৩. চট্টগ্রাম কক্সবাজার হাইওয়ে

চট্টগ্রাম কক্সবাজার হাইওয়েতে গত দু মাস পাঁচটা বাস ডাকাতি হওয়াতে বিকেলের দিকে রাস্তা এক রকম ফাঁকা থাকে। শেষ বাস ছাড়ে একটায়, যাতে সন্ধ্যের আগে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। ঝন্টুরা লক্ষ্য করেছে পনেরো কুড়ি মিনিট পর পর দু একটা গাড়ি যতটা জোরে চালানো সম্ভব–পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। শোয়েবের কথা শুনে ওরা তিনজন হতবাক হয়ে গেলো। স্টিয়ারিঙে হাত রেখে রাজা আলী সতর্ক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কান খাড়া করে ও সমবয়সী শোয়েবের কথা শুনছিলো। প্রথমে রাজা আলী কিছুটা বিরক্ত হলেও শোয়েবের সঙ্গে সুমনদের কথা শুনতে শুনতে বিরক্তি কেটে গিয়ে কখন যে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে টেরও পায়নি। ওর বিপদের কথা শুনে রাজা আলীও উদ্বেগ বোধ করলো।

শেষ বিকেলের আলো মরে গিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। জঙ্গলের মাঝে মাঝে হাইওয়ের পাশে ফাঁকা জমিতে কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। বসন্তকাল শেষ হতে চলেছে, তারপরও বাইরে তখন সমুদ্র থেকে উঠে আসা ঠাণ্ডা বাতাস বইছিলো। রাজা আলী গাড়ির হেড লাইট অন করেছে। ও জানে কুয়াশা জমা হাইওয়েতে গাড়ি খুব সাবধানে চালাতে হয়।

বিপদের কথা বলেই শোয়েব চুপ হয়ে গিয়েছিল। ও বুঝতে পেরেছে সুমনরা আন্তরিকভাবে ওর বিপদ সম্পর্কে জানতে চাইছে। তারপরও সদ্য স্কুলের পাঠ শেষ করা তিনটা নিষ্পাপ ছেলেকে ওর বিপদের কথা বলে ওদের উদ্বিগ্ন করার ব্যাপারে শোয়েব মন থেকে সায় পাচ্ছিলো না। সুমনরা কক্সবাজারে যাচ্ছে ছুটি কাটাতে, আনন্দ করতে। এ সময় ওদের আনন্দের জগৎ থেকে সরিয়ে আনা মোটেই উচিৎ হবে না। বিশেষ করে সব কথা শোনার পর ওরা যদিও কোনও ভাবে বিপদের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, সেটা খুবই অনুচিৎ কাজ হবে।

শোয়েবকে চুপ থাকতে দেখে সুমনদের প্রথমে মনে হয়েছিলো কথাটা কিভাবে বলবে ভেবে দেখার জন্য ও বুঝি সময় নিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও শোয়েব যখন কিছুই বললো না–সুমন কিছুটা আহত বোধ করলো। গম্ভীর গলায় বললো, শোয়েব ভাই, তুমি কি আমাদের বিশ্বাস করতে পারছো না?

শোয়েব একটু চমকে উঠে পেছনে তাকালো–এ কথা কেন বলছো সুমন?

তুমি বিপদে পড়ছে, অথচ আমাদের জানাতে চাও না কী সেই বিপদ।

তোমরা কক্সবাজার যাচ্ছে বেড়াতে। এতদিনের পড়ার চাপ, টেনশন এসব ভুলে গিয়ে আনন্দ করবে তোমরা। আমার বিপদের কথা বলে তোমাদের আনন্দ নষ্ট করতে চাই না।

ঝন্টু বললো, শোয়েব ভাই, বিপদকে আমরা কেউই ভয় পাই না। সুমন আর আমি স্কাউটিং করি। যে কোনও বিপদকে আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখি। এই চ্যালেঞ্জ ফেস করার ভেতরও এক ধরনের আনন্দ আছে। আমাদের স্কাউট টিচার বলেন, প্রতি মুহূর্তের চ্যালেঞ্জের ভেতরই লুকিয়ে থাকে বেঁচে থাকার আনন্দ।

শোয়েব ম্লান হেসে বললো, স্কুলে থাকতে স্কাউটিং আমিও করতাম ঝন্টু। স্কাউটিং-এর আনন্দ হচ্ছে এ্যাডভেঞ্চারের, আর আমার বিপদ হচ্ছে মৃত্যু আমাকে তাড়া করছে।

রবি জানতে চাইলো, তুমি কোন স্কুলে পড়তে শোয়েব ভাই?

সেন্ট গ্রেগরিতে। নিকোলাস স্যার ছিলেন আমাদের স্কাউট টিচার।

কী বললে? তুমি গ্রেগরিয়ান? ওরা তিনজন উচ্ছ্বসিত গলায় বললো, শোয়েব ভাই, আমরাও সেন্ট গ্রেগরির ছাত্র।

শোয়েব হেসে বললো, ভালোই হলো, হঠাৎ পথে তিন গ্রেগরিয়ান বন্ধুর দেখা পেয়ে।

সুমন এবার শোয়েবকে পেয়ে বসলো, এইবার তোমাকে বলতেই হবে শোয়েব ভাই। একজন গ্রেগরিয়ান বিপদে পড়বে আর অন্যরা ওকে ফেলে চলে যাবে, এমন শিক্ষা আমাদের টিচাররা কখনও দেন নি।

ঝন্টু বললো, তোমার বিপদই যদি শেয়ার না করবে তাহলে অযথা বন্ধু বলছো কেন?

ঠিক আছে, বলছি। একটু থেমে শোয়েব বললো, আমাদের স্কুলের সমস্যা একটাই। রাজনীতির কোনও বিষয় স্কুলের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেয়া হয় না।

রবি বললো, স্কুলের ছেলেদের কি রাজনীতির ব্যাপারে নাক গলানো ভালো?

নাক গলানো ভালো না হলেও জানা উচিৎ। রাজনীতির ভালো দিক, খারাপ দিক দুটোই জানা উচিৎ।

সুমন অধৈর্য হয়ে বললো, স্কুল পেরিয়েছি এবার জেনে ফেলবো, তুমি তোমার কথা বলো।

আমার বিপদটা রাজনীতি থেকে আলাদা নয়, তোমরা ছাত্র শিবিরের কথা শুনেছো?

ঝন্টু জবাব দিলো–কেন শুনবো না। যারা ছাত্রদের হাত পায়ের রগ কাটে, খুন করে ওরাই তো শিবির। খবরের কাগজ খুললেই ওদের দৌরাত্মের কথা জানা যায়।

ঠিক বলেছো। চিটাগং ইউনিভার্সিটি হচ্ছে ওদের ঘাঁটি। যেদিন থেকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি সেদিন থেকে ওদের দৌরাত্ম চোখের সামনে দেখছি। যারা ওদের বিরুদ্ধে কথা বলে তাদের ওপর ওরা কী ভয়াবহ অত্যাচার চালায় চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। ইউনিভার্সিটির মেয়েদের, এমন কি ম্যাডামদের ওপরও ওরা কম অত্যাচার করেনি।

রবি বললো, ইউনিভার্সিটি অথরিটি কী করে? ওদের বের করে দিতে পারে না?

পারলে তো করবে! ইউনিভার্সিটির চারপাশের গ্রামগুলোতে ওদের পার্টি জামাতে ইসলামীর শয়তানরা রীতিমতো ঘাটি বানিয়ে বসে আছে। অথরিটি ওদের ভয় পায়। টিচারদের মধ্যে ওদের সাপোর্টারও কম নয়। এদিকে ছাত্রদল আর ছাত্রলীগের মারামারি তো আছেই। এই সুযোগে শিবিরের গুণ্ডারা ছাত্রলীগ আর ছাত্রদল দুটোকেই মারছে।

তুমি কোন দল করো? জানতে চাইলো ঝন্টু।

আমি ছাত্র ইউনিয়ন করি। যেদিন শিবিরের শয়তানরা হামিদা ম্যাডামের গায়ে হাত তুললো সেদিনই ঠিক করলাম, এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। কলেজে থাকতেই ঠিক করেছিলাম যদি ছাত্র রাজনীতি করি তাহলে এমন সংগঠন করবো যারা সমাজতন্ত্রের জন্য কাজ করে। ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ভালো লাগলো। জানেনা তো, যারা সমাজতন্ত্রের জন্য কাজ করে ওদের বামপন্থী বলে। বামপন্থীদের ভেতরও অনেক ভাগ। আমি আর আমার কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম বামপন্থীদের আগে জোট বাঁধতে হবে। তারপর ছাত্রলীগ, ছাত্রদল সবাইকে এক করে শিবিরের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। আমি যখন থার্ড ইয়ারে পড়ি, তখনই শিবির আমাকে টার্গেট করেছে।

বাইরে কখন যে রাত নেমেছে সুমনরা টের পায়নি। রাজা আলী হঠাৎ জোরে ব্রেক করাতে সবাই চমকে উঠলো। শোয়েব উত্তেজিত গলায় জানতে চাইলো, কী হয়েছে?

রাজা আলী বিড় বিড় করে একটা গালি দিয়ে বললো, গাড়ির সামনে শিয়াল পইড়ছিলো।

গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। সুমনরা বাইরে তাকিয়ে দেখলো চারপাশে অন্ধকারের কালো পর্দা ঝুলছে। রাজা আলী বেশ কয়েকবার স্টার্ট নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো।

ঝন্টু শোয়েবকে বললো, কই শোয়েব ভাই, তোমার আসল বিপদের কথা বলো।

শোয়েব উদ্বিগ্ন গলায় বললো, দাঁড়াও, গাড়ি আবার বিগড়ালো নাকি?

গাড়ির কিছু হয় নাই। বলে রাজা আলী ইঞ্জিন পরীক্ষা করার জন্য টর্চ হাতে ইঞ্জিন দেখার জন্য গাড়ি থেকে নিচে নামলো।

সুমনও শোয়েবকে তাড়া দিলো, বলল শোয়েব ভাই।

এভাবে গাড়ি থেমে যাওয়া শোয়েবের ভালো লাগছিলো না। তবু সুমনদের কৌতূহল মেটাবার জন্য বললো, মাস ছয়েক হলো আমরা জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য করেছি। গত মাসে শিবিরের গুণ্ডাদের মেরে হল থেকে বের করে দিয়েছিলাম।

একজনের ঘর থেকে আমার রুমমেট রকিব শিবিরের গোপন কিছু কাগজপত্র উদ্ধার করেছে। কিভাবে ওরা ক্যাম্পাসের চারপাশে ঘাঁটি গেড়েছে, কোথায় কী অস্ত্র আছে, অস্ত্রের সাপ্লাই কোত্থেকে আসে এরকম অনেক নোট ছিলো। সাত দিন পরই শিবির পাল্টা হামলা করে। গ্রাম থেকে জামাতীরা মেশিন গান নিয়ে এসেছিলো। রকিব ছাত্রলীগ করতো। শিবিরের গুণ্ডারা ওকে ধরে নিয়ে যায়। দুদিন পর ক্যাম্পাসের গেটের কাছে ওর ডেড বডি পাওয়া গেছে। মারার আগে প্রচণ্ড অত্যাচার করেছিলো ওর ওপর।

রকিবের কথা বলতে গিয়ে শোয়েবের গলা ধরে এসেছিলো। সুমন, ঝন্টু আর রবির ভীষণ রাগ হলো শিবিরের গুণ্ডাদের ওপর। জানালার কাঁচ নামিয়ে শোয়েব পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলো। গাড়িতে ওঠার পর ও সিগারেট খায়নি। জানে, অনেকে গাড়ির ভেতর সিগারেট খাওয়া পছন্দ করে না। রকিবের কথা মনে পড়াতে ওর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। সিগারেট ধরাবার জন্য ও যখন লাইটার জ্বালালো, ঝন্টু দেখলো ওর চোখের কোণে পানি জমেছে।

সুমন বললো, তোমার বন্ধু যে কাগজগুলো উদ্ধার করেছিলো সেগুলো কি তোমার কাছে?

শোয়েব আনমনে মাথা নেড়ে সায় জানালো।

সেজন্যেই ওরা তোমাকে মারতে চাইছে।

হ্যাঁ, পরশু রাতে ওরা আমার রুমে হামলা করেছিলো। আমি তখন অন্য রুমে ছিলাম বলে এখনও বেঁচে আছি।

তুমি ঢাকা না গিয়ে কক্সবাজার যাচ্ছো কেন?

ওরা জানে আমি ঢাকা যাবো। ইউনিভার্সিটি থেকে শহরে যাওয়ার পথে ওরা শয়ে শয়ে পাহারাদার বসিয়েছে। প্রত্যেকটা বাস আর ট্রেন ওরা সার্চ করছে। কক্সবাজার আমাদের সংগঠনের এক নেতা থাকেন। ক্যাম্পাসে বন্ধুরা সবাই বললো, কিছুদিন ওখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে।

কাগজগুলো কী করবে?

জামাতের বিরুদ্ধে যারা লেখে এমন কোনও সাংবাদিককে দেবো। এগুলো পত্রিকায় বেরুলে জামাত শিবিরের আসল চেহারা সবার কাছে ধরা পড়ে যাবে।

ঝন্টু বললো, কাগজগুলো কি এখন তোমার সঙ্গে আছে?

হ্যাঁ। কাপড়ের পোটলাটা দেখিয়ে শোয়েব বললো, এর ভেতর দুটো ডায়রী, তিনটা খাতা আর দুটো ফাইল আছে।

খাতা কিসের?

ওদের যে সাপ্তাহিক বৈঠক হয় তার পুরো বিবরণও লেখা আছে ওতে। কে কখন কাকে কোথায় খুন করেছে, কার কার হাত পায়ের রগ কেটেছে, ভবিষ্যতে কাদের খুন করা হবে সব ওতে রিপোর্ট করা আছে।

পথে যারা গাড়ি থামাতে চেয়েছিলো ওরা কি শিবিরের লোক?

হ্যাঁ, একটাকে ক্যাম্পাসে দেখেছি। ওদের হয়ে মারপিট করার সময় আসে।

সুমন একটু চিন্তিত গলায় বললো, ওরা তো জেনে গেলো তুমি কক্সবাজার যাচ্ছে। হামলা তো সেখানেও হতে পারে।

হতে পারে। তবে পথে হলেই বিপদ। এই বলে শোয়েব সামনে ইঞ্জিনের দিকে তাকালো– গাড়িটা এমন জায়গায় বিগড়ালো–

বনেট তুলে রাজা আলী ইঞ্জিন পরীক্ষা করছিলো। সুমন গাড়ি থেকে নেমে ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, গণ্ডগোল কোথায় ধরতে পেরেছে রাজা ভাই?

ইঞ্জিনের ওপর থেকে মাথা তুলে বললো, বুঝতে পাইরতেছি না। মনে হইতেছে কার্বুরেটরে ময়লা জইমছে। ব্যাটারিও ডাউন হইতে পারে।

সুমন চিন্তিত গলায় জানতে চাইলো, কক্সবাজার এখান থেকে কত দূর।

পনেরো মাইলের কম। একটু আগে আমি মাইল পোস্ট দেখছি।

পনেরো মাইল হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে কোনও গাড়ি-টাড়ি যদি পাওয়া যায়, রাজা ভাই গিয়ে মেকানিক আনতে পারবে।

ঝন্টু আর রবি পথে দেরি হওয়ার জন্য খুব একটা চিন্তিত ছিলো না। জঙ্গলের ভেতর রাতের অন্ধকারে হাইওয়েতে গাড়ি খারাপ হওয়া, পনেরো মাইলের ভেতর কোনও লোকালয় না থাকা–বেশ একটা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা মনে হচ্ছিলো ঝন্টুর। শোয়েবের অবস্থা ওদের মতো নয়। গাড়ি থাকাতে একবার ওদের হাত থেকে বাঁচা গেছে। যদি টের পায় ওঁরা সময় মতো কক্সবাজার পৌঁছোয় নি তাহলে ঠিকই বুঝে ফেলবে পথে গাড়ি খারাপ হয়েছে। কক্সবাজার থেকে এ পর্যন্ত আসতে মিনিট পনেরো লাগতে পারে। ও একা না হলেও কারও কাছেই অস্ত্র নেই। ওরা আসবে পুরোপুরি সশস্ত্র হয়ে। ওদের কাগজপত্র তো ছিনিয়ে নেবেই সাক্ষী হিসেবে কাউকেই বাঁচিয়ে রাখবে না।

কাগজগুলো কিভাবে ওদের হাত থেকে রক্ষা করা যায় ভাবতে গিয়ে শোয়েব সুমনের শরণাপন্ন হলো। ওকে ডেকে বললো, আমার সঙ্গে যে কাগজগুলো আছে সেগুলো গাড়ির ভেতর কোথাও লুকিয়ে রাখা যাবে?

সুমন একটু ভেবে বললো, পেছনে বুটের ভেতর রাবার শিটের তলায় রাখা যায়।

শোয়েব ওর পোটলা খুলে কাগজগুলো বের করলো। কাগজপত্র ছাড়াও পোটলার ভেতর ওর জামা কাপড় ছিলো। পেছনের বুট খুলে রাজা আলী বাড়তি চাকা, জ্যাক, খালি জেরি ক্যান, টুল বক্স সব নামিয়ে রাখলো। রাবার শিট তুলে খাতা, ডায়রি, ফাইল সব এমন ভাবে বিছিয়ে রাখলো যাতে ওপর থেকে বোঝা না যায়। শিটটা জায়গা মতো বিছিয়ে ওপরের জিনিসপত্র আবার আগের মতো রেখে দিলো। তারপর ও শোয়েবকে বললো, এইবার আর কেউ বুইঝতে পাইরবে না নিচে যে কিছু রাইখছি।

শোয়েবও মাথা নেড়ে ওকে সমর্থন জানালো।

ঝন্টু বললো, আমরা কি কক্সবাজারের পথে হাঁটবো, না এখানে গাড়ি আসার জন্য অপেক্ষা করবো?

শোয়েব বললো, এখানে অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। এই রাতে গুণ্ডাদের গাড়িই আমরা আশা করতে পারি, কোনও ভালো মানুষ গাড়ি বের করবে না।

রাজা আলী বললো, শোয়েব ভাই ঠিক কথা কইছেন। আমি গত এক ঘণ্টা কোনও গাড়ি কিংবা মানুষজন কিছু দেখি নাই।

জঙ্গলের ভেতর অন্ধকার রাস্তায় পনেরো মাইল হাঁটার প্রস্তাব রবির মোটেই ভালো লাগলো না। ঝন্টু আর সুমন সারাক্ষণ এ্যাডভেঞ্চার আর ডিটেকটিভ বই পড়ে সব কিছুতে রহস্য খুঁজে বেড়ায়। এই জঙ্গলে বাঘ না থাকলেও বুনো হাতি থাকতে পারে, অন্য কোনও হিংস্র জানোয়ার থাকতে পারে। তাছাড়া পুরোনো বনে অনেক খারাপ জিনিস থাকতে পারে রাতে যাদের নাম নিতে নেই। রবি শুকনো গলায় বললো, শোয়েব ভাই এত সব দরকারী কাগজপত্র ফেলে কি আমাদের সবার যাওয়া ঠিক হবে? ভালো হয় রাজা ভাই গিয়ে যদি একটা মেকানিক আনতে পারে।

ঝন্টু বুঝতে পেরেছিলো শোয়েব অচল গাড়িতে বসে থাকার ঝুঁকি নিতে চাইছে না। রাস্তায় থাকলে কেউ হামলা করতে এলে সামাল দিতে না পারলে দৌড়ে পালাবার সুযোগ থাকবে। গাড়ির ভেতর বসে থাকলে ফাঁদে আটকা পড়া ইঁদুরের মতো মরতে হবে। ও বললো, না রে রবি। একা রাজা ভাইর এতটা পথ যাওয়া ঠিক হবে না। শোয়েব ভাইর কাগজপত্র যেখানে আছে সেটাই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। ওরা খুঁজবে শোয়েব ভাইকে এখানে বসে থাকার চেয়ে চল কক্সবাজারের পথে হাঁটি। পথে যদি কোনও গ্রাম কিংবা বাজার চোখে পড়ে সেখানেও আশ্রয় নিতে পারি। অচল গাড়িতে সারারাত বসে থাকা উচিৎ হবে না।

সুমন বললো, গ্রাম নিশ্চয় পথে পড়বে। ঝন্টু ঠিক বলেছিস। গ্রামে গিয়ে কারও বাড়িতে উঠে সেখানকার কোন লোককে রাজা ভাইর সঙ্গে কক্সবাজার পাঠাতে পারি। খোঁজ করলে গ্রামে সাইকেল পাওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়।

গ্রামে থাকার প্ল্যানটা রবির খারাপ লাগলো না। যে যার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে তৈরি হলো। দলের সঙ্গে বেমানান মনে হবে দেখে শোয়েব লুঙ্গি চাদর বদলে প্যান্ট শার্ট পরে, নিলো। কলা আর কমলা সব আগেই খাওয়া শেষ। শুধু মিনারেল ওয়াটারের বোতল দুটো ঝন্টু আর রবি ওদের ব্যাগে ভরে নিলো। ফাইলপত্র বের করে ফেলাতে শোয়েবের পোটলাটা ছোট হয়ে গিয়েছিলো। সুমন ওকে বললো, তোমার কাপড় চোপড় আমার ব্যাগে দাও শোয়েব ভাই। প্যান্ট শার্ট পরা তোমার মতো স্মার্ট কেউ বগলে কাপড়ের পোটলা নিয়ে হাঁটে না।

মৃদু হেসে শোয়েব বললো, তোমার বিচার ক্ষমতার প্রশংসা না করে পারছি না। তবে তোমার ব্যাগে জায়গা নিতে পারি এক শর্তে।

কী শর্ত? একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলে সুমন।

তোমার ব্যাগ আমার কাঁধে থাকবে।

ঠিক আছে শোয়েব ভাই। হাসি চেপে গম্ভীর হওয়ার ভান করে সুমন বললো, তোমার শর্ত মঞ্জুর করা হলো।

সুমনের কথার ধরণ দেখে ঝন্টু হেসে ফেললো। গত বছর ক্যাম্পিং-এ গিয়ে ওরা বাদশার বিচার নাটক করেছিলো। সুমন করেছে বাদশার পার্ট। সবাই খুব প্রশংসা করায় সুমন সুযোগ পেলে সেই নাটকের ঢংয়ে কথা বলে। ঝন্টু ওকে বললো, আমারও যে একটা আর্জি ছিলো জাঁহাপনা।

পেশ করো বাদশার ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে বললো সুমন।

আমার ব্যাগটা একটু বেশি ভারি। মাঝে মাঝে আমি জঁহাপনাকে তকলিফ দেবো ব্যাগটা বইবার জন্য।

তোমার গোস্তাখি দেখে আমি অবাক হচ্ছি বান্দা। কোন সাহসে তুমি আমাকে বোঝা বইতে বলো?

নইলে জাহাপনা, আপনার দুই বান্দা আপনাকে এই জঙ্গলে ফেলে একটা রাম খোলাই দেবে।

ঠিক আছে বান্দা। তোমার আর্জি এখন মঞ্জুর করা হলো,কাল দরবারে বসে তোমার বেয়াদবির বিচার করা হবে।

ফুর্তিভরা মনে ওরা টর্চের আলোয় হাঁটছিলো হাইওয়ে ধরে। তখন কেউ ঘুণাক্ষরে কল্পনাও করেনি সামনে কী ভয়ঙ্কর বিপদ ওদের জন্য ওঁৎ পেতে রয়েছে।