পরিচ্ছেদ – এক : পটভূমি
সমস্ত কালের ও সমস্ত দেশের মানুষকে রাশি রাশি পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। বিশেষ করে প্রাকৃতিক পরিবেশ আহার বিহার বস্ত্র ও বাসস্থানের প্রয়োজন মেটাতে একজন মানুষকে তার সঙ্গী-সাথী ও প্রতিবেশীর ওপর নির্ভর করতেই হয়। আবার অনেক সময় তাকে এমন লোকেরও সাহায্যপ্রার্থী হতে হয় যাকে সে একাধারে অতিপ্রাকৃত শক্তি সম্পন্ন পুরুষ ও অপরের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণকারী বলে জ্ঞান করে। অবস্থার বিপাকে যখনই কোন ব্যক্তির মনে নিজের অস্তিত্ব বজায়ের ব্যাপারে কোনরকম আশঙ্কা বা বিভ্রান্তির উদয় হয় কিম্বা তেমন কোন সমস্যার বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার উপায় করতে পারে না, তখন তার নিজের কাছেই জীবনটা বড়ই কষ্টকর ও দুর্বিসহ বলে বোধ হয়; এই অবস্থা থেকে বাঁচার জন্যই তাকে বিশেষ অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন লোকের সাহায্যপ্রার্থী হতে হয়। এই সুবিশাল। জটিল জীবজগতে মানুষকে যেমন অহরহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তেমনি আবার মানুষের চিন্তাশীলতা ও সভ্যতার অগ্রগতিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথেষ্ট প্রসার হয়ে চলেছে। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও সময় সময় এমন অনেক সমস্যা দেখা দেয় যার সমাধান অতিপ্রাকৃত জগতের কোন না কোন একটি অলৌকিক শক্তির কল্পনা ছাড়া কিছুতেই হয়ে ওঠে না। তবে এই ভাবে কল্পনাশ্রয়ী হলেও মানুষ যথেষ্ট ধৈর্য ও অধ্যাবসায়ের সঙ্গে বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের (unsolved questions) সদুত্তর পাবার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। কিন্তু তার সে প্রচেষ্টা যখন ষোল আনা ব্যর্থ হয় তখনই সে ঐ সমস্ত প্রশ্নগুলিকে যে কোন এক অতিপ্রাকৃত শক্তির খামখেয়াল বা বিদ্বেষ বলেই ধরে নেয়, এবং শেষ পর্যন্ত কোন ঐন্দ্রজালিকের সাহায্যে যেমন করেই হোক না কেন, সে ঐ অতিপ্রাকৃত শক্তির সন্তুষ্টি বিধানের উপায় অন্বেষণ করে, সুখ শান্তি ও নিরুদ্বেগ জীবন যাপনের প্রত্যাশায়। এই ভাবেই পৃথিবীর প্রতিটি মনুষ্য সমাজে ইন্দ্রজাল বিদ্যার উৎপত্তি হয়ে এসেছে, এবং আজও তা হয়ে চলেছে।
প্রাচীন মানুষের জ্ঞানবুদ্ধির স্থূলতা, কারিগরি দক্ষতা ও বিচার বিশ্লেষণ ক্ষমতা প্রাথমিক স্তরে অবর্ধিত হওয়ার দরুণ প্রাকৃতিক দুর্যোগের রহস্য তাকে নানা সময়ই বিভিন্ন ভাবে বিভ্রান্ত করেছে। সমস্যাসঙ্কুল অবস্থার মধ্যে থেকে তার বহু আশা আকাঙ্খা অপূর্ণ থেকেছে। হিসেবে গরমিল হয়েছে; তার ফলে অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে ডুবে থাকতে হয়েছে সদা সর্বদা। এই বিশাল বিশ্বসংসারে সে নিজের অসহায়তার ও শক্তিহীনতার কথাই ভেবেছে বেশী করে। সাধারণত এই অবস্থাই তাকে বাধ্য করেছে যত সব অবোধ্য অবাস্তব অলৌকিক শক্তির দয়াদাক্ষিণ্যের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দিতে, আর না হয় তো সে সব কিছুর প্রতিকার বা প্রতিবিধানের চেষ্টা করেছে গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারীদের কুবিদ্যার নানা হাতিয়ার অবলম্বন করে। যে সমস্ত মানুষ গুপ্তবিদ্যাচর্চায় আসক্ত হয় এবং বিভিন্ন গুপ্তক্রিয়া-প্রক্রিয়া আয়ত্ত করতে বদ্ধপরিকর হয়ে যখন এগিয়ে আসে, তখন তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হল, অতিপ্রাকৃত শক্তিকে যান্ত্রিকভাবে চালিত করা ও সমস্ত রকম মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার এক অলৌকিক ক্ষমতা হাতের মুঠোয় পাওয়া।
এই রকম ভাবেই আদিম মানুষের অন্তরে অতিপ্রাকৃত শক্তি সম্পর্কে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনা সংক্রান্ত কার্যকারণ ও দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ, দুর্দশা, রোগ, ব্যাধি, জ্বালা, যন্ত্রণা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের ধ্যান ধারণার বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ হয়েছিল। প্রকৃতি জগতের নানা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি লক্ষ্য করার সঙ্গে সঙ্গে আবেগবিহ্বল চিত্তে সেই সমস্ত পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা দিতে যাওয়ার ফলশ্রুতি হিসেবেই আদিম মানুষের গোপন মনের মনিকোঠায় অদৃশ্যশক্তি সম্পর্কে বিচ্ছিন্ন সব ধ্যানধারণা সঞ্জীবিত হয়েছিল একদিন। অনেক সময় তাদের বাস্তব জীবনের কিছু কিছু সমস্যার সমাধান আপনা থেকে হঠাৎই যে কিভাবে হয়ে যেত তা নিয়ে হয়তো তাদের মনে কোন প্রশ্নই জাগত না; কিন্তু যখন কোন আকাঙ্খিত বস্তু না পাবার অভাব মনের গভীরে জেগে উঠত তখন তারা আর চুপ করে বসে থাকত না, যে কোন উপায়েই হোক, সে অভাব মেটানোর জন্যে চেষ্টা করে যেত প্রাণপণে। তাদের এই প্রচেষ্টাতেই ক্রমে ক্রমে গজিয়ে উঠতে থাকে বিচিত্র রকমের কিছু কিছু দেশজ গুপ্তকার্য প্রণালী (indigenous xcult procedures) আর সেই সঙ্গে গুপ্তক্রিয়া সম্পর্কীয় নানা রকমের বিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার বিচারের প্রসার ও প্রচার হতে থাকে কিছু কিছু গুপ্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। গুপ্ত ক্রিয়া কৌশলের চর্চা ও প্রয়োগের পদ্ধতিতে যেসব ব্যক্তিরা নিজেদের পারদশী করে তুলতে সক্ষম হত সেইসব ব্যক্তিরাই হয়ে উঠত দুর্দশাগ্রস্ত ও দুর্বলচিত্ত মানুষের পরম সহায় ও প্রধান রক্ষক। ঐসব অসহায় মানুষেরাই আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করত যে, গুপ্তক্রিয়াকুশলীরাই তাদের হয়ে দুষ্টশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবে, যাবতীয় দুর্ভাগ্যের হৃত থেকে রক্ষা করতে সব সময় এগিয়ে আসবে তারাই।
কালে কালে গুপ্তচর্চাকারীদের চিন্তা ও কর্মের জগতে এক ধরণের বিধিবদ্ধ প্রথা বা সামঞ্জস্যপূর্ণ চিন্তনের উদ্ভব হয়। ক্রমবর্ধমান এই সব নিয়ম কানুন ধ্যানধারণার গভীরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে এটি খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, গুপ্তবিদ্যা-বিষয়ক যাবতীয় প্রচলিত বিশ্বাস লোক-মানসে (Folk-mind) এমন ভাবেই প্রোথিত বা নির্দিষ্ট স্থান করে নিয়েছিল যা কোনভাবেই অপসারণ সম্ভব ছিল না। আবার কালে কালে ঐসব বিশ্বাসই বিভিন্ন অঞ্চলের আরো বহুবিধ প্রচলিত ধ্যানধারণা বিশ্বাস ইত্যাদির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে অনুশাসনের সংস্থা হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে। এইসব সংস্থা গড়ে ওঠার মূল উপাদান হিসেবে যা লক্ষ্য করা যায় তা হল, টিকের ন্যায় স্বচ্ছ এক গুচ্ছ বিশ্বাস (a body of crystallised beliefs) ও পূর্বনির্ধারিত কিছু কিছু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। এই সমস্ত কিছু যথাযথভাবে পালনকরা গুপ্তসংস্থার সদস্যদের ছিল প্রধান কর্তব্য। সংস্থার সদস্যরা গুপ্তবিদ্যাচর্চাকে স্থায়িত্বদান করে সামাজিক আচার আচরণ ও প্রচলিত নানা প্রথার সঙ্গে ব্যক্তি মনের ও মানুষের সম্পর্ক যতদূর সম্ভব নিবিড় করে তুলেছিল। আদিম সমাজের সংকটপূর্ণ জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতি মানুষের মনে অতিপ্রাকৃত শক্তি সম্পর্কে যে বিশ্বাস জাগিয়ে তুলেছিল তা যাদুবিদ্যা সংক্রান্ত নানা রকমের পুজোপদ্ধতি বা কাল্টের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে অতিশয় এক জটিল ধর্মের উৎপত্তি ঘটায়, এবং নীতিগত দিক থেকে বেশ কিছু নিয়মের সাহায্যে এই ধর্ম পরিচালিত হতে থাকে। আজও বিভিন্ন সমাজে ডাকিনীবিদ্যা, মায়াবিদ্যা ও সম্মোহনবিদ্যার অস্তিত্ব যথেষ্টই লক্ষ্য করা যায়। এই সব বিদ্যা যে বিভিন্ন অনুন্নত সমাজের গোষ্ঠী মানুষের বাস্তব অস্তিত্বের ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজনীয় বিদ্যা, তা বিশেষ ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আবার অনুন্নত সমাজে ভবিষ্যদ্বক্তাদের আধিপত্যও অকারণ নয়। তারা কখনও ব্যক্তি বিশেষকে আবার কখনও সমগ্র গোষ্ঠীকে সম্ভাব্য আপদ-বিপদের হাত থেকে রক্ষে পাওয়ার পথনির্দেশ দেয় গণনা করে, ভবিষ্যদ্বাণী করে। ইউরোপের অনুন্নত সমাজে যেসব লোক ভেলকি পুরোহিত বা ‘শ্যাম্যান’ বলে খ্যাত, তাদের আধিপত্যও সমাজের ওপর বড় কম নয়। এরা ছোটখাট দেবতা, অপদেবতা ও নানা অতিপ্রাকৃত শক্তির সঙ্গে যোগসাজসের কাজে নিযুক্ত থাকে। যে সমস্ত দুষ্টশক্তি লোকালয়ের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থেকে বিভিন্ন রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারীর সৃষ্টি করে মানুষের ক্ষতি করে, সেই সব দুষ্টশক্তির অনিষ্টকর ক্ষমতা খর্ব ও প্রতিরোধ করায় শ্যাম্যান-রাই সিদ্ধহস্ত বলে সাধারণে বিশ্বাস করত; এবং এখনও সে বিশ্বাস আছে। আমাদের এখানকার বিভিন্ন আদিবাসী সমাজের কর্মকর্তারা গোষ্ঠী জীবনকে নিরাপদ করার উদ্দেশ্যে ওঝা, রোজা, গুণিন, গণৎকার প্রভৃতিকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিযুক্ত রাখে। এইসব গুণিনরা যে কেবল দুষ্টশক্তির আক্রোশ থেকে মানুষকে রক্ষে করে তাই নয় বরং তারা সময় সময় কিছু কিছু দুষ্ট শক্তিকে বশ করে অন্যান্য অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে তাদের লাগিয়ে থাকে, গোষ্ঠী জীবনে স্বাচ্ছন্দ দান করে, যে কোন আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির মোকাবিলা করে। সুতরাং গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারীদের প্রতি এই জাতীয় বিশ্বাস ও রহস্যবিদ্যা সংক্রান্ত নানা কার্যপ্রণালীর ধারা প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে আদিবাসী গোষ্ঠীদের মধ্যে বংশপরম্পরায় এবং তারই ফলে, আজও আমাদের আদিবাসী সমাজে এটি একটি রীতি বা আর্দশ বা সংস্কার কিম্বা কুসংস্কার যাই বলি না কেন, তা যে সমানে টিকে আছে সে কথা আমরা কোন ভাবেই অস্বীকার করতে পারি না।
.
গুপ্তবিদ্যা কি
ইংরাজী ধর্মীয় বিশ্বকোষ (Encyclopaedia of Religion and Ethics: 1961) অনুসারে গুপ্তবিদ্যা হল সেই বিদ্যা, যা নাকি, “Purports generally to signify the doctrines, practices and rites of thing hidden and mysterious and thus extends its meaning to cover the realms of magic and mystery, marvel and miracles of every kind; not only so, but it would further claim for itself authority in the well-nigh limitless regions of abnormal psychical phenomena and even those of reli gious experience.”
সুতরাং যে ব্যক্তি গুপ্তবিদ্যায় আত্মনিয়োগ করে সে ব্যক্তি যে কোন জটিল সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে তা যে অনায়াসে সামাল দিতে পারে, সে বিশ্বাস সাধারণের মধ্যে পুরোদমেই থেকে থাকে।
তবে এই বিদ্যাচর্চায় সব সময়ই কঠিন গোপনীয়তা রক্ষে করে চলতে হয় এবং গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারী অকালটিস্ট সব সময়ই নিজেকে গুপ্তশক্তির অধিকারী বলে জ্ঞান করে। অবশ্য এই অধিকার অর্জন করার জন্যে গুপ্তবিদ্যায় বিশেষ পারদশী ব্যক্তি বা গুরুর অধীনে দীর্ঘদিন থাকতে হয় শিক্ষাণবিশকে। তা নাহলে নির্দিষ্ট কতকগুলি রহস্যপ্রণালী আয়ত্ত করা কখনই সম্ভব হয় না। তবে আধুনিক রহস্যবিদ্যা বিশারদদের বক্তব্য হল,
“Modern occultist professes to bring into the field of the fully conscious, not only what the scientist regards as still in the unfocussed marginal consciousness of present scientific observa tion but also dim impressions, from the fore conscious ancestral memory and the mass impulses of general human subconsciou sness.”
গুপ্তবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত যে সমস্ত বিচিত্র ধরণের বিশ্বাস আচার বিচার পুজোপদ্ধতি ইত্যাদির পরিচয় পাই তা পৃথিবীর সমস্ত দেশেই ব্যাপক হারে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এ সবের উৎপত্তি কোন একটি বিশেষ উদ্দেশ্য বা মোটিভ থেকে হয়নি। এক এক রকমের পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে গুপ্তবিদ্যা অনুশীলনকারীরা এক এক রকম কাজের ধারা অবলম্বন করে এগিয়ে যেতে থাকে এবং কিছুদিনের মধ্যেই বিশেষ বিশেষ রহস্যজনক ক্রিয়াকর্মের প্রয়োগ পদ্ধতিতে হয়ে ওঠে এক এক জন বিশেষজ্ঞ। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী ম্যালিনোস্কি (১৯২৬) লিখেছেন যে সম্ভবত, “The belief and practice are not taken from the air, but are due to a number of experiences actually lived through in which man receives reveala tion of his power to attain the desired end.”
সামাজিক জীবন যাত্রার বিভিন্ন পথে ব্যক্তি মানুষ তার আশা আকাঙ্খা পূরণ করতে গিয়ে যখনই সে এমন কোন সমস্যা বা সংকটে পড়েছে এবং যার কারণ তার কাছে একেবারেই অজ্ঞাত তখনই সে অনন্যোপায় হয়ে রহস্যচর্চার সংস্থাগুলির শরণাপন্ন হয়ে থাকে : কারণ সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে, জীবন যুদ্ধে জয়লাভের চাবিকাঠি হাতে আসতে পারে একমাত্র গুপ্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই। এটা তাহলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। যে, গুপ্তবিদ্যাচর্চার প্রতিষ্ঠান (institution of occultism) আদিম মনুষ্য সমাজের এক স্থায়ী ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি হিসেবে চলে এসেছে বংশানুক্রমিক ভাবে যুগ যুগান্তর ধরে। কালের বিধানে অন্যান্য বহু সংস্কৃতির বিভিন্ন দিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে যাওয়াটাই হল এই আদিম সংস্কৃতির বিশেষ লক্ষনীয় ও কার্যকরী দিক। এই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত এমন বহু কার্যপ্রণালী আছে যেগুলি গভীর রহস্যব্যঞ্জক শব্দের সাহায্যে উচ্চারিত ও অনুসৃত হয়ে থাকে এবং এরই মধ্যে দিয়ে বিশেষভাবে প্রকাশ পায় আদিম মানুষের অন্তরের স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মীয় বিশ্বাস ও বহুবিধ আচার-আচরণ মন্ত্রতন্ত্র। যে সমস্ত লোকেরা গুপ্তবিদ্যার জোরে নানারকমের সংকটপূর্ণ ও জরুরী অবস্থার সম্মুখীন হয়ে সাধারণ মানুষকে বিপদমুক্ত করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারত তারাই লোকসমাজে অতিশয় বিত্ত বা বুদ্ধিমান বলে পরিচিত হতো। রহস্যবিদ্যাকে ভিত্তি করে এমন সব বিশ্বাস ও রহস্যময় কথাকাহিনীর সৃষ্টি হতে থাকে যা নাকি কালে কালে বিশেষ একটি ধর্মীয় প্রথা বা Cultএ পরিণত হয়, এবং বংশপরম্পরায় এই প্রথা সংক্রান্ত নানা আচার অনুষ্ঠান মানুষ একাগ্র চিত্তে পালন করে যেতে থাকে তার উদ্বেগপূর্ণ অনিশ্চয়তার মহাসাগরের বুকে, শুধু এক টুকরো দ্বীপের সন্ধান পাওয়ার আশায়। প্রাত্যহিক জীবনের দুঃখ কষ্ট দুর্ভাগ্য দুর্দশা হতাশা ব্যর্থতা ইত্যাদি যে অতিপ্রাকৃত শক্তিরই ক্রোধ বা আক্রোশ, সে কথা সাধারণ মানুষ স্বচ্ছন্দে বিশ্বাস করত। এই সুযোগে গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারীদল সব সময় এটাই বুঝিয়েছে যে, দুষ্ট শক্তি–যত ভয়ংকরই হোক না কেন, তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ তাকে সন্তুষ্টি করা যায়। এবং সন্তুষ্ট বিধানের জন্যে আছে রকমারি গুপ্ত ক্রিয়া প্রক্রিয়া। আবার সময় বিশেষে অশুভ শক্তিতে ভীতি প্রদর্শন ও তার আক্রমণের বিরুদ্ধে কিছু কিছু প্রতি-আক্রমণ পদ্ধতি প্রয়োগেরও একান্ত প্রয়োজন হয়। গুপ্তক্রিয়া সম্পর্কীয় নানা রকমের পদ্ধতি ও সংশ্লিষ্ট নানা প্রতিষেধকের বিবরণ উপস্থিত করা হয়েছে এক নম্বর সারনিতে।
সারণি এক
গুপ্তক্রিয়া প্রয়োগের উদ্দেশ্য ও পদ্ধতির বিবরণ
ক্রমিক সংখ্যা | ধরণ | প্রচলিত পদ্ধতি |
১ | রোগ যন্ত্রণার কারণ নির্ধারণ | মন্ত্রপূত জলের প্রয়োগ, নুন, তেল, সর্ষে, হলুদ-গাছ, নখদর্পণ, কাপডিশ, থালা, চাল ও বেণুবাঁশ ইত্যাদির ব্যবহার চোর বা অপহরণকারীর সন্ধানে। |
২ | দুষ্ট শক্তির আক্রমণ প্রতিহত বা তা থেকে রক্ষে পাবার জন্যে। | যাদুমন্ত্র উচ্চারণ ও ফুঁ পাড়া, সেই সঙ্গে মাদুলি, তাবিজ, কবচ, শেকড়বাকড় ধারণ করা এবং দুষ্টশক্তিকে লোহার পেরেকে বিদ্ধ করে রাখা ইত্যাদি। |
৩ | সুখ স্বাচ্ছন্দ ও সৌভাগ্য অর্জন। | অপরের পুকুরে মন্ত্র পড়ে, চুরি করে কাঁটা দিয়ে মাছধরা, অপরাধীর শাস্তি লঘু করা, মামলা মোকদ্দমায় জয়, রাতে কোন গৃহস্থের ঘরে চুরি বা সিধ দেওয়ার সময় ঘরের সকলকে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন করা। |
৪ | ভূতপ্রেত ও দুষ্টশক্তির বিতাড়ন। | মন্ত্রপড়া, ফুঁ পাড়া, মন্ত্রপূত হলুদগাছ, সর্ষে ইত্যাদির প্রয়োগ, ভূতে ভর করা ব্যক্তির সর্বাঙ্গে জুতো মারা ও মাথায় এক কলসী জল আনানোর পদ্ধতি। |
৫ | যেকোন জীবজন্তু পোকা মাকড়ের কামড় ও দংশনকারী সাপের জাত নির্ণয়। | সাপ, বিছে, বোলতা, মৌমাছি, কুকুর, শেয়াল ইত্যাদি মন্ত্র পড়া, ফুঁ দেওয়া ও মন্ত্রপূত দড়ির বাঁধন। |
৬ | রোগ নিরাময়। | পেটের অসুখ, তলপেটে ব্যাথা যন্ত্রণা, হঠাৎ হঠাৎ বাচ্চার কেঁদে ওঠা ইত্যাদি নিরাময়ের জন্যে সাধারণত জল পড়া, নুন পড়া, মন্ত্র পড়া ইত্যাদির প্রয়োগ। |
৭ | পুরোন বা দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি নিরাময়। | রক্ত আমাশা, চোখে ছানি, বাত, ম্যালেরিয়া জ্বর, অর্শ, মৃগী এবং প্লীহা বা যকৃতের রোগ নিরাময়ে যাদুমন্ত্র ও নানান ওষধির প্রয়োগ। |
৮ | হাড়ভাঙা বা হাড়ে চোট। | মন্ত্র ও নানা লতাপাতা শেকড় বাকড়ের প্রয়োগ। |
৯ | প্রসব বেদনা উপশমে। | আঞ্চলিক দেবদেবী ও ইষ্টকারী শক্তির উদ্দেশ্যে মানত এবং পাঁঠা বলি দেবার অঙ্গীকার, নির্বিঘ্ন প্রসবের পর। |
১০ | জন্ম নিয়ন্ত্রণে। | মন্ত্রতন্ত্র ঝাড়ফুঁক, ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মের অনুষ্ঠান এবং সেই সঙ্গে নানা ওষধির প্রয়োগ। |
১১ | গবাদি পশু ও মায়ের বুকে দুধ আনার জন্যে। | ডাইনীর নজর লেগে কোন মায়ের বা গরুর দুধ শুকিয়ে গেছে সন্দেহে নানাবিধ ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মের অনুষ্ঠান। |
১২ | পশু চিকিৎসা ও হারিয়ে যাওয়া পশু ফিরে পাবার জন্যে। | মন্ত্রতন্ত্রের প্রয়োগ ও কিছু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন। |
১৩ | বিরুদ্ধচারী বা শত্রু নিধনের উদ্দেশ্যে। | দুই রাস্তার সংযোগস্থলে সর্ষে রেখে অনিষ্টকর যাদুমন্ত্রের প্রয়োগ–কিছু কিছু ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে বা সাপকে মন্ত্রমুগ্ধ করে শত্রুর উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেওয়া। |
১৪ | মানসিক দিক থেকে কোন ব্যক্তিকে পঙ্গু করা। | অনিষ্টকর ক্রিয়াকর্ম ও যাদুর প্রয়োগ, ছল চাতুরির সাহায্যে মন্ত্রপূত কোন কিছু খাইয়ে দেওয়া এবং মন্ত্রপূত যে কোন একটি ফুল শুকিয়ে দেওয়া। ইত্যাদি পদ্ধতির প্রচলন আছে। |
১৫ | যে কোন নারী বা পুরুষকে বশীভূত করে স্বার্থসিদ্ধি করা। | প্রদীপের সলতে পোড়া ছুঁইয়ে তৈরী মিষ্টি, রোদে পোড়া চাল খাইয়ে ও মন্ত্রপূত ফুল দেখিয়েই বশীকরণ পদ্ধতি। |
গুণিনের জগৎ
বর্তমান গ্রন্থাকারকে বিশেষ তৎপরতার সঙ্গে গুপ্তবিদ্যাচর্চায় নিযুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুপ্তক্রিয়া কলাপের প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে গুণিনদের জগতে অনুপ্রবেশ করতে হয়। বেশ কিছু সংখ্যক গুণিনের সাক্ষাৎকার নিয়ে নির্দিষ্ট কতকগুলি বিষয়ের সারণি প্রস্তুত করার অবকাশ পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। এই কাজের জন্যে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার প্রান্তদেশে অবস্থিত এমন কয়েকটি অঞ্চলকে বেছে নেওয়া হয়েছিল, যে অঞ্চলগুলি বিশেষ করে বিভিন্ন জাতি ও উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল বলে খ্যাত।
আমাদের মনের ইচ্ছে আকাঙ্খা চাহিদা ইত্যাদির মতই বিস্তর ও ব্যাপক ভাবেই গুপ্ত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান ছড়িয়ে আছে মনুষ্য সমাজে। এইভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বা বিস্তার লাভ করার কারণও অবশ্য আছে। কারণ হল এই যে, গুপ্ত প্রতিষ্ঠান একজন সাধারণ মানুষকে তার দুর্ভাগ্য সম্পর্কে আগে থেকেই অবহিত ও সতর্ক করে এবং সেই সঙ্গে প্রতিবিধানের পথও বাতলে দেয়। সে পথ হল, সাহসের সঙ্গে দুর্ভাগ্য প্রেরণকারী অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে হয় তাকে লড়াই করার জন্যে প্রস্তুত হতে হবে, আর না হয়ত বিভিন্ন আচারের মাধ্যমে দুষ্টশক্তিকে তুষ্ট করতে হবে। যে সব লোকেরা এই প্রথা বা কাল্টের চর্চায় লেগে থাকে তারাই হল আঞ্চলিক মানুষের কাছে রোজা বা ওঝা। এরাই আবার ‘মেডিসিনম্যান’ (medicine-man),’সরসারার’sorcerer), ‘উইচ ফাইণ্ডার’ (witch finder) বা ‘উইচ ডক্টর’ (witch doctor) ‘সুথ সেয়ার’ (Sooth Sayer), এসঅরসিষ্ট’ (exorcist) ও ‘ডিভাইনার’ (diviner) বলে ইংরিজী রহস্যবিদ্যা বা অকাল্ট লিটারেচার-এ বর্ণিত হয়েছে। বাংলা গুণ (guna) বা গোনা (gona) অর্থাৎ গণনা শব্দ থেকেই সম্ভবত পরবর্তী কালে গুণিন শব্দের উৎপত্তি হয়ে থাকবে। গুণিনরা অজ্ঞাত ভবিষ্যতের নানা রহস্য সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে এবং সেই সঙ্গে অমঙ্গল সূচক ঘটনার মূল উৎপাটন করার জন্যে এমনই বিচিত্র সব বিধান দেয় যা সাধারণে কখন চিন্তা করতেও পারে না।
.
সমস্যার অনুধাবনে
প্রথম প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে বেশ কিছু নামজাদা গুণিন বা ওঝাদের নিয়ে একটি সারণি প্রস্তুত করেছিলাম। তারপর গুপ্তবিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের ছককাটা সারণি প্রস্তুত করা হয়, পরে ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের মাধ্যমে ঐ সারণির প্রতিটি ছক নির্দিষ্ট বিষয় দিয়ে যথাযথভাবে পূর্ণ করি। এইভাবে গুপ্তবিদ্যা বিষয়ক যে বিপুল সংখ্যক তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল তা বিভিন্ন কার্যপ্রণালী অনুসারে সাজিয়ে গুছিয়ে গবেষণামূলক এই প্রবন্ধে উপস্থিত করা হয়েছে। সব শুদ্ধ পাঁচশ’ কি তারও কিছু বেশী বিবরণ পত্র পূর্ণ করা হয়েছিল, কিন্তু তার মধ্যে থেকে মাত্র চারশ’ বাষট্টিটি ঘটনা (cases) বিচার বিশ্লেষণের উপযুক্ত বলে গ্রহণ করা হয়। তবে এই সংখ্যাও গ্রন্থকারের দৃষ্টিতে যথেষ্ট বলে মনে হয় না। তা সত্ত্বেও এই অল্প সংখ্যক ঘটনার নিখুঁত বিচার করে আমরা বলতে পারি যে, গুপ্তবিদ্যাচর্চা বিভিন্ন সম্প্রদায়, জাতি ও গোষ্ঠীর মধ্যে পুরুষানুক্রমিক প্রথা বা ঐতিহ্য বা ট্র্যাডিশন হিসেবে প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। সুতরাং রহস্যচর্চার গভীরতা, ব্যপকতা ও প্রসারতা সম্পর্কে আমাদের মনে কোন রকম সংশয় থাকার কথা নয়।
রহস্যচর্চার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত হওয়ার জন্যে বিভিন্ন অঞ্চলের গুণিনদের সংস্পর্শে আসতে হয়েছে। নানা রকমের উৎসব অনুষ্ঠান আচার বিচার গোনাগাঁথা ইত্যাদি বিষয়ের জন্যেও বিবিধ উপাদান সংগ্রহ করতে হয়েছে গুণিনদের তোয়াজ করে। গুণিনরা কিভাবে বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষকে গুপ্ত সংস্থার সভ্য করে রহস্যচর্চার তালিম দেয়, সে বিবরণীও প্রস্তুত করা হয়েছে। এক বছরের মধ্যে (১৯৭১-৭২) এক জন গুণিন কতজন রুগীকে পরীক্ষা করেছে সে তথ্যও যথাসম্ভব সংগৃহীত হয়েছে মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। গুণিনদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার পটভূমিও বিচার করা হয়েছে এখানে। তাছাড়া আলোচ্য গুণিনরা কোন জাতি বা গোষ্ঠীর লোক তাও বিবৃত করা হয়েছে।
বর্তমানে গুণিনদের গুপ্তবিদ্যা শিক্ষার মেয়াদ, প্রকৃতি, অভিজ্ঞতা ও গুপ্তক্রিয়া কর্ম সম্পাদনের জন্যে তারা কি ধরণের পারিশ্রমিক পেয়ে থাকে সে তথ্যও যতদূর সম্ভব উপস্থিত করার চেষ্টা করেছি। রহস্যচর্চায় নিযুক্ত নারী ও পুরুষের বয়স, তাদের আরাধ্য দেবতা, গুপ্ত আচার সংক্রান্ত নানা ধরণের বাধা নিষেধ (Taboos), অতিপ্রাকৃত জগতের বিভিন্ন বয়সের অশরীরী শক্তির সন্তুষ্টি বিধানের যাবতীয় ক্রিয়াপ্রক্রিয়া আচার আচরণের বিস্তৃত বর্ণনা ও কিছু সংখ্যক মন্ত্র-তন্ত্রও তুলে ধরা হয়েছে। এই সমস্ত বিষয় ছাড়াও গুপ্ত প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দিক বা প্রেক্ষাপট গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে এবং রহস্যবিদ্যা অধ্যয়ণের ক্ষেত্রে ব্যাপকতর করার উদ্দেশ্যে উক্ত প্রতিষ্ঠানের বিশেষ বিশেষ দিকের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ ও তুলনামূলক আলোচনা যথাসাধ্য করা হয়েছে অধ্যায়গুলিতে।
.
স্মৃতির সরণি বেয়ে
এই আলোচনা প্রসঙ্গে গ্রন্থকারের ইচ্ছে গ্রামীণ জীবনের কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা এখানে তুলে ধরা। গ্রন্থকারের বাল্যজীবন ১৯৩০ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত কেটেছে মেদিনীপুরের এমন এক অজগ্রামে, যেখানে থেকে নিকটতম কোন শহরে যাবার টানা পথ বলে কিছু নেই। সেই গ্রামে কাউকে আসতে হলে তাকে হাওড়া থেকে ট্রেনে করে প্রথমে পাঁশকুড়া নেমে বাস যোগে তমলুক হয়ে নরঘাট। তারপর নরঘাট থেকে ইলদিনদী পার হয়ে হাঁটা পথে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে বারো মাইল এলে এই গ্রামে উপস্থিত হওয়া যায়। ভারত স্বাধীন হওয়ার তেত্রিশ বছর পরে এই অঞ্চলের যাতায়াত বা যোগাযোগ ব্যবস্থার কিছু উন্নতি সাধন করা হয়েছে। এই গ্রামের অবস্থা আগে যা ছিল এখনও প্রায় একই রকম। আজও সেই ভাঙাচোরা কাদাভর্তি সংকীর্ণ পথ, এবং গুটি কয়েক বাড়ীর ওপর টালির ছাত ছাড়া বাকি সবার প্রায় জীর্ণ মাটীর কুঁড়ে ঘর। বর্ষাকালে বিষাক্ত পোকামাকড় সাপ বিছে বুকে নিয়ে জলের মধ্যে ডুবে থাকে সমস্ত অঞ্চলটাই। গ্রন্থকারের নিজের গ্রামটির ছবিও যে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়, তা বলাই বাহুল্য। গ্রাম থেকে প্রায় মাইল বারো দূরে আছে একটি সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হেলথ সেন্টার। কিন্তু হঠাৎ কোন জরুরী চিকিৎসার প্রয়োজন হলে গ্রামবাসীরা যে ঐ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে উঠতে পারে না, তা খুবই স্বাভাবিক। সেজন্যে তাদের মোল আনা নির্ভর করতে হয় গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার ও গুণিনদের চিকিৎসায়। এগুলো ছাড়াও, এই গ্রামের সমাজ বলতে যা আছে তা হল, জাত পাতের গোঁড়ামিপুষ্ট কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক বিচিত্র সমাজ। এক গ্রাম থেকে অন্য আর এক গ্রামে যেতে হলে অনেকখানি পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয়। এই গ্রামের নীচু জাতের মৃতদেহ সৎকারের জন্যে একটা শ্মশান আছে। কিন্তু সেটাকেও অচ্ছুৎ করে গ্রামের এক নির্জন প্রান্তে নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে।
গ্রামের অধিকাংশ রাস্তার মোড়ের মাথায় বিরাটাকার এক অশ্বখ কিম্বা বট গাছ আছে। উচ্চবর্ণের বড়লোকেরাই একদিন এইসব বৃক্ষরোপণ করিয়েছিলেন ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের পৌরোহিত্যে। এক এক রকম ঠাকুর বা দেবতার নামে গাছগুলিকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। যদিও এই বৃক্ষ রোপণের আসল উদ্দেশ্য ছিল ক্লান্ত পথচারীকে ছায়া দান করা তথাপি কোন না কোন দেবতার নামে উৎসর্গ করতে হবে, যাতে নাকি গরীব গ্রামবাসীরা জ্বালানীর প্রয়োজনে অন্তত বট অশ্বত্থের ডালপালা কাটতে না পারে। বছরের যে কোন সময়েই হোক না কেন, যদি কোন গাছ দেবতার নামে উৎসর্গ করে পোঁতা হয় তাহলে গ্রামবাসীরা কখনই সে গাছের একখন্ড কাঠ হাজার প্রয়োজনেও কাটতে সাহস করে না তাদের জন্মগত সংস্কারের ভয়ে, এবং এ ব্যাপারে তাদের বদ্ধমূল ধারণা হল, যে দেবতাকে ঐ গাছ উৎসর্গ করা হয়েছে তিনি ঐ গাছেই অধিষ্ঠান করেন। সুতরাং ঐ গাছের গায়ে কোপ মারলে দেবতার কোপে পড়তে হবে এবং তাতে তার সর্বনাশও অনিবার্য, এমন কি মৃত্যুমুখে পতিত হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া, গ্রাম্য মানুষের মধ্যে এরকম একটা বিশ্বাসেরও প্রচলন আছে যে, গাছ লাগিয়ে দেবতার নামে উৎসর্গ করার অর্থই হল দেবতার আশীবাদ লাভ ও তাঁর কৃপাধন্য হওয়া।
গ্রামের প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি বলতে বোঝায় গুণিনদের শরণাপন্ন হওয়া। কারো কিছু চুরি গেছে, কাউকে সাপে কেটেছে, কারো ওপর ভূতে ভর করেছে, কেউ দুষ্টগ্রহের কোপে পড়েছে, কিম্বা কারো ওপর ডাইনী বিষ নজর হেনেছে ইত্যাদি ইত্যাদি ঘটনার সুরাহার আশায় গ্রামবাসী মাত্রেই গুণিনের ডেরায় ধর্ণা পাড়ে। আমাদের এই সব অঞ্চলের গুণিনরা নিম্নবর্ণ বা নীচু জাতের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তারা তাদের পেশা ও ইলমের জোরে সমাজে উচ্চ সম্মান লাভ করে, এমন কি, ব্রাহ্মণরাও তাদের যথেষ্ট মান্য করে এবং সময় সময় দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাবার জন্যে গুণিনদের ফুঁ দেওয়া ও থুথু মেশান জলপড়া নামাবলীধারী বাহ্মণ পুরোহিতরাও নিঃসঙ্কোচে পবিত্র জ্ঞানে মস্তকে ধারণ করে। মন্ত্রপূত সুতোয় বেঁধে গুণিনরা যে সমস্ত মাদুলি তাবিজ কবজ ইত্যাদি দিয়ে থাকে তা উচ্চনী সব জাতের লোকই নির্দ্বিধায় হাতে গলায় কোমরে গুণিনদের নির্দেশমত ধারণ করে ঘুরে বেড়ায়। প্রতিটি গ্রামেই ছোট বড় মাপের বেশ কিছু পুকুর আছে এবং পুকুরের চারধারে নানারকমের গাছও দেখতে পাওয়া যায়। তারই মধ্যে চারটি গাছ হয়ত অনেক পুরোন এবং আকারেও বিরাট। হাজার ঝড় জলেও সেগুলোকে ভেঙে পড়তে কেউ দেখেনি। সেইজন্যে গ্রামবাসীদের ধারণা যে, এই সমস্ত গাছে ভূত প্রেত দৈত্য দানব বাস করে বলে এগুলো একই ভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সমস্ত রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগ্রাহ্য করে, কিছুতেই ভেঙে পড়ে না। এই সব গাছ থেকে গভীর রাতে এক এক জাতের ভূতপ্রেত নেমে এসে গ্রামের চারদিকে ঘুরে বেড়ায়, দুর্বলচিত্ত লোকের ওপর চড়াও হয়ে তাকে মেরে ফেলে, না হয় একেবারে পঙ্গু করে দেয়। গ্রামবাসী মাত্রেই এসব কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। আবার এই সমস্ত ভূতদের আলাদা আলাদা নামও দিয়েছে গ্রামবাসীরা। এরকম একটি ভূতের নাম হল যক্ষ (Yaksha) যাকে গ্রামের লোকেরা সব থেকে বেশী ভয় পায়। এই সব ভূতপ্রেতের হাত থেকে রেহাই পেতে গুণিনদের কাছে যাওয়া ছাড়া অন্যকোন পথ গ্রামবাসীদের সামনে খোলা আছে বলে তো মনে হয় না।
গ্রন্থকার তাঁর নিজের গ্রামে একবার স্বচক্ষে দেখেছিলেন একজনের চুরি যাওয়া কিছু জিনিষ কি ভাবে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। তিনি যখন খুব ছোট তখনই এই ঘটনা ঘটেছিল। কোন এক গৃহস্থের বাড়ী থেকে হঠাৎ কিছু সামগ্রী চুরি যায়। কিভাবে যে চুরি হলো তা গৃহস্থের আশেপাশের কেউ কিছু বলতে পারলো না। সুতরাং গুণিন ভিন্ন উপায় নেই। দ্বারিক নামে এক গুণিনকে সেই বাড়ীতে যথাসময়ে তলব করা হয়। গুণিন ছিল জাতে মাহিষ্য। গুণিনের কেরামতি দেখতে বহুলোক এসে ভিড় করে। গ্রন্থকারও কৌতূহলবশতঃ ঐ বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন আর পাঁচজনের মত। গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারীদের প্রচলিত বিধান অনুযায়ী হঠাৎ কোন দুর্ঘটনার সংবাদ গুণিনের কর্ণগোচর করতে হলে সংবাদবাহককে সক্কাল বেলায় বাসি মুখে, খালি পেটে গুণিনের দ্বারে হাজির হতে হয়, এই নিয়মের একচুল ব্যতিক্রম হলে গুণিনের কলাকৌশল যে বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে তা গ্রামের ছেলে বুড়ো প্রায় সবাই জানে। তাই এ ক্ষেত্রে গুপ্তবিধান অনুসারে যা কিছু করা প্রয়োজন তা নিখুঁতভাবেই পালন করা হয়েছিল। দ্বারিক গুণিন ঐ গৃহস্থের বাড়ীতে এসেই তাড়াতাড়ি চলে যায় বাড়ীর পেছন দিকের বাঁশ ঝাড়ে, হাতে একটা কাটারি। এক কোপে সরু একটা বাঁশের কঞ্চি কেটে নিয়ে আসে। তারপর বাড়ীর দাওয়ায় বসে কঞ্চিটাকে ছিলেদুলে পরিষ্কার করে সমান দু’ভাগে ভাগ করে এবং ভিড়ের মধ্যে থেকে দুজন লোক ডেকে তাদের চোখে পটি বেঁধে দেয়। তারপর দুজনের হাতে একটা করে কঞ্চি দিয়ে আলতো ভাবে মাটিতে ঠেকিয়ে রাখতে বলে। তারা সেইমতই করে। গুণিন তখন বিড়বিড় করে নানা মন্ত্র পড়তে থাকে। দেখে সত্যিই অবাক লাগে যে, মন্ত্রপড়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁশের কঞ্চি দুটোর মাথা একই দিকে নুইয়ে পড়ে এবং যেদিকে পড়ে গুণিন সেই দুচোখ বাঁধা দুই কঞ্চিধরকে সেইদিকে ধরে নিয়ে যেতে থাকে। প্রায় ঘন্টা দুয়েক চলার পর হঠাৎ তারা এক জায়গায় থমকে যায়। চারদিকে বনবাদার ঝোঁপ ঝাড় ছাড়া আর সেখানে কিছু নেই বললেই চলে। কিন্তু কি আশ্চর্য! একটা ঝোঁপের মধ্যে লুকোন ছিল গৃহস্থের চুরি যাওয়া সম্পদ। তবে সম্পদ অপহরণকারীকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। সে হয়তো গুণিনের আসবার খবর পেয়েই অন্য কোন গ্রামে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই উদ্ধার কার্যের সমস্ত ব্যাপারটাই যে কোন একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাছে নেহাতই আপতিক ঘটনা কিম্বা ইংরিজি মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায়, suggestive approach ছাড়া অন্য কিছুমনে হতে পারে না। কারণ এই জাতীয় ঘটনারমূলেবৈজ্ঞানিক সত্য বলে যে কিছু নেই, তা না বললেও চলে। কিন্তু যে ভাবেই হয়ে থাকুক না কেন, ঘটনাটি যথার্থই ঘটেছিল। সরল সাধাসিধে গ্রামবাসীদের জীবনে এরকম অভিজ্ঞতা প্রায়ই হয়ে থাকে। গ্রন্থকার নিজেও এই ধরণের বিস্ময়কর ঘটনায় যারপরনাই অভিভূত হয়েছিলেন, এবং সে বিস্ময়ের ঘোর আজও একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায় নি। কারণ এই ঘটনা চাক্ষুষ দেখার পর থেকে তিনি সমানেই নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে এসেছেন কি করে ঐ ঘটনা ঘটল? সেটা কি তাহলে কোন মন্ত্রশক্তি বা গুপ্তবিদ্যার যাদু?
এর কিছুদিন পর গ্রন্থকার তার গ্রামের একজনকে ভূতে পাওয়ার ঘটনাও স্বচক্ষে দেখেছিলেন। গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর এক ছাত্র নাম বিষ্ণু চাওলিয়া। তাকে একদিন দেখা যায় বিদ্যালয়ের কাছেই এক পুকুরের পাড়ে গাছতলায় বসে আছে। সে থেকে থেকে নিজের মনেই বিড় বিড় করে বকে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে চোখে মুখে নানান বিকৃতি ফুটে উঠতে থাকে। স্কুল থেকে তার সঙ্গীসাথীরা অনেকেই তাকে ঐভাবে বসে থাকতে দেখে। তাই ছুটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলের দল এসে তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। তার কিন্তু কোন দিকেই খেয়াল নেই। ক্রমে বয়স্ক মানুষরাও একে একে এসে হাজির হয়। তারা বেশ কিছু সময় ধরে ছেলেটির মুখের বিকৃতি লক্ষ্য করে এবং বিষ্ণুকে যে ভূতে পেয়েছে সে বিষয়ে বয়স্ক মানুষরা অনেকেই নিঃসন্দেহ হয়ে গুনিণকে তাড়াতাড়ি খবর দিতে বলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোপীনাথ পাণ্ডা নামে এক উৎকলী বাহ্মণ তথা ভূতের ওঝা এসে হাজির হয়। গোপীনাথ ছিল যথার্থই এক ধর্মপ্রাণ ও নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। প্রত্যহ ভোরবেলা সে রামায়ণ, মহাভারত ও চণ্ডী থেকে পাঠ করত চমৎকার সুর করে। তার কাছে আবার যাদু ও গুপ্তবিদ্যা সংক্রান্ত মন্ত্র তন্ত্রের একখানি মোটা বইও ছিল। সে এই বইয়ের পাতায় পাতায় ভূযোকালির ছোট ছোট হরফে ভূতপ্রেত তাড়ানোর নতুন নতুন মন্ত্র নিজেই তৈরী করে লিখে রাখত। গ্রন্থকারের বাড়ীর এক চত্বরেই সে স্ত্রীকন্যা নিয়ে বাস করত। গ্রন্থকারের মাতৃদেবীর সঙ্গে ধর্মবোনের সম্পর্ক পাতিয়ে গোপীনাথ তাঁর পরিবারেরই একজন হয়ে গিয়েছিলেন। ধর্মগ্রন্থ পাঠে সে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছিল বলেই বিচিত্র যত মন্ত্র উচ্চারণেও তার কোনরকম আড়ষ্টতা ছিল না, ভুলভ্রান্তিও দেখা দিত না ঝাড়ফুঁকের মন্ত্র আওড়াতে গিয়ে।
যাইহোক, ভূতে পাওয়া সেই ছেলেটির মুখের পানে পাণ্ডা, একদৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিয়েই বলে যে, বিষ্ণুকে তার মার আত্মাই ভর করেছে। গত বছর কয়েক আগে তার মা মারা গেছে। বিষ্ণুর বাবাও ছিল গ্রন্থকারের আশ্রিত একজন শ্রমিক। খামারে কাজ করত। দুই বাপ বেটার থাকা খাওয়া পড়া বাদে বিষ্ণুর বাবার বরাদ্দ ছিল বছরে একশ’ টাকা পারিশ্রমিক হিসেবে। গুণিন গোপীনাথ বড় একটা পেতলের জগে কানায় কানায় জল ভর্তি করে নিয়ে এসে বিষ্ণুর সামনে রাখে। নানারকমের মন্ত্র পড়া শুরু করে নানারকমের ভাবভঙ্গী করে। এক একবার মন্ত্ৰপড়া শেষ করেই পাণ্ডা জোর গলায় বিষ্ণুর দেহ ছেড়ে যেতে বলে বিষ্ণুর মায়ের প্রেতাত্মাকে। এই ভাবে বার কয়েক বলার পর বিষ্ণু হঠাৎ তার গায়ের জামার নীচের অংশটা দিয়ে মাথার কিছুটা ঢেকে দেয়, তারপর মেয়েলি গলায়, নাকি সুরে তার মায়ের মত বলতে থাকে। বিষ্ণু তার ছেলে, কিন্তু তাকে অনেকদিন দেখতে না পেয়ে বড়ই কষ্টের মধ্যে সে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সে তার ছেলেকে আর না দেখে থাকতে পারল না বলেই তাকে ভর করেছে। গুণিন গোপীনাথ এই কথা শুনে ভীষণ ধমকে উঠে বিষ্ণুর মার অশরীরী আত্মাকে তখনই বিষ্ণুকে ছেড়ে চলে যেতে বলে। কিন্তু প্রেতাত্মা কিছুতেই ছেড়ে যেতে চায় না। ইতিমধ্যে সেখানে বিষ্ণুর বাবা ভিড় ঠেলে এসে ছেলের সামনে দাঁড়ায়। বাবাকে দেখেই বিষ্ণু চিনতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণু তার জামা দিয়ে মাথায় আরো খানিক ঘোমটা টেনে দেয়। দেখে মনে হল, কোন গ্রামবধূর সামনে তার স্বামী যেন আর পাঁচজনের সঙ্গে হঠাৎ এসে দাঁড়াতেই সে লজ্জায় মুখ চাপা দিচ্ছে। কিন্তু বিষ্ণুর মার আত্মা যখন কিছুতেই ছেলেকে ছেড়ে যেতে চাইছে না তখন গুণিন নিজের পায়ের একপাটি চটি খুলে নিয়ে বিষ্ণুর সর্বাঙ্গে মারতে আরম্ভ করে। ভূতকে ছেড়ে যেতে বলে। চীৎকার করে। বিষ্ণুও ফাটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে “ওগো, আমি এখনই ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আর মেরো না। আমি শুধু বিষ্ণুকে দেখতে এসেছিলাম। তার কোন ক্ষতি আমি করতে আসিনি।” গুণিন তখন চটিপেটা বন্ধ করে এক টুকরো কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে বিষ্ণুর নাকে ধোঁয়া দিতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিষ্ণু অজ্ঞান অচৈতন্য হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে এক ঘন্টারও বেশী সময়। গুণিন সমানে তার মুখে জলের ঝাঁপটা দিতে থাকে। তাতেই আস্তে আস্তে বিষ্ণুর জ্ঞান ফিরে আসে। কিন্তু তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় যে, তার কি হয়েছিল, সে তখন কিছুই বলতে পারে না। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে সে কেবল একটা কথাই বলতে থাকে যে, তার সর্বাঙ্গ ব্যথা করছে। কিন্তু ব্যথার কারণ বিষ্ণু না জানলেও গুণিনের জুতো পেটায় বালকের সর্বাঙ্গ যে টাটিয়ে উঠেছে ভয়ানক ভাবে, তাতে অনেকেই ব্যর্থবোধ করেছিল।
এই রকমই আরো, একটা ঘটনার কথা গ্রন্থকারের স্মৃতিপটে আজও খুব স্পষ্ট। কোন এক গুণিন একবার বড় একটা বোতলের মধ্যে একটা ভূতকে ধরে রাখে। বোতলের মুখ যথাসাধ্য কঠিন করে এঁটে সেটাকে নিয়ে যায় গ্রামের এক প্রান্তে। সেখানে ছিল তিন রাস্তার মাথায় বহুকালের পুরোন এক বট গাছ। গুণিন প্রথমে বটের গোড়ায় বোত রেখে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করে। তারপর গাছের গায়ে বড় একটা পেরেক পুঁতে বোতলের মুখ খুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়। নিশ্চিন্ত হওয়ার কারণ এই যে গুণিন তার বোতলের ভূতকে বোতল থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে চিরদিনের মত পুঁতে দিল বট গাছের গায়ে ঐ লোহার পেরেকের সঙ্গে। এই রকম কত পেরেক যে বটের দেহ বিদীর্ণ করেছে তা আর বলার নয়। এ ব্যাপারে গ্রামবাসীদের বিশ্বাস হল যে, প্রতিটি পেরেকে একটি করে ভূত আটকানো আছে বটের গায়ে, তাদের বাইরে আসার পথ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে গুণিনরা।
উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলিকে গ্রন্থকারের কল্পনাপ্রসূত বলে যেন মনে না করা হয়। গ্রন্থকার ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান এবং বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলেই ঘুরেছেন সব থেকে বেশী। তার ফলে, এটাই লক্ষ্য করা গেছে যে, আজও গ্রামাঞ্চলের মানুষ তাদের ঐতিহ্যগত বা পুরুষানুক্রমিক ধ্যানধারণা বিশ্বাস ও নানা ধরণের গুপ্ত ক্রিয়া প্রক্রিয়া চর্চার ধারাকে ভালোমতই আঁকড়ে আছে। এইভাবে আঁকড়ে থাকার প্রধান কারণ হচ্ছে, অধিকাংশ গ্রাম্য মানুষ হল অজ্ঞ, অশিক্ষিত এবং এখনও তারা সভ্য সমাজজীবনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধ আচার বিচারের মধ্যেই নিজেদের ডুবিয়ে রেখেছে। কিন্তু এতৎ সত্ত্বেও অশুভ শক্তির প্রতিরোধে ও নানারকমের ভৌতিক রোগ ব্যাধির চিকিৎসার ব্যাপারে অজ্ঞ গ্রামবাসীরা ক্ষেত্র বিশেষে যে সমস্ত ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়া কৌশল বা রহস্যজনক পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকে তা সম্পূর্ণ নিরর্থক নয়। এ সমস্ত বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা আধুনিক সমাজবিজ্ঞানীরা একেবারে উপেক্ষা করতে পারেন না এবং তা করা যুক্তিযুক্তও নয়। এই সমস্ত ব্যাপার যে নিছক গ্রাম্য মানুষের অন্ধ বিশ্বাসের কথা, এ গুলিই যে তাদের জীবনের চরম আশ্রয়, সে কথা চিন্তা করাও সমীচীন হবে না। কারণ, এই সব মানুষদের মধ্যে প্রচলিত মন্ত্র তন্ত্র ঝাড়ফুঁক গোনাগাঁথা ইত্যাদি বিষয় যে নানা ক্ষেত্রে অভীষ্ট ফলদানে খুবই সক্ষম এবং বহুরকমের দুরারোগ্য ব্যাধি ও জ্বালা যন্ত্রণার উপশম ও নিরাময়ের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট শক্তিশালী ও কার্যকর, তা আমাদের উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলিতেই স্পষ্ট ফুটে ওঠে। তাই বলা দরকার যে, রহস্যবিদ্যার অর্ন্তগত বিভিন্ন রকমের ধর্মীয় লোক-বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান, ব্রত, ক্রিয়াকর্ম, পুজোপাঠ ইত্যাদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হতে না পারলে কাল্ট অব অকাল্টিজমের সামগ্রিক মূল্যায়ন কখনই সম্ভব নয়।
ভারতীয় সমাজের যে বৈচিত্রময় গঠন বা কাঠামো, তা সঠিকভাবে লক্ষ্য করলে যে কোন শক্তির কাছে এটি খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ভারতীয় জনসাধারণের জীবনধারণের মান বা স্ট্যানডারড়, শিক্ষার স্তর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বুদ্ধিজীবী মানুষের ব্যক্তিত্ব ও বৌদ্ধিক ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে পরিবর্তনশীল কিম্বা বিভিন্নতা যথেষ্ট পরিমাণেই বিদ্যমান। ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের যা মোট সংখ্যা তার প্রায় অর্ধেককেই সুচিকিৎসকের চিকিৎসার সুযোগ থেকে সম্পূর্ণবঞ্চিত ও চরম দরিদ্রতায় নিমজ্জিত হয়েই দিনাতিপাত করতে হয়। দুঃসহ অভাব অনটন রোগ ব্যাধি ও সেই সঙ্গে আকস্মিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই হল ভারতীয় গ্রাম জনবসতির পরিবেশের সাধারণ : বৈশিষ্ট্য। তাই গুণিন, গণৎকার, হাতুড়ে বৈদ্য ও রহস্যবিদ্যাচর্চাকারীরাই হয় গরীব গ্রামবাসীদের যাবতীয় দুর্ভাগ্য ও বিপদ আপদের পরম সহায় সম্বল। যে কোন রকম রোগের চিকিৎসার প্রয়োজনে ও অতিপ্রাকৃত সমস্যা সমাধানের জন্যে আঞ্চলিক গুণিনকে হাতের কাছে পেতে গ্রামবাসীদের একটুও বেগ পেতে হয় না। আর গুণিন তার কাজের বিনিময়ে গ্রামবাসীর কাছ থেকে যা পায় তা খুবই সামান্য। তাই গ্রামবাসী ও গুণিন, উভয়ের পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা ও আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়ে রহস্যবিদ্যাচর্চা ও তার নানান প্রয়োগ-পদ্ধতি বিষয়ে গ্রামগঞ্জের মানুষের মনে যে গভীর বিশ্বাসের সঞ্চার হয়, তা কোন সময়েই শূন্য হয় না; বংশ পরম্পরায় সে বিশ্বাস প্রায় একই ভাবে চলে আসছে। এই বিশ্বাসে ভর করেই তারা বিভিন্ন দেবদেবী যেমন, হরি, মনসা, চণ্ডী প্রভৃতির নাম স্মরণ করে। আবার অন্ধকার পথে চলতে গিয়ে এই বিশ্বাসকেই তারা আঁকড়ে থাকে ভূত প্রেত দৈত্য দানব সাপ বিছে ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সতর্কতার প্রধান হাতিয়ার মনে করে। এছাড়া আরো একটি জিনিস লক্ষ্য করা যায়। সেটি হচ্ছে, গুণিনের চিকিৎসাধীন বিভিন্ন রোগের রুগীদের প্রয়োজনে যে সমস্ত মাদুলি, তাবিজ, কবচ, জলপড়া, তেলপড়া ইত্যাদি দিতে হয় সে জন্যে গুণিন সাধারণতঃ হাত পেতে নগদ অর্থ নেয় না। সমাজের উচ্চ বর্ণের রুগী মানুষদের অন্তরে গুণিনদের দেওয়া মাদুলির ওপর যেমন অগাধ বিশ্বাস তেমনি ভক্তিরও বোধ হয় কোন সীমা পরিসীমা নেই। এই ঘটনাই যে পুরুষানুক্রমিক জাতি প্রথার সমস্ত রকম বাধানিষেধের গণ্ডী ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসে তা স্পষ্টই লক্ষ্য করা যায়।