১১.
পাউরুটি জিনিসটা হল অনেকটা ব্লটিং পেপারের মতো। যাতেই ভোবাও সুট করে রসটা টেনে নিয়ে একেবারে ভোঁট হয়ে যায়। চায়ে ডোবালে পাঁউরুটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্ধিসন্ধিতে ঢুকে যায় চায়ের রস। কী ভালই যে লাগে তখন খেতে। চায়ে টুসটুসে পাঁউরুটি যে না খেয়েছে তার জন্মই বৃথা। রসগোল্লার রসে ডুবিয়ে খাও, যেন অমৃত। পাঁউরুটি নিজেই যেন তখন ছ্যাদোনো রসগোল্লা। রসে-পাঁউরুটিতে সে যেন দাঙ্গা-হাঙ্গামা। এ বলে আমাকে দ্যাখ, ও বলে আমাকে। আর দুধে যদি ডোবাও, তা হলে তো কথাই নেই। গরম দুধে পাঁউরুটি ছেড়ে একটুক্ষণ বসে থাকো। দুধে-পাঁউরুটিতে ভাব-ভালবাসা হওয়ার জন্য একটু সময় দিতে হয়। তারপর দেখবে দুটিতে মিলেজুলে থকথকে মতো হয়ে গেছে। তখন চামচে করে মুখে দাও। পায়েস কে পায়েস, রসমালাই কে রসমালাই, কিংবা রাবড়ি কে রাবড়ি। চোখটি বুজে যা ভেবে মুখে দাও না কেন তেমনটিই মনে হবে। জিভ থেকে পেট অবধি সোয়াদ ছড়াতে ছড়াতে যাবে।
এ-বাড়িতে দুধের রোজ নেই। গত বছর গাইটা বিক্রি করে দিতে হল বড় বউমার প্রসবের সময়। বড় ছেলে নয়ন সাট্টায় অনেক নাকি টাকা লাগিয়েছিল, পথে বসেছে। খুব দুর্ভোগ গেছে তখন। গাই গোরু, এক বিঘে জমি, খোরাকির ধানও গেল কিছু। সেই থেকে দুধের জোগাড় নেই। তিনটে দুধের শিশু আছে বটে, শটিফুডের সঙ্গে একটু গুঁড়ো দুধ মিশিয়ে তাদের খাওয়ানো হয়। শটিফুডই বাঁচিয়ে রেখেছে। বেঁচে থাক শটিফুড। আর বাচ্চারা দুনিয়ার অনিয়ম অবিচার তেমন বোঝেও না বলে রক্ষে।
কিন্তু ধীরেনের এখন এই বয়সে নানান ইচ্ছে চাগাড় দিয়ে ওঠে। গত তিন রাত্তির সে স্বপ্ন দেখেছে। দুধ-পাঁউরুটি খাচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই জিভে আর টাগরায় এমন টকাস টকাস শব্দ করেছিল যে তার বউ বিরক্ত হয়ে তাকে নাড়া দিয়ে তুলে দেয়। শেষ রাতের স্বপ্ন বলে কথা। পাঁউরুটির জোগাড় হয়, কিন্তু দুধটাই কঠিন। জোগাড় হলেই যে মুখে তুলতে পারবে তাও তত সহজ নয়। তিনটে দুধ-উপোসি শিশু মুখের দিকে চেয়ে থাকবে না কি? আর তার বউ কি বলবে না, কোন আক্কেলে বুড়ো মানুষ তুমি এতগুলো চোখের সামনে দুধ নিয়ে বসতে পারলে? গলা দিয়ে নামবে? পাষণ্ড আছ বাপু!
কিন্তু তিন দিন স্বপ্ন দেখার পর ধীরেনকে এখন দুধ-পাঁউরুটি নিশিতে পাওয়ার মত পেয়েছে। যখন নিশিতে পায় তখন আর কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছু থাকে না। নাতি-পুতি বউ-বাচ্চা তখন বিস্মরণ হয়ে যায়।
জামার আড়ালে পিতলের ঘটিটি নিয়ে সকালবেলাতেই বেরিয়ে পড়ল ধীরেন। মুখ বারবার রসস্থ হয়ে পড়ছে। সামনের গোটা চারেক দাঁত নেই বলে মাঝে মাঝে সুট করে মুখের ঝোল টেনে নিতে হয়। বয়স হলে নানা অসুবিধে।
বাঙালের বাড়িই ভরসা। তিনটে দুধেল গাই কামধেনুর মতো অনবরত দুধ দিয়ে যাচ্ছে। দুধের সমুদুর একেবারে। তবে মুশকিল হল বাসি নগদ ছাড়া দুধ দেয় না বড় একটা। এমনিতে নরম-সরম মেয়েই ছিল। ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে। ফ্রক পরে গোবর কুড়িয়ে বেড়াত, কাঠকুটো জোগাড় করত, পুকুরে ডাঁই কাপড় কাঁচত খার দিয়ে, আবার কদমতলায় এক্কাদোক্কাও খেলত। কথা কইলে কাঁচুমাচু হয়ে যেত। কিন্তু সেই দিন তো আর নেই।
বাঙালের বউ হয়ে ইস্তক বাসি ধিঙ্গির মা সিঙ্গি হয়েছে। জমিজমা, মুনিশ, ঝি-চাকর, গোরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে ফলাও সংসার। চারদিকে যেন মা লক্ষ্মী ঢেউ তুলে দিয়েছেন। রোগা, শ্যামলা মেয়েটাকে আর চেনার জো নেই। গায়ে গত্তি লেগেছে, মেজাজও হয়েছে একটু।
বাবা বাছা বলে যদি একটু আদায় হয় সেই ভরসাতেই বেরিয়েছে ধীরেন। তবে সে বুঝতে পারে, আজকাল মায়া-দয়া জিনিসটা বড্ড কম পড়ে যাচ্ছে চারধারে। কোথাও যেন আর জিনিসটা তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। আগে এ-গাঁয়েই দুধের গাহেক খুঁজলে পাওয়া যেত না। বাড়তি দুধ চাইলে ফেরাত না কেউ।
রসিক বাঙালের বাড়িতে ঢুকবার আগে একটু দাঁড়াল ধীরেন। আহা, কী বাড়িই করেছে বাঙাল। ডানধারে বিশাল প্রাসাদের মতো দোতলা দালান। দক্ষিণে উঠোনের দিকে টানা লম্বা বারান্দা। এক এক তলায় পাঁচ ছয়খানা করে ঘর। তাও এখনও দালানের গায়ে পলেস্তারা পড়েনি। পড়লে আরও দেখনসই হবে। পুবে একখানা একতলা দালান, তাতেও তিন চারখানা ঘর আছে। পাকা গোয়ালঘর, গোলাঘর, ঢেঁকিশাল, কী নেই বাঙালের। দু আড়াই বিঘে জুড়ে ফলাও বাগান। মেলা সুপুরি আর নারকোলের গাছ। সবজিও ফলছে দোহাত্তা।
ধীরেন মেটে পথটায় তাকিয়ে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন দেখতে পায় যেন। লক্ষ্মী ঢুকেছেন, সহজে বেরোবেন না।
এই সব দেখার মধ্যে আনন্দ আছে। অনেকে বাঙালকে হিংসে করে বটে, কিন্তু ধীরেনের হিংসে হয় না। কারও বোলবোলাও হয়েছে জানলে ধীরেন তাকে দেখতে যায়। বাড়ি দেখে, ঘর দেখে, মানুষটার মুখে আহ্লাদ আর খুশির আভা দেখে। তখন তার মনটা খুব হে-হে করতে থাকে। ভারী একটা সুড়সুড়ে সুখ হতে থাকে তারও। কেন হয় কে জানে।
ধীরেন দেখতে বড় ভালবাসে। চোখে ছানি পড়ায় দৃষ্টি একটু ঝাপসা বটে, কিন্তু তাই দিয়েই সে অনেক কিছু দেখে। ছানি কাটাবে বলে বর্ধমানের লায়নস ক্লাবে একটা দরখাস্তও দিয়ে এসেছে সে। পঞ্চায়েতের সার্টিফিকেটও জুড়ে দিয়েছে তাতে। এখনও জবাব আসেনি। নির্যস গরিব বলে প্রমাণ হলে বিনা পয়সায় ছানি কাটিয়ে দেবে। দেখার নেশা আছে বলেই ছানিটা কাটানো বড় দরকার।
ফটকের বাইরে মুগ্ধ চোখে ৰাড়িটার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল ধীরেন।
জ্যাঠামশাই, কাকে খুঁজছেন?
ধীরেন তাকিয়ে মরণকে দেখে এক গাল হাসল, এই দেখছি তোদর বাড়িটা। তা তোদের কী খবর টবর রে? বাঙাল আসে-টাসে?
হ্যাঁ। পরশু এসেছিল, আজ সকালে চলে গেছে।
ধীরেন আগল ঠেলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, বাসি নেই?
আছে। ডেকে দেব?
তাড়া নেই। কাজ-টাজ করছে হয়তো। বসি একটু দাওয়ায়।
বসুন না। বারান্দায় উঠে চেয়ারে বসুন।
ধুতির খুঁটে দাওয়ার মেঝেটা একটু ঝেড়ে বসে পড়ল ধীরেন। বলল, এই ভাল।
সকালের মিঠে রোদ নিকোনো উঠোনে রুপোর থালা হয়ে পড়ে আছে। বাঃ বাঃ। যার ভাল তার সবই ভাল। এ বাড়ির রোদটাও যেন ধীরেনের বাড়ির রোদের চেয়ে অনেক বেশি সরেস, অনেক বেশি জমকালো। এরকমই সব হয়, লোকে বিশ্বাস করে না বটে, কিন্তু হয়।
দোতলা থেকে বাসি রেলিং-এ ঝুঁকে বলল, ও ধীরেনখুড়ো, কিছু বলবেন?
এই মা, তেমন কিছু নয়। তত্ত্বতালাশ করতেই আসা। তা খবর-টবর সব ভাল তো!
আছি খুড়ো একরকম। ঝামেলা ঝঞ্জাট তো কম নয়।
তা তো হবেই রে বাসি। কত বড় বিষয় সম্পত্তি, কত লোকলস্কর খাটছে, কত দিক সামাল দেওয়া। হওয়ারই কথা কি না।
বেরিয়েছেন কোথা?
এই ঘুরে-টুরে দেখছি। ঘরে আর কাজটা কী বল!
তা তো বটেই। বড় ছেলে কী করছে এখন?
কে জানে মা। সাট্টার পেনসিলার না কী যেন শুনি। বর্ধমানে যায় রোজ।
সে কি ভাল কাজ খুড়ো?
কে জানে মা? ভাল কাজ করার মতো বিদ্যে কি আছে?
যখন ইস্কুলে যেতুম তখন রোজ পিছু নিত আমার। ভারী অসভ্য ছেলে।
ধীরেন ছেলের অপরাধে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ওই সবই তো করত। মায়ের আসকারায় শাসনও করা যায়নি কি না।
একলা দোতলায় কথা চালাচালির অসুবিধে। চেঁচিয়ে তো আর দুধের কথাটা বলা যায় না।
বাসন্তী বলল, একটু বসুন খুড়ো, আসছি।
তা বসে ধীরেন। ওদের কাজের মেয়েটা পুকুর থেকে কাচা কাপড়-চোপড় এনে উঠোনের তারে মেলছে। দৃশ্যটা খুব মন দিয়ে দেখে ধীরেন। কমলা সবুজ নীল রঙের নানা শাড়িতে উঠোনটা যেন ভারী রঙিন হয়ে গেল। বাতাসে দুলে দুলে যেন হাসছে শাড়িগুলো। যেন বলছে, দেখেছো, কেমন চান করে ফর্সা হয়ে এলুম!
দুনিয়ায় দেখার জিনিসের কোনও শেষ নেই। এইটুকু এক রত্তি একটু গাঁয়ের চৌহদ্দির মধ্যেই ঘোরাফেরা তার। কিন্তু এইটুকুর মধ্যেই যেন অফুরান সব দৃশ্য, কুলিয়ে ওঠা যায় না।
জ্যাঠামশাই, মা জিজ্ঞেস করল চা খাবেন?
এক গাল হাসল ধীরেন, দিবি? তোদের কষ্ট হবে না তো!
না না।
তবে দে একটু। চিনি আর দুধটা একটু যেন বেশি দেয় দেখিস।
আচ্ছা জ্যাঠা।
হ্যাঁ রে মরণ, বলি দুধে ভিজিয়ে পাঁউরুটি খেয়েছিস কখনও?
মরণ মুখটা বিকৃত করে বলে, এঃ বাবা! দুধে পাঁউরুটি! ওয়াক।
পাষণ্ড আর কাকে বলে। এ ছেলে দুধ-পাঁউরুটির মর্মই বোঝে না। ধীরেন তটস্থ হয়ে বলে, তা বাবা, খাসনি বুঝি কখনও?
নাঃ। ও তো পিটুলিগোলার মতো খেতে!
দুর! তুই জানিস না। একটু দানা চিনি ছড়িয়ে খেতে
বাসি নেমে এল নীচে। বেশ চেহারাটা হয়েছে এখন। সেই রুখু শরীরে এখন একটু তেল চুকচুকে ভাব। ফর্সা একটা মেজেন্টা রঙের শাড়ি পরা, কপালে মস্ত সিঁদুরের টিপ, সিঁথি ভর্তি সিঁদুর থেকে খানিক নাকের ডগায় ঝরে পড়েছে। স্বামী-সোহাগের লক্ষণ। না, বেশ আছে মেয়েটা। সময়মতো বাঙালের চোখে পড়ে গেল, তাই বেঁচে গেছে। চোখে পড়াটাই হল আসল কথা। ওই হল ভাগ্য, ওই হল গ্রহানুকূল্য। ভাল চোখ যদি পড়ে তবে তরে গেলে। আর মন্দ চোখ যদি পড়ে তবে হেঁচড়ে হেঁচড়ে জীবন যাবে।
কিছু বলবেন খুড়ো?
হ্যাঁ মা, তা তোদের গোরুগুলো দুধ-টুধ কেমন দেয়?
আর বলবেন না। কালো গাইটা দুধ বন্ধ করেছে সেই কবে। দুটো দিচ্ছে এখনও, তবে কমে এসেছে। আমার বড় ছেলে এসেছে কলকাতা থেকে, তাকে কোথায় একটু পিঠে পায়েস করে খাওয়াবো, তাই হচ্ছে না ভাল করে। মাসিক বন্দোবস্তের গাহেকও তো আছে।
ঘটিটা জামার তলা থেকে আর বের করল না ধীরেন। না, হবে না।
কাজের মেয়েটা কাপে চা নিয়ে এল, প্লেটে দুটো থিন এরারুট বিস্কুট। চলকানো চায়ে বিস্কুট দুটো নেতিয়ে গেছে। তা যাক। এটুকুই বা মন্দ কী?
খুব যত্ন করে চাটুকু খেল ধীরেন। চায়ে ভেজানো বিস্কুটেরও একটা স্বাদ আছে।
উঠছেন খুড়ো? আবার আসবেন।
আসব বইকী! এই ঘুরে ঘুরেই সময় কাটাই। যোগাযযাগটাও রাখা হয়, সময়ও কাটে।
মরণ পোশাক পরে ইস্কুলে বেরোচ্ছে। তার পিছু পিছুই বেরিয়ে পড়ল ধীরেন। ফাঁকা ঘটিটা জামার নীচে ধরা আছে এখনও। ছোট ঘটি, বাইরে থেকে টের পাওয়া যায় না।
বেগুনক্ষেতটা পার হওয়ার সময় ধীরেন দাঁড়াল। গাছে ফুল এসে গেছে। দু-একটা গাছে কচি বেগুনের শিশুর মতো নিষ্পাপ মুখ উঁকি মারছে। কী সুন্দর দেখতে! শীতের বেগুন, তার স্বাদই আলাদা। বেগুন বড্ড তেল টানে বলে তার মা চাকা-বেগুনে আগে একটু চিনি মাখিয়ে রাখত। তাতে নাকি তেল কম লাগে। তা হবে হয়তো। আজকাল আর বেগুন ভাজা হয় না। মাঝে মধ্যে একটু পোড়া টোড়া হয় বড় জোর।
খুব ধীর পায়েই এগোয় ধীরেন। সকালটা এখনও আছে। শীত শীত ভাবটাও ক্রমে বাড়ছে বাতাসে। নাকি বয়স হচ্ছে বলেই শীতভাব হয় তার?
রায়বাড়ির উঠোনে ইজিচেয়ারে মহিমাই বসে বোধহয়। ঠিক ঠাহর হয় না। সজনের ছায়ায় ঝিরঝিরে বাতাসে এই অলস বসে থাকাটা ভালই লাগে ধীরেন কার।
উঠোনে চাটাই বিছিয়ে নানা জিনিস রোদে দিচ্ছে সন্ধ্যা। আমলকী, আমসি, সারি সারি আচার আর কাসুন্দির বোতল।
একটু কাছে গিয়ে ভুল বুঝতে পারে ধীরেন। মহিমদা নয়, বসে আছে অমল।
ভারী খুশি হয়ে ওঠে ধীরেন।
উরে বাপ রে! অমল নাকি?
অমল মানে হচ্ছে এক চোখ-ধাঁধানো ছেলে, গ্রামের গৌরব। বিলেত আমেরিকা ঘুরে এসেছে। এক এক মাসে যা বেতন পায় তা দিয়ে হাতি কিনে ফেলা যায়। গরিবগুর্বোর সম্বৎসরের খরচ।
অমল একটা বই পড়ছিল। ইংরিজি বই-ই হবে। তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভারী আনমনা চোখে চেয়ে রইল। চিনতে পারল না। তারপর সোজা হয়ে বসল। একটু হেসে বলল, ধীরেনকাকা না?
হ্যাঁ বাবা।
ইস, একদম বুড়ো হয়ে গেছেন যে! চিনতেই পারিনি।
অমল তাকে চিনতে পারায় ভারী আপ্যায়িত হয়ে ধীরেন বলে, তা বয়সও হল। আমাদের তো আর কিছু হয় না, শুধু বয়সটাই হয়।
বসুন কাকা। বাবাকে ডেকে দিচ্ছি। ঘরেই আছে।
তোমার সঙ্গে কতকাল পরে দেখা! দেশের গৌরব তুমি।
অমল কথাটা শুনে খুব খুশির ভাব দেখাল না। মুখটা শুকনো। ধীরেনের চোখ যদি খুব ভুল না হয়, তা হলে মুখে একটু দুঃখের ছাপও যেন আছে। হওয়ার কথা নয় এরকম। লম্বা বেতন, হোমরা-চোমরা চাকরি, পেটে গিজগিজ করছে বিদ্যে, এরকম মানুষের মুখে তো আহ্লাদ ফেটে পড়ার কথা!
আপনি কেমন আছেন ধীরেনকাকা?
এই আছি বাবা। টিকে আছি।
ছেলেরা সব দাঁড়িয়েছে তো?
এই একরকম। টুকটাক করে আর কী। তোমার তো ভালই চলছে বাবা! আমাদের কথা বাদ দাও। পাপীতাপী লোক আমরা।
.
চারদিকে জল, জল আর জল। ডাঙাজমির দেখাই নেই। তার ভিতর দিয়ে জল ভেঙে ছুটতে ছুটতে হাঁফ ধরে যাচ্ছিল ধীরেনের। কতবার যে খানা ডোবায় পড়ল, কতবার পা হড়কাল তার হিসেব নেই। কতটা সময় লেগেছিল তাও ভেবে পায়নি কখনও ধীরেন। যখন ডাঙাজমিতে উঠল এসে তখন তার সর্বাঙ্গ জলে কাদায় মাখামাখি। চোখ উদভ্রান্ত, মনে বিভীষিকা, পাপবোধ, পাগলের মতো অবস্থা।
যখন বাড়ি ফিরল তখন সে প্রায় উন্মাদ। আপনমনে বিড় বিড় করছে, কখনও চিৎকার করে কেঁদে উঠছে, কখনও নিজের চুল ছিঁড়ছে দু হাতে মুঠো করে। ওর মধ্যেই তার বাবা ঠ্যাঙা নিয়ে মারতে এসেছিল তাকে। মা এসে ঠেকাল, দেখছ না কী অবস্থা! নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। আগে ঠান্ডা হতে দাও।
মা-ই তার গলায় তারের ফাঁসটা আবিষ্কার করেছিল। বলল, এটা তোর গলায় কী রে? কে তোকে তুক করেছে? অ্যাঁ!
কিছু বলতে পারেনি ধীরেন। দিন দুই লেগেছিল সেই বিকারের ঘোর কাটতে। তারপর পুলিশের ভয়ে সে কালনায় তার মাসির বাড়িতে পালিয়ে গেল। মাসখানেক বাদে যখন ফিরল তখনও পুলিশ তাকে খোঁজেনি। খোঁজার কথাও নয়। বৃষ্টি বাদলা কেটে গিয়ে জোড়া লাশ যখন পাওয়া গিয়েছিল তখন দিন পাঁচেক কেটে গেছে। মড়া পচে ঢোল। পুলিশ একটা তদন্ত করেছিল বটে, কিন্তু তখন গ্রামদেশে এসব নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামানোর রেওয়াজ ছিল না। যেটা রটেছিল তা হল, বরুণ মিদ্দার তার বউকে মেরে ডোবায় ফেলতে গিয়ে নিজেও ডুবে মরেছে।
ধীরেন খুনের দায় থেকে বেঁচে গেল। ধীরে ধীরে স্মৃতি আবছা হল, সময়ের পলিমাটি পড়তে লাগল, কিন্তু আচমকা কখনও-সখনও মনে পড়ত দৃশ্যটা। শিউরে উঠত।
ইদানীং ধীরে ধীরে স্মৃতিটা ফের কেন যেন জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে। আর তাকে একা পেলেই কেন যে বরুণ মিদ্দার কাছেপিঠে চলে আসতে চায়! সে আজকাল অন্ধকার ভয় পায়, একা ঘরে ভয় পায়, নিরিবিলি মাঠ পেরোতে ভয় পায়। বাতাসে যেন একটা ফিসফাস শুনতে পায় সে। বরুণ মিদ্দারের গলা বলেই কেন যেন মনে হয় তার।
ইদানীং জ্ঞানগম্যিওলা মানুষদের কাছেপিঠে গিয়ে বসার একটু ঝোঁক হয়েছে ধীরেনের। যারা অনেক জানে-টানে তাদের কাছে গেলে অনেক ধাঁধা কেটে যায়।
এ-অঞ্চলে অবশ্য জ্ঞানী লোক বেশি নেই। গৌরহরিদা ছিলেন, মহিম রায় এখনও আছে।
তা হরিদার কাছে ব্যাপারটা একবার বলে ফেলেছিল সে। বেশি বলতে চায়নি, শুধু একটা পাপ কথা বলে ভণিতা করেছিল মাত্র। কিন্তু গৌরহরি দুঁদে উকিল। জেরা করে করে সবই পেট থেকে বের করে নিল। তারপর বলল, তা কি প্রাশ্চিত্তির করতে চাস নাকি?
এর কী আশ্চিত্তির আছে হরিদা?
কিছু নেই রে, কিছু নেই। বরাতজোরে খুনের দায় থেকে বেঁচে গেছিস, এসব কথা পাঁচকান না করাই ভাল।
কাউকে বলিনি, নিজের বউকে অবধি নয়।
বউকে আরও বলবি না। মেয়েমানুষের পেটে কথা থাকে না।
বলি না। কিন্তু আজকাল বড় মনে পড়ে যায়। ওই আদিগন্ত জল, ওই সাংঘাতিক বর্ষা, বরুণ মিদ্দার, বাতাসী সব যেন মাঝে মাঝে এসে ঘিরে ফেলে। বিশেষ করে মিদ্দার।
কেন যে অমলের মুখোমুখি বসে কথাটা আজ মনে পড়ল কে জানে। মাঝে মাঝে বড় মনস্তাপ হয়। জীবনটা ভণ্ডুল হয়ে গেছে বলে মনে হয় যেন। পাপটা কি সইবে তার?
বসুন কাকা, বাবাকে ডেকে দিচ্ছি।
ঘটিটা মোড়ার পাশে নামিয়ে রাখল ধীরেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হঠাৎ হঠাৎ মিদ্দার আজকাল মনের মধ্যে হানা দেয়। হানা দেয় বাতাসীও।
সন্ধ্যা বলল, ঘটিতে কী নিয়ে যাচ্ছেন ধীরেনকাকা?
কিছু নয় মা। বাঙালের বাড়িতে একটু দুধের খোঁজে গিয়েছিলাম। তা পাওয়া গেল না।
ওঃ দুধের যা টানাটানি চলছে আমাদেরও! মেজদারা সব এসেছে তো! দুটো মোটে গোরু। বাবার বরাদ্দই কমিয়ে দিতে হয়েছে।
ধীরেন চেয়ে চেয়ে দেখছিল।
উরেব্বাস, কত রকমের আচার করেছিস রে সন্ধ্যা! অ্যাঁ!
হ্যাঁ কাকা, মাথা থেকে সব বের করতে হয়।
তাই বুঝি? আমাদের তো ভাতপাতে একটু তেঁতুল হলেই হয়।
সে দিন আর নেই কাকা। এখন লোকে সব কিছুরই আচার চায়। শুনেছি নাকি বিলেত-টিলেতে মাংসেরও আচার হয়।
বাপ রে! বটে!
হ্যাঁ। এই যে দেখুন না, কেউ কখনও গাজরের আচার খায় শুনেছেন? এক খদ্দের চেয়েছে বলে তাও করে দিচ্ছি।
অমল উঠে গেছে। আরামকেদারার ওপর বইটা পড়ে আছে উপুড় হয়ে। ডানামেলা পাখির মতো দু মলাট দুদিকে ছড়ানো। বইটার নাম একটু ঝুঁকে দেখল ধীরেন। ইংরিজি পড়ার অভ্যাস নেই। সেই কবে একটু শিখেছিল। শুধু নামের শেষটুকু পড়তে পারল, গ্লোরি।
সন্ধ্যা বলল, খাবেন একটু আচার? দেব প্লেটে করে?
ধীরেন হাসল। বলল, দে একটু। চেখে দেখি।
একটা প্লেটে দুরকম আচার নিয়ে এল সন্ধ্যা, দেখুন তো খেয়ে কেমন টেস্ট হয়েছে।
ভাল বলার জন্য মুখিয়েই আছে ধীরেন। খেতে খেতে মাথা নাড়া দিতে দিতে বলল, বাঃ বাঃ, এ তো ফার্স্ট ক্লাস জিনিস দেখছি।
সন্ধ্যার মুখে যে হাসিটা ফুটল তা অহংকারের।
ভাল?
খুব ভাল রে মা। তাই তোর জিনিস এত চলে।
চলে তো কাকা। কিন্তু টাকা থাকলে ব্যবসাটা আরও বড় করতে পারতাম। একটা কারখানাই করে ফেলতাম।
দুধটা এখানেও হল না। আচার খেয়ে ধীরেন উঠে পড়ল। মহিমা এল না। দরকারও নেই। খানিক গল্প করা যেত।
উঠলেন কাকা?
উঠি।
বাবা বোধহয় বাগানে ঢুকেছে। ডাকব?
না মা। আবার আসবখন।
টুক টুক করে ধীরেন হাটে। আচারগন্ধী একটা সুবাসিত ঢেঁকুর উঠল। বেশ ভালই লাগল ঢেঁকুরটা তুলে। ঢেঁকুরও যে একটা উপভোগ্য জিনিস সেটাও কি সবাই বোঝে? যদি জিজ্ঞেস করে কাউকে, ওহে, ঢেঁকুর তুলে যদি মাংসের বা পায়েসের গন্ধ পাও তা হলে কেমন লাগে? তা হলে হয়তো চটেই উঠবে লোকটা। ধীরেন কাউকে জিজ্ঞেস করে না বটে, কিন্তু কথাগুলো মনে মনে খুব ভুড়ভুড়ি কাটে।
ওই গৌরহরিদার বাড়ি। এই গাঁয়ের টাটা-বিড়লা যা-ই বলো তা ছিল ওই গৌরহরি চাটুজ্যে।
দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বাড়িটা নিরীক্ষণ করে ধীরেন কাষ্ঠ। দুই ভাইয়ের অংশ কিনে নিয়েছিলেন হরিদা দুনো দামে। যা করার ইচ্ছে তা করবেনই। জান কবুল। ওরকম মানুষকে রোজ সকালে উঠে পেন্নাম করতে হয়। বড় বড় থাম, মজবুত খিলানের ওপর বাড়ি। তিন তিনটে দোতলা দালান, কত যে ঘর তার হিসেব নেই। হরিদা কি জানতেন না শেষ অবধি কেউ গাঁয়ের মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে না? ছেলেরা যাবে, মেয়েরা যাবে, পড়ে থাকবে বুড়োবুড়ি? জানতেন। জেনেও ভাইয়েদের অংশ কিনে নিয়েছিলেন। রাজা-জমিদারের মতো মেজাজটা ছিল খুব।
সসংকোচে বাগানের লোহার ফটক পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকল ধীরেন। ভিতর থেকে অনেক লোকের গলা পাওয়া যাচ্ছে। ছেলেরা এসেছে বোধহয়।
উঠোনের মুখে একটা ছেলের সঙ্গে দেখা। বিজু, নরহরির ছেলে। ভারী ফর্সা, সুন্দর চেহারা। কী যেন খেলে-টেলে। ফুটবল বা ক্রিকেট যাই হোক। লেখাপড়াতেও চৌখশ।
ধীরেনখুড়ো নাকি?
ধীরেন সরে সাইকেল যাওয়ার রাস্তা দিয়ে বলল, হ্যাঁ বাবা।
কিছু মনে করবেন না খুড়ো, পানুকে যে মেরেছিলাম সে এমনি নয়। পাতা খায় বলেই মেরেছি। যারা ওসব নেশা করে তাদের দোষ কী জানেন? তারা আর পাঁচজনকে জুটিয়ে নিতে চেষ্টা করে। পুরো গাঁয়ের আবহাওয়াই নষ্ট করে দেবে। একটু খেয়াল রাখবেন।
ধীরেন হাঁ করে চেয়ে থাকে। পানু তার ছোট ছেলে। সে যে বিজুর কাছে মার খেয়েছে এখবরটাই জানা নেই ধীরেনের। তবে পাতার কথাটা সে আবছা শুনেছে। খুব খারাপ নেশা নাকি, কিন্তু ধীরেনের কীই বা করার আছে! ছেলেরা এখন দূরের মাস্তুল, দরিয়ায় অনেক তফাতে চলে গেছে। পড়লে, মরলে শোক হবে বটে, কিন্তু নোঙর নেই যে!
সসংকোচে ধীরেন বলে, ঠিকই তো, ঠিকই করেছ বাবা মেরেছ।
একটু সামলে রাখবেন। নইলে ঘটিবাটি চাঁটি করে দেবে। এ নেশা যে করে তার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না।
ধীরেন মাথা নাড়ে। বুঝেছে, আবার বোঝেওনি সে। বিড়ি-আসটা খায়, ঠিক আছে। ধেনো-টেনো খেলেও না হয় একরকম। দুনিয়া যত এগোচ্ছে নেশাও তত এগোলে বড় কঠিন পরিস্থিতি।
যান ধীরেন খুড়ো, ভিতরে যান।
ভিতরে এক আনন্দের হাট। স্বর্গের ছবি যেন। দুটো বিশাল বারান্দার সিঁড়ির বিভিন্ন ধাপে নানা বিভঙ্গে বসে আছে সুন্দর সুন্দর সব নারী ও পুরুষ। খুব হাসছে, হল্লা করে কথা বলছে।
ধীরেন হঠাৎ শিহরিত হয়ে মাথা নেড়ে আপনমনে বলে উঠল, না, না, উচিত হচ্ছে না। এখানে আমার ঢোকাটা উচিত হচ্ছে না।
সে তাড়াতাড়ি এই সুন্দর দৃশ্যটি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য পিছু হটে চলে আসছিল। একটি মেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে এসে সামনে দাঁড়াল, এ কী খুড়ো, চলে যাচ্ছেন যে!
পারুল, বরাবরই জগদ্ধাত্রীর মতো দেখতে ছিল। এখন যেন আরও জমকালো হয়েছে।
ধীরেন ভারী অপ্রস্তুত হয়ে বলে, না মা, তেমন কোনও কাজ ছিল না। এমনিই দেখা করতে আসা। ঘুরে ঘুরে খোঁজখবর নিই আর কী।
আসুন না ভিতরে, মার সঙ্গে দেখা করবেন না?
আজ থাক।
থাকবে কেন খুড়ো? আমরা যখন থাকি না তখন তো আপনারাই যা হোক খোঁজখবর নেন। আপনাদের ভরসাতেই তো মা আছে এখানে। আসুন।
কী সহবত! তার মতো নকড়াছকড়া লোককেও কী আপ্যায়ন। গৌরদা তার ছেলেমেয়েকে কী শিক্ষাটাই দিয়ে গেছে! বুক ভরে যায়।
হাতে ওটা কী খুড়ো? ঘটি নাকি?
সসংকোচে ঘটিটা ফের আড়াল করতে করতে ধীরেন হে হে করে একটু হাসে, ও কিছুনয় মা। গাঁয়ের মানুষ তো, এক কাজে বেরিয়ে অন্য কাজও সেরে নিই। একটু দুধের খোঁজে বেরিয়েছিলুম, তাই।
পেলেন না?
সে হবে খন।
উঠোনে নিমের ছায়ায় পাতা একখানা কাঠের চেয়ারে সাদা থান পরা বউঠান বসা। গায়ের রং আগে দুধে-আলতায় ছিল, এখন শ্বেতপাথরের মতো। একটু ফিরে তাঁকে পাশচোখে দেখছেন।
ধীরেন ঠাকুরপো বুঝি! এই দেখুন আমার বাচ্চারা সব এসেছে। সবাইকে তো চিনবেনও না।
ধীরেন খুব হাসি হাসি মুখ করে কয়েক পা এগোল। বড্ড লজ্জা হচ্ছে তার। এমন সুন্দর দৃশ্য যেন মা দুর্গা আর কার্তিক গণেশ আর লক্ষ্মী সরস্বতীরা সব জড়ো হয়েছে। তার মধ্যে সে এক মহিষাসুর যেন ঢুকল এসে।
বলাকা তার দিকে চেয়ে বলে, অনেকদিন দেখিনি আপনাকে। চেহারাটা খারাপ হয়ে গেছে কেন?
ধীরেন বড় বেকায়দায় পড়েছে, জোড়া জোড়া চোখ তার দিকে।
অসুখ-বিসুখ করেনি তো ঠাকুরপো?
না বউঠান, বুড়ো হচ্ছি তো!
বলাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তা তো সবাই হচ্ছি।
আজ যাই বউঠান, আপনারা গল্প-টল্প করুন। অসময়ে এসে পড়েছি।
কোনও কথা ছিল নাকি?
না না, এই খবরটবর নিতেই আসা। আসি তাহলে?
আসবেন মাঝে মাঝে।
ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে আসছিল ধীরেন। শুনতে পেল, পেছনে একটা মেয়ে বলে উঠল, জানো, জ্যাঠামশাইয়ের কাজের দিন ধীরেন জ্যাঠা আমার ঘরের পাশে সাপ দেখে কাপড়ে পেচ্ছাপ করে ফেলেছিল!
একটু হাসির ঢেউ উঠল। বড় যন্ত্রণা হয় ধীরেনের। যা ঘটে তার কোনওটাই সে আর আটকাতে পারে না। ছেলে পাতা খায়, অন্য ছেলে সাট্টা খেলে, সে আটকাতে পারে না। এই যে পেচ্ছাপ বেরিয়ে পড়ে তাও কি পারে আটকাতে? এবারে চলে যাওয়ারই সময় হল বুঝি! তবে বানের জলে মিদ্দারকে ডুবিয়ে মেরেছিল তার পাপই কি অর্শাচ্ছে?
একটা শিউলি গাছের কাছে পারুল। ডিং মেরে পাতায় পাতায় আটকে থাকা ঝরা শিউলি তুলছে।
খুড়ো চললেন?
হ্যাঁ মা।
এত তাড়াতাড়ি? মায়ের সঙ্গে দেখা হল?
হ্যাঁ। এই একটু দেখে গেলুম। ঘুরে ঘুরে সবার খোঁজখবর নিই আর কী। আজ মহিমার মেজো ছেলে অমলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কত কাল পর, চিনতেই পারছিল না।
একটু ভ্রূ কোঁচকাল পারুল, কে বললেন?
সেই যে মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করেছিল মনে নেই? এখন কেষ্টবিষ্টু হয়ে উঠেছে। বড় ভাল লাগল দেখে।
পারুল ফুল তুলতে তুলতেই বলল, অমলদা এসেছে বুঝি?
হ্যাঁ।
আর কথা নেই। ধীরেনের কথা বড্ড তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। ধীরে হেঁটে সে রাস্তার দিকে যাচ্ছিল।
ধীরেনখুড়ো!
ধীরেন থমকে দাঁড়ায়, কী মা?
আপনি কি এখন দুধ জোগাড় করতে যাচ্ছেন?
ধীরেন ক্লিষ্ট একটু হেসে বলে, দেখি যদি পাই।
দিন তো, ঘটিটা আমাকে দিন।
অ্যাঁ!
পারুল ঘটিটা তার অবশ হাত থেকে নিয়ে লঘু পায়ে ভিতরবাড়িতে চলে গেল। ধীরেন একটু আশাভরসায় বুক বেঁধে দাঁড়িয়ে রইল। নিজেকে একটু কাঙাল ভিখিরির মতোই লাগছে বটে, কিন্তু সে তো তাই। সমাজের নীচের তলাতেই বাস ছিল তার। হয়তো আরও কয়েক ধাপ নেমে গেছে। কে জানে! তবে কী এসে যায় তাতে? এইসব বড় বড়, উঁচু উঁচু মানুষের দয়াধর্মের ওপরেই তো বেঁচে থাকা, ছোট ছোট ইচ্ছাপূরণ!
দেবী যেমন বর দেন তেমনই ছোট ঘটিটা দুধে ভরে নিয়ে এসে তার হাতে দিল পারুল। মুখটা কচুপাতায় ঢেকে দিয়েছে। কী বুদ্ধি মেয়েটার।
সাবধানে নিয়ে যাবেন খুড়ো।
কৃতজ্ঞতায় গলে যেতে ইচ্ছে করে ধীরেনের। চোখে জল আসতে চায়। একটু উথলানো গলায় বলে, দিলে মা! দিলে!
বেশি তো নয়। ছোট্ট ঘটি আপনার।
যথেষ্ট মা, এই যথেষ্ট।
আর খুড়ো!
হ্যাঁ মা।
অমলদার সঙ্গে যদি দেখা হয় তাহলে একবার আমাদের বাড়িতে আসতে বলবেন। বলবেন আমি বলেছি।
ধীরেন মাথা হেলিয়ে বলে, আচ্ছা মা। এখনই বলে আসব?
পারুল একটু হেসে বলল, আমি কয়েকদিন এখানে থাকব। যখন হয় বলবেন, আপনার সময়মতো।
হ্যাঁ মা।
দুধ! শেষ অবধি ঘটি ভর্তি দুধ! আনন্দে ধীরেনের বুকটা একটু তোলপাড় হল৷ এবার একটু পাঁউরুটি জোগাড় হলেই হয়। ঘটিটা দু হাতে মণিরত্নের মতো ধরে ধীরেন সাবধানে হাঁটে। হোঁচট টোচট খেলে দুধ চলকে যাবে বাবা। আর হঠাৎ যদি এখন তার পেচ্ছাপ পেয়ে বসে তাহলেও বিপদ। পাজি পেচ্ছাপটা যে কখন পেয়ে বসে তার কিছু ঠিক নেই। শালা ঠিক মিদ্দারের ভূতের মতো। যখন তখন এসে হানা দেয়। কাণ্ডজ্ঞান থাকে না তখন।
পাঁউরুটি কিনতে বাসরাস্তায় এসে ধীরেন চায়ের দোকানে বসল একটু। অনেক কিছু ভাবার আছে। এই দুধ নিয়ে বাড়ি গেলে কি তার ভোগে লাগবে? চারদিকে লোভী চোখ। ঘটিটা সাবধানে টেবিলের ওপর রেখে এক হাতে যখের মতো ধরে থাকল ধীরেন। তারপর অনেকক্ষণ ভাবল। ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক কাপ চা আর কোয়ার্টার রুটি নিল ধীরেন। চায়ে ডুবিয়ে পাঁউরুটি কিছু খারাপ নয়। চায়ের মধ্যেও তো একটু দুধ থাকে রে বাপু। চোখ বুজে মনে মনে ভেবে নিলেই হয় যে, দুধে ভিজিয়েই খাচ্ছি।
কাঙাল গরিবদের ভগবান কল্পনাশক্তিটাও খুব দেন বটে। ওইটুকু আছে বলেই তারা পান্তাকে পোলাও মনে করে খেয়ে নিতে পারে। না না, পোলাও-টোলাও গরিবেরা ভালবাসে না। তাদের জিভে পোলাও বা লুচির কোনও স্বাদ নেই। তারা ভালবাসে মিঠে ভাত, লঙ্কার ঝাল বা তেঁতুলের টক। তাই দিয়েই ভরপেট উঠে যায়।
চায়ে ভিজে গেলাসের মধ্যে পাঁউরুটিটা টইটম্বুর হয়ে উঠল। দৃশ্যটা মুগ্ধ চোখে দেখল ধীরেন। তারপর একটু একটু চুমুক দিয়ে আর দু-তিন আঙুলে চায়ে ভেজা পাঁউরুটির দলা মুখে দিয়ে খেতে লাগল সে। খুব ধীরে ধীরে। অন্য হাত দুধের ঘটির ওপর সতর্ক পাহারা দিচ্ছে।
অনেকক্ষণ সময় নিল ধীরেন। সব জিনিস রয়ে-সয়ে করতে হয়। জিভ, টাকরা কণ্ঠনালি বেয়ে পেট অবধি স্বাদের আলো ছড়িয়ে নেমে যাচ্ছে চায়ে ভেজানো পাঁউরুটি। পুরো এই ব্যাপারটা খুব মন দিয়ে উপভোগ করছে সে। প্রতিটি বিন্দু।
দুধটুকু থাক। এটুকু বাড়িতেই নিয়ে যাবে সে। দুধ-উপোসি শিশুরা আজ দুধ দেখে ভারী খুশি হবে। না, ধীরেনের বরাতে জুটবে না। তা না জুটুক। আজ তার একটু মহৎ হতে বড্ড ইচ্ছে করছে।
.
১২.
প্রস্ফুটিত কমলের মতো তোমার আশ্চর্য আনন। মনে হয় এখনই মধুকর গুনগুন করে উড়ে এসে ভুল করে ফুল ভেবে বসবে ওই আননে। এইভাবে পুরুষের স্তাবকতা শুরু হল, শেষ হল না আজও। কত ভূর্জপত্র, তালপাতার পুঁথি, কত কাগজ আর কলমের কালি খরচ হয়ে গেল, রচনা হল কত কাব্য, মহাকাব্য, নাটক, উপন্যাস। উপমায় উপমায় চাঁদ, ফুল, শ্রাবস্তীর কারুকার্য গেল ফুরিয়ে। পুরুষ দমেনি এখনও।
দেখন সুন্দরী না হলেও হয়। হয়তো মুখে জুতসই একটা তিল বা আঁচিল, ঠোঁটের একটু অভিমানী ভাঁজ, মুখের ডৌল, চোখ বা চাহনি, হয়তো বা গজদন্ত, গালের টোল কিছু একটা হলেই হল। বোকা পুরুষ তাই নিয়েই মাতল, মজল, পাগল হল। ডোবাল জাহাজ, ছারখার করে দিল দেশ, লাগাল ধুন্ধুমার যুদ্ধ। না পারলে হয়তো মদ খেয়ে হল দেবদাস বা কবি, আত্মহত্যা করে বসল, পাগল বা সাধু হয়ে গেল।
হ্যাঁ গা, শুধু রূপটুকু চাই? কুরূপার বুঝি প্রেম নেই?
ওই যে বারান্দার উত্তর কোণে এসে বসে আছে রাইকিশোরী। সামনে মুড়ির বস্তা, বেতের দাড়িপাল্লা নামিয়ে রেখে আঁচলে মুখের ঘাম মুছছে। ওর একটুও শ্রী নেই। খবুটে পুরুষালি গড়ন, দাঁত উঁচু, মুখে অনেক খানাখন্দ। কোনও পুরুষ বিরলে বসে একবারটিও ভাববে না ওর কথা। এক লাইন কবিতাও কোথাও লেখা হবে না ওর জন্য। তবু হয়তো ওরও একদিন বিয়ে হয়ে যাবে। প্রকৃতির নিয়মে ছেলেপুলে হবে, সংসার করবে। কিন্তু প্রেম হবে না।
আজ সে জানালা দিয়ে চেয়ে মুড়িউলি রাইকিশোরীকে দুপুরের আলোয় দেখছে আর রূপের কথা আর বেহদ্দ পুরুষের কথা ভাবছে।
আজ জানালা দিয়ে কে তার বিছানায় একখানা ভাঁজ করা প্রেমপত্র ফেলে দিয়ে গেছে। ভাল কাগজও জোটেনি। শস্তা এক্সারসাইজ বুকের একখানা ফাঁস করে ছেঁড়া পাতা। হাতের লেখাটা অবশ্য তত খারাপ নয়।
আজকাল আবৃত্তিকারদের কল্যাণে জীবনানন্দ ঘরে ঘরে। চিঠির মধ্যেও সেই বিদিশার নেশা, পাখির নীড়ের মতো চোখ, হালভাঙা নাবিক এইসব আছে। ভাল করে পড়লও না পান্না। তার সতেরোখানা প্রেমপত্রের সঙ্গে আঠেরো নম্বরটাও রেখে দিল চন্দনকাঠের বাক্সে। নীচে যার নাম সই সেই মণীশকে সে চেনেও না। হয়তো কারও বাড়িতে এসেছে। কারও আত্মীয়স্বজন হবে।
প্রেমপত্র পেলে পান্না খুশি হয় না। আবার রেগেও যায় না। আসলে তেমন কোনও প্রতিক্রিয়াই হয় তার। এসব ছ্যাবলাদের সঙ্গে নিজেকে ভাবতে তার ইচ্ছেই হয় না কখনও।
তবু ট্রফি হিসেবে থাকে। প্রেমপত্র একধরনের সার্টিফিকেটও তো বটে।
দুপুরবেলাটা গড়িমসি। আলিস্যিতে ভরা তার শরীর। তবু উঠতে হল। আজ বড়মার বাড়িতে তার নেমন্তন্ন। নেমন্তন্ন প্রায়ই থাকে। একা ফাঁকা বাড়িতে বড়মা একা বসে খায় বলে তাকে প্রায়ই ডেকে পাঠায়। কিন্তু বড়মার বাড়িতে সে কিছুতেই মাছটা খেতে পারে না।
বড়মা অবশ্য জোর করে, কেন মাছ খাবি না? খা, একটু তফাতে বসে খেলেই হবে।
না বড়মা, নিরামিষই ভাল।
তোর যে তাহলে পেট ভরবে না?
কেন বড়মা? গোবিন্দভোগ চালের ভাত, সরবাটা ঘি, আলুভাজা, পোস্ত, আলুর দম, টক–এতেও ভরবে না?
তাহলেও তোর কষ্ট তো হবে।
একটুও না। মাছে আমার আজকাল আঁশটে গন্ধ লাগে।
আজ অবশ্য তা নয়। আজ নেমন্তন্ন করেছে পারুলদি, কী সব চাইনিজ আর ইটালিয়ান রান্না করবে বলে নানারকম জিনিস আনিয়েছে কলকাতা থেকে। কাল রাতে বলল, তোর জামাইবাবু একটু আনইউজুয়াল ডিশ পছন্দ করে। তুইও খাবি। দুবেলাই নেমন্তন্ন। মনে থাকে যেন।
আর কাকে বলবে?
কাউকে না। বাইরের লোক ডাকলে বাপু ঘরোয়া আড্ডার মেজাজটা থাকে না। নিজেরা বেশ গল্প টল্প করব। অনেকদিন বাদে নিজের হাতে রান্না করব, কীরকম হবে কে জানে বাবা। নুন-টুন কমবেশি হতে পারে।
কেন, তুমি রান্না করো না?
দুর! সময় পাই কোথায়? এক মিশিরজি আছে, সেই রাঁধে। আমাকে তো তোর জামাইবাবুর অফিস সামলাতে হয়।
তাই তো! পাস-টাস করলে আমাকে তোমার অফিসে একটা চাকরি দেবে?
কেন রে মুখপুড়ি, চাকরি করবি কেন?
খারাপ কী বল! চাকরি, না হয় বিয়ে করে ঘরসংসার- এই তো! আর কোনও অলটারনেটিভ আছে?
পারুলদি একথায় হাসল না, ভাবল। বলল, অলটারনেটিভ অনেক হয়তো আছে। কিন্তু আমরা তা ভাবি না। তবে তোকে বলি, বিয়ে না করে চাকরি করলেই কিন্তু কিছু সুখ হয় না, ওটা ভুল ধারণা। বিয়ে যদি দাসত্ব হয় তবে চাকরি আরও দাসত্ব। ওসব চাকরির চিন্তা মাথা থেকে তাড়া।
ধর, চাকরি না করে যদি বুটিকের দোকান করি বা ফ্যাশন সেন্টার বা বিউটি পার্লার!
ব্যস, ফুরিয়ে গেল তো! আজকাল সব মেয়েই কেবল ওসব লাইনে ভাবে। প্রফেশনাল হয়ে যে কিছু লাভ হয় না তা বুঝতে চায় না। ভাবে গাদা গাদা টাকা রোজগার করলেই বুঝি খুব সুখ।
কী করব তাহলে বল তো! ঘরসংসার? সেও তো ফুরিয়ে যাওয়া। কী সুখ আছে বল!
পারুলদি একটা গভীর শ্বাস ফেলে বলে, সত্যি বলতে কী, আমার কেবল মনে হয়, আমরা একটা ভুল জীবন কাটিয়ে যাচ্ছি। আমার কথাই ধর না। তোর জামাইবাবু তো ভীষণ ভাল একটা লোক। আমার কোনও অভাব নেই। কাজকর্ম, সংসার নিয়ে দিব্যি সময় কেটে যায়। তবু মাঝে মাঝেই কেমন যেন হাঁফ-ধরা লাগে।
চোখ গোল গোল করে পান্না বলল, তোমারও হাঁফ ধরে যায়! তাহলে আমাদের কী হবে?
তাই তো বলছি, অলটারনেটিভ খুঁজে কিছু লাভ নেই। স্বামীর দাসত্ব করবি না, ঠিক আছে। কিন্তু আর যা করতে যাবি কোনওটাই বেটার অলটারনেটিভ নয়। বেশি টাকা রোজগার করারও একটা একঘেয়েমি আছে। মনে হবে, দুর ছাই, এত টাকা দিয়ে কী হবে?
যাঃ, আমার তা কখনও মনে হবে না।
এ বয়সে বুঝবি না। টাকা জিনিসটাকে কিছুতেই ভালবাসা যায় না।
কেন?
টাকা হচ্ছে বায়িং পাওয়ার। কেনা-বেচার মিডিয়াম। তাই যদি হয় তাহলে শুধু বেচা-কেনার জন্যই তো টাকা। ওটার তো আর কোনও মূল্য নেই। কনভার্টিবিলিটি ছাড়া টাকার আর কোন গুণ আছে বল।
ও বাবা, ওসব শক্ত কথা বুঝতে পারি নাকি?
তোকে অত বুঝতে হবেও না। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে তত আমার কাছে টাকা জিনিসটা অসাড় হয়ে যাচ্ছে।
তোমার অনেক টাকা আছে বলেই ওরকম মনে হয়।
মাথা নেড়ে পারুলদি বলল, না রে, তা নয়। মানুষ তো ভোগ করবে বলেই রোজগার করে। কিন্তু বুঝতে পারে না তার ভোগ করার ক্ষমতা খুব বেশি নয়। ধর আমি যদি পাঁচশোটা বেনারসি কি বমকাই কিনি, হাজার ভরি গয়না গড়াই, দশটা গাড়ি এনে গ্যারেজে ভরি বা দশটা বাড়ি তৈরি করি–কিছু লাভ হবে তাতে? ক্লান্তি লাগবে না?
ইস্, আগে হোক তো!
পারুলদি হেসে ফেলল, আচ্ছা যা, এখন ওসব বোঝার বয়স হয়নি তোর। পরে বুঝবি।
না পারুলদি, এসব বয়স হলেই বোঝা যায় না। এসব বোঝার জন্য অন্যরকম মন চাই। তুমি হলে বড়মার মতো। দেখ না, বড়মা কেমন যেন হয়ে গেছে। শাড়িগুলো বিলিয়ে দিল সবাইকে। গয়নাগুলো দিয়ে দিল। জ্যাঠামশাই চলে যাওয়ার পর থেকে বড়মা একদম পালটি খেয়ে গেছে। আমাকে তিনটে পিওর সিল্ক আর একটা আংটি দিয়েছে, জানো? হীরাকে দিয়েছে দুটো ঢাকাই, একটা বেনারসি আর ঝুমকো দুল।
পারুলদির চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। একটু চুপ করে থেকে বলল, ঠিকই বলেছিস হয়তো, মায়ের মনটাই হয়তো পেয়েছি। মা যেন বেঁচেই ছিল শুধু বাবার জন্য। বাবাই ছিল মায়ের ধ্যানজ্ঞান। এখন মা যেন ঠিক বেঁচেও নেই। মাঝে মাঝে ভয় হয় মা বোধহয় মনে মনে সহমরণেই চলে গেছে। চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, কথা কইছে, মজার কথা শুনে হাসছে, কিন্তু মা যেন মা নেই।
উঃ পারুলদি, ওভাবে বোলো না। শুনে এখন আমার কেমন ভয়-ভয় করছে। সহমরণ কেন হবে? বড়মার মনটা খুব খারাপ, তা তো হতেই পারে।
পারুলদি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, সারাদিন আমি কেবল মাকে ঘুরে ঘুরে দেখি, স্টাডি করি, বুঝবার চেষ্টা করি। বড্ড ভয় হয়, এত শোক সইতে না পেরে মাও যদি চলে যায়?
না না, বড়মা কেন মরবে? শোক কত কেটে গেছে দেখ না? এখন বড়মা অনেক সামলে গেছে।
মাকে দেখে রাখিস। মা তো কিছুতেই আমাদের কারও কাছে গিয়ে থাকবে না। তোরাই ভরসা।
একটা কথা জিজ্ঞেস করব পারুলদি?
বল না।
সোহাগ খুব তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। তোমাদের বাড়িতে অনেক লোকজন আছে বলে আসতে চায় না।
কেন রে, আমার কাছে আসতে চায় কেন?
কী জানি। তোমাকে ওর খুব পছন্দ।
তোর সঙ্গে ভাব হয়েছে বুঝি?
হ্যাঁ।
তোকে বলেছিলাম না ওর সঙ্গে বেশি মিশিস না।
কী করব বলল, বেচারার বন্ধু নেই। আমার কাছে আসে গল্প করতে।
এঁচোড়ে পাকা মেয়ে, না?
না পারুলদি, একটু পাগলি, কিন্তু ভারী ভাল মেয়ে।
মাও বলছিল, ওর নাকি আমাকে গডেস বলে মনে হয়।
হ্যাঁ। ও তো কতবার সে কথা বলে।
আর কী বলে?
তোমার প্রতি ওর ভীষণ সফটনেস!
বাজে কথা কিছু বলে না তো?
কী বাজে কথা?
খারাপ কিছু?
তোমার সম্পর্কে? না তো!
আমার গা ছুঁয়ে বল।
পান্না অবাক হয়ে পারুলের হাত ধরে বলল, গা ছুঁয়ে বলছি।
ফিক করে একটু হেসে পারুল বলে, তা হলে আনিস একদিন। সবাই চলে যাওয়ার পর।
ওরা বোধহয় খুব বেশিদিন থাকবে না। পুজোর পর কলকাতা চলে যাবে।
তা হলে পরে কখনও হবে।
একটু আনিই না একদিন পারুলদি?
পারুল একটু গম্ভীর হয়ে বলল, এখন বড় হয়েছিস, কাজেই তোকে বলা যায়। অমলদার সঙ্গে আমার একটা রিলেশন ছিল। সবাই জানে। ওর মেয়ে এলে সকলের সামনে আমার একটু অস্বস্তি হয়।
দুর! তুমি ভীষণ পিউরিটান। তাতে কী হয়? সেসব তো কবে চুকেবুকে গেছে।
পারুল হাসল, সে অবশ্য ঠিক। কিন্তু মেয়েটাকে কেন যেন আমার পছন্দ হয় না।
কেন হয় না বলো তো!
কী জানি। ভিতর থেকে একটা অপছন্দের ভাব আসে।
সোহাগ কিন্তু হেলপলেস মেয়ে।
কেন, হেলপলেস কেন?
ওর মা বাবার সঙ্গে রিলেশন খুব খারাপ। ওর মা বাবার ধারণা ওর মধ্যে কেউ ইভিল স্পিরিট ঢুকিয়ে দিয়েছে।
যাঃ!
হ্যাঁ গো। আমেরিকায় থাকতে নাকি একটা বাজে গ্রুপ ওকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর নাকি ব্রেনওয়াশ করে ফেরত দেয়।
ধ্যেত! গাঁজাখুরি গল্প বলেছে।
গল্পটা ও বলেনি।
তাহলে?
বলেছে ওর মা।
ওর মাকে তুই চিনিস নাকি?
হ্যাঁ, সোহাগ নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
মহিলা কেমন?
খারাপ নয় তো!
ওটা একটা কথা হল? খারাপ না হোক, একটা রকম আছে তো!
আমার তো ভালই লাগে। কাছে গেলে গল্প-টল্প করে।
কীসের গল্প?
বিদেশের গল্প।
আমার কথা কখনও জিজ্ঞেস করেনি তো!
না। কিন্তু ভদ্রমহিলা ভীষণ ডিপ্রেশনে ভোগেন।
কেন?
তা জানি না।
.
রাইকিশোরী নামটা শুনলেই একটা কবিতার মতো কিশোরী মেয়ের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠবেই উঠবে। সরু কোমর, সদ্য ফুটে-ওঠা বুক, অবাক মুখ, আর চোখে মুগ্ধ চেয়ে থাকা। হায়, এই রাইকিশোরী কিছুতেই মেলে না ছবিটার সঙ্গে।
বস্তা তুলে বড় টিনে সাবধানে এক অবিশ্বাস্য দক্ষতায় মুড়ি ঢেলে দিচ্ছে সে। এবাড়িতে মুড়ির খুব টান। চারটে মুনিশ ওই পুবের বারান্দায় বসে বড় বড় অ্যালুমিনিয়ামের কানা উঁচু থালায় মুড়ির পাহাড় নিয়ে বসবে। একটা তরকারি আর ডাল ঢেলে দিতে হয় মুড়ির মাথায়। তার ওপর জল ছিটকে ছিটকে মুড়িটা মেখে নিয়ে বড় বড় সূর্যমুখী লঙ্কা কামড়ে খেয়ে নেবে চোখের পলকে। দুদিন বাদে বাদেই রাইকিশোরীকে আসতে হয়।
সামান্য একটু সেজে নিতে নিতে দৃশ্যটা জানালা দিয়ে দেখছিল পান্না। কোনও মণীশ ওকে চিঠি দেবে কি কখনও? মুড়ি ফেরি করে করে যৌবন যায় রাইকিশোরীর। রূপহীনার তো প্রেম নেই।
আয়নায় নিজেকে একটু মন দিয়ে দেখে পান্না। না, নিজের চোখ দিয়ে নয়। অজানা এক মণীশের চোখ দিয়ে।
হাই।
পান্না হেসে বলে, হাই।
কোথাও বেরোচ্ছ?
সে একটু পরে গেলেও হবে। বোসো না।
আমি কি তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম?
না তো! বোসো।
বসব না। আমার আজ চারদিকটা খুব ভাল লাগছে। শরৎকালটা এখানে ভীষণ ভাল, না?
ভীষণ।
চলো একটু হেঁটে আসি।
চলো।
আমার একটা মুশকিল হয়েছে।
কী মুশকিল?
চলো, হাঁটতে হাঁটতে বলব।
উঠোন পেরিয়ে সরু পথটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভারী উদাস গলায় সোহাগ বলে, বাস্তুসাপ কাকে বলে জানো?
হ্যাঁ। কেন জানব না? এখানে অনেকের বাড়িতে আছে।
আমাদের বাড়িতেও আছে। সাপের একটা হিপনোটিক পাওয়ার আছে, তাই না?
ও বাবা! ওসব জানি না। সাপ শুনলেই আমার গা সিরসির করে।
আমি রোজ আমাদের খড়ের মাচানটার কাছে গিয়ে উবু হয়ে বসে সাপগুলোর জন্য অপেক্ষা করি।
তুমি একটা ক্ষ্যাপা মেয়ে। ওরকম করতে আছে?
আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু একদিনও আমার সামনে বেরোয় না।
আচ্ছা, সাপ দেখে তোমার কী লাভ হবে বলো তো!
আমার ভীষণ একটা অ্যাট্রাকশন। সাপ তো ইভিল, যেমন, ডেভিল। সাপই ইভকে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাইয়েছিল। তাই না?
তাতে কী হল?
সাপ ভীষণ মিস্টিরিয়াস একটা প্রাণী। আমার অনেকদিন ধরে একটা সাপ পুষতে খুব ইচ্ছে করে। সাপটা আমার গায়ে বেয়ে বেড়াবে, গলায় পেঁচিয়ে থাকবে, মাথার ওপর উঠে ফণা তুলে থাকবে। অনেকটা শিবের মতো।
ও মা! মাথাটা তো গেছে দেখছি! কী বিটকেল ইচ্ছে রে বাবা।
সবাই তাই বলে।
সাপ-খোপের চিন্তা মাথা থেকে তাড়াও তো।
আজ একটা কাণ্ড করে ফেলেছি।
কী করেছ?
আজ সকালে একটা সাপুড়ে যাচ্ছিল। আমি তাকে ডেকে একটা সাপ কিনতে চাইলাম। তাতে সে খুব অবাক হয়ে গেল। বলল, সাপ নিয়ে কী করবেন? বললাম, পুষব। লোকটা মাথা নেড়ে বলল, সাপ পোষা বিপদের কাজ। বিদ্যে না জানলে নাকি ওসব করতে নেই।
ঠিকই তো বলেছে।
তখন আমি তাকে কিছু টাকা বখশিস দিয়ে বললাম, তাহলে আমাকে সাপ ধরা শিখিয়ে দাও। খড়ের মাচার নীচে তিনটে গোখরো সাপ আছে, সেগুলো যদি সে ধরে তাহলে আমি কায়দাটা শিখে নেব। টাকার লোভে সে রাজি হয়ে গেল।
বাস্তুসাপ ধরতে বললে? কী সর্বনাশ! তারপর?
তখন বাড়িতে তেমন কেউ ছিল না। পিসি বর্ধমানে গেছে, জেঠিমা পাড়ায় বেরিয়েছে। শুধু বাচ্চারা কয়েকজন ছিল। সাপুড়েটা কী সব মন্ত্র বলে একটা শেকড়ের টুকরো মাচার নীচে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে লাগল। আর ভেঁপুতে কুক কুক করে অদ্ভুত শব্দ করতে লাগল।
মা গো! তুমি তখন কোথায় দাঁড়িয়েছিলে?
আমি ওর সঙ্গে সঙ্গেই ছিলাম।
তোমার দুর্জয় সাহস ভাই! তারপর কী হল?
হঠাৎ ফোঁস ফোঁস শব্দ করতে করতে ইয়া বড় একটা সাপ খুব তেড়ে বেরিয়ে আসছিল। কী সাংঘাতিক স্পিড! লোকটা চেঁচিয়ে আমাকে বলল, দিদি সরে যান! কিন্তু জানো, সাপটা যখন বেরিয়ে এল আমি তখন তার দুটো পুঁতির মতো চোখের দিকে চেয়ে একদম হিপনোটাইজড হয়ে গেলাম। একটুও নড়তে পারিনি।
ও বাবা!
লোকটা আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে না দিলে ইট কুড বি ফ্যাটাল। সাপটা আমার খুব কাছে চলে এসেছিল দুম করে।
ইস, কী যে হত আজ!
লোকটা কিন্তু খুব এক্সপার্ট। সাপটা বেরিয়ে আসতেই চট করে একধারে সরে গিয়ে এক ঝটকায় সাপটার লেজ ধরে তুলে ফেলে একটা ঝাঁকুনি দিল শুধু। তারপর ঝুড়িতে ভরে ফেলল। বলল, আমার আর ঝাঁপি নেই দিদি, আজ এই একটাই ধরলাম। অন্যগুলো এখন গর্তে নেইও, ওরা এই সময়ে নাকি খেতে বেরিয়ে যায়।
ব্যাপারটা বাড়ির লোক জানে?
হ্যাঁ। জানতে পেরেই তো আজ খুব চেঁচামেচি হল। জেঠিমা ফিরতেই বাচ্চারা তাকে সাপ ধরার কথা বলে দেয়। জেঠিমা ভীষণ ভয় পেয়ে চেঁচাতে থাকে, সর্বনাশ হয়ে যাবে! বংশ থাকবে না। ভিটেমাটি উচ্ছেদ হবে…আরও কত কী! খবর পেয়ে জ্যাঠামশাই এল, বাবা কোথায় গিয়েছিল, চলে এল। তারপর রতনদাকে ডাকিয়ে আনা হল। বাবা আমাকে ভীষণ বকল আজ। তারপর রতনদার মোটরবাইকে চেপে বাবা আর রতনদা বেরোল সাপুড়েকে খুঁজে বের করতে।
পাওয়া গেল তাকে?
হ্যাঁ। বাসরাস্তায় গুমটিতে বসেছিল। তাকে ধরে নিয়ে আসা হল। সে যেসব ওষুধ ছড়িয়েছিল সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে সাপটাকে ছেড়ে দিয়ে গেল ফের। আমি এখন বাড়িতে খুব আনপপুলার।
তুমি হাসছ! কাজটা মোটেই ভাল কয়নি। বাস্তুসাপ ধরাও ভাল নয় শুনেছি।
আমি জাস্ট শিখতে চেয়েছিলাম। আর কিছু নয়।
ওসব শিখতে অনেক সময় লাগে, গুরুর কাছে শিখতে হয়।
সোহাগ ঠোঁট উলটে বলে, তা হবে, কিন্তু আমার মনে হয় ব্যাপারটা কিছু কঠিন নয়। আসলে দরকার স্পিড, আর ঠিক জায়গায় ধরে ফেলা, আর ভয় না পাওয়া।
তার মানে! তুমি কি সাপ ধরার চেষ্টা করবে নাকি?
মনে হচ্ছে চেষ্টা করলে পারব।
খবদার সোহাগ ও-কাজও করতে যেও না।
একটু দূর থেকে নিউ স্পোর্টিং ক্লাবের বারান্দায় কয়েকটা ছেলেকে বসে থাকতে দেখতে পেয়েছিল পান্না। চেনা ছেলেই সব।
ক্লাবঘরটা পেরিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটা ছেলে বেশ উঁচু গলায় বলে উঠল, এখানে বেশি রংবাজি মারাতে এলে মুখের জিওগ্রাফি চেঞ্জ করে দেব। গাঁয়ে ফুটানি মারতে এসেছে..
পান্না অবাক হয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে ছেলেগুলোর দিকে চেয়ে বলে, কাকে বলছেন?
একটা ছেলে বলল, তোমাকে নয়। যাকে বলেছি সে বুঝতে পেরেছে।
কাকে বললেন?
বললাম তো তোমাকে নয়।
সোহাগ অন্য দিকে চেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। পান্নার হাতটা টেনে বলল, চলে এসো। দে আর কাওয়ার্ডস।
হাঁটতে হাঁটতে পান্না বলে, কাকে বলছিল বলো তো!
আমাকে।
তোমাকে! কেন বলছিল?
তা জানি না, আমি রাস্তায় বেরোলেই আজকাল কয়েকটা ছেলে আওয়াজ দেয়।
তুমি রুখে দাঁড়াওনি?
না, ঝগড়া করতে আমার ভাল লাগে না। তিন-চার দিন আগে যখন প্রথম ব্যাপারটা হয় তখন আমি একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কথাটা কি আমাকে বললেন? সে জবাব না দিয়ে চলে গেল।
খুব সাহস হয়েছে তো এদের! দাঁড়াও বিজুদাকে বলে ঠান্ডা করে দেব।
বিজুদা কে?
আমার জ্যেঠতুতো দাদা, স্পোর্টসম্যান, বিজুদাকে সবাই ভয় পায়।
তার মানে একজন পুরুষের সাহায্য চাইবে?
তাতে কী?
মাথা নেড়ে সোহাগ বলে, তাতে আমার আত্মসম্মানে লাগবে। পুরুষের অ্যাটাক থেকে বাঁচার জন্য পুরুষেরই সাহায্য নেওয়াটা কি ভাল?
এটা পুরুষ-মেয়ের ব্যাপার তো নয়, এরা বাজে ছেলে, এদের ঢিট করা দরকার।
না পান্না। বিজুদাকে বলার দরকার নেই। সব জায়গায় তো আর আমি এক একজন করে প্রোটেক্টর খুঁজে পাব না। পৃথিবীর সব জায়গাতেই অল্পবিস্তর এসব হয়। সেসব আমাকে একাই তো হ্যান্ডেল করতে হবে।
ওদের তোমার ওপর এত রাগ কেন বলো তো!
আমি তো ওদের পাত্তা দিইনা, তাই বোধহয়। দিন সাতেক আগে একটা ছেলে নির্জন রাস্তায় আমার সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ায় চেষ্টা করে। আমি মাঝে মাঝে খুব ঘোরের মধ্যে থাকি, জানো তো! সেদিনও ছিলাম। ছেলেটা কী বলছিল আমাকে, শুনতে পাইনি। ছেলেটা আমার হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে চলে যায়। তাতে ভুল ইংরিজিতে বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি কথা লেখা ছিল।
এ মা! কী লেখা ছিল তাতে?
ফোর লেটার ওয়ার্ডও ছিল।
কে ছেলেটা বলো তো!
তাকে আবার দেখলেও চিনতে পারব না। বললাম না, আমি তখন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।
এসব আগে এখানে কখনও হত না, আজকাল হচ্ছে।
প্লিজ তোমার বিজুদাকে বোলো না।
যে ছেলেটা চেঁচাল তাকে আমি চিনি। শিবেন্দ্র, কামার পাড়ার দিকে থাকে। দাঁড়াও খোঁজ নিতে হবে।
কিন্তু আমাকে নিয়ে কোনও হইচই হোক আমি চাই না। আমরা তো কিছুদিন পরেই চলে যাব।
শোনো সোহাগ, আমাদের গ্রাম সম্পর্কে তুমি যদি খারাপ ইমপ্রেশন নিয়ে যাও তাহলে তুমি হয়তো আর আসতে চাইবে না, একটা খারাপ ধারণা নিয়ে বসে থাকবে।
উদাস মুখে সোহাগ বলল, একমাত্র গভীর অরণ্য ছাড়া সব জায়গাই তো খারাপ, কলকাতা ভাল নয়, মিউনিক ভাল নয়, লন্ডন ভাল নয়, নিউ ইয়র্ক ভাল নয়। না পান্না, আমার কোনও রাগ বা অভিমান হচ্ছে না।
তুমি খুব অদ্ভুত!
সবাই তাই বলে।
জানো, আজ একটা ছেলে আমাকে প্রেমপত্র দিয়ে গেছে!
সোহাগ হাসে, তাই বুঝি?
হ্যাঁ। সেটা অবশ্য লাভ লেটার, অসভ্য কথা নেই।
.
পরনে ধুতি, গায়ে হাতাওয়ালা একটা গেঞ্জি, আর ধুতির খুঁটটা তার ওপর জড়ানো, এই পোশাকে অমল গাঁয়ের রাস্তায় ঘুরতে বেরিয়েছিল, ভারী অন্যমনস্ক, এসে অবধি সে গাঁয়ের কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের চেষ্টা করেনি, পুরনো বন্ধুদের খোঁজখবর নেয়নি, কারও বাড়িতে গিয়ে বসেনি, শৈশবের স্মৃতিচারণাও তার ভাল লাগে না।
কয়েকদিন ছুটি আছে তার। ঘরে বসে বই পড়ে আর একা একা ঘুরে ঘুরে ছুটিটা কাটিয়ে দেবে সে, বাবা, ভাই, বোন, বউ, ছেলেমেয়ে কারও সঙ্গেই সে আজকাল স্বচ্ছন্দ বোধ করে না। শুধু একা থাকতে ভাল লাগে। হৃদয় খুঁড়লেই ব্যথা-বেদনার উৎসমুখ খুলে যায়।
জনহীন জায়গাগুলো তার জানা, সন্ধের পর খেলার মাঠ, পতিত জমি, জংলা জায়গা, শুধু রতনের সঙ্গে তার কিছু কথাবার্তা হয়। ছেলেটার সংসারী বুদ্ধি নেই। মোটরবাইক হল তার নেশা। সারা দিন ঝাড়ে, মোছে, যত্ন করে, টুকটাক সারাইও করে নেয়। মোটরবাইকই তার ধ্যানজ্ঞান। অন্য খেয়াল নেই, সে অমলকে প্রায়ই দুর্গাপুর বা কালনা নিয়ে যেতে চায় তার বাইকে। বর্ধমান ঘুরিয়ে আনল কাল, বেশ চালায়।
ঘুরে ঘুরে তেষ্টা পেল অমলের। একটু চা পেলে হত। কোনও অসুবিধে নেই। যে কোনও বাড়িতে ঢুকে পড়লেই হল। আদর করে বসিয়ে চা খাওয়াবে। চা পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু আজকাল কথা বলা বা শোনা তার কাছে অসহ্য ঠেকে।
বাড়িতে ফিরে ধীর পায়ে দোতলায় উঠতেই মোনালিসা দরজা খুলে দিয়ে বলল, এসো দেবদাস। তোমার পারু তোমাকে দেখা করতে বলে পাঠিয়েছে।
থতমত অমল বলে, কে?
পারু গো পারু। ভুলে গেলে নাকি?
অমল গোরুর মতো নিস্পৃহ চোখে চেয়ে থাকে।
.
১৩.
আমি ভারী অবাক হয়ে দেখছি তোকে।
কেন, অবাক হওয়ার মতো কী দেখলেন?
আমার হিসেবমতো তোর বয়স এখন পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। ঠিক তো!
না মশাই, আপনার শ্যালিকার বয়স এখন আটত্রিশ।
বাজে বকিস না। আচ্ছা, ছত্রিশই ধরছি।
স্নেহের পাত্রী বলে সত্যি কথাটা স্বীকার করতে চান না তো!
তা নয়। হিসেব করেই বলছি।
আচ্ছা, নয় তাই হল, এবার অবাক হওয়ার কথাটা বলুন।
আমি দেখছি তোর শরীরে এক ফোঁটাও চর্বি জমেনি। আশ্চর্য সেটাই।
কেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে বিশুদা?
কিছু মানুষ থাকে দড়কচা-মারা চেহারা, তাদের কখনও চর্বি হয় না। কিন্তু তোর তো সেরকম সিঁটকোনো চেহারা নয়। তোর চর্বি হওয়ার কথা। এমনকী তোর পেট বা কোমরেও ভাঁজ পড়ে না। হ্যাঁ রে, ডায়েটিং করিস নাকি।
খাটে বসে আপন মনে উল বুনে যাচ্ছিল বকুল। সে পারুলের চেয়ে নয় বছরের বড় দিদি। এতক্ষণ চুপ করে থেকে এবার বলল, চিরকাল ডায়েটিং করাই তো ওর স্বভাব। সেই ছেলেবেলাতেও একটুখানি খেয়েই ওর পেট ভরে যেত।
বিশ্বনাথ মাথা নেড়ে বলে, যতই কম খাক, চর্বি না জমার কথা নয়। ওর দেখো, একটুও নেই। বেশি ডায়েটিং করলে চেহারায় একটা অসুস্থ শীর্ণতার ছাপ পড়ে, ওর তাও হয়নি।
পারুল হাসছিল, এসব ম্যাজিক মশাই, ম্যাজিক।
তুই কি ব্যায়াম করিস?
খুব বেশি কিছু নয়। সকালে বরের সঙ্গে একটু হাঁটি। আর সামান্য কয়েকটা আসন করি।
তোর বয়সটাও এক জায়গায় আটকে আছে। এখনও কলেজের ছাত্রী বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।
বকুল বলে, ওগো, ওকে অত নজর দিও না তো! তোমার নজর বাপু খুব খারাপ। জানিস পারুল, ও যখনই আমাকে ভাল দেখে তখনই আমার শরীর খারাপ হয়।
বিশ্বনাথ হাসে, নজরের দোষ কী বল! পারুল যে আমাকে বড্ড অবাক করে দিয়েছে। দু-তিন বছর বাদে দেখা, একইরকম আছে। একটুও বদলায়নি।
হ্যাঁ রে, আমার বয়সটা বোঝা যায়, না?
তা কেন? তবে তুই একটু মোটা হয়ে গেছিস দিদি।
কী করব বল! জল খেলেও মোটা হই।
বিশ্বনাথ একজন সরকারি আমলা। রিটায়ার করার মুখে। কালোর ওপর চেহারাটা একসময়ে ভালই ছিল। কালো বলে বিয়েতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না বকুল। আপত্তি ছিল বকুলের মা বলাকারও। এ বংশে সবাই ফর্সা। ছেলেমেয়ে কেউ কালো নয়। তা হলে কালো জামাই কেন পছন্দ করা হচ্ছে?
গৌরহরি তাঁর স্ত্রী বলাকাকে বলেছিলেন, কালো বলে আমারও যে আপত্তি হচ্ছে না তা নয়। বকুল ফর্সা, কালো বরে তারও আপত্তি হওয়ারই কথা। কিন্তু বিশ্বনাথের যে-গুণটার জন্য সম্বন্ধ করছি তা হল ছেলেটি খুব সৎ। যে-ডিপার্টমেন্টে চাকরি করে সেখানে লাখপতি হওয়া কোনও ব্যাপারই নয়। এই ছেলেটি ঘুষ খায় না, মিথ্যে কথা বলে না, নেশা নেই। এর বাবাও সরকারি অফিসার ছিলেন, সেই মানুষটিও সৎ।
বলাকা বললেন, খুঁজলে কি অমন আর পাওয়া যাবে না?
যাবে বলাই, যাবে। খুঁজলে কী না পাওয়া যায়!
তা হলে আর একটু দেখো না। মেয়ে তো সুন্দরী, আর বয়সও বয়ে যাচ্ছে না।
গৌরহরি একটু চিন্তিত হলেন। বললেন, তুমি কখনও আমার মতের বিরুদ্ধে মত দাও না। এবার যখন দিলে তখন ভাবতে হবে। চট করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে না।
গৌরহরিকে যতই স্বাধিকারপ্রমত্ত এবং খেয়ালি বলে মনে করুক অন্য লোক, পারুল জানে, তার বিবেচনাশক্তি বড় কম ছিল না।
বলাকা বললেন, ওগো, তুমি আবার আমার কথায় কিছু মনে কোরো না। পাত্র ভাল স্বীকার করছি। কিন্তু ওরা আবার বাঙাল দেশের লোক, সেটাও একটু ভেবে দেখো।
গৌরহরি চিন্তিত মুখে বললেন, সবই ভেবেছি। আবার ভাবব। চট করে কিছু করব না। কিন্তু বলাই, একটা জিনিস ভেবে দেখেছ?
কী গো?
এমন পরিবার কি আজকাল খুঁজে পাবে যারা বংশানুক্রমে ছেলের বিয়েতে পণ নেয় না?
সেটা পাওয়া মুশকিল। কিন্তু আমাদের তো টাকার অভাব নেই। পণ দিয়ে যদি ভাল পাত্র পাওয়া যায়, না হয় দিলুম পণ!
গৌরহরি হাসলেন, বেশ বললে বলাই, বেশ বললে। পণ দিলে যদি ভাল পাত্র পাওয়া যায়! কিন্তু ভেবে দেখেছ কি যারা পণ নেয় তাদের কিছুতেই ভাল বলা যায় না?
ওটা যে রেওয়াজ।
মৃদু মৃদু মাথা নেড়ে, সহাস্যে গৌরহরি বলেন, রেওয়াজ নয়, রেওয়াজ নয়। করাপশন যখন ছড়িয়ে যায় তখন সেটাকে কাস্টম বলে মেনে নেওয়া যে ভয়ংকর রকমের অন্যায়।
বলাকা একটু ভয় পেলেন। দুঁদে উকিলের সঙ্গে পেরে ওঠা তাঁর কর্ম নয় বুঝে বললেন, পণ ছাড়াও কি পাত্র জুটবে না?
জুটবে। চেষ্টা করলে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। দেখছি চেষ্টা করে।
তুমি রাগ করলে না তো!
না। বলছি, মেয়েটার ভালমন্দ বিবেচনা করার অধিকার তো আমার চেয়ে তোমার কম নেই। এক্ষেত্রে আমার মতামত জোর করে চাপানো ঠিক হবে না।
বিশ্বনাথকে তোমার কি খুব পছন্দ?
সে কথা থাক বলাই। আমি আর তার কতটুকু জানি? সৎ হওয়াটাই বড় কথা নয়, অন্যান্য ব্যাপারও দেখা উচিত। এইজন্যই তো বলে, লাখ কথা ছাড়া বিয়ে হয় না।
বিশ্বনাথ এরকম বাতিলই হয়ে গেল সেদিন।
বুড়ো ঘটক সর্বানন্দ ভট্টাচার্য তখনও বেঁচে। এ সম্বন্ধ তাঁরই করা। তিনি একদিন বলাকার সঙ্গে এসে দেখা করে বললেন, মা, এ সম্বন্ধ তোমার পছন্দ নয় বলে শুনলাম।
বলাকা ঘোমটা দিয়ে আড়াল থেকে বললেন, ছেলে যে কালো।
সর্বানন্দ হাসলেন। সত্তর বছর বয়সেও ঝকঝকে দাঁত। সুঠাম চেহারা। বললেন, তাই তো মা! বামুন কালো হলেই গেরো! তবে কিনা সব ক্ষেত্রেই কিছু ব্যতিক্রম থাকে। তা হলে মা, মুগেবেড়ের ছেলেটার কথা ভেবে দেখো। কুলীন, ফর্সা, যেমনটি চাও তেমন।
কী করে?
পড়তি জমিদার। ছেলে ফেলনা নয়। ডাক্তার।
তবে তো ভালই কাকা।
হ্যাঁ। ভাল। দেখো, কথা কয়ে। আমি গৌরহরিকেও বলেছি। পাত্র অপছন্দের নয়।
পণ দিতে ওঁর তো খুব আপত্তি। এরা কি পণ চায়?
তা এখনও কিছু বলেনি। কথা এগোলে বোঝা যাবে।
মুগবেড়ের পাত্রের নাম সায়ন্তন। চেহারা ভাল, ডাক্তারি পাস, জমিদারের ছেলে। আর কী চাই! তরতর করে কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল। হ্যাঁ, পণের ব্যাপার একটু ছিল তবে ঠিক পণও বলা যায় না। পাত্রের বাবা মেয়ে দেখে পছন্দ করে আর পাঁচটা কথার পর দেনা-পাওনার প্রসঙ্গ উঠতে বললেন, পণ-টন নয়। তবে আমাদের অবস্থা এখন পড়তি। ছেলের বিলেত গিয়ে এম আর সি পি করার প্ল্যান। ফিরে এসে বাড়িতেই নার্সিংহোম করবে। অনেক টাকার পাল্লা। যদি লাখখানেক টাকা ধার হিসেবে দেন তা হলে আমি বাকিটা সামলে নিতে পারব। এ টাকাটা আমরা ধীরে ধীরে শোধ দিয়ে দেব। চাইলে সুদও পাবেন।
গৌরহরি শান্ত গলায় বললেন, সায়ন্তনকে আমার স্ত্রীর খুবই পছন্দ হয়েছে। সে উপযুক্ত পাত্র। এক লাখ টাকা ধার হিসেবে নয়, যৌতুক হিসেবেই দেব। ও নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।
ভদ্রলোক একটু ভাবিত হলেন, যৌতুক দেবেন!
দেব।
ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমাদের আগের অবস্থা থাকলে এসব কথা উঠত না। অবস্থা বিপাকে পড়েই–ঠিক আছে, আপনার যা ইচ্ছে।
ওঁরা চলে যাওয়ার পর বাড়িটা কিছুক্ষণ থমথম করেছিল, মনে আছে পারুলের। বলাকার মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি ছিল না। বকুলেরও মন খারাপ। ব্যাপারটা বড় বাড়াবাড়ি হয়ে গেল যেন।
পরদিন সর্বানন্দ এলেন। বলাকাকে ডেকে বললেন, কেমন মা, সব দিক রক্ষে হয়েছে তো!
বলাকা হতাশার গলায় বললেন, মনটা ভাল নেই কাকা। এত টাকা দিয়ে বিয়ে!
তা মা, ভাল পাত্র চেয়েছিলে পেয়েছ। গৌরহরি টাকা কবুল করেছে, পুরুষের মতোই কাজ করেছে।
কিন্তু কাকা, ওঁরা তো ধার হিসেবেই চেয়েছিলেন। উনিই যৌতুক দিতে চাইলেন।
সর্বানন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বিয়ের শুরুতেই একটা ধারকর্জের সম্পর্ক কি ভাল লক্ষণ মা? শুভ কাজে ঋণ সুলক্ষণ নয়। তার চেয়ে এই তো ভাল হয়েছে।
আমার খারাপ লাগছে। উনি হয়তো আমার ওপর একটু রাগ করেই কাণ্ডটা করলেন।
সর্বানন্দ মাথা নেড়ে বললেন, তা নয় মা, তা নয়। গৌর তোমার ওপর রাগ করেনি। সেও ধারকর্জের মধ্যে যেতে চাইল না, উকিল মানুষ ত, মানুষ চরিয়ে খায়। মনুষ্য চরিত্র ওরা খুব বোঝে। ধর, ধার দিলে যদি ওঁরা শোধ দিতে না-পারেন বা ইচ্ছে করেই শোধ না-দেন তখন গোলমাল বেধে উঠতে পারে। আত্মীয়-কুটুম মানুষ তাঁরা, মামলা-মোকদ্দমাও করা যাবে না, ঝগড়া বিবাদ করলেও বিপদ। তিক্ততা যাতে না ঘটে তার জন্যই গৌরহরি গোড়া মেরে রাখল। ভালই হল, তোমার মেয়েরও খানিক হক থাকবে। শ্বশুরবাড়িতে মাথা উঁচু করে থাকতে পারবে।
আমার স্বামী কখনও টাকাকে টাকা মনে করেন না। ওইটেই ওঁর দোষ। যেখানে তিন টাকায় হয় সেখানে উনি তিনশো টাকা দিয়ে বসেন।
সর্বানন্দ ফের হাসলেন। বললেন, গৌরহরি কাঁচা মানুষ নয় মা। মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবেই সে টাকাটা দিতে রাজি হয়েছে। পুরনো জমিদারবাড়ি তো! তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনেক ঝুল ময়লা পোকামাকড় থাকে যে! অনেক প্রথা আছে, সহবত আছে, সেসব মেনে চলার হ্যাপা আছে। তোমার মেয়ে সব সয়ে বয়ে নিতে যদি না পারে মা? টাকাটা সেই ব্যাপারে কাজ দেবে। মেয়ের দোষঘাট আর তত দেখবেনা কেউ। কাজটা গৌরহরি ঠিকই করেছে।
সম্বন্ধটা কি ভাল হল বলে আপনি মনে করেন?
ভাল মানে! খুব ভাল। পাঁচজনকে বুক ফুলিয়ে বলার মতো সম্বন্ধ।
আমারও তাই মনে হচ্ছিল। এখন যেন মনটা কেমন আড় হয়ে আছে।
ওসব নিয়ে ভেবো না। কথা পাকা হয়ে গেছে। বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দাও।
পারুলের মনে আছে বিয়ে পাকা হয়ে যাওয়ার পর তার দিদি বকুল যেন কেমন মনমরা হয়ে গেল। বলতে লাগল, আমার বিয়ে দিয়ে বাবা তো সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে। এ বিয়েতে আমার সুখ নেই।
সবাই তাকে বোঝাতে লাগল।
দুই বোন তখন এক খাটে শোয়। এক রাতে বকুল বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছিল।
পারুল বলল, দিদি, কাঁদছিস কেন? এ মা, বিয়ে হবে, এখন কেউ কাঁদে?
আমার ইচ্ছে যাচ্ছে না রে। এ বিয়ে ভাল হবে না।
কেন? জামাইদা দেখতে কেমন সুন্দর, ডাক্তার, বড়লোক–আর কী চাস তুই?
সে আমি জানি না। আমার ভাল লাগছে না।
এক লাখ টাকা নগদ দিয়ে ক্ষান্ত হবেন না বলে গৌরহরি সোনা-দানা, দানসামগ্রীরও বেশ এলাহি আয়োজন করতে লাগলেন।
বলাকাকে বললেন, এক লাখ টাকাটা তো ওরা পাবে। আমার মেয়ে তো পাবে না। তার হাতে কী থাকবে বল! গয়নাগুলোই হবে তার অ্যাসেট।
বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!
তা হোক বলাই, তা হোক। এই আমার প্রথম মেয়ের বিয়ে। একটু পাগলামি করতে দাও।
পাত্রপক্ষ কি জানে যে, তুমি এতসব দিচ্ছ?
জানবে না কেন? সর্বানন্দ ঘটক রীতিমতো তাদের সব খবর পৌঁছে দিচ্ছে।
তারা কি খুশি?
খুশি না হওয়ার কী আছে?
বলাকা আর কিছু বললেন না। শুকনো মুখে উঠে গেলেন।
বিয়ের বোধহয় সাতদিনও তখন বাকি নেই, হঠাৎ এক মধ্যরাতে পারুলের ঘুম ভেঙে গেল বকুলের ধাক্কায়।
কী রে দিদি?
চুপ। আয় আমার সঙ্গে।
কোথায়?
পাশের ঘরে মা-বাবার কথা হচ্ছে। চল শুনি।
এঃ মা।
আয় না।
পিঠোপিঠি না হলেও তাদের দুই বোনের ভাব ছিল সাংঘাতিক। ভীষণ বন্ধুর মতো। কোনও কথাই গোপন থাকত না তাদের মধ্যে।
চুপি চুপি দুই বোন উঠে পাশের ঘরের দরজায় কান পাতল।
বলাকা বলছিলেন, আমার ঘাট হয়েছে তোমার কথা না-শুনে। বরাবর দেখে আসছি তুমি যা বল, ঠিকই বল। আমিই বারবার ভুল করে ফেলি।
তা কেন বলাই? আমি তোমার ওপর তো নির্ভরই করি। করি না বলো! যদি জানতাম তুমি বিচক্ষণ নও তা হলে কি নির্ভর করতাম। না, তা নয়। আমি তোমার মতো সাংসারিক বুদ্ধি রাখি না। আমি আমার ছেলেমেয়ের মানসিকতারও খোঁজ রাখি না। এসব ভালমন্দ বিচার করার ভার আমি তোমার ওপরেই দিয়ে রেখেছি।
তোমার পায়ে পড়ি, এ বিয়ে ভেঙে দাও।
সে কী বলছ বলাই! এখন বিয়ে ভাঙা কি সম্ভব?
কেন নয়?
এতদূর এগিয়ে কি পিছোনো যায়?
আর কেউ না পারুক, তুমি ঠিক পারবে বুদ্ধি করে বিয়েটা ভেঙে দিতে। ওগো, দশটা গাঁয়ের লোক যে তোমার বুদ্ধি-পরামর্শ নিতে আসে সে কি এমনি?
কিন্তু বিয়ে ভাঙতে চাইছ কেন?
তুমি যখন টাকাটা যৌতুক হিসেবে দিতে চাইলে তখন ভদ্রলোক একবারও আপত্তি করলেন না, মনে পড়ে?
খুব পড়ে।
ওখানেই আমার খটকা। ভদ্রলোক হলে অন্তত একবার আপত্তি করত।
দুনিয়াটা চিনলে না বলাই। শতকরা নিরানব্বই জনই তো ওরকম। কাকে ফেলে কাকে বাছবে।
বাপু, আমার মন সায় দিচ্ছে না।
তা হলে আর মনমতো পাত্র পাবে কোথায় বলো! পাত্র তো অনেক দেখলাম। সবাই কিছু না কিছু প্রত্যাশা করেই। কারও খাঁই বেশি, কারও কম। কারও চোখের চামড়া নেই, কেউ রয়ে-সয়ে চায়। কিন্তু চায় তো সকলেই। কী করবে বলো!
তোমার সেই বিশ্বনাথের কী হল?
বাঃ বলাই! সে যে কালো বলে বাতিল হয়েছে।
সে তো শুধু কালো, আর তো কিছু নয়!
না। উদ্বাস্তু পরিবার। তবে শিক্ষিত। খেটে খায়। তাদের গুণ ওইটুকুই।
তাকেই দেখো না আবার।
সেখানে তো একরকম অমত জানিয়েই দেওয়া হয়েছে। এখন কী আর
তোমার চোখ বড় একটা ভুল করে না গো। তুমি যখন তাকে পছন্দ করেছ তখন সে ভালই হবে। দেখো না গো একটু।
ভাল করে ভেবে দেখ বলাই।
ভাল করেই ভেবেছি।
তারা কিন্তু দানসামগ্রীও নেবে না। বিশ্বনাথের বাবা সাফ বলেছে, জিনিসপত্র সোনা-দানা রাখার জায়গা তাদের নেই। এসব তারা নেবে না।
তোমার পায়ে পড়ি।
ঠিক আছে বলাই, তোমার কথা আর কবে ফেলেছি?
কালো, কিন্তু কেষ্টঠাকুরের মতো কমনীয় মুখশ্রীর ভালমানুষ বিশ্বনাথ লাজুক মুখে যেদিন বিয়ে করতে এল সেদিনই তাকে খুব ভালবেসে ফেলল পারুল।
বিশুদা তার এগারো বছর বয়সি শালিটিকে বাসরঘরে একটাই মাত্র ইয়ার্কির কথা বলেছিল, আগের দিনে বিয়ে করলে শালি ফাউ পাওয়া যেত, জানো?
শুনে কী যে রোমাঞ্চ হয়েছিল পারুলের। ওই বয়সটাই অমনি।
তারপর সারাক্ষণ জামাইদার সঙ্গে লেগে লেগে ছিল সে। কী ভাল! কী নরম কথাবার্তা, কী লজ্জাশরম!
সেই বিশুদা এখন প্রবীণ এক মানুষ! চুল পেকেছে কিছু, গোঁফেও পাক। শোনা যায় তিনি বড় চাকরি করলেও তেমন সচ্ছলতা অর্জন করতে পারেননি। এখনও তাঁর বাড়িতে শৌখিন জিনিস দেখা যায় না। বকুলের গায়ে গয়না ওঠেনি, তার আলমারি ভর্তি শাড়ি নেই, যথেচ্ছ খরচ করার মতো টাকাও তারা হাতে পায় না। তাদের দুটি ছেলেই লেখাপড়ায় ভাল, এইটুকুই যা সান্ত্বনা। বড়টি এখন চল্লিশ হাজার টাকা মাইনের চাকরি করে।
না, বিশ্বনাথ জাগতিক অর্থে একজন সফল মানুষ নয়। কিন্তু এই মানুষটাকে শ্রদ্ধা করতে কখনও পারুলের অসুবিধে হয়নি।
বিশুদা, আমি আপনার সঙ্গে আমার বাবার স্বভাবের খুব মিল পাই, তা জানেন?
বিশ্বনাথ একটু হাসল। তারপর বলল, তা একটু আছে বোধহয়।
কী মিল বলুন তো!
সেটা তোরা ভেবে বলবি। আমার কেন যেন গৌরহরি চাটুজ্জেকে খুব পছন্দ হত। বিয়ের আগেই বউয়ের চেয়ে শ্বশুরের প্রতিই আমার আকর্ষণ হয়েছিল বেশি, তাই বিয়ে করতে আপত্তি করিনি।
বকুল বলল, বাবা তোমাকে ভালবাসত খুব। বলত, বিশ্বনাথের মতো ছেলে হয় না। এ মা, ওই দেখ তোমার নাম এনে ফেললাম! কী হবে!
গঙ্গাজল খাও।
তিনজনে একটু হাসাহাসি হল।
পারুল বলল, পতির নামে গতি। অত ভাবছিস কেন?
বিশ্বনাথ স্নিগ্ধ চোখে পারুলের দিকে চেয়ে বলল, হ্যাঁ রে, পারুল, তোকে একটা কথা বলব?
বলুন না।
ভাবছি, তুই আবার টেনশনে না-পড়ে যাস।
কীসের টেনশন?
অমলকে তুই শেষ অবধি কেন বিয়ে করিসনি তা জানি না। তাই জিত্তেস করছি, অমলের কি কিছু দোষ ছিল?
পারুল একটু গম্ভীর হয়ে বলে, দোষ না থাকলে তাকে বাতিল করলাম কেন বিশুদা?
কিন্তু কী জানিস, অমলকে সেদিন রাস্তায় দেখে খুব মায়া হল। কেমন উদাস, উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, গায়ে ধুতির খুঁট জড়ানো। আমাকে অবশ্য চিনতে পারেনি। কী ব্যাপার কিছু জানিস?
না। তবে ওদের বোধহয় কিছু প্রবলেম আছে।
পরশু দিন সন্ধেবেলায় বেগুনক্ষেতের ওপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে এবাড়ির দিকে চেয়ে ছিল। আমি একটু চিন্তায় পড়লাম। ভাবলাম, সেই পুরনো প্রেম থেকে আবার পাগলামি দেখা দিচ্ছে না তো!
চেয়ে ছিল?
হ্যাঁ।
চেয়ে থাকার তো কিছু নেই। অনায়াসে এ বাড়িতে আসতেই তো পারে।
সেটাই স্বাভাবিক হত। দূর থেকে চেয়ে থাকাটা ভাল লক্ষণ নয়। তুই একটু সাবধানে থাকিস।
পারুল হেসে ফেলল, কেন বলুন তো! আপনার কি ধারণা অমল রায় এখনও আপনার প্রৌঢ়া শালিটির প্রতি দুর্বল?
ওরে পাগলি, তুই প্রৌঢ়া হলে আমি তো ভবলীলাই সাঙ্গ করেছি। তোর চেয়ে আমি কত বড় জানিস?
জানি। উনিশ বছর।
তবে? যাক গে, তোকে জানিয়ে রাখলাম।
বিশুদা, অমলদাকে আমিই আমার সঙ্গে দেখা করতে বলে পাঠিয়েছি। কিন্তু বেচারা হয়তো এখন একটু লজ্জা পাচ্ছে। আসতে চেয়েও চক্ষুলজ্জায় আটকাচ্ছে। তাই হয়তো চেয়ে থাকে।
সিরিয়াস কিছু নয় বলছিস?
দুর! ওসব কবে চুকেবুকে গেছে।
প্রেম-ট্রেমের কিছুই জানি না রে ভাই। আমার সব দৌড় তো ওই যে ওই উলবুনুনির কাছে গিয়ে গিয়ে শেষ হয়।
বকুল ভ্রূ কুঁচকে কী যেন ভাবছিল। হঠাৎ বলল, অমলকে আসতে বলেছিস কেন? ওর এখন না-আসাই ভাল। জ্যোতিপ্রকাশ যদি কিছু ভাবে?
পারুল হেসে বলল, তুই যেন কী দিদি! আমরা কি সেই আগের আমরা আছি কি? ম্যাচিওরড হইনি? তা ছাড়া আমি তো আমার কর্তার কাছে কিছু গোপন করিনি। সব বলে দিয়েছি। সেও তো বিশুদার মতোই একজন সরল সহজ মানুষ। কিছু মনেই করেনি।
না বাবা, কী থেকে কী হয়ে যায়! তোর বড্ড সাহস পারুল।
ও মা, সাহসের কী?
ওই তো শুনলি, বাইরে থেকে চেয়ে থাকে। চেয়ে থাকা কি ভাল?
অমলদার বয়স কত হল জানোনা?
পুরুষমানুষ সব বয়সেই খারাপ। বেশি বয়সে আরও খারাপ।
.
অমল ধরা পড়ে গেল পরদিন সন্ধেবেলায়। নানা আঘাটায় ঘুরে সে বেগুনক্ষেতটার বেড়ার ধারে এসে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। ক্ষেতের ওপাশে গাছপালার ফাঁক দিয়ে দোতলার আলো-জ্বলা ঘরটা দেখা যায়। যেন স্বপ্নের ঘর। রোজই কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে অমল। কাউকে দেখা যায় না। দেখতে চায়ও না অমল। কয়েক মিনিট সে তৃষিতের মতো চেয়ে থেকে ফিরে যায়।
আজ সে হয়তো একটু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ একটা সাইকেল কোথা থেকে সাঁ করে এসে তার কাছেই ব্রেক কষল।
এই, কে রে ওখানে?
অমল চমকাল না। ধীরে শুধু মুখটা ঘোরাল।
কে? এখানে দাঁড়িয়ে কী হচ্ছে?
অমল জবাব দিল না। ছেলেটা সাইকেল থেকে নেমে কাছে এল।
আরে! অমলদা?
অমল চিনতে পারল। বিজু।
এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন অমলদা?
এমনি। দেখছি। অনেকদিন বাদে এলাম তো!
আসুন না ভিতরে।
না থাক।
থাকবে কেন? আসুন। বড়মা খুব খুশি হবে।
.
১৪.
পুরনো কৌটো বাউটো ডাঁই হয়ে জমে আছে খাটের তলায়, তাকে, রান্না আর ভাঁড়ারঘরে। মায়াবশে কিছুই ফেলা হয়নি তেমন। কত কৌটো বহুকাল খোলাই হয়নি। কী আছে তার মধ্যে কে জানে বাবা। আমসি, শুকনো কুল, ত্রিফলা কি গোলমরিচ। কৌটোগুলো বিদেয় না করলেই নয়। খাটের নীচে মশার আজ্ঞা হয়েছে, পোকামাকড় বেড়েছে, ইঁদুরের খুটখাট বাড়ছে, বাড়ির বেড়ালটা এই নিয়ে তিনবার প্রসব করল বলাকার খাটের তলায়।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকলে বলাকা কৌটো নিয়ে পড়লেন। তা শ দেড় দুই তো হবেই। নানা মাপ, নানা আকৃতির সব কৌটো, দু-চারটে সেই ইংরেজ আমলের জিনিসও আছে।
পুরনো, ভুলে-যাওয়া কৌটো খোলার মধ্যে একটি রহস্যরোমাঞ্চ আছে। কোন কৌটো থেকে কী বেরিয়ে পড়ে তা কে জানে! একবার একটা ওভালটিনের পুরনো কৌটোর মধ্যে হঠাৎ একছড়া সোনার হার পেয়েছিলেন বলাকা। বোধহয় কোনও কাজের মেয়ে চুরি করে লুকিয়ে রেখেছিল, কিন্তু নেওয়ার সময় পায়নি। সেই হারছড়া ছিল তাঁর মেজো জায়ের। পেয়ে সে কী আনন্দ!
দুখুরি কৌটো টেনে আনছে আর বলাকা একটা চ্যাপটা চাবির মুখ দিয়ে ভুটভাট শব্দে কৌটো খুলছেন। বেরোচ্ছেও জিনিস অনেক। একটা হালকা কৌটো না খুলেই বাতিল করতে গিয়ে কী ভেবে খুলে দেখলেন তার মধ্যে ঠাসা তেজপাতা। কবেকার কে জানে! আর একটা হালকা কৌটো থেকে তিনটে খুঁধুলের ছোবড়া বেরোল। শ্বশুর-শাশুড়ি আর তিন ভাইয়ের যৌথ সংসারেই জমেছিল এসব। কিছু জায়েরা নিয়ে গেছে, কিছু পড়ে আছে।
ভাগাভাগির ব্যাপারটা কখনও ভাল চোখে দেখেননি বলাকা। গৌরহরি যখন তার দুই ভাইয়ের অংশ বিপুল দামে কিনে নিয়েছিলেন তখন বলাকা রাগ না করে খুব আদুরে গলাতেই বলেছিলেন, ওগো, এত বড় বাড়ি দিয়ে আমরা কী করব? শ্বশুরমশাই তিন ছেলের জন্য তিনটে দালান করে গেছেন, আমাদের তো অকুলান হচ্ছিল না!
ভাইয়ে ভাইয়ে একটু তফাত থাকলে সম্পর্কটা ভাল থাকে।
সম্পর্ক কি খারাপ হচ্ছিল? কিছু তো বুঝতে পারিনি। বেশ তো ভাবসাবই ছিল সকলের।
তা ঠিক বলাই। বাইরের সম্পর্ক ভালই ছিল। কিন্তু হঠাৎ আমার রোজগারপাতি বেড়ে যেতে লাগল। তখন মনে হচ্ছিল শিবে আর রেমো কেমন যেন মুখ গোমড়া করে থাকছে। হয়তো হিংসে হতে লেগেছে। কাছাকাছি থাকলে ক্রমে ক্রমে ওটা বেড়ে যেত। তাই গোড়া মেরে রাখলুম।
কিন্তু মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেরা বাইরে থাকে, এত বড় বাড়িটা খাঁ-খাঁ করে যে গো!
অভ্যেস হয়ে যাবে বলাই, ধৈর্য ধরো।
খেয়ালি পুরুষটির সব সিদ্ধান্তের উচিত-অনুচিত আজও বুঝতে পারেন না বলাকা। মন মানতে চায়নি তবু গৌরহরি যা বলেছেন তা বরাবরই মেনে নিয়েছেন বলাকা। মানুষটা তার চেয়ে পনেরো বছরের বড়, ইয়ারবন্ধু তো নয়। বরং যেন খানিকটা বাবার মতোই এক অভিভাবক।
পুরনো কৌটোর অন্ধকারে সেকেলে বাতাস জমে আছে আজও। মুখ খুললেই ভ্যাপসামতো গন্ধ। বলাকার বেশ লাগে। কত বছরের সঞ্চিত বাতাস তার মুখে এসে লাগে। গা সিরসির করে।
কৌটোয় কী খুঁজছ মা? পয়সা?
বলাকা হেসে ফেলেন, হ্যাঁ, পয়সাই খুঁজছি। পেলে তোকে দেব।
আমি সারা বাড়িতে কত পয়সা কুড়িয়ে পাই জান? সব একটা কৌটোয় জমিয়ে রেখেছি। ঝাঁট দিতে গেলেই পয়সা পাই।
স্মিতমুখে বলাকা বলেন, পয়সা জমিয়ে কী করবি?
তোমাকে একটা জিনিস কিনে দেব।
ওমা! আমাকে আবার কী জিনিস দিবি রে?
পয়সা জমিয়ে তোমাকে একটা মহাভারত কিনে দেব। সেদিন যে বলছিলে তোমার মহাভারতখানা কে যেন নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দেয়নি!
ও বাবা! তাও মনে রেখেছিস! দিতে যে চেয়েছিস সেই ঢের। ওতেই তোর দেওয়া হয়েছে।
একটা কৌটোর মধ্যে কিছু খুচরো পয়সা পেলেন বলাকা। কেউ বোধহয় জমাতে শুরু করেছিল, বেশি পারেনি। মোট পাঁচ টাকা চল্লিশ পয়সা। বলাকা পয়সাটা দুখুরির হাতে দিয়ে বললেন, তোর কৌটোয় জমিয়ে রাখিস।
নীচের উঠোনে নিত্যানন্দ বসে আছে। সঙ্গে দুই ছেলে আর পাঁচখানা বস্তা।
দুখুরি বারান্দায় গিয়ে ডাক দিল, এসো গো, কৌটো নেবে যে!
নিত্যানন্দ ওপরে উঠে এল।
বলাকা বললেন, এই নে বাবা, কতগুলো জমেছে দেখ।
নিত্যানন্দ কাঁচুমাচু হয়ে বলে, ওসব পুরনো কৌটো মা, দশ-বিশ পয়সাতেও বিকোবে না।
দুর মুখপোড়া! তোর কাছে পয়সা কে চেয়েছে। এগুলো বিদেয় কর আগে। পয়সা লাগবে না।
নিত্যানন্দ একগাল হাসল। তারপর ছেলেদের ডেকে নিয়ে টপাটপ বস্তায় কৌটো ভরতে লাগল।
কৌটোগুলো বিদেয় হওয়ায় খাটের তলায় এখন হাওয়াবাতাস খেলছে, ঘরটাও হালকা দেখাচ্ছে।
বলাকা ঘরের আলমারি আর আসবাবগুলো দেখছিলেন। তাঁর এত লাগে না। ধীরে ধীরে বাহুল্য জিনিসগুলো বিদেয় করে দেবেন। জিনিস বিক্রি করা খুব অপছন্দ করতেন গৌরহরি। বলাকা বিক্রি করবেন না। বিলিয়ে দেবেন। তবে তার আগে ছেলেমেয়েদের মতামত নিতে হবে। ওরা যদি চায় তো ভাল, নইলে নেওয়ার লোক মেলা পাওয়া যাবে।
তুমি কি বাঁধন কাটতে চাইছ মা?
বলাকা হেসে বললেন, আমাকে নিয়ে তোর এত ভয় কেন বল তো পারুল?
পারুল মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, তোমার হাবভাব আমার মোটেই ভাল লাগে না। এবার তোমাকে আমি জামশেদপুর নিয়ে যাবই। চোখের আড়ালে তুমি কী করে বসবে তার ঠিক নেই।
ও কথা বলছিস কেন? আমি তো বেশ আছি।
তুমি যেন কেমন উদাসী হয়ে গেছ।
দুর পাগল! উদাসী হওয়ার কি জো আছে? তোর বাবা চলে যাওয়ার পর দুনিয়াটা কেমন পানসে হয়ে গিয়েছিল ঠিকই, মনে হত বেশিদিন বাঁচব না।
তুমি বাবার সঙ্গে সহমরণে যেতে চেয়েছিলে মা। আমার সব মনে আছে।
বলাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সে আর তোরা যেতে দিলি কই? গেলেই যে বাঁচতুম। তাকে ছাড়া যে বেঁচে থাকা কী কঠিন তোরা বুঝবি না।
খুব বুঝি মা। আর বুঝি বলেই ভয় পাই। সংসার থেকে তুমি যেন তোমার মন গুটিয়ে নিচ্ছ।
পারুলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলাকা বলেন, তা যদি পারতুম তাহলে তো ভালই হত। মন তুলে নিই সাধ্যি কি? ওই যে দুখুরি ওটার জন্য নতুন করে মায়ার বাঁধনে পড়লুম, গোরু, কুকুর, বেড়াল, এই বাড়ি, কাজের লোকেরা কার জন্য মায়া না করে পারি বল? মন তুলে নেওয়া কি সোজা কথা? আর তোর বাবার আক্কেল দেখ, এত বড় একখানা বাড়ি আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেছে। তাও দেওররা, জায়েরা থাকলে একটু জনমনিষ্যি থাকত। সারাদিন এই বিশাল বাড়িটায় থাকা কি সোজা?
তাই তো বলি আমার কাছে চলো।
এ-জায়গা ছেড়ে দুনিয়ার আর কোথাও গিয়ে থাকতে মন চায় না। শীতকালে গিয়ে দু-চারদিন থেকে আসবখন।
বলাকাকে নিয়ে যেতে চায় সবাই। তারা ভাবে, এখানে একা পড়ে থাকা মায়ের পক্ষে কষ্টকর। কিন্তু সেটা ওদের দিক থেকে ভাবা। বলাকার দিক থেকে ভাবনা অন্যরকম।
এই যে দুধের মতো সাদা গোরু আলো। দুখানা মায়াবি চোখ দিয়ে যখন চেয়ে থাকে বুকটা উথলে ওঠে। গৌরহরির প্রিয় এই গোরুটা এমন ভালবাসত তাকে যে গৌরহরি এসে গায়ে হাত দিয়ে না দাঁড়ালে দুধ ছাড়তে চাইত না। গৌরহরি চলে যাওয়ার পর কী বুঝল কে জানে, খুব ডাকত সারা দিন। দুখানা চোখ যেন টলটল করত। অবোলা জীবের সেই শোক যেন বলাকাকেও আচ্ছন্ন করেছিল। বলাকা গিয়ে রোজ আলোর গলায় মাথায় হাত বোলাতেন। মানুষের ভাষায় কত কথা বলতেন। গোরুর তা বুঝতে পারার কথা নয়। কিন্তু যেন বলাকার মনে হত আলো সব বুঝতে পারছে। ধীরে ধীরে যেন আলোর শোক কমে গেল। বলাকা নতুন মায়ার বন্ধনে পড়লেন। আসলে নতুন নয়, গৌরহরির প্রিয় যা কিছু সেগুলিকে ভালবেসে যেন গৌরহরির অস্তিত্বই ফের খুঁজে পান বলাকা। আজকাল তার মনে হয়, না, মানুষ অত সহজে মরে না। মরার পরও তার কত কী থেকে যায়। অস্তিত্ব কি শুধু দেহটাতে? তার সত্তাও যে ছড়িয়ে থাকে কত কিছুর মধ্যে।
এসব গূঢ় সত্য সবাই কি বুঝতে পারে? ছেলে-মেয়েরা ভাবে মা বড় একা। ওটা একপেশে দেখা। গৌরহরি যেদিন চলে গেলেন সেদিন তাঁর সঙ্গে বলাকারও চলে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তার পর ধীরে ধীরে তিনি ফের নানা অনুষঙ্গে ফিরে পাচ্ছেন গৌরহরিকে। এখন তার একাকিত্ব তত তীব্র নয়।
ওই যে স্টিলের আলমারিটা, ওটা নিবি পারুল? তোর বাবা বোম্বে থেকে অর্ডার দিয়ে আনিয়েছিল। সিকিম জিনিস, এত দিনেও একটুও রং চটেনি।
পারুল হেসে বলে, থাক না মা এসব তোমার কাছে। যেখানে যা আছে সব একইরকম থাক। তাহলে বাড়িতে এসে অচেনা ঠেকবে না কিন্তু, ছেলেবেলাটা ফিরে আসবে। না মা, তুমি সব বিলিয়ে দেওয়ার মতলব ছাড়।
কী ভাবি জানিস? আমি পট করে মরে গেলে
নরম হাতে বলাকার মুখ চাপা দিয়ে পারুল বলে, জানি তুমি মরার জন্য পা বাড়িয়েই আছ। ওসব চিন্তা কর বলেই সারাক্ষণ তোমার জন্য আমার ভাবনা হয়। মরতে চাও কেন মা? বাবা নেই বলে? আর এই যে আমরা আছি আমরা কি বাবার অংশ নই? পিতা তো জায়ার ভিতর দিয়েই ফের জন্মায় সন্তান হয়ে। জান?
মরতে চাই কে বলল? তা নয় মা, আসলে আট-দশটা আলমারি, বাক্স- প্যাঁটরা সবই প্রায় ফাঁকা। হয়ে গেছে। এগুলো পড়ে থেকে
থাক মা, পড়েই থাক।
বলাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, নিলে তোদের ভোগে লাগত।
এখনও ভোগেই লাগছে। এই যে বাড়িতে এলে বাক্স-প্যাঁটরা, আলমারি, খাট-পালঙ্ক দেখতে পাই। তাতেই মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। সেটা কি উপভোগ নয়? ভোগ মানে কি আলমারিটাতে ঠেসে জিনিসপত্র ভরে রাখা?
বলাকা হার মানলেন।
সারা বাড়িতে এখন আনন্দের হাট। মেয়ে-জামাই, ছেলে-বউমা, নাতি-নাতনি মিলে সারাদিন আড্ডা হচ্ছে, বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে, পিকনিকেরও তোড়জোড় চলছে। বলাকা দূর থেকে এসব খুব উপভোগ করেন। বড় একটা ওদের মধ্যে গিয়ে পড়েন না। তাতে বোধহয় তাল কেটে যায়। ওদের একটা বয়সের বন্ধুত্ব আছে, সেখানে গুরুজনদের গিয়ে হুট করে ঢুকতে নেই। ডাকলে আলাদা কথা।
.
আজ সকালে দুটো ভাড়া করা গাড়িতে বোঝাই হয়ে ওরা কাটোয়ার দিকে কোথায় যেন পিকনিকে গেল। বলাকাকেও টানাটানি করেছিল, বলাকা যাননি। তবে দুখুরিটাকে পাঠিয়েছেন। বেচারা সারাদিন তো তার কাছেই পড়ে থাকে, যাক আজ একটু আনন্দ করে আসুক।
দুপুরবেলা চুপিসাড়ে মেয়েটা এল। ঠিক চোরের মতো। মুখে একটু ভয় মেশানো হাসি। পরনে সেই ঝালঝালে পোশাক। সাজগোজের বালাই নেই।
বলাকা দুপুরে ঘুমোন না। সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে টুকটাক কাজ করেন। কাজ না পেলে শুধুই ঘুরে বেড়ান বা বই পড়েন। একা থাকা তার অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।
দুপুরে আজ বলাকা উঠোনে চাটাই পেতে শীতের লেপ-কম্বল রোদে দিয়েছেন। কাক-টাক যাতে এসে বসতে না পারে তার জন্য হাতে গৌরহরির হাতির দাঁতের হাতলওয়ালা লাঠিটা নিয়ে বসে আছেন। কাক-শালিক এসে কাছাকাছি হুটোপাটি করলেই বলছেন, হুশ।
এবাড়ির কাক-শালিকগুলোও তার চেনা। রোজই ঘুরে ফিরে আসে। বলাকার হাতে লাঠি হলেও চোখ জুড়ে মায়া। ওরাও তো জন। নিঃসঙ্গে সাথী।
আমি একটু আসতে পারি?
উঠোনে ঢোকার আগলটার বাইরে মেয়েটা দাঁড়িয়ে।
ও মাঃ! এসো ভাই, এসো!
মেয়েটা সসংকোচে ঢুকল।
ওই মোড়াটা টেনে এনে আমার কাছে বোসো।
লক্ষ্মী মেয়ের মতো মেয়েটা বসল।
আজ এলে! আজ যে বাড়ি ফাঁকা! তোমার বান্ধবী পান্নাও গেছে ওদের সঙ্গে পিকনিক করতে।
জানি। আমি তো আপনার কাছে এসেছি, আর কারও কাছে নয়।
কী ভাগ্যি আমার! তোমার বয়সি মেয়েরা আজকাল আর আমার মতো বুড়ির কাছে আসতে চায় না। জেনারেশন গ্যাপ না কী বলে যেন ছাই।
সোহাগ একটু হাসল। তারপর বলল, আপনারা খুব হ্যাপি ফ্যামিলি, তাই না?
বলাকা ভ্রূ কুঁচকে একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, এটা একটা আশ্চর্য কথা বললে! আমি তেমন করে ভেবে দেখিনি কখনও। কিন্তু সত্যিই বোধহয় আমাদের হ্যাপি ফ্যামিলি। তেমন কোনও সমস্যা নেই। ঝগড়াঝাটি নেই। বউমারা খারাপ নয়, জামাইরাও ভাল। আমার দুঃখ নেই।
মেয়েটা তাকে খুব অবাক করে দিয়ে বলল, কিন্তু হ্যাপিনেস কি সবসময়ে ভাল?
ওমা! বলে কী গো মেয়েটা! হ্যাপিনেস ভাল নয় বুঝি?
সোহাগ মলিন মুখ করে বলে, আমি তো একটু পাগল, তাই আমার মাথায় খুব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা আসে।
কী কথা?
কেন যেন মনে হয়, খুব হ্যাপি হওয়া ভাল নয়।
কেন বল তো!
তাতে মানুষের সার্চ কমে যায়, সে অলস হয়ে পড়ে, তার মন ঘুমিয়ে পড়ে।
বলাকা একটু অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে চেয়ে থাকেন। তারপর মৃদু স্বরে বলেন, মানুষ তো সুখী হতেই চায়, আর সেটা চায় বলেই তো সে কত পরিশ্রম করে, কষ্ট করে। তাই না? তোমার কি মনে হয় আমার মন ঘুমিয়ে পড়েছে?
মেয়েটা খুব লজ্জার হাসি হাসল, কিন্তু জবাব দিল না।
বলাকা বললেন, সুখ তো এমনিতে আসেনি। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তার জন্য। সব সময়ে তো আর সুখে থাকিনি।
মেয়েটা কিছু বলল না, সামনের দিকে চেয়ে বসে রইল।
তুমি কী বল? অসুখী হওয়াই ভাল?
মেয়েটা মাথা নেড়ে বলে, জানি না। আমরা তো ভাল নেই। আমরা খুব আনহ্যাপি।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। আমাদের পরিবারের মধ্যে সবাই সবার অ্যান্টি।
সে কী! তা কেন?
জানি না। ওইরকমই হয়ে গেছে।
এরকম হওয়া তো উচিত নয় ভাই।
আমার খুব মনে হয়, আমি অন্য কোনও ফ্যামিলিতে জন্মালে খুব ভাল হত।
তুমি তোমার মা-বাবাকে ভালবাস না?
কী জানি! ভালবাসা ব্যাপারটাই তো বুঝতে পারি না। শব্দটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে।
মা বাবাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয় না?
না। একটুও না। আমার তো সব সময়ে কোনও নির্জন জায়গায় পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
বলাকা একটু ভেবে সন্তর্পণে বললেন, অমল কত ভাল চাকরি করে। তোমার মাও তো অনেক পাস টাস শুনেছি। অমল ছেলেও তো খুব ভাল। তাহলে তোমার এরকম মনে হয় কেন?
বোধহয় আমিই স্বাভাবিক নই।
আমার তো কখনও তা মনে হয়নি! তোমাকে আমার বেশ লাগে। সাজগোজ নেই, নিজের প্রতি বিশেষ নজর নেই, চুলটা অবধি ভাল করে আঁচড়াও না কখনও। বেশ তো সরলসোজা মেয়ে তুমি।
সাজতে আমার ভাল লাগে না। কী হবে সেজে?
এ তো বুড়ো বয়সের প্রশ্ন। তোমার বয়সে কি এরকম কেউ ভাবে?
আমি বোধহয় মনে মনে বুড়োই হয়ে গেছি।
দুর পাগল!
আমি একটা কথা বলতে এসেছি।
কী কথা?
এই গ্রামে কতগুলো ছেলে মাঝে মাঝে আমাকে টিজ করে।
তাই নাকি?
সব জায়গাতেই এসব একটু-আধটু হয়। আমি মাইন্ড করি না। আমি কাউকে ভয়ও পাই না।
কিন্তু টিজ করবে কেন? দাঁড়াও, আমি বিজুকে বলে দেবোখন।
আমি সে কথাটাই বলতে এসেছি।
বিজুকে বলার কথা তো!
না, বিজুকে বারণ করার কথা।
ওমা! কেন?
সেদিন পান্নার সঙ্গে বেরিয়েছিলাম, তখন ওর সামনেই কতগুলো ছেলে আমাকে টিজ করেছিল। পান্না বলেছিল, ওর দাদা বিজুকে বলে ওদের ঢিঢ করে দেবে। আমি বারণ করেছিলাম। কিন্তু পান্না শোনেনি। ও ওর বিজুদাকে বলে দিয়েছিল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আর তার ফলে সেই ছেলেগুলোকে একটা ক্লাবের ছেলেরা এসে খুব মারে। মার দিয়েই হয়নি, ওদের নিয়ে এসে আবার আমার কাছে ক্ষমাও চাইয়েছে। আমার খুব খারাপ লেগেছে।
কেন, এ তো ভালই হয়েছে। ছেলেগুলো আর তোমার পিছনে লাগবে না।
এই ছেলেগুলো হয়তো আর লাগবে না। কিন্তু সেটা তো সলিউশন নয়। আমাকে তো সব জায়গায় কেউ প্রোটেকশন দেবে না। আর প্রোটেকশন আমি তো চাইও না। আমার খুব অপমান লেগেছে।
বলাকা হাসলেন, তুমি আজকালকার মেয়ে তো, তাই পুরুষদের প্রোটেকশন নিতে চাও না বোধহয়। কিন্তু ভাই, চিরকাল যে তাই হয়ে এসেছে।
আপনার কি মনে হয় না, এখন কিছু অন্যরকম হওয়া উচিত?
আমি পুরনো আমলের মানুষ, চিরকাল পুরুষের ছায়ায় বড় হয়েছি, আমি কি আর তোমাদের মতো করে ভাবতে শিখেছি?
সেই জন্যই কি আপনি এত হ্যাপি?
কী বলছ বুঝিয়ে বলো।
চিরকাল পুরুষের প্রোটেকশনে ছিলেন বলেই আপনার গায়ে কোনও আঁচ লাগেনি। এই প্রোটেকশন নেওয়াটাকে আপনার অপমান বলে মনে হয় না?
বলাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, পাগলি, প্রোটেকশন কি পুরুষেরও দরকার হয় না? না হলে এত পুলিশ, মিলিটারি, এত আইনকানুনের তো প্রয়োজনই থাকত না। প্রোটেকশন যে একটা ভীষণ দরকারি জিনিস। না বাপু, পুরুষমানুষের সাহায্য নিতে আমার তো কখনও অপমান লাগেনি।
কিন্তু প্রোটেকশন নেওয়ার অভ্যাস হয়ে গেলে কি মানুষ খুব নাবালক থেকে যায় না? বিপদ হলে একজন এসে বাঁচাবে এরকম ধারণা থাকলে মানুষের ডেভেলপমেন্ট কি ভাল হয়?
ও বাবা! ওসব যে শক্ত শক্ত কথা! তা ভাই, তোমার মতো করে আমি তো ভাবতে শিখিনি। কিন্তু স্বীকার করি, তোমার মতো করে ভাবাও বোধহয় খারাপ নয়। আজকাল তো পুরনো ধ্যানধারণা পালটে যাচ্ছে।
হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলল সোহাগ, বলল, হ্যাপিনেস মানেই কিন্তু সেন্স অফ সিকিউরিটি। আমার কখনও বিপদ হবে না, কখনও অভাব হবে না, আমার সব কিছু ঠিকঠাক থাকবে, আমাকে বাঁচানোর জন্য কিছু লোক সবসময়ে প্রস্তুত থাকবে, কেউ আমার নিন্দে করবে না! তাই না?
বলাকা ভারী অবাক হলেন। বললেন, তোমার বয়স কত?
আমি খুব পাকা, না? আমি সতেরো প্লাস।
ভাই, তুমি মোটেই এঁচোড়ে পাকা নও। তোমার বেশ মাথা আছে।
তা কিন্তু নয়। পড়াশুনোয় আমি ডাব্বা। তবে আবোলতাবোল ভাবতে খুব ভালবাসি।
কিন্তু কথাগুলো তো খারাপ বললে না! সুখ ওটাকেই বলে বটে। হ্যাঁ গো মেয়ে, সুখী মানুষকে তোমার ঘেন্না হয় না তো?
জোরে মাথা নাড়া দিয়ে সোহাগ বলে, না তো! আমার তো আপনাকে ভীষণ ভাল লাগে।
বলাকা হেসে ফেললেন, আমাকে আবার সুখী মানুষের সর্দার ভেবো না। অত কি সুখ আমার! গাঁয়ে পড়ে আছি, শোকাতাপা মানুষ, নিঃসঙ্গ জীবন। যত সুখী ভাবছ ততটা নই। তবে দুঃখও তেমন কিছু খুঁজে পাই না। আসল কথা কী জান, সুখদুঃখের বোধটাই বোধহয় ভোঁতা হয়ে গেছে। সেও একরকম ভালই।
আমি আপনাকে হ্যাপি বলিনি। আমি বলেছি আপনাদের ফ্যামিলিটা খুব হ্যাপি। সবাই কেমন হাসিখুশি ডগোমগো। আপনি তো তা নন।
বলাকা একটু হাসলেন।
সোহাগ বলল, পান্নার কাছে শুনেছি আপনার হাজব্যান্ড মারা যাওয়ায় আপনি খুব ভেঙে পড়েছিলেন। সবাই ধরে নিয়েছিল আপনিও বেশিদিন বাঁচবেন না।
বলাকা স্মিতমুখে বললেন, অনেকে এখনও মনে করে আমি বেশিদিন বাঁচব না।
আপনি আপনার হাজব্যান্ডকে খুব ভালবাসতেন, না?
কী জানি ভাই, তোমার মতোই ভালবাসার তত্ত্ব আমারও জানা নেই। শুধু টের পেতুম, ও মানুষটা আমার শ্বাসবায়ুর মতো, বুকে ধুকপুকুনির মতো। সে ছাড়া নিজেকে ভাবতেই পারতাম না।
সেটা কী করে সম্ভব? ইগো নেই? স্বাধীন মতামত নেই? ব্যক্তিত্ব থাকবে না?
তাই তো! সেসব বোধহয় আমার ছিল না। আমি বোধহয় খুব বোকা ছিলাম। আর তার জন্যেই এতগুলো বছর তো দিব্যি হাসিমুখে কাটিয়ে দিতে পেরেছি। তোমরা কি পারবে?
মাথা নেড়ে সোহাগ বলে, না। আমি কখনও আপনার মতো হতে পারব না। আমি চিরকাল একজন আনহ্যাপি মেয়ে হয়ে থাকব।
.
১৫.
যিশু এসে দাঁড়ালেন কদমগাছের তলায়। সন্ধিক্ষণ সমাগত। একটি আর্তনাদ শোনার জন্য অপেক্ষা করছে পৃথিবী। সেই আর্তনাদকে কোলাহলে ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য ঢাক বাজছে। ঢাকি নাচছে।
ঈশ্বরপুত্র কখনও সুখী ছিলেন না। তিনি কখনও সুখী হবেনও না। সুখী হতে নেই তাঁর। বুকে দুহাজার বছরের পুরনো দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তিনি কদমগাছের গায়ে হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ছাগশিশুটি ঘাসপাতা খেতে খেতে মাঝে মাঝে মুখ তুলে তাঁকে দেখছে।
মণিরাম… মণিরাম, তুমি যেখানেই থাকো মূল মণ্ডপের সামনে চলে এসো, তোমার পিসিমা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। মণিরাম… আজ রাত নয় ঘটিকার পর সবুজ সংঘ আয়োজিত নাট্যাভিনয় নটীর পূজা-নটীর পূজা… যাঁরা অঞ্জলি দেবেন তাঁরা দয়া করে লাইন দিয়ে আসুন…
যিশু চেয়ে আছেন। ছাগশিশুটি চেয়ে আছে। চোখে চোখ।
আমার অনন্ত ক্ষুধা প্রভু। ক্ষমা করুন।
ক্ষুধার কথা আমার মতো আর কে জানে বাছা। ক্ষুধা অনন্ত, তার কোনও নিবৃত্তি হল না আজও।
ক্ষুধা, ভয়, বংশবিস্তার ছাড়া আমাদের আর কী আছে প্রভু? বড় সামান্য এ জীবন।
জীবন সামান্য নয়। একটি জীবাণুরও জীবন এক আশ্চর্য ঘটনা, কত বিচিত্র অণু-পরমাণুর সমাহারে ওই শরীর রচিত হয় আর তার প্রকোষ্ঠে দীপাধারের মতো রহস্যময় প্রাণের শিখা। না বাছা, জীবন সামান্য নয়।
আপনার দীর্ঘশ্বাসে মথিত হচ্ছে বাতাস। সন্ধিক্ষণ সমাগত। শিয়রে শমন। আমি আমার শেষ আহার গ্রহণ করছি, যূপকাষ্ঠে একটি আঘাত আমার সব আলো নির্বাপিত করে দেবে। প্রভু, আপনার চোখের জলটুকুই আমার এ সামান্য জীবনকে অসামান্য করে তুলেছে। আপনি আমার জন্য কাঁদছেন ইহজীবনে এর চেয়ে সুন্দর আর কিছু ঘটেনি কখনও।
আমার চোখের জল কখনও শুকোয় না বৎস। কান্না ছাড়া আমি তোমাকে আর কী-ই বা দিতে পারি।
মাইক টেস্টিং…হ্যালো, হ্যালো… ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর…ইলেকট্রিশিয়ান কালু, ইলেট্রিশিয়ান কালু, মণ্ডপের বাঁদিকে স্টিক লাইটটা খুলে গেছে, এখনই ঠিক করে দাও, নইলে অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে… আজ রাত নয় ঘটিকার পর নাট্যাভিনয় নটীর পূজা… নটীর পূজা… সবুজ সংঘের নটীর পূজা.. পরিচালনা করবেন পারুল গাঙ্গুলি… মুখ্য ভূমিকায় পান্না চ্যাটার্জি, অনামিকা রায়… ভলন্টিয়াররা দেখো, অঞ্জলি দেওয়ার জায়গায় বড্ড ভিড় জমে গেছে…
প্রভু, আপনার ক্ষতচিহ্ন এখনও রক্তমুখ। আপনার মুখ বেদনায় নীল, আপনার ব্যথার অবসান নেই প্রভু?
পৃথিবীর সব আঘাতই আমাকে আহত করে, না বাছা, ঈশ্বরপুত্রের ব্যথার অবসান নেই। কতকাল এই ক্ষতচিহ্ন বহন করেছি। নিঝরের মতো আজও রক্ত বয়ে যায়। আজও তোমার সঙ্গে খড়্গাঘাত ভাগ করে নেব বলে অপেক্ষা করছি।
খাঁড়াটা ওপরে উঠে ঝক করে নেমে গেল। একটা শেষ ডাক শুধু শোনা গিয়েছিল, মা!
সুমনের হাতের ভিতরে তার হাতটা শক্ত হয়ে গিয়েছিল। আঁকড়ে ধরেছিল আঁকশির মতো।
ভয় পেলি?
মরণ মুখ তুলে চেয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল। কাহিল হাসি।
আমারও এসব দেখলে মনটা বড্ড খারাপ হয়ে যায়। না দেখলেই হত।
ওই মা ডাকটা কানে লেগে রইল মরণের, সে সাপ-খোপ অনেক মেরেছে। কিন্তু মা জানতে পারলে খুব রেগে যায়, মা মনসার জীবকে মারিস! পাষণ্ড নাকি তুই? খবরদার আর যেন না শুনি।
মায়ের সুবাদে তাদের বাড়িতে দু-দুটো বাস্তুসাপ এখনও বেঁচেবর্তে আছে। সাপ, বিছে, বোলতা, ছারপোকা, মশা বা ক্ষতিকারক জীবাণু কি পৃথিবীর কোনও উপকারে লাগে? কে জানে কী! এক সময়ে সে ফড়িং-উড়িং ধরত, মেরেও ফেলত। আজকাল, যত বড় হচ্ছে, তত কমে যাচ্ছে ওসব।
সুমনের সঙ্গে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেরিয়ে এল সে। পায়ে নতুন জুতো টাইট মারছে। সে যে বড় হচ্ছে, পায়ের মাপ বেড়ে যাচ্ছে, এটা বাবা রসিক বাঙালের খেয়াল থাকে না। কলকাতার চিনেবাজার থেকে পুরনো মাপের জুতো এনে দিয়েছে এবারও। দরকার ছিল না। বর্ধমানেই কেনা যেত। কিন্তু রসিক বাঙালকে সে কথা বোঝাবে কে?
তার মাও কেনাকাটার কিছুই বোঝে না। তবু ঝোলাঝুলি করে জিনসের ফুলপ্যান্ট আদায় করেছে মরণ। এই প্রথম ফুলপ্যান্ট হল তার এবং জিনস। লম্বায় একটু বড় হয়, কিন্তু গুটিয়ে পরা যায় বলে ম্যানেজ হয়েছে। কোমরটাও ঢলঢলে ছিল, সেটা বেল্ট দিয়ে সামলানো গেছে। সবচেয়ে মজা হয়েছিল সুমনের জন্য পাঞ্জাবি আর পাজামা কিনতে গিয়ে। বড়সড় একটা ঝিনচাক দোকানে ঢুকেই তার মা দোকানিদের বলল, খুব দামি ভীষণ ভাল পাঞ্জাবি চাই। খুব ভাল হওয়া চাই কিন্তু…
দোকানদার বিনীতভাবেই বলল, মাপ কত?
মাপ! বলে মা ভীষণ ভাবনায় পড়ে গেল। মরণের দিকে চেয়ে বলল, হ্যাঁ রে, তোর দাদার মাপ কত বল তো!
মরণ বলল, তা কি আমি জানি?
দোকানের সেলসম্যান হেসে বলে, কত লম্বা বলুন, মাপ আমি ঠিক করে নিচ্ছি।
মা নিজের মাথার ওপর হাত তুলে এই এত বড় হবে বলে যে মাপটা দেখাল তা বিরাট লম্বা কোনও লোকের।
দোকানদার বলল, ও বাবা, তাহলে তো মিনিমাম চুয়াল্লিশ লাগবে। অত বড় মাপে ভ্যারাইটি হবে না।
মরণ ফিক ফিক করে হাসচ্ছিল।
মা রেগে গিয়ে বলে, হাসচ্ছিস কেন বোকার মতো?
হাসব না? দাদা বুঝি অত লম্বা?
লম্বা নয়? বেশ লম্বা।
মোটেই না। বাবার চেয়ে দাদা একটু বেঁটে।
না না, লম্বা নেওয়াই ভাল। শেষে যদি ছোট হয়?
তাদের কথাবার্তা থেকে দোকানদার যা বোঝার বুঝে নিয়ে মাঝারি সাইজের পাঞ্জাবি বের করে দেখাতে লাগল। দারুণ দারুণ সব কাজ করা তসর, সিল্ক, র সিল্ক, গরদ।
কিন্তু মা কেবলই বলে, আরও দামি নেই? আরও ভাল?
দেখাচ্ছি বউদি। তবে এগুলোও কিন্তু খুব ভাল, লেটেস্ট ডিজাইন। ভাল করে দেখুন।
সে দোকানের স্টক ফুরিয়ে গেল, মার পছন্দই হল না। মোট চারটে দোকান ঘুরে অবশেষে প্রায় ছশো টাকা দিয়ে যে-পাঞ্জাবিটা কিনল মা সেটা এখন সুমনের গায়ে।
পাঞ্জাবি দেখে সুমন একটু অবাক হয়ে বলেছিল, ইস, এত দাম দিয়ে কিনতে গেলেন কেন? আমি তো এত ডেকোরেটেড জামা পরি না।
তা হোক বাবা, এই তো প্রথম দিচ্ছি। বয়স কম, এ বয়সেই তো একটু জমকালো জিনিস পরতে হয়।
মরণ এটা বুঝতে পারে, দাদাকে নিয়ে মার একটু আদেখলেপনা আছে। আড়ালে বলে, বড্ড ভয় পাই বাবা, আমি তো আর আসল মা নই, সৎ মা। কী চোখে দেখে কে জানে!
সুমনের ভাব দেখে কিছু বোঝা যায় না। দিন দশেক ধরে টানা আছে এবাড়িতে। একটু আপন মনে থাকে, বই পড়ে। রাত জেগে পড়ে বলে সকালে উঠতে দেরি করে। কথা কম বলে। যা একটু ভাব তা মরণের সঙ্গেই।
একদিন মরণকে বলেছিল, আমি একটু ইনট্রোভার্ট।
কথাটার মানে মরণের জানা ছিল না। পরে পান্নাদির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে জেনেছে, ইনট্রোভার্ট হল অন্তর্মুখী।
দশদিন ধরে সুমন এবাড়িতে আছে, কিন্তু মার সঙ্গে সম্পর্কটা একটুও এগোয়নি। সেই জন্য মা খুব ভাবে।
একদিন মা তাকে বলল, হ্যাঁ রে, সুমন কি আমাকে ঘেন্না করে?
কেন মা? দাদা তো সেরকম নয়। খুব ভাল তো।
কী জানি বাবা, এতদিন এসেছে তেমন কথাটথা কিছু তো বলে না। বড় ভয়-ভয় করে। গেঁয়ো মানুষ আমরা, আদরযত্ন বোধহয় তেমন হচ্ছে না।
আদরযত্ন বলতে ভাল খাওয়া-দাওয়া যদি ধরা যায় তা হলে সেটা খারাপ হচ্ছে না কিছু। ভাল মাছ, মাংস, মুরগি, পায়েস, ক্ষীর এক একদিন মা তো ভোজবাড়ির আয়োজন করে ফেলে। জিজিবুড়ির রান্নার সুখ্যাতি ছিল। সেই জিজিবুড়িও এসে চিংড়ি, মুড়িঘন্ট, চাপড়ঘণ্ট রান্নার কায়দা শিখিয়ে দেয় মাকে। আর বলে, এসে তো গেড়ে বসেছে দেখছি। মতলব তো ভাল মনে হচ্ছে না। বড়গিন্নিই সাঁট করে পাঠিয়েছে। পেটের খবর বার করতে। সাবধানে থাকিস লা।
ও কী কথা মা! ও কি তেমন ছেলে? ভাবের ঘোরে থাকে, কোনও দিকে চেয়েই দেখে না।
ও লো ও হচ্ছে ভড়ং। নজর ঠিকই রাখছে। ওপরসা-ওপরসা অমন ভাব দেখাচ্ছে। যেমন মা তেমনই তো ছা হবে।
বড়গিন্নি কেমন লোক তা জানি না মা, তাকে চোখেও দেখিনি আজ অবধি। কিন্তু ছেলের নিন্দে করতে পারব না।
তোর বুদ্ধিনাশ হয়েছে, বুঝলি! ছেলে-ছেলে করে হ্যাঁদাচ্ছিস, বলি কোন পেটে ধরেছিস ওই ধেড়ে ছেলেকে? গাণ্ডেপিণ্ডে গেলাচ্ছিস, গুরুঠাকুর বানিয়ে পারলে পুজো করিস, বলি আজ অবধি পাপমুখে একবারও মা ডাক বেরিয়েছে?
কথাটা ঠিক। মাকে আজও মা বলে ডাকেনি দাদা। এটা একটা কাঁটা হয়ে আছে মরণের মনের মধ্যে।
এত আয়োজন, তবু সুমন তেমন খায় না। খেতে বসে কেবল থাক থাক আর দেবেন না, বলে বাধা দিতে থাকে।
রান্না কি ভাল হয়নি বাবা?
রান্না? না রান্না তো বেশ ভালই। আমি বেশি খেতে পারি না।
এ কথাতেও মা আড়ালে দুশ্চিন্তা করে। মার কেবল ভয়, আদরযত্ন হচ্ছে না। কথাটা মরণও খুব ভাবে। তার এই প্রায়-অচেনা দাদাকে খুশি রাখতে তাদের আর কী কী করা উচিত সেটা বের করার চেষ্টা করে সে। আজও সে দাদাকে আপনি থেকে তুমি বলতে পারেনি।
তার ছোট বোনটার নাম দেওয়া হয়েছে হাম্মি। তার খুব হামা দেওয়ার নেশা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই খাট থেকে নেমে পড়ার জন্য হুড়োহুড়ি। সাতসকালে সারা ঘর হামা দিয়ে বেড়ায় সে। দোতলা থেকে পাছে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে সেইজন্য দোতলার সিঁড়ির মুখে কাঠের আগল লাগানো হয়েছে। হাম্মিকে যে একবারও কোলে নেয়নি বা একটুও আদর করেনি সুমন, এটাও লক্ষ করেছে তারা। হয়তো মায়ের ভয়টা মিথ্যে নয়। বাইরে ভদ্রতা বজায় রাখলেও ভিতরে ভিতরে সুমন হয়তো তাদের পছন্দ করে না।
সুমন আসার চার-পাঁচদিনের মাথায় একদিন সকালে হাম্মি হামা দিতে দিতে লম্বা বারান্দা পেরিয়ে সোজা গিয়ে সুমনের ঘরে ঢুকে পড়েছিল। তারপর কী হয়েছিল কেউ জানে না। হঠাৎ দেখা গেল বারান্দার কোণে সুমন দাঁড়িয়ে আছে, তার কোলে হাম্মি এবং সুমন তাকে কী যেন আঙুল তুলে দেখাচ্ছে আর কথা কইছে আর হাম্মি খুব অবাক হয়ে চেয়ে আছে।
উঠোন থেকে তার মা আর্তনাদ করে উঠল, ও বাবা হারু, তোমার ঘরে গিয়ে ঢুকেছিল বুঝি! পেচ্ছাপ-টেচ্ছাপ করে দেবে বাবা, ওকে নামিয়ে দাও।
হারু অর্থাৎ সুমন একটু হেসে বলল, তাতে কী? বাচ্চারা তো ওসব করেই। থাক আমার কাছে একটু।
থাকল হাম্মি। সম্পর্কের শীতলতা সে-ই ভাঙল প্রথম। আর তারপর থেকে সে রোজই নিয়মিত সুমনের ঘরে হানা দেয় এবং কোলে-টোলেও উঠে দিব্যি বসে থাকে।
ষষ্ঠীর দিন বিকেলে হইহই করে এসে পড়ল বাঙাল। সঙ্গে মুটে এবং মুটের মাথায় বোঝা। পুজোর জামাকাপড়, রাবড়ি, গলদা চিংড়ি, নতুন ফুলকপি, সোনামুগের ডাল আরও নানা জিনিসপত্র। উঠোনেই জামা খুলে বারান্দায় বসে হাওয়া খেতে খেতে উঁচু গলায় বলল, পূজা কাটাইল্যা দিনে কইলকাতায় পইড়া থাকে কেডা?
মা ঘোমটা দিয়ে চা করে নিয়ে এসে হাসি-হাসি মুখ করে বলে, অত কী এনেছ গো? পয়সা তোমাকে কামড়ায়?
চা খেতে খেতে বাঙাল নিমীলিত নয়নে চেয়ে বলে, তোমার লিগ্যা কিছু আনি নাই। তোমারে দেওনও যা, ভস্মে ঘি ঢালনও তা। বছর বছর যে শাড়িগুলি কিন্যা দেই হেইগুলি কি পাতিলের মইধ্যে গুইজ্যা রাখ নাকি? পরতে পার না?
মা ভারী লজ্জা পেয়ে বলে, আচ্ছা মানুষ যা হোক, অত দামি শাড়ি পরে কোথায় যাব বলো তো! আমি কি ঘর থেকে বেরোই? সংসার সামলাতে হয় না আমাকে?
বেনারসিখান কই?
সে তোলা আছে। বিয়েবাড়ি-টাড়ি নেমন্তন্ন হলে পরে যাব।
আর পরছ! তোমার পরনে তো হাউল্যা-জাউল্যা কাপড় ছাড়া আর কিছু দ্যাখলাম না!
এক ছড়া সোনার হার বের করে মার হাতে দিয়ে বাঙাল বলল, হেই লিগ্যা এইবার আর কাপড় আনি নাই। এইটা আনছি।
মার চোখ কপালে উঠল, ও মা গো! তাই বলে সোনার হার! কী কাণ্ড বাবা! এত খরচ করার কোনও দরকার ছিল বুঝি! সোনা-দানাই কি আমাকে পরতে দেখ?
রসিক বাঙাল একটু করুণ মুখে চেয়ে থেকে বলল, আইচ্ছা, তুমি কেমন মাইয়ালোক কও দেখি! কাপড় চাও না, সোনা-দানা চাও না, শ্যাষে কি বৈরাগী হইয়া যাইবা নাকি? তাহইলে তো সাড়ে সব্বনাশ! এই যৌবনে যোগিনীরে লইয়া আমি করুম কী?
মা হেসে ফেলল, আচ্ছা বাবা, পরবখন হার। তবে বাপু, বেশি দিও না আমাকে, আমি অত সামলাতে পারি না।
কথাটা শুনে রসিক বাঙালের মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটল। বলল, বুড়া বয়স লইয়া মাইনষের চিন্তা থাকে। কোনখানে পড়ব, কোনখানে মরব, কারে ভোগাইব, গু-মুতে নান্দিভাস্যি করব কিনা। তা বোঝলা, আমি বুড়া বয়সে আইয়া তোমার কাছেই মরুম।
ছিঃ, ষষ্ঠীর দিনটায় ওসব কী কথা! ওসব মুখে আনতে আছে?
রসিক বাঙাল মিটিমিটি হেসে বলে, আ গো, এইটা আহ্লাদের কথাই। তোমার মাথায় তো বুদ্ধি নাই, বলদা মাইয়ালোক, তুমি বোঝলা না।
পড়ার ঘর থেকে দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছিল মরণ। দুজন দুজনের দিকে অপলক চেয়েছিল কিছুক্ষণ। চা জুড়িয়ে যাচ্ছিল।
.
পৃথিবীর কোনও কোনও প্রাণী সহজেই পোষ মেনে যায়, আবার কোনও কোনও প্রাণী সহজে মানতে চায় না। যেমন কুকুর সহজেই বশংবদ হয়ে যায়, বেজি হতে চায় না।
বিজু কোথা থেকে একটা বাঁদর নিয়ে এসেছে। ছোট বাচ্চা। সরু শেকল পরিয়ে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে খুব। আজ অষ্টমী পুজোর সকালে সেটাকে কাঁধে নিয়ে এসে হাজির।
দেখো বড়মা, কেমন কিউট দেখতে। ভাল না?
বলাকার মোটেই পছন্দ হচ্ছিল না ব্যাপারটা। বললেন, তুই তো নিজেই বাঁদর, আবার একটা বাঁদরের দরকার কী?
আমার অনেক দিনের শখ বড়মা। বাজারে একটা লোক নিয়ে এসেছিল, পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কিনে ফেললাম।
ছিষ্টি অনাছিষ্টি করবে বাবা। কাঁধে নিয়ে ঘুরছিস, হেগেমুতে দিলে কী হবে?
সে তো মানুষের বাচ্চারাও করে ফেলে। তাতে কী? ট্রেনিং দিয়ে নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
না বাবা, ওসব আমার পছন্দ নয়।
হ্যাঁ বড়মা, তুমি কি শুচিবায়ুগ্রস্ত হয়ে গেলে নাকি? আগে তো এরকম ছিলে না। শুদ্ধাচার ভাল, শুচিবায়ু ভাল নয়।
কী জানি বাপু, আজকাল আমার যেন ঘেন্নাপিত্তি বড় বেড়ে গেছে। মনটা খুঁতখুঁত করে সবসময়ে। তোর জ্যাঠা চলে যাওয়ার পর থেকেই এরকম।
একটু কোলে নিয়ে দেখো না।
ও মা গো!
বিজু হি হি করে হাসে। বলে, পারলে না তো বড়মা। শুদ্ধাচারে নিজেকে গুটিয়ে রাখলে!
বলাকা মৃদু হাসলেন, বড্ড খিতখিত করে বাবা, ও আমি পারব না। তবে বাঁদরটা দেখতে কিন্তু বেশ। কেমন পিটপিট করে তাকাচ্ছে দেখ।
এদের এক প্রজাতিই তো আমাদের পূর্বপুরুষ ছিল। তাই কাঁধে নিয়ে বেড়াই।
আর একবারও তো একটা বেজি পুষেছিলি। সেটা পালিয়ে গেল জঙ্গলে।
হ্যাঁ। বেজি জাতটা একটু নেমকহারাম আছে।
এটাও না পালায়।
পালালে পালাবে। আমি ঠিক করে রেখেছি, একটু বড়-টড় করে ছেড়ে দেব। ইচ্ছে হলে থাকবে, না হয় চলে যাবে। দুনিয়াতে পার্মানেন্ট বলে তো কিছু নেই।
কত কথাই শিখেছিস। তা হ্যাঁরে বিজু, তুই কি শেষ অবধি ষণ্ডাগুণ্ডা হলি?
কেন বড়মা, হঠাৎ ওকথা কেন?
শুনতে পাই তুই নাকি মারপিট করিস?
ধুর! মারপিট করব কেন? কখনও-সখনও বেয়াদব লোকদের একটু-আধটু শাসন করতে হয়।
সোহাগ বলছিল। কয়েকটা পাজি ছেলে ওর পিছনে লেগেছিল বলে তুই নাকি মেরেছিস ওদের।
সোহাগটা কে? অমলদার মেয়ে নাকি?
হ্যাঁ।
বেশ বাহারি নাম তো!
একটু পাগলিমতো আছে, তবে মেয়েটা ভাল। ওসব আর করতে যাসনি। ছেলেগুলো গিয়ে ক্ষমা চাওয়ায় মেয়েটা লজ্জায় পড়েছে।
ফচকে ছেলেরা টিটকিরি দেয়, সেটা কি ও এনজয় করে নাকি?
কী জানি বাবা! বলছিল, কেউ ওকে প্রোটেকশন দেয় সেটা ওর পছন্দ নয়।
ওকে প্রোটেকশন দেওয়াটা তো বড় কথা নয়। গ্রামেরও তো একটা সমাজ আছে। বাইরে থেকে আসা একটা মেয়েকে টিটকিরি দেবে কেন? গ্রামের বদনাম হয় না!
এটা নারীবাদের যুগ বাপু, মেয়েরা বোধহয় পুরুষের সাহায্য নিতে পছন্দ করে না।
নারীবাদ কি তাই বড়মা যে, মেয়েরা নিজেদের সব সমস্যার সমাধান নিজেরাই করবে? পুরুষের সাহায্য লাগবে না? আমার তো মনে হয় নারীবাদের জন্য পুরুষের সাহায্য বেশিই লাগবে।
বলাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আমিও তো তাই জানি। তোর জ্যাঠার সঙ্গে এতকাল ঘর করে কখনও তো মনে হয়নি যে আমার আরও একটু পাখা মেলার দরকার। বাইরে থেকে তাকে অনেকে অত্যাচারী পুরুষ বলে ভাবত। খামখেয়ালি তো ছিলই একটু, কিন্তু অমন ভালবাসা যে বাসতে পারে তার সঙ্গে কি বিবাদ হয়? সে ঘিরে রেখেছিল বলে কখনও আঁচটুকুও গায়ে লাগেনি। পুরুষমানুষ মেয়েদের প্রোটেকশন দেবে না তো কে দেবে?
সোহাগকে বোলো, আমি ওকে বাঁচাতে কিছু করিনি, যা করেছি তা গ্রামের প্রেস্টিজ বাঁচাতে।
সে বলবখন, তুই আর ওর মধ্যে থাকিস না।
আচ্ছা বড়মা।
মনটা খারাপ হয়ে গেল বিজুর। এই গ্রামটাকে সে বুকের পাঁজরের মতো ভালবাসে। ইদানীং নেশাভাং, চুল্লুর ঠেক, সাট্টা, জুয়া, মদ আর বদমাইশি ঢুকে গেছে প্রচুর। সে তার মতো এই বেনোজল ঠেকাতে চেষ্টা করে।
.
আজ অনেক ভেবেচিন্তে একটা শাড়িই পরল সোহাগ।
কাল থেকে পিসি টিকির-টিকির করে যাচ্ছে, ও সোহাগ, কাল অষ্টমী পুজো, কাল একটা শাড়ি পরিস।
আমি যে শাড়ি পরতেই জানি না।
আমি পরিয়ে দেবখন।
শাড়ি পরে কী হবে বলো তো?
তোকে কেমন দেখায় একটু দেখব।
শাড়ি তো সবাই পরে, কী আর নতুন জিনিস হবে?
তুই তো পরিস না, তোকে নতুন রকমই দেখাবে। আমার কাছে আসিস চুল আঁচড়ে বিনুনি করে দেব। আমার সঙ্গে অঞ্জলি দিতে যাবি।
সোহাগ সাজতে ভালবাসে না। উলোঝুলো থাকতেই তার ভাল লাগে। মায়ের সঙ্গে এই নিয়ে তার কম যুদ্ধ হয়নি।
ভেবেচিন্তে সে আজ সকালে উঠে চান করেছে। পিসির ঘরে গিয়ে বলল, এবার কী করতে হবে বলো তো?
সন্ধ্যা এক গাল হেসে বলল, আয় তোর চুলটা আগে বাঁধি।
পিসি যত্ন করে চুল বেঁধে মুখটা তোয়ালে দিয়ে মুছে বলল, শাড়ি আছে?
আছে।
নিয়ে আয়।
সোহাগ তার মায়ের একখানা নীল সিল্কের শাড়ি নিয়ে এল।
এটা কেমন?
চমৎকার। ফর্সাদের সব রঙেই মানায়।
শাড়ি পরিয়ে কুঁচি ঠিক করতে করতে সন্ধ্যা বলল, কিছু খাসনি তো?
না।
তাহলে চল অঞ্জলি দিয়ে আসি। আজ অষ্টমীতে খুব ভিড় হবে।
স্টিলের আলমারির গায়ে লাগানো আয়নায় নিজেকে আপদমস্তক দেখে সোহাগ বলল, ওঃ পিসি! আই লুক ঘ্যাস্টলি?
কী বলছিস?
আমাকে যে ভীষণ বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে।
সন্ধ্যা হেসে বলল, তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। একদম অন্যরকম।
অন্যরকম কেন হব আমি? আমি তো আমার মতো হতে চাই।
তাই তো আছিস। শুধু বাইরেটাই যা অন্যরকম দেখাচ্ছে, তা বলে কি আর তুই সোহাগ নোস নাকি?
অন্যরকম হতে আমার ভাল লাগে না।
সে জানি। তুমি একটি জিদ্দি মেয়ে। কত খোশামোদ করে শাড়ি পরালাম, দয়া করে এখনই ছেড়ে ফেলো না। অঞ্জলিটা আগে দিয়ে আসি চল।
সোহাগ কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, আমাকে আজ আমার মাও বোধহয় চিনতে পারবে না।
মণ্ডপে এসে ব্যাপারটা খুব ভাল লাগছিল না সোহাগের। ভিড়, গরম, গণ্ডগোল আর অসহ্য ঢাকের বাজনা। কলকাতায় তারা পুজো দেখে বটে, কিন্তু সেটা সন্ধের পর এবং সেটা শুধু মজা দেখা মাত্র। এখানে সে অঞ্জলিও দেবে, যার কোনও মানে নেই।
ওমা! তুমি এসেছ! কী কাণ্ড! আমি তো তোমাকে চিনতেই পারিনি! এ যে একদম মেটামরফসিস!
এই বলে পান্না তাকে জড়িয়ে ধরল।
সোহাগ হেসে বলে, এ যেন ফ্যান্সি ড্রেস বলের পোশাক হয়ে গেল, না?
এ মা, তা কেন? তোমাকে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। মণ্ডপে যতগুলো মেয়ে আছে তার মধ্যে সেরা।
দিরি-দিরি-দিরি-দিরি করে ঢাকে একটা অদ্ভুত বাজনা শুরু হল।
পান্না বলল, এই রে! এবার বলি হবে। আমি ওসব দেখতে পারি না। চলো, একটু ওধারে যাই।
যেতে গিয়েই হঠাৎ সোহাগ এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল। শূন্যে উত্তোলিত খড়্গ, আর তার ওপাশে এক দীর্ঘ সুঠাম পুরুষ দাঁড়িয়ে। তার কাঁধে একটা বাঁদর। কয়েক পলক স্থির চেয়ে রইল সোহাগ।