৫১-৫৫. ভোরের কাছাকাছি

৫১.

গভীর রাত, না ভোরের কাছাকাছি তা বুঝতে পারছিল না অমল। তবে পাখিদের শব্দ নেই। চারদিক নিঃঝুম। আর হিমযুগের মতো শীত। আজকাল দিক ঠিক রাখতে পারে না সে। জানালা বন্ধ করে শোওয়ার অভ্যাস নেই বলে পায়ের দিকের জানালাটা খোলা রেখে দিয়েছিল সে। এখন ঘুম ভেঙে একটু ভেবে দেখল যে, ওটাই উত্তর দিক। আর সেইজন্যই এত হিম হয়ে আছে ঘরখানা।

হাতে ঘড়ি নেই। কটা বাজে বুঝতে পারছিল না সে। সময়ের বোধ তার ভিতরে আজকাল কাজ করে না। আগে করত। আগে ঘড়িতে বাঁধা জীবন ছিল তার। কখনও অফিসে যেতে দেরি হয়নি, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল হত না, ট্রেন বা প্লেন কখনও মিস করেনি সে। এখন সেই লোকটাকে আর চেনা বলেই মনে হয় না। মনে হয় ওটা পূর্বজন্ম।

অন্ধকারে উঠে বসল সে। সকালে সে কলকাতায় যাবে। কেন যাবে, গিয়ে কী হবে তা সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে না। মোনা ডিভোর্সের মামলা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ডিভোর্সই বা করতে চায় কেন? তারা যেমন পরস্পরকে মনে মনে প্রত্যাখ্যান করে এক ফ্ল্যাটেই বসবাস করছে ডিভোর্স কি তার চেয়ে বেশি কিছু লাভজনক হবে? এও তো ডিভোর্সই। এবং তারা যে যা খুশি করতে পারে। বিয়ে বা সম্পর্ক না মানলেই তো হয়। কোর্টকাছারি করার দরকারই বা কী। একগাদা পয়সা খরচ এবং অনভিপ্রেত পাবলিসিটি। মোনা আর তার মধ্যে বন্ধনই তো নেই, তা হলে এই ভাগভিন্ন হওয়ার পরিশ্রমই বা কেন?

লজিকটা খুঁজে পায় না অমল। ডিভোর্সের প্রয়োজন সম্পর্কে সে তেমন অবহিত নয়। তবু সে কলকাতা যাবে। কিছু সইসাবুদ করতে হবে হয়তো। করে দেবে অমল। তারপর মোনা সরে যাবে। তারপর কী হবে তা অমল জানে না।

উঠে সে বাতি জ্বালতে গিয়ে দেখল, বাতি জ্বলছে না। বাতি কেন জ্বলছে না সেটা খুব অবাক হয়ে বুঝতে চেষ্টা করল সে এবং অনেকক্ষণ পরে বুঝতে পারল, এখানে প্রায়ই সুইচ টিপলে বাতি জ্বলে না। এখানে লম্বা লম্বা লোডশেডিং হয়। তা হলে সেটা বুঝতে এত সময় লাগল কেন তার?

চেনা ঘর। হাতড়ে টেবিলের ড্রয়ার খুলে ঘড়িটা বের করল সে। রেডিয়াম ডায়ালের ঘড়ি অন্ধকারে বেশিক্ষণ থাকলে আর ঝলমল করে না, আলো নিভে যায়। ঘড়ির ডায়ালের দিকে চেয়েও তাই সময়টা বুঝতে পারল না সে। হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ বসে মশার কামড় খেল।

হঠাৎ নীচে কোথাও দরজার হুড়কো খোলার একটা শব্দ হল। কান খাড়া করে শুনল সে। একটা কাশির মৃদু শব্দ। তারপর কুয়োতলায় জলের শব্দ। বাবা উঠল নাকি? তা হলে এখন ব্রাহ্মমুহূর্ত। ভোর চারটে।

দপ করে আলো জ্বলে উঠল ঘরে। কারেন্ট এল।

খুব বেশি কিছু গোছানোর নেই তার। সম্বল একটা অ্যাটাচি কেস মাত্র। বাড়তি জামা-প্যান্ট অবধি নেই। বাবার দুটো পুরনো ধুতি চেয়ে নিয়ে তাই লুঙ্গির মতো করে পরতে হয় ঘুরিয়েফিরিয়ে। এসবে আর কোনও অসুবিধে হয় না তার। সম্মানে লাগে না। এক সময়ে লাগত। এক সময়ে সে দিনে দুবারও দাড়ি কামিয়েছে। এক সময়ে সে যা ছিল ভাবলে আজকের সে খুব অবাক হয়।

নীচে নামতেই মুখোমুখি বাবা। বাবার হাতে টর্চ। কোথায় যাচ্ছিস?

 কলকাতা।

 কলকাতা! তা এত ভোরে কেন?

যাই। সকালে যে গাড়ি পাব তাতেই যাব।

 এখানে এত ভোরে বাস পাবি কোথায়?

 পাব না?

 সাড়ে ছটা-সাতটার আগে বাস-টাস পাওয়া যায় না। খামোখা গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

যেন ভারী সমস্যায় পড়ল অমল এমন উদ্বেগের গলায় বলল, তা হলে?

সকাল সকাল যাওয়ার দরকার নাকি? তা হলে কাল যেতে পারতিস।

অমল অনেক ভেবে বলল, না, সকাল সকাল যাওয়ার দরকার নেই তো! ভাবলাম বেরিয়ে পড়ি, তাই বেরিয়ে পড়েছি।

বরং ঘরে এসে বোস। আর ঘণ্টা দেড়েক পরে বেরোলেই হবে। রাস্তাঘাট এখন অন্ধকার।

অমলের আপত্তি হল না। বাবাকে তার আজকাল ভালই লাগে। সংসারের সাতেপাঁচে নেই, নিজের মনে নিজের ঘরখানায় একাবোকা সময় কাটিয়ে দেয়। বায়নাক্কা নেই। নিজের মনেই পুজো-টুজো করে। কিন্তু বাড়াবাড়ি নেই। সোহাগ তার দাদুকে খুব পছন্দ করে। বলে, এ ম্যান অফ উইজডম। সোহাগ খুব কম লোককেই পছন্দ করে। দুনিয়ার বেশির ভাগ লোককেই সে সহ্য করতে পারে না।

বাবার ঘরটার মধ্যে যেমন ওম তেমনি একটা বেশ প্রাচীনতার গন্ধ। গন্ধটা কী দিয়ে তৈরি তা সে বলতে পারবে না। আসবাব বা জিনিসপত্রের কোনও বাহুল্য নেই। শুধু একখানা চৌকি, একখানা আলনা, দুটো কেঠো চেয়ার, একধারে কুলুঙ্গিতে ঠাকুরের আসন। হ্যারিকেনটা উসকে দেওয়ায় ঘরের দৈন্যদশা প্রকট হল।

বোস।

 অমল চেয়ারে বসল।

বউমার সঙ্গে কি বনিবনা হচ্ছে না তোর?

হ্যাঁ।

কী নিয়ে গণ্ডগোল?

কিছু নিয়ে নয়। সব নিয়েই।

 বড় বউমার কাছে শুনলাম ডিভোর্সের মামলা করবে। সত্যি নাকি?

হু। সেই রকমই তো কথা।

 তুই কি বউমার সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছিলি?

ঝগড়া! না, ঝগড়া করিনি তো!

তা হলে চলে এসেছিলি কেন?

ভাল লাগছিল না। ওদের কাছে থাকলে আমার কেবল ভয়-ভয় করে।

 ভয় করে?

হ্যাঁ।

ভয় তো করেই লোকের। আমারও তো ভয় হত।

 আপনার ভয় হত বাবা? হত না? তোর মাকে ভয় পেতাম, ছেলেমেয়েদের ভয় পেতাম। সব থেকে বেশি ভয় পেতাম তোকে।

আমাকে! বলে ভারী অবাক হয়ে বাবার দিকে চেয়ে থাকে অমল।

তোকে সবচেয়ে বেশি। পরীক্ষায় ভাল ফল-টল করলি। সে এত ভাল যে এ-বংশের কেউ কখনও স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। তার পর তোর নিজের মতামত হল। লোককে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে শিখলি। তখন তোকে এত ভয় হত যে কথাটথা বিশেষ কইতে পারতাম না। মানুষ যখন গৌরব করার মতো কিছু করে তখন তার অহংও বেসামাল হয়ে ওঠে কিনা। একটা জীবন আমারও তো কত ভয়ভীতি নিয়ে কাটল।

ভারী অবাক হয়ে অমল তার বাবার দিকে চেয়ে রইল। তাই তো! বাবা তো মিথ্যে কথা বলছে না। যখন স্কুলে সে ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বর পাচ্ছে, যখন মাস্টারমশাইরা তার মেধায় বিস্মিত এবং আপ্লুত তখন তার চারদিকে একটা ভয়, শ্রদ্ধা, সংশয় ও বিস্ময়ের বলয় কি রচিত হয়নি? ঘনিষ্ঠ তুইতোকারির বন্ধুরা পর্যন্ত যেন একটু সন্তর্পণে দূরে সরে যেতে লাগল। তাদের সাধারণ বোধবুদ্ধির জগতে হঠাৎ এক অতি-মগজ আবির্ভূত হওয়ায় তারা কিছুটা হতচকিত। এই তফাতটা সে তার বাড়িতেও টের পেতে শুরু করে। তার ভাইবোনদের ব্যবহারে, মায়ের পক্ষপাতিত্বে তার মেধার পূজা কি তখনই সে টের পায়নি? বাবার সঙ্গেও তখন থেকেই তার দূরত্ব শুরু হয়। সত্যি কথা বাবার বোধবুদ্ধি, পরামর্শ বা উপদেশকে তখন থেকেই সে তুচ্ছতাচ্ছিল্য এবং অগ্রাহ্য করতে শুরু করে। তার বাবা যে ইংরিজিতে এম এ পাস সেটাও বোধহয় সে গুরুত্ব দেয়নি।

হ্যাঁ, এসবই সত্য। কোনও ভুল নেই।

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবার দিকে চেয়ে বলল, আজ আমার পতন কি কোনও কর্মফল বাবা?

পতন! পতনের কথা বলছিস কেন?

আমার পতন আপনি দেখতে পান না?

মহিম অবাক হয়ে বলে, পতন আবার কীসের? চাকরি যায়নি তো!

না।

ডিভোর্সের কথা ভেবে বলছিস? সেটা তো আর একতরফা কারও দোষ নয়।

সেটাও বলছি না। আমার মাথাটাই যে ঠিক নেই। কী সব আবোল বোল ভাবি, বলি, আমার সব বোধবুদ্ধি যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কর্মফল কিনা বুঝতে পারছি না।

তোর চেয়ে অনেক বেশি অকাজ করেও কত লোক দাবড়ে বেড়াচ্ছে। তুই আর এমন কী করেছিস? আজকাল মা বাপকে ভক্তিশ্রদ্ধা করে আর কজন? ওসব নিয়ে ভাববার কিছু হয়নি। বউমার কথা বল। সে কী চাইছে?

ঠোঁট উলটে অমল বলে, কী জানি। একদিন এসেছিল। গটমট করে অনেক কথা বলে গেল। সবটা বুঝতে পারলাম না।

মহিম মশারি চালি করে তুলে ফেলে বিছানায় বসে ছেলের দিকে চেয়ে বলল, বুড়ো বয়সের এই একটাই কষ্ট। ছেলেপুলেরা কষ্ট পেলে স্বস্তি থাকে না।

আপনার বয়স কত হল বাবা?

 আশি।

অনেক বয়স, না?

হ্যাঁ। অনেক বয়স। সামর্থ্য থাকলে বয়সটা সমস্যা নয়। কিন্তু অপটু হয়ে পড়লে বয়স হল ভেজা কম্বল।

আপনার বয়সে আমি কোনওদিন পৌঁছব না। তার অনেক আগেই আমি যেন বুড়ো থুত্থুরে হয়ে গেছি।

তোর মনে শান্তি নেই বলে ওরকম মনে হচ্ছে।

শান্তি নেই কেন, সেটাই তো খুঁজে বেড়াচ্ছি। কী হল আমায় একটু বলুন তো!

মাথা নেড়ে মহিম বলে, সত্যি কথা বললে বলতে হয়, আমি জানি না। তোর জীবনটা তো অন্যরকম। অনেক বেশি জটিল, ঘটনাবহুল। তার ওপর শিক্ষাদীক্ষা, কালচারাল মিক্স-আপ, সেসব আমি কি আর বুঝতে পারব? তবে জানি, তোর ভিতরে অনেক গাদ জমে আছে। নিজের জোরে ঝাঁকি মেরে উঠে দাঁড়াতে পারছিস না। তাই তোর কষ্ট আড়াল থেকে দেখি। কিছু বলতে ভরসা পাই না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অমল বলে, আমার জন্য কারও কিছু করার নেই।

শুধু একটা কথা বলার আছে। ভেবে দেখতে পারিস।

কী কথা?

ডিভোর্স জিনিসটা ভাল নয়।

হুঁ।

অনেকক্ষণ বসে রইল অমল। বসে বসে ঘুমিয়ে পড়ল ঘাড় কাত করে।

মহিম করুণ চোখে দৃশ্যটা দেখে ফুলের সাজিটা নিয়ে উঠে গেল বাগানে। অনেক সময়েই তার মনে হয় কূপমণ্ডুক হয়ে এই গাঁয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া ঠিক হল না। দুনিয়াটাকে আরও একটু জানার আর বুঝবার দরকার ছিল। মানুষের যে কত রকমের জ্বালাপোড়া আছে তার খতেন নিতে পারলে আজ এই অচিন ছেলের জন্য একটা নিদান দেওয়ার মতো বোধবুদ্ধি গজাত।

ফুল তুলে ঘরে এসে মহিম দেখল, চেয়ার ফাঁকা। অমল চলে গেছে।

না, ছেলেটার জন্য তার কিছু করার নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় তার শরীর থেকে জন্মালে কী হয়, এই ছেলে যেন কোন আজব দেশের আজগুবি বাস্তবতার মানুষ, নিজের ছেলে বলে চেনা যায় না, ভারা। যায় না। ভাবটা, ভাষাটা অবধি বুঝে উঠতে পারে না মহিম।

.

অন্ধকার কাটেনি এখনও, তবে আবছায়া একটু ঘোলাটে আলো ক্ষীণ আভায় চারদিকের অন্ধকারকে একটু হালকা করেছে মাত্র। তবে কুয়াশা আছে। চারদিকের গাছপালা থেকে টুপটাপ শব্দে ঝরে পড়ছে হিম।

চণ্ডীমণ্ডপ ঘেঁষে এই রাস্তাটা দিয়েই সবাই বাসস্ট্যান্ডে যায়। পথটা একসময়ে খুব জঙ্গুলে ছিল। বর্ষাকালে জলকাদায় হাঁটাই যেত না। সাপ-খোপ, জোঁক বেরোত যখন-তখন। চণ্ডীমণ্ডপটা ভেঙে পড়েছিল প্রায়। পঞ্চায়েত হওয়ার পর রাস্তা বাঁধানো হয়েছে, চণ্ডীমণ্ডপ তৈরি হয়েছে নতুন করে। খুব আনমনে হলেও গাঁয়ের এইসব উন্নতি লক্ষ করে অমল। তাতে ভাল হয়েছে, না মন্দ, তা অমল বলতে পারবে না।

হঠাৎ খুব কাছ থেকে একটা বাজখাঁই গলার আওয়াজে চমকে উঠল অমল। বুকটা ধড়াস ধড়াস।

 আরে! বড়ভাই নাকি? কই চললেন মশয়?

এই কাকভোরের কুয়াশায় আলো বিশেষ ফোটেনি বটে, কিন্তু লোক চেনা যায়। রসিক বাঙালের গায়ে প্রিন্স কোট, মাথায় কান অবধি ঢাকা রাশিয়ান টুপি, গলায় মাফলার।

অমল কাষ্ঠহাসি হেসে বলল, কলকাতা যাচ্ছি।

আহেন, আহেন। লন, একলগেই যাই।

রসিক বাঙালকে তার কিছু খারাপ লাগে না। লোকটার মনের মধ্যে কোনও ঘুরঘুট্টি নেই, গোলোকধাঁধা নেই। লোকটা পয়সা রোজগার করতে ভালবাসে, খরচ করতে ভালবাসে, খেতে আর খাওয়াতে ভালবাসে। অমল একজন বউ নিয়েই হিমসিম খাচ্ছে, আর এই লোকটা দু-দুটো দুরকমের বউ সামাল দিয়ে দিব্যি বহাল তবিয়তে আছে। সে শুনেছে রসিকের একটা বউ বাঙাল, শহুরে এবং খাণ্ডার। অন্য বউটা ঘটি, গেঁয়ো এবং ভিতু। কী করে সামলায় কে জানে। হয়তো এও একটা প্রতিভা কিংবা এ একরকমের মস্তিষ্কহীনতা। সেটা যাই হোক, অমলের তা নেই।

দাড়িদুড়ি ফ্যালান নাই ক্যান মশয়? শোকাতাপা মাইনষের লাহান লাগে!

নিজের গালের খড়খড়ে দাড়িতে একটু হাত বুলিয়ে নিয়ে অমল বলল, ইচ্ছে হয়নি। আজকাল খেয়ালই থাকে না।

গালখান চকচকা থাকলে মাইনষে খাতির করে, বোঝলেন?

সেটা বোঝে অমল। ফিটফাট থাকার যে দাম আছে সেটা তার মতো আর কে জানে। তবে কিনা, সে সেই যুগ পার হয়ে এসেছে।

সে মৃদু স্বরে বলল, হু।

শীত লাগে না আপনের বড়ভাই?

অমল মাথা নেড়ে বলল, লাগে। শীতটা খুব পড়েছে এবার।

আমার ব্যাগে একখানা আলোয়ান আছে, দিমু আপনেরে?

লজ্জা পেয়ে অমল বলে, আরে না, তার দরকার নেই।

ঘিন্না পাইলেন নাকি বড়ভাই? ধোয়াকাচা আলোয়ান, গন্ধ-গুন্ধ পাইবেন না।

অমল বাঙালের দিকে চেয়ে বলল, আপনি বড় ভাল লোক তো!

কী যে কন বড়ভাই! এই কাল ঠান্ডাটার মইধ্যে আপনের গায়ে তো দ্যাখত্যাছি একখান স্যান্ডো গেঞ্জির মতো সোয়েটার। অসুখ-বিসুখ কইরা ফালাইব। নামডাকের মানুষ আপনে, আপনের লগে লগে যে হাটত্যাছি, কথা কইত্যাছি হেইরে কি কম কথা নাকি?

রসিক দাঁড়িয়ে তার ব্যাগের চেন খুলে আলোয়ানটা বের করল।

বেশ নরম, মোলায়েম নস্যি রঙের ওম-ওলা চাদরখানা গায়ে জড়াতেই ভারী আরাম বোধ করল অমল। বলল, বাঃ, বেশ আলোয়ানটি তো!

আইজ্ঞা, পাঞ্জাবের জিনিস। আলোয়ানটা পরম স্নেহে অমলের গায়ে ঠিকঠাকমতে জড়িয়ে দিতে দিতে রসিক বলল।

রসিককে ধন্যবাদ দেওয়ার কোনও মানেই হয় না, ওসব রসিক বাঙাল বুঝবে না। কিন্তু অমল ভারী কুণ্ঠিত এবং কৃতজ্ঞ বোধ করছিল। এ লোকটার জন্য কখনও সে কিছু করেনি, কখনও করবেও না হয়তো। কিন্তু আজ তার ভারী ইচ্ছে করছে কিছু প্রতিদান দিতে। সেটা কীভাবে দেওয়া সম্ভব তা অবশ্য মাথায় এল না তার। কিন্তু কুষ্ঠাটা রয়ে গেল।

আসোয়ানখান লইয়া যান বড়ভাই। আপনেরে দিলাম। একরকম নূতনই কইতে পারেন। গায়ে দিলে মাঝেমইধ্যে আমাগো কথা মনে পড়ব।

না না, আমার আলোয়নের দরকার নেই। আপনি জোর করে গায়ে দেওয়ালেন বলে দিলাম।

জানি বড়ভাই, আপনের মেলা আছে।

 শাল আলোয়ান তো আমার লাগে না।

আইচ্ছা মশয়, কইলকাতায় গিয়া ফিরত দিলেই হইবে। অখন লন একটু গরম চা খাই দুইজনে। বাস আইতে মেলা দেরি।

আলোয়ান গায়ে দিয়ে এখন আরামের চেয়ে অস্বস্তিই বেশি হচ্ছে অমলের। রসিক তাকে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড আলোয়ান দান করতে চাইল কেন? সে কি ওর এতটাই করুণার পাত্র? আচ্ছা বেয়াদব তো লোকটা! মন থেকে কৃতজ্ঞতা আর কুণ্ঠার ভাবটা তো উড়ে গেলই, বরং কান গরম হয়ে উঠছিল অপমানে।

আজকাল নিজের বোধ, বুদ্ধি, আবেগের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই অমলের। অপমানের বোধটা তীব্র ঝিঁঝি পোকার মতো আওয়াজ করছিল মাথার মধ্যে। সে অসুস্থ হয়ে পড়বে নাকি?

বাসস্ট্যান্ডে চায়ের দোকান কম করেও চার-পাঁচটা। ভোরবেলার যাত্রীরা এই শীতকালে চা খায় বলে সকালেই দোকানে উনুন ধরানো হয়েছে। খদ্দেরও আছে মন্দ নয়।

আহেন মশয়, শীতলের দোকানে বহি। হ্যায় চা-টা খুব ভাল কইরা বানায়।

শীতলের দোকানের বেঞ্চে বসে পড়ল অমল। তার এখন গরম লাগছে। তার এখন ভাল লাগছে না। বসেই চাদরটা খুলে ফেলে পাশে জড়ো করে রাখল সে। রসিক লক্ষ করল না। সে তখন শীতলকে বোঝাচ্ছে, আমার লগে কেডা বইয়া আছে জাননি শীতল? মস্ত মাপের মানুষ। গ্রামের মানুষ তোমরা, এই মানুষের দাম তোমরা কী বুঝবা! অখন ভাল কইরা চা বানাইয়া খাওয়াও তো বাবুরে।

শীতল দাস একটু বিরক্ত হয়ে বলে, কার কথা কইছেন বাবু? এ যে মায়ের কাছে মাসির গপ্পো। অমলকে আমি এত্তটুকুন বেলা থেকে চিনি। ওদের বাড়ির চেলাকাঠ ফেড়ে দিতুম, মহিমকর্তার সঙ্গে মাছ ধরতে বড় ঝিলে গেছি কতবার। অমল তখন কতটুকু? ব্যাঙাচির লেজ খসল এই তো সেদিন। পাস-টাস করে জলপানি পেয়েছিল, বিলেত গেল, এই তো সেদিনের কথা সব। বিয়েতে নেমন্তন্ন খেয়েছিলুম।

বাঙালরা না চেঁচিয়ে কথা কইতে পারে না, তাদের হাসি মানেই অট্টহাসি। রসিকের গলা যেমন বাজখাই, হাসিও তেমন বিকট। সেই হাসিটা হেসে রসিক বলল, খুব চিনছ হে শীতল! আমি কই, বাবুরে ল্যাংটাবেলা থিক্যা তো দেইখ্যা আইতাছ, কিন্তু মানুষটার দাম জাননি? কত বড় বহরের মানুষ হেইটা নি ট্যার পাইছ কোনওদিন? যাউকগা, কথা বাড়াইয়া লাভ নাই। চা-খান একটু প্রেমসে বানাও দেখি।

দুজনের এই ছেলেমানুষি চাপান-উতর শুনতে শুনতে অমলের চিনচিনে অপমানবোধটা উবে গেল। খানিকটা হেঁটে এসেছে বলে শরীরটা গরম হয়েছিল বটে, কিন্তু এখন ভোলামেলা রাস্তার পাশে বসতেই উত্তুরে হাওয়ায় কেঁপে উঠছিল অমল। না, বাঙাল তাকে অপমান করতে চায়নি বোধহয়। আসলে লোকটার আদরের প্রকাশ ওরকমই। কাণ্ডজ্ঞান কম হলেও রসিক লোকটা তেমন খারাপ নয়। এই তো সেদিন তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে কত যত্ন করল।

আলোয়ানটা ফের গায়ে জড়িয়ে নিল অমল। তার তেমন অপমান লাগছে না আর।

রসিক তার পাশে বসে বলল, বড়ভাই, কিছু মনে কইরেন না, মুখোন শুকনা লাগে ক্যান? কিছু হইছে নাকি?

না, কিছু হয়নি। এমনিই মনটা ভাল নেই।

গ্রামের মাইনষে নানান আকথা-কুকথা কয়।

একটু অবাক হয়ে অমল বলে, কী বলে তারা?

কয় যে আপনের লগে নাকি ওয়াইফের বনে না। মামলা মোকদ্দমার কথাও শুনি! নাকি?

অমল স্নান একটু হেসে বলে, হ্যাঁ।

মাইয়ালোক লইয়া সমস্যা কার নাই মশয়? যত ঝুট-ঝঞ্জাট তো তারাই পাকাইয়া তোলে। তবে কিনা মাইয়ালোক বশ মানলে এক্কেবারে গঙ্গাজল। তারাই তখন বৃষ্টির দিনের ছাতা, শীতের বালাপোশ, গরমের শীতলপাটি। বোঝলেন?

বুঝলাম। তবে আমি তো ওসব পেরে উঠিনি।

ঝঞ্ঝাট কি আমারও কিছু কম গেছে মশয়? মাইরধইরও খাইছি, কিন্তু ডিভোর্স করি নাই। বিয়া করা বউ, তারে ছাড়ুম ক্যান কন? জজসাহেব রায় দিলেই হইব? তা হইলে তো বিষয়সম্পত্তি ছাইড়্যা ল্যাংটা চ্যাংটা হইয়া বিবাগী হইয়া যাইতে হয়। বউও আমার সম্পত্তি, পাজি হউক ব্যাচইল্যা হউক, তারে ছাড়ুম ক্যান?

জোর করে কি রাখা যায়?

আরে মশয়, কথায়ই তো আছে জোর যার মুল্লুক তার। আমি যখন বাসন্তীরে বিয়া করলাম তখন বড়বউ মেলা চিল্লামিল্লি করছিল, উকিলবাড়ি হাঁটাহাঁটিও শুরু করল। আমি তখন কইলাম আমি যদি আরও চাইরটা বিয়াও করি তবু তোমারে ছাড়ুম না। দেখি তুমি কেমনে যাও!

এতটা মস্তিষ্কহীন হওয়া তার পক্ষে সম্ভব কিনা তা একটু ভাবতে গিয়ে হেসে ফেলল অমল। বলল, হা, ওভাবেও হয়তো হয়। গুহামানবদের যুগে হত।

আইজও হয় মশয়। না হইলে আমার দুই সংসার টিক্যা আছে কেমন কইরা। নেন, চা খান। লগে দুইখান মুড়মুড়া বিস্কুট খাইবেন নাকি? টোস্ট বিস্কুট খাইতে কিন্তু আচিমিৎকার।

আচিমিৎকার শব্দটা ভারী নতুন ঠেকল অমলের কানে। বলল, না, কিছু খেতে ইচ্ছে করেছে না। আপনি খান।

যারা মাথার কাম বেশি করে তাগো ক্ষুধা কম।

অমল বলল, না না, আমার তো ভীষণ খিদে পায়।

নাকি? ক্ষুধা পাওন ভাল। আমি তো রাইক্ষসের মতন খাই। বড়ভাই, একখান কথা কমু?

 বলুন না।

আপনের পোলাপান কয়টা?

দুটো। এক ছেলে, এক মেয়ে।

দুর মশয়, আপনের মতো মাইনষের পোলাপান যত বেশি হয় ততই ভাল।

 কেন?

মগজওলা মাইনষের পোলাপানও মগজওলাই হয়। দুঃখের কথা কী জানেন, আমাগো দ্যাশে ছোটলোকগুলারই পোলাপান বেশি হয়। তাতে লাভ কী কন? দ্যাশে ছোটলোকের সংখ্যা বাড়ে।

রসিকের এইসব বৈপ্লবিক কথাবার্তায় একটু হাসে অমল। তারপর মৃদুস্বরে বলে, আমার মগজ এখন আর কাজ করে না।

চা খেয়ে তারা উঠল। বাস আসছে।

ভারী যত্ন করে তাকে হাত ধরে বাসে তুলল রসিক। সকালের বাস বলে এতটা ফাঁকা। তাকে টিকিটটা অবধি কাটতে দিল না রসিক। বলল, আরে মশয়, টিকিটের দাম আর কয়টা পয়সা, হগ্নলেই দিতে পারে। মাইনষের দাম দেই ক্যামনে?

অমল জোরাজোরি করল না। সেটা পণ্ডশ্রম হবে।

বউয়ের লিগগ্যা কী লইয়া যাইবেন মশয়?

অবাক হয়ে অমল বলে, কিছু নেব না তো!

 ওইটাই তো ভুল করেন বড়ভাই।

 তাই নাকি? কেন বলুন তো!

মাইয়ালোকে জিনিসপত্র পাইতে ভালবাসে। তাগো কাছে খালি হাতে যাইতে নাই। যা হউক একটু কিছু লইয়া যাইতে হয়।

অমল অবাক হয়ে বলে, ওর জিনিসপত্র সব তো ও-ই কেনে, এমনকী আমার জিনিসপত্রও কেনে। আমি কেনাকাটা পারি না।

রসিক হেসে বলে, আপনেরে লইয়া আর পারুম না মশয়। আমার বউও তো গড়িয়াহাট থিক্যা বড় বাজার ইস্তক টানা মাইরা হাবিজাবি কিন্যা ঘরবাড়ি ছিটাল করতাছে। তবু মশয় আমি তার লিগ্যা কিছু না কিন্যা ঘরে ঢুকি না। যেদিন আর কিছু না পারি এক ঠোঙ্গা চিনাবাদাম কিন্যা লইয়া যাই। খুশি হয়, বোঝলেন! খুশি হয়। জিনিসটা বড় কথা না, আসল হইল অ্যাটেনশন। তারে যে ভুইল্যা যাই না এইটা হইল তার প্রমাণ।

তাই বুঝি?

হ বড়ভাই। পিরিতের সার কথাই হইল লেনদেন। যত লেনদেন তত আঠা। লেনদেন ছাড়া পিরিত হইল বন্ধ্যা। বোঝলেন! যতই মিঠা মিঠা কথা কন না ক্যান, শুকনা লাগব। লগে একখান গোলাপফুল গুইজা দেন, দ্যাখবেন মুখে হাসি ফুটছে।

স্ত্রীর জন্য উপহার কেনা এই ব্যাপারটিকেই অমলের মস্তিষ্কহীনতা বলে মনে হয়। ঘুষ ছাড়া সেটাকে আর কী বলা যায়? জিনিসের উপযোগই বা কতক্ষণ থাকে?

বউ কি কম নাকি বড়ভাই? সাক্ষাৎ ভগবতী। মাঝে মাঝে খাণ্ডারনি হইয়া খাড়য় ঠিকই, কিন্তু তারাই তো বাচ্চা দেয়, সংসার বাইন্ধ্যা রাখে। কী কন? কাইজ্যা করে আবার আগলাইয়াও তো রাখে।

বর্ধমানে পৌঁছে আবার তাকে লজ্জায় ফেলল রসিক। অমলের টিকিটও সেই কেটে ফেলল চট করে।

এটা বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে রসিকবাবু।

দুই-চাইরটা টাকা লইয়া মাথা ঘামাইয়েন না বড়ভাই। বড় বড় জিনিস লইয়া চিন্তা করেন। পাবলিকের কি আপনের লিগ্যা কিছু করনের নাই?

অমল ভদ্রতার লড়াই পারবে না জেনেই আর কথা বাড়াল না।

বেশি ভোরের ট্রেন বলেই ভিড় ছিল না তেমন। কোণের সিটে তাকে ঠেলে বসিয়ে দিয়ে রসিক বলল, এইবার জুইৎ কইরা বইয়া ঠাইস্যা একটা ঘুম দেন। আমিও ট্রেনে উঠলেই ঘুমাই।

কথাটা ভারী পছন্দ হল অমলের। সে খাঁজের মধ্যে মাথা রেখে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল।

হাওড়ায় যখন নামল তখন সোয়া নটা।

লন, আপনেরে একটা ট্যাক্সিতে উঠাই দিয়া যাই।

আমি ধরতে পারব ট্যাক্সি।

আপনি হজ্ঞলই পারবেন। কিন্তু আমারও তো করন উচিত।

বাবা যেন ছোট ছেলেটিকে আগলে নিয়ে যাচ্ছে এমনভাবেই রসিক তাকে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে নিয়ে এসে বসিয়ে দিল ট্যাক্সিতে। অমল বলল, আপনিও তো বড়বাজারেই যাবেন? চলুন নামিয়ে দিয়ে যাই।

আরে না, আমার তো হাঁটা রাস্তা। একটু মর্নিং ওয়াকও হইয়া যাইব।

 অমল আর সাধাসাধি করল না। সে এসব পেরে ওঠে না।

 ট্যাক্সি বাড়ির দিকে রওনা হতেই বুকে একটা দুরুদুরু শুরু হল অমলের। সামনেই কি যুদ্ধক্ষেত্র? ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসব? কোন ধুন্ধুমার অপেক্ষা করছে তার জন্য? তার মুখের কথা ক্রমে ফুরিয়ে যাচ্ছে। তার মনেও আজকাল কথা আসে না। তার মন কি ধীরে ধীরে বোবা হয়ে যাবে? গেলেই ভাল। গেলেই শান্তি।

বাইরে হিজিবিজি কলকাতা শহর বয়ে যাচ্ছে। সকালের কবোষ্ণ রোদেও বাইরেটাকে বাস্তব মনে হয় না তার।

যেতে যেতে দূরত্ব কমছে। বাঘিনীর গর্জন শোনা যাচ্ছে কি নেপথ্যে? মাটিতে ল্যাজ আছড়ানোর শব্দ? গায়ের গন্ধ? বাতাসে কি বারুদের ঘ্রাণ?

গড়িয়াহাটার কাছে সে চেঁচিয়ে উঠল, থামো! থামো!

তাড়াহুড়ো করে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল সে।

সবে বেলা দশটা। দোকানপাট এখনও খোলেনি। তবু সামনে যে দোকানটা ভোলা পেল তাতেই ঢুকে পড়ল সে। দোকানে এখন ধূপধুনো দেওয়া হচ্ছে। প্রস্তুত নয়। সে শো-কেসে সাজানো শাড়ি দেখতে লাগল। শাড়ির কিছুই বোঝে না সে। কেনেওনি কোনওদিন। তবু দেখতে লাগল।

একটা বাফ রঙের শাড়ির ওপর জমকালো এমব্রয়ডারির কাজটা বেশ পছন্দ হল তার।

 এটার দাম কত?

আড়াই হাজার।

 অ্যাটাচি কেস খুলে টাকাটা দিয়ে দিল সে।

.

৫২.

শাড়ি কেনাটা একটু নাটকীয় হয়ে গেল নাকি?

তা হোক। তার জীবনে তো কোনও নাটকীয়তা নেই। নিতান্তই ভ্যাতভ্যাতে ঘটনাহীন জীবনযাপন। মদ্যপান ছাড়া নিজের লেভেলকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

গড়িয়াহাটার মোড় থেকে সে জটিল কলকাতার দৃশ্য দেখল খানিক। চট করে বাড়িমুখো হতে পারল না। শাড়িটার জন্যই বাড়ি যেতে একটু লজ্জা হচ্ছে তার। কোনওদিন এভাবে কিছু উপহার দেয়নি মোনাকে। কী বলবে, কী বলতে হয় বা আনুষ্ঠানিকভাবে কী করে উপহার দিতে হয় তা তো অমল জানে না। তাই পা চলছিল না তার। মোন কি বিদ্রূপের হাসি হাসবে? ঘুষ বলে মনে করবে? গ্রহণ করবে, নাকি ছুঁড়ে ফেলে দেবে আক্রোশে, এইসব জরুরি প্রশ্ন ও সমস্যায় ভারী পীড়িত হচ্ছিল সে।

রসিক বাঙালের কথাকে গুরুত্ব দেওয়াটা কি ঠিক হল?

এর পর যা-ই ঘটুক, তার তো হারানোর কিছু নেই। এই ভেবে সে বাড়ির দিকে পা বাড়াল, গড়িয়াহাট থেকে তার বাড়ি হাঁটাপথ। শীতের রোদে কলকাতা এখনই বেশ তেতে উঠেছে। গাঁয়ে শীত অনেক বেশি। রোদ যেন তেজালো হতেই চায় না। অমল খুব আস্তে আস্তেই হাঁটছিল। মনে মনে একটু প্রস্তুতির দরকার, একটু রিহার্সাল। কিন্তু ইদানীং তার মুখে কথাই আসতে চায় না। অনেক অন্যায় অভিযোগেরও যথাযোগ্য জবাব দিতে পারে না সে।

শোওয়ার ঘরে কন্ডোম পাওয়ার পর তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মোনা। তার গূঢ় সন্দেহ, তার অনুপস্থিতিতে অমল অন্য মেয়েমানুষ এনেছিল ফ্ল্যাটে। অমল সেই অভিযোগের জবাবই দিতে পারল না। আজও রহস্যময় সেই ঘটনাটার সমাধান খুঁজে পায়নি। সমাধান খুঁজে বের করার জন্য মাথাও ঘামায়নি সে। নিজেকে কলঙ্কমুক্ত করার কোনও তাগিদ সে আর অনুভব করে না। সে যা আছে তা-ই আছে, ক্রমে ক্রমে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। এই অস্ত থেকে আর উদয় হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।

একটি থান-পরা বুড়ি ভিখিরি তার সামনে এসে মুখপানে চেয়ে হঠাৎ বলল, ও তুমি! তুমি তো বাপু দাও না।

বলে বুড়ি পিছু ফিরল। গড়িয়াহাটার প্রায় সব ভিখিরিকেই মুখ চেনে অমল। তবে কস্মিনকালেও সে কাউকে ভিক্ষে দেয় না। ভিক্ষে করা ব্যাপারটাকেই যে ভীষণ অপছন্দ করে।

আজ হঠাৎ মনে হল, এ-দিনটা অন্য রকম হোক। সে ডাকল, ও বুড়ি! ও বুড়ি মা!

বুড়ি একটু অবাক হয়ে ঘুরতেই অমল পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে বলল, নাও।

বুড়ি বলল, ও বাবা! দশ টাকা!

 বুড়িটা একটু ঠ্যাটের মানুষ। আশীর্বাদ-টাশির্বাদ করল না। এরকম ভাল। ভড়ং নেই।

 অমল একটু হাসল।

যত বাড়ির কাছাকাছি হচ্ছিল অমল তত অস্বস্তি বাড়ছে। যত নষ্টের গোড়া এই শাড়িটা। এটা না কিনলে অনেক সহজ হত ফেরাটা। কিন্তু যতই যাচ্ছে ততই যেন শাড়িটা বোঝা হয়ে উঠছে। জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকী এসব তাদের নেই। কেন কে জানে প্রথম থেকেই ওসব পালন-টালন করে না তারা। ফলে উপহারের ঝঞ্ঝাটও নেই। পুজো উপলক্ষে কিছু কেনাকাটা করা হয় বটে, কিন্তু সেটা মোনা একাই করে। কেন তারা বিবাহবার্ষিকী বা জন্মদিন পালন করে না সেটাও অমল বলতে পারবে না। কিন্তু অন্যেরা করে এবং অন্যের বিবাহবার্ষিকী বা জন্মদিনে তারা নেমন্তন্নও খেয়েছে।

এমনকী নিজের ছেলেমেয়ের জন্মদিনও পালন করে না মোনা। কথাটা এখন হঠাৎ মনে পড়ায় অমল একটু অবাক হয়। মোন কি একজন সংস্কারমুক্ত মহিলা? তার কি কোনও সেন্টিমেন্ট নেই? এসব প্রশ্ন আগে অমলের মনে আসেনি, আজ এই শাড়ি কেনার সূত্রে এসব অনেক প্রশ্ন মনের তলায় স্থিতাবস্থা থেকে হঠাৎ ভুড়ভুড়ি কেটে উঠে আসছে। মোনাকে হয়তো আর একটু স্টাডি করা উচিত ছিল তার। কাছাকাছি বাস করেও হঠাৎ মোনাকে কেন যে এত অচেনা মনে হচ্ছে।

ফ্ল্যাটবাড়িতে পৌঁছে সে দেখল, গ্যারাজে তার গাড়িটা নিশ্চল পড়ে আছে। গায়ে ধুলোর পুরু আস্তরণ পড়েছে। ড্রাইভারটাকে হয়তো ছাড়িয়ে দিয়েছে মোনা। নইলে সে এসে রোজ গাড়িটা ঝাড়পোঁছ করত।

লিফটে ওপরে উঠতে উঠতে নিজের বোকা-বোকা ভাবটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছিল অমল। তাতে আরও বোকা-বোকা লাগতে লাগল নিজেকে।

ডোরবেলের সুইচে হাত দিয়ে আবার একটু দ্বিধা।

তারপর ডোরবেলের মিষ্টি শব্দটা বেজে গেল ভিতরে। ল্যাচ ঘোরানোর শব্দ।

 দরজায় মোনা। পরনে হাউসকোট, একটু অবাক চোখ।

দরজাটা ছেড়ে তাকে ভিতরে যেতে দিল মোনা। তারপর দরজাটা প্রায় নিঃশব্দে বন্ধ করে দিয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ওটা কার চাদর গায়ে দিয়ে এসেছ! এটা তো আমাদের চাদর নয়!

চাদরের কথাটা খেয়ালই ছিল না অমলের। মেয়েদের চোখ এড়ানো মুশকিল।

থতমত খেয়ে বলল, রসিকবাবু দিল।

 রসিকবাবুটা আবার কে?

গাঁয়ের একজন লোক।

নাক কুঁচকে মোনা বলল, অন্যের চাদর গায়ে দিতে ঘেন্না হল না?

অমল কথাবার্তার এই ঝোঁকটা চালিয়ে যেতে চায়। নইলে সহজ হওয়া যাবে না। মোনার সঙ্গে একমত হয়ে বলল, ঘেন্না করছিল, উনি জোর করে দিলেন।

ওটা খুলে রাখো, কেচে ফেরত দিয়ে দিতে হবে।

 অমল সঙ্গে সঙ্গে বাধ্য ছেলের মতো চাদরটা খুলে ফেলল।

শাড়ির বাক্সটা দেখে মোনা অবাক হয়ে বলল, ওটা কী?

অমল খুব কাঁচুমাচু হয়ে বলল, তোমার জন্য।

আমার জন্য!

হ্যাঁ।

আমার জন্য কী?

 তোমার জন্য আনলাম।

মোনা কিছুক্ষণ বড় বড় চোখে তার দিকে চেয়ে বলল, কী ওটা?

একটা শাড়ি।

 হঠাৎ?

এমনি পছন্দ হয়ে গেল। তাই।

ডিভানের ওপর থেকে বাক্সটা তুলে নিল মোনা। বাঁধন খুলে বাক্সর ঢাকনা তুলে দেখল প্রথমে। তারপর শাড়িটা বের করে আলোয় একটু খুলে দেখে নিয়ে তার দিকে তাকাল।

অমল জানে, শাড়িটা ওর পছন্দ হবে না। সে তো আর শাড়ি চেনে না। চোখে যেটা লেগেছে সেটাই কিনে এনেছে। মেয়েদের পছন্দ-অপছন্দের খবর সে আর রাখল কই?

কিন্তু তাকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে মোনা শাড়িটা নিরীক্ষণের পর বলল, বাঃ, বেশ পছন্দ আছে তো তোমার!

খারাপ হয়নি তো!

নাঃ, খুব আনইউজুয়াল রং। কাজটাও ভারী সুন্দর। কে পছন্দ করে দিল?

 কেউ না।

তুমি নিজেই পছন্দ করলে?

হ্যাঁ।

হঠাৎ আমার জন্য শাড়ি কেনার কী হল?

এমনি। মনে হল, তোমাকে তো কখনও কিছু দিই না।

 সেটাই তো আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। হঠাৎ ঘটা করে শাড়ি-টাড়ি দিলে কেমন যেন সন্দেহ হয়।

সন্দেহ! সন্দেহ কীসের মোনা?

অতি-ভক্তি চোরের লক্ষণ কিনা।

চোরা মারটা হজম করে নিল অমল। দুজন মুষ্টিযোদ্ধা যখন লড়ে তখন তারা পরস্পরকে মারে এবং পরস্পরের মার হজমও করে। দুটোই দরকার। শুধু মারতে জানলেই হয় না, অম্লান মুখে মার হজমও করতে পারা চাই।

আমি কিছু ভেবে কিনিনি কিন্তু। হঠাৎ ইচ্ছে হল তাই।

নাকি কেউ বুদ্ধি পরামর্শ দিচ্ছে আজকাল!

অমল ভয় পেল। কথা যেভাবে এগোচ্ছে তাতে মোনা তাকে কোণের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। এরকম চললে হয়তো সে কবুল করে ফেলবে যে, নিজের বুদ্ধিতে সে কাজটা করেনি।

আচ্ছা, একটু চা-টা কিছু কি পাওয়া যাবে? খুব ভোরে বেরিয়েছি, গাড়িতে ভীষণ ঠান্ডা লাগছিল।

মোনা তার দিকে সেকেন্ড দুয়েক চেয়ে রইল। মেয়েদের মন, শত শত্রুতা থাকলেও একটা জায়গায় দুর্বল। তারা যে পুরুষের আশ্রয়দাত্রী এটা শেষ অবধি ভুলতে পারে না।

বাইরের জামাকাপড় বদলাও। চা দিচ্ছি।

আমার খুব খিদেও পেয়েছে।

 জানি। পাওয়ারই কথা। হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়ার টেবিলে বোসো।

তুমি কি বাড়িতে একা? ওরা কই?

দুজনেই স্কুলে গেছে। বাসুদেব তিন দিনের ছুটি নিয়েছে।

ওঃ, তাহলে?

তাহলে কী?

 চা-টা করবে কে?

 কেন, আমি কি নুলো, না অচ্ছুৎ?

কষ্ট হবে।

বাব্বাঃ, আমার কষ্টের কথা ভেবে তেরাত্তির ঘুম হবে না বোধহয়?

তা নয়।

 একা ঘরে আমাকে আবার ভয় হচ্ছে না তো! ঘাড় মটকে দিই যদি!

অমল হাসল। বলল, তোমাকে ভয় কীসের?

তা তো জানি না। চোখমুখ দেখে তো মনে হচ্ছে বাড়িতে আর কেউ নেই জেনে খুব অস্বস্তিতে পড়েছ।

তা পড়েছে অমল। কিন্তু সেটা তার মুখভাবে প্রকাশ পাচ্ছে জেনে তার আরও দুশ্চিন্তা হচ্ছে, সে বোকার মতো বলল, না না, আমি ভীষণ টায়ার্ড।

মোনার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না অমল।

তাকে এই অস্বস্তিতে বেশিক্ষণ রাখল না মোনা। হঠাৎ ঝটকা মেরে মুখ ফিরিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল।

অমল শোওয়ার ঘরে এসে পোশাক পালটাল। মস্ত আয়নায় তার প্রতিবিম্ব দেখতে পেল হঠাৎ। দাড়ি-গোঁফ এবং বড় চুলে তাকে বনমানুষের মতো দেখাচ্ছে। তবু ভাল। তার চেহারায় এমনিতে কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। তার উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুটের চেয়েও একটু কম। হিল পরে পাশে হাঁটলে মোনাকেও তার চেয়ে লম্বা লাগে। তার গায়ের রং ময়লা না হলেও ফর্সা নয়। মুখশ্রী নয় আকর্ষক। বন্য পুরুষালি আকর্ষণ তার একটুও নেই। দাড়ি-গোঁফ হওয়ায় বরং একটু কৃত্রিম বন্যতা এসেছে। দাড়ি-গোঁফের একটা আরোপিত গাম্ভীর্যও আছে।

কিছুক্ষণ নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে রইল অমল। হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বরে চমকে উঠল সে। কে যেন বলে উঠল, উই আর ইন ট্রাবল। উই আর ইন এ জ্যাম।

কে বলল কথাটা? ঘরে দ্বিতীয় কেউ তো নেই! তাহলে কি সে নিজে?

হ্যাঁ, কথাটা বোধহয় সেই বলেছে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে অমল। কী আর করা।

একা এই ফ্ল্যাটে সে আর মোনা। যেন বাঘিনী আর তার শিকার। ছেলে-মেয়েরা থাকলে হয়তো কিছু ডাইভারশন থাকত। তারা নেই, ফলে একা অমলের ওপরেই মোনা তার শব্দভেদী বাণগুলো প্রয়োগ করবে। বড্ড ভয়-ভয় করছে তার। একসময়ে যৌবনে মোনার সঙ্গে তার মাঝে মাঝেই তর্ক বা ঝগড়া হয়েছে। তখন মোনাকে তার ভয় হত না। এখন হয়। এখন সে মানসিকভাবে দুর্বল, শারীরিকভাবেও। তার ভিতরে কোনও লড়াই আর অবশিষ্ট নেই। মোনা দয়া করে যদি তাকে বাক্যবাণ থেকে রেহাই দেয়। এই দয়াটুকু সে হাঁটু গেড়ে বসে চাইবে কি?

বাথরুমে হাতমুখ ধুতে গিয়েছিল অমল। কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে ভাবতে লাগল, স্নান করে নেবে কিনা। সিদ্ধান্ত নিতে বেশ সময় লাগে তার আজকাল। খুব সামান্য বিষয় নিয়েও তার মন দুভাগ হয়ে দুরকম মত প্রকাশ করতে থাকে।

 বাথরুমের দরজায় একটু শব্দ।

কে?

 তোমার হল? কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে যে!

 ও আচ্ছা।

 সে শাওয়ারটা খুলে নীচে দাঁড়িয়ে গেল। বোধহয় আরও কিছু শীতলতাই তার দরকার।

 স্নান করে একরকম ভালই লাগছিল তার। শরীরে একটু কাঁপুনি হচ্ছে বটে, কিন্তু বেশ লাগছে।

বেরিয়ে এসে দেখল, খাওয়ার টেবিলে মোনা কফি সাজিয়ে বসে আছে।

পরোটা আর আলুভাজা খাবে?

অমল হ্যাঁ বলবে কিনা ভাবতে লাগল।

আমি বলি এত বেলায় ভারী জলখাবারের দরকার নেই। বরং একবারে ভাত খেও। এখন বিস্কুট দিয়ে কফি খাও। কেমন?

এই আশ্চর্য সদ্ব্যবহারে বিগলিত হয়ে গেল অমল, বলল, সেই ভাল।

তুমি কি স্নান করলে?

হ্যাঁ।

শীতে কাঁপছ৷ তোমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। গিজারে গরম জল তো ছিল, নাওনি?

না। খেয়াল হয়নি।

আজকাল তোমার মন কোথায় থাকে?

কফি একটু চলকে গেল অমলের। নরখাদকদের দুন্দুভি বেজে উঠল নাকি? ঝলসাবে, তারপর ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে, হাড়গোড় চিবোবে।

দুপুরে কী খাবে?

 নতমুখে অমল বলল, যা হয়।

আমি রাঁধতে যাচ্ছি। বাসুদেব চলে যাওয়ায় বাজারহাট হচ্ছে না। ডিপ ফ্রিজে শুধু খানিকটা মাছ আছে।

ব্যগ্র হয়ে অমল বলল, ওতেই হবে। ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই।

আমি রাঁধতেও ভুলে গেছি। তোমার মুখে রুচবে কি না জানি না।

একসময়ে তোমার রান্নাই তো খেতাম। চিন্তার কিছু নেই।

চিন্তার আছে বইকী! রান্না মনের মতো না হলে আবার হয়তো না বলেকয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে।

অমল নতমুখে বসে রইল।

তোমার একটা চাকরি আছে, সেটা ভুলে যাওনি তো! তারা তোমাকে মোটা মাইনে দেয়। সেখানে তোমার বেশ দায়িত্বের কাজ আছে বলেই শুনেছি। তোমার কি ধারণা তারা এরপর থেকে তোমাকে মুখ দেখে মাইনে দেবে?

অমল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কথাটা মিথ্যে নয়। তার কোম্পানি তাকে বিরাট অঙ্কের মাইনে দেয়। কিন্তু চাকরি করার জন্য একটা মোটিভেশন দরকার। সেটা কোথায় যে উবে গেছে কে জানে। তার কেবলই মনে হয় তার আর কিছু দেওয়ার নেই। তার বিদ্যা, তার বুদ্ধি, তার উর্বর মস্তিষ্ক কিছুই আর কাজ করে না।

দয়া করে অফিসে একটা ফোন করো। এই ভদ্রতাটুকু তারা আশা করতেই পারে। পরশুদিন তোমাদের এম ডি ফোন করে তোমার হোয়ারঅ্যাবাউটস জানতে চেয়েছিলেন। আমাকে এক গাদা মিথ্যে কথা বলতে হল।

কী বললে?

বললাম ওঁর বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় দেশের বাড়িতে গেছেন। সেই সঙ্গে এও বলতে হল যে, আমরাও গাঁয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম এবং সেখানে ফোন নেই। ইত্যাদি। ভদ্রলোক বলেছে, ফিরে এসে তুমি যেন ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করো।

ঠিক আছে।

তোমার ভাল-মন্দ তুমি বুঝবে। কিন্তু আমার মনে হয়, তোমার এখন বয়স হচ্ছে। নিত্যনতুন চাকরি করা তোমার পক্ষে কি ভাল হবে? এরা যদি তোমাকে ছাড়িয়ে দেয় তা হলে কী করবে তুমি? আর একটা নতুন চাকরি তো? সেটা যদি কলকাতায় না হয়ে দিল্লি, বোম্বে বা ব্যাঙ্গালোরে হয় তা হলে আবার এখানকার বাস তুলে আমাদের অন্য জায়গায় গিয়ে সেটল করতে হবে।

এই প্রথম অমল মোনার চোখের দিকে সরাসরি চাইল। চেয়ে রইল। কী বলছে মোনা? তার শেষ বাক্যটায় আমাদের শব্দটা ছিল না? তার মানে কি ডিভোর্সের কথা ভুলে গেছে মোনা? সিদ্ধান্ত বদল করেছে? বুকটা ধুকপুক করছিল তার।

অমল আলটপকা বলে উঠল, আচ্ছা আমরা, মানে আমাদের এই পরিবারে কখনও জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকী করিনি, না?

ভীষণ অবাক হয়ে মোনা তার দিকে চেয়ে রইল। তারপর বলল, হঠাৎ এ কথা কেন?

 এমনি, মনে হচ্ছিল।

না, ওসব ফর্মাল ব্যাপার আমার ভাল লাগে না। পার্টি-টার্টি আমার কোনওদিনই পছন্দ নয়। তুমিও তো কখনও বলোনি ওসব করতে।

না না, এটা আমার কোনও অভিযোগ নয়। জাস্ট কৌতূহল। অনেকেই ওসব সেলিব্রেট করে কি না তাই।

ভ্রূ কুঁচকে মোনা বলল, সেলিব্রেশনের কী আছে বুঝি না বাবা। একটা বিশেষ তারিখে জন্মানো বা বিশেষ দিনে বিয়ে করা কী এমন একটা আহামরি ব্যাপার যে বছর বছর সেটার জন্য আহ্লাদ করতে হবে!

তা তো ঠিকই।

তোমার কি এখন জন্মদিন বা ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি করতে ইচ্ছে হয়েছে নাকি?

 আরে না। ফরগেট ইট।

 হঠাৎ এমন এক একটা প্রশ্ন করো যে চিন্তায় ফেলে দাও। তোমার হল কী বলো তো!

কিছু হয়নি।

 কেউ নতুন কোনও ফর্মুলা দেয়নি তো!

কীসের ফর্মুলা?

গৃহশান্তির!

না, কেউ এ ব্যাপারে কিছু বলেনি আমাকে।

একবার তো শুনেছিলাম আমার জা তোমাকে একটা ফর্মুলা শিখিয়েছিল।

কী বলো তো!

তোমাকে শেখায়নি বউয়ের সঙ্গে এক বিছানায় শুলে ভাব হয়?

 অমল সামান্য লজ্জা পেয়ে বল, ওঃ হ্যাঁ, বউদি গাঁয়ের মেয়ে, তার সেকেলে সব ধারণা।

 তাই ভাবছিলাম এই নতুন ফর্মুলাটা আবার কেউ শেখাল কি না।

ফর্মুলা নয়। আজ হঠাৎ তোমার জন্য শাড়িটা কেনার পর মনে হচ্ছিল তোমাকে কোনও অকেশনে কিছু কখনও দিইনি। তখনই ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি আর বার্থ ডে-র কথা মনে হল।

তুমি আমাকে আজ খুব অবাক করে দিয়েছ। তোমার হঠাৎ শাড়ি নিয়ে ঘরে ঢোকার দৃশ্যটা আমার অনেক দিন মনে থাকবে।

অমল কফিটা শেষ করে বলল, শাড়িটা কি পছন্দ হয়নি?

 সেটা পরের কথা! শাড়ি নিয়ে আসাটাই তো অভিনব ব্যাপার। কত দাম নিল?

আড়াই হাজার।

গড়িয়াহাটার এই দোকানটা দাম একটু বেশিই নেয়।

তা নিক। এটাই তো প্রথম।

হ্যাঁ। তবে তোমার ভয় নেই। শাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।

অমল একটু তৃপ্তির হাসি হাসল।

খুশি হয়েছ?

 মোনা হঠাৎ করুণ একটু হেসে বলল, খুশিই তো হওয়ার কথা।

কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ।

তারপর মোনা বলল, ভাবছি শাড়িটার বদলে তোমাকে এখন আমি কী দিই!

 অমল ব্যস্ত হয়ে বলে, আরে না, আমাকে আবার তুমি কি দেবে?

মোনা একটু হেসে বলল, আমি তো আর রোজগার করি না যে নিজের পয়সায় তোমাকে কিছু কিনে দেব। যা দেব তা তো তোমার পয়সাতেই কেনা। সে দেওয়ার কথা তো বলিনি।

তা হলে?

তা ছাড়াও কি কিছু দেওয়ার নেই?

অমল একটু ধন্দে পড়ে বলে, কিছু দিও না মোনা, প্লিজ। শোধবোধ হয়ে গেলে কি দেওয়ার আনন্দ থাকে?

একটা রহস্যময় হাসি হেসে মোনা বলল, থাকতেও পারে।

এত দ্রুত ঘটনাটা ঘটে গেল যে প্রস্তুত হওয়ার সময়ই পেল না অমল। চেয়ার থেকে উঠে হঠাৎ একটা ঝলকের মতো তার ওপর এসে পড়ল মোনা। দুটো হাতে গলা জড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল। ওই আলিঙ্গনের ধাক্কায় ডাইনিং টেবিলের পলকা চেয়ার উলটে পড়েই যেত অমল। মোনাই পড়তে দিল না তাকে। ধরে রইল।

পরের পনেরো মিনিট তারা কোনও মনুষ্য ভাষায় কথা কইল না। দুজনের মুখ দিয়ে শুধু অদ্ভুত জান্তব সব শব্দ বেরিয়ে এল। কীভাবে হলঘর থেকে শোওয়ার ঘরের বিছানা অবধি এল তারা তাও স্পষ্ট মনে নেই অমলের।

পনেরো মিনিট পরে তাদের দুজনেই সামান্য হাঁফাচ্ছিল। শিথিল বাহুতে তখনও ধরে আছে পরস্পরকে।

মোনা মৃদু হেসে বলল, শোধ হল?

 অমল স্নান একটু হেসে বলল, শোধবোধের দরকার কী?

আমি কেমন?

তুমি! তুমি তো ভালই।

এই বয়সেও আমার শরীরে একটুও ফ্যাট নেই, দেখেছ? দুটো ছেলেমেয়ের মা হওয়া সত্ত্বেও!

দেখেছি। তুমি বোধহয় ব্যায়াম করো।

করি। তুমি আমার কোনও খবর রাখে না।

অমল উঠল। দীর্ঘ দিনের পর স্বামী-স্ত্রীর এই হঠাৎ মিলন যে কোনও সমস্যারই সমাধান করতে পারে না তা সে জানে। শরীরে শরীর মিশিয়ে দিলেই কি দূরত্ব ঘোচে? সাহেবরা বলে লাভ মেকিং। আদিখ্যেতা, মিথ্যাচার। সেক্স হ্যাজ নাথিং টু ডু উইথ লাভ। সাহেব শালারা ওসব বোঝে না। ওদের ভালবাসা বড় বেশি লিঙ্গ-নির্ভর। বউ নিয়ে যেমন লোক-দেখানো আশনাই করে, হনিমুনে যায়, তেমনি টপাটপ খারিজও করে দেয় পরস্পরকে।

মোনা আর তার যা সম্পর্ক তাতে কবেই ডিভোর্স হয়ে যেতে পারত, হয়নি, তারা সাহেবদের মতো নয় বলেই।

পাশাপাশি খাট থেকে পা ঝুলিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল তারা। নগ্ন, চুপচাপ।

খিদে পায়নি?

না তো! এই তো কফি খেলাম।

খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে মোনা বলল, তোমাকে শেভ করতে বলিনি, কেন জানো?

কেন?

দাড়ি আর গোঁফে তোমাকে বেশ ভালই লাগছে। দাড়িটা বরং রাখো, তবে ট্রিম করা দরকার।

অমল মোনার দিকে চেয়ে বলল, আমাকে কি তুমি সত্যিই ডিভোর্স করতে চাও?

 মোনা একটু গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, তুমি চাও?

 আমি! না তো! আমি চাই না।

কেন চাও না? এ সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে কী লাভ?

সেটা ভেবে দেখিনি কখনও। কিন্তু মনে হয় সম্পর্ক ভেঙে দিয়েও তো কোনও লাভ নেই।

মোনা উঠে অলস হাতে হাউস কোটটা তুলে নিয়ে বলল, আমি ডিভোর্স চেয়েছিলাম ঠিকই। উকিলের পরামর্শও নিয়েছিলাম। কাগজপত্র তৈরি হচ্ছিল। একদিন বিকেলে সোহাগ বলল, তুমি বাবাকে ডিভোর্স করতে চাইছ, করো, কিন্তু তোমার কি ধারণা তোমাদের দুজনের সম্পর্ক শুধু তোমাদের দুজনকে নিয়েই? স্বামী আর স্ত্রী? তার মধ্যে কি আমরাও নেই? আমাদের এতকাল একসঙ্গে থাকার অভ্যাস নেই? বিয়ের এত বছর পরও যদি তোমাদের মনে হয় যে ইট ইজ এ ফেইল্ড ম্যারেজ তা হলে তার জন্য তো তোমরাই দায়ি। আর সেজন্য তোমাদের প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। ট্রাই এগেইন টু রিকনস্ট্রাক্ট ইট।

বিস্মিত অমল বলল, সোহাগ!

হ্যাঁ। কথাগুলো আমার কাছে অদ্ভুত শোনাল। তারপর আমি কেবল কদিন ধরে ভেবেছি। তাই তো! স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা তো শুধু তাদের দুজনের নয়। তাদের জড়িয়ে আরও কত কিছু গড়ে ওঠে। সবসময়ে যে ভালবাসা থাকবেই তাও তো নয়। থাকে দায়দায়িত্ব, থাকে কর্তব্য, থাকে নির্ভরতা। সংসার গড়ে তোলা কি কম কথা? দাবার খুঁটি হলে না হয় হাটকে আটকে দেওয়া যায়।

অমল চুপ করে মোনার দিকে চেয়ে রইল। এ কথা ঠিক যে, এই ভদ্রমহিলার প্রতি তার তেমন কোনও আকর্ষণ নেই, একে খুশি করার কোনও উদ্যমও নেই তার, একে গভীরভাবে জানার চেষ্টাও সে কখনও করেনি। তবু মোনা যদি চলে যায় তা হলে একটা অদ্ভুত শূন্যতার সৃষ্টি হবে। সেটা বোধহয় তার ভাল লাগবে না।

মোনা ভারী উদাস গলায় বলে, সোহাগের ধারণা আমি চলে গেলে তুমি বেশি দিন বাঁচবে না, একদিন বলছিল, বাবা তোমাকে ভালবাসে কিনা আমি জানি না, কিন্তু তুমি চলে গেলে বাবা ঠিক মরে যাবে। নিজের দেখাশোনা করার মতো শক্তিই বাবার নেই। না খেয়ে-খেয়ে, অযত্নে শেষ হয়ে যাবে লোকটা। নিজের ভাল-মন্দ বাবা তো বুঝতে পারে না।

নিজেকে ভারী বেকুবের মতো লাগছিল অমলের। এরা তাকে নিয়ে ভাবে তা হলে? একটু হলেও ভাবে! সে তো ধরে নিয়েছিল, সে মরে গেলেও এদের তেমন কিছু যাবে আসবে না।

মোনা বিষণ্ণ মুখে বলল, তুমি আমাকে চাও বা না চাও, আমি তবু ওদের মুখ চেয়ে সিদ্ধান্ত বদল করেছি। আরও কিছুদিন দেখা যাক। কী বলো?

হ্যাঁ, মোনা, আরও কিছুদিন দেখা যাক।

কী করব আমরা?

 তা তো জানি না। তুমি যা বলবে আমি তাই করতে রাজি।

 লক্ষ্মীছেলে হয়ে গেলে নাকি?

না মোনা। লক্ষ্মীছেলে নয়। আমার মাথা বিভ্রান্ত, বুদ্ধি ঘোলাটে, চিন্তা বিক্ষিপ্ত, আমি নিজে কোনও সিদ্ধান্তই নিতে পারি না আজকাল। আমার মনে হয়, কারও ওপর নির্ভর করাটা এখন বড্ড দরকার, কিন্তু কার ওপর করব মোনা? আমার তো কোনও বন্ধু নেই!

আমারও মনে হচ্ছে তুমি ঠিক স্বাভাবিক নেই।

 না। আমি স্বাভাবিক নেই।

মোনা তার দিকে নিবিড় স্নিগ্ধ চোখে চেয়ে থেকে হঠাৎ বলল, একটা সত্যি কথা বলব?

বলো।

ঠিক এখনই কিন্তু তোমাকে আমার সবচেয়ে ভাল লাগছে। এত ভাল কখনও লাগেনি।

.

৫৩.

ব্রহ্মচারী মারা যাওয়ার পর বিজু আর তার ঘরে চড়াইপাখিদের বাসা করতে দিত না। খড়কুটো নিয়ে চড়াইপাখিরা তবু চেষ্টা কিছু কম করেনি। তাদের লক্ষ্য ছিল বিজুর ঘরে সিলিং-এর কাছ বরাবর বইয়ের তাক। বইগুলো তেমন কাজের নয়। কিন্তু বিজুর স্বভাব হল সে কখনও তার পুরনো, বাতিল কোনও বই আজ অবধি ফেলে দিতে পারেনি। এমন কী তার স্কুলের পাঠ্য বই-খাতা সে জমিয়ে রেখেছে। সেগুলোই ওই ওপরের তাকে সাজিয়ে রাখা। চড়াইপাখিদের খুবই প্রিয় জায়গা ওটা। নাগালের বাইরে একটু ঘিঞ্জি, ঘুপসি জায়গায় তারা বাসা করতে ভালবাসে।

কিন্তু বিজু খড়কুটো জড়ো হতে দেখলেই সেগুলো ফেলে দিত। তাতে পাখিরা সাময়িক নিরস্ত হলেও হাল ছাড়েনি কখনও। বারবার চেষ্টা করে গেছে। শেষ অবধি হাল ছেড়েছে বিজুই। ছাদের ঘরে সে একদম একা। মাঝে মাঝে মোতি নামের বেড়ালটা এসে বিজুর বিছানায় আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে বটে, কিন্তু বিছানায় বেড়ালের অনুপ্রবেশ একদম পছন্দ করে না বলে বিজু মোতিকে তাড়িয়ে দেয়। মোতির অভ্যাসটা খারাপ করেছে বিজুর মা। আদুরে বেড়ালকে বিছানায় নিয়ে শোয়া তার অভ্যাস। বিজু মাকে অনেক বকেও অভ্যাস ছাড়াতে পারেনি। মোতি তবু মাঝে মাঝেই নির্লজ্জের মতো আসে এবং একবার বিজুর ঘরে সন্তান প্রসবের চেষ্টাও করেছিল। শেষ অবধি মোতির উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। ছানাপোনা নিয়ে সে আজকাল নীচেই থাকে। তবে মাঝে মাঝে এসে গম্ভীরমুখে ঘরে একটু হাঁটাহাঁটি করে যায়। সেটা তার অধিকার প্রতিষ্ঠাও হতে পারে, বিজুর ওপর মায়াও হতে পারে।

যাই হোক, বিজুর ঘরে চড়াই বা বেড়াল কিছুই ছিল না। এখন চড়াইপাখিরা বাসা করেছে। বিজুর প্রতিরোধ একটু একটু করে মায়াবশে ভেঙে যাচ্ছিল। কে না জানে মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হল এই মায়া। আবার কে না জানে মায়াই হয়তো মানুষের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুও।

কিন্তু চড়াইয়ের বাসা থেকে যে বিজুর আর এক অশান্তি শুরু হবে তা কে জানত? ঘরের সর্বত্র পুরীষ ত্যাগ এবং পালকের ওড়াউড়ি তো আছেই। তা ছাড়া মাঝে মধ্যেই ডিম ভেঙে পড়া এবং চড়াইছানার আকস্মিক পতন হল আর এক দুশ্চিন্তার কারণ। প্রথম যে চড়াইছানাটা পড়ে গিয়েছিল সেটাকে সযত্নে বইয়ের তাকের বাসায় পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করেছিল বিজু। কিন্তু চড়াইরা বোধহয় পতিতজনকে আর গ্রহণ করে না। তুলে দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ক্রুদ্ধ চড়াইরা সেটাকে ফের ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। বারকয়েক পতনের পর অক্কা পেল সেটা। সদ্য-উড়তে শেখা একটা ছানা কীভাবে যেন জখম হয়ে মেঝেয় পড়ে রইল একদিন। হাঁটতে পারে, কিন্তু উড়তে পারে না। তাকে ধরতে গেলেই খাট বা টেবিলের নীচে পালায়। অবশেষে ধরেও জখমটা ঠিক বুঝতে পারল না বিজু। চড়াইপাখি যে কী খায় তাও তার জানা নেই। অগত্যা খানিকটা চাল এনে ছড়িয়ে দিল মেঝেতে। ছোট বাটিতে জল। দেখা গেল পাখিটা জলে একটু-আধটু মুখ দিলেও চাল খাচ্ছে না। কী যে মুশকিল হল বলার নয়।

মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ মা, চড়াইপাখি কী খায় জান না?

 কে জানে বাবা কী খায়। পোকামাকড়ই খায় বোধহয়। কেন, চড়াই পড়েছে নাকি?

হ্যাঁ।

 সে তো নীচের ঘরেও কতবার পড়েছে।

 সেগুলোর গতি কী হয়েছে?

গতি আর কী হবে। মোতিই মুখে করে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসে।

 মোতিটা একটা যাচ্ছেতাই তো।

 তা ওকে দোষ দিয়ে কী হবে। যার যা স্বভাব। বরং ধানুকে জিজ্ঞেস কর। ওরা আদিবাসী, কাকপক্ষী খুব চেনে।

ধানুর বয়স বছর কুড়ি-বাইশ। কালো, রোগাটে চেহারা। সে চেঁকি, উদুখল আর কাঁচাকুচির জন্য বহাল হয়েছে। বেশি কথা কয় না, নিঃশব্দে কাজ করে।

কুয়োপাড়ে ধানু কাপড় কাঁচছিল। ডাক শুনে উঠে এল।

 হ্যাঁ রে ধানু, চড়াইপাখিরা কী খায় জানিস?

কেন গো, চড়াই দিয়ে কী হবে?

 বল না।

পোকা খায়, ঘাসের বীজ খায়, ভাতও খায়, ওদের কোনও ঠিক নেই।

আমার ঘরে একটা চড়াইপাখি পড়ে গেছে। বাচ্চা পাখি। কী করব বল তো!

সাদা দাঁত দেখিয়ে হাসল ধানু, বলল, ও কি আর বাঁচবে?

কেন বাঁচবে না?

ওম না পেলে বাঁচে না।

দুর, তুই কিছু জানিস না।

 বেশি খেতে দিও না কিন্তু, বেশি খেলে তাড়াতাড়ি মরে যাবে। একটু ভাত দাও। আর জল।

তাই দিল বিজু। অনেকক্ষণ সংকোচের সঙ্গে পালিয়ে থেকে অবশেষে পাখিটা এসে ভাত ঠোকরাতে লাগল। জলও খেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বিজু। কিন্তু এ-ঘরে মোতির আনাগোনা আছে এবং তার আগমন-নিষ্ক্রমণের পথ বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। দরজা বন্ধ রাখলে মোতি জানালা দিয়ে আসবে। জানালা বন্ধ রাখলে পাখিদের যাতায়াত বন্ধ হবে। ঘুলঘুলি আছে বটে, কিন্তু তাতে জাফরি দেওয়া বলে পাখি আসতে পারে না। কী যে মুশকিল হল পাখিটাকে নিয়ে।

মোতির হাতে নয়, পাখিটা দিন তিনেক বাদে মরে গেল। ঝি ঘর ঝাট দিতে এসে টেবিলের তলা থেকে মরা পাখিটাকে বের করল। বিজুর চোখে জল এসে গিয়েছিল ঘাড় লটকানো, চোখ ওলটানো পাখিটাকে দেখে। মায়া যে কী সর্বনেশে জিনিস! দুদিন মন খারাপ রইল তার। একটা পাখিকে বাঁচানোর মতো সামান্য এলেমও তার নেই কেন? এই সীমাবদ্ধ জ্ঞান নিয়ে বেঁচে থাকাটা তো একটা ডিসক্রেডিট।

জ্যাঠা তাকে ওকালতিতে জুতে দিয়ে গিয়েছিল। গৌরহরির প্রায় সব আইনের বই-ই নিয়ে এসেছে সে। গৌরহরির ঘনিষ্ঠ এক উকিলের জুনিয়র হয়ে কিছুদিন কাজ করেছে। এখন দু-একটা মামলা নিজেও করে, অবাক কাণ্ড হল গৌরহরির মক্কেলরা আজকাল তার কাছেই আসতে লেগেছে। এক মক্কেল তাকে বলে ফেলল, মশাই, আমি স্বপ্নে দেখেছি, চাটুজ্যেমশাই বলছেন, ওহে বিজুর কাছে যাও, আমি বিজুর ওপরেই ভর করব।

জ্যাঠামশাই ভর করুন বা না করুন বিজু কথাটার প্রতিবাদ করেনি। মক্কেল আসছে, এটাই বড় কথা। সংখ্যায় তারা বেশি নয়, পাঁচ সাতজন, অন্যরাও লক্ষ রাখছে। হাতযশ দেখলে তারাও এসে জুটবে। নিজের ভবিষৎ জ্যাঠামশাইয়ের কল্যাণে খুব একটা অনুজ্জ্বল দেখছে না বিজু। ওকালতি কাজটা তার ভালও লাগে। কলম পেষার চেয়ে ঢের ভাল। উত্তেজনা আছে, থ্রিল আছে, জয়-পরাজয়ের আনন্দ ও দুঃখ আছে। একঘেয়ে তো নয়।

গাঁয়ের বাড়িতে মক্কেল আসবে না বলে পুজোর পরই বর্ধমানে জি টি রোডের ওপর দোতলায় একখানা ঘর ভাড়া নিয়ে চেম্বার খুলেছে বিজু। কোর্টের পর সেখানেই বসে আজকাল।

সেদিন জনা চারেক লোক ছিল চেম্বারে। মামলামোকদ্দমার ব্যাপার নয়, এরা এমনিই গল্পসল্প করতে আসে। দু-একজনের কেস করেছে বিজু। পাখিটা মরে যাওয়ায় মনটা সেদিন ভাল ছিল না। সে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা চড়াইপাখিদের লাইফ স্টাইল সম্পর্কে আপনারা কেউ কিছু জানেন? আমার একটা সমস্যা হয়েছে। ঘরে চড়াইপাখি বাসা করেছে। কিন্তু মাঝে মাঝে চড়াইয়ের বাচ্চা পড়ে যায়।

একজন আঁতকে উঠে বলল, চড়াইপাখি! ও তো নুইসেন্স মশাই। তাড়িয়ে দিন! তাড়িয়ে দিন! বাসা ভেঙে আঁটাপেটা করে তাড়ান। অতি অসভ্য পাখি। ঘরদোর নোংরা করবে। কোনও কাজের পাখি তত নয়। রাধাকৃষ্ণ বলবে না, দেখতেও হতকুচ্ছিত, পোষ মানাতেও পারবেন না। এক্ষুনি বিদেয় করুন।

ননীবাবু মৃদু একটু প্রতিবাদ করে বললেন, না না, ওরকম করাটা ঠিক হবে না। চড়াইপাখি বাসা করাটা নাকি সুলক্ষণ। সেই বাড়িতে লক্ষ্মীশ্রী থাকে। মা-ঠাকুমার কাছে তাই তো শুনেছি।

বিজু মাথা নেড়ে বলে, আমি ওসব কুসংস্কার মানি না। আমার প্রবলেমটা হচ্ছে হিউম্যানেটেরিয়ান গ্রাউন্ডে।

চড়াই-বিরোধী লোকটা বলে, চড়াইপাখির সঙ্গে আবার হিউম্যানিটি কী মশাই? তাও যদি বুঝতুম যে চড়াইয়ের মাংস খাওয়া যায়। তাও যখন নয় তখন ওদের জন্য হিউম্যানিটি দেখানোর কোনও মানে হয় না। দুনিয়ার নিয়ম কী জানেন? ভাল ভাল জীবজন্তুগুলো সব এক্সটিংট হয়ে যায়, আর নিঘিন্নে, বাজে, ফালতু, নোংরা স্পেসিসগুলো সংখ্যায় বাড়ে। ডোডো পাখি এক্সটিংট না হয়ে চড়াই হলে কী ক্ষতি ছিল বলুন তো!

চড়াইপ্রেমী ননীবাবু এ কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, যার হিউম্যান ফিলিংস আছে সে সব জীবজন্তুর প্রতিই সিমপ্যাথি ফিল করে। আর চড়াই মোটেই কোনও ভিলেন পাখি নয়। হাত থেকে রসগোল্লা ছো মেরে নেয় না বা ঠোক্কর মারে না। ছোট, নিরীহ একটা পাখির ওপর আপনার যে কেন এত আক্রোশ!

আক্রোশ-টাক্রোশ নয় মশাই। শুধু বলছি চড়াই এক উৎপাত। এদেশে এত গাছগাছালি আছে তাতে গিয়ে বাসা করে থাক না বাপু। মানুষের ঘরদোরে এসে ছিষ্টিনাশ করার স্বভাব কেন? কই, আর কোনও পাখি তো এমনধারা করে না।

বিজু মৃদু হেসে বলল, তাহলে চড়াই সম্পর্কে আপনারা তেমন কিছু বলতে পারলেন না। আমি একজন চড়াই-বিশেষজ্ঞ খুঁজছি।

চড়াইবিরোধী লোকটা বলল, লোকের আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই মশাই যে চড়াইয়ের ঠিকুজি কুষ্টি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবে।

ননীবাবু বললেন, না না, আছে। আমার এক শালা আছে পাখি-টাখি পোষে। সে বোধহয় বলতে পারবে।

তাকে একবার বলবেন তো আমি একটু দেখা করতে চাই।

 বলবখন। সে কাটোয়ায় থাকে। বর্ধমানে এলে–

এর বেশি আর কথা এগোল না।

কিন্তু ঠিক তিনদিন বাদে ফের চড়াই নিয়ে সমস্যায় পড়ল বিজু। একটা বাচ্চা চড়াই পড়ে গেল। ভালরকম চোট পেয়েছে। তীব্র আর্তনাদে ঘর ভরে গেল। সন্ধেবেলা পাখিটাকে হাতে নিয়ে ভাল করে দেখে বিজুর মনে হল, ঘাড় ভেঙে গেছে কিংবা ঘাড়ে ভালরকম চোট হয়েছে।

মেঝেতে ছেড়ে দিলেই পাখিটা যন্ত্রণায় পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে চরকির মতো পাক খায় আর আর্ত চিৎকার করতে থাকে। হাতে তুলে নিলে চিৎকার বন্ধ হয় বটে, কিন্তু খিচুনির মতো পা টানা দেয়, পাখা ঝাপটানোর চেষ্টা করে। ওর যন্ত্রণাটা বুঝতে পারে বিজু, কিন্তু নিরাময় বা উপশম তো তার জানা নেই। কোনও পক্ষীবিশারদ বা পক্ষীচিকিৎসক হয়তো জানে। সে জানে না। পাখিটাকে নিয়ে অসহায়ের মতো অনেকক্ষণ বসে রইল সে। একটা কৌটোর ঢাকনায় জল নিয়ে মুখের কাছে ধরল। পাখিটা ঠোঁটে একটু জল ছিটকোল বটে, কিন্তু শান্ত হল না। ওকে কি ঘুমের ওষুধ বা পেইনকিলার দেওয়া উচিত? ভেবেই চিন্তাটা কত হাস্যকর তা বুঝতে পারল বিজু। মানুষের ওষুধ খাওয়ালে পাখিটা হয়তো মরেই যাবে।

অনেক রাত অবধি পাখিটাকে হাতে নিয়ে বসে নাস্তিক বিজু ভাবছিল, ঈশ্বর নামক অলীক বস্তুর কাছে ওর প্রাণভিক্ষা করা উচিত কিনা। যুক্তিজালে তার কাছে কোনও ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই ঠিক কথা, কিন্তু মানুষের বস্তুজ্ঞানের সীমানার ওপারটা আজও তো আবছা। ওই আবছায়ায় ঈশ্বর বা ভূতের মতো কেউ নেই তো! থাক বা না থাক, প্রার্থনায় তো দোষ নেই!

না, প্রার্থনা করা উচিত হবে না। সামান্য একটা পাখির জন্য যদি সে নিজের বিশ্বাস ও মত বিসর্জন দেয় তাহলে নিজেকেই তার একদিন ঘেন্না হবে।

নাস্তিক হয়েও দুর্গাপুজো কালীপুজো নিয়ে মাতামাতি করে বলে অনেকে তাকে প্রশ্ন করেছে। সে বলে, দুর্গাপুজো কালীপুজো কোনও ধর্মকর্ম নয় রে। ওটা একটা উৎসব মাত্র। একটা উপলক্ষ করে খানিক ফুর্তি করা।

সারা রাত তো আর পাখি নিয়ে জেগে থাকা যায় না। একসময়ে সে পাখিটাকে মেঝেয় ছেড়ে দিল। পাখিটা অবিরল ঘুরপাক খেতে লাগল যন্ত্রের মতো। সঙ্গে সেই আর্তনাদ।

সারা রাত ভাল করে ঘুমোতে পারল না বিজু। বারবার ঘুম ভেঙে যেতে লাগল। বারবারই মনে হতে লাগল, এত কম জেনে বেঁচে থাকার মানেই হয় না। একটা চড়াইপাখি, নিত্যদিনকার চেনা একটা জীব, তারও ব্যথাবেদনা কমানোর উপায় কেন তার জানা নেই?

সকালবেলায় উঠেই সে প্রথম পাখিটার খোঁজ করল। লক্ষ্যহীন, নিয়ন্ত্রণহীন ঘুরপাক খেতে খেতে পাখিটা দরজার কাছ বরাবর গিয়ে নেতিয়ে কাত হয়ে পড়ে আছে। প্রথমে ভাবল মরেই গেছে বোধহয়। কিন্তু ধরতে যেতেই ফের চিড়িক শব্দ করে তার প্রবল ঘুরপাক শুরু করে দিল। জান আছে বটে পাখিটার।

জল ছিল, ভাতও ছিল একটা প্লেটে। পাখিটাকে ধরে খাওয়ানোর চেষ্টা করল সে। খেল না।

পাখিটাকে ফের তার যান্ত্রিক ঘুরপাকে ছেড়ে দিয়ে বসে রইল সে। মা-পাখিটা অপেক্ষা করছিল বোধহয়। সে সরে বসতেই নেমে এসে বাচ্চার কাছে বসল। কিন্তু মাকে দেখেও বাচ্চাটার ঘুরপাক থামল না। মুখে করে দানা জাতীয় কিছু এনেছিল মা-পাখিটা। কিন্তু খাওয়াতে পারল না।

অসহনীয় চিৎকার সহ্য করতে না পেরে নীচে নেমে গেল বিজু।

মা তাকে দেখেই বলে উঠল, কী হয়েছে রে? মুখটা অমন গম্ভীর কেন?

এমনি। কিছু হয়নি।

শরীর খারাপ নয় তো!

না, না, ওসব ঠিক আছে।

কী যে হয় তার মাঝে মাঝে। দেখে ভয় লাগে বাবা।

 চা নয়, সকালে এক গ্লাস গোরুর দুধ খেতে হয় তাকে। ছেলেবেলার অভ্যাস। দুধটা কোনওক্রমে খেয়ে সে বাগানে গিয়ে কিছুক্ষণ উদাস মুখে বসে রইল। পাখিটার যন্ত্রণা তাকে সারা রাত বিঁধেছে। একসময়ে তার মনে হচ্ছিল যন্ত্রণাটা তার শরীরের মধ্যেই হচ্ছে।

অনাত্মীয়, ভিন্ন শ্রেণীভুক্ত, নামগোত্রহীন ওই পাখিটার জন্য এই যে টান এটা অ্যানিম্যাল লাভার্সদেরও থাকে। কত লোক রাস্তার কুকুরের জন্য আশ্রয় বানিয়েছে। ওটা বড় কথা নয়। সে আজ বাগানে শীতের রোদ ও ছায়ায় ঘুরতে ঘুরতে আর একটা মহৎ ব্যাপার অনুভব করছিল। সমস্ত পৃথিবী, বিশ্বজগৎ, মহাজগৎ জুড়ে একটা সিস্টেম রয়েছে। তার সঙ্গে সে, ওই চড়াইপাখি, মোতি এবং সবাই ও সব কিছু বাঁধা। কেউ একা নয়, বিচ্ছিন্ন নয়। সব কিছুই সব কিছুর সঙ্গে এক সূক্ষ্ম মাকুর কারসাজিতে পরস্পরের সঙ্গে যোগ হয়ে আছে। ধর্মে এরকমই এক মহা সম্পর্কের কথা বলা হয় বটে। সেটা গাঁজাখুরি হতেও পারে। কিন্তু সম্পর্কও যে একটা আছে–যা মায়া, মোহ, ভালবাসা বা যাই হোক– তাও তো মিথ্যে নয়।

ঘণ্টাখানেক বাদে তার ঘর ঝটপাট দিতে এল কাজের মেয়ে। বিজুর সামনে মেঝের ওপর তখনও পাখিটা অবিরাম চক্কর খাচ্ছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। পাখিটা দুপায়ে উঠে দাঁড়াতে পারছে না, উড়তে পারছে না, শুধু আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়ে চক্রাকারে ঘুরে যাচ্ছে। যন্ত্রণাটা চোখে দেখা যায় না।

কাজের মেয়েটা ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ও কী গো! ওটা কী মেঝের ওপর?

বিজু ধমক দিয়ে বলল, চেঁচানোর কী হল তোর! ওটা একটা চড়াইপাখি। জখম হয়েছে। কিছু করতে পারিস?

 ফের পাখায় ধাক্কা খেয়েছে বুঝি?

 আমি কি পাগল যে শীতকালে পাখা চালাব! পাখা চালিয়ে একটাকে তো তুই-ই মেরেছিলি।

আহা, আমার কী দোষ বলো। পাখিগুলো অমন আহাম্মক হলে আমি কী করব?

এটার জন্য কিছু করতে পারিস?

মেয়েটা পাখিটাকে দুহাতের আঁজলায় তুলে নিয়ে বলল, ওর তো হয়ে গেছে। ঘাড় ভাঙলে কেউ বাঁচে?

ঘাড়ই ভেঙেছে বলছিস?

তাই তো মনে হচ্ছে। মাথা সোজা করতে পারছে না যে। ফেলে দিই গে?

না না। ওই ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটের মধ্যে আপাতত রেখে দিয়ে তুই ঘরটা ঝাঁটপাট দে। তারপর দেখা যাবে।

তোমাদের বাড়িভর্তি বেড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা হুলোও রোজ আনাগোনা করে। এটাকে রাখতে পারবে?

দেখা যাক।

রাখা যাবে না সে জানে। বেড়ালে না নিলেও খাদ্য-পানীয় ছাড়া পাখিটা এমনিতেও মরবে। ধীর মৃত্যু। সেটা প্রত্যক্ষ করতে হবে তাকে। বিজু ব্যাপারটা সইতে পারছে না।

কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করবি। ওই যে দুটো কৌটোর ঢাকনায় জল আর ভাত রয়েছে। দেখ না চেষ্টা করে।

মেয়েটা কিছুক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, না এ খাচ্ছে না যে। কুশি বাচ্চা এরা কি নিজে খেতে পারে? মায়ের ঠোঁট থেকে খায়।

বিজু সেটা জানে। তাই সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

কোর্টে গিয়েও তার আজ অন্যমনস্কতা কাটল না। তবে অনেকটা সহজ হল। বুকটা হালকাই লাগছিল। কিন্তু যে-ই সন্ধেবেলায় চেম্বারের পর মোটরবাইকের মুখ বাড়ির দিকে ঘোরাল তখনই সে অলক্ষ্য থেকে সেই প্রাণান্তকর আর্তনাদ অগ্রিম শুনতে পাচ্ছিল। মেঝেময় লাট খেয়ে বোঁ বোঁ করে ঘুরছে ভাঙা শরীরের এক পাখি।

মার্সি কিলিং! বাড়ি ফিরে কি পাখিটার যন্ত্রণার অবসান ঘটাতে মেরে ফেলবে ওকে? না, তা পেরে উঠবে না সে।

রাতে ঘরে খুব সাবধানে ঢুকল সে। আলো জ্বালল। ঘরে কোনও শব্দ নেই। মরে গেল নাকি পাখিটা? নিচু হয়ে মেঝের ওপর খুব ক্ষীণ রক্তের দাগ আর আঁশের মতো একটু পালক দেখতে পেল সে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাইরের দিকের জানালার পাল্লাটা খোলা। মার্সি কিলিং-এর কাজটা হয় মোতি, না হয় আগন্তুক কোনও হুলোই করে গেছে। আপাতত শান্তি। কিন্তু সমস্যার স্থায়ী সমাধান তো নয়। এ-ঘরে যতদিন চড়াইয়ের সংসার থাকবে ততদিন এই ঘটনা বারবার ঘটবে।

জামাকাপড় পালটে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিজু। আজ আর পড়াশুনো করতে ইচ্ছে হল না। মোটে আটটা বাজে।

মা রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞেস করল, আবার কোথায় চললি?

দেখি, একটু আড্ডা মেরে আসি।

রাত করিস না।

আরে না। কাকার বাড়ি যাচ্ছি।

তবেই হয়েছে। ওরা ঠিক রাতের খাবার খাইয়ে দেবে। শুনেছি পিঠেপায়েস হয়েছে ও-বাড়িতে।

 তাহলে তো ভালই। সেঁটে আসবখন।

তাকে দেখেই পান্না এক গাল হাসল, বাব্বাঃ, যা কাজের লোক হয়েছ তুমি! আজকাল টিকিরই নাগাল পাওয়া যায় না।

তোর মতো বসে খেলে আমার চলবে? মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করতে হয়।

 ইস! আমি পড়াশুনো করি না বুঝি! দাঁড়াও না, পাস করেই চাকরি করতে লেগে যাব। পারুলদিকে বলে রেখেছি। ওদের কোম্পানিতেই ঢুকে যাব।

 দুর! ও তো মিস্তিরির কাজ। তুই পারবি?

 না না, ওদের অফিস ওয়ার্কারও লাগে। এ-গাঁয়ে আমি আর থাকছি না বাবা।

কেন, গাঁ আবার কী দোষ করল?

পান্নার মুখ থেকে হাসি উবে গেল। বড় বড় চোখ করে বলল, জানো না বুঝি? আমাদের নতুন রান্নার লোক সুদর্শন রোজ ভূত নামায়।

বিজু হেসে বলল, তুইও তো একটা ভূত।

যাঃ, বাজে কথা বোলো না। রোজ রাতের বেলা সবাই ঘুমোলে ও নাকি মন্তর পড়ে ভূতেদের নামিয়ে আনে। তখন সারা বাড়ি বোঁটকা গন্ধে ভরে যায়। বাসন্তী, হিমি সবাই গন্ধ পেয়েছে।

বটে!

ভয়ে আমি মরে যাচ্ছি বাবা।

.

৫৪.

ভূত, ভূত, আর ভূত! দুনিয়াতে এত ভূত থাকলে তার চলবে কী করে? কেন যে এত ভূত-টুত চারদিকে আছে বাবা! ভগবান যে কেন ভূতের সৃষ্টি করল কে জানে! পান্নার কান্না পায়। যত নষ্টের গোড়া ওই সুদর্শন। ভূত জিনিসটাকে মাঝে মাঝে দিব্যি ভুলে থাকত পান্না। ওই সুদর্শন এসেই আবার ভূতের তাণ্ডব শুরু করেছে, সবাই বলে রোজ নাকি মাঝরাতে ও ভূত নামায়। মরতে তাদেরই বাড়িতে এসে জুটেছে বিটকেল সোকটা। নিশুতরাতে নাকি এ-বাড়িতে থিকথিক করে তারা। শোনার পর থেকে। দিনরাত রাম নাম করছে পান্না। তবু কি ভয় যায়?

বিজুদা বলেছে, পান্না, তুই কমিউনিস্ট হয়ে যা, তা হলে আর ভূতের ভয় বলে কিছু থাকবে না।

যাঃ, কী যে বলো। কমিউনিস্টের সঙ্গে আবার ভূতের কী?

ওই তো মজা। মানুষ যেমন ভূতকে ভয় পায়, তেমনই ভূত আবার কমিউনিস্টদের ভয় পায়।

দুর! সবসময়ে ঠাট্টা ভাল লাগে না। রাতে আজকাল লেপ চাপা দিয়েও ঘুমোতে পারি না, জানো? বাঁ ধারে হীরা, ডান ধারে মা শোয়, দুজনের মাঝখানে মাথা অবধি লেপ ঢাকা দিয়ে শুয়েও মনে হয়, ওই বুঝি ভূতের হাসি শুনতে পাচ্ছি।

তোর পক্ষে সবচেয়ে ভাল জায়গা কী জানিস? হয় হাসপাতালের কোয়ার্টার, না হয় শ্মশানের ধারে বাড়ি।

ও বাবা গো! তা হলে আমি মরেই যাব।

দুর বোকা! হাসপাতাল বা শ্মশানে কখনও ভূতের উপদ্রবের কথা শুনেছিস? খোঁজ নিলেই দেখতে পাবি কোনও হাসপাতালে একটাও ভূত নেই। কোনও শ্মশানে ভূতের টিকিরও নাগাল পাবি না। কেন জানিস? ও দু জায়গায় এত ভূত যে ভূতে ভূতক্ষয় হয়ে যায়।

তোমাকে বলেছে?

আরে আমি তো একসময়ে ভূতের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতাম, জানিস না?

সেটা অবশ্য জানে পান্না। বিজুদার দুর্জয় সাহস। ভূত বলে যে কিছু নেই সেটা প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। তখন সত্যিই শ্মশান আর কবরখানায় রাতবিরেতে ঘুরে বেড়িয়েছে অনেক।

অত সাহস কিন্তু ভাল নয়, বুঝলে।

 কেন, তোর ভূতেরা কি তাতে চটিতং হবে নাকি? তা হোক না হয়ে আমার ঘাড় মটকাতে আসুক না। আমি তো সেটাই চাই। সুদর্শন ভূত নামায় শুনে ওকে গতকাল চেপে ধরেছিলুম, বুজরুকির আর জায়গা পাওনি? দেখাও তো তোমার ভূত! শুনে ও তো আকাশ থেকে পড়ল। বলল, জন্মে ভূতপ্রেতের কারবার করিনি বাবু। কে যে ওসব গাঁজাখুরি কথা রটায়! ব্রাহ্মণসন্তান জপতপ একটু-আধটু করি বটে, কিন্তু ওসব তান্ত্রিক কারবারে নেই।

আমাদের কাছেও স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু সবাই জানে ও ভূতপ্রেত নামাতে পারে। ওকে না তাড়ালে আমি আর এ-বাড়িতে থাকতে পারব না।

এ-বাড়িতে তোর আর থাকার দরকারটাই বা কী? ভাল দেখে একটা কমিউনিস্ট পাত্রকে বিয়ে করে সটকে পড়। কাকাকে বলছি কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে। তাতে লেখা থাকবে, সুন্দরী, শিক্ষিতা সপ্তদশী ভূতভীতা পাত্রীর জন্য অনধিক ত্রিশ ব্রাহ্মণ অকাশ্যপ, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা সরকারি অফিসার এবং কট্টর কমিউনিস্ট পাত্র চাই। হ্যাঁ রে, কমিউনিস্টও তো আবার নানা রকম আছে। তোর কোনটা পছন্দ? সি পি আই, সি পি এম না নকশাল? নকশালের ঝাঁঝ বেশি, ওদের ধারেকাছে ভূত ঘেঁষবে না। নকশালই লিখে দিতে বলি কাকাকে?

পান্না ফিক করে হেসে বলল, ছেলেবেলার মতো আবার চিমটি কাটব কিন্তু। আমি মরছি নিজের জ্বালায়, উনি এলেন ঠাট্টা করতে।

ভাল কথা বললে তো শুনবি না। তা হলে একটা তুক শিখিয়ে দিচ্ছি। যখন ভূতের ভয় পাবি তখন রামনাম না করে কার্ল মার্ক্স কার্ল মার্ক্স করিস, দেখবি তাতে অনেক বেশি কাজ হবে।

কমিউনিস্টরা ভীষণ বাজে লোক হয়।

 কী করে বুঝলি?

তোমাকে দেখে।

আহা, আমি আর সাচ্চা কমিউনিস্ট হতে পারলাম কী? একটা ক্যারিকেচার হয়ে রইলাম। সাচ্চা কমিউনিস্ট তো দেখিসনি।

আর দেখে কাজও নেই।

ভূতপ্রেত নামাক আর যাই করুক সুদর্শনের রান্না কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস। বুঝলি, কাল একটা পালংচচ্চড়ি রান্না করেছিল, ওরকম ভাল রান্না জম্মে খাইনি। বোধহয় ভূত-টুত ফোড়ন দিয়েছিল, অর্ডিনারি রান্না নয় কিন্তু।

কথাটা মিথ্যে নয়। সুদর্শনের রান্নার ভূয়সী প্রশংসা পান্না তার খুঁতখুঁতে মায়ের মুখে অবধি শুনতে পায়। শুধু রান্নাই নয়, সুদর্শন খুব পয়পরিষ্কার মানুষ। এই চণ্ড শীতেও সকালে উঠে স্নান এবং জপতপ না করে হেঁশেল ছোঁবে না। মানুষটা লোভী নয়, হাতটান নেই। ফলে সুদর্শনের পাল্লা খুব ভারী। একা পান্না তাকে তাড়ানোর কথা ক্ষীণভাবে বলার চেষ্টা করে বটে, কিন্তু তাতে কোনও ফলোভের আশা সে দেখছে না।

সুদর্শন কড়াইশুঁটি দিয়ে একটা নতুন ধরনের ধোঁকার ডালনা রান্না করেছে। রান্নার সময়ে গন্ধে বাড়ি মাত হয়ে যাচ্ছিল। মা একটা টিফিন কৌটোয় খানিকটা ভরে পান্নার হাতে দিয়ে বলল, যা, তোর বড়মাকে দিয়ে আয়। গতকাল একাদশী গেছে, আজ একটু ভাল-মন্দ পেটে যাক। শুনি, আজকাল খাওয়াতে বড্ড অরুচি হয়েছে দিদির।

বলাকা এই শীতে একটু ক্ষীণ হয়েছেন। গায়ে তেল মাখার অভ্যাস নেই বলে একটু খড়িওঠা ভাব থাকেই। টানের সময় তেল-টেল না মাখলে শরীর একটু শুকোয়। বড় ঘরের মাদুরে বসে দুখুরিকে পাশে নিয়ে একটা অ্যাটলাস খুলে আফ্রিকার ম্যাপ দেখছে দুজনে।

ও বড়মা!

তাকে দেখে বড়মার চোখেমুখে যে আনন্দটা ছড়িয়ে পড়ে সেটা বড় ভাল লাগে পান্নার। জ্যাঠামশাই যে কী একাকিত্বের মধ্যে বড়মাকে ফেলে গেছে সেটা পান্না খুব টের পায়। বাড়িটা এত বড় বলেই যেন বড়মার নিঃসঙ্গতাটা বড় বেশি চোখে লাগে। কয়েকজন কাজের লোক ছাড়া ওই দুখুরিই শুধু বড়মার ছায়া হয়ে ঘোরে। দুখুরির বাবা মেয়ের বিয়ে দিয়ে টাকা কামাবে বলে তক্কে তক্কে ছিল। বড়মা অনেক টাকা দিয়ে দুখুরিকে একরকম কিনেই নিয়েছে। বাঙালি এসে মাঝে মাঝে তবু বলে, মেয়ের বারো তেরো বছরে বিয়ে না দিলে দেশে তার খুব বদনাম হবে। বড়মা বলেছে, তোর আবার বদনাম কী রে মুখপোড়া? কোন গুণের মানুষ তুই? আর দুখুরি আবার তোর দেহাতের মেয়ে হল কবে? ওকে আমি বড় করেছি, আমিই বিয়ে দেব। মেয়ে ভাঙিয়ে পয়সা রোজগারের ধান্ধা করবি তো তোকে গাঁ-ছাড়া করে ছাড়ব।

বাঙালি সেটা জানে। তাই আজকাল ঘাঁটায় না। তবে ধানাইপানাই করে মাঝে মাঝে দশ-বিশ টাকা আদায় করে নিয়ে যায়। স্পষ্টই ব্ল্যাকমেল, তবে বড়মা দেয়। শত হলেও বাপ তো।

আয়, আয়, দুদিন আসিসনি কেন রে?

পড়ছিলাম। সামনে পরীক্ষা।

আজকাল ছেলেপুলেদের সারা বছর যে কীসের এত পরীক্ষা থাকে তা বুঝি না বাবা। এই একরত্তি দুখুরিরও শুনি ফি মাসে পরীক্ষা লেগেই আছে। এর পর বই জলে গুলে খাওয়াবে। হাতে ওটা কী রে?

মা পাঠিয়েছে। ধোঁকার ডালনা।

বলাকা হেসে বলে, সুদর্শনের রান্না তো! বড় ভাল রান্নার হাত ছেলেটার।

একটু অভিমান করে পান্না বলে, ছাই ভাল, ও মোটেই নিজে রাঁধে না।

বলাকা অবাক হয়ে বলে, ও রাঁধে না? তা হলে কে রাঁধে?

 সেসব আমি বলতে পারব না। গভীর ষড়যন্ত্র আছে।

 বলাকা একটু চেয়ে থেকে বলে, ভেঙে বলবি তো মুখপুড়ি! কোনও অনাচার হয়ে থাকলে ও জিনিস তো আমি খাব না। শুনেছিলুম তো সে খুব আচারবিচার মেনে চলে। আগে নিরিমিয্যি বেঁধে আলাদা উনুনে আলাদা কড়াইতে মাছ রাঁধে। সেসব শুনেই তো ওর রান্না খেয়েছি কদিন, কী হয়েছে বল তো!

শুনলে তোমার বিশ্বাস হবে না। বলে কী লাভ?

ওরে, অনাচারের কথা লুকোতে নেই। পাপ হয়। আমি শুদ্ধাচারে থাকি, অনাচার সইবে না।

অনাচার কি না জানি না, তবে ওসব রান্না ওর নিজের বলে আমার বিশ্বাস হয় না। ওসব ওর পোষা ভূতের রান্না।

বলাকা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে পান্নার দিকে চেয়ে থেকে মুখে আঁচল তুলে হেসে ফেলে। তারপর বলে, যা, খাওয়ার টেবিলে টিফিনবাটিটা রেখে আমার কাছে এসে বোস একটু।

পান্না তাই করল। বলাকার কাছ ঘেঁষে বসে বলল, তোমার বিশ্বাস হল না তো!

হবে না কেন? খুব বিশ্বাস হয়েছে। তবে ভূতের তো জাত নেই, তাদের রান্না খেলে অনাচার হবে না, কী বলিস?

তুমি ঠাট্টা করছ। ও লোকটা যে ভূত নামায় তুমি বিশ্বাস করো না বুঝি?

 কেন বিশ্বাস করব না? যে ভূত নামাতে পারে সে তো মস্ত মানুষ। তাকে রোজ প্রণাম করা উচিত।

 ফের ঠাট্টা?

বলাকার সঙ্গে দুখুরিও হাসছিল। বলল, এম্মা, তুমি বুঝি ভূতের ভয় পাও? আমি তো রাতবিরেতে কত কত জায়গায় ঘুরে বেড়াই। একটুও ভয় করে না তো!

তুই তো একটা কিম্ভূত। হ্যাঁ বড়মা, তুমি তো বিশ্বাস করো, না কি? তুমি তো আর বিজুদার মতো নাস্তিক নও।

বিজু কি নাস্তিক নাকি?

ও বাবা, বিজুদা নাস্তিক নয়? বলো কী? ভীষণ নাস্তিক। ভগবান মানে না, ভূতপ্রেত মানে না। আমাকে কী বলেছে জানো? ভূতের ভয় পেলে রামনাম না করে কার্ল মার্ক্সের নাম করতে। ওর মুখে কিছু আটকায় না।

ও ওইরকম সব বলে। সেদিন তো দেখলুম শ্যামল দত্তর বাড়িতে দিব্যি নারায়ণ পুজো করে এল। নাস্তিক বলে মনে হল না তো! শ্যামলদের বাড়িতে যার পুজো করার কথা ছিল সেই পুরুতঠাকুরের ম্যালেরিয়া হওয়ায় বিজুকে ধরে এনেছিল।

সে তো আমাদের বাড়িতেও কতবার করেছে। ও তো বলে দক্ষিণা পাই বলে পুজো করি, ভক্তি টক্তি থেকে তো করি না। বোকা লোকেরা ভগবানের নামে গাঁটগচ্চা দিতে চাইলে আমার কী করার আছে! ও বড়মা, বলো না, তুমি তো ভূতে বিশ্বাস করো। ৩৮৬

ওমা, তা করব না কেন?

তা হলে ভয় পাও না কেন বলো তো!

তা তারা তাদের মতো আছে, ভয় পাওয়ার কী হল? এই তুই আছিস, আমি আছি, গাছপালা, পাখিপক্ষী, গোরু ছাগল যেমন আছে তেমনই তারাও আছে। ভয়ের তো কিছু নেই।

আহা, যদি দেখা দেয় তখন?

অত ভাগ্য কি করে এসেছি রে! তোর জ্যাঠা চলে যাওয়ার পর কি কম চেষ্টা করেছি তাকে একবার চোখের দেখা দেখবার! কত নিশুত রাতে জেগে বসে থেকেছি একা ঘরে। কত ডেকেছি তাকে মনে মনে।

বাবা গো! শুনেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

হ্যাঁ রে, আমি মরলে আমাকে কি তোর দেখতে ইচ্ছে করবে না?

পান্না কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ওসব বোলো না তো, ভাল লাগে না। মরবে কেন? একদম মরতে পারবে না বলে দিচ্ছি। আজ থেকে কেউ তোমরা আর মরবে না বলে রাখলাম। এখন থেকে সব্বার মরা বারণ।

হেসে পান্নাকে বুকে টেনে নিয়ে বলাকা বলে, ভূতের ভয়ে সবাইকে অমর করে দিলি বুঝি! তা হলে যে বুড়ো বুড়িতে দুনিয়া ভরে যাবে। খুনখুনে থুথুরে বুড়োবুড়ি চারদিকে থিকথিক করবে সেই বুঝি ভাল?

সে আমি জানি না। আজ থেকে সকলের মরা বন্ধ।

দিনের বেলাটা একরকম কাটিয়ে দিতে পারে পান্না। কিন্তু যেই সন্ধেটি হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে এগিয়ে আসে, আর শীতের কুয়াশা মাঠঘাট থেকে সাদাটে শরীর নিয়ে পাক খেয়ে উঠে আসতে থাকে, আর শকুনের ডানার মতো নেমে আসে অন্ধকার তখনই বুকের ভিতরে ভয় খামচে ধরে তাকে।

এ সময়ে যে কেন লোকে এত সত্যনারায়ণের পুজো করে কে জানে বাবা। আজ বাড়িসুদ্ধ সকলের নেমন্তন্ন ছিল মরণদের বাড়িতে। পান্না যাবে না, তার পরীক্ষার পড়া। বলল, তা হলে তোর গিয়ে কাজ নেই। তুই বরং ঘরে বসে পড়। সুদর্শন আছে, বাসন্তী কাজ করছে, তোর বাবাও এসে পড়বে খন। সন্ধে রাত্তিরে তো আর ভয় নেই।

পান্না স্বীকারও হয়েছিল। কিন্তু কে জানত আজই বাসন্তী কাজ সেরে বেলাবেলি চলে যাবে, বাবার আসতে দেরি হবে এবং সুদর্শনের পাত্তা পাওয়া যাবে না! যখন কপাল খারাপ হয় তখনই এরকম সব ঘটনা ঘটে। সন্ধে ছটা নাগাদ পড়া ছেড়ে উঠে কুঁজো থেকে জল গড়ানোর সময় হঠাৎ সে বাড়ির আঙিনায় সন্দেহজনক নির্জনতাটা টের পেল। বারান্দায় এসে বাসন্তীকে ডাকল। তারপর সুদর্শনকে। কেউ সাড়া দিল না। গোটা বাড়িটা ছমছম করছে। সে একা।

কী করে এখন পান্না! ছুটে গিয়ে পাশের বাড়িতে হাজির হবে? তা হলে বাড়ি খালি পড়ে থাকবে। মা টের পেলে কুরুক্ষেত্র হবে। বাড়ি নির্জন হলেও আশপাশের বাড়ি থেকে অবশ্য লোকজনের গলা পাওয়া যাচ্ছে। পথে লোক চলাচলও আছে। কিন্তু সেটা তো কোনও ভরসা নয়। এ বাড়ির মধ্যে সে একা। অসহায়। চারদিকে প্রকৃতির রসায়নে এক অদ্ভুত বিক্রিয়া ঘটে যাচ্ছে। বাস্তবের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে পরাবাস্তব। দিনের বেলায় যারা ঘুমিয়ে ছিল তারা জেগে উঠছে। উঠে আসছে। আর পুবের আকাশে কুয়াশার মায়াজালে জড়ানো পূর্ণিমার চাঁদ ম্যাজিক লণ্ঠনের মতো দুলতে দুলতে একটু একটু করে ওপরে উঠছে ওই।

কী করবে এখন পান্না! খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠবে? কেঁদে ফেলবে? অজ্ঞান হয়ে যাবে?

হাই!

পান্নার হার্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়ই কয়েক সেকেন্ডের জন্য। পাথরের মতো হয়ে গিয়েছিল সে। অবশ্য বেশিক্ষণ নয়।

ভগবান বলে কিছু একটা তো আছেই। কেউ একজন। নইলে কি এমন হয়? উঠোনে আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সোহাগ।

সোহাগকে দেখলে সে খুশি হয় বটে, কিন্তু আজ সে চিৎকার করে যে লাফটা দিল সেটা শুধু খুশির নয়, উল্লাসের। উঠোনে নেমে সে প্রায় জাপটে ধরল সোহাগকে।

উঃ সোহাগ! বাঁচলাম বাবা! শিগগির ঘরে এসো। একা একা আমার যা ভয় করছিল না।

 সোহাগ হেসে ঘরে এল। বলল, একা তোমার ভয় করে বুঝি! ইউ ডোন্ট এনজয় লোনলিনেস।

না বাবা, না। একা থাকতে আমার একটুও ভাল লাগে না।

 খুব সুন্দর করে হাসল সোহাগ। বলল, লোনলিনেস-এর মতো এত ভাল আর কী আছে বলে তো! আমার তো একা থাকতেই সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে।

তোমার ভাই ভীষণ সাহস। মাঝরাতে উঠে একা একা মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াও। আমি তো ভয়েই মরে যাব।

তোমার খুব ভূতের ভয়, তাই না?

 ভূত তো আছেই। পাগল, মাতাল, বদমাশ আমার যে কত ভয়। সবচেয়ে বেশি ভূত।

 আমার তো ভূতকে ভীষণ পছন্দ।

মাগো! মরেই যাব। ভূ

ত হল হিস্টরি। আমি যখন মাঝরাতে একা একা ঘুরে বেড়াই তখন আমার সবসময়ে মনে হয়, আমার চারপাশে ওরা সব রয়েছে। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ। আজ অবধি যারা জন্মেছে এবং মরে। গেছে তারা সবাই। খুব বন্ধুর মতো লাগে তাদের। তারা আশেপাশেই আছে, কিন্তু ডিস্টার্ব করে না, শুধু সঙ্গে থাকে। আমি খুব ফিল করি তাদের। অনেক সময়ে তাদের সঙ্গে কমিউনিকেট করার চেষ্টাও করি।

করো?

 হ্যাঁ তো।

কথা বলে তোমার সঙ্গে?

কী জানি? হয়তো বলে। ঠিক বুঝতে পারি না। একদিন মার সঙ্গে খুব ঝগড়া হয়েছিল। রাগ করে রাতে বেরিয়ে গিয়ে আমাদের বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়টা পেরিয়ে একটা মাঠের মতো উদোম জায়গায় অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম। সেদিন আমার কেমন যেন একটা আনক্যানি ফিলিং হয়েছিল। খুব মনে হচ্ছিল আমার কাছ ঘেঁবেই কে যেন বসে আছে।

ও মা গো!

ভয়ের কী বলল। পৃথিবীতে তো কত কী আছে আনএক্সপ্লেইনড, আনএক্সপ্লোরড।

চেঁচাওনি?

না। আমার কেমন একটা ঘোরের মতো অবস্থা হল। আমি তখন ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে? কী চাও? তুমি কীরকম একজিস্টেন্স? তুমি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?

কী বলল?

প্রথমে কিছু নয়। তারপর হঠাৎ আমিও একটা হুইসপার শুনতে শুরু করলাম। সামওয়ান ওয়াজ টেলিং মি সামথিং। কিন্তু স্পষ্ট নয়। অস্পষ্ট, স্ট্যাটিকের আওয়াজের মতো। মনে হল যে কথা বলছে সে একটা মেয়ে। কথাগুলো বোঝা যাচ্ছে না ঠিকই কিন্তু যেন খুব জরুরি গলায় বলে যাচ্ছে। মেয়েটা আমাকে কিছু বলতে চাইছে। আমি বুঝতে পারছি না। তখন খুব দুঃখ হচ্ছিল আমার। ওদের ল্যাংগুয়েজ কে আমাকে শেখাবে বলো।

পান্না হাঁ করে শুনছে। তার দুটো হাত শক্ত মুঠি পাকিয়ে আছে। সোহাগকে তার জোয়ান অফ আর্ক বা ঝানসির রানির চেয়ে কম বলে মনে হচ্ছে না।

পরে দাদুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এরকম হয় কি না। দাদু বলেছিল, হতেই পারে। তবে দাদুর ওরকম কোনও অভিজ্ঞতা নেই।

কাউকে দেখতে পেলে না?

না। হয়তো দেখার জন্য আরও কিছু প্র্যাকটিসের দরকার হয়। আমার তো তা নেই।

বিজুদাকে তোমার গল্পটা বলো তো। বিজুদা না কিছু বিশ্বাস করতে চায় না।

তোমার বিজুদা তো একজন হিরো। হিরোরা সহজে হার মানতে চায় না।

বিজুদার ওপর তোমার খুব রাগ, তাই না?

না তো! তবে হিরোদের আমি খুব একটা পছন্দ করি না।

আহা, বিজুদার কী দোষ বলল। তোমার পিছনে বদমাশ ছেলেরা লেগেছিল দেখে আমিই বিজুদাকে বলে দিই। তাই বিজুদা ওদের একটু শাসন করেছিল। আগ বাড়িয়ে তো কিছু করেনি। দোষ তো আমার।

সোহাগ মুখ টিপে হেসে বলে, তুমি বিজুদাকে খুব ভালবাসো, না?

ওঃ, ইয়েস। বিজুদা ইজ এ নাইস নাইস নাইস ম্যান। একদিন ভাল করে আলাপ করলেই বুঝতে পারবে। ওর ঘরে একটা চড়াইপাখি মরে গেল বলে কী মন খারাপ! দুদিন দাড়ি কামায়নি। একটা চড়াইপাখির জন্য কে এত ভাবে বলো!

ওকে! লেট আস লিভ বিজুদা অ্যালোন। জানো তো, এখন থেকে আমরা প্রত্যেক উইকএন্ডে গ্রামে বেড়াতে আসব বলে ঠিক হয়েছে!

ওমা! তাই? আর তোমার মা বাবার সেই ব্যাপারটা?

একটা সেটেলমেন্ট হয়েছে। দে আর নাউ স্লিপিং ইন সেম বেড। পরে কী হবে বলা যায় না। কিন্তু এখনকার মতো ধামাচাপা।

তাই তোমায় আজ ব্রাইট দেখাচ্ছে।

 কাঁধ ঝাঁকিয়ে সোহাগ বলে, হবে হয়তো। বড়রা যখন ঝগড়া করে তখন আমার খুব ইম্মাচিওর মনে হয়। কেন ঝগড়া হয় বলো তো!

আমার মা-বাবার মধ্যেও মাঝে মাঝে ঝগড়া হয়। তবে বাবা একদম ঝগড়া করতে পারে না। না খেয়ে বেরিয়ে যায়।

দুজনে খুব হাসল।

এই এত বইখাতা ছড়িয়ে কী করছিলে এতক্ষণ!

পড়ছিলাম। সামনে পরীক্ষা না!

এ মা! তা হলে তো আমি এসে তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম।

তুমি এসে আমাকে বাঁচিয়েছ। এ বাড়িতে কী হচ্ছে জানো না তো! সাংঘাতিক কাণ্ড! ভয়ে আমি দিনরাত কাঁটা হয়ে আছি।

মাই গড! কী বলো তো?

আমাদের একজন নতুন রান্নার লোক রাখা হয়েছে। সুদর্শন। লোকটা না নানারকম তন্তরমন্তর জানে। নিশুতরাতে নাকি ভূত নামায়। আর তখন এ-বাড়ির আনাচে কানাচে গিজগিজ করে ভূত।

চোখ গোল গোল করে শুনছিল সোহাগ। বলল, তোমরা ভূত দেখেছ বুঝি?

 পাগল! দেখলেই আমি অক্কা পাবো ভয়ে। কিন্তু অনেকে দেখেছে। তারা নাকি বোঁটকা গন্ধও পেয়েছে।

ভূতের কি গন্ধ থাকে?

সবাই তো তাই বলে।

লোকটা ফ্রড নয় তো?

না বাবা, লোকটা তুকতাক জানে ঠিকই। কিন্তু স্বীকার করে না।

 সোহাগ ঠাট্টা করল না, হেসে উড়িয়ে দিল না। বরং গম্ভীর মুখ করে বলল, আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে? আমি ওর কাছ থেকে শিখতে চাই।

তোমার ভাই দুর্জয় সাহস। আমি তো মাকে বলেছি লোকটাকে তাড়িয়ে দিতে।

না, তাড়িও না। এরকম লোক খুঁজলে পাওয়াই যাবে না আর। ডাকো তো লোকটাকে!

 কিন্তু সুদর্শনকে ডেকে পাওয়া গেল না। বোধহয় দোকানপাটে গেছে, কিংবা আড্ডা মারছে কোথাও।

.

৫৫.

এতদিন তার কোনও স্বদেশ ছিল না। স্বদেশের বোধও ছিল না। থাকার কথাও নয়। ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে এক দেশ থেকে আর এক দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তাকে। কখনও ফরাসি, কখনও জার্মান, কখনও ইংরিজি ভাষা বলতে শিখেছে। দুই ভাই-বোন বুঝতেই পারত না কোনটা তাদের আসল ভাষা। হ্যাঁ, ঠিক বটে, তাদের মা-বাবা নিজেদের মধ্যে অনেক সময়েই বাংলা বলত। বিশেষ করে ঝগড়ার সময়। সেই ভাষা তারা অল্প-অল্প বুঝতে পারত বটে, কিন্তু মা বা বাবা তাদের বাংলা শেখানোর চেষ্টাই করত না কখনও। যখন আমেরিকায় সোহাগ স্কুলে ভর্তি হল তখন আমেরিকান ইংরিজি হল তার মাতৃভাষার মতো। আর তখন আমেরিকাকেই তার স্বদেশ বলে মনে হত। দিস ইজ মাই কান্ট্রি কতবার একথা মাকে বলেছে সে। সে বুঝতে পারত তার মা বাবা ঠিকঠাক ইংরিজিটা বলতে পারে না, হোঁচট খায়। বিশেষ করে মা। একদিন সে মাকে বলেছিল, তোমরা এত খারাপ ইংরিজি বলো কেন? মা বলল, আমরা তো তোর মতো আমেরিকান হয়ে যাইনি। আমরা বাপু ভেতো বাঙালিই আছি।

দ্বন্দ্বের শুরু সেখানেও, বুঝতে পারত, সে আমেরিকান হলেও তার মা-বাবা তা নয়। বেশ কিছুদিন এদেশে থাকার পরেও তার মা বা বাবা আমেরিকার অনেক কিছুই বুঝতে পারত না। যেমন জ্যাজ বা রক, যেমন রেয়ার স্টেক বা যৌন ব্যবহার। দুই ভাই-বোনের সঙ্গে মা-বাবার একটা ব্যবধান রচিত হচ্ছিল ধীরে ধীরে। যেন তীরের নোঙর ছেড়ে নৌকো চলে যাচ্ছে মাঝদরিয়ার দিকে।

এতদিনে আমেরিকাই দুই ভাই-বোনের দেশ হয়ে যেত পুরোপুরি। হল না। তার কারণ একটা অদ্ভুত ঘটনা। একটি কালো মেয়ে আসত তাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে। আগে যে ছিল তার মায়ের ডোমেস্টিক হেলপ। সাদা কথায় ঝি। মোনার শরীর খারাপ ছিল বলেই রাখা হয়েছিল তাকে। গাড়ি করে আসত, ঘণ্টা দুয়েক অসুরের মতো খেটে কাজকর্ম করে ঘরদোর পরিষ্কার আর ফিটফাট সাজিয়ে রেখে চলে যেত। একদিন তার মা বাবা হিসেব করে দেখল মেয়েটার জন্য প্রচুর ডলার বেরিয়ে যাচ্ছে। মোনা বলল, ওকে ছাড়িয়ে দাও। আমি কাজ করতে পারব। ছাড়িয়ে দেওয়ার পরও যে আসত সোহাগের আকর্ষণে, সবাই ভেবেছিল হয়তো মায়া পড়ে গেছে, তাই আসে।

সেই মেয়েটিই একদিন সোহাগকে তুলে নিয়ে যায়। গাড়ি করে সোজা যে জায়গায় তাকে নিয়ে তুলেছিল মেয়েটি সেটা একটা ভোলা, আবরণহীন মাঠ। কিছু আগাছার জঙ্গল আছে। সেখানে স্বল্পবাস বা নগ্ন বিশ-পঁচিশজন মেয়ে আর পুরুষ। কয়েকটা বাচ্চাও ছিল। সকলেরই বড় বড় চুল, নখ, পুরুষদের দাড়ি আর গোঁফ। দু-চারজন সামান্য জামাকাপড় পরলেও সেগুলো ছিল ভীষণ নোংরা আর ছেঁড়া। কেউ সাবানটাবান মাখত না। কাছে একটা বড় ঝিল মতো ছিল, সেখানেই চান করত। টয়লেট ছিল না। সকলেই প্রকাশ্যে মলমূত্র ত্যাগ করত। খোলাখুলি যৌন মিলনও হত সেখানে, বাচ্চাদের সামনেই। শুধু নারী-পুরুষ নয়, মেয়েতে মেয়েতে, ছেলেতে ছেলেতে। ভয়ে, লজ্জায়, ঘেন্নায় সোহাগ হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলত। ওরা কিছু বলত না তাকে। নির্বিকার। খাবার দিত ভুট্টা সেদ্ধ আর গোরুর মাংস, ফল-টল।

তাকে শেখানো হয়েছিল, এরকমভাবে থাকাই হল ন্যাচারাল লিভিং। এই থাকার মধ্যে কোনও কৃত্রিমতা নেই। আদিম কালের মানুষ এভাবেই থাকত এবং তখনই ছিল তারা সবচেয়ে সুখী।

বৃষ্টি বা রোদ কোনওটা থেকেই তারা আত্মরক্ষার চেষ্টা করত না। নির্বিকারভাবে থাকত। সোহাগকে ন্যাংটো করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখত তারা। বলত, ফিল দি আর্থ, দি উইন্ড, দি অ্যাটমোসফিয়ার। জামা কাপড় জুতো আমাদের সঙ্গে জগতের দূরত্ব সূচনা করে। কিছুদিন এইরকম আদিম জীবনযাপন করলে তুমি প্রকৃতিকে অনেক গভীরভাবে বুঝতে পারবে। ভূমিকম্প হবে কিনা, ঝড়-বৃষ্টি হবে কিনা, বন্যা হবে কিনা তা আদিম মানুষ তাদের অত্যাশ্চর্য অনুভূতি দিয়ে টের পেত, যেমন পায় কাঠবেড়ালি, বানর, টিকটিকি বা পিঁপড়ে। যন্ত্রসভ্যতার দাস হয়ে মানুষ সেই ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। পৃথিবীকে অনুভব করার চেষ্টা করো, তোমার সামনে সত্য উদঘাটিত হবে।

কথাগুলো কিছু বুঝতে পারত না সোহাগ। সে হাঁ করে চেয়ে থাকত। কাঁদত, অস্থির হত, ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত ঘাসের ওপর। তার শরীরে চুলকুনি হচ্ছিল, দাদের মতো চক্কর দেখা দিচ্ছিল চামড়ায়, চুলে জট, দাঁত মাজতে পারত না বলে মুখে বিচ্ছিরি গন্ধ।

সন্ধের পর ক্যাম্পফায়ার। সবাই বিশাল এক বৃত্ত রচনা করে বসত। মাঝখানে আগুন জ্বলছে। দুর্বোধ্য জঙ্গলের ভাষায় সবাই মিলে কী বলে যাচ্ছে কে জানে। জেনি নামে একটি মেয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়য়ে বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে ঘুরে ঘুরে শুরু করত নাচ। তার নগ্ন শরীরে আগুনের কাঁপা কাঁপা আলো। বিভোর হয়ে তালহীন ছন্দহীন ঢেউ-ঢেউ একটা নাচে তার শরীর টলতে টলতে ঘুরতে থাকত। ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ছিটকে পড়ত ঘাসের ওপর। কেউ দৌড়ে যেত না, ধরে তুলত না। নির্বিকারভাবে তাদের সুরহীন মন্ত্র বলে যেতে থাকত।

জেনি বলত তার ট্রান্স হয়। তার মানে বোঝেনি সোহাগ। জেনি তার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে একদিন বলল, তোমাকে দেখে মনে হয় তোমারও হবে। মহান প্রেত যার তার ওপর ভর করে না।

জেনিই শেখাল সোহাগকে তার অদ্ভুত মন্ত্র, নাচ। মিথ্যে বলবে না সোহাগ, ওই অদ্ভুত মানুষদের মধ্যে যে কয়দিন ছিল তার মধ্যে ওই একটা জিনিসই ভাল লেগেছিল তার। অর্থহীন অদ্ভুত সব শব্দ বলতে বলতে ঘুরে ঘুরে নাচ। নাচতে নাচতে হঠাৎ মাথা অন্ধকার করে পড়ে যাওয়া। ওরা বলত ট্রান্স। হতে পারে সোহাগ তখন অপুষ্টিজনিত কারণে দুর্বল বলেই তার মাথা অন্ধকার হয়ে যেত। শুধু শরীর কেন, কেঁদে কেঁদে তার মনটাও তো তখন দুর্বল।

কতদিন তাকে ওই জীবনযাপন করতে হবে বুঝতে পারত না সে। শুধু ভয় পেত, সে জংলি হয়ে যাচ্ছে, অসভ্য বর্বর হয়ে যাচ্ছে, ডাইনি হয়ে যাচ্ছে। নিজের গায়ের চিমসে গন্ধে তার নিজেরই বমি পেত। গা চুলকোতে গেলে বড় নখের কোলে উঠে আসত কালো ময়লা। ওই ভূমিখণ্ডের চারপাশে ছিল র‍্যাটল সাপ আর কাঁকড়াবিছের আস্তানা। প্রায়ই একটা দুটো সাপ দেখা যেত। ঘাসের ওপর চিড়বিড় করে হেঁটে বেড়াত বিছে। ওরা মারত না। কিন্তু ভয়ে রাতে ঘুমোতে পারত না সে। ঘুমোতে পারত না খোলা আকাশের নীচের ঠান্ডায়। বৃষ্টি হলে তো আরও দুর্দশা।

কতদিন কেটেছিল কে জানে। হিসেব নেই। তারপর একদিন সকালে হঠাৎ একটা হেলিকপ্টার এল। চক্কর দিতে লাগল তাদের মাথার ওপরে। দলের আধবুড়ো একটা লোক আকাশের দিকে চেয়ে বলল, দ্যাট চপার ইজ ব্যাড নিউজ, দে আর লুকিং ফর দ্যাট কিড। ওকে ফেরত দিয়ে এসো, নইলে পুলিশ আমাদের ছিঁড়ে খাবে।

যে মেয়েটি নিয়ে গিয়েছিল তাকে সে-ই দুপুরবেলা গাড়ি করে তাকে তার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে গেল।

পুরনো অভ্যস্ত জীবনে ফিরে এল সোহাগ। ফিরল, আবার ঠিক ফিরলও না। তার অস্তিত্বের একটা খণ্ড যেন রয়ে গেল ওই উন্মার্গগামী, আধপাগলা, যাযাবর মানুষগুলোর সঙ্গে, যারা পুলিশ তাড়া করলেই নিজেদের অস্থায়ী আস্তানা ছেড়ে ভাগ ভাগ হয়ে পালিয়ে যায়। ফের সংকেতমতো জড়ো হয়ে যায় কোথাও কোনও লক্ষ্মীছাড়া জায়গায়। হয়তো একটা ভুল জীবনই যাপন করে তারা, কিন্তু অবস্থান করে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি। খাওয়ার কষ্ট, শীত-গ্রীষ্মের কষ্ট, পোকামাকড় বা মশার কামড়, রোগ ভোগ সব সহ্য করেও একটা আনন্দও কি পায়?

সোহাগ ফিরে এল বটে, কিন্তু সেই সোহাগ নয়। মাত্র কয়েকদিনের এই অদ্ভুত জীবন তাকে বয়ঃসন্ধিতেই যেন সাবালিকা করে দিয়েছিল। ছেলেবেলাটাই যেন হারিয়ে গেল তার। একটু গম্ভীর, একটু বিষণ্ণ, একটু অন্তর্মুখী। ওই বন্ধুর পতিত উষর ভূখণ্ডে, আদিম জীবনযাপনের স্মৃতি সুখকর ছিল না মোটেই। তবু ফিরে আসার পর সে কখনও কখনও একটা আকর্ষণও অনুভব করত ওই জীবনের প্রতি। কেন, কে জানে!

পুলিশ তাকে কয়েকদিন ধরে জেরা করেছিল। ওরা মারধর বা ধর্ষণ করেছে কিনা তাকে, সম্মোহিত করেছে কি, কোনও গুপ্তবিদ্যা শিখিয়েছে কিনা, কোনও রাজনৈতিক মতবাদ ঢুকিয়েছে কিনা মাথায়, সন্ত্রাসবাদে দীক্ষা দিয়েছে কিনা, ড্রাগ ধরিয়েছে কিনা ইত্যাদি। সে কিছু গোপন করেনি বটে, কিন্তু মনে মনে চায়নি, ওরা পুলিশের হাতে ধরা পড়ুক। পুলিশ বারবারই বলত, দে আর দি ভুডু পিপল। দে প্র্যাকটিস ব্ল্যাক ম্যাজিক।

ওই ঘটনার পরই তার বাবা আমেরিকা থেকে তল্পিতল্পা গুটোতে লাগল। বলল, আর বিদেশে নয়।

গল্পটা তার মুখে সন্ধ্যা অন্তত দশবার শুনেছে। তবু আবার শোনে, আর চোখ গোল করে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে তার মুখের দিকে, ধন্যি তোর সাহস!

না পিসি, সাহসের কাজ তো কিছু করিনি! ওরা তো জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।

 না রে মেয়ে, তোর সাহসও আছে। ওরা তোকে এখনও চিঠি দেয় বুঝি?

ই-মেল জিনিসটা কী তা অনেক কষ্টে পিসিকে বুঝিয়েছে সোহাগ। আজকাল ব্যাপারটা অনেকটাই বুঝতে পারে সন্ধ্যা। গাঁয়েগঞ্জেও একটা-দুটো করে কম্পিউটার দেখা দিচ্ছে ইদানীং।

হ্যাঁ তো।

কী লেখে রে?

 লেখে, পৃথিবীর যেখানেই তুমি থাকো, তুমি আমাদেরই লোক। চিরকাল তুমি আমাদেরই লোক থাকবে। মনে রেখো আদিম মানুষেরাই ঠিকভাবে বাঁচতে জানত। তারাই টের পেত বেঁচে থাকার গভীর আনন্দ। মানুষদের জড়ো করো, সভ্যতার কৃত্রিমতা থেকে দূরে নিয়ে যাও, বাঁচতে শেখাও এক মুক্ত জীবনে। চারদিকে ছড়িয়ে দাও আমাদের আনন্দের বীজ। তোমাকে আমরা ভুলিনি, তুমিও আমাদের ভুলে যেও না।

হ্যাঁ রে, তোকে ওরা আবারও চুরি করবে না তো! চারদিকে আজকাল নাকি খুব ছেলেধরার উৎপাত। মানুষজনকে হুটহাট তুলে নিয়ে যায়।

না পিসি, ওদের অত ক্ষমতা নেই, তবে কে জানে, আজও আমরা আমেরিকায় থাকলে আমিই হয়তো ওদের খুঁজে বের করতাম।

ওমা! খুঁজে বের করে কী করবি?

সোহাগ সন্ধ্যার করুণ মুখ দেখে হেসে ফেলে। মাথা নেড়ে বলে, মাঝে মাঝে উইকএন্ডে গিয়ে ওদের সঙ্গে একটু অন্য স্বাদের জীবন কাটিয়ে আসতাম।

মাগো! এই যে বলিস ওরা ন্যাংটা হয়ে থাকে, যা-তা খায়।

হ্যাঁ তো৷ ওইটেই তো মজা!

দুর পাগলি! তুই একটা কী রে? ওসব অসভ্যদের কথা একদম ভাববি না। শুনলে আমারই কেমন গা গুলোয়। হ্যাঁ রে, তোর শহর-টহর একদম ভাল লাগে না, না? গাঁ-গঞ্জ, গাছপালা ভাল লাগে?

ঠিক ভাললাগা নয় পিসি, প্যাশন। গাছপালার মধ্যে আমার কখনও ভয় করে না। আমাকে যদি সুন্দরবনের বাঘের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দাও তাহলেও আমার একটুও ভয় করবে না। আমি মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াব।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যা বলে, তাহলে তোকে ওরা মন্তরই করেছে।

 সোহাগ হেসে বলে, করেছেই তো।

তুই সত্যিই মন্ত্র জানিস?

 শব্দগুলো জানি। মুখস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু অর্থ জানি না।

মন্ত্র পড়লে কী হয়?

শব্দগুলো উচ্চারণ করতে করতে মাথাটা কেমন ধোঁয়াটে হয়ে যায়। তারপর কেমন যেন শরীরে সাড় থাকে না।

জ্বলজ্বলে চোখে সন্ধ্যা চেয়ে থেকে বলে, আমাকে শেখাবি?

 কেন শেখাব না? সত্যি শিখবে?

সন্ধ্যা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে একটু ভাবল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, না বাবা, কী থেকে কী হয়ে যাবে। মাথা গুলিয়ে গেলে আমার ব্যবসা লাটে উঠবে। তখন খাব কী বল? একা মানুষ, কে দেখবে আমাকে! সংসারের তো ভরসা নেই। যতদিন বাবা আছে ততদিনই সংসারের সঙ্গে সম্পর্ক। বাবা চোখ বুজলে ঠিক তাড়িয়ে দেবে।

কেন পিসি, ওভাবে বলছ কেন? বড়মা, জেঠু এরা তো কত ভাল।

 সন্ধ্যা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সে তোদের কাছে ভাল। লোক বুঝে লোকে ভাল হয়, বুঝলি? এখনও তত বড় হোসনি, সংসারের সব প্যাঁচ বাইরে থেকে বুঝতে পারবি না। তার ওপর আমার তো আবার পোড়া কপাল, স্বামীর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে! শ্বশুরবাড়ি ফেরত মেয়েদের কেউ ভাল চোখে দেখে না। সবাই ভাবে, নিশ্চয়ই চরিত্রের দোষ ছিল, না হলে ঝগড়ুটে বজ্জাত, নইলে গোপন রোগ আছে, না হলে বাঁজা, নইলে তাড়াবে কেন! এদেশে যত দোষ তো মেয়েদের ঘাড়েই চাপে কিনা। এসব এখন বুঝবি না, বড় হলে তখন টের পাবি। সাধে কি আর উদয়াস্ত খেটে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।

মুখটা করুণ হয়ে গেল সোহাগের। বলল, হ্যাঁ পিসি, তুমি লেখাপড়া করলে না কেন?

সন্ধ্যা হেসে ফেলে বলল, ওরে আমি হলাম অমল রায়ের অপদার্থ বোন। একই মায়ের পেটে জন্মে তোর বাবার কী মাথা! আর আমার মাথায় গোবর। রোজ চেঁচিয়ে পড়া মুখস্থ করেও আকবরের বাবার নাম মনে থাকত না। কী ভাল লাগত জানিস? আজকালকার মেয়েরা শুনলে হাসবে। আমার ভাল লাগত সংসার করতে। মায়ের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সংসারের যাবতীয় কাজ করতাম। খুব ভাল লাগত। মনে হত নিজের সংসার যখন হবে তখন এমন গুছিয়ে কাজ করব যে, বাড়িতে লক্ষ্মীশ্ৰী ফুটে থাকবে। বেশি আশা করেছিলাম তো, তাই সংসারই হল না আমার।

আচ্ছা পিসি, তুমি তো আবার বিয়ে করতে পারো!

মাথা নেড়ে সন্ধ্যা বলল, না রে পারি না। ভাইঝি হলেও তুই তো আমার বন্ধুর মতোই হয়ে গেছিস। তোকে লুকোব কেন? আমার চেহারাটা তো কারও নজরে পড়ার মতো নয়! তার ওপর বয়সও তো বসে নেই। একজন ঘুরঘুর করে আসে, বিয়ের কথাও বলে। সে আমাদের স্বজাতি বামুন নয়। বাবাকে তার কথা বলেছিলাম। বাবা শুনে চুপ করে অনেকক্ষণ ভেবে বলল, দ্যাখ মা, ট্র্যাডিশন যদি ভাঙতে চাস ভাঙবি। তোর জীবনটা তো স্বাভাবিক নয়। কিন্তু কী জানিস, এক ধাপ নেমে যদি বাঁচতে পারিস তবে নামার একটা অর্থ হয়। ভাল করে ভেবে দ্যাখ, বিয়েটা এখন তোর কতটা প্রয়োজন। যদি তেমন প্রয়োজন না বুঝিস তবে খামোখা ঝঞ্জাট ডেকে আনবি কেন?

তুমি কী বললে?

আমি অনেক ভেবে দেখলাম, বাবা ঠিকই বলেছে। আমার বিয়ের আর তেমন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এই যে কাজকর্ম নিয়ে সকাল থেকে রাত অবধি কেটে যায় এতেই বেশ আনন্দে আছি। সঙ্গে আর একটা মানুষ জুটলে তারও তো কিছু বায়ানাক্কা থাকবেই। এখন হয়তো আমার আর সেসব সইবে না।

তুমি তা হলে কুমারীই থেকে যাবে?

 দুর বোকা! আমি যে হিন্দুমতে সধবা। বর তো দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে। আবছা করে হলেও এখনও রোজ সিঁদুর পরি। বামুনের মেয়ে তো, তাই এখনও ওসব ঘুচিয়ে দিতে পারিনি। যদিও সত্যি বলতে শাঁখা-সিঁদুরের মহিমা কিছু আছে বলে মনেই হয় না আমার। সব ভণ্ডামি।

তুমি কিন্তু বেশ লিবারেটেড উওম্যান। সেইজন্যই তোমাকে আমার এত ভাল লাগে।

দুর মুখপুড়ি! পেটে বিদ্যে নেই, মাথায় বুদ্ধি নেই, গতরে খেটে খাই, আমাকে নিয়ে অত বড় বড় কথা বলতে আছে?

বুদ্ধি না থাকলে কি ব্যবসা করতে পারতে? অ্যান্ড ইউ আর আর্নিং এ লট নাউ।

ওরে চুপ চুপ! জোরে বলিসনি। বেশি রোজগার করি শুনলে চারদিকে চোখ টাটাবে। তবে আমার বুদ্ধি বলতে ওইটুকুই, লোকের পছন্দমতো জিনিস বানাও আর টাকা কামাও। ঠাকুরের দয়ায় টাকা কিছু হয়েছে। তোর বিয়েতে তোকে একটা নেকলেস দেব, দেখিস।

যাঃ, বিয়ে কে করবে?

তবে কি পিসির মতো লক্ষ্মীছাড়া জীবন কাটাবি? ও কথা ভাবা ভাল নয়। বরং অল্প বয়সে একটা সুন্দর ভাল ছেলেকে বিয়ে করে ফেল, সুখে থাকবি।

আমার কারও সঙ্গে বনিবনা হবে না পিসি। আমি একটু অদ্ভুত আছি তো।

কে বলল তুই অদ্ভুত?

 সবাই বলে। আমার মা-বাবা অবধি।

তোর যেটুকু অদ্ভুত সেটুকুই ভাল। পাঁচজনের মতো গড়পড়তা হয়ে লাভ কী?

তুমি আমার সব কিছুই ভাল দেখ, না?

সন্ধ্যা ম্লান হাসল। তারপর ধরা গলায় বলল, তোর ওপর আমার কেন যে এত মায়া! কে জানে, আর জন্মে বোধহয় আমার মেয়ে ছিলি।

এই কথাটা অনেকক্ষণ রিনরিন করল সোহাগের কানে। অনেকক্ষণ। পিসির হাহাকার, একাকিত্ব, ব্যর্থতা যেন ওই কথার মধ্যে ঘন হয়ে আছে।

বিকেলে পান্না তাকে বলল, তোমাকে বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।

 হাসল সোহাগ, এখানে এলেই আমি ভাল থাকি।

কিন্তু এটা তো একটা ধ্যাধধেড়ে গোবিন্দপুর। ম্যাগো, কী আছে বলো তো এখানে! আমার তো কলকাতায় চলে যেতে ইচ্ছে করে খুব।

আমার ঠিক উলটো। আমার তো কোনও দেশ ছিল না, জানো তো! কোনটা আমার দেশ, দেশ মানে কী তা বুঝতামই না। এক সময়ে আমেরিকা খুব ভাল লাগত। তারপর ফের একটা ভ্যাকুয়াম। মেট্রোপলিটান সিটিগুলো তো কারও দেশ হতে পারে না। তাই কলকাতা কখনও আমার দেশ হয়নি।

আহা, এটা তো তোমার দেশই। কিন্তু আমাদের গ্রামটায় কী আছে বলো!

ওটা একটা ডিসকভারির ব্যাপার। তোমাকে আবিষ্কার করতে হবে।

কীভাবে?

তা জানি না। আমি শুধু জানি, ফিল করি, এটা আমার জায়গা।

বড় বড় চোখে পান্না বলে, করো?

 সোহাগ একটু লাজুক হেসে বলে, এখন করি।

বাবা, এই ভুতুড়ে গাঁ ছেড়ে আমি বরং একটা জমজমাট শহরে চলে যেতে চাই, যেখানে অনেক আলো, অনেক লোকজন, অনেক হইচই।

ভূত যদি থেকেই থাকে তা হলে তাদের মধ্যে তো আমার অ্যানসেস্টররাও থাকবে। তাদের সঙ্গে দেখা হওয়া তো ভীষণ রোমান্টিক।

ওরে বাবা! এখন দাদু এসে সামনে দাঁড়ালে যে আমার হার্টফেল হয়ে যাবে।

দাদু এসে সামনে দাঁড়াল না, পান্নারও হার্টফেল হল না। কিন্তু এই সময়ে দরজায় এসে যে লম্বা ছিপছিপে লোকটি দাঁড়াল তাকে দেখে সোহাগের হঠাৎ বুকের মধ্যে ধক ধক শব্দ হচ্ছিল।

লোকটা গম্ভীর মুখে বলল, ওঃ, সরি।

বলেই ফিরে যাচ্ছিল।

পান্না চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাই বিজুদা! কী হচ্ছে? এসো বলছি।

বিজু মুখ ফিরিয়ে বলল, তোরা গল্প করছিস কর। আমি বরং একটু কাকিমার ঘরে যাই।

 না না, প্লিজ! একটু এসো। একে তো তুমি চেনো বাবা! অত লজ্জা কীসের?

 বিজু বলল, লজ্জা-উজ্জা নয়। তোরা গল্প কর না। টু ইজ কম্পানি, থ্রি ইজ ক্রাউড।

আচ্ছা বাবা, আর অ্যাভয়েড করতে হবে না। প্লিজ এসো।

সোহাগ বিছানায় আধশোয়া হয়েছিল। উঠে বলল, না পান্না, এবার আমি যাব। আপনি আসতে পারেন।

পান্না ধৈর্য হারিয়ে বলে ফেলল, উঃ, তোমাদের দুজনের মধ্যে যে সেই থেকে কী হচ্ছে! আমি আর পারি না তোমাদের নিয়ে। একটা শো-ডাউন করে নাও তো। তারপর ভাব করে ফেল।

বিজু হেসে ফেলল। বলল, শো-ডাউন আবার কীসের? কফি খাওয়াবি? তা হলে পাঁচ মিনিট বসে যেতে পারি। আজ যা শীত পড়েছে।

খাওয়াচ্ছি বাবা, কফির সঙ্গে আর কী খাবে?

আর কিছু না। তোদের ঘরে ঢোকাও এক ঝামেলা, জুতো খুলতে হয়।

 আর ফাঁড়া কাটতে হবে না। এসো ভিতরে। এই সোহাগ, কফি খাবে তো!

না, আমি এখন যাবো।

 প্লিজ একটু বোসো। আমি আসছি।

বলেই পান্না এক লাফে নেমে ছুট দিল রান্নাঘরে।

সোহাগ মাথা নিচু করে ছিল। পুরুষদের সে কখনও লজ্জা পায় না। তার অনাবশ্যক কোনও সংকোচ বা হীনম্মন্যতা নেই। তবু এই মানুষটার চোখে চোখ রাখতে তার একটু সংকোচ হচ্ছিল।

কেমন আছ সোহাগ?

এটা কি একটা প্রশ্ন হল? ভীষণ বোকা-বোকা ওপেনিং। সোহাগ একটু হাসল। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, বোধহয় ভালই।

বোধহয় কেন?

আমি বুঝতে পারি না কেমন আছি।

ও।

কথা ফুরিয়ে গেল। হয়তো সূক্ষ্ম একটু অপমানও করে ফেলল সোহাগ। তা হোক। অমন বোকা বোকা প্রশ্ন করে কেন?

বসে বসে পা দোলাচ্ছিল সোহাগ। দেয়ালে একটা টিকটিকি একটা পোকার দিকে এগোচ্ছে। ওই যা! পোকাটা উড়ে দূরে গিয়ে বসল। তার কোনও প্রশ্ন নেই।

প্রশ্ন নেই। কিন্তু হয়তো কথা আছে। কী কথা তা মনে পড়ছে না তার। কথা বলতেই হবে এমন কোনও নিয়মও তো নেই। তাকাতেই হবে, এমনও তো নয়। সোহাগ বসে রইল। বিজু বসে রইল। চুপচাপ।

কিন্তু সোহাগের বুকের ভিতরে ধক ধক শব্দটা হয়েই যাচ্ছে। হৃৎপিণ্ড রক্ত পাম্প করে। সুতরাং শব্দ তো হওয়ারই কথা। তফাত হল, অন্য সময়ে শব্দটা সে শুনতে পায় না। এখন পাচ্ছে। তার খারাপ লাগছে না।

আরও একটা সত্য হল, এই লোকটা এসে কাছাকাছি বসবার পর সোহাগের কেন যে ব্যাপারটা ভাল লাগছে। বেশ ভাল লাগছে। ইচ্ছে হচ্ছে এভাবে বসে থাকতে। এরকম লাগার কথা নয়। অথচ লাগছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *