১৬.
তালপাতার বস্তা
সূর্যাস্তের ঘণ্টাখানেক আগে, আলজিয়ার্স ছাড়ার পনেরো ঘণ্টা পরে, আগুইলা পয়েন্টে পৌঁছুল জাহাজ-জায়গাটা ফরমেণ্টেরা দ্বীপের দক্ষিণ উপকূলে। শাকের-আল-বাহার তখনও আপনমনে পায়চারি করছিল পাটাতনে, ধ্যান ভাঙল পুপ ডেক থেকে আসাদ-আদ-দীনের ডাক শুনে। ওকে উদ্দেশ করে জাহাজকে ওখানকার খাড়িতে ঢোকাবার নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি।
খড়িমুখটা সংকীর্ণ, তা ছাড়া বাতাসও পড়ে এসেছে। দাঁড় বাওয়া ছাড়া এগোবার উপায় নেই। তাই গলা চড়িয়ে লারোক আর ভিজিটেলোকে ডাকল শাকের, হুকুম দিল দাঁড় নামানোর।
হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল জাহাজ জুড়ে। শিঙার আওয়াজে মাল্লাদেরকে তৈরি হবার সঙ্কেত দেয়া হলো। জ্যাসপার লেই আর অন্যান্য মুসলিম নাবিকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল নেতিয়ে যাওয়া পাল গোটানোয়। দাঁড় বাইবার জন্য হুকুম দিল শাকের, সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মত শিঙা বেজে উঠল। ছপাৎ ছপাৎ শব্দে পানিতে পড়ল সবকটা দাঁড়। সমস্বরে হেঁইয়ো হেঁইয়ো বলে ওগুলো চালাতে শুরু করল মাল্লারা। তাল মেলানোর জন্য সামনে একটা ঢোলও বাজানো হচ্ছে। ধীরে ধীরে খড়িমুখে নাক ঢোকাল জাহাজ। পুপ-ডেকে উঠে এল। লারোক আর ভিজিটেলোকে দুপাশের বুলওঅর্কের পাশে অবস্থান নিতে বলল। জাহাজ ডানে-বাঁয়ে সরে যেতে থাকলে সতর্ক করে দেবে। নইলে অগভীর পানিতে আটকে যেতে পারে জলযানটা। ডুবো পাথরে ঘষা খেয়ে থোলে ফুটোও দেখা দিতে পারে।
খুব বেশি সময় লাগল না, নিপুণ দক্ষতায় জাহাজকে খুব শীঘ্রি সংকীর্ণ অংশটা থেকে নিরাপদে বের করে আনল শাকের। সামনে ডিম্বাকৃতির বিশাল খাড়ি-দীঘির মত নিস্তরঙ্গ, টলটলে পানি। নোঙর ফেলবে না বলে ঠিক করেছে শাকের, জাহাজ নিয়ে গেল তীরের কাছাকাছি। দাঁড় তুলে নেয়া হলো পানি থেকে। একটা শুধু বের করে রাখা হলো সেতুর মত ব্যবহার করবার জন্য। শাকেরের নির্দেশে কয়েকজন নাবিক ওটার উপর দিয়ে হেঁটে লাফ দিয়ে নামল অগভীর পানিতে, সেখান থেকে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠল ঋড়ির সৈকতে। জাহাজের দড়িদড়া নিয়ে নেমেছে ওরা, তীরে পা দিয়েই খুঁটি গাড়তে শুরু করল, ওসব খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হবে জাহাজ।
এবার চারপাশে নজর বোলাবার ফুরসত মিলল। খাড়ির এপাশটায় রয়েছে পাথরে ভরা বিশাল এক পাহাড়ি ঢাল, জনমনিষ্যির ছায়া নেই। এলোমেলো ভঙ্গিতে ঢালে ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটা বুনো ছাগল। এখানে-ওখানে মাথা তুলে রেখেছে অপুষ্ট ঝোঁপঝাড়–কয়েকটাতে আবার হরেক রঙের ফুল ফুটেছে। চূড়ার কাছে মাথা তুলে রেখেছে প্রাচীন কিছু জলপাই গাছ। শেষ বিকেলের কোমল রোদে সোনালি হয়ে উঠেছে ওগুলোর মাথা।
জাহাজ বাঁধা শেষ হয়েছে, এবার পাহারা বসানোর পালা। লারোককে দায়িত্ব দিল শাকের-কয়েকজন লোক নিয়ে পাহাড়চূড়ায় উঠে যাবে, ওখান থেকে নজর রাখবে চারপাশে।
ছেলেকে নিয়ে পুপ-ডেকে পায়চারি করতে করতে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল বাদশাহ্-র। আত্মগোপন এবং ওঁত পেতে হামলা চালাবার জন্য তিনি ব্যবহার করতেন এই খড়ি। কর্সেয়ারদের জন্য এমন চমৎকার আশ্রয় পুরো ভূমধ্যসাগরে খুব কমই আছে। তার মনে আছে, দ্রাগুত রইসের সঙ্গে একবার ছটা জাহাজ নিয়ে এখানে ঘাপটি মেরেছিলেন, হামলা চালিয়েছিলেন জেনোয়ার অ্যাডমিরাল ডোরিয়া-র নৌ-বহরে। সাতটা রণতরী আর তিনটে সদাগরি জাহাজ ছিল লোকটার সঙ্গে, কিন্তু পেরে ওঠেনি কর্সেয়ারদের সঙ্গে। চমক সামলাবার আগেই পরাস্ত হয়েছিল।
পিতার পাশে হাঁটতে হাঁটতে দায়সারা ভঙ্গিতে সে-কাহিনি শুনল মারযাক, কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাল না! ওর মন পড়ে আছে শাকের-আল-বাহারের দিকে। ধীরে ধীরে বদ্ধমূল হচ্ছে সন্দেহ-নিশ্চয়ই কোনও একটা রহস্য আছে ওই তালপাতার বস্তায়। ওটার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার পর থেকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে শাকেরকে, অনবরত হাঁটাহাঁটি করছে পাটাতনে, যেন পাহারা দিচ্ছে বস্তাটাকে। ব্যাপারটা মোটেই স্বাভাবিক নয়।
আসাদের স্মৃতিচারণ শেষ হলে চেহারায় কৃত্রিম প্রশংসা ফোঁটাল মারযাক। বলল, আল্লাহকে ধন্যবাদ, আপনি এই অভিযানের দায়িত্ব নিয়েছেন, আব্বা। নইলে এই খাঁড়িকে হয়তো এড়িয়ে যেতাম আমরা।
না, না, তা হবে কেন? বললেন আসাদ। এদিককার সব জায়গা শাকের ওর হাতের তালুর মত চেনে। ও নিজেও খড়িটাকে কাজে লাগিয়েছে কয়েকবার। সত্যি বলতে কী, দুপুরে ও-ই প্রস্তাব দিয়েছিল এখানে ঢুকে স্প্যানিশ জাহাজটার জন্য অপেক্ষা করতে।
আপনি আছেন বলে এত কাজ দেখাচ্ছে। একা এলে অন্য কোনও কাণ্ড ঘটাত। অন্য কিছু আছে ওর মনে, আব্বা। ভাল করে দেখুন, কী যেন ভাবছে লোকটা সারাক্ষণ। অনেকক্ষণ থেকেই দেখছি এ-অবস্থা। মনে হচ্ছে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে… ভয় পাচ্ছে কিছু একটা নিয়ে! দেখুন আপনি!
আল্লাহ তোমার শুভবুদ্ধির উদয় করুন, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন আসাদ। মনের ভিতরের কুটনামির কারণে সারাক্ষণ এটা-সেটা কল্পনা করছ তুমি, মারযাক। অবশ্য, তোমার কোনও দোষ নেই, এসবের জন্য তোমার মা দায়ী। সে-ই তোমার মনে হিংসার বীজ বুনে দিয়েছে। চালাকি করে আমাকেও এই অভিযানে অংশ নিতে বাধ্য করেছে।
হুম! মনে হচ্ছে আপনি গতরাতের ঘটনা ভুলে গেছেন।
কিছুই ভুলিনি আমি। কিন্তু এ-কথাও মনে রাখতে হচ্ছে, আল্লাহ আমাকে আলজিয়ার্সের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবার জন্য। ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণেআমি আল্লাহর আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারি না। আমার কথা শোনো, মারযাক, ক্ষান্ত দাও হিংসা-বিদ্বেষে। আশা করি আগামীকাল তুমি যুদ্ধ করতে দেখবে শাকেরকে। তখন ওর ব্যাপারে ধারণাই পাল্টে যাবে তোমার মনের সায় পাবে না ওর বদনাম করার। এখুনি সময়… ওর সঙ্গে ঝগড়া মিটিয়ে ফেলে।
নীচে চলে গিয়েছিল শাকের, গলা চড়িয়ে তাকে ডাকলেন বাদশাহ। তাড়াতাড়ি পুপ-ডেকে উঠে এল দুর্ধর্ষ কর্সেয়ার। নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে তাকে অভিবাদন জানাল মারযাক। পিতার উপদেশ মেনে নেবার কোনও ইচ্ছে নেই ওর। যে-লোক ওকে সিংহাসনের জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চলেছে, তার সঙ্গে হাত মেলানোর প্রশ্নই ওঠে না।
কী ব্যাপার, শাকের? বাঁকা সুরে বলল শাহজাদা। আসন্ন লড়াই নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ভুগছ মনে হচ্ছে?
আমি একজন যোদ্ধা, শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল শাকের। যোদ্ধারা কখনোই লড়াই নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগে না।
তা হলে মুখ-টুক এত শুকিয়ে গেছে কেন?
চোখে সমস্যা হয়েছে তোমার, শাহজাদা। আমার চেহারা-সুরত আগের মতই আছে।
উঁহু। দুশ্চিন্তায় ভুগছ তুমি। আমি নিশ্চিত!
হেসে উঠল শাকের। এরপর হয়তো বলবে, ভয় পাচ্ছি আমি। অসুবিধে নেই, যা খুশি বলো। আমি কোনও আপত্তি করব না। গোলা-বারুদ আর রক্তের খেলা যখন শুরু হবে, তখনই বোঝা যাবে, কার কতটা সাহস।
দুজনের কথা কাটাকাটি শুনে নড়ে চড়ে উঠল বিস্কেন আল-বোরাক সহ বাদশাহ্-র সহযাত্রীরা। পুপ-ডেকের একপ্রান্তে বুলওঅর্কে হেলান দিয়ে গল্পগুজব করছিল তারা, এবার এগিয়ে এল মজা দেখার জন্য। দাঁড়াল বাদশাহ্-র পিছনে। আসাদ-আদ-দীন নিজেও কৌতূহল নিয়ে শুনছেন পুত্র আর পুত্রসম অনুচরের বাদানুবাদ। পিছনে ভিড় জমতে দেখে ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন।
বললেন, শাকের ভুল বলেনি, মারযাক। একটু অপেক্ষা করো… আগামীকাল ও যখন শত্রুপক্ষের জাহাজে হানা দেবে, তখন দেখতে পাবে, ওর মধ্যে ভয়-ডর বলে কিছু আছে কি না। নিশ্চিত থাকো, লজ্জা পাবে তখন ওর সঙ্গে নিজের তুলনা করতে গিয়ে।
ঝটকা দিয়ে পিতার হাত সরিয়ে দিল শাহজাদা। রাগী গলায় বলল, এ ভারি অন্যায়, আব্বা। ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আপনি আমার অভিজ্ঞতার অভাব নিয়ে খোটা দিচ্ছেন! কতই বা বয়স আমার… সেটা তো খেয়াল রাখবেন! এ-বয়সে আর কিছু না হোক, অন্তত অস্ত্র ভাল চালাতে জানি আমি।
একটু জায়গা দিন, মহানুভব, স্বভাবসুলভ কৌতুকের স্বরে বলল শাকের। শাহজাদা আমাদেরকে তার কেরামতি দেখাক।
দাঁতে দাঁত পিষল মারযাক। বেশ, একটা ধনুক দাও। কীভাবে তীর ছুঁড়তে হয়, তা দেখিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।
শাকেরকে তীর ছোঁড়া দেখাবে তুমি? বাদশাহ্ নিজেও এবার হেসে ফেললেন। পাগল হয়েছ?
কিছুক্ষণের জন্য মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন, আব্বা, বিরক্ত গলায় বলল মারযাক। তীর ছুঁড়ে নিই, তারপর নাহয় শুনব আপনার প্রতিক্রিয়া।
তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। উড়ন্ত পাখিকে তীর দিয়ে ঘায়েল করতে পারে শাকের।
ওটা ওর বড়াই।
আর তোমার বড়াইটা কী? জিজ্ঞেস করল শাকের। এ-কথা বোলো না যে, এখান থেকে তীর ছুঁড়ে ফরমেন্টেরা দ্বীপকে ফুটো করে দিতে পারবে।
এত বড় সাহস তোমার… আমাকে নিয়ে মশকরা করছ? হিসিয়ে উঠল মারযাক।
এর মধ্যে সাহসের তো কিছু নেই।
আল্লাহ্-র কসম, আজ তোমাকে একটা শিক্ষা দেব আমি।
আমি সেই শিক্ষার অপেক্ষায় রইলাম।
পাবে… কথা দিলাম! গরগর করে উঠল মারযাক। অ্যাই, কে আছ? ভিজিটেলো, দুটো ধনুক নিয়ে এসো আমার আর শাকেরের জন্য।
ছুটোছুটি করে হুকুম তামিল করল ইটালিয়ান সারেং। আমাদের ধর্মে কিন্তু বাজি ধরা নিষেধ! মনে করিয়ে দিলেন আসাদ-আদ-দীন।
বাজি ধরছি না, মারযাক বলল। যদিও ধরা উচিত ছিল।
ভালই হতো তা হলে, তাচ্ছিল্যের সুরে বলল শাকের। মাথার মত তোমার পকেটটাও খালি হয়ে যেত।
ফোঁস ফোঁস করে উঠল মারযাক। ভিজিটেলোর হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিল একটা ধনুক। তাতে তীর পাল। কয়েক মুহূর্ত পরেই ধুরন্ধর শাহজাদার আসল মতলব টের পেল শাকের।
ওই যে, মূল মাস্তুলের গোড়ায় ইশারা করল মারযাক, তালপাতার বস্তাটা দেখতে পাচ্ছ? ওটার উপরদিকে একটা শুকনো পাতার ডগা বেরিয়ে আছে… আকারে মানুষের চোখের চাইতে বড় হবে না। আমার তীর ওটাকে ছুঁড়ে দেবে। কী শাকের, এরচেয়ে ছোট কোনও লক্ষ্যভেদ করতে পারবে তুমি?
ওর দৃষ্টি সেঁটে আছে প্রতিপক্ষের মুখের উপর। চকিতের জন্য কালো একটা ছায়া পড়ল শাকেরের চেহারায়, চোখের তারায় দেখা দিল নিখাদ আতঙ্ক। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল সে। হেসে উঠে বলল:
অদৃশ্য একটা লক্ষ্য বেছেছ তুমি, শাহজাদা। এখান থেকে তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। পাতার ডগাটা যদি থাকেও ওখানে, তীরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। কোনও অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না ওটার। আদপে কোনও কিছু ছিল কি না, তাতে তোমার তীর লেগেছে কি না… কিছুই বোঝা যাবে না। উঁহু, এসব চালাকি চলবে না।
তা-ই? ভুরু নাচাল মারযাক। তা হলে বস্তার গিট্টর মধ্যে লাগাই? ধনুক উঁচু করল ও।
খপ করে তার একটা বাহু ধরে ফেলল শাকের। বলল, না, বস্তা না। অন্য কোথাও মারো।
কেন?
তোমার টিপ কেমন, তার কিছুই জানি না। তুমি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে তীর গিয়ে লাগবে আমার মাল্লাদের গায়ে। বাছাই করা লোক ওরা, একজনও যদি মরে, জাহাজ চালানোয় সমস্যা হবে আমার। তা ছাড়া, বস্তাটা তো একেবারেই কাছে। দশ গজও হবে না। এত অল্প দূরত্বে কি প্রতিযোগিতা হয়? হ্যাঁ, শিশুদের জন্য এটা একটা পরীক্ষা হতে পারে। হয়তো সেজন্যেই লক্ষ্য হিসেবে ওটাকে বেছে নিয়েছ।
হো হো করে হেসে উঠল দর্শকরা। ধনুক নামিয়ে নিল মারযাক, মুখ লাল হয়ে উঠেছে। অগ্নিদৃষ্টি হানল অবাধ্য কর্সেয়ারের দিকে। মুখ হাসি হাসি করে রেখেছে শাকের-আল বাহার, দেখে বোঝার উপায় নেই কী বাঁচা বেঁচেছে।
পাহাড়ি ঢলের একটা জলপাই গাছের দিকে আঙুল তুলল সে। একশো গজ দূরে ওটা। বলল, ওই যে, ওটাই হলো সত্যিকার পুরুষের নিশানা। যদি পারো তো মগডালে একটা তীর লাগাও।
সমর্থন পাওয়া গেল আসাদ আর বাকিদের কাছ থেকে। বাদশাহ্ বললেন, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। সত্যিকার তীরন্দাজের উপযুক্ত নিশানা বটে!
কাঁধ ঝাঁকাল মারযাক। আমি জানতাম, আমার ঠিক করা নিশানা ওর পছন্দ হবে না। যাক গে, জলপাই ডাল..টাও মন্দ না। এত বড় জিনিসে একটা বাচ্চাও তীর বেঁধাতে পারবে।
বাচ্চারা না পারলে তোমারও চেষ্টা করা উচিত না, পিত্তি জ্বালানো সুরে বলল শাকের। একটু সরে এসেছে ও, শরীর দিয়ে শাহজাদার দৃষ্টির আড়াল করে রেখেছে তালপাতার বস্তাটাকে। আমাদের চোখ ধাধিয়ে দাও, শাহজাদা! বলতে বলতে নিজের ধনুক উঁচু করল ও। লক্ষ্যস্থির করল কি করল না, এক ঝটকায় ছিলা টেনে তীর ছুঁড়ল।
বাতাস কেটে ছুটে গেল ওটা। ঠ করে বিঁধে গেল জলপাই গাছের মগডালে। সবাই হাততালি দিয়ে উঠল।
ঠোঁট কামড়াল মারযাক। পাশার ছক উল্টে গেছে। আসলে তীর চালানোর ইচ্ছে ছিল না ওর, শাকেরকে ভয় দেখিয়ে কার্যোদ্ধার করতে চেয়েছিল। সেটা তো হয়ইনি, উল্টো ফেঁসে গেছে ফালতু এই প্রতিযোগিতায়। মুখরক্ষার জন্য তীর এখন ছুঁড়তেই হবে ওকে। তারপরেও মান-ইজ্জত থোয়ানোর ষোলোআনা সম্ভাবনা রয়েছে।
আল্লাহ-র কিরে, বলে উঠল বিস্কেন, শাকেরকে হারাতে হলে এখন আপনাকে চমক দেখাতে হবে, শাহজাদা!
এই নিশানা তো আমি চাইনি, গোমড়ামুখে বলল মারযাক।
চ্যালেঞ্জ তুমি ছুঁড়েছ, বললেন আসাদ। কাজেই নিশানা ঠিক করবার অধিকার শাকেরের। বলতে দ্বিধা নেই, চমৎকার একটা নিশানাই বেছেছে ও… তীরও ছুঁড়েছে পাকা তীরন্দাজের মত।
প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়াবার কথা ভাবল একবার মারযাক, খামোকা নাটক করে লাভ নেই। বস্তা পরীক্ষা করবার জন্য যে-কৌশল অবলম্বন করতে চেয়েছিল, তা মাঠে মারা পড়েছে। কিন্তু পরক্ষণে টের পেল, পিছিয়ে এলে সবার দুয়োধ্বনি শুনতে হবে। কী আর করা, আস্তে আস্তে ধনুক উঁচু করল ও। লক্ষ্যস্থির করল দূরের জলপাই গাছের দিকে।
পাহাড়ের ডগায় আমাদের পাহারাদার আছে, টিটকিরির সুরে বলল শাকের। ওদেরকে আবার ফুটো করে দিয়ো না!
খেপাটে ভঙ্গিতে ছিলা টানল মারযাক। টঙ্কার উঠল ধনুকে। তীরটা গাছের দশ গজ বাঁয়ের মাটিতে মাথা কুটল।
শাহজাদা বলে কথা, বহু কষ্টে হাসি ঠেকাল দর্শকরা। তবে বাদশাহ্ আর শাকের ঠিকই হেসে ফেলল।
দেখলে তো, ছেলেকে বললেন আসাদ, শাকেরের সঙ্গে, পাল্লা দিতে গেলে কী ঘটে?
আমার কী দোষ? ফুঁসে উঠল মারযাক। তীর ছোঁড়ার সময় শাকের আমাকে খেপিয়ে দিল, দেখেননি? নিশানা ঠিক রাখতে পারিনি।
ডানদিকের বুলওঅর্কের দিকে চলে গেল শাকের। ভাবল বুঝি শাহজাদার পাগলামির সমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু ওর ধারণা ভুল।
যা হবার হয়েছে, বলে উঠল মারযাক। কিন্তু ছোট নিশানাটায় আমি আবার ওকে চ্যালেঞ্জ করছি। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ধনুক তুলল ও বস্তা লক্ষ্য করে, ইতোমধ্যে নতুন একটা তীর পরিয়ে নিয়েছে ছিলাতে। সবাই সাবধান!
ঝট করে ওর দিকে ঘুরল শাকের। চোখের সামনে ঘটতে যাচ্ছে সর্বনাশ… হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। তীর-সহ নিজের ধনুক তুলল শাহজাদার দিকে।
খবরদার! চেঁচিয়ে উঠল ও। যদি বস্তার দিকে তীর ছোঁড়ো, তা হলে আমিও তীর ছুঁড়ব তোমার দিকে। আমার নিশানা কখনও ব্যর্থ হয় না।
সময় যেন থমকে গেল হঠাৎ করে। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হলো সবাই। চরম অবিশ্বাস নিয়ে তাকাল তারা শাকের-আল-বাহারের দিকে। মূর্তিমান পিশাচের মত দেখাচ্ছে ওকে। চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে ক্রোধে, দুচোখ জ্বলছে ভাটার মত, শাহজাদার দিকে তীর-ধনুক তাক করে রেখেছে নিষ্কম্প হাতে।
কুটিল হাসি ফুটল মারযাকের ঠোঁটে। ধীরে ধীরে ধনুক নামিয়ে নিল সে। সন্তুষ্ট নিজের উপর–লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। শত্রুকে খোলস থেকে বের করে আনতে পেরেছে।
কয়েক মিনিট নীরবতায় কেটে যাবার পর ভাষা খুঁজে পেলেন আসাদ-আদ-দীন। হতভম্ব গলায় বললেন, ইয়া আল্লাহ্! এসবের মানে কী? শাকের, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?।
হ্যাঁ, পাগলই হয়েছে, বলল মারযাক। ভয়ের চোটে পাগল। তাড়াতাড়ি সরে এল বিস্কেনের শরীরের আড়ালে। ওকে জিজ্ঞেস করুন, আব্বা, বস্তার ভিতরে কী লুকিয়ে রেখেছে।
চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল বাদশাহ্-র। এগোলেন দুপা। বলো, শাকের!
ধনুক নামিয়ে নিল শাকের। নিজেকে সামলে নিয়েছে। শান্ত গলায় বলল, ওটাতে দামি মালামাল আছে, মহানুভব। আমি চাইনি খামখেয়ালি একটা ছেলে তীর ছুঁড়ে ওগুলোর দফারফা করুক।
দামি মালামাল! ভুরু কোঁচকালেন বাদশাহ। আমার ছেলের প্রাণের চেয়ে দামি কী হতে পারে? দেখা দরকার। পুপ-ডেকের সামনের দিকে চলে গেলেন তিনি। গলা চড়িয়ে হুকুম দিলেন, অ্যাই, বস্তাটা খোলো।
বিদ্যুৎবেগে সামনে বাড়ল শাকের, ধরে ফেলল আসাদের হাত।
থামুন, মালিক! কর্কশ গলায় বলল ও। ওই বস্তা আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। কারও অধিকার নেই…।
আমাকে অধিকারের কথা শোনাচ্ছ? রেগে গেলেন বাদশাহ্। ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিলেন হাত। নীচে তাকালেন। খোলো বলছি বস্তাটা!
হুড়োহুড়ি পড়ে গেল কর্সেয়ারদের মাঝে। একসঙ্গে এগোল বেশ কয়েকজন। ত্রস্ত হাতে খুলে ফেলল বস্তার বাঁধন। মুখ ফাঁকা করল, পরমুহূর্তে বিস্ময়ধ্বনি বেরিয়ে এল তাদের গলা দিয়ে। শাকের তখন পাথর হয়ে গেছে অমোঘ পরিণতির কথা ভেবে।
কী হয়েছে? উত্তেজিত গলায় জানতে চাইলেন আসাদ। কী পেয়েছ তোমরা? কয়োরদের দেহের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে বস্তাটা, উপর থেকে কিছু দেখতে পাচ্ছেন না তিনি।
পায়ে পায়ে বাদশাহ্-র দৃষ্টিসীমা থেকে সরে দাঁড়াল কর্সেয়াররা। পুপ-ডেকের দর্শকদের বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে ধীরে ধীরে বস্তা থেকে বেরুতে শুরু করল রোজামুণ্ড গডলফিনের সুডৌল অবয়ব। সারা গায়ে কালিঝুলি মাখা, চেহারায় দিনভর বস্তাবন্দি থাকার ধকল… তারপরেও সৌন্দর্য একবিন্দু মান হয়নি ওর। দেখামাত্র খাবি খাওয়ার মত আওয়াজ করলেন আসাদ আদ-দীন।
আতঙ্ক কাটিয়ে নড়ে উঠল শাকের। ঝটপট নেমে গেল পুপ-ডেক থেকে। মাস্তুলের গোড়ায় গিয়ে রোজামুণ্ডকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। তারপর নিজে অবস্থান নিল ওর পাশে।
.
১৭.
প্রবঞ্চনা
মূর্তির মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন আসাদ-আদ-দীন। এরপরেই রাগ ভর করল তার মধ্যে। বুঝতে পারছেন, তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে শাকের-আল-বাহার–এমন এক মানুষ, যাকে তিনি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন। ফানযিলাহ্ আর মারযাকের হাজারো অভিযোগ এতদিন হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি, আপন পুত্র আর স্ত্রীকে গালমন্দ করেছেন প্রিয় সেনাপতির নামে মন্দ কথা বলায়… অথচ এখন প্রমাণ হয়ে গেছে, একবিন্দু ভুল বলেনি ওরা। তাঁর চোখে পট্টি বেঁধে রেখেছিল ধোকাবাজ লোকটা, মারযাকের বুদ্ধিমত্তায় আজ খুলে গেছে সেই পট্টি।
গম্ভীর মুখে পুপ-ডেক থেকে নেমে এলেন বাদশাহ্। তাঁকে অনুসরণ করল মারযাক, বিস্কেন আর অন্যান্য সঙ্গীসাথীরা।
তা হলে এ-ই তোমার দামি মাল? থমথমে গলায় বললেন আসাদ। মিথ্যেবাদী কুকুর কোথাকার! ব্যাখ্যা করো নিজেকে!
ও আমার স্ত্রী, মহানুভব, দৃঢ় গলায় বলল শাকের। যেখানেই যাই, স্ত্রীকে সঙ্গে নেবার অধিকার আছে আমার। পাশ ফিরে রোজামুণ্ডকে মুখ ঢাকতে বলল নিচু গলায়। কাঁপা কাঁপা হাতে চেহারায় ওড়না পেঁচাল মেয়েটা।
অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না, বললেন বাদশাহ। প্রশ্ন তুলছি উদ্দেশ্য নিয়ে। কেন এই লুকোচুরি? মহান শাকের আল-বাহারের স্ত্রী হিসেবে পুপ কেবিনে থাকার কথা ছিল ওর। গোপনে বস্তাবন্দি অবস্থায় নয়!
মিথ্যেই বা বলেছ কেন? যোগ করল মারযাক। আমি যখন ওর খবর জানতে চাইলাম… কেন বললে ওকে তুমি আলজিয়ার্সে রেখে এসেছ?
আমার ভয় হচ্ছিল, নিচু গলায় বলল শাকের, ওকে হয়তো সঙ্গে আনার অনুমতি পাব না আমি।
দাঁতে দাঁত পিষলেন আসাদ। অনুমতি? বউকে যুদ্ধ অভিযানে নেবার? ফাজলামির আর জায়গা পাও না? কে কবে শুনেছে, নতুন বউকে লড়াই আর মৃত্যুর মাঝখানে নিয়ে যেতে চায় স্বামী?
মৃত্যুভয় নেই আমার, মালিক। আল্লাহ অতীতে রক্ষা করেছেন আমাকে, এবারও করবেন বলে বিশ্বাস ছিল।
এ-কথা শুনে আগে উদ্বুদ্ধ হতেন বাদশাহ্। কিন্তু আজ আরও খেপে গেলেন। আল্লাহ্-র নাম নিয়ে ধোঁকাবাজি কোরো না! এই মেয়েকে তুমি লুকিয়ে রেখেছিলে মন্দ কোনও উদ্দেশ্যে!
উদ্দেশ্যটা আর যা-ই হোক, বলল মারযাক, সোনায় ভরা স্প্যানিশ গ্যালিয়ন দখলের ছিল না।
আমারও তা-ই বিশ্বাস, মারযাক, একমত হলেন আসাদ। থমথমে হয়ে গেল চেহারা। নাটক করে লাভ নেই, শাকের। ধরা পড়ে গেছ তুমি। এবার সব সত্যি বললেই ভাল করবে তুমি।
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শাকের। বলল, বেশ, সত্যি কথাই বলব আমি। তবে প্রথমেই বলে দিতে চাই, আপনার অর্পিত দায়িত্বে অবহেলার কোনও ইচ্ছে ছিল না আমার। কিন্তু মেয়েটার ব্যাপারে ভিন্ন একটা উদ্দেশ্য ছিল। ওটা ফাঁস হলে আমার শত্রুরা একটা সুযোগ পাবে বলে গোপনীয়তা অবলম্বন করতে চেয়েছিলাম। এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বা ধর্মবিরোধিতার কোনও সম্পর্ক নেই।
আমার সত্যিকার উদ্দেশ্য, যদি জানতেই চান তো বলি, ছিল মেয়েটাকে ফ্রান্স বা ইটালিতে নামিয়ে দেয়া। যাতে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে ও… নিজের আত্মীয়-স্বজনের কাছে। ওকে নামিয়ে দেবার পরে স্প্যানিশ জাহাজের উপর হামলা চালাব বলে ঠিক করেছিলাম আমি। আল্লাহর ইচ্ছাতে বিজয়ীর বেশে ফিরতে পারব বলে আশা করেছিলাম।
শয়তানের দোসর! গাল দিয়ে উঠল মারযাক। ক্রমাগত মিথ্যে বলে চলেছ তুমি! বিয়ে করা বউকে কেন নামিয়ে দেবে অজানা-অচেনা জায়গায়?
হা, সায় দিলেন আসাদ। জবাব দিতে পারো?
অবশ্যই! যদি আমার কথায় বিশ্বাস রাখেন আর কী। বলল শাকের।
শুধু আল্লাহ্ আর রাসূলের উপর বিশ্বাস রাখি আমরা, বলে উঠল মারযাক। মুসলমানের বেশধারী কোনও বহুরূপীর উপর নয়।
বলতে দাও ওকে। বাদশাহ্ থামালেন তার ছেলেকে।
আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, যা বলব তার প্রতিটা অক্ষর সত্য। বিশ্বাস করা না করা আপনাদের ব্যাপার। কাঁধ ঝাঁকাল শাকের। বহু বছর আগে… যখন ইংল্যাণ্ডে ছিলাম… এই মেয়েটিকে ভালবাসতাম আমি। ওকে বিয়ে করব বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু কয়েকজন দুষ্টলোকের ষড়যন্ত্রে ওর চোখে দোষী প্রমাণিত হই আমি। আমাকে অবিশ্বাস করে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও, বিয়েতে অসম্মতি জানায়। ভাগ্যের ফেরে দুজনে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই এরপর। বিতৃষ্ণা জেগেছিল আমার মনে, মহানুভব, ভেবেছিলাম ঘৃণা করি ওকে; তাই অপহরণ করে এনেছি ইংল্যাণ্ড থেকে… শাস্তি দেবার জন্য। কিন্তু গতরাতে ওর সঙ্গে কথা বলার পর বুঝতে পারলাম, আমার ভালবাসা এখনও মরে যায়নি… যে-ভুল ও করেছে, সেটাও ছিল অনিচ্ছাকৃত। তাই আত্মগ্লানিতে ভরে গেছে আমার অন্তর। উপলব্ধি করেছি, বিরাট অন্যায় করেছি আমি ওর সঙ্গে… আর সেটার প্রতিকারও আমাকেই করতে হবে।
থামল ও। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হেসে উঠলেন আসাদ। বিদ্রুপের সুরে বললেন, এভাবে ভালবাসা প্রকাশ করতে চাইছিলে তুমি? ওকে চিরতরে দূরে পাঠিয়ে দিয়ে? এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো?
অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি, মহানুভব।
খামোশ! চেঁচিয়ে উঠল মারযাক। তোমার কল্প-কাহিনি আর শুনতে চাই না আমরা। আব্বা, এ তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এদের বিয়েটা ছিল ভুয়া… স্রেফ একটা নাটক।
তা তো বটেই, বললেন আসাদ। এই মেয়েকে বিয়ের নামে ইসলাম ধর্মের মজা উড়িয়েছ তুমি, শাকের। বিয়েই নয় ওটা। একটা কৌশল… আমাকে পিছু হটানোর জন্য! আল্লাহ্-র প্রতি আমার অনুরাগের সুযোগ নিয়েছ তুমি। বিশ্বাসঘাতকতা করেছ? ভিজিটেলোর দিকে তাকালেন তিনি, শাকেরের একটু পিছনে দাঁড়িয়ে আছে সে। এই বেঈমানটাকে শেকলে বাঁধো!
আলহামদুলিল্লাহ্! আল্লাহ্ আপনাকে সুমতি দিয়েছেন! সোল্লাসে বলে উঠল মারযাক।
কিন্তু আর কেউ সেই উল্লাসের অংশীদার হলো না। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়… স্থবির হয়ে আছে ঘটনার আকস্মিকতায়। ভিজিটেলোও দাঁড়িয়ে আছে নির্বিকার ভঙ্গিতে, বাদশাহ্-র হুকুম যেন শুনতেই পায়নি।
আড়চোখে চারপাশটা দেখে মুচকি হাসল শাকের-আল-বাহার ওরফে অলিভার। বলল, তা-ই? আমার তো মনে হচ্ছে এই সুমতি তোমাদেরকে পরপারে পাঠিয়ে দেবে!
হতভম্ব দৃষ্টিতে কর্সেয়ারদের দিকে তাকালেন বাদশাহ্। কী হলো? তোমরা কেউ নড়ছ না কেন? আমার হুকুম তামিল করো!
থামুন! গর্জে উঠল অলিভার। অপরাধীর মত আচরণ করছে না আর। এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি হলো বাদশাহ-র। আমাকে অবলা জানোয়ার ভাববেন না, আসাদ। এত সহজে হার মানি না আমি। কোথায় আছেন, তা ভাল করে ভাবুন। আমাকে শুধু গলা চড়াতে হবে, তারপর আল্লাহই জানেন কজনকে আপনার পাশে পাওয়া যাবে। পরীক্ষা করে দেখতে চান?
হিংস্র হয়ে উঠেছে ওর চেহারা। ভয়-ডরের চিহ্ন। নেই–উদ্ধত, বেপরোয়া! এর কারণেই শাকের-আল-বাহারকে এত ভয় পায় সবাই।
বাদশাহ্ও ঘাবড়ে গেলেন। মুখ থেকে রক্ত সরে গেল তার। কাঁপতে কাঁপতে গাল দিলেন, বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক, বিদ্রোহী…
না, ওসবের কোনোটাই নই আমি, তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল অলিভার। যদি বেঈমান হতাম, এতক্ষণ চুপচাপ সহ্য করতাম না এসব। ডাক দিলে আমার পক্ষেই বেশি লোক পাওয়া যাবে, অনেক আগেই বিদ্রোহ করে বসতে পারতাম। আমার নীরবতাই আমার আনুগত্যের সবচেয়ে প্রমাণ, আসাদ! ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করুন পুরো ব্যাপারটা। দয়া করে শাহজাদার প্রলাপে কান দেবেন না। ও সারাক্ষণ একপেশে কথা বলছে।
ওর কথা শুনবেন না, আব্বা! চেঁচিয়ে উঠল মারযাক। ও আপনাকে…
চুপ করো! ধমকে উঠলেন বাদশাহ্। কুঁকড়ে গেল মারযাক।
শান্ত চোখে অলিভার আর রোজামুণ্ডের উপর নজর বোলালেন আসাদ-আদ-দীন। সফেদ দাড়িতে হাত বোলাতে শুরু করেছেন। ডুবে গেছেন ভাবনায়। বিচার করছেন পরিস্থিতি। ভয় হচ্ছে, হয়তো মিথ্যে বলেনি শাকের ওর সমর্থকদের ব্যাপারে। এখনও বিদ্রোহ ঘোষণা করেনি সে, কিন্তু ওর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে গেলে সেটা অনিবার্য হয়ে উঠবে। আর এই বিদ্রোহ শুধু জাহাজের নয়, গোটা আলজিয়ার্সের ভাগ্যও নির্ধারণ করবে। পরাজিত হলে আর কোনোদিন মাথা তোলার সুযোগ পাবেন না তিনি, মুসলিমদের রাজ্য শাসন করবে স্বঘোষিত এক বহুরূপী দলত্যাগী। হয়তো থেমে যাবে ইসলামের জয়যাত্রা, মাথা ঝোঁকাতে হবে বিধর্মীদের সামনে। অপরদিকে… যদি জয়ী হতে পারেন, অবস্থান অনেক সুসংহত হবে তাঁর। প্রমাণিত হবে, আল্লাহ্-র অনুগ্রহ তাঁর দিকে বর্ষিত হচ্ছে। কিন্তু সেজন্যে মূল্য দিতে হবে চড়া। যে-ই জিতুক লড়াইয়ে, বইবে রক্তের নহর। সেটা ভাবলেই বিতৃষ্ণা অনুভব করছেন তিনি। দোটানায় ভুগছেন।
মালিক? বিস্কেনের ডাকে ধ্যান ভাঙল বাদশাহ্-র। আদেশের অপেক্ষায় আছে সে। একটা হাত দিয়ে রেখেছে কোমরে ঝোলানো তলোয়ারের হাতলে।
মাথা নাড়লেন আসাদ-আদ-দীন। অলিভারের দিকে তাকালেন। বললেন, বেশ, তোমার কথাগুলো ভেবে দেখব আমি। নিশ্চয়তা দিচ্ছি, অবিচার করা হবে না তোমার প্রতি। কেউ আমাকে প্রভাবিতও করতে পারবে না। আল্লাহ্ সাক্ষী! তবে কিছুটা সময় দরকার আমার। আশা করি এর মাঝে উল্টোপাল্টা কিছু ঘটিয়ে বসবে না?
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, মহানুভব, কথা দিল অলিভার।
শুনে খুশি হলাম। উল্টো ঘুরে চলে গেলেন আসাদ।
.
১৮.
বাজিমাত
বাদশাহ্ চলে যাবার পরেও সবার দৃষ্টি আটকে রইল অলিভার আর রোজামুণ্ডের উপর। মাল্লারা পর্যন্ত উঁকি-ঝুঁকি দিতে লাগল দাঁড় টানার বেঞ্চি থেকে। যুদ্ধ-বিগ্রহ তো নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা, কিন্তু স্বয়ং বাদশাহ্ আর শাকের-আল-বাহারের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করবার সুযোগ জীবনে একবারই আসে।
সাঁঝের ম্লান আলোয় রোজামুণ্ডের দিকে তাকাল অলিভার। ওড়নায় মুখ ঢাকা, কিন্তু দুচোখে ফুটে আছে রাজ্যের উদ্বেগ। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে বাদশাহ্-র সঙ্গে ওর কথাবার্তা। মুখে হাসি ফুটিয়ে অভয় দিতে চাইল অলিভার, কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হলো না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল অলিভার। আর কিছু না হোক, রোজামুণ্ডের বন্দিদশার অবসান ঘটেছে, সেটাই সান্ত্বনা। মাত্র কয়েক ঘণ্টা ওকে বস্তায় রাখতে চেয়েছিল-বাড়ি থেকে জাহাজে আসা পর্যন্ত। পুপ-কেবিনে ঢুকেই মুক্ত করবার কথা ছিল ওকে। কিন্তু আসাদ আদ-দীনের আগমনে সব ওলোট-পালোট হয়ে গেছে। পাটাতনের উপর বস্তাবন্দি হয়ে দিনভর পড়ে থাকতে হয়েছে বেচারিকে–চরম অস্বস্তিকর অবস্থায়। কীভাবে যে সহ্য করেছে, সেটাই আশ্চর্য! বহু আগেই তো চেঁচিয়ে ওঠার কথা ওর, কিংবা নড়ে ওঠার কথা। মারযাকের ফন্দিফিকিরের আগেই উপস্থিতি ফাঁস হয়ে যাওয়া উচিত ছিল ওর।
এবার কী? রোজামুণ্ডের উদ্বিগ্ন প্রশ্ন শুনে সংবিৎ ফিরে পেল অলিভার।
কী আর, কাঁধ ঝাঁকাল ও, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাও যে, বস্তা থেকে বেরুতে পেরেছ। চলো, যেখানে তোমার থাকার কথা, সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি। আমার কেবিনে। এসো আমার সঙ্গে।
পুপ-ডেকে ওঠার সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল অলিভার। কিন্তু নড়ল না রোজামুণ্ড। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাল উপরদিকে… যেখানে শামিয়ানার নীচে মারযাককে নিয়ে বসে আছেন আসাদ আদ-দীন। চারপাশে বিশ্বস্ত অনুচর।
ভয়ের কিছু নেই, রোজামুণ্ডের মন পড়তে পেরে বলল অলিভার। কেউ কিছু বলবে না তোমাকে। আপাতত বাজিমাত করে দিয়েছি আমি। পরের চাল দেবার আগে শতবার ভাবতে হবে আসাদকে।
ভয় নেই? রোজামুণ্ড যেন নিশ্চিত হতে চাইছে।
না, নেই… অন্তত এ-মুহূর্তে। পরে কী ঘটবে, সেটা আমাদের উপরেই নির্ভর করছে। একটা কথা জেনে রাখো, ভয় পেলে কোনও উপকার হবে না আমাদের।
একটু যেন অপমানিত হলো রোজামুণ্ড। রূঢ় গলায় বলল, আমি ভীতু নই।
তা হলে এসো।
সাহসের প্রমাণ দেবার জন্যই যেন দৃঢ় পায়ে এগোল রোজামুণ্ড। সিঁড়ি ধরে দুজনে একসঙ্গে উঠে এল পুপ-ডেকে। একই সঙ্গে রোষ ও সমীহ নিয়ে ওখানকার সবাই তাকাল ওদের দিকে।
আসাদ-আদ-দীনের দৃষ্টি আটকে রইল রোজামুণ্ডের দিকে। ওর প্রতিটা পদক্ষেপ লক্ষ করলেন তিনি, একবারও চোখ সরালেন না। তাঁর দৃষ্টিবাণের সামনে বাহ্যিকভাবে নিজের মর্যাদা বজায় রাখল রোজামুণ্ড, হাঁটল মাথা উঁচু করে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সংকুচিত হয়ে রইল অজানা এক লজ্জা আর অপমানে। অলিভারও ভাগীদার হলো এই অনুভূতির। রাগ হলো ওর, কিন্তু সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটাল না। শুধু চলে এল রোজামুণ্ডের সামনে, নিজের দেহ দিয়ে ওকে আড়াল করল বাদশাহ্-র দৃষ্টি থেকে।
শামিয়ানার সামনে পৌঁছে থামল ওরা। সালাম দিয়ে অলিভার বলল, অনুমতি দিন, মালিক, যাতে আমার স্ত্রী-কে ওর জন্য নির্ধারিত কামরায় প্রবেশ করাতে পারি।
মুখ খুললেন না আসাদ, হাতের ইশারায় অনুমতি দিলেন। তাকে আবার সালাম জানাল অলিভার, তারপর এগিয়ে গিয়ে সরিয়ে ধরল কেবিনের পর্দা। ভিতরে সোনার প্রদীপ জ্বলছে, এক চিলতে আলো বেরিয়ে এল পর্দার ফাঁক দিয়ে, রোজামুণ্ডের সুগঠিত দেহের অবয়ব প্রকট হয়ে উঠল তাতে।
শেষবারের মত ওকে দেখলেন বাদশাহ, এরপর কেবিনে ঢুকে পড়ল রোজামুণ্ড। ওকে অনুসরণ করল অলিভার। পর্দা টেনে দিল ভিতরে ঢুকে।
কেবিনের অভ্যন্তর সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। আরামদায়ক একটা বিছানা আছে, মেঝেতে দামি গালিচা। কাঠের তৈরি নকশাদার একটা নিচু টেবিলে জ্বলছে প্রদীপ। আগরবাতি জ্বালানো হয়েছে কেবিনের কোণে, মিষ্টি সুবাস ভাসছে বাতাসে। আরেক কোণে, ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে শাকের-আল-বাহারের দুই একান্ত ভৃত্য-আবাইদ আর যালযার। পরনের সাদা পোশাক আর পাগড়ি না থাকলে ছায়ায় মিশে যেত ওদের কালো দেহ।
ভৃত্যদের উদ্দেশে নির্দেশ দিল অলিভার। সঙ্গে সঙ্গে কাবার্ড খুলে খাবার বের করল ওরা। টেবিলের উপর রাখল রুটি, মাংস আর ফলমূলের বাটি; সঙ্গে সুপেয় পানির বোতল আর কাপ। পরিবেশন শেষ হলে কোমর থেকে খাপমুক্ত করল তলোয়ার, কুর্নিশ করে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দেবে।
ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল রোজামুণ্ড। মাথা নিচু করল, দুহাত রাখল কোলের উপর। বসে রইল ওভাবেই। নীরবে ওকে কিছুক্ষণ দেখল অলিভার।
খেতে এসো, একটু পর বলল ও। শক্তি আর সাহস প্রয়োজন হবে তোমার। ক্ষুধার্ত শরীরে দুটোর কোনোটাই থাকে না।
মাথা নাড়ল রোজামুণ্ড। সকাল থেকে অভুক্ত, তারপরেও রুচি হচ্ছে না কিছু মুখে দেবার। গলা বেয়ে উঠে আসছে উদ্বেগ, দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে।
খেতে পারব না আমি, বলল ও। খেয়ে লাভ কী? শক্তি বা সাহস কোনও কাজে আসবে না আমার।
আস্থা রাখো আমার উপর, বলল অলিভার। তোমাকে সুস্থ দেহে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবার প্রতিজ্ঞা করেছি আমি, সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।
ওর কণ্ঠের দৃঢ়তা রোজামুণ্ডকে মাথা তুলতে বাধ্য করল। কীভাবে? জিজ্ঞেস করল ও। আর কোনও আশা নেই আমার মুক্তি পাবার।
যতক্ষণ আমার দেহে প্রাণ আছে, ততক্ষণ আশা হারিয়ো না।
মলিন একটা হাসি দেখা দিল রোজামুণ্ডের ঠোঁটে। তুমি বেশিক্ষণ বাঁচতে পারবে ভেবেছ?
বাঁচা-মরা আল্লাহ্-র হাতে, বলল অলিভার। তিনি না চাইলে কেউই আমার প্রাণ নিতে পারবে না। যদি করুণা দেখান তিনি আমার প্রতি… তোমাকে মুক্ত করা পর্যন্ত যদি বাঁচতে পারি, তা হলেই আমি সন্তুষ্ট।
আবারও মাথা নিচু হয়ে গেল রোজামুণ্ডের, কেঁপে উঠল একটু। আমাদের দুজনেরই ভাগ্য এক সুতোয় বাঁধা পড়ে গেছে, অলিভার, দুখি গলায় বলল ও। কারণ তুমি যদি মারা যাও, আমিও বাঁচব না। তোমার ছোরাটা আছে আমার সঙ্গে।
আবেগ উথলে উঠল অলিভারের বুকে। এগোতে গেল রোজামুণ্ডের দিকে, কিন্তু থেমে গেল মেয়েটার পরের কথা শুনে। না, ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিল না ওটা… ভুল অর্থ করেছে ও। প্রেমিকের শোকে আত্মহত্যা করবার কথা বলেনি রোজামুণ্ড।
আশা করি ঈশ্বর ক্ষমা করবেন আমাকে সম্মান বাঁচানোর জন্য অমন একটা পদক্ষেপ নেয়ায়, বলে চলেছে ও। একটা মেয়ের জন্য নিজের সম্মানের চেয়ে বড় আর কী আছে?
আমি জানি, বিমর্ষ গলায় বলল অলিভার। তোমার জায়গায় আমি থাকলেও একই কাজ করতাম।
একটু থামল ও। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল রোজামুণ্ডের দিকে। একটা কিছু আশা করছে ওর কাছ থেকে। ভালবাসা না হোক, ওকে ক্ষমা করে দেবার ঘোষণা। কিন্তু নীরব রইল মেয়েটা। মাথাই তুলল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রসঙ্গ পাল্টাল অলিভার।
এখানে তোমার দরকারি সবকিছুই পাবে, বলল ও। তারপরেও যদি আর কিছুর প্রয়োজন হয়, করতালি দিয়ো। আমার ভৃত্যরা সারাক্ষণ বাইরে থাকছে, জবাব দেবে। ফরাসি ভাষায় কথা বললে বুঝতে পারবে ওরা। তোমার সেবা-যত্নের জন্য একজন দাসী আনা গেলে ভাল হতো, কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না… জানোই তো। কথা শেষ করে দরজার দিকে পা বাড়াল।
তুমি চলে যাচ্ছ? আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করল রোজামুণ্ড।
হা। তবে কিছু ভেবো না, আমি সবসময় তোমার আশপাশেই থাকব। আপাতত ভয় পাবার কিছু নেই, অন্তত বস্তার সময়টার চেয়ে ভালভাবে এবং নিরাপদে আছ তুমি। বিশ্রাম নাও, খাওয়াদাওয়া করো। আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করুন। কাল সকালে আবার দেখা করব আমি।
কেবিন থেকে বেরিয়ে পিতা-পুত্রকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় শামিয়ানার নীচে দেখতে পেল অলিভার। সঙ্গীরা চলে গেছে। রাত নেমে এসেছে তখন। জ্বেলে দেয়া হয়েছে স্টার্ন রেইলে ঝোলানো বড় বড় লণ্ঠনগুলো। মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়েছে, জাহাজের পুরো দৈর্ঘ্য জুড়ে। এখানে-ওখানে নেচে বেড়াচ্ছে ছায়া। মাঝে মাঝে চকচক করে উঠছে মাল্লাদের বেঞ্চিতে বসা ক্রীতদাসদের ঘর্মাক্ত পিঠ। তন্দ্রায় ঢুলছে তারা। মূল মাস্তুলের ডগায়ও জ্বালানো হয়েছে একটা লণ্ঠন। বাদশাহ-র সুবিধের জন্য আরেকটা ঝোলানো হয়েছে পুপ-ডেকের রেলিঙে। মাথার উপরে কালো আকাশের বুকে মিটিমিটি করছে তারার দল। বাতাস পড়ে গেছে, গোটা পৃথিবী ডুবে গেছে নৈঃশব্দ্যে। খাড়ির পানির ছলাৎছল ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই কোথাও।
আসাদ-আদ-দীনের পাশে গিয়ে মাথা কেঁকাল অলিভার, কথা বলতে চাইল একান্তে।
একাই আছি আমি, নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন বাদশাহ্।
অ! মারযাককে তা হলে গোনায় ধরেন না? খোঁচা মারার সুরে বলল অলিভার। আমিও তা-ই ভেবেছিলাম।
দাঁত খিচাল মারযাক, গর গর করে উঠল রাগে। সেনাপতির বিদ্রুপাত্মক কথায় বিস্মিত হয়ে মাথা ঘোরালেন আসাদ। লোকটার মধ্যে কি ভয়-ডর বলে কিছু নেই?
একজন পিতার জন্য পুত্র তার আত্মার অংশ, বললেন তিনি। মারযাকের কাছে কিছু গোপন করতে চাই না আমি। কিছু বলতে চাইলে ওর সামনেই বলো। নইলে বিদায় হও।
ও আপনার আত্মার অংশ হতে পারে, হে আসাদ, বলল অলিভার, কিন্তু আমার নয়… আল্লাহকে হাজার শোকর! যা বলতে চাইছি, তার সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক আছে, কাজেই বাইরের কাউকে তা শোনানো চলে না।
ধন্যবাদ, শাকের, বিদ্রূপ করল মারযাক, আমাকে তোমার সঙ্গে না জড়াবার জন্য! আর যা-ই হই, একটা বিধর্মী বেঈমান কুকুরের অংশ হব না আমি কোনোদিনই।
তোমার ওটা জিভ তো না, যেন বিষ মাখানো তীর! তিরষ্কারের সুরে বলল অলিভার।
তীর হলে ওটা তোমার বিশ্বাসঘাতকতাকে ছিন্ন করে দেবে।
উঁহু, মুখ টিপে হাসল অলিভার। তোমার নিশানা তো দেখেছি, এই তীরও লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে। আল্লাহ ক্ষমা করুন আমাকে! তোমার এসব কথায় কি রাগ করব আমি? বারংবার কি প্রমাণ হয়ে যায়নি, আমাকে যারা বেঈমান ভাবে, তারাই আসলে মিথ্যেবাদী? বোকা ছেলে, জিভের লাগাম টানতে শেখো, নইলে আল্লাহ্ তোমাকে বোবা বানিয়ে দেবেন।
থামো! ধমকে উঠলেন বাদশাহ্। বাড়াবাড়ি করছ তুমি, শাকের!
হয়তো। সেজন্যে ক্ষমা চাইছি। কাঁধ ঝাঁকাল অলিভার। আপনি যখন আত্মার অংশকে পাশ-ছাড়া করতে চাইছেন না, তখন দেখছি ওর সামনেই কথা বলতে হবে। অনুমতি পেলে একটু বসি?
বাদশাহ্ কিছু বললেন না। যৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ ভেবে হাঁটু গেড়ে তাঁর পাশে বসল, অলিভার।
মহানুভব, বলল ও। খামোকা একটা বিভেদ রচিত হচ্ছে আমাদের মাঝখানে, অথচ ইসলামের বিজয়ের জন্য একত্র থাকা দরকার আমাদের।
এর জন্যে তুমিই দায়ী, শাকের-আল-বাহার, রুষ্ট গলায় বললেন বাদশাহ্। এর প্রতিকারও তোমাকেই করতে হবে।
এ-ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছি। আমাদের মনোমালিন্যের উৎস ওখানে! ইশারায় পুপ-কেবিনের দরজা দেখাল অলিভার। ওই উৎসকে যদি বিদায় করা যায়, তা হলে আমাদের মধ্যকার বিভেদও বিদায় হয়ে যাবে।
খুব যে আশাবাদী হয়ে কথাগুলো বলছে ও, তা নয়। অলিভার খুব ভাল করে জানে, ওর আর বাদশাহ্-র মাঝের সম্পর্ক আর কোনোদিন স্বাভাবিক হবে না। নিজের পায়ে কুড়াল মেরে বসেছে ও, আসাদ-আদ-দীনের বুকে ঢুকিয়ে দিয়েছে ওর ক্ষমতা নিয়ে ভয়। বেকায়দা পরিস্থিতির মুখে হার মানতে বাধ্য হয়েছেন তিনি, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ভবিষ্যতে দ্বিতীয় কোনও সুযোগ দেবেন ওকে। আলজিয়ার্সে ফেরামাত্র এর একটা হেস্তনেস্ত করা হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। একটাই পথ আছে পরিত্রাণেরজাহাজে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসতে হবে। এখানেই আসাদকে বন্দি বা হত্যা করতে হবে। দখল করতে হবে ক্ষমতা। বাদশাহ্ও একই আশঙ্কা করছেন। এর উপর নির্ভর করেই নতুন পরিকল্পনা এঁটেছে অলিভার। দ্বন্দ্ব মেটাবার প্রস্তাব দিলে হয়তো মেনে নেবেন আসাদ–মন থেকে না হলেও, আসন্ন বিপদ এড়াবার জন্য তো বটেই। অন্তত নিরাপদে বাড়ি ফেরার জন্য খড়কুটোও আঁকড়ে ধরবেন তিনি।
চুপ করে একটু ভাবলেন বাদশাহ্। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কীভাবে বিদায় করবে ওই উৎসকে? ভুল স্বীকার করে তালাক দেবে ওকে? তুলে দেবে আমার হাতে?
অমন কোনও কথা বলিনি আমি, বলল অলিভার। কিন্তু ভাল করে ভেবে দেখুন, হে আসাদ, আল্লাহ্-র প্রতি কী আপনার দায়িত্ব। ভাবুন আমাদের ঐক্য ইসলামের বিজয়ের জন্য কতখানি জরুরি। সামান্য এক মেয়ের জন্য সেই ঐক্য ভেঙে যাওয়া কি দুঃখজনক নয়? কী জবাব দেবেন আপনি আল্লাহ্-র কাছে? তারচেয়ে আমার প্রস্তাব শুনুন। মেয়েটাকে নিয়ে কী করতে চাইছি আমি, তা তত জেনেছেন। চলুন, কাল সকালে রওনা দিই আমরা ইয়োরোপের দিকে। সন্ধে নাগাদ ফ্রান্সের উপকূলে পৌঁছে যাব। মেয়েটাকে ওখানে নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসব স্প্যানিশ জাহাজে হামলা চালাবার জন্য। ইনশাল্লাহ, জয় হবে আমাদের। জাহাজ-ভর্তি সোনা নিয়ে ফিরতে পারব আলজিয়ার্সে। মেয়েটা আর থাকবে না, আপনিও ভুলে যাবেন আজকের এই ছোট্ট ঘটনা। সব আবার আগের মত হয়ে যাবে, মহানুভব। বলুন, রাজি আছেন আপনি? আল্লাহর জন্য… ইসলামের জন্য?
অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে টোপ ফেলেছে অলিভার। বাদশাহ্ তো বটেই, এমনকী ধূর্ত মারযাকও বুঝল না ওর প্রস্তাবের মর্মার্থ। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে আসলে নিজের প্রাণের বিনিময়ে রোজামুণ্ডের জীবন কিনে নেবার প্রস্তাব দিয়েছে ও।
প্রস্তাবটা খতিয়ে দেখতে শুরু করলেন আসাদ। গম্ভীর হয়ে গেলেন। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে বলছে, রাজি হয়ে যাওয়া উচিত। জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করলে নিজেরই ক্ষতি। তারচেয়ে শাকেরের সঙ্গে মীমাংসা করে যদি আলজিয়ার্সে ফেরা যায়, তা হলে পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে চলে আসবে। কারও সাহায্য পাবে না তখন লোকটা, ধরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া যাবে। বেঈমান সেনাপতিকে শায়েস্তা করবার জন্য এটাই সবচেয়ে সহজ এবং বুদ্ধিমত্তার পথ। কিন্তু তারপরেও মন খুঁত খুঁত করছে তার।
চুপচাপ বাদশাহ্-র মুখভঙ্গি জরিপ করল অলিভার। ক্ষণে চিন্তার ছাপ পড়ছে ওতে, দেখা যাচ্ছে সিদ্ধান্তহীনতার ছায়া। ব্যাপারটা বেশিক্ষণ সহ্য হলো না মারযাকের। বিপদ সম্পর্কে ও-ও সচেতন, এত সহজে সেটা এড়াবার প্রস্তাব ওর পিতা ফিরিয়ে দেন কি না, এই ভয়ে বলে উঠল:
এতদিনে শাকের একটা ভাল কথা বলেছে, আব্বা! সবার উপরে ইসলামের পতাকা! যা খুশি করতে দিন ওকে যেতে দিন নাসরানি মেয়েটাকে। তাতে যদি আপনাদের ঝগড়া মিটে যায়, আপত্তি করবার দরকার কী?
বুঝতে অসুবিধে হলো না বাদশাহ্-র, তাঁর ছেলেও একই ধারায় চিন্তাভাবনা করছে। প্রস্তাবটা মেনে নেবার ঝোঁক প্রবল হয়ে উঠল মনের ভিতরে, কিন্তু ইতস্তত করলেন অন্য একটা কথা ভেবে। মানসচোখে দেখতে পাচ্ছেন অপূর্ব এক চেহারা, ঈর্ষণীয় এক দেহসৌষ্ঠব। মেয়েটাকে হাতছাড়া করতে মন চাইছে না কিছুতেই। দোটানায় ভুগছেন সে-কারণে। পুরুষসুলভ কামনার সামনে হার মানতে বসেছে বুদ্ধিমত্তা। বুঝতে পারছেন না কোটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ–আলজিয়ার্সে পৌঁছে শাকেরকে শাস্তি দেয়া, নাকি স্ত্রী হিসেবে সুন্দরী ওই মেয়েটিকে পাওয়া।
একটু ঝুঁকলেন আসাদ-আদ-দীন। চোখ রাখলেন অলিভারের চোখে।
একটা প্রশ্ন আছে আমার, বললেন তিনি। মেয়েটাকে যদি–ই চাও তুমি, আমাকে গতকাল কেন হটিয়ে দিলে? তখন ভেবেছিলাম ওকে তুমি বউ করতে চাইছ… খাঁটি মুসলমানের মত সংসারধর্ম শুরু করতে চাইছ। কিন্তু এখন তো জানি–বিয়েটা ছিল স্রেফ একটা কৌশল… একটা নাটক! ওটা কোনও বিয়েই না। কাজেই মেয়েটাও আর তোমার নয়। যে কেউ এখন ওকে নিজের দখলে নিয়ে নিতে পারে।
হাসল অলিভার। ওকে দখল করার আগে আমার তলোয়ারের স্বাদ পরখ করতে হবে, মহানুভব। কথাটা প্রমাণ করবার জন্যই যেন ঝট করে উঠে দাঁড়াল, খাপ থেকে বের করে আনল নিজের তলোয়ার।
আসাদও উঠে দাঁড়ালেন। রাগী গলায় বললেন, হুমকি দিচ্ছ?
হুমকি দিচ্ছি না, ভবিষ্যদ্বাণী করছি। হালকা গলায় বলল অলিভার। তারপর ঘুরে দাঁড়াল। সরে এল শামিয়ানার তলা থেকে। আর মুখ খরচ করার মানে হয় না। উদ্দেশ্য মোটামুটি সফল হয়েছে। বাদশাহকে রাজি করাতে পারেনি বটে, তবে ওর প্রস্তাব নাকচও করে দেননি তিনি। অন্য কিছু যেন করতে না যান… মানে রোজামুণ্ডের দিকে হাত না বাড়ান… সে-ব্যাপারে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে ফেলেছে। একটাই পথ এখন আসাদের সামনে-রোজামুণ্ডকে যেতে দেয়া… অলিভারের প্রস্তাব মেনে নেয়া। দেখা যাক, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে তিনি সেটা অনুধাবন করতে পারেন কি না।
রাগে জ্বলতে জ্বলতে ওকে চলে যেতে দেখলেন আসাদ। একবার ভাবলেন ফিরে আসার হুকুম দেবেন, পরক্ষণে মত পাল্টালেন। যে-রকম তেজ দেখা যাচ্ছে শাকের-আল-বাহারের মধ্যে, হয়তো সবার সামনেই অগ্রাহ্য করবে তাঁর আদেশ। অমান্য হবার সম্ভাবনা থাকলে আদেশ না দেয়াই ভাল। তাতে নিজের মান-সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকে।
পিতার ইতস্তত ভাব লক্ষ করে উঠে দাঁড়াল মারযাক। তাঁর বাহু ধরে জিজ্ঞেস করল, কী এত ভাবছেন, আব্বা? এটাই তো সবচেয়ে ভাল পন্থা! সাদা একটা ডাইনির জন্য সবাইকে বিপদে ফেলার কোনও মানে হয় না। ও বিদায় হয়ে গেলেই বরং সবার মঙ্গল। আলজিয়ার্সে ফিরতে পারব নিরাপদে। শাকেরকে শাস্তি দিয়ে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যাবে। ভবিষ্যতে কেউ কোনোদিন আপনার বিরুদ্ধে মাথা তোলার সাহস পাবে না। পায়ে পড়ি আপনার, রাজি হয়ে যান।
ছেলের মুখের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন আসাদ। বললেন, আমি কাপুরুষ নই যে প্রাণ বাঁচানোর জন্য সহজ রাস্তা খুঁজব। এমন একটা অনুরোধ জানিয়ে তুমি নিজের দুর্বলতাই শুধু প্রকাশ করছ, মারযাক।
আমি শুধু আপনাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন, আব্বা। এখন তো ঘুমানোও নিরাপদ নয়। আমরা ঘুমিয়ে গেলে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে শাকের।
ভয় পেয়ো না, আমি নিজেই পাহারা ঠিক করেছি। আমার নিজস্ব অনুচরেরা সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত। বিস্কেনও এ-মুহূর্তে লোকজনের মতামত জানতে গেছে। খুব শীঘ্রি বোঝা যাবে, আমাদের অবস্থান কোথায়।
নিশ্চিত হবার তো উপায় নেই। আপনার জায়গায় আমি হলে শাকেরের দাবি মেনে নিতাম, যাতে পরে ওর সঙ্গে বোঝাপড়া করা যায়।
ফ্র্যাঙ্কিশ মুক্তোটাকে হাতছাড়া করতে বলছ? মাথা নাড়লেন আসাদ। না, না, এত সহজে হাল ছাড়তে রাজি নই আমি। ও-ই এখন তুরুপের তাস… ওকে ছেড়ে দেয়ামাত্র শাকেরের সঙ্গে দর কষাকষির একমাত্র অস্ত্রটা হারাব আমরা। চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? দুকূলই যদি রক্ষা করা যায়…
ও একটা বিধর্মী, আব্বা, যুক্তি দেখাল মারযাক। এমন মেয়ে খাঁটি মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ। ওর নাঙ্গা চেহারা বহু পুরুষ দেখেছে। এমনকী এক দফা বিয়েও হয়ে গেছে ওর। এমন একজনকে কী করে আপনি এখনও ঘরে তুলতে চান? সবচেয়ে বড় কথা, ওই মেয়ে আপনার জীবন আর বাদশাহী… দুটোর জন্যই বিপজ্জনক!
ঠোঁট কামড়ালেন আসাদ-আদ-দীন। শাহজাদার প্রতিটা কথা সত্য। আসলেই বোকামি করছেন তিনি। ক্ষণিকের উন্মাদনার সামনে হারিয়ে বসেছেন বিচার-বুদ্ধি। কেন করছেন এসব? শুধুই কি সুন্দরী একটি মেয়েকে পাবার জন্য? ভাল করে ভাবতেই বুঝলেন, না… ব্যাপার তা নয়। মেয়েটি উপলক্ষ্যমাত্র। আসলে তিনি শাকেরের চ্যালেঞ্জের জবাব দেবার জন্য উতলা হয়ে উঠেছেন। জীবনে এই প্রথমবারের মত কেউ তাঁর মুখের উপর বিরুদ্ধাচরণ করবার মত স্পর্ধা দেখিয়েছে। তাকে সবদিক থেকে পরাস্ত করতে না পারলে শান্তি পাবেন না তিনি। মেয়েটিকে কেড়ে নেবেন… সেইসঙ্গে কেড়ে নেবেন শাকের-আল-বাহারের জীবন!
পুত্রকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে গেলেন বাদশাহ্, কিন্তু বাধা পেলেন দীর্ঘদেহী বিস্কেন-আল-বোরাক হাজির হওয়ায়। কাছে। এসে কুর্নিশ করল সে।
খবর বলো! অধৈর্য কণ্ঠে বললেন আসাদ।
খুব কঠিন একটা দায়িত্ব দিয়েছেন আপনি, মালিক, বিস্কেন বলল। খোলাখুলি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা সম্ভব নয়, আভাসে-ইঙ্গিতে কথা বলতে হয়েছে। কার সমর্থন কোন্দিকে, তা বোঝা মুশকিল। সবাই মুখে তালা এঁটে রেখেছে। এখুনি কারও পক্ষ নিয়ে পরে বিপদে পড়তে চায় না।
ভণিতা না করে আসল কথা বলো।
আসল কথা হলো, নিশ্চিত হবার উপায় নেই, মালিক। না আমাদের, না শাকের-আল-বাহারের। আমার ধারণা, মিথ্যে হুমকি দিয়েছে ও। সত্যি সত্যি যদি বিদ্রোহ ঘোষণা করে, ভাগ্যের উপর নির্ভর করতে হবে ওকে। এটুকু অনুমান করতে পারি।
এ-ই? বিরক্ত হলেন বাদশাহ্। এখুনি শাকেরকে বন্দি করে ঝামেলা মেটাতে পারব না?
আল্লাহ্ আপনার পক্ষে থাকবেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, ইতস্তত করে বলল বিস্কেন। তারপরেও আমি আপনাকে অমন পরামর্শ দেব না। বললাম তো, নিশ্চিত হবার উপায় নেই। খামোকা ঝুঁকি নেবার কোনও মানে হয় না। শাকেরকে বন্দি করতে গেলে লড়াই বাধবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই।
হুম, গম্ভীর হয়ে গেলেন আসাদ। তারমানে সেয়ানে সেয়ানে অবস্থা আমাদের। ভাগ্য-পরীক্ষা করতে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
আপনি যা বলেন, মালিক।
তা হলে তো আর চিন্তাভাবনার কিছু নেই, বলে উঠল মারযাক। শাকেরের প্রস্তাব মেনে নিন। তারপর…।
হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিলেন আসাদ। সবকিছুরই একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। এখুনি তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ঠিক আছে, ব্যাপারটা ভেবে দেখব আমি।
বাদশাহ্-র জানা নেই, নীচের পাটাতনে ভিজিটেলোর সঙ্গে একই ধরনের আলোচনা করছে অলিভার। দুজনে পায়চারি করছে একসঙ্গে।
আমি কোনও পরামর্শ দিতে পারব না, বলল ইটালিয়ান সারেং। তবে এটুকু বুঝতে পারছি–আপনি বা বাদশাহ্… কারুরই উচিত হবে না এ-মুহূর্তে সংঘাতে যাওয়া।
বলতে চাইছ, দুপক্ষই সমানে সমান? জিজ্ঞেস করল অলিভার।
উই, মাথা নাড়ল ভিজিটেলো। সংখ্যার দিক থেকে বাদশাহ্-র দল ভারী হবে বলে আশঙ্কা করছি। সুস্থ মস্তিষ্কে কোনও খাঁটি মুসলমান তাঁর বিপক্ষে দাঁড়াবে না। যতকিছুই হোক, আসাদের প্রতি আনুগত্য মানে ধর্মের প্রতি আনুগত্য। ওঁর বিরোধিতা করে অবিশ্বাসীর দলে নাম লেখাতে চাইবে না ওরা। কিন্তু কথা হলো, আপনার ডাকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অভ্যস্ত সবাই… অভ্যস্ত প্রাণ দেবার জন্য। বাস্তবতার বিচারে ওদের জন্য আপনিই আসল নেতা। এ-কারণে বাদশাহ্ সাহস পাচ্ছেন না এখুনি কোনও পদক্ষেপ নিতে।
হুম, ঠিকই বলেছ, একমত হলো অলিভার। শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে সত্যিকার যোদ্ধাকে দলে টানা কঠিন। নেতার প্রতি অনুরাগও ওদের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক আছে, যেতে পারো তুমি।
পুপ-ডেকে ফিরে গেল অলিভার। একটাই আশা-আসাদ হয়তো মেনে নেবেন ওর প্রস্তাব। যদিও তার বিনিময়ে নিজের জীবন চলে যাবে, কিন্তু তা নিয়ে এতটুকু দুঃখ নেই। বাদশাহ্-র কাছে আর গেল না ও, গেলে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। ওর চাল ও দিয়ে ফেলেছে, এবার প্রতিপক্ষের পালা। ধৈর্য ধরতে হবে অলিভারকে। সবুরে মেওয়া ফলে। কিন্তু তারপরেও যদি একগুয়ের মত নিজের জেদ ধরে রাখেন আসাদ, কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করেন… একটামাত্র বিকল্প থাকবে সামনে। হ্যাঁ, বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হবে ওকে। একবারের জন্যও অলিভার ভাবছে না, সে-বিদ্রোহ সফল হতে পারে। বরং ভয়ানক পরিণতি ঘটবার সম্ভাবনাই বেশি। নিজে তো মরবেই, রোজামুণ্ডের ভাগ্যও আটকা পড়বে বাদশাহ্-র হাতে।
খুবই কঠিন একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে অলিভার। সবকিছু নির্ভর করছে আসাদ-আদ-দীনের বিচারবুদ্ধির উপর। আগ্রাসী পদক্ষেপ নিতে গেলে কী ঘটতে পারে, সেটা ভেবে হয়তো নিরস্ত থাকবেন তিনি। নইলে সব শেষ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরদিন কী ঘটতে পারে, তা নিয়ে ভাবল অলিভার। সন্দেহ নেই, অভিযান অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেবেন বাদশাহ্। আর যা-ই করুন, সোনা-ভরা স্প্যানিশ গ্যালিয়নটাকে ছাড়বেন না তিনি কিছুতেই। কথা হলো, তার আগে রোজামুণ্ডকে মুক্তি দেবেন কি না।
হঠাৎ একটা চিন্তা এল অলিভারের মাথায়। বুঝল, আশা পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। রোজামুণ্ডকে যদি ফ্রান্সে না-ও নামান আসাদ, আরেকটা সুযোগ পাবে ও। স্প্যানিশ জাহাজটাকে দখল করার সময় যুদ্ধ হবে। তক্কে তক্কে থাকতে হবে তখন। বলা যায় না, লড়াইয়ের ফাঁকে বিপদ থেকে পরিত্রাণের একটা সুযোগ পেয়েও যেতে পারে!
পুপ-কেবিনের দরজার সামনে, পাটাতনে বসে রাত কাটাল অলিভার। ঘুমাল ওখানেই। দুই কাফ্রি ভৃত্য রাতভর পাহারা দিল ওকে আর রোজামুণ্ডকে। পুবের আকাশে লালিমা দেখা দিলে জাগল ও, দুই ভৃত্যকে বিশ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেই নিল রোজামুণ্ডকে পাহারার দায়িত্ব। তাকাল চারপাশে।
পুপ-ডেকের শামিয়ানার নীচে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছেন মহাপ্রতাপশালী আসাদ-আদ-দীন ও তাঁর পুত্র। অনড় পাহাড়ের মত তাদেরকে পাহারা দিচ্ছে বিস্কেন-আল-বোরাক… শাকেরের এককালের সহকারী। ওকে তাকাতে দেখেই দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল লোকটা।
.
১৯.
বিদ্রোহী
ভালমত আলো ফোটার পর জ্যান্ত হয়ে উঠল গোটা জাহাজ। নাবিকরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিত্য-নৈমিত্তিক কাজে। কিছুটা সময় অপেক্ষা করার পর রোজামুণ্ডের সঙ্গে দেখা করল অলিভার।
খাওয়াদাওয়া আর বিশ্রামের সুফল লক্ষ করা গেল মেয়েটার মাঝে। দুগালের রঙ ফিরে এসেছে। সতেজও দেখাচ্ছে ওকে। আন্তরিক ভঙ্গিতে অভিবাদন জানাল অলিভারকে। অবশেষে বুঝতে পেরেছে, লোকটা তার শত্রু নয়। ওকে আশার বাণী শোনাল অলিভার, সবকিছু ভালভাবে এগোচ্ছে বলে জানাল। সাহস রাখতে বলল। মনোযোগ দিয়ে সব শুনল রোজামুণ্ড, কিন্তু ধন্যবাদ জানাল না। বিরূপ আচরণ না করলেও ভুলতে পারছে না-এসব অলিভারের কারণেই ঘটছে।
দুপুরে আবার এল অলিভার, তবে তখন আর নতুন করে কোনও আশা দিতে পারল না। খবর বলতে একটাই, পাহাড়চূড়ার পাহারাদার একটা জাহাজের পাল দেখতে পেয়েছে, তবে ওটা ওদের প্রত্যাশিত স্প্যানিশ গ্যালিয়নের নয়। সেইসঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করে জানাল, রোজামুণ্ডকে ফ্রান্সে নামিয়ে দেবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন বাদশাহ্। তবে দুশ্চিন্তার কিছু নেই, দ্রুত যোগ করল ও, খুব শীঘ্রি একটা না একটা উপায় বেরিয়ে যাবে। সুযোগের সন্ধানে রয়েছে অলিভার, সামান্যতম সম্ভাবনাও হাতছাড়া করবে না।
আর যদি কোনও সুযোগ পাওয়া না যায়? জিজ্ঞেস করল রোজামুণ্ড।
তা হলে একটা তৈরি করে নেব, হালকা গলায় বলল অলিভার। বড়াই করছি না, তবে কৌশল খাটানোয় আমি একটা প্রতিভা। জীবনভর একের পর সুযোগ তৈরি করে নিতে হয়েছে। আমাকে। অথচ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সে-প্রতিভা কাজে লাগবে না, এমনটা হতেই পারে না।
জীবনের প্রসঙ্গ এসে পড়ায় একটা প্রশ্ন না করে পারল না রোজামুণ্ড।
কী কৌশল খাটিয়েছ তুমি আজকের এই অবস্থায় আসার জন্য? জিজ্ঞেস করল ও। মানে… কর্সেয়ার ক্যাপ্টেন হলে কী করে?
লম্বা কাহিনি, মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে হাত নাড়ল অলিভার। শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে যাবে তুমি।
না, হব না, মাথা নাড়ল রোজামুণ্ড। প্লিজ, সব খুলে বলো আমাকে। এমন সুযোগ হয়তো পরে আর পাব না।
লাভ কী শুনে? বলল অলিভার। আমার ব্যাপারে তোমার ধারণা,কি পাল্টাবে তাতে?
পাল্টাতেও তো পারে! মৃদু গলায় বলল রোজামুণ্ড। নামিয়ে নিল চোখ।
মাথা নিচু করে কেবিনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হাঁটল অলিভার। রোজামুণ্ডকে নিজের কাহিনি বলবে কি না ভাবছে। অস্বীকার করবার উপায় নেই, এই তাগিদ বহু আগেই অনুভব করেছে ও। কোনও কিছু না জেনে এতদিন ওকে ঘৃণা করে এসেছে মেয়েটা, সব জানার পরে হয়তো নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করতে পারবে।
সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেল। একটা চেয়ার টেনে রোজামুণ্ডের সামনে বসল অলিভার। ধীরে ধীরে খুলে বলল সব ঘটনা। কীভাবে অপহৃত হয়েছিল, কীভাবে স্প্যানিশ জাহাজে মাল্লা হিসেবে ছমাস কাটিয়েছিল, তারপর কীভাবে উদ্ধার পেয়েছিল কর্সেয়ারদের মাধ্যমে… স-অ-ব! মনের দুঃখকষ্টের কথাও বলল–ব্যাখ্যা করল ভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতা আর রোজামুণ্ডের প্রত্যাখ্যান কীভাবে আগুন জ্বেলেছিল ওর বুকে। ঝুঁকি নিয়ে কীভাবে ইংল্যাণ্ডে অভিযান চালিয়েছে ওদেরকে ধরে আনার জন্য, তারপর আলজিয়ার্সে কী ধরনের সমস্যা মোকাবেলা। করতে হয়েছে… তা-ও জানাল।
সবকিছু সহজ ভাষায়, সংক্ষেপে বর্ণনা করল অলিভার। তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য একটাও বাদ দিল না। ক্ষণে ক্ষণে গলা ভারী হয়ে এল ওর, এক পর্যায়ে আর বসে থাকতে পারল না, আবেগাপ্লুত অবস্থায় পায়চারি করতে করতে বলে গেল নিজের কাহিনি। লক্ষ করল না, ওর কথা শুনে চোখ ভিজে উঠেছে রোজামুণ্ডের, প্রাণপণ চেষ্টা করছে মেয়েটা অশ্রু লুকাতে।
এ-ই ছিল আমার কাহিনি, উপসংহারে বলল অলিভার। এখন তুমি জানলে, কোন পরিস্থিতিতে… কীভাবে আমি আজকের এই অবস্থায় এসেছি। অস্বীকার করব না, আমার চেয়ে দৃঢ় মনোবলের অন্য কেউ যদি পড়ত এমন অবস্থায়, হয়তো বুক, চতিয়ে বরণ করে নিত মৃত্যুকে… অন্তত ধর্মত্যাগ করে জলদস্যুর জীবন বেছে নিত না। কিন্তু কী করব, অত শক্তি নেই মামার মধ্যে। মৃত্যুর চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়েছি আমি প্রতিহিংসাকে। যার জন্য আমার এই দুর্দশা… সেই লায়োনেলকে শাস্তি না দিয়ে কবরে যাবার কথা ভাবতেও পারিনি আমি!
সেইসঙ্গে আমাকে… তুমি নিজেই বলেছ সে-কথা, যোগ করল রোজামুণ্ড।
ভুল, অলিভার শুধরে দিল, আমার পরিণতির জন্য তুমি তো সরাসরি দায়ী ছিলে না। হ্যাঁ, রাগ হয়েছিল আমার-আমাকে অবিশ্বাস করেছিলে বলে… সবকিছু ব্যাখ্যা করে আমার পাঠানো চিঠি আগুনে ফেলে দিয়েছিলে বলে। কিন্তু এখন আমি জানি, তোমাকে ভুল বোঝানো হয়েছিল–কৌশল খাটিয়ে তোমাকে বাধ্য করা হয়েছিল আমাকে দোষী ভাবতে। তাই ক্ষমাও করে দিয়েছি তোমাকে। ক্ষমা যদি না-ও করতাম, জেনেশুনে তোমাকে এই নরকে আমি কখনোই আনতাম না।
এনেছ তো! বাদশাহ্-র কুদৃষ্টির কথা বাদ দাও, তারপরেও নিশ্চয়ই জানতে কী ঘটবে আমার কপালে? আমাকে ক্রীতদাসী হতে হবে, এটা জানতে না তুমি?
জানতাম। আর সে-কারণেই তোমাকে অপহরণ করবার ইচ্ছে ছিল না আমার মনে।
ইচ্ছে ছিল না? তা হলে কেন…
বলছি। আমি আসলে রেগে গিয়েছিলাম সে-রাতে… আরওয়েনাকের ডাইনিং হলে লায়োনেলের সঙ্গে তোমাকে দেখতে পেয়ে। খুব খারাপ একটা কাজ করেছি তখন-ক্ষণিকের– উত্তেজনার কাছে হার মেনেছি। তুমিও আজেবাজে কথা বলে আমার রাগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলে। কিন্তু সেই জেদের মাশুল আজ আমাকে কড়ায় গণ্ডায় চুকাতে হচ্ছে। নিজের চোখেই তো দেখছ। তীব্র বিষাদ ভর করল অলিভারের চেহারায়।
হ্যাঁ, বুঝতে পারছি আমি, সহানুভূতির সুরে বলল রোজামুণ্ড।
দৃষ্টি একটু উজ্জ্বল হলো অলিভারের। বুঝতে পারছ? তা হলে ক্ষমা পাবার পথে এক হলেও এগিয়েছি আমি। কিন্তু না, যে-অন্যায় করেছি, তার পুরোপুরি প্রায়শ্চিত্ত করবার আগে আমি তোমার কাছ থেকে ক্ষমা আশা করব না।
যদি সম্ভব হয় আর কী, বলল রোজামুণ্ড।
সম্ভব করেই ছাড়ব! দৃঢ় গলায় বলল অলিভার, পরমুহূর্তে থমকে গেল। বাইরে থেকে একটা চিৎকার ভেসে এসেছে।
লারোকের কণ্ঠ চিনতে পারল ও, পাহাড়চূড়া থেকে নেমে এসেছে লোকটা, উত্তেজিত ভঙ্গিতে চেঁচাচ্ছে বাদশাহ্-র উদ্দেশে। তাড়াতাড়ি কেবিন থেকে বেরিয়ে এল অলিভার। ওয়েইস্ট-ডেকে মারযাক আর বিশ্বস্ত বিস্কেনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। আছেন আসাদ-আদ-দীন, তাঁর দিকে ছুটে আসতে দেখল ফরাসি সারেং-কে। তাড়াতাড়ি রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়াল ও, যাতে লোকটার কথা শোনা যায়।
দৌড়ে বাদশাহ্-র সামনে এসে এস্ত ভঙ্গিতে কুর্নিশ করল লারোক।
কী ব্যাপার? এত উত্তেজিত কেন তুমি? জানতে চাইলেন আসাদ।
মালিক… সকালে দেখা সেই জাহাজটা… হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে শুরু করল লারোক, দম ফিরে পাবার জন্য থেমে গেল মাঝপথে।
কী হয়েছে ওই জাহাজের? অস্থির কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন বাদশাহ্।
ঢোঁক গিলল লারোক। ওটা এদিকেই এসেছে, মালিক…দ্বীপের উল্টোপাশের পানিতে। একটু আগে নোঙর ফেলেছে ওটা।
অস্থির হবার কিছু দেখছি না, বললেন আসাদ। নোঙর ফেলেছে যখন, তারমানে আমাদের উপস্থিতি সম্পর্কে কিছু জানা নেই ওদের। কী ধরনের জাহাজ ওটা?
বিশাল এক গ্যালিয়ন। বিশটা কামান আছে। ইংল্যাণ্ডের পতাকা উড়তে দেখেছি।
ইংল্যাণ্ডের পতাকা! চমকে উঠলেন আসাদ-আদ-দীন। নিশ্চয়ই খুব শক্তিশালী জাহাজ, নইলে মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এতদূর আসতে পারত না।
আর কোনও চিহ্ন দেখেছ? উপর থেকে গলা চড়িয়ে জানতে চাইল অলিভার।
মাথা ঘোরাল লারোক। হ্যাঁ। তৃতীয় মাস্তুলের ডগায় ছোট আরেকটা পতাকা উড়ছে। সাদা রঙের একটা পাখির ছবি আছে ওতে-বক পাখির মত লাগল।
বক? ভুরু কোঁচকাল অলিভার। ইংল্যাণ্ডের কোনও জাহাজের পতাকায় বকের ছবি থাকে বলে জানা নেই ওর। কিন্তু জাতীয় পতাকা তো উড়ছে! রহস্যটা কী? চিন্তিত ভঙ্গিতে উল্টো ঘুরতেই রোজামুণ্ডকে দেখতে পেল। দরজায় ঝোলানো পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে মেয়েটা, চোখে রাজ্যের কৌতূহল।
কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করল অলিভার।
লোকটা বকের কথা বলল! ফিসফিসাল রোজামুণ্ড, যেন এতেই ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে ওর আগ্রহের।
তো? ইংল্যাণ্ডের জাহাজে ৰকের পতাকা থাকে না। নিশ্চয়ই ভুল করছে ব্যাটা।
হ্যাঁ, ভুল করছে। কিন্তু খুব বড় ভুল নয়। সামান্য ভুল।
সামান্য? অবাক হলো অলিভার। মানে?
বক না হয়ে ওটা সারস হতে পারে না? দুটো তো প্রায় একই রকম দেখতে।
অসম্ভব নয়। কিন্তু সারস হলেই বা কী?
সাদাও না ওটা, রূপালি।
হেঁয়ালি বন্ধ করবে? কী বলতে চাও?
রূপালি সারস, অলিভার! সিলভার হেরন! সার জন কিলিগ্রুগ্র জাহাজ ওটা! উত্তেজিত গলায় বলল রোজামুণ্ড।
কী! চমকে উঠল অলিভার।
হ্যাঁ। তুমি যখন হামলা চালালে আরওয়েনাকে, তখন ওটা প্রায় তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ওটা নিয়ে ভারতবর্ষে যাবার কথা ছিল সার জনের। কিন্তু… তুমি বুঝতে পারছ না… যাননি উনি! অভিভাবক হিসেবে ভালবাসা আর দায়িত্বের খাতিরে সবকিছু তুচ্ছ করে ছুটে এসেছেন ভূমধ্যসাগরে–নিশ্চয়ই তোমার কবল থেকে আমাকে উদ্ধার করবার জন্য!
হায় খোদা! নিখাদ বিস্ময়ে বলে উঠল অলিভার। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল আকাশের দিকে। এ কী দৈব কোনও সঙ্কেত? নইলে ঠিক এ সময়েই সার জনের জাহাজ এখানে হাজির হবে কেন?
কী ভাবছ? জিজ্ঞেস করল রোজামুণ্ড।
সুযোগ খুঁজছিলাম আমি… আর ঠিক এ সময়েই সিলভার হেরন হাজির হলো! ব্যাপারটা কাকতালীয়, নাকি অন্য কিছু, তা বোঝার চেষ্টা করছি। বলল অলিভার।
ইয়ে… ইতস্তত করে শুধাল বোজামুণ্ড, ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব?
নিশ্চয়ই সম্ভব। কিন্তু তার জন্য কৌশল খাটাতে হবে। কাজটা সহজ হবে না।
চেষ্টা করবে তুমি? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল রোজামুণ্ড। ইতিবাচক জবাব আশা করছে না।
অবশ্যই করব, হাসিমুখে বলল অলিভার। যেহেতু এ-ছাড়া আর কোনও উপায় নেই আমাদের। হয়তো কিছু প্রাণহানি হবে, তারপরেও…।
না, না! ভয়ার্ত গলায় বলল রোজামুণ্ড। কারও মৃত্যু চাই না আমি।
বুঝতে বাকি রইল না অলিভারের নির্দিষ্ট করে না দিলেও আসলে ওর কথাই বলছে মেয়েটা। ওর জন্যই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। তবে কী…
ভাবনাটা শেষ হলো না। ওয়েইস্ট-ডেক থেকে ভেসে আসা চেঁচামেচিতে ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য হলো ও। নাবিকরা ঘিরে ধরেছে বাদশাহকে, উত্তেজিত গলায় দাবি জানাচ্ছে–তিনি যেন এখুনি। হামলা চালান ইংলিশ গ্যালিয়নের উপরে! ওদের এত কাছে ওটার উপস্থিতি বিপজ্জনক। কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল, মারযাক সূত্রপাত ঘটিয়েছে এই পরিস্থিতির নরম গলায় পিতাকে পরাশ দিচ্ছিল, কিন্তু ওর কথা শুনে ভয় পেয়ে গেছে আশাপাশে দাঁড়ানো কয়েকজন নাবিক, সেটা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছে সবার মাঝে।
খামোশ! গর্জে উঠলেন আসাদ-আদ-দীন। আল্লাহ ছাড়া আর কারও পরামর্শ প্রয়োজন নেই আমার। যখন মনে, করব সময় এসেছে, তখনই আদেশ দেব জাহাজ ছাড়বার। তার আগে নয়! যে-যার কাজে ফিরে যাও, এক্ষুণি! এ-বিষয়ে দ্বিতীয় কোনও কথা শুনতে চাই না।
বাদশাহ্-র যুক্তি বুঝতে পারছে অলিভার। সশস্ত্র একটা গ্যালিয়নের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে লড়তে যাওয়ার চেয়ে গা-ঢাকা দিয়ে থাকা অনেক বেশি নিরাপদ। ব্যাপারটা অধীনস্থদেরকে বুঝিয়ে দিলেই ভাল করতেন। কিন্তু রাগের বশে ওসব না বলে ধমকাধমকি করছেন। শাকেরের সঙ্গে তিক্ত অভিজ্ঞতা হবার পর থেকে সহ্যই করতে পারছেন না কেউ তাঁর সামনে দাবিদাওয়া পেশ করুক। ভুল করছেন তিনি।
আলজিয়ার্সে বড় বেশি সময় কাটিয়ে ফেলেছেন আসাদ-আদ-দীন। কিন্তু এই সময়টাতে অলিভারের অধীনে পুরো ভূমধ্যসাগর চষে বেড়িয়েছে কর্সেয়াররা। ওরা আর তার হুকুমে অভ্যস্ত নয়। বরং শাকের-আল-বাহারের নির্দেশে একের পর এক অসম্ভব অভিযানে সাফল্য পেতে পেতে নিজেদেরকে অজেয় ভাবতে শুরু করেছে। লড়াইয়ে অভ্যস্ত ওরা, গা-ঢাকা দেয়ায় নয়। বাদশাহ্-র আদেশ তাই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিল।
চেঁচামেচি থামল কর্সেয়ারদের, কিন্তু রয়ে গেল গুঞ্জন। কেউই খুশি হতে পারছে না আসাদের সিদ্ধান্তে। এই সুযোগটা হাতছাড়া করল না ওদের মাঝে লুকিয়ে থাকা ভিজিটেলো। আচমকা চেঁচিয়ে উঠল সে।
শাকের-আল-বাহার… শাকের-আল-বাহারের কাছে চলো! উনি আমাদেরকে এই খাড়ির ভিতরে কোণঠাসা হয়ে মরতে দেবেন না।
বারুদভর্তি পিপেতে যেন আগুন ধরে গেল সঙ্গে সঙ্গে। বিস্ফোরণের মত নতুন করে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হলো কর্সেয়ারদের মাঝে, একসঙ্গে সবাই ঘুরে গেল পুপ-ডেকের দিকে। ওখানে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে অলিভার… শান্তভাবে চিন্তা করছে কীভাবে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা যায়।
তীব্র আতঙ্কে এক পা পিছিয়ে গেলেন আসাদ-আদ-দীন। মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে, রাগে জ্বলছে দুই চোখ। খপ করে আঁকড়ে ধরলেন কোমরে ঝোলানো তলোয়ারের হাতল। খাপ থেকে বের করলেন না অস্ত্রটা, কিন্তু পাশ ফিরে সমস্ত রাগ ঝেড়ে দিলেন পুত্রের উপর। হাঁদারামটার জন্য জাহাজে তাঁর কর্তৃত্বের দফারফা হয়ে গেছে।
বোকার হদ্দ কোথাকার! চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন তিনি। দেখো তোমার বোকামির ফল! মায়ের বুদ্ধিতে চলতে চলতে কী হাল হয়েছে তোমার! তুমি কিনা জাহাজ চালাবে? যুদ্ধ করবে সাগরের বুকে? হায় আল্লাহ্, এমন কুপুত্র দেবার আগে আপনি আমাকে মরণ দিলেন না কেন?
পিতার বাক্যবাণের সামনে সংকুচিত হয়ে গেল মারযাক। কোনও কথা ফুটল না তার মুখে।
অন্যদিকে কেবিন থেকে তখন বেরিয়ে এসেছে রোজামুণ্ড। পায়ে পায়ে এগিয়ে দাঁড়াল গিয়ে অলিভারের পাশে।
ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করছেন, ফিসফিসিয়ে বলল ও। এ-ই তোমার সুযোগ, অলিভার। লোকগুলো তোমার কথা শুনবে এবার।
ঘাড় ফিরিয়ে নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে হাসল অলিভার। হ্যাঁ, রোজামুণ্ড। ওরা আমার কথা শুনবে।
দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে ও। আসাদের সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়নি বলে ওর মুখাপেক্ষী হয়েছে কর্সেয়াররা, কিন্তু সমস্যা হলো-সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন তিনি। আগ বাড়িয়ে সিলভার হেরনের সঙ্গে লড়তে যাবার চেয়ে এখানে ঘাপটি মেরে থাকা আসলেই নিরাপদ। সহজে ফাস হবে না ওদের উপস্থিতি। ইংলিশ জাহাজটাও খুব শীঘ্রি চলে যাবে। অথচ এ-কাজ করতে গেলে বাদশাহ্-র সঙ্গে পার্থক্য থাকে না ওর। সমর্থন ধরে রাখতে চাইলে আসাদের বিপরীত আদেশ দিতে হবে ওকে… জেনেশুনে ঝাঁপ দিতে হবে আগুনে।
ব্যাপারটা আরেকটু খতিয়ে দেখল অলিভার। হামলা না চালিয়ে পালানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। কর্সেয়ারদের জাহাজকে ধাওয়া করতে চাইবে সিলভার হেরন নিঃসন্দেহে, কিন্তু নোঙর ফেলেছে ওটা… নোঙর তুলে ধাওয়া শুরু করতে করতে অনেক সময় লেগে যাবে। এর মধ্যে দাঁড় টেনে অনেকটা এগিয়ে যেতে পারবে ওরা। কপাল ভাল, বাতাস পড়ে গেছে। কাজেই পালের সাহায্য নিয়ে দূরত্ব কমাতে পারবে না সিলভার হেরন। সমস্যা শুধু কামানগুলো। অভিজ্ঞতা থেকে জানে অলিভার, বিশ-বিশটা কামান যদি একসঙ্গে দাগাতে শুরু করে সিলভার হেরন, ওগুলোর গোলাকে ফাঁকি দেয়া সহজ হবে না।
নানাদিক ভেবে বাদশাহ-র কৌশলকে কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারল না অলিভার। অভিজ্ঞ মানুষ তিনি, ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উপায়ান্তর না দেখে তাকেই সমর্থন দেবার সিদ্ধান্ত নিল। এতে আর কিছু না হোক, নৈতিক বিজয় অর্জিত হবে ওর।
পুপ-ডেক থেকে নেমে এল অলিভার। লম্বা লম্বা কদম ফেলে এগিয়ে গেল আসাদ-আদ-দীনের দিকে। অগ্নিদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেন বাদশাহ্, ধরেই নিয়েছেন–সুযোগটা ছাড়ছে না শাকের, এখুনি নেতৃত্ব দেবে বিদ্রোহীদের। ধীরে ধীরে খাপ থেকে তলোয়ার বের করতে শুরু করলেন। ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করল অলিভার। বাদশাহ্-র পাশে গিয়ে থামল, তারপর ঘুরে দাঁড়াল কর্সেয়ারদের দিকে।
কী ব্যাপার, আদেশ কানে যায়নি তোমাদের? গমগম করে উঠল ওর কণ্ঠ। বাদশাহ্ একটা হুকুম দিয়েছেন, সেটা না মেনে কোন্ সাহসে তার মুখের উপর কথা বলছ তোমরা?
গুঞ্জন থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। নেমে এল নীরবতা। বিস্ময়ের একটা ধ্বনি বেরিয়ে এল আসাদ-আদ-দীনের গলা দিয়ে। শাকের এ-কথা বলবে, তা কল্পনাও করেননি।
পুপ-ডেকে রোজামুণ্ডেরও একই অবস্থা, অলিভারের কথা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু মানে কী এর? তা হলে কি ওকে বোকা বানিয়েছে অলিভার? প্রতারণা করেছে? নাকি ভুল অর্থ করছে অলিভারের কথার? রেলিঙের উপর ঝুঁকে পড়ল ও। যেন তাতেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।
লারোকের দিকে ফিরল অলিভার। কর্কশ গলায় বলল, পাহারায় ফিরে যাও, নজর রাখো ইংলিশ জাহাজটার উপর। কী করছে না করছে, জানিয়ে আমাদের। বাদশাহ্ যতক্ষণ না চাইছেন, এখান থেকে একচুল নড়ছি না আমরা। যাও!
বিড়বিড় করে খেদোক্তি করল লারোক। তারপর পাশ ফিরে চলে গেল। কেউ প্রতিবাদ করল না।
পাটাতনে সমবেত কর্সেয়ারদের উপর দিয়ে ঘুরে এল অলিভারের ক্রুদ্ধ দৃষ্টি। এই নাদান বাচ্চাটা… মারযাককে দেখাল ও, …কী বলল না বলল, আর তাতেই ভয় পেয়ে গেলে তোমরা? হায় আল্লাহ্! হয়েছে কী তোমাদের? বুঝতে পারছি না, তোমরা আমার নির্ভীক অনুচর, নাকি স্রেফ একদল কাপুরুষ!
ভিড় থেকে এক পা এগিয়ে এল এক বয়স্ক জলদস্যু। বলল, আমরা এখানে কোণঠাসা অবস্থায় আছি, হে শাকের আল-বাহার। ঠিক যেভাবে দ্রাগুত-কে জাবায় কোণঠাসা করা হয়েছিল।
ভুল, বলল অলিভার। দ্রাগুত কোণঠাসা হননি, পালাবার একটা পথ খুঁজে বের করেছিলেন তিনি। তা ছাড়া তাঁর প্রতিপক্ষ ছিল জেনোয়ার পুরো নৌবাহিনী, আর আমাদের বেলায় একটামাত্র গ্যালিয়ন। হামলা যদি করতেই চায় ওটা, আমরা কি জবাব দিতে জানি না? নাকি এর আগে আর কোনও গ্যালিয়নকে পরাস্ত করিনি আমরা? কিন্তু না, ওসব ভাবছ না তোমরা। নেচে উঠছ এক কাপুরুষ নাবালকের কথায়। কী চাইছ, আগ বাড়িয়ে হামলা চালাতে… নাকি পালাতে? যেটাই করো, তার পরিণতি ভেবেছ? লড়াই করো, বা পালাও… আমাদের দেখামাত্র গর্জে উঠবে ইংলিশদের বিশ-বিশটা কামান। সেই আওয়াজ ছড়িয়ে পড়বে দূর-দূরান্তে। স্বর্ণবাহী স্প্যানিশ জাহাজটা কাছাকাছিই আছে, তোমাদের কি ধারণা গোলমালের আভাস পেলে ওটা আর এদিকে আসবে? পুরো অভিযানটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে আমাদের। অথচ বাদশাহর কথামত এখানে গা-ঢাকা দিয়ে থাকলে এড়ানো যায় ওসব। আমাদের খবর জানে না ইংরেজরা, হয়তো কয়েক ঘণ্টা পরেই চলে যাবে ওরা।
চাঞ্চল্য লক্ষ করা গেল কর্সেয়ারদের মাঝে, শাকেরের কথায় প্রভাবিত হয়েছে।
যা হোক, সন্তুষ্টি ফুটল অলিভারের কণ্ঠে, এতসব যুক্তি আমি তোমাদেরকে না দেখালেও পারতাম। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের বাদশাহ্ একটা আদেশ দিয়েছেন। জীবন দিয়ে হলেও সেটা পালন করতে হবে আমাদেরকে। কাজেই আর কোনও কথা নয়। সবাই নিজের কাজে ফিরে যাও।
ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল জটলা। কর্সেয়াররা মাথা নিচু করে চলে গেল বিভিন্ন দিকে।
আসাদ-আদ-দীনের দিকে ফিরল অলিভার। বলল, দ্রাগুত আর জার্বার কথা যে-ফাজিলটা বলল, তাকে ফাঁসি দিতে পারলে একটা উদাহরণ সৃষ্টি হতো। তবে… যারা আমার পিছনে থাকে, তাদের সঙ্গে নিষ্ঠুরতা করতে পছন্দ করি না আমি। সেটা উচিতও নয়, কী বলেন?
চুপ করে রইলেন বাদশাহ্। মিশ্র অনুভূতির শিকার হয়েছেন তিনি। কৃতজ্ঞতা অনুভব করছেন শাকের পরিস্থিতির সুযোগ না নেয়ায়… তাঁকে সমর্থন করায়; কিন্তু একই সঙ্গে অনুভব করছেন ঈর্ষা-কর্সেয়ারদের মাঝে নেতা হিসেবে তার চেয়ে ওর গ্রহণযোগ্যতা বেশি দেখে। একই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন দুজনে। কিন্তু তাঁর বেলায় বিদ্রোহ করে বসল লোকগুলো, আর শাকেরের কথা মেনে নিল বিনা প্রতিবাদে! ও যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী, তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। এমন লোকের স্থান হতে পারে না তাঁর বাদশাহীতে।
তাই ধন্যবাদ জানাতে গিয়েও জানালেন না আসাদ। শুধু চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন শাকের-আল-বাহারের দিকে। শীতল চোখে জরিপ করতে শুরু করলেন নিজের সেনাপতিকে। তাঁর মনের কথা পড়তে অসুবিধে হলো না অলিভারের। বুঝে গেল, ওর আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, প্রথম সুযোগেই ওকে পথ থেকে সরিয়ে দেবেন বাদশাহ্। অনুতাপও করল ক্ষণিকের জন্য-একটু আগে সৃষ্টি হওয়া সুযোগটা নেয়নি বলে। অবশ্য পরমুহূর্তে সামলে নিল নিজেকে।
স্বভাবজাত ভঙ্গিতে হাসল ও। বিস্কেনকে বলল, চলে যাও। ইশারা করল শাহ্জাদার দিকে। এই দুঃসাহসী যোদ্ধাকেও নিয়ে যাও সঙ্গে।
বাদশাহ্-র দিকে তাকাল বিস্কেন। মালিক?
নীরবে সায় দিলেন আসাদ-আদ-দীন। শাহজাদাকে নিয়ে চলে গেল বিস্কেন।
মহানুভব, সবাই চলে যাবার পর বলল অলিভার, গতকাল একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমি, সেটা আপনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু ভেবে দেখুন, যদি আপনার ধারণা সত্যি হতো… যদি সত্যিই আমি বেঈমান ও বিদ্রোহী হতাম, তা হলে কি একটু আগে আমার কর্সেয়ারদের আবেগের সুযোগ গ্রহণ করতে পারতাম না? তা হলে তো আপনার দয়ার উপর নির্ভর করতে হতো না আমাকে, যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারতাম। কিন্তু না, ঘৃণ্য সে-পথে পা বাড়াইনি আমি। আমার আনুগত্যের প্রমাণ দিয়েছি। আশা করি এবার আপনি আমার সম্পর্কে মত পাল্টাবেন, সেইসঙ্গে বিদেশি মেয়েটার ব্যাপারে আবার বিবেচনা করবেন আমার প্রস্তাবটাকে।
ঘাড় ফিরিয়ে পুপ-ডেকের দিকে তাকালেন আসাদ। ঘোমটা-হীন রোজামুণ্ডকে দেখে পুরনো রাগ ফিরে এল তাঁর মধ্যে। রুক্ষ গলায় বললেন, কোনও ধরনের প্রস্তাব দেয়া সাজে না তোমাকে, শাকের! এই দুঃসাহসই তোমার বেয়াদবির সবচেয়ে বড় প্রমাণ। মেয়েটার ব্যাপারে আমার ইচ্ছের কথা জানা আছে তোমার। ইতিপূর্বে একবার বাধা দিয়েছ তাতে, আল্লাহ্ আর রাসূলের আইনের তামাশা উড়িয়েছ… কিন্তু জেনে রেখো, এরপর যদি সে-চেষ্টা করো, ফল ভাল হবে না। ক্রোধে গলা কাঁপছে তার।
আস্তে কথা বলুন, শীতল গলায় বলল অলিভার। আপনার এই হুমকি শুনে আমার লোকজন যদি খেপে যায়, তার দায়ভার আমি নেব না। নিজের ভাল চান তো গলা চড়াবেন না। দুহাত বুকের সামনে ভাঁজ করল ও। বেশ, আপনার মতামত আমি জানলাম। যুদ্ধ চাইছেন আপনি আমার সঙ্গে? যুদ্ধই তা হলে ঘোষণা করছি। মনে রাখবেন, আপনার পরিণতি আপনি নিজেই ডেকে আনলেন। ভবিষ্যতে আমাকে এর জন্য দোষারোপ করবেন না।
কুত্তার বাচ্চা! বেঈমান! গর্জে উঠলেন আসাদ।
গালিগুলো কানে না তুলে ঘুরে দাঁড়াল অলিভার। নির্বোধ বৃদ্ধের মত আচরণ করতে থাকুন। দেখুন তার ফলে কী ঘটে আপনার ভাগ্যে।
বাদশাহকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সরে এল ও। সিঁড়ি ধরে উঠে এল পুপ-ডেকে। আসাদ তখন তীব্র ক্রোধে থরথর করে কাঁপছেন। ফিরেও তাকাল না অলিভার। জানে বিরাট ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে, কিন্তু ঝুঁকিটা নিয়েছে মাথায় গজিয়ে ওঠা সূক্ষ্ম এক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে! খুব সাবধানে এবার পা ফেলতে হবে ওকে, নইলে সমূহ বিপদ।
রোজামুণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল অলিভার। বলল, এত খোলামেলাভাবে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত না তোমার।
ঝট করে ওর দিকে ফিরল মেয়েটা। খোলামেলা? নাকি বলতে চাইছ তোমার কর্মকাণ্ড দেখতে পাবার মত জায়গায় দাঁড়াবার কথা? কী ধরনের খেলা খেলছ তুমি, অলিভার? মুখে বলো এক কথা, অথচ কাজে দেখা যায় আরেকটা!
ওর ভুল, ভাঙানোর চেষ্টা করল না অলিভার। শুধু বলল, তড়িঘড়ি করে আমাকে বিচার কোরো না। তাতে ভুল হবার সম্ভাবনাই বেশি। অতীতে তার প্রমাণ পেয়েছ।
আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরল রোজামুণ্ডের। দমে যাওয়া গলায় বলল, তা হলে কেন…
এখন কিছু জিজ্ঞেস কোরো না, বাধা দিয়ে বলল অলিভার। শুধু এটুকু জেনে রাখো, বেঁচে থাকলে আমি তোমাকে মুক্ত করবই। তার আগ পর্যন্ত কেবিনে থাকলে ভাল হয়। তোমাকে বাইরে দেখা গেলে আমার কোনও উপকার হবে না।
ব্যাখ্যা দাবি করতে চাইল রোজামুণ্ড, কিন্তু পারল না। অলিভারের শীতল, দৃঢ় কণ্ঠে মিশে আছে এক ধরনের আদেশ-সেটাকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। মাথা নামিয়ে পাশ ফিরল ও। অদৃশ্য হয়ে গেল দরজার পর্দা সরিয়ে।
.
২০.
বার্তাবাহক
দিনের বাকিটা সময় কেবিনে পড়ে রইল রোজামুণ্ড। চরম উদ্বেগে কাটল সময়, সেটা আরও বাড়ল অলিভার একবারও দেখা করতে না আসায়। সন্ধ্যা নামলে আর সহ্য করতে পারল না ও, বেরিয়ে এল কেবিন থেকে। কিন্তু বাইরে পা রাখতেই বুঝল, ভুল সময় বেছেছে।
পশ্চিমাকাশে তখনও খেলা করছে লালিমা। মাগরিবের নামাজ শুরু করেছে কর্সেয়াররা। সারা জাহাজে ভেসে বেড়াচ্ছে তাদের কুরআন তেলাওয়াতের গুঞ্জন। তাড়াতাড়ি আবার পর্দার পিছনে চলে গেল রোজামুণ্ড, নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত রইল ওখানেই। একটু পর উঁকি দিল মাথা বের করে।
কেবিনের বাইরে যথারীতি পাহারায় দাঁড়িয়ে আছে শাকের আল-বাহারের দুই কাফ্রি ভৃত্য। বাঁয়ে, পুপ-ডেকের প্রান্তে শামিয়ানার নীচে আগের মত তক্তপোশে বসে আছেন আসাদ-আদ-দীন আর মারযাক, ওদের সঙ্গে রয়েছে বিস্কেন আর বাদশাহ্-র দুজন একান্ত অনুচর। অলিভারের খোঁজে চঞ্চল দৃষ্টি বোলাল রোজামুণ্ড, রেলিং পেরিয়ে নীচের পাটাতনে দেখতে পেল ওকে। হেঁটে পুপ-ডেকের দিকে আসছে অলিভার, পিছনে সারেঙের সহকারীরা ক্রীতদাসদের মাঝে খাবার বিতরণ করছে।
মাল্লার বেঞ্চিতে বসা লায়োনেলের সামনে পৌঁছে থামল ও। বিদ্রুপের সুরে আরবীতে বলে উঠল, কী খবর, কুকুর? ক্রীতদাসের খাবার কেমন লাগছে?
চোখ পিটপিট করে অলিভারের দিকে তাকাল লায়োনেল। কী বললে? আরবী ভাষা বুঝতে পারছে না।
ওর দিকে ঝুঁকল অলিভার। চেহারায় বিদ্রুপাত্মক হাসি ফুটিয়ে রেখেছে আগের মত, কিন্তু মুখের কথায় তার চিহ্ন রইল না। ইংরেজিতে বলল, অভিনয় করছি আমি। সবাইকে বোঝাতে চাইছি, ত্যাচার চালাচ্ছি তোমার উপরে। তুমিও অত্যাচারিতের মত অভিনয় করো। ভান করো যেন ভয় পাচ্ছ আমাকে, একই সঙ্গে ঘৃণা করছ। অভিনয় করতে করতে শোনো আমার কথা। তোমার কি মনে আছে, ছোটবেলায় আমরা একবার পেনারো থেকে ট্রেফুসিস পয়েন্ট পর্যন্ত সাঁতার কেটে গিয়েছিলাম?
কী বলতে চাও? চরম বিতৃষ্ণা নিয়ে বলে উঠল লায়োনেল। অভিনয় নয়, তবে এমন প্রতিক্রিয়াই চাইছে অলিভার!!
আমি জানতে চাইছি, এখনও তুমি তখনকার মত সাঁতার কাটতে পারো কি না। পারলে সাঁতারশেষে চমৎকার একটা ভোজ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য-সার জন কিলিগ্রু-র জাহাজে! অ, জানো না বুঝি, দ্বীপের ওপাশে সিলভার হেরন নোঙর ফেলেছে? আমি যদি ব্যবস্থা করে দিই, তুমি সাঁতার কেটে ওখানে যেতে পারবে?
ভ্রূকুটি করল লায়োনেল। তুমি কি আমার সঙ্গে মশকরা করছ?
মশকরা করব কেন?
আমাকে মুক্তি দেবার কথা বলছ, এটা মশকরা নয়?
হেসে উঠল অলিভার, এবার সত্যিকার বিদ্রূপ হিসেবে। বেঞ্চির উপরে একটা পা তুলে দিল, হাঁটু ভাঁজ করে আরেকটু ঝুঁকল ভাইয়ের দিকে।
তোমার মুক্তি? বলল ও। হায় খোদা! এখন পর্যন্ত নিজেকে ছাড়া আর কারও কথা ভাবতে পারছ না? এই স্বার্থপর স্বভাবের কারণেই আজ তোমার এই পরিণতি! যাক গে, ওসব নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভাল। তোমার মুক্তি নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাচ্ছি না আমি। আমার সমস্ত চিন্তা আরেকজনকে নিয়ে। আমি চাই তুমি সাঁতার কেটে সার জনের জাহাজে যাবে, ভকে জানাবে-~এখানে কর্সেয়ারদের একটা জাহাজ আছে, যেটাতে বন্দি অবস্থায় রয়েছে রোজামুণ্ড! ওকে মুক্ত করবার জন্যই এ-কাজ করছি আমি। যাবে তুমি? এটাই কিন্তু মাল্লার বেঞ্চি থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র পথ। যাবে?
কিন্তু কীভাবে? সন্দিহা গলায় জিজ্ঞেস করল লায়োনেল।
যাবে কি না, সেটা আগে বলো।
আমাকে যদি পানিতে নামাতে পারো, অবশ্যই যাব।
খুব ভাল, মাথা ঝাঁকাল অলিভার। আমার পরিকল্পনা তা হলে শোনো। সবাই ভাবছে আমি তোমাকে জ্বালাতে এসেছি, উপহাস করছি তোমার দুর্দশা নিয়ে। সেটারই সুযোগ নিতে হবে আমাদেরকে। আমার ইশারা পেলেই অভিনয় করবে তুমি, যেন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে তোমার… আক্রমণ করবে আমাকে। ঘুসি মেরো আমার মুখে। আমিও তখন পাল্টা আঘাত করব তোমাকে… এবং সেটা খুব জোরে। কেউ যাতে সন্দেহ করতে না পারে। মার খেয়ে বেহুশের মত পড়ে যেতে হবে তোমাকে, ঠিক আছে? ওভাবেই থেকো, বাকিটা আমি সামলাব।
ঠিক আছে।
তা হলে শুরু হোক আমাদের খেলা। সোজা হয়ে দাঁড়াল অলিভার। আরবীতে গাল দিল কয়েকটা, তারপর হাসতে হাসতে উল্টো ঘুরতে শুরু করল।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল লায়োনেল। অলিভারকে নাগালের বাইরে যেতে দিল না, তার আগেই প্রচণ্ড এক ঘুসি ঝাড়ল ভাইয়ের গালে। চোখে অন্ধকার দেখল অলিভার, লায়োনেল পুরো শক্তি নিয়ে মেরেছে ওকে-অভিনয় নিখুঁত করবার জন্য নয়, প্রতিহিংসা থেকে। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল।
ব্যথা সয়ে নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল অলিভার। আগুন জ্বলে উঠেছে দুচোখে। পাল্টা ঘুসি চালাল ও-একবার, দুবার, তিনবার। পতাকার মত এদিক-ওদিক ঘুরে গেল লায়োনেলের মুখ। তৃতীয় ঘুসি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে পড়ে গেল অচৈতন্যের মত। রাগ যেন তারপরেও মিটল না অলিভারের। লাথি কষল ও পড়ে থাকা দেহটাতে। চেঁচিয়ে ডাকল ভিজিটেলোকে।
শাকেরের ক্রুদ্ধ সমন পেয়ে হন্তদন্তের মত ছুটে এল ইটালিয়ান সারেং।
শেকল খোলো এই কুত্তার, তারপর নিয়ে গিয়ে পানিতে ফেলে দাও! হিংস্র গলায় বলল অলিভার। একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এটা সবার জন্য আমার বিরুদ্ধে মাথা তুললে কী পরিণতি হতে পারে। দাঁড়িয়ে থেকো না!
ভিজিটেলোর হাঁকডাকে হাতুড়ি আর ছেনি নিয়ে দৌড়ে এল একজন কর্সেয়ার। দ্রুত শেকল ভাঙল লায়োনেলের। তারপর দুজনে ধরাধরি করে অচেতন দেহটাকে নিয়ে গেল বুলওঅর্কের পাশে। এখানে জ্ঞান ফিরল লায়োনেলের। কী ঘটতে যাচ্ছে টের পেয়ে চেঁচামেচি জুড়ল। ক্ষমা চাইতে লাগল বারে বারে।
আড়চোখে পুপ-ডেকের দিকে চাইল অলিভার। বিস্কেনের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে, বাদশাহ্-ও সম্মতিসূচক দৃষ্টিতে দেখছেন পুরো ঘটনা। আঁতকে উঠল রোজামুণ্ড, কেঁপে উঠল। পোশাকের বুকের কাছটা খামচে ধরে এক পা পিছিয়ে গেল সভয়ে।
চ্যাঙদোলা করে ধরা হলো লায়োনেলকে, একটা দোল দিয়ে তাকে জাহাজের বাইরে ছুঁড়ে ফেলা হলো, যেন একটা আবর্জনা। পড়তে পড়তে চিৎকার দিয়ে উঠল লায়োনেল। সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে ভেসে এল পানিতে ওর আছড়ে পড়ার আওয়াজ। ডুবে যাবার আগে আরও কয়েকবার চেঁচাল সে। তারপর জাহাজজুড়ে নেমে এল থমথমে নীরবতা।
বজ্রাহতের মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল রোজামুণ্ড। অলিভারের কথা ভেবে আতঙ্ক আর ঘৃণায় রি রি করছে সর্বাঙ্গ। সব এলোমেলো লাগছে, কিছুতেই গোছাতে পারছে না চিন্তাধারা। একটা ব্যাপারই শুধু বুঝতে পারছে এইমাত্র দেখা অলিভারের কাণ্ড থেকে–বিশ্বাস করা চলে না ওকে… কিছুতেই না। ওর সঙ্গে প্রতারণা করছে লোকটা, মিথ্যে আশ্বাস দিচ্ছে মুক্তির। আসলে সময় নিয়ে নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে চলেছে সে। অলিভারের নিষ্ঠুরতার সামনে লায়োনেলের অপরাধ কিছুই না। বরং কষ্ট পেল রোজামুণ্ড ওর করুণ মৃত্যুর কথা ভেবে।
আনমনে মাথা নাড়ছিল মেয়েটা, হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠল একটা চিৎকার শুনতে পেয়ে। ফোক্যাসল থেকে ভেসে এসেছে এক কর্সেয়ারের কণ্ঠ।
ও সাঁতার কাটছে!
এর অপেক্ষাতেই ছিল অলিভার। তড়িঘড়ি করে ছুটে গেল বুলওঅর্কের পাশে। কোথায়… কোথায়?
ওই তো! হাত তুলে দেখাল একজন। চোখের পলকে ভিড় জমে গেল বুলওঅর্কের পাশে। আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। লায়োনেলের মাথা, সাঁতার কেটে জাহাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ও।
ছাগল কোথাকার! সাগরের দিকে যাচ্ছে! তাচ্ছিল্যের সুরে বলল অলিভার। অতদূর যাবার আগেই ডুবে যাবে। অবশ্য… ওর কষ্ট সংক্ষিপ্ত করে দিতে পারি আমরা।
মূল মাস্তুলের গায়ে লাগানো র্যাক থেকে তীর-ধনুক নিয়ে এল ও। ছিলায় তীর বসাতে গিয়ে থামল, চোখ ফেরাল পুপ-ডেকের দিকে। সঙ্গীসাথী-সহ বাদশাহও চলে এসেছেন রেলিঙের ধারে।
মারযাক! ডেকে উঠল অলিভার। তীরন্দাজির শাহজাদা, চেষ্টা করে দেখবে নাকি আরেকবার তোমার দক্ষতা প্রমাণের?
সাড়া দিল না মারযাক। পানির মাঝে লায়োনেলের মাথা তখন ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে আসছে।
কই, দাঁড়িয়ে রইলে কেন? কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিল অলিভার। ধনুক নাও হাতে।
বাজে কথা বলে সময় নষ্ট কোরো না তো! অস্থির গলায় বলে উঠলেন আসাদ-আদ-দীন। আর দেরি করলে ও তোমার নাগালের বাইরে চলে যাবে। এখুনি তো ঠিকমত দেখতে পাচ্ছি না।
লক্ষ্য তা হলে আরও কঠিন হলো, বলল অলিভার। ইচ্ছেকৃতভাবে সময় অপচয় করছে। দারুণ একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে। একশো দিনার, মারযাক! আমি বাজি ধরছি, তুমি তিনটা তীর ছুঁড়েও লাগাতে পারবে না। আমি একটাতেই পারব।!
অবিশ্বাসীর মুখ থেকে এমন কথাই তো বেরুবে! ঘেউ ঘেউ করে উঠল মারযাক। আমাদের ধর্মে বাজি ধরা মানা।
তাড়াতাড়ি করো, শাকের? চেঁচালেন বাদশাহ। ব্যাটা পালিয়ে যাচ্ছে তো! ঝগড়াঝাটি বন্ধ করো।
হাহ্! অবজ্ঞা প্রকাশ পেল অলিভারের কণ্ঠে। আমার চোখে এখনও পরিষ্কার দেখছি ওকে। নিশানা কখনও ব্যর্থ হয় না আমার… অন্ধকারেও না।
মিথ্যে বড়াই! চেঁচাল মারযাক।
তা-ই? ধনুক তুলল অলিভার। ছিলা টেনে লক্ষ্যস্থির করল-লায়োনেলের মাথা থেকে কয়েক গজ বাঁয়ে। তারপর ছুঁড়ে দিল তীর। পরমুহূর্তে চেঁচিয়ে উঠল। লেগেছে! লেগেছে!! ব্যাটা খতম!!!
মনে তো হচ্ছে এখনও নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছি, চোখ পিট পিট করে পাশ থেকে বলল এক কর্সেয়ার।
আলো কম তো, দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে তোমার, বলল অলিভার। ঘিলুর মধ্যে তীর বেঁধা অবস্থায় কেউ সাঁতরাতে পারে না।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, পিছন থেকে সায় দিল জ্যাসপার লেই। ও ডুবে গেছে।
বড় বেশি অন্ধকার, দ্বিধান্বিত গলায় বলল ভিজিটেলো, কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
রেলিঙের পাশ থেকে ঘুরে দাঁড়ালেন আসাদ, আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। বললেন, তীরেই হোহাক বা পানিতে ডুবে… লোকটা মরে গেছে। আর কিছু দেখার নেই।
ব্যাপারটার সমাপ্তি ঘটল ওখানেই।
তীর-ধনুক জায়গামত রেখে দিয়ে পুপ-ডেকে উঠে এল অলিভার। আবছা আলোয় দেখতে পেল রোজামুণ্ডের ফ্যাকাসে চেহারা। ওকে দেখতে পেয়েই কেবিনের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটা। পিছু পিছু অলিভারও ঢুকল। কাফ্রি ভৃত্য আবাইদ এসে জ্বেলে দিল ভিতরের সব আলো, তারপর কুর্নিশ করে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।
অগ্নিদৃষ্টিতে রোজামুণ্ড তাকিয়ে আছে অলিভারের দিকে। ভুরু কুঁচকে ও জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? এভাবে তাকাচ্ছ কেন?
শয়তান! বদমাশ! রাগে ফেটে পড়ল রোজামুণ্ড। ঈশ্বর তোমাকে তিলে তিলে শাস্তি দেবেন! যতক্ষণ বাঁচব, প্রতিটা মুহূর্ত আমি প্রার্থনা করব–তুমি যেন পাপের উপযুক্ত সাজা পাও। পিশাচ! খুনি কোথাকার! আর আমি কিনা তোমারই মিথ্যে আশ্বাসে কান দিয়েছি। কিন্তু এখন প্রমাণ হয়ে গেছে…
তুমি কি কোনও কারণে আমার ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছ? বাধা দিয়ে জানতে চাইল অলিভার, মেয়েটার রূঢ় ব্যবহারে হতচকিত হয়ে গেছে।
কষ্ট! বলল রোজামুণ্ড। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তুমি আমাকে আর কষ্ট দিতে পারবে না। তোমাকেও ধন্যবাদ, আমার ভুল ভাঙিয়ে দিয়েছ বলে। তোমার মত খুনির সাহায্য চাই না আমি মুক্তি পাবার জন্য। মুখ ফিরিয়ে নিল ও। নিশ্চয়ই কোনও কুমতলব হাসিল করতে চাইছ তুমি আমার মাধ্যমে। কিন্তু জেনে রেখো, তা কোনোদিন সফল হতে দেব না আমি। দরকার হলে প্রাণ দেব, তবু তোমার হাতের পুতুল হব না। গুঙিয়ে উঠে দুহাতে মুখ ঢাকল ও।
ভুরু কুঁচকে ওর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল অলিভার, তারপর হেসে উঠল।
বলল, বোকা মেয়ে! তুমি লায়োনেলের কথা ভেবে কাঁদছ? ও তো পালিয়ে গেছে! জ্যান্ত অবস্থায়! কিছু হয়নি ওর।
ভেজা চোখে ওর দিকে মুখ তুলে তাকাল রোজামুণ্ড। দৃষ্টিতে বিস্ময়।
হ্যাঁ, ঠিক কথাই বলছি আমি। অলিভার ব্যাখ্যা করল, আমাদের মধ্যে যা ঘটতে দেখেছ-মানে, হাতাহাতি আর ঝগড়ার কথা বলছি-ওসব ছিল অভিনয়। তীর ছোঁড়াটাও। মারযাককে খেপাচ্ছিলাম সময় নষ্ট করবার জন্য, যাতে দূরে চলে যেতে পারে লায়োনেল… অন্ধকারে কেউ যেন বুঝতে না পারে, ও ভেসে আছে না ডুবে গেছে। ওর শরীরের অনেক দূর দিয়ে তীর ছুঁড়েছি আমি। এখন ও খড়ি থেকে বেরিয়ে সার জনের জাহাজের দিকে সাঁতার কেটে এগোচ্ছে। ভাল সাঁতারু ও, সিলভার হেরনে পৌঁছে যাবে খুব শীঘ্রি। আমার বার্তা পৌঁছে দেবে সার জনের কাছে।
হতবাক হয়ে গেল রোজামুণ্ড। ঠিক বিশ্বাস হতে চাইছে না অলিভারের কথা। নিশ্চিত হবার জন্য জিজ্ঞেস করল, তুমি মিথ্যে বলছ না তো?
কাঁধ ঝাঁকাল অলিভার। মিথ্যে বলে কী লাভ আমার? নিজেই ভেবে দেখো।
তীক্ষ্ণচোখে ওর মুখভঙ্গি নিরীখ করল রোজামুণ্ড, কিন্তু তাতে কোনও কপটতা দেখতে পেল না। শেষ পর্যন্ত ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। ধরা গলায় বলল, আ… আমি দুঃখিত, অলিভার। আ… আমি ভেবেছিলাম…।
সবসময় আমাকে যা ভাবো, ওকে থামিয়ে দিল অলিভার। চেহারায় কষ্ট বাসা বেঁধেছে। এ আর নতুন কী?
পরাজিতের মত কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল ও।