১. ঘণ্টা বাজার আগেই

ভয়ঙ্করের মুখোমুখি – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির

১.

ঘণ্টা বাজার আগেই ঝন্টুর পরীক্ষার খাতা লেখা শেষ হয়ে গিয়েছিলো। ভূগোল পরীক্ষা নিয়ে কখনও ওর মাথা ব্যথা থাকে না। তবে ভালো মতো রিভাইজ না দিতেই পরীক্ষার শেষ ঘণ্টা বাজলো। এমনিতে প্রথম পাঁচজনের ভেতর প্লেস না থাকলেও ভূগোলের জুলিয়ান স্যার ওর আঁকা ম্যাপ ক্লাসের ফার্স্ট সেকেণ্ড বয়দের দেখিয়ে বলেন, এস এস সিতে ভূগোলে যদি নব্বইয়ের ওপর নম্বর তুলতে চাও ঝন্টুর মতো ম্যাপ আঁকতে শেখো। সামনে কিছু না বললেও আড়ালে ফার্স্ট বয় আতিক আর সেকেণ্ড বয় বিমল মুখ বাঁকিয়ে বলে, ভারি তো ম্যাপ আকিয়ে! তাও যদি কোনওবার ফিফথও হতে পারতো।

বাড়িতে ঝন্টুর বাবা কখনও ফাস্ট সেকেন্ড হওয়ার জন্য আতিক আর বিমলের বাবার মতো হইচই করেন না। ঝন্টুর বাবা বলেন, আশির ঘরে নম্বর পেলেই আমি খুশি। তা তুই ফাস্ট হলি না লাস্ট হলি তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।

ঝন্টুদের মিশনারি স্কুলের পড়াশোনার এমন কড়াকড়ি যে, ক্লাস এইট, নাইন, টেন-এ যারা দশের ভেতর থাকে তাদের কারও নম্বরই গড়ে আশির কম নয়।

ঘন্টা বাজার পর খাতা জমা দিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো ঝন্টু। ওদের সিট পড়েছিলো জুবিলি স্কুলে। স্কুল জীবনের শেষ পরীক্ষা দিয়ে ওর মনে হলো বুকের ওপর থেকে হিমালয়ের মতো ভারি একটা বোঝা নেমে গেছে। গত একটা বছর কী ধকলই না গেছে ওদের ওপর দিয়ে। নাইনে থাকতে সারা স্কুলের কর্তা ছিলো ওরা। পিকনিক, মিলাদ, সরস্বতী পুজো কিংবা সায়েন্স ফেয়ার সব কিছুর তদারকি করে নাইনের ছেলেরা। টেনে ওঠার পর সব বন্ধ। মাথার ওপর তখন এস এস সির তলোয়ার ঝোলানো থাকে। স্কুলের পর ওদের কোচিং ক্লাস, কারও আবার বাড়িতে দু তিনটে টিচার আসেন–দম ফেলার সময় থাকে না। জানে একটু বেতাল হলে স্টার কেন, ফার্স্ট ডিভিশনেও নাম থাকবে না। আর এসএসসিতে ওদের স্কুলের যে সব ছেলের ফার্স্ট ডিভিশন থাকে না, তারা লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারে না। দু বছর আগে এক ছেলে সেকেণ্ড ডিভিশন পেয়ে ঘুমের বড়ি-টড়ি খেয়ে এক কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছিলো।

ঝন্টুর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সুমন বললো, সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছিলি?

ঝন্টু নির্লিপ্ত গলায় বললো, না পারার কী আছে! ও সুমনের কাছ থেকে অন্য কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলো।

একটু পরে সুমন সেই কথাটা বললো, রবিকে আসতে বলবো?

ঝন্টু মুখে একটা নিরাসক্ত ভাব এনে বললো, ও কি আসতে চাইছে?

বারে তোকে সকালে বললাম না রবি তোর সঙ্গে কথা বলতে চায়!

স্কুলের বন্ধুদের ভেতর রবি সবচেয়ে কাছের হলেও ওর সঙ্গে ঝন্টুর ঝগড়াও হয় বেশি। মাস ছয়েক আগে জুবিলি স্কুলের সঙ্গে ফুটবল খেলতে গিয়ে রবি নাকি ইচ্ছে করে ঝন্টুকে পাস না দিয়ে নিজে মারতে গিয়ে নির্ঘাত গোলটা নষ্ট করেছে। খেলায় যদিও ওরা জিতেছিলো, খেলার পর ঝন্টু রবিকে কথা শোনাতে ছাড়ে নি আমার হ্যাটট্রিক হবে, সেটা বুঝি তোর সহ্য হচ্ছিলো না!

রবিও ছেড়ে কথা বলার পাত্র নয়–ভারি তো এলেন হ্যাটট্রিক করনেওয়ালা। তোকে যে ওদের লেদু মার্কিং-এ রেখেছিলো এটুকু খেয়াল নেই, তুই করবি হ্যাটট্রিক!

লেদুর মতো দু তিনটেকে ডজ দেয়া কোনও ব্যাপারই না।

থাক থাক, দেখা আছে! ফার্স্ট হাফে পেনাল্টি মিস করে বড় বড় কথা বলিস না।

ওয়ার্ল্ড কাপের স্টাররাও পেনাল্টি মিস করে।

তবে আর কী। ওয়ার্ল্ড কাপে খেললেই পারিস।

রবির বাঁকা বাঁকা কথা শুনে ঝন্টুর মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিলো–তোকে টীমে রাখলে আমি আর খেলবো না–এই বলে রাখলাম।

তোর সঙ্গে খেলতে আমার বয়ে গেছে।

আমার সঙ্গে আর কথা বলবি না তুই।

তোর সঙ্গে কথা না বললে বুঝি আমার ভাত হজম হবে না? নাকি রাতে ঘুম হবে না?

দুদিন পরই তো ভাব জমাতে আসবি!

বয়ে গেছে তোর সঙ্গে ভাব জমাতে।

শেষের দিকে কথা বলতে গিয়ে ঝন্টুর গলা ধরে এসেছিলো, চোখ ফেটে কান্না আসছিলো। রবি ওর সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারে এটা ও ভাবতেও পারেনি।

পরদিন ছুটির পর ঝন্টুর নাকের ডগা দিয়ে বিমলের সঙ্গে গলাগলি করে বাড়ি গেলো রবি। অন্য দিন ঝন্টুর জন্য দরকার হলে এক ঘন্টাও দেরি করে। ছুটির পর ঝন্টুর স্কাউটিং ক্লাস থাকে। রবি বকুল তলায় বসে ঝন্টুর পিটি প্যারেড আর অন্য সব কসরৎ দেখে। তারপর দুই বন্ধু এক সঙ্গে বাড়ি ফেরে।

স্কাউটিং-এর সুবাদে সুমনের সঙ্গে ঝন্টুর বন্ধুত্ব হয়েছে। তবে সুমন পড়ে ইংলিশ মিডিয়ামে, গাড়িতে করে স্কুলে আসে যায়, ঝন্টু ওকে রবির মতো ভাবতে পারে না। সুমনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়াতে ঝন্টুর লাভ হয়েছে গল্পের বইয়ের ব্যাপারে। সুমনের ঘরে আলমারি ভর্তি বাংলা-ইংরেজি এ্যাডভেঞ্চার আর রহস্যের বই যা ঝন্টু পেলে গোগ্রাসে গেলে।

তবু রবির সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করার পর সুমনই ওর কাছের বন্ধু। টিফিন পিরিয়ড ও রবিকে দেখিয়ে সুমনের সঙ্গে কাটায়। আর রবি ছুটির পর বিমলের কাঁধে হাত রেখে বাড়ি যায়। মাঝে মাঝে ঝন্টুর বুক ঠেলে কান্না আসতে চায়, কারণ স্কাউটিং ক্লাসের পর ওকে বাড়ি ফিরতে হয় একা।

জুবিলি স্কুলের সঙ্গে খেলার এক সপ্তাহ পরে ঝন্টুদের ফ্রেন্ডলি ম্যাচ ছিলো পগোজ স্কুলের সঙ্গে। খেলার দুদিন আগে ওদের ফুটবল ক্যাপ্টেন কামাল বললো, রবি যদি না খেলে তুই খেলবি তো ঝন্টু?

ঝন্টু বললো, রবি খেলবে না কেন?

তোকে টিমে রাখলে ও খেলবে না বলছে।

ওকে নিলেই তো পারিস?

তোর চেয়ে কি ও ভালো খেলে?

ও তো তাই মনে করে।

ও মনে করলে তো হবে না। আমি ক্যাপ্টেন। আমি রবিকে বলে দিয়েছি তুই খেলবি।

প্রথমে ঝন্টু খুব উত্তেজিত ছিলো রবিকে জব্দ করতে পেরেছে বলে। পরদিন প্র্যাকটিসের সময় ওর মনে হলো এতদিন রবির সঙ্গে খেলে দুজনের যে বোঝাঁপড়া হয়েছে সেটা মনিকে দিয়ে হবে না। প্র্যাকটিসের পর কামালকে জানিয়ে দিলো পগোজ স্কুলের সঙ্গে ও খেলবে না।

কামাল অবশ্য এ নিয়ে বেশি উচ্চ বাচ্য করে নি। কদিন ধরে টিফিনে মোগলাই পরোটা খাইয়ে সবুজ ওকে পটাচ্ছে স্ট্রাইকারের পজিশনে একটা চান্স দেয়ার জন্য। রবির জায়গায় মনিকে নামিয়েছে কামাল। ঝন্টুর জায়গায় সবুজকে নিলো। খেলার দিন মনি খুশি হয়ে কামালকে একটা টি শার্ট প্রেজেন্ট করে বসলো, যদিও খেলায় ওরা এক গোলে হেরেছিলো। তবে ফ্রেণ্ডলি ম্যাচ বলে রবি আর ঝন্টুর না খেলার ব্যাপারটাকে কেউ সিরিয়াসলি নেয়নি।

ঝন্টু চান্স পেয়েও কেন খেললো না–রবির খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো। সুমনকে ঝন্টু প্র্যাকটিসের দিনই বলেছিলো রবিকে ছাড়া ওর খেলতে ইচ্ছে করছে না। সুমনের কাছে পরে কথাটা শুনে রবির মনে হলো ঝন্টু ছাড়া আসলেই ওর কোনও বন্ধু নেই। তার পর থেকে যত দিন যাচ্ছিলো কিভাবে ঝন্টুর সঙ্গে ভাব করবে তাই নিয়ে ভাবছিলো রবি। ক্লাস নাইনে থাকতে একবার এরকম হয়েছিলো। সাত দিন না যেতেই ঝন্টুর খাতার ভেতর ও চিঠি রেখেছিলো–তোর সঙ্গে ভাব করতে চাই, লিখে। রবি একবার ভেবেছিলো ঝন্টুকে চিঠি লিখবে। পরে এরকম চিঠি লেখাটা ওর ছেলেমানুষি মনে হয়েছে। কী করবে কোনও পথ খুঁজে না পেয়ে সুমনকেই ধরেছিলো ঝন্টুর সঙ্গে ভাব করিয়ে দেয়ার জন্য। সুমন বলেছে, পরীক্ষা শেষ হলে বলবে।

সেদিন সকালে সুমন যখন কথাটা পাড়লো ঝন্টুর ইচ্ছে হলো দোয়েল পাখি হয়ে আকাশে ডিগবাজি খেতে। পরীক্ষার পড়া তৈরি করার ফাঁকে ও নিজেও ভাবছিলো কেমন করে রবির সঙ্গে ভাব করা যায়। পরীক্ষার পর তিন মাস সারা জীবনের সেরা ছুটি। রবিকে ছাড়া লম্বা ছুটি ও কাটাবে কি ভাবে? তারপরও সুমনকে ওর মনের ভাব বুঝতে দেয়নি। নির্লিপ্ত গলায় শুধু বলেছে, পরীক্ষা আগে শেষ হোক।

পরীক্ষার পর সকালের জের ধরে কথাটা ঝন্টুর কাছে আবার পাড়লো সুমন। বেশ কিছুক্ষণ কোনও কথা বললো না ঝন্টু। ওর মনের ভাব বাইরে প্রকাশ পেলে সুমন আদেখলে ভাবতে পারে। কথাটা দ্বিতীয়বার বলার পর ঝন্টু বললো, ঠিক আছে, আসতে বল রবিকে।

ঝন্টুকে বকুল তলায় রেখে সুমন গেলো রবিকে ডাকতে। শেষ পরীক্ষা দিয়ে সবাই বাড়ি যেতে পারলে বাঁচে। মিনিট দশেকের ভেতরই স্কুল প্রায় খালি হয়ে গেছে। রবি একা দাঁড়িয়েছিলো ফুটবল খেলার মাঠের কাছে। সুমন ওকে বললো, রবি চল, ঝন্টু তোকে ডাকছে।

রবির বুকের ভেতর তখন প্রচণ্ড উত্তেজনা। কান খাড়া করলে সুমন ওর হার্টবিট শুনতে পেতো। উত্তেজনা চেপে রবি জানতে চাইলো, সত্যি সত্যি ডাকতে বলেছে, না তুই বানিয়ে বলছিস?

গেলেই বুঝবি ও ডাকছে না আমি বানিয়ে বলছি!

চল, গিয়ে দেখি। নিজেকে ওর প্রজাপতির মতো হালকা মনে হলো।

ঝন্টুর কাছে গিয়ে রবি কী বলবে ভেবে কিছু ঠিক করতে পারলো না। মনে হলো সব কথা দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে আটকে আছে। ঝন্টুর চোখে চোখ পড়তেই রবি আরও গুটিয়ে গেলো। সুমন অবাক হয়ে বললো, তোরা কথা বলছিস না কেন?

ঝন্টু দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালো রবির দিকে–তোর সঙ্গে সেদিন খুব খারাপ ব্যবহার করেছি রবি। আমি দুঃখিত।

ঝন্টুর হাত চেপে ধরে রবি ধরা গলায় বললো, আমি নিজেও অনুতপ্ত ঝন্টু। আর কখনও এমন হবে না।

সুমন হেসে বললো, বাহ, ভাবতো হয়েই গেলো। তোরা বোস। আমি বাদাম কিনে আনি।

সুমনের স্কুলের গেটের পাশে বাদাম ওয়ালার কাছ থেকে বাদাম কিনতে গিয়ে চোখে পড়লো রাস্তার ওপাশে ওদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার রাজা আলি নিবিষ্ট মনে খবরের কাগজ পড়ছে। বাদাম কিনে সুমন রাস্তা পেরিয়ে রাজাকে গিয়ে বললো, বাবা কখন গাড়ি চেয়েছেন?

রাজা ওর হাত ঘড়ি দেখে বললো, আইজ তিনি অফিসে লাঞ্চ খাইবেন। বলছেন ঠিক পাঁচটায় যাইতে।

রাজা আলীকে প্রথম দেখে সুমনের মনে হয়েছিলো ওর মতো একজন সুদর্শন যুবক সিনেমায় না নেমে ড্রাইভার কেন হলো। মনে হয়েছে ও কখনও ছবিতে চান্স পাবে না কথার গ্রাম্য টানের জন্য।

সুমন ওকে বললো, তাহলে আমি এক ঘন্টা পরে যাবো।

আপনের ইচ্ছা হইলে থাকেন। বলে রাজা খবরের কাগজে মন দিলো।

সুমন বাদাম নিয়ে বকুল তলায় এসে দেখে রবি আর ঝন্টুর মুখে কথার ফুলঝুরি আর হাসির ফোয়ারা। সুমন মুখ টিপে হেসে বললো, ছ মাসের জমে থাকা কথা কি এক দিনে শেষ হবে?

ঝন্টু হাসতে হাসতে বললো, রবিকে বলছিলাম এত লম্বা ছুটি ও কিভাবে কাটাবে। বলে ন্যাড়া হয়ে নাকি ঘরে বসে থাকবে।

সুমন অবাক হয়ে বললো, ন্যাড়া হবি কেন রবি? বৈষ্ণব সন্ন্যাসী হওয়ার ইচ্ছে নেই তো?

আরে না! লজ্জা মেশানো গলায় রবি বললো, সেজো ভাইয়ের মাথার চুল সব পড়ে যাচ্ছে। বাবা বলেছেন ওকে ন্যাড়া হতে। ভাইয়া বায়না ধরেছে আমি যদি ন্যাড়া হই, তাহলেই ও ন্যাড়া হবে। আমি বলেছি, হতে পারি একশ টাকা পেলে। ভাইয়া রাজী হয়ে গেছে।

ঝন্টু আদুরে গলায় বললো, তোর ভাইয়াকে বল না রবি, আমি পঞ্চাশ পেলেই রাজি!

কী জন্য রাজি?

ন্যাড়া হতে।

ঝন্টুর কথা শুনে রবি আর সুমন এক সঙ্গে হেসে উঠলো। হাসির শব্দে বকুল গাছ থেকে এক ঝাঁক চড়ুই উড়ে গেলো। জুবিলি স্কুলের দপ্তরি বুড়ো কৃষ্ণপদ কোথায় যেন যাচ্ছিলো। ছেলেদের হল্লা দেখে বিরক্ত হলো পরীক্ষা শ্যাষ, বাড়ি না গিয়া বড় যে ইশকুলে বইসা রইছ?

কৃষ্ণপদকে ওরা সবাই চেনে বদমেজাজি ভালো মানুষ হিসেবে। সুমন হাসতে হাসতে বললো, মনেই হচ্ছে না আমাদের স্কুল লাইফ শেষ হয়ে গেছে। বাদাম খাবে কেষ্টদা?

আমারে পোলাপান পাইছ, বড় যে বাদাম খামু?

রবি বললো, একটার ঘন্টা বাজলেই আমরা বাড়ি যাবো।

কৃষ্ণপদ আপন মনে বক বক করতে করতে চলে গেলো। সুমন বললো, ছুটি কাটানোর কথা বলছিলি। তোরা কি কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করছিস?

রবি ঠোঁট উল্টে বললো, বললেই কি যাওয়া যায়? বাবা বলেছেন বেড়াতে ইচ্ছে করলে গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে।

ঝন্টু বললো, তিন মাস লাগবে রেজাল্ট বেরুতে। এ কদিন কি ঘরে বসে মাছি মারবো?

তুই কি করবি?

করার কিছু ভাবিনি বলেই তো জানতে চাইছি কারও মাথায় কোনও প্ল্যান আছে কি না।

সুমন বললো, তোরা কি দুজনে মিলে কিছু করতে চাইছিস, না আমিও নাক গলাবো?

ঝন্টু গম্ভীর হওয়ার ভান করলো–তোর নাক ক্লাসে সবার চেয়ে বড়। যেখানে ইচ্ছে তুই নাক গলাতে পারিস।

শুধু যদি বের করার কায়দা জানিস। যোগ করলো রবি।

সুমন হেসে বললো, ভালো হয় বিকেলে যদি আমাদের বাড়িতে আসিস। তিন জন মিলে এর ভেতর ভেবে ঠিক করবো ছুটির দিনগুলোতে কী করা যায়। আসবি তো?

আসতে পারি, যদি তোর মার হাতে বানানো সেদিনের মতো সিঙাড়া খাওয়াস। এই বলে ঝন্টু রবির দিকে তাকালো, এত মজার সিঙাড়া তুই জীবনেও খাসনি।

ঠিক আছে মাকে বলবো। সুমন উঠে দাঁড়ালো–তোরা কি আরও বসবি? আমার গাড়ি এসে গেছে।

ঝন্টুও উঠে পড়লো–বিকেলে তোর বাড়িতে যেতে হলে এখন আর গেঁজিয়ে কী লাভ!,

সুমন চলে যাওয়ার পর রবি আর ঝন্টু বহু দিন পর আগের মতো একে অপরের কাঁধে হাত রেখে বাড়ির পথে রওনা হলো। কাগজিটোলা হেঁটে যেতে মিনিট পনেরো লাগে। গলির ভেতর তিন নম্বর বাড়ি ঝন্টুদের, আর সাত নম্বর হচ্ছে রবিদের।

হাঁটতে হাঁটতে ঝন্টু বললো, আমার মনে হচ্ছে কতদিন তোর সঙ্গে কথা বলি না!

মৃদু হেসে রবি বললো, ভাগ্যিস সুমন ছিলো। নইলে কতদিন এভাবে থাকতে হতো কে জানে! সুমনের জন্য গভীর কৃতজ্ঞতায় ওদের মন ভরে গেলো।

ঝন্টুদের বাড়িতে মানুষ মাত্র তিনজন। ঝন্টু, ওর বড় বোন ঝুমনি, যে জগন্নাথ কলেজে বাংলায় থার্ড ইয়ার অনার্সে পড়ে আর ওদের বাবা আরিফ আহমেদ, যিনি জগন্নাথে ইংরেজি পড়ান। ঝন্টুর মা মারা গেছেন ও যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। বাবা আর বুমনি দুজনের আদর কখনও ওকে মার অভাবের কথা মনে করতে দেয় নি।

রবিদের বাড়িতে চার ভাই তিন বোনের ভেতর ও সবার ছোট। ওর বাবা জজকোর্টে ওকালতি করেন, সংসার মন্দ নয়। রবির জন্মের পর থেকে ওর মা নানা রকম অসুখে ভুগে খিটখিটে স্বভাবের হয়ে গেছেন, দিনের অর্ধেক বেলা বিছানায় পড়ে থাকেন। সংসার সামলানোর দায়িত্ব ওর মেজ ফুপুর। বারো বছর আগে ফুপা মারা গেছেন, ওর কোনও ছেলে মেয়ে নেই। ছোট বেলায় রবির বাবাকে এই ফুপু কোলে পিঠে মানুষ করেছেন, তাই ফুপা মারা যাওয়ার পর থেকে ভাইয়ের সংসারই ওঁর সংসার, ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের নিজের ছেলেমেয়ের মতো দেখেন।

রবি বাড়িতে ঢুকেই ফুপুকে পেলো সামনে। ফুপু, ভাত দাও, বলে সটান নিজের ঘরে ঢুকলো। পুরো ঘরটা ওর নয়। ওর তিন বছরের বড় সেজ ভাই হবি যে এবার ফাস্ট ইয়ারে পড়ে, সেও এই ঘরে থাকে। তবে দুই ভাইয়েরই আলাদা বিছানা পড়ার টেবিলও আলাদা।

বাথরুমে ঢুকে ঝটপট মুখ হাত পানিতে ভিজিয়ে রবি খাবার ঘরে ঢুকলো। ওদের বাড়িতে ছুটির দিন ছাড়া সবার এক সঙ্গে খাওয়া হয় না।

ঝন্টুদের বাড়িতে দুপুরে না খেলেও রাতে ওরা তিনজন এক সঙ্গেই খাবে। বুয়া যত ভালো রান্না করুক বুমনি রোজ ছোট ভাইর পছন্দের একটা পদ নিজের হাতে রান্না করে। হালে ঝন্টুর কাবাব খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। রান্নার বই দেখে দেখে একেক দিন একেক রকমের কাবাব বানায় ঝুমনি।

বিকেলে রবির ডাকে বাড়ি থেকে বেরুবার সময় কুমনি যথারীতি বললো, সাতটার মধ্যে বাড়ি ফেরা চাই।

ঝন্টু দুঃখ পাওয়া গলায় বললো, তুই কী রে আপু! আজ এস এস সি পরীক্ষা শেষ হলো। বলতে গেলে এখন আমি কলেজ স্টুডেন্ট। আজও সাতটায় ফিরতে হবে?

ঠিক আছে আটটায়। ঝন্টুকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঝুমনি বাইরের দরজা বন্ধ করে দিলো।

সুমনদের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের বাড়ি যেতে যেতে রবি বললো, কী করবি কিছু ভেবেছিস ঝন্টু?

নারে! খেয়ে উঠেই আপুর সঙ্গে দাবা নিয়ে বসলাম। দুটো গেম হেরে মাথা ঠিক নেই। তিনজন এক সঙ্গে কোথাও গেলে কেমন হয় রবি?

কোথায় যাবি?

আমার সমুদ্র দেখার ভারি ইচ্ছে। কক্সবাজার যাবি?

সমুদ্র আমিও দেখিনি। তবে কক্সবাজার যেতে কত টাকা লাগবে জানিস?

তোর বাবাকে বললে দেবেন না?

বাবা আপত্তি না করলেও মা চেঁচামেচি করবেন।

কথা বলতে বলতে কাগজিটোলা থেকে হেঁটে হেঁটেই ওরা সুমনদের বাড়ি পৌঁছে গেলো। ঝন্টুকে অবশ্য ঝুমনি রিকশাভাড়ার জন্য দশ টাকা দিয়েছিলো। অর্ধেকটা ওর বেঁচে গেলো।

কক্সবাজার যাওয়ার পরিকল্পনা সুমন অপছন্দ করলো না। কক্সবাজার জায়গাটা অবশ্য ওর কাছে নতুন নয়। বাড়ির সবার সঙ্গে আগেও দুবার ও কক্সবাজার গেছে। তবে এতটা বয়স হলো, বড়দের ছাড়া একা ওর কোথাও যাওয়া হয়নি। তিন জন কক্সবাজারে গেলে মজাই হবে।