৪. ধর্মান্তর

০৬.

ধর্মান্তর

ছেলের মুখে শাকের-আল-বাহারের ইংল্যাণ্ড অভিযানের বিবরণ শুনে অস্থিরতা অনুভব করল ফানযিলাহ্। গত কিছুদিন কায়োমনোবাক্যে প্রার্থনা করেছে সে দেবদেবী আর আল্লাহ্-র কাছে, কিন্তু সে-প্রার্থনা বিফল করে দিয়ে ফিরে এসেছে শাকের-আল-বাহার… দুংসংবাদ হিসেবে এটুকুই যথেষ্ট। তার ওপর এবার সে নিয়ে এসেছে কল্পনাতীত ধনসম্পদ, সেইসঙ্গে দুদুটো খ্রিস্টান জাহাজ! সন্দেহ নেই, এবার তার প্রতি বাদশাহ্-র অনুরাগ আরও বেড়ে যাবে; সাধারণ জনগণও ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে শুরু করবে তাকে। ভাবনাটা বজ্রাহতের মত স্থবির করে ফেলল ফানযিলাহকে। শোকে এতই মূহ্যমান হলো যে, অভিশাপও দিতে পারল না শাকেরকে।

প্রাথমিক ধাক্কাটা অবশ্য কেটে গেল খানিক পর। চিন্তা-ভাবনা পরিষ্কার হয়ে এল। ওসমানির কাহিনির খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করতে শুরু করল সে।

ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত না? আপনমনে বলে উঠল ফানযিলাহ্। এত ঝুটঝামেলা করে ইংল্যাণ্ডে গেল শাকের দুজন মাত্র বন্দিকে আনার জন্য! সত্যিকার কর্সেয়ারের মত হামলা চালিয়ে ওর তো জাহাজ-ভর্তি দাস নিয়ে ফিরে আসার কথা! উঁহু, কী যেন মিলছে না।

নিজের কামরায় বসে আছে বেগম। জানালার সবুজ পর্দা। ভেদ করে ভেসে আসছে বাইরের বাগানের সুবাস, শোনা যাচ্ছে একটা নিশাচর পাখির মন-মাতানো গান। তুর্কি চাদর বিছানো ডিভানের উপর আধশোয়া হলো সে, মেহেদি-মাখা পা থেকে খসে পড়ল সোনালি চপ্পল। হাতের উপর মাথা রেখে ছাত থেকে ঝুলন্ত প্রদীপের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। ডুবে গেল ভাবনায়।

অস্থির ভঙ্গিতে কামরার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় পায়চারি করছে মারযাক। ওর পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই কামরাতে।

কী মনে হয় তোমার? ছেলের দিকে একটু পর মাথা ঘোরাল ফানযিলাহ্। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক না?

থামল মারযাক। অস্বাভাবিক তো বটেই, মা। খুবই অস্বাভাবিক।

এর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয় তোমার?

কারণ? ভুরু কোঁচকাল মারযাক। মায়ের সঙ্গে প্রচুর মিল আছে চেহারায়, এখন সেখানে শূন্যতা ভর করল।

হ্যাঁ, কারণ! রাগী গলায় বলল ফানযিলাহ্। ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করতে পারো না? মনে হচ্ছে একটা বেকুবকে জন্ম দিয়েছি। খ্রিস্টান এক বহুরূপী যখন তোমার গায়ে সিঁড়ির মত পা দিয়ে সিংহাসনে উঠে বসবে, তখনও কি এভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে চাও? অমন সন্তান জন্ম দেবার আগেই তাকে গলা টিপে মেরে ফেলা দরকার ছিল আমার।

মায়ের সিসিলিয়ান ক্রোধের সামনে কুঁকড়ে গেল মারযাক। একটু আহতও হলো–গর্ভধারিণীর মুখে এমন অপমান তো ওর পুরুষত্বের অপমান!

কী করার আছে আমার? বলল সে?

আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? মাথা খাটিয়ে নিজেই একটা কিছু বের করতে পারছ না? এভাবে চলতে থাকলে কদিন পর ওই খ্রিস্টানের বাচ্চার সামনে মাথা নোয়াতে হবে তোমাকে। লোকে হাসবে আমার দিকে তাকিয়ে… বলবে একটা নপুংসক জন্ম নিয়েছে আমার গর্ভে। হায় আল্লাহ্, তার চেয়ে আমাকে বাঁজা বানিয়ে রাখোনি কেন?

থামো মা! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মারযাক। এভাবে আর অপমান কোরো না আমাকে। পথ দেখাও… বলে দাও কী করতে হবে। তা যদি না পারি, তখন নাহয় কথা শুনিয়ে। তার আগ পর্যন্ত রাগারাগি কোরো না। তা হলে কিন্তু আমি তোমার কাছে আসা বন্ধ করে দেব।

ছেলের হুমকি শুনে ঝট করে সিধে হলো ফানযিলাহ্। ডিভান থেকে নেমে ছুটে গেল তার কাছে, জড়িয়ে ধরল দুহাতে। পরম মমতায় টেনে নিল বুকে। বাদশাহ্-র হারেমের আঠারো বছরেও তার ভিতরের ইয়োরোপীয় মাতৃ-সত্তা বদলে যায়নি। কোমল নয়, সন্তানের প্রতি হিংস্র… আগ্রাসী তার ভালবাসা।

পুত্র আমার, মারযাকের মাথায় হাত বুলিয়ে ভারী গলায় বলল ফানযিলাহ্, ভয় পাই আমি তোমার জন্য, আর সেটাই আমাকে রূঢ় হতে বাধ্য করছে। রাগ নয়, আসলে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ওটা। তুমি নও, বাইরের এক লোক তোমার আব্বার উত্তরাধিকারী হবে–এটা ভাবলেই মাথা এলোমেলো হয়ে যায় আমার। কী বলি, তা নিজেও জানি না। কিছু মনে কোরো না। জয় আমাদেরই হবে, বাছা। তোমাকে কিছু করতে হবে না, যা করার আমিই করব। বিদেশি ওই বদমাশটাকে ফেরত পাঠাব তার জন্মস্থানে! আস্থা রাখো আমার উপর। পায়ের শব্দ পেয়ে একটু থামল সে। মনে হচ্ছে তোমার আব্বা আসছে। যাও, ওঁর সঙ্গে একা থাকতে দাও আমাকে।

মাথা ঝাঁকিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল মারযাক। একটু পর দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন আসাদ-আদ-দীন। দাড়িতে হাত বোলাচ্ছেন, সারা মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। দায়সারা ভঙ্গিতে তাকে অভ্যর্থনা জানাল ফানযিলাহ্।

আশা করি খবর তুমি শুনেছ, ফানযিলাহ্? বললেন বাদশাহ্। তোমার সমস্ত প্রশ্নের জবাব মিলেছে তো?

আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াতে শুরু করল ফানযিলাহ্। হালকা গলায় বলল, জবাব? হ্যাঁ, এক অর্থে জবাব তো বটেই। শাকের-আল-বাহার দুইশ মুসলমানের জীবন বিপন্ন করে ইংল্যাণ্ডে অভিযান চালিয়েছে মাত্র দুজন বন্দি নিয়ে ফিরে আসার জন্য। দুজন, মালিক! জোর দিল সে। অথচ ওর উদ্দেশ্য ঠিক থাকলে দুইশ নিয়ে ফিরতে পারত।

হাহ! তুমি বুঝি এই-ই শুনেছ? বাঁকা সুরে বললেন বাদশাহ্।

এটুকুই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে আমার কাছে, আয়না থেকে চোখ সরাল না ফানযিলাহ্। হ্যাঁ, এ-ও শুনেছি যে ফেরার পথে কপালজোরে একটা খ্রিস্টান ডাচম্যানের দেখা পায় ও… দামি মালামালে ভর্তি… আপনার নামে সেটাকে দখল করেছে।

কপালজোরে মানে?

নয়তো কী? এবার ঘুরল ফানযিলাহ্। দৃঢ় গলায় প্রশ্ন করল, আপনার কি ধারণা ওটা শাকেরের মূল পরিকল্পনার অংশ ছিল?

একটু যেন থমকে গেলেন আসাদ-আদ-দীন। মাথা নিচু করে ভাবতে শুরু করলেন।

স্বামীর এই দ্বিধার সুযোগ নিতে দেরি করল না ফানযিলাহ্। বলল, পুরোটাই ভাগ্যের খেলা–একটা ডাচম্যান পড়ে গিয়েছিল শাকেরের সামনে। আরও বড় ভাগ্য-ওটার খোল সোনা-দানা আর হীরা-জহরতে ভর্তি ছিল। ওসবের কারণে অন্ধ হয়ে গেছেন আপনি, দেখতে পাচ্ছেন না এই অভিযানের পিছনে লোকটার সত্যিকার উদ্দেশ্য।

সত্যিকার উদ্দেশ্য? বললেন বাদশাহ্। কী সেটা?

মন-ভোলানো হাসি ফুটল ফানযিলাহ্-র ঠোঁটে, এমন ভাব যেন কিছুই অজানা নেই তার–আসলে ওটা নিজের অজ্ঞতা ঢাকার কৌশল। বলল, এ-প্রশ্ন আপনি আমাকে করছেন, মহান বাদশাহ্? আপনার দৃষ্টি কি তীক্ষ্ণ নয়? আপনার বুদ্ধি কি যথেষ্ট প্রখর নয়? যে-জিনিস আমার কাছে পরিষ্কার, সেটা আপনার কাছে হবে না কেন? তা হলে কি ধরে নেব শাকের-আল-বাহার আপনাকে জাদুটোনা করেছে?

ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন আসাদ-আদ-দীন। এগিয়ে গিয়ে খপ করে একটা কবজি ধরলেন স্ত্রী-র। ধমকের সুরে বললেন, শাকেরের উদ্দেশ্য বলো, বেগম। পেটের মধ্যে গোমর লুকিয়ে রেখে আমার সঙ্গে মশকরা কোরো না। কথা বলো!

উঠে দাঁড়াল ফানযিলাহ্। রূঢ় গলায় বলল, আমি কিছু বলতে চাই না।

বলতে তোমাকে হবেই! গর্জে উঠলেন আসাদ। নইলে আল্লাহ্-র কসম, তোমাকে আমি চাবুকপেটা করব। এত বছরে যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছি আমি তোমার ব্যাপারে, তুমি তাই ভুলেই গেছ-অবাধ্য স্ত্রীকে শাস্তি দেবার বিধান আছে। আমার প্রশ্নের জবাব দাও, নইলে নিজের দুর্দশার জন্য তুমিই দায়ী হবে!

তবু বলব না, সরোষে বলল ফানযিলাহ্। ফাঁসিতে চড়ান আমাকে, তবু শাকের-আল-বাহারের বিরুদ্ধে একটা শব্দও উচ্চারণ করব না আমি। কেন করব? আপনি বিশ্বাস করবেন আমার কথা? আজ পর্যন্ত করেছেন? সত্যি কথা বলার পরেও যখন মিথ্যেরাদিনীর অপবাদ জোটে কপালে… তখন আর সত্য বলে লাভ কী? নিখুঁত অভিনয়ের মাধ্যমে এবার চোখের পানি ফেলতে শুরু করল সে। স্বামীর আমার… আমার প্রাণের মালিক… অন্যায় করছেন আপনি আমার সঙ্গে। মস্ত অন্যায়! হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বাদশাহ্-র পায়ের কাছে। ভালবাসার বিনিময়ে আপনি আমাকে শুধু ক্রোধ উপহার দিচ্ছেন। তার ভারে আমি চাপা পড়ে গেছি…

ঝটকা দিয়ে স্ত্রী-র হাত ছেড়ে দিলেন আসাদ-আদ-দীন। থামাও এসব ন্যাকামি! উল্টো ঘুরে বেরিয়ে গেলেন কামরা থেকে। জানেন, এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ছলনাময়ী বেগমের কথার জালে আটকা পড়ে যাবেন।

কিন্তু ততক্ষণে উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে গেছে ফানযিলাহ-র। বাদশাহ্-র মনে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে সে, সেটা ছড়াতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে। সন্দেহটা ঠিকই ঘুরপাক খাচ্ছে-শাকের কেন গিয়েছিল ইংল্যাণ্ডে… কেন মাত্র দুজন বন্দি নিয়ে ফিরেছে ওখান থেকে? এর পিছনে সত্যিই কি কোনও গূঢ় কারণ আছে? শাকেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা ছাড়া বিষয়টা পরিষ্কার করার উপায়– নেই, আর সেজন্যে অপেক্ষা করতে হবে পরদিন সকাল পর্যন্ত যখন সে লুণ্ঠিত মালামাল ভেট হিসেবে বাদশাহ্-র পায়ে নিবেদন করতে আসবে।

আগের মতই প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে থাকলেন আসাদ আদ-দীন, কিন্তু এবার তাতে আগের মত উচ্ছ্বাস রইল না।

.

নিজের জাহাজের পুপ-ডেকে আস্তে আস্তে পায়চারি করছে শাকের-আল-বাহার। বন্দরের ওপাশে, পাহাড়ি ঢলের কোলে গড়ে ওঠা নগরীর বুকে তখন নিভে যেতে শুরু করেছে কৃত্রিম আলো। ঘুমিয়ে পড়ছে সবাই। আকাশ থেকে শুভ্র আলোয় প্রকৃতিকে এখন স্নান করাচ্ছে মস্ত চাঁদ। সে-আলোয় ঝিলমিল করছে বন্দরের শান্ত পানি।

শরীরের ক্ষত শুকিয়ে গেছে ওর, শক্তিও ফিরে পেয়েছে অনেকখানি। দুদিন আগে বেরিয়ে এসেছে ডেকে, সেই থেকে বেশিরভাগ সময় খোলা আকাশের নীচে কাটিয়েছে। এর মধ্যে একবার শুধু দেখতে গেছে দুই বন্দিকে। রোজামুণ্ড একটু শুকিয়েছে, চেহারাও ফ্যাকাসে, কিন্তু অটুট মনোবল লক্ষ করা গেছে ওর মধ্যে। গডলফিন পরিবারের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে, ভেঙে পড়েনি কিছুতেই। অলিভারকে তার কেবিনে ঢুকতে দেখে একটু অবাক হয়েছিল, কারণ আরওয়েনাকের সে-রাতের পর আর সামনে আসেনি সে… কিন্তু বিস্ময়টা ছিল ক্ষণিকের। পরমুহূর্তে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে শক্ত খোলসের মধ্যে। কথা বলেনি, তাকায়নি চোখ তুলেও। মুখোমুখি বসে কথা বলবার যথেষ্ট চেষ্টা করেছে অলিভার, কিন্তু চরম ঘৃণা নিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে মেয়েটা। নিজেকে বড় ছোট মনে হয়েছে অলিভারের, বেশিক্ষণ অপমানিত হবার প্রবৃত্তি হয়নি। বেরিয়ে এসেছে কেবিন থেকে।

এরপর ভাইকে দেখতে গিয়েছিল ও। জাহাজের পাটাতনের তলায় অন্ধকার খুপরিতে বিধ্বস্ত অবস্থায় পেয়েছে তাকে। মুখ আমসি, অপরিচ্ছন্ন শরীর… সব মিলিয়ে চরম অসম্মানজনক একটা অবস্থা। কিন্তু এক ফোঁটা অভিযোগ করেনি লায়োনেল, বরং বড় ভাইকে দেখে সিটিয়ে গেছে সে, হারিয়েছে মুখের ভাষা… বোধহয় নিজের অপরাধের উপলব্ধি এসেছে তার ভিতর। ক্ষমাও চাইবার সাহস হয়নি। অলিভারও কিছু বলেনি তাকে, নীরবে ফিরে এসেছে উপরের ডেকে। সেই থেকে ওখানেই সময় কাটিয়েছে ও।

আজ রাতে… চাঁদের আলোয় যখন পায়চারি করছে শাকের, একটা ছায়ামূর্তি উদয় হলো তার পিছনে। ডাকল ওর পুরনো নামে।

সার অলিভার!

ভুরু কুঁচকে উল্টো ঘুরল ও। জ্যাসপার লেই দাঁড়িয়ে আছে কয়েক গজ দূরে। কাছে এসো। তোমাকে না কতবার বলেছি, সার অলিভারের কোনও অস্তিত্ব নেই? আমি এখন শাকের আল-বাহার… রাসূলের অনুসারী। এই নামেই ডাকবে আমাকে।

জী।

কী বলতে এসেছ?

একটা প্রশ্ন আছে–আমি কি বিশ্বস্ততার সঙ্গে আপনার দেয়া দায়িত্ব পালন করিনি?

কেউ কি সেটা অস্বীকার করেছে?

না। কিন্তু স্বীকৃতিও তো পেলাম না। ভেবে দেখুন, আপনি যখন আহত হয়ে পড়ে ছিলেন, তখন কিন্তু চাইলেই বেঈমানী করতে পারতাম। জাহাজদুটোকে যদি ভুল পথ দেখিয়ে টেগাস নদীর মুখে নিয়ে যেতাম, কী-ই বা করার ছিল আপনার লোকের?

টের পাওয়ামাত্র তোমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলত ওরা।

তার আগেই যদি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তাম? সাঁতার কেটে জমিনে উঠে যেতাম?

তা হলে আমাদের চেয়ে ভয়ঙ্কর আরেক দল লোকের কবলে পড়তে। দুদিন না যেতেই দেখতে, ক্যাথলিক ম্যাজেস্টির জাহাজে দাঁড় টানতে শুরু করেছ। যাক গে, এ-সব ফালতু ব্যাপার নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। তুমি তোমার কথা রেখেছ, আমিও আমারটা রাখব। ভয়ের কিছু নেই তোমার।

তা আমি করছিও না। কিন্তু আমাকে বাড়ি পাঠাবেন বলে কথা দিয়েছেন আপনি…

তো?

সমস্যা হলো, আমার কোনও বাড়ি নেই… কোনও ঠিকানা নেই। এতকাল পরে নতুন করে ঘর বাঁধাও সম্ভব নয় আমার পক্ষে। যদি আমাকে ফেরত পাঠান, তা হলে আমি ঠিকানাহীন এক যাযাবরে পরিণত হব।

তা হলে কী চাও তুমি?

সত্যি বলতে কী, খ্রিস্টান জাত আর খ্রিস্টধর্মের উপর বিতৃষ্ণা এসে গেছে আমার। এমনিতেও ধর্মে-টর্মে বিশ্বাস নেই আমার। কাজের মানুষ আমি, সার অলি… দুঃখিত, শাকের-আল বাহার। গোটা ইংল্যাণ্ডে আমার চেয়ে ভাল দিক-নির্দেশক পাবেন আপনি, সাগরের লড়াইয়ের ব্যাপারেও আমার আছে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। আমাকে আপনি কাজে লাগাতে পারেন না?

আমার মত দলত্যাগী হতে চাও তুমি?

দলত্যাগী শব্দটা আমার বড়ই অপছন্দ। কে কোন্ পক্ষ অবলম্বন করছে, তার উপর নির্ভর করছে ওটা। তারচেয়ে সোজা ভাষায় এটুকু বললেই হয়, আমি মুহাম্মদের ধর্মে দীক্ষিত হতে চাই।

কিন্তু এ-ধর্মে যোগ দিলে জলদস্যুতা আর সাগরে লুটপাটের কাজে অংশ নিতে হবে তোমাকে।

ওটা তো নতুন কিছু নয়। এতদিন জলি রজার্সের পতাকার তলে করেছি ও-কাজ, এখন নাহয় অন্য একটা পতাকার তলে করব।

মুসলমানরা মদ খেতে পারে না। তোমাকেও ছাড়তে হবে ওসব।

একটু-আধটু ত্যাগ স্বীকার নাহয় করলামই! তার প্রতিদানও তো পাব।

চুপ করে একটু ভাবল অলিভার। লেইয়ের কণ্ঠে কোনও কপটতা লক্ষ করেনি। সত্যিই আন্তরিক সে। স্বজাতির একজন লোক হাতের কাছে থাকলে মন্দ হয় না। হোক সে জ্যাসপার লেইয়ের মত একজন মানুষ।

ঠিক আছে, তোমার কথাই সই, একটু পর বলল ও। জীবনে অনেক মন্দ কাজ করেছ, তারপরেও যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করো, আমার সঙ্গে রাখতে রাজি আছি তোমাকে। কিন্তু কড়া নজর থাকবে আমার। যদি একটুও তেড়িবেড়ি করো… যদি সামান্যতম বিশ্বাসঘাতকতার আভাসও পাই, সোজা ফাঁসিতে লটকাব। পরপারে গিয়েও রেহাই পাবে না, নরকে পুড়তে হবে তোমাকে।

আবেগের উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হলো লেইয়ের চেহারায়। হাঁটু গেড়ে অলিভারের হাত ধরল, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল উল্টোপিঠে চুমো খেয়ে। ধন্যবাদ! বলল সে। আমি রাজি। পাওয়া উচিত নয়, তবু আমার প্রতি দয়া দেখিয়েছেন আপনি, এ-ঋণ শোধ হবার নয়। আমার বিশ্বস্ততা নিয়ে কিছু ভাববেন না। আমার জীবন এখন আপনার সম্পত্তি, যা বলবেন তা-ই অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।

লেইয়ের হাতে চাপ দিল অলিভার, মুখে কিছু বলল না। উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নুইয়ে আবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল লোকটা। তারপর সিঁড়ি ধরে নেমে গেল পুপ-ডেক থেকে। মন আনন্দে উদ্বেল, তার অন্ধকার জীবনে দেখা দিয়েছে আলোর দিশা।

.

০৭.

মারযাকবিনআসাদ

পুরো চল্লিশটা উট প্রয়োজন হলো ডাচম্যান থেকে সমস্ত মালামাল কসবাহ নগরীর প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে যেতে। শাকের-আল-বাহার নিজে তদারক করল এই বিশাল মিছিলের, জানে অমূল্য এই সম্পদ দেখে দুষ্টলোকের মাথায় কুমতলব খেলতে পারে… চেষ্টা করতে পারে সব ছিনিয়ে নেবার। আলজিয়ার্সের সংকীর্ণ রাস্তায় ধনসম্পদের এমন বিপুল সম্ভার আগে কখনও দেখা যায়নি কি না! সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্সেয়ারের উপযুক্ত লুঠ ওটা।

মিছিলের সামনে রয়েছে একশো কর্সেয়ার, পরনে জোব্বা-পাজামা, তার উপরে বর্ম, হাতে ঢাল-তলোয়ার। যে-কোনও ধরনের হামলা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত। ওদেরপিছনে রয়েছে ডাচম্যান থেকে আটক বন্দির দল-হাতে-পায়ে শেকল পরা অবস্থায় পরাজিত ভঙ্গিতে হাঁটছে তারা। চারদিক থেকে তাদেরকে ঘিরে রেখেছে বেশ কিছু কর্সেয়ার–এদের হাতে চাবুক, কেউ তেড়িবেড়ি করলে পিঠে দুঘা বসিয়ে দিতে দ্বিধা করছে না। বন্দি-দলের পরে রয়েছে আরেকদল যোদ্ধা, তাদের পিছনে উটের সারি–প্রত্যেকটার পিঠে বড় বড় বোঁচকা। সবার পিছনে শেষ একদল কর্সেয়ার-পরিবেষ্টিত অবস্থায় এগোচ্ছে স্বয়ং শাকের-আল-বাহার। সাদা একটা তেজী ঘোড়ার পিঠে বসেছে ও, মাথায় সোনালি পাগড়ি, গায়ে কারুকাজ করা বর্ম।

রাস্তার দুপাশ ভরে গেছে মানুষের ঢলে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিটি বাড়ি-ঘরের দরজা-জানালাও ঢাকা পড়ে গেছে কৌতূহলী দর্শকের চেহারায়। বকের মত গলা বাড়িয়ে সবাই একনজর দেখতে চাইছে শাকের-আল-বাহারকে। আবাসিক এলাকা পেরিয়ে বাদশাহ্-র প্রাসাদের কাছে পৌঁছুল শোভাযাত্রা। সেখানে জয়ধ্বনি দিচ্ছে বিচিত্র আরেকদল দর্শক। অভিজাত মূরেরা আছে ওখানে, সঙ্গে ব্যক্তিগত কালো ভৃত্য; রয়েছে উচ্চভূমির তামাটে চামড়ার আরবেরা, গায়ে উটের চামড়ার পোশাক; আরও দেখা গেল লেভান্টিন তুর্কি আর স্পেনের ইহুদি উদ্বাস্তু-দল-ভিন্নধর্মী হলেও খ্রিস্টানদের হাতে অত্যাচারিত হিসেবে তাদেরকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে আলজিয়ার্সে।

সূর্যের প্রখর রোদ অগ্রাহ্য করে এরা অপেক্ষা করছে শাকের-আল-বাহারকে স্বাগত জানাতে। জানালও দেখার মত ভঙ্গিতে। তাদের সম্মিলিত শ্লোগানে কেঁপে উঠল গোটা নগরী, মনে হলো বুঝি ভূকম্প শুরু হবে এখুনি।

প্রাসাদ-সীমানার কাছাকাছি গিয়ে বিভক্ত হলো শোভাযাত্রা। বাইরের একটা আঙিনার উদ্দেশে বন্দিদেরকে নিয়ে গেল ওসমানি, আর ঢালু পথ ধরে উটের সারি নিয়ে এগিয়ে চলল শাকের। খুলে দেয়া হলো প্রাসাদ-ফটক, সেটা পেরিয়ে মূল আঙিনায় প্রবেশ করল প্রাণীগুলো। অপেক্ষারত সহিস-দল এগিয়ে এল, হাঁটু গেড়ে বসাল উটগুলোকে। ব্যস্ত হয়ে পড়ল পরিচর্যায়। শাকের ঢুকল ওগুলোর পিছু পিছু, প্রাসাদরক্ষীরা ওকে সম্মান দেখিয়ে ঘোড়া থেকে নামতে সাহায্য করল।

আঙিনার একপ্রান্তে খাটানো হয়েছে শামিয়ানা। তার ছায়ায় তক্তপোশে বসে আছেন বাদশাহ্ আসাদ-আদ-দীন, সঙ্গে পুত্র মারযাক আর উজির সামানি। সবুজ-সোনালি পোশাকে জনাছয়েক দেহরক্ষী পাহারা দিচ্ছে তাকে। বাদশাহ্-র পাগড়িতে জ্বলজ্বল করছে একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতির দামি পাথর।

উটের সারি যখন আঙিনায় ঢুকছে তখনও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন আসাদ-আদ-দীন। রাতভর ঠিকমত ঘুমাতে পারেননি, ফানযিলাহ্-র ঢোকানো বিষে ছটফট করেছে অন্তর। শাকের-আল-বাহারকে সন্দেহ করতে সায় পাননি মন থেকে, কিন্তু বেগমের যুক্তিকেও একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছিলেন না। পড়ে গিয়েছিলেন উভয়সঙ্কটে। কিন্তু সামনের বিশাল লুঠ দেখবার পর আচমকা দ্বিধা কেটে গেল তাঁর। হাসি ফুটল তাঁর মুখে, উঠে দাঁড়ালেন পুত্রের মত প্রিয় দুর্ধর্ষ যুবকটিকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য।

দৃপ্ত পায়ে হেঁটে শামিয়ানার দিকে এগোল শাকের-আল বাহার। ঋজু দেহ টানটান হয়ে আছে, গর্বিত ভঙ্গিতে উঁচু করে রেখেছে মাথা। প্রতি পদক্ষেপে প্রকাশ পাচ্ছে আভিজাত্য। ওর সঙ্গে রয়েছে অনুচর আলি, আর লালচে চেহারার পাগড়ি-পরা আরেকজন মানুষ ভাল করে তাকালে জ্যাসপার লেই বলে চেনা যাবে তাকে। ইতোমধ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে সে।

বাদশাহ্-র পায়ের কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসল শাকের-আল বাহার। অভিবাদন জানাল, আল্লাহর করুণা আর শান্তি বর্ষিত হোক আপনার উপর, মহামান্য বাদশাহ্!

দুকাঁধ ধরে ওকে হাসিমুখে দাঁড় করালেন আসাদ-আদ-দীন। আলিঙ্গন করলেন আন্তরিক ভঙ্গিতে। প্রাসাদের জানালার আড়াল থেকে নীচের ঘটনা দেখছিল ফানযিলাহ্, দৃশ্যটা তার মাথায় আগুন জ্বেলে দিল, দাঁতে দাঁত পিষল সে নিজের অজান্তে।

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ আর তাঁর রাসূলের–তারাই তোমাকে সুস্থ দেহে ফিরিয়ে এনেছেন, বাছা, বললেন বাদশাহ্। আমার এই বৃদ্ধ হৃদয় আনন্দে ভরে গেছে তোমার বিজয়ের কাহিনি শুনে।

এরপর আবরণ সরিয়ে লুণ্ঠিত মালামাল দেখানো হলো তাঁকে। ওসমানির মুখে বিবরণ শুনেছেন বাদশাহ্, কিন্তু সামনাসামনি সব দেখবার পর বুঝলেন–প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি সম্পদ নিয়ে ফিরেছে শাকের। তার অনুমতি নিয়ে সবকিছু পাঠিয়ে দেয়া হলো কোষাগারে, সঙ্গে গেল উজির সামানি, মালামালের হিসেব-নিকেশ করবে সে। অভিযানে অংশ নেয়া প্রত্যেক কর্সেয়ার পাবে ওর একটা ভাগ, নেতা হিসেবে শাকের পাবে পাঁচ শতাংশ।

একে একে চলে গেল সবাই। শেষ পর্যন্ত প্রাসাদ আঙিনায় রইল মাত্র অল্প কয়েকজন-দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় আসাদ-আদ-দীন ও মারযাক, সেইসঙ্গে শাকের-আল-বাহার, আলি ও জ্যাসপার লেই।. সুযোগ পেয়ে দলের নতুন সদস্যের সঙ্গে বাদশাহকে পরিচয় করিয়ে দিল শাকের, জানাল–অভিজ্ঞ নাবিক ও যোদ্ধা লেইয়ের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবার কথা। আসাদ-আদ-দীনের অনুমতি চাইল তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলে অন্তর্ভুক্ত করবার জন্য।

প্রস্তাবটার তীব্র বিরোধিতা করল মারযাক। বলল, ইতোমধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ নাসরানি কুকুর যোগ দিয়ে ফেলেছে বিশ্বাসীদের দলে। তাদের সংখ্যা বাড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। শাকের-আল-বাহারের দলে এদের অন্তর্ভুক্তি তো আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

শান্ত চোখে তাকে জরিপ করল শাকের। দৃষ্টিতে একই সঙ্গে মিশে আছে ক্ষোভ ও ঘৃণা।

রাসূল (সাঃ)-এর পতাকাতলে নব-মুসলিমদের সমবেত হওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ বলছ তুমি? বলল ও। যাও, পবিত্র কুরআন পড়ে এসো–দেখো, নব-মুসলিমদের প্রতি সত্যিকার মুসলমানের দায়িত্ব সম্পর্কে কী লেখা আছে ওখানে। বাদশাহ্-র পুত্র তুমি, তাই বলে মহান আল্লাহ্-র বাণীকে অগ্রাহ্য করবার অধিকার নেই তোমার। যারা অন্ধকারের পথ ছেড়ে ঈমানের আলোতে এসেছে, অধিকার নেই তাদেরকে নিয়ে মন্দ কথা বলারও। ও-কাজ করতে গিয়ে শুধু আমাকে বা আমার সঙ্গীসাথীকে অপমান করছ না, অপমান করছ নিজের জন্মদাত্রী মা-কেও। কারণ তিনিও আমাদেরই মত এক ধর্মান্তরিত মুসলমান!

কোনও জবাব ফুটল না মারকের ঠোঁটে। পরাজয়ের ভঙ্গিতে পিছিয়ে গেল এক পা, কিন্তু দুচোখ জ্বলে উঠেছে ক্রোধে।

হেসে উঠলেন আসাদ-আদ-দীন। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তুমি সবকিছুই শিখে নিয়েছ শাকের, বললেন তিনি। বলতে বাধ্য হচ্ছি, সাহসিকতার পাশাপাশি তুমি জ্ঞানেরও আধার। জ্যাসপার লেইয়ের দিকে ফিরলেন। তাকে বরণ করে নিলেন বিশ্বাসীদের দলে। নাম বদলে রাখলেন–জ্যাসপার রইস।

আনুষ্ঠানিকতা শেষে শাকের ছাড়া সবাইকে বিদায় করা হলো। প্রিয় কর্সেয়ারকে মধ্যাহ্নভোজে তাঁর সঙ্গী হবার নিমন্ত্রণ জানালেন বাদশাহ্। নিজের পাশে ওকে বসতে দিয়ে খাবার পরিবেশনের নির্দেশ দিলেন।

প্রথমে আনা হলো পরিষ্কার পানি-হাত-মুখ ধোয়ার জন্য। এরপর এল খাবার-রুটি, কয়েক রকমের মাংস, ডিম আর ফলমূল।

বিসমিল্লাহ্ পড়ে খেতে শুরু করল ওরা, ফাঁকে ফাঁকে চলল গল্প। অভিযানের বিস্তারিত বিবরণ শাকেরের মুখে শুনতে চাইলেন বাদশাহ্। সব শোনার পর আরেক দফা প্রশংসা করলেন ওর। হঠাৎ একটা প্রশ্ন ছুঁড়ল মারযাক।

আচ্ছা, তুমি কি মাত্র দুজন ইংরেজ দাস আনবার জন্য এমন দুঃসাহসিক একটা অভিযানে গিয়েছিলে?

প্রশ্নটার মধ্যে ঝামেলার গন্ধ পেল অলিভার। কিন্তু শান্ত গলায় বলল, তা হবে কেন? ওটা আমার পরিকল্পনার সামান্য একটা অংশ ছিল মাত্র। আমার আসল উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহ্-র নামে মহাসাগরে হানা দেয়া।

কিন্তু ডাচম্যানের সঙ্গে দেখা হওয়া তো ছিল ভাগ্যের ব্যাপার, বলল মারযাক, মায়ের শিখিয়ে দেয়া কথা আউড়াচ্ছে সে। এমন কিছু ঘটবে, সেটা নিশ্চয়ই জানতে না আগে থেকে?

জানতাম না? হেঁয়ালি-ভরা একটা হাসি দিল অলিভার। ওর আত্মবিশ্বাস দেখে স্বয়ং বাদশাহ্ ধোঁকা খেলেন। তা হলে কি বলতে চাও, সর্বশক্তিমান আল্লাহ-র তরফ থেকে সাহায্য পাবার কোনও আশা করিনি আমি? তার উপর আস্থা রাখিনি? নির্ভর করেছি শুধু নিজের ভাগ্যের উপর?

চমৎকার জবাব! বললেন আসাদ-আদ-দীন।

কিন্তু এত সহজে হার মানতে রাজি নয় মারযাক। ফানযিলাহ তাকে ভালমত শিখিয়ে-পড়িয়ে দিয়েছে। কণ্ঠে সৌজন্য বজায় রেখে বলল, তারপরেও একটা বিষয় অস্পষ্ট লাগছে আমার কাছে, হে শাকের-আল-বাহার।

কী সেটা?

এত ঝামেলা করে ইংরেজদের দেশে পা রাখলে তুমি, অথচ বন্দি করলে মাত্র দুজন মানুষকে! সঙ্গে যথেষ্ট লোক ছিল… তোমার ভাষ্যমতে মহান আল্লাহর সাহায্যও পাচ্ছিলে… তা হলে আরও বেশি করে দাস সগ্রহ করোনি কেন? চাইলে নিশ্চয়ই শখানেক নিয়ে ফিরতে পারতে?

একটু থমকে গেল অলিভার। চেহারায় কপট সারল্য ফুটিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে মারযাক, বাদশাহ্ও কৌতূহল নিয়ে মাথা ঘুরিয়েছেন। বুঝল–এবার শুধু আল্লাহ্-রাসূলের নাম শুনিয়ে কাজ হবে না, একটা ব্যাখ্যা দিতে হবে ওকে।

আসলে, গলা খাকারি দিয়ে বলল ও, প্রথম যে-বাড়িটা পেয়েছি, সেখান থেকেই আটক করেছি ওই দুই বন্দিকে। কাজটা নিঃশব্দে সারা যায়নি, মনে হচ্ছিল আশপাশের লোকজন টের পেয়ে গেছে। তার ওপর তখন ছিল রাত, জাহাজ থেকে দূরে গিয়ে কোনও গাঁয়ে হামলা চালানো নিরাপদ ছিল না।

আসাদ-আদ-দীন মনে হলো সন্তুষ্ট হলেন না ব্যাখ্যাটায়। মারযাকের মুখে হালকা হাসি ফুটল।

ওসমানি কিন্তু ভিন্ন কথা বলেছে, বলল সে। ও নাকি তোমাকে অনুরোধও করেছে গাঁয়ে হামলা করবার জন্য, তাতে কোনও ঝুঁকি ছিল না। তুমি সে-অনুরোধ অগ্রাহ্য করেছ।

বাদশাহ্-র ভুরু কুঞ্চিত হলো এ-কথা শুনে। অলিভার টের পেল, ওকে ফাঁদে ফেলবার চেষ্টা করছে ধুরন্ধর কিনোর শাহজাদা। মন ভরে গেল তিক্ততায়।

কথাটা কি সত্যি? গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন আসাদ আদ-দীন।

পাল্টা আক্রমণে যাবার সিদ্ধান্ত নিল অলিভার। চোখ রাখল বাদশাহর চোখে। বলল, যদি সত্যি হয়, মালিক? কী করবেন আপনি?

কথা ঘুরিয়ো না। ঘটনা সত্যি কি না জানতে চাই আমি।

আপনার মত জ্ঞানী মানুষের মুখে এমন কথা শুনব, ভাবতে পারিনি, রাগতস্বরে বলল শাকের। ওসমানির কথায় গুরুত্ব দেবেন আপনি? ও আমার আদেশে চলে, নাকি আমি ওর? যদি এতই আস্থা রাখেন ওর উপর, তা হলে নেতৃত্বের ভার ওর কাঁধেই চাপিয়ে দিন না! দেখা যাক, আল্লাহ্-রাসূলের নামে ইসলামের জয়যাত্রা কেমন চালায় ও!

একটু যেন রুষ্ট হলেন আসাদ-আদ-দীন। অল্পতেই রেগে যাচ্ছ তুমি! অভিযোগ ফুটল তার গলায়।

আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলুন, মহানুভব, আমার রাগ কি অন্যায্য? বলল শাকের। পুরো বছরে যা সম্ভব হয় না, একটামাত্র অভিযান থেকে সে-পরিমাণ সম্পদ নিয়ে ফিরেছি আমি। অথচ এমন সাফল্য পাবার পরেও একটা বাচ্চা ছেলে আমাকে তিরষ্কার করছে–ওসমানির কথা আমি শুনিনি কেন!

ঝট করে উঠে দাঁড়াল ও, রাগে থমথম করছে চেহারা। আসলে পুরোটাই অভিনয়। বুঝে গেছে, সন্দেহের যে-তীর ছোঁড়া হয়েছে ওর দিকে, তা ধ্বংস করতে হবে আবেগের তীব্রতা দেখিয়ে। বলে চলল, কেন শুনব আমি ওসমানির কথা? ওর কথা শুনলে কি আজ আপনার পায়ে রাজ-সম্ভার নিবেদন করতে পারতাম আমি? আমার সাফল্য কি আমার প্রতিটা কাজের জবাব দিচ্ছে না? ওর কথামত চললে যদি বিপর্যয় দেখা দিত… যদি ব্যর্থ হতো অভিযান… তা হলে কার ঘাড়ে দোষ বর্তাতেন আপনি, মালিক? আমার, নাকি ওসমানির? ওর নাম তুলে এভাবে আমাকে ছোট করবেন না দয়া করে।

উদ্দেশ্য সফল হলো অলিভারের। প্রিয় কর্সেয়ারকে খেপে যেতে দেখে বাদশাহ্ একটু নরম হয়ে এলেন। সন্দেহের ছাপ মিলিয়ে গেল চেহারা থেকে। সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বললেন, শান্ত হও, শাকের। বড্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছ তুমি। কেউ কোনও অভিযোগ করছে না তোমার বিরুদ্ধে। তোমার বিচার-বুদ্ধির উপর আস্থা আছে আমার। আশা করি যুক্তিসঙ্গত কারণেই অগ্রাহ্য করেছ ওসমানির অনুরোধ। এ-নিয়ে আর কোনও উচ্চবাচ্য হবে না।

মাফ করবেন, মহানুভব, গলার স্বর বদলাল অলিভার। আপনার প্রতি আমার আনুগত্য আর ধর্মের প্রতি বিশ্বাসের গায়ে আঁচড় লাগায় একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। এবারের অভিযানে আহত হয়েছি আমি, এখনও জামা খুললে দেখতে পাবে সেই আঘাতের দাগ। ওই দাগই আমার আনুগত্য আর বিশ্বাসের জ্বলজ্বলে সাক্ষী। মারযাকের দিকে ফিরল। হে শাহজাদা, তোমার দাগটা কোথায়? বাঁকা সুরে জিজ্ঞেস করল ও।

মুখ কাঁচুমাচু হয়ে গেল মারযাকের, আর তা দেখে হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে।

থাক, যথেষ্ট হয়েছে, বাধা দিলেন আসাদ-আদ-দীন। ওকে আর কিছু বোলো না। ভুলটা আমারই-তোমার প্রতি সুবিচার করিনি।

না, না, মালিক, তাড়াতাড়ি বলল অলিভার। আপনি জ্ঞানী ও সুবিচারক, এ-ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। তবে কেউ কেউ আপনাকে ভুল পথে চালাতে চায় আর কী। বাদশাহ্-র পাশে আবার আসন গ্রহণ করল ও। স্বীকার করছি, ইংল্যাণ্ডের কাছাকাছি পৌঁছুনোর পর আমি আবেগের বশে কিছুটা পরিচালিত হয়েছি। ওখানকার একজন মানুষ বহু বছর আগে অন্যায় করেছিল আমার সঙ্গে, তাকে শাস্তি দেয়ার লোভ এড়াতে পারিনি। ওকেই তুলে আনার জন্য পা রেখেছিলাম তীরে… শেষ পর্যন্ত ঝোঁকের বশে একজনের জায়গায় দুজনকে তুলে এনেছি। কথা বলতে বলতে বাদশাহ্-র দিকে তাকাল ও, তাঁকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে, এবার অনুরোধটা করা যেতে পারে। ওই দুই বন্দি এখনও আমার জাহাজেই আছে। ওদেরকে আজকের মিছিলে আনা হয়নি…

কেন? জিজ্ঞেস করলেন আসাদ-আদ-দীন… স্বাভাবিক গলায়।

কারণ একটা পুরস্কার চাই আমি আপনার কাছে–এত বছরের সেবার স্বীকৃতি হিসেবে।

চাও, বাছা।

ওই বন্দিদেরকে আমি নিজের কাছে রাখতে চাই। আপনি তার অনুমতি দিন।

চুপ করে একটু ভাবলেন বাদশাহ্। একেবারে অযৌক্তিক কিছু চাইছে না শাকের, কিন্তু তারপরেও বিসর্জন দিতে পারলেন না। নিজের নীতি। ফানযিলাহ্-র ছড়ানো বিষও তাঁর সিদ্ধান্তে সম্ভবত প্রভাব ফেলল খানিকটা। বললেন, কিছু মনে কোরো না, শাকের… অনুমতি দিতে পারলে খুশি হতাম আমি, কিন্তু আইন সেটাকে সমর্থন করে না। তুমি তো জানো, লুণ্ঠিত মালামাল থেকে একটা জিনিসও সরাবার নিয়ম নেই… সবকিছু সমবণ্টন করতে হবে। দাসদের বেলায় নিয়ম হলো–তাদেরকে তোলা হবে নিলামে, পছন্দসই দাসকে যেন কিনে নেবার সমান সুযোগ পায় সবাই। এটাই আইন!

আইন! প্রতিবাদ করল অলিভার। আপনার কথাই তো আইন, মালিক! আপনি আমাদের বাদশাহ্!

না, বাছা। বাদশাহীর চেয়ে আইন অনেক বড়। ইচ্ছেমত তাকে বুড়ো আঙুল দেখাবার অধিকার নেই আমার। তা হলে স্বৈরাচারী বলবে আমায় লোকে। সম্মান হারাব আমি সবার চোখে। তা সম্ভব নয়। দুই বন্দিকে আজই তুমি পাঠিয়ে দেবে বাকিদের সঙ্গে। আগামীকাল খোলাবাজারে উন্মুক্ত নিলাম হবে ওদের। এটাই আমার সিদ্ধান্ত। বুঝতে পেরেছ?

আরেকদফা অনুরোধ করতে যাচ্ছিল অলিভার, থেমে গেল মারযাকের দিকে চোখ পড়ায়। শাকের-আল-বাহারের দুর্দশা দেখবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে শাহজাদা। নিজেকে তাই আর ছোট না করবার সিদ্ধান্ত নিল। বাদশাহকে বলল:

বেশ, তা হলে ওদের মূল্য বলুন, মহানুভব। আমি নগদ টাকা দিয়েই কিনে নিচ্ছি ওদেরকে।

মাথা নাড়লেন আসাদ-আদ-দীন। আমি ওদের মূল্য বলতে পারব না, শাকের। আগ্রহী ক্রেতারাই ওটা আগামীকাল নির্ধারণ করবে। কিনতে চাইলে তখনই ওদেরকে কিনতে হবে তোমাকে। এ-ব্যাপারে আর কিছু শুনতে চাই না। দুই বন্দিকে এখুনি পাঠিয়ে দাও বাজারে।

আপনার আদেশ শিরোধার্য, মালিক, মাথা ঝুঁকিয়ে পরিস্থিতি মেনে নিল অলিভার।

খাওয়াশেষে বেরিয়ে গেল ও প্রাসাদ-আঙিনা থেকে, হুকুম তামিল করবার জন্য। পিতার সঙ্গে একা হলো এবার মারযাক-বিন-আসাদ। একটু পর ফানযিলাহ্-ও যোগ দিল ওদের সঙ্গে।

.

০৮.

মা ও ছেলে

পরদিন ভোরে, ফজরের আজান হতে না হতে প্রাসাদে ছুটে এল বিস্কেন-আল-বোরাক। জাহাজ নিয়ে সাগরে গিয়েছিল, ওখানে দেখা পেয়েছে এক স্প্যানিশ মাছধরা নৌকার, তাতে চড়ে এক মুসলিম গুপ্তচর আসছিল আলজিয়ার্সে। তাকে নিজের জাহাজে তুলে নিয়েছে বিস্কেন, ক্রীতদাস-বাহিনীকে বাধ্য করেছে রাতভর পাগলের মত দাঁড় চালাতে, যাতে দ্রুত পৌঁছুতে পারে বাদশাহ্-র কাছে। ভোরে বন্দরে পা রেখেই লোকটাকে সহ ছুটে এসেছে।

জরুরি এক খবর এনেছে গুপ্তচর, তার এক ভাই মালাগা-য় স্প্যানিশ কোষাগারে কাজ করে। ভাই খবর পাঠিয়েছে, নেপলসের উদ্দেশে রওনা দেবার জন্য তৈরি হচ্ছে স্পেনের এক জাহাজ, সেখানকার গ্যারিসনের জন্য প্রচুর পরিমাণ সোনা থাকবে ওতে। স্বর্ণভরা এই স্প্যানিশ গ্যালিয়নের সঙ্গে কোনও পাহারা থাকবে না, ওটাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ইয়োরোপের উপকূল ছুঁয়ে গন্তব্যে পাড়ি জমাতে, যাতে কর্সেয়ারদের নজর এড়াতে পারে। খবরটা নিয়ে এসেছে গুপ্তচর, যাতে ওটাকে আক্রমণ করে দখল করা হয়।

গুপ্তচরকে ধন্যবাদ জানালেন আসাদ-আদ-দীন, নির্দেশ দিলেন তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে। প্রতিশ্রুতিও দিলেন, অভিযান সফল হলে লুঠের একটা বড়-সড় অংশ পুরস্কার দেয়া হবে তাকে। তারপর তিনি ডেকে পাঠালেন শাকের-আল বাহারকে। গুপ্তচরের সঙ্গে আলাপচারিতায় উপস্থিত ছিল মারযাক,সে-ও দ্রুত ছুটে গেল খবরটা মা-কে জানাবার জন্য।

একটু পরেই বাদশাহ্-র সামনে উপস্থিত হলো ফানযিলাহ্। রূঢ় গলায় বলল, এ-সব কি শুনছি, মালিক? আপনি নাকি শাকের-আল-বাহারকে একটা সোনা-ভরা স্প্যানিশ গ্যালিয়নের পিছনে পাঠাচ্ছেন?

বিরক্ত চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন আসাদ-আদ-দীন। বললেন, এ-কাজে ওর চেয়ে দক্ষ আর কাউকে চেনো তুমি?

আমি অন্তত একজনকে চিনি, ওই বিদেশির বদলে যার উপর আমার বাদশাহ্-র অনেক বেশি নির্ভর করা উচিত। সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত এবং নিঃস্বার্থ… ইসলামের নামে দখল করা সম্পদ থেকে যে নিজের জন্য কিছু রেখে দেবার আবদার জুড়বে না।

ধ্যাত্তেরি! সখেদে বললেন বাদশাহ্। এ-নিয়ে আর কত বকবক করবে তুমি? আর কে সেই মহাত্মা, যাকে নিয়ে এত বড়াই করছ তুমি?

মারযাক! টান দিয়ে ছেলেকে পাশে আনল ফানযিলাহ। আপনার একমাত্র সন্তান! আর কতকাল প্রাসাদে শুয়ে-বসে থাকবে ও? গতকাল আপনার সামনেই ওর গায়ে যুদ্ধের চিহ্ন নেই বলে মশকরা করেছে শাকের,.. নাকি লক্ষ করেননি সেটা? সুযোগ যদি না দেন, তা হলে কীভাবে নিজেকে প্রমাণ করবে ও? সত্যি করে বলুন, কী চান আপনি–ছেলে ঘরের চার দেয়ালে বন্দি হয়ে থাকুক, নাকি লড়াই করে নেতৃত্ব দিতে শিখুক… যাতে বাপের যোগ্য উত্তরাধিকারী হতে পারে?

তোমার-আমার ইচ্ছেয় কিছু যায়-আসে না, কাঁধ ঝাঁকালেন আসাদ। আমাদের সর্বোচ্চ নেতা হলেন ইস্তাম্বুলের সুলতান। তিনিই সিদ্ধান্ত দেবেন–কার হাতে যাবে আলজিয়ার্সের শাসনভার। আমরা তাঁর প্রতিনিধি মাত্র।

কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবার জন্য তো সুলতানের সামনে যোগ্য প্রার্থী থাকা চাই। নিজের ছেলেকে সেই যোগ্যতা অর্জন করতে দিচ্ছেন না আপনি… এ তো বড়ই লজ্জার কথা। কেন ছেলের উপর আস্থা নেই আপনার?

সে-কথা আমি কখনও বলিনি। সমস্যা হলো ওর বয়স–এখনও একেবারে বাচ্চা ও।

ওর বয়সে মহান ওকিয়ালির সঙ্গে সাগর চষে বেড়িয়েছেন আপনি।

আল্লাহ্-র দয়ায় ওর বয়সে অনেক বেশি লম্বা আর শক্তিশালী ছিলাম আমি। এমন নাজুক শরীর নিয়ে আর যা-ই করা যাক, যুদ্ধ করা যায় না।

কী যে বলছেন, তা আপনি নিজেই জানেন, ফুঁসে উঠল ফানযিলাহ্। ভাল করে দেখুন, ছেলে এখন পুরুষ হয়ে উঠেছে। এমন সন্তান নিয়ে আর যে-কেউ গর্ব অনুভব করবে। কোমরে তলোয়ার ঝোলানোর বয়স হয়েছে ওর… সময় হয়েছে জাহাজের পাটাতনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াবার।

-হ্যাঁ, আব্বা, সুর মেলাল মারযাক, আমি তৈরি!

তা-ই? বাঁকা সুরে বললেন আসাদ। এটাই তোমার মনের কথা? ওই স্প্যানিশ জাহাজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাও? এ-ধরনের অভিযানের ব্যাপারে কতটুকু জ্ঞান আছে তোমার?

বাবা-ই যখন কিছু শেখায়নি, জ্ঞান থাকবে কী করে? ছেলের পক্ষ নিয়ে বলল ফানযিলাহ্। আপনার অবহেলায় এই দশা হয়েছে ওর, ও-নিয়ে উপহাস করা মানায় না আপনাকে।

ধৈর্যচ্যুতি ঘটবার দশা বাদশাহ্-র, কষ্ট করে সামলালেন নিজেকে। বললেন, রাগারাগি করতে চাই না, ফানযিলাহ্… আমি শুধু একটা প্রশ্ন করব। সত্যি করে বলো, তোমার কি ধারণা মারযাক লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারবে?

না, স্বীকার করল ফানযিলাহ্। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ঘরে বসে থাকবে ও। যদি কোনও অভিযানে না যায়, শিখবে কী করে? আমি মিনতি করছি, ওকে যেতে দিন… আর কিছু না হোক, অন্তত অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য!

একটু ভেবে নিলেন আসাদ-আদ-দীন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, বেশ, তবে তা-ই হোক। যাবে ও অভিযানে… শাকের-আল-বাহারের সঙ্গে।

শাকের-আল-বাহার? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল ফানযিলাহ্।

মারযাকের জন্য ওর চেয়ে ভাল শিক্ষক আর কেউ হতে পারে না।

কিন্তু তাই বলে নিজের ছেলেকে ওর ভৃত্য বানিয়ে পাঠাবেন?

ভূত্য হবে কেন, ছাত্র হিসেবে যাবে।

আমি যদি পুরুষ হতাম, বলল ফানযিলাহ্, তা হলে কোনোদিন সন্তানকে অন্য কারও শিক্ষা নিতে দিতাম না। চেষ্টা করতাম তাকে নিজের আদলে গড়বার। ওটা আপনারও দায়িত্ব, হে স্বামী। আমি মিনতি করছি, আর কাউকে দেবেন না মারযাকের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব… বিশেষ করে এমন একজনকে, যাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা যায় না! তার চেয়ে আপনি নিজেই যান এই অভিযানে–ছেলেকে কায়িয়া বানিয়ে। আপনার কাছ থেকে সবকিছু শিখবে ও।

মাথা নাড়লেন আসাদ। বুড়ো হয়ে গেছি আমি, গত দুবছরে একবারও সাগরে যাইনি। কে জানে, হয়তো ভুলেই গেছি কীভাবে জয়ী হতে হয়। না, না… এত বড় ঝুঁকি নিতে পারব না আমি। শাকের-আল-বাহারই যাবে এই অভিযানে। তোমার ছেলে যদি যেতে চায়, ওর সঙ্গে যেতে হবে।

মালিক… অনুনয় করতে যাচ্ছিল ফানযিলাহ, থেমে গেল কাফ্রি এক ভৃত্য উদয় হওয়ায়। সে জানাল, শাকের-আল-বাহার এসেছে, বাদশাহ-র জন্য অপেক্ষা করছে আঙিনায়। মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন আসাদ। কামরা থেকে বেরুনোর সময় তাঁকে আটকাতে চাইল ফানযিলাহ্, কিন্তু ভ্রূক্ষেপ করলেন না।

ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে স্বামীর গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল ফানযিলাহ্। কামরার আবছায়া পরিবেশে নেমে এল থমথমে নীরবতা। দূর থেকে ভেসে আসা হালকা হাসি ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই–হারেমের মেয়েরা কী নিয়ে যেন হাসিতে মেতে উঠেছে। ওটুকু আওয়াজ-ই সহ্য হলো না ফানযিলাহ্-র। হাততালি দিয়ে এক কাফ্রি বাদীকে ডাকল।

চুপ করতে বলো ওদেরকে, হিংস্র গলায় বলল সে। এরপর কোনও শব্দ শুনলে নিজ হাতে আমি ওদেরকে চাবুকপেটা করব!

মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল বাদী। তার খানিক পরেই নেমে এল কবরের নিস্তব্ধতা। ফানযিলাহ্-কে খোদ বাদশাহ্-র চেয়েও বেশি ভয় পায় হারেমের মেয়েরা।

ছেলেকে নিয়ে জানালার কাছে গেল বেগম, উঁকি দিল নীচের আঙিনায়। ওখানে শাকের-আল-বাহারের সঙ্গে কথা বলছেন আসাদ-আদ-দীন।

..কখন রওনা হতে পারবে তুমি? শোনা গেল তার প্রশ্ন।

আল্লাহ্ যদি চান, তা হলে আপনি বলামা-ই, তড়িৎ জবাব দিল শাকের।

খুব ভাল। প্রিয় কর্সেয়ারের কাঁধে পরম মমতায় হাত রাখলেন বাদশাহ্। তা হলে এক কাজ করো, আগামীকাল সূর্য উঠলেই বেরিয়ে পড়ো। আশা করি এর মধ্যে সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে ফেলতে পারবে।

ঠিক আছে, আমি এখুনি ব্যবস্থা নিচ্ছি, বলল অলিভার। যদিও মনে মনে একটু খারাপ লাগছে এত তাড়াতাড়ি আবার, অভিযানে যেতে হবে বলে। বিশ্রাম প্রয়োজন ছিল ওর।

কটা জাহাজ নেবে?

একটামাত্র স্প্যানিশ গ্যালিয়নকে দখল করতে? আমারটাই যথেষ্ট, মহানুভব। সঙ্গে বেশি জাহাজ না থাকলেই ভাল। স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারব, প্রয়োজনে গা-ঢাকাও দিতে পারব সহজে। বেশি জাহাজ থাকলে সেটা সম্ভব হবে না।

ভাল সিদ্ধান্ত, একমত হলেন বাদশাহ্। আল্লাহ্ তোমার অভিযান সফল করুন।

আমি কি তা হলে যেতে পারি?

একটু দাঁড়াও। আরেকটা ব্যাপার আছে। আমার ছেলেকে তো দেখেছ-মারযাক, সাবালক হয়ে উঠেছে। আল্লাহ আর দেশের সেবায় নাম লেখানোর সময় হয়েছে ওর। আমার ইচ্ছে, এবারের অভিযানে তোমার কায়িয়া হিসেবে সঙ্গে যাক ও। আমি যেভাবে তোমাকে সব শিখিয়েছি, সেভাবে তুমিও সবকিছু শেখাবে ওকে।

প্রস্তাবটা পছন্দ হলো না অলিভারের। ফানযিলাহ্ আর তার ছেলের সঙ্গে আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক ওর। মারযাককে সঙ্গে নেয়া মানেই ঝামেলা কাঁধে নেয়া। কিন্তু বাদশাহকে তো আর সরাসরি আপত্তি জানানো যায় না! তাই একটু কৌশলে জবাব দিল ও।

আপনার চেয়ে ভাল শিক্ষক আর কেউ হতে পারে না, বলল অলিভার। আগামীকাল আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন না কেন, মালিক? মুসলমানদের কাণ্ডারী আপনি… আপনার উপস্থিতিতে স্প্যানিশ গ্যালিয়নে আঁকশি আটকাতে পারলে সম্মানিত বোধ করব আমি।

ভুরু কোঁচকাল আসাদ-আদ-দীন। তুমিও বলছ এ-কথা?

আর কেউ বলেছে নাকি? বলল অলিভার। বলে থাকলে খুব ভাল কথাই বলেছে। আমি তাতে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছি। আপনার অধীনে যুদ্ধ করা যে কত আনন্দের, তা আমার চেয়ে ভাল আর কেউ জানে না। চলুন না, মালিক, অন্তত এই একটা অভিযানে। আপনার ছেলেও অমূল্য এক সুযোগ পাবে দুনিয়ার সেরা কর্সেয়ারের কাছ থেকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেবার।

দাড়িতে হাত বোলালেন বাদশাহ। তুমি আমাকে প্ররোচিত করছ, শাকের!

আমি শুধু সত্যি কথা বলছি…

না, আর কিছু শুনতে চাই না, মাথা নেড়ে বললেন আসাদ। বাস্তবকে মেনে নেয়াই ভাল। সাগরে যাবার বয়স পেরিয়ে এসেছি আমি, শরীর দুর্বল হয়ে গেছে; তা ছাড়া এখানে থাকা দরকার আমার। বুড়ো সিংহ কি তরুণ হরিণকে শিকার করতে পারে? লড়াই করবার দিন শেষ আমার, এখন সময় তোমাদের যাদেরকে আমি লড়তে শিখিয়েছি। তোমরাই এখন গভীর সাগরে ইসলামের বিজয়-পতাকা ওড়াবে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। স্বীকার করছি, যেতে ইচ্ছে করছে… রক্ত নেচে উঠছে অভিযানের কথা শুনে। কিন্তু সেটাই সব নয়। তোমাকেই যেতে হবে এই অভিযানে। মারযাককে সঙ্গে নিয়ো-ওকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমি তোমার কাঁধে সঁপছি।

আল্লাহ্ সাক্ষী, আমি এই দায়িত্ব প্রাণ দিয়ে হলেও পালন করব।

বাদশাহ্-র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গেল শাকের-আল-বাহার। ওসমানিকে খুঁজে বের করে অস্ত্র আর রসদ তুলতে বলবে জাহাজে। একশো ক্রীতদাস নেবে দাঁড় টানার জন্য, আর নেবে তিনশো যোদ্ধা।

নিজের কামরায় ফিরে এলেন আসাদ-আদ-দীন। ফানযিলাহ্ আর মারযাক তখনও ওখানে অপেক্ষা করছে। নিজের সিদ্ধান্ত তাদেরকে জানিয়ে দিলেন তিনি। তা শুনে কপাল চাপড়াল ফানযিলাহ্। বলল, হায় খোদা, আমার পরামর্শ তা হলে অগ্রাহ্য করলেন আপনি? এক পয়সাও দাম নেই আমার কথার?

না! বললেন আসাদ। তিতিবিরক্ত হয়ে গেছেন তিনি স্ত্রী-র আচরণে।

আজ বুঝলাম, আমাকে কোন্ চোখে দেখেন আপনি, কাঁদো কাঁদো চেহারা করল ফানযিলাহ্! মারযাকের মুখেও তখন মেঘ জমেছে।

যা খুশি ভাবো, বললেন আসাদ। কিন্তু কাল ভোরে শাকের আল-বাহারের সঙ্গে অভিযানে যাবে মারযাক, ছাত্র হিসেবে। নিজের চোখে দেখবে কীভাবে ইসলামের অব্যর্থ অস্ত্রে পরিণত হয়েছে সে, কেন তাকে আল্লাহ্-র বর্শা বলি আমরা। এ-ব্যাপারে আর কোনও উচ্চবাচ্য যেন না হয়!

এ-কথা শুনে ক্রোধে চেহারা বিকৃত হয়ে উঠল মারযাকের। খ্যাপাটে গলায় বলল, নাসরানি ওই কুত্তাটার সঙ্গে যদি সাগরে যেতেই হয়, ওকে ক্রীতদাসদের সঙ্গে বসাব আমি-দাঁড় টানার বেঞ্চে!

কী বললে? হুঙ্কার ছাড়লেন আসাদ-আদ-দীন। ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে এগোলেন ছেলের দিকে। কী ধরনের কথা এসব?

আতঙ্কিত হয়ে দুজনের মাঝে এসে দাঁড়াল ফানযিলাহ, যেন অসহায় সিংহশাবককে রক্ষা করতে চাইছে তার মা। কিন্তু খেপে গেছেন বাদশাহ্, ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দিলেন স্ত্রীকে। মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ফানযিলাহ্।

আল্লাহর গজব পড়ক তোমার উপরে! পিতার গর্জন শুনে কুঁকড়ে গেল মারযাক। যে-সাপের পেটে জন্ম নিয়েছ, সে-ই কি তোমাকে শিখিয়েছে আমার মুখের উপর কথা বলতে? কসম আল্লাহ্র, যথেষ্ট সহ্য করেছি তোমাদের ঔদ্ধত্য। কিন্তু আর না। আজ থেকে আমার কথা মুখ বুজে মেনে নিতে হবে তোমাদেরকে, নইলে ভয়ানক শাস্তি পাবে! মারযাক-বিন-আসাদ, আগামীকাল তুমি শাকের-আল-বাহারের সঙ্গে সাগরে যাবে। যদি টু শব্দও করো এ-ব্যাপারে, তা হলে তোমার হুমকিই বাস্তবায়িত করব। তবে শাকের না, নিজেকে আবিষ্কার করবে তুমি মাল্লাদের বেঞ্চে… দাঁড় টানা অবস্থায়! ক্রীতদাসদের মত পিঠে চাবুক খেয়ে বাধ্যগত হতে শিখবে তুমি!

আতঙ্কে বিবশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মারযাক, হারাল মুখের ভাষা। এই প্রথম ওর পিতাকে এমন রেগে যেতে দেখছে। কিন্তু সে-রাগ দেখে মোটেই দমল না ফানযিলাহ্। ভিন্ন ধাতের মহিলা সে, ভয় দেখিয়ে তার জিভকে ঠেকানো সম্ভব নয়।

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, শুনিয়ে শুনিয়ে বলল সে, আমার স্বামীর চোখ খুলে দিন তিনি। যেন দেখতে পান–কারা তাঁকে সত্যি সত্যি ভালবাসে, আর কে তার দুর্বলতার সুযোগ নিতে চায়।

ঝট করে তার দিকে ফিরলেন আসাদ-আদ-দীন।

কী! চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। এখনও তোমার মুখ বন্ধ হয়নি?

বন্ধ হবেও না, যতক্ষণ এ-দেহে প্রাণ আছে। মরার আগ পর্যন্ত আপনাকে আমি সুপরামর্শ দেবার চেষ্টা করে যাব, মালিক।

সুর যদি না বদলাও, হুমকি দিলেন বাদশাহ্, খুব শীঘ্রি সেটা ঘটতে চলেছে।

আমি ভয় করি না, হে স্বামী। শাকের-আল-বাহার আপনাকে অন্ধ করে রেখেছে… ওর মুখোশ খোলার জন্য প্রয়োজনে প্রাণ দেব আমি! ওই বন্দিদুজনের কথা ভাবুন, যাদেরকে ও ইংল্যাণ্ড থেকে এনেছে। শুনেছি ওদের মধ্যে একটা মেয়ে আছে–অপূর্ব সুন্দরী, যে-সৌন্দর্য পাশ্চাত্যের মেয়েদের প্রতি ইবলিশের উপহার। কেন এনেছে শাকের মেয়েটাকে? কেন তাকে দাস-বাজারের নিলামে তুলতে চাইল না? উল্টো আপনার কাছে এসে আবদার জুড়ল তাকে নিজের কাছে রেখে দেবার জন্য! হায়, এ-সবে কিছুতেই কর্ণপাত করছেন না আপনি। বার বার আপনার সামনে শাকেরের মিথ্যে-আনুগত্যের প্রমাণ হাজির করছি আমি, অথচ সেসব অগ্রাহ্য করে অন্যায় আক্রোশ দেখাচ্ছেন নিজের রক্তের প্রতি।

খপ করে স্ত্রী-র কবজি ধরলেন আসাদ, টান দিয়ে দাঁড় করালেন তাকে। বাদশাহ্-র সৌম্য মুখশ্রী এখন হিংস্র হয়ে উঠেছে। এতক্ষণে সাহস হারাল ফানযিলাহ্, বুঝল–আজ বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।

আইয়ুব! গলা চড়িয়ে ডাকলেন আসাদ।

আঁতকে উঠল ফানযিলাহ। ভয়ার্ত গলায় বলল, মালিক! শান্ত হোন! কী করতে চাইছেন আপনি?

হিংস্র হাসি দেখা দিল বাদশাহ্-র ঠোঁটে। বললেন, কী করব? যা বহুদিন আগেই করা উচিত ছিল। আজ তুমি চাবুকের আঘাত পাবে! গলা চড়িয়ে ডাকলেন আবার–আইয়ুব! কোথায় তুমি? লোকটা তার বেগমের পরিচারক–একজন খোঁজা।

তাড়াতাড়ি স্বামীর পা জড়িয়ে ধরল ফানযিলাহ্। ক্ষম করুন… ক্ষমা করুন আমাকে। আল্লাহ্ জানেন, ভালবাসার তীব্রতায় বেয়াদবি করে ফেলেছি আমি। তার জন্য মাফ চাইছি আপনার কাছে। দয়া করুন!

ফানযিলাহ্-র স্বীকারোক্তি শুনে মন একটু টলল বাদশাহ্-র আইয়ুব হন্তদন্ত হয়ে দরজায় হাজির হতেই হাতের ইশারায় বিদায় করলেন। তারপর স্ত্রী-র দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর কণ্ঠে বললেন হ্যাঁ, তোমাকে এই অবস্থাতেই শোভা পায়। আগামীতে মুখ খোলার আগে স্মরণ রেখো কথাটা।

নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন তিনি। বেরিয়ে গেলেন কামর থেকে। পিছনে রয়ে গেল আতঙ্কিত মা আর ছেলে। দুজনেই কাঁপছে থরথর করে। কোনও সন্দেহ নেই, মৃত্যুর দুয়ার থেবে ফিরে এসেছে ওরা।

অনেকক্ষণ কোনও কথা বলল না কেউ। শেষে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াল ফানযিলাহ, হাত চালিয়ে বেশভূষা ঠিক করল এগিয়ে গেল জানালার পাশের একটা ছোট্ট আলমারির দিকে ওটা থেকে বের করে আনল একটা মাটির পাত্র, মুখ খুনে সুবাসিত পানীয় ঢালল কাপে, চুমুক দিল তাতে তৃষ্ণার্তের মত শরীরের কাঁপুনি থামেনি পুরোপুরি। মাথাও কাজ করছে ন ঠিকমত, পানীয় পরিবেশনের জন্য একগাদা দাসী-বাদ আছে–তাদেরকে ডাকার কথা মনেই নেই।

একটু পর নিজেকে সামলে নিল সে। ফিরল মারকে দিকে। প্রশ্ন করার ভঙ্গিতে বলল, এবার?

এবার মানে? বিস্মিত গলায় বলল মারযাক।

কী করব আমরা, সেটা জানতে চাইছি। বাদশাহ্-র রাগের তলায় চাপা পড়ে ধ্বংস হয়ে যাব, নাকি প্রতিকার করব এর? লোকটা পাগল হয়ে গেছে, নাসরানি শয়তানের জাদু ভর করেছে ওর উপর। এভাবে চলতে থাকলে শাকেরের পায়ের তলায় পিষ্ট হবে তুমি, মারযাক।

ধপ করে একটা চেয়ারে বসল শাহজাদা। করুণ হয়ে উঠেছে চেহারা। জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কী-ই বা করার আছে আমাদের?

মাথা খাটাও। একটা কিছু করতেই হবে… এবং সেটা খুব শীঘ্রি। কুত্তার বাচ্চা শাকের-আল-বাহার! গাল দিয়ে উঠল ফানযিলাহ্। গজব পড়ক ওর উপর। বেঁচে থাকলেও যেন কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।

হ্যাঁ… বেঁচে থাকলে… বলতে বলতে থেমে গেল মারযাক। আচমকা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে দৃষ্টি। সুর পাল্টে বলল, ভুল পথে এগোচ্ছি আমরা, মা। শাকেরকে নিচু করতে চাইছি আব্বার চোখে, কিন্তু তাতে কেবল সময়ই নষ্ট হচ্ছে। মাঝখান থেকে উনি রেগে যাচ্ছেন আমাদের উপর। আমার মনে হয় সমস্যা সমাধানের জন্য সংক্ষিপ্ত এবং সরাসরি কোনও পথ বেছে নেয়া দরকার।

অন্য চোখে ছেলের দিকে তাকাল ফানযিলাহ। বলল, ব্যাপারটা অনেক আগেই মাথায় এসেছে আমার। সামান্য কিছু সোনা খরচ করলে শাকেরকে সরাবার জন্য লোকও জোগাড় করা যাবে। কিন্তু কাজটা এত ঝুঁকিপূর্ণ যে…

ও মরে গেলে ঝুঁকি রইল কোথায়?

খুনোখুনির কাজটাই ঝুঁকিপূর্ণ। শাকের মরলেই সব শেষ হচ্ছে না, ঘটনার জের থেকে যাচ্ছে। বাদশাহ্ তদন্ত করবেন ওর মৃত্যুর… ভয়ানক তদন্ত! আসল ঘটনা যদি কোনোভাবে ফাস হয়, আমাদের দুজনকেই ফাঁসিতে ঝোলাবেন তিনি।

ঠিকমত ছক সাজাতে পারলে কিছুই ফাঁস হবে না।

হবে না? তিক্ত হাসি হাসল ফানযিলাহ্। বোকা ছেলে, সন্দেহের তালিকায় সবার আগে তোমার নামটাই আসবে। তারপর আসবে আমার নাম। সবাই জানে, আমরা শাকেরকে পছন্দ করি না; ওকে তোমার সিংহাসন পাবার পথে বাধা বলে মনে করি।

শাকেরের বদলে যদি আব্বাকে সরিয়ে দিই? কুটিল গলায় বলল মারযাক। বয়স হয়েছে ওঁর। চেষ্টা করলে মৃত্যুটা হয়তো স্বাভাবিক দেখাতে পারব।

তাতেও লাভ নেই, বলল ফানযিলাহ্। ওঁর ছেলে হিসেবে তুমিই যে সিংহাসন পাবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। জনগণের চোখে মোটেই জনপ্রিয় নও তুমি, বরং শাকেরকে ওরা পুজো করে। আমার তো মনে হয়, ওকে বাদশাহ্ বানাবার জন্য উঠেপড়ে লাগবে সবাই।

জ্যান্ত কবর হোক শয়তানটার! হতাশায় অভিশাপ দিল মারযাক।

শাকেরের জন্য কবর খুঁড়তে গেলে আমাদের ঘাড়ে বিপদ টেনে নিতে হবে। খোদ ইবলিশ ওকে রক্ষা করছে।

জাহান্নামে যাক ও!

গালাগাল দিয়ে কোনও উপকার হবে না আমাদের, ছেলেকে বোঝাল ফানযিলাহ্। তারচেয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা-ভাবনা করো। অন্য কোনও কায়দায় সারতে হবে কাজ।

ঠোঁট কামড়াল মারযাক। তারপর বলল, একটা কাজ করা যায়–ওর সঙ্গে সাগরে যাচ্ছি আমি, তক্কে তক্কে থাকব। রাতের অন্ধকারে যদি ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিতে পারি…

না, না… ধরা পড়ার ভয় আছে ওতে। দাঁড়াও, আমাকেই ভাবতে দাও ব্যাপারটা নিয়ে। হাততালি দিয়ে আইয়ুবকে ডেকে পাঠাল ফানযিলাহ। ছেলেকে বলল, চলো, দাস-বাজারে যাই। শাকেরের দুই বন্দিকে দেখব। কেন যেন মন খুঁতখুঁত করছে। বলা যায় না, ওদের মাধ্যমেই হয়তো ফাঁদে ফেলা যাবে শয়তানটাকে। তাতে নিজেরাও নিরাপদে থাকব।

ঠিক আছে, সায় দিল মারযাক। চলো।

.

০৯.

প্রতিদ্বন্দ্বী

দাস-বাজারের ফটকের সামনের খোলা জায়গায় বিশাল এক ভিড়–সরু, কাঁচা রাস্তা ধরে আসা জনস্রোত মিশে প্রতি মুহূর্তে আরও বড় হচ্ছে ওটা। ঠেলাঠেলি চলছে লোকজনের ভিতর, চেঁচামেচিতে কান পাতা দায়।

নানা ধরনের মানুষের আর্বিভাব ঘটেছে আজ-বাদামি চামড়ার বারবার, কৃষ্ণবর্ণ সাহারোয়ি, ফর্সা আরব, আন্দালুসিয়ার তাগারিন, উদ্বাস্তু ইহুদি, লেভান্টিন তুর্কি, ধনী মূর… সব ধরনের মানুষ জড়ো হয়েছে ওখানে। স্মরণকালের সবচেয়ে বড় নিলাম হতে চলেছে, সেটা প্রত্যক্ষ করবার জন্য এই বিশাল সমাবেশ। ফেরিঅলাদের তো পোয়াবারো, ফল আর খাবারের ঝুড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভিড়ের ভিতর, আয়-রোজগার বেড়ে গেছে তাদের। পুরো এলাকার ভিখিরি-রাও চলে এসেছে এখানে, লাইন ধরে বসেছে রাস্তার পাশে, ধনী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দান-খয়রাত পাবার ইচ্ছে। গলা চড়িয়ে গান গাইছে তারা।

যারা সত্যিকার ক্রেতা, তারা অবশ্য যোগ দিচ্ছে না ভিড়ে। ফটকের বাইরে ঘোড়া থেকে নামছে, পরিচয় নিশ্চিত করে ঢুকে যাচ্ছে বাজারে। আজ কোনও আলতু-ফালতু লোকের প্রবেশাধিকার নেই ওখানে। লুকিয়েও ঢোকা সম্ভব নয়। পুরো বাজার উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। মাঝখানে এক চিলতে খোলা জায়গা, সেখানেই অনুষ্ঠিত হয় নিলাম। আজকের কার্যক্রম শুরু হতে এখনও এক ঘণ্টা বাকি। তাই ক্রেতারা অলস ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাজারের চারদিকে, ওখানে ছোট ছোট দোকান খোলা হয়েছে–বিক্রি করা হচ্ছে উল, মশলা আর নানা ধরনের গহনা।

খোলা জায়গাটার ঠিক মাঝখানে মুখ ব্যাদান করে রেখেছে একটা কুয়ো–অষ্টভুজ আকৃতির, সীমানা প্রাচীর রয়েছে কিনারে, তিনধাপের সিঁড়ি উঠে গেছে প্রাচীরের মাথায়। সিঁড়িতে বসে আছে দাড়িঅলা এক বয়স্ক ইহুদি, পরনে কালো রঙের ঢোলা জোব্বা, রঙিন রুমালে ঢেকে রেখেছে মাথা। কোলের উপর রেখেছে একটা চওড়া বাক্স–তাতে অনেকগুলো খোপ… প্রতিটাই দামি রত্ন আর দুর্লভ পাথরে ভরা। বিক্রি করবার জন্য বসেছে। তাকে ঘিরে রেখেছে অল্পবয়সী কয়েকজন মূর আর দুজন তুর্কি অফিসার। দর কষাকষি চলছে রত্ন-বিক্রেতার সঙ্গে।

বাজারের উত্তরপাশের দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে বড় একটা খাঁচা–সামনের দিকটা ঢেকে রাখা হয়েছে উটের পশম দিয়ে তৈরি পর্দায়। পর্দার ওপাশ থেকে ভেসে আসছে মানুষের গুঞ্জন। ওটা আসলে বন্দিশালা-বিক্রির জন্য নিয়ে আসা দাসদেরকে রাখা হয়েছে ওর ভিতর। বন্দিশালাকে পাহারা দিচ্ছে জনাবারো কর্সেয়ার, তাদের সঙ্গে রয়েছে কিছু কাফ্রি ভৃত্য।

বাজারের দেয়ালের বাইরে মাথা তুলে রেখেছে জোইয়া মসজিদের বিশাল গম্বুজ আর সুউচ্চ দুই মিনার। বাজারের ভিতর থেকেও চোখে পড়ে ওগুলো। আরও চোখে পড়ে বেশ কিছু খেজুর গাছের ডগা, বাতাসের অভাবে আজ স্থির হয়ে আছে ওগুলোর পাতা।

হঠাৎ বাজারের ফটকে উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। রাস্তা ধরে ছজন বিশালদেহী কাফ্রি ভৃত্য উদয় হলো। চেঁচিয়ে সবাইকে সরে যেতে বলছে। হাতে বড় বড় লাঠি আছে তাদের, হুঁশিয়ারির পাশাপাশি ভিড়ের উপর নির্মমভাবে আঘাত করল ওগুলো দিয়ে, লোকজনকে বাধ্য করল পথ করে দিতে।

সরে যাও! পথ দাও আমাদের বাদশাহ্.. মহান আসাদ আদ-দীনের জন্য! সরে যাও সবাই!

হুড়োহুড়ি পড়ে গেল ভিড়ের মাঝে। হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল সবাই সম্মান দেখাবার জন্য। একটু পরেই দুধ-সাদা একটা ঘোড়ায় চড়ে হাজির হলেন আসাদ-আদ-দীন। উজির সামানি রয়েছে তাঁর সঙ্গে, আর রয়েছে কালো পোশাকে ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর দল।

একটু সময়ের জন্য নীরব রইল জনতা, তারপরেই শুরু হলো জয়ধ্বনি।..

আল্লাহ্ আপনার শক্তি বৃদ্ধি করুন। আল্লাহ্ আপনার আয়ু বাড়িয়ে দিন! রাসূলের অনুগ্রহ আসুক আপনার প্রতি! আল্লাহ্ আরও বিজয় দিন আপনাকে!

জয়ধ্বনি আর শুভকামনার জবাবে মৃদু হাসলেন বাদশাহ। হাত নাড়লেন সমবেত জনতার উদ্দেশে।

একটু পরেই ফটকে পৌঁছুল শোভাযাত্রা। স্বর্ণমুদ্রা ভরা একটা থলে সামানির দিকে ছুঁড়ে দিলেন আসাদ-ভিখিরিদের মাঝে বিতরণ করবার জন্য। তারপর অনুসরণ করলেন বাজারের নিয়ম। ঘোড়া থেকে নেমে পায়ে হেঁটে ঢুকলেন তিনি ভিতরে। থামলেন কুয়োর পাশে পৌঁছে। বন্দিশালার দিকে ফিরে আশীর্বাদ করলেন উপস্থিত সবাইকে। অনুমতি দিলেন উঠে দাঁড়াবার।

বন্দিশালার দায়িত্বে আছে শাকের-আল-বাহারের অনুচর আলি, তাকে ডেকে পাঠালেন বাদশাহ্। জানালেন, নিলাম শুরু হবার আগে দাসদেরকে দেখতে চান। সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে ফেলা হলো পর্দা, সূর্যের আলো পড়ল গাদাগাদি করে থাকা বন্দিদের গায়ে। ডাচম্যানের সমস্ত নাবিক আছে ওখানে, আরও আছে বিস্কেনের অভিযানে পাওয়া অল্প কিছু বন্দি।

কাছে গিয়ে ভিতরে নজর বোলালেন আসাদ-আদ-দীন। পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা কম। তবে সব ধরনের বয়স আর জাতের বন্দি আছে ওখানে। ফর্সা ফ্রেঞ্চ, জলপাই রঙা ইটালিয়ান, শ্যামলা স্প্যানিয়ার্ড, কৃষ্ণাঙ্গ কাফ্রি, সংকর… হরেক রকমের বৈচিত্র্য। বৃদ্ধ আছে, যুবা আছে, আছে নিতান্ত শিশুও। কারও পরনে ভাল পোশাক, কারও আবার ভেঁড়া ন্যাকড়ার মত। প্রায়-উলঙ্গের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। বন্দিদশা ছাড়া আর কোনও মিল নেই তাদের মধ্যে অসহায় এসব মানুষকে দেখে মোটেই করুণা অনুভব করলেন না আসাদ-তাঁর চোখে এরা অবিশ্বাসী… ইসলামের শত্রু। এদেরকে দয়া দেখালে নিজেরা ধ্বংস হয়ে যাবেন।

কালোকেশী এক স্প্যানিশ সুন্দরীর উপর চোখ আটকে গেল বাদশাহ্-র। দুহাঁটু একত্র করে মুখের সামনে এনে বসেছে সে, করুণ ভঙ্গি, কিন্তু দুচোখের তারায় জ্বলজ্বল করছে ক্ষোভের চিহ্ন। সামানির কাঁধে ভর দিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য মেয়েটাকে জরিপ করলেন তিনি, এরপর চোখ ফেরালেন, অন্যদিকে। পরমুহূর্তে হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়ে গেল তার। নিজের অজান্তে চাপ দিলেন উজিরের বাহুতে।

খাঁচার একপাশে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে এক অপরূপা… নারীজাতির শ্রেষ্ঠতম রূপ আর জৌলুস নিয়ে। লম্বা, একহারা দেহদাঁড়াবার ভঙ্গিতে আভিজাত্য। দুধ-আলতা মোলায়েম ত্বক; চোখ তো নয়, যেন দুটুকরো নীলকান্তমণি। মাথা থেকে নেমে এসেছে রেশমের মত সোনালি কেশ, সূর্যের আলোয় চকচক করছে। পরনে একটা সাদা গাউন, গলার কাছটা বড় বলে দেখা যাচ্ছে সুডৌল গ্রীবা।

আলির দিকে তাকালেন বাদশাহ্। গোবরের মাঝে এই পদ্মফুলটা কোত্থেকে এল?

এই মেয়েকেই ইংল্যাণ্ড থেকে শাকের-আল-বাহার নিয়ে এসেছে, মালিক, বলল আলি।

আবার চোখ ঘোরালেন আসাদ, একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন মেয়েটার দিকে। ব্যাপারটা লক্ষ করে রক্ত জমল সুন্দর গালদুটোয়, তাতে রূপ যেন বেড়ে গেল কয়েক গুণ।

নিয়ে এসো ওকে, হুকুম দিলেন বাদশাহ্।

খাঁচায় ঢুকে দুজন কাফ্রি ভৃত্য এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। ধরল তাকে দুপাশ থেকে। বাধা দিয়ে দুর্ব্যবহারের শিকার হতে চাইল না মেয়েটি, তাই নিজের মর্যাদা রেখে পা বাড়াল তাদের সঙ্গে। সোনালিচুলো এক যুবক বসে ছিল কাছে-শীর্ণ চেহারা, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল… মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখে গোঙানি বেরিয়ে এল তার মুখ দিয়ে। রুগ্ন দুহাত তুলে বাধা দিতে চাইল, কিন্তু কাফ্রিদের লাঠির আঘাতে মুখ থুবড়ে পড়ল।

আসাদ-আদ-দীন বিচক্ষণ মানুষ। ফানযিলাহ-র কথা ফেলতে পারেননি, তাই বাজারে এসেছেন এই মেয়েটিকে দেখবার জন্য। তাঁর স্ত্রী-র ধারণা, এই মেয়ের মাঝেই নাকি লুকিয়ে আছে শাকেরের বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ। বাস্তবে তেমন কিছু চোখে পড়ল না। বরং প্রিয় কর্সেয়ারের আবদারের পিছনে যুক্তি খুঁজে পেলেন-এমন সুন্দরীকে কে না পেতে চায়! তিনি নিজেও আগ্রহী হয়ে উঠছেন মেয়েটির ব্যাপারে।

নিজের অজান্তেই বাদশাহ্ হাত বাড়ালেন তাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য। কিন্তু ঝট করে পিছিয়ে গেল মেয়েটি, যেন তার স্পর্শে গা পুড়ে যাবে ওর।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আসাদ। আল্লাহ্র মর্জি বোঝা ভার। এমন সুন্দর ফল তিনি বিধর্মীদের নোংরা গাছে ফলিয়েছেন!

তীক্ষ্ণ চোখে বাদশাহ্-র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছে সামান। দীর্ঘদিন সেবা করায় মনিবের মতিগতি বুঝতে পারে সে। তাই তোয়াজের ভঙ্গিতে বলল, রাসূলের অনুসারীদেব এ-ফল পেড়ে নিতে নিষেধ নেই, মালিক।

বিধর্মীর মেয়ে বিধর্মীই হয়, সামানি। তার দিকে হাত বাড়ানো বারণ।

ধর্ম তো বদলানো যায়! ও যদি ঈমান গ্রহণ করে, তা হলে কোনও সমস্যা থাকে না। হুজুর, দ্বীনের আলো আগেও জ্বেলেছেন আপনি নারীর বুকে।

ভুরু কোঁচকালেন আসাদ। ফানযিলাহ্-র কথা বলছ? হ্যাঁ, আল্লাহ্ আমাকে ওর দিশা বানিয়েছিলেন।

হয়তো আবারও আপনাকে সেই দিশা বানাতে চাইছেন আল্লাহ্, বলল সামানি। শুধু তোয়াজ নয়, তার মনের ভিতর আরেকটা দুরভিসন্ধি খেলা করছে। ফানযিলাহ্ আর তার মধ্যে বহুদিন থেকেই শক্রতা বিরাজ করছে। ধুরন্ধর ওই বেগমের জন্য উজির হিসেবে যথাযোগ্য সম্মান পাচ্ছে না সে, ব্যবহার করতে পারছে না ক্ষমতা। যদি কোনোভাবে নতুন এক বেগম আনা যায় মহলে, সরানো যায় ফানযিলাহ্-কে… তা হলে হয়তো বদলে যাবে পরিস্থিতি। কিন্তু এতদিন তেমন কোনও সুযোগ দেখেনি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন বাদশাহ্, কাউকে বিয়ে করা তো অনেক পরের কথা। আজ… এতদিন পর এক মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হয়েছেন তিনি। তার এই মুগ্ধতাকে উস্কানি দিয়ে কামনায় পরিণত করা গেলে বড় ভাল হয়। বহুদিনের খায়েশের পালে হাওয়া লাগবে তা হলে… ফানযিলাহ-কে রাস্তা থেকে সরাবার একটা উপায় সৃষ্টি হবে।

আপনার পছন্দের তারিফ করতে হয়, মালিক, গদগদ ভাষায় বলল উজির। পাহাড়ি তুষারের মত ফর্সা এই মেয়ে, তাফিলাতের খেজুরের মত মিষ্টি চেহারা…।

ঝট করে তার দিকে ঘাড় ফেরালেন বাদশাহ্। রুষ্ট গলায় বললেন, কি এ-চেহারা হাজারো বেগানা পুরুষ দেখেছে?

ওসব তো অতীত, মালিক! সামানি বলল। আপনি চাইলে ভবিষ্যতে আর কেউ দেখবে না।

ঠিক তখুনি পিছন থেকে ভেসে এল সুরেলা কণ্ঠ। এ আবার কে?

বিস্ময় নিয়ে উল্টো ঘুরলেন আসাদ এবং তাঁর উজির। দেখলেন, একটা পালকি এসে থেমেছে তাদের পিছনে। সেখান থেকে নেমে এসেছে ফানযিলাহ্। মুখ ঘোমটায় ঢাকা, সঙ্গে রয়েছে মারযাক আর পালকি-বাহী একদল খোঁজা। খোঁজাদলের নেতৃত্ব দিচ্ছে আইয়ুব-আল-সামিন।

চেহারা বিকৃত হলো বাদশাহ্-র। স্ত্রী-পুত্রের উপর থেকে এখনও রাগ মেটেনি তাঁর। তা ছাড়া… প্রাসাদের চার দেয়ালের ভিতরে অসৌজন্য দেখালে সেটা মেনে নেয়া যায়, কেউ তার খবর জানছে না; কিন্তু খোলা বাজারে এসে এমন তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাষায় প্রশ্ন তোলা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। তাঁর জানা নেই, মরিয়া হয়ে এ-কাজ করছে ফানযিলাহ্। উদ্বেগের সামনে হার মেনেছে সতর্কতা। ভিনদেশি মেয়েটির দিকে স্বামীর আগ্রহ লক্ষ করে শঙ্কিত হয়ে উঠেছে সে, ঈর্ষার চেয়েও বেশি পাচ্ছে ভয়। বাদশাহ্-র উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছে বেগম। নতুন কোনও বধূ যদি আসে প্রাসাদে, তা হলে সব আশা শেষ।

উপায়ান্তর না দেখে স্বামীর মুখোমুখি হয়েছে ফানযিলাহ্। মুখ ঢাকা থাকলেও তার আচার-আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে ঔদ্ধত্য। বাদশাহ্-র হিংস্র দৃষ্টিকে আমলে নিল না।

এই মেয়েকেই যদি এনে থাকে শাকের-আল-বাহার, তা হলে বলব গুজবের কোনও সত্যতা নেই, বলল সে। খামোকাই দুইশ মুসলমানের জীবন বিপন্ন করেছে ও ইংল্যাণ্ড থেকে এই হলদেমুখী, কুচ্ছিত জানোয়ারটাকে আলজিয়ার্সে আনতে গিয়ে।

খেপে গেলেন আসাদ-আদ-দীন। হলদেমুখী? কুচ্ছিত? প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। তোমার শ্রবণশক্তি কমে গেছে বলে ভেবেছি এতদিন, আজ দেখছি চোখেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। সন্দেহ নেই, বুড়ো হয়ে যাচ্ছে তুমি।

একটু যেন ঘাবড়ে গেল ফানযিলাহ বাদশাহ্-র কথা শুনে।

তার দিকে এগিয়ে গেলেন আসাদ। বললেন, যথেষ্ট সহ্য করেছি তোমার শয়তানি আচরণ। বিশ্বাসীদের সমাজের কলঙ্ক হয়ে উঠছ তুমি। এর একটা বিহিত খুব শীঘ্রি করব আমি। আলির দিকে ফিরে বন্দিনীকে খাঁচায় নিয়ে যাবার ইশারা করলেন তিনি, তারপর আবার ঘুরলেন স্ত্রী-র দিকে। যাও, পালকিতে ওঠো। ফিরে যাও প্রাসাদে। আর কখনও যেন তোমাকে এমন খোলা জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে না দেখি আমি!

নীরবে আদেশটা মেনে নিল ফানযিলাহ, ফিরে গেল পালকিতে। রুদ্র চোখে তাকে চলে যেতে দেখলেন বাদশাহ্, তারপরেও স্থির হয়ে রইলেন মূর্তির মত।

সামানি বলল, হুজুর, শান্ত হোন। উনি আপনার বেগম… এবারের মত নাহয় মাফ করে দিন।

মুখ বাঁকালেন আসাদ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সৌন্দর্য কমছে ওর, সামানি। সেই সঙ্গে কমছে সভ্যতা-ভব্যতা। নিচুমনের একটা ডাইনিতে পরিণত হচ্ছে, রাজপ্রাসাদে যাকে মানায় না। আল্লাহ্ সম্ভবত ওকে স্থানচ্যুত করার সঙ্কেত দিচ্ছেন আমাকে। তাই আজ যোগ্য আরেক নারীর দর্শন করিয়েছেন।

খুশিতে নেচে উঠল উজিরের মন। তবু বোকা বোকা চেহারা করে বলল, কার কথা বলছেন, মালিক?।

প্রশ্নটা যেন শুনতেই পেলেন না আসাদ। ধীরে ধীরে ঘুরলেন বন্দিশালার দিকে। পর্দা আবার টেনে দেয়া হয়েছে, মেয়েটিকে আর দেখা যাচ্ছে না। স্বপ্নাতুর গলায় বললেন, ওর হাঁটা-টা লক্ষ করেছ? চপলা হরিণীর মত, কিন্তু তাতে মিশে আছে রাজকীয় আভিজাত্য। আমার মনে হয় না আল্লাহ্ ওকে দোজখে নিক্ষেপ করবার জন্য তৈরি করেছেন!

আমি একমত, হুজুর। সত্যিকার কোনও ঈমানদারের সেবা করবার জন্য জন্ম হয়েছে ওর।

তা তো বটেই। সেবা-ই করবে ও-আমার! আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, সামানি। এখানেই থাকো তুমি। নিলাম শুরু হলে কিনে নিয়ে মেয়েটাকে। ইসলাম ধর্মে ওকে দীক্ষা দেব আমি, বাঁচাব দোজখের আগুন থেকে।

হাসি ফুটল উজিরের ঠোঁটে। দাম কত দেব, মালিক?

দাম? আবার দামের কথা জিজ্ঞেস করছ কেন? এক হাজার দিনার উঠলেও কিছু যায়-আসে না, ওকে নিয়ে আসবে তুমি আমার কাছে।

এক হাজার! চমকে উঠল সামানি। ইয়া আল্লাহ!

তাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলেন না আসাদ-আদ-দীন। চলে গেলেন ফটকের দিকে। প্রাসাদে ফিরবেন। বাইরে থেকে আবার ভেসে এল জয়ধ্বনি।

একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল সামানি। ভিনদেশি মেয়েটিকে কেনার দায়িত্ব পেয়ে খুশি হয়েছে, কিন্তু সমস্যা হলো–পকেট একদম ফাঁকা। দাস-বাজারের নিয়ম হলো, নগদ দাম না দিয়ে কোনও দাস কেনা যাবে না। এক হাজার দিনারের কথা বলেছেন বাদশাহ, সে-পরিমাণ অর্থ থাকতে হবে তার কাছে। তাই মনিব চলে যেতেই বাজার থেকে বেরিয়ে পড়ল সে–দিনার আনার জন্য। হাতে এখনও বেশ খানিকটা সময় আছে, ফিরে আসতে পারবে নিলামের আগে।

রাস্তা ধরে কিছুদূর যেতেই খোঁজা আইয়ুবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল উজিরের। নিলামের উপর নজর রাখার জন্য মাঝপথ থেকে তাকে ফেরত পাঠিয়েছে ফানযিলাহ্। বলে রাখা ভাল, মালকিনের মত সে-ও উজিরকে পছন্দ করে না। দেখা হতেই সালাম ঠুকল বটে, কিন্তু সেটা দায়সারা ভঙ্গিতে।

আসোলামু আলাইকুম, সামানি, বলল আইয়ুব। এমন হন্তদন্ত হয়ে কোথায় চললেন? জরুরি কোনও সংবাদ আছে?

সংবাদ? কীসের সংবাদ? বিরক্ত গলায় বলল উজির। অন্তত তোমার মালকিনকে খুশি করবার মত কোনও সংবাদ নেই আমার কাছে।

আবার কী ঘটল? খ্রিস্টান ওই মেয়েটার ব্যাপারে কিছু নয়।

জবাব দিল না, তার বদলে ধূর্ত হাসি দেখা দিল সামানির চেহারায়। নীরব ক্রোধ অনুভব করল আইয়ুব। ফানযিলাহ্-র অধীনে কাজ করে সে, বেগমের ক্ষমতা খর্ব হলে সে-ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, ঠিক ঠিক বলুন। কিছু লুকাবেন না আমার কাছে… বেগমসাহেবা খুবই নাখোশ হবেন!

হাহ! বেগম না কচু!বলল সামানি। তোমাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে, বুঝলে?

কী বললে, কুকুর! রাগ আর চাপতে পারল না আইয়ুব। বেগমসাহেবা-কে অপমান করলে?

আমাকে কুকুর বললে? এবার সামানিও খেপল। যাও, তা হলে তোমার মালকিনকে গিয়ে জানাও-খ্রিস্টান মেয়েটাকে কিনবার নির্দেশ দিয়েছেন আমাকে বাদশাহ্। ওকে বিয়ে করবেন, ফানযিলাহকে লাথি মেরে তাড়াবেন প্রাসাদ থেকে। এ-ও বোলো, মেয়েটার জন্য এক হাজার দিনার পর্যন্ত খরচ করবার অনুমতি পেয়েছি আমি। আজ ও প্রাসাদে যাচ্ছেই… কারও সাধ্য নেই তা ঠেকায়। ফানযিলাহকে বলে দিয়ো-বাক্সপ্যাটরা যেন গুছিয়ে রাখে। নইলে শেষে এক কাপড়ে বেরুতে হবে প্রাসাদ থেকে।

স্থবির হয়ে গেল আইয়ুব। তাকে ও-অবস্থায় রেখে হাসতে হাসতে চলে গেল সামানি।

ঝড়-বংশে নিপাত হোক তোমার, ধাতস্থ হয়ে তাকে গালি, দিল আইয়ুব। তারপর ছুটল প্রাসাদের দিকে।

.

খবরটা শুনে যেন বাজ পড়ল ফানযিলাহর মাথায়। চমক যখন, সামলাল, তখন জ্বলে উঠল ক্রোধের আগুন। উঁচু গলায় অভিশাপ দিতে লাগল বাদশাহ্ আসাদ আর দাস-বাজারের ওই মেয়েটাকে।

একটু পর শান্ত হলো সে। বিশ্বস্ত খোঁজাকে বলল, এখুনি একটা কিছু করতে হবে, আইয়ুব, নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে আমার… সেইসঙ্গে মারযাকেরও। আমি না থাকলে বাপের সামনে মাথাই তুলতে পারবে না ও। শাকের ওকে নিজের চাকর বানিয়ে ছাড়বে। একটু ভাবল সে। যেভাবেই হোক, ঠেকাতে হবে সামানিকে। ও যেন কিছুতেই ওই সাদা ডাইনিটাকে কিনতে না পারে। নইলে আমাদের সঙ্গে তুমিও শেষ হয়ে যাবে, আইয়ুব।

বুঝতে পারছি, মালকিন, মাথা ঝাঁকাল খোঁজা। কিন্তু ঠেকাব কীভাবে সামানিকে?

মেয়েটাকে ওর নাগালের বাইরে নিয়ে যেতে হবে।

কীভাবে সেটা সম্ভব?

মাথায় কি গোবর নাকি তোমার? সহজ কথাও বুঝতে পারছ না? নিলামে অংশ নেবে তুমি, মেয়েটার দাম তুলে দেবে আকাশে… সামানির সাধ্যের বাইরে। যত টাকা লাগে আমি দেব! কিন্তু মেয়েটাকে হাতে পাওয়া চাই। তারপর ওকে দুনিয়ার বুক থেকে সরিয়ে দেব আমরা। বাদশাহ যাতে আর কোনোদিন খোঁজ না পান ওর।

ইয়ে… ইতস্তত করল আইয়ুব, আমাকে এ-কাজ থেকে মাফ করা যায় না, মালকিন? বাদশাহ-র বিপক্ষে যেতে বলছেন আপনি, সেটা খুবই বিপজ্জনক। মেয়েটা গায়েব হয়ে গেলে কী ঘটিয়ে বসেন, তার কিছুই বলা যায় না।

খামোকা ভয় পাচ্ছ। আমাদের বাদশাহ্ তো আর অল্পবয়সী যুবক না যে, একটা মেয়ের জন্য পাগল হয়ে যাবে। যুক্তিবাদী মানুষ তিনি, বাস্তবতাকে মেনে নেবেন… আগেও নিয়েছেন। আমি ওঁকে খুব ভাল করেই চিনি। আমি নিশ্চিত মেয়েটার আশা ছেড়ে দেবেন উনি, ওকে ভুলে যাবেন।

ফানযিলাহ্-র আশ্বাসে স্বস্তি পেল না আইয়ুব। আমাকে রেহাই দিন, মালকিন। এসবে জড়াতে চাই না আমি।

জড়ানো মানে? কী এমন করতে বলেছি তোমাকে? আমার হুকুম তামিল করতে যাচ্ছ তুমি-তার বেশি কিছু তো আর নয়। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে এ-কথাই বলবে তুমি।

তবু…

চুপ! চাবুকের মত সপাং করে উঠল ফানযিলাহ-র গলা। আর কোনও অজুহাত শুনতে চাই না। যেতেই হবে তোমাকে। এদিকে এসো। দেড় হাজার দিনার আছে আমার কাছে, ওগুলো নিয়ে যাও। আশা করি ওতেই কাজ হবে।

অগত্যা কাঁধ ঝাঁকাল আইয়ুব। এক অর্থে ভুল বলেনি তার মালকিন-স্রেফ হুকুম তামিল করতে যাচ্ছে ও। কেউ এ-জন্য দোষারোপ করতে পারবে না ওকে। তা ছাড়া কাজটা থেকে আনন্দও পাবে–দেখতে পাবে সামানির পরাজিত চেহারা, তাকে খালি হাতে ফেরাতে পারবে অসন্তুষ্ট বাদশাহ্-র কাছে… একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না এ-প্রলোভন।

ফানযিলাহ্-র কাছ থেকে দিনারের থলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ও।

.

১০.

দাসবাজার

দাস-বাজারে নিলাম শুরু হতে চলেছে–শিঙা আর ঢোল বাজিয়ে ঘোষণা দেয়া হলো তার। ঝটপট বন্ধ হয়ে গেল সব দোকান, রত্ন-বিক্রেতাও তার বাক্স বন্ধ করে সরে গেল কুয়োর কাছ থেকে-ওখান থেকেই পরিচালিত হবে নিলাম। অল্পক্ষণেই ভিড় জমে গেল ভোলা জায়গার চারপাশে।

কাফ্রি ভৃত্যরা এসে পানি ছড়াল খোলা জায়গায়, যাতে ধুলো না ওড়ে। শিঙার আওয়াজ থামল একটু পর। ফটক খুলে গেল। সাদা পোশাক আর পাগড়ি পরা তিনজন নিলাম-পরিচালক ভিতরে ঢুকল ওখান দিয়ে। কুয়োর গোড়ায় এসে থামল তারা। ওদের নেতা সিঁড়ির সবচেয়ে উপরের ধাপে গিয়ে দাঁড়াল। এতক্ষণ ফিসফাস আর গুঞ্জন চলছিল সমবেত ক্রেতাদের মাঝে। নিলামের পরিচালকদেরকে দেখে চুপ হয়ে গেল তারা।

এবার মুখ খুলল প্রধান পরিচালক। উদাত্ত গলায় বলল, শুরু করছি পরম করুণাময় আল্লাহতালার নামে, মাটি থেকে যিনি সৃষ্টি করেছেন আমাদের। সমস্ত প্রশংসা তার। অসীম শক্তিমান তিনি… স্বর্গমর্তের মালিক। তার ইচ্ছেয় বাঁচি আমরা, তাঁর ইচ্ছেয় মরি। আসমান-জমিনের সবকিছুই চলে তাঁর হুকুমে। মহাজ্ঞানী তিনি-সব দেখেন ও জানেন।

আমিন! সমস্বরে বলে উঠল জনতা।

দয়ালু তিনি, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে পাঠিয়েছিলেন আমাদের কাছে-দ্বীনের শিক্ষা দেবার জন্য, এবং শয়তানের অনুসারীদের ধ্বংস করে দিতে।

আমিন!

এই বাজারের উপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আশীর্বাদ বর্ষিত হোক। আশীর্বাদ বর্ষিত হোক এখানকার ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপর, ওদের আয়ু এবং ধনসম্পদ… দুটোই যেন দিনে দিনে বৃদ্ধি পায়!

আমিন! তৃতীয়বারের মত বলল জনতা।

উপরদিকে তাকিয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল পরিচালক। তারপর বন্দিশালার দিকে ফিরে হাতের ইশারা করল। ভৃত্যরা সঙ্গে সঙ্গে পর্দা সরিয়ে ফেলল। আগ্রহী ক্রেতারা প্রথমবারের মত দেখতে পেল বিক্রি হতে আসা শতিনেক বন্দিকে–তিনভাগে বিভক্ত বন্দিশালায় অপেক্ষা করছে তারা।

মাঝখানের অংশটায়… যেখানে রোজামুণ্ড আর লায়োনেল রয়েছে… ওটার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুই কাফ্রি যুবক। পেশিবহুল শরীর ওদের, নির্বিকার, বন্দিদশা নিয়ে কোনও বিকার নেই। পাহারারত কর্সেয়ারদেরকে ইশারা করল পরিচালক ওই দুজনকে বের করে আনার জন্য। কুয়োর গোড়ায় নিয়ে যাওয়া হলো ওদের।

আজকের প্রথম আকর্ষণ হলো এক জোড়া কাফ্রি পালোয়ান, ঘোষণা করার সুরে বলল পরিচালক। ভাইসব, ভাল করে দেখুন ওদেরকে-কী শরীর… কী শক্তি! ভারী কাজ করাবার জন্য এরচেয়ে ভাল শ্রমিক আর হয় না। কেউ যদি আগ্রহী হন, তা হলে দাম বলতে শুরু করুন।

দুই বন্দিকে ক্রেতাদের সামনে দিয়ে ঘোরাতে শুরু করল তার সহকারীরা।

ফটকের কাছাকাছি, ভিড়ের সামনে দাঁড়িয়েছে আলি। ওসমানি তাকে নির্দেশ দিয়েছে শাকেরের জাহাজের জন্য ভাল কিছু দাস নিয়ে যেতে। পালোয়ান-দুজনকে পছন্দ হলো তার। তাই সবার আগে গলা চড়িয়ে বলল, শাকের-আল-বাহারের জাহাজে দাঁড় টানার জন্য এমন লোকই দরকার আমার।

ঠিক বলেছেন, আলি, হাসিমুখে বলল পরিচালক। সাগরের বাজপাখি, ইসলামের বর্শার জাহাজে এমন তাগড়া জোয়ান-ই মানায়। বলুন, কত দাম দেবেন?

দুইশো দিনার।

বাকি ক্রেতাদের দিকে ফিরল পরিচালক। দুইশো দিনারের ডাক পেয়েছি আমি। কেউ কি পঞ্চাশ বাড়াবেন?

ভিড়ের মাঝ থেকে দামি পোশাক পরা এক মূর ব্যবসায়ী হাত নাড়ল। তার সামনে নিয়ে যাওয়া হলো দুই পালোয়ানকে। ওদেরকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, লোকটা-হাত-পা টিপল, হাঁ করিয়ে পরীক্ষা করল জিভ-দাঁতও। সন্তুষ্ট হয়ে নতুন দাম হাঁকল সে।

দুইশো বিশ দিনার!

দুই বন্দিকে এক পাক ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো আলির সামনে। পরিচালক বলল, দুইশো বিশ দিনার দাম উঠেছে, হে আলি! কসম খোদার, আসলে তিনশো হওয়া উচিত। ডাকবেন নাকি?

দুইশো ত্রিশ। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল অলি।

মূর ব্যবসায়ীর দিকে ফিরল পরিচালক। দুইশো ত্রিশ দিনার ডেকেছেন আলি। আপনি নিশ্চয়ই বিশ দিনার বাড়াবেন, হামিদ?

মাথা খারাপ? বলল ব্যবসায়ী হামিদ। ও-ই কিনুক।

হাল ছাড়তে রাজি নয় পরিচালক। অন্তত দশ বাড়ান।

এক আধলাও বাড়াতে পারব না।

তা হলে ওদেরকে আপনিই পেলেন, আলি, ঘোষণা করল পরিচালক। দুইশো ত্রিশ দিনারের বিনিময়ে। আল্লাহকে ধন্যবাদ জানান এত সস্তায় পেয়েছেন বলে।

দুই বন্দিকে আলি-র সহচরদের হাতে সোপর্দ করা হলো। পরিচালকের এক সহকারী এগিয়ে এল টাকা নেবার জন্য।

এত অস্থির হবার কী আছে? বিরক্ত হয়ে বলল আলি। যথাসময়ে টাকা পাবে। শাকের-আল-বাহারের নামের উপরে কি আস্থা নেই তোমাদের?

মাফ করবেন, জনাব, বলল পরিচালক, কিন্তু এখানকার অলঙ্ঘনীয় নিয়ম হলো, দাম পরিশোধ না করে দাস নিতে পারবে না কেউ।

নিয়ম ভাঙব না আমি। অপেক্ষা করতে চাইছি আরও দাস কিনব বলে। সবগুলোর দাম একসঙ্গে মেটালে কোনও সমস্যা আছে?

না, না, সমস্যা কীসের? তাড়াতাড়ি বলল পরিচালক। বড় খদ্দেরকে চটাতে চাইছে না। জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল। আরও কিনবেন?

হা। ওই যে… ওটাকে। হাত তুলে রোজামুণ্ডের পাশে বসে থাকা লায়োনেলকে দেখাল আলি। ওকে কিনে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন শাকের।

বিস্ময় ফুটল নিলাম-পরিচালকের চেহারায়। ওই হাড় জিরজিরে লোকটা কী কাজে লাগবে শাকেরের? কিন্তু তাই বলে বিক্রির সুযোগ হাতছাড়া করল না।

নিয়ে এসো ওই হলুদ চামড়ার বিধর্মীটাকে! হুকুম দিল সে।

লায়োনেলের গায়ে হাত রাখল কর্সেয়ার প্রহরী। বাধা দিতে চাইল সে, কিন্তু ঘাড়ের উপর একটা রদ্দা খেয়ে চোখে আঁধার দেখল। ফুঁপিয়ে উঠল সশব্দে। সান্ত্বনাসূচক কিছু বলল ওকে রোজামুণ্ড। তা শুনে শান্ত হলো, বিনা প্রতিবাদে বেরিয়ে এল বন্দিশালা থেকে। দুর্বল পায়ে এসে দাঁড়াল কুয়োর গোড়ায়।

কী ব্যাপার, আলি? ঠাট্টার সুরে বলে উঠল ব্যবসায়ী হামিদ। ওকে দিয়েও দাঁড় টানাবে নাকি? অন্যেরা হেসে উঠল সে-কথা শুনে।

অসুবিধে কী? নিরুত্তাপ গলায় জবাব দিল আলি। অন্তত সস্তায় লতা পাব ওকে।

সস্তা মানে? অবাক হবার অভিনয় করল পরিচালক। এমন কচি মাল আর কোথায় পাবেন? ন্যায্য দাম কত হতে পারে… একশো দিনার?

একশো দিনার! ঠোঁট বাঁকাল আলি। এই তালপাতার সেপাইয়ের জন্য? ভালই বলেছ! বড়জোর পাঁচ দিনার দিতে পারি আমি।

আবার হেসে উঠল জনতা। তা শুনে যেন একটু অপমানিত হলো পরিচালক। বলল, আপনি রসিকতা করছেন, জনাব। ভাল করে দেখুন, হালকা-পাতলা হলেও ওর মধ্যে কোনও খুঁত নেই।

তার ইশারা পেয়ে লায়োনেলের জামা খুলে নিল এক ভৃত্য। উন্মুক্ত করে দিল ঊর্ধ্বাঙ্গ। ব্যাপারটা আত্মসম্মানে বাধল ইংরেজ যুবকের, বুকের উপর দুহাত এসে শরীর ঢাকল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চাবুক পড়ল পিঠে। কর্কশ ভাষায় এক প্রহরী ওকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবার নির্দেশ দিল।

হ্যাঁ, এবার বিচার করুন ওর, বলল পরিচালক। দেখতে-শুনতে ভাল, রোগব্যাধি নেই। ঠিকমত খাবার পেলে স্বাস্থ্যও ঠিক হয়ে যাবে। দাঁত দেখুন… কত্তো চমৎকার!

খপ করে লায়োনেলের মাথা ধরল এক ভৃত্য, ওকে বাধ্য করল হাঁ করতে।

সবই বুঝলাম, আলি বলল। কিন্তু ওর হাতদুটো তো মেয়েমানুষের মত সরু!

দাঁড় টানতে টানতে পুরুষের হাত হয়ে যাবে, যুক্তি দেখাল পরিচালক।

বিশ্বাস করতে পারছে না লায়োনেল, গরু-ছাগলের মত ওর দর-কষাকষি চলছে। নরকে যাও তোমরা! ক্ষোভে-দুঃখে চেঁচিয়ে উঠল ও।

অসন্তোষ দেখা দিল আলির চেহারায়। নিলাম-পরিচালককে বলল, মেজাজ দেখেছ বিধর্মীটার? গালি দিচ্ছে আমাদের! না, না, এমন বদমেজাজী দাস কেনা-ই উচিত না। পাঁচ দিনার বলে ফেলেছি… ওটাই শেষ।

হতাশ হয়ে লায়োনেলকে ক্রেতাদের সামনে ঘোরাবার নির্দেশ দিল পরিচালক। কিন্তু কেউই আগ্রহ দেখাল না ওর ব্যাপারে।

পাঁচ দিনার বড় কম হয়ে যায়, বলল পরিচালক। একটু গলা চড়াল। কেউ কি দশ দিনারও দেবেন না এই চমৎকার দাসটার জন্য?

সাড়া পাওয়া গেল না জনতার কাছ থেকে। দুর্বল এই যুবককে কিনে ঠকতে চাইছে না ওরা। খাইয়ে-দাইয়ে মোটা-তাজা করা তো অনেক সময়ের ব্যাপার। এত ঝামেলা করে কে? বরং স্বাস্থ্যবান দাস কিনলে সঙ্গে সঙ্গে কাজে লাগানো যাবে। ক্রেতাদের মনোভাব পরিচালকও বুঝতে পারছে। অগত্যা কাঁধ ঝাঁকাল সে। আলির দিকে ফিরল।

আপনিই জিতলেন, আলি। ও এখন আপনার সম্পত্তি… মাত্র পাঁচ দিনারের বিনিময়ে। আল্লাহ দু-দুবার লাভবান করলেন আপনাকে।

হাসল আলি। কাফ্রি দুই পালোয়ানের মত লায়োনেলকেও তার সহচরদের হাতে তুলে দিল নিলাম-পরিচালকের লোকেরা। আরও দাস চাইতে যাচ্ছিল আলি, বাধা পেল ভিড় থেকে ইহুদি এক ব্যবসায়ী মুখ খোেলায়। লম্বা, মাঝবয়েসী সে-পরনে কালো আচকান, গলায় দামি রুমাল বাঁধা। কোমরের চওড়া বেল্টে ঝুলছে একটা নকশাদার ছোরা। অধৈর্য হয়ে উঠেছে, তাই ফাঁক পেয়েই হাঁক ছেড়েছে নিলাম-পরিচালকের উদ্দেশে।

বন্দিশালার খাঁচার বামপাশের অংশে, বিস্কেন-আল বোরাকের আনা বন্দিদের ভিতর রয়েছে এক আন্দালুসিয়ান মেয়ে। বছর বিশেক বয়স, স্প্যানিশ সৌন্দর্য আগুনের মত জ্বলছে তার সারা দেহে। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙ, চুল মেঘের মত কালো, বাদামি চোখ আর ভুরু যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা। সাধারণ গ্রাম্য মেয়ের পোশাক তার গায়ে, দুঃখ-দুর্দশা পোহাতে পোহাতে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে চেহারা, তারপরেও রূপ কমেনি একবিন্দু। এই মেয়ের উপরেই দৃষ্টি পড়েছে ইহুদি ব্যবসায়ীর, বুকের ভিতর জ্বলে উঠেছে কামনার আগুন। তাকে হাতে পাবার জন্য তর সইছে না। নিলাম-পরিচালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মেয়েটাকে দেখাল সে।

ওই স্প্যানিশ মেয়েটাকে কিনতে চাই আমি, বলল ব্যবসায়ী। পঞ্চাশ দিনার দেব।

পরিচালক ইশারা করল। টেনে-হিঁচড়ে মেয়েটাকে খাঁচা থেকে বের করে আনল প্রহরীরা। তাকে এক নজর দেখে নিল পরিচালক। তারপর বলল, এমন রূপসীকে মাত্র পঞ্চাশ দিনারে পাওয়া যায় না, আব্রাহাম! এই যে… ইউসুফ ওর জন্য ষাট দিনারের বেশি খরচ করবে। কাছে দাঁড়ানো এক মূরের দিকে ইঙ্গিত করল সে।

মাথা নাড়ল মূর। বলল, ঘরে তিন-তিনটা বউ আমার ওদের ঝগড়াঝাটিতে জীবন অতিষ্ঠ। আরেকজনকে নিয়ে মারা পড়ব নাকি?

হাসল শ্রোতারা। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বাকিদের দিকে ফিরল পরিচালক। মেয়েটাকে হাঁটাতে বলল ক্রেতাদের সামনে থেকে, তাদের আগ্রহ জাগাবার জন্য। খাঁচা থেকে অসহায়, চোখে বেচারির দুর্দশা দেখল রোজামুণ্ড, ভিড়ের লোকজন লোভী দৃষ্টি দিয়ে চাটতে শুরু করেছে ওকে। একজন তো হাত-ই দিয়ে বসল ওর গায়ে, সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠল মেয়েটা। ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে, থুতু ছিটাল লোকটার মুখে। পরমুহূর্তে চাবুকের বাড়ি পড়ল বেচারির পিঠে। চুল ধরে তাকে সরিয়ে আনল এক প্রহরী, তো দিয়ে হাঁটতে বাধ্য করল। জনতা হাততালি দিয়ে উঠল দৃশ্যটা দেখে।

ঘুরিয়ে আনায় কাজ হলো। এক তুর্কি ক্রেতা হাত তুলে বলল, এই বুনো বেড়ালকে বশ করার আনন্দ পাবার জন্য ষাট দিনার দিতে রাজি আছি আমি।

সাবাস! এমন পুরুষই তো চাই! সোল্লাসে বলে উঠল পরিচালক।

কিন্তু আব্রাহাম এত সহজে হার মানতে রাজি নয়। সত্তর দিনার ডাকল সে। তুর্কি লোকটা আশি বলল। আব্রাহাম বলল নব্বই। এরপরে নীরবতা নামল কিছুটা সময়ের জন্য।

তুর্কি লোকটাকে প্ররোচিত করতে চাইল পরিচালক। বলল, কী ব্যাপার, ভাই? চুপ হয়ে গেলেন কেন? একটা ইহুদির কাছে হার মেনে নেবেন? মান-ইজ্জত কি থাকবে তাতে? এখনও সময় আছে, একশো দিনার ডাকুন।

মুখ লাল হয়ে উঠল তুর্কির। যেন ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ডাক দিল আবার। তবে একশো নয়, পঁচানব্বই দিনার।

কোমর থেকে একটা থলে বের করল আব্রাহাম। বলল, এখানে একশো দিনার আছে। দাম বড় চড়া হয়ে যাচ্ছে, তবু আমি এগুলো দিতে রাজি আছি।

কৌতূহলী দৃষ্টিতে সবাই তাকাল তুর্কির দিকে। কিন্তু মাথা নাড়ল সে। নাহ্, এর বেশি সম্ভব নয় আমার পক্ষে। ও-ই নিক মেয়েটাকে।

মেয়েটা তা হলে আপনার, আব্রাহাম। দাম মিটিয়ে দিন।

পরিচালকের এক সহকারীর হাতে স্বর্ণমুদ্রার থলে তুলে দিল আব্রাহাম, তারপর এগিয়ে গেল মেয়েটাকে বুঝে নেবার জন্য। ওকে ধাক্কা দিয়ে ইহুদি লোকটার কাছে পাঠাল প্রহরীরা।

শক্তিশালী দুহাতে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরল আব্রাহাম। কুটিল গলায় বলল, তোমার জন্য বহু টাকা খরচ হলো আমার, স্পেনের সুন্দরী! চলো, ওগুলো কড়ায়-গণ্ডায় পুষিয়ে দেবে।

আতঙ্ক ফুটল মেয়েটির চোখের তারায়, শরীর মোচড়াতে শুরু করল আলিঙ্গনের ভিতর। ছাড়া পেতে চাইছে। কিন্তু একটুও আলগা হলো না তার ইহুদি মালিকের বাঁধন। বরং হেসে উঠল লোকটা খিকখিক করে। আর কিছু না পেরে আচমকা খামচি দিল সে আব্রাহামের মুখে, চামড়া তুলে ফেলল। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গেল আব্রাহাম। আঁচড়ের উপর হাত বুলিয়ে রক্ত দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে রুদ্রমূর্তি ধারণ করল

কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। মেয়েটার উপর চোখ পড়তেই থমকে গেল আব্রাহাম। ওর হাতে শোভা পাচ্ছে তার নকশাদার ছোরাটা। খামচি খেয়ে যখন সরে যাচ্ছিল, তখন কোমর থেকে ওটা নিয়ে নিয়েছে মেয়েটা। দর্শকরা আঁতকে ওঠার মত একটা আওয়াজ করল।

ভালগা মা ডিয়োস! স্প্যানিশে চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা। ছোরার ফলা নিজের দিকে তাক করে দুহাতে ওটা উঁচু করল। চোখ বন্ধ করে বসিয়ে দিল বুকে। আর্তনাদ করে উঠল সে, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, বুকের ক্ষত আর মুখ দিয়ে গলগল করে বেরুচ্ছে রক্ত। একটু সময়ের জন্য স্থির রইল ওভাবে, তারপর কাত হয়ে পড়ে গেল। প্রাণ বেরিয়ে গেছে।

বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সবকিছু দেখল রোজামুণ্ড। নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে বেরিয়ে এল পানি। কিন্তু একটু পরেই নিজেকে সামলাল ও। মনের ভিতর আশার আলো জ্বলে উঠেছে, স্প্যানিশ মেয়েটা দেখিয়ে দিয়ে গেছে কী করা যেতে পারে… কীভাবে চরম অসম্মান থেকে বাঁচতে পারবে ও। হ্যাঁ, আত্মহত্যা করতে হবে এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেতে চাইলে। ঈশ্বর নিশ্চয়ই ক্ষমা করবেন ওকে। কোন পরিস্থিতিতে এই মহাপাপ করতে হচ্ছে, তা তো তিনি দেখতে পাচ্ছেন

আব্রাহামের ধাতস্থ হতে অনেকটা সময় লাগল। শেষ পর্যন্ত লাশ ডিঙিয়ে নিলাম-পরিচালকের দিকে এগোল সে। কাছে গিয়ে বলল, ও মারা গেছে। আমার সোনা ফেরত দাও।

ভুরু কোঁচকাল পরিচালক। ভাল আবদার জুড়েছেন তো! দাস মরলে পয়সা ফেরত? অমন কোনও নিয়ম আছে নাকি?

ও আমার দাসী হলো কীভাবে? প্রতিবাদ করল আব্রাহাম। বাজার থেকেই তো নিতে পারলাম না!

তাতে কী? দাম মিটিয়েছেন, আপনার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে ওকে। এরপর কিছু ঘটলে তার জন্য আমরা দায়ী নই।

থমথমে হয়ে উঠল আব্রাহামের চেহারা। কী! তারমানে খামোকাই একশো দিনার খোয়ালাম আমি?

ভাগ্যে যা ছিল, তা-ই ঘটেছে, দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলল পরিচালক। কপালের লিখন কেউ বদলাতে পারে না। আল্লাহ্-র ইচ্ছের বিরুদ্ধে কী-ই বা করার আছে আমাদের।

খেপে গেল আব্রাহাম। কথা ঘুরিয়ো না। আমি আমার একশো দিনার ফেরত চাই!

দেখেছেন ব্যাটার আস্পর্ধা! জনতার উদ্দেশে বলল পরিচালক। আল্লাহ্-র বিরুদ্ধে আঙুল তুলছে! নষ্ট করছে বাজারের শৃঙ্খলা!

হইচই শুরু করল উপস্থিত ক্রেতারা। বেশিরভাগই মুসলমান, তাই ইহুদি লোকটার প্রতি কোনও সহানুভূতি অনুভব করছে না।

ভাগো এখান থেকে! তোমার চেহারা দেখতে চাই না আমরা! শোনা গেল চিৎকার।

অসহায় বোধ করল আব্রাহাম। কেউ তার পক্ষে নেই। চেঁচামেচি বেড়ে যাওয়ায় হার মানল। বলল, ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি আমি। উল্টো ঘুরল বাজার থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য!

আপনার সম্পত্তি নিয়ে যান! টিটকিরির সুরে পিছন থেকে বলল পরিচালক। ইঙ্গিত করল লাশের দিকে। কেনা মাল রেখে যাবার নিয়ম নেই এখানে।

আরেক দফা অপমানের শিকার হতে হলে আব্রাহামকে, ভৃত্যদের ডেকে স্প্যানিশ মেয়েটার প্রাণহীন দেহ তুলে নেবার সময়। চলে যাবার আগে শেষবারের মত ফিরল নিলাম পরিচালকের দিকে। হুমকির সুরে বলল, বাদশাহ্-র কাছে নালিশ জানাব আমি। আসাদ-আদ-দীন সুবিচারক, আমার টাকা ফেরত দেবেন তিনি।

নিশ্চয়ই দেবেন! বলল পরিচালক। যখন আপনি ওই লাশকে জ্যান্ত করে তুলতে পারবেন! হেসে উঠল নিজের রসিকতায়।

জামার হাতায় টান পড়াতে থামল সে, ঘাড় ফেরাতেই দেখল খোঁজা আইয়ুবকে। নিচু গলায় বাজারে আসার উদ্দেশ্য জানাল সে। ফানযিলাহ্-র নাম শুনে তটস্থ হয়ে উঠল পরিচালক। তাড়াতাড়ি নির্দেশ দিল ইংরেজ বন্দিনীকে হাজির করবার।

বিনা প্রতিবাদে কুয়োর গোড়ায় এল রোজামুণ্ড। হাঁটল এলোমেলো পায়ে, যেন ঘুমের ঘোরে পা ফেলছে। মুখ খোলার আগে ওকে ভাল করে দেখে নিল পরিচালক। তারপর শুরু করল গুণগান… যদিও তার প্রয়োজন ছিল না। উজ্জ্বল সূর্যালোকে দেবীর মত দাঁড়িয়ে আছে ও, পরনের সাদা পোশাক থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে দ্যুতি। উপস্থিত ক্রেতাদের বুকে ঝড় তুলল এই দৃশ্য।

সবার আগে হাঁক দিল এক মোটাসোটা মূর। কাফ্রি ভৃত্য কিনতে এসেছে সে, কিন্তু রোজামুণ্ডকে দেখে ভুলে গেছে প্রয়োজনের কথা। ঝুঁকি এড়াবার শুরুতেই চড়া দাম বলল, যাতে আর কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারে।

একশো দিনার!

