ষষ্ঠ অধ্যায় – উপসংহার
প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে আমি যথাক্রমে ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যা, চার্বাক জ্ঞানবিদ্যা, পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যা ও হিউমের জ্ঞানবিদ্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। এরপর, পঞ্চম অধ্যায়ে চার্বাক ও হিউমের জ্ঞানবিদ্যার তুলনামূলক আলোচনা করেছি। প্রথম অধ্যায়ে ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যা, বিশেষ করে, ভারতীয় প্রমাণতত্ত্বের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে গিয়ে এটা দেখেছি যে, মীমাংসা, বেদান্ত, ন্যায়, সাংখ্য, যোগ, বৈশেষিক, বৌদ্ধ ও জৈন এই আটটি সম্প্রদায়ই তাঁদের জ্ঞানবিদ্যায় প্রত্যক্ষ ও অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। যার ফলে এসব দার্শনিক সম্প্রদায়কে জ্ঞানোৎপত্তিসংক্রান্ত মতবাদের দিক থেকে পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মতো বিশুদ্ধ বুদ্ধিবাদী বা বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে চার্বাক জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় দেখা যায়, চার্বাক দার্শনিকগণ জ্ঞানবিদ্যার দিক থেকে উল্লিখিত আটটি সম্প্রদায় থেকে ভিন্নধর্মী এবং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ধারার সূচনা করেছেন। তাঁরা জ্ঞানোৎপত্তিসংক্রান্ত মতবাদ হিসেবে বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতার কথা আপোষহীনভাবে ঘোষণা করে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ হিসেবে অভিহিত করেন। শুধু জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে নয়, অধিবিদ্যার দিক থেকে তাঁরা বিশুদ্ধ জড়বাদ, আত্মা সম্পর্কিত মতবাদের ক্ষেত্রে দেহাত্মবাদ, জড় ও চেতনার উৎপত্তিসম্পর্কিত ব্যাখ্যায় স্বভাববাদ বা প্রকৃতিবাদ, কার্যকারণের ব্যাখ্যায় আকস্মিকতাবাদ, মোক্ষের ক্ষেত্রে ইহলোকবাদ ও জাগতিকতাবাদ এবং নীতিবিদ্যার দিক থেকে দৃঢ়ভাবে সুখবাদকে সমর্থন করেছেন। দর্শনের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের অনুসারিত তত্ত্বে প্রত্যক্ষবাদী জ্ঞানবিদ্যার সমর্থন খুঁজে পাওয়া যায়। অন্য আটটি ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে অধ্যাত্মবাদের প্রতি যে সমর্থন পরিলক্ষিত হয় চার্বাক দর্শন এর ব্যতিক্রম। সাম্প্রতিককালের দার্শনিক চিন্তার বিচার বিশ্লেষণে তাঁদের অভিজ্ঞতাবাদ ত্রুটিমুক্ত ও সন্তোষজনক মতবাদ না হলেও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, চার্বাক দার্শনিকগণ দর্শনের ইতিহাসে অভিজ্ঞতাবাদী ধারার প্রবর্তক। শুধু তাই নয়, চার্বাকগণ তাঁদের অন্যান্য দার্শনিক মতবাদের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাবাদের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষার যে প্রয়াস পেয়েছেন তা অনেক পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতাবাদী চিন্তায় অনুপস্থিত।
তৃতীয় অধ্যায়ে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসের আলোচনায় প্রধানত দুটি জ্ঞানবিদ্যাগত ধারার পরিচয় পাওয়া যায়। অভিজ্ঞতাবাদ ও বুদ্ধিবাদ। অভিজ্ঞতাবাদী ধারাটি সোফিস্টদের হাতে জন্মলাভ করে। সোফিস্টদের অভিজ্ঞতাবাদী আলোচনার মধ্যে দিয়েই পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা শুরু হয়। পরবর্তীকালে এপিকিউয়িস-জেনো-একুইনাস-বেকন-লক-বার্কলে প্রমুখের দার্শনিক আলোচনার মধ্যে দিয়ে এই ধারা হিউমের দর্শনে বিশেষ স্থান লাভ করে। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার এই ধারাটি যেন ভিন্ন আঙ্গিক ও প্রেক্ষাপটে চার্বাক অভিজ্ঞতাবাদেরই অনুরণন।
চতুর্থ অধ্যায়ে হিউমের জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, তিনি উপর্যুক্ত পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতাবাদী ধারারই প্রতিনিধিত্ব করেন এবং বিভিন্ন দিক থেকে বৃহত্তর পরিসরে একে ত্রুটিমুক্ত, সংশোধিত ও উন্নত করে পূর্ণাঙ্গ ও সঙ্গতিপূর্ণ রূপ দিতে প্রয়াসী হন। তাঁর এই প্রয়াসের ফলে পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতাবাদ সুসঙ্গত রূপলাভ করে। তাঁর পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাবাদী লক ও বার্কলের দ্রব্যের ধারণা তাঁর দ্বারা অস্বীকৃত হয়। আত্মা সম্পর্কিত শাশ্বত-ধারণা মতবাদ তাঁর অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যায় পুঞ্জবাদে রূপ নেয়, কার্যকারণের আবিশ্যক সম্পর্কের ধারণার স্থলে আকস্মিক বা সম্ভাব্য সম্পর্কের ধারণা প্রতিস্থাপিত হয় এবং অভিজ্ঞতাবাদের চরম পরিণতি হিসেবে সংশয়বাদের উদ্ভব হয়। এভাবেই হিউম তাঁর ব্যাখ্যায় অভিজ্ঞতাবাদের সর্বশেষ গন্তব্য নির্ধারণের চেষ্টা করেন।
চার্বাক ও হিউমের অভিজ্ঞতাবাদের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হয়েছে পঞ্চম অধ্যায়ে, চার্বাক ও হিউমের জ্ঞানবিদ্যার তুলনামূলক সমীক্ষায়। এখানে উভয় অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বিচার করতে গিয়ে মনে হয়, হিউম যেন চার্বাক প্রতিষ্ঠিত অভিজ্ঞতাবাদেরই আধুনিক রূপকার। সমসাময়িক আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এই মতবাদ থেকে অসঙ্গতিপূর্ণ উপাদানগুলোকে বর্জন করে অভিজ্ঞতাবাদকে সঙ্গতিপূর্ণ পরিণতি দানের প্রয়াস নিয়ে হিউম যেন তাঁর উপর ইতিহাসের অর্পিত দায়িত্বই পালন করেছেন।
হিউম প্রত্যক্ষভাবে চার্বাক দর্শনের সাথে পরিচিত ছিলেন, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কারণ, তিনি তাঁর লেখায় কোথাও চার্বাকদের কথা উল্লেখ করেন নি। তবে তিনি যে চার্বাক প্রতিষ্ঠিত অভিজ্ঞতাবাদী ধারার আধুনিক যুগের একজন প্রতিনিধি তা পঞ্চম অধ্যায়ের আলোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে। এছাড়া, এই আলোচনা থেকে আমরা এটাও দেখতে পেয়েছি যে, অভিজ্ঞতাবাদের সাথে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের উন্নতির প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে।
এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত পাঁচটি অধ্যায়ের উপর্যুক্ত সারসংক্ষেপ থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, দর্শনের ইতিহাসের অভিজ্ঞতাবাদী ধারা একটি শক্তিশালী জ্ঞানবিদ্যাগত ধারা। খ্রিস্টপূর্ব সাতশত অব্দেরও আগে প্রাচ্য দর্শনের ইতিহাসে চার্বাক দার্শনিকগণ যে ধারাটির সূচনা করেছিলেন বিজ্ঞানের উন্নতির বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে আঠারো শতকের ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক লক, বার্কলে এবং শেষ পর্যন্ত হিউমের দর্শনে এসে সে ধারাটি চরম রূপ লাভ করে। হিউমের দর্শনে অভিজ্ঞতাবাদের চরম বিকাশ একদিকে যেমন জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপিত করেছে, অন্যদিকে তা একটি শক্তিশালী ধারা হিসেবে পরবর্তী দার্শনিক মতবাদগুলোকেও প্রভাবিত করেছে। হিউম পরবর্তীকালেও এই ধারার প্রভাব দর্শনের ইতিহাসে প্রবাহমান থাকে, এবং এর প্রভাবে অনেক নতুন দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব হয়। বিশ শতক পর্যন্ত কোনো গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক মতবাদই হিউমের দর্শনকে সরাসরি উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কোনো কোনো মতবাদ হিউমের দর্শন থেকে উপাদান সংগ্রহ করে তাঁদের দার্শনিক চিন্তাকে সমৃদ্ধ করেছে, আবার কোনো কোনো মতবাদে হিউমের মতবাদকে খণ্ডনের প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর Histary of Western Philosophy গ্রন্থের সপ্তদশ অধ্যায়ে হিউম সম্পর্কিত আলোচনা প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছেন, হিউম পরবর্তী অধিবিদদের প্রিয় অবসর বিনোদন ছিল হিউমকে খণ্ডন করা। তবে তাঁদের এই হিউম-খণ্ডন কখনই সন্তোষজনক ছিল না।
হিউম-পরবর্তী উল্লেখযোগ্য দার্শনিক ধারার ক্ষেত্রে বিচারবাদ, উপযোগবাদ, যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ, প্রয়োগবাদ, রূপতত্ত্ব বা অবভাসবাদ এবং বিশ্লেষণী দার্শনিক মতবাদ অন্যতম। এসব মতবাদের উপর হিউমের দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিদ্যমান।
জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট হিউম পরবর্তী দার্শনিকদের মধ্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে হিউমের অবদান কান্টের দর্শনে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। কান্টের Critique of Pure Reason ১৮৮১ সালে, অর্থাৎ হিউমের মৃত্যুর মাত্র পাঁচ বছর পর প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থকে রাসেল কান্টের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ বলেন। এই গ্রন্থে কান্ট তাঁর পূর্ববর্তী বুদ্ধিবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদের সমন্বয় সাধন করে বিচারবাদী মতবাদ দেন। কান্ট প্রথম জীবনে ভলফ ও লাইবনিজের বুদ্ধিবাদী মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। হিউমের রচনা থেকে তিনি বুদ্ধিবাদের বিচারবিযুক্তবাদিতা সম্পর্কে সচেতন হন। তাই তিনি নিজেই একথা স্বীকার করেছেন যে, হিউম তাঁকে বুদ্ধিবাদের বিচারবিযুক্তবাদী নিদ্রা থেকে জাগিয়েছেন।[১] জ্ঞানের উপাদান যে অভিজ্ঞতাজাত তা তিনি হিউমের কাছ থেকেই অবগত হন। তিনি তাঁর উপরিলিখিত গ্রন্থের শুরুতেই একথা স্বীকার করেন যে, আমাদের সকল জ্ঞানই অভিজ্ঞতা থেকে শুরু হয়, এক্ষেত্রে কোনো সন্দেহ নাই।[২] এখানেই তাঁর উপর হিউমের প্রভাব লক্ষণীয়। কিন্তু তিনি হিউমকে সর্বান্তকরণে গ্রহণ করেননি। বরং তাঁর গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য ছিল একথা প্রমাণ করা যে, যদিও আমাদের কোনো জ্ঞানই অভিজ্ঞতাকে অতিক্রম করতে পারে না তবুও এর একটি অংশ অভিজ্ঞতাপূর্ব। এই অংশটিকে অভিজ্ঞতা থেকে আরোহাত্মকভাবে পাওয়া যায় না।[৩] জ্ঞানের এই অংশটিই আকারগত অর্থাৎ বুদ্ধিলব্ধ, এবং এর জন্যই জ্ঞান সার্বিক ও অনিবার্য হতে পারে। সুতরাং কান্ট বুদ্ধিবাদের বিচারবিযুক্ততা থেকে মুক্ত হয়ে হিউমের অভিজ্ঞতাবাদের জ্ঞানোৎপত্তি সংক্রান্ত অংশটুকু গ্রহণ করেন। কিন্তু সংশয়বাদকে বর্জন করে জ্ঞানের নিশ্চয়তা ও অনিবার্যতা প্রত্যয়নে প্ৰয়াসী হন।
শুধু জ্ঞানোৎপত্তির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার গুরুত্বের স্বীকৃতিই নয়, আরো কিছু বিষয়ে কান্ট হিউমের মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। হিউম জ্ঞানের বিষয়কে ধারণার সম্বন্ধ ও বাস্তব বিষয়, এই দুটি ভাগে ভাগ করেন। কান্টও অবধারণকে বিশ্লেষণী ও সংশ্লেষণী, এই দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। এই দুই প্রকার অবধারণ ছাড়াও কান্ট অবধারণকে অভিজ্ঞতাজাত এবং অভিজ্ঞতাপূর্ব এ দুই ভাগে বিভক্ত করেন।[৪] অবধারণের এই বিভক্তিকরণে কান্টের উপর হিউমের প্রভাব সুস্পষ্ট। কান্টের ভাষায় হিউমের অবস্থাটি ছিল এরকম : সব অবধারণ হয় অভিজ্ঞতাজাত সংশ্লেষক হবে, যাকে হিউম তথ্যগত বিষয় বলেছেন, না হয় অভিজ্ঞতাপূর্ব বিশ্লেষক হবে, যাকে হিউম ধারণার সম্বন্ধ বলেছেন। কিন্তু কান্টের মতে, এ ছাড়াও তৃতীয় আরেক প্রকার অবধারণ রয়েছে, যাদের মধ্যে হিউমের বর্ণিত উভয় প্রকার অবধারণের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এর নাম অভিজ্ঞতাপূর্ব সংশ্লেষক অবধারণ।[৫] এরূপ অবধারণকে স্বীকার করেই কান্ট সার্বিক ও অনিবার্য জ্ঞান সম্ভব করে তোলেন। কিন্তু হিউম এসব অবধারণকে স্বীকার করেননি।
এভাবেই কান্ট হিউমের অভিজ্ঞতাবাদের প্রাথমিক উপাদান অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করে এবং তাঁর জ্ঞানবিদ্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সংশয়বাদকে বর্জন করে অভিজ্ঞতাজাত জ্ঞানকে সার্বিক ও অনিবার্যতার স্তরে উন্নীত করে বিচারবাদী মতবাদ দেন। তাঁর বিচারবাদ যদিও হিউমের প্রতি চ্যালেঞ্জ তবুও তা হিউমের অভিজ্ঞতাবাদকে উপেক্ষা করতে পারেনি। বরং তা হিউমের মতবাদ থেকে প্রাথমিক উপাদান সংগ্রহ করেছে। অনেক দার্শনিক একথা মনে করেন যে, হিউম জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে যে সমস্যা রেখে যান কান্ট তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে সে সমস্যার সমাধান দিতে পেরেছেন। কিন্তু রাসেল এ মতের সাথে একমত নন। তাঁর মতে, জার্মান দার্শনিক ধারা বিশেষত কান্ট ও হেগেলের দর্শন, হিউম-পূর্ব বুদ্ধিবাদী ধারার প্রতিনিধিত্ব করেছে যাকে হিউমের যুক্তি দ্বারা খণ্ডন করা যায়।
হিউম-পরবর্তী অন্যতম দার্শনিক ধারা হলো উপযোগবাদ। আধুনিক ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী দর্শনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে উনিশ শতকে এই ধারাটি গড়ে ওঠে। উপযোগবাদের অন্যতম প্রবক্তা বেনথাম নীতিদর্শনের একজন সংস্কারক। নীতিদর্শনের ক্ষেত্রে তিনিই দৃঢ়ভাবে অভিজ্ঞতাবাদী ও বিশ্লেষণী ধারার প্রবর্তন করেন। তাঁর দার্শনিক মতবাদের প্রেক্ষাপট জুড়ে আছে হিউমের দার্শনিক মতবাদ। বেনথাম হিউমকে তাঁর একজন শিক্ষক হিসেবে গণ্য করেন। কারণ, নীতিদর্শনের ক্ষেত্রে উপযোগনীতি কথাটি সর্বপ্রথম হিউমই ব্যবহার করেন। এজন্য বেনথাম তাঁর The Fragments on Government নামক গ্রন্থে হিউমকে প্রশংসা করেছেন। এ একথাও বলা হয়ে থাকে যে, ইংল্যান্ডে হিউমের Enquiry গ্রন্থই ছিল উপযোগবাদী শতাব্দীর সূচনা।[৮] বেনথাম বিভিন্ন দিক থেকে হিউমের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।’ তিনি নিজেই একথা বলেছেন যে, হিউমের Treatise তাঁকে নীতিদর্শনের ক্ষেত্রে প্রতারিত ব্যক্তিকে প্রকৃত অবস্থা অনুধাবনে সাহায্যকারীর মতো সহায়তা করেছে।[১০] বেনথামের অনুসারী প্রখ্যাত উপযোগবাদী জেমস মিলও হিউমের মতোই অভিজ্ঞতার ভূমিকা স্বীকার করে অতীন্দ্রিয় ‘আমি’র অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তিনিও হিউমের সাথে এ বিষয়ে একমত যে, অবধারণ ক্রিয়া ও প্রত্যক্ষণ ক্রিয়া থেকে পৃথক করার মতো স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বশীল কোনো ‘আমি’কে খুঁজে পাওয়া যায় না। এছাড়া, তিনিও হিউমের মতোই জানাকে প্রত্যক্ষণ ক্রিয়া বা জ্ঞান ক্রিয়া থেকে আলাদা কিছু বলে মনে করেন না। তবে এক্ষেত্রে জেমস মিল হিউমের ব্যাখ্যা থেকে এগিয়ে গিয়ে আত্মসত্তাকে অভিজ্ঞতায় অনুভূত একটি গুণ হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যেখানে হিউম একে শুধু প্রত্যক্ষণের সমষ্টি বলেছিলেন।
বেনথামের ছাত্র ও জেমস মিলের পুত্র জন স্টুয়ার্ট মিল জ্ঞানোৎপত্তিসংক্রান্ত মতবাদ, বহির্জগৎ সম্পর্কিত ধারণা এবং অনুষঙ্গবাদী ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে হিউমকে অনুসরণ করেন।[১১] হিউমের মতোই তিনি অভিজ্ঞতাকে সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বতন্ত্র সংবেদনের অনুক্রম হিসেবে আখ্যায়িত করেন। মিলের মতে, স্থায়ী আত্মার ধারণা হলো অনুভূতির একটি স্থায়ী সম্ভাবনায় বিশ্বাস। এই বিশ্বাস স্মৃতি ও কল্পনা থেকে অনুসঙ্গ নিয়মের সাহায্যে গঠিত হয়। বহির্জগৎ সম্পর্কেও একই কথা সত্য। কারণ, কোনো প্রত্যক্ষ প্রতীতি বা স্বজ্ঞার মাধ্যমে আমরা বহির্জগৎ সম্পর্কিত জ্ঞান পাই না। যাকে আমরা বাহ্যজগতের জ্ঞান বলি তা মূলত অনুষঙ্গ নিয়ম নির্ভর একটি বিশ্বাস যা সংবেদনের স্থায়ী সম্ভাবনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এককথায়, তিনি হিউমের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাকে অনুসরণ করেই বাহ্যজগৎকে সংবেদনের স্থায়ী সম্ভাবনা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তবে, আরোহানুমান সম্পর্কিত প্রশ্নে মিল হিউমকে অনুসরণ করেননি। মিল আরোহ অনুমানের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে আশাবাদী ছিলেন। তিনি গাণিতিক সত্যকে অভিজ্ঞতার অত্যন্ত উচ্চস্তরের নিশ্চিত সাধারণীকরণ হিসেবে আখ্যায়িত করে একে আরোহের উপর প্রতিষ্ঠিত করেন। তাই তাঁর কাছে হিউম স্বীকৃত ধারণার সম্বন্ধের প্রয়োজন ছিল না। কারণ, তিনি যৌক্তিক ও গাণিতিক আবশ্যকতাকে মনস্তাত্ত্বিক বলে মনে করতেন।
হিউম-পরবর্তী অভিজ্ঞতাবাদী ধারার উপরও হিউমের প্রভাব সুস্পষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ। উনিশ শতকের অভিজ্ঞতাবাদী ও উপযোগবাদী দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের উপর হিউমের প্রভাব পূর্বে আলোচিত হয়েছে। তিনি সরাসরি হিউমের ঐতিহ্যকে অনুসরণ করেন।[১২] বিশ শতকের অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকগণও হিউম নির্দেশিত গণিত ও যুক্তিবিদ্যার আবশ্যিক সত্য এবং বাস্তব ঘটনার পর্যবেক্ষণগত সত্যের ব্যবধানকে সাধারণভাবে গ্রহণ করেন। অর্থাৎ তাঁরা মিলকে প্রত্যাখ্যান ও হিউমকে গ্রহণ করেন।[১৩] তাঁরা সকলেই একথা মনে করেন যে, আবশ্যিকতা শুধুমাত্র যুক্তিবিদ্যা ও গণিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এছাড়া আর সবকিছুই সম্ভাব্য। এসব অভিজ্ঞতাবাদীর মধ্যে যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীরা অন্যতম।
হিউম-পরবর্তী দর্শনে অধিবিদ্যাগত প্রশ্নকে কেন্দ্র করে দুটি দার্শনিক ধারার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। একটি ধারা হিউমের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত অধিবিদ্যাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াসী হয় এবং হিউমকে খণ্ডন করার চেষ্টা করে। অন্য ধারাটি সরাসরি হিউমের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে তাঁর অভিজ্ঞতাবাদকে গ্রহণ করে, এবং অধিবিদ্যাগত প্রশ্নে হিউমের অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করে। শেষোক্ত ধারায় গড়ে ওঠা অন্যতম দার্শনিক মতবাদ যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ, যার উপর হিউমের অভিজ্ঞতাবাদের সর্বাপেক্ষা বেশি প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয়। মূলত ১৯২৮ সালের দিকে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ভিয়েনা-চক্র নামক দার্শনিক গোষ্ঠীই যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদের প্রবক্তা। পাশ্চাত্য দর্শনের কোনো কোনো ঐতিহাসিক বেকন, হবস, লক, বার্কলে, হিউম, ম্যাক, রাসেল, যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদী দার্শনিকগণ এবং কোঁতেকে এই ধারার চিন্তাবিদ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।[১৪] ঐতিহাসিক স্যামুয়েল স্টাফ-এর মতে, যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীগণ যে মতবাদকে যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ বলেছেন সে মতবাদে নতুন যুক্তিবিদ্যাগত কৌশল এবং হিউমের অভিজ্ঞতাবাদী মনোভাবের সমন্বয় ঘটেছে মাত্র।[১৫] বি. আর. এসও যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীদের উপর হিউমের প্রভাবকে স্বীকার করেন। তবে তাঁর মতে, হিউমের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীরা যৌক্তিক বিশ্লেষণ যোগ করেছেন।[১৬] হিউমের প্রখ্যাত ভাষ্যকার এন্টনি ফ্লু হিউমকে যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীদের ভাবগত পিতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন।[১৭] বিশ্লেষণী দার্শনিক আর্মসনও যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীদের উপর হিউমের স্পষ্ট প্রভাব নির্দেশ করেছেন।[১৮] তাঁর মতে, হিউমের ধারণা সম্পর্কিত মতবাদ অর্থ সংক্রান্ত প্রদর্শী সংজ্ঞার (ostensive definition) ইঙ্গিত করে। অর্থাৎ একটি শব্দ যে অর্থ নির্দেশ করে তা প্রদর্শনের মাধ্যমে সে শব্দের অর্থ জানার প্রতি ইঙ্গিত করে। কারণ, হিউমের মতবাদে ধারণার অর্থ ইন্দ্রিয়ছাপের মাধ্যমে জানতে হয়। যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীদের যাচাইনীতি হিউমের জ্ঞানবিদ্যাগত প্রদর্শী সংজ্ঞারই অনুরূপ পুনর্বিন্যাস। এ প্রসঙ্গে আর্মসনের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি হিউম ও যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদের সাদৃশ্য দেখানোর জন্য তাঁর বক্তব্যকে নিম্নরূপে উপস্থাপিত করেন :
হিউম : পুরাতন অভিজ্ঞতাবাদী, অধিবিদ্যাগত মত : সকল বস্তুই ইন্দ্ৰিয়প্রদত্ত।
যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদী : নতুন অভিজ্ঞতাবাদী, অধিবিদ্যাগত মত : সকল তথ্যই ইন্দ্ৰিয়প্রদত্ত।
পুরাতন অভিজ্ঞতাবাদী : জ্ঞানবিদ্যাগত মত : সকল অর্থপূর্ণ শব্দই হলো ইন্দ্রিয়প্রদত্ত বস্তুর নাম।
নতুন অভিজ্ঞতাবাদী : জ্ঞানবিদ্যাগত মত : সকল অর্থপূর্ণ বাক্যই হলো ইন্দ্রিয়জাত তথ্যের বর্ণনা।
যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীগণ অর্থপূর্ণ বচনকে সংশ্লেষক বা অভিজ্ঞতাজাত এবং বিশ্লেষক বা অভিজ্ঞতাপূর্ব বা পুনরুক্তিমূলক এই দুই ভাগে ভাগ করেন। তাঁদের মতে, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বচন এবং নিত্যব্যবহার্য তথ্যগত বচনই প্রথম শ্রেণির বচন। অর্থাৎ এগুলো অভিজ্ঞতাজাত। অন্যদিকে, গণিতের বচন অভিজ্ঞতাপূর্ব বা বিশ্লেষণাত্মক। তাঁদের এই বিভাজনের সঙ্গে হিউমের ধারণার সম্বন্ধ ও তথ্যগত বিষয়ের অনুরূপতা লক্ষ করা যায়। বিশেষত, হিউমের পরবর্তীকালে অভিজ্ঞতাজাত ও অভিজ্ঞতাপূর্ব জ্ঞানের মধ্যে স্পষ্ট বিজ্ঞানের যে ধারা লক্ষিত হয় হিউমের হাতেই এই ধারার সূচনা—একথা অস্বীকার করার উপায় নাই
যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীগণ কেবল হিউমের অভিজ্ঞতাবাদ নয় বরং তাঁর অধিবিদ্যা দ্বারাও গভীরভাবে প্রভাবিত হন। তবে এ সম্পর্কে তাঁরা হিউমের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যৌক্তিক বিশ্লেষণকে আরোপ করেন। হিউম ধারণার সম্বন্ধ ও তথ্যগত বিষয় এই দুই প্রকার বচনের বাইরে যেসব বচন আছে সেগুলোকে কূটতর্ক এবং অধ্যাস বলেছেন। যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীগণও প্রায় একই কথা বলেন। তবে তাঁরা কূটতর্ক এবং অধ্যাস-এর স্থলে অর্থহীন কথাটি ব্যবহার করেন।[১৯]
যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ শেষ পর্যন্ত দুটি ধারায় প্রবাহিত হয়। একটির প্রতিনিধিত্ব করেন রুডলফ কারনাপ, অন্যটির প্রতিনিধিত্ব করেন এ. জে. এয়ার। কারনাপের হাতে প্রত্যক্ষবাদ প্রত্যক্ষ সম্পর্কে জড়বাদী ও মন সম্পর্কে শারীরবৃত্তীয় ধারণার দিকে অগ্রসর হয়। এয়ারের ধারাটি প্রত্যক্ষ ও মন উভয় ক্ষেত্রেই ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদকে অনুসরণ করে। তবে, কারনাপ ও এয়ার নির্দেশিত এই উভয় ধারাই ভ্রান্তির ঝুঁকি থেকে মুক্ত সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞানের সম্ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করে। অর্থাৎ উভয় মতবাদের ক্ষেত্রেই হিউমের সংশয়বাদের স্বীকৃতি দেখা যায়।[২০]
এয়ার নিজেই হিউমের মতবাদের সাথে যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদের সাদৃশ্য নির্ণয় করেছেন। হিউম পরিমাণ বা সংখ্যা সম্পর্কিত বিমূর্ত চিন্তন এবং বাস্তব বিষয় বা অস্তিত্ব সম্পর্কিত পরীক্ষণমূলক চিন্তন—এই দুই শ্রেণির গ্রন্থ ছাড়া অন্যান্য সকল গ্রন্থকে আগুনে নিক্ষেপ করতে পরামর্শ দেন। কারণ, এগুলো কূটতর্ক ও ভ্রান্তিমূলক ছাড়া আর কিছুই নয়।[২১] এয়ার তাঁর Language, Truth and logic গ্রন্থে হিউমের এই উক্তিকে উদ্ধৃত করেন। তাঁর মতে, হিউমের এই উক্তি যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীদের পরখনীতির, অর্থাৎ যে বাক্য আকারগত সত্য বচন প্ৰকাশ করে না বা কোনো অভিজ্ঞতাপূর্ব প্রকল্প প্রকাশ করে না সে বাক্য অর্থহীন—এই নীতির অলংকারপূর্ণ প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়।[২২]
বিশ শতকের দার্শনিক আন্দোলনের অতি পরিচিত নাম যৌক্তিক বিশ্লেষণী দর্শন বা যৌক্তিক পরমাণুবাদের অন্যতম প্রতিনিধি ব্রিটিশ দার্শনিক লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন। তাঁর রচনা থেকেই যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ কেন্দ্রীয় উপকরণ লাভ করে। ভিটগেনস্টাইনের দর্শনের উপরও হিউমের দর্শনের যথেষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তিনি তাঁর Tractatus Logico Philosophicus গ্রন্থে অর্থপূর্ণ বচনকে মৌলিক ও যৌক্তিক এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করেন। মৌলিক বচন জগৎসংক্রান্ত এবং যৌক্তিক বচন পুনরুক্তিমূলক।[২৩] এই দুই শ্রেণির বচন ছাড়া অন্য কোনো বচন অর্থপূর্ণ নয় বলে তিনি অধিবিদ্যক বচনকে অর্থপূর্ণ বচন নয় বলে মন্তব্য করেন। তিনি অধিবিদ্যক বচনকে ভাষার অপব্যবহার বলে মনে করেন।
ভিটগেনস্টাইনের মৌলিক ও যৌক্তিক বচন হিউমের তথ্যগত ও ধারণার সম্বন্ধমূলক বিষয়ের অনুরূপ। এছাড়া, হিউম যে মানদণ্ডে আধিবিদ্যক বচনকে কূটতর্ক ও অধ্যাসমূলক বলেছেন ভিটাগেনস্টাইন একই মানদণ্ডে এই সব বচনকে ভাষার অপব্যবহার বলেন। ভিটগেনস্টাইন তাঁর Tractatus-এর উপসংহারে বলেন, যেসব বিষয়ে আমাদের বলার কিছু নেই সেসব বিষয়ে আমাদের নীরব থাকাই শ্রেয়। তাঁর বক্তব্য একদিকে যেমন ভাষার সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে অন্যদিকে তা অধিবিদ্যা সংক্রান্ত আলোচনার অসারতাকেই নির্দেশ করে। কিন্তু হিউম যখন এ প্রসঙ্গে বলেন, যে গ্রন্থ বিমূর্ত ধারণা বা তথ্যগত বিষয় সম্পর্কিত পরীক্ষামূলক ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করে না সে গ্রন্থকে আগুনে ছুড়ে ফেলে দাও, কারণ, তা কূটতর্ক ও অধ্যাসমূলক, তখন তাঁকে ভিটগেনস্টাইনের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর বলে মনে হয়। ভিয়েনা সার্কেল বিশ শতকে হিউমের এই অভিজ্ঞতাবাদী নীতিরই উত্তরাধিকার বহন করে।[২৪] ভিটগেনস্টাইনের মতে, একমাত্র গাণিতিক সমীকরণ বা পুনরুক্তিতেই অনিবার্যতা পাওয়া যায়। কিন্তু গাণিতিক সমীকরণ বা পুনরুক্তি জগৎ সম্পর্কে কিছু বলে না। সুতরাং জগতে অনিবার্যতা নাই। যুক্তিবিদ্যা ছাড়া সবকিছুই আকস্মিক।[২৫] জগৎ সম্পর্কিত তাঁর আকস্মিকতাবাদে হিউমের সংশয়বাদের প্রভাব স্পষ্ট।
ভিটগেনস্টাইন যে মৌলিক বচনের কথা বলেন তাঁর সাথে হিউমের সরল ইন্দ্রিয়ছাপের মিল দেখা যায়। মৌলিক বচন সরলতম এবং অবিশ্লেষণযোগ্য। মৌলিক বচনের অর্থ জগতের সাথে তাদের সম্পর্কের মধ্যে নিহিত থাকে। সকল যথার্থ বচনই মৌলিক বচনের সত্যাপেক্ষক। যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীরা এই যথার্থ বচনকেই অভিজ্ঞতায় যাচাইযোগ্য বলেছেন। ভিটনেস্টাইন ও যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীদের যথার্থ বচনের মানদণ্ডকে হিউমের—প্রতিটি যথার্থ ধারণাই অনুরূপ ইন্দ্রিয়ছাপের অনুলিপি—এই নীতির ভিন্ন প্রকাশ বলে মনে হয়। আমসনও এই বিষয়টিকে সমর্থন করেন। তিনি বলেন যে, অভিজ্ঞতার বিষয়বস্তু বা চরম বিশেষ হিসেবে হিউমের ইন্দ্রিয়ছাপকে যদি তাঁর অধিবিদ্যাগত মত বলে গণ্য করা হয় তবে হিউমের ইন্দ্রিয় প্রদত্ত তথ্যের স্থলে ইন্দ্রিয় প্রদত্ত বিশেষকে প্রতিস্থাপিত করে যৌক্তিক পরমাণুবাদী ভিটগেনস্টাইন হিউমের মতেরই ভাষ্য দান করেছেন।[২৬] আর্মসন এই কথা স্পষ্টতই বলেছেন যে, একদিক থেকে বিচার করলে যৌক্তিক পরমাণুবাদ নতুন কিছু নয়। হিউমের সূত্র থেকে যৌক্তিক পরমাণুবাদীদের খুব একটা পার্থক্য নেই।[২৭]
ভিটগেনস্টাইনের দর্শনের ভাষ্যকার ও ভিটগেনস্টাইন বিশেষজ্ঞ জর্জ পিচার হিউম ও ভিটগেনস্টাইনের দর্শনের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাদৃশ্য লক্ষ করেন। তাঁর মতে, ভিটগেনস্টাইন তাঁর মতবাদে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেন যার উদ্দেশ্য হলো জটিল বিষয়কে সরলীকৃত করা। হিউম তাঁর Enquiry গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলেন যে, যখন আমরা আমাদের চিন্তা বা ধারণাকে বিশ্লেষণ করি, তা যতই জটিল হোক না কেন, সব সময়ই এগুলো সে সব সরল ধারণায় বিশ্লিষ্ট হয় যেসব সরল ধারণা পূর্ববর্তী অনুভূতি বা মনোভাবের অনুলিপি। হিউমের ধারণা সম্পর্কিত এই বক্তব্যে জটিল বিষয়কে সরলীকরণের ব্যাপারটি লক্ষিত হয়।[২৮]
অহাদ সম্পর্কে দর্শনে যে সাধারণ দ্বৈতবাদী ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে তা হলো, অনুভবকারী বা আত্মা এবং অনুভূত বস্তুর দ্বৈতবাদ। ভিটগেনস্টাইন এই ব্যাখ্যাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর মতে, আমরা সকল অভিজ্ঞতালব্ধ বস্তুকে পাই, এর ধারক কোনো আত্মাকে পাই না।[২৯] যদিও তিনি নিজে এই ধারণাটি শোপেনহাওয়ারের কাছ থেকে নিয়েছেন বলে মনে করেন তবুও আধুনিক যুগে হিউমই এই ধারণার প্রবক্তা।[৩০] ভিটগেনস্টাইন শব্দের অর্থ সম্পর্কিত প্রয়োগ তত্ত্বের (Use Theory) কথা বলেছেন। গিলবার্ট রাইলের মতে, এ মতবাদের ব্যবহার হিউমের কারণের ব্যাখ্যায় দেখা যায়। হিউম যখন কারণকে ব্যাখ্যা করেছেন তখন তিনি ‘কারণ’ শব্দটি সম্পর্কে প্রশ্ন করেননি, বরং প্রশ্ন করেছেন ‘কারণ’ শব্দটির ব্যবহার বা প্রয়োগ সম্পর্কে।[৩১]
ভিটগেনস্টাইনের Tractatus ও Philosophical Investigation এর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের পার্থক্য থাকলেও যেসব বিষয়ে সাদৃশ্য লক্ষ করা যায় তার মধ্যে ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতা এবং বৌদ্ধিকভাবে কী বলা যেতে পারে এবং কী বলা যায় না সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা অন্যতম। এই কাজ করতে গিয়ে ভিটগেনস্টাইন মূলত তাঁর নিজস্ব ধরনে আধুনিক ব্রিটিশ দার্শনিক লক, বার্কলে, হিউমের চিন্তারই প্রতিনিধিত্ব করেছেন।[৩২] এ ছাড়াও একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, হিউমের অভিজ্ঞতাবাদের প্রয়োজনীয়তা যৌক্তিক পরমাণুবাদী দার্শনিকগণ বারবার অনুভব করেন। কারণ, ভিটগেনস্টাইনের মতে, যৌক্তিক পরামাণুবাদ অনুসারে একটি বচন তখনই অর্থপূর্ণ হয় যদি এবং কেবল যদি বচনটি পরমাণুগত তথ্যের অনুরূপ হয়। পরমাণুগত তথ্যের অনুরূপতা পরীক্ষার উপায় হলো হিউমের অভিজ্ঞতাবাদ। কারণ, হিউমের মতে, আমাদের ইন্দ্রিয় কেবল বিশেষ বস্তুর অভিজ্ঞতা পায়।[৩৩]
বর্তমান শতকে আমেরিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি অন্যতম দার্শনিক আন্দোলন প্রয়োগবাদ। যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ ও অস্তিত্ববাদকে যেমন ইউরোপের দার্শনিক মত হিসেবে গণ্য করা হয় প্রয়োগবাদ তেমনি আমেরিকার নিজস্ব মৌলিক দার্শনিক মতবাদ। এ মতবাদের মাধ্যমে মার্কিন দার্শনিক চিন্তা প্রথমবারের মতো পরিপক্বতা লাভ করে এবং চিন্তার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের প্রভাবমুক্ত বলে দাবি করতে পারে।[৩৪] কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, উইলিয়াম জেমস, চার্লস সেন্ডার্স পার্স এবং জন ডিউই—প্রয়োগবাদের এই তিনজন অন্যতম প্রবক্তা হিউমের দর্শন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁরা হিউমের দর্শন থেকে তাঁদের চিন্তার উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন।
প্রয়োগবাদীদের মধ্যে জেমসকেই হিউমের কাছে সবচেয়ে বেশি ঋণী বলা যায়। জেমস প্রশ্নাতীতভাবে জন লক প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক গোষ্ঠীর অনুসারী ছিলেন। তিনি কান্টীয় দর্শনের বিচারবাদী ও ভাববাদী ধারার বিরোধিতা করে হিউমের জ্ঞানবিদ্যাগত ধারাকে গ্রহণ করেন। তাঁর মতে, হিউমের অভিজ্ঞতাবাদী সূত্র যথার্থভাবে প্রয়োগ করেই হিউমের দর্শনের ত্রুটি নিরসন করা যায়। এর জন্য কান্টীয় পদ্ধতি গ্রহণ নিষ্প্রয়োজন। তাই জেমস মৌলিক অভিজ্ঞতাবাদের মাধ্যমে হিউমের অভিজ্ঞতাবাদের ত্রুটি নিরসন করেন।[৩৫] জেমস এ কথা স্বীকার করেন যে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে পরীক্ষণাত্মক পদ্ধতির ব্যবহারই হিউমের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। এটাই তাঁর বন্ধুদের কাছে তাঁর সার্থকতা ও শত্রুদের কাছে তাঁর ব্যর্থতার চাবিকাঠি।[৩৬]
জেমস হিউমের মতো ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাকে তাঁর জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তিনি হিউমের সাথে এ বিষয়েও একমত যে, কেবল বিশেষ বস্তুরই অভিজ্ঞতা হয়। তবে তিনি হিউমের সমালোচক টি. এইচ. গ্রিনের৩৭] সাথে একমত হয়ে বলেন যে, এই সব বিশিষ্ট বস্তু যদি একটি সংযুক্ত পদ্ধতিতে পরস্পর বিজড়িত না হয় তবে অস্তিত্বের জ্ঞান থাকবে না। এখানেই হিউমের ব্যর্থতা। এ কারণেই জেমস ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদীদের মতো অভিজ্ঞতার আধেয়কে আনবিক স্বভাবের মনে করেন না। তাঁর মতে, অভিজ্ঞতা পরস্পর বিচ্ছিন্ন আনবিক উপাদান নয় বরং একটি প্রবাহমান নিরবচ্ছিন্ন ব্যাপার যার মধ্যে কোনো ফাঁক নেই। এখানেই হিউমের সাথে জেমস-এর পার্থক্য।
লক, বার্কলে ও হিউম প্রত্যেকেই অভিজ্ঞতার আধেয়কে অভিজ্ঞতা বা ক্রিয়া থেকে আলাদা করে অস্তিত্বের জ্ঞান সম্পর্কিত সমস্যার সৃষ্টি করেছেন। জেমস তাঁর মৌলিক অভিজ্ঞতাবাদে অভিজ্ঞতার আধেয়কে অভিজ্ঞতা প্রক্রিয়া থেকে পৃথক না করে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। তাঁর মতে, আধেয় ক্রিয়া দ্বারা আবৃত্ত।[৩৮] জেমস মনে করেন যে, কান্ট ও তাঁর অনুসারী গ্রিন হিউমের সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে গ্রিন হিউমের সাথে একমত যে, অনুভূতি তাঁদের নিজেদের সম্পর্ককে বহন করে না। তাই কান্ট ও গ্রিনের মতে এটি বুদ্ধির কাজ। কিন্তু জেমস এ বিষয়ে কান্ট ও গ্রিনের মতানুসারী নন। বরং তিনি অভিজ্ঞতার প্রতি হিউমের আস্থাকে সমর্থন করেন এবং অনুভূতি ও সম্বন্ধের দ্বন্দ্বকে অপ্রাসঙ্গিক মনে করেন।[৩৯] তাঁর মতে, অনুভূতিই এই সম্বন্ধকে বহন করে। জেমস তাঁর মৌলিক অভিজ্ঞতাবাদে তথ্যবিষয়ক কোনো সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত বলে গণ্য করেন না, যার উপর হিউমের সংশয়বাদের প্রভাব স্পষ্ট বলে মনে হয়। এছাড়া তিনি যখন জড়, আত্মা, দেহ, মন, বিষয়, বিষয়ী প্রভৃতি বিমূর্ত ধারণাকে মৌলিক অভিজ্ঞতার সাহায্যে বোঝা বা প্রতিপাদন করা অসম্ভব বলেন তখন তাঁর উপর হিউমের চরম অভিজ্ঞতাবাদের প্রভাব লক্ষিত হয়। সর্বোপরি, জেমস হিউমের মতবাদ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, অনবধানতা জনিত ত্রুটি, কোনো কোনো বিষয়কে বাদ দেওয়া এবং অসঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও হিউমের মতবাদ অত্যন্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ।[৪০] তাঁর এই স্বীকৃতিসূচক মন্তব্য থেকে তাঁর কাছে হিউমের গ্রহণযোগ্যতাই প্রতীয়মান হয়।
জেমসের মতো অন্য দুজন আমেরিকান প্রয়োগবাদী দার্শনিক সি. এস. পার্স ও জন ডিউই–এর মতবাদের উপরও হিউমের অভিজ্ঞতাবাদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কান্টের ছাত্র হিসেবেই পার্স দর্শনের জগতে প্রবেশ করেন এবং কান্টের কাছ থেকে তিনি দর্শনের জন্য পরিকল্পিত কাঠামো মতবাদ (Architectonic Theory) অর্জন করেন যা জ্ঞানকে যুক্তিবিদ্যা ও অন্যান্য জ্ঞান—এই দুটি ভাগে বিভক্ত করে।[৪১] এই বিভাজনের উপর হিউমের প্রভাব লক্ষিত হয়। এছাড়া, হিউমের মতো পার্সও মনে করেন, বাস্তব বিষয় সম্পর্কে প্রতিপাদনমূলক জ্ঞান থাকতে পারে না।[৪২] পার্সও হিউমের মতো প্রত্যক্ষকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে সচেতনতার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করেন, যদিও তিনি প্রত্যক্ষকেই জ্ঞান বলেননি।
ডিউইর প্রয়োগবাদী মতবাদকে করণবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর করণবাদের মূলভিত্তি অভিজ্ঞতা। তিনি জীবনকে অভিজ্ঞতার অনুক্রম হিসেবে বিচার করেন এবং ব্যক্তির স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতাকে জীবনের প্রাথমিক ঐক্য হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর এই মতবাদেও হিউমের প্রভাব লক্ষিত হয়।[৪৩] হিউমের মতো ডিউই বলেন, অভিজ্ঞতার বাইরে চিন্তার নিজস্ব কোনো সত্তা নেই। অভিজ্ঞতার অন্তরালে কোনো স্বাধীন ও অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষ সত্তা থাকতে পারে— একথা হিউমের মতো ডিউইও অস্বীকার করেন।
বিশ শতকে রূপতত্ত্ব বা অবভাসবিদ্যা নামে যে দার্শনিক মতবাদ প্রতিষ্ঠালাভ করে তার উপরও হিউমের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এই মতবাদের মূল প্রবক্তা হিসেবে জার্মান দার্শনিক এডমণ্ড হুসের্ল-এর নাম উল্লেখযোগ্য। তবে ফ্রেঞ্চ ব্রেন্টানো এবং এলেক্সিয়াস মেইনঙ-এর দর্শনেও অবভাসবিদ্যার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মেইনঙ-এর শিক্ষক ব্রেন্টানো হিউমের Treatise গ্রন্থের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। তিনি তাঁর Psychology From an Empirical Standpoint (১৮৭৮) নামক গ্রন্থে হিউমের মতো মনোবিজ্ঞানকে সকল বিজ্ঞানের প্রথম বিজ্ঞান হিসেবে গণ্য করেন।[৪৪] ব্রেন্টানোর ছাত্র অভিজ্ঞতাবাদী মেইনঙও হিউমের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। তিনি নিজেকে হিউমের শিষ্য বলে মনে করতেন।[৪৫] ব্রেন্টানোই তাঁকে এই পথ দেখিয়েছেন। মেইনঙ হিউমের বিমূর্ত ধারণা ও সম্বন্ধের বিশ্লেষণের উপর বিশেষ মনোযোগ দেন। হিউম যে অর্থে মনোবিজ্ঞানী ছিলেন মেইনঙকেও ঠিক সেই অর্থে মনোবিজ্ঞানী বলা যায়। হিউমের মতোই তিনি সম্বন্ধ ও সার্বিকতাকে মনের ক্রিয়া বলে মনে করেন।
হুসের্ল ১৮৮৪] থেকে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হিউম ও জন স্টুয়ার্ট মিলের উপর ব্রেন্টানোর বক্তৃতা শুনেন।[৪৬] হুসের্ল Ideas for a Pure Phenomenology and Phenomenological Philosophy গ্রন্থে যে অবভাসবাদী মতবাদ প্রদান করেন তাঁর উপর হিউমের প্রভাব স্পষ্ট। হর্সেল নিজেই একথা স্বীকার করেছেন যে, হিউমের দর্শনে রূপতত্ত্বের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে।[৪৭] হুসের্ল-এর অবভাসবাদ অনুসারে প্রকৃতপক্ষে বস্তুর যতটুকু দেখা যায় তার বেশি কখনও দেখার বা উপলব্ধির চেষ্টা করা হয় না। হিউমও বাহ্য বস্তুর অস্তিত্বের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষের প্রাথমিক উপাদান ইন্দ্রিয়ছাপের বাইরে যেতে রাজি নন। হুসের্ল নিজেই হিউমের মতের মধ্যে অবভাসবাদের বীজ খুঁজে পান। তাঁর মতে, প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষণের সময় সারসত্তাকে বা ধারণাকেই দেখে, বিশেষ বস্তুকে নয়।
অভিজ্ঞতাবাদীদের—মানুষ বিশেষ বস্তুকে দেখে—এই ধারণাকে হুসের্ল খণ্ডন করেন এবং একে স্পষ্ট অনুমান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি মনে করেন, হিউম যখন প্রত্যক্ষণক্রিয়ার কথা বলেন তখন তা মূলত সারধর্মকেই নির্দেশ করে।[৪৮] কারণ, হিউম যখন দেখা, স্মরণ করা, কল্পনা করা, ইত্যাদি মানসিক ক্রিয়ার কথা বলেন তখন তিনি কোনো অস্তিত্বশীল বা অনস্তিত্বশীল বিশেষ প্রাকৃতিক বস্তুকে নির্দেশ করেননি। তিনি প্রত্যক্ষকে ইন্দ্ৰিয়ছাপ হিসেবে বর্ণনা করেন, জড়বস্তুর গুণাবলির পর্যবেক্ষণ হিসেবে নয়। এভাবে হিউম এমন একটি পদ্ধতিতে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে দেখাতে চান যা প্রতিটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তের চেয়ে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন। হুসের্লের মতে, হিউম আসলে এর মাধ্যমে প্রত্যক্ষণ ক্রিয়ার সারধর্মের প্রতিই মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। তিনি অভিজ্ঞতাবাদী মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে এগিয়ে গিয়ে কেইস হিস্ট্রি বা তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ বা অন্তর্দর্শনের কথা বলেননি, বরং তাঁর লক্ষ্য ছিল প্রত্যক্ষণ ক্রিয়ার সারধর্মকে উপলব্ধি করা। এর বেশি বা কম কিছু নয়। এটিই অবভাসবাদের মূল কথা।[৪৯]
বিশ শতকের গোড়ার দিকে প্রধানত ব্রিটিশ দার্শনিকদের চিন্তাকে ভিত্তি করে বিশ্লেষণী দর্শন বা ভাষাগত দর্শন নামে যে দার্শনিক আন্দোলন অধিকতর পরিচিতি লাভ করে তাও হিউমের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। কেবল ধরন বা পদ্ধতির ক্ষেত্রে নয়, দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও বটে।[৫০] প্রাচীনকালে প্লেটো, সক্রেটিস যেমন সাহস, দয়া, ন্যায়পরতা, ইত্যাদি সম্পর্কিত উক্তি বিশ্লেষণ করেছেন আধুনিক যুগে হিউমও তেমনি কারণ সম্পর্কিত উক্তিকে বিশ্লেষণ করেন।[৫১] বিশ্লেষণী দার্শনিকগণ বিশ শতকে শব্দ, ও ধারণাবলির অর্থ স্পষ্টায়নের জন্য ভাষার যৌক্তিক বিশ্লেষণের কথাই বলেছেন যা হিউমের বিশ্লেষণ থেকে পৃথক কিছু নয়। হিউম কারণ, আত্মা, ইত্যাদি শব্দের বিশ্লেষণ করে মূলত এসব ধারণার অর্থ স্পষ্টায়নের কাজই করেছেন। কোনো যুক্তিতেই আমরা বস্তুর অস্তিত্বশীলতাকে বিশ্বাসযোগ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য বলে জানতে পারি না।
বিশ্লেষণী দার্শনিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা ব্রিটিশ দার্শনিক মূর এবং রাসেলের দার্শনিক মতবাদেও হিউমের দর্শনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মূর জ্ঞানবিদ্যাগত দিক থেকে অভিজ্ঞতাবাদের সমর্থক ছিলেন। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে সকল জ্ঞানকেই তিনি পর্যবেক্ষণ নির্ভর বলে মনে করেন। যদিও তিনি হিউম প্রমুখ অভিজ্ঞতাবাদীদের সাথে সম্পূর্ণ একমত হতে পারেননি তবুও তাঁর “Four Forms of Scepticism” শীর্ষক বক্তৃতায় একথা বলেন যে, আমরা সাদৃশ্যমূলক বা আরোহাত্মক কোনো যুক্তিতেই বস্তুর অস্তিত্বশীলতাকে বিশ্বাসযোগ্য বা যুক্তিগ্রাহ্য বলে জানতে পারি না।[৫২] তাঁর এই বক্তব্যের ক্ষেত্রে তিনি হিউমের বাহ্য জগৎ সম্পর্কিত মতকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।
ভাষা বিশ্লেষণের উপর গুরুত্ব দেওয়ায় বর্তমান শতকের দর্শনকে বিপ্লবাত্মক দর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু জে. জি. ওয়ারনকের মতে, রাসেল ও মূর কোনো নতুন বিপ্লবাত্মক পথ আবিষ্কার করেননি। তাঁরা পুরাতন পথেরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁর মতে, তাঁদের দর্শনের সঙ্গে হিউম এবং মিলের দর্শনের যথেষ্ট সম্পর্ক আছে। তাছাড়া, ওয়ারনক একথা মনে করেন যে, অধিবিদ্যাগত বাকপটুতার অনুপস্থিতির জন্য কোনো কৃতিত্ব থাকলে তা আজকের বিশ্লেষণী দর্শনের নয়, বরং দেড়শত বছর আগের ব্রিটিশ দার্শনিক হিউমের।[৫৩]
বিশ শতকের দার্শনিক রাসেল এবং মূর বর্হিজগতের জ্ঞান প্রসঙ্গে ইন্দ্রিয় উপাত্তের কথা বলেছেন। বিশ্লেষণী দর্শনের প্রখ্যাত ভাষ্যকার বি. আর. এসের মতে, রাসেল ও মূর-এর ব্যবহৃত ‘ইন্দ্ৰিয় উপাত্ত’ কথাটি নতুন হলেও চিন্তার এই ধারাটি নতুন নয়, বরং বহু পুরাতন। সতেরো ও আঠারো শতকে লক, বার্কলে ও হিউমের দর্শনে এরূপ চিন্তা দেখতে পাওয়া যায় তাঁরা ইন্দ্রিয় উপাত্তকে অন্য নামে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, বার্কলে ও হিউম ইন্দ্রিয় উপাত্ত সম্পর্কিত যে সমস্যার সৃষ্টি করেছিলেন মূর তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করার মাধ্যমে এ সমস্যারই সমাধান দিতে সচেষ্ট হয়েছেন।[৫৪]
রাসেল হিউমের মতো কঠোর অভিজ্ঞতাবাদী ছিলেন বলে মনে হয় না। কারণ, তিনি একথা বলেছেন যে, অভিজ্ঞতাতিরিক্ত জ্ঞান কীভাবে অর্জন করা যায় তা ব্যাখ্যা করায় যথেষ্ট জটিলতা থাকলেও যে মতবাদ এই ধরনের জ্ঞানকে অস্বীকার করে সে মতবাদ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।[৫৫] কিন্তু রাসেল যখন বলেন, পৃথিবীতে যা অস্তিত্বশীল তার জ্ঞান, যদি প্ৰত্যক্ষণ বা স্মৃতির মাধ্যমে জ্ঞাত ঘটনাবলিকে সরাসরি প্রতিপাদন না করে তবে, সে সব আশ্রয়বাক্য থেকে অনুমিত হবে যার একটি আশ্রয়বাক্য অন্ততপক্ষে প্রত্যক্ষণ বা স্মৃতির মাধ্যমে জ্ঞাত,৫৬] তখন তাঁর উপর হিউমের অভিজ্ঞতাবাদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া, রাসেল কোনো বস্তুর অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতাপূর্ব কোনো পদ্ধতি আছে বলে মনে করেন না। তিনি মনে করেন, যুক্তিবিদ্যা ও গণিতের ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য মতবাদের সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই।[৫৭] তাঁর এই চিন্তায় হিউমের ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা মতবাদ এবং সংশয়বাদের প্রভাব দেখা যায়।
হিউম অর্থের মানদণ্ড প্রণয়ন করতে গিয়ে বলেন যে, কোনো ধারণা সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিলে কোন ইন্দ্ৰিয়ছাপ থেকে এই ধারণার উৎপত্তি তা খুঁজে বের করতে হবে। ধারণার অনুরূপ ইন্দ্ৰিয়ছাপ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলে এই ধারণাকে অর্থহীন মনে করতে হবে। রাসেল তাঁর The Problems of Philosophy গ্রন্থে যে সূত্র প্রণয়ন করেন তার সাথে হিউমের সূত্রের সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। রাসেল বলেন, যে সব বচন আমাদের বোধগম্য হয় সেগুলোর প্রত্যেকটি এমন সব উপাদান দ্বারা গঠিত যে সব উপাদানের সঙ্গে আমরা পরিচিত।[৫৮] জন পাসমোরের মতে, রাসেল লক বার্কলে স্বীকৃত দ্রব্যের ধারণাকে বর্জন করে বিরামহীন বস্তুর কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর লক্ষ্য ছিল বৈজ্ঞানিক অনুমানকে সম্ভব করার জন্য গ্রহণযোগ্য সূত্রাবলি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেওয়া, যার সাথে হিউমের দর্শনের সাধারণ নিয়মাবলির যথেষ্ট মিল দেখা যায়।[৫৯] এছাড়া, পাসমোর এও বলেন যে, দর্শনের সারসত্তা মনস্তাত্ত্বিক—এই ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী ধারণাকে রাসেল প্রথম দিকে যদিও পরিত্যাগ করেছেন তবুও তাঁর শেষের দিকের রচনায় মনস্তত্ত্বকে পুনর্গঠিত করার একটি প্রবণতা দেখা যায়। এই প্রবণতার মধ্যে হিউমের কাছে প্রত্যাগমনের মনোভাব পরিলক্ষিত হয়।[৬০]
শুধু দর্শনের ক্ষেত্রেই নয়, বিশ শতকের বিজ্ঞানও হিউমের কাছ থেকে তার উপাদান সংগ্রহ করেছে বলে মনে হয়। প্রখ্যাত আপেক্ষিকতাবাদী আইনস্টাইন স্বীকার করেন, হিউমের রচনা দ্বারা জ্ঞানতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছেন।[৬১] আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদী কার্যকারণতত্ত্বকে হিউমের আকস্মিকতাবাদী কার্যকারণ তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বলে মনে করা যায়। এছাড়া, বিশ শতকের বিজ্ঞানের দার্শনিক পটভূমি নির্মাণের ক্ষেত্রে হিউমের অভিজ্ঞতাবাদী দর্শন যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে।[৬২]
হিউম-পরবর্তী দর্শনের ধারাগুলোর মধ্যে হিউমকে গ্রহণ, বর্জন ও তাঁর প্রভাব, সবকিছু মিলিয়ে একথা সুস্পষ্ট যে, চার্বাক অভিজ্ঞতাবাদের আধুনিক রূপকার ডেভিড হিউম পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে একটি প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভিজ্ঞতাবাদকে নবরূপ দান করেন। তাঁর অবদানের কারণেই তাঁর দর্শনের, আরো ব্যাপক অর্থে বলা যায়, চার্বাকদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত ধারার সুদূরপ্রসারী প্রভাব দর্শনের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত বিদ্যমান।
সুতরাং বলা যায়, খ্রিস্টপূর্ব সাত শতকের আগে প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক চার্বাকদের হাতে যে অভিজ্ঞতাবাদী চিন্তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় সে চিন্তার ধারাই যেন প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ও দেশ-কালের সীমা অতিক্রম করে বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন দেশের দার্শনিকদের চিন্তাধারাকে আশ্রয় করে ইতিহাসের গতির সাথে তাল মিলিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এই প্রবাহের ক্ষেত্রে সমসাময়িক দেশ-কাল, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি এবং আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রভাব এই ধারাটিকে প্রভাবিত করে। তাই এর গতি সব সময় ঊর্ধ্বগামী সরলরেখার মতো ছিল না, বরং ছিল উঁচুনিচু। এমনকি কখনো কখনো (যেমন মধ্যযুগে) এই প্রবাহে ছেদ পড়তেও দেখা যায়। সমসাময়িক আর্থ-সামজিক অবস্থাই এর কারণ।
আঠারো শতক মূলত পাশ্চাত্যে বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির যুগ। এই সময়ের ব্রিটিশ দার্শনিক হিউম চার্বাক প্রতিষ্ঠিত অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। চার্বাকদের মতবাদের সময়োপযোগী উন্নতি সাধন করে তিনি যেন ইতিহাস নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিজ্ঞানের প্রভাবে অভিজ্ঞতাবাদের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি তথা পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির ব্যবহার করেন। এছাড়া, তিনি অভিজ্ঞতাবাদ থেকে যাবতীয় অসঙ্গতি নিরসনেও প্রয়াসী হন। এর ফলে তাঁর হাতে আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদ চরম পরিণতি লাভ করে। হিউমই একথা প্রমাণ করেন যে, চার্বাকদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং প্রাচীন-মধ্য-আধুনিক যুগের দার্শনিকদের চিন্তাস্রোতের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত অভিজ্ঞতাবাদের চরম পরিণতি হলো সংশয়বাদ। তাঁর এই অবদানের জন্যই পরবর্তীকালে দার্শনিকদের কাছে তাঁর দ্বারা উদ্ভূত জ্ঞানবিদ্যাগত প্রশ্ন একটি কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়। হিউম-পরবর্তী দার্শনিকগণ তাঁদের জ্ঞানবিদ্যাগত আলোচনায় হিউম নির্দেশিত সংশয়বাদের একটি সঙ্গতিপূর্ণ সমাধান খুঁজে পেতে চেষ্টা করেন। উনিশ ও বিশ শতকের অভিজ্ঞতাবাদ, বিচারবাদ, যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ, প্রয়োগবাদ, রূপতত্ত্ব বা অবভাসবাদ, বিশ্লেষণী দর্শন, এমনকি বিশ শতকের আপেক্ষিকতাবাদী বৈজ্ঞানিক মতবাদও হিউমের দ্বারা উত্থাপিত জ্ঞানবিদ্যাগত প্রশ্নকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে সক্ষম হয়নি।
এ থেকে বলা যায়, জগৎ ও জীবন সম্পর্কিত সমস্যার যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা হলো দর্শন। দর্শনের ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। এক বিশেষ আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষের চিন্তা চেতনার বিকাশের বিশেষ পর্যায়ে দর্শনের ইতিহাসের সূচনা হয়। অতপর দেশ, কাল, জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম, বর্ণ, ইত্যাদির গণ্ডি অতিক্রম করে জগৎ জীবন সম্পর্কিত সমস্যার দার্শনিক ব্যাখ্যা ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে চলে। দার্শনিক চিন্তার এই ধারাবাহিকতার কারণেই প্রাচ্যের চার্বাক দার্শনিকদের উত্থাপিত জ্ঞানবিদ্যাগত সমস্যার আলোচনায় মনোযোগী হয়েছেন আড়াই হাজার বছর পরবর্তী পাশ্চাত্য দার্শনিক ডেভিড হিউম। একই দার্শনিক সমস্যার চার্বাক ও হিউম প্রদত্ত দুটি ব্যাখ্যায় যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে তার মূল নিহিত রয়েছে তাঁদের আর্থ- সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির মধ্যে।
দার্শনিক সমস্যা ও এর সমাধান প্রচেষ্টাকে কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা দৃঢ়ভাবে সীমাবদ্ধ করা সঙ্গত বলে মনে হয় না। ভারতীয় দার্শনিক, পাশ্চাত্য দার্শনিক, ইত্যাদি নামে ভৌগোলিকভাবে দার্শনিক গোষ্ঠীকে চিহ্নিত ও সীমাবদ্ধ করা গেলেও তাঁদের আলোচিত সমস্যা ও এর সমাধান প্রচেষ্টাকে তথা দার্শনিক মতবাদকে দেশকালের সীমারেখা দ্বারা সীমাবদ্ধ করা যাবে না। বরং এর উপর দেশ-কাল ও ভৌগোলকি গণ্ডিভেদে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক চিন্তার ইতিহাস ও তাঁদের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রভাব খুঁজে পাওয়া যাবে। কোনো স্থানিক ও কালিক গণ্ডির মধ্যে এই প্রভাব সীমাবদ্ধ থাকে না। এখানেই দর্শনের ইতিহাসের বিশেষত্ব। কোনো দার্শনিক মতবাদকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করতে হলে ভৌগোলিক গণ্ডি তথা স্থান-কালের সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে ওঠে সে মতবাদকে ও তার প্রেক্ষাপটকে বিচার করাই হবে যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি।
তথ্যপঞ্জি
১. কান্ট বলেন : I radily confess, the reminder of David Hume was what many years ago first broke my dogmatic slumber and gave my researches in the field of speculative philosophy quite a different direction. : Immanual Kant: Kant’s Prolegomena. Introduction, in the Prolegomena and Metaphysical Foundations of Natural Science. Tr. by Ernest Belfort Bax. London, George Bell and Sons. 1883. পৃ. 8।
২. Immanual Kant: Critique of Pure Reason, Tr. by J.M.D. Mieklejohn, London, Everyman’s library, 1943. পৃ. ২৫। কান্ট বলেছেন, but though all our knowledge begins with experience, it by no means follows, that all arises out of experience.
৩. B. Russell : History of Western Philosophy, London, George Allen & Unwin Ltd., 1965, পৃ. ৬৭৯।
৪. অভিজ্ঞতাপূর্ব ও অভিজ্ঞতাজাত এবং সংশ্লেষণী ও বিশ্লেষণী অবধারণের জন্য কান্টের Critique., পূর্বোক্ত, যথাক্রমে পৃ. ২৫-২৬] এবং ৩০-৩২ দ্রষ্টব্য।
৫. আমিনুল ইসলাম : আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ২য় প্রকাশ, ১৯৮৪, পৃ. ৩১৭–১৮।
৬. B. Russell : History., পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৪৬।
৭. Elie Halevy : The Growth of Philosophic Radicalism, Boston, The Bacon Press. 1960. পৃ. ১১।
৮. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫।
৯. বেনথামের উপর হিউমের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণের জন্য পূর্বোক্ত গ্রন্থের, বিশেষত, পৃ. ৪৬, ৪৭, ৭৪, ৮৮] ও ১৬২ দ্রষ্টব্য।
10. Samual Enoch Stumpf: Socrates to Sartre, New York, McGrow-Hill Book Co. 1975, পৃ. ৩৫২।
১১. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন, আমিনুল ইসলাম : সমকালীন পাশ্চাত্য দর্শন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৮২, পৃ. ১২৫-১৩৩।
১২. Paul Edwards (ed): Encyclopedia of Philosophy. Vol. 2, New York. Macmillan Publishing Co., 1972. পৃ. 50৩।
১৩. পূর্বোক্ত।
১৪. Samual Enoch Stumpf Socrates to Sartre, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৪৯। তুলনীয়, D. M. Datta : The Chief Current of Contemporary Philosophy, 3rd ed., Calcutta, Calcutta University, 1970, পৃ. ৩৬৪।
১৫. Samual Enoch Stumpf Socrates to Sartre, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৩৬-৩৭।
১৬. Barry R. Gross: Analytic Philosophy, New Delhi. Oxford and IBH Publishing Co., 1981. পৃ. ১০৮।
১৭. Antony Flew : Hume’s Philosophy of Belief, London, Routledge and Kegan Paul Ltd., 1961, পৃ. ১৫, দৃষ্টান্তের জন্য A. J. Ayer, Language, Truth and Logic, 2nd ed. London, Victor Gollancz Ltd., 1946, পৃ. ৫৪-৫৫ দ্রষ্টব্য।
১৮. J.O. Urmson : Philosophical Analysis, London, Oxford University Press, 1976, পৃ. ১০৮।
১৯. Barry R. Gross: Analytic Philosophy, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০৯।
২০. John Passmore: A Hundred Years of Philosophy, New york, Penguin Books Ltd, 1978, পৃ. ৩৯৩।
২১. David Hume : Enquiry., পূর্বোক্ত, দ্বাদশ অধ্যায়, পূর্বোক্ত, দ্বাদশ অধ্যায়, অংশ তিন দ্রষ্টব্য।
২২. A. J. Ayer : Language, Truth and Logic, 2nd ed. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৪]
২৩. L. Wittgenstein : Tractatus Logico – Philosophicus. Tr. By C. K. Ogden. London, Routledge and Kegan paul, 1922, 4.21 ও 4.46।
২৪. Samuel Enoch Stumpf: Socrates to Sartre, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৩৩।
২৫. L. Wittgenstein : Tractatus, পূর্বোক্ত ৬.৩।
২৬. J. O. Urmson : Philosophical Analysis, পৃ. ১০৮।
২৭. পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৯।
২৮. George Pitcher : The Philosophy of Wittgenstein, New Delhi, Prentice-Hal of Indian Private Limited, 1972. পৃ. ৪২-৪৩।
২৯. L. Wittgenstein : Tractatus, পূর্বোক্ত, পৃ. ২২৭।
৩০. George Pitcher : The Philosophy of Wittgenstein, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৭।
৩১. G. Ryle : “Ordinary Language”, Philosophical Review, 1953, পৃ. ১৭১, উদ্ধৃত, R. B. Gross : Analytic Philosophy, পূর্বোক্ত, পৃ. ২২৭।
৩২. George Pitcher. The Philosophy of Wittgenstein., পূর্বোক্ত, পৃ. ৩২
৩৩. Samuel Enoch Stumpf Socrates to Sartre, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৩৬।
৩৪. আমিনুল ইসলাম : সমকালীন পাশ্চাত্য দর্শন, পূর্বোক্ত, পৃ. ২২।
৩৫. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন, R. B. Perry: The Thought and Character of William James, Vol. I, London, Oxford University Press, 1935, পৃ. ৫৪৩-৫৭০।
৩৬. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৫০।
৩৭. T. H. Green & T. H. Gross, A Treatise of Human Nature, etc, 1874 এর ভূমিকায় গ্রিন হিউমের সমালোচনা করেন।
৩৮. R. B. Perry : The Thought and Character, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৬৯-৭০।
৩৯. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৬৮।
৪০. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৫২।
৪১. Paul Edwards (ed) : Encyclopedia of Philosophy, Vol. 5 পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৫।
৪২. D. M. Datta : The Chief Current of Contemporary Philosophy, পূর্বোক্ত পৃ. ৩৯৭।
৪৩. পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৮১।
৪৪. John Passmore: A Hundred Years of Philosophy, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭৮।
৪৫. Marie – Luise Schubert Kalsi : Mainong’s Theory of Knowledge, Dordrecht. Martinus Nijhoff Publishers. 1987. পৃ. ৩, তুলনীয় পৃ. ১৬
৪৬. Samual Enoch Stumpf: Socrates to Sartre পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৬৮।
৪৭. Edmund Husserl: Formal and Transcendental Logic, by Dorion Cairns. The Hague, Martinus Nijhoff of 1969. পৃ. ১০০।
৪৮. John Passmore : A Hundred Years of Philosophy, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮৮।
৪৯. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮৯।
৫০. Barry R. Gross: Analytic Philosophy, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০।
৫১. J. O. Urmson : Philosophical Analysis, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪১।
৫২. Paul Edward (ed.): Encyclopedia of Philosophy. Vol. 5. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮৮।
৫৩. G. J. Warnock : English Philosophy Since 1900, Oxford University press. 1969, পৃ. ১১-১২।
৫৪. Barry R. Gross : Analytic Philosophy, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫-২৬।
৫৫. বার্ট্রান্ড রাসেল : আমার দার্শনিক চিন্তার ক্রমবিকাশ, রশীদুল আলম অনূদিত, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৯০, পৃ. ১৯২।
৫৬. পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৩।
৫৭. পূর্বোক্ত।
৫৮. B. Russell : The Problems of Philosophy, 16th imp, London, Oxford University Press, 1936. পৃ. ৯১।
৫৯. John Passmore : A Hundred Years of Philosophy, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৯।
৬০. পূর্বোক্ত, পৃ. ২১৪।
৬১. John Passmore: A Hundred Years of Philosophy, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৩১।
৬২. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন, এ.এম.হারুন-অর রশীদ : বিজ্ঞান ও দর্শন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী,