১১.
সত্য প্রকাশ
নগর-প্রাচীরের বাইরে, বাব-আল-ওয়াবে শাকের-আল-বাহারের বাড়ি। সঙ্গীসাথী আর সদ্য-কেনা দাসদের নিয়ে ও যখন সেখানে পৌঁছুল, সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। অন্ধকার, সংকীর্ণ প্রবেশপথ পেরিয়ে বাড়ির বিশাল আঙিনায় ঢোকানো হলো রোজামুণ্ড আর লায়োনেলকে। দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল আকাশের নীলিমা, নামতে থাকল আঁধার। শোনা গেল মাগরিবের আজান-উদাত্ত কণ্ঠে সবাইকে নামাজ পড়বার আহ্বান জানাচ্ছে মুয়াজ্জিন।
আঙিনার ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটা পাথরের ফোয়ারা। স্বচ্ছ পানি উঠে আসছে মাটি থেকে, ছাতার মত আকৃতি নিয়ে আবার শত-সহস্র কণায় খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাচ্ছে, আছড়ে পড়ছে গোড়ার মার্বেল-বেসিনে। ওখান থেকে রূপার পাত্রে পানি নিয়ে এল এক ভৃত্য, সেই পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে নিল শাকের, অজু করল। আরেক ভৃত্য জায়নামাজ বিছিয়ে দিয়েছে মাটিতে, তাতে নামাজের জন্য দাঁড়াল ও। সঙ্গীরাও যোগ দিল পিছনে, যার যার আলখাল্লা বিছিয়ে নিয়েছে জায়নামাজের মত করে।
বন্দিদের ঘুরে দাঁড়াতে হলো, পাছে ওদের কারণে কোনও ব্যাঘাত ঘটে প্রার্থনায়। চুপচাপ তাকিয়ে রইল তারা আঙিনার একপাশের বাগানের দিকে। রঙ-বেরঙের ফুল ফুটেছে ওখানে, সুগন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিক। দুজন মালী পানি দিচ্ছে গাছের গোড়ায় আর ফুলের কেয়ারিতে।
নামাজ শেষে উঠে পড়ল শাকের। ভারিক্কি গলায় আরবীতে কী যেন নির্দেশ দিল, তারপর ঢুকে গেল বাড়িতে। শাকেরের দুই কাফ্রি দেহরক্ষী এগিয়ে এল, লায়োনেল আর রোজামুণ্ডকে ইশারা করল হাঁটতে। বাড়ির দরজা পেরিয়ে সিঁড়িতে গেল ওরা, উঠতে শুরু করল উপরে। একটু পরেই ছাদের পাশের মস্ত এক ঝুলবারান্দায় পৌঁছুল। পুবের ঐতিহ্য অনুসারে এ-জায়গা বাড়ির গৃহকর্ত্রীর জন্য বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু এ-বাড়িতে প্রথমবারের মত নারীর পা পড়ছে এখানে, কারণ শাকের অবিবাহিত।
ঝুলবারান্দার চারপাশ চারফুট উঁচু প্যারাপেট দিয়ে ঘেরা। কিনারে দাঁড়ালে চোখে পড়ে পাহাড়ি ঢাল ধরে বিস্তৃত কসবাহ্ নগরীর পূর্ব অংশ। আরও চোখে পড়ে বন্দর আর খাড়ি। দূরে, খাড়ির মাঝখানে মাথা তুলে রেখেছে কৃত্রিম এক দ্বীপ-খ্রিস্টান ক্রীতদাসদের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে ওটা পেনন দুর্গের পাথর দিয়ে, বহুদিন আগে স্প্যানিয়ার্ডদের হাত থেকে এই দুর্গ জয় করে নিয়েছিলেন খায়রুদ্দিন বারবারোসা। সাঁঝের আঁধার এখন জেঁকে বসছে সবকিছুর উপরে, দিনের সমস্ত রঙ হারিয়ে প্রতিটা ভবন ধারণ করেছে ধূসর বর্ণ। পশ্চিমদিকে রয়েছে বাড়ির বাগানটা, ওখানকার গাছে গাছে কলকাকলি করছে নীড়ে ফেরা পাখির দল। এরপর রয়েছে পাহাড়ি এক উপত্যকা, নিচু এক টিলার গা বেয়ে ওটার বুকে নেমে এসেছে ঝর্ণাধারা, আবছাভাবে শোনা যাচ্ছে ব্যাঙের ডাক।
দুটো লম্বা বর্শার সাহায্যে ঝুলবারান্দার দক্ষিণ পাশের দেয়াল থেকে খাটানো হয়েছে শামিয়ানা। তার তলায় রয়েছে গদিমোড়া ডিভান আর সিল্কের অনেকগুলো ছোট বালিশ। কাছে আছে একটা নিচু টেবিল-হাতির দাঁতে গড়া, কিনারাগুলো সোনা দিয়ে গিল্টি করা। শামিয়ানার উল্টোপাশে, প্যারাপেট ঘেঁষে শোভা পাচ্ছে অনেকগুলো ফুলের টব, তাতে গোলাপের গাছ। ফুল ফুটেছে সবগুলোয়। আলোকস্বল্পতার কারণে কালচে-বাদামি দেখাচ্ছে রক্তলাল গোলাপগুলোকে।
আবছা আলোয় মুখ চাওয়াচাওয়ি করল লায়োনেল আর রোজামুণ্ড, দুজনের মুখই ফ্যাকাসে হয়ে আছে। ওদের কয়েক গজ পিছনে অনড় প্রহরায় রয়েছে দুই দেহরক্ষী। হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল লায়োনেল, দুহাতে মুখ ঢাকল। ঊর্ধ্বাঙ্গ এখন আর অনাবৃত নয় তার, বাজার থেকে বেরুনোর সময় একটা পুরনো কোর্তা পরিয়ে দেয়া হয়েছে, তারপরেও আত্মসম্মানে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে সে।
শক্ত হও, ধীর কণ্ঠে বলল রোজামুণ্ড। এভাবে ভেঙে পোড় না।
হায় ঈশ্বর, তোমাকেও এমন অসম্মান সইতে হলো! বলল লায়োনেল। আমার যা হবার হয়েছে, কিন্তু তোমাকে কেন তিনি ওই অমর্যাদা আর নিষ্ঠুরতার শিকার বানালেন?
ওর বাহুতে হাত রাখল রোজামুণ্ড। কী-ই বা আর সয়েছি? বলল ও। আশ্চর্যরকম দৃঢ় শোনাল কণ্ঠ। আমাকে করুণা কোরো না, লায়োনেল… কারণ সব ভোগান্তির ইতি ঘটাতে চলেছি আমি খুব শীঘ্রি। চাইলেও আর কেউ আমাকে অসম্মান করতে পারবে না। অদ্ভুত একটা হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে।
কীভাবে? বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল লায়োনেল।
জীবনের ভার যখন বড্ড বেশি হয়ে যায়, তখন সেটার হাত থেকে মুক্তি পাবার তো একটাই উপায় থাকে!
গোঙানি বেরুল লায়োনেলের মুখ দিয়ে… বরাবরের মত। ধরা পড়ার পর থেকে গোঙানি ছাড়া আর কিছুই করেনি সে। রোজামুণ্ডের যদি বিচার-বিবেচনা করবার মত মানসিকতা থাকত, তা তুলে নিঃসন্দেহে বিতৃষ্ণ হয়ে উঠত লায়োনেলের প্রতি। সত্যিকার পুরুষ হলে ছেলেটা এভাবে ভেঙে পড়ত না। যত বাধাই আসুক, চেষ্টা করত নিজেকে আর হবু স্ত্রীকে মুক্ত করতে… তাতে জীবন গেলে যাক। কিন্তু সে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে কাপুরুষের মত গোঙাচ্ছে, কাতরাচ্ছে।
একটু পর বড় বড় মশাল নিয়ে কয়েকজন ভৃত্য এল ঝুলবারান্দায়। দেয়ালের খাঁজে ঝুলিয়ে দিল মশালগুলো। আগুনের কাঁপা কাঁপা শিখায় আলোকিত হয়ে উঠল জায়গাটা। চলে গেল ভৃত্যরা। আর তার পর পরই দরজায় উদয় হলো দীর্ঘদেহী এক মূর্তি।
শাকের-আল-বাহার।
এক মুহূর্তের জন্য নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল সে। আচরণে দম্ভ, চেহারা নির্বিকার। শান্ত চোখে জরিপ করল দুই বন্দিকে। তারপর ধীর পায়ে এগোল। খাটো একটা কাতান পরেছে, কোমরে সোনার কটিবন্ধনী-মশালের আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে ওটা থেকে। দুহাত আর হাঁটুর নীচ-টা অনাবৃত। পায়ে সোনালি কারুকাজের তুর্কি চপ্পল। মাথায় সাদা পাগড়ি, কপালের উপরটাতে জ্বলজ্বল করছে দামি একটা রত্ন।
মনিবের ইশারা পেয়ে ঝুলবারান্দা থেকে বেরিয়ে গেল দুই দেহরক্ষী। বন্দিদের সঙ্গে শাকের এখন একা।
মাথা ঝুঁকিয়ে রোজামুণ্ডকে অভিবাদন জানাল ও। হাত নেড়ে চারপাশ দেখাল। বলল, আজ থেকে এ-জায়গা তোমার। কারণ ক্রীতদাসী নয়, স্ত্রী-র মত তোমাকে রাখতে চাই আমি। বাড়ির ওপরতলা মুসলিমরা তাদের স্ত্রী-র জন্য বরাদ্দ করে। আশা করি জায়গাটা তোমার পছন্দ হয়েছে।
ভাইয়ের কথা শুনেও শুনতে পাচ্ছে না লায়োনেল। মড়ার মত সাদা হয়ে গেছে তার মুখ। কী করা হতে পারে ওকে নিয়ে, তা ভেবে শুকিয়ে যাচ্ছে বুক। আর কোনও কিছু নেই তার চিন্তা-চেতনায়।
রোজামুণ্ড ঠিক তার বিপরীত। বাজারের ভয় কাটিয়ে উঠেছে, চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে চোখ রাখল অলিভারের চোখে। সুন্দর মুখটা আবার ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। উদ্ধত সুরে প্রশ্ন করল, কী করতে চাইছ তুমি আমাকে নিয়ে?
কী করতে চাইছি? বাঁকা সুরে বলল অলিভার। রোজামুণ্ডের উপর যথেষ্ট রাগ আর ক্ষোভ আছে ওর, কিন্তু মনে মনে এ-মুহূর্তে মেয়েটার সাহসের প্রশংসা না করে পারল না। বুকও কেমন যেন করে উঠল। দ্রুত আবেগটাকে চাপা দিল ও। কঠোর সুরে বলল, আমাকে প্রশ্ন করবার কোনও অধিকার নেই তোমার। একটা সময় ছিল, রোজামুণ্ড, যখন আমি তোমার দাস হয়ে ছিলাম… ভালবাসার দাস। কিন্তু হৃদয়হীনতা আর অবিশ্বাস দিয়ে তার প্রতিদান দিয়েছ তুমি, ভেঙে দিয়েছ সেই প্রেমের শেকল। কিন্তু আজ আমি তোমাকে যে-শেকল পরাচ্ছি, তা এত সহজে ভাঙতে পারবে না।
কী বলতে চাও?
রোজামুণ্ডের দিকে একটু এগোল অলিভার। রুদ্রকণ্ঠে বলল, তুমি এখন আমার ক্রীতদাসী। বাজার থেকে গরু, ছাগল বা উটের মত কেনা একটা জন্তু, যার দেহ-মন আমার সম্পত্তি। যা খুশি করতে পারি আমি তোমার সঙ্গে, সব মুখ বুজে সহ্য করতে হবে! ভালবাসতে বললে ভালবাসতে হবে, চুমো খেতে বললে চুমো খেতে হবে… যদি আঘাত করতে চাই, তা হলে গাল বাড়িয়ে দিতে হবে। নিজের কোনও ইচ্ছে বা মত নেই আর তোমার, আমার ইচ্ছেই তোমার ইচ্ছে। আমার প্রতিটা আদেশ অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে তোমাকে। অবাধ্য হলে জুটবে ভয়ঙ্কর শাস্তি!
দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে গেল রোজামুণ্ডের। বিশ্বাস করতে পারছে না, অলিভার এমন ঘৃণাভরা কথা উচ্চারণ করতে পারে ওর সম্পর্কে।
ফিসফিসিয়ে ও বলল, তুমি… তুমি পশু হয়ে গেছ!
তুমিই তৈরি করেছ এই পশু-প্রেমের বন্ধন ছিন্ন করে। আর সেজন্যেই এখন আটকা পড়েছ দাসত্বের বন্ধনে।
ঈশ্বর তোমাকে ক্ষমা করুন!
প্রার্থনার জন্য ধন্যবাদ। তিনি যেন তোমাকেও ক্ষমা করেন।
অলিভারের কথা শেষ হতেই ঘরঘর করে উঠল লায়োনেল। ফোঁপাতে চাইছিল, কিন্তু গলায় আটকে গেছে আওয়াজটা। ধীরে ধীরে তার দিকে ফিরল অলিভার। এক মুহূর্ত দেখল ভাইকে, তারপর হেসে উঠল।
হাহ্! আমার এককালের ভাই! ধর্মের কল বাতাসে নড়ে, তাই না, লায়োনেল? ভাল করে ওকে দেখো, রোজামুণ্ড। দুর্দশায় কী হাল হয়েছে এই বীরপুরুষের! অথচ ওকেই অবলম্বন বানাতে চাইছিলে তুমি। আমাকে ছেড়ে বিয়ে করতে চলেছিলে ওকে। দেখো আমার প্রিয় ভাইয়ের অবস্থা!
অপমানের এই সুর ক্ষণিকের জন্য বিদ্রোহী করে তুলল লায়োনেলকে। রাগান্বিত গলায় ও বলল, তুমি আমার ভাই নও! তোমার মা ছিল এক চরিত্রহীনা… তাকে বিয়ে করে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছিল বাবা।
থমকে গেল অলিভার। ওকে দেখে মনে হলো এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়ে লায়োনেলের উপর। কিন্তু আশ্চর্য দক্ষতায় নিজেকে সামলাল। থমথমে গলায় বলল, ওই নোংরা জিভে আর একবারও যদি আমার মায়ের কথা উচ্চারণ করো, তা হলে জিভটা ছিঁড়ে নেব আমি। এমন নয় যে, কেউ বদনাম করলেই কলঙ্কিত হবে আমার মহান মা, কিন্তু তাই বলে তোমার মুখ। থেকে অমন কথা সহ্য করব না আমি। বাজে কথা যদি বলতে হয়, নিজের জন্মদাত্রী সম্পর্কে বলো। আমি খুব মজা করে শুনব।
হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল লায়োনেল, ঝাঁপ দিল অলিভারকে লক্ষ্য করে। দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছে ওর গলার নাগাল পাবার জন্য। সফল হলো না সে-প্রচেষ্টা। আলতো পায়ে সরে গিয়ে ওকে ফাঁকি দিল অলিভার, পিছন থেকে ছোবল দিল, সাঁড়াশির মত ধরে ফেলল ভাইয়ের ঘাড়। চাপ দিয়ে তাকে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে ফেলল মাটিতে। শরীর মোচড়াল লায়োনেল, কিছুতেই ছাড়াতে পারল না নিজেকে।
আমার শক্তি দেখে অবাক হচ্ছ? উপহাসের সুরে বলল অলিভার। যদি জানতে ছটা মাস কীভাবে কাটিয়েছি আমি, তা হলে অবাক হতে না। যদি ক্রীতদাস হিসেবে ছমাস দাঁড় টানার অভিজ্ঞতা থাকত, তা হলে বুঝতে-কেন আমার শরীর লোহায় পরিণত হয়েছে… কেন সমস্ত মানবিক অনুভূতি হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়েছি আমি।
টান দিয়ে লায়োনেলকে দাঁড় করাল ও। ছুঁড়ে ফেলল গোলাপের টবের সারির উপর। ধুমধাম শব্দে কয়েকটা টব ভাঙল, মাটি আর গোলাপের ডালপাতা বর্ষণের মত নেমে এল লায়োনেলের গায়ে।
কথায় পেয়ে বসেছে অলিভারকে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে চলল, কী জানো তুমি মাল্লার জীবন সম্পর্কে? বিশ্রাম নেই ওদের, দিন-রাত একটা কাঠের বেঞ্চে ন্যাংটো হয়ে বসে থাকতে হয় শেকল-পরা অবস্থায়… মল-মূত্র আর মানব-আবর্জনার মাঝখানে। টানতে হয় দাঁড়। সইতে হয় রোদ-বৃষ্টির অত্যাচার। থামার উপায় নেই, ক্লান্ত হবার উপায় নেই… দুর্বলতা দেখালেই পিঠে নেমে আসে চাবুকের আঘাত! বুঝতে পারছ কেমন জীবন ওটা? মাথা ঝাঁকাল ও। বুঝবে… হাতে-কলমে বুঝবে। যে-নরকযন্ত্রণা সয়েছি আমি তোমার কারণে, তা এবার তোমাকেও সইতে হবে।
দম নেবার জন্য থামল অলিভার। লায়োনেল কোনও কথা বলল না। শরীর কুঁকড়ে পড়ে আছে মাটিতে। দপ্ করে যেভাবে জ্বলে উঠেছিল আক্রোশ, তা নিভে গেছে ওভাবেই।
আজ তোমাকে এখানে এনেছি কেন, জানো? খেই ধরল। অলিভার। তোমার শাস্তির ষোলোআনা পূর্ণ করতে। আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ তুমি, খুনি সাজিয়েছ আমাকে, ধ্বংস করেছ আমার সুনাম, দখল করেছ সব সহায়-সম্পত্তি… তারপর আবার বিয়ে করার চেষ্টা করেছ আমারই প্রেমিকাকে অক্ষমণীয় অপরাধ এসব, শুধু দৈহিক শাস্তি দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত হয় না এর। তাই মানসিক শাস্তি পেতে হবে তোমাকে। যে ভয়ানক মনোযন্ত্রণায় ভুগেছি আমি, তা ভুগতে হবে তোমাকেও! রোজামুণ্ডের দিকে তাকিয়ে হিংস্র ভঙ্গিতে হাসল ও। আশা করি ওকে তুমি ভালবাসো, লায়োনেল। তোমার ওই আত্মহীন হৃদয়ে একটু হলেও দুর্বলতা আছে রোজামুণ্ডের জন্য। ওটাই আমার অস্ত্র, ভাই! আজ তোমাকে এখানে এনেছি ভালবাসার মানুষের পরিণতি জানাবার জন্য… কী কঠিন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে ওর ভাগ্যে, তা বুঝিয়ে দেবার জন্য। এবার তোমাকে হাসিমুখে জাহাজে পাঠাতে পারি আমি। দাঁড় টানার প্রবল কষ্টের মাঝেও মরমে মরমে মরবে তুমি রোজামুণ্ডের কথা ভেবে… তোমার কারণে কী ভোগ করতে হচ্ছে ওকে, তা উপলব্ধি করে। সারাক্ষণ তোমার চোখে ভাসবে আমার হাতে ওর নিপীড়িত হবার দৃশ্য। চাবুকের আঘাতের চেয়েও বেশি ক্ষত-বিক্ষত হবে তোমার হৃদয়!
তুমি পিশাচ! হাহাকার করে উঠল লায়োনেল। নরক থেকে উঠে আসা পিশাচ তুমি!
নিজেই যে-পিশাচকে সৃষ্টি করেছ, ছোট্ট ভাই আমার, তাকে গাল দেয়া অন্তত তোমার মুখে শোভা পায় না।
ওর কথায় কান দিয়ো না, লায়োনেল, বলে উঠল রোজামুণ্ড। যত চেষ্টাই করুক শয়তানটা, আমি কিছুতেই নিজের সম্মান বিসর্জন দেব না। ওর অশুভ ইচ্ছে কোনোদিন সফল হবে না।
বড়াই না করলেই ভাল করবে, বলল অলিভার। তাতে জেদ চেপে যেতে পারে আমার।
নিকুচি করি তোমার জেদের, বদমাশ!
গাল দিচ্ছ কেন? আজ আমি যা… তোমরাই তা বানিয়েছ আমাকে।
আমরা তোমাকে মিথ্যেবাদী আর কাপুরুষ বানিয়েছি? আর কিছু তো নও তুমি!
কাপুরুষ? ভুরু কোঁচকাল অলিভার। তাকাল লায়োনেলের দিকে। তুমি আমাকে কাপুরুষ বলেও প্রমাণ করেছ নাকি? হুম, মনে হচ্ছে খুব মজার কোনও গল্প হবে ওটা। হাসল রোজামুণ্ডের দিকে ফিরে। একটু বলবে, কখন-কোথায় কাপুরুষত্ব দেখিয়েছি আমি?
এখন যা করছ, সেটাই কি যথেষ্ট নয়? মুখ ঝামটা দিল রোজামুণ্ড। অসহায় দুজন মানুষকে যেভাবে ভোগাচ্ছ?
এখনকার কথা শুনতে চাই না। এখন যদি কাপুরুষ হয়েও থাকি, সেটা তোমাদেরই কর্মফল। আমি জানতে চাই অতীতের কথা। কর্নওয়ালে কখন কাপুরুষত্ব দেখিয়েছি আমি?
অতীতের কথা বলছ তুমি? আমার কাছে? এত সাহস তোমার?
অতীতের কথা বলবার জন্যই তোমাকে ইংল্যাণ্ড থেকে এনেছি আমি। তখন সবকিছু তোমার কাছে গোপন রেখে বড় বোকামি করেছি আমি। পরে যখন বলতে চেয়েছি, সুযোগ দাওনি তুমি…।
হ্যাঁ, তোমার কথা না শুনে অন্যায়ই করেছি বটে, বিদ্রুপের সুরে বলল রোজামুণ্ড। ভাইয়ের খুনির সঙ্গে হাসিমুখে কথা বললেই বেশি শোভন হতো। তাই না?
আমি পিটারের খুনি নই, বলল অলিভার। এ-কথা তখনও তোমাকে বলেছি আমি।
মিথ্যে কথা! নিজেকে বাঁচাবার জন্য ওসব বলেছ তুমি।
তা-ই তোমার ধারণা? একজন মিথ্যেবাদীকে ভালবেসেছিলে তুমি? তার সঙ্গে পুরো জীবন কাটাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে?
তখন তোমার স্বরূপ জানা ছিল না আমার। জানতাম না, তোমার হিংসার সামনে পরাজিত হতে পারে প্রেম। অবুঝের মত তোমাকে মন-প্রাণ সঁপে শাস্তি পেয়েছি আমি… কে জানে, হয়তো ওটাই আমার প্রাপ্য ছিল।
ভুল বলছ। আমার প্রেমে কোনও খাদ ছিল না। মনের হিংসা-বিদ্বেষকে আমি দূর করে দিয়েছিলাম শুধু তোমার কথা ভেবে। আমার ভালবাসা ছিল নিখুঁত… পবিত্র!
এসব আর শুনিয়ো না আমাকে! মুখ ফিরিয়ে নিল রোজামুণ্ড।
কেন শোনাব না? তেতে উঠল অলিভার।
কারণ তোমার কথাগুলো আমাকে লজ্জা দেয়… মনে করিয়ে দেয়, একটা সময়ে নির্বোধের মত আমি কাকে ভালবেসেছিলাম!
লজ্জা? বাঁকা হাসি ফুটল অলিভারের ঠোঁটে। কৃতকর্মের জন্য যদি লজ্জা পেতে হয়, তা হলে সেটা আজ তুমি পাবে, রোজামুণ্ড। আমার সব কথা শোনার পরে। এবং আজ তোমাকে সব শুনতেই হবে–কেউ তাতে বাধা দিতে পারবে না, তোমার কোনও আপত্তিতে কাজ হবে না। এরপর দেখব তোমার প্রতিক্রিয়া। সব শোনার পর বুঝতে পারবে, অযৌক্তিক সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আমাকে পিটারের খুনি ভেবে কতবড় ভুল করেছিলে।
অযৌক্তিক সাক্ষ্য-প্রমাণ?
অবশ্যই! নইলে তো ট্রুরো-র বিচারকই আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেন।
আমাকে ধোকা দিচ্ছ তুমি, বলল রোজামুণ্ড। মাস্টার বেইন কখনও বলেননি তুমি খুনি নও। তিনি শুধু বলেছেন, পিটার তোমাকে খেপিয়ে দিয়েছিল… আঘাত করেছিল তোমাকে। তোমার রাগকে যুক্তিসঙ্গত বলে ভেবে নিয়েছিলেন তিনি, তাই কোনও ব্যবস্থা নেননি। কিন্তু অলিভার… ওই যুক্তি আমাকে দেখিয়ে কাজ হবে না। কারণ আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলে তুমি, পিটারের কোনও আচরণেই রাগ করবে না তুমি… প্রতিশোধ নেবে না। সে-প্রতিজ্ঞা তুমি ভঙ্গ করেছ।
ওর আক্রমণাত্মক কথাবার্তা শুনে ধৈর্য ধরে রাখা মুশকিল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল অলিভার। বিড়বিড় করল, খোদা আমাকে শক্তি দিন! তারপর রোজামুণ্ডকে বলল, একতরফাভাবে আমাকে দোষারোপ করছ তুমি, রোজামুণ্ড। অপমান করে চলেছ। কিন্তু উত্তেজিত হতে চাই না আমি। কারণ আজ রাতে অনেক কিছুই তোমাকে বোঝাতে হবে আমার। শোনো, মাস্টার বেইন আমাকে সহানুভূতি দেখিয়ে রেহাই দেননি। তিনি জানতেন, আমি নির্দোষ।
কার দোহাই দিচ্ছ? উনি নিজেই তো পিটার আর তোমার মধ্যকার ঝগড়ার সাক্ষী ছিলেন। নিজের চোখে তোমাকে ওর পিছু নিতে দেখেছেন।
সেটা ছিল ক্ষণিকের উত্তেজনা। কিন্তু পরে আমি ভেবে দেখলাম…
পরে মানে কখন? আমার ভাইটাকে খুন করার পর?
আবার বলছি, শান্ত কণ্ঠে বলল অলিভার, ও-কাজ আমি করিনি।
তা হলে আবার তুমি মিথ্যে কথা বলছ।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল অলিভার। তারপর বলল, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করো, আজ পর্যন্ত কাউকে বিনা কারণে মিথ্যে কথা বলতে শুনেছ তুমি? প্রতিটা মিথ্যের পিছনেই একটা না একটা উদ্দেশ্য থাকে-শয়তানি বা ব্যক্তিগত লাভের জন্য মিথ্যে বলে লোকে, কিংবা নিজের কাপুরুষত্ব লুকানোর জন্য। পাশ ফিরে চাইল ও লায়োনেলের দিকে, আর হ্যাঁ, কখনও কখনও মিথ্যে বলে অন্যকে বাঁচানোর জন্য… আত্মত্যাগী মানসিকতা থেকে। রোজামুণ্ডের চোখে চোখ রাখল আবার। আজ আমি কেন মিথ্যে বলব বলে মনে হয় তোমার? কী লাভ হবে আজ তোমাকে বানোয়াট কথা শুনিয়ে? ইতোমধ্যেই তোমার নির্দয় আচরণের জন্য ঘৃণা প্রকাশ করেছি আমি, সেজন্য শাস্তি শুনিয়ে দিয়েছি… এরপরে আর মিথ্যে গল্প শোনাবার প্রয়োজন কোথায় আমার?
তা হলে সত্যটাই বা শোনাবে কেন? পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল রোজামুণ্ড।
তোমার মনে উপলব্ধি জাগাবার জন্য–কত বড় অন্যায় করেছ তুমি, আমার সঙ্গে… এই শাস্তি কেন তোমার প্রাপ্য। নিজেকে মহান আত্মত্যাগী যেন না ভাবতে পারো, কারণ এতসব দুর্ভোগের মূলে রয়েছে তোমারই একগুয়েমি আর অবিশ্বাস।
আমাকে বোকা ভেবেছ তুমি, অলিভার?
শুধু বোকা না, তারচেয়ে অধম তুমি।
যাক, সত্যি কথাটা বলে দিলে, থমথমে কণ্ঠে বলল রোজামুণ্ড। কিন্তু একটা বিষয় জেনে রেখো-আমার মত পাল্টাবে না কিছুতেই। যত কিছুই করো… যা-ই বল… কিছুতেই তাতে মুছে যাবে না তোমার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ। আমার ভাইয়ের লাশের পাশ থেকে তোমার বাড়ির দরজা পর্যন্ত গিয়েছিল রক্তের দাগ, তুমি পিছু নিয়েছিলে ওর, শত্রুতা ছিল তোমার পিটারের সঙ্গে!
তুমি যেমন প্রমাণের কথা বলছ, তেমনি আমিও প্রমাণ দেখাতে পারব। আমার নির্দোষিতার প্রমাণ!
তা-ই? তা হলে রানির প্রতিনিধি আসার আগেই লেজ তুলে পালিয়ে গিয়েছিলে কেন?
ভুরু কোঁচকাল অলিভার। পালিয়ে গিয়েছিলাম? আমি? এ আবার কেমন কথা?
ও! তা হলে তুমি বলতে চাও, কর্নওয়াল থেকে পালাওনি তুমি? এটাও তোমার বিরুদ্ধে আরেকটা অপবাদ?
চিন্তায় ডুবে গেল অলিভার। এবার দেখতে পাচ্ছে। লায়োনেলের দূরদর্শী পরিকল্পনার স্বরূপ। ও-ই গুজব ছড়িয়েছে, অলিভারের পালানোর। সবার মনে তাই বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে। ওর অপরাধের। নির্দোষ হলে তো কেউ পালায় না। মাথা নিচু হয়ে গেল ওর। কী করেছে ও! রোজামুণ্ডকে দায়ী করেছে দুর্ভোগের জন্য… কিন্তু এতসব মিথ্যে প্রমাণ দেখার পর কী করে ওর উপর আস্থা রাখবে মেয়েটা? ভাইয়ের মৃত্যুতে মানসিকভাবে দুর্বল ছিল বেচারি, সেটার সুযোগ নিয়ে ওর মন বিষিয়ে দিয়েছে লায়োনেল। সামান্য দ্বিধাদ্বন্দ্ব যদি থাকতও, সেটা মিলিয়ে গেছে অলিভারের পালাবার কথা শুনে। ও আসলে পরিস্থিতির শিকার… ষড়যন্ত্রের শিকার… ঠিক অলিভারের মত! অথচ ওকেই আজ অপহরণ করে এনেছে, পরিয়েছে দাসত্বের শেকল!
তীব্র অনুশোচনায় জ্বলে উঠল অলিভারের অন্তর। ফিসফিস করে উঠল, হায় খোদা! কী করেছি আমি?
রোজামুণ্ডের দিকে তাকাল ও, আবার ফিরিয়ে নিল চোখ। শীর্ণ, ক্লিষ্ট মুখটা ওর হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে।
ঠিকই তো, বলল অলিভার, আর কী-ই বা বিশ্বাস করবে তুমি?
এখনও কি বলবে আমি ভুল বুঝেছি তোমাকে? বলল রোজামুণ্ড। বেদনাদায়ক সত্যকে দেখতে পাইনি আমি?
সত্য? প্রতিধ্বনি করল অলিভার। সত্যকে দেখলে চিনতে পারবে? পার্থক্য করতে পারবে মিথ্যের সঙ্গে? কারণ সত্যটা যে বড়ই ভয়ঙ্কর, রোজামুণ্ড। বিশ্বাসের অযোগ্য!
বিশ্বাসের অযোগ্য!
হ্যাঁ, এখুনি শুনবে সেটা। তোমার ভাই আমার হাতে মারা পড়েনি… মারা পড়েছে এক ভীরু কাপুরুষের হাতে, যার প্রতি আমার কিছু পবিত্র কর্তব্য ছিল। খুনের পর পরই ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে সে আমার কাছে আসে আশ্রয় পাবার জন্য… শরীরে একটা ক্ষত নিয়ে। সেই ক্ষত থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্তই সবাই দেখেছে আমার বাড়ির বাইরে। ধরে নিয়েছে, ওটা আমার রক্ত। আমাকে দোষারোপ করেছে। কিন্তু মাস্টার বেইন করেননি। কারণ ওঁর কাছে গিয়েছিলাম আমি, সার অ্যাণ্ডুর উপস্থিতিতে নিজের পুরো শরীর দেখিয়েছি… একটাও ক্ষত ছিল না ওতে। তাই ওঁরা একটা প্রমাণপত্র লিখে দিয়েছিলেন আমাকে, আমি সেটা অনেক চেষ্টা করেও তোমাকে দেখাতে সক্ষম হইনি। আমার নির্দোষিতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ছিল ওটা। রানির প্রতিনিধিদের ফিরিয়ে দেবার জন্য ওটাই যথেষ্ট ছিল, পালানোর প্রয়োজন ছিল না আমার…
আবছাভাবে মনে পড়ল রোজামুণ্ডে–এমন একটা প্রমাণপত্রের কথা বলবার চেষ্টা করেছিলেন মাস্টার বেইন, কিন্তু তার কথায় কোনও কান দেয়া হয়নি তখন। অলিভারের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগে তাকে অগ্রাহ্য করেছিল সবাই। সার অ্যাণ্ডু তাঁকে সমর্থন দিলে হয়তো ঘটনা অন্যরকম হতে পারত, কিন্তু তার আগেই বেচারা মারা যান।
যা হোক, বলে চলল অলিভার, এতকিছুর মাঝেও আমি সত্যিকার খুনির পরিচয় প্রকাশ করিনি। আগেই বলেছি, ওকে রক্ষা করা নিজের পবিত্র কর্তব্য বলে ভেবেছিলাম আমি। কিন্তু কাপুরুষটা তাতে সন্তুষ্ট হয়নি। বুকে সাহস না থাকলে যা হয় আর কী, সারাক্ষণ ভয় পেয়েছে সে-এই বুঝি সব ফাস করে দিই আমি! ওকে খুনি হিসেবে প্রমাণ করাটাও কঠিন ছিল না–গায়ে ক্ষত তো ছিলই, আরও ছিল মালপাসের এক সস্তাদরের মেয়ে… তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই ফাঁস হয়ে যেত, পিটার আর ওর মধ্যে মেয়েটাকে নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। ওই মেয়েটার জন্য পিটারকে শেষ পর্যন্ত মরতে হয়েছে…।
থামো! ফুঁসে উঠল রোজামুণ্ড। আমার মরা ভাইটার নামে বাজে কথা বোলো না!
শান্ত হও, বলল অলিভার। কাউকে ছোট করবার ইচ্ছে নেই আমার। শুধু সত্য ঘটনা বলছি তোমাকে। বাধা দিয়ো না, শুনে যাও পুরোটা। তো যা বলছিলাম… ওই কাপুরুষটা ভয় পাচ্ছিল আমাকে। নিজের দোষ ঢাকবার জন্য আমাকেই শেষ পর্যন্ত বলির পাঠা বানাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এক রাতে ভাড়াটে লোক দিয়ে অপহরণ করায় আমাকে, একটা জাহাজে তুলে দেয় দাস হিসেবে বিক্রি করবার জন্য। আমার গায়েব হয়ে যাবার রহস্য এটাই, রোজামুণ্ড। দুধ-কলা দিয়ে সাপ পুষেছিলাম আমি, সময় বুঝে দংশন করেছে আমাকে। মিথ্যে খুনের অভিযোগে ফাঁসিয়েছে, তারপর আবার বিক্রি করে দিয়েছে দাস হিসেবে… যাতে নিজে নিষ্কলুষ থাকতে পারে, আমার সমস্ত সহায়-সম্পত্তি দখল করতে পারে, তারপর আবার বিয়ে করতে পারে আমারই এককালের প্রেমিকাকে!
থমকে গেল রোজামুণ্ড। চরম বিস্ময় নিয়ে বলল, তুমি কি… তুমি কি বলতে চাইছ… লায়োনেল…
মিথ্যে বলছে ও! মরিয়ার মত চেঁচিয়ে উঠল লায়োনল। ওর কথায় দিয়ো না, রোজামুণ্ড! বিশ্বাস কোরো না ওকে!
আমি তা করছিও না, নিজেকে সামলে নিল রোজামুণ্ড।
রাগে লাল হয়ে উঠল অলিভারের চেহারা। ভাইয়ের দিকে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল ও। নতুন আতঙ্কে সিঁটিয়ে গেল লায়োনেল।
ভাইয়ের পোশাকের বুক মুঠো করে ধরল অলিভার। বলল, আজ রাতে সমস্ত সত্য প্রকাশ হবে, লায়োনেল। দরকার হলে গরম চিমটা দিয়ে তোমার ভিতর থেকে বের করে আনা হবে সব।
টান দিয়ে তাকে ঝুলবারান্দার মাঝখানে নিয়ে এল ও, রোজামুণ্ডের সামনে হাঁটু গেড়ে বসাল। বলল, কর্সেয়ারদের অত্যাচার কেমন হয়, জানো লায়োনেল? পেটের কথা মুখে আনার জন্য এখানে যা করা হয়, সে-তুলনায় ব্রিটিশদের অত্যাচার রীতিমত ছেলেখেলা।
সাদা হয়ে গেছে রোজামুণ্ডের চেহারা। বলল, ছেড়ে দাও ওকে! তুমি উন্মাদ হয়ে গেছ, অলিভার!
এখনও কিছুই দেখোনি। ভাইকে ছেড়ে দিয়ে তালি বাজাল অলিভার। কী দিয়ে শুরু করব, লায়োনেল? আঙুলের ফাঁকে আগুন ধরিয়ে দেব? নাকি জ্বলন্ত দুটো বালা পরাব দুহাতে?
পাগড়িপরা একটা ছায়ামূর্তি উদয় হলো ঝুলবারান্দায়।
লায়োনেলের চুল ধরে ওদিকে মুখ ঘোরাল অলিভার। বলল, তাকাও ওর দিকে। ভাল করে তাকাও! চিনতে পারো ওকে?
লায়োনেলের শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল।
হাসল অলিভার। হ্যাঁ, ও-ই জ্যাসপার লেই। সেই লোক, যাকে তুমি টাকা দিয়েছিলে আমাকে অপহরণ করবার জন্য… আমাকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেবার জন্য। কপাল খারাপ, কাজটা শেষ করতে পারেনি বেচারা। তার আগেই স্প্যানিয়ার্ডদের হাতে ধ্বংস হয়ে যায় ওর জাহাজ, আমার সঙ্গে ধরা পড়ে ওদের হাতে। বহু ঘাটে জল খাবার পর অবশেষে ওকে আমি বাগে পেয়েছি। এখন ও আমার দলে যোগ দিয়েছে ক্ষমা পাবার আশায়। রোজামুণ্ডের দিকে তাকাল ও। চাইলে জ্যাসপারের মুখে সব শোনাতে পারি তোমাকে, কিন্তু যা একগুঁয়ে স্বভাব তোমার; বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। তাই লায়োনেলের মুখ থেকেই সব শোনাব তোমাকে। লেই, আলিকে বলল এক জোড়া লোহারবালা যেন আগুনে গরম করে দেয়। আশা করি আমার ভাইয়ের মুখ ভোলানোর জন্য ওগুলোই যথেষ্ট হবে।
মাথা নুইয়ে চলে গেল লেই।
দেখা যাক, স্বীকারোক্তি না দিয়ে কেমন করে থাকো তুমি, লায়োলেকে বলল অলিভার।
কিছু স্বীকার করব না আমি, জেদী গলায় বলল লায়োনেল। অত্যাচার করে বড়জোর আমাকে দিয়ে মিথ্যে বলিয়ে নিতে পারবে তুমি।
মিথ্যে বলানোর জন্য তো অত্যাচারের প্রয়োজন নেই। ওটা তোমার মুখ দিয়ে এমনিতেই বৃষ্টির মত ঝরে। আমরা শুনব সত্যটা… বিস্তারিতভাবে! রোজামুণ্ডকে তুমি খুলে বলবে, সেই রাতে কীভাবে তুমি মালপাসে যাবার পথে ঘাপটি মেরে ছিলে। পিটার ওখানে পৌঁছুনোমাত্র কীভাবে পিছন থেকে ওর উপর হামলা চালিয়েছিলে…।
না! অমন কিছু ঘটেনি!
তা অলিভারও জানে। কিন্তু ইচ্ছেকৃতভাবে ফাঁদ পেতেছে ও। লায়োনেলের আঁতে ঘা দিয়ে সত্য কথা বলিয়ে নেবার মতলব। ওর ভাই ধূর্ত হতে পারে, কিন্তু এখন ও-ও কম ধূর্ত নয়।
ঘটেনি মানে! বলল অলিভার। আলবত ঘটেছে! খামোকা অত্যাচার সইতে যেয়ো না, লায়োনেল। আমাকে যা যা বলেছিলে, সেগুলোই বলো রোজামুণ্ডকে। তলোয়ার বাগিয়ে ঝোপের পিছনে বসে ছিলে তুমি, তাই না? পিটার পৌঁছুনোমাত্র ছুটে গিয়েছিলে পিছন থেকে, ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই তলোয়ার বিধিয়ে দিয়েছিলে পিঠে। জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করল। আহা রে! বেচারা খাপ থেকে নিজের তলোয়ারটাও বের করতে পারেনি।
তুমি যে মিথ্যে কথা বলছ, তা তো এমনিতেই প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে। বলল লায়োনেল। পিটারের লাশের পাশে পড়ে ছিল ওর তলোয়ার। খাপ থেকে বের করতে না পারলে ওটা ওখানে পড়ল কী করে?
মাথা নাড়ল অলিভার। ও মারা যাবার পর তুমিই ওটা বের করে মাটিতে ফেলেছ। কাউকে বুঝতে দিতে চাওনি, ওকে তুমি পিছন থেকে খুন করেছ।
অভিযোগটা পুরুষত্বের চরম অপমান। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল লায়োনেল, যিশুর কিরে, মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছ তুমি! আমি ওকে ন্যায্য সুযোগ দিয়েছিলাম…।
এটুকু বলেই থেমে গেল সে। আচমকা টের পেয়েছে, উত্তেজনার বশে কী বলে ফেলেছে। রোজামুণ্ডের দৃষ্টি ততক্ষণে বিস্ফারিত হয়ে গেছে। অলিভারের ঠোঁটে ফুটে উঠেছে বিজয়ের ক্ষীণ হাসি। হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল লায়োনেল।
থামলে কেন? বলল অলিভার। ন্যায্য লড়াইয়ের প্রমাণটাও দাও! বলো, পিটারের তলোয়ারে আহত হয়েছিলে তুমি। বাড়ি পর্যন্ত চলে যাওয়া রক্তের দাগই তো তোমার সাহসিকতার প্রমাণ!
নীরবতা নেমে এল।
লায়োনেল! অবশেষে চেঁচিয়ে উঠল রোজামুণ্ড। এক পা এগোল ও, আবার পিছাল। এ… এসব কি সত্যি?
কেন, নিজের কানেই কি শোনননি ওর কথা? বিদ্রূপ করল অলিভার।
দুলতে শুরু করল রোজামুণ্ডের দেহ। একবার লায়োনেল, আরেকবার অলিভারের দিকে তাকাচ্ছে। চেহারায় প্রকট হয়ে উঠছে বেদনা। ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াল অলিভার, মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাবে মেয়েটা, তেমন কিছু ঘটলে ধরে ফেলবে। কিন্তু অজ্ঞান হলো না রোজামুণ্ড, কাঁপা কাঁপা পায়ে ডিভানের কাছে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। মুখ ঢাকল দুহাতে।
ঈশ্বর ক্ষমা করুন আমাকে! ফুঁপিয়ে উঠল ও।
লায়োনেল খানিকক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল রোজামুণ্ডের দিকে। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে কাছে গেল। বাধা দিল না অলিভার, এবার ও দর্শকের ভূমিকা নিয়েছে। উদ্দেশ্য সফল হয়েছে ওর, লায়োনেল এবার আরও ভালমত ফাঁসবে… রোজামুণ্ডকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে।
রোজামুণ্ড! হাহাকার করে উঠল লায়োনেল। দয়া করো! ভুল বুঝো না আমাকে। একটু ব্যাখ্যা করতে দাও ব্যাপারটা!
বলো, বলো! ফোড়ন কাটল অলিভার। দেখা যাক, নতুন কী কাহিনি কেঁদেছ তুমি।
খোঁটায় কাজ হলো, শেষ প্রতিরোধও চূর্ণ হলো লায়োনেলের। বলল, রোজামুণ্ড, ও যা বলছে, তার একটা বর্ণও সত্যি নয়। পিটারকে পিছন থেকে খুন করিনি আমি। যা করেছি, তা সম্পূর্ণ আত্মরক্ষার খাতিরে। হ্যাঁ, ঝগড়া হয়েছিল আমাদের… বিশেষ একটা ব্যাপার নিয়ে। কপাল খারাপ, সেদিন রাতে দেখা হয়ে যায় আমাদের। আমাকে অপমান করতে শুরু করে পিটার। শেষ পর্যন্ত তলোয়ার নিয়ে আক্রমণ করে বসে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য আমিও তলোয়ার বের করি। লড়াই হয় আমাদের, তাতে ও… আকুতি ফুটল কণ্ঠে। বিশ্বাস করো, এ-ই আসল ঘটনা। তোমার সামনে হাঁটু গেড়ে কসম কাটছি আমি!
থামো! থামো তুমি! চরম ঘৃণা নিয়ে বলল রোজামুণ্ড।
না, আমাকে বলতে দাও। পায়ে পড়ি, আমার কথা শোনো। দয়া করো আমাকে!
দয়া! কীসের দয়া?
পিটারের মৃত্যুটা ছিল দুর্ঘটনা। বিশ্বাস করো, ওকে খুন করবার কোনও ইচ্ছে ছিল না আমার। আমি শুধু নিজের প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছি। কিন্তু লড়াইয়ের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখা খুব কঠিন, উত্তেজনার বশে অনেক কিছুই ঘটে যায়… আমার বেলাতেও তা-ই ঘটেছে। পুরোটাই একটা দুর্ঘটনা!
চোখ মুছল রোজামুণ্ড। কঠিন হয়ে উঠল চেহারা। আর পরে যা ঘটেছে? ভাইকে খুনি বানিয়েছ সবার চোখে… সেটাও কি দুর্ঘটনা?
মাথা নিচু করে ফেলল লায়োনেল। বড় ভুল হয়ে গেছে আমার, রোজামুণ্ড। ভালবাসার খাতিরে নাহয় ক্ষমা করো আমাকে…
খবরদার! ভালবাসার কথা উচ্চারণ করবে না তোমার ওই নোংরা মুখে!
কিন্তু আমি যে তোমাকে ভালবাসি! আমার ভুলটুকুর চেয়ে ভালবাসার ওজন কি বেশি নয়?
ভালবাসার ওজন বেশি? তোমার মিথ্যেবাদিতা, নীচতা আর বিশ্বাসঘাতকতার চেয়ে? হায় ঈশ্বর! কী বলছ তুমি!
তা হলে নাহয় নিজের মহত্ত্ব দিয়েই ক্ষমা করো আমাকে…
এবার তুমি রোজামুণ্ডকে বিরক্ত করছ, লায়োনেল! গমগম করে উঠল অলিভারের গলা। আমাকেও! পারলে ব্যাখ্যা করো, আমাকে অপহরণ করিয়েছিলে কেন? কেন জ্যাসপার লেইকে নির্দেশ দিয়েছিলে আমাকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিতে? আছে কোনও জবাব? না থাকলে এখানেই থামাও তোমার মায়াকান্না। সত্যিকার পুরুষের মত কৃতকর্মের ফল ভোগ করবার জন্য তৈরি হও।
জ্যাসপার লেইয়ের গলা খাকারি শোনা গেল। ফিরে এসেছে সে। জানাল, গরম লোহার বালা নিয়ে আসছে আলি।
ওসবের আর দরকার নেই। অলিভার বলল। এই দাসটাকে নিয়ে যাও। আলিকে বলবে, কাল সকালে আমার জাহাজের মাল্লাদের মাঝে আমি ওকে শেকল পরা অবস্থায় দেখতে চাই।
না! যাব না আমি! বলল লায়োনেল। রোজামুণ্ড, মানা করো ওকে।
কিছু বলল না রোজামুণ্ড, মুখ ফিরিয়ে নিল। ঘাড় ধরে লায়োনেলকে দাঁড় করাল লেই। তারপর ধাক্কা দিয়ে নিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। একটু পরেই দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল ওরা। ঝুলবারান্দায় রয়ে গেল শুধু অলিভার আর, রোজামুণ্ড।
.
১২.
ফানযিলাহ্–র কৌশল
ডিভানের উপর শরীর কুঁকড়ে রেখেছে রোজামুণ্ড, মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কাঁদছে। ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল অলিভার, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে উল্টো ঘুরল। প্যারাপেটের পাশে গিয়ে বাইরে দৃষ্টি ফেলল ও। চাঁদের আলোয় স্নান করছে কসবাহ নগরী। দূরে কোথাও ডেকে উঠল একটা নিশাচর পাখি। তার সঙ্গে তাল মেলাল একদল ব্যাঙ।
অবশেষে প্রকাশ পেয়েছে সত্য। রোজামুণ্ডের মুখের উপর ছুঁড়ে দিতে পেরেছে অলিভার সেই সত্যকে। কিন্তু যতটা আনন্দ অনুভব করবে ভেবেছিল, তা করছে না। বরং মন ভারী হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারছে, প্রতিহিংসার নেশায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল ও। তাই বিজয়টা তেতো ঠেকছে জিভে।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল অলিভার। তারপর ফিরে এল ডিভানের কাছে। রোজামুণ্ডের উদ্দেশে বলল, সবই তো শুনলে! আমি খুশি যে অত্যাচার ছাড়াই সত্যটা বলে দিয়েছে লায়োনেল। নইলে হয়তো বিশ্বাস করতে না তুমি। একটু থামল ও রোজামুণ্ডের জবাব শোনার জন্য। কিন্তু মেয়েটা নীরব থাকায় আবার মুখ খুলল। আমাকে ফেলে ওকেই বিয়ে করতে যাচ্ছিলে তুমি! আমার উপর বিশ্বাস না রেখে কতবড় ভুল করেছ, তা আশা করি বুঝতে পেরেছ এবার।
ডিভান থেকে মাথা তুলল রোজামুণ্ড। রূঢ় গলায় বলল, হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি তোমাদের দুজনের মধ্যে পার্থক্য কত সামান্য! আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল, রক্তের সম্পর্কের দুই ভাইয়ের স্বভাব-চরিত্র আলাদা হতে পারে না। এখন সেসব জানছি আমি… খুবই খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।
ওর এই কথা শুনে আবার রেগে গেল অলিভার, দূর হয়ে গেল মনের আর্দ্রতা। কী বললে তুমি?
ভুল কিছু বলেছি? এতদিন মূর্খ ছিলাম, এখন পুরুষের মন-মানসিকতা সম্পর্কে জানতে শুরু করেছি আমি।
ঠোঁট বেঁকে গেল অলিভারের। আশা করি এই জ্ঞান তোমার ভিতরে সেই তিক্ততা জাগিয়ে তুলবে, যা তোমার মন-মানসিকতা আমার ভিতরে জাগিয়েছিল। আমি ভেবে পাই না, কাউকে সত্যিকার অর্থে ভালবাসলে একটা মেয়ে তার সম্পর্কে মিথ্যে অপবাদ বিশ্বাস করে কী করে?
করুণা ভিক্ষা আশা করছ আমার কাছে? তা হলে প্রার্থনা–আমাকে পুরনো লজ্জার কথা মনে করিয়ে দিয়ো না।
কোন্ লজ্জা? তোমার বিশ্বাসহীনতার? নাকি আমার সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করবার?
ওসবের কোনোটাই না। আমার একমাত্র লজ্জা হচ্ছে, কোনোদিন তোমাকে আমি ভালবেসেছিলাম। এরচেয়ে বড় লজ্জা আর কিছু নেই… এমনকী দাস-বাজারে পশুর মত বিক্রি হওয়াটাও নয়! মানুষ নও তুমি, পিশাচ। আমার অসহায়ত্ব, আমার অনিচ্ছাকৃত ভুলের কথা জানবার পরেও কষ্ট দিয়ে চলেছ পুরনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়ে!
এ তো কিছুই না। তোমার অপরাধ অনেক বড়। আমার জীবনের অনেকগুলো বছর নষ্ট হয়ে গেছে, মোড় ঘুরে গেছে জীবনের, সবকিছু হারিয়েছি, পরিণত হয়েছি ঘৃণিত এক জলদস্যুতে… এসবের জন্য তুমিই দায়ী।
আমি দায়ী? শীতল গলায় বলল রোজামুণ্ড। আমার কারণে এসব জুটেছে তোমার কপালে?
নয়তো কী? যদি ওভাবে মুখ ফিরিয়ে না নিতে তুমি, মিথ্যে অভিযোগে কান না দিতে, বিশ্বাস রাখতে আমার উপর… তা হলে ঘটনা অন্যরকম হতে পারত। লোকের চোখে খুনি সাব্যস্ত হতাম না আমি, লায়োনেলও সুযোগ পেত না আমার পিঠে ছোরা বসানোর। বরং ও-ই ঝুলত ফাঁসিতে।
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রোজামুণ্ড। তোমার সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। কিছুই বুঝতে চাও না। হ্যাঁ, স্বীকার করছি–পিটারের খুনি নও তুমি, সেটা আজ প্রমাণ করেছ। কিন্তু পাশাপাশি আরও কী প্রমাণ করেছ, জানো? প্রমাণ করেছ যে, খুনির চেয়েও ভয়ঙ্কর তুমি… মানবহত্যার চেয়েও নিকৃষ্ট কাজ করতে পারো অবলীলায়। তোমার অন্ধকার দিক আজ প্রকাশ পেয়ে গেছে, অলিভার। আজ আমি স্বচক্ষে দেখেছি, প্রতিহিংসা আর ঘৃণায় ভরা কত বড় একটা অমানুষ তুমি! উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল ও। কর্নওয়ালের এক ভদ্রঘরের খ্রিস্টান ছিলে তুমি, অলিভার। অথচ আজ পরিণত হয়েছ এক ধর্মত্যাগী বিবেকহীন দস্যুতে। কেন? শুধুই প্রতিশোধ নেবার জন্য। হিংসার সামনে ঈশ্বরকে ত্যাগ করেছ তুমি।
ওর ক্রুদ্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল অলিভার, একটুও ঘাবড়াল না। রোজামুণ্ডের কথা শেষ হলে বলল, মেয়েরা নাকি সবকিছু বুঝতে পারে। মন দেবার আগে আমার এতসব খুঁত তুমি ধরতে পারোনি বুঝি? বড়ই আশ্চর্য ব্যাপার! থাক, ফালতু ব্যাপার নিয়ে আলোচনা না করাই ভাল। পায়ের শব্দ হওয়ায় ঘাড় ফেরাল ও। দুজন ভৃত্য উদয় হয়েছে খাবারের থালা নিয়ে। এই তো, খাবার এসে গেছে। আশা করি তোমার যুক্তির চেয়ে ক্ষুধার জ্বালা বেশি।
ডিভানের পাশের টেবিলের উপর থালা নামিয়ে রাখল ভৃত্যরা। রুটি আর মাংস নিয়ে এসেছে। সঙ্গে বোতল-ভরা খাওয়ার পানি। সালাম দিয়ে চলে গেল দুই ভৃত্য।
খেতে এসো, রোজামুণ্ডকে বলল অলিভার।
খাবার চাই না আমি! ঝঝের সঙ্গে জবাব দিল মেয়েটা।
শীতল দৃষ্টিতে তাকাল অলিভার। এখন থেকে তোমার চাওয়া-না-চাওয়ার কোনও দাম নেই, মেয়ে। মনিবের হুকুমমত চলতে হবে তোমাকে। খেতে বলছি, খাও।
না… খাব না আমি।
খাবে না? দাসীর মুখে অমন কথা শোভা পায় না। এসো বলছি!
পারব না, খেতে পারব না আমি।
দাসী যদি মনিবের হুকুম মানতে না পারে, তা হলে তার মৃত্যু অনিবার্য, হুমকি দিল অলিভার।
তা হলে মেরেই ফেলো আমাকে! ঝট করে উঠে দাঁড়াল রোজামুণ্ড। মানুষ খুন করায় তো অভ্যস্ত হয়ে উঠেছ। আমাকে খুন করলে ধন্য হব।
ভেবো না আমার হাত কাঁপবে, ঠাণ্ডা গলায় বলল অলিভার। দরকার হলে অবশ্যই তোমার প্রাণ নেব আমি। তবে সেটা নিজের ইচ্ছেয়, তোমার ইচ্ছেয় নয়। তুমি আমার সম্পত্তি, না খেয়ে শুকিয়ে গেলে আমারই ক্ষতি। খেতে বসো। নইলে চাবুকপেটা করে খাওয়ানো হবে।
কয়েক মুহূর্ত উদ্ধতের মত দাঁড়িয়ে রইল রোজামুণ্ড। কিন্তু অলিভারের পাথরের মত মুখ দেখে বুঝতে পারল, মিথ্যে হুমকি দিচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত হার মানল ও। টেবিল থেকে তুলে নিল একটা থালা, তা দেখে মুচকি হাসি ফুটল অলিভারের ঠোঁটে।
টেবিলের উপর চঞ্চল দৃষ্টি বোলাল রোজামুণ্ড। কিছু খুঁজছে। না পেয়ে অলিভারের দিকে তাকাল। বলল;
ছুরি-চামচ কোথায়? নাকি চাইছ আমি খালি হাতে রুটি-মাংস ছিঁড়ে খাই?
ভুরু কোঁচকাল অলিভার, সন্দিহান হয়ে উঠেছে। কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলল, রাসূলের নীতিতে ছুরি বা চামচের জায়গা নেই। আল্লাহ দুটো হাত দিয়েছেন সবাইকে, খাবার মুখে দেবার জন্য ওগুলোই যথেষ্ট।
রাসূলের কথা বলে মশকরা করছ নাকি? ওই নীতি আমি মানব কেন? আমি মুসলমান নই। খেতেই যদি হয়, অসভ্যের মত খাব না। খ্রিস্টান রীতিতে খাব।
কাঁধ ঝাঁকাল অলিভার। কোমরের খাপ থেকে নিজের ছোরা খুলে নিল, ওটা ছুঁড়ে দিল রোজামুণ্ডের দিকে। ঠিক আছে, আপাতত এ-ই দিয়ে কাজ চালাও।
ছোরাটা হাতে তুলে নিল রোজামুণ্ড। বলল, যাক, ধন্যবাদ পাবার মত অন্তত একটা জিনিস দিয়েছ আমাকে। বলেই ওটার ফলা তাক করুল নিজের বুকের দিকে।
বিদ্যুৎ খেলে গেল অলিভারের শরীরে। দ্রুত সামনে বাড়ল ও, সাপের মত ছোবল দিয়ে ধরে ফেলল মেয়েটার হাত। মোচড় দিয়ে বাধ্য করল ছোরাটা ফেলে দিতে। ব্যথায় ককিয়ে উঠল রোজামুণ্ড। ছোরাটা কোমরের খাপে ঢুকিয়ে ফেলল অলিভার।
ভেবেছ বিশ্বাস করেছি তোমাকে? হাসিমুখে বলল ও। হার মেনে নেবার নাটক করছ, তা বুঝতে পারিনি? বোকা মেয়ে কোথাকার, আমাকে ধোকা দেয়া এত সহজ নয়। আমি স্রেফ তোমাকে পরীক্ষা করছিলাম। তাতে তুমি শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছ।
তা হলে আমার ইচ্ছে তুমি জানতে পেরেছ, গোঁয়ারের মত বলল রোজামুণ্ড। এ-জীবন আমি রাখব না!
সহজে সে-ইচ্ছে পূরণ হবে না।
অগ্নিদৃষ্টি হানল রোজামুণ্ড। জীবন দেয়া কি খুব কঠিন? ছুরি ছাড়াও আরও অনেক কায়দা আছে। অনেক বড়াই করছ তুমি, অলিভার, আমার দেহ আর মনের মালিক ভাবছ নিজেকে। কিন্তু সত্যি কথা হলো, বাজার থেকে আমার দেহটাকেই শুধু কিনেছ তুমি… ওর উপর যত খুশি অত্যাচার চালাতে পারো, ব্যবহার করতে পারো যথেচ্ছভাবে। কিন্তু মন কখনও বিকোয় না, ওর উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই তোমার। আমার জীবন-মরণ তোমার হাতে বলে দাবি করছ… হাহ, শুধু মরণটাই তুমি নিশ্চিত করতে পারো, জীবন নয়।
ওর এই কথার উপযুক্ত জবাব দিতে যাচ্ছিল অলিভার, বাধা পেল হন্তদন্ত হয়ে ঝুলবারান্দায় নতুন একটা ছায়ামূর্তি উদয় হওয়াতে। মাথা ঘোরাতেই আলিকে দেখতে পেল। সে জানাল, এক মহিলা এসেছে নীচে, শাকের-আল-বাহারের সঙ্গে দেখা করতে চায়।
মহিলা? বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল অলিভার। নাসরানি মহিলা?
জী না, হুজুর, মাথা নাড়ল আলি। মুসলিম। বোরখা পরে এসেছে।
মুসলিম মহিলা! এখানে? অসম্ভব!
ঠিক তখুনি বোরখা-পরা মহিলাটি সিঁড়ি থেকে বেরিয়ে এল ঝুলবারান্দায়।
ঝট করে তার দিকে ঘুরল আলি। অ্যাই! তোমাকে নীচে অপেক্ষা করতে বলেছি না? এখানে এসেছ কেন? তাড়াতাড়ি ক্ষমা চাইল শাকেরের কাছে। মাফ করবেন, মালিক। বেটি আমার পিছু পিছু চলে এসেছে। তাড়িয়ে দেব?
থাকুক, হাত নাড়ল অলিভার। তুমি যেতে পারো।
কুর্নিশ করে বিদায় নিল আলি। নবাগতার মুখ খোলার অপেক্ষায় রইল অলিভার; কিন্তু আলির পায়ের আওয়াজ পুরোপুরি মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত নড়ল না সে। এরপর হাত তুলল মুখের কাছে; চুলের তলায় আটকানো বাধন খুলল, ফলে সরে গেল ঘোমটা। উদ্ভাসিত হলো পরিচিত একটা চেহারা।
চমকে উঠল অলিভার। নিজের অজান্তেই পিছিয়ে গেল এক পা। বলে উঠল, ফানযিলাহ! এসবের মানে কী?
জবাব না দিয়ে হাসল ফানযিলাহ। শান্তভাবে ঘোমটা আবার বাঁধল মুখে। চেহারা লুকাল।
আপনি এভাবে… আমার বাড়িতে এসেছেন কেন? হতভম্ব গলায় বলল অলিভার। বাদশাহ্-র কানে যদি এ-খবর যায়, তা হলে কী ঘটবে ভেবে দেখেছেন? চলে যান… চলে যান এখুনি!
তুমি বা আমি যদি মুখ না খুলি, তা হলে বাদশাহ্-র কানে কিছুই পৌঁছুবে না, ফানযিলাহ্ বলল। এত ভড়ং করবারও দরকার নেই। আমরা কেউই জন্মগত মুসলমান নই। পরপুরুষের সামনে যাবার অভিজ্ঞতা আছে আমার। তুমিও নিশ্চয়ই জীবনে বহু বেগানা নারী দেখেছ?
এটা আপনার জন্মভূমি সিসিলি নয়, গম্ভীর গলায় বলল অলিভার। ওখানকার রীতি-রেওয়াজ এখানে অচল।
হাত তুলে ওকে থামাল ফানযিলাহ্। বক্তৃতা দিয়ে আমাকে শুধু শুধু দেরি করাচ্ছ তুমি।
তা হলে তাড়াতাড়ি আপনার কাজ শেষ করে বিদায় হোন।
মাথা ঝাঁকিয়ে সরাসরি কাজের কথা পাড়ল ফানযিলাহ। রোজামুণ্ডকে ইশারা করে বলল, ব্যাপারটা তোমার ওই দাসীকে নিয়ে। আজ আমার এক অনুচরকে পাঠিয়েছিলাম বাজার থেকে ওকে কিনে নেবার জন্য…
আমি জানি, বাধা দিয়ে বলল অলিভার।
কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে আমার লোক। তুমি বাড়তি দাম হেঁকে কিনে নিয়েছ ওকে।
নতুন কিছু বলুন।
যা খরচ হয়েছে তোমার, সেটা যদি পুষিয়ে দিই, ওকে আমার কাছে বিক্রি করবে?
দুঃখিত, ফানযিলাহ্। মেয়েটা বিক্রির জন্য নয়।
দাঁড়াও, এখুনি শেষ কথা বলে দিয়ো না, মরিয়ার মত বলে উঠল ফানযিলাহ্। জানি চড়া দাম দিয়েছ তুমি… মেয়েটা অমন দামের উপযুক্তই বটে। আমারও ওকে খুব পছন্দ হয়েছে। আর পছন্দের জিনিস আমি নিজের দখলে রাখতে ভালবাসি। এক ধরনের ঝোঁক বলতে পারো। তাই একটা প্রস্তাব দিচ্ছি-তিন হাজার দিনার পাবে, ওকে তুলে দাও আমার হাতে।
বিস্ময়ের বদলে এবার সন্দেহ ভর করল অলিভারের মনে। মতলব কী এই মহিলার? কী ফন্দি এঁটেছে সে রোজামুণ্ডকে নিয়ে?
তিন হাজার দিনার দেবেন? ভুরু নাচাল ও। কেন?
বললাম তো, ঝোঁক।
এত দামি একটা ঝোঁক ওঠার কারণ জানতে পারি?
ওর মালিক হতে চাই আমি, কথা ঘোরানোর চেষ্টা করল ফানযিলাহ্।
কেন এমন ইচ্ছে জাগল, সেটাই তো জানতে চাইছি, অলিভারের কণ্ঠ আশ্চর্যরকমের শান্ত।
বড় বেশি প্রশ্ন করো তুমি, একটু যেন রেগে গেল ফানযিলাহ্।
কাঁধ ঝাঁকাল অলিভার। হাসল। আর আপনি খুব কম জবাব দেন।
মাপা দৃষ্টিতে ওকে জরিপ করল ফানযিলাহ্। বোঝার চেষ্টা করল, অলিভারকে টলানো সম্ভব কি না।
অতশত বুঝি না, শাকের, শেষ পর্যন্ত বলল সে, তিন হাজার দিনারে মেয়েটাকে বিক্রি করবে কি না বলো।
এক কথায়… না।
করবে না? তিন হাজার দিনার কম মনে হচ্ছে? বিস্ময় ফুটল ফানযিলাহ্-র গলায়।
ত্রিশ হাজার দিলেও করব না, চাঁছাছোলা ভঙ্গিতে বলে দিল অলিভার। ও আমার সম্পত্তি; আর সম্পত্তিটা এখুনি হাঁতছাড়া করবার কোনও ইচ্ছে নেই আমার। খামোকা এ-নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। সময়ই শুধু নষ্ট করবেন। তারচেয়ে চলে যান। আপনার উপস্থিতি আমাদের দুজনের জন্যই বিপজ্জনক।
মেঘ জমল ফানযিলাহ্র চেহারায়। অলিভার নির্বিকার। নীরবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল ওরা পরের কিছুটা সময়। দুজনের কেউই খেয়াল করল না, রোজামুণ্ড কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। আরবী না জানলেও ওদের হাবভাব দেখে বুঝে নিয়েছে ও আলোচনার বিষয়।
এক পা সামনে এগোল ফানযিলাহ। বিক্রি করবে না?, হিসিয়ে উঠল সে অলিভারকে উদ্দেশ করে। এত নিশ্চিত হয়ো না, শাকের। তোমাকে বাধ্য করা হবে! আমি না, খোদ আসাদ করবেন। নিজেই আসছেন তিনি… মেয়েটাকে নেবার জন্য!
আসাদ? চমকাল অলিভার।
বাদশাহ্-র নাম ভুলে গেছ? আসাদ-আদ-দীনের কথা বলছি আমি! এখনও সময় আছে, আমার সঙ্গে সওদা করে লাভবান হও। বাদশাহ্-র কাছে এত দাম পাবে না।
মাথা নাড়ল অলিভার। আপনাদের কারও সঙ্গেই সওদা করবার ইচ্ছে নেই আমার। বললাম তো, মেয়েটাকে বিক্রি করব না আমি।
ঠেকাতে পারবে আসাদকে? খোঁচা মারা সুরে বলল ফানযিলাহ্। মেয়েটাকে উনি নিয়ে ছাড়বেন… বিক্রি করো, বা না-ই করো!
আচ্ছা! চোখ ছোট হয়ে এল অলিভারের। এ-কারণেই ছুটে এসেছেন আপনি! মোটেই কৌশলী বলা যাবে না আপনাকে, ফানযিলাহ্। অল্পতেই সব ফাঁস করে দিলেন।
বাদশাহ-র সুনজর আপনার উপর থেকে সরে গিয়ে এই নতুন দাসীর উপর পড়তে পারে, এই ভয় কাজ করছে আপনার মধ্যে। তাই বাদশাহ্-র হাত পড়বার আগেই ওকে সরিয়ে ফেলতে চাইছেন। ভুল বললাম?
ঘোমটার কারণে চেহারা দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ফানযিলাহ-র পুরো শরীর রাগে কেঁপে উঠতে দেখল ও। খ্যাপাটে কণ্ঠে সে বলল, যদি ওটা সত্যও হয়, তাতে তোমার কী?
কিছুই না, সোজাসাপ্টা ভাষায় বলল, অলিভার। আপনার কপালে কী ঘটল না-ঘটল, তা নিয়ে মাথা ঘামাই না।
ঘামানো উচিত, আকুতি ঝরল ফানযিলাহ্-র গলায়। তোমার একজন বন্ধু আমি, শাকের। সবসময়ই ছিলাম। বাদশাহ্-র কাছে সবসময় প্রশংসা করেছি তোমার, আমার অনুরোধেই তোমাকে ধাপে ধাপে পদোন্নতি দিয়েছেন তিনি।
তা-ই? সকৌতুকে বলল অলিভার।
যত খুশি হাসো, কিন্তু সত্যি কথা বলছি আমি। আমি যদি না থাকি, তুমি তোমার সবচেয়ে বড় মিত্রকে হারাবে। আমার জায়গায় যে আসবে, সে তোমার প্রতি অনুরক্ত না-ও হতে পারে। এমন হতে পারে, মিথ্যে কথা বলে বলে তোমার ব্যাপারে বাদশাহ-র মন বিষিয়ে তুলল সে! এই খ্রিস্টান মেয়েটার কথাই ধরো-দেশের মাটি থেকে ওকে অপহরণ করে এনেছ তুমি। এই মেয়ে কোনোদিন তোমাকে সহ্য করবে না। কোনোদিন কদর করবে না তোমার।
ওসব নিয়ে আপনার মাথা না ঘামালেও চলবে, রুক্ষ গলায় বলল অলিভার। এই দাসী আমার। আসাদ ওকে কোনোদিনই পাবেন না।
বোকা কোথাকার! স্বেচ্ছায় যদি না দাও, বাদশাহ্ ওকে কেড়ে নেবেন।
তাচ্ছিল্য দেখা দিল অলিভারের চেহারায়। আমার কাছ থেকে যদি ওকে কেড়ে নিতে পারেন উনি; আপনার কাছ থেকে তো আরও সহজেই পারবেন। আমার ধারণা, সেটা আপনার জানাও আছে। আর সে-কারণে সিসিলিয়ান-সুলভ দুষ্ট কোনও ফন্দিও এটে রেখেছেন। ঠিক কী করতে চাইছেন, বলুন তো? বাদশাহ্ যখন জানবেন আপনার কীর্তির কথা, তখন কীভাবে বাঁচাবেন নিজেকে?
ওসবের পরোয়া করি না। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল ফানযিলাহ্। বাদশাহ কিছু টের পাবার আগেই বন্দরের পানির তলায় চলে যাবে মেয়েটার লাশ-পায়ে ভারী পাথর বাঁধা অবস্থায়। রেগে গিয়ে হয়তো চাবুকপেটা করবেন আমাকে তিনি, কিন্তু ওই পর্যন্তই। রাগ কমে যাবার পর আবার আমার কাছেই ফিরতে হবে তাঁকে।
তীব্র এক ক্রোধ অনুভব করল অলিভার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই মহিলা ঠাণ্ডা মাথায় রোজামুণ্ডকে খুন করতে চাইছে। তার টুটি চেপে ধরার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে দমন করল। বলল, ভাল চান তো এখুনি এখান থেকে চলে যান, ফানযিলাহ। এই দাসীকে কারও হাতেই তুলে দেব না আমি। হোন তিনি আসাদ-আদ-দীন, বা খোদ শয়তান!
শেষ কথা বলে দিয়েছে ও। কণ্ঠ শুনেই ফানযিলাহ্ বুঝতে পারল তা। নতুন কৌশল খাটাল সঙ্গে সঙ্গে–আগেই ঠিক করে রেখেছে এমনটা ঘটলে কী করবে।
তা হলে একটাই পথ তোমার সামনে, শাকের, বলল সে। বিয়ে করে ফেলো মেয়েটাকে… এবং খুব তাড়াতাড়ি। কারণ ওই একটা বাধাই শুধু ঠেকাতে পারবে বাদশাহকে। ধার্মিক মানুষ তিনি; আর যা-ই করুন, কারও ঘরের বউকে তুলে নেবেন না। বরং পবিত্র এই বন্ধনকে শ্রদ্ধা দেখাবেন।
ওতে আপনার উদ্দেশ্যও সফল হবে, তাই না? গম্ভীর হয়ে গেল অলিভার।
অস্বীকার করছি না।
হেসে উঠল অলিভার। আপনি কৌশলী নন-এ-কথা বলে বড় ভুল করেছি আমি। কৌশলী তো বটেই, সেইসঙ্গে সাপের মত ধূর্ত আপনি। ভাল একটা চাল দিয়েছেন-এক ঢিলে মারতে চাইছেন দুই পাখি! বিয়ে হলে মেয়েটা বাদশাহ-র নাগালের বাইরে চলে যাবে… সেইসঙ্গে ওকে বিয়ে করায় বাদশাহ্ আমার উপরেও খেপে যাবেন! বাহ, ভাল ফন্দি এঁটেছেন!
আমার পরামর্শের ভুল অর্থ করছ তুমি, শাকের। আমি শুধু বন্ধু হিসেবে…
কথা শেষ হলো না ফানযিলাহ-র। তার আগেই দূর থেকে ভেসে এল হাঁকডাক আর ঘোড়ার খুরের টগবগানি। প্যারাপেটের পাশে ছুটে গেল সে। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল বাইরে। পরক্ষণে আতঙ্ক ফুটল কণ্ঠে।
সর্বনাশ! আসাদ-আদ-দীন! এসে পড়েছেন উনি!
অলিভারও তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দলবল নিয়ে এগোতে থাকা বাদশাহ্-র শোভাযাত্রার দিকে তাকিয়ে বলল, হুম, মনে হচ্ছে একটা অন্তত সত্য কথা বলেছেন আপনি। বাদশাহ্ সত্যি সত্যি আসছেন আমার বাড়িতে।
ওর দিকে ফিরল ফানযিলাহ্। বাকি কথার সত্যতাও খুব শীঘ্রি টের পাবে তুমি। কিন্তু… কিন্তু আমার কী হবে? আসাদ যদি আমাকে এখানে দেখে ফেলেন, নির্ঘাত মৃত্যুদণ্ড দেবেন!
তাতে কোনও সন্দেহ নেই, বলল অলিভার। তবে এত ভয় পাবার কিছু নেই। বোরখা আছে আপনার গায়ে, চেহারা দেখা যাবে না। এক কাজ করুন, নীচে চলে যান। আঙিনার ছায়ার ভিতর লুকিয়ে পড়ুন। বাদশাহ্ যখন উপরে উঠবেন, তখন বেরিয়ে যেতে পারবেন বাড়ি থেকে। ধরে নিচ্ছি আর কোনও সঙ্গীসাথী আনেননি আপনি?
না, মাথা নাড়ল ফানযিলাহ্। এখানে আসার খবর গোপন রাখতে চেয়েছি আমি। আশা করছি তুমিও মুখ খুলবে না।
নিশ্চিত থাকুন, কথা দিল অলিভার। মহিলাকে অপছন্দ করলেও এক অর্থে তার সাহসের প্রশংসা করতে বাধ্য হচ্ছে। এত বছর বাদশাহ্-র হারেমে কাটাবার পরেও ফানযিলাহ্ তার সিসিলিয়ান বিদ্রোহী সত্তা পুরোপুরি বিসর্জন দেয়নি। চরম ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে স্বামীর বিরুদ্ধে, অক্ষুণ্ণ রাখতে চাইছে স্ত্রী হিসেবে নিজের আসন-পদ্ধতি একটু অন্যরকম আর কী। তাই বলে এই প্রচেষ্টাকে দুয়ো দেয়া যায় না।
ঝুলবারান্দার দরজা দিয়ে বেরুনোর আগে থামল ফানযিলাহ। ঘাড় ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি সত্যিই ওকে বিক্রি করবে না তো?
উঁহু, মাথা নাড়ল অলিভার। নির্ভয়ে থাকুন।
.
১৩.
বিয়ে
ফানযিলাহ্ চলে যাবার পর অপেক্ষা করতে থাকল অলিভার, কখন আলি এসে বাদশাহ্-র আগমনী বার্তা ঘোষণা করে। কিন্তু তেমনটা ঘটল না। আলি উপস্থিত হলো ঠিকই, তবে ঘোষণা দেবার জন্য নয়… পথ দেখাতে। ওর পিছু পিছু ঝুলবারান্দায় বেরিয়ে এলেন স্বয়ং আসাদ-আদ-দীন। নীচে অপেক্ষা করবার মত ধৈর্য হয়নি তাঁর।
আল্লাহর করুণা বর্ষিত হোক তোমার উপর, শাকের-আল বাহার, অভিবাদন জানালেন বাদশাহ্।
আপনার উপরেও, মহানুভব। মাথা নুইয়ে সালাম দিল অলিভার। আপনার পদধূলি পড়ায় আমার গরীবখানা ধন্য হলো। ইশারা করল আলিকে চলে যেতে।
শুনে খুশি হলাম, বললেন বাদশাহ্। কিন্তু আজ আমি এসেছি তোমার কাছে একটা জিনিস চাইতে।
ছি, ছি, এসব কী বলছেন? চাইতে হবে কেন, আমার সবকিছু তো আপনারই সম্পত্তি।
আসাদ-আদ-দীনের চঞ্চল দৃষ্টি অলিভারকে পেরিয়ে নিবদ্ধ হলো ডিভানে বসে থাকা রোজামুণ্ডের উপর। গম্ভীর গলায় বললেন, ওই মেয়েটার জন্য এসেছি আমি। ইংল্যাণ্ড থেকে তোমার কুড়িয়ে আনা মুক্তো… ওকে খুব মনে ধরেছে আমার। তাই সামানিকে বলেছিলাম ওকে কিনে নিতে। কিন্তু গাধাটা ব্যর্থ হয়েছে। খবরটা পেয়ে প্রথমে খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম, ভেবেছিলাম বুঝি দূরদেশের কোনও দাস-ব্যবসায়ীর কাছে। হারিয়েছি ওকে। পরে যখন শুনলাম, আমার প্রিয় শাকের-আল বাহার ওকে কিনে নিয়েছে, তখন দূর হয়ে গেল সব দুঃখ। আমি জানি, বাদশাহূকে খুশি করবার জন্য তুমি সবকিছু ত্যাগ করবে। মেয়েটাকে আমার হাতে তুলে দাও, বাছা।
দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলছেন বাদশাহ্। তাঁকে কীভাবে হতাশ করবে, ভেবে পেল না অলিভার। দ্বিধান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তাই।
তোমার ক্ষতি পুষিয়ে দেব আমি, বললেন আসাদ। ষোলোশ দিনার খরচ করেছ তো? তার সঙ্গে আরও পাঁচশো পাবে ক্ষতিপূরণ বাবদ। তাড়াতাড়ি জবাব দাও, আমি অধৈর্য হয়ে উঠেছি।
মলিন হাসি ফুটল অলিভারের ঠোঁটে। এই মেয়েটার ব্যাপারে আমিও আপনার মতই অধৈর্য, মালিক। পাঁচ-পাঁচটা বছর ওর কথা ভেবে জ্বলেছি আমি। শেষ পর্যন্ত অভিযান চালিয়েছি সুদূর ইংল্যাণ্ডের মাটিতে। আপনি আমার মনের অবস্থা জানেন না, মহানুভব, জানলে…।
আরে! তুমি দেখছি পাকা ফেরিঅলা! বলে উঠলেন আসাদ। অবশ্য বুদ্ধির খেলায় কেউ যে তোমার সমতুল্য নয়, তা তো জানিই। ঠিক আছে, ইচ্ছেমত দাম হাঁকো। যা লাভ চাও, তা-ই পাবে। আমি আর সময় নষ্ট করতে রাজি নই।
প্রশ্নটা লাভ-ক্ষতির নয়, মালিক, শান্তস্বরে বলল অলিভার। মেয়েটাকে বিক্রি করব না আমি।
চোখ পিট পিট করলেন বাদশাহ্, হতবাক হয়ে গেছেন। মুখ আরক্ত হয়ে উঠল।
ব… বিক্রি করবে না? বিস্ময়ে কথা আটকে গেল তার।
দাম হিসেবে আপনার পুরো বাদশাহী-ও যদি দিতে চান, তবু না, বলল অলিভার। অস্বাভাবিক দৃঢ়তা ফুটে উঠেছে কণ্ঠে। অন্য যে-কোনও কিছু চান, আমি আপনার পায়ে সমর্পণ করব আনুগত্য আর ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে।
কিন্তু আমি যে আর কিছুই চাই না, অস্থিরতা প্রকাশ পেল আসাদের গলায়। সেইসঙ্গে উত্মা। আমি শুধু ওই দাসীকে চাই।
তা হলে আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হচ্ছি আমি। অনুরোধ করছি আপনার দৃষ্টি ওর উপর থেকে সরিয়ে নিতে।
খেপে গেলেন বাদশাহ্। ফিরিয়ে দিচ্ছ তুমি আমাকে?
আমার দুর্ভাগ্য!
নীরবতা নেমে এল খানিকক্ষণের জন্য। মেঘ জমল বাদশাহর চেহরায়, আগুন জ্বলে উঠল দুচোখের তারায়। একটু পর যখন মুখ খুললেন, কণ্ঠে মৃত্যুর শীতলতা। আচ্ছা, ব্যাপার তা হলে এ-ই? যতটা ভেবেছিলাম, ফানযিলাহ-র কথায় দেখছি তারচেয়ে বেশি সত্যতা আছে! হুম! অগ্নিদৃষ্টি হানলেন তিনি অবাধ্য কর্সেয়ারের দিকে।
দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না।
অলিভারের কথায় প্রভাবিত হলেন না আসাদ। চাপা ক্ষোভের সুরে বললেন, ভাল করে ভেবে দেখো, শাকের আল-বাহার, কে তুমি… কে তোমাকে আজকের অবস্থানে এনেছে। আমার এই দুহাত দিয়ে ধনী বানিয়েছি তোমাকে, আমার দয়ায় কর্সেয়ার-বাহিনীর সেনাপতি হয়েছ তুমি। পুরো আলজিয়ার্সে আমার পরেই তোমার স্থান। অথচ কৃতার্থ হবার বদলে কী করছ তুমি? এতদিনে একটামাত্র জিনিস চেয়েছি তোমার কাছে, সেটাই দিতে রাজি হচ্ছ না! অকৃতজ্ঞতারও একটা সীমা থাকা উচিত।
যদি জানতেন এর সঙ্গে আমার কতকিছু…।
কিছুই জানার প্রয়োজন নেই আমার, গর্জে উঠলেন আসাদ-আদ-দীন। আমার ইচ্ছের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনও কিছুই হতে পারে না। শান্ত হলেন পরমুহূর্তে। একটা হাত রাখলেন শাকেরের চওড়া কাঁধে। থাক, আর রাগারাগি করব না। ঝোঁকের মাথায় নাহয় একটা ভুল করে ফেলেছ। তোমাকে অত্যন্ত ভালবাসি আমি, সে-কারণে সব ভুলে যেতে রাজি আছি।
ভালই যদি বাসেন আমাকে, তা হলে দয়া করে মেয়েটার কথা মুছে ফেলুন আপনার হৃদয় থেকে।
এখনও প্রত্যাখ্যান করছ? আবার কর্কশ হয়ে উঠল বাদশাহ-র কণ্ঠ। সাবধান শাকের, ভুলে যেয়ো না আমি কে। ধুলো থেকে উঠিয়ে এনেছি তোমাকে, আবার মিশিয়ে দিতে পারি সেই ধুলোতেই। দাসত্বের যে-শেকল থেকে মুক্ত করেছি তোমাকে, আবার সেই শেকলই পরিয়ে দিতে পারি চোখের পলকে!
অবশ্যই পারেন, স্বীকার করল অলিভার। কিন্তু তারপরেও নিজের সম্পত্তি আঁকড়ে ধরে রাখব আমি। এই দাসীকে আমিই জোগাড় করেছি, কিনেও নিয়েছি ন্যায্য দাম দিয়ে। এর উপরে আমার চেয়ে বেশি অধিকার আর কারও নেই। দয়া করুন, মালিক…
আমি যদি ওকে ছিনিয়ে নিতে চাই? হুমকি দিলেন আসাদ।
প্রাণ থাকতে তা হতে দেব না আমি, শান্ত গলায় বলল অলিভার।
কী! চেঁচিয়ে উঠলেন বাদশাহ্। অকৃতজ্ঞ কুকুর কোথাকার! তুমি আমাকে বাধা দেবে?
আল্লাহ্-র কাছে প্রার্থনা করি, আপনি যেন আমাকে অমন লজ্জাজনক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য না করেন।
এটাই তোমার শেষ কথা?
হ্যাঁ, তবে তার সঙ্গে যোগ করতে চাই–আমি আপনার দাস, হে আসাদ।
ক্রুদ্ধচোখে অলিভারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন বাদশাহ্। তারপর ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন ঝুলবারান্দা থেকে। শোনা গেল তাঁর হুমকি, দেখে নেব!
মূর্তির মত তাঁর গমনপথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল অলিভার, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে উল্টো ঘুরল। দেখল, রোজামুণ্ডের দৃষ্টি সেঁটে আছে ওর উপর। কী বলবে ভেবে পেল না, মাথা নামিয়ে একপাশে সরে গেল ও। ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করা দরকার। ভয়ানক একটা কাজ করেছে বিরুদ্ধাচরণ করেছে আসাদ-আদ-দীনের। খুব যে ভেবে-চিন্তে করেছে, তা নয়। মনের ভিতর থেকেই বেরিয়ে এসেছে বিদ্রোহ। বাদশাহ্-র হারেমের রক্ষিতা হিসেবে ভাবতেই পারেনি রোজামুণ্ডকে। বুঝতে পারছে অলিভার, রোজামুণ্ডের প্রতি ওর ভালবাসা এখনও মিলিয়ে যায়নি। গেলে এমন উত্তাল হয়ে উঠত না হৃদয়, বরং বাদশাহ্-র হাতে ওক তুলে দিয়ে শাস্তির ষোলোকলা পূর্ণ করত।
আপন চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল অলিভার, সংবিৎ ফিরে পেল রোজামুণ্ডের তীক্ষ্ণকণ্ঠের প্রশ্ন শুনতে পেয়ে।
ওঁকে ফিরিয়ে দিলে কেন?
বিস্মিত হয়ে উল্টো ঘুরল অলিভার। তুমি আমাদের কথা বুঝতে পেরেছ?
প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট, ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল রোজামুণ্ড। কেন ফেরালে ওঁকে?
ওর দিকে এগিয়ে গেল অলিভার! কেন জানতে চাইছ? বোঝার চেষ্টা করছি তোমাকে। ব্যাপার কী, নিজের হাতে আমাকে শায়েস্তা করবার জন্য উতলা হয়ে পড়েছ? অন্য কারও হাতে শাস্তি পেলে তাতে মন ভরবে না?
চেহারায় তিক্ততা ফুটল অলিভারের। আমার কাজের এমন অর্থ করা তোমাকেই মানায়।
আমি শুধু সম্ভাবনার কথা বলেছি। অন্য কোনও কারণও থাকতে পারে। সেজন্যেই জানতে চাইছি।
ধারণা করতে পারো, বাদশাহ্-র কবলে পড়লে কী দশা হতে পারে তোমার?
শরীর একটু কেঁপে উঠল রোজামুণ্ডের। নামিয়ে নিল চোখ। নিচু গলায় বলল, শাকের-আল-বাহারের কবলে পড়ার চেয়ে খুব কি খারাপ হবে সেটা?
যদি বোঝাতে চাও যে, আমার আর বাদশাহ্-র মধ্যে কোনও পার্থক্য দেখতে পাও না তুমি, তা হলে খামোকাই তাঁকে বাধা দিয়েছি আমি। অলিভার বলল। চাইলে যেতে পারো ওঁর কাছে। কিন্তু জেনে রাখো, আমি প্রতিশোধের নেশায় আপত্তি জানাইনি, আপত্তি জানিয়েছি শুধু তোমার মঙ্গলের জন্য। হারেমে তোমাকে কল্পনা করতেই শিউরে উঠেছি আমি।
নিজের কথা ভাবলেও ওভাবেই শিউরে ওঠা উচিত।
মুখ ঘোরাল অলিভার। নিচু গলায় বলল, হয়তো উচিত… সত্যিই হয়তো উচিত।
ঝট করে ওর দিকে তাকাল রোজামুণ্ড। কড়া গলায় কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু সুযোগ পেল না। আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছে অলিভার।
হায় খোদা! বলে উঠল ও। এটাই দরকার ছিল আমার চোখ খুলে দেবার জন্য। আমাকে বোঝানোর জন্য কত নিকৃষ্ট একটা কাজ করেছি আমি। প্রতিহিংসা আমাকে পরিচালিত করেছে, কিন্তু বাদশাহ্ পরিচালিত হচ্ছেন তারচেয়েও খারাপ একটা রিপুর তাড়নায়। না, ওঁর হাতে তোমার সর্বনাশ হতে দেব না আমি!
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল রোজামুণ্ড, এগোল অলিভারের দিকে, অদ্ভুত এক দোলায় দুলছে ওর হৃদয়। চেহারাতেই প্রকট হয়ে উঠেছে দ্বিধাদ্বন্দ্বের ছাপ। কিন্তু অলিভার সেটা খেয়াল করল না। ওর দিকে ফিরে বলল:
একটাই পথ আছে… ফানযিলাহ্-র দেখিয়ে দেয়া পথ। একটু ইতস্তত করল ও। আমাদের বিয়ে হতে হবে!
যেন আঘাত করা হয়েছে, এই ভঙ্গিতে এক পা পিছিয়ে গেল রোজামুণ্ড। চমকে উঠে বলল, বিয়ে?।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল অলিভার। তারপর ব্যাখ্যা করল, এক মুসলিমের স্ত্রীর দিকে অন্য মুসলিমের দৃষ্টি দেয়াও ভয়ানক অন্যায়। খাঁটি ধার্মিক আসাদ-আদ-দীন কিছুতেই এমন অন্যায় করবেন না। একমাত্র এভাবেই তোমাকে ওঁর থাবা থেকে বাঁচাতে পারব আমি।
রোজামুণ্ড ওর কথায় প্রভাবিত হলো না। শান্ত গলায় বলল, খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চাইছ তুমি, অলিভার। কিন্তু দুঃখিত, এ বিয়ে আমি করতে পারব না। ,
করতেই হবে! জোর গলায় বলল অলিভার, একটু রেগে গেছে। নইলে আজ রাতেই বাদশাহ্-র হারেমে যেতে হবে তোমাকে। তাও স্ত্রী হিসেবে নয়, ক্রীতদাসী হিসেবে! ওহ্, বিশ্বাস করো আমাকে… অন্তত নিজের জন্য! বিশ্বাস তোমাকে করতেই হবে!
বিশ্বাস? যেন হেসে উঠল রোজামুণ্ড। তোমাকে? ধর্মত্যাগী একজন জলদস্যুকে বিশ্বাস করি কীভাবে, বলতে পারো?
নিজেকে সামলাল অলিভার। মেয়েটাকে বোঝাবার জন্য শান্ত থাকা প্রয়োজন ওর। বলল, তুমি পাষাণীর মত কথা বলছ, রোজামুণ্ড। আমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার সময় এড়িয়ে যাচ্ছ অতীতকে। মিথ্যে খুনের দায়ে ফাঁসানো হয়েছিল আমাকে, অপহরণ করে দাস বানানো হয়েছিল… এই দুনিয়ায় যাদেরকে আমি আপন বলে ভাবতাম, তারাই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল আমার সঙ্গে। সেসবেরই ফলাফল আজকের আমি। মানুষ আর ঈশ্বরের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলাম। হ্যাঁ, মুসলমান হয়েছি আমি, ধর্মত্যাগ করে জলদস্যুতা বেছে নিয়েছি… কিন্তু এ-সবই করেছি আর কোনও দরজা খোলা ছিল না বলে, শেকল-পরা মাল্লার দুর্বিষহ জীবন থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় ছিল বলে! দুঃখ ভর করল ওর চেহারায়। এতসব জানবার পরেও তুমি ক্ষমা করতে পারছ না আমাকে?
কাঁপন উঠল রোজামুণ্ডের বুকে। কণ্ঠের রূঢ়তা হারিয়ে গেল, রইল কেবল ক্ষোভ। দুখি গলায় বলল, যত অবিচারই হোক তোমার প্রতি; তাই বলে মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিতে পারো না। অনেক নীচে নেমে গেছ তুমি, অলিভার। এ-অবস্থায় আর যা-ই করি, তোমাকে বিশ্বাস করতে পারব না আমি।
মাথা হেঁট হয়ে গেল অলিভারের। রোজামুণ্ডের কথাগুলো অন্তরে বিঁধেছে। ম্লান গলায় ও বলল, আমি জানি। তবুও তোমাকে আজ মিনতি করছি আমার উপর বিশ্বাস রাখার জন্য। আমার জন্য নয়, তোমার নিজের জন্য। প্রমাণ চাও? খাপমুক্ত করে ছোরাটা আবার ও বাড়িয়ে ধরল রোজামুণ্ডের দিকে। রাখো এটা তোমার কাছে। আমার তরফ থেকে কোনও ধরনের বেঈমানীর আভাস পেলেই ব্যবহার কোরো এটা–নিজের বুকে, বা আমার বুকে!
অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইল রোজামুণ্ড, তারপর নিজের হাতে নিল ছোরাটা।
ভয় হচ্ছে না তোমার, বলল ও, এখুনি এটা ব্যবহার করতে পারি আমি?
তোমাকে বিশ্বাস করছি আমি, বলল অলিভার। আশা করব প্রতিদানে তুমিও বিশ্বাস করবে আমাকে। তা ছাড়া… খারাপ কিছু ঘটলেও ওটা দরকার হবে তোমার। বাদশাহ্-র হারেম আর মৃত্যুর মধ্যে যদি একটাকে বেছে নিতে হয়, আমি তোমাকে দ্বিতীয়টা বেছে নেবার পরামর্শ দেব। আর হ্যাঁ, ওটা এখুনি করতে যেয়ো না। জীবনের আশা থাকার পরেও মরতে চায় শুধু বোকারা।
কীসের আশা? তোমার সঙ্গে বাকি জীবন কাটাবার?
না, অলিভার মাথা নাড়ল। যদি আস্থা রাখো আমার উপর, তা হলে কথা দিচ্ছি, সমস্ত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করব আমি। শোনো, কাল ভোরে একটা জাহাজ নিয়ে অভিযানে যাবার কথা আছে আমার। সবার চোখ এড়িয়ে তোমাকে ওই জাহাজে তুল আমি, সুযোগ বুঝে ইটালি বা ফ্রান্সে নামিয়ে দেব, যাতে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারো।
কিন্তু তার আগে আমাকে তোমার বউ হতে হবে, মনে করিয়ে দিল রোজামুণ্ড।
হাসল অলিভার। তুমি কি ভাবছ আমি তোমাকে ফাঁদে ফেলতে চাইছি? হায় খোদা, আমার সদিচ্ছা কি কিছুতেই বুঝবে না তুমি? মুসলমানের বিয়ে তো খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আমি ওটাকে বিয়েই বলব না। ব্যাপারটা শুধুই তোমাকে বাঁচাবার একটা ঢালমাত্র।
যদি পরে কথা না রাখো তুমি?
কথা যদি না রাখি, কাঁধ ঝাঁকাল অলিভার, তোমার কাছে ছোরাটা তো থাকছে!
ঠোঁট কামড়ে একটু ভাবল রোজামুণ্ড। তারপর বলল, বেশ। বিয়েটা তা হলে কীভাবে হবে?
মুসলিমদের নিয়ম ব্যাখ্যা করল অলিভার-সাক্ষীর উপস্থিতিতে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা যায় যে-কোনও অবিবাহিতা নারীকে, মেয়েটির সম্মতিক্রমে অবশ্যই। তবে বিয়ের বৈধতা দেবার জন্য প্রয়োজন হয় একজন কাজী বা তার ঊর্ধ্বতন কোনও ব্যক্তির। ওর কথা শেষ হবার আগেই বাইরে থেকে ভেসে এল হৈচৈ। দেখা গেল অনেকগুলো মশালের আবছা আভা।
ওই যে, দলবল নিয়ে এসে পড়েছেন বাদশাহ্, বলল অলিভার। গলা কেঁপে উঠল উদ্বেগে। বলো রোজামুণ্ড, তুমি রাজি আছ আমার প্রস্তাবে?।
কিন্তু এ-মুহূর্তে কাজী পাবে কোথায়? শঙ্কিত গলায় জানতে চাইল রোজামুণ্ড। ইতিবাচক সম্মতি প্রকাশ পেল তাতে।
আমি বলেছি কাজী বা তার ঊর্ধ্বতন কোনও ব্যক্তি। বাদশাহ্ নিজেই আমাদের বিয়ের বৈধতা দেবেন। তাঁর সঙ্গীসাথীরা সাক্ষী হবে।
উনি যদি রাজি না হন? উত্তেজিত কণ্ঠে বলল রোজামুণ্ড। ঈশ্বর! লোকটা কিছুতেই রাজি হবে না!
আমরা তো আর অনুমতি চাইতে যাচ্ছি না। সরাসরি আশীর্বাদ চাইব।
খেপে যাবে তো! নিশ্চয়ই ভাববে কৌশল খাটাচ্ছ তুমি। প্রতিশোধ নিতে পারে!
সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেয়া না, একমত হলো অলিভার। কিন্তু ঝুঁকিটা না নিয়ে উপায় নেই আমাদের। যদি ব্যর্থ হই…
আমার কাছে ছোরা আছে! বাক্যটা শেষ করল রোজামুণ্ড।
আর আমার কপালে জুটবে ফাঁসির দড়ি বা তলোয়ার, যোগ করল অলিভার। শান্ত থাকো। ওই তো, এসে পড়েছে।
কিন্তু না, পায়ের শব্দের পিছু পিছু হাজির হলো আলি। উল্কণ্ঠিত গলায় বলল, মালিক, সৈন্য-সামন্ত নিয়ে এসেছেন আসাদ-আদ-দীন!
ভয়ের কিছু নেই, অলিভার নির্বিকার। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ওর কথা শেষ হতেই ঝড়ের মত উদয় হলেন আসাদ-আদ-দীন। সঙ্গে জনাবারো দেহরক্ষী নিয়ে এসেছেন অবাধ্য সেনাপতিকে শায়েস্তা করবার জন্য। মশালের আলোয় চকচক করছে তাদের হাতের নাঙ্গা তলোয়ার।
শাকের-আল-বাহারের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন বাদশাহ্। দুহাত ভাঁজ করে বজ্রকঠিন কণ্ঠে বললেন, আমি ফিরে এসেছি, বাছা। দেখতেই পাচ্ছ, সোজা আঙুলে ঘি না ওঠায় আঙুল বাঁকা করবার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। তারপরেও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি তোমাকে সুমতি দেবার।
সুমতি হয়েছে, মহানুভব, বলল অলিভার।
আল্লাহ দয়াময়! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আসাদ-আদ দীন। হাত বাড়িয়ে দিলেন। তা হলে পাঠাও মেয়েটাকে।
পিছিয়ে গেল অলিভার, রোজামুণ্ডের হাত তুলে নিল নিজের হাতে। বাদশাহ্-র দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, পরম করুণাময় আল্লাহ্-র নামে, হে আসাদ-আদ-দীন, আপনার এবং উপস্থিত অন্যান্য সাক্ষীদের সামনে এই মেয়েকে আমি রাসূলের নিয়ম অনুসারে স্ত্রী বলে গ্রহণ করছি। বলুন আমিন!
দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে গেল আসাদ-আদ-দীনের। তাঁর চোখের সামনে ঘটে গেছে অকল্পনীয় কাণ্ডটা, আর তিনি নিজে সেটার বৈধতা-দানকারী কর্তৃপক্ষ হয়ে গেছেন। গলার রগ ফুলে উঠল তাঁর, চোখ দিয়ে বেরুতে শুরু করল আগুনের হলকা।
বাদশাহ্-র প্রতিক্রিয়ায় বিচলিত হলো না অলিভার। ডিভান থেকে একটা চাদর তুলে নিল, ঘোমটার মত পরিয়ে দিল রোজামুণ্ডকে। ঢেকে দিল মুখ।
বলল, আজ থেকে এই চেহারা পরপুরুষের দেখা নিষিদ্ধ। যদি কেউ এ ঘোমটা সরাবার চেষ্টা করে, আল্লাহ্ যেন তার উপর গজব বর্ষণ করেন। কেউ যদি ওর দিকে হাত বাড়ায়, আল্লাহ যেন তার হাত কেটে নেন। আমিন!
দুর্ধর্ষ এক কাজ করেছে অলিভার। আসাদ-আদ-দীন বিমূঢ় হয়ে গেছেন। পিছনে শিকারী কুকুরের মত তলোয়ার বাগিয়ে অপেক্ষা করছে দেহরক্ষীরা, হুকুম পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু এল না কোনও হুকুম। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন বাদশাহ। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছেন, দুলছেন খানিকটা, লাল থেকে ফ্যাকাসে ॥ হয়ে যাচ্ছে চেহারা। যুদ্ধ করছেন ভিতরে ভিতরে-একদিকে সীমাহীন ক্রোধ, অন্যদিকে তাঁর অনড় ধর্মবিশ্বাস।
এবার আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন, মহানুভব, বলল অলিভার, কেন মেয়েটাকে হাতছাড়া করতে রাজি হইনি আমি? অবিবাহিত থাকায় বহুবার আমাকে কটাক্ষ করেছেন আপনি, বলেছেন বিয়ে করাটা খাঁটি মুসলমানের দায়িত্ব। এতদিনে পছন্দসই একজনকে খুঁজে পেয়েছি, ওকে দেখামাত্র বিয়ে করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনিই বলুন, যাকে বউ বলে ভেবেছি, তাকে অন্য কারও কাছে বিক্রি করি কীভাবে?
অনেকক্ষণ কোনও জবাব দিলেন না বাদশাহ্। শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, যা হবার তা হয়ে গেছে। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞানী, তার ইচ্ছেতেই সব হয়। আমি তাতে বাধা দেবার কে?
আমিন! উঁচু গলায় বলল অলিভার। কৃতজ্ঞতা অনুভব করছে সর্বশক্তিমানের প্রতি।
আরও কিছু বলতে চাইছিলেন আসাদ-আদ-দীন, কী ভেবে যেন মত পাল্টালেন। পরাজিত ভঙ্গিতে উল্টো ঘুরলেন তিনি। দেহরক্ষীদের উদ্দেশে বললেন, চলে, যাওয়া যাক। এখানে আর কিছু করার নেই আমাদের।
.
১৪.
সঙ্কেত
প্রাসাদ-কামরার জানালা থেকে আসাদ-আদ-দীনকে উত্তেজিত অবস্থায় প্রথমবার ফিরতে দেখল ফানযিলাহ্। সে নিজেও তখন হাঁপাচ্ছে, প্রায় ছুটতে ছুটতে ফিরে এসেছে শাকের-আল বাহারের বাড়ি থেকে। ওর কয়েক মিনিট পরেই ফিরেছেন বাদশাহ্।
দেহরক্ষীবাহিনীর প্রধান আবদুল মুখতারের নাম ধরে আসাদকে ডাকাডাকি করতে শুনল ও। একটু পরেই ছোটাছুটি শুরু হলো আঙিনায়। জনাবারো দেহরক্ষী একত্র হলো, তাদেরকে নিয়ে ঝড়ের বেগে আবার বেরিয়ে গেলেন বাদশাহ।
মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে মারযাক। পিতা বেরিয়ে যেতেই উল্লসিত গলায় বলল, এইবার জমবে খেলা! কুত্তাটা বেয়াদবি করে বসেছে আব্বার সঙ্গে। আজ রাতেই শেষ হয়ে যাবে শাকের-আল-বাহারের সমস্ত গর্ব আর অহঙ্কার! দুহাত তুলল মুখের সামনে। আল্লাহ্-র অশেষ দয়া।
ছেলের উচ্ছ্বাসে যোগ দিল না ফানযিলাহ্। দ্বিধাদ্বন্দ্বে দুলছে তার হৃদয়। সন্দেহ নেই, শাকের-আল-বাহারকে পথ থেকে সরাতে হবে… আর মোক্ষম একটা অস্ত্রও পাওয়া গেছে তার জন্য। কথা হলো, সেই অস্ত্রের আঘাতে সে নিজেও কি আহত হবে না? চমৎকার এক কৌশল খাটিয়ে শাকেরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে ফানযিলাহ্, কিন্তু এখন বুঝতে পারছে ফাঁদটা পুরোপুরি নিখুঁত হয়নি। শাকের পরাজিত হলে খ্রিস্টান মেয়েটা এসে যাবে আসাদ-আদ-দীনের হাতে… আর তার মানে প্রাসাদের রানির পদ থেকে পতন ঘটবে তার। ছেলের জন্য এটুকু ত্যাগ স্বীকার করা মায়ের কর্তব্য, কিন্তু কেন যেন মন মানছে না। শাকেরের পাশাপাশি খ্রিস্টান মেয়েটাকেও যদি সরিয়ে দেয়া যেত দৃশ্যপট থেকে, তা হলেই চূড়ান্ত বিজয় ঘটত তার। অথচ এখন… ছেলের জন্য খুশি হতে পারছে না, বুকের ভিতরটা খচ্ করে উঠছে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবলে।
মনের এই অশান্ত অবস্থা নিয়ে তাই অপেক্ষা করতে থাকল ফানযিলাহ্। কান দিল না ছেলের বকবকানিতে–দেবে কেন, মারযাক আনন্দিত নিজের কথা ভেবে। একবারও চিন্তা করছে না মা-কে নিয়ে, তাকিয়ে দেখছে না জন্মদাত্রীর উদ্বেগমাখা চেহারা। নিজের অজান্তে ফানযিলাহ্ একটু বিরক্ত হয়ে উঠল ছেলের প্রতি।
অনেকক্ষণ পর বাদশাহকে ফিরতে দেখল মা-ছেলে। দেহরক্ষীদের মধ্যে কোনও ধরনের উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হলো না, আসাদও ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন পরাজিত ভঙ্গিতে। হাঁটলেন ক্লান্ত পায়ে, মাথা নিচু করে বুকের সঙ্গে ঠেকিয়ে রেখেছেন, দুহাত শরীরের পিছনে। চঞ্চল চোখে তার পিছনে নজর বোলাল ফানযিলাহ্ আর মারযাক-খ্রিস্টান দাসীকে দেখবে বলে আশা করল, হাত-পা বেঁধে তাকে নিয়ে আসবে বাদশাহ্-র সঙ্গীরা… কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু ঘটল না।
বাদশাহ্-র কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল, দেহরক্ষীদেরকে চলে– যেতে বলছেন। কুর্নিশ করে বিদায় নিল তারা। এরপর চাঁদের আলোয় প্রাসাদ-আঙিনায় একাকী পায়চারি করতে লাগলেন আসাদ-আদ-দীন। হাঁটার ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল, মনের ভিতর ঝড় বইছে তাঁর।, বিস্ময় বোধ করল ফানযিলাহ্ আর মারযাক। কী ঘটেছে? বাদশাহ্ কি দুজনকেই হত্যা করে এসেছেন নাকি? সম্ভাবনাটা অমূলক নয়। বিদ্রোহ করায় এমনিতেই শাকেরের কপালে মরণ লেখা ছিল, এরপর হয়তো খ্রিস্টান মেয়েটাও প্রত্যাখ্যান করেছে তাঁকে… বাধা দিয়েছে। রাগের মাথায় তাকেও হয়তো প্রাণদণ্ড দিয়েছেন বাদশাহ্। ব্যাপারটা ভাবতেই ফাযিলাহ্-র রক্ত নেচে উঠল। এক ঢিলে দুই পাখি শিকার হয়ে গেছে তা হলে। কিন্তু আসলেই কি তাই? নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। তাই ডেকে পাঠাল খোঁজা আইয়ুবকে। দেহরক্ষীদের নেতা আবদুল মুখতারের কাছ থেকে সব জেনে আসবার জন্য নির্দেশ দিল।
কিছুক্ষণ পর ফিরল আইয়ুব-দুঃসংবাদ নিয়ে। শাকের আল-বাহার খ্রিস্টান মেয়েটিকে বিয়ে করেছে। পরাজয় মেনে নিয়ে ফিরে এসেছেন আসাদ-আদ-দীন। ওর দুজনেই বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। বলা বাহুল্য, খবরটা শুনে চরম হতাশায় ডুবে গেল মা-ছেলে।
ঝটকা-টা খুব দ্রুত সামলে নিল ফানযিলাহ্। ঘটনা যে এদিকে গড়াতে পারে, তা একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল না ওর কাছে। ও-ই তো বুদ্ধিটা ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছিল শাকেরের মাথায়। যা চাইছিল, তা হয়নি-মারা পড়েনি দুর্ধর্ষ কর্সেয়ার; তারপরেও যা ঘটেছে, তা একদিক থেকে মন্দের ভাল। অন্তত প্রাসাদে ওর অবস্থান অটুট রইল। আসাদ-আদ-দীন আর যা-ই করুন, একটা বিবাহিত মেয়েকে তুলে এনে নিজের হারেমে ঢোকাবেন না। তার ওপর মেয়েটাকে বিয়ে করে বাদশাহ্-র বিরাগভাজন হয়েছে শাকের, তাকে এবার সহজেই আসাদের চোখের বালিতে পরিণত করা যাবে।
কীভাবে এগোতে হবে, তা পরিষ্কার বুঝতে পারছে ফানযিলাহ্। আসাদ-আদ-দীনের ধর্মভীরুতাকে কাজে লাগিয়েছে শাকের-আল-বাহার; তাকেও একই কাজ করতে হবে। ধর্মের প্রতি বাদশাহ্-র অনুরাগকে ব্যবহার করেই স্বার্থসিদ্ধি করবে সে।
একটা ওড়না তুলে নিল ফানযিলাহ্, ভাল করে শরীর আর মুখ ঢাকল, তারপর চপল পায়ে সিঁড়ি ধরে নেমে এল আঙিনায়। এককোনায় খাটানো শামিয়ানার নীচে আশ্রয় নিয়েছেন তখন আসাদ, তক্তপোশে বসে আছেন ধ্যানমগ্ন হয়ে। সাবধানে তাঁর পাশে গিয়ে বসল সে, হাত রাখল কাঁধে।
আমার প্রাণের মালিক, নরম গলায় বলল ফানযিলাহ্, আপনি দুঃখ পাচ্ছেন! কণ্ঠে উপচে পড়ছে সহানুভূতির সুর।
একটু যেন চমকে উঠলেন আসাদ। মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, কে বলেছে তোমাকে?
আমার হৃদয়, গদগদ ভাষায় বলল ফানযিলাহ্। দুঃখে আপনার হৃদয় ভারী হলে আমারটা কি আর হালকা থাকতে পারে? আপনি অশান্তির আগুনে পুড়লে আমি কীভাবে শান্তিতে থাকি? কামরায় বসেও আপনার মনের অবস্থা অনুভব করেছি আমি, বুঝেছি এ-মুহূর্তে আপনার জন্য আমার প্রয়োজনীয়তা। দুঃখ ভাগাভাগি করতে তাই ছুটে এসেছি, পারলে পুরোটাই নিজে নিয়ে নেব।
বাদশাহ্-র চেহারায় তারল্য এল। সত্যিই এখন একজন সহমর্মী দরকার তাঁর। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে স্বামীর মুখ থেকে পুরো ঘটনা জেনে নিল ফানযিলাহ্। বাদশাহ্-র কথা শেষ হলে ফেটে পড়ল রাগে।
কুকুর কোথাকার! শাকেরের উদ্দেশে গাল দিয়ে উঠল সে। অবিশ্বাসী, অকৃতজ্ঞ কুকুর! ওর ব্যাপারে আগেই আপনাকে আমি সতর্ক করেছিলাম, হে স্বামী, কিন্তু আপনি তো আমার কথা কানেই তোলেননি। তারপরেও… দেরিতে হলেও শাকেরের স্বরূপ আপনি দেখেছেন, এটাই আল্লাহ্-র অশেষ দয়া। আর আপনাকে ধোঁকা দিতে পারবে না ও। এবার নির্দ্বিধায় শয়তানটাকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে পারেন আপনি আলজিয়ার্স থেকে, ওকে মিশিয়ে দিতে পারেন ধুলোয়।
কোনও প্রতিক্রিয়া দেখালেন না আসাদ-আদ-দীন। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন সামনের দিকে। একটু পর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নীতিপরায়ণ তিনি, সেইসঙ্গে বিবেকবান-জলদস্যু দলের নেতার মধ্যে এমন গুণ কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হতে পারে অনেকের কাছে।
সব আল্লাহর ইচ্ছাতে ঘটেছে, ভারিক্কি গলায় বললেন তিনি। ইসলামের সবচেয়ে বড় সৈনিকের বিরুদ্ধে তাই প্রতিশোধ নেয়া সাজে না আমার। ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে গিয়ে আমি ইসলামের বিজয়-অভিযানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারি না।
এই কথা তো শাকের চিন্তা করেনি, স্বামী, বলল ফানযিলাহ্। ব্যক্তিগত খায়েশকে প্রাধান্য দিয়েছে সে। অগ্রাহ্য করেছে নেতার আদেশ!
হ্যাঁ। যদি সম্ভব হতো, অবশ্যই একটা শিক্ষা দিতাম ওকে। মাথা ঝাঁকালেন আসাদ। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র ত্যাগ স্বীকার করতে হবে আমাকে। প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষার চাইতে আল্লাহ্-র প্রতি আমার দায়িত্ববোধ অনেক বেশি। সামান্য একটা ক্রীতদাসীর জন্য মুসলমানদের সবচেয়ে বড় আশা… সবচেয়ে বড় যোদ্ধাকে বিসর্জন দিতে পারব না। বিধর্মীদের ধ্বংস করে শাকের ইসলামের পতাকাকে দিনে দিনে শক্তিশালী করে তুলছে। এর বিনিময়ে একটা দাসীকে সে চাইতেই পারে। মেয়েটাকে আমারও পছন্দ হয়েছিল বলে বঞ্চিত করব ওকে? শাস্তি দেব? এরপরে যদি থেমে যায় আমাদের বিজয়ের রথ, আল্লাহ্-র কাছে কী জবাব দেব তখন?
আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আপনি এখনও ওকে ইসলামের সবচেয়ে বড় সৈনিক বলছেন! বিস্মিত কণ্ঠে বলল ফানযিলাহ্।
আমার বলায় কিছু যায়-আসে না, ওর কাজই এ-কথা বলছে।
আমি অন্তত একটা কাজের কথা জানি, যেটা কোনও খাঁটি মুসলমান করতে পারে না। একটা নাসরানি মেয়েকে বিয়ে করেছে সে! বিয়ের আগে কলেমা পড়ায়নি ওকে। অথচ রাসূল (সাঃ)-এর পরিষ্কার নির্দেশ আছে, বিধর্মীকে যেন বিয়ে না করে কেউ। পবিত্র এই নিয়ম ভঙ্গ করেছে শাকের। অবজ্ঞা করেছে আল্লাহ, রাসূল আর আপনাকে!
গম্ভীর হয়ে গেলেন আসাদ। অভিযোগ মিথ্যে নয়, ব্যাপারটা আসলে এর আগে মাথাতেই আসেনি তার। তারপরেও মনের ভিতর থেকে তাড়না অনুভব করলেন শাকের-আল-বাহারের পক্ষ নেবার।
নিচু গলায় তিনি বললেন, তাড়াহুড়োয় হয়তো একটু ভুল। করে ফেলেছে ও। যতকিছুই হোক, আমি মেয়েটাকে জোর করে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। নিয়ম-কানুন মেনে বিয়ে করবার সময় পায়নি ও।
হতাশায় গোঙানি বেরিয়ে এল ফানযিলাহ্-র গলা দিয়ে। হে স্বামী, আপনি দেখছি দয়ার সাগর! এতকিছুর পরেও শাকেরের হয়ে সাফাই গাইছেন? ভুল করেছে ও? ভালমত ভেবে দেখুন, যত তাড়াহুড়োই থাকুক, খাঁটি মুসলমান কি এমন একটা অলঙ্ঘনীয় নিয়ম ভুলে যেতে পারে? তা ছাড়া… কলেমা পড়তে কতক্ষণই বা লাগে?
তিলকে তাল বানাবার চেষ্টা করছ তুমি, বেগম, বিরক্ত। গলায় বললেন আসাদ। এ-বিষয়ে আর কিছু শুনতে চাই না। আর কোনও কথা থাকলে বলো।
কথা অবশ্যই আছে। অনেক কথা। কিন্তু সেগুলো আপনার কানে কতখানি পৌঁছুবে, তা বুঝতে পারছি না। চরম বিশ্বাসঘাতকতার পরও আপনি শাকেরকে মাফ করে দিচ্ছেন। এ অবস্থায় কিছু বলে তো লাভ নেই।
কথা পেঁচিয়ো না। যা বলার, সরাসরি বলো।
ওর সবচেয়ে বড় অপরাধটাই আপনি দেখতে পাচ্ছেন না, হে স্বামী। যে-ধর্মবিশ্বাস, আর যে-সৃষ্টিকর্তার কথা ভেবে আপনি ওকে ক্ষমা করে দিচ্ছেন, ও তো ওসবকে স্রেফ স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার বানিয়েছে। ব্যক্তিগত লাভের জন্য আল্লাহ্ আর ইসলামকে ব্যবহার করা গুনাহ্ নয়?
ব্যাখ্যা করো! আদেশের সুরে বললেন আসাদ। কণ্ঠে কর্কশ ভাব ফিরে এসেছে।
ধর্মকে… আর আপনার ধর্মভীরুতাকে ঢাল বানিয়েছে শাকের, নাসরানি মেয়েটা-সহ আশ্রয় নিয়েছে তার পিছনে। বিয়ে করায় সাত খুন মাফ… কিন্তু আমার বিশ্বাস ও বিয়ে করেছে স্রেফ মেয়েটাকে আপনার নাগাল থেকে দূরে সরাবার জন্য, ঘর-সংসার শুরু করবার কোনও ইচ্ছে নেই ওর।
ওটা একটা কৌশল বলতে চাইছ? তবু আমি নিরুপায়। আইনসম্মতভাবে বিবাহিত ওরা। দম্পতি হিসেবে যেটুকু মর্যাদা প্রাপ্য, তা আমাকে দিতেই হবে।
আল্লাহ্ আপনাকে এমন মনোভাবের জন্য নিঃসন্দেহে পরকালে পুরস্কৃত করবেন। কিন্তু জেনে রাখুন, ইহকালে শাকের আপনার পিছনে হাসবে–সবার কাছে বলে বেড়াবে, কত সহজে ও আপনাকে বোকা বানাতে পেরেছে!
ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন বাদশাহ্। চলে গেলেন আঙিনার মাঝখানে। উত্তেজিত ভঙ্গিতে শুরু করলেন পায়চারি। বাধা দিল না চতুর ফানযিলাহ্, শামিয়ানার নীচে আয়েশ করে বসল। বিষ ঢেলে দিয়েছে স্বামীর মনে, এখন ওটার কাজ শুরু হবার অপেক্ষা।
হঠাৎ আসাদকে থেমে দাঁড়াতে দেখল। আকাশের দিকে দুহাত তুললেন তিনি মোনাজাতের ভঙ্গিমায়, বুঝি সাহায্য চাইছেন সর্বশক্তিমানের কাছে। বিড়বিড় করে কিছু বলতে শোনা গেল তাঁকে।
একটু পর ফিরে এলেন তিনি স্ত্রী-র কাছে। এখনও দ্বিধান্বিত। ফানযিলাহ্-র কথায় যে সত্যতা আছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু শাকেরের প্রতি স্ত্রী-র তীব্র বিদ্বেষও তাঁর অজানা নয়। মারযাককে সিংহাসনে বসানোর বাসনায় ক্রমাগত মিথ্যে অপবাদ দেয়ায় অভ্যস্ত। ওর কথায় নেচে উঠে কিছু করে বসা ঠিক হবে না। তা ছাড়া দুর্ধর্ষ যুবকটির প্রতি তাঁর নিজের ভালবাসাও কম নয়। বারংবার নিজেকে প্রমাণ করেছে সে। সিদ্ধান্ত নেবার বেলায় সবকিছুই মাথায় রাখতে হবে। দোটানায় পড়ে কিংকর্তব্য ঠিক করতে পারছেন না বাদশাহ্, অশান্ত হয়ে উঠেছে মন।
ফানযিলাহ্ কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু এক হাত উঁচিয়ে তাকে থামালেন আসাদ। বললেন, যথেষ্ট! এ-ব্যাপারে এখন আর কিছু শুনতে বা বলতে চাই না আমি। সব আল্লাহ্-র উপর ছেড়ে দিচ্ছি। রাতটা যাক, হয়তো ঘুমের মাঝেই আমাকে সঠিক পরামর্শ দেবেন তিনি।
পাশ ফিরে সিঁড়ির দিকে এগোলেন তিনি। ফানযিলাহ পিছু নিল। প্রাসাদে প্রবেশ করল দুজনে।
রাতভর ঘুমাল না বেগম। স্বামীর পায়ের কাছে মাথা রেখে মেঝেতে বসে রইল। বলা যায় না, যদি রাত-দুপুরে ঘুম ভাঙে বাদশাহ্-র, তখন নিজ হাতে তার যত্ন-আত্তি করবে। অবশ্য তেমন কোনও সুযোগ পেল না। বালিশে মাথা ঠেকাবার একটু পরেই ভারী শ্বাস ফেলতে শুরু করলেন আসাদ। তার ঘুম ভাঙল ফজরের আজানের সময়।
শান্তভাবে বিছানা ছাড়লেন বাদশাহ্। ফানযিলাহ্-র দিকে ফিরেও তাকালেন না। জিজ্ঞেস করলেন না, সারা রাত সে পায়ের কাছে পড়ে ছিল কেন। তার বদলে হাত-মুখ ধুয়ে ভৃত্যদেরকে ডেকে পাঠালেন। পোশাক পাল্টে তৈরি হলেন বাইরে বেরুবার জন্য। মনে হলো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
আল্লাহ্ কি তবে আপনাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন? কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইল ফানযিলাহ্। কী ঠিক করলেন, হে স্বামী?
এখন পর্যন্ত… কিছুই না। আসাদ নির্বিকার।
তা হলে কোথায় যাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করল ফানযিলাহ্।
একটা সঙ্কেতের খোঁজে, সংক্ষেপে বললেন আসাদ। কিছু ব্যাখ্যা করলেন না। স্ত্রী-কে চিন্তায় ফেলে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন কামরা থেকে।
তাড়াতাড়ি মারযাককে ডাকল ফানযিলাহ। নির্দেশ দিল পিতার সঙ্গে যাবার। কী করতে হবে ওকে, তা বুঝিয়ে দিল এক নিঃশ্বাসে। শেষে যোগ করল, তোমার ভাগ্য এখন তোমারই হাতে, মারযাক। দেখো, ওটা যেন মুঠো গলে না পালায়।
আঙিনায় ছুটে গেল শাহজাদা। আসাদ তখন একটা সাদা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসেছেন। সঙ্গে রয়েছে উজির সামানি, বিস্কেন-আল-বোরাক সহ আরও কিছু পদস্থ যোদ্ধা। মারযাকও অনুমতি চাইল যাবার জন্য। দায়সারা ভঙ্গিতে রাজি হলেন বাদশাহ, একটু পরে সবাই বেরিয়ে পড়ল প্রাসাদ থেকে।
পিতার পাশে পাশে যাচ্ছে মারযাক, বাকিদের সামনে রয়েছে ওরা। প্রথমে কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজ করল। তারপর ইতস্তত করে মারযাক বলল, আমার একটা আর্জি আছে, আব্বা। এবারের অভিযান থেকে শাকের-আল-বাহারকে সরিয়ে নিন আপনি।
ভুরু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকালেন আসাদ-আদ-দীন। ও যদি না যায়, তা হলে কাকে পাঠাব?
আমার উপর একটিবার আস্থা রেখে দেখুন, আকুতি ফুটল মারযাকের কণ্ঠে।
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন আসাদ। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসেছে তোমার, মারযাক? জাহাজ নিয়ে সাগরে আত্মহত্যা করতে চাইছ কেন?
আপনি অবিচার করছেন আমার প্রতি! প্রতিবাদ করে উঠল মারযাক।
মোটেই না। আমি বরং দয়া দেখাচ্ছি তোমাকে। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে যেতে মানা করছি।
আর কোনও কথা হলো না তাদের মধ্যে।
.
বন্দরের জেটির পাশে দাঁড়িয়ে আছে শাকের-আল-বাহারের জাহাজ। রওনা হবার জন্য তৈরি। গ্যাঙওয়ে ধরে শেষ মুহূর্তের মালামাল ওঠাচ্ছে কুলিরা, গুটিয়ে নেয়া হচ্ছে বাড়তি দড়িদড়া। আসাদ-আদ-দীন যখন সঙ্গীসাথী নিয়ে ওখানে পৌঁছুলেন, তখন জাহাজে তালপাতার বিশাল এক বস্তা তুলছে চার কাফ্রি কুলি।
পুপ-ডেকে দেখা গেল শাকের-আল-বাহারকে। সঙ্গে রয়েছে ওসমানি, আলি, জ্যাসপার লেই সহ আরও কয়েকজন তাদেরকে নানা রকম নির্দেশনা দিচ্ছে সে। পাটাতনে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে লারোক আর ভিজিটেলো নামে দুই দলত্যাগ কর্সেয়ার–জাতে ফরাসি আর ইটালিয়ান ওরা–মালামাল ওঠানো তদারক করছে প্রথমজন, কোটা কোথায় যাবে বলে দিচ্ছে; দ্বিতীয়জন খেয়াল রাখছে শেকলপরা মাল্লাদের দিকে।
তালপাতার বস্তাটা মূল মাস্তুলের গোড়ায় রাখার নির্দেশ দিচ্ছিল লারোক, কিন্তু শাকের বাধা দিল। বলে দিল ওগুলো জাহাজের পিছনদিকে… পুপ-হাউসে রাখার জন্য।
ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন আসাদ, হাঁটতে শুরু করলেন গ্যাঙওয়ের দিকে। পাশে পাশে চলল মারযাক, শেষবারের মত আর্জি পেশ করল–আর কিছু না হোক, বাদশাহ নিজেই যেন কর্তৃত্ব নেন এই অভিযানের, ওকে কায়িয়া বানান। রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন আসাদ, মুখে কিছু বললেন না। উঠে এলেন জাহাজের পাটাতনে।
পুপ ডেক থেকে তড়িঘড়ি করে নেমে এল শাকের-আল বাহার। সালাম দিয়ে বলল, কী সৌভাগ্য আমার, মহানুভব! আমরা জাহাজ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, আপনি আসায় ভালই হলো। আপনার আশীর্বাদ পেলে আমাদের যাত্রা শুভ হবে।
তীক্ষ্ণচোখে ওকে দেখলেন আসাদ-আদ-দীন। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুজনের মাঝখানে বিশাল এক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। শাকের সম্মান দেখিয়ে কথা বলছে বটে, কিন্তু কোথায় যেন একটু আন্তরিকতার অভাব লক্ষ করছেন তিনি।
আশীর্বাদের চেয়েও বেশি কিছু করবার পরামর্শ পেয়েছি আমি। এই অভিযানে নিজেই নেতৃত্ব দেব। বললেন বাদশাহ্। নিজর সরাননি শাকেলে উপর থেকে। তার কথা শোনামাত্র একটু কেঁপে উঠল ওর চোখের পাতা।
আপনি নেতৃত্ব দেবেন? হালকা গলায় বলল শাকের। কে দিয়েছে এই পরামর্শ? মুচকি হাসি হাসল।
চোখদুটো জ্বলে উঠল বাদশাহ্-র। এক পা সামনে এগোলেন। হাসছ কেন?
মাফ করবেন, তবে হাসার মতই কথা, তাড়াতাড়ি বলল শাকের। পরামর্শটা অদ্ভুত কি না!
মেঘ জমল বাদশাহ্-র চেহারায়। এর মধ্যে অদ্ভুতের কী দেখলে?
কথা গুছিয়ে নিল শাকের। গম্ভীর হয়ে বলল, এমন একটা অভিযানে আপনাকে যাবার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে, যা মোটেই বিশ্বাসীদের সিংহের জন্য উপযুক্ত নয়, মালিক। আপনার নাম শুনেই রক্ত নেচে ওঠে আমাদের, সেই প্রেরণায় ছিনিয়ে আনি জয়… উপস্থিতির কোনও প্রয়োজন পড়ে না। এবারও পড়বে বলে মনে করি না। স্পেনের একটা নিঃসঙ্গ জাহাজের উপর হামলা চালাব আমরাযুদ্ধজাহাজ নয়, মালবাহী জাহাজ! এত্তো সাধারণ অভিযানে মোটেই মানায় না আপনাকে। আপনি তো যাবেন বড় বড় যুদ্ধে নিজের নৌ-বহর নিয়ে স্প্যানিশ আর্মাডার সঙ্গে লড়াইয়ে!
মাপা দৃষ্টিতে ওকে জরিপ করলেন আসাদ। শীতল, গলায় বললেন, গতকালের তুলনায় তুমি দেখছি অনেক বদলে গেছ, বাছা।
বদলে গেছি, মহানুভব?
অবশ্যই! গতকাল তুমি নিজেই আমাকে সাধাসাধি করছিলে অভিযানে যাবার জন্য। মনে করিয়ে দিচ্ছিলে পুরনো দিনের কথা, আমাকে লোভী করে তুলছিলে… অথচ এখন দেখছি। তোমার সুর পাল্টে গেছে। পরিষ্কার অভিযোগ ফুটল তাঁর কণ্ঠে। মত পাল্টেছ কেন?
ইতস্তত করল শাকের, বেকায়দা একটা পরিস্থিতিতে পড়ে গেছে। চোখ বোলাল আশপাশে-বাদশাহ-র কনুই ঘেঁষে দাঁড়ানো মারযাক, পিছনের সামানি-বিস্কেন… সবাই প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। জবাব না দিয়ে পার পাওয়া যাবে না।
গলা খাঁকারি দিয়ে ও বলল, গতকাল যে-সব যুক্তি দেখিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন প্রস্তাবটা, তার মর্ম বুঝেছি আমি, মহানুভব। তা ছাড়া… ভালমত ভেবেচিন্তে দেখলাম, এই অভিযান আপনার জন্য বড় ছোট হয়ে যায়। তাই…।
আবছা একটা হাসি দেখা দিল মারযাকের ঠোঁটে, যেন শাকেরের আপত্তির আসল কারণ ধরতে পেরেছে। না পারলেও অবশ্য ক্ষতি নেই, বাদশাহকে নিরুৎসাহিত করতে গিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মেরে বসেছে গাধাটা। যে সঙ্কেতের খোঁজে এসেছেন আসাদ, তা দিয়ে ফেলেছে। নিজে যেটা করতে সক্ষম হয়নি, সেটা এবার শাকেরই করে দিয়েছে। কারণ ওর বিরূপ মনোভাব দেখে বাদশাহ্ অভিযানে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।
হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, তুমি চাও না আমি এ-অভিযানে যাই, বললেন আসাদ, হাসছেন। যদি তা-ই হয়, ব্যাপারটা দুর্ভাগ্যজনক। কারণ পুত্রের প্রতি দায়িত্বে যথেষ্ট অবহেলা করেছি আমি এতদিন, আজ তার সংশোধন করব বলে ঠিক করেছি। তোমার সঙ্গে আমরা এই অভিযানে যাচ্ছি, শাকের-আল-বাহার… আর আমি নিজেই তুলে নিচ্ছি নেতৃতু-ভার। শিক্ষানবীশ হিসেবে মারযাক আমার সঙ্গে থাকবে।
আর কোনও প্রতিবাদ করল না শাকের, মাথা নুইয়ে মেনে নিল বাদশাহ্-র সিদ্ধান্ত। যখন মুখ খুলল, তাতে মিশে রইল এক ধরনের আনন্দ।
আপনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শুনে খুশি হলাম, মহানুভব। অভিযানের ক্ষুদ্রতা নিয়ে আর কিছু বলব না, আপনাকে। কারণ আপনি সঙ্গে যাওয়ায় আমিই লাভবান হচ্ছি। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্-র!
.
১৫.
সমুদ্রযাত্রা
উজির সামানিকে একপাশে ডেকে নিয়ে গেলেন আসাদ-আদ দীন, পরবর্তী কয়েক মিনিটে জরুরি কিছু নির্দেশ দিলেন–তাঁর অনুপস্থিতিতে কী করতে হবে না হবে, সে-বিষয়ে। কথা শেষ হলে জাহাজ থেকে নেমে গেল উজির, বাদশাহ্ হুকুম দিলেন জাহাজ ছাড়বার।. ..
গ্যাঙওয়ে টেনে নেয়া হলো, খুলে ফেলা হলো শেষ দড়িগুলো। সারেং বাজাল শিঙা। লগি দিয়ে ঠেলে জেটির পাশ থেকে খোলা পানিতে সরিয়ে আনা হলো জাহাজ। শিঙার দ্বিতীয় আওয়াজে একসঙ্গে নামানো হলো সবকটা বৈঠা। চাবুক হাতে নিয়ে ক্রীতদাস মাল্লাদের মাঝে অবস্থান নিল লারোক আর ভিজিটেলো, চেঁচিয়ে হুকুম দিল সবাইকে তৈরি হতে। শিঙার তৃতীয় আওয়াজে একসঙ্গে সামনে ঝুঁকল আড়াইশ দেহ, টান দিল দাঁড়ে। এগোতে শুরু করল শাকের-আল-বাহারের জমকালো জাহাজ, সূচনা ঘটল ওদের রোমাঞ্চকর সমুদ্রযাত্রার। মাস্তুলের ডগায় পত পত করে উড়ছে কর্সেয়ারদের লাল-সবুজ পতাকা। সেদিকে মাথা তুলে শ্লোগান দিয়ে উঠল নাবিকের দল।
ফুরফুরে বাতাস বইছে উপকূলের দিক থেকে, ওটাই লায়োনেলের একমাত্র স্বস্তি। নইলে মাল্লার বেঞ্চির ভয়াবহ পরিবেশ কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। বাকিদের মত শেকল পরানো হয়েছে তাকে, খুলে নেয়া হয়েছে সমস্ত পরিধেয়, কোমরে একটা কৌপিন ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। নিচু ওয়েইস্ট ডেকের উপরে, ডানদিকের প্রথম বেঞ্চিতেই বসানো হয়েছে লায়োনেলকে। অল্প একটু এগিয়েছে জাহাজ, এর মাঝে ওর অদক্ষ ভঙ্গিতে দাঁড় টানা পছন্দ হলো না সারেঙের। পিছনে এসে সজোরে চাবুক চালাল। ফটাস করে প্রচণ্ড শব্দ হলো, কাঁধের পিছনটা কেটে গিয়ে বেরিয়ে এল তাজা রক্ত। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল লায়োনেল, তাড়াতাড়ি সমস্ত শক্তি ঢেলে দিল দাঁড় টানায়। জাহাজ যখন বন্দর-মুখে পৌঁছুল, তখন দরদর করে ঘামছে সে, টনটন করছে শরীরের প্রতিটা পেশি। পরিষ্কার বুঝতে পারল, এ-কাজ তাকে দিয়ে হবে না। শরীরটা মোটেই উপযুক্ত নয়। আরাম-আয়েশে সারাটা জীবন কাটিয়েছে লায়োনেল, কায়িক পরিশ্রম কাকে বলে সেটাই জানা নেই।
আর কিছুক্ষণ দাঁড় টানতে হলে হয়তো অজ্ঞান হয়ে যেত বেচারা, কিন্তু কপাল ভাল-বন্দর-মুখ পেরিয়ে খোলা সাগরে পৌঁছুতেই বেড়ে গেল বাতাসের বেগ। আসাদের নির্দেশে জাহাজ। চালানোর কাজ তদারক করছে শাকের-আল-বাহার, চড়া গলায় নির্দেশ দিল সবকটা পাল খুলে দিতে। একটু পরেই বেলুনের মত ফুলে উঠল ওগুলো। বাতাসের সাহায্য পেয়ে জ্যা-মুক্ত তীরের মত ছুটতে শুরু করল জাহাজ। গতি বেড়ে গেল কয়েক গুণ। দাঁড় তুলে নেবার নির্দেশ দিল শাকের, মাল্লারা এবার বিশ্রাম নিতে পারে। এ-কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল ক্রীতদাসদের মাঝে। নিচু গলায় যে-যার স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানাল জোরালো বায়ুপ্রবাহের জন্য।
জাহাজের বো-টা বেশ চওড়া, লোহায় মোড়ানো ডগা, গুতো মেরে শত্রু-জাহাজের গায়ে ফুটো তৈরি করার জন্য আদর্শ। ওখানকার পাটাতনে সমবেত হয়েছে একদল কর্সেয়ার। এ-মুহূর্তে কোনও কাজ নেই ওদের, তাই অলস ভঙ্গিতে আড্ডা দিচ্ছে, উপভোগ করছে সাগরের মুক্ত বাতাস। ফাঁকে ফাঁকে সেরে নিচ্ছে ব্যক্তিগত কাজকেউ সুঁই-সুতো নিয়ে পোশাক ঠিক করছে, কেউ বা শান দিচ্ছে ছুরি-তলোয়ারে। হেঁড়ে গলায় গান ধরল একজন, তা শুনে হুল্লোড় করে উঠল বাকিরা।
জাহাজের পিছনদিকে রয়েছে বিশাল এক কেবিন। ওটায় ঢোকার জন্য রয়েছে দুটো দরজা। লাল রঙের পর্দা ঝুলছে দরজায়, মাঝখানে কাস্তের মত বাঁকা সবুজ চাঁদ-কর্সেয়ারদের প্রতীক। কেবিনের ছাদে রয়েছে বড় বড় তিনটে গোল লণ্ঠন, সোনালি কারুকাজ-মণ্ডিত ফ্রেমে শোভা পাচ্ছে ওগুলো। কেবিনের সামনে, পুপু-ডেকের প্রায় অর্ধেকটা দখল করে রেখেছে একটা সবুজ শামিয়ানা। ওটার তলায় পাতা হয়েছে তক্তপোেশ, মারযাক-সহ ওখানে বসেছেন আসাদ-আদ-দীন। বিস্কেন-আল-বোরাক এবং বাদশাহ-র অন্যান্য সহযাত্রীরা দাঁড়িয়ে আছে পুপ-ডেকের সামনের দিকে, নজর রাখছে নীচের মাল্লাদের উপর।
রূপালী কোর্তা-পাজামা আর পাগড়ি পরা শাকের-আল বাহার নিঃসঙ্গভাবে দাঁড়িয়ে আছে বামদিকের বুলওঅর্ক ধরে। দূরে আবছা হয়ে আসা আলজিয়ার্সের তটরেখার দিকে তাকিয়ে আছে উদাস দৃষ্টিতে।
কয়েক মিনিট ওকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করলেন আসাদ-আদ-দীন, তারপর ডেকে পাঠালেন। তাড়াতাড়ি তাঁর শামিয়ানার নীচে হাজির হলো শাকের, শ্রদ্ধাবনত ভঙ্গিতে দাঁড়াল বাদশাহ্-র সামনে। কথা বলার আগে ওর মুখভঙ্গি নিরীখ করলেন আসাদ, মারযাকের চেহারায় তখন মিটিমিটি হাসি খেলা করছে।
তোমাকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে দেয়া দরকার, শাকের, একটু পর বললেন বাদশাহ্। ভেবো না কাল রাতের ঘটনার কারণে আজ আমি হাজির হয়েছি এখানে। তোমাকে তো বলেছি, ছেলের প্রতি একটা দায়িত্ব আছে আমার… এতদিন তা অবহেলা করেছি, কিন্তু আর তা করা সম্ভব নয়। সেটাই এই অভিযানে যাবার পিছনে মূল কারণ। কণ্ঠ শুনে মনে হলো অজুহাত দেবার চেষ্টা করছেন।
পিতার কথা, বা বলার ভঙ্গি… কোনোটাই পছন্দ হলো না মারকের। ব্যাপার কী, তাঁর মত প্রতাপশালী একজন মানুষ কেন নমনীয়তা দেখাচ্ছেন অবাধ্য এই যুবকের প্রতি?
মাথা ঝোঁকাল শাকের। মহানুভব, আপনার সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করবার অধিকার নেই আমার। কীসের পরিপ্রেক্ষিতে কোন্ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সেটাও জানার দরকার নেই। জানা দরকার শুধু আপনার ইচ্ছে, ওটাই আমার জন্য হুকুম।
সত্যি? তিক্ত গলায় বললেন আসাদ। কাজে-কর্মে তো অন্য ধারণার জন্ম দিচ্ছ আমার মনে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অস্বীকার করব না, গতকাল রাতে তুমি যা করেছ, তাতে অসন্তুষ্ট হয়েছি আমি। তারপরেও আল্লাহর বিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে আমাকে, তোমার স্ত্রী-র চিন্তা মুছে ফেলতে হবে হৃদয় থেকে। তা আমি করেছিও। তুমিও সব ভুলে যাও। এই দেখো না, আবার আমরা একসঙ্গে পাড়ি জমিয়েছি স্প্যানিয়ার্ডদের উপর মরণ-আঘাত হানার জন্য! আমাদের মধ্যকার বিভেদ, যেন আল্লাহ্-র কাজে বাধা সৃষ্টি না করে।
আমিন, মহানুভব! গাঢ় স্বরে বলল শাকের। আমার ভয় হচ্ছিল…
আর না! ওকে বাধা দিলেন বাদশাহ্। কোনও ভয় নেই তোমার। সবসময় তোমাকে নির্ভীক দেখেছি আমি, আর সেজন্যেই তোমাকে নিজের সন্তানের মত ভালবেসেছি।
চেহারা বিকৃত হয়ে উঠল মারযাকের। এত সহজে শাকেরের সঙ্গে ওর পিতার সংঘাতকে মিটে যেতে দেবে না সে। নতুন করে বিষ ছড়ানোর চেষ্টা করল, শাকের বাদশাহকে কৃতজ্ঞতা জানাবার আগেই কথা বলে উঠল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে।
আচ্ছা শাকের, তোমার বউয়ের খবর কী? বাঁকা সুরে বলল মারযাক। স্বামীর বিরহ কীভাবে সামাল দেবে ও?।
দুঃখিত, শাহজাদা, শান্ত গলায় বলল শাকের, মেয়েদের ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা খুব সামান্য। ও কী করবে না করবে, তা বলতে পারছি না।
নাহ্, বেকায়দা কিছু বলানো গেল না। তাই বলে হাল ছাড়ল না মারযাক। গলায় কপট সহানুভূতি ফুটিয়ে বলল, তোমার জন্য বড় খারাপ লাগছে, ভাই। বউয়ের নরম বাহুর বন্ধন ছেড়ে এত তাড়াতাড়ি চলে আসতে হলো! ভাল কথা, ওকে কোথায় রেখে এসেছ?।
মুসলমানের বউকে কোথায় রাখতে বলেছেন রাসূল? একটু রূঢ় হলো শাকেরের গলা। বাড়িতে!
মুখ বাঁকাল মারযাক। এত সহজে বউকে ছেড়ে চলে এলে… ভাবতে অবাক লাগছে আমার।
ছেলের বক্রোক্তি কান এড়াল না বাদশাহ-র। এসব কী বলছ? খাঁটি মুসলমানের জন্য আল্লাহ্-র সেবার চাইতে বড় কিছু কি আর আছে? কীসের বউ, কীসের সংসার? আগে ধর্ম, তারপর বাকি সব।
বাহ্যিক রূপ দেখে বিভ্রান্ত হবেন না, আব্বা, সতর্ক করে দিল মারয়াক। ভিতরটাই আসল।
চুপ! গর্জে উঠলেন আসাদ। জিভের লাগাম টানো, মারযাক। বাজে কথা বন্ধ করে আল্লাহ্-কে ডাকো। তোমার প্রথম অভিযান যেন সফল করেন তিনি। আমরা যেন জয়ী হয়ে ঘরে ফিরতে পারি।
আমিন! উদাত্ত গলায় বলল শাকের। কিন্তু মনের ভিতরটা খুঁত খুঁত করছে ওর। কেন ওসব বলল মারযাক? বাদশাহ্-র মনে রোজামুণ্ডের স্মৃতি জাগিয়ে রাখবার জন্যে, নাকি সত্যিই কিছু আঁচ করেছে মেয়েটার ব্যাপারে?
কয়েক ঘণ্টা পর ওর আতঙ্ক আরেকটু বাড়ল। তখন দুপুর, রেলিঙে ভর দিয়ে ক্রীতদাসদের মাঝে খাবার বিতরণ তদারক করছে শাকের, এমন সময় ওর পাশে এসে দাঁড়াল মারযাক।
কিছুক্ষণ নীরবে নীচের দিকে তাকিয়ে রইল শাহজাদা। ওখানে এক বেঞ্চি থেকে আরেক বেঞ্চিতে বিস্কুট আর শুকনো খেজুর বিতরণ করছে লারোক আর ভিজিটেলো। প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগাবে এ-খাবার, তবে পেট ভরবে না। সেটাই ভাল, কারণ ভরপেটে ঠিকমত দাঁড় টানতে পারে না মাল্লারা। তৃষ্ণা মেটানোর জন্য দেয়া হচ্ছে ভিনেগার মেশানো পানি, সঙ্গে এক ফোঁটা তেল।
হঠাৎ আঙুল তুলল মারযাক, নির্দেশ করল তালপাতার বিশাল বস্তাটার দিকে। মূল মাস্তুলের তলায় পাউডার ব্যারেলের পাশে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে ওটা।
বস্তাটা ওখানে বেমানান ঠেকছে, বলল সে। লড়াই শুরু হলে পাউডার ব্যারেল সরাবার পথে বাধা সৃষ্টি করবে। হোন্ডে ঢুকিয়ে রাখছ না কেন?
বুক ঢিব ঢিব করে উঠল শাকেরের। বস্তাটা প্রথমে পুপ-কেবিনে ঢুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল, পরে বাদশাহ কেবিনটা দখল করায় ওটা আবার মাস্তুলের গোড়ায় আনিয়েছে ও। মারযাক ওকে সে-আদেশ দিতে শুনেছে। কিছু কি সন্দেহ করেছে ছোকরা? আন্দাজ করেছে, বস্তার ভিতরে আসলে কী আছে? উদ্বেগ চাপা দিয়ে পাশ ফিরল ও, মুখে অবহেলার হাসি।
আমার ধারণা ছিল, তুমি আমাদের সঙ্গে শিক্ষানবীশ হিসেবে যাচ্ছ, শাহজাদা।
তো? ভুরু নাচাল মারযাক।
আমি বলতে চাইছি যে, এখুনি আমাকে পরামর্শ দেয়া। মানায় না তোমাকে। কোথায় কী রাখতে হবে, আর কখন কী করতে হবে, তা তোমার চেয়ে আমি ভাল বুঝি। চুপচাপ এখানকার কাজ দেখলেই অনেক কিছু শিখতে পারবে তুমি। তখন নাহয় ইচ্ছেমত আদেশ-নির্দেশ দিয়ো। প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য সামনের দিকে ইশারা করল ও। মেঘের ছায়ায় ঢাকা উপকূল ভেসে উঠেছে ওখানে। ওই যে, বালেয়ারিক দেখা যাচ্ছে। বেশ দ্রুত এগোচ্ছি আমরা।
শেষ বাক্যটা না বললেও চলত। এ-কথা সবার জানা যে, ভূমধ্যসাগরের এই এলাকায় শাকের-আল-বাহারের জাহাজ সবচেয়ে দ্রুতগামী। আড়াইশ মাল্লা দাঁড় টানুক, বা বাতাসের সাহায্যে এগোক, ওটার সঙ্গে কেউ পেরে উঠবে না। তার প্রমাণ দেবার জন্যই যেন প্রাণপণে ছুটছে জাহাজটা। উঁচু উঁচু ঢেউকে বিচ্ছিন্ন করছে অবহেলায়, মাঝে মাঝে ঝাঁপ দিচ্ছে শিকারী বাঘের মত, রোদে চকচক করছে ভেজা শরীর… সে এক দর্শনীয় দৃশ্য।
বাতাস যদি এভাবে বইতে থাকে, বলল শাকের, তা হলে সন্ধ্যার আগেই আগুইলা পয়েন্টে পৌঁছে যাব আমরা।
জাহাজ বিষয়ক আলোচনায় আগ্রহী দেখাল না মারযাককে। ওর দৃষ্টি সেঁটে আছে মাস্তুলের গোড়ায় পড়ে থাকা বস্তার উপরে। কিছুক্ষণ মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর উল্টো ঘুরে ফিরে গেল শামিয়ানার তলায়। তক্তপোশে বসে আসাদ-আদ-দীন তখন আপন চিন্তায় হারিয়ে গেছেন। মনে মনে নিজেকে অভিসম্পাত দিচ্ছেন ফানযিলাহ্-র কথায় কর্ণপাত করে এই অভিযানে আসার জন্য। শাকের-আল-বাহারকে অবিশ্বাস করবার কোনও কারণ দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। মারযাক তার কানে মন্দ কথা বলতে গিয়ে ধমক খেলো। মুখ লাল হয়ে গেল শাহজাদার।
তোমার মুখে শুধু নিজের শয়তানিই প্রকাশ পাচ্ছে, মারযাক, রাগী গলায় বললেন আসাদ। মা-ছেলের কুকথায় কান দিয়ে বোকা বনেছি আমি। খবরদার, আর কিছু বলতে আসবে না তুমি আমাকে।
দমে গেল মারযাক। অস্ফুট ক্রোধ নিয়ে শাকেরের দিকে তাকাল সে। পুপ ডেক থেকে নেমে গেছে দুর্ধর্ষ কর্সেয়ার, হাঁটছে মাল্লাদের বেঞ্চির সারির মাঝ দিয়ে।
অস্বস্তিতে ভুগছে শাকের-আল-বাহার। মনে হচ্ছে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ওর সঙ্গে। যদিও সেটা অসম্ভব। পুরো জাহাজে মাত্র তিনজন ব্যক্তি জানে বস্তার রহস্য-আলি, ভিজিটেলো আর জ্যাসপার লেই। প্রথম দুজনের আনুগত্য প্রশ্নাতীত, মরে গেলেও মুখ খুলবে না ওরা। জ্যাসপার লেইয়েরও স্বার্থ জড়িত আছে শাকেরকে সাহায্য করায়। কাজেই ওকেও সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে হয়। তা হলে কে? ভুল করছে ও? কিন্তু বস্তার ব্যাপারে মারযাকের আগ্রহ তো ভিন্ন ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ভিজিটেলোকে ডাকল শাকের, তিনজনের ভিতরে ও-ই সবচেয়ে বিশ্বস্ত। জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, কেউ কি বাদশাহ্-র কাছে আমার গোমর ফাঁস করে দিতে পারে?
একটু বিস্ময় ফুটল ইটালিয়ান সারেঙের চেহারায়, পরমুহূর্তে আত্মবিশ্বাসের হাসি ফুটল। আমাদের গোপন মালামালের ব্যাপারে বলছেন? ইশারা করল তালপাতার বস্তার দিকে। অসম্ভব! আসাদ যদি আসল ঘটনা জানতেন, আলজিয়ার্সেই একটা কিছু ঘটে যেত। অন্তত আরও কিছু দেহরক্ষী না নিয়ে কিছুতেই জাহাজে চড়তেন না উনি।
দেহরক্ষীর দরকার কী? কাঁধ ঝাঁকাল শাকের। ঝামেলা বাধলে আমাদের কর্সেয়াররা কার পক্ষ নেবে, সেটা তো জানা কথা।
এতটা হতাশ হবেন না, আশ্বাসের সুরে বলল ভিজিটেলো। এদের বেশিরভাগই আপনার সঙ্গে অসংখ্য লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে, জয়ী হয়ে ফিরেছে। ওদের চোখে আপনিই আসল বাদশাহ।
হয়তো। কিন্তু ওদের সত্যিকার আনুগত্য আসাদ-আদ দীনের প্রতি, কারণ উনিই আল্লাহ্-র প্রতিনিধি। আমাদের দুজনের মধ্যে কাউকে বেছে নিতে হলে ধর্মবিশ্বাসের খাতিরে বাদশাহ্-র পক্ষ নিতে বাধ্য হবে ওরা। অতীতে আমার সঙ্গে কী বন্ধন ছিল, তা মনে রাখবে না।
তারপরেও গুঞ্জন শুনেছি আমি–আপনার কাছ থেকে নেতৃত্ব কেড়ে নেয়াকে পছন্দ করছে না কেউ, বলল ভিজিটেলো। স্বীকার করছি, ধর্মবিশ্বাসের কারণে প্রভাবিত হবে অনেকে; তাই বলে আপনার পাশে কাউকে পাওয়া যাবে না, তা হতে পারে না। তা ছাড়া ভুলে যাবেন না… গলার স্বর খাদে নামিয়ে আনল সে, আপনার-আমার মত বহু দলত্যাগী আছে কর্সেয়ারদের ভিতর। বাদশাহ্-র চাইতে বহুগুণ বেশি টান রয়েছে ওদের আপনার প্রতি। তবে আশা করছি, সুর বদলাল আবার, সে-ধরনের কোনও পরিস্থিতি দেখা দেবে না।
আমিও তা-ই চাই, বলল শাকের। কিন্তু কেন যেন মন মানছে না। তাই জানা দরকার, বিপদ দেখা দিলে কী মোকাবেলা করতে হবে আমাকে। যাও তুমি, লোকজনের সঙ্গে কথা বলে দেখো, কার মনোভাব কেমন। বোঝার চেষ্টা করো, ঝামেলা শুরু হলে কোন্ পক্ষে কতজনকে পাওয়া যাবে। সাবধানে থেকো, কেউ যেন কিছু সন্দেহ করতে না পারে।
চোখ টিপল ভিজিটেলো। কিছু ভাববেন না, বলল সে। খুব শীঘ্রি খবর নিয়ে আসব আমি।
চলে গেল ইটালিয়ান সারেং। যোগ দিল কর্সেয়ারদের আড্ডায়। পুপ ডেকের দিকে ফিরতি পথ ধরল শাকের। ক্ষণিকের জন্য থামল মাল্লাদের একটা বেঞ্চির সামনে। সাদা চামড়ার একজন ক্রীতদাসকে দেখা যাচ্ছে হতশ্রী অবস্থায়। লায়োনেল। চাবুকের আঘাতে চামড়া কেটে গিয়েছিল, রক্ত শুকিয়ে আছে ওখানে। নিষ্ঠুর একটা হাসি ফুটল শাকেরের ঠোঁটে। প্রতিশোধের আনন্দ উপভোগ করছে।
বাহ্! ইংরেজিতে বলে উঠল ও। এরই মধ্যে চাবুকের স্বাদ পেয়ে গেছ দেখছি! অবশ্য… সামনে যা আসছে, তার তুলনায় এটা কিছুই নয়। কপাল ভাল তোমার, আজ বাতাস বইছে। সবসময় এমনটা ঘটে না। খুব শীঘ্রি টের পাবে, তোমার কারণে কী সইতে হয়েছে আমাকে।
রক্তলাল চোখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকাল লায়োনেল। গাল। দিতে চাইল, কিন্তু নিজেকে সংযত করল শাস্তির কথা ভেবে। দুর্বল গলায় শুধু বলল, নিজের জন্য পরোয়া করি না আমি?
করবে, প্রিয় ভাই আমার, পিত্তি জ্বালানো সুরে বলল শাকের। চরম কষ্ট নিয়ে নিজের জন্য পরোয়া করতে শুরু করবে তুমি, করুণা অনুভব করবে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি! সম্ভাবনা আছে যে, বাঁচবে না তুমি… খুব বেশিদিন কষ্ট ভোগ করবে না। ওটাই আমার একমাত্র দুঃখ। শরীর-স্বাস্থ্য একটু ভাল হলে এই ভাসমান নরকে তোমাকে ভালমত সেদ্ধ করা যেত।
বললাম তো, নিজেকে নিয়ে পরোয়া করি না, খ্যাপাটে শোনাল লায়োনেলের গলা। রোজামুণ্ডকে নিয়ে তুমি কী করেছ?
খুব কি অবাক হবে, যদি বলি ভদ্রলোকের আচরণ করেছি আমি… ওকে বিয়ে করেছি?
বিয়ে! খাবি খেলো লায়োনেল। নরকের কীট কোথাকার, তুমি বিয়ে করেছ ওকে?
খামোকা গালি দিচ্ছ কেন? এরচেয়ে খারাপ কিছুও আমি করতে পারতাম ওর সঙ্গে। সেটা ভেবে সান্ত্বনা দাও নিজেকে।
হাসতে হাসতে ওখান থেকে সরে এল শাকের, লায়োনেলের বুকে তোলপাড় জাগিয়ে দিয়ে।
এক ঘণ্টা পর দিগন্তের কাছে পরিষ্কার হয়ে এল বালেয়ারিক দ্বীপমালার ধোঁয়াটে উপকূল। ওয়েইস্ট ডেকে আবার মিলিত হলো শাকের আর ভিজিটেলো।
বলো কী জানতে পেরেছ। ঠিকমত হিসাব দেয়া মুশকিল, শাকেরকে জানাল ইটালিয়ান সারেং। তবে যদ্র বুঝেছি, দুই পক্ষই সমানে সমান। লড়াই বাধলে কে জিতবে বলা যায় না। সেধে ঝামেলায় জড়াবার পরামর্শ দেব না আপনাকে।
অমন কোনও ইচ্ছে আমারও নেই। নিতান্ত বাধ্য করা না হলে কিছুতেই বাদশাহ-র বিরুদ্ধে যাব না আমি। শুধু জানতে চেয়েছিলাম কাউকে আমার পক্ষে পাওয়া যাবে কি না। এই আর কী। ঠিক আছে, কাজে যাও তুমি।
মন শান্ত হলো না শাকেরের। সমস্যা মেটেনি ওর। ফ্রান্স বা ইটালিতে রোজামুণ্ডকে নামিয়ে দেবে বলে কথা দিয়েছে, যদি ব্যর্থ হয়-মেয়েটা নিঃসন্দেহে ওকে প্রতারক ভাববে। মনে করবে তেমন কোনও ইচ্ছে ওর ছিল না। কিন্তু কীভাবেই বা প্রতিজ্ঞা পূরণ করবে ও? জাহাজে আসাদ-আদ-দীনের উপস্থিতি সব এলোমেলো করে দিয়েছে। যেভাবে লুকিয়ে রোজামুণ্ডকে জাহাজে তুলেছে, মনে হচ্ছে সেভাবেই আবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে আলজিয়ার্সে। অপেক্ষা করতে হবে আরেকটা সুযোগের। কিন্তু সেটাও ঝুঁকিমুক্ত নয়। কদিন লাগে ফিরতে, কে জানে। এর মধ্যে রোজামুণ্ডের উপস্থিতি ফাঁস হয়ে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। যা করবার, তা করতে হবে এ-যাত্রাতেই। কিন্তু মাথা কাজ করছে না শাকেরের। ভেবেই পাচ্ছে না কীভাবে কী করবে। উপায় এখন একটাই-অপেক্ষা করতে হবে ওকে। ভাগ্য সহায় হলে একটা সুযোগ মিলেও যেতে পারে।
দুশ্চিন্তা নিয়ে জাহাজময় পায়চারি করে বেড়াল শাকের। দুহাত পিছনে বাঁধা, পাগড়ি-পরা মাথা বুকে ঠেকে থাকা অবস্থায়। মন ভারী হয়ে রইল। বুঝতে পারছে, নিজের জালে নিজেই আটকা পড়ে গেছে। এখন জীবন নিয়ে টানাটানি! কিন্তু ওসবের পরোয়া করছে না। ওর জীবন তো এমনিতেই তছনছ হয়ে গেছে, ওটার আর মূল্য কী? তারচেয়ে মরে গিয়ে যদি রোজামুণ্ডের প্রতি করা অবিচারের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারে, খুশিমনেই জীবন দেবে ও। সমস্যা হলো, আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকার পরেও সমস্যার কোনও হাল দেখতে পাচ্ছে না।
তাই অবিরাম পায়চারি করে চলল শাকের-আল-বাহার। মনে মনে প্রার্থনা করল অলৌকিক কিছু ঘটবার জন্য।