২. কোচে করে কক্সবাজার

ঠিক হয়েছিলো ওরা কোচে করে কক্সবাজার যাবে। ঢাকা থেকে নাইট কোচে উঠলে সকালে কক্সবাজার নামিয়ে দেয়। রবির বাড়ি থেকে কেউ আপত্তি করেনি। শুধু বাবা বলেছেন, যাওয়া আসার বাস ভাড়ার জন্য শ তিনেক টাকা দিতে পারি। কদিন থাকবে, কোথায় উঠবে, কী খাবে এসব ব্যবস্থা করতে পারবো না।

রবি জানে এত ভাই বোন না হলে ঝন্টুর মতো ওর বাবাও এক কথায় দেড় দু হাজার টাকা বের করে দিতেন। ঝন্টু অবশ্য রবিকে বলেছে, তুই ভাবছিস কেন? আমার দু হাজার টাকায় দিব্যি দুজনের চলে যাবে। চাই কি টেকনাফ থেকেও ঘুরে আসতে পারবো। সস্তা হোটেলে উঠলেই চলবে।

রবির তবু দ্বিধা কাটেনি—সুমন কি সস্তা হোটেলে থাকতে রাজী হবে?

যাচ্ছি সমুদ্র দেখতে টাকার গরম দেখাতে নয়। সুমনের যদি সস্তা হোটেল পছন্দ না হয় পর্যটনের মোটেলে থাকুক গে। আমরা আমাদের মতো থাকবো।

যেদিন ওরা যাওয়ার প্ল্যান করলো তার দুদিন পর সুমন ওদের দুর্ভাবনার কথা শুনে হেসে খুন হলো–তোরা এত ভাবছিস কেন? কক্সবাজারের ডিসি বাবার বন্ধু। আমরা সার্কিট হাউসেই থাকতে পারবো। কম পয়সায় রাজার হালে থাকা যায়। এক রুম হলেই। তো আমাদের চলে যাবে।

ঝন্টুর বাবা প্রথমটায় একটু চিন্তিত ছিলেন–পনেরো ষোল বছরের ছেলে, বড়দের ছাড়া এতটা পথ যাবে! সেই চিন্তাও দূর হলো শেষ মুহূর্তের ব্যবস্থায়। হঠাৎ করে সুমনের বাবার কাজ পড়ে গেলো চট্টগ্রামে। প্লেনে টিকেট পাওয়া গেলো না। ঠিক করলেন পরদিন ভোরে গাড়ি নিয়ে চলে যাবেন। সুমন শুনে বললো, তাহলে তো তুমি আমাদের চিটাগাং পর্যন্ত লিফট দিতে পারো।

হ্যাঁ, তা পারি। তবে তারা যে পরশু যাবি বলে ঠিক করলি। আমি তো যাবো কাল।

আমি এখনই গিয়ে ঝন্টু আর রবিকে গিয়ে বলছি। কাল আর পরশু আমাদের কাছে সমান।

সুমনের বড় ভাই সুজন পড়ে ইউনিভার্সিটিতে। বললো, যেখানে যেতে হয় রিকশায় যাও। গাড়ি আমার লাগবে। সুমনের এভাবে কক্সবাজার যাওয়াটা ওর পছন্দ হচ্ছিলো না। ওকে পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে হবে আর সুমন সমুদ্রের হাওয়া খেয়ে বেড়াবে একেবারে অসহ্য মনে হচ্ছিলো ওর।

রিকশায় করেই প্রথম ঝন্টুদের বাসায় এলো সুমন। ঝন্টুর বাবা অফিস থেকে ফিরে চা খাচ্ছিলেন। যে কারণে ঝন্টুদের যাওয়া একদিন এগিয়েছে, শুনে তার দুশ্চিন্তা কেটে গেলো। সুমনকে বললেন, খুব ভালো হয়েছে–তোমরা তোমার বাবার সঙ্গে যাচ্ছো।

গাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে রবিও খুশি হলো। তবে ওর আরও সমস্যা ছিলো। ভেবেছিলো কাল সকালে ওর জিন্‌সের প্যান্ট দুটো ধুয়ে দেবে। ওদের বাড়িতে যে যার কাপড় নিজেই দেয়। রাতে থোয়াটা ওর সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে সকালে শুকোবে কি না।

সুমন আর ঝন্টুর বিদায় হতেই ও বাথরুমে কাপড় কাঁচতে বসলো। ওর বাইরে পরার মতো প্যান্ট মাত্র দুটো। এক সেট পায়জামা পাঞ্জাবি অবশ্য আছে, যা মিলাদ টিলাদে যেতে হলে পরে।

কাপড় ধোয়ার পর ফুপু বুদ্ধি দিলেন, রান্না ঘরে মেলে দে। ভোর না হতেই শুকিয়ে যাবে।

রবিরা নিজেদের ধোয়া কাপড় নিজেরাই ইস্ত্রি করে। ফুপুর কথা শুনে রবি নিশ্চিন্ত হলো। তবে ভোরে ও ঘুম থেকে উঠে দেখলো, প্যান্ট দুটো আর তিনটা শার্ট ইস্ত্রি করা অবস্থায় ওর টেবিলের ওপর রাখা। রবি বুঝলো এ কাজ ফুপু ছাড়া আর কারও নয়। কাল রাতে ও শুনেছে ফুপু মাকে বলছেন, এইটুকুন তিনটে ছেলে কক্সবাজার যাবে, বড় কেউ সঙ্গে থাকবে না–ভারি চিন্তা হচ্ছে। মা জবাব দিয়েছেন, দুনিয়াটা বড় কঠিন জায়গা বুবু। এখন থেকে সব কিছু চিনতে শিখুক, নইলে পদে পদে হোঁচট খেতে হবে।

সকাল সাতটায় ইস্ত্রি ভাঙা প্যান্ট শার্টের ওপর হাত কাটা সুয়েটার গায়ে দিয়ে এয়ার ব্যাগ কাঁধে যখন রবি ঘর থেকে বেরুতে যাবে ফুপু ওর হাতে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিলেন– এটা রাখ। ক্ষিদে লাগলে পথে কিছু কিনে খাস।

রবি কখনও যা করে না–টুপ করে ফুপুর পা ছুঁয়ে সালাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ঝন্টুকে সঙ্গে নিয়ে পৌনে আটটায় পৌঁছে গেলো সুমনদের বাড়ি।

সুমন তৈরি হয়ে ড্রইং রুমে অপেক্ষা করছিলো। ওদের দুজনকে মৃদু হেসে সম্ভাষণ জানালো–তোরা পনেরো মিনিট আগে এসে গেছিস।

.

ঢাকা থেকে সকাল আটটায় রওনা দিয়ে ঠিক একটায় ঝন্টুরা পৌঁছলো চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে। পথে মেঘনার ফেরিতে দেরি না হলে আরো আধঘন্টা আগে পৌঁছতে পারতো ওরা।

সুমনের বাবা বলেছিলেন চট্টগ্রামে তিনি ওদের সঙ্গে লাঞ্চ করবেন আর এই গাড়িই ওদের কক্সবাজার নামিয়ে দিয়ে সকালে ফিরে আসবে। তিনি পরদিন বিকেলে ঢাকা ফিরবেন। এও বলেছেন সুমনরা যেন আট দশ দিনের বেশি কক্সবাজার না থাকে।

লাঞ্চের জন্য সুমনের বাবা সবাইকে নিয়ে গেলেন আগ্রাবাদ হোটেলে। এত দামী হোটেলে রবি কেন, ঝন্টুও কখনও খায়নি। রবির ভয় হচ্ছিলো, যদি কাঁটা চামচ দিয়ে খেতে হয় বিপদে পড়তে হবে। কোন হাতে কাঁটা আর কোন হাতে ছুরি ধরে এটা না হয় অন্যদের দেখে ঠিক করে নিতে পারবে, কিন্তু ছুরি কাঁটা দিয়ে কেটে কেটে খেতে গেলে ওকে আধপেটা থাকতে হবে।

সুমনের বাবা এই বিড়ম্বনা থেকেও ছেলেদের রেহাই দিলেন। খাবার জন্য নিয়ে গেলেন বুফে কর্ণারে। বললেন, সবাই যে যার প্লেটে খাবার তুলে নাও। ইচ্ছে করলে হাতে খেতে পারো, ইচ্ছে করলে ছুরি কাঁটা দিয়ে। যা ইচ্ছে করবে প্লেটে তুলে নাও।

রবি আর ঝন্টু খেতে বসে টের পেলো এত উপাদেয় খাবার ওরা জীবনেও খায়নি।

পোলাও আর ভাত দুইই ছিলো। তিন ধরনের মাংশ, চার রকমের মাছ আর সবজি ছিলো দুই পদের। খাবার শেষে কাস্টার্ড, আর পুডিং দুটোই ছিলো। ওরা সবাই যে যার ইচ্ছে মতো খেলো। রবির বেশি পছন্দ ছিলো চিংড়ির কালিয়া, আর ঝন্টু মজা করে খেলো কচি বাছুরের মাংশের স্টেক, এত নরম যে মুখে দিতেই মোমের মতো গলে যাচ্ছিলো।

বুফে রুমে চা সার্ভ করা হয় না। সুমনের বাবার দুপুরে খাওয়ার পর এক পেয়ালা সবুজ চা না হলে চলে না। চা খেতে ওদের তিনি নিয়ে গেলেন আধো অন্ধকার এক ঘরে। সারা ঘর অন্ধকার, শুধু টেবিলে হালকা আলোর আভাস। ঝন্টু ফিশ ফিশ করে রবির কানে কানে বললো, একেবারে ইংরেজি ছবির মতো লাগছে না?

রবি বললো, ছবি নয়, স্বপ্ন।

খেয়ে উঠে ওরা যখন হোটেলের বাইরে এলো বেলা তখন তিনটা। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। ড্রাইভার রাজাকে সুমনের বাবা খাওয়ার জন্য আগেই টাকা দিয়েছিলেন। ও খেয়ে দেয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে লেটেস্ট মাসুদ রানা পড়ছিলো। সুমন লক্ষ্য করেছে রাজা অবসর সময়টা বই না হলে খবরের কাগজ পড়ে কাটায়।

সুমনের বাবাকে আগ্রাবাদের এক অফিসে নামিয়ে দিয়ে ওরা রওনা হলো কক্সবাজারের পথে। রাজা আপন মনে বললো, কক্সবাজার যাইতে যাইতে রাইত হইয়া যাইবো।

সুমনদের গাড়িটা নাইন্টি টু মডেলের হোন্ডা সিভিক। বলতে গেলে একেবারেই নতুন। রবি, ঝন্টু আর সুমন বসেছিলো পেছনের সিটে। সুমনের বাবা নেমে যাওয়াতে রাজার পাশের সিটটা খালি পড়ে আছে।

সুমন কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে চোখ বুজে ওয়াকম্যানে ম্যাডোনার গান শুনছিলো। ঝন্টু আর রবির বহু দিনের জমে থাকা কথায় ওর কোনও আগ্রহ ছিলো না। সুমন ওদের কথা শুনছে না দেখে রবি আর ঝন্টু বলাবলি করছিলো কথা না বলার এক মাস ওরা কী কষ্টে কাটিয়েছে। রবি বলছিলো, কী যে বিচ্ছিরি লাগতো বিমলের সঙ্গে বাড়ি ফিরতে!

ঝন্টু অভিমান ভরা গলায় বললো, আমার বুঝি খুব ভালো লাগতো সন্ধ্যে বেলা একা একা বাড়ি ফিরতে?

ভালো শিক্ষা হয়েছে। আর কখনও এরকম হবে না।

গত বছরও তো বলেছিলাম, আর এরকম হবে না।

আমার কী মনে হয় জানিস?

কী মনে হয়?

তুই যে আমার কত আপন এটা বুঝতে পারি তোর সঙ্গে ঝগড়া করে কথা বন্ধ করলে।

আমারও তাই মনে হয়।

রবি আর ঝন্টু কক্সবাজারের পুরোটা রাস্তাই এভাবে কথা বলে কাটিয়ে দিতে পারতো। সুমনও কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে ম্যাডোনার গানে বুঁদ হয়ে থাকতে পারতো। যাত্রায় বাধা পড়লো চট্টগ্রাম ছাড়ার এক ঘন্টা পর।

দু পাশে কোথাও ফাঁকা কোথাও ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে দক্ষিণে সমুদ্রের শহর কক্সবাজারের দিকে। শেষ বিকেলের মায়াবি রোদ পাহাড় আর জঙ্গলের গাছের মাথায় এলিয়ে পড়েছিলো। এমন সময় সুমন বললো, রাজা ভাই, সামনে একটা লোক লিফট চাইছে।

একটা উঁচু শাল গাছের নিচে লুঙ্গি পরা, চাদর গায়ে বগলে কাপড়ের পুটলি এক লোক লিফট নেয়ার জন্য হাত তুলেছে–এটা রাজারও চোখে পড়েছিলো। ও ভেবেছিলো সাড়া না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। গাড়ির স্পীড কমিয়ে সুমনকে বললো, জানি না, শুনি না–একজনরে গাড়িতে তোলা কি ঠিক হইবো?

এই রাস্তায় বিপদে না পড়লে কেউ লিফট চাইবে না। তাছাড়া বেশভূষা গ্রামের হলেও মনে হয় শহরের লোক। গ্রামের লোককে আমি কখনও লিফট চাইতে দেখি নি।

লোকটার পাশে রাজা গাড়ি দাঁড় করাতেই ও এগিয়ে এলো। বয়স খুব বেশি হলে তেইশ চব্বিশ হবে। গায়ের রঙ এক সময় ফর্শা ছিলো, রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। এক মাথা ঝাকড়া চুল, ধারালো অথচ মার্জিত চেহারা, চোখে চশমা, দেখেই মনে হয় কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া ছেলে।

লোকটা ভেবেছিলো, গাড়ির পেছনের সিটে বোধহয় মালিক বসে আছে কাছে এসে একটু অস্বস্তিতে পড়লো। রাজার চেহারা আসলে রাজপুত্রের মতো। তবে ওর পাশের সিট খালি দেখে লোকটার মনে হলো ও মালিক নয়। তবু ও রাজাকেই বললো, আপনারা কদুর যাবেন?

বিরক্তি মেশানো গলায় রাজা আলী এক শব্দে জবাব দিলো–কক্সবাজার।

দেখুন, আমি খুব অসুবিধেয় পড়েছি। লোকটাকে বিব্রত মনে হলো–সঙ্গে টাকা পয়সা কিছুই নেই। আজ রাতের ভেতরই আমাকে কক্সবাজার পৌঁছতে হবে। যদি দয়া করে লিফট দেন–

রাজা মাথা ঘুরিয়ে সুমনের দিকে তাকালো। সুমন লোকটাকে সামনের সিট দেখিয়ে বললো, উঠে পড়ুন।

অনেক ধন্যবাদ। বলে কৃতজ্ঞতার এক টুকরো হাসি ওদের উপহার দিয়ে লোকটা রাজার পাশের সিটে গিয়ে বসলো। রাজা আলী গাড়িতে স্টার্ট দিলো।

লোকটাকে দেখে ঝন্টুরও খুব মায়া লেগেছিলো। শক্ত সমর্থ শরীর হলেও ক্লান্ত চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিলো সারাদিন ওর কিছু খাওয়া হয়নি। পথে খাওয়ার জন্য সুমনের বাবা কমলা আর কলা কিনেছিলেন দাউদকান্দি ঘাট থেকে। ঝন্টুর একবার ইচ্ছে হলো লোকটাকে জিজ্ঞেস করে–কিছু খাবে কি না, পরে মনে হলো সুমন এটাকে আদিখ্যেতা ভাবতে পারে। অচেনা একজন লোক গাড়িতে ওঠাতে রবির সঙ্গেও আগের মতো কথা বলতে পারছিলো না ঝন্টু।

লোকটাকে দেখার পরই সুমনের গান শোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। রহস্য লহরী সিরিজের বই পড়া ওর অনুসন্ধিৎসু মন বলছিলো লোকটা খুব সাধারণ একজন যাত্রী নয়। কিছুক্ষণ পর ও লোকটাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলো, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

লোকটা গাড়িতে ওঠার সময়ই টের পেয়েছিলো রাজা নিছক ড্রাইভার, গাড়ির মালিক আপাতত সুমন। বয়সে ওর চেয়ে ছ সাত বছরের ছোট হবে। মাত্র গোঁফের রেখা গজিয়েছে–তুমি বলবে না আপনি বলবে ঠিক করতে না পেরে বললো, কী কথা?

আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি এখানকার লোক নন। আপনার বাড়ি কোথায় জানতে পারি?

লোকটার ঠোঁটের ফাঁকে ম্লান হাসি ফুটে উঠলো–বাড়ি কোথায় জানাটা কি খুব জরুরী?

জানা উচিৎ। গম্ভীর গলায় সুমন বললো, আপনাকে যখন লিফট দিচ্ছি আপনার পরিচয় জানা দরকার।

আমাকে যদি সন্দেহজনক বা বিপদজনক মনে হয় আমি তো মিথ্যে পরিচয়ও দিতে পারি।

আমি মনে করি আপনি তা করবেন না।

ঝন্টু বললো, ওঁর যদি পরিচয় দিতে আপত্তি থাকে, তুই জোর করছিস কেন সুমন?

লোকটা একটু ইতস্তত করে বললো, না, আপত্তি কিসের! আমার বাড়ি ঢাকা। আর কিছু জানার আছে?

সুমন বললো, আপনার নাম বলেননি। কী করেন এটাও জানা দরকার।

লোকটার কথা বলার ভেতর বেশ একটা ব্যক্তিত্বপূর্ণ ভাব ছিলো। আধ ময়লা চাদর আর লুঙ্গি পরা হলেও গলার স্বর, উচ্চারণ খুবই মার্জিত আর পরিষ্কার। শান্ত গলায় লোকটা বললো, আমার নাম শোয়েব আহমেদ। চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্সে মাস্টার্স পড়ছি।

সুমন আবার প্রশ্ন করলো, আপনি কি কোনও বিপদে পড়েছেন?

শোয়েব মৃদু হেসে প্রসঙ্গটা পাল্টাতে চাইলো–কারও পরিচয় জানতে হলে নিজের পরিচয়ও দিতে হয়।

একটু অপ্রস্তুত হয়ে সুমন বললো, সরি, আমার নাম সুমন। এরা আমার বন্ধু, ঝন্টু আর রবি। রাজা আলী আমাদের ড্রাইভার হলেও আমার বন্ধুর মতো। আমরা এবার এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছি। কক্সবাজার যাচ্ছি বেড়াতে।

সাবজেক্ট কী, সায়েন্স না আর্টস?

আমরা তিনজনই সায়েন্সের ছাত্র।

পরীক্ষা কেমন হয়েছে?

মন্দ নয়। আমার স্টার না থাকলেও সেভেন্টি পারসেন্টের ওপরে থাকবে। ঝন্টু স্টার পেতে পারে।

ঝন্টু বললো, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে সারাদিন কিছু খাননি। আমাদের সঙ্গে কলা আর কমলা আছে, খাবেন?

বেশি থাকলে খেতে পারি।

ঝন্টু দুটো কলা আর এটা কমলা এগিয়ে দিলো। শোয়েব একটু ইতস্তত করে বললো, খাবার পানি আছে?

চার বোতল মিনারেল ওয়াটার কেনা হয়েছিলো পথে। মাত্র এক বোতল শেষ হয়েছে। সুমন পানির বোতল বের করে শোয়েবকে দিলো।

ঢক ঢক করে বোতলের অর্ধেক পানি গলায় ঢেলে লাজুক হেসে শোয়েব বললো, ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছিলো।

সুমন লক্ষ্য করলো শোয়েবের হাসি খুবই নিষ্পাপ। ওর জড়তা কাটাবার জন্য বললো, আপনাকে আমরা যদি শোয়েব ভাই বলি আপনি আপত্তি করবেন?

করবো। শোয়েবের মুখে আগের মতো নিষ্পাপ হাসি। ওর মনে হলো এই ছেলেগুলোকে বিশ্বাস করলে ও ঠকবে না।

ওরা তিনজন একটু অবাক হলো শোয়েবের কথা শুনে। একটু দমেও গেলো। শোয়েব হেসে বললো, ভাই বললে কি আপনি বলার দরকার হয়?

এবার ওদের তিন জনের মুখে হাসি ফুটলো। ঝন্টু বললো, আপনিও কিন্তু কথা বলার সময় এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমরা আপনার অনেক নিচে পড়ি। আমাদের তবু তুমি বলছেন না। ভাববাচ্যে কথা বলছেন।

অনুমতি পেলে বলা যায়।  

নিশ্চয় তুমি বলবেন শোয়েব ভাই।

সুমন আর রবিরও কি একই মত?

হ্যাঁ শোয়েব ভাই। সুমন আর রবি শব্দ করে হাসলো। ঝন্টু বললো, সুমন তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলো শোয়েব ভাই।

কোন কথা?

তুমি কি কোনও বিপদে পড়েছো?

এ কথা কেন মনে হচ্ছে?

সুমন বললো, তুমি চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে পড়ো, হাইওয়ের মাঝখানে এলে কোত্থেকে? তার ওপর বলছো টাকা পয়সা নেই, আজই কক্সবাজার পৌঁছতে হবে?

শোয়েব এবার শব্দ করে হাসলো–মনে হচ্ছে তোমরা রহস্য আর গোয়েন্দা গল্পের বই পড়তে খুব পছন্দ করো।

তা করি। তুমি কিন্তু প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে না।

আমার টাকা পয়সা যদি ডাকাতরা নিয়ে যায় এটাও কম বিপদের কথা নয়।

তুমি সত্যি কথা বলছে না শোয়েব ভাই। সুমন বললো, ঢাকার যে ছেলে চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স পড়ে, সে কখনও লুঙ্গি পরে কক্সবাজার যাবে না। তার কাপড় চোপড়ও এরকম আধময়লা আর আন ইম্প্রেসিব হবে না।

তুমি ভালো ডিটেকটিভ হতে পারবে। আমি সত্যি–

শোয়েবের কথার মাঝখানে রাজা আলী বললো, সামনে পাঁচ ছয়টা লোক গাড়ি থামাইতে বইলতেছে।

শোয়েবের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ওরা সামনের রাস্তার দিকে লক্ষ্য করেনি। প্রায় একশ গজ দূরে ছয় জন লোক বেশ উদ্ধত ভঙ্গিতে গাড়ি থামানোর জন্য ইশারা করছে। দুজনের হাতে লাঠি। আরেকজনের চাঁদরের ভেতর কী আছে আল্লা মালুম, খুবই সতর্ক আর বেপরোয়া মনে হচ্ছে।

লোকগুলোর ওপর নজর পড়তেই শোয়েব উত্তেজিত গলায় বললো, গাড়ি থামাবেন না, রাজা ভাই। ফুল স্পীডে বেরিয়ে যান।

রাজা আলী গাড়ির স্পীড কমিয়েছিলো। হাত ভোলা লোকগুলো ভেবেছে গাড়ি বুঝি থামানো হচ্ছে। ওদের সতর্কতায় একটু ঢিল পড়তেই রাজা আলী পুশ করে ওদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো। ঝন্টু শোয়েবকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি এদের চেনো?

হ্যাঁ চিনি। তিক্ত গলায় শোয়েব বললো, ওরা আমাকে পেলে নির্ঘাত খুন করবে।

কী বলছো তুমি শোয়েব ভাই?

হ্যাঁ ঝন্টু। শান্ত গলায় শোয়েব বললো, তোমরা ঠিকই অনুমান করেছে। আমি ভীষণ বিপদে পড়েছি।