৫. লেপের তলায় গিয়ে

ওদের তিনজনকে শোয়েব বলেছিলো ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নিতে, ও জেগে পাহারা দেবে। সুমনরা লেপের তলায় গিয়ে শুলেও অনেকক্ষণ কারও চোখেই ঘুম এলো না। ঘন্টা দেড়েক পর বাইরের বারান্দায় মকবুল আর ওর সঙ্গী পাল্লা দিয়ে নাক ডাকা শুরু করলো। কোনও কথা না বলে শোয়েব গায়ে হাত দিতেই ওদের তন্দ্রা কেটে গেলো। বুঝলো যাওয়ার সময় হয়েছে।

শোয়েব খুব সাবধানে বিছানা থেকে নেমে হুড়কো খুলে দরজাটা সামান্য ফাঁক করলো। একটুখানি শব্দ হলো। সামনে দেখলো মকবুলরা দুজন নয়, তিনজন। এমন বিচ্ছিরি ভাবে শুয়ে আছে বেরুতে হলে ওদের গা মাড়িয়ে যেতে হবে। হতাশ হয়ে শোয়েব আবার দরজা বন্ধ করে দিলো। সুমনদের কাছে গিয়ে বললো সিঁদ না কেটে বেরুনো যাবে না।

কিভাবে সিঁদ কাটবে অবাক হয়ে জানতে চাইলো রবি।

ঘরের ভেতর শাবল, খন্তা কিংবা মাটি খোঁড়া যায় এমন কিছু আছে কি না দেখতে হবে।

তিনজন খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামলো। হারিকেনের সলতে সামান্য উস্কে দিয়ে তক্তপোষের তলায় ভালো মতো খুঁজলো। ঘরে কেন, আলমারির পেছনে সব কিছু খুঁজেও শাবল জাতীয় কিছু পেলো না। মনে মনে প্রমাদ গুণলো শোয়েব। একটা কিছু খুঁজে বের করতেই হবে। শুধু হাতে মাটি খোঁড়া যাবে না।

অনেকক্ষণ খোঁজার পর বেড়ার গায়ে গোজা একটা খুরপি চোখে পড়লো শোয়েবের। গায়ে জমা মর্চে দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো বহুদিন ওটা কেউ ব্যবহার করেনি। নিঃশব্দে বেড়ার গা থেকে ওটা খুলে শোয়েব। ঝন্টু অবাক হয়ে জানতে চাইলো, এতে হবে।

উত্তেজনায় ওর গলায় সামান্য শব্দ হলো। ঠোঠে-আঙুল চেপে শোয়েব ওদের শব্দ করতে বারণ করলো। ফিশ ফিশ করে বললো, এ দিয়েই কাজ চালাতে হবে।

ওরা তিনজন অবাক হয়ে দেখলো বেড়ার নিচে মাটির মেঝেতে শোয়েব খুরপি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মাটি তুলতে লাগলো। ওদের বিস্মিত চোখের সামনে আধঘন্টার ভেতর ও বাইরে যাওয়ার মতো একটা গর্ত কেটে ফেললো। সুমন শুধু একটু পর পর দরজায় কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করছিলো মকবুলদের নাক ডাকার ছন্দে কোনও পতন হয় কি না। শোয়েবদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত মকবুলরা তিনজন তিন রকম তালে পাল্লা দিয়ে নাক ডাকছিলো।

ঝামেলা বাধালো কুকুরগুলো। বড় রাস্তায় না ওঠা পর্যন্ত দুটো নেড়ি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে তারস্বরে ডাকছিলো। রবি একবার মাটির ঢেলা ছুঁড়ে মারতে নেড়ি দুটো এমন চি ৎকার শুরু করলো যে গ্রামের সব কটা কুকুর ওদের সঙ্গে গলা মেলালো।

প্রথমে ঘুম ভাঙলো মকবুলের। চোখ কচলে উঠে বসে টর্চ জ্বালালো। সঙ্গী দুজনকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললো, মনে হচ্ছে চোর এসেছে। বিনা কারণে মাঝ রাতে এভাবে কুকুর ডাকার কথা নয়।

বাইরে তখন রীতিমতো হিম পড়ছে। চৈত্রের শেষে দিনে মোটামুটি গরম থাকলেও শেষ রাতে রীতিমতো শীত পড়ে। মকবুলের সঙ্গী দুজন খুবই অনিচ্ছার সঙ্গে উঠে বসলো। একজন বিড় বিড় করে বললো, কুকুরকে নিশি পেলে এরকম ডাকে।

আরেকজন বললো, হাজি বাড়িতে চুরি করতে আসবে কার এমন বুকের পাটা! জানে না বাড়িতে কটা বন্দুক আছে।

মকবুল বললো, ওঠ তোরা আমি গিয়ে বাড়ির চারপাশটা একটু ঘুরে আসি। তোরা ওখানে বসে থাক।

কাঁচারি ঘরে টাকা পয়সা কিছু থাকে না। যা কিছু চুরি বা ডাকাতি হতে পারে সব গৃহকর্তার শোয়ার ঘরের স্টিলের আলমারি আর লোহার সিন্দুকে রাখা। মকবুল সবার আগে বড় ঘরের চারপাশটা ঘুরে দেখলো। গাছের ওপরও টর্চের আলো ফেলে দেখলো কেউ সেখানে লুকিয়ে আছে কি না। বড় ঘর দেখে বিবিদের ঘর দেখলো। কোথাও সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লো না। বুঝতে পারলো না কেন কুকুরগুলো এভাবে চিৎকার করছে।

ভাবতে গিয়ে মকবুলের একাত্তরের কথা মনে হলো। ওদের মনিব বলেন গণ্ডগোলের বছর। তখন গ্রামে যখন পাকিস্তানী সৈন্য কিংবা খাকি পোশাক পরা রাজাকার ঢুকতো কুকুরগুলো এভাবে চিৎকার করতো। হঠাৎ মনে হলো গ্রামে পুলিশ ঢোকেনি তো। ও জানে বাড়িতে এমন সব অস্ত্র আছে যেগুলোর লাইসেন্স পাওয়া যায় না। হুজুরের বড় ছেলে করিম মিয়া একবার বলেছিলো এসব অস্ত্র পুলিশ কিংবা আর্মির নজরে পড়লে বিপদ হবে। যদিও থানার দারোগা মাসে দু একবার এসে জেয়াফত খেয়ে যান তবু সাবধান থাকা ভালো। এই ভেবে মকবুল গৃহকর্তার ঘরের দরজায় সমানে কয়েক বার। টোকা দিয়ে বললো, হুজুর, একটু দরজা খোলেন।

পনেরো কুড়িটা কুকুর যেভাবে তারস্বরে ডাকছিলো গৃহকর্তারও ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। মকবুলের গলা শুনে উঠে দরজা খুললেন তিনি। ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে।

মকবুল সতর্ক গলায় বললো, গ্রামে মনে হয় পুলিশ এসেছে। কুকুরের ডাক শুনে আমি প্রথমে চোর ভেবেছিলাম। উঠে ভালো মতো দেখেছি। চোর টোর কিছু চোখে পড়েনি।

শহর থেকে ছেলেরা যে এসেছে ওগুলো ঠিক মতো আছে তো?

জ্বী হুজুর আছে।

চল গিয়ে দেখি।

মকবুলকে সঙ্গে নিয়ে গৃহকর্তা কাঁচারি ঘরে এলেন। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিলো। কয়েকবার ডাকাডাকি করার পর গৃহকর্তা মকবুলকে বললেন, পিছনের জানালা খোলা কিনা দেখ।

কাঁচারি ঘরের পেছনে যেতেই জানালার নিচে কাটা সিঁদ মকবুলের চোখে পড়লো। আর্ত চিৎকার করে বললো, হুজুর জলদি আসেন। সর্বনাশ হয়ে গেছে।

গৃহকর্তা ব্যস্ত পায়ে ছুটে গেলেন সেখানে। সিঁদ দেখে মকবুলকে বললেন, এটার ভেতর দিয়ে ঘরে ঢোক। ছেঁড়াগুলোর জিনিসপত্র বোধহয় সব নিয়ে গেছে।

মকবুল খচমচ করে পাকা চোরদের মতো সিঁদের গর্ত দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে আবার চিৎকার করলো। হুজুর ঘরে কেউ নাই।

গৃহকর্তা ধমকে বললেন, দরজা খোল হারামজাদা।

মকবুল দরজা খুলতেই ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন তিনি। টর্চের আলোয় দেখলেন মস্ত বিছানা খা খা করছে। ওদের ব্যাগ, আলনায় রাখা জামা কাপড় কিছুই নেই। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ইবলিশগুলো সিঁদ কেটে পালিয়েছে। তোরা নিশ্চয় নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলি। বাস করে মকবুলের গালে এক প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দিলেন তিনি। নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলি! বলে মকবুলের সঙ্গে সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চাকর দুটোকে দুটো লাথি মারলেন।

দূরে তখনও তারস্বরে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছিলো। মকবুলকে তিনি ধমক দিয়ে বললেন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিস নাকি। হোন্ডায় করে জলদি যা বজ্জাতগুলো মনে হয় বেশি দূর যেতে পারেনি।

মকবুল ছুটে বেরুতে যাবে, গৃহকর্তা আবার ওকে ধমক দিয়ে ডাকলেন, খালি হাতে কোথায় যাচ্ছিস হারামি। মতিউর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে যা । তোর কাছেও পিস্তল রাখবি। ধাড়িটাকে যেভাবে পারিস আমার সামনে হাজির করবি, শুধু জানে মারবি না।

মতিউর রহমান এ বাড়িতে জায়গীর থাকে, কক্সবাজার কলেজে পড়ে আর সৎ লোকের শাসন চাই বলে কলেজের ছেলেদের হাত পায়ের রগ কাটে।

মকবুলরা চলে যাওয়ার পর হতাশ হয়ে গৃহকর্তা তক্তপোষের ওপর বসলেন। তিনি ভালো মনে করেই ছেলেগুলোকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ভাগ্যিস রাতে চেয়ারম্যান এসেছিলেন। ধাড়ি ছেলেটা নাকি ইউনিভার্সিটি থেকে ওদের দলের খুবই মূল্যবান আর গোপন দলিল চুরি করে পালাচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে উত্তরে ফেণী আর দক্ষিণে কক্সবাজার পর্যন্ত দলের সবগুলো ঘাঁটিতে খবর দেয়া হয়েছে। ওপর থেকে বলা হয়েছে, এই দলিলগুলো উদ্ধার করার জন্য যদি দশটাকেও মারতে হয় মারবে, যে কোনও মূল্যে কাগজগুলো পেতে হবে। এই দলের এটাই একটা সুবিধে। ওপর থেকে আসা যে কোনও হুকুম কর্মীরা বিনা প্রশ্নে তামিল করে।

.

গৃহকর্তা যখন শোয়েবদের কিভাবে কজা করবেন এ নিয়ে আকাশ পাতাল ভাবছেন তখন ওরা চারজন অন্ধকার হাইওয়ে ধরে কক্সবাজারের দিকে দৌড়াচ্ছিলো। মিনিট পনেরো দৌড়োনোর পর অন্যরা ক্লান্ত না হলেও সুমনের হাঁপ ধরে গেলো। ঝন্টু আর। রবির এক ঘন্টা দৌড়ের অভ্যাস আছে। স্কুলে থাকতে শোয়েবও এ্যানুয়াল স্পোর্টস-এ নাম লেখাতো। সুমন মনে মনে ভাবলো ঢাকা ফেরার পর সকালে ঝন্টুর সঙ্গে দৌড় প্র্যাকটিস করবে। বহুদিন ঝন্টু ওকে বলেছে পাত্তা দেয়নি। এখন ওর মনে হচ্ছে বডি ফিট রাখাটা কত দরকার।

শেষের দিকে সুমন যেভাবে টেনে টেনে নিঃশ্বাস ফেলছিলো–ঝন্টুর চোখ পড়লো। দৌড়ের গতি কমিয়ে বললো, একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার শোয়েব ভাই।

শোয়েব এত তাড়াতাড়ি বিশ্রাম নেয়ার পক্ষপাতি ছিলো না। মকবুল আর তার দলবল ধাওয়া করছে কি না কে জানে। ওদের সঙ্গে ট্রেইনড কুকুরও থাকতে পারে। এত কিছু ভাববার পরও সুমনের অবস্থা দেখে বাধ্য হয়ে থামতে হলো শোয়েব আর রবিকে। চারপাশে তাকিয়ে শোয়েব বললো আমরা ওই পাথরটার আড়ালে বসতে পারি। হাইওয়ে ধরে কেউ আমাদের খুঁজতে বেরহলেও টের পাবে না।

কথা না বলে সবাই নিরবে শোয়েবেকে অনুসরণ করলো। দূর থেকে ওরা যেটাকে পাথর ভেবেছিলো ওটা ছিলো কারও পরিত্যক্ত বাড়ির উঁচু পাকা ভিটে। শুধু ভিটেটুকুই আছে, দেয়ালের কোনও চিহ্ন নেই। এদিকে জঙ্গলও বেশ ফাঁকা। হাইওয়ে থেকে চোখের আড়াল হলেও শোয়েবের কাছে জায়গাটা নিরাপদ মনে হলো না। কেউ যদি ওদের খুঁজতে বেরোয় এদিকে ঢু মারাটা বিচিত্র নয়। তারপরও রবির অবস্থা দেখে শোয়েব ওর আশঙ্কার কথা বলতে পারলো না।

এয়ার ব্যাগটা মাথার নিচে দিয়ে সুমন হাত পা মেলে শুয়ে পড়েছে। নিঃশ্বাস ফেলছে জোরে জোরে। শোয়েবের মনে হলো মিনিট পনেরো বিশ্রাম না নিলে ও হাঁটতে পারবে না।

পাঁচ মিনিটও হয়নি ওরা বিশ্রাম নেয়ার জন্য বসেছে দূরে মটর সাইকেলের শব্দ শোনা গেলো। একটু আগে শোয়েব ঘড়ি দেখেছে। রাত তখন আড়াইটা। এ সময় কোনও সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বেরুবে না। যে আসছে সে নিশ্চয় ওদের বন্ধু নয়। তবু কিছুই করার নেই। ভরসার কথা একটাই। হোন্ডায় করে দুজনের বেশি আসতে পারবে না। শোয়েবরা রয়েছে চারজন। কথাটা মনে হওয়াতে ও একটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলতে যাবে। তখনই ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো গভীর রাতে ছাত্রদের হল-এ ছাত্র শিবিরের গুণ্ডাদের অস্ত্র হাতে ছুটোছুটির দৃশ্য। হোন্ডায় যারা আসছে তাদের হাতে মেশিন পিস্তল না থাকুক দুটো রিভলভারও যদি থাকে শোয়েবরা নিরস্ত্র চারজন কিছুই করতে পারবে না।

নিজেকে এক রকম ভাগ্যের হাতে সপে দিয়ে কাঠ হয়ে বসেছিলো শোয়েব। শিবিরের ছেলেদের নৃশংসতার কথা সুমন, ঝন্টু আর রবি অতটা জানে না, যতটা জানে শোয়েব। তবে সুমনরা এটা বুঝে ফেলেছে শোয়েবকে যদি ওরা ধরতে পারে নির্ঘাত খুন করবে। শোয়েবের সঙ্গী হওয়ার জন্য ওদেরও ছেড়ে দেবে না।

ওদের সবাইকে সাময়িকভাবে উদ্বেগ থেকে রেহাই দিয়ে ভট ভট শব্দ করে হোন্ডাটা কক্সবাজারের দিকে চলে গেলো। বুকের ওপর তো চেপে বসা আতঙ্কের ভারি বোঝা থেকে কিছুক্ষণের জন্যে মুক্ত হলো শোয়েব। সুমন লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো, এই যাত্রা জানে বেঁচে গেছি–কী বলো শোয়েব ভাই?

শোয়েব শুকনো হেসে বললো, কক্সবাজার না পৌঁছা পর্যন্ত কিছুই বলা যায় না।

সুমন বললো রাতটুকু আমরা বনের ভেতর বিশ্রাম নিয়ে কাটাতে পারি। সকালে একবারে গাড়ি নিয়ে কক্সবাজার চলে যেতাম। আমার মনে হয় রাজা আলী মেকানিক নিয়ে সকালের আগে আসতে পারবে না।

ওদের কাছে দিন রাত সব সমান। শোয়েব শান্ত গলায় সুমনকে বললো, তুমি যা ভাবছো, ওরাও তোমার মতোই ভাববে। গাড়ির আশে পাশে ওদের পাহারাওয়ালা থাকবে। গাড়িতে বোমা জাতীয় কিছু ফিট করে রাখাটাও অসম্ভব নয়।

রবি ভয় পাওয়া গলায় জানতে চাইলো–তাহলে আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি। কিভাবে?

হেঁটে। শোয়েব জবাব দিলো–রাতে যতটা পারি হাইওয়ে থেকে নেমে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে এগিয়ে থাকবো। বাকি পথ দিনে ম্যানেজ করা যাবে।

মাঝ রাতে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটার প্রস্তাব রবির পছন্দ হলো না। কত দিনের পুরোনো জঙ্গল কে জানে। গাড়িতে আসার পথে লক্ষ্য করেছে কোনও কোনও গাছ এত পুরোনো যে গায়ে পুরু শ্যাওলা জমেছে। হিংস্র জন্তু জানোয়ার আর সাপখোপের কথা বাদ দিলেও এ ধরনের জঙ্গলেই অপদেবতারা থাকে। ওদের স্কুলের শুভদারঞ্জন স্যার বলেছেন বনের ভেতর অপদেবতারা কেউ গাছের চেহারা ধরে কেউ পাথর কিংবা পাহাড়ের চেহারা ধরে পড়ে থাকে। সিদ্ধ পুরুষ ছাড়া কেউ ওদের চিনতে পারেন না। বাগে পেলে ওরা মানুষের ঘাড় মটকে দেয় রক্ত শুষে নেয়। এসব কথা অবশ্য রবি সুমনরা বিশ্বাস করে না। গত কয়েক ঘন্টায় শোয়েবের সঙ্গে যতটুকু পরিচয় হয়েছে সেও শুনলে হেসে উড়িয়ে দেবে। খুবই অনিচ্ছার সঙ্গে অসহায় রবি ওদের সঙ্গী হলো।

বনের ভেতর দিয়ে হাঁটলেও ওরা দূরে হাইওয়ের দিকে লক্ষ্য রাখছিলো। হোন্ডায় চেপে যারা কক্সবাজারের দিকে গেছে ওরা যে কোন সময় ফিরে আসতে পারে। এবার এলে হয়তো দল আরও ভারি করে আসবে। চেয়ারম্যান যখন জামাতী গ্রামে ওদের ঘাঁটি বেশ শক্তই বলতে হবে। শোয়েব পত্রিকায় পড়েছে, নিজেও জানে চট্টগ্রাম আর পার্বত্য চট্টগ্রামে ওরা যথেষ্ট শক্তিশালী। ওকে যেভাবে ওরা খুঁজছে কতক্ষণ ওদের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচবে আল্লা মালুম।

ও যা ভেবেছিলো–মিনিট দশেক পরই দক্ষিণের কক্সবাজারের দিক থেকে একটা হোন্ডা বেশ মন্থর গতিতে উত্তর দিকে গেলো। শব্দ শুনে ওরা বুঝতে পেরেছিলো এই হোন্ডাটাই একটু আগে ওদের পাশ কাটিয়ে কক্সবাজারের দিকে গিয়েছে।

হোন্ডার শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝন্টু উত্তেজিত গলায় বললো, একটা জিনিস তোমরা লক্ষ্য করোনি। কী জিনিস? অবাক হয়ে জানতে চাইলো সুমন আর রবি। কক্সবাজারের দিকে যাওয়ার সময় হোন্ডার লোক ছিল তিনজন, এখন দেখছি মাত্র একজন।

কি বলতে চাইছিস তুই?

হয় ওরা দুজন পথের দু পাশে অস্ত্র হাতে আমাদের আপেক্ষা করবে, নইলে সামনের যে গ্রামগুলো ওদের ঘাঁটি–সেখানে আগের মতো ইনফর্ম করবে।

তাহলে আমরা সামনে যাচ্ছি কেন?

শোয়েব বললো, ওদের চোখ এড়িয়ে যেভাবেই হোক আমাদের কক্সবাজার পৌঁছাতে হবে।

সুমন আবারও বললো, রাতটুকু অপেক্ষা করে সকালে গেলে হয় না শোয়েব ভাই? সকালে আমরা রাজা আলীকে না পেলেও বাসে কিংবা ট্রাকে লিফট নিয়ে কক্সবাজার যেতে পারি।

তোর কি হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে সুমন? জানতে চাইলো ঝন্টু।

হ্যাঁ, পা ব্যথা করছে?

সুমনের কথায় রবিও সায় জানালো, রাতটা মনে হয় বনের ভেতর কাটানোই ঠিক হবে।

শোয়েব বললো, ঠিক আছে, সামনের ওই কড়ই গাছের নিচে বসে রাতটুকু কাটিয়ে দেয়া যাবে। তবে সকালেও হাঁটতে হবে। সুমন হাইওয়েতে ওঠা আমি নিরাপদ মনে করছি না।

সুমন বললো, রাতে বিশ্রাম নিতে পারলে সকালে হাঁটতে মোটেই কষ্ট হবে না।

ঝন্টু আর সুমনের ব্যাগে চাদর ছিলো। ঝকড়া পুরোনো কড়ই গাছের নিচে ঘাসের ওপর চাদর বিছিয়ে বসলো সবাই। গাছের চেহারা দেখে অবশ্য রবির মনের ভেতর খুঁত খুঁত করছিলো। তবে রাতের বেলা জঙ্গলের ভেতর হাঁটতে গিয়ে পথ হারিয়ে যদি অশুভ কোনও শক্তির কোপে পড়ে সেই ভয়ে পুরোনো গাছ হলেও কড়ই তলাটাই নিরাপদ ওর মনে হলো। হাত ব্যাগের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লো রবি। ওর মনে হলো ঝন্টুরাজেগে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়া উচিৎ। সুমনের মতো ক্লান্ত না হলেও রবি আর ঝন্টুরও ঘুম পাচ্ছিলো। রাত যদিও শেষ হতে চলেছে–ঘুম ছিলো না শুধু শোয়েবের চোখে। সুমনদের কথা ভেবে নিজেকে ওর অপরাধী মনে হচ্ছিল। বেচারারা কক্সবাজার যাচ্ছিলো বেড়াতে। ও যদি পথের মাঝখানে ওদের গাড়িতে লিফট না নিতো এত সব ঝামেলা হতো না। এতক্ষণে ওদের কক্সবাজারের সার্কিট হাউসের নরম গদি মোড়া বিছানায় ঘুমোনোর কথা। একটু ইতস্তত করে শোয়েব মৃদু গলায় বললো, তোমরা কি আমার ওপর রাগ করেছে সুমন?

সুমন অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, এ কথা কেন বলছো শোয়েব ভাই?

আমার জন্য তোমাদের এত সব ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে দেখে আমার খুব খারাপ। লাগছে।

আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা খুব রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে।

ঝন্টু সায় জানিয়ে বললো, কতগুলো গুণ্ডা, আউটল আমাদের খুঁজছে–ওয়েস্টার্ণ কাহিনীর মতোই রোমহর্ষক মনে হচ্ছে।

শুকনো হেসে শোয়েব বললো, ব্যাপারটা মোটেই রোমাঞ্চকর কিংবা ওয়েস্টার্ণ কাহিনীর মতো রোমহর্ষক নয়। জামাত শিবিরের গুন্ডাদের তোমরা চেনো না। আল্লার নাম নিয়ে এরা যে কোনও জঘন্য কাজ করতে পারে। মানুষ খুন করা, নয়তো হাত পায়ের রগ কেটে দেয়া এদের কাছে খুবই মামুলি ব্যাপার।

ঝন্টু ভয় পাওয়া গলায় বললো, ধরতে পারলে তোমাকে ওরা খুব মারধোর করবে, তাই না শোয়েব ভাই? শুধু মারধোর করে যদি ছেড়ে দেয় তাহলে বুঝতে হবে বনের বাঘ মাংশ ছেড়ে ঘাস খাওয়া শুরু করেছে। কথাটা বলে শোয়েব সবার মুখের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলো–ওরা মারধোর খুব একটা করে না। কম শাস্তি দিতে হলে হাত আর পায়ের রগ কেটে ছেড়ে দেয়, চিরজীবন যাতে পঙ্গু হয়ে থাকতে হয়। শাস্তির মাত্রা সামান্য বাড়লে কবজি থেকে হাত কেটে আলাদা করে ফেলে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওদের শত্রুদের ওরা প্রাণে মেরে ফেলতেই পছন্দ করে।

শোয়েবের কথা শুনে সুমন আর ঝন্টু আঁতকে উঠলো। ভাগ্যিস রবি ঘুমিয়ে পড়েছিলো। নইলে কয়েক রাতের জন্য ওর ঘুম হারাম হয়ে যেতো।