যথেষ্ট নয়, বলল পরিচালক। চাঁদের মত মুখটা দেখুন। এর দাম-ই তো একশো দিনারের বেশি। শরীরের কথা নাহয় বাদ দিলাম। দয়া করে ঠিকমত দাম বলুন।

দেড়শো দিনার! বলে উঠল সেই তুর্কি ক্রেতা। নতুন উদ্যম ফিরে পেয়েছে সে।

এবারও কম বললেন। কত লম্বা ও, দেখুন। শরীরটা কেমন টানটান! চোখদুটো কত সুন্দর! এই সুন্দরী তো বাদশাহ-র হারেমের উপযুক্ত, আর আপনারা কিনা দাসী-বাদীর দাম বলছেন!

প্ররোচনায় কাজ হলো। ইউসুফ নামের সেই মূর সরাসরি দুইশো দিনার ডেকে বসল। একটু আগেই বলেছে, চতুর্থ স্ত্রী নেবার ইচ্ছে নেই তার; কিন্তু রোজামুণ্ডের রূপ দেখে খায়েশটা আবার মাথায় চেপে বসেছে।

এবারও সন্তুষ্ট হলো না পরিচালক। বন্দিনীর পাশে গিয়ে একটা হাত উঁচু করাল। বলল, পেলব এই বাহু দেখুন। গোলাপের মত ঠোঁট দেখুন। মাত্র দুইশো দিনারে কি পাওয়া যায় এসব? দাম বাড়ান। হামিদ, আপনি কিছু বলছেন না কেন?

একটু বিরক্ত দেখাচ্ছে মূর ব্যবসায়ী হামিদকে। বলল, কী যে হয়েছে আপনাদের, বুঝতে পারছি না। এরচেয়ে কম দামে কদিন আগেও একসঙ্গে তিনটা দাসী কিনেছি আমি সাস থেকে।

সাসের বিশ্রী মেয়েদের সঙ্গে এমন অপরূপার তুলনা করবেন না, হামিদ। নিজেই ভেবে দেখুন, ওরা কি এর নখেরও যোগ্য?

কাঁধ ঝাঁকাল হামিদ। বেশ, তা হলে দুইশো দশ দেব আমি।

এতক্ষণ ভিড়ের পিছনে ছিল উজির সামানি। এবার সামনে এগিয়ে এল। দর কষাকষির ইচ্ছে নেই, তাই একবারেই বলে দিল দাম।

তিনশো দিনার! ব্যাপারটা চুকেবুকে যাবার জন্য ডাক দিল সে, কিন্তু…

চারশো দিনার! ভেসে এল একটা কর্কশ কণ্ঠ।

ঝট করে সেদিকে ফিরল সামানি, দেখতে পেল আইয়ুবের কুটিল হাসিমাখা চেহারা। গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল ভিড়ের মাঝে। সবাই উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে পাগলাটে এই ক্রেতাকে দেখার জন্য।

মূর ব্যবসায়ী ইউসুফ খেপে গেল। শাপশাপান্ত করে বলল, আর কোনোদিন পা রাখবে না আলজিয়ার্সের এই বাজারে। কসম খোদার, সবাইকে জাদু-টোনায় পেয়েছে, যোগ করল সে। নইলে একটা খ্রিস্টান মেয়ের দাম চারশো দিনার হয়? আল্লাহ্ তোমাদের সম্পদ বৃদ্ধি করুন। না হলে এই দামে দাসী কিনে ফতুর হয়ে যাবে তোমরা।

রাগী ভঙ্গিতে ভিড় ঠেলে বাজার থেকে বেরিয়ে গেল সে। কিন্তু নাটক তখনও শেষ হয়নি। সামানি তার বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কা সামলাবার চেষ্টা করছে… আইয়ুবকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে একেবারেই আশা করেনি সে… এই সুযোগে নতুন ডাক দিল তুর্কি লোকটা।

পাগলামিই হয়তো করছি, বলল সে, কিন্তু এই মেয়ে আমার মন ভরিয়ে দিচ্ছে আনন্দে। আল্লাহ্ হয়তো ওকে আমার জন্যই পাঠিয়েছেন। যা থাকে কপালে… চারশো বিশ দিনার ডাকছি আমি, পরিচালক ভাই। আল্লাহ্ আমাকে ক্ষমা করুন।

কথাটা শুনে যেন চাবুকের বাড়ি খেল সামানি, ফিরে এল বাস্তবে। তাড়াতাড়ি পরিচালকের দিকে ফিরে চেঁচিয়ে উঠল, পাঁচশো দিনার!

হায় আল্লাহ্! আঁতকে উঠল তুর্কি। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জনতাও চেঁচাল হায় আল্লাহ বলে।

নির্বিকার রইল আইয়ুব। শান্ত গলায় বলল, সাড়ে পাঁচশো!

ছয়শো! পাল্টা ডাক দিল সামানি।

উপস্থিত জনতা চেঁচাচ্ছে না আর। হতভম্ব হয়ে গেছে তারা। কোনও দাসীর জন্য এমন লড়াই আগে কখনও দেখা যায়নি এই বাজারে। ওদেরকে আরও বিস্মিত করে সাতশো দিনার ডাকল আইয়ুব।

আটশো! খ্যাপাটে কণ্ঠে বলল সামানি।

নয়শো। জবাব দিল যেন আইয়ুব।

খোজার দিকে ফিরল উজির। রাগে লাল হয়ে গেছে চেহারা। ধমকের সুরে বলল, তুমি কি এখানে ফাজলামি করতে এসেছ?

ফাজলামি? বলল আইয়ুব। আপনি কি আমার দুলাভাই যে ফাজলামি করব?

মাটিতে পা ঠুকল সামানি ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে। পরিচালকের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ল, এক হাজার দিনার!

তীব্র গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল ভিড়ের মধ্যে।

চুপ করুন সবাই! বলে উঠল পরিচালক। চুপচাপ আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন, যিনি এমন চমৎকার মূল্য পাঠাচ্ছেন আমাদের সামনে।

এগারোশ দিনার! লোকটার কথা শেষ হতেই চেঁচাল আইয়ুব।

অসহায় বোধ করল সামানি। বাদশাহ-র বলে দেয়া সীমায় পৌঁছে গেছে সে, এরচেয়ে বেশি খরচ করতে চাইলে অনুমতি নিতে হবে। অত টাকাও নেই তার কাছে। জোগাড় করে আনতে পারবে, কিন্তু তার সময় কোথায়? নিলাম তো আর থামিয়ে রাখা যাবে না। উভয়সঙ্কট আর কাকে বলে? দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ওর উপর অসন্তুষ্ট হবেন বাদশাহ্… রেগে যেতে পারেন অকারণে বাড়তি টাকা জলাঞ্জলি দিলেও। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।

ভিড়ের দিকে তাকাল সে। হতাশায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, এ আমি মানি না! খোঁজাটা মশকরা করছে আমাদের সবার সঙ্গে। কেনার কোনও ইচ্ছে নেই ওর। আপনারাই ভাবুন, সামান্য এক নফরের কাছে এত টাকা আসবে কোত্থেকে?

কোমর থেকে মোটাসোটা একটা থলে বের করে সবাইকে দেখাল আইয়ুব। বলল, আমার একজন পৃষ্ঠপোষক আছে। পিত্তি জ্বালানো ভঙ্গিতে হাসল। পরিচালক মহোদয়, আমি কি এগারোশ দিনার গুনে ফেলব?

উজির সামানি-র যদি তাতে আপত্তি না থাকে, বলল পরিচালক। জানো কার হয়ে আমি কিনতে এসেছি মেয়েটাকে? গর্জে উঠল সামানি। স্বয়ং বাদশাহ্ আসাদ-আদ-দীনের হয়ে! কয়েক পা এগিয়ে আইয়ুবের মুখোমুখি হলো। কত বড় সাহস তোমার, বাদশাহ্-র মুখের গ্রাস কেড়ে নিতে চাইছ! কী জবাব দেবে তুমি তাঁর সামনে?

মোটেই বিচলিত হলো না আইয়ুব। বলল, ভয় দেখিয়ে লাভ নেই, উজির। আমাদের বাদশাহ্ সুবিচারক। উন্মুক্ত নিলামে অংশ নেবার জন্য তিনি শাস্তি দেবেন না আমাকে। আমি নিশ্চিত!

আগুন নিয়ে খেলছ তুমি!

রাগে অন্ধ হয়ে গেছেন আপনি। মাথা কাজ করছে না। শান্ত হোন।

অগ্নিদৃষ্টি হানল সামানি, আইয়ুব তার জবাবে, নিক্ষেপ করল শীতল চাহনি। কয়েক মুহূর্ত নীরবে দৃষ্টির লড়াই চলল দুজনের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত গলা খাকারি দিয়ে তার ইতি ঘটাল নিলাম পরিচালক।

ডাক এখন এগারোশ দিনার, হে উজির। আপনি কি বাড়াবেন?

মাথা নেড়ে পিছিয়ে গেল সামানি!. সম্ভব নয়। এরচেয়ে বেশি ডাকার ক্ষমতা নেই আমার।

বেশ, তা হলে এগারোশ দিনারের বিনিময়ে, আইয়ুব…

কথা শেষ হলো না তার। বাজারের ফটকের দিক থেকে শোনা গেল একটা জলদগম্ভীর কণ্ঠ।

বারোশ দিনার!

স্বয়ং নিলাম-পরিচালকও চমকে গেল এই ডাক শুনে। পাগলামির অবসান ঘটেছে ভেবেছিল, কিন্তু তার ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে নতুন মানুষটা। হুল্লোড় করে উঠল জনতা। সামানির মুখেও হাসি ফুটল। কে দিয়েছে ডাক, তা দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু আইয়ুবের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি হওয়ায় খুশি হয়ে উঠেছে। নিজে না পারুক, এই নতুন ক্রেতা হয়তো প্রতিশোধ নেবে ওর হয়ে। একটু পরেই কৌতূহলের অবসান ঘটল তার।

ভিড় দুভাগ হয়ে পথ করে দিল, সেখান দিয়ে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে এল শাকের-আল-বাহার। জনতা জয়ধ্বনি দিল তার নামে।

ফটকের দিকে পিঠ দিয়ে রেখেছে রোজামুণ্ড, অলিভারকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু ঠিকই ওর কণ্ঠ চিনতে পারল। কেঁপে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। আরবী ভাষা জানে না, নিলামের খুঁটিনাটি বুঝতে পারছে না, টেরই পায়নি ওকে নিয়ে কতবড় নাটক চলছিল এতক্ষণ থেকে। কিন্তু অলিভারের কণ্ঠ ওকে বিচলিত করে তুলল। ক্ষণিকের জন্য দুনিয়া দুলে উঠল চোখের সামনে। নিলামে অংশ নিতে এসেছে সে। কেন? ওকে নিজের ক্রীতদাসী বানাবার জন্য? চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরকে ডাকল রোজামুণ্ড, লোকটার ইচ্ছে যেন সফল না হয়। সবকিছু মেনে নেবে, তবু কিছুতেই মানতে পারবে না অলিভারের হাতে নিগৃহীত হবার অসম্মান। তার আগে প্রয়োজনে জীবন দেবে।

একটু পর ধাতস্থ হলো ও। উপস্থিত লোকজন তখন মাশাল্লাহ্, শাকের-আল-বাহার! বলে চেঁচাচ্ছে। নিলাম পরিচালকের সহকারীরা ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ওদেরকে শান্ত করবার। জনতার উচ্ছ্বাস একটু স্তিমিত হলে পরিচালক বলল:

আল্লাহ্ দয়াময়… এমন আগ্রহী ক্রেতা পাঠিয়েছেন তিনি আমাদের মাঝে। আইয়ুব, আপনি কিছু বলতে চান?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলো আইয়ুব, খোঁচা মারল সামানি। চুপ করে থেকো না।

তেরোশ দিনার, অস্বস্তি নিয়ে দাম বাড়াল খোঁজা। পাশার ছক উল্টে গেছে।

আরও একশো দেব আমি, শান্তস্বরে জানাল শাকের আল-বাহার।

দেড় হাজার দিনার! মরিয়ার মত বলল আইয়ুব। ফানযিলাহ্-র দেয়া পুরো টাকাই বাজি ধরে ফেলেছে। ওখান থেকে কিছুটা লাভ করবে ভেবেছিল, সে-আশায় গুড়েবালি।

কিন্তু ওর এই ডাকের মুখে অবিচল রইল শাকের-আল বাহার। ভুরু পর্যন্ত নড়ল না, তাকাল না প্রতিদ্বন্দ্বী খোজার দিকে। শুধু শান্তস্বরে বলল, আরও একশো, হে পরিচালক।

ষোলোশ দিনার! প্রায় চিৎকার করে উঠল পরিচালক। যত না বিস্ময়ে, তারচেয়েও বেশি গর্বে। আজ পর্যন্ত এত দামে কোনও ক্রীতদাস বিক্রি করেনি সে… কেউ কোনোদিন করেছে বলেও শোনেনি। হাত তুলে কৃতজ্ঞতা জানাল, আল্লাহ্ চাইলে কী না হয়। তিনিই আজ আমার কপালে এমন ধনী ক্রেতা জুটিয়েছেন! সব প্রশংসা তাঁর।

এদিকে বজ্রাহতের মত স্থবির হয়ে গেছে আইয়ুব। মুখে কোনও রা নেই। আর ডাক দেবার ক্ষমতা নেই তার–দাম মেটাতে পারবে না। লোকটার এই অবস্থা দেখে খিকখিক করে হাসল সামানি। প্রতিশোধের জ্বালা অনেকখানিই মিটেছে তার। বলল, কী আইয়ুব, ঠোঁট সেলাই হয়ে গেল কেন? আর ডাকবে না?

মাথা নাড়ল খোঁজা। শয়তানের দয়ায় টাকার অভাব নেই ওঁর। আমার পক্ষে পাল্লা দেয়া সম্ভব নয়।

এই প্রথমবারের মত লোকটার দিকে তাকাল শাকের, ধক করে জ্বলে উঠল দুচোখ। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাছে। পৌঁছুল, লৌহকঠিন হাতে সাঁড়াশির মত চেপে ধরল তার গলা।

কী বললে? শয়তানের দয়ায় ধনী হয়েছি আমি? মৃত্যুর শীতলতা ফুটল শাকেরের কণ্ঠে। আইয়ুব হাঁসফাঁস করছে বাতাসের অভাবে, খামচি দিচ্ছে দুর্বলভাবে, কিন্তু আলগা করল না মুঠি। চাপ দিয়ে তাকে মাটিতে বসাল ও, এরপর চিৎ করে ফেলল, চেপে বসল বুকের উপর। আজ তুমি মরবে, বদমাশ! আমাকে অপমান করার দায়ে কবরে যেতে হবে তোমাকে।

টকটকে লাল হয়ে উঠেছে আইয়ুবের চেহারা, চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। ফাঁসাসে গলায় বলল, দয়া করুন… দয়া করুন, হে শাকের-আল-বাহার। মাফ চাই… অন্যায় করে ফেলেছি আমি।

গলার উপর থেকে চাপ একটু কমাল শাকের। নির্দেশ দিল, কথা ফিরিয়ে নাও। স্বীকার করো, তুমি একটা মিথ্যেবাদী কুকুর।

নিচ্ছি… নিচ্ছি! তড়িঘড়ি করে বলল আইয়ুব। আমি আসলেই মিথ্যেবাদী কুকুর, আপনার নামে অপবাদ দিয়েছি। আপনি তো ধনী হয়েছেন আল্লাহ্র আশীর্বাদে… তাঁর অক্লান্ত সেবা করে!

লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল শাকের। এবার তোমার নোংরা জিভ এখানকার ধুলো দিয়ে পরিষ্কার করো।

জী? নির্দেশটার অর্থ বুঝতে পারছে না আইয়ুব।

মাটি চার্ট, হারামজাদা! পিছন থেকে গাল দিয়ে উঠল আলি।, তাড়াতাড়ি হামাগুড়ির ভঙ্গিতে গেল আইয়ুব। জিভ বের করে চাটতে শুরু করল বাজারের মাটি। শেষ পর্যন্ত যখন উঠে দাঁড়াবার অনুমতি পেল, তখন আত্মমর্যাদা মিশে গেছে ধুলোর সঙ্গে। ধূলিময় চেহারায় ফুটেছে চরম পরাজয়। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে টিটকিরি।

এবার কেটে পড়ো এখান থেকে, তাকে বলল শাকের। নইলে আমার ছেলেরা তোমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।

পড়িমরি করে ছুটে পালাল আইয়ুব।

শাকের ঘুরে দাঁড়ালে নিলাম-পরিচালক ঘোষণা করল, ষোলোশ দিনারের বিনিময়ে এই দাসী এখন আপনার, হে শাকের-আল-বাহার। আল্লাহ্ আপনার বিজয় বাড়িয়ে দিন!

তোষামোদের প্রভাব পড়ল না শাকেরের চেহারায়। ঠাণ্ডা গলায় বলল, দাম মিটিয়ে দাও, আলি। তারপর এগোল রোজামুণ্ডকে বুঝে নিতে।

আবারও মুখোমুখি হলো দুজনে। শীতল দৃষ্টিতে পুরনো প্রেমিকার দিকে তাকাল অলিভার, আর ওর সেই তাকানোতে ভয় পেয়ে এক পা পিছিয়ে গেল রোজামুণ্ড। চিরচেনা মানুষটা কতখানি বদলে গেছে… কতখানি নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে, তা ওই খোঁজাকে শাস্তি পেতে দেখে বুঝে ফেলেছে ও। ঘৃণা আর অনুভব করছে না মেয়েটা, অস্তিত্ব জুড়ে চেপে বসেছে ভয়।

হালকা একটা হাসি দিয়ে সে-ভয় আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিল অলিভার। ইংরেজিতে বলল, এসো।

মাথা নেড়ে পিছিয়ে গেল রোজামুগু, ইতিউতি তাকিয়ে আশ্রয় খুঁজল। সামনে এগোল অলিভার, নিষ্ঠুরের মত আঁকড়ে ধরল ওর কবজি, হিড়হিড় করে টেনে সরিয়ে আনল কুয়োর গোড়া থেকে। ছুঁড়ে দিল নিজের সঙ্গী-সাথীর দিকে।

মুখ ঢাকো ওর, নির্দেশ দিল সে। তারপর নিয়ে চলো আমার বাড়িতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *