দ্বিতীয়পর্ব — শাকের–আল–বাহার
০১.
বন্দি
স্পারটেল অন্তরীপের একটা পাহাড়ি চাতালে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে শাকের-আল-বাহার, অর্থাৎ সাগরের বাজপাখি। দুর্ধর্ষ এক কর্সেয়ার… মানে, মুসলিম জলদস্যু সে। ভূমধ্যসাগরের ত্রাস বলা হয় তাকে, সেইসঙ্গে খ্রিস্টান স্পেনের জন্য এক ভয়ানক আতঙ্ক।
ওর মাথার উপরে, পাহাড়ের ডগায় শোভা পাচ্ছে আরাইশের বিখ্যাত কমলা-বাগিচার সারি সারি সবুজ গাছ। মাইলখানেক পুবে রয়েছে বেদুঈন এক গোত্রের বেশকিছু কুঁড়েঘর আর তাঁবু, উপর থেকে ছোট ছোট বিন্দুর মত দেখাচ্ছে ওগুলোকে। আবাসগুলোর ওপাশে, যতদূর দৃষ্টি যায়, রয়েছে একের পর এক ফসলি জমি। চলে গেছে একেবারে সিউটা পর্যন্ত। শাহাদুর গোড়ায় নাড়া এক পাথরের উপর দুপা মেলে বসে আছে এক রাখালবালক, আনমনে বাজিয়ে চলেছে বাঁশের বাঁশি। সেই সুরে আন্দোলিত হয়ে উঠছে আকাশ-বাতাস… নেচে উঠছে সাগরের ঢেউ, ছুটে এসে আছড়ে পড়ছে সৈকতের বুকে।
পাহাড় বেয়ে, চাতালে উঠে এসেছু শাকের-আল–বাহার। তারপর উটের পশমে তৈরি একটা চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে আরাম করে। দুজন কাফ্রি ভৃত্যও এসেছে ওর সঙ্গে—বিশালদেহী পালোয়ান ওরা, কোমরে একপ্রস্থ কৌপিন ছাড়া আর কিছু নেই, তেল-চকচকে পুরো গায়ে কিলবিল করছে পেশি। চাতালের দুপাশে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে এরা। হাতে একটা করে তালপাতার পাখাও ধরে রেখেছে, পালা করে বাতাস দিচ্ছে মনিবকে, সেইসঙ্গে তাড়াচ্ছে মাছি।
জীবনের স্বর্ণ-সময় চলছে এখন শাকের-আল-বাহারের। লম্বা, মেদহীন, একহারা, দেহ। চওড়া বুকের ছাতি আর হাতের পেশিতে অমিতশক্তির আভাস। নাকটা বাজপাখির ঠোঁটের মত তীক্ষ্ণ, কালো দাড়িতে ঢাকা মুখটা সুদর্শন, মায়াময়। কিন্তু তারপরেও তাতে ফুটে থাকে অদ্ভুত এক রুক্ষতা। মাথায় রয়েছে সাদা একটা পাগড়ি, পরনে সাদা একটা শার্ট, তার উপরে দীর্ঘ সবুজ রেশমের টিউনিক–কিনারাগুলো সোনালি সুতোয় কারুকাজ করা। খাটো একটা পাজামা পরেছে, হাঁটুর তলায় গিয়ে শেষ হয়ে গেছে ওটা, পায়ের নিম্নাংশ উন্মুক্ত। পায়ের পাতা ঢেকে রেখেছে নকশাদার একজোড়া নাগরা জুতো-লাল চামড়ায় তৈরি, ডগাদুটো খুবই চোখা। অস্ত্র বলতে বড় একটা ছোরা রয়েছে শুধু শাকের-আল-বাহারের কাছে–কোমরে গোঁজা, বেরিয়ে আছে ওটার রত্নখচিত হাতল।
কয়েক গজ বাঁয়ে আরেকজন মানুষ রয়েছে–এ-ও সুঠামদেহী, উপুড় হয়ে আছে, কনুই-দুটো মাটিতে, চোখের উপর হাত দিয়ে রেখেছে রোদ থেকে বাঁচার জন্য। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সে সাগরের দিকে। শাকেরের মতই একহারা এবং শক্তিমান সে। বুকের উপর পরেছে একটা লোহার বক্ষাবরণ। মাথায়ও রয়েছে একটা শিয়োস্ত্রাণ। তার শরীরের পাশে মাটিতে পড়ে আছে একটা প্রমাণ আকারের খাপবদ্ধ তলোয়ার, দেখলেই ভয় জাগে। সে-ও সুদর্শন, তবে শাকেরের চেয়ে চেহারা অনেক বেশি হিংস্র। গায়ের চামড়া রোদে পোড়া, তামাটে।
সঙ্গীর দিকে মনোযোগ নেই শাকের-আল-বাহারের। তার দৃষ্টি পড়ে আছে পাহাড়ি ঢলের উপর, ওটা নানা প্রজাতির চিরহরিৎ গাছপালায় ছাওয়া। মেঘের ফাঁকফোকর দিয়ে তার উপর আছড়ে পড়ছে সূর্যের সোনালি রশ্মি। পাহাড়ের একটা অংশ নেমে গিয়ে মিশেছে সাগরের বুকে। সেখানে রয়েছে বড় বড় গুহা। গুহামুখের সম্মুখে অবারিত জলরাশি… টগবগ করে ফেনাময় নীলচে-সবুজ ঢেউ ভাঙছে সবখানে। ছোট একটা খাঁড়ির মত আছে, তাতে নোঙর করে আছে তিনটে পালতোলা জাহাজ। প্রথম দুটো বেশ বড়–একেকটায় পঞ্চাশটা দাঁড়; তৃতীয়টা একটু ছোট–ত্রিশটা দাঁড় আছে ওতে। এ-মুহূর্তে সবগুলো দাঁড় তুলে রাখা হয়েছে, জাহাজগুলোকে দেখাচ্ছে পাখা-মেলা রাজহাঁসের মত। এক নজরেই বোঝা যায়, জাহাজগুলো ওখানে ঘাপটি মেরে আছে শিকারের আশায়।
পানির উপর দিয়ে তারিফা প্রণালীতে চোখ বোলাল শাকের-আল-বাহার। গ্রীষ্মের আর্দ্র বাতাস ভেদ করে আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে ইয়োরোপের তটরেখা। এই পটভূমির মাঝখানে রয়েছে একটা সাদা পালতোলা সওদাগরি জাহাজ, প্রণালীর চার মাইল দূর দিয়ে সাবলীল গতিতে ভেসে চলেছে ওটা। পুব দিক থেকে ধেয়ে আসা হাওয়ায় ফুলে উঠেছে পাল। সন্দেহ নেই, চোখে দূরবীন লাগিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে আফ্রিকান উপকূল পর্যবেক্ষণ করছে জাহাজের ক্যাপ্টেন। এদিকটায় এলেই যে খ্রিস্টান জাহাজগুলোকে স্থানীয় জলদস্যুদের কবলে পড়তে হয়, তা অজানা থাকার কথা নয় তার। নিশ্চয়ই সতর্ক হয়ে আছে লোকটা।
মুচকি হাসি ফুটল শাকের-আল-বাহারের ঠোঁটের কোণে। যত সতর্কই হোক ক্যাপ্টেন, অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যৎ-কে ঠেকাবার কোনও উপায় নেই তার। দূরবীন দিয়ে আঁতিপাতি করে খুঁজেও খুঁড়িতে লুকানো জাহাজগুলোকে দেখতে পাবে না সে। বুঝতেই পারবে না, ফাঁদের ভিতর পা দিতে চলেছে। উঁচু পাহাড় থেকে এখন তাই বাজপাখির মত শিকারের দিকে নজর রাখছে শাকের, হামলা চালাবার উপযুক্ত দূরত্বে পৌঁছুনোর অপেক্ষায় আছে।
প্রণালীর পুবদিকে সাগরের পানি ভেদ করে উঠে এসেছে চওড়া একটা শৈলপ্রাচীর, ওটার গায়ে বাধা পায় বায়ুপ্রবাহ আর সাগরের স্রোত। উপর থেকে তাকিয়ে প্রাচীরের এই প্রভাব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ও। বাড়ি খেয়ে বদলে গেছে স্রোতের গতিপথ আর তীব্রতা। বাতাসও ওখানে আটকা পড়ায় উল্টো দিকটাতে সৃষ্টি হয়েছে মন্দা হাওয়া। সোজা কথায় ওটা একটা ফাঁদ। দক্ষ নৌ-চালক ওটা দূর থেকে লক্ষ করবে, চেষ্টা করবে জায়গাটা এড়িয়ে যাবার… কিন্তু কথা হলো, সব জাহাজের চালক একই রকম দক্ষ নয়। নিজের অজান্তেই তারা পা দিয়ে বসে ফাঁদ-তুল্য জায়গাটায়। আজকের এই জাহাজও তা-ই করে কি না, সেটাই এখন দেখবার বিষয়।
কোর্স বদলাল না জলযানটা, একটু পরেই শৈলপ্রাচীরের আধমাইলের মধ্যে পৌঁছে গেল। তা দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠল দীর্ঘদেহী জলদস্যু। ঝট করে ফিরল শাকেরের দিকে। বলল, আসছে… এদিকেই আসছে জাহাজটা!
ইনশাল্লাহ? নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল শাকের।
উত্তেজনাকর নীরবতা নেমে এল চাতালে। আরও কাছে চলে এসেছে জাহাজটা। কালচে খোলের খুঁটিনাটি চোখে পড়ছে এবার। মাস্তুলের ডগায় পত পত করতে থাকা পতাকার দিকে তাকাল শাকের-আল-বাহার। লাল আর হলুদ রঙের পটভূমিতে তাতে ফুটে আছে একটা দুর্গ আর সিংহের মাথার ছবি।
স্প্যানিশ গ্যালিয়ন, বিস্কেন, হাসিমুখে বলল ও। কী ভাগ্য আমাদের! আল্লাহর অশেষ দয়া!
এদিকে ঢুকবে নাকি? জিজ্ঞেস করল বিস্কেন।
অবশ্যই! নিশ্চিত শোনাল শাকেরের কণ্ঠ। বিপদের ভয় করছে না ওরা। এত পশ্চিমে সাধারণত আসি না আমরা। ওই তো, মুখ ঘোরাচ্ছে। স্প্যানিশ গৌরব নিয়ে আমাদের কাছেই আসছে ওরা।
শৈলপ্রাচীরের পিছনের মন্দা বাতাসে পড়ে গেছে গ্যালিয়ন। উপায়ান্তর না দেখে প্রণালীর ভিতরে ঢুকতে বাধ্য হচ্ছে ক্যাপ্টেন। এদিক দিয়ে জায়গাটা পেরিয়ে যাবার ইচ্ছে।
হামলা করা দরকার… এখুনি! হড়বড় করে বলল বিস্কেন-আল-বোরাক। বিদ্যুৎবেগে তলোয়ার চালাবার দক্ষতার কারণে এ-নাম পেয়েছে সে। অধৈর্য হয়ে উঠেছে।
তাড়াহুড়োর কিছু নেই, শান্ত রইল শাকের। যত কাছে আসবে, ততই ওদের সর্বনাশ নিশ্চিত হবে। হামলার সঙ্কেত দেবার আগে যথেষ্ট সময় আছে। কাফ্রি এক ভৃত্যের দিকে ফিরল। আমাকে কিছু পান করতে দাও, আবাইদ। গলা শুকিয়ে গেছে।
মাথা ঝাঁকিয়ে পায়ের কাছ থেকে একটা মাটির পাত্র তুলে। নিল লোকটা। তালপাতা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা হয়েছে, ওটার বাঁধন খুলল। তারপর একটা ছোট কাপে ঢালল খেজুরের রস। বাড়িয়ে ধরল মনিবের দিকে। শিকারের দিক থেকে চোখ ফেরাল শাকের-আল-বাহার, আস্তে আস্তে চুমুক দিল কাপে। একেবারে কাছে চলে এসেছে গ্যালিয়ন, খুঁটিনাটি দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। পাটাতনের উপর চলাফেরা করছে নাবিকের দল, মাস্তুলের উপর রাখা হয়েছে পাহারাদার-বিপদের পূর্বাভাস পাবার জন্য। তবে পাথরসারির পিছনে থাকা খাড়িটা এখনও তাদের দৃষ্টির আড়ালে।
খাঁড়ির আধমাইলের মধ্যে জাহাজটা পৌঁছে যেতেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল শাকের। গলায় বাঁধা সবুজ রুমাল খুলে নিয়েছে, ওটা উঁচু করে নাড়ল, সঙ্কেত দিল নিজের জাহাজগুলোকে। পরমুহূর্তে ওদিক থেকে ভেসে এল শিঙার আওয়াজ, মাল্লাদেরকে নির্দেশ দেয়া হলো ওভাবে। পানিতে একযোগে সবকটা দাঁড় নামানোর আওয়াজ শোনা গেল। চোখের পলকে খাড়ি থেকে বেরিয়ে এল বিশাল দুই দস্যু-জাহাজ। পাটাতনের উপরে কিলবিল করছে পাগড়ি-পরা সশস্ত্র জলদস্যুর দল। সূর্যের আলোয় ঝকমক করছে তাদের হাতে ধরা তলোয়ার। মাল আর বো-র কাছে রয়েছে বিশেষ দুটো দল, তারা তীর-ধনুক তাক করে রেখেছে শিকারের দিকে। সে এক ভয়-জাগানো দৃশ্য!
আকস্মিক এই আক্রমণের জন্য একেবারেই তৈরি ছিল না স্প্যানিয়ার্ড-রা। বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ল তাদের মধ্যে। ঠিকমত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারল না। শুরু হলো মহা হট্টগোল। আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে ছুটোছুটি করতে থাকল তারা। মরিয়া হয়ে পিঠটান দিতে চাইল ক্যাপ্টেন। কিন্তু চাইলেই কী তা হয়? সরু প্রণালীর মধ্যে মুখ ঘোরাতে গিয়ে বরং বাতাসের আনুকূল্য হারাল সে। ন্যাতানো কাপড়ের মত ঝুলে পড়ল পাল, প্রায় থেমে গেল গ্যালিয়ন। তাড়াতাড়ি দাঁড় নামানো হলো, ধীরে ধীরে উল্টো পথে চলতে শুরু করল জাহাজ। পিছু পিছু শিকারী বাঘের মত ধেয়ে এল দস্যুরা।
এতকিছু দেখবার জন্য উপরে বসে নেই শাকের-আল বাহার। হামলার নির্দেশ দিয়েই চাতাল থেকে নামতে শুরু করেছে ও। ঢালের গায়ে জন্মানো গাছপালার ডাল ব্যবহার করছে, বানরের মত দক্ষতায় লাফিয়ে নামছে এক পাথর থেকে আরেক পাথরে। কষ্টেসৃষ্টে ওর সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে বিস্কেন আর দুই কাফ্রি ভৃত্য। একটু পরেই ওরা নেমে এল সৈকতে। জায়গাটা ঠিক খাড়ির পারে। ছোট একটা নৌকা অপেক্ষা করছিল, সেটায় চড়ে দ্রুত ওরা উঠে এল পিছনে রয়ে যাওয়া ছোট জাহাজটাতে। হুকুম পেতেই খ্রিস্টান ক্রীতদাসরা দাঁড় নামাল পানিতে। শুরু করল দাঁড় টানা। পাটাতনের উঁচু একটা জায়গায় অবস্থান নিল শাকের-আল-বাহার। দুপা ফাঁক করে, হাতে তলোয়ার নিয়ে বীরোচিত ভঙ্গিমায় দাঁড়াল। ওর পিছনে, মাস্তুলের উপরে সদর্পে উড়ছে কর্সেয়ার-দের পতাকা-লাল পটভূমিতে একটা উজ্জ্বল সবুজ কাস্তের মত চাঁদ।
সামনে তখন যুদ্ধ বেধে গেছে। তাড়াহুড়ো করে একবার কামান দাগল স্প্যানিয়ার্ড-রা, কিন্তু লাগাতে পারল না আগ্রাসী জাহাজদুটোয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই তাদের নাগাল পেয়ে গেল দস্যুরা। লোহার আঁকশি ছুঁড়ল, সেটা গিয়ে আটকাল ডানদিকের বুলওঅর্কে। দড়ি টেনে স্প্যানিশ গ্যালিয়নের গায়ে ভিড়ল জলদস্যুদের একটা জাহাজ। অবিরাম তীর ছুঁড়ে স্প্যানিয়ার্ডদের কোণঠাসা করে রাখা হলো, আর সে-সুযোগে লাফ দিয়ে ওদের জাহাজে চড়ল তলোয়ার আর ছোরাধারী দস্যুরা। প্রত্যেকের চোখে-মুখে নগ্ন আক্রোশ–এই স্প্যানিয়ার্ড-রাই আন্দালুসিয়ান মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করেছিল মূর-দেরকে। একটু পরে দ্বিতীয় জাহাজটাও চলে এল অন্যপাশে। ওদিক থেকে হামলা চালাল আরেকদল।
লড়াইটা হলো সংক্ষিপ্ত। শুরু থেকেই বিভ্রান্ত ছিল স্প্যানিয়ার্ডরা। আকস্মিক হামলায় হতভম্ব হয়ে পড়েছে তারা। লড়াইয়ের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেবার সময় পায়নি। প্রাথমিক আঘাতেই বেশ কিছু লোক নিহত হলো। এরপর নিজেদের কিছুটা গুছিয়ে নিল ওরা, সাহসিকতার সঙ্গে যতটা পারে প্রতিরোধ গড়ে তুলল। কিন্তু অকুতোভয় কর্সেয়ার-দের সামনে সে-সব কিছুইনা। আল্লাহ আর নবীর নামে যুদ্ধ করছে তারা, মৃত্যুর পরোয়া নেই। বরং মরে গিয়ে শহীদ হবার প্রতিই তাদের আগ্রহ বেশি। বলা বাহুল্য, এমন পাগলাটে দস্যুদের সঙ্গে পেরে ওঠার কথা নয় কারও। অকাতরে খুন হয়ে গেল স্প্যানিশ নাবিকেরা। লোকবল যখন চারভাগের একভাগে নেমে এল, তখন বাধ্য হলো আত্মসমর্পণ করতে।
শাকের-আল-বাহার যখন ছোট জাহাজটা নিয়ে গ্যালিয়নের পাশে পৌঁছুল, তখন শেষ হয়ে গেছে লড়াই। স্প্যানিশ জাহাজের মাস্তুল থেকে খুলে নেয়া হয়েছে রাজকীয় পতাকা, আর তার তলায় ঝুলতে থাকা কাঠের কুশ; সেখানে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে কর্সেয়ারদের সবুজ চাঁদঅলা ঝাণ্ডা। বিজয়ের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল দস্যুদের মাঝে। সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল তারা:
আলহামদুলিল্লাহ!
গ্যালিয়নে উঠে এল শাকের-আল-বাহার। এগোল ভিড়ের মাঝ দিয়ে। ওকে দেখে ঝটপট সরে গেল দস্যুরা, বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে। দুহাতে তলোয়ার উঁচিয়ে শুরু করল স্লোগান–জয়ধ্বনি . দিল সাগরের বাজপাখির নামে। যদিও আসল লড়াইয়ে অংশ নেয়নি, তারপরেও ওর-ই নিখুঁত পরিকল্পনার কারণে সফল হয়েছে আজকের অভিযান। সমস্ত প্রশংসা ওর-ই প্রাপ্য।
গ্যালিয়নের পাটাতন রক্তে মাখামাখি, সাবধানে না হাঁটলে পিছল খেতে হবে। তার মাঝে তূপ হয়ে পড়ে আছে নিহত স্প্যানিয়ার্ডদের লাশ। শাকেরের ইশারায় ওগুলো সাগরে ফেলে দিতে শুরু করল দস্যুরা। সুস্থ বন্দিদেরকে এনে জড়ো করা হলো মাস্তুলের গোড়ায় নিরস্ত্র, ভয়ে কাঁপতে থাকা অবস্থায়।
ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল শাকের। গম্ভীর চোখে নিরীখ করল বন্দিদেরকে। সংখ্যায় শখানেকের মত হবে। অভিযাত্রীর দল… ভাগ্য গড়বার আশায় ক্যাডিয থেকে ভারতবর্ষে যাচ্ছিল। কপাল খারাপ, যাত্রা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। ভাগ্য বদলাবে ওদের ঠিকই, তবে সেটা দাস হিসেবে। আলজিয়ার্স বা তিউনিসে নিয়ে গিয়ে ধনী মূর-দের কাছে বিক্রি করে দেয়া হবে ওদেরকে।
সময় নিয়ে সবাইকে দেখল শাকের-আল-বাহার। শেষ পর্যন্ত ওর দৃষ্টি থামল গ্যালিয়নের ক্যাপ্টেনের উপরে। অধীনস্থদের চেয়ে দুপা সামনে এগিয়ে দাঁড়িয়েছে লোকটা, এ-পরিস্থিতিতেও নিজেকে আলাদা করে দেখাতে চাইছে। পরাজয়ের গ্লানিতে চেহারা মলিন, দুচোখে জ্বলজ্বল করছে নিষ্ফল আক্রোশ। দামি একটা পোশাক তার পরনে, রেশমের তৈরি টুপির কিনারে শোভা পাচ্ছে পাখির পালক, কপালের উপরে রয়েছে একটা সোনার ক্রুশ।
কপালের কাছে হাত তুলে তাকে ইসলামি কায়দায় সালাম জানাল শাকের। তারপর চোস্ত স্প্যানিশে বলল, যুদ্ধের ফসল, সেনিয়র ক্যাপিতান! আপনার নামটা জানতে পারি?
আমি ডন পাওলো দ্য গুযম্যান, বুক চিতিয়ে বলল লোকটা। শক্রর সামনে নিজের আত্মমর্যাদা বজায় রাখার ক্ষীণ প্রচেষ্টা আর। কী।
আহ্! আপনি তো তা হলে সম্ভ্রান্ত পরিবারের ভদ্রলোক। যদ্র দেখছি, শিক্ষিত এবং সবলও বটে। আলজিয়ার্সের বাজারে দুইশ দিনারে বেচা যাবে আপনাকে। তবে… চাইলে নিজের মুক্তি কিনে নিতে পারেন। তার জন্যে পাঁচশো দিনার খরচ করতে হবে।
জাহান্নামে যাও! ঈশ্বরের নামে অভিশাপ দিচ্ছি তোমাকে… চেঁচিয়ে উঠল ডন পাওলো।
মুখ বাঁকাল শাকের। বলল, বেশ, তা হলে আপনার এই অভদ্রতার কারণে মুক্তিপণের পরিমাণ এক হাজার দিনার নির্ধারণ করা হলো। অ্যাই, নিয়ে যাও ওঁকে। ভালমত খাতিরদারি করো, তাতে যদি বুদ্ধি খোলে ভদ্রলোকের!
টেনে-হেঁচড়ে ক্যাপ্টেনকে নিয়ে গেল দুই দস্যু।
বাকিদের পিছনে বেশি সময় খরচ করল না শাকের। জানিয়ে দিল, যদি কেউ চায়, ওর অধীনে কাজ করতে পারে। তাদের মুক্তিপণ ও নিজেই পরিশোধ করবে। তিনজনের সাড়া পাওয়া গেল তাতে। অবশিষ্ট বন্দির্দেরকে সহকারী বিস্কেনের হাতে তুলে দিল শাকের। তার আগে গ্যালিয়নের সারেংকে জিজ্ঞাসাবাদ করল, জাহাজে কোনও ক্রীতদাস আছে কি না। জানা গেল, জনা-বারো আছে। তিনজন ইহুদি, সাতজন মুসলমান আর দুজন নাস্তিক। লড়াই শুরু হতেই তাদেরকে পাটাতনের নীচে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
ক্রীতদাসদেরকে খুঁজে নিয়ে আসা হলো। মুসলমানরা স্বধর্মীদের দেখা পেয়ে আবেগে আপ্লুত হলো, ওখানেই বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে, কৃতজ্ঞতা জানাল আল্লাহ্র প্রতি। তিন ইহুদিও খুশি হলো–খ্রিস্টানদের চেয়ে মুসলমানদেরকে তারা বেশি আপন ভাবে। অন্তত স্প্যানিয়ার্ডদের মত অত্যাচার চালায় না এরা। প্রতিক্রিয়াহীনভাবে দাঁড়িয়ে থাকল শুধু দুই নাস্তিক। ওদের কাছে খ্রিস্টান-মুসলমান একই কথা। কারও কাছ থেকেই সাহায্য পাবার আশা নেই। ওদের একজনকে একটু বেশিই বিতৃষ্ণ দেখাল। লোকটা সুঠামদেহী, তবে বয়স্ক। ছেঁড়া ন্যাকড়ায় পরিণত হয়েছে পরনের পোশাক। মুখ-ভর্তি চুল-দাড়ি এককালে লাল ছিল, এখন ধূসর হতে শুরু করেছে। হাতের চামড়ায় কালো কালো ফুটকি।
লোকটা শাকের-আল-বাহারের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বিষণভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে–জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক সৈনিকের মত। আশা-আকাঙ্ক্ষা আর স্পৃহা বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই, যেন মেনেই নিয়েছে ক্রীতদাস হিসেবে তাকে মরতে হবে। কেন যেন মানুষটাকে চেনা চেনা লাগছে।
কয়েক পা এগোল শাকের, সামনে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল ক্রীতদাসটিকে। সামনে ওর উপস্থিতি টের পেয়ে লোকটাও মাথা তুলল। চোখাচোখি হলো ওদের, কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থির হলো দুজনের দৃষ্টি। ধীরে ধীরে বিস্ফারিত হলো দুজোড়া চোখই।
ভুল দেখছি না তো! চরম বিস্ময়ে বলে উঠল ক্রীতদাস, ইংরেজিতে কথা বলছে। চমক সামলাবার জন্য একটু অপেক্ষা করল সে। হঠাই হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। খুব পরিচিত ভঙ্গিতে লোকটা বলল, শুভ অপরাহ্ন, সার অলিভার। ধরে নিচ্ছি আমাকে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ফাঁসিতে ঝোলাবেন আপনি।
ইয়া আল্লাহ্! ফিসফিসাল শাকের-আল-বাহার।
.
০২.
দলত্যাগী
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, দুধর্ষ জলদস্যু শাকের-আল-বাহার এবং এককালের বীর নাইট সার অলিভার ট্রেসিলিয়ান এক ও অভিন্ন ব্যক্তি। কিন্তু কীভাবে ঘটল এই অদ্ভুত রূপান্তর? কর্নওয়ালের সম্ভ্রান্ত পরিবারের অভিজাত এক ভদ্রলোক কেমন করে পরিণত হলো ভূমধ্যসাগরের ত্রাসে, আলজিয়ার্সের বাদশাহ্ আসাদ আদ-দীনের প্রিয়পাত্রে, কিংবা খ্রিস্টানদের পরম শত্রুতে? সংক্ষেপে এবার সেটাই বলা যাক।
সোয়ালো ডুবে যাবার পর সাগর থেকে যাদেরকে স্প্যানিশ জাহাজটা তুলে নেয়, তাদের মধ্যে ছিল অলিভার এবং জ্যাসপার লেই। বন্দিদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় লিসবনে, হস্তান্তর করা হয় পবিত্র চার্চের আদালতের জিম্মায়। বলে রাখা ভাল, নাবিকদের বেশিরভাগই ছিল নাস্তিক; পারিবারিকভাবে খ্রিস্টান হলেও অলিভারও কোনোদিন ধর্মকর্ম নিয়ে মাথা ঘামায়নি। যা হোক, এসব ধর্মহীন মানুষদেরকে খ্রিস্টান হিসেবে দীক্ষিত করবার জন্য পাঠানো হয় সেইন্ট ডমিনিকের সন্ন্যাসীদের অধীনে। জীবন বাঁচানোর জন্য বাকিদের পাশাপাশি ওরা দুজনও মেনে নেয় ব্যাপারটা।
পাপের পথ থেকে এতজন মানুষকে ফিরিয়ে আনতে পারার আনন্দে কদিন পরেই বিশাল উৎসবের আয়োজন করা হলো পবিত্র গৃহে। সেখানে হাতে প্রদীপ আর মুখে ঈশ্বরের জয়গান গেয়ে নবদীক্ষার পরীক্ষা দিতে হলো বন্দিদেরকে। চরম বিতৃষ্ণা নিয়ে তাতে অংশগ্রহণ করল অলিভার আর লেই। ধর্মযাজকদেরকে সন্তুষ্ট করবার পর মুক্তি মিলল চার্চের হাত থেকে। তবে ব্যাপারটার সমাপ্তি ঘটল না ওখানে।
ধর্মীয় বিভাগ থেকে এবার ওদের মামলা চলে গেল আইনের আদালতে। সাগরে দস্যুতা এবং অবৈধ কার্যক্রমের অভিযোগে শুরু হলো বিচার। নামে বিচার, আসলে ওটা প্রহসন ছাড়া আর কিছু না। আত্মপক্ষ সমর্থন করে বেশ ভালমতই লড়ল ক্যাপ্টেন লেই, কিন্তু বিচারকেরা সাক্ষ্য-প্রমাণ শুনবার আগেই ঠিক করে রেখেছে রায়। অলিভারও উপস্থাপন করলাম নিজের সাফাই আদালতকে জানাল, ও সোয়ালো জাহাজের ক্রু নয়, বরং তাদের অপহরণের শিকার। নিজের আসল পরিচয়ও দিল ওখানে। তাতে বরং কয়েক গুণ বড় বিপদের মধ্যে পড়ল। স্প্যানিয়ার্ড-দের নৰ্থি-সংরক্ষণ পদ্ধতি যে কত নিখুঁত, তা জানা হয়ে গেল। চব্বিশ ঘণ্টা না যেতেই সার অলিভার ট্রেসিলিয়ানের সমস্ত কীর্তির বিবরণ হাজির করল প্রতিপক্ষের উকিল। বলা বাহুল্য, সেগুলো আসলে স্প্যানিশ আর্মাডার বিরুদ্ধে ব্রিটেনের লড়াইয়ে ওর হাতে ঘটা ক্ষয়ক্ষতির হিসেব-নিকেশ। এরপরে বিচারকদের কাছ থেকে কোনও ধরনের সহানুভূতি পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
শেষ পর্যন্ত যা ঘটবার তা-ই ঘটল। ওদেরকে দোষী বলে রায় দিল আদালত। শোনাল মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি। ফাঁসিতে ঝুলে মরণই কপালে ছিল ওদের, বেঁচে গেল স্রেফ ভাগ্যের জোরে। সে-সময়ে ভূমধ্যসাগরের স্প্যানিশ জাহাজগুলো ভীষণরকম লোক-সঙ্কটে ভুগছিল, তাই মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করে জোয়ান-তাগড়া বন্দিদেরকে পাঠানো হলো ওসব জাহাজে ক্রীতদাস হিসেবে কাজ করবার জন্য। ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে ওদেরকে পর্তুগাল থেকে স্পেন, তারপর ক্যাডিযের বন্দরে নিয়ে যাওয়া হলো। ওখানেই ক্যাপ্টেন লেইকে শেষবার দেখে অলিভার, রাজকীয় একটা গ্যালিয়নের দাঁড় টেনে বন্দর থেকে লোকটা বেরিয়ে যাবার সময়।
ক্যাডিযের এক খোয়াড়ের মত বন্দিশালায় মাসখানেক কাটায় অলিভার। সে এক নরকতুল্য পরিবেশ-রোগব্যাধি, ময়লা আবর্জনা আর উচ্ছিষ্ট খাবার মিলিয়ে অসহনীয় এক অবস্থা। বুনো শূকরকেও কেউ অমন জায়গায় রাখে না। ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ল অনেকে, মারাও গেল… যারা টিকল, তারা প্রতি মুহূর্তে কামনা করল মৃত্যু। যা হোক, মাসশেষে এক অফিসার উদয় হলো ওখানে, নিজের জাহাজের জন্য দাস জোগাড় করতে এসেছে। বাছাই করে বেশ কিছু লোক নিল, তাদের মধ্যে স্থান পেল অলিভার। মনে হলো যেন ত্রাতা হিসেবে হাজির হয়েছে লোকটা।
পঞ্চাশটা দাঁড়অলা বিশাল এক জাহাজে ওঠানো হলো ওদেরকে, একেকটা দাঁড় টানতে সাতজন মানুষ লাগে। নেপলসে যাচ্ছে জাহাজটা। গ্যাঙওয়ের পাশের একটা দাড়ের পিছনে বসানো হলো অলিভারকে। সেখানে, কাঠের তক্তার উপর বসে, শেকলপরা ও অর্ধনগ্ন অবস্থায় ভয়ঙ্কর ছটা মাস কাটাল ও। তক্তাটা মাত্র দশফুট লম্বা, তাতে গাদাগাদি করে বসত সাতজন মাল্লা। দাঁড় টানা, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম…. সব ওই ছোট্ট জায়গাতেই করতে হতো। ছমাসের জন্য ওটাই ছিল ওর দুনিয়া।
জাহাজের ক্রীতদাসের জীবনূতের মত জীবন বদলে দিল অলিভারকে। পোড়-খাওয়া, শক্তপোক্ত এক মানুষ হয়ে উঠল ও। হারিয়ে গেল আবেগ-অনুভূতি। নেপলসের প্রথম যাত্রাটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। টানা আট থেকে দশ ঘণ্টা দাঁড় টানতে হতো ওদেরকে, এক মুহূর্ত বিশ্রাম পাওয়া যেত না। সে-চেষ্টা করলে উন্মুক্ত পিঠের উপর জুটত চাবুকের আঘাত, হতে হতো রক্তাক্ত। চিকিৎসা জুটত না, মুছতে দেয়া হতো না রক্তও। একটাই কাজ ছিল ওদের-দাঁড় টানা। সামনে-পিছনে… সামনে-পিছনে। হাত আর কাঁধের পেশি টন টন করত, ঘোলা হয়ে আসত চোখের দৃষ্টি, তবু থামাথামি নেই। পানির আওয়াজ, দাঁড়ের কাঁচকোচ, শেকলের ঝনঝনানি… এই-ই ছিল ওদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এভাবেই কাটল সময়। দিনের বেলা সূর্যের প্রখর রোদে চামড়া ঝলসাল, রাতের কুয়াশায় আবার হলো ঠাণ্ডা। সারা গায়ে পড়ল ময়লার আস্তর, মুখ ঢেকে গেল জট পাকানো চুল-দাড়িতে। মাঝে-মধ্যে বৃষ্টির পানিতে শরীর ধুয়ে যায়, নইলে দুর্গন্ধে দম আটকে মরতে হতো। খাবার বলতে শুকনো বিস্কুট বা বাসি ভাত… এমনকী পরিষ্কার পানিও মিলত না ঠিকমত। কঠোর পরিশ্রম আর খাদ্যাভাবে শরীর শুকিয়ে দড়ির মত হতে থাকল ক্রীতদাসদের।
একবারের সমুদ্রযাত্রায় স্কার্ভি ছড়াল জাহাজে, মাল্লাদের মাঝে অন্যান্য রোগব্যাধি তো আছেই। জীবন কতটা মূল্যহীন, তা সে-বারই প্রথম প্রত্যক্ষ করল অলিভার। সংক্রমণের ভয়ে মৃতদের পাশাপাশি অসুস্থদেরকেও পানিতে ছুঁড়ে ফেলল নাবিকরা। এভাবে… রোগে ভুগে কিংবা পরিশ্রমের ধকল সহ্য করতে না পেরে প্রথম মাসেই মারা গেল অনেক ক্রীতদাস। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মৃত্যুর হার আরও বাড়ল। তবে তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই স্প্যানিয়ার্ডদের। একেকটা বন্দরে থামে, আর নতুন দাস জোগাড় করে ওরা। অসাধারণ প্রাণশক্তি যাদের আছে, তারাই কেবল টিকে রইল শেষ পর্যন্ত।
হাতে গোনা সে-সব সৌভাগ্যবানদের মধ্যে অলিভার একজন। আরেকজন হচ্ছে ওর-ই এক প্রতিবেশী, যুবক এক মূর… পাশাপাশি বসে দাঁড় টানে ওরা। সঙ্গীটি শুরু থেকেই নজর কেড়েছে ওর। বলিষ্ঠ, নির্বিকার… কোনও ব্যাপারেই অভিযোগ নেই তার মধ্যে। শান্তভাবে যেন মেনে নিয়েছে অদৃষ্টকে। শুরুতে বেশ কিছুদিন কোনও কথা হয়নি ওদের মধ্যে। হাজার হোক, সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মের দুজন মানুষ, চোখের পলকে একাত্ম হতে পারার কথা না। তবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কমে এল ওদের মধ্যকার দূরত্ব, দুই দুর্ভাগা ভুলে গেল ধর্মের বিভেদ, হয়ে উঠল পরস্পরের সমব্যথী।
এক সন্ধ্যায় ইহুদি এক দাস অসুস্থ হয়ে পড়ল। মরণাপন্ন দশা, বাঁচার আশা নেই। ওর পিছনে সময় নষ্ট করতে রাজি হলো না স্প্যানিয়ার্ডরা। শেষ নিঃশ্বাস ফেলবার আগেই হতভাগ্য মানুষটিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হলো সমুদ্রে। দৃশ্যটা এতই মর্মান্তিক যে, দুঃখ আর ব্যথায় ভরে উঠল অলিভারের অন্তর। গাল দিয়ে বসল গোটা খ্রিস্টান জাতিকে। পাশে বসা মূরের দিকে ফিরে বলল:
আমার ধারণা, নরক তৈরিই করা হয়েছে খ্রিস্টানদের জন্য। তাই ওরা দুনিয়াকেও নরকে পরিণত করছে।
কপাল ভাল, ঢেউ আর দাঁড় টানার আওয়াজে চাপা পড়েছে ওর কণ্ঠ। স্প্যানিয়ার্ডদের কানে ওর শাপ-শাপান্ত গেলে কী ঘটত বলা যায় না। তবে মূর কথাটা ঠিকই শুনতে পেয়েছে। জ্বলজ্বল করে উঠল তার চোখের দৃষ্টি।
এরচেয়ে সাত গুণ উত্তপ্ত দোজখ অপেক্ষা করছে ওদের জন্য, ভাই, বলল সে। কণ্ঠে দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু… তুমি নিজেও কি খ্রিস্টান নও?
এই মুহূর্ত থেকে ওই ধর্মকে ত্যাগ করলাম আমি, বলল অলিভার। যে-ধর্মের নামে এমন অনাচার চলে, তাকে আমি স্বীকার করি না। তাকিয়ে দেখো ওই পাষণ্ডগুলোর দিকে। ঈশ্বরের পুজো করে, নিজেদেরকে ধার্মিক বলে পরিচয় দেয়। কী জানে ওরা ধর্মের? দামি মদ, ভাল খাবার আর সুন্দরী মেয়েমানুষ ছাড়া আর কিছুই চেনে না ওরা। মানুষকে যদি মানুষ বলেই মর্যাদা না দিল, তা হলে কী মূল্য ওই ধর্মের? রেগে গেল ও। চুলোয় যাক খ্রিস্টান জাত আর খ্রিস্টধর্ম। আমি আর ওসব মানি না।
কিন্তু তারপরেও আমরা আল্লাহর বান্দা, বলল ওর সঙ্গী। তার কাছেই একসময় ফিরে যেতে হবে আমাদেরকে।
সেদিন থেকে পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠল অলিভার আর এই মূর… তার নাম ইউসুফ-বিন-মুখতার। ইংরেজ সঙ্গীটির প্রতিক্রিয়া দেখে বিশ্বাস জন্মাল মুসলিম যুবকটির মধ্যে আল্লাহ ওর দৃষ্টি খুলে দিতে শুরু করেছেন, সত্যিকার ধর্মবিশ্বাসকে গ্রহণ করবার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠেছে অলিভার। ইউসুফ নিজেও ধর্মপ্রাণ, অবিশ্বাসীদেরকে আল্লাহর রাস্তায় আনাকে পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করে। তাই সেদিন থেকে ধীরে ধীরে অলিভারকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ধারণা দিতে শুরু করল ও। বর্ণনা করতে থাকল আল্লাহর মাহাত্ম। পরম করুণাময়ের প্রতি বিধর্মী বন্ধুটির অনুরাগ সৃষ্টি করবার প্রয়াস আর কী।
খুব যে প্রভাবিত হলো অলিভার, তা নয়। প্রতিক্রিয়াহীনভাবে ইউসুফের বক্তব্য শুনে গেল ও। মনে হলো, নতুন কিছু নয় এসব। খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কেও এ-ধরনের প্রশংসা প্রচুর শুনেছে। তবে মনের কথা মুখে প্রকাশ করল না। নতুন বন্ধুটিকে কষ্ট দেবার কোনও ইচ্ছে নেই ওর। দুর্ভাগ্যে ভরা জীবনে একজন সঙ্গী পাওয়াও মস্ত ব্যাপার। তাই নীরবে শুনল ইউসুফের সব কথা, কখনও কখনও আলোচনাতেও অংশ নিল। দুজনের মধ্যকার এই আলাপচারিতার ফল হিসেবে মাসছয়েক পর দেখা গেল, আরবী ভাষা শিখে গেছে অলিভার, আঁফ্রিকান উপকূলের খাঁটি অধিবাসীদের মতই বলতে পারছে ভাষাটা।
যা হোক, ষষ্ঠ মাসের শেষে বিশেষ একটা ঘটনা ঘটল… আর সেটাই ক্রীতদাসের জীবন থেকে মুক্তি এনে দিল অলিভারকে। ততদিনে একেবারে বদলে গেছে ও। হাত-পা হয়ে গেছে পাথরের মত শক্ত, তাতে হাতির মত শক্তি। দাঁড় টানার কাজটাই এমন–হয় কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মরতে হবে, কিংবা পরিণত হতে হবে পুরোদস্তুর অতিমানবে। অলিভারের বেলায় দ্বিতীয়টা ঘটেছে। ছমাসের হাড়ভাঙা পরিশ্রম রক্তমাংসের দেহকে বানিয়ে ফেলেছে খাঁটি লোহা–যা কখনও ক্লান্ত হয় না, কখনও দম হারায় না… কোনও ধরনের দৈহিক কষ্টের সামনে ভেঙে পড়ে না।
জেনোয়া থেকে ফিরছিল জাহাজ, বালেরিক দ্বীপপুঞ্জের মিনোর্কা-র কাছে পৌঁছুতেই হঠাৎ মুসলিমদের চার জাহাজের এক নৌ-বহর বহর হামলা করল ওদের উপর। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল স্প্যানিয়ার্ডদের মধ্যে, ক্ষণে ক্ষণে শোনা গেল একটামাত্র নাম-আসাদ-আদ-দীন… কর্সেয়ারদের নেতা, দুধর্ষ মুসলিম বীর। জাহাজগুলো নাকি তার-ই! বেজে উঠল দামামা আর শিঙা, ছুরি-তলোয়ার-বর্শা… যে যা পেল, তা-ই নিয়ে তৈরি হলো নাবিকরা নিজেদের জীবন আর জাহাজকে রক্ষা করতে। গোলন্দাজ-রা ছুটে গেল কামানের কাছে, কিন্তু ওগুলোকে গোলা ছুঁড়বার জন্য তৈরি করতে প্রচুর সময় লেগে গেল। হামলার আশঙ্কা করেনি স্প্যানিয়ার্ড-রা, কামানের গোলা-বারুদ সযত্নে রেখে দিয়েছিল পাটাতনের তলায়। সেগুলো বের করে আনতে না আনতেই পৌঁছে গেল কর্সেয়ার-রা। একপাশ থেকে অনেকগুলো আঁকশি এসে আটকে গেল বুলওঅর্কে, ওগুলোর পিছনে বাঁধা দড়ির টানে আসাদ-আদ-দীনের জাহাজ পাশ থেকে এসে সজোরে আঘাত হানল স্প্যানিশদের খোলে।
সংঘর্ষের ফলাফল হলো ভয়াবহ। চাপ খেয়ে ভেঙে গেল পনেরোটা দাঁড়। ক্রীতদাস মাল্লাদের আর্তনাদ ভেসে এল চারপাশ থেকে। ভাঙা দাঁড় থেকে ছুটে আসা কাঠের টুকরোয় আহত-নিহত হয়েছে ওদের বেশ কজন। অলিভারের ভাগ্যও তা-ই হতে পারত, বেঁচে গেল স্রেফ ইউসুফের উপস্থিতবুদ্ধির কারণে। কী ঘটতে যাচ্ছে, তা আঁচ করতে পেরেছিল সে। সংঘর্ষের আগেই দাঁড় ছেড়ে দিয়ে নেমে পড়েছে ওদের আসন থেকে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে পাটাতনের উপর। চেঁচিয়ে অলিভারকেও তা-ই করবার নির্দেশ দিল। দ্বিরুক্তি না করে তার সঙ্গী হলো তরুণ ইংরেজ, ফলে বেঁচে গেল মৃত্যুর হাত থেকে।
অস্ত্রের ঝনঝনানি আর মানুষের হুঙ্কার-আর্তনাদে একটু পরেই ভরে গেল পরিবেশ। মাথা তুলে পরিস্থিতি দেখে নিল অলিভার। একদফা কামান দেগেছে স্প্যানিয়ার্ডরা, বুলওঅর্কের উপর এখন ধোঁয়ার মেঘ ভাসছে। তবে তাতে বিশেষ উপকার হয়েছে বলে মনে হলো না। কারণ এরই মধ্যে পাশে ভিড়েছে কর্সেয়ারদের একটা জাহাজ, সেটা থেকে লাফঝাঁপ দিয়ে খুনে জলদস্যুরা চড়তে শুরু করেছে ওদের জাহাজে। লম্বা, সুঠাম, কিঞ্চিৎ বয়স্ক একজন মানুষ নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের। সাদা পাগড়িতে মাথা ঢাকা তার, সেটা আবার রত্নখচিত; শুভ্র দাড়িতে ভরা চেহারাটা ঈগলের মত তীক্ষ্ণ। হাতে বিশাল এক তলোয়ার নিয়ে প্রবল-বিক্রমে লড়ে যাচ্ছে মানুষটা, একাই যেন একশো! কেউ টিকতে পারছে না তার সামনে। ক্ষণে ক্ষণে স্লোগান দিয়ে উৎসাহ জাগাচ্ছে মুসলিম সঙ্গীদেরকে।
দীন! দীন! আল্লাহ… ইয়া আল্লাহ!
জাহাজজুড়ে বইল রক্তের নহর, বিনা-বিচারে খুন হয়ে যেতে থাকল স্প্যানিয়ার্ডরা। কিছুতেই পেরে উঠছে না দুর্ধর্ষ মুসলমানদের সঙ্গে। পাশে তাকিয়ে ইউসুফকে শেকল নিয়ে টানা-হেঁচড়া করতে দেখল অলিভার, মুক্তি পেতে চাইছে। সাহায্য করল ও। দুজনে মিলে একসঙ্গে টানতে শুরু করল শেকল, একটু পরেই সেটা হার মানল, গোড়াটা উঠে এল কাঠ ভেঙে। একইভাবে নিজেও মুক্ত হলো।
বন্দিদশা কেটে যাওয়ায় প্রতিশোধের নেশা ভর করল অলিভারের মধ্যে। তা ছাড়া জাত-সৈনিক ও, চারপাশের যুদ্ধের মাঝখানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়। এ-মুহূর্তে মুসলমানরাই ওর মিত্র, তাই নিদ্বিধায় দীন-দীন বলে চিৎকার করল ও, যোগ দিল লড়াইয়ে। হাতের শেকল বনবন করে ঘোরাচ্ছে, ওটাই ওর অস্ত্র। যোগ্য যোদ্ধার হাতে পড়ে সেটা ভাল কাজও দেখাল। ডেকের একপ্রান্তে সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল একদল স্প্যানিয়ার্ড, ঠেকিয়ে রেখেছিল কর্সেয়ারদেরকে। পিছন থেকে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তরুণ ইংরেজ। শেকলের আঘাতে থেঁতলে দিল দুজনের মুখ, আরেকজনকে শ্বাসরুদ্ধ করল ওটা গলায় পেঁচিয়ে। ওর পিছু পিছু ইউসুফও ছুটে এল ভাঙা দাঁড়ের একটা অংশ হাতে নিয়ে। বলা বাহুল্য, এমন আক্রমণের জন্য তৈরি ছিল না স্প্যানিয়ার্ডরা। চমকে গেল, তারা, দুই ক্রীতদাসকে ঠেকাতে গিয়ে ভুলে গেল সামনে থাকা কর্সেয়ারদের কথা, শেষ পর্যন্ত দ্বিমুখী আক্রমণে পটল তুলল। তাই বলে ওখানেই শেষ হলো না অলিভারের আক্রোশ, নিহত এক স্প্যানিয়ার্ডের তলোয়ার হাতে তুলে নিয়ে আরেকদিকে ছুটে গেল ও।
সেদিনকার লড়াইয়ের খুঁটিনাটি মনে নেই তরুণ ইংরেজের। পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল, স্প্যানিয়ার্ডদের যাকে সামনে পেয়েছে, তাকেই খুন করেছে নির্দয়ভাবে। মৃত্যু-টুত্যুর কথা ভাবেনি একবারও, শুধু ভেবেছে প্রতিশোধের কথা… প্রতিহিংসার কথা। ভয়াল আক্রোশের উন্মাদনা শেষে যখন ওর সংবিৎ ফিরল, তখন শেষ হয়ে গেছে যুদ্ধ-হাতে-গোনা অল্প কিছু জ্যান্ত স্প্যানিয়ার্ডকে পাটাতনে জড়ো করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কর্সেয়াররা, সেই সঙ্গে জাহাজের আনাচ-কানাচ থেকে সগ্রহ করা হচ্ছে দামি জিনিসপত্র, খুলে দেয়া হচ্ছে, ক্রীতদাসদের বাঁধন, তাদের অনেকেই ঈমানদার মুসলমান।
নিজেকে কর্সেয়ারদের শুভ্র শুশ্রুমণ্ডিত নেতার সামনে আবিষ্কার করল অলিভার। পাটাতনে তলোয়ার ঠেকিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে আছেন তিনি, বিস্ময় আর সামান্য কৌতুক মেশানো দৃষ্টিতে দেখছেন ওকে। দেখবার মত চেহারাই হয়েছে বটে ওর সারা শরীর শক্রর রক্তে ভেজা, মনে হচ্ছে যেন গোসল করে এসেছে। জট-পাকানো চুল-দাড়ি, হাত-পায়ের শেকল আর চোখের বুনো দৃষ্টি মিলিয়ে ওকে দেখাচ্ছে মূর্তিমান দানবের মত!
কর্সেয়ার নেতার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ইউসুফ। তার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, এমন ভয়ঙ্কর যোদ্ধা জীবনে দেখিনি আমি! মনে হচ্ছিল খোদ রাসূল (সাঃ) ওর উপর ভর করেছেন বিধর্মী শয়তানগুলোকে ধ্বংস করবার জন্য।
মুচকি হাসি ফুটল অলিভারের ঠোঁটে। বলল, আমি শুধু ওদের চাবুকের আঘাতগুলোর মূল্য চুকাচ্ছিলাম… সুদ সমেত।
এভাবেই ওর সঙ্গে পরিচয় ঘটল আলজিয়ার্সের বাদশাহ্ আসাদ-আদ-দীনের। পরে তার জাহাজে চেপে বারবারি-তে পৌঁছুল অলিভার। চুল কেটে, গোসল করে ভদ্রস্থ হবার সুযোগ পেল ও। খেতে পারল পেট পুরে। নতুন পোশাক পেল-মূরদের পোশাক… পাগড়ি আর ঢোলা কোর্তা-পাজামা… বিনা আপত্তিতে সেগুলো চড়াল গায়ে। তারপর ওকে নিয়ে যাওয়া হলো আসাদ-আদ-দীনের সামনে।
ইউসুফ-বিন-মুখতার যে সাধারণ কোনও মূর নয়, সেটা টের পেল অলিভার তখনই। আসাদ-আদ-দীনের আপন ভাইপো সে, মুসলিমদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব। খ্রিস্টানদের হাতে সে ধরা পড়ায় শোক নেমে এসেছিল বারবারি উপকূলে, মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসেছে আনন্দ। হালকা মেজাজে আছেন বাদশাহ্ নিজেও। সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে ইউসুফ, তোেয়াজ করে তাকে জানিয়েছে, ইংরেজ বন্ধুটি ইসলামের দীক্ষা পাবার জন্য উপযুক্ত, খাঁটি মুসলমান হবার মত সমস্ত গুণ আছে ওর মধ্যে। এমনিতেই বাদশাহর সমীহ আদায় করে নিয়েছে অলিভার, বীরত্বের মর্যাদা দিতে জানেন তিনি। ভাইপোর সুপারিশ পেয়ে আরও খানিকটা নরম হয়ে গেলেন।
কাজেই অলিভার যখন হাজির হলো সামনে, আসাদ-আদ দীন ওকে প্রস্তাব দিলেন-ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তার দলে যোগ দিতে। ওর মত দুর্ধর্ষ যোদ্ধাকে পেলে খ্রিস্টানদেরকে খতম করবার কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে তার জন্য। কিন্তু… ও যদি ধর্মান্তরিত হতে রাজি না হয়, ফিরে যেতে হবে ক্রীতদাসের জীবনে। টানতে হবে দাঁড়… এবার মুসলমানদের জাহাজে। বলা বাহুল্য, মানবেতর ওই জীবনে প্রত্যাবর্তনের কোনও ইচ্ছে নেই অলিভারের। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবার ব্যাপারে ক্ষীণ আপত্তি আছে বটে, কিন্তু ভালমত ভেবে দেখল–ওতে আসলে বিশেষ ক্ষতি নেই। ওটা স্রেফ অজুহাত, আসলে বাদশাহ্ চাইছেন ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওকে ব্যবহার করতে। মজার ব্যাপার হলো, সেই শত্রুরা ওর নিজের শত্রুও বটে। প্রস্তাবটা গ্রহণ করলে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করতে পারবে ও। সাত-পাঁচ ভেবে রাজি হয়ে গেল তাই।
কলেমা পড়িয়ে সাদরে অলিভারকে বরণ করে নেয়া হলো মুসলিমদের মাঝে। ইউসুফ-বিন-মুখতারের কায়িয়া, অর্থাৎ সহকারী হিসেবে নিয়োগ করা হলো ওকে। তার সঙ্গে নতুন এক জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অভিযানে। অংশ নিল একের পর এক যুদ্ধে, যাতে যোদ্ধা এবং কৌশলী হিসেবে ইংরেজ তরুণটির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল পুরো ভূমধ্যসাগরে। মাসছয়েক পর সিসিলি উপকূলে মাল্টার নাইটদের এক রণতরীর সঙ্গে লড়াইয়ের সময় গুরুতর আহত হলো ইউসুফ। জয়ী হলো মুসলিমরা, কিন্তু তাকে বাঁচানো গেল না। অলিভারের কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল বেচারা, কিন্তু তার আগে জাহাজের নেতৃত্ব তুলে দিয়ে গেল বন্ধুটির হাতে। আলজিয়ার্সে ফেরার পর আনুষ্ঠানিকভাবে সেটার স্বীকৃতি দিলেন বাদশাহ্।
নিজের একটা জাহাজ পেয়ে গেল অলিভার। সেটা নিয়ে নব-উদ্যমে শুরু করল অভিযান। খুব শীঘ্রি ওর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল সবখানে। অলিভার নামটা হারিয়ে গেল ওর কীর্তি-কাহিনির তলায়; শাকের-আল-বাহার, মানে সাগরের বাজপাখি হিসেবে সবাই ডাকতে শুরু করল ওকে। বাজপাখির মত ঝটিকা আক্রমণ চালাবার জন্যই হলো এ-নাম, যা পৌঁছে গেল ইয়োরোপের খ্রিস্টান রাজ্যগুলোতেও। খুব শীঘ্রি আসাদ-আদ-দীনের লেফটেন্যান্ট পরিণত হলো ও, মানে পুরো আলজিরিয়ান নৌ-বহরের উপ-অধিনায়ক বা সেনাপতি। পদবীর দিক থেকে দ্বিতীয় হলেও আসলে নৌ-বহরের হর্তা-কর্তাই বলা যায় অলিভারকে, কারণ বাদশাহ্-র বয়স হয়েছে, এখন আর আগের মত সমুদ্রযাত্রায় যেতে পারেন না তিনি। ইসলামের নামে, আসাদ-আদ-দীনের একের পর এক অভিযান চালায় শাকের-আল-বাহার, কখনোই খালি হাতে ফেরে না।
সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই, আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ রয়েছে দুঃসাহসী এই কর্সেয়ারের প্রতি। সর্বশক্তিমান নিজেই যেন ওকে বাছাই করেছেন ইসলামের জয়যাত্রায় নেতৃত্ব দেবার জন্য। শুরুতে অলিভারকে সমীহ করতেন আসাদ-আদ-দীন, ধীরে ধীরে ভালওবাসতে শুরু করলেন। তাঁর মত ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য সেটাই স্বাভাবিক। নাবালক এক সন্তান আছে বাদশাহ্-র, কিন্তু সে শাসনভার গ্রহণের জন্য তৈরি নয়; তাই সবাই একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গেল-আসাদের মৃত্যুর পর শাকের-আল-বাহারই আলজিয়ার্সের সিংহাসনে বসতে চলেছে, ঠিক যেভাবে বারবারোসা, ওকিয়ালি-সহ অন্যান্য খ্রিস্টান দলত্যাগীরা মুসলিম কর্সেয়ারদের রাজপুত্রে পরিণত হয়েছিল।
অলিভার যে তর্ক বা সন্দেহের সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে ছিল, তা বলা যাবে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওর কর্মকাণ্ড কুটি সৃষ্টি করেছে কর্সেয়ারদের মধ্যে। সে-সব ব্যাপারে ধীরে ধীরে জানতে পারবেন পাঠক। তবে একটা ঘটনা এখানেই বলে দেয়া ভাল। ইউসুফের মৃত্যুর ছ-সাত মাস পরে ঘটেছিল সেটা। সেবার অভিযান শেষে আলজিয়ার্সে ফিরে অলিভার দেখল, আরেকটা জাহাজ ওর বেশ কজন স্বদেশীকে… মানে ইংরেজকে ধরে নিয়ে এসেছে। কারও সঙ্গে কোনও ধরনের আলোচনা ছাড়া… বলতে গেলে একতরফাভাবে… ও হুকুম দিল বন্দিদেরকে মুক্তি দেবার জন্য। বলা বাহুল্য, অনেকেই বেজায় নাখোশ হলো ওর এই আচরণে। বিষয়টা বাদশাহ্-র কান পর্যন্ত গড়াল। অলিভারকে ডেকে পাঠালেন তিনি।
সমন পেয়ে মাথা গরম হয়ে গেল অলিভারের। অনেকদিন থেকে কর্সেয়ারদের সঙ্গে আছে ও, নিজের আনুগত্যের চরম পরীক্ষা দিয়েছে, মুসলমানদের মাথা উঁচু করেছে সবখানে, তারপরেও যদি সামান্য কজন বন্দিকে মুক্তি দেবার অধিকার না থাকে, তা হলে এসব করে লাভ কী? রাজদরবারে গিয়ে এসব কথাই বলল ও। বাদশাহ্ বিজ্ঞ মানুষ, নরম কণ্ঠে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, ওর বীরত্ব বা আনুগত্য নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছে না; সবাই শুধু জানতে চায়, ইংরেজ বন্দিদেরকে ও ছেড়ে দিল কেন? জবাবে অলিভার জানাল–ধর্ম বদলালেও স্বদেশী মানুষের সঙ্গে বেঈমানী করতে পারবে না ও। অস্ত্র ধরবে না ওদের বিরুদ্ধে। বরং কখনও কোনও ইংরেজ ধরা পড়লে তাকে মুক্তি দেবে। কর্সেয়ারদের কোনও ক্ষতি হবে না এতে, কারণ মুক্তিপ্রাপ্ত একেকজন ইংরেজের বদলে দুজন করে স্প্যানিশ, ইটালিয়ান, গ্রিক বা ফরাসি বন্দি সরবরাহ করবে ও।
অলিভারের আবেগ লক্ষ করে প্রস্তাবটা মেনে নিলেন আসাদ-আদ-দীন। তবে শর্ত জুড়ে দিলেন, কাউকে মুক্তি দিতে চাইলে তাকে প্রথমে কিনে নিতে হবে। কিনতে হবে নিজেরই পয়সায়। মানুষটা ওর সম্পত্তি হয়ে যাবার পর মুক্তি দিক, বা কাজে লাগাক… তা নিয়ে কারও কিছু বলবার থাকবে না। বাদশাহ্-র এই সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিল অলিভার। সেই থেকে আলজিয়ার্সের বাজারে কোনও ইংরেজ দাস এলেই খবর চলে যেত ওর কাছে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে কিনে নিত অলিভার, নিজ খরচে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করত। এতে প্রচুর টাকা খরচ হতো ওর, সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রতি অভিযানে এত আয় হতো যে ওসব গায়ে লাগত না।
এসব বিবরণ পড়ে পাঠক হয়তো ভাবছেন, অতীত জীবনের কথা ভুলে গেছে অলিভার। ভুলে গেছে কর্নওয়ালে ফেলে আসা সুন্দরী প্রেমিকাটিকে, কিংবা সৎ ভাইয়ের নির্মম বিশ্বাসঘাতকতা। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তা নয়। তার প্রমাণ পাওয়া গেল একদিন, যখন বিস্কেন-আল-বোরা, মানে ওর ভবিষ্যৎ-সহকারী, আলজিয়ার্সের দাস-বাজারে অল্পবয়েসী এক কর্নিশ বন্দিকে নিয়ে হাজির হলো। ছেলেটির নাম পিট, তার পিতাকে চেনে অলিভার।
বরাবরের মত বন্দিকে কিনে নিল ও, তারপর নিয়ে গেল ওর নিজের বাড়িতে। অতিথির মত খাতির করল পিটকে, তারপর রাত জেগে কথা বলল। একের পর এক প্রশ্ন করে জেনে নিল, গত দুবছরে… মানে ওর অনুপস্থিতিতে কী ঘটে গেছে কর্নওয়ালে। যত জানল, ততই উদ্বেল হয়ে উঠল হৃদয়। যেন খুলে গেল শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতের মুখ। আবারও রোজামুণ্ডের জন্য তীব্র টান অনুভব করল অলিভার, অনুভব করল লায়োনেলের প্রতি প্রতিহিংসার ছাইচাপা আগুন। ঠিক করল, সুযোগ যখন পাওয়া গেছে, রোজামুণ্ডকে সব সত্য জানিয়ে দেবে। বিশ্বাসঘাতক ভাইটির গোমর আর রক্ষা করবার কোনও মানে হয় না।
একটা চিঠি লিখল অলিভার। পিটার গডলফিনের মৃত্যু-রহস্য, এবং তারপর ঘটে যাওয়া সব ঘটনার বিবরণ দিল তাতে। নিজের নির্দোষিতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, মাস্টার বেইনের স্বাক্ষর করা প্রমাণপত্রটা কোথায় পাওয়া যাবে, উল্লেখ করল তা-ও। পেনারো হাউসের লাইব্রেরির একটা বইয়ের ভিতর লুকানো আছে সেটা, লায়োনেলের জানা নেই। পিটকে ওটা উদ্ধারের জন্য ভৃত্য নিকোলাসের সাহায্য নিতে পরামর্শ দিল অলিভার। ইতোমধ্যে হতভাগ্য নাইটের দুঃখের কাহিনি জানতে পেরেছে পিট, সানন্দে রাজি হলো ওকে সাহায্য করতে। চিঠিটা তার হাতে দিল অলিভার, তারপর ব্যবস্থা করল ছেলেটার জেনোয়া যাবার। ওখান থেকে সে ইংল্যাণ্ডগামী জাহাজে চড়তে পারবে।
তিন মাস পর চিঠি এল পিটের কাছ থেকে। নিরাপদে কর্নওয়ালে পৌঁছেছে সে, অলিভারের কথামত নিকোলাসের সাহায্য নিয়ে প্রমাণপত্রটাও সংগ্রহ করতে পেরেছে। তারপর অলিভারের চিঠি আর প্রমাণপত্র… দুটো নিয়ে সশরীরে দেখা করেছে লেডি রোজামুণ্ডের সঙ্গে তিনি এখন সার জন কিলিগ্রুর সঙ্গে আরওয়েনাকে থাকছেন। সুখবর বলতে এতটুকুই, এরপর রয়েছে দুঃসংবাদ। পিট কার পক্ষ থেকে এসেছে, সেটা শোনামাত্র নাকি রাগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল রোজামুণ্ড। চিঠি আর প্রমাণপত্রটা খুলেও দেখেনি, পিটের চোখের সামনেই ছুঁড়ে ফেলেছে জ্বলন্ত ফায়ারপ্লেসে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ওগুলো। দুঃখ প্রকাশ করে ছেলেটি জানিয়েছে, কিছুই করার ছিল না তার। অলিভারকে নির্দোষ প্রমাণ করবার কোনও উপায় নেই আর।
শোকে স্থবির হয়ে গেল অলিভার চিঠিটা পড়ে। কামরায় ঢুকে নিজেকে বন্দি করে ফেলল বেশ কদিনের জন্য। ভিতরে কী ঘটেছে, তা জানা নেই কারও। ভৃত্যরা শুধু ওর দীর্ঘশ্বাস আর কান্নার শব্দ শুনেছে। আবেগ-অনুভূতির কোনও বহিঃপ্রকাশ বলতে সে-ই শেষ। কামরা থেকে যেদিন অলিভার বেরিয়ে এল, একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেছে ও। আগের চেয়ে বেপরোয়া… আগের চেয়ে নিষ্ঠুর… হৃদয়হীন স্রেফ একটা পাথর। সেদিনের পর থেকে ইংরেজ দাসদেরকে নিয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ করে দিল, কাউকে আর মুক্তি দিল না। দিল শুধু যন্ত্রণা আর অত্যাচার-নির্মম এক জলদস্যুর কাছ থেকে যা আশা করা যায়।
পাঁচ বছর কাটল এভাবে। এ-পাঁচ বছরে ওর খ্যাতি বা কুখ্যাতি যা-ই বলা হোক না কেন, লেলিহান আগুনের শিখার মত বাড়ল। ওর নাম পরিণত হলো ভয়াবহ এক ত্রাসে। মাল্টা, নেপলস্ আর ভেনিস থেকে ঘোষণা করা হলো পুরস্কার-ওকে জ্যান্ত বা মৃত অবস্থায় ধরে আনার জন্য। বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনী ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে গেল ওর নির্মম জলদস্যুতার অবসান ঘটাতে। কিন্তু আল্লাহর অশেষ করুণায় কেউই কিছু করতে পারল না শাকের-আল-বাহারের। প্রতিটা লড়াইয়ে জয় হতে থাকল কর্সেয়ারদের এই অকুতোভয় নেতার।
তারপর… পঞ্চম বছরের বসন্তে… হঠাৎ আরেকটা চিঠি এল। কর্নিশ পিটের কাছ থেকে। কৃতজ্ঞতার বশে লেখা চিঠি, অলিভারের উপকারের কথা আজও ভোলেনি সে। ছেলেটা জানাল–এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা অলিভারকে জানানো উচিত বলে মনে হয়েছে তার। পিটকে নাকি গ্রেফতার করিয়েছিলেন সার জন কিলিগ্রু, অত্যাচার করে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করেছেন অলিভার ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমানদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, হয়ে গেছে জলদস্যু। আদালতে ওর এই সাক্ষ্য দেখিয়ে অলিভারকে আইনতঃ মৃত বলে ঘোষণা করিয়েছেন তিনি, এর ফলে ট্রেসিলিয়ান পরিবারের সমস্ত সহায়-সম্পত্তির বৈধ মালিকানা পেতে যাচ্ছে লায়োনেল। এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার কিছু ছিল না, কিন্তু চিঠির পরের অংশে যে-খবরটা আছে, তা-ই অলিভারকে অশান্ত করে তুলল। পিট জানিয়েছে, দুবছরের জন্য ফ্রান্সে লেখাপড়া করতে গিয়েছিল রোজামুণ্ড, কিছুদিন আগে ফিরেছে… আর দেশে ফেরামাত্র লায়োনেলের সঙ্গে বাগদান হয়ে গেছে ওর, আগামী জুনে বিয়ে। সার জন-ই নাকি উদ্যোগ নিয়েছেন ওদের দুজনের এই বিয়ের–তিনি চান, সংসার তোক রোজামুণ্ডের, কঠিন দুনিয়ার বিপদ-আপদ থেকে ওকে রক্ষা করবার জন্যও নাকি একজন স্বামী দরকার। তিনি নিজে আর ওর দেখভাল করতে পারবেন না, খুব শীঘ্রি নাকি জাহাজ কিনে ভারতবর্ষে ব্যবসা করতে যাবেন। এলাকায় ব্যাপারটা বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, সবাই খুব আনন্দিত। হাজার হোক, দীর্ঘদিনের সংঘাতশেষে এই বিয়ের মাধ্যমে একত্র হতে যাচ্ছে কর্নওয়ালের সবচেয়ে অভিজাত দুই পরিবার।
চিঠির এটুকু পড়ে আপনমনে হেসে উঠল অলিভার। ভাল করেই বুঝতে পারছে–বিয়েটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, আসলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে দুই জমিদারি একত্র হবার সম্ভাবনা। মাথার উপর দুই প্রভুর বদলে এক প্রভু থাকলে কে না খুশি হয়! কর্নওয়ালের প্রজারাও তা-ই হচ্ছে। এই বিয়ে আসলে হতে যাচ্ছে। বিশাল দুটো এস্টেট, ফসলি জমি আর বন-বনানীর মধ্যে। দুজন নারী-পুরুষ যে জড়িত আছে ওগুলোর সঙ্গে, তা স্রেফ এক কাকতালীয় ঘটনা।
নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস টের পেয়ে তিক্ততায় ছেয়ে গেল অলিভারের অন্তর। ভাইয়ের সন্দেহভাজন খুনিকে দূরে সরিয়ে দিয়ে রোজামুণ্ড শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে চলেছে সত্যিকার খুনিকে! কিন্তু এ-মুহূর্তে কী-ই বা করার আছে ওর? চুপচাপ সব মেনে নেয়া ছাড়া? অভিমানও কাজ করছে মনের ভিতর। কেন পরোয়া করবে ও? কেন এই বিয়েতে বাধা দিতে চাইবে? ভালবাসার জন্য? ন্যায়ের জন্য? না… ওসবের কোনও মূল্য নেই অলিভারের কাছে। ওর হৃদয় এখন পাথরের মত শক্ত। সেখানে কোনও কিছুর… বা কোনও মানুষের স্থান নেই।
চিঠিটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিল ও। পিট ওর উপকারের জন্য পাঠিয়েছিল ওটা, কিন্তু তাতে কোনও গুরুত্ব দিল না। মনের অস্থিরতা কাটাবার জন্য তিনটে জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অলিভার নতুন অভিযানে। দুসপ্তাহ পরে সে-অভিযানেই স্পারটেল অন্তরীপে ওই স্প্যানিশ গ্যালিয়ন দখল করল ও। দেখা পেল জ্যাসপার লেইয়ের।
চলুন এবার ফিরে যাই সেই কাহিনিতে।
.
০৩.
ইংল্যাণ্ড অভিমুখে
দখল হয়ে যাওয়া স্প্যানিশ গ্যালিয়নের ক্যাপ্টেনের কেবিনে সন্ধেবেলায় জ্যাসপার লেইকে নিয়ে এল দুই কাফ্রি ভৃত্য, পেশ করল তাদের মনিবের সামনে।
দুষ্ট ক্যাপ্টেনের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত শাকের-আল-বাহার তার ইচ্ছের কথা জানায়নি। কিন্তু মাস্টার লেই জানে, সে অপরাধী, মস্ত অন্যায় করেছে অলিভারের প্রতি, তার সমস্ত দুর্দশার জন্য প্রত্যক্ষভাবে সে-ই দায়ী। এর ফল ভাল হতে পারে না। দেরিতে হলেও প্রতিশোধ নেবে প্রাক্তন নাইট, আর সে-কথা ভেবে ফোক্যাসলের বন্দিশালায় চরম উদ্বেগে ভুগেছে সে পুরোটা সময়। … আবার দেখা হলো আমাদের, মাস্টার লেই, অভিবাদন
জানানোর সুরে তাকে বলল শাকের। তবে এবার অবস্থান বদলে গেছে আমাদের… মানে, শেষবার যখন কোনও ক্যাপ্টেনের কেবিনে আমাদের কথা হয়েছিল… তখনকার হিসেবে।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল লেই। তবে সে-বার আপনার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম আমি।
মূল্যের বিনিময়ে, মনে করিয়ে দিল শাকের। মূল্য দিলে আজ আমার বন্ধুত্বও হয়তো পাবে তুমি।
আশায় দুলে উঠল জ্যাসপার লেইয়ের হৃদয়।
কী মূল্য চান, বলুন, সার অলিভার! সাগ্রহে বলল সে। যদি সাধ্যে থাকে, তা চুকাতে দ্বিধা করব না। দাসত্বের জীবন যথেষ্ট ভোগ করেছি আমি। হিসেবও দিল। পাঁচ-পাঁচটা বছর! তার মধ্যে চার বছরই কেটেছে স্পেনের বিভিন্ন জাহাজে। এমন একটা দিন যায়নি, যে-দিন আমি নিজের মৃত্যু কামনা করিনি। কল্পনাও করতে পারবেন না, কী সইতে হয়েছে আমাকে!
অমন শাস্তিই প্রাপ্য ছিল তোমার! শীতল গলায় বলল শাকের, ভয় ঢুকিয়ে দিল লেইয়ের বুকে। আমাকে তুমি দাস হিসেবে বিক্রি করে দিতে যাচ্ছিলে… অথচ কোনোদিন তোমার কোনও ক্ষতি করিনি আমি, বরং বন্ধুর মত থেকেছি। মাত্র দুইশ পাউণ্ডের জন্য…
না, না? তাড়াতাড়ি বলে উঠল লেই। অমন ইচ্ছে কখনোই ছিল না আমার। কী কথা হয়েছিল আমাদের মধ্যে, তা কি মনে নেই আপনার? আপনাকে আমি বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাব বলে কথা দিয়েছিলাম।
সত্য, তবে সেটার জন্যও টাকা দাবি করেছিলে। ফাঁসিতে ঝোলানো দরকার তোমাকে। কিন্তু কপাল ভাল তোমার, দক্ষ একুজন পথ-প্রদর্শক দরকার আমার। পাঁচ বছর আগে যে-কাজ তুমি দুইশ পাউণ্ডের বিনিময়ে করতে যাচ্ছিলে, আজ সেটা করবে জীবন বাঁচাবার জন্য। বলল, আমার জাহাজকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে রাজি আছ তুমি?
অবশ্যই! বলল লেই। নিজের কানে বিশ্বাস করতে পারছে, অলিভার তাকে এমন সুযোগ দিচ্ছে। আপনি বললে নরকেও যেতে রাজি আছি!
এ-যাত্রায় স্পেনে যাচ্ছি না আমি, বলল শাকের-আল বাহার। পাঁচ বছর আগে যেখানে নিয়ে যাবার কথা ছিল, সেখানেই তুমি নিয়ে যাবে আমাকে। ফাল নদীর মুখে, যাতে কর্নওয়ালের মাটিতে পা রাখতে পারি আমি। রাজি আছ?
হা… আনন্দের সঙ্গে, নির্দ্বিধায় জানাল মাস্টার লেই।
খুব ভাল। তা হলে শর্তগুলো জানিয়ে দিই। কাজটা সুষ্ঠুভাবে করবার বিনিময়ে জীবনভিক্ষা পাবে তুমি, সেইসঙ্গে নিজের মুক্তি। কিন্তু এ-কথা ভেবো না, ইংল্যাণ্ডে পৌঁছুনোমাত্র ছাড়া পাবে। জাহাজকে আবার আলজিয়ার্সে ফিরিয়ে আনতে হবে তোমাকে। তারপর তোমার বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করব আমি। যদি ঠিকঠাকমত দায়িত্ব পালন করো, হয়তো বা পুরস্কারও দেব। কিন্তু যদি পুরনো বদভ্যাসের চিহ্নমাত্র দেখি… বেঈমানীর আভাস পাই, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে জুটবে মৃত্যু। আমার এই দুই ভৃত্য ছায়ার মত পাশে থাকবে তোমার সবসময়। ইশারায় দুই কাফ্রি পালোয়ানকে দেখাল। ওরা তোমার উপর নজর রাখবে। বিপদ হতে দেবে না, কিন্তু শয়তানি করলে গলা টিপে ধরবে। এবার তুমি যেতে পারো। জাহাজে চলাফেরার স্বাধীনতা দিচ্ছি তোমাকে, ভাল চাও তো পালাবার চেষ্টা কোরো না।
নিজের সৌভাগ্যে বিমূঢ় হয়ে পড়েছে মাস্টার লেই। বিড়বিড় করে ধন্যবাদ জানাল, তারপর বেরিয়ে গেল ক্যাপ্টেনের কেবিন। থেকে। তার পিছু নিল দুই ভৃত্য। একটু পর শাকেরের সামনে হাজির হলো বিস্কেন। জানাল, তার লোকেরা পুরো জাহাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। লড়াইয়ে কোনও ক্ষতি হয়নি খোলের। তবে তল্লাশি চালিয়ে গোলাবারুদ ছাড়া আর কোনও দামি মালামাল পাওয়া যায়নি। যাত্রীবাহী গ্যালিয়ন এটা, বন্দিদেরকে দাস হিসেবে বিক্রি করে কিছু টাকা পাওয়া যাবে, এর বেশি কিছু না। সব মিলিয়ে তেমন লাভজনক হয়নি এবারের হামলা।
জবাবে বিস্কেনকে বিস্মিত করে দিল শাকের।
বন্দিদেরকে আমাদের জাহাজগুলোয় ভোলো, বিস্কেন, বলল ও। তারপর ওগুলো নিয়ে তুমি ফিরে যাও আলজিয়ার্সে। আমি এখানেই থাকছি। দুইশ কর্সেয়ার দিয়ো শুধু আমার সঙ্গে। ওরা যোদ্ধা এবং নাবিকের দায়িত্ব পালন করবে।
আপনি আলজিয়ার্সে ফিরছেন না? অবাক হয়ে জানতে চাইল বিনে।
উঁহু। লম্বা একটা অভিযানে যাচ্ছি আমি। বাদশাহ আসাদ-আদ-দীনকে আমার সালাম জানিয়ো। আল্লাহ যেন তাঁকে রক্ষা করেন। ওঁকে বোলো, ছসপ্তাহের মধ্যে ফিরব আমি।
শাকের-আল-বাহারের সিদ্ধান্ত শুনে বেশ সরগরম হয়ে উঠল তিন জাহাজের পরিবেশ। খোলা সাগরে জাহাজ চালাবার ব্যাপারে কোনও অভিজ্ঞতা নেই কর্সেয়ারদের, স্পারটেল অন্তরীপের এদিকটাতেই আসে না কখনও, ভূমধ্যসাগরের বাইরে তো যায়ইনি কেউ কোনোদিন। তা হলে লম্বা অভিযানে কোথায় যেতে চাইছে ওদের নেতা? তবে মনের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও মুখে তা প্রকাশ করল না কেউ। শাকের-আল-বাহারের উপর অগাধ আস্থা প্রত্যেকের, আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ রয়েছে তার উপর, আজ পর্যন্ত কোনও যুদ্ধে পরাজিত হয়নি। কাজেই সে যেখানে বলবে, সেখানেই যেতে রাজি আছে ওরা। অবশ্য অন্য কেউ হলে কিছুতেই ওদেরকে রাজি করানো যেত না আটলান্টিকের বিপদসঙ্কুল পানিতে যেতে।
যা হোক, সহজেই দুইশ নাবিক পেয়ে গেল শাকের… অভিযানে স্বেচ্ছায় যোগ দিল ওরা।
পাঠকদেরকে বলে রাখা ভাল, সদূরপ্রসারী কোনও পরিকল্পনার ফসল নয়, অলিভারের এই অভিযান। আলজিয়ার্স ত্যাগ করবার সময় সত্যিই অমন কোনও ইচ্ছে ছিল না ওর। স্পারটেল অন্তরীপের পাহাড়ি চাতাল থেকে স্প্যানিশ গ্যালিয়নটাকে দেখতে পেয়েই প্রথমবারের মত মাথায় আসে, এমন একটা জাহাজ পেলে ইংল্যাণ্ডের উদ্দেশে যাত্রা করা যায়, কর্সেয়ারদের জাহাজে যেটা সম্ভব নয়। ওগুলো আকারে ছোট, তা ছাড়া একেবারে মার্কামারা বলা চলে… শত্রুদের চোখে পড়ামাত্র আক্রমণের শিকার হতে হবে। শুরুতে ব্যাপারটা ছিল অবচেতন মনের ক্ষণিক চিন্তামাত্র, কিন্তু গ্যালিয়ন দখলের পর জ্যাসপার লেইয়ের দেখা পেয়ে চিন্তাটা ডালপালা ছড়াতে শুরু করে।
ভেবে দেখে ও–এটা আসলে একটা সঙ্কেত। ইংল্যাণ্ডে যাবার সঙ্কেত! নইলে পিটের চিঠিটা পাবার পরেই এই গ্যালিয়ন ওর দখলে আসবে কেন… কেন দেখা হবে সেই মানুষটার সঙ্গে, যে ওকে পথ দেখিয়ে দেশে নিয়ে যেতে পারবে? অস্বীকার করবার উপায় নেই, বহুদিন থেকেই সুপ্ত একটা ইচ্ছে আছে ওর–কোনও একদিন ফিরবে কর্নওয়ালে, মুখোমুখি হবে রোজামুণ্ডের, ওকে বাধ্য করবে পিটারের মৃত্যুর বিষয়ে সত্যি কথাটা শুনতে। সার জনের সঙ্গেও দেখা হওয়া প্রয়োজন। আজ পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি, লোকটা ওর শত্রু নাকি মিত্র। কিন্তু এখন সে-লোকই কলকাঠি নাড়ছে লায়োনেলকে ওর জায়গায় বসাতে, রোজামুণ্ডের স্বামী বানাতে। এসব কি কন্যাসম মেয়েটির মঙ্গলের জন্য করছে, নাকি তার পিছনে লুকিয়ে আছে গভীর কোনও ষড়যন্ত্র? জানতে হবে অলিভারকে। লায়োনেলের সঙ্গে বোঝাপড়ার বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এসব তাড়না শেষ পর্যন্ত আর অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়।
জীবনের ঝড়-ঝাপটা সহ্য করে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একজন মানুষ হয়ে উঠেছে অলিভার, নিতে শিখেছে কঠিন সব সিদ্ধান্ত। আজও তাই তেমন একটা সিদ্ধান্তই নিয়েছে ও-যাবে কর্নওয়ালে, ফয়সালা করবে সবকিছুর। জাহাজ, লোকবল আর পথ-প্রদর্শক… সবই রয়েছে হাতে, এমন সুযোগ আবার কবে পাবে, কে জানে! না,
এরপরে আর পিঠ ফেরানো চলে না।
খুব দ্রুত নেয়া হলো প্রস্তুতি। খাবার-দাবার আর পানি ভোলা হলো গ্যালিয়নে। বন্দি এবং নাবিকদের জাহাজ-বদল করা হলো। গ্যালিয়নের পিছন থেকে মুছে ফেলা হলো ওটার নাম-নুয়েস্ত্রা সিনোরা দি ল্য লাগাস। পরদিনই কর্সেয়ারদের জাহাজগুলোকে বিস্কেনের নেতৃত্বে আলজিয়ার্সের পথে পাঠিয়ে দিল অলিভার। আর ক্যাপ্টেন জ্যাসপার লেইয়ের নির্দেশনায় ইংল্যাণ্ডের উদ্দেশে রওনা হলো স্প্যানিশ গ্যালিয়ন, ভূমধ্যসাগর থেকে বেরিয়ে এল আটলান্টিকে। বাতাস অনুকূল থাকায় সেইন্ট ভিনসেন্ট অন্তরীপ পেরুনোর দশদিনের মাথায় গন্তব্যের দেখা পেল ওরা।
.
০৪.
হানা
ফাল নদীর মোহনায়… উঁচু যে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে আরওয়েনাক প্রাসাদ, তার ছায়ায় গর্বিত ভঙ্গিতে নোঙর করে আছে জমকালো এক জাহাজ। দক্ষ কারিগরের হাতে তৈরি হয়েছে, ওটা, খরচের বেলায় কোনও কার্পণ্য করা হয়নি। দূরযাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে জাহাজটা, চলছে রসদ আর গোলাবারুদ তুলবার কাজ। নদীর পারের জেলে-গ্রামে সে-কারণে চলছে কর্মব্যস্ততা। সার জন কিলিগ্রুর ধারণা, তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে এর মাধ্যমে গোড়াপত্তন হতে চলছে নতুন এক বন্দরের। ধীরে ধীরে প্রসার ঘটবে এর।
মাস্টার লায়োনেল ট্রেসিলিয়ানের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব এর পিছনে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। সার অলিভারের বিরোধিতায় থমকে গিয়েছিল এ-স্বপ্ন, তবে লায়োনেল সে-আপত্তি ফিরিয়ে নিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, পার্লামেন্ট এবং রানির কাছে নিজের সমর্থনপত্র-ও পাঠিয়েছে সে। এর ফলে আবার গতি পেয়েছে সার জনের কাজ। পেনারো এবং আরওয়েনাকের মধ্যকার দ্বন্দ্বের মূল উৎপাটিত হওয়ায় বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছে তার এবং লায়োনেলের মধ্যে।
ভাইয়ের মত তীক্ষ্ণ বিচারবুদ্ধি নেই ছোট ট্রেসিলিয়ানের মধ্যে, তবে সেটার ঘাটতি সে পূরণ করেছে ধূর্ততা দিয়ে। হিসেব করে দেখেছে, সার জনের জমিতে সমুদ্রবন্দর স্থাপন করা হলে ট্যুরো আর হেলস্টন গ্রামের পাশাপাশি ট্রেসিলিয়ানদের সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বটে, কিন্তু সেটা ওর জীবদ্দশায় ঘটবার সম্ভাবনা খুবই কম। তারচেয়ে সার জনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রোজামুণ্ডকে বিয়ে করতে পারলে অনেক বেশি লাভবান হতে পারবে ও। দুই জমিদারি এক হয়ে যাবে, আর তার মালিক হবে লায়োনেল নিজে। এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে যাবে ওর সম্পত্তি এবং আয়।
তবে এ-কথা ভাববার অবকাশ নেই যে, বিয়ের প্রস্তাবে সহজে রাজি হয়েছে রোজামুণ্ড বরং শুরুতে নাকচ করে দিয়েছিল ওটা। লায়োনেলকে এড়াবার জন্য লেখাপড়ার নাম করে স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছিল ফ্রান্সে–সার জনের বোনের সঙ্গে। ভদ্রমহিলার স্বামী ওখানে ইংল্যাণ্ডের রাজদূত হিসেবে নিয়োজিত। বলে রাখা ভাল, ভাইয়ের মৃত্যু এবং বয়োপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে রোজামুণ্ডের অভিভাবকত্ব হারিয়েছেন সার জন। ওর উপর জোর খাটাবার কোনও উপায় ছিল না তাঁর।
রোজামুণ্ড চলে যাবার পর বেশ কিছুদিন বিমর্ষ রইল লায়োনেল। সার জন ওকে সাহস জোগালেন, পরামর্শ দিলেন ধৈর্য ধরবার। আশ্বাস দিলেন, শেষ পর্যন্ত ওর ইচ্ছেই পূর্ণ হবে। অগত্যা কিছু সময়ের জন্য লণ্ডনে চলে গেল লায়োনেল, আইন। পেশায় নাম লেখাবার চেষ্টা করল… তবে তাতে সফল হলো না। শেষে প্যারিসে পাড়ি জমাল সে। ওখানে গিয়ে রোজামুত্রে সঙ্গে দেখা করল, চেষ্টা করল ওকে বিয়েতে রাজি করাবার।
লায়োনেলের অব্যাহত চেষ্টায় কিছুটা নরম হয়ে এল মেয়েটা, কিন্তু তারপরেও পুরোপুরি সায় পেল না মনের। যতকিছুই হোক, পাণিপ্রার্থী যুবকটি সার অলিভারের ভাই-সেই মানুষ, যাকে এককালে ভালবাসত ও… যার হাতে খুন হয়েছে ওর আপন সহোদর! লায়োনেলের সঙ্গে মিলনের পথে বাধা হয়ে রয়েছে ওর পুরনো প্রেমের ছায়া এবং ভাইয়ের রক্ত।
বছরদুই পরে যখন কর্নওয়ালে ফিরল, তখন এসব যুক্তিই রোজামুণ্ড দেখাল সার জনের সামনে। বোঝাল কেন লায়োনেলকে বিয়ে করা সম্ভব নয় ওর পক্ষে।
সার জন ওর সঙ্গে একমত হতে পারলেন না। বললেন, বাছা, তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে আমাদেরকে। এখন আর বাচ্চা নও তুমি, বড় হয়েছ। স্বীকার করি, নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার তোমার আছে। তাই বলে তরুণী একটি মেয়ের একাকী থাকা ঠিক নয়। গডলফিন কোর্টের নিঃসঙ্গতা ছেড়ে আরওয়েনাকে থাকতে এসে খুব ভাল করেছ… যতদিন খুশি থাকো, আমার কোনও আপত্তি নেই। যতদিন আমি আছি, তোমার দেখাশোনার কোনও কমতি হবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, খুব শীঘ্রি ব্যবসার জন্য ভারতবর্ষে যাবার পরিকল্পনা রয়েছে আমার, তখন তো আবার নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে তুমি। কে দেখবে তোমাকে? বিপদ-আপদ থেকে কে রক্ষা করবে?
দেখাশোনার জন্য যাকে আপনি জোর করে আমার ঘাড়ে গছাতে চাইছেন, তার চেয়ে একা থাকা ঢের ভাল, বলল রোজামুণ্ড।
খুবই অন্যায় কথা, মাথা নাড়লেন সার জন। তোমার জন্য কাতর লায়োনেল… ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে ভদ্রলোকের মত। এ-ই বুঝি তার প্রতিদান?
ও অলিভার ট্রেসিলিয়ানের ভাই!
তার জন্য যথেষ্ট প্রায়শ্চিত্ত কি ইতোমধ্যেই করেনি ও? ভাইয়ের পাপের জন্য আর কতকাল শাস্তি পেতে হবে ওকে? তা ছাড়া… আপন ভাইও নয় ওরা, সৎ-ভাই।
ভাই তো! বিয়ে যদি আমাকে করতেই হয়, তা হলে অন্য কোনও পাত্র দেখুন, সার জন।
লায়োনেলের পক্ষ নিয়ে রোজামুণ্ডের মত পাল্টাবার চেষ্টা করলেন সার জন। যুক্তি দেখালেন–একই এলাকার ছেলে সে, তার স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে সবই জানা আছে ওদের। ভিন্ন পাত্রের ক্ষেত্রে অতটা জানাশোনা না-ও থাকতে পারে। দেখা যাবে, বিয়ের পরে একগাদা বাজে স্বভাব প্রকাশ পেয়েছে। তা ছাড়া লায়োনেলকে বিয়ে করলে দূরে কোথাও যেতে হবে না। কর্নওয়ালেই থাকবে রোজামুণ্ড, নিজের বাড়ি আর পরিচিত লোকজনের কাছাকাছি। দুই পরিবারের সম্পত্তি একত্র হলে মান-সম্মান আর প্রভাব-প্রতিপত্তি কতখানি বেড়ে যাবে, তা উল্লেখ করতেও ভুললেন না।
ক্রমাগত চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলো রোজামুণ্ড। হাজার হোক, নারী ও; একাকী আর কতদিন শক্ত থাকা যায়? মান-মর্যাদা বজায় রেখে মত দিল বিয়েতে, কষ্ট নিয়ে বুকের গহীনে চাপা দিল নিজের সত্যিকার আপত্তি-অলিভারের প্রতি ওর প্রেম। হ্যাঁ, এতকিছু ঘটে যাবার পরেও… আজও মানুষটাকে ভালবাসে রোজামুণ্ড। অনেক যুদ্ধ করেও কিছুতেই দূর করতে পারেনি বিশুদ্ধ এই আবেগকে। জানে, পিটারের খুনি সে… তার জন্য যথেষ্ট রাগও আছে, কিন্তু নেই ঘৃণা। অন্তরের অন্তস্তল থেকে জানে, ওর ভাই থোয়া তুলসীপাতা ছিল না, অলিভারকে নিশ্চয়ই বাধ্য করেছিল অমন একটা কাজ করতে। তাই বলে ভাইয়ের খুনিকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নেয়া যায় না। লোকে কী বলবে? সমাজ কী বলবে? নিজেও তাই বাধ্য হয়েছে অলিভারকে দূরে ঠেলে দিতে। সত্যিকার আবেগকে গলা টিপে মারার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ও সবসময়। স্বভাববিরুদ্ধভাবে রূঢ় আচরণ করে চলেছে।
মনের টানাপড়েনের জন্য প্রায়শই নিজের উপর রাগ হয় রোজামুণ্ডের, কিন্তু তা থেকে মুক্তি পায় না। আচরণে রুক্ষতা ধরে রেখেছে ও-বারবারি উপকূল থেকে পাঠানো অলিভারের চিঠি পোড়ানোর মাধ্যমে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে–কিন্তু অবচেতন হৃদয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই ওর। বুকের মধ্যে একটা আকাক্ষা ঘুরপাক খায়, একটা আশা… অলিভার হয়তো কোনোদিন ফিরে আসবে, যদিও ওর ফেরা না-ফেরায় কোনও লাভ নেই রোজামুণ্ডের।
সার জন অবশ্য ওই আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন আর কখনও ছায়াও দেখবেন না খুনি নাইটের। কিন্তু তারপরেই একটা বোকামি করে বসল বোকা যুবক-চিঠি পাঠাল পিট নামের ওই ছেলেটির হাতে। ওর কাছ থেকে জানা গেল অলিভারের পরিণতি, ইংরেজ বীর থেকে শাকের-আল-বাহার নামের এক ঘৃণিত জলদস্যু হবার কাহিনি। সুযোগটা হাতছাড়া করেননি তিনি। পিটের জবানবন্দি নিয়ে আদালতে গেছেন, নিশ্চিত করেছেন রোজামুণ্ডের হবু-স্বামীর উত্তরাধিকার। তাঁর ধারণা, মেয়েটার ভবিষ্যৎও নিষ্কণ্টক হয়েছে এতে। নিজের অজান্তেই রোজামুণ্ডের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করলেন এর মাধ্যমে।
ঘটনাটার আগ পর্যন্ত শক্ত থেকেছে রোজামুণ্ড। কিন্তু অলিভারকে যখন আইনত মৃত বলে ঘোষণা করা হলো, সমস্ত আশা-ভরসা শেষ হয়ে গেল ওর। বুঝতে পারল, আর কোনোদিন দেশে ফিরতে পারবে না ওর মনের মানুষ। সমস্ত সম্পত্তি হারিয়েছে, মাথার উপর ঝুলছে ধর্মান্তরিত হবার কলঙ্ক, সেইসঙ্গে জলদস্যুতার অভিযোগ… এমন অবস্থায় কোনও বোকাও ইংল্যাণ্ডের মাটিতে পা রাখবার সাহস করবে না। চরম হতাশা গ্রাস করল রোজামুণ্ডকে, আর সেজন্যেই সম্ভবত মেনে নিল সার জনের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত।
বেশ ধুমধামের সঙ্গে বাগদান হলো ওর আর লায়োনেলের। উচ্ছ্বাস দেখাল না রোজামুণ্ড, নির্বিকারত্ব-ও না। লায়োনেল তাতেই খুশি। আত্মবিশ্বাসী সে-বিয়েটা একবার হয়ে গেলে ঠিকই স্ত্রী-র ভালবাসা আদায় করে নিতে পারবে। কয়েকদিনের মধ্যে কিছুটা এগিয়েও গেল। নিঃসঙ্গ এবং হতাশ ছিল রোজামুণ্ড, লায়োনেল ওকে সময় দেয়ায় কিছুটা ঘনিষ্ঠ হলো, আচরণে বন্ধুত্ব প্রকাশ পেল। দুজনের মধ্যকার দূরত্ব কমে আসছে দেখে সার জনও খুশি হয়ে উঠলেন, ভাবলেন সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এদেরকে বিয়ে করাবার। রোজামুণ্ডের ভাবনা লায়োনেলের উপর সঁপে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নিজের জাহাজ-সিলভার হেরন-এর নির্মাণ এবং আশু সমুদ্রযাত্রার প্রস্তুতিতে।
ধীরে ধীরে ঘনিয়ে এল বিয়ের সময়। আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। সার জনও অস্থির হয়ে উঠেছেন। লায়োনেল আর রোজামুণ্ডের বিয়ের ঘণ্টা তো আসলে তার বিদায়ের সঙ্কেত। অনুষ্ঠানটা শেষ হলেই জাহাজ নিয়ে ভারতবর্ষের পথে রওনা হবেন তিনি। কিন্তু বেচারার জানা নেই, তাঁর সমস্ত পরিকল্পনা ওলোটপালোট হতে বসেছে। ঘনিয়ে আসছে বিপদ… শুরু হতে চলেছে নতুন এক ঘটনাপ্রবাহ।
.
জুনের এক তারিখ। দিনের আলো মিলিয়ে গেছে, নেমে এসেছে রাতের আঁধার। কৃত্রিম আলোয় ঝলমল করছে আরওয়েনাক প্রাসাদের বিশালায়তন ডাইনিং হল। নৈশভোজে বসেছে সেখানে পাঁচজন মানুষ। সার জন কিলিগ্রু, রোজামুণ্ড, লায়োনেল ট্রেসিলিয়ান এবং সস্ত্রীক লর্ড হেনরি গোড-কর্নওয়ালে মহামান্য রানির লর্ড লেফটেন্যান্ট। আরওয়েনাকে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন শেষ দুজন। বিয়ের অনুষ্ঠান পর্যন্ত থাকবেন।
বাড়িতে চলছে প্রস্তুতিপর্ব-লায়োনেল-রোজামুণ্ডের বিয়ে, সেইসঙ্গে সার জনের সমুদ্রযাত্রার। ওপরতলার টারেট চেম্বারে দিন-রাত ডজনখানেক সহকারিণী নিয়ে খাটছে স্যালি পেনট্ৰিথ নামে এক নামকরা মহিলা-দর্জি-রোজামুণ্ডের বিয়ের পোশাক তৈরি করছে সে।
কারও জানা নেই, সার জন যখন অতিথিদের নিয়ে খেতে বসেছেন, ঠিক তখনই মাইলখানেক দূরে কর্নওয়ালের মাটিতে পা রাখছে সার অলিভার ট্রেসিলিয়ান।
পেনডেনিস পয়েন্ট অতিক্রম করেনি ও, সন্ধ্যার ছায়া ঘনিয়ে আসতেই সোয়ানপুলের পশ্চিম দিককার খাঁড়িতে নোঙর ফেলেছে। তারপর দুটো নৌকা নামিয়েছে পানিতে। পালা করে জাহাজে আসা-যাওয়া করেছে ওগুলো, মোট একশো কর্সেয়ারকে পৌঁছে দিয়েছে সৈকতে। বাকি একশো রয়েছে গেছে জাহাজের পাহারায়। এত লোক না নিলেও চলত, কিন্তু কোনও ধরনের ঝুঁকি নিতে রাজি নয় অলিভার। লোকবল দেখিয়েই ভড়কে দিতে চায় প্রতিপক্ষকে, তা হলে অযথা রক্তপাতের প্রয়োজন হবে না।
অন্ধকারের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল ও, সবার অলক্ষে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে রওনা হলো আরওয়েনাকের দিকে। এদিককার এলাকা ওর হাতের তালুর মত চেনা, সহজেই এগোতে পারল ঝোঁপঝাড়ের ভিতর দিয়ে, লুকিয়ে রাখতে পারল নিজের বিশাল বাহিনী। ক্ষণিকের জন্য আনমনা হয়ে গেল-ভাবল পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে। কে ভাবতে পেরেছিল, এভাবে কোনোদিন কর্নওয়ালে আসতে হবে ওকে! সঙ্গে একদল খুনে অপরাধী নিয়ে… চোরের মত! কত বদলে গেছে ও! পরিণত হয়েছে এমন এক মানুষে, যে-ধরনের মানুষকে ঠেকাবার শিক্ষা পেয়েছে ও সারাটা জীবন।
মনে মনে একটু দুর্বল হয়ে পড়ল অলিভার, কিন্তু একটু পরেই মাথা ঝাড়া দিয়ে দূর করল সে-দুর্বলতা। না, অন্যায় করছে না ও। আর কোনও পথ খোলা নেই ওর সামনে। আরওয়েনাকে যেতেই হবে ওকে, সার জন আর রোজামুণ্ডকে বাধ্য করতে হবে ওর কথা শুনবার জন্য। তারপর যাবে পেনারো-তে, বিশ্বাসঘাতক লায়োনেলের সঙ্গে বোঝাপড়া করবার জন্য। প্রতিশোধের সে-স্পৃহাই শক্তি যোগাল ওকে, সাহস জোগাল পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে-যার চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে দুর্গপ্রতীম শক্রশিবির।
আরওয়েনাকের বিশাল লোহার ফটক বন্ধ অবস্থায় পেল ওরা। সেটাই স্বাভাবিক, অস্থির হলো না অলিভার, এগিয়ে গিয়ে প্রাচীরের গায়ে লাগানো পার্শ্ব-দরজায় টোকা দিল। পায়ের শব্দ হলো ওপাশে, পার্শ্ব-দরজার পাল্লা সামান্য ফাঁকা হলো, একটা লণ্ঠন উঁচু হলো ওখানে–অতিথির চেহারা দেখবার চেষ্টা করছে গেটকিপার। বিদ্যুৎ খেলে গেল অলিভারের শরীরে। কাঁধ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ও পাল্লাটার উপরে। ধাক্কা খেয়ে ওপাশের মানুষটা ছিটকে পড়ল মাটিতে, হাত থেকে ছুটে গেল লণ্ঠন। তার উপর একদল কালো ছায়ার মত ঝাঁপিয়ে পড়ল দস্যুরা। শব্দ করতে দিল না, হাত-পা বেঁধে ফেলল দ্রুত।
ফটক আর খুলল না অলিভার, পার্শ্ব-দরজা দিয়েই আঙিনায় ঢোকাল সঙ্গীদেরকে। তারপর সবাইকে নিয়ে ছুটল বাড়ির দিকে। বাগানে আলো নেই, সহজেই লক্ষ্যের কাছে পৌঁছুতে পারল ওরা, কোনও বাধার সম্মুখীন হলো না। সদর দরজা খোলা থাকায় সরাসরি ঢুকে পড়ল মূল ভবনে।
হলওয়েতে যত ভৃত্য পাওয়া গেল, সবাইকে গেটকিপারের মত বেঁধে ফেলা হলো। ভূতের মত চলতে জানে কর্সেয়ার-রা, নিঃশব্দে কাজ সারল, ফলে ডাইনিং হলে সমবেত গৃহকর্তা আর অতিথিরা টের পেল না, বাড়িজুড়ে কী ঘটে যাচ্ছে। যখন পেল, তখন আর কিছু করার নেই। আচমকা প্রচণ্ড আওয়াজে হাট হয়ে খুলে গেল কামরার দরজা। চমকে উঠে ওদিকে তাকাল সবাই… এবং স্থবির হয়ে গেল।
পিলপিল করে ডাইনিং রুমে ঢুকল পাগড়ি আর ঢোলা কোর্তা-পাজামা পরা সশস্ত্র কর্সেয়ার-রা। সবার সামনে দুর্ধর্ষ শাকের-আল-বাহার। আতঙ্ক জাগাবার মত একটা দৃশ্য! পিনপতন নীরবতা নেমে এল ঘরে। চুপচাপ সামনের মানুষগুলোর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল অলিভার। তারপর পায়ে পায়ে এগোল সামনে। লায়োনেলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
হতবাক হয়ে ওকে দেখল কুচক্রী ট্রেসিলিয়ান। দাড়িগোঁফে ঢাকা নিষ্ঠুর চেহারা পেরিয়ে চোখ রাখল চোখে। আগুনের মত জ্বলছে মণিদুটো। আচমকা সে বুঝল, এই চোখ সে চেনে… চেনে। মানুষটিকেও! তীব্র আতঙ্ক ভর করল তার ভিতরে। কুঁকড়ে গেল দেহ, গদিমোড়া চেয়ারে সেঁধিয়ে যেতে চাইল যেন।
বক্র হাসি ফুটল অলিভারের ঠোঁটে।
যাক, অন্তত তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ, জলদগম্ভীর স্বরে বলল ও। খুবই আনন্দের কথা, সময় আর দুর্ভাগ্যের কষাঘাতে যে-পরিবর্তন এসেছে আমার মধ্যে, সেটাকে ভেদ করতে পেরেছে ভাইয়ের দৃষ্টি।
ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন সার জন, চেহারায় আক্রোশ, গাল দিয়ে উঠলেন। রোজামুণ্ড স্থির, ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে অলিভারের দিকে, নিজের অজান্তেই আঁকড়ে ধরেছে টেবিলের কিনার। দুজনেই এখন চিনতে পারছে ওকে। বুঝতে পারছে, চোখের ভুল নয় ব্যাপারটা। সন্দেহ নেই, ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটতে চলেছে; কিন্তু সেটা কী হতে পারে, কল্পনাও করতে পারছে না। ইংল্যাণ্ডের মাটিতে এই প্রথম উদয় হয়েছে বারবারি জলদস্যুরা। আয়ারল্যাণ্ডের বাল্টিমোরে তাদের বিখ্যাত আগ্রাসন ঘটতে এখনও ত্রিশ বছর বাকি।
সার অলিভার ট্রেসিলিয়ান! হতভম্ব কণ্ঠে বললেন সার জন।
অলিভার ট্রেসিলিয়ান? চমকালেন লর্ড হেনরি গোড। হা ঈশ্বর!
সার অলিভার ট্রেসিলিয়ান না, জবাব এল, শাকের-আল বাহার… ভূমধ্যসাগরের ত্রাস, খ্রিস্টানদের যম, বেপরোয়া এক কর্সেয়ার… যার জন্ম হয়েছে তোমাদের মিথ্যেবাদিতা, ষড়যন্ত্র আর হৃদয়হীনতার কারণে! মুখ বাঁকাল অলিভার। স্বাগত জানাও আমাকে। তোমাদেরকে প্রায়শ্চিত্ত করানোর জন্য এখানে আমার প্রত্যাবর্তন তো অনিবার্য-ই ছিল।
এক মুহূর্তের জন্য স্থির রইলেন সার জন, তারপরেই পাশ ফিরে ছুটলেন কামরার একপ্রান্তে দেয়ালে ঝোলানো ঢাল-তলোয়ারের নাগাল পেতে চাইছেন। নড়ল না অলিভার, আরবীতে একটামাত্র শব্দ উচ্চারণ করল। সঙ্গে সঙ্গে জনাছয়েক কর্সেয়ার ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর, আছড়ে ফেলল মেঝেতে।
লেডি হেনরি চেঁচিয়ে উঠলেন, বাকিরা বসে রইল মূর্তির মত। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল রোজামুণ্ড, দুহাতে মুখ ঢাকল লায়োনেল। বোধহয় নৃশংস হত্যাকাণ্ড আশা করল ওরা, কিন্তু তেমন কিছু ঘটল না। দলের লোকজনকে অকারণে রক্তপাত ঘটাতে নিষেধ করেছে অলিভার, তাই ওরা সার জনকে টেনে-হিঁচড়ে শুধু সরিয়ে আনল দেয়ালের কাছ থেকে উপুড় করে শোয়াল, দুহাত বেঁধে ফেলল পিছমোড়া করে। পুরোটাই সারা হলো বিস্ময়কর দ্রুততায়।..
নির্বিকার ভঙ্গিতে ব্যাপারটা দেখল শাকের-আল-বাহার, তারপর আবার টেবিলের দিকে ফিরল। ভাইকে উদ্দেশ্য করে একটা আঙুল তুলল ও, আর তা দেখে আতঙ্কে গুঙিয়ে উঠল লায়োনেল। দুজন কর্সেয়ার এগিয়ে গেল, দুপাশ থেকে তাকে আঁকড়ে ধরে দাঁড় করাল, নিয়ে এল নেতার সামনে। মুখোমুখি হলো দুই ভাই। অলিভারের দৃষ্টি যেন ছুরির মত বিদ্ধ করছে লায়োনেলকে। আরও সংকুচিত হয়ে গেল সে। তীব্র ঘৃণায় ওর মুখে থুতু দিল অলিভার। নির্দেশ দিল:
নিয়ে যাও ওকে!
দস্যুদের ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেল লায়োনেলের দেহ। যেন তাকে গিলে ফেলল ওরা।
হাঁচড়ে-পাঁচড়ে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালেন সার জন। রাগে মুখ লাল হয়ে গেছে তাঁর। হিংস্র কণ্ঠে জানতে চাইলেন, কী করতে যাচ্ছ তুমি ওকে নিয়ে?
জবাব দিল না অলিভার।
আমার ভাইয়ের মত নিজের ভাইকেও খুন করবে তুমি? বলে উঠল রোজামুণ্ড। অবশেষে মুখ খুলেছে ও, কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়েছে। ফ্যাকাসে চেহারায় ফিরতে শুরু করেছে রক্ত। এক মুহূর্তের জন্য অলিভারকে বিচলিত হতে দেখল ও, চোখ থেকে মুছে যেতে দেখল ক্রোধ… কিন্তু পরক্ষণেই আবার ফিরে এল সব। খেপে গেছে… যা করবে ভেবে এসেছিল, তা আর মাথায় নেই। সার জন আর রোজামুণ্ডের কথাগুলো ছুরির মত বিঁধেছে হৃদয়ে। এর উপযুক্ত জবাব দিতে না পারলে শান্তি পাবে না। তাই নতুন এক সিদ্ধান্ত নিল ও।
মনে হচ্ছে আমার ভাই নামের কলঙ্কটাকে ভালবাসো তুমি, বিদ্রুপের সুরে বলল অলিভার। দেখা দরকার, ওকে ভালমত চেনার পরে সেই ভালবাসা অক্ষুণ্ণ থাকে কি না। মেয়েমানুষের ভালবাসার ব্যাপারে কিছুই বলা যায় না… এই আছে তো এই নেই। বড় কৌতূহল অনুভব করছি। কৌতূহলটা নিবৃত্ত করা প্রয়োজন। হাসল ও। ঠিক আছে, তোমাদেরকে আলাদা করব না আমি… মানে, এখুনি না।
এগিয়ে গেল অলিভার। আমার সঙ্গে এসো, লেডি। বলে বাড়িয়ে দিল একহাত।
এতক্ষণে নড়ে উঠলেন লর্ড হেনরি গোড। ছুটে এসে রোজামুল্পে সামনে দাঁড়ালেন, ঢাল হবার চেষ্টা করলেন যেন। চেঁচিয়ে বললেন, খবরদার, লেডি রোজামুণ্ডের দিকে ফিরেও তাকিয়ো না! নইলে ভুগতে হবে তোমাকে!
ভুগব? বলল অলিভার। ইতোমধ্যে যথেষ্ট ভুগেছি আমি, সার। সে-কারণেই আজ আমার এখানে আসা।
তা হলে জেনে রাখো, আরও ভোগান্তি আছে তোমার কপালে, নরকের কীট! সম্ভ্রান্ত এক ভদ্রমহিলাকে অপহরণের কারণে চরম শাস্তি পেতে হবে তোমাকে।
তাই নাকি? শান্ত কণ্ঠে বলল অলিভার। কে দেবে সেই শাস্তি?
আমিই দেব, ঈশ্বরের দোহাই! গর্জে উঠলেন লর্ড হেনরি। তোমাকে ধাওয়া করে শূলে চড়াব!
হেসে উঠল অলিভার। আপনি? আপনি শিকার করবেন সাগরের বাজপাখিকে? খামোকা লোক হাসাবেন না। সরুন!
না!
আরবীতে আবার একটা নির্দেশ দিল অলিভার। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন কর্সেয়ার এসে টান দিয়ে সরিয়ে নিল লর্ড হেনরিকে, একটা চেয়ারে বসিয়ে বেঁধে ফেলল আষ্টেপৃষ্ঠে।
রোজামুণ্ডের মুখোমুখি হলো অলিভার… দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে। ওর গায়ের সুবাস পাচ্ছে, পাচ্ছে ওর নিঃশ্বাসের ছোঁয়া। উত্তেজনায় দ্রুত ওঠানামা করছে সুগঠিত বুক। অনুভব করল, এভাবে আবার ওর মুখোমুখি হবার জন্যই এতদিন আকুল হয়ে ছিল হৃদয়।
চলো, লেডি, নরম কণ্ঠে বলল অলিভার।
মুহূর্তের জন্য চরম ঘৃণা আর বিতৃষ্ণার চোখে ওর দিকে তাকাল রোজামুণ্ড, তারপরেই ঝট করে টেবিল থেকে তুলে নিল একটা ছুরি, ওটা বসিয়ে দেবার চেষ্টা করল ওর বুকে। কিন্তু অলিভারের হাত নড়ল আরও দ্রুত-খপ করে মেয়েটার কবজি ধরে ফেলল ও, হালকা একটা মোচড় দিতেই ছুরিটা খসে পড়ল মেঝেতে।
হাহাকারের মত একটা শব্দ বেরিয়ে এল রোজামুণ্ডে গলা দিয়ে-ব্যর্থতা, নাকি অনুতাপে… তা বোঝা গেল না। কিন্তু আচমকা নেতিয়ে গেল ওর দেই, পড়ে যেতে শুরু করল জ্ঞান হারিয়ে। নিজের অজান্তেই ওকে জাপটে ধরে ফেলল অলিভার, টেনে নিল বুকে। মনে পড়ল, পাঁচ বছর আগে শেষবার এভাবে ওকে আলিঙ্গন করেছিল ও। সুন্দর এক সন্ধ্যায়, গডলফিন কোর্টের দেয়ালের বাইরে। তখন কল্পনাও করেনি, ওদের পরের আলিঙ্গনটা হবে এভাবে… এই পরিবেশে। পুরোটাই যেন অদৃশ্য কোনও শক্তির নির্মম তামাশা। তারপরেও এ সত্যি-রোজামুণ্ড আবার ওর বুকে ফিরে এসেছে!
মেয়েটার অজ্ঞান দেহ পাঁজাকোলা করে তুলে নিল অলিভার, উল্টো ঘুরল। আরওয়েনাকে ওর কাজ শেষ। যা করবার জন্য এসেছিল, তারচেয়ে এক অর্থে বেশিই অর্জন হয়েছে। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে কম।
ফিরে চলো! নির্দেশ দিল ও।
যেভাবে এসেছিল, ঠিক সেভাবেই আবার ডাইনিং হল থেকে বেরুতে শুরু করল কর্সেয়ার-রা। বাড়ির অলি-গলি পেরিয়ে আঙিনায় নেমে এল জনস্রোত, সেখান থেকে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে সৈকতের দিকে, যেখানে ওদের নৌকাদুটো অপেক্ষা করছে। রোজামুণ্ড হালকা হওয়ায় সহজেই তাদের সঙ্গে তাল মেলাল অলিভার, মেয়েটাকে আর কারও হাতে দিল না। ওর কয়েক গজ সামনে, লায়োনেলকে বইতে গিয়ে অবশ্য হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে অন্যেরা।
ঢাল ধরে নামবার আগে ক্ষণিকের জন্য থামল অলিভার, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ঘন বনের উপর দিয়ে। ওখানে, পেনারো পয়েন্টের মাথায়, চাঁদের আলোয় গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ওর বাড়ি-পেনারো হাউস। যাবার কথা ছিল ওখানে, কিন্তু লায়োনেলকে আরওয়েনাকেই পেয়ে যাওয়ায় পরিকল্পনাটা বাদ দিতে হয়েছে। এত কাছে এসেও দেখা হলো না প্রিয় জায়গাটা। বুক খা খা করে উঠল ওর।
ওসমানি আর আলি নামে দুই সহকারী কাছে আসায় চিন্তায় ছেদ পড়ল ওর। দুজনে অনেকক্ষণ থেকেই ফিসফাস করছিল। কাছে এসে গলা খাকারি দেয়ায় সংবিৎ ফিরল অলিভারের।
কী ব্যাপার?
হাত তুলে, মিটমিট করে জ্বলতে থাকা স্মিথিক আর পেনিকামউইক গাঁয়ের আলো দেখাল ওসমানি। বলল, মালিক, ওখানে জোয়ান-তাগড়া অনেক পুরুষ আর মহিলা পাওয়া যাবে বলে ধারণা আমার।
তো?
আপনি অনুমতি দিলে জনাপঞ্চাশেক লোক নিয়ে যেতে পারি ওখানে। আমাদের উপস্থিতির কথা জানে না ওরা, অতর্কিত হামলা চালিয়ে খুব সহজেই বেশ কিছু দাস জোগাড় করতে পারব। শক-আল-আবিদের বাজারে ভাল দাম পাওয়া যাবে।
চরম বিরক্তি নিয়ে সঙ্গীর দিকে তাকাল অলিভার। ওসমানি, তুমি একটা গাধা… এবং বেয়াদব! এটা আমার মাতৃভূমি, এখানকার আলো-বাতাসে বড় হয়েছি আমি, এখানকার মানুষ আমার স্বজাতি… এই দেশ আমার জন্য পবিত্রভূমি। ভাবলে কী করে, এখান থেকে দাস সগ্রহ করব আমি! বাজে কথা না বলে। হাঁটতে থাকো। তাড়াতাড়ি জাহাজে ফেরা দরকার।
হাল ছাড়তে রাজি নয় ওসমানি। বলল, তারমানে আপনি বলতে চাইছেন, বিপজ্জনক, অচেনা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিধর্মীদের দেশে এসেছি আমরা সামান্য দুজন বন্দির জন্য? এমন অভিযান কি শাকের-আল-বাহারকে শোভা পায়?
সেটা শাকের-আল-বাহারকেই ভাবতে দাও, রূঢ় গলায় বলল অলিভার।
মাফ করবেন, মালিক… কিন্তু আরেকজন আছেন, যার কাছে আপনাকে জবাবদিহি করতে হয়। আমাদের বাদশাহ্, মহান আসাদ-আদ-দীন যদি প্রশ্ন তোলেন, তখন কী জবাব দেবেন আপনি? দুইশ মুমিনের জীবন বিপন্ন করেছেন আপনি কীসের জন্য?
যা খুশি জিজ্ঞেস করতে পারেন তিনি, আল্লাহ যদি চান তো সেসবের জবাবও দেব আমি, বলল অলিভার। আর কোনও কথা শুনতে চাই না তোমাদের মুখ থেকে। আগে বাড়ো! এ আমার হুকুম!
মাথা ঝাঁকিয়ে ঢাল ধরে নামতে শুরু করল ওসমানি আর আলি। ওদের পিছু নিল অলিভার। হাতের ভাঁজে ধরা দেহটির মৃদু উত্তাপ অনুভব করছে, তীব্র এক আবেগে ছেয়ে যাচ্ছে অন্তর-কিন্তু জানে না সেটা ভালবাসা, নাকি ঘৃণা।
স্থানীয় লোকজনের দৃষ্টি এড়িয়ে সহজেই জাহাজে পৌঁছুল কর্সেয়ার-বাহিনী। নোঙর তুলল, সন্ধ্যার মৃদু-মন্দ বাতাস ব্যবহার করে ভেসে চলল ফিরতি পথে। রাত পোহাবার আগেই কর্নিশ উপকূল থেকে অনেক দূরে চলে গেল ওরা। ফলে সূর্যোদয়ের পর ফাল নদীর মোহনা এবং চারপাশের সমুদ্রকে দেখা গেল বরাবরের মত শান্ত রূপে-আগের দিন সূর্য ডোবার আগে ঠিক যেমনটা ছিল। বোঝারই উপায় নেই, মাঝের কয়েক ঘণ্টায় কী ঘটে গেছে। রোজামুণ্ড আর লায়োনেল অপহৃত না হলে হয়তো বা দুঃস্বপ্ন ভেবেই ভুলে যাওয়া যেত ব্যাপারটা।
যা হোক, জাহাজের পিছনদিককার একটা পরিষ্কার কেবিনে রোজামুণ্ডের থাকার ব্যবস্থা করল অলিভার, দরজায় তালা দেয়া থাকবে ওটার সবসময়। লায়োনেলকে নিক্ষেপ করা হলো পাটাতনের নীচের এক অন্ধকার খুপরিতে। ওকে নিয়ে কী করা হবে, তা এখনও ঠিক করেনি অলিভার। আগামী কয়েকটা দিন অনিশ্চয়তা আর মানসিক চাপের মধ্যে কাটাবে ওর কুচক্রী ভাইটি।
এক ধরনের চাপ অলিভারও অনুভব করছে। রাতের বেলা খোলা আকাশের নীচে শুয়ে নানা বিষয়ে ভাবছে ও। সবচেয়ে বেশি ভাবছে ওসমানির কথাটা। সে-সময় ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলেও এখন বুঝতে পারছে–সমস্যা গুরুতর। আলজিয়ার্সে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে অভিযান সম্পর্কে জানতে চাইবেন আসাদ-আদ-দীন, কী জবাব দেবে ও? দুইশ কর্সেয়ারের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত শত মাইল মহাসাগর পাড়ি দিয়েছে, হামলা চালিয়েছে চরম বৈরি এক এলাকায়… কেন? মাত্র দুজন বন্দি নিয়ে ফেরার জন্য, যাদের উপর নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবে? এ কি মেনে নেবেন বাদশাহ্? বুঝতে পারছে অলিভার, বড় ধরনের একটা ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে। আলজিয়ার্সে ওর শত্রু আছে অনেক, এমনকী বাদশাহ্-র সিসিলিয়ান বেগমও দুচোখে দেখতে পারে না ওকে। সবাই মিলে এই ঘটনার ফায়দা লুটবে, বিপদে ফেলবে অলিভারকে।
এসব ভাবনাই সম্ভবত শাকের-আল-বাহারের পরদিনের দুঃসাহসিক কাজের ইন্ধন জোগাল। ভোরবেলা ওরা দেখা পেল উঁচু মাস্তুলঅলা এক ডাচম্যান জাহাজের, দেশে ফিরছিল ওটা। ধাওয়া করল অলিভার, যদিও ভাল করে জানে–এ-ধরনের প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করবার কোনও অভিজ্ঞতা নেই কর্সেয়ারদের। কিন্তু নেতার উপর রয়েছে তাদের অগাধ আস্থা, আজ পর্যন্ত কোনও যুদ্ধে পরাজয় ঘটেনি শাকের-আল-বাহারের, তাই উত্তাল অচেনা সমুদ্রে, অচেনা জাহাজের উপর নির্দ্বিধায় হামলা করল তারা।
লড়াইয়ের বিস্তারিত বিবরণ দেবার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। সাগরের আর দশটা লড়াইয়ের মতই ছিল ওটা। এটুকু বলা যেতে পারে যে, ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছে, উভয়পক্ষকে সইতে হয়েছে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। কামান ব্যবহার হয়ইনি বলতে গেলে-দুর্ধর্ষ কর্সেয়ার-রা শত্রুকে কামান চালাতে দেয় না, যত দ্রুত পারে আঁকশি ছুঁড়ে পাশে ভিড়ে শিকারের, তারপর জাহাজে উঠে সম্মুখসমরে নামে। এ ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটল। বলে রাখা ভাল, বর্ম আর তলোয়ার হাতে সবার আগে অলিভার-ই চড়ল শত্রু-জাহাজে। আল্লাহর নাম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ডাচম্যানের নাবিকদের উপর।
শাকের-আল-বাহারের বেপরোয়া আচরণ এবং প্রচণ্ড আক্রোশ। দেখে উদ্দীপনা জাগল অনুসারীদের মাঝে। প্রবলবিক্রমে আক্রমণ চালাল ওরা। তবে ডাচম্যানের আরোহীরা আনাড়ি সওদাগর নয়, শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলল। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে গেল কর্সেয়ার-রা। দুপক্ষেই বাড়তে থাকল হতাহতের সংখ্যা। শেষ পর্যন্ত সফল হলো জলদস্যুরা, তবে তার জন্য চওড়া মাশুল গুনতে হয়েছে। অলিভার-ও আহত-এক প্রতিপক্ষের শক্ত বর্শা ওর বর্ম ভেঙে ফেলেছে, চিরে দিয়েছে বুকের একপাশ, রক্ত ঝরছে ওখান থেকে, কিন্তু লড়াইয়ের উন্মাদনায় তৎক্ষণাৎ টের পায়নি আঘাতটা। এক সময়ে রক্তক্ষরণে দুর্বল হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল, তবে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে পড়েছে পরমুহূর্তেই। জানে, ওকে ঘায়েল হতে দেখলে মনোবল হারাবে সঙ্গীরা; তখন আর কিছুতেই জিততে পারবে না। শারীরিক ব্যথা-বেদনা চাপা দিয়ে লড়ে গেল ও, চেঁচিয়ে দিতে থাকল আদেশ-নির্দেশ, নিজের বাহিনীকে নিয়ে গেল বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। শেষে বিদ্রোহ করল দেহ, নিহত ও আহতদের মাঝে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল মহা-পরাক্রমশালী শাকের-আল বাহার-জীবনে প্রথমবারের মত।
কঠিন এক লড়াইয়ে জয় পেল কর্সেয়ার-রা, কিন্তু ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নেতাকে নিয়ে ফিরতে হলো স্প্যানিশ গ্যালিয়নে। শাকের যদি মারা যায়, তা হলে এ-বিজয় মূল্যহীন। জাহাজের মাঝামাঝি জায়গায় একটা বিছানা পেতে শোয়ানো হলো অলিভারকে, ওখানে জাহাজের দুলুনি সবচেয়ে কম। মূরিশ এক চিকিৎসক রয়েছে ওদের সঙ্গে, সে এসে পরীক্ষা করল ওকে। জানাল, আঘাত অত্যন্ত গুরুতর, তবে একেবারে আশা ছেড়ে দেবার মত নয়। তার কথা শুনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল কর্সেয়ার-রা। দৃঢ়বিশ্বাস রয়েছে ওদের মনে–আল্লাহ্ তাঁর এমন দুর্দান্ত অস্ত্রকে ফিরিয়ে নেবেন না। ইসলামের জয়ের জন্যই তিনি টিকিয়ে রাখবেন শাকের-আল-বাহারকে।
ওদের ধারণাই সত্যি বলে প্রমাণিত হলো। গ্যালিয়ন যখন জিব্রাল্টার প্রণালীতে পৌঁছুল, তখন জ্ঞান ফিরে পেল অলিভার, মৃদু স্বরে জানতে চাইল লড়াইয়ের ফলাফল এবং তখনকার পরিস্থিতি। ওসমানি জানাল, জয় হয়েছে ওদের, ডাচম্যান-টা গ্যালিয়নের পিছু পিছু আসছে। আলি এবং আরও কিছু লোক মিলে চালাচ্ছে ওটা। শখানেক তাগড়া-সুস্থ বন্দি পাওয়া গেছে জাহাজ থেকে, খোলের ভিতর পাওয়া গেছে সোনা, রূপা, মুক্তো, হাতির দাঁত, রেশমি কাপড় আর মশলা-র বড় এক চালান। খবরটা শুনে স্বস্তি পেল অলিভার। যাক, এবার আর অভিযানটাকে ব্যর্থ বলে অপপ্রচার চালাতে পারবে না কেউ। ডাচম্যান দখল করতে গিয়ে যারা নিহত হয়েছে, তাদের রক্তও বিফলে যায়নি। শান্তিতে এবার আলজিয়ার্সে ফিরতে পারবে ও; শাকের-আল বাহারের বিরোধীরা, কিংবা বাদশাহ্-র কুটিল বেগমের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা ছাড়া।
ইংরেজ দুই বন্দির ব্যাপারে খোঁজ নিল অলিভার। ওসমানি জানাল, ওরা আগের মতই আছে… সুস্থ। শাকেরের নির্দেশ অনুসারে কেউ বিরক্ত করছে না ওদেরকে।
সন্তুষ্ট হয়ে চোখ মুদল অলিভার। জাহাজের পাটাতনে তখন দলবদ্ধভাবে প্রার্থনায় বসেছে কর্সেয়ার-রা। একযোগে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে দয়ালু-দাতা মহান আল্লাহতালার কাছে।
.
০৫.
আসাদ–আদ–দীন
কসবাহ নগরীর সুরভিত উদ্যানে সন্ধ্যার মিষ্টি বাতাস উপভোগ। করছেন আলজিয়ার্সের বাদশাহ্, বিশ্বাসীদের সিংহ বলে পরিচিত আসাদ-আদ-দীন। সঙ্গে রয়েছে তার স্ত্রী–ফানযিলাহ, রাজকীয় হারেমের প্রধান নারী… যাকে আঠারো বছর আগে মেসিনার এক গ্রাম থেকে তুলে এনেছিলেন তিনি।
ষোড়শী ছিল তখন ফানযিলাহ্, সাদাসিধে এক কৃষক পরিবারের মেয়ে, বিনা-প্রতিবাদে আত্মসমর্পণ করেছিল, আসাদ-আদ-দীনের কাছে। এখন… চৌত্রিশ বছর বয়সেও রূপসী সে, আগের চেয়েও বেড়েছে তার সৌন্দর্য-যে-সৌন্দর্য কামনার আগুন জ্বেলেছিল বিখ্যাত আলি বাশা-র তরুণ ক্যাপ্টেন আসাদের বুকে। মুক্তোর মত ফর্সা, মাখনের মত মোলয়েম ত্বক। ফানযিলাহ্-র। চোখদুটো জলপাই আকারের, কালচে-সোনালি মণিদুটোয় আগুন জ্বলে। ঠোঁটদুটো পুরু এবং গোলাপি। বেশ লম্বা, একহারা দেহ। মেদ বলে কিছু নেই। সমীর পাশে চপল হরিণীর মত হাঁটছে, প্রতি পদক্ষেপে প্রকাশ পাচ্ছে দৃঢ়তা এবং আভিজাত্য। মুখে কোনও ঘোমটা নেই, ঘোমটা দিতে পছন্দ করে না সে, তাই দেখা যাচ্ছে অপূর্ব চেহারা–যে-কোনও পুরুষের রাতের ঘুম হারাম করে দেবার জন্য যথেষ্ট। বিয়ের আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে ফানযিলাহ্, সে-অনুসারে পর্দা-পুশিদার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এ-ব্যাপারে উদাসীন। কেন যেন তা মেনেও নিয়েছেন আসাদ-আদ-দীন। হয়তো আর দশটা মেয়ের চেয়ে ফানযিলাহ্ একেবারে আলাদা বলেই। স্বামীর হাতের পুতুল হতে আপত্তি নেই তার, একান্ত সময়ে বাদশাহ-র উপভোগের বস্তু… কিন্তু তারপরেও নিজেকে গুরুত্বহীন করে ফেলেনি। শাসন-কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়, বাদশাহ্-র একান্ত বিশ্বস্ত, তাঁকে বুদ্ধি-পরামর্শ দেয়–ঠিক যেভাবে ইয়োরোপীয় রাজাদের প্রভাবিত করে রানি-রা। আরব সমাজে এ এক ব্যতিক্রম তো বটেই।
শুরুতে ফানযিলাহ্-র রূপের জাদুতে বহুদিন মজে ছিলেন আসাদ-আদ-দীন, তবে ধীরে ধীরে সে-মোহ কাটাতে শুরু করেছেন। অবশ্য দেরি করে ফেলেছেন–ইতোমধ্যে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করে নিয়েছে সে। ফলে ইয়োরোপীয় রাজাদের মতই, অনেক ক্ষেত্রে অসহায় হয়ে পড়েছেন বাদশাহ্, স্ত্রী-র নাক গলানো ঠেকাতে পারছেন না রাজকার্যে। ফানযিলাহ্ও পা ফেলছে সতর্কভাবে, সহজে বিরক্ত হতে দেয় না স্বামীকে, চাইলে খুব সহজেই ওকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে নিতে পারবেন তিনি। মুখ ফুটে শুধু বলতে হবে, এই যা। ঝুঁকিটা মাথায় রেখে কাজ করে সে, একজন মুসলিম স্ত্রী হয়েও স্বামীর ক্ষমতায় ভাগ বসাচ্ছে সীমানান ধূর্ততা দিয়ে।
বাগানে বাদশাহ্-র পাশে হাঁটছে এখন ফানযিলাহ। ফুলে-ফলে ভরে আছে চারদিক। বইছে মিষ্টি সুবাস। হালকা মেজাজে আছেন আসাদ-আদ-দীন, সে-সুযোগে তার কান ভারী করবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে দুর্ধর্ষ কর্সেয়ার শাকের-আল বাহারের নামে। ঈর্ষার বশে করছে এই কাজ, নিচ্ছে বাদশাহকে রুষ্ট করবার ঝুঁকি, কারণ লোকটা আসাদের অত্যন্ত প্রিয়। তার এই অনুরাগ-ই ঈর্ষার জন্ম দিয়েছে ফানযিলাহ্-র মনে। নিজের স্ত্রী-পুত্রের চেয়ে শাকেরকে বেশি ভালবাসেন আসাদ-আদ-দীন। শোনা যাচ্ছে ও-ই তাঁর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবে। ব্যাপারটা কিছুতেই মানতে পারছে না ফানযিলাহ্।
…আমি বলব, লোকটা আপনার ভালমানুষির সুযোগ নিচ্ছে, হে স্বামী। বলে উঠল সে।
বাজে কথা, বললেন আসাদ-আদ-দীন। খামোকাই সন্দেহ করছ শাকেরকে। কাজ-ই মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয়, আর সে-কাজ দিয়েই আমার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য দেখিয়েছে ও।
আমিও কাজের কথাই বলছি। কথা নেই, বার্তা নেই, দখল করা স্প্যানিশ জাহাজ নিয়ে কোথায় হারিয়ে গেল? এই-ই কি আপনার প্রতি ওর আনুগত্য?
যা জানো না, তা নিয়ে কথা বোলো না, একটু যেন বিরক্ত হলেন আসাদ-আদ-দীন। নতুন অভিযানে গেছে শাকের। ফিরে আসুক, তখন নাহয় বিচার করা যাবে অভিযানটার বিষয়-আশয়। আগেভাগেই বাজে ধারণা নিয়ে বসে থাকার দরকার কী?
আমি শুধু আপনাকে সতর্ক করে দিতে চাইছি…
এবার সত্যিই মেঘ জমল বাদশাহর চেহারায়। রাগী গলায় বললেন, ওর বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ আছে তোমার হাতে? নইলে মুখ বন্ধ রাখো, বোকা মেয়েমানুষ!
থতমত খেয়ে গেল ফানযিলাহ্। মাথা নিচু করে পিছিয়ে গেল এক পা।
চলো, বলে উল্টো ঘুরলেন আসাদ-আদ-দীন। নামাজের সময় হয়ে আসছে।
বাগানের সবখান থেকে ভেসে আসছে নীড়ে ফেরা পাখিদের কলকাকলি। পশ্চিমের আকাশে লাল আভা। সূর্য হারিয়ে যেতে বসেছে দিগন্তে, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে আসছে ছায়াগুলো। মোহনীয় পরিবেশ।
কণ্ঠে কপট দুঃখ ফুটিয়ে ফানযিলাহ্ বলল, আপনি আমার উপর রাগ করলেন, হে স্বামী? নিজের জন্য নয়, আপনার মঙ্গলের জন্যই তো বলেছি কথাগুলো! এ কি আমার অপরাধ? এ-ই কি তার প্রতিদান?
যদি এমন আচরণ পেতে না চাও, তা হলে আমার পছন্দের লোকজনের নামে বাজে কথা বোলা না, শান্তস্বরে বললেন বাদশাহ্। আমি তোমাকে আগেই সাবধান করেছি।
স্বামীর কাছে ঘেঁষে এল ফানযিলাহ্, কণ্ঠে মধু ঢেলে বলল, আর আমি? আমি আপনার পছন্দের নই? আমাকে আপনি ভালবাসেন না? দুনিয়ায় আমার চেয়ে বিশ্বস্ত আর কেউ কি আছে? আমার জীবন তো আপনারই জীবন। আপনার সুখের জন্য নিজেকে কি উৎসর্গ করে দিইনি আমি? তা হলে কেন এ অবিচার? বহিরাগত এক মানুষের হাতে আপনার জীবনসংশয়ের আশঙ্কা করছি বলে?
আমার জীবনসংশয়? হেসে উঠলেন বাদশাহ্। তাও আবার শাকের-আল-বাহারের হাতে?
খাঁটি মুসলমান নয় ও। আমার তো ধারণা, স্রেফ স্বার্থ হাসিলের জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে লোকটা। এমন মানুষের ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত আপনার।
ঝট করে স্ত্রীর দিকে ফিরলেন আসাদ-আদ-দীন। রাগতস্বরে অভিশাপ দিলেন, তোমার জিভ খসে পড়ক, মিথ্যেবাদিনী!
আমি আপনার পায়ের তলার ধুলো, স্বামী, বলল ফানযিলাহ্। কিন্তু রাগের মাথায় যা বলে ডাকলেন, তা আমি নই।
রাগের মাথায় না, বললেন আসাদ-আদ-দীন, ভেবেচিন্তেই বলেছি ওটা। শাকের হলো বর্শা, আল্লাহ্-র দেয়া
অব্যর্থ অস্ত্র, বিধর্মীদের বুকে যা প্রতিনিয়ত বিদ্ধ হয়ে চলেছে। আমাদের জয় এনে দিচ্ছে ও, আর তুমি কিনা ওকেই অবিশ্বাস করবার কথা বলছ? না, যথেষ্ট সহ্য করেছি, আর না। এক্ষুণি তুমি প্রমাণ দেবে তোমার অভিযোগের, নইলে মিথ্যে অপবাদ ছড়াবার জন্য শাস্তি পাবে।
ভাবছেন ভয় পাব তাতে? একটু কঠিন হলো ফানযিলাহ্। সত্যভাষণের জন্য যদি শাস্তি পেতে হয়, তা মাথা পেতে নিতে রাজি আমি। প্রমাণ অবশ্যই দেব। আপনি বলুন, স্বামী, আমার সন্তান মারকের পিতা, বিধর্মী ক্রীতদাসকে কিনে মুক্তি দিচ্ছে শাকের-আল-বাহার… এ কি খাঁটি মুসলমানের কাজ?
চুপ হয়ে গেলেন আসাদ-আদ-দীন। ভুল বলেনি ফানযিলাহ্, শাকেরের এই বিশেষ অভ্যাসটি সত্যিই মেনে নেয়া কঠিন। বহুবার এ-নিয়ে অস্বস্তি বোধ করেছেন তিনি, কিন্তু খোঁজখবর নেয়ার পর যা জানতে পেরেছেন, তা-ই যুক্তি হিসেবে দাঁড় করালেন স্ত্রী-র সামনে। একজনের মুক্তির বিনিময়ে দশজন দাস এনে দিচ্ছে ও…
বাধ্য হয়ে! যোগ করল ফানযিলাহ্। নইলে সবার মনে সন্দেহ সৃষ্টি হবে। খাঁটি মুসলমানদের চোখে ধুলো দেয়ার প্রচেষ্টা ওটা। আপনারও দৃষ্টি ঘোলা করে রেখেছে, তাই বুঝতে পারছেন না, আজও ওই বিধর্মীদের জন্য দরদ আছে ওর মনে। খাঁটি মুসলমান হলে এমন দরদ থাকত না। ভেবে দেখুন, আপনিও তো সিসিলি থেকে তুলে এনেছেন আমাকে, তাই বলে কোনোদিন আমাকে একজন সিসিলিয়ানকেও মুক্তি দিতে দেখেছেন? এ-সবই বিশ্বাসঘাতকতার চিহ্ন… ওর ভিতরে বাস করতে থাকা খ্রিস্টান আত্মার বহিঃপ্রকাশ। এখন আবার নতুন কাণ্ড ঘটাচ্ছে–ইসলামের নামে দখল করা জাহাজ নিয়ে চলে গেছে সাগর পাড়ি দিতে… দুইশ নিরীহ মুসলমানের জীবন বিপন্ন করছে নিজের জন্মভূমির চেহারা একটিবার দেখবার জন্য। বিস্কেনের মুখে তো তা-ই শুনলাম। ভেবে দেখেছেন, এর পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে?
আবারও তুমি না-জেনে বাজে কথা বলছ, ক্ষোভ প্রকাশ করলেন বাদশাহ্। ও না ফেরা পর্যন্ত আসল ঘটনা তো জানতে পারছি না আমরা।
সেটা ভেবেই মনকে সান্ত্বনা দিন, স্বামী আমার। ভুল বুঝুন আমাকে। আমি তো মূল্যহীন, আপনার হাতের খেলনা! কিন্তু তবু সতর্ক করে দেয়া কর্তব্য মনে করছি-শাকেরকে বিশ্বাস করলে মস্ত ভুল করবেন আপনি। এর জন্য যা শাস্তি দিতে চান, দিন।
তিক্ত হাসি ফুটল বাদশাহর ঠোঁটে। জিভ তো না, যেন শয়তানের বাজানো কোনও ঘণ্টা ওটা তোমার, বেগম! আর কিছু বলবে?
মনঃক্ষুণ্ণ সুরে ফানযিলাহ্ বলল, না। আপনি আমাকে নিয়ে মশকরা করছেন। এই আমি মুখে তালা আঁটলাম।
আল্লাহর অশেষ দয়া! হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন যেন বাদশাহ। চলো এখন, নামাজের সময় হয়ে গেছে।
কিন্তু তার জানা নেই, ফানযিলাহ্-র ছলাকলা এখনও শেষ হয়নি। রাজপ্রাসাদের কাছাকাছি পৌঁছে হাত তুলল সে।
ওই যে আমাদের ছেলে। দেখতে পাচ্ছেন, মালিক?
হ্যাঁ। কেন?
পুত্রই কি পিতার প্রকৃত উত্তরাধিকারী নয়? বলল ফানযিলাহ্। অথচ মারযাকের বদলে একজন বিদেশিকে পাশে নিয়েছেন আপনি। ওই স্থান শুধু ওর-ই প্রাপ্য।
ওই স্থানটা কি পূরণ করতে পারবে মারযাক? জিজ্ঞেস করলেন আসাদ-আদ-দীন। এই বাচ্চা ছেলেটা… যার এখনও গোঁফ-দাড়িই গজায়নি ঠিকমত… সে কি নেতৃত্ব দিতে পারবে শাকের-আল-বাহারের মত? তলোয়ার ধরতে পারবে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয় এনে দিতে পারবে আল্লাহ্ আর রাসূলের নামে?
শাকের-আল-বাহারের এই সাফল্য আসছে আপনার সাহায্য পাওয়ায়, স্বামী! মারযাক-ও তা পারবে, বয়স যতই কম হোক না কেন। শাকেরকে আজকের অবস্থানে আপনি নিয়ে এসেছেন, ওর নিজের কোনও কৃতিত্ব নেই তাতে।
এখানেই তুমি ভুল করছ, বেগম। শাকেরকে আজকের অবস্থানে এনেছেন মহান আল্লাহ্তালা। আমি নই। তাঁর মর্জি ছাড়া কিছুই ঘটে না। তুমি কি জানো না, আল্লাহ্ আমাদের সবার ভাগ্য নির্ধারণ করে রেখেছেন?
সাঁঝের আঁধার নেমে আসায় আলোচনার ইতি ঘটল ওখানে। নিষ্ফল রইল ফানযিলাহ্-র অপচেষ্টা। দ্রুত পা চালালেন বাদশাহ, পরাজিত ভঙ্গিতে তাঁর পিছু নিল সে। গোধূলির আলো মুছে গিয়ে নেমে এল রাতের কালো পর্দা। দূর থেকে ভেসে এল মুয়াজ্জিনের আজান।
..লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)…
ব্যক্তিগত কামরায় পৌঁছুতেই রূপার পাত্রে পরিষ্কার পানি নিয়ে এল ভৃত্য, হাত-মুখ ধুয়ে অজু করলেন আসাদ-আদ-দীন। জায়নামাজ বিছিয়ে দেয়া হলো, মক্কামুখী হয়ে তার উপর দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতে শুরু করলেন তিনি। উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন কুরআনের আয়াত, নামাজ শেষে দুহাত তুলে করুণা চাইলেন সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহতালার কাছে।
প্রার্থনা শেষ হতেই নীচ থেকে ভেসে এল পদশব্দ। সঙ্গে সঙ্গে ছায়া থেকে বেরিয়ে এল বাদশাহ্-র ব্যক্তিগত দেহরক্ষীরা, কালো পোশাকে প্রায়-অদৃশ্য ছিল ওরা, দর্শনপ্রার্থীকে থামাবার জন্য এগিয়ে গেল।
প্রাসাদ-আঙিনার অন্ধকার প্রবেশপথে জ্বলে উঠল বেশ কিছু প্রদীপ-ছাগলের চর্বির কারণে উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। কামরা থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি ধরে নামতে শুরু করলেন আসাদ, কে এসেছে জানার ইচ্ছে। সিঁড়ির গোড়ায় থামলেন তিনি, তখন প্রাসাদের আনাচে-কানাচে জ্বলে উঠছে বাতি। আঙিনাও আলোকিত হয়ে উঠল খুব শীঘ্রি।
বর্শাধারী রক্ষীদের প্রহরায় আলখাল্লা-পরা একজন মানুষকে। এগিয়ে আসতে দেখা গেল। কাছে আসার পর চেনা গেল তাকে। সামানি… আসাদ-আদ-দীনের উজির। তার পিছনে বর্ম-পরিহিত আরেকজন রয়েছে।
আসোলামু আলাইকুম, মহান আসাদ! কুর্নিশ করল উজির।
ওয়ালাইকুম আস-সালাম, সামানি, প্রত্যুত্তর দিলেন বাদশাহ্। কী খবর?
সুসংবাদ আছে, হুজুর। শাকের-আল-বাহার ফিরে এসেছে।
আল্লাহ্ মেহেরবান! আকাশের দিকে মুখ তুলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন আসাদ। উত্তেজনার আভাস পাওয়া গেল কণ্ঠে।
পিছনে পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ফেরালেন তিনি। সিঁড়ির মাথায় উদয় হয়েছে শীর্ণদেহী এক কিশোর। মাথায় পাগড়ি, গায়ে সোনালি কারুকাজ-অলা জোব্বা। বাদশাহ্ ঘাড় ফেরাতেই নিঃশব্দে সালাম জানাল। তারপর নামতে শুরু করল সিঁড়ি ধরে। মুখে আলো পড়ল এবার। ধবধবে ফর্সা, গোলগাল, সুন্দর চেহারা-দাড়ি-গোঁফের অভাবে মেয়েলি একটা ভাব রয়েছে তাতে।
একটু হাসলেন আসাদ। নিশ্চয়ই মায়ের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে এসেছে মারযাক, এখানকার খবর তার কানে পৌঁছে দেবে।
শুনেছ, মারযাক, বললেন তিনি, শাকের-আল-বাহার ফিরে এসেছে।
বিজয়ীর বেশে, আশা করি? নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল মারযাক।
আগের যে-কোনও বারের চেয়ে অনেক বড় বিজয় হয়েছে ওর, উত্যু গলায় জানাল সামানি। সূর্যাস্তের খানিক আগে ঢুকেছে বন্দরে-দুদুটো ফ্র্যাঙ্কিশ জাহাজ নিয়ে। খোল-ভর্তি দামি মালামাল!
আলহামদুলিল্লাহ! স্বস্তি প্রকাশ করলেন আসাদ-আদ-দীন। ফানযিলাহ্-র অনর্থক সন্দেহের উপযুক্ত জবাব দেয়া যাবে এবার। কিন্তু এ-খবর ও নিজেই নিয়ে এল না কেন?
জাহাজ ছেড়ে আসতে পারছে না শাকের, বলল সামানি। তাই ওর কায়িয়া ওসমানিকে পাঠিয়েছে আপনার কাছে।
বর্ম-পরা কর্সেয়ার এবার এগিয়ে এসে কুর্নিশ করল বাদশাকে।
স্বাগতম এবং শুভেচ্ছা, ওসমানি, বললেন আসাদ। ভূত্যরা আঙিনায় বসবার ব্যবস্থা করেছে, সেখানে গিয়ে আসন নিলেন পুত্র-সহ। সব খুলে বলো আমাকে।
বুক ফুলিয়ে অভিযানের বিবরণ শোনাল ওসমানি। দখল করা স্প্যানিশ গ্যালিয়ন নিয়ে ইংল্যাণ্ডে হানা দেবার কাহিনি… এমন এক সাগর পাড়ি দিয়েছে ওরা, যা আগে কোনও কর্সেয়ার পাড়ি দেয়নি। তারপর ফেরার পথে ডাচম্যানের সঙ্গে লড়াই–আকার এবং লোকসংখ্যায় বেশি হবার পরেও কীভাবে আল্লাহর দয়ায় আর শাকের-আল-বাহারের সুযোগ্য নেতৃত্বে সেটাকে পরাজিত করা হয়েছে। পাওয়া গেছে বহুমূল্য ধনসম্পদ। তবে ওই লড়াইয়ে আহত হয়েছে তাদের দুর্ধর্ষ নেতা, কিন্তু মৃত্যুকে হার মানিয়ে টিকে আছে ইসলামের জয়যাত্রা অক্ষুণ্ণ রাখবে বলে। সফল অভিযানের প্রমাণ হিসেবে আগামীকাল সমস্ত লুষ্ঠিত মালামাল নিবেদন করা হবে বাদশাহর পদতলে।