৫. অর্জুন একটা বেশ্যা মাগির পুত

০৫

তোমার অর্জুন একটা বেশ্যা মাগির পুত। নিজের মায়ে তার শুইছে বারো মাইনসের লগে তাই আমারেও সে বিলাইয়া দিছে পাঁচ ভাইয়ের বিছানায়। কর্ণ কি মিথ্যা কয় আমি একটা বেশ্যা? একটা বেশ্যারে জুয়ার দানে তুইলা দিতে যুধিষ্ঠিরের যেমন যায় আসে না তেমনি একটা বেশ্যারে কেউ বিবস্ত্র করলে অর্জুনেরও আসে যায় না কিছু…

কাম্যকবনে কৃষ্ণা দ্রৌপদী হামলাইয়া পড়ে কৃষ্ণের উপর। কৃষ্ণ কিছু কইতে গিয়া গুছাইতে না পাইরা তোতলায়। হাত তুইলা দ্রৌপদী তারে থামাইয়া দিয়া নিজে স্থির খাড়াইয়া থাকে। কৃষ্ণের মনে হয় যা বলার তা বইলা দিয়া দ্রৌপদীর বলা শেষ তাই থামানো কথা সে আর বাড়ায় না। কিন্তু দ্রৌপদী আবার মুখ খোলে। এক্কেবারে ধীর। অতি ধীর লয়ে কৃষ্ণের চোখে চোখ রাইখা সে জিগায়- দোস্ত। কও তো দেখি তোমরা সকলেই ক্যান কর্ণরে মারতে চাও? কর্ণ কী এমন করছে যা তোমরা কেউ করো নাই? তোমরা তারে অর্জুনের লগে লড়াই করতে দেও নাই; নমশূদ্র গালাগাল দিয়া সরাইয়া দিছ। সকলের লাইগা সমান সুযোগের স্বয়ংবরা থাইকা আমিও তারে গাড়োয়ানের পোলা কইয়া বিনা দোষে খেদান দিছি। সেই অপমানে সে যদি আমারে একবার বেশ্যা কইয়া ডাকে; তয় কি তা খুব বড়ো অপরাধ? কৃষ্ণ। তুমি কও তো সখা; তোমার সখী কৃষ্ণা পাঞ্চালী একটা বেশ্যা না?

একটা দম নিয়া পাঞ্চালী ফাইটা পড়ে আবার- হা কৃষ্ণ। আমি জানি এইখানে আমারে সান্ত্বনা দিতে আসো নাই তুমি। তুমি আসছ আমারে বুঝাইয়া আবার পাণ্ডবগো বনবাসের বিছানায় পাঠানোর ধান্দায়। পাঁচ পাণ্ডবগো নয়টা বৌ থাকতে একলা আমারেই বনবাসে পাঠাইছে তোমার পিসি যাতে পাঁচ পোলার একলা যৌনসঙ্গী হইয়া তাগোরে হাতের এক মুঠায় ধইরা রাখি আমি। তুমি যাও কৃষ্ণ। ভীষ্ম তোমার অর্জুনের ঠাকুরদা; দ্রোণ তার গুরু। তাগোর দিকে হাত তুলতে ভীমেরও গদা কাঁপতে পারে। কিন্তু পাঞ্চাল রাজারে তুমি চিনো। তুমি ভালো কইরা জানো তার দুই পোলা ধৃষ্টদ্যুম্ন আর শিখণ্ডীরে। দ্রোণ আর ভীষ্মর লাইগা তাদের অস্ত্র শাণ দেওয়া কেউ ঠেকাইতে পারব না জাইনা। রাখো তুমি। আর ধৃতরাষ্ট্রের পোলাগো লাইগা একলা ভীমই যথেষ্ট আমার। ভীম যদি বাঁইচা থাকে যদি বাঁইচা থাকে আমার দুই ভাই। যদি বুড়া বাপের শরীরে প্রাণ থাকে; তয় দ্রৌপদী তার হিসাব বুইঝা নিব এক দিন। তুমি যাও। তোমারেও এখন আর বিশ্বাস করি না আমি…

অপমান থাইকা বড়ো কোনো অস্ত্র নাই যা মানুষ ভোলে না ফিরাইয়া দিবার কথা। ঘৃণার থাইকা। বড়ো কোনো যুক্তি নাই যাতে মানুষ যে কাউরে ছোবল দিতে না পারে। ধীর কৃষ্ণ ধীর। জয় পরাজয় ক্ষত্রিয়দের নিত্য অভ্যাস। পাণ্ডবরা ভুইলা যাইতে পারে পরাজয়ের কথা; কিন্তু পাঞ্চালীর অপমানই তাগোরে আবার ফিরাইয়া আনব হস্তিনাপুর…

অতি দ্রুত হিসাব মিলাইয়া কৃষ্ণ চুপ থাকে। কৃষ্ণ যায়ও না; খাড়ায়ও না; খালি ডানে বামে পায়চারি করে। পাণ্ডবরা বনবাসে আসার তিন দিন পরেই দেখতে আসছিল বিদুর। ফিরা গিয়া যে সংবাদ দিছে তা শুইনা কুন্তী নিজেই রওনা দিছিল বনবাসে আসার। ধৃতরাষ্ট্রের সভাতেই যুধিষ্ঠিরের হাত পুড়াইতে গেছিল ভীম; অর্জুন তারে কোনোমতে আটকাইছে। ভীম বনবাসের শর্তও মানে নাই। এর মধ্যেই সে কয়েকবার হাতে গদা নিছে হস্তিনাপুর ফিরা যাবার লাইগা। ভীমেরে সামলাইতে পারে। এমন কেউ এখন এইখানে নাই। অন্য সময় হইলে কুন্তীর পরে ভীমেরে সামলাইতে পারত দ্রৌপদী। কিন্তু দ্রৌপদী এখন অপমানে রাগে অর্ধ উন্মাদ হইয়া আছে। হইবারই কথা। পাঞ্চাল রাজের মাইয়া সে; সম্রাটের মহিষী। পাঁচ-পাঁচটা তরুণ পোলাও আছে তার। কিন্তু মূর্খ যুধিষ্ঠির কি না সেই দ্রৌপদীরে পাশা খেলায় বাজি ধইরা বসল। হালা ফকিন্নির পুত; কপাল জোরে কুন্তীপিসির লাইগা দ্রৌপদীর মতো মেয়েরে নিজের বৌ হিসাবে পাইছে; সেই কি না দ্রৌপদীরে নিজের সম্পত্তি ভাইবা তুইলা দিলো জুয়ায়…

কৃষ্ণের অস্থির লাগে। দ্রৌপদীরে সামলাইতে না পারলে ভাইসা যাবে সব। আসার সময় কৃষ্ণ সাথে কইরা দ্রৌপদীর দুই ভাই আর পাঁচ পোলারেও নিয়া আসছে এইখানে। কিন্তু দ্রৌপদী কারো লগেই কথা কইতে চায় না। স্বামীগো লগে তো তার কথা পুরাটাই বন্ধ। সে তাগো লগে বনবাসে আসছে ঠিকই কিন্তু সে থাকতাছে পুরোহিত ধৌম্যের আশ্রমে…

বহুক্ষণ চুপ থাইকা আবার মুখ খোলে দ্রৌপদী-কৃষ্ণ তুমি আমারে কইতা সখী। আমার আছিল পাঁচ-পাঁচটা স্বামী। কিন্তু আইজ আমি বুঝতাছি আমার স্বামী নাই; ভাই নাই; পিতা নাই; পুত্র নাই; তুমিও নাই কৃষ্ণ। আমার যদি কেউ থাকত তাইলে দুঃশাসন আমার চুলের মুঠা ধইরা রাজসভায় টানতে পারত না। আমার যদি কেউ থাকত তাইলে কর্ণ আমারে বেশ্যা কইয়া গালি দিতে পারত না। আমার যদি কেউ থাকত তাইলে রাজসভায় কেউ আমার পোশাক খুলতে পারত না। আমার কেউ থাকলে আমারে নগ্ন হইতে দেইখা যুধিষ্ঠির মুখ ঘুরাইতে পারত না। আমার কেউ থাকলে ভীমরে

আটকাইতে পারত না অর্জুন। কেউ নাই আমার। কেউ নাই। আমার লাইগা ধর্মও নাই সখা। রাজদরবারে উলঙ্গ হইয়া আমি ভীষ্মের কাছে আশ্রয় চাই- পিতামহ আমারে বাঁচান। গঙ্গাবেশ্যার পোলা ভীষ্ম তখন ধর্ম ভুইলা যায়। আমি চিল্লাইয়া কান্দি- পিতামহ ধর্মের দোহাই অন্তত আমারে বিবস্ত্র হওনের থাইকা বাঁচান। বেজন্মা ভীষ্ম আমারে কয়-  ধর্মের ব্যাখ্যা বড়োই কঠিন। ধর্ম এতই

কঠিন রে কৃষ্ণ বিবস্ত্রা নারীর পোশাক ফিরাইয়া দেওয়া যাবে কি যাবে না; সেই ধর্মব্যাখ্যা আবিষ্কার করতে পারে না কুরুসভার কেউ। দ্রোণ আমারে দেইখা হাসে; পাঞ্চাল রাজের মাইয়ারে হাটে ন্যাংটা হইতে দেখলে ফকিন্নির পুত দ্রোণের হাসবারই কথা। কিন্তু সৎমায়ের শরীর চাইটা খাওয়া নির্বংশ ভীষ্মও তখন ফ্যালফ্যাল কইরা চোখ দিয়া চাটে নাতিবৌর নগ্ন শরীর। আমি একটা বেশ্যারে কৃষ্ণ। আমার নগ্ন শরীর দেখে দেবর শ্বশুর দাদাশ্বশুর আর নিজের পাঁচ-পাঁচটা পোলা। ঘেন্না। কৃষ্ণ ঘেন্না। আমারে আবারও বেশ্যা প্রমাণ করার লাইগা কি সাথে কইরা আমার পাঁচটা পোলারে এইখানে নিয়া আসছ তুমি? দোহাই। তোমারে আমি নিজের বন্ধু বইলা জানি। আমার সেই নগ্ন নরকের সময় আমি কারো নাম ধইরা ডাকি নাই। শুধু তোরেই আমি ডাকছিরে কৃষ্ণ। আমার মনে হইছে তুই থাকলে আমি তোর পায়ে ধইরা বলতাম-কৃষ্ণ; দোস্ত আমার; আমারে দয়া কর তুই। তোর হাতের চক্ৰখান দিয়া আমারে মরণ দে ভাই…

থাইমা থাইমা ফুইসা উঠে পাঞ্চালী। ফুঁসতে থাকা এই দ্রৌপদীই পাণ্ডবগো ভবিষ্যৎ। কৃষ্ণ তারে। ফুঁসতে দেয়। কথা বলুক পাঞ্চালী। কথা বলা দরকার তার। পাঞ্চালী বলতেই থাকে- আমারে তুই একটা মরণ দে কৃষ্ণ। হতভাগী অনাথ; যার কেউ নাই অন্তত তুই তারে দয়া কর। যাবার আগে তোর চক্ৰখান দিয়া আমার মাথাটা নিয়া যা বন্ধু। যে শরীর নিজের পোলাগো সামনে উন্মুক্ত হয় সেই শরীর আর টানতে পারি না আমি। আমারে দয়া কর তুই। আমি রাজ্য চাই না; প্রতিশোধ চাই না। ঘেন্নার এই জীবন থাইকা আমি শুধু মুক্তি চাই। আমারে তুই হত্যা কর…

দ্রৌপদীর দরকার কান্নার অবাধ সুযোগ। হস্তিনাপুর ছাড়ার পর কারো লগে একটাও কথা কয় নাই সে। তবে দ্রৌপদী যে এই কয় দিন কারো লগে কথা কয় নাই তাতে কৃষ্ণের শান্তি লাগে। কথা কইলে সে সকলের আগে ভীমের লগেই কইত। কিন্তু যে কথাগুলান সে কৃষ্ণরে কইল সেই কথাগুলান যদি ভীমেরে কইত তবে যুধিষ্ঠিররে খুন কইরা হয়ত অতক্ষণে ভীম গিয়া খাড়াইত হস্তিনাপুর…

চিল্লাইতে চিল্লাইতে গলা ভাইঙ্গা দ্রৌপদী টায়ার্ড হইয়া পড়ে। জীবনে কিছুই যারে এক চুল নড়াইতে পারে না সেই কৃষ্ণেরও দম বন্ধ হইয়া আসে। এই সেই পাঞ্চালী; যার স্বয়ংবরায় নিজেও একজন প্রার্থী আছিল কৃষ্ণ। সেই পাঞ্চালী যার শিক্ষা সৌন্দর্য বংশ গৌরব আর আত্মসম্মান দেইখা জরাসন্ধের মতো রাজাও তারে করতে চাইছিল মহারানি। সেই পাঞ্চালী নিজের উপর ঘৃণায় ধিক্কারে আইজ কাতর হইয়া কৃষ্ণের কাছে মৃত্যু প্রার্থনা করে- জীবনে বহুত মানুষ মারছো তুমি বন্ধু যুদ্ধ হিংসা কিংবা রাগের কারণে; আইজ তুমি দয়া কইরা অন্তত একজন মানুষ মারো। আমি তোমারে মিনতি করি কৃষ্ণ; আমারে হত্যা করো তুমি…

কৃষ্ণ তার চক্ৰখান নাড়াচাড়া করে- সখী। যদি আসমানও ভাইঙ্গা পড়ে যদি হিমালয়ও সাগরে ডোবে; তবু যারা তোমার অপমানের লাইগা দায়ী; হিসাব তাগোরে ফিরত পাইতেই হবে। কসম। এই কসম তোমার সখা কৃষ্ণের…

.

০৬

তোমার লাইগাই ভীমের আইজ না খাইয়া থাকতে হয়; এইটা তুমি বোঝো? তোমার মায় যেমন ফকিন্নি আছিল তেমনি তুমিও তো আছিলা ফকির। কিন্তু আমারে তো নিয়া আসছ রাজবাড়ি থাইকা। সেই তোমার লাইগা পাঞ্চাল রাজের মাইয়া আজ বনবাসী; এইটা তুমি বোঝো? তুমি নাকি ধর্ম বোঝো খুব? তয় জুয়া খেলার সময় তোমার ধর্মবুদ্ধি আছিল কই?

কৃষ্ণ চইলা যাওয়ার পর পাণ্ডবেরা চইলা আসে দ্বৈতবনে সরস্বতী নদীর কাছে। এর মাঝে দ্রৌপদী কিছুটা সামলাইয়াও নিছে। কিন্তু অন্যদের লগে স্বাভাবিক হইলেও যুধিষ্ঠিররে এখনো সহ্য হয় না তার-তুমি কোন মুখে নিজেরে ক্ষত্রিয় পরিচয় দেও? নকল ব্রাহ্মণ সাইজা দুয়ারে দুয়ারে গিয়া। তোমার ভিক্ষা করাই ভালো। তাতে বাকিরা মুক্তিও যেমন পায় তেমনি ভীম গিয়া রাজ্যটাও উদ্ধার করতে পারে…

যুধিষ্ঠির যুক্তি বাদ দিয়া কয়-  সকলই কপাল বিবি…

ভীম দ্রৌপদীরে থামাইতে আইসা উল্টা নিজেই খেইপা উঠে যুধিষ্ঠিরের উপর-বালছাল বুঝাইতে আসবা না তুমি। কপাল আর ধর্ম কপচাইয়া তুমি একটা হিজড়ায় পরিণত হইছ। তোমার ধর্মব্যাখ্যায় খালি শত্রুগোই লাভ। ওইটা ধর্ম না; ওইটা হইল নপুংসকের কুযুক্তি। তোমার তেরো বছর-টছর আমি বুঝি না। তেরো বছর পরে বাঁচব কি মরব তার কী গ্যারান্টি? আর বাঁচলেও বাঁচতে হইব বুড়া হাবড়া হইয়া লাঠি ভর দিয়া। এই কয় দিনেই যথেষ্ট হইছে। যা করা লাগে আমি একলাই করব। তোমার কিছু করা লাগব না। এখন চলো হস্তিনাপুর…

যুধিষ্ঠির ভীমরে বুঝাইতে চায় যে রাজসূয় যজ্ঞের সময় জোর কইরা যাগো কাছ থাইকা কর আনছিলাম তারা সবাই এখন দুর্যোধনের পক্ষে। জরাসন্ধের পক্ষের মানুষরাও এখন দুর্যোধনের লগে। বিষয়টা ভীম যত সোজা মনে করে তত সোজা না। কিন্তু ভীম তা মানতে নারাজ- সোজা হউক আর বাকা হউক। যা করা লাগে আমিই কৃষ্ণের লগে মিলা করুম…

যুধিষ্ঠির এইবার গম্ভীর হইয়া যায়- হস্তিনাপুরের রাজসভায় তুমি যখন আমারে মারতে গেছিলা; তখন মাইরা ফালাইলেই ভালো করতা। তা হইলে এখন বড়ো ভাই হিসাবে পাণ্ডবগো সিদ্ধান্ত তুমিই নিতে পারতা। কিন্তু যখন তা করো নাই তখন আমারে না মাইরা তুমি সিদ্ধান্ত নিতে পারো না…

ভীম শান্ত হয় না। মাটিতে একটা লাত্থি দিয়া আবার গিয়া যুধিষ্ঠিররে জিগায়- আইচ্ছা। ধইরা নিলাম বারো বছর বনবাস আর এক বছর অজ্ঞাতবাসের পর তোমার ধর্মসম্মত উপায়ে আমরা রাজ্য ফিরা পামু। কিন্তু এমন কী নিশ্চয়তা আছে যে তুমি আবার জুয়ার দানে সব ভাসাইয়া দিবা না? পাশা খেলার কথা শুনলে তো তোমার আবার হুঁশবুদ্ধি থাকে না; কিন্তু খেলতে বসলে খেলো আমার ধোনটা…

ভীম পারলে আইজই হস্তিনাপুর গিয়া দুর্যোধনের লগে মারামারি করে। যুধিষ্ঠির যতই বোঝায় যে এই সব আলোচনা ঠিক না। বনবাসেও দুর্যোধনের চর আছে। কিন্তু ভীম রাগে গাছের ডালডুল ভাইঙ্গা রাগ সামলাইয়া আবার ফিরা আসে যুধিষ্ঠিরের কাছে- আইচ্ছা; পণ্ডিতরা তো কয় পুঁইশাকের বীজ হইল পুঁইশাকের প্রতীক। সেই হিসাবে মাসও তো বচ্ছরের প্রতীক। আমরা বনে আছি তেরো মাস হইল; তো একটা যুক্তি দিয়া তেরো মাসরে তেরো বছরের প্রতীক বানাইয়া এখন আমরা ফিরা যাইতে পারি না?

যুধিষ্ঠির কয়-  না; তাতে পাপ হয়।

— ধুত্তুরি তোমার বালের পাপ। পাপ ধুইয়া ফেলার লাইগা না কত কী ভংচং আছে? পাপ করার পরে সেই রকম একটা কিছু করলেই তো হয়। এইরকম ছোটখাটো পাপের প্রায়শ্চিত্তের লাইগা একটা বলদরে ঘাস খাওয়াইয়া খুশি করলেই তো যথেষ্ট। চলো যাই। গিয়া কই তেরো মাসেই আমাগো তেরো বচ্ছর পূর্ণ হইছে…

যুধিষ্ঠির এইবার খেইপা উঠে- ছাগিবাচ্চার লাহান ফালাফালি বন্ধ করো। গেলে তো যাওয়াই যায়। কিন্তু দুর্যোধন পর্যন্ত পৌঁছাইতে হইলে যে তোমার কর্ণের সামনে পড়া লাগব সেইটা খেয়াল আছে? তোমারে নাকি কেউ মাকুন্দা কইয়া গালি দিলে তুমি তারে মাইরা ফালাও? কর্ণ তো তোমারে ট্যারা পেটুক মাকুন্দা ছাড়া আর কোনো নামে কোনো দিন ডাকেও নাই? কই এক দিনও তো কর্ণের একটা বাল ছিঁড়তেও দেখলাম না তোমারে…

ভীম ধুম ধুম কইরা মাটিতে লাথি মারতে থাকে। এইটা তার সবচে দুর্বল জায়গা; তার ট্যারা চোখ আর দাড়িগোঁফবিহীন মুখ। সবাই জানে যে ভীমরে কেউ মাকুন্দা কইলে তার আর জীবিত থাকার কোনো অধিকার নাই। কিন্তু কর্ণ সব সময় প্রকাশ্যে তারে মাকুন্দা কইয়া ডাকলেও কর্ণরে কিছু করার সাহস তার কোনো দিনও হয় নাই। কথাটা সে আগে ভাবে নাই যে দুর্যোধনরে মারতে হইলে তারে কর্ণের সামনে পড়তে হবে; যে কর্ণরে কৃষ্ণও ডরায়…

আশপাশের গাছপালার উপর ভীম রাগ ঝাড়ে। অবস্থা খারাপের দিকে যাইতাছে দেইখা দ্রৌপদী ভীমেরে সরাইয়া নেয়। অর্জুন এই বিষয়ে নাক গলায় না। কিন্তু একটু পরেই গিয়া যুধিষ্ঠিরের সামনে খাড়ায়- খালি তো বনবাস করলেই হবে না। আমাগো তো কিছু অস্ত্রশস্ত্রও জোগাড় করতে হবে। না হইলে যুদ্ধ করব কেমনে?

বাকিদের বনে রাইখা অস্ত্র সংগ্রহের নামে অর্জুন বাইর হইয়া যায়। দ্রৌপদী বোঝে তেরো মাসেই অর্জুন বনের জীবনে হাঁপাইয়া উঠছে; তাই একটা অজুহাত দিয়া বন থাইকা বাইরে যাবার উপায় বাইর করছে সে। দ্রৌপদী বেশি কিছু বলে না। খালি কয়-  ভালো থাইকো আর দয়া কইরা শক্তিমান কারো লগে বাহাদুরি করতে যাইও না অর্জুন পিছলাইয়া যাবার পর ভীমেরে দৌড়ের উপরে রাখতে যুধিষ্ঠির আবার জায়গা বদলাইয়া কাম্যকবনে ফিরা আসে। এইখানে জঙ্গল টঙ্গল পরিষ্কার কইরা থাকার জায়গা করতে গিয়া ভীম কয় দিন চুপচাপ থাকে। কিন্তু তারপরে আবার সে অস্থির হইয়া উঠে। তবে এইবার চিল্লাচিল্লি লাফালাফি বাদ দিয়া বহুত মাথা খাটাইয়া এমন যুক্তি বাইর করছে যাতে যুধিষ্ঠিরের প্রতিজ্ঞাও থাকে আবার পাণ্ডবদেরও থাকতে হয় না বনে। সে ঠান্ডা মাথায় বিনীতভাবে যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়া কয়-  ভাইজান। ক্ষত্রিয়ের কামই তো হইল রাজ্য শাসন; বনবাস না; কথাটা ঠিক কি না? তো এক কাম করি; আমরা অর্জুনরে ফিরাইয়া আইনা কৃষ্ণের লগে মিলা তেরো বছর হইবার আগেই হস্তিনাপুর আক্রমণ কইরা দুর্যোধনরে বিনাশ কইরা ফালাই। কিন্তু তাতে প্রতিজ্ঞাভঙ্গের লাইগা তোমার পাপ হইব; কথাটা আমি মানি। তো তেরো বছরের প্রতিজ্ঞা কইরা সময়ের আগেই হস্তিনাপুর যাওয়ার লাইগা যে পাপ হইব; সেইটা খণ্ডানের লাইগা রাজ্য জয়ের পর না হয় আবার আইসা তুমি একলা একলা বনবাস করবা। এতে রাজ্যও জয় হবে আবার তোমার পাপও খণ্ডাইব। বুদ্ধিটা ঠিক আছে না ভাইজান? আর এতেও যদি পাপ খণ্ডন না হয় তাইলে আমরা সকলে মিলাই না হয় পাপ খণ্ডনের লাইগা বামুন খাওয়াইয়া যজ্ঞ করব। ক্ষমতা থাকলে পাপমুক্ত হওয়া তো কঠিন কিছু না; তাই না ভাইজান?

যুধিষ্ঠির ভীমেরে বোঝায়- তোমার কথা শুনতে ধর্মের মতো শুনাইলেও এইটা কিন্তু চালাকি…

ভীম আইজ ধর্মের যুক্তি নিয়াই ধম্মপুত্তুরের লগে তর্ক করতে আসছে। একটায় যখন যুধিষ্ঠিররে পটানো গেলো না তখন সে আরেকটা বাইর করে। সে কয়- আইচ্ছা ভাইজান। ঠিকাছে। তুমি যখন কইছ যে এইটা চালাকি তখন আমি মাইনা নিতাছি। এইবার তাইলে তোমারে বেদ থাইকা একটা খাঁটি নিখুঁত ধর্মের ব্যাখ্যা দেই তুমি তো জানোই যে বেদে কইছে দুঃখকষ্টের এক রাত্রিই সাধারণ এক বৎসরের সুমান হয়? সেই হিসাবে বনে-জঙ্গলে তো আমরা তো দুঃখকষ্টেই আছি। আর বেদের এই যুক্তিতে তেরো দিনেই তো আমাগো তেরো বছর পার হইয়া গেছে। তাই না? তাইলে আর দেরি কীসের? আমরা তো বেদ আর ধর্ম মাইনাই এখন ফিরা যাইতে পারি?

ভীমের কাছে যুধিষ্ঠিরের বেদ বুঝতে হবে এইটা ভাইবা তার দম আটকাইয়া যায়। যুধিষ্ঠির কিছু না কইয়া ছটফট করে। ভীম মনে করে যুধিষ্ঠিররে সে যথেষ্ট পরিমাণ বেদ বুঝাইতে পারছে। এইবার তার যুক্তিগুলারে আরো পাকাপোক্ত করার লাইগা কিছু রেফারেন্স দেওয়া দরকার। ভীম আরো স্থির হইয়া ঋত্বিক বামুনের মতো যুধিষ্ঠিরের সামনে আসন পাইতা বসে- আমি যা কইলাম তাতে যুদি তোমার কোনো সংশয় থাকে তবে তুমি ঠাকুরদা দ্বৈপায়ন কিংবা ভীষ্ম কিংবা জ্যাঠা শুকদেব কিংবা বিদুর কাকারে জিগাইয়া দেখতে পারো যে আমি বেদবিরুদ্ধ কিছু কইছি কি না…

যুধিষ্ঠির পুরা তালা খাইয়া বইসা থাকে। একটাও কথা কয় না। ভীমের মনে হয় চাইর-চাইরজন বেদবিজ্ঞের রেফারেন্সসহ বেদের ব্যাখ্যা শুইনা যুধিষ্ঠিরের যেহেতু আর কিছু কওয়ার নাই তাই ধইরা নিতে হবে যে ভীমের যুক্তিটা সে মাইনা নিছে। ভীম এইবার আসন ছাইড়া পাছার ধুলা ঝাইড়া মুচকি হাসি দিয়া যুধিষ্ঠিরের কাছে নিজের বেদবিদ্যার রহস্য পরিষ্কার করে- তুমি তো মনে করো আমি খালি খাই আর কিলাকিলি করি; কিন্তু বেদব্যাস দ্বৈপায়নের নাতি আমি; চতুর্বেদী ঋষি শুকদেবের ভাতিজা। সেই হিসাবে দুই-চাইর পাতা বেদ পড়া তো আমার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে; তাই না?

যুধিষ্ঠির এখনো কিছু কয় না। ভীমের মনে হয় বেদের ব্যাখ্যা খণ্ডাইতে না পারলেও যুধিষ্ঠির মনে মনে দুঃখ পাইছে। তারে একটু সান্ত্বনা দেওয়া দরকার। সে গলায় দরদ মাখাইয়া যুধিষ্ঠিরের কান্ধে হাত রাখে- আরে ভাইজান; কষ্ট পাওয়ার কী আছে? গুণীজনরা তো কইয়াই দিছেন যে বাটপারের লগে বাটপারি করা কোনো পাপ না…

এইবার দপ কইরা যুধিষ্ঠিরের চোখ জ্বইলা উঠে। সাথে সাথে ভীম টের পায় একটা মারাত্মক ভুল কইরা ফালাইছে সে। সে এখন যে কথাটা কইছে সেইটা বেদেও নাই আবার কোনো বেদজ্ঞও কয় নাই। সে লগে লগে তার দোষ কাটায়- না না। এইটা কিন্তু বেদের কথা না। এই কথাটা আমি কৃষ্ণের কাছে শুনছি…

যুধিষ্ঠিরের জ্বইলা উঠা চোখ আবার ফ্যাকাশে হইয়া উঠে। ভীম মজা পায়। এই অবস্থায় যুধিষ্ঠিররে একটা খোঁচা না মরতে পারলে ভীমের কইলজা ঠান্ডা হয় কেমনে? সে একটু দূর গিয়া হাসে ভাইজান। তুমি মূর্খ কইয়া আমার কথা ফালাইয়া দিলেও কৃষ্ণের কথা ফালানোর ক্ষমতা তো তোমার নাই…

ভীমের হাতে চটকনা খাওয়ার ডরে বড়ো ভাইদের কথাবার্তা না শোনার ভান কইরা মুখ ঘুরাইয়া হাসে নকুল সহদেব। দ্রৌপদী হাসব না কানব বুইঝা উঠতে পারে না। ভীম যেভাবে দ্বৈপায়ন

শুকদেবের রেফারেন্স দিয়া যুধিষ্ঠিররে বেদ আর ধর্ম শিক্ষা দিতাছে তা দেখার মতো একটা বিষয়। ভীম বোধ হয় আইজ সিদ্ধান্তই নিয়া ফালাইছে যে সাক্ষাৎ দ্বৈপায়নের মতো ঠান্ডা মাথায় যুধিষ্ঠিররে বেদের যুক্তি দিয়া হস্তিনাপুর ফিরত নিয়া যাবে। আইজ যুধিষ্ঠিরের ধৈর্যশক্তির পরীক্ষা হইতাছে না

সে বেকুব বইনা গেছে সেইটা এখনো দ্রৌপদী ঠাহর করতে পারে নাই। দ্রৌপদী দূরে খাড়াইয়া ত্যাড়া চোখে ভীমের বেদ শিক্ষার ইস্কুলের দিকে নজর রাইখা গাছ লতা পাতা নাড়াচাড়া করে। যুধিষ্ঠির ঠাডাপড়া মানুষের মতো কাঠ হইয়া বইসা আছে। যুধিষ্ঠিররে যথেষ্ট পরিমাণ ধর্মশিক্ষা দিবার কৃতিত্ব জাহির করার লাইগা ভীম বারবার নকুল সহদেব আর দ্রৌপদীর চোখে পড়ার চেষ্টা করতাছে। কিন্তু নাটকের বাকি অংশ দেখার লোভে সকলেই মুখ ঘুরাইয়া কান খাড়া কইরা আছে দুই ভাইয়ের দিকে…

ভীমের লাইগা দুঃখ হয় দ্রৌপদীর। মানুষটা সরল-সোজা কিন্তু পরিবারের কোনো বিষয়েই বিন্দুমাত্র অবহেলা নাই তার। ধৃতরাষ্ট্রের পোলাগো লগে অন্য কোনো পাণ্ডবই প্রায় মারামারি করে নাই; যা করার করছে শুধু এই ভীম। ধৃতের পোলাদের একমাত্র শত্রুও এই ভীম। মানুষটা খায় একটু বেশি কিন্তু বনবাসে আসার দিন ভীমেরে খাওনের খোটা দিয়া দুর্যোধন যেভাবে ভ্যাংচাইছে তা সহ্য হয় নাই দ্রৌপদীর। নিজের দুঃখ ভুইলাও সেদিন তার মনে হইছিল এই কামটা ভালো করল না দুর্যোধন…

ভীম হাঁটে ঝুঁইকা ঝুঁইকা; লম্বা লম্বা পা ফালাইয়া। মোটা মানুষ হওয়ায় হাঁটার সময় তার হাঁটু ভাঙ্গে কম। পুরা পা ফালাইয়াই সে বুইকা ঝুঁইকা হাঁটে। রাগের মাথায় যখন হাঁটে তখন তার হাঁটার ঝাঁকুনি আরো বাড়ে। হস্তিনাপুর ছাড়ার সময় পঞ্চপাণ্ডব আর দ্রৌপদী যখন হাঁটতে হাঁটতে আসছিল তখন দুর্যোধন আইসা ভীমের পাশাপাশি তারে ভ্যাংচাইয়া ঝুঁইকা ঝুঁইকা হাঁটা শুরু করে- হি হি হি…

দুর্যোধন ভীমেরে ভ্যাংচাইয়া হাঁটে আর হাসে- হি হি হি। ভাইরে। আমার পেটলা ভাই ভীম; তোর লাইগা দুঃখে আমার বুকটা ফাইটা যায়। কত মারামারি করলি দুইডা খাওনের লাইগা। কিন্তু তোর পেট থাকলেও কপাল নাই। নির্বোধ যুধির লাইগা তোর পেট ভইরা খাওনটাও গেলো। আমি জানি রে ভাই; রাজ্য থাকা না থাকায় তোর কিছু যায় আসে না; কিন্তু রাজ্যের লগে লগে যে তোর গামলা ভইরা খাওনের বন্দোবস্তও গেলো। আহারে…

দুর্যোধন কান্নার ভান কইরা ভীমের সামনে আইসা চোখ মোছে- আমার ভাইরে ভাই। পেটলা উপাসি ভাই আমার আঁউ আঁউ আঁউ…

দ্রৌপদী ভীমের কাছাকাছি থাকে। ভীমের হাঁটার গতিই বইলা দেয় যেকোনো সময় সে সবকিছু ভুইলা দুর্যোধনরে মাইরা বসতে পারে। কিন্তু দুর্যোধনও যে ভীমের উপরে তার জীবনের সব রাগ আইজই মিটাইতে চায়। দুর্যোধন ভীমেরে ভ্যাংচাইয়া কান্দে-ভাইরে আমার ভীম ভাই। বনের। লতাপাতা কচুঘেঁচু খাইয়া যুধিষ্ঠির ঠিকই ধর্ম করতে পারব কিন্তু তোর এই গতরটা টিকব কেমনে রে ভাই? আহারে; তেরো বচ্ছর পর যখন তুই ফিরা আসবি তখন তো আর তোর এই তাকত থাকব রে ভাই। আমার মাথায় মারার লাইগা গদার বদলা ভর দিয়া হাঁটার লাইগা তোর হাতে থাকব একটা বাঁশের লাঠি। হি হি হি…

দুর্যোধন বারবার ভীমের পথ আগলায়। ভীম একটাও কথা না কইয়া ফুঁসতে ফুঁসতে দুর্যোধনরে এড়ায়। দুর্যোধন আবার দৌড়াইয়া গিয়া ভীমের কাছে খাড়ায়- আমি তোরে কথা দিলাম ভাই। তুই যেদিন ফিরা আসবি সেদিন তোরে আমি পেট ভইরা ঘিয়ে ভুনা মাংস খাওয়ামু। তোর লগে যতই শত্রুতা থাউক; আমি আস্ত একখান ঘিয়ে ভুনা বলদের রান দিমু তোরে। তুই তো জানোসই যে আমি ডেলি ডেলি কতশত ফকির খাওয়াই; সেই ক্ষেত্রে তোরে একটা বলদের রান দিতে পারব না আমি? অবশ্যই দিমু। আরে তুই আমার পাণ্ডুকাকার পোলা না? আমার ভাই। কিন্তু রে ভাই…

দুর্যোধন আবার ভীমের সামনে আইসা কান্দনের ভান কইরা চোখ মুছে- কিন্তু সেই দিন তো গরুর রান চাবানোর লাইগা তোর মুখে একটাও দাঁত থাকব না রে ভাই। তুই মাংস খাবি কেমনে? হি হি হি। এখন দাঁত আছে কিন্তু খাওন নাই; খাওন যখন পাবি তখন থাকব না দাঁত। হি হি হি। আইচ্ছা যা; কথা যখন দিছি তখন তোরে যেমনেই পারি আমি মাংস খাওয়ামু। আমি নিজে মাংস চাবাইয়া থুক কইরা তোর পাতে ফালামু আর তুই সেই থুতু চাইটা সেদিন মাংসের স্বাদ নিবি? এইটাই হইব তোর উপযুক্ত আপ্যায়ন তাই না? ঝুটা ছাড়া তো তোর কপালে আর কিছু জুটার কথা না। হি হি হি…

অদ্ভুতভাবে ভীম একটাও কথা কয় না সেদিন। কিন্তু ভীমরে দেইখাই দ্রৌপদীর মনে হইছিল দুর্যোধন কামটা ভালা করতাছে না। সবাই সবকিছু ভুইলা গেলেও প্রতিশোধ ভোলে না ভীম। ভীমরে এই টিটকারি দিবার খেসারত দুর্যোধনরে এক দিন দিতেই হবে…

বনে আইসা ভীমের সত্যিই কষ্ট হইতাছে। এর লাইগা সে লাফালাফিও করে। কিন্তু আইজ যে সে বুদ্ধি কইরা যুধিষ্ঠিররে বেদ বুঝাইতে গেছে এইটা দেইখা দ্রৌপদী হাসি থামাইতে পারে না। ভীমের মুখে বেদবাণী শোনার ধৈর্য পরীক্ষায় বোধ হয় যুধিষ্ঠির পাশ কইরা ফালাইছে। সে বেশ শান্তশিষ্ট হইয়া চুপ মাইরা বইসা এখন ভীমের পেটে বেদের মজুত মাপছে। ভীমও এখন যুধিষ্ঠিরের লগে ধৈর্যের কম্পিটিশনে নামছে। অশেষ ধৈর্য নিয়া একেকটা কথা ঘুরাইয়া ফিরাইয়া বারবার বলতে বলতে ভীমের খেয়াল হইছে তার বেদের স্টক শেষ কিন্তু এখন পর্যন্ত যুধিষ্ঠির একটাও কথা কয় নাই। সে একটু ঘাবড়াইয়া গেলেও ধৈর্য হারায় না। বেদ ছাইড়া এইবার সে যুধিষ্ঠিররে কূটনীতি বুঝাইতে শুরু করে- ভাইজান। না হয় আমরা বারো বছর বনবাস করলাম। কিন্তু তারপরে তেরো নম্বর বছরে তো আমাগো লুকাইয়া থাকতে হবে। লুকাইতে না পারলে তো আবার আরো বারো বছরের লাইগা বনবাস। তো তুমি কি মনে করো যে তেরো নম্বর বছরে দুর্যোধনের চেলারা আমাগো খুঁইজা বাইর করব না? আমরা যেইখানেই যাই না কেন; সবখানে তার চর আছে; এইখানেও আছে। তার মানে আমরা কিন্তু জীবনেও হস্তিনাপুর ফিরা যাইতে পারব না…

ভীমের এইবারের কথায় মিনতির সুর। এইবার যুধিষ্ঠির মুখ খোলে- একবার যখন ধর্মমতে কইছি যে বারো বছর বনবাস আর এক বছর অজ্ঞাতবাস করব। তখন তেরো বচ্ছরের আগে আমারে তুমি কোনোভাবেই হস্তিনাপুর নিতে পারবা না। যত যাই ব্যাখ্যা দেও আমারে দিয়া কোনো অধর্ম করাইতে পারবা না তুমি…

বেদ শেষ। কূটনীতি শেষ। যুধিষ্ঠিরের সিদ্ধান্ত জানার লগে লগে ভীমের ধৈর্যও শেষ। এইবার এক লাফে ভীম তার নিজের চেহারা ধরে- ধর্ম কইরা কোন বালটা ছিড়বা তুমি? ধর্ম কইরা রাজ্য। পাইলেও পাশা খেলার কথা শুনলে তো তোমার হুঁশবুদ্দি কিছু থাকে না। তখন তো আবার বাজি ধইরা নিজের বিচি পর্যন্ত হারাইয়া বসবা তুমি…

.

০৭

রাজ্যনাশ হইবার পর পাণ্ডবগো রাজপুত্র পোলাপানরা বাপ-কাকারে বনে পাঠাইয়া এখন আদরে মাখনে আরামে থাকতাছে নিজেগো রাজা মহারাজা মামাদের ঘরে। আর যে জীবনে রাজবাড়িতে থাকেও নাই; খায়ও নাই কিংবা নিজেরে রাজপুত্র বইলা পরিচয়ও দেয় নাই; দুঃসময়ে ভীম তারেই সংবাদ দিলো বনে-বাদাড়ে বাপ-কাকা আর সম্মায়ের মালপত্র টানার কামে। সে ঘটোৎকচ; পাণ্ডব বংশের প্রথম সন্তান; ভীম আর হিড়িম্বার পোলা…

ভীমেরে সামলাইতে পারত দ্রৌপদী কিন্তু সে এখন ভীমের কোয়ালিশন হইয়া যুধিষ্ঠিরের অপজিশন। ভীমরে কিছুটা সামলাইতে পারত অর্জুন কিন্তু অস্ত্র জোগাড়ের নামে সে পলাইছে বনবাস ছেড়ে। এই

অবস্থায় দৌড়ের উপ্রে না রাখলে ভীমেরে সামলানো কঠিন। তাই এক দিন ভবঘুরে মুনি লোমশরে পাইয়া তার নেতৃত্বে যুধিষ্ঠির তীর্থ যাত্রার একটা পরিকল্পনা বানাইয়া ফালায়। কিন্তু তীর্থযাত্রায় দরকারি মালপত্র বহন করব কেডায়?

ভীমের সংবাদ পাইয়া ঘটোৎকচ আইসাই যুধিষ্ঠিররে ঠেলায়- লও জ্যাঠা। তীর্থফিৰ্ত বাদ দিয়া আমার ঘরে চলো। এই বয়সে তোমাগো বনে-বাদাড়ে ঘুইরা কাম নাই। সবাইরে নিয়া আমার লগে চলো…

যুধিষ্ঠির ঘটারে বোঝায়- তোর বাড়ি যাওয়া ঠিক হইব না বাজান। কারণ আমরা যে প্রতিজ্ঞা করছি বনবাসে থাকার। এখন তোর বাড়ি গেলে তো সেই প্রতিজ্ঞা থাকে না…

–হ। আমার বাড়ি গেলে তোমাগো প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গে কিন্তু বনবাসের প্রতিজ্ঞা কইরা যে অর্জুন কাকু বনের বাইরে গিয়া রাজা বাদশার বাড়িতে ঘি-মাখন খাইয়া দিন কাটায় তাতে প্রতিজ্ঞার কিছু হয় না?

যুধিষ্ঠির ঘটার কথার উত্তর দেয় না কিন্তু ধৌম্য আগাইয়া আসে- শোনো ঘটোৎকচ। বাপ-কাকা জ্যাঠারে এমনভাবে কওয়া ঠিক না। তাগো বিষয় আশয় তাগোরেই দেখতে দাও…

ঘটোৎকচ পিটপিট কইরা ধৌম্যের দিকে তাকায়- অ্যারে। পরখাউকি বামনা দেখি এইখানেও আছে। তুমি অত চিন্তা করো ক্যান? বাপ-কাকারে খাওয়াইতে পারলে তোমার খন্দকও ভরাইতে পারব আমি। এখন সইরা খাড়াও; আমি জ্যাঠার লগে কথা কই…

এই অপমানটা ধৌম্যের লাগে- এইভাবে কওয়া উচিত না ঘটা। আমি তোমার মুরব্বি মানুষ। তাছাড়া আমি সম্রাট যুধিষ্ঠিরের পুরোহিত…

–বালের পুরোহিত তুমি। সম্রাটের জুয়া খেলা ছাড়াইতে পারো নাই তো কোন বালটা ছিঁড়ছ তুমি পুরতগিরি কইরা?

এইবার ভীমের মনে হয় পোলারে থামান দরকার। সে জায়গায় খাড়াইয়া ঘটারে দাবড়ানি দেয় থাপড়াইয়া কইলাম তোর কান ফাটাইয়া ফালামু। বেশি বক বক করছ তুই…

–হ আব্বা। কথাবার্তা একটু বেশিই কই। কিন্তু মায়ে কয় আমার এই দোষটা নাকি বাপের থাইকা পাওয়া…

ঠাঠা কইরা হাইসা উঠে যুধিষ্ঠির- হা হা হা। তোরে আমি কইছি না ভীম; যে তুই বেশি কথা কস? এইবার নিজের পোলার মুখে হুনলি তো?

দ্রৌপদী হাসে। যুধিষ্ঠিররে জীবনেও এমন হাসতে দেখে নাই সে। ঘটা আবার গিয়া যুধিষ্ঠিররে ধরে ও জ্যাঠা তোমার চ্যালাচামুন্ডা যা আছে সব নিয়া চলো। তোমার বামনার লাইগাও আমার ঘরে ঘাসপাতার অভাব হইব না…

ধৌম্য চুপসাইয়া গেছে। ভীম ধৌম্যরে বাঁচাইতে আইসা পোলা আর ভাইয়ের ডবল টেক্কায় পুরাটাই বেকুব। এইবার দ্রৌপদী আগাইয়া আসে- এইভাবে কয় না বাপ। ব্রাহ্মণ মানুষ। মনে কষ্ট পাইলে অভিশাপ লাগব যে…

–যারে জন্ম দিয়া বাপে ফালাইয়া গেছে জঙ্গলে; সেই পোলারে তুমি ঠোলা বামনার অভিশাপের ডর দেখাও ছুডু মা? এখন আমিও ডাঙ্গর দুইটা পোলার বাপ। দশ বিশজন মানুষ নাইড়া খাই। কোনো হালার আশীর্বাদ ছাড়াই যখন অতটুকু আসতে পারছি তখন অভিশাপে ডরানের কী আছে? চলো বাইত যাই…

ঘটার এই খোঁচাটা সরাসরি ভীমের দিকে। ভীম চামে চামে কাটে। দ্রৌপদী তাকায় যুধিষ্ঠিরের দিকে। ঘটা দ্রৌপদীরে ছাইড়া আইসা খাড়ায় যুধিষ্ঠিরের সামনে-বুঝলা জ্যাঠা। তোমরা আশ্বিনে কাত্তিকে কয় দিন রাজা হইলেও জীবনের বেশির ভাগ কাটাইছ বনে-জঙ্গলে। তাই এই সবে তোমাগো অভ্যাস আছে। কিন্তু ছুডু মা তো খাঁটি রাজকইন্যা। তুমি তোমার সিংহাসন নিয়া যা ইচ্ছা করতে পারতা কিন্তু ছুডু মায়েরে বনে-জঙ্গলে আইনা কষ্ট দেওন কিন্তু ঠিক হয় নাই…

–কপালে না থাকলে কী আর করব রে বাপ?

— কপাল কইও না জ্যাঠা। তোমার খাইসলতের দোষ। তুমি নিজের বুদ্ধিতে কোনো বালও ছিঁড়তে পারো না। তোমারে রাজা বানাইছে কুন্তী আর সম্রাট বানাইছে কৃষ্ণা তারপর যখনই তারা তোমারে একলা ছাইড়া দিছে তখনই তুমি করলা একটা আকাম…

– তোরে মাথার উপ্রে তুইলা কিন্তু একটা আছাড় দিমু ঘটা…

ভীম এইবার নাক গলায় যুধিষ্ঠিররে বাঁচাইতে। কিন্তু ঘটা নির্বিকার- তা দেও। কিন্তু তার আগে আমার যুক্তিটা খণ্ডাইতে পারলে ভাবতাম জীবনে পয়লাবারের মতো একটা বাপের কাম করলা…

–তুই কিন্তু সত্যি সত্যি এখন মাইর খাবি…

ভীম থাবা বাগাইয়া আসলে যুধিষ্ঠির থামায়- ওরে কইতে দে। বংশের বড়ো পোলা। বাপ চাচার পরে সেই হইব এই বংশের রাজা। সে তো বাপ-জ্যাঠার একটু সমালোচনা করতেই পারে

— তোমার নিজের রাজ্য থাকলে না উত্তরাধিকার নিয়া ভাবো। নিজেই এখন জঙ্গলে বইসা বাল ফালাও আবার আরেকজনরে দেও সিংহাসনের ভাগ…

পোলারে সামলাইতে গিয়া ভীম নিজেই খেইপা উঠে যুধিষ্ঠিরের উপর। যুধিষ্ঠিরও একটু গরম হয় ভীমের উপর- পোলাপানের সামনে মুখ খারাপ করলে কিন্তু পোলার সামনেই তোরে আমি একটা চটকনা দিমু ভীম…

এইবার ঘটা নেয় মধ্যস্থের ভূমিকা- আহা জ্যাঠা। তুমিও দেখি রাগ করো। আসোলে যারা মারামারি করে তাগো মুখ একটু খারাপই হয়। ধরো গিয়া তুমি করো ধর্মকর্ম। তোমার যা ডাকাডাকি তা সব ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব কিংবা সর্বনিম্নে দ্বৈপায়ন। তুমি তো আর তাগো শালা বাইঞ্চত কইয়া ডাকতে পারো না। কিন্তু অর্জুন কাকায় যখন কর্ণরে মারতে যাইব তখন যদি- খানকির পোলা কর্ণ তোরে আমি খাইয়া ফালামু কইয়া আওয়াজ না দেয় তো মাইরের জোশ পাইব কই?

–কর্ণ আমাগো শত্রুর হইলেও তারে মা তুইলা গালি দেওন কিন্তু ঠিক না ঘটা…

যুধিষ্ঠিরের কথায় ঘটোৎকচ হাসে- হ জ্যাঠা। তা অবশ্য ঠিক; কার গালি যে কার পিঠে লাগে কে জানে। তো যা কইতাছিলাম জ্যাঠা। তোমাগো খাইসলতের যেমন দোষ আছে; হিসাব-নিকাশেও কিন্তু ভুল আছে। ধরো আব্বায় ফালাইতাছে দুর্যোধন কাকুরে মারার লাইগা আর অর্জুন কাকা কাগুকৃষ্ণের লগে মিলা পিছলা পথ খুঁজতাছে কর্ণ জ্যাঠারে মারার…

— কর্ণ আবার তোর জ্যাঠা হয় কেমনে?

ভীমের ধামকিতে ঘটোৎকচ ত্যাড়া চোখে যুধিষ্ঠিররে সার্ভে কইরা আবার ভীমের দিকে ফিরে- শত্রুর হইলেও তিনি আমার মুরব্বি মানুষ আব্বা। নাম ধইরা ডাকলে তো আবার জ্যাঠায় আপত্তি করব। তাই তিনারেও জ্যাঠা কইলাম আরকি। তো যাই হোক তোমরা একজন ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর পোলা দুর্যোধনরে মারতে চাও আর আরেকজন মারতে চাও সূর্যপুত্র; ঠিক না জ্যাঠা? কর্ণরে তো মাইনসে সূর্যপুত্রই কয়?

–হ। সে সূর্যপুত্র হিসাবেই পরিচিতি

— তার মায়ের নাম যেন কী জ্যাঠা?

ভীম আবার বাগড়া দেয়- ওর মায়ের নাম রাধা গাড়োয়ানি…

ঘটোৎকচ আবার যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকায়- কর্ণরে রাধার পোলা কইলে তো তারে আর সূর্যপুত্র কওয়া যাইব না। কইতে হইব অধিরথের পোলা। তাই না জ্যাঠা?

যুধিষ্ঠির এইবার একটু বিরক্ত হয়- এইটা নিয়া পরে তোর লগে কথা কমু আমি। যা কইতেছিল তা ক। কারো বাপ-মায়ের নাম দরকার নাই। নাম কইলেই ওগোরে সবাই চিনে…

–হ। কথা হইল তোমরা মারতে চাও দুর্যোধন আর কর্ণরে। কিন্তু হিসাব কইরা কি দেখছ যে কার ঘাড়ে পা দিয়া মাখনটা কার ঘটি থাইকা খাইতাছে কে?

— তুইই ক

যুধিষ্ঠিরের কথায় ঘটা আগে বাড়ে-আসোল মাখনটা কিন্তু খাইতাছে ভরদ্বাজের বাটপার পোলা; যারে তোমরা গুরু দ্রোণাচার্য কইয়া নম নম করো।

— এমন কইরা কয় না বাপ। তিনি কিন্তু আমাগো গুরু আর বহু বড়ো সাধক

— ল্যাওড়ার সাধক। আর তোমাগো গুরু হইলে আমার কী? চোররে চোর কইতে অসুবিধা কই? ওই চোট্টা হালায় কিন্তু একটা বাটপার আর মিচকা শয়তান। পানি না ছুঁইয়া খলুইতে মাছ তোলে। চিন্তা কইরা দেখো তো তোমাগো যে কুরু পাণ্ডব কর্ণে অত মারামারি; সেই কুরু পাণ্ডব কর্ণরে সে কিন্তু গুরুদক্ষিণা নিবার নামে এক কইরা ফালাইছিল ছুডু মায়ের বাপ দ্রুপদের রাজ্য কাইড়া নিবার সময়। তোমরা কিন্তু কুরু পাণ্ডব কর্ণ একলগে যুদ্ধ কইরা ঠিকই দ্রুপদের অর্ধেক রাজ্য কাইড়া নিয়া দিছিলা তারে। আবার দেখো সেই কুরু পাণ্ডবে পাশা খেইলা তোমরা যে রাজ্যটা হারাইলা; সেই রাজ্যের রাজা কিন্তু এখন শকুনিও না; দুর্যোধনও না- কর্ণও না। তোমাগো ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্যের রাজাও কিন্তু এখন তোমাগো সেই গুরু দ্রোণচোট্টা…

ভীম হা কইরা পোলার মুখের দিকে তাকায়- তুই অত হিসাব শিখলি কেমনে?

— আব্বা। আমি তো আর তোমার কোলে চইড়া বড়ো হই নাই। বড়ো হইছি একলা একলা মাইনসের লাত্থিগুঁতা খাইয়া। হিসাবে ভুল করলে তো অত বড়ো হইয়া দুই পোলার বাপ হইতে পারতাম না…

পোলার খোঁচায় যতটা না আঘাত পায় তার থাইকা পোলার বুদ্ধিতে বেশি খুশি হয় ভীম। সে আগাইয়া আইসা আসন গাইড়া বসে- আমিও তো কই হালায় লোভী বামুন। না হইলে বামুন হইয়া অস্ত্র চালায় ক্যান? |||||||||| — হিসাব আরো আছে আব্বা; সেইটা হইল ক্ষতির হিসাব। ক্ষতিটা কার বেশি হইছে জানো? বেশি হইছে ছুডু মায়ের। তোমরা আলসালে কেউই কোনো দিন রাজপুত্র আছিলা না; আছিলা কুন্তীপুত্র। মাঝখানে কিছু দিন রাজবাড়িতে ছিলা এর বেশি কিছু না। কিন্তু ছুডু মায়ে জন্মের পয়লা দিন থাইকাই রাজকইন্যা। বিবাহের পর সে হইছে রাজরানি। এখন সেই ছুডু মায়ের বাপের রাজ্যও নিছে দ্রোণ আবার তার স্বামীগো রাজ্যও ভোগ করতাছে দ্রোণ আর এখন তারেই ঘুইরা বেড়াইতে হইতাছে বনে-বাদাড়ে। আর লাঞ্ছন যা হইবার সেইটাও তো হইছে ছুডু মায়ের একলাই…

দ্রৌপদী দৌড়াইয়া আসে। তার লাঞ্ছনার হিসাব দিতে গিয়া এখন আবার ঘটা কাহিনি বয়ান করুক তা চায় না সে। দ্রৌপদী দ্রুত আইসা কথা আগলায়- খালি গল্প করলে হইব? আয় আগে কিছু খাওয়া-দাওয়া কইরা নে…

লাফ দিয়া উঠে ঘটা- আরে। আমি তো ভুইলাই গেছিলাম। তোমাগো লাইগা কিছু খাওন নিয়া। আসছি আমি। আব্বা আসো। তোমার লাইগা আস্ত একটা গরু মাইরা ঘিয়ে ভুনা কইরা আনছি; তোমার পোলার বৌ নিজের হাতে রান্না করছে…

— তোর বৌয়ের হাতের রান্না আমি খামু না

–ক্যান? সে আবার কী করল?

ভীম উইঠা যায়- খাই বেশি বইলা আমারে কি তুই ভুক্ষাসি পাইছস যে যার তার হাতের রান্না খামু?

ঘটা এইবার মেরুদণ্ড সোজা কইরা ভীমের সামনে গিয়া খাড়ায়- আমার বৌয়ের জাত নিয়া কথা কবা না কলাম আব্বা। তোমার সাক্ষাৎ দাদা দ্বৈপায়ন আছিল নমশূদ্র মাইমল বেটির পুত আর তোমার নিজের বাপ তো বাতাস; ধরাও যায় না ছুঁয়াও যায় না; দেখার তো প্রশ্নই নাই; পবন। আমারে জাত দেখাইও না তুমি…

— জাতের গুষ্টি মারি আমি। কিন্তু তোর বৌয়ের হাতের রান্না আমি খামু না…

ভীম সইরা যায়। ঘটা গিয়া আবার তার সামনে খাড়ায়-ক্যান? খাবা না ক্যান?

— খামু ক্যান? তুই যে বিয়া করছস আমারে কইছিলি?

ঘটোৎকচ এইবার ভীমেরে ভালো কইরা দেইখা আস্তে আস্তে গিয়া দ্রৌপদীর সামনে খাড়ায়- তুমি কও তো ছুডু মা; আব্বারে গিয়া কি আমার কওয়া উচিত আছিল যে; আব্বাজান আপনার পোলার বিবাহে আপনার নিমন্ত্রণ? নাকি তারই গিয়া মাইনসেরে কওয়া দরকার ছিল যে আমার পরথম পোলার বিবাহে আপনাগো নিমন্ত্রণ? তুমি একটু ন্যায্য বিচার করো তো; কামলা খাটার দরকার না পড়লে যে বাপে একবার সংবাদও নেয় না পোলায় বাঁইচা আছে কি মরছে; আমি বিয়া করার সময় সেই বাপের পারমিশন না নেওয়া কি খুব অন্যায় হইছে আমার?

দ্রৌপদী এই প্রশ্নের উত্তর খুঁইজা পায় না। ভীম আঙ্গুল দিয়া মাটি খামচায়। যুধিষ্ঠির ঘটার দিকে। আগাইয়া আসে- মনে কষ্ট নিস না বাপ। দোষ আমারই বেশি। পরিবারের মুরুব্বি হিসাবে আমারই কর্তব্য আছিল নিজে খাড়াইয়া তোর বিবাহ তদারকি করা। কিন্তু পারি নাই; সেইটা খালি তোর বাপের না; আমাগো সবারই অন্যায় হইছে মানি…

যুধিষ্ঠিরের কথার সূত্র ধইরা ভীম এইবার গলা খাঁকারি দেয়-হ। অন্যায় হইছে আমিও মানি। কিন্তু তুই তো একবারের লাইগা তোর বৌটারে দেখাইলিও না। অথচ তুই বৌ নিয়া হস্তিনাপুর গিয়া মায়ের লগে দেখা করস আমি সংবাদ পাই…

যুধিষ্ঠির কথা কাটে- বৌমার লগে কিন্তু আমার দেখা হইছে ভীম। আমি কিন্তু তারে আশীর্বাদও করছি। বৌটা খুবই লক্ষ্মী; বড়ো মা সত্যবতীর লগে তার ব্যবহারে খুব মিল…

— হ জ্যাঠা। তুমি যে তারে আশীর্বাদ করছ তাতে অহিলা খুবই খুশি হইছে। তোমার লাইগা সে আলাদা কইরা পায়েস রাইন্ধা পাঠাইছে। কইছে-জ্যাঠারে নিয়া দিও; জ্যাঠায় মিঠা জিনিস খুব পছন্দ করে…

ঝেংটি মাইরা এইবার ভীম সইরা যায়- তাইলে তোর জ্যাঠারেই মাংসগুলান খাওয়া। আমি খামু ক্যান? আমারে কি বৌ দেখাইছস?

দ্রৌপদী মিটিমিটি হাসে। যুধিষ্ঠির আস্তে গিয়া ভীমের কান্ধে হাত রাখে- তোরে না কইছি সবখানে লাফাবি না? পোলার খোঁজ নিস নাই জীবনেও একবার। এতে পোলার মনে দুঃখু থাকতেই পারে। হের লাইগা পোলায় হস্তিনাপুর গিয়া দাদির লগে দেখা করছে কিন্তু অভিমান থাইকা ইন্দ্রপ্রস্থ গিয়া বাপ-কাকারে বৌ দেখায় নাই। সেইটা সে করতেই পারে। এইটা নিয়া তর্ক করলে তুই কিন্তু বেকায়দায় পইড়া যাবি…

— কিন্তু তোমারে তো দেখাইছে…

ঘটা কিছু কইতে গেলে যুধিষ্ঠির হাত তুইলা থামাইয়া হাসে- তোর পোলায় আমারেও বৌ দেখায় নাইরে বেকুব। সে বৌ-পোলা নিয়া মায়ের কাছে গেছে শুইনা আমিই গেছিলাম তাগোরে দেখতে…

ভীম আরো কিছু কইতে গিয়া যুধিষ্ঠিরের চোখে চোখে তাকাইয়া ঘটনাটা বোঝে। সাথে সাথে এই প্রসঙ্গ ছাইড়া সে অন্য প্রসঙ্গে মোড় ঘোরায়-হ হ। সেইটা তো আমিও করছি। ওর বড়ো পোলা অঞ্জনরে আমি কিন্তু ছুডু একটা গদাও উপহার দিছি…

— হ আব্বা তা দিছ। কারণ নাতিরে খাতির না করলে দরকারে-অদরকারে তোমার পাশে লাঠি নিয়া খাড়াইব কেডায়?

যুধিষ্ঠির ঘটারে থামাইয়া দেয়-যা হইবার হইছে। কই খানা বাইর কইরা তোর আব্বারে খাইতে দে। ঘিয়ে ভুনা মাংস সে খুব পছন্দ করে…

কুন্তী ছাড়া কারো সামনে যুধিষ্ঠির আর ভীমরে এমন বিলাই হইতে দেখে নাই দ্রৌপদী। সে ঘটারে জিগায়- তুই এত কথা জানস তা তো জানতাম না। তোরে তো ইন্দ্রপ্রস্থেও দেখছি। কিন্তু তোর মুখে তো এত কথা শুনি নাই…

–কথা কেমনে শুনবা? এখন তোমরা জঙ্গলে আছ তাই তোমাগোরে পরিবারের মানুষ মনে হইতাছে। ইন্দ্রপ্রস্থে তো তোমরা আছিলা রাজা-মহারাজা। তোমাগোর লগে কথা কওয়া তো দূরের কথা; কাছে

যাইতেই ডর লাগত। কত কাম তোমাগো। আমার মতো জংলি পোলার দিকে তাকানোর কি সময় আছিল কারো? আমার তো আর মণিমুক্তার হার নাই; মাথায় মুকুটও নাই…

যুধিষ্ঠির আবার থামায়-রাগ করিস না বাপ। বুঝসই তো রাজনীতিতে অনেক মাইনসেরে সময় দেওয়া লাগে। অনেক কাম…

–কী রাজনীতি তোমরা করতা সেইটা তো দেখতেই পাইতাছি; বিচি পর্যন্ত জুয়ার দানে বন্ধক দিয়া এখন বনে আইসা আঙ্গুল চোষো…

যুধিষ্ঠির কথাটা গায়ে মাখে না- যতবারই গেছস আমি কিন্তু তোর সংবাদ নিছি। আমারে তুই দোষ দিবার পারস না…

— তোমারে দোষ দেই না জ্যাঠা। তুমি আমারে খাতির করতা সত্য। কিন্তু জীবনে একবার মাত্র মায়েরে নিয়া গেলাম তোমার রাজসূয় যজ্ঞে। তাও যাইচা যাই নাই; গেছিলাম তোমার আর দাদির নিমন্ত্রণ পাইয়া। কিন্তু তোমার তিন পয়সার দারোয়ান আমারে দরজায় আটকাইয়া দিলো- কয় জংলিফংলির রাজবাড়িতে ঢুকার পারমিশন নাই…

সেদিন হিড়িম্বার লগে আছিল ঘটোৎকচ আর তার মায়াযুদ্ধের সম্পূর্ণ বাহিনী। তারা জানে সম্রাট যুধিষ্ঠিরের সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী এই ঘটা। ঘটার লগে ঢোল-নাকাড়া বাজাইয়া। ভবিষ্যৎ সম্রাটের লগে যখন তারা আইসা খাড়াইল দরজায় তখনই ঘটল এই ঘটনা-জংলিদের ভিতরে যাওয়া নিষেধ…

বলতে দেরি কিন্তু চোক্ষের পলকে দারোয়ানের চিত হইয়া পড়তে দেরি হয় নাই। পাশ থাইকা কেউ একটা আওয়াজ দিলো- ভাঙ…

সঙ্গে সঙ্গে হিড়িম্বা দৌড়াইয়া আসে- ঘটা এইগুলারে থামা। আমরা আসছি তোর দাদির নিমন্ত্রণে…

বহুত কষ্টে ঘটা তার বাহিনী থামায়। ঘটার যেখানে অপমান সেইখানে যজ্ঞের অধিকার কারো নাই। মায়াযুদ্ধের কাহিনি শুনছে অনেকেই। কিন্তু চোক্ষের পলকে এক পাল মায়াযোদ্ধার খেইপা উঠা দেখে ঘাবড়ে যায় দারোয়ান দল। নিজের দলেরে সামলাইয়া ঘটা গিয়া বড়ো দারোয়ানের সামনে খাড়ায়-যুধিষ্ঠিররে গিয়া কও; হিড়িম্বার পোলা ঘটোৎকচ আসছে। তার সংবাদ পাওয়া পর্যন্ত আমি এইখানে শান্ত হইয়া খাড়ামু। যা করার করব সংবাদ পাওয়ার পর…

সকল রথী-মহারথী রাজা-মহারাজা থুইয়া যুধিষ্ঠির দৌড়াইয়া আইসা জড়াইয়া ধরে ঘটারে-রাগ করিস না বাজান। তোরে চিনতে পারে নাই… যুধিষ্ঠির হিড়িম্বার কাছে গিয়াও জোড় হাত করে-রাগ কইরো না বইন…

হিড়িম্বারে নারীমহলে পাঠাইয়া যুধিষ্ঠির ঘটারে নিজের পাশে বসাইয়া ঘোষণা দেয়- এই পোলা হইল ভীম আর হিড়িম্বার ছেলে ঘটোৎকচ; আমাগো বংশের জ্যেষ্ঠ সন্তান। আপনেরা সকলে তারে আশীর্বাদ করেন…

যুধিষ্ঠির ঘটার কান্ধে হাত রাখে- সেই দিন দারোয়ানটা তোরে চিনতে পারে নাই বাজান। আসোলে আমরা ভাইদেরই দায়িত্ব আছিল দরজায় খাড়াইয়া অতিথিগো চিনা বাড়ির ভিতরে নিয়া যাওয়া। কিন্তু কী কারণে যে সেই সময় আমাগো কেউই দরজার সামনে আছিল না; সেই সুযোগে

দারোয়ানটা তোর লগে বেয়াদবি কইরা ফালাইছে। কিন্তু পরে তো সকলের সামনে বুক ফুলাইয়াই আমি তোরে পরিচয় করাইয়া দিছি পাণ্ডব বংশের জ্যেষ্ঠ সন্তান কইয়া…

-হ। জ্যাঠা। তুমি তা করছ। সমবেত সকলের সামনে ঘোষণাও দিছ যে বংশের বড়ো পোলা হিসাবে জ্যাঠা বাপ-কাকার পরে সিংহাসনের উত্তরাধিকারও আমি। তোমার উপরে কোনো রাগ নাই জ্যাঠা। যার যা পাওনা তা দিতে তুমি কোনো দিন কিপটামি করো না। কিন্তু মায়েরে যে অন্দরে পাঠাইয়া দিলা; সেইখানে তোমাগো বৌরা কী ব্যবহারটা করল মায়ের লগে সেইটা খেয়াল আছে তোমার?

পাণ্ডবগো মোট নয় বৌয়ের লাইগা নয়খান আসন সাজাইয়া রাখা ছিল অন্দরের ভিতর। বংশের বড়ো বৌ হিসাবে হিড়িম্বারে নিয়া কুন্তী হাতে ধইরা বসায় মধ্যের আসনে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়া উঠে দ্রৌপদী- জংলি রাক্ষুসীরে ঘরের ভিত্রে ঢুকতে দিছে কেডা?

পাণ্ডবগো বাকি বৌরাও দ্রৌপদীর লগে তাল মিলায়। কুন্তী যখন দৌড়াইয়া যায় দ্রৌপদীরে থামাইতে তখন দাদি কুন্তীর লগে দেখা করার লাইগা ঘটোৎকচও গিয়া হাজির হইছে অন্দরমহলের দরজায়। ঘটা কয়েক মিনিট থ মাইরা বুইঝা ফালায় ঘটনা; হিড়িম্বারে কেউই পাণ্ডবগো অন্য বৌদের লগে বসতে দিতে রাজি না…

এক লাফে ঘটা গিয়া খাড়ায় সকলের মাঝখানে- আমার মা এই বংশের বড়ো বৌ। সকলের মাঝখানেই হইব তার আসন…

— এই তুই কেডা? জংলি রাক্ষুসী ভীমের লগে পেট লাগাইয়া তোরে বিয়াইছিল দেইখা তুইও নিজেরে পাণ্ডব মনে করস নাকি?

— খবরদার। আমার মায়ের নামে বাজে কথা কবা না কেউ…

— আ রে রে। রাক্ষুসী সতিনের পোলা দেখি রাজপুত্রের মতো গরম দেখায়…

–মুখ সামলাইয়া কথা কবা। আমার মায়ে তোগো সতিন হয় নাই। তোরাই সতিন হইছস আমার মায়ের। তোরাই আমার বাপ-কাকা-জ্যাঠারে রাজা-বাদশা দেইখা পেট লাগাইতে আসছস। আমার মায়ে যখন বাপেরে বিয়া করে তখন ভালোবাইসাই রাস্তার এক ফকিররে বিয়া করছিল…

–ফকিররে বিয়া কইরা জন্ম দিছে তোর মতো ফকিন্নির পুত

তাতে হৈছেটা কী? ঘটা খাড়াইয়া থাকে ভীমের মতো- তোরা হইলি পাণ্ডবগো দাসীবান্দি। দাসীবান্দিগো কাছে নিজের পরিচয় নিয়া আলাপ করার দরকার মনে করি না আমি…

কুন্তী দৌড়াইয়া আইসা ঘটারে জড়াইয়া ধরে- দাদা ভাই থাম। তোরে আমি কিরা দেই পাগলামি করিস না। এরা সবাই তোর কাকি জেঠি। তোর সম্মানের মানুষ…

ঘটা থামে। কিন্তু খুব ধীরে কুন্তীরে জানাইয়া দেয়- তোমারে একটা কথা কইয়া দেই দাদি। আমার মায়েরে কেউ অসম্মান করলে কে বাপের বৌ আর কে জ্যাঠার বৌ তা কিন্তু দেখব না। চুলের মুঠা

ধইরা আছড়াইয়া কইলাম মাইরা ফালামু সব বান্দিগুলারে…

কুন্তী যখন ঘটারে থামাইতে ব্যস্ত তখন এক ভয়ংকর হুমকি উইঠা আসে দ্রৌপদীর মুখে- তোরে আমি কর্ণ দিয়া খুন করামু কইলাম সতিনের পুত…

.

০৮

হারামজাদি কুন্তীবুড়ি তার পোলাগো রাজা বানানের লাইগা ঠকাইছে আমার মায়েরে। সিংহাসনের লোভে এক দিন বয়সী আমারে জঙ্গলে ফালাইয়া থুইয়া নিজের পোলারে নিয়া পলাইছে বুড়ি। হইলনি রাজা? পাইলিনি সিংহাসন? দেখ তোর রাজপুত্তুরেরা এখন ফকিরের মতো গাছের। ছালবাকলা পইরা রাস্তায় ঘোরে আর পাঁচটা পোলা থুইয়া তোর নিজেরে খাইতে হয় পরের ঘরে ভিক্ষার ভাত…

রাগে মাটিতে লাথি মারতে মারতে যুধিষ্ঠিরের সামনে ফিরা আসে ঘটা- খালি বুড়ি হাবড়ি দাদির লাইগা সেই দিন কিছু করতে পারলাম না জ্যাঠা। বুড়ি আমার গলা জড়াইয়া কয়- তুই আমার পয়লা নাতি। আমি তোরে মিনতি করি তুই থাম…

কুন্তীবুড়িটা সত্যই একটা হতভাগী জ্যাঠা। তার লাইগা মায়া হয়। বিয়া কইরা পাইল নামর্দ স্বামী। তারপর বারো বেটার লগে পেট লাগাইয়া তারেই আবার রক্ষা করতে হইল স্বামীর সংসার। তারপর পাঁচটা বলদা পোলারে একলা একলাই বানাইল রাজা। কিন্তু অত কিছুর পরেও বুড়া বয়সে আবার তারে গিয়া পরের ভাত খাইয়া বাঁইচা থাকতে হয়…

যুধিষ্ঠির আইসা ঘটার হাত জোড় কইরা ধরে- তোর মায়েরে কইস আমারে মাপ কইরা দিতে। তার উপরে বহুত অবিচার করছি আমরা…

দ্রৌপদী সইরা যায়। সেদিন হিড়িম্বারে অপমানটা তার হাতেই শুরু হইছিল। যুধিষ্ঠির কথা ঘুরায়- তুই কইছিলি বৌমা আমার লাইগা পায়েস রাইন্ধা পাঠাইছে? কই দে খাই…

ঘটা খাওনের বোঁচকা খুলতে গিয়া দেখে পোঁটলা খুইলা পায়েসের পাতিল পাশে রাইখা গপাগপ কইরা মাংস খাইতাছে ভীম। সে ভীমের দিকে তাকায়-কই আব্বা? একটু আগে না কইলা আমার বৌয়ের রান্না খাইবা না? এখন তো দেখি চামে চামে অর্ধেকটাই শেষ কইরা ফালাইছ…

যুধিষ্ঠির হাসে- খাইব না মানে? খাওনের কথা শুইনা তোর বাপ দুর্যোধনের দেওয়া বিষ পর্যন্ত খাইয়া ফালাইছিল। আর এইটা তো পোলার বৌয়ের রান্না…

ভীম তাকায় না। খাইতেই খাইতেই আওয়াজ দেয়- ভালোমন্দ পাইলে দুইটা খাই। তার লাইগা খোঁটা দেওয়া কিন্তু ঠিক না…

— খাইবা না ক্যান? খাও। কিন্তু পোলার বৌয়ের রান্না খাইয়া তো একটু কইতে হয় ভালো কি মন্দ হইছে…

ভীম মুখে মাংস নিয়া চাবাইতে থাকে-তুই আমার পোলা হইয়া কথা কস তোর জ্যাঠার মতো। খাওনের ধরন দেইখা বুঝস না ব্যাটা রান্না কেমন হইছে?

— কিন্তু বাকি দুই কাকা তো বইসা বইসা ভাবতাছে বাপের সতিলা ভাই বইলা আমি তাগোর লাইগা কিছু আনি নাই। কই কাকুরা আসো খাইতে বসো। খাওয়া-দাওয়া কইরা রওনা দেই…

— কই যাবি?

–কই যাব মানে? কইলাম না তোমাগো আমার বাড়ি নিয়া যামু?

ঘটা কাকাদের খাবার তুইলা দিতে দিতে ভীমের দিকে তাকায়- তা আব্বা কইলা না তো রান্না কেমন হইছে?

— ভালৈছে।

— অ্যাহ। খাইতাছে কনুই পর্যন্ত চাইটা আর কওয়ার সময় চিমটি দিয়া কয় ভালৈছে। কইলে কী হয় যে আমার বৌয়ের রান্না তোমার মা আর বৌয়ের রান্না থাইকা ভালা…

–তুই থাম তো ঘটা। মানুষটা খাইতাছে খাইতে দে…

সহদেবের কথায় ঘটোৎকচ হাসে- অহিলাবতী কয় কী জানো কাকু? কয় ভিত্রের কথা কইয়া ফালাইলে কৃষ্ণের মতো ভিত্রে আর কোনো বিষ নিয়া ঘুরতে হয় না…

–কৃষ্ণের ভিত্রে বিষ?

–হ বিষই তো। হালার বাইরে থাইকা ভিত্রে বেশি কালা

–কৃষ্ণের বদনাম করলে তোর জ্যাঠায় কিন্তু থাবড়াইব তোরে

— থাবড়াইব। কিন্তু শিশুপালের মতো মাইরা তো ফালাইব না। হের লাইগাই তো তার সামনে গিয়া বদনাম করি না।

–তুই তাইলে কৃষ্ণরে ডরাস?

— বিষাক্ত সাপ কেডায় না ডরায়?

এইবার যুধিষ্ঠির কথা ধরে- ক্যান? কৃষ্ণরে তুই ডরাস ক্যান?

— ডরাই ক্যান সেইটা তুমিও জানো জ্যাঠা। হালায় তো সামনে দিয়া মারে না। মারে পিছন থাইকা। একবার আমার লগে তার দেখা হইছিল আমার এলাকায়। আমার বাড়িত গিয়া আমার অস্ত্রপাতি আর প্র্যাকটিস দেইখা সে কয়- ভাতিজা তুই তো আমার সুমান বীর হইছস। এই কথা শুইনা কিন্তু আমি ডর খাইলাম। কারণ কৃষ্ণ কাউরে তার সমান কিংবা তার থাইকা বড়ো বীর কওয়া মানে তার খবর আছে। আমি কইলাম- কাপ্তা বড়ো হই আর ছুডু হই। ভাতিজা হিসাবে তোমার কাছে আমার একটা মিনতি; তুমি যদি আমারে মারতে চাও তো সামনে দিয়া মাইরো। তাইলে আমিও একটা ফাইট দিবার সুযোগ পামু। দয়া কইরা পিছন দিয়া মাইরো না আর মন্ত্রপড়া কুত্তা লেলাইয়া দিও না…

–কুত্তা লেলানো কী রে?

নকুলের প্রশ্নে ঘটা তাকায়-বুঝলা না? কৃষ্ণের কিছু চ্যালা আছে না; যারা কৃষ্ণ যা কয় তারেই বেদ বইলা মানে? এই যেমন ধরো আমাগো অর্জুন কাকু বা সাত্যকি। কৃষ্ণ যদি কয়-  তুই ঘটার বুকে তির মার; তাইলে কিন্তু অর্জুন কাকু এক মুহূর্তও চিন্তা না কইরা আমার বুকে তির বিন্ধাইয়া গিয়া কৃষ্ণরে জিগাইব- হে জনার্দন; তুমি কেন মোরে মোর ভ্রাতুস্পুত্রের বুকে তির বিন্ধাইতে কহিলা? তখন কৃষ্ণের রেডি উত্তর তো আছেই- তোর ভাতিজা হইলেও সে আগের জন্মে আছিল রাক্ষস। এর লাইগা তোরে কইছি তারে মাইরা ফালাইতে। এতে তোর পুণ্য হইছে। হা হা হা। সে তো আবার হগগলের পূর্ব জন্মের কাহিনি জানে। যারা তার শত্রু তারাই হয় পূর্বজন্মের রাক্ষস আর তার দোস্তরা সব দেবতা; অর্জুন কাকুর পূর্ব জন্ম নিয়াও একখান দেবতা কাহিনি বানাইছে না সে?

হঠাৎ ঘটার খেয়াল হয় সবাই খাইতাছে কিন্তু দ্রৌপদী নাই। ছুডু মা কই গেলা কইয়া ডাক পাড়তে দ্রৌপদী আইসা খাড়ায়…

— আরে তুমি খাইতাছ না ক্যান? কইলাম না এইগুলা তোমার সতিনের তৈয়ারি না। এইগুলা বানাইছে তোমার পোলার বৌ। আসো খাও…

— তোর বৌ তোর বাপ-কাকার লাইগা রান্না কইরা পাঠাইছে। পাণ্ডবগো দাসীবান্দির ওইগুলা খাওয়ার কী কাম?

ঘটা এইবার হা কইরা একবার যুধিষ্ঠির একবার দ্রৌপদী আর একবার নকুল সহদেবের দিকে তাকায়। কী বলবে সে খুঁইজা পায় না। মাংস চাবাইতে চাবাইতে ভীম আস্তে আওয়াজ দেয়- মায়েরে কষ্ট দিছস। মাপ চা হারামজাদা। নাইলে কিন্তু তোর খবর আছে…

হঠাৎ ঘটা এক কাণ্ড কইরা বসে। এক ঝটকায় দ্রৌপদীরে কান্ধে তুইলা বনের ভিতর হাঁটা ধরে। ভ্যাবাচেকা খাইয়া দ্রৌপদী চিল্লায়- ওই কী করস? কই যাস?

— তোমারে তোমার সতিনের বাড়ি নিয়া যামু। স্বামী তোমারে সতিনের ভাত খাওয়ায় নাই। এইবার

সতিনের পোলা তোমারে সতিনের ভাত খাওয়াইব…

— আরে কী করে। ছাড়। তোর বাপেরে ডাকলে কিন্তু অসুবিধা হইব…

–বাপ জ্যাঠা কৃষ্ণ কর্ণ যারে ইচ্ছা ডাকো। দেখি কে তোমারে বাঁচায়। সেই দিন আমারে রাক্ষুসীর পোলা কইছিলা না? এইবার দেখবা রাক্ষস কারে কয়…

— ছাড় বাপা ছাড়। আমার কষ্ট হইতাছে

— আগে কও খাইবা কি না

— আইচ্ছা খামু নে। ছাড়

হো হো কইরা হাসে যুধিষ্ঠির ভীম আর নকুল সহদেব। ঘটার কাণ্ড দেইখা ধৌম্যও হাসে- গোঁয়ারের একটা সীমা থাকে। কিন্তু ভীমের এই পোলটার কোনো সীমা পরিসীমা নাই। মায়েরে গালিও দিলো আবার মাপ না চাইয়া তারে খাইতেও রাজি কইরা ফালাইল…

ঘটা দ্রৌপদীরে নামাইয়া নিজে পায়েস বাইড়া দিয়া ধৌম্যের দিকে ফিরে- চোখ দিয়া না চাইটা খাইয়া ফালাও। আব্বায় যা শুরু করছে তাতে একটু পরে হাড্ডিও পাইবা না। নাকি অপেক্ষা করতাছ যে তোমারেও তেলামু আমি?

ধৌম্য নিজেই আগাইয়া আসে- আরে না। তোর কাছে তেল আশা করার মতো বেক্কল আমি না। পরখাউকি বামুন হইয়া যখন জন্মাইছি তখন খাওনের উপর রাগ করলে কি আর চলে? বীরের রাগ খাওনরে আগে আর ফকির-বামুনের রাগ খাওনের পর; দে খাই…

খাইতে খাইতে দ্রৌপদীর খেয়াল হয় সবাই খাইতাছে ঘটোৎকচ ছাড়া। সে জিগায়- তুই খাবি না?

–তুমি যা রানছ পরে আমি তাই খামু। তোমরা খাও

— আমি তো শাক রানছি

— শাকই সই। তোমরা রাজবাড়িতে চইলা গেলে জীবনে তো আর কোনো দিন তোমার হাতের রান্না খাওয়ার সুযোগ হইব না…

–তুই কিন্তু আবার আমারে খোঁচাখুঁচি করতাছস…

ঘটোৎকচ এইবার মাথা নুয়াইয়া দ্রৌপদীর পায়ের কাছে পড়ে- মাপ চাই ছুডু মা। ধইরা নেও এইডাই তোমারে আমার শেষ খোঁচা। তয় আমার বৌ অহিলা কী কয় জানো? কয় ভিত্রে কথা রাখতে নাই। ভালো হোক মন্দ হোক পেটের কথা বাইর কইরা দিয়া তারপর খাইতে বসো। ভিত্রে কথা চাইপা রাইখা খাইতে বসলে খাওন বদহজম হয়। তখন বুক জ্বলাপোড়া করে আর ঘুমও ঠিকঠাক হয় না। তাই সে সব সময় কয় পয়লা ভিত্রের কথা সব বাইরে ফালাও; তারপরে পেট ভইরা খাইয়া একটা ঘুম দেও; তারপরে হাতে গদা নিয়া দেখো তুমার সামনে কেউ খাড়াইতে পারে কি না…

–তুই মনে লয় তোর বৌয়ের সব কথা শুনস?

— আমার আর কে আছে যে আমারে কিছু কইব আর আমি শুনুম? আগে আছিল একলা মা। এখন বৌটা হইছে। আর তো কেউ নাই…

দ্রৌপদী হাসে- এইটাও কিন্তুক খোঁচার কথা হইল

— কিন্তু এই খোঁচা তো তোমার লাগার কথা না। লাগলে লাগতে পারে তোমার স্বামীগো…

— তোর লগে নিরালায় কিছু কথা আছে আমার…

সকলে খাইতে বসলে যুধিষ্ঠির ঘটারে আড়ালে নিয়া যায়- সেই সময় তুই কর্ণরে জ্যাঠা কইয়া ক্যান ডাকলি?

ঘটা সরাসরি যুধিষ্ঠিরের চোখে তাকায়- কর্ণ তোমার বড়ো ভাই তাই তারে জ্যাঠা কইছি…

–তুই কেমনে জানলি এই সব?

— জানছি তোমার রাজসূয় যজ্ঞের সময়। সেই দিন যখন ছুডু মা কর্ণরে দিয়া আমারে খুন করানের হুমকি দিলো; তখন মনে হইল পাঁচ পাণ্ডবের বৌ দ্রৌপদী পাণ্ডবগো কথা কইল না; কৃষ্ণের বান্ধবী পাঞ্চালী কৃষ্ণের কথা কইল না; কইল কর্ণের কথা। তাইলে তো সেই লোকটার লগে একবার দেখা কইরা আসা লাগে। তার নাম আর গুণ আগে শুনছি। কিন্তু সে অত গুণী যে আমারে খুন করাইবার লাইগা পাণ্ডবগো বৌ আর কৃষ্ণের বান্ধবীরেও তার শরণাপন্ন হইতে হয় সেইটা তো বুঝি নাই। তাই তারে পাইয়া একটা প্রণাম করতে গিয়া আমি টাসকি খাইলাম। দেখি তার পায়ের পাতা দেখতে এক্কেবারে দাদির পায়ের পাতার মতো। তোমাগো তিন ভাইয়ের পায়ের পাতাও তো এই রকম। তো প্রণাম কইরা মাথা না তোলায় কর্ণ আমারে ধইরা তোলে। কয়-  আমি তো কোনো মুনিঋষি না; এক সাধারণ সৈনিক। আমারে তুমি অত লম্বা প্রণাম করো ক্যান? তুমি কে বেটা? আমি কইলাম একজন কইছে যে আপনেরে দিয়া আমারে খুন করাইব। তাই ভাবলাম অত বড়ো বীররে একটা প্রণাম কইরা যাই। আমি হিড়িম্বার পোলা; দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম আমার বাপ…

কর্ণ আমারে জড়াইয়া ধইরা কয়-  যে কইছে সে তোমারে আর আমারে দুইজনরেই ডরায় তাই এই কথা কইছে। তয় আমি খুনি না। যোদ্ধা। শুধু সেই যুদ্ধেই আমার হাতে মানুষ মরে যে যুদ্ধে তাগো হাতে আমারও মরার ডর থাকে। আর কেউ কইলেই যে আমি তোমারে খুন করব এইটা ভুল; আমি কৃষ্ণও না; অর্জুনও না। আমি রাধাপুত্ৰ কৰ্ণ। সামনাসামনি যুদ্ধ ছাড়া মানুষের দিকে অস্ত্র ধরি না আমি…

সে কথা কয় আর আমি তার পায়ের পাতা আর চোখের দিকে তাকাই- তার চোখটাও এক্কেবারে দাদির মতো। আমার সন্দেহ হয়। সবাই জানে এই বেডার বাবা অধিরথ; মা রাধা কিন্তু তারে কয় দেবতা সূর্যের পোলা; ঠিক যেমন তোমরা পাণ্ডবগো বাপ পাণ্ডু; কিন্তু তোমরা একেকজন একেক দেবতার পোলা হিসাবেই পরিচিত। তোমাগো কাহিনির লগে কর্ণের কাহিনিটা আমার কেমন যেন মিল মিল লাগে। আমার সন্দেহ হয় গাড়োয়ানের বেটি রাধার তো দাদি কুন্তীর মতো দেবতার পোলা জন্মাইবার কথা না…

আমি কিন্তু পরে তার বাড়ি গেছিলাম তার বাপ-মায়েরে দেখতে। দেখলাম বিন্দুমাত্র মিল নাই কর্ণের লগে অধিরথ কিংবা রাধার চেহারায়। তারপরে গিয়া সরাসরি দাদিবুড়িরে চাইপা ধরলাম- তোমার চেহারার লগে কর্ণের চেহারা অত মিলা যায় ক্যান?

দাদি পয়লা গাঁইগুঁই করলেও পরে স্বীকার যাইয়া আমারে কয়- তুই কাউরে কইস না ভাই। তাইলে আবার সবকিছু লণ্ডভণ্ড হইয়া যাইব। আমি জিগাইলাম আর কেডা কে জানে? দাদিবুড়ি কয় যুধিষ্ঠির কৃষ্ণ ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ ছাড়া আর কেউ জানে না। কর্ণও হয়ত না। এর লাইগা তোমারে একটু খোঁচাইলাম জ্যাঠা। দেখলাম তুমি কেমন চমকাইয়া উঠলা…

— আমি চমকামু ক্যান?

— তুমিই তো চমকাইবা। কারণ কর্ণের পরিচয় সবাই জাইনা গেলে তোমার বনবাস বেহুদা যাইব। কুন্তীর বড়ো পোলা হিসাবে রাজা তো হবে কর্ণ। তাই কর্ণরে তোমার এত ডর…

যুধিষ্ঠির এইবার খেইপা উঠে- তোর কি মনে হয় আমি অতটাই লোভী?

–তুমি লোভী না জ্যাঠা। তুমি ধুরন্ধর। বুদ্ধিমান আর শক্তিমানগো মাথায় কাঁঠাল ভাইঙ্গা খাওনের লাইগা বেক্কলগিরি তোমার একটা কৌশল। তুমি ঠিকই জানো; অর্জুন ভীম কৃষ্ণ যতই লাফালাফি করুক না ক্যান; রাজ্যটা তোমারই। আর সেইটার প্রমাণ তুমি দিছ পুরা দেশটারেই পাশা খেলায় বাজি ধইরা। পুরা রাজ্য বাজি ধরার আগে তুমি কাউরে ল্যাওড়া দিয়াও পুছো নাই। তুমি আসোলে বুঝাইতে চাইছ যে- আমার রাজ্য আমি পানিতে ফালামু; তোগো কী? তুমি সবাইরে বুঝাইয়া দিছ যে-কেউ যদি আমার গৌরবের ভাগীদার হইতে চাও তয় আমার দুর্দশারও ভাগীদার হইতে বাধ্য। আমিই ঠিক করুম তোমরা রাজবাড়িতে থাকবা না জঙ্গলে থাকবা। আসোলে দাদি কুন্তীর উপযুক্ত পোলাই তুমি জ্যাঠা। তোমার বাকি ভাইরা যে কাজগুলা করে সেই কাজগুলা যার ভাইবেরাদর নাই সে বেতন দিয়া লোক রাইখা করায়। এই যেমন দ্রোণ আর কর্ণরে বেতন দিয়া রাখছে ধৃতরাষ্ট্র। এখন সেই কামের লাইগা তোমার ভাইয়েরা আছে তাই তুমি তাগোরে সেনাপতি কিংবা মন্ত্রী বানাইছ; না বানাইলেও তেমন কিছু যাইত-আসত না…

যুধিষ্ঠির অনেকক্ষণ ঝিম মাইরা থাইকা মুখ খোলে- তোর বাপ-কাকায় করে যুদ্ধ আর আমি করি রাজনীতি। ফারাকটা নিশ্চয়ই তোরে বুঝাইয়া কইতে হবে না?

— তা বুঝি বইলাই তো এই সব কথা সকলের সামনে তোমারে কই না। সকলের সামনে পাশা খেলার লাইগা তোমারে খোঁচাখাঁচাও দেই। কিন্তু আড়ালে আসছ বইলা কইলাম যে তুমি পুরা রাজ্য আর ভাইবেরাদর সবার জীবনও তোমার নিজস্ব সম্পত্তি বইলা ভাবো; তাই কাউরে না পুইছাই তুমি বাজি ধরছ। বাজি হাইরা একবারের লাইগাও কও নাই ফিরা যাইবার কথা। এইটা তোমার একটা অসাধারণ গুণ জ্যাঠা…

যুধিষ্ঠির ঘটার হাত চাইপা ধরে- তোর লগে রাজনীতি নিয়া আলাপ করতে কোনো দোষ নই। সেই সব বিষয় বুঝার যোগ্যতাও তোর আছে। তোরে আমি কই; কর্ণের বিষয়টা তোর বাপ-কাকা কেউ জানে না। জানান ঠিকও হইব না। তোরে আমার অনুরোধ…

— হা হা হা। অনুরোধের দরকার নাই জ্যাঠা। আমি তো দাদিরেও কইয়া আসছি যে; সে যদি না কর্ণের পরিচয় প্রকাশ করে তয় আমিও করুম না…

— আমিও করব না। মায়ে যদি নিজের পোলারে স্বীকার না করে তো আমরা করব ক্যান? ঠিক কি না?

— এই কথা কইও না জ্যাঠা। দাদি তার পোলা স্বীকার করে না কিন্তু তোমার লাইগা। তয় জ্যাঠা; কৃষ্ণ থাইকা একটু সাবধানে থাইকো…

–ক্যান?

— এই হালা দুইমুখা সাপ। লেঙ্গুর মাথা দুইটা দিয়াই ছোবল মারে। দেখলা না তোমার সভাতেই সে তার আরেক পিসির পোলার কল্লা নামাইয়া দিলো। তার স্বার্থে টান পড়লে কিন্তু তোমার মাথা নামাইতেও সে দেরি করব না। আর এখন তো সে তোমারে ছাতা হিসাবে ব্যবহার কইরা দেবতা হইতে চায়…

যুধিষ্ঠির হাসে- সে আমরে ব্যবহার করে ছাতা হিসাবে আর আমি তারে করি ঢাল হিসাবে। সে হইতে চায় দেবতা আর আমি হইতে চাই সম্রাট। দুইজনের চাওয়া কিন্তু দুইটা। রাজনীতিতে যতক্ষণ পর্যন্ত একজনের লগে আরেকজনের চাওয়া-পাওয়া ঠোকাঠুকি না খায় ততক্ষণ পর্যন্ত তারা বন্ধু হইতে পারে। এতে কোনো সমস্যা নাই। কৃষ্ণ রাজা হইতে চায় না; আর আমি দেবতা হইতে চাই না। তাই সে আমার লাইগা আর আমি তার লাইগা ঠিকাছি। হিসাব খুবই সোজা আর নিরাপদ ভাতিজা…

— কিন্তু ভবিষ্যতে কী না হইতে পারে?

–ভবিষ্যৎ সব সময়ই আন্ধা। ভবিষ্যতে যে কেউ যেকোনো সময় ভাইসা যাইতে পারে। সেইটা নিয়া চিন্তার কিছু নাই। যাউকগা। তোরে একটা কথা কই; তুই তোর বাড়ি যাওয়ার লাইগা আর চাপাচাপি করিস না…

— ক্যান?

— রাজসূয় যজ্ঞের সময় দ্রৌপদী তোর মায়ের লগে কাইজা করছে। এখন তারে নিয়া আবার তোর মায়ের বাড়ি গেলে সে তা মাইনা নিতে পারব না। বহুত কষ্ট পাইয়াও বনে আইসা এখন একটু স্বাভাবিক হইছে সে। খামাখা তারে আর কষ্ট দেওয়া ঠিক না…

— ঠিক আছে জ্যাঠা। তোমার যুক্তি আমি মানি। চলো তাইলে। তোমাগো লগে আমিও তীর্থ দেইখা আসি…

.

০৯

— ও মুনিবর; এই বেডায় না নিজের মায়ের মাথা কাটছিল?

অগস্ত্য মুনির আশ্রম আর ভৃগুতীর্থ দেইখা বধূসরা-নন্দা-অপরনন্দা নদী পার হইয়া ঋষভকূট পর্বত ডিঙ্গাইয়া কৌশিক নদীর তীরে বিশ্বামিত্রের আশ্রম পরিদর্শন কইরা যুধিষ্ঠিরের তীর্থযাত্রীদল আইসা উপস্থিত হয় মহেন্দ্র পর্বতে ভার্গব ঋষি পরশুরামের ডেরায়। এই ভ্রমণের গাইড ভবঘুরে মুনি লোমশ আর মালপত্র বহনের কামে আছে হিড়িম্বার পোলা ঘটোৎকচ। তীর্থযাত্রী দলে বাকিদের মইদ্যে আছে যুধিষ্ঠির- ভীম-নকুল- সহদেব- দ্রৌপদী- পুরোহিত ধৌম্য আর বহু অনুচর ব্রাহ্মণ। অত পথ ঘটা কোনো কথা কয় নাই। মালপত্র ঘাড়ে নিয়া চুপচাপ হাঁটছে বাপ জ্যাঠা আর সম্মায়ের লগে। কিন্তু পরশুরামের আশ্রমে আইসাই সে মুনি লোমশরে কইরা বসে এই প্রশ্নখান…

ঘটার এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খাইয়া লোমশ তারে ধর্ম বোঝাইতে চায়। কিন্তু ঘটা তারে থামাইয়া দেয়- ধর্মের কাহিনি যারা খায় আপনি তাগোরে তা খাওয়ান। এর সম্পর্কে আমি যা জানি তা সঠিক কি না আমারে কন…

লোমশ কথা না বাড়াইয়া যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকায়। ঘটার এমন প্রশ্নে যুধিষ্ঠিরও ডর খাইছে ভীষণ। ঋষি পরশুরাম এখনো জীবিত। দুনিয়াতে তার সমান শক্তি আর গোস্বা মনে হয় আর কারো নাই। শিবের শিষ্য হইয়াও কুড়াল দিয়া স্বয়ং শিব-নন্দন গণেশের দাঁত ভাইঙ্গা ফালাইছিলেন তিনি। ঘটার

এমন কথা শুইনা যদি তিনি কুড়াল তুইলা নেন তয় এইখানেই তীর্থ আর জীবন দুইটারই সমাপ্তি সবার…

যুধিষ্ঠির যুক্তি বুদ্ধি তর্কে যায় না। সরাসরি আইসা ঘটার কান্ধে হাত রাখে- আমার মাথার কিরা দেই বাপ। উল্টাসিধা কিছু কইস না এইখানে। তিনি শুনলে রুষ্ট হইবেন…

— হইলে হইল; পোছে কেডায়?

— আইচ্ছা ঠিকাছে। পোছার দরকার নাই। কিন্তু তুই তার লগে কোনো বেয়াদবি করিস না; এইটাই আমার অনুরোধ…

— তা না হয় করলাম না। কিন্তু তোমার প্রধান তিন শত্রু ভীষ্ম- দ্রোণ আর কর্ণ; তিনজনই যে এই পরশুরামের শিষ্য তা তো তুমি জানো জ্যাঠা…

— আরে বেটা সেইটা তো জানিই। সবাই তা জানে

— এইটা কিন্তু তোমার লাইগা একটা দুশ্চিন্তার বিষয় জ্যাঠা…

যুধিষ্ঠির অবাক হইয়া তাকায়- এইখানে দুশ্চিন্তার কী আছে?

— দুশ্চিন্তার কথা হইল; তোমার পক্ষে কিন্তু পরশুরাম ঘরানার কোনো যোদ্ধা নাই। ওগোর যুদ্ধকৌশল আর অস্ত্রচালনা কিন্তু তোমাগো থাইকা আলাদা। তোমার পক্ষে যারা আছে তারা সবাই দ্রোণচোট্টার শিষ্য। তিরাতিরির বেশি কিছু করতে পারব না তারা। আর পরশুরামের শিষ্যরা কিন্তু তিরের লগে ভার্গবাস্ত্র মানে কুড়ালে তুলনাহীন; বিশেষত কর্ণ। হেয় কিন্তু তির থাইকা ভল্ল আর । কুড়ালে কম উস্তাদ না। কুরুগো লগে যুদ্ধ হইলে এই পরশুরামের তিন শিষ্যই কিন্তু তোমারে বেশি ভুগাইব জ্যাঠা…

যুধিষ্ঠির হাসে- ওগোর লগে থাকব পরশুরামের তিন শিষ্য আর আমার লগে থাকব কৃষ্ণ। পরশুরামের শিষ্যরা কী পারে না পারে তা সকলেই জানে। কিন্তু কৃষ্ণ কী পারে তা কারো পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব না। সেই ক্ষেত্রে আমার দিকেই কিন্তু সুবিধা বেশি ভাতিজা…

ঘটা স্বীকার করে- তা অবশ্য ঠিক। একলা আব্বারে নিয়া সে জরাসন্ধের মতো রাজারে শুয়াইয়া ফালাইছে। কুরুরা তো নস্যি তার কাছে…

যুধিষ্ঠির ঘটারে চোখে চোখে রাইখা পরশুরামের আশ্রমে মাত্র এক রাইত থাইকা আবার মেলা দেয় দক্ষিণ দিকে। ঘুরতে ঘুরতে যখন তারা আইসা প্রভাসতীর্থে স্থির হইল কিছু দিন তখন সংবাদ পাইয়া দেখা করতে আসে কৃষ্ণ আর বলরাম; লগে কৃষ্ণের দুই পোলা প্রদ্যুম্ন-শাম্ব; আর সাত্যকিসহ কৃষ্ণের আরো কিছু চ্যালা ও শিষ্য। ভীমের গদার উস্তাদ বলরাম সিধাসাধা মানুষ। আইসাই পাণ্ডবগো দুর্দশা দেইখা সে খেইপা উঠে- খালি ধর্ম করলেই যে মঙ্গল হয় না আর অধর্ম করলেই অমঙ্গল আসে না; তার প্রমাণ হইল ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির এখন ছালবাকলা পইরা জঙ্গলবাসী আর দুর্যোধন করতাছে দুনিয়া শাসন…

— ধর্মাত্মা মানুষ কেমনে আবার জুয়া খেলে উস্তাদ?

ভীমের এই খোঁচা শুইনা বলরাম টের পায় সে যা বুঝাইতে চাইছিল তা হাঁটা দিয়ে অন্য পথে। সে ধর্মটর্মের ধারও ধারে না আবার তা ব্যবহারও করে না। বলরামরে দেখলে মনে হয় না সে যাদব বংশের মানুষ। সে যা কয় তা সোজাসুজি কয়। কিন্তু ভীম এমন কইরা তার কথার মইদ্যে বাম হাত ঢুকাইয়া দিব ভাবতেও পারে নাই। ভীম গদায় তার সাক্ষাৎ শিষ্য। ভীমের কইলজা-ছিড়া কথার ধরন সে জানে। এখন যুধিষ্ঠিরের পক্ষে কিছু কইতে গেলে বলরামরেও ধুইতে ছাড়ব না ভীম…

বলরাম বেকায়দায় পইড়া কৃষ্ণের দিকে তাকায়। কৃষ্ণ সাধারণত জটিল কোনো আলোচনায় বলরামরে নিতে চায় না। কিন্তু সাক্ষাৎ বড়ো ভাই; সব সময় এড়াইতেও পারে না। তাই সেও যখন পাণ্ডবগো দেখতে আসতে চাইল তখন কৃষ্ণ তারে না করতে পারে নাই। কিন্তু আইসাই যে সে দর্শন কপচাইতে গিয়া ঝামেলা পাকাইব তা কে জানত…

যুধিষ্ঠিরও ভ্যাবাচেকা খাইয়া কৃষ্ণের দিকে তাকায়। আলোচনাটারে এখন অন্য দিকে নেওয়া দরকার। কৃষ্ণ ঘটোৎকচের দিকে তাকায়-ভাতিজা কেমুন আছস? তোর মা আর পোলারা ভালা তো? আমি নিত্যই তোগো সংবাদ লই; কিন্তু যামু যামু কইরাও তোর মা আর পোলাপানরে দেখতে যাওয়ার সময় কইরা উঠতে পারি না বাপ…

–তুমি যে ওগোরে মনে রাখো সেইডা আমার মা আর পোলাগো সৌভাগ্য কাগু। কিন্তু একটা কথা; তুমি আমার মায়ের কথা জিগাইলা; পোলাগো কথা জিগাইলা কিন্তু আমার বৌয়ের কথা জিগাইলা না ক্যান?

কৃষ্ণ হাসে- তুই একটা বুদ্ধিমান পোলা। তোর ঠিকই বোঝার কথা যে তোর এই বিবাহে আমি খুশি হইতে পারি নাই…

—ক্যান কাগু? আমি কি কারো বৌ মাইয়া বা বাগদত্তারে লুট কইরা বিয়া করছি যে তোমার মুখে চুনকালি পড়ছে?

কৃষ্ণ এইবার একটু নইড়া-চইড়া বসে। বৌ মাইয়া বাগদত্তা ছিনতাইয়ের কথা কইয়া ঘটা যে কৃষ্ণরেই খোঁচাটা মারল তা সকলেই বোঝে। কিন্তু এইখানে থাইমা গেলে বেইজ্জতির সীমা থাকব না। তাই কৃষ্ণ খোঁচাটা না খাওয়ার ভান কইরা সরাসরি মাঠের বলটা পাণ্ডবগো দিকে নিয়া যায়- দূর বেটা। আমার মুখ রক্ষা না রক্ষায় কী আসে যায়? তুই তোর বাপ-জ্যাঠার শত্রু বংশের মাইয়া বিয়া করছস দেইখা আমার একটু খারাপ লাগছে; এই আর কি। তুই জানস যে ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্য নির্মাণের সময় তোর বাপ-জ্যাঠার লগে নাগ বংশের শত্রুতা তৈরি হয়। সেই থাইকা এখন পর্যন্ত নাগ বংশ পাণ্ডবগো ঘোরতর শত্রু। তুই কি না গিয়া বিয়া করলি সেই নাগ বংশেরই মেয়ে…

ঘটা এইবার লজ্জার ভান কইরা হাসে- হ কাগু তা করছি। আমার বাপ-কাকারা তোমার লগে মিলা নাগ বংশরে উচ্ছেদ কইরা দিছিল তাগো বাপ-দাদার ভিটামাটি থাইকা। সেই কারণে তারা আমাগো বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিবার রাস্তা খুঁজতে পারে। সেই হিসাবে তাগোরে আমরা শত্রু ভাবতে পারি; তোমার কথাটায় যুক্তি আছে। কিন্তু কাগু; আমার বাপ আর জ্যাঠার সবচে বড়ো যে শত্রু; সেই দুর্যোধনের মাইয়ার লগে তো তুমি তোমার নিজের পোলার বিয়া দিছ। আমার কামটা কি তোমারটা থাইকা বেশি খারাপ হইছে?

এমন ধরা খাইব কৃষ্ণ ভাবে নাই। তার পাশেই তার পোলা শাম্ব বসা; যে কি না আবার দুর্যোধনের মাইয়ার জামাই। দ্রৌপদীর চোখে কৃষ্ণের চোখ পড়ায় দ্রৌপদী হাসে। ভীম না শোনার ভান কইরা অন্য দিকে তাকাইয়া আছে। যুধিষ্ঠির বুঝতে পারে না কারে কী বইলা থামায়। কৃষ্ণ ভাইবা দেখে ছোটলোকের পন্থা ধইরা এখন দায় ঠেইলা না দিলে বাঁচার উপায় নাই। সে জোর গলায় ঘটারে সমর্থন করে- ঠিক কইছস ভাতিজা। তুই যা করছস তার থাইকা বেশি অপরাধ শাম্ব করছে দুর্যোধনের মাইয়া বিবাহ কইরা। আমি তোর লগে পুরাই একমত। কিন্তু তুই তো জানস যে; এই বিষয়ে সে আমারে কিছু জিগায় নাই। নিজেই বুদ্ধি কইরা লক্ষণারে তুইলা আনতে গিয়া বান্ধা খাইছিল দুর্যোধনের হাতে। আমি যখন শুনলাম যে দুর্যোধন ওরে বাইন্ধা থুইছে; আমি কিন্তু পোলারে ছাড়াইয়া আনতে যাই নাই; কারণ রাজা যুধিষ্ঠিরের যে শত্রু; সে আমারও শত্রু। সে যদি আমার পোলারে মাইরাও ফালাইত তবু আমি গিয়া তারে অনুরোধ করতাম না পোলারে ছাইড়া দিতে। কিন্তু তোর বড়ো জ্যাঠা বলরাম তো আবার সন্ন্যাসী মানুষ। সে কইল- তোমাগো একজনের লগে আরেকজনের যাই সম্পর্ক থাউক; আমার কাছে কিন্তু ভীম আর দুর্যোধন দুইজনই সুমান শিষ্য। আমার ভাতিজা গেছে শিষ্যের মাইয়ারে উঠাইয়া আনতে আর শিষ্য বাইন্ধা থুইছে আমার ভাতিজারে। এইখানে আমার একটা দায়িত্ব আছে। জিগাইয়া দেখা তোর বলাই জ্যাঠা গিয়া তার শিষ্যের লগে মিটমাট কইরা শাম্বর বিয়া দিছে…

বলাই যেমনে বসা ছিল তেমনে বইসাই উত্তর দেয়- আমি যা ভালো মনে করছি তাই করছি। আমার ভাতিজার লগে আমার শিষ্যের ঝামেলা বাঁধছে আমি তা মিটাইয়া দিছি। অসুবিধা কই? যুদ্ধ হইলে কে কই থাকব না থাকব সেইটা কৃষ্ণ আর তার পোলা শাম্ব জানে। ওগোরেই জিগা…

ঘটা আবারও হাসে- তা ঠিক জ্যাঠা। তুমি যা করছ তাতে আমার কোনো অভিযোগ নাই। ঠিক কামটাই করছ তুমি। তো কৃষ্ণ কাগু। বলাই জ্যাঠা সোজাসিধা মানুষ। যা ভালো মনে করে তাই করে। কিন্তু কাগু; আমার বাপ-জ্যাঠার যুদ্ধ হইলে কিন্তু কোনোদিনও নাগ বংশের লগে হইব না। হইব দুর্যোধনের লগে। তা এইবার তুমি কও তো; আমার বাপ-জ্যাঠার লগে আলোচনা করার সময় তুমি দুর্যোধনের মাইয়া লক্ষণার স্বামীরে এইখানে নিয়া আসছ ক্যান?

যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের দিকে তাকাইয়া অনুমান করে তার রাগের পরিমাণ। নিজের চোখের সামনে সে দেখছে কৃষ্ণ কীভাবে নিজের পিসাতো ভাই শিশুপালের মাথা নামাইয়া দিছিল ভরপুর সভায়। ঘটোৎকচের লাইগা যুধিষ্ঠিরের ভয় হয়। কিন্তু কৃষ্ণের ধৈর্যেরও সে সম্মান করে। শিশুপাল একশোটা গালি দেওয়া পর্যন্ত কৃষ্ণ অপেক্ষা করছিল সেই দিন…

কৃষ্ণ নিজেরে সামলাইয়া ঘটার দিকে তাকাইয়া হাসে- ভাতিজা। আমি যে ঘটনার লগে আছিলাম না; ঘটনা ঘটার আগে জানতামও না। সেই ঘটনার সব দোষ তুই আমারে দিতাছস ক্যান? আমি শাম্বরে নিয়া আসছি আমার পোলা হিসাবে। এখন দুর্যোধনের জামাই হিসাবে সে কী করব না করব সেই সব প্রশ্নের উত্তর বোধ হয় শাম্বরই দেওয়া দরকার। কইরে শাম্ব; ঘটার প্রশ্নগুলার উত্তর দে…

নিজের বাপ কৃষ্ণরে এমন ধরা খাইতে জীবনেও দেখে নাই শাম্ব। বাপ যেমনে ঘটার খোঁচাগুলা সামলাইতাছিল তাতে সে অতক্ষণ বাপের কৌশলে মুগ্ধই আছিল। কিন্তু বাপ যে হঠাৎ কইরা উত্তর। দিবার দায়িত্বটা তার ঘাড়েই ফালাইয়া দিব তা সে ভাবতেও পারে নাই। এই প্রশ্নের কী উত্তর দিব না দিব কিছু না ভাইবাই সে কয়-  দুর্যোধন আমার শ্বশুর ঠিকাছে। কিন্তু আমি তোমারে কইয়া দিতে পারি ঘটা; যদি শ্বশুর মশাইর লগে যুধিষ্ঠির জ্যাঠার যুদ্ধ হয় তয় আমি কিন্তু শ্বশুরের বিরুদ্ধে গিয়া পাণ্ডবগো পক্ষেই যুদ্ধ করুম…

— তা তো করবাই। কিন্তু করবা দুর্যোধনের গুপ্তচর হইয়া। পাণ্ডবপক্ষে থাইকা তোমার বৌ লক্ষণারে দিয়া তুমি পাণ্ডবগো সংবাদ পাচার করবা দুর্যোধনের কাছে…

শাম্ব তো নাদান পোলা। স্বয়ং কৃষ্ণেরও এইবার নিজেরে বেকুব মনে হয় প্রসঙ্গটা শুরু করার লাইগা। বলরাম নিশ্চিন্তে তামাশা দেখতাছে। তার মোটাবুদ্ধির শিষ্য ভীমের পোলা বুদ্ধির পঁাচে যে কৃষ্ণরেও চাইপা ধরছে তাতে বলরামের খুশিই লাগে। দ্রৌপদী মুচকি হাসে। ভীম হাসে মুখ ঘুরাইয়া- আমার। পোলায় খালি আমার মতো খায় না। বুদ্ধির জোরে সে কৃষ্ণরেও কাইত কইরা দিতে পারে…

কৃষ্ণের চ্যালা সাত্যকির এইবার মনে হয় শাম্বর কথাটারে সমর্থন কইরা কিছু একটা কওয়া দরকার না হইলে যুদ্ধের সময় শাম্ব পাণ্ডবগো পক্ষে যুদ্ধ করলেও লক্ষণা যে পাণ্ডবপক্ষের সংবাদ তার বাপ দুর্যোধনের কাছে পাচার করব না সেইটা নিয়া কোনো কিছু প্রমাণ করা যাইব না এখন। সে তাড়াহুড়া কইরা কয়-  আমি কই কি যুদ্ধের ঘটনা যুদ্ধে প্রমাণ হওয়াই ভালো। তুমি শাম্বর বিষয়ে যে সন্দেহ করছ তা যৌক্তিক। কিন্তু আমি আমার বংশের মাইনসেরে চিনি। আমি বিশ্বাস করি শাম্ব কোনোদিনও তার বাপ আর পাণ্ডবগো ছাইড়া দুর্যোধনের চর হইব না। কথাটা যদি প্রমাণ করতে চাও তো আমি বলি- চলো; এখনই আমরা দুর্যোধনের লগে যুদ্ধ শুরু করি। তখন দেখা যাইব কে কার পক্ষে আছে আর কে নাই…

— কিন্তু এখন যুদ্ধ করবা কেমনে? জ্যাঠায় তো পণ করছে যা করার তা তেরো বছর পরেই করব। হবায় তো গেছে চাইর বছর…

এইটা একটা সহজ প্রশ্ন। তাই কিছু না ভাইবাই সাত্যকি উত্তর দেয়- অসুবিধা নাই। যুধিষ্ঠির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মানুষ। তার প্রতিজ্ঞায় আমাগো বাধা দেওয়ার দরকার নাই। তিনি তার বনবাসের মেয়াদ শেষ কইরাই ইন্দ্রপ্রস্থ ফিরা যাবেন। তার আগে পর্যন্ত না হয় যুধিষ্ঠিরের পক্ষে অভিমন্যুই রাজ্য শাসন করব…

— অভিমন্যু ক্যান? জ্যাঠার পক্ষে অভিমন্যু রাজ্য শাসন করব ক্যান? বংশের বড়ো পোলা হইলাম আমি; পাঁচ পাণ্ডবের পরে বাপ-জ্যাঠার সিংহাসনের অধিকারে আমিই পরথম। আর পাণ্ডবগো নয় পোলার মধ্যে অভিমন্যু হইল সবার ছোট; নয় নম্বর। তার অধিকার সবার থাইকা পরে। আট-আটটা বড়ো ভাই রাইখা পাণ্ডবগো পক্ষে রাজ্য শাসনের লাইগা তুমি অভিমন্যুর নাম কইলা ক্যান? সে কৃষ্ণের ভাগিনা বইলা?

সাত্যকির ঘাম ছুটতে থাকে না। না। পাণ্ডবগো প্রতিনিধি কে হইব তা পাণ্ডবরাই ঠিক করব; সত্য কথা। অভিমন্যুর নাম মুখ দিয়া আসলো কারণ সে তো আমাগো সামনেই থাকে; তাই…

— ছুডু মা দ্রৌপদীর পাঁচ পোলাও কিন্তু এখন দ্বারকায় তোমাগো সামনেই আছে। তুমি তো তাগোর নাম নেও নাই। আর অত বড়ো গতর নিয়া আমি যে তোমার সামনে খাড়াইয়া আছি তাও তোমার চোখে পড়ে নাই না? আসোলে তোমরা তলে তলে যুধিষ্ঠিরের সিংহাসনটা অভিমন্যুরেই দিতে চাও; তাই সেইটাই তোমার মুখ থাইকা বাইর হইয়া আসছে। তয় মনে রাইখ সাত্যকি; বাপ-কাকার পরে ইন্দ্রপ্রস্থের সিংহাসন কিন্তু আমার। এইখানে কোনো ঘিরিঙ্গি করতে আসবা না কেউ…

কৃষ্ণ এইবার ফাঁক খুঁইজা পায়- ধুত্তুরি। তোমরা কী সব পোলাপানের বিষয় নিয়া কাইজা শুরু। করলা। যুদ্ধ সিংহাসন উত্তরাধিকার এই সব এখনো বহুত দেরি। আর সবকিছুর সিদ্ধান্ত একমাত্র নিতে পারেন যুধিষ্ঠির। তিনিই রাজা। তার যারে ইচ্ছা তারেই তিনি উত্তরাধিকার দিবেন। আর তিনি যেদিন মনে করবেন সেই দিনই যুদ্ধ হইব। এইটা নিয়া কিন্তু অন্য কারো কিছু আলাপ করার সুযোগ নাই…

যুধিষ্ঠিরও এইবার কথা খুঁইজা পায়- হ হ হ। কৃষ্ণ যেদিন বলবে সেই দিনই যুদ্ধ হবে। তার আগে কারো কিছু ভাবার দরকার নাই…

ঘটা আরো যেন কী বলতে চাইতেছিল। কিন্তু দ্রৌপদী তারে টান দেয়-ঘটা। বাপ এদিকে আয় তো। অতিথিরা সেই কখন থাইকা বইসা আছে। তুই আমার লগে আয়। মায়েরে যে একটু রান্নায় সাহায্য করা লাগে বাপ…

যুধিষ্ঠিরও দ্রৌপদীর কথায় তাল দেয়– হ হ। তুই যা। তোর মায়ের কামে একটু হাত লাগা…

দ্রৌপদী ঘটারে টাইনা রান্নার কাছে নিয়া আসে-তুই তো কৃষ্ণরে এক্কেবারে ধুইয়া ফালাইছস। আমার তো ডর লাগতাছিল যে কৃষ্ণ না কখন আবার খেইপা উইঠা শিশুপালের লগে যা করছিল তোর লগেও তা করে…

— ওইগুলার ধার ধারি না আমি। আমি শিশুপাল না। সামনা-সামনি আমারে মারতে হইলে আমিও তারে ছাইড়া কথা কমু না সেইটা সে ভালো কইরাই জানে। আমার মায়াযুদ্ধের কৌশল দেইখাই সে আমারে কইছিল আমি তার থাইকা বড়ো যোদ্ধা?

— মায়াযুদ্ধ কী রে?

ঘটোৎকচের মায়াযুদ্ধ হইল আজকে দিনের মার্শাল আর্ট। ভঙ্গির লগে বর্ণনা দিয়া ঘটা তার মায়াযুদ্ধের কৌশল দ্রৌপদীরে বোঝায়- মায়াযুদ্ধ হইল গিয়া শত্রুর চোখে ঘোর লাগাইয়া যুদ্ধ করা। কোন দিকে সে মাইর খাইব সেইটা তারে বুঝতে না দেওয়া। এই যুদ্ধে অস্ত্র থাইকা চোখ আর নাচের কাম বেশি। শত্রু তোমারে যেখানে দেইখা বর্শা তির বা খড়গ মারব; মারার পর দেখব তুমি সেইখানে নাই। বিষয়টা হইল চোক্ষের পলকে শত্রুর টারগেট থাইকা সইরা যাওয়া আর শত্রুরে এক দিকে দেখাইয়া অন্য দিকে ঘাই মারা। মনে করো তুমি ভান করলা যে তলোয়ার দিয়া তুমি তার মাথায় কোপ মারতে যাইতাছ। তখন সে দুই পা ফাঁক কইরা ঢাল দিয়া তার মাথা বাঁচাইতে যাইব। কিন্তু তুমি তলোয়ার দিয়া তার মাথায় না মাইরা এক ঝটকায় মাটিতে শুইয়া দিলা তার বিচিতে একটা লাত্থি। এইরকম আরকি। কৃষ্ণ ভালো কইরাই জানে যে ওর চক্ৰ দিয়া আমার বালও ছিঁড়তে পারব না সে…

— তুই তো সব সময় কস যে সিংহাসনে তোর লালসা নাই। কিন্তু অভিমন্যু রাজা হইব শুইনা তুই খেইপা উঠলি ক্যান?

— আমি এখনো কই সিংহাসনে আমি মুতি। আইজ যদি জ্যাঠায় তার সিংহাসন দুর্যোধনরেও দান কইরা দেয়; তাতেও আমার কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু আমার আপত্তি আছে অভিমন্যুরে নিয়া। সে বংশের সব থাইকা ছোট পোলা। আমি না পাইলে সিংহাসন পাইব তোমার বড়ো তিন পোলা প্রতিবিন্ধ্য- সুতোসোম আর শ্রুতকর্মা। সিরিয়াল মতে এর পরে সিংহাসন যাইব অর্জুন কাকুর দুই পোলা ইরাবান আর বভ্রুবাহনের কাছে। এর পরে সিংহাসন আবার আসব তোমার ছোট দুই পোলা শতানীক আর শ্রুতসেনের কাছে। এইভাবে বড়ো আট ভাই পার হইবার পর না আসব অভিমন্যুর পালা। আমার আপত্তি ওগো সাহস দেইখা। কোন সাহসে যাদববংশ পাণ্ডব রাজ্যর উত্তরাধিকার বিলিবণ্টন করে? অভিমন্যু কৃষ্ণের ভাগিনা। আমার বাপ-কাকার রাজ্য আরেকজন বিলিবণ্টন করতে গেলে তো আমি ছাইড়া দিমু না। জান ধইরা হইলেও আমি ফাইট দিমু তাতে আমি বাঁচি বা মরি। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের রাজ্য অভিমন্যু পাইব এইটা কেমনে হয়?

— দুর বেটা। অভিমন্যুর উপরে রাগ করার কী আছে? সে এখনো ছোট একটা পোলা। কারো সাথেও নাই পাছেও নাই…

— তা নাই ছুডু মা। তার উপর আমার রাগও নাই। সে আমাগো ভাইগো মইদ্যে সবার ছোট; তার লাইগা আমি একটা মুক্তার মালাও নিয়া গেছিলাম তোমাগো রাজসূয় যজ্ঞের সময়; যেইটা আমি তারে কোলে নিয়া পরাইয়া দিছি। কিন্তু কানপড়া জিনিসটা খুবই খারাপ। এরা তারে দ্বারকায় রাইখা কানপড়া দিতাছে যে যুধিষ্ঠিরের পরে সেই হইব রাজা। সে ওইটা শুইনাই বড়ো হইব। তারপর রাজা হইবার লাইগা বড়ো আটটা ভাইরে ঘুমের মইদ্যে খুন করব সে…

— এইডা কী কস?

–হ ঠিকই কই। কানপড়ায় মাইনসেরে যেমন রাক্ষস বানায় তেমনি মেরুদণ্ডহীনও বানায়। দেখো না; নিয়মমতো ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর পরে বিদুরেরই রাজা হইবার কথা। কিন্তু ছুডুবেলা থাইকা তারে সবাই কানপড়া দিছে যে তুই দাসীর পোলা; রাজা হইবার অধিকার তোর নাই। তাই সে নিজেও জীবনে ভাবতে পারে নাই যে হস্তিনাপুরের রাজা তারই হইবার কথা। ফলে এখন তার ভাতিজার কাছেও তারে শুনতে হয় দাসীপুত্র ডাক। অথচ দেখো নিয়মমতো যুধিষ্ঠির দুর্যোধন তো কোন ছার; সেই কিন্তু আইনত হস্তিনাপুর রাজ্যের উত্তরাধিকার

— কিন্তু সেইটা কি নিয়মের মধ্যে পড়ে?

— নিয়মের মধ্যে ঠিকই পড়ে। কিন্তু তার হেডম নাই দেইখা হয় না। তার কীসের অভাব? খালি একবার বুক চিতাইয়া গিয়া যদি কইত যে পাণ্ডুর পরে এই সিংহাসন আমার। তখন যুধিষ্ঠির দুর্যোধন বন্যার স্রোতে ভাইসা যাইত। কে ঠেকাইতে পারত তারে? কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ধৃত-পাণ্ডু দুইজনরে জন্ম দিলেও তিনি কন তারা অম্বিকা আর অম্বালিকার পোলা; অথচ বিদুররে তিনি সব সময় নিজের পোলা কইয়া পরিচয় দেন। তার কিছু করা লাগত না; খালি গিয়া যদি নিজের বাপেরেই কইত; আর দ্বৈপায়ন আইসা খাড়াইয়া যদি খালি একবার কন-হ। বিদুরই এই সিংহাসনের ন্যায্য উত্তরাধিকার তাইলে দুনিয়াতে কে আছে তারে ঠেকায়? ভীষ্ম তো দ্বৈপায়নরে দেখলে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করার লাইগা মাটিতে আছাড় খাইয়া এখনো নাকমুখ ঘঁাতলাইয়া ফালান। কেউ আছে দ্বৈপায়নরে ঠেকানোর? যে লোক দেবতাগো জন্ম দেয়-মারে তার লাইগা একটা সিংহাসন তো কানি আঙ্গুলের একটা চিমটি দিয়া বড়ো পোলা থাইকা ছোট পোলার কোলে ফালাইয়া দিবার মতো তুচ্ছ বিষয়। কিন্তু তা হইল না। কারণ। ছোটবেলা থাইকা কানপড়া শুইনা বিদুর নিজেও নিজেরেও দাসীপোলা ভাইবা মেরুদণ্ডহীন হইয়া আছে। সব যোগ্যতা থাকতেও ভাতিজাগো মুখে দাসীপুত্র ডাক শুইনাই মরতে হইব তারে…

— দ্বৈপায়নের ক্ষমতা তুই অত বড়ো মনে করস?

–করব না মানে? দেখো না আগে যেখানে বামুনরা শূদ্র আর মেয়ে মাইনসেরে বেদ শুনতেই দিত না; সেইখানে ব্রাহ্মণগো পুটকি মাইরা দ্বৈপায়ন সবার লাইগা বেদের পাতা খুইলা দিছেন। বেদের কোন কথার কোন অর্থ হইব তা শুধু জানেন তিনি; তার পোলা শুকদেব আর তার চাইর শিষ্য। আর তার কিছু ক্ষমতা তো তুমি নিজের জীবনেই দেখছ। পাঁচজনের লগে এক মাইয়ার বিয়া কোনোমতেই হয় না। কিন্তু দ্বৈপায়ন খাড়াইয়া যেই কইলেন- হয়; অমনি আর কেউ কোনো টু শব্দও করল না। বিদুর

একটা বেক্কল হালায়। দ্বৈপায়নের পোলা হইয়া না হইতে পারল শুকদেবের মতো ঋষি; আবার বিচিত্রবীর্যের উত্তরাধিকার হইয়াও না হইতে পারল রাজা। সে থাইকা গেলো রাজবাড়ির এক বেহুদা পণ্ডিত আর দাসীর পোলা হইয়া। আর উল্টা দিকে দেখো; সিংহাসনে বিন্দুমাত্র অধিকার না। থাকলেও খালি বাপ আর মামার কানমন্ত্র পাইয়া এখন দুর্যোধন কইরা বসছে সিংহাসনের দাবি…

— যাউকগা। তোর বাপ-জ্যাঠা যত দিন আছে তত দিন তোর নিজের এই সব বিষয় নিয়া চিন্তার দরকার নাই? তাগোর রাজ্য তাগোরেই সামলাইতে দে…

— তা নিয়া কে চিন্তা করে? রাজ্য নিয়া চিন্তা করে তোমাগো পোলারা। এর লাইগা তারা বিভিন্ন রাজবাড়িতে থাইকা শিক্ষাদীক্ষা করতাছে। আমি বাপ-কাকারে বাপ-কাকা হিসাবেই জানি বইলা তাগো লগে আইসা জঙ্গলে বাল ফালাই। ওই সিংহাসনে মুতনের টাইম আছে নাকি আমার? তয় একটা কথা কি জানো; মাইনসে কয় কৃষ্ণ আর অর্জুন হরিহর আত্মা। আসোলে তা ভুল। হরিহর আত্মা হইল কৃষ্ণ আর যুধিষ্ঠির। দেখলা না কৃষ্ণ কইল যুধিষ্ঠির যখন কইব তখন যুদ্ধ হইব আর যুধিষ্ঠির কইল কৃষ্ণ যখন মনে করব তখনই হইব যুদ্ধ? হাঃ হাঃ হাঃ অর্জুন হইল কৃষ্ণ আর যুধিষ্ঠিরের একটা যৌথ মালিকানার লাঠি। যখন যার দরকার তখন সে সেই লাঠি ব্যবহার করে। এর বেশি কিছু না…

যাদবরা বিদায় নিল। প্রভাসতীর্থ ছাইড়া পাণ্ডবরাও বাইরাইল পথে। আগে হাঁটে পাণ্ডবগণ; মালপত্র ঘাড়ে নিয়া দ্রৌপদীর পাশে হাঁটে ঘটা। হাঁটতে হাঁটতে তার যা কথাবার্তা সবই তার বৌপোলাপান নিয়া। তার দুই পোলার দুইটাই লড়াইর কৌশলে এখনই বহুত পাকা। বড়ো পোলা অঞ্জনপর্বা লড়াইতে দারুণ হইলেও বিদ্যাশিক্ষায় তার বেশি আগ্রহ নাই। কিন্তু তার ছোট পোলা বর্বরীক দুইটাতেই দারুণ। বর্বরীক তার মায়ের খুব ভক্ত। অহিলাবতী তার ছোট পোলারে কইয়া দিছে সব সময় দুর্বলের পক্ষে থাকতে। বর্বরীক কয় সে হইল গিয়া হারু পার্টির সহায়…

ঘটার কালো মুখ ঝকঝক কইরা উঠে-বুঝলা ছুডু মা। ঋষি দ্বৈপায়নের বংশ আমরা। এই বংশে হগগলেই খালি মারামারি করলে হবে? একটা-দুইটা ঋষিও তো জন্মানো লাগে। আমার মনে লয় এই বংশে আমার পোলা বর্বরীকই হইব পরবর্তী ঋষি…

দ্রৌপদীর তাজ্জব লাগে সতিনের এই পোলাটারে দেইখা। জীবনে কোনো দিনও ঘটারে সে চোক্ষের বিষ রাক্ষুসী সতিনের পোলা ছাড়া কিছু ভাবতে পারে নাই। তীর্থ ভ্রমণের আগে ভীম যখন মালপত্র টানার কামে তারে সংবাদ দিয়া আনল তখনো সে তারে মাগনায় একটা কুলিমজুর ছাড়া কিছু ভাবে নাই। কিন্তু পরতে পরতে হিড়িম্বার পোলাটারে বিস্ময়ে আবিষ্কার করে দ্রৌপদী। কৃষ্ণ তারে স্বীকৃতি দিছে তার সমান যোদ্ধা বইলা। কিন্তু বুদ্ধির পঁাচেও যে সে কৃষ্ণরে ধরাশায়ী করতে পারে তা তো নিজের চোখেই দেখছে কিছু দিন আগে। সে বিয়াও করছে স্বয়ংবরায় বুদ্ধির পরীক্ষা দিয়া। দ্রৌপদী মানতে বাধ্য হয়- এই বংশে যদি কেউ যুদ্ধের লগে লগে বুদ্ধিরও চর্চা করে তবে এই ঘটা…

শ্বেতকেতুর আশ্রমের উঠানে বোঁচকা নামাইয়া রাইখা ঘটোৎকচ দ্রৌপদীর দিকে ফিরে-বুঝলা ছুডু মা। তোমার দুর্দশা আর অপমানের গোড়ায় যে দুইজন মানুষ দায়ী তার মধ্যে প্রথমজন কিন্তু ঋষি উদ্দালকের পোলা এই শ্বেতকেতু…

দ্রৌপদী হা কইরা ঘটার মুখের দিকে তাকায়- ক্যামনে? তার লগে কুরু-পাণ্ডবের কোনো সম্পর্ক আছে বইলা তো জানি না। তাছাড়া তিনি তো গত হইছেন আমার বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষ জন্মানোরও আগে…

— হ। বহুত আগেই মইরা ভূত হইছে হালা। কিন্তু যে সিস্টেম বানাইয়া থুইয়া গেছে সেই সিস্টেমেরই বলি হইছ তুমি…

— মানে?

— মানে এই বেডায়ই পয়লা বিধান করছিল যে বিয়াইত্তা নারীরা হইব স্বামীর ইচ্ছার অধীন। সেই বিধানরে আরো জোরদার করে উতখের পোলা দীর্ঘতমা; যে আবার সম্পর্কে আছিল তোমার দ্রোণচোট্টার জ্যাঠা। আর তাগোর সেই বিধানের জোরেই কিন্তু জ্যাঠায় তোমারে তুইলা দিতে পারছে পাশা খেলার দানে। বুঝলা?

যুধিষ্ঠির তোতলায়। মুনি লোমশ এই কয় দিনে ঘটারে ভালোই চিনছে। সে যুধিষ্ঠিররে বাঁচাইতে গিয়া কয়-  এইটা কিন্তু খালি শ্বেতকেতুর আশ্রম না। এইখানে কিন্তু মুনি ভরদ্বাজও বাস করতেন…

ঘটা হাসে- মুনিবর সেই কাহিনিতেও কিন্তু আপনে আমারে ভুলাইতে পারবেন না। ভরদ্বাজের এক পোলা দ্রোণ যেমন এখন কুরু-পাণ্ডব দুই দলেরই পুটকি মারতাছে। আরেক পোলা যবক্রীত যে এইখানে বইসা মুনি-ঋষিগো পুটকিতে আঙ্গুল দিত তা কিন্তু আমি জানি। বুঝলা ছুডু মা। দ্রোণ যেমন মূর্খ হইয়াও ব্রাহ্মণের দাবি করে- তার ভাই যবক্রীত তেমনি বেদ না জাইনাই কইয়া বেড়াইত সে বেদজ্ঞ। এইখানে বাপের লগে যবক্রীত যে রৈভ্যের আশ্রয়ে থাকত-খাইত; এক দিন হালায় সেই রৈভ্যেরই পোলার বৌয়ের হাত ধইরা টানাটানি করছিল দেইখা রৈভ্য তারে বাপ ভরদ্বাজের চোখের সামনে শূল দিয়া খোঁচাইয়া নরকে পাঠায়। সেই দুঃখে ভরদ্বাজও কিন্তু আগুনে ঝাঁপ দিয়া নিজের লজ্জা লুকায়। সেই যবক্রীতের ভাই কিন্তু আমার জ্যাঠা-কাকার মহাগুরু চোট্টা দ্রোণ…

— থাউক। আমি আর এই বিষয়ে কিছু শুনতে চাই না। চল কিছু খাওনের বন্দোবস্ত করি…

ঘটা আর কথা বাড়ায় না। কয়েক দিন এইখানে থাইকা পাণ্ডবেরা প্রস্তুতি নেয় কৈলাস পর্বতে উঠার। যুধিষ্ঠির আমতা আমতা করে- এই রাস্তা বহুত কঠিন। সকলে বোধ হয় সেইখানে যাইতে পারব না… ভীম হাসে- তুমি আর তোমার বামুনের দল পারবা কি না সেইটা কও। পাঞ্চালী আর নকুল সহদেব যদি না পারে তয় আমি তাগোরে কান্ধে কইরা নিয়া যামু…

যুধিষ্ঠির আর কিছু কয় না। সকলেই হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে ঘটা দ্রৌপদীরে আস্তে কইরা কয় অর্জুন কাকু কিন্তু কৈলাসের আশেপাশে আছে। জ্যাঠায় অর্জুন কাকুর লগে নিরালায় কানাকানি করতে চায় দেইখা কিন্তু অন্য সবাইরে কৈলাস যাইতে আপত্তি করছে। কিন্তু আব্বায় যে খোঁচাটা মারছে তাতে জ্যাঠার আর কিছু কওয়ার নাই…

— অর্জুন কৈলাসে আছে তুই জানলি কেমনে?

–জানছি মুনি লোমশের কাছে। কাকু ভালোই আছে এখন। খালি শুরুতে এক কিরাতের লগে বাহাদুরি করতে গিয়া নাকি মরতে বসছিল। পরে মাপ-টাপ চাইয়া বাঁইচা আসছে। এরপরে অবশ্য বেবুঝের মতো আর কোথাও শক্তি দেখাইতে যায় নাই; বিভিন্ন দেশের অতিথিশালায় ঘি-মাখন খাইয়া ভালোই দিন কাটাইছে। কাকু নাকি অস্ত্রশিক্ষা বাদ দিয়া চিত্রসেনের কাছে নাচ-গানও শিখছে এই কয় দিনে…

অর্জুনের প্রসঙ্গে ঘটার লগে আলাপ করতে ইচ্ছা হয় না পাঞ্চালীর। সে চুপচাপ হাঁটে। রাস্তাটা সত্যিই কঠিন। হাঁটতে হাঁটতে গন্ধমাদন পর্যন্ত গিয়া তারা পড়ে তুফানের তলে। দ্রৌপদী আর চলতে পারে না। ভীম ঘটার দিকে তাকায়- মায়েরে কান্ধে নেও পুত…

সতিনের পোলার কান্ধে চইড়া গন্ধমাদন পর্বতে উঠতে থাকে দ্রৌপদী। হা দ্রৌপদী। নিজে সে পাঁচ পাঁচটা রাজপুত্তুরের জননী। রাজপুতুরেরা নানার ঘর রাজবাড়িতেই আরামে আছে। আর যে সতিনের পোলারে কর্ণ দিয়া খুন করার হুমকি সে নিজের মুখে দিছে; তার কান্ধে চইড়াই কি না তারে আইজ পার হইতে হয় দুর্গম পথ। দ্রৌপদীর চোখে জল। এই প্রথমবারের মতো সে প্রশংসায় স্মরণ করে হিড়িম্বারে- রাজপুত্তুর দরকার নাই তোমার। ভালোবাসার পুরুষরে বরণ কইরা যে পোলা পাইছ তুমি সহস্র রাজপুত্তুর থাইকাও মহামূল্যবান তোমার এই ঘটা…

সকলে গিয়া হাজির হইল বদরিকাশ্রমে। এইখানে বইসাই সন্ধান পাঠানো হইল অর্জুনের। এইখানে এক সপ্তা থাকার পরে এক দিন একটা ঘটনা ঘটাইল দ্রৌপদী। বাতাসে উইড়া আসা একটা পদ্ম। ফুলের পাপড়ি দেইখা সে গিয়া ভীমের কাছে আব্দার জানাইয়া বসে- তুমি যেইখান থাইকা পারো এই ফুলের চারা আমারে আইনা দেও। আমি কাম্যকবনে নিয়া লাগামু এই গাছ…

পাঞ্চালী একখান আব্দার করছে আর ভীম বইসা থাকব? সে অস্ত্রপাতি নিয়া জঙ্গল তছনছ কইরা খুঁজতে লাগে সেই ফুলগাছ। জঙ্গলের সব পশুপাখি দৌড়াইলেও হনুমানের দল আইসা থাবাইয়া খামচাইয়া ভীমেরে এক্কেবারে অস্থির কইরা ফালায়। ভীম পয়লা হনুমানের লগে মারামারি করতে গেলেও শেষে পলাইয়া বাঁইচা গিয়া হাজির হয় যক্ষরাজ কুবেরের দিঘিতে। সেইখানেই ফুইটা আছে শতে শতে এই ফুল। ভীমেরে আর আটকায় কেডা? কিন্তু ভীম যেই পানিতে নামতে গেছে অমনি কুবেরের সেপাইরা আইসা শুরু করে আক্রমণ। ভীমও শুরু করে গদার খেলা। শতে শতে কুবের সৈন্য পড়তে থাকে ভীমের গদার বাড়িতে। এই দিকে ভীমের সন্ধান নিয়া যুধিষ্ঠির যখন শুনল সে দ্রৌপদীর ফুল আনতে গেছে। তখনই যুধিষ্ঠির আরেক দফা ডর খাইল। এইটা কুবেরের এলাকা। ফুল আনতে গিয়া যদি আবার ভীম কুবেরের লোকজনের লগে ঝামেলা পাকায়?

ঘটাসহ সকলরে নিয়া দৌড়াইতে দৌড়াইতে যুধিষ্ঠির দিঘির ঘাটে গিয়া দেখে সে যা ভয় করতাছিল তাই ঘটাইছে ভীম। অনেক লোকরে মাইরা চ্যাপটা কইরা ফালাইছে সে। যুধিষ্ঠির ভীমেরে দাবড়ানি দিয়া বাকিদের মাথায় হাত-টাত বুলাইয়া মাফ চাইয়া লড়াই থামায়। ঘাড় থাইকা গদা নামাইয়া ভীম ঘটার কাছে গিয়া পইড়া থাকা লোকগুলারে দেখায়- দেখলি কেমন পিডানিডা দিলাম?

— হ। তা দিছ। কিন্তু বেহুদা। একটা ফুলগাছের চারা যেখানে মানুষ চাইলেই দেয় সেইখানে লাঠালাঠি করা কোনো কামের কথা না…

ভীমের বড়োই ইচ্ছা আছিল পোলারে নিজের বাহাদুরি দেখায়। কিন্তু হালায় যেন তার জ্যাঠা থাইকাও বড়ো ধার্মিক…

ভীম আরেকটা চান্স পায় পোলারে নিজের কেরামতি দেখানোর। এক দিন পোলারে নিয়া সে গেছে শিকারে। এমন সময় শোনে আকুলিবিকুলি কইরা সহদেবের চিক্কর। গিয়া দেখে তীর্থযাত্রী দলের। এক ব্রাহ্মণ যুধিষ্ঠির নকুল সহদেব আর দ্রৌপদীরে বাইন্ধা থুইয়া সকল অস্ত্র আর অলংকার নিয়া পলাইতাছে। ঘটা কয়-  ব্রাহ্মণ মারলে তুমি প্রায়শ্চিত্ত কইরা কূল পাইবা না। পাবলিকে কোনো দিনও ব্রাহ্মণের খুনিরে রাজা হিসাবে মাইনা নিব না। তার থাইকা তুমি খাড়াও আব্বা। আমি ওইটারে থাপড়াই…

ভীম পোলার দিকে তাকাইয়া হাসে- বাপের বুদ্ধিতেও ভরসা রাখিস ব্যাটা। দেখ না কৃষ্ণের থিউরি দিয়া কেমনে ওর ব্রাহ্মণত্ব ছাড়াই…

ব্রাহ্মণরে কাইত করতে ভীমের একটার বেশি কিলের দরকার হয় না। দুই পা ধইরা টান দিয়া তারে দুই টুকরা করতেও কষ্ট হয় না ভীমের। ব্রাহ্মণের দুই টুকরা শরীর দুই দিকে ফিককা ফালাইয়া ভীম সকলের বান্ধন-বুন্ধন খুইলা দিয়া যুধিষ্ঠিরের সামনে খাড়ায়- আমি আগেই সন্দেহ করছিলাম ভাইজান; এইটা কোনো ব্রাহ্মণ না। এইটা হইল রাক্ষস জটাসুর। ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধইরা আছিল বইলা আমি তারে কিছু কই নাই। এখন দেখলেন তো এইটা আসলেই রাক্ষস?

যুধিষ্ঠির মিনমিন করে- তা অবশ্য ঠিক। তা অবশ্য ঠিক। এইটা তো ব্রাহ্মণ না। এইটা তো সত্যই একটা রাক্ষস। রাক্ষস বধ কইরা তুমি যেমুন তোমার পরিবাররে বাঁচাইছ তেমনি বহুত পুণ্যিরও কাম করছ ভাই…

ভীম দুই মুষ্টি উপরে তুইলা ধৌম্য আর বাকিসব ব্রাহ্মণের দিকে ফিরে। সাথে সাথে সকল ব্রাহ্মণ মাথা ঝাঁকায় যুধিষ্ঠিরের সুরে-হহ। ঠিক কথা। আমরা না চিনলেও রাক্ষস-খোক্কশ এইগুলা ভীম সব থিকা ভালো কইরা চিনে। বহুত রাক্ষস যেমন মারছে তেমনি রাক্ষসকুলে বিবাহ কইরা একটা সন্তানও জন্ম দিছে ভীম। ভীম যখন কইছে এইটা রাক্ষস জটাসুর; আমরাও কই সে রাক্ষস জটাসুরই বটে…

ভীম পোলার দিকে তাকায়-কী রে? তুই না কইছিলি প্রায়শ্চিত্তি করা লাগব? এখন দেখলি তো কতটা পুণ্য কামাইছে তোর বাপ?

পাণ্ডবেরা সিদ্ধান্ত নিল অর্জুনের অপেক্ষায় বদরিকাশ্রমে থাকার। ঘটা বলে- আমি তয় বৌ পোলা আর মায়ের কাছে যাই…

বাপ-জ্যাঠা-কাকার কাছে বিদায় নিয়া ঘটা একটা পেন্নাম কইরা খাড়ায় দ্রৌপদীর সামনে- লাগলে সংবাদ দিও জননী। মায়ের লগে যেই আচরণ করি সেই আচরণে তোমারও অধিকার আছে। আর যদি এর মইদ্যে দেখা না হয়; তাইলে নয় বচ্ছর পরে দুই পোলারে নিয়া হাজির হমু পাণ্ডবপক্ষের যুদ্ধে। তখন দেখা হইব। আশা করি তখন তোমার কর্ণের হাতে মরার আগে সামনা-সামনি একটা ফাইটেরও সুযোগ পামু আমি…

ধক কইরা উঠে দ্রৌপদীর বুক। কী কুক্ষণে কী কথা বাইর হইছিল তার মুখে। ঘটারে জড়াইয়া ধরে পাঞ্চালী- রানি দ্রৌপদীরে জননী দ্রৌপদী বানাইবার পরে আর ওই কথা মনে রাখিস না বাপ…

ঘটা মনে মনে হাসে- তুমি না জানলেও আমি কিন্তু কর্ণের পরিচয় জানি ছুডু মা। তুমি বেশি বড়ো কোনো অভিশাপ দেও নাই আমারে। তুমি খালি কুন্তীর ভাসাইয়া দেওয়া বড়ো পোলার সামনে খাড়া কইরা দিছ কুন্তীর ফেলাইয়া আসা বড়ো নাতিটারে। অভিশাপ যারে যা দিবার দাদি কুন্তীই তা দিয়া থুইছে আগে…