পঞ্চম অধ্যায় – চার্বাক ও হিউম : তুলনামূলক সমীক্ষা
এ অধ্যায়ে আমি চার্বাক ও হিউমের জ্ঞানবিদ্যার তুলনামূলক সমীক্ষায় প্রয়াসী হবো। এখানে চার্বাক ও হিউমের জ্ঞানবিদ্যার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য নির্ণয় করা হবে। প্রথম অধ্যায়ে ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যা, দ্বিতীয় অধ্যায়ে চার্বাক জ্ঞানবিদ্যা, তৃতীয় অধ্যায়ে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যা এবং চতুর্থ অধ্যায়ে হিউমের জ্ঞানবিদ্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। বর্তমান অধ্যায়ের তুলনামূলক সমীক্ষার ক্ষেত্রে প্রধানত দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ের আলোচনার উপর নির্ভর করা হবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে যথাক্রমে চার্বাক ও হিউমের জ্ঞানবিদ্যার আলোচনাকালে তাঁদের প্রমাণতত্ত্ব বা জ্ঞানোৎপত্তিসংক্রান্ত মতবাদের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তবে, তাঁদের প্রমাণতত্ত্বের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয় যেমন, দ্রব্য, আত্মা, কার্যকারণ ইত্যাদিও আলোচনায় স্থান পেয়েছে। এ অধ্যায়ে উক্ত আলোচনার প্রাসঙ্গিক অংশের সারসংক্ষেপ পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে উভয় জ্ঞানবিদ্যার মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যমূলক বিষয়গুলোর আলোচনা করা হবে।
ভারতীয় ও পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাস আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, যদিও ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাস কালের দিক থেকে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসের চেয়ে প্রাচীন তবুও ভারতীয় দর্শনের প্রচলিত নয়টি সম্প্রদায়ের নিকট জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা সাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসের প্রাথমিক পর্যায়ে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা তেমন গুরুত্ব পায়নি। পরবর্তীকালে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে, আধুনিক যুগ থেকেই পাশ্চাত্যে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব পায়, এবং আধুনিক দর্শন বলতে মূলত জ্ঞানবিদ্যাকেন্দ্রিক দর্শনকেই বুঝানো হয়। অন্যদিকে, প্রায় সকল ভারতীয় দার্শনিকই সত্তার প্রকৃতি এবং সত্তার জ্ঞানের সম্ভাব্যতা প্রত্যাদেশিত গ্রন্থের উপর নির্ভর করে বলে মনে করেছেন। সুতরাং তাঁদের কাছে শুধু প্রমাণ বা জ্ঞানের উৎস সম্পর্কিত আলোচনাই হয়ে পড়ে জ্ঞানবিদ্যার কাজ। তাই ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় দার্শনিকগণ অন্যান্য বিষয়গুলোর পরিবর্তে প্রমাণ বা জ্ঞানের উৎস সম্পর্কিত আলোচনার উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে জ্ঞানের উৎস সম্পর্কিত প্রশ্নটি সকল দার্শনিকের কাছে এতো গুরুত্ব পায়নি।
ভারতীয় দার্শনিকদের সকলেই জ্ঞানের উৎস সম্পর্কিত মতবাদের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তবুও পাশ্চাত্য দার্শনিকদের যেমন বুদ্ধিবাদী, অভিজ্ঞতাবাদী, বিচারবাদী ও স্বজ্ঞাবাদী এই চারটি দলে স্পষ্টভাবে বিভক্ত করা যায় ভারতীয় দার্শনিকদের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব নয়। কারণ, চার্বাক ব্যতীত অন্য সকল সম্প্রদায়ই প্রত্যক্ষ ও অনুমানকে প্রমাণ হিসাবে স্বীকার করেছেন। এদিক থেকে বিচার করে জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে ভারতীয় দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গিকে পাশ্চাত্য দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে বেশি বিচারমূলক বলে মনে হয়। এর প্রমাণ হলো, কান্ট, তাঁর পূর্ববর্তী বুদ্ধিবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদী পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসকে যেভাবে বিচারবিযুক্তবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে এরূপ অভিযোগের অবকাশ নেই। তবে চার্বাক দর্শন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কারণ, ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে একমাত্র চার্বাক দর্শনকেই চরম অভিজ্ঞতাবাদী হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়।
ফলে অন্তত সাতশত খ্রিস্টপূর্ব অব্দের ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় চার্বাক জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কে যে মতবাদ প্রচার করে গেছেন তার সঙ্গে আঠারো শতকের ব্রিটিশ দার্শনিক হিউমের জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কিত মতবাদের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। প্রধানত এ সাদৃশ্যই চার্বাক জ্ঞানবিদ্যার সঙ্গে হিউমের জ্ঞানবিদ্যার তুলনামূলক আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। উভয় জ্ঞানবিদ্যার মধ্যে যেসব বিষয়ে তুলনামূলক আলোচনা করা যায় সেগুলোর মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্ব গ্রহণ, অনুমান বর্জন, শাশ্বত আত্মার ধারণা খণ্ডন এবং কার্যকারণের আবশ্যিক সম্পর্ক অস্বীকার প্রভৃতি অন্যতম।
প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্ব প্রসঙ্গে
ভারতীয় দর্শনে কোনো কোনো সম্প্রদায় প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ, উপমান, অর্থাপত্তি, ও অনুপলব্ধি, এই ছয় প্রকার প্রমাণকে স্বীকার করেছেন। প্রায় সকল দার্শনিক সম্প্রদায়ই এক বাক্যে প্রত্যক্ষ ও অনুমানকে প্রমাণ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু চার্বাক দার্শনিকগণ এর ব্যতিক্রম। তাঁরা প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলে মনে করেন এবং যে জ্ঞান প্রত্যক্ষের মাধ্যমে পাওয়া যায় না সে জ্ঞানকে অস্বীকার করেন। তাঁদের মতে, পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা সরাসরি যে জ্ঞান পাওয়া যায় সে জ্ঞানই বৈধ। চার্বাকদের এই মতের সঙ্গে হিউমের মতের মিল পরিলক্ষিত হয়। পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও স্বজ্ঞাকে জ্ঞানোৎপত্তির উপায় হিসাবে নির্দেশ করা হলেও হিউম চার্বাকদের মতো শুধু প্রত্যক্ষণকেই যথার্থ জ্ঞানোৎপত্তির একমাত্র উপায় বলে নির্দেশ করেন। এজন্য ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় চার্বাক ও পাশ্চাত্য দার্শনিক ডেভিড হিউম উভয়কেই চরম অভিজ্ঞতাবাদী বলে অভিহিত করা যায়।
একথাও সম্ভবত বলা যায় যে, পাশ্চাত্য দর্শনে জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে জ্ঞানের উৎস হিসেবে যখন অভিজ্ঞতার কথা বলা হয় চার্বাক দার্শনিকগণ এর বহু পূর্বেই জ্ঞানের উৎস হিসেবে অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। তবে চার্বাক অভিজ্ঞতাবাদী ও পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকদের দর্শনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। আমরা জানি, পাশ্চাত্যে বিস্ময় বা জিজ্ঞাসা থেকে দর্শনের জন্ম হয়েছে। কিন্তু ভারতে তা হয়নি। এখানে বরং মানুষের জাগতিক দুঃখ, দুর্দশা, বেদনা, হতাশা ইত্যাদির উপলব্ধিজনিত বাস্তব প্রয়োজনের চাপ থেকে দর্শনের জন্ম। দুঃখ কী করে দূর করা যায়, সে প্রশ্নই ভারতবাসীকে সবচেয়ে বেশি বিচলিত করেছে। চার্বাক ও হিউমের জ্ঞানবিদ্যাগত আলোচনার প্রেক্ষাপটের ক্ষেত্রেও এরূপ পার্থক্য দেখা যায়।
এ প্রসঙ্গে চার্বাক ও হিউমের দর্শনের প্রেক্ষাপটের প্রতি নজর দেওয়া যাক। চার্বাকদের সঠিক কাল নির্ণয় সম্ভব নয়, তবুও আনুষঙ্গিক পরিবেশ বিচার করে যে আনুমানিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় সে অনুসারে চার্বাক দর্শন ৭০০ খ্রিস্টপূর্ব অব্দের পূর্ববর্তী সময়ের। এই সময়ের ভারতীয় সমাজ ছিল বৈদিক ধর্মের নিগড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। বৈদিক শাস্ত্রাচার ও ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবে ভারতের সমাজ তখন বর্ণবৈষম্য, জাতিভেদপ্রথাসহ বিভিন্ন প্রকার দুর্ভোগে আক্রান্ত। ধর্মের নামে কর্মবাদের ভয় দেখিয়ে লোকবঞ্চনা করে জীবিকা নির্বাহ, শ্রেণিশোষণ ইত্যাদি তখন ভারতীয় সমাজে প্রকট। ধর্মের অতীন্দ্রিয় শক্তির দোহাই এই শোষণের মূল ভিত তৈরি করেছিল।
চার্বাক মতবাদ এই সামাজিক অবস্থার বিরুদ্ধে একটি আপোষহীন প্রতিবাদরূপে বিকশিত হয়। জড়বাদের ভিত্তিতে শোষণ বঞ্চনার উৎস শাস্ত্রবচনকে ধোকাবাজি এবং ব্রাহ্মণদের জীবিকা নির্বাহের পথ হিসেবে ঘোষণা করে চার্বাক দর্শন দেহাতীত আত্মার ধারণা পরলোক, পরজন্ম এবং এসবের তত্ত্বগত ভিত্তি কর্মবাদকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করে। ফলে প্রাচীন ভারতীয় সমাজের সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ জাতিভেদের বিরুদ্ধে অভিযানের পথ প্রশস্ত হয়। জড়বাদী তত্ত্ববিদ্যার ভিত্তি হিসেবে অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানতত্ত্বকে প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করা ছিল চার্বাকদের জন্য একান্ত আবশ্যক। সুতরাং বলা যায়, কেবল একাডেমিক জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রয়োজন নয় বরং তৎকালীন ভারতের বাস্তব আর্থ-সামাজিক অবস্থাই প্রধানত চার্বাক প্রত্যক্ষবাদী জ্ঞানবিদ্যার প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করেছে। তবে, এর উপর প্রাচীন ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্র অর্থাৎ আয়ুর্বেদ এবং বৈদিক জড়বাদী ধারারও প্রভাব পড়েছে।
পক্ষান্তরে, হিউম আঠারো শতকের ব্রিটিশ দার্শনিক। চৌদ্দ শতকের রেনেসাঁ ও সতেরো শতকের বিজ্ঞান বিপ্লবের ফলে ইউরোপীয় চিন্তাধারা যখন প্রধানত পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণমূলক হয়ে ওঠে এবং তার ফল হিসেবে ব্রিটিশ দর্শনে যখন অভিজ্ঞতাবাদের রাজত্ব এমনি এক প্রেক্ষাপটে দর্শনের জগতে হিউমের আবির্ভাব। তাই পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসবেত্তাগণ হিউমের অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাকে ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী দর্শনের, তথা জন লক ও জর্জ বার্কলের অভিজ্ঞতাবাদের, চরম এবং সঙ্গতিপূর্ণ পরিণতি হিসেবে মূল্যায়ন করেন। এ ছাড়াও হিউমের দর্শনের পেছনে রয়েছে দুহাজার বছরেরও বেশি সময়ের দর্শনচর্চার ইতিহাস। খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতক থেকে হিউমের কাল পর্যন্ত পাশ্চাত্য দর্শনের. ইতিহাসে যে বিবর্তন ও ক্রমবিকাশ সাধিত হয় তা দ্বারা হিউমের প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু চার্বাকগণ যেহেতু খ্রিস্টপূর্ব সাত শতকের পূর্বের, অর্থাৎ পাশ্চাত্য দর্শনের প্রারম্ভিক যুগেরও আগের এবং ভারতীয় দর্শন বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ের দর্শন সেহেতু চার্বাক দর্শনের ক্ষেত্রে একাডেমিকভাবে প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ না থাকাই স্বাভাবিক। তাই একথা বলা যায় যে, চার্বাক দর্শনের ভিত্তি যত না একাডেমিক তার চেয়ে বেশি প্রায়োগিক বা সাধারণ মানুষের বাস্তব জীবনভিত্তিক। মূলত এই কারণেই চার্বাক দর্শনকে লোকায়ত দর্শন বলা হয়। অন্যদিকে হিউমের দর্শন যত না প্রায়োগিক তার চেয়ে বেশি একাডেমিক। অবশ্য এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, কোনো দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তির কারণই বিশুদ্ধ একাডেমিক বা তাত্ত্বিক হতে পারে না। সকল দার্শনিক চিন্তাই কোনো এক পরিমাণে সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার ফসল। এদিক থেকে বিচার করলে হিউমের দর্শনে সমসাময়িক যুগের প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের উন্নতির প্রভাব দেখা যায়। বিজ্ঞানের ও দর্শনের এই উন্নতির মূল উৎস ছিল তৎকালীন ইউরোপের ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। হিউমের দর্শন ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পরিপূরক হিসেবেই গড়ে ওঠেছিল।
চার্বাক ও হিউমের দর্শনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও জ্ঞানের উৎপত্তির দিক থেকে চার্বাক দর্শনে প্রত্যক্ষের যে প্রকারভেদ দেখানো হয়েছে তার সাথে হিউমের প্রত্যক্ষের প্রকারভেদের মিল লক্ষিত হয়। চার্বাকগণ প্রত্যক্ষকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা, বাহ্যিক প্রত্যক্ষ, এবং অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষ। জ্ঞানের উৎপত্তির দিক থেকে হিউমও অভিজ্ঞতার একমাত্র উৎস প্রত্যক্ষণকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। তিনি এর নাম দিয়েছেন, ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা। বাহ্যিক প্রত্যক্ষ বলতে চার্বাকগণ ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষকে বুঝেছেন। পঞ্চেন্দ্রিয়ের সঙ্গে বাহ্যবস্তুর সংযোগের ফলেই বাহ্য প্রত্যক্ষ ঘটে। হিউম তাঁর ইন্দ্রিয়ছাপের প্রকৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, যেসব প্রত্যক্ষণ ভীষণ তীব্র ও প্রচণ্ড তাদের নাম দেওয়া যায় ইন্দ্রিয়ছাপ। মনে প্রথম আগত সংবেদন, অতিরাগ ও প্রচণ্ড আবেগকে এই পর্যায়ে ফেলা যায়। ইন্দ্রিয়ছাপ বলতে আমরা আমাদের সব সজীবতর প্রত্যক্ষণকে বুঝি। যেমন, যখন আমরা শুনি, দেখি, অনুভব করি, কামনা করি, বা সংকল্প করি। অর্থাৎ প্রত্যক্ষকারী সরাসরি প্রত্যক্ষণের সময় বাহ্য বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগের ফলে যে বস্তুর সংবেদন পায় তাই ইন্দ্ৰিয়ছাপ।
অন্যদিকে, বাহ্য প্রত্যক্ষের দ্বারা সরবরাহ করা উপাদানের উপর ক্রিয়া করে মন যে প্রত্যক্ষ লাভ করে তাকেই চার্বাকগণ অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষ বলেন। হিউমও ধারণা বলতে চিন্তা ও ন্যায় ক্রিয়ার ইন্দ্রিয়ছাপের ক্ষীণ প্রতিবিম্বকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ সরাসরি প্রত্যক্ষণে যে ইন্দ্ৰিয়ছাপ পাওয়া যায় তা যখন অনুপস্থিত থাকে তখন প্রত্যক্ষণকারী এসব ইন্দ্রিয়ছাপ নিয়ে যে চিন্তা করে তা-ই হলো ধারণা।
সুতরাং, চার্বাক ও হিউম উভয়ই প্রত্যক্ষের প্রথম ধাপকে অর্থাৎ ইন্দ্রিয় ও বস্তুর সংযোগকে যথাক্রমে বাহ্যিক প্রত্যক্ষ ও ইন্দ্ৰিয়ছাপ বলেছেন। প্রত্যক্ষের পরবর্তী ধাপ অর্থাৎ বাহ্য প্রত্যক্ষ নির্ভর মানসিক প্রত্যক্ষকে তাঁরা যথাক্রমে অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষ ও ধারণা বলেছেন। চার্বাকদের বাহ্য প্রত্যক্ষ এবং হিউমের ইন্দ্রিয়ছাপের উৎপত্তিস্থল ও উৎপত্তিপ্রক্রিয়া যেমন অভিন্ন তেমনি অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষ ও ধারণার উৎপত্তিস্থল ও উৎপত্তিপ্রক্রিয়াও অভিন্ন। চার্বাকদের অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষ যেমন বাহ্য প্রত্যক্ষের উপর নির্ভরশীল এবং সময়ের দিক থেকে পরবর্তী তেমনি হিউমের ধারণাও ইন্দ্রিয়ছাপের উপর নির্ভরশীল এবং সময়ের দিক থেকে পরবর্তী।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, তথ্যের সীমাবদ্ধতার কারণে চার্বাকগণ প্রত্যক্ষের শ্রেণিবিভাগ অর্থাৎ বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষ সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছিলেন কি না, করলেও তা কী ছিল তা সুস্পষ্ট বর্ণনা করা সম্ভব হয়নি। তবে, এ ব্যাপারে হিউম বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্রত্যক্ষণের অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কেও তিনি আলোকপাত করেছেন। হিউম একথা স্পষ্ট বলেছেন যে, ইন্দ্ৰিয়ছাপ ছাড়া ধারণার সৃষ্টি হতে পারে না। অন্যকথায়, প্রত্যেক ধারণার অনুরূপ ইন্দ্রিয়ছাপ বিদ্যমান। এটাই তাঁর অভিজ্ঞতাবাদের মূলসূত্র। হিউম নিজে এই সূত্রকে মানব প্রকৃতি-বিজ্ঞানের প্রথম সূত্র বলে উল্লেখ করেন। দ্রব্য, আত্মা, ঈশ্বর, কার্যকারণ সম্পর্ক ইত্যাদি দর্শনের প্রচলিত ধারণাবলির অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য হিউম তাঁর অভিজ্ঞতাবাদী এই সূত্রকেই প্রয়োগ করেন, এবং এর মাধ্যমে অর্থাৎ অনুরূপ কোনো ইন্দ্ৰিয়ছাপ পাওয়া যায় না বলেই তিনি এসব বিষয়ের ধারণাও পাওয়া যায় না বলে মনে করেন। এই সূত্র দ্বারা তিনি ঘোষণা করতে চান যে, ইন্দ্রিয়ছাপ হলো অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের একমাত্র প্রাথমিক উপাদান। মূলত এই সূত্রই তাঁর অভিজ্ঞতাবাদ, তথা ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদকে সঙ্গতিপূর্ণ পরিণতি দান করার চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে। এর দ্বারাই তিনি মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা প্রমাণ করেন ও কল্পনার বল্গাহীনতার লাগাম টেনে ধরেন। বলা যায়, এই সূত্রকে কঠোরভাবে অনুসরণ করতে গিয়েই তাঁর মতবাদ সংশয়বাদে রূপ নেয়।
চার্বাক দর্শনে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষ সম্পর্কে এমন বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে চার্বাকগণ প্রত্যক্ষযোগ্য নয় বলে অনুমান ও স্মৃতিজাতীয় অন্যান্য সকল প্রকার প্রমাণ বা অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তাই এটা অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, চার্বাকগণ বাহ্য প্রত্যক্ষকেই অভিজ্ঞতা তথা জ্ঞানের উপাদান সরবরাহের একমাত্র প্রাথমিক উৎস বলে মনে করেছেন। একথা ঠিক যে, হিউম ধারণা বলতে ইন্দ্রিয়ছাপের অবিকল প্রতিকৃতিকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু চার্বাকগণ অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষ বলতে বাহ্য প্রত্যক্ষের অবিকল প্রতিকৃতিকে বুঝিয়েছেন কি না তা স্পষ্ট নয়। চার্বাকগণ অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষের উৎপত্তিস্থল হিসেবে মনকে গ্রহণ করলেও মন বলতে তাঁরা কোনো স্বতন্ত্র ইন্দ্ৰিয় বা দ্রব্যকে বুঝান নি বরং তাঁরা একথা বলেছেন যে, মন বাহ্য ইন্দ্রিয় থেকে স্বাধীন নয়। সুতরাং মনে যা উৎপন্ন হয় তা পঞ্চেন্দ্রিয় থেকে যা পাওয়া যায় তার উপর নির্ভরশীল।
চতুর্থ অধ্যায়ের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, হিউম ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণাকে উৎপত্তির দিক থেকে সংবেদনজাত ও চিন্তাজাত এবং প্রকৃতির দিক থেকে সরল ও জটিল ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত করেছেন। অন্তদৰ্শনজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপকে তিনি আবার শান্ত ও উগ্র এই দুই ভাগে ভাগ করে কীভাবে বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে বিভিন্ন রকম ধারণার উৎপত্তি ঘটে তার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এছাড়া, হিউম ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার মধ্যে পার্থক্য নিয়ে বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট আলোচনা করেছেন। তাঁর আলোচনা থেকে নির্দেশিত হয়, ইন্দ্ৰিয়ছাপ ও ধারণার পার্থক্য সজীবতার বা তীব্রতার মাত্রাগত। প্রথমটি দ্বিতীয়টির চেয়ে সবক্ষেত্রেই বেশি সজীব। অর্থাৎ এদের পার্থক্য মাত্রাগত, গুণগত নয়। কিন্তু বাহ্য ও অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষ প্রসঙ্গে এরূপ বিশ্লেষণ চার্বাক দর্শনে লক্ষ করা যায় না।
এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, প্রত্যক্ষণ প্রসঙ্গে সকল প্রকার পুঙ্খানুপুঙ্খ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণেই মনস্তাত্ত্বিক ও শারীরবিদ্যাগত জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত। চার্বাকদের সময়ে ভারতবর্ষে ভেষজবিদ্যা বা চিকিৎসাশাস্ত্র ছাড়া মনস্তত্ত্ব ও শারীরবিদ্যার উন্নতির নজির পাওয়া যায় না। অথচ হিউমের সময়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে মনস্তত্ত্ব ও শারীরবিজ্ঞানের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়েছে। সুতরাং প্রত্যক্ষণের বিভাজনের ব্যাপারে হিউমের ব্যাখ্যা অধিকতর বিশ্লেষণাত্মক ও বৈজ্ঞানিক। একথা বলা ভুল হবে না যে, আদি যুগে ভারতবর্ষে চার্বাক দার্শনিকগণ এরূপ চিন্তার সূচনা করে গেছেন।
প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ হলে সার্বিক জ্ঞান সম্ভব কি না—এ প্রশ্ন প্রসঙ্গিকভাবে দেখা দেয়। এর উত্তরে চার্বাক ও হিউম উভয়েই একমত যে, সার্বিক জ্ঞান সম্ভব নয়। তবে সার্বিক জ্ঞানের অসম্ভাব্যতার কারণসম্পর্কিত ব্যাখ্যায় চার্বাক ও হিউম ভিন্নমত পোষণ করেন। চার্বাকগণ বাহ্য প্রত্যক্ষকে জ্ঞানের প্রাথমিক উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে অতীত ও ভবিষ্যতের জ্ঞানকে অস্বীকার করেছেন। এর কারণ হলো, অতীত ও ভবিষ্যতের বাহ্য প্রত্যক্ষ সম্ভব নয়। চার্বাকদের বক্তব্য থেকে মনে হয়, এই অসম্ভাব্যতার কারণ হিসেবে তাঁরা আমাদের ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকেই নির্দেশ করতে চেয়েছেন। কিন্তু হিউমের ব্যাখ্যা ভিন্ন। তিনি এক্ষেত্রে সার্বিক জ্ঞানের ভিত্তি আরোহানুমানের মূল ভিত্তি কার্যকারণ সম্পর্ক সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলেন। তাঁর মতে, কার্য ও কারণের মধ্যে সম্পর্কের আবশ্যিকতার ধারণার উপর নির্ভর করেই আরোহানুমান সম্ভব হয়। আর আরোহানুমানই সকল সার্বিক জ্ঞানের ভিত্তি। কিন্তু আবশ্যিকতার ধারণা হলো মানসিক প্রবণতা। কারণ, এ ধারণার ইন্দ্রিয়ছাপ নেই। কার্য ও কারণ নামক দুটি ভিন্ন ঘটনার সান্নিধ্যের পুনরাবৃত্তি থেকেই অনুষঙ্গ নিয়মের মাধ্যমে আবশ্যিকতার ভ্রান্ত ধারণা জন্মে।
সুতরাং বলা যায়, সার্বিক জ্ঞানের অস্বীকৃতির কারণ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও চার্বাকদের চেয়ে হিউম অধিকতর বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। তিনি সার্বিক জ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে আরোহানুমানকে চিহ্নিত করেছেন এবং আরোহানুমানের ভিত্তি কার্যকারণ খণ্ডনের মাধ্যমে সার্বিক জ্ঞান খণ্ডন করেছেন। কার্যকারণ সম্পর্ক খণ্ডনের ফলে তাঁর হাতে বাস্তব ঘটনা সম্পর্কিত ধারণার নিশ্চয়তার ভিত্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এছাড়া, এর ফলে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নিশ্চয়তার ভিত্তিও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। চার্বাকগণ যদিও ভারতীয় অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায়কর্তৃক গৃহীত অনুমান-প্রমাণকে খণ্ডন করেছেন তবুও সার্বিক জ্ঞানের সম্ভাব্যতা খণ্ডন করতে গিয়ে তাঁরা অনুমান খণ্ডনের কথা বলেননি। অর্থাৎ সার্বিক জ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে তাঁরা অনুমানকে চিহ্নিত করেননি, বরং অতীত ও ভবিষ্যতের জ্ঞান প্রত্যক্ষযোগ্য নয় বলে সার্বিক জ্ঞানকে অসম্ভব বলেছেন। সুতরাং দেখা যায়, সার্বিক জ্ঞান খণ্ডনের ব্যাপারে চার্বাকদের ব্যাখ্যার চেয়ে হিউমের ব্যাখ্যা অধিকতর উন্নত, বিশ্লেষণধর্মী ও বৈজ্ঞানিক। তবে একথা ঠিক যে, সার্বিক জ্ঞানের অসম্ভাব্যতা সম্পর্কিত যে মত হিউম পাশ্চাত্যে আঠারো শতকে পোষণ করেছেন চার্বাকগণ এর বহুযুগ পূর্বে ভারতে এই মতবাদের ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন। সম্ভবত তাঁরাই এই মতবাদের প্রবক্তা।
উল্লেখ্য যে, হিউম লক ও বার্কলের ব্যবহৃত ‘ধারণা’ শব্দটির অর্থ স্পষ্ট করেছেন এবং দেকার্ত প্রবর্তিত সহজাত বা আন্তর্ধারণা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি দেখাতে প্রয়াসী হয়েছেন যে, কার্তেসীয় অর্থে সহজাত ধারণা একমাত্র ইন্দ্ৰিয়ছাপকেই বলা যায়। কারণ, একমাত্র ইন্দ্ৰিয়ছাপই মৌলিক। কিন্তু চার্বাক দর্শনে সহজাত ধারণা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এর কারণ সম্ভবত এই যে, চার্বাকদের সময়ে সহজাত ধারণা সম্পর্কে ধারণা ছিল না।
প্রত্যক্ষের মাধ্যম বা ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতি ও সংখ্যা নিয়েও ভারতীয় দর্শনে মতভেদ দেখা যায়। ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতি সম্পর্কে ভারতীয় দর্শনে তিনটি ভিন্নমত দেখা যায়। প্রথম মতানুসারে ইন্দ্রিয় হলো অঙ্গ, দ্বিতীয় মতানুসারে ইন্দ্রিয় অঙ্গের শক্তি, তৃতীয় মতানুসারে ইন্দ্রিয় স্বতন্ত্র দ্রব্য যা ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এই চার প্রকার জড় দ্বারা গঠিত। তাই এসব উপাদান যে বস্তুতে আছে সে সব বস্তুই ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের বিষয়। চার্বাকগণ তৃতীয় মতের সমর্থক।
অন্যদিকে, ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা সম্পর্কেও ভারতীয় দর্শনে ভিন্নমত দেখা যায়। কেননা ভারতীয় দর্শনের কোনো কোনো সম্প্রদায় ছয়টি, কোনো কোনো সম্প্রদায় তেরটি, আবার কোনো কোনো সম্প্রদায় বাইশটি ইন্দ্রিয়কে স্বীকার করেছেন। তবে চার্বাকগণ স্পষ্টভাবে মোট পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের কথা বলেন। সেগুলো হলো, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক। যে সব দার্শনিক ছয়টি ইন্দ্রিয়ের কথা বলেছেন তারা মনকে একটি স্বতন্ত্র ইন্দ্রিয় বলে স্বীকার করেন। কিন্তু চার্বাকগণ মনকে স্বতন্ত্র ইন্দ্রিয় বলে মেনে নেননি। তাঁদের মতে, মন হলো পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের উপবস্তু। উল্লেখ্য যে, চার্বাকদের মনসম্পর্কিত উপবস্তুবাদের সাথে আধুনিক যুগের পাশ্চাত্য দার্শনিক দেকার্তের মন সম্পর্কিত উপসত্তাবাদ (Epiphenomenalism)-এর মিল পরিলক্ষিত হয়। আধুনিক যুগের পাশ্চাত্য মনোবিজ্ঞানী ক্লিফোর্ড (Cliford), হাক্সলী (Huxly), হসন (Hodgson) প্রমুখ মন সম্পর্কে এই মতবাদ দেন। চার্বাক দার্শনিকগণই এই মতবাদের প্রবক্তা।
হিউমের দর্শনে ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতি ও সংখ্যা নিয়ে কোনো আলোচনা পাওয়া যায় না। এর কারণ সম্ভবত এই যে, ভারতীয় দর্শনে ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতি ও সংখ্যা নিয়ে যেরূপ বিতর্ক আছে পাশ্চাত্য দর্শনে তা নেই। বিতর্কহীনতার কারণ হলো, পাশ্চাত্য দর্শনের উপর মনোবিজ্ঞানের প্রভাব। মনোবিজ্ঞানই ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা ও প্রকৃতি সম্পর্কিত সমস্যার স্থিরীকৃত সমাধান দিয়েছে যা পাশ্চাত্য দর্শন গ্রহণ করেছে। এছাড়া, ভারতীয় দর্শনের প্রতিটি সম্প্রদায় তাঁদের ব্যবহৃত ধারণাগুলো বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আদি যুগে যেরূপ সচেতন ছিলেন পাশ্চাত্য দর্শনের ক্ষেত্রে এরূপ সচেতনতা খুব কমই লক্ষ করা যায়। বরং সাম্প্রতিক কালের পাশ্চাত্য দার্শনিকদের ক্ষেত্রে অনুরূপ সচেতনতা পরিলক্ষিত হয়। এই সচেতনতার ফল হিসেবেই সাম্প্রতিককালে বিশ্লেষণী দর্শনের উদ্ভব। এসব কারণেই পাশ্চাত্য দর্শনে সাধারণত ইন্দ্ৰিয় বলতে ভারতীয় দর্শনের পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়কেই বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বকই হলো ইন্দ্রিয়। মন বা আত্মাকে পাশ্চাত্য দর্শনে কখনই স্বতন্ত্র ইন্দ্ৰিয় বলে মনে করা হয়নি। উল্লেখ্য যে, পাশ্চাত্য দর্শনে ইন্দ্রিয় বলতে যে পঞ্চেন্দ্রিয়কে বুঝানো হয়েছে চার্বাক দর্শনেই এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়।
পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে ইন্দ্রিয় সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা অনুসারে জ্ঞানেন্দ্রিয় হলো পাঁচটি। হিউমও ইন্দ্রিয়ছাপের উপায় হিসেবে পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়কেই স্বীকার করেছেন বলে মনে করা যায়। ইন্দ্রিয়ের সংখ্যার ক্ষেত্রে চার্বাক ও হিউমের মধ্যে মিল পরিলক্ষিত হয়। অবশ্য হিউম সত্যিকার অর্থেই জ্ঞানের উৎস হিসেবে পঞ্চেন্দ্রিয়কে ধরে নিয়েছিলেন কি না এ ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ থাকতে পারে। কারণ, তিনি প্রত্যক্ষণ কীসের মাধ্যমে হয় তা কোথাও স্পষ্ট করে বলেননি। যেহেতু ইন্দ্ৰিয়ছাপই হিউমের প্রত্যক্ষণের প্রথম স্তর সেহেতু ইন্দ্রিয়ছাপের প্রকৃতি সম্পর্কে হিউম যা বলেছেন তা থেকে এর উৎস নির্ণয় করাই উত্তম পথ বলে মনে হয়।
ইন্দ্রিয়ছাপের পরিচয় দিতে গিয়ে হিউম কিছু সমস্যার সৃষ্টি করেছেন। Treatise গ্রন্থে (১ম পৃষ্ঠায়) তিনি বলেছেন, “মনে প্রথম আগত সংবেদন, অতিরাগ (passion) ও আবেগকে এই পর্যায়ে ফেলা যায়।” Enquiry গ্রন্থে তিনি বলেন, “ইন্দ্ৰিয়ছাপ বলতে আমি বুঝি আমাদের সব সজীবতর প্রত্যক্ষণ, যখন আমরা শুনি, দেখি, অনুভব করি, ভালবাসি, ঘৃণা করি, বা ইচ্ছা করি।” এখানে প্রথম বর্ণনায় সংবেদন ছাড়াও ‘অতিরাগ’ ও ‘আবেগকে ‘ অন্তর্ভুক্ত করায় এবং দ্বিতীয় বর্ণনায় শুনি, দেখি, অনুভব করি ছাড়াও ‘ভালবাসি’, ‘ঘৃণা করি’ বা ‘ইচ্ছা করি’ শব্দগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করায় জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ অতিরাগ, আবেগ, ভালবাসা, ঘৃণা করা, ইচ্ছা করা ইত্যাদি পঞ্চেন্দ্রিয়জাত কি না এ নিয়ে সন্দেহ থাকে। এছাড়া, হিউম অতিরাগ ও আবেগ শব্দ দুটিকে ‘ও’ (and) দ্বারা যুক্ত করায় এগুলোকে সংবেদনের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছেন বলে মনে হয় না। মনে হয় এগুলো সংবেদন থেকে স্বতন্ত্র। কিন্তু এক্ষেত্রে যে বিষয়টি স্মরণ রাখা দরকার তা হলো, মনোবিজ্ঞানে সংবেদন বলতে পঞ্চইন্দ্রিয়লব্ধ চেতনাকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ সংবেদনের মধ্যে প্রতিক্রিয়াও অন্তর্ভুক্ত। এবং মাথাঘোরাও মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এক প্রকার সংবেদন সুতরাং বলা যায়, হিউম সংবেদন বুঝাতেই অতিরাগ, আবেগ, ভালবাসা, ঘৃণা করা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ‘সংবেদন’ শব্দটি ব্যবহার করার পর অন্য শব্দগুলো না ব্যবহার করলেও চলে। সুতরাং চার্বাকদের বাহ্য প্রত্যক্ষ যেমন পঞ্চইন্দ্রিয়জাত হিউমের ইন্দ্রিয়ছাপও তেমনি পঞ্চইন্দ্রিয়জাত। এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ খুব কম।
হিউমের জ্ঞানবিদ্যায় ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতির কোনো ব্যাখ্যা নাই যা চার্বাক দর্শনে পাওয়া যায়। তবে, চার্বাকদের ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতি সম্পর্কিত ব্যাখ্যার সাথে হিউমের ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতির সাদৃশ্য রয়েছে। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলো যে জড় দ্রব্যে গঠিত এই বিষয়ে উভয় মতবাদে সাদৃশ্য আছে। অবশ্য জড় দ্রব্য বলতে চার্বাকগণ যেমন ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ইত্যাদি চতুর্ভূতকে বুঝিয়েছেন হিউম এরকম কোনো চতুর্ভূতকে বুঝান কি না তা স্পষ্ট করে কোথাও বলেননি।
সুতরাং বলা যায়, বাহ্য প্রত্যক্ষের মাধ্যম অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতি ও সংখ্যা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে চার্বাক দর্শনে যেমন বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করা হয়েছে হিউমের দর্শনে সেরূপ আলোচনা করা হয়নি। হিউম কেবল ইন্দ্রিয়ছাপের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এগুলোর উৎস, তাঁর মতে, অজ্ঞাত। চার্বাকদের আলোচনার বিশ্লেষণধর্মিতা ও পূর্ণাঙ্গতার পেছনে যে কারণটি কাজ করেছে তা হলো, চার্বাক দর্শনে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনার পাশাপাশি গুরুত্বসহ তত্ত্ববিদ্যার আলোচনাও করা হয়েছে। প্রত্যক্ষবাদী জ্ঞানবিদ্যার আলোকে অতীন্দ্রিয় তত্ত্ববিদ্যাকে খণ্ডন করাই ছিল চার্বাকদের জ্ঞানবিদ্যার আলোচনার অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু হিউমের আলোচনা ছিল বিশুদ্ধ জ্ঞানতাত্ত্বিক। তাঁর দর্শনে পরমতত্ত্বের আলোচনা অনুপস্থিত। এ কারণেই চার্বাকদেরকে স্পষ্টতই বিশুদ্ধ অর্থে জড়বাদী এবং সম্ভবত জড়বাদের প্রবক্তা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। কিন্তু হিউমকে সুস্পষ্টভাবে বিশুদ্ধ জড়বাদী বা ভাববাদী বলা কষ্টসাধ্য।
প্রত্যক্ষের প্রকারভেদ নিয়েও ভারতীয় দর্শনে তিনটি দার্শনিক মতের উদ্ভব হয়েছে। একদল দার্শনিকের মতে, নির্বিকল্পই প্রত্যক্ষের একমাত্র ধরন। দ্বিতীয় মত অনুসারে সবিকল্প ও নির্বিকল্প এই দুই প্রকার প্রত্যক্ষ স্বীকৃত হয়েছে। তৃতীয় মত অনুসারে কেবল সবিকল্প প্রত্যক্ষ স্বীকার করা হয়েছে। চার্বাকগণ তৃতীয় মতের প্রতিনিধি। সম্ভবত তাঁরাই এই মতের প্রবক্তা। তাঁরা সবিকল্প প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রত্যক্ষ বলে মনে করেন এবং নির্বিকল্প প্রত্যক্ষের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। নির্বিকল্প প্রত্যক্ষে বস্তুর জ্ঞান হয়, কিন্তু বস্তুর প্রকার ও নাম সম্বন্ধে জ্ঞান হয় না। অর্থাৎ বস্তুর প্রকৃতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান হয় না। কিন্তু সবিকল্প প্রত্যক্ষে বস্তুর প্রকৃতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান হয়।
পাশ্চাত্য দর্শনে ভারতীয় দর্শনের মতো বিভিন্ন প্রকার প্রত্যক্ষের কথা বলা হয়নি। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যায় প্রত্যক্ষ দ্বারা বস্তুর প্রকৃতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান পাওয়া যায় মনে করা হয়েছে। এদিক থেকে বিচার করলে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার স্বীকৃত সকল প্ৰত্যক্ষ জ্ঞানকে সবিকল্প প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলে মনে করা যায়। সুতরাং বলা যায়, ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যায় যাকে সবিকল্প প্রত্যক্ষ বলা হয়েছে হিউম প্রত্যক্ষ বলতে অনুরূপ প্রত্যক্ষকেই বুঝিয়েছেন। যেহেতু চার্বাক দার্শনিকগণ শুধু সবিকল্প প্রত্যক্ষকে স্বীকার করেছেন এবং সম্ভবত তাঁরাই এই মতের প্রবক্তা সেহেতু চার্বাকগণ প্রত্যক্ষের ধরন সম্পর্কে যে ধারণার প্রবর্তন করে গেছেন হিউমের দর্শনে, এমনকি পাশ্চাত্য দর্শনে, প্রত্যক্ষ বলতে সে ধরনের প্রত্যক্ষকেই বুঝানো হয়েছে। প্রত্যক্ষের ধরন সম্পর্কিত ধারণার ক্ষেত্রেও পাশ্চাত্য দর্শন মনোবিজ্ঞান দ্বারা প্রভাবিত। অথচ মনোবিজ্ঞানের উন্নতির বহু পূর্বেই ভারতে চার্বাকগণ প্রত্যক্ষের ধরন সম্পর্কিত ধারণা প্রবর্তন করে গেছেন।
সংক্ষিপ্তসার
উপরের আলোচনার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্ব প্রসঙ্গে চার্বাক ও হিউমের দর্শনের মধ্যে যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলো পাওয়া যায় তা সংক্ষেপে নিম্নরূপ :
সাদৃশ্য : (১) চার্বাকগণ ও হিউম উভয়ই জ্ঞানবিদ্যাগত দিক থেকে প্রত্যক্ষবাদী তথা অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক। কারণ, তাঁরা উভয়েই প্রত্যক্ষকে জ্ঞানোৎপত্তির একমাত্র উপায় বলে নির্দেশ করেন।
(২) উভয় দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক বিদ্যমান। চার্বাক দর্শনের সাথে যেমন প্রাচীন ভারতীয় রসায়নবিজ্ঞান তথা আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয় তেমনি হিউমের দর্শনের সাথেও সতেরো শতকের নিউটনীয় পর্যবেক্ষণমূলক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান।
(৩) চার্বাক ও হিউম উভয়েই প্রত্যক্ষণকে প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন : বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ বা মানসিক। উভয়ের মতেই অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষ বাহ্য প্রত্যক্ষ নির্ভর এবং সে কারণেই সময়ের দিক থেকে দ্বিতীয়টি প্রথমটির পরবর্তী।
(৪) চার্বাক ও হিউম উভয়েই অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষকে বাহ্য প্রত্যক্ষ নির্ভর হিসেবে বিবেচনা করে কল্পনার সীমা নির্দেশ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ যার বাহ্য প্রত্যক্ষ নাই তার কল্পনাও করা যায় না।
(৫) চার্বাক ও হিউম উভয়ে সার্বিক জ্ঞানের সম্ভাবনাকে নাকচ করেছেন। কারণ, কোনো সঙ্গতিপূর্ণ অভিজ্ঞতাবাদীই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সার্বিক জ্ঞানে পৌঁছাতে পারেন না।
(৬) চার্বাক ও হিউম উভয়ই প্রত্যক্ষ বলতে সবিকল্প প্রত্যক্ষকে বুঝেছেন। অর্থাৎ যে প্রত্যক্ষে বস্তুর পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান হয় সে প্রত্যক্ষের কথা বলেছেন। ভারতীয় দর্শনের নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ বলে অন্য একটি প্রত্যক্ষ আছে। চার্বাক ও হিউম সে প্রত্যক্ষের কথা বলেননি।
বৈসাদৃশ্য : (১) সাতশত খ্রিস্টপূর্ব অব্দেরও পূর্ববর্তী সময়ের দর্শন হিসেবে চার্বাক দর্শন ভারতীয় দর্শনের বিকাশের আদি পর্বের। তাই এ দর্শনের উপর পূর্ববর্তী দর্শনের প্রভাব পড়ার সুযোগ ছিল না। বরং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা থেকে চার্বাক দর্শন তার উপাদান সংগ্রহ করেছে। চার্বাক জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। পক্ষান্তরে, হিউম আঠারো শতকের ব্রিটিশ দার্শনিক। তাঁর দর্শনের প্রেক্ষাপটে রয়েছে প্রায় দুই হাজার বছরের দর্শনের ইতিহাস। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর জ্ঞানবিদ্যার উপর তাঁর পূর্ববর্তী দর্শনের প্রভাব পড়েছে।
(২) চার্বাক জ্ঞানবিদ্যা চার্বাক জড়বাদী তত্ত্ববিদ্যার ভিত্তি হিসেবে গড়ে ওঠেছে। এর প্রেক্ষাপট ছিল বৈদিক শ্রেণিবৈষম্যমূলক সমাজের শ্রেণিশোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। অর্থাৎ এই জ্ঞানবিদ্যা যতটা না একাডেমিক তার চেয়েও বেশি প্রায়োগিক বা বাস্তবতাভিত্তিক, লোকায়ত। পক্ষান্তরে, রেনেসাঁ প্রভাবিত ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যার সঙ্গতিপূর্ণ পরিণতিই হলো হিউমের জ্ঞানবিদ্যা। এর প্রেক্ষাপট যতটা না প্রায়োগিক বা বাস্তবতাপ্রসূত তার চেয়ে বেশি একাডেমিক।
(৩) চার্বাক জ্ঞানবিদ্যায় বাহ্য ও অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষের পার্থক্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। এছাড়া, চার্বাকদের স্বীকৃত বাহ্য ও অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষের আর কোনো শ্রেণি বিভাগ করা হয়নি। এ বিষয়ে চার্বাকদের ব্যাখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। ফলে অভিজ্ঞতাবাদী চার্বাকদের জ্ঞানোৎপত্তির পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। পক্ষান্তরে, হিউম ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার মধ্যে স্পষ্টভাবে পার্থক্য করে বলেছেন যে, এদের পার্থক্য মাত্রাগত ফলে হিউমের জ্ঞানবিদ্যায় জ্ঞানোৎপত্তির পদ্ধতি বা জ্ঞানোৎপত্তির ক্ষেত্রে মনের ক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর সম্পর্কিত জ্ঞান পাওয়া যায়। হিউম আসলে মনের ক্রিয়ার বিজ্ঞান নির্মাণ করেছেন যা চার্বাক মতবাদে এতো স্পষ্টভাবে উপস্থিত নয়। চার্বাক ও হিউমের প্রত্যক্ষণের বিভাজন ছকের সাহায্যে দেখানো গেল।
চার্বাক ও হিউমের প্রত্যক্ষণের বিভাজন ছক
(৪) চার্বাক জ্ঞানবিদ্যায় বলা হয়েছে, বাহ্য প্রত্যক্ষের উপর অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষ নির্ভরশীল। ফলে, এতেও কল্পনার সীমা নির্দেশিত হয়েছে। কিন্তু এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। পক্ষান্তরে হিউমের জ্ঞানবিদ্যায় যার ইন্দ্রিয়ছাপ নাই তাঁর ধারণা থাকতে পারে না, এই নীতি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে কল্পনার সীমা নির্দেশ করা হয়েছে। এর যথাযথ ব্যাখ্যাও হিউমের দর্শনে পাওয়া যায়। হিউম মূলত এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে অভিজ্ঞতাপূর্ব সকল প্রকার ধারণার জ্ঞানকে অস্বীকার করে দেকার্তের সহজাত ধালণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে প্রয়াসী হয়েছেন। ঐতিহাসিকভাবে সম্ভবত এটা হিউমের দায়িত্ব ছিল। কিন্তু চার্বাকদের এ রকম দায়িত্ব ছিল না।
(৫) চার্বাক জ্ঞানবিদ্যায় ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে, অর্থাৎ অতীত ও ভবিষ্যৎ পর্যবেক্ষণযোগ্য নয় বলে সার্বিক জ্ঞানকে অসম্ভব বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে, হিউমের দর্শনে কার্যকারণের আবশ্যিকতা তথা আরোহানুমানের ভিত্তি কার্যকারণকে খণ্ডন করার মাধ্যমে সার্বিক জ্ঞানকে অসম্ভব বলা হয়েছে। সুতরাং সার্বিক জ্ঞান অস্বীকৃতির ব্যাপারে হিউমের ব্যাখ্যা চার্বাকদের ব্যাখ্যার চেয়ে অধিকতর দার্শনিকসূলভ। এর পেছনেও রয়েছে দর্শনের ইতিহাসের দীর্ঘ প্রভাব।
(৬) বাহ্য প্রত্যক্ষের মাধ্যম বা ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতি ও সংখ্যা প্রভৃতি বিষয় প্রসঙ্গে চার্বাকদের ব্যাখ্যা স্পষ্ট ও পর্যাপ্ত। তাঁরা ইন্দ্রিয় বলতে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়কে বুঝিয়েছেন। চারিভূত বা চার প্রকার পদার্থ হলো এর উপাদান। পক্ষান্তরে, হিউমের জ্ঞানবিদ্যায় ইন্দ্রিয়ছাপের মাধ্যম বা ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতি ও সংখ্যা প্রভৃতি বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নাই। হিউম ইন্দ্রিয়ছাপের ব্যাখ্যা দিয়েই আলোচনা শুরু করেছেন। এর পেছনে অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতি ও সংখ্যা সম্পর্কে তিনি আলোচনায় যান নি। এ থেকে মনে হয়, তিনি পাশ্চাত্য দর্শনে ও মনোবিদ্যায় ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতি ও সংখ্যা সম্পর্কিত প্রচলিত মতকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন।
(৭) চার্বাক দর্শন জড়বাদী। তাই, তাঁদের জ্ঞানবিদ্যা জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত। পক্ষান্তরে, হিউম আদি সত্তা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু না বলায় তাঁর দর্শন জড়বাদী না ভাববাদী তা সুস্পষ্টভাবে বলা কষ্টসাধ্য। তিনি মূলত বিশুদ্ধ জ্ঞানবিদ্যাগত আলোচনার উপরই অধিক মনোযোগ দিয়েছেন। তত্ত্ববিদ্যাগত মত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা করেননি।
(৮) চার্বাক জ্ঞানবিদ্যায় সহজাত ধারণা সম্পর্কিত আলোচনার অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। অবশ্য সে সময় সহজাত ধারণার আলোচনার প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হয়নি। পক্ষান্তরে, হিউম সহজাত ধারণা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি কার্তেসীয় সহজাত ধারণাকে খণ্ডন করে বলেছেন যে, একমাত্র ইন্দ্ৰিয়ছাপকেই মৌলিকতার কারণে সহজাত বলা যায়। দেকার্তের মতবাদকে খণ্ডন করে নিজ মতবাদের ভিত্তি মজবুত করার উদ্দেশ্যে হিউমের পক্ষে সহজাত ধারণার আলোচনার প্রয়োজন ছিল।
চার্বাক ও হিউমের জ্ঞানবিদ্যার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বিচার করে সাদৃশ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, আঠারো শতকে হিউমের জ্ঞানবিদ্যায় যে চরম অভিজ্ঞতাবাদ, কল্পনার সীমারেখা নির্দেশ, এবং সার্বিক জ্ঞানের অসম্ভাব্যতার কথা ঘোষণা করা হয়েছে সাতশত খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্ববর্তী চার্বাক দার্শনিকগণ এসব ধারণার প্রবর্তন করে গেছেন। উভয় মতের মধ্যে যেসব বৈসাদৃশ্য দেখা যায় তা থেকে এটাই নির্দেশিত হয় যে, এই পার্থক্য প্রধানত ব্যাখ্যার পার্থক্য। চার্বাকগণ এসব ধারণা প্রবর্তন করে গেছেন, কিন্তু স্পষ্টভাবে এগুলোর ব্যাখ্যা দেননি। হিউমের জ্ঞানবিদ্যায় এসব ধারণার বিকাশ ঘটেছে এবং এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদানের প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। এর কারণ হিসেবে হিউমের দর্শনের উপর জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির সুদীর্ঘ প্রভাবের কথা বলা যায়।
অনুমান খণ্ডন প্রসঙ্গে
প্রথম অধ্যায়ে ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি যে, ভারতীয় দর্শনে চার্বাক ছাড়া অন্য সকল দার্শনিক সম্প্রদায়ই অনুমানকে স্বতন্ত্র প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করেছেন। ন্যায় জ্ঞানতত্ত্বে অনুমান প্রসঙ্গে বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়েছে। অনুমানের প্রকার ও অবয়ব নিয়ে ভারতীয় দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবুও এ ব্যাপারে চার্বাক ভিন্ন আর সকলেই একমত যে, অনুমান একটি স্বতন্ত্র প্রমাণ বা বৈধজ্ঞানের উপায়। এছাড়া, যাঁরা অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন তাঁরা সকলেই এই ব্যাপারে একমত যে, সাধ্য পদ ও মধ্য পদের সার্বিক ও অনিবার্য সংযোগ বা ব্যাপ্তি সম্পর্কই অনুমানের ভিত্তি। কিন্তু তাঁদের মতে, ব্যাপ্তি সম্পর্কের জ্ঞান সম্ভব নয়। তাই অনুমান সম্ভব নয়। ন্যায় দার্শনিকদের মতে, হেতুর সাধ্যের সাথে নিয়ত সম্পর্ক প্রত্যক্ষিত হয়। কিন্তু চার্বাকদের মতে, হেতুর সাথে সাধ্যের সম্পর্ক বিশেষ ঘটনার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষিত হতে পারে। এ দুয়ের মধ্যে কোনো সার্বিক এবং অনিবার্য সম্পর্ক প্রত্যক্ষিত হয় না। তাই চার্বাকগণ ব্যাপ্তি জ্ঞানের অসম্ভাব্যতা দেখিয়ে অনুমান খণ্ডন করেন।
চার্বাক দার্শনিকগণ ব্যাপ্তি জ্ঞানের অসম্ভাব্যতা প্রমাণ করতে গিয়ে দেখিয়েছেন যে, প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ, উপমান, প্রভৃতি কোনো প্রমাণ দ্বারাই ব্যাপ্তি জ্ঞান লাভ করা যায় না। কারণ, তাঁদের মতে, ইন্দ্রিয়ের অতীত ও ভবিষ্যৎ প্রত্যক্ষের ক্ষমতা নাই। প্রত্যক্ষ দ্বারা ব্যাপ্তি জ্ঞান লাভ করা যায় না। অনুমান দ্বারা ব্যাপ্তি জ্ঞান পেতে গেলেও অনবস্থা বা সীমাহীন অনুক্রম ঘটে। কারণ, ব্যাপ্তিকে জানার জন্য যে অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয় সে অনুমানও আবার ব্যাপ্তি নির্ভর। তাই অনুমান দ্বারাও ব্যাপ্তি জ্ঞান লাভ করা যায় না। শব্দ দ্বারাও ব্যাপ্তি জ্ঞানলাভ করা যায় না। কারণ, বৈশেষিকগণ শব্দকেও অনুমান নির্ভর বলে প্রমাণ করেছেন। সুতরাং শব্দ দ্বারা ব্যাপ্তি জ্ঞান পেতে গেলে আবার অনুমান নির্ভর হতে হয়, যাতে অনবস্থা দোষ বা সীমাহীন অনুক্রম দোষ ঘটে। উপমান জ্ঞান বচন ও তার অর্থের নিয়ত সংযোগের জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। এই নিয়ত সংযোগের জ্ঞানই ব্যাপ্তি জ্ঞান। সুতরাং কোনো প্রমাণ দ্বারাই ব্যাপ্তি জ্ঞান সম্ভব নয়। আর ব্যাপ্তি জ্ঞানের অসম্ভাব্যতার কারণে চার্বাকগণ অনুমানকে অসম্ভব বলে মনে করেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে অনুমান প্রমাণের বৈধতা খণ্ডন প্রসঙ্গে আলোচনায় আমরা দেখেছি, চার্বাক দার্শনিকগণ আরোহাত্মক ও অবরোহাত্মক উভয় প্রকার অনুমান খণ্ডন করেছেন। অবরোহাত্মক অনুমানকে তাঁরা চক্রক দোষে দুষ্ট মনে করেন। কারণ, অবরোহানুমানের সিদ্ধান্তে যা প্রমাণ করা হয় আশ্রয় বাক্যে তা-ই স্বীকার করা হয়। এটাই চক্রক অনুপপত্তি। অন্যদিকে, ব্যাপ্তির অসম্ভাব্যতার কারণে আরোহাত্মক অনুমান সম্ভব নয়।
আধুনিক যুগের পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিউমের সাথে চার্বাকদের আরোহানুমান খণ্ডনের মিল পরিলক্ষিত হয়। হিউম সার্বিক জ্ঞানের অসম্ভাব্যতা দেখাতে গিয়ে এর ভিত্তি আরোহানুমান খণ্ডন করেন। তাঁর মতে, আমরা যে সার্বিক জ্ঞানের কথা বলি তার ভিত্তি হলো বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্তের নিরীক্ষণ। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানগুলো বিশেষ দৃষ্টান্ত নিরীক্ষণের মাধ্যমেই কোনো বিষয় সম্পর্কে সাধারণ নিয়ম প্রণয়ন করে। অর্থাৎ সাধারণ নিয়ম প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানগুলোর ভিত্তি হলো আরোহ। আর হিউমের মতে, আরোহের ভিত্তি হলো কার্যকারণের অনিবার্য বা আবশ্যিক সম্পর্ক। তবে তিনি কার্যকারণ সম্পর্কের আবশ্যিকতাকে পূর্বতঃসিদ্ধ বা বুদ্ধিগ্রাহ্য এবং অভিজ্ঞতালব্ধ বা প্রত্যক্ষণযোগ্য কোনোটাই নয় বলে অস্বীকার করেন।[১] তাঁর মতে, বিশেষ দৃষ্টান্তে কার্য ও কারণের সম্পর্ক দৃষ্ট হয়। কিন্তু এ থেকে বলা যায় না যে, সর্বদা সকল দৃষ্টান্তে এরূপ সম্পর্ক থাকবে। সুতরাং বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্তের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সার্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে সাধিত আরোহানুমান বৈধ নয়।
এই আলোচনা থেকে দেখা যায়, চার্বাকদের মতো হিউমও আরোহানুমানের বৈধতাকে খণ্ডন করে অনুমানলব্ধ জ্ঞানকে অস্বীকার করেন। তবে, চার্বাকদের আরোহানুমান খণ্ডনের ভিত্তি হলো ব্যাপ্তি সম্পর্ক অস্বীকার করা। অন্যদিকে হিউমের আরোহানুমান খণ্ডনের ভিত্তি হলো কার্যকারণের অনিবার্য সম্পর্ক অস্বীকার করা। ভারতীয় দার্শনিকগণ অনুমানের ভিত্তি হিসেবে ব্যাপ্তি সম্পর্কের ধারণার কথা বলেছেন। এরকম ধারণার আলোচনা পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যায় পাওয়া যায় না। অন্যদিকে, হিউমের জ্ঞানবিদ্যায় আরোহানুমানের ভিত্তি হিসেবে কার্যকারণকে নির্দেশ করা হলেও চার্বাক তথা ভারতীয় দর্শনে কার্যকারণ সম্পর্ককে আরোহনুমানের ভিত্তি বলে মনে করা হয়নি। তবে, ব্যাপ্তি সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করলে এর সাথে কার্যকারণ সম্পর্কের ধারণার মিল দেখা যায়।
সাধ্য ও মধ্য পদের মধ্যে সার্বিক এবং অনিবার্য সম্পর্ককেই ভারতীয় দর্শনে ব্যাপ্তি সম্পর্ক বলা হয়। যেমন, ধূম ও অগ্নির সম্পর্ক। ভারতীয় দার্শনিকদের মতে, যেখানে ধূম সেখানেই অগ্নি, এটাই ব্যাপ্তির মূল কথা। কিন্তু কীভাবে এই সার্বিক সম্পর্কের জ্ঞান পাওয়া যাবে এটাই চার্বাকদের সমস্যা। আবার কার্যকারণের দিক থেকে বিচার করলে ধূম ও অগ্নির মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক বর্তমান। ধূম হলো অগ্নির কারণ। কার্যকারণের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ধূম ও অগ্নি অনিবার্য বা আবশ্যিক সম্পর্কে সম্পর্কিত। কিন্তু বিশেষ ঘটনার ক্ষেত্রে এই সম্পর্ক বা সংযোগ লক্ষিত হলেও সকল ঘটনায় তা কীভাবে সম্ভব হবে এটাই হিউমের সমস্যা। এই সমস্যাকেই হিউম আরোহনুমানের সমস্যা বলেছেন। তাই চাৰ্বাক দার্শনিকগণ ব্যাপ্তির যে সমস্যার কথা বলেছেন এবং হিউম আরোহানুমানের সমস্যা বলতে যা বুঝিয়েছেন তার মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। বরং হিউমের আরোহানুমানের সমস্যা চার্বাক নির্দেশিত ব্যাপ্তি জ্ঞান সম্পর্কিত সমস্যারই যেন নতুন উপস্থাপন। সুতরাং এদিক থেকে বিচার করে ব্যাপ্তি ও কার্যকারণ সম্পর্কের অন্তর্নিহিত মূল ধারণায় তেমন কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। এতদ্সত্ত্বেও একথা ঠিক যে, ভারতীয় দার্শনিকগণ ব্যাপ্তি ও কার্যকারণকে অভিন্ন বলে মনে করেছেন কি না তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। একইভাবে পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ কার্যকারণ সম্পর্ক ও ব্যাপ্তিসম্পর্ককে অভিন্ন মনে করেছেন কি না তাও স্পষ্টভাবে বলা যায় না।
উল্লেখ্য যে, হিউম সার্বিক জ্ঞানকে অস্বীকার করতে গিয়েই আরোহানুমান খণ্ডন করেছেন। তিনি চার্বাকদের মতো জ্ঞানের স্বতন্ত্র উপায় হিসেবে অনুমান খণ্ডনের বিষয়টি নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করেন নি। অন্যদিকে, চার্বাক দার্শনিকগণ স্বতন্ত্র প্রমাণ হিসেবে অনুমানের বৈধতা খণ্ডনের জন্য অনুমান খণ্ডন নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করেছেন। সম্ভবত এ কারণেই চার্বাক দার্শনিকগণ আরোহ ও অবরোহ উভয় প্রকার অনুমানের বিপক্ষে স্বতন্ত্রভাবে যুক্তি দিয়েছেন এবং উভয় প্রকার অনুমানকে খণ্ডন করেছেন। কিন্তু হিউম অবরোহানুমান নিয়ে এতো স্পষ্ট ও বিস্তারিত আলোচনায় মনোযোগ দেন নি। এর কারণ সম্ভবত ভারতীয় ও পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসের মধ্যে নিহিত।
ভারতীয় ও পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে এটা দেখা যায়, চার্বাক ব্যতীত সবগুলো ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় একাধারে প্রত্যক্ষ ও অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করায় তাঁদেরকে বিশুদ্ধ বুদ্ধিবাদী বা বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতাবাদী বলা যায় না। সুতরাং চার্বাকগণই ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে প্রথম চরম অভিজ্ঞতাবাদী। চার্বাক, দার্শনিকদের প্রত্যক্ষবাদী মত প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বুদ্ধিবাদী প্ৰমাণতত্ত্ব তথা অনুমান-প্রমাণ খণ্ডন করা আবশ্যক ছিল। এছাড়া, একই কারণে অনুমানের মতো শব্দ-প্রমাণকেও খণ্ডন করা তাঁদের দায়িত্ব ছিল, যা তাঁরা করেছেন। অন্যদিকে, পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যায় বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের দুটি পরস্পর বিরোধী স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ধারা হিউমের পূর্ব থেকেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। হিউম ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদের একজন প্রতিনিধি এবং জন লক ও জর্জ বার্কলের অভিজ্ঞতাবাদের উত্তরসূরি। জন লকই ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদের গোড়াপত্তন করেন। তাই তিনি পূর্ববর্তী কার্তেসীয় বুদ্ধিবাদের মূল ভিত্তি সহজাত ধারণা খণ্ডনে প্রয়াসী ছিলেন। সুতরাং হিউমের পক্ষে বুদ্ধিবাদ তথা অনুমান প্রমাণকে স্বতন্ত্রভাবে খণ্ডনের প্রয়োজন ছিল না, যা চার্বাকদের জন্য ঐতিহাসিক কারণেই আবশ্যক ছিল।
সংক্ষিপ্তসার
অনুমান খণ্ডন প্রসঙ্গে চার্বাক ও হিউমের আলোচনার তুলনা থেকে তাঁদের মধ্যে নিম্নোক্ত সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।
সাদৃশ্য : চার্বাকগণ ও হিউম আরোহ অনুমানের প্রামাণ্য খণ্ডন করেছেন। অর্থাৎ বৈধজ্ঞানের উপায় হিসেবে তাঁরা উভয়ই আরোহানুমানের সম্ভাবনা খণ্ডন করেছেন। তাঁদের মতে, যে ভিত্তির উপর নির্ভর করে আরোহানুমান সম্ভব হয় সে ভিত্তি যথার্থ নয়। চার্বাকদের মতে, ব্যাপ্তি জ্ঞানই আরোহের ভিত্তি। কিন্তু ব্যাপ্তি জ্ঞানকে বৈধ বলে প্রমাণ করা যায় না। হিউমের মতে, কার্যকারণ সম্পর্কের ধারণা আরোহানুমানের ভিত্তি। কিন্তু কার্যকারণ সম্পর্কের আবশ্যিকতাও প্রমাণ করা যায় না।
বৈসাদৃশ্য : (১) চার্বাক দার্শনিকগণ ব্যাপ্তি জ্ঞানকে আরোহানুমানের ভিত্তি হিসেবে ধরে নিয়েছেন। ব্যাপ্তি হলো সাধ্য ও হেতুপদের সার্বিক এবং অনিবার্য সম্পর্ক। তাঁরা অনুমানকে খণ্ডন করতে গিয়ে বিভিন্ন যুক্তির সাহায্যে ব্যাপ্তির ধারণাকে খণ্ডন করেছেন। তাঁদের মতে, প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ ইত্যাদি কোনো প্রকার প্রমাণ দ্বারাই ব্যাপ্তি জ্ঞান পাওয়া যায় না। পক্ষান্তরে, হিউম কার্যকারণ সম্পর্ককে আরোহানুমানের ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি আরোহানুমান খণ্ডনের জন্য কার্যকারণ সম্পর্ক খণ্ডনের পক্ষে যুক্তি প্রদান করেন। তাঁর মতে, কার্যকারণের আবশ্যিকতার জ্ঞান বুদ্ধি বা অভিজ্ঞতা কোনোটি দ্বারাই পাওয়া যায় না।
(২) চার্বাক ছাড়া আর সকল ভারতীয় দার্শনিকই অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাই চার্বাকদের অনুমান খণ্ডন একটি স্বতন্ত্র এবং একক তথা ভারতীয় দর্শনে বিপ্লবাত্মক প্রচেষ্টা। সম্ভবত এ কারণেই চার্বাক দর্শনে অনুমান খণ্ডনের বিষয়টি স্বতন্ত্র ও বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। তাঁরা শুধু আরোহানুমান নয়, অবরোহানুমানকে চক্রক দোষে দুষ্ট বলে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। ভারতীয় দর্শনে পাশ্চাত্য দর্শনের মতো বুদ্ধিবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদী সম্প্রদায় আলাদাভাবে চিহ্নিত নয়। তাই চরম অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে ঐতিহাসিক কারণেই চার্বাকদের অনুমান প্রমাণকে স্বতন্ত্রভাবে খণ্ডন করতে হয়েছে।
পক্ষান্তরে, হিউমের জ্ঞানতত্ত্বে সার্বিক জ্ঞান খণ্ডন করতে গিয়ে এর ভিত্তি হিসেবে অনুমান খণ্ডনের বিষয়টি এসেছে। তাই এই আলোচনা স্বতন্ত্র ও বিস্তৃত রূপ পায়নি। এমনকি হিউম শুধু আরোহানুমানের সমস্যাকেই তুলে ধরেছেন। অবরোহানুমান সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেননি। এর কারণ সম্ভবত এই যে, পাশ্চাত্য দর্শনে বুদ্ধিবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক গোষ্ঠী হিউমের বহু আগে থেকেই চিহ্নিত, এবং হিউম মূলত অভিজ্ঞতাবাদী দলেরই উত্তরসূরি। সুতরাং তাঁর বিপ্লবাত্মক ভূমিকা অভিজ্ঞতাবাদের সঙ্গতিপূর্ণ পরিণতি দানের ক্ষেত্রে, চার্বাকদের মতো অভিজ্ঞতাবাদের ভিত্তি রচনার ক্ষেত্রে নয়।
উপরের আলোচনা থেকে একথা বলা যায়, হিউম আঠারো শতকে আরোহ অনুমানকে খণ্ডন করেছেন। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব বহু শতক পূর্বে ভারতীয় দার্শনিক চার্বাক সম্প্রদায়ই অনুমান খণ্ডনের ধারণার প্রবর্তন করেন। চার্বাকগণ আরোহ ও অবরোহ উভয় প্রকার অনুমানকে খণ্ডন করেন। পাশ্চাত্য দর্শনে, বহুযুগ পরে, জন স্টুয়ার্ট মিলও অবরোহ অনুমানের বিরুদ্ধে একইরূপ যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাই একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনে অনুমান খণ্ডনের যে ধারণা আছে চার্বাক দার্শনিকগণ এর প্রবর্তক।
যে যুক্তিতে হিউম অনুমান খণ্ডন করেছেন চার্বাকদের ব্যবহৃত যুক্তির সাথে এর মৌলিক কোনো পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। কারণ, ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যায় আরোহের ভিত্তি ব্যাপ্তি সম্পর্ক এবং পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যায়, বিশেষত হিউমের জ্ঞানবিদ্যায় আরোহের ভিত্তি কার্যকারণের আবশ্যিকতার সম্পর্ক। চার্বাকগণ যেভাবে ব্যাপ্তি সম্পর্কে জ্ঞানের অসম্ভাব্যতা দেখিয়ে আরোহানুমান খণ্ডন করেছেন ঠিক তেমনি হিউমও কার্য কারণের আবশ্যিক সম্পর্কের জ্ঞানের অসম্ভাব্যতা দেখিয়ে আরোহানুমান খণ্ডন করেছেন। সুতরাং হিউম যে পদ্ধতিতে অনুমান খণ্ডন করেছেন চার্বাক দার্শনিকরা সে পদ্ধতির প্রবর্তনকারী। ব্যাপ্তি ও কার্যকারণের আবশ্যিক সম্পর্কের মধ্যে যদি কোনো পার্থক্য না থাকে তবে একথাও বলা যায় যে, পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্বে আরোহানুমানের ভিত্তি হিসেবে যে ধারণাকে গ্রহণ করা হয়েছে ভারতীয় চার্বাক দার্শনিকগণই এর ভিত্তি স্থাপন করেন। এছাড়া, দর্শনের ইতিহাসে আরোহানুমান ও অবরোহানুমান খণ্ডনের ধারণা, খণ্ডন পদ্ধতি এবং এর জন্য ব্যবহৃত যেসব যুক্তি আছে সে সবের আদি প্রবর্তক হিসেবে চার্বাকদের নামই উল্লেখ করা যায়।
শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব খণ্ডন প্ৰসঙ্গে
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে আত্মার ধারণা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত ধারণা। দ্বিতীয় অধ্যায়ে চার্বাক জ্ঞানবিদ্যায় শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব খণ্ডন শীর্ষক আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, জ্ঞানসাধনার ইতিহাসে ঋগ্বেদ সংহিতায়ই সর্বপ্রথম আত্মা সম্পর্কিত আলোচনার সূত্রপাত হয়। পরবর্তীকালে উপনিষদ-পূর্ব বৈদিক সাহিত্য এবং গীতা ও উপনিষদে এই ধারণাটি বহুল আলোচিত হয়। এছাড়া জৈন, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা, সাংখ্য ও যোগ দর্শনেও আত্মার আলোচনা প্রাধান্য পায়। এসব আলোচনায় আত্মাকে একটি আধ্যাত্মিক দ্ৰব্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভারতীয় দর্শনে মন ও আত্মা দুটি স্বতন্ত্র ধারণা। অনেক ভারতীয় দার্শনিক মনকে একটি স্বতন্ত্র ইন্দ্রিয় হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু তাঁদের মতে, আত্মা জ্ঞাতা, ইন্দ্রিয় নয়। অনেকের মতে, আত্মা জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা। কিন্তু এটি যে একটি আধ্যাত্মিক দ্রব্য এ ব্যাপারে চার্বাক ও বৌদ্ধ দর্শন ব্যতীত আর সকলেই একমত।
ভারতীয় দার্শনিকদের মধ্যে চার্বাক ও বৌদ্ধ এই দুটি দার্শনিক সম্প্রদায়ই আধ্যাত্মিক দ্রব্য হিসেবে আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন। এদিক থেকে চার্বাক দর্শনই প্রাচীনতম ভারতীয় দর্শন যেখানে স্বতন্ত্র দ্রব্য হিসেবে আত্মার ধারণাকে প্রথম অস্বীকার করা হয়। পরবর্তীকালে গৌতম বুদ্ধও শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তবে বুদ্ধ ও চার্বাকদের আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকৃতির মধ্যে মূল পার্থক্য হলো, চার্বাকগণ আত্মাকে অস্বীকার করেছেন অভিজ্ঞতাবাদের ভিত্তিতে, কিন্তু বুদ্ধ করেছেন অনিত্যবাদ বা সর্বব্যাপক পরিবর্তনবাদের ভিত্তিতে। এছাড়া, চার্বাকগণ আত্মাকে দেহের উপবস্তু বলেছেন যাকে দেহাত্মবাদ বলা হয়। এ মতবাদ অনুসারে আত্মা দেহ থেকে স্বতন্ত্র কিছু নয় বরং দেহের সাথে অভিন্ন এবং ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এই চার প্রকার জড় দ্রব্য দ্বারা গঠিত। কিন্তু বৌদ্ধ দর্শনে আত্মা চেতনার প্রবাহ। এটি একটি মনোদৈহিক অবয়ব। বৌদ্ধ দার্শনিকগণ আত্মাকে পঞ্চস্কন্ধের সমষ্টি বলেন। পঞ্চস্কন্ধের একটি স্কন্ধ জড়ীয়, অন্য চারটি মানসিক। এই মতবাদ অনাত্মাবাদ নামে খ্যাত।
ভারতীয় দর্শনে আত্মা ও মন আলাদা হলেও পাশ্চাত্য দর্শনে আত্মা ও মন এই শব্দ দুটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। পাশ্চাত্য দর্শনেও আত্মার ধারণা আদি যুগ থেকে স্বীকৃত ও বিতর্কিত ধারণা। প্রাক-সক্রেটিস যুগে আত্মা বলতে গ্রিক দার্শনিকগণ একটি প্রাণশক্তি বা বাষ্পময় দ্রব্যকে বুঝতেন যা দৈহিক জীবনের জন্য আবশ্যক। কিন্তু এই আত্মা চেতনার অধিষ্ঠান বা কর্মের উৎস নয়। আত্মাই দেহের বাহক ও ধারক। আত্মা ছাড়া দেহ নির্জীব ও সংবেদনহীন। হিরাক্লিটাস আত্মাকে নিয়ত বহ্নিমান দৈব আগুনের অংশ মনে করেন। পিথাগোরীয় দার্শনিকবৃন্দ আত্মাকে দেহের পিঞ্জরে আবদ্ধ দেবতা বলে মনে করতেন। আত্মা বলতে আজ আমরা যা বুঝি পাশ্চাত্য দর্শনে সক্রেটিস সর্বপ্রথম এ ধারণার প্রবর্তন করেন। তিনিই প্রথম আত্মাকে বুদ্ধিসংক্রান্ত নৈতিক শক্তি হিসেবে কল্পনা করেন যা ভাল ও মন্দ আচরণের জন্য দায়ী। পরবর্তীকালে প্লেটোর দর্শনে প্রথম আত্মাকে একটি অবিনাশি অমিশ্র দ্রব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে আত্মা সম্পর্কে একটি সুসঙ্গত মতবাদ প্রদান করা হয়। মধ্যযুগেও সব দার্শনিকই আত্মাকে আধ্যাত্মিক দ্রব্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আধুনিক যুগে দেকার্ত, স্পিনোজা, প্রমুখ বুদ্ধিবাদী এবং লক, বার্কলে প্রমুখ অভিজ্ঞতাবাদীও আত্মাকে স্বতন্ত্র আধ্যাত্মিক দ্রব্য বলে মনে করেন। পাশ্চাত্য আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদী হিউমই প্রথম আত্মার প্রচলিত ধারণাকে খণ্ডন করেন। তিনিও চার্বাকদের মতো অভিজ্ঞতাবাদ তথা তাঁর ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা তত্ত্বের ভিত্তিতে আধ্যাত্মিক দ্রব্যরূপ শাশ্বত আত্মার ধারণা খণ্ডন করেন।
চার্বাক ও হিউমের আত্মা সম্পর্কিত মতবাদের বিভিন্ন দিক থেকে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। হিউমের আত্মা সম্পর্কিত আলোচনাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে প্রথম অংশকে নঞর্থক তথা প্রচলিত আত্মা সম্পর্কিত ধারণা খণ্ডন, এবং পরবর্তী অংশকে সদর্থক বা গঠনমূলক অর্থাৎ আত্মা সম্পর্কে হিউমের নিজস্ব মতের ব্যাখ্যা, হিসেবে উল্লেখ করা যায়। এ বিষয়ে চতুর্থ অধ্যায়ে হিউমের জ্ঞানবিদ্যায় শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব খণ্ডন শীর্ষক আলোচনায় বিস্তারিত রয়েছে। চার্বাকদের আলোচনাকে এভাবে স্পষ্ট দুই ভাগে বিভক্ত করা না গেলেও একথা বলা যায় যে, চার্বাক দার্শনিকগণ আত্মা সম্পর্কিত প্রচলিত আধ্যাত্মিক দ্রব্য মতবাদকে খণ্ডন করে এ সম্পর্কে তাঁদের নিজস্ব মত ব্যাখ্যা করেছেন। সুতরাং তাঁরাও প্রচলিত মত খণ্ডন ও নিজস্ব মত প্রদানের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
চার্বাক দার্শনিকগণ যদিও আত্মা সম্পর্কিত মতবাদ দিতে গিয়ে হিউমের মতো প্রচলিত মত খণ্ডনের বিষয়ে বিস্তাতির আলোচনা করেননি তবুও এ বিষয়ে সন্দেহ নাই যে, তাঁরা প্রত্যক্ষবাদের ভিত্তিতে দেহাতিরিক্ত দ্রব্য হিসেবে আত্মার ধারণাকে অস্বীকার করেছেন।[২] চার্বাকগণ আত্মাকে দেহাতিরিক্ত সত্তা বলে স্বীকার করেন না। এর কারণ হলো, তাঁরা একমাত্র জড়ের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। কেননা জড় ছাড়া অন্য কোনো দ্রবের ধারণা প্রত্যক্ষ দ্বারা পাওয়া যায় না। সুতরাং কেবলমাত্র দেহ ছাড়া চিরন্তন বা শাশ্বত আধ্যাত্মিক দ্রব্য বা জ্ঞাতারূপ কোনো আত্মার জ্ঞান পাওয়া যায় বলে চার্বাকগণ মনে করেন না। অর্থাৎ তাঁরা অভিজ্ঞতাবাদী ও জড়বাদী দিক থেকে দেহাতিরিক্ত শাশ্বত দ্রব্যরূপ আত্মার ধারণাকে অস্বীকার করেন।
হিউমও তাঁর আত্মা সম্পর্কিত মতবাদের নঞর্থক দিক আলোচনায় প্রচলিত আত্মা সম্পর্কিত মতবাদ খণ্ডন অর্থাৎ শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব খণ্ডনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। এখানে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতাবাদের মূলসূত্র—যার ইন্দ্রিয়ছাপ নাই তার ধারণা থাকতে পারে না—প্রয়োগ করে দেখাতে চান যে, শাশ্বত আত্মার ইন্দ্রিয়ছাপ আমরা কোনোভাবেই পাই না। সুতরাং এর ধারণাও থাকতে পারে না। আত্মার ধারণাকে খণ্ডন করতে গিয়ে হিউম দ্রব্যের ধারণাকে খণ্ডন করেন। তাঁর পূর্বসূরি ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী লক বস্তুর দৃশ্যযোগ্য মুখ্য ও গৌণ গুণের পেছনে অজ্ঞেয় জড় ও মানসিক দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। বার্কলে জড় দ্রব্যকে অজ্ঞেয় বলে অস্বীকার করেন। কিন্তু তিনি মানসিক দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। হিউম প্রত্যক্ষণ তথা ইন্দ্রিয়ছাপ দ্বারা পাওয়া যায় না বলে জড়ীয় ও মানসিক উভয় প্রকার দ্রব্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তাঁর মতে, ইন্দ্রিয়ছাপ ছাড়া কোনো কিছুর ধারণা পাওয়া যায় না। আত্মার ধারণা হলো অপরিবর্তনীয় স্থির সত্তার ধারণা। এরূপ কোনো ইন্দ্ৰিয়ছাপকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। সুতরাং শাশ্বত, অবিনশ্বর বা স্থায়ী দ্রব্যরূপ আত্মার অস্তিত্বের ধারণা আমাদের থাকতে পারে না। বরং কেবল প্রত্যক্ষণেরই ধারণা থাকতে পারে।
এখানে হিউম প্রত্যক্ষণগুলো থেকে দ্রব্য যে আলাদা তা প্রমাণ করতে গিয়ে প্রভেদকরণ (distinguishable) ও বিচ্ছিন্নকরণ (separable)-এর ধারণাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। তাঁর মতে, যা কিছু প্রভেদকরণযোগ্য তাই বিচ্ছিন্নকরণযোগ্য। উল্লেখ্য যে, এস. এম. বর্লিঙ্গে প্রভেদকরণযোগ্য কোনোকিছুকে বিচ্ছিন্নকরণযোগ্য মনে করাকে বাস্তবায়ন নামক অবৈধ প্রক্রিয়া বলে মনে করেন।[৩] কারণ, প্রভেদকরণ বিমূর্ত ধারণার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তা স্বাধীন অস্তিত্বশীল বস্তুসমূহ থেকে স্বতন্ত্র। কিন্তু বিচ্ছিন্নকরণ মূর্ত সত্তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যা দেশ ও কালে অস্তিত্বশীল। বার্লিঙ্গের দৃষ্টিকোণ থেকে হিউমের প্রত্যক্ষণগুলোকে প্রভেদকরণযোগ্য বলা যায়, কিন্তু বিচ্ছিন্নকরণযোগ্য নয়। কারণ, প্রত্যক্ষণগুলো বিমূর্ত বা মানসিক। সুতরাং একথা বলা যায় যে, এখানে প্রত্যক্ষণ ও দ্রব্যকে আলাদা করতে গিয়ে হিউম যে যুক্তি দিয়েছেন তাতে বার্লিঙ্গে নির্দেশিত বাস্তবায়ন নামক অবৈধ প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে।o তবে এতে সন্দেহ নাই যে, তাঁর মতে, প্রত্যক্ষণযোগ্য নয় বলেই দ্রব্যের ধারণা পাওয়া যায় না। সুতরাং দেখা যায়, চার্বাক ও হিউম উভয়ই প্রত্যক্ষণ দ্বারা পাওয়া যায় না বলে দেহাতিরিক্ত শাশ্বত সত্তা হিসেবে আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, চার্বাক ও হিউম প্রচলিত আত্মা সম্পর্কিত মত খণ্ডন করে এ সম্পর্কে তাঁদের নিজস্ব মত প্রদান করেছেন। চার্বাকগণ আত্মাকে দেহের সাথে অভিন্ন হিসেবে বর্ণনা করেন। তাঁদের মতে, চেতনা সমন্বিত দেহই আত্মা। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ইত্যাদি চতুর্ভূত একটি বিশেষ পরিমাণে সমন্বিত হয়ে যখন মানবদেহ গঠন করে তখন এর মধ্যে চেতনা নামক গুণের উৎপত্তি হয়। সুতরাং আত্মা দেহাতিরিক্ত দ্রব্য নয়, বরং দেহের আগন্তুক গুণ। দেহের মৃত্যুর সাথে আত্মারও মৃত্যু ঘটে। আত্মাকে দেহ থেকে আলাদা করা যায় না। এ প্রসঙ্গে চার্বাকগণ যে উদাহরণটি ব্যবহার করেন তার উপর প্রাচীন ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্রের তথা আয়ুর্বেদশাস্ত্রের প্রভাব লক্ষিত হয়। তাঁরা বলেন, মদ তৈরির দ্রব্যাদিতে মাদকতা না থাকলেও এগুলো সমন্বিত অবস্থায় মদ তৈরি হলে মাদকাশক্তি উৎপন্ন হয়। অথবা চুন, পান, সুপারি, খয়ের, ইত্যাদিতে লাল রং না থাকলেও এগুলো সমন্বিত হলে লাল রং উৎপন্ন হয়। তেমনি চতুর্ভূত বিশেষ পরিমাণে সমন্বিত হয়ে দেহ উৎপন্ন হলে তাতে চেতনাগুণের আবির্ভাব ঘটে। সুতরাং তাঁদের মতে, দেহই আত্মা। আত্মা দেহের অতিরিক্ত দ্রব্য নয়। চেতনা দেহের উন্মেষমূলক গুণ। এজন্য তাঁদের মতবাদকে দেহাত্মবাদ বলে।
বার্লিঙ্গের আলোচিত প্রভেদকরণ ও বিচ্ছিন্নকরণ ধারণা দুটিকে চার্বাকদের দেহ ও আত্মার ধারণার উপর প্রয়োগ করে বলা যায়, চার্বাকদের দেহ ও আত্মা প্রভেদকরণযোগ্য কিন্তু বিচ্ছিন্নকরণযোগ্য নয়। কারণ, দেহের অবস্থান দেশ কালে থাকলেও আত্মা তার গুণ। অর্থাৎ আত্মা অমূর্ত বিষয়। চার্বাক দেহাত্মবাদের সাথে উনিশ শতকের দেহ-মন সম্পর্কিত উপঘটনাবাদের মিল লক্ষিত হয়। কার্ল মার্ক্সের দ্বান্দ্বিক জড়বাদে চেতনার উদ্ভবের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় চার্বাক দেহাত্মবাদেই তার বীজ বপন করা হয়েছে, একথা বলা যায়।
হিউম তাঁর আত্মা সম্পর্কিত মতবাদের সদর্থক বা গঠনমূলক দিক আলোচনা করতে গিয়ে আত্মাকে প্রবাহমান প্রত্যক্ষণের সমষ্টি হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি যখন আমিত্বকে খুঁজতে যান তখন ঠাণ্ডা-গরম, ভালবাসা-ঘৃণা, আলো-অন্ধকার ইত্যাদি প্রত্যক্ষণ ছাড়া আর কিছুকে খুঁজে পান না। তিনি এও বলেন যে, যখন তিনি ঘুমন্ত থাকেন তখন এসব প্রত্যক্ষণ সম্পর্কে সচেতন থাকেন না। তখন আত্মা বলে তাঁর মধ্যে অন্য কিছুকে তিনি খুঁজে পান না। তার মতে, যখন তিনি প্রত্যক্ষণগুলোকে অনুভব করেন না তখন তিনি যথার্থ অর্থে অস্তিত্বশীল থাকেন না। তাঁর কাছে গোটা মানবজাতি হলো ধারণাতীত দ্রুততার সঙ্গে পরস্পরকে অনুসরণ করে এমন সব প্রত্যক্ষণের পুঞ্জ বা সমষ্টিমাত্র। হিউমের ব্যাখ্যা থেকে আত্মা সম্পর্কে যে তিনটি মূলসূত্র পাওয়া যায় সেগুলো হলো;
(ক) আত্মা বিভিন্ন স্বতন্ত্র প্রত্যক্ষণের সমষ্টি বা পুঞ্জ ছাড়া আর কিছুই নয়;
(খ) এসব প্রত্যক্ষণ ধারণাতীত দ্রুততার সঙ্গে পরস্পরকে অনুসরণ করে; এবং
(গ) প্রত্যক্ষণগুলো সব সময়ই পরিবর্তিত হতে থাকে এবং এরা গতিশীল।
এজন্য হিউমের আত্মা সম্পর্কিত মতবাদকে পুঞ্জবাদ নামে আখ্যায়িত করা হয়। সুতরাং দেখা যায়, চার্বাকগণ আত্মাকে দেহের উপবস্তু বা উপঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করে দেহকে আত্মার সাথে অভিন্ন বলেছেন। তাঁদের এই মতবাদ দেহাত্মবাদ নামে পরিচিত। পক্ষান্তরে, হিউম আত্মাকে প্রত্যক্ষণের পুঞ্জ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাঁর মতবাদ আত্মা সম্পর্কিত পুঞ্জবাদ নামে পরিচিত। চার্বাক প্রদত্ত আত্মার ব্যাখ্যা জড়বাদী। কিন্তু হিউম প্রদত্ত আত্মার ব্যাখ্যা জ্ঞানতাত্ত্বিক, তথা মনস্তাত্ত্বিক। হিউম প্রদত্ত পুঞ্জবাদী মতবাদ দ্বারা পরবর্তী পাশ্চাত্য দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল, উইলিয়াম জেমস, বার্ট্রান্ড রাসেল প্রমুখ প্রভাবিত হয়েছেন। কারণ, তাঁরা সকলেই দেহাতিরিক্ত দ্রব্য হিসেবে আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করে অভিজ্ঞতামূলক আত্মার কথা বলেছেন। অন্যকথায়, তাঁরা সকলেই আত্মাকে মানসিক ঘটনা অর্থাৎ প্রত্যক্ষণের পুঞ্জ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এদের সকলেই হিউমকে পাঠ করেছেন।
হিউমের পুঞ্জবাদের সাথে ভারতীয় দার্শনিক গৌতম বুদ্ধের আত্মা সম্পর্কিত মতবাদের তথা অনাত্মাবাদের যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়। গৌতম বুদ্ধ দেহাতিরিক্ত দ্রব্য হিসেবে আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তিনি অভিজ্ঞতাবাদী দিক থেকে আত্মার ধারণাকে ব্যাখ্যা করে আত্মাকে চেতনার প্রবাহ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাঁর মতে, চিন্তা, স্মৃতি, সংবেদন, প্রত্যক্ষণ, চেতনা ইত্যাদি ক্ষণস্থায়ী, গতিশীল ও পরস্পর নির্ভরশীল অবস্থাগুলোর যোগফলই আত্মা। এদিক থেকে বিচার করলে বুদ্ধের অনাত্মাবাদ হিউমের পুঞ্জবাদের পথিকৃৎ। কিন্তু হিউমের পুঞ্জবাদের সাথে বুদ্ধের অনাত্মাবাদের গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো, বুদ্ধ আত্মাকে একটি মনোদৈহিক অবয়ব হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি আত্মাকে পঞ্চস্কন্ধের সমষ্টি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পঞ্চস্কন্ধ পাঁচটি উপাদানে গঠিত। তার মধ্যে একটি জড়ীয়, চারটি মানসিক উপাদান। কিন্তু হিউম আত্মা সম্পর্কে এরকম তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেননি। তিনি জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক থেকে প্রচলিত দ্রব্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করার মাধ্যমে আত্মার বস্তুত্ব ও অবস্তুত্ব সম্পর্কিত বিতর্কটিকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য ও অর্থহীন বলেছেন। তাঁর কাছে আত্মিক দ্রব্য সম্পর্কিত প্রশ্নটি দুর্বোধ্য। সুতরাং আত্মার কোনো তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়ার অবকাশ তাঁর মতবাদে নাই।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, চার্বাকগণ চেতনা বা আত্মাকে দেহের উপবস্তু বলে অভিহিত করে দেহাত্মবাদী মত প্রদান করেন। অর্থাৎ বলা যায়, তাত্ত্বিক দিক থেকে চার্বাকগণ আত্মার জড়বাদী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু বুদ্ধের ব্যাখ্যা জড়বাদী নয়, বরং সম্ভবত দ্বৈতবাদী। কারণ, বুদ্ধের আত্মা মনোদৈহিক অবয়ব মানসিক ও দৈহিক উভয় উপাদানে গঠিত। তবে চার্বাক ও বৌদ্ধ উভয় দর্শনেই আত্মা সম্পর্কে একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে একথা বলা যায়। পক্ষান্তরে, হিউমের আত্মা সম্পর্কিত ব্যাখ্যা জ্ঞানতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক।
উল্লেখ্য যে, হিউম তাঁর আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা করার পর আত্মা সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণার উৎপত্তির কারণও নির্দেশ করেণ। এছাড়া, তাঁর আত্মার পুঞ্জবাদ প্রচলিত ব্যক্তি অভিন্নতার ব্যাখ্যা অস্বীকার করে। তাই তিনি ব্যক্তি অভিন্নতা সম্পর্কিত তাঁর নিজস্ব মতও ব্যাখ্যা করেন। বুদ্ধ তাঁর অনাত্মাবাদের আলোচনায় প্রচলিত আত্মা সম্পর্কিত ধারণার কারণ নিয়ে স্পষ্ট আলোচনা করেছেন এবং ব্যক্তি ভিন্নতার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে চার্বাক দর্শনে এসব বিষয়ে হিউমের বা বুদ্ধের দর্শনের মতো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার প্রয়াস লক্ষিত হয় না।
হিউম আত্মা সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণার কারণ হিসেবে অনুষঙ্গ নিয়মের কথা উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, আত্মার ধারণা একটি যৌগিক ধারণা। বিভিন্ন সরল ধারণার সমন্বয়ে এর সৃষ্টি। এর সৃষ্টিতে যে সম্বন্ধগুলো কাজ করে সে সম্বন্ধগুলোকে একত্রে তিনি ‘অনুষঙ্গ নিয়ম’ হিসেবে নামকরণ করেন। অনুষঙ্গ নিয়ম সাদৃশ্য, সান্নিধ্য ও কার্যকারণ এই তিনটি সম্বন্ধের ধারণার মাধ্যমে গঠিত হয়। হিউমের মতে, ধারণাতীত দ্রুততার সঙ্গে অনুক্রমণশীল প্রত্যক্ষণগুলোর মধ্যে সাদৃশ্য, সান্নিধ্য ও কার্যকারণের সম্বন্ধ থাকায় এদেরকে অভিন্ন বলে মনে করা হয়। এভাবেই শাশ্বত বা অপরিবর্তনশীল আত্মা এবং ব্যক্তি অভিন্নতার ধারণা গঠিত হয়। লক্ষিত পরিবর্তনের মাঝেও দেহ বা আত্মার অপরিবর্তনের যে ধারণা, এটাই অভিন্নতার ধারণা। হিউমের মতে, অভিন্নতা সম্পর্কিত যে ধারণা দর্শনে প্রচলিত তা ভ্রান্তিমূলক আরোপিত মানসিক প্রবণতা যা অনুষঙ্গ নিয়মের দ্বারা ঘটে থাকে। অনুষঙ্গ নিয়মের কারণেই পরিবর্তনের মধ্যে অপরিবর্তনের ধারণা সৃষ্টি হয়। যোগসূত্রটি কল্পিত। তাই তিনি অভিন্নতা সম্পর্কিত বিতর্ককে বাচনিক (verbal) হিসেবে চিহ্নিত করেন। অর্থাৎ বিতর্কটি ‘অভিন্নতা’ শব্দটির দ্বারা কী অর্থ প্রকাশ করা হয় তাকে নিয়ে। বাচনিক সমস্যা হিসেবে তাঁর কাছে অভিন্নতার সমস্যা ব্যাকরণের সমস্যা, দার্শনিক সমস্যা নয়।
সুতরাং হিউমের মতে, অভিন্নতা মূলত অনুষঙ্গ নিয়ম দ্বারা উৎপন্ন কল্পিত মানসিক সম্বন্ধ। বাস্তবে এর অস্তিত্ব নাই। স্মৃতিই অনুষঙ্গ নিয়মের তিনটি সম্বন্ধকে পর্যবেক্ষণ করে। তাই তিনি স্মৃতিকে ব্যক্তি অভিন্নতার উৎস হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অর্থাৎ তাঁর ব্যক্তি অভিন্নতার ব্যাখ্যাও মনস্তাত্ত্বিক। অবশ্য কেবল হিউম নয়, আত্মা সম্পর্কিত পুঞ্জবাদের সমর্থক সকল দার্শনিকই ব্যক্তি অভিন্নতার উৎস হিসেবে স্মৃতিকে দায়ী করেছেন। উল্লেখ্য যে, বুদ্ধ তাঁর অনাত্মাবাদে শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও ব্যক্তি অভিন্নতাকে আরোপিত মানসিক প্রবণতাজনিত ভ্রান্তি বলেননি। বরং তিনি ব্যক্তি অভিন্নতাকে জীবনের বিভিন্ন অবস্থার পারম্পর্য বা ধারাবাহিক প্রবাহ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর এই ব্যাখ্যার ভিত্তি হলো তাঁর সৎকার্যবাদ বা কার্যকারণ সম্পর্ক। এই সম্পর্ককে হিউম ও চার্বাকদের কেউই স্বীকার করেননি।
চার্বাক দার্শনিকগণ ব্যক্তি অভিন্নতার স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন বলে জানা যায় না। প্রশ্ন ওঠতে পারে, দেহাত্মবাদের সমর্থন করে তাঁদের পক্ষে ব্যক্তি অভিন্নতাকে ব্যাখ্যা করার উপায় ছিল কি না? এর উত্তরে দুটি সম্ভাবনার কথা বলা যেতে পারে। প্রথমত, জড়বাদী ও অভিজ্ঞতাবাদী চার্বাকগণ দৈহিক অভিন্নতা দ্বারা ব্যক্তি অভিন্নতার ব্যাখ্যা দিতে পারেন। কারণ, একটি বিশেষ পরিমাণে ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ-এর মধ্যে যে অভিন্নতা আছে তা দ্বারা তাঁরা ব্যক্তি অভিন্নতার ব্যাখ্যা করা যেতে পারে বলে মনে করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে সমস্যা হলো, এই চতুর্ভূত অপরিবর্তনশীল কি না? দেহ গঠনকারী উপাদান চতুষ্টয়কে অপরিবর্তনশীল বলে ধরে নিলে মানব দেহের বর্ধন বা পরিবর্তন ব্যাখ্যা চার্বাকদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, দেহ গঠনকারী চতুর্ভূত পরিবর্তনশীল হলে দেহের অভিন্নতা দ্বারা ব্যক্তি অভিন্নতা ব্যাখ্যায় জটিলতা সৃষ্টি হয়। চার্বাকদের ব্যক্তি অভিন্নতার ব্যাখ্যার দ্বিতীয় সম্ভাবনা হিসেবে হিউম প্রদত্ত ব্যক্তি অভিন্নতার ব্যাখ্যার কথা বলা যায়। এই ব্যাখ্যাটি চার্বাকদের জন্যও বিবেচ্য হতে পারে। অন্তত এতে তাঁদের জড়বাদী ও অভিজ্ঞতাবাদী অবস্থান ক্ষুণ্ন হয় না। অর্থাৎ তাঁরা ব্যক্তি অভিন্নতাকে স্মৃতি নামক ক্ষমতার দ্বারা ব্যাখ্যা করতে পারতেন, যদিও এরূপ ব্যাখ্যা তাঁদের মতবাদে লক্ষিত হয় না। বুদ্ধ যেদিক থেকে ব্যক্তি অভিন্নতাকে ব্যাখ্যা করেছেন সে পথ হিউমের মতো চার্বাকদের জন্য খোলা ছিল না। কারণ, তাঁরাও তাঁদের অভিজ্ঞতাবাদী অবস্থানে আপোষহীন থেকে কার্যকারণের আবশ্যিকতাকে অস্বীকার করে একে সম্ভাবনা ও আকস্মিকতা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
একথা বলা যায় যে, চার্বাকগণ কেবল আত্মা সম্পর্কিত দেহাত্মবাদী মতবাদ দিয়েই তাঁদের দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন। অবশ্য তাঁরা যদি দেহাতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসের কারণ নির্ণয় করতে প্রয়াসী হতেন তবে বুদ্ধের মতো প্রজ্ঞাজনিত বা হিউমের মতো মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার মধ্যে এর কারণ অনুসন্ধান না করে তাঁরা হয়তো তৎকালীন সামাজিক অবস্থার মধ্যে এর কারণ খুঁজে পেতেন। তাঁরা হয়তো একথা বলতেন যে, শাশ্বত আত্মার ধারণার সাথে পরজন্মের ধারণা, পরজন্মের ধারণার সাথে পাপের ধারণা, পাপের ধারণার সাথে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করার ধারণা সম্পর্কিত। সুতরাং শাশ্বত আত্মার ধারণা ছিল ভারতের তৎকালীন উচ্চশ্রেণিকর্তৃক কল্পিত একটি আধ্যাত্মিক ধারণা যার মধ্যে নিম্নশ্রেণিকে শোষণের বীজ নিহিত। কিন্তু হিউম মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে আত্মা সম্পর্কিত প্রচলিত মতবাদের কারণ নির্ণয় করেছেন এবং ব্যক্তি অভিন্নতার ব্যাখ্যায়ও প্রয়াসী হয়েছেন।
চার্বাক ও হিউমের দর্শন আত্মা সম্পর্কে প্রচলিত মতবাদ খণ্ডনের ক্ষেত্রে অভিন্ন মতাবলম্বী। এ সত্ত্বেও প্রচলিত মতবাদের উৎপত্তির কারণ নির্ণয়ে হিউম চার্বাকদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। এই ভিন্ন মতের কারণ সম্ভবত তাঁদের উভয়ের দর্শনালোচনার উদ্দেশ্যের মধ্যেই নিহিত। চার্বাক দার্শনিক মতবাদ তৎকালীন সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ। তাঁরা তৎকালীন শোষণকারীদের তত্ত্বকে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে গিয়ে নিজস্ব মতবাদ দিয়েছেন। কিন্তু হিউম মূলত মানবপ্রকৃতির স্বরূপ তথা মনস্তাত্ত্বিক নীতিমালা অনুসন্ধান করেছেন। সুতরাং উদ্দেশ্যগত কারণেই চার্বাকগণ এসব প্রচলিত ধারণার পেছনে বর্ণবৈষম্য, শ্রেণিশোষণ প্রভৃতি প্রায়োগিক কারণ নির্দেশ করেছেন, আর হিউম এ সবের কারণ খুঁজেছেন মানবপ্রকৃতির মধ্যে, অর্থাৎ মনস্তাত্ত্বিক নীতিমালার মধ্যে।
সংক্ষিপ্তসার
শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব খণ্ডন বিষয়ে উপরের আলোচনা থেকে চার্বাক ও হিউমের মতের মধ্যে নিম্নোক্ত সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় :
সাদৃশ্য : (১) চার্বাক ও হিউম উভয়ই দেহাতিরিক্ত শাশ্বত দ্রব্য হিসেবে আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। ভারতীয় দর্শনে আত্মা সম্পর্কিত আধ্যাত্মিক মতবাদকে চার্বাকগণই প্ৰথম খণ্ডন করেন এবং আধ্যাত্মিক দ্রব্য হিসেবে আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। পাশ্চাত্য দর্শনে হিউমও অনুরূপভাবে প্রাচীন যুগ থেকে প্রচলিত আত্মা সম্পর্কিত মতবাদকে খণ্ডন করেন এবং শাশ্বত আধ্যাত্মিক দ্রব্য হিসেবে আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন।
(২) চার্বাক ও হিউম উভয়ের দর্শনেই অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রচলিত আত্মার ধারণাকে খণ্ডন করা হয়েছে। চার্বাকগণ যেমন প্রত্যক্ষণে বাহ্য প্রত্যক্ষের মাধ্যমে দেহাতিরিক্ত দ্রব্যের ধারণা খুঁজে পাননি তেমনি হিউমও নিত্য, শাশ্বত, অপরিবর্তনশীল আধ্যাত্মিক দ্রব্যরূপ কোনো আত্মার ধারণা ইন্দ্রিয়ছাপের মধ্যে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন। সুতরাং বলা যায়; উভয় দর্শনই প্রত্যক্ষবাদী জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রচলিত আত্মার ধারণাকে খণ্ডন করেছে।
(৩) চার্বাকগণ আত্মা ও চেতনাকে স্পষ্টত অভিন্ন বলে স্বীকার করেছেন এবং চেতনার উৎপত্তির ব্যাখ্যা দিয়ে চেতনাকে দেহের উপবস্তু বলেছেন। হিউম চেতনার উৎপত্তির ব্যাখ্যা দেননি। তিনি আত্মা ও চেতনাকে অভিন্ন অর্থে দেখেছেন কি না তাও স্পষ্ট করে বলেননি। তবে তিনি প্রত্যক্ষণগুলোকেই আত্মা বলে উল্লেখ করেন এবং প্রত্যক্ষণের স্বরূপ বর্ণনায় তিনি এগুলোকে অবিভাজ্য ও অবিচ্ছিন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেন। সুতরাং হিউম নির্দেশিত প্রত্যক্ষণের প্রকৃতি অজড়, চেতনার বিষয়। এদিক থেকে বিচার করে বলা যায়, উভয় মতবাদেই আত্মা ও চেতনাকে অভিন্ন অর্থে গ্রহণ করা হয়েছে। তবে, চার্বাকগণ এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা হিউম দেননি।
বৈসাদৃশ্য : (১) চার্বাক প্রদত্ত আত্মা সম্পর্কিত মতবাদকে দেহাত্মবাদ বলা হয়। চার্বাকগণ দেহ ও আত্মাকে অভিন্ন মনে করেন। তাঁদের মতে, ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ এই চার প্রকার বস্তু বিশেষ পরিমাণে সমন্বিত হয়ে মানব দেহ গঠন করলে এর উপবস্তু হিসেবে চেতনা বা আত্মার উৎপত্তি হয়। অর্থাৎ আত্মা দেহের আগন্তুক গুণ। তাই চার্বাকদের মতে, দেহের ধ্বংসে আত্মাও ধ্বংস হয়। পক্ষান্তরে, হিউমের আত্মা সম্পর্কিত মতবাদকে পুঞ্জবাদ বলা হয়। তাঁর মতে, যাকে আত্মা বলা হয় তা মূলত ধারাবাহিকভাবে অনুক্রমণশীল স্বতন্ত্র প্রত্যক্ষণের পুঞ্জ বা সমষ্টি। তাই হিউমের মতে, ঘুমন্ত অবস্থায় প্রত্যক্ষণগুলোকে অনুভব করা যায় না বলে তখন তিনি যথার্থ অর্থে অস্তিত্বশীল থাকেন না বা তখন আত্মাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। হিউম আত্মাকে দেহের আগন্তুক গুণ বলেননি। বরং প্রত্যক্ষণের পুঞ্জ বলেছেন।
(২) চার্বাক দার্শনিকদের আত্মাসম্পর্কিত ব্যাখ্যা জড়বাদী। কারণ, তাঁরা আত্মাকে চতুর্ভূতের উপবস্তু বলে মনে করেন। এর সাথে আধুনিক জড়বাদী মার্ক্সীয় ব্যাখ্যার মিল পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে, হিউম প্রদত্ত আত্মার ব্যাখ্যা জ্ঞানতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক। কারণ, তিনি আত্মাকে প্রত্যক্ষণের সমষ্টি বলে মনে করেন। একে ইন্দ্রিয়ছাপের মাধ্যমে জানা যায়। তাঁর মতবাদের সাথে পরবর্তী পাশ্চাত্য প্রত্যক্ষবাদী, প্রয়োগবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদের মিল পরিলক্ষিত হয়।
(৩) চার্বাক দর্শনে ব্যক্তি অভিন্নতার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। সম্ভবত এর কারণ হলো এই যে, চার্বাকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আত্মার ধারণার ব্যাখ্যা দেওয়া নয় বরং তৎকালীন শ্রেণিবৈষম্যমূলক সমাজে শোষণমুক্তির জন্য শোষণের ভিত প্রস্তুতকারী অধ্যাত্মবাদ খণ্ডন। পক্ষান্তরে, হিউমের দর্শনে ব্যক্তি অভিন্নতার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তিনি ব্যক্তি অভিন্নতাকে একটি আরোপিত মানসিক প্রবণতাজনিত ভ্রান্তি বলে মনে করেন। এই ভ্রান্তি অনুষঙ্গ নিয়মের কারণে সম্পাদিত হয়। স্মৃতিই অনুষঙ্গ নিয়মের ধারক হিসেবে কাজ করে ব্যক্তি অভিন্নতার ধারণার ভিত্তি স্থাপন করে। চরম অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে তাঁর এই ব্যাখ্যা তাঁর জ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক।
(৪) চার্বাকগণ আত্মা সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণার উৎপত্তির কারণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত আলোচনা করেননি। তবে এটা মনে করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, এর কারণ নির্ণয় করতে গেলে তাঁরা একে তৎকালীন সমাজের উচ্চশ্রেণির দ্বারা নিম্নশ্রেণিকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের জন্য কল্পিত ধারণা বলেই মনে করতেন। কারণ, আত্মা চিরন্তন না হলে পরকালের ধারণা থাকে না। পরকালের ধারণা না থাকলে ব্রাহ্মণদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে পাপ হবে এই ধারণা টিকে থাকে না। পক্ষান্তরে, হিউম আত্মা সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণার কারণ সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করেছেন। তাঁর মতে, এর কারণ মনস্তাত্ত্বিক। অনুষঙ্গ নিয়মের কারণে আত্মার ধারণা করা হয়। অনুষঙ্গ নিয়ম ব্যক্তি অভিন্নতার ধারণারও কারণ।
উপরের আলোচনা থেকে বলা যায়, অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে শাশ্বত দ্রব্য হিসেবে আত্মার অস্তিত্ব খণ্ডন করার ক্ষেত্রে হিউম যে ধারণা পোষণ করেন চার্বাক দার্শনিকগণই সে ধারণার পথিকৃৎ। দর্শনের ইতিহাসে চার্বাকগণ যেমন প্রথম জড়বাদী ও প্রথম অভিজ্ঞতাবাদী তেমনি তাঁরা দেহাতিরিক্ত আধ্যাত্মিক দ্রব্য হিসেবে আত্মার অস্তিত্ব খণ্ডনের ধারণারও আদি প্রবর্তক। অবশ্য হিউমের মতবাদে যেভাবে ব্যক্তি অভিন্নতার ধারণার স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে চার্বাক দর্শনে তা অনুপস্থিত। আত্মা সম্পর্কে দেহাত্মবাদের যে ধারণা চার্বাকগণ বহুযুগ আগেই প্রবর্তন করে গেছেন সে ধারণাকে চেতনা সম্পর্কে আধুনিক জড়বাদী ব্যাখ্যারও পথিকৃৎ বলে গণ্য করা যায়।
কার্যকারণের আবশ্যিকতা খণ্ডন প্রসঙ্গে
কার্যকারণের ধারণা দর্শন ও বিজ্ঞানের একটি বহুল আলোচিত ও স্বীকৃত ধারণা। এর মূল কথা হলো, সকল কার্যেরই কারণ আছে এবং কার্য ও কারণের মধ্যে অনিবার্য বা আবশ্যিক সম্পর্ক বর্তমান। এই তত্ত্বের উপর নির্ভর করে আধুনিক বিজ্ঞান তার সূত্রসমূহকে প্রমাণ করেছে।
চার্বাক ছাড়া ভারতীয় দর্শনে অন্য সকল সম্প্রদায়ই মুক্তি বা মোক্ষের প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁরা বন্ধনের কারণ হিসেবে অবিদ্যার কথা বলে অবিদ্যার হাত থেকে মুক্তিকেই মোক্ষের উপায় বলে নির্দেশ করেছেন। এতে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে কার্যকারণ তত্ত্বকেই স্বীকার করা হয়েছে। বৌদ্ধদর্শনে কার্যকারণ তত্ত্ব গুরুত্বসহকারে আলোচিত হয়েছে এবং প্রতীত্যসমূৎপাদ্ববাদ বা কার্যকারণকে একটি দার্শনিক তত্ত্ব হিসেবে স্বীকার করে এ সম্পর্কে বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং বলা যায়, কার্যকারণতত্ত্ব ভারতীয় দর্শনের একটি স্বীকৃত ধারণা।
অন্যদিকে, দর্শনের ইতিহাসে আদি যুগে থেলিস এই জগতের উৎপত্তির কারণসংক্রান্ত প্রশ্ন করেন। এ প্রশ্নকে দর্শনের প্রথম প্রশ্ন, এবং প্রধানত এজন্য থেলিসকে দর্শনের জনক হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। সে প্রশ্নের মধ্যেই কার্যকারণ তত্ত্বের স্বীকৃতি দেখা যায়। অতঃপর এরিস্টটলের Metaphysics গ্রন্থে কারণ চতুষ্টয়ের আলোচনার মধ্য দিয়ে কার্যকারণ তত্ত্ব আত্মপ্রকাশ করে। মধ্যযুগে এই তত্ত্বকে স্বীকার করে নিয়ে স্কলাস্টিক দার্শনিকগণ তাঁদের দর্শনালোচনা করেন। আধুনিক যুগে বেকনের আরোহাত্মক পদ্ধতিতে কার্যকারণ তত্ত্বের স্বীকৃতি লক্ষিত হয়। পরবর্তী বুদ্ধিবাদী দার্শনিক দেকার্ত এবং অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক লক ও বার্কলে কার্যকারণ তত্ত্বকে স্বীকার করে নিয়েছেন। ভারতীয় দর্শনে চার্বাক দার্শনিকগণ এবং আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনে সম্ভবত হিউমই প্রথম সুস্পষ্টভাবে কার্যকারণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন, এবং দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে কার্য ও কারণের অনিবার্য সম্পর্ক বিচার করতে প্রয়াসী হন। অবশ্য একথা সত্য যে, পাশ্চাত্য দর্শনে গ্রিক দার্শনিক এনেসিডেমাস, মধ্যযুগীয় দার্শনিক উইলিয়াম অব ওকাম প্রমুখ কার্যকারণের অনিবার্য সম্পর্ক প্রসঙ্গে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাঁদের আলোচনা হিউমের মতো সুস্পষ্ট রূপ নেয়নি।
কার্যকারণতত্ত্ব খণ্ডন প্রসঙ্গে চার্বাক ও হিউমের মতের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।[৬] হিউম তাঁর Enquiry গ্রন্থে কার্যকারণ সম্পর্কিত আলোচনাকে প্রথম ও দ্বিতীয় অংশ নামে দুটি অংশে বিভক্ত করেন। প্রথম অংশে তিনি কার্যকারণ সম্পর্কিত প্রচলিত মতবাদের ত্রুটি বিচার করে একে খণ্ডন করেন। তাঁর আলোচনার এই দুটি অংশকে যথাক্রমে নঞর্থক ও সদর্থক দিক নামে অভিহিত করা হয়। যদিও Treatise গ্রন্থে তিনি তাঁর কার্যকারণ সম্পর্কিত আলোচনাকে Enquiry-র মতো দুই ভাগে বিভক্ত করেননি তবুও তাঁর আলোচনার মধ্যে উপর্যুক্ত নঞর্থক ও সদর্থক উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। মূলত Treatise গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়কে সহজবোধ্য, সংক্ষিপ্ত ও সুশৃঙ্খল করার জন্যই Enquiry গ্রন্থের পরিকল্পনা। সুতরাং গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্যগত কারণেই Treatise গ্রন্থের কার্যকারণের আলোচনাকে Enquiry গ্রন্থে দুটি অংশে বিভক্ত করে সুবিন্যস্ত রূপ দিয়েছেন।
চার্বাকদের কার্যকারণ সম্পর্কিত আলোচনায় হিউমের Enquiry গ্রন্থের মতো সদর্থক ও নঞর্থক দিক দুটি আলাদা করা হয়নি। তবে হিউমের Treatise এর আলোচ্য এ দুটি উপাদান চার্বাকদের আলোচনায় উপস্থিত। চার্বাক দার্শনিকগণও যুক্তি সহকারে কার্যকারণ তত্ত্বকে খণ্ডন করেছেন এবং এ সম্পর্কে নিজস্ব ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। সুতরাং আলোচনার আঙ্গিক ও পদ্ধতিগত দিক বিচারে চার্বাক ও হিউমের কার্যকারণ সম্পর্কিত আলোচনার মধ্যে মিল প্রতীয়মান হয়।
কার্যকারণতত্ত্ব খণ্ডন করতে গিয়ে চার্বাকগণ মূলত অনুমানকে অস্বীকার করার ভিত্তিতে কার্যকারণের অনিবার্য সম্পর্ক অস্বীকার করেন। চার্বাকগণ প্রত্যক্ষকেই একমাত্র জ্ঞানোৎপত্তির উপায় বলে স্বীকার করেন। প্রত্যক্ষ ভিন্ন অন্য কোনো প্রমাণ চার্বাক জ্ঞানতত্ত্বে স্বীকৃত নয়। ব্যাপ্তি সম্পর্ক প্রত্যক্ষযোগ্য নয় বলে চার্বাকগণ একে স্বীকার করেন না। ফলত ব্যাপ্তিনির্ভর অনুমানকেও অস্বীকার করেন। অনুমান অস্বীকার করার ফলে কার্যকারণের অনিবার্য সম্পর্ক অস্বীকৃত হয়। কেননা, কার্যকারণের অনিবার্য সম্পর্কের অস্তিত্ব স্বীকার করা অর্থাৎ কারণ ‘ক’-এর সাথে কার্য ‘খ’-এর অনিবার্য সম্পর্ক আছে একথা বলার অর্থ হলো ‘ক’ ও ‘খ’ অতীতে, বর্তমানে ও ভবিষ্যতে সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ স্থান কাল নির্বিশেষে এদের সম্পর্ক স্বীকার করা। কিন্তু চার্বাকদের স্বীকৃত প্রত্যক্ষ দ্বারা অতীত ও বর্তমানের ক ও খ- এর মধ্যে সম্পর্ক জানা যায়, ভবিষ্যতের সম্পর্ক জানা যায় না। এজন্য অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয়। অনুমানের উপর নির্ভর করার অর্থ হলো ব্যাপ্তি সম্পর্ক স্বীকার করা, যে সম্পর্ক নিজেই প্রত্যক্ষযোগ্য নয়, বরং অনুমানলব্ধ। সুতরাং প্রত্যক্ষ দ্বারা শুধু দুটি ঘটনার অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। এদের অনিবার্য সম্পর্কের জ্ঞান পাওয়া যায় না।
হিউম যখন তাঁর কার্যকারণতত্ত্বের নঞর্থক দিক আলোচনা করেন তখন চার্বাকদের উপর্যুক্ত মতের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। হিউম প্রত্যক্ষণকে একমাত্র জ্ঞানের উৎস হিসেবে স্বীকার করেন এবং প্রত্যক্ষণের দ্বারা পাওয়া যায় না বলে অনিবার্য সম্পর্ককে অস্বীকার করেছেন। হিউম প্রত্যক্ষণকে ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণায় বিভক্ত করে একথা বলেছেন যে, শুধু যার ইন্দ্রিয়ছাপ পাওয়া যায় তারই ধারণা সম্ভব। কার্যকারণের ক্ষেত্রে কার্য ও কারণ এ দুটি ঘটনার ইন্দ্রিয়ছাপ আমরা পাই, কিন্তু এদের মধ্যে অনিবার্য সম্পর্কের ইন্দ্রিয়ছাপ আমরা পাই না। সুতরাং কার্যকারণের মধ্যে অনিবার্য সম্পর্কের অস্তিত্ব নাই। হিউম কার্যকারণের অনিবার্যতার উৎপত্তিকে শুধুমাত্র অভিজ্ঞতার দিক থেকে খুঁজে দেখেননি বরং বুদ্ধির দিক থেকেও খুঁজে দেখেছেন। তিনি এও বলেছেন যে, এই সম্পর্ককে অভিজ্ঞতা দ্বারা তো নয়ই, বুদ্ধি দ্বারাও খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ, বুদ্ধি দ্বারা তাকেই খুঁজে পাওয়া যায় যা বিশ্লেষক, তথা অভিজ্ঞতাপূর্ব। কার্যকারণের অনিবার্য সম্পর্ক বিশ্লেষক বা অভিজ্ঞতাপূর্বও নয়। কারণ, কার্য ও কারণ নামক দুটি ঘটনার সংলগ্নতার ও পুনরাবৃত্তির অভিজ্ঞতা ছাড়া এই সম্পর্কের ধারণা হয় না। কিন্তু অভিজ্ঞতা শুধু পুনরাবৃত্তি বা সতত সংযোজনের ধারণা দেয়, আবশ্যিক সংযোজনের ধারণা দেয় না।
সুতরাং অনিবার্য সম্পর্ককে অভিজ্ঞতা বা বুদ্ধি কোনো কিছু দ্বারাই খুঁজে পাওয়া যায় না। উল্লেখ্য যে, চার্বাকগণ শুধুমাত্র অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে কার্যকারণের অনিবার্য সম্পর্ক খুঁজে পাবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হিউম অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধি উভয় দিক থেকে বিচার করেছেন। সম্ভবত এর কারণ হলো, হিউম-পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাবাদ ও বুদ্ধিবাদের ইতিহাস। কার্যকারণতত্ত্ব খণ্ডন করতে গিয়ে হিউম অনিবার্যতার উৎসকে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা কোনোটি দ্বারাই খুঁজে পাওয়া যায় না বলেছেন। তিনি শুধু এটা বিচার করেই ক্ষান্ত হননি, বরং কার্যকারণ তত্ত্বের পক্ষে প্রচলিত সবগুলো যুক্তি বিচার করে দেখেছেন এবং তা খণ্ডনে প্রয়াসী হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি শক্তিতত্ত্ব ও উপলক্ষবাদের যুক্তি খণ্ডন করেন। এছাড়া, কার্যের জন্য কারণের উপস্থিতির আবশ্যিকতা সংক্রান্ত যুক্তিগুলোও খণ্ডন করেন। কিন্তু চার্বাক দর্শনে এসব আলোচনা দেখা যায় না। এর কারণ সম্ভবত এই যে, হিউমের সময়ে কার্যকারণতত্ত্ব আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা সমর্থিত হয়ে এর পক্ষে বিভিন্ন দার্শনিক যুক্তি সংগ্রহ করেছিল, যা চার্বাকদের সময়ে তা ছিল অপরিচিত। সুতরাং ঐতিহাসিক কারণেই চার্বাকদের এতো বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ ছিল না।
চার্বাকদের মতে যে সব ক্ষেত্রে দুটি ঘটনার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক বিদ্যমান বলে আমরা মনে করি সে সব ক্ষেত্রে একটি পূর্বগ এবং অন্য একটি ঘটনার শুধুমাত্র একটি অনুগকে প্রত্যক্ষ করা হয়। কিন্তু ঘটনার অপরিবর্তনীয় পূর্বগ ও অপরিবর্তনীয় অনুগকে প্রত্যক্ষ করা হয় না। এছাড়া, অতীতের প্রত্যক্ষিত দুটি ঘটনার অনুক্রম ভবিষ্যতে পরিবর্তিত পরিবেশে ব্যর্থও হতে পারে। সুতরাং পূর্বগ ও অনুগের সম্পর্ক আকস্মিক, অনিবার্য নয়। তাই এই সম্পর্ক অনিশ্চিত সম্পর্ক।
হিউমও কার্য ও কারণের সম্বন্ধকে ‘অনিবার্য বা নিশ্চিত না বলে আকস্মিক ও সম্ভাব্য বলেছেন। হিউমের মতে, কার্য ও কারণ নামক দুটি ঘটনাকে আমরা বার বার একইভাবে ঘটতে দেখে থাকি। অর্থাৎ অভিজ্ঞতা কার্য ও কারণ নামক ঘটনা দুটির মধ্যে পারম্পর্য, সংলগ্নতা ও সতত সংযোগের জ্ঞান দেয়, আবশ্যিক সংযোজনের নয়। এই সতত সংযোজন অনিবার্য নয়, আকস্মিক। সুতরাং বলা যায়, চার্বাকগণ যেমন কার্য ও কারণের সম্পর্ককে আকস্মিক বা অনিশ্চিত বলেছেন হিউমও তেমনি কার্যকারণের সম্পর্ককে অনিশ্চিত বলেছেন।
হিউম একথা বলেছেন যে, সতত সংযোজন থেকে অনিবার্য সংযোগের ধারণা করলে যাকে প্রমাণ করতে হবে তাকে আগে থেকেই স্বীকার করে নেওয়াজনিত অনুপপত্তি ঘটে। এই অনুপপত্তি হলো চক্রক অনুপপত্তি। অর্থাৎ কার্যকারণ সম্পর্ককে অনিবার্য সম্পর্ক বললে চক্রক অনুপপত্তি ঘটে বলে হিউম মনে করেন। চার্বাকগণও একই কথা বলেছেন। তবে পরোক্ষভাবে, প্রত্যক্ষভাবে নয়। কারণ, চার্বাকগণ কার্যকারণের অনিবার্য সম্পর্ক অনুমান নির্ভর বলেছেন। আর অনুমানের জ্ঞান ব্যাপ্তির উপর নির্ভরশীল। চার্বাকদের মতে, ব্যাপ্তি সম্পর্ককে অনিবার্য সম্পর্ক মনে করলে চক্রক অনুপপত্তি ঘটে। সুতরাং বলা যায়, চার্বাকগণও পরোক্ষভাবে একথা স্বীকার করেছেন যে, কার্যকারণের সম্পর্ককে অনিবার্য মনে করলে চক্রক অনুপপত্তি সম্পাদন করা হয়।
কার্যকারণতত্ত্বের গঠনমূলক আলোচনা করতে গিয়ে চার্বাকগণ কার্যকারণের অনিবার্য সম্পর্ককে মানসিক প্রত্যাশাজাত বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁদের মতে, অসংখ্য ক্ষেত্রে দুটি ঘটনার সংযুক্তির পুনরাবৃত্তির প্রত্যক্ষণ থেকে ভবিষ্যতেও এর সংযুক্তির প্রত্যাশা জন্মে যা অনিবার্য সম্বন্ধের ধারণার নির্দেশ দেয়। অর্থাৎ এই সম্বন্ধ বস্তুগত নয়, মনোগত। এটি জ্ঞাতার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। এজন্যই চার্বাকদের মতে, এই সম্পর্ক নিশ্চিত নয়, বরং আকস্মিক। এজন্য কার্যকারণতত্ত্বের ব্যাখ্যায় চার্বাকদের আকস্মিকতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা হয়। আবশ্যকতা সম্পর্কিত তাঁদের এই মতবাদকে মানসিক প্রবণতা মতবাদ বলা যায়।
হিউমের দর্শনে কার্যকারণতত্ত্বের সদর্থক দিক আলোচনায় ঠিক একই দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়। হিউমও কার্যকারণের অনিবার্য সম্পর্ককে একাধিক দৃষ্টান্তের সংলগ্নতা, পারম্পর্য ও সতত সংযোজনের অভিজ্ঞতা থেকে উৎপন্ন মানসিক প্রবণতাজাত বলে আখ্যায়িত করেন। এটা মূলত অভ্যাসজাত সংযুক্তি। অর্থাৎ আবশ্যিকতা বাস্তবে নয়, বরং মনে অবস্থিত। তাই তাঁর মতবাদকেও আবশ্যিকতা সম্পর্কিত মানসিক প্রবণতা মতবাদ বলা যায়। যেহেতু আবশ্যিকতা বিষয়গত নয়, বরং বিষয়ীগত সেহেতু তা নিশ্চিত নয়, আকস্মিক। কিন্তু এক্ষেত্রে চার্বাক ও হিউমের মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। চার্বাক এই সম্পর্ককে আকস্মিক বলে শেষ করলেও হিউম এখানে থেমে যাননি। তিনি এ ব্যাখ্যাকে আরো এগিয়ে নিয়ে গেছেন যার ফলে তাঁর মতবাদ সংশয়বাদে রূপ নিয়েছে।
হিউম জ্ঞানের বিষয়কে দুই ভাগে ভাগ করেন। ধারণার সম্বন্ধ ও তথ্যগত বা বাস্তব বিষয়। ধারণার সম্বন্ধগুলোকে তিনি নিশ্চিত বলেছেন। তথ্যগত বিষয়ের জ্ঞান কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ভর। যেহেতু কার্যকারণ সম্পর্ক নিশ্চিত নয় বরং বিষয়ীগত, আকস্মিক, অনিশ্চিত ও সম্ভাব্য সেহেতু এর উপর নির্ভরশীল সকল প্রকার তথ্যগত বিষয়ের জ্ঞানও আকস্মিক অর্থাৎ নিশ্চিত নয়, সম্ভাব্য মাত্র। সুতরাং তথ্যগত বিষয়ে সার্বিক জ্ঞান সম্ভব নয়। এই মতবাদই সংশয়বাদ। এভাবে কার্য ও কারণের অনিবার্য সম্পর্কের অস্বীকৃতি সম্পর্কিত হিউমের মতবাদের চরম পরিণতি ঘটে সংশয়বাদে।
কার্যকারণ সম্পর্কের সদর্থক দিক আলোচনায় হিউম আরো কিছু বিষয়ের উল্লেখ করেছেন যা চার্বাকদের আলোচনায় পরিলক্ষিত হয় না। প্রচলিত কার্যকারণের ব্যাখ্যাকে হিউম খণ্ডন করে এর মধ্যেকার আবশ্যিকতাকে মানসিক প্রবণতা বলে আখ্যায়িত করায় কারণের নতুন সংজ্ঞাদানের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। তিনি কারণের দুটি নতুন সংজ্ঞা দেন। সংজ্ঞা দুটিতে কারণ ও কার্যকে যথাক্রমে দার্শনিক সম্বন্ধ ও প্রাকৃতিক সম্বন্ধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। তাঁর মতে, প্রচলিত অর্থে কারণ ও কার্য বলে অভিহিত দুটি ঘটনার মধ্যে আসলে দার্শনিক ও প্রাকৃতিক—এই দুটি সম্বন্ধ পরিলক্ষিত হয়। দার্শনিক সম্পর্ক বলতে তিনি দুটি ধারণার মধ্যেকার তুলনাকে এবং প্রাকৃতিক সম্পর্ক বলতে তিনি দুটি ধারণার মধ্যে অনুষঙ্গকে অর্থাৎ সান্নিধ্য, সাদৃশ্য ও পারম্পর্যের সম্পর্ককে বুঝিয়েছেন। তাই তাঁর মতে, কার্যকারণের সম্পর্ককে আবশ্যিক সম্পর্ক না বলে দার্শনিক বা প্রাকৃতিক বা উভয় প্রকার সম্পর্ক হিসেবে বিবেচনা করা সঠিক হবে।
কারণের নতুন সংজ্ঞায়ন থেকে তিনি কতগুলো অনুসিদ্ধান্তও নেন। এসব অনুসিদ্ধান্তের ফলে এরিস্টটলকৃত চার প্রকার কারণ, অর্থাৎ নিমিত্ত, উপাদান, রূপগত ও চরম কারণের মধ্যে পার্থক্য রহিত হয় এবং সব কারণই এক রকম কারণে পরিণত হয়। এছাড়া, এতে সব রকম আবশ্যিকতা একই রকম আবশ্যিকতা বলে পরিগণিত হয়। আদি কারণ অস্বীকৃত হয় এবং ধারণা করা যায় না এমন বস্তুর অস্তিত্বও অস্বীকৃত হয়। কিন্তু চার্বাক দর্শনে কার্যকারণের এসব আলোচনা অনুপস্থিত।
নির্যাস
উপরের আলোচনা থেকে কার্যকারণতত্ত্ব সম্পর্কে চার্বাক ও হিউমের মতের মধ্যে নিম্নোক্ত সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলো পরিলক্ষিত হয়।
সাদৃশ্য : (১) চার্বাক ও হিউম উভয়ের আলোচনায়ই কার্যকারণ সম্পর্কে প্রচলিত মতবাদ খণ্ডন এবং নিজস্ব মতবাদ প্রদান করা হয়েছে। উভয়ের আলোচনায়ই নঞর্থক ও সদর্থক, এই দুটি উপাদান উপস্থিত। সুতরাং আলোচনার আঙ্গিক ও পদ্ধতির ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান।
(২) উভয় মতেই কার্যকারণের অনিবার্য সম্পর্ক খণ্ডন করা হয়েছে। উভয় মতেই একথা মনে করা হয়েছে যে, কার্য ও কারণ নামক দুটি ঘটনাকে অভিজ্ঞতা দিয়ে পাওয়া যায় কিন্তু অনিবার্য সম্বন্ধকে অভিজ্ঞতায় পাওয়া যায় না। তাই এ সম্বন্ধ বিষয়ীগত, বিষয়গত নয়। অর্থাৎ আকস্মিক, অনিবার্য বা নিশ্চিত নয়। বাস্তবে এই সম্বন্ধের অস্তিত্ব নাই। এর অস্তিত্ব মনে অবস্থিত। এটি একটি মানসিক প্রত্যাশামাত্র। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির অভিজ্ঞতা থেকে এই প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ সম্বন্ধটির প্রকৃতি মনস্তাত্ত্বিক।
(৩) চার্বাক ও হিউম উভয়েই মনে করেন, কার্যকারণের সম্বন্ধকে অনিবার্য সম্বন্ধ বলে মনে করলে চক্রক অনুপপত্তি ঘটে। অবশ্য হিউম একথা প্রত্যক্ষভাবে বললেও চার্বাকগণ পরোক্ষভাবে বলেছেন। হিউম বলেছেন যে, সতত সংযোগ থেকে অনিবার্য সংযোগের ধারণা করলে যাকে প্রমাণ করতে হবে তাকে আগেই স্বীকার করে নেওয়া হয়। অর্থাৎ এতে চক্রক অনুপপত্তি ঘটে। অন্যদিকে চার্বাকদের মতে, কার্যকারণের অনিবার্য সম্বন্ধ অনুমান নির্ভর। অনুমান ব্যাপ্তি নির্ভর। ব্যাপ্তি সম্পর্ককে অনিবার্য মনে করলে চক্রক অনুপপত্তি ঘটে। অর্থাৎ কার্যকারণকে অনিবার্য সম্পর্কে সম্পর্কিত মনে করলে চক্রক অনুপপত্তি ঘটে, একথা চার্বাকগণও পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছেন।
বৈশাদৃশ্য : (১) চার্বাকগণ কেবলমাত্র প্রত্যক্ষ দ্বারা পাওয়া যায় না বলে অনিবার্য সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বুদ্ধি দ্বারা অনিবার্য সম্পর্ককে পাওয়া যায় কি না তা বিচার করে দেখেননি। এর কারণ সম্ভবত এই যে, ভারতীয় দর্শনে পাশ্চাত্য দর্শনের মতো বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ নামক দুটি জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ স্বতন্ত্র ও পরস্পর বিরোধিতা নিয়ে আবির্ভূত হয়নি। এছাড়া, চার্বাকদের পূর্ববর্তী সময়ে কার্যকারণতত্ত্বের ব্যাপক আলোচনা হয়েছে বলেও মনে হয় না। তাই তাঁরা বুদ্ধি দিয়ে এই সম্পর্ক আবিষ্কারযোগ্য কি না তা বিচার করে দেখতে প্রয়াসী হননি।
পক্ষান্তরে হিউমের মতে, শুধু অভিজ্ঞতা দ্বারা নয় বুদ্ধি দ্বারাও অনিবার্য সম্বন্ধকে পাওয়া যায় না। এছাড়া, তিনি কারণতত্ত্বের পক্ষে দেওয়া বিভিন্ন যুক্তি যেমন শক্তিতত্ত্ব, উপলক্ষবাদ, কার্যের জন্য কারণের আবশ্যকতা ইত্যাদি খণ্ডন করেছেন। এই আলোচনা চার্বাকদের আলোচনার চেয়ে অধিক বিশ্লেষণধর্মী। চার্বাকদের চেয়ে হিউমের অতিরিক্ত বিশ্লেষণধর্মী আলোচনার কারণ সম্ভবত তার কালিক পরিস্থিতি। হিউমের আগে পাশ্চাত্য দর্শনে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগে কার্যকারণ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সুতরাং নতুন মতবাদ দেওয়ার জন্য হিউমের সেসব মতবাদ বিচার করে দেখার প্রয়োজন ছিল।
(২) কার্যকারণতত্ত্বের আলোচনায় চার্বাকদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো আকস্মিকতাবাদী। তাঁরা কারণের কোনো অভিজ্ঞতাবাদী সংজ্ঞায়ন করেননি। পক্ষান্তরে, হিউম কার্যকারণতত্ত্বের সদর্থক আলোচনায় কার্যকারণকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য কারণের দুটি নতুন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন যাতে কার্যকারণকে আবশ্যিক না বলে দার্শনিক ও প্রাকৃতিক সম্পর্ক হিসেবে দেখানো হয়েছে। এছাড়া, তাঁর সংজ্ঞা থেকে কতগুলো নতুন অনুসিদ্ধান্তও টানা হয়েছে যাতে কারণ, আবশ্যিকতা ইত্যাদির নতুনতর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, প্রচলিত কার্যকারণ সম্পর্কিত ধারণাকে খণ্ডন করে নতুন ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষেত্রে চার্বাকদের চেয়ে হিউমের আলোচনা অধিকতর বিস্তৃত ও বিশ্লেষণধর্মী। হিউম চার্বাকদের অভিজ্ঞতাবাদী তথা আকস্মিকতাবাদী ধারাকে বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে এর চরম পরিণতি দান করেছেন। ফলে কার্যকারণ নির্ভর জ্ঞানের ক্ষেত্রে সংশয়বাদ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তাই রাসেলের সাথে সূর মিলিয়ে যথার্থ অর্থেই একথা বলা যায়, অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে কার্যকারণের ব্যাখ্যা হিউমের হাতে চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি লাভ করে। কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কার্যকারণতত্ত্বকে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে হিউম যে ধারণার চরম পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন চর্বাকগণই সে ধারণার পথিকৃৎ। দর্শনের ইতিহাসে চার্বাকগণ যেমন প্রথম জড়বাদী, প্রথম অভিজ্ঞতাবাদী, প্রথম দেহাত্মবাদী তেমনি কার্যকারণের ব্যাখ্যায় চার্বাকগণই প্রথম আকস্মিকতাবাদী বা আকস্মিকতাবাদের প্রবক্তা। তাই একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, বহুযুগ পূর্বে চার্বাক নামক ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় কার্যকারণ সম্পর্কে আকস্মিকতাবাদী ব্যাখ্যার যে ধারা প্রবর্তন করে গেছেন আধুনিক যুগের পাশ্চাত্য দার্শনিক ডেভিড হিউম সে ধারার উন্নততর ও চূড়ান্ত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, পদার্থবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদী কার্যকারণতত্ত্বেও চার্বাক ও হিউমের আকস্মিকতাবাদী মতের সমর্থন পাওয়া যায়।
নির্যাস
উপরে চার্বাক ও হিউমের জ্ঞানবিদ্যার তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে আমরা মূলত চারটি বিষয়ে চার্বাক ও হিউমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য লক্ষ করেছি। এই চারটি বিষয় হলো, (১) প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ, (২) অনুমান খণ্ডন, (৩) শাশ্বত আত্মার ধারণা খণ্ডন, এবং (৪) কার্যকারণের আবশ্যিকতা খণ্ডন। এই বিষয়গুলোর আলোচনায় উভয় জ্ঞানবিদ্যার মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে। এ থেকে যে দার্শনিক দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় তা-ই এখানে আমাদের আলোচ্য।
(১) প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ—এ বিষয়ে চার্বাক ও হিউমের মধ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ সাদৃশ্যগুলো পরিলক্ষিত হয়েছে তা থেকে বলা যায়, হিউম তাঁর জ্ঞানবিদ্যায় প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্বের ভিত্তিতে চরম অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদের মাধ্যমে কল্পনার সীমারেখা নির্দেশ করে সার্বিক জ্ঞানের অসম্ভাব্যতার কথা ঘোষণা করেন। তাতে পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে অভিজ্ঞতাবাদ একটি চরম ও যৌক্তিক পরিণতি লাভ করে। চার্বাক জ্ঞানবিদ্যায়ও আমরা ঠিক একই বিষয় লক্ষ করি। চার্বাকগণও প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্বের ভিত্তিতে চরম অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কল্পনার সীমারেখা নির্ণয় করে সার্বিক জ্ঞানের অসম্ভাব্যতার কথা বলেছেন। এ থেকে বলা যায়, হিউম প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণ হিসেবে আখ্যায়িত করে যে মতবাদ দিয়েছেন চার্বাক দর্শনেই সে মতবাদের ভিত্তি স্থাপন হয়েছে।
অন্যদিকে, উপর্যুক্ত বিষয়ে চার্বাক ও হিউমের মধ্যে যে বৈসাদৃশ্য তা কেবলমাত্র ব্যাখ্যার পার্থক্য। যেমন, হিউম প্রত্যক্ষের প্রকারভেদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ধারণা ও সহজাত ধারণাকে বিশ্লেষণ করে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এছাড়া ইন্দ্ৰিয়ছাপ থেকে ধারণার উৎপত্তির বিষয়টিও অধিকতর গুরুত্ব সহকারে ও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই ব্যাখ্যা চার্বাক দর্শনে দেখা যায় না। সুতরাং বলা যায়, চার্বাকদের হাতে যে চরম অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদ প্রবর্তিত হয়েছে হিউমের হাতে সে মতবাদই আরো বৈজ্ঞানিক, বিশ্লেষণাত্মক, সুদৃঢ় ভিত্তি ও উন্নত রূপলাভ করেছে।
(২) অনুমান খণ্ডন বিষয়ে চার্বাক ও হিউমের মধ্যে যে সাদৃশ্য লক্ষিত হয়েছে তা থেকে বলা যায়, উভয় জ্ঞানবিদ্যায়ই জ্ঞানোৎপত্তির যথার্থ উৎস হিসেবে আরোহের বৈধতাকে খণ্ডন করা হয়েছে। উভয় জ্ঞানবিদ্যায় আরোহানুমান খণ্ডনের পদ্ধতিও প্রায় অভিন্ন। কারণ, উভয় ক্ষেত্রেই আরোহের ভিত্তির বৈধতা খণ্ডনের মাধ্যমে আরোহকে খণ্ডন করা হয়েছে।
অন্যদিকে, শুধুমাত্র আরোহের ভিত্তি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চার্বাক ও হিউমের মধ্যে বৈসাদৃশ্য লক্ষিত হয়। চার্বাকগণ আরোহের ভিত্তিকে বলেছেন ব্যাপ্তি সম্পর্ক। হিউমের মতে এই সম্পর্ক কার্যকারণের। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে ব্যাপ্তি ও কার্যকারণ এই দুটি সম্পর্কের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। কার্যকারণ ভারতীয় দর্শনের ব্যাপ্তি সম্পর্কের বৈজ্ঞানিক নাম। সুতরাং এ ক্ষেত্রেও যে পার্থক্য রয়েছে তা শুধুমাত্র ব্যাখ্যাগত।
(৩) শাশ্বত আত্মার ধারণা খণ্ডন বিষয়েও হিউম ও চার্বাক জ্ঞানবিদ্যার অভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। উভয় জ্ঞানবিদ্যায় প্রত্যক্ষবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে শাশ্বত দেহাতিরিক্ত দ্রব্যরূপ আত্মার ধারণাকে অস্বীকার করা হয়েছে। তবে হিউম ও চার্বাকের মধ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ বৈসাদৃশ্য লক্ষিত হয় তা থেকে বলা যায়, হিউমের আত্মা সম্পর্কিত পুঞ্জবাদ জ্ঞানবিদ্যাগত, কিন্তু চার্বাকদের দেহাত্মবাদী মতবাদ জড়বাদী এবং অধিবিদ্যাগত। এছাড়া, হিউম ব্যক্তি অভিন্নতার ব্যাখ্যা দিলেও চার্বাক দর্শনে তা অনুপস্থিত। আত্মার প্রচলিত ধারণার উৎপত্তি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে হিউমের ব্যাখ্যা মনস্তাত্ত্বিক, কিন্তু চার্বাক ব্যাখ্যা সমাজতাত্ত্বিক এবং জড়বাদী।
সুতরাং বলা যায়, চার্বাকগণ শাশ্বত আত্মার ধারণা খণ্ডন বিষয়ে যে চিন্তার বীজবপন করে গেছেন হিউম যেন সে ধারণারই উত্তরসূরি। পার্থক্য কেবল স্থান, কাল ও আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটের। চার্বাকদের আত্মা সম্পর্কিত দেহাত্মবাদ ও আত্মার ধারণার উৎপত্তি সম্পর্কিত সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় যেমন সে সময়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থা তথা শ্রেণি শোষণের বিরুদ্ধে চার্বাকদের অবস্থানের প্রমাণ রয়েছে, হিউমের পুঞ্জবাদ ও প্রচলিত আত্মার ধারণার উৎপত্তি সংক্রান্ত মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় তেমনি ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও বিজ্ঞান বিপ্লবের যুগের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী সামাজিক প্রেক্ষাপটের ভূমিকা দেখা যায়।
(৪) কার্যকারণের আবশ্যকতা খণ্ডন বিষয়ে হিউম যেমন প্রত্যক্ষবাদকে উপায় হিসেবে ব্যবহার করেছেন চার্বাকগণও হিউমের বহু পূর্বে ঠিক একই উপায়ে কার্যকারণের আবশ্যিকতা খণ্ডন করেছেন। এছাড়া, উভয় জ্ঞানবিদ্যায় একথা মনে করা হয়েছে যে, এই সম্পর্ক বিষয়ীগত তথা জ্ঞাতার মানসিক প্রবণতাজাত, সর্বজনীন বা বিষয়গত নয়। এর ফলে উভয় জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ আকস্মিকতাবাদে রূপ নিয়েছে।
এ বিষয়ে হিউম ও চার্বাকদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে। যেমন, হিউম বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা উভয় উৎস থেকে কার্যকারণের ধারণাকে বিচার করে এর অসম্ভাব্যতা নিরূপণ করেছেন। তিনি আকস্মিকতাবাদ থেকে এগিয়ে গিয়ে কার্যকারণনির্ভর জ্ঞান সম্পর্কে সংশয়বাদ প্রচার করেছেন এবং কার্যকারণকে নতুনভাবে অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এর ফলে কার্য ও কারণ নামক ঘটনাদ্বয় তাদের আবশ্যিক সম্পর্ককে হারিয়ে দার্শনিক ও প্রাকৃতিক তথা পূর্ববর্তিতা ও সংলগ্নতার সম্পর্কে সম্পর্কিত হয়েছে। এসব ব্যাখ্যা চার্বাকদের কাছে পাওয়া যায় না।
সুতরাং চার্বাক দার্শনিকগণই সম্ভবত কার্যকারণের আবশ্যিকতা খণ্ডনের ধারণার পথিকৃৎ। কিন্তু তাঁদের ব্যাখ্যায় অনেক কিছুই অব্যাখ্যাত থেকে গেছে। পরবর্তীকালে হিউম যেন একই ধারণাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তিগ্রাহ্য, উন্নত ও পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যাদানে প্রয়াসী হয়েছেন।
উপরের আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্ব তথা চরম অভিজ্ঞতাবাদ, সার্বিক ও অনিবার্য জ্ঞানের উৎস হিসেবে আরোহের বৈধতা খণ্ডন, শাশ্বত আত্মার ধারণা খণ্ডন ও কার্যকারণের আবশ্যিকতা খণ্ডনের ক্ষেত্রে দর্শনের ইতিহাসে যে ধারাটি লক্ষিত হয় সে ধারাটি অত্যন্ত প্রাচীন। এই ধারার সাথে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। সাতশত খ্রিস্টপূর্ব অব্দেরও পূর্ববর্তীকালে প্রাচীন ভারতে ভেষজবিজ্ঞান তথা রসায়নশাস্ত্রের উন্নতির প্রাথমিক যুগে চার্বাক নামক দার্শনিক গোষ্ঠীর হাতে উপর্যুক্ত দার্শনিক ধারার সূচনা। আধুনিক বিজ্ঞান বিপ্লবের পরবর্তীকালের দার্শনিক হিউম সেই ধারারই আঠারো শতকের প্রতিনিধি। একটি অতি প্রাচীন দার্শনিক ধারার প্রতিনিধি হিসেবে যুগ, কাল ও সামাজিক ঐতিহাসিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে হিউমের উপর যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব বর্তেছে তা তিনি অত্যন্ত শ্রম, নিষ্ঠা, যৌক্তিকতা ও দার্শনিকতার সাথে পালন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এই প্রচেষ্টার ফল হিসেবে তিনি চার্বাক প্রতিষ্ঠিত প্রত্যক্ষবাদের উন্নততর এবং বিশ্লেষণাত্মক ব্যাখ্যা দেন। তিনি বৈজ্ঞানিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানব প্রকৃতির স্বরূপ অন্বেষণের মাধ্যমে মানুষের চিন্তার মৌলিক সূত্রাবলি আবিষ্কার করেন এবং এর মাধ্যমেই জ্ঞানোৎপত্তির উপায় হিসেবে অভিজ্ঞতাবাদকে একটি বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে প্রয়াসী হন।
ফলত, চার্বাকদের অনুমানের ভিত্তি ব্যাপ্তি সম্পর্ক হিউমের মতবাদে কার্যকারণ সম্পর্ক হিসেবে প্রতিস্থাপিত হয়। চার্বাকদের আত্মার ধারণা খণ্ডনের ক্ষেত্রে অব্যাখ্যাত ব্যক্তি অভিন্নতা তাঁর দ্বারা যেমন ব্যাখ্যাত হয় তেমনি চার্বাকদের আত্মা সম্পর্কিত জড়বাদভিত্তিক দেহাত্মবাদ মনস্তত্ত্ব নির্ভর পুঞ্জবাদী মতবাদ হিসেবে উপস্থাপিত হয়। এছাড়া, কার্যকারণের আবশ্যকতা খণ্ডন বিষয়ে চার্বাক প্রবর্তিত ধারণা উন্নত বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ লাভ করে এবং কার্যকারণ অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞাত হয়। ফলে, চার্বাক প্রবর্তিত আকস্মিকতাবাদ সংশয়বাদ পর্যন্ত এগিয়ে যায়। অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে হিউম যেন এসব বিষয়ে চার্বাক প্রবর্তিত, অনেক ক্ষেত্রে আংশিক ব্যাখ্যাত, অপরিপক্ব, অপূর্ণাঙ্গ ধারণাগুলোকে নির্দেশনা দিয়ে পূর্ণতার দিকে, বলা যায়, চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন।
হিউম চার্বাক দর্শনের সাথে পরিচিত ছিলেন কি না তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কিন্তু স্থান কালের দূরত্ব ভুলে গিয়ে দুটি জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদকে পাশাপাশি বিচার করলে মনে হয় যেন হিউমের জ্ঞানবিদ্যাগত আলোচনা চার্বাকদের চিন্তা চেতনারই উন্নততর বিশ্লেষণ এ থেকে অনুসৃত হয়, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প ও সংস্কৃতির বিস্তৃতির ধারায়, চার্বাকদের চিন্তা দেশকালের ঊর্ধ্বে ওঠে প্রাচ্য পাশ্চাত্যের গণ্ডি অতিক্রম করে, বিভিন্ন দেশের ও কালের দার্শনিকদের চিন্তাকে প্রভাবিত করেছে, প্রবাহিত হয়েছে স্থান থেকে স্থানান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে। এভাবেই হিউম হয়ে ওঠেছেন চার্বাকদের সার্থক উত্তরসূরি। তাই সতেরো শতকের হিউমের জ্ঞানবিদ্যা যেন খ্রিস্টপূর্ব যুগের চার্বাকদের চিন্তারই সময়োপযোগী ফসল। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, দার্শনিক চিন্তা, তথা জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন মতবাদ একটি নিত্য চলমান প্রক্রিয়া। মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতি যেমন এসব মতবাদ থেকে তার দিক নির্দেশনা পায় তেমনি এসব মতবাদও সভ্যতা-সংস্কৃতি থেকে গ্রহণ করে তার উপাদান। দেশ-কালের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেই এই প্রক্রিয়াটি চলমান থাকে।
তথ্যপঞ্জি
১. চতুর্থ অধ্যায়, হিউমের জ্ঞানবিদ্যা ও কার্যকারণের আবশ্যকতা খণ্ডন, দ্রষ্টব্য।
২. দ্বিতীয় অধ্যায়, চার্বাক জ্ঞানবিদ্যা ও শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব খণ্ডন, দ্রষ্টব্য।
3. S. S. Barlingay : “Distinguishables and Separables”. Indian Philosophical Quarterly, Vol. 2. 1975.
৪. প্রদীপ কুমার রায় : “মূল্য ও তথ্যের মূল্যায়ন”, দর্শন, বাংলাদেশ দর্শন সমিতির মুখপত্র, ৮ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ১৯৮৩, পৃ. 83-88।
৫. বুদ্ধ ও হিউমের আত্মা সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য : কালী প্রসন্ন দাস : “আত্মা সম্পর্কে হিউম ও বুদ্ধ : একটি তুলনামূলক আলোচনা”, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, দ্বাত্রিংশ সংখ্যা, অক্টোবর, ১৯৮৮, পৃ. ২৩৫-২৫৬।
৬. প্রথম অধ্যায়, কার্যকারণের আবশ্যকতা খণ্ডন প্রসঙ্গে, দ্রষ্টব্য।