দ্য সি-হক / রাফায়েল সাবাতিনি / রূপান্তর: ইসমাইল আরমান
প্রথম পর্ব –সার অলিভার ট্রেসিলিয়ান
০১.
ক্রুদ্ধ যুবক
প্রাসাদোপম পৈত্রিক নিবাস-পেনারো হাউস-এর বৃহদায়তন ডাইনিং হলে বসে আছে সার অলিভার ট্রেসিলিয়ান। কর্নওয়ালের এক নির্জন এলাকায় এই বাড়ি, নির্মিত হয়েছে ব্যাগনোলো নামে এক ইতালীয় নির্মাতার হাতে; প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে বিখ্যাত ইমারতশিল্পী টরিগিয়ানি-র সঙ্গে ইংল্যাণ্ডে এসেছিল সে। অনবদ্য নির্মাণশৈলী এবং তার পিছনের কাহিনির কারণে পেনারো হাউসের কথা লোকের মুখে মুখে ফেরে।
শিল্পী হিসেবে প্রতিভাবান হলেও ব্যাগনোলো ছিল রগচটা স্বভাবের মানুষ। সাউথওয়ার্কের এক মদ্যশালায় কথা কাটাকাটি থেকে খুন করে বসে এক লোককে। আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্য এরপর পালিয়ে বেড়াতে শুরু করে সে। কোন্ পরিস্থিতিতে বা কীভাবে অলিভারের পিতা সার র্যাল ট্রেসিলিয়ানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল, তা জানা নেই কারও। তবে এটুকু জানা গেছে, ব্যাগনোলোকে আশ্রয় দেন তিনি, ইতালীয় শিল্পীও সে-উপকারের প্রতিদান দেয় ভগ্নপ্রায় পেনারো হাউসকে নতুন করে নির্মাণ করবার মাধ্যমে। তাই ভাঙাচোরা কাঠের কাঠামো সরে গিয়ে সেখানে মাথা তুলেছে লাল ইটের এক অপূর্ব দালান। জানালাগুলো রঙিন কাঁচে মোড়া, মেঝে থেকে প্রায় ছাত পর্যন্ত লম্বা, সে-কারণে ঘরের ভিতরে অবাধে ঢুকতে পারে আলো-বাতাস। মূল প্রবেশপথে রয়েছে চমৎকার দুটো খিলান, তার উপরে ভর দিয়ে ঝুলছে বিশাল এক খোলামেলা ব্যালকনি, রেলিঙগুলো সবুজ লতায় ছাওয়া। লাল টালিতে ঢাকা ছাতের উপর রাজকীয় ভঙ্গিতে উঁচু হয়ে আছে দুটো পেঁচানো চিমনি। সবমিলিয়ে ব্যাগনোলোর এই সৃষ্টি হয়ে উঠেছে অসাধারণ এক আভিজাত্যের প্রতীক।
তবে এ-সব ছাড়াও পেনারো হাউসের আরেক গর্ব হলো বাড়ির চারপাশে গড়ে তোলা চমৎকার এক বাগান। এককালের ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করে এখন সেখানে লাগানো হয়েছে হরেক রকমের ফুলগাছ, তৈরি করা হয়েছে ভাস্কর্য-মণ্ডিত অনেকগুলো পানির ফোয়ারা। কালের প্রবাহে ইমারতের জৌলুস কমেছে, কিন্তু কমেনি এই বাগানের সৌন্দর্য। বরং দিনে দিনে আরও সমৃদ্ধ… আরও রূপসী হয়ে উঠেছে পেনারো পয়েন্টের উপরের এই সুসজ্জিত উদ্যান।
ডাইনিং হলের জানালা দিয়ে পেনারো হাউসের এই বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে অলিভার। মন উৎফুল্ল। জীবনকে বড় সুখের মনে হচ্ছে। তার পিছনে যৌক্তিক কারণও আছে। যৌবন চলছে ওর, মানবজীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। সুদর্শন, সুঠাম শরীর, রোগব্যাধি বলে কিছু নেই। সম্মান ও খ্যাতিও অর্জন করেছেস্প্যানিশ আর্মাডার বিরুদ্ধে লড়াই করে। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তাই নাইট উপাধিতে ভূষিত করেছেন ওকে ব্রিটেনের রানি। প্রেমও এসেছে জীবনে-রোজামুণ্ড নামে অপরূপা এক তরুণীর বেশে।
মধ্যাহ্নভোজের পরে বসে বসে এসব নিয়েই ভাবছে অলিভার। আয়েশ করে টানছে পাইপ। বুদ্ধিমান মানুষ ও, শিক্ষিতও বটে; কিন্তু একটা কথা জানা নেই ওর–সুখের অপর পিঠে লুকিয়ে থাকে দুঃখ। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে সৌভাগ্য যে-কোনও মুহূর্তে বদলে যেতে পারে দুর্ভাগ্যে। এবং সেটার সূচনা হতে চলেছে খুব শীঘ্রি।
পায়ের শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল অলিভার, ওর ভূত নিকোলাস হাজির হয়েছে ডাইনিং হলে। জানাল, মাস্টার পিটার গডলফিন ওর দর্শনপ্রার্থী। মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল অলিভার। একটু পরেই কামরায় উদয় হলো অতিথি-হাতে একটা ছড়ি, আর মাথায় চওড়া স্প্যানিশ হ্যাট পরে। লম্বা, একহারা যুবক এই পিটার, চেহারায় আভিজাত্য, বয়সে অলিভারের চেয়ে দু-তিন বছরের ছোট। মাথাভর্তি পিঙ্গল বর্ণের চুল। দামি পোশাক পরেছে, তবে সেটা রুচিসম্মত বলা যাবেনা।
উঠে দাঁড়িয়ে মাথা ঝোকাল অলিভার, অভ্যর্থনা জানাল অতিথিকে।
পাইপের ধোঁয়া নাকে যাওয়ায় মুখ কুঁচকে ফেলল পিটার। বলল, আপনিও দেখছি বিশ্রী অভ্যেসটা রপ্ত করেছেন।
এরচেয়েও বাজে অভ্যেস থাকে মানুষের, হালকা গলায় বলল অলিভার।
তাতে কোনও সন্দেহ নেই, রুক্ষ গলায় বলল পিটার। বোঝা গেল, ঠাট্টা-মশকরা পছন্দ করছে না।
হুম, কাঁধ ঝাঁকাল অলিভার। কিছু মনে কোরো না, আমার এই ছোট্ট খুঁত তোমাকে মেনে নিতে হবে। নিকোলাস, একটা চেয়ার দাও মাস্টার গডলফিনকে। একটা কাপও নিয়ে এসো। পিটারের দিকে ফিরল। পেনারো হাউসে স্বাগতম!
বিতৃষ্ণা ফুটল পিটারের ফর্সা চেহারায়। বলল, সম্মান দেখানোয় ধন্যবাদ, কিন্তু আমি তা দেখাতে পারছি না বলে দুঃখিত।
অস্থির হবার কিছু নেই, হাসল অলিভার, যখন সময় হবে, তখন নাহয় দেখিয়ো।
কখন সেটা?
আমি যখন তোমার বাড়িতে যাব।
ওই ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছি।
বসো না! নিকোলাসের বাড়িয়ে দেয়া চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করল অলিভার। ভৃত্যকেও ইশারা দিল চলে যাবার জন্য।
বসল না পিটার। শুনলাম, গতকাল আপনি গডলফিন কোর্টে গিয়েছিলেন, কাঠখোট্টা গলায় বলল সে। একটু বিরতি নিল অলিভার অস্বীকার করে কি না, তা দেখতে। তেমন কিছু না ঘটায় যোগ করল, আমি জানাতে এসেছি, ভবিষ্যতে আমাদের বাড়িতে আপনাকে আর দেখা না গেলে খুব খুশি হব।
মেঘ জমল অলিভারের চেহারায়। গম্ভীর গলায় বলল, বোধহয় না বুঝে কথাটা বলে ফেলেছ, পিটার। রোজামুণ্ড কি তোমাকে জানায়নি, গতকাল ও আমার বিয়ের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে?
হাহ! রোজামুণ্ড একটা বাচ্চা মেয়ে, এখনও ভালমন্দ বোঝার বয়স হয়নি ওর।
তারমানে ভুল করেছে ও? এমনটা ভাবার পিছনে কোনও কারণ আছে?
এবার চেয়ারে বসল পিটার। হ্যাট খুলল মাথা থেকে, নামিয়ে রাখল কোলের উপর। হেলান দিয়ে বলল, কমপক্ষে এক ডজন কারণ দেখাতে পারব। তবে ওসব শোনাবার প্রয়োজন দেখছি।আপাতত এটুকুই মনে করিয়ে দেয়া যথেষ্ট যে, রোজামুণ্ডের বয়স এখন সতেরো… এবং এ-মুহূর্তে আমি আর সার জন কিলিগ্রু ওর অভিভাবক। আমাদের কারুরই এই বিয়েতে মত নেই।
হেসে উঠল অলিভার। কে চাইছে তোমাদের মতামত? বছরখানেক পরেই আইন অনুসারে সাবালিকা হয়ে যাবে ও, তখন আর অভিভাবকের প্রয়োজন পড়বে না। আমারও কোনও তাড়া নেই, বিয়েটা নাহয় এক বছর পরেই হবে। আমি ধৈর্য ধরতে জানি।
ধৈর্য ধরে কোনও লাভ হবে না, সার অলিভার। আমি আর সার জন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি–কিছুতেই আপনার হাতে তুলে দেব না রোজামুণ্ডকে।
তাই বুঝি? বিদ্রূপ প্রকাশ পেল অলিভারের কণ্ঠে।
এ-কথা শোনাবার জন্য তোমাকে পাঠিয়েছে সার জন? নিজে আসতে পারেনি?
দরকার হলে আসবেন তিনি।
চেহারা কঠোর হলো অলিভারের। তোমাদের সিদ্ধান্ত তো শুনলাম, এবার আমার সিদ্ধান্ত শোনো। সার জন যদি ভুলেও পা রাখে পেনারো-তে, নিজ হাতে আমি তার কল্লা কেটে নেব…যে-কাজ বহু আগে কোনও জল্লাদের করা উচিত ছিল।
আমার ব্যাপারেও কিছু করবেন নাকি? থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করল পিটার।
তুমি? তাচ্ছিল্য প্রকাশ পেল অলিভারের ঠোঁটে। ছোট শিকারে আগ্রহ নেই আমার। তা ছাড়া তুমি রোজামুণ্ডের ভাই… আমার সম্বন্ধি হতে চলেছ। তোমার ক্ষতি করে আমি রোজামুণ্ডের মনে দুঃখ দিতে চাই না। একটু থামল ও। যখন আবার মুখ খুলল, কণ্ঠে পরিবর্তন এসেছে। মাথা ঠাণ্ডা করো, পিটার। সত্যিকরে বলো, সমস্যাটা কী? হ্যাঁ, আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে পুরনো শত্রুতা আছে… কিন্তু তা কি আমরা ভুলে যেতে পারিনা? সার জনের কথা বাদ দাও, একরোখা আর বদমেজাজী স্বভাবের লোক সে-হিংসা-বিদ্বেষ জিইয়ে রাখতে চায়। কিন্তু তুমি তো একজন ভাই! বোনের সুখের জন্য সামান্য ত্যাগ স্বীকার করতে পারবে না? এসো, সবকিছু ভুলে গিয়ে আমরা বন্ধু হয়ে যাই।
বন্ধুত্ব? ফুঁসে উঠল পিটার। কী ধরনের বন্ধু হতে পারি আমরা, তার উদাহরণ রেখে গেছেন আমাদের বাবা-রা।
ওঁরা যা-ই করে থাকেন, তাতে আমাদের কী? প্রতিবেশী হবার পরেও সদ্ভাব ছিল না তাঁদের মধ্যে–এ তো লজ্জার কথা! আমরা কেন সে-উদাহরণ অনুসরণ করব?
আমার বাবার উপর তার দায় চাপানোর চেষ্টা করলে ভুল করবেন! সতর্ক করে দিল পিটার।
কারও একার উপর দায় চাপাচ্ছি না, শান্ত গলায় বলল অলিভার।
ওঁদের দুজনকেই ধিক্কার দিচ্ছি।
কী! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল পিটার। আপনি আমার মরা বাবাকে গালি দিচ্ছেন?
গালি বলো, বা প্রশংসা… সেটার দাবিদার দুজনেই। কপাল খারাপ, কবর থেকে কেউ ফিরতে পারে না। তা হলে হয়তোওঁরাও স্বীকার করতেন নিজেদের ভুল।
গালাগালগুলো নিজের বাবার ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ রাখুন, সার অলিভার! তার মত মানুষের সঙ্গে শান্তি বজায় রেখে বসবাস করা কোনও ভদ্রলোকের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
এবার বোধহয় তোমার সংযত হওয়া দরকার, পিটার, গম্ভীর হয়ে গেল অলিভার।
কীসের সংযত? সবাই জানে, র্যালফ ট্রেসিলিয়ান ছিল একটা ইতর, ছোটলোক। পুরো এলাকার কলঙ্ক! আর সে-কলঙ্কের ধারক-বাহক এখন আপনি, সার অলিভার! এমন জঘন্য পরিবারে আমার বোনের সম্বন্ধ আমি কোনোদিনই হতে দেব না।
একই অভিযোগ আমিও করতে পারি, বলল অলিভার। কলঙ্ক তোমাদের পরিবারেও কম নেই। কিন্তু ভালবাসার খাতিরে সে-সব আমি অগ্রাহ্য করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যা-খুশি করো, পিটার। কিন্তু রোজামুণ্ড আমারই হতে যাচ্ছে।
ঝট করে উঠে দাঁড়াল পিটার। পায়ের ধাক্কায় পড়ে গেল তার চেয়ার। হাতের ছড়ি তুলে অলিভারকে আঘাত করবার চেষ্টা করল।
খপ করে ছড়িটা ধরে ফেলল অলিভার। শান্ত রইল। বলল, বড় উত্তেজিত হয়ে পড়েছ তুমি, পিটার। মাথা ঠাণ্ডা করো। খামোকাই এমন করছ। পুরনো ঝগড়ার জের টেনে কী লাভ হবে, বলো? ওই ঝগড়া ছিল আমাদের বাবাদের মধ্যে, আমাদের মধ্যেতো নয়!
ঝগড়া-টগড়া বুঝি না, টান দিয়ে ছড়িটা ছাড়িয়ে নিল পিটার। কিন্তু আমার বোন একটা জলদস্যুকে বিয়ে করবে না!
জলদস্যু! আমি? স্প্যানিশ আর্মাডার বিরুদ্ধে আমার লড়াইকে দস্যুতা বলছ তুমি? মহামান্য রানি কি দস্যুতার জন্য নাইট উপাধি দিয়েছেন আমাকে? পাগল হয়ে গেছ তুমি, পিটার। এসব আজে-বাজে কথা কে বুঝিয়েছে তোমাকে? নিশ্চয়ই সার জন কিলিগ্রু?
কচি খোকা নই আমি, গরম স্বরে বলল পিটার। যা বোঝার, তা নিজেই বুঝে নিতে জানি। মুখে প্রতিবাদ করলেও আচরণে প্রকট হয়ে উঠল, অলিভারের ধারণা ভুল নয়।
আমাকে জলদস্যু বলে ডাকলে তাতে মহামান্য রানিকেই অপমান করা হয়। তা ছাড়া এই ফালতু অভিযোগের পিছনে কোনও প্রমাণও দেখাতে পারবে না তুমি। বাস্তবতা হলো, কর্নওয়ালের সুপাত্রদের মধ্যে আমি একজন। রোজামুণ্ড আমাকে ভালবাসে। বংশমর্যাদার দিক থেকে যেমন অনেক উঁচুতে আছি আমি, তেমনি আছি ধন-সম্পদের দিক থেকেও।
ওই ধনসম্পদ এসেছে সাগরে দস্যুতা চালিয়ে, সার অলিভার। সওদাগরি জাহাজ লুটপাট করে, বন্দি নাবিকদেরকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়ে!
এ-সব কে বলেছে তোমাকে? সার জন? শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল অলিভার।
আমিই বলছি!
বলছ ঠিকই, কিন্তু শুনে এসেছ সার জনের কাছ থেকে। উনিই সব শিখিয়ে-পড়িয়ে দিয়েছেন তোমাকে। অসুবিধে নেই, এর জবাব যথাসময়ে দেব আমি তাকে। কিন্তু তার আগে সার জনের প্রকৃত চরিত্র সম্পর্কে তোমাকে একটু সবক দিতে চাই।
না! কিছুই শুনতে চাই না আমি সার জনের সম্পর্কে! অন্তত আপনার মুখে না! খেপাটে গলায় বলল পিটার।
শুনতে তোমাকে হবেই! কাটা কাটা স্বরে বলল অলিভার। জানি, যথেষ্ট সম্মান করো লোকটাকে। তোমার আর রোজামুণ্ডের বাবার বন্ধু ছিলেন তিনি, তোমরা অনাথ হয়ে যাবার পর নিজ থেকে অভিভাবকত্বের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন.. সম্মান সৃষ্টি হবারই কথা। কিন্তু তাই বলে মুখ বুজে থাকা যায় না। আমার পিছনে কেন আদাজল খেয়ে লেগেছেন তিনি, তা তোমার জানা থাকা দরকার।
কী সেটা?
ফাল নদীর মুখে একটা বন্দর তৈরি করতে চাইছেন সার জন, কিন্তু সেটা করতে চাইছেন নিজের জমিতে… যাতে ওই বন্দর আর আশপাশের জনপদ থেকে নিজের পকেট ভারী করতে পারেন। একই রকম ইচ্ছে আমারও আছে… কিন্তু তাতে ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই। সবার উপকার হয়, এমন জায়গাই বেছে নেব আমি। কদিন আগে কাজ শুরু করবার অনুমতি আর টাকার জন্য রানির দরবারে একসঙ্গে হাজির হই আমরা। দুপক্ষের বক্তব্য শোনার পর আমার পক্ষে রায় দেন রানি। যুদ্ধের সময়ের বীরত্বের জন্য হয়তো কিছুটা দুর্বলতা আছে তার আমার প্রতি, তারপরেও সিদ্ধান্তটাকে অন্যায় বলা চলে না। কিন্তু ব্যাপারটাকে অন্য চোখে দেখছেন সার জন। ভাবছেন রানিকে প্রভাবিত করেছি আমি তাঁর কাজ ছিনিয়ে নেবার জন্য। তাই শুরু করেছেন। অপপ্রচার।
কীসের অপপ্রচার? বলল পিটার। রানির উপরে অবশ্যই প্রভাব খাটিয়েছেন আপনি। তাতে একা সার জন নন… আমিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
ও! ব্যাপার তা হলে এই? বাঁকা সুরে বলল অলিভার। এবার বুঝতে পারছি তোমার বিষোদগারের কারণ। বড় ভুল করেছি তোমাকে সৎ, ভাল ছেলে ভেবে। সার জনের মত তুমিও একই পথের পথিক। স্বার্থপর, নীচ… না, তোমার সঙ্গে কথা বলে আর সময় নষ্ট করবার কোনও মানে হয় না।
যদি এর জবাব না দিয়েছি…দাঁতে দাঁত পিষল পিটার।
তোমার জবাবে কোনও আগ্রহ নেই আমার, ওকে থামিয়ে দিল অলিভার। যথেষ্ট সহ্য করেছি তোমার অভদ্র আচরণ। ধৃষ্টতা দেখে অবাক হতে হয়! বোনকে বিয়ে দেবে না আমার সঙ্গে। আমার নাকি বংশ-পরিচয় নেই, আমি নাকি একটা জলদস্যু! আরে, সাহস থাকে তো সত্যি কথাটা মুখ ফুটে বলে ফেলো না! তোমাকে আর সার জনের পকেট ভারী করবার পথ বন্ধ করে দিয়েছি বলে খেপেছ… কথাটা স্বীকার করে নিলেই পারো!
রাগে কাঁপতে শুরু করল পিটার। এই অপমান আমি কোনোদিন ভুলব না, সার অলিভার।
ভাল… মনে রাখলেই ভাল, চাঁছাছোলা গলায় বলল অলিভার। গলা চড়িয়ে ডাকল ভৃত্যকে, নিকোলাস!
হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলো নিকোলাস।
আবার আমার দেখা পাবেন আপনি, রুদ্রকণ্ঠে বলল পিটার। সেদিন সবকিছুর হিসাব-নিকাশ হবে… তলোয়ারের ভাষায়!
ছোটলোকদের সঙ্গে লড়াই করি না আমি, বলল অলিভার।
আপনি আমাকে ছোটলোক বললেন? চেঁচাল পিটার।
যা সত্যি, তা-ই বলেছি, নির্বিকার রইল অলিভার। নিকোলাস, মাস্টার গডলফিনকে দরজা দেখিয়ে দাও
.
০২.
রোজামুণ্ড পিটার গডলফিন চলে যাবার পর বেশ কিছুক্ষণ থম্ মেরে বসে রইল অলিভার। মেজাজ খাট্টা হয়ে গেছে। পারিবারিক শত্রুতার কারণে এমনিতেই ওর আর রোজামুণ্ডের মিলনের পথে হাজারটা বাধা রয়েছে, তাতে আবার নতুন করে প্যাঁচ কষছে সার জন কিলিগ্রু। চুপ করে বসে থাকলে আরও মাথায় চড়ে বসবে লোকটা। এর একটা বিহিত না করলেই নয়… এবং সেটা এখুনি।
নিকোলাসকে ডেকে বাইরে যাবার বুট আনাল অলিভার। ওগুলো পায়ে গলাতে গলাতে জিজ্ঞেস করল, মাস্টার লায়োনেল কোথায়? ওকে দেখছি না যে?
বাইরে গিয়েছিলেন, একটু আগে ফিরে এসেছেন, জানাল নিকোলাস।
ডাকো ওকে।
সমন পেয়ে একটু পরেই হাজির হলোলায়োনেল ট্রেসিলিয়ান-অলিভারের সৎ ভাই। বয়স একুশ, সার র্যালফ ট্রেসিলিয়ানের দ্বিতীয় স্ত্রী-র গর্ভে জন্ম হয়েছে তার। মেয়েলি চেহারা, ঠিক সুপুরুষ বলা চলে না। দুচোখের মণি নীল, মাথাভর্তি সোনালি চুল। চামড়া ধবধবে সাদা। মা আলাদা হলেও অলিভার তাকে আপন ভাইয়ের চেয়ে কোনও অংশে কম স্নেহ করে না। ওরাই এখন ট্রেসিলিয়ান পরিবারের শেষ বংশধর-সার র্যালফ এবং তাঁর দুই স্ত্রী বহু বছর আগে মারা গেছেন।
পাগলা গডলফিন তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল নাকি? কামরায় ঢুকেই প্রশ্ন করল.লায়োনেল।
হ্যাঁ, বলল অলিভার, আমাকে কড়া কথা শোনাতে এসেছিল… ফিরে গেছে নিজেও কিছু কড়া কথা শুনে।
হাসল লায়োনেল। তা-ই বলো! গেটের কাছে দেখা হয়েছে। আমার সঙ্গে। অভিবাদন জানালাম, যেন শুনতেই পেল না। নিশ্চয়ই খেপেছে খুব।
খেপলেই ভাল, উঠে দাঁড়াল অলিভার। আরওয়েনাক-এ যাচ্ছি আমি। সার জনের সঙ্গে একটু বাতচিত হওয়া দরকার।
ওর ভাবভঙ্গি দেখে শঙ্কা ফুটল লায়োনেলের চেহারায়। বলল, তুমি কি…
হ্যাঁ, ভাইয়ের কথা শেষ হবার আগেই ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল অলিভার। বড় বাড় বেড়েছে সার জনের, মুখ দিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বেরুচ্ছে অনবরত। জিভে কীভাবে লাগাম দিতে হয়, তা শিখিয়ে দিয়ে আসব।
ঝামেলা দেখা দেবে, অলিভার! সতর্ক করল লায়োনেল।
তা তো দেবেই… সার জনের জন্য। আমার নামে বদনাম ছড়াচ্ছে সে–আমি নাকি জলদস্যু, দাস-ব্যবসায়ী, খুনি! এসব কথা বলবার আগে পরিণামের কথা ভাবা উচিত ছিল তার। সে-যাক… প্রসঙ্গ পাল্টাল অলিভার, তোমার এত দেরি কেন? কোথায় ছিলে এতক্ষণ? , .
ঘুরতে বেরিয়েছিলাম, বলল লায়োনেল। মালপাস পর্যন্ত গেছি।
মালপাস? ভুরু কোঁচকাল অলিভার। আজকাল ওদিকটায় বড্ড ঘন ঘন যাচ্ছ তুমি। ব্যাপারটা কী?
সমস্যা কোথায়?
বাবার পথে হাঁটছ তুমি। তার মত পরিণতি যদি বরণ করতে চাও, সরে এসো ও-পথ থেকে। মালপাসে আর যেয়ো না তুমি, লায়োনেল-এটাই আমার ইচ্ছে।
ভাইকে আলিঙ্গন করে বেরিয়ে গেল অলিভার।
নিকোলাস খাবার নিয়ে এসেছে, খেতে বসল লায়োনেল। কিন্তু মুখে রুচল না কিছু। দুশ্চিন্তা অনুভব করছে অলিভারের কথা ভেবে। যে-ভাবে ছুটে চলে গেল আরওয়েনাকে, নিঃসন্দেহে তুলকালাম বাধিয়ে দেবে সার জনের বাড়িতে। কী ঘটবে বলা যায়। চুপচাপ অপমান সহ্য করবার মানুষ নন সার জন কিলিগ্রু,অলিভারের কোনও ক্ষতি করে বসেন কি না, সে-আশঙ্কা পেয়ে বসছে ওকে। ভাইয়ের অমঙ্গলের পাশাপাশি ভবিষ্যতের চিন্তাও খেলতে শুরু করল মাথায়… অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধেই। অস্বীকার করবার উপায় নেই, অলিভার মারা গেলে লাভ বৈ ক্ষতি হবে না লায়োনেলের। ভাইয়ের সমস্ত সহায়-সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী ও। চিন্তাটা মাথায় আসায় বিব্রত অনুভব করল লায়োনেল।
একেবারে সাধারণ মানুষের মত মারা গেছেন ওদের পিতা, দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে… চরম দারিদ্রের মাঝে। বাড়ি পর্যন্ত বন্ধক দিয়ে ফেলেছিলেন। সব টাকা উড়িয়েছেন মদ, জুয়া আর মেয়েমানুষের পিছনে। কপাল ভাল, হেলস্টনের কাছাকাছি কিছু জমিজমা ছিল অলিভারের, মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। ওগুলো বিক্রি করে কিছু টাকা জোগাড় করে ও, জাহাজ কিনে হকিন্স নামে এক বন্ধুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে বাণিজ্যে। ধীরে ধীরে ফিরিয়ে আনে পরিবারের হারানো গৌরব, পিতার ধার-দেনা শোধ করে মুক্ত করে নিজেদের সম্পত্তি। ওই জাহাজ নিয়েই স্প্যানিশ আর্মাডার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে অলিভার, অর্জন করেছে নাইট খেতাব। একার চেষ্টায় উন্নতির শিখরে পৌঁছুনোর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ আর কী। বলা বাহুল্য, তরুণ নাইটের এ-সাফল্য সহ্য করতে পারছে না অনেকে, তাই অলিভারের সাগর-অভিযানকে জলদস্যুতা বলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
ভাইয়ের সাফল্য সবচেয়ে উপকার করেছে লায়োনেলের। ভিক্ষের থালা নিয়ে রাস্তায় নামার বদলে পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করতে পারছে সে। তবে ইদানীং একটা দুর্ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে মনে–অলিভারের বিয়ের পর কী ঘটবে? আরাম-আয়েশের জীবন কি অব্যহত থাকবে? ঘরে বউ আসবার পরেও কি ওকে এখনকার মত অঢেল হাতখরচ দেবে অলিভার?
লায়োনেলকে ভালবাসে অলিভার। শুধু ভাই নয়, ও তার অভিভাবকও বটে। পিতার মৃত্যুর পর অলিভারই তাকে বাবা-মায়ের ভালবাসা দিয়ে বড় করেছে। তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়, স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা কি ভাইয়ের প্রতি ভালবাসার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়াবে কি না। এমনও হতে পারে, অলিভারের বউই আপত্তি জানাল লায়োনেলের বেহিসেবি খরচ এবং উদ্দাম জীবনযাপনের ব্যাপারে। তার ফলাফল হবে ভয়াবহ। এক পয়সা উপার্জন নেই, লায়োনেলের, অলিভার যদি টাকা না দেয়… কে দেবে?
বসে বসে এ-সব নিয়ে ভাবছে লায়োনেল। অশুভ একটা চিন্তা জেঁকে বসছে মাথায়। সার জনের বাড়ি আরওয়েনাক-এ যদি ভালমন্দ একটা কিছু ঘটে যায় অলিভারের, তা হলে পেনারো হাউস-সহ ভাইয়ের সমস্ত ধনসম্পদ পেয়ে যাবে ও! ওহ্, কী ভালই না হবে তাতে! সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে যেতে বসেছিল, হঠাৎ করে সংবিৎ ফিরে পেল। সঙ্গে সঙ্গে লজ্জা আর ঘৃণায় লাল হয়ে উঠল মুখ। এসব কী ভাবছে ও!
নিজের অজান্তেই ঝট করে দাঁড়িয়ে গেল লায়োনেল। চেঁচিয়ে উঠল, না!
ওর চিৎকার শুনে ছুটে এল নিকোলাস। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, মাস্টার লায়োনেল! কী হয়েছে?
ঘামে মুখ ভিজে গেছে লায়োনেলের। রুমাল বের করে মুছল। তাকাল ভৃত্যের দিকে। আরওয়েনাকে গেছে অলিভার, জানো তুমি?
মাথা নাড়ল নিকোলাস। জানতে চাইল, কেন?
সার জনকে শাস্তি দেবার জন্য।
নিকোলাসের পোড়খাওয়া চেহারায় হাসি ফুটল। তাই নাকি? খুব ভাল। কিছুদিন থেকে খুব বাড়াবাড়ি করছেন সার জন, শাস্তি একটা পাওনা হয়েছে তাঁর।
বিস্মিত হলো লায়োনেল। তোমার… তোমার ভয় হচ্ছে না অলিভারের জন্য?
কীসের ভয়? ওই চামচিকে-টা সার অলিভারের ক্ষতি করতে পারবে নাকি? বরং তলোয়ারের খোঁচা খেয়ে বাপ-বাপ করে পালাবে।
তা-ই যেন হয়।
.
ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে ফাল নদীর মোহনার কাছে পৌঁছুল অলিভার। ওখানেই কিলি পরিবারের দুর্গ-প্রতীম প্রাসাদ–আরওয়েনাক। বেশ উঁচু জমিতে অবস্থিত, দুর্গের ছাদ থেকে চারপাশের মোটামুটি দশ-পনেরো মাইল চোখে পড়ে। ভিতরে ঢুকতেই দেখা পাওয়া গেল পিটার গডলফিনের। পেনারো হাউস থেকে সম্ভবত সরাসরি এসেছে আরওয়েনাকে।
পিটারের উপস্থিতিতেই সার জনের সঙ্গে দেখা করল অলিভার কড়া ভাষায় তার কাছে কৈফিয়ত দাবি করল, কেন ওর নামে আজেবাজে কথা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। পিটার সঙ্গে থাকাতেই যেন তেজ বাড়ল সার জনের। সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিলেন, যা বলেছেন, তার মধ্যে একবিন্দু মিথ্যে নেই। আসলেই অলিভার একজন জলদস্যু।
মাথায় রক্ত চড়ে গেল অলিভারের। এমন অপমান সহ্য করা সম্ভব নয়। সার জনকে ডুয়েলের জন্য চ্যালেঞ্জ করল ও। লোকটাও সাড়া দিল তাতে। ফলে মিনিট পনেরো পরেই আরওয়েনাক দুর্গের বাগানে মুখোমুখি হলো দুজনে। শুরু করল অসিযুদ্ধ।
প্রবল বিক্রমে অলিভারের উপর হামলা চালালেন সার জন, কিন্তু তা অনায়াসে ঠেকিয়ে দিল তরুণ নাইট। ভৃত্য নিকোলাসের ধারণাকে সত্য প্রমাণিত করে খুব শীঘ্রি পরাস্ত করল প্রতিপক্ষকে। মিনিট পাঁচেক পর দেখা গেল, কাঁধে একটা গভীর ক্ষত নিয়ে বাগানের মাটিতে পড়ে আছেন সার জন।
তলোয়ারটা খাপে ভরে ফেলল অলিভার, তাকাল পিটারের দিকে। দর্শক হিসেবে কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে ছিল ছেলেটা, তরুণ নাইটের যুদ্ধংদেহী রূপ দেখে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে চেহারা।
আশা করি কিছু সময়ের জন্য মুখ বন্ধ হয়েছে ওঁর, বক্রোক্তি করল অলিভার, ইশারা করল কাতরাতে থাকা সার জনের দিকে। চাইলে চিরতরেই চুপ করাতে পারতাম… আগামীতে যদি আবার এভাবে আসতে হয় আমাকে, তা হলে সে-কাজটাই করব।
পরাজিত শত্রুকে নিয়ে উপহাস করছ? ফুঁসে উঠল পিটার। কেমনতরো নাইট তুমি?
উপহাস না, সতর্ক করে দিচ্ছি, ঠাণ্ডা গলায় বলল অলিভার। আবার যদি আমার নামে আজেবাজে কথা ছড়ারার চেষ্টা করো তোমরা, তার ফল ভাল হবে না। বিদায়।
প্রতিপক্ষকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরওয়েনাক ত্যাগ করল ও। সরাসরি বাড়িতে ফিরল না, থামল গডলফিন কোর্টে, রোজামুণ্ডের সঙ্গে দেখা করবার জন্য।
ট্রেফুসিস পয়েন্টের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে গডলফিন পরিবারের আবাস, ক্যারিক রোডের ধারে। বাড়ির পুরনো আমলের ফটক পেরিয়ে নুড়ি বিছানো আঙিনায় ঢুকল অলিভার। একজন চাকরকে ডেকে খবর পাঠাল রোজামুণ্ডের কাছে। একটু পরে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো বাড়ির পশ্চিম প্রান্তের একটা ছোট কামরায়। উজ্জ্বলভাবে আলোকিত ওটা, জানালা দিয়ে চোখে পড়ে বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী আর ঘাসে ছাওয়া পাহাড়ি ঢলের চমৎকার দৃশ্য।
কোলের উপর একটা বই নিয়ে বসে ছিল রোজামুণ্ড, উঁচু গলায় ওর ব্যক্তিগত দাসী অলিভারের আগমন-বার্তা ঘোষণা করায় চোখ তুলে তাকাল। উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নোয়াল অভিবাদন জানাবার ভঙ্গিতে। হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুততর হয়ে গেল অলিভারের। এমনিতেই অপূর্ব সুন্দরী রোজামুণ্ড আজ আরও সুন্দর লাগছে। সিল্কের মচ মসৃণ কোমরু-ছাড়ানো সোনালি চুল ওর, পটলচেরা চোখেরু নীল মণিতে সাগরের গভীরতা। তীক্ষ্ণ নাক, ছোট্ট কপাল, পাতলা ঠোঁট আর ডিম্বাকৃতির মুখটা যেন শিল্পীর হাতে গড়া হয়েছে–চেহারা হয়ে উঠেছে অপূর্ব সুন্দর আর মায়াময়। ছোটখাট গড়নের দেহটাও ছিপছিপে, তাতে, অকৃপণ, হাতে যৌবনের সম্পদ ঢেলেছেন সৃষ্টিকর্তা, নশ্বর এক নারীকে পরিণত করেছেন সব পুরুষের আরাধ্য দেবীতে।
তোমাকে এ-মুহূর্তে আশা করিনি আমি… বলতে বলতে থেমে গেল রোজামুণ্ড। প্রেমিকের চেহারায় অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেছে। কী হয়েছে, অলিভার?
এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরল অলিভার। ভয় পাবার মত কিছু না, বলল ও। বিব্রতকর একটা ব্যাপার। সার জন কিলিগ্রুর প্রতি তোমার আলাদা কোনও টান নেই তো?
থাকাটাই কি স্বাভাবিক নয়? ভুরু কোঁচকাল রোজামুণ্ড। আমাদের দুভাই-বোনের অভিভাবক তিনি।
বিতৃষ্ণা ফুটল অলিভারের চেহারায়। হ্যাঁ, অপ্রিয় একটা বাস্তবতা ওটা। ইয়ে… আরেকটু হলে আজ ওঁকে খুন করে ফেলেছিলাম আমি।
আতঙ্ক দেখা দিল রোজামুল্পে চোখের তারায়, ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে। কাছে এসে তাড়াতাড়ি ওকে সব ব্যাখ্যা করল অলিভার। শেষে যোগ করল, এমনিতে এসব উড়ো কথায় খুব একটা পাত্তা দিই না আমি। কিন্তু সার জন একটা অক্ষমণীয় অপরাধ করেছেন। তোমার ভাইয়ের মন বিষিয়ে তুলেছেন আমার ব্যাপারে। আজ পিটার হাজির হয়েছিল আমার বাড়িতে। মুখের উপর অপমান করেছে আমাকে… ঝগড়া বাধানোর চেষ্টা করেছে। মুখ বুজে ওসব সহ্য করা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে।
তারমানে কি পিটারকেও তুমি… ভাইয়ের অমঙ্গল আশঙ্কায় গলা কেঁপে উঠল রোজামুণ্ডের।
হাসল অলিভার। ভয় পেয়ো না। আর যা-ই করি, তোমার ভাইয়ের কোনও ক্ষতি করব না আমি, আমাদের বিয়ের পথে যত। বাধা-ই ও দিক না কেন। আসলে… আমি এসেছি সব তোমাকে খুলে বলবার জন্য। অন্য কারও মুখ থেকে অতিরঞ্জন শোনার আগে সত্যি ঘটনা জানা থাকা প্রয়োজন তোমার।
মাথা নিচু করে ফেলল রোজামুণ্ড। নিচুকণ্ঠে বলল, সবাই বলে, তুমি খুব একগুয়ে স্বভাবের মানুষ। কারও সঙ্গে ঝগড়া বাধলে খুব নিষ্ঠুর হয়ে ওঠো।
গম্ভীর হয়ে গেল অলিভার। মনে হচ্ছে তুমিও সার জনের কথায় কান দিতে শুরু করেছ।
দুঃখিত, তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। ওগুলো লোকের কথা… আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু ওদের ভুল ধারণা তোমাকেই ভাঙাতে হবে। ভেবে দেখো, আজ কি সে-চেষ্টা করেছ?
অবশ্যই। আজ যথেষ্ট সংযমের পরিচয় দিয়েছি আমি।
সংযম! বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বেঁকে গেল রোজামুণ্ডের ঠোঁটের কোনা। তুমি ঠাট্টা করছ?
সংযম নয়? সার জন যা ঘটিয়েছে, তার জন্য প্রাণ নেয়া উচিত ছিল আমার। নিইনি। তোমার ভাইয়ের ব্যাপারেও একই কথা খাটে। বয়স কম, অন্যের কথায় নেচে উঠেছে… এই ভেবে রেহাই দিয়েছি ওকে। এ-সবই কিন্তু করেছি তোমার কথা ভেবে।
একটু কেঁপে উঠল রোজামুণ্ড। ভালবাসার মানুষটার হাতে প্রাণপ্রিয় ভাই আর শ্রদ্ধেয় অভিভাবকের রক্ত লাগে কি না, এই ভেবে।
ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারল অলিভার, হাঁটু গেড়ে বসল চেয়ারের সামনে। হাতের মুঠোয় প্রেমিকার দুহাত ধরে কোমল গলায় বলল, আমার কথা শোনো, রোজামুণ্ড। যা ঘটেছে, তার পিছনে আমার কোনও হাত ছিল না। লোকের বাজে কথা দূর করে দাও মন থেকে। আমার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করো। আজ যদি আমার ভাই লায়োনেল হাজির হতো এখানে, তোমার আর তোমার পরিবারের নামে মিথ্যে অভিযোগ এনে বলে দিত–কিছুতেই তোমার-আমার বিয়ে হতে দেবে না… তা হলে কেমন লাগত তোমার? মেনে নিতে পারতে ওসব? নাইট আমি, নিজের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য প্রতিবাদ করতে হয়েছে। সত্যি করে বলো, আসলেই কি অন্যায় করেছি আমি? জবাব দাও!
মুখ তুলে তাকাল রোজামুণ্ড। দুচোখে পানি চিকচিক করছে। যা বলেছ, তার মধ্যে একবিন্দু মিথ্যে নেই তো?
ঈশ্বর সাক্ষী, মিথ্যে বললে যেন আমার উপর গজব নামে।
ঠিক আছে, তোমার কথা বিশ্বাস করলাম আমি। না, দোষ করোনি তুমি নিজের সম্মান বাঁচাতে গিয়ে। কিন্তু… ব্যাপারটা এখানেই শেষ হবে না। আগামীতে কী করবে তুমি?
পিটারের কথা ভাবছ, তাই না? একটু হাসল অলিভার। ভয় নেই, আমার হাতে ওর কোনও ক্ষতি হবে না। আমাকে যতই অপমান করুক না কেন!
নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে নিজেকে? তুমি নিশ্চিত?
অবশ্যই! আজ করেছি না? তোমাকে তো বলিনি, আজ আমাকে ছড়ি দিয়ে আঘাত করবার চেষ্টা করেছে পিটার। কিছু বলিনি ওকে।
বিস্ফারিত হয়ে গেল রোজামুল্পে দৃষ্টি। ও তোমার গায়ে হাত তুলেছে?
চেষ্টা করেছে, বলল অলিভার। সফল হয়নি। আগামীতেও হবে না। আমি ওকে এড়িয়ে চলব, রোজামুণ্ড। আমাকে এ-বাড়িতে আসতে নিষেধ করেছে পিটার… তা-ও মেনে নেব। আসলে, এ অসুবিধে সাময়িক। আর এক বছর পরেই সাবালিকা হয়ে যাবে তুমি। তখন আর কেউ বাধা দিতে পারবে না আমাদের দেখা-সাক্ষাতে। ততদিন পর্যন্ত নাহয় একটু কষ্ট করলাম। কী বলো?
কষ্টটা মুখ্য নয়, মাথা নাড়ল রোজামুণ্ড। আমার ভাই ও। আমাকে যেমন তুমি ভালবাসো, আমি চাই ওকেও একই রকম ভালবাসা দাও তুমি।
আমার তরফ থেকে চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না, কথা দিল অলিভার। কিন্তু ও যদি আমার স্নেহ-ভালবাসা অগ্রাহ্য করে, তা হলে কিছু করার নেই।
তাই বলে তুমি ওকে ঘৃণা করবে না তো?
কক্ষণো না, রোজামুণ্ড।
হাসি ফুটল রোজামুণ্ডের ঠোঁটে। হাত বোলাল অলিভারের গালে। বলল, তুমি বড় ভালমানুষ, অলিভার। লোকে ভুল কথা বলে… না, নিষ্ঠুর নও তুমি, একগুঁয়েও নও।
হয়তো ছিলাম এককালে, অলিভার বলল, কিন্তু তুমি আমাকে বদলে দিয়েছ, রোজামুও। আর আমি সেই মানুষটি নেই। রোজামুণ্ডের হাতে চুমো খেয়ে উঠে দাঁড়াল ও। এবার আমাকে যেতে হয়। ট্রেফুসিস পয়েন্টের নদীতীরে কাল সকালে হাঁটতে আসব আমি। যদি সুযোগ মেলে তো দেখা কোরো ওখানে।
হাসল রোজামুণ্ড। থাকব আমি ওখানে।
তা হলে বিদায়, প্রিয়তমা, মাথা নুইয়ে বলল অলিভার। উল্টো ঘুরে হাঁটতে শুরু করল।
একদৃষ্টে ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল রোজামুণ্ড। শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় ভরে উঠেছে অন্তর।
.
০৩.
কামারশালা
আগেভাগে রোজামুণ্ডকে সবকিছু জানিয়ে দিয়ে ভাল করেছে অলিভার। কারণ বাড়ি ফিরেই বোনের কাছে ছুটে গেল পিটার গডলফিন-অলিভারের ব্যাপারে ওর কানে বিষ ঢালবার জন্য।
রোজামুণ্ড, সার অলিভারের কাণ্ড শুনেছিস? কামরায় ঢুকেই চেঁচিয়ে উঠল সে। সার জনকে ভয়ানকভাবে জখম করেছে… ওঁর এখন মরার দশা।
জানি, শান্ত কণ্ঠে বলল রোজামুণ্ড। এবং যদ্র বুঝতে পেরেছি, কৃতকর্মের উপযুক্ত ফল-ই পেয়েছেন তিনি। উল্টোপাল্টা কাজের পরিণাম সম্পর্কে ভাবা উচিত ছিল তাঁর।
থমকে গেল পিটার। চরম অবিশ্বাস নিয়ে কয়েক মুহূর্ত একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল বোনের দিকে। তারপর ফেটে পড়ল রাগে। শুরু করল গালাগাল–রোজামুণ্ডকে, সেইসঙ্গে অলিভারকেও।
গাল দিয়ে লাভ হবে না, রূঢ় গলায় বলল রোজামুণ্ড, তুমি আসার আগেই অলিভার আমাকে আসল ঘটনা জানিয়ে দিয়ে গেছে।
ও! ব্যাটা তা হলে এরই মধ্যে তোকে শিখিয়ে-পড়িয়ে দিয়েছে! বলল পিটার। আগেই বোঝা উচিত ছিল, তোকে জাদুটোনা করে রেখেছে লোকটা।
প্লিজ, পিটার… ওভাবে বোলো না, অনুনয় করল রোজামুণ্ড। সার জনের অমঙ্গল আমিও চাই না। ঘটনাটা শুনে খারাপ লেগেছে খুব। কিন্তু এ-ও সত্যি, অলিভারকে বাধ্য করা হয়েছে এমন পদক্ষেপ নিতে।
বাধ্য করা হয়েছে? মুখ খিঁচিয়ে বলল পিটার। কাকে বাধ্য করা বলে, তা টের পাবে এবার। যদি ভেবে থাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেব ওকে…।
তাড়াতাড়ি ভাইয়ের হাত চেপে ধরল রোজামুণ্ড। নরম গলায় বোঝাতে চেষ্টা করল, রাগের মাথায় যেন বোকার মত কিছু না ঘটিয়ে বসে। অলিভারের হয়ে কৈফিয়ত দেবার চেষ্টা করল, বোঝাতে চাইল–আজ যা ঘটেছে, তাতে ওর কোনও দোষ নেই।
হাহ্! ওসব কথায় তুই ভুলতে পারিস, আমি না। বলল পিটার। সার অলিভারকে ভোলা বইয়ের মত পড়তে পারি আমি। আপাদমস্তক বদমাশ, মানুষের আবেগ নিয়ে খেলতে জানে।প্রতিটা পদক্ষেপ নেয় হিসেব করে। আজ আমার গায়ে হাত তোলেনি, কারণ আমার কিছু হলে বিগড়ে যেতি তুই। কিছুতেই বিয়ে করতি না ওকে। তাই হামলা চালিয়েছে সার জনের উপরে… আমাকে শিক্ষা দেবার জন্য। ঝি-কে মেরে বউকে শেখানোর মত একটা ব্যাপার আর কী! কিন্তু ওসবে ভয় পাই না আমি; জেনে রাখিস, যদি সার জনের কিছু হয়…
বেশ কিছুক্ষণ হম্বিতম্বি চালিয়ে গেল ও। হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিল রোজামুণ্ড। পিটারকে বোঝানোর চেষ্টা করে লাভ নেই কোনও। একটাই আশা, অলিভার তার কথা রাখবে। যা-ই করুক পিটার, তার প্রতিশোধ নেবে না। আসল সমস্যা ওর ভাইকে নিয়ে। যদি সত্যিই ভালমন্দ কিছু ঘটে যায় সার জনের, তা হলে ওকে সামলানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে, তা শুধু ঈশ্বরই বলতে পারেন!
.
মরলেন না সার জন কিলিগ্রু, সপ্তাহখানেক পড়ে রইলেন বিছানায়, তারপর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। তবে শরীর-স্বাস্থ্য শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেল–রক্তপাতের কুফল।
একটা সুফলও পাওয়া গেল এর ফলে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার পর আচার-আচরণে পরিবর্তন এল তাঁর। সবকিছু বিচার করতে পারলেন নিরপেক্ষভাবে। বুঝতে পারলেন, সত্যিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলেন অলিভারের বিষয়ে। কেন করেছিলেন, তাও অনুধাবন করলেন। পিতার কারণে ভূলুণ্ঠিত পারিবারিক গৌরবকে আবার ফিরিয়ে আনতে শুরু করেছে তরুণ নাইট। স্প্যানিশ আর্মাডার সঙ্গে যুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা, সেইসঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে ধনসম্পদ অর্জন করে আস্তে আস্তে আবার ও পুরনো আসনে বসিয়ে দিচ্ছে ট্রেসিলিয়ান নামটাকে। এর ফলে কিলিগ্রু পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তি খর্ব হতে চলেছে, সেটাই আসলে সহ্য করতে পারছিলেন না তিনি। অন্যায় পথে চেষ্টা করছিলেন বীর নাইটকে কলঙ্কিত করতে। একদম উচিত হয়নি কাজটা।
মনে মনে নিজের ভুলত্রুটি স্বীকার করে নিলেও রোজামুল্পে জন্য অলিভারকে মোটেই উপযুক্ত পাত্র ভাবতে পারছেন না সার জন। র্যালফ ট্রেসিলিয়ানের স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বল করছে তাঁর মনে-মদ্যপ, জুয়াড়ি ছিল লোকটা। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না, পিতার রক্তের সেই বাজে দোষগুলো বিসর্জন দিতে পারবে অলিভার। পরিবেশ-পরিস্থিতি বদলে গেলে তরুণ নাইটও হয়তো ও-পথেই পা বাড়াবে, ডেকে আনবে স্ত্রী আর পরিবারের জন্য দুর্দশা। জেনেশুনে রোজামুণ্ডকে এমন একটা ছেলের হাতে তুলে দেয়া যায় না।
সুস্থ হবার পর গডলফিন কোর্টে গেলেন সার জন। দুই ভাই-বোনের সামনে তুলে ধরলেন তাঁর এ-সব যুক্তি। বলা বাহুল্য, গলা চড়িয়ে একমত হলো পিটার। কিন্তু রোজামুণ্ড মেনে নিল না তার কথা।
আমি মানি না, সোজাসাপ্টা ভাষায় জানিয়ে দিল ও। সার জন, পূর্বপুরুষের পাপের দায় সন্তান কেন ভোগ করবে?
অলিভারের বাবার ব্যাপারে তো জানো না… বলতে চাইলেন সার জন।
বাবার কথা শুনতে চাই না, বাধা দিয়ে বলল রোজামুণ্ড। আপনি আমাকে ছেলের কথা বলুন।
কাঁধ ঝাঁকালেন সার জন। একরোখা স্বভাবের ছেলে অলিভার, ঠিক ওর বাবার মত। বাপের বাকি বদভ্যাসগুলোও রপ্ত করে কি না, সেটা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আমাদেরকে।
কতদিন অপেক্ষা করবেন? ও কবরে যাওয়া পর্যন্ত? তার, আগে তো নিশ্চিত হবার উপায় নেই, আমার জন্য ও সঠিক পাত্র কি না!
ঠাট্টা করছ? একটু যেন রুষ্ট হলেন সার জন।
ঠাট্টা না, রোজামুণ্ড বলল, আপনার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিচ্ছি।
বেশ, তা হলে এখন পর্যন্ত যতটা প্রকাশ পেয়েছে অলিভারের স্বভাব-চরিত্র, তার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেব আমরা।
সেক্ষেত্রে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পাচ্ছে। আমি জানি, অলিভারকে আপনি দুচোখে দেখতে পারেন না।
দৃষ্টিভঙ্গিটা কেবল আমার নয়। দুনিয়া ওকে কী চোখে দেখছে, সেটাই বড় কথা।
অন্যের মতামত নিয়ে কেন মাথা ঘামাব আমি, বলতে পারেন? ওরা অলিভারকে কী চোখে দেখছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়; আমি ওকে কীভাবে দেখছি, সেটাই আসল কথা। আপনারা সারাক্ষণই দুর্নাম করে বেড়াচ্ছেন ওর, কিন্তু আমি কোনোদিন অলিভারের মধ্যে খারাপ কিছু দেখতে পাইনি।
এখনও তো দূরে দূরে আছ, তাই টের পাচ্ছ না কিছু। আমি চাই না বিয়ের পরে তোমার হৃদয় ভেঙে যাক।
ভাঙলে ভাঙুক। ওকে আমি ভালবাসি, বিয়ে করতে চাই। লোকের কথায় নিজের প্রেমকে বিসর্জন দিতে পারব না।
বিরক্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন সার জন, চলে গেলেন জানালার কাছে। পিছন থেকে তাঁকে জড়িয়ে ধরল রোজামুণ্ড, ঠিক যেভাবে বাবাকে জড়িয়ে ধরে মেয়ে। গত দশ বছরে পিতা-কন্যার মতই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ওদের ভিতর।
কী চাও? রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করলেন সার জন।
হাসল রোজামুণ্ড। আপনার অবস্থা দেখে মায়া লাগছে। একটা মেয়ের সঙ্গে যুক্তিতে পেরে উঠছেন না!
যুক্তি না, ঘুরে দাঁড়ালেন সার জন। পেরে উঠছি না তোমার গোয়ার্তুমির সঙ্গে। চোখে ঠুলি পরে বসে আছ, কিছুই দেখতে চাইছ না।
আপনি কিন্তু কিছুই দেখাচ্ছেন না আমাকে, সার জন, রোজামুণ্ড বলল। শুধু বলছেন ধারণার কথা… আশঙ্কার কথা। অলিভারের শরীরে দূষিত রক্ত বইছে, ও খারাপ পথে চলে যেতে পারে… এ-সবই হলো মুখের কথা। একটা প্রমাণও কি আছে আপনার হাতে? স্বীকার করতে দোষ নেই, আমার মঙ্গলের জন্য, বলছেন এসব; তাই বলে কথাগুলো যুক্তিসঙ্গত নয়। প্লিজ, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করুন ব্যাপারটা। একটা… শুধু একটা উদাহরণ দেখান অলিভারের কুকীর্তির। প্রমাণ করে দিন, আপনার ধারণা আর বাস্তবতার মধ্যে মিল কতখানি।
মুখের ভাষা হারালেন সার জন। চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারলেন না। শেষে হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। নাহ্, তোমার সঙ্গে কথায় পেরে ওঠা আমার কম্মো নয়। স্বীকার করছি, পরিস্থিতির বিচারে এ-মুহূর্তে সার অলিভার একজন সুপাত্রই বটে!
তার গালে চুমো খেল রোজামুণ্ড। সত্যি কথা বলবার জন্য ধন্যবাদ। এখন আপনি কী করবেন?
আমার দায়িত্ব পালন করব। বলে গডলফিন কোর্ট থেকে বেরিয়ে এলেন সার জন। চলে গেলেন পেনারো হাউসে। অলিভারের সঙ্গে দেখা করে দুঃখ প্রকাশ করলেন তাঁর অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য। প্রস্তাব দিলেন শত্রুতা মিটিয়ে ফেলবার।
যথার্থ ভদ্রলোকের মত আচরণ করল অলিভার, রাগ আর ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলে হাত মেলাল সার জনের সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই বেঁকে বসলেন তিনি। জানিয়ে দিলেন, আজকের এই সাক্ষাৎ-টাকে তার সম্মতি ভেবে বসবার কিছু নেই। এখনও তিনি রোজামুণ্ডের সঙ্গে অলিভারের বিয়ের ব্যাপারে রাজি নন।
আমি বাধা দেব না এ-বিয়েতে, বললেন তিনি, কিন্তু সমর্থনও জানাব না। বয়স হোক রোজামুণ্ডের, তারপর ওর ভাই-ই নেবে সিদ্ধান্ত। একটা ব্যাপারে শুধু নিশ্চয়তা দিতে পারি, পিটারকে কোনোভাবে প্রভাবিত করব না আমি।
শুনে খুশি হলাম, বলল অলিভার। আশা করি ইতিবাচক সিদ্ধান্তই নেবে ও। না নিলেও ক্ষতি নেই। থাক সে-কথা, স্পষ্টবাদিতার জন্য ধন্যবাদ, সার জন। ভাবতে ভাল লাগছে যে, বন্ধু না হলেও আপনি অন্তত আমার শত্রু নন।
ওর সঙ্গে আরেক দফা করমর্দন করে বিদায় নিলেন সার জন।
.
সার জনের নিরপেক্ষ আচরণের কোনও প্রভাব পড়ল না পিটার পডলফিনের উপর। দিনে দিনে সে বরং আরও বৈরি হয়ে উঠল অলিভারের প্রতি। তবে সেটা নিয়ে চিন্তিত হলো না তরুণ নাইট। বছরখানেক সময় আছে হাতে, সময়-সুযোগমত ছেলেটার মন জয় করবার চেষ্টা চালানো যাবে। আপাতত ওর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একটা সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে ওকে।
লায়োনেল বলতে গেলে রোজই মালপাসে আসা-যাওয়া করছে… এবং তার পিছনের কারণটাও জানে অলিভার। খারাপ স্বভাবের এক মেয়েলোক থাকে ওখানে, উঠতি যুবকদের জালে ফাসানোই তার পেশা। ওদের কাছ থেকে পয়সাকড়ি হাতিয়ে আয়েশ করে বেড়ায়। মেয়েটার ব্যাপারে কয়েকবারই ভাইকে সতর্ক করে দিয়েছে অলিভার, কিন্তু লাভ হয়নি। কিছু বলতে গেলে খেপে যায়, শুরু করে দুর্ব্যবহার। উপায়ান্তর না দেখে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে তরুণ নাইট, দূর থেকে লক্ষ রাখছে লায়োনেলের উপর, প্রথম সুযোগেই ওকে মুক্ত করবে মেয়েটার কবল থেকে।
এরই মাঝে শরৎ পেরিয়ে শীতকাল এল। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে দেখা-সাক্ষাৎ কমে এল অলিভার আর রোজামুণ্ডের। ভারী তুষারপাত আর ঝোড়ো বাতাসের কারণে ঘর থেকে বেরুনোই দায়, দেখা করবে কীভাবে? গডলফিন কোর্টে গিয়ে প্রেমিকাকে দেখবার ইচ্ছে জাগে অলিভারের মনে, কিন্তু গলা টিপে মারে সে-ইচ্ছেকে। ওখানে যাওয়া মানেই সেধে পিটারের সঙ্গে ঝগড়া বাধানো। শত্রুতা বেড়ে যাবে আরও। কদাচিৎ রাস্তাঘাটে দেখা মেলে ছেলেটার, তখন চরম ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। সামান্য সৌজন্যও প্রদর্শন করে না। ওর বাড়িতে গেলে আগুনে ঘি ঢালা হবে। তাই কী আর করা, বিচ্ছেদের কষ্ট সহ্য করে নিঃসঙ্গ সময় কাটাতে থাকল তরুণ নাইট।
আশার কথা একটাই–প্রতিদিনই কমছে প্রতীক্ষার প্রহর, ঘনিয়ে আসছে ক্লোজামুণ্ডের আঠারোতম জন্মদিন। খুব শীঘ্নি পেনারো হাউসে পা পড়বে নতুন এক বধূর। এর জন্যে যত পরীক্ষাই দিতে হোক না কেন, তার জন্য প্রস্তুত অলিভার। দুঃখের পরে সুখ আসে–এ তো চিরন্তন সত্য। কিন্তু সবকিছুর পরেও কেন যেন নিশ্চিন্ত হতে পারে না ও। কেবলই মনে হয় একটা কালো মেঘ ঝুলছে ওর ভাগ্যাকাশে, যে-কোনও মুহূর্তে তা নেমে আসবে কালবৈশাখীর মত, তছনছ করে দেবে সব। তরুণ নাইটের জানা নেই, এই আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হতে চলেছে।
এক দিন, ক্রিসমাসের তখনও এক সপ্তাহ বাকি, ছোট্ট একটা কাজে হেলস্টন গেল, অলিভার। আগের সপ্তাহের অর্ধেকটা জুড়ে চলেছে তুষারঝড়, গৃহবন্দির মত কাটাতে হয়েছে ওকে। রাস্তায় নেমে দেখল, পুরো এলাকা ঢাকা পড়ে গেছে কয়েক ফুট ফের তলায়। সকালে রওনা হলো ও, কাজ সেরে আবার বিকেল নাগাদ ধরল বাড়ির পথ। কিন্তু হেলস্টন ছেড়ে মাইলদুয়েক আসতেই খোড়তে শুরু করল ওর ঘোড়া, এক পায়ের নাল খুলে গেছে ওটার।
ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়ল অলিভার, লাগাম ধরে হাঁটতে শুরু করল। যতক্ষণ না কোনও কামারশালা পাচ্ছে, এভাবেই এগোতে হবে ওকে। খুব একটা খারাপ লাগল না অবশ্য হাঁটতে। বিকেলের সূর্যের তির্যক কিরণ প্রতিফলিত হচ্ছে বরফে ছাওয়া প্রকৃতির গায়ে, সৃষ্টি করেছে মোহনীয় পরিবেশ। আনমনে একটা গানের সুর ভাজতে ভাজতে হাঁটতে থাকল ও।
আধঘণ্টা পরে স্মিথিক গায়ে পৌঁছুল অলিভার, সরাসরি চলে গেল ওখানকার কামারশালায়। স্থানীয় লোকজন জটলা করছে উঠানে। ওঁর জানা আছে, গায়ে কোনও সরাইখানা না থাকায় এখানেই নিয়মিত আড্ডা দেয় তারা। কয়েকজন সওদাগরও আছে, বিশ্রাম নেবার জন্য থেমেছে; কাছেই পিঠভর্তি মালামাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওদের গাধার পাল। ভিড়ের মধ্যে পরিচিত দুজন মানুষও পেয়ে গেল অলিভার। তার অ্যাণ্ডু ফ্ল্যাক-পেনরিনের যাজক; এবং মাস্টার গ্রেগরি বেইন-ট্যুরো গাঁয়ের বিচারক। কামারকে ডেকে ঘোড়ার নাল লাগাতে দিয়ে ওঁদের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠল অলিভার।
মন্দ কপাল বলতে হবে… একটু পরেই আর ওয়েনাকের দিককার পাহাড়ি ঢাল ধরে ওখানে হাজির হলো পিটার গডলফিন। সার জনের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের দাওয়াত ছিল, ওখান থেকে ফিরছে। মদ গিলেছে ইচ্ছেমত, মাথা এলোমেলো। কামারশালায় কোনও কাজ নেই, তারপরেও দূর থেকে অলিভারকে দেখতে পেয়ে ঘোড়ার রাশ টানল। স্যাডল থেকে নেমে টলতে টলতে এগিয়ে গেল সেদিকে। ওকে দেখতে পেয়েই প্রমাদ গুনল অলিভার, কিন্তু চেহারায় উদ্বেগ ফুটতে দিল না। গল্প করতে থাকল সার অ্যান্ড্রু আর মাস্টার বেইনের সঙ্গে।
ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল পিটার। অভিবাদন জানানোর ধার ধারল না। জড়ানো গলায় অলিভারকে উদ্দেশ্য করে বলল, আরওয়েনাক থেকে আসছি আমি। এতক্ষণ আপনাকে নিয়েই ওখানে কথা হচ্ছিল।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ওকে দেখে নিল অলিভার–দুচোখ টকটকে লাল হয়ে আছে। চাহনিতে গোলমালের আভাস। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফোঁটাল ও। বলল, খুব ভাল। আলোচনার জন্য এরচেয়ে ভাল বিষয় আর কিছু হতে পারে না।
তা তো বটেই। বড়ই মুখরোচক বিষয়-আপনি আর সপনার চরিত্রহীন বাপ!
একই কথা আমি তোমার বাবার ব্যাপারে বলতে পারি, শান্ত গলায় বলা অলিভার।
উঠানে জড়ো হওয়া লোকজনের মনোযোগ এখন ওদের দিকে কথাটা শোনামাত্র উচেস্বরে হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল পিটার। হাতে ঘোড়ার চাবুক ছিল, সেটা সঙ্কোরে ঘোরাল অলিভারের দিকে। অপ্রত্যাশিত আঘাত, ঠেকানার আগেই তরুণ নাইটের গালে পড়ল চাবুকের বাড়ি, চামড়া কেটে গেল অনেকখানি। দরদর করে বেরিয়ে এল রক্ত।
থমকে গেল। দর্শকরা। উঠানে নেমে এল পিনপতন নীরবতা। গালের রক্ত মুছল অলিভার, চেহারায় দানা বাঁধতে শুরু করেছে ক্রোধ। এখুনি বুঝি বিস্ফোরণ ঘটে! কিন্তু না, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখল ও। কিছু করল না, শুধু অগ্নিদৃষ্টি হানল পিটারের দিকে।
মাস্টার গডলফিন? হাহাকারের সুরে বলে উঠলেন যাজক। এ কী করেছেন আপনি?
ঠিকই করেছি, খ্যাপাটে গলায় বলল পিটার। কুত্তাটা ওর নোংরা মুখে আমার বাবাকে অপমান করেছে! না, এখানেই শেষ নয় এর। আজ একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব!
ভাল চান তো চলে যান এখান থেকে, মাস্টার গডলফিন, বললেন যাজক। আমি মিনতি করছি!
যাব না আমি, বলল পিটার। কী, সার অলিভার, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? আজ আর দোষ চাপাতে পারবেন না সার জনের উপরে। প্রতিশোধ নিতে চাইলে আমার উপরেই নিতে হবে। আসুন, আমি তৈরি।
নড়ল না অলিভার। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পিটারের দিকে। শরীর আড়ষ্ট হয়ে আছে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে উঁচু গলায় হেসে উঠল পিটার। বলল, ও! লোকের সামনে লড়তে ভয় পাচ্ছেন? কোনও অসুবিধে নেই। ওরা চলে গেলেই নাহয় আসুন। আমি অপেক্ষা করব।
হাসতে হাসতে নিজের ঘোড়ার পিঠে চড়ল ও। লাগাম টেনে মুখ ঘোরাল বাহনের। সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেল অলিভারের। ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে এগোতে গেল, কিন্তু দুপাশ থেকে ওকে ধরে ফেললেন সার অ্যাণ্ডু আর মাস্টার বেইন।
যেতে দিন, বললেন বেইন। বদ্ধ মাতাল… কী করছে, তা নিজেও জানে না।
ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল অলিভার, সরে এল তাদের কাছ থেকে।
কী মনে হয় আপনার? পিটারের অপসৃয়মাণ অবয়বের দিকে তাকিয়ে সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করলেন যাজক। এখানেই ব্যাপারটা চুকে-বুকে যাবে?
অসম্ভব! মাথা নাড়লেন মাস্টার বেইন। এই কামারশালায় নতুন একটা তলোয়ার তৈরি হলো আজ-শত্রুতার তলোয়ার। কারও না কারও রক্তে ভিজবে ওটার ফলা… আমি নিশ্চিত।
.
০৪.
খুন
নাল লাগানো হয়ে যেতেই ঝটপট ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল অলিভার, পিটার যে-দিকে গেছে, সে-দিকেই ছোটাল নিজের বাহনকে। চেহারায় খুনের নেশা ভর করেছে, প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষান্ত হবে না। ওর পিছু নিতে চাইলেন সার অ্যাণ্ড, খারাপ কিছু ঘটে যাবার আগেই তরুণ নাইটকে নিরস্ত করবার ইচ্ছে; কিন্তু কিছুতেই তাঁর সঙ্গী হতে রাজি হলেন না মাস্টার বেইন। ট্রেসিলিয়ানদের বদমেজাজের ব্যাপারে জানা আছে তার, বাধা দিতে গিয়ে নিজেকেই না জখম হতে হয়! সোজাসাপ্টা ভাষায় জানিয়ে দিলেন, খাল কেটে কুমির ডেকে এনেছে পিটার গডলফিন; তাকেই সামলাতে হবে বিপদ। খামোকা তার ভিতরে নাক গলিয়ে ঝামেলায় জড়াবার মানে হয় না। ভদ্রলোকের এ-কথা শুনে দমে গেলেন সার অ্যাণ্ড-ও, সাহস পেলেন না একাকী অলিভারের পিছু নিতে।
নদীর ধার ধরে উধ্বশ্বাসে তখন ঘোড়া ছোটাচ্ছে তরুণ নাইট। প্রতিহিংসার চিন্তা ছাড়া আর কিছু মাথায় নেই। সবার সামনে ওকে আঘাত করেছে পিটার, তার উপযুক্ত জবাব দিতে না পারলে আর মান থাকবে না ওর। চুপচাপ যদি মেনে নেয় ব্যাপারটা, লোকে ওকে কাপুরুষ বলবে। কপাল ভাল পিটারের, ঘোড়ার নাল লাগাতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে অলিভারের, সহসা ওর নাগাল পেল না। পেলে কী ঘটত বলা যায় না।
যত সময় গেল, ততই উত্তেজনা কমতে থাকল অলিভারের মানুষের স্বভাবই তাই। আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে এল চিন্তা-ভাবনা। খতিয়ে দেখতে শুরু করল সবকিছু। মনে পড়ে গেল রোজামুণ্ডকে দেয়া প্রতিশ্রুতি। পিটারের কোনও ক্ষতি করবে না বলে কথা দিয়েছে ও। তা হলে কী করতে চলেছে এখন? কী লাভ হবে প্রতিশোধ নিয়ে? অর্বাচীন এক যুবককে হয়তো শায়েস্তা করা হবে তাতে, লোকের সামনে বাহাদুরি দেখানো যাবে… কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ তো তার চেয়ে অনেক বেশি! রোজামুণ্ড ওর উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে, এমনকী দূরে সরিয়ে নিতে পারে নিজেকে। লোকের ক্ষণিক হাসিঠাট্টার চেয়ে ওটা কি অনেক বড় ঝুঁকি নয়?
ভাবতে ভাবতে শান্ত হয়ে এল অলিভার। আপাতত মাফ করে দিল পিটারকে। ওর সঙ্গে পরে কখনও বোঝাপড়া করা যাবে। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিল ও, একটা ফেরি ধরে নদী পার হলো, ছোট এক পাহাড়ের নির্জন ঢাল ধরে বাড়ির পথে চলল। এ-পথে সাধারণত চলাচল করে না অলিভার; যেখানেই যাক, ট্রেফুসিস পয়েন্ট হয়ে গডলফিন কোর্টের সামনে দিয়ে যায়। রোজামুণ্ডকে দেখা না যাক, তার আবাসের দিকে তাকিয়ে মনকে সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু আজ ওদিকে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। পিটারের সঙ্গে যদি আবার দেখা হয়ে যায়, নিজেকে হয়তো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তারচেয়ে জায়গাটা এড়িয়ে চলাই ভাল। আজ যা ঘটেছে, সেটা নাহয় চিঠি লিখে জানিয়ে দেবে রোজামুণ্ডকে। ও বুঝতে পারবে, কতটা ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে অলিভার।
বাড়ি পৌঁছে নিজেই ঘোড়াকে আস্তাবলে ঢোকাল অলিভার। দুজন সহিস আছে ওর, কিন্তু এ-মুহূর্তে তারা কাজ করছে না। একজন অসুস্থ, অন্যজনকে ছুটি দিয়েছে পরিবারের সঙ্গে বড়দিন উদ্যাপনের জন্য। ঘোড়া রেখে বাড়িতে ঢুকল ও, ডাইনিং হলে গিয়ে দেখল, ইতোমধ্যে নৈশভোজ সাজিয়ে রেখেছে নিকোলাস। ফায়ারপ্লেসে জ্বালিয়ে দিয়েছে আগুন, আরামদায়ক উষ্ণতা বিরাজ করছে বিশাল কামরাটায়। কাঁপা কাঁপা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে দেয়ালে ঝোলানো ট্যাপেস্ট্রি আর ওর পূর্বপুরুষদের পোর্ট্রেটগুলো।
মনিবের পায়ের আওয়াজ শুনে মোমবাতি হাতে হাজির হলো নিকোলাস। ফিরতে অনেক দেরি করে ফেললেন, সার অলিভার, বলল সে। অবশ্য, মাস্টার লায়োনেলও ফেরেননি এখনও।
বিরক্তিতে মুখ বাঁকাল অলিভার। নিশ্চয়ই আবার মালপাসে গেছে লায়োনেল… ওই মেয়েটার কাছে। কোট আর হ্যাট খুলে ফেলল ও, ফায়ারপ্লেসের পাশে একটা চেয়ারে বসল। নিকোলাস এগিয়ে এল মনিবকে বুট খোলায় সাহায্য করতে।
আশা করি শীঘ্রি এসে যাবে লায়োনেল, বলল অলিভার। আমাকে একটা ড্রিঙ্ক দাও, নিকোলাস।
জী, এখুনি আনছি, বলে উঠে দাঁড়াল নিকোলাস। ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, আপনার গালে কী হয়েছে?
আনমনে একটা হাত তুলল অলিভার, স্পর্শ করল, ক্ষতটা। খুব বড় নয় ওটা, রক্ত শুকিয়ে গেছে ইতোমধ্যে, সেরে যাবে দুচারদিনের মধ্যে।
কিছু না, বলল ও। ড্রিঙ্ক আনো।
মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল নিকোলাস, মদের বোতল আর গ্লাস নিয়ে ফিরে এল একটু পর। ততক্ষণে অলিভার টেবিলে গিয়ে বসেছে। ওকে মদ পরিবেশন করল ভৃত্য। অসুস্থ সহিসের কথা জানতে চাইল অলিভার, নিকোলাস জানাল-তার অবস্থা উন্নতির দিকে।
একটু মদ ওকেও দিয়ে এসো, অলিভার বলল। গা গরম হলে চাঙা বোধ করবে।
জী, সার, সায় দিল নিকোলাস।
এমন সময় বাইরে থেকে ভেসে এল ঘোড়ার খুরের আওয়াজ।
মাস্টার লায়োনেল এলেন বুঝি! বলল নিকোলাস।
আসুক, নিস্পৃহ গলায় বলল অলিভার। তোমার এখানে থাকবার দরকার নেই। খাবার-দাবার তো টেবিলেই আছে, আমরা নিজেরাই নিয়ে নিতে পারব। যাও, টমের কাছে যাও। সহিসের কাছে তাকে পাঠিয়ে দিল ও।
নিকোলাস চলে গেলে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল অলিভারের। ভাইকে কড়া কয়েকটা কথা শোনাবে বলে ঠিক করেছে। যথেষ্ট সহ্য করেছে ওর উদ্ধৃঙ্খলতা, আর না।
একটু পরেই ত্রস্ত পদশব্দ হলো, তারপর ঝট করে খুলে গেল ডাইনিং হলের দরজা। সেদিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করতে গিয়ে থমকে গেল তরুণ নাইট। এমন দৃশ্য আশা করেনি। নিজের অজান্তেই দাঁড়িয়ে গেল ও, বিস্ফারিত হলো দৃষ্টি।
লায়োনেলকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ঝড় বয়ে গেছে তার উপর দিয়ে। পোশাক-আশাক আর চুল অবিন্যস্ত। চেহারা। ফ্যাকাসে, মুখ থেকে সরে গেছে রক্ত। একটা হাতের দস্তানা খুলে পড়ে গেছে, হাতটা রক্তে ভেজা। পোশাকের একপাশেও বিশাল এক কালচে-খয়েরি ছোপ।
হা ঈশ্বর! আঁতকে উঠল অলিভার। ছুটে গেল ভাইয়ের কাছে। এ কী হয়েছে, লায়োনেল! কে করেছে এসব?
তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করল লায়োনেল। ঘুরে মুখোমুখি হলো বড় ভাইয়ের। দুর্বল একটা হাসি হেসে বলল, পিটার গডলফিন।
কী! চমকে উঠল অলিভার। বদমাশটা তা হলে লায়োনেলের পিছনেও লেগেছে? ভীষণ রাগ হলো ওর, বাড়াবাড়ির একটা সীমা থাকা উচিত। নিজের মান-অপমান সহ্য করা যায়, কিন্তু ভাইয়ের গায়ে হাত তুললে সেটা বরদাশত্ করা মুশকিল।
কাঁপা কাঁপা পদক্ষেপে ফায়ারপ্লেসের কাছে এগিয়ে গেল লায়োনেল। ধপ করে বসে পড়ল অলিভারের চেয়ারে। ওর পিছু পিছু এল তরুণ নাইট।
তুমি কি আহত? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল অলিভার। বেশি জখম হওনি তো?
না, মাথা নাড়ল লায়োনেল। সামান্য কাটাছেঁড়া। ভয় পাবার কিছু নেই। তবে রক্ত পড়েছে অনেক। বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছুতে পারব কি না, সেটাই ছিল দুশ্চিন্তা। এসে যখন পড়েছি, আর ভাবনা নেই।
দেখতে দাও আমাকে। হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসে পড়ল অলিভার। নিজের ছুরি দিয়ে কেটে ফেলল লায়োনেলের কোর্তা, ভাল করে দেখল আঘাতের অবস্থা। গভীর ক্ষত হয়েছে, তবে গুরুতর নয়। রক্তপাতও কমে এসেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও।
বলেছিলাম না? ভুরু নাচাল লায়োনেল। আমাকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। পিটারের অবস্থায় এরচেয়ে অনেক খারাপ।
উঠে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের মুখোমুখি হলো অলিভার। থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করল, কীভাবে ঘটল এসব?
একটু জড়োসড়ো হয়ে গেল লায়োনেল। বলল, আমার কোনও দোষ নেই। বাড়ি ফিরছি, এমন সময় পথে দেখা হয়ে গেল পিটারের সঙ্গে। আমি কিছু করিনি, ও-ই গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাতে এল। এমন সব নোংরা কথা বলতে শুরু করল যে, আত্মসচেতন একজন মানুষের পক্ষে সেসব সহ্য করা অসম্ভব…
থাক, পরে শুনব ওসব, বাধা দিল অলিভার। আগে তোমার ক্ষতের পরিচর্যা দরকার।
নিকোলাসকে ডেকো না, তাড়াতাড়ি বলল লায়োনেল।
ভুরু কুঁচকে গেল অলিভারের। কেন?
ইয়ে… ইতস্তত করল লায়োনেল, ব্যাপারটা যত কম জানাজানি হয়, ততই ভাল। অন্ধকারে লড়েছি আমরা, আশপাশে কোনও প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না। যা ঘটেছে, তার কোনও সাক্ষী নেই…
হেঁয়ালি কোরো না, লায়োনেল! কড়া গলায় বলল অলিভার। যা বলার সরাসরি বলো। লড়াই করেছ তোমরা, দুজনেই আহত হয়েছ… সাক্ষীর প্রশ্ন আসছে কেন?
পিটার আহত নয়, অলিভার, নিচুকণ্ঠে বলল লায়োনেল। নিহত!
বজ্রাহতের মত স্থির হয়ে গেল অলিভার। কী শুনছে ও! পিটার মারা গেছে?
বোঝার চেষ্টা করো, অলিভার! অনুনয় করল লায়োনেল। আর কোনও বিকল্প ছিল না আমার হাতে। বদ্ধ মাতাল ছিল পিটার, তলোয়ার বের করে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমি প্রথম লড়তে চাইনি, তখন শুরু করল গালাগাল। কাপুরুষ বলল আমাকে, বলল লড়াই না করলে তলোয়ারের ফলা দিয়ে পিটিয়ে পাছা লাল করে দেবে… এসবের পর আর চুপ করে থাকা যায়, বলো? তলোয়ার বের করতে বাধ্য হয়েছি আমি, কিন্তু ঈশ্বর সাক্ষী–ওকে খুন করার কোনও ইচ্ছে ছিল না আমার মনে। এটা ঘটনাচক্রে হয়ে গেছে।
মাথা ঝাঁকাল অলিভার। পাশ ফিরে চলে গেল কামরার একপ্রান্তে, ওখানে একটা লোহার বেসিন আছে। এক টুকরো কাপড় ভিজিয়ে ফিরে এল ভাইয়ের কাছে, পরিষ্কার করতে শুরু করল ওর পাঁজরের পাশের ক্ষত। মুখে কিছু বলছে না, মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নানা ধরনের চিন্তা। খুব একটা দোষারোপ করতে পারছে না লায়োনেলকে। বিকেলে তো নিজ চোখেই দেখেছে পিটার গডলফিনের অবস্থা। অলিভারের গালে চাবুক মেরেছে… এরপর লায়োনেলের উপরে তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে থাকলে অবাক হবার কিছু নেই। সমস্যা শুধু রোজামুণ্ডকে নিয়ে এই ঘটনায় ও কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সেটা নিয়ে শঙ্কিত অলিভার। সন্দেহ নেই, বড় ধরনের একটা ঝামেলার সূচনা হয়েছে।
টেবিল থেকে বড় বড় কয়েকটা হাত-মুখ মোছার রুমাল নিয়ে এল ও। সেগুলো ফালি ফালি করে বেঁধে দিল লায়োনেলের আঘাতগুলো। তারপর জানালা খুলে বাইরে ফেলে দিল রক্ত-মেশা পানি। যে-কাপড়গুলো দিয়ে ক্ষত পরিষ্কার করেছে, সেগুলো ছুঁড়ে দিল ফায়ারপ্লেসের আগুনে। নিকোলাসের চোখে কিছু পড়তে দেয়া যাবে না। না, একান্ত ভৃত্যের বিশ্বস্ততা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই ওর মনে, তাই বলে ওকে মিথ্যে বলতে বাধ্য করা সাজে না। কারণ অলিভার পরিষ্কার বুঝতে পারছে–যতই যুক্তি দেখাক লায়োনেল, সাক্ষী না থাকায় ওকে পিটারের খুনের দায়ে ফাসতে হবে।
লায়োনেলের জন্য নতুন জামাকাপড় আনার জন্য একটু পর ডাইনিং হল থেকে বেরুল অলিভার। সিঁড়ির দিকে এগোতেই নিকোলাসের দেখা পেল–ফিরে আসছে সে অসুস্থ সহিসের কামরা থেকে। ওকে থামিয়ে ছেলেটার খোঁজখবর নিল অলিভার, তারপর অন্য একটা কাজ দিয়ে নিকোলাসকে পাঠিয়ে দিল আরেকদিকে। এর ফলে বেশ কিছুক্ষণ সে ডাইনিং হলে ফিরতে পারবে না।
জামাকাপড় নিয়ে খানিক পর আবার ভাইয়ের কাছে ফিরল অলিভার। ওগুলো পরতে সাহায্য করল তাকে। রক্তে ভেজা পোশাকগুলো টুকরো টুকরো করে ফায়ারপ্লেসে পোড়াল। বেশ কিছুটা সময় পর নিকোলাস যখন ডাইনিং হলে ঢুকল, তখন দুভাই টেবিলে বসে নৈশভোজ সারছে। কী ঘটে গেছে, তা বোঝার উপায় নেই।
লায়োনেলের ফ্যাকাসে চেহারা খেয়াল করল না ভৃত্য, শুধু জানতে চাইল, ওদের বিছু লাগবে কি না। নেতিবাচক জবাব দিয়ে তাকে রাতের মত ছুটি দিল অলিভার। মাথা নুইয়ে চলে গেল নিকোলাস।
খাওয়া মুখে রুচছে না দুই ভাইয়ের। কুচবার কথাও নয়। ব্যথায় বার বার মুখ কোঁচকাল লায়োনেল, তা চাপা দেবার জন্য ঘন ঘন চুমুক দিল মদের ব্যাপারটা কিছুক্ষণ অগ্রাহ্য করল অলিভার, শেষে বলতে বাধ্য হলো–এত মদ গেলা উচিত হচ্ছে না ওর। কাঁধ ঝাঁকাল লায়োনেল তা শুনে।
খাওয়া শেষে টেবিল ছাড়ল অলিভার। ম্যান্টেলশেলফের কাছে গিয়ে পাইপ আর তামাকের কৌটা নিল, তারপর ফিরে এল নিজের আসনে। পাইপ ধরিয়ে ঘন ঘন কয়েকটা টান দিল ও, তারপর প্রশ্ন ছুঁড়ল ভাইয়ের দিকে।
কী নিয়ে ঝগড়া ছিল তোমাদের?
কী? একটু যেন থতমত খেয়ে গেল লায়োনেল। ঢোক গিলে বলল, না… ঝগড়া তো ছিল না কোনও। কেন যে আমার উপর হামলা করে বসল…।
মিথ্যে বোলো না, লায়োনেল, জলদগম্ভীর কণ্ঠে বলল অলিভার। আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। কিছু একটা তো হয়েছিল বটেই! সব খুলে বলো আমাকে।
দ্বিধা ফুটল লায়োনেলের চেহারায়, যেন কিংকর্তব্য ঠিক করতে পারছে না। চুপ করে রইল কয়েক মুহূর্ত, তারপর বুঝতে পারল-ভাইয়ের কাছে কাছে ব্যাপারটা গোপন রাখলে তারই ক্ষতি। এ-মুহূর্তে অলিভারই ওর একমাত্র আশ্রয়স্থল। ও ছাড়া আর কেউ বাঁচাতে পারবে না তাকে।
ইয়ে… মালপাসের মেয়েটাই সমস্ত নষ্টের গোড়া, আমতা আমতা করে বলল লায়োনেল। অলিভারের চোখ জ্বলে উঠেছে দেখে তাড়াতাড়ি যোগ করল, ওকে অন্যরকম ভেবেছিলাম আমি… বোকামি করেছিলাম। কণ্ঠ আটকে গেল উত আবেগে।. ভালবেসে ফেলেছিলাম ওকে, বিয়ে করব বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু…।
তা-ই? চরম বিদ্রূপ প্রকাশ পেল অলিভারের কণ্ঠে।
ভাল মেয়ে ভাবতাম ওকে… অবশ্য, এখনও খারাপ বলতে পারছি না। মনে হয় না ওর কোনও দোষ আছে। বদমাশ গডলফিন-ই ওর মাথা খারাপ করে দিয়েছে। যতদিন না ও আমাদের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে, ততদিন কোনও সমস্যা ছিল না। সব ঠিকঠাকই ছিল…
হুম, বলল অলিভার, আর কিছু না হোক, পিটার একটা উপকার করে দিয়ে গেছে। মেয়েটার সত্যিকার রূপ দেখিয়ে দিয়েছে তোমাকে। ওর ব্যাপারে বহু আগেই আমি তোমাকে সতর্ক করেছি, লায়োনেল।
আমার সে-সব বিশ্বাস হয়নি…।
হওয়া উচিত ছিল! কী মনে হয় তোমার, খামোকাই একটা মেয়ের নামে বাজে কথা বলেছি? তোমার ভাই কি সে-ধরনের মানুষ?
মাথা তুলল লায়োনেল। আন্দি এখনও জানি না কী বিশ্বাস করব। সন্দেহের দোলায় দুলছে আমার মন।
সন্দেহ দূর করো, লায়োনেল। আমার কথা মেনে নাও। হাসল অলিভার। আচ্ছা! তলে তলে তা হলে এ-সব করে বেড়াত পিটার? ভণ্ডামি আর কাকে বলে! আসলেই… মানুষের চরিত্রের তল পাওয়া কঠিন।
মুখে হাসি ফোটালেও তিক্ততায় ভরে যাচ্ছে অন্তর। সার র্যালফ ট্রেসিলিয়ানের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে অনেক কথা শুনিয়েছে ওকে পিটার, তার উপযুক্ত একটা জবাব পেয়েছে বটে, কিন্তু এখন আর ছেলেটাকে শোনাবার উপায় নেই। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে হঠাৎ শঙ্কিত হয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করল, অ্যাই, ওই মেয়েটা কতদূর জানে, লায়োনেল? ও কি আন্দাজ করতে পারবে, পিটারের মৃত্যুতে তোমার হাত আছে?
সম্ভবত, মলিন মুখে বলল লায়োনেল। আজ পিটারকে নিয়ে ঝগড়া হয়েছে আমাদের মধ্যে। বেরুনোর সময় রাগের মাথায় বলে দিয়ে এসেছি, শয়তানটার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে যাচ্ছি। সত্যি বলতে কী, গডলফিন কোর্টের দিকেই যাচ্ছিলাম আমি; পথে দেখা হয়ে গেছে পিটারের সঙ্গে।
তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছ, লায়োনেল, অভিযোগ ফুটল অলিভারের গলায়। তুমি তো বলেছ, ও-ই তোমার উপর হামলা করেছে!
আসলেই তা-ই, জোর গলায় বলল লায়োনেল। যখন দেখা হলো ওর সঙ্গে, কথাই বলতে দেয়নি আমাকে। তলোয়ার বের করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমার উপর।
আমি নাহয় বিশ্বাস করলাম, কিন্তু লোকে তো করবে না, চিন্তিত কণ্ঠে বলল অলিভার। ওই মেয়েটা যদি মুখ খোলে…
খুলবে না, বলল লায়োল। খুললে ওর-ই ক্ষতি।
হয়তো ঠিকই বলছ, মাথা ঝাঁকাল অলিভার। যদি জানাজানি হয় যে, তোমাদের দুজনের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখছিল ও, তা হলে টি টি পড়ে যাবে পুরো এলাকায়। নিজের মান-সম্মান বাঁচাবার জন্যেই মুখ বন্ধ রাখতে হবে ওকে। তুমি নিশ্চিত, আর কেউ তোমাকে যেতে বা আসতে দেখেনি?
অবশ্যই!
স্বস্তির সঙ্গে পাইপের ধোয়া ছাড়ল অলিভার। তা হলে আর ভয়ের কিছু নেই। চলো, এবার তোমার বিশ্রাম দরকার। আমি তোমাকে কামরায় পৌঁছে দিচ্ছি।
পাইপ নামিয়ে ভাইকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল ও। দোতলার কামরায় নিয়ে গিয়ে সযত্নে শুইয়ে দিল বিছানায়। তারপর ফিরে এল নীচে। নতুন করে পাইপ ধরিয়ে বসল আগুনের সামনে, ডুবে গেল চিন্তার সাগরে।
হ্যাঁ, ভয়ের কিছু নেই–তবে সেটা লায়োনেলের জন্য; কারণ পিটারের খুনের সঙ্গে কেউ তাকে জড়াতে পারবে না। কিন্তু ওর নিজের কী হবে? কীভাবে সহ্য করবে এমন একটা গোমর রক্ষার চাপ? একজন মানুষ খুন হয়েছে… হয়তো মৃত্যুই প্রাপ্য ছিল তার… তাই বলে তার পরিবারের কি অধিকার থাকবে না জানার-কেন, কীভাবে খুন হয়েছে সে? চাপটা আরও বড়, কারণ মানুষটা রোজামুণ্ডের ভাই। অলিভারের চেয়ে কোনও অংশে তাকে কম ভালবাসত না মেয়েটা, ঠিক যেভাবে লায়োনেলকে ভালবাসে ও নিজে। ভাই আর প্রেমিকার মধ্যকার দায়িত্ব নিয়ে টানাপড়েনে আক্রান্ত হলো তরুণ নাইট।
এক পর্যায়ে উঠে দাঁড়াল ও। শুরু করল পায়চারি। বিড়বিড় করে অভিশাপ দিল মালপাসের ওই দুশ্চরিত্রা মেয়েটিকে। তার জন্যেই এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই যথেষ্ট ঝামেলায় আছে অলিভার, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাড়তি উপদ্রব। তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত, ভাইয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে না ও। তারমানে চুপ করে থাকতে হবে ওকে, ধোকা দিতে হবে রোজামুণ্ডকে। যতই কষ্ট হোক না কেন।
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল অলিভারের বুক চিরে। পাইপ নিভিয়ে নিজের কামরায় চলে গেল ও। শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুমাতে পারল না। সারারাত এপাশ-ওপাশ করল বিছানায়।
.
০৫.
অপবাদ
সকালবেলা নিকোলাস নিয়ে এল খবরটা।
দুভাই তখন নাশতা করতে বসেছে। লায়োনেলের অবশ্য বিছানায় থাকা দরকার ছিল, তলোয়ারের আঘাত আর রক্তক্ষরণের ফলে জ্বর এসেছে ওর, কিন্তু কামরায় থাকার সাহস পায়নি। তাতে সন্দেহ জাগবে লোকের মনে। ভাইয়ের কাঁধে ভর দিয়ে ডাইনিং হলে নেমে এসেছে, একসঙ্গে বসেছে নাশতা সারতে। চেহারায় ফ্যাকাসে ভাব বেড়েছে, কিন্তু তা নিয়ে করবার কিছু নেই।
খাবার মুখে তুলতে না তুলতে ঝড়ের মত ডাইনিং হলে প্রবেশ করল নিকোলাস-উত্তেজিত অবস্থায়। কাঁপতে কাঁপতে শোনাল, কোথায়-কীভাবে পিটার গডলফিনের লাশ পাওয়া গেছে। কিন্তু শেষে যে-কথা যোগ করল, তা আরও ভয়ঙ্কর।
সবাই বলছে, আপনি ওকে খুন করেছেন, সার অলিভার!
কী! আঁতকে উঠল তরুণ নাইট! আচমকা টের পেল, বড় ভুল হয়ে গেছে–কাল রাতে এই সম্ভাবনাটা একবারও মাথায় খেলেনি ওর। এমন একটা মিথ্যে কথা কোথায় শুনলে তুমি?
ও যা ভেবেছিল, সে-জবাবই পাওয়া গেল ভৃত্যের মুখ থেকে। কামারশালার ঘটনা সবার মুখে মুখে ফিরছে। ওখান থেকে ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে অলিভার যে পিছু নিয়েছিল পিটারের, তার-ও সাক্ষীর অভাব নেই। দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিয়েছে সবাই। ধরে নিচ্ছে, তরুণ গডলফিনকে খুন করে অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছে ও।
তড়াক করে উঠে দাঁড়াল অলিভার। রোজামুত্রে মাথায় এ-ধারণা বদ্ধমূল হবার আগেই ভাঙাতে হবে ওকে। ইতোমধ্যে দেরি হয়ে গেছে কি না কে জানে।
দ্রুত পোশাক পাল্টে নিল ও। আস্তাবল থেকে ঘোড়া নিয়ে ছুটল গডলফিন কোর্টের দিকে। ওখানে পৌঁছুতে বেশি সময় লাগল না। সদর ফটকে কেউ অভ্যর্থনা জানাল না ওকে। আঙিনায় ঢুকে দেখতে পেল দাস-দাসীদের একটা ছোট জটলা, অলিভারকে দেখে বিস্ময় ফুটল তাদের চেহারায়। শুরু হলো গুঞ্জন।
স্যাডল থেকে নামল তরুণ নাইট, কিন্তু ঘোড়ার লাগাম ধরবার জন্য এগিয়ে এল না কেউ। বিরক্ত গলায় ও বলল, ব্যাপার কী, তোমরা নিয়ম-কানুন সব ভুলে গেছ নাকি? অ্যাই, এদিকে এসো! কাছে দাঁড়ানো একটা ছেলেকে ডাকল ও।
একটু ইতস্তত করল ছেলেটা, কিন্তু অলিভারের কর্তৃত্বপূর্ণ দৃষ্টির সামনে হার মানতে বাধ্য হলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে এল কাছে। তার হাতে লাগাম ধরিয়ে দিয়ে বাড়ির দিকে এগোল অলিভার, সিঁড়ি ধরে তরতর করে উঠে গেল সদর দরজার দিকে।
টোকা দেবার আগেই খুলে গেল পাল্লা। বয়স্ক এক ভূতকে, দেখা গেল দোরগোড়ায়। থমথমে চেহারা।
তোমার, মালকিন কোথায়? জানতে চাইল অলিভার।
দুঃখিত, সার অলিভার, বলল ভৃত্য।- উনি আপনার সঙ্গে দেখা করবেন না। চলে যেতে বলেছেন আপনাকে।
রোজামুণ্ডের সঙ্গে দেখা না করে কোথাও যাচ্ছি না আমি, রাগী গলায় বলল অলিভার। সরো, ভিতরে যেতে দাও আমাকে।
আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়, সার।
মুখ খরচ করা বৃথা। খপ করে ভৃত্যের কলার চেপে ধরল তরুণ নাইট। তাকে ছুঁড়ে দিল মেঝেতে। তারপর ঢুকে পড়ল বাড়ির ভিতর।
প্লিজ, সার! চেঁচিয়ে উঠল ভৃত্য। যাবেন না আপনি!
তার কথায় কান দিল না অলিভার। ছুটল রোজামুণ্ডের কামরার দিকে। ওখানেই পাওয়া গেল মেয়েটাকে। বিধ্বস্তের মত দাঁড়িয়ে আছে কামরার মাঝখানে, পরনে সাদা রঙের পোশাক, চুল অবিন্যস্ত, সুন্দর মুখটা ভাই হারানোর বেদনায় ক্লিষ্ট। চোখদুটো লাল হয়ে আছে অবিরাম কান্নাকাটির কারণে। পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ফেরাল অলিভারের দিকে। ঠোঁটদুটো একটু ফাঁক হলো, বোধহয় কিছু বলবে, তারপর আবার সিদ্ধান্ত পাল্টাল। ঘৃণার ভঙ্গিতে অলিভারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল ও।
রোজামুণ্ড! দুপা এগোল অলিভার। মিথ্যে কথা বলছে লোকে। তুমি ওসব বিশ্বাস কোরো না।
চলে যাও তুমি, ওর দিকে না তাকিয়েই শীত গলায় বলল। রোজামশু, তাতে ভালবামা বা শ্রদ্ধার ছিটেফোঁটা নেই।
চলে যাব তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে? শুনবে না আমার কী?
বোকার মত বহুবার তোমার কথা শুনেছি আমি… অন্যদের কথা না শুনে। তা হলে এদিন দেখতে হতো না। আর কিছু শুনতে চাই না আমি। চাই তোমার বিচার… যেন ফাঁসিতে ঝোলানো হয় তোমাকে।
অবর্ণনীয় এক ব্যথায় ভরে গেল অলিভারের হৃদয়। যদি তা-ই তুমি চাও, ফাঁসিতে ঝুলতে আপত্তি নেই আমার, ভাঙা গলায় বলল ও। ভুল বুঝে যে-কষ্ট তুমি আমাকে দিচ্ছ, তারচেয়ে মরে যাওয়া ভাল। আমার উপর তোমার আস্থা যে এত ঠুনকো, তা আমার জানা ছিল না। লোকের কথায় যে-আস্থা চুরমার হয়ে যায়, সে-আস্থার কী মূল্য?
লোকের কথা? ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল রোজামুণ্ড। এখনও ধোকা দিতে চাইছ আমাকে? তোমার মিথ্যের বেসাতির কি কোনও শেষ নেই?
কখনোই তোমাকে ধোকা দিইনি আমি। বিশ্বাস করো, পিটারের মৃত্যুতে কোনও হাত নেই আমার। মিথ্যে বললে যেন, ঈশ্বরের গজব নেমে আসে আমার উপর।
বাহ! বাহ! পিছন থেকে ভেসে এল বিদ্রুপাত্মক একটা কণ্ঠ। সার অলিভার দেখছি এবার ঈশ্বরের নাম নিয়ে ছলনা শুরু করেছে!
ঘাড় ফিরিয়ে সার জন কিলিগ্রুকে দেখতে পেল অলিভার। কামরায় এসে ঢুকেছেন তিনি। দুচোখ, জ্বলে উঠল ওর। অভিযোগের সুরে বলল, এসব আপনার ষড়যন্ত্র!
আমার ষড়যন্ত্র? হেসে উঠলেন সার জন। তোমার ধৃষ্টতা দেখে অবাক হতে হয়, বাছা। নির্লজ্জতা আর অভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে গেছ তুমি…।
চুপ করুন! গর্জে উঠল অলিভার। যারা গালাগালে ভয় পায়, তাদেরকে গালি দিন। আমি ওসবের উপযুক্ত জবাব দিতে জানি। ভাল চান তো…।
হ্যাঁ, রক্তপিপাসু খুনির মতই কথা বলছ বটে! মিছরির ছুরি চালাচ্ছেন সার জন। একজনকে খুন করে সাধ মেটেনি, এখন আবার তারই বাড়িতে এসে হুমকি দিচ্ছে আরেকজনকে খুন করবার!
জিভের লাগাম টানুন, সার জন, খুঁসে উঠল অলিভার। নইলে সত্যিই খুনোখুনি হয়ে যাবে এখানে।
অলিভার! চাবুকের মত সপাং করে উঠল রোজামুণ্ডের কণ্ঠ।
সঙ্গে সঙ্গে সংবিৎ ফিরে পেল অলিভার। তাড়াতাড়ি রোজামুণ্ডের দিকে ফিরে বিব্রত গলায় ক্ষমা চাইল। দুঃখিত, আমি আসলে ওভাবে বলতে চাইনি। মিথ্যে অপবাদ শুনে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। প্লিজ, বিশ্বাস করো, পিটারকে আমি খুন করিনি। তোমাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। হয়তো শুনেছ, গতকাল আমার মুখে চাবুক মেরেছে পিটার… এই দেখো, এখনও তার দাগ আছে। অন্য কেউ হলে তখুনি খুন করত ওকে। কিন্তু আমি করিনি। হ্যাঁ, রাগ হয়েছিল খুব… ওর পিছুও নিয়েছিলাম, তবে শেষ পর্যন্ত তোমার কথা ভেবে নিজেকে সংযত করেছি। ভাগ্যের পরিহাসে শেষ পর্যন্ত মারা গেছে ও, কিন্তু আমার হাতে নয়! বিশ্বাস করো… বিশ্বাস করো!
তোমার কথায় বিশ্বাস করবার কোনও প্রশ্নই আসে না! বলে উঠলেন সার জন।
ঝট করে তাঁর দিকে মুখ ঘোরাল অলিভার। সার জন, এর মধ্যে আপনি নাক না গলালেই খুশি হব আমি। আমাকে খুনি ভেবে বোকামির পরিচয় দিচ্ছেন আপনি, আর বোকার পরামর্শ প্রয়োজন নেই রোজামুণ্ডের।
এর মধ্যে বোকামির কী আছে?
বোকামি নয়? সবার সামনে আমাকে আক্রমণ করেছে পিটার, এমন একটা ঘটনার প্রতিশোধ আমি চোরাগোপ্তাভাবে নেব কেন? সাক্ষী রেখে… জনসমক্ষে নেয়াই কি যুক্তিসঙ্গত ছিল না? তাতে কেউ অভিযোগের আঙুল তুলতে পারত না আমার দিকে। মান-ইজ্জতও রক্ষা পেত। কী ধারণা আপনার-জেনেশুনে ফাঁসিতে ঝোলার মত একটা কাজ করেছি আমি?
গম্ভীর হয়ে গেলেন সার জন। ভাল একটা যুক্তি খাড়া করেছে বটে অলিভার। আর যাই হোক, খামোক নিজের ঘাড়ে বিপদ নেবার মত মানুষ সে নয়।
কিন্তু ওর এই যুক্তি প্রভাব ফেলল না রোজামুণ্ডের মধ্যে। থমথমে গলায় বলল, এখনও তুমি মিথ্যে কথা বলছ, অলিভার। পিটারের লাশের পাশে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের রেখা পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়েছে আমাকে… ওটা চলে গেছে একেবারে পেনারো হাউস পর্যন্ত! তুমি যদি ওকে খুন করে না থাকো, তা হলে কোত্থেকে এল ওই রক্তের রেখা?
মুখ থেকে রক্ত সরে গেল অলিভারের। বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ, এবার কাঁধ ঝুলে পড়ল। পরিবর্তনটা দৃষ্টি এড়াল না বাকি দুজনের।
রক্ত? নিচু গলায় বলল ও।
হ্যাঁ, অলিভার… জবাব দাও! দৃঢ় গলায় বললেন সার জন। দ্বিধা কেটে গেছে তাঁর।
এর জবাব দিতে পারব না আমি, শান্ত গলায় বলল অলিভার। হয়তো পাওয়া গেছে রক্তের দাগ, কিন্তু তাতে প্রমাণ হয় না যে, আমিই খুন করেছি পিটারকে।
বড়ই খোঁড়া শোনাল যুক্তিটা। হতাশায় মাথা নাড়ল রোজামুণ্ড, ধপ করে বসে পড়ল একটা চেয়ারে। সন্দেহের শেষ রেখাও মিলিয়ে গেছে ওর মন থেকে। দুহাতে মুখ ঢাকল।
তা হলে কী প্রমাণ হয় ওতে? প্রশ্ন করলেন সার জন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল অলিভার। দুঃখিত, এ-ব্যাপারে কিছুই বলতে পারব না আমি। বলে কোনও লাভও হবে না। রোজামুণ্ড কিছুতেই বিশ্বাস করবে না আমাকে। ও মনস্থির করে ফেলেছে।
ভেজা চোখে ওর দিকে তাকাল রোজামুণ্ড। আর কী বিকল্প-ই বা আছে আমার? তুমি আমার হৃদয় ভেঙে দিয়েছ, অলিভার। তোমার যে-কোনও অপরাধ, যে-কোনও ভুল আমি মেনে নিতে পারতাম, কিন্তু তাই বলে আমার ভাইয়ের খুন…না, এ ক্ষমা করা যায় না।
তা হলে তুমি আমাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইছ?
অবশ্যই। খুন করেছ তুমি… তার বিচার হতেই হবে!
কীসের বিচার? প্রমাণ কোথায়? রক্তের দাগ? ওটার কথা শুনে তুমি বিভ্রান্ত হতে পারো, কিন্তু বুদ্ধিমান কোনও বিচারক হবে না।
সেটা যথাসময়ে দেখা যাবে, অলিভার, কঠিন হয়ে উঠল রোজামুণ্ডের গলা। আমি তোমাকে এত সহজে পার পেতে দেব না।
ঈশ্বর তোমার সহায় হোন, বিড়বিড় করল অলিভার। তারপর বেরিয়ে এল গডলফিন কোর্ট থেকে।
ভারী হৃদয় নিয়ে বাড়ি ফিরল ও। কেমনতরো ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে ওর জন্যে, তা জানে না। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত, ভুল ভেঙে যাবার পর আবার ওর কাছে ফিরে আসবে রোজামুণ্ড, ক্ষমা চাইবে। সেই সময়েরই এখন প্রতীক্ষা। এরমাঝে কেউ যদি ওকে ফাঁসিতে চড়াতে আসে, তার উপযুক্ত জবাব দেবে অলিভার। ততদিন পর্যন্ত খেয়াল রাখতে হবে লায়োনেলের দিকে–ওর কোনও ক্ষতি হতে দেয়া যাবে না। সুস্থ হবার পর ওকে বোঝাতে হবে নিজের সমস্যা–তাতে হয়তো শুভবুদ্ধির উদয় হবে ছেলেটার মাথায়। বিবেকের তাড়নায়… স্বেচ্ছায় হয়তো রাজি হবে। জবানবন্দি দিতে, নির্দোষ প্রমাণ করবে বড় ভাইকে।
রাতে বিছানায় শুয়ে খামোকাই গড়াগড়ি করল অলিভার, কিছুতেই ঘুমাতে পারল না। মন অস্থির হয়ে আছে। বার বার ভাবছে রোজামুণ্ডের কথা। না, ওকে ভুল বোঝার জন্য মেয়েটাকে দোষ দিতে পারছে না। কামারশালার ঘটনা, তারপর আবার পেনারো হাউস পর্যন্ত লায়োনেলের রক্তের দাগ… এ-দুইয়ে মিলে ওর সন্দেহ জোরালো হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। সত্যি কথা না বলে অলিভারও তো অন্যায় করেছে ওর সঙ্গে। দিনের পর দিন লোকমুখে ওর বদনাম শুনেছে মেয়েটা, কিন্তু ওকে ভালবাসে বলে উড়িয়ে দিয়েছে সব অভিযোগ। সেই বিশ্বাসের কী প্রতিদান দিল আজ অলিভার? জানাল না ওকে ভাইয়ের খুনির পরিচয়-এ কি এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা নয়?
কিন্তু কিছুই করার নেই অলিভারের। লায়োনেল অসুস্থ, ওর মতামত না নিয়ে সত্যি ঘটনা ফাঁস করে দিলে আরেক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা করতে হয় ওকে। সেটা কিছুতেই সম্ভব নয়। ভুল বুঝুক প্রেমিকা, কিন্তু রক্তের সম্পর্কের সঙ্গে বেঈমানী করতে পারবে না ও কিছুতেই।
.
ধীরে ধীরে গড়াতে থাকল সময়। কয়েকদিন পরে খবর পেল অলিভার-ট্যুরো-তে গিয়ে ওর নামে মামলা করতে চেয়েছেন সার জন। কিন্তু ওখানকার বিচারক, মাস্টার গ্রেগরি বেইন, রাজি হননি সেটা লিপিবদ্ধ করতে। কামারশালার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। সোজাসাপ্টা ভাষায় বলে দিয়েছেন-অলিভার যদি পিটারকে খুন করে থাকে, তা হলে অন্যায় কিছু করেনি। নিজের সম্মান বাঁচিয়েছে। এর জন্য ওর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করবেন না তিনি কিছুতেই।
খবরটা নিয়ে এলেন সার অ্যান্ড্রু ফ্ল্যাক, পেনরিনের যাজক-ওই ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী। সঙ্গে এ-ও জানালেন, বিচারকের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন তিনি। পিটার গডলফিনের উদ্ধত আচরণ তো তিনি নিজ চোখে দেখেছেন।
ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানাল অলিভার তার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল মাস্টার বেইনের প্রতিও। কিন্তু এ-ও জানিয়ে দিল, পিটারের হত্যাকাণ্ডে ওর কোনও হাত নেই, আপাতদৃষ্টিতে ঘটনা যা-ই দেখাক না কেন।
ব্যাপারটা তখনকার মত ওখানেই চুকেবুকে গেল। কিন্তু কয়েকদিন পরেই নতুন খবর এল অলিভারের কাছে–পুরো এলাকাবাসী নাকি খেপে গেছে মাস্টার বেইনের উপর, একজন খুনির প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছেন বলে। মিছিল-মিটিং করে বেড়াচ্ছে তারা, জায়গা-জায়গায় বিচারকের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছে। দাবি তুলছে তার পদত্যাগের।
এ-পরিস্থিতিতে চুপ করে থাকার কোনও মানে হয় না। সার অ্যাকে ডেকে পাঠাল অলিভার, তাঁর সঙ্গে রওনা হলো ট্যুরো-র দিকে। ওখানে পৌঁছে সরাসরি দেখা করল মাস্টার বেইনের সঙ্গে। বিচারকের বাড়ির লাইব্রেরিতে একসঙ্গে বসল সবাই।
মাস্টার বেইন, শুরু করল অলিভার, প্রথমেই আপনার সৎসাহসের জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই, আমার পক্ষ নেয়ায়… পিটার গডলফিন আমার সঙ্গে কী ধরনের অসদাচরণ করেছিল, সেটা সবার সামনে প্রকাশ করায়। কিন্তু আপনার এই বদান্যতার সুযোগ নিতে চাই না আমি। আজ এখানে এসেছি সমস্ত অভিযোগ খণ্ডন করবার জন্য। প্রমাণ করে দিতে–আমি পিটারকে খুন করিনি।
আপনি করেননি? বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন মাস্টার বেইন।
জী না, সার।
তা হলে কে?
এ প্রশ্নের জবাব আমি এ-মুহূর্তে দেব না। ভবিষ্যতে কোনোদিন হয়তো জানবেন আপনারা। আজ আমি শুধু নিজের নির্দোষিতার প্রমাণ দেব।
কিছু মনে করবেন না, সার অলিভার, বললেন বেইন। আপনি যদি মাস্টার গডলফিনকে খুন করেও থাকেন, আইন কিছু বলবে না। সেদিনকার ঘটনা আমি নিজ চোখে দেখেছি।
ধন্যবাদ, কিন্তু সত্যিই খুন করিনি আমি। সেটা এখুনি বুঝতে পারবেন। গলা খাকারি দিল অলিভার। আমার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে রক্তের দাগ–পিটারের লাশের পাশ থেকে ওটা নাকি পেনারো হাউস পর্যন্ত এসেছে, তাই না? সবাই ধরে নিচ্ছে ওটা খুনির রক্ত, পিটারের হাতে জখম হয়েছে সে। একটু থেমে সবার চেহারা জরিপ করে নিল ও। কৌতূহলী হয়ে উঠেছে শ্রোতারা। হ্যাঁ, আমিও মানছি ওটা খুনিরই রক্ত। আর সেক্ষেত্রে আরও একটা ব্যাপার মেনে নিতে হয়–লড়াইয়ে ভালরকম জখম হয়েছে মানুষটা, নইলে এত রক্ত ঝরবার কথা না। এখন… আমিই যদি পিটারের খুনি হয়ে থাকি, তা হলে ধরে নিতে হবে জখমটা আমার শরীরে রয়েছে। আমি আপনাদেরকে দেখিয়ে দিতে চাই আমার গায়ে একটাও আঘাত নেই। কাজেই আমি পিটারের খুনি নই… হতে পারি না।
নিচু স্বরে সার অ্যা-র সঙ্গে কথা বলে নিলেন মাস্টার বেইন। তারপর সায় জানালেন, আপনার প্রস্তাব যুক্তিসঙ্গত। ঠিক আছে, দেখান।
অন্তর্বাস ছাড়া বাকি সব পোশাক খুলে ফেলল অলিভার। ওর পুরো শরীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন দুই বৃদ্ধ। বলা বাহুল্য, গালের সামান্য কাটা-টুকু ছাড়া আর কোনও ক্ষত পেলেন না। শেষে একটা কাগজে লিখে নিলেন পরীক্ষার ফলাফল। সেটাই সই করলেন দুজনে।
মনে হচ্ছে সত্যি কথাই বলেছেন আপনি, বললেন মাস্টার বেইন। আপনার শরীরে কোনও জখম নেই, তারমানে লাশের পাশ থেকে রক্তের যে-দাগ গেছে পেনারো হাউস পর্যন্ত, তা আপনার নয়।
আপনি তো সন্তুষ্ট হলেন, এবার বাকিদেরকে সন্তুষ্ট করবার পালা। পোশাক পরে দুই বৃদ্ধের সই করা কাগজটা পকেটে নিয়ে নিল অলিভার। খুব শীঘ্রি ওটা মেলে ধরবে রোজামুণ্ড আর সার। জনের চোখের সামনে। দেখা যাক, তখন ওরা কী বলে।