২. অন্বেষণ

অন্বেষণ

সূদূরবর্তী রাজ্য শাক্য পেছনে ফেলে মগধ রাজ্যে প্রবেশের পর নতুন সভ্যতার প্রাণকেন্দ্রে এসে পৌঁছেছিলেন গৌতম। পালি কিংবদন্তী আমাদের জানাচ্ছে, প্রথমে অল্প কিছুদিন মগধের রাজধানী অন্যতম শক্তিশালী উন্নয়নশীল নগর রাজাগহের বাইরে অবস্থান করেন তিনি। খাবার ভিক্ষা করার সময় আর কেউ নন, খোদ রাজা বিম্বিসারার নজরে পড়ে যান। তরুণ শাক্য ভিক্ষুকে দেখে এতই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি যে তাঁকে আপন উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করতে চেয়েছিলেন।[১] এটা স্পষ্টতই রাজাগহে গৌতমের প্রথম পদার্পণের কাল্পনিক অলঙ্করণ। তবে ঘটনাটি তাঁর ভবিষ্যৎ মিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে। গৌতম ছিলেন কাপিলবাস্তুর নেতৃস্থানীয় পরিবারগুলোর একটির সদস্য, রাজা ও অভিজাতজনদের সঙ্গে অনায়াসে মিশতে পারতেন তিনি। শাক্যতে কোনও গোত্রপ্রথা ছিল না। কিন্তু সমাজের মূল স্রোতধারায় পৌঁছানোর পর নিজেকে ক্ষত্রিয় হিসাবে তুলে ধরেছেন তিনি সরকারের পক্ষে উপযোগি গোত্রের সদস্য। কিন্তু বহিরাগত কারও মতো বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে বৈদিক সমাজের কাঠামো পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলেন গৌতম। ব্রাহ্মণদের সমীহ করার জন্যে বড় করা হয়নি তাঁকে; কখনওই তাঁদের সঙ্গে সমস্যায় পড়েননি তিনি। পরে নিজস্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার পর তিনি উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে যে কোনও রকম কঠোর শ্রেণীবিন্যাসে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এই সমালোচনামূলক অবস্থান শহরগুলোয় তাঁকে সুবিধাজনক অবস্থান দেবে যেখানে গোত্র-প্রথা ভেঙে পড়ছিল। গৌতমের প্রথম আহ্বানস্থল প্রত্যন্ত অঞ্চল না হয়ে বিরাট শিল্পনগরী হওয়ার বিষয়টি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কর্মজীবনের অধিকাংশ সময়ই শহর ও নগরে কাটাবেন তিনি, যেখানে নগরায়নের সঙ্গে আবির্ভূত পরিবর্তন ও উত্থানপতনের ফলে সৃষ্ট ব্যাপক অস্থিরতা ও বিস্ময়ের উপস্থিতি ছিল। পরিণামে বেশ আধ্যাত্মিক তৃষ্ণাও ছিল।

প্রথম দফার দীর্ঘ সময় রাজাগহে কাটাননি গৌতম, বরং তাঁর আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণে সাহায্য করতে পারবেন ও পবিত্র জীবনের প্রাথমিক বিষয়াদি শিক্ষা দিতে পারবেন এমন একজন গুরুর সন্ধানে নেমে পড়েছিলেন। শাক্যে গৌতম সম্ভবত গুটিকয় সন্ন্যাসীর দেখা পেয়েছিলেন। কিন্তু ওই অঞ্চলের শহরগুলোকে সংযুক্তকারী বাণিজ্যপথে নতুন অসংখ্য ভিক্ষুকে দেখে সম্ভবত হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। হয়তো শহরের বিভিন্ন বাড়ির দরজায় তাঁদের নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থাকবেন, সরাসরি খাবার না চেয়ে স্রেফ থালা সামনে বাড়িয়ে রেখেছেন। গৃহস্থরা তাদের উন্নত পুনর্জন্ম এনে দেবে এমন যোগ্যতা অর্জনে উদ্বিগ্ন থাকায় সাধারণত উচ্ছিষ্ট দিয়ে ওগুলো ভরে দিত। চাষাবাদের জমিকে ঘিরে রাখা বট, সেগুন ও নারিকেল গাছের জঙ্গলে ঘুমানোর জন্যে পথ ছেড়ে শিবিরে সন্ন্যাসীদের দল বেঁধে ঘুমোতে দেখে থাকবেন গৌতম। তাদের কেউ কেউ স্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পবিত্র জীবনের সন্ধান করার সময় বনে-জঙ্গলে সংসার পেতেছেন। এমনকি ব্রাহ্মণরাও ছিলেন যাঁরা ‘মহান অনুসন্ধানে’ নামা সত্ত্বেও তিনটি পবিত্র অগ্নিকুণ্ডের পরিচর্যা করে কঠোরতর বৈদিক প্রেক্ষিতে আলোকপ্রাপ্তির প্রয়াস পাচ্ছিলেন। মধ্য-জুনে এলাকায় আঘাত হেনে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকা বর্ষার বৃষ্টির কারণে ভ্রমণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে সন্ন্যাসীদের অনেকেই দলবেঁধে জঙ্গল বা শহরতলীর পার্ক ও শ্মশানে বাস করতেন যতক্ষণ না বানের পানি নেমে গিয়ে পথঘাট আবার সুগম হয়ে উঠত। গৌতম যখন তাঁদের দলে যোগ দিতে আসেন ততদিনে ভবঘুরে ভিক্ষুরা দৃশ্যপটের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিলেন। সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য শক্তি ছিলেন তাঁরা। বণিকদের মতো তাঁরাও পঞ্চম গোত্রে পরিণত হয়েছিলেন।[২]

আগের দিনে অনেকেই সংসার ও নিয়মিত চাকরির একঘেয়ে পরিশ্রম থেকে নিস্তার পেতে এই বিশেষ আজিভা বৃত্তি বেছে নিয়েছিল। বরাবরই কিছু গৃহত্যাগী ছিল যারা মূলত ঘর-পালানো, দেনাদার, দেউলিয়া ও আইনের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো লোকজন। কিন্তু গৌতম যখন অনুসন্ধান শুরু করেন তখন তাঁরা আরও সংগঠিত হয়ে উঠেছিলেন। এমনকি সবচেয়ে অঙ্গীকার বিহীন সন্ন্যাসীকেও তাদের অস্তিত্বের পক্ষে একটা আদর্শের প্রচার করতে হতো। ফলে বেশ কয়েকটা মতবাদের জন্ম হয়েছিল। কোসালা ও মগধের নতুন রাজ্যে সরকার অধিবাসীদের ওপর অধিকতর নিয়ন্ত্রণ আরোপ শুরু করেছিল। সামগ্রিকভাবে সমাজে অবদান রাখে না এমন কোনও বিকল্প জীবনধারা আঁকড়ে ধরতে জনগণকে অনুমতি দেয়নি। সন্ন্যাসীদের প্রমাণ করতে হয়েছে, তাঁরা পরজীবী নন, বরং দার্শনিক যাদের বিশ্বাস দেশের আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য উন্নতি ঘটাতে পারে।[৩]

অধিকাংশ নতুন আদর্শ পুনর্জন্ম ও কম্মের মতবাদ কেন্দ্রীক ছিল: তাদের লক্ষ্য ছিল ক্রমাগত এক অস্তিত্ব হতে আরেক অস্তিত্বে ঠেলে দেওয়া অন্তহীন সামসারা চক্র হতে নিস্তার লাভ। উপনিষদ শিক্ষা দিয়েছিল যে, দুঃখ-দুর্দশার প্রধান কারণ হচ্ছে অজ্ঞতা: অনুসন্ধানী একবার নিজের প্রকৃত ও পরম সত্তা (আত্মা)র গভীর জ্ঞান লাভ করার পর আবিষ্কার করবে যে আর আগের মতো তীব্রভাবে যন্ত্রণা বোধ করছে না, চূড়ান্ত মুক্তির আভাস লাভ করবে সে। কিন্তু মগধ, কোসালা ও গাঙ্গেয় সমতলের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সন্ন্যাসীগণ প্রায়োগিক বিষয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন। অজ্ঞতাকে দুঃখের প্রধান কারণ হিসাবে দেখার বদলে তাঁরা আকাঙ্ক্ষাকে (তানহা) আসল অপরাধী মনে করেছেন। আকাঙ্ক্ষা দিয়ে তাঁরা পবিত্র জীবনের সন্ধানে নামার মতো উৎসাহব্যঞ্জক আর উন্নতি সাধক কাজে অনুপ্রাণিতকারী সেইসব মহৎ ইচ্ছাকে বোঝাননি, বরং সেইসব কামনাকে বুঝিয়েছেন যা আমাদেরকে ‘আমি চাই,’ বলতে বাধ্য করে। তাঁরা নতুন সমাজের লোভ ও অহমবোধে ভারি উদ্বিগ্ন ছিলেন। আমরা যেমন দেখেছি, তাঁরা ছিলেন সময়ের সন্তান; রাজার এলাকায় আবির্ভূত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও আত্ম-নির্ভরতার রীতিনীতি আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু অ্যাক্সিয়াল-যুগের অন্য সাধুদের মতো জানতেন অহমবাদ বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। পূর্ব-গাঙ্গেয় এলাকার সন্ন্যাসীদের বিশ্বাস ছিল যে এই পিপাসার্ত তানহাই মানুষকে সামসারায় আটকে রেখেছে। তাঁরা যুক্তি দেখিয়েছেন, আমাদের সকল কর্মকাণ্ড একটা পর্যায় পর্যন্ত আকাঙ্ক্ষায় অনুপ্রাণিত। আমরা একটা কিছু প্রয়োজন বোঝার পর সেটা পাওয়ার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিই: একজন পুরুষ যখন কোনও নারীকে কামনা করে, সে তাকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে; মানুষ প্রেমে পড়ে ভালোবাসার পাত্রকে অধিকার করতে চায়, আঁকড়ে ধরে আন্তরিকভাবে কাছে পেতে চায়। জাগতিক আরাম- আয়েস না চাইলে কেউই জীবিকা নির্বাহ করার জন্যে কঠোর ও প্রায়শঃ একঘেয়ে কাজ করতে যাবে না। সুতরাং আকাঙ্ক্ষা মানুষের কর্মকাণ্ডে (কম্ম ইন্ধন যোগায়। কিন্তু প্রতিটি কাজের দীর্ঘ মেয়াদী পরিণাম রয়েছে, সেটা ব্যক্তি পরবর্তী জীবনে যে অস্তিত্ব লাভ করবে তা নির্ধারণ করবে।

এটা বোঝায় যে, কম্ম পুনর্জন্মের দিকে চালিত করে। আমরা যদি আদৌ কোনও কাজ করা এড়িয়ে যেতে পারি, হয়তো পুনর্জন্মের দুঃখ আর পুনঃমৃত্যুর চক্র হতে নিজেদের মুক্ত করার সুযোগ পেতে পারি। কিন্তু আকাঙ্ক্ষা আমাদের কাজে বাধ্য করে। সুতরাং, উপসংহারে পৌঁছেছেন সন্ন্যাসীগণ আমরা আমাদের মন-প্রাণ থেকে তানহাকে নিশ্চিহ্ন করতে পারলে আমরা অল্প সংখ্যক কম্ম সম্পাদন করতে পারব। কিন্তু একজন গৃহস্থের নিজেকে আকাঙ্ক্ষা হতে মুক্ত করার কোনও সুযোগ নেই। তার গোটা জীবন একের পর এক সর্বনেশে কাজের সম্মিলন।[৪] বিবাহিত পুরুষ হিসাবে সন্তান জন্ম দেওয়া তার দায়িত্ব। কিছু পরিমাণ যৌন আকঙ্ক্ষা ছাড়া স্ত্রীর সঙ্গে ঘুমাতে পারবে না সে; কিছু পরিমাণ লোভ বাধ্য না করলে সাফল্য বা দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য বা শিল্পে নিয়োজিত হতে পারবে না। রাজা বা ক্ষত্রিয় হলে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা ছাড়া শাসন কাজে বা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধেই লিপ্ত হতে পারবেন না। আসলেই তানহা ও তানহা হতে উদ্ভুত কাজ (কম্ম) ছাড়া সমাজ থমকে দাঁড়াত। একজন গৃহস্থের জীবন কামনা, লোভ ও উচ্চাভিলাষে প্রভাবিত হওয়ায় তাকে অস্তিত্বের মাঝে বন্দি করা কর্মকাণ্ডে বাধ্য করে: অনিবার্যভাবে সে আরেকটি যন্ত্রণাদায়ক জীবন সহ্য করার জন্যে জন্ম নেবে। সত্য বটে সৎ কৰ্ম্ম সম্পাদন করে যোগ্যতা অর্জন করতে পারে একজন গৃহস্থ। যেমন ভিক্ষুকে ভিক্ষা দিতে পারে এবং এভাবে ভবিষ্যতে কাজে আসার মতো মূল্য লাভ করতে পারে। কিন্তু সকল কৰ্ম্ম সীমাবদ্ধ বলে সেগুলোর পরিণামও সীমিত থাকবে, গৃহস্থকে নিব্বানার অপরিমেয় শান্তি এনে দিতে পারবে না। আমাদের কম্ম সবচেয়ে ভালো যেটা করতে পারে সেটা হলো পরবর্তী জীবনে আমরা কোনও স্বর্গীয় জগতে দেবতা রূপে জন্ম নিতে পারি। কিন্তু সেই স্বর্গীয় অস্তিত্বও একদিন শেষ হয়ে যাবে। পরিণামে একজন গৃহস্থের জীবনকে গড়ে তোলা অন্তহীন দায়িত্ব ও কর্তব্য সামসারা ও পবিত্রতা হতে বিচ্ছিন্নতার প্রতাঁকে পরিণত হয়েছে। এই পরম কর্মকাণ্ডের ঘানিতে আটকে পড়ে গৃহস্থের মুক্তির আর কোনও আশাই ছিল না।

কিন্তু সন্ন্যাসীর অবস্থান ছিল উন্নততর। তিনি যৌনতাকে বিসর্জন দিয়েছেন: ভরণপোষণ করার জন্যে তাঁর কোনও স্ত্রী-সন্তান নেই; কোনও কাজ বা ব্যবসায়ে নিয়োজিত হবার কোনও প্রয়োজন নেই তাঁর। গৃহস্থের তুলনায় মোটামুটি কর্মহীন জীবন উপভোগ করেন।[৫] কিন্তু সামান্য কম্ম সম্পাদন করলেও সন্ন্যাসী তাঁকে এই জীবনে আবদ্ধ করে রাখা আকাঙ্ক্ষা বোধ করেন। এমনকি সবচেয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ সন্ন্যাসীও জানেন, তিনি নিজেকে আকাঙ্ক্ষা হতে মুক্ত করতে পারেননি। এখনও তিনি কামনায় তাড়িত হন; এখনও জীবনের ছোটখাট সুখের জন্যে মাঝে মাঝে ইচ্ছা বোধ করেন। প্রকৃতপক্ষে বঞ্চনা অনেক সময় আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে দেয়। কেমন করে একজন সন্ন্যাসী নিজেকে মুক্ত করতে পারবেন? কেমন করে তিনি তাঁর আপন সত্তায় প্রবেশাধিকার পাবেন এবং তাঁকে বস্তু জগৎ হতে মুক্ত করবেন? যেখানে তাঁর সর্বাত্মক প্রয়াস সত্ত্বেও এখনও নিজেকে পার্থিব বস্তুর জন্যে আকাঙ্ক্ষা করতে দেখছেন? প্রধান প্রধান সন্ন্যাস-মতবাদে ভিন্ন ভিন্ন সমাধান দেখা দিয়েছিল। জনৈক গুরু মতবাদ ও অনুশীলনের ব্যবস্থা হিসাবে একটা ধৰ্ম্ম গড়ে তুলেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, এটা এইসব দুর্গম সমস্যা মোকাবিলা করতে পারবে। এরপর তিনি একদল শিষ্যকে সংগঠিত করে এমন কিছু যা সংঘ বা গণ (ধর্মে গোত্রীয় দলবদ্ধতা বোঝাতে প্রাচীন বৈদিক পরিভাষা) নামে পরিচিত সংগঠন গড়ে তুললেন। এইসব সংঘ আধুনিক ধর্মীয় গোষ্ঠীর মতো সুসংগঠিত প্রতিষ্ঠান ছিল না। তাদের সামান্য বা কোনওরকম সাদৃশ্যমূলক জীবন ধারা ছিল না, ছিল না কোনও আনুষ্ঠানিক আচরণ বিধিও। সদস্যরা ইচ্ছামতো যোগ দিত ও বিদায় নিত। আরও সুবিধাজনক ধৰ্ম্মের সন্ধান পাওয়ামাত্র সন্ন্যাসীকে গুরুকে ত্যাগে বিরত রাখার মতো কিছু ছিল না। সন্ন্যাসীরা সাধ্যমতো সেরা গুরুর সন্ধানে ঘুরে বেড়াতেন। পথে পরস্পরকে সম্ভাষণ জানানো ভিক্ষুদের রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। তাঁরা পরস্পরকে জিজ্ঞেস করতেন: ‘আপনার গুরু কে? আপনি কোন ধৰ্ম্ম পালন করেন?’

মগধ ও কোসালায় ভ্রমণের সময় স্বয়ং গৌতমও সম্ভবত এভাবে পাশ কাটানো সন্ন্যাসীদের প্রশ্ন করে থাকবেন, কারণ একজন গুরু ও সংঘের সন্ধানে ছিলেন তিনি। শুরুতে আদর্শের সংঘাত তাঁর কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হয়ে থাকতে পারে। সংঘগুলো প্রতিযোগিতামূলক ছিল, বণিকরা যেভাবে বাজার এলাকায় নিজ নিজ পণ্য বিক্রি করত ঠিক সেরকম আগ্রাসীভাবে ধম্ম প্রচার করত তারা। অত্যুৎসাহী শিষ্যরা তাদের গুরুদের ‘বুদ্ধ’ (‘আলোকপ্রাপ্ত জন) ) বা ‘মানুষ ও দেবতাদের গুরু’ বলে সম্বোধন করেও থাকতেও পারে।[৬] অন্যান্য অ্যাক্সিয়াল দেশের মতো বিভিন্ন বিষয়ে জোরাল বিতর্ক, বেশ উন্নত যুক্তি ও জনগণের আগ্রহ ছিল। ধর্মীয় জীবন অল্প কিছু ধর্মান্ধের একচেটিয়া বিষয় নয় বরং সবার আগ্রহের বিষয় ছিল। নগর মিলনায়তনে গুরুরা পরস্পরের সঙ্গে বিতর্ক করতেন: জন-হিতোপদেশ শুনতে জড়ো হতো জনতা।[৭] সাধারণ মানুষ পক্ষ নিয়ে এক সংঘের বিরুদ্ধে অন্য সংঘকে সমর্থন যোগাত। কোনও এক সংঘের নেতা শহরে এলে গৃহস্থ, বণিক ও সরকারি কর্মকর্তরা তাকে খুঁজে বের করত। তাঁকে ধৰ্ম্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করত। আমরা আজকাল ফুটবল দল নিয়ে যেমন উৎসাহের সঙ্গে আলোচনা করি তেমন উৎসাহের সঙ্গে তার গুনাগুন আলোচনা করত। সাধারণ জনগণ এইসব বিতর্কের সূক্ষ্ম বিষয় বুঝতে পারত। কিন্তু তাত্ত্বিক বিষয়ে কখনও আগ্রহ ছিল না তাদের। ভারতে ধর্মীয় জ্ঞানের একটা মানদণ্ড ছিল: এটা কি ফলদায়ক? এটা কি ব্যক্তিকে বদলে দেবে, জীবন-যন্ত্রণা দূর করবে, শান্তি ও চূড়ান্ত মুক্তির আশা যোগাবে? কেউই খামোকা অধিবিদ্যিক মতবাদে আগ্রহী ছিল না। ধম্মের বাস্তবমুখীতা থাকার প্রয়োজন ছিল: উদাহরণ স্বরূপ, বনচারী সন্ন্যাসীদের প্রায় সকল আদৰ্শই নয়া সমাজের আগ্রাসন ঠেকাতে চেয়েছে, সৌজন্য ও অমায়িকতার পক্ষে অহিংসার নীতি তুলে ধরেছে।

এভাবে মাক্কালি, গোসালা ও পুরানা কশ্যাপা গুরুদের অনুসরণকারী অজিভাকাস কম্মের চলমান ধারণা অস্বীকার করেছেন: হাজার বছর সময় লাগলেও শেষ পর্যন্ত সবাইই সামসারা হতে মুক্তি লাভ করবে বলে তাঁরা বিশ্বাস করতেন। প্রত্যেককে নির্দিষ্ট সংখ্যক জীবন যাপন করতে হবে। সব ধরনের জীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করতে হবে। মনের শান্তির বিকাশ ঘটানোই ছিল এই ধম্মের মূল কথা। ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও কারণ নেই, কেননা সমস্ত কিছুই পূর্ব-নির্ধারিত। মোটামুটি একই চেতনায় অমিতের নেতৃত্বাধীন বস্তুবাদীরা পুনর্জন্ম মতবাদ অস্বীকার করেন। তাঁদের যুক্তি, মানুষ সম্পূর্ণ ভৌত সৃষ্টি বলে স্রেফ মৃত্যুর পর আবার মূল উপাদানে ফিরে যাবে। সুতরাং আপনি যেমন আচরণ করেন না কেন তার কোনওই গুরুত্ব নেই, কারণ সবার জন্যে একই নিয়তি অপেক্ষা করছে। তবে যার যেমন ইচ্ছা তেমন করে শুভেচ্ছা ও সুখীভাব লালন করা এবং সেইসব কম্ম সম্পাদনই সম্ভবত মঙ্গলজনক যেগুলো এই উদ্দেশ্য পূরণ করে। সংশয়বাদীদের নেতা সঞ্জয় যে কোনও রকম চূড়ান্ত সত্যের সম্ভাবনা অস্বীকার করেছেন। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যে, সকল কম্মের উদ্দেশ্য উত্তয়া উচিত বন্ধুত্ব ও মনের শান্তি বিকশিত করা। সকল সত্যই যেহেতু আপেক্ষিক, আলোচনা কেবল তিক্ততারই সৃষ্টি করবে। সুতরাং এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। গৌতমের জীবদ্দশায়ই মহাবীর নামে পরিচিত বর্ধমান জ্ঞানপুত্রের নেতৃত্বাধীন জৈনরা বিশ্বাস করত যে, অশুভ কৰ্ম্ম আত্মাকে সূক্ষ্ম ধূলোয় ঢেকে দেয়। ফলে আত্মা ভারি হয়ে নিম্নগামী হয়। কেউ কেউ তাই যেকোনও ধরনের কম্ম এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করত। বিশেষ করে সেই ধরনের কম্ম যেগুলো অন্য কোনও প্রাণীর ক্ষতি করতে পারে-এমনকি গাছ বা কীট পতঙ্গও। অজান্তে কোনও কাঠিতে পা দিয়ে ফেলতে পারে বা এক ফোঁটা পানি ফেলে দেবে, এই ভয়ে জৈনদের কেউ কেউ নিশ্চল থাকার প্রয়াস পেয়েছে। কেননা জীবনের এই নিম্ন পর্যায়ের ধরণগুলোর সবই প্রাণ ধারণ করে; পূর্বজন্মের অসৎ কম্মের কারণে আটকা পড়ে গেছে। কিন্তু জৈনরা প্রায়শঃই এই অসাধারণ কোমলতার সঙ্গে নিজেদের বিরুদ্ধে সহিংসতার মিশ্রণ ঘটিয়েছে। অসৎ কম্মের প্রভাব দূর করতে ভয়ঙ্কর প্রায়শ্চিত্তের আশ্রয় নিয়েছে: উপবাস পালন করত তারা, পান বা স্নানে অস্বীকৃতি জানাত আর প্রচণ্ড গরম বা শীতে নিজেদের উন্মুক্ত করতে চাইত না।[৮]

এইসব সংঘের কোনওটায়ই যোগ দেননি গৌতম। বরং সমক্ষ্যের একটা ধরনের শিক্ষা দানকারী আলারা কালামের ধম্মে দীক্ষা নেওয়ার জন্যে বিদেহা রাজ্যের রাজধানী বেসালির মহল্লায় চলে গেছেন।[৯] গৌতম সম্ভবত আগে হতেই সমক্ষ্য দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে থাকবেন, কেননা এই সমক্ষ্য দর্শন (পার্থক্যকরণ) সবার আগে সপ্তম-শতাব্দীর গুরু কাপিলাই শিক্ষা দিয়েছিলেন কাপিলবাস্তুর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর। এই মতবাদের বিশ্বাস ছিল, আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং অজ্ঞতাই আমাদের সব সমস্যার মূল: প্রকৃত সত্তাকে বোঝার অক্ষমতা থেকেই আমাদের দুঃখ-দুর্দশার উদ্ভব। আমরা এই সত্তাকে সাধারণ মনস্তাত্ত্বিক জীবনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। কিন্তু মুক্তি অর্জনের স্বার্থে আমাদের এক গভীর স্তরে সচেতন হয়ে উঠতে হবে যে সত্তার সঙ্গে এইসব ক্ষণস্থায়ী, সীমিত ও অসন্তোষজনক মানসিক অবস্থার কোনও সম্পর্ক নেই। সত্তা পরম আত্মা (পুরুসা)-র হুবহু অনুরূপ ও চিরন্তন, যা সমস্ত বস্তু ও প্রাণীতে প্রভাবশালী কিন্তু প্রকৃতির বস্তুজগৎ (প্রকৃতি) দিয়ে আড়াল করা। সমক্ষ্য দর্শন অনুসায়ী পবিত্র জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে প্রকৃতি হতে পুরুসার পার্থক্য করতে শেখা। নবীশকে আবেগের বিভ্রান্তি হতে ঊর্ধ্বে জীবন যাপন করা শিখতে হতো এবং মানুষের নিখুঁততম অংশ বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটাতে হতো, যার চিরন্তন আত্মার প্রতিফলন ঘটানোর ক্ষমতা রয়েছে, ঠিক যেভাবে আয়নায় ফুলের প্রতিবিম্ব দেখা যায়। কোনও সহজ প্রক্রিয়া ছিল না এটা। কিন্তু একজন সন্ন্যাসী সত্যিকার অর্থে তাঁর প্রকৃত সত্তা মুক্ত, পরম ও চিরন্তন এ বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি অর্জন করতেন। অন্যতম ধ্রুপদী টেক্সটে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকৃতি তখন নিমেষে ‘গুরুর ইচ্ছা পূরণের পর কোনও নৃত্যশিল্পীর বিদায় নেওয়া’র মতো সত্তা হতে বিদায় নেবে।[১০] এই ব্যাপারটি ঘটে যাওয়ার পর সন্ন্যাসী আলোকপ্রাপ্ত হবেন, কারণ তিনি তাঁর প্রকৃত সত্তায় জাগ্রত হয়েছেন। দুঃখ-দুর্দশা তাঁকে আর স্পর্শ করতে পারবে না, কেননা তিনি জানেন তিনি চিরন্তন, পরম। প্রকৃতপক্ষেই নিজেকে তিনি ‘আমি কষ্ট পাচ্ছি’র বদলে ‘ওটা কষ্ট পাচ্ছে,’ উচ্চারণ করতে শুনবেন, কারণ এখন যাকে তাঁর প্রকৃত পরিচয় হিসাবে জানেন যন্ত্রণা তার বহু দূরের অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়েছে। আলোকপ্রাপ্ত সাধু পৃথিবীতে বাস করে চলবেন এবং সম্পাদিত অসৎ কম্মের অবশিষ্টাংশ ভস্মীভূত করবেন, কিন্তু মারা যাবার পর আর পুনর্জন্ম নেবেন না, কেননা তিনি বস্তুগত প্রকৃতি হতে মুক্তি অর্জন করেছেন।[১১]

সমক্ষ্য দর্শন গৌতমের চোখে উপযোগি ঠেকেছে। আপন ধৰ্ম্ম নির্মাণের সময় এই দর্শনের কিছু উপাদান অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন তিনি। গৌতমের মতো একজনের কাছে স্পষ্টতই আকর্ষণীয় আদর্শ ছিল এটা, অতি সম্প্রতি জগতের মোহমুক্ত ঘটেছিল তাঁর, সর্বত্র পবিত্রতার সন্ধান করারই শিক্ষা দিয়েছিল এই আদর্শ। প্রকৃতি স্রেফ ক্ষণস্থায়ী বিষয়। একে যত নিপীড়ক মনে হোক না কেন, আদৌ চূড়ান্ত বাস্তবতা নয়, যাদের কাছে জগৎ অচেনা জায়গায় পরিণত হয়েছে সমক্ষ্য তাদের কাছে উপশমকারী দর্শন ছিল, কারণ এর শিক্ষা ছিল নৈরাশ্যজনক বাহ্যিক রূপ সত্ত্বেও প্রকৃতি আমাদের বন্ধু। আলোকপ্ৰাপ্তিতে মানুষকে তা সাহায্য করতে পারে। নারী-পুরুষের মতো প্রকৃতির জগতের প্রতিটি প্রাণী সত্তাকে মুক্ত করার তাগিদে চালিত হয়: প্রকৃতি এভাবে সত্তাকে মুক্ত হবার সুযোগ করে দিতে নিজেকে অতিক্রম করে যেতে বদ্ধপরিকর। এমনকি ভোগান্তিরও একটা পরিত্রাণমূলক ভূমিকা আছে, কারণ আমরা যতই কষ্ট ভোগ করি ততই এ জাতীয় কষ্ট হতে মুক্ত অস্তিত্বের কামনা করি। আমরা যতই প্রাকৃতিক জগতের সমস্যা মোকাবিলা করি ততই মুক্তির আকাঙ্ক্ষা করি। আমরা যতই বুঝতে পারি যে, আমাদের জীবন বাহ্যিক শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত আমরা ততই পুরুসার পরম, নিয়ন্ত্রণহীন সত্তার আকাঙ্ক্ষা বোধ করি। কিন্তু আকাঙ্ক্ষাটুকু যত শক্তিশালী হোক না কেন, প্রায়শঃই একজন সাধু বস্তুজগ‍ৎ হতে নিজেকে মুক্ত করা কঠিন আবিষ্কার করেন। মরণশীল মানুষ আবেগের ঝঞ্ছাবিক্ষুব্ধ জীবন ও দেহের উচ্ছৃঙ্খল জীবনের ঊর্ধ্বে উঠে কেবল বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভর করে বাঁচবে?

অচিরেই এই সমস্যার মুখোমুখি হলেন গৌতম। তিনি আবিষ্কার করলেন, সমক্ষ্যের সত্য সাধনা প্রকৃত মুক্তি বয়ে আনেনি। কিন্তু প্রথমে দীর্ঘপথ পেরিয়ে যান তিনি। আলারা কালাম শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করেন তাঁকে এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে অচিরেই তিনি ধম্ম উপলব্ধি করতে পারবেন, গুরুর সমান জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন। এই মতবাদ আপন করে নেবেন। অল্প দিনেই প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো আত্মস্থ করে নিলেন গৌতম। অচিরেই সংঘের অন্যান্য সদস্যের মতোই অনর্গল গুরুর শিক্ষা আবৃত্তি করতে শিখে গেলেন। কিন্তু আশ্বস্ত হতে পারলেন না। কিছু একটা ঘাটতি রয়েছে। আলারা কালাম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এইসব শিক্ষা ‘উপলব্ধি’ করতে পারবেন তিনি, সেগুলোর সম্পর্কে ‘প্রত্যক্ষ জ্ঞান’ অর্জন করবেন। সেসব আর বাহ্যিক সত্য হিসাবে রয়ে যাবে না বরং তার আপন সত্তার সঙ্গে মিশে গিয়ে জীবনের বাস্তবতায় পরিণত হবে। অচিরেই তিনি ধম্মের একজন জ্বলন্ত মূর্ত প্রকাশ হয়ে উঠবেন। কিন্তু তেমন কিছু ঘটছিল না। তিনি আলারা কালামের ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক মতবাদে ‘প্রবেশ করে’ তাতে ‘বসবাস’ করছেন না, শিক্ষা দূরবর্তী রয়ে গেছে। শিক্ষা অধিবিদ্যিক দূরবর্তী বিমূর্ত বিষয় রয়ে গেছে, তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সামান্যই সম্পর্ক আছে মনে হয়েছে। সর্বাত্মক প্রয়াস সত্ত্বেও প্রকৃত সত্তার কোনও আভাস পেলেন না তিনি। প্রকৃতির দুর্ভেদ্য আচ্ছাদনে একগুঁয়ের মতো আড়ালে রয়ে গেছে। এটা খুবই সাধারণ ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা। মানুষ প্রায়শঃই অন্যের সাক্ষ্য মেনে নিয়ে কোনও ঐতিহ্যের সত্যকে বিশ্বাস করে নেয়। কিন্তু দেখে যে, ধর্মের সারৎসার, আলোকময় সত্তা আড়ালে রয়ে গেছে। কিন্তু এই পথে চলার মতো অবকাশ গৌতমের ছিল না। কখনওই কোনও কিছু আপসে মেনে নেননি তিনি। পরে তাঁর নিজস্ব সংঘ গঠনের পর শিষ্যদের লাগাতার যে কোনও রকম জনশ্রুতিকে নির্বিচারে মেনে নিতে নিষেধ করেছেন। তারা যেন গুরুর সমস্ত কথাই বিনা সমালোচনায় মেনে না নেয়। বরং প্রত্যেক ক্ষেত্রে ধম্মকে যাচাই করে, নিজস্ব অভিজ্ঞতায় অনুরণিত হচ্ছে কিনা সেটা নিশ্চিত করে।

তো অনুসন্ধানের এই প্রাথমিক পর্যায়েও আলারা কালামের ধম্মকে বিশ্বাস হিসাবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তিনি। গুরুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কীভাবে এইসব মতবাদ ‘উপলব্ধি’ করতে পেরেছেন তিনিঃ নিশ্চয়ই স্রেফ অন্য কারও কথা মেনে নেননি? আলারা কালাম স্বীকার গেলেন, তিনি তাঁর সমক্ষ্য দর্শনের ‘প্রত্যক্ষ্য জ্ঞান’ কেবল ধ্যানের মাধ্যমে অর্জন করেননি। স্রেফ স্বাভাবিক যৌক্তিক চিন্তাভাবনা দিয়ে এইসব মতবাদের ভেতর প্রবেশ করেননি তিনি। যোগের অনুশীলন করেছেন।[১২]

যোগ সাধনা কবে ভারতে বিকাশ লাভ করেছিল আমরা জানি না।[১৩] আর্য গোত্রগুলো উপমহাদেশে আগ্রাসন চালানোর আগেও এখানে যোগের কোনও কোনও ধরনের অনুশীলন হয়ে থাকতে পারে এমন আলামত আছে। বিসিই দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সময়কার মোহর পাওয়া গেছে যেখানে যোগাসনের মতো ভঙ্গিতে আসীন মানুষের চিত্র রয়েছে। গৌতমের জীবনকালের বেশ পরেই কেবল যোগের উপর লিখিত বিবরণ দেখা যায়। ধ্রুপদী টেক্সট লিখিত হয়েছে সিই দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকে। বিসিই দ্বিতীয় শতাব্দীর অতিন্দ্রীয়বাদী পতঞ্জলির শিক্ষার ভিত্তিতে এসব রচিত। পতঞ্জলির ধ্যান ও মনোসংযোগের পদ্ধতি সমক্ষ্যের দর্শন ভিত্তিক হলেও সমক্ষ্যের বিভক্তির পর্যায়েই তার সূচনা। কোনও অধিবিদ্যিক তত্ত্ব তুলে ধরা নয় বরং সচেতনতার একটা ভিন্ন ধরনের বিকাশই তাঁর লক্ষ্য ছিল, যা সত্যিই আমাদের ইন্দ্রীয়াতীত সত্যে প্রবেশ করাতে পারবে। এখানে মনস্তাত্বিক ও শারীরিক কৌশলের মাধ্যমে স্বাভাবিক চেতনাবোধ অতিক্রম করে যাওয়ার প্রয়োজন, যোগিকে যা অতিন্দ্রীয় ও যুক্তির অতীত অর্ন্তদৃষ্টি দান করবে। আলারা কালামের মতো পতঞ্জলিও জানতেন, আঁচ অনুমান ও ধ্যান সত্তাকে প্রকৃতি থেকে মুক্ত করতে পারে নাঃ সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে যোগিকে এটা অর্জন করতে হয়। বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার সাধারণ পথ ধ্বংস করতে হয় তাকে, স্বাভাবিক চিন্তা-প্রক্রিয়াকে আড়াল করে, আপন জাগতিক (নিম্ন পর্যায়ের) সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে অনীহ, অবাধ্য মনকে বল প্রয়োগ করে এমন একটা স্তরে নিয়ে যেতে হয় যেখানে ভ্রান্তি ও বিভ্রমের স্থান নেই। কিন্তু যোগে অতিপ্রাকৃত বলে কিছু নেই। পতঞ্জলি বিশ্বাস করতেন, যোগি স্রেফ তার মনস্তাত্ত্বিক ও মানসিক শক্তিকে ব্যবহার করছে। পতঞ্জলী বুদ্ধের মৃত্যুর বহু পরে শিক্ষা দিচ্ছিলেন যদিও, কিন্তু এটা স্পষ্ট যে প্রায়শঃ সমক্ষ্যের দর্শনের সঙ্গে সম্পর্কিত যোগানুশীলন গৌতমের জীবদ্দশায় গাঙ্গেয় অঞ্চলে যথেষ্ট প্রচলিত ছিল এবং বনচারী সন্ন্যাসীদের মাঝে জনপ্রিয় ছিল। গৌতমের আলোকপ্রাপ্তিতে যোগ গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে। নিজস্ব ধৰ্ম্ম বিকাশে তিনি তিনি এই ঐতিহ্যবাহী অনুশীলন গ্রহণ করেন। সুতরাং, এই ঐতিহ্যবাহী যোগ পদ্ধতি অনুধাবন করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, যা গৌতম সম্ভবত আলারা কালামের কাছে শিখেছিলেন এবং যা তাঁকে নিব্বানের পথে নিয়ে গিয়েছিল।

‘যোগ’ শব্দটি ক্রিয়াপদ ইউজ: ‘জোয়াল পরানো’ বা ‘একত্রে গ্রন্থিত করা’ হতে নেওয়া।[১৪] এর লক্ষ্য যোগির মনকে তার সত্তার সঙ্গে সংযুক্ত করা ও মনের সকল শক্তি ও প্রণোদনাকে গ্রন্থিত করা যাতে সকল চেতনা এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ হয় যা সাধারণভাবে মানুষের পক্ষে অসম্ভব। আমাদের মন সহজেই বিচ্যুত হয়। কোনও একটা বিষয়ে দীর্ঘ সময় মনোসংযোগ প্রায়ই কঠিন। এমনকি সবচেয়ে অনুপযুক্ত মুহূর্তেও মনের গহনে অনাহুত চিন্তা ও কল্পনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যেন। এইসব অবচেতন প্রণোদনার ওপর আমাদের যেন তেমন কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। মানসিক কর্মকাণ্ডের অনেকটাই স্বয়ংক্রিয়: একটা দৃশ্য আরেকটিকে ডেকে আনে; দীর্ঘ বিস্মৃতি হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে স্পন্দিত হয়। বিরল ক্ষেত্রে আমরা কোনও বস্তু বা ধারণাকে সেটার স্বরূপে বিবেচনা করি, কারণ তা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে সম্পর্কিত হয়ে পড়ে যা তাকে অচিরেই বিকৃত করে। সেটাকে বস্তুগতভাবে বিবেচনা করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব করে তোলে। এইসব মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার কিছু কিছু যন্ত্রণায় পরিপূর্ণ: এগুলো অজ্ঞতা, অহমবোধ, আবেগ, বিতৃষ্ণা ও আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি দিয়ে বৈশিষ্ট্যায়িত হয়, অবচেতন কর্মকাণ্ডে (বাসনা) প্রোথিত বলে এগুলো শক্তিশালী, নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন; কিন্তু আমাদের আচরণে এসবের গভীর প্রভাব রয়েছে। ফ্রয়েড ও জাং আধুনিক সাইকোঅ্যানালিসিস পদ্ধতি গড়ে তোলার বহু আগে ভারতীয় যোগিরা অবচেতন মন আবিষ্কার করে কিছু মাত্রায় তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছিল। সুতরাং যোগ গভীরভাবে অ্যাক্সিয়াল যুগের রীতির সঙ্গে সম্পর্কিত–মানুষকে নিজের সম্পর্কে অধিকতর পূর্ণাঙ্গভাবে সচেতন করে তোলা এবং অস্পষ্টভাবে অনুভূত বিষয়কে প্রকাশ্য আলোয় তুলে আনাই এর প্রয়াস। অনুশীলনকারীর আধ্যাত্মিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করে থাকলে তা এইসব অবাধ্য বাসনাকে শনাক্ত করে পরিত্রাণে সক্ষম করে তোলে। কঠিন ছিল এই প্রক্রিয়া। প্রতিটি ধাপে যোগির একজন গুরুর সযত্ন তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন হতো, ঠিক আধুনিক অ্যানালিস্যান্ডের যেমন একজন অ্যানালিস্টের সহায়তার প্রয়োজন হয়। অবচেতন মনের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করার জন্যে যোগিকে স্বাভাবিক জগতের সঙ্গে সাধারণ সম্পর্ক ছিন্ন করতে হতো। প্রথমত, যে কোনও সন্ন্যাসীর মতোই সমাজ পেছনে ফেলে ‘পথে নামতে’ হতো তাকে। তারপর কঠোর নিয়ম পালনের প্রয়োজন হতো, যা তাকে ধাপে ধাপে সাধারণ আবরণ ও মনের স্বভাবের বাইরে নিয়ে যেত। পুরোনো সত্তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে সে প্রকৃত সত্তাকে–সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সত্তা-জাগিয়ে তুলবে বলে আশা করা হতো।

কোনও কোনও পশ্চিমার কাছে এসব যারপরনাই অদ্ভুত ঠেকতে পারে, যোগ সম্পর্কে যাদের সম্পূর্ণ ভিন্নরকম অভিজ্ঞতা রয়েছে। অ্যাক্সিয়াল যুগের সাধু ও পয়গম্বরগণ ক্রমশঃ উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলেন যে, অহমবাদ তাঁরা যে পরম ও পবিত্র সত্তার সন্ধান করছেন তাঁর দেখা পাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। ঈশ্বর, ব্রাহ্মণ বা নিব্বানের সত্তাকে বুঝতে হলে নারী বা পুরুষকে আমাদের মানবীয় অবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত মনে হওয়া স্বার্থপরতাকে বিসর্জন দিতে হবে। চীনা দার্শনিকগণ শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, মানুষ আলোকপ্রাপ্ত হতে চাইলে তাকে অবশ্যই তার আকাঙ্ক্ষা ও আচরণকে জীবনের অত্যাবশ্যকীয় ছন্দে সমর্পণ করতে হবে। হিব্রু পয়গম্বরগণ ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের কথা বলেছেন। পরবর্তীকালে জেসাস তাঁর শিষ্যদের জানাবেন যে, আধ্যাত্মিক সন্ধান সত্তায় মৃত্যুবরণ দাবি করে: একটি গমের বীজকে তার পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন ও ফল ধারণ করার জন্যে আগে মাটিতে ঝরে পড়ে মৃত্যুবরণ করতে হবে। মুহাম্মদ (স) ইসলামের গুরুত্ব প্রচার করবেন: ঈশ্বরের কাছে সমগ্র সত্তার আত্মসমর্পণ। আমরা যেমন দেখব, স্বার্থপরতা ও অহমবাদের বিসর্জন গৌতমের নিজস্ব ধৰ্ম্মের মুলকথা হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু ভারতীয় যোগিরা ইতিমধ্যেই এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিল। যোগকে জগৎ সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিকৃতকারী ও আমাদের আধ্যাত্মিক অগ্রগতিতে বাধা দানকারী অহমবাদের সুশৃঙ্খল ধ্বংস হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। বর্তমানে আমেরিকা ও ইউরোপে যারা যোগ চর্চা করেন তারা সব সময় এই উদ্দেশ্য অনুসরণ করেন না। তারা প্রায়শঃ স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানোর লক্ষ্যে যোগের অনুশীলনকে কাজে লাগান। দেখা গেছে, মনোসংযোগের এইসব অনুশীলন মানুষকে অতিরিক্ত উদ্বেগ দমন বা দূর করতে সাহায্য করে। অনেক সময় ক্যান্সার রোগিরা আধ্যাত্মিক ভাবাবেশ অর্জনের জন্যে যোগিদের ব্যবহৃত মনোছবি কৌশল কাজে লাগান; আক্রান্ত কোষকে কল্পনা করার প্রয়াস পান তারা, রোগের বিস্তারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অবচেতন শক্তিসমূহ জাগিয়ে তুলতে চান। সঠিকভাবে চর্চা করলে যোগ অনুশীলন নিঃসন্দেহে আমাদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রশান্তি বাড়িয়ে তুলতে পারে। কিন্তু আদি যোগিগণ ভালো বোধ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করার লক্ষ্যে এই পথের যাত্রী হয়নি। তারা স্বাভাবিকতা ধ্বংস করে জাগতিক সত্তা মুছে ফেলতে চেয়েছে।

গৌতমের মতো গাঙ্গেয় সমতলের বহু সন্ন্যাসী বুঝতে পেরেছিলেন, যৌক্তিক অসংলগ্ন উপায়ে ধম্মের অনুধাবন দিয়ে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি অর্জন করতে পারবেন না তাঁরা। চিন্তার যৌক্তিক ধরন মনের ছোট্ট একটি অংশকে কাজে লাগায়। আধ্যাত্মিক বিষয়েই কেবল চালিত করার প্রয়াস পেলে দেখা গেছে নিজেরই তার বিশৃঙ্খল জীবন রয়েছে। তারা দেখেছেন, মনোসংযোগের জন্যে যত জোরাল প্রয়াসই পান না কেন, অবিরাম অগুনতি বিক্ষিপ্ততা ও চেতনায় আক্রমণ চালানো অসহযোগি সম্পর্কের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন তারা। কোনও ধম্মের শিক্ষাসমূহ প্রয়োগ শুরু করার পর নিজেদের মধ্যেই সব ধরনের নিয়ন্ত্রণাতীত মনে হওয়া প্রতিবন্ধকতা আবিষ্কার করেছেন তাঁরা। ইচ্ছাশক্তি যত জোরালই হোক না কেন, সত্তার কোনও গোপন অংশ নিষিদ্ধ বস্তুর আকাঙ্ক্ষা করে যায়। মনের মাঝে যেন সুপ্ত প্রবণতা রয়েছে যা আলোকনের বিরুদ্ধে বিকৃতরূপে সংঘাতে লিপ্ত হয়। যে শক্তিকে বৌদ্ধ টেক্টটসমূহ মারার পবিত্র ব্যক্তি রূপ দিয়েছে। অনেক সময় এইসব অবচেতন-প্রবণতা সন্ন্যাসীরা যুক্তির বয়সে পৌঁছার আগেই তাঁদের মাঝে রোপিত বা তাঁদের বংশগতির উত্তরাধিকারের অতীত অবস্থার ফলাফল। গাঙ্গেয় সন্ন্যাসীগণ অবশ্যই জিন সম্পর্কে কিছু বলেননি। তাঁরা ওই বাধার জন্যে বিগত জন্মের অসৎ কৰ্ম্মকে দায়ী করেছেন। কিন্তু কীভাবে তাঁরা তাঁদের বিশ্বাস অনুযায়ী মানসিক আলোড়নের অতীত চরম সত্তায় পৌঁছাতে এই অবস্থাকে পেরিয়ে যেতে পারবেন? কেমন করে উন্মত্ত প্রকৃতি থেকে সত্তাকে উদ্ধার করবেন?

বর্তমানে পশ্চিমে যে মুক্তির সন্ধান করা হয় তার চেয়ে অনেক মৌলিক, সাধারণত নিজেদের সীমাবদ্ধতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বোঝায় সন্ন্যাসীরা এমন স্বাভাবিক চেতনার পক্ষে অসম্ভব এক মুক্তির সন্ধান করেছেন। ভারতের সাধুরা মানবীয় ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণকারী শর্তাবলী হতে মুক্তি পেতে চেয়েছেন। আমাদের উপলব্ধিকে সীমিতকারী সময় ও স্থানের বাধাকে বাতিল করতে চেয়েছেন। তাঁদের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি সম্ভবত সেইন্ট পল পরে যাকে “ঈশ্বর পুত্রদের মুক্তি’[১৫] বলে উল্লেখ করবেন তার কাছাকাছি। কিন্তু তাঁরা সেটা স্বর্গীয় জগতে প্রত্যক্ষ করার জন্যে আলাদা করতে রাজি ছিলেন না। নিজস্ব প্রয়াসে বর্তমানেই তাঁরা সেটা অর্জন করবেন। আলোকনের পথে অবচেতনবাদ অপসারণ ও মানবীয় ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার লক্ষ্যে যোগ সাধনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। যোগিদের বিশ্বাস ছিল, একবার সেটা করা গেলে শেষপর্যন্ত তারা তাদের অনিয়ন্ত্রিত, চিরন্তন এবং পরম প্রকৃত সত্তার সঙ্গে একীভূত হয়ে যাবে।

সুতরাং সত্তাই ছিল অস্তিত্বের পবিত্র মাত্রার মূল প্রতীক, একেশ্বরবাদের ঈশ্বর, হিন্দুধর্মমতের ব্রাহ্মণ/আত্মা ও প্লেটোর দর্শনের শুভের মতো একই ভূমিকা পালন করেছে। গৌতম আলারা কালামের ধম্মে ‘বাস’ করার প্রয়াস পাওয়ার সময় এমন এক শান্তি আর সমগ্রতায় প্রবেশ ও বাস করতে চেয়েছিলেন যা জেনেসিস অনুযায়ী আদি মানব স্বর্গোদ্যানে প্রত্যক্ষ করেছিল। এই স্বর্গীয় শান্তি, এই শালোম, এই নিব্বানা ধারণাগতভাবে লাভ করাই যথেষ্ট ছিল না। তিনি সেই ‘প্রত্যক্ষ জ্ঞান’ চেয়েছিলেন যা তাঁকে আমাদের বসবাসের, শ্বাস-প্রশ্বাসের ভৌত পরিবেশের মতো আবৃত করে ফেলবে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, তিনি তাঁর মনের গভীরে এই দুর্ভেয় ছন্দের অনুভূতি লাভ করবেন। তাকে পুরোপুরি পাল্টে দেবে সেটা: এক নতুন সত্তা অর্জন করবেন তিনি যা আর রক্ত মাংসের উত্তরাধিকার সেই যন্ত্রণার শিকারে পরিণত হবে না। সকল অ্যাক্সিয়াল দেশে মানুষ আধ্যাত্মিকতার অধিকতর অন্তস্থ ধরনের সন্ধান করছিল। কিন্তু খুব সামান্য সংখ্যকই যোগিদের মতো পূর্ণাঙ্গভাবে তা করতে পেরেছে। অ্যাক্সিয়াল যুগের অন্যতম দর্শন ছিল, পবিত্র ‘মহাশূন্যে’ অবস্থিত এমন কিছু নয়: এটা পৃথিবীতে প্রতিটি ব্যক্তির সত্তায় উপস্থিত এবং সর্বব্যাপী। ব্রাহ্মণ ও আত্মার পরিচয়ের উপনিষদের ভাষ্যে ধ্রুপদী ঢঙে প্রকাশিত একটি ধারণা। কিন্তু সত্তা আমাদের নিজস্ব সত্তার মতোই কাছাকাছি হলেও তা আবিষ্কার কঠিন বলেই প্রমাণিত হয়েছে। স্বর্গোদ্যানের দুয়ার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অতীতকালে পবিত্রতা মানুষের পক্ষে সুলভ চিন্তা করা হতো। প্রাচীন ধর্মগুলো বিশ্বাস করত, উপাস্য মানব-সন্তান এবং সকল প্রাকৃতিক ঘটনাবলী একই স্বর্গীয় উপাদানে গঠিত: মানুষ ও দেবতাদের মাঝে কোনও অস্তিত্বমূলক দূরত্ব ছিল না। কিন্তু অ্যাক্সিয়াল যুগের সূচনাকারী বিপর্যয়ের অংশ ছিল এই যে, পবিত্র বা স্বর্গীয় এই মাত্রাটি কোনওভাবে জগৎ হতে সরে গিয়ে এক অর্থে নারী-পুরুষের কাছে অচেনা হয়ে গিয়েছিল।

উদাহরণ স্বরূপ, হিব্রু বাইবেলের আদি টেক্সটে আমরা পড়ি যে, একজন সাধারণ পর্যটকের বেশে হাজির হওয়া ঈশ্বরের সঙ্গে আব্রাহাম একবার ভোজন পর্ব সেরেছিলেন।[১৬] মন্দিরে ঈশ্বরের দর্শন পাওয়ার পর মৃত্যু ভয়ে ভরে উঠেছিল ইসয়াহর মন।[১৭] জেরেমিয়াহ্ ঐশ্বরিকতাকে তাঁর হাত পা অবশ করে দেওয়া, হৃদয় মোচড়ানো ও মাতালের মতো বেসামাল করে দেওয়া যন্ত্রণা হিসাবে জানতেন।[১৮] সম্ভবত গৌতমের সমসাময়িক হয়ে থাকবেন ইযেকিয়েল, তাঁর গোটা জীবন একদিকে বর্তমানে পবিত্র এবং অন্যদিকে সচেতন, আত্ম- রক্ষাকারী সত্তার মাঝে বিরাজ করা মারাত্মক বিচ্যুতি তুলে ধরে। পয়গম্বরকে ঈশ্বর এমন উদ্বেগে আক্রান্ত করেছেন, তিনি কাঁপুনি থামাতে পারছেন নাঃ স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ঈশ্বর তাঁকে শোক প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন: তাঁকে পশুর বিষ্ঠা খেতে বাধ্য করেছেন তিনি; বাধ্য করেছেন শরণার্থীর মতো ঠাসা ব্যাগ নিয়ে শহরময় ঘুরে বেড়াতে।[১৯] অনেক সময় স্বর্গীয় সত্তায় প্রবেশের জন্যে একজন সভ্য মানুষের স্বাভাবিক সাড়াকে অস্বীকার ও পার্থিব সত্তার বিরুদ্ধে সহিংস আচরণ প্রয়োজনীয় মনে হয়। আদি যোগিরাও তাদের অন্তরে বিরাজিত বলে বিশ্বাস করা অনিয়মিত ও চরম সত্তার উপলব্ধি করার লক্ষ্যে সাধারণ চৈতন্যে একই ধরনের আক্রমণের প্রয়াস পাচ্ছিল।

যোগিরা বিশ্বাস করত, কেবল তাদের স্বাভাবিক চিন্তন প্রক্রিয়া ধ্বংস, চিন্তা ও অনুভূতি নির্বাপিত করে আলোকনের বিরুদ্ধে যুদ্ধমান অবচেতন বাসনা মুছে ফেলতে পারলেই সত্তাকে মুক্ত করা যাবে। তারা প্রচলিত মানসিক অভ্যাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। অন্তস্থ আত্মার প্রতিটি পর্যায়ে যোগি স্বাভাবিকের উল্টো কাজ করত। সাধারণ সাড়াকে নাকচ করার জন্যেই নির্মাণ করা হয়েছিল প্রতিটি যোগ অনুশীল। যে কোনও ভাববাদীর মতো যোগি সমাজ হতে ‘বেরিয়ে গিয়ে’ আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু করত, কিন্তু তারপর আরেক ধাপ বেশি অগ্রসর হতো। কোনও গৃহস্থের মতো একই মানসিকতাও বহন করবে না সে: খোদ মনুষ্য সমাজ হতেই ‘বেরিয়ে যাচ্ছে’ সে। অশ্লীল জগতে পরিপূর্ণতার সন্ধান করার বদলে যাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপে ভারতীয় যোগিরা এখানে বাস করতে অস্বীকৃতি জানাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল।

আলারা কালাম সম্ভবত ক্রমান্বয়ে গৌতমকে এই যোগ অনুশীলনগুলো দীক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু ধ্যান শুরু করার আগেই প্রথমে গৌতমকে নৈতিকতার শক্ত ভিত্তি স্থাপন করতে হয়েছিল যা তাঁকে মূল উপাদানে নামিয়ে এনে নৈতিক শৃঙ্খলা ও অহমবাদকে নিয়ন্ত্রণ করবে। যোগ অনুশীলনকারীকে এমন মনোসংযোগ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয় যা স্বার্থপরতার লক্ষ্যে ব্যবহার করলে দানবীয় হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং শিক্ষার্থীকে তাঁর অবাধ্য সত্তা (নিম্ন পর্যায়ের) শক্ত নিয়ন্ত্রণে আছে নিশ্চিত করার জন্যে চারটি ‘নিষেধাজ্ঞা’ (ইয়ামা) পালন করতে হতো। ইয়ামা শিক্ষার্থীর উপর চুরি, মিথ্যাচার, মাদক গ্রহণ, হত্যা বা অন্যান্য প্রাণীর ক্ষতি সাধন বা যৌনাচারে অংশ গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করত। এইসব নিয়ম জৈনদের সাধারণ শিষ্যদের জন্যে নির্ধারিত নিয়মের অনুরূপ। বেশির ভাগ গাঙ্গেয় ভাববাদীদের ক্ষেত্রে যা সাধারণ বিষয় পরম মানসিক ও দৈহিক স্পষ্টতা অর্জনের জন্যে আকাঙ্ক্ষা প্রতিহত করার প্রতিজ্ঞা ও অহিংসার নীতির প্রতিফলন দেখায়। এইসব ইয়ামা দ্বিতীয় প্রকৃতিতে পরিণত না হলে গৌতমকে আরও অগ্রসর যোগ অনুশীলনের অনুমতি দেওয়া হতো না।[২০] নির্দিষ্ট কিছু নিয়মও (দৈহিক ও মানসিক অনুশীলন) অনুসরণ করতে হয়েছে তাঁকে, যার ভেতর বিবেকের পরিচ্ছন্নতা, ধম্ম পাঠ ও এক ধরনের স্বাভাবিক প্রশান্তি অর্জন অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই সঙ্গে কৃচ্ছ্রতার অনুশীলনও (তপস) ছিল: শিক্ষাব্রতাঁকে বিনা অভিযোগে চরম শীত ও প্রচণ্ড গরমে, ক্ষুধা এবং পিপাসার মোকাবিলা করতে হতো। কথা ও ভাবভঙ্গিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হতো যাতে মনের ভাবনা কখনও প্রকাশিত হতে না পারে। সহজ প্রক্রিয়া ছিল না এটা। কিন্তু ইয়ামা ও নিয়ামায় দক্ষতা অর্জন করার পর গৌতম সম্ভবত ‘বর্ণনাতীত সুখ’ অনুভব করতে শুরু করেছিলেন যা কিনা ধ্রুপদী যোগ আমাদের জানাচ্ছে, এই আত্ম নিয়ন্ত্রণ, সংযম ও অহিংসার ফল।[২১]

এরপর গৌতম আসল যোগ অনুশীলনের প্রথমটি অনুসরণে প্রস্তুত হয়েছিলেন: আসন, যোগের বৈশিষ্ট্য শারীরিক ভঙ্গি।[২২] এই পদ্ধতির প্রতিটিতে মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা অস্বীকারের ব্যাপার রয়েছে। যোগির জগতকে অস্বীকার করার প্রথামিক নীতি তুলে ধরে। নড়াচড়া করতে অস্বীকৃতি জানানোর মাধ্যমে মন ও ইন্দ্রিয়ের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে শেখেন। পায়ের ওপর পা তুলে ঋজু ভঙ্গিতে নিশ্চল বসে থাকতে হতো তাঁকে। এতে তিনি হয়তো উপলব্ধি করে থাকবেন যে, স্বাধীন অবস্থায় আমাদের দেহ অবিরাম চলার ওপর থাকে: আমরা চোখ, পিঠ, কাঁধ চুলকাই, আড়মোড়া ভাঙ্গি, এক নিতম্ব হতে অন্য নিতম্বে ভর বদল করি, বিভিন্ন প্রণোদনায় সাড়া দিয়ে মাথা ঘোরাই। এমনকি ঘুমের ভেতরও আমরা আসলে স্থির থাকি না। কিন্তু আসনে যোগি এমন নিশ্চল থাকে যে তাকে মানুষের চেয়ে বরং কোনও মূর্তি বা গাছের মতো মনে হয়। অবশ্য একবার দক্ষতা অর্জন করার পর অস্বাভাবিক নিশ্চলতা অন্তস্থ প্রশান্তি প্রতিফলিত করে যা সে অর্জনের প্রয়াস পাচ্ছে।

এরপর শ্বাস-প্রশ্বাসে অস্বীকৃতি জানায় যোগি। শ্বাস-প্রশ্বাস সম্ভবত আমাদের শারীরিক কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে মৌলিক, স্বয়ংক্রিয় এবং সহজাত অংশ, প্রাণ ধারণের জন্যে অনিবার্য। আমরা সাধারণত শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে ভাবি না। কিন্তু গৌতমকে এবার প্রাণায়ামের কৌশলে দক্ষতা অর্জন করতে হয়েছিল হয়তো-ক্রমাগত ধীর হতে ধীরে শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ।[২৩] চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল ক্রমাগত শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগের মাঝখানে যত দীর্ঘ সময় সম্ভব বিরতি দেওয়া যাতে শ্বাসপ্রশ্বাস একেবারে থেমে গেছে বলে মনে হয়। প্রাণায়াম নৈমিত্তিক জীবনের ছন্দোহীন শ্বাসপ্রশ্বাস হতে খুবই আলাদা। আমরা ঘুমের সময় যেভাবে শ্বাস- প্রশ্বাস ফেলি অনেকটা বরং সেই রকম, যখন স্বপ্ন ও সম্মোহিত অবস্থায় ইমেজারির সময়ে অবচেতন অনেক সুগম হয়ে ওঠে। শ্বাস-প্ৰশ্বাস গ্রহণে অস্বীকৃতি যোগির জগতকে অস্বীকার করাই দেখায় নাঃ শুরু থেকেই তার মানসিক অবস্থায় প্রাণায়ামের গভীর প্রভাব দেখা গেছে। প্রাথমিক অবস্থায় শিক্ষাব্রতী দেখত যে এটা এমন এক অনুভূতির জন্ম দেয় যা নিজের বাজানো বাজনার প্রভাবের সঙ্গে তুলনীয়: এক বিশালতার অনুভূতি পাওয়া যায়, বিশালত্ব ও শান্ত আভিজাত্য। যেন নিজের হাতে নিজ দেহের অধিকার নিচ্ছে কেউ।[২৪]

এইসব শারীরিক অনুশীলন আয়ত্ত করার পর একাগ্রতার পরবর্তী অনুশীলনের জন্যে প্রস্তুত হয়েছিলেন গৌতম। শিক্ষাব্রতী অন্য যে কোনও আবেগ বা সম্পর্ক বাদ দেওয়ার জন্যে কোনও ‘একটি বস্তু বা ধারণা’[২৫]র ওপর মনোসংযোগের শিক্ষা গ্রহণ করে, এবং মনে ভীড় জমানো বিচ্যুতির কোনওটাকেই স্থান দিতে অস্বীকৃতি জানায়।  

ক্রমে নিজেকে স্বাভাবিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন গৌতম, চেষ্টা করছিলেন চিরন্তন সত্তার স্বাধীনতায় পৌঁছানোর। প্রত্যাহার (অনুভূতির প্রত্যাহার), যখন তাঁর অনুভূতিগুলো নিষ্ক্রিয় থাকে, কেবল বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কোনও বস্তুকে চিন্তা করার ক্ষমতা, শিখেছেন তিনি।[২৬] ধরণায় (মনোসংযোগ) তাঁকে আপন সত্তার জমিনে প্রকৃত সত্তাকে ফুটিয়ে তোলা শেখানো হয়েছে, অনেকটা পকুরে ভাসমান পদ্মফুল বা অন্তস্থ আলোর মতো। ধ্যানের সময় শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ রেখে শিক্ষাব্রতী আপন সচেতনতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠার আশা করত, যেখানে মনে করা হয়েছে সে নিজের বুদ্ধিমত্তাকে ভেদ করে চিরন্তন আত্মার (পুরুসা) প্রতিফলন দেখতে পাবে।[২৭] প্রতিটি ধরণার মেয়াদ বারটি প্রাণায়াম- এর সমান হওয়ার কথা। বারটি ধরণা শেষে যোগি এমন গভীরভাবে নিজের মাঝে ডুবে যেত যে, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই একটা ‘ঘোর’ (ধ্যান: পালি ভাষায় ঝানা) অর্জন করত।[২৮]

টেক্সট জোর দিয়ে বলছে, এসবই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমাদের চিন্তাভাবনার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটা মাদক প্রভাবিত অবস্থার মতোও নয়। কোনও দক্ষ যোগি এইসব অনুশীলনে নৈপূণ্য লাভ করার পর সাধারণত এক নতুন ধরনের প্রতিরক্ষা অর্জন করেছে বলে আবিষ্কার করত। অন্তত ধ্যানের সময়ের জন্যে হলেও। সে আর আবহাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী নয়। চৈতন্যের অস্থির ধারা নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে ও সত্তার মতোই পরিবেশের টেনশন ও পরিবর্তনের ব্যাপারে অভেদ্য হয়ে উঠেছে। এভাবে যে মানসিক ইমেজ বা বস্তুর ধ্যান করছিল তাতে বিলীন হয়ে গেছে বলে আবিষ্কার করত সে। কারণ সে স্মৃতিকে চাপা দিয়েছে, সাধারণত কোনও বস্তু যে বিশৃঙ্খল ব্যক্তিগত ইমেজ সৃষ্টি করে তার প্লাবনকে ঠেকিয়েছে; এখন আর নিজের গরজে এ থেকে বিচ্যুত নয় সে, একে সে বস্তুগতভাবে দেখছে না, বরং ‘যেমন ঠিক সেভাবেই’ দেখতে যাচ্ছে। যোগিদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বাকধারা। তার চিন্তার জগৎ হতে ‘আমি’ মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। এখন আর আপন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে বস্তুকে দেখা হচ্ছে না। ফলে এমনকি একেবারে নিরস বস্তুও সম্পূর্ণ নতুন গুণাগুণ প্রকাশ করছে। কোনও কোনও শিক্ষাব্রতী এই পর্যায়ে প্রকৃতির পর্দা ভেদ করে পুরুসার ঝলক দেখার কথা কল্পনা করে থাকতে পারে।

এইসব কৌশল প্রয়োগ করে যোগি ধম্মের মতবাদের উপর ধ্যান করার সময় সেগুলো সম্পর্কে এমন স্পষ্ট অনুভূতি হয় যে এইসব সত্যের একটা যৌগিক গঠন তুলনায় ম্লান হয়ে যায়। আলারা কালাম একেই ‘প্রত্যক্ষ জ্ঞান’ বুঝিয়েছেন। যেহেতু স্বাভাবিক চেতনার বিভ্রম ও অহমবাদ আর যোগি ও ধম্মের মাঝখানে আসতে পারছে নাঃ বিকৃতকারী পর্দা বা বিষয়ানুগ সম্পর্কহীন নতুন স্পষ্টতার সঙ্গে ‘দেখছে’ সে একে। এইসব অভিজ্ঞতা বিভ্রম নয়। প্রাণায়াম অনুশীলনের ফলে সৃষ্ট মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনসমূহ যোগিকে তার মানসিক প্রক্রিয়াকে পরিচালিত করার, এমনকি চেতনায় পরিবর্তন নিয়ে আসা অবচেতন প্রণোদনাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে শিখিয়েছে। দক্ষ যোগি এখন সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব মানসিক কেরামতি দেখাতে পারবে। নির্দিষ্ট উপায়ে প্রশিক্ষিত হলে মন কীভাবে কাজ করে জানা হয়ে যায় তার। তখন দক্ষতার কল্যাণে নতুন নতুন গুণ আলোর দেখা পায়, ঠিক কোনও নৃত্য শিল্পী বা অ্যাথলেট যেভাবে মানবদেহের পূর্ণ দক্ষতার প্রদর্শন করে। আধুনিক গবেষকরা লক্ষ করেছেন, ধ্যানের সময় যোগির হৃৎপিণ্ডের গতি ধীর হয়ে আসে, মস্তিষ্কের ছন্দ ভিন্ন ধারায় বাঁক নেয়। স্নায়বিক দিক দিয়ে পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সে ও ধ্যানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তীব্রভাবে স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে।[২৯]

যোগি ভাবের ঘোরে (ঝানা) প্রবেশ করার পর ধারাবাহিকভাবে কিছু গভীর মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যায় সে, যার সঙ্গে সাধারণ অভিজ্ঞতার তেমন সম্পর্ক নেই। ঝানার প্রথম পর্যায়ে আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কে একেবারে নির্বিকার হয়ে আনন্দ ও খুশির দারুণ অনুভূতি বোধ করে সে: যা কোনও যোগির পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব। এটাই তার চূড়ান্ত মুক্তির সূচনা। তখনও বিক্ষিপ্ত চিন্তা থাকে তার, পলাতক ভাবনা খেলে যায় মনে। কিন্তু সে আবিষ্কার করেছে, এই ঘোরের সময় আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ ও যন্ত্রণার নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল সে। মুগ্ধ মনোসংযোগের সঙ্গে যার ধ্যান করছে সেই বস্তু, প্রতীক বা মতবাদের দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঝানায় যোগি এসব সত্যিকে এমনভাবে মিশে যায় যার ফলে তার চিন্তা পুরোপুর থেমে যায়। খানিক আগের নিখুঁত সুখের ব্যাপারেও আর সচেতনতা থাকে না। চতুর্থ ও চূড়ান্ত ঝানায় সে ধম্মের প্রতীক সমূহের সঙ্গে এমনভাবে মিশে যায় যেন ওগুলোর অংশ হয়ে গেছে সে। অন্য কিছু সম্পর্কে আর কোনও বোধ থাকে না। এইসব অবস্থার ভেতর অলৌকিক কোনও ব্যাপার নেই। যোগির জানা থাকে এসব সে নিজেই সৃষ্টি করেছে; তবে এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, আসলেই পৃথিবী ছেড়ে অভীষ্টের দিকে এগিয়ে যাবার কথা কল্পনা করেছে সে। সত্যিই নিপুণ হলে ঝানাকে অতিক্রম করে চারটি আয়তনের ধারায় প্রবেশ করতে পারে সে। এগুলো এতই প্রবল, আদি যোগিদের ধারণা ছিল যে তারা দেবতাদের বাসস্থানের এলাকায় প্রবেশ করেছে।[৩০] যোগি ক্রমাগতভাবে চারটি মানসিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করে যেগুলো তাকে সত্তার এক নতুন রূপের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বলে মনে হয়: অসীমের বোধ, কেবল নিজ সম্পর্কে সচেতন এক খাঁটি চেতনাবোধ; বিপরীতভাবে পরিপূর্ণতায় ভরা অনুপস্থিতির একটা ধারণা। কেবল প্রতিভাবান যোগিরাই এই তৃতীয় আয়তনে পৌঁছতে পেরেছে। যাকে ‘কিছু না’ বলে, কারণ এর সঙ্গে জাগতিক অভিজ্ঞতার কোনও মিল নেই। এটা আরেকটা সত্তা নয়। একে বর্ণনা করার মতো পর্যাপ্ত শব্দ বা ধারণা নেই। সুতরাং একে ‘একটা কিছু’ বলার চেয়ে ‘কিছু না’ বলাই বেশি সঠিক। কেউ কেউ একে কোনও ঘরে প্রবেশ করে কিছু না পাওয়ার মতো বর্ণনা করেছেন: এক ধরনের শূন্যতা, স্থান ও মুক্তির অনুভূতি রয়েছে সেখানে।

একেশ্বরবাদীরা ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে একই ধরনের মন্তব্য করেছে। ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকদের সবাই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে মানবীয় চেতনায় সর্বোচ্চ স্বর্গীয় উৎসারণকে ‘কিছু না’ বলেছেন। তাঁরা এও বলেছেন যে ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই’ বলাই ভালো, কারণ ঈশ্বর স্রেফ আরেকটা ঘটনা নন। দুর্ভেয় বা পবিত্রতার মুখোমুখি হলে ভাষা অসম্ভব সমস্যার মুখে হোঁচট খায় এবং এর ‘অন্যতা’র ওপর জোর দিতে অতিন্দ্রীয়বাদীরা সহজাতভাবে এই ধরনের ঋণাত্মক পরিভাষা বেছে নিয়েছে।[৩১] বোধগম্যভাবেই এইসব আয়তনে পৌঁছাতে সক্ষম যোগিরা অবশেষে তাদের সত্তার কেন্দ্ৰে বাসকারী অসীম সত্তার অভিজ্ঞতা লাভের কল্পনা করেছে। আলারা কালাম ‘কিছু না’র পর্যায়ে উন্নীত হওয়া তাঁর সময়ের অন্যতম যোগি ছিলেন। তাঁর দাবি, তিনি তাঁর অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য সত্তায় ‘প্রবেশ করেছেন’। গৌতম ছিলেন অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান শিষ্য। সাধারণত যোগের জন্যে দীর্ঘ শিক্ষানবীশকালের প্রয়োজন হতো। জীবনব্যাপীও হতে পারত সেটা। কিন্তু খুবই অল্প সময়ে গৌতম তাঁর গুরুকে ‘কিছু না’র পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার কথা বলতে পেরেছিলেন। দারুণ খুশি হয়েছিলেন আলারা কালাম। সংঘের নেতৃত্ব দানে গৌতমকে অংশীদার হবার আমন্ত্রণ জানালেন তিনি। কিন্তু প্রত্যাখ্যান করলেন গৌতম। আলারা কালামের গোত্রও ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।

যোগ পদ্ধতি নিয়ে গৌতমের কোনও সমস্যা ছিল না। বাকী জীবন একে কাজে লাগাবেন তিনি। কিন্তু ধ্যানের অভিজ্ঞতার গুরুর দেওয়া ব্যাখ্যা তিনি মেনে নিতে পারেননি। এখানেই তিনি তাঁর সমগ্র ধর্মীয় জীবনকে বৈশিষ্ট্যায়িত করে তোলা অধিদবিদ্যিক মতবাদ সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কীভাবে ‘কিছু না’র পর্যায় অনিয়ন্ত্রিত ও অসৃষ্ট সত্তা হতে পারে যেখানে তিনি বেশ ভালো করেই জানেন যে এই অভিজ্ঞতা তাঁর নিজেরই সৃষ্টি? এই ‘কিছু না’ পরম হতে পারে না, কারণ তিনি নিজস্ব যোগ দক্ষতার সাহায্যে একে সৃষ্টি করেছেন। গৌতম ছিলেন নিষ্ঠুর রকম সৎ। তথ্য দিয়ে নিশ্চিত নয় এমন কোনও ব্যাখ্যায় নিজেকে প্রতারিত হতে দেবেন না তিনি। তাঁর অর্জিত চেতনার উন্নত অবস্থা নিব্বানা হতে পারে না, কারণ ঘোর হতে বেরিয়ে আসার পরও তীব্র আবেগ, আকাঙ্ক্ষা ও প্রলোভনের অধীনে রয়ে গেছেন তিনি, তাঁর অনঅনুপ্রাণিত লোভী সত্তাকেই বহন করে চলেছেন। অভিজ্ঞতার কারণে স্থায়ীভাবে বদলে যাননি। চিরস্থায়ী শান্তিও অর্জন করেননি। নিব্বানা অস্থায়ী হতে পারে না! নিব্বানা যেহেতু চিরন্তন, সুতরাং এটা শর্তের বিপরীত।[৩২] আমাদের সাধারণ জীবনের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতি দুঃখের অন্যতম প্রধান কারণ, যন্ত্রণার অন্তহীন উৎস।

কিন্তু গৌতম যোগ অভিজ্ঞতার এই পাঠ নিয়ে শেষ চেষ্টা করতে প্রস্তুত ছিলেন। ‘কিছু না’র জমিন সর্বোচ্চ আয়তন নয়। ‘উপলব্ধি বা অনউপলব্ধি কোনওটাই নয়’, এমন একটি চতুর্থ মাত্রা রয়েছে। এমন হতে পারে, এই অতি পরিমার্জিত অবস্থা সত্তার দিকে অগ্রসর করে। তিনি জানতে পারেন উদ্দক রাজপুত্ত নামে এক যোগি এই সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর বিরল ভাগ্য লাভ করেছেন। উদ্দক তাঁকে এই সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছতে সাহায্য করতে পারবেন আশা করে তাঁর সংঘে যোগ দিতে যান। ফের সফল হন তিনি। কিন্তু আবার নিজের মাঝে ফিরে এসে গৌতম দেখতে পান তারপরেও আকাঙ্ক্ষা, ভয় ও ভোগান্তির শিকার রয়ে গেছেন তিনি। চূড়ান্ত যোগ জমিনে পৌঁছে তিনি সত্তার দেখা পেয়েছেন, উদ্দকের এই ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারেননি তিনি।[৩৩] এমনকি হতে পারে যে, এইসব অতিন্দ্রীয়বাদীরা যাকে চিরন্তন সত্তা বলেছেন, সেটা স্রেফ আরেকটা বিভ্রম? এইসব অনুশীলন যোগিকে কেবল ভোগান্তি হতে সাময়িক নিষ্কৃতিই দিতে পারে। সমক্ষ্য যোগ-এর অধিবিদ্যিক মতবাদ তাঁকে ব্যর্থ করেছিল, কারণ তা কোনও প্রতিভাবান যোগিকে চূড়ান্ত মুক্তি এনে দিতে পারেনি।

তো কিছু দিনের জন্যে যোগ ছেড়ে কৃচ্ছ্রতা (তপস) সাধনের দিকে মন দিলেন গৌতম। বনচারী সন্ন্যাসীদের কেউ কেউ সকল অশুভ কম্ম পুড়িয়ে দিয়ে তা মুক্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে মনে করতেন। আরও পাঁচজন সাধকের সঙ্গে যোগ দিলেন তিনি। একসঙ্গে কঠোন সাধনা চালিয়ে গেলেন। যদিও মাঝে মাঝে নির্জনতার খোঁজ করেছেন গৌতম। এমনকি দিগন্তে কোনও রাখালের ছায়া চোখে পড়লেও বনে বাদারে পাগলের মতো ছুটে যেতেন। এই পর্যায়ে গৌতম হয় নগ্ন থাকতেন বা খুবই কর্কশ খড়ের আচ্ছাদন পরতেন। হাড় কাঁপানো শীতের রাতে খোলা জায়গায় ঘুমাতেন, কাঁটার বিছানায় শুতেন এবং এমনকি নিজের মলমূত্রও পান করতেন। এত দীর্ঘ সময় দম বন্ধ করে রাখতেন, মনে হতো বুঝি মাথা ফেটে যাবে। দুকানে ভীতিকর পর্দা সৃষ্টি হতো। খাওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় ‘একসারি টাকুর মতো…কিংবা পুরোনো ছাপড়ার কড়িকাঠের মতো’ পাঁজরের হাড় বেরিয়ে পড়েছিল। পেটে হাত দিলেই বলতে গেলে মেরুদণ্ডের ছোঁয়া পেতেন। তাঁর চুল ঝরে পড়ে। গায়ের চামড়া কালো হয়ে কুঁচকে যায়। এক পর্যায়ে চলমান কয়েকজন দেবতা তাঁকে প্রাণের চিহ্নহীন অবস্থায় পথের পাশে পড়ে থাকতে দেখেন। তাঁরা মনে করলেন মারা গেছেন তিনি। কিন্তু এসবই ব্যর্থ চেষ্টা, তাঁর কৃচ্ছ্রতা যত কঠোরই হোক, এমনকি হয়তো সেকারণেই তাঁর দেহ এখনও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। এখনও কামনা আর প্রলোভনে আক্রান্ত তিনি। আসলে যেন নিজের সম্পর্কে আগের চেয়ে ঢের বেশি সজাগ হয়ে উঠেছেন।[৩৪]

শেষ পর্যন্ত গৌতমকে মেনে নিতে নিতে হলো যে কৃচ্ছ্রতা সাধন যোগ সাধনার মতোই নিষ্ফল প্রমাণিত হয়েছে। নিজের অহমবাদের বিরুদ্ধে বীরত্বসূচক হামলা চালানোর পর যা অর্জন করেছেন সেটা হচ্ছে প্রকট হয়ে ওঠা পিঞ্জর এবং মারাত্মক দুর্বল শরীর। তিনি মারাই যেতে পারতেন হয়তো, কিন্তু নিব্বানার শান্তি অর্জন হতো না। এই সময় তিনি ও তাঁর পাঁচজন সঙ্গী প্রশস্ত নিরঞ্জরা নদীতীরে ঊরবেলার কাছাকাছি বাস করতেন। জানতেন অন্য পাঁচজন ভিক্ষু তাঁকে নেতা মেনে নিয়েছেন। তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন, তিনিই সবার আগে দুঃখ এবং পুনর্জন্মের চক্র হতে চূড়ান্ত মুক্তি অর্জন করবেন। কিন্তু তাঁদের হতাশ করেছেন তিনি। আপন মনে বলেছেন তিনি, তাঁর মতো অন্য কেউই নিজেকে এরচেয়ে কঠোর প্রায়শ্চিত্তের শিকার করতে পারবে না, কিন্তু নিজেকে মানবীয় সীমাবদ্ধতা হতে মুক্ত করার বদলে নিজের জন্যে কেবল আরও কষ্টেরই জন্ম দিয়েছেন তিনি। পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন, আলোকনের প্রচলিত উপায়গুলো অবলম্বন করেছেন। কিন্তু কোনওটাই কাজে আসেনি। সেই সময়ের মহান গুরুদের শিক্ষা দেওয়া ধৰ্ম্মগুলোকে মৌলিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়েছে। ওগুলোর বহু অনুশীলনকারীকেই তাঁর মতোই অসুস্থ, অসহায় ও জরাগ্রস্ত মনে হয়েছে।[৩৪] কেউ কেউ হয়তো হতাশ হয়ে অনুসন্ধানে ক্ষান্ত দিত, ফিরে যেত পেছনে ফেলে আসা আরামপ্রদ জীবন ধারায়। একজন গৃহস্থ হয়তো পুনর্জন্মের নিয়তির শিকার হতে পারে, কিন্তু সমাজ হতে ‘বেরিয়ে যাওয়া’ সাধকদেরও সেই একই পরিণতির শিকার মনে হয়েছে।

যোগি, সাধক ও বনচারী সন্ন্যাসীদের সবাই বুঝতে পেরেছিলেন যে, আত্মসচেতনতা ও চিরন্তনভাবে লোভী অহমই সমস্যার মূল। নারী ও পুরুষকে অবিরাম নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত মনে হয়। এটা তাদের পক্ষে পবিত্র শান্তির বলয়ে প্রবেশ অসম্ভব করে তুলেছে। নানা উপায়ে এই অহমবাদকে বিনাশ করে সচেতন অবস্থার অস্থির স্রোতের আর অচেতন বাসনার অতীতে পরম এক নীতির কাছে যাবার প্রয়াস পেয়েছে তারা। মনের গভীরে তার দেখা পাবে বলে বিশ্বাস ছিল তাদের। যোগি ও সাধকরা বিশেষ করে এই জাগতিক বিশ্ব হতে পালাতে চেয়েছিলেন যাতে বাহ্যিক অবস্থার ব্যাপারে নিরাসক্ত হয়ে উঠতে পারেন। অনেক সময় তাদের কোনওমতে বেঁচে আছেন বলে মনে হতো। অহমবাদ কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তারা জানতেন। অহিংসার আদর্শ দিয়ে সেটা দূর করার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু এই স্বার্থপরতাকে চাপা দেওয়া প্রায় অসম্ভব মনে হয়েছে। এইসব কৌশলের কোনওটাই গৌতমের কাজে আসেনি। তাঁর সেক্যুলার সত্তাকে অপরিবর্তিত রেখে দিয়েছে ওগুলো। এখনও তিনি আকাঙ্ক্ষায় আক্রান্ত। এখনও চেতনার ফাঁদে আটকা পড়ে আছেন। পবিত্র সত্তা কোনওরকম কুহক কিনা সন্দেহ জেগেছিল তাঁর মনে, সম্ভবত ভাবতে শুরু করেছিলেন যে, এটা তাঁর কাঙ্ক্ষিত চিরন্তন, নিয়ন্ত্রিত বাস্তবতার সহায়ক প্রতীক নয়। কোনও উন্নত সত্তার অনুসন্ধান হয়তো অহমবাদকে সমর্থন করতে পারে যাকে বিনাশ করা প্রয়োজন। যা হোক, আশা হারাননি গৌতম। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, মানুষের পক্ষে আলোকনের চূড়ান্ত মুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব। এখন থেকে তিনি কেবল আপন অন্তর্দৃষ্টির উপর নির্ভর করবেন। তাঁর বেলায় আধ্যাত্মিকতার প্রতিষ্ঠিত ধরণ ব্যর্থ হয়েছে। তাই নিজস্ব ধরণ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। অন্য কোনও গুরুর ধম্ম মানবেন না বলে স্থির করলেন। ‘নিশ্চয়ই,’ চিৎকার করে বললেন তিনি, ‘আলোক প্রাপ্তির নিশ্চয়ই আরও পথ আছে!’[৩৬]

ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন তিনি রুদ্ধ পথে এসে পৌঁছেছেন বলে মনে হয়েছে, নতুন এক সমাধান আপনাআপনি হাজির হয়েছিল তাঁর সামনে।

তথ্যসূত্র

১. সুত্তা-নিপাতা ৩: ১।

২. ট্রেভর লিঙ, দ্য বুদ্ধা: বুড্ডিস্ট সিভিলাইজেশন ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড সিলোন, লন্ডন, ১৯৭৩, ৭৬-৮২; হারমান অলদেনবার্গ, দ্য বুদ্ধা: হিজ লাইফ, হিজ ডকট্রিন, হিজ অর্ডার (অনু. উইলিয়াম হোয়ে), লন্ডন, ১৮৮২, ৬৬-৭১; মাইকেল কারিথার্স, দ্য বুদ্ধা, অক্সফোর্ড ও নিউ ইয়র্ক, ১৯৮৩, ১৮-২৩; সুকুমার দত্ত, বুড্ডিস্ট মঙ্কস অ্যান্ড মনেস্টারিজ ইন ইন্ডিয়া, লন্ডন, ১৯৬২, ৩৮-৫০।

৩. লিঙ, দ্য বুদ্ধা, ৭৭-৭৮।

৪. রিচার্ড এফ. গোমব্রিচ, থেরাভেদা বুদ্ধজম: আ সোশ্যাল হিস্ট্রি ফ্রম অ্যানশেন্ট বেনারেস টু মডার্ন কলোম্বো, লন্ডন ও নিউ ইয়র্ক, ১৯৮৮, ৪৭।

৫. প্রাগুক্ত, ৪৮-৪৯।

৬. অলদেনবার্গ, দ্য বুদ্ধা, ৬৭।

৭. কারিথার্স, দ্য বুদ্ধা, ২৫।

৮. লিঙ, দ্য বুদ্ধা, ৭৮-৮২; জোসেফ ক্যাম্পবেল, অরিয়েন্টাল মিথোলজি : দ্য মাস্কস অভ গড, নিউ ইয়র্ক, ১৯৬২, ২১৮-৩৪।

৯. লিঙ, দ্য বুদ্ধা, ৯২; মির্চা এলিয়াদ, ইয়োগা, ইমমর্টালিটি অ্যান্ড ফ্রিডম (অনু. উইলিয়াম জে. ট্রাস্ক), লন্ডন, ১৯৫৮, ১০২।

১০. সমক্ষ্য কারিতা ৫৯।

১১. এলিয়াদ, ইয়োগা, ৮-৩৫।

১২. মাজহিমা নিকয়া, ২৬, ৩৬, ৮৫, ১০০।

১৩. ধ্রুপদী যোগের আলোচনার জন্যে এলিয়াদ, ইয়োগা, ৩৫-১১৪।

১৪. প্রাগুক্ত, ৪-৫।

১৫. গ্যালাশিয় ৪: ১-১১।

১৬. জেনেসিস ১৮cf. দ্য অ্যাক্টস অভ দ্য অ্যাপসলস্ ১৪: ১১-১৭, যেখানে লিস্ট্রার জনগণ মনে করেছিল, পল এবং বারনাবাস দেবতা জিউস ও হার্মেসের অলৌকিক প্ৰকাশ।

১৭. ইসায়াহ্ ৬: ৫।

১৮. জেরেমিয়াহ্ ৪৪: ১৫-১৯।

১৯. ইযেকিয়েল ৪: ৪-১৭; ১২: ২৪: ১৫-২৪।

২০. এলিয়াদ, ইয়োগা, ৫৯-৬২।

২১. ইয়োগা-সুত্তা ২: ৪২।

২২. এলিয়াদ, ইয়োগা, ৫৩-৫৫।

২৩. প্রাগুক্ত, ৫৫-৫৮।

২৪. প্রাগুক্ত, ৫৬।

২৫. প্রাগুক্ত, ৪৭-৪৯।

২৬. প্রাগুক্ত, ৬৮-৬৯।

২৭. প্রাগুক্ত, ৭০-৭১।

২৮. প্রাগুক্ত, ৭২-৭৬: ১৬৭-৭৩: কারিথার্স, দ্য বুদ্ধা, ৩২-৩৩; এডোয়ার্ড কনযে, বুড্ডিস্ট মেডিটেশন, লন্ডন, ১৯৫৬, ২০-২২।

২৯. করিথার্স, দ্য বুদ্ধা, ৩০, ৩৪-৩৫।

৩০. প্রাগুক্ত, ৩৩; এলিয়াদ, ইয়োগা, ৭৭-৮৪।

৩১. ক্যারেন আর্মস্ট্রং, আ হিস্ট্রি অভ গড, লন্ডন ও নিউ ইয়র্ক, ১৯৯৩। [বর্তমান অনুবাদকের অনুবাদে স্রষ্টার ইতিবৃত্ত নামে একুশে বইমেলায় (২০১০) রোদেলা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত]

৩২. মাজহিমা নিকয়া, ২৬,৩৬, ৮৫, ১০০।

৩৩. প্রাগুক্ত।

৩৪. প্রাগুক্ত, ১২, ৩৬, ৮৫, ২০০

৩৫. প্রাগুক্ত, ৩৬।

৩৬. প্রাগুক্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *