দ্বিতীয় অধ্যায় – চার্বাক জ্ঞানবিদ্যা
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে ভারতীয় দর্শনের সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, বৌদ্ধ, জৈন, মীমাংসা ও বেদান্ত জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা করা হয়েছে। এই আটটি সম্প্রদায়ের আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ভারতীয় দর্শনের স্বীকৃত সর্বাধিক প্রমাণ ছয়টি। এই প্রমাণগুলো হলো, প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ, উপমান, অর্থাপত্তি এবং অনুপলব্ধি। মীমাংসা ও বেদান্ত দার্শনিকগণ এই ছয়টি প্রমাণ স্বীকার করেছেন। জৈন দার্শনিকগণও মোট ছয়টি প্রমাণের কথা বলেছেন। তবে তাঁদের প্রমাণগুলো উপর্যুক্ত ছয়টি প্রমাণ থেকে কিছুটা ভিন্ন। জৈন প্রমাণগুলো হলো, প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ, প্রত্যাভিজ্ঞা, স্মৃতি এবং আরোহ বা তর্ক। এককথায়, মীমাংসা, বেদান্ত এবং জৈন দর্শনেই সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রমাণ বা ছয়টি প্রমাণ স্বীকার করা হয়েছে। অন্যদিকে, এই আটটি দার্শনিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃত ন্যূনতম প্রমাণ হলো দুটি। অর্থাৎ এদের সকলেই প্রত্যক্ষ এবং অনুমান নামক দুটি প্রমাণকে স্বীকার করে নিয়েছেন। এদের কেউই বিশুদ্ধ বুদ্ধিবাদ বা বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতাবাদকে সমর্থন করেন নি। ফলে ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়কে পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মতো বুদ্ধিবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদী গোষ্ঠীতে বিভক্ত করা যায় না। চার্বাক দার্শনিকগণ এর ব্যতিক্রম। অধিবিদ্যার দিক থেকে চার্বাক দর্শন ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে যেমন একমাত্র বিশুদ্ধ জড়বাদী, জ্ঞানবিদ্যার দিক থেকে তেমনি একমাত্র বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতাবাদী। কারণ, চার্বাক দর্শনে মীমাংসা বা বেদান্তের মতো ছয়টি প্রমাণ স্বীকার করা হয়নি। আবার বৈশেষিক ও বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতো শুধু দুটি প্রমাণেরও স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বরং স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। তাঁদের মতে, প্রত্যক্ষ ভিন্ন অন্য কোনো উপায়েই যথার্থ জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়।[১]
প্রত্যক্ষই একমাত্র প্ৰমাণ
চার্বাক দার্শনিক মতবাদ জ্ঞানবিদ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত।[২] চার্বাক জ্ঞানবিদ্যা তাঁদের প্রত্যক্ষ সম্পর্কিত মতবাদের উপর নির্ভরশীল। মীমাংসা, বেদান্ত ও জৈন দর্শনে, সর্বাধিক অর্থাৎ ছয়টি প্রমাণ স্বীকার করা হলেও চার্বাক দার্শনিকগণ মাত্র একটি প্রমাণকে বৈধ বলে মনে করেন। তা হলো প্রত্যক্ষ। তাঁদের মতে, প্রত্যক্ষই বৈধ জ্ঞানের উৎস এবং ইন্দ্রিয় প্ৰত্যক্ষ বহির্ভূত সবকিছুই অনিশ্চিত। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ বহির্ভূত বলে অনুমানসহ অন্যান্য সকলপ্রকার প্রমাণের বৈধতাকেও চার্বাক দার্শনিকগণ অস্বীকার করেন।[৩] তাঁদের দর্শনকে ‘লোকায়ত’ দর্শন হিসেবে অভিহিত করারও অন্যতম কারণ হলো তাঁদের প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্ব।
ষড় ইন্দ্রিয়ে বিশ্বাসী মীমাংসা, ন্যায়, বৈশেষিক ও সাংখ্য দার্শনিকগণ মনকে স্বতন্ত্র ইন্দ্রিয় হিসেবে স্বীকার করেছেন। কিন্তু চার্বাক দার্শনিকদের মতে, মন বাহ্য ইন্দ্রিয় থেকে পৃথক নয় এবং প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রে তা বাহ্য ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ বাহ্য উদ্দীপক ও বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সংযোগে বাহ্য প্রত্যক্ষণ হয়, অতঃপর মানসিক প্রত্যক্ষণ ঘটে।
চার্বাক দর্শনে কেন প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়?—এই প্রশ্নের উত্তরে ভারতীয় দর্শনের প্রখ্যাত ভাষ্যকার মনিভদ্র দুটি কারণের কথা বলেন। প্রথমটি হলো, ধর্মের প্রবঞ্চনা এড়াবার জন্য। মনিভদ্রের ভাষায় :
এবম্ অমী অপি ধর্মচ্ছদ্ধধূর্তাঃ পরবঞ্চনপ্রবণা যৎ কিঞ্চিৎ
নুমানাগমাদিদার্ঢ্যম্,
আদর্শ ব্যর্থম্ মুগ্ধজনান্ স্বর্গাদিপ্রাপ্তিলভ্য ভোগাভোগপ্রলোভনয়া ভক্ষ্যাভক্ষ্যগম্যাগম্যহেয়োপাদেয়াদি সঙ্কটে পাতয়ন্তি,
মুগ্ধ ধার্মিকান্ধম্ চ উৎপাদয়ন্তি…।[৪]
অর্থাৎ অনুমান, আগম বা শব্দ ইত্যাদি জ্ঞানের তথাকথিত উৎসের দোহাই দিয়ে প্রতারণাপ্রবণ ধূর্তের দল সাধারণ মানুষের মনে স্বর্গপ্রাপ্তি সম্পর্কে মোহের সঞ্চার করে। এই সঙ্কট থেকে বাঁচার জন্য সাধারণ লোকের পক্ষে প্রত্যক্ষ ছাড়া আর কোনো প্রমাণ স্বীকার করা নিরাপদ নয়। দ্বিতীয় যে কারণটির কথা মনিভদ্র উল্লেখ করেন তা হলো, দারিদ্র্য ও দাসত্বের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া। মনিভদ্রের ভাষায় :
কিম চ অপ্রত্যক্ষম অপি অস্তিত্বতয়া অভ্যুপগম্যতে চেৎ জগৎ অনপহ্নুতম্ এ স্যাৎ, দরিদ্রঃ হি স্বর্ণরাশিঃ মে অস্তি ইতি অনুধ্যায় হেলোয়া এব দৌঃস্থ্যম্ দলয়েৎ, দাসঃ অপি স্বচেতসি স্বামিতাম্ অবলম্ব্য কিংকরতাম্ নিরাকুর্য্যাৎ ইতি।… এবং ন কশ্চিৎ সেব্য-সেবকভাবঃ দরিদ্রধনিভাবঃ বা স্যাৎ।[৫]
অর্থাৎ অপ্রত্যক্ষকে সত্যের সম্ভাবনা দেওয়া হলে দরিদ্রের পক্ষে তার দারিদ্র্যের কথা, দাসের পক্ষে দাসত্বের কথা ভুলে থাকা সম্ভব। কারণ, দরিদ্র ‘স্বর্ণরাশির মালিক হয়েছি’– একথা কল্পনা করে, দাস নিজেকে স্বামী মনে করে, তার নিজের অবস্থাকে অবহেলায় দমন করতে পারে। এভাবে দরিদ্র-ধনিভাব ও সেব্য-সেবকভাব সবকিছুই নস্যাৎ হয়ে যায়।
মনিভদ্রের উক্তি থেকে দেখা যায়, মানুষের দারিদ্র্য ও দাসত্বের কারণরূপে যে শোষণ রয়েছে-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই চার্বাক দর্শনের অন্যতম উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যেই চার্বাকগণ প্রত্যক্ষ ছাড়া আর কোনো প্রমাণ স্বীকার করেন নি।
মনিভদ্র নির্দেশিত উপরিলিখিত কারণ দুটিকে চার্বাকদের প্রমাণতত্ত্বের সামাজিক কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। চার্বাক দর্শনচর্চা মূলত এই সামাজিক কারণ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। চার্বাক প্রমাণতত্ত্বের পেছনে যে দার্শনিক কারণটি বিদ্যমান তাও এই সামাজিক কারণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মানুষকে অতিপ্রাকৃতের উপর নির্ভরশীলতার হাত থেকে মুক্তিদানের জন্য দর্শন থেকে অধিবিদ্যাকে বর্জন করা চার্বাকদের জন্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এই লক্ষ্য সাধনের একমাত্র যথার্থ হাতিয়ার হলো প্রত্যক্ষবাদী প্রমাণতত্ত্ব। বিশ শতকের পাশ্চাত্য যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীদের মতো চার্বাকগণও এ বিষয়টি যথার্থই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়। দর্শন থেকে সকলপ্রকার অধিবিদ্যার ধারণাকে বর্জন করা বিশুদ্ধ জড়বাদী চার্বাকদের জন্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। আলোচনার অগ্রগতিতে আমরা দেখবো যে, প্রত্যক্ষ প্রমাণের ভিত্তিতেই চার্বাকগণ দর্শন থেকে সকলপ্রকার অধিবিদ্যার ধারণাকে বর্জন করে লোকায়ত তথা ইহজাগতিক দর্শনকে জনপ্রিয় করে তুলতে প্রয়াসী হন।
চার্বাকদের মতে, প্রত্যক্ষ দু’ভাবে হতে পারে। বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ।[৬] বাহ্য বস্তুর সঙ্গে পঞ্চেন্দ্রিয়ের সংযোগের ফলে বাহ্য প্রত্যক্ষ হয়ে থাকে। যেহেতু অতীত বা ভবিষ্যতের বাহ্য প্রত্যক্ষ সম্ভব নয় সেহেতু সার্বিক জ্ঞানও সম্ভব নয়।[৭] অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ নির্ভর। কারণ, মন স্বাধীনভাবে বাহ্য বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে না। তাই মন বাহ্য ইন্দ্রিয় নির্ভর।[৮] বাহ্য প্রত্যক্ষ যেসব উপাদান সরবরাহ করে মন কেবল তার উপরই কাজ করতে পারে। মন বাহ্য ইন্দ্রিয় থেকে স্বাধীন নয়। সর্বদর্শন সংগ্রহ গ্রন্থে মাধবাচার্য বলেন, অন্তঃকরণস্য বহিরিন্দ্রিয় তন্ত্রত্বেন বাহ্যেঅর্থে স্বাতন্ত্রেণ প্রবৃত্ত্যনুপপত্তেঃ।[৯] অর্থাৎ মন বহিরিন্দ্রিয়ের উপর নির্ভলশীল হওয়ায় স্বতন্ত্রভাবে বাহ্যবস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে না।
সুতরাং অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষ বাহ্যিক প্রতক্ষের পরবর্তী। প্রত্যক্ষকে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ এই দুভাগে ভাগ করায় এবং অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষকে বাহ্য প্রত্যক্ষের উপর নির্ভরশীল এবং পরবর্তী হিসেবে চিহ্নিত করায় চার্বাক প্রত্যক্ষণের সঙ্গে আধুনিক পাশ্চাত্য দার্শনিক হিউমের প্রত্যক্ষণ সম্পর্কিত মতবাদ তথা ইন্দ্ৰিয়ছাপ ও ধারণা মতবাদের সাদৃশ্য দেখা যায়। এছাড়া, শুধু প্রত্যক্ষকে বৈধ প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করায় চার্বাক দর্শনে যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদেরও পূর্বাভাষ পাওয়া যায়।
প্রত্যক্ষের প্রকৃতি : ‘প্রত্যক্ষ’ শব্দটির দুটি অংশ, প্রতি+অক্ষ। প্রতি শব্দের অর্থ পূর্বে বা কাছাকাছি বা সম্পর্কিত, অক্ষ শব্দের অর্থ চক্ষু। সুতরাং আক্ষরিক অর্থে চক্ষুর সঙ্গে যে জ্ঞান সম্পর্কিত তা-ই প্রত্যক্ষ এবং একমাত্র চক্ষুই এর উৎস। উল্লেখ্য যে, প্রত্যক্ষকে কখনো বিশেষ্য অর্থে আবার কখনো বিশেষণ অর্থে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ্য অর্থে প্রত্যক্ষ দ্বারা প্রত্যক্ষিত জ্ঞানকে এবং বিশেষণ অর্থে প্রত্যক্ষ দ্বারা জ্ঞানের উৎসকে বোঝায়। ভারতীয় দর্শনে প্রধানত জ্ঞানের উৎস বা প্রমাণ বোঝাতেই প্রত্যক্ষ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। তাই ন্যায় দার্শনিক কেশবমিশ্র প্রমুখ প্রত্যক্ষিত জ্ঞান বোঝাতে ‘সাক্ষাৎকার’, এবং প্রত্যক্ষিত জ্ঞানের উৎস বোঝাতে ‘প্রত্যক্ষ’ শব্দটি ব্যবহার করেন।[১০]
আক্ষরিক অর্থে চাক্ষুষ জ্ঞানকে প্রত্যক্ষজ্ঞানের একমাত্র ভিত্তি বলা হলেও ভারতীয় দর্শনে প্রত্যক্ষ প্রমাণের মধ্যে সবকটি জ্ঞানেন্দ্রিয় অন্তর্ভুক্ত, এবং কমপক্ষে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ প্রমাণের মাধ্যম। চার্বাক দার্শনিকগণ প্রত্যক্ষ প্রমাণ বলতে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে প্রমাণ সাধিত হয় তাকেই বুঝিয়েছেন।
কখন একটি বিষয়কে প্রত্যক্ষ বলা হবে—এই নিয়েও ভারতীয় দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। প্রাচীন ন্যায় দার্শনিক উদ্দয়ঠাকুর প্রমুখের মতে, আক্ষরিক অর্থে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে যা সম্পর্কিত তাকেই প্রত্যক্ষের বিষয় বলা যাবে। ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে কোনো কিছুর সম্পর্ক বা সন্নিকর্ষ ঘটলেই তা প্রত্যক্ষ।[১১] অন্যদিকে, বৈশেষিক দার্শনিক প্রশস্তপদ প্রমুখের মতে, প্রত্যক্ষের উপর কোনো বিষয় নির্ভরশীল হলে তার জ্ঞানই প্রত্যক্ষ।[১২] কিন্তু নব্য-নৈয়ায়িক জয়ন্ত ভট্ট প্রমুখ প্রত্যক্ষকে একটি বিশেষ উপজাতির জ্ঞান বলেন। তাঁদের মতে, শুধু ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংযুক্ত বা ইন্দ্রিয়ের মধ্যে অবস্থিত বা ইন্দ্রিয়ের গঠনকারী বস্তুকে প্রত্যক্ষ বলা যাবে না। বরং প্রত্যক্ষ বলতে সেই সচেতনতাকে বোঝাবে যা ইন্দ্রিয় থেকে উৎপন্ন হয়।[১৩] জয়ন্ত ভট্ট প্রত্যক্ষের মধ্যে সচেতনতাকে আবশ্যিক উপাদান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করায় তাঁর মতকে বেশি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। কারণ, জ্ঞানোৎপত্তির ক্ষেত্রে জ্ঞাতার সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং সচেতনতাহীন জ্ঞাতার ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বাহ্যবস্তুর সংযোগ জ্ঞানোৎপত্তি ঘটায় না। তাই সচেতনতাহীন ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষকে প্রমাণ বলা কতটুকু সঙ্গত সে সম্পর্কে সংশয়ের অবকাশ থাকে।
চার্বাক দার্শনিকগণ প্রত্যক্ষের প্রকৃতি সম্পর্কিত এই মতকেই সমর্থন করেন। কারণ, তাঁরা মনকে বাহ্য ইন্দ্রিয় থেকে স্বতন্ত্র বলে মনে করেন না। সুতরাং ইন্দ্রিয় ও বস্তুর সংযোগের মধ্যে সবসময়ই সচেতনতা বিদ্যমান। মন বাহ্য ইন্দ্রিয় থেকে স্বতন্ত্র নয় বলে চার্বাকদের প্রত্যক্ষণের মধ্যে সচেতনতা একটি অনিবার্য উপাদান। এ জন্যেই বলা হয়, চার্বাক প্রত্যক্ষণ হলো ‘অভ্যস্ত-দেহ-প্রতিক্রিয়া’, যাকে ‘দেহজ্ঞানমাত্র’ বলা যায়। অর্থাৎ একটি মনস্তাত্ত্বিক পটভূমিতে প্রত্যক্ষণ সংঘটিত হয়। সংবেদনের পর এক ধরনের বাহ্য উদ্দীপকের ক্রমক্রিয়ার ফলে অভ্যস্ত মস্তিষ্ক বিক্রিয়াই প্রত্যক্ষণ ঘটায়। একেই আধুনিককালে ব্যাখ্যাতত্ত্ব (Interpretation Theory) বলা হয়।[১৪] সম্ভবত বার্ট্রান্ড রাসেল একেই ‘প্রাণী অভ্যাসের শারীরতাত্ত্বিক অনুমান’ বলেছেন।[১৫] যদিও চার্বাকগণ মনকে স্বতন্ত্র ইন্দ্রিয় মনে করেননি তবুও প্রত্যক্ষণের এই মনোদৈহিক দিক সম্পর্কে বুদ্ধপূর্ব যুগের চার্বাকগণ সচেতন ছিলেন বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
ভারতীয় সবগুলো দার্শনিক সম্প্রদায় প্রত্যক্ষকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করে নিলেও তাঁদের মধ্যে প্রত্যক্ষের সংজ্ঞা নিয়ে মতবিরোধ আছে। এই মতবিরোধকে বৃহত্তর অর্থে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়।[১৬] প্রথমত, প্রত্যক্ষ হলো স্বতন্ত্র (স্বলক্ষণ) বিশেষের অভ্রান্ত জ্ঞান। বৌদ্ধ দার্শনিকগণই এই মতের প্রধান সমর্থক। বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতে, নাম বা সার্বিক ধারণা, অর্থাৎ যেগুলোর মাধ্যমে আমরা সাধারণত বিশেষকে ব্যাখ্যা করে থাকি, সেগুলো প্রত্যক্ষের অন্তর্ভুক্ত নয়। এগুলো কল্পনাজাত। দ্বিতীয়ত, জ্ঞেয়বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগের ফলে যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তা-ই প্রত্যক্ষ। ন্যায় দার্শনিক গৌতম, বৈশেষিক দার্শনিক কণাদ, মীমাংসা দার্শনিক কুমারিল ভট্টসহ বেশিরভাগ দার্শনিক এই শ্রেণির অন্তর্গত। প্রত্যক্ষ সম্পর্কে তৃতীয় মত হলো, প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সরাসরি বা সাক্ষাৎ জ্ঞান। অদ্বৈত বেদান্ত, প্রভাকর মীমাংসা, নব্য-নৈয়ায়িক গঙ্গেশ, এবং চার্বাক দার্শনিকগণ এই শ্রেণির অন্তর্গত। এই শ্রেণির দার্শনিকদের মতে, দ্বিতীয় শ্রেণির মতকে মেনে নিয়ে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে জ্ঞেয় বস্তুর সংযোগকে প্রত্যক্ষ বললে স্মৃতিকেও প্রত্যক্ষের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। কারণ, ইন্দ্রিয় ও বস্তুর সংযোগে স্মৃতিজ্ঞানের উদ্ভব হয়। কিন্তু তাঁরা স্মৃতিকে প্রত্যক্ষের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি নন।
প্রত্যক্ষের প্রকার বা ধরন অনুসারে ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যায় প্রত্যক্ষকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।[১৭] প্রথমত, নির্বিকল্পই প্রত্যক্ষের একমাত্র ধরন। এতে সবিকল্প প্রত্যক্ষ অস্বীকৃত হয়েছে। বৌদ্ধগণ এই মতের প্রধান প্রতিনিধি। দ্বিতীয়ত, সবিকল্প ও নির্বিকল্প উভয়ই প্রত্যক্ষের ধরন। ন্যায় দর্শনসহ বেশিরভাগ দার্শনিক সম্প্রদায় এই মতের সমর্থক। তৃতীয়ত, সবিকল্পই প্রত্যক্ষের একমাত্র ধরন। এতে নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ অস্বীকৃত হয়েছে। চার্বাকগণ এবং বেদান্ত দর্শনের মাধব ও বল্লবগোত্র এই মতের প্রতিনিধি।
ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতি, সংখ্যা ও উপাদান : যেহেতু প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়কে অন্তর্ভুক্ত করে সেহেতু প্রত্যক্ষ সম্পর্কিত বিস্তারিত জ্ঞান পাবার জন্য ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতি, সংখ্যা, উপাদান ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা দরকার। ইন্দ্রিয়ের প্রকৃতি সম্পর্কে মতভেদ বিবেচনা করে ভারতীয় দার্শনিকগণকে তিনটি দলে বিভক্ত করা যায়।[১৮] প্রথম দলের সমর্থকদের মতে, ইন্দ্রিয় হলো এক প্রকার অঙ্গ। বৌদ্ধ দার্শনিকগণ এই মতের সমর্থক। তাঁরা ইন্দ্রিয় বলতে গোলক বা ইন্দ্রিয়গহ্বর, অর্থাৎ নাক, কান, চোখ ইত্যাদি বুঝেছেন। এগুলো দৃশ্যযোগ্য। দ্বিতীয় দলের সমর্থকদের মতে, ইন্দ্রিয় অঙ্গ নয়, বরং অঙ্গের স্বতন্ত্র শক্তি। মীমাংসা দার্শনিকগণ এই মতের সমর্থক। তৃতীয় দলের সমর্থকগণ ইন্দ্রিয়কে অঙ্গ বা অঙ্গের শক্তি কোনোটাই বলেন নি। তাঁদের মতে, ইন্দ্রিয় একটি স্বতন্ত্র দ্রব্য। এই দ্রব্য ইন্দ্রিয়লব্ধ বস্তু দ্বারা গঠিত। চার্বাক দার্শনিকগণ এই দলের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, চার্বাকদের মতে, ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ দ্বারা অর্থাৎ মাটি, জল, অগ্নি ও বায়ু, এই চতুর্ভূত দ্বারা ইন্দ্রিয় গঠিত। এসব উপাদান যেসব বস্তুতে আছে সেসব বস্তুই ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের বিষয়।
ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা নিয়েও ভারতীয় দর্শনে মতভেদ দেখা যায়।[১৯] মীমাংসা, ন্যায় ও বৈশেষিক দার্শনিকদের মতে, ইন্দ্রিয় ছয়টি। যথা চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও মন। সাংখ্য দর্শন পরোক্ষভাবে মোট তেরোটি ইন্দ্রিয় স্বীকার করেছে। অভিধর্ম মতাবলম্বী দার্শনিকগণ বৌদ্ধ বাইশটি ইন্দ্রিয় স্বীকার করেন। কিন্তু চার্বাক দর্শনে মোট পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের কথা বলা হয়েছে। তাঁদের মতে, মন স্বতন্ত্র ইন্দ্রিয় নয়। বরং মন এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের উপবস্তু।
ইন্দ্রিয়ের উপাদান সম্পর্কেও ভারতীয় দার্শনিকগণ একমত নন। সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শনে ইন্দ্রিয়ের জড়ীয় উপাদানকে অহংকার বলা হয়েছে।[২০] মীমাংসা, ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনে ইন্দ্রিয়ের জড়ীয় উপাদান হিসেবে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম এই পঞ্চভূতের কথা বলা হয়েছে।[২১] বৌদ্ধদের মতে, রূপ বা জড়দ্রব্য দ্বারা ইন্দ্রিয় গঠিত।[২২] জৈনদের মতে, পুদ্গল নামক স্বতন্ত্র দ্রব্য দ্বারা ইন্দ্রিয় গঠিত।[২৩] চার্বাকগণ মীমাংসা, ন্যায় ও বৈশেষিকদের পঞ্চভূত থেকে ব্যোম বা আকাশকে বাদ দিয়ে ক্ষিতি, অপ, তেজ, ও মরুৎ—এই চতুর্ভূতকেই সব কিছুর মূল উপাদান বলেন। সুতরাং তাঁদের মতে, ইন্দ্রিয় এই চতুর্ভুতের সমন্বয়ে গঠিত। মীমাংসা, ন্যায় ও বৈশেষিক দার্শনিকগণ পঞ্চভূতের একেকটি ভূত দ্বারা পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের একেকটি ইন্দ্রিয় গঠিত বলে মনে করেন। তাঁরা এ-ও মনে করেন যে, যে ইন্দ্রিয় যে ভূতে গঠিত সে ইন্দ্রিয় সে ভূতের বিশেষ গুণ প্রত্যক্ষ করে। তাঁদের মতে, মন কোনো বিশেষ ভূতে গঠিত নয়। তাই এর প্রত্যক্ষ সীমাহীন। কিন্তু চার্বাকগণ বিশেষ ইন্দ্ৰিয় গঠনের উপাদান হিসেবে বিশেষ ভূতের অবদান স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, চারটি ভূত সমন্বিত হয়েই পাঁচটি ইন্দ্রিয় গঠন করে। তাঁরা মনে করেন, মন এই চতুর্ভূত দ্বারা গঠিত পঞ্চ-ইন্দ্রিয়-সম্পন্ন মানবদেহের উপজাত বিষয়
সুতরাং চার্বাক প্রত্যক্ষ-প্রমাণ সম্পর্কে বলা যায় যে, চার্বাক দার্শনিকগণ ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ এই চতুর্ভূতে গঠিত পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে বাহ্য জগৎ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকেই একমাত্র বৈধ জ্ঞান বলেছেন। তাঁরা যেহেতু মানসিক প্রত্যক্ষকে বাহ্য প্রত্যক্ষের উপর নির্ভরশীল বলেছেন। সেহেতু একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, চার্বাকগণ প্রধানত বাহ্য প্রত্যক্ষকেই জ্ঞানের উপাদান সরবরাহকারী মাধ্যম বা জ্ঞানোৎপত্তির প্রাথমিক উৎস বলে স্বীকার করেছেন।
এদিক থেকে বিচার করে, ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যায় চার্বাক দার্শনিকদের চরম অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় চার্বাকদেরকে প্রত্যক্ষ-প্রমাণবাদীও বলা হয়। তাঁদের এই জ্ঞানবিদ্যাগত অবস্থান অনন্য এবং অন্য আটটি সম্প্রদায় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে চার্বাকগণ শুধুমাত্র প্রত্যক্ষকে প্রমাণ হিসেবে আখ্যায়িত করেই নিরত হন নি। তাঁরা তাদের মতবাদকে যুক্তিযুক্ত করার জন্য অনুমান ও শব্দসহ অন্যান্য সকলপ্রকার প্রমাণকে অযথার্থ বলে খণ্ডন করেন।
অনুমান প্রমাণের বৈধতা খণ্ডন
ন্যায় জ্ঞানবিদ্যায় অনুমানের বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। ন্যায় দর্শনে স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান—এই দুই প্রকার অনুমানকে স্বীকার করা হয়েছে। পরার্থানুমান পঞ্চাবয়বী।
যথা,
(ক) পর্বতে বহ্নি আছে (প্রতিজ্ঞা)।
(খ) কারণ, পর্বতে ধূম আছে (হেতু)।
(গ) যেখানে ধূম সেখানেই বহ্নি, যেমন, পাকশালা (উদাহরণ)।
(ঘ) পর্বতে ধূম আছে (উপনয়)।
(ঙ) সুতরাং, পর্বতে বহ্নি আছে (নিগমন)।
মীমাংসা, বেদান্ত, বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনেও স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমানকে স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চাবয়বী অনুমান স্বীকৃত হয় নি। বরং মীমাংসা ও বেদান্ত দর্শনে ত্রি-অবয়বী স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান, বৌদ্ধ দর্শনে ত্রি-অবয়বী পরার্থানুমান এবং জৈন দর্শনে দ্বি- অবয়বী, ত্রি-অবয়বী ও দশাবয়বী পরার্থানুমান স্বীকার করা হয়েছে।[২৪]
ন্যায় অনুমানে তিনটি পদ থাকে। সাধ্য, পক্ষ ও মধ্যপদ। উপরের উদাহরণে মধ্যপদ ধূম, সাধ্যপদ বহ্নি এবং পক্ষপদ পর্বত। এতে মধ্যপদ সাধ্য পদের অস্তিত্বের ইঙ্গিত বহনকারী চিহ্ন। মধ্যপদ সর্বদাই অনুমানের উদ্দেশ্য বা পক্ষপদের মধ্যে অস্তিত্বশীল হয়ে সাধ্যের সঙ্গে সার্বিক ও অনিবার্য সম্পর্কে সম্পর্কিত থাকে। মধ্যপদ ও সাধ্যপদের এই সার্বিক ও অনিবার্য সম্পর্কই ‘ব্যাপ্তি সম্পর্ক’।[২৫] ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে অনুমানের প্রকারভেদ ও অবয়ব নিয়ে মতভেদ থাকলেও এ ব্যাপারে সকলে একমত যে, ব্যাপ্তি সম্পর্কই অনুমানের মূল ভিত্তি। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ব্যাপ্তি সম্পর্কের অস্তিত্ব অনুমানের কারণ নয়, বরং ব্যাপ্তি সম্পর্কের জ্ঞানই অনুমানের কারণ।[২৬] কিন্তু অনুমানের ভিত্তি হলো ব্যাপ্তি সম্পর্ক। ব্যাপ্তি সম্পর্ক দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞানের সত্যতায় বিশ্বাস করার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি না থাকায় চার্বাকগণ অনুমানকে অস্বীকার করেন।[২৭] ব্যাপ্তি সম্পর্ক হলো কাৰ্য ও কারণের মধ্যে অনিবার্য সম্পর্ক। আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনে, বিশেষত হিউমের জ্ঞানবিদ্যায়, কার্যকারণের অনিবার্য সম্পর্ক অস্বীকৃত হয়েছে। নিউটনীয় পদার্থবিদ্যায় কার্যকারণের অনিবার্যতা স্বীকৃত ছিল। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদী তত্ত্বে কার্যকারণের অনিবার্যতা অস্বীকৃত হয়েছে।
চন্দ্রধর শর্মা চার্বাকদের অনুমানের বৈধতা খণ্ডনের বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে অবরোহাত্মক ও আরোহাত্মক উভয় প্রকার অনুমান খণ্ডনের পক্ষে যুক্তি উত্থাপন করেছেন। অবরোহাত্মক অনুমান চক্রক দোষে দুষ্ট। এতে সিদ্ধান্তকে সার্বিক আশ্রয়বাক্যে প্রথমেই স্বীকার করা হয় এবং তাকেই আবার সিদ্ধান্তে প্রমাণ করা হয়। কিন্তু এরূপ সার্বিক বাক্যের বৈধতা প্রমাণিত থাকে না। অন্যদিকে, আরোহাত্মক অনুমানের দ্বারা অবরোহাত্মক অনুমানের সার্বিক আশ্রয়বাক্যকে প্রমাণ করা হয়। কিন্তু আরোহ অনুমানও অনিশ্চিত। কারণ, এই অনুমান নিশ্চয়তা ছাড়াই জানা থেকে অজানার দিকে অগ্রসর হয়। প্রত্যক্ষযোগ্য বিষয়ের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ বচন সত্য হতে পারে। কিন্তু অপ্রত্যক্ষযোগ্য বিষয়ের ক্ষেত্রে এরূপ বচন সত্য হবে বলে নিশ্চয়তা নাই।[২৮] তাই সরল গণনামূলক আরোহ থেকে প্রকৃত আরোহকে পৃথক করার একমাত্র উপায় হলো, আরোহ অনুমানকে কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ভর অর্থাৎ নিয়ত বা ব্যাপ্তি সম্পর্ক নির্ভর বলে প্রমাণ করা। সুতরাং ব্যাপ্তি হলো অনুমানের মূল ভিত্তি। কিন্তু চার্বাকদের মতে ব্যাপ্তি সম্পর্ক অনিশ্চিত বা অনুমানমূলক। অনুমানমূলক সম্পর্ককে অনুমানের ভিত্তি বলে স্বীকার করলে চক্রক অনুপপত্তির উদ্ভব হয়।[২৯] ফলে আরোহ অনিশ্চিত এবং অবরোহ চক্রক দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে। তাই অনুমানকে জ্ঞানের বৈধ উপায় হিসেবে গণ্য করা যায় না। ন্যায় দর্শনে অনুমান হলো প্রত্যক্ষ বিশেষমূলক জ্ঞান।[৩০] এখানে মূলত হেতু বা লিঙ্গের সঙ্গে সাধ্য বা লিঙ্গীর নিয়ত সম্পর্কের জন্য প্রত্যক্ষের উপরই জোর দেওয়া হয়েছে। এটাই অনুমানের মূল ভিত্তি। কিন্তু চার্বাকদের মতে, লিঙ্গ ও লিঙ্গীর সম্পর্ক প্রত্যক্ষিত হলেও তা বিশেষ ঘটনার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষিত হয়। সার্বিক সম্পর্ক প্রত্যক্ষিত হয় না। অনুমানের বিরুদ্ধে চার্বাকদের মূল আপত্তি এখানেই।
ভারতীয় দর্শনের অন্য আটটি সম্প্রদায় অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করেছে। তাঁদের স্বীকৃত অনুমানের ভিত্তি হলো ব্যাপ্তি সম্পর্কের জ্ঞান। কিন্তু চার্বাকগণ অনুমানের ভিত্তি ব্যাপ্তি জ্ঞানের বৈধতা খণ্ডন করেন। এ সম্পর্কিত চার্বাকদের মত নিম্নে উপস্থাপন করা গেল :
(ক) প্রত্যক্ষের মাধ্যমে ব্যাপ্তি জ্ঞান পাওয়া যায় না। প্রত্যক্ষ দুই প্রকার : বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ। বাহ্যিক প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বস্তুর যথাযথ সংযোগের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়। কিন্তু অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল বিশেষ বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ সম্ভব নয়। তাই বাহ্য প্রত্যক্ষের মাধ্যমে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সাধ্য ও মধ্যপদের নিয়ত সংযোগ জানা যায় না। অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষের মাধ্যমেও ব্যাপ্তিজ্ঞান সম্ভব নয়। কারণ, মন ইন্দ্রিয় থেকে স্বাধীন নয়। মন কেবলমাত্র বাহ্য প্রত্যক্ষ দ্বারা ইন্দ্রিয়ের নিকট থেকে প্রাপ্ত উপাদানগুলো বিশ্লেষণ করতে পারে। যেহেতু বাহ্য প্রত্যক্ষে ব্যাপ্তি জ্ঞানকে পাওয়া যায় না এবং অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষ বাহ্য প্রত্যক্ষের দ্বারা সরবরাহকৃত উপাদানের উপর নির্ভরশীল সেহেতু অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষেও ব্যাপ্তিজ্ঞান পাওয়া যায় না। সুতরাং বলা যায়, প্রত্যক্ষে আমরা কেবল বিশেষ দৃষ্টান্ত পাই। চার্বাকদের প্রশ্ন, এ থেকে আমরা কীভাবে সকল সম্পর্কিত সার্বিক বচনে পৌঁছতে পারি? সুতরাং এ ধরনের জ্ঞান প্রমাণিত নয়।[৩১]
(খ) ব্যাপ্তিজ্ঞান সাধ্য ও মধ্য পদের জাতিবাচক জ্ঞানও নয়। কারণ, শ্রেণি ও জাতিবাচক বৈশিষ্ট্যকে প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে জানা যায় না। সুতরাং কোনো শ্রেণিবাচক বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব নাই। ন্যায়মঞ্জরী গ্রন্থে জয়ন্ত ভট্ট বলেন :
সামান্যদ্বারকোঅপ্যস্তি নাবিনাভাবনিশ্চয়।
বাস্তবং হি ন সামান্যং নাম কিং চন বিদ্যতে।[৩২]
অর্থাৎ সামান্যের (universal) ভিত্তিরূপ নিয়তসম্পর্কের নিশ্চয়তা নাই। বাস্তবে সামান্য বলতে কিছু নাই। এমনকি, প্রত্যক্ষণ দ্বারা শ্রেণিবাচক বৈশিষ্ট্য জানা গেলেও তা সকল বিশেষ সাধ্য ও মধ্যপদের মধ্যে নিয়ত সংযোগকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।[৩৩] কারণ, বিশেষ সাধ্য ও মধ্য পদের স্থান, কাল ও পাত্রের ভিন্নতার কারণে ব্যাপ্তি সকল বিশেষ দৃষ্টান্তে অস্তিত্বশীল হতে পারে না। ন্যায়মঞ্জরী গ্রন্থে বলা হয়েছে :
দেশকালদশাভেদবিচিত্ৰাত্মসু বস্তুষু।
অভিনাভাবনিয়মো ন শক্যো…।।[৩৪]
অর্থাৎ দেশ, কাল এবং অবস্থার ভিন্নতাভেদে বিচিত্র বস্তুতে নিয়ত সম্পৰ্ক সম্ভব নয়।
(গ) ব্যাপ্তির জ্ঞান অনুমানের মাধ্যমেও সম্ভব নয়। কারণ, এতে অনবস্থা বা সীমাহীন অনুক্রম দোষ ঘটে। ব্যাপ্তিকে জানার জন্য অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয়। এই অনুমান আবার ব্যাপ্তি-নির্ভর এবং এ নির্ভরতা সীমাহীন।[৩৫] সুতরাং অনুমান প্রমাণও ব্যাপ্তি জ্ঞানলাভের জন্য যথেষ্ট নয়।
(ঘ) ব্যাপ্তি জ্ঞান শব্দ-প্রমাণ দ্বারাও লাভ করা যায় না। কারণ, বৈশেষিক দার্শনিকগণ শব্দ-প্রমাণকে অনুমান নির্ভর বলে প্রমাণ করেছেন। তাছাড়া, শব্দ-প্রমাণ অনুমান নির্ভর না হলেও তাদ্বারা ব্যাপ্তি সম্পর্কে জানা যায় না। কারণ, এতে বিশ্বস্ত ব্যক্তির উচ্চারিত বচনের উপর নির্ভর করতে হয়। এখানে উচ্চারিত বচন হলো শব্দের অর্থের চিহ্ন। শব্দের অর্থের উপলব্ধি শব্দ ও এর অর্থের নিয়ত অপরিবর্তনীয় সংযোগের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং এদিক থেকেও শব্দ—প্রমাণ শব্দ ও তার অর্থের ব্যাপ্তি সম্পর্ক নির্ভর। তাই ব্যাপ্তি সম্পর্ক শব্দ-প্ৰমাণ নির্ভর হলেও অনবস্থা দোষ ঘটে।[৩৬]
(ঙ) উপমান বা তুলনা-প্রমাণ দ্বারাও ব্যাপ্তি জ্ঞানলাভ করা যায় না। কারণ, উপমান জ্ঞান হলো বচন নির্দেশিত বস্তুর (বনগাই) জ্ঞান। যেমন, বন কর্মকর্তা নির্দেশিত বচন, বনগাই গাভি-সদৃশ। সুতরাং এই জ্ঞানও বচন ও তার অর্থের নিয়ত সংযোগের জ্ঞান নির্ভর। অর্থাৎ এখানেও আবার ব্যাপ্তি-জ্ঞানের জন্য ব্যাপ্তি নির্ভরতা বা অনবস্থা দোষ ঘটে।
(চ) ব্যাপ্তি জ্ঞান সাধ্য ও মধ্যপদের নিয়ত সংযোগের জ্ঞান। নৈয়ায়িকদের মতে, ব্যাপ্তি জ্ঞান সকল প্রকার উপাধি বা শর্তমুক্ত। অর্থাৎ এই সম্পর্ক প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক। যেমন, ভিজা কাঠে আগুন লাগলে ধোঁয়া থাকে। এই দৃষ্টান্তে ভিজা কাঠ হলো ধোঁয়া থাকার শর্ত বা উপাধি। উপাধি দুই রকম হতে পারে। নিশ্চিত বা শঙ্কিত। ভিজা কাঠ আমাদের জানা তাই এখানে উপাধি নিশ্চিত। কিন্তু যে উপাধি অজানা তা শঙ্কিত উপাধি। অজানা বলে এর সম্ভাবনা সম্পূর্ণরূপে দূর করা যায় না।[৩৭] চার্বাকদের যুক্তি হলো, নৈয়ায়িকদের মত যদি যথার্থ হয়, অর্থাৎ ব্যাপ্তি—জ্ঞান যদি শর্তহীন হয় তবে তা প্রমাণের উপায় কী? সকল শর্তকে কখনোই প্রত্যক্ষ করা যায় না। সকল শর্তের অনুপস্থিতিকে অনুপলব্ধি-প্রমাণ দ্বারাও জানার উপায় নাই। কোনো বস্তু ইন্দ্রিয়ের সামনে অনুপস্থিত—একথা উপলব্ধি করতে হলে সেই বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত পূর্বজ্ঞান থাকতে হবে। সুতরাং সকল প্রকার শর্তের অনুপলব্ধির জ্ঞান অনিবার্যভাবে সকল শর্তের উপস্থিতির জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সকল শর্তের উপস্থিতির জ্ঞানও প্রত্যক্ষযোগ্য নয়। এছাড়া, সকল প্রকার শর্তের অনুপলব্ধি সম্ভব নয়। যেমন, আগুন ছাড়াও ধোঁয়ার অস্তিত্বের সন্দেহ সব সময়ই থেকে যায়। আবার যদি অনুমান, শব্দ বা উপমান দ্বারা সকল শর্তের অনুপস্থিতিকে জানার চেষ্টা করা হয় তবে পূর্বোক্ত অনুমান, শব্দ ও উপমান প্রমাণ সম্পর্কিত অসুবিধাগুলোর উদ্ভব হয়। এছাড়া, শর্তের অনুপস্থিতির জ্ঞানকে জানতে গেলেও একটি যুক্তির বৃত্ত সৃষ্টি হয়। যেমন, ব্যাপ্তি জ্ঞান শর্তের অনুপস্থিতির জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। শর্তের অনুপস্থিতি আবার শর্তের জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং ব্যাপ্তি জ্ঞান শর্তের জ্ঞান-নির্ভর।[৩৮]
(ছ) চার্বাকগণ যুক্তি দিয়ে বলেন যে, ব্যাপ্তি সম্পর্ক বিরোধিতাহীন ঐক্যের প্রত্যক্ষণ। অর্থাৎ তা সরল গণণামূলক আরোহানুমান নির্ভর। কিন্তু অতীতে বহু ঘটনার মধ্যে দুটি পদের সংযোগ থাকলেও ভবিষ্যতে থাকবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং অতীতের সম্পর্ক থেকে ভবিষ্যতের সম্পর্কের ব্যাপারে প্রত্যাশা করা যেতে পারে। কিন্তু এর দ্বারা অনিবার্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, একথা বলা যায় না।[৩৯] পৃথিবীর সকল ক্ষেত্রে আগুন ও ধোঁয়ার সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। যদি তা সম্ভব হয় তবুও এ সন্দেহ থেকেই যায় যে, আগুন ছাড়াও ধোঁয়ার অস্তিত্ব থাকতে পারে। সর্বক্ষেত্রে আগুন ও ধোঁয়ার একত্র উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা গেলেও অসংখ্য দৃষ্টান্ত পর্যবেক্ষণ করে সর্বক্ষেত্রে তাদের অনুপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। কারণ, যেসব ক্ষেত্রে আগুন অনুপস্থিত সেসব ক্ষেত্রে ধোঁয়াও অনুপস্থিত কি না—এই প্রত্যক্ষণ অসম্ভব।[৪০] আগুন ব্যতীত পৃথিবীর আর সব বস্তুই অগ্নিহীন। কিন্তু সব অগ্নিহীন বস্তু যে ধোঁয়াহীন এ বিষয় কখনও প্রত্যক্ষ করা যাবে না।
উপর্যুক্ত যুক্তিগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, চার্বাকগণ যদিও প্রত্যক্ষ ছাড়া অন্য কোনো প্রমাণকে বৈধ বলে স্বীকার করেন নি, তবুও ভারতীয় দর্শনে স্বীকৃত প্রধান প্রমাণগুলো দ্বারা বিচার করে দেখিয়েছেন যে, ব্যাপ্তি জ্ঞানকে কোনো প্রমাণ দ্বারাই লাভ করা যায় না। যেহেতু প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ ও উপমান এর কোনোটি দ্বারাই ব্যাপ্তি-জ্ঞান পাওয়া যায় না সেহেতু তাঁদের সিদ্ধান্ত হলো, ব্যাপ্তি-জ্ঞান নির্ভর অনুমান সম্ভব নয়। মাধবাচার্যের সর্বদর্শন সংগ্ৰহ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে, তম্মাবিনাভাবস্য দুর্বোধতয়া নানুমানাদ্যবকাঃ।[৪১] অর্থাৎ নিয়ত সম্পর্কের দুর্বোধ্যতাহেতু অনুমান প্রভৃতি সম্ভব নয়।
মাধ্যমিক বৌদ্ধ ও অদ্বৈত বেদান্ত অনুমানের সঙ্গে তুলনা : মাধ্যমিক শূন্যবাদী বৌদ্ধ ও অদ্বৈত বেদান্ত দার্শনিকগণও অনুমানের চূড়ান্ত বৈধতা অস্বীকার করেছেন। তবে অনেকের মতে,[৪২] চার্বাক দার্শনিকদের অনুমান খণ্ডন এবং শূন্যবাদী বৌদ্ধ ও অদ্বৈত বেদান্ত দার্শনিকদের অনুমান খণ্ডনের মধ্যে পার্থক্য আছে। কারণ, চার্বাক দার্শনিকগণ একমাত্র প্রত্যক্ষের বৈধতাকে স্বীকার করেছেন এবং অন্যান্য প্রমাণের বৈধতাকে প্রত্যক্ষের উপর নির্ভরশীল বলেছেন। কিন্তু শূন্যবাদী বৌদ্ধ ও অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে প্রত্যক্ষসহ সকলপ্রকার প্রমাণের চূড়ান্ত বৈধতাকে অস্বীকার করা হলেও সকলপ্রকার প্রমাণের অভিজ্ঞতাভিত্তিক বৈধতাকে স্বীকার করা হয়েছে। চার্বাক দার্শনিকগণ চূড়ান্ত ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক জ্ঞানের পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলে মনে হয় না।[৪৩] সুতরাং এসব পণ্ডিতের মতে, শূন্যবাদী বৌদ্ধ ও অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে অনুমানের চূড়ান্ত বৈধতাকে অস্বীকার করা হলেও অভিজ্ঞতামূলক বৈধতাকে স্বীকার করা হয়েছে, যা চার্বাকগণ করেন নি। প্রত্যক্ষের বৈধতাকে স্বীকার করে একই সময়ে একই ভিত্তি থেকে অনুমানের বৈধতাকে অস্বীকার করায় চার্বাক দার্শনিকদের বিরুদ্ধে স্ববিরোধিতার অভিযোগ আনা হয়েছে।[৪৪] কারণ, প্রত্যক্ষ বৈধ, অনুমান অবৈধ—এই মতবাদ অনুমানেরই ফল।
এছাড়া, অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে অনুমান যে বৈধ নয় তাও চার্বাকগণ অনুমান ছাড়া প্রত্যক্ষ দ্বারা জানতে পারেন না। কারণ, অন্যের চিন্তা, ধারণা ইত্যাদি অনুমানের বিষয়, প্রত্যক্ষের বিষয় নয়।
চার্বাক দার্শনিকগণ দৈনন্দিন জীবনের উপযোগী অভিজ্ঞতামূলক অনুমানসহ সকল প্রকার অনুমানের বৈধতা যথার্থই অস্বীকার করেছেন কি-না, এ বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। সপ্তম শতকের চার্বাকপন্থী দার্শনিক পুরন্দর মনে করেন, প্রত্যক্ষযোগ্য জগতে অনুমান বৈধ, কিন্তু অতীন্দ্রিয় জগতে অনুমান বৈধ নয়।[৪৫] পুরন্দরের মন্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত বলেন, দুটি বিষয়ের মধ্যে নিয়ত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হলে অনুমান সম্ভব নয়। নিয়ত সম্পর্কের দুইটি শর্ত হলো : বহু দৃষ্টান্তে উভয়কে একত্রে দর্শন, এবং বহু দৃষ্টান্তে একটির অভাবে অন্যটিরও অভাব দর্শন। কিন্তু এ জাতীয় দ্বিবিধ প্রত্যক্ষণ পারলৌকিক বিষয়ে সম্ভব নয়। তাই এ বিষয়ে নিয়ত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাও সম্ভব নয়। শুধু প্রত্যক্ষগোচর ইহলৌকিক বিষয়েই এ জাতীয় দ্বিবিধ দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষণের সম্ভাবনা আছে। তাই প্রত্যক্ষগোচর ইহলৌকিক বিষয়ে সাধারণ স্বীকৃত অনুমানের উপযোগিতা স্বীকার করা যায়।[৪৬] এ প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মত উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন :
ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যের নানা নজির অবজ্ঞা না করলে পুরন্দর নামের দার্শনিককে চার্বাক মতের প্রবক্তা বলে স্বীকার করতে হবে। অতএব পুরন্দরের উপরোক্ত বক্তব্য চার্বাক মত বলেও স্বীকার করা যায়। তাহলে চার্বাকগণ কোনো রকমের অনুমানই মানতেন না এহেন দাবিকে অত্যুক্তি বলে সন্দেহ করারও কারণ আছে। বরং বলা যায়, চার্বাকমতে পরলোকাদির অনুমান অসম্ভব হলেও প্রত্যক্ষগোচর ইহলৌকিক বিষয়ে লোক প্রসিদ্ধ অনুমান স্বীকার্য।[৪৭]
চার্বাক দার্শনিকগণ অনুমানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন—এই মতকে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন।[৪৮] কিন্তু মাধবাচার্যের মতে, চার্বাকগণ অনুমানমাত্রেরই বিরোধী। কারণ, অনুমানের ভিত্তি ব্যাপ্তি-জ্ঞান নিশ্চিত নয়। বাচস্পতি মিশ্রের বর্ণনানুসারে, জন্তু জানোয়ারের আচরণ থেকে অনুমান পরায়নতার যতটুকু পরিচয় পাওয়া যায় চার্বাকগণ তাও স্বীকার করেন নি। আধুনিক পণ্ডিতগণ বাচস্পতির বর্ণনাকে অত্যুক্তি বলে মনে করলেও মাধবাচার্যের মতকে প্রায় সকলেই যথার্থ বলে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু এতে দুটি অসুবিধার সৃষ্টি হয়। সেগুলো হলো, (ক) লৌকিকসহ সকল প্রকার অনুমানকে অস্বীকার করলে সাধারণ লোকব্যবহারই অসম্ভব হয়ে পড়ে। দৈনন্দিন জীবন হয়ে পড়ে অচল। চার্বাকগণ এতো অসাবধান ছিলেন বলে মনে হয় না। অন্যদিকে তাঁদের দর্শন লোকায়ত। অথচ লৌকিক অনুমান অস্বীকার করলে তা সাধারণের কাছে সমাদৃত হয় কীভাবে—এ প্রশ্ন থেকে যায়।
(খ) লোকায়তিকদের প্রামাণিক গাথাগুলো অনুমানের উপর নির্ভরশীল। কারণ, যজ্ঞে নিহত জীবের স্বর্গপ্রাপ্তি হলে যজ্ঞে নিহত স্বীয় পিতারও স্বর্গপ্রাপ্তি মানতে হবে, চার্বাকদের এই দাবিটিও অনুমান নির্ভর। এসব কারণে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্ত হলো :
চার্বাক মতকে খেলো প্রতিপন্ন করার উৎসাহে অনেকে বলেছেন এই মতে প্রত্যক্ষ ছাড়া আর কিছুই প্রামাণ্য নয়। অতএব চার্বাকগণ অনুমান মানেন না, … কিন্তু প্রাসঙ্গিক সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, পারলৌকিক বিষয়ে অনুমানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেও প্রত্যক্ষগোচব বা প্রত্যক্ষ অনুগামী লৌকিক অনুমান স্বীকার করায় চার্বাকদের আপত্তি ছিল না।[৪৯]
উক্ত বিতর্ক থেকে একথা প্রমাণিত হয়, চার্বাক দার্শনিকগণ প্রত্যক্ষকেই অন্যতম প্রমাণ বলে স্বীকার করেছেন। তাঁরা প্রত্যক্ষযোগ্য বিষয়ের অনুমান স্বীকার করলেও অপ্রত্যক্ষযোগ্য বিষয়ের অনুমান স্বীকার করেন নি। তবে চরম অভিজ্ঞতাবাদীদের পক্ষে কোনো অনুমানকে যৌক্তিক দিক থেকে বৈধ প্রমাণ বলে মনে করা এবং অনুমানলব্ধ জ্ঞানকে নিশ্চিত জ্ঞান বলে স্বীকার করার অবকাশ নাই। কারণ, অনুমানের ভিত্তি হেতু ও সাধ্যের মধ্যে ব্যাপ্তি সম্পর্ক প্রত্যক্ষযোগ্য নয়। অবশ্য, চরম অভিজ্ঞতাবাদীদের পক্ষে প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানকেও নিশ্চিত বলে দাবি করার অবকাশ নাই। কারণ, কোনো প্রত্যক্ষণই ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ বা অধ্যাসের সম্ভাবনা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত নয়। তাই চরম অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে যৌক্তিক দিক থেকে সকল জ্ঞানই সম্ভাব্য, এবং অতীন্দ্রিয় জ্ঞান অসম্ভব।
এদিক থেকে বিচার করে বলা যায় যে, চার্বাকদের পক্ষে প্রত্যক্ষ ছাড়া আর কোনো প্রমাণকে বৈধ হিসেবে স্বীকার করার অবকাশ ছিল না। তবে দৈনন্দিন জীবনে অনুমানের উপযোগিতাকে তাঁরা স্বীকার করতে পারেন। কেননা, দৈনন্দিন জীবনে অনেক সময় অনুমানের মাধ্যমে সফল কার্যসম্পাদন সম্ভব হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে অনুমান সত্য বা যথার্থ বলেও প্রমাণিত হয়। এ বিষয়টি সম্পর্কে চার্বাক দার্শনিকগণ অজ্ঞ বা অসচেতন ছিলেন বলে মনে হয় না। তবে তাঁদের মতে, অনুমানের সত্যতা বা যথার্থতা অনুমানের অনিবার্য বৈশিষ্ট্য নয়, বরং তা আকস্মিক। অনুমান অনিবার্যভাবে নয়, বরং আকস্মিকভাবেই সত্য হয় এবং সম্ভাব্যতা দ্বারাই আমাদের জীবন পরিচালিত হয়।[৫০] এ প্রসঙ্গে হিরিয়ানার মত বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, যুক্তি বা অনুমানের সিদ্ধান্ত যে চূড়ান্ত নয় এ প্রসঙ্গে ভারতীয় অভিজ্ঞতাবাদীরা সচেতন ছিলেন। কারণ, সকলপ্রকার যুক্তিই মূলত কিছু পরিমাণ আরোহাত্মক সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। এসব আরোহ অত্যন্ত বেশি পরিমাণে সম্ভাব্য, প্রতিপাদনযোগ্য সত্য নয়।[৫১] চার্বাকগণ মূলত তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তিবিদ্যার তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর নির্ভর করেই অনুমানের বৈধতাকে খণ্ডন করেছেন। এজন্য তাঁদেরকে চরম যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদী আখ্যা দেওয়া যায়।[৫২] অনুমানলব্ধ জ্ঞান যে নিশ্চিত নয়, বরং সম্ভাব্যমাত্র চার্বাকদের এ মতের প্রতিধ্বনি শোনা যায় সমকালীন দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের লেখায়। রাসেলও অনুমানলব্ধ জ্ঞান সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, সমগ্র জ্ঞানতত্ত্বের সবচেয়ে কঠিন সমস্যাটি সম্ভবত আরোহের সমস্যা। সমস্ত বৈজ্ঞানিক নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হয় এর সাহায্যে। অথচ একে কেন আমরা একটা বৈধ যৌক্তিক পদ্ধতি বলে বিশ্বাস করবো তা বোঝা কঠিন। কীভাবে অথবা কেন যে আরোহ যুক্তিসিদ্ধ হবে সেটা দেখানোর সমস্যা এখনও সমাধান খুঁজে পায় নি। এর সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত যুক্তিবাদী মানুষ সন্দেহ করবে যে, তার খাদ্য পুষ্টি যোগাবে কি-না এবং আগামীকাল সূর্যোদয় হবে কি-না।[৫৩]
সুতরাং রাসেলের পরিভাষা ব্যবহার করে প্রাচীন ভারতের চার্বাকদের ‘যুক্তিবাদী মানুষ ‘ বলতে দ্বিধা নেই। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ইতিমধ্যে জ্ঞাত নয় এমন জ্ঞান মূলত একটি বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে যা অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রমাণও করা যায় না, আবার খণ্ডনও করা যায় না।[৫৪] বিশ শতকের বিশ্লেষণী দার্শনিক আর. এম. চিজম-এর জ্ঞানবিদ্যায় চার্বাক মতের অনুরণন শোনা যায়। তাঁর মতে, ইংরেজ দার্শনিক উইলিয়াম হোয়েওয়েল বলেন, নিছক দৃষ্টান্তসমূহের সংকলন ঐ সব দৃষ্টান্তের উপর ভিত্তিশীল সাধারণীকরণের আবশ্যিকতার পক্ষে সামান্যতম যুক্তিও প্রদান করে না। অভিজ্ঞতা কী ঘটেছে তা নিরীক্ষণ ও লিপিবদ্ধ করতে পারে। কিন্তু যে কোনো ঘটনা বা ঘটনাসমূহের কোনো সংকলন থেকে কোন্ ঘটনাটি অবশ্যই ঘটবে তার কোনো যুক্তিই খুঁজে বের করতে পারে না।[৫৫] চিজম্ হোয়েওয়েলের এই মতকে সমর্থন করেন।[৫৬]
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ব্যাপ্তি-জ্ঞানভিত্তিক অনুমানের বৈধতার প্রশ্নে যৌক্তিক বিরোধিতা করে প্রাচীন ভারতীয় চার্বাক দার্শনিকগণ আধুনিক মননেরই পরিচয় দিয়েছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি নঞর্থক হলেও দর্শনের ইতিহাসে এর মূল্য অস্বীকার করা যায় না। কারণ, এটি হাজার হাজার বছর আগেই দার্শনিকদেরকে অনুমানের সীমা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে।[৫৭] তাই অনুমান বিরোধিতার কারণে যখন কোনো কোনো ভারতীয় দার্শনিক[৫৮] চার্বাকদের মতকে অর্থহীন বা বাজে বলে অবহেলা করেন এবং এ দর্শনকে ‘আদৌ কোনো দর্শন নয়’ বলে উড়িয়ে দিতে চান তখন সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চার্বাকদের কাছে ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসের ঋণ স্বীকার করেন। তিনি বলেন :
প্রমাণ ও প্রামাণ্য বিষয়ে চার্বাকদের মতামতের যথেষ্ট মূল্য আছে। অনুমান সম্বন্ধে চার্বাকদের যে আপত্তি, আরোহানুমানের বিরুদ্ধে আধুনিককালে সে আপত্তি উত্থাপিত হচ্ছে। চার্বাকদের ন্যায় পাশ্চাত্য কার্যকারিতাবাদী [প্রয়োগবাদী] ও দৃষ্টবাদী [প্রত্যক্ষবাদী দার্শনিকগণ স্বীকার করেন যে, অনুমান দ্বারা নিঃসন্ধিগ্ন জ্ঞানলাভ করা যায় না।[৫৯]
চার্বাকগণ দৈনন্দিন জীবনে অনুমানের উপযোগিতাকে স্বীকার করেন, এবং অনুমান যে কোনো কোনো সময় আকস্মিকভাবে সত্য হয় একথা বলেন। তাই প্রশ্ন জাগতে পারে চার্বাকদের এই স্বীকৃতি তাঁদের অনুমানের বৈধতা খণ্ডনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি-না। এর উত্তরে বলা যায়, আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, মাধ্যমিক বৌদ্ধ ও অদ্বৈত বেদান্ত দার্শনিকগণ অনুমানের চূড়ান্ত বৈধতা অস্বীকার করা সত্ত্বেও অভিজ্ঞতাভিত্তিকে অনুমানের বৈধতা স্বীকার করেছেন। এছাড়া, অনুমানলব্ধ জ্ঞানের নিশ্চয়তা সম্পর্কে যেসব পাশ্চাত্য আধুনিক বা সমকালীন দার্শনিক সংশয় প্রকাশ করেছেন তাঁরাও সকলেই দৈনন্দিন জীবনে অনুমানের উপযোগিতাকে স্বীকার করে নিয়েই তাঁদের দার্শনিক জীবন ও কার্যসম্পাদন করেছেন। এতে অনুমান সম্পর্কিত যৌক্তিক ও তাত্ত্বিক আলোচনায় স্ববিরোধিতা দেখা দিয়েছে—এই অভিযোগ দার্শনিকসূলভ নয়। রাসেল সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, কোনো এক রকমের এবং কোনো এক মাত্রায় আরোহের যুক্তিসিদ্ধতা যে থাকতেই হবে সে বিষয়ে তিনি সুনিশ্চিত। কিন্তু কীভাবে অথবা কেন আরোহ যুক্তিসিদ্ধ হবে সেটা দেখানোর সমস্যা এখনও এর সমাধান খুঁজে পায় নি। এই সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত যুক্তিসিদ্ধ মানুষ সন্দেহ করবে।[৬০] চার্বাক দার্শনিকগণও সম্ভবত এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই অনুমানের বৈধতাকে সন্দেহ করেছেন। অথচ দৈনন্দিন জীবনে এর উপযোগিতা ও আকস্মিক সত্যতা মেনে নিয়েছেন। এতে তাঁদের প্রত্যক্ষবাদী জ্ঞানতত্ত্বে অসঙ্গতি সম্পাদিত হয়েছে—একথা বলা দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক হবে বলে মনে হয় না।
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, চার্বাকদের অনুমান খণ্ডন তাঁদের প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্বের পরিপূরক। অনুমান-প্রমাণ খণ্ডন ছাড়াও চার্বাকগণ শব্দ-প্রমাণকে খণ্ডন করে তাঁদের অভিজ্ঞতাবাদকে আরো শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে প্রয়াসী হন। শব্দ-প্রমাণ খণ্ডনের একটি সামাজিক দিকও রয়েছে।
বেদ বা শব্দ প্রমাণের বৈধতা খণ্ডন
মীমাংসা, বেদান্ত, ন্যায়, সাংখ্য, যোগ প্রভৃতি দর্শনে বেদের প্রাধিকার স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু চার্বাকগণ বেদের বৈধতাকে অস্বীকার করেন। বেদের বৈধতা অস্বীকার করার ক্ষেত্রে চার্বাকদের যুক্তি হলো, বেদ মিথ্যা। বেদ স্ববিরোধিতা ও পুনরুক্তিতে পরিপূর্ণ। তাই বেদ বৈধ জ্ঞানের উৎস হওয়ার অযোগ্য।[৬১]
বেদ মিথ্যা এ কারণে যে, বেদপ্রদত্ত বচনসমূহ মিথ্যা। বেদ স্ববিরোধী কারণ, বেদপ্রদত্ত বচনসমূহ অসঙ্গতিপূর্ণ। বেদ পুনরুক্তিমূলক কারণ, একই বাক্য বেদে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং জ্ঞানের উৎস হিসেবে বেদের বৈধতা নাই।[৬২] চার্বাকদের মতে, বেদে যেসব রীতি ও অনুষ্ঠানাবলির বর্ণনা আছে সেসব অন্যান্য শ্রেণির লোকদের ঠকিয়ে জীবিকার্জনের জন্য ব্রাহ্মণদের আবিষ্কার। আধুনিককালের মার্ক্সীয় জড়বাদী দর্শন ধর্মীয় নিয়ম নীতিকে সামাজিক শ্রেণিশোষণের হাতিয়ার হিসেবে আখ্যায়িত করে যে ব্যাখ্যা দিয়েছে ভারতে বহুযুগ পূর্বে চার্বাক দর্শনে তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। চার্বাকদের মতে, ব্রাহ্মণরা ছিল বুদ্ধিমত্তা ও মানবতাবর্জিত। তারা সৎ উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারত · না। তাই তারা জীবিকার্জনের জন্য এসব রীতিনীতি ও অনুষ্ঠানাদির আবিষ্কার করে। সুতরাং বেদ হলো প্রতারকদের অবান্তর অসংলগ্ন বক্তব্য। তাদের জীবনধারণের উপায়। জীবিকার্জনের উপায় আবিষ্কারের লক্ষ্যেই তারা ধর্মীয় রীতিনীতির সৃষ্টি করেছে। সর্বদর্শন সংগ্রহ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে, এয্যা ধূর্তপ্রলাপমাত্রত্বেনাগ্নিহোত্রাদেজীবিকামাত্রপ্রয়োজনত্বাৎ।[৬৪] অর্থাৎ তিন ধরনের ব্যক্তি [ভণ্ড, ধূর্ত, নিশাচর অর্থাৎ বেদ কর্তাগণ] কেবল জীবিকার প্রয়োজনেই যজ্ঞাদিকর্মের বিধান করেছেন।
চার্বাকগণ ধর্মকে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে যাজকদের কর্ম বলেও আখ্যায়িত করেন। ধর্মে যে আত্মার সদ্গতির কথা বলা আছে তা শূন্যগর্ভ। কারণ, আত্মা ও দেহ অভিন্ন। আত্মার সদ্গতির জন্য যেসব রীতি আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলো জীবিকার্জনের জন্য ভণ্ডদের আবিষ্কার। উল্লেখ্য যে, চার্বাকগণ আত্মার সদ্গতি বিষয়ে বৈদিক ধারণাকে ভণ্ডদের আবিষ্কার বলেই বিরত হন নি, তাঁরা শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব খণ্ডন করে তাঁদের অভিমতের যৌক্তিকতাও প্রদর্শন করেন।
শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব খণ্ডন
চার্বাক দার্শনিকদের আত্মা সম্পর্কিত মতবাদও তাঁদের জ্ঞানবিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ, প্রত্যক্ষবাদী জ্ঞানবিদ্যাকে আপোসহীনভাবে সমর্থন করার মাধ্যমেই চার্বাকগণ শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব খণ্ডন করেছেন।
আত্মার ধারণা ধর্ম ও দর্শনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি সম্ভবত একটি প্রাচীনতম দার্শনিক সমস্যা।[৬৫] ভারতীয় দর্শন ও ধর্মের ইতিহাসে ঋদ্বেদ সংহিতায় প্রথম এ ধারণাটি লক্ষ করা যায়।[৬৬] হিন্দু ধর্মে পরমাত্মা ও জীবাত্মা, এই দুই ধরনের আত্মার কথা স্বীকৃত হয়েছে। উপনিষদ-পূর্ব বৈদিক সাহিত্যে এবং গীতায় ব্যক্তি আত্মার বিষয়টি বেশি পরিমাণে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র প্রভৃতিতে পরমাত্মার আলোচনা প্রাধান্য লাভ করে। বৃহদারণ্যকোপনিষদ-এ আত্মাকেই জগতের মূল সত্তা বলা হয়েছে।[৬৭] জৈন দর্শনে সাতটি তত্ত্বের কথা বলা হয়েছে।[৬৮] আত্মা এর মধ্যে একটি। আত্মা দেহ থেকে স্বতন্ত্র, নিত্য সত্তা। আত্মা জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা। ন্যায় দার্শনিকদের মতে, আত্মা দেহ, বাহ্য ইন্দ্রিয় এবং মনের অতিরিক্ত এক স্বতন্ত্র সত্তা। ন্যায় দার্শনিকগণও জৈন দার্শনিকদের মতো আত্মাকে জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা বলেছেন। বৈশেষিক দার্শনিকগণও আত্মা সম্পর্কে ন্যায় মতের অনুসারী। এই দর্শনেও আত্মাকে শাশ্বত ও সর্বব্যাপী দ্রব্য হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। মীমাংসা দার্শনিকগণও আত্মাকে দেহ মন ও বুদ্ধি থেকে ভিন্ন এক স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে বর্ণনা করেন। সাংখ্য ও যোগ দর্শন একথা মনে করে যে, আত্মা চিত্তবৃত্তি থেকে স্বতন্ত্র এক আধ্যাত্মিক সত্তা। বৌদ্ধ দর্শনে আত্মাকে স্বতন্ত্র দ্রব্য হিসেবে স্বীকার করা হয় নি। বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতে, মানসিক অবস্থার ধারাবাহিক প্ৰবাহই আত্মা।
পাশ্চাত্য দর্শনে মন ও আত্মাকে সাধারণত একই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এও মনে করা হয়েছে যে, চেতনা হলো মন বা আত্মার আবশ্যিক গুণ।[৬৯] কিন্তু ভারতীয় দর্শনে মন ও আত্মা একই অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা ও সাংখ্য দার্শনিকগণ মনকে স্বতন্ত্র ইন্দ্রিয় বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে, মন সরাসরি দুঃখ, আনন্দ, ইত্যাদি জ্ঞানের কারণ হিসেবে কাজ করে। এদিক থেকে মন অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মতো অচেতন। তবে অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো, এটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম। অন্যদিকে, সকল ভারতীয় দার্শনিকই চেতনাকে আত্মার আবশ্যিক গুণ বলে স্বীকার করেন নি। ন্যায় ও বৈশেষিক দার্শনিকদের মতে, আত্মা স্বরূপত অচেতন। চেতনা আত্মার আগন্তুক গুণ। মীমাংসা দার্শনিক প্রভাকর মিশ্রের মতে, চৈতন্য আত্মার স্বাভাবিক ধর্ম। জৈন দার্শনিকদের মতে, চেতনা আত্মার আগন্তুক গুণ নয়, বরং স্বরূপলক্ষণ। আত্মা জ্ঞাতা। সাংখ্য ও যোগ দার্শনিকদের মতে, আত্মা চৈতন্যস্বরূপ। আত্মা চৈতন্যবিশিষ্ট দ্রব্য নয়, বরং আত্মা চিৎস্বরূপ বা জ্ঞানস্বরূপ। অদ্বৈত বেদান্ত দার্শনিকদের মতে, আত্মা বিশুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ। অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে আত্মাকে শুধু জ্ঞান বা চৈতন্যস্বরূপই বলা হয় নি বরং সৎ, চিৎ ও আনন্দস্বরূপও বলা হয়েছে। সাংখ্য দার্শনিকগণ আত্মাকে চৈতন্যস্বরূপ বলেছেন, তবে আনন্দস্বরূপ বলেন নি।
চার্বাকগণ আত্মা সম্পর্কে উপরোক্ত দার্শনিক সম্প্রদায়গুলো থেকে স্বতন্ত্র মত পোষণ করেন। তাঁদের মতে, ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ অর্থাৎ যথাক্রমে মাটি, জল, অগ্নি ও বায়ু, প্রত্যক্ষযোগ্য এই চারিভূত দ্বারা জগৎ গঠিত হয়।[৭০] কোনো কোনো ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় এর সঙ্গে ব্যোম বা আকাশকে অন্তর্ভুক্ত করে পঞ্চভূতের কথা বললেও চার্বাক দার্শনিকগণ প্রত্যক্ষযোগ্য নয় বলে আকাশকে জগতের মূল উপাদানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন নি।[৭১] একই কারণে তাঁরা দেহাতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্বকেও অস্বীকার করেছেন। তাঁদের মতে, পূর্বোক্ত চতুর্ভূত যখন একটি বিশেষ পরিমাণে সমন্বিত হয়ে মানবদেহে পরিণত হয় তখন এতে চেতনা নামক গুণের উৎপত্তি হয়।[৭২] সুতরাং চেতনা দেহের আগন্তুক গুণ, দেহাতিরিক্ত কোনো দ্রব্য নয়। চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই আত্মা। তাঁদের মতে, মন হলো দেহের ক্রিয়া, অর্থাৎ জড়ের কার্য। তাই একথা বলা হয় যে, চার্বাক বা লোকায়ত চিন্তাধারার একটি বিকশিত রূপই হলো আধুনিক জে. বি. ওয়াটসনের আচরণবাদ।[৭৩] সুতরাং চার্বাকদের মতে, আত্মা স্বতন্ত্র জ্ঞাতা নয়। গুড় জাল দিলে যেমন মাদকজাতীয় পানীয় উৎপন্ন হয় তেমনি জড় পদার্থ থেকে চেতনা সৃষ্টি হয়। মাধবাচার্য এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত চার্বাক লোকগাথাটি উদ্ধৃত করেছেন :
অত্র চত্বারি ভূতানি ভূমিবাৰ্যনলানিলাঃ।
চতুর্ভ্যঃ খলু ভূতেভ্যশ্চৈতন্যমুপজায়তে।।
কিম্বাদিভ্যঃ সমেতেভ্যো দ্রব্যেভ্যো মদশক্তিবৎ।
অহং স্থূলঃ কৃশো২স্মীতি সামানাধিকরণ্যতঃ।।
দেহঃ স্থৌল্যাদিযোগাচ্চ স এবাত্মা ন চাপর
মম দেহো২য়মিত্যুক্তঃ সম্ভবেদৌপচারিকী।।[৭৪]
অর্থাৎ এখানে শুধু মাটি, পানি, আগুন ও বায়ু এই চার প্রকার ভূতবস্তুই বর্তমান। এই চার প্রকার ভূতবস্তু থেকেই চৈতন্য উৎপন্ন হয়। কিন্তু প্রভৃতি বস্তুগুলো থেকে যেমন মদশক্তি উৎপন্ন হয়, তেমনি মৌল চতুর্ভূতের পারস্পরিক ক্রিয়া বিক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিকভাবেই চৈতন্য উৎপাদিত হয়। আমি মোটা, আমি রোগা এ জাতীয় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আসলে বিশেষ্য-বিশেষণ সম্পর্কই বর্তমান। মোটা প্রভৃতি বদ্ধ দেহেরই বিশেষণ। তাই স্বতন্ত্র কোনো আত্মার কথা অবান্তর। আমার দেহ—এ জাতীয় কথা নেহাত কথার কথা, যাকে উপাচার বলা হয়।
সুতরাং চার্বাকদের মতে, দেহ থেকেই আত্মার উৎপত্তি এবং জড় দেহের ধ্বংস হলেই আত্মা ধ্বংস হয়। এ মতবাদ দেহাত্মবাদ নামে খ্যাত। দেহাত্মবাদের ধারণা বৃহাদরণ্যকোপনিষদ যাজ্ঞবল্ক্য-মৈত্রেয়ী উপাখ্যানে এবং ছান্দোগ্য উপনিষদ-এর ইন্দ্র- বিরোচন উপাখ্যানে পাওয়া যায়। বৃহদারণ্যকোপনিষদ-এ যাজ্ঞবল্ক্য মৈত্রেয়ীকে বলেন,
“এতেভ্যো ভূতেভ্যঃ সমুখায় তান্যেবানু বিনশ্যতি ন প্রেত্যসংজ্ঞাস্তীত্যরে ব্রবীমীতি হোবাচ যাজ্ঞ্যবন্ধ্যঃ”।[৭৫] অর্থাৎ এই মহান আত্মা সর্বভূত থেকে জীবাত্মারূপে প্রকাশিত হয়ে এতেই বিলীন হয়। মৃত্যুর পর এর চেতনা থাকে না। আমি যাজ্ঞবল্ক্য একথাই বলছি। এখানে যাজ্ঞ্যবন্ধ্য আত্মা সম্পর্কে জড়বাদী মত প্রদান করে দেহ ও আত্মাকে অভিন্ন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। রামায়ণ-এর জাবালিও চার্বাক মতেরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন।[৭৬] অবশ্য দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় জাবালিকে লোকায়ত বলতে নারাজ। তাঁর মতে, একথা মনে রাখা দরকার যে, রামচন্দ্রের ভর্ৎসনা শুনে জাবালি বলেন আমি আসলে নাস্তিক নই, সময় বুঝে নাস্তিক হই, আবার সময় বুঝে আস্তিক হই। অতএব তাঁকে লোকায়তিক মনে করার কোনো কারণ নেই।[৭৭]
চার্বাকদের মতে, ইন্দ্রিয় ও বস্তু উভয়ই হলো মাটি, পানি, বায়ু ও আগুনের পুঞ্জমাত্র। এই উপাদানগুলো সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষের বিষয়। উপাদানের বাইরে ইন্দ্রিয় বা বস্তু ইত্যাদির অস্তিত্ব নাই। যখন দুটি বস্তুর মধ্যে নিয়ত সংযোগ হয় তখন তারা একটি অন্যটির সঙ্গে কারণিক সম্পর্কে সম্পর্কিত হয় এবং একটি অন্যটির জড়ীয় কারণরূপে কাজ করে। বাতি ও আলো সব সময়ই একত্রে দেখা যায়। তাই বাতিই আলোর জড়ীয় কারণ। দেহ ও চেতনার মধ্যে এরকম নিয়ত সংযোগ বর্তমান। সুতরাং দেহই চেতনার জড়ীয় কারণ।[৭৮] তাই চার্বাকদের মতে, চেতনা হলো আত্মাসমন্বিত দেহ। মাধবাচার্য সর্বদর্শন সংগ্রহ গ্রন্থে বলেন, “তচ্চৈতন্যবিশিষ্টদেহ এবাত্মা।”[৭৯] অর্থাৎ চেতনাবিশিষ্ট দেহই হলো আত্মা। চেতনা দেহের উন্মেষমূলক গুণ। মাটি, পানি, বায়ু ও আগুন বিশেষ পরিমাণে সমন্বিত হয়ে যখন মানবদেহ গঠন করে তখন তাতে চেতনার উন্মেষ ঘটে। এসব উপাদান বিচ্ছিন্ন হলে চেতনাও ধ্বংস হয়।[৮০]
চার্বাক দার্শনিকদের আত্মা সম্পর্কিত ধারণার সঙ্গে আধুনিক পাশ্চাত্য জড়বাদী দার্শনিক ক্যাবাইন্স (১৭৫৭-১৮০৮) এর ধারণার মিল পাওয়া যায়। ক্যাবাইন্স আত্মা ও দেহকে প্রকৃতির দিক থেকে অভিন্ন মনে করেন। তাঁর মতে, মন হলো চেতনাসমন্বিত দেহ। দেহেরই চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা আছে।[৮১] এছাড়া, আধুনিক জড়বাদ মন সম্পর্কে উপঘটনাবাদী মতকে সমর্থন করে। উপঘটনাবাদ অনুসারে মন দেহের উপঘটনা বা উপবস্তু। এটি জড়ীয় দেহের কার্য। মার্ক্সীয় জড়বাদেও চেতনা বা মন সম্পর্কে এরূপ ধারণা পোষণ করা হয়েছে। মার্ক্সীয় জড়বাদে চেতনার প্রকৃতি নির্ণয় করতে গিয়ে বলা হয়েছে, মানুষের চেতনা হলো অত্যন্ত সুসংগঠিত অঙ্গ মস্তিষ্কেরই একটি বিশেষ গুণ। চেতনা মস্তিষ্কের অগ্রভাগের বিপুল তৎপরতার সঙ্গে জড়িত। আর মস্তিষ্কের অগ্রভাগ স্নায়ুতন্ত্রের শত শত বছরের বিবর্তন প্রক্রিয়ার পরিণতিতে বিকশিত রূপ। কার্ল মার্ক্সের মতে, আমাদের চেতনা ও চিন্তা দেহগত অঙ্গ মস্তিষ্ক থেকেই উৎপন্ন হয়। জড় থেকে চিন্তাকে পৃথক করা অসম্ভব।[৮২] লেনিনও একই মত পোষণ করেন। তাঁর মতে, মস্তিষ্কই হলো চিন্তার অঙ্গ।[৮৩] মার্ক্সীয় মতানুসারে, যে কোনো পদার্থের মধ্যেই চেতনা থাকে না। শুধু সুসংগঠিত বস্তুর মধ্যেই চেতনার সৃষ্টি হয়। চার্বাকগণও একথা বলেছেন যে, চতুর্ভূত বিশেষ পরিমাণে সমন্বিত হয়ে মানবদেহ গঠন করলেই চেতনার সৃষ্টি হয়। এই দুই মতবাদের মধ্যে মিল লক্ষিত হয়। সাম্প্রতিক বিজ্ঞানও একথা প্রমাণ করেছে যে, চেতনা হলো বস্তুর দীর্ঘ বিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সুসংগটিত উচ্চতম উপাদান। বৌদ্ধ দার্শনিকগণ মনে করেন, চেতনা অন্য কোনো দেহ উৎপন্ন করতে পারে না। চার্বাকগণও অনুরূপ মত প্রদান করেন। এ কারণেই তাঁরা পরজীবন, জন্মান্তর এবং পূর্বজন্ম অস্বীকার করেন। সাধারণত আত্মাকে জীবন, ঐচ্ছিক ক্রিয়া, চেতনা, স্মৃতি ইত্যাদির ধারক বলে মনে করা হয়।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, জীবন, ঐচ্ছিক ক্রিয়া, চেতনা, স্মৃতি এসব সর্বদা দেহাভ্যন্তরে প্রত্যক্ষিত হয়, বাইরে নয়।[৮৪] এরকম ধারণাও প্রচলিত আছে যে, দেহ হলো আত্মার ধারক এবং জানা, অনুভব করা, ইচ্ছা ইত্যাদি আত্মার গুণ। কিন্তু চার্বাক দার্শনিকদের মতে, এ ধারণা ঠিক নয়। দেহ আত্মার ধারক নয়, বরং দেহ ও আত্মা এক। জানা হলো দেহেরই গুণ। কারণ, জানা দেহের সঙ্গে অভিন্ন হিসেবে প্রত্যক্ষিত হয়। সুখ, দুঃখ, দেহের গুণ। কারণ, এগুলো দেহের মধ্যে পরিবর্তন আনয়ন করে।[৮৫] এগুলো আত্মার গুণ হলে দেহের মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারত না। কাম্য বস্তু অর্জন এবং অকাম্য বস্তু বর্জনের প্রতি দেহের সক্রিয়তা প্রত্যক্ষ করা যায়। এর দ্বারাই কাম্য ও অকাম্য প্রকাশিত হয়। তাই এগুলো দেহের বিষয়। সুতরাং জানাও দেহের বিষয়।[৮৬] আধুনিক বিজ্ঞানও জানাকে কেন্দ্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করে দৈহিক বিষয় হিসেবে ব্যাখ্যা করে। চার্বাকগণ অনুভূতিকেও জড়দেহের একটি বৈশিষ্ট্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। শান্তরক্ষিতের মতে, কম্বলাশ্বতর (৫০০ খ্রিঃ) নামক একজন চার্বাক একথা মনে করেন যে, চেতনা দেহ থেকেই জীবনীশক্তির ক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়। শান্তরক্ষিতের তত্ত্বসংগ্রহ গ্রন্থে বলা হয়েছে :
কায়াদেব এতো জ্ঞানং প্রাণাপানাদ্যধিষ্ঠিতা।
যুক্তং জায়ত ইত্যেতৎ কম্বলাশ্বতরোদিতম্।।[৮৭]
অর্থাৎ কম্বলাশ্বতর বলেন, চেতনা থেকেই গঠিত দেহ জীবনীশক্তির ক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন হয়। চার্বাকদের মতে, দেহের সঙ্গে আত্মার অভিন্নতা সাধারণ অভিজ্ঞতায়ও প্রমাণিত হয়। কেননা আমরা সাধারণত আমি স্থূল, আমি কৃশ, আমি সুন্দর, আমি কালো ইত্যাদি বলে থাকি। এখানে স্থূলতা, কৃশতা, সুন্দরত্ব ও কালোত্ব দেহের গুণ। সুতরাং দেহ চেতনাসমন্বিত আত্মার সঙ্গে অভিন্ন।[৮৮]
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, চার্বাক দার্শনিকগণ আত্মাকে দেহাতিরিক্ত স্বতন্ত্র শাশ্বত সত্তা হিসেবে স্বীকার না করে দেহেরই একটি আগন্তুক বা অর্জিত গুণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁরা দেহ ও আত্মাকে অভিন্ন হিসেবে আখ্যায়িত করে আত্মা সম্পর্কে দেহাত্মবাদী মতবাদ প্রদান করেছেন। আধুনিক বিশ্লেষণী পাশ্চাত্য দার্শনিক গিলবার্ট রাইলের সঙ্গে চার্বাকদের মতের মিল পরিলক্ষিত হয়।[৮৯] তাঁর মতে, মন, দেহ ও জড় বস্তু পৃথক ও বিচ্ছিন্ন কোনো জিনিস নয়। মন বলতে ব্যক্তির আচার আচরণের রীতি, ধরন বা পদ্ধতিকেই বোঝায়। দেহযন্ত্রে ভূতসদৃশ মনের কল্পনাকে রাইল অলীক ও অবাস্তব বলেছেন।[৯০]
সুতরাং বলা যায়, রাইল মন সম্পর্কে যে মতবাদ দিয়েছেন চার্বাকগণই সে মতবাদের আদি প্রবক্তা। চার্বাকদের আত্মার অস্তিত্ব খণ্ডনের মূল ভিত্তি হলো জড়বাদ ও প্রত্যক্ষবাদ। ডেভিড হিউমও অভিজ্ঞতাবাদের ভিত্তিতে শাশ্বত আত্মার অস্তিত্বকে খণ্ডন করেছেন। হিউম আত্মাকে রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে তুলনা করেন যা প্রত্যক্ষণ ছাড়া আর কিছুই নয়। আত্মা সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা খণ্ডনের ক্ষেত্রে চার্বাক ও হিউমের দর্শনের মধ্যে অনেকাংশে মিল পরিলক্ষিত হয়। তবে আত্মা সম্পর্কিত ইতিবাচক মতবাদ দিতে গিয়ে চার্বাকগণ যেখানে দেহাত্মবাদের কথা বলেছেন হিউম সেখানে বলেছেন পুঞ্জবাদের কথা। চার্বাকদের দেহাত্মবাদ জড়বাদভিত্তিক। কিন্তু হিউমের পুঞ্জবাদ মনস্তাত্ত্বিক। এর কারণ সম্ভবত এই যে, চার্বাকগণ প্রভাবিত হয়েছিলেন তৎকালীন ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞান বা রসায়ন বিজ্ঞান তথা আয়ুর্বেদ শাস্ত্র দ্বারা এবং তাঁদের দর্শনের মূল সুর ছিল ভাববাদ বিরোধী। অর্থাৎ তাঁরা তৎকালীন ভারতীয় সমাজে বিরাজিত ব্রাহ্মণ্যবাদের বর্ণভিত্তিক বৈষম্যবাদ বিরোধী এবং জড়বাদী ছিলেন। অন্যদিকে, হিউমের মতবাদে তাঁর সময়ের বৈজ্ঞানিক ও মনোবিজ্ঞানের উন্নতির প্রভাব ছিল স্পষ্ট। তাঁর মতবাদ ছিল বিশুদ্ধ জ্ঞানতাত্ত্বিক।
চার্বাক ও এপিকিউরিয়াস : গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরিয়াসের (৩৪১-২৭০ খ্রি. পূ.) দর্শনের সাথে চার্বাক দর্শনের দেহাত্মবাদী মতবাদের বিশেষ মিল পরিলক্ষিত হয়।[৯১] চার্বাকদের মতো এপিকিউরিয়াসও দেহ এবং আত্মাকে অভিন্ন মনে করেন। তাঁর মতে, আত্মা চারটি ভিন্ন উপজাতির অনুর যৌগস্বরূপ জড় দ্রব্য। আগুন, বায়ু, শ্বাসপ্রশ্বাস এবং এর চেয়েও সূক্ষ্ম গতিশীল পদার্থ দ্বারা আত্মা গঠিত, এবং তা মরণশীল। দেহের সঙ্গে আত্মাও তার উপাদানসমূহে পর্যবসিত হয় এবং এর শক্তি হারায়।[৯২] এজন্য এপিকিউরিয়াসের অনুসারী লিউক্রিটাস বলেন যে, মৃত্যু আমাদের জন্য কিছুই নয়। কারণ, এটা প্রমাণিত যে, মনের প্রকৃতি মরণশীল হবে।[৯৩] চার্বাকগণও আত্মা সম্পর্কে একই কথা বলেছেন। মাটি, পানি, বায়ু ও অগ্নি এই চারটি উপাদানের সমন্বয় দ্বারা দেহ গঠিত হলেই তার উন্মেষমূলক গুণ হিসেবে চেতনার উৎপত্তি হয় এবং দেহের মৃত্যুর সাথে সাথে চেতনাও এসব উপাদানসমূহে বিলুপ্ত হয়। এজন্যই চার্বাক দার্শনিকগণ মৃত্যু ও পরজন্মের ভীতিতে চিন্তিত নয়। তাঁরা বর্তমান জীবনকেই আদর্শ হিসেবে গণ্য করেন। সুতরাং দেখা যায়, গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরিয়াস খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে আত্মা সম্পর্কে যে মতবাদ পোষণ করেছেন এর বহু পূর্বেকার ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় চার্বাক ছিলেন এ মতবাদের প্রবক্তা।
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, চার্বাকগণ শাশ্বত আত্মার ধারণা খণ্ডন করে আত্মা সম্পর্কে যে দেহাত্মবাদী মতবাদ প্রদান করেছেন তা তাঁদের প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্বের পরিপূরক। প্রত্যক্ষোত্তর আত্মার ধারণাকে খণ্ডন করা ছাড়াও তাঁরা কার্যকারণের মধ্যেকার আবশ্যিক সম্পর্কের ধারণাকে প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্বের ভিত্তিতে অস্বীকার করেন। বিশ শতকের বিজ্ঞানেও এর যথেষ্ঠ সমর্থন পাওয়া যায়।
কার্যকারণতত্ত্ব খণ্ডন
কার্যকারণতত্ত্ব সম্পর্কিত চার্বাক মতবাদ তাঁদের জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কিত মতবাদের উপর নির্ভরশীল। কারণ, তাঁরা প্রত্যক্ষবাদী জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তিতেই কার্যকারণের অনিবার্য সম্পৰ্ক খণ্ডন করেছেন।
কার্যকারণতত্ত্ব দর্শন ও আধুনিক বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং স্বীকৃত তত্ত্ব। এ তত্ত্বানুসারে, প্রত্যেক ঘটনারই কোনো না কোনো কারণ থাকে এবং কার্য ও কারণ অনিবার্য সম্পর্কে সম্পর্কিত। কার্যকারণতত্ত্ব সম্পর্কে আধুনিক যুগের বিজ্ঞানী নিউটন এই মত পোষণ করেন। পাশ্চাত্য দর্শনের জনক থেলিস যখন বিশ্বের উৎপত্তির কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন তখনই কার্যকারণতত্ত্বকে স্বীকার করে নেয়া হয়। তবে থেলিসের অনেক পরে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের হাতেও কারণতত্ত্ব সুসংহত রূপলাভ করে। তিনি কোনো বস্তুর উৎপত্তির জন্য রূপ, উপাদান, নিমিত্ত ও পরিণতি—এই কারণ চতুষ্টয়ের কথা বলেন। আধুনিক যুগের প্রখ্যাত যুক্তিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল একটি বিশেষ কার্যের জন্য সর্বক্ষেত্রেই একটি বিশেষ কারণের কথা বলে বহুকারণবাদ বর্জন করেন। তিনি কার্য ও কারণের সম্পর্ককে শর্তহীন, অনিবার্য, অপরিবর্তনীয় এবং অব্যবহিত পূর্ববর্তিতা ও পরিবর্তিতার সম্পর্ক হিসেবে অভিহিত করেন। ভারতীয় দর্শনে কার্যকারণ সম্পর্কের স্বীকৃতি পরিলক্ষিত হয়। চার্বাক ছাড়া অন্য সকল ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ই অবিদ্যাকে বন্ধনের একমাত্র কারণ বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, অবিদ্যার হাত থেকে মুক্তি পেলেই মোক্ষলাভ সম্ভব। অর্থাৎ অবিদ্যা ও বন্ধনের সম্পর্ক অনিবার্য, শর্তহীন ও অপরিবর্তনীয়। বৌদ্ধ দার্শনিকগণ প্রতীত্যসমুৎপাদ্ববাদ বা কার্যকারণতত্ত্বকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁরা একে ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করে যদৃচ্ছাবাদ, স্বভাববাদ, নিয়তিবাদ ও অলৌকিকতাবাদের বিরোধী এবং শাশ্বতবাদ ও উচ্ছেদবাদের মধ্যবর্তী পন্থা হিসেবে নির্দেশ করেছেন। মূলত ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে বৌদ্ধ দর্শনেই কার্যকারণতত্ত্ব অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ও সুশৃঙ্খলভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে।
ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একমাত্র চার্বাক দর্শনেই কার্যকারণ এবং এর সার্বিকতাকে অস্বীকার করা হয়েছে। চার্বাক দার্শনিকগণ কোনো ঘটনার অপরিবর্তনীয় কারণের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না।[৯৪] চার্বাকগণ মূলত অনুমানকে অস্বীকার করার ভিত্তিতেই কার্যকারণকে অস্বীকার করেছেন। প্রত্যক্ষণে দুটি ঘটনার অভিজ্ঞতা হয়। কিন্তু দুটি ঘটনার মধ্যে একটি সম্পর্ক আছে মনে করে যদি একটিকে কারণ এবং অপরটিকে কার্য বলা হয় তবে এ কথাই স্বীকার করা হয় যে, অতীতে এই সম্পর্ক ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু বর্তমানে আমরা মাত্র দুটি ঘটনাকে প্রত্যক্ষণ করি। এই প্রত্যক্ষণের উপর ভিত্তি করে শাশ্বত অর্থাৎ অনিবার্য সম্পর্ক নির্ণয় করার অর্থ হলো অনুমানের আশ্রয় গ্রহণ করা। যেহেতু অনুমানের ভিত্তি যে ব্যাপ্তি সম্পর্ক তা প্রত্যক্ষণ করা সম্ভব নয় সেহেতু অনিবার্য কারণ বলেও কিছু নেই। অর্থাৎ কার্যকারণের অনিবার্য সম্পর্কের প্রত্যক্ষণ সম্ভব নয়।
চার্বাকদের মতে, কার্যকারণ হলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে একত্রে বহুবার প্রত্যক্ষিত পূর্বগ ও অনুগের কাল্পনিক সম্পর্ক। এসব ক্ষেত্রে একটি ঘটনার শুধু একটি পূর্বগ এবং অন্য একটি ঘটনার শুধু একটি অনুগকে প্রত্যক্ষ করা হয়। কিন্তু কোনো ঘটনার একটি অপরিবর্তনীয় পূর্বগ ও অন্য ঘটনার অপরিবর্তনীয় অনুগ প্রত্যক্ষিত হয় না। এর কারণ হলো, প্রত্যক্ষণ শুধু বিশেষ দৃষ্টান্তে সীমাবদ্ধ থাকে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল দৃষ্টান্তকে প্রত্যক্ষণ করা যায় না। অতীতে অসংখ্য ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষিত দুটি ঘটনার অনুক্রম ভবিষ্যৎ প্রতিকূল পরিবেশে ব্যর্থ হতে পারে। সুতরাং পূর্বগ ও অনুগের অনিবার্য সম্পর্ক জানা যায় না। এ সম্পর্ক আকস্মিক। চার্বাকদের মতে, সকল ঘটনাই স্বতঃস্ফূর্ত বা আকস্মিক। কণ্টকের তীক্ষ্ণতা, পক্ষী ও কীটপতঙ্গের প্রবৃত্তি, আখের মিষ্টত্ব, নিমের তিক্ততা, এগুলো সবই আকস্মিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত বা স্বাভাবিকভাবে প্রাপ্ত গুণ। এসব ঈশ্বর বা অতীন্দ্রিয় সত্তার সৃষ্টি নয়।[৯৫] চার্বাক দার্শনিকগণ নৈসর্গিক সকল বস্তুর মধ্যে এই আকস্মিকতাকেই লক্ষ করেছেন। প্রকৃতির সবকিছুই আদি মৌল উপাদান ক্ষিতি, অপ, তেজ, ও মরুৎ-এর স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত বিশেষ প্রক্রিয়ার আকস্মিক ফল।[৯৬] এতে কার্যকারণ সম্পর্ক নামক কোনো অনিবার্য বৈশিষ্ট্য আমরা প্রত্যক্ষ করি না। এছাড়া, সর্বক্ষেত্রে এই আকস্মিক সম্পর্ক ঘটবেই এমন কোনো কথা নেই। এককথায়, অনুমান নির্ভর কার্যকারণ সম্পর্ক অনিশ্চিত।[৯৭]
বিশ শতকে পাশ্চাত্য দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলও অনুমান নির্ভর কার্যকারণের আবশ্যিকতায় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, পাঠ্যপুস্তক একথা বলে যে, খ যদি অবশ্যম্ভাবীরূপে ক-এর পরে আসে তাহলে ক হলো খ-এর কারণ। মনে হয়, অবশ্যম্ভাবিতার ধারণাটা সম্পূর্ণ নরত্বারোপী ( anthropomorphic)। জগতের কোনো আবিষ্কারযোগ্য বৈশিষ্ট্যের উপর এ ধারণা নির্ভরশীল নয়। কতগুলো নিয়মানুসারে ঘটনাগুলো ঘটে, নিয়মগুলোকে সাধারণ করা যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা নিরেট তথ্য থেকে যায়।[৯৮] তিনি আরো বলেন, কারণ যেন কার্য ঘটতে বাধ্য করছে—এরূপ বাধ্যবাধকতার ধারণা আমাদের অবশ্যই থাকবে না। কার্য কারণকে বাধ্য করে—একথা বলা যেমন বিভ্রান্তিকর, কারণ কার্যকে বাধ্য করে—একথা বলাও তেমনি বিভ্রান্তিকর। বাধ্যবাধকতা নরত্বারোপী। যা ঘটে, বিজ্ঞানের সম্পর্ক কেবল তারই সঙ্গে, যা অবশ্যই ঘটবে, তার সঙ্গে নয়।[৯৯]
রাসেল একদিকে অনুমান ও কার্যকারণভিত্তিক অনিশ্চয়তাকে তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে আধুনিক পদার্থবিদ্যা ও মনোবিজ্ঞানের আলোকে অনুমান-নিরপেক্ষভাবে বাস্তবে যা যেভাবে ঘটছে তার গাণিতিক দিকটাকে বোঝাতে চেয়েছেন। তবে তিনি পদার্থগত কার্যকারণের ক্ষেত্রেও সংশয় প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, পরমাণুর মধ্যে যে ইলেকট্রন আছে সেটা লাফ দিয়ে একটা ক্ষুদ্রতর কক্ষপথে চলে যায়। কখন যে ইলেকট্রনটা লাফ দেবে সে সম্পর্কে কোনো কার্যকারণ নিয়ম আমাদের জানা নেই।[১০০] তিনি বৈজ্ঞানিক নিয়মের ক্ষেত্রেও সংশয় প্রকাশ করেন। এ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হলো, বৈজ্ঞানিক নিয়মগুলো যে সম্পূর্ণ অভ্রান্ত, এ বিষয়ে আমরা কখনো নিশ্চিত হতে পারি না। নিউটনীয় মাধ্যাকর্ষণ নিয়মের আইনস্টাইনীয় পরিবর্তনের মধ্যে এর একটি স্মরণীয় দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।[১০১]
রাসেলের এই সংশয়ের মধ্যে বহুযুগ পূর্বেকার ভারতীয় চার্বাক দার্শনিকদের কার্যকারণের আকস্মিকতাবাদের সমর্থন পাওয়া যায়। চার্বাকগণ কার্যকারণের অনিশ্চয়তাকে উপলব্ধি করে চরম জ্ঞানতাত্ত্বিক আকস্মিকতাবাদ সৃষ্টি করেছেন। অপরদিকে, রাসেল বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে পদার্থগত কার্যকারণকে গ্রহণ করেও অনিশ্চয়তায় দোদুল্যমান।[১০২]
প্রশ্ন হলো, পূর্বগ ও অনুগের মধ্যে অনিবার্য সম্পর্ক না থাকলে কার্যকারণ সম্পর্ক কেন বিশ্বাসযোগ্য হবে? এ প্রশ্নের উত্তরে চার্বাক দার্শনিকগণ মানসিক কারণের কথা বলেন। দুটি ঘটনার পূর্বগামী ও অনুগামিতার পুনরাবৃত্তির পর্যবেক্ষণ থেকে ভবিষ্যতেও সর্বক্ষেত্রে এই অনুক্রম বজায় থাকবে বলে মনে একটি প্রত্যাশা জন্মে। অসংখ্য ক্ষেত্রে দুটি ঘটনার সংযুক্তি এই প্রত্যাশা উৎপন্ন করে যে, ঘটনা দুটি সর্বক্ষেত্রে সংযুক্ত থাকবে। জয়ন্ত ভট্ট ন্যায়মঞ্জরী গ্রন্থে বলেন :
ভূয়োদৰ্শনতস্তাবদুদেতি মতিরীদৃশী।
নিয়তো২য়মনেনেতি সকল প্রাণিসাক্ষিকা।[১০৩]
অর্থাৎ বারবার প্রত্যক্ষণ থেকে এরূপ জ্ঞানের উদ্ভব হয়। এই সত্যটি সকল প্রাণীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। চার্বাক দার্শনিকদের কার্যকারণ নিয়মের এই গঠনমূলক ব্যাখ্যার সঙ্গে রাসেলের ব্যাখ্যারও মিল লক্ষিত হয়। কারণ, ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, রাসেল কার্যকারণকে নরত্বারোপী বলেছেন। এছাড়া তিনি এও বলেছেন যে, আমরা যখন কোনো প্রক্রিয়া বুঝতে পারছি বলে মনে করি তখন আসলে যা ঘটে তা হলো, একটা ঘটনা পরম্পরা অতীতের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এতো পরিচিত হয়ে উঠেছে যে, প্রত্যেক পর্যায়েই আমরা পরবর্তী পর্যায়টা আশা করি। এভাবে আমরা ‘অবশ্যম্ভাবী’ অনুক্রমের ধারণায় এসে পৌঁছাই।[১০৪] এ থেকে দেখা যায় রাসেলও, চার্বাকদের মতো, কার্যকারণের মধ্যেকার আবশ্যিক সম্পর্ককে ‘আশা’র বিষয় বা মানসিক ব্যাপার হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
উল্লেখ্য যে, রাসেলের বহু আগে অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিউম প্রত্যক্ষবাদের ভিত্তিতে কার্যকারণের আবশ্যিক সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন। তিনি একথা বলেছেন যে, কার্যকারণের আবশ্যিকতা বস্তুতে বা ঘটনায় নয়, বরং মনে অবস্থিত।[১০৫] সুতরাং একথা বলা হয়তো অসঙ্গত হবে না যে, চার্বাক দার্শনিকদের কার্যকারণ সম্পর্কের অনিবার্যতা খণ্ডন যেমন পরবর্তীকালের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক চিন্তাধারার জন্য একটি সতর্কবাণী ছিল, ঠিক তেমনি পাশ্চাত্য দর্শনে হিউমের সংশয়বাদও পরবর্তী দার্শনিক চিন্তাধারার জন্য ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, চার্বাক দার্শনিকগণ পূর্ববর্তী ও অনুবর্তী ঘটনার মধ্যে সম্পর্কের আবশ্যিকতা বা নিশ্চয়তার ধারণাকে খণ্ডন করে অনুগ ও পূর্বগের সহ- উপস্থিতির ঘটনাকে নিশ্চিতিহীন আকস্মিকতা দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন এবং কার্যকারণের ধারণাকে মানসিক প্রত্যাশাজাত ধারণা বলে অভিহিত করেছেন। এর ফলে চার্বাক দর্শনকে আকস্মিকতাবাদী বলা যায়। চার্বাক দার্শনিকদের আকস্মিকতাবাদী ধারণা বিশ শতকের দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক চিন্তায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
উল্লেখ্য যে, চার্বাকগণ অতীন্দ্ৰিয় শাশ্বত আত্মা, কার্যকারণের আবশ্যিক সম্পর্ক ইত্যাদি প্রত্যক্ষোত্তর ধারণাকে খণ্ডন করার মাধ্যমে তাঁদের অভিজ্ঞতাবাদী প্রমাণতত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। আপোষহীন প্রত্যক্ষবাদের মানদণ্ডের নিরিখে ভারতীয় দর্শনের প্রচলিত অন্যসব অতিপ্রাকৃত বা প্রত্যক্ষোত্তর ধারণাকেও তাঁরা অস্বীকার করেন। এ প্রসঙ্গে কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদের ধারণা খণ্ডন করা হলো তাঁদের অন্যতম পদক্ষেপ।
কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ খণ্ডন
চার্বাক জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ খণ্ডন তথা পূর্বজন্ম ও পরজন্ম সম্পর্কে আলোচনা প্রাসঙ্গিক বলে প্রতীয়মমান হয়। চার্বাকগণ তাঁদের প্রত্যক্ষবাদী জ্ঞানবিদ্যার আলোকেই কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদের ধারণা খণ্ডন করেন।
কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ ভারতীয় দর্শনে একটি বহুল আলোচিত ধারণা। সাধারণত দেহ থেকে স্বতন্ত্র শাশ্বত, অমর আত্মার ধারণা থেকেই কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ তথা পুনর্জন্ম ও পূর্বজন্ম ইত্যাদি ধারণার উৎপত্তি হয়। একথা মনে করা হয় যে, একই আত্মা পূর্বজন্মের কর্মফল অনুযায়ী বর্তমান জন্মলাভ করেছে, এবং এই জন্মের কর্মফল অনুযায়ী পরবর্তী জন্ম হবে। এটাই কর্মবাদ। কর্মবাদের ধারণার ভিত্তি হলো কার্যকারণতত্ত্বে বিশ্বাস। অর্থাৎ কর্ম অনুসারে ফলভোগ করতে হবে—এই তত্ত্বে বিশ্বাস। কর্মবাদের উপর জন্মান্তরবাদের ধারণা নির্ভরশীল। জন্মান্তরবাদ অনুসারে মৃত্যুর পর আত্মা নতুন দেহ ধারণ করে। জীব যে সব কর্ম করে তার ফল একজীবনে শেষ না হলে জীব নতুনভাবে জন্মগ্রহণ করে। বৌদ্ধ দার্শনিকগণ শাশ্বত আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস না করেও প্রতীত্যসমুৎপাদবাদ বা কার্যকারণ নিয়মের ভিত্তিতে কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদকে স্বীকার করেছেন। গৌতম বুদ্ধের মতে, জন্মান্তর অর্থে কোনো চিরন্তন আত্মার নতুন দেহ ধারণ নয়, বরং বর্তমান জীবন থেকে পরবর্তী জীবনের উদ্ভব। মৃত ব্যক্তি নয়, অপর এক ব্যক্তির উদ্ভব হয়। দেহ পরিবর্তন করে এমন কোনো আত্মা নাই। ব্যক্তির চরিত্রই কেবলমাত্র চলমান থাকে। কর্মের ফলেই কার্যকারণ নিয়মে পুনর্জন্ম হয়। কর্মফল থেকে মুক্তিকে বৌদ্ধ দার্শনিকগণ নির্বাণ বলেছেন।
সুতরাং দেখা যায়, ভারতীয় দর্শনে কর্মবাদ বা জন্মান্তরবাদ সমর্থনের দুটি ভিত্তি আছে। এই দুটি ভিত্তির উপর নির্ভর করে কর্মবাদে সমর্থক দার্শনিকগণ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। প্রথম শ্রেণির দার্শনিকগণ শাশ্বত আত্মার ধারণার ভিত্তিতে কর্মবাদ সমর্থন করেন। চার্বাক ও বৌদ্ধ ছাড়া ভারতীয় অন্য সকল দার্শনিক সম্প্রদায়ই এই শ্রেণিভুক্ত। বৌদ্ধ দার্শনিকগণ দ্বিতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা শাশ্বত আত্মাকে অস্বীকার করে কার্যকারণ নিয়মের ভিত্তিতে কর্মবাদ ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু চার্বাক দর্শন এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
পূর্ববর্তী আলোচনায় দেখা গেছে, চার্বাক দার্শনিকগণ প্রত্যক্ষযোগ্য নয় এমন কিছুকে স্বীকার করেন নি বলে শাশ্বত আত্মা এবং কার্যকারণতত্ত্বকে স্বীকার করেন নি। শাশ্বত আত্মা না থাকায় কর্মফল ভোগ করার জন্য কেউ থাকে না। আবার কার্যকারণ সম্পর্ক না থাকায় পূর্ববর্তী জীবনের ফলস্বরূপ পরবর্তী জীবনের উদ্ভবের সম্ভাবনাও রহিত হয়। তাই চাৰ্বাক দার্শনিকগণ পূর্বজীবনকে অস্বীকার করেন। চার্বাকদের পূর্ববর্তী জীবন অস্বীকার করা প্রসঙ্গে শান্তরক্ষিতের তত্ত্বসংগ্রহ গ্রন্থে বলা হয়েছে :
কার্যকারণতা নাস্তি বিবাদপদচেতসোঃ।
বিভিন্নদেহবৃত্তিত্বাদ্ গবাশ্বজ্ঞানযোরিব।।[১০৬]
অর্থাৎ পূর্ববর্তী চৈতন্য ও পরবর্তী চৈতন্যের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। গরু এবং অশ্বের দেহ আলাদা বলে এদের জ্ঞানও ভিন্ন। একই যুক্তিতে চার্বাকগণ পরবর্তী জীবনের অস্তিত্বও খণ্ডন করেন।
এমন যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে, চেতনার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না থাকলেও চেতনার মধ্যে শক্তির আকারে অস্তিত্বশীল ধারাবাহিকতা আছে। বৌদ্ধ দার্শনিকগণ এরূপ ধারাবাহিকতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু চার্বাক দার্শনিকদের মতে, মৃত্যুতে পূর্ববর্তী দেহ ধ্বংস হয় এবং নতুন দেহ জন্ম নেয়। এই দুটি দেহ সম্পূর্ণ আলাদা। তাই শক্তির আকারে অস্তিত্বশীল চেতনার কোনো ধারাবাহিকতাকে স্বীকার করা যায় না। সুতরাং জন্মান্তর সম্ভব নয়। তত্ত্বসংগ্রহ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে :
জ্ঞানাধারাত্ম নো২সত্ত্বেও দেহ এব তদাশ্রয়ঃ।
অন্তে দেহনিবৃত্তু চ জ্ঞানবৃত্তিঃ কিমাশ্রয়া?[১০৭]
অর্থাৎ জ্ঞানের আধাররূপ আত্মাই হলো দেহ। মৃত্যুতে দেহের ধ্বংস হলে জ্ঞানবৃত্তি কাকে আশ্রয় করে থাকবে? সুতরাং যেহেতু জন্মান্তর সম্ভব নয় সেহেতু পূর্বজন্মও নেই। এ কারণে চার্বাক দার্শনিকগণ দেহের মৃত্যুকেই মোক্ষ বলেছেন।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, চার্বাক দার্শনিকগণ ভারতীয় অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায় কর্তৃক স্বীকৃত পূর্বজন্ম ও পরজন্মের ধারণা, তথা কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদের ধারণা খণ্ডন করছেন। এই মতবাদ খণ্ডনে তাঁদের যুক্তির ভিত্তি হলো, শাশ্বত আত্মা ও কার্যকারণতত্ত্বকে অস্বীকার করা। আত্মা ও কার্যকারণতত্ত্ব খণ্ডনের ভিত্তি সরবরাহ করেছে চার্বাক প্রত্যক্ষবাদ বা অভিজ্ঞতাবাদ। সুতরাং বলা যায়, চার্বাক প্রত্যক্ষবাদী জ্ঞানতত্ত্বই তাঁদের কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ খণ্ডনের ভিত্তি রচনা করেছে। কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ খণ্ডিত হওয়ায় নৈতিকতা সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা অর্থাৎ শাশ্বত পরম নৈতিক আদর্শের ধারণাও অস্বীকৃত হয়। এতে ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে নৈতিকতা সম্পর্কিত একটি নতুন ধারার সূচনা হয়। এই ধারা তাঁদের অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
চার্বাক নীতিবিদ্যা
আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে হিউমের সংশয়বাদকে যেমন লকের অভিজ্ঞতাবাদের যৌক্তিক পরিণতি হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় তেমনি ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে চার্বাক নৈতিকতা হলো তাঁদের জ্ঞানবিদ্যার যৌক্তিক পরিণতি। ইন্দ্রিয়কেই একমাত্র বৈধ জ্ঞানের উপায় হিসেবে ধরে নিয়ে যা ইন্দ্রিগ্রাহ্য শুধু তার অস্তিত্ব স্বীকার করায়, প্রত্যক্ষযোগ্য নয় এমন কোনো নৈতিক পরম আদর্শ চার্বাকদের কাছে অস্বীকৃত হয়। তাই তাঁরা কাম বা ইন্দ্রিয় সুখকেই জীবনের পরমাদর্শ বলে অভিহিত করেন। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষিত বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ থেকেই ইন্দ্রিয় সুখ উৎপন্ন হয়। পুরুষার্থ সম্পর্কে চার্বাক মতের উল্লেখ করে মাধবাচার্যের সর্বদর্শন সংগ্রহ গ্রন্থে বলা হয়েছে :
“অঙ্গনাদ্যালিঙ্গনাদিজন্যং সুখমেব পুরুষার্থঃ।”[১০৮]
অর্থাৎ সুখউৎপন্নকারী বস্তুর সঙ্গে আলিঙ্গনজাত সুখই হলো পরম পুরুষার্থ।
চার্বাক ছাড়া অন্যসব ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় দুঃখের হাত থেকে মুক্তিকেই পুরুষার্থ বলেছেন। তবে মুক্তির প্রকৃতি বর্ণনায় তাঁদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। বৌদ্ধদের মতে, দুঃখের আত্যন্তিক মুক্তিই নির্বাণ। অষ্ঠাঙ্গিক মার্গ বা সৎ দৃষ্টি, সৎ সংকল্প, সৎ বাক্য, সৎ কর্ম, সৎ চেষ্টা, সৎ জীবিকা, সৎ স্মৃতি এবং সৎ সমাধি অনুসরণে তা লাভ করা যায়। জৈন মতে, আত্মার স্বরূপে অবস্থানই মুক্তি। ত্রিরত্ন অর্থাৎ সম্যক দর্শন, সম্যক জ্ঞান ও সম্যক চরিত্র অনুসরণ এবং পঞ্চমহাব্রত পালন, অর্থাৎ অহিংসা, সত্য, অস্তেয় বা চৌর্যবৃত্তি থেকে বিরত থাকা, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ বা সকল প্রকার আসক্তি থেকে বিরত থাকা—এ সবই মোক্ষলাভের উপায়। ন্যায়-বৈশেষিকগণও প্রায় একই মত পোষণ করেন। তাঁদের মতে, দেহ ও মনের সঙ্গে আত্মার সংযোগহীনতা বা আত্মার স্বরূপে অবস্থানই মুক্তি। শ্রবণ, মনন ও নিধিদ্যাসন মুক্তিলাভের উপায়। সাংখ্য মতে, পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতির সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং পুরুষের স্বরূপে অবস্থানই মুক্তি। পুরুষ ও প্রকৃতির ভেদজ্ঞান বা বিবেকজ্ঞানই মুক্তিলাভের উপায়। এই ভেদজ্ঞান অষ্টাঙ্গ যোগের দ্বারা সাধিত হয়। যোগ দর্শনও একই মতে বিশ্বাসী। মীমাংসকদের মতে, স্বর্গ সুখলাভই মুক্তি। যজ্ঞাদি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুক্তিলাভ ঘটে। অদ্বৈত বেদান্ত মতে, জীবাত্মা ও পরমাত্মার একাত্মতা উপলব্ধিই মুক্তি। সাধন চতুষ্টয়ের অধিকারী হয়ে বেদান্ত পাঠ মুক্তির উপায়।
এককথায়, চার্বাক ছাড়া অন্যসব ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় মোক্ষ বা মুক্তি বলতে হয় জাগতিক বন্ধন থেকে আত্মার মুক্তি, না হয় জাগতিক সুখ দুঃখের হাত থেকে চিরমুক্তিকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু চার্বাক দার্শনিকগণ যেমন শাশ্বত আত্মা বা পুনর্জন্মের ধারণায় বিশ্বাসী নন, তেমনি মানুষ জাগতিক সুখ দুঃখের হাত থেকে চিরমুক্তি পেতে পারে, এ ধারণাও তাঁরা পোষণ করতেন না। তাই তাঁরা মোক্ষ বা মুক্তি বলতে এ দুটির কোনটিকেই না বুঝিয়ে মৃত্যুকে বুঝিয়েছেন। কারণ, মৃত্যুই সবকিছুর পরিসমাপ্তি। মোক্ষতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁদের মতবাদ ইহলোকবাদী বা জাগতিকতাবাদী। চার্বাকগণ বলেন :
“কণ্টকাদিজন্যং দুঃখমেব নরকং। লোকসিদ্ধো রাজা পরমেশ্বরঃ। দেহোচ্ছেদো মোক্ষঃ। এবং ন স্বর্গোনাপবর্গো বা নৈরাত্মা পারলৌকিকঃ”।[১০৯]
অর্থাৎ কণ্টকাদির কারণে প্রাপ্ত দুঃখই নরক। অতীন্দ্রিয় ঈশ্বর নয়, বরং প্রত্যক্ষযোগ্য রাজাই সকলের শাসনকর্তা ও প্রভু বা পরমেশ্বর। তিনিই সর্বোচ্চ ক্ষমতাশীল। দেহের মৃত্যুই মোক্ষ। স্বর্গ নরক বলে কিছু নাই। শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব নাই।
মোক্ষই চার্বাক দার্শনিকদের কাছে পরম পুরুষার্থ নয়, বরং ইন্দ্রিয় সুখভোগই হলো পরম পুরুষার্থ। সম্পদকে চার্বাক দার্শনিকগণ সুখের উপায় হিসেবে মনে করেছেন। তাঁদের মতে, সুখ আত্মমূল্যে মূল্যবান। কিন্তু সুখের উপায় হিসেবে সম্পদ মূল্যবান। এভাবে, সম্পদ ও সুখ উভয়ই মানুষের পরম কাম্য। বৃহস্পতিসূত্র গ্রন্থে বলা হয়েছে, “কাম এবেক পুরুষার্থ।”[১১০] অর্থাৎ কামই পুরুষার্থ। মধ্যযুগের গ্রন্থ সর্বমত সংগ্রহ তে বলা হয়েছে, “অর্থকামাবের পুরুষার্থো, ন ধর্মঃ”।[১১১] অর্থাৎ অর্থ ও কামই পুরুষার্থ, ধর্ম পুরুষার্থ নয়। এখানে ‘কাম’ বলতে ইন্দ্রিয় সুখকে বোঝানো হয়েছে। নীতিশাস্ত্র ও কামশাস্ত্রের রচয়িতা বাৎসায়নই সম্ভবত এ মতের প্রবক্তা।[১১২] চার্বাকগণও একই মত পোষণ করে অতীন্দ্রিয় সুখকে অস্বীকার করেন। তাঁরা একথা বলেন যে, জাগতিক বা দৈহিক আনন্দ নিশ্চিত। কারণ, তা প্রত্যক্ষযোগ্য। কিন্তু অতীন্দ্রয় জগতের পারলৌকিক আনন্দ অপ্রত্যক্ষযোগ্য বিধায় অনিশ্চিত। সুতরাং প্রত্যক্ষযোগ্য জাগতিক সুখ প্রত্যাহার করে অতীন্দ্রিয় সুখ কামনা নির্বুদ্ধিতা। তাই তাঁদের পরামর্শ হলো, “পিব খাদ চ, যদ্ অতীতং তন্নতে।”[১১৩] অর্থাৎ খাও, পান কর। অতীত কখনো ফিরে আসবে না।
পারলৌকিক সুখকে অস্বীকার করে জাগতিক সুখকে কাম্য বলায় চার্বাক দার্শনিকগণকে অন্যান্য ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ের চেয়ে বেশি আশাবাদী বলে মনে হয়। কারণ, অন্যান্য সকল দার্শনিক সম্প্রদায়ই মোক্ষের জন্য জাগতিক বিষয়ের প্রতি অনীহার কথা বলে অন্তত আংশিক দুঃখবাদ ব্যক্ত করেছেন। জাগতিক বিষয়ে অনাসক্তি মানুষকে অপেক্ষাকৃত বেশি ত্যাগী ও কম আশাবাদী হতে উৎসাহী করে। সম্ভবত এজন্যই ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়গুলোকে পরিণামে না হলেও শুরুতে দুঃখবাদী বলা হয়। কিন্তু চার্বাকগণ এর ব্যতিক্রম।
জড়বাদের সমর্থক চার্বাক দার্শনিকগণ জগতের সবকিছু চতুর্ভূতে সৃষ্টি বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, মৃত্যুর পর দেহ তার উপাদান কারণে পর্যবসিত হবে। কোনো অবিনশ্বর আত্মা নাই। তাই পূর্বজন্ম, জন্মান্তর, কর্মবাদ ইত্যাদি ধারণা অমূলক। এজন্যই চার্বাকগণ জাগতিক জীবনকে আনন্দ সহকারে ভোগ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। তর্করহস্যদীপিকা গ্রন্থে গুণরত্ন সূরি চার্বাক মতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন :
“যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেত্তাবদ্ বৈষয়িকং সুখম্।
ভষ্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমণং কুতঃ।।”[১১৪]
অর্থাৎ যতদিন বাঁচ বৈষয়িক সুখ নিয়ে বাঁচ। দেহ ভষ্মীভূত হলে কীভাবে ফিরে আসবে?
প্রশ্ন ওঠে, বৈষয়িক সুখ নিয়ে বাঁচার পরামর্শ দিয়ে চার্বাকগণ পরোক্ষভাবে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও স্বেচ্ছাচারিতা অনুমোদন করেছেন কি না। এ প্রসঙ্গে দক্ষিণারঞ্জন ভট্টাচার্যের মত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। বৃহস্পতি সম্পর্কে বিরুদ্ধবাদীদের কটূক্তির উপর মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, বৃহস্পতির প্রতি তাঁর সমর্থকগণ যে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন তা থেকে বৃহস্পতি অসামাজিক কার্যকলাপ অনুমোদন করেছেন বলে মনে হয় না।[১১৫] বরং মনে হয় যে, তিনি সামাজিক শৃঙ্খলা সম্পর্কে সজাগ ছিলেন এবং তা নিশ্চিত করেছেন। লোকায়তিকেরা বৃহস্পতিকে গণপতি আখ্যা দিয়েছেন। গণপতি বলতে তাঁরা প্রকৃত গণস্বীকৃত রাষ্ট্রশাসককে বুঝিয়েছেন। গণস্বীকৃত রাষ্ট্রশাসকের এই ধারণা আধুনিক সুশৃঙ্খল গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ধারণার সঙ্গে অনেকাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই ধারণা থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়। প্রথমত, লোকায়তিকেরা সামাজিক শৃঙ্খলা সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। দ্বিতীয়ত, তৎকালীন ভারতবর্ষে বিদ্যমান শ্রেণিবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনতার ঐক্যকে তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন। দক্ষিণারঞ্জন ভট্টাচার্যের মতে, চার্বাকগণ সকল মানুষের সাম্যের প্রচারক ছিলেন। তাঁরা মনে করতেন, ব্রাহ্মণ কিংবা চণ্ডাল সকল মানুষের সুযোগ ও অধিকার সমান। দক্ষিণারঞ্জন ভট্টাচার্যের চার্বাক সম্পর্কিত এ মন্তব্য সঠিক হলে এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, চার্বাকগণ তাঁদের নীতিতত্ত্বে সামাজিক বিশৃঙ্খলার কথা বলেন নি। বরং তৎকালীন ভারতের শ্রেণিবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। ভারতীয় গবেষকদের মধ্যে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় চার্বাকদের প্রতি সবচেয়ে বেশি সুবিচার করেছেন। তিনি দক্ষিণারঞ্জন ভট্টাচার্যের সঙ্গে একমত। চার্বাকদের সমসাময়িক ভারতীয় সমাজে আনন্দের উপাদানগুলো ছিল উচ্চশ্রেণি তথা ব্রাহ্মণদের অধিকারে। তাঁরাই ছিলেন সম্পদশালী। চার্বাকগণ তাই আনন্দের উপাদানগুলোর উপর সকল মানুষের অধিকার ঘোষণা করেছেন। ফলে, চার্বাকদের এই সাম্যের দাবির মধ্যে আধুনিক শ্রেণিহীন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য যে, চার্বাকগণ যে নৈতিক বিশৃঙ্খলা প্রকাশ করেছেন তাঁর প্রমাণস্বরূপ প্রচলিত জনপ্রিয় একটি লোকগাথার উল্লেখ করা হয়। লোকগাথাটি হলো :
যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ।
ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।।
অর্থাৎ যতদিন বাঁচ সুখে বাঁচ, ঋণ করেও ঘি খাও। এই লোকগাথা চার্বাকদের নিজেদের দ্বারা প্রচারিত বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং এটি উত্তরপক্ষের চার্বাক সম্পর্কে উপহাসপ্রবণ উক্তি। চার্বাক দর্শনকে অগ্রহণযোগ্য প্রমাণ করার জন্য চার্বাক বিরোধীরা পরবর্তীকালে এই বাক্যদুটি প্রচার করেছে। কালক্রমে তা লোকায়ত নামে প্রচারিত হয়ে প্রবাদের আকার নিয়েছে এবং আজও এভাবে প্রচলিত আছে।[১১৬]
চার্বাক দার্শনিকগণ আনন্দ বা সুখকে জীবনের পরম লক্ষ্য হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁরা যে আনন্দের মধ্যে বেদনা মিশ্রিত নয় সে আনন্দকে বেদনা মিশ্রিত আনন্দের চেয়ে উৎকৃষ্টতর বলেছেন। চার্বাকগণ যখন বলেন যে, সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ইন্দ্রিয় সুখের মধ্যে সবচেয়ে কম পরিমাণ বেদনার উপস্থিতি থাকে তখনই সর্বোচ্চ ভাল নির্মিত হয়, তখন তাঁদের মতবাদে বিশ শতকের স্থূল উপযোগবাদী নীতিদার্শনিক জেরেমি বেনথামের মতের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যা ইন্দ্রিয় সুখ উৎপাদনে সহায়ক তাই ন্যায়, যা দেহের বেদনা উৎপন্ন করে তা অন্যায়, এটি যেমন চার্বাকদের কথা তেমনি স্থূল সুখবাদীদেরও মূল কথা। তবে চার্বাকগণ দৈহিক বা ইন্দ্রিয়জাত আনন্দের কথা বলেছেন বলে তাঁদের মতবাদকে স্থূল সুখবাদ মনে করার কারণ নেই যেহেতু দেহাত্মবাদী চার্বাক দার্শনিকগণ আত্মার অস্তিত্বই স্বীকার করেন নি সেহেতু ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তিতেই তাঁরা আনন্দকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন।[১১৭] এছাড়া তাঁদের হাতে কোনো বিকল্প ছিল বলে মনে হয় না। সর্বোপরি, দৈহিক ও মানসিক আনন্দের মধ্যে যে পার্থক্য আছে, অর্থাৎ জন স্টুয়ার্ট মিল যেভাবে সুখের গুণগত পার্থক্যের কথা বলে সূক্ষ্ম সুখবাদ প্রচার করেছেন, সুখ বা আনন্দের এরূপ বিশ্লেষণী ধারণা সম্পর্কে চার্বাকগণ তখনকার যুগে সচেতন থাকবেন এমন আশা করাও যুক্তিগ্রাহ্য নয়। তাই ইন্দ্রিয় সুখকে পরম উদ্দেশ্য বলার কারণে চার্বাক দার্শনিকদের স্থূল সুখবাদী বা ভোগবাদী বলে আখ্যায়িত করলে তাঁদের প্রতি অবিচার করা হবে বলেই মনে হয়।
আমরা পূর্বেই দেখেছি, চার্বাক দার্শনিকগণ সকল মানুষের সাম্যের কথা বলে আনন্দের উপাদানগুলোর উপর মানুষের সমঅধিকারের কথা বলেছেন। এ থেকে বরং তাঁদের মতবাদে আধুনিক সর্ববাদী সুখবাদের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাঁদের নীতিতত্ত্বের সামাজিক প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য বিচার করলে তা-ই প্রমাণিত হয়। বেশি পরিমাণে ইন্দ্রিয় সুখের মধ্যে সবচেয়ে কম বেদনার উপস্থিতিকে চার্বাকগণ সর্বোচ্চ ভাল হিসেবে আখ্যায়িত করলেও যে সুখের সাথে দুঃখ বা বেদনা অনিবার্যভাবে সংযুক্ত, বেদনার কারণে সে সুখ ভোগ বর্জন করাকে তাঁরা মূর্খতা মনে করেন। সর্বদর্শন সংগ্রহ গ্রন্থে এ সম্পর্কে উদ্ধৃত হয়েছে : “ত্যাজ্যং সুখং বিষয়সঙ্গমজন্ম পুংসাং দুঃখোপসৃষ্টমিতি মুর্খবিচারণৈষা।”[১১৮] অর্থাৎ বিষয় সংযোগজাত সুখ হলো দুঃখের কারণ। তাই তা ত্যাগ করা উচিত—এমন কথা মূর্খেরাই বলে থাকেন।
চার্বাক দার্শনিকদের সুখবাদী নৈতিকতার সঙ্গে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টিপাস-এর নৈতিক মতবাদের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। এরিস্টিপাসও ব্যক্তির নিজের সুখের উপর জোর দিয়ে ভোজন, পান ও স্ফূর্তি করার কথা বলেছেন। কারণ, আগামীকাল মৃত্যুও হতে পারে। সুখবাদী এপিকিউরিয়াসও সুখকেই পুরুষার্থ বলেছেন। ওমর খৈয়ামও এরূপ মত পোষণ করতেন। তিনিও যতক্ষণ বেঁচে থাকা যায় ততক্ষণ পান করার কথা বলেছেন। কারণ, একবার মৃত্যু হলে আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নাই।[১১৯]
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, চার্বাকগণ শাশ্বত আত্মা, পূর্বজন্ম, পরলোক, ঈশ্বর ইত্যাদি অ-প্রত্যক্ষযোগ্য সকল বিষয়কে অস্বীকার করে ব্যক্তির প্রত্যক্ষযোগ্য ইহলৌকিক জীবনভিত্তিক নৈতিক মতবাদ প্রচার করেন। তাঁদের মতবাদে আধুনিক সুখবাদী মতবাদের ইঙ্গিত রয়েছে। প্রত্যক্ষযোগ্য না হওয়ায় তাঁরা শাশ্বত আত্মা, পরলোক ইত্যাদি ধারণা অস্বীকার করেছেন এবং এর ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে তাঁদের সুখবাদী মতবাদ। সুতরাং তাঁদের নৈতিক মতের সাথে তাঁদের জ্ঞানবিদ্যার সুসঙ্গত সম্পর্ক রয়েছে। তাই বলা যায়, চার্বাক নৈতিক মতবাদ তাঁদের প্রত্যক্ষবাদী জ্ঞানবিদ্যা ও জড়বাদী তত্ত্ববিদ্যারই যৌক্তিক পরিণতি।
উল্লেখ্য যে, চার্বাক দার্শনিকদের নৈতিক মতবাদ ভারতীয় অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায়ের নৈতিক মতবাদ থেকে স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রমধর্মী। চার্বাক জ্ঞানবিদ্যার মতো চার্বাক নীতিবিদ্যাও একদিকে যেমন তৎকালীন ভারতীয় শ্রেণিবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রথার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদস্বরূপ তেমনি পরবর্তীকালের নীতিদার্শনিকদের জন্য তা একটি সম্পূর্ণ নতুন দিকনির্দেশনা ও সতর্কতামূলক পদক্ষেপরূপে বিবেচ্য। চার্বাকদের নীতিতত্ত্বে তৎকালীন সমাজব্যবস্থার স্পষ্ট প্রতিফলন থাকায় অনেকে তাঁদের নীতিদর্শনকে শুধুমাত্র নীতিদর্শন না বলে নৈতিক রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।[১২০] এছাড়া, নীতিদর্শনের ইতিহাসে প্রাক-বৌদ্ধ যুগের চার্বাক দার্শনিকগণই প্রথম নীতিতত্ত্বকে অধ্যাত্মবাদের হাত থেকে মুক্ত করেন এবং সুখবাদী নৈতিক আদর্শ প্রচার করার মাধ্যমে ইহলোকবাদী বা জাগতিকাতাবাদী নীতিতত্ত্বের প্রবর্তন করেন।
চার্বাকগণ তাঁদের অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নৈতিক আদর্শ হিসেবে ইহলোকবাদ বা জাগতিকতাবাদ প্রবর্তন করেন। এর ফলে নৈতিকতার ক্ষেত্রে অতীন্দ্ৰিয় শাশ্বত পরম আদর্শ অস্বীকৃত হয় এবং অধিবিদ্যা প্রত্যাখ্যাত হয়। প্রচলিত অধিবিদ্যক মতবাদকে অস্বীকার করে চার্বাকগণ জগতের উৎপত্তি সম্পর্কে যে মতবাদ দেন তা জড়বাদী।
চার্বাক অধিবিদ্যা
বুৎপত্তিগত অর্থে মেটাফিজিক্স্ বা অধিবিদ্যা ফিজিক্স্ বা পদার্থবিদ্যার পরবর্তী আলোচনাকে বোঝায়। অধিবিদ্যার প্রধান কাজ তত্ত্বনির্ণয় করা। বিশ্বপ্রকৃতির আদি সত্তার অস্তিত্ব, প্রকৃতি, সংখ্যা ইত্যাদি সম্পর্কিত আলোচনাই অধিবিদ্যার মূল আলোচনা। তত্ত্বের অনুসন্ধানের জন্য অধিবিদ্যা জ্ঞানের উৎস, প্রকৃতি ও সম্ভাব্যতা নিয়েও আলোচনা করে। চার্বাক অধিবিদ্যা চার্বাক জ্ঞানবিদ্যার সাথে সম্পর্কিত। চার্বাক জ্ঞানবিদ্যাই অধিবিদ্যার মূল ভিত্তি। চার্বাক দার্শনিকগণ প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ হিসেবে আখ্যায়িত করায় দর্শনের ইতিহাসে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত আত্মা, পুনর্জন্ম, পরজন্ম, ঈশ্বর ইত্যাদি ধারণা প্রত্যক্ষযোগ্য নয় বলে অস্বীকৃত হয়। জড়কে জগতের মূলতত্ত্ব হিসেবে স্বীকার করায় চার্বাক দর্শনিকগণকে জড়বাদী আখ্যা দেয়া হয়।
আনুমানিক খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতক থেকে ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে চার্বাক বলতে আপোষহীন কট্টর জড়বাদী দর্শনকে বা এর প্রবক্তাদেরকেই বোঝানো হয়। এর পূর্ববর্তী কোনো বিশিষ্ট দার্শনিক গ্রন্থে চার্বাক শব্দটি চোখে পড়ে না। অবশ্য মহাভারতের শান্তিপর্বে (রচনাকাল ৪০০-৫০০ খ্রি.) রাজধর্মানুশাসন প্রসঙ্গে চার্বাক নামে ব্রাহ্মণদের তীব্র সমালোচক এক রাক্ষসের উপাখ্যান আছে। এই রাক্ষস জড়বাদী নয়। জড়বাদী দর্শনের নাম চার্বাক দর্শন হওয়া অসম্ভব নয়।[১২১] তবে অষ্টম শতকের আগে জড়বাদী দর্শন বোঝাতে ‘লোকায়ত’ শব্দটির ব্যবহার করা হতো। চার্বাক ও লোকায়ত একই দার্শনিক মতের বিকল্প নাম মাত্র। মাধবাচার্য এ প্রসঙ্গে স্পষ্টতই বলেছেন : “তস্য চার্বাকমতস্য লোকায়তম্ ইতি অন্বর্থঅপরং নামধেয়ম্”।[১২২] অর্থাৎ চার্বাক দর্শনেরই অপর এবং জুৎসই নাম ‘লোকায়ত’।
বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তরক্ষিত তাঁর তত্ত্বসংগ্রহ গ্রন্থে জড়বাদী দর্শন বলতে ‘লোকায়ত’ নামটি ব্যবহার করেছেন। বাৎসায়ন-এর ন্যায়ভাষ্য-তে জড়বাদী বোঝাতে ভূতচৈতন্যবাদ (যে মতবাদ অনুসারে চৈতন্য জড়পদার্থ থেকে উৎপন্ন) বোঝানো হতো। জৈন দার্শনিক হরিভদ্র রচিত ষড়দর্শন সমুচ্চয় এবং শঙ্করাচার্যের বেদান্তভাষ্য গ্রন্থে জড়বাদ বোঝাতে ‘লোকায়ত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সেন্ট পিটার্সবার্গ অভিধানে ‘লোকায়ত’ শব্দটির অর্থ করা হয়েছে জড়বাদ। কিন্তু শান্তরক্ষিতের শিষ্য কমলশীলের পঞ্জিকা, ন্যায় দার্শনিক জয়ন্ত ভট্টের ন্যায়মঞ্জরী, জৈন দার্শনিক হরিভদ্রের ষড়দর্শন সমুচ্চয় গ্রন্থের গুণরত্ন রচিত ব্যাখ্যাগ্রন্থ তর্করহস্যদীপিকা, অদ্বৈত বেদান্ত দার্শনিক মাধবাচার্যের সর্বদর্শন সংগ্ৰহ প্ৰভৃতি গ্রন্থে জড়বাদী দর্শন বোঝাতে ‘চার্বাক’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, আনুমানিক আট শতকের বৌদ্ধ দার্শনিক কমলশীল থেকে পনেরো শতকের জৈন দার্শনিক গুণরত্ন পর্যন্ত সকলেই চার্বাক বলতে কট্টর জড়বাদী দর্শনকেই বুঝিয়েছেন।
জড়বাদ অনুসারে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আদি কারণ হলো জড় বা বস্তু। ভাব নয়। সকল সত্তা, এমনকি মানুষ, মানুষের আত্মা বা প্রাণও জড় থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। তাই, জড়বাদ প্ৰাণ ও মনকে দেহেরই কোনো গুণ বা দেহ থেকে উৎপন্ন বলে মনে করে। আধুনিক জড়বাদ অনুসারে জীবন হলো যৌগিক দেহযান্ত্রিক গতি। মন বা চেতনা হয় মস্তিষ্কের ক্রিয়া, অথবা অত্যন্ত সুসংগঠিত জড়েরই বিকশিত রূপ বা উপবস্তু। জড়বাদের সাথে অভিজ্ঞতাবাদের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। কারণ, জড়বাদ অভিজ্ঞতায় প্রাপ্ত জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করে। এ মতবাদ মনে করে, ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই সঠিক জ্ঞানলাভ করা যায়।[১২৩] চার্বাক দার্শনিকগণ অভিজ্ঞতাবাদী। তাঁরা প্রত্যক্ষকেই একমাত্র বৈধ জ্ঞানলাভের উপায় বলে মনে করেন। যেহেতু তাঁদের কাছে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ সেহেতু প্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুই তাঁদের মতে একমাত্র সত্তা। তাই, প্রত্যক্ষবাদী বা অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে চার্বাক দার্শনিকগণ জড়বাদকেই সমর্থন করেছেন।
জড়বাদী দর্শন ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার। এই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও জড়বাদী দর্শন উভয়ই বিকাশলাভ করেছে। তাই জড়বাদের জন্ম ও বিকাশ কোনো বিশেষ দেশে সীমাবদ্ধ থাকে নি। প্রাচীন ভারত, চিন ও গ্রিসের দাসভিত্তিক সমাজে জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক অন্যান্য জ্ঞানসূত্র বিকশিত হওয়ার ফলেই জড়বাদের জন্ম হয়।[১২৪] প্রাচীন জড়বাদী দার্শনিকদের মধ্যে ভারতের চার্বাক, চিনের লাওজু, ওয়াংচু, গ্রিসের হিরাক্লিটাস, এ্যানাক্সাগোরাস, এম্পিডলিস, এপিকিউরিয়াস প্রমুখ দার্শনিকদের নাম সুপরিচিত। প্রাচীন জড়বাদের অসম্পূর্ণতা ছিল। এর পক্ষে জড় ও মনের সম্পর্কের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব হয় নি। ইউরোপের মধ্যযুগীয় জড়বাদ ধর্মীয় প্রকৃতিবাদের রূপ গ্রহণ করে। সর্ববস্তুতে ঈশ্বর প্রকাশিত এবং প্রকৃতি ও ঈশ্বর উভয়ই নিত্যসত্তা, এই অভিমতের মাধ্যমে মধ্যযুগে জড়বাদ আত্মপ্রকাশ করে।
ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশের যুগেই জড়বাদের পরবর্তী পর্যায়ের বিকাশ ঘটে। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে সতেরো ও আঠারো শতকে জড়বাদ মধ্যযুগের চেয়ে অধিকতর সুস্পষ্ট রূপলাভ করে। এই যুগের জড়বাদী দার্শনিকদের মধ্যে বেকন, গেলিলিও, হবস, গেসেন্ডি, স্পিনোজা ও লকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই যুগে জড়বাদী দার্শনিকগণ অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানের উৎস এবং প্রকৃতিকে আদি সত্তা হিসেবে অভিহিত করে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা ও যাজক প্রাধান্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেন। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গণিত ও বলবিদ্যার উন্নতির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় যান্ত্রিকতাই সতেরো ও আঠারো শতকের জড়বাদী দর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্যে রূপ নেয়। চেতনা এবং বস্তুর বিভিন্ন প্রকাশের মধ্যে অন্তর্নিহিত সংযোগসূত্র ব্যাখ্যায় এই সময়কার জড়বাদে ব্যাপক সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। আঠারো শতকে ফরাসি জড়বাদী দার্শনিক ডিডেরস, হেলোভেটিয়াস, হলোবাক প্রমুখ এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রমে প্রয়াসী। এর পরবর্তী পর্যায়ে জার্মান দার্শনিক ফয়েরবাখের মধ্যে নৃতাত্ত্বিক জড়বাদের বিকাশ লক্ষ করা যায়। জড়বাদের পূর্ণতর বৈজ্ঞানিক বিকাশ ঘটেছে উনিশ শতকে কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ও লেনিনের দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক জড়বাদী দার্শনিক চিন্তায়। জড়বাদের ঐতিহাসিক বিকাশের প্রেক্ষিতে বিচার করলে চার্বাক দার্শনিকদের জড়বাদী চিন্তা প্রাচীনতম পর্যায়ের। তাই কালগত বিচারে চার্বাক জড়বাদের গুরুত্বকে অবহেলা করা যায় না।
উল্লেখ্য যে, প্রাচীনতম ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে জড়বাদের বহু নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রাচীনতম আর্য সাহিত্য ঋগ্বেদ-এ জড়বাদের উল্লেখ আছে। ভগবদ্গীতা, মহাভারত-এর শান্তিপর্ব এবং শল্যপর্বে, বিষ্ণুপুরাণ, মনুসংহিতা প্রভৃতি গ্রন্থে জড়বাদের কিছু কিছু উল্লেখ আছে।[১২৫] বিষ্ণুপুরাণে জড়বাদীদেরকে অসুর হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। জাগতিক আনন্দের প্রতি যাদের কামনা তীব্র, যারা বেদ ও বেদদত্ত নির্দেশকে বর্জন করেছেন এবং সকল প্রকার উৎসর্গ, উৎসর্গের উপাদান এবং যেসব দেবদেবীর প্রতি উৎসর্গ করা হয় সে সব দেবদেবীকেও বর্জন করেছেন, বিষ্ণুপুরাণ অনুসারে তারাই জড়বাদী।[১২৬] ব্রহ্ম বৈবর্তপুরাণ জড়বাদী বলতে উপর্যুক্ত শ্রেণির লোকদেরকে বোঝানো হয়েছে। রামায়ণের ঋষি জাবালি জড়বাদের সমর্থক ছিলেন। রামের প্রতি তার দেয় উপদেশকে চার্বাক মতের সাথে তুলনা করা যায়।[১২৭] চার্বাকদের এ মতের সাথে হরিবংশের রাজা ভেনা’র মতের মিল পরিলক্ষিত হয়।[১২৮] মহাভাষ্য-এর লেখক ভাগুরি ছিলেন চার্বাকদের একনিষ্ঠ সমর্থক। গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক পালিশাস্ত্রে অজিত কেশকম্বলীর জড়বাদী মত বর্ণিত হয়েছে। তিনি দেহকে ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ দ্বারা গঠিত বলেছেন। তাঁর মতে, দেহ যেসব উপাদানে গঠিত ছিল মৃত্যুর পরে আবার সে সব উপাদানে পরিণত হয়। অজিত কেশকম্বলীর শিষ্য পায়াশি আত্মাকে দেহের সাথে অভিন্ন মনে করেন এবং ভবিষ্যৎ জীবন ও পুনর্জন্মকে অস্বীকার করেন।
সুতরাং ঋগ্বেদের যুগ থেকে বৌদ্ধ যুগ পর্যন্ত ভারতীয় সাহিত্যে জড়বাদের যথেষ্ট উল্লেখ দেখা যায়। প্রাচীনতম আর্য সাহিত্য বেদে জড়বাদের উল্লেখ থেকে অনুমিত হয় যে, আর্যপূর্ব যুগেও ভারতের লোকমনে জড়বাদের ধারণা নিহিত ছিল।[১২৯] তবে একথা অনুমান করা হয়তো অসঙ্গত হবে না যে, প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতের জড়বাদে সংশয়বাদ ও অজ্ঞেয়তাবাদ মিশ্রিত ছিল। বৃহস্পতিই একে স্বতন্ত্র রূপদান করেন।[১৩০] বৃহস্পতি সর্বপ্রথম ঋগ্বেদে জড়বাদের ভিত্তি স্থাপন করেন। এই জড়বাদই স্পষ্টত জড়কে আদি সত্তা বলে স্বীকার করে। তাঁর মূলসূত্র ছিল জীবন জড় থেকেই উৎপন্ন।[১৩১] বিশ শতকের মার্ক্সবাদী জড়বাদেও এর প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
চার্বাকগণ জড়বাদী বৃহস্পতির অনুসারী। তাই তাঁরা চরম অর্থে জড়বাদকে সমর্থন করেন। চার্বাকদের মতে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ—এই চার প্রকার প্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুগত উপাদান দ্বারাই সবকিছু গঠিত। তাই যে বস্তুতে এই চার প্রকার উপাদান অনুপস্থিত সে বস্তু প্রত্যক্ষযোগ্য নয়, এবং তা অস্তিত্বশীল নয়। এজন্য চার্বাক দর্শনকে জড়বাদী ও বহুত্ববাদী দর্শন বলা হয়।[১৩২] প্রশ্নোপনিষদ-এর ঋষি কবদি কাত্যায়নের মতবাদেও চার্বাক জড়বাদ ও বহুত্ববাদের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তিনিও চার্বাকদের মতো মাটি, পানি, আগুন ও বায়ুকে আদি উপাদান বলেছেন।[১৩৩] অধিকাংশ ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম, এই পঞ্চমহাভূতকে আদি উপাদান হিসেবে স্বীকার করেন। কিন্তু প্রত্যক্ষযোগ্য নয় বলে চার্বাক দার্শনিকগণ ব্যোমকে অস্বীকার করে প্রত্যক্ষযোগ্য চারিভূতকে জগতের আদি কারণ বলে স্বীকার করেন। এছাড়া অভিজ্ঞতাবাদ বা প্রত্যক্ষবাদের ভিত্তিতে তাঁরা আত্মা, ঈশ্বর, পূর্বজন্ম, পরজন্ম, কর্মবাদ, জন্মান্তরবাদ, স্বর্গ, নরক, মোক্ষ, ইত্যাদি আধিবিদ্যক ধারণাকে অস্বীকার করেন। এসব কারণে একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, চার্বাক অধিবিদ্যা তথা জড়বাদের প্রধান ভিত্তি হলো প্রত্যক্ষপরায়ণতা। একমাত্র প্রত্যক্ষযোগ্য জগৎকে সত্য বলে স্বীকার করা।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, চার্বাকদের অধিবিদ্যা সম্পর্কিত মতবাদে শাশ্বত সত্তার অস্তিত্ব অস্বীকৃত হয়ে জড়বাদী মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে সকল প্রকার অধ্যাত্মবাদ ও পূর্বনির্ধারণবাদ অস্বীকৃত হয়। এছাড়া, তাঁরা অতীন্দ্রিয় কার্যকারণতত্ত্বকে অস্বীকার করেন। ফলে জগতের কারণ ও উৎপত্তির পদ্ধতি সম্পর্কে নতুন ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়। চার্বাকগণ স্বভাববাদ বা প্রকৃতিবাদ দ্বারাই জগতের কারণ ও উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেন। এই ব্যাখ্যাও তাঁদের অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যার পরিপূরক।
চার্বাক স্বভাববাদ
স্বভাববাদ হলো বিশ্বপ্রকৃতি ও বিশ্বপ্রকৃতিতে মানুষের স্থান সম্পর্কিত দার্শনিক মতবাদ। এ মতবাদ অনুসারে মানুষের দৈহিক, মানসিক ও নৈতিক জীবন প্রকৃতি দ্বারা সৃষ্ট ও স্বাভাবিক। সকল কিছুই প্রাকৃতিক নিয়মের অনুসারী।[১৩৪] স্বভাববাদ নৃবিজ্ঞানবাদের (Anthropologism) ঘনিষ্ট মতবাদ। নৃবিজ্ঞানবাদ অনুসারে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম সামাজিক জীবনকে পরিচালনা করে না।[১৩৫] মূলত এটি অধ্যাত্মবাদ ও পূর্বনির্ধারণবাদ বিরোধী একটি মতবাদ। স্বভাববাদও অধ্যাত্মবাদ এবং পূর্বনির্ধারণবাদ বিরোধী। চার্বাকগণ এ মতবাদ দ্বারা তাঁদের অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে কারণতত্ত্ব ও জগতের উৎপত্তিতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। তবে আধুনিক স্বভাববাদে প্রাকৃতিক নিয়মের যে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় প্রাচীন স্বভাববাদে তা এতো স্পষ্ট ছিল না। ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে, সম্ভবত শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদ-এ স্বভাববাদের সবচেয়ে পুরাতন উল্লেখ পাওয়া যায়।[১৩৬] অদ্বৈত বৈদান্তিক দার্শনিক শঙ্কর ‘স্বভাব’ বলতে বস্তুর প্রাকৃতিক গুণ বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, দাহিকাশক্তি অগ্নির প্রাকৃতিক গুণ। নিম্নমুখী বাহিকাশক্তি পানির প্রাকৃতিক গুণ। বৌদ্ধ দার্শনিক অমলানন্দ স্বভাব বা প্রকৃতি বলতে বস্তু যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ যা থাকে তাকেই বুঝিয়েছেন। জীবন্ত দেহ যতক্ষণ থাকে শ্বাসপ্রশ্বাস ততক্ষণ থাকে। সুতরাং শ্বাসপ্রশ্বাস হলো জীবন্ত দেহের প্রকৃতি।[১৩৭] হরিভদ্রের রচিত ষড়দর্শন-সমুচ্চয় গ্রন্থের ব্যাখ্যায় গুণরত্ন স্বভাববাদের কিছুটা বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। তা হলো :
স্বভাব বলতে বোঝায় বস্তুর স্বীয় বা স্বকীয় পরিণাম। স্বভাবের জন্যই সবকিছুর উৎপত্তি। যেমন, মৃত্তিকার পরিণাম ঘট, তেমনি, তন্তু বা সুতো থেকে শুধু কাপড়ই তৈরি হয়— স্বভাববাদ দিয়ে এ জাতীয় পরিণাম নিয়মের কোনো ব্যাখ্যাই অসম্ভব নয়। অতএব সব কিছুই স্বভাবের পরিণাম বলে মানতে হবে। …মুগ ডাল যে সেদ্ধ হয় তারও কারণ স্বভাব। তাই স্বীকার করতে হবে, সব ঘটনার কারণ হলো স্বভাব।[১৩৮]
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, স্বভাববাদের মূলসুর হলো অধ্যাত্মবাদ ও পূর্বনির্ধারণবাদের বিরোধিতা। যে কোনো জাগতিক ঘটনার ব্যাখ্যায় ঘটনার জাগতিক কারণটুকুকে যথেষ্ট মনে করা এ মতবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কারণ হিসেবে অতিপ্রাকৃত বা প্রকৃতিবহির্ভূত অন্য কিছুকে না মানা, ঈশ্বর, অদৃষ্ট, ধর্ম, কর্মফল ইত্যাদিকে অস্বীকার করা, ইত্যাদি এ মতবাদের লক্ষ্য। এ জন্য কোনো কোনো পণ্ডিত স্বভাববাদের মধ্যে আধুনিক প্রাকৃতিক নিয়মের পূর্বাভাস দেখতে পান।[১৩৯] স্বভাববাদের সাথে জড়বাদ বা ভূতবাদের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। কারণ, জড়বাদীরা অতীন্দ্রিয় কারণের অস্তিত্ব অস্বীকার করায় স্বভাববাদকে স্বীকার করার সুযোগ থাকে না। সম্ভবত এই কারণে চার্বাক দার্শনিকগণও বস্তুজগৎ, দেহ, আত্মা ইত্যাদির ব্যাখ্যায় স্বভাববাদের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। চার্বাকগণ পূর্ব-অস্তিত্ব, ভবিষ্যৎ জীবন, পুনর্জন্ম, কর্মবাদ, স্বর্গ, নরক, মোক্ষ বা মুক্তি ইত্যাদিকে অস্বীকার করেছেন। কারণ, এসব প্রত্যক্ষযোগ্য নয়। শুধুমাত্র জড় জগৎ প্রত্যক্ষিত হয় বলে কেবল জড় জগৎই অস্তিত্বশীল। জড় জগতের বৈচিত্র্যের কারণ হলো স্বভাবের জন্যই জগতের বৈচিত্র্য ঘটে।[১৪০] সর্বদর্শন সংগ্রহ গ্রন্থে চার্বাক মতের ব্যাখ্যায় মাধবাচার্য যে লোকগাথা উদ্ধৃত করেছেন তা থেকেও চার্বাক স্বভাববাদের পরিচয় পাওয়া যায়। লোকগাথাটি নিম্নরূপ :
অগ্নিরুষ্ণো জলং শীতং সমস্পর্শস্তিথানিলঃ।
কেনেদং চিত্রিতং তম্মাৎ স্বভাবাত্তদ্ব্যবস্থিতিঃ।।[১৪১]
অর্থাৎ অগ্নি উষ্ণ, জল শীতল, বাতাস গরম ঠাণ্ডা কিছুই নয়। এতো বৈচিত্র্য কার সৃষ্টি? স্বভাবের জন্যই এগুলো এ রকম। চার্বাক স্বভাববাদ প্রসঙ্গে গোপীনাথ কবিরাজের মন্তব্য স্মরণযোগ্য। তিনি বলেন :
মনে হয় চরম স্বভাববাদের প্রতিনিধি বলতে সুপ্রাচীন ভারতের একদল স্বাধীন চিন্তাশীল ছিলেন। আদিতে এদেরকে লোকায়ত বলে ডাকার প্রথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এরাই ব্যাপকভাবে চার্বাক নামে পরিচিত হন। তাঁদের মতের আদি রূপের বৈশিষ্ট্য ছিল কট্টর জড়বাদ, অদৃষ্টে অবিশ্বাস, আপোষহীন যুক্তিবাদ বা বাকবিতণ্ডা।[১৪২]
মহাভারতেও সরাসরি স্বভাবং ভূতচিন্তকাঃ বলা হয়েছে। অর্থাৎ যারা শুধু ভূত বিষয়ে চিন্তা করেন তাঁরা স্বভাববাদী। বৃহৎ-সংহিতা’র ব্যাখ্যায় উৎপল ভট্ট বলেছেন যে, লোকায়তিকেরা স্বভাবকেই জগৎকারণ বলে গ্রহণ করেন। স্বভাবের জন্যই বৈচিত্র্যময় জগতের উৎপত্তি, স্বভাবতই তার বিলোপ।[১৪৩]
ভূতবাদ বা জড়বাদের সাথে স্বভাববাদের এই ঘনিষ্ঠতার কারণে একথা নির্দ্বিধায় বলা হয় যে, ভূতবাদী চার্বাক দার্শনিকগণ স্বভাববাদীও ছিলেন। স্বভাববাদ না মানলে চার্বাকদের ভূতবাদ বা চরম জড়বাদ প্রমাণ করা দুঃসাধ্য।[১৪৪] অনেকে লোকায়ত দেহাত্মবাদকে জড়বাদেরই একটি দিক বলে মনে করেন। স্বভাববাদই এর পদ্ধতি। চতুর্ভূত যথা ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ থেকে পৃথিবীর সবকিছুর উৎপত্তি। চুন, পান, সুপারি মিলে যেমন লাল রস উৎপন্ন হয় তেমনি বিশেষ পরিমাণে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ মিশ্রিত হয়ে সঠিকভাবে দেহ গঠন করলে তাতে চৈতন্য নামক দেহ উপাদানের সৃষ্টি হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি প্রাকৃতিক নিয়মে প্রকৃতিতে ঘটছে। স্বতঃস্ফূর্ততা ও আকস্মিকতাই এর বৈশিষ্ট্য। এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় অতীন্দ্রিয় হস্তক্ষেপের কোনো স্থান নাই। উদ্দেশ্যমূলক কোনো অস্তিত্ব অবান্তর।[১৪৫]
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, চার্বাক দার্শনিকগণ মূলত ভারতের প্রাচীন স্বভাববাদী ধারণার অন্যতম প্রতিনিধি। সম্ভবত স্বভাব হলো তাঁদের কাছে সবকিছুর কারণ সম্পর্কিত একটি তত্ত্ব। বস্তুর মধ্যে যেসব উপাদান থাকে সে সব উপাদানের স্বভাব থেকেই বস্তুর উৎপত্তি। স্বতঃস্ফূর্ততা ও আকস্মিকতা স্বভাববাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্বভাব থেকে বস্তুর উৎপত্তির প্রক্রিয়া হলো স্বতস্ফূর্ততা ও আকস্মিকতা। কোনো উদ্দেশ্যমূলক অতীন্দ্রিয় হস্তক্ষেপে নয় বরং স্বভাব থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সবকিছুর উৎপত্তি ঘটে।
জড়বাদ ও স্বভাববাদকে সমর্থন করার ফলে চার্বাকগণ চারিভূতের স্বভাবগত কারণেই জগতের উৎপত্তি হয় বলে মনে করেন। এছাড়া, পূর্বের আলোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, তাঁরা কার্যকারণের আবশ্যকতাকে খণ্ডন করেছেন। এর পরিণতিতে তাঁদের কার্যকারণতত্ত্ব আকস্মিকতাবাদে পর্যবসিত হয়। এই আকস্মিকতাবাদ তাঁদের প্রত্যক্ষবাদী জ্ঞানবিদ্যার সাথে সম্পর্কিত। আকস্মিকতাবাদ ও প্রত্যক্ষবাদ পরস্পর পরিপূরক।
চার্বাক আকস্মিকতাবাদ
পূর্ববর্তী আলোচনায় দেখা গেছে, চার্বাকগণ কার্যকারণের মধ্যেকার অনিবার্যতাকে খণ্ডন করেন। জগতের উৎপত্তির ব্যাখ্যায় তাঁরা স্বভাববাদী মতবাদ পোষণ করেন। প্রশ্ন হলো, জড় থেকে স্বভাবগুণবশত বস্তুজগতের উৎপত্তি হয় কীভাবে? চার্বাকদের উত্তর হলো, আকস্মিকভাবে। এ মতবাদকে আকস্মিকতাবাদ বলা হয়।
আকস্মিকতাবাদ ঘটনার স্বতঃস্ফূর্ত আকস্মিক উৎপাদনে বিশ্বাস করে। এ মতবাদ কার্যকারণতত্ত্বের বিরোধী। নির্দিষ্ট কার্যের জন্য নির্দিষ্ট কারণের উপস্থিতি অনিবার্য—এই মতবাদের বিরোধিতা করে আকস্মিকতাবাদ বলে যে, অনুগের উপস্থিতির জন্য পূর্বগের উপস্থিতি অনিবার্য নয়। একটি বস্তু তার প্রকৃতিগত কারণে একটি বিশেষ সময়ে কোনো বাহ্য কারণ ছাড়াই উৎপন্ন হতে পারে। ন্যায় দার্শনিক উদয়নের মতে :
পূর্বকালাসত্ত্বে সত্যুত্তরকালসত্ত্বং কাদাচিৎকত্বম।
কাদাচিকত্বস্বভাবনিয়মো নির্হেতুকঃ স্বভাবনিয়মত্বাৎ।[১৪৬]
অর্থাৎ পূর্বকালে না থাকলেও কখনো কখনো পরবর্তীকালে সে বস্তুর সৃষ্টি হতে পারে। কখনো কখনো কোনোরূপ কারণ ছাড়াই স্বভাবগতভাবে কোনো বস্তুর উদ্ভব হয়। ন্যায় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি গৌতমের মতে, আকস্মিকতাবাদে কার্যের কারণ প্রয়োজন হয় না। যেমন, কাঁটার সূক্ষ্মতার কোনো কারণ নাই। স্বভাবগতভাবেই কাঁটা সূক্ষ্ম। তিনি বলেন : “অনিমিত্ততো ভাবোৎপত্তিঃ কণ্টকটক্ষতাদিদর্শনাৎ”।[১৪৭] অর্থাৎ কাঁটার তীক্ষ্ণতা প্রভৃতির মতো কারণ ছাড়াই ফলোৎপত্তি হয়।
অদ্বৈত বেদান্ত দার্শনিক শঙ্কর আকস্মিকতাবাদকে আকস্মিক ফলোৎপাদনের মতবাদ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। এতে সুযোগমতো আকস্মিকভাবে ঘটনা উৎপন্ন হয়। বৌদ্ধ দার্শনিক অমলানন্দের মতে, আকস্মিকতাবাদ অনুসারে নির্দিষ্ট কোনো কারণের উপর নির্ভর না করে যে কোনো সময় ঘটনা উৎপাদিত হতে পারে।[১৪৮]
চার্বাক দর্শনের সাথে উপর্যুক্ত আকস্মিকতাবাদী মতবাদগুলোর যথেষ্ট মিল থাকায় চার্বাক দার্শনিকদেরকে আকস্মিকতাবাদী বলে অভিহিত করা হয়।[১৪৯] অবশ্য চার্বাকদেরকে একাধারে স্বভাববাদী ও আকস্মিকতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা যায় কি না এ সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে নামক গ্রন্থে বিভিন্ন তথ্য প্রমাণসহ স্বভাববাদ ও আকস্মিকতাবাদ বা যদৃচ্ছাবাদের পার্থক্য নির্ণয় করেন। তাঁর মতে স্বভাববাদ ও আকস্মিকতাবাদকে অভিন্ন মনে করলে স্বভাববাদকে খেলো করা হয়। কারণ, এ দুটি পরস্পর অসঙ্গতিপূর্ণ মতবাদ। বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, স্বভাববাদে প্রাকৃতিক কার্যকারণকে স্বীকার করা হয়। তাই তা প্রকৃতি বিজ্ঞানসম্পন্ন মতবাদ। অন্যদিকে, আকস্মিকতাবাদে কার্যকারণকে স্বীকার করা হয় না। এমনকি প্রাকৃতিক কার্যকারণকেও নয়। অর্থাৎ স্বভাববাদে প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতাকে স্বীকার করা হয়। কিন্তু আকস্মিকতাবাদে তা করা হয় না। তিনি চার্বাক সমর্থিত স্বভাববাদের মধ্যে আধুনিক প্রাকৃতিক নিয়মের প্রতিশ্রুতি বা পূর্বাভাস খুঁজেছেন এবং চার্বাক দার্শনিকদের আকস্মিকতাবাদী নয় বরং স্বভাববাদী দার্শনিক হিসেবেই মূল্যায়িত করেছেন।[১৫০]
অন্যদিকে, দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী তাঁর চার্বাক দর্শন গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে তত্ত্বসংগ্রহকার শান্তরক্ষিতের মত উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে, শান্তরক্ষিত স্বভাববাদীগণকে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। একদল স্বভাবের কারণত্ব স্বীকার করেন, অপর দল করেন না। প্রথম দল বলেন, ‘স্বত এব ভাবা জায়ন্তে’ বা স্বভাবের জন্যই পদার্থের উৎপত্তি হয়। অর্থাৎ বস্তুর উৎপত্তির কারণ হলো বস্তুর স্বভাব। তবে স্বভাবের কোনো কারণ নেই। অপর দল বলেন, ‘ন স্বতো নাপি পরতো ভাবানাং জন্ম’। অর্থাৎ অকারণেই পদার্থের উৎপত্তি হয়। বস্তুসৃষ্টি স্বভাব নিয়মেরও অপেক্ষা করে না। এঁদের মতে, জগৎবৈচিত্র্যের সৃষ্টি অহেতুক, আকস্মিক বা যাদৃচ্ছিক। দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রীর মতে, দ্বিতীয় দলের স্বভাববাদীদের সাথে যদৃচ্ছা বা আকস্মিকতাবাদীদের পার্থক্য নেই। এদের উভয়ই কার্যকারণ সম্বন্ধ অস্বীকার করেন। তবে স্বভাববাদীদের একদল স্বভাবের বা স্বভাব নিয়মের কারণতা অর্থাৎ দ্রব্য স্বভাবের অপরিবর্তনীয়তা স্বীকার করেন, অন্যদল তা করেন না। আকস্মিকতাবাদীরাও দ্বিতীয় দলের স্বভাববাদীদের অনুরূপ মত পোষণ করে সবকিছুর কারণকে আকস্মিক বলেন। তাই এদের সাথে আকস্মিকতাবাদীদের মতের মিল দেখা যায়।[১৫১]
চার্বাক দার্শনিকদের ‘কার্যকারণতত্ত্ব খণ্ডন’ শীর্ষক আলোচনায় আমরা দেখেছি, কার্যকারণের আবশ্যিক সম্পর্ক অস্বীকার করে তাঁরা বলেছেন যে, পূর্বগ ও অনুগের অনিবার্য সম্পর্ক জানা যায় না। এ সম্পর্ক আকস্মিক। প্রকৃতির সব বস্তুকেই তাঁরা আদি মৌল উপাদান চতুষ্টয়ের স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত বিশেষ প্রক্রিয়ার ফল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এছাড়া স্বভাববাদ বা প্রকৃতিবাদ শীর্ষক আলোচনায় চার্বাক লোকগাথা সম্পর্কিত মাধবাচার্যের উদ্ধৃতিতে আমরা দেখেছি যে, জাগতিক বৈচিত্র্যকে স্বভাবের সৃষ্টি বলা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, চার্বাকগণ স্বভাববাদকে স্বীকার করে প্রাকৃতিক কার্যকারণতা অর্থাৎ দ্রব্যস্বভাবের অপরিবর্তনীয়তা স্বীকার করেছেন কি না?
চার্বাকদের স্বীয় বক্তব্যে এই প্রশ্নের পক্ষে বা বিপক্ষে তথ্য প্রমাণ কেউ উপস্থাপন করেননি। তবে কার্যকারণ সম্পর্ক ও অনুমান খণ্ডনে চার্বাকগণ যে সব যুক্তি প্রদান করেছেন তা থেকে মনে হয়, তাঁরা ব্যাপ্তি সম্পর্কের নিশ্চয়তাকে যৌক্তিক দিক থেকে মেনে নিতে নারাজ, যদিও ব্যবহারিক জীবনে এর উপযোগিতাকে তাঁরা অস্বীকার করেননি। সুতরাং দ্রব্যস্বভাবের অপরিবর্তনীয়তাকে মেনে নিলে যৌক্তিক দিক থেকে চার্বাকগণ স্ববিরোধিতা সম্পাদন করবেন। যদি তাই হয়, অর্থাৎ চার্বাকগণ যদি দ্রব্যস্বভাবের অপরিবর্তনীয়তা মেনে না নিয়ে চরম অর্থে আকস্মিকতাবাদী হন, অথচ স্বভাববাদকে স্বীকার করেন তবে চার্বাক মতবাদে আধুনিক বিচারে স্ববিরোধিতার সূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো, স্বভাববাদকে মেনে নেওয়া অথচ দ্রব্য স্বভাবের অপরিবর্তনীয়তা অস্বীকার করা বা চূড়ান্ত আকস্মিকতার কথা বলা, এ দুয়ের মধ্যে যে ধারণাগত বিরোধিতা আছে এ সম্পর্কে তৎকালীন যুগে চার্বাকগণ সচেতন থাকবেন এই দাবি খুব সঙ্গত বলে মনে হয় না। কারণ, এই পার্থক্যকরণ সুস্পষ্ট হয়েছে আধুনিক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রাকৃতিক নিয়ম আবিষ্কারের পর। অবশ্য উপনিষদের যুগেও যদৃচ্ছাবাদ ও স্বভাববাদের মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। কিন্তু উপনিষদ চার্বাকদের যুগের পরবর্তী সময়ের ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্য।
প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে মনে হয়, চার্বাকগণ স্বভাববাদের দ্বারা আধ্যাত্মিকতা বা পূর্বনির্ধারণবাদের বিরোধিতা করতে প্রয়াসী হয়েছেন এবং জাগতিক সবকিছুর উৎপত্তির পদ্ধতি হিসেবে স্বতঃস্ফূর্ততা ও আকস্মিকতার কথা বলেছেন। এতে প্রাকৃতিক নিয়ম বা দ্রব্য স্বভাবের অপরিবর্তনীয়তা রক্ষিত হয়েছে কি না এ সম্পর্কে সুষ্ঠু কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। এসব কারণে চার্বাক দার্শনিকদের যেমন স্বভাববাদী বলে আখ্যায়িত করতে হয় তেমনি একথাও স্বীকার করতে হয় যে, তাঁদের দার্শনিক মতবাদে আকস্মিকতাবাদেরও ইঙ্গিত নিহিত আছে। এই আকস্মিকতাবাদের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া যৌক্তিক দিক থেকে চার্বাকদের সম্ভবত কোনো বিকল্প নাই। উল্লেখ্য যে, পাশ্চাত্য দার্শনিক ডেভিড হিউমও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জগৎ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আকস্মিকতাবাদের কথা বলেছেন। চার্বাক আকস্মিকতাবাদ আধুনিক বিচারে স্বয়ংসম্পূর্ণ না হলেও তৎকালীন সময়ের পরবর্তী দার্শনিকদের জন্য এ মতবাদ নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে এবং দর্শনালোচনায় সতর্কতামূলক পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছে।
নির্যাস
চার্বাক জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কিত উপরের আলোচনা থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো পরিলক্ষিত হয় :
(১) চার্বাকগণ ভারতীয় অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায় থেকে স্বতন্ত্র মত পোষণ করে শুধুমাত্র প্রত্যক্ষকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেন। প্রত্যক্ষ ছাড়া ভারতীয় দর্শনে স্বীকৃত অন্য কোনো প্রমাণকে তাঁরা প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেন নি। মীমাংসা, বেদান্ত, ন্যায়, সাংখ্য, যোগ, বৈশেষিক, বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনে সাধারণভাবে প্রত্যক্ষ ও অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু চার্বাকগণ অনুমানের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখিয়ে বলেন যে, প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ, উপমান ইত্যাদি কোনো প্রমাণ দ্বারাই অনুমানের যথার্থতা প্রমাণ করা যায় না। অনুমানের অযথার্থতা প্রমাণ করতে গিয়ে চার্বাকগণ মূলত অনুমানের মূল ভিত্তি ব্যাপ্তি সম্পর্ককে অনিশ্চিত বলে প্রমাণ করেছেন। ব্যাপ্তি সম্পর্কের নিশ্চিতির প্রশ্ন তুলে অনুমান খণ্ডন করায় চার্বাক মতবাদে পাশ্চাত্য দার্শনিকদের আরোহ অনুমানের নিশ্চিতি খণ্ডন সম্পর্কিত ধারণার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় চার্বাকদের চরম অভিজ্ঞতাবাদী বা প্রত্যক্ষ প্রমাণবাদী বলা হয়।
এদিক থেকে বিচার করে বলা যায়, আধুনিক পাশ্চাত্য দার্শনিক ডেভিড হিউম যে চরম অভিজ্ঞতাবাদের কথা বলেন, বিশ শতকের পাশ্চাত্য যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদী দার্শনিকগণ যে প্রত্যক্ষবাদ প্রচার করেন এবং হিউম, এয়ার, রাসেল প্রমুখ দার্শনিক আরোহানুমানের নিশ্চিতি খণ্ডন করে আরোহের সম্ভাব্যতা সম্পর্কিত মতবাদ দিয়ে পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে যে যুগান্তকারী অবদান রাখেন প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্যে স্বতন্ত্র চিন্তাধারার বাহক চার্বাক দার্শনিকদের চিন্তায় এসব মতবাদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। চার্বাকগণই এসব মতবাদের প্রবক্তা।
(২) প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্ব তথা অভিজ্ঞতাবাদের ভিত্তিতে চার্বাকগণ ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দর্শনে স্বীকৃত বহুল আলোচিত শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব খণ্ডন করেন। শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব খণ্ডন করতে গিয়ে চার্বাকগণ আত্মাকে দেহাতিরিক্ত সত্তা না বলে দেহ ও আত্মাকে অভিন্ন বলে মনে করেন। তাঁদের ব্যাখ্যানুসারে আত্মা দেহের আগন্তুক গুণ বা উপবস্তু। তাই তাঁদের আত্মা সম্পর্কিত মতবাদকে দেহাত্মবাদ নামে অভিহিত করা হয়। আধুনিক কালে পাশ্চাত্য বিশ্লেষণী দার্শনিক গিলবার্ট রাইল ও জড়বাদী দার্শনিক ক্যাবাইন প্রমুখের আত্মা সম্পর্কে উপঘটনাবাদী মতবাদে চার্বাক দার্শনিক মতের প্রভাব লক্ষ করা যায়। এছাড়া, ডেভিড হিউমের আত্মা সম্পর্কিত মতবাদে, দ্বান্দ্বিক জড়বাদী দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের মতবাদে, এমনকি সাম্প্রতিক কালের চেতনা সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় চার্বাক মতের অনুরণন শোনা যায়। সুতরাং এদিক থেকে বলা যায়, আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানে আত্মার যে উপঘটনাবাদী ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে ভারতীয় দার্শনিক চার্বাকদের ব্যাখ্যায় এসব মতবাদের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। চার্বাকগণ আত্মা সম্পর্কে যে দেহাত্মবাদী ধারণার কথা বলেছেন তার মধ্যে আধুনিক কালের আত্মা সম্পর্কিত উপঘটনাবাদী, পুঞ্জবাদী ও জড়বাদী মতের ভিত্তিভূমি নির্মিত হয়েছে! ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে আত্মা সম্পর্কিত অধ্যাত্মবাদী মতবাদের স্থলে জড়বাদী মতবাদের প্রবক্তা হিসেবে চার্বাক দার্শনিকদের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ দার্শনিকগণ যে অনাত্মবাদের কথা বলেন তার মধ্যেও চার্বাক মতবাদের প্রভাব লক্ষ করা যায়।
(৩) প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্বের ভিত্তিতে চার্বাক দার্শনিকগণ ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দর্শনে স্বীকৃত, এমনকি আধুনিক নিউটনীয় বিজ্ঞানের ভিত্তিভূমি হিসেবে স্বীকৃত কার্যকারণতত্ত্বকেও খণ্ডন করেন। তাঁরা কার্যকারণের আবশ্যিকতা সম্পর্কে নিশ্চিতিবাদকে খণ্ডন করে আকস্মিকতাবাদের প্রবর্তন করেন। তাঁদের মতে, কার্যকারণের সম্পর্ক নিশ্চিত নয়, সম্ভাব্য। কারণ, এ সম্পর্ক ব্যাপ্তি জ্ঞান নির্ভর আর ব্যাপ্তি জ্ঞান নিশ্চিত নয়, সম্ভাব্য বা আকস্মিক মাত্র। চরম অভিজ্ঞতাবাদী হিউমও কার্যকারণের আবশ্যকতাকে নিশ্চিত না বলে সম্ভাব্য এবং আকস্মিক হিসেবে প্রমাণ করে জ্ঞানের ক্ষেত্রে সংশয়বাদী মতবাদ প্রদান করেন। বিশ শতকের বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদেও কার্যকারণের এই সম্ভাব্যতাতত্ত্ব তথা আকস্মিকতাবাদ সমর্থিত হয়েছে। সুতরাং বলা যায়, কার্যকারণের আবশ্যকতা খণ্ডনের ব্যাপারে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানে যে মতবাদ প্রদান করা হয়েছে বহু পূর্বে প্রাচীন ভারতে চার্বাক দার্শনিকগণই এই আকস্মিকতাবাদ প্রবর্তন করে গেছেন। এদিক থেকে বিচার করে চার্বাক দার্শনিকগণকে দর্শন ও বিজ্ঞানের ইতিহাসে কার্যকারণতত্ত্বের ক্ষেত্রে আকস্মিকতাবাদের প্রবক্তা বলা যায়। এছাড়া, কার্যকারণকে অস্বীকার করে বস্তুর স্বভাব বা প্রকৃতি দ্বারা বস্তুর উৎপত্তি ব্যাখ্যা করায় তাঁদেরকে স্বভাববাদ বা প্রকৃতিবাদের প্রবক্তা হিসেবেও অভিহিত করা যায়।
(৪) চার্বাকগণ প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতীয় দর্শনের স্বীকৃত কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদের ধারণা খণ্ডন করেন। তাঁদের মতে, কর্মফল ভোগ করার জন্য পুনর্জন্ম গ্রহণের ধারণা যথার্থ নয় বরং নিম্নশ্রেণির মানুষকে পরলোকের ভয় দেখিয়ে শোষণ করার জন্য এ ধারণা উচ্চশ্রেণির মানুষ উদ্দেশ্যমূলকভাবে তৈরি করেছে। পুনর্জন্ম ও জন্মান্তরবাদ খণ্ডন করায় পূর্বজন্মের ধারণাও খণ্ডিত হয়েছে। এছাড়া, আত্মার মুক্তি নয় বরং দেহের মৃত্যুকেই মোক্ষ হিসেবে অভিহিত করে চার্বাকগণ মোক্ষ সম্বন্ধে ইহলোক বা জাগতিকতাবাদী মতবাদ প্রচার করেছেন। এদিক থেকে ভারতীয় দার্শনে চার্বাক দর্শন অনন্য এবং ব্যতিক্রমী।
(৫) প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্বের ভিত্তিতে চার্বাকগণ সুখকেই নৈতিকতার চরম আদর্শ হিসেবে অভিহিত করে সুখবাদী নৈতিক আদর্শকে সমর্থন করেছেন। প্রত্যক্ষযোগ্য নয় বলেই ঈশ্বর, আত্মা, পরজন্ম, পূর্বজন্ম, কর্মবাদ ইত্যাদির ধারণাকে পরিত্যাগ করে চার্বাকগণ মানুষের প্রত্যক্ষযোগ্য ইহলৌকিক যে সুখবাদী নৈতিক মতবাদ প্রচার করেছেন। তাঁদের মতবাদে গ্রিক সুখবাদী এরিস্টিপাস ও আধুনিক সুখবাদী জেরেমি বেনথামের স্থূল বা অসংযত সুখবাদী মতের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এদিক থেকে বিচার করে নৈতিকতার ক্ষেত্রে চার্বাক দার্শনিকদেরকে সুখবাদের প্রবক্তা বলা যায়। এছাড়া, নীতিতত্ত্বের সাথে চার্বাকগণ রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার সংযোগ সাধন করায় অন্য আটটি ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ের নীতিতত্ত্বের চেয়ে চার্বাক নীতিতত্ত্ব স্বতন্ত্ররূপ ধারণ করে। এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য চার্বাক নীতিদর্শনকে শুধু নীতিদর্শন না বলে নৈতিক-রাজনৈতিক দর্শন হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়, যা অন্যান্য ভারতীয় সম্প্রদায়ের নীতিতত্ত্ব থেকে স্বতন্ত্র।
(৬) প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্বভিত্তিক চার্বাক অধিবিদ্যা বহুত্ববাদী জড়বাদভিত্তিক। কারণ, তাঁদের মতে, প্রত্যক্ষযোগ্য ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ এই চারটি জড়বস্তুই জগতের মূলতত্ত্ব। জগতের সকল বস্তু, এমনকি চেতনাও এই চারিভূত দ্বারা গঠিত। পরবর্তীকালে গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাস, এম্পিডক্লিস প্রমুখ পাশ্চাত্য দার্শনিক জড়বাদী মতবাদ প্রদান করেন এবং আধুনিক কালে কার্ল মার্ক্স দ্বান্দ্বিক জড়বাদী মতবাদ প্রদানের মাধ্যমে জড়বাদের সুসঙ্গত রূপ দেন। তাই দর্শনের ইতিহাসে চার্বাক দার্শনিক সম্প্রদায়কে প্রথম জড়বাদী সম্প্রদায় তথা জড়বাদের প্রবক্তা বলা যায়।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, ভারতীয় দর্শনে, বিশেষত ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে চার্বাক দার্শনিকগণ অনন্য বৈশিষ্ট্যের দাবিদার। তাঁরাই ভারতীয় দর্শনের একমাত্র চরম অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক। অভিজ্ঞতাবাদভিত্তিক জ্ঞানবিদ্যার সাথে সাথে দর্শনের অন্যান্য ধারণার ব্যাখ্যায়ও তাঁরা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, এমনকি মৌলিক ও বিশ্লেষণাত্মক ভূমিকা রেখেছেন। এছাড়া তাঁরা বহু দার্শনিক ধারণার ভিত্তি নির্মাণ করেছেন। এসব দিক বিচার করে শুধু ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে নয়, বরং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় দর্শনের ইতিহাসে চার্বাক দার্শনিকগণকে জ্ঞানবিদ্যার দিক থেকে প্রথম অভিজ্ঞতাবাদী, আত্মার ধারণার ব্যাখ্যায় প্রথম দেহাত্মবাদী, কার্যকারণতত্ত্বের ব্যাখ্যায় প্রথম আকস্মিকতাবাদী ও স্বভাববাদী, মোক্ষের ধারণার ব্যাখ্যায় প্রথম ইহলোকবাদী বা জাগতিকতাবাদী, নীতিতত্ত্বের দিক থেকে প্রথম সুখবাদী এবং তত্ত্ববিদ্যাগত দিক থেকে প্রথম জড়বাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এসব কারণে ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে চার্বাকদের ভূমিকা ও স্থান অনন্য। আলোচনার অগ্রগতিতে আমরা ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে চার্বাকদের স্থান নির্ণয়ে প্রয়াসী হব।
ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যায় চার্বাকদের অবস্থান
পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে চার্বাক সম্প্রদায় একটি ব্যতিক্রমধর্মী এবং অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত স্বতন্ত্র দার্শনিক ধারার বাহক। জ্ঞানোৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্ব বা চরম অভিজ্ঞতাবাদ, অধিবিদ্যাগত দিক থেকে বা সত্তার স্বরূপ সম্পর্কে জড়বাদ, আত্মা সম্পর্কে দেহাত্মবাদ, বস্তু ও চেতনার উৎপত্তি সম্পর্কে স্বভাববাদ বা প্রকৃতিবাদ, কার্যকারণের ব্যাখায় আকস্মিকতাবাদ, মোক্ষ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে ইহলৌকিতাবাদ বা জাগতিকতাবাদ এবং নৈতিক আদর্শ সম্পর্কে সুখবাদের দৃঢ় ও সুস্পষ্ট সমর্থক হিসেবেই চার্বাকদের এই স্বাতন্ত্র্য। মূলত ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের একক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে চার্বাক দর্শন প্রাচীনকাল থেকে নিজ স্ব আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে।[১৫২]
সনাতনী মানদণ্ডে ভারতীয় নব-দর্শন বা নয়টি দার্শনিক সম্প্রদায়কে আস্তিক ও নাস্তিক এই দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। এ বিভাগ অনুসারে সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত, এই ছয়টি আস্তিক দার্শনিক সম্প্রদায় বেদকে স্বীকার করে তাঁদের দার্শনিক চিন্তাধারার আলোচনা করেছে। এদেরকে একত্রে ষড়দর্শন বলা হয়। ষড়দর্শনের মধ্যে বেদান্ত, সাংখ্য, যোগ, ন্যায় ও বৈশেষিক প্রধানত এ পাঁচটি দর্শন বেদের জ্ঞানকাণ্ড তথা উপনিষদের অনুসারী।[১৫৩] যদিও উপনিষদীয় ভাবধারার অবিকৃত রূপায়ণ একমাত্র বেদান্ত দর্শনেই দেখা যায়, তবুও একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, অন্যান্য দর্শনের ভাষ্যকারগণও মূলত উপনিষদের সঙ্গে অবিরুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন। এদের সকলেই জাগতিক দুঃখভোগের একান্ত নিবৃত্তিস্থল হিসেবে মোক্ষকে নির্দেশ করে মোক্ষলাভের উদ্দেশ্যে দর্শালোচনা করেছেন। ষড়দর্শনের মধ্যে মীমাংসা প্রত্যক্ষভাবে বেদের জ্ঞানকাণ্ড তথা উপনিষদানুসারী দর্শন নয়। এই দর্শন প্রধানত বেদের কর্মকাণ্ডের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু বৈদিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্বর্গলাভই এ দর্শনের চরম লক্ষ্য। প্রভাকর ও কুমারিলের রচনায় সংসার বন্ধনের পরিসমাপ্তি বা মোক্ষকে চরম লক্ষ্য হিসেবে নির্দেশ করে এই দর্শনও উপনিষদানুসারী অন্য দর্শনগুলোর সঙ্গে একসূত্রে গ্রথিত হয়েছে।
ভারতীয় দর্শনে বৌদ্ধ ও জৈন এ দুটি দার্শনিক সম্প্রদায় ষড়দর্শন থেকে পৃথক গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত। এরা নাস্তিক হিসেবে পরিচিত। এ সত্ত্বেও ভাবগত ঐক্যের বিচারে এ দুটি দর্শনকেও উপনিষদীয় দর্শনের সমপর্যায়ের বলে মনে করা হয়।[১৫৪] বৈদিক অনুষ্ঠানের বিরোধী হলেও বৌদ্ধ দর্শনে সমসাময়িক দেশ ও কালের আধ্যাত্মিক ভাবধারার সঙ্গে সঙ্গতি বিধানের প্রচেষ্টা সুস্পষ্ট। এদিক থেকে বিবেচনা করে রাধাকৃষ্ণণ প্রাথমিক বৌদ্ধ মতকে উপনিষদীয় চিন্তার নতুন প্রকাশ বলে মন্তব্য করেন।[১৫৫] জৈন তীর্থঙ্করদের দার্শনিক চিন্তাও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই ভারতীয় সাহিত্যের খ্যাতনামা ঐতিহাসিক উইন্টারনিশ্ -এর মতে, পরবর্তীকালের সকল ভারতীয় দার্শনিক চিন্তাই বস্তুতপক্ষে উপনিষদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।[১৫৬] সুতরাং দেখা যায়, বেদ-সমর্থক এবং আস্তিক নামে পরিচিত ষড়দর্শন এবং নাস্তিক বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন, এই আটটি ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মূল ভাবগত দিক থেকে ভারতীয় আধ্যাত্ম ভাবধারার অনুসারী ও পৃষ্ঠপোষক
ষড়দর্শন বেদকে স্বীকার করে গড়ে উঠলেও একথা সত্য যে, তা বেদের মধ্যে নিহিত জড়বাদী ভাবধারা অর্থাৎ সংহিতা ও ব্রাহ্মণ পর্যায়ের বৈদিক সাহিত্যের ধ্যান-ধারণার চেয়ে বেদের অধ্যাত্মবাদী তথা উপনিষদীয় ভাবধারার প্রভাবে অধিক পরিমাণে প্রভাবিত হয়েছে। এদিক থেকে একমাত্র চার্বাক বা লোকায়ত দৰ্শনই ব্যতিক্রম। চার্বাক দর্শনে যেমন বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মণ পর্যায়ের সাহিত্যের ভাবধারা, অর্থাৎ বেদের জড়বাদী ভাবধারা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে তেমনি অধ্যাত্মবাদী দার্শনিক ভাবধারার প্রতি সুস্পষ্ট বিরোধাত্মক মনোভাবও প্রকাশ পেয়েছে।
সনাতনী বিভাগের দিক থেকে চার্বাক দর্শন বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনের পর্যায়ভুক্ত, অর্থাৎ নাস্তিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। তবে অন্য দুটি নাস্তিক দর্শন থেকেও চার্বাক দর্শনের বিশেষ স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। কারণ, বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন বেদপ্রামাণ্যে অবিশ্বাস করে নাস্তিক। তবে তাঁরা নিজেদের শাস্ত্রপ্রামাণ্যে বিশ্বাস করে। যেমন, বৌদ্ধরা বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রে তথা ত্রিপিটকে, জৈনরা জিনদের উপদেশাবলিতে অবিচলভাবে বিশ্বাস করেন। কিন্তু চার্বাকগণ কোনো শাস্ত্রেই বিশ্বাস করেন না। বৌদ্ধ দার্শনিকগণ পারমার্থিক অর্থে আত্মায় বিশ্বাস না করলেও ব্যবহারিক অর্থে আত্মায় বিশ্বাস করেন। জৈন দার্শনিকগণও আত্মায় বিশ্বাস করেন। কিন্তু চার্বাক দর্শনে আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। বৌদ্ধ ও জৈন উভয় সম্প্রদায়ই জন্মান্তরবাদ, কর্মবাদ, কার্যকারণ সম্পৰ্ক এবং মুক্তি বা নির্বাণের ধারণায় বিশ্বাস করে। কিন্তু চার্বাক এসবের কোনো কিছুকেই স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, প্রত্যক্ষ প্রমাণই যথার্থ জ্ঞানের একমাত্র উৎস ও মানদণ্ড।
সুতরাং আস্তিক ও নাস্তিক উভয় সম্প্রদায়ের দার্শনিকদের থেকে চার্বাক দর্শনের এসব স্বাতন্ত্র্যই তাঁদেরকে ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে একটি অনন্য আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। চার্বাকগণ অন্য আটটি সম্প্রদায়ের সাধারণ বৈশিষ্ট্যের বাইরে এসে একটি নিজস্ব একক ধারাকে বহন করেছেন, যে ধারাটির মূল উৎস বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মণ অংশ। চার্বাক দর্শনের এই অধ্যাত্মবাদ বিরোধী ব্যতিক্রমধর্মী জড়বাদী অবস্থানের উৎস ও প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করতে হলে চার্বাকদের যুগে প্রাচীন ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থার দিকে দৃষ্টি দিতে হয়।
চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের আবির্ভাবকাল সঠিকভাবে নির্ণয় করা ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয়। তবে বৌদ্ধশাস্ত্র, মহাভারত, মনুসংহিতা প্রভৃতি নজির থেকে অনায়াসেই অনুমান করা হয় যে, এ সম্প্রদায়টির ইতিহাস সুপ্রাচীন।[১৫৭] হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে চার্বাক মতের উল্লেখ পাওয়া যায়।[১৫৮] ঋগ্বেদ, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে অনুমান করা হয় যে, খ্রিষ্টপূর্ব যুগে, এমনকি গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের বহু পূর্বে ভারতে চার্বাক বা লোকায়ত মতের আবির্ভাব ঘটেছিল। রামায়ণ ও মহাভারত খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ থেকে খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে লিখিত বলে অনুমান করা হয়, তবে এ দুটি মহাকাব্যের কাহিনী বাস্তবে ঘটেছিল আরও অনেক আগে। কাব্য দুটির মূল কাহিনী এবং গ্রন্থ দুটির অন্তর্ভুক্ত বহু উপাখ্যানকে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের প্রথমার্ধের সময়কার বলে মনে করা হয়।[১৫৯] রামায়ণে লোকায়ত দার্শনিকদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। রামচন্দ্র ভরতকে বলেন :
কৃচ্চিন্ন লৌকায়তিকান ব্রাহ্মণাংস্তাত সেবসে।
অনর্থকুশলীহ্যোতে বালাঃ পণ্ডিত মানিনাঃ।।[১৬০]
অর্থাৎ হে বৎস, আশা করি তুমি লোকায়তিক ব্রাহ্মণদের সেবা করছ না। তারা অনর্থকুশল এবং পণ্ডিত হলেও বালক।
রামায়ণের কাহিনীগুলোকে প্রায়শই আর্য উপজাতি ও দক্ষিণ ভারতের জনসাধারণের মধ্যে সংগ্রামের স্মারক হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুও একথা বলেছেন যে, রামায়ণ ও মহাভারত হলো ইন্দো-আর্যদের প্রাথমিক জীবনের বিবরণ, তাঁদের গৃহযুদ্ধের কাহিনী, যদিও এগুলো পরবর্তীকালে রচিত হয়েছে।[১৬১] রামায়ণের মতো ঋগ্বেদেরও দশম মণ্ডলের বাহাত্তর সুক্তের তৃতীয় ঋক-এ বৃহস্পতিলৌক্য নাম পাওয়া যায়। তাঁকে ‘গণপতি’ আখ্যাও দেওয়া হয়েছে! তিনিই সম্ভবত চার্বাকদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে খ্যাত জড়বাদী বৃহস্পতি।[১৬২] ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলকে অন্য নয়টি মণ্ডলের অনেক পরবর্তীকালের রচনা বলে মনে করা হয়। তবে বর্তমান কালের ভারতীয় ও বিদেশী পণ্ডিতদের বিতর্ক থেকে বৈদিক সাহিত্য রচনার যে সর্বশেষ সময় সীমা পাওয়া যায় তা হলো ৭০০ খ্রিষ্টপূর্ব অব্দ। অর্থাৎ উত্তর- বৈদিক সাহিত্য বা ঋগ্বেদের দশম মণ্ডল থেকে উপনিষদ পর্যন্ত ৭০০ খ্রিষ্টপূর্ব অব্দের মধ্যে রচিত হয়ে গিয়েছিল।[১৬৩] এসব তথ্যের ভিত্তিতে লোকায়ত বা চার্বাক মতকে অন্তত ৭০০ খ্রিষ্টপূর্ব অব্দের পূর্ববর্তী বলে মনে করা অসঙ্গত হবে না।
খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শুরুতে ভারতে লৌহ ব্যবহার শুরু হয় এবং দাস-মালিক রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। অবশ্য এ উপমহাদেশে আর্য-আগমনের পর থেকেই দ্রাবিড় অনার্যদের পদানত করে রাখার মাধ্যমে দাসপ্রথা শুরু হয়ে গিয়েছিল। শীঘ্রই পশুপালন ও চাষ-বাসকে কেন্দ্র করে আর্য অনার্য বর্ণপ্রথা অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে চালিত হয়ে জটিল বর্ণপ্রথায় রূপলাভ করে এবং অমার্জিত ধর্মীয় সংস্করণের সূত্রপাত এর সমর্থন যোগায়। চার্বাক দর্শন এই বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ। ঋগ্বেদে যে সমাজের পরিচয় পাওয়া যায় তা আদিম সাম্যবাদী সমাজের সর্বশেষ এবং শ্রেণিবিভক্ত সমাজের প্রারম্ভের ইঙ্গিত বহন করে। অর্থাৎ ঋগ্বেদ হলো আদিম সাম্যবাদী সমাজের শেষ ও শ্রেণিবিভক্ত সমাজের শুরুর সন্ধিক্ষণ।[১৬৪] উপনিষদে যে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের স্পষ্টরূপ দেখা যায় ঋগ্বেদে সে সমাজের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ঋগ্বেদে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিনটি বর্ণের বহুবিধ উল্লেখ পাওয়া যায়। এই তিন বর্ণকেই ‘দ্বিজ’ বলে গণ্য করা হত। তবে কেবলমাত্র ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলেই শুদ্র বর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়, যাদেরকে ‘দ্বিজ’ গণ্য করা হত না। এরা বৈদিক আচারে দীক্ষিত হওয়া, বৈদিক ক্রিয়াকলাপে অংশ নেওয়া ও বৈদিক ধর্মগ্রন্থ পাঠের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। শুধুমাত্র ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের পুরুষ সুক্তে বলা হয়েছে ব্রাহ্মণরা ‘পুরুষ’-এর মুখগহ্বর থেকে, ক্ষত্রিয়রা বাহু থেকে, বৈশ্যরা উরু থেকে এবং শূদ্ররা পদ থেকে উৎপন্ন হয়েছে।[১৬৫] শূদ্ররা ছিল কৃতদাসের মতো দরিদ্র, বঞ্চিত, শোষিত ও অন্য তিন সম্প্রদায়ের উপর নির্ভরশীল। বর্ণপ্রথার ফলে সুবিধাপ্রাপ্ত ধনী জমি—মালিক ও দাস-মালিকদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। সমাজের সম্পদ তাদের হাতে কুক্ষিগত হয়। সুখ লাভের উপাদান বা সম্পদের উপর সকল মানুষের অধিকার থাকে না। এ অবস্থায় শোষিত মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি কামনা করে। বৈদিক যুগে এমনি এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতির আবির্ভাব বলে মনে করা হয়।[১৬৬]
বৃহস্পতিলৌক্য তাঁর দ্বারা প্রচারিত জড়বাদী দর্শনে মানুষের সাম্য ও যাবতীয় সুযোগের সমবণ্টনের উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি অতীন্দ্রিয়, পারলৌকিক সুখের আশার বাণীর পরিবর্তে ইন্দ্রিয়সুখ এবং প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বিষয়ের উপর অতীন্দ্রিয় বিষয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন। তাই তাঁর দর্শন তৎকালীন শোষিত, বঞ্চিত, মানুষের মুক্তির স্বাভাবিক দর্শনে রূপলাভ করে। সম্ভবত এ কারণেই তিনি গণপতি উপাধি লাভ করেন। তাই এটা মনে করা হয় যে, অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন বর্ণপ্রথায় আক্রান্ত আর্থসামাজিক কাঠামো এবং ধর্মীয় রাজনৈতিক, দাস- মালিক রাষ্ট্রের মুষ্টিমেয় সবল ব্যক্তির শাসন ও শোষণের পরিবেশেই প্রাচীন ভারতে লোকায়ত দর্শনের ধীর স্ফুরণ ঘটে।[১৬৭] মূলত সামাজিক দুর্ভোগের বিরুদ্ধে একটি আপোষহীন প্রতিবাদ হিসেবে চার্বাক মতবাদ বিকশিত হয়। জড়বাদের ভিত্তিতে চার্বাক দর্শন শাস্ত্রবচনকে শোষণ বঞ্চনার উৎস ধোঁকাবাজি এবং ব্রাহ্মণদের জীবিকা নির্বাহের পথ হিসেবে ঘোষণা করে। এছাড়া এ দর্শন দেহাতীত আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করার মাধ্যমে পরলোক, পরজন্ম এবং এসবের তত্ত্বগত ভিত্তি কর্মবাদকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করে। ফলে প্রাচীন ভারতীয় সমাজের সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ, জাতিভেদের বিরুদ্ধে অভিযানের পথ প্রশস্ত হয়।[১৬৮] এই সামাজিক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণকেই চার্বাক দর্শনের পক্ষে লোকায়ত দর্শনের মর্যাদালাভের অন্যতম কারণ হিসেবে ধারণা করা যেতে পারে। এ কারণে অনেকে মনে করেন, পৃথিবীর ইতিহাসে বৃহস্পতিলৌক্যের চিন্তার মধ্যেই সর্বপ্রথম জড়বাদী দার্শনিক চিন্তার বীজ পাওয়া যায়।[১৬৯]
উপরে আলোচিত প্রেক্ষাপটের কথা স্মরণ রেখে ভারতীয় দর্শনের আধুনিক পণ্ডিতগণ এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয় সমাজে দ্বিজ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই তিনটি বর্ণ) ও শূদ্রের শ্রেণিবিরোধ দার্শনিক চিন্তাকে প্রভাবিত করেছে। এই বিরোধ প্রজা বা জন-দর্শন এবং রাজা বা যাজক সম্প্রদায়ের দর্শনের মধ্যে দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই প্রজা বা সাধারণ মানুষের দর্শনই ভারতীয় পরিভাষায় ‘লোকায়ত দর্শন’ হিসেবে প্রচলিত। অন্যদিকে রাজ-দর্শন প্রচলিত হয়েছে দর্শন নামে।[১৭০] এই বিরোধের ফলে লোকায়ত বা জন- দর্শন যখন দেহাত্মবাদ তথা জড়বাদ প্রচার করেছে রাজ-দর্শন তখন অতীন্দ্রিয় দেহাতিরিক্ত আত্মার তত্ত্ব তথা ভাববাদ প্রচার করেছে।
এ প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মত স্মরণযোগ্য। তাঁর মতে, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে জড়বাদ বনাম ভাববাদের সংঘর্ষ সর্বপ্রথম দেহাত্মবাদ বনাম দেহাতিরিক্ত আত্মাসংক্রান্ত মতের মধ্যে সংঘর্ষ হিসেবে রূপায়িত হয়।[১৭১] আসলে দেহাতিরিক্ত আত্মবাদ প্রতিষ্ঠা ও দেহাত্মবাদের ধ্বংস সাধনই তৎকালীন সমাজের বিধান ছিল। একমাত্র চার্বাক দর্শনই দেহাতিরিক্ত সত্তা হিসেবে আত্মার অস্তিত্বের বিরোধিতা করে দেহাত্মবাদকে স্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছে। অর্থাৎ ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে অধ্যাত্মবাদের বিরোধিতা ও দেহাত্মবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চার্বাক বা লোকায়তরাই ছিল একমাত্র দার্শনিক গোষ্ঠী। চার্বাক ছাড়া অন্যান্য দর্শনে ভাববাদ বিরোধিতার বীজ নিহিত থাকলেও একমাত্র চার্বাক বা লোকায়ত দৰ্শনই সাহিত্য, দর্শন, লোকাচার ইত্যাদি সমস্ত দিক দিয়ে তৎকালীন সমাজ ও মানুষের সামনে ভাববাদের কপটাচারের মুখোশ খুলে দিয়েছিল।[১৭২] তাই চার্বাক দর্শন সম্পর্কে সর্বত্রই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য-পরিহাস-উপহাস-ঘৃণা-বিদ্বেষ সহকারে আলোচনা করা হয়েছে। লোকায়ত বা চার্বাক নামের সঙ্গে অত্যন্ত গভীরভাবে সম্পৃক্ত সমকালীন প্ৰচলিত যে প্রবাদ—যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, ১৭৩] তাও আসলে উত্তরপক্ষের বা সমালোচকদের উপহাসপ্রবণ উক্তি।[১৭৪]
উল্লেখ্য যে, ভারতীয় দর্শনে জড়বাদী ধারণা শুধু চার্বাকদের মধ্যেই ছিল না, বরং উপনিষদ বা বেদান্ত দার্শনিক উদ্দালক আরুনি থেকে শুরু করে বৌদ্ধ সর্বাস্তিবাদ, সাংখ্য আদিরূপ, ন্যায়-বৈশেষিক পরমাণুবাদ প্রভৃতিকেও জড়বাদঘেঁষা মতবাদ বলে আখ্যায়িত করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।[১৭৫] তবে এ কথা সত্য যে, চার্বাকদের মতো আপোষহীনভাবে জড়বাদের প্রচার অন্য কোনো দার্শনিক সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। পরমাণুবাদের সমর্থন করেই ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকদের আবির্ভাব। তাই এই দর্শন বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে। তবুও এই দর্শন পরমাণুবাদের চরম ও যৌক্তিক পরিণতি হিসেবে জড়বাদী দর্শনে পরিণতি লাভ করেনি। ন্যায় দর্শনের উৎকর্ষকেই এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। উৎকর্ষ লাভের শর্ত হিসেবেই সমসাময়িক চিন্তাধারার কাছে ন্যায় দার্শনিকদের মাথা নোয়াতে হয়েছে এবং প্রসঙ্গ বিশেষে ভাববাদের সাথেও কমবেশি আপোষ করতে হয়েছে।
কিন্তু চার্বাক দার্শনিকগণ এ রকম আপোষকে মেনে নেননি। তাঁদের আপোষহীনতা এবং জড়বাদী দার্শনিক সম্প্রদায় হিসেবে ভারতীয় দর্শনে তাঁদের স্বাতন্ত্র্য, তাঁদের প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্বেও প্রমাণিত হয়েছে। চার্বাক ব্যতীত অন্য যে সব দার্শনিক সম্প্রদায় জড়বাদকে সমর্থন করেছে তাদের মধ্যে একমাত্র বৌদ্ধ ছাড়া আর সকলেই কমপক্ষে তিনটি প্রমাণ যথা, প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দকে গ্রহণ করেছে। বৌদ্ধগণ শব্দকে বাদ দিয়ে প্রত্যক্ষ এবং অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু চার্বাক দার্শনিকগণ শুধুমাত্র প্রত্যক্ষকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রত্যক্ষবাদী হিসেবে তাঁদের অধ্যাত্মবাদ বিরোধী ও জড়বাদী অবস্থান দৃঢ় করেছেন। এই আপোষহীনতা হয়তো চার্বাক মতবাদকে দর্শন হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। অর্থাৎ ভাববাদের সঙ্গে আপোষহীনতার কারণে চার্বাক দর্শন অন্যান্য ভাববাদী দর্শনের মতো মর্যাদা লাভ করতে পারে নি। চার্বাকদের রচনা দুষ্প্রাপ্য বা দুর্লভ হওয়ারও এটি প্রধান কারণ। অনুমান করা হয় যে, তাঁদের রচনাবলি বিরুদ্ধবাদীদের দ্বারা যথাসম্ভব ধ্বংস করা হয়েছে। তবে একথা সত্য যে, জড়বাদী ও প্রত্যক্ষবাদী হিসেবে চার্বাক দর্শন যতটুকু টিকে আছে ততটুকু আপোষহীন। ফলে দার্শনিক উৎকর্ষের দিক থেকে তা সুযোগ বঞ্চিত হলেও জড়বাদ ও প্রত্যক্ষবাদের বৈপ্লবিক ভূমিকার দিক থেকে ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে চার্বাক মত অতুলনীয়।[১৭৬]
প্রশ্ন হলো, চার্বাক দার্শনিকগণ কেন সমসাময়িক অধ্যাত্মবাদবিরোধী তথা প্রচলিত সমাজবিরোধী, প্রত্যক্ষবাদী, দর্শন প্রচার করতে প্রয়াসী হন? প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান, বিশেষত চিকিৎসাশাস্ত্রের বা রসায়নশাস্ত্রের প্রভাব এর একটি অন্যতম কারণ। আয়ুর্বেদ প্রাচীন ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্র। আয়ুর্বেদের শুরু ঋগ্বেদে এবং বিকাশ অথর্ববেদে।[১৭৭] ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে চারিবেদ থেকে ব্রহ্মা আয়ুর্বেদ সৃষ্টি করেন। আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, -গান্ধর্ববেদ ও অর্থশাস্ত্র—এ চারখানা গ্রন্থ হলো উপবেদ। উপবেদ চতুষ্টয় অথর্ববেদমূলক বলে প্রসিদ্ধ হলেও এর শুরু ঋগ্বেদে। উপবেদের মূলভিত্তি বেদ। কিন্তু এগুলো লৌকিক অর্থাৎ লোকযাত্রা নির্বাহক। এই উপবেদগুলোর মধ্যে আয়ুর্বেদ প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রের নামান্তর মাত্র।[১৭৮] যাতুবিদ্যা (মন্ত্রের প্রভাবে উদ্দীষ্ট কার্য সম্পাদনের বিদ্যা) যেমন অথর্ববেদের অঙ্গ ছিল তেমনি ফলিত জ্যোতিষ এবং চিকিৎসাশাস্ত্রও অথর্ববেদের অঙ্গ। চিকিৎসাশাস্ত্র মানবজীবনে অত্যাবশ্যকীয় হলেও অথর্ববেদের অঙ্গ হওয়ায় যাতুবিদ ও ফলিত জ্যোতিষীর মতো চিকিৎসাবিদও তৎকালীন হিন্দু সমাজে নিন্দিত ছিলেন।[১৭৯] আয়ুর্বেদের শল্য, শালক্য, কায়, কৌমাবভৃত্য, অগদ, ভূতবিদ্যা, রসায়ন ও বাজীকরণতন্ত্র—এই আটটি ভাগের মধ্যে রসায়নশাস্ত্র অন্যতম। অনুমান করা হয় যে, ভারতীয় ইতিহাসে আয়ুর্বেদই সর্বাধিক প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রকৃতিবিজ্ঞানের দিকে প্রথম পদক্ষেপ রেখেছিল। তৎকালীন সামাজিক প্রতিকূলতার কারণেই তা খুব বেশি বিকশিত হতে পারেনি। ভারতীয় বিজ্ঞানচেতনার এই অবক্ষয়ের জন্য আধুনিক ভারতীয় বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় শঙ্করের মায়াবাদকে বিশেষভাবে দায়ী করেছেন।[১৮০]
ভারতীয় প্রাকৃতিক বিজ্ঞান তথা চিকিৎসাশাস্ত্রের লোকযাত্রা নির্বাহক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং এর প্রতি তৎকালীন উচ্চ হিন্দু সমাজের অবজ্ঞা বা নিন্দাসূচক মনোভাবসহ অন্যান্য বিভিন্ন সাদৃশ্য থেকে মনে করার অবকাশ থাকে যে, ভারতের প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিকাশের সঙ্গে চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল। প্রখ্যাত ন্যায় দার্শনিক জয়ন্ত ভট্ট তাঁর ন্যায়মঞ্জরী গ্রন্থে চার্বাক ভূতচৈতন্যবাদ খণ্ডনের উদ্দেশ্যে পূর্বপক্ষ হিসেবে চার্বাকদের একটি যুক্তির উল্লেখ করেন। যুক্তিটি নিম্নরূপ :
অন্ন পানাদি দ্বারা শরীর পুষ্ট হলে চেতনার উৎকর্ষ দেখা যায়। কিন্তু শরীরের পুষ্টির অভাব হলে চেতনাও ক্ষুণ্ণ হয়। এছাড়া ব্রাহ্মীঘৃত খেলে চেতনা বা জ্ঞান বাড়ে। অর্থাৎ ভূতবস্তুর আধিক্যে চৈতন্য বাড়ে, অভাবে কমে। সুতরাং চৈতন্য ও ভূতবস্তুর মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক আছে।[১৮১]
আয়ুর্বেদশাস্ত্রে একথা বলা হয়েছে যে, প্রাণঃ প্রাণভূতম্ অনুম্। অর্থাৎ অন্নই হলো প্রাণীর প্রাণ।[১৮২] এছাড়া, আয়ুর্বেদশাস্ত্রে ব্রাহ্মীঘৃতের কথাও আছে। এ থেকে অনুমান করা হয় যে, চার্বাকগণ চেতনার কারণ হিসেবে যে অনুপানাদি ও ব্রাহ্মীঘৃতকে নির্দেশ করেছেন তার উৎস প্রাচীন ভারতের আয়ুর্বেদশাস্ত্র। অবশ্য ছান্দোগ্য উপনিষদের বিজ্ঞানমনস্ক ঋষি উদ্দালকের মুখেও অন্নের উদাহরণ শোনা যায়। প্রাচীন ভারতের আয়ুর্বেদ তথা রসায়ন বা চিকিৎসাশাস্ত্র চার্বাক চিন্তার উপাদান সরবরাহ করেছে এ বিষয়ে আরো অনেক দৃষ্টান্ত আছে। যেমন, দেহাত্মবাদের প্রমাণ করতে গিয়ে চার্বাকগণ একটি সাদৃশ্যানুমান করেন। তাঁরা বলেন, মদ তৈরির নানা উপকরণের মধ্যে নেশা না থাকলেও এগুলো মিলে যখন মদ উৎপন্ন করে তখন নেশাও উৎপন্ন হয়। সুতরাং বলা যায়, ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ বিশেষ পরিমাণে একত্রে সমন্বিত হয়ে মানবদেহ গঠন করলে এর মধ্যে চেতনার উৎপত্তি হয়। মদশক্তির দৃষ্টান্তের ব্যবহারও আয়ুর্বেদশাস্ত্রের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
বস্তুগত উপাদান থেকে চৈতন্যের উৎপত্তির ক্ষেত্রে চার্বাকগণ স্বভাববাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। অন্যান্য ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় স্বভাববাদ মেনে নেন নি। এমনকি অনেকে এর বিরোধিতাও করেছেন। স্বভাববাদ বিরোধিতার কারণ হিসেবে ভাববাদ ও অধ্যাত্মবাদ অচল প্রমাণিত হওয়ার ভয়ই বেশি পরিমাণে কাজ করেছে বলে মনে হয়। কিন্তু চার্বাকগণ আপোষহীনভাবে স্বভাববাদ সমর্থন করেছেন। তাঁদের সমর্থিত স্বভাববাদে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রাকৃতিক নিয়মের প্রাথমিক রূপের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তৎকালীন সকল দার্শনিক সম্প্রদায় স্বভাববাদকে উপেক্ষা করলেও ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। বিজ্ঞানীমহলে, বিশেষত চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মূল প্রতিপাদ্য প্রসঙ্গে স্বভাববাদ স্বীকৃত হয়েছে। এদিক থেকেও ভারতে বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে চার্বাক মতের অচ্ছেদ্য ঘনিষ্ঠতা অনুমানের অবকাশ থাকে
ভারতীয় জড়বাদী দর্শন তথা চার্বাক দর্শনের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো, (১) শাস্ত্রশাসনের শৃঙ্খলমুক্তি, (২) ভূতচৈতন্যবাদ, (৩) প্রত্যক্ষবাদ, (৪) স্বভাববাদ ও (৫) জ্ঞানের বৈধতা সম্পর্কে প্রয়োগবাদ। আয়ুর্বেদশাস্ত্রের সঙ্গে এই বৈশিষ্ট্যগুলোর হুবহু সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন, আয়ুর্বেদের আদি গ্রন্থ চরক সংহিতা ও সুশ্রুত সংহিতা। চরক সংহিতা গ্রন্থে দুই রকম চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। তা হলো দৈব-ব্যাপাশ্রয় ভেষজ ও যুক্তি- ব্যাপাশ্রয় ভেষজ। এ দুই প্রকার ভেষজের প্রথমটি হলো, মন্ত্র, তাগা, তাবিজ, শান্তি- স্বস্ত্যয়ণ। অর্থাৎ অথর্ববেদনির্ভর ভেষজশাস্ত্র। চরক সংহিতা এই ভেষজশাস্ত্র বর্জন করে যুক্তি-ব্যাপাশ্রয় ভেষজের দিকে অগ্রসর হওয়ার আয়োজন করেছে। এতে ঔষধ হিসেবে একশত পঁয়ষট্টি রকম জীবজন্তুর রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি, দুগ্ধ, মূত্র ইত্যাদি ছাড়াও নয়শত নব্বই রকম গাছের ফল-মূল-ছাল ইত্যাদি ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া, ক্ষয়রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে গোমংসজাতীয় শাস্ত্র-নিষিদ্ধ খাদ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। এর ফলে শ্রুতি, স্মৃতি অর্থাৎ শাস্ত্রশাসন অবজ্ঞাত হয়েছে। এর সাথে চার্বাকদের উক্ত প্রথম বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।
দ্বিতীয়ত, চরক সংহিতা-তে ইন্দ্ৰিয়যুক্ত দ্ৰব্যকে চেতন ও ইন্দ্রিয়হীন দ্রব্যকে অচেতন বলা হয়েছে। আবার চেতনার উপাদান হিসেবে ভূতবস্তুর কথাও বলা হয়েছে। এর সাথে চার্বাক ভূত-চৈতন্যবাদের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।
তৃতীয়ত, আয়ুর্বেদে রোগীর রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে ঔষধ সেবন পর্যন্ত প্ৰত্যক্ষ নির্ভরতার বহু দৃষ্টান্ত আছে। যেমন, বলা হয়েছে, আমরা সম্যকভাবে পরিদর্শন করবো এবং এর ভিত্তিতে সম্যক উপদেশ দেবো। এছাড়া, শল্যবিদ্যা শেখার জন্য সুশ্রুত সংহিতা গ্রন্থে লাশ কেটে প্রত্যক্ষ করার কথা বলা হয়েছে। এটা দুঃসাহসিক। কারণ, লাশকাটা তৎকালীন ধর্ম সংস্কার বিরুদ্ধ।[১৮৩] এ থেকে চার্বাক প্রত্যক্ষবাদের সাথে চিকিৎসাশাস্ত্ৰ তথা প্রকৃতিবিজ্ঞানের যথেষ্ট মিল দেখা যায়।
চতুর্থত, চরক ও সুশ্রুত উভয় সংহিতায় স্বভাববাদের প্রভূত উল্লেখ আছে। যেমন, সুশ্রুত সংহিতা খাদ্য গুরুপাক ও লঘুপাক হওয়ার কারণ হিসেবে স্বভাবের কথা বলে, চরক সংহিতা তেল, জল, লবণ ইত্যাদির বিশিষ্ট গুণাগুণের জন্য স্বভাবের কথা বলে।
পঞ্চমত, চরক সংহিতা গ্রন্থে কোনো কথা সত্য কি না তা নির্ণয়ের জন্য প্রায়োগিক মাপকাঠিকে মানদণ্ড ধরে নেওয়া হয়েছে। আয়ুর্বেদে জড়বাদ সমর্থন করা হয়েছে। এ সম্পর্কে সুশ্রুত সংহিতা গ্রন্থে প্রমাণ পাওয়া যায়। এতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য জড়বাদকে অপরিহার্য হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, “ভূতেভ্যঃ হি পরং যস্মাৎ নাস্তি চিন্তা চিকিৎসিতে”।[১৮৪] অর্থাৎ ভূতবস্তুকে বাদ দিয়ে চিকিৎসার কথা চিন্তা করা যায় না। এসব বিষয় থেকে চার্বাক দর্শনের সঙ্গে আয়ুর্বেদের উন্নতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়।
ভারতে প্রকৃতি বিজ্ঞানের উন্নতির যুগ ও চার্বাক যুগের সুনির্দিষ্ট কাল নির্ণয় সম্ভব নয়। তবে আনুষঙ্গিক পরিবেশ বিচারে অনুমিত হয় যে, চার্বাগণ প্রাচীন ভারতের প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং ঋগ্বেদের জড়বাদী ধারার অনুসারী। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঋগ্বেদের প্রাচীনতম অংশে বর্ণাশ্রম সমাজের নজির নেই। এছাড়া, চিকিৎসা ও শল্যবিদ্যার প্রতি ঋগ্বেদ প্রশংসামুখর। কিন্তু যজুর্বেদের যুগে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এতে চিকিৎসাবিদ্যার প্রতি প্রবল ঘৃণাও প্রকাশিত। চিকিৎসাবিদদের অপবিত্র ইতর শ্রেণির লোক বলা হয়েছে। বর্ণাশ্রম সমাজে কারিগর শ্রেণির লোকের মর্যাদা হলো নীচু বা ইতর শ্রেণিতে। বিজ্ঞানীরা কারিগর শ্রেণির লোক। তাই এরূপ সমাজে বিজ্ঞানের অপমৃত্যু হতে বাধ্য। সুতরাং বলা যায়, যজুর্বেদের যুগেই প্রথমবারের মতো এই উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অগ্রগতি ব্যাহত হয় এবং বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিদের ইতর শ্রেণিভুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে শঙ্করের মায়াবাদ বিজ্ঞানের উন্নতির ক্ষেত্রে বিশেষ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এসব কারণে এ ধারণা করা হয় যে, ভারতে বিজ্ঞানের প্রাথমিক বিকাশ ঘটে ঋগ্বেদের যুগ থেকে যজুর্বেদের যুগ পর্যন্ত, এবং বিজ্ঞানমনস্কতার জন্যই অষ্টম-নবম শতক, অর্থাৎ উপনিষদের যুগ থেকে লোকায়ত দর্শনকে ইতর জনগণের দর্শন বলে অভিহিত করা হয়।
ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, চার্বাক ছাড়া অন্য সব দার্শনিক গোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ও অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু চার্বাকগণ এর ব্যতিক্রম। তাঁরা শুধু প্রত্যক্ষকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং মতান্তরে প্রত্যক্ষ-প্রসূত অনুমানকে স্বীকার করেছেন। এর কারণ হলো, চার্বাক ব্যতীত আর প্রায় সকল দার্শনিক সম্প্রদায়ই প্রকারান্তরে এক বা একাধিক প্রত্যক্ষত্তোর ধারণার অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন। ফলে প্রত্যক্ষত্তোর ধারণার জ্ঞান পাবার জন্য অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করে নিতেও তাঁরা বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু চার্বাকগণ জড়বাদী। তাই বস্তু ব্যতীত কোনো ধারণার অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। ফলে তাঁদেরকে প্রত্যক্ষ ব্যতীত অন্য কোনো প্রমাণ স্বীকার করতে হয়নি। বস্তুকে জানার জন্য একমাত্র প্রত্যক্ষ প্রমাণই যথেষ্ট। একই কারণে তাঁরা প্রত্যক্ষ-বহির্ভূত বস্তুর অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন।
উল্লেখ্য যে, বিজ্ঞানের মূল বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে চার্বাকদের প্রত্যক্ষতত্ত্বের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। বিজ্ঞানে পর্যবেক্ষণ তথা প্রত্যক্ষকেই জ্ঞানার্জনের প্রাথমিক উপায় হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং পরবর্তীকালে প্রত্যক্ষলব্ধ তথ্যকে পরীক্ষণ দ্বারা যাচাই করা হয়। এছাড়া, বিজ্ঞান প্রত্যক্ষত্তোর তত্ত্বকে অর্থাৎ আত্মা, কর্মবাদ, জন্মান্তর ইত্যাদিকে স্বীকার করে না। ফলে বিজ্ঞানমনস্ক সমাজে এসবের ভিত্তিতে উঁচু নীচু শ্রেণিভেদও দেখা যায় না। ভারতীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে জড়বাদের সমর্থক চার্বাকগণ বিরাজিত সামাজিক ও ধর্মীয় ধারণাগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে চরম অভিজ্ঞতাবাদী অবস্থান নেন। এই অবস্থান তাঁদের আপোষহীন বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় বহন করে।
উপরের আলোচনা থেকে অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে, ভারতীয় আদি সাহিত্য অর্থাৎ ঋগ্বেদের প্রকৃতিবাদী, দেহাত্মবাদী, প্রত্যক্ষবাদী ও জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি, এবং আয়ুর্বেদ বা প্রকৃতি বিজ্ঞান প্রদত্ত প্রাচীন ভারতের প্রাথমিক স্তরের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে চার্বাকদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। প্রাচীন ভারতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিকাশ চার্বাকদের উৎসাহিত ও প্রভাবিত করেছে। অন্যদিকে, একমাত্র চার্বাক দর্শনই চরম জড়বাদী তত্ত্ব প্রচার করে প্রাচীন ভারতের প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের উন্নতির প্রাথমিক দার্শনিক ভিত্তি মজবুত করতে ভূমিকা রেখেছে। এই প্রেক্ষাপটে চার্বাক দর্শনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলেন :
অবশ্য চার্বাকসংক্রান্ত যেটুকু কথা আমাদের জানা আছে তার উপর নির্ভর করে মন্তব্যের সুযোগ আছে যে, ভারতীয় ইতিহাসে এই নামের সঙ্গে সংযুক্ত জড়বাদের প্রকৃত গুরুত্ব—এমনকি বৈপ্লবিক ভূমিকা—স্বীকার্য। বিশেষত ভাববাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে শুধু দার্শনিক বিচারের মানদণ্ডে নয়, …ভারতীয় ইতিহাসে প্রকৃতিবিজ্ঞানের যতটা বিকাশ হয়েছিল, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তারও উপযুক্ত ভিত্তি প্রস্তুতের জন্য জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন ছিল। ভারতীয় দর্শনে চার্বাক মত ছাড়া আর কোনো নির্ভেজাল জড়বাদের পরিচয় পাওয়া যায় না। তাই অনুমানের সুযোগ থাকে যে, ভারতে প্রকৃতিবিজ্ঞানের পক্ষ থেকে চার্বাক নাম উল্লেখ করে কোনো ঋণের প্রমাণ না থাকলেও চার্বাক বা চার্বাক ঘেষা কোনো মতাদর্শের উপর প্রকৃতিবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপিত ছিল।[১৮৫]
উপরের আলোচনা থেকে ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যায় চার্বাকদের অবস্থান সম্পর্কে বলা যায়, ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে চার্বাক ছাড়া অন্য আটটি দার্শনিক সম্প্রদায় প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ ইত্যাদিকে জ্ঞানের উপায় হিসেবে ধরে নিয়ে বেদের অধ্যাত্মবাদী ভাবধারা তথা উপনিষদীয় ধারার প্রতিনিধিত্ব করে। এছাড়া, তারা শ্রেণিবৈষম্যমূলক প্রাচীন ভারতীয় সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে প্রধানত সমাজের উচ্চশ্রেণির প্রতিনিধিস্বরূপ বিজ্ঞানবিরোধী এবং অধ্যাত্মবাদী দর্শন-চর্চা করে। একমাত্র চার্বাক দার্শনিকগণই অধ্যাত্মবাদী ধারার বিরোধিতা করে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী প্রত্যক্ষবাদী, জড়বাদী, স্বভাববাদী, দেহাত্মবাদী ইহজাগতিকতাবাদী ও সুখবাদী লোকায়ত দার্শনিক ধারাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আপোষহীন মতবাদ প্রচার করেন। ঋগ্বেদের প্রকৃতিবাদী ও জড়বাদী উপাদানের দ্বারা তাঁদের দর্শনের ভিত্তি নির্মিত হয়েছে। এছাড়া, ভারতীয় লোকায়ত চিকিৎসাশাস্ত্র বা আয়ুর্বেদ তথা ভারতীয় প্রকৃতিবিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাঁদের মতবাদকে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করেছে। অর্থাৎ এই সম্প্রদায় ভারতীয় দর্শনের নয়টি সম্প্রদায়ের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম। এরা উপনিষদের পরিবর্তে বেদের প্রাচীনতম সংহিতা ও ব্রাহ্মণ অংশের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব করে আপোষহীন প্রত্যক্ষবাদ ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে। এই আপোষহীনতার কারণে অন্য আটটি দার্শনিক গোষ্ঠীর বিরোধিতার প্রতিকূলে চার্বাক দর্শন পরবর্তীকালে টিকে থাকতে এবং যথেষ্ট পরিমাণে পরিচিত লাভ করতে সক্ষম হয়নি। তাঁদের গ্রন্থাবলি সম্ভবত সুপরিকল্পিতভাবে নষ্ট করা হয়েছে। তাঁদের প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্বে যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত ছিল, সম্ভবত যথার্থ চর্চার অভাব ও বিকৃত প্রচারণার প্রভাবে, এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের কাছে বিরূপ, বিকৃত ও নিন্দাসূচক অর্থে পরিচিত হয়েছে।
একথা সত্য যে, আজও ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের জীবন তথা লোকায়ত জীবনে চার্বাকদের প্রভাব স্পষ্ট। দেশের পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলিতে তথাকথিত ‘ছোটজাতের’ মানুষদের মনে যে চেতনা আজও বেঁচে রয়েছে তা আসলে লোকায়তিক চেতনারই নামান্তর। একথা বলাও অসঙ্গত হবে না যে, ভারতীয় অন্যসব দর্শনে স্বীকৃত অনুমান প্রমাণের ভিত্তি ব্যাপ্তিজ্ঞানের বিরুদ্ধে চার্বাক জ্ঞানবিদ্যায় যে যুক্তি প্রদান করা হয়েছে আধুনিক পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ আরোহানুমানের সার্বিক সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে প্রায় একই যুক্তির ব্যবহার করেছেন। সর্বোপরি, অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত অবস্থানকে সঙ্গতিপূর্ণ করতে গিয়ে চার্বাকগণ জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষবাদ, তত্ত্ববিদ্যার ক্ষেত্রে জড়বাদ, আত্মা সম্পর্কে দেহাত্মবাদ, নৈতিকতার ক্ষেত্রে সুখবাদ এবং মোক্ষের ক্ষেত্রে ইহজাগতিকতাবাদী তত্ত্বের প্রচার করে সঙ্গতিপূর্ণ দার্শনিক চিন্তার পরিচয় দিয়েছেন। তুলনার চোখে দেখলে আধুনিক ব্রিটিশ দার্শনিক লক ও বার্কলের দর্শনেও এরূপ সঙ্গতির পরিচয় পাওয়া যায় না। আধুনিক পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতাবাদে লক ও বার্কলেকৃত অসঙ্গতিকে অপসারণ করার জন্য হিউমকে ভূমিকা রাখতে হয়। হিউম তাঁর চরম অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদ দ্বারা তাঁর পূর্বসূরি লক ও বার্কলেকৃত অভিজ্ঞতাবাদের অসঙ্গতিকে যেভাবে দূর করেন তাতে প্রাচীন ভারতীয় চার্বাক দার্শনিকদেরই চিন্তার অনুরণন শোনা যায়।
তাই, একথা বলা যায়, জ্ঞানবিদ্যাগত অবস্থান থেকে চার্বাকগণ তৎকালে যে মতবাদ প্রদান করেছেন তা আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদী ও জড়বাদী ধারণার মতো বিজ্ঞানসম্মত না হলেও সময়ের বিচারে তাঁরা যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, তাঁদের দর্শনের অন্যান্য ধারণার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তাঁরা প্রত্যক্ষবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত অবস্থানের সাথে যে সঙ্গতি বজায় রেখেছেন তাও প্রসংশাযোগ্য। এসব বিষয় বিচার করে ভারতীয় দর্শনে চার্বাকদের জ্ঞানবিদ্যাগত অবস্থান সাম্প্রতিককালের বিচারেও প্রশংসনীয় ও গুরুত্ববাহী বলে প্রতীয়মান হয়।
নির্যাস
ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যায় চার্বাকদের অবস্থান সম্পর্কিত উপরের আলোচনার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ :
(১) ভারতীয় দার্শনের প্রাচীন যুগ থেকে বেদের অধ্যাত্মবাদী ভাবধারার প্রভাবে প্রভাবিত সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা, বেদান্ত, বৌদ্ধ ও জৈন-এই আটটি দার্শনিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বেদের প্রাচীনতম অংশ সংহিতা ও ব্রাহ্মণ ভাগের প্রভাবে প্রভাবিত বেদের জড়বাদী ভাবধারার অনুসারী লোকায়ত আখ্যাপ্রাপ্ত চার্বাক দর্শন একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যময় ব্যতিক্রমী ধারার জন্ম দেয়। এই ধারার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্ব বা চরম অভিজ্ঞতাবাদ, বিশুদ্ধ জড়বাদ ও দেহাত্মবাদ। ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে প্রত্যক্ষবাদ ও জড়বাদের অনুসারী বিজ্ঞানমনস্ক দার্শনিক ধারার যে ঐতিহ্য পাওয়া যায় সে ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে এই ধারাটি একক কৃতিত্বের দাবিদার।
(২) এই ব্যতিক্রমধর্মী লোকায়ত বা চার্বাক দার্শনিক মতবাদের যেমন একটি আর্থ- সামাজিক দিক ছিল তেমনি এর ছিল একটি বিশুদ্ধ দার্শনিক দিক। তৎকালীন শ্রেণিশোষণে আক্রান্ত ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় শোষিত বঞ্চিত সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী এই দর্শন লোকায়ত দর্শন হিসেবে শোষক বা উচ্চশ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে একটি সামাজিক বিদ্রোহ। অন্যদিকে, বিশুদ্ধ দার্শনিক দিক থেকে এই দর্শন ছিল জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ প্রমাণতত্ত্ব বা চরম অভিজ্ঞতাবাদী, তত্ত্ববিদ্যার ক্ষেত্রে জড়বাদী, আত্মা সম্পর্কিত মতের ব্যাখ্যায় দেহাত্মবাদী, বস্তু ও চেতনার উৎপত্তি সম্পর্কিত ব্যাখ্যায় স্বভাববাদী বা প্রকৃতিবাদী, কার্যকারণের ব্যাখ্যায় আকস্মিকতাবাদী, মোক্ষতত্ত্বের ব্যাখ্যায় ইহজাগতিকতাবাদী এবং নৈতিক আদর্শের ব্যাখ্যায় সুখবাদী। আরো স্পষ্ট করে বলা যায়, চার্বাকগণ এসব বিশুদ্ধ তত্ত্বের শুধু অনুসারীই ছিলেন না বরং কালের দিক থেকে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় দর্শনের ইতিহাসের আলোকে বিচার করলে তাঁদেরকে এসব দার্শনিক তত্ত্বের প্রবক্তা হিসেবেও অভিহিত করা যায়।
(৩) একথা সত্য যে, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে এই দার্শনিক ধারাটি পরবর্তীকালে অধ্যাত্মবাদ প্রভাবিত অন্য আটটি দার্শনিক সম্প্রদায়ের বিরোধিতা ও প্রতিকূলতার কারণে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি। এছাড়া, এই উপমহাদেশের উচ্চশ্রেণির মানুষ ভাববাদ প্রভাবিত হওয়ায় এবং শাষক গোষ্ঠী প্রধানত ভাববাদের সমর্থক হওয়ায় তাঁদের কাছে চাৰ্বাক দর্শন নিন্দনীয়, হাস্যকর এবং অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের পিছিয়ে পড়া তথাকথিত নিম্নশ্রেণির মানুষের জীবনে এবং জড়বাদ প্রভাবিত ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের চিন্তায় লোকায়ত দর্শনের প্রভাব আজও প্রতীয়মান। পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত অনেক মতবাদের সাথেই চার্বাক মতের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন, গ্রিক পরমাণুবাদ থেকে শুরু করে আধুনিক মার্ক্সীয় জড়বাদ পর্যন্ত বিভিন্ন দার্শনিকের তত্ত্ববিদ্যাগত ও আত্মা সম্পর্কিত মতবাদের সাথে যথাক্রমে চার্বাক জড়বাদ ও দেহাত্মবাদের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। আধুনিক ব্রিটিশ দার্শনিক হিউমের অভিজ্ঞতাবাদে চার্বাক প্রত্যক্ষবাদ এবং হিউমের কার্যকারণ সম্পর্কিত ব্যাখ্যায় চার্বাক আকস্মিকতাবাদের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। আধুনিক উপযোগবাদী নৈতিক আদর্শ সম্পর্কিত মতবাদে, বিশেষত বেনথামের স্থূল সুখবাদে চার্বাকদের নৈতিক আদর্শের, এবং যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদী ও প্রয়োগবাদী দার্শনিক মতবাদে যথাক্রমে চার্বাক প্রত্যক্ষতত্ত্ব ও জ্ঞানের বৈধতা সম্পর্কিত মতবাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে এই ব্যতিক্রমধর্মী একক ধারাটির আর্থ-সামাজিক ও বিশুদ্ধ দার্শনিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
তথ্যপঞ্জি
১. চার্বাক দর্শন সম্পর্কে আলোচনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো চার্বাকদের দ্বারা রচিত গ্রন্থের অভাব। বিভিন্ন তথ্য থেকে প্রমাণিত হয়, চার্বাকগণ তাঁদের মতবাদগুলো লিখে গেছেন। তবে এসব রচনা আমাদের হাতে পৌছায়নি। প্রচীন চীনে ২৫৬] থেকে ২১০ খ্রিষ্টপূর্ব অব্দ পর্যন্ত চ ইন রাজবংশ রাজত্ব করেছিল। এর চতুর্থ রাজা ওয়াঙ চেঙ স্বঘোষিত শে–হুয়োঙতি অর্থাৎ প্রথম সম্রাট নাম গ্রহণ করে অতীতকে মুছে ফেলে ইতিহাসে নিজেকে সুপ্রতিষ্টিত করার প্রয়াস নেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি ২১৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থাবলি এবং কনফুসিয়াসের সমস্ত গ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। অবশ্য লুকিয়ে রাখা গ্রন্থগুলো তাঁর উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে। (দ্রষ্টব্য : সিরাজুল ইসলাম: “লোকায়ত দৰ্শন,” Copula, A Journal of the Department of Philosophy, Jahangirnagar University, Savar, Dhaka. Vol. 2. No. 1, June, 1985, পৃ. ৩৫।) ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় চার্বাকদের ক্ষেত্রে উপরের কথাটি প্রযোজ্য বলে মনে করা হয়। চার্বাক চরম জড়বাদী দর্শন বিধায় পরবর্তী সময়ে জড়বাদ বিরোধী দার্শনিক গোষ্ঠীগুলো দ্বারা চার্বাক মতকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে তাঁদের সবগুলো গ্রন্থকে ধ্বংস করা হয়। জওহরলাল নেহেরু দুঃখ করে বলেন, সম্ভবত ভারতীয় জড়বাদের অধিকাংশ রচনাই ধর্মযাজক ও অন্যান্য গোড়া ধর্মবিশ্বাসীদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। (দ্রষ্টব্য : Jawaharlal Nehru : The Discovery of India, New Delhi, Jawharlal Memorial Fund, 1981, পৃ. ৯৭।) এ কারণে বর্তমানকালে প্রধানত অর্থশাস্ত্র প্রভৃতি প্রাচীন কিছু গ্রন্থ, প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত কিছু লোকগাঁথা এবং পূর্বপক্ষ হিসেবে চার্বাক ও লোকায়ত মতের বর্ণনা এই তিন প্রকার উপাদান অবলম্বন করেই চার্বাক মত নিয়ে আলোচনার ভিত্তি গড়ে ওঠে। চার্বাক দর্শনের বিশিষ্ট গবেষক (‘৯৩ সালে প্রয়াত) অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় রচিত গ্রন্থসমূহ চার্বাক দর্শন মূল্যায়নের জন্য বর্তমানে সর্বোৎকৃষ্ট উৎস।
২. S. Radhakrishnan (ed.) : History of Philosophy : Eastern and Western, Vol. 1. London, George Allen and Unwin Ltd., 1952. পৃ. ১৩৪।
৩. M. Hiriyanna: Indian philosophy, London, George Allen and Unwin Ltd., 1958. পৃ. ১৮৯।
৪. মনিভদ্র : ষড় দর্শন সমুচ্চয়-এর টীকা-৮১। উদ্বৃত, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : লোকায়ত দৰ্শন, অখণ্ড, কলিকাতা, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, প্রথম প্রকাশ, ভাদ্র ১৩৬৩, পৃ. ৫১।
৫. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫১-৫২।
৬. J. N. Sinha: History of Indian Philosophy, Vol. 1. Calcutta, Sinha Publishing House, 1956, পৃ. ২৩৫] এবং Cowell, E. B. and Gough, A. E. (Tr.) : Sarva Darsana Samgraha, London, Kegan Paul, Trench, Trabner and Co. Ltd., 1908, পৃ. ৬।
৭. S. Radhakrishnan and C. A. Moore (ed.): A Sourcebook in Indian Philosophy, New Jersey, Princeton, 1967, পৃ. ২৩১।
৮. পূর্বোক্ত।
৯. মাধবাচার্য : সর্বদর্শন সংগ্রহ, ১ম খণ্ড, মহামহোপাধ্যায় বাসুদের শাস্ত্রী (সম্পাদিত), পুনা, ভাণ্ডার অরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট, ১৯২৪, পৃ. ৯।
১০. কেশবমিশ্র : তর্কভাষা, দেবদত্ত রামকৃষ্ণ এবং পণ্ডিত কেদারনাথ সাহিত্য ভূষণ সম্পাদিত, ১ম সংস্করণ, বোম্বে, সংস্কৃত ও প্রাকৃত সিরিজসংখ্যা ৮৪, ১৯৩৭] ইং, পৃ. ৩২।
১১. উদ্দয়ঠাকুর : ন্যায়বার্ত্তিক, কলিকাতা, বিবলিওথিকা ইণ্ডিকা, ১৮৮৭, ১.১.৪। প্রত্যক্ষ সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন, বাৎসায়ন : ন্যায়ভাষ্য, ১ম খণ্ড, পণ্ডিত শ্রীযুক্ত ফণিভূষণ তর্কবাগীশ, অনূদিত কলিকাতা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ মন্দির, ১৩২৪] বঙ্গাব্দ, পৃ. ১১৪-১৩৩।
১২. C. D. Bijalwan : Indian Theory of Knowledge, New Delhi, Heritage Publishers, 1977, পৃ. ৬৭।
১৩. পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৮।
১৪. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন, সিরাজুল ইসলাম : Copula, June, 1985. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৪।[১৫. রাসেল বলেছেন, Spontaneously and without conscious thougth we interpret what we see and hear and fill it out with customary adjuncts. Human Knowledge: It’s Scope and Limit. New York, Simson & Schuoster, 1948, পৃ. ১৬৭।
১৫. C. D. Bijalwan: Indian Theory of Knowledge, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৪।
১৭. পূর্বোক্ত।
১৮. দ্রষ্টব্য; পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৬] এবং D. M. Datta : The Six Ways of Knowing, Calcutta. University of Calcutta. 1972. পৃ. ৩৯-৪০।
১৯. ভারতীয় দর্শনে ইন্দ্রিয় দুই প্রকার। কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়। কর্মেন্দ্রিয় পাঁচ প্রকার : হাত, পা, পায়ু, উপাস্থ (যৌন ইন্দ্রিয়), এবং বাক। যেসব ভারতীয় দার্শনিক কর্মেন্দ্রিয়কে স্বীকার করেন তাঁদের যুক্তি হলো, এসব ইন্দ্রিয়েরও জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মতো স্বতন্ত্র কাজ আছে। কিন্তু কোনো কোনো ভারতীয় চিন্তাবিদ কর্মেন্দ্রিয়কে আলাদা ইন্দ্রিয় বলতে রাজি নন। তাঁদের যুক্তি হলো, এসব ইন্দ্রিয়ের স্বতন্ত্র কাজ নেই। কারণ, আংশিকভাবে হলেও এসব ইন্দ্রিয়ের একটির কাজ অন্যটি দ্বারা সাধিত হয়। যেমন, পা না থাকলে গড়িয়ে চলা যায়। পাখিরা মুখ দিয়ে খাবার সংগ্রহ করে। এছাড়া, এসব অঙ্গকে ইন্দ্রিয়ের মধ্যে গণ্য করলে ঠোঁট, বুক, কাঁধ এগুলোকেও কর্মেন্দ্রিয়ের মধ্যে গণ্য করতে হয়। কারণ, এদেরও প্রতিটির স্বতন্ত্র নির্ধারিত কাজ আছে, যদিও একটির কাজ অন্যটির দ্বারা কিছুটা হলেও সাধিত হয়। জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলোর ক্ষেত্রে কোনো বিকল্প ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তাই এসব দার্শনিকের মতে, যথার্থ অর্থে জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলোই ইন্দ্রিয় পদবাচ্য।
২০. সাত্ত্বিক একাদশক : প্রবর্ততে বৈকৃতাসঅঙ্কারাৎ।
ভূতাদেস্তন্মাত্রঃ সঃ তামসস্তৈজসাদুর্ভয়ম্।
ঈশ্বরকৃষ্ণ : সাংখ্য কারিকা (২৫), (অনু.) স্বামী দিবাকরানন্দ, কলিকাতা, মডার্ন আর্ট প্রেস, ১৯৮২, পৃ. ৭৬।
২১. ঘ্রাণরসনচক্ষুত্বক শ্রোত্রাণীন্দ্রিয়ানি ভূতেব্যঃ। গৌতম: ন্যায়সূত্র, কলিকাতা, জীবানন্দ, ১৯১৯, ১,১,১২।
২২. বৌদ্ধ দর্শন অনুসারে মানুষের সত্তা পাঁচ প্রকারের উপাদান নিয়ে গঠিত : রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান। পরিবর্তনশীল ও মূর্ত বৈশিষ্ট্যের জন্য দেহকে রূপস্কন্ধ এবং মনন লক্ষণের জন্য অন্য চারটিকে মন বা নামস্কন্ধ বলা হয়। এই উভয়ই অনিত্য।
২৩. পুদ্গল শব্দটি দ্বারা জৈনদর্শনে জড়বস্তুর মূল উপাদান জড় পরমাণুকে বোঝায়। জৈনদের মতে, জড় পরমাণু নিত্য ও অনন্ত। তবে এর আকার পরিবর্তিত হয়। বৌদ্ধ দর্শনে একথা বলা হয়েছে যে, পুদ্গলতত্ত্বে বিশ্বাস করার অর্থ হলো আত্মার পুনর্জন্মে বিশ্বাস করা।
২৪. তুলনীয় : প্রথম অধ্যায়, ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যা।
২৫. তুলনীয় : প্রথম অধ্যায়, ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার পাদটীকা নং-২১।
২৬. J. N. Sinha: History, Vol.1. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৬।
২৭. M. Hiriyanna: Indian Philosophy, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮৯।
২৮. C. D. Sharma: A Critical Survey of Indian Philosophy, Delhi, Motilal Banarsidass, 1987, পৃ. ৮২, ১৪২]
২৯. পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৩, এবং মাধবাচার্য : সর্বদর্শন সংগ্রহ, ১ম খণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬।
৩০. অথ তৎপূর্ব্বকং ত্রিবিধমন্নমানং পূর্ব্ববচ্ছেষবৎ সামান্যতোদৃষ্টঞ্চ।
গৌতম : ন্যায়সূত্র, পূর্বোক্ত, ১, ১, ৫।
৩১. S. Radhakrishnan (ed.) : History, Vol. 1 পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৪।
৩২. জয়ন্তভট্ট : ন্যায়মঞ্জরী, মহামহোপাধ্যায় গঙ্গাধর শাস্ত্রী তৈলঙ্গ (সম্পাদিত), ৩য় খণ্ড, ২য় অংশ, বেনারস, ই, জে, লাজারুস এণ্ড কোং, ১৮৯৫, পৃ. ১৯৯।
৩৩. J. N. Sinha, History, Vol. 1. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৬।
৩৪. জয়ন্তভট্ট : ন্যায়মঞ্জরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৯।
৩৫. S. Radhakrishnan & Moore (ed.): Sourcebook., পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩১।
৩৬. J. N. Sinha: History., Vol. 1. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৬–২৩৭।
৩৭. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়: ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৪।
৩৮. J. N. Sinha: History, Vol. 1 পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩, এবং বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন : মাধবাচার্য : সর্বদর্শন সংগ্রহ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬-৯।
৩৯. ভূয়োদর্শনগম্যা২পি ন ব্যাপ্তিরবকল্পতে।
সহস্রশো২পি তদ্দৃষ্টে ব্যভিচারাবধারণাৎ।। জয়ন্তভট্ট: ন্যায়মঞ্জরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯।
৪০. ভূয়োদৃষ্টা চ ধূমোবূহাগ্নিসহচারীতি গম্যতাম্।
অনগ্নৌ তু স নাস্তীতি ন তি ভূয়োদর্শনাদ্গতিঃ।। পূর্বোক্ত।
৪১. মাধবাচার্য : সর্বদর্শন সংগ্রহ, ১ম খণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২।
৪২. সি. ডি. শর্মা প্রমুখ
৪৩. C. D. Sharma, Indian Philosophy., পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৩।
৪৪. পূর্বোক্ত।
৪৫. পুরন্দর : আহ-লোকপ্রসিদ্ধমনুমানং চার্বাকৈরপীষ্যত এব।
যৎ তু কৈচিল্লৌকিকং মাৰ্গমতিক্রম্য অনুমানমুচাতে তন্নিষিধ্যতে।।
কমলশীল : তত্ত্বসংগ্রহ পঞ্চিকা, বরোদা, গায়কোয়াড অরিয়েন্টাল সিরিজ, ১৮৮৩, পৃ. ৪৩১।
৪৬. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৩–৬৪।
৪৭. পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৪।
৪৮. পূর্বোক্ত, পৃ. ৬১।
৪৯. পুর্বোক্ত, পৃ. ৮৮।
৫০. J. N. Sinha : Introduction to Indian Philosophy, Calcutta, Sinha Publishing House. 1970. পৃ. ১৮। তুলনীয়, Cowell and Gough (Tr.) : Sarva Darsana Samgraha. পূর্বোক্ত, পৃ. ৯।
৫১. M. Hiriyanna : The Essentials of Indian Philosophy, London, George Allen & Unwina Ltd., 1969. পৃ. ৫৭-৫৮।
৫২. সিরাজুল ইসলাম, Copula, June 1985. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫২।
৫৩. B. Russell : An Qutline of Philosophy, London, Unwin Paperbacks, 1983. পৃ. ১১।
অনূদিত, আবদুল মতীন : দর্শনের রূপরেখা, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৮১, পৃ. ১৭–১৮।
৫৪. B. Russell : The Problems of Philosophy, Oxford, Oxford University Press Paperbacks, 1973. পৃ. ৩৮।
৫৫. William Whewell Philosophy of the Inductive Science Founded upon Their History, London, J. W. Parker & Son. 1940. পৃ. ৫৯-৬১। উদ্ধৃত, R. M. Chisholm : Theory of Knowledge, 2nd ed. New Jersey, Prentice Hall. 1977. অনূদিত, মোঃ আবদুর রশীদ : জ্ঞানবিদ্যা, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, জুন ১৯৮৯, পৃ. ৫০।
৫৬. দ্রষ্টব্য, পূর্বোক্ত, অনুবাদ, পৃ. ৪৯-৫১।
৫৭. সিরাজুল ইসলাম, Copula, June, 1985. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৬।
৫৮. C. D. Sharma: Indian Philosophy, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৩।
৫৯. শ্রী সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দর্শন, কলিকাতা, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৩, পৃ. ২৬। 60. B. Russell : An Outline of Philosophy, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮।
৬১. তদ্প্রামাণ্যমনৃত-ব্যাঘাত—পুনরুক্ত-দোষেভ্যঃ।
গৌতম : ন্যায়সূত্র, কলিকাতা, জীবানন্দ, ১৯১৬, ২.১.৫৭। তুলনীয়, Cowell and Gough (Tr.): Sarva Darsana Samgraha, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০।
৬২. এবং বাসংবাদবিসংবাদাভ্যামপ্ৰমাণং বেদঃ।
জয়ন্তভট্ট : ন্যায়মঞ্জরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭৩।
৬৩. বুদ্ধিপৌরুষহীনানাং জীবিকা ধাতুনির্মিতা।
মাধবাচার্য : সর্বদর্শন সংগ্রহ, ১ম খণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩।
৬৪. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫।
65. Azizun Nahar Islam: The Nature of Self : Seffering and Salvation : Allahabad, Vohra Publishers and Distributors, 1987. পৃ. ১।
৬৬. পূর্বোক্ত, পৃ. ২।
৬৭. বৃহদারণ্যকোপনিষদ, ১, ৪, ১। অতুলচন্দ্র সেন, সীতানাথ তত্ত্বভূষণ প্রমুখ কর্তৃক অনূদিত ও সম্পাদিত : উপনিষদ, অখণ্ড সংস্করণ, কলিকাতা, হরফ প্রকাশনী, অক্টোবর, ১৯৮০।
৬৮. এ সাতটি হলো আজীব, আসব, বন্ধ, সম্বর, নির্জরা, মোক্ষ ও আত্মা।
৬৯. C. D. Bijalwan : Indian Theory of Knowledge, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৮] এবং D. M. Datta : The Six Ways of Knowing, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৭।
৭০. Cowell and Gough (Tr.): Sarva Darsana Samgraha, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫।
৭১. S. Radhakrishnan (ed.): History., পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৫।
৭২. পূর্বোক্ত এবং মাধবাচার্য: সর্বদর্শন সংগ্রহ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২।
৭৩. বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, সিরাজুল ইসলাম: Copula, পূর্বোক্ত, June, 1985. পৃ. ৫২।[৭৪. মাধবাচার্য: সর্বদর্শন সংগ্রহ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭।
৭৫. বৃহদারণ্যকোপনিষদ, ২. ৪. ১২ এবং ৪, ৫, ১৩, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৩৪ ও ৮২২।
৭৬. বাল্মীকি: রামায়ণ, (অনু.) মন্মথনাথ দত্ত, কলিকাতা, ১৮৯৩, ২. ১০৮. ৩, এবং মহাভারত, শান্তিপর্ব, ৩৮, ২২-৩৬ ও ৩৯, ৩-১১।
৭৭. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়: লোকায়ত দর্শন, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলিকাতা, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, পৌষ, ১৩৭৫, পৃ. ৫২, পাদটীকা-৮১, এবং রামায়ণ, অযোধ্যা খণ্ড ১০৯, ৩৮-৩৯।
৭৮. কমলশীল: তত্ত্বসংগ্রহ পঞ্জিকা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫২৫-৫২৬।
৭৯. মাদবাচার্য : সর্বদর্শন সংগ্রহ, ১ম খণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩ এবং Maxmuller F. (ed.) : Sacred Books of the East. (Jaina Sutras). Part, 11. 1.1.12.
৮০. J. N. Sinha: History, Vol. 1. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৪৫।
৮১. J. N. Sinha: Introduction to Indian Philosophy. পূর্বোক্ত, পৃ. ২১৬।
৮২. Karl Marx : Selected Works, Vol. 1. Moscow, Progress Publishers, 1946. পৃ. ৩৯৭, ৪৩৫।
৮৩. পূর্বোক্ত, Vol. XI. পৃ. ২০৮, ২১৪।
৮৪. প্ৰাণচেষ্টাচৈতন্যনৃত্যায়শ্চ আত্মধর্মত্বেন অভিমতাঃ আত্মবাদিনাং। ভে২পি অন্তরের দেহে উপলভ্যমানা বহিশ্চানুপলভ্যমানাঃ। দেহধর্মা এ ভবিতুমরহন্তি। (ব্রহ্মসূত্রের শঙ্করভাস্য, ৩, ৩, ৫৩) স্বামী বিশ্বরূপানন্দ (অনু.): বেদান্ত দর্শন, কলিকাতা, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৮৯, পৃ. ৫১০।
৮৫. শরীরবিকারহেতুত্বাচ্চ তেষাং শরীরগুণত্বম।
শালিকানাথ : প্রকরণ পঞ্চিকা, পণ্ডিত মুকুন্দশাস্ত্রী (সম্পা.), বেনারস, চৌখম্ব সংস্কৃত সিরিজ, ১৯০৩, পৃ. ১৪৭।
৮৬. শরীরাণাম আরম্ভনিবৃত্তিদর্শনাদ্ ইচ্ছাদ্বেষজ্ঞানাইর যোগাইতি চৈতন্যম্ গৌতম : ন্যায়সূত্র, কলিকাতা, জীবনানন্দ, ১৯১৯, ৩. ২. ৩৭।
৮৭. শান্তরক্ষিত : তত্ত্বসংগ্রহ, ১ম খণ্ড, বরোদা, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, ১৯২৬, ১৯৬৪, এবং বাল্মীকি : রামায়ণ, পূর্বোক্ত, ২.১০৮.১০।
৮৮. চৈতন্য বিশিষ্ট : কায়ঃ পুরুষঃ। দেহ এব চেতনশ্চাত্মা।
স্বামী বিশ্বরূপানন্দ (অনু.) :। বেদান্ত দর্শন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫০৯।
৮৯. Gilbert Ryle : The Concept of Mind, London, Hutchinson & Co. Publishers Ltd., 1949. Self Knowledge অধ্যায়।
৯০. মুহাম্মদ জহরুল হক : গিলবার্ট রাইল ও দেকার্তের দ্বৈতবাদ, Proceedings of the Second General Conference of the Bangladesh Darsan Samiti, Dhaka. Bangladesh Philosophical Association. 1977. পৃ. ৫৭।
৯১. আহম্মদ শরীফ : বাঙ্গালীর চিন্তাচেতনার বিবর্তনধারা, ঢাকা, ইউনিভারসিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৮৭, পৃ. ৩৫।
৯২. F. Thilly : A History of Philosophy, Allahabad Central Book Depot 1978. পৃ. ১২৬-১২৭।
৯৩. লউক্রিটাস তাঁর On the Nature of Things (Book 111) গ্রন্থে একথা বলেছেন। উদ্ধৃত, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৭।
৯৪. S. Radhakrishnan (ed.) : History, Vol. 1, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৪।
৯৫. পূর্বোক্ত।
৯৬. সিরাজুল ইসলাম : Copula, June, 1985. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৭।[৯৭. পূর্বোক্ত।
৯৮. B. Russell : An Outline., পূর্বোক্ত, পৃ. ৯০, অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৫।
৯৯. পূর্বোক্ত, পৃ. ৯১, অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৬।
১০০. পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৪, অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮২।
১০১. পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৭, অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮৬।
১০২. সিরাজুল ইসলাম : Copula, June, 1985. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৫।
১০৩. জয়ন্তভট্ট : ন্যায়মঞ্জরী, পূর্বোক্ত, পৃ. 122।
১০৪. B. Russell : An Outline. পূর্বোক্ত, পৃ. ৯০, অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৫।
১০৫. David Hume : A Treatise of Human Nature, London, Everyman’s Library. 1968. পৃ. ৮১।
১০৬. শান্তরক্ষিত : তত্ত্বসংগ্রহ, ১ম খণ্ড, পূর্বোক্ত, ১৮৬১।
১০৭. পূর্বোক্ত, ১৮৬৮।
১০৮. মাধবাচার্য : সর্বদর্শন সংগ্রহ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩।
১০৯. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩।
১১০. রমেন্দ্রনাথ ঘোষ : ভারতীয় দর্শন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৩, পৃ. ১৩।
১১১. গণপতি শাস্ত্রী সম্পাদিত : সৰ্বমত সংগ্রহ, অনন্তসায়ন সংস্কৃত গ্রন্থসংখ্যা ২, ১৯১৮, পৃ. ১৫। উদ্ধৃত, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : লোকায়ত দৰ্শন, পূর্বোক্ত, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৌষ ১৩৭৫, পৃ. ৮৯। অবশ্য এখানে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় সর্বমত সংগ্রহের এই মতকে সমর্থন করার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি খুঁজে পাননি।
১১২. তবে বাৎসায়ন উচ্চতম ও নিম্নতম অর্থাৎ বৌদ্ধিক ও ইন্দ্রিয়জাত সুখের মধ্যে পার্থক্য করেছিলেন। তিনি সম্পদ, সুখ ও ধর্মের সমন্বয়কে পরম উদ্দেশ্য বলেছেন। চার্বাকগণ এ থেকে ধর্মকে বাদ দিয়েছেন।
১১৩. Cowell and Gwugh (Tr) : Sarva Darsana Samgraha, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০ এবং হরিভদ্রসূরী: ষড়দর্শন সমুচ্চয়, বেনারস, চৌখম্ব সংস্কৃত সিরিজ, নং ৯৫. পৃ. ৮২।
১১৪. গুণরত্নসূরী : তর্কহস্যদীপিকা, কলিকাতা, বিবলিওথিকা ইণ্ডিকা, ১৯১৪, পৃ. ৩০২।
১১৫. S. Radhakrishanan (ed.): History., Vol. 1, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৭।
১১৬. রাসবিহারী দত্ত, ভারতীয় দর্শনে ভাববাদ খণ্ডন, কলিকাতা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ১৯৮৯, পৃ. ২০২।
১১৭. সিরাজুল ইসলাম : Copula, Vol 3. No. 1. June 1986. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৩।
১১৮. মাধবাচার্য : সর্বদর্শন সংগ্রহ, ১ম খণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪।
১১৯. S. Radhakrishnan. History, Vol. 1. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৩।
১২০. সিরাজুল ইসলাম : Copula, June, 1986. পূর্বোক্ত, পৃ. ২২।
১২১. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৫।
১২২. উদ্ধৃত, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪।
১২৩. সাইয়েদ আবদুল হাই : দর্শন ও মনোবিদ্যা পরিভাষা কোষ, ২য় খণ্ড, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৬, পৃ. ৫২৩।
১২৪. সরদার ফজলুল করিম : দর্শন কোষ, ১ম সংস্করণ, ঢাকা বাংলা একাডেমী, ১৯৭৩, পৃ. ২৯০।
১২৫. ভগবদ্গীতা, ১৬ : ৮, মহাভারত, ১৪১৪, ১৪৩০-৪২, এবং ৩৬১৯, বিষ্ণুপুরাণ, ৩ : ১৮, ১৪-২৬, মনুসংহিতা, ২ : ১১৫, এবং ৩ : ১৫০, ১৬ এবং ৫ : ৮৯] এবং ৮ : ২২, ৩০৯ এবং ৯ : ৬৫, ৬৬, এবং ১২ : ৩৩, ৯৫, ৯৬।
১২৬. বিষ্ণুপুরাণ, ১] : ৬, ২৯-৩১।
১২৭. S. Radhakrishnan (ed.): History., Vol. 1. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৩।
১২৮: পূর্বোক্ত।
১২৯. আহমদ শরীফ : বাঙ্গালীর চিন্তাচেতনার., পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৪।
১৩০. S. Radhakrishnan (ed.) : History., Vol. 1. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৩।[১৩১. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৫।
১৩২. M. Hiriyanna : Indian Philosophy., পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯১।
১৩৩. S. Radhakrishnan (ed.): History, Vol, 1. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৩।
১৩৪. সাইয়েদ আবদুল হাই : দর্শন ও মনোবিদ্যা পরিভাষা কোষ, ২য় খণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫১৮।
১৩৫. I. Frolov (ed.) : Dictionary of Philosophy. Moscow, Progress Publishers. 1984. পূ. ২৮৭।[১৩৬. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : ভারতে বস্তুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩২-১৩৩। তবে এখানে মাধবাচার্য আকস্মিকতাবাদকে অস্বীকার করেছেন।
১৩৭. J. N. Sinha : History., Vol. 1, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৩-৩৪।
১৩৮. উদ্ধৃত : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : ভারতে বস্তুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৭-১৩৮।
১৩৯. পুর্বোক্ত, পৃ. ১৩৯।
১৪০. নন্বতদৃষ্টানিষ্টো জগদ্বৈচিত্র্যমাকষ্মিকং স্যাদিতি চেৎ-ন তভদ্রম্। স্বভাবাদেব তদুপপতেঃ। মাধবাচার্য: সর্বদর্শন সংগ্রহ, ১ম খণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬। উল্লেখ্য, এখানে মাধবাচার্য স্বভাববাদকে স্বীকার করতে গিয়ে আকস্মিকতাকে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রীর মতানুসরণ করে আমরা এখানে চার্বাকদের মতবাদে স্বভাববাদ ও আকস্মিকতাবাদ উভয়ের ইঙ্গিত খুঁজে পেয়েছি। দ্রষ্টব্য: চার্বাক জ্ঞানবিদ্যা ও আকস্মিকতাবাদ, পরে আলোচিত।
১৪১. মাধবাচার্য : সর্বদর্শন সংগ্রহ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৩।
১৪২. উদ্ধৃত, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : ভারতে বস্তুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৬।
১৪৩. উদ্ধৃত, পূর্বোক্ত।
১৪৪. পূর্বোক্ত।
১৪৫. সিরাজুল ইসলাম : Copula, June, 1986. পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৮।
১৪৬. উদ্ধৃত, J. N. Sinha : History., Vol. 1. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৩।
১৪৭. গৌতম : ন্যায়সূত্র, পূর্বোক্ত, ৪.১.২২। উদ্ধৃত, J. N. Sinha : History, Vol. 1 পৃ. ২৩৩। 148. J. N. Sinha : History., Vol. 1, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৩।
১৪৯. পূর্বোক্ত।
১৫০. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : ভারতে বস্তুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩১-৪৩।
১৫১. দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী : চার্বাক দর্শন, কলিকাতা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ১৯৮২, পৃ. ১১২-১১৪।
১৫২. লতিকা চট্টোপাধ্যায় : চার্বাক দর্শন, কলিকাতা, নিউ এজ পাবলিশার্স, প্রাঃ লিঃ ১৯৮২, পৃ. ১।
১৫৩. পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৪।
১৫৪. পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৭।
১৫৫. S. Radhakrishnan : Indian Philosophy. Vol. 1 পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৫৩।
১৫৬. M. Winternitz : A History of Indian Literatures. Vol. 1. 2nd ed. New Delhi. Oriental Books Reprint Corporation. 1972. পৃ. ২৬৬।
১৫৭. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতে বস্তুবাদ., পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩।
১৫৮. S. Radhakrishnan (ed.) : History of Philosophy : Eastern and Western. Vol. 1, London. George Allen and Unwin Ltd., 1967. পৃ. ১৩৩।
১৫৯. কো, আন্তোনভা, গ্রি, বোন্গার্দ- নেভিন, প্রমুখ : ভারতের ইতিহাস, মস্কো, প্রগতি প্রকাশন, ১৯৮৬, পৃ. ৬৯।
১৬০. বাল্মীকি : রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড, মাদ্রাজ, রামরত্নম প্রকাশিত সংস্করণ, ১৯৫৮, ১০০ : ৩৮।
১৬১. Jawaharlal Nehru : The Discovery of India, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৯।
১৬২. সিরাজুল ইসলাম : Copula, June 1986. পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৩ তুলনীয় : S. Radhakrishnan (ed.): History., পূর্বোক্ত., পৃ. ১৩৩।
১৬৩. দ্রষ্টব্য : সুকুমারী ভট্টাচার্য : ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য, কলিকাতা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ১৯৯১, পৃ. ২৯-৩০।
১৬৪. রাসবিহারী দত্ত : ভারতীয় দর্শনে ভাববাদ খণ্ডন, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০৫।
১৬৫. কো, আস্তোন ভা. প্রমুখ : ভারতবর্ষের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৫, ৫৬।
১৬৬. সিরাজুল ইসলাম : Copula, June, 1986, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৪-৬৫।
১৬৭. পূর্বোক্ত
১৬৮. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাদ্যায় : ভারতে বস্তুবাদ. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩১।
১৬৯. সিরাজুল ইসলাম : Copula, June, 1986. পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৫-৬৭।
১৭০. রাসবিহারী দত্ত : ভারতীয় দর্শনে ভাববাদ খণ্ডন, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯৬।
১৭১. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : লোকায়ত দর্শন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৯।
১৭২. উপনিষদে উদ্দালক-বিরোচন সংবাদে, মীমাংসা প্রভাকর ও কুমারিল মতে, আদি বৌদ্ধদর্শনে, জৈন, বৈশেষিক, ন্যায় ও সাংখ্যাদর্শনে ভাববাদ বিরোধী মতের জন্য রাসবিহারী দত্ত : ভারতীয় দর্শনে ভাববাদ খণ্ডন, পূর্বোক্ত, চতুর্থ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
১৭৩. মাধবাচার্য : সর্বদর্শন সংগ্রহ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪
১৭৪. রাসবিহারী দত্ত : ভারতীয় দর্শনে ভাববাদ খণ্ডন, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০০।
১৭৫. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : ভারতে বস্তুবাদ, পূর্বোক্ত, ৩য় পরিচ্ছদ, দ্রষ্টব্য।
১৭৬. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩০-১৩১।
১৭৭. অধ্যক্ষ কবিরাজ শ্রীনিকেতন চক্রবর্তী : আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের ইতিহাস, ঢাকা, আয়ুর্বেদ নিকেতন, ২৭/৮ উমেশদত্ত রোড, বকশীবাজার, ১৯৯০, পৃ. ১৮।
১৭৮. দুলাল ভৌমিক (অনু) : শতপথ ব্রাহ্মণ : শুক্ল যজুর্বেদীয় মাধান্দিন শাখা, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৯০, পৃ. ১৫।
১৭৯. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৪।
১৮০. Profulla Chandra Roy: History of Hindu Chemistry, 2 Vols. 1909. 3 & 1909. তুলনীয় : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : ভারতে বস্তুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৬, ১৫৯] ও ১৬২।
১৮১. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : ভারতে বস্তুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৫-১২৬।
১৮২. উদ্ধৃত, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬৯।
১৮৩. ১৮৩৬] সাল পর্যন্ত কলিকাতা মেডিকেল কলেজের হিন্দু ছাত্ররা ধর্মীয় সংস্কার বিরুদ্ধ বলে শবব্যবচ্ছেদ শেখার জন্য লাশকাটা ঘরে প্রবেশ করত না।
১৮৪. সুশ্রুত সংহিতা (৩/১/১৭), উদ্ধৃত, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : ভারতে বস্তুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬৯।
১৮৫. পূর্বোক্ত, পৃ. ১২১।