ভণিতা

ভণিতা

০১

কবিরা যুক্তি মানে না আর ধার্মিকেরা যুক্তি বানায়। এতে কোনো ঝামেলা নাই কারণ কাব্যকাহিনি যারা পড়ে আর ধর্মকথন যারা মানে তারা ভিন্ন ভিন্ন লোক; ভিন্ন ভিন্ন রঙের অন্তর নিয়া তারা বসবাস করে ভিন্ন ভিন্ন জগতে; যদিও দুই দলেরই ভিত্তি মূলত কল্পনায়। পার্থক্য শুধু এই যে কাব্যভক্তরা কল্পনারে কল্পনা জাইনা বিনোদিত হন আর ধর্মভক্তরা কল্পনারে সত্য জাইনা করেন বিশ্বাস…

এতেও কোনো ঝামেলা নাই। কিন্তু ঝামেলা তখনই বাঁধে যখন কবিরা ধর্মকথা কইতে যান কিংবা ধার্মিকেরা আসেন কাব্য রচনায়। আর তখনই তৈরি হয় বিশ্বাসের কাব্য কিংবা কাব্যিক বিশ্বাস কিংবা দুনিয়ার সব থাইকা বড়ো ভজঘট; মহাভারত…

উল্টাপাল্টা কিছু কইরা তারে জায়েজ করতে গেলে মাইনসে যুক্তি দেখায়। এতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হইল? আসোলে মহাভারত এমন একখান অশুদ্ধ জিনিসের শুদ্ধতম উদাহরণ যে কোনোমতেই তারে অশুদ্ধ করার সাধ্যি কারো বাপেরও নাই। অন্তত এইটা আমার উপলব্ধি…

০২

এখন থাইকা সাড়ে চাইর হাজার বছর আগে তৈরি একখান কাহিনি কথক-পালাকারের মুখে ঘুরতে ঘুরতে লিপিবদ্ধ পুস্তকের চেহারা পাইছে মাত্র হাজার দুয়েক বছর আগে। এই যে কথাটা কইলাম সেইখানেও কিন্তু বিশাল ভজঘট আছে। কারণ প্রাচীন দুই গণিতবিদ আর্য ভট্ট আর বরাহ মিহিরের রেফারেন্স টাইনা যেইখানে ড. অতুল সুর কন যুধিষ্ঠিরের রাজ্য অভিষেক হইছিল খ্রিস্টপূর্ব ২৪৪৮ সালে; সেইখানে প্রাচীন শাস্ত্র ঘাঁইটা আর বিস্তর গোনাগুনতি কইরা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কন কুরুযুদ্ধ হইছে খ্রিস্টপূর্ব ১৪৩০ সালে। প্রাচীন দুই গণিতবিদের মতো অতুল সুর কুরুযুদ্ধের অস্তিত্বে সন্দেহ করলেও কুরুযুদ্ধ আর যুধিষ্ঠিরের রাজ্য অভিষেক যেহেতু পিঠাপিঠি জিনিস তাতে সহজেই বলা যায় যে এই দুই মহারথীর গোনাগুনতির মইদ্যেও ফারাক প্রায় হাজার বছরের। এর বাইরেও আরো কথা আছে। কইতে কইতে কেউ কেউ সাক্ষী দলিল দেখাইয়া মহাভারতের ঘটনারে টানতে টানতে আরো বহু কাছাকাছি; মানে তৃতীয় চতুর্থ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নিয়া আসেন। তো এইটা হইল মহাভারতের ঘটনাবলির সময়কাল নিয়া গ্যাঞ্জাম। একইভাবে ভিন্ন ভিন্ন যুক্তি আর সিদ্ধান্ত আছে পুস্তক হিসাবে মহাভারত লিখিত হইবার সময়কাল নিয়া; যেইটা মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থাইকা ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আটশো বছরের ঘাপলাকাল…

যে কালেই শুরু হউক আর যে কালেই লেখা হউক না কেন; মূল কথা হইল শুরু হইবার পর এই পুস্তক বহু জায়গায় বহু চেহারা পাইছে ভিন্ন ভিন্ন দেশে; ভিন্ন ভিন্ন গোত্র; ভিন্ন ভিন্ন মানুষের হাতে। এইটার চেহারা বদলাইছেন কবিরা; চেহারা বদলাইছেন ধার্মিকেরা; চেহারা বদলাইছেন রাজনীতিবিদেরা। মাঝে মাঝে নিজের জাতিরে ঐতিহ্যবান দেখাইতে গিয়া তৈরি হইছে লাখে লাখে উপকাহিনি-মহাভারতে বর্ণিত অমুক জায়গাখান কিন্তু মোগো বাসস্থান কিংবা কুরুযুদ্ধের অমুক চরিত্র হইল মোগো পূর্বপুরুষ। যদিও নৃতাত্ত্বিকেরা মহাভারতের কিছু ঘটনা আর কিছু কেন্দ্রীয় ভূগোলের ঐতিহাসিক বাস্তবতা স্বীকার কইরা নিলেও সম্পূর্ণ সন্দেহ করেন কুরুযুদ্ধের অস্তিত্ব নিয়া। তারা কন কোনোকালেই কুরুযুদ্ধ নামে কিছু হয় নাই। এর পক্ষে পয়লা দুইটা যুক্তি হইল দ্বৈপায়নের মহাভারত লেখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বয়ানকার বৈশম্পায়ন আর উগ্রশ্রবা সৌতি যে কথাগুলা বলেন তার মধ্যেও যেমন কুরুযুদ্ধের কথা নাই তেমনি কুরুযুদ্ধের কোনো নামগন্ধ নাই ঋগ্বেদের পাতায়…

বেদের কথাবার্তায় মহাভারত ভরপুর থাকলেও এক হিসাবে বেদ কিন্তু তৈরি হইছে মহাভারতের বহুত পরে। ঋগ্বেদরে যারা অনেক প্রাচীন কইতে চান তারা কন এইটা তৈরি হইছে খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ তে আর যারা এরে আরো নবীন বলেন তারা কন খ্রিস্টপূর্ব ১২০০-তে; মানে বঙ্কিমচন্দ্রের হিসাবে কুরুযুদ্ধের কমপক্ষে ১৩০ বছর আর অতুল সুরের হিসাবে কমপক্ষে প্রায় সাড়ে এগারোশো বছর পর। বাকি বেদগুলার রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব হাজার থাইকা নয়শো পর্যন্ত হইলেও সেইগুলাতেও কুরুযুদ্ধের কোনো তথ্য-তালাশ নাই…

কেউ কেউ কন হইলে হইতে পারে মহাভারতের দশ-বিশজন পালোয়ান কোনো এক সময় কিছু কিলাকিলি আর লাঠালাঠি করছিল; আবার এমনও হইতে পারে যে কুরু-পাঞ্চাল মারামারিরে ফুলাইয়া-ফাঁপাইয়া কবিগণ আঠারো দিনের কুরুযুদ্ধ বানাইয়া ফালাইছেন। তবে এইটাও মনে রাখা দরকার যে পাঞ্চালজাতি সম্পর্কেও কিন্তু বেদে পরিষ্কার কিছু নাই; যদিও অনেকে অনুমান-টনুমান করেন যে বেদের অমুক কথায় বোধ হয় পাঞ্চালের কথা কওয়া হইছে। কিন্তু কারো কথার লগেই কারো কথা মিলে না। একজন একখান পুস্তক রচনা কইরা এক বয়ান করেন তো আরেকজন তা অন্য রচনায় বাতিল কইরা কন- তিনি যা কইছেন তা ঠিক না; মূলত মহাভারত কইছে অন্যকথা… তয় এইটা ঠিক যে মহাভারত কইছে বহুত কিছু কিংবা মহাভারতরে দিয়া কওয়ানো হইছে বহুত কিছু। মহাভারত চতুর্বর্ণের কথা কইছে। কিন্তু গুণীজন হিসাব কইরা কন চতুর্বর্ণের সংবিধান মনু সংহিতার রচনাকাল মাত্র খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক। কেউ কেউ কন আরো পরে; খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থাইকা ২০০ খ্রিস্টাব্দ। মহাভারতের পরতে পরতে আছে কর্মফল- জন্মান্তরবাদ আর পূর্বজন্মের কাহিনি। কিন্তু ঋষি যাজ্ঞবল্কের উর্বর মগজ থাইকা এই জন্মান্তরবাদের থিওরিখান নাকি বাইরাইছে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০’র দিকে; বর্ণপ্রথা চালুর সময়। মহাভারত জুইড়া অবতারগো বিশাল দাপট; স্বয়ং কৃষ্ণ সেইখানে অবতার; কিন্তু এই অবতারবাদের উদ্ভব হইছে যিশুখ্রিস্ট জন্মাইবার তিন থেকে। চাইরশো বছর পরে; গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়; যেইখানে এইটারে জোরালো বিশ্বাসে পরিণত করছে বৌদ্ধ ধর্মের জাতক কাহিনি। কুরুযুদ্ধে বহুত ভারী ভারী লোহার অস্ত্রের বর্ণনা পাওয়া গেলেও মানবজাতি কিন্তু লোহা আবিষ্কার করছে মাত্র খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালে আর তার ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারছে আরো বহু পরে…

তো কথা হইল তাইলে মহাভারতে অত বর্ণপ্রথা জন্মান্তরবাদ অবতারবাদের থিউরি আর লোহার অস্ত্র সাপ্লাই দিলো কেডায়?

সাপ্লাই দিছে এখন থাইকা মাত্র দেড়-দুই হাজার বছর আগের কবিদল; মানে পুরাণ রচয়িতাগণ। পুরাণগুলারে যারা অনেক প্রাচীন কইতে চান তারা কন খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থাইকা শুরু হইয়া ৫০০ খ্রিস্টাব্দের মইদ্যে রচিত হইছে এইগুলা আর যারা পুরাণের বয়স কমাইবার পক্ষে তারা কন

এইগুলা খ্রিস্টজন্মের ৬ থাইকা ১২ শতাব্দী সময়কালে উৎপাদিত জিনিস। আর ড অতুল সুর কন মহাভারতখান লিখিত রূপ পাইছে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থাইকা ৪০০ খ্রিস্টাব্দের মইদ্যে। মানে যা কারিগরি হইবার তা হইছে এই সময়টাতেই; মহাভারত লিখিত হইবার সময়। এই সময়ে লেখকগো হাতে মগজে বোঁচকায় যার যত অ্যাজেন্ডা আছিল সব তারা ঢুকাইয়া দিছে মহাভারতের পাতায়; আর তাতে চেহারায় বিষয়ে গল্পে পুরা ভজঘট পাকাইয়া হইয়া উঠছে বর্তমান লিখিত মহাভারত। যদিও লিখিত প্রাচীন মহাভারতও কিন্তু এক মহাভারত না; ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন ভার্সনের অস্তিত্ব বিদ্যমান; যদিও সকলেই নিজেরটা সম্পর্কে দাবি করেন- ইহাই আদি ও অকৃত্রিম দ্বৈপায়নের রচনা…

০৩

উপমহাদেশে আদি মহাভারত নামে যেইগুলা প্রচলিত তার মইদ্যে আছে কাশ্মীরি দেবনাগরি মৈথিলি নেপালি তামিল তেলেগু মালয়ালাম আর বাংলা মহাভারত; যদিও একটার লগে কাহিনি বহুত জায়গায় মিলে না আরেকটার…

বাংলায় মহাভারতের খণ্ড খণ্ড অংশ বহু আগে থাইকা অনুবাদ হইলেও ১৫১৫-১৫১৯ সালের মইদ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলে রচিত পরাগলি মহাভারতই হইল পরথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা মহাভারত; যদিও সংক্ষিপ্ত…

সূত্রমতে গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ’র চট্টগ্রাম অঞ্চলের লস্কর বা শাসনকর্তা পরাগল খাঁ কিংবা পরাগ আলী খাঁ মহাভারতের এই অনুবাদ করান তার সভাকবি পরমেশ্বর দাসরে দিয়া “এই সব কথা কহ সংক্ষেপিয়া দিনেকে শুনিতে পারি পাঁচালি পড়িয়া মানে এক দিনের মইদ্যে পুরাটা শোনা যায় এমন সাইজে মহাভারতের বাংলা পাঁচালি ভার্সন করতে কবি পরমেশ্বররে কইছিলেন পরাগল খাঁ। পরাগল খাঁর কথামতো কবি পরমেশ্বর দাস পাণ্ডববিজয় কাব্য; মতান্তরে বিজয়পাণ্ডব কাব্য নামে মহাভারত অনুবাদ কইরা কবীন্দ্র উপাধি পান; যে কারণে পরাগলি মহাভারতখান কবীন্দ্র মহাভারত নামেও পরিচিত। ড. কল্পনা ভৌমিকের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি কবীন্দ্র মহাভারত নামেই দুই খণ্ডে প্রকাশ করছে বইখান। বইখান খুবই কম প্রচারিত আর পরিচিত হইলেও এই বইখান প্রকাশ করতে গিয়া কল্পনা ভৌমিক যে বিস্তর গবেষণা করছেন তার সব তথ্য-উপাত্ত-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও সংযুক্ত আছে দুই খণ্ডের কবীন্দ্র মহাভারতে। সাহিত্য মহাভারত নিয়া যারা ঘাঁটাঘাঁটি করতে চান তাগো যাত্রা শুরুর পয়লা ধাপ হইতে পারে ড. কল্পনা ভৌমিকের এই মহামূল্যবান গবেষণা…

তবে কেউ কেউ অবশ্য কিছু ঝামেলা পাকান পরাগলি মহাভারত নিয়া। তারা কন কবীন্দ্র পরমেশ্বর আর শ্রীকর নন্দী মূলত একই মানুষ। কিন্তু সত্য কথা হইল শ্রীকর নন্দী আলাদা মানুষ যিনি জৈমিনি মহাভারতের অশ্বমেধ পর্ব অনুবাদ করছিলেন পরাগল খাঁর পোলা ছুটি খার অনুরোধে; যা আবার পরিচিত আছিল ছুটিখানী মহাভারত নামে। জৈমিনি মহাভারত কিন্তু দ্বৈপায়ন মহাভারত থাইকা কিছুটা আলাদা; মূলত এর অশ্বমেধ পর্বটা; আর দ্বৈপায়ন মহাভারত নামে আমরা এখন যা পাই তা মূলত বৈশম্পায়ন ভার্সন; যা উগ্রশ্রবা সৌতি শুনছিলেন জন্মেজয়ের যজ্ঞে আর আর সৌতির মুখ থাইকা শুইনা সেইটা আমাগো বলতে আছেন অন্য কোনো এক অজ্ঞাত কথক…

দীনেশ চন্দ্র সেন অবশ্য কইতে চান যে সঞ্জয় রচিত মহাভারতই হইল পয়লা বাংলা মহাভারত। মানে পরাগলি মহাভারতেরও আগে তা রচিত হইছিল যা পরবর্তীতে সঞ্জয় ভারত নামে প্রকাশিতও হয়। দীনেশ চন্দ্ররে কেউ কেউ সমর্থন করলেও দীনেশ চন্দ্রসহ কেউই এই যুক্তির পক্ষে শক্ত কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেন নাই। অবশ্য সেই যুগে পরাগলি মহাভারত থাইকা সঞ্জয় ভারতের প্রচার আর প্রসার দুইটাই আছিল বেশি। পরাগলি মহাভারতখান কোনো কারণে পরাগল খার প্রাসাদের বাইরে তেমন একটা বাইরায় নাই; উল্টাদিকে সঞ্জয় ভারত সেই যুগে পরিচিত আছিল সিলেট-ত্রিপুরা-নোয়াখালী-চট্টগ্রাম-ফরিদপুর-বিক্রমপুর এবং রাজশাহী এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে…

সঞ্জয় ভারত হইল মহাভারতের জৈমিনি ভার্সনের রূপান্তর। কেউ কেউ কন যে সঞ্জয় মূলত কবীন্দ্র মহাভারতেরই একখান কপি করছিলেন নিজের মতো কইরা; যদিও কবীন্দ্র মহাভারত হইল বৈশম্পায়ন ভার্সন। তবে এইটা সত্য যে বিভিন্ন জনের রচনা হইলেও সকল প্রাচীন মহাভারতেই কিছু কিছু জিনিস অবিকলভাবে কপি-পেস্ট পাওয়া যায়। এইটার কারণ হিসাবে দীনেশ চন্দ্র সেন কন; লিখিত হইবার আগেও মহাভারতের বিভিন্ন গল্প কামরূপ আর সিলেট অঞ্চলে বসতি করা মগধের ভাট ব্রাহ্মণরা এইদিকে সেইদিকে বিভিন্ন সভায় গাইয়া বেড়াইতেন; সেইগুলারই কিছু কিছু অংশ কাটিং অ্যান্ড ফিটিং হইয়া ঢুইকা গেছে বিভিন্ন অনুবাদকের মহাভারতে; আর তাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের অনুবাদ হইলেও মিলের সংখ্যা প্রচুর…

সঞ্জয় ভট সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের মানুষ। ২০১৭ সালে সুনামগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমিতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সঞ্জয় স্মারকস্তম্ভ নির্মাণের একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়। তিনারা সঞ্জয়রে প্রথম বাংলা মহাভারত লেখক হিসাবেই উল্লেখ করছেন সেই স্মারকস্তম্ভে…

সন্দেহ নাই বাংলা মহাভারত পয়লাবারের মতো লেখার দাবিদার দুইজনের মইদ্যে একজন সঞ্জয় ভট। কিন্তু এককভাবে তিনারে মহাভারতের পয়লা বাংলা লেখক কিংবা অনুবাদক কইবার দাবিটা বিতর্কহীনভাবে প্রমাণিত না। যুক্তি আর প্রমাণে এই ক্ষেত্রে বরং পরাগলি মহাভারতের লেখক কবীন্দ্র পরমেশ্বরই আগায়া আছেন…

পরাগলি মহাভারতের প্রায় দুই শো বছর পরে রচিত হইলেও বাংলায় সব থিকা জনপ্রিয় আর প্রচারিত মহাভারতখান কাশীরাম দাসের। এইটা মহাভারতের কাব্যিক ভাবানুবাদ। মহাভারতের অনেক বিষয় যেমন এইটাতে বাদ পড়ছে তেমনি মহাভারতের বাইরের বিষয়ও যোগ হইছে। আবার কাশীরামের নিজস্ব জিনিসও ঢুকছে এইখানে। ষোলো শতকের শেষ থাইকা সতেরোর প্রথমাংশ শতাব্দীকালে ভারত পাঁচালি নামে রচিত এই বইটা প্রকাশ হইছিল ব্রিটিশগো ইচ্ছায় এবং পয়সায় ১৮০১ থাইকা ৩ সাল পর্যন্ত। এই পুস্তকখান এখনো পাওয়া যায়; যদিও এইটার কোনটা যে আদি কাশীদাসি ভার্সন তা নিয়া যেমন বহুত মারামারি আছে তেমনি এর কতটা মূল কাশীদাসের আর কতটা অন্যদের অনুবাদ তা নিয়াও আছে বহুত মতামত দ্বিমত…

কালীপ্রসন্ন নিজে মহাভারত অনুবাদ করার শুরুর দিকে এই কাশীদাসের বহুত সমালোচনা করছেন এইটা বাদ দিছে ওইটা জুইড়া দিছে সেইটা কাব্য করছে কইয়া। কিন্তু নিজে একদল মানুষ নিয়া আট বছর মহাভারত ঘাঁটানির পর বোধ হয় বুঝছেন যে একলা কাশীদাসের কী অমানুষিক খাটনিখান গেছে পুরা মহাভারতের পদ্য অনুবাদ করতে। তাই পরের দিকে দেখি কালীপ্রসন্ন কথায় কথায় কাশীদাসরে পেন্নাম দিয়া কথা কন। আবার নিজেই উদ্যোগী হইয়া কাশীদাসের জীবনীও ছাপাইতে চান। কিন্তু কাশীদাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু উদ্ধার করতে পারেন নাই তিনিও। তবে যদ্দুর নিশ্চিত তা হইল কাশীদাস আছিলেন বর্ধমান জেলার মানুষ…

যাই হউক। কাশীদাসি মহাভারতখানই বাংলায় সব থাইকা জনপ্রিয় মহাভারত। এইটা তার নিজস্ব একখান মহাভারত। পদ্যে রচিত এই পুস্তকখান হেইলা-দুইলা সুর কইরা পড়ার লাইগা যেমন দারুণ তেমনি রাক্ষস-খোক্কশের কাণ্ড কারখানা দেইখা হাসার লাইগাও দারুণ আবার ভক্তিতে গদগদ হইয়া চোখ বন্ধ কইরা ঝিমানোর লাইগাও দারুণ; কিন্তু তার পদ্যের ঠেলায় সেইখান থাইকা রক্তমাংসের মানুষগুলারে চিনা বড়োই কঠিন; ছন্দে যেদিকে টাইনা নিয়া যায় সেই দিকে তিনি মহাভারতরে ঠেইলা নিয়া গেছেন…

দুইখণ্ডে রচিত কালীপ্রসন্ন সিংহের বাংলা মহাভারতখানের সাইজ দেইখা সহজে কেউ হাত দিবার সাহস করে না। অতি বিস্তৃত অতি বিশাল। কাহিনি-উপকাহিনির ছোটখাটো বিষয়গুলাও তিনি ছাইড়া যান নাই। কাশীদাসি মহাভারতে কাশীদাস যেসকল জায়গা জটিল বইলা ছাইড়া গেছিলেন কিংবা ছাইটা ফালাইছেন কিংবা কাব্য কইরা গুলাইয়া ফালাইছেন কিংবা নতুন কাহিনি জুইড়া দিছেন সেই সব জায়গা তিনি ভরাট কইরা দেন গদ্য অনুবাদে। পুস্তকখান তার একলা অনুবাদ নয়; অনেকের অনুবাদ যার দলনেতা আছিলেন তিনি। দাবি করছেন তার পুস্তকখান মূলানুগ। এই বিষয়ে কিছু কওয়ার বিদ্যা আমার নাই; কিন্তু তার গ্রন্থের উৎসর্গপত্ৰখান দেখলে কেমন যেন মনের মইদ্যে খচাখচ করে…

তিনার অনুবাদখানও ব্রিটিশগো অনুদানের ফসল। তিনার বইখান তিনি উৎসর্গ করছেন উপনিবেশের মহারানি ভিক্টোরিয়ারে মারাত্মক তেলাইয়া আর যবন-মোগলগো কিলাইয়া চিরদুখি ভারতরে উদ্ধার করার লাইগা ব্রিটিশ জাতিরে ভারতের উদ্ধারকর্তা হিসাবে ধন্যবাদ দিয়া। পুরা। মহাভারত জুইড়াই পরিষ্কারভাবে রাজা-বাদশাগো তেলাইবার কথা কওয়া হইছে। কওয়া হইছে যে রাজায় যারে কিলাইব তার লাশ পাইলেও যেন প্রজারা দুই-চাইরখান লাত্থি বসাইয়া দেয় রাজারে খুশি করার লাইগা; সেইখানে যিনি ব্রিটিশ জাতি আর রানি ভিক্টোরিয়ার চির অনুগত প্রজা কইয়া নিজের পরিচয় দেন; তার হাতে মহাভারতের কাহিনিখান কি কোনো জায়গায় এই দিক-সেই দিক হয় নাই ব্রিটিশরে তেলানোর খাতিরে?

হইলে হইতে পারে। কিন্তু বড়ো কথা হইল বাংলায় তিনার আটখান বচ্ছরের পরিশ্রমই বোধ হয় এখনো আমাগো বিস্তৃতি মহাভারত পাঠের সব থাইকা নির্ভরযোগ্য সূত্র…

০৪

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উঁচা বর্ণের ধর্মবিশ্বাসী বামুন। তিনি কৃষ্ণরে ভগবান মাইনা মহাভারতে খুঁজতে যান কৃষ্ণের তত্ত্ব-তালাশ সূত্র আর ইতিহাস। কিন্তু কৃষ্ণ সন্ধানে গিয়া তিনি উন্মুক্ত করেন মহাভারতের পরতে পরতে ভজঘটের মহাসূত্রাবলি। কবিদের উপর তিনি মহাখাপ্পা হইয়া প্রথমে শুরু করেন মহাভারত শুদ্ধি অভিযান। একটার পর একটা প্রসঙ্গ ধইরা কইতে থাকেন এইটা প্রক্ষিপ্ত ওইটা প্রক্ষিপ্ত। মানে মূল রচনায় আছিল না; পরে কেউ ঢুকাইয়া দিছে; মহাভারতরে পুরাই আউলাইয়া ফালাইছে কবিরা; এর বংশতালিকা ভুল; সংখ্যার হিসাব ভুল; পাঞ্জিপুঁথি ভুল; সেনাসৈনিক ভুল; মহাভারতের কৃষ্ণও ভুল; মানে ভগবান কৃষ্ণরে সেইখানে খুঁজতে যাওয়া একখান যাচ্ছেতাই বিষয়…

তো মহাভারতে ভগবান কৃষ্ণরে না পাইয়া নিজের ভগবানের জীবনী নিজের মতো কইরা লিখতে যাইবার আগে তিনি কর্ণরে মনোহর হিসাবে চারিত্রিক সনদপত্র দিয়া মহাভারতের যে প্রক্ষিপ্ত ঘটনার তালিকা তৈয়ার করেন সেইটা ধইরা মহাভারত এডিট করতে গেলে অবশ্য মহাভারতে সাকুল্যে। পঞ্চাশখান পৃষ্ঠা টিকব কি না আমার সন্দেহ। সেইটা যাই হউক; মহাভারত নিয়া ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে বঙ্কিমের কৃষ্ণ চরিত্র পুস্তকের বিশ্লেষণগুলা মূল্যবান জিনিস; বিশেষত মহাভারতের চুরি ধরার কৌশল বয়ান। এইটা চুরি কি না সেই বিষয়ে সন্দেহ আছে। কারণ দুনিয়ার অন্যসব জায়গায় যেখানে মাইনসে অন্যের লেখা নিজের নামে চালায়; সেইখানে উপমহাদেশে মাইনসে নিজের লেখা অন্য কোনো বিখ্যাত মাইনসের নামে চালায়। হয়ত বুইড়া মাতব্বরের সমাজে চ্যাংড়া পোলাপানগো কথায় পাত্তা না দিবার সংস্কৃতি থাইকা তরুণরা এই জিনিসটা উদ্ভাবন করছে-ব্যাটা আমার কথা যখন শুনবি না তখন তোর বাপের নামে কই…

তবে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রক্ষিপ্ত তালিকা আর প্রক্ষিপ্ত বাছাইর টেকনিক কিন্তু বিনা প্রশ্নে অনেকেই মানতে নারাজ। আবার কৃষ্ণ চরিত্র নির্মাণে মহাভারত ঘাঁটাঘাঁটিতে তিনার উদ্দেশ্যখানও খুব একটা সৎ আছিল না…

বঙ্কিমচন্দ্রের মূল খায়েশ আছিল ইংরেজগো কাছে গ্রহণযোগ্য একখান হিন্দুধর্ম নির্মাণ করার। কারণ বেদের মেয়াদোত্তীর্ণ বিধিবিধান আর শত শত পৌরাণিক কাহিনি কিংবা দেবদেবী মিল্লা যুক্তির টেবিলে হিন্দু ধর্মরে এক্কেবারে ছ্যারাবেরা কইরা থুইছে বহুকাল। তিনার বিশ্বাস আছিল ইংরেজগো কাছে যুক্তি দিয়া হিন্দু ধর্মরে গ্রহণযোগ্য কইরা তুলতে পারলে ইংরেজি শিক্ষিত কিংবা যুক্তিসঙ্গত ভারতীয়গো কাছেও হিন্দু ধর্মখান বিনা-শরমে পালনযোগ্য হইয়া উঠতে পারে। তো এই মিশনের লাইগা পয়লা তিনি নির্মাণ করলেন শ্রীকৃষ্ণের জীবনী; কৃষ্ণচরিত্র। পুরাণ আর লোক সাহিত্যের কৃষ্ণসংক্রান্ত আউলাঝড়া কাহিনিগুলারে কোথাও যুক্তি দিয়া; কোথাও গায়ের জোরে মুচড়াইয়া এবং বাইবেল থাইকা যিশু খ্রিস্টের জীবনের ছায়া-মায়া ছিটাইয়া তিনি নির্মাণ করলেন প্রায় একখান তথাকথিত ঐতিহাসিক এবং প্রায় দয়ালু এবং প্রায় একজন মাত্র নারীর স্বামী শ্রীকৃষ্ণের জীবনী…

এই কাম করতে গিয়া মহাভারতরে তিনি মোটামুটি তিনার বামুনদণ্ড দিয়া বহুত জায়গায় ধর্ষণও করছেন অবলীলায়। তবে সেই জীবনীতে কোত্থাও কৃষ্ণের কোনো ভগবানত্ব নাই; ভগবানত্ব আরোপের চেষ্টাও করেন নাই। সেইখানে তিনার মূল চেষ্টাটা আছিল কৃষ্ণের একখান ক্লিন ইমেজ তৈয়ারি করা। এমনকি রুক্মিণী ছাড়া কৃষ্ণের অন্য বৌদের ঘরের সন্তানগো কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না; এইরকম একটা আবাল যুক্তি দিয়া তিনি উপসংহার টাইনা দিলেন যে কৃষ্ণ আসলে একটার বেশি বিবাহই করেন নাই…

কোনো কোনো গবেষকে কন; সিরিয়া থাইকা আসা আভীর জাতির খ্রিস্টান মানুষ ভারতে বসতি করার পর তাগো কাছ থিকা শোনা খ্রিস্ট কথাটা লোকাল উচ্চারণে বদলাইয়া কেষ্ট হইয়া উঠছে। মানে যিশু খ্রিস্টের জীবনী থাইকা রচিত হইছে কৃষ্ণের জীবনী। ওই যুক্তিটা মিলে না। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণ চরিত্র পড়লে মনে হইতে পারে যে কৃষ্ণ আসলেই যিশুর একটা কালো পুত্তুলিকা মাত্র…

তো মনমতো কৃষ্ণ-গল্প লেখা শেষে বঙ্কিমচন্দ্র কইলেন- আমি কিন্তু কৃষ্ণরে ভগবান বইলা মানি। মানেন অসুবিধা নাই। নিজের ভগবানের জীবনী নিজে তৈয়ার করার ক্ষ্যামতা খুব কম মানুষেরই থাকে…

আমার হিসাবে বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থখান সব কিছুর পরেও কৃষ্ণ বিষয়ক একখান ভালো পুস্তক। বিশেষত যারা মথুরার কৃষ্ণ আর মহাভারতের কৃষ্ণরে আলাদা মানুষ বইলা ভাবেন তারা নিজেগো পক্ষে বহুত যুক্তি পাইবেন এই পুস্তকে…

কিন্তু পণ্ডিত যখন সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত হয় তখন তারে ভণ্ডামি না কইরা উপায় থাকে না। বঙ্কিমচন্দ্র চূড়ান্ত কিছু ভণ্ডামি কইরা বসেন কৃষ্ণচরিত্রের সিকুয়াল তার ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতায়’। এই পুস্তকটার মূল উদ্দেশ্য আছিল ইংরেজ আর ইংরেজি শিক্ষিতগো কাছে গীতার গ্রহণযোগ্য বিশ্লেষণ কিংবা টিকা তৈয়ারি…

গীতা বেদোত্তর ও বেদবিরোধী দর্শন। পৌরাণিক দেবদেবীরে সাইডলাইনে সরাইয়া আর বৈদিক ঝাপসা অচল ধর্ম দর্শনরে বাতিল কইরাই তৈয়ারি হইছে গীতার ভক্তিবাদী দর্শন…

গীতারে মহাভারতের কুরুযুদ্ধ চ্যাপ্টারে ঢুকাইয়া কৃষ্ণ-অর্জুনের ডায়লগ আকারে উপস্থাপন করায় প্রাথমিকভাবে এইটা হত্যার দর্শন মনে হইলেও এর মূলমন্ত্র কিন্তু ভক্তিবাদ; যেই জিনিসটা বেদে আছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত…

গীতার ভক্তিবাদের যুক্তিগুলা তৈয়ারি হইছে আত্ম-জন্মান্তরবাদ-কর্মফল আর চতুবর্ণ প্রথার ঘাড়ে ভর কইরা। আত্ম-জন্মান্তরবাদ-কর্মফল আর চতুর্বর্ণ প্রথার প্রেক্ষাপট মাথায় না রাইখা গীতা পড়তে গেলে আসলে কোনো মানেই খাড়ায় না পুস্তকটার…

তো ধার্মিকেরা যখন গীতার ব্যাখ্যা বা টিকা লিখছেন তখন তারা সকলেই আত্ম-জন্মান্তর এইসবে বিশ্বাস রাইখা সেই প্রেক্ষাপটে বিশ্বাসীগো লাইগা কথা কইছেন। মানে ধর্মের প্রেক্ষাপটে ধর্মের ব্যাখ্যা; পৌরাণিক প্রেক্ষাপটে পুরাণের বিশ্লেষণ…

কিন্তু ইংরেজগো ব্যাখ্যায় গীতা পড়া চূড়ান্ত মূর্খতা ঘোষণা কইরা বঙ্কিমচন্দ্র কাইল্লা ইংরেজগো লাইগা যেই গীতাখান রচনা করছেন; সেইখানে তিনি ধর্মের প্রেক্ষাপটে ধর্মরে উপস্থাপন না কইরা আত্ম-জন্মান্তরবাদ-কর্মফল এইগুলার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-প্রমাণ দিবার একখান বেহুদা চেষ্টা চালাইছেন। বহুত বাণী কপচাইছেন চুতর্বর্ণ প্রথা আর বিধবা নারীগো প্রতি ঘিন্নারে সামাজিক বিজ্ঞানের সূত্র দিয়া যুক্তিযুক্ত করার…

ধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হয় মূর্খত না হয় ভণ্ডামি। বঙ্কিমচন্দ্র মূর্খ আছিলেন না। তিনি জাইনা বুইঝাই আত্মা আর জন্মান্তরবাদের বৈজ্ঞানিকতা প্রমাণের ভণ্ডামিটা করেন; সমাজবিজ্ঞান কপচাইয়া চতুবর্ণপ্রথা আর বিধবা-ঘিন্নারে জায়েজ করার নোংরামিটা করেন…

কৃষ্ণচরিত্র রচনার স্টাইলে গীতায়ও তিনি যেইসব শ্লোকের শেষ পর্যন্ত কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেন না; সেইগুলারে গায়ের জোরে প্রক্ষিপ্ত কইয়া ফালাইয়া দেন…

বৌদ্ধ ধর্মরে ছ্যা ছ্যা দূর দূর করলেও বঙ্কিমের কৃষ্ণভক্তির ফর্মুলাটা প্রায় বৌদ্ধদের নির্বাণ-সূত্রেরই কাছাকাছি। মানে অর্জুনরে তিনি কৃষ্ণের উপদেশের ব্যাখ্যা দিয়া প্রায় বৌদ্ধ শমন পর্যায়ে নিয়া যান। পাশাপাশি তার কৃষ্ণের ভিতর থাইকা যেমন নাজারতের ক্ষমাশীল যিশু উঁকি মারেন তেমনি তার গীতার পাতা ফুইড়া মাঝে মাঝেই উঁকি মারে বাইবেলীয় রোমান সুসমাচার…

কৃষ্ণ বিষয়ে যাগো অধিক আগ্রহ আছে আমি তাগোরে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর ‘মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ’ বইখান পড়তে সুপারিশ করি। অসাধারণ একটা পুস্তক। নৃসিংহপ্রসাদ কৃষ্ণ বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন সুকুমারী ভট্টাচার্যের সুপারভিশনে। কিন্তু সুকুমারী যেমন ঠনঠন কইরা হাড্ডি বাজাইয়া কৃষ্ণরে বিশ্লেষণ করেন; নৃসিংহপ্রসাদ সেইপথ নেন না। আবার বঙ্কিমের পূর্ব নির্ধারিত ভগবান বিশ্লেষণের পথেও যান না…

নৃসিংহপ্রসাদের বইটার ধরন বইয়ের ভূমিকায় তারই দুইটা মন্তব্য থাইকা দারুণভাবে পাওয়া যায়; যার একটা হইল- জীবনকালেই কৃষ্ণরে বহুবিধ কারণে অভিযুক্ত করা হইছে বহুবার; মহাভারতেও হইছে; মহাভারতের বাইরেও হইছে। সুতরাং সেইগুলা কৃষ্ণপুরাণেরই অংশ; বেহুদা যুক্তি দিয়া সেইগুলা খণ্ডণ করতে যাওয়া কোনো কামের কথা না…

আর দ্বিতীয় কথাটা হইল- ভগবত্তা দিয়া কৃষ্ণের সামাজিক কলঙ্কমোচনের গুরুদায়িত্ব আমার নাই; এমনকি কৃষ্ণ কোন কাজ সঠিক না বেঠিক করছেন সেইটা বিচারের দায়িত্বও নাই…

এই বইটা কৃষ্ণের রাজনৈতিক জীবনের বই; কোন প্রেক্ষাপট আর কোন পরিস্থিতির ফলাফলে এক সাধারণ তরুণ ভারতকর্তা হইয়া উঠে তার বিবরণ। তার লগে কৃষ্ণ বিষয়ক বিখ্যাত সব রচনার অসাধারণ লিটারেচার রিভিউ; খণ্ডণ-সমর্থন দুইটাই। কৃষ্ণ বিষয়ক অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনাগুলার রিভিউ পড়ার লাইগা এই বইটার কোনো তুলনা নাই। বঙ্কিমের কৃষ্ণ চরিত্রের একটা বিশাল রিভিউও আছে এই বইটাতে…

নৃসিংহপ্রসাদ রাধার কৃষ্ণ আর মহাভারতের কৃষ্ণরে একই মানুষ বইলা মনে করেন; যেইটার লগে আমার দ্বিমত থাকলেও তিনার যুক্তিগুলারে ফুৎকার দিয়া ফালাইয়া দিবার সুযোগ নাই…

তবে নৃসিংহপ্রসাদ কিন্তু নৃতাত্ত্বিক গবেষক না। পৌরাণিক গবেষক। তিনি পুরাণের সূত্র দিয়াই পৌরাণিক চরিত্রগুলারে মূর্তিমান করেন। সেইটা করতে গিয়া তিনি বস্তুবাদী বহুত জিনিস বাদ দিয়া যান। যেইটা তার গবেষণার ধরনের লাইগা গুরুত্বপূর্ণও…

এই বইটা কৃষ্ণরে নিয়া হইলেও একই সাথে বইটা কিন্তু একটা ‘ভরত পুরাণ’। মানে ভরত থাইকা ভারতবর্ষের সূচনার যে পৌরাণিক কাহিনি; তার একটা অসাধারণ রূপরেখা আছে বইটায়…

একটা বিশাল বংশধারা বর্ণনা করছেন তিনি এই পুস্তকে। কেমনে তখনকার ভারতবর্ষের প্রায় সব রাজারা ভরতের বংশধর হইল সেইটা। তার সূত্রগুলা বিভিন্ন পুরাণ থাইকা নেওয়া। কিন্তু একটা জিনিস তিনি ছাইড়া গেছেন; হয়ত সচেতনভাবেই। সেইটা হইল সব ভরদ্বাজি বামুন কিংবা পরশুরামি বামুন যে রক্ত সম্পর্কিত না; বরং ভরদ্বাজ কিংবা পরশুরামের ইস্কুলে পড়ার কারণে অনাত্মীয় হইয়াও সকলেই ভরদ্বাজ কিংবা পরশুরাম বইলা পরিচিত; সেইটা বেদে আর পুরাণে আছে বইলাই নৃসিংহপ্রসাদ উল্লেখ করলেও তিনি কিন্তু পাশ কাটাইয়া যান ক্ষত্রিয়গো বংশ তালিকার ফাঁক…

ভরত থাইকা ভারতবর্ষের সব বড়ো গোষ্ঠীর উৎপত্তি এইটাতে যতটা না ভরত বংশের কৃতিত্ব তার থাইক কিন্তু বেশি কৃতিত্ব পুরাণ লেখক বামুন আর যারা নিজেগো ভরতের বংশধর বইলা দাবি করছেন তাদের…

ঘটনাটা হইল সেইকালে সকল অখ্যাত আর নতুন রাজারাই কিন্তু নিজেরে প্রতিষ্ঠিত বংশের মানুষ প্রমাণ করার লাইগা বামুনগো পয়সা দিয়া পুরাণের নতুন নতুন ভার্সন লেখাইতেন। কেউ কেউ নতুন নতুন কাহিনি তৈয়ারি করতেন। আর সকল পুরাণের লেখকই কিন্তু পেশাদার। সেইসব পেইড বামুনগো কাম আছিল একটাই; সেইটা হইল প্রচলিত ভরত পুরাণ টাইনা একটা লতা ধইরা। সেইখানে নতুন রাজারে প্রক্ষিপ্ত কইরা দেখাইয়া দেওয়া যে এই রাজা নতুন হইলেও কিন্তু সেই মহান ভরতবংশের উত্তরাধিকার…

এইটা এক্কেবারে পয়সা নিয়া ভার্জিলের ইনিড লেখার মতো। যেইখানে তিনি অজ্ঞাত অক্টাভিওনরে ইনিয়াসের বংশধর বানাইবার লাইগা মহাকাব্যখান লেখছিলেন…

তো শেষ পর্যন্ত যে বিপত্তিটা খাড়ায় সেইটা হইল এইসব পুরাণ এক জায়গায় জড়ো কইরা দেখলে দেখা যায় যে ভারতে আসলে ভরতের বংশধর ছাড়া গনবার মতো কোনো মানুষ নাই। নৃসিংহপ্রসাদের মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ বইটার দ্বিতীয় অধ্যায় কিন্তু সেই পৌরাণিক। ভরতবংশ বর্ণনা; যেইটা নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস দিয়া যাচাই করলে বহুকিছুই প্রশ্নবোধক হইয়া পড়বে। এই কথাটা নৃসিংহপ্রসাদের সবগুলা বইর বেলাতেই ঠিক। তবে এইটাও ঠিক যে তিনি নৃতাত্ত্বিক না; পৌরাণিক গবেষক। তার বইগুলা পৌরাণিক ইতিহাস না; বরং ইতিহাসের পুরাণ…

০৫

বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণ চরিত্র পুস্তকে মহাভারত বিশ্লেষণের কিছু সূত্র দিলেও তিনার উদ্দেশ্যখান সৎ আছিল না দেইখা শেষ পর্যন্ত তিনার সূত্র দিয়া মহাভারতের কোনটা আদি ভার্সন আর কোনটা প্রক্ষিপ্ত সেইটা বিচার করতে যাওয়া বেকুবি। তিনি আসলে তিনার মনমতো কৃষ্ণ চরিত্র আবিষ্কার করার লাইগাই মহাভারত ঘাঁটাইছেন…

তবে মহাভারতের মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একখান প্রায় আদি বৈশম্পায়নী ভার্সন আছে এখন। সম্পূর্ণ বিতর্কহীন না হইলেও এইটা দিয়া ২৪ হাজার শ্লোকের মহাভারতের বৈশম্পায়নী ভার্সন ‘বিজয়’ বা ‘ভারত’ এর একটা চিত্র পাওয়া সম্ভব। আর একেবারে আদি দ্বৈপায়নী ভার্সন ‘জয়’ আছিল আরো ছোট; মোটামুটি নয় হাজার শ্লোকের…

মহাভারতের এই ভার্সনটা বাইর করছে পুনার ভাণ্ডারকর গবেষণা কেন্দ্র। মহাভারত সংশোধন সমিতি নামে একটা গ্রুপ গবেষণার পর মোট ২২ খণ্ডের পয়লা খণ্ড বাইর করে ১৯৩৩ সালে। ড. বিষ্ণু সুথংকর আছিলেন দলনেতা। তিনি মারা যান ৪৩ সালে। মারা যাবার আগে পর্যন্ত বেশ কয়েকটা খণ্ড বাইর হয়। তিনার পর এই টিম লিড দেন ড. কৃষ্ণপদ ভেলকর। ড. ভেলকরের নেতৃত্বে সর্বশেষ খণ্ড বাইর হয় ১৯৬৬ সালে। শেষ খণ্ড প্রকাশের আগেই ড. ভেলকর মারা যান। তবে তিনি মারা যাবার আগেই মহাভারতের উপাঙ্গ ‘হরিবংশ’ যেইটারে মহাভারতের অংশ বইলা কেউই মানে না; সেইটা ছাড়া বাকি সবটার মূল পাঠ উদ্ধার হইয়া যায়…

বর্তমানে প্রচলিত ১ লাখের বেশি শ্লোকের মহাভারত থাইকা ২৪ হাজার শ্লোকের ভার্সন উদ্ধার করতে ভাণ্ডারকর যে ২২ খণ্ড পুস্তক বাইর করছে সেইখানে যেইসব শ্লোক বাদ দেওয়া হইছে সেইগুলার প্রতিটা ধইরা ধইরা বিশ্লেষণ করা হইছে। কেন বাদ দেওয়া হইছে; কোন প্রদেশের কোন ভার্সনে কোনটা আছে আর কোন ভার্সনে কোনটা নাই; তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে। আর সেইটা কইরা তারা ২৪ হাজার শ্লোকের আদি ব্যাখ্যা আর যুক্তিসহ বৈশম্পায়নী ভার্সনখান চিহ্নিত করছেন…

এইটার একটা বাংলা অনুবাদও আছে। শিশির কুমার সেন নামে এক রিটায়ার্ড বিচারপতি সেইটা করছেন ১৯৯০ সালের দিকে। তবে নেহাৎ গবেষণার দরকার না পড়লে ওইটা কাউরে পড়তে সুপারিশ করি না আমি। কারণ ওইটা মহাভারতের সাহিত্য না; নৃতত্ত্ব। সাহিত্য মহাভারতের ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুর কথাখানই সবথিকা দামি; সেইটা হইল- বহু হাত পার হইয়া আমাগো কাছে এখন যে পুস্তকখান আছে সেইটাই পূর্ণ সাহিত্য মহাভারত; বাকিগুলা গবেষণার উপাদান…

০৬

বর্তমান যুগে বাংলায় মহাভারত নিয়া কথা কইতে গেলে চাইরজন মানুষ সম্পর্কে আলাদাভাবে না কইলে মহাভারতমূর্খ কইতে হয় নিজেরে। তার পয়লাজন উপেন্দ্রকিশোর রায় দ্বিতীয়জন রাজশেখর বসু তৃতীয়জন বুদ্ধদেব বসু আর চতুর্থজন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী…

উপেন্দ্রকিশোর যেখানে ছোটবেলায় মহাভারত পড়তে আগ্রহ তৈরি করেন; রাজশেখর বসু সেইখানে বড়ো হইবার পর মহাভারত বুঝাইয়া দেন। নির্লিপ্তভাবে পক্ষপাতহীন সাবলীল ভাষায় তিনি পুরা মহাভারতের মূল গল্পগুলা বর্ণনা কইরা যান। কোনো কিছু যোগও করেন না; কোনো কিছু বাদও দেন না নিজের থাইকা। নিরপেক্ষ থাইকা সংক্ষেপে খালি বুঝাইয়া দেন। আমি কই; কারো মহাভারতপাঠ শুরু কিংবা শেষ হওয়া উচিত না রাজশেখর বসুর মহাভারত বাদ দিয়া…

তুলনামূলক সাহিত্যের বিচারে কেউ মহাভারত দেখতে চাইলে তার লাইগা সেরা পুস্তক বুদ্ধদেব বসুর ‘মহাভারতের কথা’। সাহিত্যের চোখ দিয়াই সাহিত্য বিশ্লেষণ। দুনিয়ার সেরা সাহিত্যকর্মগুলার সাথে এক টেবিলে ফালায়া মহাভারতের আলাপ। কোনটা প্রক্ষিপ্ত আর কোনটা আদি; কোনটা ইতিহাস আর কোনটা রূপকথা সেইসব খটখটানি বাদ দিয়া আমাগো হাতে বর্তমানে যা আছে সেইটাই পূর্ণাঙ্গ ‘সাহিত্য মহাভারত’; আর আলোচনা সেইটারে নিয়াই…

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বাইর কইরা আনেন মহাভারতের চরিত্রগুলারে। একেকটা চরিত্রই যেন একেকটা মহাকাব্য। তা হোক মহাভারতের নায়ক আর হোক প্রতিনায়ক কিংবা প্রবীণ কিংবা নারী কিংবা কৃষ্ণ। মহাভারতের মানুষগুলারে তিনি জীবন্ত কইরা তোলেন মহাকাব্যিক অসংগতিগুলা সংশোধন কইরা। আমার মনে হয় তিনি বিশ্বাস করেন যে মহাভারতখান একক কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের লেখা। দ্বৈপায়নের সবকিছুরে যেমন তিনি যুক্তি দিয়া প্রতিষ্ঠা করেন তেমনি দ্বৈপায়নের নামে চলা সবগুলা লেখারেও প্রমাণ করতে চান আদি ও অকৃত্রিম দ্বৈপায়নেরই অবদান কইয়া…

তিনি সংস্কৃত সাহিত্যের পণ্ডিত লোক হইলে হইতে পারে সংস্কৃত তর্কশাস্ত্রের নিয়মনীতিগুলা তিনি মাইনা চলেন। যেইখানে বেদ নিয়া তর্ক হয় আগে বেদ বিশ্বাস কইরা; বিশ্লেষণ কিংবা শ্লোকের পক্ষে যুক্তি পরিষ্কার করার লাইগা। কিন্তু কোনোভাবেই কোনো চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ নাই সেইটা মাইনা নিয়া। তিনি সেই স্টাইলেই মূলত মহাভারতে গাওয়া দ্বৈপায়নের সবকিছুরে জাস্টিফাইড করতে চান যুক্তি দিয়া। বহুত দুর্বল যুক্তিও দেন; কিন্তু দুর্বল যুক্তিরেও কেমনে আকর্ষণীয় কইরা কইতে হয় সেইটা একই সাথে সংস্কৃত আর বাংলার পণ্ডিত এই মানুষটা মারাত্মক ভালোভাবে জানেন…

মহাভারতের চরিত্রগুলারে আধা পুরাণ আর আধা বাস্তবের আবহে রক্তমাংস নিয়া চিনবার লাইগা নৃসিংহপ্রসাদের কাজগুলার থাইকা ভালো কাজ আছে কি না আমার জানা নাই…

মহাভারত সম্পর্কিত একটা বই নিয়া বহুত আলোচনা শোনার পরও প্রায় দুই যুগ ধইরা মহাভারত ঘাঁটাঘাঁটির সময়কালে সেই বইটা সংগ্রহ কইরা দেখতে পারি নাই; বইটা হইল প্রতিভা বসুর ‘মহাভারতের মহারণ্যে’। এই বইটা পড়তে না পারার আফসুস জানাইয়াই আমি অভাজনের মহাভারত বইখান পয়লা প্রকাশ করছিলাম…

কিন্তু অভাজনের মহাভারত প্রকাশ হইবার এক বছর পর সেই বইটা পইড়া মনে হইল মহাভারতের মহারণ্যে বইটা না পড়াই মঙ্গল হইছে আমার। কারণ ওইটারে মহাভারত সংক্রান্ত পুস্তক না কইয়া দ্বৈপায়ন- বিদুর আর যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন বলাই বোধহয় সব থিকা ভালো। যদিও বিদুর যে মূলত একখান ভিলেন চরিত্র সেইটা খিটখিট করতে করতে তিনি বহুত ভালো কইরাই দেখাইয়া দিছেন…

কিন্তু আগাগোড়া অবৈধ সন্তান-অবৈধ সন্তান কইয়া খিটখিট করা এই লেখক সম্পূর্ণ এড়াইয়া গেছেন যে মহাভারতের কালে কোনো মানুষের জন্মই অবৈধ হিসাবে গণ্য হইত না। মহাভারতে বহুত আদিমতা থাকলেও যেকোনোভাবে যেকোনো মনুষ্য জন্মরে স্বাগত জানাইবার মতো উদারতাখান আছিল তাদের। মনুষ্যজন্মরে অবৈধ বলার সংস্কৃতিটা মূলত যিশুপুরাণ প্রভাবিত ইউরোপিয়ান সভ্যতার দান…

আর সেই ইউরোপিয়ান সভ্যতার বর্ণবাদী চশমা দিয়া প্রতিভা বসু মহাভারতের দিকে তাকান বইলাই সারা মহাভারতে তিনি খালি অসভ্য কালা মানুষ আর অবৈধ সন্তানদের আবিষ্কার করেন…

মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু নাই; এই কথাখান দুনিয়ার প্রাচীন সাহিত্যগুলার মাঝে একমাত্র মহাভারতেই উচ্চারিত হইছে; জিনিসটা চোখেও পড়ে না প্রতিভা বসুর। তিনার মহাভারতের মহারণ্য একখানা কুৎসিত পুস্তক। মহাভারত সম্পর্কে এত বর্ণবাদী কোনো পুস্তক আমি এর আগে আর পড়ি নাই…

০৭

ইন্দোনেশিয়ার পুরা সংস্কৃতি মহাভারতীয়; বহুত কাহিনি-উপকাহিনি আছে মহাভারতের। কিন্তু আমি কোনো ইন্দোনেশিয়ান অখণ্ড মহাভারতের সন্ধান পাই নাই। সম্রাট আকবরও নাকি ফারসি ভাষায় মহাভারতের একখান অনুবাদ করাইছিলেন; সেইটার কোনো আলোচনা-বিশ্লেষণ সংগ্রহ করার সুযোগ হয় নাই আমার…

ভারতীয় ভাষার বাইরেও মহাভারতের বিস্তার বহু। এশিয়ার বহু জায়গায় এর কাহিনি পাওয়া যায়। ইংরেজিতে আছে এর ভুরি ভুরি ভার্সন আর বিশ্লেষণ। ইংরেজিগুলা মূলত দুই ধরনের লোকজনের কাম; পয়লা দল হইলেন ভারতীয়; যারা এইখানকার কোনো আখ্যান ইংরেজিতে অনুবাদ করছেন আর দ্বিতীয় দল হইল অভারতীয়; যারা নিজেরাই নিজের বুঝ থাইকা লিখছেন মহাভারতের ঘটনা কিংবা কাহিনি কিংবা বিশ্লেষণ। এর মাঝে সব থিকা উল্লেখযোগ্য হইল আশির দশকে পিটার ব্রুকের রচনা ও পরিচালনায় ৯ ঘণ্টা দীর্ঘ ইংরেজি মঞ্চনাটক; যেইটারে তিনি পরে ৬ ঘণ্টার টিভি সিরিজ আর ৩ ঘণ্টার চলচ্চিত্র বানান। এইটারে নিয়া বহুত সমালোচনা থাকলেও আমার মনে হয় দুইটা জিনিস তিনি খুব ভালো কইরা করছেন; পয়লাটা হইল মহাভারতের অলৌকিক ঘটনাগুলার মানবিক চেহারাদান আর মহাভারতখানরে মানবজাতির রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশ হিসাবে দেখা…

তবে ইংরেজি লেখাগুলায় বহুত উল্টাসিধা আছে তথ্য বানান আর উচ্চারণের ঝামেলায়। তারা কৃষ্ণ আর কৃষ্ণা একই বানানে পড়তে আর লিখতে গিয়া মাঝে মাঝে দ্রৌপদী আর যাদব কৃষ্ণের মাঝে যেমন গুলাইয়া ফেলায় তেমনি ইংরেজি ওয়াই বর্ণ দিয়া যাদব বানানের লগে যবন বানান মিলাইয়া কইয়া দেয় হইলে হইতে পারে কৃষ্ণ মূলত যবন; মানে গ্রিক বংশজাত। আবার কেউ কেউ রামায়ণের কুম্ভকর্ণের লগে মহাভারতের কর্ণরে মিলাইয়া কিছু আজাইরা হাইপোথিসিসও খাড়া কইরা দেয়…

মহাভারত নিয়া বাংলায় কবিতা বেশুমার। নৃতাত্ত্বিক গবেষণাও বেশুমার। সেইগুলা পড়তে যারা আগ্রহী তারা আগ্রহমতে উঁকি দিয়া দেখতে পারেন…

মহাভারতের কৃষ্ণসহ বাকি নায়কদের নিয়া যেইখানে প্রচুর ধর্মকাহিনি আছে; সেইখানে মহাভারতের প্রতিনায়ক কর্ণ দুর্যোধন আর অন্যদের নিয়া আছে অসংখ্য নাটক আখ্যান আর উপন্যাস। সব থিকা বেশি নাটক আর সিনেমা হইছে কর্ণরে নিয়া। এইটার একটা অর্থ হইতে পারে যে ধার্মিকেরা যাগোরে ফালাইয়া দিছে পাপী কইয়া; সংস্কৃতিকর্মীরা তাগোরেই কুড়াইয়া নিছে মানবিক মানুষ কইয়া। তয় সব থাইকা বেশি ছোটদের কমিক বই কিন্তু আছে ভীমেরে নিয়া; ধর্মে-অধর্মে কামে আকামে ভীমের থাইকা জনপ্রিয় বোধ হয় কোনো পৌরাণিক চরিত্র নাই…

মহাভারত নিয়া ইন্টারনেটনির্ভর তরুণগো কাজকর্ম বিস্ময়কর রকমের বিশাল। মহাভারতের চাইর পাঁচটা সম্পূর্ণ বাংলা এবং ইংরেজি ভার্সন অন্তত এখন ইন্টারনেটে মাগনায় গুতা মারলে পাওয়া যায়; পিডিএফও আছে আবার টেক্সটও আছে। কেউ কেউ ছোট ছোট খণ্ডে নিজেদের ব্লগে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে তার পছন্দমতো কোনো এক ভার্সন। এইটা মোটেই সোজা কাম না কারণ মহাভারতের মানুষ জায়গা আর জিনিসপত্রের নামগুলা এতই অপ্রচলিত যে প্রতিটা বানান পুস্তক দেইখা দেইখা টাইপ কইরা তিন-চাইরবার প্রুফ না দেখলে ভুল হইবার ভয় নিরানব্বই ভাগ।

অথচ ইন্টারনেটের ভার্সনগুলা ছাপা ভার্সন থাইকা বেশি নিখুঁত। এর বাইরে আছে মহাভারত সম্পর্কিত লাখে লাখে তথ্য বিশ্লেষণ আর আলোচনা; যার পুরাটাই মহাভারত ভালো লাগা থাইকা এই যুগের তরুণগো বেগার খাটনির ফসল; বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যারা নিজেদের নামটাও লুকাইয়া রাখে। এই তরুণগো লাইগা মহাভারতীয় কায়দায় আমার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম। কারণ এদের অবদানগুলা সহজলভ্য না হইলে মহাভারত নিয়া অত প্যাচাল পাড়ার ক্ষমতা হইত না আমার…

তো এই বিষয়ে কথা শেষ করি রবীন্দ্রনাথের উপর কবিগিরি কইরা। তিনি মহাভারত সম্পর্কে কইছেন- ইহা কোনো ব্যক্তিবিশেষের রচিত ইতিহাস নয়; ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস…

হ। কথা প্রায় সত্য। তয় ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস নহে; ইহা বহু জাতির রচিত ঘাপলা ইতিহাস…

০৮

মহাভারতের কুরুযুদ্ধরে গীতার উৎপত্তিস্থল হিসাবে বিশ্বাস করা হয়। আত্মীয়স্বজন আর গুরুজনের বিপক্ষে অস্ত্র চালাইতে বিমুখ অর্জুনরে দায়িত্ব পালন আর কর্মফলের হিসাব-নিকাশ বুঝাইবার লাইগা কৃষ্ণ যে কথা যুক্তি আর উপদেশগুলা শোনান; দাবি করা হয় সেইগুলাই হইল গীতার মূলসূত্র। কিন্তু মূলত মহাভারতের লগে গীতার কোনো সম্পর্ক নাই। কুরুযুদ্ধ শেষে সম্রাট হইবার পর যুধিষ্ঠির কিন্তু কৃষ্ণরে খেদাইয়া দেয়। হস্তিনাপুর থাইকা নির্বাসিত হইবার পর বিষণ্ণ কৃষ্ণের জীবনে সামরিক আর কূটনৈতিক অধ্যায় শেষ হইয়া শুরু হয় এক লোক-দার্শনিকতার অধ্যায়। সেই সময়েই উৎপত্তি হয় গীতার…

মহাভারত আছিল বৈদিক ঘরানার উপাখ্যান আর গীতা হইল বেদবিরোধী ঘরানার দর্শন। পরবর্তীকালে গীতাবাদী দর্শনরে ভিত্তি কইরা বৈষ্ণব ধর্ম তৈয়ারি হইবার পর সমস্ত বেদের বৈষ্ণবায়ন ঘটাইবার কালে মহাভারত এডিট কইরা গীতাখান ঢুকাইয়া দেওয়া হয় গীতা দর্শনের প্রধান প্রতিপক্ষ দ্বৈপায়নের রচনা মহাভারতের ভিতর…

গীতা আমি সম্পূর্ণ বাদ দিয়া গেছি আমার গল্প থাইকা। আমি আমার গল্পটারে কইছি সম্পূর্ণ অলৌকিকত্ব বাদ দিয়া। রক্তমাংসের মানুষের গল্প। কৃষ্ণরে আবিষ্কার করতে চাইছি একজন কূটনীতিবিদ এবং যুদ্ধকলা বিশারদ হিসাবে। খণ্ড খণ্ড গোত্রপ্রধানগো শাসনের যুগে প্রথম সাম্রাজ্য চিন্তা আর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার নায়ক হিসাবেই কৃষ্ণ আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। একইসাথে দ্বারকায় রাজতন্ত্র উচ্ছেদ কইরা অভিজাততন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার এক্সপেরিমেন্টখানাও রাজনীতি বিদ্যার ইতিহাসে আমার লাইগা আকর্ষণীয়। ব্যস এই হইল আমার কৃষ্ণ; রক্তমাংসের এক বুদ্ধিমান মানুষ…

আমি ইতিহাস আর নৃতত্ত্বের বইগুলা ঘাঁইটা চেষ্টা করছি রক্তমাংসের ঘটনাগুলা বাইর কইরা আনার। যেইখানে বইপুস্তক থাইকা নৃতাত্ত্বিক কিংবা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাই নাই সেইখানে নিজেই কিছু লৌকিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাইছি নিজের মতো করে মানে নিজেই মহাভারতের একজন কবি হইয়া গেছি…

০৯

যত দিন ধইরাই লেখা হউক আর যত মাইনসেই কাহিনি যোগ করুক না ক্যান; মহাভারতের কাহিনিখান এখনো প্রচারিত আছে একক মানুষ বেদব্যাস কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের নামে; এবং মহাভারতের প্রধানতম ভজঘট হইলেন স্বয়ং এই বেদব্যাস কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। তো এই কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের একখান কাব্যিক বর্ণনা দিছেন রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় তার অন্নদামঙ্গলের পাতায়: “দাঁড়াইলে জটাভার
চরণে লুটায় তাঁর
কক্ষলোমে আচ্ছাদয়ে হাঁটু
পাকা গোপ পাকা দাড়ি
পায়ে পড়ে দিলে ছাড়ি
চলেন কতক আঁটুবাঁটু”

কক্ষলোম মানে বগলের লোম। বগলের লোমে নাকি দ্বৈপায়নের হাঁটুগুলাও ঢাইকা গেছিল। বুইঝেন কিন্তু; কবিরা স্বাধীনতা পাইলে পদ্য মিলাইবার লাইগা কত দূর পর্যন্ত যাইতে পারে। মাইনসের বগলের লোমে নাকি হাঁটু পর্যন্ত ঢাইকা যায়; কহিছেন রায়গুণাকর…

তো এমন মইনসের চুল আর দাড়িগোঁফ দিয়া যে রাস্তা মাপার আমিনগো গজফিতা বানানো যাইব সেইটা তো স্বাভাবিক কথা। এইখানে কিন্তু যুক্তি বিজ্ঞান; আর ইতিহাস পুরা অচল। মহাকবি নামে পরিচিত কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন নিজেই হাজার বছর ধইরা শত শত কবির রচনায় স্বয়ং একখান মহাকাব্যে পরিণত হইছেন। তার জীবনী পড়লে মনে হইব চুলদাড়ি জটাজুট নিয়া তিনি যেই জন্মাইছিলেন। তারপর খালি হাঁটতেই আছেন তো হাঁটতেই আছেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি বেদমন্ত্রগুলারে চাইরভাগে ভাগ করেন; রচনা করেন বেদের ব্যাখ্যা বেদান্ত; রচনা করেন আঠারোখান পুরাণ আর আঠারোখান উপপুরাণ এবং সর্বশেষ রচনা করেন একখান মহাভারত। তার নামে একখান রামায়ণেরও অস্তিত্ব আছে। যদিও হিসাবে নিকাশে গবেষণায় তার নামে প্রচলিত সব কর্ম নিয়াই আছে লাখে লাখে প্রশ্ন। যার মইদ্যে প্রধানতম প্রশ্ন হইল তার নামে প্রচলিত বেশির ভাগ পুস্তকই স্বাভাবিক নিয়মে তিনি মইরা যাইবার পরের রচনা…

মাইমল কন্যা সত্যবতীর গর্ভে ব্রাহ্মণ পরাশরের ঔরসে জন্ম নেওয়া এই দ্বৈপায়ন শুকদেব- ধৃতরাষ্ট্র- পাণ্ডু ও বিদুরের পিতা আর মহাভারত কাহিনির একখান চরিত্র…

গায়ের কালা রঙের কারণে কৃষ্ণ আর দ্বীপ বা চরে জন্ম নিবার কারণে দ্বৈপায়নের পাশাপাশি মুখে মুখে আউলাঝাউলা হইয়া ছড়ানো বেদমন্ত্রগুলারে তিনি বিষয়ভিত্তিক চাইরভাগে ভাগ করেন বইলা তার সম্মানজনক নাম বেদব্যাস মানে বেদের ভাগকর্তা… বেদের পাঠ যাতে নির্ভুল হয় সেজন্য তিনি বেদরে ভাগবাটোয়ারা করার পর চাইর শিষ্য; পৈল বৈশম্পায়ন- সুমন্ত আর জৈমিনি; প্রত্যেকরে একখণ্ড কইরা আর পুত্র শুকদেবেরে মুখস্থ করাইছিলেন একসাথে চাইর খণ্ড বেদ; যাতে শুকদেবের পাঠের লগে অন্যগো পাঠ মিলাইয়া সঠিক পাঠখান পাওয়া যায়…

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী আরেক ধাপ আগাইয়া গিয়া কন-দীর্ঘ দিন থাইকা শূদ্র আর নারীগো বেদপাঠ বিষয়ে যে নিষেধাজ্ঞা আছিল তা তিনি উঠাইয়া দিয়া সকলের লাইগা বেদ উন্মুক্তও কইরা দেন।

দ্বৈপায়ন সম্পর্কে তার আরো তিনটা আবিষ্কার বড়োই ভক্তিমূলক। তিনি কন দুনিয়াতে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে দ্বৈপায়নই প্রথম উদ্যোক্তা; এক জায়গায় বেশি দিন থাকলে বনের ক্ষতি হয় এবং বনের পশুপাখি ধ্বংস হয় বইলা বনবাসকালে তিনি পাণ্ডবগো ঘন ঘন বন বদলাইতে পরামর্শ দিছেন। দ্বিতীয়ত দুনিয়াতে তিনিই পয়লা যুদ্ধকালীন নিয়মকানুন নির্ধারণ করেন। আর দুনিয়াতে যুদ্ধ সাংবাদিকতা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিকের অবাধ অধিকার তিনিই পয়লা চালু করেন। সেই হিসাবে সঞ্জয় হইল দুনিয়ার পয়লা পেশাদার সাংবাদিক…

তো এই দ্বৈপায়ন ব্যাসরে তার মা সত্যবতী ডাইকা আনছিলেন মৃত সৎ ভাই বিচিত্রবীর্যের বৌদের গর্ভে সন্তান জন্ম দিতে। মায়ের বিবাহ রাজবাড়িতে হইলেও মা না ডাকা পর্যন্ত জীবনেও তিনি রাজবাড়ি আসেন নাই। মহাভারতের শেষ দিকে ভীষ্মের বয়ানে তখনকার যে সংস্কৃতি পাওয়া যায়; সেই সূত্রে তিনি মায়ের বিবাহকারণে মায়ের স্বামী রাজা শান্তনুর পোলা আর উত্তরাধিকার হইবার কথা। কিন্তু নিজে তিনি ঋষি মানুষ; নিয়ম মানেন না বরং নিয়ম বানান। তাই মায়ের বিবাহ রাজা শান্তনুর লগে হইলেও তিনি যেমন রাজবাড়িতে যান না; তেমনি নিজেরেও পরিচয় দেন না শান্তনুপুত্র কিংবা শান্তনুর উত্তরাধিকার হিসাবে; বরং নিজেরে তিনি পরিচয় করান নিজের নামে দ্বৈপায়ন কইয়া; এমনকি তার পিতা পরাশর খান্দানি বশিষ্ঠ গোত্রের বামুন হইলেও দ্বৈপায়নরে একবারের লাইগাও নিজেরে বাশিষ্ঠ কইয়া পরিচয় দিতে দেখা যায় নাই…

পয়লা দিকে হরিভক্ত এবং শেষ দিকে হরভক্ত এই স্বনামখ্যাত ঋষি টোল চালাইয়া বইপুস্তক লেইখা ঘুইরা বেড়াইবার পরেও আছিলেন বহুত সংসারী মানুষ। জঙ্গল জীবনেই অস্থায়ী বৌ ঘৃতাচীর গর্ভে তার আছিল এক পোলা; শুকদেব। যিনি পরে হইয়া উঠেন চতুর্বেদী ঋষি। কিন্তু এই শুকদেব যখন সন্ন্যাসী হইয়া গেলো; কাব্যমতে বৃদ্ধ বাপের কান্দনে জঙ্গলের গাছ কাইপা উঠলেও শুকদেব ফিরল না; তখন অন্যের খোপে পাইড়া যাওয়া ডিম ফুইটা যে তিনটা বাচ্চা হইছিল তার; তাগো কাছেই বিনা নিমন্ত্রণে বারবার ছুঁইটা গেছেন ব্যাস দ্বৈপায়ন। বড়ো পোলা ধৃতরাষ্ট্রটা আন্ধা আর লোভী; মাঝে মাঝেই মহাভারতে দেখি পোলারে আইসা বোঝান পিতা দ্বৈপায়ন। মাইজা পোলা পাণ্ডুটা অসুস্থ আর আঁটকুড়া; কিন্তু ক্ষেত্ৰজের যুগে যখন নির্বাসনে যুধিষ্ঠির জন্মাইল পুত্রবধূ কুন্তীর গর্ভে রাজবাড়িতে পরবর্তী উত্তরাধিকার জন্মাইবার সংবাদটাও পৌঁছাইয়া দিলেন দ্বৈপায়ন; যাতে তখনো অপুত্রক ধৃতরাষ্ট্র পরে কোনো বাগড়া না দেয় পোলাপাইনগো মাঝে যুধিষ্ঠিরের বড়োত্ব নিয়া। গান্ধারীর গর্ভসংকট? সেইখানেও দ্বৈপায়ন…

পাণ্ডু অকালে মইরা গেলেও রাজবাড়িতে তার পাঁচ পোলা নিশ্চিন্ত আছিল ভীষ্মের ছায়ায়। কিন্তু যখন জতুগৃহ পুড়াইয়া তারা পলাইল? তখন এই পাঁচ নাতির আক্ষরিক অর্থেই অভিভাবক আবার দ্বৈপায়ন। বুদ্ধি দেওয়া; নিজে হাত ধইরা ছদ্মবেশ পরাইয়া নিজের শিষ্যের বাড়িতে রাখা আর নিজে পুরোহিত হইয়া পাঁচ নাতিরে দ্রুপদের মাইয়ার লগে বিবাহ দিয়া আবারো শক্তিশালী করা…

তার ছোট পোলা বিদুর; বিচিত্রবীর্যের দাসীর গর্ভে জন্মাইছিল বইলা রাজবংশে উত্তরাধিকার পায় নাই। কিন্তু দ্বৈপায়ন যেমন বিদুরের মায়ের দাসত্ব মুক্ত কইরা দেন তেমনি ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডুর ক্ষেত্রে যেখানে কন তারা অম্বিকা আর অম্বালিকার পোলা; সেইখানে বিদুরের ক্ষেত্রে কন- আমার সন্তান।

আবার পুত্রহীন বিদুর মরার কালে তার শেষকৃত্যের লাইগা সম্রাটরেও মনে করাইয়া দেন- তুমি কিন্তু বিদুরেরই অংশ যুধিষ্ঠির। তার এই কথার সূত্র ধইরা অনেকে কন: যুধিষ্ঠির যে মূলত বিদুরের ঔরসজাত সেই বিষয়ে স্বয়ং দ্বৈপায়নই বইলা রাইখা গেছেন…

সবখানেই মহাভারতের লেখক দ্বৈপায়ন মহাভারতের সক্রিয় চরিত্র হইয়া মারাত্মক প্রকট; এমনকি কুরুযুদ্ধেও দেখি তিনি ঋষির গাম্ভীর্য নিয়া খাড়াইয়া দেখতে আছেন নিজের বংশনাশ…

কাব্যকাহিনি মতে ইনি নিজে কলম দিয়া লিখতেন না। লেখাইতেন গণেশরে দিয়া। কিন্তু নৃতত্ত্বমতে আর্যঘরানার মানুষগুলা আছিল অকাট নিরক্ষর; লেখাপড়া জানতই না তারা। লেখাপড়া জানত এই অঞ্চলের আদিবাসী মানুষ; মানে খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০ থাইকা খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ পর্যন্ত চলা সিন্ধু সভ্যতার মানুষ; যার মইদ্যে আছিল বিনায়ক বা গণেশ; যাগোরে আর্যঘরানার প্রাচীন সাহিত্যে রাক্ষস আর সিদ্ধিনাশক কইয়া বহুত গালাগালি করা হইছে। গণেশ নাকি তাগো সব সিদ্ধি নাশ কইরা দিত। কিন্তু বচ্ছরের পর বছর মাইনসের মুখে মুখে ঘুইরা যখন মহাভারত পাল্টাইয়া যাইতে শুরু করল; তখন তারা ভাইবা দেখল যে এইটারে লেইখা বান্ধাইয়া না থুইলে মাইনসে নতুন নতুন ভার্সন বানাইতেই থাকব দিনের পর দিন। আর সেই উদ্দেশ্যে তারা গিয়া গণেশরে শুরু করে তেলানি-মোগো পুস্তকখান লেইখা দেও মাস্টর…

কিন্তু গণেশ মাস্টার কি আর সহজে রাজি হয়? রাজি হয় না সে। তারপর আর্যরা তারে লোভায় সিদ্ধিনাশক থাইকা তোমারে সিদ্ধিদাতার পদে প্রমোশন দিমু মাস্টর; পুস্তকে তোমারে সম্ভ্রান্ত বংশজাত দেবতা কইয়া নমো নমো কইরা সকল দেবতার আগে করব তোমার পূজা…

বহুত তেলানোয় গণেশ রাজি হয় আর আমরা বিশ্বাসী মহাভারতে দেখি দ্বৈপায়ন মুখে মুখে শোলক বইলা যাইতাছেন আর শিবনন্দন গণেশ তা লিখতাছেন একটার পর একটা; যদিও গণেশের নামে যত কাহিনি আছে তার অর্ধেক কাহিনিতেও শিব-পার্বতীর লগে গণেশের কোনো সম্পর্ক নাই…

এইখানে একটা কথা কইয়া যাওয়া দরকার তা হইল আর্য কিন্তু কোনো জাতি আছিল না; আছিল একটা ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ। এই আর্যগোষ্ঠীর মইদ্যে বহুজাতির মানুষ যেমন আছিল; তেমনি অসুর নামে পরিচিতরাও কিন্তু আর্য। শুরুতে বোধ হয় দেবতা আর অসুরে কোনো ফারাকও আছিল না। প্রাচীন সাহিত্যে প্রায় সব দেবতারেই যেমন কোনো না কোনো সময় অসুর কওয়া হইছে তেমনি অন্যদেরও কওয়া হইছে আর্য…

যাই হউক; আমার হিসাবে কয় মহাভারত গ্রন্থখানও সত্যবতীপুত্র এবং শুকদেব- ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডু বিদুরের পিতা বেদব্যাস কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের লেখা না। এইটা হইতে পারে না। হইতে পারে এইটা বেদব্যাস কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের মা এবং তার বংশের কাহিনি কিন্তু কোনোভাবেই তার লেখা না। কারণ মহাভারতমতে ব্যাস জীবিত আছিলেন জন্মেজয়ের সময়। জন্মেজয়ের লাইগাই তিনি স্লিম সাইজের ‘জয়’ নামে মহাভারতের আদিপুস্তক রচনা কইরা শিষ্য বৈশম্পায়নরে পাঠান জন্মেজয়রে তা শুনাইয়া আসতে। জন্মেজয় হইল দ্বৈপায়নের নাতির নাতি পরীক্ষিতের পোলা। তো জন্মেজয়ের সময় পর্যন্ত কর্মক্ষম অবস্থায় বাঁচতে হইলে দ্বৈপায়নের কর্মজীবী বয়স হইতে হয় কমপক্ষে দেড়শো বছরের বেশি। এইরকম দীর্ঘ কর্মজীবী বয়স তখনই সম্ভব যখন বহুত প্রজন্ম মানুষের কাহিনি এক মানুষের নামে চালাইয়া দেওয়া হয়; অথবা এক মানুষের জীবনী কয়েকশো প্রজন্মের মানুষ লেখে; অথবা বয়সটা যখন ধর্মবিশ্বাস দিয়া মাপা হয়; অথবা যখন মাইনসের বয়স গুনার দায়িত্বখান কবিদের হাতে পড়ে তখন। কিন্তু ইতিহাস আর বিজ্ঞানমতে মানুষ বর্তমানে যতটা দীর্ঘজীবী; ইতিহাসের কোনো কালেই তার থিকা বেশি আছিল না কোনো দিন; বরং বহুত সংক্ষিপ্ত আছিল পুরানা মানুষের জীবনী আর সক্ষমতার কাল…

এই ক্ষেত্রে মহাভারতের বয়ানকার উগ্রশ্রবা সৌতির কথাখান ধরলে কিছু ভরসা পাওয়া যায় কয়েকজন কবি এই ইতিহাস পূর্বে বলে গেছেন। শুধু দরকার তার বাক্যের দুইটা শব্দ ‘ব্যাসপ্রোক্ত মহাভারতকথা’ কথাটারে বদলাইয়া যদি কওয়া হয় ‘ব্যাসের জীবনী মহাভারত কথা’ তাইলেই ধইরা নেওয়া যায় ব্যাসের বংশে ঘটা ঘটনা আগেও বহু কবি বইলা গেছেন; যা জন্মেজয় শুনছেন অন্য কোনো ব্যাসের কাছে আর শুনছেন সৌতিও…

সুকুমারী ভট্টাচার্যের হিসাবে বেদ এবং পুরাণের লগে বেদব্যাস দ্বৈপায়নের কোনো সম্পর্ক থাকারই কথা না। দ্বৈপায়নের নামে যতগুলা রচনা প্রচলিত আছে সেইগুলার তালিকা দিয়া সুকুমারী ভট্টাচার্য কন; যদি একজন মানুষরে এই সবগুলা পুস্তক রচনার কাম করতে হয়; তাইলে তার বাইচা থাকতে হবে কমপক্ষে আড়াই হাজার বছর। তাই ব্যাস মূলত একখান ‘সংজ্ঞা মাত্র’ কইয়া দ্বৈপায়ন সম্পর্কে ভারতীয় পুরাণের সবথিকা গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিটা তুইলা ধরেন সুকুমারী- ‘ব্যাসের মৃত্যুর কথা শাস্ত্রে লেখে না…’

১০

কুরুযুদ্ধখান পুরাটাই রিটায়ার যাইবার বয়সী বুইড়াদের যুদ্ধ। কুরুযুদ্ধের সময় অত কারিশমার মহানায়ক অর্জুনের বয়স গল্পের খাতিরে মেকাপ-গেটাপ দিয়া কমাইতে কমাইতেও ৫৭ বছরের থাইকা কমানো সম্ভব হয় নাই আমার যেইটা আবার একটু মেকাপ উঠাইয়া দিলে গিয়া খাড়ায় ৮০’র উপরে। অর্জুন থাইকা ভীম এক বছরে বড়ো; তার থিকা এক বছরে বড়ো যুধিষ্ঠির আর অর্জুনের এক বছর কইরা ছোট হইল যমজ নকুল সহদেব। কর্ণ যুধিষ্ঠির থাইকা কমপক্ষে চাইর বছর বড়ো; দুর্যোধন ভীমের সমবয়সী এবং কৃষ্ণের বয়স অর্জুন আর ভীমের মাঝামাঝি; কয়েক মাস এদিক-সেদিক…

কুরুযুদ্ধের সময় যাতে অন্তত অর্জুনের গায়ে তির-ধনুক চালাইবার তাকত রাখা যায় তার লাইগা আমি যুদ্ধের সময় ৫৭ বছর হিসাব ধইরা আগাইছি। কিন্তু তাতে আবার ঝামেলা বাঁইধা গেছে অন্যখানে। এই হিসাবে আগাইলে স্বয়ংবরার সময় দ্রৌপদীর বয়স গিয়া খাড়ায় মাত্র ৪ বচ্ছর বুইঝেন কিন্তু। তো কেমনে আমি কুরুযুদ্ধে তিরাতিরির লাইগা অর্জুনের বয়স ৫৭-তে আটকাইয়া দিছি এইবার সেই হিসাবটা কই…

মহাভারতমতে পাণ্ডু মরার পর পোলাগো নিয়া কুন্তী যখন হস্তিনাপুর আইসা খাড়ায় তখন যুধিষ্ঠিরের বয়স ১৬। তারপরে মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের বয়স পাই যখন যুবরাজ হিসাবে তার অভিষেক হয়; তখন সে ২৪। এক বচ্ছর যুবরাজগিরি কইরা বারণাবতে যাইবার সময় তার বয়স খাড়ায় ২৫। সময় উল্লেখ না থাকলেও বারণাবতে তারা কিন্তু বহু দিন বসবাস করে। ধরি কমপক্ষে ১ বছর। সেই হিসাবে জতুগৃহ পুড়াইয়া পাণ্ডবরা যখন হিড়িম্বের দেশে আসে তখন যুধিষ্ঠির ২৬। এইখানে হিড়িম্বার লগে ভীমের বিবাহ আর পোলা ঘটোৎকচের জন্ম হয়। এইখানে আড়েগড়ে আরো ১ বছর ধরলে জ্যাঠা যুধিষ্ঠির গিয়া খাড়ায় ২৭…

ঘটার জন্মের পর কুন্তী তার পোলাগো নিয়া মৎস্য কীচক ত্রিগর্ত আর পাঞ্চাল দেশ ঘুইরা একচক্রা নগরে আইসা বসবাস করে। ভীমেরে বক রাক্ষস মারতে পাঠাইবার আগে কুন্তী জানায় বহুকাল তারা এইখানে বসবাস করছে। বহুকাল মানে কতকাল জানি না কিন্তু বারণাবত থাইকা পাঞ্চালীর স্বয়ংবরা পর্যন্ত কমপক্ষে এক বছর ধরাই লাগে। কারণ মৎস্য দেশ মানে রাজস্থানের জয়পুর আর ড. অতুল সুর কন একচক্রা হইল বীরভূম। এই দীর্ঘ মানচিত্র হাঁটাহাঁটি কইরা পার হইতে ঘোড়ারও তো কমপক্ষে এক বচ্ছর লাগার কথা। তো যাই হোক; নায়কগো বয়স যখন কমাইতে বসছি তখন কমাইয়াই ধরলাম এক বচ্ছর। তার মানে দ্রৌপদীর স্বয়ংবরার সময় যুধিষ্ঠিরের বয়স ২৮ আর। অর্জুনের বয়স ২৬। এই পর্যন্ত নায়কেরা তরতাজাই আছে। তো আসেন এইবার বসি দ্রুপদের মাইয়া দ্রৌপদীর কুষ্ঠী গনায়…

দ্রুপদ মিয়া মাইয়ার বাপ হইল কবে? মহাভারত কয় দ্রুপদের মাইয়া হইছে দ্রোণ শিষ্যগো কাছে তার পরাজয় আর অর্ধেক রাজ্য হারাইবার পর। সেই ঘটনা ঘটে যুধিষ্ঠির যুবরাজ হইবার এক বছর আগে; মানে যুধিষ্ঠির তখন ২৩ আর অর্জুন ২১। তার এক বছর পর যখন অর্জুনের বয়স ২২ তখন ধৃষ্টদ্যুম্নের লগে যমজ হিসাবে জন্মায় দ্রুপদের মাইয়া দ্রৌপদী। এই হিসাবে দ্রৌপদী অর্জুন থাইকা কমপক্ষে ২২ বছরের ছোট আর বিয়ার সময় ৪ বছরের শিশু…

কিন্তু মহাভারতে কোথাও স্বয়ংবরার সময় দ্রৌপদীরে শিশু হিসাবে পাওয়া যায় নাই; তারে যুবতিই কওয়া হইছে। অবশ্য সেই যুগে ঋতু শুরু হইলেই মাইয়াগো যুবতি বইলা ধরা হইত। সেই হিসাবে স্বয়ংবরার সময় দ্রৌপদীর কমপক্ষে ১১-১২ বছর বয়স হইতেই হয়। আবার নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বাপের বাড়িতে দ্রৌপদীর যে বিদ্যাশিক্ষার ব্যাপ্তি আর বিবরণ দিছেন তাতে তার বয়স আরো বাইড়া কমপক্ষে গিয়া খাড়ায় ১৬-১৭। কিন্তু দ্রৌপদীর বয়স বাড়াইলে তো অৰ্জুনেরও বয়স বাড়ে। স্বয়ংবরায় দ্রৌপদীর বয়স ১১ ধরলে অর্জুনের হয় ৩৩ আর কুরুযুদ্ধের সময় গিয়া খাড়ায় ৬৪; মানে লাঠি ভর দিয়া হাঁটার বয়স। আর বিয়ার সময় দ্রৌপদীর বয়স আরো বাড়াইলে অর্জুনের বয়স কই গিয়া খাড়ায় তা নিজেরা হিসাব কইরা দেখেন…

স্বয়ংবরায় দ্রৌপদীরে যুবতি ধইরা নিতে হইলে পাণ্ডবগো বয়স আরো বাড়াইতে হয়; না হয় ধইরা নিতে হয় দ্রোণশিষ্য কুরু-পাণ্ডবগো হাতে রাজ্য হারাইয়া দ্রুপদের যজ্ঞমজ্ঞের ঘটনা হইল ভুয়া জোড়াতালি। মূলত দ্রুপদ যখন কুরু-পাণ্ডবগো হাতে ধরা খায় তখনো তার পোলা-মাইয়া বেশ বড়োসড়ো আছিল। কেউ কেউ কন কুরুযুদ্ধে ব্রাহ্মণ দ্রোণের মরার কাহিনি জায়েজ করার লাইগা পরবর্তীতে বামুন লেখকেরা দ্রুপদরে দিয়া যজ্ঞমজ্ঞ করাইছেন; যাতে তার পোলা ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে দ্রোণ মরায় পাণ্ডবরা যেন ব্রাহ্মণহত্যার পাপে পাপিষ্ঠ না হয়; আবার পরবর্তীতেও কেউ যেন বামুনের দিকে অস্ত্র তোলার সাহস না করে। কারণ মহাভারতসূত্রমতে ব্রাহ্মণ হত্যা মানে পুরা গোষ্ঠীর নরকযাত্রা; একমাত্র দ্রুপদের পোলা ধৃষ্টদ্যুম্ন ব্যতিক্রম; কারণ যজ্ঞ থাইকা সে ব্রাহ্মণ মারার অনুমতিপত্র নিয়া জন্মাইছে…

তবে নকুল সহদেবের লগে দ্রৌপদী যেভাবে মায়ের মতো আচরণ করে; যেভাবে অর্জুন আর কৃষ্ণের লগে সমবয়সীর মতো বইসা আড্ডাটাড্ডা মারে আর দ্রৌপদীর যমজ ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন যেভাবে ভীমেরে পর্যন্ত নাম ধইরা তুমিতামি কইরা কথাবার্তা কয় তাতে মনে হয় দ্রৌপদী বরং অর্জুনের থাইকা বয়সে বড়োই…

এইবার আগাই কুরুযুদ্ধকালে পাণ্ডবগো বয়সের দিকে। বিয়ার কমপক্ষে ১ বছর পর যুধিষ্ঠির রাজা হয় ২৯ বছর বয়সে। তারপর ১৬ বছর রাজাগিরি কইরা শকুনির লগে পাশা খেইলা যখন নেংটি পর্যন্ত হারায় তখন তার বয়স ৪৫। তারপরে ১২ বছর বনবাস ১ বছর অজ্ঞাত বাস আর ১ বচ্ছর যুদ্ধের প্রস্তুতি। কয় বছর হইল? যুধিষ্ঠির ৫৯ আর অর্জুন ৫৭…

বয়স নিয়া আর বেশি কথা কমু না। তয় খালি কইয়া দেই যে অর্জুনের বয়স বাড়লে কিন্তু কর্ণের বাড়ে কমপক্ষে ৬ বছর; অশ্বত্থামার বাড়ে ৮-১০ বছর; অশ্বত্থামার বাপ দ্রোণেরও বয়স বাড়ে; আর সবচে বেশি বাড়ে সর্বপ্রধান মহানায়ক ভীষ্মের বয়স। ভীষ্ম হইলেন অর্জুনরে বাপ পাণ্ডুর বাপ বিচিত্রবীর্য থাইকা কমপক্ষে ৩০ বছরের বড়ো; দ্বৈপায়নের মা সত্যবতীর বয়সের কাছাকাছি; সেই হিসাবে কুরুযুদ্ধের সময় ইনার বয়স ব্যাটারি খুইলাও ক্যালকুলেটারে তিন ডিজিটের নিচে আনা অসম্ভব…

১১

কুরুযুদ্ধের একটা বিশাল অংশ জুইড়া আছে লোহার অস্ত্রপাতি; অথচ মহাভারতের ঘটনার সময় পর্যন্ত দুনিয়াতে লোহাই আবিষ্কার হয় নাই। অবশ্য তামা আবিষ্কার হইছে আরো বহু আগে; খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে চাইর হাজার বছরে। ড. অতুল সুর কন তখনকার দিনে বর্তমান বাংলা অঞ্চলে আছিল তামার খনি আর ব্যাপারীরা সেইসব খনিজদ্রব্য আর সামগ্রী চালান দিত সিন্ধু সভ্যতায়। আর্যগোষ্ঠী সিন্ধুসভ্যতা তছনছ কইরা দিলেও হইলে হইতে পারে তামার যাতায়াত বাংলা থাইকা তখনো কুরুক্ষেত্র অঞ্চলে আছিল। কিন্তু মহাভারতের কোনো অস্ত্রপাতিতে তামার উল্লেখ নাই। মহাভারতে একবার তামার কথা আছে দ্রৌপদীর এক হাঁড়ির বেলায়; যা তারে পুরোহিত ধৌম্য দিছিলেন। ঘটোৎকচের বেলায় কওয়া হইছে সে পরতো কাসার বর্ম আর অনুমান করা যায় কর্ণের অভেদ্য বর্মখানও আছিল তামা কিংবা কাসার তৈয়ারি। কারণ দ্রৌপদীর হাঁড়ি আর কর্ণের বর্ম; দুইটার বেলাতেই সূর্যের একটা কইরা কাহিনি যুক্ত আছে। হইলে হইতে পারে মাটির বাসনের যুগে তামার একমাত্র হাঁড়িতে সূর্যের আলো পইড়া ঝিকমিক করত বইলা এর নাম সূর্যদত্ত হাঁড়ি আর পশুর চামড়া-টামড়া দিয়া বর্ম বান্ধনের যুগে কর্ণের তামা বা কাসার বর্মেও রোদ পইড়া ঝকমক করত দেইখা তারে কওয়া হইত সূর্যপ্রদত্ত বর্ম…

তামার অস্ত্র না থাকলে পুরা মহাভারতে আর কোনো ধাতুর অস্ত্র থাকবার কথাও না। হিসাব মতে ওই সময়ে সব লড়াই আছিল হাতে গদায় লাঠিতে বর্শায়। এমনকি তিরের বিষয়েও অনেকে সন্দেহ করেন। কিন্তু তির বাদ দিয়া মহাভারত কেমনে কয়?

হড় কিংবা সাঁওতাল জাতিতে তিরের ব্যবহার অন্য বহুত জাতির থাইকা আগে। ড. অতুল সুর পাঞ্চাল রাজ্যের বর্ণনা দিতে গিয়া কন এইটা বর্তমান বীরভূম জেলা আর সাঁওতাল পরগনার কাছাকাছি; এই পাঞ্চাল এলাকাটাই দ্রোণের জন্মস্থান। হইলে হইতে পারে আদিবাসীগো কাছ থিকা শিখে দ্রোণই তির-ধনুক রপ্তানি করছেন হস্তিনাপুরে তার শিষ্যগো মাঝে। পঞ্চমবর্ণের নিষাদেরা তির চালাইতে জানত না দেইখা নিষাদপুত্র একলব্য লুকাইয়া লুকাইয়া দূর থাইকা দ্রোণের তিরাতিরি দেইখা তির-ধনুক চালানো শিখে। অন্য কোথাও তির শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে নিশ্চয়ই এতটা কষ্ট করত না সে…

মহাভারতে প্রথম জেনারেশনে যত তিরন্দাজ দেখি তারা কোনো না কোনোভাবে দ্রোণের শিষ্য; অর্জুন-কর্ণ- সাত্যকি- জয়দ্রথ- অশ্বত্থামা- ধৃষ্টদ্যুম্ন- শিখণ্ডী সবাই। কিন্তু এইখানে প্রশ্ন আইসা যায় তাইলে ভীষ্ম কেমনে তির চালান? তিনি তো আর দ্রোণের শিষ্য না। আমার উত্তর হইল ভীষ্ম মানুষ আছিলেন নাকি সেনাপতি পদের নাম আছিল ভীষ্ম সেইটা কেউ খুঁইজা দিতে পারলে কুরুযুদ্ধের সময় তার তিন ডিজিট বয়সী হাতে খালি তির কেন; আমি কামানও ধরাইয়া দিতে পারি। দেবতাগো রাজার পদের নাম যেমন আছিল ইন্দ্র; আমার ধারণা কৌরবগো প্রধান সেনাপতি পদের নামও তেমনি আছিল ভীষ্ম; মানে ভীষণ; মানে জাদরেল; মানে জেনারেল; মানে কমান্ডার…

কর্ণ তিরাতিরি লাইগা বিখ্যাত হইলেও সে কিন্তু অন্য ধরনের হাতিয়ার জাতীয় অস্ত্রই বেশি চালায়। বর্শা-ভল্ল- খড়গ- গদা আর ভার্গবাস্ত্র। ভার্গবাস্ত্র মানে ভৃগু বংশজাত পরশুরামের কাছ থিকা পাওয়া অস্ত্র। সোজা বাংলায় কুড়াল। কুড়াল বাদ দিয়া বাকি অস্ত্রগুলা ভীমেও চালায়। কর্ণের মল্লযুদ্ধের কাহিনিও পাওয়া যায় জরাসন্ধের লগে…

আমি যদি কই যে তখন তির-ধনুকের প্রচলনই হয় নাই তয় পাব্লিকে আমারে কিলাইব। কারণ তাইলে দুই মহানায়ক কর্ণ আর অর্জুনরে কুরুযুদ্ধের সাইড লাইনে বসাইয়া আঙ্গুল চুষাইতে হইব যুদ্ধের আঠারো দিন। কিন্তু তারপরেও কই; তির-ধনুকের যুদ্ধে অত আজাইরা কথাবার্তা কওয়ার সুযোগ কই? যেমনে তারা গালাগালি দিয়া লড়াই শুরু করে; নিজের লম্বা পরিচয় দেয়; আবার পেন্নাম-টেন্নামও করে; তির-ধনুকের নাগালের বাইরে অত দূর থাইকা অত খাজুইরা আলাপ যেমন সম্ভব না; তেমনি তিরাতিরি হইব কিন্তু একটা পাব্লিকেরও চোখে তির গাঁথব না এইটা কীভাবে সম্ভব? কুরুযুদ্ধে তির খাইয়া কিন্তু কারো চোখ নষ্ট হইবার কোনো কাহিনি নাই; অথচ ধুলাবালি থাইকা বেশি ছুটানো হইছে তির…

কৃষ্ণের চক্ৰখানের হিসাব মিলাইতে পারি নাই। সুবর্ণচক্রের বাইরেও কৃষ্ণ একবার যেমন রথের চাকা খুইলা ভীষ্মরে দাবড়ানি দেয়; ঠিক একইভাবে তার শিষ্য আর ভাগিনা অভিমন্যুও কিন্তু রথের চাকা নিয়া কৌরবগো দাবড়ায়। এতে কৃষ্ণ ঘরানায় চাকাজাতীয় অস্ত্রে সাবলীলতা বোঝা যায়। কিন্তু সুবর্ণচক্ৰখান এক্কেবারে চাকতি জাতীয় কিছু হইলে খুব ভালো অস্ত্র হইবার কথা না জুইতমতো ধরার জায়গার অভাবে। চক্ৰখান কিন্তু সে ছুঁইড়া শত্রুরে আঘাত করে…

আইচ্ছা কৃষ্ণের চক্র কি বুমেরাং-জাতীয় কিছু? যা চক্কর দিয়া মাইরা আবার চক্কর দিয়া ফিরা আসে দেইখা চক্র? নাকি আইজ পর্যন্ত শিখগো মাঝে প্রচলিত চক্রমই হইল কৃষ্ণের চক্র?

কৃষ্ণের চক্র যদি শিখগো চক্রমের মতো কিছু হইয়া থাকে তবে সেইটা দিয়া শিশুপালের মাথা কাটা সম্ভব হইলেও যুদ্ধের মাঠে সেইটা দিয়া খুব বেশি সুবিধা আদায় করা আদৌ সম্ভব কি না সন্দেহের বিষয়…

অবশ্য কৃষ্ণর কি আদৌ অস্ত্র হাতে সামনা সামনি যুদ্ধ করার কোনো ইতিহাস আছে? আমার তো মনে হয় না…

১২

মহাভারতমতে যাদব আর পাণ্ডব বংশ দুইটা শুরু হইছে ভৃগুমুনির পুত্র শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী এবং তার সতিন; রাজা বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠার গর্ভ থাইকা; রাজা যযাতির ঔরসে। দেবযানী গর্ভজাত রাজা যযাতির বড়ো পোলা যদু থাইকা যাদব বংশ যার শেষ মাথায় পাই কৃষ্ণরে। শর্মিষ্ঠাগর্ভজাত যযাতির ছোট পোলা পুরু থাইকা পয়লা পুরু বংশ তার পর কুরু বংশ তারপর পাণ্ডব বংশ; যার শেষ মাথায় পাই পঞ্চপাণ্ডব। তো শর্মিষ্ঠার পোলা পুরু থাইকা আগাইলে দেখা যায় যে ২৪ নম্বর প্রজন্মে আছে যুধিষ্ঠির; যা ভৃগু থাইকা গুনলে হয় ২৬…

অন্য দিকে ঋষি অঙ্গিরার বংশধররাও মহাভারতে আছে। যার শেষ মাথায় যুধিষ্ঠির থাইকা কয়েক বছরে বড়ো অশ্বত্থামারে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু অশ্বত্থামা অঙ্গিরার মাত্র ৫ নম্বর প্রজন্ম। অথচ ঋষি অঙ্গিরা আর ভৃগুমুনি যেমন আছিলেন সমবয়সী তেমনি অঙ্গিরাপুত্র বৃহস্পতি আর ভৃগুপুত্র শুক্রাচার্যও আছিলেন সমবয়সী সতীর্থ। তো একই টাইমলাইনে যেইখানে অঙ্গিরা বংশ মাত্র ৫ প্রজন্ম গিয়া থামে সেইখানে ভৃগুর পোলা শুক্রাচার্যের মাইয়ার সতিনের বংশ কেমনে ২৬ পর্যন্ত পৌঁছাইয়া যায়? অথচ ভৃগুমুনির আরেক পোলা ঋচীকের বংশও কিন্তু অত উর্বর না। ঋচীকের পোলার ঘরের নাতি পরশুরাম হইলেন মুনি ভৃগু থাইকা চতুর্থ প্রজন্ম; যা অঙ্গিরার চতুর্থ প্রজন্ম দ্রোণাচার্যের লগে মিলে যায়; পরশুরাম দ্রোণের বয়সে বড়ো এবং গুরু; কিন্তু দুইজনই অঙ্গিরা এবং ভৃগুর চতুর্থ প্রজন্ম…

এইখানে প্রজন্মের ইতিহাস না খুঁইজা বরং মহাভারত সম্পাদনার ইতিহাসের দিকেই নজর দেওয়া ভালো। কওয়া হয় মহাভারত সবচে বেশি এডিট হইছে ভার্গব ব্রাহ্মণগো হাতে। ভার্গব ব্রাহ্মণ মানে ভৃগুমুনির বংশধর। এই এডিটের মূল উদ্দেশ্য আছিল মহাভারতের মহাক্ষেত্রে নিজেগো প্রতিষ্ঠা করা। এইটার পিছনে অবশ্য আরো পুরানা একখান ইতিহাস আছে…

বর্তমান তাজাকিস্তানের পশুরজন অঞ্চলের মানুষগুলারে আর্যরা সেনাপতি ইন্দ্রের নেতৃত্বে ভিটামাটি থাইকা পিটাইয়া খেদাইয়া দেয়। পশুরজনের এই পলানো মানুষগুলা পরবর্তীকালে পরিচিত হয় পারস্য- পারসিক বা পার্সিয়ান নামে…

ইন্দ্রের দলের আর্যরা নিজেগো কইত দেবতা। এককালের সেনাপতি ইন্দ্র পরবর্তী কালে পরিণত হন দেবরাজ ইন্দ্র নামে। অন্য দিকে ভূমি থাইকা উচ্ছেদ হওয়া পার্সিয়ানগো স্পিতামা গোত্রের মানুষ হইলেন মুনি ভৃগু। এই মানুষগুলা জীবনেও নিজেগোভিটা হারানোর ইতিহাস ভুলতে পারে নাই। বলা হয় দেবরাজ ইন্দ্রের নামের লগে যত চুরি-চামারির কাহিনি আছে সব এই পার্সিয়ান গোত্রেরই সংযোজন। এমনকি দীপাবলির রাইতে যে বাত্তি জ্বালানো হয় তাও নাকি প্রচলন হইছে ইন্দ্র যাতে বলির পশু চুরি করতে না পারে তার লাইগা। মানে ইন্দ্ৰ পুরাই একটা চোর বদমাশ লম্পট…

এই গোত্রের ভার্গব বংশে বহু বড়ো মানুষও জন্মাইছেন। চ্যাবন- শুক্র-জমদগ্নি-পরশুরাম- মনু বাল্মিকী; সবাই এই বংশের। ভৃগুমুনির পোলাগো মইদ্যে চ্যাবন ভেষজ-বিদ্যার বিশেষজ্ঞ তো শুক্র। আছিলেন যুদ্ধ বিশারদ আর শল্যবিদ্যার বিশেষজ্ঞ। অঙ্গিরা বংশ সর্বদাই ইন্দ্রের দলে থাকত বইলা ভৃগুপুত্র শুক্রাচার্য সব সময় থাকতেন অপজিশন; মানে অসুর-রাক্ষস আর দানবগো লগে। একলার বুদ্ধি আর কৌশলেই তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলারে টিকাইয়া রাখতেন দেবতাগো আক্রমণের মুখে। তিনি নিজে ব্রাহ্মণ হইয়া; সংহিতামতে নিষিদ্ধ হইবার পরেও নিজের মাইয়া দেবযানীর বিবাহ দেন ক্ষত্রিয় রাজা বৃষপর্বার লগে। এই পার্সিয়ান স্পিতামা গোত্রের অন্য ধারায় আরেকজন বিখ্যাত মানুষ হইলেন পার্সিয়ান ধর্মের প্রবর্তক জরথুস্ট…

ভূমি হারানো এই মানুষগুলাই যুগের পর যুগ ধইরা ইন্দ্র আর অঙ্গিরা বংশরে ধরা খাওয়ানোর লাইগা কাঞ্চি চালাইছে পুঁথিপুস্তকের পাতায়। আর একই লগে মহাভারতের যাদব-পাণ্ডব দুই বংশরেই নিজেগো পকেটে ঢুকাইতে গিয়া প্রজন্ম গণনা আর বংশলতিকায় পাকাইয়া ফালাইছে বিশাল ভজঘট। যদু থাইকা যাদব বংশ এবং কৃষ্ণ পর্যন্ত আসতেও বহুত গোঁজামিল দিছে তারা…

মহাভারতে কিছু মাইনসের কোনো নাম নাই। গান্ধার রাজের মাইয়া বইলা ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধারী; তার আর কোনো নাম নাই। তেমনি নাম নাই নকুল সহদেবের মা মাদ্রীর। দেশের নামেই তাগোরে ডাকা হইছে আজীবন। দ্রৌপদীরে দেশের নামে পাঞ্চালী আর বাপের নামে দ্রৌপদী ডাকা হইলেও তার মূল নাম কৃষ্ণা পাওয়া যায়। আবার কিছু মানুষের নাম পুরাই বিকৃত কইরা দেওয়া হইছে। যেমন শকুনি-দুঃশাসন- দুর্যোধন। দুর্যোধনের মূল নাম আছিল সূর্যোধন; সেইটা পাওয়া গেলেও ধৃতরাষ্ট্রের বেশিরভাগ পোলাগো মূল নাম মোটেই উদ্ধার করা সম্ভব না মহাভারত থাইকা। পাণ্ডবপক্ষের ভক্তরা পুরাই খাইয়া ফালাইছে তাগোরে। তবে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিবার কারণেই বোধ হয় ধৃতরাষ্ট্রের দাসীগর্ভজাত পোলার নামখান বেশ নাদুসনুদুসই আছে- যুযুৎসু…

এর বাইরে কিছু মাইনসেরে ডাকা হইছে জাতিবাচক নামে; যেমন হিড়িম্ব- হিড়িম্বা। হিড়িম্ব-হিড়িম্বা শুনলে কেমন জানি হড় জাতির লগে একটা মিল পাওয়া যায়। সাঁওতালরা নিজেগো জাতেরে কয় হড় জাতি। আর একইসাথে যখন ড. অতুল সুর কন সাঁওতাল পরগনার পাশে বীরভূমে আছিল হিড়িম্বার বাস আর এখনো সেইখানে আছে ঘটোৎকচের পোলার রাজ্যের চিহ্ন পাণ্ডুরাজার ঢিবি; তখন মনে হয় ঘটোৎকচের মা হিড়িম্বা মূলত আছিল সাঁওতাল বংশজাত নারী…

১৩

কুরুযুদ্ধে নাকি অংশ নিছিল ১৮ অক্ষৌহিণী সৈনিক; যাগো লগে হাতিঘোড়াও আছে আরো আছে জোগানদার কবিরাজ দাসদাসী বাদ্যকার বাবুর্চি পশুরাখাল দোকানদার এমনকি বেশ্যাও। তো ১৮ অক্ষৌহিণীরে বর্তমান সংখ্যা দিয়া কনভার্ট করলে খাড়ায় ৪৭ লক্ষ চব্বিশ হাজারের মতো। এর সাথে অন্য লোকজন যোগ দিলে পুরা যুদ্ধে বলতে হয় আছিল ৫০-৫৫ লক্ষ লোক; এবং তারা নাকি যুদ্ধ করছে একটা মাঠেই…

দুনিয়াতে সেই যুগে অর্ধকোটি মানুষ খাড়াইবার মতো কোনো মাঠ আছিল কি না আমার জানা নাই। তার উপ্রে আবার সেই মাঠে ছুটছে ঘোড়া; দাবড়াইছে হাতি; উড়ছে তির। মানে মানুষগুলার মাঝখানেও কমপক্ষে কোয়ার্টার কিলো বা পাঁচশো হাত জায়গা ফাঁকা আছিল ধাওয়া দেওয়া আর নিজেগো চান্দি সুরক্ষার লাইগা। সেইখানে মানুষ হাজির হইছিল যেমন; তেমনি মরছেও বেশুমার। একেকজন বীর একেটা তির মাইরা একলগে দশ-বিশ হাজার মানুষ মাইরা ফালাইছেন। তলোয়ার দিয়া কোপাইয়া এক বেলাতেই মাইরা ফালাইছেন হাজার দশেক সৈন্য…

যে কুড়ালি কুড়াল দিয়া গাছ কাটে সেও দিনে দশ হাজার কোপ বসাইতে পারে না নিরীহ নির্জীব গাছের উপর। আর সৈনিকরা নিশ্চয়ই গলা পাইতা খাড়াইয়া আছিল না; তারাও কোপাইছে; তারাও কোপ ফিরাইছে। তাছাড়া সেই সময় পুরা ভারতে অত মানুষ আছিল কি না সেইটা যেমন একটা প্রশ্ন তেমনি ইতিহাসবিদরা কন খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মগধের নন্দ সাম্রাজ্যের আগে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন কোনো যোগাযোগ প্রায় আছিলই না যাতে রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে দুই পক্ষে অতগুলা মানুষ গিয়া জড়ো হইতে পারে। তয় যেহেতু এই মগধের নন্দ সাম্রাজ্যের সময়েই মহাভারত বিশাল আকার পাইয়া লিখিত হইছে; সেইহেতু মহাভারতের সংখ্যা রাজনীতি আর রাজনৈতিক ভূগোলটাও বোধ হয় রপ্তানি হইছে মগধের নন্দ সাম্রাজ্য থাইকা…

এতে অবশ্য মহাভারত পড়তে অসুবিধা হয় না; মাঝে মাঝে খালি বিরক্তি লাগে। তবে যেইখানে বলা হইছে অর্জুন তিরের বৃষ্টি চালায় সেইখানে ধইরা নিতে হইব যে একই ডিরেকশনে অর্জুনরে বাহিনী তিরাইতাছে। কারণ তির যুদ্ধের সাধারণ টেকনিকটাই হইল তাই; শত্রু নিশানায় আকাশের দিকে মুখ কইরা ঝাঁকে ঝাঁকে তির ফালাইয়া শত্রু বাহিনীরে ছত্রভঙ্গ করা। এই ক্ষেত্রে তির কাউরে টারগেট কইরা ছাড়া হয় না বরং তির ছাড়া হয় শত্রু বাহিনীরে টারগেট কইরা…

কুরুক্ষেত্রে সেই আঠারো দিনের যুদ্ধে নাকি বেশির ভাগ মানুষই মইরা গেছিল। সেই হিসাবে আঠারো দিনে যদি আঠারো অক্ষৌহিণী লোকের মরতে হয় তবে দৈনিক কমপক্ষে মরতে হয় আড়াই লক্ষর বেশি লোকের। এই পরিমাণ মানুষ যদি এক দিনে একটা মাঠে মরে তবে মরার গন্ধেই তো টিকা যাইব না কয়েক মাস। সেইখানে কেমনে বাকিরা হাইসা-খেইলা আঠারো দিন যুদ্ধ করে? তার উপরে আবার খাজুইরা আলাপও করে পিরিতি মাখাইয়া?

মহাভারতে আরেকখান গোলমাইল্লা সংখ্যা হইল গান্ধারীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের একশো পোলা। হইলে হইতে পারে অনেক বুঝাইতে শত ব্যবহার করছে কবিরা। আবার হইতে পারে রাজা যেহেতু অন্যগোও পিতা বইলা সম্মানিত হইতেন সেই হিসাবে ধৃতরাষ্ট্র তার বিশেষ বাহিনীরে পুত্র কইতেন আর তারাও তারে পিতা বইলা সম্বোধন করত। কারণ ভীষ্মের দাপটের সামনে ধৃতরাষ্ট্রের একটা নিজস্ব বাহিনী তখন অনিবার্য আছিল। হইলে হইতে পারে স্বয়ং দ্বৈপায়ন বিভিন্ন গ্রাম থাইকা আইনা একশোটা পোলা জোগাড় কইরা দিছেন ধৃতরে; সেইগুলা একলগে লাউয়ের খোলের দোলনায় দোল খাইত বইলা লাউ কাইট্টা পোলা জন্ম দিবার কাব্যিক কাহিনি জন্ম নিছে পরে। দাসীপুত্র যুযুৎসুসহ ধৃতরাষ্ট্রের একশো এক পোলার যে নামের তালিকাখান পাওয়া যায়; সেইটার মইদ্যে কয়টা আদৌ মানুষের নাম আর কয়টা খাইস্টা বিশেষণ তা দেখলেই বুঝতে পারা যায়…

এক নারীর পক্ষে সর্বোচ্চ কতটা সন্তান জন্ম দেয়া সম্ভব সেই প্রশ্নটা বাদ দিয়া গেলেও সন্তান যতটাই হউক মায়ে অন্তত সবগুলারে চিনব; সবগুলার কথা বলব; আর মরলে সবগুলার লাইগাই কানব; এইটাই সোজা হিসাব হইবার কথা। কিন্তু আমার যত দূর মনে পড়ে অত বড়ো মহাভারতে গান্ধারী চাইর-পাঁচটার বেশি পোলার নাম মুখেও আনেন নাই; আবার কান্দেনও নাই চাইর-পাঁচজনের বেশি পোলার মরণে। তো?

১৪

ভূগোল নিয়া বহুত ঝামেলা পাকাইছে মহাভারত। মগধ সময়কালের মানচিত্র আর রাজনীতি যে মহাভারতে ঢুইকা গেছে সেই প্যাচালও আগে পাইড়া আসছি। এর বাইরে মহাভারতের মূল জায়গাগুলারে বর্তমান কালে চিহ্নিত করা গেছে ঠিকঠাকমতোই। কুরুক্ষেত্র আর হস্তিনাপুর আছিল দিল্লির কাছে হরিয়ানায়। দ্বারকা হইল বর্তমানের গুজরাট। মৎস্যদেশ হইল রাজস্থানের জয়পুর তক্ষক নাগের রাজধানী তক্ষশিলা হইল রাওয়ালপিন্ডি; গান্ধার হইল কান্দাহার। মদ্রদেশ পাঞ্জাবে। মানে মূল ঘটনাটা ওই অঞ্চলের কাহিনি কারবার। কিন্তু যখনই এর লগে মাইনসে মহাভারতের সূত্র ধইরা কয় বর্তমান মণিপুরের কথা মহাভারতে আছে তখনই বাঁধে ঝামেলা। হিসাব মিলে না। রাজশেখর বসুও কন সেই মণিপুর এই মণিপুর না। কিন্তু তাতে মণিপুরের মানুষের মহাভারতের কাহিনির লগে নিজেগো কাহিনি মিলাইয়া ঐতিহ্য সন্ধান থাইমা থাকে না…

ড. অতুল সুর নৃতাত্ত্বিক সাক্ষীসাবুদ ভূগোল ইতিহাস ঘাইটা কন যে দ্রৌপদী আছিল বাঙালি নারী। এতে বাঙালিরা খুশি হইলেও অন্যরা কিন্তু যুক্তি দিয়া কিলাইতে পারে। কারণ অতুল সুর বারণাবত থাইকা পাণ্ডবগো নৌপথে পলাইয়া বীরভূম পর্যন্ত আসার একটা যুক্তিসংগত বিবরণ দিলেও পাঞ্চালের লগে হস্তিনাপুর বা বীরভূমের লগে হরিয়ানার অত দ্রুত যোগাযোগ কেমনে হইল সে বিষয়ে যেমন কিছু বলেন না; তেমনি মহাভারতের অন্য কোথাও নৌ যোগাযোগের কোনো সংবাদও পাওয়া যায় না…

আমার ধারণা অতুল সুর বিজ্ঞানচর্চা করতে গিয়াও আবেগি বাঙালি হইয়া কবিগো মতো কিছু ভাঙ্গা যুক্তি দিয়া দাবি কইরা বসছেন যে দ্রৌপদী হইল বাঙালি নারী। তার উপরে অনেকেই কন যে কর্ণের অঙ্গ রাজ্যের ভিতরে আছিল বর্তমান বাংলা অঞ্চল; মানে কর্ণ আছিলেন বাঙালির রাজা; এমনিতেই রবীন্দ্রনাথের কর্ণ-কুন্তী সংবাদ পইড়া বাঙালিজাতি কর্ণের লাইগা যে কান্দনটা কান্দে তার উপ্রে যদি প্রমাণিত হয় যে কর্ণ আছিল বাংলার রাজা তাইলে তো বাংলার কবিরা কৃষ্ণ অর্জুনরে ভর্তা বানাইয়া নতুন মহাভারত লিখতে বইসা যাইব কাইল…

কর্ণের অঙ্গরাজ্য কিংবা পাঞ্চালের লগে বাংলার সম্পর্কসূত্র খাড়ার উপ্রে বাতিল করতে না পারলেও হরিয়ানার লগে যখন আসামের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটাইয়া দেওয়া হয়; তখন পুরাই আউলা হইয়া উঠে মহাভারতীয় ভূগোলের পাঠ…

ভগদত্ত নামে একখান চরিত্র আছে মহাভারতে। তিনি দুর্যোধনের স্ত্রী ভানুমতির বাপ। প্ৰাগজ্যোতিষপুরের রাজা নরক-এর পোলা। তার বাহিনীর মূল শক্তি হইল হাতি আর তার সৈনিকরা হইল চীনা আর কিরাত। দাবি করা হয় মহাভারতের প্রাগজ্যোতিষপুর হইল পরবর্তীকালের কামরূপ রাজ্য যার সীমানায় পড়ছে বর্তমান সময়ের আসাম এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল…

আসাম থাইকা দিল্লির আকাশ-দূরত্ব দুই হাজার কিলোমিটারের মতো। আধুনিক মিলিটারিগো হিসাবমতে গ্রাউন্ড ডিসটেন্স কমপক্ষে এয়ার ডিস্টেন্সের ডাবল হয়। সেই হিসাবে আসাম থাইকা দিল্লির কাছাকাছি হরিয়ানার স্থল-দূরত্ব কমবেশি চাইর হাজার কিলোমিটার। যে যুগে ট্রেন বাস বিমান জাহাজ নাই; রাস্তাঘাট নাই; নদীতে ব্রিজ বা ফেরি নাই; থাকা-খাওয়ার লাইগা দোকানপাট কিংবা হোটেলপাতি নাই; সেই যুগে আসাম থাইকা হরিয়ানা যাইতে কত দিন লাগতে পারে?

মিলিটারিরা কয় ভালো রাস্তায় সৈনিকগো হাঁটার কার্যকর গতি গড়ে ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার। আর যেইখানে রাস্তাঘাট তেমন নাই সেইখানে গড়ে তা নাইমা আসে ৩ কিলোতে। দৈনিক কার্যকর হাঁটার ঘণ্টা হইল ১০ আর বচ্ছরে পায়ে হাঁটার কার্যকর মাস হইল সাত। মানে ২১০ দিনের কার্যকর বচ্ছর।

তো এই অবস্থায় এই গতিতে আসাম থাইকা রওনা দিয়া একলা এক সৈনিকের হরিয়ানা যাইতে হইলে হাঁটতে হইব মোট ১৩৪ দিন; মানে প্রায় ৮ ক্যালেন্ডার মাস। তাও যদি সবগুলা নদী-উপনদীতে তার লাইগা নৌকা রেডি থাকে তয়…

তো সেই যুগে বাহিনী আর হাতি নিয়া হাঁটার হ্যাপাগুলা কী? পয়লা কথা হইল সেনাপতিরা হাতিতেই যাউক আর ঘোড়াতেই যাউক; দলের মালপত্র টানা মুটে-মজুরগো চলার গতিই আছিল তাগো অগ্রগতির গড় গতি। সেনাপতিগো কিছুদূর গিয়া থামতে হইত; পায়েদল মজুররা আসার অপেক্ষায়। তারপর তারা আইসা আশপাশ থাইকা খাবারদাবার জোগাড় করত; রান্নাবান্না করত; থাকার ব্যবস্থা বানাইত; হাতিঘোড়ার খাবার দিত বিশ্রাম দিত। তার উপরে ঝড়বাদলা বৃষ্টিতে থাইমা অপেক্ষা করতে হইত; অসুখ-বিসুখে মানুষ মরত; কাহিল হইয়া পড়ত; পাহাড়-জঙ্গলের ভিতর রাস্তা বানাইতে হইত; লোকাল মাতবর কিংবা ডাকাত-ফাকাতের লগে মারামারি করতে হইত; তারপর হইত আগাইতে। তার উপরে আছে হাতিঘোড়া মালপত্র নিয়া ছোট বড়ো অসংখ্য নদী পার হইবার হ্যাপা…

বলা হইছে ভগদত্ত কুরুযুদ্ধে অংশ নিছে এক অক্ষৌহিণী সৈনিক নিয়া। এক অক্ষৌহিণী মানে হইল ১ লক্ষ ৯ হাজার সাড়ে তিনশো পায়দল সৈনিকের লগে ২১ হাজার ৮৭০টা কইরা রথ আর হাতি এবং ৬৫ হাজার ৬১০টা ঘোড়া। তো এইবার একেকটা হাতির লগে দুইজন কইরা মাহুত আর রথে কমপক্ষে একজন কইরা সারথি আর জোগানদার কামলা যোগ কইরা গুইনা দেখেন মোট পাব্লিক কত হইতে পারে এক অক্ষৌহিণী সৈনিকের ভিতর; এবং সেই বিশাল বাহিনীরে সেই যুগে আসাম থাইকা হরিয়ানা নিয়া যাইতে কত বছর লাগতে পারে? তো একজন রাজা; যার নিজের আছে বিশাল একখান রাজ্য; সে কেমনে কথায় কথায় গিয়া আসাম থাইকা অত বড়ো বাহিনী নিয়া হরিয়ানা হাজির হয়? তার উপরে আবার বিবাহ-শাদির সম্বন্ধ পাতায়? কেমনে সম্ভব? কেমনে সম্ভব গুজরাট থাইকা আসামে আইসা কৃষ্ণের পক্ষে ভগদত্তের বাপেরে মাইরা ফালানো?

মহাভারতের লগে ভগদত্তরে জুইড়া দেওয়ার কারিগরি ইতিহাস অন্য আরেকটা জায়গার ইতিহাস খুঁজলে বোধ হয় পাইলেও পাওয়া যাইতে পারে। ভগদত্ত প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা নরকের পোলা; যারে বামুন ঘরানার সাহিত্যে কইত নরক রাজ্য। সেই নরক রাজ্য যখন চতুর্থ শতকে বর্মন রাজ বংশের শাসনামলে প্রাগজ্যোতিষপুর নাম পাল্টাইয়া হইল কামরূপ; তখন বর্মন রাজারা দেশের মাইনসেরে শিক্ষাদীক্ষা দেওয়া আর বৈষ্ণব ধর্ম প্রতিষ্ঠার লাইগা মগধ সাম্রাজ্য থাইকা কামরূপে আমদানি করছিল ব্যাপক সংখ্যার ব্রাহ্মণ। বামুনরা কিন্তু সহজে কামরূপে আসতে চাইত না। তারা বাংলারে কইত পক্ষী জাতীয় মানুষের দেশ আর কামরূপরে কইত নরক। কোনো বামুন এই দিকে আসলে ফিরা যাইবার সময় তারে প্রায়শ্চিত্ত কইরা ঢুকতে হইত নিজের সমাজে। তো দেশ আর আত্মীয়-স্বজন ছাইড়া যেই সব বামুন সেই নরক রাজ্যে আসতে রাজি হইত তারা মূলত আছিল নিজেগো অঞ্চলে খাইতে না পাওয়া কিংবা পতিত কিংবা আকাম কইরা পলাইয়া থাকা বামুনের দল। কালে কালে তাই পতিত আর অকর্মা মানুষগো সর্বশেষ ঠিকানা হিসাবে নরক হইয়া উঠে একমাত্র গন্তব্যের নাম…

তো সেই নরকে কিংবা কামরূপে কিংবা আসামে-সিলেটে যে বামুনরা আসলো; মাইনসেরে শিক্ষাদীক্ষা দিলো; সেইটার প্রভাব কিন্তু এখনো রইয়া গেছে সিলেটি আর অহোমিয়া ভাষার শব্দে। আর উচ্চারণে। এই ভাষাগুলায় সংস্কৃত শব্দবাহুল্য; দীর্ঘ ক্রিয়াপদ আর উচ্চারণ এখনো বহন করে সেই ভাট বামুনগো অবদানের চিহ্ন। কিন্তু একবারও কি ভাইবা দেখা যায় না যে ৩৫০ থাইকা ৬৫০ সাল পর্যন্ত শাসন করা বর্মন রাজারা খালি নরকরে প্রাগজ্যোতিষপুর থাইকা কামরূপ বানাইয়া শিক্ষিত আর বৈষ্ণব করার পিছনেই পুরা ইনভেস্টমেন্ট খরচা করে নাই; বরং নতুন কামরূপের ঐতিহ্য নির্মাণেও তারা ইনভেস্টমেন্টের একটা বিশাল অংশ খরচা করছে?

ভিন্ন সমাজে এইরকম আরেকখান উদাহরণ দেখার লাইগা এইবার একটু ভার্জিলের ইনিড মহাকাব্যখানের শানেনুজুল স্মরণ কইরা নেন। গোত্র-পরিচয়হীন অক্টাভিওন যখন অগস্টাস সিজার হইয়া জুলিয়াস সিজারের উত্তরাধিকার হইল; তখন তার মা আতিয়া বালবা কবি ভার্জিলরে দায়িত্ব দিলেন পোলার একখান ঐতিহ্যময় বংশকাহিনি বানাইয়া দিতে…

তো সেই অ্যাসাইনমেন্ট নিয়া ভার্জিল হোমারের ইলিয়াড থাইকা ট্রয় যুদ্ধের সূত্র ধইরা একখান চরিত্র বাইর করলেন- ইনিয়াস। তারপর তিনি লিখতে থাকলেন ইনিড। কাহিনি বানাইয়া কইয়া দিলেন যে ট্রোজান রাজবংশের পোলা ইনিয়াস ট্রয় থাইকা পলাইয়া আইসা প্রতিষ্ঠা করছেন রোমান জাতির। মানে তিনি রোমান জাতির পিতা। তো যাই হউক ভার্জিল ইনিয়াসরে দিয়া রোমান জাতিটাতি প্রতিষ্ঠা করার পর কইলেন যে আতিয়াপুত্র অক্টাভিওন; মানে অগস্টাস সিজার হইলেন সেই মহান ইনিয়াসের বংশধর; মানে অতি সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান…

তো কি এমনো হইতে পারে যে কামরূপের বর্মন রাজারা নিজেগো বৈষ্ণব ঘরানায় ঐতিহ্যশালী করার ইচ্ছায় সংস্কৃত পণ্ডিতগো পয়সা-পাতি দিছে মহাভারতে তাগোরে ঢুকাইয়া দিবার লাইগা? হইলে হইতে পারে সেই সব পেইড কবিরাই ছক কইরা কৃষ্ণরে দিয়া ভগদত্তের বাপ নরকরে হত্যা করাইয়া কৃষ্ণের নাম ধইরা নিজেগো দেশ থাইকা পয়লা নরকের গন্ধ ছাড়ায়; তারপর কুরুযুদ্ধের মাঠে নিয়া কৃষ্ণ আর অর্জুনের হাতে প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা ভগদত্তরে মারে; তারপর শুরু করে বর্মন রাজবংশের অধীনে বামুন প্রভাবিত বৈষ্ণব ঘরানার নয়া কামরূপ…

মহাভারতের স্বর্গও কিন্তু বর্তমানের স্বর্গ না। অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ হিসাব কইরা অতুল সুর কন মহাভারতের স্বর্গ হইল মূলত হিমালয়ের উত্তর অংশ যেইখানে আছিল দেবরাজ ইন্দ্রের নগর আর রাজধানী অমরাবতী। যাই হউক মহাভারতের পুরা ভূগোলই কিন্তু এইরকম ব্যাপক ক্রিয়েটিভিটিতে ভরা…

ভীমের পোলা ঘটোৎকচরে নিয়াও বেশ আউলাঝড়া কাহিনি আছে। মহাভারতে সে গোঁয়ার মহাভারতের কবিরা তারে পুরা রাক্ষসও বানাইয়া থুইছেন। কিন্তু মহাভারতের ইন্দোনেশিয়ান কাহিনিগুলায় সে আবার অন্যরকম হিরো। আমার হিসাবে মহাভারতে যত উচ্চশিক্ষিত আর উচ্চ সংস্কৃতির চরিত্র আছে তাগো মাঝে মনে হয় ঘটোৎকচ পয়লা সারির একজন…

সেই সময় গুণী কইন্যাগো লাইগা বহু স্বয়ংবরা প্রচলিত আছিল; কিন্তু সেইসব স্বয়ংবরায় পাত্ররা কইন্যা জয় করত নিজের শানশওকত কিংবা বাহাদুরি দেখাইয়া। ঘটোৎকচও বিবাহ করছে স্বয়ংবরার আসর জিতা; কিন্তু সেইটা আছিল বুদ্ধি পরীক্ষার স্বয়ংবরা। এই রকম বুদ্ধি পরীক্ষার স্বয়ংবরা আমি দ্বিতীয়টা পাই নাই কোথাও। যদিও স্বয়ংবরায় বুদ্ধি পরীক্ষার প্রশ্নগুলা আমি উদ্ধার করতে পারি নাই; সবখানেই বলা হইছে অহিলাবতী স্বয়ং কিছু কঠিন কঠিন প্রশ্ন করছে পাত্ৰগো। আর সেইসব কঠিন কঠিন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়া ঘটা তারে জিতা নিছে। এতে কিন্তু অন্তত তার বুদ্ধির একটা ঝিলিক পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিষয়টা হইতাছে মহাভারতে যেইখানে সকলেই নিজের পোলাপানগো বীর আর যোদ্ধা বানাইবার লাইগা অস্থির সেইখানে ঘটোৎকচ পড়ালেখা শিখাইয়া নিজের ছোট পোলারে বানাইতে চায় ঋষি। তার ছোট পোলা বর্বরীক ঋষি হয়ও। রাজস্থানে এক নামে আর নেপালে আরেক নামে বর্বরীকের মন্দিরও আছে…

এইটা কেমনে সম্ভব? একটা মানুষের ঐতিহ্যে যদি শিক্ষা-সংস্কৃতি আর বুদ্ধিচর্চার অস্তিত্ব না থাকে তবে হিড়িম্বার পোলা কেমনে বুদ্ধি পরীক্ষার স্বয়ংবরায় গিয়া নাগরাজ মুরুর মাইয়া অহিলাবতীরে বিয়া করে আর নাতি হয় ঋষি? মূলত আদিবাসী মানুষগুলারে বড়ো বেশি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হইছে মহাভারতে; যার প্রমাণ এই ঘটোৎকচ…

অবশ্য ঘটোৎকচের বৌ নিয়া কিছু ভিন্ন মত আছে। কোনো সূত্রে অহিলাবতী যাদব বংশজাত। কোনো সূত্রে কয় সে নাগ বংশজাত। ঘটোৎকচের আরেক বৌয়ের সন্ধান পাওয়া যায় ভার্গবী নামে। কোনো সূত্রে দেখা যায় ভার্গবী যাদব বংশজাত আবার কোনো সূত্র বলে ভার্গবী হইল অর্জুনের মাইয়া; সুভদ্রা গর্ভজাত। অবশ্য নেপালে যারা ইয়ালাম্বর নামে বর্বরীকের পূজা করে আর বলে যে সেই হইল নেপালি প্রথম কিরাত রাজা; তারা আবার ঘটোৎকচরেও কিরাত বানাইয়া ফালায়। কিরাতরা আবার অন্য কোথাও দানব নামে পরিচিত আর বৈশিষ্ট্যে মঙ্গোলয়েড গোত্রজাত। সেই ক্ষেত্রে কিন্তু মহাভারতের অস্ট্রিক গোত্ৰজাত ঘটোৎকচের লগে দুই কাহিনির একটা প্যাঁচ লাইগা যায়…

এক কাহিনি বলে ঘটোৎকচের পোলা বর্বরীক কৃষ্ণের সামনে আত্মবলিদান দেয় আর অর্জুনের পোলা ইরাবান মরে কুরুযুদ্ধে। কিন্তু অন্য কাহিনি বলে যুদ্ধের আগে আত্মবলিদান দেয় অর্জুনের পোলা ইরাবান। যারা দ্বিতীয় কাহিনি বিশ্বাস করে তারা আবার ইরাবানরে দেবতা ইরাবৎ কইয়া পূজাও করে। আমার আখ্যানে আমি হিড়িম্বারে সাঁওতাল কইন্যাই কইছি; ঘটার বৌ অহিলাবতীর লাইগা বাইছা নিছি নাগবংশের পরিচয়…

শিখণ্ডীরে অনেকেই হিজড়া কন; কিন্তু এই বিবাহিত ব্যাডার রীতিমতো পোলাপান আছে। মনে লয় ভীষ্মের মরণরে মহান বানাইতে গিয়া অম্বার পুনর্জন্ম-টুনর্জন্ম জুইড়া দিয়া শিখণ্ডীরে ছাইয়া বানাইয়া থুইছে কবিরা। আর ভীষ্ম যে হিজড়া দেখলে অস্ত্র ছাইড়া দেন সেইটাও কিন্তু পুরা ভুয়া। কারণ শিখণ্ডী তার লগে সাত নম্বর আর নয় নম্বর দিনেও যুদ্ধ করছে; তখন কিন্তু তিনি তারে দেইখা কুফা কইয়া অস্ত্র ছাড়েন নাই। তাইলে দশ নম্বর দিনে আইসা হঠাৎ শিখণ্ডীরে দেইখা ভীষ্ম অস্ত্র ছাইড়া দিবার নাটক করলেন ক্যান?

মহাভারতে বর্ণিত বংশ আর ভূগোলের একখান ব্যাখ্যা দিবার চেষ্টা করছেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তার ‘মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ’ পুস্তকে। নৃসিংহপ্রসাদ বড়ো বেশি দ্বৈপায়নভক্ত মানুষ। তিনি কৃষ্ণ দ্বৈপায়নরে যেমন একক ব্যক্তি হিসাবে বিশ্বাস করেন তেমনি দ্বৈপায়নের নামে লিখিত প্রতিটা অক্ষররে ভক্তিসহকারে বিশ্বাস করেন। সেই অনুযায়ী তিনি মহাভারতে বর্ণিত ভরত থাইকা প্রবাহিত বংশের যেমন একখানা বর্ণনা উপস্থাপন করেন বিভিন্ন পুরাণের সূত্র দিয়া তেমনি পৌরাণিক সূত্র দিয়াই মহাভারতীয় ভূগোলের একখানা মানচিত্রও উপস্থাপন কইরা ফালান তিনার এই পুস্তকে…

কিন্তু কথা হইল পুরাণগুলা যেইখানে রচিত হইছে অন্যসব পুরাণের উপর ভিত্তি কইরা; সেইখানে শুধু পৌরাণিক রেফারেন্স দিয়া রচিত বই পৌরাণিক গবেষণা হিসাবে ঠিকাছে; কিন্তু কোনোভাবেই পুরাণের নৃতাত্ত্বিক গবেষণা নয়। অবশ্য সেই দাবি নৃসিংহপ্রসাদ নিজেও করেন নাই; তিনি পুরাণের মইদ্যেই থাকতে চাইছেন। সেই দিক দিয়া বিশ্বাসী মানুষদের লাইগা নৃসিংহপ্রসাদের এই গবেষণাটা একখানা ভালো রেফারেন্স পুস্তক…

১৫

মহাভারত পরিবারের দুই প্রধান পুরুষ ভীষ্ম এবং দ্বৈপায়ন দুইজনই আছিলেন নদীমাতৃক মানুষ; একজন গঙ্গাপুত্র তো আরেকজন দ্বৈপায়ন। হিসাবমতে ভীষ্ম দ্বৈপায়ন থাইকা বেশ কয়েক বছরের বড়ো হইবার কথা। কারণ শিক্ষাদীক্ষা শেষ কইরা যুবরাজ ভীষ্ম যখন সত্যবতীর বিয়ার ঘটকালি করেন তখন সত্যবতীপুত্র দ্বৈপায়নের বয়স বারো। যদিও মহাভারতে আমরা দেখি ভীষ্ম নতমস্তকে পেন্নাম করতে আছেন দ্বৈপায়নের চরণে। এইটা হইতে পারে দ্বৈপায়ন ঋষি হইবার কারণে; অথবা হইতে পারে বামুনবাদীগো বামুনসম্মান বাড়াইবার কৌশলের কারণে…

জীবনীর দিক থাইকা দ্বৈপায়ন আর ভীষ্ম আছিলেন অদ্ভুতভাবে একজন আরেকজনের একেবারে আয়নামুখ। পরাশর দ্বৈপায়নের মায়েরে ফালায়া গেলেও পোলারে নিয়া গিয়া লালন পালন দিছে। অন্যদিকে গঙ্গা ভীষ্মর বাপেরে ফালায়া গেছে কিন্তু পোলারে নিয়া বড়ো কইরা তুলছে শিক্ষায় দীক্ষায়…

দ্বৈপায়ন বাপের কাছে বড়ো হইয়া আইসা হাল ধরছেন মায়ের বংশের; আর ভীষ্ম মায়ের কাছে বড়ো হইয়া আইসা হাল ধরছেন বাপের সংসারে…

ভীষ্ম ব্যক্তি জীবনে সন্ন্যাসী কিন্তু সারা জীবন বান্ধা থাকছেন সংসারে। আর চাইর পোলার বাপ দ্বৈপায়ন বেশিরভাগ সময় সংসারের পিছনে অস্থির হইয়া দৌড়াইলেও জীবনটা কাটাইলেন সন্ন্যাসে…

১৬

কৃষ্ণসহ মহাভারতের বেশির ভাগ মানুষই আছিল দেখতে কালা; শিবপূজারি আর রাজা-বাদশা সকলেই বসবাস করত খড়কুটা কিংবা মাটির ঘরে। বারণাবতে যুবরাজের লাইগা ধুমধাম কইরা যে ঘর বানানো হয় সেইটা কিন্তু একটা বাঁশ বেত শণের ঘর। একই সাথে দেখা যায় সেই সময় মানুষ মাটির নিচে কিংবা গুহায়ও বসবাস করত। তার প্রমাণ সেই বারণাবতেই পাওয়া যায়। বিদুর এক কারিগর পাঠায় যে মাটির নিচে গুহাঘর বানানোয় এক্সপার্ট। তখন যদি এই জাতীয় ঘর বানাইবার প্রচলনই না থাকত তবে এক্সপার্ট মিস্ত্রি আইল কেমনে?

সিংহাসন মনে হয় খালি নামেই আছিল কিংবা পরে ঢুকানো হইছে। কামের ক্ষেত্রে চেয়ার জাতীয় কোনো আসন-টাসনের সন্ধান পাই নাই। মনে লয় মাটিতে আসন পাইতাই বসত সবাই। পোশাক আশাকেরও কোনো বিস্তারিত নাই। সুতা আর কাপড়ের প্রচলন তখন থাকলেও কথায় কথায় পশুর চামড়া আর ছালবাকলার পোশাকের বর্ণনা দেইখা মনে হয় একইসাথে গরিবগুর্বাগো মাঝে ছালবাকলার পোশাকের ব্যাপক প্রচলন আছিল তখন। বনবাসে অর্জুনরেও একবার ছালবাকলার পোশাক বানাইতে দেখা যায়। প্রচলন না থাকলে অতি সহজে যেমন পাওয়া যাইত না তেমনি অর্জুনও বানাইতে পারত না অত সহজে। সেই সূত্র ধইরা দ্রৌপদীর পোশাক নিয়া কথা কওয়া বিপজ্জনক। তবে রাজরানির পোশাক থান কাপড় জাতীয় কিছু হইলেও হইতে পারে; মানে পুরুষে পরলে হইত ধুতি আর নারীতে পরলে হইত শাড়ি। তয় মিলিটারিগো চিনার লাইগা কুরুযুদ্ধে ইউনিফর্মের সন্ধান পাওয়া যায়। অর্জুন না মরা পর্যন্ত কর্ণের জুতা না পরার প্রতিজ্ঞা থাইকা অনুমান করা যায় সেই যুগে জুতারও প্রচলন আছিল। তবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই অতিথি বরণের সময় পা ধোওয়ার পানি দিবার ঘটনা দেইখা মনে হয় বেশিরভাগ লোকজনই খালি পায়ে হাঁটতো তাই ঘরে ঢোকার আগে এই পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা…

যুদ্ধের ব্লকিং নিয়া বহুত কথা থাকলেও বহুত হিসাব আবার মিলে না। যেই যুগে মহাভারতে কুরুযুদ্ধ ঢোকানো হইছে সেই যুগের মানুষেরা যুদ্ধে তির-ধনুক আর ঘোড়ার নিশ্চিত ব্যবহার করত। কিন্তু ঘোড়া আর তির-ধনুকের ব্লকিং যখন লাঠি গদা আর মল্লযুদ্ধের যুগের মহাভারতে ঢুকাইয়া দেওয়া হইছে তখনই লাগছে ভজঘট। কারণ ঘোড়া আর তির-ধনুকের ব্লকিং করতে গেলে ভীমেরে গদা চালাইবার জায়গা দেওয়া যায় না। আবার গদা আর মল্লযুদ্ধের অনিবার্য অংশ; মা-বাপ তুইলা গালাগালি করা কিংবা গুরুজনরে প্রণাম-টনাম রাখতে গেলে তির-ধনুক আর ঘোড়া বাদ দিতে হয়। তার উপরে আবার ঢুকছে চাইর-ছয় ঘোড়ার ফ্যাশনেবল রথ; যেইটা মোটেই সামনাসামনি যুদ্ধের উপযোগী কোনো বাহন হইতে পারে না; না গতিতে; না আকারে। তো এতে যা হইছে তা হইল সবকিছু মিলা একটা খিচুড়ি পাকাইয়া গেছে; যেইটা কাব্যে পড়তে সুন্দর; সিনেমায় দেখতে সুন্দর কিন্তু যুদ্ধবিদ্যার গ্রামারে কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত না…

১৭

নকুল-সহদেবরে মহাভারতে হালকার উপর মাদ্রীর পোলা কইলেও কাহিনি পইড়া তাগোরে কুন্তীর সতীনের পোলা মনে হয় না। অনেকেই দাবি করেন তারা কুন্তীরই পোলা। আমারো তাই মনে হয়। নকুল-সহদেব মাদ্রেয় না; কৌন্তেয়…

সেই কালের নিয়ম মতো কোনো নারী চাইরজনের বেশি পুরুষের লগে যৌনতা করলে বেশ্যা বইলা গণ্য হইত। সেই সূত্রমতেই পাঁচ পাণ্ডবের লগে বিছানা ভাগ করায় দ্রৌপদীরে বেশ্যা কইয়া খোটা দিছিল কর্ণ…

কর্ণ থাইকা অর্জুন পর্যন্ত জন্ম দিতে গিয়া বাইরের চাইরজন আর স্বামী পাণ্ডুরে নিয়া কুন্তীর কিন্তু পাঁচ পুরুষের লগে যৌনতা করা হইয়া যায়। কেউ কেউ কন; শুধু চাইরজনের অধিক পুরুষের বিছানায় সে যায় নাই এইটা প্রমাণ করতেই পরে আর কর্ণের জন্ম স্বীকার যায় না কুন্তী। এর উপরে নকুল সহদেবের জন্মগর্ভ স্বীকার করতে গেলে কর্ণের জন্ম লুকাইলেও কুন্তীর পাঁচ পুরুষের বিছানাযাত্রা প্রমাণ হইয়া পড়ে…

এর লাইগাই কুন্তী নকুল-সহদেবরে মাদ্রীর পোলা বইলা প্রচার করে। এতে কর্ণরে বাদ দিলে তার পুরুষসঙ্গীর সংখ্যা চাইরের বেশি হয় না…

কুন্তী ছাড়া পাঁচ পাণ্ডবের জন্ম আর পাণ্ডু-মাদ্রীর মৃত্যুর অন্য কোনো সাক্ষী কিন্তু মহাভারতে নাই। পাণ্ডু আর মাদ্রীর লাশের লগে ষোলো থাইকা তেরো বছর বয়েসি পাঁচটা পোলা নিয়া যখন কুন্তী হস্তিনাপুরে আইসা হাজির হয় তখন তার সাথে আসছিল কয়েকজন বনবাসী ঋষি। যারা হড়বড় কইরা পাঁচটা পোলারে মৃত পাণ্ডুর পুত কইয়া হস্তিনাপুর রাজবাড়িতে পরিচয় করাইয়া দিয়া। এক্কেবারে গায়েব হইয়া যায়; আস্ত মহাভারতে সেই লোকগুলারে আর দ্বিতীয়বার দেখা যায় না পাণ্ডু-মাদ্রীর মরণ কাহিনী থাইকা পাঁচ পাণ্ডবের জন্ম সবকিছুরই একমাত্র জীবন্ত সূত্র শুধু কুন্তী…

১৮

আইচ্ছা কর্ণ কি আদৌ কুন্তীর পোলা? সন্দেহ হয় আমার। কওয়া হইছে যে কুন্তী তারে ভাসাইয়া দিবার পর সন্তানহীন সূত অধিরথ তারে কুড়াইয়া আইনা পোষে। কিন্তু অধিরথের তো আরো পোলাপান আছে। কুরুযুদ্ধেই তারা যুদ্ধ করে। বলা হয় তারে স্তন্যদান করে সন্তানহীন রাধা। কিন্তু সন্তানহীন বন্ধ্যা নারী কেমনে স্তন্য পান করায়?

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী কন আরো বহু লোকই জানত যে কর্ণ কুন্তীর পোলা; কুন্তীর সন্তানদানের ক্ষমতা নিশ্চিত জাইনাই ভীষ্ম পাণ্ডুরে কুন্তীর স্বয়ংবরায় পাঠান। কারণ তার বংশটা আগের জেনারেশনে বহুত ভুগছে বংশের বাত্তি নিয়া; তাইলে প্রশ্ন হইল কৌরব আর পাণ্ডবরা এই কথা জানতো না ক্যান?

সেই কালের নিয়ম অনুযায়ী কুন্তীর কানীন সন্তান হিসাবে কর্ণ পাণ্ডুর পুত্র হিসাবে গণ্য হইবার কথা। এইটা প্রচলিত বিষয়। রাখঢাকের কিছু নাই। কিন্তু পাণ্ডুর অত সন্তানসংকট গেলেও একবারের লাইগাও কুন্তী কেন তারে কর্ণের কথা কইল না?

মহাভারতে বলা হইছে ভীষ্ম কৃপ দ্রোণ বিদুর জানতেন যে কর্ণ কুন্তীর পোলা। ভীষ্ম কৃপ দ্রোণ বিদুর বহুত চেষ্টা করছেন দুর্যোধনরে যুদ্ধ থাইকা ফিরাইতে। কিন্তু একমাত্র কর্ণের ভরসায় সে ফিরে নাই। তো ইনারা জানলে দুর্যোধন জানত না কেন? আর তারা যদি দুর্যোধনরে কর্ণের এই পরিচয়টা দিতেন তাইলেই তো কর্ণের উপর থাইকা তার বিশ্বাস আর ভরসা উইঠা যাইত। যুদ্ধ না করার লাইগা তারা তারে বহুত যুক্তি দেখাইছেন কিন্তু একবারের লাইগাও তো কন নাই যে অর্জুন হত্যার লাইগা কেমনে সে অর্জুনের মায়ের পেটের ভাইর উপরে ভরসা করে?

পোলাপাইন বয়সীগো মাঝে কৃষ্ণ জানত যে কর্ণ কুন্তীর পোলা; তাইলে কেমনে বিশ্বাস করা যায় যে যুধিষ্ঠির অর্জুন আর দ্রৌপদী তা জানে না?

একটা আখ্যান আছে যেইখানে কর্ণের পরিচয় গোপন রাখার লাইগা সম্রাট হইবার পরে যুধিষ্ঠির কুন্তীরে অভিশাপ দেয়- নারীজাতি কিছুই লুকায়ে রাখতে পারবে না কোনো দিন…

এই অভিশাপটা যুধিষ্ঠিরের মুখে কতটা মানায়? যে যুধিষ্ঠির জীবনে একবারের লাইগাও কুন্তীর চোখের দিকে চোখ তুইলা কথা কয় নাই। মায়ের সম্মান রক্ষার লাইগা বলতে গেলে যেকোনো কিছু যে করতে রাজি। সেই যুধিষ্ঠির হঠাৎ কইরা কুন্তীরে কেমনে অত তাচ্ছিল্য কইরা অভিশাপ দেয়?

আর সর্বশেষ ভীম। ভীম হইল মায়ের পোলা। মায়ের রান্নাবাড়া থাইকা মায়েরে কান্ধে নিয়া হাঁটা পর্যন্ত একলাই করছে ভীম। সেই ভীম কেন কর্ণরে কুন্তীর পোলা জানার পরেও পাপিষ্ঠ কইয়া তার শেষকৃত্যের লাইগা পয়সা দিতে রাজি হইল না? সে কেন কইল পাপিষ্ঠ কর্ণের শেষকৃত্য কুন্তী তার নিজের তহবিল থাইকা করবেন? ভীমের চরিত্রে ইতরামি মানায় কিন্তু কুন্তীরে ঠেস দিয়া কথা কওয়া মাইনা নেওয়া কঠিন…

পাণ্ডবগো অর্থমন্ত্রী ভীম রাজকোষ থাইকা পয়সা বরাদ্দ না দেওয়ায় ধৃতরাষ্ট্রের পোলাগো শেষকৃত্য হইল অর্জুন আর যুধিষ্ঠিরের ব্যক্তিগত পয়সায়। কিন্তু কর্ণের শেষকৃত্য কেন শেষ পর্যন্ত করল না কেউ? না পাণ্ডব না কুন্তী?

আমার খটকা লাগে। মনে লয় রাজবংশ ঘরানার বাইরে সাধারণ পরিবারের এই সন্তানের উইঠা আসা যেমন তার আশপাশের লোকজন মানতে পারে নাই তেমনি কবিরাও মানতে পারে নাই যে কর্ণ কোনো সম্ভ্রান্ত বংশজাত নয়। তাই কাহিনি জুইড়া তারে কুন্তীর পোলা বানাইয়া দিছে। যেমন ষাইট সত্তুর দশকে সিনেমায় রাজার পোলারে ধুমায়ে বাইদানির লগে প্রেম করানোর পর বিবাহের সময় দেখানো হইত সেই বাইদানি কিন্তু মূলত আরেক রাজার হারাইয়া যাওয়া মেয়ে মানে সমাজে সমাজে সমান রাখা। তো কর্ণরেও মনে লয় জোর কইরা এমন সম্ভ্রান্ত বানানো হইছে… কর্ণের চরিত্রও কেমন যেন খাপছাড়া। মাঝে মাঝে সে বহুত ভালো মানুষ আর মাঝে মাঝে চূড়ান্ত ইতর। একই সাথে তার মাঝে আছে যুধিষ্ঠিরের উদারতা; ভীমের ইতরামি আর অর্জুনের হিরোইজম। এই ভজঘটটা বোধ হয় হইছে কর্ণরে অভিজাত বংশজাত ভিলেন বানাইতে গিয়া। কিন্তু মূলত সে ভীষ্মের ঘোড়ার গাড়োয়ান অধিরথেরই পোলা; রাধাগর্ভজাত; যে তার নিজস্ব শিক্ষা শক্তি আর ক্ষমতায় রাজপুত্রগো ছাড়াইয়া উইঠা গেছিল বহুত উচ্চতায়…

১৯

বাংলা ভাষার মূল চরিত্রটা হইল কথা কইতে গিয়া যদি কোনো শব্দ মুখে আটকাইয়া যায় কিংবা চেহারা ভচকাইয়া তার উচ্চারণ করা লাগে তবে বাঙালি সেই শব্দটা বদলাইয়া ফালায়। দরকার পড়লে নতুন শব্দ বানায়; সুযোগ থাকলে বাইর থাইকা আইনা বাংলার লগে ফিট কইরা দেয়। এই পুস্তকে আমি সমস্ত বাঙালি জাতির ভাষা থাইকা যখন যে শব্দ পছন্দ হইছে সেইটাই নিছি; খালি খেয়াল রাখছি কোথাও আটকায় কি না। চেষ্টা করছি সহজিয়া বাংলায় গল্পগুলান কইতে; যেমনে মহাভারতের গল্পখান কইতে দিলে কইত বাংলার পালাকার কিচ্ছাকার বয়াতি বাউল…

পয়লা চেষ্টা। গোঁজামিল আছে বহুত জায়গায়। মাঝে মাঝে ইসকুলি বাংলা বাগড়াও দিছে। ধরাইয়া দিয়েন…

২০

মহাভারত নিয়া আমি শুরু করছিলাম সেই পিচ্চিবেলায় উপেন্দ্রকিশোর রায়ের কিশোর মহাভারত দিয়া। তারপর এক সময় ঢাউস ঢাউস পুস্তক ঘাঁটাঘাঁটি; ইন্টারনেট গুতাগুতি; বন্ধুবান্ধবগো চাপাচাপি; ফোনে ঠেলাঠেলি আর বৌম্যাডামরে কঠিন কঠিন প্রশ্নের মুখে ফালাইয়া ঘুটু পাকানো। বিষয়গুলার গিটটু খুইলা নিজে তৈরি কইরা নিছি মহাভারতের নিজস্ব পাঠখান। নিজস্ব পাঠ তৈরির ক্ষেত্রে মহাভারতের গিটঠু খোলার লাইগা জিগাইতে কাউরেই ছাড়ি নাই; তা হোক গ্রামীণ লাঠিয়াল আর হউক মিলিটারি অফিসার আর হউক কাঠখোট্টা ইঞ্জিনিয়ার। পাশাপাশি ধুমায়ে দেখছি এই সব বিষয়ের লগে সামান্যতম সম্পর্কযুক্ত সিনেমা নাটক টিভি সিরিয়াল…

তারপরে শুরু করছি লেখা। একটু একটু করে লেখি আর অনলাইন লেখক ফোরাম সচলায়তনে প্রকাশ করি। সচলায়তনে প্রকাশ করি আর শত শত মানুষের মন্তব্যে পরামর্শে রেফারেন্সে ডকুমেন্ট সমালোচনায় যেমন ভইরা উঠতে থাকে আমার পাঠের দুর্বলতা; তেমনি আমিও ধীরে ধীরে পাইতে থাকি নিজস্ব পাঠের স্বচ্ছ উপাখ্যান। এরপর যখন খসড়া দাঁড়ায়ে যায় তখন ভারতীয় পুরাণ বিশেষজ্ঞ থাইকা গল্পকার এমনকি নবীনতম পাঠক পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত পাঠক নিজেদের বিশ্লেষণ আর মেরামতির পরামর্শগুলা আমারে জানায়ে দেন। তাদের কারো কথা পুরাটাই রাখতে পারছি কারোটা পারছি আংশিক। কিন্তু তাদের আগ্রহ আমার কাছে যেমন বিস্ময়কর তেমনি তাগো কাছে আমার কৃতজ্ঞতাও অসীম; কারণ এই বইটাতে মন্তব্য করতে গিয়া অনেকেরই অনেক বইপুস্তক ঘাঁটাঘাঁটি করতে হইছে; নেটে গুতাইতে হইছে বহুত সময়…

তাগোরে কেমনে কৃতজ্ঞতা জানাই জানি না। তবে অনলাইনভিত্তিক এই পাঠক সমালোচক সহায়ক সমাজ না থাকলে এই বইটা আমার লেখা হইত না সেইটা এক্কেবারে নিশ্চিত…

বইখান গল্প আকারে লেখা শুরু হইছিল চুমকির ধাক্কায় আর শেষ হইছে টুটুলের গুঁতায়। অভিনয় শিল্পী নাজনিন হাসান চুমকিরে একবার কুন্তীরে নিয়া একখান মঞ্চনাটক লেইখা দেওয়ার কথা দিয়া ফালাইছিলাম। লিখতে গিয়া দেখি পারি না। মহাভারত নিয়া নিজস্ব গল্পের লাইনটা লিখিত না থাকায় নাটক লিখতে গিয়া বারবার ধাক্কা খাই। তো ভাবলাম আগে তাইলে কুন্তীর গল্পগুলান গোছাইয়া লই। সেইটা গোছাইতে গিয়া চুমকির কথা ভুইলা কুন্তীরে ছাড়াইয়া পুরা মহাভারতের গল্পগুলাই লিখতে শুরু কইরা দিলাম নিজের মতো কইরা। কিন্তু লেখা কিছু আগায় তো আবার বহু দিন বইসা থাকে। এর মাঝে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি এক দিন টাল হইয়া টুটুলরে কথা দিয়া ফালাইলাম যে বই কইরা ফালামু এইবার। টুটুল মানে আহমেদুর রশীদ। লেখক। শুদ্ধস্বর প্রকাশনী এবং আমার সবগুলা বইয়ের প্রকাশক। কিন্তু কইয়া তো পড়লাম বিপদে। বই তো গোছানো নাই। কেমনে কী? আমি যত কই যে টাল সময়ের কোনো কথা আমার মনে থাকে না; সে তত কয় শুধু টাল সময়ের কথাই নাকি তার মনে থাকে; বই তারে দিতেই হবে…

আমার দুর্গতি দেইখা বৌম্যাডাম দিনা ফেরদৌস; আমার কাছ থিকা বাপের ন্যাওটা দেড় বছরের মাইয়াটারে পুরা সরাইয়া নিয়া একখান আলাদা ঘর বাইর কইরা দিলেন-বইসা বইসা লেখো…

মাইয়া আইসা বাপ বাপ কইয়া দরজা থাবড়াইয়া চিল্লায় আর আমি দরজা লাগাইয়া ঘাপটি মাইরা বইসা করি মহাভারত। কিন্তু এত আউলাঝড়া জিনিস কেউ দেইখা না দিলে কেমনে হয়? পয়লা দুইজন মানুষেরই নাম আসে। রণ দা আর পাণ্ডব দা। রণ দা মানে রণদীপম বসু; লেখক। আর পাণ্ডব দা; জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আরিফ; লেখক। পাণ্ডব বংশের কেউ না; মহাভারত নিয়া লেখালেখিও করেন না কিন্তু নিজেরে পরিচয় দেন ষষ্ঠ পাণ্ডব কইয়া। দুইজনই মারাত্মক ব্যস্ত মানুষ কিন্তু তার উপরও খুঁটায়ে খুঁটায়ে মন্তব্য আসলো এই দুইজনের কাছ থিকা। সাহস বাইড়া গেলো আমার। আর লেখা যখন শেষ তখন আমার মারাত্মক কিছু ঘাটতি ধরাইয়া দিয়া অনেকগুলা তথ্য জোগান দিলো নজরুল; মানে ইন্টারনেটে আর মিডিয়াতে নজরুল ইসলাম আর ছাপা পুস্তকে যার নাম সৈয়দ দেলগীর…

পুলিশ মাইনসেরে বহুবিধ কারণে দৌড়ায়। কিন্তু বই লেখার লাইগা কাউরে তাইয়া দৌড়ের উপ্রে রাখা পুলিশ বোধহয় একজনই; মাসরুফ হোসেন। কঠিন পাঠক আর ভারতীয় পুরাণের এক ঘোরলাগা গ্রাহক। খণ্ড খণ্ড লেখার উপর শুধু মন্তব্যই না; বরং পুরা বইটা পইড়া অসঙ্গতি ধরার দায়টাও নিছে মাসরুফ প্রকাশের আগে…

কেউ কেউ আমারে কইছেন কই থাইকা কোন জিনিস নিছি আর কোন কথার সাক্ষী কোথায় পাওয়া যাবে তা তালিকাবদ্ধ কইরা দিলে পাঠকের নাকি সুবিধা হবে। কিন্তু এতে আমার আপত্তি আছে। প্ৰথমতো আমি লেখছি মহাভারতের গল্প; তালিকা-তুলিকা টাঙাইয়া এরে গবেষণাপুস্তক বানাইবার কোনো ইচ্ছা আমার নাই। দ্বিতীয়ত এই যুগে সবই পাওয়া যায় ইন্টারনেটে গুঁতা দিলে। তৃতীয়ত যদি কিছু নাও পাওয়া যায় কিংবা না মিলে আমার কথার লগে তবুও সমস্যা নাই; কারণ মহাভারত নিয়া নিজের মতো কইরা গল্প কইবার অধিকার মহাভারতই আমারে দিছে। সেই যে সৌতি কইছিলেন শত কবি কইছেন এর কথা আর বহু কবি কইবেন পরে…

তো আমিও কইলাম আমার মতো কইরা। যেকোনো বিষয়ে যে কাউরে দ্বিমত করার সম্পূর্ণ অধিকার দিয়া…

অভাজনের মহাভারত পয়লা আর পরবর্তী প্রকাশগুলার মাঝখানে পইড়া আছে অনেকগুলা লাশ; বেশ কিছু নির্বাসন এবং একটা প্রকাশনা সংস্থার স্বপ্নময় জন্ম আর দুর্বিসহ মৃত্যু যন্ত্রণার ছাপ…

বইটা পয়লা ছাপা ভার্সন প্রকাশিত হয় শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থাইকা ২০১৫ সালের বইমেলায়। ওই বছরই শুদ্ধস্বর প্রকাশনী আর প্রকাশনীর লেখকদের অনেক কিছুই লণ্ডভণ্ড হইয়া যাইতে শুরু করে ইসলামি জঙ্গিদের আক্রমণে। শুদ্ধস্বর আগাগোড়াই সেকুলার ধারার বই প্রকাশ করে; মূল নীতির মইদ্যে লালন করে অসাম্প্রদায়িকতা আর বিজ্ঞানমনস্কতা…

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থাইকা ফেরার পথে টিএসসিতে জঙ্গিরা চাপাতি দিয়া কোপাইয়া হত্যা করে মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়রে। মারত্মকভাবে জখম হন লেখক বন্যা আহমেদ। বছর জুইড়া মৌলবাদীরা একের পর এক খুন করতে থাকে লেখকদের। ৩১ অক্টোবর একই সাথে আক্রমণ করে ঢাকার দুই প্রকাশনী সংস্থায়; শাহবাগে জাগৃতি প্রকাশনীতে খুন হন। প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন আর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের অফিসে হামলায় আহত হন প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল; লেখক রণদীপম বসু আর কবি তারেক রহিম…

শুদ্ধস্বরে আহতরা প্রাণে বাইচা যায়। কিন্তু হইতে হয় দেশান্তরী। আরো বহু লেখকই দেশান্তরি হইতে থাকেন জঙ্গিদের ভয়ে…

শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থমকাইয়া যায়। বুকে হাত দিয়া বললে হয়ত বলতে হয় বন্ধই হইয়া গেছে চিরতরে। শুদ্ধস্বরের শুরু থাইকাই আমি আছি এর লগে। ২০০৪ সালে শুদ্ধস্বরের প্রথম দুইটা প্রকাশনীর একটা বই আমার; আর ২০১৫ সালে শুদ্ধস্বরের সর্বশেষ প্রকাশনীরও একটা বই আছিল আমার- অভাজনের মহাভারত…

বইটার দ্বিতীয় ছাপা ভার্সন প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে বাতিঘর থাইকা। তৃতীয় ভার্সন ই-বুক প্রকাশিত হইল বইদ্বীপ থাইকা। বইটার প্রথম আর পরের প্রকাশনাগুলার মাঝখানে সূত্রপথ হইয়া গাঁথা রইল লেখকদের রক্তের দাগ; নির্বাসনের অমর্যাদা আর একটা প্রকাশনী সংস্থার মৃত্যুযন্ত্রণার অস্বচ্ছ ইতিহাস…

মাহবুব লীলেন
আগস্ট ২০২০