০৬.
বিকেল যখন ঘনিয়ে আসে তখন মাঠের ওধারে জড়ামরি গাছপালার ফাঁকে যে কী তুলকালাম একটা কাণ্ড ঘটে যায় রোজ তা কেউ তাকিয়েই দেখে না ভাল করে। আকাশ থেকে আলোর চাকাটা তখন নামতে থাকে আর সেই সময়ে কোথাও কিছু না হঠাৎ একটা ভুতুড়ে মেঘ এসে তিন-চার খণ্ড হয়ে ভাসতে থাকে। আর গাছপালার কালচে রঙের ছায়া থেকে অশরীরীর মতো ভেসে উঠতে থাকে ঘোর ঘোর কুয়াশার মতো, ধোঁয়ার মতো, প্রেতের মতো সব জিনিস। পশ্চিমের আকাশে তখন লাল সাদা কালো মেঘের তুলির টান। দিগন্ত দ্রুত তার আলোর গালিচা গুটিয়ে নিতে থাকে। প্রথমে দীর্ঘ ছায়া দীর্ঘতর হতে থাকে, আর অন্ধকার বুনে চলে কালো এক মাকড়সা। প্রতিদিন এইভাবে দিন যায়, দিন আসে। কেউ ঘটনাটা গ্রাহ্যও করে না তেমন। বাসরাস্তায় ব্যস্ত দোকানপাট অন্ধকার নামতেই দিল না কখনও। পটাপট জ্বলে উঠল আলো। ঝাঁই ঝাঁই করে বেজে যায় কালীপদর ক্যাসেটের দোকানের গান। অষ্টধাতুর আংটি বিক্রি করতে বসা লোকটা একঘেয়ে গলায় তার আংটির গুণের কথা বলে, বিফলে মূল্য ফেরতের ভরসা দিয়ে যাচ্ছে। সেই কবে থেকে। তেলেভাজার গন্ধ ছড়িয়ে দেয় হরিপদ দাস। মাঠের ওধারে নানা দৃশ্য অবতারণার পর আলোর চাকা ডুবে গেল হায় হায় করে। কেউ দেখল না। টেরই পেল না ভাল করে। ধুলো উড়িয়ে দুখানা বাস গেল পরপর। লোক নেমেছে মেলা। বাস-আড্ডায় এখন মেলা লোক, বিস্তর বিকিকিনি। এ সময়টায় তার যে খিদেটা পায় সেটা হল বিস্কুটের খিদে।
মানুষের বুদ্ধিরও বলিহারি যেতে হয়। মাথা খাটিয়ে যে কোন জিনিসে কী প্যাঁচ বের করে তার ঠিকঠিকানা পাওয়া মুশকিল। এই যে নিতাইয়ের দোকানের নিমকি বিস্কুট–শুনতে সোজা হলে কী হয়, বিস্কুটখানা বিস্তর প্যাঁচালো। সে গুণে দেখেছে বিস্কুটখানায় অন্তত আটখানা থাক। পরতে পরতে জুড়ে কী করে যে বানিয়েছে মাথা খাটিয়ে, কে জানে বাবা! যেমন মুচমুচে তেমনই গালভরা স্বাদ। জিব যেন জুড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে এক-আধটা কালোজিরে দাঁতে পড়লে ভারী চমৎকার লাগে। গোটাগুটি কামড়ে খায় না সে। খবরের কাগজের ঠোঙায় বিস্কুটখানা নিয়ে প্রথম কিছুক্ষণ চুপ করে অনুভব করে। ছোঁয়ার মধ্যেও একটা উপভোগ হয় না কি? তার তো হয়। তারপর বিস্কুটখানা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখে। এই দেখাটাও খাওয়ারই একটা অঙ্গ। গানের আগে যেমন হারমোনিয়মের প্যাঁ পোঁ আর তবলা বাঁধার ঠুকঠাক। খুব সাবধানে বিস্কুটের ওপরের পরতটা দু আঙুলে ধরে ছাড়িয়ে নেয় সে। পাতলা ফিনফিনে চমৎকার লম্বাটে জিনিসটি টুক করে দাঁতে কামড়ে একটুখানি মুখে নেয় সে। অনেকক্ষণ ধরে চিবোয়। সঙ্গে সুড়ুত করে এক চুমুক চা। কী যে ভাল লাগে তখন! একটা পরত শেষ হলে আর একটা পরত, তারপর আর একটা। মোট আটখানা খেতে খেতে চা কখন শেষ হয়ে যায়। শেষ পরতখানা খাওয়ার সময় মনটা খারাপ লাগে। শেষ হলেই তো শেষ। আরও একখানা যে খাওয়া যায় না তা নয়, তবে সেটা বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। এক একখানা বিস্কুট এক এক টাকা।
খাওয়া শেষ হওয়ার পর খাওয়ার রেশটা অনেকক্ষণ মুখের মধ্যে থেকে যায়। তখন চুপটি করে বসে সেটা উপভোগ করতে হয়। গোরু যেমন জাবর কাটে অনেকটা তেমনই। খাওয়াটা ফুরিয়ে গিয়েও যেন ফুরোয় না, তার স্বাদ জিবকে জড়িয়ে ধরে থাকে অনেকক্ষণ। বিস্কুট আর চায়ের স্মৃতি তাকে কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে।
মাথাটা কিছু ভুলভুম্বুল হয়েছে আজকাল। কাছেপিঠের কথাই ভুল হয় বেশি। এই যদি হঠাৎ করে আদিগন্ত সব কথাই আচমকা ভুল পড়ে যায় তা হলেও খারাপ কিছু তো নয়। বাড়িঘর, ঠিকানা, বউ, ছেলেপুলে সব ভুলে পাকার হয়ে এই বাস-আড্ডার বেঞ্চে বসে হাঁ করে চেয়ে থাকা সেও কি খারাপ রে বাপু! বেশ জায়গা এটা। আলো-টালো আছে, গান বাজছে, বিকিকিনি হচ্ছে, বাস আসছে যাচ্ছে, মানুষের সঙ্গে বসে মানুষ সুখদুঃখের দুটো কথা কইছে, লোকের গ্যাঞ্জাম। এখানে বসেই কত কী দেখে দেখে সময় কেটে যায়। উত্তর দিকে কখন থেকে একটা মাল-বোঝাই ট্রাক খারাপ হয়ে পড়ে আছে। এখন হ্যাজাক জ্বেলে একটা খালাসি জ্যাক লাগিয়ে হ্যান্ডেল মেরে মেরে সেটা তুলছে। দেখার মতোই দৃশ্য। মানুষের বুদ্ধির কোনও কূলকিনারাই করে ওঠা মুশকিল। কী বুদ্ধি! কী বুদ্ধি! একরত্তি একটা যন্ত্র লাগিয়ে একটা মাত্র রোগাভোগা খালাসি ওই গন্ধমাদন ট্রাকটাকে কেমন তুলে ফেলছে দেখ! ট্রাকটা উঠছে একটু কেতরে। কুকুরে যেমন পিছনের ঠ্যাং তুলে পেচ্ছাপ করে ঠিক তেমনই। যত দেখে তত মুগ্ধ হয় সে। মুগ্ধ হয়, আর ভাবে। ভেবে ভেবে কূলকিনারা পায় না। বুদ্ধি খাটিয়ে খাটিয়ে মানুষ কত কী বানিয়েছে! রেলগাড়ি, হাওড়ার পোল, মনুমেন্ট। এইসব বসে বসে ভাবে সে। আর খুশি হয়। আর ফিচিক ফিচিক হাসে আপনমনে। তার মেজো ছেলের বউ কুসুম সেদিন তার শাশুড়িকে বলছিল বটে, বাবার একটু মাথার দোষ হয়েছে মনে হয়, একলা একলা বসে কেমন বিড়বিড় করে কথা কইছে আর হাসছে গো। দরমার বেড়ার ওপাশ থেকে কথাটা কানে এসেছিল। মাথার দোষ একটু হয়েও থাকতে পারে তার। ভুলভুম্বুল ভাবটা যেন একটু বেড়েই পড়েছে। গোটাগুটি সব ভুলে মেরে দিলে মন্দ হবে না তখন।
কিছু চাষিবাসি লোক ক্ষেতের কাজ সেরে ঘরমুখো ফেরার পথে এইখানে চায়ের দোকানে বসেছে বেঞ্চ জুড়ে। তাদের হাতে চায়ের গেলাস আর কোয়ার্টার পাঁউরুটি। তাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী লোকটি বলছিল, সেবার জাজপুরে যাত্রার আসর বসেছিল, বুঝলি। হই হই রই রই কাণ্ড। রামের বনবাস পালা হচ্ছে। খোদ লালমুখো সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট যাত্রা দেখতে এসেছে। আসরের পাশেই চেয়ারে বসা। তা পালা তো শুরু হল। কিন্তু রামের বনবাসে যাওয়া নিয়ে ঘ্যানঘ্যানানি, প্যানপ্যানানি, কান্নাকাটি সাহেবের তেমন পছন্দ হচ্ছিল না। ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসছে মাঝে মাঝে ভেড়ুয়াদের কান্নাকাটি দেখে। এমন সময় আসরে নামল বীর হনুমান। হনুমান দেখে সাহেব ভারী খুশি। হ্যাঁ, এতক্ষণে একটা জম্পেস ব্যাপার হল। সাহেব সঙ্গে সঙ্গে হনুমানের গায়ে একখানা দশ টাকার নোট ছুঁড়ে দিয়ে বলে উঠল, মোর হনু। মানে বুঝলি? মানে হল, আরও হনুমান চাই। অধিকারী তো তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে আর একজনকে হনুমান সাজিয়ে আসরে নামিয়ে দিল। উপায় তো নেই, সাহেবের মর্জি, সাহেব ফের দশ টাকা বখশিস দিয়ে হেঁকে উঠল, মোর হনুমান। অধিকারীমশাই ফের ছুটে গিয়ে আর একজনকে হনুমান সাজিয়ে নামিয়ে দিল। ফের দশ টাকা। সঙ্গে সঙ্গে হুকুম, মোর হনু। সে আমলের দশ টাকা তো কম নয়। টাকার ছড়াছড়ি দেখে তখন রাম সীতা লক্ষ্মণ সবাই গিয়ে হনুমান সেজে এসে আসরে নেমে পড়ল। রামের বনবাস চুলোয় গেল, আসর জুড়ে শুধু হনুমানদের হুপহাপ ধুপধাপ। তা আমাদের অবস্থাও হয়েছে। তাই। যার রামচন্দ্র হওয়ার কথা ছিল, যার সতীলক্ষ্মী সীতা হওয়ার কথা ছিল, যার ভ্রাতৃভক্ত লক্ষ্মণ হওয়ার কথা ছিল সবাই নিজের নিজের পাঠ শিকেয় তুলে হনুমান হয়ে নেমে পড়েছে। দেশ জুড়ে এখন শুধু হনুমানদের দাপাদাপি। তাই বলছিলুম, গান্ধীবাবা আর সুভাষ বোস মিলে যে সাহেবদের তাড়াল তাতে লাভটা কী হল বল তো! এক পয়সার পাঁউরুটি দেড় টাকায় ঠেলে উঠেছে।
বিড়ি ধরানোর গন্ধটা বড্ড ভাল লাগল তার। গন্ধেরও কত রকমারি আছে। মিষ্টি ঝাঁঝালো গন্ধে মনটা চনমনে হয়ে যায়। জ্ঞানী লোকটা বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে বলল, বুড়োশিবতলার জলায় এক সাহেবের মোটরগাড়ি কাদায় বসে গিয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা। কিছুতেই তোলা যায় না। তখন কাশীনাথ আর শিবনাথ দুই ভাই ক্ষেতের কাজ সেরে ফিরছিল। কাঁধে হাল, হাতে বলদের দড়ি। অবস্থা দেখে দু ভাই নেমে পড়ল কাদায়। দড়ি বেঁধে বলদ দিয়ে টেনে গাড়ি তুলে দিল। তারপর ঠেলে নিয়ে পোঁছে দিল দু মাইল দূরের ডাকবাংলোয়। সাহেব খুশি হয়ে দুই ভাইকে একশো টাকা করে বখশিস দিলেন। তখনকার একশো টাকা বাবা! তার অনেক দাম। দুই ভাই টাকা পেয়ে জমিজিরেত কিনে ফেলল। চাষবাস করে অবস্থা ফিরিয়ে ফেলল লহমায়। গাঁয়ে পুকুর কেটে দিল, শিবমন্দির গড়ে দিল। গায়ে সেন্ট মেখে জুতো মসমসিয়ে যখন রাঁড়ের বাড়ি যেত তখন রাস্তার দুধার থেকে লোকে সেলাম ঠুকত। তাই বলছিলুম, গান্ধীবাবা আর সুভাষ বোস মিলে সাহেব তাড়িয়ে কাজটা ভাল করেননি মোটে। সাহেবরা মাথার ওপর ছিল, সে একরকম। এখন যে কে কখন মাথায় চড়ে বসছে নগেনের পোষা বাঁদরটার মতো কে জানে বাবা! যিনি যখন চড়েন তখন তিনিই আমাদের জো-হুজুর।
ট্রাকটা তেমনই কেতরে কুকুরের মতো ঠ্যাং তুলে আছে। খালাসিটা একখানা চাকা খুলে ফেলে আর একখানা লাগাচ্ছে। তার ওপাশে ঝুপসি গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে আলোর চৌহদ্দির বাইরে থেকে ঠেলে উঠছে চাপ বাঁধা অন্ধকার। ফিনফিনে কুয়াশার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে চায়ের উনুনের ধোঁয়া আর বাসের চাকায় ওড়া ধুলো। উত্তরে বাতাসে শীতের চোরা টান টের পাওয়া যায়।
মানুষের একটা ফেরা থাকে। কোথা থেকে যে আসে, কোথায় যে ফিরে যায় তার মীমাংসা আজও হল না। দিনশেষে সে বাড়ি ফেরে বটে, কিন্তু এটা ঠিক ফেরা নয়। আর একটা আসল ফেরা আছে তার। সেইটে একটু একটু ভাবিয়ে তোলে তাকে আজকাল।
ধীরেন কাষ্ঠ উঠে পড়ল। পেচ্ছাপের বেগটা আর সামলানো যাচ্ছে না। চাপতে গেলে আজকাল হয়ে পড়ে।
শিশুগাছের তলায় বসে বেগটা ছেড়ে দিয়ে ধীরেন কাষ্ঠ একটা ভারী আরাম পেল। এইসব ছোটোখাটো প্রাকৃতিক কাজের মধ্যেও মাঝে মাঝে একটা ভারী আনন্দ হয় তার। পেচ্ছাপ করার আরামটা কি সবাই টের পায়? কে জানে বাবা! ধীরেন কাষ্ঠ পায়।
ব্যাপারটা যাচাই করার জন্যই সে ভালমানুষের মতো গিরীশ মুহুরিকে জিজ্ঞেস করেছিল, মুতে কেমন আরাম পাও হে গিরীশ?
গিরীশ তখন মাচা থেকে কচি লাউডগা কাটছিল। সুতোয় বেঁধে ভাতে দিয়ে সর্ষের তেল মেখে খেতে চমৎকার। প্রথমে কথাটা বুঝতে পারেনি। তারপর বুঝতে পেরে ভারী চটে উঠে বলল, ও তোমার কেমন কথা ধীরেনদা! মাথাটাই গেছে দেখছি! বলি সব ছেড়ে মুতের খতেন নিতে লেগেছ কেন?
কথাটা আরও দু-চারজনের কাছে যাচাই করার ইচ্ছে ছিল ধীরেনের। কিন্তু আর সাহস পায়নি। আজকাল লোকে বড় খপ করে চটে যায়। অথচ কত কী যে জানতে ইচ্ছে করে, জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে লোককে।
ফ্যান্সি স্টোর্সের সামনে দাঁড়িয়ে শো-কেসে সাজানো জিনিসপত্র ভারী অবাক চোখে দেখছিল ধীরেন। যত দিন যাচ্ছে কত কী নতুন নতুন জিনিস আসছে। মানুষের যে কত কী লাগে আজকাল! ধীরেনের লাগে না বটে, কিন্তু জিনিসগুলি সম্পর্কে তার অপার কৌতূহল। এই যেমন শ্যাম্পু বা কর্নফ্লেক বা বোতলের কড়াইশুঁটি কি দাড়ি কামানোর ফোম–যত দেখে তত ভাল লাগে তার।
দোকানি স্বপন একটু ঝুঁকে বলল, টর্চ নেবেন বলেছিলেন, নিলেন না তো জ্যাঠা!
ধীরেন একটু তটস্থ হয়ে বলে, নেব বাবা। বড্ড দাম।
চল্লিশ-পঞ্চাশের নীচে ভাল জিনিস নেই যে। দশ-পনেরো টাকার মালে গ্যারান্টি নেই, আলোও হয় না তেমন।
দেখি। আর দু-চারদিন যাক।
আগে টর্চ লাগত না, আজকাল মনে হয় একটা হলে হত। অন্ধকারে সাপ-খোপের ভয় আছে ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আজকাল কেমন যেন গা ছমছম করে। দিন দিন গা ছমছমে ভাবটা বাড়ছে আর বরুণ মিদ্দার যেন আজকাল কাছেপিঠেই ঘোরাঘুরি করে, তক্কে তক্কে থাকে। ধীরেন আজকাল এসব টের পায় খুব। গত পঁয়তাল্লিশ বছর বরুণ মিদ্দারের চিহ্নও ছিল না, এখন কেন যে ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে কে জানে বাবা।
কথাটা পাঁচকান করার মতো নয়। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ধীরেন কাষ্ঠ নামে বাইশ-তেইশ বছরের যে তরতাজা জোয়ান দাপিয়ে বেড়াত তার সঙ্গে এখনকার এই ধীরেন কাষ্ঠর সম্পর্কটাই বুঝতে কষ্ট হয়। কালোর মধ্যেও ভারী নাকি সুন্দর চেহারা ছিল সেই ধীরেন কাষ্ঠর। আর ছিল নানা দিকে মন। ম্যাট্রিক পাসটা করেছিল কোনওক্রমে, তারপর আর পড়া হল না। তবে হাতের কাজে ঝোঁক ছিল খুব। ভাল লাটাই তৈরি করতে পারত, পুতুল গড়ত, মূর্তি তৈরি করতে পারত, কাঠের কাজেও ছিল ভাল হাত। কিন্তু পাঁচ রকম জিনিসে মন দিতে গেলে কোনওটাই তেমন হয়ে ওঠে না। বাবা চরণ কাষ্ঠ তাড়না করত খুব। টাকা আয় না করলে ঘরছাড়া করার হুমকি দিত।
সেই সময়ে পাশের গাঁ শূলপুরে বরুণ মিদ্দারের কাছে গিয়ে জুটল সে। গুণী মানুষ, ঘরে বসে মৃদঙ্গ, খোল, দোতারা এইসব তৈরি করত। বিক্রিবাটা কিছু খারাপ হত না। তবে হাঁফি রুগি বলে সারা বছর কাজ তুলতে পারত না। ধীরেনকে পেয়ে তার সুবিধে হল। ধীরেন চিৎপুর থেকে কাঁচা মাল কিনে আনত, খদ্দের ধরে আনত আর বাকি সময়টা কাজ শিখত।
কিন্তু জীবনটা তো সবসময় সোজা পথে চলে না। হঠাৎ হঠাৎ বাঁক ফেরে। আর তখনই ভাঙন লাগে।
মিদ্দারের ঘরে ছিল কালনাগিনী। যেমন তার লকলকে চেহারা, তেমনই তার ঠাটঠমক। চোখের ভিতর থেকে যেন ইলেকট্রিক ঠিকরে আসত। বাপ রে! প্রথম প্রথম দেখে তো ভয়ই খেয়ে যেত ধীরেন। এই ফুটন্ত যুবতী বউকে সামলায় কী করে রোগাভোগা বরুণ মিদ্দার!
কারণে অকারণে তাদের কাজের ঘরে এসে উদয় হত বাতাসী। দু হাত তুলে খোঁপা ঠিক করত– তাতে বুকখান ঠেলে উঁচু হয়ে উঠত বেশ, অকাজের কথা বলে বলে ভাব করত ধীরেনের সঙ্গে। বরুণ মিদ্দার কিছু বলত না। তবে মুখ দেখে মনে হত বউ নিয়ে তার স্বস্তি নেই।
কিছুদিনের মধ্যেই ইশারা ইঙ্গিত শুরু করে দিল বাতাসী। সুরেলা গলায় উঠোন থেকে হয়তো একটু রসের গান গেয়ে উঠল, বা ছাগলছানাটাকে কোলে নিয়ে এমন সব কথা বলে আদর করত যা ছাগলছানাকে বলার কথা নয়।
সেই বয়সে তখনও ধীরেনের মেয়েমানুষের বউনি হয়নি। বাধোবাধো ভাব তো ছিলই, ভয়ও ছিল বেশ। কীসে পাপ লেগে যায় কে জানে বাবা! কিন্তু ওই দামাল বয়সে বাঁধ রাখাও কঠিন কাজ।
মুশকিল হল বরুণ মিদ্দার ঘর থেকে বেরোত না মোটে। রোগাভোগা মানুষ বলেও বটে আর তার কাজটাও ঘরে বসা কাজ বলেও বটে। ফলে বাতাসীর বিশেষ সুবিধে হচ্ছিল না। ধীরেনও নিজেকে খুব সংযত রাখত। ইশারা ইঙ্গিত পেয়েও চোখ তুলে তাকাত না।
কিন্তু সুযোগসন্ধানীদের কখনও সুযোগের অভাব হয়নি। ভগবানই কি পাপীদের জন্য নানা ফাঁকফোকর তৈরি করে দেন? তাই যদি না হবে তবে হঠাৎ সেদিন সন্ধেবেলা ঘটকবাড়ি থেকে বরুণ মিদ্দারের ডাক আসবে কেন? ঘটকরা বড় মানুষ, ডাকলে না গিয়ে উপায় নেই। মেয়ের স্কেল চেঞ্জার হারমোনিয়ম খারাপ হয়েছে, ফলে তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে, আজই গিয়ে হারমোনিয়ম সারিয়ে দিয়ে আসতে হবে।
বরুণ মিদ্দার যখন শশব্যস্তে যন্ত্রপাতির ব্যাগ নিয়ে রওনা হচ্ছিল তখন ভালমানুষের মতো ধীরেন বলেছিল, চলুন আমিও সঙ্গে যাই। কাজটা শেখাও হবে।
কথাটা শুনে ঘাড়ও কাত করেছিল মিদ্দার। তারপরই দোনোমোনোতে পড়ে গেল। নিয়তি কেন বাধ্যতে। যে খোলটার কাজ চলছিল সেটা সত্যকিশোর দাসের। মস্ত কীর্তনীয়া। কাজটাও জরুরি। কাল সকালেই সত্যকিশোরের লোক আসবে খোল নিতে। নগদ টাকার কারবার। তাই মিদ্দার একটু ভেবে বলল, হারমোনিয়ম সারাতে সময় লাগবে। তুই বরং খোলটা এগিয়ে রাখ, আমি এসে বাকিটুকু করব।
নিয়তি! নিয়তি ছাড়া আর কী? মিদ্দার কুকুরের মুখের কাছে রসালো মাংসের টুকরো রেখে চলে গেল। আহাম্মক আর কাকে বলে!
বোধহয় পাশের শোওয়ার ঘরে দম বন্ধ করে অপেক্ষায় ছিল বাতাসী। তাকেই কি দোষ দিতে পারে ধীরেন? না, আজও দোষ দিয়ে উঠতে পারে না। উপোসি শরীর, তীব্র অতৃপ্ত কাম কামনা, মনের জ্বালা মানুষের মাথা ঠিক রাখতে দেয় নাকি?
মিদ্দার বাড়ির চৌহদ্দি ডিঙোতে না ডিঙোতেই বাতাসী যেন বাজপাখির মতো উড়ে এল।
অ্যাই!
ধীরেন ধুকপুক করা বুকে নিচু মাথা উপরে তুলেই দেখল দুটো চোখ জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। শরীরের ছিলা টান টান।
ধীরেন ভালমানুষের মতো বলল, কী?
যেন ভারী অবাক হয়ে বড় বড় চোখ করে বাতাসী বলল, কী? কী?
তারপরই ছুটে এসে তার ঝাঁকড়া চুল দু হাতে খামচে ধরে ঝাঁকানি দিতে দিতে পাগলের মতো বলতে লাগল, কী? কী? তুমি জানো না কী? তুমি জানো না? ন্যাকা কোথাকার…।
গায়ে কী জোর রে বাবা! ধীরেনের মতো জোয়ান লোককে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে ফেলল পাশের ঘরের বিছানায়। উন্মাদিনীর মতো তাকে খাবলাচ্ছে, খিমচোচ্ছে আর বলছে, জানো না কী? জানো না? বদমাশ! শয়তান! জানো না?
ধীরেনের বাঁধ ভেঙেছিল আগেই। এবার ভেসে গেল।
কতটা পাপ হল তা ধীরেন জানে না। কিন্তু কোনওদিন যদি ভগবান তাকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করেন তা হলে ধীরেনও সপাটে বলবে, আমি কি ইচ্ছে করে করেছি কিছু? আপনিই তো ঠাকুর, ঘটকবাড়ির হারমোনিয়ম খারাপ করে রেখেছিলেন। তাও ভর সন্ধেবেলা। তার ওপর আবার পরদিন ঘটকবাড়ির মেয়েকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে বলে তাদের তর সয় না। এই এতগুলো যোগাযোগ এই ত্র্যহস্পর্শ ঠাকুর, আপনি ছাড়া আর কে ঘটাতে পারে? আমি তো সঙ্গেই যেতুম, কিন্তু সত্যকিশোরের খোল বাদ সাধল যে!
পাপবোধটা বড্ড খোঁচা দিচ্ছিল, যখন একটু বেশি রাতের দিকে বরুণ ফিরে এল। তখন ধীরেন নতুন খোল ছাওয়ার কাজটা অনেক এগিয়ে রেখেছে। বরুণ তার মুখখানা ভাল করে দেখল। তারপর মুখটা একটু তেতো করে বলল, রাত হয়েছে বাড়ি যা।
মিদ্দার বোকা লোক নয় যে, টের পাবে না। এসব বাতাসেই টের পাওয়া যায়, টের পেতে চাইলে। খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে, দুরুদুরু বুকেই অত রাতে দু মাইল পথ হেঁটে বাড়ি ফিরেছিল ধীরেন। দুশ্চিন্তায় আর ভয়ে রাতে ভাল ঘুম হয়নি। তার মধ্যেও মনস্তাপে বারবার চমকে ঘুম ভেঙে গেছে।
পরদিন অপরাধী মুখ নিয়ে সে যখন গিয়ে মিদ্দারের বাড়িতে হাজির হল তখন কোনও বৈলক্ষণ চোখে পড়ল না। মিদ্দার তার কাজের ঘরে বসে কাজ করছে, বাতাসী ঘরকন্নার কাজ করছে। তাকে দেখে একটু হাসল। খুব মিষ্টি আর মানেওয়ালা হাসি।
একবার হলে পাপ আবার হতে চায়। একবার পর্দাটা সরে গেলে আর ঢাকা-চাপা দেওয়া যায় না কি না।
কিন্তু বরুণ মিদ্দার তো আর নিত্যি নিত্যি সন্ধেবেলা ঘটকবাড়ি হারমোনিয়ম সারাতে যায় না। সুতরাং বাতাসী অন্য পন্থা নিল। রান্নায় মিশিয়ে কী যেন একটা খাইয়ে দিল মিদ্দারকে। সেই খেয়ে মিদ্দারের ছুটল হাগা। একে রোগাভোগা মানুষ, চার-পাঁচবার দাস্ত করেই নির্জীব হয়ে নেতিয়ে পড়ল বিছানায়। গাঁয়েগঞ্জে ডাক্তারের ব্যবস্থা নেই। গ্যাঁদাল থানকুনি ছেঁচে বাতাসীই খাওয়াল তাকে। দুর্বল মানুষটা যখন ঘুমিয়ে পড়ল তখন ফের ব্যাপারটা হল। কী শরীর! কী শরীর বাতাসীর!
তবে ষড়যন্ত্রটা মোটেই ভাল লাগল না ধীরেনের। সে বলল, তুমি খুব পাষণ্ড আছ বাপু। মিদ্দারকে ওষুধ খাওয়ালে, মরেটরে যেত যদি?
যেত তো যেত। মরলে বাঁচি। সারাজীবন ওই নপুংসককে গলায় ঝুলিয়ে বেঁচে থাকব নাকি?
কাজটা ভাল করোনি। এরকম করলে আমি কিন্তু আর আসব না।
ইস্! না এসে পারবে?
পারবে না, সে ধীরেনও জানে। তার তখন নেশা ধরেছে।
বাতাসী একদিন প্রস্তাব দিল, আমাকে নিয়ে পালাবে?
এ প্রস্তাবে আকাশ থেকে পড়ল ধীরেন। বিয়ে করার মতো অবস্থাই তার নয়। বাপ এমনিতেই রোজ চাকরি-বাকরি করার জন্য হুড়ো লাগাচ্ছে। মাও মুখনাড়া দিয়ে তবে দুটি ভাত দেয়। তার ওপর অন্যের বউ ফুসলিয়ে বাড়ি নিয়ে তুললে তো চিত্তির। বাড়িতে কাকচিল বসতে পারবে না। তার ওপর বাতাসীর মতো মেয়েছেলে। এ তো দিনকে রাত করতে পারে। একে বিশ্বাস কী?
সে মিন মিন করে বলল, কাজটা ঠিক হবে না।
কেন হবে না শুনি? তোমার আপত্তি কীসের?
শত হলেও বরুণদাদা আমার গুরু, তার কাছে কাজ শিখছি। তার সঙ্গে নেমকরাহামি করব কী করে?
আহা, সাধুপুরুষ রে! নিমকহারামি যা করার তো করেই ফেলেছ। আমার পেটে তোমার ছেলে। নিমকহারামির আর বাকি আছে কিছু?
খবরটা শুনে ধীরেন অগাধ জলে পড়ল। ঘটনাটা সত্যি হয়ে থাকলে তো জল অনেক দূর গড়িয়েছে। ভয় খেয়ে ধীরেন বলল, আমার চালচুলো নেই বাতাসী, তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধার মতো অবস্থাও নয়।
বাতাসী বলল, তা হলে মিদ্দারকে সরাও। সরিয়ে দুজনে বেশ এখানেই থাকব।
ধীরেন অবাক হয়ে বলে, সরাব? সরাব কোথায়?
আহা, সরানো মানে বুঝলে না? দুনিয়া থেকে সরাও।
ধীরেনের মাথায় বজ্রাঘাত। মেয়েটা বলে কী? এ যে মিদ্দারকে খুন করাতে চাইছে! ভীষণ ভয় খেয়ে সে বলল, ছিঃ, ওসব বোলো না। বলতে নেই। শুনলেও পাপ হয়।
মশা মাছি মারলে যা পাপ হয় ভগবানের দুনিয়ায় মানুষ মারলে তার বেশি হয় না। বুঝলে? যদি পাপের ভয়ে পিছিয়ে যাও তা হলে তুমি বোকা। ভগবানের কাছে মশা, মাছি, পোকা, মানুষ সব সমান।
ধীরেন মাথা নেড়ে বলল, ওসব মরে গেলেও আমি পারব না।
তা হলে কাজটা আমিই করব। তুমি সাহায্য কোরো, তাহলেই হবে।
ধীরেন এ কথায় এত ভয় পেয়েছিল যে বলার নয়।
যে সময়ে তাদের কথা হচ্ছিল সে সময়ে মিদ্দার হাটে গিয়েছিল। ফিরে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে তাদের কথা বলতে দেখে গম্ভীর মুখ করে নিজের কাজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। ভারী অপরাধবোধ হচ্ছিল ধীরেনের। একটু আগেই দুপুরবেলা মিদ্দারের বিছানাতেই জড়ামড়ি করে শুয়ে থেকেছে সে আর বাতাসী। দুপুর তুফানের মতো উড়ে গেছে। এখন বড় অবসাদ, বড় পাপবোধ। মিদ্দার বোধহয় সবই টের পায়, তবে কেন ফুঁসে ওঠে না? কেন তাড়িয়ে দেয় না ধীরেনকে? কেন ঝাঁটাপেটা করে না বাতাসীকে?
ধীরেন বড় টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে গেল। কী যে অবস্থা গেছে কদিন তা বলার নয়। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এসব কাণ্ড যখন চলছে তখনও কিন্তু বরুণ মিদ্দার শান্ত, চুপচাপ। আপনমনে নিজের কাজ করে যায়। তার ঘর থেকে নানা বাদ্যযন্ত্র পরীক্ষার নানা সুরেলা শব্দ ওঠে। আর কোনওদিকেই যেন মন নেই মিদ্দারের।
তখন ঘোর বর্ষাকাল। এক তুমুল বৃষ্টির রাতে বরুণ মিদ্দার বলল, আজ কি আর যেতে পারবি?
ধীরেন বলল, পারব। বর্ষাবাদলায় আমার অসুবিধে হয় না।
বরুণ মিদ্দার বলল, কাজ কী ফিরে? চাট্টি ভাত খেয়ে এখানেই শুয়ে থাক।
ধীরেন আপত্তি করল না। রাতে বাতাসী খিচুড়ি বেঁধেছিল। তাই খেয়ে বাদ্যযন্ত্রের ঘরে মাদুরে শুয়ে রইল ধীরেন। তুমুল বৃষ্টি আর প্রলয় বাতাসে ঘরদোর ভেঙে পড়ার অবস্থা। পাশের ঘরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কী হচ্ছে তা ভাবতে ভাবতে একটু ভয়-ভয় ভাব নিয়েই ধীরেন ঘুমিয়ে পড়েছিল।
অচেনা যে-ভয়টা তার মনের মধ্যে ছিল সেই ভয়টা যে কেন তা হঠাৎ করে তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যখন নিশুত রাতে হঠাৎ একটা উন্মাদিনী মেয়েমানুষের শরীর তাকে সাপের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল।
ধীরেন সেই আলিঙ্গন ছাড়াতে ছাড়াতে চাপা গলায় বলল, করো কী? বরুণদা টের পাবে যে!
ভয় নেই, ওকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছি।
কী ওষুধ?
ও তুমি বুঝবে না।
বিষ দাওনি তো?
না গো না, ঘুমের ওষুধ। ভয় পেও না।
মনে একটা ধন্দ থেকেই গিয়েছিল তবু ধীরেনের। এ পাগলি কী করে এল মিদ্দারকে ফাঁকি দিয়ে কে জানে! বাতাসীকে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব ছিল না। সে তার পাওনাগণ্ডা আদায় করে যেমন এসেছিল তেমনই চলে গেল হঠাৎ। বৃষ্টির তেজ আরও বাড়ল। হাওয়ায় তখন ঝড়ের গর্জন। ধীরেন অশান্ত মনে খানিকক্ষণ এপাশ ওপাশ করে ঘুমিয়ে পড়ল।
ম্যাদাটে আলোয় ভোরবেলা উঠে ধীরেন দেখল, ঝোড়ো বাতাস থামলেও বৃষ্টি পড়েই চলেছে। উঠোনে এক হাঁটু জল। ঘরের ভিটে ডুবে যেতে আর খুব বাকি নেই। কেঁচো, কেন্নো, উইচিংড়েরা বারান্দা ভরে ফেলেছে। আর উঠোন, বাগান, সব জলে একাকার। কোথাও ডাঙাজমি দেখা যাচ্ছে না। ঘটির জলে চোখমুখ ধুয়ে সে কিছুক্ষণ চারদিকের অবস্থা দেখল দাঁড়িয়ে। এই অবস্থায় বাড়ি ফেরা শক্ত হবে। কিন্তু ফেরাটাও দরকার। কাল রাতে যা হল তাতে তার আর এ বাড়িতে থাকতে সাহস হচ্ছে না। বরুণ মিদ্দার কিছু টের পেয়ে থাকলে বড় লজ্জার কথা।
ও-ঘর থেকে অবশ্য কোনও সাড়াশব্দ আসছিল না। আকাশের আলো দেখে ধীরেন অনুমান করল, সকাল ছটা-সাড়ে ছটা হবে। এত বেলা অবধি ওদের ঘুমোনোর কথা নয়।
ধীরেন ঘরে এসে মাদুরে চুপচাপ বসে রইল। মনে বড় দুশ্চিন্তা।
আরও কিছুক্ষণ বাদে দরজা খোলার শব্দ হল। ও-ঘর থেকে বরুণ মিদ্দার এসে মাদুরে বসল। তাকে দেখে খুশিই হল ধীরেন। যাক, বাতাসী তাহলে লোকটাকে বিষ-টিষ দেয়নি। কিন্তু মিদ্দারের অবস্থা ভাল নয়। বর্ষার ঠান্ডা আর জোলো বাতাসে তার হাঁফের টান উঠেছে, গলায় শ্লেষ্মার শব্দ হচ্ছে, চোখ দুটো লাল আর টসটসে। গলা আর মাথায় কম্ফর্টার জড়ানো। গায়ে চাদর।
এঃ, শরীরটা যে খারাপ দেখছি বরুণদাদা?
বরুণ মিদ্দার কথাই কইতে পারল না। কিছুক্ষণ হাঁফাল, বারান্দায় গিয়ে অনেকটা শ্লেষ্মা ফেলে এসে ফের কিছুক্ষণ কাহিল শরীরে বসে হাঁফ ছাড়ার জন্য হাঁসফাঁস করল। আবার গিয়ে শ্লেষ্মা ফেলল।
বার কয়েক শ্লেষ্মা উগড়ে একটু ধাতস্থ হয়ে বরুণ মিদ্দার হঠাৎ তাকে বলল, তোর তো গায়ে বেশ জোর-টোর আছে। একটা ভারী জিনিস তুলতে পারবি?
ধীরেন অবাক হয়ে বলল, কী তুলতে হবে বরুণদাদা?
একটা লাশ। মেয়েমানুষের লাশ।
ধীরেন এত স্তম্ভিত হয়ে গেল যে, মুখ দিয়ে বাক্য সরল না। বড় বড় চোখে চেয়ে রইল।
পারবি না?
ধীরেন স্খলিত কণ্ঠে শুধু বলল, অ্যাঁ!
বরুণ মিদ্দার হঠাৎ একটা হাত বাড়িয়ে তার ডান হাতের কবজিটা শক্ত করে ধরে ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, আয়।
ধীরেনের আজও মনে আছে, সে যেন একটা ঘোরের মধ্যে মিদ্দারের সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল। শরীরে একরত্তি শক্তি নেই, পা দুটো ভেঙে আসছে ভয়ে, মাথাটা বড্ড ধোঁয়াটে।
দরজা জানালা বন্ধ বলে ঘরটা এখনও অন্ধকার। আবছা দেখা যাচ্ছিল, বাতাসী বিছানায় আড়াআড়িভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। দুটো পা বেরিয়ে আছে চৌকির বাইরে।
ধীরেন হাঁ করে চেয়ে রইল।
বরুণ মিদ্দার বলল, এতকাল লুকিয়ে-চুরিয়ে নষ্টামি করছিল, টের পেয়েও কিছু বলিনি। আমি কি বুঝি না যে, ওরও একটা পুরুষমানুষ দরকার! টের পেয়েও না-পাওয়ার ভান করতুম। কিন্তু কাল রাতে যা করল তা কি সহ্য করা যায় বল তো! হাঁফানির টান বেড়েছে বলে ঘুমোতে পারছি না। এপাশ ওপাশ করছি। জেগে আছি জেনেও দিব্যি উঠে চলে এল এ-ঘরে। আমি গলাখাঁকারি দিয়ে জানান দিলুম যে জেগে আছি। তবু গ্রাহ্য করল না। যেন আমি কেউ না, কিছু না। চলে এল, আর আমি তখন বসে বসে ভাবলুম যা করার আজই করতে হবে। এ জিনিস আর সহ্য করা যায় না।
ধীরেন তখনও হাঁ করে পলকহীন চোখে চেয়ে আছে মিদ্দারের দিকে। বরুণ মিদ্দার তার চাদরের তলা থেকে তার হাতটা বের করল। হাতে একটা তারের ফাঁস। বাদ্যযন্ত্রের সরু স্টিলের শক্ত তার দিয়ে তৈরি। একপ্রান্তে কাঠের হাতল লাগিয়ে নিয়েছে, যাতে টান মারতে সুবিধে হয়। এ অস্ত্র যে ভয়ংকর তা ধীরেন জানে, একটা হ্যাঁচকা টান মারলেই গলার মাংস কেটে বসে যাবে। আধখানা গলা নেমে যাবে লহমায়। দড়ির ফাঁসের চেয়ে বহুগুণ ভয়ংকর।
বরুণ মিদ্দার বলল, একটা শব্দ করারও সময় পায়নি। হাসি-হাসি মুখ করে তোর ঘর থেকে এসে দিব্যি আমার পাশে শুয়ে পড়ল। এমনকী আমি জেগে আছি জেনেও নির্লজ্জের মতো বলল, একটু সরে শোও তো, গরম লাগছে। যেন কিছুই হয়নি। গায়ে জ্বালা করে না, বল তো! কিন্তু আমি হড়বড় পছন্দ করি না। ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে পছন্দ করি। চমকে দেওয়ার জন্য বললুম, হ্যারিকেনটা একটু উসকে দেখ তো, ঘরে বোধহয় সাপ ঢুকেছে। সাপ শুনে টক করে উঠে বসে বলল, কোথায় সাপ? ব্যস, ওইটাই শেষ কথা। তৈরিই ছিলুম, ও উঠে বসতেই গলায় ফাঁসটা গলিয়ে টেনে দিলুম।
ধীরেন ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল। শুধু ভাঙা গলায় বলল, সর্বনাশ!
একটু হাত লাগাতে হবে যে রে। লাশটা ইট বেঁধে পিছনের ডোবায় ফেলতে হবে।
ধীরেন আতঙ্কিত গলায় বলল, আমি পারব না।
বরুণ মিদ্দার হাসল, পারব না বললে কি হয়! ফুর্তি লুটবে আর দায় সারবে না তাই কি হয়?
পায়ে ধরছি বরুণদা, ও আমি পারব না।
পারত না ধীরেন। তার হাত-পা ভয়ে অবশ। দৌড়ে পালাবে ভেবেছিল, কিন্তু শরীরে তখন একরত্তি ক্ষমতা নেই।
আচমকাই বরুণ মিদ্দার হাতের ফাঁসটা তার গলায় গলিয়ে হালকা একটা টানে সেঁটে দিয়েছিল ফাঁস। ওই একটু টানেই ধারালো তার বসে গেল গলায়, দম আটকে এল তার। টপটপ করে গরম রক্ত ঝরে পড়ছিল গলা থেকে বুকে।
ফাঁসটা আলগা করে বরুণ মিদ্দার বলল, এই। ওকে কাঁধে নে। গড়বড় করলে কিন্তু বাঁচবি না।
ধীরেনের বাঁচার কথাই ছিল না সেদিন। বরুণ মিদ্দার রোগাভোগা মানুষ হলেও রাগে আর প্রতিহিংসায় সেদিন তার শরীর লোহার মতো শক্ত। আর ধীরেন সেদিন ভয়ে আতঙ্কে কেঁচো। গলায় তারের ফাঁস, তার হাতলটা মিদ্দারের শক্ত মুঠোয় ধরা। সেই অবস্থাতেই বাতাসীর ঠান্ডা শক্ত শরীরটা যে কীভাবে কাঁধে তুলেছিল ধীরেন তা আজও রহস্য। প্রাণের ভয়ে মানুষ কী না পারে! বাতাসীর গলা অর্ধেক নেমে গিয়েছিল, রক্তে ভেসে যাচ্ছিল বিছানা। বরুণ মিদ্দার ফাঁসের হাতল ধরে থেকেই দরজা খুলল, বলল, নাম।
উঠোনে হাঁটু জল, এঁটেল পিছল মাটি, কাঁধে বাতাসী। সে যে কী অবস্থা তার! সে যদি হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যায় তাহলে মিদ্দারের হাতে ধরা ফাঁস ঘ্যাঁস করে গলায় বসে যাবে। আর মিদ্দার যদি পা পিছলে পড়ে তাহলেও একই পরিণতি। ধীরেনের তখন দু চোখে জলের ধারা। এরকম বিপদে সে কখনও পড়েনি। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। চারদিক অন্ধকার। লোকজনের চিহ্ন নেই। উঠোন পেরোনোই হয়ে দাঁড়িয়েছিল শক্ত কাজ। পা টিপে টিপে সেটা পেরোনোর পর পিছনে ডোবার ঢল। ঢালু দিয়ে এই লাশ কাঁধে নিয়ে নামা তো সোজা নয়। একটু এদিক ওদিক হলেই তার গলায় ফাঁস বসে যাবে।
সজনেগাছের তলায় কিছু ভাঙা ইটের স্তূপ ছিল। সেখানে এসে মিদ্দার বলল, ওকে নামিয়ে ওর পেট-কোঁচড়ে ইটের টুকরোগুলো ভাল করে বাঁধ। তাড়াতাড়ি কর, সময় নেই।
সেই জলের মধ্যে বাতাসীকে নামাতে হল। তারপর ইটের টুকরো জড়ো করে আঁচলে বেঁধে তা কোমরে জড়িয়ে গিঁট দেওয়া–ওই প্রবল বৃষ্টির মধ্যে কাজটা তো সোজা নয়। তার ওপর ধীরেনের হাত-পা তখন বশে নেই। তবু সে অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য প্রাণের তাড়নায় জন্তুর মতো মিদ্দার যেমন বলছিল–করে যাচ্ছিল। কাজটা যে খুব সুষ্ঠু হল তাও নয়। আঁচল কোমরে জড়িয়ে বাঁধতে গিয়ে বারবার বাতাসীর মুখের দিকে চাইতে হচ্ছিল তাকে আর চোখ বুজে ফেলছিল সে।
এবার সাবধানে ডোবার ঘাটে নাম।
নাবব? পড়ে যাব যে! আর পড়লেই–
বৃষ্টিতে ভিজে এখন বরুণ মিদ্দারের অবস্থাও ভাল নয়। হাঁফের টান চৌগুণে উঠেছে। তবু গর্জন করল, নাম বলছি। মরলে দুজনেই মরব। মরতে ভয় কী রে শালা? ফুর্তি লোটার সময় মনে ছিল না?
ডোবার নাবালে ওই লাশ নিয়ে নামতে গিয়েই ধীরেন বুঝল, আজ মৃত্যু নির্ঘাৎ। এত পেছল মাটি যে দাঁড়ানোই যাচ্ছে না। এক ধাপের পর দ্বিতীয় ধাপেই হঠাৎ পা হড়কে চিত হয়ে পড়ে গেল ধীরেন। বাতাসীর লাশ পড়ল তার ওপর। চোখের পলকে তার গলায় ফাঁসটা টাইট হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু হঠাৎ সেটা ফের আলগাও হয়ে গেল।
হাঁচোড়-পাঁচোড় করে মাথা তুলেই ধীরেন দেখল, বরুণ মিদ্দারও পড়ে গেছে জলে। হাতে ফাঁসের হাতলটা নেই। সাদা মুখ, বড় বড় চোখ, হাঁ করে শ্বাস টানতে টানতে উঠতে চেষ্টা করছে। ধীরেন দেখল, এই সুযোগ। এক মুহূর্ত দেরি না করে সে বরুণ মিদ্দারের মাথাটা ধরে চেপে দিল জলের তলায়। হাত পা ছুঁড়েছিল বটে মিদ্দার। আঁকুপাঁকু করেছিল। কিন্তু এক মিনিটও নয়। জলের তলায় স্থির হয়ে গিয়েছিল সে। গলার ফাঁসটা খুলতে ভুলে গিয়েই ধীরেন জল ভেঙে ছুটতে শুরু করেছিল।
.
০৭.
ভোররাতের নির্জনতায় একটা অ্যালার্ম ঘড়ি বেজে উঠল। কুক-কুক-কুক-কুক।
নিস্তব্ধতার ওপর শব্দের ছুরি বসে যাচ্ছে উপর্যুপরি। সেই শব্দে তন্দ্রা ভেঙে নিরর্থক খানিকক্ষণ প্রথমে ভুক ভুক, তার পর ভৌ ভৌ করে চেঁচাল কেলো নামে কুকুরটা। তার কোনও বীরত্ব নেই, সে জানে। মাঝে মাঝে তবু তাকে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে হয়। মহিম রায়ের বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে সে খানিকক্ষণ ঊর্ধ্বমুখ হয়ে ঘড়িটাকে বকাঝকা করল। অ্যালার্ম থামল না। কোয়ার্টজ ঘড়ির অ্যালার্ম সহজে থামেও না। তীক্ষ্ণ শব্দটা বারবার চারদিকের নির্জনতায় ছুরির মতো ঢুকে যাচ্ছে।
কেলোর চিৎকারেই ধড়মড় করে উঠে বসেছিল সন্ধ্যা। চোর এল নাকি? চোরেদের খবর থাকে। কাল রাতেই ছ হাজার সাতশো টাকা পেমেন্ট দিয়ে গেছে রাতুল নস্কর। টাকাটা এখনও তার বালিশের তলায়। কাল রাতে আলমারিতে তুলে রাখার সময় পায়নি। বালিশের নীচে হাত ঢুকিয়ে সে তাড়াতাড়ি বান্ডিলটা দেখল। অনেক কষ্টের রোজগার তার। টাকাও কি সহজে আদায় হয়েছে এতকাল? দোকানদাররা টাকা দিতে কত গড়িমসি করে। কতবার ঘোরায়। বেশি তাগাদা দিলে মাল তুলতে চায় না। আজকাল আদায় উশুল খানিকটা সহজ হয়েছে। টর্চ জ্বেলে চারদিকটা দেখে নিল সন্ধ্যা। না, কেউ ঢোকেনি ঘরে। ওপাশের আর একটা চৌকিতে সীমন্তিনী নামে কাজের মেয়েটা ঘুমোচ্ছ। গাঢ় ঘুম। সারাদিন যা অসুরের মতো খাটুনি যায় তাতে সন্ধ্যারও ঘুম গাঢ় হওয়ার কথা। কিন্তু হয় না। মাঝে মাঝে নিশুতরাতে অকারণে ঘুম ভেঙে যায়। না, ঠিক অকারণে নয়। ঘরে নগদ টাকা থাকে তার। সব সময়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে দিয়ে আসার সময় হয় না। চোরছ্যাঁচড়ের ভয়েতেই বোধহয় আজকাল ঘুম খুব সজাগ হয়েছে তার। পঞ্জিকা থেকে চোরের মন্তর শিখে নিয়েছে সে। রোজ সেইসব মন্তর বিড়বিড় করে আওড়ায়। তারপর শোয়। কিন্তু মন্তরের ভরসায় আর কে নিশ্চিন্তে ঘুমোয় বাবা! ঘুম ভাঙার আরও একটা কারণ হল, তার এই জীবনটা। এ যে কোথায় গিয়ে কেমনভাবে শেষ হবে কে জানে! মাঝে মাঝে একজন তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় বটে, কিন্তু বড্ড বাধো বাধো ঠেকে। বাবা বা দাদারা শুনলে কী বলবে। বাবা হয়তো শয্যাই নিয়ে নেবে। ওসব ভাবতে কেন যেন সাহস হয় না তার, আবার ইচ্ছেও করে। স্বামীটার কথাও সারা দিনে না হলেও এই নিশুতি রাতে ঠিক মনে পড়বেই। হাড়েবজ্জাত লোকটার ওপর তার রাগ হয় বটে, কিন্তু কেন যেন মায়াও হয়। পুরুষ জাতটা তো ভালবাসতে জানে না। ভালবাসে মেয়েরাই। আর সেই জন্যই মরে।
কেলোর চিৎকার ছাপিয়ে ঘড়ির অ্যালার্মটা হঠাৎ শুনতে পেল সন্ধ্যা। মুরগি যেমন উঠোনে দানা খুঁটতে খুঁটতে আদুরে শব্দ করে ঠিক তেমনই শব্দ। কুককুক কুককুক। দোতলা থেকে আসছে। টর্চ জ্বেলে দেয়ালঘড়িটা দেখল সন্ধ্যা। ভোর পৌনে চারটে বাজে। মেমসাহেব এত সকালে তো ওঠে না। বেলা আটটা বাজলে বারান্দায় এসে নাইটি-পরা অবস্থায় ভাসুর-শ্বশুরের চোখের সামনে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজে। তখন সন্ধ্যার ইচ্ছে করে একটা ঢেলা তুলে ছুঁড়ে মারতে। কিন্তু মেয়েটা একটু কিম্ভূত আছে। সন্ধ্যা ওঠে ভোর পাঁচটায় বা তারও একটু আগে। উঠে প্রায় সময়েই দেখতে পায়, মেয়েটা ভূতের মতো বারান্দার এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কেন ওরকম দাঁড়িয়ে থাকে কে জানে বাপু!
সন্ধ্যার সন্দেহ ক্রমে ঘনীভূত হচ্ছে। ছেলেটা কলকাতায় যাতায়াত করে বটে, কিন্তু মা আর মেয়েতে পনেরো-ষোলোদিন ধরে কেন যে থানা গেড়ে আছে সেটাই সন্দেহের বিষয়। মেজদা কিছুতেই ওদের নিয়ে যাচ্ছে না। শুধু মেয়েটার অ্যালার্জি সারাতেই এখানে রয়েছে, এটা গুয়ে হাত দিয়ে বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। কেলেঙ্কারির গন্ধটা খুব পাচ্ছে সন্ধ্যা, কিন্তু সেটা কতদূর খারাপ সেটাই ধরতে পারছে না। কথা বললে পাছে মুখ ফসকে দু-একটা কথা বেরিয়ে পড়ে সেই ভয়েই বাড়ির কারও সঙ্গে কথাই বলে না ওরা। এমনকী ওদের খাবার পর্যন্ত ঝি সাবিত্রীকে দিয়ে ঘরে পৌঁছে দিতে হয়।
আমলকীটা খুব চলছে। বিটনুন দিয়ে জারিয়ে রোদে শুকিয়ে প্যাকেট করে ছেড়েছে সন্ধ্যা। খুব চলে। গত শীতে এক কুইন্টাল আমলকী কিনেছিল, তার কয়েক কেজি মাত্র পড়ে আছে। ঘরে রাখলে ছাতা ধরে যায় বলে মাঝে মাঝে রোদে দিতে হয়। পরশু দিন উঠোনে চাটাই পেতে যখন আমলকীগুলোকে রোদ খাওয়াচ্ছিল সে তখন মেয়েটা হঠাৎ দোতলা থেকে নেমে এল। একটু এদিক ওদিক পায়চারি করে কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। সন্ধ্যা আড়চোখে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। পাত্তা দেয়নি।
মেয়েটাই আচমকা বলল, এগুলো কি আমলকী?
সন্ধ্যা একটু অবাক হল। তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলবে, এতটা ভাবেনি। ভদ্রতার খাতিরেই সন্ধ্যা বলেছিল, হ্যাঁ।
তাকে আরও অবাক করে দিয়ে মেয়েটা বলল, একটু টেস্ট করে দেখতে পারি?
ভারী অবাক হল সন্ধ্যা, একটু খুশিও হল কি? একটু কথা বলার ভিতর দিয়ে যে কত মেঘ কেটে যায়। সন্ধ্যা বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, খাও না, খাও।
সোহাগ নিচু হয়ে দু-তিনটে আমলকী তুলে মুখে দিয়ে তার দিকে চেয়ে ছেলেমানুষের মতো বলল, এগুলো কি চিবিয়ে খেতে হয়?
সন্ধ্যা একটু হেসে বলে, না না। শুকনো আমলকি চিবিয়ে খাওয়া যায় না। গালে রেখে দাও। ভিজে নরম হয়ে গেলে তখন চিবোবে।
সোহাগ খানিকক্ষণ মুখের আমলকী এ-গাল ও-গাল করে বলল, বেশ লাগে তো খেতে।
সন্ধ্যা খুশি হয়ে বলল, আরও নাও না। নিয়ে গিয়ে ঘরে রেখে দাও। যখন ইচ্ছে হবে খেও।
তার দরকার নেই। খেতে ইচ্ছে হলে আপনার কাছে এসে খেয়ে যাব।
সন্ধ্যা এটুকুতেই যেন গলে গেল। বলল, আমি পিসি হই। আমাকে আপনি-আজ্ঞে করতে নেই।
সোহাগ হঠাৎ উদাস হয়ে গেল যেন। শুধু বলল, আচ্ছা।
তারপর মুখ ফিরিয়ে খানিক আনমনে উঠোনের এদিকে সেদিকে একটু হেঁটে বেড়াল। যখন প্রথম এসেছিল তখন যেমন ঢলঢলে দেখতে ছিল এখন আর তেমন নেই। একটু যেন রোগা হয়েছে, একটু রুক্ষ। সন্ধ্যা লক্ষ করেছে মেয়েটা একদম সাজে না, চুলটা পর্যন্ত আঁচড়ায় না ভাল করে, সন্ধ্যা মনে মনে খুব চাইছিল মেয়েটা তার সঙ্গে আরও একটু কথা বলুক, একটু ভাব করুক।
না, আর কোনও কথা বলেনি সোহাগ। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে যেমন এসেছিল তেমনই আবার ওপরে চলে গেল। গতকাল কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকবার সোহাগকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে সন্ধ্যা। কিন্তু তার দিকে তাকায়নি সোহাগ। আমলকী খেতেও আসেনি। কিন্তু সন্ধ্যা খুব অপেক্ষা করেছিল। যদি আসে!
সন্ধেবেলা কাসুন্দি আর আচারের শিশি ভর্তি করে লেবেল লাগাতে খুব ব্যস্ত ছিল সন্ধ্যা। তিনটে মেয়ে মেঝেতে বসে মন দিয়ে লেবেল লাগিয়ে যাচ্ছে। মাটির মালসায় আঠা, ডাঁই করা লেবেল, স্তূপাকার ঝুড়িভর্তি শিশি-বোতল। সকালেই মাল নিতে আসবে চার-পাঁচজন। আজ অনেক রাত অবধি জাগতে হবে সন্ধ্যাকে।
ঠিক এমন সময়ে খোলা দরজার ওপাশ থেকে মিষ্টি মিহি গলা পাওয়া গেল, আমি একটু ভিতরে আসতে পারি?
তেমনই অবিন্যস্ত চুল, তেমনই ঝ্যালঝালে একটা মেটে রঙের ঢলঢলে কামিজ আর বিবর্ণ একটা প্যান্ট-পরা সোহাগ চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। দেখে এত ব্যস্ততার মধ্যেও সন্ধ্যা হঠাৎ উদ্ভাসিত হয়ে গেল। বলল, এসো এসো।
মেয়েটা ঘরে ঢুকতেই সন্ধ্যা চেয়ারটা ঠেলে দিয়ে বলল, বোসো।
সোহাগ চেয়ারে বসল না, মেঝেতে মেয়েগুলোর পাশেই ঝুপ করে আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে পড়ল।
সন্ধ্যা মোলায়েম গলায় বলল, মেঝেতে বসলে ঠান্ডা লাগবে। এখন শীত পড়ছে।
সোহাগের কানে কথাটা গেলই না। সে খুব মন দিয়ে মেয়েদের কাজ দেখল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ সন্ধ্যার দিকে চেয়ে বলল, আমি কি কিছু করতে পারি?
সন্ধ্যা অবাক হয়ে বলে, ওমা! তুমি আবার কী করবে? এসব কি তোমার কাজ?
কাজের মেয়েগুলো কাজ থামিয়ে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে সোহাগকে দেখছিল। তাদের চোখে বিস্ময় আর কৌতুক।
সন্ধ্যার সব কাজেই খুব যত্ন। পরিষ্কার চকচকে মস্ত মেটে হাঁড়ি থেকে বড় হাতায় কাসুন্দি তুলে ফানেল দিয়ে শিশিতে ভরছিল সে। ছিপি লাগানোর একটা ছোট হাতযন্ত্র কিনেছে সে, দুটো মেয়ে সেই যন্ত্রে পটাপট ছিপি আটকে দিচ্ছে। যাতে কেউ নকল করতে না পারে তার জন্য পিলফার প্রুফ করার ব্যবস্থা। ব্যবস্থাটা অবশ্য খুবই দুর্বল, কিন্তু খদ্দেররা আজকাল এসব চায়।
সোহাগ উঠে এসে সন্ধ্যার কাছে দাঁড়িয়ে কাণ্ডটা দেখছিল। ওর গা থেকে একটা মৃদু সুঘ্রাণ আসছে। বিদেশি সেন্ট।
সন্ধ্যা একটু লাজুক মুখে বলল, এইসব নিয়েই বেঁচে আছি, বুঝলে? আমি তো লেখাপড়া শিখিনি।
সারাদিন তুমি খুব কাজ করো, না?
তাকে শেষ অবধি সোহাগ তুমি বলছে দেখে ভারী খুশি হল সন্ধ্যা। বুক থেকে যেন একটা ভার নেমে গেল। গতকাল অবধি মেয়েটাকে কী ঘেন্নাই করত। এখন বড্ড মায়া হচ্ছে। আর মায়াবশে অন্যমনস্ক ছিল বলে হাতের শিশি ভরে একটু কাসুন্দি উপচে পড়ল। হেসে সন্ধ্যা একটা ন্যাকড়ায় হাত মুছে নিয়ে বলল, হ্যাঁ। গতরে খাটুনির কাজ। আর তো কিছু জানি না।
সোহাগ খুব কৌতূহল নিয়ে ছিপি আটকানোর যন্ত্রটা দেখছিল। বলল, ওই যন্ত্রটা তো খুব মজার।
ওটা দিয়ে ছিপি আটকায়। এসব তো আধুনিক কল নয়, শস্তার জিনিস।
এ-ঘরটায় কেমন সুন্দর একটা গন্ধ!
তোমার ভাল লাগছে বুঝি? এসব হচ্ছে মশলার গন্ধ। বোসো না, গল্প করি। তোমাদের সঙ্গে তো ভাল করে আলাপই হল না। ওই মোড়াটা টেনে বোসো।
সোহাগ লক্ষ্মী মেয়ের মতো বসল।
আমলকী খেতে এলে না তো আজ!
আমলকীর একটা ল্যাটিন নাম আছে বোধহয়। জানো?
সন্ধ্যা হেসে ফেলে, না। এসব ল্যাটিন-ট্যাটিন কি আমি শিখেছি?
আমিও জানি না।
এক প্যাকেট নিয়ে গিয়ে কাছে রেখো। শুনেছি আমলকীর অনেক উপকার।
আমি কি রোজ তোমার কাজে একটু হেলপ করতে পারি?
সন্ধ্যা ফের হাসে, শোনো কথা! এসব মৈষালি কাজ, এসব কি তুমি পারো?
ওই যে তুমি একটা কাঠের জিনিসে মশলা গুঁড়ো করো ওটা আমি পারব।
না গো মেয়ে, ওসব তোমাকে করতে হবে না। তোমার মা রাগ করবে।
মা তো সব ব্যাপারেই রাগ করে। তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
তুমি মাঝে মাঝে এসে গল্প কোরো, তাহলেই হবে।
কিন্তু আমার কিছু করতে ইচ্ছে করছে। আই ওয়ান্ট টু কিপ মাইসেলফ বিজি।
সন্ধ্যা মায়াভরে মেয়েটার দিকে একটু চেয়ে থেকে বলল, একটু একঘেয়ে তো লাগবেই। এসব গাঁগঞ্জ জায়গা তো, তাই তোমার বোধহয় ভাল লাগে না।
একটা ঝটকা মেরে মাথা নাড়া দিয়ে মেয়েটা বলে, না না, শহর আমার একদম সহ্য হয় না। আমি তো গ্রামই ভালবাসি। তার চেয়েও ভালবাসি জঙ্গল।
ও হ্যাঁ, শুনেছিলুম শহরে থাকলে তোমার নাকি শরীর খারাপ করে। কীরকম অসুখ হয় তোমার?
ওটা একটা অ্যালার্জি। পলিউশন থেকে হয়।
তা হলে তো মুশকিল। পড়াশুনো করতে তো শহরেই থাকতে হবে।
পড়াশুনো করতে আমার ভাল লাগে না।
ওমা! সে কী? শুনেছি তুমি খুব ভাল ছাত্রী!
না তো! আমি একদম ভাল ছাত্রী নই। আমার ভাল লাগে শুধু হিস্টরি আর ন্যাচারাল সায়েন্স। ক্লাসের পড়া হিসেবে নয়।
সন্ধ্যা কী বলবে ভেবে পেল না। পড়াশুনোর কথা উঠলেই সে জব্দ। তবু সে বলল, তা হলে তুমি কী করবে?
মেয়েটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে একটা অসহায় ভঙ্গি করল। তারপর মৃদু স্বরে বলে, আমি যা করতে চাই তা তো আমাকে কেউ করতে দেয় না।
কী করতে চাও তুমি?
মৃদু একটা দুষ্টু হাসি খেলে গেল সোহাগের মুখে। তারপর বলল, বলব?
বলোই না!
আমার ইচ্ছে করে খুব গভীর জঙ্গলে গিয়ে সব পোশাক খুলে ফেলে ঘুরে বেড়াই।
এ কথা শুনে কাজের মেয়েরা খিলখিল করে হেসে উঠল।
সন্ধ্যা একটা ধমক দিল, অ্যাই চুপ। মানুষের তো কতরকম ইচ্ছেই হয়। হাসতে আছে? জানিস আমার ভাইঝি বিলেত আমেরিকা ঘুরে এসেছে?
বাণী নামে একটা মেয়ে বলল, আমারও কিন্তু অমন ইচ্ছে যায়।
তোর আবার কী ইচ্ছে?
ওই যে গো, যেখানে কেউই থাকবে না তেমন জায়গায় গিয়ে সব খুলে ফেলে রোদে হাওয়ায় এলোচুলে বসে থাকি।
সোহাগ রাগ করল না। হাসল। তারপর হঠাৎ মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। খুব মৃদু স্বরে বলল, আমার খুব হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
সন্ধ্যা মায়াভরে বলে, ষাট, ষাট, হারিয়ে যাবে কেন? মানুষ হারিয়ে গেলে বড় কষ্ট।
কেন, ও কথা বলছ কেন? ওয়ার্ল্ড ইজ এ বিগ প্লেস।
সন্ধ্যা একটু আনমনা হল। তারপর বলল, হারিয়ে যেতে নেই। কদিনই বা বাঁচে বলো মানুষ, তার মধ্যেই কত শোকতাপ, কত দুঃখদুর্দশা! আমার জীবন থেকেও তো একটা লোক হারিয়ে গেল বলে–
সন্ধ্যা আর বলল না। ভাইঝির কাছে হয়তো বলতে নেই।
তুমি কি তোমার হাজব্যান্ডের কথা বলছ?
সন্ধ্যা চুপ করে থাকে।
সোহাগ বলে, আই নো অ্যাবাউট ইউ। ইউ আর এ কনজুগাল ডিসকার্ড। সো হোয়াট? ইউ স্টিল হ্যাভ ইওর লাইফ।
সন্ধ্যা একটু হেসে বলে, আমি কি অত ইংরিজি বুঝি?
সোহাগ একটু লজ্জা পেয়ে বলে, সরি।
সন্ধ্যা তার এই একটু ছিটিয়াল, একটু সরল ভাইঝির দিকে চেয়ে বলে, তোমার আর কী ইচ্ছে করে?
সোহাগ একটু লজ্জার হাসি হেসে বলে, আমার বয়সের ছেলেমেয়েরা যা করে, মানে পড়াশুনো, ক্যারিয়ার, কম্পিউটার আমার একদম ভাল লাগে না। তুমিই না বললে কদিনই বা বাঁচে মানুষ! ঠিক তাই। আমাদের লনজিভিটি তো খুব বেশি নয়, এত পড়াশুনো, ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবাভাবি, কত সময় চলে যায় বলো! তা হলে বাঁচব কখন? কদিন? আয়ুর নাইনটি পারসেন্টই তো চলে যাবে বাবা!
ওমাঃ ঠিক বলেছ তো! আমারও মাঝে মাঝে মনে হয়, এত খাটাখাটনিতে কত সময় চলে যাচ্ছে, দুনিয়াটাকে টেরই পাচ্ছি না।
সোহাগ স্মিত মুখে বলে, কিন্তু তোমার কাজটা আমার বেশ ভাল লাগছে।
কেন বলো তো? একাজ আবার কীসের ভাল?
ইউ আর উইথ নেচার। ডুয়িং এ জব অফ ইওর ওন।
বাংলা করে বলো। বুঝতে পারি না যে! তোমার সব কথা আমার বুঝতে ইচ্ছে করছে।
মনে হয় তুমি তোমার কাজটাকে প্যাশোনেটলি ভালবাসো। তাই না?
সন্ধ্যা এবার এক গাল হাসে, কথাটা ভুল বলোনি। করতে করতে কাজটা এখন খারাপ লাগে না।
ওটাই তো আসল কথা। আমরা যে কাজ করতে ভালবাসি তা আমাদের করতে দেওয়া হয় না। ক্যারিয়ার আমাদের সব নষ্ট করে দেয়। নো লাভ ফর লাইফ, নাথিং।
দোতলা থেকে মোনার গলা পাওয়া যাচ্ছিল, সোহাগ! সোহাগ, আর ইউ হিয়ার সামহোয়ার? প্লিজ কাম আপস্টেয়ার্স। ডিনার ইজ রেডি।
সন্ধ্যা বলল, যাও, তোমার মা ডাকছে।
সোহাগ উঠে পড়ল, যাই পিসি৷
সন্ধ্যার কান জুড়িয়ে গেল পিসি ডাক শুনে। মনটা হালকা লাগল, খুশির বাতাস লাগল বুকটায়। পিসি বলে ডেকেছে এতদিনে। পিপাসাটা তার বুকের ভিতরে লুকিয়ে ছিল এতদিন।
নীলিমা বলল, তোমার ভাইঝিটা পাগলি আছে দিদি।
সন্ধ্যা মাথা নেড়ে বলে, ও তুই বুঝবি না। কত ভাল কথা বলে গেল। ওইটুকু তো বয়স, এক রত্তি মাথায় কত চিন্তা করেছে দেখলি! বড় ভাল মেয়ে।
.
কুক কুক করে ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজছে। মৃদু কিন্তু খর শব্দ। এ-শব্দ গভীর ঘুমের ভিতর ঠিক ঢুকে যেতে পারে। ঘুম না ভাঙিয়ে ছাড়ে না।
আগে এসব অ্যালার্ম ছিল না। মহিমকে তার বাবা একখানা ঘড়ি কিনে দিয়েছিল, রোজ দম দিতে হত কটর কটর করে চাবি ঘুরিয়ে। তার অ্যালার্ম ছিল ঝনঝনে। সাইকেলের বেলের মতো বেজে থেমে যেত, তাতে ঘুম ভাঙলে ভাল, না ভাঙলে ঘড়ির কিছু করার নেই। আজকাল এসব কোয়ার্টজ ঘড়ির আওয়াজ অন্যরকম। কানে নয়, যেন আঁতে গিয়ে ঢুকে পড়ে।
অ্যালার্মটা বাজছে দোতলায়, মেজো বউমার ঘরে, ভোর পৌনে চারটের গভীর নিস্তব্ধতায় শব্দটা চারদিকে যেন ছুরির ফলার মতো বারবার ঢুকে যাচ্ছে।
মহিমের ঘুম ইদানীং এমনিতেই পাতলা। শেষরাতে ঘুম আরও মিহি হয়ে আসে। চারটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে উঠে পড়ে সে।
আজ বুডঢা কলকাতা যাবে। বর্ধমান থেকে ভোর ছটায় একটা লোকাল আছে, সেইটে ধরবে। খবরটা মহিমের জানার কথা নয়। যাওয়াআসার স্বাধীনতা ওদের তো আছেই। জিজ্ঞাসাবাদ অনুমতি নেওয়া ইত্যাদির বালাই নেই।
কাল রাত দশটা নাগাদ হঠাৎ মোনা–অর্থাৎ মোনালিসা তার ঘরে এসে হাজির। বাবা বলে ডাকে না কখনও। কালও ডাকেনি। তবে বেশ নরম গলায় বলল, বুডঢা আজ কলকাতা থেকে এসেছে। খুব টায়ার্ড। কিন্তু কাল সকালেই ওকে কলকাতা ফিরতে হবে।
মহিম কথাটার প্যাঁচ ধরতে না পেরে তাকিয়ে ছিল। বুডঢা যে কলকাতা থেকে এসেছে, এ খবরটাও তার জানা নেই, যেমন জানা নেই বুডঢা এখান থেকে কলকাতা গিয়েছিল কবে।
মোনা বলল, মুশকিল হয়েছে ট্রেনটা খুব ভোরে। ছটায়। এখান থেকে অত ভোরে বাস বর্ধমান যায় কি না কে জানে। কিন্তু ট্রেনটা ওকে ধরতেই হবে। সকাল সাড়ে নটায় ওর কম্পিউটার ক্লাস।
মহিম তাকিয়ে ছিল। বুঝতে পারছিল, আসল কথাটা এর পর আসবে।
মোনা এবার বলল, কমলদার ছেলে রতনের তো মোটরবাইক আছে। ওকি সকালে একটু বুডঢাকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে পারবে?
এ কথাটা মহিমকে জিজ্ঞেস করার মানেই হয় না। যার মোটরবাইক তাকে জিজ্ঞেস করলেই হত। মহিম মৃদু গলায় বলল, রতনের সঙ্গে কি বুঢডার আলাপ পরিচয় নেই?
মোনা একটু অপ্রতিভ হল কি? ফর্সা রংটা যেন একটু রাঙা হয়ে গেল। বলল, আসলে ওরা ভাইবোন তো তেমন মিশুকে নয়।
মিশুকে নয়–এ কথাটা মিথ্যে। ওরা ও-বাড়ির লোকজনকে মেশবার যোগ্য বলেই মনে করে না। কিন্তু কথাটা তো আর বউমাকে বলা যায় না। মহিম বলল, স্টেশনে পৌঁছে দেওয়াটা তো কোনও ব্যাপার নয়। নিশ্চয়ই দেবে। আমি বলে দেবোখন।
মহিম এটুকু বলেই চুপ করে গিয়েছিল।
মোনা একটু দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, কথাটা হয়তো রতনকে আমারই বলা উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের মধ্যে তেমন রাপো তৈরি হয়নি বলে বলতে সংকোচ হচ্ছে।
একটু হাসল মহিম। বলল, সংকোচের কোনও কারণই ছিল না। আপনজনই তো। বললেই পারতে। ওরা তাতে খুশিই হত।
মোনা বলল, আপনি বললে বলব। তবে রতন তো বাড়িতে থাকেই না, অনেক রাতে ফেরে শুনেছি। কমলদাকে বলতে পারতাম, কিন্তু তিনি আজ কোথায় যেন গেছেন, রাতে ফিরবেন না।
ওঃ, ঠিক আছে, রতনকে আমি বলে দেব।
মোনা চলে যাওয়ার পর মহিম রায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টানা প্রায় পনেরো-ষোলো দিন এখানে আছে, তবু কেন যে পর্দাটা এখনও টেনে রেখেছে, কোথায় বাধছে, কোথায় বাধক হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। মেজো বউমার সঙ্গে ভাসুর কমলের একটু আলাপ আছে বটে, কিন্তু সম্পর্কটা ফাইফরমাশের। মহিমের ছেলেদের মধ্যে কমলই একটু ব্যক্তিত্বহীন এবং ভালমানুষ। আত্মসম্মানের বালাইও নেই তেমন। উপযাচক হয়ে সে-ই ওদের খোঁজখবর নেয়, গায়ে পড়ে কাজ করে দেয়। আর কেউ ওদের ছায়াও মাড়ায় না।
মহিম খুব ভোরেই ওঠে। পরশুদিনও উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে ঠাকুরপুজোর ফুল তুলতে বাইরে বেরিয়েছিল। বেশি দূর যেতে হয় না, ঘরের পিছনেই বাগান। সকালে তখনও অন্ধকার ঝুলে আছে চারদিকে, কুয়াশা আছে, ঠান্ডা ভাবও আছে, একটু পাতলা আলোর আভাসও আছে, কাক ডাকছিল, দূরে একটা মোরগও ডেকে উঠল। রোজকার মতোই ভোর। নতুন কিছু নয়।
বাগানে বেশি দূর ঢুকতেও হয় না, সামনেই শিউলি ফুলের ঝুপসি গাছ। নীচে অজস্র ফুল পড়ে থাকে ভোরবেলা। সেগুলো পুজোয় লাগে না। বোঁটা-খসা ফুল অনেক আটকে থাকে পাতায় আর ডালপালায়। ফুল তুলতে গিয়ে আচমকা তার চোখ গিয়ে পড়ল বাগানের মাঝখানে। কেন যে তার চোখই পড়ল। সাদাটে ঢিলা পোশাক-পরা স্থির মূর্তিটা দেখে আঁতকে ওঠবারই কথা তার। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল বলে একটু চমকাল মাত্র।
কে ওখানে? সোহাগ নাকি?
না আজ মেয়েটা সেদিনের মতো আচ্ছন্ন নেই। মহিমের সাড়া পেয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল।
দাদু!
ভারী অবাক হল মহিম। এর আগে কখনও দাদু বলে ডেকেছে কি না মনে পড়ল না। ডাকটা শুনেই তাই ভাল লাগল।
তুমি ওখানে কী করছ ভাই?
সোহাগ এগিয়ে এল কাছে, তুমি রোজ ভোরে ওঠো বুঝি?
মহিম বলে, হ্যাঁ। ওখানে কী করছিলে?
এমনি দাঁড়িয়েছিলাম। ট্রায়িং টু ফিল দি ওয়ার্ল্ড।
তোমার পায়ে জুতো বা চটি নেই কেন দিদিভাই?
চটি পরলে আই ক্যান্ট ফিল দি আর্থ।
কিন্তু কাঁটা ফুটতে পারে তো!
ফুটলেই বা!
আর শুঁয়োপোকা, সাপ এসবও তো থাকতে পারে।
আমার একটুও ভয় করে না।
মহিম স্নেহভরে বলে, তোমার গাছপালা ভাল লাগে বুঝি?
ভীষণ। মাঝে মাঝে ভাবি, ইস আমি যে কেন গাছ হয়ে জন্মালাম না।
ঠান্ডা লাগবে দিদিভাই, গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে এসো গিয়ে।
একদিন তো মানুষের কোনও পোশাক ছিল না। তখন কীভাবে থাকত মানুষ?
মহিম একটু থতমত খেয়ে বলে, সেসব তো আদ্যিকালের কথা দিদিভাই। তখন মানুষের ইমিউনিটি ছিল।
এখন নেই?
না, মানুষের অভ্যাস পালটে গেছে।
পোশাক একটা বাধা।
মহিম বড্ড অবাকের পর অবাক হচ্ছে, মেয়েটার কি একটু মাথার দোষ আছে?
দিক বসন কাকে বলে জানো দাদু?
হ্যাঁ, দিক বসন মানে আবরণহীন। দিকই যার বসন।
আমি জানি। কথাটা খুব সুন্দর, না?
ওসব ঠাকুর-দেবতার ব্যাপার দিদিভাই। মানুষের ক্ষেত্রে খাটে না।
ইট হ্যাজ এ মেসেজ, এ মেসেজ ফর হিউম্যানিটি।
মহিম প্রমাদ গুনছিল। বিদেশে নুডিস্ট কলোনি আছে বলে শুনেছে সে। মেয়ে-পুরুষ ন্যাংটা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। পাগলের কাণ্ড সব। এ মেয়েটা তাদের খপ্পড়ে পড়েনি তো রে বাবা! বিদেশে যে কত কুশিক্ষাই আছে!
মেয়েটা কি তার মনের কথা শুনতে পেল? স্বগতোক্তির মতো করে বলল, তা বলে আমি নুডিস্ট নই, দে আর এ স্যাড অ্যান্ড পারভারটেড লট। আমার শুধু মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে চারদিকটাকে সমস্ত শরীর দিয়ে শুষে নিতে।
একটু পাগুলে ব্যাপার আছে মেয়েটার। মহিম বলল, এ নিয়ে তোমার সঙ্গে একদিন কথা বলব। এখন শিশির পড়ে তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।
আমি ইমিউন হওয়ার চেষ্টা করছি।
ওসব কি সইবে তোমার? শুনেছি তোমার একটা অ্যালার্জি আছে।
হ্যাঁ, কিন্তু গাছপালার মধ্যে আমি তো ভাল থাকি।
গাছপালা তো ভালই, কিন্তু বিপদের কথাও খেয়াল রাখতে হয়, এটা ঋতু পরিবর্তনের সময়।
তুমি একজন খুব কারেজিয়াস লোক!
মহিম তটস্থ হয়ে বলে, আমি! কে বলল তোমাকে? না দিদিভাই, আমি একটা ভিতু লোক।
তুমি সেদিন আমাকে কাঁধে করে অনেক দূর থেকে নিয়ে এসেছিলে। অ্যান্ড ইউ আর অ্যান অকটোজেনেরিয়ান।
বিপদে পড়লে মানুষ বাঁচার তাগিদে অনেক কিছু করে। কিন্তু দিদিভাই, তোমার যে বড্ড সাহস! একা একা ওভাবে ঘুরে বেড়াও কেন?
মেয়েটা হাত উলটে বলে, জানি না।
তুমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলে।
মেয়েটা মাথা নেড়ে বলে, সামটাইমস ইট হ্যাপেন।
তুমি কি রোজ এত ভোরে ওঠো?
না, কখনও কখনও আমি বেলা আটটা-নটাতেও উঠি, কিছু ঠিক নেই। মাঝে মাঝে রাতে আমার ঘুম আসে না।
এই বয়সে ঘুম আসে না কেন?
ভাবতে ভাবতে মাথা গরম হয়ে যায়।
কী ভাবো তুমি?
মাই রিলেশন উইথ দিস ভাস্ট ইনফাইনিট ইউনিভার্স। আরও কত কী, ভাবতে ভাবতে আমি উঠে বসে থাকি, তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি।
কিন্তু তাতে যে বিপদ হতে পারে।
হিহি করে একটু হাসল সোহাগ, সেই হাসিতে ওর শৈশব ফুটে উঠল যেন। বলল, কাল রাত দুটো-আড়াইটার সময় আমি উঠে নীচে নেমে আসি। তারপর হেঁটে হেঁটে কোথায় কোথায় যে চলে গেলাম।
সর্বনাশ!
কিন্তু কিছু বিপদ হয়নি তো, আমার সঙ্গে তোমাদের ওই কালো কুকুরটা ছিল।
কতদূর গিয়েছিলে?
অনেক দূর, আমি তো এ-জায়গাটা ভাল চিনি না, জঙ্গল-টঙ্গল মাঠঘাট দিয়ে অনেক হেঁটে তারপর একটা হাইরোডে উঠে দেখলাম, ট্রাক যাচ্ছে, তখন ফিরে আসি।
কী করে ফিরলে?
কুকুরটাই পথ দেখিয়ে নিয়ে এল, যখন এসে কোর্ট ইয়ার্ডে ঢুকছি তখন–ওই যে ওই ঘরে যিনি থাকেন–উনি কে বলো তো! জেঠিমা না?
হ্যাঁ, উনি তোমার জেঠিমা।
উনি হঠাৎ ভয় পেয়ে চোর, চোর বলে কাকে যেন ডাকছিলেন। আমি তখন জানালার কাছে গিয়ে বললাম, আমি চোর নই, আমি সোহাগ। উনি খুব অবাক হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, মাঝরাতে একা মেয়েছেলে এলোচুলে ঘুরছ যে বড়! হাওয়া বাতাস লাগবে যে! ঘরে যাও।
উনি ঠিকই বলেছেন।
হাওয়া বাতাস লাগার কথাটা আমি বুঝতে পারিনি। তুমি জানো?
অস্বস্তিতে পড়ে মহিম বলে, উনি বোধহয় ভূতপ্রেতের কথাই বলতে চেয়েছেন। গাঁয়েগঞ্জে তো অনেক সংস্কার থাকে।
সংস্কার মিনস সুপারস্টিশনস?
হ্যাঁ, এসব জায়গায় মানুষকে মাঝে মাঝে নাকি ভূতে পায়। ওসব বিশ্বাসযোগ্য নয়।
কিন্তু আই বিলিভ ইন গোস্টস।
মহিম একটু হাসল। বলল, কেন বিশ্বাস করো?
আই ফিল দেম। আই ইভন সি দেম।
মহিম অবাক হয়ে বলে, কী দেখেছ তুমি?
আমার মনে হয় লক্ষ লক্ষ বছর ধরে যেসব মানুষ মরে গেছে তাদের প্রত্যেকের একটা করে ইমপ্রেশন রয়ে গেছে অ্যাটমোসফিয়ারে। আই সি দেয়ার শ্যাডোজ, আই ফিল দেয়ার প্রেজেন্স।
সেটা কীরকম দিদিভাই, বুঝিয়ে বলো।
তারা তো আমাদের মতো নয়, তারা কেউ নেইও। কিন্তু তাদের ইমপ্রেশন, তাদের অনেক কথাবার্তা, অনেক সময় তাদের শ্বাসপ্রশ্বাসও টের পাই এবং মাল্টিচুডস অব দেম।
তুমি যে আমাকে চিন্তায় ফেললে দিদি। তোমার এরকম হয় কেন?
আমি তা জানি না। আমার বন্ধুরা কেউ ভূতে বিশ্বাস করে না, তারা শুনলে অবাক হয়। বলে অল বোগাস।
হয়তো তুমি খুব ভালো বলেই ওসব কল্পনা মাথায় আসে।
মে বি৷ আই হ্যাভ এ ভেরি স্ট্রং ইমাজিনেশন। কিন্তু আমার মনে হয় আমি ভুল দেখি না। ভূতকে অনেকে ভয় পায়। আমার একটুও ভয় করে না, আমার মনে হয় দে আর মাই ফ্রেন্ডস, মাই বেস্ট ফ্রেন্ডস।
চিন্তিত ও শঙ্কিত মহিম রায় ভোরের আবছা আলোয় তার এই প্রায় অচেনা নাতনিটির মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, তুমি মাঝে মাঝে আমার কাছে এসো। আমি তোমার কথাগুলো আরও একটু বুঝতে চেষ্টা করব।
কিন্তু বিশ্বাস করবে না তো? আমার কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না।
মহিম একটু হাসল, পৃথিবীতে কত রহস্যই যে আছে, সব কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? না দিদি, আমি তোমার কথাগুলো নিয়ে ভাবব। হয়তো বিশ্বাসও করব, কে জানে! এই বুড়ো বয়সে খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় যে মানুষ মরে গেলেও একেবারে শেষ হয়ে যায় না। তার কিছু একটু থেকে যায়।
এসব কাল ভোররাতের কথা। আজ এই ভোররাতে বিছানায় মশারির মধ্যে বসে অ্যালার্ম ঘড়ির শব্দ শুনতে শুনতে কত ভাবনাই যে সিনেমার ছবির মতো মাথার ভিতরে ভেসে ভেসে যায়। মাঝে মাঝে যতিচিহ্নের মতো মৃত্যুর কথাও মনে পড়ে।
অচেনা অমল এবং ততোধিক অচেনা অমলের বউ, ছেলে, মেয়ে এদের সঙ্গে তার একটা সেতুবন্ধন হল কি? সেতুটি ওই ছিটিয়াল, বায়ুগ্রস্ত, চঞ্চলমতি সোহাগ। ঠিক বুঝতে পারছে না মহিম, সেতুবন্ধনটি টিকে থাকবে কিনা।
মশারি তুলে পাকাপাকি উঠে পড়ল মহিম। প্রাতঃকৃত্য, বাসি ছাড়া, ঠাকুরঘর সারা, ফুলহোলা, পুজোয় বসা।
তার মাঝখানেই নিস্তব্ধ ভোরে বজ্রাঘাতের মতো রতনের মোটরবাইক গর্জে উঠল। পাঁচটা বাজে। বুডঢাকে অবশেষে স্টেশনে পৌঁছে দিচ্ছে রতন, দুর্গা, দুর্গা।
রতন আর তার মোটরবাইক যেন দুটো জিনিস নয়। একটাই। যেন মোটরবাইকে করেই জন্মেছিল রতন। দিনরাত সে ওটায় চড়ে ঘুরছে, মোটরবাইক ছাড়া রতনকে আজকাল ভাবাই যায় না, মাঝে মাঝে বলে, যখন মোটরবাইকে চড়ে থাকি তখন নিজেকে আমার চে গুয়েভারা, ফিদেল কাস্ত্রো, জোসেফ স্তালিন, মাওসেতুং কত কী মনে হয়, মনে হয় আমি একজন লিডার, একজন পায়োনিয়ার।
কিন্তু ওরা কি মোটরবাইকে চড়তেন?
তা কে জানে। মোটরবাইকে চড়লে আমি ওরকম কেউ হয়ে যাই।
বন্ধুরা বলে ভটভটিয়া রতন। মোটরবাইকই ওর হাত পা মগজ। কাউকে জরুরি খবর দিতে চাও, অসময়ে হঠাৎ কিছু আনতে চাও বাজার থেকে, কাউকে কোথাও পৌঁছে দিতে চাও, রতন সঙ্গে সঙ্গে রাজি, মোটরবাইকে যতই তাকে দৌড় করানো হোক তার ক্লান্তি নেই।
মহিম রায় উঠোনের একধারে পাতা কাঠের চেয়ারে এসে বসল, বাঁ ধারে বাঁশবনের ফাঁকফোঁকর দিয়ে অন্ধকারকে ঝাঁঝরা করে দিয়ে আলো আসছে।
আরও একটা দিন। আরও এক পা এগিয়ে যাওয়া।
.
০৮.
আশি চুটকি, নব্বে তাল তব জানিয়ো খইনিকে হাল। খইনি মজানো কি সোজা কথা রে বাপু? দু চারবার ডলেই ঠোঁটে ফেলে দিলেই হল? ও হল চাষাড়ে জিনিস, ধকের চোটে ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত চমকে ওঠে। খইনির গভীরে যে প্রাণরস আছে তাকে টেনে বের করা চাই তো। সেই মোলায়েম নেশা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে চনমনে করে তোলে মানুষকে। হ্যাঁ, তবে তার জন্য ধৈর্য চাই। পরিমাণমতো চুনটুকু দিয়ে মশলা, মলো, মলো। ফিন তালি লাগাও। চুণা উড়েগা, ধূল উড়েগা। ফিন মলো, মলো, মলো। ফিন তালি লাগাও–হাঁ। আশি চুটকি, নব্বে তাল, তব জানিও খইনিকে হাল…
উত্তরের দাওয়ায় বসে খইনিটাকে মজিয়ে ফেলেছে প্রায় বাঙালি। বাঙালি রাম কাহার। পাশে বিস্কুটের কাঁচ লাগানো টিন। দাওয়ার নীচে ছাড়া মোটা চামড়ার ধুলিধূসর একজোড়া শস্তা জুতো। বাঙালির পরনে হেঁটো জনতা ধুতি, গায়ে মোটা কাপড়ের পিরান। মাথা ন্যাড়া, মস্ত টিকি, খইনি ডলতে ডলতে তার চোখ এখন ভাবালু।
হাত চারেক তফাতে উঠোনে উবু হয়ে বসে আছে গোকুল আর বাসু। তারা মুখ চোবলাচ্ছে, জিব রসস্থ, ভারী উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে বাঙালির দিকে। ব্যাটা খইনিটা বানায় বড় ভাল। মিহি, মোলায়েম, খুব সোয়াদ। তবে বড় সময় নেয়। গোকুলের কাজ বেশির ভাগই গোয়ালঘরে। তিনটে গোরুকে মাঠে খোঁটায় বেঁধে এসে গোয়াল পরিষ্কার করেছে এতক্ষণ। এই একটু হাঁফ ছাড়ার সময়। বাসু বাগান সামলায়। নিড়েন দিতে দিতে উঠে এসেছে বাঙালিকে দেখে। দুজনেই কিছু উশখুশ। কিন্তু বাঙালিকে হুড়ো দিয়ে লাভ নেই। তার মনের মতো না হওয়া ইস্তক সে খইনির ভাগা দেবে না।
রুখু চুলের খোঁপায় আজ একটা কলাবতী ফুল গুঁজেছিল দুখুরি। হাঁসের ঘর থেকে বারোটা ডিম বের করল। আজ তার মনে একটু আনন্দ ছিল সকাল থেকেই। মেলা লোক আসবে আজ। দুই দিদিমনি, দুই দাদাবাবু, তাদের বরেরা, বউয়েরা, ছেলেমেয়েরা। আজ খুব হই-চই লেগে যাবে বাড়িতে। দুখুরি তাই ঘরদোর পরিষ্কার ন্যাকড়া দিয়ে মুছছিল। টেবিল, চেয়ার, তাক, জানালার গরাদ, দরজার পাল্লা। ওই জানালা দিয়েই সে তার বাপকে দেখেছিল একটু আগে। অমনি মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওই যে এসেছে তার যম।
গিন্নিমার ঘরে ঢুকেই দুখুরি কাঁদুনে গলায় বলল, ওই আবার এসেছে গো, দ্যাখো গে।
বলাকা চট্টোপাধ্যায়ের বয়স এখন বাহাত্তর চলছে। শরীরে এখনও মেদের সঞ্চার নেই। সাদা থানে গৌরবর্ণা বলাকাকে অনেক সময়ে মানবী বলে মনে হয় না। শোকের একটা গাম্ভীর্য তাকে আরও একটু অবাস্তব দূরত্বে নিয়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা কেউ কাছে নেই। একা বাড়ি আগলে তার পড়ে থাকা। এই দুখুরি, রাঁধুনি বামনি, কাজের মেয়েরা, মুনিশ, দু-চারটে কাজের লোক, পাড়া-প্রতিবেশী, জ্ঞাতিরা, কিছু স্মৃতি, কিছু চিহ্ন আর বস্তুপুঞ্জ নিয়ে তার বাস। এই আগলে থাকা ভাল লাগে না বলাকার। একটা মানুষ যতদিন ছিল ততদিন সেই মানুষটার জন্যই এত ফাঁকা লাগত না কখনও। তার স্বামী গৌরহরি চট্টোপাধ্যায় মেজাজি, প্রতাপশালী, খেয়ালি এক মানুষ। তবু সারা জীবন বলাকার কাছে ওই মানুষটাই ছিল যেন সবচেয়ে বেশি। ওই মানুষটাকে ছাড়া যে বেঁচে আছে বলাকা তাতেই সে ভারী অবাক হয়ে যায়। ওকে ছাড়া একটা দিনও কাটবে বলে কখনও ভাবেনি। অথচ অবাক কাণ্ড, এখনও বলাকা বেঁচেই আছে দিব্যি।
ঝন্টু আর মন্টু তাকে নিজেদের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য টানাটানি করে। বকুল, পারুল, জামাইরা সবাই তাকে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু কোথাও যেতে ইচ্ছেই হয় না তার। মানুষটা নেই, কিন্তু তার শ্বাসপ্রশ্বাসটুকু যেন এখনও আছে।
স্টিলের আলমারি খুলে আজ শাড়ির ডাঁই বের করে মেঝেয় পাতা মাদুরে জড়ো করেছে বলাকা। কমলা আর কালী সাজিয়ে রাখছে থাকে থাকে। কত শাড়ি তার। গৌরহরি কোনও বড় মামলায় জিতলেই একটা শাড়ি বা গয়না আনত। এইভাবে জমেছে মেলা, অনেকগুলো তো পরাই হয়নি আজ অবধি। বলাকা গুণে দেখেছে বেনারসিই আঠারোখানা, পিওর সিল্ক অন্তত পঞ্চাশটা, গরদ কম করেও বারোটা, তাঁত আর সিন্থেটিকের হিসেব নেই।
দুই মেয়ে আর দুই বউমাকে এ সবই আজ ভাগ করে দেবে বলাকা। কোনটা কাকে সেই নিয়েই কথা হচ্ছে। কমলা পুরনো লোক, তার টান বেশি বকুল আর পারুলের ওপর। ভাল শাড়িগুলো সে ওদের ভাগে ফেলতে চাইছিল। বলাকা বলল, তাই কি হয়? বউমারা কী ভাববে তা হলে?
বলাকা আবার একথাও ভাবে, ওদের কারও তো কম নেই। এসব পুরনো শাড়ি-টাড়ি পেয়ে খুশি হবে তো? নাকি মনে মনে নাক সিঁটকোবে?
একখানা ডুরে শাড়ি বেরোল এক ডাঁই শাড়ির তলা থেকে। সাদা খোলের ওপর টানা লাল সবুজ নীল ডুরে। তেমন কোনও বাহারি শাড়িও নয় এবং বহরে একটু খাটো। শাড়িটা এত পুরনো যে সাদা রংটা হলদেটে হয়ে গেছে। তেমন মজবুতও নেই আর, টানাহ্যাঁচড়া করলে ফেঁসে যাবে। শাড়িটা কোলে নিয়ে একটু বসে রইল বলাকা। চোখে জল আসি-আসি করে যে!
দশ সাড়ে দশ বছর বয়সে বিয়ে হল পরিপূর্ণ যুবক গৌরহরির সঙ্গে। বলাকা তখন মেয়েমানুষই হয়ে ওঠেনি ভাল করে। ভয়ে আধমরা। আর বরটি এত ছোট্ট একটা বউ পেয়ে মোটেই খুব স্বস্তিতে ছিল না। নাক সিঁটকে বলত, এ বাবা এর তো এখনও নাক টিপলে দুধ বেরোয়! গৌরহরি তাকে তার বউ বলেই ভাবতে পারত না। স্বামীর বিছানাতেই শুত বটে সে, কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মতো নয়। ঘুমের মধ্যে হাত-পা ছোঁড়ার অভ্যেস ছিল তার, গৌরহরি তাই খ্যাপাত, ঘুমের ভান করে তো দিব্যি লাথি ঘুষি চালাও দেখছি! ভীষণ লজ্জা পেত বলাকা। তেরো বছর বয়স অবধি ওরকমই চলেছিল। প্রাপ্তবয়স্ক এক পুরুষের পাশে একটি নাবালিকাই মাত্র ছিল সে। তেরো বছর বয়সে একবার টাইফয়েড হয়ে বলাকার যায়-যায় অবস্থা। তখন গৌরহরি তাকে বেডপ্যান দিত, জামাকাপড় পালটে দিত। লজ্জায় আজও মরে যায় বলাকা। কিন্তু গৌরহরি তখনও তাকে তো মেয়েমানুষ হিসেবে দেখতেই শুরু করেনি। বিয়ের পর চার বছরের মাথায় একদিন গৌরহরি একটা মামলার কাজে কলকাতা যাচ্ছে। সেই রাতে তার ফেরার কথা নয়। কিন্তু হঠাৎ বলাকা তাকে বলে বসল, আজ ফিরবে কিন্তু, আজ আমাদের বিয়ের তারিখ। গৌরহরি অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি?
তখন বৈশাখ মাসের শেষ। দুদিন পরই সংক্রান্তি। সেই দিন সন্ধের পর এক ক্ষ্যাপা মহিষের মতো মেঘ উঠল আকাশে। সেই সঙ্গে এক অতিকায় কালবোশেখী। জীবনে ওরকম ভয়ংকর ঝড় বলাকা আর দেখেনি। চারদিকে যেন মধ্যরাতের অন্ধকার ঘনিয়ে উঠল, আর পাগলা মোষের মতোই ছুটে এল ঝড়। উপড়ে পড়তে লাগল গাছ, উড়ে গেল আশপাশের চালের টিন। গোরু, কুকুর, হাঁসমুরগিদের যে কী প্রাণান্তকর আর্তনাদ! আর সেই সঙ্গে শাঁখের শব্দ, মানুষের চেঁচামেচি। সেই প্রচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট গেল ভেসে, গাছ উপড়ে পড়ে চলাচল বন্ধ।
খুব ভাবছিল বলাকা। জানালায় দাঁড়িয়ে কেঁদেছিল অঝোরে। এই ঝড়ের দিনে সে লোকটাকে ফিরতে বলে দিয়েছে, যদি ফেরে তা হলে কোন অপঘাত ঘটে তার ঠিক কী?
ভয়টা অমূলক ছিল না তার। বউয়ের কথার দাম রাখতে প্রবল ঝড়ের সূচনা দেখেও গৌরহরি হাওড়ায় এসে ট্রেন ধরেছিল। বর্ধমান পৌঁছতে সময় লেগেছিল অনেক। তারপর ওই ডাকাবুকো মানুষটা সেই ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রাঘাত মাথায় করে হেঁটে অতিক্রম করেছিল গোটা পথ। চারবার আছাড় খেয়ে, ভিজে, জলকাদা মেখে যখন বাড়ি পৌঁছেছিল তখন ভোর চারটে। ঘুমকাতুরে বলাকা সেই রাতে ঘুমোতেই পারেনি। দু চোখ সটান মেলে শুয়ে শুয়ে শুধু ঠাকুর-দেবতাকে ডেকেছে। গৌরহরি উঠোনে পা দিতেই কী করে যেন সে-ই টের পেয়েছিল তার মানুষটা এসেছে। কড়া নাড়ার আগেই দরজা খুলে দিয়ে সে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল, তুমি এসেছ?
গৌরহরি খুব অবাক। একটু হেসে বলল, কী করে টের পেলে?
অভিমানভরে বলাকা বলেছিল, আমি পাবো না তো কে টের পাবে?
গৌরহরির মুখটা হ্যারিকেনের আলোতেও উদ্ভাসিত দেখাচ্ছিল। পোর্টম্যান্টো খুলে শাড়ির প্যাকেটটা বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, ইংরিজি মতে বিয়ের তারিখ পার হয়ে গেছে। কিন্তু দিশি মতে এখনও পেরোয়নি। শাড়িটা পরো।
এই শাড়ির দাম কে দেবে? কে জানবে এ-শাড়ির প্রতিটি সুতোয় কত ভালবাসা জড়িয়ে আছে! সেই প্রথম গৌরহরি তাকে মেয়েমানুষের দাম দিল। হয়তো সেদিনই তাকে প্রথম বউ বলে মনে হল তার।
চোখের জল মুছে শাড়িটা কমলার হাতে দিয়ে বলল, এটা আলমারিতে তুলে রাখ।
কালী বলল, কেন যে তুমি থান পরো তা বুঝি না। আজকাল বিধবারা অত মানে না তোমার মতো। সাদা খোলের শাড়ি পরলেই তো হয়।
বলাকা জবাব দিল না। বড় দেওরের ছেলে বিজুটা বড্ড ফচকে। সেদিন এসে বলল, ও বড়মা, থানটা কি বিধবাদের জার্সি নাকি? তুমি কি জানো যে, থান পরলে তোমাকে পাথরপ্রতিমা বলে মনে হয়?
আজকাল বিধবারা অম্বুবাচী করে না, কেউ কেউ মাছমাংসও খায় এসবও বলছিল বিজু। বলাকা হেসে বলল, আর বলিসনি রে ছেলে। বিধবারা তো বিয়েও করছে। আমরা সেকেলে লোক, আমাদের ছেড়ে দে বাবা, আর একেলে করে তুলবার চেষ্টা করিসনি।
না বড়মা, তোমাকে আর মানুষ করা গেল না। তবে থাকো তুমি দেবী-টেবী হয়ে।
পুরনো শাড়িগুলোর প্রত্যেকটার গায়েই একটা করে গল্প আর ঘটনা জড়িয়ে আছে। আছে দীর্ঘশ্বাসও। কয়েকটা বেছে আলমারিতে তুলে রাখল বলাকা। কোনওদিন পরবে না আর, শুধু মাঝে মাঝে নেড়ে-চেড়ে দেখবে।
ও মা! কথা কানে যাচ্ছে না তোমার?
চোখ তুলে দুখুরিকে দেখে বলাকা বলে, কী হয়েছে?
বলছি না, বাবা এসেছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ গো, উঠোনে বসে খইনি ডলছে।
তাতে কী হল?
ফের বিয়ের কথা বলবে যে! আজ খুব বকে দাও তো!
বিয়ের কথা বলবে কী করে বুঝলি?
খুব জানি। আমাকে বেচে দোকান আর মোষ কিনবে।
ব্যাপারটা সবাই জানে। তবু কমলা আর কালী খুব হাসছিল। বলাকা হাসল না, দুখুরির বয়স এখন দশ-এগারো, ঠিক যে বয়সে তার নিজের বিয়ে হয়েছিল। দেহাতে এখনও এই বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। পরে গাওনা হয়। কিন্তু মুশকিল হল, দুখুরি তার বাপের মতো দেহাতের মানুষ নয়। পাঁচ ছয় বছর বয়সে তার মা মারা যাওয়ার পর বাঙালি রাম কাহার মেয়েটাকে বলাকার কাছে গচ্ছিত করে দিয়ে নিজে আর একটা বিয়ে করে। গত পাঁচ ছয় বছরে দুখুরির গায়ে অন্য হাওয়া লেগেছে। সে এখন লেখাপড়া করে, ইস্কুলে যায়, চারদিকটা দেখে এবং বুঝতেও পারে, দেহাতি নিয়ম চাপালে চলবে কেন?
কিন্তু বাঙালিরও কিছু বক্তব্য আছে। মাত্র হাজার খানেক টাকা হলে সে ননী পালের দোকানঘরটা নিতে পারে। আরও হাজার দুয়েক পেলে একটা বাচ্চা মাদী মোষ কিনবার জো হয় তার। শুধু বেকারির দিশি বিস্কুট বেচে অত বাড়তি টাকা ফেলবার উপায় নেই। কিন্তু দুখুরির বিয়ে দিলে দু-আড়াই হাজার তার হাতে আসে। পাত্রও প্রস্তুত। বর্ধমানের পান-বিড়িওলা লছমন দাসের ছোট ছেলে রণবীর। কথা হয়ে আছে। তাই কিছুকাল যাবৎ ঘুরঘুর করছে বাঙালি। মেয়েকে নিজের অধিকারবলে টেনে নিয়ে যাবে তেমন তাকত নেই তার। চাটুজ্যেদের প্রতিপত্তির কথা সে জানে। সহিষ্ণুতা এবং বিনয়বচন আর কাকুতিমিনতি ছাড়া তার অন্য পথ নেই। দুনিয়া যে অনেক এগিয়ে গেছে, মেয়েদের যে আর ধরে বেঁধে বিয়ের ফাঁস পরানো যায় না এসব খবর সে রাখে না। সে শুধু সাদাসাপটা হিসেবটা বোঝে, মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলে তার দোকানঘর আর একটা মোষ হয়ে যায়। আর এটা হলে তার অনেক দিনের স্বপ্নটাও সার্থক হয়।
বলাকা বলল, অত ভয় পাস কেন? আমি তো আছি। বাঙালিকে তো বলেছি তোর বিয়ে আমি দেবো।
তবে কেন ঘুরে ঘুরে আসে বলো তো! আজ ভাল করে বকে দিও।
তোকে অত ভাবতে হবে না, ভাল করে ঘরদোর ডাস্টিং কর।
দুখুরি চলে গেলে মায়াভরে দরজাটার দিকে চেয়ে থাকে বলাকা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, বাঙালিকে তিন হাজার টাকা দিয়ে দুখুরিকে রেখেই দেয়। কিন্তু একজন উঁদে উকিলের ঘর করে বলাকার কিছু বাস্তববুদ্ধি হয়েছে। সে জানে টাকা নিয়ে আপাতত মহানন্দে চলে যাবে বটে বাঙালি, কিন্তু কিছুদিন বাদে ফের টাকায় টান পড়লে এসে হাজির হবে। ফের ঘ্যান ঘ্যান করবে। এ এক জ্বালা!
দুখুরি যে খুব কাজের মেয়ে তা নয়, ফাঁক পেলেই খেলতে লাগে। ঘুমোনোর নেশা আছে। কাজের জন্য নয়, দুখুরি বলাকার একটা সম্বল। ফাঁকা বাড়িতে ও সারাদিন কাছেপিঠে থাকে, ডাকলে সাড়া দেয়। কত কথা কয় বসে বসে। বলাকার এখন জনের অভাব।
তা বলে কি বাঙালিকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিতে পারে বলাকা? পারে না, কারণ যত দূরের মানুষ হোক, বাঙালির তো পিতৃত্বের একটা অধিকার আছেই।
খইনিটা মজে এসেছে। শেষ কয়েকটা তালি লাগিয়ে আর একটু ডলে বাসু আর গোকুলকে ভাগা দিয়ে নিজেরটুকু ঠোঁটে ফেলল বাঙালি। হ্যাঁ, জমেছে। মুখে দিতেই মনটা যেন খুশ হয়ে গেল।
গোকুল বলল, ও বাঙালি, উঠোনে থুথু ছিটোস না যেন। মা দেখলে আস্ত রাখবে না।
আরে নেহি বাবা, উঠানমে কৌন থুক ফেলবে?
দোতলা থেকে বলাকাকে নামতে দেখে গোকুল আর বাসু পালাল।
কী রে বাঙালি, কিছু বলবি?
বাঙালি শশব্যস্তে উঠে হাতজোড় করে রাম রাম দিয়ে এক গাল হাসল, তবিয়ত ঠিক আছে তো মাতাজি?
আছি একরকম বাবা। তা তোর কী খবর? বিয়ে পাকা করে এলি নাকি?
ভারী লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে বাঙালি বলে, ঠিকঠাক তো সব আছে। আমি বলেছি কী, শাদি এখুন হোবে, গাওনা দশ বরষ বাদ।
দশ বছর বাদে দুখুরি যে কলেজে পড়বে সে খেয়াল আছে তোর? পাত্র তো লেখাপড়াই জানে না ভাল করে।
হাঁ হাঁ, কেন জানবে না, উ ভি ইস্কুলে পড়ছে। পাস ভি দিবে।
ও তোর বানানো কথা। বিয়ে দিবি দেশওয়ালির সঙ্গে, দুখুরি তো দেহাতি ভাষা বলতেই পারে না।
তো কী আছে মাতাজি? বাংলা বলবে। রণবীর ভি বাংলা বলতে পারে।
তোকে তো বলেছি, দুখুরিকে আমায় দিয়ে দে। ওর ভাবনা তোকে ভাবতে হবে না। বিয়েও আমিই দেবো। কথাটা কেন পছন্দ হচ্ছে না তোর?
উ বাত তো ঠিক আছে মাতাজি। লেকিন ননীবাবুর দুকানটা শম্ভুবাবু লিয়ে লিবে। ভৈঁষওয়ালা ভি বলছে আর দেরি হলে মুশকিল।
আঠারো বছর বয়সের আগে মেয়ের বিয়ে দিলে জেল খাটতে হয় তা জানিস?
যেন খুব একটা হাসির কথা হয়েছে, এমনভাবেই হাসল বাঙালি, হাঁ, উ তো বাবুলোগদের জন্য আছে। মুলুকমে উরকম শাদি হরবখত হচ্ছে।
তা জানি বাবা। তোরা আইনকানুন একটুও মানিস না। কিন্তু মেয়ে যদি থানায় যায় তা হলে বিপদে পড়বি। দুখুরির একটুও মত নেই বিয়েতে।
ভারী অবিশ্বাসের সঙ্গে চেয়ে থাকে বাঙালি, থানায় যাবে? থানায় যাবে দুখুরি?
তুই বেশি চাপাচাপি করলে যাবে না তো কী? তোকে দেখলেই মেয়েটা ভয় পায় কেন রে?
বাঙালি উবু হয়ে বসে পড়ল। মাথায় হাত। দুখুরি থানায় যাবে, এতটা ভাবেনি বাঙালি। খইনির থুতু গিলে ফেলায় একটা দুটো হেঁচকি উঠল তার।
বলাকার একটু মায়া হল। বলল, শোন মুখপোড়া, দুখুরি এখন আমার কাছেই থাকবে। বড় মায়া পড়ে গেছে আমার। দোকান আর মোষ কেনার টাকা আমি তোকে দেবো। কিন্তু টাকা নিবি লেখাপড়া করে। পরে ফের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলে কিন্তু বিপদে পড়বি। বুঝেছিস?
খুব বুঝেছে বাঙালি। তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে বলে, রাম কি কৃপা মাতাজি। দুকানটা আর ভৈঁষটা হলে হামার আর কুছু লাগবে না।
মনে থাকে যেন। কখানা ভাল বিস্কুট রেখে যা। আমার নাতি-নাতনিরা দিশি বিস্কুট খেতে ভালবাসে। খাস্তা দেখে দিস বাবা।
বাঙালি বিস্কুট নিয়ে ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
গৌরহরি চাটুজ্যে দুঁদে উকিল হলেও বিষয়বুদ্ধি তেমন ছিল না। খরচের হাত ছিল বড্ড বেশি। এ নিয়ে বলাকার চাপা ক্ষোভ ছিল। স্বামী-স্ত্রীতে কখনও ঝগড়াঝাঁটি বা মন কষাকষির বালাই ছিল না তাদের। গৌরহরির কথাই সুপ্রিম কোর্ট। তবু এ নিয়ে মাঝে মাঝে মৃদু একটু-আধটু অনুযোগ কখনও তুলেছে বলাকা। গৌরহরি জবাবে বলত, ভার কমাও বলাই, ভার কমাও। নইলে মরার সময় বড় কষ্ট হবে যে!
বলাই বলে বলাকাকে ডাকার আর কেউ নেই। ঠাট্টার ওই ডাক আজও যেন কানকে স্নিগ্ধ করে দেয়। আর কী আশ্চর্য, গৌরহরি চলে যাওয়ার পর বলাকারও যেন টাকাপয়সা, বিষয় সম্পত্তির ওপর টান হঠাৎ ছিঁড়ে খুঁড়ে গেল। জেটি থেকে স্টিমার যেন পৃথক হয়ে ভেসে আছে। কোনও বাঁধন নেই। তাই দোনোমোনো করেও টাকাটা বাঙালিকে কবুল করে ফেলল বলাকা। সামান্যই টাকা। তার তো অভাব নেই। গৌরহরি অনেক রেখে গেছে, তার ওপর ছেলেরা পাঠায়, মেয়েরা পাঠায়। টাকা কোন কাজে লাগে তার? চাল ডাল সবজি কিছুই কিনতে হয় না তাকে। বরং ধান, সবজি, দুধ, সর্ষে এসব বিক্রি করেও বেশ টাকা পায় সে। কটা টাকা দিয়ে যদি মা-মরা মেয়েটার মুখে হাসি ফোটানো যায়।
ঘরে এসে ফের আলমারির সামনে বসে বলাকা। চারদিকে ডাঁই করা সব শাড়ি, শায়া, ব্লাউজ।
কমলা গলা নিচু করে বলে, গয়নাগুলোও কি সব দিয়ে দিচ্ছ মা?
কেন বল তো!
নিজের হাতের পাতের কয়েকখানা রেখো।
গয়না দিয়ে করব কী? ওসব আপদ বিদেয় করাই ভাল। শেষে চোরে ডাকাতে নেবে।
তুমি যেন কেমনধারা হয়ে যাচ্ছ। কর্তাবাবা মরল তো তুমি যেন যোগিনী হলে। এমন দেখিনি।
দুর মুখপুড়ি। বুড়ো বয়সে কি গয়না পরে বসে থাকব নাকি?
তাই বললুম বুঝি। বলছি, গয়না তো একটা সম্বল। সোনা-দানা হাতে রাখে না মানুষ?
তা রাখে। দুর্দিনের ভয় পায় বলে রাখে, লোভেও রাখে। আমার সেসব নেই। আমার আসল গয়নাই চলে গেল তো সোনা-দানা দিয়ে কী হবে?
আসল গয়না যে কে তা কমলা জানে, কালী জানে। গাঁয়ের লোকও জানে।
কমলা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, একটা মটরদানা হার ছিল না তোমার! সেই যে ডায়মন্ড কাটা মটরদানা গো, কী ঝিকমিকই না করে!
হ্যাঁ। কর্তা দিয়েছিলেন। খয়রাশোলের বড় মামলাটা জিতে খুব আনন্দ হয়েছিল। তাই দিয়েছিলেন।
ওইটে রেখো। তোমাকে বড় সুন্দর দেখায়।
দুর! গলায় একটা চেন পরি, এই যথেষ্ট। মেয়েরা, বউমারা খালি গলায় থাকতে দেয় না বলে পরি। আর এই হিরের আংটিটা। এটা ঝন্টু চাকরি পেয়ে দিয়েছিল, তাই খুলিনি। ব্যস, আর কিছু রাখব না।
উঠোনে একটা শোরগোল উঠল। দুজন মুনিশ পুকুরে জাল ফেলেছিল। মস্ত একটা কাতলা তুলে এনে উঠোনে ফেলেছে।
দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে মাছটা দেখল বলাকা। পাকা কাতলা, এখনও কানকো নড়ছে। তার কি মাছ দেখে লোভ হয়? একটুও হয় কি?
মুখটা ফিরিয়ে নিল বলাকা। না, তার কোনও লোভ নেই। একটা মানুষের সঙ্গে সঙ্গেই যেন চলে গেল ওসব। এখন আঁশটে গন্ধে তার গা গুলোয়।
এই যে আজ তার ছেলেমেয়েরা আসবে, নাতি-নাতনিরা দামাল পায়ে সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়াবে, হাসিখুশি হইহট্টগোল হবে এসব ভালই লাগবে বলাকার। ভর ভরন্ত সংসার কার না ভাল লাগে? তবু সব থেকেও বুকের একটা পাশ যেন চিরকালের মতো ফাঁকা হয়ে গেছে। ওইখানে অন্ধকার আর হু হু করে বিরহের বাতাস বহে যায় সারাক্ষণ।
ভালবাসা কারে কয়? দশ বছর বয়সের বালিকা কামবোধহীনা বলাকা তা জানতই না। আবার মেয়েদের সহজ সংস্কারবশে জানতও। সে এক জানা না-জানার রহস্যময় আলো-আঁধারিতে তাদের শুভদৃষ্টি। ঘুমকাতুরে বলাকার বিছানায় এক প্রাপ্তবয়স্ক অচেনা পুরুষ-তার তথাকথিত স্বামী। পনেরো বছর বয়সের তফাত। দেহ জাগেনি, মন জাগেনি। রজোদর্শনও হয়নি তখনও। তার শোওয়া খারাপ ছিল বলে লোকটা তাকে সযত্নে পাশ ফিরিয়ে দিত। পাছে চঞ্চলতাবশে ঘুমের ঘোরে খাট থেকে পড়ে যায় সেই জন্য বারবার উঠে পাশবালিশের ব্যারিকেড ঠিকঠাক করে দিত। আর টাইফয়েডের সময় তো কোলে তুলে বাথরুমেও নিয়ে গেছে। টাইফয়েডের যখন বাড়াবাড়ি যাচ্ছে তখন আর বাথরুমে গিয়ে বসবার ক্ষমতাও ছিল না বলে বেডপ্যান দিত ওই লোকটাই। এসবের ভিতর দিয়েই বুনে ওঠে ভালবাসা। তার অত বাহার নেই, রোমান্স নেই, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে এমন বজ্ৰবাঁধন তৈরি করে যে আর জোড় ভাঙে না কখনও, ভালবাসা কি শুধু উথালপাথাল ঝড় জল, নাকি উথলে-পড়া দুধ, নাকি বর্ষায় ফুলে ফুলে ছেয়ে যাওয়া কদম গাছ, নাকি সুফলা বছরে সম্পন্ন গৃহস্থের ধানের গোলা, সে কি সেতারের মির, নাকি আশ্চর্য সুগন্ধ কোনও? না না, ওরকম নয়। ওরকম নয় কিছুতেই। দুটো নারী পুরুষের সম্পর্কই তো শুধু নয়, তার মধ্যে শ্বশুর-শাশুড়ি, দেওর-ননদ, গোরু-ছাগল, পাখি-পশু, খরা বন্যা, কাঙাল-ভিখিরি কত কী ঢুকে পড়ে এসে। সহবত, নিয়মকানুন, অভদ্রতা ভদ্রতা–সব মিলিয়ে সম্পর্ক কি সোজা কথা? তারা যেন এক কুলি আর এক কামিন সযত্নে খেটেপিটে রচনা করেছিল এই সংসার। কাজ ভাগ করা ছিল, দায় ছিল, দায়িত্ব ছিল।
দশ বছর বয়সে বিয়ে। একটি সমর্থ পুরুষের ছায়ায় সে ক্রমে ক্রমে বয়ঃসন্ধি পেরোল। তার সংযত পুরুষটি স্ত্রীর যৌবন সমাগমের জন্য অপেক্ষা করেছিল, কখনও নিয়ম ভাঙেনি কোনও। পৌরুষের অন্যায্য জোর খাটায়নি কখনও। তার কাম কখনও ছিল না অন্ধ ও বধির। দীর্ঘকায়, গৌরবর্ণ, অতীব সুপুরুষ এই লোকটি কখনও ছিল বাবার মতো স্নেহশীল ও প্রযত্নপরায়ণ, কখনও ছিল বন্ধুর মতো বিশ্বস্ত দোসর, কখনও নির্জন রাতে গোপনে হ্যারিকেন জ্বেলে ষোলো গুটি খেলতে খেলতে হয়ে যেত তার সঙ্গী খেলুরি। বলাকা বুঝতেই পারেনি, লোকটি তার কে? শুধু বুঝত, একে ছাড়া তার চলে না।
তারপর ক্রমশ শরীরে বন্যার জল এল তার, কূল ভাসিয়ে। কানায় কানায় ভরে এল সে। এক পাগল বর্ষার রাতে হ্যারিকেনের নিবু নিবু আলোয় মানুষটার মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ যেন চিনতে পেরেছিল তাকে বলাকা। দুটি লীলায়িত হাতে তার কণ্ঠ বেষ্টন করে লজ্জায় মরে গিয়ে খুব আস্তে বলেছিল, এবার…।
সেই রাতের কথা মনে পড়লে আজও এই বাহাত্তর বছরের শরীর ও মনে একটা ঝংকার ওঠে, রক্তে নুপুর বেজে যায়। বিবশ হয়ে যায় মন। সে তো শুধু কাম নয়, সে এক অপার্থিব নিবেদন। একটি চুম্বন গড়ি, দোঁহে লই ভাগ করি, এ বিশ্বে মরি মরি এত আয়োজন। এ হল সেই পৃথিবীর কথা যখন দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করতেন। যখন শরীর জুড়ে শঙ্খধ্বনি আর জোকার শোনা যেত।
বড়মা! ও বড়মা।
দুটি টইটুম্বুর চোখ তুলে দরজাটা বড্ড আবছা দেখল বলাকা। গলার স্বরটা অবশ্য চেনা।
আয়। দুদিন আসিসনি তো! কী হয়েছিল?
পান্নার সঙ্গে ওর বয়সি একটা মেয়ে। চোখের জলটা আঁচলে মুছে ভাল করে দেখল বলাকা। ভারী ফুটফুটে চেহারার মেয়ে। কিন্তু মুখটা বড় দুঃখী।
কাঁদছিলে নাকি বড়মা? জ্যাঠার কথা মনে পড়লে আমারও যে কী ভীষণ কান্না পায়!
কষ্ট করে একটু হাসল বলাকা।
কিন্তু অনেক কেঁদেছ বড়মা। আর কেঁদো না। অজ্ঞান হয়ে জ্যাঠার খাট থেকে পড়ে গিয়েছিলে সেদিন, মাথা কেটে রক্তারক্তি। কী ভয় পেয়েছিল সবাই।
বলাকা একটু হেসে বলল, তবু তো মরিনি। তার আগেই যে কেন গেলাম না সেই দুঃখ কি কম? আয় বোস সামনে। তোকে একটু দেখি।
সঙ্গে কাকে এনেছি বলো তো! চেনো একে?
বলাকা একটু তাকিয়ে থেকে বলল, অমলের মেয়ে না?
ও মাঃ চিনলে কী করে, আগে দেখছ কখনও?
না রে। শুনেছি ওরা গাঁয়ে এসেছে। তা ছাড়া ওর মুখে অমলের মুখের আদল আছে।
মেয়েটা এগিয়ে এসে একটু আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ বলল, আচ্ছা, আমি কি আপনাকে প্রণাম করব?
না, না, প্রণাম করতে হবে না, একটা মোড়া টেনে নিয়ে বোসো।
মোড়াতে নয়, মেয়েটা ঝুপ করে মেঝেতেই বলাকার মুখোমুখি বসে পড়ল। পাশে পান্না।
কী করছিলে বড়মা? আজ তো তোমার খুব আনন্দ, না? সবাই আসছে।
বলাকা হেসে বলল, আনন্দ তো বটে মা, কিন্তু ফের যখন চলে যাবে সবাই, তখন আমি যে একা সে-ই একা।
ও বড়মা, বাবাকে বলো না, আমি এসে তোমার কাছে থাকি।
থাকবি?
এত বড় বাড়িতে তুমি একা একা থাকো, তোমার ভয় করে না?
বলাকা হেসে বলে, ভয়! ভয়টা কীসের?
আমার যা ভয়! বাব্বাঃ, ভয়ে যেন মরে যাই। মাঝে মাঝে এমন হয়, যেন ভয়ে হার্টফেল হয়ে যাবে।
তোর তো চিরকাল ভয়। সেই ছোট থেকে। আমার কাছে এসে থাকতে চাস সে তো খুব ভাল কথা। কিন্তু এই ফাঁকা বাড়িতে তো তোর আরও ভয় করবে।
ম্লান মুখে পান্না বলে, সেটাই তো প্রবলেম। তোমার কেন ভয় করে না বলো তো!
কাকে ভয় করব? ভূতপ্রেতকে! আমি নিজেই তো ভূতপ্রেতের কাছাকাছি চলে গেছি, আর ভয় করে কী হবে?
তুমি বড় জ্যাঠাকে দেখতে পাও?
না, তবে দেখতে পেলে ভয় পেতাম না। খুশিই হতাম।
তোমার দুর্জয় সাহস বড়মা। আর এই যে দেখছ সোহাগ, এরও খুব সাহস। রাতে একা একা বেরিয়ে পড়ে, জানো? বলে কী, ভূতেরা নাকি ওর বন্ধু! হিঃ হিঃ!
মেয়েটার দিকে তাকাল বলাকা। মুখের বিষণ্ণতাটা ভারী গভীর। পোশাকটাও ভাল নয় তেমন। রংচটা একটা ঢোলা ধুলোটে রঙের কামিজ আর একটা কালচে সালোয়ার। গায়ে কোথাও গয়নার চিহ্ন নেই।
বলাকা মৃদু স্বরে বলে, রাতবিরেতে একা একা বেরোনো ভাল নয়। গাঁ-গঞ্জেও পাজি লোক আছে।
মেয়েটা বড় বড় চোখ করে বলাকার মুখের দিকে চেয়ে ছিল। খুব এক নজরে। হঠাৎ বলল, আপনাকে দেখলে রিয়েল বলে মনেই হয় না, মনে হয় ম্যানেকুইন বা স্ট্যাচু।
এটা প্রশংসা না নিলে বুঝতে না পেরে বলাকা হেসে ফেলল, বলল, হ্যাঁ, এখন স্ট্যাচুই হয়ে গেছি। বোধবুদ্ধিও বোধহয় আর কাজ করে না।
মেয়েটা মাথা নেড়ে বলে, তা বলছি না, ইউ লুক হেভেনলি। আপনি তো পারুলের মা!
পারুলের মা শুনে একটু অবাক হল বলাকা। পারুল তো আর ওর সমবয়সি নয়। তবু রাগ হল না। সাহেবি কেতায় ওরকমই সব বলে বোধহয় ওরা। ঠিকঠাক সব হলে আজ তো পারুলেরই ওর মা হওয়ার কথা ছিল।
আজ মনে হয়, বিয়েটা না হয়ে বেঁচেছে পারুল। সবটুকু অবশ্য বাঁচেনি। মায়েরা অনেক কিছু টের পায়। বলাকাও পেয়েছিল। পারুল কিছুই ভেঙে বলেনি তাকে। তবু ঘটনা যে একটা ঘটেছিল এটা খুবই স্পষ্ট টের পেয়েছিল বলাকা। মা আর মেয়ের মধ্যে একটা লুকোচুরি চলছিল বটে, কিন্তু বলাকা নজর রেখেছিল, অঘটনের ফল কতদূর গড়ায়। গড়ায়নি, কিন্তু মর্মে গভীর আঘাত পেয়েছিল বলাকা।
কোনও কথাই সে কখনও স্বামীর কাছে গোপন করেনি। এক রাতে সে গৌরহরিকেও নিজের আশঙ্কার কথা বলে ফেলে। রাগী ও মেজাজি গৌরহরি সটান উঠে বসে বলেছিল, বলো কী? হারামজাদার এত সাহস!
গৌরহরিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠান্ডা করতে হয়েছিল। বলাকা বলেছিল, অমলকে শাসন করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে যে! চারদিকে রটে যাবে।
গৌরহরি ফুঁসছিল রাগে। গরগর করছিল। সেই পুরুষের রাশ ধরা বড় সহজ ছিল না তখন।
মেঘটা কেটে গিয়েছিল কয়েকদিন পর। তারপর পারুলই বেঁকে বসল, অমলকে বিয়ে করবে না। বলাকার মন থেকে ভার নেমে গিয়েছিল।
আজ মেয়েটাকে দেখে সেইসব পুরনো কথা একটা ঝটকা মেরে গেল যেন।
হ্যাঁ, আমি পারুলের মা। পারুলকে চেনো?
হ্যাঁ, চিনি। শি ইজ এ গডেস।
বলাকা হেসে ফেলে, সে কী? পারুল আবার গডেস কীসের?
ওকে আমার ওরকমই লাগে। আই অ্যাডোর হার।
বলাকা খুশিই হল। বলল, বেশ তো, ভালই তো।
সোহাগ আর আমি খুব বন্ধু হয়ে গেছি, জানো বড়মা? ও-ও একটু পাগল, আমিও একটু পাগল। তাই খুব মিল।
তাই বুঝি? তা কী পাগলামি করিস তোরা?
খুব হোঃ হোঃ হিঃ হিঃ করে হাসি, আবোলতাবোল কথা বলি, আচার চুরি করে খাই আর ক্যারিক্যাচার করি।
কিন্তু সোহাগের মুখে তো হাসির চিহ্ন দেখছি না। মুখখানা ভার কেন?
ও খুব চিন্তা করে যে!
কীসের চিন্তা?
সেটাই তো আমি বুঝতে পারি না। সব সময়ে কেবল ভাবে আর ভাবে।
এইটুকু বয়সে অত ভাবো কেন?
সোহাগ মৃদু হেসে মাথাটা নোয়াল।
পুজো অবধি কি থাকবে তোমরা?
সোহাগ উদাস মুখে বলে, কী জানি!
তোমাদের তো কয়েকদিন আগেই চলে যাওয়ার কথা ছিল, শুনেছিলাম।
হ্যাঁ, বাবা হঠাৎ জরুরি কাজে লন্ডন গেছে, তাই আমরা আর যাইনি, কলকাতায় আমার হেলথ হ্যাজার্ড হয়।
সেও যেন শুনেছিলাম। ভালই তো, থাকো। আজ তোমার পছন্দের পারুলও আসবে। সেও পুজো অবধি থাকবে বলেছিল। মাঝে মাঝে এসে গল্প-টল্প করে যেও।
হঠাৎ হি হি করে হেসে পান্না বলে, ও কী বলে জানো বড়মা? বলে, আমি যদি পারুলের মেয়ে হতাম তো খুব ভাল হত।
বলাকার মনটায় একটা ধাক্কা লাগল। হঠাৎ এ কথা বলে কেন মেয়েটা? এরকম ভাবা তো স্বাভাবিক নয়?
আলগা গলায় বলাকা জিজ্ঞেস করে, তাই নাকি সোহাগ?
কথাটার জবাব না দিয়ে সোহাগ হঠাৎ বলল, আপনার নামটা খুব অদ্ভুত, না?
কেন বলো তো!
বেশ আধুনিক নাম।
মোটেই না। রবীন্দ্রনাথ বলাকা লিখেছিলেন সেই কবে। সেই থেকেই তো বাবা আমার নাম রেখেছিল বলাকা। পড়েছ বলাকা?
ঘাড় হেলিয়ে সোহাগ বলে, হ্যাঁ। মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা, লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা। ইট ইজ ফ্যানটাস্টিক।
এ কথায় মুগ্ধ হল বলাকা। না, ততটা সাহেবি চাল নেই তো!
কী খাবে বলো তো!
ফের ঘাড় হেলিয়ে বলল, এনিথিং, এখানে সবাই খুব খাওয়াতে ভালবাসে, না?
বলাকা স্মিত মুখে বলে, খাওয়ানোর মধ্যে একটা আদর থাকে তো!
সোহাগ হাসিমুখেই বলল, আমার মাও আমাকে খুব খাওয়াতে চায়। কিন্তু তার মধ্যে আদরটা থাকে না।
.
০৯.
প্রথম দৃশ্য। বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক জীবনের উপান্তে পৌঁছে গেছেন। জরাজীর্ণ শরীর, বিরলকেশ মাথা, বেশবাসের ঠিক নেই। মধ্য রাতে বৈজ্ঞানিক একটি পুরনো, প্রকাণ্ড, কীটদষ্ট, জীর্ণ পুঁথির ওপর ঝুঁকে বসে আছেন। উত্তেজনায় তাঁর হাত-পা কাঁপছে, চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে অতি পঠনের ফলে, বুক ধড়ফড় করছে আবেগে। জরাজীর্ণ এই প্রাচীন পুঁথির ভিতরেই তিনি নানা সংকেত পেয়ে যাচ্ছেন এবং জীবনের বহু সাধনা, অধ্যবসায়, অনেক বিনিদ্র রাত্রি ও বিশ্রামবিহীন দিন কাটিয়ে অবশেষে তিনি তাঁর অভীষ্টের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন প্রায়। এই বিরল, অজ্ঞাত পুঁথির ভিতরেই লুকোনো রয়েছে মানুষের অমরত্ব লাভের বীজ। আর কয়েকটি পৃষ্ঠা অতিক্রম করলেই সেই বাতিঘর, যা মৃত্যুর অন্ধকার মহাসাগরে মানুষকে অনন্তকাল বেঁচে থাকার গুপ্তমন্ত্রের সন্ধান দেবে।
একটা মাছি বিরক্ত করছে বারবার। নাকের ওপর, চোখের সামনে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে, টাকের ওপর বসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। বৈজ্ঞানিক বিরক্ত হয়ে পতঙ্গ নিধনের জন্য চামড়ার ফলক লাগানো শলাকাটি তুলে ফটাস করে মাছিটাকে টেবিলের ওপরে মেরে ফেললেন। অতি ব্যগ্রতায় ঝুঁকে পড়লেন পুঁথির ওপর।
একটা বাতাস এল জানালা দিয়ে। দমকা বাতাসের ঝটকায় পুঁথির জীর্ণ পাতা পট করে উলটে গেল। বৈজ্ঞানিক বিরক্ত হয়ে ধমক দিলেন, থামো! এ সময়ে বিরক্ত কোরো না।
দ্বিতীয় দমকা হাওয়াটি আরও একটু জোরালো। ফড়ফড় করে পুঁথির পাতা উলটে গেল কয়েকটা, বৈজ্ঞানিকের নোটবই পড়ে গেল মেঝের ওপর। কলম গড়িয়ে যেতে লাগল।
বৈজ্ঞানিক ধমক দিলেন, এসব কী হচ্ছে এ সময়ে?
তৃতীয় দমকা বাতাসটা এল হা-হা রবে প্রবল ঝঞ্ঝার বেগে, জানালা দরজার কপাট প্রবল ঝাপটায় আর্তনাদ করে উঠল। বৈজ্ঞানিক পাগলের মতো উঠে জানালা বন্ধ করতে গেলেন আর তখনই লুঠেরা বাতাস জীর্ণ পুঁথির পাতার বাঁধন ছিন্ন করে উড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগল। বিপরীত জানালা দিয়ে কাটা ঘুড়ির মতো উড়ে যাচ্ছে পাতাগুলি, অমূল্য পাতাগুলি। বৈজ্ঞানিক আর্তনাদ করে উঠলেন, থামো ছিন্নপত্র, স্থির হও! আমার কাজটুকু শেষ করতে দাও দয়া করে।
কেউ শুনল না তাঁর কথা। বাইরের অন্ধকার মুক্তাঞ্চলে পাতাগুলি উড়ে যাচ্ছে। বৈজ্ঞানিক পাগলের মতো দরজা খুলে ছুটে গেলেন বাইরে। অসহায় চোখে চেয়ে দেখলেন, মহার্ঘ পাতাগুলি অন্ধকারে কোন অদৃশ্য ঠিকানায় ভেসে চলে যাচ্ছে, গাছের মগডালে, পুকুরের জলে, বিছুটি বনে, আকাশে। বজ্রপাত হল, মেঘ ডেকে উঠল গম্ভীর কণ্ঠস্বরে, প্রবল বৃষ্টি ছুটে এল তার অসংখ্য খরসান বল্লমে চতুর্দিক বিদ্ধ করতে করতে। বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।
শরীর কেঁপে উঠল বয়সের শীতে। বিধ্বস্ত বৈজ্ঞানিক ফিরে এলেন ঘরে। স্মৃতিভ্রংশ, স্থাণুর মতো বসে রইলেন নিজের আসনে। হাতে একটি পানীয়পাত্র। সেটি মুখে তুলতে ভুলে গেছেন। তাঁর চোখের জল ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ছে পাত্রের ভিতরে।
দ্বিতীয় দৃশ্য। অন্ধকার মঞ্চে একটি নারীকণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, আমি শ্রেষ্ঠীকন্যা অম্বালিকা। দুষ্কৃতীরা অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে। নগরবাসীগণ, তোমরা অবহিত হও, আমার পিতা এক কোটি টাকা মুক্তিপণ দিয়ে আমাকে মুক্ত করেছেন। দেখ, আমি অম্বালিকা, এক মহার্ঘ মেয়ে। আমার দাম কোটি টাকা।
মঞ্চ আলোকিত হল। গাছতলায় দুটি কাঙাল ভিখিরি মেয়ে বসে আছে। কিশোরী। মঞ্চের মাঝখানে একটি বেদির ওপর দাঁড়িয়ে শ্রেষ্ঠীকন্যা অম্বালিকা হাত তুলে জনতার অভিনন্দন গ্রহণ করছে।
কাঙাল মেয়েদের একজন আর একজনকে বলে, হ্যাঁ লা দিদি, এক কোটি টাকা কত টাকা রে?
তা কী জানি! হাজার টাকা অবধি জানি, তা সেও অনেক টাকা। গুণে শেষ করা যায় না।
আর মুক্তিপণটা কী বল তো!
ওই তো, একজনকে ধরে নিয়ে যায়, তারপর টাকা আদায় করে ছেড়ে দেয়।
ছোট মেয়েটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমাদের কেউ ধরে নেবে না কখনও।
সে কথা বলিসনি, আমাদেরও মাঝে মাঝে ধরে বইকী। ভিক্ষে বা বেশ্যাবৃত্তি করাতে নিয়ে গিয়ে লাগায়। এই যে আমাদের রোগাভোগা, কালো চেহারা, মেয়ে-শরীর বলে মনেই হয় না, এই শরীরেরও কিছু ব্যবহার আছে। মেয়ে বলেই একটু-আধটু কাজে লাগি আজও। দুখানা রুটি একটু গুড় খাইয়ে আমাকেও একজন আধবুড়ো লোক ভোগ করেছিল।
আমাকে ভোগ করেছিল একজন মাতাল। আমার তুচ্ছ শরীর নিয়ে সে যখন ব্যস্ত ছিল তখন আমি তার পকেট থেকে টাকা তুলে নিই।
শ্ৰেষ্ঠীকন্যা অম্বালিকাকে ঘিরে ধরেছে সাংবাদিকরা। একজন বাঁচাল সাংবাদিক বলল, মুক্তির জন্য অভিনন্দন অম্বালিকা। দয়া করে বলুন, দুষ্কৃতীরা আপনাকে ধর্ষণ করেনি তো!
অম্বালিকা অবিচলিত হয়ে বলল, আমি এ কথার জবাব দেব না। আমি শুধু বলতে চাই, মুক্তি কীসের? কেমন মুক্তি? এক বন্দিদশা থেকে আর এক বন্দিদশায় গমন করা ছাড়া মেয়েদের কোনও মুক্তি কি কোথাও আছে? ভদ্রমহোদয়গণ, ওই দেখুন, দক্ষিণ দিকে একটু দূরে ওই দাঁড়িয়ে আছেন আমার প্রেমিক, আমি ওঁর বাগদত্তা। যখন আমাকে হরণ করা হয় তখন নগর-উদ্যানে মনোরম এক অপরাহে আমি ও আমার প্রেমিক বিশ্রম্ভালাপে রত ছিলাম। গদগদ ভাব, পরস্পরের শ্বাসবায়ুতে ঘটে যাচ্ছিল প্রগাঢ় ভালবাসার আশ্চর্য সংক্রমণ। সেই সময়ে সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা অস্ত্র উদ্যত করে আমাদের ঘিরে ফেলে। না, আমার প্রেমিক কোনও প্রতিরোধ করেননি। আত্মরক্ষা সকলেরই জীবনধর্ম। উদ্যত অস্ত্রের সামনে তাঁর কিছুই করার ছিল না। কোটি টাকা মুক্তিপণ দিয়ে আমাকে মুক্ত করা হয়েছে বটে, কিন্তু দেখুন, আমার প্রেমিকের মুখে কোনও হাসি নেই, আনন্দ নেই। বিষণ্ণ ও দ্বিধাগ্রস্ত মুখে ওই তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ওই বিষণ্ণতা অকারণ নয়। উনি চেয়েছিলেন এক শুদ্ধ ও অনাঘ্রাতা নারী। কিন্তু দুষ্কৃতীদের ডেরায় কী ঘটেছিল তা উনি জানেন না। আমার শুদ্ধতা নিয়ে উনি আজ বিচলিত, দোলাচলায়মান, দ্বিধাগ্রস্ত। পৌরাণিক সীতাই কখনও সন্দেহপাশ থেকে মুক্ত হননি, আমি তো সামান্যা নারী। ভদ্রমহোদয়গণ, আমি তাই প্রশ্ন করতে চাই, নারীর মুক্তিপণ এক ব্যর্থ প্রয়াস। তার মুক্তিই যে আদপে নেই। বরং ওই দেখুন, গাছতলায় ওই যে দুটি ভিখিরি মেয়ে বসে আছে. ওরাও আমার চেয়ে কত স্বাধীন, কত সুখী …
ওলো দিদি, মাগী কী বলছে শুনলি?
ভদ্দরলোকেরা ওরকম কত আজগুবি কথা কয়। আয়, বরং একটু ঘুমিয়ে নিই দুজনেই।
তাই ভাল। জেগে থাকলেই খিদে চাগাড় দেয়।
তৃতীয় দৃশ্য। বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক চারধারে পাগলের মতো পুঁথির নিরুদ্দেশ পাতাগুলি খুঁজছেন। এক আধটা পেয়ে যাচ্ছেন। হতাশায় মাথা নেড়ে বলছেন, না, না, সব মুছে গেছে। সব মুছে গেছে।
বুড়োটা কী খুঁজছে রে দিদি?
পাগল-টাগল হবে। ছেঁড়া ভেজা কাগজ কুড়োচ্ছে।
বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক এগিয়ে এলেন তাদের দিকে, ওহে, তোমরা একটা পুঁথির কিছু ছেঁড়া পাতা পেয়েছ কুড়িয়ে?
বড় জন হাই তুলে বলল, ঝড়বৃষ্টির সময় কতক উড়ে যাচ্ছিল দেখেছি। কাগজ কুড়িয়ে কী হবে? আমরা কি পড়তে জানি!
মূর্খ বালিকা। কী অমূল্য সম্পদ যে ওই কাগজের মধ্যে ছিল তা তোমরা জান না।
লটারির টিকিট নাকি রে পাগলা-বুড়ো?
তার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। ওতে লেখা ছিল মানুষের মৃত্যুর প্রতিষেধক। মৃত্যুহীনতার মোহনায় মানুষকে পৌঁছে দিচ্ছিলাম আমি। বিধি বাম। মৃত্যুকে রোধ করা গেল না।
কী বলছে রে দিদি?
বলছে এমন ওষুধ বের করবে যাতে মানুষ আর মরবে না।
মরণ! একটু আগে ঝড়বৃষ্টির সময় ওই তালগাছে যে বাজটা পড়ল সেটা আমাদের মাথায় পড়লেও কি মরব না?
ওগো ও বিটলে বুড়ো, মানুষ মরবে না তো খাবে কী?
বৈজ্ঞানিক হতবাক হয়ে বললেন, তার মানে?
বলি মানুষকে যে বাঁচিয়ে রাখতে চাও তার খোরাকির জোগাড়টা আগে করে রাখ বাপু।
মূর্খ বালিকা, মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি চাও না তোমরা?
দুই বোন হেসে গড়িয়ে পড়ল। বড় জন বলল, বেঁচে আছি কিনা সেটাই যে টের পেলুম না এখনও। আয় তো বিটলে বুড়ো, গায়ে একটা চিমটি কেটে দেখ তো বেঁচে আছি কিনা।
নাটকের নাম মুক্তিপণ। কিংবা ঠিক নাটকও নয়। ঈষৎ নাটকীয় গদ্য। কী এটা, কী সে বলতে চাইছে তা অমল নিজেও জানে না। কিন্তু কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে তার আজকাল এরকম কিছু কিছু লেখার ঝোঁক চেপেছে। শুরু হয়, কিন্তু প্রায়ই শেষ হয় না। তবে নানা ছদ্মবেশে এসব লেখার মধ্যে সে নিজে ঢুকে যায়, আর চলে আসে পারুল। পারুলের সঙ্গে কখনও আর কেউ মিশে যায়, যেমন তার নিজের আদলেও আসে অন্যের আদল।
অম্বালিকা কি পারুল? না, ওর মধ্যে সোহাগও রয়েছে কিছুটা। কীভাবে যে মিশে গেল দুজন কে জানে। ছয় সাত বছর আগে তাদের কলম্বাস শহরের বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল সোহাগ। তখনও সে নিতান্তই বালিকা। দশ এগারো বছর বয়স। এইলিন নামে একজন ব্রাজিলীয় মেয়ে আসত তাদের বাড়িতে। সে এক এজেন্সির মাধ্যমে বুডঢার বেবি সিটিং-এর কাজ পায়। সেই থেকে যাতায়াত। এইলিন প্রায়ই ব্ল্যাক ম্যাজিক হিপনোটিজম এবং অদ্ভুত সব বিষয়ে কথা বলতে ভালবাসত। ভুডুর প্রতি ছিল অমোঘ আকর্ষণ। সোহাগকে নিয়ে গিয়েছিল সে-ই।
সোহাগকে অপহরণের পরই বাড়িতে ফোন আসত যাতে তার খোঁজখবর করা বা পুলিশে জানানো না হয়। আশ্বাস দেওয়া হত, সোহাগকে নিরাপদে ফেরত দেওয়া হবে। উদ্বিগ্ন অমল আর মোনা পুলিশকে জানায়, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। এইলিনের চিহ্নও খুঁজে পায়নি তারা। দিন সাতেক বাদে এক ভোরবেলায় একটা গাড়ি সোহাগকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে যায়। যে সোহাগ ফেরত এল সে যেন ঠিক আগের সোহাগ নয়। একটু গম্ভীর, একটু ভাবুক, একটু বিষণ্ণ আর উদাসীন। অমল আর মোনা এবং পুলিশের লোকেরা তাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করেছে। সে নানা উলটোপালটা জবাব দিত। রেপ করা হয়েছে কিনা। তার ডাক্তারি পরীক্ষাও হয়। রেপ না হলেও তার গায়ে বিশেষ জায়গায় কয়েকটি উল্কি পাওয়া যায়। পুলিশ বলেছিল, কোনও ধর্মোন্মাদ গোষ্ঠীর কাজ। কথাটা হয়তো মিথ্যে নয়। সোহাগ গোপনে নানা প্রক্রিয়া করত, অদ্ভুত ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ করত এবং কখনও কখনও তার অর্ধচেতন অবস্থা হত। অনেক সময় মধ্যরাত্রে সে নিশি-পাওয়ার মতো সারা ঘর ঘুরে ঘুরে নাচত। মোনা মাঝে মাঝে মারধরও করেছে ওকে। সোহাগের ই-মেল-এ কিছু অদ্ভুত ও দুর্বোধ্য বার্তা আসতে শুরু করেছিল। অমলের কলকাতায় ফিরে আসার কতকগুলো কারণের মধ্যে সোহাগও একটা কারণ।
সোহাগ ফিরল, কিন্তু তার সত্তার খানিকটা অংশ রয়ে গেল অন্য কোথাও, কোনও এক রহস্যময় গোষ্ঠীর কাছে। এখনও সোহাগের ই-মেল মার্কিং করলে সেই সব অদ্ভুত বার্তা পাওয়া যায়। কী যে হল মেয়েটার! কোন বিটকেল মানুষদের পাল্লায় পড়ল তার সমাধান আজও করতে পারেনি অমল রায়।
শ্ৰেষ্ঠীকন্যা অম্বালিকার মধ্যে পারুলই রয়েছে বটে, একটু সোহাগও আছে যেন। আর ওই বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক কি তারই প্রতিচ্ছবি নয়? স্বপ্ন আর সম্ভাব্যতার মধ্যে কী বিপুল ফাঁক? এখন সে মাসে এক কাঁড়ি টাকা মাইনে পায়। দেড় লাখেরও কিছু বেশি। দিল্লি বা বম্বে বা বিদেশে গেলে আরও অনেক বেশি পেত। কিন্তু শুধু টাকা রোজগারের যন্ত্র হওয়ার ইচ্ছে তো ছিল না তার। সে হতে পারত একজন আবিষ্কারক, একজন দার্শনিক বা না হয় একজন কবিই। এখন তার মনে হয় এত টাকাই তার সব সম্ভাব্যতা নষ্ট করে দিল। বানিয়ারা মগজ কিনে আনে, নষ্ট করে দেয়। এর চেয়ে কত ভাল ছিল গবেষণাগার, ভাল ছিল একাগ্র চিন্তার গৃহকোণ।
শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসের এ.সি. চেয়ারকারে বসে অমল রায় কিছুতেই ভারতের শিল্পমন্ত্রীর নামটা মনে করতে পারছিল না। গত কয়েক দিনে অফিসের বিভিন্ন মিটিংয়ে কয়েকবারই নামটা শুনেছিল সে। এখন কিছুতেই নামটা যে কেন মনে আসছে না। মনে করার কোনও জরুরি কারণও নেই। শরতের এই সুন্দর সকালে শিল্পমন্ত্রীর নাম নিয়ে কে-ই বা মাথা ঘামায়? কিন্তু সে ভিতরে ভিতরে অস্পষ্ট একটা তাগিদ টের পাচ্ছে, নামটা তার মনে পড়া উচিত। ইদানীং তার স্মৃতিশক্তি কমে যাচ্ছে। সন্দেহ হয়, এখন ফের মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসলে, স্ট্যান্ড করা তো দূরের কথা, সে আদৌ সেকেন্ড ডিভিশনেও পাস করবে কিনা। আজকাল হঠাৎ যেন বিস্মৃতি এসে বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়ায়, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, লোপাট করে দেয় মাথার যত প্রোগ্রামিং, যত ডাটা, যত ফাইল। কী যে হয় মাঝে মাঝে। যত দিন পরেই দেখা হোক, চেনা মানুষের মুখ দেখলেই তার নাম ঠিক মনে পড়ে যেত অমলের। মাসখানেক আগে একসঙ্গে ওয়ান থেকে টেন অবধি পড়া সহপাঠী এবং গলাগলি বন্ধু গৌরাঙ্গ যখন তার অফিসে দেখা করতে এসেছিল, কিছুতেই নামটা মনে পড়ল না তার। ঠিক বটে, গৌরাঙ্গর সঙ্গে মাধ্যমিকের পর আর দেখাই হয়নি। তবু তার স্মৃতিশক্তি কখনও এরকম ডিলিট হয়ে যায়নি কখনও। তিনটে ক্ষিপ্র জিনিস ছিল তার। ক্ষিপ্র চিন্তা, ক্ষিপ্র স্মৃতি, ক্ষিপ্র কাজ।
হঠাৎ অমল টের পেল, আজ যেন এ.সি. চেয়ারকারে প্রার্থিত নিস্তব্ধতাটা নেই। বড্ড বেশি কথাবার্তা হচ্ছে চারদিকে। সামনে পিছনে। সুবেশ ও সুভদ্র কয়েকজন এক রকমের স্যুট-পরা তোক আইল দিয়ে ঘন ঘন যাতায়াত করছে। অমল বিরক্ত হয়ে সদ্য কেনা ইংরিজি খবরের কাগজটা খুলে খুঁজতে লাগল, যদি কোথাও ভারতের শিল্পমন্ত্রীর নামটা পাওয়া যায়। খুবই হাস্যকর এই চেষ্টা। কারণ নামটা জানার কোনও প্রয়োজনই নেই তার। কিংবা সূক্ষ্মভাবে আছেও। শিল্পমন্ত্রী নয়, সে খুঁজছে তার স্মৃতির হারানো তথ্যগুলিকে। কেন হারিয়ে যাচ্ছে তারা, কেন উবে যাচ্ছে অকারণে?
আজকাল কি এ.সি. চেয়ারকারে ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়? তাই তো মনে হচ্ছে। সুবেশ ও সুভদ্র স্যুট পরা লোকগুলো ট্রে-ভর্তি বাক্স সাজিয়ে এনে বিলি করছে, সঙ্গে সিল করা বোতলে জল। ভাল, বেশ ভাল। এরা এ.সি-র যা ভাড়া নেয় তাতে ব্রেকফাস্ট তো দেওয়াই উচিত। খাবারের আমিষ-গন্ধে অমলের পেটের ভিতরটা কেমন করে ওঠে। সে আজ সকালে এক কাপ কফি ছাড়া কিছুই খেয়ে আসেনি। বাসুদেব ব্রেকফাস্ট করে দিতে চেয়েছিল, তার তখন খাওয়ার ইচ্ছে হয়নি। আজ সকালে কিন্তু ক্লান্ত ও অবসন্ন ছিল অমল। কাল রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখার পর শেষ রাতে ঘুম আসেনি আর।
দুঃস্বপ্ন! ঠিক দুঃস্বপ্নও বলা চলে না সেটাকে। একটা অন্ধকার গলি। এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে অমল। গলির অন্য প্রান্তে একটা মরা আলোর মলিন চৌখুপি। গোধূলির মতো পাঁশুটে আলো। কেউ কোথাও নেই। ওপরে নিরেট কালো অন্ধকার আকাশ। কিংবা হয়তো আকাশ বলেও কিছু ছিল না। শুধু ওই জনহীন গলিটাই দেখতে পেয়েছিল অমল। ঘেয়ো কুকুর বা রাস্তার বেড়ালও ছিল না, ছিল না দৌড়ে-যাওয়া ইঁদুর কি আরশোলা। এত প্রাণহীন গলি আর কখনও দেখেনি অমল। গলির ও-প্রান্তে ওই পাঁশুটে আলোর চৌখুপিও যেন এক নিষ্প্রাণতা। কোনও যাতায়াত নেই কারও, ছায়া নেই, গাছ নেই, প্রাণ নেই, শব্দ নেই। অমল দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই, এক পা-ও এমোনোর সাধ্য নেই তার। আর তার চোখ বেয়ে অঝোরে জল পড়ে যাচ্ছিল।
অন্ধকারের চেয়েও ভয়ংকর ওই পাঁশুটে আলো। সম্মোহিতের মতো চেয়ে থেকে অমল টের পাচ্ছিল, এখানেই সব শেষ। এখানেই মানুষের সব আয়াস ও প্রয়াসের শেষ, সভ্যতার শেষ, মানুষের স্বপ্ন ও সাধ্যের শেষ। আর কোথাও যাওয়ার নেই তার। বৃথা তার বেঁচে থাকা, বৃথা তার দর্শন বিজ্ঞান। এই গলিমুখ আর ওই পাঁশুটে আলোর চৌখুপি এক ভয়ংকর সংকেতের মতো নিশ্রুপে বলে দিচ্ছে, কিছু নেই, আর কিছু নেই।
একটুও বাতাস ছিল না, শ্বাসের শব্দও নয়, জ্যোৎস্না নয়। এত কান্না আসছিল তার। এইভাবে শেষ হয়ে যায় বুঝি সব কিছু?
যখন জেগে উঠল অমল তখন তার আকাশপাতাল জুড়ে ভয়। এত ভয় সে কখনও পায়নি। কিন্তু ভয়ের স্বপ্ন তো নয়! আশ্চর্য! তবে সে এত ভয় পেল কেন? পিপাসায় ব্লটিং পেপার হয়ে গিয়েছিল জিব। ভয় আর অজানা এক হাহাকার ঘুরে বেড়াচ্ছিল তার শূন্য বুকের খাঁচায়। চোখে জল ছিল তখনও। হাত-পা কাঠ হয়ে ছিল।
বারবার স্বপ্নটার কথা ভাবছে। ভাবছে স্বপ্নটার মধ্যে ভয়ের বীজ কীভাবে ছড়ানো ছিল? কোন সর্বনাশের সংকেত ছিল তার মধ্যে? কোন কূট আভাস?
এখনও ভাবছে সে। যদিও একটা স্বপ্নের জন্য এত বিচলিত হওয়ার কোনও মানেই হয় না। স্বপ্নের মধ্যে সত্য থাকে না কখনও। আবার কোনও জটিল প্রক্রিয়ায় হয়তো থাকেও। স্বপ্নটা নিয়ে অনিচ্ছের সঙ্গেও সে হয়তো আরও কয়েকদিন ভাববে।
যে লোকটা খাবারের বাক্স দিচ্ছিল সে অমলের ডান ও বাঁপাশের দুজনকে দুটো বাক্স দিয়ে অমলকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলে যাচ্ছিল। অমলের রাগ হল। তাকে কি দেখতে পায়নি নাকি লোকটা! আশ্চর্য তো!
সাধারণত সে যা করে না আজ তাই করে ফেলল অমল। হয়তো হঠাৎ নিজের খিদেটাকে আবিষ্কার করেই সে ধৈর্য হারিয়ে হঠাৎ এগিয়ে যাওয়া লোকটার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, এই যে, এখানে দেননি কিন্তু।
লোকটা একটু বিস্মিত চোখে ফিরে তাকাল তার দিকে। লোকটার মাথায় টাক এবং বেশ ভারী গোঁফ। হঠাৎ একটু হেসে লজ্জিতভাবে বলল, সরি, আপনাকে দেওয়া হয়নি। বলে একটা বাক্স এগিয়ে দিল তার হাতে।
লোকটাকে ক্ষমা করে দিয়ে অমল ফোল্ডিং টেবিলটা নামিয়ে তার ওপর রেখে বাক্সটা খুলল। চমৎকার ব্যবস্থা। বড় একটা পরোটা রোল, দুটো চিকেন স্যান্ডউইচ, ডিমসেদ্ধ, এক টুকরো চিজ, দুটো সন্দেশ, একটা কলা। অমল খেতে খেতে হঠাৎ একটু অস্বস্তিবোধ করছিল কেন যেন। তার মনে হল দুপাশের দুজন যাত্রী তাকে মাঝে মাঝে কৌতূহলের সঙ্গে দেখছে। আইলের ওপাশের সিট থেকেও যেন দুজন একটু ঝুঁকে চকিতে দেখে নিল তাকে। হঠাৎ তাকে ঘিরে একটু নিস্তব্ধতাও ঘনিয়ে উঠল যেন।
হঠাৎ ডানপাশের লোকটা খুব বন্ধুর মতো তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার এজেন্সিটার নাম কী?
অমল বিরক্ত হল। গায়ে-পড়া লোক তার পছন্দ নয়। বলল, আমার এজেন্সি নেই।
ও! লোকটা আর কিছু বলল না।
হঠাৎ যেন বোধবুদ্ধির একটা ঝিলিক জেগে উঠল মাথার মধ্যে। কাণ্ডজ্ঞান ফিরে এল, যখন সে লক্ষ করল, কামরার সবাই ব্রেকফাস্টের বাক্স পায়নি। তার সামনের সিটের অন্তত দুজন, আড়াআড়ি সামনের ডানদিকের সারির তিনজন এবং লক্ষ করলেই, আরও অনেকেই খাচ্ছে না। জলের বোতলটা খুলে দু ঢোঁক জল খেয়ে অমল তার ডানদিকের লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, সামথিং ইজ রং, ইজনট ইট! আপনারা কারা?
লোকটা খেতে খেতে মুখ তুলে একটু হেসে বলে, আমরা একটা ইলেকট্রনিক গুডস কোম্পানির সাব এজেন্ট। ইয়ারলি কনফারেন্সে শান্তিনিকেতনে যাচ্ছি।
ইস ছিঃ ছিঃ, আমার বড় ভুল হয়ে গেছে
লোকটা হাসিমুখেই বলল, তাতে কী? ইউ আর ওয়েলকাম–
বিস্তারিত ক্ষমাপ্রার্থনা বা ক্ষতিপূরণের সময় ছিল না। বর্ধমান এসে গেছে। অমল অ্যাটাচি কেসটা তুলে নিয়ে দ্রুত পায়ে আইল পেরিয়ে প্রিং-এর দরজাটা ঠেলে বেরিয়ে আসার সময়ে পিছনে, কামরার ভিতর থেকে একটা বড়সড় হাসির রোল শুনতে পেল।
তার কান গরম, লজ্জায় ঝাঁঝাঁ করছে মাথা। একদল ডেলিগেট কনফারেন্সে যাচ্ছে, তাদের জন্য কোম্পানি রাজকীয় ব্রেকফাস্ট আয়োজন করেছে এই সহজ ব্যাপারটা অমল রায়ের মতো বুদ্ধিমান, দুনিয়া-চষা একজন লোক বুঝতে পারল না!
ঘটনাটা হয়তো সামান্যই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গিন্নী গল্পের সেই ছোট ছেলেটির মতো তার আজ মনে হচ্ছিল, এ ঘটনাটা ওরা কেউ হয়তো কোনওদিনই ভুলতে পারবে না।
লজ্জা, নিজের ওপর বিরক্তি আর রাগ নিয়ে অমল স্টেশনের ফটক পেরিয়ে এল, নিজেকে চোর, লোভী, বেকুব ও অপদার্থ ভাবতে ভাবতে আনমনা অমল তার অ্যাটার্চি কেসটার একটা গুঁতো লাগাল একজনকে হাঁটুতে। লোকটা বাপ-রে বলে চেঁচিয়ে উঠতেই অমলের ইচ্ছে হল দৌড়ে পালায়। আজ তার এসব কী হচ্ছে?
সামনে একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট মডার্ন আর্ট। অবিশ্বাস্য রিকশার জড়াজড়ি, সাইকেল, গাড়ি, মানুষ, হর্ন, চিৎকার, ধুলো। এই জটিলতার দিকে হতাশভাবে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল অমল। সুশৃঙ্খল লন্ডন শহর থেকে সদ্য ফিরে এসে এই ভিড়ে ভিড়াক্কার, রিকশা-গাড়ি-মানুষের বিশৃঙ্খলা বড় ক্লান্তিকর মনে হয়। এই জটাজাল পার হয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে ভিড়ের বাসে ঠেলে ওঠা গন্ধমাদন বহন করার মতোই কঠিন ব্যাপার। অমলের হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। মনে হয় সে কখনওই কোথাও গিয়ে পৌঁছতে পারবে না।
পৌঁছনোর কোনও তাড়াও নেই তার। ভিড় একটু হালকা হওয়ার জন্য থাম ঘেঁষে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। নিজের গন্তব্য বিষয়ে সে যেন নিশ্চিত নয়। বউ, ছেলে, মেয়ের প্রতি সাধারণ গৃহস্থের যেমন টান থাকে কেন তার সেরকম নেই তা সে ভেবেও পায় না।
এর মূলে কি পারুল? ওই নামটা তার মনের মধ্যে উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাড্রেনালিন প্রবাহ বেড়ে যায়। এখনও। বাড়ে অস্থিরতা। আর আচমকা অন্ধ রাগ তাকে ছোবল মারতে থাকে। পারুলকে তার খুন করতে ইচ্ছে করে, আর কাঁদতে ইচ্ছে করে পারুলের জন্যই।
মোনালিসা বিয়ের সাত দিনের মধ্যেই জেনে গিয়েছিল সব কিছু।
নতুন বউয়ের প্রতি আদিখ্যেতার অভাবই মোনালিসাকে হয়তো একটু সন্দিহান করে থাকবে। তারপর উড়ো কথা, ফিসফাস, রটনা এসব থেকেও কিছু আঁচ করে নিয়েছিল। গোয়ায় মধুচন্দ্রিমা যখন নিতান্ত ম্যাড়ম্যাড়ে, রসকষহীন একটা সাইট সিয়িং-এ পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছিল তখনই কথাটা তুলেছিল মোনালিসা।
পারুল কে?
পারুল! পারুল একটা বন্ধ দরজা।
দরজা বন্ধ হলেও ওপাশে কেউ তো থাকতেও পারে।
সে আছে। পারুলের কথা নিয়ে আমাদের ভাববার দরকার নেই।
তুমি রবীন্দ্রনাথের মধ্যবর্তিনী গল্পটা পড়েছ?
না। কিন্তু প্লিজ, গল্পটা আমাকে আবার শোনাতে বসো না।
যে মানুষটা অ্যাবসেন্ট তার প্রেজেন্স অনেক সময়ে খুব স্ট্রং হয়ে ওঠে।
এসব তো ফিলজফি।
তাই কি? ফিলজফিও কিন্তু ফ্যালনা নয়।
লিভ পারুল অ্যালোন, প্লিজ মোনা।
তোমার আর আমার মধ্যে পারুল যে বড্ড বেশি ঢুকে বসে আছে।
উত্তেজিত অমল বলেছিল, না, নেই! নেই!
অত জোর দিয়ে বলছ বলেই সন্দেহ হচ্ছে।
পারুলের কথা মনে হলেই আমার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। ও আমাকে ভীষণ অপমান করেছিল।
আমি পারুলের বিষয়ে আরও একটু জানতে চাই। বলবে?
পারুল একটা নষ্ট মেয়ে।
নষ্ট? কীরকম নষ্ট?
শি ওয়াজ নট ফেইথফুল।
তোমার বোন ছায়া বলছিল, পারুল দেখতে খুব সুন্দর আর খুব ভাল মেয়ে। আমাকে ঠেস দেওয়ার জন্যই বলছিল। কথাটা কি মিথ্যে?
অ্যাপারেন্টলি লোকে ওকে ভালই বলবে।
তুমি বলছ না?
না। পারুল ভাল নয়।
তোমাকে রিফিউজ করেছে বলে?
কেন যে এসব কথা খুঁচিয়ে তুলছ মোনা! অকারণ অশান্তি করে লাভ কী তোমার?
স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যে এসব গোপন থাকলে পরে আমাদের অসুবিধে হবে। বরং ফ্র্যাঙ্ক হওয়া ভাল। তাতে আমরা আমাদের প্রবলেমগুলো সর্ট আউট করতে পারব।
তোমাকে নিয়ে আমার কোনও প্রবলেম নেই। আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি এখন একজন সুখী মানুষ।
সে তো খুব ভাল কথা। ভালবাসাটা কীরকম জানো? মুখের কথা নয় কিন্তু। কেউ ভালবাসলে সেটা ফিল করা যায়। আমি সেটা ফিল করছি না।
ফিল করছ না, তার কারণ পারুলকে নিয়ে তোমার সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সন্দেহ এক মারাত্মক ব্যাধি।
আমি তা জানি। আমার এক কাকিমা স্বামীকে সন্দেহ করত। শেষ অবধি স্বামীর এমন সব অসম্ভব যৌন সম্পর্কের কথা বলত যে আমরা কানে আঙুল দিয়ে পালাতাম। মিথ্যে সন্দেহটাই হল ব্যাধি। আমি তো তোমাকে সন্দেহ করছি না। কাউকে ভালবাসা তো অপরাধ নয়। সন্দেহের কী আছে বল!
এতই ফর্সা ছিল মোনা যে ওর গায়ের তিলগুলো পর্যন্ত তেমন কালো হয়ে উঠতে পারেনি ফর্সা রঙের ঠেলায়। সেগুলো ছিল লালচে বা বাদামি। মুখের একটা খর সৌন্দর্য ছিল। নাকটা পুরুষালি রকমের তীক্ষ্ণ। কিন্তু ওর রূপ চেয়ে দেখার মতো মুগ্ধতা কখনওই অমলকে পেয়ে বসেনি। অসহায় এক দেহভোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল মোনার প্রতি তার মনোভাব।
পারুলের কথা তুমি না তুললেই আমি স্বস্তি বোধ করব।
সেটা হবে অভিনয়। পারুলের কথা জেনেও তার কথা কখনও তুলব না সে কি হয়?
অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে লাভ কী?
অতীত যে কখনও কখনও বর্তমানকে বিষিয়ে দেয়।
তাহলে কী জানতে চাও বলো!
সব জানতে চাই। বলবে?
কোন একটা উপন্যাসে যেন পড়েছিলাম, একটি মেয়ে তার প্রেমিক সম্পর্কে বলছে, আমরা এক বৃন্তের দুটি ফুল, আমাদের ছিঁড়িলেন কেন?
এতটা?
হয়তো এতটাই। ছেলেবেলা থেকে চেনাজানা, যাতায়াত। সেই থেকে একটা বোঝাপড়া। পারুলের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে এটা সকলেই জানত। অন্যরকম যে হতে পারে এটা ভাবাই যেত না।
তাহলে অন্যরকম হল কেন? কী নিয়ে তোমাদের বনল না?
আমি জানি না।
অন্য কোনও পুরুষ?
আমি জানি না। শুধু জানি হঠাৎ একদিন পারুল আমাকে ঘেন্না করতে শুরু করে।
তাই কি পারা যায়?
হল তো! আমার কিছু করার ছিল না।
তুমি কোনও দোষ করনি?
না। কোনও দোষ করিনি। তুমি বড় উকিলের মতো জেরা করছ। জেনে রাখো, এসব ঘটনা আমাকে আর স্পর্শ করে না।
শুনেছি পারুল তার মা বাবার পছন্দ করা পাত্রকে বিয়ে করেছে।
হ্যাঁ।
ওর বাবা-মা জোর করে বিয়ে দেয়নি তো!
না। ওঁরা ওরকম লোক নন।
ব্যাপারটা অদ্ভুত। তোমাকে হঠাৎ ঘেন্না করার কী হল?
অহংকারীদের অনেক প্রবলেম মোনা।
পারুল কি অহংকারী?
ভীষণ। শি ইজ অলসো এ পিউরিটান।
পিউরিটান! তার মানে কী?
আমাকে কখনও ওর হাতটাও ধরতে দিতে চাইত না।
মাই গড! তাহলে কি তুমি কখনও ওর পিউরিটি নষ্ট করার চেষ্টা করেছিলে?
এ কথায় আতঙ্কিত হয়ে অমল প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছিল, না, না। আমি কিছু করিনি।
কথার চক্করে ফেলে সেদিনই মোনা তার মুখ থেকে সত্যটা প্রায় বের করে ফেলেছিল। আর সেইদিন থেকেই এই চালাক, গোয়েন্দার মতো তদন্তে ওস্তাদ, প্রোবিং, ন্যাগিং মেয়েটিকে সে ভয় পেতে শুরু করে। ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘেন্নাও।
যেই ঘেন্না শুরু হল অমনি অমলের নজরে পড়তে লাগল অদ্ভুত সব ব্যাপার। মনে হত, ওর গালে কি মেচেতা আছে? মাথার চুল তেমন ঘেঁষ নয় তো, টাক পড়ে যাবে কি? নীচের ঠোঁটটা একটু ঝুলে-পড়া না? ইস, দাঁতের সেটিং কী বিচ্ছিরি! বেশ মোটা কিন্তু। লোকে কি ওর মুখখানা একটু চোয়াড়ে দেখে না? হাতে বেশ লোম আছে তো! আর ও কি একটু গোঁফের রেখা?
অথচ অমল জানে নিরপেক্ষ বিচারে তা নয়। মোনা বেশ সুন্দরী। খুবই সুন্দরী। ওর এত বেশি চোখধাঁধানো রূপটাও যেন একটা অপরাধ বলে মনে হত তার।
জার্মানিতে বা ইংল্যান্ডে বা আমেরিকায় তাদের বিবাহিত জীবন যখন পুরনো হচ্ছে তখন তাদের ঝগড়াও হতে লাগল খুব। মোনা মাঝে মাঝেই বলত, তোমাকে বিয়ে না করে পারুল ঠিক কাজই করেছে। পারুলই ঠিক চিনেছিল তোমাকে।
পারুলের নাম মুখে আনার যোগ্যতাও তোমার নেই।
সে যোগ্যতা তোমারও নেই।
এইভাবেই তাদের সম্পর্ক থেকে মুছে-যাওয়া পারুল আবার স্পষ্ট হয়ে উঠত, জেগে উঠত। নবীকরণ হত পারুলের, পারুল তাই পুরনো হতে পারল না, বিস্মৃত হতে পারল না কখনও।
শেষ অবধি ধরা পড়ে গিয়েছিল অমল। একদিন নেশার ঘোরে সে ঘটনাটা প্রকাশ করে দেয়। বউয়ের সামনে, মেয়ের সামনে।
পরদিন মোনা তাকে বলেছিল, আমার এরকম সন্দেহ ছিলই। ছিঃ ছিঃ!
তোম্বা মুখ করে অমল বসে রইল কিছুক্ষণ। তার পর মুখ তুলে বলেছিল, সো হোয়াট! উইল ইউ ডেজার্ট মি?
আমি তোমাকে ছেড়ে গেলেও তো শূন্য স্থান ভরাতে পারুল ফিরে আসবে না।
আমি তোমাকে ঘেন্না করছি মোনা।
তার চেয়ে ভাল হত তুমি যদি নিজেকে ঘেন্না করতে কাপুরুষ।
আশ্চর্যের বিষয় হল, মেয়েদের সহজ সংস্কারবশে মোনার রাগ হওয়ার কথা পারুলের ওপর। কিন্তু অবাক কাণ্ড, সে কখনও পারুলের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেনি কখনও। বরং পারুলের ছবিখানা আলাদা করে সযত্নে অ্যালবামের একটা আলাদা পৃষ্ঠায় সেঁটেছিল সেই। সে জানত, মাঝে মাঝে অমল ছবিটা খুলে দেখে। ধরা পড়লে সংকোচ বোধ করত অমল। কিন্তু মোনা বলত, দেখ, দেখ, ওই ছবি দেখে তোমার বিবেক জাগ্রত হোক।
ভিড় কমেছে। অমল ক্লান্ত পায়ে স্টেশনচত্বর পার হল। এখন তার কানে এত কোলাহল কিছুই ঢুকছে না। বড় আনমনা সে আজ। দিনটা বিচ্ছিরিভাবে শুরু হল। দিনশেষে কী ঘটবে আরও, বলা যায় না। শরীরের ভার টেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। অফুরান মনে হচ্ছে পথ। পথের শেষে কেউ নেই তার। কেউ নেই।
.
১০.
ওইখানে ওই কদমগাছের তলায় শিব এসে দাঁড়ান। বেশ পেল্লায় চেহারা, একটু ভুঁড়ি আছে, বেশ বড় জটা, গোঁফ আছে, দাড়ি নেই। কাঁধ আর মাথার ওপর তিনটে সাপ ফোঁস ফোঁস করছে ফণা তুলে। বাঁ হাতে কমণ্ডলু, ডান হাতে ত্রিশূল, পরনে শুধু বাঘছাল। পিছনে ষাঁড়। শিবঠাকুর তাকে ডেকে বলেন, বৎস, তুমি তিনটে বর চাও।
মরণের এইখানেই মুশকিলটা হয়। তার এত কিছু চাওয়ার আছে যে তিনটে বরে তার সিকিভাগও হয় না। কিন্তু ঠাকুর-দেবতাদের নিয়মই হল, তিনটের বেশি বর দেন না, তাই মরণ খুব হিসেবনিকেশ করে রোজ। এমন তিনটে বর চাইতে হবে যে, আর কিছু চাওয়ার না থাকে। খুব কায়দা করে, বুদ্ধি খাটিয়ে তিনটে বর তৈরি রাখতে হবে। শিবঠাকুর একটু ভোলেভালা আদমি। কৌশল করে যদি একটা বরের মধ্যেই তিন-চারটে বর ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তাহলেও হয়তো খেয়াল করবে না। এই নিয়ে তার গ্যাঁড়ার সঙ্গে কথাও হয়েছে। গ্যাঁড়ার অবশ্য বর নিয়ে তেমন কোনও সমস্যা নেই। সে শুধু চায় অমিতাভ বচ্চনের মতো লম্বা হবে, কুংফু ক্যারাটের ওস্তাদ হবে আর বড় হয়ে আমেরিকায় যাবে। ব্যস, ওতেই তার তিনটে বর ফুস।
কিন্তু মরণের সমস্যা অত সরল নয়, প্রথমে সে ভেবেছিল, শিবঠাকুরের কাছে রসিক বাঙালের বদলে একজন ভাল বাবা চেয়ে নেবে। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছে, তার মা রসিক বাঙাল বাবাকে এতই ভালবাসে যে, বাবা বদলালে মা কেঁদেই মরে যাবে। তার চেয়ে বরং রসিক বাঙালই তার বাবা থাক, শুধু মেজাজটা অমন তিরিক্ষি না হয়ে যেন একটু নরম-সরম হয়, আর তাকে যেন ন্যাংটো করে চান না করায়, আর যেন ন্যাড়া করে না দেয়। দুনম্বর হল, কলকাতার বড়মা আর দাদা-দিদিরা যেন বেশ ভাল লোক হয় আর তারা যেন তাকে খুব ভালবাসে। মরণের মাঝে মাঝে মনে হয়, বোনটা হওয়ার পর থেকে তার মা যেন তাকে আর ততটা ডাক-খোঁজ করে না। তার ধারণা, এক মায়ের জায়গায় দুটো মা হলে আদর-টাদর ডবল হয়ে যাবে। সুতরাং তার দুনম্বর বর হল, বড়মা আর দাদা-দিদিরা যেন এখানে এসেই থাকে। তিন নম্বর বরটা নিয়ে সে খুব ভাবছে। ভেবে কোনও কূলকিনারা করে উঠতে পারছে না।
সকাল থেকে জিজিবুড়ি বারবার টানা মারছে। মুখ শুকনো। চোখ কপালে উঠেছে, সাতসকালে এসে ধপাস করে বারান্দায় বসে পড়ে খানিক হাঁফ ছেড়ে বলল, ওরে ও বাসি, কাল রাত থেকে বাড়িতে যে সুন্দ-উপসুন্দের লড়াই হচ্ছে। তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না যে।
মরণের মা দোতলার বারান্দা থেকে ঝুঁকে বলল, আহা, ভারী নতুন বৃত্তান্ত কিনা। ও তো নিত্যি হচ্ছে।
জিজিবুড়ি কাহিল গলায় বলে, এ তা নয় মা, এবার একটা খুনোখুনি না হয়ে যায়। সারা রাত কুরুক্ষেত্তর হল, সকালেও হচ্ছে। পাড়াসুদ্ধ সবাই ঝেটিয়ে এসে মজা দেখছে। এই রঙ্গে লোক।
ছেলেদের যেমন শিক্ষা দিয়েছ তেমনই তো হবে। আমার ধান চাল কম হরির লুট করেছে? ধার বলে টাকা নিয়ে যায়, একটা পয়সা আজ অবধি শোধ করেনি, মায়ের পেটের ভাই বলতে লজ্জা করে।
ওঃ, খুব যে ফোঁটা কেটে বষ্টুমি হয়েছিস আজ। তুইও তো একই ঝাড়ের বাঁশ। বাঙালের টাকায় দুদিন ধরে না হয় ফুটুনি করছিস, তা বলে নিজের জনদের দিকে চাইবি না? এই কি ধর্মের বিচার?
আমাকে আর ধর্ম দেখিও না মা, তোমার গুণধর ছেলেরা আমার সর্বনাশ করে পথে বসাতে চেয়েছিল, তখন তোমার ধর্ম কি পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছিল নাকি? এখন যেই অশান্তি লেগেছে অমনি নাকি কান্না কাঁদতে এসেছ! ধর্ম এখনও আছে বলেই দু ভাইয়ে খুনোখুনি হচ্ছে। আরও হোক, সত্যনারায়ণের সিন্নি দেব।
বলতে পারলি ও কথা? অভাবের সংসার বলে ঝগড়া হয়, তা কোথায় না হচ্ছে শুনি? তা বলে নিজের ভাইদের শাপশাপান্ত করবি? এতে কি তোরই ভাল হবে ভেবেছিস?
খবরদার মা, শাপশাপান্ত করবে না বলে দিচ্ছি। সেবারও খুঁড়েছিলে বলে ছেলেটার একশো চার-পাঁচ জ্বর উঠেছিল, তোমার মুখে বিষ আছে, শাপশাপান্ত করলে এ বাড়িতে ঢোকার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।
জিজিবুড়ির গুণ হল টক করে ভোল পালটাতে পারে। হঠাৎ ভারী নরম হয়ে বলল, ওমা! খুঁড়লুম কোথায়? বলছিলুম যে, মেয়েদের বাপের বাড়ির ওপর কত টান থাকে, তুই যে কেন ওদের ওরকম বিষনজরে দেখিস।
জিজিবুড়ি কিছুক্ষণ বারান্দার থামে মাথা হেলিয়ে বসে রইল। তারপর বলল, তোকে তো ওবাড়িতে যেতে বলিনি। বলছিলুম, দু ভাইয়ের একটা ব্যবস্থা করে দে। বাঙালকে বল না তার দোকানে কর্মচারী করে নিক।
আর বাঁধানো কথা বোলো না তো মা। তোমার ছেলেরা সেই চরিত্রের মানুষ কিনা! দোকানের টাকা ভেঙে জুয়ো খেলবে, মদ-গাঁজা খাবে, গুণের তো শেষ নেই।
জিজিবুড়ির সঙ্গে সবসময়ে পানের বাটা থাকবেই। এসব কথার পর পান সাজতে সাজতে বলল, বাঙালের ঘর করে করে তোরও মায়া-দয়া সব উবে গেছে। বাঙাল এলে এবার না হয় আমিই তাকে বলব, দুদুটো হুমদো হুমদো সম্বন্ধী বেকার বসে আছে বাপু, দোষঘাট থাকতে পারে, কুটুম তো, তাদের কথাও একটু ভেব বাপু। না হয় বাসরাস্তায় দুখানা মুদির দোকান করে বসিয়ে দাও।
আহা, একেবারে গিল্টি করা কথা। দোকান করে বসিয়ে দাও। তোমার ভীমরতি হলেও তার তো হয়নি। সম্বন্ধীদের সে খুব চেনে। তুমিই চিনলে না কী ছেলে পেটে ধরেছ!
ভীমরতি কি তোকেও ধরতে বাকি রেখেছে? ক বিঘে জমি আর একটা পাকা বাড়ি পেয়ে আহ্লাদে ডগমগ হয়ে আছিস। বাঙালের যে লাখো লাখো টাকা কারবারে খাটছে তার কাছে এ তো চুষিকাঠি। দেবে ভেবেছিস তোকে সে টাকার ন্যায্য ভাগ? সব ওই বড়বউয়ের গর্ভে যাচ্ছে। বাঙাল চোখ বুজলে উকিল লাগিয়ে আইনের প্যাঁচে তোর সম্পত্তিও এক ঝটকায় নিয়ে নেবে। তাই বলছি, এখনও সময় আছে, সব বুঝেসুঝে নে। দুটো দোকান না হয় তোর নামেই করে দেবে, ভাইরা খেটেখুটে, দোকান চালিয়ে তোর ন্যায্য পাওনা-গণ্ডা মাসকাবারে মিটিয়ে দেবে।
সাধে কি বলে যে, তোমার মুখে বিষ! এর মধ্যে আমার স্বামীর মরণের ভাবনাও ভেবে ফেলেছ! তোমার আর কবে আক্কেল হবে মা? জামাইয়ের বাড়বাড়ন্ত দেখে তোমার চোখ টাটায় কেন? মেয়ে সুখে আছে সেও তোমার সহ্য হয় না। তুমি কেমনধারা মানুষ?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজিবুড়ি উঠে পড়ল। বলল, জামাইয়ের বাড়বাড়ন্ত দেখেই তো বলছি, বেশি বাড়ও তো ভাল নয়। তোর ভাল ভেবেই বলছি, টাকাপয়সা নগদ যা পারিস ঝেঁকে নে। বাসরাস্তায় দুখানা দোকানঘর বন্দোবস্তে আছে শুনেছি। দশ বিশ হাজারে হয়ে যাবে।
তুমি এখন যাও তো, আমার মাথাটা আর খারাপ করে দিও না।
জিজিবুড়ি গেল, পড়া ফেলে দিব্যি জানালা দিয়ে দৃশ্যটা দেখে খুব হাসছিল মরণ। আজ মায়ের হাতের রান্না খুলবে। রেগে গেলে মা দারুণ রাঁধে।
জিজিবুড়ি আর দুবার এল, শেষবার দশটা নাগাদ। এসে বলল, ও বাসি, কাল রাত থেকে দানাপানি জোটেনি মা, ছোটবউ খানকির মেয়ে ওই নয়নটা এমন ধাক্কা দিয়েছে যে কাঁকাঁলে বড্ড ব্যথা, আজ তোর এখানে দুটো ভাতে ভাত করে দিবি? এক ফোঁটা ঘি দিয়ে
আজ সুবিধে হবে না মা, আজ তোমার জামাই আসছে।
মোলো যা, আজ আবার বাঙাল আসছে কেন?
তাতে কি তোমার গতরে শুঁয়োপোকা ধরল? তার বাড়িতে সে আসবে, তাতে কথা কীসের?
তাই কি বললুম, বলছি, আজ তো আর শনিবার নয়, কাজকারবার ফেলে আসছে তো!
তার বিশ্বাসী কর্মচারী আছে, তোমার অত মাথাব্যথা কীসের?
ঘরে যে যেতে পারছি না মা, ধুন্ধুমার কাণ্ড দেখে এসেছি একটু আগে। শোনা যাচ্ছে থানা-পুলিশেও খবর গেছে। তারা এল বলে! কী যে হবে কে জানে বাবা।
কী আবার হবে, নতুন বৃত্তান্ত তো নয়। থানা-পুলিশ তো আগেও হয়েছে। চাটুজ্যেদের গোরু নিয়ে হাটে বেচে দিয়ে তোমার বড় ছেলে হাজতে গিয়েছিল মনে আছে?
মনে আছে বাবা, সব মনে আছে। কপালের দোষ মা, ও কি খণ্ডায়?
দুধ চিঁড়ে দিয়ে ফলার করতে পার। ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
মুখটা বিকৃত করে জিজিবুড়ি বলে, ম্যাগো, পেটে এখন ভাতের খিদে, দুধ চিঁড়ে কি গলা দিয়ে নামে বাছা!
ঠিক আছে। মরণের ঘরে গিয়ে বসে থাক, ভাতের কথা বলেছ, গেরস্থের ঘর বলে কথা, খেও খন দুপুর বেলায়।
তবে দুটো পোস্তর বড়া করিস আর একটু টক, টক ছাড়া মুখে রোচে না।
মরণের আজ দুঃখের কপাল, বাবা আসছে, বাবা আসা মানেই যমদূতের আগমন, আজ সকাল থেকেই মা পড়তে বসিয়ে দিয়েছে। পড়ছে তো লবডঙ্কা, কিন্তু পড়ার টেবিলে বই-খাতা মুখে করে এই বসে থাকাও এক যম-যন্ত্রণা। বাইরে খোলা মাঠঘাট আয়-আয় করে ডাকছে। স্কুলটা খোলা থাকলেও না হয় হত। কিন্তু কপাল খারাপ, স্কুলের এক প্রাক্তন হেডমাস্টার মারা যাওয়ায় স্কুলও আজ ছুটি।
হ্যাঁ লা বাসি, তোর ঘরে কি পান আছে?
মা দোতলা থেকেই বলল, না মা, আমরা কেউ পান খাই নাকি যে থাকবে?
তবে যে মুশকিল হল। আমার পান ফুরিয়েছে, পান ছাড়া আমার এক দণ্ড চলে না। ও ভাই মরণ, দিবি এনে একটু পান?
মরণ আনন্দে লাফিয়ে উঠল, এক লাফে উঠোনে নেমে বলল, পয়সা দাও এনে দিচ্ছি।
ওপর থেকে মা ধমক দিয়ে বলে, ওকে বলছ কেন মা? ওর বাবা টের পেলে রাগ করবে। ওই মুনিশ-টুনিশ কেউ এলে এনে দেবে খন।
মরণ ঊর্ধ্বমুখ হয়ে করুণ গলায় বলে, আমার পড়া হয়ে গেছে মা, এক ছুটে যাব আর আসব।
তোর বাবা এসে যদি দেখে–
বাঃ, তা বলে সারা দিন পড়ব নাকি? সকাল থেকে তো পড়ছি৷
ওঃ, কী রকম পড়া তা খুব জানা আছে। বই খুলে বসে থাকলেই বুঝি পড়া হয়?
যাই না মা।
বাসন্তী আর আপত্তি করল না, বলল, যাবে যাও, দয়া করে তাড়াতাড়ি ফিরো।
পয়সা নিয়ে মরণ দুই লাফে বেরিয়ে পড়ল। ছুটি! ছুটি!
অবারিত মাঠ-ঘাট, আলো-হাওয়ায় এসে বুকটা হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে তার। ছুট! ছুট! হালকা পায়ে খানিকক্ষণ দৌড়ে নেয়, কদমতলায় দুর্গাপূজার প্যান্ডেল হচ্ছে। দাঁড়িয়ে একটু দেখে নেয় সে। দক্ষিণপাড়ায় ফুটবল ম্যাচ। তাও একটু দেখে, তারপর হাঁটতে থাকে। পান্নাদির বাড়ি থেকে ঘুঙুরের আওয়াজ আসছে। ঘোষ জ্যাঠাইমার বাড়ি থেকে গুড় আর নারকেল পাক দেওয়ার মিঠে গন্ধ। আর রায়বাড়ির বারান্দায় আজও সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে, যাকে দেখলে ঠিক মনে হয় এক রাজপুত্তুর এসে ওকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে বলে অপেক্ষা করে আছে। চাটুজ্যে বাড়ি থেকে খুব হাসিখুশির একটা শব্দ আসছে। খোলা উঠোনে কানামাছি খেলছে একদঙ্গল হুমদো হুমদো মেয়ে-পুরুষ, মাঝখানে ওটা পারুলমাসি না? হ্যাঁ, পারুলমাসিই। রুমালে চোখ বাঁধা পারুলমাসি হাসতে হাসতে টলোমলো পায়ে দু হাত সামনে বাড়িয়ে কাউকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে এরকম জমায়েত হয়, আবার সব সুনসান হয়ে যায়। দাদু আর দিদা একা পড়ে থাকত, দাদু ওই একতলার বড় দালানের বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে থাকত সকালের দিকটায়, তাকে দেখলেই ডাক দিত, এই বাঙাল আয় তো দেখি তোর লেজ আছে কিনা। গৌরহরি দাদু বাবাকে বড় ভালবাসত। বলত, বাঙালটার রসকষ কম বটে, কিন্তু লোকটা জব্বর খাঁটি, আর এখন দিদা একদম একা, মরণ মাঝে মাঝে হাজির হয়ে যায় এসে। দিদার নারকেল বা সুপুরি পেড়ে দেয়, গোয়ালঘরের চাল থেকে চালকুমড়ো। দিদা প্রায়ই রাগ করে বলে, তুই তো বড়লোকের ছেলে, তবে কেন চেহারাটা অমন চাষাভুসোর মতো করে রেখেছিস? ভাল জামাকাপড় নেই তোর? দাঁড়া তোর বাবা আসুক, বলব।
কানামাছি খেলায় কাউকে ছুঁতে পারল না পারুলমাসি। একটা টু দিয়ে পালাচ্ছিল বিজুদা, ছুঁতে গিয়ে দক্ষিণের দালানের বারান্দায় উপুড় হয়ে পড়ে গিয়ে হেসে উঠল। কাকে কী ডাকবে তার বেলায় সম্পর্কে ঠিক রাখতে পারে না মরণ। গৌরহরিদাদুর ছোট ভাই রামহরিকে সে ডাকে জ্যাঠামশাই। আবার পারুলমাসির খুড়তুতো বোন পান্নাদিকে তো দিদিই ডাকে সে। মা অবশ্য বলেছে, ওদের সঙ্গে তো আর আত্মীয়তা নেই, যা খুশি ডাকতে পারিস।
বাসরাস্তার কাছে এসে খানিক দাঁড়িয়ে লোকজন দেখল মরণ, বেশ লাগে তার। বেঁটে, লম্বা, সরু, মোটা, কালো, ফর্সা কত রকমের যে লোক আছে দুনিয়ায়। কোথা থেকে যে আসে আর কোথায় যায়।
গাঁ গাঁ করে বর্ধমানের একটা বাস এসে ধুলো উড়িয়ে থামল। লোক নামছে। বাবা নামে কিনা তা সতর্ক চোখে দেখছিল মরণ। না, বাবা নামল না। তবে সবার শেষে যে নামল তাকে সে খুব চেনে। তার স্কুল থেকেই অমলদা মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করেছিল। সারা গ্রামে নাকি হুলস্থুল পড়ে গিয়েছিল সেই ঘটনায়। স্ট্যান্ড করা ছেলে দেখলে কি বোঝা যায়? মরণ তো কিছু বুঝতে পারে না। লোকটা কেমন টালুমালু চোখে চারদিকে চাইল, যেন জায়গাটা চিনতে পারছে না। ডান হাতের ভারী অ্যাটাচি কেসটা টানতে লোকটার যেন কষ্ট হচ্ছে। মাথায় বড় বড় চুল, এলোমেলো হয়ে কপালে ঝুলে আছে। মুখটায় রাজ্যের দুশ্চিন্তা যেন। মরণের একবার ইচ্ছে হল, গিয়ে বলে, দিন আপনার অ্যাটাচি কেসটা পৌঁছে দিয়ে আসি। কিন্তু কেমন যেন সাহস হল না।
দীনু সিংহের এস টি ডি বুথের পাশে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ লোকের টেলিফোন করা দেখল সে, মাঝে মাঝে তার খুব ইচ্ছে হয় এখান থেকে বড়মার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। বড়মা তাকে চিনতেই পারবে না।
আর একটা বাস এসে ওই দাঁড়াল। লোক নামছে। আর হঠাৎ সে ভিড়ের মধ্যে এক মাথা উঁচু তার বাবা বাঙালকে দেখতে পেল।
পাঁই পাঁই করে ছুঁটতে লাগল মরণ, হঠাৎ খেয়াল হল, এই যা, পান কেনা হয়নি যে!
পান কিনতে বাজারের নাবালে নেমে গিয়ে সে একটু আড়াল হয়ে দেখতে গিয়ে দেখল, বাবা একা নয়, সঙ্গে একটা সুন্দরমতো ছেলে, আঠারো-উনিশ বছর বয়স হবে। হাতে স্যুটকেস। ছেলেটার মুখ খুব গম্ভীর।
পানটা কিনেই ফের ছুট লাগাল মরণ। বাড়িতে ঢুকেই অভ্যাসবশে চেঁচাল, ও মা, বাঙাল এসেছে, সঙ্গে বোধহয় দাদা!
দোতলার রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে বাসন্তী বলল, সঙ্গে কে বললি?
মনে হচ্ছে দাদা, বেশ লম্বাপানা, সুন্দর দেখতে।
ও মা গো! এখন কী হবে!
কী হবে মা?
কী জানি কী হবে বাবা! বড্ড ভয় করছে। শহুরে ছেলে। ঘরদোর তো গোছগাছও করা নেই, ও মরণ, তোর দিদিমাকে বল যেন এ সময়ে ঘর থেকে না বেরোয়।
আমি কি ফের পড়তে বসব মা?
আর পড়ার দরকার নেই বাবা, বরং ওপরে এসে ফর্সা জামা-প্যান্ট পরে যা, ফিটফাট না দেখলে কী মনে করবে।
একটু বাদে উঠোনের ওপর যে দৃশ্যটা দেখা গেল সেটা যেন যাত্রা- থিয়েটারের একটা সিন। মাকে কোনওদিন সাজতেগুজতে দেখে না মরণ। এমনকী যেদিন বাবা আসে সেদিনও না। কিন্তু মা আজ পাটভাঙা একটা ঢাকাই শাড়ি পরেছে, চুল আঁচড়ানো, মাথায় ঘোমটা, কপালে টিপ, তাড়াহুড়োয় যতটা করা যায়। মায়ের পাশে ইস্তিরি করা নীল জামা আর খাকি হাফ প্যান্ট পরা মরণ। তারও চুল আঁচড়ানো, পায়ে আবার হাওয়াই চটি–যা সে কস্মিনকালেও পরে না। তিন পা পিছনে বোনটাকে কোলে নিয়ে মুক্তাদি দাঁড়িয়ে। সব কেমন অ্যাটেনশন হয়ে আছে। মায়ের মুখটা দেখে মায়া হচ্ছে মরণের, কেমন কান্না কান্না ভাব, অথচ ঠোঁটে আবার একটু হাসিও। মা ভীষণ ঘাবড়ে গেছে, বারবার ঢোঁক গিলছে।
ও মুক্তা, সব ঠিক আছে তো, উঠোনটা ভাল করে দেখেছিস? কোথাও গোবর-টোবর বা কুকুরের গু পড়ে নেই তো?
না বউদি, সব দেখেছি।
একটু আগে জিজিবুড়ি মরণের ঘর থেকে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে বলেছিল, আদিখ্যেতা দেখে মরে যাই, যেন বড়লাট আসছেন।
মা যেন উঁকিঝুঁকি না দেয়, বলেছিস?
হ্যাঁ, কিন্তু এঃ মা, তুমি যে দু পায়ে দু রঙের চটি পরে আছ।
বাসন্তী নিজের পায়ের দিকে চেয়ে জিব কেটে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এমা কী হবে?
মুক্তা বলল, দাও তো, কচুগাছের আড়ালে রেখে দিয়ে আসি।
খালি পায়ে থাকব, কেমন দেখাবে?
এর চেয়ে তো ভাল।
মরণ ফিক করে হেসে ফেলেছিল। বাসন্তী তার দিকে চেয়ে ধমকে বলল, ওরকম হাসতে নেই, দাদা উঠোনে এসে দাঁড়ালে গিয়ে পেন্নাম করিস, বাবাকেও, মনে থাকে যেন!
মরণ জানে, এসব তাকে একটু আগেই শিখিয়েছে মা।
হ্যাঁ রে ভুল দেখিসনি তো! আসতে দেরি হচ্ছে কেন?
বাবা তো মাঝে মাঝে কেনাকাটা করতে বাজারে ঢোকে।
যত দেরি হচ্ছে তত আমার বুক কাঁপছে বাবা। ও মুক্তা, মেয়েটা কাজলের টিপটা জেবড়ে ফেলেনি তো!
না বউদি, কাঁধে মাথা রেখেছে, ঘুমোবে মনে হয়।
একটু জাগিয়ে রাখ, ওর বাবা আবার এসে মেয়েকে জাগা না দেখলে খুশি হয় না। আর হাঁক দিয়ে মুনিশটাকে বল তো, এ সময়ে যেন হুট করে গোরু-ছাগল না ঢুকে পড়ে উঠোনে।
জানালা দিয়ে জিজিবুড়ির গলা পাওয়া গেল, গাঁয়ে তো গোরু-ছাগলই থাকে রে বাপু, আর সেসব দেখতেই তো বাবু ভায়েরা আসে।
ফের ফিক করে হেসে ফেলল মরণ, ইস্তিরি করা জামায় তার গরম লাগছে। এমন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকারও অভ্যাস নেই তার। কেবল মনে হচ্ছে তারা একটা থিয়েটারের পার্ট করতে নেমেছে।
একটু চুপ করবে মা? মুখে আঁচল ঢুকিয়ে বসে থাকো তো, যখন তখন ফুট কেটো না, আমার বলে বুক কাঁপছে আর উনি কুট কুট করে কথা ফোঁটাচ্ছেন, ও নবীনা তোর হল?
দোতলার বারান্দায় বেরিয়ে এসে নবীনা বলল, হ্যাঁ গো বউদি, ফুলদানিতে ফুল সাজিয়েছি, ছোট কার্পেটটাও পেতে দিয়েছি।
বেডকভারটা টানটান করে পেতেছিস তো!
হ্যাঁ গো, ধূপকাঠিও জ্বালিয়ে দিয়েছি।
বারান্দার কাপড় মেলার দড়িগুলো খুলে ফেল, বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে।
মরণেরও একটু বুক কাঁপছে, তেষ্টা পাচ্ছে। সে জানে তাদের পরিবারটা আর পাঁচ জনের মতো নয়। কলকাতা আর পল্লীগ্রাম ভাগ হয়ে যাওয়া একটা ব্যাপার আছে তাদের। একবার ক্লাসে একটা ছেলের সঙ্গে তার ঝগড়া হয়েছিল। ছেলেটা ঝগড়ার সময়ে বলে ফেলেছিল, যা যা, বেশি কথা বলিস না, তোর বাবার তো দুটো বউ।
বাড়িতে এসে সে মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, দুটো বউ থাকা কি খারাপ মা?
মা বলেছিল, খারাপ কেন বাবা? যার সাধ্য আছে সে দুটো-তিনটে বিয়ে করতেই পারে। আগে তো আরও কত বিয়ে করত লোকে।
তবে যে ওরা বলে!
বলে বলুক। ওদিকে কান দিও না, বাবার ওপর যেন অশ্রদ্ধা না আসে। তোমার বাবা ভাল লোক।
সে তো জানি। কিন্তু লোকে বলে যে, আইন নেই নাকি!
আইন কি মানুষের জীবনের সঙ্গে সবসময়ে মেলে? দরকার পড়লে মানুষকে কত বে-আইনি কাজ করতে হয়। আমি না থাকলে তোমার বাবার এত বিষয়সম্পত্তি কে যক্ষীর মতো আগলাত বলো তো! লোকের কথায় কান দিও না, বড় হলে নিজেই বুঝতে পারবে সব কিছু।
বাবার দুই বিয়ের কথা আজকাল খুব ভাবে মরণ। মনে হয় তার বাবার দুটো ভাগ। একটা শহরে লোক আর একটা গেঁয়ো লোক। ওই বড়মা, দাদা, দিদি ওরা একটু ওপরতলার লোক। সে তার মা, বোন এরা সব একটু নিচুতলার লোক। তাই তার বুক কাঁপছে, তেষ্টা পাচ্ছে।
উঁচু মাথার লোকটাকে শেফালি ঝোপের ওপর দিয়ে এক ঝলক দেখা গেল।
মরণ চাপা গলায় বলল, ওই আসছে!
সঙ্গে ছেলে আছে ঠিক দেখেছিলি তো!
সেরকমই তো মনে হল।
আগে জানলে একটু আয়োজন করে রাখতাম। কী খেতে ভালবাসে তাই তো ভাল করে জানি না।
মায়ের যে কত উদ্বেগ! ভয়ে ভাবনায় কাঁটা হয়ে আছে। মরণের একটু কষ্ট হয় মায়ের জন্য।
কই গো! আরে দ্যাখো কারে আনছি! বলতে বলতে রসিক বাঙাল আগর ঠেলে উঠোনে ঢুকল। হাতে একটা মস্ত ইলিশ মাছ। সামনেই তাদের এমন নাটুকে ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকেও গেল। পিছনে লম্বাপানা, ফর্সা, ছিপছিপে সুন্দর ছেলেটা, মরণ জানে তার দাদা সুমন উচ্চ মাধ্যমিকে স্টার পেয়ে পাস করেছে। ডাক্তারি পড়বে বলে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষাও দিয়েছিল। পাসও করেছে হয়তো। সে মুগ্ধ স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখে চেয়ে রইল।
মা হাসি কান্না মেশানো মুখে বলল, এই বুঝি–?
আরে হ, এই হইল সুমন। হারু বইল্যাই ডাইক্যো, আয় রে হারু, এই হইল গিয়া তর ছোটমা। আরে, বান্দরটা দেখি আইজ সাইজ্যা গুইজ্যা খাড়াইয়া আছে!
মরণ গিয়ে টপাটপ প্রণাম সেরে ফেলল।
দাদা মাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে যাচ্ছিল, মা প্রায় সাপ দেখার মতো চমকে গিয়ে পিছিয়ে তার হাত ধরে ফেলে বলল, না না, ছিঃ ছিঃ আমাকে প্রণাম করতে হবে না বাবা, এসো, কতকাল পথ চেয়ে আছি তোমাদের জন্য। আমি এক অভাগী মা।
এসব কথা মা বোধহয় আগে থেকে তৈরি করে রেখেছিল মনে মনে। অভাগী মা কথাটা ঠিক খাটল না যেন, ঘাবড়ে গিয়ে মা নাটকের ডায়লগ দিচ্ছে।
তবে হ্যাঁ, দাদাটাকে খুব পছন্দ হল মরণের। হালকা নীল জিনসের প্যান্ট আর খুব কারুকাজ করা লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবিতে খুব টং দেখাচ্ছে। নরম পাতলা গোঁফ আছে, অল্পস্বল্প দাড়িও। মাথায় বেশ ঢেউ খেলানো লম্বা চুল, ডান ধারে সিঁথি, কাঁধে একটা ব্যাগ।
ও মরণ দাদাকে দাদার ঘরে নিয়ে যা বাবা।
সুমন ওরফে হারু চারদিকটা চেয়ে দেখছিল। তার দিকে ফিরে বলল, তুমি মরণ?
মরণ কৃতার্থ হয়ে গেল। ঘাড় হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ।
আর বোনটা?
মা বলল, ওই তো মুক্তার কোলে। ঘুমিয়ে পড়ল বোধহয়। যাও বাবা, তুমি ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করো। জামাকাপড় পালটাও, চা খাবে তো!
না, আমি চা খাই না।
কী খাবে এখন বলল তো! ময়দা মাখা রয়েছে, একটু লুচি-টুচি ভেজে দেব?
না। খেয়ে এসেছি। একেবারে দুপুরে খাব।
গলার স্বরটা বড় ভাল দাদার। বেশ গমগমে। একটু লাজুক আছে। চোখ তুলে চাইছে না বেশি।
জড়তা, আড়ষ্টতা, লজ্জা অনেক কিছু মিশে আছে দু পক্ষের সম্বন্ধের মধ্যে।
হাত বাড়িয়ে মাছটা মার হাতে দিয়ে বাবা বলল, ভাপা কইরো তো, প্যাটে ডিম থাকলে ভাইজ্যা দিও।
এখন খাওয়া-দাওয়া নিয়ে মাতে আর বাবাতে কিছুক্ষণ কথা হবে। বাঙালরা খুব খাওয়া নিয়ে কথা কইতে ভালবাসে।
তার পিছু পিছু দাদা উঠে এল ওপরে। দক্ষিণ পশ্চিমের বড় ঘরখানায় ভুরভুর করছে চন্দন ধুপকাঠির গন্ধ। খোলা জানালা দিয়ে আলো-হাওয়া আসছে। এক ধারে বড় খাটের ওপর বিছানা। নতুন একটা ফুলকারি বেডকভার দিয়ে ঢাকা, খাটের পাশে টুল, তার ওপর ঢাকা দেওয়া কাচের গ্লাসে জল, পাশে সাদা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের জগে আরও জল। দুটো স্টিলের ফোল্ডিং চেয়ারের ওপর আসন পাতা। ঘরের কোণে একটা টেবিলে কিছু বই। তাদের বাড়িতে বেশি বই নেই। যে কখানা আছে তাই মা টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে। টেবিলের ওপর ফুলদানিতে টাটকা কিছু গোলাপ আর গোলাপের ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে রাখা শিউলি ফুল। এ-ঘর অনেকদিন ধরেই দাদার জন্য সাজিয়ে রেখেছে মা। যদি কখনও আসে!
দরজায় দাঁড়িয়েই ঘরটা একটু দেখল সুমন। তারপর তার দিকে চেয়ে একটু লজ্জার হাসি হেসে বলল, আমার একটা জিনিস ভুল হয়ে গেছে। বাড়িতে পরার চটি আনিনি। এখানে হাওয়াই চটি পাওয়া যায় না?
হ্যাঁ, বাজারে মাখন দাসের দোকানে ভাল জিনিস পাওয়া যায়। এনে দেব!
পরে হলেও চলবে।
চটি বাইরে ছেড়ে ঘরে ঢুকল সুমন। ব্যাগটা বিছানায় রেখে তার দিকে চেয়ে বলল, এ ঘরে কে থাকে?
আপনি না তুমি কী বলবে ঠিক করতে পারছিল না মরণ, শেষমেশ আপনি করে বলাটাই সাব্যস্ত করে বলল, কেউ থাকে না। এ-ঘরটা আপনার জন্যই রেখে দিয়েছে মা।
তাই বুঝি! বলে অবাক চোখে চারদিকটা ফের দেখল সুমন।
ওইটে বাথরুম। আপনি হাতমুখ ধোবেন না?
সুমন একটু হেসে বলল, তার চেয়ে চলো জায়গাটা একটু ঘুরে দেখে আসি।
কোথায় যাবেন?
বিশেষ কোথাও নয়। এমনিই একটু ঘুরে দেখব।
সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে মরণ বলে, চলুন।
যখন নীচে নামল তারা তখনও মায়ের সঙ্গে বাবার খাওয়া নিয়ে কথা হচ্ছে। বাবা মাকে কইমাছ রান্নার একটা পদ্ধতি শেখাচ্ছিল।
মা বলল, ও মা, দাদাকে নিয়ে এই দুপুরে কোথায় চললি? ওর স্নান-খাওয়া নেই?
মরণ জবাব দেওয়ার আগে সুমনই বলল, একটু ঘুরে আসি।
বাবা বলল, যাউকগা, ঘুইরা-টুইরা আসুক। গ্রামের হাওয়া বাতাস লাগাইয়া আসুক একটু শরীরে। কইলকাতায় তো অন্ধকূপে থাকে।
বাইরে বেরিয়ে দাদার পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে মরণের ইচ্ছে হচ্ছিল সবাইকে ডেকে ডেকে বলে, দেখ, দেখ, এই আমার দাদা, স্টার পাওয়া দাদা, কেমন সুন্দর চেহারা দেখেছ? আছে তোমাদের এমন দাদা?
সুমন বেশি কথা বলছিল না। চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল শুধু।
ঘোষবাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উঠোনে টিনের পাতের ওপর বড়ি দিতে দিতে জ্যাঠাইমা চেঁচিয়ে উঠল, ও মরণ, আমার সুপুরিগুলো পেড়ে দিয়ে গেলি না বাবা! কবে থেকে খোশামোদ করছি।
আজ নয় জ্যাঠাইমা। পরে পেড়ে দিয়ে যাব। আজ কলকাতা থেকে আমার দাদা এসেছে।
কথাটা বেশ অহংকারের সঙ্গেই বলেছিল মরণ, কিন্তু তার জবাবটা এল বিছুটির মতো।
ঘোষ জ্যাঠাইমা কপালে হাত দিয়ে নিরীক্ষণ করে বলল, অ বাঙালের আগের পক্ষ বুঝি?
লজ্জায় কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল মরণের। ওভাবে বলতে আছে? গাঁয়ের লোকগুলোর মুখের কোনও আগল নেই। দাদা শুনে কী ভাবল? ছিঃ ছিঃ। আর কখনও জ্যাঠাইমার সুপুরি যদি পেড়ে দেয় তো তার নাম মরণই নয়।
সুমনের মুখে অবশ্য খুব একটা ভাবান্তর দেখতে পেল না মরণ। মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে বলল, তুমি গাছে উঠতে পার বুঝি?
হ্যাঁ।
নারকেল গাছে উঠতে পার?
হ্যাঁ। খুব সোজা।
তোমার তো খুব সাহস দেখছি। যদি পড়ে যাও?
প্রথম প্রথম ভয় করত। এখন বেশ ভাল পারি।
আর কী পার?
আর? বলে একটু ভাবল মরণ। তারপর মাথা নেড়ে বলল, আর কিছু পারি না।
খেলতে পার? ফুটবল ক্রিকেট?
তা পারি। আর হ্যাঁ, আমি খুব জোরে দৌড়োতে পারি।
কত জোরে?
তা তো কখনও মাপিনি, এখানে তো স্টপ ওয়াচ নেই। তবে প্রতি বছর স্পোর্টসে আমি তিনটে দৌড়ে ফাস্ট হই।
লেখাপড়াতে?
না। টেনে-মেনে পাস করে যাই।
লেখাপড়া ভাল লাগে না তোমার?
না।
সুমন একটু হাসল, আর কিছু বলল না।
হাওয়াই চটি কিনে যখন তারা ফিরল তখন অনেক বেলা হয়েছে।
মা বলল, ও মরণ, তুই আলাদা বসে রান্নাঘরে খেয়ে নেগে যা। ওদের বাপ ব্যাটাকে দোতলার ডাইনিং হল-এ দিচ্ছি।
আচ্ছা মা।
কিন্তু খাওয়ার সময় সুমন বাসন্তীকে বলল, মরণ কোথায়?
ও রান্নাঘরে বসে খাবেখন বাবা। তোমাদের জন্য এই ব্যবস্থা।
না, ওকে ডাকুন, ও আমার পাশে বসে খাবে।
বাসন্তী হেসে বলল, আচ্ছা ডাকছি।
মরণ লজ্জায় মরে গিয়ে ওপরে এল। আসলে বাবার সঙ্গে বসে সে কখনও খায় না। তাই আজ ভারী লজ্জা করছে, এক সঙ্গে দাদা আর বাবার সঙ্গে বসে খাওয়া! আজ তার পেটই ভরবে না।
সুমন বাপকে তেমন ভয় পায় না। অন্তত মরণের মতো তো নয়ই। খেতে বসে কত কথা কইতে লাগল তার সঙ্গে।
দুপুরে মা যখন রান্নাঘরে খেতে বসেছে তখন মরণ গিয়েছিল লেবুপাতা দিতে। মা ছলো ছলো চোখে বলল, দেখলি, এখনও পর্যন্ত একবারও মা বলে ডাকল না আমাকে ছেলেটা!
মরণ বলে, তাতে কী মা! আমি তো মা বলে ডাকি।
মা আঁচলে চোখ মুছে বলল, আমি শত্রুর বই তো নয়। ডাকবে কেন?
বড় কষ্ট হল মরণের।
দুপুর যখন ঘন হল, বেলা গড়িয়ে গেল তখন মরণ চুপি চুপি কদমগাছটার তলায় এসে দাঁড়াল। এইখানে শিবঠাকুর আসেন। চোখ বুজে মরণ তার তিন নম্বর বরটা চেয়ে ফেলল, ঠাকুর, দাদা যেন মাকে একবার মা বলে ডাকে।