৬১-৬৫. পান্নার পিছনে সোহাগ

৬১.

পান্নার পিছনে সোহাগকে দেখে ভারী অবাক হল বিজু। মেয়েটা তাকে পছন্দ করে না। কয়েকবার বিজুকে বেশ অপমানও করেছে। একটু খেপা গোছের আছে। কখন কী রকম রি-অ্যাক্ট করবে তার ঠিক নেই। আনপ্রেডিকটেবল মেয়েটিকে সে একটু ভয় পায়। কিন্তু সেটা তো আর প্রকাশ করা চলে না। সে বলল, আরে, এসো তোমরা।

ঘরে ঢুকে সোহাগ নিঃশব্দে চারদিক খুব কৌতূহলী চোখে চেয়ে দেখছিল। বিজু শৌখিন মানুষ। তার ঘরে খুব আধুনিক মিউজিক সিস্টেম, রঙিন টি ভি ইত্যাদি আছে। খাট, আলমারি, টেবিল, বইয়ের র‍্যাক, ক্যাবিনেট সবই খুব বাছাই ম্যাট ফিনিশ দামি কাঠের তৈরি।

পান্না বলল, সোহাগ আমাকে একটু কম্পিউটার শেখালে তোমার আপত্তি নেই তো।

 না, আপত্তি কীসের?

 তুমি কম্পিউটারে কোনও কাজ করছিলে নাকি?

না না, তেমন কিছু নয়। তোরা বোস না। আমি বরং একটু ঘুরে আসছি।

যাঃ, তুমি না থাকলে মজাটাই হবে না।

কেন, তুই তো কম্পিউটার শেখার মাস্টারমশাইকে সঙ্গেই নিয়ে এসেছিস। আমি তো আর কম্পিউটার এক্সপার্ট নই। শুধু আমার কাজটুকু করে নিতে পারি।

সোহাগ কম্পিউটারের সামনে বসে যন্ত্রটার চাবি টিপে স্পেসিফিকেশন দেখে মৃদু স্বরে বলল, মডেলটা আপডেট করা দরকার। বেশ স্লো।

বিজু বলল, জানি। তবে আমার তো বেশি সফিস্টিকেটেড জিনিসের দরকার হয় না। কিছু নথিপত্র লোড করে রাখি। বেশির ভাগ সময়েই এটা ব্যবহার করা হয় টাইপরাইটার হিসেবে। আর ইন্টারনেট, তবে নেটওয়ার্ক সিগন্যাল এখানে খুব উইক।

সোহাগ একটু হাসল। আর কিছু বলল না, কিছুক্ষণ মগ্ন হয়ে নানা চাবি টিপে টিপে অনেক কিছু দেখে নিয়ে পান্নাকে বলল, এতে তোমার শেখার কাজ চলে যাবে। তোমার দাদা বোধহয় ই-মেল চেক করেছিলেন, আমরা এসে ডিস্টার্ব করলাম।

বিজু বলল, আরে দুর দুর। ই-মেল আসে নাকি আমার। বেশির ভাগই জাঙ্ক মেল। দু-চারটে কাজের মেল আসে। চেক করা হয়ে গেছে। তোমরা এখন ব্যবহার করতে পারো।

আপনি বসুন না। আমি এসেছি বলেই যদি আপনি চলে যান তা হলে আমার খুব খারাপ লাগবে।

সন্ধেবেলা কি আমি বাড়িতে বসে থাকি নাকি? ক্লাবে ব্যাডমিন্টন খেলতে যাই। তারপর নাটকের রিহার্সাল আছে।

পান্না বলল, আচ্ছা, আজ না হয় আমাদের অনারে একটু বসলেই বাবা। রোজই তো ওসব আছে।

 আরে আজ শনিবার। অনেকে আসবে। যারা কলকাতায় থাকে তারা উইক এন্ডে চলে আসে যে।

একদিন না হয় একটু আমাদের সঙ্গেই আড্ডা মারলে।

 আড্ডা মারতে তো আসিসনি। এসেছিস তো কম্পিউটার শিখতে।

 কম্পিউটার তো আর পালাচ্ছে না। পালাচ্ছ তুমি। চুপ করে বোসো তো ওই সোফাটায়।

 বিজু বসল। তবে অস্বস্তি নিয়ে। সোহাগ মেয়েটাকে সে ঠিক বুঝতে পারে না। এই বেশ মিষ্টি করে কথা বলল, আবার কোন কথায় পালটি খাবে তার ঠিক নেই।

কম্পিউটারে মগ্ন সোহাগ একবার হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখল, তারপর চোখ ঘুরিয়ে নিল। মেয়েদের চোখের ভাষা পড়বার মতো অভিজ্ঞতা বিজুর নেই। তার বান্ধবী-টান্ধবী নেই। প্রেমিকা নেই, নেই বলে দুঃখও নেই কিছু। তবে মেয়েদের ব্যাপারে অভিজ্ঞতা কম থাকায় কখনও-সখনও একটু অসুবিধেয় পড়তে হয়। এই যেমন এখন। ওই যে সোহাগ একবার তাকাল এটা অর্থহীন না অর্থপূর্ণ তা অনুমান করা তার অসাধ্য। শুধু মনে হল, আর যাই হোক তাকানোটা অন্তত হোস্টাইল নয়।

দুই বান্ধবী কম্পিউটার নিয়ে খুব মজে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। খুব নিচু স্বরে পান্নাকে কম্পিউটারের ব্যবহার শেখাচ্ছে সোহাগ। স্বর এত নিচু যে, সামান্য দূরত্বে বসেও কিছুই ভাল বুঝতে পারছে না বিজু। সে নিজে কম্পিউটার খুব ভাল জানে না। শুধু নথিপত্র ফাইলভুক্ত করতে পারে, ইন্টারনেট খানিকটা পারে আর পারে গেমস। কিন্তু কম্পিউটার তো একটা মহাসমুদ্র, শেখার শেষ নেই। সে উকিল মানুষ। ভবিষ্যতে ওকালতিই করবে। তার কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ না হলেও চলবে। কিন্তু আজ এখন সোহাগের সহজাত দক্ষতা দেখে তার একটু হিংসে হচ্ছিল। মেয়েটা অনেক জানে। আর একটু আপডেটেড কম্পিউটার হলে আরও ভাল এলেম দেখাতে পারত।

উপযাচক হয়ে বিজু বলল, একটু অসুবিধে হচ্ছে, না?

সোহাগ ভারী সুন্দর একটু হেসে তার দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল। বলল, আপনার সেটটা এমনিতে তো ভালই। মাদার বোর্ড, প্রসেসর আর হার্ড ডিস্কটা বদলে নিলেই হবে। স্পিকার দুটোও চেঞ্জ করে নেবেন। আজকাল খুব ছোট আর পাওয়ারফুল স্পিকার পাওয়া যায়।

বিজু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে অডিও বা ভিডিও সিডি কখনও চালায় না কম্পিউটারে। অত সব করার সময় কোথায় তার। ওকালতি আছে, ক্লাব আছে, সমাজসেবা আছে, মোটরবাইকে চড়ে ছোটখাটো অভিযানে বেরিয়ে পড়া আছে। কম্পিউটার সে সামান্যই ব্যবহার করে। তবু বলল, আচ্ছা।

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ তুলে মা উঠে এল, পিছু পিছু কাজের মেয়ে ননীবালা। ননীবালার হাতে ট্রে এবং তাতে গরম ফুলকপি আর বাঁধাকপির বড়া, মিষ্টি আর নাড়ু, আর চা।

পান্না চেঁচিয়ে বলল, এ মা, ছোটমা, এসব কী করেছ? তোমাকে না বললাম এক্ষুনি আমাদের একরাশ চাওমিন করে খাইয়ে দিয়েছে। তাও আবার চিংড়িমাছ দিয়ে! এই সোহাগ, বলল না।

সোহাগ হাসছিল। বলল, এখানে এলেই সবাই কেবল খাওয়ায়। কেন বলুন তো? আমাদের বাড়িতেই ভীষণ খাওয়ার জন্য প্রেশার। পিসি খাওয়ায়, বড়মা খাওয়ায়, জ্যাঠা রোজ রাজ্যের খাবার নিয়ে আসে।

বিজুর মা হেসে বলল, এইটুকু তো বয়স, এখনই তো খাবে। ওই যে আমাদের পান্নারানি ওর কথা আর বোলো না। ওর ধারণা হয়েছে মোটা হয়ে যাবে। তাই খাওয়া ধরাকাট করছে। নাও তো, এসব খুব হালকা জিনিস। কাজ করতে করতে খেয়ে নাও। শীতকালে খুব তাড়াতাড়ি সব হজম হয়ে যায়।

সোহাগ বলল, আমি কিন্তু এমনিতেই একটু ফ্যাটি। আমারই সবচেয়ে বেশি ডায়েটিং দরকার।

ও মা! যাব কোথায়। তুমি নাকি ফ্যাটি। তুমি তো বেশ রোগা। পান্নার চেয়েও।

কিন্তু আমার যে মনে হয় আমি বেশ ফ্যাটি!

একদম বাজে কথা। তুমি তো রোগাই। শরীরে আর এক পরত মাংস লাগলে তোমাকে আরও অনেক বেশি সুন্দর লাগবে।

পান্না নাক সিঁটকে বলল, ইস ছোটমা, তুমিও কেমন যেন আদ্যিকালের বুড়ি হয়ে যাচ্ছ। কেবল মোটা হ, সোটা হ, মোটা-সোটা হলেই বুঝি ভাল?

ওরে, তা বলিনি। মোটা হবি কেন? মানানসই হবি তো। হাড়গিলে হওয়া বুঝি ভাল।

সোহাগ হাসছিল। বলল, আমেরিকায় জাঙ্ক ফুড খেয়ে খেয়ে মা আর আমি একবার বেশ ওয়েট গেন করেছিলাম। তারপর চেক আপ করাতে গিয়ে ডাক্তারের কী বকুনি। মাকে বলল, এক মাসের মধ্যে তোমাকে কুড়ি পাউন্ড ওজন কমাতে হবে। আমাকে বলল দশ পাউন্ড।

কী করলে তখন?

আমি তো তখন আরও ছোট। সকালে উঠে রোজ দৌড়াতাম। আমার এক মাসে পনেরো পাউন্ড কমে গেল। কিন্তু মা পারেনি। জগিং-টগিং তো পারত না, হাঁফিয়ে পড়ত। খাওয়া কন্ট্রোল করে করে একটু কমল।

পান্না বলল, জাঙ্ক ফুড কী বলল তো!

হ্যামবার্গার, হট ডগ, পিৎজা, চকোলেট, আইসক্রিম। যত খাবে তত মোটা হবে। খেতে ভীষণ ভাল তো ওসব। আমেরিকানরা তো ওসব খেয়ে খেয়েই ওরকম মোটা।

গোরুর মাংস খেতে, না?

মৃদু হেসে সোহাগ বলল, হ্যাঁ। এখানে শুনেই সবাই আঁতকে ওঠে।

বিজুর মা বলল, মা গো! কী করে খেতে? গন্ধ লাগত না?

না তো? গন্ধটা খারাপ ছিল না। এখানে এসে শুনলাম হিন্দুরা নাকি খায় না।

না বাপু, এদেশে ওসব চলে না। আজকাল খাচ্ছে অনেকে শুনি। দিনকাল বদলে যাচ্ছে তো। মানুষ হল আসলে রাক্ষস। সব খায়।

সোহাগ হি হি করে হাসল।

নীরবে দৃশ্যটা দেখছিল বিজু। মেয়েটা কী সুন্দর হাসে! যখন হাসে তখন মনে হয় ওর ভিতর আর বাইরেটা একাকার হয়ে গেল।

এই খাবার রেখে যাচ্ছি, যা পারো খেয়ো। গরম থাকতে থাকতে না খেলে ভাল লাগবে না।

 ছোটমা চলে গেলে পান্না বলল, এই বিজুদা, একটু খাও না গো আমাদের সঙ্গে।

ভ্যাট। আমি কোর্ট থেকে ফিরেই রুটি তরকারি খেয়েছি। তোরা খা।

আমরা কি আর পারব? না খেলে ছোটমা ঠিক বকুনি দেবে।

 তার আমি কী জানি! দু-চারটে তুলে ঢিল মেরে পিছনের বাগানে ফেলে দে বরং।

ওমা, খাবার জিনিস ফেলে দিলে পাপ হবে না?

অনিচ্ছের সঙ্গে খেলে আরও পাপ হবে।

 সোহাগ মাঝে মাঝে তার ঘন চুলে ঝাপটা মেরে বিজুর দিকে ফিরে দেখছে, আপনি বোরড হচ্ছেন, না?

না না, ঠিক আছে।

সোহাগ কম্পিউটারের দিক থেকে তার দিকে একটু ঘুরে বসে বলল, আমি একটু মুডি বলে মাঝে মাঝে অকওয়ার্ডলি বিহেভ করি, তাই না?

বিজু হেসে বলল, সবাই তো এক রকম হয় না। তুমি তোমার মতো হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

কেউ কেউ বলে আমি নাকি পাগলি।

 বলে নিজেই হেসে কুটিপাটি হল সোহাগ।

স্মিত মুখে বিজু বলল, আমরা সবাই একটু একটু পাগল। যে যার নিজের মতো।

 পান্না বলল, যাঃ, সোহাগ মোটেই পাগলি নয়। একটু ডেয়ারিং আছে অবশ্য।

সোহাগ আবার কম্পিউটারের দিকে ফিরে বসল। পান্নাকে বলল, আমি সুইচ অফ করে দিচ্ছি। তুমি নিজে নিজে সুইচ অন করো। নিজে অপারেট না করলে হবে না।

আমার বাবা ভয় করে। ইলেকট্রিকের সব জিনিসকেই আমি ভয় পাই।

যাঃ, ভয়ের কী আছে?

যদি শক-টক দেয়। আমি আগে টেপ রেকর্ডার অবধি চালাতে পারতাম না। আরও ছোট যখন ছিলাম তখন ঘরের লাইট ফ্যানের সুইচে অবধি হাত দিতে ভয় করত।

ওমা! কেন?

একবার বর্ষাকালে সুইচে হাত দিতেই যা শক দিয়েছিল। সেই থেকে ভয়।

তোমার দাদা না ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে!

হ্যাঁ তো। দাদা বাড়ি এলে আমাকে ভীষণ খেপায়। ইলেকট্রিকের তার নিয়ে এসে ভয় দেখায়।

 বিজু হেসে বলল, তোর সব ভয়ের কথা সোহাগ জানে?

আমি সব বলেছি। ভূতের ভয়, একা থাকার ভয়, অন্ধকারের ভয়, পাগল আর মাতালের ভয়। আর চোর ডাকাতের ভয় তো আছেই। ঠাকুর-দেবতাকেও খুব ভয় পাই বাবা। আমার বাপু ভয়ের জীবন। এত কেন ভয় পাই বলো তো সোহাগ?

তোমার যেমন ভয় বেশি, আমার আবার তেমনি ভয় ভীষণ কম।

সেই জন্যই তো তোমাকে আমার ভীষণ হিংসে হয়।

আবার দুজনে হেসে কুটিপাটি হল। মেয়েদের নিয়ে বিজুর এই এক সমস্যা। এই টিনএজার মেয়েরা নিজেদের মধ্যে সামান্য কথায় এত হাসি যে কেন হাসছে তার তাল রাখাই মুশকিল। বিজুর তাই নিজেকে বড় বোকা বোকা আর বহিরাগত আর অনধিকারী এক আগন্তুক বলে মনে হচ্ছে।

অস্বস্তি বোধ করে বিজু বলল, তোরা কাজ কর, আমি একটু ঘুরে আসি।

পান্না চোখ পাকিয়ে বলল, খবরদার না। তুমি চলে গেলে মজাটাই মাটি।

স্মিত হেসে বিজু বলল, আমাকে নিয়ে মজা করতে এসেছিস নাকি?

আহা, ওভাবে বলছ কেন? আজ সোহাগ তোমার সঙ্গে ভাব করতে এসেছে।

বিজু বলল, আড়ি তো ছিল না।

ছিল বইকী। চুপ করে বোসো। নড়বে না।

বিজু ফের বসে পড়ল।

সোহাগ কম্পিউটারে চোখ রেখে বলল, পান্না একটু বাড়াবাড়ি করছে। আসলে আমি বোধহয় আপনার সঙ্গে একটু অভদ্র ব্যবহার করে ফেলেছি। আপনি তো আমার ভাল করতেই চেয়েছিলেন।

আরে সেসব আমি মনে করে রাখিনি। তবে এখানে আগে ছেলেরা কখনও মেয়েদের টিজ করত না। আজকাল কিছু ছেলে ইভ টিজিং করে বলে খবর পাই। ওটা আমি একদম সহ্য করতে পারি না। আমি একটু প্রাচীনপন্থী মানুষ। মেয়েদের শ্রদ্ধা করা উচিত বলেই মনে করি।

সোহাগ আর একবার একঝলক তার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, শ্রদ্ধার কথা কেন বলছেন?

কেন বলছি তা জানি না। ওরকমই শিখে এসেছি ছেলেবেলা থেকে।

আমার তো মনে হয় খোলামেলা মেলামেশা হলেই ছেলে আর মেয়েদের সম্পর্ক ভাল হয়।

আমার ঠিক ওরকম ভাল লাগে না। আজকাল মেলামেশা খুব বেশি হয়, কিন্তু সম্পর্ক টিকছে কই? মেয়েদের প্রতি সামাজিক অপরাধ তো বেড়ে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে তোমার মত মিলবে না।

মত মিললেই বুঝি ভাল?

কথাটার অর্থ বুঝতে পারল না বিজু। ম্লান মুখে বলল, আমি একটু সেকেলে, না?

একটু আছেন। তাতে কী? নিজের মতো হওয়াই তো ভাল। আমার প্রবলেমটাও তো তাই। কেউ আমাকে নিজের মতো হতে দিতে চায় না, তার মতো হওয়াতে চায়। সেইজন্যই মা বাবার সঙ্গে আমার ক্ল্যাশ হয়।

তুমি বোধহয় একটু লিবারেল, তাই না?

মিষ্টি হেসে সোহাগ বলে, উইমেনস লিব? এসব নিয়ে ভাবি না কখনও। আমার প্রবলেম আমার নিজেকে নিয়ে।

সকলেরই তো নিজেকে নিয়ে প্রবলেম।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্মিত মুখে দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে রইল। না, কোনও বিদ্যুৎ বাহিত হল না মধ্যবর্তী শূন্যতায়। কিন্তু যেন একটু সুগন্ধী একটা বাতাস বয়ে গেল। মেয়েটাকে নিয়ে একটা অস্বস্তি ছিল বিজুর। একটু ভয়-ভয় ভাব। সেটা উড়ে গেল আজ।

আপনাকে জোর করে বসিয়ে রেখেছে পান্না। আই অ্যাম সরি। আজ যাই। ফিরে গিয়ে দাদুকে কফি করে দেব বলে এসেছি। দাদু ঠিক আমার জন্য বসে থাকবে।

বিজু একটু হেসে বলল, এসো।

বাই।

 দুজনে চলে যাওয়ার পর ঘরটা অনেক ফাঁকা লাগল বিজুর। আনমনে উঠে সে চটি পরে ধীর পায়ে বেরোল। সারা সন্ধেটা সে অন্যমনস্ক রইল আজ। ব্যাডমিন্টনে সহজ শট ফসকাল বারবার। আড্ডায় সে-ই বরাবর প্রধান বক্তা। আজ সে প্রায় নির্বাক রইল। আজ তার ভিতরকার বিজু যেন হারিয়ে গেছে। কী হল তার হঠাৎ?

এক বড়লোক মক্কেল গাড়ি হাঁকিয়ে রাতের দিকে এল। তার সঙ্গে একটা গুরুতর মামলা নিয়ে কথা বলতে বলতেও বিজু টের পাচ্ছিল সে খানিকটা রিফ্লেক্সের ওপর কথা বলছে, যন্ত্রের মতো। ভাবছে না মামলা নিয়ে। তার মন সোহাগকে ভাবছে। ঠিক এরকম ব্যাপার তার আগে কখনও হয়নি। এই প্রথম।

কিন্তু এরকম কেন হবে? সুন্দরী মেয়ে সে কি বিস্তর দেখেনি? মেয়েদের সম্পর্কে তার একটা সহজাত বিমুখতাই আছে। সে মেয়েদের সঙ্গে মিশতে ভালবাসে না, প্রেম করার কথা তার মনেও হয় না। নারীচিন্তার সে ঘোর বিরোধী। তাকে বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই ব্রহ্মচারী আখ্যা দিয়ে রেখেছে। তবে এসব কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে? পচা শামুকে পা কাটলে তো তার চলবে না।

রাত্রিবেলা বিছানায় শুয়ে সে নিজের সঙ্গে লড়াইটা শুরু করল। মন থেকে যেভাবেই হোক ওই মেয়েটার চিন্তাকে তাড়াতেই হবে। তার সেই মানসিক শক্তি আছে। ছ্যাবলা ছেলেদের মতো দুম করে একটা মেয়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে গেলে তো তার হবে না। এ তার নিজের পক্ষেই অপমানজনক।

লড়াইটা করতে গিয়ে তার ঘুমের বারোটা বাজল। মাথা গরম হয়ে যাওয়ায় সে উঠে ওডহাউসের একটা উপন্যাস পড়ার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। তারপর সেটা রেখে একটা থ্রিলার খুলে বসল। তাতেও মন লাগল না দেখে কম্পিউটারে একটা গেম খেলল কিছুক্ষণ। আর খেলতে খেলতেই হঠাৎ ভারী অবাক হয়ে সে মৃদু খুব মৃদু একটা সুবাস পেল নাকে।

কোথা থেকে সুন্দর মৃদু গন্ধটা আসছে? সে এদিক ওদিক তাকাল। সন্দেহজনক কিছু দেখা গেল না কোথাও। গন্ধটা এতই মৃদু যে, আছে না নেই তা নিয়েই খানিকটা ধন্দে পড়তে হয়।

হঠাৎ মনে পড়ল ওরা দুই বান্ধবী যখন ঘরে ঢুকেছিল তখনই গন্ধটা পেয়েছিল সে। তখন খেয়াল করেনি। এরকম গন্ধ পান্না মাখে না। এ গন্ধ আটলান্টিকের ওপারের গন্ধ।

এমনিতেই বিজু খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। একটু ধ্যান করে। তারপর দৌড়তে বেরোয়। এসব তার অনেক দিনের অভ্যাস। স্বামী বিবেকানন্দ তার এক সময়ে আদর্শ ছিল। আজকাল আর ততটা কঠোরভাবে সব দিক বজায় রাখতে পারে না। তবু অভ্যাসটা এখনও আছে।

শেষ রাতে ঘুমিয়েও ঠিক পাঁচটাতেই ঘুম ভাঙল আজও। প্রচণ্ড শীত। বাইরে এখনও অন্ধকার। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। তবু উঠে অভ্যাসমতো ধ্যান করতে বসে গেল সে। আর কী আশ্চর্য! ধ্যানের শুরুতেই সোহাগের মুখ দপ করে ভেসে উঠল আজ্ঞাচক্রে। কী গেরো রে বাবা!

ফের লড়াই। এবং সোহাগের প্রস্থান।

গায়ে পুলওভার চাপিয়ে, জার্সি এবং জুতো মোজা পরে দৌড়তে বেরিয়ে পড়ল বিজু। আজ সে পাগলের মতো দৌড়াল। যেন নিজের কাছ থেকে পালানোর চেষ্টা, চেষ্টা যে ফলবতী হচ্ছে, এমনটা তার মনে হল না। গাঁয়ের নির্জন রাস্তায় তাকে তাড়া করছে নারীচিন্তা, যৌবনের জ্বালা, পতনের আহ্বান। সে হাঁপিয়ে পড়ছিল আজ। ঘুমহীনতার ক্লান্তিই হবে বোধহয়।

দৌড়তে দৌড়তে হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ায় সে বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। আজ রবিবার। রবিবার সকালে যে সে দৌড়োয় না। সপ্তাহে একদিন বিশ্রাম নেয়। কথাটা একদম খেয়াল ছিল না তার। এত অন্যমনস্কতা তো ভাল নয়! কেন এরকম হচ্ছে? কেন হবে?

আজ তার ব্যায়াম করার কথা নয়। তবু ঘরে ফিরে সে রোজকার মতো ব্যায়াম সারল। গা ঘেমে গিয়েছিল শীতের মধ্যেও। তোয়ালে দিয়ে গা মুছে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে স্নান সেরে নিল ঠান্ডা জলে। মনের অস্থির চঞ্চল ভাবটা কিছুতেই যেতে চাইছে না। বড্ড ক্লান্ত করে দিচ্ছে তাকে। সে এরকম নয়। সে এরকম হতে চায়নি কখনও। এর পর থেকে দেখা হলেই সে সোহাগের সঙ্গে ইচ্ছে করেই খারাপ ব্যবহার করবে। পাত্তা দেবে না। তেমন হলে অপমানও করবে। সবচেয়ে ভাল অবশ্য দেখাই না হওয়া। কিন্তু ওরা আজকাল নিয়মিত প্রতি উইক এন্ডে গাঁয়ে আসে। তা হলে বিজু শনি আর রবিবার গাঁ থেকে গায়েব হয়ে যাবে?

কী করা উচিত সে বুঝতে পারছিল না। তবে এই ফেজটা কেটে যাবে বলেই তার মনে হয়। সে শক্ত মনের ছেলে। সে বিবেকানন্দের ভাবশিষ্য। তাকে একটা ন্যাকা খুকি যদি নাকে দড়ি পরিয়ে ঘোরায় তা হলে এই লজ্জা সে রাখবে কোথায়?

রবিবার সকালটায় সে বড়মার কাছে জলখাবার খেতে যায়। এটা প্রায় নিয়মেই দাঁড়িয়ে গেছে। রবিবার বড়মার বাড়িতে কড়াইশুটির কচুরি, না হয় লুচি বা পরোটা কিছু একটা হবেই। বড়মা অপেক্ষাও করে থাকে।

আজ তাকে দেখেই বলাকা বলল, তোর মুখটা অমন শুকনো কেন রে?

আর বোলো না। রাতে ঘুম হয়নি।

ওমা! ঘুম হয়নি কেন?  

বায়ু চড়া হয়ে গিয়েছিল।

বলাকা হাসল, তোর জ্যাঠারও হত মাঝে মাঝে। গোলমেলে মামলা নিয়ে পড়লে মাঝে মাঝে রাতে ঘুম হত না। তখন আমাকে ঠেলে জাগিয়ে নিত।

কেন?

গল্প করবে বলে। ও মানুষটা তো ওরকম ধারাই। আমার সঙ্গে যত কথা ছিল তার। সব কথা আমাকেই বলত।

তোমাদের দারুণ প্রেম ছিল বড়মা।

সে কি আর তোদের মত ফচকে প্রেম রে? ওটা অন্য জিনিস। সে আর আমি ছিলুম যেন একই দেহের সত্তা। কিংবা কে জানে বাবা ভুলভাল বললুম কি না।

যা-ই বলো, বুঝে নিয়েছি।

.

৬২.

গুরু বললেন, ওহে শিষ্য।

শিষ্য বলল, আজ্ঞা করুন গুরুদেব।

বলি, তোমাকে যে চারিপাদ ব্রহ্মজ্ঞান দিলাম তা কি হৃদয়ঙ্গম হয়েছে?

আজ্ঞে গুরুদেব, হয়েছে।

হয়ে থাকলে তোমার মুখমণ্ডলে ব্রহ্মজ্ঞানের দীপ্তি প্রকাশ পাচ্ছে না কেন? বলো তো কী বুঝেছ, ব্রহ্ম ব্যাপারটা কী?

আজ্ঞে গুরুদেব, ব্ৰহ্ম হচ্ছে হাওয়ার নাড়ু।

বৎস, সেটা কী বস্তু।

হাওয়া দিয়ে নাড়ু পাকালে যা হয় আর কী। পুরোটাই ফক্কিকারি।

বৎস, তুমি যে ব্রহ্মকে একেবারে বোঝানি তা নয়। ব্ৰহ্ম অনেকটা এরকমই বটে। কিন্তু আগে কহো আর।

যদি অভয় দেন তো বলি।

 ভীত হওয়ার কিছু নেই বৎস। নির্ভয়ে বলল।

আজ্ঞে ব্ৰহ্ম-ট্রহ্ম কিছু নেই। ব্রহ্মের আকার নেই, প্রকার নেই, গুণ নেই, বাক্য বা মন দিয়ে তার হদিশ মেলে না। সুতরাং ও বস্তুর থাকাও যা, না-থাকাও তাই। ব্ৰহ্ম হচ্ছে কিছু মানুষের অলীক কল্পনা। ব্রহ্ম আমাদের কোনও কাজে লাগে না, ব্ৰহ্ম ব্যবহারযোগ্য নয়, সুতরাং তার জ্ঞানেও আমাদের কোনও প্রয়োজন নেই।

বৎস, তা হলে গত পাঁচ বছর ধরে তুমি আমার সন্নিধানে কায়ক্লেশে অবস্থান এবং সাধনাদি করলে কেন? তোমার উদ্দেশ্য কী?

ব্ৰহ্মসাধনই আমার উদ্দেশ্য ছিল বটে, কিন্তু হে আচার্য, সাধনা করতে গিয়েই ধীরে ধীরে এই সাধনার নিরর্থকতাও আমি হৃদয়ঙ্গম করেছি। ব্ৰহ্ম আছেন এটাও যেমন জ্ঞান, ব্রহ্ম নেই এটাও তেমনই জ্ঞান। সাধনা করে আমি বুঝতে পেরেছি ব্ৰহ্ম-ট্রহ্ম কিছু নেই। এই নেতিবাচক জ্ঞানটির জন্যই সাধনার প্রয়োজন ছিল।

বৎস, আমার ধারণা হচ্ছে তুমি ঠিক মতো ব্রহ্মচর্য পালন করোনি, যথাবিহিত সংযম অবলম্বন করোনি এবং যথার্থ নিষ্ঠাও তোমার ছিল না।

হে ঋষি, আপনি অযথা আমাকে ভর্ৎসনা করছেন। তপোধন, এই সুবিশাল নৈমিষারণ্যে বহু ঋষিই নানা প্রকার তপস্যায় নিয়োজিত রয়েছেন, তারা সকলেই ব্রহ্মজ্ঞানী, তবু মাঝে মাঝেই তারা চরিত্রভ্রষ্ট হয়ে পড়েন বলে শোনা যায়। অথচ ব্রহ্মজ্ঞানী ব্রহ্মই হয়ে যান বলে কথিত আছে, তাই ব্ৰহ্মজ্ঞানীর পতন সম্ভব নয় বলেই আমরা শুনে আসছি। অথচ তাদের মধ্যে অনেকেই কোপন স্বভাববিশিষ্ট, ব্যভিচারী, লোভী, পরশ্রীকাতর, সংকীর্ণমনা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং অহংকারী। তা হলে ব্রহ্মজ্ঞান আমাদের কোন অভীষ্ট সিদ্ধ করে তা আজ্ঞা করুন।

বৎস, তোমার অনাবিল দৃষ্টি এবং সরল অভিব্যক্তির জন্য তোমাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। অপিচ তোমাকে ইহজীবনের কিছু সারসত্যকেও উপলব্ধি করতে হবে। ঋষিরা কেউ সামান্য মানুষ নন। যাঁরা ব্রহ্মজ্ঞানী তারা সাধারণ হবেন কী করে? তুমি তাদের মধ্যে যে সব অবগুণ প্রত্যক্ষ করেছ তাও ভ্রান্তি। প্রয়োজনে প্রত্যেকেই নির্মোক ধারণ করেন মাত্র। বহিরঙ্গের আচরণে তাদের বিচার না করাই ভাল। অন্তরে এঁরা সকলেই নির্বিকার, অচঞ্চল, স্থিতধী, মহাজ্ঞানী মানুষ। একমাত্র পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে অনুগমন করলেই এঁদের স্বরূপ বুঝতে পারা যায়। আবার স্বভাবনিন্দুকদের অপপ্রচারও আছে। রটনার বশীভূত হয়ে এঁদের বিচার না করাই ভাল।

তপোধন, আপনি আমার পূজনীয় গুরু। দীর্ঘ পাঁচ বছর আমি আপনার গোধনের পরিচর‍্যা করেছি, গৃহকর্মে যথাসাধ্য সাহায্য করেছি, সমিধ ও ফলমূল আহরণ করেছি, নিজহাতে আপনার অঙ্গ সংবাহন করেছি, গোধূমাদি চূর্ণ করেছি। আমার সেবায় কোনও ফাঁকি ছিল না। আমার পরিচর্যায় সন্তুষ্ট হয়েই আপনি আমাকে ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করেছিলেন।

বৎস, একথা অতি সত্য। তোমার সেবা ও সৎকর্মে সন্তুষ্ট হয়েই আমি তোমাকে ব্রহ্মজ্ঞানের উপযুক্ত পাত্র বলে স্থিরনিশ্চয় হয়েছিলাম। তোমার অধ্যয়ন ও পঠনপাঠনও সন্তোষজনক ছিল। আমার সিদ্ধান্তে কোনও ভুল ছিল বলে মনে হয় না।

তপোধন, ব্রহ্মজ্ঞানী যেহেতু ত্রিকালদর্শী হয়ে থাকেন তাই তাদের সিদ্ধান্ত নির্ভুল হতে বাধ্য বলে শাস্ত্রের নির্দেশ আছে। তথাপি যদি আপনার ভুল হয়ে থাকে তা হলে ব্রহ্মজ্ঞানকেই সন্দেহ করতে হবে।

বৎস, তুমি আমাকে যে ধিক্কার দিচ্ছ তা প্রতিহত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। ব্রহ্মজ্ঞানও সন্দেহাতীতভাবে সত্য। আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই, ব্রহ্মজ্ঞান তোমার অন্তরকে আলোকিত করল না কেন? পুত্র, তুমি আনুপূর্বিক বলল, কিছু গোপন করো না। আমি যোগযুক্ত হয়ে বসছি।

মহাভাগ, আমি এক সামান্য রাজকর্মচারীর পুত্র। আমার পিতা রাজকীয় কোষাগারের রক্ষক। চিরকাল পরধন প্রহরার কাজে নিযুক্ত। প্রত্যহই তিনি শতসহস্র স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা প্রত্যক্ষ করেন। মাসান্তে সামান্য বেতন নিয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। আমাদের কায়ক্লেশে দিনাতিপাত করতে হয়। পিতা আমাকে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, যাতে আমি বিদ্যাশিক্ষা করে অধ্যাপক বা আরও কোনও সঙ্কর্মে নিযুক্ত হতে পারি। পিতার উদ্দেশ্য পূরণার্থে আমার চেষ্টার অবধি ছিল না। আমি সাতিশয় মেধাবী এবং প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী হওয়ায় আমার অধ্যাপক স্বল্পকাল শিক্ষাদানের পরই বললেন, বৎস, তোমাকে আমার আর কিছুই শেখানোর নেই। তুমি সভাপণ্ডিতের শরণাপন্ন হও। সভাপণ্ডিত আমার মেধার পরিচয় পেয়ে চমৎকৃত হয়ে বললেন, শাস্ত্রাদি, ব্যাকরণ ও কাব্য সবই তোমার কণ্ঠস্থ দেখছি। তোমাকে আমি আর কী শেখাব? তুমি কোনও সর্বজ্ঞ পুরুষের সন্ধান করো। নানা পণ্ডিতদের নানা বিধান শুনে শুনে আমি অবশেষে আপনার কাছে উপনীত হই। কিন্তু পিতা, মেধার বড় জ্বালা, মেধা যে সর্বদাই স্বস্তিদায়ক তা নয়। শাস্ত্রাদি আমার কণ্ঠস্থ বটে, কিন্তু হৃদয়স্থ নয়। উপরন্তু জন্মসূত্রে আমি রূপবান ও সুগঠন। মদনবাণে আমি প্রায়শই জর্জরিত হই। নগরের যুবতী নারী, কুলবধূ, কুমারী, বরাঙ্গনা ও বারাঙ্গনা সকলেই আমার প্রতি সহজেই আকর্ষিতা হয়। আমি কৈশোরকাল থেকেই রমণীগমনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। অবৈধ প্রণয়, ব্যাভিচার, বলাকার কোনওটাতেই আমি অপটু নই। আসঙ্গপিপাসা ও তৃপ্তি ব্রহ্মস্বাদসহোদর বলেই শুনেছি। প্রভো, নারীসঙ্গ আমাকে যে আনন্দ দিয়েছে, ব্রহ্মের জ্ঞান যদি তাদৃশও দিত তা হলেও আমার বলার কিছু ছিল না। এখন আপনিই বলুন পিতা, আমার দোষ কী!

পুত্র, অন্যান্য অনেক ঋষি যেমন বিবাহাদি করে থাকেন আমি তেমন নই। চিরকাল ব্রহ্মচর্যই অবলম্বন করে আছি। নারীসঙ্গ আমি কখনও লাভ করিনি। আসঙ্গপিপাসাও বোধ করি না। সুতরাং তোমার অভিজ্ঞতা কীরকম তা আমি অবগত নই।

হে মহর্ষি, নারীদেহে অবগাহন এক আশ্চর্য আনন্দ, রাজা থেকে ভিক্ষাজীবী সকলেই নারীদেহের বশ। নারীর প্রণয়ও এক বিরল অভিজ্ঞতা। আপনি নারীসঙ্গসুখ কখনও উপভোগ করেননি বলে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আপনার অগোচর রয়ে গেছে। প্রভু, আপনি মৃদু হাস্য করলেন কেন?

পুত্র, রমণীগমনের অভিজ্ঞতা বিষয়ে তোমাকে বিশেষ আগ্রহী দেখছি। সত্য বটে আমার সেই অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু নারী বিষয়ে আমি অজ্ঞ নই। বিধাতার সৃষ্টি কিছুই উপেক্ষার বস্তু নয়। তার সৃষ্টি সবকিছুই বিশেষ অর্থ বহন করে। নারী বিনা কোনও মহান অবতার পুরুষেরও মানবজন্ম সম্ভব নয়। বৎস, সৃষ্টিতত্ত্বের অনেক নিগূঢ় কথাই আমি তোমাকে বলেছি। তুমি যে-সম্ভোগের কথা বলছ তার এই স্বল্প মূলে তুমি পিছনেও সৃষ্টিরই অনুপ্রেরণা বিদ্যমান। নর ও নারীর বিহিত মিলন শ্রদ্ধারই ব্যাপার।

ভগবান, আপনি কখনও মাধ্বী বা দ্রাক্ষাসব পান করেননি।

না বৎস।

আপনি কখনও গীত শ্রবণ বা নৃত্য পরিদর্শন করেননি।

না পুত্র।

 আপনি কখনও দূতক্রীড়া বা বাজিতে অংশগ্রহণ করেননি।

না ধীমান।

আমি সবই আস্বাদ করেছি। অজ্ঞান, ব্রহ্মজ্ঞানহীন, প্রাকৃতজনেরা এই সকল উৎস থেকেই আনন্দ আহরণ করে। ক্ষণিকের তীব্র সুখানিভূতি তাদের গ্লানি, শ্রম, ক্লান্তি, বিষাদ, উদ্দীপনার অভাব অপনোদন করে। আয়ুষ্কাল পদ্মপত্রে নীরবিন্দু মাত্র। সাধারণ মানুষও এইসব সুখানুভূতির ভিতর ব্রহ্মস্বাদই পেয়ে থাকে। জীবনযাপন সহনীয় হয়।

তোমার এই বাক্য আমাকে বিস্মিত করছে বৎস।

মহাভাগ, বিস্ময় উৎপন্নের হেতু আপনার অনাস্বাদ। আপনি এইসব সুখানুভূতির শরিক নন। শরিক হলে বুঝতেন এও ব্রহ্মেরই আস্বাদ।

বটে!

আজ্ঞা ঋষিশ্রেষ্ঠ।

 বৎস, তোমার কথা শুনে ওইসব ক্ষুদ্র ব্রহ্মবিশ্বকে অনুধাবন করার ইচ্ছা হচ্ছে।

 অতি উত্তম প্রস্তাব মহর্ষি।

 ক্ষণকাল অপেক্ষা করো, আমি প্রস্তুত হয়ে আসছি।

গুরুদেব তাঁর গৃহমধ্যে অন্তর্হিত হলেন এবং কয়েক দণ্ড পর যখন নিষ্ক্রান্ত হলেন তখন শিষ্য বিস্ফারিত লোচনে স্থানুবৎ বসে রইল। কোথায় সেই শ্মশ্রুমণ্ডিত প্রবৃদ্ধ অশীতিপর ঋষি। ইনি যে এক সতেজ, সটান, উজ্জ্বলকান্তি অতীব সুদর্শন এক যুবা পুরুষ।

আপনি কে?

বৎস, আমিই তোমার গুরু। বিস্মিত হয়ো না। আমি সামান্য পরিচর্যা করেছি মাত্র।

সেই লোলচর্মবিশিষ্ট, পলিতকেশ অশীতিপর বৃদ্ধই কি আপনি? হা পুত্র, বৃথা কালক্ষেপে কাজ কী? সন্ধ্যা ঘনায়মান, এই তো প্রমোদের কাল। চলো। কিছুকাল পরে গুরু ও শিষ্য একত্রে নগরের দুর্ধর্ষ নটী রাজবিনোদিনীর আলয়ে প্রবেশ করলেন। সেখানে নগরের শ্রেষ্ঠ ধনী, রাজন্যবর্গ, সেনাধ্যক্ষ, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত। প্রত্যেকেরই অঙ্গে মহার্ঘ পোশাক, স্বর্ণালঙ্কার, পেটিকায় প্রভূত স্বর্ণমুদ্রা ও মূল্যবান উপহারসামগ্রী। প্রত্যেকেই রাজবিনোদিনীর আসঙ্গলিন্দু ও স্তুতি-উন্মুখ। প্রমোদশালা গন্ধে, পুষ্পে, রত্নখচিত বস্ত্রসম্ভার ও বর্ণাঢ্য গালিচায় শোভাময়। রাজবিনোদিনী সভাস্থলে অচিরেই প্রবেশ করবেন। সুন্দরী দাসীরা অতিথিবৃন্দকে উত্তম আসব ও নানাপ্রকার খাদ্যদ্রব্য বিতরণে নিরন্তর পরিচর‍্যা করে চলেছেন। পরিচারকেরা বড় বড় সুদৃশ্য পাখায় ব্যজন করছেন। শিষ্য সমভিব্যাহারে ঋষি প্রবেশ করামাত্র সভাস্থল যেন হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অতিথিরা সকলেই হতচকিত, বিস্মিত। তারা এরকম দিব্যকান্তি পুরুষ আর দেখেননি। ঋষির পরনে নিতান্তই দুটি বস্ত্রখণ্ড। কিন্তু সেই সামান্য বেশবাসেই তাকে বড় অপরূপ দেখাচ্ছে। সকলেরই বিস্মিত দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ। যেসব যন্ত্রানুসঙ্গী নানা বাদ্যযন্ত্রে মধুর শব্দলহরী সৃষ্টি করছিল তারাও আচমকা থেমে গেল।

দেবর্ষি, আপনার আগমনে এখানে কিছু রসভঙ্গ হয়েছে।

কিন্তু বৎস, আমি তো রসভঙ্গ ঘটাতে আসিনি। গীতবাদ্য যেমন চলছে চলুক। তুমি সকলকে আশ্বস্ত করো। আমি আজ রসগ্রহণ করতেই এসেছি।

গীতবাদ্য ফের শুরু হল বটে, কিন্তু বেসুর বাজছিল।

উপস্থিত শ্ৰেষ্ঠীদের মধ্যে একজন উঠে পড়লেন। ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার আগে কী ভেবে হঠাৎ এগিয়ে এসে নতজানু হয়ে ঋষিকে প্রণাম করে বিনা বাক্যব্যয়ে চলে গেলেন।

ক্ষণকাল পরে রাজন্যবর্গের একজন অনুরূপভাবেই উঠে পড়লেন। তিনিও বিদায় নেওয়ার আগে ঋষিকে অভিবাদন করে গেলেন।

ক্ষণকাল পরে আরও একজন এবং তার পরে আরও একজন। এমনি করে প্রমোদালয় ধীরে ধীরে শূন্য হতে লাগল।

শিষ্য উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, প্রভো, এঁরা রণে ভঙ্গ দিচ্ছেন কেন তা বুঝতে পারছি না। এঁরা কি আপনাকে অসম প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন? রাজবিনোদিনীর অনুগ্রহপ্রার্থীরা সহজে হার মানার মানুষ নন।

গুরু মৃদু হাস্য করলেন মাত্র।

প্রমোদগৃহ শূন্য হয়ে গেল। শেষ অতিথি রাজ্যের সহসেনাপতি বিদায় নিয়ে যাওয়ার আগে যথাবিহিত প্রণাম করলেন ঋষিকে। তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও বললেন না। মাথা নত করে বিদায় নিলেন।

গীতবাদ্যকাররা নীরবে বসে রইল। তাদের কণ্ঠে সুর আসছে না। বাদ্যযন্ত্রে আঙুল স্থির হয়ে আছে।

এমন বিস্ফোরক অবস্থায় নিরানন্দ প্রমোদগৃহে প্রতিহারী অতি নির্বাপিত কণ্ঠে রাজবিনোদিনীর আগমনবার্তা ঘোষণা করল।

আগমন তো নয়, যেন আবির্ভাব। রাজবিনোদিনী সর্বাঙ্গসুন্দরী। কেশদাম থেকে পাদনখ পর্যন্ত যেন কোনও চতুর শিল্পীর কারুকার্য। স্বর্ণ, হীরকখণ্ডের আবরণে যেন বিদ্যুৎ খেলা করছে। অতি মূল্যবান রেশমি বসনের কুশলী বিন্যাস দেহঘষ্ঠিকে আরও প্রকট করেছে। আয়ত দুই চোখে অপ্সরাসদৃশ কটাক্ষ। লীলায়িত দুখানি হাত যেন সর্বদাই নানা নৃত্যের মুদ্রায় আন্দোলিত। রাজবিনোদিনীর চলনেও ছন্দ, নৃত্যবিভঙ্গ প্রকাশ পাচ্ছে। অপরিমেয় এই সৌন্দর্য যে-কারও ধ্যান ভঙ্গ করতে সক্ষম।

রাজবিনোদিনী প্রমোদকক্ষে পা দিয়েই থমকে দাঁড়াল।

এ কী! আজ আমার প্রমোদগৃহ শূন্য! এ যে অবিশ্বাস্য। আমার কি যৌবন অতিক্রান্ত হয়েছে? কেশপাশে কি দেখা দিয়েছে বার্ধক্যের শ্বেতাভাস! আমার নৃত্য কি আকর্ষণ হারিয়েছে? ছলাকলা কি বিস্মৃত হয়েছি? নাকি অতিথিবৃন্দকে যথেষ্ট পরিচর‍্যা করা হয়নি? নাকি তারা অপমানিত বোধ করে আমার গৃহ ত্যাগ করেছেন?

প্রমোদগৃহের এক কোণ থেকে শিষ্য উঠে দাঁড়িয়ে বিনয় সহকারে বলল, না ভদ্রে, প্রমোদগৃহ একেবারে শূন্য নয়। আমরা তোমরা দর্শনাভিলাষী হয়ে অপেক্ষা করছি।

অপরূপ নারী এবার তাদের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করল। চোখে বিরক্তি। মুহূর্তকাল মাত্র। তার পরেই রাজবিনোদিনীর দুটি আয়ত চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। প্রমোদগৃহের এক কোণে দীপশিখার আলো তেমন উজ্জ্বল নয়। অথচ সেখানে যেন একটি দীপদণ্ড দাউ দাউ করে জ্বলছে। না, দাউ দাউ করে জ্বলছে না। অগ্নিরেখার মতো স্থির ও দীপ্ত হয়ে আছে। এ কে? কোনও প্রণয়প্রার্থী? প্রমোদপ্রিয়? সংগীতরসজ্ঞ?

বিভ্রান্ত রাজবিনোদিনী চঞ্চল হল। পদক্ষেপে স্বর্ণমঞ্জরীর নিক্কণ তুলে কয়েক পা এগিয়ে গেল অতিথিদ্বয়ের দিকে। তারপর বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। তার সর্বাঙ্গ প্রকম্পিত হচ্ছিল এক অজ্ঞাত ভয়ে। বুকের মধ্যে এক সুগভীর দুন্দুভি বেজে উঠল যেন। আর বিস্ফারিত লোচন হঠাৎ সিক্ত হল অকারণ অশ্রুতে। স্থাণুবৎ কিছুক্ষণ দণ্ডায়মান থেকে আচমকা প্রবল বাত্যায় উৎপাটিত বৃক্ষের মতো ভূপাতিত হল রাজবিনোদিনী। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করার পর অতি ধীরে নিজেকে উত্তোলন করে দুই পদ্মপত্রের মতো চোখে তাকিয়ে রইল ঋষির দিকে। মুখে বাক্যস্ফুর্তি হল না।

শিষ্য সবিস্ময়ে বলে উঠল, মহাতপ, এ কী! এই প্রমোদগৃহকে যে আপনি বিষাদগৃহে পরিণত করেছেন!

গুরু শুধু মৃদু হাস্য করলেন।

রাজবিনোদিনী তার স্খলিত অঞ্চল তুলে নিয়ে নীরবে নতমস্তকে প্রমোদগৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলে গুরুদেব গাত্রোত্থান করে বললেন, চলো বৎস, আমাদের নৈমিষারণ্যের তপোবনে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। আর কালক্ষেপ বৃথা।

শিষ্য স্তম্ভিত মুখে গুরুদেবের অনুসরণ করতে লাগল।

নিশাকালে জনবিরল শব্দহীন তপোবনে গুরুদেবের পদপ্রান্তে বসে শিষ্য প্রশ্ন করল, গুরুদেব ব্রহ্মজ্ঞান আসলে কী বস্তু তা আজ্ঞা করুন।

গুরুদেব সহাস্যে বললেন, বৎস, ব্রহ্মজ্ঞান কোনও অলীক কল্পনা নয়, ধরাছোঁয়ার বাইরের ব্যাপারেও নয়, তোমার হাওয়ার নাড়ও নয়। ব্রহ্মজ্ঞান হল কাণ্ডজ্ঞান বা বাস্তব চৈতন্য।

মহাশয়, আপনি বিস্তারিত বলুন। আমার কোথায় ভুল হয়েছিল?

বৎস, মানুষ যৌবনের অনিত্যতার কথা জানে, প্রমোদের ক্লান্তির কথাও জানে, সৌন্দর্যের অবসানের কথাও জানে। জীবনের শেষে যে মৃত্যু অপেক্ষমাণ তার কথাও কি মানুষ জানে না? তবু নিজেকে সে ভুলিয়ে রাখতে চায়। যে-জ্ঞান সব ধাঁধাকে ধ্বংস করে বস্তুর মর্মে পৌঁছয় তাই ব্ৰহ্মজ্ঞান। তুমি আবার সাধনায় ব্যাপৃত হও।

যথা আজ্ঞা গুরুদেব।

.

 শীতের প্রকোপ কমে আসছে। মাঝে মাঝে দক্ষিণের হাওয়া বয়ে যায় আজকাল। গাঁয়ে বসন্তকালের দেখাসাক্ষাৎ পাওয়া যায় এখনও। ভারী আরামদায়ক একটি আবহাওয়ায় সকালে নিজের ঘরে বসে আপনমনে লিখছিল অমল। আজকাল তার মন ভাল আছে। রাতে ঘুম হয়। আবার প্রশ্নও জাগে, ভোতা হয়ে যাচ্ছি নাকি? বুড়ো হয়ে গেলাম না তো! কিংবা কে জানে, আর পাঁচজন এলেবেলে মানুষের মতো আমিও হয়ে যাচ্ছি নিরীহ গৃহপালিত একটি প্রাণী। মেধাবী অমলের এ কি অধঃপতন? প্রশ্ন কমছে, জীবনের রহস্যময়তা হ্রাস পাচ্ছে, গণ্ডিবদ্ধ সংসারে দিব্যি খাপে খাপে বসে যাচ্ছে সে৷ মোনার সঙ্গে যে আকচা-আকচিটা ছিল সেটাও আর নেই। এখন সে খুবই ভদ্রভাবে অনুগত স্বামীর মতো বেশির ভাগ কথাতেই সায় দিয়ে চলে। ভিতরের সব অঙ্গার খাক হয়ে গেল নাকি তার? মাঝে মাঝে এই খাতাকলম নিয়ে বসা। এটাই তার একমাত্র অ্যাডভেঞ্চার। এইসব খণ্ডচিত্র কোনও নাটক নভেল নয়, উপন্যাস বা গল্পও নয়, শুরু-মধ্য-শেষ বলে কিছু নেই। এগুলোর নেই কোনও ভবিষ্যৎও। তবু এই একমাত্র তার আবরণহীন হওয়ার ক্ষেত্র।

গতকাল শুক্রবার গেছে। অফিসের পর গাড়ি নিয়ে সন্ধের মুখেই তারা বেরিয়ে পড়েছিল উইকএন্ডে। একটু রাতের দিকেই পৌঁছেছে গাঁয়ে। এটা আজকাল তাদের প্রিয় অভ্যাস। এক সময়ে নাকি মোনার খুব গাছপালার শখ ছিল। বিদেশবিভূঁইয়ে আর সেসব শখ বজায় রাখা যায়নি। কলকাতার ফ্ল্যাটে টবে কিছু গাছপালা পালনের চেষ্টা হয়েছিল, সুবিধে হয়নি। মোনাকে তার শ্বশুরমশাই একটা ফাঁকা জমি ঘিরে দিয়ে বলেছে, তোমার এত গাছপালার শখ, আমি তোক ডেকে লাঙল দিয়ে দিচ্ছি। তুমি ইচ্ছেমতো গাছ লাগাও। সারা সপ্তাহ জল-টল আমরা দিয়ে দেবখন।

মোনা কলকাতার নার্সারি থেকে ইচ্ছেমতো ফুলের গাছ কিনে এনে লাগাচ্ছে তিন সপ্তাহ হল। তার চোখমুখে নতুন খেলনা পাওয়ার উত্তেজনা। সকাল থেকেই বাগানে পড়ে আছে। অন্য কোনও দিকে খেয়ালই নেই।

থাক, একটা কিছু নিয়ে থাক। যারা একটা কিছু নিয়ে মেতে থাকে তাদের মাথায় শয়তানের বাসা হয় কমই। মোনা আজকাল অশান্তি কমই করে।

বাবা।

অমল তার অন্যমনস্ক চোখ ফিরিয়ে মেয়েকে দেখল, কী রে?

একটু ঘুরে আসছি। আজ চাক ভাঙা মধু খাব।

অমল হাসল। সব মধুই তো চাক ভাঙা।

হ্যাঁ। কিন্তু ভাঙা চাক থেকে টপ টপ করে মুখে গরম মধু পড়ার মতো তো নয়। খাবে? তা হলে তোমার জন্য নিয়ে আসব ক্যারিব্যাগে করে।

আনিস।

 ওই রকম করে খেতে হবে কিন্তু। স্কুইজ এ লিটল, ড্রিংক এ ড্রপ অর টু।

তাই করব। কার বাড়িতে চাক ভাঙছে রে?

পান্নাদের জামগাছে। ইয়া বড় চাক।

এখানে এলেই সোহাগের মুখে একটা উজ্জ্বলতা দেখা যায়। ভিতরকার আনন্দ যেন ফেটে বেরোতে চায়। শহর ওর ভাল লাগে না, অমল জানে। শরীরও ভাল থাকে না কলকাতায়। মেয়েটা ভারী মানিয়ে নিয়েছে সকলের সঙ্গে।

অমল একটা তৃপ্তির শ্বাস ফেলল। হঠাৎ তার জীবনে সবকিছুই ভারী অনুকূল মনে হচ্ছে। গ্রহনক্ষত্রের খেলা নাকি? কে জানে বাবা! এত ভাল কি সত্যিই ভাল? ভালর আবার গুনোগার দিতে হবে না তো!

.

গাছের তলায় রাজ্যের ছোবড়া, ছুঁটে আর কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া তৈরি হয়েছে। নিথর বাতাসে ধোঁয়া উঠছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। কোনও পতঙ্গই ধোঁয়া সহ্য করতে পারে না।

সোহাগের হাতে একটা নতুন গামছা দিয়ে পান্না বলল, এটা দিয়ে মাথা মুখ ঢেকে নাও।

 ওমা! কেন?

কী জানি বাবা, মৌমাছিদের ঘর ভাঙা হচ্ছে, ওরা যদি রাগ করে ছুটে এসে কামড়ায়!

যাঃ, কিচ্ছু হবে না।

বিজুর পরনে ফুলপ্যান্ট, গায়ে টি শার্ট, কোমরে বাঁধা একটা গামছা, তাতে একটা চকচকে দা গোঁজা। সে খুব সন্তর্পণে টারজানের মতো জামগাছটা বেয়ে উঠে যাচ্ছিল। পিছু পিছু উঠছিল মরণ।

জানো তো, বিজুদা হল গাছ বাওয়ার ওস্তাদ। আর মরণ। কেউ ওদের মতো পারে না।

ঊর্ধ্বমুখে সোহাগ দেখছিল বিজুকে। ছিপছিপে দীঘল সুপুরুষ এই যুবকটিকে সে আজকাল কেন যেন খুব খুঁটিয়ে লক্ষ করে। একটু প্রাচীনপন্থী, ডু গুডার, একটু কুসংস্কারাচ্ছন্নও বোধহয়। কিন্তু লোকটা মন্দ নয়। মেয়েদের সামনে একটু আপসেট হয়ে পড়ে।

বিজু চাকটার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। মরণ ওপর থেকে চেঁচিয়ে বলল, পান্নাদি চাদরটা দুজনে শক্ত করে ধরবে কিন্তু। মস্ত বড় চাক। অনেক মধু।

বিজু বলল, দুজনে পারবি তো! না হলে সুদর্শনকে বরং ডেকে আন।

মৌমাছিদের পাখার শব্দে চারদিকে ঝালা বেজে যাচ্ছে। অনেক মৌমাছি উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ধোয়ার পরিধির বাইরে। খুব দূরে যায়নি এখনও। বাসার বড় মায়া। কত যত্নে কতদিন ধরে তৈরি করেছে এই চাক।

দাঁড়াও সোহাগ, সুদর্শনদাকে বরং ডেকেই আনি। মস্ত বড় চাক। আমরা পারব না।

 পান্না সুদর্শনকে ডাকতে গেল। সোহাগ চেয়ে রইল ওপর দিকে। হঠাৎ যেন মধুর মতোই এক সুস্বাদ সে অনুভব করছিল তার সর্বাঙ্গে। কেন কে জানে।

.

৬৩.

বাইগুনগুলা দ্যাখেন খুড়া, কেমন বোঝেন?

ধীরেন কাষ্ঠর চোখ ভারী জুলজুল করছিল। গোয়ালের পিছন দিকটায় পচাই সার দিয়ে বেগুন ফলিয়েছে বাঙাল। শীতের মাঝামাঝি পার করে তবে ফলেছে বটে বেগুনের মতো বেগুন। কিছু সবজে-বেগুনি দো আঁশলা, কিছু প্রগাঢ় কালচে-বেগুনি রঙের। আখাম্বা বিরাট সাইজের নয়, মাঝারি গড়নের। বড় বড় পাতার আড়ালে আবডালে যেন নববধূর মতো সব আধো-ঢাকা হয়ে উঁকি দিচ্ছে। বেগুন চেনে ধীরেন। এর জাতই আলাদা। গা এত চকচকে যেন কেউ তেলে ডুবিয়ে এইমাত্র তুলেছে।

হাঁটু মুড়ে বসে জহুরির চোখে কয়েকটা বেগুন নেড়েঘেঁটে দেখল ধীরেন। ভারী নরম শরীর, ভিতরে যেন বিচিই নেই মোটে।

বাঙাল হে, এ তো বড় জাতের বেগুন দেখছি। ফলনও তো ধুন্ধুমার।

আইজ্ঞা। আপনারা কাশীর বাইগুন কইতে লোল ফালান, আমি কই ময়মনসিংহের বাইগুন একটু চাইখ্যা দেইখেন, রসগোল্লা ফালাইয়া বাইগুন খাইবেন।

আরও বড় হবে তো!

কন কী! আরও বড় মানে! লাউয়ের লাহান হইব। অখনই কী দ্যাখতাছেন, আর এক মাস পরে দেইখ্যেন, চোখে ধন্দ লাগব।

আজ বাঙালকে বেগুনে পেয়েছে। এক একদিন এক একটা পায় ওকে। তবে সত্যি কথা বলতে কি, ধীরেন সব বেগুনেরই স্বাদ পায়। পেটে খিদে থাকলে স্বাদ-সোয়াদের অভাব হয় না। তার কাছে কাশীর বেগুন যেমন, ময়মনসিংহের বেগুনও তেমন। তফাত হয়তো আছে, কিন্তু বাছবিচার নেই, তবে মোসাহেবি করা তার রক্তের মধ্যেই আছে, যখন যে যা বলে তাতেই তাল ঠুকে না গেলে ধীরেনের চলেই বা কী করে? সুতরাং সে সারা সকালটা বেগুনের ক্ষেতে ঘুরে ঘুরে বিস্তর হ্যাঁ, হুঁ, বটেই তো বলে যেতে লাগল। বেগুন নিয়ে আরও কিছুক্ষণ কাটত। কিন্তু বাঙালের কোলে তার মেয়ে হাম্মি চড়া রোদে আর থাকতে চাইছে না। সে কান্নাকাটি শুরু করায় বাঙাল বাড়ির দাওয়ায় ফিরে এসে ছায়ায় বসল। মেয়েটাকে ছেড়ে দিল উঠোনে।

একটা মেয়ের বমি করার শব্দ আসছিল কুয়োতলার দিক থেকে। কুয়োতলাটা আবডালে। রান্নাঘরের ওপাশটায় একটা নিমগাছের ছায়ার নীচে। এখান থেকে দেখা যায় না। বাঙাল কুয়োতলাটা বানিয়েছে হিসেব করে। নিমপাতা পড়ে পড়ে কুয়োর জল নাকি শুদ্ধ হবে, তা হবে হয়তো। কিন্তু বমিটা করছে কে? একটু কান খাড়া করে ধীরেন। লক্ষণ ভাল নয়। এ যদি বাসন্তী হয় তা হলে চিন্তার কথা। বমি করে নেতিয়ে-টেতিয়ে পড়বে হয়তো। তা হলে ধীরেনের সকালের খ্যাটনটা গেল।

বমির শব্দটা বাঙালও শুনছিল। মন দিয়েই শুনল। তারপর ধীরেনের দিকে চেয়ে বলল, মাইয়ালোকের এই বড় দোষ।

ধীরেন বুঝতে না পেরে একটা হু দিয়ে দায় সারল।

 রসিক নিজেই ফের বলল, প্যাটে বাচ্চা আইলেই বমিছমি কইরা নান্দিভাস্যি কাণ্ড।

এবার ধীরেন বুঝল, বলল, বলো কী। হাম্মি তো এই সবে দাঁড়াতে শিখেছে।

আর কইয়েন না খুড়া। ইচ্ছায় তো হয় নাই অ্যাকসিডেন্টাল কেস। হইয়া পড়ছে আর কী!

এরকম তো হতেই পারে। ধীরেন ব্যাপারটার মধ্যে আর কোনও দোষ দেখতে পেল না। তবে সকালে আজ হাঁটাহাঁটি হয়েছে বিস্তর। মহিমদাদার বাড়িতে আজকাল সকালের দিকে গিয়ে পড়লে একটু কফি জোটে। কফির একটু নেশাও হয়েছে আজকাল ধীরেনের। তা গিয়ে শুনল, কফি ফুরিয়েছে। আজ তাই লিকার চা জুটেছে। লিকার চা নিমকহারাম জিনিস। পেটে গিয়ে ঘুমন্ত খিদেকে নাড়া দিয়ে জাগিয়ে দেয়। তখন ভারী হাল্লাচিল্লা পড়ে যায় পেটে। পেটের সেই হাঁচোড়-পাঁচোড় থেকেই মনে পড়ে গেল আজকাল বিজুদের বাড়িতে সকালের দিকে পাউরুটি সেঁকা হয়, পুরু মাখন লাগিয়ে খায় সবাই। জব্বর জিনিস। গিয়ে শুনল, সকালে সব পিকনিকে গেছে। আজ শনিবার, বাঙালের আজ বিকেলে আসার কথা। রোববার সকালে তার বাঙালের বাড়িতে পাকা বন্দোবস্ত আছে। কিন্তু বাঙাল না-থাকলে সুবিধে হয় না। বাসন্তীর মা এসে সকালবেলায় থানা গেড়ে বসে থাকে। যৌবনের সেই রসে ঢলঢল মেয়েটি এখন কাকতাড়ুয়া বুড়ি। দেখলেই বুকের ভিতরটা গুড়গুড় করে। তার বউয়ের কাছে নালিশও করে এসেছে।

কামারপাড়ার রাস্তায় সকালে হঠাৎ বলাইয়ের সঙ্গে দেখা। বাসন্তীর হেক্কোড় দাদা। কানাই আর বলাইয়ের মধ্যে মারদাঙ্গা লেগেই আছে। একসময় বাঙাল ভগ্নীপপিতকে গা-ছাড়া করে বিষয়সম্পত্তি গাপ করার ফন্দি এঁটেছিল। কালু গুণ্ডাকে দিয়ে খুন অবধি করানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বাঙাল শক্তপোক্ত লোক, সে ভয় খায়নি। মার খেয়েও নিজের দখল ছাড়েনি। গো আছে বটে। মাঝখানে থেকে কানাই বলাইকেই এখন আঁটি চুষতে হচ্ছে।

তাকে দেখেই বলাই হাঁটায় ব্রেক কষে বলল, এই যে ধীরেনকাকা কোথায় চললেন?

গলার চড়া আওয়াজটা ধীরেনের ভাল মনে হল না। বলাই মারমুখো মানুষ। তাই মিনমিন করে বলল, এই একটু বেরিয়েছি বাপু।

ওই শালার কাছে আপনার নাকি খুব যাতায়াত শুনতে পাই!

শালাটা কে তা বুঝতে না পেরে ধীরেন থতমত খেয়ে বলল, না তো! কে বলেছে তোমাকে?

লুকিয়ে তো লাভ নেই কাকা। সব জানি। আপনারা কিছু লোকই তো আসকারা দিয়ে ওকে মাথায় তুলেছেন। এখন শালা চোখে ভেলভেট দেখছে। নইলে শুয়োরের বাচ্চার এত সাহস হয়?

ধীরেন বিপদের গন্ধ পাচ্ছিল। বড্ড তেড়িয়া মেজাজ বলাইয়ের। গদগদে একটু হেসে বলল, না বাবা, কে কী রটায় কে জানে। ওসবে কান দিও না।

কেন কাকা, মিছে কথা বলে বুড়ো বয়সে পাপের বোঝা বাড়াচ্ছেন। ওই খানকির ছেলে আপনাদের মাথা খাচ্ছে কী করে? বাইরে থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে আমাদের গাঁ ছারখার করে দিচ্ছে, দেখছেন না? আমার বোন তখন কুঁড়ি মেয়ে, বোধবুদ্ধি হয়নি। তাকে ফুসলিয়ে শাঁখা সিঁদুর পরিয়ে বিয়ের ভড়ং করল, আপনারা পাঁচজন টু শব্দটি করলেন না। নইলে নাবালিকা হরণের জন্য ওর দশ বছর জেল হয়। ও শালা কী মতলবে একটা বউ থাকতে আবার বিয়েতে বসল সেটা কি বোঝেন না আপনারা?

এইবার কার কথা হচ্ছে তা ধরতে পারল ধীরেন। তবে সম্পর্কটা রাগের মাথায় বড্ড গুলিয়ে ফেলছে বলাই। কে কার শালা তার পর্যন্ত হিসেব করছে না।

আমতা আমতা করে ধীরেন বলল, যা হয়েছে তা তো হয়েই গেছে বাবা। একটা মিটমাট করে নাও বরং।

মিটমাট! ভাল বলেছেন বটে। ও হারামজাদা মিটমাটে আসতে চাইলে তো!

যেন ভারী অবাক হয়েছে এমন ভাব করে ধীরেন বলল, চাইছে না বুঝি?

রাগে বলাই যেন দুনো হয়ে উঠছিল, এ কথায় ফেটে পড়ে বলল, ও শালার পাখা গজিয়েছে, বুঝলেন? পেটে পেটে শয়তানি কি কম? আমার বোনকে ফুসলিয়ে বের করে নিয়েছে, লোককে ধাপ্পা দিয়ে দোহাত্তা জমি গাপ করছে, খোঁজ নিলে দেখবেন আরও কটা বিয়ে করে বসে আছে। এসব বদমাশ লোককে আপনারা প্রশ্রয় দিচ্ছেন কী করে? ভুবন জ্যাঠা তো বলেছিল, এই গাঁয়ে বাইরের লোক বসান দিতে দেবে না। পঞ্চায়েত না কচু। কিছু পারল করতে, টাকা খাইয়ে সব মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। বেশি নয়, আমার ধূপকাঠির ব্যবসায় দশটি হাজার টাকা ঢাললেই ফুলেফেঁপে উঠবে। খদ্দের ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। মাত্র দশটি হাজার টাকা ধার হিসেবে চেয়ে পাঠিয়েছিলাম। আমার মাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে।

ধীরেন ভারী অবাক হয়ে বললে, তাই নাকি? এ তো অন্যায় কথা।

অন্যায় নয়! বলে পাঠিয়েছিলুম হ্যান্ডনোট লিখে দিচ্ছি, না হয় বউয়ের নথ বাউটি বাঁধা দিচ্ছি, তা কানেই তুলল না। আপনারা সবাই মিলে এই অন্যায়ের একটা বিহিত তো করতে পারেন। নাকি?

হে হে করে ভারী বুঝদারের মতোই হাসছিল ধীরেন। বাসন্তীর মা বিয়ের সময় মোটা টাকা পণ নিয়েছিল রসিকের কাছ থেকে, সবাই জানে। বিষয়-সম্পত্তিও সবই বাসন্তীর নামে। এদের হয়তো আশা ছিল লোকটাকে হাড়িকাঠে ফেলা গেছে। কিন্তু বাসন্তীকে যত বোকা বলে ধরে নিয়েছিল এরা ততটা বোকা যে বাসন্তী নয়, সেও যে নিজের ভাল-মন্দ বোঝে এটা টের পেয়ে এখন এদের এক গাল মাছি। শুধু তাই নয়, বাসন্তী তার বাঙাল স্বামীকে ভালবাসে খুব। যদিও তার কানে বিষ বড় কম ঢালেনি কানাই বলাইয়ের মা।

তবে এতসব আস্ফালনের ভিতর থেকে পরমহংস যেমন জল থেকে দুধ তুলে নেয় তেমনি ধীরেনও আসল খবরটা পেয়ে গেল। তা হল বাঙাল এসেছে। আর তার মানেই হল সকালে আজ একটা খ্যাটনের ব্যবস্থা হল।

তা এ পর্যন্ত ভালই এগোচ্ছিল ব্যাপারটা। বেগুনক্ষেত দেখে বেড়ানো অবধি, কিন্তু বাধক হচ্ছে বাসন্তীর ওই বমিটা, ওতেই এক বালতি দুধে এক ফোঁটা গোচোনা পড়ে যাচ্ছে।

সে বাঙালের দিকে চেয়ে বলল, তাই বুঝি?

হ খুড়া। ইচ্ছায় হয় নাই। তবে ভগবানের ইচ্ছার উপর তো হাত নাই।

তা তো বটেই।

আমি বউরে কইছি, কষ্ট-টষ্ট হয় হউক, পোষাইয়া দিমু অনে। কিন্তু মুশকিল কী জানেন? প্যাটে তো কিছুই রাখতে পারছে না। যা খায় উগরাইয়া দেয়।

তবে তো সমস্যা।

খুব সমস্যা।

বমির শব্দ থেমেছে। এখন জল কুলকুচি করার শব্দ হচ্ছে। মুক্তার গলার স্বর শোনা গেল, অ বউদি, পেট তো একেবারে খালি করে দিলে। গিয়ে শুয়ে থাকো গে যাও, রান্না-বান্না আমি দেখছি।

বাসন্তীর ক্ষীণ গলায় বলল, না বাপু, শখ করে ইলিশ মাছ এনেছে। বেগুন-ইলিশ খাবে। আমি পারবখন, তুই একটু আগুপিছু করে দিস।

তোমার মাকে একটা খবর দেব কি?

 কেন?

শুনেছি নাকি কোন শেকড় বাটা খাইয়ে পোয়াতির বমি বন্ধ করতে পারে।

না বাপু, ওসব জিনিসে আমার দরকার নেই। বমি হচ্ছে তোক। এ তো আর নতুন কিছু নয়।

বাঙাল খুব আনমনে সামনের দিকে চেয়ে বসে আছে। হাম্মি টলোমলো পায়ে দাওয়া ধরে ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে বাপের দিকে ফিরে চেয়ে মোট চারখানা দাঁত দেখিয়ে হাসছে।

ভারী সুন্দর সব দৃশ্য। ছানি-পড়া চোখে এসব দৃশ্য আবছা হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার সব ফুটে উঠেছে। ভারী ভাল দেখছে আজকাল ধীরেন। পেটে খিদে আঁচড়াচ্ছে। তবু কিছু খারাপ লাগছে না এখন। মনটা ভাল থাকলে এমন ধারা হয়! তখন খিদে-টিদে সব চাপা পড়ে থাকে।

মনটা ভাল হতে বেশি কিছু লাগে না! মানুষের এক-একটা উচ্চারণই যেন যুগযুগান্তের কুয়াশা কাটিয়ে রোদের আলো ছড়িয়ে দেয়! ওই যে কুয়োতলায় বাসন্তীর ক্ষীণ কণ্ঠ শোনা গেল, বমি করে উঠে হাঁফ ধরা গলায় বলছে, না বাপু শখ করে ইলিশ মাছ এনেছে। বেগুন-ইলিশ খাবে। আমি পারবখন, তুই একটু আগুপিছু করে দিস।

একটুকুই তো কথা, কিন্তু এই কথাটুকুই বড় বিহ্বল করে ফেলেছে তাকে। তাও বাসন্তী হল গিয়ে বাঙালের দ্বিতীয় বউ। আইনে যার স্বীকৃতি নেই। তার উপর ভিনদেশি মানুষ, গোঁয়ারগোবিন্দ, ভাষাটাও রাক্ষুসে। তা বলে কি ভালবাসায় ভাটা হল? নাঃ, বাঙালটার কপাল আছে। পুরুষও বটে।

বুঝলেন খুড়া, টাকাপয়সা বিষয়সম্পত্তি কোনও কামের জিনিস না। যার লিয়া করি সেই হইল আসল। হ্যায় যদি না থাকে তাহইলে হলই ফাঁক। বুঝলেন?

বুঝেছি হে। বাসন্তীর জন্য ভাবছ তো! আরে, চিন্তা কী? ও গাঁয়ের মেয়ে, শহুরে মেয়ের মতো ফুলের ঘায়ে মূৰ্ছা যায় না।

উপর্যুপরি হইয়া গেল তো, তাই একটু ডরাই।

আগে তো বাপু সব উপর্যুপরিই হত। তখন তো আর আটকানোর উপায় ছিল না।

খুড়া, বাসন্তীরে ভাল কইরা আশীর্বাদ কইরেন তো। আপনে একজন সজ্জন মানুষ, মনে কালিঝুলি নাই, প্রাণ ভইরা আশীর্বাদ কইরেন তো। গর্দিশটা য্যান পার হইতে পারে।

তার আশীর্বাদের কোনও দাম আছে বলে যে কেউ বিশ্বাস করে এটাই ধীরেনের কাছে অবিশ্বাস্য। বিল থেকে বিহ্বলতর লাগতে লাগল তার। এতটাই যে, চোখে জল এসে গেল। বুড়ো বয়সে কিছুই আটকানো যায় না। না পেচ্ছাপ, না চোখের জল। সুড়সুড় করে চোখের কোল বেয়ে জলের ধারা নেমে এল। 

ধুতির খুঁটে চোখ মুছে ধরা গলায় ধীরেন বলল, কোনও কাজ হবে কিনা জানি না, তবে পাপীতাপী মানুষেরও মনে আশীর্বাদ জমা হয়ে থাকে, বাসন্তীর কিছু হবে না হে বাঙাল, তুমি দেখো।

বড় চিন্তা হয় খুড়া। মাইয়াটা বড় ভাল। ভালগুলাই তো টিকতে চায় না কিনা।

টিকবে হে টিকবে। শশধর ডাক্তারের সঙ্গে একবার দেখা কোরো। পুরনো ডাক্তার। এরকম হোমিওপ্যাথ পাবে না।

না, পেটের হাঁচোড়-পাঁচোড়টা আর নেই ধীরেনের। মন উপচে আনন্দটা চলকে পড়েছে বুঝি পেটেও। বেশ ভরা ভরা লাগছে।

চলি হে বাঙাল। বলে উঠতে যাচ্ছিল সে।

আরে, কই যান খুড়া? গিরস্তের অকল্যাণ চান নাকি?

কী যে বলো বাঙাল। তাই চাইতে পারি?

 এই বাড়ি থিক্যা একটা কাউয়া পইর্যন্ত শুধু মুখে যায় না। বহেন বহেন।

আবার চোখে জল আসে ধীরেনের। স্খলিত কণ্ঠে বলে, আজ থাক।

পাগল নাকি? আপনারে খাওয়াইলে তো আমারই লাভ খুড়া। পরকালের বোঝা কমব। বহেন।

তা বসল ধীরেন। মনের বিহ্বল ভাবটা যাচ্ছে না। বড় অন্যরকম লাগছে চারদিকটা। ভারী ভাল লাগছে। জীবনে বোধহয় এরকম দিন দুটো-একটাই আসে।

মুক্তা এসে প্রথমে চা দিয়ে গেল। খাঁটি দুধের জিনিস, চা-পাতাটাও বেজায় ভাল। এরকম চা কোথাও খায়নি কখনও ধীরেন।

একটু বাদেই এল লুচি আর নতুন লালচে ছোট আলুর শুকনো দম।

খান খুড়া, প্যাট ভইরা খান।

আজ ধীরেন খিদের জন্য খেল না। লোভেও না। খেতে খেতে মনে মনে বলল, এদের দোষঘাট যা আছে তা সব আমার হোক ঠাকুর। এদের ভাল হোক। এই এদের সব গ্রহের দোষ, সব রিষ্টি, ফাড়াসব আমার গ্রাসে গ্রাসে মিশে যাক।

খুড়া।

অ্যাঁ।

প্যাট ভরছে?

 ওঃ, খুব ভরেছে হে বাঙাল।

এইবার এক গ্লাস দুধ খান। নূতন গোরুর দুধ।

নাঃ হে, একদিনে এত ভাল নয়। পেট ছেড়ে দেবে।

আরে ধুর, আপনেরে তো অনেকদিন দেখতাছি। পারবেন।

 দুধ খেতে হল। তারপর উঠল ধীরেন।

সকালটা আজ বড় ভাল কাটল। এখন বাকি দিনটা যেমনই কাটুক কিছু যায়-আসে না। দিন কেমন কাটবে তার একটা আন্দাজও আছে ধীরেনের। এই গাঁয়ের ঘাটায়-আঘাটায় চরকিবাজি করে বেড়ানোই তার জীবনযাপন। কোনও অর্থকরী কাজ নেই, লাভালাভ নেই, উপার্জন নেই। বাড়ি ফিরলে অশান্তি হয় বলে আজকাল বাইরেই সময়টা কাটিয়ে দেয় সে। কেউ বসতে বললে বসে। চুপচাপ ঘন্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে তার কোনও কষ্ট নেই। কত কী দেখে, কত কী শোনে। সূর্য মাথায় চড়ে বসলে ঘরমুখো হয়।

বাড়ি ফিরতেই তার বউ আজ বলল, বাঙাল বাড়িতে কিছু মেগে-পেতে এসেছ নাকি?

ধীরেন সভয়ে বলল, না তো!

 তবে যে বড় ঝুড়িভর্তি আনাজ পাঠিয়েছে। কী ব্যাপার?

অবাক হয়ে ধীরেন বলে, পাঠিয়েছে নাকি?

হ্যাঁ। মেলা পাঠিয়েছে। সঙ্গে একটা খোকা ইলিশ অবধি।

আমি কিছু চাইনি। বাঙাল দিলদরিয়া লোক।

সে তো বুঝলুম। সে তোক খারাপ নয় জানি। কিন্তু তার খাণ্ডার শাউড়ি এসে না ফের ঝেড়ে কাপড় পরায়।

ধীরেন কী বলবে, চুপ করে রইল।

শুনলুম, ছেলের বউরা মিলে নাকি আজ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তেঁতুলতলায় পুঁটুলি বগলে বসে আছে গিয়ে।

কার কথা বলছ?

বাঙালের শাউড়ির কথাই বলছি। এতকাল ঝগড়াঝাঁটি হত, কিন্তু ঘরের বার করে দেয়নি। আজ দিয়েছে।

কেন?

তা অত কে জানে? ভুতোর মা বলে গেল ছেলের ব্যবসার জন্য বাঙালের কাছে টাকা চাইতে গিয়েছিল। বাঙাল দেয়নি বলে বুড়ির ওপরে গিয়ে রাগ পড়েছে। তাই বুড়িকে বেড়ালপার করতে চাইছে। কর্মফল তো আছে রে বাবা! আমাকে সেদিন বিধিয়ে কত কথাই বলে গেল তোমাকে নিয়ে।

মনটা খারাপ হয়ে গেল ধীরেনের। এখন অভাবে কষ্টে, সংসারের অশান্তিতে বাসন্তীর মা হয়তো ডাইনিবুড়ির মতো একজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এরকম তো ছিল না মহিলা। বিয়ে হয়ে যখন এল তখন রূপের বন্যা বয়ে যায়নি ঠিকই কিন্তু ভারী মিঠে চেহারাখানা ছিল। দাঁতের সারি ছিল দেখবার মতো। একটু পুরু রসালো ঠোঁট। গায়ে বেশ বলাবলি হত তাকে নিয়ে। মনে পাপ নেই তার, তবু ধীরেনের স্বীকার করতে বাধাও নেই, ওইরকম একখান বউয়ের বড় সাধ হয়েছিল তার।

সেই জোয়ান বয়সে ধীরেনের শরীরখানাও বড় কম ছিল না। ইয়া বুক ছিল, দু হাতে ছিল কামারের হাতের মতো জোর। আঁকড়া চুল ছিল। অনেক কটাক্ষই তাকে বিঁধেছে এককালে। বাসন্তীর মাও খুব আড়ে আড়ে তাকাত তার দিকে, মিষ্টি মিষ্টি রহস্যময় হাসত। রসালো কথাটথাও হত মাঝে মাঝে।

না, তার বেশি কিছু হয়নি।

 সময়ের পোকা সব কেটেকুটে ফোঁপরা করে দিয়ে গেছে তাদের। এখন সে বউঠানের চোখের বিষ।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ধীরেন।

.

মরণ হাঁফাতে হাঁফাতে রান্নাঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে উঠল, ওমা!

দুর্বল শরীরে জলচৌকিতে বসে বাঁশের খুঁটিতে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে ছিল বাসন্তী। একটু অসাবধানে পেটে এল কুঁচোটা। তাতে বাসন্তী মোটেই বিরক্ত নয়। কিন্তু প্রথম কয়েকটা মাস তার বড় কষ্টের মধ্যে যায়। এই নিয়ে চারবার। প্রথমটা বাঁচেনি। এটাও বেঁচেবর্তে থাকবে কিনা কে জানে। শরীরে মায়া ছড়িয়ে মাকে কষ্ট দিয়ে আসছে তো!

মরণের চেঁচানিতে চোখ খুলে বলল, কী রে?

 জিজিবুড়িকে মামিরা তাড়িয়ে দিয়েছে। তেঁতুলতলায় বসে আছে গিয়ে।

সে কী!

 হ্যাঁ গো। খুব কাঁদছে বসে, আর রাজ্যের লোক জুটে গেছে সেখানে।

 তুই গিয়ে দেখলি?

 হ্যাঁ গো। আমি তো গিয়ে হাত ধরে কত টানাটানি করলাম। বললাম, আমাদের বাড়ি চলো।

সোজা হয়ে বসে শুষ্ক মুখে বাসন্তী বলল, তা কী বলল তোকে?

 বলল, তোর মাও তো আমাকে সকালে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমি কোথাও যাব না। আমি আজ মরব। হা মা, তুমি সত্যিই তাড়িয়ে দিয়েছ?

বাসন্তী একটু চুপ করে থেকে বলল, তাই বলেছে বুঝি? মার যেমন সব কথা! তাড়াব কেন? টাকা চাইতে এসেছিল, দিইনি।

কী হবে মা? জিজিবুড়ি যদি মরে যায়?

 কাঁদছে বললি?

হ্যাঁ গো। খুব হাপুস কাঁদছে। মণিবউ বলল, সে নাকি দেখেছে বড় মামি জিজিবুড়িকে চুল ধরে টেনেছে, আরও সব কী করেছে যেন।

বাসন্তী স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ উনুনের দিকে চেয়ে থেকে বলল, মা তো সব কথা চেপে যায়। ওরা যে কী করে কে জানে!

কী হবে মা?

 লোক জড়ো হয়েছে কেন রে?

জিজিবুড়ি যে তাদের কাছে সব বলছে।

কী বলছে?

এইসব অত্যাচারের কথা-টথা। তোমার আর বাবার কথাও বলছে।

কী বলছে শুনলি?

বলছিল, তোমরা নাকি মা শাশুড়ি বলে মানো না। সব সময়ে দুরছাই করো। উপোস করলেও খেতে দাও না। শাপশাপান্তও করছিল।

মায়ের জিভে যে বড্ড ধার। তোর বাবা কোথায়?

 বাবা তো জমিতে গেছে।

দৌড়ে যাবি বাবা, ডেকে নিয়ে আয় তো মানুষটাকে।

 বাবাকে ডাকব? বাবা যে জিজিবুড়িকে দেখতে পারে না।

কে বলল তোকে?

আমি জানি তো।

বাজে কথা। বাবাকে তুমি চেনো না ধন। তোমার বাবার মন বড় ভাল। যা দৌড়ে গিয়ে ডেকে নিয়ে আয়।

তার চেয়ে তুমি চলো না মা।

না বাবা, পাঁচজনের সামনে আমি মেয়েমানুষ গিয়ে আদিখ্যেতা করতে পারব না। তোর বাবা বিবেচক মানুষ, ঠিক একটা ব্যবস্থা করবে। যা, দেরি করিস না।

মরণ পাঁই পাঁই করে ছুটল। বেশি দূর যেতেও হল না। একটু গিয়েই দেখতে পেল তার বাবা ললিতখুড়োর সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করছে।

বাবা!

তার বাবা ফিরে তাকিয়ে হঠাৎ সচকিত হয়ে বলল, কী রে, তর মায়ের কিছু হইছে নাকি?

 না। মা তোমাকে ডাকছে।

ডাকতাছে? ক্যান রে, শরীর খারাপ লাগে নাকি?

না। মা ঠিক আছে। কী দরকার যেন।

 তার বাবা সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এল বাড়িতে।

কী হইছে গো?

বাসন্তী উঠোনে বসে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছিল। মুখ তুলে বলল, কী করি বলো তো? বউদিরা মাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

কও কী?

তেঁতুলতলায় গিয়ে নাকি বসে আছে, রাজ্যের লোক জুটেছে সেখানে। কী করব বলো তো?

অকালকুষ্মাণ্ডগুলা কই? বাড়িতে নাই?

ওদের তো চেনো। মাকে ওরাই কি ভাল চোখে দেখে? দেখলে কি বউদের এত সাহস হয়?

 কাইন্দো না। কী করতে চাও কও।

সেইজন্যই তো তোমাকে ডেকেছি। তুমি বলে দাও কী করব এখন।

 যদি এই বাড়িতে আইন্যা রাখতে চাও তো রাখতে পারো।

আমার যে বড্ড ভয় করে। যেই মা এ-বাড়িতে আসবে অমনি দাদারাও ওই ছুতোয় এসে হানা দেবে। মাকে তো চেনো। ছেলেরা বিষ দিলেও ছেলেদের বিরুদ্ধে মুখ খুলবে না।

হেইটা তো পরের কথা। অখন চটজলদি তো কিছু করতে হইব।

মাকে নিয়ে আসবে?

 তুমি কইলে আনুম। ভাইব্যা কও।

আমার মাথায় কি বুদ্ধি আছে? আমি তো তোমার মুখের দিকে চেয়ে আছি।

একখান কথা কই?

বলো না।  

ঠাইরেনের দম একটু পরেই ফুরাইব। গুটিগুটি বাড়িও ফিরব। কিন্তু হেইটা কথা না। কথা হইল তোমারে লইয়া। এই অবস্থায় বেশি টেনশন ভাল না।

এই অশান্তি আমার আর সহ্য হয় না যে।

হেই লিগ্যাই কই, আমি গিয়া ঠাইরেনেরে লইয়া আসি। দুই দিন থাউক। তারপর ভাল বুঝলে বাড়িতে ফিরা যাইব।

মা তো ইদানীং এ বাড়িতেই থাকতে চাইছিল। কিন্তু আমি রাজি হইনি। মায়ের কথাবার্তা আমার ভাল লাগে না। বড্ড খারাপ খারাপ কথা বলে। পান থেকে চুন খসলেই শাপশাপান্ত করে। এখনও নাকি করছে, মরণ শুনে এসেছে।

তবু গর্ভে তো ধারণ করছিল। মায়ে কি আর খারাপ হয়?

তুমি যদি ভাল বোঝো তো আনো গিয়ে। আমি কিছু ভাবতে পারছি না। তুমি কলকাতায় চলে গেলে আমার ভারী ভয়-ভয় করবে কিন্তু।

দুর বলদা মাইয়ালোক, মায়েরে ভয় কী?

আমি যে যুঝতে পারি না।

খুব পারবা। বরং এই অবস্থায় মা কাছে থাকলে তোমার সুবিধাই হইব। বুড়ি-ধুড়িরা ভাল সামাল দিতে পারে।

মাকে তো তুমি চেনো না!

খুব চিনি। একটু ঘুষঘাষ দিলেই বুড়িরে হাত করতে পারবা। চিন্তা নাই।

ঘুষ দেব? মাকে?

আরে, ঠাইরেন কি আর আবগারির দারোগা? একটু দোক্তা, একটু দুধ, একটু মাথার তেল, একখান কাঁকই, একথান থান, একজোড়া ভাল জুতা এইসব আইন্যা দিলেই দ্যাখবা ঠাইরেনের মুখে তালা ঝুলতাছে।

মুখে তালা ঝুলবার কথায় বেমক্কা হিহি করে হেসে ফেলল মরণ। বাসন্তীও লজ্জা পেয়ে মাথা নোয়াল। রসিক ছেলের দিকে চেয়ে বলল, এই বান্দর, খাড়াইয়া খাড়াইয়া বড় মাইনষের কথা গিলতাছছ যে বড়!

.

৬৪.

তুমি ভূত নামাতে পারো সুদর্শনদা?

কস্মিনকালেও নয় দিদি।

তবে লোকে যে বলে, তুমি ভূত নামাতে পারো।

লোকের যেমন কথা।

 কিন্তু তুমি তো লোককে তাবিজ কবচ দাও শুনেছি। নিলুর দিদিমার নাকি তোমার তাবিজে অর্শ সেরে গেছে।

এই সন্ধেবেলাটায় আজ সুদর্শন এসে একখানা ভাঁজ করা বস্তা পেতে মেঝেতে জড়সড় হয়ে বসেছে পান্নার ঘরে। আজ অমাবস্যা, কুয়াশা, এবং লোডশেডিং-এর এ্যহস্পর্শ। তার ওপর বাড়িতে কেউ নেই। বাবা কোথায় আড্ডা মারছে গিয়ে, মা গেছে বড়মার বাড়িতে। হীরা পরেশ মাস্টারের বাড়ি গেছে পড়তে। ঝপ করে বাতিটা নিবতেই ধক করে উঠেছে পান্নার বুক। এবার কী হবে? সন্ধের পর এমনিতেই ভয়ে তার হাত পা গুটিয়ে আসে। হাতের কাছে আকস্মিক লোডশেডিং-এর জন্য হ্যারিকেন আর দেশলাই থাকে। টর্চ জ্বেলে হ্যারিকেনের সলতে ধরাতে গিয়ে পান্না দেখল তার হাত কাঁপছে। রান্নাঘরে আছে শুধু সুদর্শন। লোকটাকে দেখলেই সে ভূত-ভূত গন্ধ পায়। তাই প্রথমে সুদর্শনকে ডাকেনি সে। কিন্তু এই অলক্ষুণে গাঁয়ে সন্ধের পরেই ঝুপ করে এমন নিশুতি নেমে আসে কেন কে জানে বাবা। আর তার মধ্যেই অন্ধকারে কত রকমের যে বিকট শব্দ হতে থাকে। এই কাক ডাকল, কিংবা পাচা। গাছে গাছে ভুতুড়ে হাওয়া বয়ে গেল। বাঁশবনে এমন মটমট শব্দ উঠল যেন কেউ বাঁশ ভাঙছে। লোডশেডিংটা এখনই না হলে কি চলত না বাপু?

তবু খানিকক্ষণ লেপ চাপা দিয়ে কান মাথা ঢেকে হ্যারিকেনের আলোয় পড়ার চেষ্টা করছিল পান্না। কিন্তু হঠাৎ পশ্চিমের বন্ধ জানালাটায় এমন শব্দ হল যে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়।

আর না পেরে পান্না উঠে দরজা খুলে চেঁচিয়ে ডাকল, সুদর্শনদা! ও সুদর্শনদা, একটু এস তো!

সুদর্শন সুকণ্ঠ মানুষ। একটা কালীকীর্তন গাইছিল রাঁধতে রাঁধতে। ডাক শুনে দরজায় এসে দাঁড়াল, কী গো দিদি, ভয় পাচ্ছো নাকি?

সবাই তার ভয়ের কথা জানে। তাই বড্ড রাগ হয়ে যায় পান্নার। বলে, ভয় পাবো না তো কী? একটু এসে বোসো এখানে। আমার পড়া হচ্ছে না।

এই যে যাই। ডালটা নামিয়ে ভাত চাপিয়েই যাচ্ছি।

গ্যাস নিবিয়ে দিয়েই এসো না। তাই যাচ্ছি দিদি।

সুদর্শন এসে বসে আছে। লোকটা খুব বকাবাজ। কথা কইতে ভালবাসে। তা পান্নার কিছু খারাপ লাগল না। এই গা ছমছমে অন্ধকার সন্ধেবেলায় বরং কথাবার্তাই ভাল।

তাবিজের কথায় লজ্জা পেয়ে সুদর্শন বলল, ও আমার কোনও বাহাদুরি নয় দিদি। পেটের ধান্ধায় নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি তো,নানা লোকের সঙ্গে মিশতে হয়েছে। এক একজনের কাছ থেকে এক একটা টোটকা শিখেছি। গরিব মানুষদের তো ডাক্তার দেখানো বা ওষুধ কেনার পয়সা থাকে না, টোটকাই ভরসা। তবে ওতে কাজও হয় খুব।

আর কী জানো তুমি?

সুদর্শন মাথা নেড়ে বলে, কিছুই জানি না। পেটে ক্লাস ফাইভের বিদ্যে। তবে টুকটাক অনেক কিছু শিখেছি। পুজোপাঠ জানি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রিরির কাজ জানি, খানিক ছুতোরগিরিও করতে পারি। এসব না জানলে কি চলে?

ওসব নয়। ভূতপ্রেতের কথা কী জানো?

ওসব তো আজকাল কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না মোটে। তোমার বয়সি ছেলেমেয়েরা তো হেসেই উড়িয়ে দেয়।

না বাপু, আমার ওসবে খুব বিশ্বাস। হ্যাঁ সুদর্শনদা, তুমি কখনও দেখেছ?

ওই দেখো, ওসব বললে তো তুমি হাঁ করে গিলবে, তারপর ভয় পাবে, আর তারপর মা ঠাকরুন আমাকে বকবে ভয়ের কথা বলেছি বলে।

আচ্ছা, মাকে বলব না।

কাজ কী তোমার ওসব শুনে? আমাদের মতো তো আর তোমাকে ঘাটে অঘাটে ঘুরতে হবে না। তুমি থাকবে পাকা বাড়িতে, বিজলি বাতির তলায়, ভূতপ্রেত সেখানে সেঁধোয় সাধ্যি কী?

একটা ঘটনা বলোই না বাপু।

ঘটনা কি একটা দিদি? অনেক ঘটনা।

একটা কম ভয়ের গল্প বলো তাহলে। বেশি বিদঘুটে গল্প হলে কিন্তু আমি চেঁচাব।

 শুনে সুদর্শন খুব হাসল। বলল, তাহলে শোনো। ভয়-ভয় লাগলে বোলো, থামিয়ে দেবো।

 আচ্ছা।

তখন রামপুরহাটে একটা বাড়িতে রান্নার কাজ পেয়েছি। সে খুব বড়লোকের বিরাট বাড়ি৷ দু দুটো মহল। অগুন্তি ঘর, কিন্তু লোজন নেই মোটে। স্বামী-স্ত্রী আর একজন বুড়ো চাকর। ওই বিশাল পুরনো আমলের রাক্ষুসে বাড়িতে আর কেউ থাকে না। কর্তা-গিন্নির বয়স বেশি নয়। চল্লিশের নীচেই। পৈতৃক সম্পত্তি আছে বলে কর্তা চাকরিবাকরি করেন না। সারাদিন শুয়ে বসেই সময় কাটান। গিন্নিও তাই। পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে গল্পগাছা করে আর সেজেগুজে বেড়িয়ে-টেড়িয়ে দিব্যি আছেন। সন্ধেরাত্তিরেই খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তাঁরা। বুড়ো চাকরটারও একই দশা। তাদের আয়েস আলসেমি দেখে আমার হাসি পেত। কত লোক দুমুঠো ভাতের জন্য কত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, আর এরা তো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে আয়ু কাটিয়ে দিচ্ছে। তা যাই হোক, আমি সন্ধেরাত্তিরে ছুটি পেয়ে আমার ঘরটিতে বসে লক্ষ জ্বেলে রামায়ণ মহাভারত এইসব পড়তাম। একটু সুর করে গুনগুন শব্দে কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়েছ কখনও?

না তো!

পড়ে দেখো, ভারী ভাল লাগবে।

এখনও পড়?

হ্যাঁ। আমি আবার তাড়াতাড়ি ঘুমোতে পারি না। রাত জেগে ওসব পড়া আমার অনেক দিনের অভ্যেস।

তারপর বলো।

একদিন বুড়ো চাকরটা আমাকে বলল, ওহে সুদর্শন, এ বাড়িতে সবাই আগেভাগে শুয়ে পড়ে কেন জানো? আমি বললাম, না তো! সে বলল, এ বাড়িতে ভূত আছে, রাতের দিকে তারা সব কোনাঘুপচি থেকে বেরিয়ে আসে। সারা বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। তাদের বিরক্ত করা ঠিক হবে না ভেবেই আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়ি। তুমি যে রাতজেগে থাকো এটা কিন্তু ভাল নয়। আমি তার কথা মোটে গায়ে মাখলাম না। বললাম, আমি তো আমার ঘরটিতে বসে বই পড়ি, ভূতেরা তো গোটা বাড়িটাই পাচ্ছে। তা যাই হোক, আমি যেমন রাত জেগে পড়ছিলাম তেমনই পড়তে লাগলাম। দিন কতক পর একদিন রাত জেগে রামায়ণ পড়তে পড়তে হঠাৎ টের পেলাম, আমি ছাড়া ঘরে আরও কে যেন আছে।

ওরে বাবা! সত্যি?

এটা কিন্তু বেশি ভয়ের গল্প নয় দিদি। ভয় পেও না।

আচ্ছা বলো।

টের পেয়ে গা-টা কেমন শিরশির করে উঠল। ঘাড়টা শক্ত হয়ে গেল, হাত পায়ে খিল-ধরা অবস্থা। গলাটাও ফেঁসে গিয়ে কেমন বেসুর কঁপা ফাপা স্বর বেরোচ্ছে। প্রথম অভিজ্ঞতা তো!

তুমি তবু চেঁচাওনি?

না দিদি। চেঁচিয়ে লাভ কী? বিরাট বাড়ির আর এক প্রান্তে একটেরে একখানা ঘরে ছিলাম, চেঁচালেও কেউ শুনতে পেত না। তা ছাড়া বিপদে মাথা ঠান্ডা না রাখলে ভুলভাল হয়ে যায়। সব কাজেই তাই বুদ্ধিটা ঠিক রাখতে হয়। এটি গেলেই সর্বনাশ।

তুমি কী করলে?

 প্রথমটায় মুখ তুলে চারদিকে তাকাতে সাহস হচ্ছিল না। তবে খানিক বাদে ভাবলাম, ভূতপ্রেত বা চোর-ডাকাত যাই হোক, আমার মতো গরিবকে মেরে তার লাভ কী? আর আমি মরলেও দুনিয়ার তো কিছু যাবে আসবে না। আমার মতো মনিষ্যিরা তোতা পৃথিবীর জঞ্জাল বই নয়। ভিড় বাড়ানো ছাড়া আমরা কোন কাজে লাগি বলো! এইসব ভেবে মুখ তুলে তাকালাম। লফের আলোয় কিছুই প্রথমটায় ঠাহর হল না। তারপর চোখে পড়ল, বাঁদিকে দেয়াল ঘেঁষে কে যেন অন্ধকারে বসে আছে। থান পরা বিধবা বলেই মনে হচ্ছিল।

বাবা গো!

আগেই ভয় পেও না। চোখেরও তো নানা বিভ্রম হয়। বেশির ভাগ ভূত দেখাই তো ভুল দেখা কিনা। তাই চোখ কচলে ভাল করে চেয়ে দেখলাম।

তোমার দুর্জয় সাহস কিন্তু সুদর্শনদা।

না দিদি, সাহস-টাহস নয়। আমরা হলাম মরিয়া মানুষ। আমাদের জলেও বিপদ, ডাঙাতেও বিপদ। ভয়ডর বগলদাবা করেই তো চলতে হয়। ওটা ঠিক সাহস নয়, ও হল আয় শালা কে কী করবি ভাব।

সেটা আবার কী?

জানোনা বুঝি? মানুষ যখন খুব ভয় খেয়ে যায়, যখন দেখে আর রক্ষা নেই, এবার গেছি, তখন হঠাৎ তার ভিতরে একটা পাগলাটে ক্ষ্যাপা সাহস হয়। সে তখন ফুঁসে তেড়ে আয় শালা কে কী করবি বলে ঘুরে দাঁড়ায়। ওটা সাহস বা বীরত্ব নয়, সাময়িক ক্ষ্যাপামি।

আহা, বিধবার কথাটাই তো চাপা পড়ে যাচ্ছে। তুমি বড্ড অন্য কথায় চলে যাও।

সুদর্শন হেসে বলল, না দিদি, পরিস্থিতিটা বলছি আর কী।

তারপর বলো। তুমি সত্যিই দেখলে?

হ্যাঁ। বেশ অন্ধকার, ঝুঝকো মতো আবছায়ায় বিধবা মানুষটি আসনপিড়ি হয়ে বসা। গায়ে একটা শালও যেন জড়ানো ছিল। খুব স্থির হয়ে বসা। সেই দেখে আমার বুকের মধ্যে ধপধপ করে যেন হাতির পা পড়তে লাগল। গলা শুকিয়ে কাঠ। শিরদাঁড়া বেয়ে বরফজল নেমে যাচ্ছে যেন। আর হাত পায়ের সে কী ঠকঠক কাঁপুনি!

অজ্ঞান হয়ে গেলে না?

না। হয়তো দাঁতকপাটি লাগত, কিন্তু কী হল জানো?

 কী?

বিধবা ঠাকরুন হঠাৎ ডান হাতটা দিয়ে রামায়ণ বইটা দেখিয়ে দিলেন।

ওরে বাবা!

বুঝলাম, ঠাকরুন আমাকে রামায়ণ পড়তে বলছেন।

 কিন্তু রাম নাম শুনলে নাকি ভূত পালায়!

ওসব লোকের মনগড়া কথা। রামায়ণে তো কোথাও তেমন কথা পাইনে বাপু। রাম তো আর ভূতের ওঝা ছিলেন না।

তারপর কী হল বলো।

 ঠাকরুনের হুকুম মনে করে আমি ফের রামায়ণ পড়ার চেষ্টা করতে গেলাম। দেখলাম ভয়ে গলার স্বর বেরোচ্ছে না, চোখেও আবছা দেখছি। কিন্তু তবু কাঁপতে কাঁপতে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলাতেই পড়তে লাগলাম। আশ্চর্যের কথা হল, কিছুক্ষণের মধ্যে গলা বেশ পরিষ্কার হয়ে গেল, হাত পায়ের ঠকঠকানিও রইল না, শীতভাবটা উধাও হল। আড়চোখে দেখলাম, ঠাকরুন স্থির হয়ে বসে আছেন।

আর ভয় করল না?

না গো দিদি। ভগবানের নাম করছিলাম তো, ভয় কি থাকে? ধীরে ধীরে ভয় উবে গেল। মনে হল ঠাকরুন হয়তো অতৃপ্ত আত্মা, ভগবানের নাম শুনলে জুড়োবেন। তাতে আমারও পুণ্যিই হবে। মনে আছে, পড়া শেষ করে বই বন্ধ করতেই ঠাকরুন উঠে আসনখানা কুড়িয়ে নিয়ে নিরেট দেয়ালের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন।

তখন তুমি কী করলে?

কী আর করব, বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়লাম।

ভয় করল না?

না, আর ভয়ের কী? একবার ভয় কেটে গেলে ও আর হয় না। বসন্ত রোগের মতো, একবার হলে আর হয় না। দিব্যি ঘুমোলাম। পরদিন সেই বুড়ো চাকর নিতাইদাকে ঘটনাটা বলতেই সে খুব গম্ভীর হয়ে বলল, খুব বেঁচে গেছ। আজ থেকে আর রামায়ণ পড়ার দরকার নেই, বরং আমার ঘরে এসে শুয়ো।

তাই করলে?

পাগল! আমি বললাম, তা কেন, ঠাকরুন যদি রামায়ণ শুনতে চান তাহলে রোজ শোনাব।

শোনাতে বুঝি?

হ্যাঁ দিদি। রোজ রাতে বসে বসে রামায়ণ পড়তাম আর ঠাকরুন এসে শুনতেন। পড়া শেষ হলে রোজ একইভাবে আসন তুলে নিয়ে দেয়ালের মধ্যে মিলিয়ে যেতেন। আমার ভারী তৃপ্তি হত। মনটা ভরা ভরা লাগত।

তোমার দুর্জয় সাহস সুদর্শনদা!

সুদর্শন লাজুক হাসি হেসে বলল, তুমি ভিতু মানুষ বলে সবচেয়ে কম ভয়ের গল্পটা শোনালাম। ভয়, পাওনি তো!

পাইনি মানে! আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

আমি কী ভাবি জানো? ভাবি আমরা যেমন ওরাও তো তেমনই। আমরাও আছি, ওনারাও আছেন। ভগবানের দুনিয়ায় কাকে ফেলা যায় বলল। ঘেয়ো কুকুরটাকে যে সৃষ্টি করলেন তিনি, তারও হয়তো দরকার ছিল। ঘুরে ঘুরে এইসব মনে হয়েছে আমার।

তুমি ওই বাড়িতে কতদিন ছিলে?

তা বছরটাক হবে।

চাকরিটা ছাড়লে কেন?

কোনও জায়গায় বেশিদিন আটকে থাকতে যে আমার ভাল লাগে না। আর কী জানো? তারা ভারী অলস লোক। তাদের আলসেমি দেখে দেখে আমারও যেন শরীরে আলিস্যি আসছিল। কিন্তু তা হলে তো আমার চলবে না। আমাকে তো খেটে খেতে হবে। তাই একদিন পুঁটুলি বগলে করে বেরিয়ে পড়লাম।

তার মানে তুমি আমাদের বাড়িতেও বেশি দিন থাকবে না!

সুদর্শন লাজুক হেসে বলল, তা কী বলতে পারি? এখন বয়স হচ্ছে, বেশি ঠাইনাড়া হতে আর ইচ্ছে যায় না।

আর একটা গল্প বলবে?

উপর্যুপরি শোনার দরকার কী? আর একদিন শুনো। আমার যে রান্না পড়ে আছে।

 লোকে কিন্তু ঠিকই বলে। তুমি ভূতের বন্ধু। ভূতের সঙ্গে কথা বল্প।

বাজে কথা বলে। গাঁয়ের লোকের অন্ধ বিশ্বাস তো। তবে একথা বলতে পারি যে আমার শত্রুও কেউ নয়।

কথা ঘুরিয়ো না সুদর্শনদা, তুমি ভূত পোষো কিনা বলো।

 বাপ রে, ভূত কি পোর বস্তু দিদি? বেড়াল কুকুর তো নন। তাঁরা সবাই মান্যিগন্যি মানুষ, শ্রদ্ধার পাত্র।

একটা সত্যি কথা বলবে?

বলব না কেন?

এ-বাড়িতে ভূত দেখেছ?

না দিদি, এ বাড়িতে ভূত-টুত কিচ্ছু দেখিনি।

 আমি ভয় পাবো বলে বলছ না। এ বাড়িতে ভূত কিন্তু আছে।

ও তোমার ভয়-ভয় ভাব থেকে মনে হয়। আর থাকলেই বা কী? চোখের আড়ালে তো রোগের জীবাণুও থাকে। ওই যে টিভিতে ছবি দেখো, রেডিওতে গান শোনো ওসবও তো এই হাওয়া বাতাসেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাদা চোখে দেখতে পাও কি? যেই টিভি বা রেডিও খুললে অমনই সব ভেসে উঠল। এও তো ভৌতিক ব্যাপারই, তাহলে ভয় পাও না কেন?

দুর, ওসব তো সায়েন্স। ভৌতিক হবে কেন?

ভৌতিক ছাড়া কী বলো। ওসব ছবি গান তো পঞ্চভূতেই মিলেমিশে রয়েছে। ভয় না পেলেই হল।

না বাবা, আমার বড্ড ভয়।

বাইরে থেকে একটা মিষ্টি মেয়েলি গলা ডাকল, এই পান্না।

গায়ের লেপটা ফেলে সটান উঠে বসল পান্না। মুখ উদ্ভাসিত। সোহাগ এসেছে।

 সুদর্শন উঠে দরজাটা খুলে দিয়ে এক গাল হেসে বলল, এসো দিদিমনি।

হাই পান্না!

 হাই সোহাগ! জানো, এতক্ষণ বসে সুদর্শনদার কাছে একটা ফ্যান্টাস্টিক ভূতের গল্প শুনছিলাম। রিয়াল লাইফ স্টোরি।

সত্যি

 হ্যাঁ। সুদর্শনদার ফাস্ট হ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স।

 সুদর্শন বলল, তোমার যত ভয় দিদি, আর সোহাগ দিদিমনিকে দেখো তো, একটুও ভয়-ডর নেই!

তা বলে ভেবো না যে, আমি ভূতে বিশ্বাস করি না। আই ফিল দেম।

হ্যাঁ ভাই, তোমারও ভীষণ সাহস। আমার না ভীষণ কান্না পায়।

 ওমা! কেন?

তোমাদের মতো আমার সাহস নেই বলে। ভয় পেয়ে পেয়ে একদিন আমি ঠিক হার্টফেল হয়ে মরে যাব।

যাঃ। হার্টফেল তোমার হবে না। আমার সঙ্গে কয়েকদিন নাইট অ্যাডভেঞ্চার করো, তাহলে তোমারও ভয়ডর কেটে যাবে।

তোমার সঙ্গে! রক্ষে করো। মরেই যাব।

তোমরা বসে গল্প করো, আমি তোমাদের জন্য কফি করে আনছি। বলে সুদর্শন চলে গেল।

 এই সোহাগ বিছানায় উঠে লেপচাপা দিয়ে বোসো।

 যাঃ, আমি চটি পরে এসেছি, পায়ে ধুলোময়লা আছে না!

এই শীতে চটি পরে ঘুরছ!

 তোমার খুব শীত লাগছে বুঝি?

ভীষণ। লেপের বাইরে হাত রাখতে পারছি না।

বাইরে বেরিয়ে দেখো, অত শীত নেই।

তা হবে হয়তো। আমি সেই বিকেল থেকে লেপচাপা হয়ে আছি। কতক্ষণ আগে বাথরুম পেয়েছে, যাইনি।

তুমি ভীষণ কুনো, তাই না!

 হ্যাঁ তো।

এই বাংলাটা সবে শিখেছি।

হ্যাঁ, আজকাল তোমার বাংলায় বেশ গাঁইয়া টানও আছে।

তা হবে না। আমি তো বড়মা, পিসি, দাদু এদের কাছ থেকে শিখি। আজকাল ইংরিজি বলি না। শুধু বুডঢার সঙ্গে বলতে হয়। ও বাংলায় তেমন ফ্লুয়েন্ট নয়।

হ্যাঁ সোহাগ, তোমার চেহারাটাও আজকাল বদলে গেছে।

তাই বুঝি?

আগের মতো রাফ-টাফ ভাবটা নেই তো!

আগে কি রাফ-টাফ দেখাত আমাকে?

একটু লাগত যেন।

আমি বিশেষ বদলে গেছি বলে আমি কিন্তু টের পাই না। মনে হয় যা ছিলাম তাই তো আছি। বরং বদলে গেছে আমার মা আর বাবা।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। দে আর নার্ড রিকনসাইলড।

সেটা তো ভীষণ ভাল ব্যাপার। আমার মা বাবার মধ্যে ছাড়াছাড়ির অবস্থা হলে আমি তো পাগলই। হয়ে যাব।

সেটা আমারও নিশ্চয়ই ভাল লাগত না। কিন্তু যা হল সেটাও কি ভাল?

ভাল নয়! বলো কী?

মাথা নেড়ে সোহাগ বলল, ব্যাপারটা নরম্যাল হলে কথা ছিল না। কিন্তু কী হল জানো! বাবাকে দেখছি, প্রাণপণে মাকে খুশি রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। আগে বাবা যেমন একটু খেয়ালি ছিল, আনমনা ছিল, রিসার্চ নিয়ে ডুবে থাকত সেরকমটা আর নেই। ঠিক কথা, বাবার মনে ব্যালান্স ছিল না, কিন্তু তখন বাবার কিছু ক্রিয়েটিভিটি ছিল। একজন পুরুষ যখন কোনও মহিলাকে খুশি করাটাই টারগেট করে নেয় তখন তার চিন্তার জগৎ ধীরে ধীরে ব্যাঙ্করাপ্ট হতে থাকে। আমার বাবার চোখে আগে একটা গ্লিন্ট দেখতে পেতাম। এখন পাই না।

ঝগড়াটা তো মিটেছে সোহাগ।

হ্যাঁ। আর সেটা মেটাতে গিয়ে বাবার ভিতরটা বোধহয় মরে গেছে। অনেক দিন ধরে ডিপ্রেশন চলছিল বাবার। ডিপ্রেশন মানুষকে পাগল করে তোলে ঠিকই, কিন্তু জিনিয়াসদের ওটা হয়। কারণ তারা সব স্বাভাবিক আচরণের সঙ্গে নিজেদের অ্যাডজাস্ট করতে পারে না।

কী যে বলছ মাথামুণ্ডু আমার মগজে একদম ঢুকছে না।

তাহলে থাক। ওসব শুনে তোমার কাজ নেই।

 তুমি পালটে গেছ সোহাগ, টের পাও না?

মুখ টিপে একটু হেসে সোহাগ বলল, সাপ তো মাঝে মাঝে খোলস ছাড়ে।

 যাঃ! কী একটা উপমা।

 সাপ কিন্তু ভারী সুন্দর একটা জীব। তোমার ভাল লাগে না?

 মাগো! সাপের কথা ভাবলেই গা শিরশির করে।

কেন বলো তো! সাপের সারা শরীরেই তো লিরিক। যেমন রঙের কম্বিনেশন তেমনই ব্যালেরিনার মতো শরীরের ঢেউ। যখন ফণা তোলে তখনও মনে হয় ম্যাজিক্যাল। তুমি কি জানো যে সাপ একটা স্পিরিচুয়াল প্রাণী?

কী জানি বাবা, শুধু জানি সন্ধের পর নাম নিতে নেই। আস্তিক মুনি, আস্তিক মুনি, আস্তিক মুনি।

ও কে বাবা, লেট আস ড্রপ দি স্নেক বিট। কাল কি তোমাদের পিকনিক হচ্ছে?

হবে না মানে? সব অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে গেছে। ফ্রম ব্রেকফাস্ট টু আফটার নুন টি।

অতক্ষণ কি ভাল লাগবে, বলো তো! অনেক লোক থাকবে তো!

আরে তাতে কী? আমরা থাকব আমাদের মতো।

সুদর্শন একটা প্লেটে ফুলকপির বড়া আর কফি নিয়ে এল ট্রেতে করে। বলল, খাও তোমরা। গরম আছে, সাবধানে হাত দিও।

ওঃ, ইউ আর অ্যান এঞ্জেল!

.

শেষ অবধি লোক বেশি হল না। সোহাগ সবাইকে চেনেও না। সে আর পান্না জোট বেঁধে ছিল। কিছুক্ষণ। তারপর এই উদাস প্রান্তরে একমুঠো বনভূমি আর ছোট্ট একটু নদীর একা বয়ে যাওয়া তাকে ভারী উদাস করে দিল। মানুষের জটলা কি এখানে মানায়? এখানে সবচেয়ে ভাল একা আসা।

পান্না যখন তার সমবয়সি বন্ধুদের সঙ্গে কথায় মেতে আছে সেই সময়ে টুক করে সরে এল সোহাগ। তারপর ছোটো বনভূমিটি পার হয়ে হাঁটতে লাগল।

পিছন ফিরে দেখতে পেল, ওরা আড়ালে পড়েছে।

একটা ছোট্ট টিবি পেরিয়ে সোহাগ পরিপূর্ণ নির্জনতা পেয়ে গেল। সামনে ক্ষেত-খামার। বহু দূর পর্যন্ত সবুজ আর হলুদ।

খুঁজে খুঁজে নদীর ধারে ঘাসের ওপর বসল সে। নদী বলতে শুধুই বালি। ক্ষীণ একটু স্রোত কষ্টে বয়ে যাচ্ছে। জলে নামলে হাঁটু অবধিও হবে না।

তার মন ভাল নেই। কেন ভাল নেই তা সে ভাল বুঝতে পারে না। সে কি বদলে যাচ্ছে?

চুপচাপ অনেকক্ষণ শূন্য মনে ঝুম হয়ে বসে রইল সে।

তারপর তার বুকের ভিতরে একটা আশ্চর্য কথোপকথন শুরু হল। এটা আজকাল হয়। হচ্ছে।

একজন অচেনা পুরুষ বলল, কতদিন পালিয়ে থাকবে তুমি? ধরা তো পড়বেই।

 পালাচ্ছি কে বলল? পালাব কেন?

টের পাও না?

 না। আমি কখনও পালাইনি। আমি তো ভয় পাই না।

পাও। নিজেকে।

নিজেকেই বা কেন ভয় পাব?

পাও নিজের ভিতরকার সত্যের মুখোমুখি হতে চাও না বলে পাও।

বাজে কথা। যাও তুমি।

যাব! যেতে বলছ?

.

৬৫.

ক্ষীণতোয়া নদীটির ধারে ধারে সাবধানী পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মাছলোভী কিছু পাখি। এক কাঠঠোকরা অবিরল ঠুকরে যাচ্ছে কোনও গাছে, তাকে দেখা যাচ্ছে না। একটি দুটি কাঠবেড়ালির ব্যস্তসমস্ত যাতায়াত, এই বিরলে, নির্জনে ভাষাহীন এক কর্মকাণ্ড বয়ে যাচ্ছে। বাতাস কথা কইছে, নদী কথা কইছে, কে জানে গাছে গাছেও কথা হয় কি না, হয় বোধহয়। এই নির্জনতায় বসে সোহাগ তার ভাষাহীন চারদিককার ভাষাহীন কথা যেন শুনতে পাচ্ছিল। তার ভিতরকার অচেনা পুরুষটি তার মতোই চুপ করে আছে। তার মতোই যেন শুনছে এই চারদিকটার কথা।

সোহাগের পৃথিবী আর সকলের মতো নয়। যা দেখা যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে, অনুভব করা যাচ্ছে সেখানেই সোহাগের পৃথিবীর শেষ নয়। তার জগৎ আরও অনেক গভীর। চারদিককার শূন্যতার মধ্যেও লুকিয়ে থাকে কত রহস্য, কত দীর্ঘশ্বাস, কলকাকলি, কত হারিয়ে যাওয়া কথা। তার তো মনে হয় পৃথিবীর প্রথম মানুষ এবং প্রথম মানবীর শ্বাসবায়ু আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে তার চারদিকে।

চারদিকটা আজ যেন প্রাণময়। গাছপালা, পাখি, কীটপতঙ্গ সকলের সঙ্গেই তার বড় ভাব করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সকলের সঙ্গে ভাব হয় না, করাও যায় না। বেড়াল, কুকুর, গোরু, ছাগল একরকম। কিন্তু আরও কত প্রাণী আছে পৃথিবীতে তারা আদর ভালবাসা বোঝে না, তাদের প্রেম-ট্রেম নেই। আছে শুধু কাজ, শুধু বেঁচে থাকা এবং প্রজনন। যেমন পিঁপড়ে, যেমন কেঁচো বা সাপ। কিছুতেই ভাব হয় না তাদের সঙ্গে, সে বইতে পড়েছিল, উইপোকাদের কথা, মাটির গোপন গহন প্রকোষ্ঠে রানি উইপোকাটাকে কেমন তোয়াজে রাখে অন্য উইপোকারা, খাওয়ায়, গরমে বাতাস অবধি করে। তার বদলে অলস রানির কাজ হল কেবল প্রসব করে যাওয়া। তার খুব ইচ্ছে হয়েছিল উইপোকাদের সেই বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন থেকে আসে। মানুষ যদি মাঝে মাঝে পোকামাকড়ের মতো ছোট্টটি হয়ে যেত তবে বড্ড ভাল হত। ওই যে একটা কাক গাছের ডালে বসে তাকে উদ্দেশ করে অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে, সোহাগের মনে হচ্ছে ও কিছু বলতে চাইছে তাকে। কাকের ভাষা যদি সে বুঝত!

বন্ধুদের সঙ্গে গল্পে গল্পে একদম খেয়াল ছিল না পান্নার। হঠাৎ একসময়ে খেয়াল হল সোহাগ কোথায় গেল? তাকে তো দেখা যাচ্ছে না কোথাও!

একটা ট্রাকে কমলবাবু আর কেটারারের লোকজন এসেছে। একটা ভাড়া করা বাসে এসেছে তারা। তবু লোজন বেশি হয়নি। মেরেকেটে সতেরো আঠেরোজন হবে। তার মধ্যে বিজুর ক্লাবের সাত-আটজন ছেলে। সবই এক গাঁয়ের লোক, সবাই চেনা জানা। শুধু সোহাগই এদের মধ্যে নতুন। সে কাউকে ভাল চেনে না। বলতে গেলে এই দঙ্গলে সে-ই একমাত্র সোহাগের বন্ধু। যারা এসেছে তারা অধিকাংশই একটু জায়গাটা দেখতে গেছে ঘুরেফিরে। শুধু কয়েকজন একটু দূরে ব্যাডমিন্টন খেলছে। দু-তিনজন বয়স্কা মহিলা রোদে পিঠ দিয়ে উল বুনছে বা গল্প করছে শতরঞ্চি পেতে, কোথাও সোহাগ নেই।

পান্না উঠে চারদিকটা দেখে এল। কোথাও নেই।

বন্ধুদের কাছে এসে বলল, এই, সোহাগ কোথায় বলতে পারিস?

টুসকি বলল, ও তো একটা পাগল। কোথায় গিয়ে কার সঙ্গে ভাব জমিয়েছে দ্যাখ। কয়েকদিন আগেই তো দেখছিলাম কুমোরপাড়ায় সন্ধিবুড়ির দাওয়ায় বসে কী যেন বকবক করে যাচ্ছে।

পান্না বলল, মোটেই পাগল নয়, একটু খেয়ালি আছে।

 ইতু বলল, যাই বল ভাই, বড্ড দেমাক। আমেরিকায় ছিল তো, তাই মাটিতে পা পড়ে না।

 পদ্মা বলল, দেমাক হলে কি কেউ সন্ধিবুড়ির ঘরে গিয়ে বসে?

সে যাই বলিস, আমাদের সঙ্গে তো মিশতেই চায় না।

পান্না মাথা নেড়ে বলে, বললাম তো, একটু খেয়ালি। কিন্তু ভীষণ ভাল মেয়ে।

টুসকি বলল, মা তো আমাকে বলেই দিয়েছে অমল রায়ের মেয়ের সঙ্গে যেন না মিশি।

 কেন রে! কী করেছে এমন সোহাগ?

দেমাক আছে ভাই, সে তুই যাই বলিস।

গাঁয়ের মহিলামহলে সোহাগ যে জনপ্রিয় নয় তা পান্না জানে।

সে বলল, মেয়েটা কোথায় গেল একটু খুঁজে দেখা দরকার।

 নন্দিনী এতক্ষণ কিছু বলেনি। এবার বলল, অ্যাডাল্ট মেয়ে বাবা, অত চিন্তার কী আছে? এখানে তো আর হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই, গাড়িও চাপা পড়বে না। অস্থির হচ্ছিস কেন? চারদিকটা ঘুরতে গেছে হয়তো।

চল না, আমরাও একটু চারদিকটা দেখি। সেই তখন থেকে তো বসে গল্পই করে যাচ্ছি।

সবাই উঠে পড়ল।

হঠাৎ একটা খটকা লাগল পান্নার। ধারেকাছে বিজুদাকেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এমনকী হতে পারে যে বিজুদা আর সোহাগ কোথাও নির্জনে গিয়ে গল্প-টল্প করছে! এরকমই তো হওয়ার কথা। সে তো নিজেও তাই চায়। ওদের মধ্যে ভাব থোক। খুব ভাব হোক। চায় না কে?

কিন্তু সমস্যা সোহাগকে নিয়েই। নিকষ্যি নারীবাদীরা যেমন হয় সোহাগ তেমন নয়। কিন্তু ওর পাগলা খেয়ালিপনা আছে। কোনও পুরুষ কি পারবে ওকে সামাল দিতে! বিজুদাকে পান্না চেনে। বিজুদা বড় ভাল ছেলে। ভীষণ মরালিস্ট এবং বিশুদ্ধতাবাদী। অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়ায়। বোধহয় পুরুষের সুপ্রিমেসিতেও বিশ্বাস প্রবল। ওর সঙ্গে কি সোহাগের বনবে?

ইস, যদি ওদের মিলমিশ হত কী ভালই হত তবে!

বনভূমি পার হয়ে খানিকটা এগোতেই সোহাগের দেখা পাওয়া গেল। তন্ময় হয়ে, বিভোর হয়ে বসে আছে। বাহ্যচেতনা নেই যেন।

সোহাগ! এই সোহাগ!

সোহাগ চমকাল না। ধীরে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। ভারী সুন্দর দেখাল ওকে এখন। কী নিষ্পাপ, ভাবলেশহীন মুখ! মুখে একটু মিষ্টি হাসি।

কী করছ এখানে বসে? আমরা তখন থেকে খুঁজছি তোমাকে!

 নদীর ধারে এসে বসেছিলাম। নদী আমার ভীষণ ভাল লাগে।

ও মা! আমরা তো নদীর ধারেই পিকনিক করছি।

এমনই একা হতে ইচ্ছে করছিল বড্ড। একা না হলে ঠিক ফিল করা যায় না।

ও বাবা! আমরা তো বসে কলকল করে কথা বলেছি এতক্ষণ। কথাই আর ফুরোয় না।

 আমারও কি কথা ফুরোয়! কত কথা জমা হয়ে আছে।

কার সঙ্গে কথা বলছিলে তুমি?

কে জানে! কথা হচ্ছিল, তবে কার সঙ্গে তা জানি না। বোধহয় নিজের সঙ্গে নিজের।

 পান্না হেসে ফেলল, মাথায় পোকা আছে তোমার।

তা আছে।

বন্ধুরা একটু ছড়িয়ে গেছে। নদীর অগভীর জলে চটি হাতে নিয়ে নেমে পড়েছে সবাই। ওপাশে যাবে। নদীটায় মাত্রই কয়েক হাত চওড়া জলস্রোত। পেরোনো কোনও সমস্যা নয়।

টুসকি মুখ ফিরিয়ে ডাকল, এই পান্না ওপারে যাবি? ছোলার খেত দেখা যাচ্ছে, কঁচা ছোলা খেতে বিউটিফুল।

তোরা যা আমি একটু পরে আসছি।

পান্না সোহাগকে বলল, হ্যাঁ সোহাগ, তোমাকে একটা কথা বলব?

বলো না।

এত একা তুমি কী করে থাক?

একা? বলে ভ্রূ কুঁচকে একটু ভাবল সোহাগ, তারপর মাথা নেড়ে বলল, না, একা নই তো!

একা নও! এই তো একা বসে আছ!

তোমার তাই মনে হচ্ছে বুঝি?

হ্যাঁ তো।

মাথা নেড়ে সোহাগ বলল, আমার তো একা বলে মনেই হয় না। আমার সঙ্গে কত কে থাকে।

শুনে পান্নার গায়ে একটু কাঁটা-কাঁটা দিল।

 কে থাকে তোমার সঙ্গে?

সোহাগ হেসে ফেলে বলল, তোমাকে কতবার বলেছি, তুমি ভুলে যাও।

 ভূতপ্রেত তো!

ওরকমভাবে ভাবলে হবে না। আমার মনে হয় আজ অবধি পৃথিবীতে যত মানুষ জন্মেছে এবং মরে গেছে তাদের সকলের ইমপ্রেশন আমাদের অ্যাটমসফিয়ারে রয়ে গেছে। আমি তাদের ফিল করি। এমনকী আদম আর ইভকেও, তারা ঠিক ভূতপ্রেত নয়, তবে একটা এনটিটি।

তুমি তাদের সঙ্গে কথা বল?

ঠিক তা নয়, তবে আমি অনেক কথা যেন শুনতে পাই, বাতাসে একটা ফিসফিসানির মতো, সব কথার কোনও অর্থও নেই, বেশিরভাগ সময় কথাগুলো বোঝাও যায় না। কিন্তু অ্যাটমসফিয়ারটা খুব বাত্ময় বলে মনে হয়।

বাবা গো, শুনে এই দিন দুপুরেও আমার ভয় করছে।

শুধু ওরা কেন পান্না, চারদিকে কত জীবজন্তু, পোকামাকড়, এমনকী ওই নদী বাতাস গাছপালা সকলকেই যে আমার ভারী জীয়ন্ত বলে মনে হয়। বন্ধুর মতো, সঙ্গীর মতো। তাই আমি কখনও একা বলে নিজেকে মনে করি না। তোমাকে বলিনি আমার খুব ইচ্ছে করে গভীর জঙ্গলের মধ্যে একদিন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বাস করতে। গায়ে কেন পোশাক থাকবে না জানো? অসভ্যতা করার জন্য তো নয়, সম্পূর্ণ নগ্ন হলে চারপাশটাকে আরও বেশি করে অনুভব করা যাবে।

আমি বাবা মরে গেলেও পারব না।

 পৃথিবীর কোনও জীবজন্তুরই তো পোশাক নেই।

আহা, মানুষ বুঝি জীবজন্তু?

বায়োলজিক্যালি তাই।

এখন তো বিটকেল বন্ধুদের ছেড়ে মেয়েবন্ধুদের সঙ্গে একটু মিশবে এসো, চলো, নদীর ওপাশটায় যাই।

ওরা বোধহয় আমাকে খুব একটা পছন্দ করে না পান্না।

 মিশলেই করবে। না মিশলে নানারকম ভেবে নেয়। ওরা কেউ কিন্তু খারাপ মেয়ে নয়।

মিশলে ওরা আমাকে পছন্দ করবে বলছ?

খুব করবে, ভাব হলে অনেক ভুল ধারণা কেটে যায়।

আসলে আমি ওদের মতো অত হাসতে-টাসতে পারি না তো।

তোমাকে জোর করে হাসতে হবে কেন? চলো তো, আগে থেকেই ওদের নিয়ে অত চিন্তা করার কিছু নেই। গাঁয়ের মেয়ে তো সব, একটু বোকা হয়তো, আমিও তো তাই। আমার সঙ্গে ভাব হল কী করে তোমার?

সোহাগ একটু হাসল, তারপর উঠে পড়ল।

আমি কী ভেবেছিলাম জানো সোহাগ?

কী?

ভেবেছিলাম তুমি হয়তো বিজুদার সঙ্গে একটু কেটে পড়েছ।

বিজুবাবু! তার সঙ্গে কেন?

এমনি ভেবেছিলাম। বিজুদার তো তোমাকে খুব পছন্দ।

তাই বুঝি?

টের পাও না?

না তো!

বিজুদাকে তোমার কেমন লাগে সোহাগ?

বড্ড ভাল।

তার মানে? 

গুডবয় বলতে যা বোঝায় তাই।

তার মানেটা কী দাঁড়াল? অপছন্দ?

তাই বললাম বুঝি?

আমি তো হাঁদা নই। মেয়েরা মোটেই গুডবয়দের বিশেষ পছন্দ করে না।

এ মাঃ। পান্না, চটি খুলেছ, কিন্তু মোজা খোলোনি!

 পান্না জিভ কেটে দেখল সত্যিই সে মোজা সমেত জলে পা ডুবিয়েছে।

এখন কী হবে?

সোহাগ বলল, কী আর হবে! খুলে রোদে মেলে দাও। সিন্থেটিক মোজা, কয়েক মিনিটে শুকিয়ে যাবে।

জল হিলহিল করছে ঠান্ডা। পা থেকে শরীর বেয়ে উঠে আসছে ওপরে। গোড়ালি ছাড়িয়ে প্রায় হাঁটু অবধি জল, একেবারে মাঝখানটায় খপাৎ গভীরতা।

এ মাঃ! শাড়ি ভিজে গেল!

সোহাগ তার ঘাগরার মত পোশাকের ঘেরাটোপটা অনেকটা ওপরে তুলে নিয়েছে। হেসে বলল, অত ভয় পাচ্ছ কেন, শীতের টান বাতাস আর এত রোদে শুকিয়ে যাবে। শাড়ি পরে এসে ভুল করেছ।

হ্যাঁ, কী যে হল, শাড়ি পরে ফেললাম।

 এখন আর কী করবে!

দুজনে ফের বালি জমিতে উঠে চটি পরে নিল। চটির মধ্যে বালি কিরকির করছে।

হ্যাঁ সোহাগ, বললে না তো!

কী বলব?

 গুডবয়কে নিয়ে ওই কথাটা।

গুডবয়দের নিয়ে আবার কথা কীসের? গুডবয়রা গুডবয় থেকে যায়।

 তার মানে বিজুদাকে তোমার পছন্দ নয়।

আমার মুখে কথা বসাচ্ছ পান্না, বিজুবাবু বেশ লোক।

যাঃ, আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল।

ওমা, কেন?

 কত আশা করেছিলাম।

 কীসের আশা?

বলতে এখন একটু লজ্জা করছে, আশাটা হয়তো একটু বেশিই করেছিলাম।

 আগে আশার কথাটা বলো তো।

আসলে বিজুদা আমাদের কাছে হিরো হলেও তোমার কাছে তো কিছুই নয়। কেরিয়ার বলতে ওকালতি, সেটাও এমন কিছু গ্ল্যামারাস কেরিয়ার নয় আজকাল তার ওপর গাঁয়ে থাকে, শহুরে পালিশ নেই।

কিন্তু বিজুদাকে নিয়ে এত কথা হচ্ছে কেন? প্রবলেমটা কী?

আমি যে ভেবেছিলাম তোমার সঙ্গে বিজুদার প্রেম-ট্রেম কিছু একটা হবে।

সোহাগ হেসে ফেলল, তাই বলো। ছেলেতে মেয়েতে ওই একটা ছাড়া আর বুঝি কিছু হতে নেই?

তুমি যে কেন বিজুদাকে পাত্তা দিলে না, অবশ্য দেবেই বা কেন। তুমি কত বড়লোকের মেয়ে, কত স্মার্ট, কত আধুনিক।

তোমার আজ কী হল বলো তো পান্না! আজ একদম উলটোপালটা কথা বলছ।

না সোহাগ, সত্যিই আমার খুব আশা ছিল। বিজুদার সঙ্গে তোমাকে ভীষণ মানায়।

সোহাগ মৃদু হেসে বলল, পুয়োর গার্ল!

 পান্না একটু লজ্জা পেয়ে বলল, কথা উইড্র করছি।

আমি কিছু মনে করিনি পান্না। তোমার বিজুদা অনেস্ট অ্যান্ড গুডম্যান, সেটা কিন্তু তার ডিসক্রেডিট নয়। এ-যুগে ওরকম মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

এটা প্রশংসা হতে পারে, কমপ্লিমেন্টও হয়তো, কিন্তু বড্ড ক্যারেক্টার সার্টিফিকেটের মতো শোনাচ্ছে যে!

সোহাগ একটা কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কী করব বলো, আমি যে ঠিক গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। পুয়োর ভোকাবুলারি।

ধ্যুৎ তুমি ভীষণ বুদ্ধিমতী মেয়ে, তোমাকে আমি চিনি।

তা হলে ওকথাটা এখন থেমে থাক।

পান্না হেসে বলল, থাক।

দুপুরে রোদে ঘুরে লাল হয়ে ঘেমে-চুমে তারা যখন ফিরে এল তখন খাবার সার্ভ করা হচ্ছে। ঘাসের ওপর শালপাতার থালা আর বাটিতে সুস্বাদু সব পদ।

টুসকি অভিমানের গলায় বলল, পিকনিকে আজকাল কত গানবাজনা, নাচানাচি হয়, অন্তাক্ষরী হয়, কমপিটিশন হয়, আমাদের কিছু হল না। বিজুদার পিকনিক তো, বেশি আর কী হবে। যা নীরস লোক।

নিরু ঠোঁটকাটা আছে, বলল নীরস লোক তো তবে লাইন দিয়েছিলি কেন?

 টুসকি লাল হয়ে সিঁটিয়ে গেল।

ব্যাপারটা আগাগোড়া লক্ষ করল সোহাগ। এগিয়ে গিয়ে বলল, আমরা একটু সেলিব্রেশন তো করতেই পারি। পিকনিক মানেই তো তাই।

নিরু বলল, কী করে হবে! মিউজিক সিস্টেমই তো আনা হয়নি।

তাতে কী! গান তো গাইতেও পারি আমরা। পারি না?

 টুসকি করুণ মুখ করে বলল, ঝিনচাক মিউজিক ছাড়া কি জমবে?

চেষ্টা করতে দোষ কী?

কে কে গান জান বলল। খুব ভাল না জানলেও চলবে।

 নবীনা বলল, বিজুদার পারমিশন নিয়ে নাও। নইলে পরে আবার কবে।

 চাপা গলায় সোহাগ বলল, বিজুদা তো আমাদের অভিভাবক নন, অত ভয় পাবার কী আছে? ইনোসেন্ট গান, সঙ্গে একটু নাচ তো হতেই পারে। এ তো ডিসকোথেক নয়।

ভয়ে ভয়ে তিন চারজন নাম দিল। একটা জায়গায় কাঠকুটো জড়ো করে আগুন দেওয়া হল চারদিকে গোল হয়ে বসল তারা।

সোহাগ বলল, এটা ক্যাম্পফায়ার। বিকেলের দিকে হলে ভাল হত কিন্তু দুপুরেও দোষ নেই। লেট আস সিং।

পান্না খুব অবাক হয়ে দেখল সোহাগ ভারী সুরেলা গলায় গান ধরেছে, উই শ্যাল ওভারকাম…

সুরটা সকলের চেনাজানা। সহজ গানটার মধ্যে একটা চোরা আবেগ আছে, সহজেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়। হাততালির সঙ্গে সঙ্গে এই গানে মুহূর্তেই জমে গেল আসর। যারা দূরে দূরে ছিল সব এসে জড়ো হয়ে গেল চারধারে। একটু বাদে গলা মিলিয়ে ফেলল সবাই। আর নাচবার জন্য কাউকে আহ্বান করতে হল না। প্রথমে শরীরের দোল তারপর নাচের ব্যাপারটা আপনা থেকেই ঘুরতে লাগল। সোহাগ এরপর ডো রে মি.. ধরল। তারপর রবীন্দ্রসংগীত। সব চেনা গান। হিন্দিও হল, গানের উৎসমুখ খুলে যেতেই লজ্জা সংকোচ ঝেড়ে ফেলে সবাই একে একে নিজের জানা প্রিয় গান গেয়ে উঠতে লাগল। গলা মেলাল সবাই।

পান্না চোরচোখে একবার খুঁজে দেখল, বিজুদা কোথায় দাঁড়িয়ে। বেশি খুঁজতে হল না। দেখা গেল, গোল চক্করটার একটু বাইরে বিজুদা বসে আছে, মুখে স্মিত হাসি।

কেটারারের লোকেরাও গানের আসরে চলে আসায় মধ্যাহ্নের ভোজ স্থগিত রইল। প্রায় ঘণ্টাদুয়েক চলল গানের আসর।

খাওয়ার পর ঘণ্টাখানেক অন্তাক্ষরী হল। রোদ মরে আসছিল ক্রমে। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল খুব।

ফেরার সময় পান্না চাপা গলায় বলল, ইস তুমি কী ভাল গাও!

দুর! ওটা শিক্ষিত গলার গান নয়। তবে এসব অকেশনে কাজে লাগে।

আমি গলা চিনি সোহাগ। তোমার গলায় ভীষণ সুর আছে।

আমি কিন্তু গান-টান শিখিনি। স্কুলে-টুলে যা শিখিয়েছে তাই।

 তা হলে এখন শেখো। প্র্যাকটিস করলে দারুণ হবে।

কী হবে শিখে? গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পাব, না কি গানকে কেরিয়ার করব বল তো! আমার ওরকম হতে ভাল লাগে না। গান গাইতে হলে মনের আনন্দে গাওয়াই ভাল। ব্যায়াম বা শরীরচর্চার মতো রেগুলার গলা সাধা ওসব আমার একটুও ভাল লাগে না।

তোমাকে নিয়ে আর পারি না। কী যে তোমার ভাল লাগে!

সোহাগ হাসল, তোমার বন্ধুরা আর আমাকে অপছন্দ করছে না তো!

না না, তারা তো তোমার ফ্যান হয়ে গেছে।

আচ্ছা, আমরা সকলের সঙ্গে বাসে না ফিরে একটা মারুতি গাড়িতে ফিরছি কেন বলো তো পান্না। এটা খারাপ দেখাচ্ছে না?

কী জানি। শুনছি তো এ-গাড়িটা বিজুদা কিনবে। তার কোন মক্কেলের গাড়ি। ট্রায়াল দিচ্ছে। বোধহয় তোমাকে ইমপ্রেস করার জন্যই এই অ্যারেঞ্জমেন্ট। কিন্তু তুমি তো ইমপ্রেসড হচ্ছ না।

না। মানুষটার বদলে গাড়ি কি বেশি ইমপ্রেস করতে পারে? বরং ব্যাপারটা খারাপ দেখাল। কেউ হয়তো কিছু ভাববে।

তা ভাবুক না। মানুষের স্বভাবই হল নিজেদের ইচ্ছেমতো কিছু একটা ভেবে নেওয়া।

তোমার বিজুদা কিন্তু এ-গাড়িতে ওঠেনি।

উঠলে খুশি হতে?

দুঃখিতও হতাম না। হি ইজ এ গুড কম্পানি।

 সেটা আরও খারাপ দেখাত। সবাইকে ছেড়ে উনি কি আলাদা গাড়িতে ফিরতে পারেন? আফটার অল বিজুদাই তো আজকের হোস্ট।

গাড়ি তাকে বাড়ির দোরগোড়া অবধি পৌঁছে দিয়ে গেল।

সোহাগ ঘরে ফিরে আগে দাদুর ঘরে উঁকি দিল।

 কফি খেয়েছ দাদু?

এই খেলাম। কেমন হল তোর পিকনিক?

যে রকম হয়।

যা ঘরে গিয়ে বিশ্রাম কর। সারাদিন ধকল গেছে।

না, সারাদিনের ধকল কিছু টের পাচ্ছে না সোহাগ। তার বেশ ভাল লাগছে। বেশ ভাল।

আজকাল মা বাবা একসঙ্গে ও-ঘরে থাকে। নতুন নিয়ম। বুডঢা এবার আসেনি, তার পরীক্ষা। এ ঘরে সোহাগ একা।

ফিরে এসে সোহাগ চুপ করে চেয়ারে কিছুক্ষণ বসে রইল। আলো জ্বালল না। খুব চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে সে একটু ধ্যান করল। মেডিটেশন তার প্রিয় এক প্রক্রিয়া। ধ্যানে সে নিজের মনটাকে আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখতে চায়। তার মনের মধ্যে আজ অনেক ধাঁধা। অনেক প্রশ্ন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *