিছু পুড়ছে।’ অনুভূতি ও বাহ্যিক জগৎ, দেহ, মন ও আবেগ, যার ওপর এসব টিকে থাকে, পুড়ছে সমস্ত কিছু। এই অগ্নিকাণ্ডের কারণ কী? লোভ, ঘৃণা ও বিভ্রমের তিনটি অগ্নিকুণ্ড।[১০] মানুষ যতদিন এই শিখাগুলোকে ইন্ধন যোগাবে, ততদিন তা জ্বলতে থাকবে, কখনও নিব্বানার শীতলতা লাভ করবে না। পাঁচটি খণ্ডকে (ব্যক্তিত্বের ‘স্তূপ’ বা ‘উপাদান’) এভাবে আভাসে লাকড়ির ‘বান্ডিলে’র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। উপাদনা (‘আঁকড়ে’ থাকা) শব্দটার মধ্যেও এক ধরনের পরিহাস রয়েছে, যার মৌল অর্থ ‘জ্বালানি।’[১১] এই জগতের বস্তু সামগ্রী আঁকড়ে থাকার আকাঙ্ক্ষাই আমাদের জ্বালিয়ে রাখে ও আলোকন ব্যাহত করে। যথারীতি এই লোভ ও বাসনা জগতের অশুভ ও সহিংসতার জন্যে দায়ী ঘৃণার সঙ্গে মিশে যায়। অজ্ঞতার তৃতীয় অগ্নিকুণ্ড যতদিন জ্বলবে, মানুষ ততদিন ‘জন্ম, মায়া ও মৃত্যুর দুঃখ, শোক, বেদনা দুঃখ আর হতাশার’[১২] জ্বালাতনকারী চক্র হতে মুক্তির জন্যে আবশ্যক চারটি মহান সত্যি উপলব্ধি করতে পারবে না। সুতরাং ভিক্ষুকে অবশ্যই নিরাসক্ত হয়ে উঠতে হবে। অভিনিবেশের কৌশল তাঁকে তাঁর পাঁচটি খণ্ড হতে বিচ্ছিন্ন হতে শেখাবে; অগ্নিশিখাগুলোকে নিভিয়ে দেবে। তারপর নিব্বানার মুক্তি ও শান্তি প্রত্যক্ষ করবে সে।

অগ্নি-হিতোপদেশ বৈদিক ব্যবস্থার চমৎকার সমালোচনা ছিল। এর পবিত্র প্রতীক অগ্নি বুদ্ধ যেসব জিনিসকে জীবনের পক্ষে ভ্রান্তিপূর্ণ মনে করেছেন তার ইমেজ: অগ্নিকুণ্ড ও বাড়ির প্রতীক যেখান হতে একজন আন্তরিক সন্ধানীকে অবশ্যই ‘অগ্রসর হতে’ হবে। এটা আবার মানুষের চেতনাকে গড়ে তোলা অস্থির, বিধ্বংসী অথচ ক্ষণস্থায়ী শক্তিসমূহেরও চমৎকার প্রতীক। লোভ, ঘৃণা ও অজ্ঞতার তিনটি আগুন বেদের তিন পবিত্র আগুনের বিদ্রূপাত্মক বিপরীত নজীর: এক পুরোহিত গোষ্ঠী গড়ে তোলার ভ্রান্ত বিশ্বাস হতে এগুলোর পরিচর্যা করে ব্রাহ্মণরা স্রেফ তাঁদের আপন অহমবাদেই ইন্ধন যোগাচ্ছিলেন। হিতোপদেশটি ধম্মকে শ্রোতাদের উপযোগি করে তোলায় বুদ্ধের দক্ষতারও প্রকাশ, যেন তিনি তাদের অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন। বুদ্ধের হিতোপদেশ এমন জোরালভাবে তাদের ধর্মীয় চেতনায় সাড়া জাগিয়েছিল যে শোনার পর সাবেক অগ্নি-উপাসকদের সবাই নিব্বানা অর্জন করে আরাহান্তে পরিণত হয়েছিল।

ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ নতুন হাজার ভিক্ষু সঙ্গে নিয়ে মগধের রাজধানী রাজাগহের উদ্দেশে যাত্রা করেন বুদ্ধ। আলোড়ন সৃষ্টি করল তাঁদের আগমন। নতুন আধ্যাত্মিকতার জন্যে ক্ষুধার্ত ছিল নগরবাসীরা। নগর উপকণ্ঠে চারাগাছের বনে নিজেকে বুদ্ধ দাবিকারী এক ব্যক্তি শিণির স্থাপন করেছেন জানতে পেরে রাজা বিম্বিসারা ব্রাহ্মণ গৃহস্থদের বিরাট একটা দল নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। উরুবেলা সম্প্রদায়ের সাবেক প্রধান কশ্যপকে বুদ্ধের অনুসারী রূপে দেখে হতবাক হয়ে গেলেন তাঁরা। কশ্যপের কাছে অগ্নি- উপাসনা ছাড়ার কারণ জেনে দারুণ ক্ষুব্ধ হলেন সবাই। কিন্তু তারা বুদ্ধের বাণী শোনার পর, পালি টেক্সট আমাদের বলছে, ১,২০,০০০ গৃহস্থের সবাই সাধারণ অনুসারীতে পরিণত হলো। সবার শেষে স্বয়ং রাজা বিম্বিসারাও বুদ্ধের সামনে নতজানু হয়ে তাঁকেও সাধারণ অনুসারী করে নেওয়ার আবেদন জানালেন। ছোটবেলা হতেই রাজার আশা ছিল এমন একজন বুদ্ধের প্রচার শুনবেন যাঁর ধম্ম তিনি বুঝতে পারবেন। এবার তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ হলো। এটা ছিল বুদ্ধ ও রাজার দীর্ঘস্থায়ী এক সম্পর্কের সূচনা। সেরাতে বুদ্ধকে তাঁর সঙ্গে খাবার জন্যে আমন্ত্রণ জানান রাজা।

খাবার সময় রাজা সংঘকে এমন এক উপহার দেন যা কিনা বৌদ্ধ সংগঠনের বিকাশের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট প্রভাব রাখবে। ভিক্ষুদের সংঘের আবাস হিসাবে রাজাগহের ঠিক বাইরে বেলুবানার বাঁশ বন নামে পরিচিত একটা প্রমোদ-উদ্যান (আরামা) দান করেছিলেন। সন্ন্যাসীগণ সেখানে নিরিবিলি শান্তি তে বসবাস করতে পারবেন, যেটা আবার যুগপৎ শহর ও মানুষের জন্যে সুগম, যাদের পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে। বনটি শহর হতে খুব দূরে বা খুব কাছে ছিল না… মানুষের পক্ষে সুগম, কিন্তু নিরিবিলি, নির্জন।[১৩] উপহার গ্রহণ করলেন বুদ্ধ। চমৎকার সমাধান ছিল এটা। তাঁর সন্ন্যাসীদের ‘বিচ্ছিন্নতা’ মনস্তাত্ত্বিক হওয়ার কথা, জগৎ হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা নয়। সন্ন্যাসীদের ব্যক্তিগত সন্তোষের জন্যে নয়, মানুষের জন্যেই ব্যবস্থার অস্তিত্ব। ধ্যানের জন্যে সন্ন্যাসীদের কিছু মাত্রার শান্ত পরিবেশের প্রয়োজন হবে, যেখানে তাঁরা নিব্বানামুখী নিস্পৃহতা ও অন্তস্থ বিচ্ছিন্নতার বিকাশ ঘটাতে পারবেন, কিন্তু ধম্মের দাবি অনুযায়ী তাঁরা সম্পূর্ণ অন্যদের জন্যে বাঁচতে চাইলে নিজেদের দুঃখ-কষ্ট প্রশমিত করার পদ্ধতি শিখতে সাধারণ মানুষের অবশ্যই তাঁদের কাছে আসার সুযোগ থাকতে হবে। বাঁশ বনের উপহার একটা নজীর স্থাপন করে। ধনী দাতারা প্রায়শঃই সংঘকে শহরতলীর অনুরূপ উদ্যান উপহার দিয়েছে, যা ভবঘুরে ভিক্ষুদের আঞ্চলিক কার্যালয়ে পরিণত হয়েছিল।

নতুন আরামায় দুমাস ছিলেন বুদ্ধ। এই সময়ই তাঁর দুজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুসারী সংঘে যোগ দেন: রাজাগৃহের বাইরে ছোট গ্রামে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হয়েছিল সারিপুত্ত ও মগ্গালানার। একই দিনে তাঁরা জগত- সংসার ত্যাগ করে সংশয়বাদী সঞ্জয়ের নেতৃত্বাধীন সংঘে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কেউই পূর্ণ আলোকপ্রাপ্ত হতে পারেননি। তখন তাঁদের ভেতর যে আগে নিব্বানা লাভ করবেন সঙ্গে সঙ্গে অন্যকে জানানোর রফায় পৌঁছেছিলেন তাঁরা। বুদ্ধের আগমনের সময় দুই বন্ধু রাজাগহে বাস করছিলেন। একদিন আশাজিকে (আদি পাঁচ ভিক্ষুর একজন) ভিক্ষা করতে দেখলেন সারিপুত্ত। মুহূর্তে সন্ন্যাসীর প্রশান্তি ও স্থৈর্য্যে ধাক্কা খেলেন তিনি। বুঝে গেলেন, এই মানুষটি আধ্যাত্মিক সমাধান পেয়ে গেছেন। তো প্রচলিত কায়দায় তাঁকে সম্ভাষণ জানিয়ে আশাজির গুরুর পরিচয় ও তিনি কোন ধম্ম অনুসরণ করেন জানতে চাইলেন। পবিত্র জীবনের সামান্য নবীশ হিসাবে নিজেকে তুলে ধরে ধম্মের সারাংশ জানালেন আশাজি। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট ছিল। সেখানেই ‘স্রোতে প্রবেশকারী’তে পরিণত হলেন সারিপুত্ত। মগ্গালানাকে এ সংবাদ পৌঁছে দিতে ছুটলেন দ্রুত। তাঁর বন্ধুও ‘স্রোতে প্রবেশকারী’তে পরিণত হলেন। দুজনে মিলে সংঘে অন্তর্ভুক্ত হবার আবেদন জানাতে সঞ্জয়কে হতাশ করে তাঁর ২৫০ জন শিষ্যকে নিয়ে বাঁশ বনে বুন্ধের কাছে গেলেন তাঁরা। সারিপুত্ত ও মগ্গালানাকে আসতে দেখার সাথে সাথে ওদের প্রতিভা টের পেয়ে গেলেন বুদ্ধ। ‘এরাই হবে আমার প্রধান অনুসারী,’ ভিক্ষুদের বললেন তিনি। ‘সংঘের জন্যে বিরাট ভূমিকা রাখবে ওরা।’[১৪] এবং তাই প্রমাণিত হয়েছিল। বুদ্ধের মৃত্যুর ২০০ থেকে ৩০০ বছরের মধ্যে বিকশিত বৌদ্ধ মতবাদের দুটো প্রধান ধারার প্রেরণাদাতা হয়েছিলেন দুই বন্ধু।[১৫] অধিকতর কঠোর এবং মঠমুখী থেরাভেদা সারিপুত্তকে দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বিবেচনা করে। বিশ্লেষণী ক্ষমতা ছিল তাঁর। এমনভাবে ধম্মের ব্যাখ্যা দিতে পারতেন যা সহজেই মনে রাখা যেত। কিন্তু তাঁর ধার্মিকতা বৌদ্ধ মতবাদ সম্পর্কে আরও গণতান্ত্রিক দর্শন বিশিষ্ট ও সহানুভূতির ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব দানকারী জনপ্রিয় মহায়না ধারার তুলনায় বড় কাঠখোট্টা। মহায়না ধারা মগ্গালানাকে তাদের মন্ত্রণাদাতা হিসাবে গ্রহণ করেছে। ইদ্ধির জন্যে খ্যাত ছিলেন তিনি, অতিন্দ্রীয়ভাবে স্বর্গে আরোহণ করতে পারতেন; যোগ ক্ষমতায় মানুষের মনের কথা বোঝার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল তাঁর। বুদ্ধের সারিপুত্ত ও মগ্গালানার উভয়ের প্রশংসা থেকে বোঝা যায় দুটো মতবাদকেই সঠিক মনে করা হয়েছে। এবং প্রকৃতপক্ষেই ক্রিশ্চান জগতের ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্টদের চেয়ে ঢের শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করেছে ওরা।

সবাই অবশ্য বুদ্ধের প্রেমে পড়েনি। বাঁশ বাগানে অবস্থান কালে রাজাগহের বহু অধিবাসী বোধগম্য কারণেই সংঘের নাটকীয় সমৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন বোধ করেছে। প্রথমে জটাধারী ব্রাহ্মণ, এবার সঞ্জয়ের সংশয়ীরা–এরপর কে? সমস্ত তরুণ-যুবাকে কেড়ে নিয়ে গৌতম সন্ন্যাসী সবাইকে সন্তানহীন ও নারীদের বিধবায় পরিণত করছেন। অচিরেই তাদের সংসার বিনষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু প্রসঙ্গটি বুদ্ধের গোচরে আনা হলে তিনি ভিক্ষুদের চিন্তা করতে নিষেধ করলেন: এটা স্রেফ সাতদিনের একটা বিস্ময় এবং নিশ্চিতভাবে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে সমস্যা মিটে গিয়েছিল।[১৬]

পালি টেক্সট আমাদের বলছে, এই সময় কাপিলাবাস্তুতে বাবার বাড়িতে গিয়েছিলেন বুদ্ধ–তবে আমাদের বিস্তারিত কিছু জানায় না। অবশ্য, পরবর্তী সময়ের ধর্মগ্রস্থ ও ধারাভাষ্যগুলো পালি টেক্সটের কংকালে রক্ত-মাংস জুড়েছে; এইসব উত্তর-শাস্ত্রীয় কাহিনী বুদ্ধের কিংবদন্তীর অংশে পরিণত হয়েছে।[১৭] এসব আমাদের বলে, শুদ্ধোদন তাঁর ছেলে, এখন বিখ্যাত বুদ্ধ রাজাগহে ধর্ম প্রচার করছেন জানতে পেরে বিরাট এক প্রতিনিধিদলসহ বার্তাবাহক পাঠিয়ে কাপিলা-বাস্তুতে অতিথি হবার আমন্ত্রণ জানালেন। কিন্তু বুদ্ধের বক্তব্য শোনার পর শাক্যদের এই মিছিলের সবাই শুদ্ধোদনের বার্তার কথা ভুলে গিয়ে আরাহান্তে পরিণত হয়– এমন ঘটনা সাতবার ঘটেছিল। অবশেষে বুদ্ধকে আমন্ত্রণ পৌঁছে দেওয়া হলো। বিশ হাজার ভিক্ষু নিয়ে নিজ শহরের উদ্দেশে রওনা হলেন তিনি। শাক্যরা কাপিলাবাস্তুর বাইরে নিগরোধা বাগান ভিক্ষুদের হাতে ছেড়ে দেয়। শাক্যের সংঘের প্রধান কার্যালয়ে পরিণত হয় তা। কিন্তু শাক্যরা অহংকার ও ঔদ্ধত্য দেখিয়ে বুদ্ধকে সম্মান জানাতে অস্বীকার করে। ফলে, কথিত আছে, তাদের পর্যায়ে অবতরণ করে ইদ্ধির আকর্ষণীয় চমক তুলে ধরেন বুদ্ধ। শূন্যে ভাসলেন তিনি, হাত-পা হতে আগুন ও পানির ধারা বের হলো এবং সবশেষে আকাশের বুকে রত্নখচিত পথে হাঁটলেন। সম্ভবত অভ্যাসবশত শাক্যদের বোধগম্য ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করছিলেন তিনি, তাদের মনের ভেতর প্রবেশ করতে চেয়েছেন। বাবা শুদ্ধোদন চেয়েছিলেন তিনি যেন বিশ্বশাসক চক্কবত্তী হন; এই কিংবদন্তীর চরিত্রও, কথিত আছে, রাজকীয় ঢঙে আকাশে ঘুরে বেড়াতে পারেন। উরুবেলায় বুদ্ধ ব্রাহ্মণ সাধকদের কাছে নিজেকে যেকোনও চক্কবত্তীর চেয়ে শ্রেয় করে তুলে ধরেছিলেন। প্রদর্শনীয় প্রভাব সৃষ্টি হয়েছিল তাতে, যদিও তা ছিল বাহ্যিক। শাক্যরা হতবাক হয়ে গিয়েছে। বুদ্ধের সামনে মাথা নত করেছে।

কিন্তু যথারীতি ইদ্ধি স্থায়ী ফল বয়ে আনতে পারেনি। পরদিন কাপিলাবাস্তুতে ছেলেকে খাবার মাংতে দেখে দারুণ পিড়ীত বোধ করলেন শুদ্ধোদন: পরিবারের মর্যাদার এমন অসম্মান করার সাহস তিনি পেলেন কোথায়? কিন্তু বাবার কাছে ধৰ্ম্ম ব্যাখ্যা করলেন বুদ্ধ। কোমল হলো শুদ্ধোদনের হৃদয়। নিমেষে ‘স্রোতে প্রবেশকারী’ তে পরিণত হলেন তিনি, যদিও সংঘে যোগদানের আবেদন জানাননি। বুদ্ধের কাছ থেকে পাত্র নিয়ে ঘরে নিয়ে এলেন তাঁকে। এখানে তাঁর সম্মানে প্রস্তুত খাবার গ্রহণের সময় একটা উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম বাদে বাড়ির সব মহিলা তাঁর সাধারণ শিষ্যে পরিণত হয়। বুদ্ধের সাবেক স্ত্রী দূরে সরে রইলেন, সম্ভবত বোধগম্যভাবেই কোনওরকম কথাবার্তা ছাড়াই তাঁকে ত্যাগ করে যাওয়া মানুষটির প্রতি তখনও বৈরী ভাবাপন্ন ছিলেন তিনি।

পালি টেক্সটসমূহ ধারণ করেছে যে, কাপিলাবাস্তু সফরের পর অনির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর শাক্যের নেতৃস্থানীয় যুবকেরা গৃহ ত্যাগ করে সংঘে যোগ দেন। বুদ্ধের সাত বছর বয়সী ছেলে রাহুলাও ছিলেন সেই দলে। দীক্ষা নেওয়ার আগে বিশ বছর বয় পূর্ণ হওয়া অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁকে। বুদ্ধের তিন নিকটাত্মীয়ও ছিলেন: তাঁর চাচাত ভাই আনন্দ; সৎভাই নন্দ ও শ্যালক দেবদত্ত। নাপিত উপলও সঙ্গী হয়েছিল তাঁদের। নতুন ভিক্ষুদের মাথা মোড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে, কিন্তু সেও যোগদানের আবেদন জানায়। সঙ্গীরা আগে নাপিতকে দীক্ষা দিতে বলেছেন যাতে তাদের শাক্য অহংকার চূর্ণ হয়।[১৮] এই শাক্যদের কেউ কেউ সংগঠনের উল্লেখযোগ্য চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। উপল হয়ে ওঠে মঠ-জীবনের নিয়ম-কানুনের ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় বিশেষজ্ঞ। সজ্জন, বিবেকবান আনন্দ পরিণত হন বুদ্ধের জীবনের শেষ বিশ বছরের ব্যক্তিগত পরিচারক। আনন্দ অন্য যেকারও থেকে বুদ্ধের অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলেন; প্রায় সর্বক্ষণিক সাহচর্যে থাকার সুবাদে বুদ্ধের হিতোপদেশ ও বাণীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু দক্ষ যোগি ছিলেন না তিনি। ধম্মের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অভিজ্ঞ কর্তৃপক্ষে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও ধ্যানের ক্ষমতা না থাকায় বুদ্ধের জীবদ্দশায় নিব্বানা লাভ করেননি। দেবদত্তের ক্ষেত্রে আমরা যেমন দেখি, ধর্মগ্রস্থসমূহ তাকে গস্পেল কাহিনীর জুডাসের অনুরূপ ভূমিকা দিয়েছে।

জেসাসের অনুসারীদের বর্ণাঢ্য উপস্থাপনসহ গস্পেলের উল্লেখ পশ্চিমা পাঠকদের মনে আদি এইসব বৌদ্ধদের সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী করে তোলে। হাজারে হাজারে সংঘে যোগ দেওয়া এই মানুষগুলো কারা ছিল? বুদ্ধের কাছে কীসের আকর্ষণে ছুটে এসেছিল তারা পালি টেক্সট সে সম্পর্কে সামান্যই জানায় আমাদের। কিংবদন্তী আভাস দেয় যে, ‘বহুজনের’ কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হলেও ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় গোত্র হতে এসেছিল প্রথম যোগদানকারীরা। সবাই যোগদানের আহ্বান পেয়েছিল: বণিকরাও সংগঠনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। সন্ন্যাসীদের মতো তারাও বিকাশমান সমাজের ‘নতুন মানুষ’ ছিল। আবশ্যিকভাবে গোত্র বর্জিত সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী একটা বিশ্বাসের প্রয়োজন ছিল তাদের। তবে গস্পেল যেমন জেলেদের জাল ছাড়া ও কর সংগ্রাহকদের বাড়ি ছাড়ার কথা বলে সে রকম ব্যক্তিগত ধর্মান্তরের কোনও বিস্তারিত কাহিনী নেই। ভিক্ষুদের মাঝে অনন্য হয়ে আছেন আনন্দ ও দেবদত্ত, কিন্তু জেসাসের কিছু অনুসারীর আরও ব্যাপক বিবরণের তুলনায় তাদের কাহিনীও প্রতীকী ও বিশেষ রীতি অনুসারী। এমনকি বুদ্ধের নেতৃস্থানীয় শিষ্য সারিপুত্ত ও মাগ্গালানাকেও দৃশ্যতঃ সামান্য ব্যক্তিত্বপূর্ণ মলিন চরিত্র হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। ছেলের সঙ্গে বুদ্ধের সম্পর্ক নিয়েও কোনও মর্মস্পশী আখ্যান নেই: পালি টেক্সটে রাহুলা স্রেফ আরেক জন সন্ন্যাসী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁকে ধ্যানের শিক্ষা দিয়েছেন বুদ্ধ, অন্য যেকোনও ভিক্ষুর ক্ষেত্রে যেমনটি করতেন তিনি। বিবরণে তাঁরা যে পিতা-পুত্র এমনটি বোঝানোর মতো কিছু নেই। ইমেজ পাই আমরা, কোনও ব্যক্তিত্ব নয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতি পাশ্চাত্য অনুরাগের কারণে আমরা অসন্তুষ্ট বোধ করি।

কিন্তু তাতে বৌদ্ধদের অভিজ্ঞতার প্রকৃতিকে ভুল বোঝা হবে। আদি এই সন্ন্যাসীদের অনেকেই কেবল অনাত্মার মতবাদ অনুধ্যান করে আলোকপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এটা তাদের সত্তার উর্দ্ধে যেতে সক্ষম করেছে। আসলে স্থায়ী ব্যক্তিত্ব বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব থাকার কথা অস্বীকার করেছেন বুদ্ধ। তিনি সত্তাবোধের কোনও পবিত্র, নূন্যতম বস্তুর প্রতি অটল বিশ্বাসকে আমাদের আলোকনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো ‘অদক্ষ’ বিভ্রান্তি মনে করতেন। অনাত্মার আধ্যাত্মিকতার ফলে খোদ বুদ্ধ পালি শাস্ত্রে বিশেষ ব্যক্তি না হয়ে বরং একটা ধরণ হিসাবে উপস্থাপিত হয়েছেন। অন্যান্য ধরনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনিঃ সংশয়বাদী, ব্রাহ্মণ ও জৈন। পশ্চিমা মানুষ যেসব অসাধারণ গুণ ও বৈশিষ্ট্যকে আদর্শ হিসাবে কদর করে ঠিক সেগুলোর বিলুপ্তি ঘটিয়েই মুক্তি অর্জন করেছেন তিনি। শিষ্যদের বেলায়ও একই কথা খাটে। ভিক্ষুদের সাথে বুদ্ধের পার্থক্য টানার মতো কিছু নেই, তাঁদের ক্ষুদ্র বুদ্ধ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। বুদ্ধের মতো তাঁরাও নৈর্ব্যক্তিক হয়ে গেছেন, ব্যক্তি হিসাবে বিলীন হয়ে গেছেন। অনুমোদিত টেক্সট তাঁদের মনের গভীরে যেতে অস্বীকার জানিয়ে এই পরিচয়হীনতা সংরক্ষণ করেছে; এসব আলোকন প্রাপ্তির আগে তাঁদের চরিত্রের কোনও পছন্দযোগ্য আচরণও প্রকাশ করবে না। দেবদত্ত ও আনন্দের সাধারণের চেয়ে ভিন্ন হওয়াটা দুর্ঘটনা নাও হতে পারে। দেবদত্ত অহমবাদে পরিপূর্ণ, এবং আনন্দ আলোকপ্রাপ্ত হতে ব্যর্থ হওয়ায় পরিণামে সরিপুত্তের মতো আধ্যাত্মিক মহাপুরুষের চেয়ে বেশি লক্ষযোগ্য ব্যক্তিগত গুণের অধিকারী ছিলেন। বুদ্ধের জীবনের শেষ ভাগে আমরা আনন্দের মহৎ হৃদয় সম্পর্কে আরও জানতে পারি, কিন্তু আমরা যেমন দেখব, তিনি বুদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গির অংশীদার হতে পারেননি। ব্যক্তিত্বের এমনি বিনাশে বিলাপকারী কোনও পশ্চিমাবাসীকে ভিক্ষুরা সম্ভবত জানাতেন যে নিব্বানার অন্তস্থ শাস্তি লাভের জন্যে অহম বিসর্জনই যথার্থ মূল্য, সত্তাবোধে বন্দি কারও পক্ষে যা সম্ভবত অসম্ভব।

কিন্তু বুদ্ধ এবং তাঁর শিষ্যদের নৈর্ব্যক্তিক ভাবে এর মানে এই নয় যে তাঁরা শীতল, অনুভূতিহীন ছিলেন। তাঁরা কেবল সহানুভূতি সম্পন্ন ও সজ্জনই ছিলেন না, গভীরভাবে সামাজিকও ছিলেন। তাঁদের ‘বহুজনের’ কাছে পৌঁছানোর প্রয়াস মানুষকে আকৃষ্ট করেছে, অহমবাদের অভাব অপ্রতিরোধ্য মনে হয়েছে তাদের।

সকল সন্ন্যাসীর মতো অবিরাম চলার উপর থাকতেন বুদ্ধ। যতদূর সম্ভব বৃহৎ দর্শকের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতেন, কিন্তু বর্ষা মৌসুমের তিন মাসে চলাচল কঠিন হয়ে গেলে রাজাগহের বাইরে বাঁশ বাগানেই অবস্থান করতেন। উদ্যানটি এখন সংঘের মালিকানাধীন হলেও ভিক্ষুরা সেখানে কোনও কিছু নির্মাণ না করে খোলা মাঠেই অবস্থান করতেন। যাহোক এক ধনী বর্ণিক বাঁশ বন বেড়াতে এসে জায়গাটা পছন্দ করে ফেললেন, সন্ন্যাসীদের জন্যে ষাটটি কুটির নির্মাণ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন তিনি। অনুমতি দিলেন বুদ্ধ। এরপর বুদ্ধ এবং সন্ন্যাসীদের খাবারে আমন্ত্রণ জানালেন বণিক। এমন বিশাল জমায়েতকে খাওয়ানো সামান্য ব্যাপার ছিল না। খাবারের দিন সকালে কাজের লোকেরা জাউ, ভাত, ঝোল ও মিষ্টি বানানোর সময় গোটা বাড়ি শোরগোলে ভরে উঠেছিল। বণিক মহাশয় নানা কাজ ও ফরমাশ দিতে এতই ব্যস্ত ছিলেন যে ব্যবসায়িক কাজে সাবস্তি থেকে রাজাগহে আগত শ্যালক অনাথাপিন্দিকাকে স্বাগত জানানোরও ফুরসত পাননি। ‘হচ্ছেটা কী?’ সবিস্ময়ে জানতে চাইলেন অনাথাপিন্দিকা। সাধারণত এ বাড়িতে বেড়াতে এলে ভগ্নিপতি তার সমাদর করে কুলিয়ে উঠতে পারেন না। বিয়ে জাতীয় কিছু হচ্ছে? নাকি রাজা বিম্বিসারাকে আপ্যায়ন করা হচ্ছে? ‘মোটেই তা নয়,’ জবাব দিলেন বণিক I বুদ্ধ ও তাঁর সন্ন্যাসীরা খেতে আসছেন।

নিজের কানকে বিশ্বাস করে উঠতে পারলেন না অনাথাপিন্দিকা। ‘কী বললে, বুদ্ধ?’ অবিশ্বাসের সুরে জানতে চাইলেন তিনি। সত্যি কি একজন আলোকপ্রাপ্ত বুদ্ধ আবির্ভূত হয়েছেন এই জগতে? তিনি কী এখনই তাঁর সাথে দেখা করতে যেতে পারেন? ‘এখন তার উপযুক্ত সময় নয়,’ তীর্যক কণ্ঠে জবাব দিয়ে ফের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বণিক। ‘কাল ভোরে তাঁর সাথে কথা বলতে পারবে।’ অনাথাপিন্দিকা এমনই উত্তেজিত ছিলেন, বলতে গেলে রাতে ঘুমাতে পরলেন না তিনি। খুব ভোরে বাঁশ বাগানের পথ ধরলেন তিনি। কিন্তু নগর থেকে বের হয়ে আসার পরপরই অ্যাক্সিয়াল যুগের সাধারণ ভীতিতে প্রবলভাবে আক্রান্ত হলেন। নিজেকে নাজুক মনে হলো তাঁর। ‘জগৎ থেকে আলো হারিয়ে গেল, সামনে কেবল অন্ধকার দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি।’ ভোরের আলোয় বুদ্ধকে পায়চারিরত অবস্থায় না দেখা অবধি ভয়ে ভয়ে আগে বাড়লেন তিনি। অনাথাপিন্দিকাকে দেখে তাঁকে বসতে দিলেন বুদ্ধ, নাম ধরে ডাকলেন। অতীতের ইয়াসার মতোই নিমেষে প্রফুল্ল হয়ে উঠলেন বণিক; বুদ্ধে কথা শোনার সাথে সাথে এমন প্রবলভাবে তাঁর শিক্ষা জেগে উঠতে শুরু করল যেন তাঁর আত্মার গভীরে তা খোদাই হয়েছিল। ‘অসাধারণ, প্রভু!’ চিৎকার করে বলে উঠলেন তিনি। বুদ্ধের কাছে তাঁকে একজন শিষ্য করে নেওয়ার আবেদন জানালেন। পরদিন ভগ্নিপতির বাড়িতে বুদ্ধকে আপায়ন করলেন তিনি। নিজ শহর কোসালার রাজধানী সাবস্তি সফরের আমন্ত্রণ জানালেন তাঁকে।[১৯]

ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ পাদে সাবস্তি সম্ভবত গাঙ্গেয় উপত্যকার সবচেয়ে অগ্রসর শহর ছিল। রিবতি নদীর দক্ষিণ পাড়ে দুটো বাণিজ্য পথের মিলনস্থলে গড়ে উঠেছিল শহরটি। প্রায় ৭০,০০০ পরিবারের আবাস ছিল এখানে। নেতৃস্থানীয় বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে অনাথাপিন্দিকার মতো বহু ধনী ব্যবসায়ী এখানে বাস করত। কথিত আছে, শহরের নাম ‘সর্বমাস্তি’ হতে নেওয়া, কেননা এটা এমন এক জায়গা ছিল যেখানে ‘সবকিছুই পাওয়া সম্ভব’। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ফুট উঁচু দর্শনীয় টাওয়ারে সুরক্ষিত সাবস্তির প্রধান সড়কগুলো দক্ষিণ দিক থেকে শহরে এসে শহর কেন্দ্রের একটা খোলা চত্বরে মিলিত হয়েছে।[২০] কিন্তু সাবস্তির সমৃদ্ধি সত্ত্বেও একজন সত্যিকার বুদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাতের সম্ভাবনায় অনাথাপিন্দিকার উত্তেজনা বহু মানুষের জীবনের এক অস্বস্তিকর শূন্যতার অনুভূতি তুলে ধরে। সংঘের জন্যে জুৎসই জায়গা।

বুদ্ধের জন্যে একটা ঘাঁটি নির্মাণে কোনও রকম ব্যয়ে কণ্ঠিত হলেন না অনাথাপিন্দিকা। জুৎসই একটা জায়গার খোঁজে কঠোর পরিশ্রম করেছেন তিনি। অবশেষে কোসালার সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী রাজকুমার জিতের একটা উদ্যান বেছে নিলেন। অনাথাপিন্দিকা ঠেলাগাড়ি ভর্তি করে সোনার মোহর আনার আগে পর্যন্ত বিক্রিতে অনীহ ছিলেন রাজপুত্র। মোহরগুলো সারা বাগানে ছড়িয়ে দিলেন তিনি, গোটা জমিন ঢাকা পড়ে গেল তাতে। এত টাকা দিতে রাজি ছিলেন তিনি। কেবল প্রবেশ পথের কাছে সামান্য একটু জায়গা বাকি ছিল। দেরিতে হলেও রাজকুমার জিত বুঝতে পারলেন, কোনও মামুলি লেনদেন নয় এটা। চাঁদা দেওয়াটা সুবিধাজনক হতে পারে। ফলে সেই জায়গাটুকু বিনামূল্যে ছেড়ে দিলেন। সেখানে একটা গেইট-হাউস নির্মাণ করে দিলেন। তারপর জিতের উদ্যানকে সংঘের জন্যে তৈরি করে দিলেন অনাথাপিন্দিকা। তিনি ‘উন্মুক্ত কুটির নির্মাণ করালেন, তোরণ বানালেন, নির্মাণ করালেন দর্শক মহল, অগ্নিকক্ষ, গুদাম ও স্নানাগার তৈরি করালেন, পুকুর কাটালেন, তাঁবু খাটালেন।’[২১] সংঘের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হবে এটা।

কিন্তু ‘গৃহহীনতা’কে আলিঙ্গনকারী মানুষের পক্ষে খুবই জাঁকাল আয়োজন ছিল এসব। খুবই কম সময় পরিসরে রাজাগহ কাপিলাবাস্তু ও সাবস্তিতে পদ্মপুকুর, অসংখ্য আম গাছ আর ছায়াময় নারকেল সারিতে ঘেরা তিনটি বিরাট উদ্যানের মালিক হয়েছেন বুদ্ধ যেখানে সন্ন্যাসীরা বসবাস ও ধ্যান করতে পারবেন। অন্য দাতাগণ দ্রুত অনাথাপিন্দিকার নজীর অনুসরণ করলেন। বুদ্ধ সাবস্তিতে ধম্ম প্রচার করছেন জেনে যমুনা তীরের কোসাম্বির তিন মহাজন তাঁর বয়ান শুনতে জিতের উদ্যানে হাজির হলেন এবং তাঁকে স্ব স্ব শহরে আমন্ত্রণ জানালেন। প্রত্যেকে যার যার শহরে একটি করে ‘প্রমোদ উদ্যান’ (আরামা) নির্মাণ করলেন। কেবল নিজেদের পয়সা খরচ করে দালান কোঠাই নির্মাণ করলেন না তাঁরা, বরং অন্যান্য দাতার মতো নিজেরাই খরচ যুগিয়ে আরামার সংরক্ষণও করেছেন তাঁরা। বাঁশ বাগান পরিচর্যায় রাজা বিম্বিসারা এত লোক নিয়োজিত করেছিলেন যে গোটা গ্রাম পূর্ণ করে ফেলেছিল তারা। কিন্তু সন্ন্যাসীরা বিলাসিতায় বাস করেননি। প্রচুর হলেও আয়োজন ছিল সাধারণ। কুঁড়েগুলোয় মধ্যপন্থীদের উপযোগি আসবাবের অতিরিক্ত তেমন কিছু ছিল না। প্রত্যেক ভিক্ষুর ভিন্ন সেল ছিল, কিন্তু প্রায়শঃই সেটা ছিল পার্টিশন দিয়ে আলাদা করা একটা জায়গা, ঘুমানোর জন্যে স্রেফ একটা পাটাতন আর বসার জন্যে জোড়া দেওয়া পায়াঅলা একটা আসন থাকত সেখানে।[২২]

ভিক্ষুগণ সারা বছর এইসব আরামায় থাকতেন না, বরং বেশিরভাগ সময় পথেই কাটাতেন তাঁরা। গোড়ার দিকে অধিকাংশই বর্ষাকালেও চলার উপর থাকতেন, কিন্তু পরে এটা আঘাতকারী হিসাবে আবিষ্কার করেন। জৈনদের মতো অন্য গোত্রগুলো বৃষ্টির সময় পথ চলতে অস্বীকার করেছে, কারণ তাতে বুনোজীবনের ক্ষতি হবে এবং অহিংসার নীতি লঙ্ঘিত হবে। লোকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছিল, শাক্যমুনির শিষ্যরা কেন বর্ষাকালে ভ্রমণ অব্যাহত রেখেছে? ‘কাচি ঘাস মাড়াচ্ছে, গাছপালা নষ্ট করছে, অসংখ্য ক্ষুদে প্রাণীকে কষ্ট দিচ্ছে?’ এমনকি শকুনের ঝাঁকও তো, যুক্তি দেখিয়েছে তারা, বর্ষার সময় গাছে বসে থাকে। কেন কেবল বুদ্ধের সন্ন্যাসীরা কারও কথা কানে না তুলে নিজেদের কর্দমাক্ত পথঘাটে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য মনে করেন?[২৩]

এই জাতীয় সমালোচনায় স্পর্শকাতর ছিলেন বুদ্ধ। এইসব অভিযোগ শুনতে পেয়ে মৌসুমি বিশ্রামকে (বাস্যা) সংঘ সদস্যদের জন্যে বাধ্যতামূলক করে দিলেন তিনি। কিন্তু অন্য ভবঘুরেদের চেয়ে আরেক কদম অগ্রসর হয়ে তিনি মঠচারী গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন শুরু করলেন। অন্যান্য গোত্রের সন্ন্যাসীগণ বাস্যার সময়ে একাকী বাস করতেন বা যেখানে থাকতেন সেখানেই সম্পূর্ণ ভিন্ন ধৰ্ম্ম অনুসারী সন্তদের সঙ্গে বনের কোনও ফাঁকা জায়গায় সময় কাটাতেন। অন্যান্য গোত্রের সদস্যদের সঙ্গে নয়, বাস্যার সময় সন্ন্যাসীদের একসঙ্গে থাকবার নির্দেশ দিলেন বুদ্ধ। তারা যেকোনও আরামা বা প্রতি বছর শূন্য হতে গড়ে তোলা কোনও পল্লী বসতি (আবাসা) বেছে নিতে পারতেন। প্রতিটি আরামা ও আবাসার নির্ধারিত সীমানা ছিল। জোরাল কোনও কারণ ছাড়া বর্ষার তিনমাস কোনও সন্ন্যাসীর সপ্তাহকালের বেশি সময়ের জন্যে বিশ্রাম ত্যাগ করার অনুমতি ছিল না। ক্রমে সন্ন্যাসীগণ একটা গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন গড়ে তুলতে লাগলেন। সহজ সাধারণ অনুষ্ঠান সৃষ্টি করলেন তাঁরা। তাঁদের বসতির মিলন কক্ষে এসবের আয়োজন করা হতো। সকালে ধ্যান করতেন তাঁরা, কিংবা অন্য কোনও প্রধান সন্ন্যাসীর নির্দেশনা শুনতেন। তারপর দিনের রসদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে যার যার পাত্র নিয়ে শহরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তেন। দিনের মূল খাবার গ্রহণ করতেন। বিকেলে চলত বিশ্রাম, সন্ধ্যায় আয়োজন করা হতো আরও ধ্যানের।

কিন্তু সবার ওপরে ভিক্ষুগণ আন্তরিকতার সঙ্গে বাস করতে শিখেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে হয়তো পছন্দ হবে না এমন মানুষের সঙ্গে সহবাস করার অনিবার্য সমস্যাগুলো ধ্যানের মাধ্যমে যে প্রশান্তি অর্জন করার কথা তাকে পরীক্ষার সম্মুখীন করত। ভিক্ষুরা পরস্পরের প্রতি সমব্যাথী না হতে পারলে পৃথিবীর চারদিকে সহানুভূতি প্রেরণ শুভকর হতো না। বুদ্ধ সন্ন্যাসীদের শাস্তি দিয়েছেন, এমন ঘটনাও আছে। একবার পেটের পীড়ায় আক্রান্ত ভিক্ষুর যত্ন নিতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁদের ভর্ৎসনা করছেন তিনি।[২৪] আরেকবার বুদ্ধ ও তাঁর সফরসঙ্গীরা সাবস্তি ভ্রমণ করার সময় সন্ন্যাসীদের ক্ষুদে একটা দল আগেভাগে স্থানীয় এক বসতিতে গিয়ে সবগুলো বিছানা দখল করে নিয়েছিলেন। প্রবল কাশিতে ভুগছিলেন সারিপুত্ত, সারারাত গাছের নিচে কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। এমন নিষ্ঠুরতা, অপরাধী সন্ন্যাসীদের বলেছেন বুদ্ধ, সংঘের সামগ্রিক উদ্দেশ্যকে খাট করেছে। কেননা এতে মানুষ ধম্ম হতে দূরে সরে যাবে।[২৫] কিন্তু আস্তে আস্তে সেরা ভিক্ষুরা তাঁদের নিজস্ব স্বার্থপর প্রবণতা বিসর্জন দিয়ে সতীর্থদের কথা বিবেচনা করতে শিখেছেন। ভিক্ষা নিয়ে শহর থেকে প্রথম প্রত্যাবর্তনকারী অন্যদের জন্যে কুটির গোছাতেন, আসন সাজাতেন ও রান্নার পানি যোগাড় করে রাখতেন। সবার শেষে যিনি বাড়ি ফিরতেন তিনি উচ্ছিষ্ট খেয়ে এঁটো থালাবাসন গুছিয়ে রাখতেন। ‘দেহের দিক দিয়ে আমরা একেবারে আলাদা, প্রভু,’ সম্প্রদায় সম্পর্কে বুদ্ধকে বলেছিলেন একজন সন্ন্যাসী। ‘কিন্তু মনে হয় আমাদের মন একটাই।’ কেন আপন পছন্দ-অপছন্দ উপেক্ষা করে অন্যদের ইচ্ছানুযায়ী চলবেন না তিনি? এমন সঙ্গীদের সঙ্গে পবিত্র জীবন কাটাতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেছেন এই ভিক্ষু।[২৬] বাস্যার গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে সন্ন্যাসীদের অপরের জন্যে বাঁচতে শেখানোর নতুন উপায় আবিষ্কার করেছিলেন বুদ্ধ।

বৌদ্ধদের আরামার বন্ধুসুলভ ও আনন্দময় জীবন দেখে খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন কোসালার রাজা পাসেনেদি। রাজ দরবারের সম্পূর্ণ উল্টো, বুদ্ধকে বলেছিলেন তিনি, যেখানে স্বার্থপরতা, লোভ ও আগ্রাসনই দস্তুর। এক রাজা অন্য রাজার সঙ্গে ঝগড়া করেন, ব্রাহ্মণরা ব্রাহ্মণদের সঙ্গে। পরিবার ও বন্ধুবান্ধব সারাক্ষণ ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত। কিন্তু আরামায় তিনি ভিক্ষুদের দুধ আর পানির মতো বিবাদহীন জীবন কাটাতে দেখেছেন, দয়ার্দ্র দৃষ্টিতে পরস্পরকে দেখেছেন তাঁরা।’ অন্যান্য ক্ষেত্রে সাধকদের শীর্ণ ও দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থায় দেখে মনে হয়েছে, জীবনধারা তাদের সঙ্গে খাপ খায়নি। ‘কিন্তু আমি দেখছি ভিক্ষুরা হাসছেন, ভদ্র, আন্তরিকভাবেই সুখী…স্বজনরা, শান্ত, অবিচলিত, ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন, তাদের মন বুনো হরিণের মতোই কোমল রয়ে গেছে।’ মন্ত্রণা সভায় বসলে, কৃশ কণ্ঠে বলেছেন রাজা, বারবার বাধা দেওয়া হয় তাঁকে, এমনকি উত্যক্ত করা হয়; কিন্তু বুদ্ধ সন্ন্যাসীদের বিশাল জমায়েতের উদ্দেশে বক্তব্য রাখার সময় কেউ এমনকি কাশি বা গলা খাকারিও দেয় না।[২৭] জীবনের এক বিকল্প ধারা নির্মাণ করছিলেন বুদ্ধ যা নতুন শহর ও রাজ্যের ঘাটতিসমূহকে স্পষ্ট করে তুলেছিল।

কোনও কোনও পণ্ডিত বিশ্বাস করেন, পাসেনেদি ও বিম্বিসারার মতো শাসকদের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার কর্মসূচির সহযোগি হিসাবে দেখেছেন বুদ্ধ। তাঁরা মত প্রকাশ করেছেন, সমাজ এক গোত্রীয়, গোষ্ঠী ভিত্তিক রীতিনীতি হতে প্রতিযোগিতামূলক, গলাকাটা রাজার অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অনিবার্য ক্রমবর্ধমান ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদকে মোকাবিলা করার জন্যেই সংঘের নকশা করা হয়েছিল। এক ভিন্ন ধরনের সামাজিক সংগঠনের নীলনকশায় পরিণত হবে সংঘ এবং এর ধারণাসমূহ ক্রমে জনগণের কাছে পৌঁছে যাবে। টেক্সটে বুদ্ধ ও চক্কবত্তীর ঘনঘন পাশাপাশি উপস্থাপনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন তাঁরা: বুদ্ধ মানবীয় চেতনাকে সংস্কার করবেন, অন্য দিকে রাজাগণ সামাজিক সংস্কারের সূচনা ঘটাবেন।[২৮] অতি সাম্প্রতিকালে অন্যান্য পণ্ডিত অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন যে, রাজতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা দূরে থাক, তিনি বরং এভাবে কাজ করার বেলায় যারপরনাই সমালোচনামুখর ছিলেন; নিজ রাজ্য শাক্যে চলমান প্রজাতন্ত্র ধরনের সরকারই পছন্দ করতেন।[২৯]

বুদ্ধের এমন রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল বলে মনে হয় নাঃ যে কোনও সামাজিক কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত থাকাকে নির্ঘাৎ জাগতিক বিশ্বকে ‘আঁকড়ে’ থাকার মতো অনুপযোগি মনে করতেন তিনি। তবে বুদ্ধ অবশ্যই মানুষ হবার একটা নতুন উপায় উদ্ভাবনের প্রয়াস পাচ্ছিলেন। ভিক্ষুদের স্পষ্ট সন্তুষ্টি দেখায়, তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ফলপ্রসু হয়েছিল। সন্ন্যাসীগণ অতিপ্রাকৃত করুণায় পরিপূর্ণ হননি বা কোনও দেবতার অনুগ্রহে সংস্কৃত হননি, বুদ্ধের আবিষ্কৃত পদ্ধতি সম্পূর্ণ মানবীয় উদ্যোগ ছিল। তাঁর সন্ন্যাসীগণ দক্ষতার সঙ্গে স্বাভাবিক ক্ষমতা কাজে লাগাতে শিখছিলেন যেমন করে কোনও কামার এক টুকরো ধাতুকে চকচকে ও সুন্দর করে তুলবে এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পূর্ণ সম্ভাবনায় বিকশিত হতে সাহায্য করবে। মনে হয় মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে বাঁচতে ও সুখী হওয়ার শিক্ষা দেওয়া সম্ভব ছিল। ভিক্ষুরা বিষণ্ন বা হতাশ হয়ে থাকলে বোঝাত যে, তাঁদের জীবনধারা মানবীয় সত্তার প্রতি নিপীড়ন চালাচ্ছে। কোনও দেবতা কর্তৃক ‘পাপপূর্ণ’ হিসাবে নিষিদ্ধ করায় নয় বরং এই ধরনের আবেগে আপ্লুত হওয়া মানবীয় প্রকৃতির জন্যে ক্ষতিকর বলে ‘ক্রোধ, অপরাধ, দয়াহীনতা, ঈর্ষা ও লোভের মতো ‘অদক্ষ’ অবস্থা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সহানুভূতি, সৌজন্য, বিবেচনাবোধ, বন্ধুতা ও দয়া মঠচারী জীবনের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো নতুন কৃচ্ছ্রতাবাদ নির্মাণ করেছিল। কিন্তু প্রাচীন, চরম তাপসের বিপরীতে ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য সৃষ্টি করেছে এটা। নিষ্ঠার সঙ্গে বিকাশ সাধিত হলে এটা নিব্বানার সেতো-বিমুত্তি আনতে পারে, আরেক উল্লেখযোগ্য স্বাভাবিক মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা।

কিন্তু কেবল সন্ন্যাসীদের পক্ষেই পূর্ণাঙ্গ ধৰ্ম্ম সম্ভাবপর ছিল। সাধারণ ভারতীয় সংসার জীবনের কোলাহল আর ব্যস্ততা ধ্যান ও যোগসাধনা অসম্ভব করে তুলবে, তো জগত্ত্যাগী কোনও সন্ন্যাসীর পক্ষেই নিব্বানা লাভ সম্ভব। অকাঙ্ক্ষায় পরিচালিত বাণিজ্যিক ও প্রজনন কর্মকাণ্ডে জড়িত অনাথাপিন্দিকার মতো সাধারণ জন লোভ, ঘৃণা ও বিভ্রমের ত্রি-অগ্নি নির্বাপনের আশা করতে পারে না। একজন সাধারণ মানুষ কেবল পরবর্তী জন্মে আলোকনের পক্ষে অনুকূল পরিবেশে পুনর্জন্ম লাভের আশা করতে পারে। মহান সত্যিগুলো আমজনতার জন্যে নয়: ‘এগুলো’ উপলব্ধি করতে হবে আর এই ‘প্রত্যক্ষ জ্ঞান’ বৌদ্ধদের পূর্ণাঙ্গ রীতিনীতি পালনে আবশ্যক যোগ সাধনা ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়।[৩০] অভিনিবেশের অনুশীলন ছাড়া অনাত্মার মতো মতবাদ কোনও অর্থ বয়ে আনবে না। কিন্তু বুদ্ধ সাধারণ জনকে অগ্রাহ্য করেননি। মনে হয়, দীক্ষা দানের দুটো প্রধান ধারা ছিল: একটা সন্ন্যাসীর জন্যে, অপরটি সাধারণের।

অনাথাপিন্দিকার করুণ মৃত্যুবরণের কাহিনীতে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তিনি মুমূর্ষু হয়ে ওঠার পর সারিপুত্ত ও আনন্দ দেখতে গেলেন তাঁকে। তাঁকে বিদায়ের ওপর ছোট একটা কাহিনী শোনালেন সারিপুত্তঃ অনাথাপিন্দিকাকে ইন্দ্রিয়কে আঁকড়ে না থাকার শিক্ষা নিতে হবে। কারণ বাহ্যিক জগতের সঙ্গে এই সম্পর্ক তাঁকে সামসারার ফাঁদে বন্দি করবে। কেউ একে মৌল বৌদ্ধ শিক্ষা ভাবতে পারেন। কিন্তু অনাথাপিন্দিকা কখনও আগে এমনটি শোনেননি। শুনতে শুনতে গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল তাঁর। ‘ব্যাপার কী, গৃহী? ‘ উদ্বেগের সঙ্গে জানতে চাইলেন আনন্দ। ‘খুব খারাপ লাগছে?’ না, প্রতিবাদ করলেন অনাথাপিন্দিকা, এটা কোনও সমস্যা নয়। ‘গুরু আর ধ্যানী ভিক্ষুদের এত বছর ধরে পরিচর্যা পরিচর্যা করেছি, অথচ আগে কখনও ধম্ম সম্পর্কে এমন কথা শুনিনি।’ এটাই শোকাক্রান্ত করেছে তাঁকে। সাধারণ জনকে এই শিক্ষা দেওয়া হয়নি, ব্যাখ্যা করলেন আনন্দ। কেবল গৃহত্যাগীদের জন্যেই এই শিক্ষা। এটা ঠিক হয়নি, জবাব দিলেন অনাথাপিন্দিকা। গৃহস্থদেরও এইসব বিষয় নির্দেশনা দেওয়া উচিত: এমনও লোকজন রযেছে যাদের মাঝে সামান্য আকাঙ্ক্ষাই অবশিষ্ট আছে। তারা আলোকন লাভের উপযোগি। সুতরাং নিব্বানা লাভ করতে পারবে তারা।[৩১]

সেরাতেই মারা গেলেন অনাথাপিন্দিকা এবং আমাদের জানানো হয়েছে, স্বর্গে একজন ‘স্রোতে প্রবেশকারী’ হিসাবে মাত্র সাতটি পুনর্জন্ম সামনে নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। নিঃসন্দেহে আশীর্বাদ হিসাবে দেখা হয়েছে একে। কিন্তু তাঁর ঔদার্য ও নিবেদিত সেবার বিনিময়ে এই পুরস্কার সামান্য বলে মনে হয়। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এই ধরনের আবিশ্যিক শিক্ষা দূরে সরিয়ে রাখা অন্যায় বোধ হয়। কিন্তু প্রত্যেকের একই আধ্যাত্মিক স্তরে অবস্থানের ধারণাটি আবশ্যিকভাবেই আধুনিক ধারণা। প্রাক-আধুনিক ধর্ম বরাবরই দুটো স্তরে পরিচালিত হতো: অভিজাত একটি গোষ্ঠী সারাজীবন ঐশীগ্রন্থের পাঠ ও ধ্যানে কাটিয়ে দিতেন এবং অনিবার্যভাবে অধিকতর অজ্ঞ সাধারণ জনকে নির্দেশনা দিতেন। সবাই শিক্ষিত ও ধর্মগ্রন্থ পাঠের সুযোগ পাওয়ার পরেই কেবল পূর্ণ ধর্মীয় সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। বিসিই প্রথম শতাব্দীর আগে বৌদ্ধ শাস্ত্র লিপিবদ্ধ করা হয়নি, কিন্তু তরপরেও পাণ্ডুলিপি ছিল বিরল। ধৰ্ম্ম শোনার জন্যে যে কাউকে খোদ বুদ্ধ কিংবা কোনও সন্ন্যাসীর কাছে যেতে হতো।

আমজনতাকে কী শিক্ষা দিয়েছিল সংঘ? একেবারে গোড়া থেকেই বুদ্ধের কাছে ‘আশ্রয় নিয়েছিল’ সাধারণ মানুষ। জনগণ সন্ন্যাসীদের খাইয়ে, সাহায্য করে উন্নত পুনর্জন্মের জন্যে প্রয়োজনীয় পূণ্য অর্জন করত। সন্ন্যাসীগণও সাধারণ মানুষকে নৈতিক জীবন যাপন করে, সৎকর্মের মাধ্যমে কৰ্ম্মকে পরিশুদ্ধ করার শিক্ষা দিতেন যাতে তারা আধ্যাত্মিক অগ্রগতি অর্জন করতে পারে। সবাই একে ন্যায়সঙ্গত বিনিময় হিসাবে দেখেছে। অনাথাপিন্দিকার মতো কোনও কোনও সাধারণ মানুষ বুদ্ধ ও ভিক্ষুদের সঙ্গে প্রচুর সময় কাটিয়েছে। তাদের পাঁচটি নৈতিক শপথ গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়েছে– নবীশদের জন্যে ধম্ম: অবশ্যই হত্যা করবে না, চুরি করবে না, মিথ্যা বলবে না বা মাদক সেবন করবে না, অবশ্যই যৌন উচ্ছৃখলতা এড়িয়ে যাবে। মোটামুটি জৈন অনুসারীদের আচরিত অনুশীলনের মতোই ছিল এসব। প্রতি মাসের সপ্তম দিনে (উপসোথা) বৌদ্ধ জনগণের প্রাচীন বৈদিক অনাহার ও নিবৃত্ত থাকার উপবাসতা অনুশীলনের পরিবর্তে বিশেষ উপাচার ছিল; বাস্তবক্ষেত্রে যা তাদের চব্বিশ ঘন্টার জন্যে সংঘের নবীশের মতো কিছুতে পরিণত করেছিল। তারা যৌনতা হতে বিরত থাকত, আমোদ অনুষ্ঠান দেখত না, ভদ্রজনোচিত পোশাক পরত ও মধ্যাহ্ন পর্যন্ত শক্ত খাবার গ্রহণ করত না।[৩২] এটা তাদের পূর্ণাঙ্গ বৌদ্ধ জীবনের একটা স্বাদ যুগিয়েছে, কাউকে কাউকে হয়তো সন্ন্যাসী হতেও অনুপ্রাণিত করেছে।

এমনকি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ধ্যান শুরু করার আগেই যেকোনও যোগির মতো তাঁকে সহানুভূতি, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও অভিনিবেশের নৈতিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হতো। সাধারণ মানুষ কখনও গভীর যোগ আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়নি, তো তারা নৈতিকতার (শীলা) ওপর জোর দিয়েছে। বুদ্ধ একে তাদের জীবনের উপযোগি করে দিয়েছিলেন। এভাবে সাধারণ নারী-পুরুষ এক পূর্ণাঙ্গ আধ্যাত্মিকতার ভিত্তি নির্মাণ করছিল যা পরজন্মে তাদের শক্ত অবস্থান গড়ে দেবে। সন্ন্যাসীরা ধ্যানের মাধ্যমে ‘দক্ষ’ কৌশল শিক্ষা করতেন, আর আমজনত্তা ‘দক্ষ’ নৈতিকতার প্রতি জোর দিয়েছে।[৩৩] ভিক্ষুকে দান করা, সবসময় সত্যি কথা বলা ও অন্যদের সঙ্গে দায়ালু ও ন্যায়সঙ্গত আচরণ তাদের অধিকতর সজীব স্বাস্থ্যবান মানসিক অবস্থা সৃষ্টি ও অহমবাদের আগুন সম্পূর্ণ নিভানো সম্ভব না হলেও কিছুটা প্রশমিত করতে সাহায্য করেছে। এই নৈতিকতার প্রায়োগিক সুবিধা ছিল: এটা অন্যদের তাদের প্রতি একইরকম আচরণে উৎসাহিত করতে পারে। ফল স্বরূপ, পরবর্তী জীবনে পূণ্য অর্জন ছাড়াও বর্তমান জীবনে আরও সুখী হওয়ার উপায় শিক্ষা নিচ্ছিল তারা।

বৈদিক ব্যবস্থায় যাদের কোনও স্থান ছিল না, অনাথাপিন্দিকার মতো ব্যবসায়ী ও মহাজনদের কাছে ধম্ম খুবই আবেদনময় ছিল। চতুর বিনিয়োগ নীতিমালা ভিত্তিক হওয়ায় ব্যবসায়ীরা বুদ্ধের ‘দক্ষ’ নীতিমালা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। এটা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অস্তিত্বে সুনাম বয়ে আনবে। সন্ন্যাসীগণ ক্ষণস্থায়ী মানসিক অবস্থার প্রতি মনোযোগি থাকার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন: সাধারণ অনুসারীদের আর্থিক ও সামাজিক লেনদেনে আপ্পানদা (মনোযোগ)- এর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[৩৪] বুদ্ধ তাদের জরুরি অবস্থার জন্যে সঞ্চয়, নির্ভরশীলদের দেখাশোনা, ভিক্ষুদের সাহায্য করা, ঋণ এড়ানো, পরিবারের জরুরি প্রয়োজন মেটানোর মতো অর্থ সঞ্চয় নিশ্চিত করা ও সতর্কতার সাথে অর্থ বিনিয়োগের জন্যে বলেছেন।[৩৫] মিতব্যয়ী, বিবেচক ও ধীর-স্থির হতে হবে তাদের। সাধারণ মানুষের জন্যে সবচেয়ে উন্নত হিতোপদেশ সিগালা বেদ সুত্তায় সিগালাকে মদ পান, রাত্রি জাগরণ, জুয়া, আলস্য ও অসৎ সঙ্গ এড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।[৩৬] অগ্নি-হিতোপদেশের একটি সাধারণ ভাষ্যে অনুসারীদের তিনটি ‘শুভ-অগ্নি’র পরিচর্যার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। নির্ভরশীলদের যত্ন, স্ত্রী, সন্তান ও ভৃত্যদের দেখাশোনা এবং সংঘের সকল ভিক্ষুকে সহায়তা করতে হবে।[৩৭]

কিন্তু বরাবরের মতো সহনশীলতাই ছিল মুখ্য গুণ। একদিন রাজা পাসেনেদি ও তাঁর স্ত্রী আলোচনাক্রমে সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, আপন সত্তা ছাড়া তাদের কাছে প্রিয়তম আর কিছু নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি বুদ্ধের সমর্থন না পাবারই কথা। কিন্তু রাজা এই আলাপের কথা জানালে বুদ্ধ তাঁকে ভর্ৎসনা করেননি, অনাত্মার আলোচনায় লিপ্ত হননি বা অষ্টশীল পথের উপর হিতোপদেশ শুরু করেননি। তার বদলে যথারীতি পাসেনেদির দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রবেশ করলেন তিনি এবং তাঁর মনের বিষয়বস্তুর ভিত্তিতেই আলোচনা শুরু করলেন-যেখানে কী থাকা উচিৎ ভেবেছেন তার ভিত্তিতে নয়। সুতরাং, রাজাকে তিনি বলেননি যে, সত্তা একটা বিভ্রম, কারণ নিয়মিত যোগের জীবন ছাড়া তিনি এটা ‘বুঝতে’ পারতেন না। বরং রাজাকে এই বিষয়টি ভাবতে বললেন তিনিঃ তিনি যদি বুঝে থাকেন যে তাঁর কাছে নিজের চেয়ে প্রিয় আর কিছু নেই, তাহলে এটাও নিশ্চয়ই সত্যি যে অপরাপর মানুষও তাদের ‘ভিন্ন সত্তা’ লালন করে। সুতরাং উপসংহার টানলেন বুদ্ধ, ‘যে ব্যক্তি সত্তাকে ভালোবাসে, তার অন্যের সত্তাকে আঘাত দেওয়া উচিৎ নয়।’[৩৮] রেওয়াজ অনুযায়ী যাকে ‘স্বর্ণ বিধি’ বলা হয়, সেটা অনুসরণ করা উচিৎ তাঁর: ‘তুমি নিজের জন্যে যা সঠিক মনে করো না, অন্যের বেলায় তা করো না।[৩৯] সাধারণ মানুষ অহমবাদ পুরোপুরি নির্বাপিত করতে পারে না, কিন্তু অন্য মানুষের দুর্বলতায় সমব্যথী হতে স্বার্থহীনতার অনুভূতি কাজে লাগাতে পারে। এটা অহমের বাড়াবাড়ির ঊর্ধ্বে নিয়ে যাবে তাদের, অহিংসার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দেবে।

আমরা কালামানদের[৪০] উদ্দেশে প্রদত্ত হিতোপদেশে বুদ্ধের সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার কৌশল দেখতে পাই। গাঙ্গেয় উপত্যকার সবচেয়ে উত্তর সীমানায় ছিল এই জাতির বাস। এককালে গোত্রীয় রাজ্য পরিচালনা করলেও এখন কোসালার প্রজায় পরিণত হয়েছে। ক্রমশঃ নতুন শহুরে সভ্যতার অধীনে নিয়ে আসা হচ্ছিল তাদের। এই অভিজ্ঞতা তাদের কাছে অনিশ্চিত ও অপমানকর মনে হয়েছে। বুদ্ধ তাদের কেসাপুত্ত শহর দিয়ে যাওয়ার সময় পরামর্শ চেয়ে এক প্রতিনিধি দল পাঠাল তারা। একের পর এক সাধু আর শিক্ষক তাদের ওপর অবতীর্ণ হয়েছেন, ব্যাখ্যা করল তারা, কিন্তু প্রত্যেক সন্ন্যাসী ও ব্রাহ্মণ যার যার নিজস্ব মতবাদ ব্যাখ্যা করেছেন, অন্যদের অভিশম্পাত করেছেন তাঁরা। এইসব ধম্ম কেবল পরস্পর বিরোধীই নয়, সুসংস্কৃত মূলধারার সংস্কৃতির অংশ বলে অচেনাও ছিল। ‘এইসব শিক্ষকের কে সঠিক, কে ভুল?’ জানতে চাইল তারা। বুদ্ধ বললেন কালামানদের বিভ্রান্ত বোধ করার কারণ বুঝতে পেরেছেন তিনি। যাথারীতি তাদের অবস্থায় প্রবেশ করলেন তিনি। গড়গড় করে নিজ ধম্ম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাদের বিভ্রান্তি বাড়াননি, মোকাবিলা করার জন্যে নতুন কোনও মতবাদ শোনাননি তাদের, বরং কালামানরা যাতে নিজেরাই সমাধান খুঁজে নিতে পারে, সেজন্যে তাৎক্ষণিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন (সক্রেটিস ও কনফুসিয়াসের মতো অন্যান্য অ্যাক্সিয়াল সাধুদের প্রশ্ন ও উত্তর পদ্ধতির স্মারক)। তিনি এই বলে শুরু করলেন যে, তাদের হতবুদ্ধি হওয়ার অন্যতম কারণ অন্যদের কাছ থেকে জবাব পাওয়ার আশা করছে তারা। কিন্তু যখন নিজেদের হৃদয়ের দিকে চোখ ফেরাবে তখনই বুঝতে পারবে আসলে কোনটা সঠিক।

‘শোন, কালামানবাসী,’ বললেন তিনি। ‘শোনা কথায় সন্তোষ বোধ করো না বা সরল বিশ্বাসে সত্য হিসাবে মেনে নিয়ো না।’ নৈতিকতার প্রশ্নে মানুষকে নিজেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেমন ধরা যাক, লোভ কি ভালো নাকি খারাপ? ‘খারাপ, প্রভু।’ জবাব দিল কালামানরা। তারা কি লক্ষ করেছে যখন কেউ আকাঙ্ক্ষায় তাড়িত হয়ে কোনও কিছু পেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে তখন হত্যা, চুরি বা মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে সে? হ্যাঁ, কালামনরা এ ব্যাপারটি লক্ষ করেছে। এই ধরনের আচরণ স্বার্থপর মানুষকে কি অজনপ্রিয় ও সেকারণে অসুখী করে না? আর ঘৃণার বেলায়? কিংবা বস্তুকে স্বরূপে দেখার চেষ্টা করার বদলে স্পষ্টতই বিভ্ৰমকে আঁকড়ে থাকা? এইসব আবেগ কি বেদনা আর কষ্টের দিকে চালিত করেনি? ধাপে ধাপে কালমানদের নিজ অভিজ্ঞতা স্মরণ করে লোভ, ঘৃণা আর অজ্ঞতার ‘ত্রি-অগ্নি’র প্রভাব অনুধাবন করতে বললেন তিনি। আলোচনার শেষ নাগাদ কালামানরা বুঝতে পারল, আগে হতেই বুদ্ধের ধম্মের সঙ্গে পরিচিত ওরা। ‘সেজন্যেই আমি তোমাদের কোনও শিক্ষকের ওপর নির্ভর না করতে বলেছি,’ উপসংহার টানলেন বুদ্ধ। ‘তোমরা যখন নিজেরাই কোন জিনিসগুলো ‘সহায়ক’ (কুসলা) আর কোনগুলো ‘অনুপযোগি’ (অকুসলা) বুঝতে পারেব তখন অন্যরা যাই বলুক না কেন তোমরা এই নীতিরই চর্চা করবে ও ধরে রাখবে।’[৪১]

তিনি কালামানদের এও বোঝালেন যে, লোভ, ঘৃণা ও বিভ্রম এড়ানোর পাশাপাশি বিপরীত গুণাবলীর চর্চার করাও নিঃসন্দেহে উপকারী হবে: ‘নির্লোভ, ঘৃণাহীন ও বিভ্রমহীন।’ তারা উপকার, দয়া ও উদারতার বিকাশ ঘটিয়ে জীবন সম্পর্কে যথাযথ উপলব্ধি অর্জনের প্রয়াস পেলে নিজেদের সুখী মানুষ হিসাবে আবিষ্কার করবে। যদি ভিন্ন জীবন আসে (কালামানদের উপর পুনর্জন্মের মতবাদ চাপিয়ে দেননি বুদ্ধ, এর সঙ্গে তাদের পরিচয় নাও থাকতে পারত) তাহলে এই সৎ কন্ট পরবর্তী সময় স্বর্গে দেবতা হিসাবে পুনর্জন্ম দান করবে। অন্য কোনও জগৎ না থাকলে এই সুবিবেচক ও সদয় জীবনধারা অন্যদের নিজেদের প্রতি একই ধরনের আচরণে উৎসাহিত করবে। আর কিছু না হোক, তারা অন্তত এটুকু জানবে যে, সৎ আচরণ করেছে-সেটা সবসময়ই স্বস্তির কারণ হবে। কালামানদের এই ‘দক্ষ’ মানসিকতা গড়ে তোলায় সহায়তা করতে ধ্যানের একটা কৌশল শিক্ষা দিয়েছিলেন বুদ্ধ; এটাই ছিল ‘অপরিমেয়’র সাধারণ মানুষের ভাষ্য। প্রথমে তাদের অবশ্যই মন হতে ঈর্ষা, খারাপ ইচ্ছার অনুভূতি ও বিভ্রম দূর করতে হবে। তারপর সর্বদিকে প্রেমময় দয়ার অনুভূতি প্রেরণ করবে। তখন তারা দেখতে পাবে, ‘প্রচুর মর্যাদাপূর্ণ, অপরিমেয়, প্রেমময়, প্ৰবল দয়ায় পরিপূর্ণ’ হয়ে উঠেছে তারা। তখন তারা নিজেদের সীমিত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এসে সমগ্র জগতকে আলিঙ্গন করবে। অহমবাদের তুচ্ছতাকে ছাপিয়ে গিয়ে মুহূর্তের জন্যে এমন এক মোহাবেশ অনুভব করবে যা তাদের সত্তার বাইরে ‘উর্ধ্বে, নিচে, চারপাশে ও সর্বত্র’ নিয়ে যাবে। তারা দেখবে তাদের হৃদয় নিরাসক্ত প্রশান্তিতে প্রসারিত হয়ে গেছে।[৪২] সাধারণ নারী- পুরুষ নিব্বানার স্থায়িত্ব অর্জন না করতে পারে, কিন্তু চূড়ান্ত মুক্তির আভাস লাভ করতে পারবে।

সুতরাং, বুদ্ধ সন্ন্যাসী ও সাধারণ জনগণকে আগ্রাসি নতুন সমাজে বিরাজিত অহমবাদ প্রশমিত করার জন্যে একই রকম সহানুভূতিপূর্ণ আক্রমণ পরিচালনার শিক্ষা দিচ্ছিলেন। অহমবাদ মানুষকে জীবনের পবিত্র মাত্রা অর্জন হতে দূরে ঠেলে রেখেছিল। তিনি যে দক্ষ অবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তা পালি লিপির এই কবিতায় চমৎকার ফুটে উঠেছে:

সকল প্রাণী সুখী হোক! শক্তিশালী কি দুর্বল, উচ্চ, মধ্য
বা নিচু গোত্রের,
ক্ষুদ্র বা বৃহৎ, দৃশ্য বা অদৃশ্য, কাছের বা দূরের,
জীবিত বা জন্ম প্রত্যাশী-সকলেই সুখী হোক!

কেউ যেন কাউকে মিথ্যা না বলে বা কোথাও কোনও সত্তাকে
ঘৃণা না করে।
কেউ যেন ক্রোধ
বা ঘৃণা বশত কোনও প্রাণীর অমঙ্গল কামনা না করে!
আসুন সকল প্রাণীর লালন করি, মা যেমন তার সন্তানকে লালন করে।
আমাদের প্রেমময় চিন্তা যেন ঊর্ধ্ব-অধের গোটা পৃথিবীকে পরিপূর্ণ করে
সীমাহীনভাবে; এক সীমাহীন শুভেচ্ছা গোটা জগতের প্রতি,
ঘৃণা ও শত্রুতা হতে মুক্ত, বাধাহীন![৪৩]

এই প্রবণতা অর্জনকারী সাধারণ মানুষ আধ্যাত্মিক পথে বহুদূর অগ্রসর হয়েছে।

ধর্মগ্রন্থসমূহ সংঘের বাইরে ধ্যানের চর্চা করে নিব্বানা লাভকারী সাধারণ শিক্ষাব্রতী সম্পর্কে গুটিকয় নজীর তুলে ধরে, তবে নিঃসঙ্গ অলোকসামান্য ব্যক্তিগণ নিয়ম নন বরং ব্যতিক্রম ছিলেন। মনে করা হতো যে, কোনও আরাহান্তের পক্ষে সংসার জীবন অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়: আলোকপ্রাপ্ত হওয়ার পরই হয় তিনি সংঘে যোগ দেবেন বা মারা যাবেন। দৃশ্যতঃ বুদ্ধের বাবা শুদ্ধোদনের বেলায় এমনটাই ঘটেছিল, ছেলের দীক্ষা দানের পঞ্চম বছরে নিব্বানা অর্জন করেন তিনি এবং পরদিনই মারা যান। বুদ্ধ এই সংবাদ পেয়ে কাপিলবাস্তুতে ফিরে কিছুদিন নিগরোধা উদ্যানে অবস্থান করেছিলেন। এই ঘটনা সংঘের নতুন পরিবর্তন বয়ে এনেছিল, বুদ্ধ প্রথমে যাকে ভালোভাবে নেননি বলেই মনে হয়।

তিনি নিগরোধ আরামায় অবস্থান করার সময় বাবার বিধবা স্ত্রী ও বুদ্ধের খালা পজাপতি গৌতমী তাঁর কাছে আসেন। আপন মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর পালক মায়ে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। যেহেতু এখন তিনি মুক্ত, বোনের ছেলেকে বলেন তিনি, তাই সংঘে যোগ দিতে চান। জোরের সাথে প্রত্যাখ্যান করলেন বুদ্ধ। সংগঠনে মহিলাদের গ্রহণ করার প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি পজাপতি তিনবার বিবেচনার আবেদন জানানো সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত পাল্টাবেন না তিনি। খুবই দুঃখের সঙ্গে বিদায় নিলেন পজাপতি। কয়েকদিন পর গঙ্গার উত্তর তীরবর্তী বিদেহা প্রজাতন্ত্রের রাজধানী বেসালির উদ্দেশে রওনা হলেন বুদ্ধ। প্রায়শঃই সেখানকার আরামায় অবস্থান করতেন তিনি। উঁচু ছাদঅলা একটা মিলানায়তন ছিল এখানে। বারান্দায় অন্যান্য শাক্য মহিলাদের সঙ্গে পজাপতিকে কাঁদতে দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠলেন আনন্দ। চুল কেটে ফেলেছেন মহিলা, গায়ে গেরুয়া বসন চাপিয়ে সেই কাপিলাবাস্তু থেকে পায়ে হেঁটে এসেছেন এত দূর। পা ফুলে গিয়েছিল তাঁর, ধূলিমলিন, পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। ‘গৌতমী,’ চেঁচিয়ে উঠলেন আনন্দ; ‘এখানে এই হালে কী করছেন আপনি? কাঁদছেনই বা কেন?’ ‘কারণ আশীবার্দপ্রাপ্ত জন সংঘে মেয়েদের যোগ দিতে দেবেন না।’ জবাব দিলেন পজাপতি। উদ্বিগ্ন বোধ করলেন আনন্দ। ‘এখানে অপেক্ষা করুন,’ বললেন তিনি। ‘এব্যাপারে তথাগতকে জিজ্ঞেস করছি আমি।’

কিন্তু তারপরও ব্যাপারটা বিবেচনা করতে অস্বীকার গেলেন বুদ্ধ। গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এটা। নারীদের সংঘের বাইরে রাখা অব্যাহত রাখলে তার মানে দাঁড়াত মানবজাতির অর্ধেক অংশকে আলোকপ্রাপ্তির অযোগ্য মনে করছেন তিনি। কিন্তু ধম্ম সবার হওয়ার কথা: দেবতা, পশুপাখি, ডাকাত, সকল গোত্রের মানুষ–কেবল নারীরাই বাদ পড়বে? কেবল পুরুষ হিসাবে পুনর্জন্মই তাদের সবচেয়ে ভালো আশা হবে? অন্যভাবে চেষ্টা করলেন আনন্দ। ‘প্রভু,’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘নারীরা “স্রোতে প্রবেশকারী” হয়ে শেষ পর্যন্ত আরাহান্ত হওয়ার যোগ্যতা রাখে?’ ‘রাখে, আনন্দ,’ জবাব দিলেন বুদ্ধ। ‘তাহলে পজাপতিকে বরণ করে নেওয়াই মঙ্গলজনক হবে,’ আবেদন জানালেন আনন্দ। মায়ের মৃত্যুর পর মহিলার আদর যত্নের কথা মনে করিয়ে দিলেন তিনি গুরুকে। অনীহার সঙ্গে পরাজয় মেনে নিলেন বুদ্ধ। আটটি কঠিন নিয়ম মেনে নিলেই কেবল সংঘে প্রবেশ করতে পারবেন পজাপতি। এই বিধানগুলো এটা পরিষ্কার করে নিয়েছে যে নানরা (ভিক্ষুনি) নিম্ন পর্যায়ের গোত্র। অল্পবয়সী বা নব্য দীক্ষিত হলেও পুরুষ ভিক্ষুর উপস্থিতিতে ভিক্ষুনিকে অবশ্যই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে; নানদের সবসময় বাস্যার অবকাশ কোনও আরামায় একাকী নয় বরং পুরুষ সন্ন্যাসীদের সঙ্গে কাটাতে হবে; পাক্ষিক একবার একজন পুরুষ ভিক্ষুর কাছে সবক নিতে হবে; নিজেরা কোনও শাস্ত্রাচার করতে পারবে না; গুরুতর অন্যায়কারী পাপীকে ভিক্ষুনি ও সন্ন্যাসীদের উপস্থিতিতে প্রায়শ্চিত করতে হবে; একজন ভিক্ষুনিকে অবশ্যই পুরুষ ও নারী উভয় সংঘের কাছে যাজকানুষ্ঠানের অনুরোধ জানাতে হবে; সে কখনও কোনও ভিক্ষুকে বকাঝকা করতে পারবে না, যদিও যেকোনও সন্ন্যাসী তাকে ভর্ৎসনা করতে পারবে; ভিক্ষুদের শিক্ষাও দিতে পারবে না সে। সানন্দে এইসব বিধান মেনে নিলেন পজাপতি। বরণ করে নেওয়া হলো তাঁকে। কিন্তু তারপরও অস্বস্তিতে ভুগছিলেন বুদ্ধ। মহিলাদের যোগ দিতে না দেওয়া হলে, আনন্দকে বললেন তিনি, ধম্ম হয়তো হাজার বছর ধরে পালিত হতো। এখন বড় জোর পাঁচ শো বছর টিকে থাকবে। অসংখ্য নারী বিশিষ্ট গোত্র দুর্বল হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে; একইভাবে নারী সদস্যঅলা কোনও সংঘ বেশিদিন টিকতে পারে না। ধান ক্ষেতে ছত্রাকের মতো সংগঠনের ওপর ছড়িয়ে পড়বে তারা।[৪৪]

এই নারী বিদ্বেষ হতে কী বুঝতে পারি আমরা? বুদ্ধ সবসময়ই নারী ও পুরুষ উভয়কে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি অনুমতি দেওয়ার পর হাজার হাজার নারী ভিক্ষুনিতে পরিণত হয়েছে। তাদের আধ্যাত্মিক অর্জনের প্রশংসা করেছেন বুদ্ধ। বলেছেন তারা সন্ন্যাসীদের সমপর্যায়ের হতে পারে। যথেষ্ট প্রাজ্ঞ সন্ন্যাসী ও ভিক্ষুনি, সাধারণ পুরুষ ও সাধারণ নারী অনুসারী না সংগ্রহ করা পর্যন্ত পরলোকে না যাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।[৪৫] টেক্সটে কোনও রকম বৈসাদৃশ্য আছে বলে মনে হয়। এটা কোনও কোনও পণ্ডিতকে এই উপসংহারে পৌঁছতে তাড়িত করেছে যে, নারীদের গ্রহণ করার বেলায় ক্রুদ্ধ সম্মতির কাহিনী ও আটটি বিধান পরবর্তী সময়ে সংযোজন, তা সংগঠনের পুরুষতান্ত্রিকতাকে প্রতিফলিত করে। বিসিই প্রথম শতাব্দী নাগাদ সন্ন্যাসীদের কেউ কেউ অবশ্যই তাঁদের আলোকপ্রাপ্তি হতে দূরে ঠেলে রাখা যৌনাকাঙ্ক্ষার জন্যে নারীদের দায়ী করেছেন। নারীদের তাঁরা আধ্যাত্মিক অগ্রগতির পথে সর্বজনীন বাধা হিসাবে দেখেছেন। অন্য পণ্ডিতগণ যুক্তি দেখিয়েছেন যে, আলোকপ্রাপ্ত হলেও বুদ্ধ সেই সময়ের সামাজিক শর্তাবলী এড়িয়ে যেতে পারেননি। পিতৃতান্ত্রিক নয়, এমন সমাজ কল্পনা করতে পারেননি তিনি। তাঁরা যুক্তি তুলে ধরেছেন, বুদ্ধের প্রাথমিক অনীহা সত্ত্বেও নারীদের অন্তর্ভুক্তি ব্যতিক্রমী কাজ ছিল যা প্রথমবারের মতো নারীদের সংসারের বাইরে একটা বিকল্পের সন্ধান দিয়েছিল।[৪৬]

একথা সত্যি হলেও নারীদের জন্যে সমস্যা ছিল যা উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। বুদ্ধের মনে নারীরা হয়তো আলোকনকে অসম্ভব করে তোলা ‘কামনা’ হতে অবিচ্ছেদ্য ছিল। বাড়ি ছেড়ে সন্ধানে নামার সময় কোনও কোনও গৃহত্যাগীর মতো স্ত্রীকে সঙ্গী করার কথা ভাবেননি তিনি। স্রেফ ধরে নিয়েছিলেন তিনি (স্ত্রী) মুক্তি লাভে সঙ্গী হতে পারবেন না। কিন্তু সেটা গীর্জার ক্রিশ্চান ফাদারদের মতো যৌনতাকে বিরক্তিকর ভেবেছিলেন বলে নয়, বরং স্ত্রীর প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন তিনি। ধর্মগ্রন্থে একটি অনুচ্ছেদ রয়েছে যা সন্ন্যাসীদের প্রক্ষেপণ বলে পণ্ডিতগণ একমত। ‘প্রভু, আমরা নারীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করব?’ জীবনের শেষ দিকে বুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন আনন্দ। ‘ওদের দিকে তাকিয়ো না, আনন্দ।’ ‘ওদের দিকে না তাকালে কেমন করে আচরণ করব?’ ‘ওদের সঙ্গে কথা বলো না, আনন্দ।’ ‘কিন্তু যদি কথা বলতে হয়?’ ‘অবশ্যই অভিনিবেশ পালন করতে হবে, আনন্দ।’[৪৭] বুদ্ধ ব্যক্তিগতভাবে হয়তো নারী বিদ্বেষ সমর্থন করতেন না, কিন্তু এমন হতে পারে যে এই কথাগুলো তিনি অতিক্রম করতে পারেননি এমন অস্বস্তির অবশেষ।

বুদ্ধ নারীদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে থাকলে সেটা অ্যাক্সিয়াল যুগেরই রেওয়াজ। দুঃখজনক যে, সভ্যতা নারীর প্রতি সদয় ছিল না। প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ দেখায়, প্রাক-শহুরে সমাজে কখনও কখনও নারী উচ্চ মর্যাদা পেয়েছে, কিন্তু সামরিক রাষ্ট্রের উত্থান ও আদি নগরসমূহে বিশেষায়ণ তাদের অবস্থানের অবনতি ঘটিয়েছে। পুরুষ মানুষের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে তারা, প্রায় সব পেশা হতে বাদ পড়েছে এবং মাঝে মাঝে প্রাচীন কোনও আইনি বিধানের কারণে নিষ্ঠুর নিয়ন্ত্রণের শিকার হয়েছে। অভিজাত নারীগণ কিছুটা ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছেন, বুদ্ধ যখন ভারতে ধর্ম প্রচারণা করছেন, তখন অ্যাক্সিয়াল দেশসমূহে নারীরা আরও মর্যাদা হারিয়েছে। ইরান, ইরাক ও পরবর্তীকালে হেলেনিস্টিক দেশসমূহে মহিলাদের পর্দার আড়ালে হেরেমে বন্দি করা হয়েছে। নারী বিদ্বেষী ধ্যান-ধারণা বিকাশ লাভ করেছে। ধ্রুপদী এথেন্সের (৫০০-৩২৩) নারীরা বিশেষভাবে সুবিধা বঞ্চিত এবং সমাজ হতে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। কথিত আছে, নীরবতা ও আত্মসমর্পণই ছিল তাদের প্রধান গুণ। আদি হিব্রু ট্র্যাডিশনসমূহ মিরিয়িাম, ডেবোরাহ্ ও জায়েলের মতো নারীদের কাহিনীকে মর্যাদা দিয়েছে, কিন্তু বিশ্বাসের পয়গম্বরীয় সংস্কারের পর ইহুদি আইনে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীতে অবনমিত করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য, মিশরের মতো দেশে, যা কিনা প্রাথমিকভাবে অ্যাক্সিয়াল যুগে অংশ নেয়নি, নারীদের প্রতি অধিকতর উদার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।[৪৮] মনে হয়, নতুন আধ্যাত্মিকতার নারীদের প্রতি এক ধরনের অন্তর্গত বৈরিতা ছিল যা আমাদের সময় পর্যন্ত অব্যহত রয়ে গেছে। বুদ্ধের অন্বেষণ বীরত্বের দিক থেকে পুরুষালি: সব বাধা দূর করার প্রতিজ্ঞা, গৃহস্থ জগৎ ও নারীদের প্রত্যাখ্যান, নিঃসঙ্গ সংগ্রাম ও নতুন জগতে প্রবেশ, সমস্তই পুরুষালি গুণের প্রতাঁকে পরিণত হয়েছে। কেবল আধুনিক যুগে ক্রমেই এই প্রবণতার পরিবর্তন ঘটেছে। নারী তার নিজস্ব ‘যুক্তি’ খুঁজে নিয়েছে (এমনকি বুদ্ধের মতো একই শব্দ ব্যবহার করেছে তারা)। তারাও পুরোনো কৰ্তৃত্ব অস্বীকার করেছে এবং নিজস্ব নিঃসঙ্গ যাত্রায় নেমেছে।

নারীরা সংগঠনকে ধ্বংস করবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বুদ্ধু, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সংঘে প্রধান সংকট দেখা দিয়েছিল পুরুষ অহমের সংঘাতের কারণে।[৪৯] বৌদ্ধ নীতিমালা অনুযায়ী অন্যায়কারী ভুল না বোঝা পর্যন্ত কোনও অপরাধ শাস্তিযোগ্য নয়। কোসাম্বিতে একজন আন্তরিক ও জ্ঞানী সাধুঁকে বহিষ্কার করা হয়। এই শাস্তিকে অন্যায় বলে প্রতিবাদ করেন তিনি, যেহেতু অন্যায় করার বিষয়টি তিনি বুঝতে পারেননি। কোসাম্বির ভিক্ষুরা নিমেষে বৈরী উপদলে ভাগ হয়ে যায়। বুদ্ধ এই বিভেদে এমনই বিপর্যস্ত বোধ করেছিলেন যে এক পর্যায়ে একাকী বনে বাস করতে চলে যান তিনি, আগ্রাসী সঙ্গীদের কাছে নাস্তানাবুদ এক হাতির সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। ঘৃণা, বলেছেন বুদ্ধ, কখনও আরও ঘৃণায় হ্রাস পায় না। কেবল বন্ধুত্ব ও সহানুভূতি দিয়েই তা নাকচ করা সম্ভব।[৫০] তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, উভয় দলই ন্যায়ের পক্ষে আছে; কিন্তু বুদ্ধ এক পক্ষকে অন্য পক্ষের অবস্থান বোঝানোর চেষ্টা সত্ত্বেও সকল ভিক্ষুর অহমবাদ অপর পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা অসম্ভব করে তুলেছিল। সারিপুত্ত ও নারীদের সংঘের প্রধান পজাপতিকে তিনি তিনি দু’পক্ষকেই সম্মানের সঙ্গে দেখাতে বলেছেন। উভয় শিবিরকে নিরপেক্ষভাবে দান করার নির্দেশ দিয়েছেন অনাথাপিন্দিকাকে। কিন্তু কোনও সমাধান চাপিয়ে দেননি তিনি। খোদ অংশগ্রহণকারীদের ভেতর থেকেই সমধান আসতে হবে। শেষ পর্যন্ত বরখাস্ত ভিক্ষু শান্ত হলেন: যদিও সেটা তার জানা ছিল না, কিন্তু তিনি অপরাধ করেছেন। অবিলম্বে পুনর্বহাল করা হলো তাঁকে এবং বিবাদের পরিসমাপ্তি ঘটল।[৫১]

এই কাহিনী আমাদের আদি সংঘ সম্পর্কে অনেক কিছু জানায়। সুসংহত সংগঠন ও কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব বলে কিছু ছিল না। প্রাচীন রাজ্যগুলোর সংঘের কাছাকাছি ছিল তা, যেখানে পরিষদের সকল সদস্যের মর্যাদা ছিল সমান। বুদ্ধ কর্তৃত্বপরায়ণ ও নিয়ন্ত্রক শাসক হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। পরবর্তী কালের ক্রিশ্চান ধর্মীয় সংস্থার ফাদার সুপিরিয়রের মতো ছিলেন না তিনি। আসলে একে একটি সংগঠন বলা ঠিক হবে না, বরং বিভিন্ন ধরনের সংগঠন একই ধৰ্ম্ম অনুসরণ করত ও একই জীবনধারা অনুযায়ী চলত। ছয় বছর পর পর বিক্ষিপ্ত ভিক্ষু ও ভিক্ষুনিরা ‘পতিমোক্ষ’ (‘শপথ’) নামে পরিচিত বিশ্বাসের ঘোষণা দিতে সমবেত হতেন।[৫২] নামটা যেমন বোঝায়, সংঘকে এক সূত্রে গাথাই ছিল এর উদ্দেশ্য:

ক্ষতিকর সমস্ত কিছু হতে বিরত থেকো
যা কিছু দক্ষ তা অর্জন করো
মনকে পরিশুদ্ধ করো,
এটাই বুদ্ধের শিক্ষা।

আত্ম সংযম ও ধৈর্য সমস্ত কৃচ্ছ্রতার
মাঝে সেরা,
বুদ্ধ ঘোষণা দিয়েছেন যে নিব্বানাই
সর্বোত্তম মূল্য,
অপরকে যে আঘাত করেনি সেই সত্যিকার
অর্থে গৃহস্থ জীবন হতে ‘অগ্রসর’ হতে পেরেছে।
অপরকে যে আহত করে না সে-ই প্রকৃত সন্ন্যাসী।

ছিদ্রান্বেষণ নয়, নয় ক্ষতি, নয় সংযম,
খাদ্য, একক শয্যা ও আসন সম্পর্কে জানা
ধ্যান হতে প্রাপ্ত উচ্চতর অনুভূতি প্রয়োগ,
জাগ্রত জন এই শিক্ষাই দিয়েছেন।[৫৩]

প্রজাতন্ত্রগুলোর বৈশিষ্ট্য পূর্ণ সম্মেলনের অনুরূপ এই অনুষ্ঠানের প্রতি বেশ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন বুদ্ধ। কাউকেই পতিমোক্ষ থেকে অনুপস্থিত থাকার সুযোগ দেওয়া হতো না, কারণ কেবল এই বিষয়টি আদি সংঘকে একত্রিত রেখেছিল।

অনেক পরে, বুদ্ধের পরলোকগমনের পর, সহজ আবৃত্তিকে আরও বিস্ত ারিত জটিল সম্মেলন দিয়ে পুনস্থাপিত করা হয়। প্রত্যেক অঞ্চলে পাক্ষিক ভিত্তিতে স্থানীয় সম্প্রদায় উপসোথা দিবসে এর আয়োজন করে। এই পরিবর্তন সংঘের একটি গোত্র হতে সংঘে পরিবর্তন তুলে ধরে। অন্য গোত্র থেকে পৃথককারী ধম্ম না গেয়ে সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসীনিরা সংঘের বিধিবিধান আবৃত্তি করতেন ও পরস্পরের কাছে অধিকার লঙ্ঘনের দায় স্বীকার করতেন। ততদিনে সংঘের বিধানের সংখ্যা বুদ্ধের আমলের তুলনায় অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কোনও কোনও পণ্ডিত যুক্তি দেখান যে, বিনয়ায় লিপিবদ্ধ নিয়ম কানুন চূড়ান্ত রূপ নিতে দুই থেকে তিন শতাব্দী সময় লেগেছে। কিন্তু কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, সংগঠনের চেতনা অন্ততপক্ষে মোটামুটিভাবে খোদ বুদ্ধ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সম্ভব।[৫৪]

সংঘই বৌদ্ধ মতবাদের প্রাণ, কারণ এর জীবনধারা বাহ্যিকভাবে নিব্বানার অন্তস্থ অবস্থা ধারণ করে।[৫৫] সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসীনিদের অবশ্যই কেবল গৃহ হতেই ‘অগ্রসর হতে’ হবে না বরং সত্তাও ত্যাগ করতে হবে। একজন ভিক্ষু ও ভিক্ষুনি প্রাপ্তি ও ব্যয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত ‘আকাঙ্ক্ষা’ বিসর্জন দিয়েছেন, তাদের যা দেওয়া হয় সম্পূর্ণ তার উপর নির্ভর করেন তাঁরা। সামান্যেই সন্তুষ্ট থাকেন। সংঘের জীবনধারা সদ্যস্যদের ধ্যানে সাহায্য করে আমাদের দুঃখ-কষ্টের চাকায় বেঁধে রাখা অজ্ঞতা, লোভ ও ঘৃণার আগুন দূর করতে সক্ষম করে তোলে। সহানুভূতি ও সাম্প্রদায়িক ভালোবাসার আদর্শ নিজস্ব অহমবাদ একপাশে সরিয়ে রেখে অন্যের জন্যে বাঁচতে শেখায়। এইসব প্রবণতাকে অভ্যাসে পরিণত করে সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসীনিরা অটল অন্তস্থ শান্তি –পবিত্র জীবনের মোক্ষ-নিব্বানা অর্জন করতে পারে। সংঘ পৃথিবীর বুকে এখনও টিকে থাকা অন্যতম প্রাচীন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। একমাত্র জৈন সংগঠনই এমনি প্রাচীনত্ব দাবি করতে পারে। এর স্থায়িত্ব মানুষ ও মানবীয় জীবন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু জানায় আমাদের। সুবিশাল সৈন্যবাহিনী দিয়ে পারিচালিত বিরাট বিরাট রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কিন্তু ভিক্ষুদের সংগঠন প্রায় ২,৫০০ বছর টিকে আছে। আদি বুদ্ধ কিংবদন্তীতে বুদ্ধ ও চক্কবত্তীকে পাশাপাশি দেখিয়ে যে বৈপরীত্যের আভাস দেওয়া হয়েছিল: এটা তাই। বার্তাটিকে এমন মনে হয় যে, নিজেকে রক্ষা করে নয়, বরং নিজেকে বিলিয়ে দিয়েই আপনি বেঁচে থাকতে পারেন।

কিন্তু সংঘের সদস্যরা সিংহভাগ জনগণের জীবনধারার দিকে পিঠ ফিরিয়ে নিলেও সাধারণভাবে লোকে কিন্তু তাঁদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়নি, বরং তাঁদের দারুণভাবে আকর্ষণীয় মনে করেছে। এটাও আমাদের জানায় যে বুদ্ধের আবিষ্কৃত জীবন পদ্ধতি অমানবিক মনে করা হয়নি, বরং গভীরভাব মানবিক আরামাগুলো নির্জন আউটপোস্ট ছিল নাঃ রাজণ্য, ব্রাহ্মণ, বণিক, ব্যবসায়ী, আমাত্য, অভিজাত এবং অন্যান্য গোত্রের সদস্যরা ভিড় জমাতেন এখানে। পাসেনেদি ও বিম্বিসারা নিয়মিত বুদ্ধের পরামর্শের জন্যে আসতেন। বুদ্ধ হয়তো অপরাহ্নে পদ্মপুকুরের ধারে বসে থাকতেন, কিংবা কুঁড়ে ঘরের বারান্দায় বসে মোমবাতির শিখায় মথের ঝাঁপিয়ে পড়া দেখতেন। বুদ্ধ বসতিগুলোয় সাধুদের ভিড় জমানোর কথা পড়ি আমরা। বুদ্ধকে প্রশ্ন করতে প্রতিনিধি দল আসত। হাতির পিঠে চেপে অভিজাতজন ও বণিকরা আসতেন এবং কোনও অঞ্চলের তরুণের দল বুদ্ধকে খাবার আমন্ত্রণ জানাতে সদলবলে হাজির হতো।

এমনি উত্তেজনা ও কর্ম চাঞ্চল্যের ভেতর থাকতেন বুদ্ধের শান্ত নিয়ন্ত্রিত অবয়ব, নতুন ‘জাগ্রত’ পুরুষ। আমাদের মধ্যে যারা তাঁর মতো সম্পূর্ণ আত্ম- পরিত্যাগে অক্ষম তাদের কাছে তিনি অস্পষ্ট ও জ্ঞানাতীত রয়ে যান, কারণ আলোকপ্রাপ্তির পর নৈর্ব্যক্তিক হয়ে গেছেন তিনি, যদিও কখনওই দয়াহীন বা শীতল নন। তাঁর দিক হতে সংগ্রাম বা প্রয়োসের কোনও চিহ্ন নেই। আলোকপ্রাপ্তির রাতে যেমন চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, যা করার তার সবই সম্পন্ন করেছেন তিনি। তিনি তথাগত, যিনি অদৃশ্য হয়ে গেছেন। তাঁর কোনও ব্যক্তিগত বন্ধন ছিল না; ছিল না কোনও আগ্রাসী তাত্ত্বিক মতবাদও। পালি টেক্সটে প্রায়শঃ তাঁকে অমানবীয় সত্তার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, সেটা তাঁকে অতিপ্রাকৃত মনে করা হয়েছে বলে নয়, বরং মানুষ তাঁকে কোন শ্রেণীতে ফেলতে হবে জানত না বলে। এক ব্রাহ্মণ একদিন দেখলেন, একটা গাছের নিচে স্থির, ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ বসে আছেন। ‘তাঁর মানসিক শক্তি বিশ্রামরত, তাঁর মন অটল। তাঁর আশপাশের সবকিছু আত্মনিয়ন্ত্রণ ও প্রশান্তি প্রকাশ করছিল।’ এ দৃশ্য ব্রাহ্মণকে বিস্ময়াভিভূত করে তুলল। বুদ্ধকে দেখে দাঁতাল হাতির কথা মনে হলো তাঁর: অপরিমেয় শক্তি ও বিপুল সম্বাবনাকে নিয়ন্ত্রণে এনে বিরাট শান্তিতে পরিণত করার সেই একই ছবি। শৃঙ্খলা, সংযম ও পরিপূর্ণ প্রশান্তি বিরাজ করছিল। এমন মানুষ কখনও দেখেননি ব্রাহ্মণ। ‘আপনি কি দেবতা, প্রভু?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি। ‘না,’ জবাব দিলেন বুদ্ধ। ‘আপনি কি তবে দেবদূত…বা আত্মায় রূপান্তরিত হচ্ছেন?’ আবার প্রশ্ন করলেন ব্ৰাহ্মণ। কিন্তু বুদ্ধ আবার জবাব দিলেন, তিনি তা নন। ভিন্ন কিছুতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন তিনি। হাজার হাজার বছর আগে পৃথিবীতে জীবন কাটানো শেষ বুদ্ধের পর তাঁর মতো মানুষ জগৎ আর দেখেনি। বিগত এক জীবনে একবার দেবতা ছিলেন তিনি, ব্যাখ্যা দিয়েছেন বুদ্ধ; পশু ও সাধারণ মানুষ হিসাবেও জীবন কাটিয়েছেন, কিন্তু প্রাচীন, অসজীব মানবতার সঙ্গে তাঁকে বন্দি করে রাখা সবকিছু নির্বাপিত হয়ে গেছে, ‘একেবারে গোড়ায় কাটা পড়েছে, তাল গাছের গুঁড়ির মতো উপড়ে ফেলা হয়েছে, সম্পূর্ণ উৎপাটিত।’ ব্রাহ্মণ কি কখনও এমন লাল পদ্ম দেখেছেন যেটা জলের গভীরে জীবন শুরু করে জল ছাড়িয়ে না যাওয়া পর্যন্ত পুকুরের ওপর উঠে এসেছে? জিজ্ঞেস করলেন বুদ্ধ। আমিও পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে বড় হয়েছি,’ অতিথিকে বললেন তিনি। ‘কিন্তু আমি জগৎ ছাড়িয়ে গেছি। এখন আর এর সংস্পর্শে নেই।’ এই জীবনে নিব্বানা লাভের মাধ্যমে মানুষের প্রকৃতিতে এক নতুন সম্ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। বেদনার এই জগতে অবশিষ্ট সৃষ্টির সঙ্গে শান্তিতে, নিজের সঙ্গে সুনিয়ন্ত্রিত ও সামঞ্জস্যের সঙ্গে বাঁচা সম্ভব। কিন্তু এই শান্ত নিষ্কৃতি লাভের জন্যে নারী- পুরুষকে অহমবাদ হতে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ অন্যান্য সত্তার স্বার্থে জীবন যাপন করতে হবে। বহিরাগত কারও কাছে যত ভীতিকরই মনে হোক না কেন সত্তার কাছে এমন মৃত্যু-অন্ধকার নয়। এটা মানুষকে তার নিজস্ব প্রকৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ করে তোলে যাতে তারা নিজেদের ক্ষমতার সর্বোচ্চ বিন্দুতে বাস করতে পারে। বুদ্ধকে কেমন করে শ্রেণীবন্ধ করবেন ব্রাহ্মণ? ‘আমার কথা মনে রেখ,’ তাঁকে বলেছেন বুদ্ধ, ‘জাগ্রত একজন হিসাব।[৫৬]

তথ্যসূত্র

১. সাম্যত্তা নিকয়া, ২২: ৮৭।

২. অ্যান্ড্রু স্কিলটন, আ কনসাইজ হিস্ট্রি অভ বুদ্ধজম, বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্য, ১৯৯৪, ১৯।

৩. বিনয়া: কুলাভাগ্য, ১: ১২; সুকুমার দত্ত, বুড্ডিস্ট মঙ্কস অ্যান্ড মনাস্টারিজ অভ ইন্ডিয়া, লন্ডন, ১৯৬২, ২২।

৫. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ১৩।

৬. প্রাগুক্ত, ১: ১৪-২০।

৭. মির্চা এলিয়াদ, ইয়োগা, ইমমর্টালিটি অ্যান্ড ফ্রিডম (অনু. উইলিয়াম আর, ট্রাস্ক); লন্ডন, ১৯৫৮, ৮৫-৯০।

৮. সুত্তা নিপাতা, ১৩৬; উদনা, ১: ৪।

৯. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ২০।

১০. প্রাগুক্ত, ১: ২১; সাম্যত্তা নিকয়া, ৩৫: ২৮।

১১. রিচার্ড এফ. গমব্রিচ; থেরাভেদা বুদ্ধজম: আ সোশ্যাল হিস্ট্রি ফ্রম অ্যানশেন্ট বেনারেস টু মডার্ন কলোম্বো, লন্ডন ও নিউ ইয়র্ক, ১৯৮৮, ৬৫-৬৯।

১২. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ২১।

১৩. প্রাগুক্ত, ১: ২২।

১৪. প্রাগুক্ত, ১: ২৩।

১৫.এডোয়ার্ড কনযে, বুদ্ধজম; ইটস্ এসেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, অক্সফোর্ড ১৯৫৭, ৯১-৯২।

১৬. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ২৪।

১৭. জাতকা, ১: ৮৭; আঙুত্তারা নিকয়ার ব্যাখ্যা, ১: ৩০২; এডোয়ার্ড জে. টমাস. দ্য লাইফ অভ বুদ্ধা ইন লেজেন্ড অ্যান্ড হিস্ট্রি, লন্ডন, ১৯৬৯, ৯৭- ১০২; ভিক্ষু নানামোলি (অনু. ও সম্পা.), দ্য লাইফ অভ দ্য বুদ্ধা, অ্যাকর্ডিং টু দ্য পালি ক্যানন, ক্যান্ডি, ক্যান্ডি, শ্রী লঙ্কা, ১৯৭২, ৭৫-৭৭।

১৮. টমাস, লাইফ অভ বুদ্ধা, ১০২-৩

১৯. বিনয়া কুলাভাগ্য, ৬: ৪; সাম্যত্তা নিকয়া, ১০: ৮।

২০. ট্রেভর লিঙ, দ্য বুদ্ধা: বুড্ডিস্ট সিভিলাইজেশন ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড সিলোন, লন্ডন, ১৯৭৩, ৪৬-৪৭।

২১. বিনয়া: কুলাভাগ্য, ৬: ৪; সাম্যত্তা নিকয়া ১০: ৮।

২২. দত্ত, বুড্ডিস্ট মঙ্কস, ৫৮।

২৩. বিনয়া: মহাভাগ্য, ৩: ১।

২৪. প্রাগুক্ত, ৮: ২৭।

২৫. বিনয়া: কুলাভাগ্য, ৬: ৫-৯।

২৬. মাজহিমা নিকয়া, ১২৮; বিনয়া: মহাভাগ্য, ১০: ৪।

২৭. মাজহিমা নিকয়া, ৮৯।

২৮. লিঙ, দ্য বুদ্ধা, ১৪০-৫২; মাইকেল এডোয়ার্ডস, ইন দ্য ব্লোইং আউট অভ আ ফ্লেইম: দ্য ওঅর্ল্ড অভ দ্য বুদ্ধা অ্যান্ড দ্য ওঅর্ল্ড অভ ম্যান, লন্ডন, ১৯৭৬, ৩০-৩১।

২৯. গমব্রিচ, থেরাভেদা বুদ্ধজম, ৮১-৮৬; মাইকেল কারিথার্স, দ্য বুদ্ধা, অক্সফোর্ড ও নিউ ইয়র্ক, ১৯৮৩, ৯৫-৯৭।

৩০. দিঘা-নিয়া, ৩: ১৯১।

৩১. মাজহিমা নিকয়া, ১৪৩।

৩২. লিঙ, দ্য বুদ্ধা, ১৩৫-৩৭; গমব্রিচ, থেরাভেদা বুদ্ধজম, ৭৫-৭৭।

৩৩. কারিথার্স, দ্য বুদ্ধা, ৮৬-৮৭।

৩৪. গমব্রিচ, থেরাভেদা বুদ্ধজম, ৭৮।

৩৫. আঙুত্তারা নিয়া, ২: ৬৯-৭০।

৩৬. দিঘা নিকয়া, ৩: ১৮০-৮৩।

৩৭. আঙুত্তারা নিকয়া ৪: ৪৩-৪৫।

৩৮. সাম্যত্তা নিকয়া, ৩: ১-৮।

৩৯. শাব্বাত, 31A:cf, ম্যাথু, ৭: ১২; কনফুসিয়াস, অ্যানালেক্টস, ১২: ৪০. আঙুত্তারা নিকয়া ৩: ৬৫।

৪১. প্রাগুক্ত।

৪২. প্রাগুক্ত।

৪৩. সুত্তা নিপাতা, ১১৮।

৪৪. বিনয়া: কুলাভাগ্য ১০: ১।

৪৫. দিঘা নিকয়া, ১৬; ইসালেইন ব্লিউ হর্নার, উইমেন আন্ডার প্রিমিটিভ বুদ্ধজম, লন্ডন, ১৯৩০, ২৮৭।

৪৬. রিটা এম. গ্রস, ‘বুদ্ধজম’ জাঁ হল্মে’র (জন বাউকারের সঙ্গে) সম্পা. উইমেন ইন রিলিজিয়ন, লন্ডন, ১৯৯৪, ৫-৬; অ্যান ব্যানক্রফট, ‘উইমেন ইন বুদ্ধজম,’ উরসুলা কিং (সম্পা.)-এর উইমেন ইন দ্য ওঅর্ল্ডস রিলিজিয়ন্স, পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট, নিউ ইয়র্ক, ১৯৮৭।

৪৭. দিঘা নিকয়া, ১৬।

৪৮. লেইলা আহমেদ, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার ইন ইসলাম, নিউ হাভেন ও লন্ডন, ১৯৯২, ১১-২৯।

৪৯. মাজহিমা নিকয়া, ১২৮।

৫০. সম্মপদ, ৫-৬।

৫১. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১০: ৫।

৫২. দত্ত, বুড্ডিস্ট মঙ্কস, ৬৬।

৫৩. ধম্মপদ, ১৮৩-৮৫।

৫৪. গমব্রিচ, থেরাভেদা বুদ্ধজম, ৯২; অলদেনবার্গ, দ্য বুদ্ধা: হিজ লাইফ, হিজ ডকট্রিন, হিজ অর্ডার (অনু. উইলিয়াম হোয়ে), লন্ডন, ১৮৮২,xxxiii।

৫৫. গমব্রিচ, থেরাভেদা বুদ্ধজম, ৮৮-৮৯।

৫৬. আঙুত্তারা নিকয়া ৪: ৩৬।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *