২১-২৫. পাপীদের স্বীকারোক্তি

২১.

পাদরি পাপীদের স্বীকারোক্তি গ্রহণ করছেন। স্বীকারোক্তি করার জন্য পাপীরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। পাদরির কাজটাও সোজা। পাপীর মুখ তাঁকে দেখতে হয় না। পর্দার ওপাশ থেকে শুধু পাপীর কণ্ঠস্বর শোনা যায়। ফাদারের কাজ হল ঈশ্বরের নামে পাপীকে ক্ষমা করে দেওয়া। পাদরি একের পর এক পাপীকে ক্ষমা করে যাচ্ছেন। তার মধ্যেই একজনের স্বীকারোক্তি শুনতে শুনতে পাদরি হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, ইউ ডিড হোয়াট? সেই চিৎকার শুনে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো অন্য পাপীরা দুদ্দাড় করে দৌড়ে পালিয়ে গেল। তাদের ভয়, না জানি তাদের পাপও কত ভয়ংকর যা শুনে পাদরিও ভিরমি খায়।

মানুষের সব পাপকে একমাত্র ভগবানই বুঝি ক্ষমা করতে পারেন। তাও ভগবান বলে যদি সত্যিই কেউ থেকে থাকে। ভগবান থাক বা না থাক সব মানুষই একজন ক্ষমাশীলকেই খুঁজে বেড়ায়। পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে যে মেরে ফেলেছে তাকে কোন মানুষ ক্ষমা করতে পারে? সেই নরকগামী লোকটা হয়তো একদিন অন্তর্দহনে এক শ্বেতশুভ্র সর্বপাপহারী ক্ষমাশীলকেই খোঁজে। পাক বা না পাক, খোঁজে। পুণ্যবানদের বরং ভগবানকে তেমন প্রয়োজন নেই, পাপীরই প্রয়োজন বেশি।

যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায়, ভালমন্দ মিলায়ে সকলি। এই ভালমন্দ মিলিয়ে আখাম্বা লোকটাকে পক্ষপাতশূন্য চোখে কে দেখতে পারে? ভগবান? ভগবান তা হলে কি ইট, কাঠ, পাথরের মতোই অনুভূতিহীন কেউ? তা হলে তাকে দিয়ে কী লাভ মানুষের?

ভালবাসা না পেলেও চলে যায়, কিন্তু ক্ষমা না পেলে কি মানুষের চলে? এই মধ্যবয়সে আজ সেও এক ক্ষমাশীলকে খুঁজতে শুরু করেছে বুঝি।

সামনেই রণাঙ্গন। এবং যুদ্ধকে সে ভীষণ ভয় পায়। বরাবরই পেত। কোনও যুদ্ধেই আজ অবধি তার জয় হয়নি। লেখাপড়া বা চাকরি কোনওদিনই তার যুদ্ধ ছিল না। মাথা পরিষ্কার ছিল, স্মৃতি ছিল প্রখর, তাই মশামাছি মারার মতো অনায়াসে সে বেড়াগুলো ডিঙিয়ে গেছে। কিন্তু অন্য দিকে বারবার তাকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়েছে তার জীবন। মোনালিসা, সোহাগ, বুডঢা–তার এইসব আপনজনের সঙ্গে তাকে অবিরল এক অদ্ভুত লড়াই করতে হয়। ধীরে ধীরে সে ওদের ভয় পেতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে মনের ভিতরে সে দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ক্রমে একা হয়ে যাচ্ছে। স্বামী হিসেবে, বাবা হিসেবে কতভাবে যে হেরে যাচ্ছে সে তা ভাবতেও ইচ্ছে হয় না।

কত সামান্য ব্যাপার। আজ তার কলকাতা যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মোন আজই যেতে চায়। এই সামান্য সমস্যা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন ক্রমশই গুরুভার হয়ে উঠতে লাগল। মোনাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার সাহসটা পর্যন্ত পাচ্ছে না সে। ভয় হচ্ছে, বলতে গেলেই মোনা বিস্ফোরিত হবে। প্রচণ্ড রেগে যাবে। কিংবা হয়তো ঠান্ডা চোখে এমনভাবে তাকাবে যে নিজেকে বে-আব্রু এক আহাম্মক বলে মনে হবে তার।

এইসব দুঃখের মূলে আজও পারুল। পারুলই। প্রজাপতির মতোই ছিল পারুল। নিষ্ঠুর, লোভী অমল একদিন সেই প্রজাপতির দুটি ডানা ছিঁড়ে দিয়েছিল। তখন প্রজাপতির শরীর থেকে জন্ম নিল বিষধর সাপ। একটি প্রত্যাখ্যানের ছোবলে মেরে ফেলল তাকে। ক্ষমা করল না। কিছুতেই আর নিজেকে বাঁচিয়ে তুলতে পারল না অমল। নিজের শরীরকে বহন করা যেন মৃতদেহ বহন করে যাওয়ার মতোই একটি একঘেয়ে কাজ। সামান্য একটু ক্ষমার দরকার ছিল তার। পাওয়া গেল না।

তুমি এখনও বসে আছ যে! গোছগাছ করবে না?

মানুষ যখন রেগে যায় তখন তার চেহারাটা যেন হয়ে ওঠে ক্ষুরধার। এখন যেমন, মোনার ফর্সা রং থেকে যেন হঙ্কা বেরিয়ে আসছে। তার উত্তাপ দূর থেকেও টের পাচ্ছে অমল। দুটো চোখ যেন চাবুকের মতো শিস টেনে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। তীক্ষ্ণ নাকটা যেন বল্লমের মতো উদ্যত। আর সমস্ত শরীর যেন ঝংকার ভোলার জন্য সরোদের তারের মতো টানটান।

ভয় আর একটু মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে থাকে অমল। এই তো তার রণাঙ্গন। ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমাগত যুযুৎসু। তার স্ত্রী। কিন্তু সে অর্জুনের মতোই যুদ্ধবিমুখ। তার জয়স্পৃহা নেই। ক্ষাত্ৰতেজ নেই। বীরত্ব নেই। দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়ানো সে এক হেরো মানুষ।

খুব বিনয়ের সঙ্গে সে বলে, গোছানোর তো কিছু নেই। একটা মাত্র অ্যাটাচি কেস।

তা হলে দেরি না করে তৈরি হয়ে নাও। দুপুরের আগেই বেরিয়ে পড়তে হবে।

 যুদ্ধ না করেই সে বশ্যতা স্বীকার করে নেয়, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। দুপুরের এখনও দেরি আছে।

তোমার মেয়ে কিন্তু গোঁজ হয়ে বসে আছে। উঠছেও না, গোছগাছও করছে না। দয়া করে মেয়েকে একটু শাসন করো। নইলে–

নইলে কী সেটা ভাবতেও ভয় করে অমলের। কিছু না ভেবেই সে শুধু আত্মরক্ষার জন্য বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই তো। ওর কি যাওয়ার ইচ্ছে নেই?

না, ইচ্ছে নেই। এই ধ্যাধধেরে গোবিন্দপুরে কী মধু পেয়েছে কে জানে। বেশি জেদ করলে কিন্তু আমি চুলের মুঠি ধরে নিয়ে যাব।

শঙ্কিত অমল বলে, থাক, থাক আমি দেখছি।

কিন্তু অমল জানে তার দেখার কিছু নেই। দুই জনের মাঝখানে তার ভূমিকা রেফারিরও নয়। কাউকেই সে কিছু বোঝাতে পারে না। তবু সে উঠল। উঠতে উঠতে মিনমিন করে বলল, কী যেন একটা বলছিল তখন।

কী বলছিল?

বোধহয় শরীর খারাপের কথা।

ওসব ন্যাকামি। আমি আর কিছুতেই এখানে থাকব না।

সে তো ঠিকই। কিন্তু

কিন্তু আবার কী? কীসের কিন্তু?

ও যেন বলছিল, কয়েকদিন ও এখানে এদের সকলের সঙ্গে থাকতে পারবে। আমি আপত্তি করিনি।

যেন অসম্ভব এক প্রস্তাব। শুনে চোখ বড় বড় করে মোনা বলে, একা থাকবে? এখানে?

সেরকমই বলছিল যেন। তুমিও সে কথা মেনে নিলে? খুব ভদ্রভাবে বহিরাগত মানুষের মতো সে জিজ্ঞেস করে, সেটা কি উচিত হবে না?

না, হবে না। তোমার মেয়ে এখানে এসে যা-খুশি করছে। পড়াশুনো নেই ওর? যোগ ক্লাস নেই? ড্যান্সিং লেসন নেই? গান নেই? এখানে এসে তো সব চুলোয় গেছে।

কিন্তু ওঁর হাঁপানির ভাবটা নেই, লক্ষ করেছ? ঘন ঘন সর্দিও হচ্ছে না।

সেজন্যই এখানে চিরকাল থাকতে হবে নাকি?

তা বলছি না। ও বলছিল কয়েকটা দিন যদি–

একদিন দুদিন করে প্রায় মাসখানেক হতে চলল। যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়। তোমারও আক্কেল নেই দেখছি। এখানে গ্যাঁট হয়ে বসে আছ, অথচ তোমার অফিস খোলা। কী ব্যাপার বলো তো?

আক্রমণটা কোন দিক থেকে আসবে তা আঁচ করে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে সে বলল, কয়েকদিন ছুটি নিয়েছি। ছুটি অনেক জমে গেছে। কতকাল ছুটি নিইনি বলল তো!

ছুটি নিয়ে থাকলে আমরা অন্য কোথাও যেতে পারি। এখানে বসে থেকে সময় নষ্ট করার মানেই হয় না।

সঙ্গে সঙ্গে একমত হয়ে অমল বলে, সেও হয়।

তোমার এখানে বসে থাকার মতলবটা যে আমি জানি না তা তো নয়। তোমার পুরনো প্রেম নতুন করে উথলে উঠছে। ইউ হ্যাভ টু লিভ দিস প্লেস।

একটু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে অমল। কত দূরে সরে গেছে পারুল। এত দুর এক নক্ষত্র যার আলো এসে পৃথিবীতে পৌঁছয় না। ও কি পারুলকে হিংসে করছে? ও কি সন্দেহ করে এখনও তার আর পারুলের মধ্যে সম্পর্ক হতে পারে? অসম্ভব সব ব্যাপার ঘটছে যে! শীতল, কঠিন মোনার মধ্যে এখনও কি দখলদার জেগে আছে একজন? সেই দখলদার কি তার পুরুষের ওপর সম্পূর্ণ অধিকার চায়? কী করে তা সম্ভব?

অমল শুধু বলল, তা হয় না।

কী হয় না?

ওরকম হয় না মোনা। অঙ্ক মেলে না।

আমি সেসব জানি না। আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। তুমি ওঠো, তোমার মেয়েকে ঘাড়ে ধরে রাজি করাও। আমরা আজ যাচ্ছি।

মোনার গলা সামান্য উঁচুতে উঠেছিল। দু হাত তুলে অমল বলল, ও কে, ও কে। পিস, পিস।

অমলের মনে হচ্ছিল মোনা যেন টাইগার টাইগার বার্নিং ব্রাইট। গনগন করছে সমস্ত শরীর, মুখ।

মোনা বলল, আমি যাচ্ছি গোছগাছ করতে। সব জিনিস নিয়ে যাওয়া যাবে না। কিছু এখানে থাকবে। পরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কোরো।

মোনা চলে গেল।

অমল উঠল। কোনও উপায় তার জানা নেই। সামনে আর এক রণাঙ্গন। কলকাতার ফ্ল্যাটবাড়ি। সেখানে আপাতশান্ত এক পরিবারের বাস। তারা চারজন। প্রায় কোনও সময়েই কারও সঙ্গে কারও সম্পর্ক রচিত হয় না। একটু রাতের দিকে অমল মদের বোতল খুলে বসে এবং হিসেব না করেই খেয়ে যায়। খেতে খেতে যুক্তিসিদ্ধ চিন্তা ও আচরণের চৌকাঠ ডিঙিয়ে যায়। তারপর কী হয় তা সে জানে না। তবে বুডঢা তাকে একদিন বলেছিল, ড্রিংক করলে তুমি খুব প্যাথেটিক হয়ে যাও। আর কিছু বলেনি। প্যাথেটিক বলতে কী বুঝিয়েছিল তাও ভেবে দেখেনি অমল।

মোনার গলা পাওয়া যাচ্ছে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাকছে, সোহাগ! সোহাগ! কোথায় গেলে তুমি?

রাগের গলা, চিৎকারের কাছাকাছি।

সোহাগ! সোহাগ!

অমলের গোছানোর মতো কিছু নেই। প্যান্ট শার্ট আর কোটটা পরে নেবে। পাজামা ইত্যাদি সামান্য দু-তিনটে জিনিস গুছিয়ে নিতে পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়।

একটা কথা ভেবে হঠাৎ সে আজ ভারী অবাক হল। এতকালের মধ্যে তার কখনও গ্রামের বাড়িতে এসে থাকতে ইচ্ছে হয়নি। এখনও যে এখানে থাকতে তার খুব ভাল লাগছে তা নয়। কিন্তু কলকাতায় ফিরে যেতেও তার তেমন ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু কেন? তার মনের গভীরে কি এখনও পারুল-লোভী কেউ লুকিয়ে আছে? ওপর-মন দিয়ে সে ভিতর-মনকে ধরতে পারছে না?

অমল বুঝতে পারল না। একটু আগে পারুলকে দূরতম নক্ষত্র বলে মনে হয়েছিল। বাস্তবের পারুল হয়তো তাই। কিন্তু পারুলের একটা মূর্তি কি প্রতিষ্ঠিত আছে ভিতরে স্বর্ণসীতার মতো? সে-ই কি তার সব গণ্ডগোলের মূল?

মোনা এবার চেঁচাচ্ছে, সোহাগ! সোহাগ! এই, তোমরা সোহাগকে কেউ দেখেছ?

নীচে থেকে সন্ধ্যা বিরক্তির গলায় বলে, না, দেখিনি।

তুমি তো উঠোনেই ছিলে, তবু দেখনি?

সন্ধ্যা গলা চড়িয়ে বলে, কী করে দেখব? আমি তো কাজ করছিলাম! উঠোন দিয়ে কত লোক তো যাচ্ছে আসছে।

মোনা চড়া গলায় বলল, তোমার ঘরে গিয়ে বসে আছে কি না দয়া করে দেখ। আমরা আজ কলকাতায় যাচ্ছি, তাড়া আছে।

আচ্ছা লোক বাপু, তুমি তো আর ফিসফিস করে ডাকছ না! আমার ঘরে থাকলে তো শুনতেই পেত!

শুনেও হয়তো জবাব দিচ্ছে না।

 তা হলে আমি আর কী করব বলো! তুমি এসে ঘরে তল্লাশ নিয়ে যাও।

সেটাই নেওয়া উচিত। মেয়েটা তো দিনরাত তোমার ঘরেই পড়ে থাকে। দিনরাত গুজগুজ, ফুসফুস।

উঠোনে সন্ধ্যার কয়েকজন গাহেক এসে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাগে জিনিস বুঝে নিচ্ছে। তারপর সাইকেলে বিলি করতে বেরোবে। তারা কাজ থামিয়ে হাঁ করে ঘটনাটা বুঝবার চেষ্টা করছে।

সন্ধ্যা হেঁকে বলল, ঘরে যাও তো বউদি, আর লোক হাসিও না। তোমার মেয়ে তার পিসির ঘরেই আসে, ডাইনিবুড়ির কাছে নয়। তোমার যদি পছন্দ না হয় তা হলে নিজের মেয়েকে নিজেই সামলে রাখতে শেখো। পাঁচজনের সঙ্গে ঝগড়া করার দরকার কী? সোহাগ তো সকলের ঘরেই যায়, শুধু আমাকে বলছ কেন?

তুমিই ওর মাথাটা খাচ্ছ বলে বলছি।

কী করে খেলাম বলো তো! কী করেছি ওর আমি?

তা আমি জানি না। আগে ও এত অবাধ্য ছিল না, আজকাল হয়েছে। আজকাল মুখে মুখে কথাও বলছে। পাড়াগাঁর মতো ঝগড়ুটে স্বভাব তো ওর আগে ছিল না!

পাড়াগাঁর লোকেরা না হয় বাংলা ভাষায় ঝগড়া করে, আর তোমরা করো ইংরিজিতে, এটুকু ছাড়া আর কোনও তফাত আছে? লেখাপড়া জেনে, বিলেত ঘুরে এসে কি সাপের পাঁচ পা দেখেছ নাকি যে, যাকে-তাকে যা খুশি তাই বলবে!

অমল এই রণাঙ্গনে ঢুকতে চায় না। তার কোনও ভূমিকাও নেই, দর্শক ও শ্রোতা হওয়া ছাড়া। কিন্তু আজকাল চেঁচামেচি শুনলে তার মাথা ঝিমঝিম করে, হাত পা কাঁপে, নার্ভাস লাগে।

সে বারান্দার দরজাটা খুলে আর্তস্বরে বলল, প্লিজ! প্লিজ মোনা, ঘরে চলে এসো।

মোনা তার ক্ষুরধার এবং রক্তাভ মুখ ফিরিয়ে গর্জন করল, চুপ করো! আমার ব্যাপার আমাকে বুঝতে দাও। শি হ্যাজ গন ইনটু হাইডিং।

আহা, তা কেন? হয়তো টয়লেটে গেছে, কিংবা…।

না, টয়লেট আমি দেখেছি। এ বাড়িতেই কারও ঘরে লুকিয়ে আছে।

কী করে বুঝলে? হয়তো কিছু কিনতে-টিনতে গেছে।

না, কোথাও যায়নি। আমি জানি। বুডঢা আশেপাশে দেখে এসেছে।

অমলকে দেখে সন্ধ্যা মুখ তুলে বলল, দেখেছ মেজদা, বউদি কীসব বলছে! সোহাগ আমার ঘরে আসে সে কি আমার দোষ? আমি নাকি আমার নিজের ভাইঝিকে কানমন্তর দিয়ে নষ্ট করছি।

সে রেফারি নয়, আম্পায়ার নয়, বিচারক নয়। সে অসহায় দুর্বল গলায় শুধু বলল, মোনা, প্লিজ…

সন্ধ্যাকে চেনে অমল। দুঃখী মেয়ে, খেটে খায়। এই বোনটার কথা মনেও থাকে না অমলের। এর স্বামী পরিত্যক্ত জীবনে কেউ কিছু সাহায্যে আসেনি। তাই ওর ভিতরে বিষ জমেছে মেলাই। এই অহেতুক আক্রমণে ও যদি মুখে সেই বিষ উগড়ে আনে তা হলে মোনা বিধ্বস্ত হয়ে যাবে।

মোনা ধমক দিল, তুমি চুপ করো।

শোনো মোনা, উঠোনে বাইরের লোক রয়েছে, শুনছে।

ইস, ভারী লোক রে! সব তো ছোটলোক ক্যানভাসার। তোমার বোন তো ওদের সঙ্গে মিশে মিশেই ছোটলোক হয়ে গেছে।

নীচের লোকেরা পরস্পর একটু তাকাতাকি করে নিল। তাদের সম্পর্কেই এসব কথা বলা হচ্ছে, বুঝতে পারছে তারা। কিন্তু তারা রা কাড়ল না। ওদের এই অহেতুক অপমানে কান ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে অমলের।

চেঁচামেচি শুনে বাড়িসুদ্ধ লোক বেরিয়ে এসেছে উঠোনে। পাড়া প্রতিবেশীরা উঁকিঝুঁকি মারছে আশপাশ থেকে।

নীচে থেকে বউদি হঠাৎ বলল, সোহাগ তো একটু আগে পেছন দিকের পথটা দিয়ে কোথায় যেন গেল।

মোনা ধমকের গলায় বলল, কোথায় গেল?

আমাকে তো বলে যায়নি ভাই। তবে এক ছুটে বেরিয়ে যেতে দেখেছি।

শি ইজ হাইডিং। আপনারা জানেন, কিন্তু বলবেন না।

অমল ঘরে এসে মাথাটা চেপে ধরে বসে পড়ল বিছানায়। তার শরীর দুর্বল লাগছে। মাথা ঘুরছে। এতক্ষণে খোঁয়াড়ি ভাঙছে নাকি তার?

নীচে হঠাৎ মহিমের গলা পাওয়া গেল, কী হল, এত চেঁচামেচি কীসের?

সন্ধ্যা চেঁচিয়ে বলল, সেটা তোমার মেমসাহেব বউমাকে জিজ্ঞেস করো। উনি বিলেত থেকে এসেছেন আমাদের সহবত শেখাতে। ইংরিজি বললেই যদি ভদ্রলোক হত তা হলে তো কথাই ছিল না!

মহিম বলে, কী হয়েছে বউমা, আমাকে বলবে?

সোহাগকে পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ আজ আমরা কলকাতা যাব।

কতক্ষণ ধরে পাওয়া যাচ্ছে না?

চল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে।

মহিম শান্ত গলায় বলে, দেখ কাণ্ড! এ হল গাঁ দেশ, কোথায় আর যাবে! হারিয়ে যাওয়ার তো জায়গা নেই এখানে। সকালে তো আমার সঙ্গে বাগানে ঘুরছিল। কোথায় আর যাবে।

তার কোথাও যাওয়ার কথা নয়। তার এখন গোছগাছ করার কথা। ইচ্ছে করেই কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছে।

আচ্ছা আচ্ছা, আমিই না হয় খুঁজে আনছি তাকে। তুমি বরং গোছগাছ শুরু করে দাও গে।

 আপনাকে বলে রাখছি, সোহাগকে বুদ্ধি পরামর্শ দেওয়ার অনেক লোক কিন্তু এবাড়িতে আছে।

শুনছ বাবা! ভাল করে শুনে নাও। আমরাই নাকি ওর মেয়েকে পালানোর পরামর্শ দিয়েছি।

 আহা, তুই চুপচাপ নিজের কাজ কর না।

চুপ করে থাকতে দিচ্ছে কোথায়? এখন এই সকালবেলায় খদ্দেরদের ভিড়, হিসেবপত্তর করতে হচ্ছে, এ সময়ে চেঁচিয়ে মাথাটাই গরম করে দিল।

বউমা, তুমি ভেবো না। আমি বেরোচ্ছি খুঁজতে।

 খুঁজে পান ভাল, নইলে আমি পুলিশ ডাকব।

মহিম ভয় খেয়ে বলে, না, না, অত কিছু করতে হবে না বউমা ছেলেমানুষ, কোথাও গেছে।

সন্ধ্যা চেঁচিয়ে বলে, ডাকতে দাও না বাবা। ডাকুক পুলিশ। আমাদের কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাক। কিন্তু তাতে তোমার মুখে কালিঝুলি কিছু কম পড়বে না। বুঝেছ? ও মেয়েই তোমার সঁতের গোড়া ভাঙবে। পুলিশ ডাকবে। এঃ, মুরোদ কত! পুলিশ যেন ওর বাপের চাকর! পায়ে দাসখত দিয়ে বসে আছে, নাচতে বললেই নাচবে! যাও না যাও, পুলিশ ডেকে আনো। এখানকার পুলিশে না কুলোলে বাপের বাড়ির পুলিশ ডেকে আনো গিয়ে।

মোনা তীক্ষ্ণ গলায় বলে, শুনলেন! ওর কথা শুনলেন! কত দূর স্পর্ধা একবার দেখুন। বাপের বাড়ি তুলে কথা বলছে! শ্বশুরবাড়ি থেকে তো লাথি খেয়ে পালিয়ে এসেছ, অত বড় বড় কথা মুখে আসে কী করে?

সন্ধ্যা এবার বিকট একটা গলায় চেঁচিয়ে উঠল, আমার দাদা যদি পুরুষের মতো পুরুষ হত তাহলে তোমার মতো বজ্জাত মাগীকে অনেক আগেই পাছায় তিন লাথি মেরে তাড়াত। দাদা ভেড়ুয়া বলে বেঁচে গেছ। কোন গুণীন ধরে ওষুধ করিয়েছ কে জানে বাপু, লোকটা তো ওরকম ছিল না। সোনার মেডেল পাওয়া ছাত্র, এক ডাকে দশটা গাঁ চিনত। তার কী অবস্থা করেছ তা কি আমরা দেখতে পাই না!

ঘরের মধ্যে অমল বিছানায় শুয়ে পড়েছে। তার বুকের মধ্যে ব্যথা হচ্ছে। তার বমি পাচ্ছে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমাদের অনেক গুণ জানি। সোনার মেডেল পাওয়া ছেলে গাঁয়ের মেয়েদের ধরে ধরে রেপ করে বেড়াত। আর তোমার কাছে যারা আসে তাদের কথাও জানি। স্বামী তাড়িয়েছে, এখন যত ওটোলোক ছোটনোক জুটিয়ে নিয়েছ। তোমরা সবাই তো এক ঝাড়েরই বাঁশ, গুণকীর্তির কথা আর বোলো না।

সন্ধ্যা চিৎকার করতে লাগল, বল মাগী, বল আমার দাদা কাকে রেপ করেছে! বল, পাঁচজনের সামনেই বল দেখি তোর কত বড় বুকের পাটা! তোর মুখে পোকা পড়বে হারামজাদী, বেশ্যা মাগী কোথাকার!

এই সময়ে বুডঢা কোথা থেকে দৌড়ে এসে ভিড়ে ভরা উঠোনে ঢুকল। বুদ্ধিমান ছেলে। তরতর করে দোতলায় উঠে মাকে জাপটে ধরে ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

জ্ঞান হারানোর আগে অমল শুনতে পাচ্ছিল, ঘরের মধ্যে মোনা চিৎকার করছে, বলতে দে, আমাকে বলতে দে। ওর দাদা কাকে রেপ করেছে তা ফাঁস করে দিচ্ছি

মা! মা! প্লিজ! ইউ আর আউট অফ ইওর সেনসেস! ওদের সঙ্গে কি তোমার ঝগড়া করা মানায়? চুপ করো, প্লিজ চুপ করো।

তবু ফুঁসছিল মোনা, ছাড়, ছাড় আমাকে। এখনই ওদের ভদ্রলোকের মুখোশ খুলে দিয়ে আসছি।

 সেটা ঠিক হবে না মা। এরকম করতে নেই। জাস্ট টেক রেস্ট।

 বুডঢাকে বোধহয় চটাস করে একটা থাপ্পড় মারল মোনা, কেন ছাড়ছিস না আমায়? ও যে এক তরফা চেঁচিয়ে যাচ্ছে শুনছিস না?

শুনছি মা। লেট দি ডগ বার্ক। তুমি চুপ করো।

 তোর বাবাকে শুনতে বল। তোর বাবা বেরিয়ে গিয়ে বলুক কাকে রেপ করেছে।

 সন্ধ্যা চিৎকার করছিল, কী রে খানকির মেয়ে, বললি না আমার দাদা কাকে রেপ করেছিল! বললি না আমি কার সঙ্গে শোয়াবসা করি! বুকের পাটা থাকে তো আয়, সামনে এসে পাঁচজনকে বল! গুয়ের পোকা, কেলে কুত্তার পায়খানা, ইংরিজি মারাতে আসে।

নীচে যারা জড়ো হয়েছিল তারা সববাই সন্ধ্যাকে শান্ত করতে চেষ্টা করছিল।

ছেড়ে দাও দিদি, বড় মাপের মানুষের কেলেঙ্কারিও বড় মাপেরই হয়। তুমি তোমার মতো থাকো। আমরা তো চিনি তোমাকে।

আরে ওরা সব সাহেব মেম লোক, ওদের ধাত আলাদা।

সন্ধ্যা ফোঁপাচ্ছিল, কী সব বলল শুনলি তো তোরা। শুনি নাকি লেখাপড়া জানা মেয়ে। অমন লেখাপড়ার মুখে আগুন। বাইরের রং ফর্সা হলে কী হবে, ভেতরটা কালো আংরা।

যেভাবে পৃথিবীর সব ঝগড়াই ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে কথা ফুরিয়ে দম শেষ হয়ে স্তিমিত হতে থাকে এ ঝগড়াটাও শেষ অবধি থামল। হাত মুঠো করে, দাতে দাঁত চেপে বজ্রাঘাতের অপেক্ষায় ছিল অমল। কখন উত্তেজিত বলগাহীন মোনার মুখ থেকে পারুলের নামটা উচ্চারিত হয়। অল্পের জন্য আজ বেঁচে গেল পারুল। খুব অল্পের জন্য। বুডঢা সময়মতো না এলে সারা গাঁয়ে চাউর হয়ে যেত পারুলের নাম।

তীব্র উত্তেজনা, স্নায়ুর দুর্বলতা এবং অবসাদে অমল কিছুক্ষণের জন্য সত্যিই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। এই ক্ষমাহীন পৃথিবীতে মানুষ কী করে যে বেঁচে থাকে!

কী হয়েছে তোমার ঠাকুরপো! কী হয়েছে?

অমল ফ্যালফ্যাল করে যখন চাইল তখন তার মুখে চোখে ছিটোনো জলের শীতল স্পর্শ। সে প্রতিধ্বনি করল, কী হয়েছে আমার বললো তো!

তাই তো জিজ্ঞেস করছি। ঘরে এসে দেখি দাঁতকপাটি লেগে পড়ে আছ।

অমল এত দুর্বল বোধ করছিল যে চোখের পাতা দুটো পর্যন্ত খুলে রাখতে পারছিল না। বারবার বুজে আসছে চোখ, মানুষের শরীর যে এত শক্তিহীন হয়ে যেতে পারে এমন অভিজ্ঞতা তার আগে হয়নি কখনও।

আমার মেয়েটা কোথায় ঠাকরোন?

কোথায় আবার! পান্নাদের বাড়িতে গিয়েছিল। রোজই তো যায়। কী যে আজ অশান্তি হল তাই নিয়ে।

অমলের কিছু বলার নেই। চুপ করে থাকে।

চিন্তা কোরো না। তোমার মেয়েটা একটু ক্ষ্যাপাটে হলেও খারাপ কিছু নয়। বলতে কি বাপু, ওই তো আমাদের সঙ্গে যা একটু মেশে-টেশে। তোমরা আর কেউ বাপু আমাদের পাত্তাও দাও না।

সোহাগও মিশুকে নয়। এখানে এসে মিশুকে হয়েছে। সেটা হয়তো তোমাদের গুণ।

বাপু, গুণের কথা ওঠে কেন? আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মেলামেশাটাই স্বাভাবিক। আমরা তো পর নই। পর করে রাখলে আর কী করা যাবে।

সোহাগ কোথায়?

এসেছে। দাদুর কাছে বসে আছে। আজ যা কাণ্ড হল তাতে শ্বশুরমশাইয়ের হার্টফেল হতে পারত। ঝগড়া দেখে সোহাগকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। ফিরে এসে কেঁপেকেঁপে অস্থির হয়ে শয্যা নিয়েছিলেন। ডাক্তার অবধি ডাকতে হয়েছে। অনল বাগচী এসে ওষুধ ইনজেকশন দেওয়ায় এখন ঘুমোচ্ছেন।

খারাপ কিছু নয়তো?

ডাক্তার তো তেমন কিছু বলল না। শক পেয়ে নাকি হয়েছে। বয়সও তো কম হল না।

সব কিছুর জন্য নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয় ঠাকরোন। আমি যদি একটু ভাল মানুষ হতাম।

 যা বাবা, ও আবার কী কথা? তুমি আবার খারাপ কীসে?

 আমিই তো খারাপ। বিদ্বান গাধা।

ছিঃ, ওরকম বলতে নেই। তুমি তো এ বংশের গৌরব। আর কেউ তোমার মতো হল না।

আশীর্বাদ করো যেন না হয়।

 নিজের ঘাড়ে দোষ নিচ্ছ, কিন্তু তোমার বউটি আজ কী কাণ্ড করল বলো। অমন চেঁচিয়ে পাড়া জানিয়ে কেউ নিজের শ্বশুরবাড়ির কথা বলে? আর ওরকম সব অসভ্য কথা!

শঙ্কিত অমল একবার দু ঘরের মাঝখানের বন্ধ দরজাটার দিকে চাইল। বউদি বেশ জোর গলাতেই কথা কইছে। মোনা যদি শুনতে পায়?

কী দেখছ? মোনা তো কখন চলে গেছে!

কোথায়?

 বুডঢা তো ঘণ্টাখানেক আগে মাকে নিয়ে কলকাতায় চলে গেছে।

ওঃ!

 তোমার ঘরে একটা উঁকিও দিয়ে গেল না দেখলাম।

 কলকাতায় চলে গেল?

যেতে পারবে কিনা দেখ।

কেন ঠাকরোন?

শুনছি কোন পার্টি নাকি সড়ক আর রেল অবরোধ করেছে বেলা দশটা থেকে। কিছুই চলছে না। গাঁয়ের অনেকে যেতে না পেরে ফিরে এসেছে।

অমল সিলিং-এর দিকে চেয়ে রইল।

উঠতে পারবে?

শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে।

আগে জানলে ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনতাম।

না, তার দরকার নেই। হঠাৎ অত চেঁচামেচি শুনে মাথাটা কেমন ঘুরে গিয়েছিল। আজকাল আমার চেঁচামেচি সহ্য হয় না।

সন্ধ্যারও ওরকম সব কথা বলা উচিত হয়নি। তোমার বউ আর হয়তো আসবেই না। হা ঠাকুরপো, তোমরা কি শেষে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক তুলেই দেবে?

তা কেন ঠাকরোন, সম্পর্ক কি ইচ্ছে করলেই তুলে দেওয়া যায়!

 যায় না? বলল কী? কত বাপ ছেলেতে মুখ দেখাদেখি বন্ধ।

হ্যাঁ, তাও বটে। ভাবছি ওরা যে গেল কোথাও আটকে থাকবে হয়তো। এ বাড়িতে ফিরবে না হয়তো।

তোমার দাদা সঙ্গে গেছে, ঠিক ফিরিয়ে আনবে।

দাদা সঙ্গে গেছে?

হ্যাঁ। তার তো ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই। বড্ড ভালমানুষ। মান অপমান গায়ে মাখে না। তোমার বউ ফাইফরমাশ করে, হাসিমুখে মেনে নেয়। ওই একধরনের মানুষ। মান অভিমান যা-কিছু সব আমার সঙ্গে। আর কারও সঙ্গে শত্রুতা নেই।

হেসে ফেলে অমল, দাদাকে খুব চিনেছ তো!

না চিনে উপায় কী বললো! কত বলি ভাদ্দর বউয়ের ফাইফরমাশ খাটো, লোকে বলবে কী! কিন্তু সে বলে, ওরা গায়ে এসে অচেনা পরিবেশে পড়েছে, আমার তো দেখা উচিত। কথাটা তো মিথ্যেও নয়।

মোনাও দাদার কথা খুব বলে।

 তুমি কি এক কাপ চা বা কফি খাবে?

 খাব। তারপর ঘুমোব। স্নান-খাওয়ার জন্য ডেকো না। আমার খিদে নেই।

সোহাগকে ডেকে দেব? একটু বসুক এসে তোমার কাছে।

না ঠাকরোন। ওরা অনেক দূরের লোক। দূরেই থাকুক।

 কী যে সব বল না, অলক্ষুণে কথা।

তোমার এক বিছানায় শোওয়ার থিওরি সব জায়গায় খাটে না।

দাসীর কথা বাসি হলে বুঝবে।

কফি খেয়ে অমল ঘুমোল। অনেকক্ষণ ঘুমোল। বিকেলে পড়ন্ত বেলায় ঘুম ভাঙল খিদেয়।

মোনা আর বুডঢা ফিরে এসেছে। পাশের ঘরে তাদের ইংরিজি ডায়ালগ শুনতে পাচ্ছিল অমল। এ দেশের সিস্টেমকে গালাগাল দিচ্ছিল মোনা। রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে ফের ফিরে আসার লজ্জা তো কম নয়।

বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ল, আজ পারুল আসবে। সর্বনাশ! এই আগ্নেয়গিরির লাভামুখে সত্যিই কি আসবে নাকি পারুল? তাকে যে আটকানো দরকার। ভীষণভাবে আটকানো দরকার!

তড়িঘড়ি উঠতে গিয়ে বিবশ হয়ে ফের বসে পড়ল অমল। মাথা ঘুরছে। স্পন্ডেলাইটিস ধরা পড়েছিল বছর খানেক আগে। ডান হাতে ঝিঁঝি। ঘাড় টনটন করছে ব্যথায়।

চুপ করে বসে থাকে অমল। সামনেই চৌকাঠের ওপারেই দাঁড়িয়ে আছে সর্বনাশ। পারুলকে কী করে একটা খবর পাঠানো যায়?

কিছুই করতে পারল না অমল। দাঁড়াতে গেলেই টলে যাচ্ছে মাথা, পায়ের নীচে মেঝে টলমল করছে। একটু হুইস্কি খাবে কিনা ভাবল। খাওয়াটা বোধহয় বিচক্ষণতা হবে না। একটাই ভরসা, গ্রামে কোনও বাড়িতে ঝগড়া কাজিয়া হলে সেটা রটে যেতে দেরি হয় না। যদি তাদের বাড়ির ঝগড়াটার কথা পারুলের কানে পৌঁছে থাকে তাহলে সে হয়তো নিজে থেকেই আসবে না।

এই ক্ষীণ আশাটুকু নিয়ে গায়ে লেপ চাপা দিয়ে শুয়ে থাকে সে।

সন্ধের শঙ্খধ্বনি শেষ হতে না-হতেই হঠাৎ চটকা ভাঙল অমলের। নীচের তলায় হঠাৎ হাসি আর কথার শব্দ হচ্ছে। কারা যেন উঠে আসছে ওপরে।

মোনার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। কাকে যেন বলছে, আসুন, আপনার কথা কত যে শুনেছি ভাই।

কে এল? কে আসতে পারে? পারুল? অসম্ভব। অসম্ভব। তবু বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে থাকে তার।

পারুলের গীতধ্বনির মতো কণ্ঠস্বর বলে উঠল, ইস, কী সুন্দর দেখতে ভাই আপনি! অমলদার ভাগ্য খুব ভাল।

আপনার কাছে আমি! কী যে বলছেন। ভিতরে এসে বসুন।

এই ইনিই হলেন আমার স্বামী জ্যোতিপ্রকাশ গাঙ্গুলি।

আপনার কথাও খুব শুনেছি। আপনি তো ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট।

 গম্ভীর এক পুরুষ কণ্ঠ বলে, যা শুনেছেন তার অনেকটাই বাড়াবাড়ি। মিস্টার রায় কোথায়?

বসুন। ডাকছি, ওঁর শরীরটা আজ ভাল নেই।

অমলের ইচ্ছে হল দোতলা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পালিয়ে যায়। কিন্তু শরীর আজ বড্ড বাদ সেধেছে। উপায় নেই।

পারুল উচ্চকণ্ঠে বলে, আমার বান্ধবীটি কোথায়?

ও সোহাগের কথা বলছেন?

হ্যাঁ। ও আমাকে পারুল বলে ডাকে। ঠিক বান্ধবীর মতো।

 হ্যাঁ, বিদেশ থেকে শিখে এসেছে। চট করে অচেনা কাউকে মাসি পিসি বলতে পারে না।

মাসি বললে খুশিও হই না। পারুল বলেই ডাকুক। সে গেছে কোথায়?

আর বলবেন না। এখানে এখন তার অনেক বন্ধু হয়েছে। দিনরাত আড্ডা। তবে এসে পড়বে ঠিকই। আপনি আসবেন জানে তো।

খুব ইন্টারেস্টিং মেয়ে।

এমনিতে খুব ভাল, কিন্তু বড্ড খেয়ালি।

কী চমৎকার অভিনয় মোনার। ওকে অস্কার দিতে ইচ্ছে হচ্ছে অমলের। অমল তীব্র শীতে জবুথবু হয়ে জড়বস্তুর মতো বসে রইল অন্ধকার ঘরে। মনে হচ্ছিল, সে আর নড়তে পারবে না। পারুলের মুখোমুখি হওয়াও সম্ভব নয় তার পক্ষে। মোনা বড় বিপজ্জনক জায়গায় চলে গেছে। আজই রাগের মাথায় সে পারুলের কথা বলে ফেলেছিল প্রায়। অমলের কলঙ্কের কোনও ভয় নেই, তার কিছুতেই কিছু যায় আসে না। কিন্তু পারুলের মূর্তিটা ভেঙে পড়ে যেত আর একটু হলেই।

সে শুনতে পেল, পারুল বলছে, অমলদার কি শরীর খারাপ?

হ্যাঁ। স্পন্ডেলাইটিসে কষ্ট পাচ্ছেন। দাঁড়ান, ডেকে আনছি।

থাক না। একটু পরে ডাকলেও হবে। আজ আপনার সঙ্গে আলাপ করতেই তো আসা।

মোনা বলল, আপনার সঙ্গেও আলাপ করার ভীষণ ইচ্ছে ছিল আমার। সোহাগের কাছে তো আপনি একজন গডেস।

খুব করুণ গলায় পারুল বলে, আচ্ছা, দেখুন তো কী কাণ্ড! ও আমাকেও ও কথা বলেছে, শুনে যে আমার কী লজ্জা হয়েছে বলার নয়। আমাকে ওসব ভাবে কেন ও?

মোনা হেসে বলে, ভাবার কারণ আছে বলেই ভাবে।

কারণ! কী কারণ থাকতে পারে?

আপনার মধ্যে একটা অদ্ভুত গ্রেসফুলনেস আছে। এতদিন কেবল আপনার ছবি দেখেছি আর কথা শুনেছি, আজ মুখোমুখি দেখে আমারও যেন মনে হচ্ছে আপনার মধ্যে ডিভাইন কিছু আছে।

যাঃ, আপনিও এসব বলছেন!

আমার ছেলেও বলে।

 কী লজ্জার কথা বলুন তো। আমি তো একেবারে সাধারণ একটা মেয়ে।

তাহলে বোধহয় আমাদেরই চোখের ভুল।

জ্যোতিপ্রকাশ চুপ করে ছিল। এবার তার গুরুগম্ভীর গলায় বলল, দেবী হলে কিন্তু এদেশে খুব কদর হয়। দেবী বলে সেই যে গল্পটা

আহা, ওসব তো গল্প।

সিঁড়িতে দুদ্দাড় পায়ের শব্দ তুলে উঠে এল সোহাগ।

হাই! পারুল পিসি!

এই দুষ্টু মেয়ে আমি আবার পিসি হলুম কবে?

.

২২.

আগে পাড়াপ্রতিবেশীরা ভাবত বাঙালবাড়িতে বুঝি ঝগড়া লেগেছে। ঝগড়া দেখতে চলেও আসত কেউ কেউ। আজকাল সবাই জেনে গেছে, হাঁকডাক আর চেঁচামেচি হল বাঙালের স্বভাব। ভাল কথাটাও উঁচু গলায় না বললে তার সুখ হয় না। বিষয়ী কথাই হোক, আদুরে কথাই হোক পাঁচবাড়ি জানান দেওয়া চাই। হাঁকডাক শুনলেই পাড়া-প্রতিবেশীরা নিজেদের মধ্যে কওয়াকওয়ি করে, ওই বাঙাল এয়েছে, কদিন এখন ভূত-প্রেতও তফাত থাকবে।

ধীরেন কাষ্ঠ কিন্তু খুশিই হয়। বাসন্তীকে একবার বলেছিল, যারা চেঁচিয়ে কথা কয় তাদের মনে ময়লা নেই। তারা সরল মানুষ।

জিজিবুড়ি বলে, ও হচ্ছে মাগী নাচানো গলা। খোঁজ নিয়ে দেখগে, আলকাপ না বউ মাস্টারের দলে যাত্রা থিয়েটার করে বেড়াত। ও কী গলা বাবা, বাঘের অবধি পিলে চমকে যায়। জন্মের পর মা মাগী বোধহয় তেঁতুলগোলা গিলিয়ে দিয়েছিল।

কথাটা ঠিক যে, হাঁকডাকে বাঙাল খুব দড়। সকালবেলা রসিক বাঙাল তার বাজখাঁই গলায় হাঁকডাক করতে করতেই দোতলা থেকে নামছিল, কই রে, হারু কই গেলি? মরইন্যাটা কইরে? আরে তুমি কই গ্যালা…?

বাঙালের বাঁ কোলে হাম্মি, ডান হাতে এক গোছা ভাঁজ করা রুটি। সকাল আটটা সাড়ে আটটায় বাঙাল রোজ কাককে রুটি খাওয়ায়। বাঁধা নিয়ম।

উঠোনের কোণে রান্নাঘর থেকে বাসন্তী হাসিমুখে বেরিয়ে এল।

কী বলছ?

বেহানবেলায় পাকঘরে ঢুইক্যা করটা কী?

 জলখাবার করছি তো।

পোলাপানগুলি কই?

একটা তো তোমার কোলে। মরণ পড়তে বসেছে, আর সুমন এখনও ঘুমোচ্ছে। তাই কও।

আসলে এই ডাকখোঁজ করাটা বাঙালের স্বভাব। আপনজনরা কে কোথায় কী করছে সে খবরটা সবসময়ে চায়। বড্ড মায়া লোকটার। যা করবে তা সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে করবে। জন না হলে যেন বাঙালের এক মুহূর্ত চলে না।

কাউয়া খাওয়াইতে যাইতাছি। আইবা নাকি?

উনুনে যে তরকারি হচ্ছে। পুড়ে যাবে।

আইচ্ছা মাইয়্যালোক, রান্ধন বান্ধন লইয়াই থাক গিয়া।

 দুড়দাড় করে উঠোন পেরিয়ে গেল লোকটা। বাসন্তী হাসিমুখে চেয়ে রইল। বড় ছেলেমানুষ তার এই মানুষটা। মানুষটার আধখানামাত্র সে পেয়েছে। তাইতেই ভরে গেছে বাসন্তীর। পুরোটা যদি পেত! না, থাক। ওসব ভাবতে নেই।

উঠোনের পুব-দক্ষিণ কোণে গোয়ালঘরের পিছনে সবজিবাগান ঘেঁষে একটা ফর্সা জায়গা আছে। সেখানে রাজ্যের কাক বাঙালের জন্য ওত পেতে থাকে। বাঙাল রুটির টুকরো ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয় আর কাকগুলো নানা কায়দায় শূন্যে পাক খেয়ে খেয়ে এরোপ্লেনের মতো গোঁত্তা মেরে শূন্য থেকেই লুফে নেয় ঠোঁটে। দৃশ্যটা খুব উপভোগ করে বাঙাল। খুব হাসে, খা, খা, ভাল কইরা খা।

বাপের কোল-সই হয়ে হাম্মিও দৃশ্যটা খুব মন দিয়ে দেখে আর নানা শব্দ করে চেঁচায়। দুই শিশুর কাণ্ড।

রান্নাঘরে গা-ঢাকা দিয়ে জিজিবুড়ি বসা। রোজ সকালেই এ সময়ে একবারটি আসে সে। লুকিয়ে বসে এক কাপ দুধ-চা খেয়ে যায়। বাসন্তী মায়া করে তাকে ওটুকু দেয়।

চাপা গলায় জিজিবুড়ি বলে, ওই চললেন কাককে ভোজ খাওয়াতে। ওই করে করেই ঘটিবাটি সব চাঁটি হবে বলে রাখছি বাপু। শেষে কৌপীনসম্বল। বলি কাকের মতো নিঘিন্নে জীব আছে? সারাদিন অখাদ্য সব জিনিস খেয়ে বেড়ায়, পচা-ঘচা বাসি-ত্যাতা কোনটায় অরুচি দেখেছিস? কেলেকুষ্টি, ছিষ্টিছাড়া কাককে কেউ নেমন্তন্ন করে পয়সার জিনিস খাওয়ায় আহাম্মক ছাড়া? আড়াইশো তিনশো আটা জলে গেল। কত দাম হয় হিসেব করেছিস কখনও?

তুমি চুপ করো তো মা। তার ইচ্ছে হয়, তাই খাওয়ায়। ভূতভূজ্যি বলেও তো একটা কথা আছে, নাকি?

তুই আর বাঙালের পোঁ ধরিসনি তো! দশ বারোখানা আটার রুটি কি কম কিছু হল? দুটো মনিষ্যির খোরাক। তোর ভালর জন্যই বলি। নইলে দিক না সব উড়িয়ে পুড়িয়ে, আমার তাতে কী?

দুধ খেতে এসেছ চুপচাপ বসে দুধ খাও। এ-সংসারের ব্যাপারে তোমার অত নাক গলানোর দরকার কী?

ওলো আমার সংসারী লো! দুদিনের বৈরিগী ভাতকে বলে মালসাভোগ। বলি সংসারটার সুসার হয় কীসে তা বুঝি দেখার দরকার নেই?

আমার সংসারে সুসারের অভাব কবে দেখলে? ওসব বোলো না তো! ভাল লাগে না। ও মানুষ সবাইকে খাওয়াতে ভালবাসে।

খেয়ে খেয়েই তো বাঙালগুলো গেল। পেছনের কাপড় তুলে দিনরাত কেবল গিলছে। অমন রাক্ষুসে খাঁই দেখিনি বাপু। আড়াইটি লোকের সংসার, তা বাপু ফি শনিবারে দেখি গন্ধমাদন বয়ে নিয়ে আসছে। মাছ রে, মাংস রে, ঘি রে, তেল রে…যেন মচ্ছব লেগেছে। এই বলে দিচ্ছি এখন থেকে একটু লাগামে টান দে, নইলে তোর দশাও শেষে আমার মতো হবে। সেই মিনসে আমাকে যে দশায় ফেলে গেছে এখন সামনে পেলে তার মুখে নুড়ো জ্বেলে দিতুম।

বাসন্তী ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, খাওয়া নিয়ে খোঁটা দেবে না তো মা! তোমাদের মতো স্বার্থপর মানুষ তো নয়। খেতে জানে, খাওয়াতেও জানে।

খাওয়াতে জানে ওই কাকবক শ্যালকুকুরকে। দুটো শালা, শাউড়ি এদের যে পেটে পাটকেল সিদিকে খেয়াল আছে? কত বড় দাতাকর্ণ এলেন রে? আবার বলে খেতে জানে, খাওয়াতেও জানে!

দেখো মা, সোজা বলে দিচ্ছি কাল থেকে আর এসো না। আমি আর তোমার আফিং-এর দুধ। জোগাতে পারব না। যারটা খাবে তারই নিন্দে করে বেড়াবে সেটা আমি আর সহ্য করব না।

জিজিবুড়ি একটু মিইয়ে গেল। জুল জুল করে মেয়ের মুখপানে একটু চেয়ে দেখল। হাতের গেলাস থেকে চায়ের লিকার মেশানো দুধ সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে কয়েক চুমুক খেয়ে গলাটা মোলায়েম করে বলল, বাব্বা, কী এমন বললুম যে, তোর আঁতে লাগল। ভালর জন্যই বলা। বাঙাল কি আর মনিষ্যি খারাপ! হাতটাই যা একটু দরাজ। তাই তো বললুম, নাকি?

যা বলেছ সে আমি বুঝেছি। কাল থেকে তোমার দুধ বন্ধ রইল।

জিজিবুড়ি একটু তোম্বা মুখ করে বসে থেকে বলে, আফিং খাই বলেই আতান্তরে পড়েছি মা, নইলে কি আর মান খোয়াতে আসি। তা সেই আফিংটাই বা জোটে কোথায়? কানাই আফিং-এর খোসা এনে দেয়, তাই জলে সেদ্ধ করে খাওয়া। বাঙালকে বলে পো টাক আফিং-ও তো আনিয়ে দিতে পারিস। দশ মাস গর্ভে ধরেছিলুম, সে কথা কি ভুলে গেলি যে, খুঁড়ছিস!

গলা উঁচুতে তোলা যাচ্ছে না, তবু তার মধ্যেই যতটা সম্ভব দ্বেষ মিশিয়ে বাসন্তী বলে, তোমাকে হাড়ে হাড়ে চিনি মা। ছেলেরা লাথিঝাঁটা মারলেও তুমি তাদের দোর ধরে পড়ে থাকবে। তাদের খোঁট ছাড়বে না। তা এনে দিক না তারা তোমার আফিং। তার বেলা আমার বাঙাল বরকে দরকার হয় কেন? তাও তিন-চার মাস আগে দু ভরি আফিং আনিয়ে দিয়েছিলাম। অত মুখ মুছে ফেল কী করে বলল তো! বেইমান আর কাকে বলে?

জিজিবুড়ি দুধ-লিকারের শেষটুকু গিলে ধপাৎ করে গেলাসটা মেঝেতে রেখে বলল, ইঃ, বড় যে বেউলো হলি। বলি বাঙাল কি তোর আর জন্মের স্বামী নাকি লা? বে বসেছিল তোক দেখাতে। ও মোটে বে-ই নয়। রাঁড়ের মতো আছিস, তাই থাকবি। ও তোকে বউ বলে বড় গেরাহ্যি করে কি না। তুই বোকার বেহদ্দ বলে দুধের বদলে পিটুলিগোলা খেয়ে নাচছিস। চোখ থাকলে সব দেখতে পেতিস। ভারী তো এক পো দুধ খাওয়াস তার জন্য এত কথা!

বাসন্তী জিজিবুড়ির দিকে এমনভাবে তাকাল যেন ভস্ম করে ফেলবে। তারপর দাঁতে দাঁত পিষে বলল, তোমাকে মা বলে ডাকতে আজকাল ঘেন্না হয়। যাও তো, এখন বিদেয় হও। আর এ-মুখো হয়ো না।

তোম্বো মুখ করে জিজিবুড়ি উঠে পড়ল। বলল, আমাকে তাড়ালে কি আর দাগ উঠে যাবে? যা বললুম ভাল করে ভেবে দেখিস। দুটো পয়সার মুখ দেখেছিস বলে বড় অহংকার তোর।

জিজিবুড়ি বিদেয় হওয়ার পর বাসন্তী চুপ করে বসে রইল। তার দু চোখের জলের ধারায় ভেসে যাচ্ছিল গাল। কড়াইয়ে তরকারি পোড়া গন্ধ ছাড়তে লাগল। খেয়ালই করল না সে।

তার বুকের মধ্যে ঝুলকালির মতো ভয়টা তো আছেই। সত্যিই সে রসিক সাহার কতখানি বউ? কতখানি অধিকার তার ওই মানুষটার ওপর? টাকাপয়সার অভাব রাখেনি, বাড়িঘর জমি-জমা সব তার নামে। কিন্তু সেটাই তো আর স্বামীত্ব প্রমাণ করে না। লম্পট লোকেরা তাদের রক্ষিতাদের তো কত কিছু দেয়, তাতে তো রক্ষিতা বউ হয়ে যায় না। সে ভাবতে চায় না, তবু মাঝেমাঝে প্রশ্নটা হঠাৎ ছোবল তোলে মনের মধ্যে, আমি ওর কতখানি বউ?

তার মায়ের বুকে গরল, মুখে গরল। ঠিক কথা। কিন্তু কখনও কখনও এমন কথা কয় যে বড় চমকে যায় বাসন্তীর ভিতরটা। নিশ্চিন্ত, সুখী মনটা যেন কাচের গেলাসের মতো ঝনঝন করে ভেঙে শতখান হয়ে পড়ে। তখন বড় দিশাহারা লাগে। এখন বড় পাগল-পাগল লাগে। এখন ইচ্ছে হয়, ছুটে কোথাও পালিয়ে যায়।

মাঝে মাঝে আদর সোহাগের সময় সে রসিকের বুক ঘেঁষে মাথাটা সাপটে দিয়ে বলে, এত সুখে রেখেছ কেন আমায় বলো তো! এত সুখ কিন্তু ভাল নয়।

ক্যান গো, তোমারে কি সুখে থাকতে ভূতে কিলায়?

হুঁ, কিলোয়। আমার বড় ভয়-ভয় করে যে! ছেলেবেলা থেকে আদর-সোহাগ পাইনি তো কখনও। অভাবের সংসার, নিত্যি খিটিমিটি, কথায় কথায় চড়চাপড়, আধপেটা খাওয়া এইসব নিয়েই বড় হয়েছি। তাই মনে হয় ভগবান আবার সব কেড়ে না নেন। বড্ড ভয় যে!

তুমি একখান আজব মাইয়ালোক। অত ডরাও ক্যান?

ভয় কি সাধে পাই! আমাকে বিয়ে করে তোমারও তো কত ঝাট গেল। আমার দাদারা তোমার পেছনে গুণ্ডা লাগিয়েছিল, ধান চাল চুরি করত, গাঁয়ের লোককে তোমার পিছনে লাগাত। আমি যে কী ভয় পেতুম!

আরে ওইসব কথা বাদ দেও তো! মাইর আমি অনেক খাইছি।

 কিন্তু সবচেয়ে বড় ভয়ের কথাটা সে মুখ ফুটে বলতে পারে না।

সে কি বাঙালের সত্যিকারের বউ, না রক্ষিতা?

 হ্যাঁ, তাদের পুরুত ডেকে বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সে শুনেছে, আইনে নাকি ও বিয়ে গেরাহ্যি হয় না। তা হলে কি ইহজন্মে সে বাঙালের বউ হবে না?

এই চিন্তাটা ছাইচাপা আগুনের মতো তার বুকের মধ্যে সবসময়ে থাকে। মাঝমাঝে তার মা এসে সেটাকে ফুঁ দিয়ে গনগনে করে দিয়ে যায়। ঝাঁপিতে যেমন সাপ নিশ্চিন্তে ঘুমোয়, সাপুড়ে তাকে খুঁচিয়ে জাগায়।

চোখের জল আজ বড় উথলে পড়েছে। জমি-বাড়ি-গাড়ি-গয়না ছেলেমেয়ে সব মিথ্যে মনে হচ্ছে। পায়ের তলায় বুঝি ধরণী নেই তার। ওই একটা লোককে ঘিরে তার লতিয়ে ওঠা জীবন যে মিথ্যে হয়ে যায় তা হলে। সেই মিথ্যে নিয়ে বাঁচবে কী করে বাসন্তী?

ফুলে ফুলে কাঁদছিল বাসন্তী। কাণ্ডজ্ঞান লুপ্ত হয়ে আকুল কান্নার নদী হয়ে যাচ্ছিল সে। তরকারি পুড়ল, কড়াই পুড়ল, তপ্ত লোহার গন্ধে ঘর ভরে গেল।

ও বউদি! ও কী গো! ঘরে যে অগ্নিকাণ্ড হবে! ইঃ বাবা…।

দৌড়ে এসে উনুন থেকে কড়াই নামিয়ে তাতে ফাস করে জল ঢেলে দিল হিমি, পাশের বাড়ির অক্ষয়বাবুর মেয়ে। সুমন আসার পর থেকে এ মেয়েটার যাতায়াত বেড়েছে। নানা ছুতোয় এসে হানা দেয়। একদম পছন্দ করে না বাসন্তী।

একটা উলের ডিজাইন দেখাতে এসেছিলাম। এসে দেখি কী কাণ্ড! কী হয়েছে বউদি, কাঁদছ কেন?

 বাসন্তীর চেতনা ফিরল। আঁচলে ঢাকা মুখ সহজে তুলল না। মাথা নেড়ে ধরা গলায় বলে, কিছু না।

ঝগড়া হয়েছে বুঝি? তোমাদের তো কখনও ঝগড়া হয় না।

 ফোঁপানিটা কিছুতেই লুকোনো যায় না। হেঁচকির মতোই বেসামাল জিনিস।

কড়াইটা ঝামা হয়ে গেছে বউদি। ওঠো তো, মুখেচোখে জল দাও।

লজ্জা করছিল বাসন্তীর। এই কান্না নিয়ে পাঁচটা কথা উঠবে। এমনিতেই সে একজনের দুনম্বর বউ বলে দুটো চারটে উড়ো কথা কানে আসে তার। গাঁ হচ্ছে কূটকচালির এঁদো পুকুর। চোখ মুছে বাসন্তী বলে, তুই এখন যা হিমি। আমার মনটা আজ ভাল নেই।

খুব ভাল মানুষের মতো হিমি রাজি হয়ে বলে, আচ্ছা বউদি, পরে আসবখন ডিজাইনটা দেখিয়ে নিতে।

ডিজাইন না ছাই। এসে নানা ফাঁকে সুমনের দিকে চেয়ে থাকে। ইশারা ইঙ্গিতের চেষ্টা করে। সুমন অবশ্য আনমনা ছেলে। কিন্তু বয়সটা খারাপ, কখন কী হয়ে যায়। বদনাম যা হওয়ার বাসন্তীরই হবে। বড়গিন্নি বলে বেড়াবে, ছেলেটার মাথা খাওয়ার মূলে এই হতভাগী বাসন্তী। তারই ষড়যন্ত্র।

কড়াই বের করে নিয়ে ফের নতুন করে রাঁধতে বসল বাসন্তী। জলখাবার দিতে আজ দেরি হয়ে যাবে একটু।

.

ধীরেন কাষ্ঠ ওঠে সেই কাকভোরে। ওঠা বলতে শয্যাত্যাগ। নইলে ঘুমও কি আর তেমন হয় আজকাল। মাঝরাত্তিরেই চটকা ভেঙে এপাশ ওপাশ। ঘড়ি ঘড়ি পেচ্ছাপও পায় এই শীতকালটায়। ঘুমের জো কী?

কাকভোরে উঠে লোকে ইষ্টনাম-টাম করে। ধীরেনের ইষ্ট-টিস্ট নেই। যৌবনকাল পেরিয়ে আধবুড়ো বয়স অবধি ধর্মে মতি ছিল না। আর এখন বুড়ো বয়সে মনে হয় ওসব করে আর হবেটা কী? তার যা পাহাড়প্রমাণ পাপ জমা হয়ে আছে তা ক্ষয় হওয়ার নয়। মাথায় তাই ভগবানকে আর ঢোকায়নি কাষ্ঠ, তাতে মনের জ্বালা আরও বাড়বে। পাপ নিয়ে নরক নিয়ে চিন্তা বাড়বে। তার চেয়ে নাস্তিক হওয়া ভাল। তা হলে আর ওসব ল্যাঠা থাকে না।

আলো ফুটি-ফুটি হলেই বেরিয়ে পড়ে ধীরেন। তার গরম জামাকাপড় বিশেষ নেই। যা আছে তাই চাপিয়ে নেয় গায়ে। মোটা গেঞ্জি, জামা, একটা আড়েবহরে ধুতি, মোজা, চটি। শীতটাও ওখানেই বেশি লাগে।

ঘরে চা জোটে না তা নয়। তবে বেলা হয়। আর সে অখাদ্য চায়ের জন্য বসে থাকার মানে হয় না। যে বাড়িতে হানা দেবে সে বাড়িতেই একটু চা জুটেই যায় সকালবেলাটায়।

এ-গাঁয়ে বাঙালের বাড়িটাই তার সবচেয়ে পছন্দের। বাঙাল থাকলে তো কথাই নেই। দিলদরিয়া লোক। গিয়ে দুদণ্ড বসলে চা জোটে, খাবার-দাবারও জুটে যায়। বাঙাল বলে, খান খুড়া, খান। দুনিয়ায় খাওনের মতো বস্তু নাই।

তা খাওয়ার পরিপাটি আছে বাঙালের। সেজন্য খরচও করে দেদার।

এই সকালবেলায় বাঙাল কাককে রুটি-টুটি খাওয়ায়। ধীরেন প্রথমটায় যায় মহিম রায়ের বাড়ি। মহিমা ওঠে খুব সকালে। পুজোপাঠ সেরে উঠোনের রোদে বসে চা খায়। মহিমদার বাড়ির চা-টি বড় ভাল। ঘন লিকার, ভাল দুধের চা। সঙ্গে বিস্কুট। পুরনো কথাটথা হয় কিছুক্ষণ।

গৌরহরি চাটুজ্জে বেঁচে থাকতে সেখানেও একটা ঠেক ছিল বটে ধীরেনের। গৌরহরিদা পগারপার হওয়ায় সেখানকার পাট একরকম উঠেছে। ক্রমে ক্রমে ঠেক কমে আসছে।

বেলা একটু গড়ালে ধীরেন কাষ্ঠ এ-পাড়া ও-পাড়া ঘুরে নানা ছোটখাটো দৃশ্য দেখে তারপর বাঙালবাড়িতে হানা দেয়।

দৃশ্যটা বড় ভাল। বাগানের এক কোণে বাঙাল জলচৌকিতে সেঁটে বসে রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে শূন্যে তুলে ছুঁড়ে দিচ্ছে আর কাকেরা একটা অন্যকে এড়িয়ে কপাকপ তুলে নিচ্ছে ঠোঁটে।

ভারী আহ্লাদ হয় ধীরেনের। সব দৃশ্যেরই একটা সৌন্দর্য আছে। কাকেঁদের উড়ে উড়ে উড়ন্ত রুটির টুকরো ছিনতাই করাটার মধ্যেও একটু আর্ট থাকে।

কাক বককে আর কে খাওয়ায় আজকাল!

খুড়া নাকি? আরে আহেন আহেন। বহেন জুইত কইর‍্যা। আরে কে আছস, খুড়ারে একখান চেয়ার দে।

মুনিশ কামলার অভাব নেই। একজন দৌড়ে কেঠো চেয়ারখানা এনে পেতে দেয় আতাগাছের তলায়।

কাক রুটি খাচ্ছে–এই দৃশ্যটা হাসিমুখে খুব মন দিয়ে দেখে ধীরেন।

কাউয়ারা যে কথা কয় তা বোঝেন খুড়া?

 ধীরেন হেসে বলে, না হে বাপু, কাকের ভাষা কি কেউ বোঝে? কিন্তু কিছু কয়, নাকি?

কাউয়ারা কথা কয় খুড়া, কান্দে, নালিশ করে।

সে কি তুমি বোঝো?

না খুড়া, তবে বুঝনের চেষ্টা করি। দুই একখানা কথা বুইঝ্যাও ফালাই।

সত্যি? কী বোঝ বলো তো!

ক্ষুধার কথা কয়, আহ্লাদের কথা কয়।

ধীরেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, শুনেছি, আগে নাকি এসব নিয়ে চর্চা হত। আজকাল গাঁজাখুরি বলে সবাই উড়িয়ে দেয়।

উড়াইয়া দিলে সবই উইড়া যায়। থাকে কী কন তো!

কাকের ভাষা ধীরেন কাষ্ঠ বুঝতে পারে না ঠিকই। কিন্তু বাঙালের ভাষাটা বুঝতে পারে। শুধু মুখের ভাষা নয়, বাঙালের ওই যে মায়াদয়া, কাক কুকুর খাওয়ানো, দরাজ হাবভাব ওরও একটা ভাষা আছে। ওসব দিয়ে ভিতরের মানুষটাকে দেখা যায়। হাবভাব, আচার-আচরণেরও একটা ভাষা আছে। মুখের বুলি অনেক সময় সত্যি কথা কয় না। কিন্তু হাবভাব আসল মানুষটাকে ঠিক চিনিয়ে দেয়। একখানা মুচকি হাসি কখন যে লক্ষ কথাকে ছাড়িয়ে যায়, একখানা চোখের চাউনি যে কখন শত ছুরিকাঘাতের চেয়েও বেশি মারক হয়ে ওঠে। কী বলে যেন ব্যাপারটাকে আজকাল? বডি ল্যাংগুয়েজ না কী যেন!

বেহানবেলা কী খাইয়া আইছেন খুড়া?

হ-হ-হ করে লজ্জার হাসি হাসে ধীরেন। ভারী অপ্রস্তুত হয়ে বলে, কী আর খাব! সকালে বিশেষ খাই-টাই না। ওই একটু চা-বিস্কুট।

গরম রুটি-ব্যঞ্জন খাইবেন? আহেন, আহেন, আমার বউ রুটিটা বড় ভাল বানায়। পাতলা, নরম লাহান। আহেন।

ঘটনাটা নতুন কিছু নয়। বাঙালের বাড়িতে বাঙাল থাকলে এরকম প্রায়ই ঘটে। তবু ধীরেন আজও খুব লজ্জা পায়। এই লজ্জাবোধটুকুই যা এখনও আছে অবশিষ্ট। লোভ কি আর বশ মানতে চায়?

উঠোনে পা দিয়েই বাঙাল হাঁক মারল, কই গো, তোমার রুটি-মুটি হইছে নাকি? কয়েকখান বেশি কইরো। খুড়া আর আমি খামু।

রান্নাঘর থেকে বাসন্তী বলল, রুটি হচ্ছে। একটু দেরি হবে। বোসো।

ক্যান গো, আইজ দেরি ক্যান?

তরকারিটা পুড়ে গিয়েছিল। আবার চাপিয়েছি নতুন করে।

শোনো কথা! বলে বাঙাল খুব হাসল, শোনলেন খুড়া, ব্যঞ্জন নাকি পুইড়া গেছে। বহেন, জুইত কইরা রৌদ্রে বহেন। হইয়া যাইব। আমার বউ খুব কর্মিষ্ঠা রমণী।

একজন মুনিশ দৌড়ে গিয়ে কাঠের চেয়ারটা এনে উঠোনের রোদে পেতে দিল। রসিক বাঙাল কোলের মেয়েটাকে উঠোনে হামা দিতে ছেড়ে দিয়ে বলল, খেজুরের রস খাইবেন খুড়া?

কিছু খেতেই আপত্তি নেই ধীরেনের। এই বয়সে নাকি খাওয়া-দাওয়ার কাটছাঁট করে লোকে। তারা নমস্য মানুষ। ধীরেনের কাটছাঁট করার কিছু নেই। খিদে সেই যে খাপ পেতে বসে থাকে পেটের মধ্যে, সারাদিন তার নট নড়ন, নট চড়ন। তবু লাজুক মুখে বলে, তা খেতে পারি একটু।

কই রে, খেজুর রসের পাতিলটা লইয়া আয় দেখি। দেইখেন, ঘৎ কইরা গিল্যা ফালাইয়েন না। সারা রাইত গাছে ঝুইল্যা পাতিল এক্কেবারে ঠান্ডা কাল হইয়া আছে।

এক মুনিশ রসের হাঁড়ি নিয়ে এল।

দু গেলাস চোঁ চোঁ করে মেরে দিল ধীরেন। বুক পেট যেন জুড়িয়ে গেল একেবারে। হ্যাঁ, ঠান্ডা বটে। গলায় আর বুকে যেন চিড়িক মেরে গেল। তা হোক, ধীরেনের এতে কিছু হবে না।

.

হাম্মি হামা দিয়ে তকতকে উঠোনে খানিক দূর যায়, আবার ফিরে এসে বাঙালের হাঁটু ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। ওই যে ঝুব্দুস চেহারার একটা লোকের সঙ্গে তার বাবা কথা কইছে এটা তার পছন্দ নয়। লোকটা মাঝে মাঝে তাকে একটু আদর করার চেষ্টা করে। হাম্মি তাতে মোটেই খুশি হয় না। ছিটকে সরে যায়।

কাজের মেয়েরা উঠোনে চাটাই পেতে লেপ, কম্বল-বালিশ রোদে দিচ্ছে। হাম্মি গিয়ে ছড়ানো একটা লেপের ওপর উঠে বসল।

রান্নাঘর থেকে বাসন্তী চেঁচিয়ে বলল, ওরে, মুতে দেবে লেপের ওপর। হাম্মিকে নামা।

 রসিক হাঁ-হাঁ করে ওঠে, আহা, মুতুক, মুতুক। অর মুত তো গঙ্গাজল।

আহা, কীসব কথা। মা গঙ্গার অভক্তি হয় না বুঝি?

 বাঙাল দরাজ একখানা হাসি হেসে বলে, তোমাগো গঙ্গার কথা আর কইও না গো, নিত্যি তিরিশদিন মাইনষে গুয়েমুতে গঙ্গারে নান্দিভাস্যি করতাছে। হাম্মির মুত আর কী দোষ করল?

ওসব কথা বলতে নেই। পাপ হয়।

 দক্ষিণের বারান্দায় চারজন মুনিশ খেতে বসেছে। কোনও দিন ভাত, কোনও দিন মুড়ি। আজ মুড়ি। কাজের মেয়ে শীতলা ধামা ভর্তি মুড়ি নিয়ে এল ভাঁড়ারঘর থেকে। অ্যালুমিনিয়ামের থালায় ঢেলে দিচ্ছে দেদার পরিমাণে। মুনিশদের পাশে ঘটি ভর্তি জল। মুড়ি পাতে পড়তেই দু মুঠো মুখসই করে ঘটির জল ঘিঁচে মেরে মুড়ি নরম করে ফেলতে লাগল।

বাসন্তী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, আজ তরকারি পুড়ে গেছে গো বাবারা, গরম চপ আনিয়েছি বটতলা থেকে, পেঁয়াজ লঙ্কা দিয়ে খেয়ে নাও আজ।

বুড়ো মুনিশ হারাধন একগাল হেসে বলল, চপ কি কিছু খারাপ জিনিস মা? ও মেরে দেবোখন, চিন্তা কোরো না। পোড়া তরকারি থাকলে তাও একটু দিও। আমাদের সব চলে।

না বাবা, সে খাওয়ার জো নেই। পুড়ে ঝামা।

গরম চপ পাতে পড়তেই তা ভেঙে মিয়োন মুড়ির সঙ্গে মেখে নিতে লাগল মুনিশেরা। সঙ্গে পেঁয়াজ আর লঙ্কা।

এই দৃশ্য চোখ গোল করে মুগ্ধ হয়ে দেখে ধীরেন। মানুষ খাচ্ছে, এর চেয়ে ভাল ঘটনা আর কী হতে পারে তা তার মাথায় আসে না। পরিপাটি করে খাচ্ছে, তৃপ্তি করে খাচ্ছে, ভগবান যেন সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন।

হঃ হঃ করে খুব হাসে ধীরেন। তার ভিতর থেকে আনন্দ যেন উথলে আসতে থাকে। ছোটখাটো এরকম কত ঘটনাই ঘটে যাচ্ছে দুনিয়াতে। দেখার লোক নেই, চোখ নেই। এইসব ঘটনার ভিতরেও কত রস, কত সৌন্দর্য। একেবারে টইটম্বুর।

বাবার এই উঠোনে বসে থাকাটা মোটেই ভাল চোখে দেখছে না মরণ। সামনে পড়ার বই খোলা রেখে সে হাঁ করে বসে বাইরেটা দেখছে। ওই বাইরেটা তাকে খুব ডাকাডাকি করে সবসময়ে। কিন্তু উঠোনে জ্যান্ত বাঘ বসা। কী করে বেরোবে সে?

তার পড়ার ঘরের পিছনেই রান্নাঘর। আজ মায়ে আর জিজিবুড়িতে খুব একচোট হয়েছে, তা অবশ্য প্রায়ই হয়। জিজিবুড়িকে কতবার মা বের করে দিয়েছে, আবার জিজিবুড়িও শাপশাপান্ত করতে করতে এ-বাড়িতে কোনওদিন আসবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে চলে গেছে এবং ফের পরদিন এসেছে। সুতরাং সেজন্য চিন্তিত নয় মরণ, যেটা চিন্তার কথা সেটা হল মা আজ খুব কেঁদেছে। সহজে কাঁদে না তো মা!

ওই দাদা নামছে দোতলা থেকে! দাদাকে দেখলেই একটা আশাভরসা হয় মরণের। দাদাকে কেউ শাসন করে না। বাবা অবধি যেন সমঝে চলে। মরণ জানে সে যখন দাদার মতো বড় হবে তখন তাকেও সবাই খাতির করবে। এমনকী বাবাও। সেই দিনটা যে কবে আসবে তারই প্রহর গোনে মরণ।

সুমন দক্ষিণের বারান্দার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মুনিশদের খাওয়া দেখতে দেখতে বলে, তোমরা বুঝি মুড়ি জলে ভিজিয়ে খাও?

বুড়ো মুনিশ একগাল হেসে বলে, হ বাবা, মুড়ি ভিজিয়ে নিলে ও ভাতের সমান।

আরও বড় এক ধামা মুড়ি নিয়ে এল শীতলা। চুড়ো করে ঢেলে দিল পাতে পাতে। সঙ্গে চপ।

সবাই কথা থামিয়ে চারটে লোকের খাওয়া দেখছে।

রসিক ভারী আহ্লাদের গলায় বলল, খাও হে, ভাল কইর‍্যা খাও।

বুড়ো মুনিশ শীতলার দিকে চেয়ে বলে, আরও দুধামা নিয়ে এসো তো। ওরে, তোরা থামিস না। বাবুরা দেখছে।

তা খেলও মুড়ি চারজনে। অবিশ্বাস্য। জল মেরে মেরে মুড়ি ভিজিয়ে চপ দিয়ে এক একজন মুড়ির গন্ধমাদন তুলে ফেলল। বাসন্তীর তরকারিও নেমে গেছে। তাই শেষ পাতে মুলো-পালং-বেগুনবাড়ির চচ্চড়িও দু হাতা করে জুটে গেল তাদের।

রসিক বাঙাল হেসে বলে, মাল অন্যের হইলে কী হইব, নৌকা তত তোমাগর। এই যে ঠাইস্যা খাইলা, শ্যাষে ক্ষ্যাতের কামে গিয়া গাছতলায় গামছা পাইত্যা ঘুমাইবা না তো!

বুড়ো মুনিশ বলে, না কর্তা, মুড়ি হালকা জিনিস, নেমে যাবে। খোরাকটা একটু দেখিয়ে রাখলাম আর কী।

ভাল ভাল।

চারদিকে সম্পন্নতার চেহারাটা দুচোখ ভরে দেখছিল ধীরেন কাষ্ঠ। চারদিকে লক্ষ্মীর অদৃশ্য পায়ের ছাপ। সম্পদ উথলে উঠছে। ভারী খুশি-খুশি ভাব সকলের মুখে। নাঃ, বাঙালের বাড়িতে মনটা ভাল হয়ে যায়।

দুখানা করে গরম ধোঁয়া ওঠা রুটি আর গরম চচ্চড়ির এক খাবলা। স্টিলের রেকাবে সাজিয়ে নিয়ে এল বাসন্তী।

ধীরেন খুড়ো, এই নিন।

ধীরেন খুশিতে লজ্জায় গলে গিয়ে বলে, দিলি আমাকে?

ওমা! দেবো না কেন? আমরা তো রান্নায় একটু মিষ্টি খাই, কিন্তু ওঁরা পছন্দ করেন না। তাই চচ্চড়ির হয়তো স্বাদ পাবেন না।

হ্যাঁ, ধীরেন শুনেছে বটে, বাঙালরা রান্নায় চিনি বা গুড় দেওয়া পছন্দ করে না। তাতে রান্নাটা একটু তাহা-তাহা লাগে বটে, কিন্তু ধীরেনের বাছাবাছি নেই। আজকাল তার সবই অমৃত বলে মনে হয়। একটু ধনেপাতা ছড়ানো চচ্চড়িটার দিব্যি বাস বেরিয়েছে।

কী খুড়া, কেমন খান?

আহা, বড় চমৎকার স্বাদ হয়েছে।

সুমন মরণের জানালাটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বলল, পড়ছিস না হাঁ করে তাকিয়ে আছিস?

মরণ এক গাল হেসে বলে, বাইরে আসব দাদা?

আয়।

বাবা বকবে না তো!

না বোধহয়। মুড ভাল আছে। আয়।

 মরণ এক লম্ফে বেরিয়ে এল।

ঠিক তক্ষুনি বাঁশের আগল ঠেলে হিমি এসে ঢুকল। হাতে উলের কাটা। সুমনের দিকে চোখ হেনে মুচকি একটু হেসে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ল। সুমন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। গাঁয়ের মেয়েগুলো বড্ড বোকা হয়।

.

২৩.

গরম ডাইল নাই? গরম ডাইল?

রান্নাঘরের দরজায় এসে বাসন্তী বলে, ডাল ফুটছে। দেব?

আরে আমারে না। খুড়ারে এক বাটি দ্যাও।

এখনও ভাল সেদ্ধ হয়নি যে, ফোড়ন দিতে দেরি হবে।

আরে ফোড়নের কাম কী? এক খাবলা ঘি ঢাইল্যা দিলেই হয়।

ধীরেন কাষ্ঠ আহ্লাদে হাসল। গরম ডালে ঘি হল অমৃত। স্বর্গীয় জিনিস। কিন্তু মুখে ভদ্রতা করতে হয় বলে বলল, না না, এই তো চচ্চড়ি দিয়েই বেশ খাচ্ছি।

রসিক বলে, আরে একটু ডাইলই তো। লজ্জা পান ক্যান? ডাইলটা খুব খাইবেন। ডাইলের মইধ্যে মেলা ভিটামিন আর প্রোটিন।

কথা থামিয়ে রান্নাঘরের দিকে চেয়ে আবার হাঁক মারে রসিক, আগো, আইজ কী ডাইল রানতে আছ?

বাসন্তী বলল, মুসুরি।

তা হইলে তো কথাই নাই। মুসুরি হইল ডাইলের রাজা। ফুটার ডাইল খাইতেও চমৎকার।

 ধীরেন কাষ্ঠ খুব হাসে, বাঙাল হল রাজা লোক। এমন দরাজ দিল এ তল্লাটে কখনও দেখেনি ধীরেন। বাঙাল দেশটা কেমন সেটা ভাল জানে না ধীরেন। তবে শুনেছে, সেটা প্রায় মগের মুলুক। বানভাসি, জলকাদার দেশ। সেখানকার লোকগুলো একটু কাটখোট্টা বটে, কিন্তু মনটি খুব সরেস।

বাঙাল দেশে ভাগ্যান্বেষণে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল ধীরেনের। মিদ্দার মরার পর যখন তার আগল পাগল অবস্থা, ঘরে-বাইরে কোথাও শান্তি নেই, বুকের ভিতর সর্বদা হুহু করে মনস্তাপ তখনকার কথা। কাটোয়ায় কিছুদিন আত্মীয়বাড়িতে গিয়ে পালিয়ে ছিল সে। কিন্তু সেটা তো আর পাকা ব্যবস্থা নয়। একদিন ফিরে আসতে হল দেশে। এসে বুঝল, পুলিশের ঝাট কিছু হয়নি। কেউ তার খোঁজখবর বা তল্লাশেও আসেনি। মোটপর মিদ্দার আর তার বউয়ের সঙ্গে তাকে জড়ায়নি কেউ। বুকটার ধুকুর-পুকুর কমল বটে, কিন্তু মাথাটা কেমন পাগল-পাগল হয়ে রইল। নিজের বাড়ি, নিজের গাঁ ভাল লাগছিল না তখন।

মদন সামন্ত বন্ধু তোক। নানারকম ব্যবসা করতে গিয়ে বারবার মার খাচ্ছে। পুঁজিও বেশি ছিল না। মদন তখন বাঙাল দেশে যাতায়াত করছে। সে বলেছিল, ভাবছি ওদিকেই গেড়ে বসব। কিছু জমি কিনতে পারলে না খেয়ে মরার ভয় নেই।

ধীরেন ধরে পড়ল, আমাকেও নিয়ে চল তাহলে।

 তুই গিয়ে কী করবি?

যা হোক কিছু করা যাবে। শুনেছি ওটা অন্যরকম দেশ।

তা বটে। কিন্তু গিয়ে হাজির হলেই তো হবে না। আগে থেকে কিছু একটা ভেবেচিন্তে যাওয়া ভাল।

 বাঙাল দেশটা দুধ-ভাতের দেশ বলে একটা আবছা কল্পনা ছিল বটে তার। সেটা যে মিথ্যে স্বপ্ন তাও সে বুঝতে পারত। তবু মন দুর্বল হয়ে পড়েছিল বড়। ভেবেছিল, নতুন জায়গায় গেলে কাজকর্ম জুটে যাবে, মাথার পাগল ভাবটাও ঠান্ডা হবে।

মদনের বাড়িতে তখন খুব যাতায়াত। ঘন ঘন মিটিং হচ্ছে দুজনের। কাজের কথা কিছু হত না, আগডুম বাগড়ম নানা ফন্দি আঁটত দুজনে। কারও মাথায় তেমন ঘি ছিল না তো। শুধু কল্পনা ছিল খুব।

তবে মদন চাষবাস-বোঝা মানুষ। বলত, দিনে চাষবাস করব, রাতে নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে বেরোব। সেখানে জাল ফেললেই মাছ।

কিন্তু কোথায় শেকড় গাড়বি তা কিছু ঠিক করেছিস?

নাঃ। তবে টাঙ্গাইল জায়গাটা আমার বেশ পছন্দ। সেখানে আমার দাদার এক সম্বন্ধী আছে। বিষয়ী লোক। বলেছে, গেলে ব্যবস্থা করে দেবে।

আমার জন্যে করবে না?

গিয়ে দেখতে পারিস।

তখন ধীরেনের উড়ুউড়ু অবস্থা। যে-কোনও শর্তেই তখন সে এ-দেশ ছাড়তে রাজি। কিছু টাকাপয়সাও জোগাড় করে ফেলল সে। গাড়িভাড়া আর দু-দশ দিনের খরচ তো কিছু আছেই। তারপর মদনকে তাগাদার পর তাগাদা দিতে লাগল।

প্রথম প্রথম মদনের উৎসাহ ছিল খুব। কিন্তু তারপর হঠাৎই একদিন ভারী লাজুক মুখ করে বলল, ওরে একটু অসুবিধে দেখা দিয়েছে।

কী অসুবিধে?

একটু বাধক হচ্ছে। একজন যেতে দিচ্ছে না।

এ কথায় মাথায় বাজ পড়ল ধীরেনের। দেহটা এখানে পড়ে থাকলেও তার মন বাঙাল দেশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। নানা ছবি ভেসে উঠছে চোখের সামনে। রূপকথার দেশের মতো। সেখানে গিয়ে পড়লেই। হয়, সব সমস্যার সমাধান। ভাত কাপড়, মিদ্দারের ভূত, কপালের ফের, কিছুটি আর নাগাল পাবে না তার।

সে মদনের চোখে চোখ রাখতে গিয়ে দেখল মদনের চোখ পিছলে সরে যাচ্ছে। সেখানে অন্য ব্যাপার।

সে বলল, কে তোকে বারণ করল রে? জ্যোতিষ নাকি?

আরে না। আছে একজন।

খোলসা করে বল। আমাকে এত নাচালি, এখন তুই পিছোলে আমার যে অগাধ জল।

না না, তুই বরং একাই যা। আমি দাদার সম্বন্ধীকে একটা হাতচিঠি লিখে দিচ্ছি।

 ভয় পেয়ে ধীরেন বলে, হাতচিঠি দিয়ে কী হবে! ওসবের কোনও দাম নেই। সম্পর্কই বা কী বল। তোর দাদার সম্বন্ধী মানে তো মামার গোয়ালে বিয়োনো গাই। তোর আটকাচ্ছে কোথায়?

মদন ভারি অস্বস্তিতে পড়ে বলে, সে একটা কাণ্ডই হয়েছে।

কী কাণ্ড।

 দাদার সম্বন্ধীর ব্যাপারে কয়েকদিন দাদার শ্বশুরবাড়ি মুকুন্দপুরে যাতায়াত করতে হয়েছিল তো!

সে খুব জানি। তুই তো প্রায়ই মুকুন্দপুরে যাস।

হ্যাঁ, সেই কথাই তো। যাতায়াত করতে করতে দাদার ছোট শালি মিনতির সঙ্গে ভারী চেনাজানা হয়ে গেছে। ওই করতে করতে যা হয়। দাদার শাউড়িরও আমাকে ভারী পছন্দ।

তাই বল! আশনাই।

 তা একরকম ভাই। মুশকিল কী জানিস, ওদেশে যাব শুনে মিনতি ভারী আপত্তি করছে।

কেন, আপত্তিটা কীসের?

সে এ-জায়গা ছেড়ে যাবে না।

বিয়ে করলেও না?

তাই তো বলছে। মিনতির বাবাও বলছে, আমার ছেলে ওদেশে আছে বটে বাপু, কিন্তু আমি সেটা ভাল বলে মনে করি না। ও না যাওয়াই ভাল।

তুই মেনে নিলি?

কাঁদে যে!

খুবই হতাশ হয়ে পড়েছিল ধীরেন।

তার চোখের সামনেই কয়েক মাসের মধ্যে মদন মিনতিকে বিয়ে করে দিব্যি মুকুন্দপুরে গিয়ে বসবাস করতে লাগল।

ধীরেন তবু তক্কে তক্কে ছিল। বাঙাল দেশ না হোক, দুনিয়াটা তো আর ছোট জায়গা নয়। কোথাও না কোথাও চলে গেলেই হল। চলে যাওয়ার ইচ্ছেটা তখন তাকে ভূতের মতো পেয়ে বসেছে। কাউকে ভাল লাগে না, কিছু ভাল লাগে না।

কয়েকজন বন্ধু মানুষের সঙ্গে পৌষের মেলায় হরিহরপুরে গিয়েছিল সে। মাইল দশেক রাস্তা। মেলায় গিয়ে বন্ধুরা সব তাসের জুয়া খেলতে বসে গেল। হরিহরপুরের মেলায় ওইটের খুব চল। ধীরেনের পয়সা নেই, আগ্রহও ছিল না। সে মেলায় ঘুরে ঘুরে বেড়াল খানিক। বেশ জম্পেশ মেলা। ধীরেন দেখতে আর শুনতে বড্ড ভালবাসে। চোখের খোরাক কিছু কম ছিল না সেখানে। জামাকাপড় থেকে শুরু করে খেলনাপাতি। নাগরদোলা থেকে নিয়ে পাঁপড়ভাজা সবই তার কাছে দেখার বস্তু।

দেখতে দেখতেই সে এক ব্যাপারির দোকানে মোমের পুতুল দেখতে দাঁড়িয়ে পড়ল। ছোট, বড় নানা মাপের নানা গড়নের পুতুল। পুতুলে আবার সলতে লাগানো আছে। ইচ্ছে করলে মোমবাতি হিসেবে জ্বালানোও যায়। কে জানে ধীরেনের ভিতরে হয়তো একটু শিল্পবোধও আছে। শিল্পকর্ম দেখতে সে বেশ ভালবাসে। সে দোকানির সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলল। সে মা কালীর দিব্যি কেটে বলতে পারে, দোকানির সঙ্গে যে কিশোরী মেয়েটি টালুক-টুলুক চারদিকে চাইছিল আর টোপাকুল খাচ্ছিল টুলে বসে তার দিকে একবারের বেশি দুবার তাকায়নি সে।

একথা সে কথার পর সে জানল, দোকানির বাড়ি নদীয়ার গাঁয়ে। সে ভালমানুষের মতো জিজ্ঞেস করল, ওদিকটায় কিছু সুবিধে-টুবিধে হয়?

কীসের সুবিধে বাপু? এদিকও যেমন ওদিকও তেমন।

তা বটে, তবে ইদিকে আমার সুবিধে হচ্ছে না। বাঙাল দেশে চলে যাব ভেবেছিলাম, তাও হল না। এখন ভাবছি জয় মা বলে যেদিকে দু চোখ যায় রওনা হয়ে পড়ি।

দোকানি হেসে বলে, তা বাপু, অনেক সময় জায়গার গুণেও কিছু হয়ে পড়ে বইকী। আমার বয়স তো এত হল, অভিজ্ঞতাও কম হল না। মনে হয় কোনও কোনও মানুষের কোনও কোনও জায়গা সহ্য হয় না। অন্য জায়গায় গেলে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়।

ধীরেন আশান্বিত হয়ে বলে, আমারও সেরকমই মনে হয়।

তা নদীয়ায় গিয়েও দেখতে পার। বা অন্য কোথাও। তবে বাপু, তাতে হয়রানি বাড়বে। ঘরের খেয়ে লড়াই করা যায়, অন্য জায়গায় গিয়ে আতান্তরে পড়ে গেলে পারবে কি?

টুকটাক পুতুল বিক্রি হচ্ছিল মন্দ নয়। মেয়েটাই বিক্রিবাটা করে পয়সা গুনে নিচ্ছে। বছর পনেরো ষোলো বয়স, ফ্রক পরা, গায়ে লাল সোয়েটার, দুই বিনুনি ঝুলছে।

ওটা আমার মেয়ে। খুব বাপক্যাংলা। যেখানে যাই সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। তা বাপু, কী করা হয় টয়?

অনেক কিছুই করে দেখেছি। কিছু তেমন হচ্ছে না।

চাষবাস আছে?

আছে। সামান্য। পেটের ভাতটুকু জোটে।

 কারবারে নামতে চাও নাকি?

 সে তো খুব ইচ্ছে যায়। কিন্তু টাকা কোথায়?

সেই তো কথা।

এইভাবে আলাপ বেশ জমে গেল।  

সন্ধের পর দোকানি হ্যাজাক জ্বেলে দিল, ধূপ-ধুনো লাগাল, হ্যাঁজাকের আলোয় মেয়েটা যেন হঠাৎ করে ফুটে উঠল। বিকেলের মরা আলোয় তেমন দেখায়নি, এই আলোতে দিব্যি দেখাচ্ছিল। যেন বহুরূপী।

দেখতে ভালবাসে ধীরেন। আর মেয়েটাও ঘন ঘন তাকাতে লাগল তার দিকে। এইভাবেই সব হয়-টয় আর কী।

দোকানির নাম বৃন্দাবন পাল। বলল, মেলার কয়েকদিন আছি। ইদিকে এলে দেখা করে যেও। গল্প টল্প করা যাবে।

একদিন ফাঁক দিয়ে গেলও ধীরেন। মেয়েটার হ্যাঁজাকের আলোয় দেখা মুখখানা দুদিন ভুলতে পারেনি। হ্যাজাক বাতির কী জাদু আছে কে জানে!

গিয়ে দেখল, দোকানি সওদা করতে গেছে। মেয়েটা একা দোকান সামলাচ্ছে। মেলার শেষ দিন ছিল সেটা। দোকানে বেশ ভিড়। রমরম করে মোমের পুতুল বিকিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা সামাল দিতে পারছে না। বয়সের মেয়ে দেখে বখাটে ছেলে-ছোকরাও জুটেছিল কয়েকটা।

তা ধীরেনের তখন বেশ শক্ত জোয়ান চেহারা। গায়ের জোরও ছিল মন্দ নয়। সে গিয়ে মেয়েটার পাশে দাঁড়িয়ে যেতেই ভিড়টা একটু একটু করে পাতলা হল।

মেয়েটা কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, কতগুলো পুতুল চুরি হয়ে গেছে, জান! চোখের সামনেই পটাপট তুলে নিয়ে গেল। যেই বললুম, দাম দিলে না যে, অমনি বলে, দিয়েছি তো! এই তো গুনে নিলে!

ইস, আমি একটু আগে এলেই হত।

ভাগ্যিস এলে, নইলে এতক্ষণে সব লুটপাট হয়ে যেত।

মেয়েটাকে ভাল করে দেখল ধীরেন। তখনও দিনের আলো আছে, হ্যাজাক জ্বলেনি। তবু বেশ লেগেছিল দেখতে। ডাগর ফর্সা চেহারা, চোখ দুখানা মিঠে তাতে তখনও রাগ-অভিমান-ভয় মেশানো চাউনি। একটু জলও চিকচিক করছিল চোখে।

ধীরেন ভরসা দিয়ে বলল, আর ভয় নেই। আমি আছি কিছু হবে না।

অবলা নারীকে রক্ষা করা চিরকালই সবল পুরুষের কর্তব্য। মেয়েটা তার দিকে চেয়ে বলল, রোজই ছেলেগুলো আসে, বাবা থাকলে বেশি কিছু করে না। আজ আমাকে একা পেয়ে

ওরা পাজি ছেলে।

 ভীষণ পাজি। কী সব অসভ্য অসভ্য কথা বলছিল শুনিয়ে শুনিয়ে।

 তুমি বুঝি সব সময়ে বাবার সঙ্গে থাকো?

না। মাঝে মাঝে। আজকাল মা ছাড়তে চায় না। বড় হচ্ছি তো!

 ও, তাও তো বটে।

বাবার একজন কর্মচারী আছে। সব জায়গায় সে বাবার সঙ্গে থাকে। এবার অসুখ করেছে বলে আসেনি।

বড্ড সরল মেয়েটা, নিজের থেকেই অনেক কথা বলে যাচ্ছিল। খুব মন দিয়ে শুনছিল ধীরেন।

বাড়িতে তোমার কে কে আছে?

মা বাবা দিদি, ছোট দুই ভাই, দাদু আর ঠাকুমা।

 ইস্কুলে পড় না?

 হ্যাঁ, পড়ি তো। ক্লাস সিক্স-এ।

বাবা বুঝি শুধুই পুতুল গড়েন?

পুতুল আমরা সবাই গড়ি। খুব সোজা। মোম গলিয়ে ছাঁচে ফেলতে হয়। গাঁয়ে আমাদের মুদির দোকানও আছে একটা।

তাহলে তো তোমাদের অবস্থা ভালই।

ওই একরকম।

জমিজমা নেই?

হ্যাঁ, তাও আছে।

গোরু বাছুর?

 দুটো দুধেল গাই।

পাকা ঘর?

হ্যাঁ।

তাহলে তো তোমরা বড়লোক।

মেয়েটা লাজুক হেসে বলে, না, না, তা কেন? আমাদের গাঁয়ে বড়লোক হল রায়বাবুরা, মুখার্জিবাবু আর সরকারবাবুরা। তাদের অনেক কিছু আছে।

কী আছে তাদের?

রায়বাবুরা তো খুব বড়লোক। মেলা জমিজমা।

আচ্ছা তোমাদের তো বেশ ভাল অবস্থা, তাহলে তোমার বাবা পুতুল বিক্রি করে কেন?

 ওটা বাবার শখ। আমার দাদুর মোমের পুতুলের ব্যবসা ছিল। দাদু এখনও ছাঁচ তৈরি করে দেয়।

প্রায় সন্ধের মুখে বৃন্দাবন ফিরল।

এই যে ধীরেন, এসেছ? আমার একটু দেরি হল।

সঙ্গের দু ব্যাগ মালপত্র নামিয়ে ক্লান্ত বৃন্দাবন একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, কালই চলে যাচ্ছি।

 হ্যাঁ, আজই তো মেলা শেষ।

 তা বাপু, তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল।

বলুন।

 কথাটা একটু আবডালে বলতে হবে।

কয়েক পা তফাত হয়ে মেয়ে যাতে শুনতে না পায় এমন দূরত্বে এসে বৃন্দাবন বিনা ভণিতায় বলে ফেলল, বাপু হে, আমার বয়স হচ্ছে, এই মোম দিয়ে পুতুল বানানোর কারবারে আমার আর পোষাচ্ছেও না।

ও। তাহলে কি ব্যবসাটা তুলে দেবেন?

 তুলে দিতেও মায়া হয়।

 তাহলে?

উপযুক্ত কাউকে পেলে বিদ্যেটা শিখিয়ে ব্যবসা তার হাতে তুলে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হতাম।

সে তো ভাল প্রস্তাব।

তোমাকে আমার খুব পছন্দ।

আমাকে! কিন্তু আমাকে দিয়ে কি হবে?

খুব হবে। ব্যবসাটা খারাপও নয়। খাটাতে পারলে স্বচ্ছন্দে পেট চালাতে পারবে। আমিও সাহায্য করব।

ভেবে দেখি।

ও রে বাপু, ভাবতে বসলে আর কাজ হবে না। আগু-পিছু করতে থাকবে।

 বন্দোবস্তটা কী রকম হবে?

 বন্দোবস্তটস্ত কিছু নেই। সোজাসুজিই বলছি মেয়ে আমার ফ্যালনা নয়।

মেয়ে!

হ্যাঁ। আমার বড় মেয়ে মালতীর কথাই বলছি। এই যে মিনতিকে দেখছ এর চেয়ে দুগুণ সুন্দর দেখতে, আরও ফর্সা। যদি বিয়ে করো তাহলে সব দিক রক্ষে হয়।

বিয়ে! ভ্রূ কুঁচকে খানিক বিয়ে নিয়ে খুব ভাবল ধীরেন। গাঁগঞ্জ জায়গা। লোকে কিছু করার না থাকলে পট করে বিয়ে বসে যায়। ধীরেনের তখনও বিয়ে হয়নি, নানা গণ্ডগোলে মাথায় আসেওনি কথাটা। তবে প্রস্তাবটা পেয়ে তার মনে হল, বিয়ে করলেও হয়তো মনটা অন্য দিকে ঘুরে যেতে পারে। যে কারণে বাঙাল দেশে পালাতে চেয়েছিল সেই একই কারণে বিয়েও করা যেতে পারে। প্রস্তাবটা মন্দ নয়।

ওহে বাপু, বেশি ভেবো না। ভাবনাচিন্তা বড় কর্মনাশা। তাতে জীবনে ওই আগু-পিছু চলে আসে। ওতে কাজ ভণ্ডুল হয়।

একটু ভাবতে তো দেবেন মশাই। মাথার ওপর মা-বাবাও আছেন।

শোনো বাপু, মোমের কারবারে আমার পাঁচ হাজার টাকা খাটছে। যদি পুরো ব্যবসাটাই তোমাকে দিই তাহলে বড় কম পাচ্ছ না। হিল্লে হয়ে গেল বলেই ধরে নিতে পারো। আর এ যা মোমবাতি দেখছ এগুলোই তো নয়, আমি গির্জায় সাহেবরা যে মোম জ্বালে তাও বানাই। ব্যবসা ধরে রাখতে পারলে লুটেপুটে খেতে পারবে।

দাঁড়ান, মা-বাবাকে আগে গিয়ে বলি।

তুমি রাজি তো!

পট করে কী যে বলি!

মোটপর তোমার অমত নেই। কাল সকালে দোকান গুটিয়ে আমি প্রথম তোমার বাড়িতে যাব। তোমার মা বাবাকে রাজি করিয়ে তবে দেশে ফিরব।

বৃন্দাবন যে কী দেখে তাকে পছন্দ করেছিল কে জানে! দুনিয়ায় কত আহাম্মকই থাকে। ধীরেনের বাবার অবস্থা যে খুব খারাপ ছিল তা নয়। তবে জমিজমার ওপর নির্ভর। নগদ টাকার বিশেষ টানাটানি। একটা পেট বাড়লে খুব ইতরবিশেষ হবে না বটে, কিন্তু নতুন বউয়ের সুখেরও বিশেষ কারণ ঘটবে না। তার ওপর পয়সাওলা ঘর থেকে আসবে।

ধীরেনের দুশ্চিন্তা একটু হচ্ছিল বইকী।

ওই ভাবনাচিন্তার মধ্যেই প্রস্তাব চালাচালি হয়ে গেল। খারাপ প্রস্তাবও তো নয়। মুষলের মতো একটা ছেলে ঘরে বসে বাপের অন্ন ধ্বংস করছে, শ্বশুর যদি হিল্লে করে দেয় তো ভালই।

তা হয়েও গেল বিয়ে।

মালতী দেখতে কিছু খারাপ নয়। রং ফর্সার দিকেই। নাকটা একটু থ্যাবড়া না হলে আরও ভাল হত।

বিয়ের রাতেই মালতী জিজ্ঞেস করেছিল, মদগাঁজার নেশা নেই তো!

না, আমার নেশা নেই। থাকলে কি তোমার বাপ বিয়ে দিত আমার সঙ্গে?

বাবা কি সব খবর নিয়েছে?

নেশা থাকলে কী করবে?

 নেশারু লোক আমি সইতে পারি না। নেশা দেখলে বাপের বাড়ি চলে যাব।

কথাটা বিয়ের আগে জানতে চাইলে ভাল করতে।

বিয়ের আগে মেয়েদের কিছু জানতে দেওয়া হয় নাকি? পুঁটুলি পাকিয়ে এনে ফেলা হয় ছাঁদনাতলায়।

ও বাবাঃ! তুমি যে বেশ কটর কটর কথা কও।

 হ্যাঁ, আমার সব পষ্টাপষ্টি কথা।

জ্বালাবে দেখছি! ফুলশয্যার রাতেই এত স্পষ্ট কথা!

সব জেনেবুঝে নেওয়া ভাল।

 আর কী জানতে চাও?

 মেয়েমানুষের দোষ নেই তো!

থাকলে?

 থাকলে মুশকিল হবে।

 ধীরেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বউকে তার ভারী অপছন্দ হতে লাগল প্রথম থেকেই।

সে বলল, দোষঘাট কোন মানুষের না থাকে বলল! মেয়ে পুরুষ সবার থাকে।

তার মানে আছে।

 আমি কি তাই বললুম?

তাহলে পষ্ট করে বললে না কেন যে তোমার মেয়েছেলের দোষ নেই?

 বললেই তুমি মেনে নেবে?

বলেই দেখ না!

শোনো মালতী, আমার একটা মানসম্মান আছে। পায়ে ধরে সেধে তো বিয়ে করে আনিনি। তুমি যদি অতই সতী তবে বাপকে বললে না কেন বিয়ের আগে খোঁজখবর নিতে!

বলেছি। বাবা পাত্তা দেয়নি। কোন মেলায় তোমাকে দেখেই বাবার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল।

সেখানে তোমার বোন মিনতিও ছিল।

 মিনতি ছেলেমানুষ, সে কী বুঝবে?

তাহলে এখন আর বোঝার কিছু নেই। আমি মাতাল বা চরিত্রহীন যাই হই, তোমার স্বামী।

 ওটাই কি তোমার জোর? স্বামী বলেই মাথা কিনে নিয়েছ?

আমি কিনতে যাইনি। তোমার বাবা গছিয়েছে। তুমি একটি গেছে মেয়েছেলে।

ফুলশয্যার রাত্রিটা ঝগড়া করেই কেটেছিল দুজনের। আদর সোহাগের নামগন্ধ ছিল না।

তবে একথা সত্যি যে মেয়েদের গতিই বা আর কী। সে আমলে স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ার হিম্মৎই বা কটা মেয়ের ছিল?

সুতরাং মালতীর সঙ্গে তার ভাবও হল দু-চারদিন পরে। গৃহত্যাগ করার ইচ্ছেটাও ধামাচাপা পড়ে গেল।

ধীরেন ভাবে বৃন্দাবন হঠাৎ উদয় না হলে তার জীবনটা অন্য খাতে বইতে পারত। গৃহত্যাগ করে সে হয়তো একদিন এক কেবিন্ধু হয়েই ফিরে আসত। এরকম তো কতই হয়।

এতকাল নানা ঝড়ঝাপটা সয়েও মালতীও আছে, সেও আছে, ছেলেপুলেও আছে। তবে সব মিলিয়ে ভাল কিছু হয়ে উঠল না।

এক বাটি ধোঁয়া ওঠা গরম ডাল একটা স্টিলের প্লেটে বসিয়ে নিজেই নিয়ে এল বাসন্তী। হলুদ ডালের ওপর অনেকটা ঘিয়ের দলা ভেসে আছে।

হেঃ হেঃ করে হেসে ধীরেন বলে, ওঃ গন্ধটা যা ছেড়েছে।

 খান খুড়া, খান। আগো, আরও দুইখান রুটি দাও খুড়ারে। খুড়া খাইতে ভালবাসে।

আরে না না, রুটি তো আছে।

আরে, লজ্জা কীসের? পেট ভইরা খান।

ধীরেনকে আর বলতে হল না।

উঠোনের ওধারে সুমন চাপা স্বরে মরণকে জিজ্ঞেস করে, লোকটা কে রে?

ও হল কাষ্ঠ জ্যাঠামশাই। রাস্তায় ঘাটে আমরা ওকে ক্ষ্যাপাই।

 পাগল নাকি?

কী জানি।

 তবে ক্ষ্যাপাস কেন?

একটু কেমন যেন। ছেঁড়া ময়লা জামাকাপড় পরে ঘোরে। একটু লোভী আছে।

এখানে আসে কেন?

 বাড়িতে খেতে পায় না তো। গরিব।

 খুব গরিব?

তা জানি না। কাষ্ঠ জ্যাঠামশাইকে কেউ পাত্তা দেয় না।

 হ্যাঁ রে, বাবা ওকে কাকা ডাকে, তুই তাহলে জ্যাঠা ডাকিস কেন?

 কাঁচুমাচু হয়ে মরণ বলে, সবাই ডাকে বলে আমিও ডাকি। ডাকের খুব গোলমাল এখানে।

হঠাৎ হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া সুমনের একটা স্বভাব। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল বেভুল হয়ে। তারপর বলল, চল বেড়িয়ে আসি।

দাঁড়াও, মাকে বলে আসি।

সুমন হঠাৎ একটু গম্ভীর মুখ করে বলে, আমিও কিন্তু তোর একজন গার্জিয়ান। আমার সঙ্গে গেলে তোর মা কিছু বলবে না।

তা ঠিক। সুমন যেন গুরুঠাকুরটি। তার প্রতিটি কথাকেই মা ভীষণ গুরুত্ব দেয়। তবু মুখটা মলিন হল মরণের। দাদা এই মাত্র বলল তোর মা। এটা কানে খট করে বড় লাগল মরণের। দাদা তো শুধু মা বললেই পারত।

আজও দাদা তার মাকে মা বলে ডাকেনি।

রাস্তায় বেরিয়ে মরণ বলল, আজ কোন দিকে যাবে দাদা?

 ওই দিকটায়।

বলে যে দিকটায় দেখাল সে দিকটায় তারা রোজই যাচ্ছে আজকাল। ও পথটা পান্নাদিদের বাড়ির কাছ ঘেঁষে গেছে। দাদা আজকাল এই পথটাই বেশি পছন্দ করে।

দিন পাঁচ-সাত আগে পান্নাদি জ্বর থেকে উঠে মলিন মুখে জানালায় দাঁড়িয়ে ছিল।

 দাদা দেখে বলল, কে রে মেয়েটা?

 ও তো পান্নাদি।

কী করে?

 পান্নাদি! ওঃ পান্নাদি খুব ভাল ছাত্রী। গান গায়, নাচে, নাটকে পার্ট করে।

 তাই নাকি?

 হ্যাঁ।

কার মেয়ে বল তো।

 রামহরি জ্যাঠার মেয়ে। আলাপ করবে?

না থাক।

আমার সঙ্গে খুব ভাব কিন্তু।

তোর সঙ্গে তো দেখছি বিশ্বসুদ্ধু সকলের ভাব!

 হ্যাঁ। আমি তো পান্নাদিদের বাড়ির নারকোল পেড়ে দিই।

 অন্যের ফাইফরমাশ খাঁটিস কেন? তুই কি ওদের চাকর?

 কথাটা বুঝতে পারল না মরণ। লোকে কিছু বললে সে করে দেয়। এটাই রেওয়াজ। তার সঙ্গে চাকরের কী সম্পর্ক। দাদার রাগের কারণটা বুঝতে না পারলেও মরণ আর একটা জিনিস বুঝতে পারে যেটা তার বোঝার কথা নয়। সে বুঝতে পারে, তার এই শহুরে দাদাটি পান্নাদিদের বাড়ির সামনে দিয়ে আনাগোনা করতে পছন্দ করে।

পান্নাদি একদিন তাকে ডেকে বলেছিল, তুই আজকাল কার সঙ্গে ঘুরে বেড়াস রে? ছেলেটা কে?

ওমা চেনো না! ওই তো আমার দাদা।

পান্না অবাক হয়ে বলে, দাদা! তোর আবার দাদা কোত্থেকে এল?

বাঃ, আমার কলকাতার দাদা!

বুঝতে তবু একটু সময় লেগেছিল পান্নার। খানিকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থেকে হঠাৎ হেসে ফেলেছিল, ওঃ তাই তো! ও বোধহয় তোর বড়মার ছেলে, তাই না!

হ্যাঁ তো। দেখতে সুন্দর না?

হ্যাঁ, বেশ দেখতে। দাদাকে পেয়ে খুব আনন্দ বুঝি তোর! তাই আজকাল আর আসিস না।

তা নয় পান্নাদি। আজকাল বাবা প্রায়ই চলে আসে তো, তাই।

তোর দাদা কী করে?

পড়ে। কলেজে।

কী পড়ে?

 বি এসসি বোধহয়। ঠিক জানি না। একদিন নিয়ে আসব।

আনিস।

পান্নাদির কথা সে দাদাকে বলেও দিয়েছিল পরে। তখন লক্ষ করল, দাদার মুখে একটু হাসি খেলা করে গেল আর উজ্জ্বল হল দুটো চোখ।

এসব সে আজকাল বুঝতে পারে, যদিও এসব তার বোঝার কথা নয়। না বোঝার ভান করেই থাকতে হয় তাকে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে সব বুঝতে পারে।

দাদা আজও পান্নাদিদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাবে এবং আসবে। কিন্তু পান্নাদি জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে না। দাদা একটু যেন হতাশ হয়। তার ইচ্ছে করে পান্নাদিকে গিয়ে বলতে, আমি যখন দাদাকে নিয়ে তোমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাব তখন তুমি একটু জানালায় দাঁড়িয়ে থেকো।

পান্নাদি তখন হয়তো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করবে, কেন রে?

তখন সে মুচকি হেসে পালিয়ে আসবে।

এসব আগে সে বুঝত না। এখন বুঝতে পারে। তার সামনে একটা নতুন পৃথিবী জেগে উঠছে। তাতে সে খুশি হয় তা নয়। বরং অনেক সময় তার ভিতরে একটা যন্ত্রণা হয়।

একদিন সে তার মা আর বাবাকে মধ্যরাতে দেখে ফেলেছিল। ঘর অন্ধকার ছিল তবু দেখে ফেলেছিল। ভয়ে শ্বাস বন্ধ করে ছিল সে। কী করছে ওসব বাবা আর মা! এঃ মা। ওসব করতে হয়? বাবাকে তার খুন করতে ইচ্ছে হয়েছিল সেদিন।

.

২৪.

আমি ভেবেছিলুম তুই আর আমার মুখদর্শন করবি না, সম্পর্কও রাখবি না।

তা কেন পিসি?

 তোর মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করলুম যে। মাথা গরম হয়ে গেলে আজকাল আমার লঘু-গুরু জ্ঞান থাকে না। মুখ দিয়ে ছোটলোকী বচন বেরিয়ে যায়। কী যে সব বলে ফেললুম!

মাও তো তোমাকে কম বলেনি।

সে বলুক গে। আমি কি আর তেমন ভারিক্কী লোক! আমার মান-অপমান বলে তো কিছু নেই। হয়েও গেছি ছোটলোক। গতর খাটিয়ে খাই। তোর মা তো তা নয়। মুখ আমার বড় শত্রুর।

তুমি কেঁদো না পিসি। ব্যাপারটা ঠান্ডা হতে দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।

 সে তো হবে। কিন্তু মনটা খারাপ থাকবে। তুইও তো দুঃখ পেলি। পেলি না?

না তো। আমার মা ডিজার্ভস ইট।

মেজদা সম্পর্কে ও কথাটা কেন যে বলল বউদি!

 মা তো ওরকমই। যা মুখে আসে বলে।

দ্যাখ, আমাদের বংশের গৌরব হল তোর বাবা। অমল রায়কে এক ডাকে গাঁয়ের সবাই চেনে, সম্মান করে। আজ অবধি ওরকম রত্ন ছেলে এ-গাঁয়ে আর কেউ হয়নি। তার সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলতে আছে? আমরা না হয় খারাপ–

তুমি খারাপ নও পিসি।

হ্যাঁ রে, আমি কি তোকে কানমন্তর দিই, বল না?

কানমন্তর কাকে বলে?

কানমন্তর কাকে বলে জানিস না?

না তো!

কানমন্তর হল–দুর ছাই, ও আমি তোকে বোঝাতে পারব না। মানেটা বোধহয় খারাপ সব পরামর্শ দেওয়া।

তুমি তো শুধু আমার সঙ্গে গল্প করো।

তোর মাকে সে কথা কে বোঝাবে বল। তার ধারণা আমার সঙ্গে মিশে তুই খারাপ হয়ে যাচ্ছিস। লেখাপড়া জানি না বটে, কিন্তু আপন পিসিটা তো! আমি কি তোর খারাপ করতে পারি?

সোহাগ একটু হাসল, আমিই তো খারাপ।

 যাঃ, তুই কেন খারাপ হতে যাবি?

 আমিই খারাপ পিসি। আমার অনেক দোষ আছে।

দোষঘাট সকলেরই একটু-আধটু থাকে। মানুষ তো আর ভগবান নয়।

আচ্ছা, তুমি তো একজন ওয়ার্কিং উওম্যান, তোমার এত সেন্টিমেন্ট থাকবে কেন? 

কথাটা ইংরিজি হলেও বুঝতে পারল সন্ধ্যা। মুখখানা ভার করে বলল, সে তুই বুঝবি না। আমার ভিতরটা তো পুড়ে আংরা।

তার মানে কী?

দুর মুখপুড়ি, তুই যে কেন সব কথা বুঝতে পারিস না!

দুজনেই হেসে ফেলে। তারপর সন্ধ্যা একটু থমথমে গলায় বলে, কত কষ্টে তোদের সঙ্গে অল্পস্বল্প ভাব হচ্ছিল। হঠাৎ কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল সেদিন! আমার মোটেই ঝগড়া করার ইচ্ছে ছিল না। তবু হয়ে গেল। সেদিন থেকে কেবল ভয় হয়েছে, তুই বুঝি আর আমার ঘরে আসবি না, আড়িই করে দিবি বুঝি!

আড়ি মানে বয়কট না?

হ্যাঁ। তার ওপর দুদিন তুই এলি না, কথাও বললি না। তখন ভীষণ মনটা খারাপ লাগতে লাগল। ভাবলুম, সোহাগ বোধহয় আমার ওপর রাগ করেছে। করবেই তো। নিজের মায়ের অপমান কার সহ্য হয় বল। যত ভাবতুম তত কান্না পেত।

একটা চাপা দুষ্টু হাসি হাসছিল সোহাগ। ভারী ভাল দেখায় ওকে ওই হাসিটাতে। বলল, কী করব বলো। দুদিন আমাকে একটু শাসনে রাখা হয়েছিল।

শাসন! হ্যাঁ রে, তোর মা কি তোকে মারধর করেছে নাকি?

 সে তো আছেই। প্রায়ই আমাকে মায়ের হাতে মার খেতে হয়।

বলিস কী? সোমত্ত মেয়েকে মারতে আছে?

শি ইজ এ বিচ।

তার মানে কী?

ওটা তোমার জানার দরকার নেই। বাংলায় অনেক কথা খুব খারাপ শোনায়, ইংরিজিতে ততটা নয়।

তবে থাক। ওই জন্যই ইংরিজির ওপর আমার রাগ।

হি হি করে বাচ্চা মেয়ের মতো হাসল সোহাগ।

 খুব মেরেছে?

ওসব আমি গায়ে মাখি না। মারুক না; কত আর মারবে?

আমিও মায়ের হাতে অনেক মার খেয়েছি। বোকাহাবা ছিলুম তো, মা তাই খুব মারত। কিন্তু ডাগর হওয়ার পর আর গায়ে হাত তুলত না।

বোকা হাবা ছিলে কেন?

ছিলুম কী রে, এখনও তাই আছি। বোকা বলেই তো গতি হল না। আমার মাথায় একটুও বুদ্ধি নেই। তাই তো গতরে খেটে পুষিয়ে নিতে হয়।

তুমি কি নিজেকে খুব বোকা ভাব?

বোকাই তো। সবাই তাই ভাবে।

ওটা কিন্তু অটো সাজেশন।

তার মানে কী রে?

মানুষ নিজেকে খারাপ ভাবতে ভাবতে ওরকমই হয়ে যায়। কনফিডেন্স থাকে না।

একটা শ্বাস ফেলে সন্ধ্যা বলল, কী করব বল। ছেলেবেলা থেকেই সকলের মুখে শুনে আসছি, আমি নাকি মাথা-মোটা। গবেট, বোকা, কুচ্ছিত। শুনতে শুনতে সেটাই বিশ্বাস হয়ে গেল। ওই জন্যই বোধহয় কপালে সংসারও টিকল না।

তুমি বোকা নও পিসি।

এখন আর নিজেকে নিয়ে ভাবিই না। সব ভাবনাচিন্তা হামানদিস্তায় ফেলে গুঁড়ো করে দিই। দিলুম তো জীবনটা একরকম কাটিয়ে।

তোমার প্রবলেমগুলো কিন্তু খুব ছোটখাটো।

এক গাল হেসে সন্ধ্যা বলে, সেটাও খুব ভাবি। দুনিয়ায় কত কী হয়ে যাচ্ছে বলে শুনি মাঝে মাঝে। সেসব নিয়ে এক মিনিটও ভাবনা হয় না। আমার সব ভাবনাচিন্তা আচার, কাসুন্দি, মশলাপাতি, পাওনাগণ্ডা, হিসেবনিকেশ নিয়ে। ছোট মাপের মানুষদের সমস্যাও ছোটখাটোই তো হবে।

তা নয় পিসি!

তবে কী?

 তুমি যে মনের দরজা বন্ধ করে রাখো। দুনিয়াকে ঢুকতেই দাও না তোমার ভিতরে।

কী সুন্দর যে বলিস তুই! বেশ বলিস তো! একরত্তি মেয়ে হলে কী হবে, তোর খুব বুদ্ধি!

ছাই! বলে খুব হিহি করে হাসে সোহাগ, এ কথাটা তোমার কাছে শিখেছি। আজকাল কথায় কথায় বলি, ছাই!

আহা, কী ভাল কথাই না শিখলেন আমার কাছে থেকে! তবে শেখাবোই বা কী! আমি কি ভাল কথা জানি কিছু! হ্যাঁ রে, বুডোরও কি তোর মতোই খুব বুদ্ধি?

বুডঢা! বুডঢা মেরিটোরিয়াস। ক্লাসে ভাল গ্রেড পায়। আর পড়াশুনোয় খুব সিরিয়াস। আমার চেয়ে ওর বুদ্ধি অনেক বেশি।

ওর সঙ্গে আলাপই হল না ভাল করে। হয়তো মনে মনে ঘেন্না পায় আমাকে।

না, বুডঢা ইজ নট দ্যাট টাইপ। ও হল গুঁড়ি গুডি বয়। আমার মায়ের সঙ্গে একমাত্র বুডঢারই যা একটু ভাব।

মায়ের তো ছেলের ওপর টান থাকবেই। আমার মারও দেখেছি, মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের ওপর টান অনেক বেশি। অনেক, অনেক বেশি।

ওটা মায়েদের একটা কমপ্লেক্স। তুমি বুডঢার সঙ্গে আলাপ করতে চাও? তা হলে ডেকে আনতে পারি কিন্তু।

না বাবা থাক, যা গম্ভীর।

মোটেই তা নয় কিন্তু। আসলে খুব ফাজিল। খুব হাসাতে পারে। মুখটা গম্ভীর করে রাখে বটে, কিন্তু সেটা ওর মুখোশ।

না বাবা, ডেকে আনতে হবে না। বড় সাজানো ব্যাপার হবে তা হলে। আমার লজ্জা কি জানিস? ঝগড়ার সময় ছেলেটা সামনেই ছিল। সব শুনেছে। কী মনে করল কে জানে। সেই থেকে ওর চোখের দিকে চাইতেই পারি না আমি।

দেয়ার ইজ এ পয়েন্ট। মায়ের ওপর বুডঢার সফটনেস আছে। জানো তো, আমাদের ফ্যামিলিতে কেউ কাউকে পছন্দ করে না। সবাই সবাইকে ঘেন্না করে। শুধু মা আর বুডঢার মধ্যেই যা একটু ভাল সম্পর্ক।

তোর বাবা কিন্তু তোকে খুব ভালবাসে।

ছাই বাসে। বাবা কাউকেই ভালবাসে না। হি হেটস আস অল।

তুই বুঝিস না রে।

সোহাগ সামান্য হেসে বলে, আমিই যদি না বুঝতে পারি তা হলে আর কেউ বুঝলে লাভ কী বলল। আমাদের ফ্যামিলিকে তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না।

কেন রে, তোর ওরকম মনে হয় কেন?

ইট অল স্টার্টেড উইথ পারুল।

পারুলদি?

হ্যাঁ।

সে তো কবেকার কথা।

তা জানি। বাট দি গডেস ইজ দি রুট অব অল মিসচিভস।

আবার ইংরিজি বলছিস?

ভুলে গিয়েছিলাম। সরি।

আমি কিন্তু এই ইংরিজিটা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তুই বারবার পারুলদিকে গডেস বলিস কেন? ওতে দেবদেবীর অপমান হয়। একটা জলজ্যান্ত মেয়ে আবার গডেস কী রে?

পারুল গডেস নয়, সে তো ঠিক কথা। কিন্তু খুব কম বয়সে ওর ছবিটা দেখে কেন যে গডেস মনে হত কে জানে।

সুন্দরী বলে বলছিস?

হ্যাঁ তো৷ গড় আর গডেসরা তো সুন্দরীই হয়। কিন্তু তাদের একটা অরাও থাকে।

কী থাকে বললি?

অরা। অরাটা তোমাকে কী করে বোঝাব বলো তো!

তুই নিয়ম করে রোজ আমাকে একটু একটু ইংরিজি শেখা। তা হলে তোর কথা টক করে বুঝতে পারব।

অরা মানে ধরো একটা-একটা কী বলে ওটাকে বলো তো–

 সন্ধ্যা হেসে খুন হয়ে বলে, থাক বাবা, থাক। আর তোকে বোঝাতে হবে না। খুব বুঝেছি।

কী বুঝেছ বলো তো!

ঠাকুর-দেবতাদের গা থেকে জ্যোতি বেরোয় তো! সেটাকেই বোধহয় অরা না কী ছাঁইপাশ বললি, তাই বলে–

মাই গড! তবু তুমি বলবে যে তুমি বোকা?

বোকা নই?

 তুমি জলের মতো বুঝতে পেরে গেলে। হ্যাঁ তো, ওই জ্যোতি কথাটা আমার কিছুতেই মনে পড়ছিল না।

কিন্তু পারুলদির মোটেই জ্যোতি-ট্যোতি নেই। গায়ের রংটা অবশ্য ফর্সা। কিন্তু তাকে তো আর জ্যোতি বলে না। তোর মা তো আরও ফর্সা।

ধ্যাত। ফর্সা বলে নয়। সামথিং মোর দ্যান ফর্সা।

আমিও তো তাই বললুম। ফর্সা ছাড়া পারুলদির আর কী আছে বল তো।

মুশকিল কী জানো?

কী বল তো!

ছেলেবেলায় সেই যে মনে হয়েছিল ছবিটা একজন গডেসের সেই হিপনোটিজমটা আজও যায়নি।

আচ্ছা, পারুলদিকে সামনাসামনি দেখেও তোর ভুল ভাঙেনি?

একটু ভেঙেছে বোধহয়। কিন্তু ভাঙুক, তা আমি চাইনি। আমার তো কোনও গডেস নেই, ওই একজন ছাড়া।

কী অদ্ভুত কথা বলিস তুই? এই যে দুর্গামূর্তি দেখলি সেদিন, সে-ই তো গডেস।

ধ্যুত, তুমি যে একটা কী না। দুর্গা হল আইডলাইজড ইমাজিনেশন। ও তো ভীষণ কৃত্রিম।

আহা, দেবদেবীরা সব আমাদের মতো হ্যাতান্যাতা কি না।

তা বলে দুর্গার মূর্তিটা কিন্তু গডেস নয়। বিয়ন্ড মূর্তি গডেস কেউ থাকতেও পারে। কিন্তু মূর্তি দেখলে গডেসে ইমেজ আসে না আমার।

আচ্ছা, তা হলে পারুলদির ছবি দেখেই বা এল কেন বল।

তা জানি না যে!

তা হলে তুই আমার মতোই হাঁদারাম।

 সন্ধ্যা আর সোহাগ দুজনেই খুব হাসল।

তুমি খুব ভুল বলোনি পিসি। আমি একটু বোধহয় তোমার মতোই বোকা।

তা হলে আমাকে বোকা বলে স্বীকার করলি?

এখনও করিনি। তবে আমার একটা হ্যাবিট আছে, মাঝে মাঝে কিছু একটা দেখে খুব ইমপ্রেস্ত হয়ে যাই। তুমি হও?

হই না? এই যে তোকে দেখে আমি মুগ্ধ।

আমাকে দেখে? যাঃ! আমি তো একটা বাজে মেয়ে।

ও আবার কী কথা! বাজে মেয়ে কেন হবি।

আমাকে দেখে মুগ্ধ হওয়ার কিছু নেই পিসি।

একটু পাগলি সেজে থাকিস বটে, কিন্তু আমি টের পাই, তোর ভিতরটা বড্ড ভাল।

আচ্ছা, আজ কি আমরা দুজন দুজনেই একটু অয়লিং করছি?

সন্ধ্যা হেসে ফেলে বলে, তা নয়। তবে তুই আমার ভারী লক্ষ্মী মেয়ে। কী করে বুঝলুম জানিস?

কী করে?

যেদিন তুই আমার ঘরে প্রথম এলি, মনে আছে?

 হ্যাঁ তো!

সেদিন থেকেই আমার ব্যবসা খুব বেড়ে গেছে।

 যাঃ!

সত্যি! কত অর্ডার আসছে ভাবতে পারবি না।

ওই তো তোমাদের রোগ। যাকে তাকে ভগবান বানিয়ে ফেল।

ঠিক তোর মতো, না? পারুলদি যদি ভগবান হতে পারে তো তুই কী দোষ করলি বল তো?

 ইউ আর এ গুড ডিবেটার।

এটা কিন্তু বুঝলুম না। বুঝিয়ে দে।

থাক, তোমার বুঝে কাজ নেই। এটা একটা কমপ্লিমেন্ট।

 এটা বুঝেছি।

একটু একটু বুঝলেই তোমার চলবে।

 তবু আমাকে ইংরেজিটা একটু শেখাস। ইংরেজি জানলে অনেক কাজ হয়।

কী কাজ হবে?

একটা লোন অ্যাপলিকেশন করেছিলুম বাংলায়। দিলই না। কে যেন বলছিল, অফিসারটা সাউথ ইন্ডিয়ান। ইংরেজিতে করলে দিত।

আমি তোমার অ্যাপলিকেশন লিখে দেব।

দিবি? খুব ভাল হয় তাহলে।

এখানে তো কম্পিউটার নেই। তাহলে তোমাকে কম্পিউটারে টাইপ করে দিতাম।

এখানে কিছুই নেই রে। পোড়া জায়গা।

 কিন্তু পিওর আলো-বাতাস আছে। গাছপালা আছে। সন্ধের পর আকাশে কত তারা দেখা যায়।

দুর! ওসব দিয়ে কী হয়! আলো-বাতাস তো জন্ম থেকেই পাচ্ছি, কী হয়েছে বল। বরং ভাবি যদি ইংরেজিতে হড়বড় করে কথা কইতে পারতুম, যদি তুঘোড় বুদ্ধি থাকত তাহলে হয়তো সেই লোকটা অমন তাড়িয়ে দিতে সাহস পেত না।

কে লোকটা বলো তো! তোমার হাজব্যান্ড?

তার কথাই বলছি।

 আর ইউ স্টিল ইন লাভ উইথ হিম?

তা নয় রে! আসলে কী জানিস, কেন যে আমাকে তার পছন্দ হল না তা আজ অবধি ভেবেই পেলাম না। তাই ভাবি কয়েকটা বাড়তি গুণ থাকলে হয়তো ভাল হত।

 তুমি এবার একটা বিয়ে করো পিসি। ইট ইজ হাই টাইম।

দুর বোকা! ওসব শুনলে খারাপ লাগে। একবার বাতিল হয়েছি তো, সেই ঘা-ই শুকোয়নি।

ইউ আর এ ম্যাড উওম্যান। আর সেইজন্যই তোমাকে ভাল লাগে। আই লাভ এভরিথিং ম্যাড।

দুর পাগল! তোর যে কী সব অলক্ষুণে কথা! হ্যাঁ রে, তোর মায়ের সঙ্গে আমার ভাব করিয়ে দিবি?

অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সোহাগ বলে, ইউ আর ইমপসিবল। কেন ভাব করতে চাও বলো তো!

ইচ্ছে করছে। ঝগড়া হওয়ার পর থেকে মনটা ভাল নেই।

 মাথা নেড়ে সোহাগ বলে, নো ডাইস।

মানে কী রে?

মানে চান্স নেই। আমার মা একজন স্টাবোর্ন উওম্যান। বাবার সঙ্গে বা আমার সঙ্গে যখন ঝগড়া হয় তখন দিনের পর দিন আমাদের ভাব হয় না। এখন তো মায়ের সঙ্গে কখনওই আমার ভাব নেই। সব সময়েই আমাদের সম্পর্ক খারাপ।

তবে থাক, ভাবের দরকার নেই।

দরকার নেই পিসি।

তুই তোর মাকে পছন্দ করিস না?

 আমরা কেউ কাউকে পছন্দ করি না।

তা হলে কী করে থাকিস?

অভ্যাস হয়ে গেছে। তবে আমি তো থাকব না।

 কোথায় যাবি?

 পালাব।

চোখ বড় বড় করে সন্ধ্যা বলে কোথায় যাবি?

তা জানি না। শুধু জানি পালাব।

 ওরে বাবা, ওসব ভাবতে নেই। মেয়েরা পালালে ভীষণ বদনাম।

হোক না বদনাম!

কোনও ছেলের সঙ্গে?

কোনও পুরুষের সঙ্গে পালানোটা ভীষণ ভ্যাতভ্যাতে ব্যাপার। কাওয়ার্ড মেয়েরাই ওরকম পালায়। না, আমি একাই পালাব।

পালিয়ে কোথায় যাবি?

 তা কিছু ঠিক করিনি। একটা জায়গায় তো যাব না, সন্ন্যাসিনী হয়ে একা একা ঘুরে বেড়াব।

 যাঃ, এই বয়সে সন্ন্যাসিনী হবি কী রে?

সন্ন্যাসিনীর ব্যাপারটা ক্যামোফ্লেজ। ক্যামোফ্লেজ বোঝো?

না।

ছদ্মবেশ।

ছদ্মবেশ মানে তো ভেক ধরা।

ভেক? তার মানে?

 ছদ্মবেশ। দুজনেই হাসে।

ভেক ধরবি কেন? ‘

কোনও দেশেই একা যুবতী মেয়ে তো নিরাপদ নয়। তাই সন্ন্যাসিনী সাজলে খানিকটা হয়তো সেফ।

 ছাই সেফ। কত সন্ন্যাসিনীও রেপ হয়।

ওসব ভাবলে কি হয় পিসি? দুনিয়াটা নিজের চোখে দেখতে হবে না?

দুনিয়াটা তো তুই অনেক দেখেছিস, আর কী দেখার আছে?

আরও কত কী দেখার আছে, জানার আছে। একা একা ঘুরে বেড়ানোর থ্রিলই আলাদা।

তোর বাপু বড় দুর্জয় সাহস।

 হ্যাঁ, আমার ভয়-টয় করে না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যা বলে, আমার কখনও পালানোর ইচ্ছে হয় না। কিন্তু আমারই বোধহয় পালানো উচিত। তাই না?

পালালে না কেন পিসি?

ভয় করে যে! তোর মতো সাহস তো আমার নেই। ছেলেবেলা থেকেই জেনে এসেছি, আমি অবলা মেয়েমানুষ। আর মেয়েদের দুনিয়াটা হল ভয়ভীতিতে ভরা। তোর মতো সাহস থাকলে ঠিক পালাতুম। তুই তবু অনেক কিছু দেখেছিস, আমি তো একটুখানি জায়গায় সারাজীবন কলুর বলদের মতো ঘুরে মরছি।

কলুর বলদ কী?

ওঃ, তোকে আর বোঝাতে পারি না। ঘানিগাছ জানিস?

না তো! তবে আর তোকে বুঝতে হবে না বাপু। বিয়ে হয়ে দুর্গাপুর গিয়েছিলুম, সেই যা বাইরে যাওয়া। দু-তিনবার কলকাতায় গেছি। আর আমার সর্বতীর্থ সার হল বর্ধমান। মোল্লার দৌড় মসজিদ অবধি। এর বাইরের পৃথিবীটা কেমন তা জানাই হল না।

তুমি আর পারবে না পিসি।

মাথা নেড়ে সন্ধ্যা বলে, না, আর পারব না। বড্ড আটকে পড়েছি। স্বামী নেই, সন্তান নেই, তবু পিছুটানও কি কম! নিজেই মায়া সৃষ্টি করে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছি। অথচ সবই তো ফক্কিকারি।

ফকিকারি! বাঃ বেশ শব্দটা তো!

 মানে জানিস?

আন্দাজ করতে পারি।

কী বল তো!

নাথিংনেস।

ও বাবা, ওটা আবার আমি জানি না।

এখানে এসে আমি অনেক শব্দ শিখে গেছি।

গাঁয়ে কিন্তু লোকে কথায় কথায় অনেক খারাপ খারাপ শব্দ উচ্চারণ করে। সেগুলো শিখিসনি যেন।

হি হি করে হেসে সোহাগ বলে, হ্যাঁ, খুব স্ল্যাং শব্দ। পোঁদের কাপড়, পাছা, মাগী, আরও বলব?

রক্ষে কর বাপু, আর নয়। খবরদার যার-তার সামনে বলিসনি যেন!

আচ্ছা পিসি, চার দিকটা এমন অন্ধকার হয়ে গেল কেন বলো তো!

ও মা! তাই তো! এখন তো মোটে বেলা তিনটে, এত তাড়াতাড়ি তো রোদ মরে যাওয়ার কথা নয়। মেঘ করেছে বোধহয়। দেখ তো জানালার কাছে গিয়ে!

সোহাগ এক ছুটে জানলার কাছে গিয়ে বাইরেটা দেখে বলল, ওঃ পিসি, শিগগির দেখবে এসো।

 কী রে?

কী সাংঘাতিক মেঘ!

 দুর বোকা! মেঘ আবার সাংঘাতিক কী রে! শীতকালে তো মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়ই।

আমার মনে হচ্ছে ইটস এ টুইস্টার।

সেটা আবার কী?

টর্নেডো। সাংঘাতিক ঝড়।

 না না, এটা ঝড়ের সময় নয়।

 তুমি টুইস্টার দেখনি?

সেটা কীরকম বলবি তো।

আমরা যখন ফ্লোরিডায় ছিলাম তখন একবার দেখেছি।

 কীরকম বল তো?

ঘূর্ণিঝড়, সব উলটেপালটে দেয়, উড়িয়ে নিয়ে যায়। আমি চোখের সামনে একটা টয়োটা গাড়িকে উড়ে যেতে দেখেছি।

এই মেয়েটা, ভীষণ ঠান্ডা বাতাস ছেড়েছে। গরমজামা গায়ে দিয়ে আয়।

দুর! আমার কুটকুট করে যে!

 তাহলে ওই লাল পশমি চাদরটা গায়ে দে। আলনায় আছে। কাচা চাদর, ঘেন্নার কিছু নেই।

ঘেন্না নয়, আমি সব সময়ে যে অ্যাটমোসফিয়ারটাকে ফিল করতে চাই।

তোর মাথা। জানলার কাছ থেকে সরে আয়। ইস্ বাতাসে যেন বরফের কুচি মিশে আছে। বুকে ঠান্ডা লাগলে আর দেখতে হবে না।

.

এক উন্মাদ ক্ষ্যাপা হাওয়া কোথা থেকে ময়লা ছেঁড়া কাগজের মতো মেঘের টুকরো কুড়িয়ে এনে জড়ো করছিল আকাশের এক কোণে, সকাল থেকে। দুপুরের পর থেকে সেই মেঘ জুড়ে জুড়ে কালো স্লেটের গায়ের মতো মেঘের মহাপর্বত তৈরি হল। ওই থমথমে, কালো, ভয়ংকর মেঘখানাকে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিল সে। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায় তার কান কনকন করছে, চোখে জল আসছে, গাঁটে গাঁটে ব্যথা। গলায় খুশখুশি তুলছে শীতের সরু সরু আঙুল। আর শরীরের ভিতরে যেন হাঁটু মুড়ে বসে আছে একশো বছরের এক থুরথুরে বুড়ি।

এখান থেকে ফটিক কাঞ্জিলালের ফাঁকা বাস্তুজমিটা দেখা যাচ্ছে। সেখানে সামান্য একটা ধুলোর ঘূর্ণি উঠল। নেচে নেচে বেড়াল এদিক সেদিক। পান্না জানে, ওইখানে জ্যোৎস্না রাতে পরিরা নেমে আসে। যে গাছটায় গলায় দড়ি দিয়েছিল লোকটা সেই গাছটার চারপাশে পরিরা খেলা করে আর ফটিক কাঞ্জিলাল দড়িতে ঝুলতে ঝুলতে দেখে আর খুব হাসে।

বিজুদাই গল্পটা বলেছিল। ফাঁসির দড়িটা দিয়ে নাকি কাঞ্জিলাল একটা দোলনা বানিয়ে নিয়েছে। তাইতেই দোল খায় আর পরিদের খেলা দেখে। মা গো! ভাবলেই বুকটা ভয়ে দুরদুর করে। তবে বিজুদা বড্ড বিচ্ছু। তাকে ভয় দেখানোর জন্যই বানিয়ে বলে কিনা কে জানে।

ফটিকের সঙ্গে তার বউ আশালতার ছিল ভীষণ ঝগড়া। আশালতা কতবার মরতে গেছে। আর ফটিক নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে বলে শাসাত।

মরার দিন সকাল থেকে ঝগড়া লেগেছিল খুব।

শেষে ফটিক বলল, দেখবে? মজা দেখাব?

দেখাও না! তোমার পাল্লায় পড়ে কত মজাই তো দেখলুম। আর কী দেখাবে?

 তখন কিন্তু থই পাবে না।

 থই আমার এখনও নেই।

সবাই বলে, কাঞ্জিলাল খুব গুছিয়ে মরেছিল। টাকাপয়সা সব আদায়-উশুল করে বউয়ের নামে গচ্ছিত রেখে, কাজকারবার গুটিয়ে একটু বেশি রাতের দিকে নাইলনের দড়িগাছ নিয়ে নিরিবিলিতে গিয়ে–ম্যাগো!

আশালতাকে মজা দেখিয়েছিল বটে কাঞ্জিলাল। সে কী বুকফাটা কান্না মেয়েটার! বয়সও তত বেশি নয়। বাইশ-টাইশ হবে।

কিন্তু মুশকিল হল, দুনিয়াটা বড্ড নিষ্ঠুর। দুদিন পরেই সবাই সব কিছু ভুলে যায়। সব আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে।

বর-বউয়ের ঝগড়া তার চারদিকে। বর-বউতে যে কেন এত ঝগড়া হয় তা বোঝে না পান্না। সে যদি বিয়ে করে তাহলে সে একদিনও ঝগড়া করবে না তার বরের সঙ্গে। একবারও না।

ওলো পতিসোহাগী লো, দেখা যাবেখন বিয়ের পর। বিয়ের আগে কত কথাই থাকে মেয়েদের। বুঝবি মজা।

ছোট জ্যাঠাইমা বড্ড ঠোঁটকাটা। ভাল কিছু ভাবতেই চায় না।

প্রথমে এক ফোঁটা দু ফোঁটা বৃষ্টি উড়ে এল। তারপর হঠাৎ অ্যাই বড় বড় শিল পড়তে লাগল নষ্টচন্দ্রের ঢিলের মতো। সরে এল পান্না। আর দেখতে পেল একটা মেয়ে ফটিকের জমির পাশ দিয়ে কুঁজো হয়ে দৌড়ে আসছে। গায়ে গরমজামাটা পর্যন্ত নেই। সোহাগ।

.

২৫.

মন মানুষকে খায় নানাভাবে। কখনও বাঘের মতো হালুম করে এসে লাফিয়ে পড়ে ঘাড় মটকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। কখনও অজগরের মতো ধীরে ধীরে গিলে ফেলতে থাকে। কাকে কখন কী ভাবে খাবে তার কোনও ধরাবাঁধা নিয়ম তো নেই। যখন শত্রু তখন ষোলো আনা শত্রু। আবার যখন পোষ মানে তখন মনের মতো বন্ধুই বা কে। তখন তুমি মরুভূমিতে থাকলেও সে অধরা হয়ে নাচ দেখাবে। ঝড়ের দরিয়ায় সে বন্দরের ছবি টাঙিয়ে দেবে। কখনও ঈশ্বর, কখনও শয়তান, কখনও নিয়তি।

অমলকে খাচ্ছে অজগরের মতো। ধীরে ধীরে একটা অমন মানুষ তার ক্ষুরধার বুদ্ধি, ঝকঝকে মেধা নিয়েও অজগরের গরাস হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই আর ছাড়িয়ে নিতে পারছে না নিজেকে।

ভাবতে একটু কষ্ট হয় পারুলের।

মন আজ ভাল নেই। ভোররাতে বাবাকে স্বপ্ন দেখেছে সে। মরা মানুষকে স্বপ্ন দেখা কি ভাল? বার। বার? গত সাতদিনে বোধহয় বারতিনেক বাবাকেই স্বপ্নে দেখেছে সে। ভোররাতে আজ দেখল, বিরাট বড় একটা বাড়ি আর তার অফুরান গড়ানে বারান্দা পুবের রোদে ভেসে যাচ্ছে। এই অত বড় বারান্দা ধু ধু করছে জনহীনতায়। কেউ কোথাও নেই। আর আশ্চর্য, সেই বারান্দাটা কোথাও শেষ হয়নি। সে হাঁটছে তো হাঁটছেই। কেন যে শেষ হচ্ছে না ছাই কে জানে। ভীষণ ভয় করছিল তখন। ধ্যাত, এত বড় বারান্দা কে যে বানাল। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন বলল, যা না, আরও যা, একসময়ে শেষ হবে ঠিকই।

কে বলল কথাটা? ঝট করে মুখ ঘুরিয়ে সে দেখল, বাবা। তেমনই ফর্সা টকটকে রং, তেমনই মস্ত গোঁফ, তেমনই সুন্দর।

ও বাবা, তবে যে লোকে বলে তুমি মরে গেছ?

দুর বোকা! মরব কেন? এই একটু বেড়িয়ে এলুম।

 এ বাড়িটা কে বানাল বল তো! এত বড় বারান্দা কেন?

 তা ঠিক, বারান্দাটা একটু বড়। চল তোকে এগিয়ে দিই।

এর আগেও বারদুয়েক বাবাকে স্বপ্নে দেখেছে সে। স্বপ্ন নিয়ে তার তেমন কোনও কুসংস্কার নেই। আবার এও মনে হয়, কী জানি বাবা, স্বপ্নের মধ্যেও কোনও ইশারা ইঙ্গিত থাকতেও পারে।

সকাল থেকেই আকাশে মেঘলা ভাব। মনের মধ্যেও তাই। জ্যোতিপ্রকাশ আজ ভোরে চলে গেল জামশেদপুর। মন খারাপের সেটাও একটা কারণ। বিয়ের পর যখন বরের সঙ্গে ভাব হল তখন সম্পর্কটা উত্তেজক, মাদক। তখন দুজনেরই দুজনের জন্য আনচান অবস্থা। চোখে হারাই ভাব।

তারপর ধীরে ধীরে সেই আকর্ষণের তীব্রতা কমতে লাগল। কিন্তু অন্যরকম একটা টান জন্মাতে লাগল তা থেকে। এখন বরকে ছেড়ে থাকলে একটা কেমন নিরাপত্তার অভাব টের পায় সে।

অবশ্য সেখানে রান্না আর কাজের লোক আছে। তার বরের কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তবু পারুলের একটু খুঁতখুঁত করে। মনটা সেই কারণেই আজ কেমনধারা হয়ে আছে যেন।

সকালে বিজু এল তার নতুন মোটরবাইক নিয়ে। সবে কিনেছে। ভট ভট করে ফটক দিয়ে ঢুকে সোজা উঠোনে এনে দাঁড় করিয়েই হক মারল, বড়মা! ও বড়মা।

বলাকা ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে বললেন, শয়তানের কলটা শেষ অবধি কিনেই ফেললি?

 শিগগির কাপড়টা পালটে এসো।

কেন রে মুখপোড়া, কাপড় পালটাব কেন?

তোমাকে এই শয়তানের কলে চাপিয়ে শীতলাবাড়ি থেকে ঘুরিয়ে আনব।

বলাকা চোখ কপালে তুলে বললেন, ওইটেই বাকি আছে আমার কপালে। রক্ষে কর বাপু, বুড়ো বয়সে পড়ে হাড়গোড় ভেঙে দ হয়ে থাকতে পারব না।

আরে, চলোই না, একবার চড়লেই বুঝতে পারবে জিনিসটা মোটেই ভয়ের নয়।

আমার আর আহ্লাদের দরকার নেই বাবা। ওসব তোরা চড় গে।

দেখ বড়মা, বেশি কথা কইবে তো হাটে হাঁড়ি ভাঙব কিন্তু।

ওমা, চোখ রাঙায় দেখ! কী হাঁড়ি ভাঙবি রে মুখপোড়া?

জ্যাঠামশাই একসময়ে মোটরবাইক চড়ত, আমি জানি। একটা গাবদা-গোবদা বি এস এ মোটরবাইক ছিল তখন। তুমি তাতে চেপে জ্যাঠার সঙ্গে শহরে সিনেমা দেখতে যেতে।

তোর মাথা। তোর জ্যাঠা আমাকে মোটে একদিন চাপাতে পেরেছিল।

 মোটে একদিন?

তাও অনেক সাধাসাধির পর। আর সে যা কাণ্ড হয়েছিল। বাড়ি থেকে পঞ্চাশ গজও যায়নি দুড়ুম করে আমি পড়ে গেলুম।

এ মা!

আর বলিসনি। হাঁটু ছড়ে, শাড়ি ছিঁড়ে বিদিকিচ্ছিরি কাণ্ড। ওই একবারই।  

তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না। ভাবলুম নতুন বাইকটায় তোমাকে চাপিয়ে নিয়ে ঘুরে আসব একটু। আমার মা তো দিব্যি কাল আমার সঙ্গে ঘুরে এল।

আহা, ও ছুঁড়ির আর বয়স কী? আমার চেয়ে বছর দশেকের ছোট।

 বয়স নয় বড়মা, এ হল স্মার্টনেসের প্রশ্ন। তুমি একদম স্মার্ট নও। অথচ আমি তোমাকে স্মার্ট বলে ভাবতুম।

আর আমার স্মার্ট হওয়ার দরকার নেই বাবা। কিন্তু দুচাকার জিনিসে বিশ্বাস নেই। কেন যে তোর বাবা মত দিল তাও বুঝি না।

অবশেষে বিজু এসে পারুলকে পাকড়াও করল।

চলো তো পারুলদি, তোমাকে নিয়েই একটা চক্কর দিয়ে আসি।

আজ ভাল লাগছে না রে।

আচ্ছা, তোমরা সবাই নন কো-অপারেশন করলে কেমন করে হয় বল তো! বড়মা রিফিউজ করল, তুমিও।

পারুলের অবশ্য ভয় নেই। গাড়ি কেনার আগে জ্যোতিপ্রকাশের স্কুটার ছিল। বহুবার চেপেছে পারুল। নিজেও চালাতে পারত। আজ অবশ্য মেজাজটা ঠিক নেই। তবু শেষ অবধি রাজি হল সে। ছেলেমেয়ে দুটো আজ ছোট কাকার সঙ্গে বর্ধমানে গেছে ওদের বাবাকে সি অফ করতে। কীসব কেনাকাটা করে দুপুরে ফিরবে। বাড়িটা ফাঁকা লাগছে বলে বেরিয়ে পড়ল পারুল।

কিন্তু বাইক চলতেই বুঝতে পারল, কাজটা ঠিক হয়নি। বড্ড ঠান্ডা বাতাস লাগছে। কান কনকন করছে, হাত পা সিটিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু ওই গতি আর খোলা হাওয়া তার মাথা থেকে মনখারাপটাকে ঝেঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

একবার মুখ ফিরিয়ে বিজু বলল, বর্ধমান যাবে পারুলদি?

 অত দূর যাবি! দরকার কী?

 আহা চলোই না। ঘরে বসে থেকে হবেটা কী?

বড্ড ঘিঞ্জি শহর, সাবধানে চালাস।

বর্ধমানে গিয়ে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে বিজু বলে, চলো পারুলদি কিছু খেয়ে নিই। বড্ড খিদে পেয়েছে।

দুর! আমার তো একটুও খিদে নেই। এই তো একটু আগে মা জোর করে লুচি তরকারি খাওয়াল। গলা অবধি হয়ে আছে বাবা।

ডায়েটিং করার বদ অভ্যাসটা ছাড়ো তো পারুলদি। আমি জানি তুমি একটার বেশি দুটো লুচি খাও না। না হয় হবেই একটু মোটা, তা বলে খাওয়ার আনন্দটাকে ভোগ করবে না? জীবনটা কদিনের শুনি!

হয়েছে, তোকে আর ফিলজফি ঝাড়তে হবে না। তুই খা, আমি বসছি।

যখন গোগ্রাসে টোস্ট আর ওমলেট খাচ্ছিল বিজু তখন এক কাপ দুধ-চিনি ছাড়া চা নিয়ে চুপচাপ বসেছিল পারুল। একটা চুমুকও দেয়নি। দোকান-টোকানে খেতে তার বড় গা ঘিন ঘিন করে।

তোর সত্যিই খুব খিদে পেয়েছিল, না রে?

খুব। তোমার আর আমার মধ্যে তফাত কী জানো? আমি খিদে পেলে খাই, আর তুমি সুঁটকি মেরে থাক।

আমার আড়াই মন ওজন হলে তুই কি আমাকে তোর মোটরবাইকে তুলতে সাহস পেতি?

 কেন, অসুবিধে কী আছে? আমার বাইকটা কীরকম সফিসটিকেটেড জানো?

তুই একটা ক্যাবলা।

কেন বলো তো!

মোটরবাইকের পেছনে চাপাতে হয় গার্লফ্রেন্ডকে। তোর গার্লফ্রন্ড জোটে না কেন বল তো!

দুর দুর, ওসব তোমাদের সেকেলে ধারণা। গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘোরার মধ্যে কোনও গ্ল্যামার নেই। আজকাল। গণ্ডায় গণ্ডায় ঘুরছে।

ও বাবা! তুই যে অনেক এগিয়ে গেছিস! গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘোরাটাও সেকেলে হয়ে গেছে বুঝি?

আমার কাছে তাই।

 আসল কথাটা বললেই তো হয়।

আসল কথাটা কী?

তোর গার্লফ্রেন্ড নেই।

বিজু এক গাল হাসল, কথাটা মন্দ বলোনি। সত্যিই নেই।

কেন নেই রে? চেহারাখানা তো সুন্দর। তোর চেহারায় আমি বাবার আদল পাই। তেমনই লম্বা, ফর্সা, তোর কাছে মেয়েরা ঘেঁষে না কেন?

ঘেঁষবে কী করে? পাত্তা দিলে তো?

 পাত্তা দিলেই তো হয়।

বিজু মাথা নেড়ে বলে, হয় না পারুলদি। আমাকে ছেলেবেলা থেকে শেখানো হয়েছে মেয়েদের সঙ্গে সম্মানজনক দূরত্ব রাখতে হয়। মাখামাখি করতে নেই। বড় হয়ে আমি গাঁয়ের যুব সমাজের অভিভাবক। স্বনিযুক্ত অভিভাবকই ধরে নাও। আমি কি পারি মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করতে?

এত বেশি পিউরিটান হলে তুই যে এই বয়সেই বুড়োটে মেরে যাবি!

কী আর করা যাবে বলো। রক্ষক হয়ে তো ভক্ষক হতে পারি না। কোথাও কোনও মেয়ের ওপর কোনও রকম হামলা হলে, অপমানের ঘটনা ঘটলে আমরা গিয়ে তো রুখে দাঁড়াই। সেই আমিই যদি প্রেম-ট্রেম করে বেড়াই তাহলে লোকে বলবে কী?

দুর পাগলা, দুটোকে গুলিয়ে ফেলছিস কেন? মেয়েদের রক্ষা করিস সে তত ভাল কথা, তাতে প্রেম করা আটকায় কীসে?

আটকায়। ও তুমি বুঝবে না। আর প্রেমের যা-সব ছিরি দেখছি তাতে ও ব্যাপারটার ওপরেই আমার ঘেন্না ধরে গেছে।

একটা কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পারুল বলে, বুঝেছি। তোর তো দেখছি গভীর বিপদ।

না পারুলদি, বেশ আছি। মেয়েদের নিয়ে ভাবতে হয় না বলে অন্য সব ব্যাপারে মন দিতে পারি। নারীচিন্তা কিন্তু অন্য সব চিন্তাকে খেয়ে নেয়।

পারুল রুমালে মুখ চেপে খুব হাসল। বলল, হ্যাঁ রে তুই ব্রহ্মচর্য-টর্য করছিস না তো! বিবেকানন্দের বই-টই পড়ছিস নাকি?

কেন, পড়া কি খারাপ?

 বদহজম হলে খারাপ। নইলে ভালই তো।

না, ওসব নয়। আমি পিউরিটানও নই। আসলে আমি তেমন মেয়ের দেখাও পাইনি যাকে দেখলে দয়ে পড়ে যেতে হয়।

বড় বড় চোখে চেয়ে পারুল বলে, একটাও নয়?

না পারুলদি, একটাও নয়।

কথাটা কি মিথ্যে বলল বিজু? ভাবের ঘরে চুরি! একথা ঠিক তার জীবনে কোনও মহিলার আবির্ভাব ঘটেনি এতকাল। কিন্তু এখন সে অতটা নিশ্চিত নয়।

এরকম ঘটনা যে ঘটতে পারে তা তার স্বপ্নেও কখনও মনে হয়নি। তার একটা স্পর্ধিত অহং আছে। সেই অহং তাকে পাঁচিলের মতো ঘিরে রেখেছে এতকাল। সুন্দর চেহারা, মেধাবী ছাত্র, রবীন্দ্রসংগীতের দারুণ কণ্ঠ এবং বড় বাড়ির ছেলে– এইসব গুণাবলীর জন্য সে কৈশোরকাল থেকেই চুম্বকের মতো মেয়েদের আকর্ষণ করেছে। কিন্তু তাকে একটা মন্ত্র সেই অবোধ বয়সেই শিখিয়ে দিয়েছিল তার বাবা, দেখো বাবা, মেয়েদের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করো না। মায়ের জাত, তাদের সম্মান রাখতে হয়।

তাদের বংশে এই ধারাটা আছে। পুরুষেরা একটু এইরকম, মহিলাদের এড়িয়ে চলে। যখন সে বর্ধমান কলেজে পড়ে তখন ইউনিয়ন করত। খেলাধুলোয় ভাল ছিল বলেও বেশ নামডাক। সেই সময়ে বুলবুলি নামে ফুটফুটে একটি মেয়ে খুব ঘুরঘুর করত তার কাছে। ছোটখাটো, রোগা, কিন্তু ভারী মিষ্টি দেখতে ছিল সে। নানাভাবেই সে নিত্য নিজেকে নিবেদন করতে চাইত। তাকে দেখে মাঝে মাঝে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ত বিজুও। অনেক সময়ে তাদের দীর্ঘ সংলাপও হয়েছে।  

বুলবুলি বলত, আমার চোখে চোখে তাকাও না কেন বলো তো! তোমার কি ভয় আমি তোমাকে হিপনোটাইজ করে ফেলব?

খানিকটা হিপনোটিজম তো মেয়েদের মধ্যে থাকেই। কিন্তু কথাটা উঠছে কেন? চোখে চোখ রাখাটা কি জরুরি?

আমার কাছে জরুরি।

 কেন?

একটু বোঝার চেষ্টা করো। তুমি বোকা নও।

না নই। বোকা নই বলেই বোকামিটা করি না।

 তুমি কি আমাকে ভয় পাও?

 না বুলবুলি, আমি বোধহয় নিজেকেই ভয় পাই।

আমাকে নিয়ে কখনও ভাব? যখন একা থাকো?

না-ভাবার চেষ্টা করি।

আমি সবসময়ে তোমার কথা ভাবি। তুমি কেন ভাব না?

তোমাকে কখনও বলা হয়নি, মানুষের মহার্ঘ্য মস্তিষ্কটা অর্থহীন, প্রয়োজনহীন চিন্তায় ভারাক্রান্ত থাকে বলেই অধিকাংশ মানুষ তার মাথাকে সঠিক ব্যবহার করতে পারে না।

ওসব শক্ত শক্ত কথা বলছ কেন? সহজ করে বলো।

 সহজ করে বললে বিচ্ছিরি শোনাবে যে।

অর্থাৎ আমার কথা ভাবলে তোমার সময় নষ্ট হয়?

 অনেকটা তাই।

এ কথায় বুলবুলির চোখ ভরে জল এল। ধরা গলায় বলেছিল, এরকম অপমান আমাকে কেউ কখনও করেনি জানো?

ভাল করে ভেবে দেখো বুলবুলি, এটা অপমান নয়। এটা এক ধরনের আত্মরক্ষা। বন্ধুত্ব থেকে অবসেশন জন্ম নিলে সমস্যা হবে।

কেন, সমস্যা কীসের?

 ভাল লাগার তো শেষ নেই। একটা ভাল লাগার স্টেজ শেষ হলে আর একটা ভাল লাগার স্টেজ আসতে পারে। জীবন পরিবর্তনশীল।

আবার শক্ত শক্ত কথা বলছ?

 তুমি বুঝতে চাইছ না বলে শক্ত মনে হচ্ছে। একটু ভাবো তুমি। একটু গভীরভাবে ভাবো।

বুলবুলির সঙ্গে একটা ঘনিষ্ঠতর সম্পর্কের সম্ভাবনা সেদিনই শেষ হয়ে যায়।

এরকম হব-হব সম্পর্ক আরও তৈরি হয়েছে তার জীবনে। বারবার। শেষ অবধি বিচিত্র সব বহিরাক্রমণেও অটুট থেকেছে তার দুর্গ। ফটক ভাঙেনি, বিজয়োল্লাসে ঢুকেও পড়েনি কেউ।

লুঠেরা না থাক, তস্কর তো আছে। তারা দেয়াল ভাঙে না, সিঁদ কেটে আসে।

অষ্টমী পুজোর দিন একটা ঘটনা ঘটেছিল। তুচ্ছ সামান্য ঘটনা।

মনে না রাখলেও চলে। তবু কী করে যেন থেকে গেছে মনে। তার প্রিয় বানর বজরংকে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। সামনেই বলি হচ্ছে। ঢাক বাজছে দ্রিমি দ্রিমি। রাজ্যের লোকের ভিড় চারদিকে। তার মধ্যেই হঠাৎ এক জোড়া বিহ্বল চোখ তার দিকে অপলক চেয়েছিল। ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে উঠছিল লজ্জায়। তবু চোখ দুটো সরিয়েও নিতে পারেনি মেয়েটা। বজরং একাধ থেকে ওকাঁধে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল, চুল ধরে টানছিল বিবেকের মতো। বিজু খুব অস্বস্তির সঙ্গে সরে এসেছিল ভিড় থেকে।

পুজোর ভাসানের দিন প্যান্ডেলে মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল একটু তফাতে। সবাই লরিতে উঠল হুড়মুড় করে। মেয়েটির চোখ চকচক করছিল লোভে। কিন্তু শেষ অবধি সে এসে আর দশজনের মতো উঠল না লরিতে, দাঁড়িয়ে রইল একা, ফাঁকা প্যান্ডেলে। এবং সে নির্ভুল চোখে তাকিয়েছিল বিজুর দিকেই। বিজুই যে এই বাহিনীর সর্দার তা জানত সে। হয়তো সে দূরাকাঙ্ক্ষা করেছিল, বিজু তাকে ডাকবে। ডেকে নেবে। কিন্তু বিজু তাকে ডাকবে কেন? সবাই নিজের ইচ্ছেয় যাচ্ছে, সকলেরই প্রবল উৎসাহ, শুধু ওই অহংকারী মেয়েটাই দেমাক দেখাচ্ছিল। বিজুর কী দায় পড়েছিল ডাকার!

পরে মেয়েটা পান্নাকে দুঃখ করে বলেছিল, আমাকে তো কেউ ডাকেনি।

কার ডাকের অপেক্ষা ছিল মেয়েটার?

 বিহ্বলতা জিনিসটা বিজু টের পায়। বারবার ওই করুণ একজোড়া চোখ তার স্মৃতিতে হানা দিয়েছে। আর ওই কথা, আমাকে তো কেউ ডাকেনি।

প্রেমিক না হলেও মেয়েদের কাছে হিরো হওয়ার লোভ কি সংবরণ করতে পেরেছে বিজু? বোধহয় না।

স্পোর্টিং ক্লাবের বদমাশ ছেলেরা যখন সোহাগের পিছনে লেগেছিল তখন কথাটা তার কানে তুলেছিল পান্না। স্বাভাবিক অবস্থায় এসব ঘটনা ঘটলে সে প্রতিকার করে বটে কিন্তু বাড়াবাড়ি কখনও করে না। হঠাৎ ওই ঘটনা শোনার পর সে যে কেন উন্মাদের মতো রেগে গিয়েছিল তা কে বলবে? রেগে গিয়ে সে তার ডু গুডার দলবল নিয়ে নিজেই চড়াও হয়েছিল ওদের ওপর। মাত্রা ছাড়িয়ে মারধর করেছিল। তারপর পাঠিয়েছিল সোহাগের কাছে ক্ষমা চাইতে।

কোথায় বিগলিত কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ঘটবে, হল উলটো। মেয়েটা বড়মাকে আর পান্নাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব কাউকে নিতে হবে না। সুস্পষ্ট অপমান এবং প্রত্যাখ্যান।

তা হলে কি ওই দু চোখের বিহ্বলতা ভুল রিডিং দিয়েছিল বিজুকে? ভুল পাঠ? ভুল ব্যাখ্যা? সব ভুল?

তাই হবে। মেয়েদের মতো এত ভাল ড্রিবল আর কে করতে পারে? অদৃশ্য থাপ্পড় খেয়ে মেয়ে জাতটার ওপরেই কিছুদিন বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছিল তার।

নতুন বাইকটি হাতে পাওয়ার পর কিছুদিন হল লম্বা লম্বা ড্রাইভে চলে যাচ্ছে বিজু। খোল রাস্তা, অফুরান পথ, হাওয়া, রোদ, গতি–সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত মুক্তি। বুকটা হা-হা করে আনন্দে। সাইকেল এর কাছে কোথায় লাগে! মোটরগাড়িও না। যৌবন এবং মুক্তির দূত হল মোটরবাইক। হাইওয়েতে সে যখন একের পর এক গাড়ি এবং স্কুটারকে কাটিয়ে দুরন্ত গতিতে ছোটে তখন মনে হয়, এর চেয়ে ভাল কিছু নেই।

পরশু সকালবেলা থেকে একটু একটু মেঘলা করেছিল, হাওয়া দিচ্ছিল খুব। একটা পুলওভার আর তার ওপর উইন্ডচিটার চাপিয়ে হেলমেটে মাথা ঢেকে সাতসকালে বেরিয়ে পড়েছিল বিজু। বর্ধমান থেকে বাইপাস ধরে বাঁকুড়া আরামবাগের রাস্তা ধরে অনেকটা চলে গিয়েছিল সে। তারপর ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা প্রবল হচ্ছে দেখে ফিরল।

ফেরাটা ছিল পাগলের মতো। বৃষ্টির আগেই গাঁয়ে পৌঁছনোর জন্য সে স্পিড তুলে দিয়েছিল সাংঘাতিক। বাইকটা ক্ষণে ক্ষণে লাফাচ্ছিল রাস্তার খানাখন্দে। শক্ত হাতে হ্যান্ডেল চেপে দাঁতে দাঁত পিষে ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিল বিজু।

কিন্তু শেষ অবধি বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারল না। প্রথমেই বড় বড় শিল পড়তে থাকায় একটা গাছতলায় কিছুক্ষণ দাঁড়াল সে। তারপর বৃষ্টিতে বেরিয়ে পড়ল। ভিজে ঝুল্লুস হয়ে গেল মাঝ রাস্তায়। ভিজতে ভিজতেই গাঁয়ে ঢুকে সে বাইকের স্পিড কমিয়ে ধীর গতিতে চালাচ্ছিল।

ফটিক কাঞ্জিলালের জমির কাছ বরাবর এসে সে অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখতে পায়। একটা মেয়ে ওই প্রবল বৃষ্টিতে ফাঁকা জমিটায় দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো ঘুরে ঘুরে নাচছে।

পাগল নাকি মেয়েটা?

বাইক থামিয়ে নেমে এল সে।

 এই! তুমি কী করছ এখানে?

মেয়েটা জবাব দিল না। ভ্রূক্ষেপও করল না তার দিকে। যেমন ঘুরে ঘুরে নাচছিল তেমনই নেচে যেতে লাগল।

এই সোহাগ! সোহাগ! বাড়ি যাও।

মেয়েটা সম্পূর্ণ সম্মোহিতের মতো নেচেই যাচ্ছিল। জবাব দিল না, তাকালও না।

নিতান্ত বাধ্য হয়েই এগিয়ে হঠাৎ মেয়েটার পথ জুড়ে দাঁড়াল বিজু।

শুনতে পাচ্ছ? কী হচ্ছে এখানে?

মেয়েটা বেভুলে ঘুরতে ঘুরতে এসে ধাক্কা খেল তার সঙ্গে। তখনই বিজু প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও শুনতে পেয়েছিল মেয়েটা বিড়বিড় করে অস্ফুট উচ্চারণে কিছু বলে যাচ্ছে। মন্ত্রের মতো।

ধাক্কা খেয়ে মেয়েটা হঠাৎ জলকাদার মধ্যে ধড়াস করে পড়ে গেল। এমন অদ্ভুত ছিল পড়াটা। খাড়া অবস্থা থেকে গাছ যেমন পড়ে তেমনই টানটান শরীর নিয়ে পড়ল। চারদিকে খোয়া ইট, পাথরের টুকরো। মাথা কেটে যেতে পারত।

ভয় পেয়ে গেল বিজু। মেয়েটা পড়ে নড়ছিল না।

গাঁয়ে লোকলজ্জার ভয় আছে। মেয়েটাকে পাঁজাকোলা করে তুলতে পারত বিজু। সেটা করার সাহস না পেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ডাল, এই যে সোহাগ! ওঠো। তোমার কী হয়েছে?

সোহাগ জবাব দিল না। ওই প্রবল বৃষ্টিতে নির্বিকারভাবে পড়ে রইল।

অগত্যা দুটো কাঁধ ধরে তাকে তোলার চেষ্টা করতে লাগল বিজু। মেয়েটার কপালে নিউমোনিয়া লেখা আছে। কিন্তু মূৰ্ছিত সোহাগকে বসানোও যাচ্ছিল না। তুললেই ফের পড়ে যাচ্ছে। কী যে মুশকিল হয়েছিল বিজুর। একবার ভাবল গিয়ে লোকজন ডেকে আনবে। কিন্তু ওই প্রবল বৃষ্টি এবং ঠান্ডায় লোজন পাওয়াও মুশকিল।

যখন প্রবল দুশ্চিন্তায় দ্বিধাগ্রস্ত বিজু সোহাগের বৃষ্টিস্নাত মুখের দিকে চেয়ে আছে তখনই হঠাৎ তার দুর্গের প্রাকারে নয়, কোনও অন্ধ রন্ধ্রের পথে চোর ঢুকছিল অবরোধের ভিতর। নিজের হৃদয়কে সে দুর্বল হয়ে যেতে টের পাচ্ছিল।

আর তখনই হঠাৎ খুব ধীরে চোখ খুলছিল সোহাগ। অস্ফুট একটা উঃ শব্দ করে সে বৃষ্টির ঝাপটা থেকে মুখ বাঁচাতে দু হাতে মুখ ঢাকা দিল। স্বপ্লেখিতের মতো উঠে বসল।

সোহাগ!

কে আপনি?

 আমি বিজু। তুমি এখানে কী করছিলে?

সোহাগ বৃষ্টির ঝরোখার ভিতর দিয়ে তাকে দেখল। চিনতে পারল। তারপর বলল, আমি যা-খুশি করছিলাম। আপনাকে তো আমি ডাকিনি।

ডাকোনি। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে

তাতে আপনার কী?

তোমার ঠান্ডা লাগবে ভেবে–

আপনি আমার স্পেলটা ভেঙে দিয়েছেন।

কী ভেঙে দিয়েছি?

আপনি বুঝবেন না। বুঝবার মতো বুদ্ধি আপনার নেই।

রেগে গেলেও নিজেকে সংবরণ করে বিজু বলল, তুমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলে, তাই ভাবলাম–

প্লিজ! আপনি আমার অনেক ক্ষতি করেছেন। এখন দয়া করে চলে যান।

 যাব?

হ্যাঁ, যাবেন।

 বিজু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, তুমি নিজেকে কী ভাব তা তুমিই জানো। আমি তোমাকে পাগলের মতো কাণ্ড করতে দেখেই এসেছিলাম।

আমি একজন পাগলই। আপনি দয়া করে যান।

রেগে গেলে মানুষ অনেক সময়ে বোকার মতো কথা বলে। বিজুও বলল, এইজন্যই মানুষের উপকার করতে নেই।

দু হাতে ভেজা এবং ভিজন্ত চুল গুছি করে একটা খোঁপার মতো বেঁধে নিতে নিতে সোহাগ বলল, আমি আপনার উপকার চাই না তো! কে বলেছে আপনাকে আমার উপকার করতে?

আচ্ছা, ঠিক আছে! এর বেশি আর কথা জোগায়নি বিজুর মুখে। সে বৃষ্টির মধ্যে এসে ফের তার বাইক স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। আর হতভাগা, বিশ্বাসঘাতক মোটরবাইকটা জলে ভিজে কিছুতেই আর স্টার্ট নিল না। বাইকটা ঠেলে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিজু দেখতে পেল, উন্মাদিনী সোহাগ পান্নাদের বাড়ির দিকে ছুটছে।

কী ভাবছিস বল তো! অনেকক্ষণ চুপচাপ।

 লজ্জা পেয়ে বিজু বলে, একটা স্পেল।

 তার মানে কী?

কী যেন ভাবছিলাম একটা। ভুলে গেছি।

 লুকোচ্ছিস।

না, সত্যিই ভুলে গেছি।

 এবার চল একটু কেনাকাটা করি।

কী কিনবে?

কিছু ঠিক করিনি। শহরে যখন এসেই পড়েছি, মার জন্য কিছু নিয়ে যাই।

বড়মা! বড়মার জন্য আবার কী নেবে? জ্যাঠামশাই মারা যাওয়ার পর থেকে তো বড়মা একেবারে বৈরাগী হয়ে গেছে। দু হাত্তে কত জিনিস বিলিয়ে দিল। আমাকে কী দিয়েছে জানো?

কী রে?

জ্যাঠামশাইয়ের দুটো পার্কার কলম, একটা জেনিথ ঘড়ি, পুরনো একটা প্রিন্স কোট, দশটা রুপোর টাকা।

হ্যাঁ, মা যেন কেমন হয়ে গেছে।

আমি বলেছিলাম, জ্যাঠামশাইয়ের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এগুলো রাখো। কী বলল জানো?

কী?

বলল স্মৃতির কোনও চিহ্ন লাগে না। আমার বুক জুড়ে, চোখ জুড়েই তো লোকটা আছে। জিনিসগুলো বরং ভোগে লাগুক। এরকম ভালবাসা ভাবাই যায় না, কী বলে?

পারুল একটু হাসল। বলল, এরকম ভালবাসা আর আনুগত্যই তো তোরা পুরুষেরা চাস।

যা বলেছ। তবে চাইলেই তো হবে না। দেনেওয়ালারও তো ইচ্ছে অনিচ্ছে আছে।

পুরুষেরা সবসময়েই কলোনিয়াল প্রভুদের মতো মেন্টালিটির হয় কেন রে? তারা রাজা, মেয়েরা প্রজা।

 মাইরি পারুলদি, সেরকম হলে কিন্তু বেশ হত।

 মারব থাপ্পড়। এখন ওঠ। খাবারের দাম আমি দিয়ে দিয়েছি।

 আরেব্বাস! কখন দিলে?

 তুই যখন হাঁ করে কার কথা ভেবে আনমনা ছিলি তখন।

 যাঃ, কার কথা আবার ভাবলাম!

সে কি আর তুই আমাকে বলবি? তবে ঠিক বের করে নেব। গোয়েন্দা লাগাতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *