৪. হিউমের জ্ঞানবিদ্যা

চতুর্থ অধ্যায় – হিউমের জ্ঞানবিদ্যা

পূর্ববর্তী অধ্যায়ের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রাচীন যুগ থেকে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ নামক দুটি মতবাদ প্রাধান্য পায়। বলা যায়, কান্ট— পূর্ববর্তী পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যায় এই দুটি মতবাদেরই প্রতিফলন ঘটেছে। রেনেসাঁ ও বিজ্ঞান বিপ্লবের প্রভাবে আধুনিক যুগের পাশ্চাত্য দর্শন জ্ঞানবিদ্যাকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। সতেরো শতকের ব্রিটিশ দর্শনে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি নির্ভর অভিজ্ঞতাবাদে কেন্দ্রীভূত হয়। দর্শনের উপর প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির প্রভাব এর কারণ। সতেরো-আঠারো শতকের আধুনিক ব্রিটিশ দার্শনিকদের হাতেই পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার অভিজ্ঞতাবাদী ধারা সুসংহত ও সমন্বিত রূপলাভ করে।

অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত ধারাকে সুসংহত রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে ডেভিড হিউম (১৭১১-১৭৭৬)-এর অবদান সর্বাধিক। বিশেষত, লক ও বার্কলে স্বীকৃত প্রচলিত দ্রব্যের ধারণাকে খণ্ডন করে এর অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যা দিয়ে হিউমই প্রথম অভিজ্ঞতাবাদের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিকে যথার্থ অর্থে প্রয়োগ করতে, এবং পর্যবেক্ষণলব্ধ নয় এমন উপাদানকে অভিজ্ঞতাবাদ থেকে বর্জন করতে প্রয়াসী হন। হিউমের এ অবদান পরবর্তী জ্ঞানবিদ্যাগত আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। কান্ট একথা স্বীকার করেছেন যে, হিউমই তাঁকে নির্বিচার নিদ্রা, অর্থাৎ বুদ্ধিবাদের একচ্ছত্র প্রভাব থেকে জাগিয়েছেন। অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে এই অবদান হিউমকে দর্শনের ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যায় চার্বাকগণ যেমন নিরঙ্কুশভাবে প্রত্যক্ষণের প্রাধান্য ঘোষণা করেন তেমনি পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যায় হিউম ইন্দ্রিয়ছাপকে জ্ঞানের একমাত্র প্রাথমিক উপাদান হিসেবে অভিহিত করেন। হিউমের দর্শনের মূল সমস্যা হলো জ্ঞানবিদ্যাগত সমস্যা। তিনি জ্ঞানবিদ্যার বিভিন্ন বিষয়, যেমন জ্ঞানের উৎস, সীমা, নিশ্চিতি, ক্যাটাগরি ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করেন। তবে জ্ঞানের উৎস ছিল তাঁর মূল আলোচ্য বিষয়

ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণাতত্ত্ব

হিউম তাঁর A Treatise of Human Nature গ্রন্থের প্রথম পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে এবং An Enquiry Concerning Human Understanding গ্রন্থের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে জ্ঞানের উৎস সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন।[১] ইতোপূর্বে ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাস আলোচনায় আমরা দেখেছি, একমাত্র চার্বাক দার্শনিকগণই প্রত্যক্ষকে বৈধ জ্ঞানের উপায় বলে স্বীকার করে অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদ প্রদান করেন। তাই ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে চার্বাকগণই একমাত্র অভিজ্ঞতাবাদী। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে, বিশেষত আধুনিক যুগে, লক ও বার্কলের মতো হিউমও প্রত্যক্ষণকে যথার্থ জ্ঞানোৎপত্তির একমাত্র উপায় বলে অভিহিত করে অভিজ্ঞতাবাদী অবস্থান নিয়েছেন। হিউমের অন্যতম সমালোচক এন. কে. স্মিথ-এর মতে, ‘প্রত্যক্ষণ’ শব্দটিকে হিউম হাচিনসন-এর কাছ থেকে গ্রহণ করেন।[২]

হিউম প্রত্যক্ষণকে দুভাগে ভাগ করেন : ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা। Treatise গ্রন্থের শুরুতেই তিনি বলেছেন, মানব মনের প্রত্যক্ষণগুলো স্পষ্ট দুই ভাগে বিভক্ত। ইন্দ্ৰিয়ছাপ ও ধারণা।[৩] হিউমের কাছে ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা হলো জ্ঞানের একমাত্র উপাদান। এদুটি উপাদান থেকেই আমাদের জটিল অভিজ্ঞতা গঠিত হয়। মনে প্রথম আগত সংবেদন, অতিরাগ ও প্রচণ্ড আবেগকে হিউম ইন্দ্রিয়ছাপ নামে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, যেসব প্রত্যক্ষণ ভীষণ তীব্র ও প্রচণ্ড, তাদের নাম দেওয়া যায় ইন্দ্ৰিয়ছাপ। মনে প্রথম আগত সংবেদন, অতিরাগ ও আবেগকে এ পর্যায়ে ফেলা যায়।[৪]

অন্যদিকে, ধারণা বলতে তিনি ইন্দ্রিয়ছাপের ক্ষীণ প্রতিরূপকে বুঝান।[৫] অর্থাৎ প্রত্যক্ষণকারী সরাসরি প্রত্যক্ষণের সময় বাহ্যবস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগের ফলে যে বাস্তব সংবেদন পায় তা হলো ইন্দ্রিয়ছাপ। পরবর্তীকালে ইন্দ্রিয়ছাপগুলোর অনুপস্থিতিতে সে যখন এগুলোকে নিয়ে চিন্তা করে তখন স্মৃতি বা কল্পনা দ্বারা অতীতে দেখা ইন্দ্রিয়ছাপগুলোর যে প্রতিরূপ তার মনে সৃষ্টি হয় তা হলো ধারণা। অর্থাৎ ধারণা ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে স্মৃতি ও কল্পনার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়। ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে ধারণার আবির্ভাব প্রসঙ্গে হিউম বলেন :

ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে ধারণার আবির্ভাব দুরকম হতে পারে। প্রথমত, নতুনভাবে আবির্ভূত হবার সময় ইন্দ্রিয়ছাপটির মৌলিক সজীবতার অনেকখানি অবশিষ্ট থেকে সেখানে ইন্দ্রিয়ছাপ ও পূর্ণাঙ্গ ধারণার মাঝামাঝি কিছু একটা সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত, তার সজীবতা সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ ধারণা গঠিত হয়। যে মৌলিক মানসিক শক্তি দ্বারা প্রথম প্রক্রিয়ার সাহায্যে আমরা ইন্দ্রিয়ছাপগুলোকে আবার সৃষ্টি করি তার নাম স্মৃতি। অপরটির নাম কল্পনা।…স্মৃতির ধারণাগুলো কল্পনার ধারণার চেয়ে অনেক বেশি সজীব ও শক্তিশালী।[৬]

ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার পরিচিতি দিতে গিয়ে হিউম Enquiry গ্রন্থে বলেন :

ইন্দ্ৰিয়ছাপ বলতে আমি বুঝি আমাদের সব সজীবতার প্রত্যক্ষণ, যখন আমরা শুনি, দেখি, অনুভব করি, ভালবাসি, ঘৃণা করি, কামনা করি বা ইচ্ছা করি। ইন্দ্রিয়ছাপগুলো থেকে ভিন্ন ধারণাগুলো হলো কম সজীব প্রত্যক্ষণ। আমরা যখন উপর্যুক্ত সংবেদনের কোনো একটি সম্পর্কে চিন্তা করি তখন এর ধারণা সম্পর্কে সচেতন হই।[৭]

সুতরাং দেখা যায়, বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সরাসরি সম্পর্ক থেকে ইন্দ্রিয়ছাপ উৎপন্ন হয়। কিন্তু ধারণার উৎপত্তির জন্য বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক আবশ্যিক নয়। বস্তু যখন ইন্দ্রিয়ের সামনে থাকে তখন তা থেকে আমরা ইন্দ্রিয়ছাপ পাই। কিন্তু বস্তু যখন ইন্দ্রিয়ের সামনে থাকে না তখন যদি অতীতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এর সম্পর্কে চিন্তা বা কল্পনা করি তবেই ধারণা পাই। সুতরাং ধারণা হলো ইন্দ্রিয়ছাপের অনুলিপি।

হেন্ডেল মনে করেন, ‘ইন্দ্রিয়ছাপ’ শব্দটির জন্য হিউম মনটেগু এবং মালেবাসে—এই দুজনের কাছে ঋণী। কিন্তু এন. কে. স্মিথ-এর মতে, ‘ইন্দ্রিছাপ’ শব্দটি হিউমের নিজের আবিষ্কার। এই শব্দটির মধ্যে অতিরাগ, আবেগ, সংবেদন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এ সম্পর্কে হিউমের নিজস্ব বক্তব্য হলো :

আমি ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা শব্দ দুটিকে তাদের প্রচলিত অর্থে ব্যবহার করিনি। আশা করি এই শব্দ দুটির এই দুরকম বিশেষ ব্যবহারের স্বাধীনতা আমাকে দেওয়া হবে। মিস্টার লক ‘ধারণা’ শব্দটিকে সব প্রত্যক্ষণের জন্য ব্যবহার করে এর মূল অর্থ বিকৃত করেছিলেন। এই শব্দটিকে তার আদি অর্থেই হয়তো আমার ব্যবহার করা উচিত। ‘ইন্দ্ৰিয়ছাপ’ শব্দটি দিয়ে আমি, প্রত্যক্ষণগুলো মনে কী প্রক্রিয়া দ্বারা সৃষ্ট হয়—তা বুঝাচ্ছি না। এর দ্বারা আমি শুধু প্রত্যক্ষণকেই বুঝাচ্ছি। স্বয়ং প্রত্যক্ষণের জন্য ইংরেজি কিংবা আমার জানা ভাষাগুলোতে কোনো নাম নেই।[৯]

সুতরাং হিউমের নিজস্ব ব্যাখ্যা থেকে দেখা যায়, ‘ইন্দ্রিয়ছাপ’ দ্বারা তিনি ‘স্বয়ং প্রত্যক্ষণ’কেই বুঝাচ্ছেন। আর ‘ধারণা’ শব্দটিকে তিনি এর মূল অর্থে ব্যবহার করেছেন। তাঁর ব্যবহৃত ধারণা শব্দটির অর্থ তাঁর পূর্ববর্তী ব্রিটিশ দার্শনিক জন লক দ্বারা ব্যবহৃত ধারণা শব্দটির অর্থ থেকে ভিন্ন। এখানে লক ও হিউমের ব্যবহৃত শব্দ দুটির অর্থের পার্থক্য নির্ণয় করলে হিউমের ব্যবহৃত ‘ধারণা’ শব্দটির অর্থ আরো স্পষ্ট হবে।

‘ধারণা’ শব্দটিকে নিয়ে আধুনিক দর্শনের প্রারম্ভিক কাল থেকে আলোচনা হতে দেখা যায়। অবশ্য গ্রিক দার্শনিক প্লেটো দর্শনের ইতিহাসে প্রথম ‘ধারণা’ শব্দটির ব্যবহার করেন। তিনি ‘ধারণা’ বলতে বাস্তব জগতের সকল প্রকার বস্তু যে নিত্য বা শাশ্বত আদর্শের সম্পূর্ণ প্রতিরূপ সে আদর্শকে বুঝেছেন। আধুনিক যুগে রেনে দেকার্ত প্রথম ‘ধারণা’ সম্পর্কে আলোচনা করেন। তাঁর মতে, মন যা নিয়ে চিন্তা করে তা–ই ধারণা। দেকার্ত ধারণাকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন। আগন্তুক, কৃত্রিম ও সহজাত। সংবেদনের মাধ্যমে যেসব ধারণা বাইরে থেকে আমাদের মনে আসে সেগুলো আগন্তুক ধারণা। যেমন, গোলাপ ফুলের ধারণা। এসব আগন্তুক ধারণা অনিশ্চিত ও অস্পষ্ট। আমাদের মন বিভিন্ন ধারণাকে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করে যেসব ধারণা গঠন করে সেগুলো কৃত্রিম ধারণা। এগুলো আমাদের দ্বারা সৃষ্ট। যেমন, মৎসকন্যা, ডানাকাটা পরী। এসব ধারণা অলীক ও অসত্য। পক্ষান্তরে, মন নিজের সম্বন্ধে চিন্তা করতে গিয়ে অনিবার্যভাবে যেসব ধারণা সম্পর্কে চিন্তা করে সেগুলো আন্তর্ধারণা বা সহজাত ধারণা। এরা বাইরে থেকে আগত নয়, আবার নিজেদের দ্বারা সৃষ্টও নয়। এগুলো সহজাত। যেমন, অসীমতা, নিত্যতা, পূর্ণসত্তা, ইত্যাদির ধারণা। অবশ্য দেকার্ত সহজাত ধারণাকে আমাদের জন্মের সময় থেকেই মনে উপস্থিত একথা বলতে চাননি। বরং চিন্তাশীল দ্রব্যরূপে মনের অস্তিত্বের জন্য যেসব ধারণা আবশ্যিক তাদেরকেই দেকার্ত সহজাত ধারণা বলেছেন। এসব ধারণা, দেকার্তের মতে, যথার্থ জ্ঞানের ভিত্তি।

দেকার্ত-পরবর্তী দার্শনিক, আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদী ধারার প্রবক্তা, জন লকও ‘ধারণা’ শব্দটির ব্যবহার করেছেন। তাঁর দর্শনেও ‘ধারণা’ শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লক ‘ধারণা’ দ্বারা মানুষের চিন্তার বিষয়বস্তুকে বুঝিয়েছেন।[১০] চিন্তা বলতে এখানে যেমন প্রত্যক্ষ, কল্পনা ও ইচ্ছাকে বুঝানো হয়েছে ঠিক তেমনি যথার্থ অর্থে জানার মধ্যে যে চিন্তা আছে তাকেও বুঝানো হয়েছে। তাই লকের কাছে চিন্তা থাকার অর্থ হলো ধারণা থাকা। মূলত তিনি ধারণা বলতে চিন্তার উপাদানসমূহকে বুঝিয়েছেন।[১১] ফলে লকের ধারণা কথাটির মধ্যে ইন্দ্রিয় উপাত্ত যেমন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তেমনি প্রত্যয় (concept) এবং সার্বিক ধারণাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। লকের অনুসারী বার্কলে ধারণা ও বস্তুকে অভিন্ন মনে করেন।

কিন্তু হিউম লক ও বার্কলে থেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি ‘ধারণা’ বলতে ইন্দ্রিয়ছাপের অবিকল প্রতিরূপকে বুঝিয়েছেন। হিউম মনের বিষয়বস্তু বলতে লকের মতো ধারণাকে বুঝাননি। বরং প্রত্যক্ষণকে বুঝিয়েছেন। তিনি প্রত্যক্ষণকে দুভাগে ভাগ করেন। ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা। ধারণাগুলো ইন্দ্রিয়ছাপের অবিকল প্রতিরূপ। হিউমও লকের মতো মনকে সাদা কাগজ বলেছেন। তবে তা লকের অর্থে নয়। হিউমের মতে, মনে কোনো ধারণা অস্তিত্বশীল থাকে না। মনের সব উপাদানই অভিজ্ঞতা থেকে আসে। এ অভিজ্ঞতা বা মনের উপাদানের সবটুকুকে লক বলেছেন ধারণা। হিউম একে দুভাগে ভাগ করেন। এই ভাগটি মূলত অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি এবং চিন্তা বা বিচারবুদ্ধির (reasoning)-মধ্যেকার প্রভেদ। চিন্তা বা বিচারবুদ্ধির ক্ষেত্রে আমাদের মনে আগে থেকেই এর উপাদানগুলো অস্তিত্বশীল থাকে, এবং মনের এসব উপাদান চূড়ান্ত অর্থে চিন্তা বা বিচার বুদ্ধির বাইরে কোনো কিছু অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ছাপ থেকে আসে। লকের দ্বারা এভাবে সংবেদন ও চিন্তাকে আলাদা করা সম্ভব ছিল না।

সুতরাং দেখা যায়, লক ও হিউম ধারণা শব্দটিকে এক অর্থে ব্যবহার করেননি। লক যাকে ধারণা বলেছেন হিউম তাকে বলেছেন প্রত্যক্ষণ। এভাবে হিউম ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে আলাদা করে ‘ধারণা’ শব্দটিকে অধিকতর সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহার করেন। এতে ইতোপূর্বে এ শব্দটির অর্থ নিয়ে যে দ্ব্যর্থবোধকতা ও বিকৃতি সৃষ্টি হয়েছিল তা থেকে শব্দটি কিছুটা মুক্তি পায়। হিউম ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে ধারণাকে আলাদা করে এবং ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার মধ্যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করে ‘ধারণা’ শব্দটির অর্থের উন্নতি সাধন করেন। ধারণা ইন্দ্রিয়ছাপের তুলনায় সব সময়ই কম সজীব বা অস্পষ্ট। এ প্রসঙ্গে হিউম তাঁর Enquiry গ্রন্থে বলেন, সবচেয়ে সজীব চিন্তন (ধারণা) সবচেয়ে নিস্তেজ সংবেদন (ইন্দ্রিয়ছাপ)-এর তুলনায় হীনতর।[১২] সুতরাং ধারণা ও ইন্দ্রিয়ছাপ পরস্পর আলাদা। হিউমের মতে, আমাদের জ্ঞানের ভিত্তি হলো ইন্দ্রিয়ছাপ, ধারণা নয়। কেননা, ইন্দ্ৰিয়ছাপ না হলে ধারণার উৎপত্তি সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আমাদের সব ধারণা বা ক্ষীণতর প্রত্যক্ষণ আমাদের ইন্দ্রিয়ছাপ বা সজীবতর প্রত্যক্ষণের প্রতিরূপ।[১৩]

স্মরণ করা যেতে পারে যে, হিউম-পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক বার্কলে ঈশ্বরকে সর্বোচ্চ প্রত্যক্ষণকারী এবং আমাদের প্রত্যক্ষণকে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষণের অংশ হিসেবে অভিহিত করে জ্ঞানের সীমাকে অনির্দিষ্ট করেছিলেন। কিন্তু হিউম ইন্দ্রিয়ছাপকে ধারণার ভিত্তি হিসেবে নির্দেশ করে জ্ঞানের সীমা নির্দিষ্ট করে দেন। এখানেই তাঁর অভিজ্ঞতাবাদ সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং সংশয়বাদের ভিত্তি রচিত হয়। কারণ, অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে হিউম ইন্দ্রিয়ছাপের বাইরে যেতে পারেন না। ইন্দ্রিয়ছাপ জ্ঞানোৎপত্তির মূল উৎস হলে সার্বিক জ্ঞান পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, অভিজ্ঞতায় সার্বিকতাকে পাওয়া যায় না। সার্বিক জ্ঞানের জন্য বুদ্ধির আশ্রয় নিতে হয়। হিউম জ্ঞানোৎপত্তির ক্ষেত্রে বুদ্ধির অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাই সার্বিক জ্ঞান লাভের উপায় না থাকায় তাঁর অভিজ্ঞতাবাদ সংশয়বাদে রূপ নেয়।

উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, হিউম প্রত্যক্ষণকেই একমাত্র জ্ঞানোৎপত্তির উপায় বলে অভিহিত করেছেন। তিনি প্রত্যক্ষণকে ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা এ দুভাগে বিভক্ত করেন। তবে ইন্দ্ৰিয়ছাপকে প্রাধান্য দিয়ে ধারণাকে ইন্দ্রিয়ছাপের অনুলিপি বলেছেন। অর্থাৎ জ্ঞানোৎপত্তির প্রাথমিক উপায় হলো ইন্দ্রিয়ছাপ বা সরাসরি প্রত্যক্ষণ। একথা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে একমাত্র চার্বাক দার্শনিকগণই প্রত্যক্ষকে বৈধ জ্ঞানোৎপত্তির একমাত্র উপায় বলে অভিহিত করেছিলেন। চার্বাকগণও প্রত্যক্ষণকে দুভাগে বিভক্ত করেন : বাহ্যিক ও মানসিক। চার্বাকদের মতে, মানসিক প্রত্যক্ষ বাহ্যিক প্রত্যক্ষের উপর নির্ভরশীল। এদিক থেকে হিউমের ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার সাথে চার্বাকদের বাহ্যিক ও মানসিক প্রত্যক্ষের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।

আমাদের সকল জ্ঞানই যে একমাত্র ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে আসে, অন্যকথায়, আমাদের ধারণাগুলো যে ইন্দ্রিয়ছাপের প্রতিরূপ বা ইন্দ্রিয়ছাপের উপর নির্ভরশীল এ বিষয়টিকে প্ৰমাণ করার লক্ষ্যে হিউম তাঁর Treatise গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদে ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণাকে সরল ও যৌগিক—এই দুই ভাগে বিভক্ত করেন। তিনি এদের গঠনগত পার্থক্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার সম্পর্ক আবিষ্কারে প্রয়াসী হন।

হিউমের মতে, গঠনগত দিক থেকে ইন্দ্ৰিয়ছাপ ও ধারণা দুভাগে বিভক্ত : সরল ও যৌগিক। যেসব ইন্দ্ৰিয়ছাপ বা ধারণাকে আরো ক্ষুদ্রতর বা একাধিক সরল ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণায় বিভক্ত করা যায় না সে সব ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণাই সরল। অন্যদিকে, যে সব ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণাকে আরো ক্ষুদ্রতর বা একাধিক সরল ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণায় বিভক্ত করা যায় সে সব ইন্দ্ৰিয়ছাপ বা ধারণা যৌগিক। একাধিক সরল ইন্দ্রিয়ছাপ বা সরল ধারণার সমন্বয়ে যথাক্রমে যৌগিক ইন্দ্ৰিয়ছাপ বা যৌগিক ধারণা গঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে হিউম বলেন:

আমরা সহজেই লক্ষ করতে পারি যে, ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা, এ দুরকম প্রত্যক্ষণকেই আরও একরকমভাবে বিভক্ত করা যায়। যেমন, সরল ও যৌগিক। সরল প্রত্যক্ষণকে, অর্থাৎ সরল ইন্দ্রিয়ছাপ ও সরল ধারণাকে আর কিছুতেই ভাগ বা পৃথক করা যায় না। যৌগিক প্রত্যক্ষণগুলো এর উল্টো। তাদেরকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করা যায়।[১৪] যৌগিক ইন্দ্রিয়ছাপের উদাহরণ দিতে গিয়ে হিউম একটি আপেলের মধ্যে যে রং, স্বাদ ও গন্ধের সমাবেশ হয় তাকে বুঝিয়েছেন। আলাদাভাবে রং, স্বাদ ও গন্ধ হলো সরল ইন্দ্ৰিয়ছাপ। তাদের মানসিক প্রতিরূপই হলো যথাক্রমে যৌগিক ধারণা ও সরল ধারণা।

হিউম ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার গঠনগত পার্থক্য নির্দেশ করার মাধ্যমে ধারণা ও ইন্দ্রিয়ছাপের সম্পর্ক বিশ্লেষণে প্রয়াসী হন। তিনি মনে করেন, যৌগিক ধারণাগুলো সব সময়ই আবশ্যিকভাবে যৌগিক ইন্দ্রিয়ছাপের অনুলিপি হবে এমন কোনো কথা নাই। কেননা তাঁর মতে, অনেক যৌগিক ধারণার ক্ষেত্রে দেখা যায়, এগুলোর অনুরূপ কোনো ইন্দ্রিয়ছাপ নাই। এছাড়া, অনেক যৌগিক ইন্দ্ৰিয়ছাপ আছে যেগুলো ধারণারূপে অবিকল প্রতিকৃত হয় না। বিষয়টিকে স্পষ্ট করার জন্য উদাহরণ হিসেবে তিনি নতুন জেরুজালেম নামে একটি শহরের কল্পনা করা যাক যার ফুটপাত সোনা দিয়ে এবং প্রাচীরগুলো পদ্মরাগ মণি দিয়ে তৈরি, যদিও এসব জিনিস কখনো দেখা যায়নি।[১৫] এথেকে বোঝা যায়, সোনা দিয়ে বাঁধানো ফুটপাত আর পদ্মরাগ মণি দিয়ে তৈরি প্রাচীরসম্পন্ন শহরের কোনো যৌগিক ইন্দ্ৰিয়ছাপ না থাকলেও যৌগিক ধারণা থাকা সম্ভব। অন্যদিকে, আমার এমন যৌগিক ইন্দ্ৰিয়ছাপও থাকা সম্ভব যার অবিকল প্রতিরূপ কোনো যৌগিক ধারণা আমি গঠন করতে পারি না। হিউম বলেন, আমি প্যারিস শহর দেখেছি। কিন্তু আমি কি ঐ শহরের এমন কোনো ধারণা সৃষ্টি করতে পারি যা তার রাস্তা ও বাড়িগুলোকে তাদের যথার্থ সঙ্গতি বজায় রেখে মনের সামনে তুলে ধরবে?১৬]

উপরের আলোচনা থেকে হিউম সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, যদিও সাধারণত যৌগিক ইন্দ্রিয়ছাপের সাথে যৌগিক ধারণার সাদৃশ্য রয়েছে, তবু তারা যে পরস্পরের প্রতিকৃতি এ সূত্রটিকে সার্বিকভাবে প্রয়োগ করা যায় না।[১৭] সুতরাং যৌগিক ধারণাগুলো যে সব সময় আবশ্যিকভাবে যৌগিক ইন্দ্রিয়ছাপের অবিকল প্রতিরূপ হবে এমন কোনো কথা নেই। অন্যকথায়, যৌগিক ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার সম্পর্ক অবিকল অনুরূপ নাও হতে পারে। কিন্তু সরল ইন্দ্রিয়ছাপের সাথে সরল ধারণার সম্বন্ধ বিষয়ে উপরের মত খাটে না। কারণ, যথাসম্ভব নির্ভুলভাবে পরীক্ষা করে হিউম দেখতে পান, প্রতিটি সরল ধারণাই কোনো না কোনো সরল ইন্দ্রিয়ছাপের অনুলিপি। তাই তাঁর মতে, প্রত্যেক সরল ধারণাই কোনো না কোনো সরল ইন্দ্রিয়ছাপের প্রতিকৃতি। আর প্রত্যেক সরল ইন্দ্রিয়ছাপের অনুরূপ একটি সরল ধারণা রয়েছে।[১৮]

সরল ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার উপরিলিখিত সম্পর্ক সার্বিকভাবে প্রযোজ্য বলে হিউম মনে করেন। তাই তিনি মানব প্রকৃতিবিজ্ঞানে একে একটি সার্বিক সূত্রাকারে প্রয়োগ করেন। এই সূত্রটি হলো, আমাদের সব সরল ধারণাই প্রথম আবির্ভাবের সময় এগুলোর সরল ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে উৎপন্ন হয়, এবং এরা এগুলোর অবিকল প্রতিকৃতি।[১৯] সূত্রটিকে আরো স্পষ্ট করে তিনি অন্যত্র বলেছেন, কিন্তু প্রাথমিক ধারণাগুলোকে যেমন ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে উৎপন্ন বলে মনে হয়, তেমনি এ কথাও সত্য যে, সরল ধারণাগুলো প্রত্যক্ষভাবে কিংবা পরোক্ষভাবে তাদের প্রতিরূপ ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে উৎপন্ন হয়। তাঁর মতে, মানব প্রকৃতিবিজ্ঞানে এটিই তাঁর প্রথম সূত্র।[২০] বলা যায়, এই সূত্রের মাধ্যমেই তিনি বুদ্ধিবাদের ভিত ভেঙে অভিজ্ঞতাবাদের যুক্তিসঙ্গত ভিত রচনা করেন। এছাড়া, এই সূত্রের ভিত্তিতেই তিনি ধারণাগুলোর অর্থ নির্ণয়ের জন্য যে ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে ধারণাটি উৎপন্ন হয়েছে সে ধারণাটিকে পরীক্ষা করার কথা বলেন। Enquiry গ্রন্থে তিনি বলেন, কোনো দার্শনিক শব্দ সম্পর্কে সংশয় জাগলে আমরা প্রশ্ন করবো কোন ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে ধারণাটি পাওয়া গেছে।[২১] প্রশ্ন হলো, এই সূত্রটি যে সার্বিকভাবে প্রযোজ্য তা হিউম কীভাবে নিশ্চিত করেন? অন্যকথায়, এই সূত্রটি সম্পর্কে সন্দেহমুক্ত হওয়ার উপায় কী? হিউম এ ব্যাপারে একটি চ্যালেঞ্জ প্রদান করে। কেউ যদি এই সার্বিক সাদৃশ্যকে অস্বীকার করতে চান তবে তাঁকে অন্তত একটি সরল ইন্দ্রিয়ছাপের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে হবে যার কোনো সদৃশ্য ধারণা নেই। অথবা এমন একটি সরল ধারণার দৃষ্টান্ত দিতে হবে যার কোনো অনুরূপ ইন্দ্ৰিয়ছাপ নেই।[২২]

কোনো সার্বিক সূত্রের নিশ্চয়তার ব্যাপারে এইরূপ চ্যালেঞ্জ প্রদান করায় হিউমের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে আরোহ পদ্ধতিতে বিশেষ বিশেষ ঘটনা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ করে সার্বিক সিদ্ধান্ত তথা বিজ্ঞানের স্বতঃসিদ্ধ বা সার্বিক নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিজ্ঞানী এই রকম নিয়মের চূড়ান্ত নিশ্চিতি দাবি করেন না, বরং আপেক্ষিক নিশ্চিতি দাবি করেন। অর্থাৎ অন্য কোনো বিজ্ঞানী এই নিয়মের ব্যতিক্রম না দেখানো পর্যন্ত এই নিয়ম দ্বারাই ঐ বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করা চলে। কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত টলেমির ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বই ছিল সার্বিক নিয়ম, এবং এর দ্বারা পদার্থ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করা হতো। হিউমই মানুষের জ্ঞানোৎপত্তির ক্ষেত্রে সরল ইন্দ্রিয়ছাপকে প্রাথমিক উপাদান হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রতিটি সরল ধারণাকে আবশ্যিকভাবে সরল ইন্দ্রিয়ছাপের অনুলিপি বলে চিহ্নিত করার মাধ্যমে মানব প্রকৃতিবিজ্ঞানে একটি প্রাথমিক সূত্র প্রণয়ন করেন। তিনিই সম্ভবত প্রথম দার্শনিক যিনি তাঁর মানব প্রকৃতিবিজ্ঞানের প্রথম সূত্রটির সার্বিকতার প্রমাণের জন্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় দেন।

ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার উপরিলিখিত সম্বন্ধের উপর ভিত্তি করেই হিউম অভিজ্ঞতাবাদের ভিত্তি স্থাপন করেন। ধারণা যদি ইন্দ্রিয়ছাপ ছাড়া উৎপন্ন না হয় তবে লক যে অর্থে সহজাত ধারণাকে অস্বীকার করেছেন সে অর্থে ধারণার অস্বীকৃতি অপরিহার্য। হিউম দার্শনিকদের স্বীকৃত সকল ধারণার পেছনেই ইন্দ্রিয়ছাপের অনুসন্ধান করেছেন এবং যেখানে ইন্দ্রিয়ছাপকে খুঁজে পাননি সেখানে ধারণাকে অস্বীকার করেছেন। এভাবে তিনি দ্রব্য, আত্মা, কার্যকারণ ঈশ্বর, প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ছাপহীন ধারণাকে বর্জন করে বুদ্ধিবাদের বিরুদ্ধে চরম আঘাত হেনেছেন। কারণ, বুদ্ধিবাদ অনুসারে ধারণার জন্য ইন্দ্রিয়ছাপ আবশ্যিক নয়। শুধুমাত্র বুদ্ধিজাত ধারণা বা আন্তর্ধারণাও সম্ভব। হিউমের মতবাদ এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ হিসেবে প্রতিভাত হয়। কান্টও একথা স্বীকার করেছেন যে, ইন্দ্রিয়ছাপ ছাড়া ধারণার উৎপত্তি হতে পারে না—এ তত্ত্ব হিউমের যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের ফলেই বুদ্ধিবাদের বক্তব্য যে বিচারভিত্তিক নয় বা নির্বিচারবাদী তা প্রমাণিত হয়েছে। এজন্যই কান্ট স্বীকার করেছেন যে, হিউম তাঁকে নির্বিচারবাদী নিদ্রা থেকে জাগিয়েছেন।

সরল ধারণা যে সরল ইন্দ্রিয়ছাপের প্রতিকৃতি তা প্রমাণ করার জন্য হিউম তাঁর Enquiry গ্রন্থে দুটি যুক্তি দিয়েছেন। প্রথম যুক্তিতে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, আমাদের যে কোনো যৌগিক ধারণাকে বিশ্লেষণ করলে তার মধ্যে এমনসব সরল ধারণাবলি পাওয়া যাবে যেগুলো অনুরূপ ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, তিনি ঈশ্বরের ধারণার কথা বলেন। তাঁর মতে, ঈশ্বর অসীম, বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও সৎ সত্তা বলে যে ধারণা আমাদের মনে রয়েছে সে ধারণাও মূলত আমাদের নিজেদের মধ্যে লক্ষিত গুণগুলো থেকে সৃষ্ট। আমরা সততা, জ্ঞান ও বিজ্ঞতারূপ যে গুণগুলো নিজেদের মধ্যে দেখতে পাই সেগুলোকেই সীমাহীনভাবে বর্ধিত করে ঈশ্বরের ধারণা গঠন করি। এভাবে যে কোনো ধারণাকে পরীক্ষা করলেই আমরা দেখবো যে তা অনুরূপ ইন্দ্রিয়ছাপের প্রতিরূপ।[২৩] দ্বিতীয় যুক্তিতে হিউম বলেন, কোনো ব্যক্তি যদি তার ইন্দ্রিয়জনিত ত্রুটির জন্য কোনো এক ধরনের ইন্দ্রিয়ছাপ লাভে ব্যর্থ হয় তবে সে ব্যক্তি সেরূপ ইন্দ্রিয়ছাপের ধারণা গঠন করতে পারবে না। যেমন, একজন অন্ধ ব্যক্তি রং-এর ধারণা এবং বধির ব্যক্তি শব্দের ধারণা গঠন করতে পারে না।[২৪] এ প্রসঙ্গে Treatise গ্রন্থে তিনি বলেন, আনারসের স্বাদ কখনো না পেলে তার যথার্থ ধারণা গঠন করা সম্ভব নয়।[২৫] মানুষের আবেগের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি কার্যকর। শান্ত আচরণে অভ্যস্ত ব্যক্তি প্রতিহিংসা বা নিষ্ঠুরতার ধারণা করতে পারে না। অবশ্য হিউম এ বিষয়টির ব্যতিক্রমও স্বীকার করেন।[২৬] তবে হিউমের মতে, এর ব্যতিক্রম একটি বিশেষ ঘটনা মাত্ৰ এই ব্যতিক্রমের কারণে ‘ধারণা ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে উৎপন্ন হয়’, এই সাধারণ সূত্র পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে না।[২৭]

এই ব্যতিক্রম ছাড়াও আরেক দিক থেকে ধারণার আগে ইন্দ্রিয়ছাপের আবির্ভাবের সূত্রটি সীমিত। তা হলো, ধারণাগুলো যেমন ইন্দ্রিয়ছাপের প্রতিকৃতি তেমনি মুখ্য ধারণার প্রতিকৃতিরূপে গৌণ ধারণার সৃষ্টি হতে পারে। এই ক্ষেত্রে গৌণ ধারণা অনুরূপ ইন্দ্ৰিয়ছাপ থেকে জন্ম না নিয়ে বরং অনুরূপ মুখ্য ধারণা থেকে জন্ম নেয়। তবে একথা ঠিক যে, মুখ্য ধারণাগুলো সব সময়ই ইন্দ্ৰিয়ছাপ থেকে উৎপন্ন হয় এবং সরল ধারণাগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এদের প্রতিরূপ ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে উৎপন্ন হয়।[২৮] হিউমের বিশিষ্ট সমালোচক ম্যাকনাব এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, হিউমের বিশেষ পর্যবেক্ষণলব্ধ সাধারণ বচনটি জ্ঞানতাত্ত্বিক বচন। বচনটি হলো, কোনো শব্দ বা অন্য প্রতীকের অর্থ জানার জন্য আমাদেরকে প্রথমে এই শব্দের অভিজ্ঞতালব্ধ উপাদানের উপর মনোযোগ দিতে হয়। অর্থাৎ এ শব্দটি যে বস্তুর সঙ্গে প্রথানুসারে সম্পর্কিত সে বস্তুকে জানতে হয়। কিন্তু ‘কমলা’ শব্দটির অর্থ কী তা জানা, আর কমলা কী তা জানা—এই বাক্য দুটি একই অর্থ বহন করে না। অথচ হিউম যখন বলেছেন যে, প্রতিটি সরল ধারণা সরল ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে আসে, তখন তিনি উপরের বাক্য দুটিকে একই অর্থ বহনকারী বলে বর্ণনা করতে চেয়েছেন।

সরল ধারণা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ম্যাকনার বলেন, এটা মনে করা যেতে পারে যে, হিউম সরল ধারণা বলতে রং, শব্দ, গন্ধ ইত্যাদি জাতীয় শব্দের ধারণাকে বুঝিয়েছেন। এসব শব্দাবলিকে প্রদর্শীরূপে (ostensibly) জানা যেতে পারে। এ শব্দগুলো অসংজ্ঞায়নযোগ্য। কারণ, জি. ই. মূর-এর মতে, এসব শব্দ ‘সরল ও অবিশ্লেষণযোগ্য’ গুণাবলিকে নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়। লালকে কোনো প্রকার বিশ্লেষণযোগ্য গুণাবলির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। লাল রং-এর উদাহরণ দিতে গেলে লাল রং-এর বস্তু প্রদর্শন করা এবং অ-লাল রং-এর বস্তু থেকে এর পার্থক্য দেখানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। এই অর্থ ‘লাল’ জাতীয় শব্দগুলো সরল ধারণাকে নির্দেশ করে। তাই ম্যাকনারের মতে, হিউমের সরল ও জটিল ধারণার ক্ষেত্রে অসংজ্ঞায়নযোগ্য ও সংজ্ঞায়নযোগ্য শব্দ দুটি ব্যবহার করা উচিত, এবং সকল সরল ধারণাই অনুরূপ ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে নির্দেশিত হয়, একথা বলার পরিবর্তে সকল অসংজ্ঞায়নযোগ্য শব্দকে প্রদর্শীরূপে, অর্থাৎ এ শব্দটি যে অভিজ্ঞতাকে নির্দেশ করে সে অভিজ্ঞতার উল্লেখ করার মাধ্যমে ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে—একথা বলা উচিত! [২৯]

Enquiry গ্রন্থে দেওয়া হিউমের পূর্বোক্ত যুক্তি ছাড়াও Treatise গ্রন্থে হিউম সরল ধারণাই সরল ইন্দ্রিয়ছাপের অনুলিপি—এই সূত্রটিকে প্রমাণ করার জন্য ‘আরোহাত্মক’ যুক্তি দেন। তিনি বলেন, সব অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সরল ইন্দ্রিয়ছাপগুলো এদের অনুরূপ সরল ধারণার পূর্বগামী এবং এর উল্টোটি কখনোই ঘটে না।[৩০] যেমন, কোনো শিশুকে কোনো রং বা দ্রব্যের ধারণা দিতে হলে তার কাছে প্রথমে এসব বস্তু উপস্থাপন করা হয় অর্থাৎ আগে ইন্দ্ৰিয়ছাপ সৃষ্টি করা হয়। কখনোই উল্টোভাবে প্রথম ধারণার সৃষ্টি করে তার সাহায্যে ইন্দ্ৰিয়ছাপ সৃষ্টি করা হয় না। এজন্যই তিনি কোনো দর্শন বিষয়ক পদের অর্থ বা ধারণা সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিলে এই সন্দেহ নিরসনের জন্য যে ইন্দ্ৰিয়ছাপ থেকে ধারণাটি সৃষ্ট সে ইন্দ্ৰিয়ছাপটিকে খুঁজে বের করার কথা বলেন। উপরের যুক্তিগুলোর মাধ্যমে হিউম প্রমাণে প্রয়াসী হন যে, জ্ঞানের সরলতম উপাদান হলো সরল ধারণা এবং তা এর অনুরূপ ইন্দ্রিয়ছাপ ছাড়া উৎপন্ন হতে পারে না। অন্যকথায়, যার ইন্দ্রিয়ছাপ নেই তার ধারণাও নেই।

প্রত্যক্ষণের শ্রেণিবিভাগ : হিউম Treatise গ্রন্থের প্রথম পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে প্রত্যক্ষণকে ইন্দ্ৰিয়ছাপ ও ধারণা এই দুভাগে ভাগ করেন। এছাড়া, এই পরিচ্ছেদেই তিনি গঠনগত দিক থেকে ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণাকে সরল ও যৌগিক এই দুই ভাগে বিভক্ত করেন, যা পূর্বে আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে তিনি আলাদাভাবে ইন্দ্রিয়ছাপের প্রকারভেদ এবং তৃতীয় পরিচ্ছেদে ধারণার প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করেন।

ইন্দ্রিয়ছাপগুলোকে তিনি দুভাগে বিভক্ত করেন : সংবেদনজাত ইন্দ্রিয়ছাপ ও চিন্তাজাত বা অন্তদর্শনজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপ। Treatise গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে তিনি ইন্দ্রিয়ছাপকে আরো দুটি ভাগে বিভক্ত করেন। এই দুটি ভাগ হলো মৌল (original) ও গৌণ (secondary) ইন্দ্ৰিয়ছাপ। প্রথম পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে তিনি যাকে সংবেদনজাত ইন্দ্রিয়ছাপ বলেছেন মৌল ইন্দ্ৰিয়ছাপ বলতে তিনি সে ইন্দ্ৰিয়ছাপকেই বুঝিয়েছেন। গৌণ ইন্দ্রিয়ছাপ বলতে পূর্বোক্ত অন্তর্দর্শনজাত বা চিন্তাজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপকে বুঝিয়েছেন।[৩১] সময়ের দিক থেকে চিন্তাজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপ সংবেদনের ইন্দ্রিয়ছাপের পরে আসে। তাই চিন্তাজাত ইন্দ্রিয়ছাপগুলো গৌণ বা বুৎপত্তিলব্ধ (derivative)। কিন্তু এগুলো কোনো ইন্দ্রিয়ছাপের অনুলিপি নয় বলে মৌলিকভাবে অস্তিত্বশীল এবং এগুলোও ইন্দ্ৰিয়ছাপ।

সংবেদনজাত ইন্দ্রিয়ছাপের উৎপত্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে হিউম বলেন, মূলত অজ্ঞাত কারণ থেকে এগুলো আত্মায় উৎপন্ন হয়।[৩২] অর্থাৎ এগুলো পূর্ববর্তী প্রত্যক্ষণ ছাড়াই দেহের গঠন, পাশব জীবনীশক্তি (animal spirit) বা বাহ্যিক অঙ্গসমূহের সঙ্গে বস্তুর সংযোগ থেকে উৎপন্ন হয়।[৩৩] ইন্দ্রিয়সমূহের সকল ইন্দ্রিয়ছাপ এবং সকল প্রকার দৈহিক বেদনা ও আনন্দ সংবেদনজাত বা মৌল ইন্দ্রিয়ছাপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তাঁর মতে, এগুলোর উৎপত্তির যথার্থ কারণ প্রাকৃতিক ও দৈহিক। তাই এগুলোর উৎপত্তি অনুসন্ধান করতে গেলে অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যা ও প্রাকৃতিক দর্শনের আলোচনা প্রয়োজন।[৩৪]

চিন্তাজাত বা গৌণ ইন্দ্রিয়ছাপগুলোর উৎপত্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, এগুলো মৌল ইন্দ্ৰিয়ছাপ থেকে প্রত্যক্ষভাবে বা মৌল ইন্দ্রিয়ছাপের ধারণার মধ্যস্ততায় সৃষ্টি হয়।[৩৫] চিন্তাজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপগুলো যে ক্রম অনুসারে সৃষ্টি হয় সে ক্রম সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হলো:

প্রথমে কোনো ইন্দ্ৰিয়ছাপ আমাদের ইন্দ্রিয়ের ওপর আঘাত হানে। এর ফলে আমরা কোনো না কোনো ধরনের গরম বা ঠাণ্ডা, পিপাসা বা ক্ষুধা, আনন্দ বা ব্যথা প্রত্যক্ষ করি। আমাদের মন ঐ ইন্দ্রিয়ছাপের একটি প্রতিরূপ গ্রহণ করে। ইন্দ্রিয়ছাপটি মুছে যাবার পরও প্রতিরূপটি থেকে যায়। একে আমরা ধারণা বলি। আনন্দ বা ব্যথার এই ধারণা আত্মায় আবির্ভূত হয়ে ইচ্ছা বা অনিচ্ছা, আশা বা ভয় এসব নতুন ইন্দ্ৰিয়ছাপ তৈরি করে একথা বলা যায়। কারণ, এগুলো চিন্তা থেকে উৎপন্ন হয়। আমাদের স্মৃতি ও কল্পনা দিয়ে আবার এদের প্রতিরূপ অর্জিত হয়। এভাবে এরা ধারণায় পরিণত হয়।[৩৬]

সুতরাং উৎপত্তির দিক থেকে চিন্তাজাত ইন্দ্ৰয়ছাপগুলো একদিকে এগুলোর ধারণার পূর্ববর্তী, অন্যদিকে এগুলো সংবেদনজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপের পরবর্তী, এবং এদের দ্বারা সৃষ্ট। চিন্তাজাত বা গৌণ ইন্দ্রিয়ছাপের মধ্যে অতিরাগগুলো এবং সদৃশ অন্যান্য সকল আবেগ অন্তর্ভুক্ত।

চিন্তাজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপগুলো সংবেদনের ইন্দ্রিয়ছাপ দ্বারা সৃষ্ট হলেও এগুলোর স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও সজীবতার জন্য হিউম এগুলোকেও মৌলিক বলেছেন। সংবেদনের ইন্দ্ৰিয়ছাপগুলো দুই অর্থে মৌলিক। যথা, প্রত্যক্ষণের অন্যান্য উপজাতির তুলনায় সময়ের বিচারে এগুলো সব সময় আগে ঘটে, এবং এগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ। অর্থাৎ এগুলো প্রতিনিধিত্বমূলক। অনুলিপি নয়। চিন্তাজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপগুলো দ্বিতীয় অর্থে মৌলিক। প্রথম অর্থে নয়। অর্থাৎ সময়ের বিচারে এগুলো সংবেদনের ইন্দ্রিয়ছাপের পরে উদ্ভূত হলেও এগুলো ইন্দ্রিয়ছাপের অনুলিপিমাত্র নয়। কেননা, এগুলো কোনোরূপ পূর্ববর্তী প্রত্যক্ষণের উপর নির্ভরশীল নয়। এগুলো প্রধানত চিন্তাবেগ বাসনা ও ভাবাবেগের সমবায়ে গঠিত।[৩৭]

হিউম চিন্তাজাত বা গৌণ ইন্দ্রিয়ছাপগুলোকে আবার দুভাগে বিভক্ত করেন : শান্ত ও উগ্র চিন্তাজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপ।[৩৮] হিউমের মতে, প্রথম শ্রেণির অর্থাৎ শান্ত ইন্দ্রিয়ছাপগুলোর মধ্যে সৌন্দর্যের অনুভূতি, কাজের বিকৃতি, শব্দ বা বাক্য গঠন এবং বাহ্যবস্তু অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় শ্রেণির অর্থাৎ উগ্র চিন্তাজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপগুলোতে আছে ভালবাসা ও ঘৃণার অতিরাগ, দুঃখ ও আনন্দ, গর্ব ও বিনয়।[৩৯] এ প্রসঙ্গে স্মিথ বলেন, উগ্র চিন্তাজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপ বলতে হিউম সাধারণভাবে তথাকথিত অতিরাগ ও আবেগগুলোকে বুঝিয়েছেন, এবং শান্ত চিন্তাজাত ইন্দ্রিয়ছাপ বলতে অনুমোদন ও অননুমোদন, নন্দনতাত্ত্বিক ও নৈতিক মনোভাবকে বুঝিয়েছেন।[৪০] Treatise গ্রন্থের প্রথম পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে হিউম চিন্তাজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপগুলোকে অতিরাগ ও আবেগ এই দুই ভাগে ভাগ করেন। এ দুটোই উগ্র চিন্তাজাত ইন্দ্রিয়ছাপের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে হয়, যদিও এ ব্যাপারে হিউম স্পষ্ট কিছু বলেননি। তিনি উগ্র চিন্তাজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপ হিসেবে গণ্য অতিরাগগুলোকে আবার দুভাগে ভাগ করেন : প্রত্যক্ষ অতিরাগ প্রত্যক্ষভাবে সৃষ্টি হয়। কামনা, বিরোধিতা, দুঃখ, আনন্দ, আশা, ভয়, হতাশা, নিরাপত্তা ইত্যাদি প্রত্যক্ষ অতিরাগ। অন্যদিকে, পরোক্ষ অতিরাগ বলতে তিনি সেসব অতিরাগকে বুঝান যেগুলো একই নিয়মে সৃষ্টি হয়। কিন্তু এগুলো অন্যান্য গুণাবলির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে উৎপত্তিলাভ করে। অহঙ্কার, বিনয়, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অসার দত্ত, ভালবাসা, ঘৃণা, শত্রুতা, সৌহার্দ্য, বিদ্বেষ, ভদ্রতা ইত্যাদি হলো পরোক্ষ অতিরাগ।[৪১]

Treatise গ্রন্থের প্রথম পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয় পরিচ্ছেদে হিউম উৎপত্তির দিক থেকে ধারণাকেও দুভাগে ভাগ করেন : স্মৃতির ধারণা ও কল্পনার ধারণা। তাঁর মতে, ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে ধারণার অবির্ভাব দুরকম হতে পারে। প্রথমত, নতুনভাবে আবির্ভূত হওয়ার সময় ইন্দ্ৰিয়ছাপটিতে যে মৌলিক সজীবতা ছিল তার অনেকখানি অবশিষ্ট থেকে যায় এবং সেখানে ইন্দ্রিয়ছাপ ও পূর্ণাঙ্গ ধারণার মাঝামাঝি কিছু একটার সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত, ইন্দ্রিয়ছাপটির সজীবতা সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণার সৃষ্টি করে। যে মৌলিক মানসিক শক্তি দ্বারা প্রথম প্রক্রিয়ার সাহায্যে আমরা ইন্দ্রিয়ছাপগুলোকে আবার সৃষ্টি করি তার নাম স্মৃতি, এবং অপরটির নাম কল্পনা।[৪২] তাঁর মতে, স্মৃতির ধারণা কল্পনার ধারণা থেকে অধিকতর স্পষ্ট বা সজীব ও শক্তিশালী। সজীবতা ও স্পষ্টতার দিক থেকে স্মৃতির ধারণা ইন্দ্রিয়ছাপ ও পূর্ণাঙ্গ ধারণার মাঝামাঝি। কিন্তু কল্পনার ধারণা সজীবতা ও স্পষ্টতার দিক থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা।

সুতরাং দেখা যায়, Treatise গ্রন্থের প্রথম পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে হিউম শুধু ইন্দ্রিয়ছাপকে দুভাগে, সংবেদনজাত ও চিন্তাজাত, এবং তৃতীয় পরিচ্ছেদে শুধু ধারণাকে দুভাগে, স্মৃতির ধারণা ও কল্পনার ধারণা, ভাগ করেন। ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার উৎপত্তির দিকে লক্ষ রেখেই এই বিভাজন করা হয়েছে। এছাড়া, প্রথম পরিচ্ছেদে তিনি ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা উভয়কে তাদের প্রকৃতিগত দিক থেকে আরো দুটি ভাগে বিভক্ত করেন: সরল ও যৌগিক। যে সব ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণাকে বিভিন্ন ক্ষুদ্রতর অংশে ভাগ করা যায় সে সব ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা যৌগিক।[৪৩] সরল ইন্দ্রিয়ছাপ দ্বারাই যৌগিক ইন্দ্ৰিয়ছাপ গঠিত হয়। হিউমের কাছে সরল ইন্দ্রিয়ছাপ হলো অভিজ্ঞতার পরমাণু বা মৌলিক উপাদান। এই অর্থেই এগুলো বিভাজ্য নয়। আর বিভাজ্য নয় বলেই, হিউমের মতে, মৌলিক ইন্দ্ৰিয়ছাপগুলো সংজ্ঞায়নযোগ্যও নয়।[৪৪] মনোবিজ্ঞানের বিশ্লেষণের দ্বারাই এই সরল ইন্দ্রিয়ছাপ নামক অভিজ্ঞতার মৌলিক উপাদান বা পরমাণুকে পাওয়া যায়। তাই হিউমের এই মতবাদকে মনস্তাত্ত্বিক পরমাণুবাদ বলে অভিহিত করা হয়।

হিউম যৌগিক ধারণাগুলোকেও মোট তিন ভাগে বিভক্ত করেন : সম্বন্ধ, ধরন ও দ্রব্য। তাঁর মতে, যৌগিক ধারণাগুলোই হলো চিন্তা ও ন্যায়ের সাধারণ বিষয়বস্তু। সাধারণত আমাদের সরল ধারণাগুলোর মধ্যে কোনো না কোনো বচনের সংযোগ থেকেই এদের উৎপত্তি হয়ে থাকে। এসব যৌগিক ধারণাকে সম্বন্ধ, অভিব্যক্তি বা ধরন এবং দ্রব্য—এই কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।[৪৫] হিউমকৃত প্রত্যক্ষণের উপর্যুক্ত শ্রেণিবিভাগকে সংক্ষেপে ছকের সাহায্যে দেখানো যায়।

হিউমের প্রত্যক্ষণের শ্রেণিবিভাগ

হিউমের প্রত্যক্ষণের শ্রেণিবিভাগ

হিউমকৃত প্রত্যক্ষণের বিভাজনের উপরের তালিকা থেকে প্রশ্ন জাগে কেন হিউম প্রত্যক্ষণকে এতো ভাগে বিভক্ত করেছেন? এর উত্তরে বলা যায়, তিনি মূলত মানবপ্রকৃতির স্বরূপ অন্বেষণ করতে গিয়ে তাঁর জ্ঞানবিদ্যাগত আলোচনায় জ্ঞানোৎপত্তির ক্ষেত্রে মনস্তত্ত্বের ভূমিকা নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছেন। নিউটন যেমন মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের জন্য নতুন চিন্তাপ্রণালী সরবরাহ করেছেন তেমনি হিউমও জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে চিন্তার নতুন প্রণালী আবিষ্কারের প্রয়াস নেন। তাই তিনি জ্ঞানোৎপত্তিতে চিন্তার বিভিন্ন স্তর ও প্রণালী নির্ণয়ে প্রত্যক্ষণের এই বিভাজনে মনোনিবেশ করেন।

হিউমকৃত প্রত্যক্ষণের বিভাজন-ছক থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। তবে উৎপত্তির দিক থেকে মূল বা প্রাথমিক উপাদান হলো ইন্দ্রিয়ছাপ। একেই তিনি মানবপ্রকৃতির প্রথম সূত্র বলে অভিহিত করেছেন। এছাড়া, আমাদের সকল ধারণা ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে উৎপন্ন হয়—একথা বলার মাধ্যমেই তিনি জ্ঞানোৎপত্তিতে মনস্তত্ত্বের ভূমিকা প্রমাণের প্রয়াস নেন। এখানেই পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাবাদী লক ও বার্কলে থেকে তাঁর পার্থক্য ও বিশেষত্ব নির্দেশিত হয়। যদিও হিউম প্রত্যক্ষণকে ইন্দ্ৰিয়ছাপ ও ধারণায় বিভক্ত করেছেন তবুও ধারণা বলতে স্মৃতি বা কল্পনার মাধ্যমে সৃষ্ট ইন্দ্রিয়ছাপের অনুলিপিকেই বুঝিয়েছেন। এই সূত্রের মাধ্যমেই হিউম দেকার্তের সহজাত মতবাদকে খণ্ডন করে জ্ঞানোৎপত্তিতে অভিজ্ঞতার ভূমিকা যৌক্তিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। সুতরাং হিউমের কাছে সহজাত ধারণা নয়, ইন্দ্রিয়ছাপই হলো জ্ঞানের বা প্রত্যক্ষণের একমাত্র প্রাথমিক উপাদান।

ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার পার্থক্য : ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হিউম দুয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেন। এই পার্থক্য নিয়ে তিনি খুব বেশি বিস্তৃত আলোচনা করেননি। তবে তাঁর দ্বারা নির্ণীত ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার পার্থক্য থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, একমাত্র ইন্দ্ৰিয়ছাপই জ্ঞানের প্রাথমিক উপাদান। ইন্দ্রিয়ছাপ থেকেই ধারণার উৎপত্তি হয়। তিনি তাঁর Treatise গ্রন্থের প্রথম পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ে এবং Enquiry গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ধারণার উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে খুব স্বল্প পরিসরে ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন।

হিউম ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার মধ্যে যে পার্থক্য নির্দেশ করেন তা হলো, তীব্রতার মাত্রাগত পার্থক্য। তাঁর মতে, যে পরিমাণ শক্তি ও সজীবতা নিয়ে এরা আমাদের মনে আঘাত করে এবং চিন্তা ও চেতনায় প্রবেশ করে তার তারতম্যের ওপর এদের পার্থক্য নির্ভরশীল।[৪৬] অনুসন্ধানের শেষ পর্যায়েও তিনি এছাড়া কোনো পার্থক্য নির্দেশ করেননি।[৪৭] Treatise গ্রন্থে তিনি ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার পার্থক্যকে অনুভূতি ও চিন্তার পার্থক্য বলে উল্লেখ করেছেন। ঠিক একইভাবে Enquiry গ্রন্থেও তিনি এ পার্থক্যকে চিন্তা ও ধারণার পার্থক্য বলেছেন।[৪৮] এই পার্থক্য তীব্রতার মাত্রার। Enquiry গ্রন্থে তিনি বলেন :

যখন কোনো ব্যক্তি প্রচণ্ড তাপের বেদনা অনুভব করে বা অসহনীয় উষ্ণতার অনুভূতি লাভ করে এবং পরবর্তীকালে যখন সে এই সংবেদনের বিষয়টিকে স্মৃতিতে পুনরুদ্রেক করে বা কল্পনায় উপলব্ধি করে তখন তার মনের প্রত্যক্ষণগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে বলে সকলেই অনুভব করতে পারেন। মূল প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রে যে শক্তি ও সজীবতার উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে স্মৃতি ও কল্পনা সে শক্তি ও সজীবতাকে কখনো জাগিয়ে তুলতে পারে না।[৪৯]

অর্থাৎ মূল প্রত্যক্ষণ বা ইন্দ্ৰিয়ছাপ এবং চিন্তা অর্থাৎ স্মৃতি বা কল্পনাজাত ধারণার মধ্যে পার্থক্য হলো, সজীবতার মাত্রার। অবশ্য হিউম একথা স্বীকার করেন যে, কল্পনায় ইন্দ্রিয়ছাপের ক্ষীণ প্রতিবিম্বগুলো কোনো কোনো সময় এমন সজীবতাপ্রাপ্ত হয় যে, তখন এগুলোকে আর কল্পনা বলে মনে হয় না। মনে প্রথম আগত সংবেদন বা ইন্দ্রিয়ছাপের মতোই মনে হয়। নিদ্রা, জ্বর বা বিকারে অথবা মনে কোনো প্রবল আবেগ উৎপন্ন হলে এরূপ মনে হতে পারে। অন্যদিকে, কোনো কোনো সময় আমাদের ইন্দ্রিয়ছাপগুলোও তীব্রতার দিক থেকে এতো অস্পষ্ট বা ক্ষীণ থাকে যে, তখন ধারণার মতোই মনে হয়। কিন্তু হিউমের মতে, এসব সত্ত্বেও ইন্দ্ৰিয়ছাপ ও ধারণার মধ্যেকার মাত্রাগত তারতম্যটি অত্যন্ত স্পষ্ট। ধারণা যত স্পষ্টই হোক না কেন তা কখনোই ইন্দ্রিয়ছাপের মতো সজীব ও স্পষ্ট হতে পারে না। তাই তিনি তাঁর Enquiry গ্রন্থে বলেন, সবচেয়ে সজীব বা প্রাণবন্ত চিন্তন সবচেয়ে নিস্তেজ সংবেদনের তুলনায় হীনতর।[৫০]

হিউম এই পার্থক্যের বিষয়টিকে বুঝাতে গিয়ে অনেকগুলো উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, মনের যে কোনো প্রত্যক্ষণের দিকে লক্ষ করলেই তীব্রতার মাত্রার পার্থক্য সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। যেমন, কোনো ব্যক্তি যিনি ক্রুদ্ধ হয়েছেন তার মধ্যে যে সক্রিয়তা বিদ্যমান যিনি কেবল ক্রোধের কথা চিন্তা করছেন তাঁর মধ্যে সে সক্রিয়তা থাকবে না। অথবা কোনো ব্যক্তি প্রেমে পড়েছেন একথা কেউ বললে তার কথার অর্থ আমরা বুঝি এবং সে ব্যক্তির অবস্থাও আমরা ধারণা করতে পারি। কিন্তু বাস্তবে প্রেমরূপ আবেগ যে মানসিক উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তার সাথে পূর্ববর্তী ধারণা অভিন্ন নয়।

এই উদাহরণে হিউম দেখাতে চান, চিন্তন বিশ্বস্ত দর্পণের মতো কাজ করতে পারে। অর্থাৎ চিন্তন অবিকৃতভাবে প্রত্যক্ষিত ঘটনার যথাযথ অনুলিপি উপস্থাপন করতে পারে। কিন্তু চিন্তন প্রত্যক্ষিত যথার্থ মূল ঘটনাকে উপস্থাপিত করতে পারে না। অর্থাৎ চিন্তন দ্বারা উপস্থাপিত প্রতিকৃতি ও মূল ঘটনার মধ্যে পার্থক্য থাকে। তা হলো, প্রতিকৃতি মূল ঘটনা থেকে ক্ষীণ, অস্পষ্ট বা নিস্তেজ। সুতরাং বলা যায়, ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার মূল পার্থক্য মাত্রাগত বা পরিমাণগত, প্রকৃতিগত নয়। হিউমের উদাহরণে এ বিষয়টি স্পষ্ট। তিনি তাঁর Treatise গ্রন্থে বলেন, অন্ধকারে লাল রঙ এর যে ধারণা আমরা তৈরি করি এবং সূর্যকিরণে তার যে ইন্দ্রিয়ছাপ আমাদের চোখে পড়ে তাদের মধ্যে পার্থক্য পরিমাণগত, প্ৰকৃতিগত নয়।[৫১] অর্থাৎ তাদের আকার, গঠন, বৈশিষ্ট্যাবলি অভিন্ন, কেবল সজীবতার ক্ষেত্রে পার্থক্য বিদ্যমান। এজন্য Enquiry গ্রন্থে হিউম ধারণা ও ইন্দ্রিয়ছাপের পরিচয় দিতে গিয়ে যেগুলো কম স্পষ্ট ও সজীব সেগুলোকে সাধারণভাবে ধারণা এবং অপর সবগুলো প্রত্যক্ষণকে ইন্দ্রিয়ছাপ বলেছেন।[৫২] সুতরাং এদের পার্থক্য সজীবতা বা স্পষ্টতার মাত্রার, অর্থাৎ পরিমাণগত, প্রকৃতিগত নয়।

অবশ্য হিউমের আলোচনা থেকে ইন্দ্ৰিয়ছাপ ও ধারণার মধ্যে আরো কিছু পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেগুলো হলো, ধারণা সর্বদাই ইন্দ্রিয়ছাপের অনুগামী, পূর্বগামী নয়। অর্থাৎ সময়ের দিক থেকে ধারণার আবির্ভাব সব সময়ই ইন্দ্রিয়ছাপের পরে ঘটে, কখনো আগে নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর Treatise গ্রন্থে বলেন, সব অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সরল ইন্দ্রিয়ছাপগুলো তাদের অনুরূপ সরল ধারণার পূর্বগামী, এর উল্টোটি কখনো ঘটে না।[৫৩] অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার উৎপত্তিক্ষণে পার্থক্য বিদ্যমান। সময়ের দিক থেকে ধারণা ইন্দ্রিয়ছাপের পরে আসে। যদিও অন্তর্দর্শনের ইন্দ্রিয়ছাপের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়ছাপ ধারণার পরে আসে, তবুও এই ধারণার আগেও কোনো না কোনো ইন্দ্ৰিয়ছাপ অবশ্যই থাকে। সুতরাং শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রিয়ছাপ ধারণার পূর্বেই অস্তিত্বশীল থাকে।[৫৪] এ থেকে ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার আরেকটি পার্থক্য অনুসৃত হয়। প্রাথমিকভাবে সর্বদাই ইন্দ্ৰিয়ছাপ থেকে ধারণার উৎপত্তি ঘটে, কখনো ধারণা থেকে ইন্দ্রিয়ছাপের উৎপত্তি ঘটে না। এ প্রসঙ্গে হিউম তাঁর Treatise গ্রন্থে বলেন, আমাদের সব ধারণাই প্রথম আবির্ভাবের সময় তাদের সদৃশ্য ইন্দ্ৰিয়ছাপ থেকে উৎপন্ন হয় এবং এরা তাদের অবিকল প্রতিকৃতি।[৫৫] অন্যদিক থেকে বলতে গেলে, ইন্দ্ৰিয়ছাপ ধারণার কারণ। ধারণা ইন্দ্রিয়ছাপের কারণ নয়। হিউম এ প্রসঙ্গে বলেন, দুই রকমের সদৃশ প্রত্যক্ষণের সতত সংযোগ থেকে নিশ্চিত প্রমাণ হয় যে, একটি অন্যটির কারণ এবং এদের মাঝে ইন্দ্রিয়ছাপের সতত পূর্ববর্তিতা একইভাবে প্রমাণ করে যে, ইন্দ্রিয়ছাপ ধারণার কারণ। ধারণা ইন্দ্রিয়ছাপের কারণ নয়।[৫৬]

হিউম বিভিন্ন প্রকার ইন্দ্রিয়ছাপ ও বিভিন্ন প্রকার ধারণার মধ্যেও পার্থক্য নির্ণয় করেছেন। তিনি ইন্দ্রিয়ছাপকে সংবেদনজাত ও চিন্তাজাত এই দুই ভাগে ভাগ করেন। এই দুই প্রকার ইন্দ্রিয়ছাপের মধ্যে পার্থক্য হলো, সংবেদনজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপগুলো উৎপত্তির দিক থেকে চিন্তাজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপের পূর্ববর্তী। কারণ, সংবেদনজাত ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে যে ধারণার জন্ম নেয় তা ‘আত্মায় আবির্ভূত হয়ে’ চিন্তাজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপ গঠিত হয়। এদিক থেকে বিচার করলে সংবেদনজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপগুলো শুধু সময়ের দিক থেকে চিন্তাজাত ইন্দ্রিয়ছাপের পূর্বগামী নয়, বরং চিন্তাজাত ইন্দ্রিয়ছাপের কারণও বটে। এছাড়া, সংবেদনজাত ইন্দ্রিয়ছাপগুলো হলো মূল বা আদি। কারণ, উৎপত্তির দিক থেকে এরাই প্রথম ইন্দ্রিয়ছাপ। এরা মৌলিক। কেননা, এরা অন্য কিছুর নকল বা প্রতিলিপি নয়। চিন্তাজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপগুলো উপর্যুক্ত অর্থে কেবল মৌলিকতার দাবিদার। কিন্তু এগুলো আদি বা মূল নয়। কেননা, উৎপত্তির দিক থেকে এরা সংবেদনজাত ইন্দ্রিয়ছাপের পরে আসে এবং সেগুলোর উপর নির্ভরশীল।

Treatise গ্রন্থের প্রথম পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয় পরিচ্ছেদে হিউম ধারণাকে স্মৃতি ও কল্পনার ধারণায় বিভক্ত করেন। এই দুই প্রকার ধারণার মধ্যে পার্থক্য হলো শক্তি ও সজীবতার। স্মৃতির ধারণা কল্পনার ধারণা থেকে বেশি সজীব। স্মৃতির ধারণার অবস্থা সজীবতার দিক থেকে ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার মাঝামাঝি। কিন্তু কল্পনার ধারণা একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা। এর সজীবতা যে কোনো ধারণার সজীবতার মতো, এর বেশি নয়। তিনি বলেন, স্মৃতির ধারণাগুলো কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি সজীব ও শক্তিশালী।[৫৭] তিনি স্মৃতি ও কল্পনার ধারণার মধ্যে আরো একটি পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেন। স্মৃতি নিজের বিশেষ ধর্ম অনুযায়ী এর ধারণাগুলোর মৌলিক অবস্থান ও বিন্যাসকে রক্ষা করে। কিন্তু কল্পনা ধারণাগুলোকে এবং এগুলোর বিন্যাসকে ইচ্ছামতো পরিবর্তিত করে।[৫৮] তবে হিউম একথা স্বীকার করেন যে, স্মৃতি ও কল্পনার ক্রিয়াকর্মের সময় এদের ভিন্নতা বুঝে ওঠার জন্য এই পার্থক্য যথেষ্ট নয়। কারণ, অতীত ইন্দ্ৰিয়ছাপগুলোকে বর্তমান ধারণাসমূহের সঙ্গে তুলনা করার জন্য তাদেরকে স্মরণ করে তাদের বিন্যাস একইভাবে রয়েছে কি না তা বিবেচনা করে দেখা অসম্ভব। সুতরাং স্মৃতি ও কল্পনার ধারণার মূল যে পার্থক্য আমাদের চোখে পড়ে তা হলো, স্মৃতির ধারণা কল্পনার ধারণার চেয়ে অধিকতর সজীব। পক্ষান্তরে, কল্পনার ধারণা স্মৃতির ধারণার চেয়ে কম স্পষ্ট বা কম সজীব।

ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার পার্থক্য বিষয়ে উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, হিউম শুধু এদের মধ্যে পরিমাণগত পার্থক্যের কথা বলেছেন। এদের মধ্যে গুণগত পার্থক্য নেই। এছাড়াও, হিউমের আলোচনা থেকে এই দুয়ের মধ্যে যে পার্থক্য পাওয়া যায় তা হলো, ইন্দ্রিয়ছাপ ধারণার পূর্বগামী এবং সর্বক্ষেত্রেই প্রাথমিকভাবে ইন্দ্ৰিয়ছাপ ধারণার কারণ। অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে ইন্দ্রিয়ছাপ না থাকলে ধারণার উৎপত্তি সম্ভব নয়। এখানে হিউম মানুষের চিন্তার ক্ষমতার সীমারেখা টেনে দিয়ে তাঁর জ্ঞানোৎপত্তিসংক্রান্ত মতবাদকে চরম অভিজ্ঞতাবাদে পরিণত করেছেন। ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার হিউম নির্দেশিত এই পার্থক্যকরণ মূলত—ইন্দ্ৰিয়ছাপই জ্ঞানের প্রাথমিক উপাদান এবং ইন্দ্রিয়ছাপ ছাড়া ধারণার উৎপত্তি হতে পারে না—এই মূল সূত্রকে দৃঢ়তর করে।

হিউমের অন্যতম সমালোচক বেরি স্ট্রাউড নিম্নরূপে হিউমের প্রত্যক্ষণ সম্পর্কিত উপরের আলোচনাকে সংক্ষেপে প্রকাশ করেন :৫৯]

(১) মনে কোনো প্রত্যক্ষণ যদি পূর্ব থেকে না থাকে তবে কোনো চিন্তার বা মানসিক ক্রিয়ার উৎপত্তি হতে পারে না।

(২) প্রতিটি প্রত্যক্ষণই হয় একটি ইন্দ্ৰিয়ছাপ নয়তো ধারণা।

(৩) প্রতিটি প্রত্যক্ষণই হয় সরল নয়তো জটিল।

(৪) প্রতিটি সরল প্রত্যক্ষণই একটি ইন্দ্রিয়ছাপ নয়তো ধারণা।

(৫) প্রতিটি সরল ধারণার অনুরূপ একটি সরল ইন্দ্রিয়ছাপ আছে।

(৬) প্রতিটি সরল ধারণাই অনুরূপ সরল ইন্দ্রিয়ছাপের কার্য হিসেবে মনে উৎপন্ন হয়।

(৭) সংবেদনজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপ ছাড়া চিন্তাজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপ উৎপন্ন হতে পারে না।

(৮) সুতরাং, সংবেদনজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপ ছাড়া চিন্তাজাত প্রক্রিয়া উৎপন্ন হতে পারে না।

স্ট্রাউড এর মতে, উক্ত বক্তব্যগুলো হিউমের দর্শনের পদ্ধতিগত ঘোষণা ও বাস্তবে অনুসারিত পদ্ধতির পটভূমি নির্মাণ করে। হিউম মনে করেন, মানুষের মনকে বোঝার জন্য এবং আমরা যে উপায়ে চিন্তা করি সে উপায়ে কেন চিন্তা করি তা বোঝার জন্য আমাদের অবশ্যই চিন্তার উপায়গুলোর মূল বা আদি উৎস আবিষ্কার করতে হবে। অর্থাৎ যতদূর সম্ভব চিন্তার ধরনগুলোর উদ্ভব বা বিকাশের ব্যাখ্যা দিতে হবে। হিউম সাদৃশ্যমূলক উদাহরণ দিয়ে বলেন, ব্যাধিকে আমরা যেভাবে কারণ আবিষ্কারের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করি মানব মনের আচরণ ও ক্রিয়াপরতাকেও সেভাবে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সুতরাং মানব মনের যথার্থ অধ্যয়ন বলতে মানব মনের উপাদানরূপ প্রত্যক্ষণগুলো কীভাবে প্রথমে মনের মধ্যে আসে এবং কেন তারা সেখানে তখন প্রতিভাত হয় এই বিষয়ের অধ্যয়নকেই বুঝায়। হিউমের মতবাদের উপর্যুক্ত আটটি রূপরেখা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রত্যক্ষণগুলো আমাদের মনে আবির্ভূত হওয়ার ন্যূনতম কারণ হলো, সংবেদনের ইন্দ্রিয়ছাপগুলো আমাদের মনে আসা। তাই আমাদের মনে যে সব ধারণার অস্তিত্ব আমরা দেখি সেগুলোর উৎপত্তিস্থল হলো ইন্দ্ৰিয় অভিজ্ঞতা। এই সূত্র আবিষ্কার করার পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই হিউমের মানব মন সম্পর্কিত পরীক্ষাকার্য শুরু হয়।

সুতরাং দেখা যায় হিউমের মতে, সংবেদনজাত ইন্দ্ৰিয়ছাপ যা প্রত্যক্ষণের প্রাথমিক উপাদান তা-ই, জ্ঞানোৎপত্তির একমাত্র উৎস। যার ইন্দ্রিয়ছাপ নাই তার জ্ঞান পাওয়া যায় না—এটাই হলো হিউমের জ্ঞানবিদ্যার মূলসূত্র বা একমাত্র মানদণ্ড। এই মানদণ্ডের ভিত্তিতেই তিনি দার্শনিক সমস্যাবলি, যেমন কার্যকারণ, ঈশ্বর, দ্রব্য, আত্মা ইত্যাদি ধারণাকে পর্যালোচনা করে খণ্ডন করেন এবং এগুলো সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা দেন। হিউম তাঁর দর্শনের এই মানদণ্ড সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, মানব প্রকৃতি বিজ্ঞানে এটাই আমার প্রথম সূত্র।[৬০] এই মানদণ্ডই হিউমের জ্ঞানবিদ্যার অন্যতম আবিষ্কার। ম্যাকনাব মনে করেন, হিউমের ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা মতবাদ দ্বারা অভিজ্ঞতাবাদী অবস্থানকে নতুন এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী উপায়ে উপস্থাপনের প্রয়াস নেওয়া হয়েছে।[৬১] এ মতবাদ দ্বারাই তিনি কার্তেসীয় বুদ্ধিবাদের মূলভিত্তি সহজাত ধারণার অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যা প্রদান করেন।

সহজাত ধারণার অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যা : জ্ঞানের উৎস সম্পর্কিত হিউম প্রদত্ত সূত্রটি—ইন্দ্ৰিয়ছাপ ছাড়া ধারণার সৃষ্টি হতে পারে না—কার্তেসীয় বুদ্ধিবাদের মূল ভিত্তি আন্তর্ধারণা বা সহজাত ধারণাকে খণ্ডন করে। তবে হিউম নিজে সহজাত ধারণা কথাটিকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু প্রচলিত অর্থে নয়, বরং নতুন অর্থে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সহজাত’ শব্দটি যদি ‘স্বাভাবিকতা’র সমার্থক হয় তাহলে মনের সব প্রত্যক্ষণ বা ধারণাকে অবশ্যই সহজাত বা স্বাভাবিক বলতে হবে। কিন্তু যদি সহজাত বলতে আমাদের জন্মের সমসাময়িক অর্থে বুঝি তবে বিতর্কের ব্যাপারটি অসার হবে। এছাড়া, আমাদের চিন্তনক্রিয়া কখন থেকে শুরু হয়—জন্মের পূর্বে, জন্মের সময় বা জন্মের পরে—তা অনুসন্ধান করাও গুরুত্বহীন।[৬২] লকের আন্তর্ধারণা খণ্ডনকে হিউম প্রশংসা করেন। কিন্তু হিউমের পূর্ববর্তী অন্যান্য দার্শনিক, বিশেষত লক, ধারণা কথাটিকে যেভাবে গ্রহণ করেছেন হিউম তার সঙ্গে একমত নন। হিউমের মতে, লক ও অন্যান্য দার্শনিক ধারণা বলতে প্রত্যক্ষণ, সংবেদন, আবেগ এবং এর সাথে চিন্তনকেও বুঝিয়েছেন। এই অর্থে কোনো আঘাতের ফলে অসন্তুষ্টি প্রকাশ বা স্ত্রী- পুরুষের আসক্তি সহজাত বা আন্তর্ধারণার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। অথচ তারা এসবকে আন্তর্ধারণা বলেননি। লক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুণগুলোকে কখনো ধারণা বলেছেন আবার কখনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুণগুলোর ধারণার কথা বলেছেন। তিনি ধারণা কথাটিকে ইন্দ্রিয় উপাত্তরূপে যেমন ব্যবহার করেছেন তেমনি প্রত্যয় ও সামান্য ধারণারূপেও ব্যবহার করেছে। বার্কলে ধারণা ও বস্তুকে একই অর্থে গ্রহণ করেছেন। তাই হিউমের মতে, তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকগণ ‘ধারণা’ শব্দটিকে অনির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহার করেছেন।[৬৩] তিনি ধারণাকে ইন্দ্রিয়ছাপের অনুলিপি হিসেবে সুনির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহার করেন। তিনি সহজাত ধারণাকে কার্তেসীয় অর্থে, অর্থাৎ পূর্ববর্তী কোনো প্রত্যক্ষণের প্রতিরূপ নয়—এই অর্থে গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত নেন যে, আমাদের সব ইন্দ্ৰিয়ছাপ হলো সহজাত বা মৌলিক। এরা কোনোকিছুর অনুলিপি নয়। কিন্তু এই অর্থে আমাদের ধারণাগুলো সহজাত নয়। কারণ, এরা মৌলিক নয়, বরং প্রতিকৃতি মাত্র। হিউম তাঁর Enquiry গ্রন্থের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের শেষ পাদটীকায় বলেন :

কিন্তু ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণাকে উপরে ব্যাখ্যাত অর্থে গ্রহণ করে এবং ‘আন্তর’ বা ‘সহজাত’ শব্দটিকে মৌলিক বা পূর্ববর্তী কোনো প্রত্যক্ষণের অনুলিপি নয় এই অর্থে বুঝে নিয়ে আমরা ঘোষণা করতে পারি যে, আমাদের সকল ইন্দ্রিয়ছাপই আন্তর বা সহজাত এবং আমাদের ধারণাগুলো সহজাত নয়।[৬৪]

অর্থাৎ কার্তেসীয় মতকে গ্রহণ করলে মৌলিকতার কারণে ধারণাগুলোকে নয় বরং ইন্দ্রিয়ছাপগুলোকেই আন্তর বা সহজাত বলতে হয়। এভাবে হিউম কার্তেসীয় সহজাত ধারণার অভিজ্ঞতাপূর্ব অস্তিত্ব খণ্ডন করে এ সম্বন্ধে অভিজ্ঞতাবাদী নতুন তত্ত্ব দেন।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, আন্তর্ধারণাকে অমৌলিক হিসেবে প্রমাণ করে ইন্দ্রিয়ছাপকেই জ্ঞানের একমাত্র উৎস হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে হিউম জ্ঞানের সীমাও নির্দেশ করে দিয়েছেন। যেহেতু ইন্দ্ৰিয়ছাপ ছাড়া কোনো ধারণা আমাদের মনে থাকতে পারে না, অর্থাৎ সব ধারণারই অনুরূপ ইন্দ্ৰিয়ছাপ আছে এবং কার্তেসীয় অর্থে কোনো ধারণারই অস্তিত্ব নাই, সেহেতু আমরা ইন্দ্রিয়ছাপে যা পাই শুধু তারই জ্ঞান পেতে পারি। এর চেয়ে বেশি কিছুর নয়।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, লক মুখ্য ও গৌণ গুণের আধাররূপ অজ্ঞাত জড় দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করেছিলেন, বার্কলে লকের জড় দ্রব্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও প্রত্যক্ষণকারী হিসেবে মানসিক দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করে জ্ঞানের সীমাকে অনির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। কিন্তু হিউম জড় ও মানসিক উভয় প্রকার দ্রব্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করে ইন্দ্রিয়ছাপকে জ্ঞানোৎপত্তির প্রাথমিক, মূল ও একমাত্র উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেন। এতে জ্ঞানের সীমারেখা নির্দিষ্ট হয়। এখানেই তাঁর অভিজ্ঞতাবাদ তাঁর পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাবাদীদের দ্বারা সম্পাদিত অসঙ্গতি কাটিয়ে ওঠে চরম অভিজ্ঞতাবাদে রূপলাভ করে। পূর্ববর্তী অসঙ্গতি কাটিয়ে সঙ্গতিলাভ করতে গিয়েই হিউমের জ্ঞানবিদ্যায় এটা প্রমাণিত হয় যে, অভিজ্ঞতাবাদের চরম বা সঙ্গতিপূর্ণ পরিণতি সংশয়বাদে। অবশ্য হিউমের মতে, এই সংশয়বাদ ধ্বংসমূলক নয়, গঠনমূলক। অর্থাৎ যুক্তিনির্ভর অভিজ্ঞতাবাদীর হাতে এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও থাকে না। তাই রাসেল হিউমের জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে হিউমকে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিকদের মধ্যে একজন হিসেবে আখ্যায়িত করেন। রাসেলের মতে, হিউম, লক ও বার্কলের অভিজ্ঞতাবাদী দর্শনের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত টেনে অভিজ্ঞতাবাদকে সঙ্গতিপূর্ণ করার মাধ্যমে অবিশ্বাস্য হিসেবে প্রতিপন্ন করেন। একটি নির্দিষ্ট অর্থে তিনি এর সর্বশেষ প্রতিনিধি। কারণ, তাঁর গতিপথে আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।[৬৫]

উপরের ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা এবং সহজাত ধারণা সম্পর্কিত তত্ত্ব থেকে সংক্ষেপে একথা বলা যায় যে, হিউম প্রত্যক্ষণকেই জ্ঞানের একমাত্র উৎস হিসেবে আখ্যায়িত করে সকল প্রকার ধারণাকে ইন্দ্রিয়ছাপের উপর নির্ভরশীল বলে প্রমাণ করেন। ফলে, ইন্দ্রিয়ছাপ জ্ঞানের একমাত্র প্রাথমিক উপাদানে পরিগণিত হয়। তিনি দেকার্তের আন্তর্ধারণা বা সহজাত ধারণার অভিজ্ঞতাপূর্ব প্রকৃতিকে অস্বীকার করেন। কারণ, জন্মের সময় থেকে, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ছাপের পূর্বে, কোনো ধারণার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। দেকার্তের সহজাত ধারণাকে তিনি মৌলিক ধারণা অর্থে গ্রহণ করেন এবং এর অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যা দিয়ে সকল প্রকার ইন্দ্রিয়ছাপকেই আন্তর বা সহজাত বলেন। হিউম সকল ধারণাকে ইন্দ্রিয়ছাপের অনুলিপি হিসেবে গ্রহণ করায় জ্ঞানের সীমা ইন্দ্রিয়ছাপের মধ্যে নির্দিষ্ট হয় এবং অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যা থেকে লক ও বার্কলের দ্বারা স্বীকৃত দ্রব্যের ধারণা প্রত্যাখ্যাত হয়।

উল্লেখ্য যে, হিউম ইন্দ্রিয়ছাপকে জ্ঞানের প্রাথমিক উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, দেকার্তের দ্বারা স্বীকৃত আন্তর্ধারণাকে অস্বীকার করে, সকল প্রকার ধারণাকে ইন্দ্রিয়ছাপের অনুলিপি হিসেবে চিহ্নিত করলেও তাঁর হাতে ‘ধারণা’ শব্দটি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান লাভ করে। তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকগণ ধারণা শব্দটিকে যেভাবে অনির্দিষ্ট এবং বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন হিউম এর হাত থেকে ‘ধারণা’ শব্দটিকে মুক্তি দিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট অর্থে, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ছাপের অনুলিপি অর্থে ধারণা শব্দটিকে ব্যবহার করেন। যার ফলে ‘ধারণা’ শব্দটি দর্শনের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে।

আলোচনার অগ্রগতিতে আমরা দেখবো যে, হিউম ধারণার নির্দিষ্ট অর্থ প্রদান করেই ক্ষান্ত হননি, বরং ভ্রান্ত জ্ঞানের উৎস হিসেবে ধারণার অনুষঙ্গ নিয়ম নিয়ে আলোচনা করেন। এছাড়া তিনি অভিব্যক্তি বা ধরন, দ্রব্য ও সম্বন্ধ ইত্যাদি যৌগিক ধারণা গঠনের ক্ষেত্রে ধারণার অনুষঙ্গের গুরুত্ব নির্ণয় করে লক ও বার্কলের দ্বারা স্বীকৃত দ্রব্যসংক্রান্ত সমস্যার অভিজ্ঞতাবাদী সমাধানে প্রয়াসী হন। এর ফলে ধারণার অনুষঙ্গ সম্পর্কিত আলোচনা তাঁর জ্ঞানবিদ্যায় বিশেষ স্থান দখল করে।

ধারণার অনুষঙ্গ

পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, চরম অভিজ্ঞতাবাদী হিউম অভিজ্ঞতাকেই জ্ঞানের একমাত্র উৎস বলেছেন। ইন্দ্রিয়ছাপ হলো অভিজ্ঞতার মৌল উপাদান। সুতরাং আমাদের জ্ঞান ইন্দ্রিয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রশ্ন হলো, যে সব ধারণার সঙ্গে আমাদের ইন্দ্রিয়ছাপের সরাসরি সম্পর্ক নাই অর্থাৎ যে সব ধারণা আমাদের অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে যায়। যেমন দ্রব্য, আত্মা। এ সব ধারণা আমরা কীভাবে পাই? এর উত্তরে হিউম ধারণার অনুষঙ্গ নিয়মের কথা বলেন। এছাড়া, ধারণার অনুষঙ্গকে তিনি সকল প্রকার ভ্রমাত্মক জ্ঞানের কারণ হিসেবেও দায়ী করেন।

Treatise গ্রন্থের প্রথম পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ের চতুর্থ পরিচ্ছেদে এবং Enquiry গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি ধারণার অনুষঙ্গ সম্পর্কে আলোচনা করেন। এই পরিচ্ছেদগুলোতে তিনি যা বলতে চেয়েছেন সংক্ষেপে তা হলো, দুভাবে ইন্দ্ৰিয়ছাপ থেকে ধারণার উৎপত্তি হতে পারে। স্মৃতির মাধ্যমে ও কল্পনার মাধ্যমে। স্মৃতির ধারণাগুলো কল্পনার ধারণার চেয়ে অনেক বেশি সজীব ও শক্তিশালী। এছাড়া, স্মৃতির ধারণা তাঁদের মূল ইন্দ্রিয়ছাপের ক্রমকে অনুসরণ করে উৎপত্তিলাভ করে। কিন্তু কল্পনার ধারণার সঙ্গে মূল ইন্দ্রিয়ছাপের ক্রমের অনুরূপতা বজায় থাকে না।

অন্যদিকে, স্মৃতির ক্ষেত্রে ধারণাগুলোর মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বর্তমান। কিন্তু কল্পনার ক্ষেত্রে ধারণাগুলোর মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক অনুপস্থিত। অর্থাৎ কল্পনার ধারণাগুলো স্বাধীন ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কহীন। তবে এই স্বাধীনতা ও অসংলগ্নতা সীমাহীন বা অবাধ নয়। আমাদের সবচেয়ে অবাধ কল্পনা ও অসংলগ্ন ধারণার মধ্যেও একটি যোগসূত্ৰ বৰ্তমান। কল্পনা থেকে একটি বিশেষ সময়ে একটি বিশেষ ধারণার উৎপত্তি হয় এবং তা একটি নিয়ম মেনে চলে। স্বাধীন কল্পনাকেও ধারণার উৎপত্তির সময় এই নিয়ম মেনে চলতে হয়। এভাবে মনের এক ধারণা অন্য ধারণার সঙ্গে যুক্ত হয়, এক ধারণা অন্য ধারণার কথা মনে করিয়ে দেয়। হিউম একে কোনো আকস্মিক ঘটনা বলে মনে না করে বরং এর পেছনে একটি সার্বিক নিয়মের কথা বলেন। এই নিয়ম হলো অনুষঙ্গ নিয়ম। অন্যকথায়, সরল ধারণাগুলো বিভিন্ন নিয়মে সংযুক্ত হয়ে সম্বন্ধ, অভিব্যক্তি বা ধরন এবং দ্রব্য, এই তিন প্রকার যৌগিক অভিজ্ঞতাতীত ধারণার সৃষ্টি করে। কল্পনা বিভিন্ন ধারণার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে এসব যৌগিক ধারণা সৃষ্টি করে।

স্মৃতির তুলনায় কল্পনাকে বাহ্যিক দিক থেকে স্বাধীন বলে মনে হলেও কল্পনার ধারণার স্বাধীনতাকে সীমাহীন বলা যায় না। আমাদের সবচেয়ে অবাধ কল্পনামূলক চিন্তা, স্বপ্ন, অসংলগ্ন স্বাধীন কথাবার্তা, ইত্যাদির ক্ষেত্রেও আমরা বিভিন্ন ধারণার মধ্যে একটা যোগসূত্র দেখতে পাই। কতগুলো নির্দিষ্ট নিয়মে এগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়। এসব নিয়ম হলো কল্পনার নিয়ম। সরল ধারণার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনকারী এসব নিয়মকেই হিউম অনুষঙ্গ নিয়ম হিসেবে আখ্যায়িত করেন। রবার্ট একারম্যান হিউমের অনুষঙ্গ নিয়ম সম্পর্কে বলেন, কীভাবে বিভিন্ন ইন্দ্ৰিয়ছাপ বিশ্লেষিত ও একত্রিত হয়ে ধারণার সৃষ্টি করে তা দেখাতে গিয়েই হিউম ধারণার অনুষঙ্গের কথা বলেন। বিভিন্ন ইন্দ্ৰিয়ছাপ একত্রিত হয়ে ধারণার সৃষ্টি করতে পারে এবং ধারণাগুলো আবার একত্রিত হয়ে জটিল ধারণার সৃষ্টি করতে পারে।[৬৬]

ধারণার অনুষঙ্গ নিয়মটি তিনভাবে কাজ করে বলে হিউম মনে করেন। তা হলো সাদৃশ্য, দেশ ও কালের সান্নিধ্য ও কার্যকারণ। হিউমের মতে, যে সব গুণাগুণের সাহায্যে এই অনুষঙ্গ গঠিত হয় এবং যেগুলো মনকে এক ধারণা থেকে অন্য ধারণায় নিয়ে যায় সেগুলো তিন রকম : সাদৃশ্য, কাল ও দেশে সান্নিধ্য এবং কার্যকারণ।[৬৭] উল্লেখ্য যে, Treatise গ্রন্থের দ্বিতীয় পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ের চতুর্থ পরিচ্ছেদে ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার সম্বন্ধ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি মনের তিনটি গুণের কথা বলেন। এর প্রথমটি হলো ধারণার অনুষঙ্গ, দ্বিতীয়টি ইন্দ্রিয়ছাপের অনুষঙ্গ এবং তৃতীয়টি এই উভয় শ্রেণির অনুষঙ্গ। তাঁর মতে, মনের তৃতীয় গুণ হিসেবে উভয় শ্রেণির অনুষঙ্গ পরস্পরকে সাহায্য করে এবং একে অপরের দিকে এগিয়ে যায়। যেখানে একই বস্তুতে উভয় অনুষঙ্গ ঘটে সেখানে তাদের মধ্যে আদান-প্রদান অতি সহজে ঘটে থাকে। এই পরিচ্ছেদে ধারণার অনুষঙ্গ নামক মনের প্রথম গুণটির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, যখন একটি ধারণা কল্পনায় উপস্থিত হয় তখন সাদৃশ্য, দেশ-কাল সান্নিধ্য ও কার্যকারণ দ্বারা সংযুক্ত অন্য যে কোনো ধারণা কল্পনায় উপস্থিত ধারণাটিকে অনুসরণ করে।[৬৮]

মনের দ্বিতীয় গুণ হিসেবে ইন্দ্রিয়ছাপের অনুষঙ্গ প্রসঙ্গে বলেন যে, ইন্দ্রিয়ছাপের অনুষঙ্গ হলো ধারণার অনুষঙ্গের মতো মনের দ্বিতীয় গুণ। তাঁর মতে, সকল সাদৃশ্যমূলক ইন্দ্ৰিয়ছাপ একত্রে সংযুক্ত হয় এবং একটি মনে উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথেই অন্যটি তাকে অনুসরণ করে। উদাহরণস্বরূপ, দুঃখ হতাশা ও ক্রোধের উদ্রেক করে। ক্রোধ থেকে ঈর্ষার উৎপত্তি হয়। ঈর্ষা থেকে বিদ্বেষ এবং বিদ্বেষ থেকে আবার দুঃখের উৎপত্তি হয়। এভাবে যতক্ষণ পর্যন্ত এই অনুক্রম শেষ না হয় ততক্ষণ একটি ইন্দ্রিয়ছাপ সদৃশ্য ইন্দ্ৰিয়ছাপের জন্ম দেয়। তবে হিউম মনের উপর্যুক্ত দুটো গুণের অর্থাৎ ধারণার অনুষঙ্গের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ছাপের অনুষঙ্গের পার্থক্য করেন। তাঁর মতে, এদের পার্থক্য হলো ধারণা সাদৃশ্য, দেশ-কাল সান্নিধ্য ও কার্যকারণ এই তিনটি নিয়মে অনুষঙ্গবদ্ধ হয়। কিন্তু ইন্দ্ৰিয়ছাপ কেবল একটি নিয়মে অনুষঙ্গবদ্ধ হয়। এই নিয়মটি হলো সাদৃশ্য নিয়ম।[৬৯]

হিউম তাঁর Enquiry গ্রন্থে ধারণার অনুষঙ্গ নিয়মের উদাহরণ দেন। কোনো একটি প্রতিকৃতি, সেই মূল বস্তুর দিকে আমাদের চিন্তাকে চালিত করে। এটি সাদৃশ্য নিয়মের উদাহরণ। কোনো দালানের একটি কক্ষের উল্লেখ করা হলে অন্যান্য কক্ষগুলোর আলোচনা এসে পড়ে। এটি সান্নিধ্য নিয়মের উদাহরণ। আবার কোনো আঘাতের কথা চিন্তা করলে সে আঘাতের ফলে উদ্ভূত বেদনার কথা চিন্তা না করে আমরা পারি না। এটি কার্যকারণ নিয়মের উদাহরণ। তবে এই তিনটি নীতির বাইরে অন্য কোনো নীতি অনুষঙ্গের ক্ষেত্রে কাজ করে কি না এ বিষয়টি সঠিকভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয় বলে হিউম মনে করেন।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে ধারণার উৎপত্তির বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য তিনি অভিজ্ঞতাবাদী পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতির সমর্থন করে বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় দেন। অনুষঙ্গের তিনটি নিয়ম প্রমাণ করার ক্ষেত্রেও তিনি উক্ত পদ্ধতিকে অনুসরণ করেন। তিনি অধিকতর দৃষ্টান্ত পরীক্ষা করে দেখতে বলেন। তাঁর মতে, ব্যতিক্রমহীনভাবে পরীক্ষিত দৃষ্টান্তের সংখ্যা যত বেশি হবে নিয়মটি তত বেশি ব্যাপকতর বলে প্রমাণিত হবে। এ প্রসঙ্গে Enquiry গ্রন্থের তৃতীয় পরিচ্ছেদে দীর্ঘ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর শেষ ছত্রে হিউম যে মন্তব্য করেন তা হলো, আমাদের জন্য বর্তমানে এ সিদ্ধান্তে আসাই যথেষ্ট হবে যে, মনের সকল ধারণার সংযুক্তির নিয়ম হলো, তিনটি সম্বন্ধ : সাদৃশ্য, সান্নিধ্য ও কার্যকারণ।[৭০]

অনুষঙ্গ নিয়মের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হিউম একে একটি ‘শান্ত শক্তি’ বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর মতে, অনুষঙ্গ নিয়মগুলো একটি সঙ্গতিবিধানকারী সার্বিক সূত্র।[৭১] উল্লেখ্য যে, এই নিয়মগুলো ধারণাবলির অনিবার্য কিংবা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের নির্দেশক নয়। এগুলো অভিজ্ঞতামূলক সার্বিকীকরণ মাত্র।[৭২] অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা শুধু দেখতে পাই অনুষঙ্গ নিয়মগুলোর মাধ্যমে কল্পনা ধারণার মধ্যে সংযুক্তি ঘটায়। অর্থাৎ একটি ধারণা অপর একটি ধারণার সদৃশ কিংবা দেশ কালের দিক থেকে কাছাকাছি, অথবা একটি সংগঠিত হলে অপরটি সংগঠিত হয়। এ থেকে এদের একটির সঙ্গে অপরটির সম্পর্ক আছে বলে আমরা মনে করি। তবে এই সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য নয়।

এ. এন. বেসন হিউমের ধারণার অনুষঙ্গ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, চিন্তন এমনকি কল্পনাও কীভাবে কমবেশি একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ পারম্পর্য অনুসরণ করে হিউম তা-ই অনুষঙ্গের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। তাঁর চরম লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য এর প্রয়োজন ছিল বলে বেসন মনে করেন। কেননা, এ ব্যাখ্যা বুদ্ধিবাদীদের দ্বারা ব্যাখ্যাত মনের বৌদ্ধিক বৃত্তির অস্তিত্ব অস্বীকার করে। তিনি ঘোষণা করেন, ধারণার মধ্যে সংযোগের ফলই হলো শৃঙ্খলা। শৃঙ্খলাকেই অনুষঙ্গ বলা হয়। এই শৃঙ্খলা বৌদ্ধিক নয়, বরং অভিজ্ঞতাভিত্তিক। বেসনের মতে, হিউমের অনুষঙ্গ নীতির মাধ্যমে অন্য যে আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয়েছে তা হলো, হিউম একজন পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণবাদী নন। কেননা, কোন ধারণা অন্য কোন ধারণাকে পুনরুদ্রেক করবে তা অনুষঙ্গ দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় না। যদিও হিউম স্মৃতি ও কল্পনা উভয়কে অনুষঙ্গ নীতির অধীনস্থ মনে করেন তবুও একথা সত্য যে, অনুষঙ্গ নীতির মাধ্যমে হিউম আমাদের চিন্তার ক্ষেত্রে কিছুটা স্বাধীনতা রক্ষা করতে চান।[৭৩] এন. কে. স্মিথ এ প্রসঙ্গে বলেন, অনুষঙ্গ হলো মাধ্যাকর্ষণের মতো ক্রিয়া করতে পারে এমন একটি শান্ত ও মৃদু শক্তি। তবে অনুষঙ্গ এই ক্রিয়া তখনই করতে পারে যখন পর্যাপ্ত পরিমাণ বিরুদ্ধ শক্তিসম্পন্ন কোনো কারণ উপস্থিত না থাকে। এই শক্তি তিনটি ভিন্ন নীতির মাধ্যমে ক্রিয়া করে। এসব নীতি কখনো স্বতন্ত্রভাবে আবার কখনো কখনো একে অপরের দ্বারা শক্তিশালী হয়।[৭৪]

হিউমের ধারণার অনুষঙ্গের আলোচনায় লক্ষণীয় বিষয় হলো, ধারণার মধ্যে কেন অনুষঙ্গ স্থাপিত হয় সে সম্পর্কে হিউম কিছু বলেননি। এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সি. আর. মরিস বলেন, অনুষঙ্গবদ্ধ ধারণাগুলোর নির্দিষ্ট গুণাবলির উপরই ধারণার অনুষঙ্গ নির্ভর করে বলে মনে হয়। কিন্তু হিউম কোথাও একথা বলেননি যে, ধারণার নির্দিষ্ট গুণাবলি মনের দ্বারা বোধগম্য হওয়ার উপরই অনুষঙ্গের সম্ভাবনা নির্ভর করে। হিউমের পরবর্তীকালে কান্ট একথা বলেন যে, কোনো এক সক্রিয় মনের অনুপস্থিতিতে ধারণাগুলোর মধ্যে অনুষঙ্গ স্থাপিত হতে পারে না। কিন্তু হিউম এমন কোনো ইঙ্গিত দেননি। এমনকি, কীভাবে তিনটি নীতিতে অনুষঙ্গ স্থাপিত হয় তা-ও হিউম ব্যাখ্যা করতে যাননি।

হিউমের সমালোচকদের মধ্যে সি. আর. মরিস এবং রবার্ট একারম্যানের ব্যাখ্যা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। মরিস-এর মতে, হিউম এ ব্যাপারে নীরব থাকার কারণ সম্ভবত এই যে, অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে হিউমের কাছে এ বিষয়টির অভিজ্ঞতাজাত কোনো প্রমাণ ছিল না।[৭৫] একারম্যানও এ ব্যাপারে একই মত পোষণ করেন। তাঁর মতে, হিউম অনুষঙ্গ নিয়মের কারণ ব্যাখ্যা করা থেকে বিরত থেকেছেন। আমাদের সামনে একাধিক ধারণার পারম্পর্য হলে তার মধ্যে যে অনুক্রম থাকে সে অনুক্রম এই তিন প্রকার প্রাকৃতিক সম্পর্কের যে কোনো একটির দ্বারা হতে পারে। আমাদের সামনে যে ধারণাটি উপস্থিত হয়েছে তার সাথে এর পরে যে ধারণাটি আবির্ভূত হবে সে ধারণাটি তিনটি সম্পর্কের কোনটি দ্বারা সম্পর্কিত হবে তা বলা সম্ভব নয়। তাই অনুষঙ্গ যৌক্তিকভাবে আবশ্যিক সম্পর্ক নয়। বরং তা প্রথা বা অভ্যাসের ফল। একারম্যানের মতে, হিউম এটা মনে করেছেন যে, দার্শনিকদের কাজ হলো এই সম্বন্ধকে পর্যবেক্ষণ ও বর্ণনা করা। কখন এগুলো ঘটে তা বৈধভাবে ব্যাখ্যা করা দার্শনিকদের কাজ নয়। কারণ, তা সম্ভব নয়। তাই হিউম অনুষঙ্গকে একটি পর্যবেক্ষণলব্ধ ঘটনা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, এবং কী কী বিশেষ নিয়মে অনুষঙ্গ ঘটে তা ব্যাখ্যা করেছেন। অনুষঙ্গের বৈধ কারণ ব্যাখ্যা না করায় হিউমের এই মতবাদকে পূর্ণাঙ্গ মতবাদ হিসেবে অভিহিত করার ক্ষেত্রে সন্দেহের অবকাশ থাকে। কিন্তু এটা ঠিক যে, অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে হিউম যৌক্তিকভাবে পর্যবেক্ষণের বাইরে পা বাড়াতে পারেন না। অনুষঙ্গ নিয়মের ক্ষেত্রেও তিনি এই নীতিকে সচেতনভাবে পালন করেছেন বলে মনে হয়।[৭৬] এ প্রসঙ্গে সি. আর. মরিসের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। তাঁর মতে, হিউমের এই ব্যাখ্যা পূর্ণাঙ্গ হোক বা না হোক এটা সত্য যে, শেষ পর্যন্ত তিনি পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিকে দৃঢ়ভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন।[৭৭]

আঠারো ও উনিশ শতকের ব্রিটিশ দর্শন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের উন্নতির প্রভাবে প্রভাবিত ছিল। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির প্রভাবেই ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকগণ জ্ঞানের জন্য পর্যবেক্ষণের বাইরে যেতে রাজি ছিলেন না। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বর্ণনামূলক। একটি ঘটনা কেন ঘটে তা ব্যাখ্যা করা নয়, বরং একটি ঘটনা কীভাবে ঘটে তা ব্যাখ্যা করা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রধান কাজ। হিউম অনুষঙ্গনীতি কীভাবে ঘটে কেবল তা-ই ব্যাখ্যা করেছেন। কেন ঘটে তা ব্যাখ্যা করেননি। সম্ভবত প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই এমনটি ঘটেছে।

রবার্ট একারম্যান হিউমের অনুষঙ্গ সম্পর্কে এরূপ মত পোষণ করেন। তাঁর মতে, হিউম নিউটনের মতো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে গ্রহণ করেছিলেন বলেই অনুষঙ্গের কারণ ব্যাখ্যা তাঁর কাছে অসম্ভব ছিল।[৭৮] সি. আর. মরিসও একারম্যানের সাথে একমত পোষণ করে বলেন, হিউম নিউটন প্রদত্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করছেন এবং পর্যবেক্ষণযোগ্যতার বাইরের কিছু সম্পর্কে কথা বলেননি।[৭৯] নিউটন কেন বস্তু পৃথিবীতে পড়ে তা ব্যাখ্যা করেননি, বরং কীভাবে পড়ে তা ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ তিনি নির্দিষ্ট অবস্থায় বস্তুর পতনের হার এবং দিক ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেছেন। এভাবে হিউমও কেন ধারণার অনুষঙ্গ স্থাপিত হয় তা ব্যাখ্যা না করে বরং কীভাবে স্থাপিত হয় তা ব্যাখ্যা করেছেন। একারম্যানের মতে, হিউমের জ্ঞান সম্পর্কিত মতবাদের আদি অব্যাখ্যাত শব্দ ‘অনুষঙ্গ’ নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ মতবাদের আদি অব্যাখ্যাত শব্দ ‘মাধ্যাকর্ষণ”-এর অনুরূপ। মাধ্যাকর্ষণ দ্বারা কীভাবে বস্তুর পতন হয় তা ব্যাখ্যাত হয়েছে। এদিকে, অনুষঙ্গ দ্বারা কীভাবে ধারণাগুলোর মধ্যে অনুষঙ্গ স্থাপিত হয় তা ব্যাখ্যাত হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই ‘কেন’ প্রশ্নটি গুরুত্ব পায়নি বরং ‘কীভাবে’ প্রশ্নটি গুরুত্ব পেয়েছে। একারম্যানের মন্তব্য হলো, হিউম ও নিউটনের গৃহীত দৃষ্টিভঙ্গি সাম্প্রতিককালের অভিজ্ঞতাবাদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পর্যবেক্ষণের উপর আস্থা স্থাপন করাই হলো এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি। এর ফলস্বরূপ সাধারণ অভিজ্ঞতা ও যথার্থ পরীক্ষণাত্মক পর্যবেক্ষণ যে কোনো প্রকার সার্বিকীকরণের উপায় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, এবং পর্যবেক্ষণলব্ধ নয় বলে অধিবিদ্যাও বর্জিত হয়েছে।[৮০] মরিসও এটা মনে করেন যে, ধারণার অনুষঙ্গ নীতিকে হিউম পদার্থবিদ্যার সার্বিক আকর্ষণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এর প্রকাশ যেমন বিভিন্নমুখী, এর কারণ ও ক্রিয়ার ধরন তেমনি অজ্ঞেয়। কেবল পর্যবেক্ষণ থেকেই এর অস্তিত্বের প্রমাণ নিতে হবে।[৮১]

এ প্রসঙ্গে হিউমের নিজস্ব বক্তব্য হলো, এসব সংযোগকারী বা সংযোগসূত্র সরল ধারণার মধ্যে সংযোগ ঘটায়। এসব যোগসূত্র এমন এক আকর্ষণ সৃষ্টি করে যা প্রাকৃতিক ও মানসিক উভয় জগতেই সমভাবে প্রভাবশালী। বিভিন্নরূপে এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। সর্বক্ষেত্রেই ক্রিয়াগুলো সুস্পষ্ট। কিন্তু এর কারণগুলো প্রায়ই অজ্ঞাত থাকে।[৮২] এই অজ্ঞাত কারণগুলোকে শেষ বিচারে মানব প্রকৃতির মৌলিক গুণ হিসেবে বিশ্লেষণ করতে হবে বলে হিউম মত প্রকাশ করেন।[৮৩] এর দ্বারা হিউম মানব মনের একটি বিজ্ঞান নির্মাণ করেছেন যার সাথে পদার্থ বিজ্ঞানের যথেষ্ট মিল দেখা যায়। এই বিজ্ঞান একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষককে মানব প্রকৃতির যথাযথ ক্রিয়াশীল নীতিকে শনাক্ত করতে পরিচালিত করে, যদিও এই নীতিটি কীভাবে কাজ করে তা সে বুঝতে পারে না। এসব বিশ্লেষণ থেকে প্রমাণিত হয় যে, হিউম অনুষঙ্গ নিয়মের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

জ্ঞানোৎপত্তির ক্ষেত্রে হিউমের তিনটি অনুষঙ্গ নিয়মের ভূমিকা কী—এ প্রশ্ন অত্যন্ত স্বাভাবিক। অনুষঙ্গ নিয়মগুলো ধারণার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে জ্ঞানের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে সন্দেহ নাই। কিন্তু প্রশ্ন হলো; এদের দ্বারা প্রসারিত জ্ঞানের ক্ষেত্র কতটুকু নির্ভরযোগ্য বা যথার্থ? এছাড়া, এ প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক আরেকটি প্রশ্ন হলো, ধারণার অনুষঙ্গ জ্ঞানের পরিধিকে বিস্তৃত করে যথার্থ জ্ঞান উৎপাদনে সক্ষম হলে হিউমের চরম অভিজ্ঞতাবাদী নীতির জন্য তা ক্ষতিকর কি না?

হিউমের Treatise গ্রন্থের প্রথম পুস্তকের দ্বিতীয় অধ্যায়ের চতুর্থ পরিচ্ছেদে প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যায়। এখানে হিউমের বক্তব্যের মূল কথা হলো, ধারণার অনুষঙ্গ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান নিশ্চিত নয়। তাঁর মতে, সাদৃশ্য, সান্নিধ্য ও কার্যকারণ নিয়ম তিনটি যখন ধারণাসমূহকে একত্রীকরণের জন্য কাজ করে তখন এরা ভ্রান্তি উৎপন্ন করতে পারে। মন ধারণাগুলোকে ভুল শনাক্ত করার মাধ্যমে যেখানে দুটো ধারণার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সেখানে একটার ক্ষেত্রে অন্যটিকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে। অনুষঙ্গ তিনটির মধ্যে তিনি সাদৃশ্যকে ভ্রান্তির সর্বাপেক্ষা উর্বর উৎস বলে অভিহিত করেন। তার মতে, চিন্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে যে সব ভ্রান্তি দেখা যায় এর বেশির ভাগই সাদৃশ্য নিয়মের কারণে ঘটে। কারণ, সাদৃশ্যমূলক ধারণাগুলো কেবল এদের পরস্পরকে সম্পর্কযুক্ত করে না, বরং মনের যে সব ক্রিয়া দ্বারা আমরা এগুলোকে বিবেচনা করি সে সব ক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য এতো কম যে, এদের একটি থেকে অন্যটিকে আলাদা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এজন্যই ভ্রান্তির উৎপত্তি হয়। এই ভ্রান্তি দূরীকরণের উপায় হিসেবে তিনি ধারণাগুলোর উৎপত্তি অনুসন্ধান করতে বলেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও তিনি তাঁর চরম অভিজ্ঞতাবাদী নীতিতে ফিরে গিয়ে যে ইন্দ্ৰিয়ছাপ থেকে ধারণাগুলোর উৎপত্তি হয়েছে সে ধারণাগুলোকে বিচার করে দেখতে বলেন। তাঁর মতে সাদৃশ্য, সান্নিধ্য ও কার্যকারণ এই তিনটি নিয়ম কী কারণে ঘটে সে সম্পর্কে পরীক্ষা না করে ধারণার একত্রীকরণের নিয়মাবলি হিসেবে গ্রহণ করলে শেষ পর্যন্ত অবশ্যই অভিজ্ঞতার আধেয়র উপর নির্ভর করতে হয়।

সুতরাং দেখা যায়, হিউমের অনুষঙ্গ নীতিগুলো সরল ধারণাবলির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে অভিজ্ঞতালব্ধ নয় এমন সব যৌগিক ধারণার জ্ঞান উৎপন্ন করে। এতে জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হয়। তবে, ধারণার অনুষঙ্গ ইন্দ্রিয়ছাপ নির্ভর নয় বলে এর দ্বারা বিস্তৃত জ্ঞানে ভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকে। হিউমের অভিজ্ঞতাবাদী সূত্র অনুসারে এর নিশ্চিতি পরীক্ষার জন্য এদের অনুরূপ ইন্দ্ৰিয়ছাপকে যাচাই করে দেখতে হয়। এভাবে ধারণার অনুষঙ্গ আলোচনার মাধ্যমে হিউম কল্পনার স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা এবং কল্পনার কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতাবাদী পৰ্যবেক্ষণলব্ধ সূত্রের নির্দেশ করেন। ফলে বুদ্ধিবাদীদের অভিজ্ঞতাপূর্ব সহজাত ধারণার অস্তিত্ব অস্বীকৃত হয় এবং অভিজ্ঞতাবাদের ভিত মজবুত হয়। হিউমের অনুষঙ্গ নীতির এই ব্যাখ্যায় দর্শনের উপর সতেরো শতকের প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের তথা নিউটনীয় বিজ্ঞানের প্রভাবও স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়।

ধারণার অনুষঙ্গ সম্পর্কিত উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে সংক্ষেপে বলা যায়, অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে সাদৃশ্য, দেশ কালের সান্নিধ্য ও কার্যকারণ—এই তিনটি সম্বন্ধ বা অনুষঙ্গ নিয়ম এ সব ধারণার কারণ। এ তিনটি সম্বন্ধের ফলে স্মৃতি ও কল্পনার মাধ্যমে আমরা অভিজ্ঞতাবহির্ভূত ধারণাগুলো পাই। হিউম স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, এসব সম্বন্ধ থেকে প্রাপ্ত ধারণা আবশ্যিকভাবে নিশ্চিত নয়, বরং এরাই সকল প্রকার ভ্রান্তির উৎস। এ সব ধারণার নিশ্চিতি পরীক্ষার জন্য তিনি এদের উৎসরূপে যে ইন্দ্রিয়ছাপ বর্তমান তার অনুসন্ধান করতে বলেছেন। হিউমের এ আলোচনা থেকে যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে নির্দেশিত হয়েছে সেগুলো হলো:

(১) অনুষঙ্গ নিয়ম অর্থাৎ সাদৃশ্য, সান্নিধ্য ও কার্যকারণই অভিজ্ঞতা-ঊর্ধ্ব সকল প্রকার ধারণা এবং ভ্রান্ত জ্ঞানের উৎস। এতে তাঁর মতবাদে ভ্রান্ত জ্ঞানের ব্যাখ্যা সংযোজিত হয়েছে।

(২) স্মৃতি ও কল্পনা দ্বারা আবশ্যিকভাবে যথার্থ জ্ঞান পাওয়া যায় না, বরং এগুলো ভ্রমাত্মক জ্ঞানের কারণরূপে কাজ করে, এই তথ্য নির্দেশিত হওয়ার সাথে সাথে স্মৃতি ও কল্পনার ক্ষমতা বা সীমাও নির্দেশিত হয়েছে। সাধারণত কল্পনাকে অবাধ মনে করা হলেও আসলে কল্পনা ও স্মৃতি উভয়েরই সীমা ইন্দ্রিয়ছাপের সীমা দ্বারা নির্ধারিত হয়।

(৩) সর্বোপরি, যথার্থ জ্ঞানের ক্ষেত্রে সকল প্রকার অভিজ্ঞতাপূর্ব ধারণার প্রভাব অস্বীকৃত হয়ে একমাত্র ইন্দ্রিয়ছাপই যে যথার্থ এবং অভ্রান্ত জ্ঞানের উৎস তা দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

(৪) এ তিনটি বিষয় স্পষ্টভাবে নির্দেশিত হওয়ায় জ্ঞানোৎপত্তির ক্ষেত্রে বুদ্ধিবাদীদের সহজাত ধারণার গুরুত্বের দাবি খণ্ডিত হয়। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান প্রভাবিত পদ্ধতি তথা অভিজ্ঞতাবাদী পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির গুরুত্ব স্বীকৃত হয়। পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি হিউমের ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা সম্পর্কিত মতবাদকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে সাহায্য করেছে।

হিউম-পূর্ব ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী জন লক ও জর্জ বার্কলে অভিজ্ঞতাবাদকে সমর্থন করা সত্ত্বেও তাঁদের মতবাদের পরিপূরক হিসেবে আত্মা বা দ্রব্যের ধারণাকে স্বীকার করেন। হিউম তাঁর ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণার অভিজ্ঞতাবাদী মানদণ্ডে সকল প্রকার দ্রব্য তথা শাশ্বত আত্মার ধারণা খণ্ডন করে ব্যক্তি অভিন্নতাকে ধারণার অনুষঙ্গ দ্বারা ব্যাখ্যা দেন এবং একে আরোপিত মানসিক প্রবণতাজাত ভ্রান্তি হিসেবে প্রতিপন্ন করেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, অভিজ্ঞতাবাদের পরিপূরক হিসেবে দ্রব্য বা আত্মার ধারণা স্বীকার করার প্রয়োজন নেই। এখানেই লক ও বার্কলের অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদ থেকে হিউমের অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদের পার্থক্য ও অভিনবত্ব। তাই শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব খণ্ডন সম্পর্কিত আলোচনা হিউমের জ্ঞানবিদ্যার অপরিহার্য এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে পড়ে। এটিই আমাদের পরবর্তী অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়।

শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব খণ্ডন

পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, হিউম ইন্দ্রিয়ছাপকেই জ্ঞানের একমাত্র উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করে অভিজ্ঞতায় পাওয়া যায় না এমন সব ধারণাকে অনুষঙ্গ নিয়মের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন। এসব ধারণাকে তিনি ভ্রান্ত বলেও আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর এই পদক্ষেপ অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত অবস্থানের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান।

আধুনিক ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী জন লক দেকার্তের সহজাত ধারণাকে খণ্ডন করেন এবং মনকে সাদা কাগজের সাথে তুলনা করে অভিজ্ঞতাবাদের গোড়াপত্তন করেন। কিন্তু তিনি তাঁর বৈজ্ঞানিক বা প্রতীকী বাস্তববাদী তত্ত্ববিদ্যাকে অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে গিয়ে জড় ও অধ্যাত্ম দ্রব্যের অস্তিত্বকে স্বীকার করেন। কারণ, সংবেদন ও অন্তর্দর্শনের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞেয় বস্তুর মুখ্য ও গৌণ গুণের আধার হিসেবে দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করা তাঁর জন্য আবশ্যিক হয়ে পড়ে। বার্কলে লকের দ্বারা সমর্থিত বাস্তববাদকে অস্বীকার করে ভাববাদকে স্বীকৃতি দেওয়ায় তাঁর ক্ষেত্রে জড়দ্রব্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করা সম্ভব হয়। তবে তাঁর অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদকে আত্মকেন্দ্রিকতার হাত থেকে মুক্তি দিতে গিয়ে তিনি মানসিক দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। · অর্থাৎ লক ও বার্কলে তাঁদের জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদ ব্যাখ্যার পরিপূরক হিসেবেই শাশ্বত আত্মা বা দ্রব্যের অস্তিত্বকে স্বীকার করেন। কিন্তু হিউম এক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে, অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ ব্যাখ্যার জন্য প্রচলিত দ্রব্য বা শাশ্বত আত্মার অস্তিত্বের স্বীকৃতি অনিবার্য নয়। বরং একে খণ্ডন করে এর অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যা দেওয়াই সঙ্গত। মূলত এ বিষয়টি লক ও বার্কলের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। তাই তাঁদের অভিজ্ঞতাবাদে অসঙ্গতি সম্পাদিত হয়েছে। এ কারণেই হিউম প্রচলিত শাশ্বত আত্মার ধারণাকে খণ্ডন করতে এবং আত্মা সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যা দিতে প্রয়াসী হন।

হিউম তাঁর আত্মা সম্পর্কিত মতবাদ দিতে গিয়ে প্রথমে তথাকথিত দ্রব্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করে আত্মা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে খণ্ডন করেন। তাঁর এই প্রয়াসকে তাঁর মতবাদের নঞর্থক দিক বলা হয়। আত্মা সম্পর্কিত প্রচলিত মতকে অসার প্রতিপন্ন করার পর তিনি আত্মার অবিনশ্বরতা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মত প্রদান করেন। এই অংশকে তাঁর মতবাদের সদর্থক দিক বলা হয়।

হিউম আত্মা সম্পর্কিত প্রচলিত মতকে খণ্ডন করতে গিয়ে প্রথম দ্রব্যের অস্তিত্ব খণ্ডন করেন। কারণ, প্রচলিত মত অনুযায়ী আত্মা হলো একটি আধ্যাত্মিক দ্রব্য। লক মুখ্য ও গৌণ গুণের আধার হিসেবে অজ্ঞেয় একটি দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু হিউম বার্কলের সাথে একমত হয়ে জড় দ্রব্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। এছাড়া তিনি বার্কলের স্বীকৃত অধ্যাত্ম দ্রব্যের অস্তিত্বও অস্বীকার করেন। আমরা পূর্বেই দেখেছি, চরম অভিজ্ঞতাবাদী হিউমের কাছে আমাদের মনের ধারণাগুলোর উৎপত্তি সম্পর্কিত সূত্র হলো, কোনো বস্তুর এমন কোনো গুণের ধারণা আমাদের নেই যা কোনো ইন্দ্রিয়ছাপের কোনো গুণকে প্রতিকৃত করে না, বা তার মতো নয়। এর কারণ হলো, আমাদের সব ধারণাই ইন্দ্ৰিয়ছাপ থেকে গৃহীত। তাই, দ্রব্যের প্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁর মতো হলো, দ্রব্য কতগুলো সরল ধারণার সমষ্টি ব্যতীত আর কিছুই নয়। এসব সরল ধারণা কল্পনার সাহায্যে একত্রিত হয়। নিজেদের এবং অন্যদের স্মরণ রাখার সুবিধার জন্য ঐ সব সমষ্টির বিশেষ নাম দেওয়া হয়ে থাকে।[৮৪]

লক মুখ্য ও গৌণ গুণের অজ্ঞাত আধারকে স্বীকার করেন। বার্কলে সে আধারকে অস্বীকার করে বলেন, অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ নির্ভর। তবে বিপদমুক্ত হওয়ার জন্য তিনি ঈশ্বরের প্রত্যক্ষণকে স্বীকার করে নেন। কিন্তু হিউম এই মতকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যান। লক ধারণা ও দ্রব্যকে পৃথক করেন এবং প্রত্যক্ষণ বা ধারণার অধিষ্ঠানকেই দ্রব্য হিসেবে অভিহিত করেন। হিউমও একথা স্বীকার করেন যে, প্রত্যক্ষণ ও দ্রব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং প্রত্যক্ষণের অস্তিত্বকে ধারণ করার জন্য অন্য কিছুর মাঝে এর অধিষ্ঠান করা আবশ্যক বলে মনে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এমন কোনো দ্রব্যকে স্বীকার করতে নারাজ। তাঁর মতে, অধিষ্ঠান সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। তাই দ্রব্য সম্পর্কেও আমাদের কোনো ধারণা থাকার কথা নয়।

ধর্মতাত্ত্বিকগণ প্রত্যক্ষণের অবস্তুগত বা আত্মিক আধারকে স্বীকার করেন। কিন্তু হিউম প্রত্যক্ষণের বস্তুগত ও অবস্তুগত উভয় প্রকার আধারকে অস্বীকার করেন। ধর্মতাত্ত্বিকদের মতে, বস্তু বিস্তৃতিসম্পন্ন। একে বিভক্ত করা যায়। কিন্তু চিন্তা বা প্রত্যক্ষণের বিস্তৃতি নাই। তাই এদেরকে বিভক্ত করা যায় না। হিউমের মতে, যদি এ যুক্তি যথার্থ হয় তবে প্রত্যক্ষণ কোনো বস্তুগত আধারে অধিষ্ঠিত থাকতে পারে না। এমনকি তার সঙ্গে সংযুক্তও থাকতে পারে না। কারণ, চিন্তা ও বিস্তৃতি সম্পূর্ণ বিরূদ্ধ প্রকৃতির গুণ এবং এগুলো কখনো একটি বিষয়ের মধ্যে একত্রে সম্মিলিত অবস্থায় থাকতে পারে না।

প্রত্যক্ষণের অবস্তুগত অধিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাঁর যুক্তি হলো, ব্যাপ্ত ও বিভাজ্য প্রত্যক্ষণ কোনো বিপরীতধর্মী সরল অবিভাজ্য আধ্যাত্ম দ্রব্যে বা আত্মায় অধিষ্ঠান করতে পারে না। প্রত্যক্ষণ বিভাজ্যতা ও ব্যাপ্তির সঙ্গে জড়িত। সুতরাং এগুলো বিভাজ্য ও ব্যাপ্ত। তাই ব্যাপ্ত ও বিভাজ্য প্রত্যক্ষণ অবিভাজ্য অবস্তুগত অধিষ্ঠানে অবস্থান করতে পারে না।

আধুনিক দর্শনের ইতিহাসে স্পিনোজা দ্রব্য সম্পর্কিত আলোড়ন সৃষ্টিকারী মতের প্রবক্তা হলেও হিউম স্পিনোজার দ্রব্য সম্পর্কিত ধারণাকে খণ্ডন করেন। স্পিনোজার মতে, জগতের মাঝে মাত্র একটি দ্রব্যই রয়েছে এবং এই দ্রব্যটি সম্পূর্ণ সরল, অযৌগিক অবিভাজ্য। হিউম- এর মতে, স্পিনোজার এই মতের সাথে ধর্মতাত্ত্বিকদের মতের অভিন্নতা আছে। তাই হিউম এখানেও অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর যুক্তি প্রয়োগ করেন। তিনি সকল ধারণাকেই ইন্দ্রিয়ছাপের প্রতিরূপ হিসেবে মূল্যায়িত করেন। তাই বাহ্য যা কিছুকে আমরা সংবেদন দ্বারা আবিষ্কার করি এবং অভ্যন্তরীণ যা কিছুকে চিন্তা দ্বারা অনুভব করি হিউম তাঁদের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পান না। এগুলো সবই, তাঁর মতে, একটি বস্তুকে প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে বা ইন্দ্ৰিয়ছাপ ও ধারণার মাধ্যমে প্রাপ্ত গুণ। হিউম এভাবে প্রত্যক্ষণের আধাররূপ দ্রব্যের তথাকথিত অস্তিত্ব অস্বীকার করে শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকারের ভিত্তি নির্মাণ করেন। তিনি বলেন :

দেখা যাচ্ছে যে, ধারণাসমূহের আদি উৎপত্তি বিবেচনা করে কিংবা কোনো সংজ্ঞার সাহায্য নিয়ে আমরা দ্রব্যের সন্তোষজনক কোনো ধারণায় পৌঁছাতে পারি না। আমার মনে হয়, আত্মার অবস্তুত্ব কিংবা বস্তুত্ব সম্পর্কে বিতর্ক সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করার সপক্ষে এটি একটি শক্তিশালী যুক্তি। এজন্য এই প্রশ্নটিই আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়।[৮৫]

তাঁর মতে, স্থায়ী বা অপরিবর্তনশীল মন বা আত্মা বলতে যাকে বুঝানো হয় তা আসলে ক্ষণস্থায়ী ইন্দ্রিয়ছাপ ও অনুভূতি ছাড়া আর কিছু নয়। এগুলোকে সাদৃশ্য ও কার্যকারণ নিয়মের মাধ্যমে একত্রিত করা হয় এবং স্থির ও অপরিবর্তনশীল মনে করা হয়। এ ধরনের কাল্পনিক একত্রীকরণের মাধ্যমে মূলত ধারণাগুলোর মধ্যেই মানসিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। যথার্থ ইন্দ্ৰিয়ছাপগুলোর মধ্যে কোনো সম্পর্ক স্থাপিত হয় না। হিউম আত্মাকে অস্বীকার করার পক্ষে যে সব যুক্তি দাঁড় করান সেগুলোকে নিম্নরূপে সাজানো যায়:

ক) প্রত্যক্ষণের বাইরে কোনো ধারণার অস্তিত্ব নেই,

খ) কোনো স্থায়ী ইন্দ্ৰিয়ছাপ নেই,

গ) প্রত্যক্ষণগুলো পরস্পর সংযুক্ত নয়,

ঘ) প্রত্যক্ষণগুলোর কোনো ক্রমিক স্থায়িত্ব নেই,

ঙ) প্রত্যক্ষণগুলোর কোনো অধিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই, এবং

চ) প্রত্যক্ষণগুলোর বাইরে কোনো আত্মার অস্তিত্ব নেই।

ক) হিউম ইন্দ্ৰিয়ছাপ ও ধারণা মতবাদ অনুসারে বলেন যে, প্রত্যেক বাস্তব ধারণাই কোনো না কোনো ইন্দ্ৰিয়ছাপ থেকে উৎপন্ন হয়। কিন্তু আত্মা বা ব্যক্তি কোনো বিশেষ ইন্দ্ৰিয়ছাপ নয়।[৮৬] তাই প্রত্যক্ষণের বাইরে কোনো আত্মার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এরকম কোনো আত্মা থাকলে তার ধারণা ইন্দ্রিয়ছাপের মাধ্যমে পাওয়া যেত।

খ) ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা মতবাদ অনুযায়ী আত্মার কোনো ধারণা থাকলে তা অবশ্যই অনুরূপ ইন্দ্রিয়ছাপের প্রতিকৃতি। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী আত্মা অপরিবর্তনীয় ও স্থির। কিন্তু হিউমের মতে, এমন কোনো ইন্দ্ৰিয়ছাপ নাই যা অপরিবর্তনীয় ও স্থির। তাই এমন কোনো ধারণাও থাকতে পারে না। তাঁর মতে, আত্মার মধ্যে এমন কোনো শক্তি নেই যা অন্তত এক মুহূর্তের জন্যও অপরিবর্তিত থাকে।[৮৭] তিনি সময়ের সাথে অভিন্ন কোনো অপরিবর্তনশীল আত্মার অস্তিত্বকে অসম্ভব বলে মনে করেন। কারণ, সময় নিজেই পরিবর্তনশীল। সি. ডি. ব্রড হিউমের এই মতের সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, কোনো অপরিবর্তনশীল বা অবিচল আত্মার ধারণা ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে আসতে পারে না। যদি আত্মাকে “আমাদের গোটা জীবন ধরে” অবস্থান করতে হয় তবে, বিশুদ্ধ আত্মা অন্তর্দর্শী অবস্থায় বস্তুনিষ্ঠ অবিচলতা বজায় রাখতে পারে না। কারণ, একটি অন্তদর্শী অবস্থার সময়কাল শুধুমাত্র কটি সেকেন্ড বা মিনিট।[৮৮] অবশ্য ঐ বিশেষ মুহূর্তের জন্য আমরা আত্মাকে সরাসরি জানি এবং এ থেকেই স্থায়ী আত্মার অস্তিত্বের অনুমান করি। কিন্তু, হিউম এরকম ধারণাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন।

গ) হিউমের মতে, যে সব ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যক্ষণ নিয়ে মন গঠিত হয়, সেগুলো প্রত্যেকটিই ভিন্ন ভিন্ন সত্তা এবং প্রত্যেকটিই অন্য যে কোনো সমসাময়িক বা ক্রমিক প্রত্যক্ষণ থেকে ভিন্ন ও প্রভেদনীয়। বুদ্ধি কখনোই বস্তুগুলোর মধ্যে কোনো বাস্তব বন্ধন লক্ষ করে না। হিউম এখানে ‘বাস্তব বন্ধন’ কথাটির দ্বারা আবশ্যিকতাকেই বুঝিয়েছেন।

ঘ) আত্মার প্রচলিত ধারণা অনুসারে সংবেদনগুলোর ধারক হিসেবে এক অপরিবর্তিত মনের অস্তিত্ব কল্পনা করা হয়, এবং সংবেদনগুলোর মধ্যে সারল্য ও অভিন্নতার ধারণা করা হয়। কিন্তু হিউম প্রত্যক্ষণগুলোর ক্রমিক স্থায়িত্বকে অস্বীকার করেন। তাঁর মতে:

মন হলো এক ধরনের রঙ্গমঞ্চ। সেখানে বহু প্রত্যক্ষণ ক্রমান্বয়ে আবির্ভূত হয়, ধীরে ধীরে চলে যায় এবং অসংখ্য ভঙ্গিমায় মিশ্রিত হয়। এর মধ্যে কোনো একটি সময়ে যথার্থ কোনো সারল্য নেই এবং বিভিন্ন সময়ের মধ্যে কোনো অভিন্নতাও বজায় থাকে না।[৮৯]

তাঁর মতে, আমরা যে সারল্য ও অভিন্নতার কথা কল্পনা করি তা প্রবণতাজাত। রঙ্গমঞ্চের ব্যবহার করায় মনকে যাতে স্থায়ী মনে করে ভুল না করা হয় এজন্য তিনি সাবধান করে দিয়েছেন।

ঙ) হিউম দ্রব্যের কার্তেসীয় সংজ্ঞা অনুসারে একথা বলেন যে, কার্তেসীয় দ্রব্যের সংজ্ঞাকে মেনে নিলে আমাদের প্রত্যক্ষণগুলো নিজেরাই দ্রব্য। প্রত্যক্ষণের জন্য কোনো অধিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই। তিনি দুটি সূত্রের সাহায্যে প্রত্যক্ষণকে দ্রব্যরূপে প্রমাণ করেন। তাঁর মতে, আমাদের প্রত্যক্ষণগুলো পরস্পর হতে ভিন্ন এবং জগতের অন্য সব কিছু হতে ভিন্ন। তাই সেগুলোও ভিন্ন ও প্রভেদীয়। এগুলোকে পৃথকভাবে অস্তিত্বশীল বলে বিবেচনা করা যায়। তারা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে অবস্থান করতে পারে। তাদের অস্তিত্বকে বজায় রাখার জন্য অন্য কিছুর প্রয়োজনও হয় না। এই সংজ্ঞানুসারে সেগুলো হচ্ছে দ্রব্য।[৯১] সুতরাং এদের অধিষ্ঠান হিসেবে অন্য কোনো দ্রব্যের অস্তিত্ব নিষ্প্রয়োজন।

চ) কোনো কোনো দার্শনিক আমিত্বকে স্থায়ী, অবিনশ্বর বলেছেন। কিন্তু হিউম ‘আমিত্ব’ বলতে ক্রমিক প্রত্যক্ষণগুলোকেই বুঝান। তিনি স্পষ্ট বলেছেন :

আমি কোনো প্রত্যক্ষণ ছাড়া ‘আমি’কে ধরতে পারি না।…যখন আমার প্রত্যক্ষণগুলোকে কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে নেওয়া হয়, যেমন নিদ্রায়, তখন আমি আমার সম্পর্কে অচেতন থাকি। যথার্থভাবেই বলা যায়, আমি তখন আর অস্তিত্বশীল থাকি না।[৯২]

তাঁর মতে, ভৌত বস্তুর ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। সেখানেও আমরা শুধু কতগুলো প্রত্যক্ষণকেই খুঁজে পাই।

এভাবে হিউম প্রমাণ করতে প্রয়াসী হন যে, বাহ্যিক ও অন্তদর্শনগত—উভয় দিক থেকে বিচার করে প্রত্যক্ষণের বাইরে আর কোনোকিছু সম্বন্ধে তিনি সচেতন হতে পারছেন না। অন্যদিকে, প্রত্যক্ষণের জন্য কোনো আধারও নিষ্প্রয়োজন। তারা নিজেরাই দ্রব্য। সুতরাং প্রত্যক্ষণের বাইরে আর কোনো অপরিবর্তনশীল আমিত্ব বা আত্মার ধারণা থাকে না। আত্মা সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাকে বিশ্লেষণমূলক যুক্তিতে খণ্ডন করার পর হিউম এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে বলেন, তাহলে সর্বমোট আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো, আত্মিক দ্রব্য (sub- stance of soul) সম্পর্কিত প্রশ্নটি সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য।[৯৩]

আত্মার অস্তিত্বকে খণ্ডন করার পর হিউম অভিজ্ঞতাবাদী অর্থে আত্মার ব্যাখ্যা দেন। এই ব্যাখ্যা তাঁর মতবাদের গঠনমূলক দিক। হিউম প্রত্যক্ষণের বাইরে অন্য কিছুকে স্বীকার করতে নারাজ। তাই তাঁর মতে, আত্মা প্রত্যক্ষণের সমষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়। এ সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত উক্তি :

আমি আমার আমিত্ব বলতে যা বুঝাই তার মধ্যে যখন অত্যন্ত নিবিড়ভাবে প্রবেশ করি, তখন আমি কোনো না কোনো বিশেষ প্রত্যক্ষণের উপর, গরম বা ঠাণ্ডার উপর, আলো বা ছায়ার উপর ভালোবাসা বা ঘৃণার উপর, বেদনা বা আনন্দের উপর হোঁচট খাই।[৯৪] তিনি মানব মন বা আত্মাকে প্রত্যক্ষণের সমষ্টি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন:

মানবজাতি সম্পর্কে বলতে পারি যে, তাঁরা বিভিন্ন প্রত্যক্ষণের সমষ্টি ছাড়া আর কিছুই নয় এসব প্রত্যক্ষণ ধারণাতীত দ্রুততার সাথে পরস্পরকে অনুসরণ করে। এগুলো সব সময়ই পরিবর্তিত হতে থাকে। সব সময়ই এরা গতিশীল।[৯৫]

হিউমের উক্তি থেকে আত্মা সম্পর্কে তাঁর আলোচনার গঠনমূলক দিক নিয়ে তিনটি সূত্র পাওয়া যায়। সেগুলো হলো :

ক) মন বা আত্মা বিভিন্ন স্বতন্ত্র প্রত্যক্ষণের সমষ্টি বা পুঞ্জ ছাড়া আর কিছুই নয়।

খ) এসব প্রত্যক্ষণ ধারণাতীত দ্রুততার সঙ্গে পরস্পরকে অনুসরণ করে।

গ) প্রত্যক্ষণগুলো সব সময়ই পরিবর্তিত হতে থাকে এবং এরা গতিশীল। এ কারণেই হিউমের আত্মা সম্পর্কিত মতবাদকে পুঞ্জবাদ (Bundle Theory), আত্মার ধারাবাহিকতাবাদ (Serial Theory), আত্মার অনুষঙ্গবাদ ( Association Theory), যৌক্তিক গঠনবাদ (Logical Construction Theory) ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। হিউমের আত্মা সম্পর্কিত মতের সাথে জে. এস. মিল প্রমুখের মতের মিল পাওয়া যায়। বার্ট্রান্ড রাসেলও মন কী, এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, এটা অতি স্পষ্ট যে, মন অবশ্যই মানসিক ঘটনার সমষ্টি বা পুঞ্জ।[৯৬] আবার অন্যত্র তিনি বলেছেন, একজন ব্যক্তি হলো অভিজ্ঞতার একটি নির্দিষ্ট অনুক্রম।[৯৭]

প্রশ্ন হলো, শাশ্বত আত্মা বলতে যদি কিছু না থাকে এবং মন যদি বিচ্ছিন্ন প্রত্যক্ষণের সমষ্টিমাত্র হয় তবে হিউম ব্যক্তি অভিন্নতাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? ব্যক্তির অভিন্নতা তাহলে কী? এর উত্তরে হিউম ব্যক্তি অভিন্নতাকে একপ্রকার আরোপিত মানসিক প্রবণতাজাত ভ্রান্তি হিসেবে পরিগণিত করেন। তাঁর মতে, অনুষঙ্গ নিয়মের দ্বারাই বিচ্ছিন্ন প্রত্যক্ষণগুলো সংযোজিত হয় এবং ব্যক্তি অভিন্নতা নামক ভ্রান্তি প্রতিপাদিত হয়। এই ভ্রান্তিটি, সম্পূর্ণরূপে মনস্তাত্ত্বিক কারণে ঘটে থাকে।

হিউম ব্যক্তি অভিন্নতা এবং বস্তুগত বা উদ্ভিদ ও জীবজন্তুর অভিন্নতাকে অভিন্ন মনে করেন। তাঁর মতে, এই সবগুলো থেকেই আমরা একই ধরনের ভ্রান্তি সম্পাদন করি। অভিন্নতার সংজ্ঞা দিয়ে তিনি বলেন, লক্ষিত বস্তু সম্পর্কে আমাদের একটা স্পষ্ট ধারণা রয়েছে যা সময়ের কোনো অনুমিত পরিবর্তনের মাঝেও অপরিবর্তিত ও অব্যাহত থাকে। এই ধারণাকে অভিন্নতা বা অনুরূপতা বলে থাকি।

এই অভিন্নতার কারণ সম্বন্ধে তাঁর ব্যাখ্যা হলো, আমাদের প্রতিটি প্রত্যক্ষণ পর্যায়ক্রমে আনুক্রমিকভাবে আমাদের মনে উদিত হয়। যদিও প্রতিটি প্রত্যক্ষণ আলাদা তবুও এদের পারম্পর্য বা ক্রমের মধ্যে যে ফাঁক থাকে তা আমরা লক্ষ করি না। উপরন্তু এর উপর অভিন্নতা ও বিরামহীন অস্তিত্ব আরোপ করি।[১৯৮]

আনুক্রমিক প্রত্যক্ষণগুলোর উপর মনের এই বিরামহীনতা আরোপের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা এরকম তখনই হয় যখন তারা সাদৃশ্য, সংলগ্নতা অথবা কার্যকারণের সম্বন্ধ দ্বারা সংযুক্ত অংশগুলোর পারম্পর্য দিয়ে গঠিত হয়। তিনি বলেন :

সুতরাং সাদৃশ্য, সংলগ্নতা ও কার্যকারণ—এই তিনটি সম্বন্ধের কোনো না কোনোটির উপর অভিন্নতা নির্ভর করে। এবং…উপরোক্ত সূত্রগুলো অনুসারে সংযুক্ত সম্বন্ধসমূহের মধ্যে দিয়ে চিন্তার সাবলীল ও অব্যাহত গতি থেকেই ব্যক্তির অভিন্নতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা জন্মে।[৯৯]

এই তিনটি অনুষঙ্গ নিয়ম দ্বারা সম্বন্ধযুক্ত প্রত্যক্ষণগুলোর ধারণা এবং অভিন্নতার ধারণা যদিও পরস্পর থেকে পৃথক তবুও আমরা আমাদের সাধারণ চিন্তার ক্ষেত্রে এদের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলি। এজন্যই বস্তুগুলোর মধ্যে সম্বন্ধের ধারণার পরিবর্তে আমরা অভিন্নতার ধারণা করে বসি। বেরি স্ট্রাউড হিউমের এই মতকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। তাঁর মতে, এটা হিউমের একটা আবিষ্কার। বস্তুগুলোর ক্ষেত্রে যখন আমরা এদের সত্তাকে অবিরাম অভিন্নতা বলে মনে করি তখন তা আসলে সাদৃশ্য, সংলগ্নতা ও কার্যকারণের দ্বারা সংযুক্ত অংশগুলোর পারম্পর্য ছাড়া আর কিছু নয়।[১০০]

এই প্রসঙ্গে এন. কে. স্মিথের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, হিউমের আত্মার ধারণাকে বুঝতে হলে একমাত্র প্রত্যক্ষণগুলোর মধ্যকার সম্বন্ধ দিয়েই বুঝতে হবে। তিনি বলেন, আত্মা একমাত্র সম্বন্ধের ধারণার মাধ্যমেই তার নিজস্ব ভিন্নতা ও জটিলতার মধ্যে বোধগম্য হয়। আর তাই, স্মিথের মতে, হিউমের বিবাদ হলো তাদের সাথে, যারা আত্মার ভিন্ন ভিন্ন নিয়মে পরিবর্তনশীল জটিল চরিত্রকে অভিন্নতা শব্দটির দ্বারা ব্যাখ্যা করতে চান।[১০১]

সুতরাং দেখা যায়, হিউমের ব্যাখ্যানুসারে অভিন্নতা ব্যক্তি, বস্তু, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু যারই হোক না কেন, সকল ক্ষেত্রেই একটা আরোপিত মানসিক প্রবণতামাত্র। ব্যক্তি অভিন্নতার ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি প্রত্যক্ষণই অন্তত কালিক দিক থেকে পরস্পর থেকে আলাদা। এই আলাদা প্রত্যক্ষণগুলো সাদৃশ্য, সান্নিধ্য বা কার্যকারণ—এদের যে কোনো একটি সম্বন্ধ দ্বারা একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কিত হওয়ার দাবি করতে পারে। কিন্তু এখানে অভিন্নতার দাবি কল্পিত। তাই হিউম বলেছেন, অভিন্নতাকে আমরা মানুষের মনের ক্ষেত্রে যেভাবে ব্যাখ্যা করি আসলে তা কল্পিত। এ প্রসঙ্গে জন লেয়ার্ড-এর বক্তব্য স্মরণযোগ্য। তিনিও অভিন্নতাকে একটি কল্পিত বিষয় বলে মনে করেন। তিনি প্রশ্ন করেন, অভিন্নতা কি এমন কিছু যা সত্যিকার অর্থে আমাদের বিভিন্ন প্রত্যক্ষণকে একত্রিত করে, নাকি শুধুমাত্র কল্পনায় তাদের ধারণার মধ্যে অনুষঙ্গ স্থাপন করে? এ প্রশ্নের উত্তর হিসেবে তিনি শেষোক্তটিকেই গ্রহণ করেন। লেয়ার্ড বলেন, ব্যক্তি অভিন্নতা চেতনা থেকে উদ্ভূত হয় এবং চেতনা প্রত্যক্ষণের একটি প্রতিফলিত চিন্তা ছাড়া আর কিছুই নয়।[১০২]

সুতরাং এককথায় বলা যায়, বিভিন্ন প্রত্যক্ষণের মধ্যে সহজ সম্বন্ধের ধারণাগুলো যে সহজ সংক্রমণ ঘটায় তা থেকেই অভিন্নতার সৃষ্টি হয়। তাই, এটা এক প্রকার আরোপিত মানসিক প্রবণতাজাত ভ্ৰান্তিমাত্র। এটা ভ্রমাত্মক ও কল্পিত। ব্যক্তি অভিন্নতার এই আলোচনা থেকে হিউম যে সিদ্ধান্ত নেন তা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ব্যক্তি অভিন্নতা সম্পর্কিত প্রশ্নটিকে দার্শনিক সমস্যা না বলে ব্যাকরণিক সমস্যা, অর্থাৎ বাচনিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করতে আগ্রহী। তিনি বলেন :

এই গোটা মতবাদটি আমাদেরকে এমন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয় যা বর্তমান বিষয়টির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সিদ্ধান্তটি হচ্ছে, ব্যক্তির অভিন্নতাসম্পর্কিত সুন্দর ও সূক্ষ্ম প্রশ্নগুলোকে সম্ভবত কখনো মীমাংসা করা যাবে না, এবং এগুলোকে দার্শনিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা না করে বরং ব্যাকরণিক (grammatical) সমস্যারূপে বিবেচনা করা উচিত। অভিন্নতার ধারণা সম্বন্ধসমূহের ওপর নির্ভরশীল। এই সম্বন্ধগুলো যে সহজ সংক্রমণ ঘটায় তা দিয়ে তারা অভিন্নতা সৃষ্টি করে। কিন্তু সম্বন্ধগুলো এবং সংক্রমণের সাবলীলতা ক্রমে ক্রমে অনুভবহীন মাত্রায় হ্রাস পেতে থাকতে পারে। তাই কখন যে তারা অভিন্ন নাম ধারণ করার অধিকার লাভ করে, আর কখন যে সে অধিকার হারায়, সে সম্পর্কে বিবাদ মীমাংসা করার যথার্থ মানদণ্ড আমাদের কাছে নাই। সংশয়গুলোর সম্বন্ধ থেকে যে কল্পিত যোগসূত্র উৎপন্ন হয়…তা বাদ দিলে সংযুক্ত বস্তুগুলোর অভিন্নতা সম্পর্কে সব বিবাদই বাচনিক (varbal) মাত্র।[১০৩]

এখন প্রশ্ন হলো, যদি সাদৃশ্য, সংলগ্নতা অথবা কার্যকারণ এ সম্বন্ধ তিনটির কারণে অভিন্নতা সম্পর্কিত ভ্রান্তিটি সম্পাদিত হয়, তবে কোনো স্থায়ী আত্মা না থাকলে এ সম্বন্ধগুলো পর্যবেক্ষণ বা ধারণ করবে কে? এর উত্তরে হিউম স্মৃতিকে এই সম্বন্ধগুলোর কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। স্মৃতি পূর্ববর্তী ধারণাকে আমাদের মনে সংরক্ষণ করে বলেই আমরা পরবর্তী ধারণার সঙ্গে এই সম্বন্ধ আবিষ্কার করতে পারি। সুতরাং দেখা যায়, অভিন্নতার ভিত্তি হিসেবে যে সম্বন্ধের ধারণাগুলো কাজ করে সেগুলো স্মৃতির উপর নির্ভরশীল। তাই হিউম বলেন, প্রধানত এ কারণেই স্মৃতিকে ব্যক্তি অভিন্নতার উৎসরূপে বিবেচনা করতে হবে। আমাদের যদি স্মৃতি না থাকতো, তাহলে কার্যকারণ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা থাকতো না। ফলে কারণ ও ক্রিয়াগুলোর যে শৃঙ্খল দিয়ে আমাদের আত্মা বা ব্যক্তিরূপ গঠিত হয় সে সম্পর্কেও আমাদের ধারণা থাকতো না।[১০৪] হিউম যেভাবে স্মৃতিকে অভিন্নতার কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, আত্মা সম্পর্কিত পুঞ্জ মতবাদে সর্বত্রই তা দেখা যায়। যেমন, এইচ. পি. গ্রিস, রাসেল, এ. জে. এয়ার প্রমুখ ব্যক্তি অভিন্নতার জন্য স্মৃতিকেই দায়ী করেন।[১০৫]

হিউমের আত্মা সম্পর্কিত মতবাদ সম্পর্কে উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হিউম তাঁর ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা সম্পর্কিত মতবাদের মাধ্যমে প্রচলিত সকল প্রকার দ্রব্যের ধারণাকে খণ্ডন করেছেন। ফলে দর্শনে স্বীকৃত এবং বহুল আলোচিত স্থায়ী আত্মার ধারণাও অস্বীকৃত হয়। তিনি আত্মা সম্পর্কে নতুন মতবাদ প্রদান করে আত্মাকে প্রত্যক্ষণের সমষ্টি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এ মতবাদকে আত্মা সম্পর্কিত পুঞ্জবাদ বলা হয়।

এছাড়া, তিনি ব্যক্তি অভিন্নতাসহ সকল প্রকার অভিন্নতার ধারণাকে আরোপিত মানসিক প্রবণতাজাত ভ্রান্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে স্মৃতিকে এই ভ্রান্তির কারণ বলে অভিহিত করেন।

এর ফলে দ্রাব্যিক আত্মার ধারণা একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার হয়ে পড়ে। তাই হিউম এই সমস্যাকে দার্শনিক সমস্যা না বলে ব্যাকরণিক সমস্যা বলেছেন। এর ফলে দর্শনের ইতিহাসে চিরায়ত শাশ্বত আত্মার ধারণা প্রত্যাখ্যাত হয় এবং আত্মার ধারণা একটি সুস্পষ্ট অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যা পায়। হিউমের ব্যাখ্যায় আত্মা সম্পর্কিত ধারণার যেমন একটি নতুন দিকনির্দেশ করা হয়েছে তেমনি এই ব্যাখ্যা তাঁর অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত মতবাদকে সঙ্গতিপূর্ণ করার ক্ষেত্রে পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। এর ফলে অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক লক ও বার্কলে আত্মার ধারণাকে স্বীকার করে অভিজ্ঞতাবাদের যে অসঙ্গতি সম্পাদন করেছিলেন হিউমের হাতে তা তিরোহিত হয়। ফলে একথা বলা যায় যে, হিউমের জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদে তাঁর আত্মা সম্পর্কিত ব্যাখ্যা একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। হিউমের ব্যাখ্যায় আত্মা সম্পর্কিত চিরায়ত ধারণা প্রত্যাখ্যাত হয় এবং আত্মার ধারণা সুস্পষ্ট অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যা পায়।

হিউম আত্মাসম্পর্কিত ধারণার অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যা দেওয়ার সাথে সাথে কার্যকারণের আবশ্যিকতা সম্পর্কিত ধারণারও অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যা দেন। ফলে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসহ সকল প্রকার বাস্তব ঘটনা সম্পর্কিত জ্ঞানের ক্ষেত্রে আবশ্যিকতার সম্পর্ক অস্বীকৃত হয়। ফলে এসব বিষয়ের জ্ঞানের ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা ও সর্বজনীনতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং অভিজ্ঞতাবাদ সংশয়বাদে পর্যবসিত হয়। কার্যকরণ প্রসঙ্গে হিউমের এই ব্যাখ্যাই আমাদের পরবর্তী আলোচ্য বিষয়।

কার্যকারণের আবশ্যিকতা খণ্ডন

এ পর্যন্ত আলোচনায় থেকে দেখা যায়, হিউম তাঁর ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণাতত্ত্ব দ্বারা শাশ্বত আত্মার অস্তিত্বের ধারণাকে খণ্ডন করে আত্মাকে প্রত্যক্ষণের পুঞ্জ হিসেবে অভিহিত করেন। এতে অভিজ্ঞতাবাদ থেকে লক ও বার্কলেকৃত অসঙ্গতির নিরসন হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত এসেই হিউম থেমে যাননি। তাঁর সমসাময়িক যুগের প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নিউটনীয় নিশ্চয়তাবাদী ধারণা তাঁর জ্ঞানবিদ্যাগত সূক্ষ্মদৃষ্টি এড়াতে পারেনি। ফলে তিনি নিউটনীয় প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি কার্যকারণ নিয়ম সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদী বিশ্লেষণ করেন, এবং দর্শন ও বিজ্ঞানে স্বীকৃত কার্যকারণের আবশ্যিক বা অনিবার্য সম্পর্কের ধারণাকে ইন্দ্ৰিয়ছাপ ও ধারণাতত্ত্বের মানদণ্ডে বিচার করে দেখতে প্রবৃত্ত হন। তাঁর কার্যকারণ সম্পর্কিত আলোচনা দর্শনের ইতিহাসে যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।

আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে হিউম সর্বপ্রথম দার্শনিক যিনি দর্শন ও বিজ্ঞানে স্বীকৃত ও বহুল প্রচলিত কার্য ও কারণের অনিবার্য সম্পর্কের ধারণার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করেন। মূলত তাঁর এই প্রতিবাদ থেকেই কার্যকারণ সম্পর্ক প্রসঙ্গে আধুনিক দার্শনিক আলোচনা শুরু হয়।[১০৬] হিউম তাঁর A Treatise of Human Nature গ্রন্থের প্রথম পুস্তকের তৃতীয় অধ্যায়ের ষোলটি পরিচ্ছেদে কার্যকারণ প্রসঙ্গে যে আলোচনা করেছেন তাকে অত্যন্ত দীর্ঘ ও জটিল মনে হয়।[১০৭] কিন্তু তাঁর পরবর্তী রচনা An Enquiry Concerning Human Understanding নামক গ্রন্থের On the Idea of Necessary Connection শীর্ষক সপ্তম অধ্যায়ে তিনি তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থের বক্তব্যকে গুছিয়ে স্পষ্টতরভাবে প্রকাশ করেন।

অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে হিউমের লক্ষ্য হলো কারণ ও কার্যের মধ্যে অনিবার্য বা আবশ্যিক সম্বন্ধ বর্তমান—একথা খণ্ডন করা এবং কারণ ও কার্যের তথাকথিত আবশ্যিক সম্বন্ধের অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যা দেওয়া। প্রথম অংশকে তাঁর মতবাদের নঞর্থক দিক এবং দ্বিতীয় অংশকে সদর্থক দিক বলে অভিহিত করা যেতে পারে।

হিউম কার্যকারণের তথাকথিত অনিবার্য সম্পর্কের ধারণাকে খণ্ডন করতে গিয়ে প্ৰথমে এর উৎপত্তি অনুসন্ধান করেন। তাঁর পূর্বসূরি জন লক ও জর্জ বার্কলের আদর্শ অনুসরণ করে তিনি বলেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বাইরে কোনো কিছুর ধারণা আমরা পেতে পারি না। লক অভিজ্ঞতাকে বলেছিলেন ‘ধারণা’। হিউম একে বলেন প্রত্যক্ষণ। তাঁর মতে প্রত্যক্ষণ দুভাগে বিভক্ত : ইন্দ্ৰিয়ছাপ ও ধারণা। যার ইন্দ্রিয়ছাপ নাই তার ধারণা থাকতে পারে না। এ কারণেই হিউমের জ্ঞানবিদ্যার মূলসূত্র হলো, কোনো ধারণা সম্পর্কে সন্দেহ হলে এই ধারণার মূল উৎস যে ইন্দ্ৰিয়ছাপ তাকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।[১০৮]

হিউম তাঁর অভিজ্ঞতাবাদী সূত্র অনুসরণে কোন ইন্দ্ৰিয়ছাপ থেকে অনিবার্য ধারণার উৎপত্তি হয় তা বিচার করতে প্রয়াসী হন। এছাড়াও, তিনি অভিজ্ঞতা ছাড়া বুদ্ধি থেকে অনিবার্য ধারণা পাওয়া যায় কি না তা-ও বিচার করে দেখেন।

অভিজ্ঞতায় কার্যকারণের অনিবার্য সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় কি না এ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে হিউম দেখেন যে, বাহ্য জগৎ থেকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অনিবার্য সম্পর্ক বা ক্ষমতার ধারণা পাওয়া যায় না। আমরা আমাদের চারপাশের বাহ্যবস্তুর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যা প্রত্যক্ষ করি তা হলো একটি বস্তু অন্যটিকে অনুগমন করে মাত্র।[১০৯]

অনিবার্যতার ধারণার উৎসরূপে ইন্দ্রিয়ছাপকে খুঁজে পাবার জন্য হিউম যে সমস্ত বস্তুর মধ্যে অনিবার্যতার ধারণা নিহিত আছে বলে মনে করা হয় সেগুলোকেও বিচার করে দেখেন। সাধারণত কারণ ও ক্রিয়ার মধ্যে অনিবার্যতাকে আরোপ করা হয়। কিন্তু দুটি ধারণাকে পরীক্ষা করেও হিউম সংলগ্নতা ও পূর্ববর্তিতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। বর্তমানে দৃষ্ট দুটি বস্তু বা ঘটনাকে কার্য ও কারণ বলে অভিহিত করার জন্য পূর্ব প্রত্যক্ষিত একাধিক দৃষ্টান্তের সমর্থন প্রয়োজন। অর্থাৎ, অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা এ রকম অনুমানের উৎস খুঁজে পাই। কিন্তু, অভিজ্ঞতা থেকে অনিবার্য বা আবশ্যিক সম্পর্ককে আবিষ্কার করা যায় না। অভিজ্ঞতা থেকে পারম্পর্য ও সংলগ্নতার বাইরে যা পাওয়া যায় তা হলো, সতত সংযেজন। এই জন্যই হিউম বলেন, বিগত কোনো ইন্দ্রিয়ছাপের অনন্ত পুনরাবৃত্তি থেকেও অনিবার্য সম্পর্কের কোনো নতুন মৌলিক ধারণা উৎপন্ন হবে না।[১১০]

সুতরাং তাঁর মতে, অভিজ্ঞতায় কার্যকারণের বহু দৃষ্টান্ত পর্যবেক্ষণ করে আমরা দুটি ঘটনার মধ্যে পারম্পর্য, সংলগ্নতা ও সতত সংযোজন দেখতে পাই। আর এ সতত সংযোজনের জন্যই ধারণা করি যে সংলগ্ন ঘটনা দুটি আবশ্যিক বা আদি সংযোগে সংযুক্ত। হিউম এরূপ অনুমানে একটি যৌক্তিক অনুপপত্তি ঘটে বলে মনে করেন। তিনি বলেন :

অস্তিত্ব বিষয়ক সব ন্যায়ক্রিয়া কার্যকারণ সম্পর্কের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং কার্যকারণ সম্পর্কের জ্ঞান অভিজ্ঞতালব্ধ। আমাদের সব পরীক্ষণমূলক সিদ্ধান্ত যে অনুমানের উপর নির্ভর করে অগ্রসর হয় তা হলো ভবিষ্যৎ অতীতের মতো হবে। এই শেষের অনুমানটিকে সম্ভাব্য যুক্তির বা অস্তিত্ব বিষয়ক যুক্তির সাহায্যে প্রমাণ করার প্রচেষ্টা হবে চক্রক দোষে দুষ্ট। এই দোষ হলো, যাকে প্রমাণ করতে হবে তাকে প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া।[১১১] হিউম নির্দেশিত কার্যকারণের অনিবার্য সম্পর্কের এই দার্শনিক সমস্যাকেই ঐতিহ্যগতভাবে আরোহানুমানের সমস্যা বলা হয়। অর্থাৎ ‘সকল জানা ক হয় খ’–এই বচন থেকে ‘সকল ক হয় খ’ এই বচনকে প্রমাণ করার সমস্যা। এ. জে. এয়ার-এর মতে, হিউমই তার Treatise গ্রন্থে এ সমস্যাকে প্রথমবারের মতো স্পষ্টভাবে উত্থাপন করেন।[১১২]

আরোহ অনুমানের হিউম কর্তৃক সমালোচনা দর্শনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। কারণ, আরোহানুমান যে প্রতিপাদনমূলক নয় তা হিউমই প্রথম নির্ণয় করেন। তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকগণ স্পষ্টভাবে আরোহ ও অবরোহের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেন নি।[১১৩]

জন লক প্রমুখ অভিজ্ঞতাবাদীগণ এটা মনে করতেন যে, প্রতিটি কারণের মধ্যেই ফলোৎপাদনের গোপন শক্তি নিহিত আছে। এই মতবাদকে কার্যকারণের অনিবার্য সম্বন্ধ সম্পর্কিত শক্তিতত্ত্ব বলা হয়। তাঁদের মতে, এই শক্তি পদার্থের অজ্ঞাত গুণ। কিন্তু হিউমের যুক্তি হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত এ শক্তির ক্রিয়াকে কতগুলো দৃষ্টান্তে প্রত্যক্ষণ করা না যায় ততক্ষণ পর্যন্ত এ শক্তি বা ক্ষমতার কোনো ধারণা আমাদের থাকতে পারে না।[১১৪]

এ শক্তিকে প্রত্যক্ষ করার দৃষ্টান্ত বস্তুর মধ্যে আবিষ্কারে ব্যর্থ হয়েই দেকার্তপন্থীরা তাঁদের সহজাত ধারণার সূত্রের উপর নির্ভর করে উপলক্ষবাদ প্রবর্তন করেন।[১১৫] তাঁরা ঈশ্বরকে সব ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে চিহ্নিত করে তাকেই বিশ্বের একমাত্র ক্রিয়াশীল সত্তা এবং কার্য ও কারণ নামক দুটি বস্তুর চিরন্তন সংযোগকে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ ইচ্ছার কার্য বলে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু দর্শনের ইতিহাসে সহজাত ধারণার সূত্রটি জন লক কর্তৃক ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া, হিউমের মতে, ঈশ্বরকে প্রতিটি পরিবর্তনের কারণ বলে গণ্য করারও কোনো অর্থ হয় না। কারণ, ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা মতবাদ অনুসারে প্রত্যেক ধারণাই ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে উৎপন্ন হয়। ঈশ্বরের ধারণাও নিশ্চয়ই একই উৎস থেকে উৎপন্ন হবে। সংবেদনজাত ও চিন্তাজাত কোনো ইন্দ্ৰিয়ছাপ থেকেই যদি শক্তি বা ক্ষমতার ধারণা নির্দেশিত না হয় তবে এমন কোনো সক্রিয় সূত্রকে ঈশ্বরের মধ্যে আবিষ্কার করা, এমনকি, কল্পনা করাও একইভাবে অসম্ভব। হিউম দুটি পৃথক যুক্তির সাহায্যে উপলক্ষবাদকে সমালোচনা করেন।[১১৬] সংক্ষেপে যুক্তিগুলো হলো :

(ক) যে ব্যক্তি মানুষের বিচার ক্ষমতার দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে জ্ঞাত তার কাছে এই মতবাদ বিশ্বাসযোগ্য নয়; এবং

(খ) অচেতন বস্তু বা মানুষের ইচ্ছা কীভাবে ক্রিয়া করে তা যেমন আমাদের কাছে অজ্ঞাত ঠিক তেমনি পরমসত্তার ক্রিয়াও আমাদের কাছে অজ্ঞাত।

এককথায় শক্তিতত্ত্বের বিরুদ্ধে হিউমের বক্তব্য হলো শক্তি কিংবা ক্ষমতার কোনো ইন্দ্ৰিয়ছাপ আমাদের নেই। তাই শক্তির কোনো ধারণাও আমাদের থাকতে পারে না।[১১৭]

কার্যকারণের অনিবার্যতাকে খণ্ডন করতে গিয়ে হিউম কার্যের জন্য কারণের উপস্থিতির আবশ্যিকতাকেও খণ্ডন করেন। প্রত্যেক কার্যেরই একটি কারণ রয়েছে। অন্যকথায়, যে কোনো অস্তিত্বশীল বস্তুরই একটি কারণ রয়েছে বলে দর্শনে একটি ধারণা প্রচিলত আছে। এই কারণের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে যাতে সীমাহীন অনুক্রমে পতিত হতে না হয় সেজন্য গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল থেকে শুরু করে অনেকেই একটি আদি কারণ বা কারণহীন কারণকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। হিউম এই বহুল পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেন। তাঁর মতে, কারণের আবশ্যিকতা বা অনিবার্যতা সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা ভ্রান্ত এবং একে প্রতিষ্ঠিত করার সব প্রচেষ্টাই ভ্রমাত্মক ও কুযুক্তিপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে তিনি কারণের আবশ্যিকতার পক্ষে যে যুক্তিগুলো দেওয়া হয় সেগুলোকেও খণ্ডন করেন।[১১৮] কারণের আবশ্যিকতার পক্ষের সবকটি প্রধান যুক্তি খণ্ডন করে হিউম প্রমাণ করেন যে, যে বস্তুর অস্তিত্বের আরম্ভ রয়েছে তার কোনো না কোনো কারণ থাকাও আবশ্যিক—একথা বলার কোনো যুক্তি নেই। অন্যকথায়, কারণের আবশ্যিকতা সম্পর্কিত যুক্তি ভ্রান্ত।

উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, হিউম তাঁর ধারণার উৎপত্তিসংক্রান্ত ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা তত্ত্ব দ্বারা প্রমাণ করেন যে, অভিজ্ঞতা থেকে কার্যকারণের অনিবার্যতাকে পাওয়া যায় না। একই যুক্তিতে তিনি কার্যকারণের অনিবার্যতা সম্পর্কিত শক্তিতত্ত্ব বা কারণের মধ্যেই ফলোৎপাদনের শক্তি থাকে, এবং উপলক্ষবাদ বা কার্যকারণের সম্পর্ক পরমসত্তার ইচ্ছা, এসব মতবাদ খণ্ডন করেন। এছাড়া, তিনি কার্যের জন্য কারণের আবশ্যিকতা সম্পর্কিত মতবাদের পক্ষের প্রধান যুক্তিগুলোকে ভ্রমাত্মক বলে প্রমাণ করেন। এ পর্যন্ত এসেই তিনি থেমে থাকেননি, বরং এও প্রমাণ করেন যে, অভিজ্ঞতা থেকে তো নয়ই, বুদ্ধি থেকেও কার্যকারণের অনিবার্যতাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

কোনো ধারণা পূর্বতঃসিদ্ধ হলেই তাকে বুদ্ধি দ্বারা আবিষ্কার করা যায়। এরূপ ধারণা অভিজ্ঞতা ছাড়াই আবিষ্কারযোগ্য। অন্যকথায়, ধারণাটি সংশ্লেষক নয়, বিশ্লেষক। কার্যকারণের অনিবার্যতার ধারণা পূর্বতঃসিদ্ধ বা বিশ্লেষক হলে কোনো একটি কার্য নামক ঘটনাকে দেখার পরই এর কারণ কী তা বলা যেত। এর জন্য যেসব দৃষ্টান্তে কার্য ও কারণ নামক ঘটনাদ্বয় ঘটেছে সে সব দৃষ্টান্তের পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন হত না। অন্যকথায়, অভিজ্ঞতার সাহায্য ছাড়া, বিশ্লেষণের মাধ্যমে কার্য থেকে কারণ ও কারণ থেকে কার্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেত। কিন্তু তা সম্ভব হয় না। এছাড়াও, হিউমের মতে, প্রজ্ঞা বা বুদ্ধি দ্বারা যদি আদি সংযোগকে ব্যাখ্যা করা যেত তবে ব্যাপারটি একটি সূত্রের উপর নির্ভর করত। সূত্রটি হলো, যেসব দৃষ্টান্ত সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা নাই সেগুলো ঐ সব দৃষ্টান্তের সদৃশ হবে, যাদের সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর প্রকৃতির কার্যধারা সর্বদা একইভাবে চলতে থাকে।[১১৯]

কিন্তু যেসব দৃষ্টান্তের অভিজ্ঞতা নেই সে সব দৃষ্টান্ত অভিজ্ঞতাজাত দৃষ্টান্তগুলোর সদৃশ, একথা কোনো প্রতিপাদনযোগ্য যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করা যায় না। প্রকৃতির কার্যধারা সব সময় একইভাবে চলতে থাকবে, একথাও ঠিক নয়। কারণ, এর মধ্যে কোনো না কোনো রকম পরিবর্তনের ধারণা যৌক্তিকভাবে অসম্ভব বা স্ববিরোধী নয়। সুতরাং বলা যায়, প্রজ্ঞা দ্বারা কার্যকারণের আদি সংযোগ ব্যাখ্যা করা যায় না। অর্থাৎ এই ধারণাটি পূর্বতঃসিদ্ধ নয়।

কার্যকারণ প্রসঙ্গে হিউমের মতের উপর্যুক্ত নঞর্থক দিক আলোচনার সারসংক্ষেপ হলো, কার্যকারণের ধারণা যে অনিবার্যতার ইঙ্গিত বহন করে তা যুক্তিবিদ্যার পূর্বতঃসিদ্ধ অনিবার্যতা নয়। আবার তা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গঠিত কোনো পরতঃসাধ্য অনুমানও নয়। ধারণার সম্বন্ধ ও বাস্তব ঘটনা—জ্ঞানের এই দুটি উপায়ের কোনোটির সাহায্যেই কার্যকারণ সম্বন্ধের অনিবার্যতাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে অনিবার্যতা সম্বন্ধে কোনো কিছু জানতে না পারলেও অভিজ্ঞতা থেকে কী করে ইন্দ্রিয়ের মধ্যে অনিবার্য সম্বন্ধের অনুভূতি জাগ্রত করে তা আমরা বুঝতে পারি।

হিউম কার্যকারণের অনিবার্যতা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা খণ্ডন করার পর এ সম্পর্কিত তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা দেন। এটি তাঁর মতের গঠনমূলক দিক। তাঁর মতে, বিদ্যুৎ চমকালেই আমরা মেঘের গর্জন শুনতে পাই এবং প্রায় সবগুলো বিদ্যুৎ চমকানোর ঘটনাতেই মেঘের গর্জন উপস্থিত থাকে। এ থেকে আমরা ধরে নেই যে, মেঘের গর্জন ও বিদ্যুৎ চমকানো একটি অপরটির কারণ বা কার্য, এবং এ দুটি ঘটনা আবশ্যিক সম্পর্কে সম্পর্কিত। এ অবস্থায় আমরা একটি ঘটনা থেকে অন্যটিকে অনুমান করি। অথচ পৃথক পৃথকভাবে বিচার করলে যদিও ঘটনা দুটিকে সব সময় সংযুক্ত দেখা যায় তবুও এদের সংযুক্তির ধারণাকে পাওয়া যায় না। তাই Enquiry গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ের দ্বিতীয় অংশে হিউম বলেন, তাহলে দেখা যাচ্ছে ঘটনার মধ্যে অনিবার্য সম্পর্কের ধারণাটি একাধিক অনুরূপ দৃষ্টান্তে এই ঘটনাগুলোর নিয়ত সংযোগ থেকেই উৎপন্ন হয়।[১২০]

হিউমের মতে, একটিমাত্র দৃষ্টান্ত ও একাধিক দৃষ্টান্তের মধ্যে এটাই পার্থক্য। একটি মাত্র দৃষ্টান্ত থেকে সম্বন্ধ বা সম্পর্কের ধারণা পাওয়া যায় না, কিন্তু একাধিক দৃষ্টান্ত থেকে শুধু সাদৃশ্যকেই খুঁজে পাওয়া যায়, কোনো রকম সংযুক্তিকে নয়। হিউমের মতে, সদৃশ বস্তুগুলোর এই বহুতাই শক্তি বা সংযুক্তির সারসত্তা গঠন করে এবং এটাই আবশ্যিক সংযোগের ধারণার উৎস। সংযোজন বা শক্তির ধারণা কোনো একটি দৃষ্টান্তে থেকে নয় বরং দৃষ্টান্তের পুনরাবৃত্তি থেকে আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু দৃষ্টান্তের পুনরাবৃত্তি কোনো নতুন মৌলিক ধারণা গঠন করতে পারে—একথা যৌক্তিকভাবে বলা যায় না। এর যে তিনটি কারণ হিউম নির্দেশ করেন সেগুলো হলো, (১) দৃষ্টান্তের পুনরাবৃত্তি থেকে এমন কোনো মৌলিক ধারণা সৃষ্টি হলে তাকে বিশেষ দৃষ্টান্তেও খুঁজে পাওয়া যেত, (২) দৃষ্টান্তের পুনরাবৃত্তির সময় এমন কোনো ধারণার ইন্দ্রিয়ছাপকে পাওয়া যেত। কিন্তু এমন কোনো ইন্দ্ৰিয়ছাপকে পাওয়া যায় না, এবং (৩) সদৃশ কারণ ও ক্রিয়ার সংযোজনগুলোর দৃষ্টান্ত পরস্পর স্বকীয়ভাবে পরস্পর থেকে ভিন্ন।

উপরের যুক্তিত্রয় থেকে প্রমাণিত হয় যে, শুধুমাত্র পুনরাবৃত্তি থেকে সংযোগের ধারণা গঠিত হয় না, বরং এ থেকে এমন কিছু গঠিত হয় যা সংযোগের ধারণার উৎস। এই এমন কিছুই হলো নতুন ইন্দ্ৰিয়ছাপ। কিন্তু এই ইন্দ্ৰিয়ছাপটি প্রত্যক্ষণজাত নয়, বরং সদৃশ বস্তুর পর্যবেক্ষণ দ্বারা আমাদের মনের মধ্যে গঠিত। এ প্রসঙ্গে হিউম Treatise গ্রন্থে বলেন :

যথেষ্ট সংখ্যক দৃষ্টান্তে সাদৃশ্যটিকে লক্ষ করার পর আমরা একটি বস্তু থেকে তার সচরাচর সহগামীটিতে সংক্রমণ করার ও ঐ সম্বন্ধের জন্য তাকে আরো স্পষ্টভাবে ধারণা করার মনের এক প্রবণতাকে অনুভব করি। এই প্রবণতাই সাদৃশ্যের একমাত্র ক্রিয়া। সুতরাং এই প্রবণতাই হলো শক্তি বা ক্ষমতার ধারণা যা আমরা সাদৃশ্য থেকে লাভ করে থাকি।[১২১]

তিনি আরো বলেন :

এসব দৃষ্টান্ত (যাদের পুনরাবৃত্তি ঘটে থাকে) স্বকীয়ভাবে পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, যে মন তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করে সে মনের মাঝেই এদের সংযোগ ঘটে। সুতরাং আবশ্যিকতা এই পর্যবেক্ষণেরই ফলাফল এবং মনের অভ্যন্তরীণ ইন্দ্ৰিয়ছাপ বা কোনো একটি লক্ষিত বস্তু থেকে অন্য একটিতে আমাদের চিন্তাকে সংক্রমণ করানোর প্রবণতা ছাড়া আর কিছুই নয়।[১২২]

তিনি এই প্রবণতাকে অভ্যাস থেকে সৃষ্ট বলে মনে করেন।[১২৩] লক্ষণীয় যে, তিনি মনের অভ্যন্তরীণ ইন্দ্ৰিয়ছাপ বলতে চিন্তাকে সংক্রমণ করানোর প্রবণতাকে বুঝিয়েছেন।

উল্লেখ্য যে, Enquiry গ্রন্থে হিউম কার্যকারণের অনিবার্য সম্পর্ককে অভিজ্ঞতাজাত ধারণা, এবং কোনো অভিজ্ঞতাজাত ধারণা ন্যায়ক্রিয়ার ফল নয়, বরং অভ্যাসের ফল বলেছেন।[১২৪] Treatise গ্রন্থেও তিনি অনিবার্য সম্বন্ধ বা আবশ্যিক সংযোজন ও অভ্যাসজাত সংযুক্তিকে একই ব্যাপার বলে উল্লেখ করেন। কারণ, এক জাতীয় দৃষ্টান্তের পুনরাবৃত্তির পর একটি ঘটনার আবির্ভাব ঘটলে মন অভ্যাসবশত এর স্বাভাবিক অনুগামীটিকে প্রত্যাশা করে, এবং বিশ্বাস করে যে এটি অস্তিত্বশীল হবে। এই বিশ্বাসই আবশ্যিকতা। কিন্তু বিশ্বাস করা ও ধারণা থাকা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। এদের একটির অস্তিত্ব যৌক্তিকভাবে অন্যটির অস্তিত্ব নির্দেশ করে না। এরা পরস্পর স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল হতে পারে। এ কারণে বেরি স্ট্রাউট মনে করেন, হিউমই প্রথম দার্শনিক যিনি সরল ধারণা ও বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করতে সক্ষম হয়েছেন।[১২৫]

হিউমের কার্যকারণ সম্পর্কিত গঠনমূলক আলোচনার সারসংক্ষেপ করে বলা যায়, কারণ ও ক্রিয়ার মধ্যে আবশ্যিক সংযোজনের যে দাবি করা হয় হিউমের প্রমাণ অনুসারে সে দাবি মূলত অভ্যাসজনিত কারণেই ঘটে থাকে। লক্ষিত বস্তুগুলো অনিবার্যভাবে সংযুক্ত থাকে না। বরং আমাদের মনের ধারণাগুলো অনুষঙ্গের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়। অভ্যাসের প্রত্যক্ষণ থেকেই এই অনুষঙ্গের উৎপত্তি। অর্থাৎ এই সংযোজনকে কারণ ও কার্যের মধ্যে অনুসন্ধান না করে অনুসন্ধান করতে হবে অভ্যাসজাত মানসিক প্রবণতার মধ্যে, তথা মনের মধ্যে। এ কারণে হিউম কার্যকারণনির্ভর সকল বাস্তব ঘটনাকে অভ্যাসের ফল হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাঁর Treatise গ্রন্থে বলেন, বাস্তব বিষয় সম্পর্কিত সব বিচারবুদ্ধি‍ই শুধু অভ্যাস থেকে গঠিত হয়ে থাকে। আর, অভ্যাস হলো কিছুকে বারবার প্রত্যক্ষণ করার ফল।[১২৬] Enquiry গ্রন্থে বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট করে তিনি বলেন, বাস্তব ঘটনা বা বাস্তব অস্তিত্ব সম্বন্ধে সব বিশ্বাসই স্মৃতি বা ইন্দ্রিয়ের কাছে উপস্থিত নিছক কোনো বস্তু এবং সেই বস্তু বা অন্য কোনো বস্তুর অভ্যাসগত সংযোগের বিষয় থেকে উদ্ভূত।[১২৭]

স্মরণ করা যেতে পারে, হিউম তার Treatise গ্রন্থে (১ম পুস্তক, ৩য় অধ্যায়, ১ম পরিচ্ছেদ) দার্শনিক সম্বন্ধগুলোকে সাত ভাগে ভাগ করেন। এগুলো আবার দুই প্রকার। ফ্রেডরিক কপলেস্টোন প্রথম প্রকার সম্বন্ধকে অপরিবর্তনশীল ও দ্বিতীয় প্রকার সম্বন্ধকে পরিবর্তনশীল বলেন।[১২৮] প্রথম প্রকার সম্বন্ধগুলো থেকে অভিজ্ঞতাপূর্ব প্রমাণের মাধ্যমে নিশ্চিত জ্ঞান পাওয়া যায়। এ সম্বন্ধগুলো হলো সাদৃশ্য, বৈপরীত্য, গুণগত মাত্ৰা, এবং সংখ্যাগত ও পরিমাণগত মাত্রা। দ্বিতীয় প্রকার সম্বন্ধগুলোর সত্যতা পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ দ্বারা নির্ণিত হয়। সুতরাং এগুলো সম্ভাব্য। এগুলো হলো, অভিন্নতা, দেশ- কালের সম্বন্ধ ও কার্যকারণ সম্বন্ধ। সুতরাং কার্যকারণ এক প্রকারের সম্ভাব্য সম্বন্ধ। অনিবার্য নয়।

কার্যকারণ সম্পর্কিত উপর্যুক্ত হিউমের ব্যাখ্যা প্রচলিত বুদ্ধিবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদী উভয় ব্যাখ্যা থেকে স্বতন্ত্র। যে সব বুদ্ধিবাদী মনে করেন কারণের প্রকৃতির বিচারবুদ্ধিসম্মত বিশ্লেষণ দ্বারা কার্যকে আবিষ্কার করা যায়, হিউমের মতবাদ সেসব মতের বিরোধী। আবার লক প্রমুখ অভিজ্ঞতাবাদীরা মনে করেন, বস্তুর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণ করলেই কার্যকারণের আবশ্যিক সম্পর্ক আবিষ্কার করা যায়। হিউমের মত সে মতেরও বিরোধী। এজন্যই হিউম একশত সংখ্যক কার্যের পক্ষে একটি কারণকে অনুসরণ করা সম্ভব বলে মনে করেন।[১২৯]

প্রচলিত কার্যকারণের ধারণাকে পরিহার করে এর আবশ্যিক সংযোজনের ধারণাকে ব্যক্তির অভ্যাসজাত মানসিক প্রবণতা বলে হিউম কার্যকারণের যে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা দর্শনের ইতিহাসে কার্যকারণ সম্পর্কের আলোচনায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূত্রপাত ঘটায়। হিউমের মতবাদকে আবশ্যিকতা সম্পর্কিত মানসিক প্রবণতা মতবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।

আবশ্যিকতা সম্পর্কিত মানসিক প্রবণতা মতবাদের আবশ্যিক ফল হিসেবে কার্যকারণ সম্পর্ক বিষয়গত বা সর্বজনীন রূপ হারিয়ে বিষয়ীগত হয়ে পড়ে। সঙ্গত কারণেই তা সম্ভাব্য জ্ঞানের বিষয়ে পরিণত হয়। এছাড়া, কার্যকারণনির্ভর বাস্তব তথ্য সম্পর্কিত সকলপ্রকার জ্ঞানও সর্বজনীনতা হারিয়ে বিষয়ীগত ও সম্ভাব্য হয়ে পড়ে। বাস্তব তথ্যের সর্বজনীন জ্ঞানলাভ অসম্ভব হওয়ায় হিউমের অভিজ্ঞতাবাদ জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক থেকে সংশয়বাদে রূপ নেয়। হিউম-পূর্ব অভিজ্ঞতাবাদী জন লক ও জর্জ বার্কলে অভিজ্ঞতাবাদী হওয়া সত্ত্বেও কার্যকারণের আবশ্যিকতাকে স্বীকার করেছিলেন। ফলে, তাঁদের হাতে জ্ঞানের নিশ্চয়তার ভিত্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি। তবে অভিজ্ঞতাবাদ অসঙ্গতিপূর্ণ হয়। হিউমের হাতে অভিজ্ঞতাবাদের এই ত্রুটি নিরসন হয়। এজন্য বার্ট্রান্ড রাসেল হিউমকে দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম একজন হিসেবে আখ্যায়িত করেন।[১৩০]

কার্যকারণের আবশ্যিকতা সম্পর্কিত মানসিক প্রবণতা মতবাদ দ্বারা হিউম কার্যকারণের প্রচলিত আবশ্যিক সম্পর্কের ধারণা বর্জন করায় কারণের প্রচলিত সংজ্ঞাও বদলে যায়। এই অবস্থায় হিউম কারণের নতুন সংজ্ঞা দেন এবং কার্য ও কারণের আবশ্যিক সম্পর্কের ধারণাকে পরিহার করে পারম্পর্য, সংলগ্নতা ও সতত সংযোজন দ্বারা এদের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন। তিনি কারণের দুটি সংজ্ঞা প্রদান করেন।

সংজ্ঞা (১) : কারণ এমন একটি লক্ষিত বস্তু যা অন্য একটি লক্ষিত বস্তুর পূর্ববর্তী ও সংলগ্ন এবং যেসব লক্ষিত বস্তু পূর্ববর্তী বস্তুটির সদৃশ সেগুলোর সবই পরবর্তী বস্তুটির সদৃশ বস্তুগুলোর সঙ্গে পূর্ববর্তিতা ও সংলগ্নতার সম্পর্কে সম্পর্কিত; এবং

সংজ্ঞা (২) : কারণ এমন একটি লক্ষিত বস্তু যা অন্য একটি লক্ষিত বস্তুর পূর্ববর্তী ও সংলগ্ন এবং এর (পূর্ববর্তীটির) সঙ্গে এমনভাবে সংযুক্ত যে, একটি ধারণা উপস্থিত থাকলে মন অন্যটির ধারণা গঠন করতে এবং একটির ইন্দ্রিয়ছাপ থেকে অন্যটির আরো সজীব ধারণা গঠন করতে নির্ধারিত হয়।

কারণের এই দুটি সংজ্ঞার মধ্যে হিউম কোনো পার্থক্য আছে বলে মনে করেননি। সংজ্ঞা দুটিতে মূলত একই বিষয়কে ভিন্ন দিক থেকে ব্যক্ত করা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। প্রশ্ন হলো, হিউমের পক্ষে কার্যকারণ সম্পর্কের দুটি সংজ্ঞা প্রদানের কারণ কী? এর কারণ বুঝতে হলে হিউম নির্দেশিত দার্শনিক সম্বন্ধ ও প্রাকৃতিক সম্বন্ধ[১৩১]—এই দুটি সম্বন্ধের ধারণাকে বোঝা প্রয়োজন।

দুটি বস্তুর মধ্যে যে কোনো প্রকার তুলনা থেকে যে সম্বন্ধ সৃষ্টি হয় তা দার্শনিক সম্বন্ধ। অন্যদিকে, যখন একটি বস্তুর চিন্তা মনের মধ্যে অন্য একটি বস্তুর চিন্তার উদ্ভব ঘটায় তখনই এ দুটি বস্তুর সম্পর্ককে প্রাকৃতিক সম্বন্ধ বলে। সাদৃশ্য, পারম্পর্য ও কার্যকারণ, অন্য কথায়, অনুষঙ্গ নিয়মই হলো প্রাকৃতিক সম্পর্কের ভিত্তি। অন্যদিকে, সকল প্রকার সম্পর্কই যেহেতু দার্শনিক সম্বন্ধ সেহেতু যে দুটি ঘটনা বা বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্য, পারম্পর্য বা কার্যকারণের সম্পর্ক আছে সে দুটি ঘটনা বা বস্তু দার্শনিক সম্পর্কেও সম্পর্কিত। সুতরাং সাদৃশ্য, সান্নিধ্য ও কার্যকারণ, এই তিন শ্রেণির সম্পর্ককে হিউমের সংজ্ঞানুসারে দার্শনিক ও প্রাকৃতিক উভয় প্রকার সম্বন্ধ বলা যায়। তাই সংজ্ঞা (১)-এ হিউম কার্যকারণ সম্পর্ককে দার্শনিক সম্পর্ক হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। অন্যদিকে, সংজ্ঞা (২)-এ হিউম কার্যকারণ সম্পর্ককে প্রাকৃতিক সম্বন্ধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

দেখা যায়, হিউম কার্যকারণ সম্পর্ককে দার্শনিক ও প্রাকৃতিক উভয় শ্রেণির সম্পর্কের মধ্যে গণ্য করেছেন। এজন্যই তাঁর নির্দেশিত কার্যকারণ সম্বন্ধের দুটি সংজ্ঞা একই অর্থ বহন করে। এর একটি অপরটিকে নির্দেশ করে বলেও তিনি মনে করেন। উপরের দুটি সংজ্ঞানুসারে কার্যকারণের সম্পর্ককে দার্শনিক বা প্রাকৃতিক সম্বন্ধ হিসেবে, অন্যকথায়, দুটি ধারণার মধ্যে তুলনা হিসেবে, বা দুটি ধারণার মধ্যে অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করাই সঠিক হবে, আবশ্যিক সম্পর্ক হিসেবে নয়। হিউমের কার্যকারণ সম্পর্কিত নতুন সংজ্ঞায় কার্যকারণকে পূর্ববর্তিতা ও সংলগ্নতা দ্বারা সংজ্ঞায়িত করে প্রত্যেক অস্তিত্বের আরম্ভের কোনো না কোনো কারণের আবশ্যিকতাকে যেমন অস্বীকার করা হয়েছে তেমনি কারণ কোনো শক্তির দ্বারা কার্য উৎপন্ন করে, এই ধারণাকেও বর্জন করা হয়েছে।

ফলত এই ব্যাখ্যা কার্যকারণ সম্পর্কে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করে। হিউমের আক্রমণ থেকে কার্যকারণের প্রচলিত নিয়মকে রক্ষা করা ছিল পরবর্তীকালের দার্শনিকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক সমস্যা।[১৩২] কারণের সংজ্ঞাগুলোর ব্যাখ্যা নিয়ে হিউমের সমালোচকদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। কারণের নিয়মানুবর্তিতা বলতে যা বুঝানো হয় হিউম তার সমর্থক ছিলেন কি না, কারণের দুটি সংজ্ঞা একই অর্থ প্রকাশ করে কি না—এসব বিষয় নিয়ে এন. কে. স্মিথ, জে. এ. রবিনসন, ডব্লিউ. এল. রবিনসন, ও থমাস জে. রিচার্ডস-এর মধ্যে দার্শনিক বিতর্ক হয়। এর বিস্তারিত আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।[১৩৩]

কার্যকারণ সম্পর্কে হিউমের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর জ্ঞানবিদ্যাকে সংশয়বাদের দিকে নিয়ে যায়। এ বিষয়েই আমাদের পরবর্তী আলোচনা।

হিউমের সংশয়বাদ

দর্শনের ইতিহাসে সংশয়বাদ হলো জ্ঞানের বিশ্বস্ততা বা যথার্থতা সম্পর্কিত একটি বিচারমূলক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি। জ্ঞানের নিশ্চয়তার প্রশ্নে এই মতবাদের উদ্ভব হয়। ব্যক্তি নিরপেক্ষ জ্ঞানলাভ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, এটাই সংশয়বাদের মূল কথা। প্রাচীনকালে গ্রিকদেশে এই মতবাদের জন্ম হলেও দর্শনের ইতিহাসে এর একটি ধারা দেখতে পাওয়া যায়। যদিও মধ্যযুগে ধর্ম প্রভাবিত বিশ্বাসনির্ভর দর্শনচর্চায় সংশয়বাদ প্রাচীন যুগের মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি তবুও রেনেসাঁ পরবর্তী আধুনিক দর্শনের মুক্ত চিন্তাভিত্তিক দর্শনচর্চায় সংশয়বাদের যথেষ্ট প্রভাব দেখা যায়। আধুনিক যুগের ব্রিটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম এর অন্যতম নিদর্শন। তাঁর সংশয়বাদকে ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদের চরম পরিণতি হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। একথা মনে করা হয় যে, জন লকের Essay Concerning Human Understanding প্রকাশের মধ্য দিয়ে যে ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদের সূচনা হয় ডেভিড হিউমের হাতে তা যুক্তিসঙ্গত পরিণতি লাভ করে।[১৩৪] একথাও বলা হয় যে, কোনো যুক্তিসঙ্গত অভিজ্ঞতাবাদীর পক্ষেই হিউমের সংশয়বাদকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।[১৩৫] সুতরাং অভিজ্ঞতাবাদের যুক্তিসঙ্গত পরিণতি হিসেবে হিউমের সংশয়বাদকে উপলব্ধি করার জন্য ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদী দর্শন তথা জন লক ও জর্জ বার্কলের অভিজ্ঞতাবাদের সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রাসঙ্গিক।

জন লক থেকে ডেভিড হিউম পর্যন্ত জ্ঞানবিদ্যার যে আলোচনা হয়েছে তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের জ্ঞানের সীমা ও বিস্তৃতি অনুসন্ধান করা। জন লক দেকার্তের তথা কার্তেসীয় বুদ্ধিবাদকে সমালোচনা করেই তাঁর অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদ প্রদান করেন। দেকার্ত অভিজ্ঞতাপূর্ব সহজাত ধারণা বা আন্তর্ধারণাকে ভিত্তি হিসেবে ধরে নিয়ে অবরোহ পদ্ধতিকে জ্ঞানের পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং বুদ্ধিবাদী জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মতে ঈশ্বর, দ্রব্য, কার্যকারণ প্রভৃতির সার্বিক জ্ঞান সহজাত ধারণা হিসেবে আমাদের মনে থাকে এবং এ থেকে অবরোহ পদ্ধতি দ্বারা বিশেষ বিশেষ বিষয়ের নিশ্চিত জ্ঞানলাভ করা যায়। ঈশ্বর, দ্রব্য, কার্যকারণ প্রভৃতি সার্বিক বিষয়ের জ্ঞান সহজাত ধারণার মাধ্যমে পাই— একথা বলায় দেকার্তের হাতে জ্ঞানের বিস্তৃতি সীমাহীন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ সকল কিছুরই জ্ঞান পাওয়া সম্ভব বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু জন লক তার Essay Concerning Human Understanding নামক বিখ্যাত গ্রন্থের প্রথম পুস্তকে দেকার্তের আন্তর্ধারণা মতবাদকে খণ্ডন করে যে বিষয়টির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তা হলো, সব কিছুরই জ্ঞান পাওয়া সম্ভব নয়। জ্ঞানের একটা সীমা আছে। সি. আর. মরিস লকের এই মতকে জ্ঞানের সীমার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান বলে মনে করেন। তাঁর মতে, পরবর্তীকালে হিউম জ্ঞান আদৌ সম্ভব কি-না বলে যে মৌলিক প্রশ্নটি তুলেছেন লকই এর পটভূমি তৈরি করেছিলেন।[১৩৬]

লক ও বার্কলের অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদে দেখা যায়, তাঁরা উভয়েই এ বিষয়ে একমত যে, অভিজ্ঞতা যথার্থ জ্ঞানের একমাত্র উৎস। তবে লক অভিজ্ঞতার কারণ হিসেবে জড় ও মানসিক উভয় প্রকার দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করেন, এবং এসব দ্রব্যকে অজ্ঞেয় হিসেবে আখ্যায়িত করে জ্ঞানের সীমা নির্ণয় করে দেন। এর ফলে সংশয়বাদের পথ প্রশস্ত হয়। কিন্তু বার্কলে লকের অভিজ্ঞতাবাদ দ্বারাই লকের অজ্ঞেয় জড় দ্রব্যের অস্তিত্ব খণ্ডন করেন, এবং লকের প্রতীকবাদকে ধারণাবাদে রূপান্তরিত করে শুধু মানসিক দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। বার্কলের হাতে লকের জ্ঞানের সীমা অসীম হয়ে যায় এবং নিশ্চিত জ্ঞান সম্ভব বলে ঘোষিত হয়। হিউম লক ও বার্কলের দর্শনের অভিজ্ঞতাবাদী যৌক্তিক উপাদানগুলো গ্রহণ এবং অযৌক্তিক উপাদানগুলো খণ্ডন করে তার মতবাদ দেন।

বার্কলে যে যুক্তিতে লককে সমালোচনা করেছিলেন হিউম একই যুক্তিতে বার্কলের মানসিক দ্রব্যের অস্তিত্বের ধারণাকে খণ্ডন করে বার্কলের মতবাদকে পক্ষপাতিত্ব দোষে দুষ্ট বলে মত প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে কালের মধ্যে জড় বস্তুর অভিন্নতা রক্ষার জন্য লকের জড় দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করার পক্ষে যেমন কোনো যুক্তি নেই তেমনি কালের মধ্যে মনের অভিন্নতা রক্ষার জন্য বার্কলের স্বীকৃত মনের অস্তিত্বকে স্বীকার করার পক্ষেও তেমন কোনো যুক্তি নেই। সুতরাং হিউমের হাতে লকের অজ্ঞেয় জড়ীয় ও মানসিক দ্রব্য এবং বার্কলের জ্ঞেয় ও নিশ্চিত মানসিক দ্রব্যের অস্তিত্ব অস্বীকৃত হয়। ফলে তাঁর কাছে শুধু অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। এছাড়াও লক ও বার্কলে কারণিক সম্পর্ককে স্বীকার করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে শুধু পার্থক্য ছিল এই যে, লক কারণিক সম্পর্ককে পদার্থের অংশগুলোর শক্তির সম্পর্ক হিসেবে এবং বার্কলে একে মানসিক সম্পর্ক হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু হিউম কার্যকারণের আবশ্যিক সম্পর্ককে অস্বীকার করে একে অতিকথা (myth) হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। জড় ও মানসিক উভয় প্রকার দ্রব্যসহ কার্যকারণের আবশ্যিক সম্পর্ক অস্বীকৃত হওয়ায় হিউমের হাতে ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদ থেকে লক ও বার্কলেস্বীকৃত অসঙ্গতিপূর্ণ উপাদান বর্জিত হয়। তবে এর পরিণতি হিসেবে জ্ঞান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, অর্থাৎ সংশয়বাদের জন্ম হয়।

পূর্ববর্তী আলোচনায় এটা প্রতীয়মান হয়েছে যে, হিউম একমাত্র ইন্দ্ৰিয়ছাপকেই জ্ঞানের প্রাথমিক উপাদান বলেছেন। যার ইন্দ্রিয়ছাপ নাই তার ধারণাও নাই। আর ইন্দ্রিয়ছাপ নাই বলে দ্রব্য আত্মা ও কার্যকারণের আবশ্যিক সম্পর্কের ধারণার অস্তিত্বকেও তিনি অস্বীকার করেছেন।

হিউম তাঁর An Enquiry Concerning Human Understanding নামক গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ের প্রথম অংশে দুই ধরনের জ্ঞানের বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য করেন। এই দুটি বিষয় হলো ধারণার সম্বন্ধ (relations of ideas) এবং বাস্তব ঘটনা (matter of facts)। তিনি বলেন, মানুষের বিচারবুদ্ধি বা অনুসন্ধানের সব বস্তুকে স্বাভাবিক দুরকমভাবে ভাগ করা যেতে পারে : ধারণার সম্বন্ধ ও বাস্তব ঘটনা।[১৩৭] প্রথম ধরনের বিষয় নিয়ে যে সব বিজ্ঞান আলোচনা করে সে সব বিজ্ঞানের উদাহরণ দিতে গিয়ে হিউম জ্যামিতি, পাটিগণিত ও বীজগণিতের কথা বলেন। এ সব বিজ্ঞানে যা ঘোষণা করা হয় তার স্বজ্ঞামূলক (intu- tional) অথবা প্রমাণমূলক (demonstrative) নিশ্চয়তা আছে।[১৩৮] শুধুমাত্র চিন্তন ক্রিয়ার দ্বারাই এ ধরনের বচনগুলোকে আবিষ্কার করা যায়। এগুলোর জন্য অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের উপর নির্ভর করতে হয় না। এই ধরনের বচনকে অস্বীকার করতে গেলে স্ববিরোধ দেখা দেয়। অন্যকথায়, এ ধরনের বচনের বিপরীত বচন কল্পনা করা অসম্ভব। গণিতের সম্বন্ধকে আবশ্যিক সম্বন্ধ বলায় কপলেস্টোন হিউমের গণিত বিষয়ক জ্ঞানকে অভিজ্ঞতাবাদী না বলে বুদ্ধিবাদী বলেছেন।[১৩৯] স্মরণ করা যেতে পারে যে, Treatise গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে হিউম পাটিগণিত ও বীজগণিতকেই একমাত্র সুনির্দিষ্ট ও সুনিশ্চিত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বিজ্ঞান বলে আখ্যায়িত করেন। জ্যামিতির এই বৈশিষ্ট্য নাই। কিন্তু Enquiry গ্রন্থে তিনি জ্যামিতিকেও পাটিগণিত ও বীজগণিতের সমমর্যাদা দান করেন।[১৪০]

অন্যদিকে, দ্বিতীয় ধরনের বিষয়, অর্থাৎ বাস্তব ঘটনা নিয়ে যে সব বচন আলোচনা করে এদের স্বজ্ঞামূলক বা প্রমাণমূলক নিশ্চয়তা নাই বলে হিউম উল্লেখ করেন। শুধুমাত্র চিন্তনক্রিয়ার মাধ্যমে এসব বচনকে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। তাঁর জন্য অভিজ্ঞতার সাহায্যে নেওয়া প্রয়োজন। বাস্তব ঘটনা সম্পর্কিত বচনের স্ববিরোধী বচনের কল্পনা করা সম্ভব। অন্যকথায়, এ ধরনের বচনকে চিন্তার ক্ষেত্রে অস্বীকার করা সম্ভব। এমনকি বাস্তবেও এসব ঘটনার বিপরীত ঘটনা ঘটা সম্ভব। অর্থাৎ ধারণার সম্বন্ধগুলোর যে চূড়ান্ত নিশ্চয়তা আছে, বাস্তব ঘটনা সম্পর্কিত বচনের সেরূপ নিশ্চয়তা নাই বা থাকতে পারে না। এগুলো সম্ভাব্য মাত্র। এন্টনি ফ্লু হিউমের এই শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রথম শ্রেণির বচনকে অভিজ্ঞতাপূর্ব এবং দ্বিতীয় শ্রেণির বচনকে অভিজ্ঞতাপ্রসূত বলে উল্লেখ করেন। ফ্লু বলেন :

হিউম যখন বলেন, প্রথম ধরনের বচনকে শুধুমাত্র চিন্তন প্রক্রিয়ার দ্বারাই আবিষ্কার করা যায় বাস্তব জগতে কোনো কিছু অস্তিত্বশীল কি না তার দিকে খেয়াল করার প্রয়োজন হয় না, তখন বস্তুত তিনি অভিজ্ঞতাপূর্ব বচনেরই সংজ্ঞার্থ নিরূপণ করেন। আর যখন তিনি বলেন দ্বিতীয় ধরনের বচনকে শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা দ্বারা জানা যায় তখন তিনি অভিজ্ঞতাপ্রসূত বচনকেই বোঝাতে চেয়েছেন।[১৪১

 হিউম অবশ্য অভিজ্ঞতাপূর্ব বলতে বিশ্লেষক এবং অভিজ্ঞতাপ্রসূত বলতে সংশ্লেষক বচনকে বুঝাচ্ছেন কি না এমন কিছু নিজে স্পষ্ট করে বলেননি। তবে আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদী এ. জে. এয়ার, বেসন, এন. কে. স্মিথ, [১৪২] ম্যাকনাব, [১৪৩] প্রমুখ মনে করেন, হিউমের সম্বন্ধ বিষয়ক সত্যতা বিশ্লেষক, এবং বাস্তব ঘটনা বিষয়ক সত্যতা সংশ্লেষক। কান্টও তাঁদের সঙ্গে একমত। এন্টনি ফ্লু এই মতের বিরোধিতা করেন।[১৪৪] এ প্রসঙ্গে কলেস্টোনের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। তাঁর মতে, হিউম যে সব বচনকে ধারণার সম্বন্ধ বলেছেন সে সব বচনকে বর্তমানে সাধারণভাবে বিশ্লেষক বচন এবং যে সব বচনকে বাস্তব ঘটনা সম্পর্কিত বলেছেন সে সব বচনকে সংশ্লেষক বচন নামে অভিহিত করা হয়। তাঁর মতে, অভিজ্ঞতাপূর্ব বচন, অর্থাৎ যে সব বচনের সত্যতা শুধু তাদের প্রতীকের অর্থের উপর নির্ভর করে সে সব বচনকে বিশ্লেষক বচন হিসেবে চিহ্নিত করা আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদীদের অবদান। তারাই এ বিষয়টিকে স্পষ্ট করেছেন যে, কোনো সংশ্লেষক বচনেরই অভিজ্ঞতাপূর্ব হওয়ার যোগ্যতা নাই। এগুলো শুধু অভিজ্ঞতামূলক প্রকল্প মাত্র। সুতরাং এ সব বচনের শুধু কম বা বেশি পরমিাণে সম্ভাব্যতা আছে। কোনো প্রকার নিশ্চয়তা নাই।

অভিজ্ঞতাবাদীদের এই অবদানের ফলে অভিজ্ঞতাপূর্ব সংশ্লেষক বচনের অস্তিত্ব স্বীকৃত হয়েছে। কান্ট এরকম বচনের কথা পরবর্তীকালে বলেছেন। এরূপ বচন বাস্তব ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে অথচ নিশ্চিত। কপলেস্টোন আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদীদের এই অবদানকে হিউমের মতের উন্নয়ন হিসেবে মূল্যায়ন করেন।[১৪৫] এ প্রসঙ্গে ম্যাকনাবের অভিমত কলেস্টোনের মতের সাথে অভিন্ন। ম্যাকনাবের মতে, বুদ্ধিবাদী অধিবিদ্যার বিরুদ্ধে আধুনিক অভিজ্ঞতাবাদীদের ব্যবহৃত সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র হলো, অভিজ্ঞতাপূর্ব বচন সংশ্লেষক হতে পারে না। এবং এ তথ্য হিউমেরই আবিষ্কার।[১৪৬] রাসেলের মতে, হিউম অনিশ্চিত জ্ঞান বলতে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে বুঝিয়েছেন। এই জ্ঞান প্রমাণমূলক নয়। এ ধরনের জ্ঞান অতীত ও বর্তমান সম্পর্কিত জ্ঞানের অপর্যবেক্ষিত অংশকে এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করে। বস্তুতপক্ষে, এরূপ জ্ঞান প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ, যুক্তিবিদ্যা ও গণিত ছাড়া অন্য সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই ধরনের সম্ভাব্য জ্ঞানের বিশ্লেষণ হিউমকে এমন নির্দিষ্ট সংশয়বাদী সিদ্ধান্তে উপনীত করে যা গ্রহণ করা ও বর্জন করা উভয়ই সমানভাবে কষ্টকর। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দার্শনিকদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রতিভাত হয়। এই চ্যালেঞ্জের উত্তর আজ পর্যন্ত যথার্থভাবে দেওয়া সম্ভব হয়নি।[১৪৭]

হিউম প্রদত্ত জ্ঞানের বিষয়ের উপরিল্লিখিত শ্রেণিবিভাগ থেকে দেখা যায়, ধারণার সম্বন্ধ সম্পর্কিত বচনের নিশ্চয়তা চিন্তামূলক, তথা অভিজ্ঞতাপূর্ব। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাস্তব ঘটনা সম্পর্কিত বচনের নিশ্চয়তার প্রমাণ কী? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই হিউমের মতবাদ সংশয়বাদে পর্যবসিত হয়। কেননা, হিউম মনে করেন, বাস্তব ঘটনা সম্পর্কিত বচন সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়ার জন্য আমরা যে সব ন্যায়ক্রিয়া ব্যবহার করি তার সবগুলোই কার্যকারণ সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। এ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হলো, বাস্তব ঘটনা সম্পর্কে যে সাক্ষ্য প্রমাণ আমাদের সুনিশ্চিত করে তার প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হতে গেলে আমাদের অবশ্যই জানতে হবে কীভাবে আমরা কার্যকারণের জ্ঞান লাভ করি।[১৪৮]

কিন্তু কার্যকারণ সম্পর্কিত পূর্বোক্ত আলোচনায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, কার্যকারণে আবশ্যিক সম্পর্ককে হিউম ব্যক্তির মনোগত ব্যাপার বলেছেন। কারণ, এটা ব্যক্তির অভ্যাসজনিত প্রবণতার ফল। অর্থাৎ এর কোনো সর্বজনীন মানদণ্ড নেই। এর মানদণ্ড ব্যক্তিসাপেক্ষ। সুতরাং সম্ভাব্য। কার্যকারণের এরূপ ব্যাখ্যার ফলস্বরূপ হিউমের কাছে বাস্তব ঘটনা সম্পর্কিত সকল বিষয়ই কার্যকারণের মতো ব্যক্তির অভ্যাসের ফল তথা ব্যক্তিসাপেক্ষ ও সম্ভাব্য বিষয়ে পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর Treatise গ্রন্থে বলেন, কিন্তু বাস্তব বিষয় সম্পর্কিত সব ন্যায়ক্রিয়াই শুধু অভ্যাস হতে গঠিত হয়ে থাকে। আর অভ্যাস হলো কোনো কিছুকে বার বার প্রত্যক্ষণ করার ফল।[১৪৯]

Enquiry গ্রন্থে বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট করে তিনি বলেন, বাস্তব ঘটনা বা বাস্তব অস্তিত্ব (real existence) সম্বন্ধে সব বিশ্বাসই স্মৃতি বা ইন্দ্রিয়ের কাছে উপস্থিত নিছক কোনো বস্তু এবং সেই বস্তু বা অন্য কোনো বস্তুর অভ্যাসগত সংযোগ (customary con- junction) থেকে উদ্ভুত।[১৫০] তিনি এই অভ্যাসকে উপকার পেলে অপরের প্রতি যে ভালবাসা এবং ক্ষতি হলে যে ঘৃণার ভাব আমাদের মনে জেগে ওঠে সেই মানসিক স্বাভাবিক (nat- ural) প্রভৃতির সঙ্গে তুলনা করেন। তাঁর মতে, কোনো ন্যায়ক্রিয়া অথবা চিন্তাপদ্ধতি অথবা বোধক্রিয়া এই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে উৎপন্নও করতে পারে না আবার বাধাও দিতে পারে না। এটা হলো এক বিশেষ অবস্থায় মনকে স্থাপন করার অনিবার্য পরিণতি। এককথায়, হিউম মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বাস্তব ঘটনা সম্পর্কিত আমাদের জ্ঞানের বিষয়ীবাদী ব্যাখ্যা দিয়েছেন।[১৫১] এর ফলে বাস্তব ঘটনা সম্পর্কিত জ্ঞানের সর্বজনীনতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।

লক বাহ্য বস্তু সম্পর্কে প্রতীকবাদী বাস্তববাদ প্রচার করে একথা বলেছিলেন যে, বস্তুকে আমরা তার মুখ্য ও গৌণ গুণের মাধ্যমে জানি। তিনি মুখ্য ও গৌণ গুণের দ্বারা সৃষ্ট বস্তুর ধারণাকে বস্তুর অনুরূপ বলেন। বার্কলে মুখ্য ও গৌণ গুণের পার্থক্য অস্বীকার করতে গিয়ে সকল গুণকেই মূলত গৌণ গুণ বলেন। কারণ, তিনি বস্তুর গুণ থেকে বস্তুর ধারণাকে আলাদা করেন না। তাঁর মতে বস্তু ও বস্তুর ধারণা অভিন্ন। আর ধারণা মানেই মনের ধারণা। সুতরাং বাহ্য বস্তু হলো মনের ধারণা। এতে তার মতবাদ আত্মগত ভাববাদে রূপ নেয়। হিউম লকের প্রতীকবাদ ও বার্কলের আত্মগত ভাববাদকে বর্জন করে বাহ্য বস্তু ও প্রত্যক্ষণকে অভিন্ন বলে ঘোষণা করেন। তিনি লকের সমালোচনা করে বলে, প্রত্যক্ষণগুলো এর সদৃশ কোনো বাহ্য বস্তু দ্বারা উৎপন্ন হয়—এ কথা অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে না। আবার বার্কলের সমালোচনা করে বলেন, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সব গুণ মনে অবস্থিত, বস্তুতে নয়—এই ধারণা জড়ের ধ্বংস সাধন করে। এই অবস্থায় জড় অজ্ঞাত অব্যাখ্যাত কিছু হয়ে পড়ে। সুতরাং এ ধারণাও ত্রুটিপূর্ণ।[১৫২]

বাহ্যবস্তুর বিরামহীন অস্তিত্ব সম্পর্কে হিউম গঠনমূলক যে ব্যাখ্যা দেন সে ব্যাখ্যাও কার্যকারণের আবশ্যিক সম্পর্কের মতো। তিনি বাহ্যবস্তুর বিরামহীন অস্তিত্বের ধারণাকে ধারণার সম্বন্ধ নয় বরং বাস্তব ঘটনা সম্পর্কিত বিষয় বলে মনে করেন। সুতরাং এই ধারণাও সম্ভাব্য। এই ধারণা ব্যক্তি নিরপেক্ষ বা বস্তুগত নয় বরং জ্ঞাতার মনোগত। এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর পূর্বসূরি লক বার্কলে প্রদত্ত বাহ্যবস্তুসংক্রান্ত ব্যাখ্যারও ত্রুটি নির্দেশ করেন। তাই লক ও বার্কলে প্রদত্ত বাহ্যবস্তুর ধারণা বর্জন করে তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রতিরূপ বা প্রত্যক্ষণকেই বাহ্যবস্তু হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং এ কথা বলেন যে, সরাসরি প্রত্যক্ষণের বাইরে প্রত্যক্ষণের কারণরূপ কোনো বস্তুর অস্তিত্ব প্রমাণ করা অসম্ভব। কারণ তাঁর মতে, মনের কাছে বস্তুর প্রত্যক্ষণ ছাড়া আর কিছুই উপস্থিত থাকে না। বস্তুর সাথে প্রত্যক্ষণের কারণ রূপ কোনো বস্তুর সম্পর্কের কোনো অভিজ্ঞতা মন লাভ করতে পারে না। প্রত্যক্ষণগুলো তাদের কোনো সদৃশ্য বাহ্য বস্তু দ্বারা সৃষ্টি হয় কি-না, এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা নির্বাক।[১৫৩]

হিউম তাঁর Treatise গ্রন্থে যুক্তি প্রমাণের সাহায্যে যে মত প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হন তা হলো, সব প্রত্যক্ষণই আমাদের ইন্দ্রিয়ের উপর এবং আমাদের স্নায়ুতন্ত্র ও মেজাজের প্রবণতার উপর নির্ভরশীল। এদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রত্যক্ষণগুলোর যেমন কোনো স্বাধীন সত্তা নেই তেমনি এদের কোনো বিরামহীন সত্তাও নেই।[১৫৪] বাহ্য জগতের বিরামহীন অস্তিত্বের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি কার্যকারণ সম্পর্কের মতো এক্ষেত্রেও মানুষের প্রকৃতিগত প্রবৃত্তি বা পূর্ব সংস্কারকে দায়ী করেন। তাঁর মতে, মানুষ তার প্রকৃতিগত প্রবৃত্তির কারণে ইন্দ্রিয়ের উপর আস্থা স্থাপন করে এবং কোনো যুক্তির ব্যবহার না করেই বাহ্যজগৎ এবং এর বিরামহীন অস্তিত্ব অনুমান করে।[১৫৫] তাঁর মতে, আমরা যে পৃথিবীকে বাস্তব ও স্থিতিশীল বলে মনে করে এসেছি এবং আমার প্রত্যক্ষণের কাছে অনুপস্থিত থাকার সময়েও তাকে অস্তিত্বশীল মনে করেছি এটা এক স্বাভাবিক (natural) বিবেচনার ফলশ্রুতি।[১৫৬]

কারণ ও কার্যের মধ্যে ব্যক্তিনিরপেক্ষ আবশ্যিক সম্পর্ক এবং এ সাথে বাহ্যবস্তুর ব্যক্তিনিরপেক্ষ বিরামহীন অস্তিত্ব অস্বীকার করায় হিউমের কাছে বাস্তব ঘটনা সম্পর্কিত জ্ঞানের সর্বজনীনতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসহ সকল বিজ্ঞানের জ্ঞান হয়ে পড়ে অনিশ্চিত ও ব্যক্তিসাপেক্ষ। এই অবস্থায়ই তাঁর মতবাদ সংশয়বাদে রূপ নেয়।

প্রশ্ন হলো, হিউমের সংশয়বাদের প্রকৃতি কী? তাঁকে কীরূপ সংশয়বাদী বলা যায়? হিউম তাঁর Treatise ও Enquiry উভয় গ্রন্থেই সংশয়বাদ সম্পর্কে আলোচনা করেন। তবে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে নিজের অনুসারিত মত সম্পর্কে কিছু বলেননি। Treatise গ্রন্থের প্রথম পুস্তকের চতুর্থ অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে তিনি বলেন :

আমাকে হয়তো জিজ্ঞেস করা হবে…আমি কি সত্যিই এমন একজন সংশয়বাদী যিনি মনে করেন, সবকিছুই অনিশ্চিত এবং কোনো বিষয়েই আমাদের বিচার সত্য মিথ্যার ধার ধারে না। এর উত্তরে আমি বলবো, প্রশ্নটি সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক এবং আমি কিংবা অন্য কেউ কখনো এই মত আন্তরিকভাবে সব সময় পোষণ করিনি।[১৫৭]

অর্থাৎ যে সংশয়বাদী জ্ঞানের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করেন হিউম এমন চূড়ান্ত সংশয়বাদী নন। এছাড়া তিনি তাঁর Enquitry গ্রন্থের দ্বাদশ অধ্যায়ে দুই ধরনের সংশয়বাদের মধ্যে পার্থক্য করেন।[১৫৮] সংযত সংশয়বাদ ও চূড়ান্ত সংশয়বাদ। তিনি সংযত সংশয়বাদী।[১৫৯] তিনি যা প্রমাণ করতে চেয়েছেন তা হলো, একমাত্র ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাই সকল প্রকার জ্ঞানের উৎস। বুদ্ধিবাদীদের স্বীকৃত সহজাত ধারণার নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বুদ্ধিবাদের ‘ধারণা’ শব্দটির অর্থ সুস্পষ্ট করেন, এবং দ্ব্যর্থবোধকতা ও শূন্যগর্ভ ব্যবহারের হাত থেকে এ শব্দটিকে মুক্ত করেন। এছাড়া তিনি অত্যন্ত বিশ্লেষণাত্মক আলোচনার মাধ্যমে তাঁর চরম অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদকে প্রকাশ করেন যার মূলকথা হলো, সরল ইন্দ্রিয়ছাপই জ্ঞানোৎপত্তির মূল ভিত্তি। নিউটন যেমন পদার্থবিজ্ঞানের মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করেন হিউমও তেমনি মানব প্রকৃতি বিজ্ঞানে ইন্দ্ৰিয়ছাপ ও ধারণাসূত্রের আবিষ্কার করেন।[১৬০] তাঁর এই মতবাদের সাথে চার্বাক দার্শনিকদের জ্ঞানোৎপত্তিসংক্রান্ত মতের যথেষ্ট মিল দেখা যায়।

(১) অভিজ্ঞতার অতীত যে সব ধারণার অস্তিত্ব আমাদের মনে আছে সেগুলোর উৎপত্তির কারণ হিসেবে হিউম ধারণার অনুষঙ্গ নিয়ম অর্থাৎ দেশকালের সান্নিধ্য, সাদৃশ্য ও কার্যকারণ—এই তিনটি সম্বন্ধ আবিষ্কার করেছেন। এই তিনটি সম্বন্ধের ফলে মনস্তাত্ত্বিক কারণে আমরা অভিজ্ঞতা-ঊর্ধ্ব বিষয়গুলোর ধারণা গঠন করি। এ অনুষঙ্গ তিনটির ভিত্তি হলো স্মৃতি ও কল্পনা। অনুষঙ্গজাত ধারণাগুলো যে নিশ্চিত জ্ঞান দিতে পারে না তা হিউম স্পষ্টভাবে নির্দেশ করেন। এতে তাঁর জ্ঞানবিদ্যায় ভ্রান্ত জ্ঞানের ব্যাখ্যাও সংযোজিত হয়েছে। এসাথে তিনি দেখাতে সমর্থ হয়েছেন যে, স্মৃতি ও কল্পনার সীমা ইন্দ্রিয়ছাপের সীমা দ্বারাই নির্দেশিত হয়। এর ফলে বার্কলের হাতে অনির্দিষ্ট হয়ে যাওয়া জ্ঞানের সীমা হিউমের হাতে এসে অভিজ্ঞতার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়, জ্ঞান থেকে অভিজ্ঞতা-ঊর্ধ্ব উপাদান বর্জিত হয় এবং অভিজ্ঞতা—ঊর্ধ্ব ধারণাবলিরও একটি অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

(২) হিউম তাঁর ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণা মতবাদের দ্বারা অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ দ্রব্য, আত্মা, কার্যকারণের সম্পর্ক ইত্যাদি ধারণাকে খণ্ডন করেন। এসব ধারণাকে খণ্ডন করার সাথে সাথে তিনি অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এদের নতুন ব্যাখ্যাও প্রদান করেন। দ্রব্য বা আত্মা সম্পর্কিত তাঁর এই ব্যাখ্যাকে পুঞ্জবাদ, এবং কার্যকারণ সম্পর্কিত ব্যাখ্যাকে আকস্মিকতাবাদ বলা হয়। তাঁর এই নতুন ব্যাখ্যার মূল ভিত্তি ছিল মনস্তত্ত্ব।

লক ও বার্কলে অভিজ্ঞতাবাদী হওয়া সত্ত্বেও দ্রব্য, আত্মা ও কার্যকারণ সম্পর্ককে স্বীকার করে অভিজ্ঞতাবাদের ক্ষেত্রে যে অসঙ্গতি সম্পাদন করেছিলেন হিউমের হাতে এর নিরসন হয়। হিউম কার্যকারণের আবশ্যিক সম্পর্ককে আরোপিত মানসিক প্রবণতা হিসেবে আখ্যায়িত করে আকস্মিকতাবাদী মতবাদ প্রদান করেন। তা তাঁর অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যা তথা সামগ্রিক দর্শনকে ঐতিহাসিক মর্যাদা দান করে। এতে নিউটনীয় প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ভিত্তি আরোহানুমানের নিশ্চয়তা প্রশ্নের সম্মুখীন হয় এবং আরোহ নির্ভর কার্যকারণ তথা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের জ্ঞান আকস্মিক বলে পরিগণিত হয়। এ ছাড়াও, হিউমের জ্ঞানবিদ্যা শেষ পর্যন্ত সংশয়বাদে রূপ নেয়। এর মাধ্যমে তিনি যে দিকটির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তা হলো, একজন সঙ্গতিপূর্ণ অভিজ্ঞতাবাদীর পক্ষে সংশয়বাদকে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। তাঁর এই আকস্মিকতাবাদ আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদী তত্ত্ব দ্বারা সমর্থিত হয়। মূলত হিউম তাঁর কার্যকারণ তত্ত্বে অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকদের জন্য একটি নতুন ধারার সূচনা করেন, এবং দর্শন ও বিজ্ঞানের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ রেখে যান। হিউমের আত্মা সম্পর্কিত পুঞ্জবাদের সাথে চার্বাকদের দেহাত্মবাদের অমিল থাকলেও কার্যকারণ সম্পর্কিত আকস্মিকতাবাদের সাথে চার্বাকদের কার্যকারণ খণ্ডনের যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়।

(৩) পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে হিউমই প্রথম দার্শনিক যিনি তাঁর সংশয়বাদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে সংশয়ের বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করেন। তিনি ধারণার সম্পর্ককে নিশ্চিত জ্ঞানের বিষয় এবং বাস্তব ঘটনা বা তথ্যগত বিষয়কে সম্ভাব্য জ্ঞানের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেন। ফলে একদিকে জ্ঞানের জগৎ থেকে সংশয়ের জগৎ স্পষ্টত আলাদা হয়, অন্যদিকে হিউমের সংশয়বাদ পূর্ববর্তী সকল সংশয়বাদের চেয়ে যৌক্তিক, তথা উন্নত রূপলাভ করে। হিউমের ব্যাখ্যায় সংশয়বাদের ধ্বংসাত্মক রূপ বর্জিত হয় এবং সংশয়বাদ একটি গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করে। তিনি একথা প্রমাণ করেন যে, তথ্যগত বিষয়ের জ্ঞানের ক্ষেত্রে একজন যৌক্তিক অনুসন্ধানকারীর সম্ভাব্যতার উপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নাই। তাঁর এই আবিষ্কার দর্শন ও বিজ্ঞানের জগতে একটি মাইলফলক।

উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, হিউম আধুনিক যুগের দর্শনে একটি অতি প্রাচীন জ্ঞানবিদ্যাগত ধারা তথা অভিজ্ঞতাবাদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তবে তাঁর হাতে অভিজ্ঞতাবাদ সুসমন্বিত ও যৌক্তিক রূপলাভ করে। তিনি অভিজ্ঞতাবাদীদের দ্বারা ব্যবহৃত প্রত্যক্ষণ, ইন্দ্ৰিয়ছাপ, ধারণা ইত্যাদি বিভিন্ন ধারণার বিশ্লেষণ করে যেমন এগুলোর সঠিক ও সুনির্দিষ্ট অর্থ খুঁজে পাবার প্রয়াস নেন তেমনি অভিজ্ঞতাবাদ থেকে সকল প্রকার অভিজ্ঞতাবহির্ভূত ধারণাকে দৃঢ়ভাবে বর্জন করেন এবং এদের অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যা দেন। এছাড়াও তিনি অভিজ্ঞতাবাদের যৌক্তিক পরিণতির প্রতি দিক নির্দেশ করেন। এ কারণে একজন সঙ্গতিপূর্ণ অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে হিউমের নাম চিরস্মরণীয়। তাঁর মতবাদ দর্শন ও বিজ্ঞানের ভিতকে নাড়া দেয়। বিশ শতকের যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদী ও উপযোগবাদী দার্শনিক মতবাদে এবং আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদী বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে হিউমের অভিজ্ঞতাবাদী চিন্তার যথেষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। প্রখ্যাত জ্ঞানতাত্ত্বিক, জার্মান দার্শনিক কান্ট তাঁর বুদ্ধিবাদের বিচারবিযুক্ত মোহনিদ্রা থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে হিউমের অবদানকে নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন। এসব কারণে বলা যায়, পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে হিউমের ভূমিকা ও অবস্থান অনন্য এবং উল্লেখযোগ্য।

আলোচনার অগ্রগতিতে আমি অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারার ব্রিটিশ প্রতিনিধি হিসেবে পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে হিউমের স্থান নির্ণয় করবো।

পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যায় হিউমের অবস্থান

পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে ডেভিড হিউম একটি উল্লেখযোগ্য নাম। জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে তাঁর সমর্থিত মতবাদ বা অভিজ্ঞতাবাদ নতুন মতবাদ নয়। এর প্রাচীন ইতিহ্য রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব সাতশত অব্দেরও পূর্বে ভারতীয় দার্শনিক চার্বাকদের হাতে সর্বপ্রথম এই মতবাদের সূচনা হয়। অন্যদিকে পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে প্রাচীন যুগের সোফিস্ট দার্শনিকদের হাতে এই মতবাদের প্রাতিষ্ঠানিক গোড়াপত্তন হয়। হিউম এই মতবাদের আধুনিক যুগের প্রতিনিধি। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসের প্রেক্ষিতে বিচার করলেও হিউমের পূর্বে অভিজ্ঞতাবাদের এক হাজার বছরের বেশি সময়ের ইতিহাস পাওয়া যায়। তথাপিও একথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, অভিজ্ঞতাবাদের ইতিহাসে হিউমের মতবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কেননা, তাঁর মতবাদে অভিজ্ঞতাবাদ চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। সতেরো শতকের দার্শনিক হিসেবে হিউম তাঁর উপর ইতিহাস নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাবাদীদের মতবাদকে বিচারবুদ্ধির আলোকে যাচাই করে এর ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশনা দেন, যার উপর তাঁর সময়কার জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তিনি দর্শনকে জ্ঞানের অন্যতম শাখা বিজ্ঞান থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা করে দেখেনি। তাই বিজ্ঞানের পদ্ধতিকে তাঁর মতবাদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি মূলত বিজ্ঞানেরও দার্শনিকীকরণ করেন। তাই, পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যায় হিউমের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য তাঁর দর্শনচর্চার প্রেক্ষাপট এবং তাঁর সময়কে বিশেষভাবে জানা প্রয়োজন।

হিউমের কালের উপর প্রধানত পূর্ববর্তী চারটি চিন্তাধারার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। দর্শনের ইতিহাসে প্রাচীনকালে প্লেটো, এরিস্টটল এবং মধ্যযুগে সেন্ট অগাস্টিন সমর্থিত বুদ্ধিবাদী যে ধারার পরিচয় পাওয়া যায় রেনেসাঁ-পরবর্তী দর্শনের ইতিহাসে সে ধারা একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করে। রেনেসাঁর পরে এই ধারার সমর্থকদের মধ্যে হস্‌, দেকার্ত, লাইবনিজ, স্পিনোজা, প্রমুখ দার্শনিক উল্লেখযোগ্য। এসব দার্শনিক অবরোহ পদ্ধতির সমর্থক ছিলেন। তাঁরাই প্রথম দর্শনে সুষ্ঠুভাবে অবরোহ পদ্ধতির প্রয়োগ করেন এবং প্রধানত ঈশ্বর, আত্মা, বিশ্বজগৎ ইত্যাদি বিষয়কে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এসব ধারণা থেকে অবরোহাত্মকভাবে বিশেষ ঘটনার সত্যতা যাচাই করেন। এদের সকলেই জ্ঞানোৎপত্তির উপায় হিসেবে অভিজ্ঞতার অবদানকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেন। তাঁরা অভিজ্ঞতাপূর্ব বুদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং বুদ্ধিবাদকে জ্ঞানোৎপত্তির একমাত্র মতবাদ হিসেবে স্বীকৃতি দেন।

হিউমের কালের উপর দ্বিতীয় যে চিন্তাধারার প্রভাব ছিল তা হলো অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক ধারা। প্রাচীন যুগের সোফিস্ট পিকিউরিয়াস, জেনো এবং মধ্যযুগে সেন্ট থমাস একুইনাস সমর্থিত অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত ধারা রেনেসাঁ পরবর্তী বিজ্ঞান বিপ্লবের প্রভাবে আধুনিক ব্রিটিশ দর্শনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করে। আধুনিক দর্শনে প্রধানত বেকন, লক ও বার্কলে এ ধারার অন্যতম সমর্থক। এসব দার্শনিক বুদ্ধিবাদীদের সমর্থিত মতবাদ খণ্ডন করেন। আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জ্ঞানের ক্ষেত্রে অবরোহাত্মক পদ্ধতির স্থলে আরোহ পদ্ধতির প্রচলন করেন। জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে আরোহ পদ্ধতির মাধ্যমে তাঁরা বিশেষ থেকে সার্বিক জ্ঞানলাভ সম্ভব বলে দাবি করেন। ফলে জ্ঞানের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাপূর্ব উপাদানের গুরুত্ব অস্বীকৃত হয়।

হিউম পূর্ববর্তী দর্শনের ইতিহাসে তৃতীয় যে প্রভাবশালী দার্শনিক ধারা দেখা যায় তা হলো সংশয়বাদ। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের গ্রিক দার্শনিক পাইরোর হাতে দার্শনিক পদ্ধতি হিসেবে সংশয়বাদের প্রথম পূর্ণাঙ্গ আত্মপ্রকাশ ঘটে। অতপর টাইমন-আর্কেসিলাস, কার্নিয়াডিস, এনাসিডেমাস এবং সেক্সটাস এমপিরিকাসের চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে এই ধারা প্রবাহিত হয়। মধ্যযুগে সেন্ট অগাস্টিন ও উইলিয়াম অব অকাম এর প্রতিনিধিত্ব করেন। রেনেসাঁ যুগের বিখ্যাত খ্রিস্টান চিন্তাবিদ ইরাসমাস ও মার্টিন লুথারের ধর্মীয় বিতর্কে খ্রিস্টীয় সংশয়বাদের পুনর্জাগরণ ঘটে। ষোল শতকে ফ্রান্সে মাইকেল ডি, মন্‌টেইন, পাইরে সারন, সতেরো শতকে পেরি গেসেন্ডি, রেনে দেকার্ত এবং পিয়ারে বাইল এই ধারার অন্যতম ধারক। অবশ্য দেকার্তের সংশয়বাদ যদিও সিদ্ধান্তগত সংশয়বাদে রূপলাভ করেনি তবুও তাঁর সমর্থক পিয়ারে বাইল সংশয়বাদের একজন জোর সমর্থক হিসেবে প্রতিভাত হন। উল্লেখ্য যে, বাইল ছিলেন হিউমের প্রিয় লেখক।[১৬১]

হিউমের যুগের উপর প্রভাব বিস্তারকারী অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নবজাগরণ। যে সব বিজ্ঞানীর অধ্যবসায় ও আত্মত্যাগ বিজ্ঞানের নবজাগরণ সূচিত করে তাঁদের মধ্যে কোপার্নিকাস, কেপলার, গ্যালিলিও এবং নিউটন উল্লেখযোগ্য। এসব বিজ্ঞানীর উল্লেখযোগ্য অবদানের ফলেই মধ্যযুগীয় ধর্মীয় প্রাধিকারবাদ থেকে দর্শন মুক্তিলাভ করতে সমর্থ হয় এবং দর্শনে ব্যক্তিমানুষের পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানলব্ধ জ্ঞানের গুরুত্ব স্বীকৃতি পায়। এই সময়ের অনেক দার্শনিক জ্ঞানবিদ্যার আলোচনার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করেন।[১৬২] এ যুগের উপর নিউটনের প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। তিনি প্রাকৃতিক জগৎ থেকে অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আরোহাত্মক পদ্ধতিতে সত্যতা নিরূপণের অনুসারী ছিলেন। তাঁর এ পদ্ধতিকে লক, বার্কলে প্রমুখ অভিজ্ঞতাবাদী প্রত্যক্ষভাবে গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, নিউটনের তত্ত্ব যখন এডেনবার্গে পাঠ্য বিষয় তখন হিউম সেখানকার ছাত্র ছিলেন।

উপরের আলোচনা থেকে একথা বলা যায় যে, বুদ্ধিবাদ, অভিজ্ঞতাবাদ, সংশয়বাদ ও নিউটনীয় বিজ্ঞান—এই চারটি চিন্তাধারার উপস্থিতি হিউমের দর্শনের প্রেক্ষাপট নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। হিউম বুদ্ধিবাদী ধারাটিকে বর্জন করে অভিজ্ঞতাবাদী ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকগণ অভিজ্ঞতাবাদের ক্ষেত্রে যেসব ত্রুটি সম্পাদন করেছিলেন হিউম তা থেকে অভিজ্ঞতাবাদকে মুক্ত করতে প্রয়াসী হন। এর ফলে, তাঁর হাতে অভিজ্ঞতাবাদের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে সংশয়বাদে। তবে এ সংশয়বাদ পাইরোবাদী সংশয়বাদ বা চূড়ান্ত সংশয়বাদ ছিল না। বরং তাঁর সংশয়বাদ ছিল গঠনমূলক ও জীবনধর্মী। তাঁর মতবাদের আগাগোড়াই তিনি নিউটনীয় বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিকে একমাত্র পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি মূলত ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদের উপর নিউটনের অভিজ্ঞতামূলক পদ্ধতির প্রয়োগ করে মানব মনের চিন্তার ক্ষমতা ও সূত্রাবলি আবিষ্কার করেন। নিউটন যেমন পদার্থবিজ্ঞানে সকল প্রকার প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যার জন্য প্রাকৃতিক জগতে একমাত্ৰ কেন্দ্ৰীয় নিয়ম মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করেন হিউমও তেমনি মানব-প্রকৃতি-বিজ্ঞানে তথা মানব মনের চিন্তার ক্ষমতা ও সূত্রাবলি ব্যাখ্যার লক্ষ্যে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ম আবিষ্কার করতে আগ্রহী হন। এই নিয়মটি হবে বিজ্ঞানের মতো বিশুদ্ধ পরীক্ষণাত্মক এবং যার কষ্টিপাথরে বুদ্ধিবাদী অধিবিদ্যার প্রকল্পগুলো যাচাই করা যায়। তাঁর আবিষ্কৃত নিয়ম হলো ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণাতত্ত্ব। এর মূল কথা হলো, প্রতিটি সরল ধারণাই সরল ইন্দ্রিয়ছাপের অনুলিপি। তিনি নিজেই একে মানব প্রকৃতি বিজ্ঞানের প্রথম সূত্র বলেছেন। দর্শনের ইতিহাসে এই সূত্রকে হিউমের অনুবীক্ষণ, হিউমের ক্ষুর, হিউমের কাঁটাচামচ ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করা হয়।[১৬৩]

হিউম-পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে হিউমের অভিজ্ঞতাবাদের বিশেষত্ব নির্ণয় করতে হলে উপরের সূত্রটিকে একটি অন্যতম আবিষ্কার হিসেবে গণ্য করতে হয়। কেননা, এ সূত্রের সাহায্যেই তিনি তাঁর পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদ থেকে সকল অসঙ্গতিপূর্ণ উপদান বর্জনে সক্ষম হয়েছেন।

ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণাতত্ত্বের দ্বারা তিনি তিন দিক থেকে পূর্ববর্তী লক ও বার্কলের অভিজ্ঞতাবাদের উন্নতি সাধন করেন। প্রথমত, শব্দগত দিক থেকে। লকের ব্যবহৃত ‘সংবেদন’ ও ‘অন্তদর্শন’ শব্দ দুটিকে তিনি ‘ইন্দ্ৰিয়ছাপ’ নামে অভিহিত করেন এবং ‘ধারণা’ শব্দটিকে এর প্রতিরূপ অর্থে গ্রহণ করেন। হিউমের হাতেই ‘ধারণা’ শব্দটি একটি সঠিক ও নির্দিষ্ট অর্থ লাভ করে। দ্বিতীয়ত, ধারণাকে ইন্দ্রিয়ছাপের উপর নির্ভরশীল করে তিনি সুষ্ঠুভাবে বুদ্ধির বিষয়কে অভিজ্ঞতার অনুবর্তী করেন, যা লক ও বার্কলের দর্শনে এতো সুস্পষ্ট রূপলাভ করেনি। তৃতীয়ত, তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে তাঁর ইন্দ্রিয়ছাপ ও ধারণাতত্ত্বের ওপর অবস্থান নেন। লক ও বার্কলে উভয়ই অভিজ্ঞতাবাদী, এ সত্ত্বেও আধিবিদ্যক ধারণাগুলোকে স্বীকার করে চূড়ান্ত পর্যায়ে অভিজ্ঞতাবাদ থেকে সরে গিয়েছিলেন, যা হিউমের ক্ষেত্রে ঘটেনি।

হিউমের অভিজ্ঞতাবাদকে মাত্র দুটি বচনে সংক্ষেপিত করা যায়। যথা :

(১) সকল ধারণাই ইন্দ্রিয়ছাপের অনুলিপি; এবং

(২) বাস্তব তথ্যকে কখনোই প্রাকসিদ্ধ বা অভিজ্ঞতাপূর্ব উপায়ে প্রমাণ করা যায় না। একে অবশ্যই অভিজ্ঞতা থেকে আবিষ্কার বা অনুমান করতে হয়।

এই দুটি বচন থেকে প্রমাণিত হয় যে, আধিবিদ্যক পদ্ধতিসমূহ, যা ঈশ্বর, আদি কারণ, অতীন্দ্রিয় সত্তা ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান দেয়, তা অর্থহীন। এমনকি, যদিও এগুলো থেকে থাকে তবুও এদেরকে যথার্থ বলে প্রমাণ করা যায় না। এর ফলে, প্লেটো থেকে শুরু করে দেকার্ত পর্যন্ত বুদ্ধিবাদীদের দ্বারা স্বীকৃত তত্ত্ববিদ্যাগত ধারণা বর্জিত হয়। পরবর্তীকালে যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীদের অধিবিদ্যার অর্থহীনতা প্রতিপাদন সম্পর্কিত মতবাদে হিউমের এই ধারণার অনুরণন শোনা যায়।

জ্ঞানের বিষয়কে ধারণার সম্পর্ক ও বাস্তব বিষয়—এই দুই ভাগে বিভক্ত করে হিউম দর্শনের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো বুদ্ধিজাত জ্ঞান থেকে অভিজ্ঞতাজাত জ্ঞানকে সুস্পষ্টভাবে আলাদা করেন। এ বিষয়টি তাঁর জ্ঞানবিদ্যাকে অভূতপূর্ব মর্যাদা দান করে। তিনি ধারণার সম্বন্ধকে নিশ্চিত এবং বাস্তব তথ্যকে সম্ভাব্য হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ থেকে তাঁর দর্শনের যে দুটি বিশেষ দিক পাওয়া যায় তা হলো, (১) কার্যকারণের আবশ্যিক সম্পর্কের প্রকৃতি সম্পর্কিত বিশেষত্ব, এবং (২) অস্তিত্বমূলক বচন সম্পর্কিত বিশেষত্ব।

কার্যকারণের ক্ষেত্রে তাঁর আবিষ্কার হলো, কার্য ও কারণের সম্পর্ককে কোনোভাবেই বাস্তব তথ্যের অভিজ্ঞতা দ্বারা আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। তাই এই সম্পর্ক সম্ভাব্য। হিউমের এই আবিষ্কার কার্যকারণ সম্পর্কের নিশ্চিতি সম্পর্কিত পূর্ববর্তী বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের, এমনকি অভিজ্ঞতাবাদী লক ও বার্কলের মতবাদকে খণ্ডন করে। এছাড়া, এই মতবাদ প্রভাব সৃষ্টিকারী সমকালীন নিউটনীয় বৈজ্ঞানিক সূত্রকেও চ্যালেঞ্জ করে। কারণ নিউটনীয় বিজ্ঞানের আরোহাত্মক পদ্ধতি ছিল কার্যকারণের আবশ্যিকতা নির্ভর। নিউটন কার্যকারণ নির্ভর আরোহ পদ্ধতিতে নিশ্চিত জ্ঞান পাওয়া যায় বলে মনে করতেন।

অন্যদিকে, অস্তিত্বমূলক বচন সম্পর্কে তাঁর আবিষ্কার হলো, প্রতিটি অস্তিত্বমূলক বচনই তথ্যগত বিষয় সম্পর্কিত। এর সত্যতা অবশ্যই অভিজ্ঞতায় যাচাইযোগ্য হবে। সুতরাং ঈশ্বরের অস্তিত্বসহ অন্যান্য আধিবিদ্যক সত্তার অস্তিত্বের ধারণা প্রাকসিদ্ধ বা অভিজ্ঞতাপূর্ব পদ্ধতিতে প্রমাণিত নয়।[১৬৪] ফলে, তাঁর হাতে অধিবিদ্যা অত্যন্ত সহজভাবে বর্জিত হয়।

হিউম ধারণার সম্বন্ধ ও তথ্যগত বিষয়ের মধ্যে যে পার্থক্য নির্ণয় করেন তা তাঁর হাতে সংশয়বাদের অস্ত্র তুলে দেয়। এর দ্বারা তিনি সংখ্যা ও পরিমাণ সম্পর্কিত বিমূর্ত চিন্তন এবং বাস্তব বিষয় সম্পর্কিত পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান ছাড়া আর সব কিছুকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করতে সমর্থ হন। অধিবিদ্যা এই দুই বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত নয় বলে অধিবিদ্যাকে বর্জন করতেও তিনি সমর্থ হন। এ কাজ লক ও বার্কলের দ্বারা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালের দার্শনিক মতবাদে সংশ্লেষণী ও বিশ্লেষণী, অভিজ্ঞতাপূর্ব ও অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণার মধ্যে পার্থক্যকরণের যে শক্তিশালী ধারাটি গড়ে ওঠে তা হিউমের মতবাদেরই স্বীকৃতিস্বরূপ।

এই পার্থক্যকরণের ফলে হিউমের সংশয়বাদ পাইরোবাদী সংশয়বাদের চেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লাভ করে। হিউম কার্যকারণ নির্ভর আরোহের মাধ্যমে সার্বিক জ্ঞানলাভ অসম্ভব বলে ঘোষণা করে তথ্যগত বচনের জগতকে সম্ভাব্য জগতে পরিণত করেন। তিনি নিশ্চিতিকে শুধু ধারণার সম্বন্ধের জগতে অর্থাৎ গণিত ও যুক্তিবিদ্যার জগতে স্থান দেন। এতে অভিজ্ঞতালব্ধ প্রাকৃতিক বিজ্ঞান সম্ভাব্য হয়ে পড়ে। ফলত, তাঁর অভিজ্ঞতাবাদ সংশয়বাদে পর্যবসিত হয়। কিন্তু এই সংশয়বাদ পূর্ববর্তী সংশয়বাদ থেকে আলাদা। কারণ, তা অভিজ্ঞতার জগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ জন্যই তিনি এই মতবাদকে সংযত বা একাডেমিক সংশয়বাদ আখ্যা দেন। সংশয়বাদকে তিনি সকল প্রকার বিচারবিযুক্তবাদ এবং অতিনিশ্চয়তাবাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন। তবে সাধারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে বা দৈনন্দিন জীবনে তিনি সংশয়বাদকে ব্যবহার করেননি। প্রকৃতিবাদ বা দৈনন্দিন জীবনের প্রকৃতিগত মনোভাবকে স্বীকার করে নিয়েই তিনি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সংশয়বাদ থেকে রক্ষা করেছেন। আমাদের প্রকৃতিগত মনোভাব ও দৈনন্দিন বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এই সংশয়বাদ ক্ষমতাহীন। এভাবে তাঁর সংশয়বাদ হয়ে ওঠেছে জীবনোপযোগী, গঠনমূলক ও বিচারমূলক।

অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানবিদ্যাগত ধারায় হিউম আধুনিক যুগে তাঁর মতবাদ দ্বারা যেসব প্রশ্নের উত্থাপন করেন তাঁর পরবর্তী দার্শনিক ধারার উপর এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়ে। তাঁর পরবর্তীকালে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিকদের কেউই তাঁকে অবজ্ঞা করে তাঁদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি। পরবর্তী দার্শনিকদের মধ্যে কোনো কোনো দার্শনিক তাঁকে খণ্ডন করতে চেষ্টা করেছেন, কেউ কেউ তাঁকে আংশিকভাবে গ্রহণ ও আংশিকভাবে বর্জন করেছেন, আবার কেউ কেউ তাঁর মতবাদকে প্রাধান্য দিয়েই নিজ মতবাদ গড়ে তুলেছেন। বস্তুতপক্ষে, হিউমের মতবাদ ছিল পরবর্তী দার্শনিকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাঁর পরবর্তী অধ্যাত্মবাদী আলোচনায় তাঁর মতবাদকে খণ্ডনের প্রবল অথচ অনেকাংশে ব্যর্থ প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া, আধুনিক ও সাম্প্রতিককালের গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক মতবাদসমূহে যেমন, বিচারবাদ, উনিশ ও বিশ শতকের অভিজ্ঞতাবাদ, প্রয়োগবাদ, যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ উপযোগবাদ, রূপতত্ত্ব বা অবভাসবাদ এবং বিশ্লেষণী দর্শনের উপর হিউমের গভীর এবং অনুপেক্ষণীয় প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।[১৬৫] এই প্রভাব দর্শনের ইতিহাসে, আরো বিশেষভাবে বললে, জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে হিউমকে একটি মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত করে।

তথ্যপঞ্জি

১. উল্লেখ্য যে, হিউম Inquiry শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু বর্তমানে Enquiry. প্রচলিত। এরপরে এ দুই গ্রন্থের নাম সংক্ষেপে যথাক্রমে Treatise ও Enquiry বলে উল্লেখ করা হবে।

2. Norman Kermp Smith: The Philosophy of David Hume, New York, St. Martin’s Press. 19. পৃ. ১০৫।

৩. David Hume: A Treatise of Human Nature, ed. by L. A. Selby- Bigge. Oxford. At the Clarendon Press, 1978. পৃ. ১। অনূদিত, আবু তাহা হাফিজুর রহমান : মানব প্রকৃতির স্বরূপ অন্বেষা, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৮১, পৃ. ৩।

৪. David Huma: Treatise., পূর্বোক্ত, পৃ. ১। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩।

৫. পূর্বোক্ত।

৬. David Hume : Treatise., পূর্বোক্ত, পৃ. ৮-৯। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯-১০। তুলনীয় : Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৫।

৭. David Hume: An Inquiry Concerning Human Understanding. ed. by Antony Flue. in the Hume On Human Nature and Understanding. New York, Collier Books. 1962. পৃ. ৩৪।

৮. N. K. Smith: The Philosophy of David Hume, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০৫।

৯. David Hume: Treatise., পূর্বোক্ত, পৃ. ২-এর পাদটীকা। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪] এর পাদটীকা

১০. John Locke: Essay Concerning Human Understanding, collected and annotated by A. C. Fraser, Vol. 1. New York. Dover Publication. 1959, পৃ. ৩২।

১১. Barry Stroud: Hume, London, Routledge and Kegan Paul, 1977. পৃ. ১৭।

১২. David Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৩

১৩. পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৪।

১৪. David Hume: Treatise., পূর্বোক্ত, পৃ. ২। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪

১৫. পূর্বোক্ত। পৃ. ৩। অনুবাদ, পূর্বোক্ত।

১৬. পূর্বোক্ত।

১৭. পূর্বোক্ত অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫।

১৮. পূর্বোক্ত।

১৯. পূর্বোক্ত।

২০. পূর্বোক্ত, পৃ. ৬–৭। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭-৮।

২১. David Hume: Enquiry… পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৬-৩৭।

২২. David Hume: Treatise. পূর্বোক্ত, পৃ. ৩। অনুবাদ, পৃ. ৫।

২৩. David Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৫।

২৪. পূর্বোক্ত।

25. David Hume: Treatise. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫। অনুবাদ, পৃ. ৬

২৬. ব্যতিক্রম হলো, কোনো ব্যক্তির সামনে যদি নীল রং-এর বিভিন্ন মাত্রাকে খুব গভীর থেকে ক্রমশ ফিকে হয়ে আসা ক্রম অনুসারে সাজানো হয় এবং এ ক্রম থেকে এমন একটি মাত্রাকে অনুপস্থিত রাখা হয় যে, মাত্রাটির কোনো ইন্দ্রিয়ছাপ ঐ ব্যক্তির কখনও ছিল না তবে এমন অবস্থায়ও সে ব্যক্তি অনুপস্থিত মাত্রাটির ফাঁকটি বুঝতে সক্ষম হবেন এবং কল্পনায় সে ফাঁকটি পূরণের জন্য নীল রং-এর অনুপস্থিত মাত্রাটিরও ধারণা করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়ছাপ ছাড়াই ধারণা উৎপন্ন হওয়ার উদাহরণ পাওয়া যায়।

২৭. David Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৬।

২৮. David Hume: Treatise. পূর্বোক্ত, পৃ. ৬-৭। অনুবাদ, পৃ. ৭-৮।

২৯. D. G. C. Macnabb : David Hume: His Theory of Knowledge and Morality. London. Hutchinson Houses, 1951, পৃ. ২৯-৩০।

30. David Hume: Treatise., পূর্বোক্ত, পৃ. ৫। ২৯-৩০।

31. David Hume: Treatise. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭৫।

৩২. পূর্বোক্ত, পৃ. ৭। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮।

৩৩. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭৫।

৩৪. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭৫-২৭৬।

৩৫. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭৫।

৩৬. পুর্বোক্ত, পৃ. ৭–৮। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮-৯।

৩৭. আমিনুল ইসলাম : আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, জুন ১৯৮৪, পৃ. ২১৭।

৩৮. David Hume: Treatise., পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭৬।

৩৯. পূর্বোক্ত।

40. N. K. Smith: The Philosophy of., পূর্বোক্ত, পৃ. ১০৬] এর ছক দ্রষ্টব্য।

৪১. David Hume: Treatise. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭৬-২৭৭।

৪২. পূর্বোক্ত, পৃ. ৮-৯।

৪৩. পূর্বোক্ত, পৃ. ২।

৪৪. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭৭, ৩২৯।

৪৫. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪।

৪৬. পূর্বোক্ত, পৃ. ১। অনুবাদ, পৃ. ৩।

৪৭. পূর্বোক্ত, পৃ. ২। অনুবাদ, পৃ. ৪।

৪৮. David Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, Sec. II para 12.

৪৯. পূর্বোক্ত, পৃ. ৩২।

৫০. পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৩।

৫১. David Hume: Treatise, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫।

৫২. David Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৫। অনুবাদ পৃ. ৬।

৫৩. David Hume: Treatise. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫। অনুবাদ পৃ. ৬।

৫৪. Frederick Copleston: A History of Philosophy, Vol. V. London, Burns and Oates Ltd. 1964. পৃ. ২৬৫-২৬৬।

৫৫. David Hume: Treatise. পূর্বোক্ত, পৃ. ৪। অনুবাদ, পূর্বোক্ত পৃ. ৫।

৫৬. পূর্বোক্ত, পৃ. ৫। অনুবাদ, পৃ. ৬।

৫৭. পূর্বোক্ত, পৃ. ৯। অনুবাদ, পৃ. ১০।

৫৮. পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৫। অনুবাদ. পৃ. ১০।

৫১. Barry Stroud : Hume… পূর্বোক্ত, পৃ. ২২।

60. David Hume: Treatise. পূর্বোক্ত, পৃ. ৭। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮]

61. D. G. C. Macnabb : David Hume, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩২।

৬২. David Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৭।

৬৩. পূর্বোক্ত।

৬৪. পূর্বোক্ত।

৬৫. B. Russell: History of Western Philosophy. London. George Allen and Unwin Ltd. 1965. পৃ. ৬৩৪।

৬৬. R. Ackermann : Theories of Knowledge. Bombay Tata McGraw-Hill Publishing Co. Ltd., 1965. পৃ. ১৭৯।

৬৭. David Hume: Treatise. পূর্বোক্ত, পৃ. ১১। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২] এবং Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৮।

৬৮. David Hume: Treatise, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৮৩।

৬১. পূর্বোক্ত।

৭০. David Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৬।

৭১. David Hume: Treatise. পূর্বোক্ত, পৃ. ১০।

৭২. আমিনুল ইসলাম : আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৮০, পৃ. ২১৯।

৭৩. A. N. Basson: David Hume, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫০।

৭৪. N. K. Smith: The Philosophy of. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৯।

৭৫. C. R. Morris: Locke, Berkeley and Hume. পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৩।

76. R. Ackermann : Theories of Knowledge, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮০।

77. C. R. Morris: Locke, Berkeley and Hume, পূর্বোক্ত।

৭৮. R. Ackermann: Theories of Knowledge, পূর্বোক্ত।

৭৯. C. R. Morris: Locke, Berkeley and Hume, পূর্বোক্ত।

৮০. R. Ackermann : Theories of Knowledge, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮১।

৮১. C. R. Morris: Locke, Berkeley and Hume, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৪

৮২. Hume: Treatise., পূর্বোক্ত, ১২-১৩। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩।

৮৩. পূর্বোক্ত।

৮৪. David Hume: Treatise. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭

৮৫. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৪৩। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮৬।

৮৬. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫১। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০২।

৮৭. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫১-২৫৩। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০২-২০৪।

৮৮. C. D. Broad; The Mind and it’s Place in Nature, পৃ. ২৭৯, উদ্ধৃত, Akhter Imam : David Hume on the Nature of the Self, Dhaka, 3 Shegun Bagicha. 1976, p. 41।

৮৯. David Hume: Treatise., পৃ. ২৫৩। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০৩-২০৪।

৯০. সূত্র দুটি হলো : 1. Whatever is clearly conceiv’d may exist; and whatever is clearly conceive’d, after any manner, may exist after the same manner. 2. … every thing, which is different, is distinguishable, and every thing which is distinguishable, is separable by the imagination. দ্রষ্টব্য, Treatise, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৩।

91. David Hume: Treatise. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৩। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮৫-১৮৬।

৯২. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫২। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০৩।

৯৩. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫০। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০০।

৯৪. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫২। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০৩।

৯৫. পূর্বোক্ত।

৯৬. B. Russell: An Outline of Philosophy, New York, The World Publishing Company, 1967, পৃ. ২৯৬।

৯৭. B. Russell : “The Philosophy of Logical Atomism” in the Logic and Knowledge: Essays. ed, by R. C. March, London, 1956, পৃ. ২৯৯।

৯৮. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন, কালী প্রসন্ন দাস : “আত্মা সম্পর্কে হিউম ও বুদ্ধ : একটি তুলনামূলক আলোচনা”, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অক্টোবর, ১৯৮৮, পৃ. ২৪৩-২৪৫।

৯৯. David Hume: Treatise, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬০। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২১০।

১০০. Berry Stroud: Hume, London, Routledge and Kegan Paul, 1977. পৃ. ১২০।

101. N. K. Smith : The Philosophy of David Hume, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫০১।

১০২. John Laird: Hume’s Philosophy of Human Nature, London, Archon Books, 1967, পৃ. ২৫৯ ও ২৬০।

103. David Hume: Treatise. পূর্বোক্ত, ২৬২
 অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২১৩।

১০৪. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬১-২৬২।

১০৫. দ্রষ্টব্য : H. P. Grice : “Personal Indentity”, Mind, (1951) পৃ. 346। B. Russell: “On the Nature of Aquaintance”. In the Logic and Knowledge, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৮, ১৪২।
A. J. Ayer : The Foundation of Emperical Knowledge, London, 1951, পৃ. ১৪২।

106. B. Russell: History., পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৮৩।

১০৭. B. C. Chappell (ed.) : David Hume, London, Macmillan Publishing Col. Ltd., 1968, পৃ. ১২৯।

১০৮. David Hume : Treatise, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৪-৭৫। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৫-৩৬] এবং Enquiry. পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৮।

১০৯. David Hume : Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৮।

১১০. David Hume : Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৯। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪০।

১১১. David Hume : Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৫৭।

১১২. A. J. Ayer : The Central Questions of Philosophy. New Delhi, The Macmillan Co. of India Ltd., 1979. পৃ. ১৩৮।

১১৩. Stephen F. Barker : The Elements of Logic, McGraw-Hill International Edition, 1965, 5th ed., পৃ. ২৪৮।

১১৪. David Hume: Treatise., পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬০। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৭।

১১৫. উপলক্ষবাদ জ্ঞানের উৎস এবং ঐচ্ছিক ক্রিয়ার মন ও বস্তুর সম্পর্ক বিষয়ক মতবাদ। এ মতবাদ অনুসারে মন ও বস্তুর মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এদের মধ্যে সাময়িক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এ সম্পর্ক পূর্ব থেকেই ঐশী শক্তি দ্বারা নির্ধারিত। মধ্যযুগীয় মুসলিম দার্শনিক আল গাজ্জালীও উপলক্ষবাদ দ্বারা কার্যকারণ সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন।

116. David Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৫-৮৬।

১১৭. David Hume: Treatise. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬১। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৮।

১১৮. বিস্তারিত দেখুন, কালী প্রসন্ন দাস : “কার্যকারণ প্রসঙ্গে হিউম”, দর্শন ও প্রগতি, গোবিন্দদেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জুন-ডিসেম্বর, ১৯৮৯, পৃ. ৭০-৭২।

১১৯. David Hume: Treatise, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৯। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫০।

১২০. David Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৮।

১২১. David Hume: Treatise. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬৫। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২১-১২২।

১২২. পূর্বোক্ত, অনুবাদ, পৃ. ১২২।

১২৩. পূর্বোক্ত।

১২৪. David Hume : Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৬১।

১২৫. Barry Stroud: Hume, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৯।

১২৬. David Hume: Treatise., পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯৮। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৩।

১২৭. David Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৪।

১২৮. F. Copleston: A History of Philosophy, Vol. V. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭৫-২৭৬।

১২৯. David Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৫০।

১৩০. B. Russell: History., পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৩৪।

১৩১. দার্শনিক ও প্রাকৃতিক সম্বন্ধের জন্য দ্রষ্টব্য : যথাক্রমে Treatise. ১ম খণ্ড, ১ম অধ্যায়, ৫ম পরিচ্ছেদ এবং Treatise. ১ম খণ্ড, ১ম অধ্যায়, ৪র্থ পরিচ্ছেদ।

১৩২. C. R. Morris: Locke, Berkeley and Hume, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৫।

১৩৩. দ্রষ্টব্য : কালী প্রসন্ন দাস : “কার্যকরণ প্রসঙ্গে হিউম”, দর্শন ও প্রগতি, গোবিন্দদের দর্শন গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জুন-ডিসেম্বর, ১৯৮৯, পৃ. ৬২-৯১।

১৩৪. B. Russell: History., পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৩৪।

১৩৫. পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৪৭] এবং ৪৮১।

১৩৬. C. R. Morris: Locke, Berkeley and Hume, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০-২১।[১৩৭. David Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৭।

১৩৮. পূর্বোক্ত। উল্লেখ্য যে, জন লকও স্বজ্ঞামূলক, প্রতিপাদনমূলক ও সংবেদনমূলক এই তিন প্রকার জ্ঞানের কথা বলেন। হিউম অবশ্য তাঁর Treatise গ্রন্থে গণিতের প্রমাণমূলক নিশ্চয়তা যে আছে তা স্বীকার করেননি। এ প্রসঙ্গে লকের মতবাদকে তিনি সমালোচনা করেছেন, যদিও Enquiry গ্রন্থে তিনি গণিতের প্রমাণমূলক নিশ্চয়তার কথা বলেছেন। তুলনীয়, Treatise, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭০, অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১।

১৩৯. F. Copleston: History., পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭৪।

১৪০. হিউম Treatise গ্রন্থে জ্যামিতিকে সঠিকতা ও যথার্থতার দিক থেকে ইন্দ্রিয় ও কল্পনার বিশৃঙ্খল বিচারের চেয়ে উত্তম মনে করলেও এদেরকে একেবারে সঠিক ও নির্ভুল বলেননি। কারণ, এর মৌলিক সূত্রগুলো লক্ষিত বস্তুর সাধারণ বাহ্যরূপ থেকে গ্রহণ করতে হয়। আর বাহ্যরূপ কখনো নিশ্চয়তা দিতে পারে না। কারণ, এতে চোখ ও কল্পনার সাহায্যে লক্ষিত বস্তু বা ধারণাগুলোর মাঝে তুলনা করার যে নির্ভুলতা আছে এর চেয়ে বেশ নির্ভুলতা কখনো পাওয়া যায় না। অর্থাৎ বিমূর্ত ধারণা থেকে যে নিশ্চয়তা আসে তা জ্যামিতিতে নাই। কিন্তু Enquiry গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে হিউম জ্যামিতি সম্পর্কে বলেন, সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের উপর অবস্থিত বর্গক্ষেত্র ত্রিভুজের ওপর দুটি বাহুর উপর অবস্থিত বর্গক্ষেত্রের সমান—এ বচনটি চিত্রগুলোর মধ্যে একটি সম্বন্ধ প্রকাশ করে। শুধু চিন্তন প্রক্রিয়ার দ্বারা অর্থাৎ অভিজ্ঞতার সাহায্য ছাড়াই এসব বচনকে আবিষ্কার করা যায়।

১৪১. Antony Flew: Hume’s Philosophy of Belief. London, Routledgde and Kegan Paul. 1961, পৃ. ৫৪।

১৪২. N. K. Smith: The Philosophy of David Hume, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৯-১০০।

১৪৩. D. G. C. Macnabb : David Hume., পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৬-৪।

১৪৪. A. Flew: Hume’s Philosophy., পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৬।

১৪৫. F. Copleston: A History of Philosophy, পূর্বোক্ত, ২৭৭।

১৪৬. D. G. C. Macnabb : David Hume, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৬]

১৪৭. B. Russell: History. পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৩৭।

১৪৮. David Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৮।

১৪৯. David Hume: Treatise., পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯৮। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৩।

১৫০. David Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৪।

১৫১. T. E. Jessop : “Some Misunderstanding of Hume”. in the V. C. Chappell ed. : Hume, London, Macmillan Publishing Co. Ltd., 1968, পৃ. ৫২।

১৫২. Enquiry গ্রন্থে প্রকাশিত হিউমের নিম্নোক্ত বক্তব্যে লকের প্রতীকবাদ ও বার্কলের আত্মগত ভাববাদের, এককথায় বাহ্য বস্তুর বিরামহীন অস্তিত্বের, বিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়। হিউম বলেন : কাজেই ইন্দ্রিয়প্রদত্ত প্রমাণ বা বাহ্য অস্তিত্ব সম্পর্কে অভিমতের ব্যাপারে প্রথম দার্শনিক অভিযোগ হলো, এ ধরনের অভিমত যদি স্বাভাবিক প্রবৃত্তির (natural instinct) উপর নির্ভর করে তবে তা বিচারবুদ্ধির বিরোধী হবে, এবং যদি বিচার বুদ্ধিকে এ ব্যাপারে টেনে আনা হয় তবে তা স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বিরোধী হবে। এবং একই সময়ে কোনো নিরপেক্ষ অনুসন্ধানকারীর কাছে এটি কোনো বিচারবুদ্ধিসম্মত প্রমাণ বহন করে নিয়ে আসে না। দ্বিতীয় অভিযোগটি আরো কিছুদূর অগ্রসর হয়। সকল ইন্দ্ৰায়গ্রাহ্য গুণ মনে অবস্থিত, বস্তুতে নয়—এটা যদি বিচারবুদ্ধির একটি নীতি হয় তবে তাকে বিচারবুদ্ধির বিরোধী হিসেবে প্রমাণ করে। কারণ, জড় বস্তু থেকে সব মুখ্য ও গৌণ গুণ কেড়ে নিলে বস্তুত জড়ের ধ্বংসসাধন করা হবে। জড় বস্তুতে তখন যা থাকবে তা হলো অজ্ঞাত অব্যাখ্যাত কিছু। এবং এটাই হবে আমাদের প্রত্যক্ষের কারণ। এই ধারণা এতো ত্রুটিপূর্ণ যে, কোনো সংশয়বাদী এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক করতে চাইবে না। Enquiry পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৫।

এছাড়া Treatise গ্রন্থেও (১ম পুস্তক, ৪র্থ অধ্যায়ের সবশেষে) হিউম জড় জগতের স্বাধীন অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে গিয়ে বলেন :

কার্যকারণ সম্পর্কে আমরা যখন চিন্তা করি তখন আমরা এই সিদ্ধান্ত নেই যে, শব্দ, বর্ণ, স্বাদ ও গন্ধের বিরামহীন অস্তিত্ব নাই। এসব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুণকে আমরা যখন বাদ দেই তখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বিরামহীন ও স্বাধীন অস্তিত্ব বলতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। Treatise. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩১। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮৪।

১৫৩. David Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৩।

১৫৪. David Hume: Treatise. পূর্বোক্ত, পৃ. ২১১] অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬৫।

১৫৫. David Hume: Enquiry., পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫১।

১৫৬. David Hume: Treatise, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯৭। অনুবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫২।

১৫৭. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮৩।

১৫৮. David Hume: Enquiry, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৮।

১৫৯. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৯।

১৬০. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬১।

161. Paul Edwards (ed.): Encyclopedia of Philosophy. New York. Macmillan

Publishing Co. Inc. and Free Press. 1972. Vol. IV. পৃ. ৭৮।

১৬২. R. Ackermann : Theories of knowledge., পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৯।

১৬৩. Paul Edwards (ed.): Encyclopedia., পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৪] এবং D. J. O’Connor (ed.): A Critical History of Western Philosophy, London, The Free Press. 1965, পৃ. ২৫৮।

১৬৪. হিউমের Enquiry গ্রন্থের দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ অধ্যায়ের আলোচনা থেকে বিষয়টি নির্দেশিত হয়।

১৬৫. এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণের জন্য উপসংহার দ্রষ্টব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *