ভণিতা বিস্তার

ভণিতা বিস্তার

ক. মহাভারতের কৃষ্ণায়ণ এবং রামের বৈষ্ণবায়ন
খ. বেদবিরোধী গীতার বৈদিকায়ন এবং রামায়ণের অতীতযাত্রা

অভাজনের মহাভারত পয়লা প্রকাশের কালে কাঠখোট্টা কথা বইলা বইটা ভারী করতে চাই নাই রেফারেন্স দিয়া। গল্পে নিজে কোনটা কেমনে ভাবছি আর কেন ভাবছি তারই একখানা খতিয়ান জুইড়া দিছিলাম ভণিতায়। আর গীতা যেহেতু মহাভারতের পরের যুগে জুইড়া দেওয়া অধ্যায়; তাই গল্প বলতে গিয়া গীতা যেমন পুরা বাদ দিয়া গেছিলাম তেমনি ভণিতায়ও এই বিষয়টা বাদ দিয়া গেছি ধর্মটর্মের বিতর্কে যাইতে না চাওয়ার ইচ্ছায়…

কিন্তু বইটা প্রকাশ হইবার পর আবিষ্কার করলাম; আমি গীতায় যাইতে চাই না বলার পরও মাইনসে কোমর বাইন্ধা হাজির হয় গীতা বিতর্ক নিয়া। আর গীতা আইলে চইলা আসে অবতার কৃষ্ণের প্রসঙ্গ। আর সেইটার ল্যাঞ্জা ধইরা আসে অবতারবাদ আর অবধারিতভাবে রামের কথা…

আমাগো দেশে কৃষ্ণ আর রামের নাম যেমন পাশাপাশি উচ্চারণ হয়; তেমনি মহাভারত নিয়া কেউ বাক্য শুরু করলে শেষ করে রামায়ণ দিয়া। যদিও হইবার কথা না; কিন্তু এইটা হইয়া গেছে। কৃষ্ণের লগে রামের মিল বা সম্পর্ক যেমন নাই; তেমনি মহাভারতের লগে বাস্তবে রামায়ণের কোনো মিল বা সম্পর্কও নাই। কৃষ্ণ আর রাম যেমন আলাদা সমাজের মানুষ; তেমনি মহাভারত আর রামায়ণও আলাদা সময় আর সমাজের ঘটনা; ধরনও ভিন্ন…

যখন বেদ আর উপনিষদ বাতিল কইরা; শৈব ধর্মের লগে এডজাস্ট কইরা আর বৌদ্ধ ধর্মরে টেক্কা দিয়া গীতা নির্ভর বৈষ্ণব ধর্মটা ধীরে ধীরে দানা পাকাইয়া হিন্দু ধর্ম সৃষ্টি হইতে থাকল; তখন কাহিনির গোষ্ঠি সম্পাদনায় মহাভারত আর আর রামায়ণের ভিতর যেমন বহুত মিল তৈয়ার করা হইল; তেমনি কৃষ্ণ আর রামেরে আইনা খাড়া করা হইল এক লাইনে; অবতার বানাইয়া…

ফলে মহাভারত নিয়া কথা কইতে গিয়া রামায়ণের নাম উচ্চারণ না করলে যেমন মানুষ গোষ্ঠী অভিজ্ঞতা স্মরণ কইরা হাউকাউ করে তেমনি কৃষ্ণ বিষয়ে কথা শেষ কইরা দিবার পর কান খাড়া কইরা থাকে রামের বিষয়ে শুনতে…

কৃষ্ণ আর রাম একলগে আলোচনা করার পদ্ধতি আছে মাত্র দুইটা। এর একটা হইল ধর্মভক্তি যেইটা দিয়া আলাপ করলে কোথাও কোনো খটকা চোখে পড়ে না। আর দ্বিতীয়টা হইল তুলনামূলক আলোচনা; যেইটা মূলত একটা ধান্দা লাগা বিতর্ক। কারণ সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের দুইটা মানুষরে কবিরা কল্পনা দিয়া জোড়া দিছে এক জায়গায়। ফলে এই বিষয়ে আলোচনা হয় না; হয় বিতর্ক…

কিন্তু এড়াইবার যেহেতু উপায় নাই; সেহেতু এইখানে দুইটা অধ্যায় জোড়া দিয়া দিলাম। খটমটানি যাগো ভাল্লাগে না; তারা এইটা বাদ দিয়া যাইতে পারেন। আর যাদের খুঁতখুতানি আছে তথ্যমথ্য নিয়া; তারা দেখতে পারেন…

তবে রামায়ণের লগে যারা মহাভারতের তুলনামূলক সাহিত্যিকি আলোচনায় আগ্রহী তাগো লাইগা সুকুমারী ভট্টাচার্যের ‘আপেক্ষিক মূল্যায়নে রামায়ণ ও মহাভারত’ একখান অসাধারণ পুস্তক। এইটা সম্ভবত সুকুমারীর একমাত্র রচনা যেইটা পড়তে গেলে রামায়ণ বা মহাভারতের মূল গল্প বিষয়ে সামান্য ধারণা থাকা ছাড়া পাঠকের আর কোনো প্রাক-যোগ্যতার প্রয়োজন নাই…

যেহেতু ভণিতাটা লেখা হইছিল সরল পাঠকের লাইগা আর এই বাগাড়ম্বড়খান যুক্ত করা হইছে পণ্ডিতগো লাইগা; সেহেতু ঘটনা আলাপের সুবিধার লাইগা কিছু কিছু বিষয় দুইখানে রিপিটেশন আছে…

এই আলোচনায় কাহিনী উপকাহিনীর লাইগা আমি বাল্মিকীর নামে প্রচলিত প্রাদেশিক-আঞ্চলিক রামায়ণের আখ্যানগুলার লগে উপজাতি রামায়ণ আখ্যানগুলাও হাতড়াইছি। নির্ভর করছি প্রচলিত বেদ উপনিষদ এবং পুরাণ সংগ্রহে…

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কালীপ্রসন্ন সিংহ আর কাশীরাম দাসের বাংলা মহাভারত থাইকা ঘটনা উল্লেখ করলেও বুঝতে সুবিধাজনক বইলা কোটেশনের লাইগা বাইছা নিছি রাজশেখর বসুর গদ্য অনুবাদের সংক্ষিপ্ত মহাভারত ও রামায়ণ…

যুক্তিটুক্তি দেখাইতে গিয়া যেইখানে যার নামে ঠ্যাক দিছি; চেষ্টা করছি সেইখানেই বইপুস্তকের নাম বইলা দিতে। তবে কমপক্ষে যেইসব পুঁথিপুস্তক ঘাঁটাঘাঁটি করা থাকলে এই আলোচনার কথাবার্তাগুলা বাজাইয়া দেখতে সুবিধা হবে সেইগুলার মইদ্যে আছে কেদারনাথ মজুমদারের রামায়ণের সমাজ; রোমিলা থাপারের ভারতবর্ষের ইতিহাস; নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ীর বাল্মিকীর রাম ও রামায়ণ, মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ; বিপ্লব মাজীর বাল্মিকী রামায়ণে রাম- আদিবাসী রামায়ণে রাম; অতুল সুরের ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, মহাভারত ও সিন্ধু সভ্যতা, ভারতের বিবাহের ইতিহাস; সুকুমারী ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ সংগ্রহ; ভবানীপ্রসাদ সাহুর ধর্মের উৎস সন্ধানে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কৃষ্ণ চরিত্র, শ্রীমদভগবদগীতা; বুদ্ধদেব বসুর মহাভারতের কথা; শিশির কুমার সেনের মহাভারতের মূল কাহিনি ও বিবিধ প্রসঙ্গ; জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায়ের ধর্ম ও প্রগতি; হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রামায়ণ: খোলা চোখে, কৃষ্ণ কাহিনী মহাভারত…

. মহাভারতের কৃষ্ণায়ণ এবং রামের বৈষ্ণবায়ন

জনপ্রিয় ধারণায় রাম-রামায়ণ-বাল্মিকীরে কৃষ্ণ-মহাভারত-দ্বৈপায়ন থাইকা প্রাচীন ভাবা হইলেও ঘটনা কিন্তু ঠিক উল্টা। এর পক্ষে পয়লা জোরালো যুক্তিটা হইল দক্ষিণ দিকে আর্যগো ভারত বিস্তারের কালক্রমের লগে দখলি-মানচিত্রের হিসাব। মহাভারতের ঘটনাস্থল থাইকা রামায়ণ ঘটনাস্থল আরো বহুত পূর্ব দিকে। আর্যগো দক্ষিণ দিকে পা বাড়াইবার ঐতিহাসিক সময়কাল মাথায় রাইখা রমিলা থাপারও মন্তব্য করেন যে রামায়ণ তৈরি হইছে ৮০০খিপূর অন্তত পঞ্চাশ থাইকা একশো বছর পরে। মানে সাড়ে সাত থাইকা সাতশো খিপূর দিকে…

রমিলা থাপারের এই যুক্তিটা অতুল সুরও সমর্থন করেন। আর্য-যাত্রার সময়কালের লগে আর্যগো ভূগোল-পরিক্রমা নিয়া যারা কাজ করেন তাগো প্রায় সকলেরই হিসাব নিকাশ প্রায় এক। সকলেই মোটামুটি একমত যে কুরু-পাঞ্চাল এলাকাই হইল পয়লাবারের মতো আর্যগো সাম্রাজ্য স্থাপনের নিদর্শন; যেইখান থাইকা অযোধ্যা কিংবা কোশলের মতো দক্ষিণের ভূমি পর্যন্ত পৌঁছাইতে আর্যগো সময় লাগছে আরো কয়েক শো থাইকা হাজার বছর…

বাল্মিকীরে রামায়ণের সক্রিয় চরিত্র ধইরা রামায়ণ বিচার করতে গেলে রামায়ণের প্রাচীনত্ব কইমা আসে আরো কয়েকশো বছর। কারণ ঐতিহাসিকভাবে ধরা হয় বাল্মিকী খিপূ পাঁচ থাইকা চাইর শতাব্দির মানুষ। এমন কি বিপ্লব মাজীর মতো কেউ কেউ কন যে সংস্কৃতে রামকথার সব থিকা প্রাচীন নিদর্শন ভট্টিকাব্য। এবং বাল্মিকীর রামায়ণ রচনার আগেই কালিদাস তার রঘুবংশ লিখা ফালাইছিলেন। মানে বাল্মিকী কালিদাসেরও পরের মানুষ। রামায়ণে বাল্মিকীর উপস্থিতি সঠিক ধইরা নিতে গেলে তার পোলার বয়েসি রামের বয়সও কইমা আসে আরো বেশ কিছু। আর রামেরে অবতার ধরতে গেলে সেই হিসাবটা চইলা আসে আরো বহু বহু কাছে; বৌদ্ধ বিপ্লবের পরে আর খ্রিস্ট জন্মের সামান্য কিছু আগে। কারণ ধর্মের উৎস সন্ধানে বইয়ে ভবানীপ্রসাদ সাহু কন রামেরে অবতার হিসাবে পরিচিত করানো হইছে আর্যগো দক্ষিণ দিকের যাত্রার সময়; গুপ্ত যুগে…

অন্যদিকে মহাভারতের পাণ্ডবগো সপ্তম পুরুষের রাজত্বকালীন হস্তিনাপুরের কিছু নিদর্শনের বয়স মোটামুটি নির্ধারিত হইছে খিপু ৮০০’র মতো। এইটারে ধইরা রমিলা থাপার তার ভারতবর্ষের ইতিহাস পুস্তকে কুরুযুদ্ধের সময় নির্ধারণ করেন ৯০০খিপূ। বেশিরভাগের হিসাবে মহাভারত কমবেশি এক হাজার খিপু সালের ঘটনা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হিসাবে কুরুযুদ্ধ হইছে ১৪৩০খিপূ সালে। অতুল সুর তার মহাভারত ও সিন্ধু সভ্যতা পুস্তকে বিশ্লেষণ কইরা দেখান যে প্রাচীন দুই গণিতবিদ আর্য ভট্ট আর বরাহ মিহিরের গণনায় যুধিষ্ঠিরের রাজ্য অভিষেকের সময় গিয়া খাড়ায় ২৪৪৮ খিপূ সাল। আর্যভট্ট-বরাহ মিহির কুরুযুদ্ধ নিয়া কিছু কন নাই আর সাক্ষী প্রমাণের অভাবে অতুল সুর কুরুযুদ্ধের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। কুরুযুদ্ধ বিশ্বাসীরা চাইলে এই তারিখ থাইকা তিরিশ বচ্ছর বিয়োগ দিয়া কুরুযুদ্ধের সাল বাইর কইরা নিতে পারেন…

এর বাইরে জনপ্রিয় প্রচলিত ধারণামতে মহাভারতের সময়কাল ৩১০০খিপূর কাছাকাছি। কিন্তু আর্যভট্ট-বরাহ মিহিরদের হিসাব কিংবা মহাভারতের আরো প্রাচীনত্বের দাবি মানতে গেলে আরেকটা বিকট ঝামেলায় পড়তে হয়। সেই ক্ষেত্রে মাইনা নিতে হয় যে মহাভারতের ঘটনা ঘটছে ভারতবর্ষে আর্যগো আগমন এবং ঋগবেদ তৈরির দেড় দুই হাজার বচ্ছর আগেই। সেইটা মানার যুক্তি আছে বইলা মনে হয় না। কারণ মহাভারতের চরিত্রগুলারে অন্তত প্রাক-আর্য হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর মানুষ ভাবা প্রায় অসম্ভব…

ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম দিকে ঢোকা ইরানি মানুষ বা আর্যগো পয়লা দলের যে আগমন। ক্যালেন্ডার পাওয়া যায় তা সর্বোচ্চ ১৫০০ খিপূ সাল। ঘোড়ায় চইড়া প্রথমে আফগানিস্তানে ঢোকা এই ইরানিরাই নিজেগো আদিভূমি থাইকা স্মৃতিতে নিয়া আসছিল ঋগবেদের কিছু শ্লোক। পরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে পাঞ্জাবে থিতু হইয়া আদিভূমির স্মৃতির লগে পাঞ্জাববাসের অভিজ্ঞতা মিলাইয়া মোটামুটি ঋগবেদরে একটা সাইজে নিয়া আসে; যদিও ঋগবেদ রচনা চলতে থাকে আরো প্রায় হাজারখানেক বছর। মোটামুটি আর্যগো সারা ভারত জয়কালীন পর্যন্ত চলতে থাকে ঋগবেদের সংযোজন পরিবর্ধন। এবং এর লগে লগেই তৈয়ারি হয় আরো দুইখানা কিংবা মতান্তরে তিনখান বেদ…

ভারতে আর্যগো আগমনকালের দিকে তাকাইয়া একটা জিনিস অন্তত নিশ্চিত কইরা বলা যায় যে খিপূ ১৫০০ সালের আগে ভারতবর্ষে বৈদিক কিংবা ইরানি-আর্যভাষাগোষ্ঠী সম্পৃক্ত কোনো ঘটনার কোনো অস্তিত্ব নাই; শাস্ত্রও না; ভগবানও না; রাজা-বাদশা-ঋষি-কবি-যুদ্ধ এইগুলা তো বহুত বহুত দূর। এর আগের বইলা যা কিছু দাবি করা হয় তা সবই মূলত সময় গুণতে না পারা ধর্মবিশ্বাস কিংবা লোকায়ত সাহিত্য…

এই হিসাবে মহাভারত ঘটনার বয়স সংক্রান্ত বঙ্কিমচন্দ্রের হিসাবটাও বাতিল না কইরা উপায় থাকে না। কারণ আর্যগো আগমন কাল থাইকা বঙ্কিমচন্দ্রের হিসাবে কুরুযুদ্ধকালের ব্যবধান সত্তুর বছর। আর হিসাবমতে কুরুযুদ্ধকালে যুধিষ্ঠিরসহ প্রায় সকলের বয়স আছিল কমপক্ষে ষাইটের কাছাকাছি কিংবা বেশি। এই ক্ষেত্রে বঙ্কিমের হিসাব মাইনা নিতে গেলে ধইরা নিতে হইব যে বিদুর পাণ্ডু- ধৃতরাষ্ট্র এদের সকলেরই জন্ম হইছে ভারতে আর্যগো আগমনের আগেই; অন্য কোথাও। তাছাড়া ঋগ্বেদরে যারা অনেক প্রাচীন কইতে চান তারা কন এইটা তৈরি হইছে খিপূ ১৩০০-তে আর যারা এরে আরো নবীন বলেন তারা কন ১২০০ খিপূ; মানে বঙ্কিমচন্দ্রের হিসাবে কুরুযুদ্ধের কমপক্ষে ১৩০ কিংবা ২৩০ বছর পরে…

মহাভারতরে ঋগবেদের আগের ঘটনা ভাবা কঠিন। কারণ ঋগবেদ যেখানে বেশ ভালো কইরাই আর্যগো ছোটখাটো ঘটনাবলীর ডায়েরি কইরা গেছে সেইখানে কিন্তু মহাভারত ঘটনার কিছুই নাই। আবার এইটাও সইত্য যে মহাভারত কাহিনিতে কিন্তু কিছু বৈদিক দেবতার অগোছালো উপস্থিতি ছাড়া বৈদিক সিস্টেমের প্রভাব প্রায় কিছুই নাই। আবার মহাভারতে বৈদিক দেবতাগো যে উপস্থিতি তাতে এইটারে বৈদিক দেবতাগো দাপটের কাল না কইয়া পতনকালের সময় হিসাবেই ধরবার যুক্তি বেশি মনে হয়। সেইখানে সূর্য আইসা কিশোরী কুন্তীর খেলায় সঙ্গ দেন; অগ্নী আইসা ভিক্ষা করেন কৃষ্ণ-অর্জুনের কাছে। দেবরাজ ইন্দ্র অর্জুনের কাছে মাইর খাইয়া পরে কুরুযুদ্ধে অর্জুনের ফুটফরমাস খাটেন। অথচ অন্যদিকে পাণ্ডবপক্ষের অর্জুন কিংবা কুরুপক্ষের অশ্বত্থামা কারো পক্ষেই কার্যকর বীরত্ব দেখানো সম্ভব হয় না বৈদিক সমাজে আত্মীকৃত নতুন অনার্য দেবতা শিবের আশীর্বাদ ছাড়া…

অবশ্য হিসাব মতে মহাভারতে বৈদিক দেবতার উপস্থিতি; মানে কুন্তীরে গর্ভবতী করা থাইকা কর্ণের অক্ষয় কবচ চুরি আর অবৈদিক দেবতা শিবের ভূমিকা; মানে দ্রৌপদীরে পাঁচ স্বামী দান করা থাইকা পাঁচ পোলা হত্যায় ইন্ধন দেয়া; দুইটার কোনোটাই আদি মহাভারতের অংশ না। দুই ধরনের দেবতার উপস্থিতিই পরবর্তীকালের ইনজেকশন। কিন্তু ইনজেকশনের ধরন দেইখাই সেইখানে বৈদিক দেবতাগো পতনকাল আর শিবের উত্থানকালের নিদর্শন কিন্তু অনুমান করা যায়…

আবার অন্যদিকে দ্বৈপায়নের মতো অনার্যগর্ভজাত এক ঋষি ছাড়া পুরা মহাভারত কিন্তু সম্পূর্ণভাবে সাধারণ ব্রাহ্মণগো দাপটমুক্ত আখ্যান। তবে দ্বৈপায়ন সেইখানে ঋষি হিসাবে নাকি কুরু-পাণ্ডবের পিতামহ হিসাবে সম্মানিত সেইটা কিন্তু বিতর্কের বিষয়…

সাধারণভাবে ব্রাহ্মণসেবা বা বামুন বন্দনা বলতে যা বোঝায় তার অস্তিত্ব মহাভারতে নাই। মহাভারতে পুরোহিত বামুনগো এক্কেবারে নিচু স্তরের রাজকর্মচারী ছাড়া অন্যকিছু ভাবা কঠিন। সম্রাট ধৃতরাষ্ট্রের পুরোহিত কৃপাচার্য শান্তনু পরিবারে পালিত এক না খাওয়া ঘরের সন্তান। ধৃতরাষ্ট্রের দূত সূতপুত্র সঞ্জয়রে আমরা সম্রাটের লগে যতটা বড়ো গলায় কথা কইতে দেখি কৃপাচার্যরে তার কণামাত্রও দেখি না। তিনি আগাগোড়া তলুয়া হিসাবেই আচরণ করেন। যুধিষ্ঠিরের পুরোহিত ধৌম্যরে পাণ্ডবগো পিছে পিছে ঘটিধরা মানুষ ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নাই…

মহাভারতে আরেকজন রাজকীয় পুরোহিতের দেখা পাই; পাঞ্চাল রাজ দ্রুপদের পুরোহিত; যে পয়লাবার শান্তি প্রস্তাব নিয়া হস্তিনাপুর যায়। কিন্তু দ্রপদ যেইভাবে তারে কাজ বুঝাইয়া দিছেন আর রাজসভায় তারে যেইভাবে ভীষ্ম এমনকি কর্ণ পর্যন্ত ঝাড়ি দেয়; তাতে তার সামাজিক অবস্থান যে কোনোভাবেই উপরের দিকে না তা কিন্তু এক্কেবারে পরিষ্কার হইয়া যায়। উল্টাদিকে রামায়ণে বিশ্বামিত্র-বশিষ্ঠগো দাপট ছাড়াও গৌতমপুত্র তরুণ শতানন্দ যেই রকম ব্যক্তিত্ব নিয়া রাজার লগে কথা কয়; তাতে নিশ্চিত ধইরা নিতে হয় যে রামায়ণ সমাজে পুরোত বামুনের স্থান যেকোনো মন্ত্রী থাইকাও উপরে…

অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসু আমাগো মনে করাইয়া দেন যে মহাভারতে একবারের লাইগাও কিন্তু কৃষ্ণের মুখে বামুন বন্দনা কিংবা শূদ্র নিন্দার কথা শোনা যায় না। মানে মহাভারত যুগ পর্যন্ত এই দুইটার কোনোটাই আছিল না। এর আরেকটা প্রমাণ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে কুন্তীর আয়োজনে নয় পুত্রবধূর এক্কেবারে মাঝখানের আসনে শূদ্রেতর অনার্য নারী হিড়িম্বারে বসানোর ঘটনা থাইকাও আমরা পাইতে পারি…

কৃষ্ণভক্ত বামুন বঙ্কিমচন্দ্র যেইখানে খালি শূদ্রঘরে জন্মাইবার কারণে শূদ্রগো ছ্যা ছ্যা কইয়া তার ভগবদগীতায় ঘিন্না করেন; সেইখানে বঙ্কিমের ভগবান কৃষ্ণ কোনো শূদ্রনিন্দাই করেন নাই; কারণ চতুবর্ণ জিনিসটা মহাভারতের আরো প্রায় পাঁচশো বছর পরে বঙ্কিমচন্দ্রের মতো বামুনগো হাতে আবিষ্কৃত জিনিস। মহাভারতে যা আছে তা কিন্তু ব্যক্তির বন্দনা কিংবা নিন্দা; সেইটা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের লাইগাই। তার জাতের লাইগা না। সেইখানে পরের ঘরের বৌ টানাটানি করার লাইগা ভরদ্বাজের মতো ঋষি বামুনের পোলারে আমরা পাব্লিকের হাতে পিটানি খাইয়া মরতে দেখি। অস্ত্র চুরির লাইগা সন্ন্যাসী বামুনরে ভীমের হাতে কিল খাইয়া মরতেও দেখি। তেমনি বিনাবাক্যে সকলরেই দেখি মাইমল কন্যা সত্যবতীর পোলা দ্বৈপায়নের কথা মাথা পাইতা নিতে…

বামুনরা ধীরে ধীরেই তাগো পরখাউকি পদ সুরক্ষিত করছে রাজতন্ত্রের ভিতর। বহুত বহুত সময় লাগছে এতে। বেদ প্রচার-যজ্ঞ- উপনিষদ-পুরাণ-গীতা এমনকি পূজা পদ্ধতি প্রচলন হওয়া পর্যন্ত চলছে বামুনগো অবস্থান নিশ্চিতকরণের প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ারে মাথায় রাইখা মহাভারতের দিকে তাকাইলে এইটা অন্তত মনে হয় যে মহাভারতকালে অগোছালোভাবে ঋগবেদ এবং হয়ত অন্য বেদগুলার কিছু কিছু বিধান বা শ্লোক প্রচলিত থাকলেও বৈদিক সিস্টেমের লাঠিটারে বামুনরা তখনো ঠিকমতো জুইত কইরা ধরতে পারে নাই। যেইটা রামায়ণ সময়ে আইসা মোটামুটি পোক্ত কইরা ধরছে তারা…

মহাভারত সময়ে বেদের শ্লোকগুলা অগোছালো অবস্থায় থাকার একটা ইংগিত মহাভারত রচয়িতার জীবনীতেই আছে। সেইখানেই কওয়া হইছে যে অগোছালো বেদগুলারে দ্বৈপায়নই পয়লা গুছায়া সংকলন করেন। সুকুমারী ভট্টাচার্যের ভাষায় ‘শাস্ত্রে ব্যাসের মৃত্যুর কথা লেখে না’ মাইনা নিলেও সত্য হইল যে দ্বৈপায়নের জীবনী রচনা করা হইছে তিনি মইরা যাবার অন্তত ছয়-সাতশো বছর পরে…

রামায়ণরে মহাভারতের পরের আখ্যান কইতে গেলে সব থিকা বড়ো বাধাটা আসে অবতারবাদী বৈষ্ণবগো কাছ থিকা। তাগো হিসাব মতে রাম বিষ্ণুর সপ্তম আর কৃষ্ণ হইলেন অষ্টম অবতার…

অবতারবাদী ধারণামতে বিষ্ণুর দশজন অবতারের মইদ্যে নয়জন আইসা গেছেন আর ভবিষ্যতে কল্কি অবতার নামে আরো একজন আসবেন। তবে আইসা পড়া নয় অবতারের তালিকায় কিন্তু ভিন্নতা আছে…

তালিকায় বিষ্ণুর অবতারগো মইদ্যে পয়লা তিন অবতার মাছ-কচ্ছপ-শূওর। চতুর্থ অবতার আধা মানুষ আধা সিংহ। পঞ্চম অবতার এক অপূর্ণ বা বাইট্টা মানুষ। বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার হইলেন ভার্গব বংশের পরশুরাম; পয়লাবারের মতো এক পূর্ণ মানুষ। এই তালিকার সাত নম্বরে রাম আট নম্বরে কৃষ্ণ। যদিও ছয় নম্বর পরশুরামরে আমরা সাত আর আট নম্বরের সময়ও কুড়াল হাতে নিয়া ঘুরাঘুরি করতে দেখি…

অবতার তালিকার নয় নম্বরে দক্ষিণ ভারতীয় তালিকায় আছে কৃষ্ণের ভাই বলরামের নাম। অন্যসব তালিকায় বলরামের জায়গায় গৌতম বুদ্ধ। আবার গৌড়ীয় আর নিম্বার্ক এর মতো মধ্যযুগীয় বৈষ্ণবগো তালিকায় অবতার হিসাবে কৃষ্ণর নাম নাই। এইসব মতে কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান; কৃষ্ণ শুধু অন্যান্য অবতারগো উৎসই না; স্বয়ং বিষ্ণুরও উৎস তিনি…

কৃষ্ণ বিষ্ণুর উৎস কথাটারে সোজা বাংলায় অনুবাদ করলে কিন্তু খাড়ায় যে বিষ্ণু বা নারায়ণের সৃষ্টিকর্তা হইলেন কৃষ্ণ। বেদে বিষ্ণু বা নারায়ণের কোনো অস্তিত্বই নাই। যদিও বেদের কয়েকজন বসু কিংবা সূর্যর লগে বিষ্ণু বা নারায়ণের সম্পর্ক দেখানোর একটা চেষ্টা করা হয়; কিন্তু বেদে বসুরা যেমন নগণ্য দেবতা তেমনি সূর্যও তাই। মূলত ব্রহ্মা এবং শিবের মতো নারায়ণ বা বিষ্ণুও অবৈদিক লৌকিক দেবতা…

ঠিক এই জায়গাটায় সুকুমারী ভট্টাচার্য আর নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর রচনা সামারি করলে কিন্তু সরাসরি বইলা দেয়া যায় যে- আইজকার ভগবান নারায়ণ বা বিষ্ণুর সৃষ্টি হইছে স্বয়ং বাসুদেবপুত্র কৃষ্ণ এবং তার ভার্গব বংশজাত আত্মীয় স্বজনের হাতে। কৃষ্ণ দ্বারা নারায়ণী বা ভাগবতী বা পাঞ্চজন্য ধর্মের প্রচার আর তার সংকলন হিসাবে ভগবৎগীতা রচনা; সব কিছুই ঘটছে তথাকথিত কুরুযুদ্ধের পরে…

কৃষ্ণের বুদ্ধিতে কুরুযুদ্ধ জয় কইরা সম্রাট হইবার পর যুধিষ্ঠির কিন্তু কৃষ্ণরে ফালায়া দেয়। বলতে গেলে হস্তিনাপুর থাইকা খেদাইয়াই দেয়। রাজসূয় যজ্ঞে যেই কৃষ্ণরে যুধিষ্ঠির দেবতার অর্ঘ্য দেয়; সম্রাট হইবার পর তার অশ্বমেধ যজ্ঞে সেই কৃষ্ণরে নিমন্ত্রণখান পর্যন্ত করে না যুধিষ্ঠির। এই পর্বে যুধিষ্ঠির পুরাই চইলা যায় কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের কব্জায়। এই নিয়া ভাইয়েগো মাঝে গ্যাঞ্জামও হয়। যুধিষ্ঠিরের লগে গ্যাঞ্জামে অর্জুন ভিন্নভাতে বাস করতে থাকে ইন্দ্রপ্রস্থ গিয়া। আর বাকি তিন ভাই থাকে সম্রাটের লগে হস্তিনাপুর। এই পর্বে পাণ্ডবগো মাঝে কৃষ্ণের যোগাযোগ থাকে একমাত্র তার বন্ধু আর বইনের জামাই অর্জুনের লগে। যুধিষ্ঠিরের সাথে এক্কেবারেই না। এর পিছনে কিন্তু মূল কাঠি নাড়েন বেদজ্ঞ কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন…

কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন কৃষ্ণরে বেদবিরোধী মানুষ বইলাই প্রচার করতেন। এই পর্বটারে অনেকে কৃষ্ণের পতন কইলেও সেইটাই কিন্তু কৃষ্ণ-জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায়। কারণ হস্তিানপুর থাইকা বহিস্কৃত হইবার পরেই অন্য এক পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে কৃষ্ণ। যুদ্ধমুদ্ধ বাদ্দিয়া কৃষ্ণ শুরু করে ধর্মের প্রচার। ভক্তিবাদী ধর্ম। নারায়ণী অথবা ভাগবতী অথবা পঞ্চরাত্র। বহুত সম্পাদনা আর সংযোজন বিয়োজনের পর সেইটারই আজকের পুস্তক ভার্সন হইল গীতা আর প্রায়োগিক ভার্সন হইল বৈষ্ণব ধর্ম…

গীতারে বর্তমানে বেদ উত্তীর্ণ দর্শন হিসাবে সাফাই দিয়া বেদের লগে লাইনআপ করা হইলেও গীতা মূলত বেদবিরুদ্ধ দর্শন। যার লাইগা ঘাটে ঘাটে কৃষ্ণের এই দর্শন বাধাপ্রাপ্ত হয় দ্বৈপায়নের কাছে। কৃষ্ণের ধর্মপ্রচার থামাইতে না পাইরা পুরা যাদব বংশটারেই নির্বংশ কইরা দেন বেদব্যাস কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। মহাভারতে নারদ টারদের যেইসব অভিশাপে যাদবকূল ধ্বংস হইবার কথা পাওয়া যায় সেইগুলা ভুয়া। মূলত দ্বৈপায়ন আর তার বেদব্যাস ঘরাণাই যাদব বংশরে নাশ কইরা দেয়…

বড়ো বেঘোরে ধ্বংস হয় কৃষ্ণের বংশ। বড়োই করুণ মৃত্যু ঘটে কৃষ্ণের। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় মানবেতিহাসের হীনতম মৃত্যু। কিন্তু বংশনাশ হইয়া গেলেও কোনোভাবে টিকা থাকে কয়েকটা জিনিস; ভাগবতী বা নারায়ণী ধর্ম; বেদ বিরুদ্ধ ভগবতগীতা; দেবতা হিসাবে নারায়ণের প্রতিষ্ঠা আর নারায়ণ বা বিষ্ণুর প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে যাদব কৃষ্ণ স্বয়ং…

ভাগবতী ভক্তিবাদী দর্শন এক্কেবারে কিন্তু একলা কৃষ্ণের আবিষ্কার না; এর কিছু কিছু উপাদান আগেও আছিল। বিশেষ কইরা এর উপর উপনিষদের ব্রহ্মতত্ত্বের প্রভাব বহুত। তবে ব্রহ্মতত্ত্ব আর বৈষ্ণব ধর্মে বর্তমানে ফারাকের পরিমাণই বরং বেশি। কৃষ্ণ বৈদিক যজ্ঞ-মজ্ঞর স্থলে নিয়া আসেন ভক্তিরে; ধীরে ধীরে তৈরি হইতে থাকে গীতার দর্শন। অবতার জিনিসটা মূলত ভগবানরে নিজের ঘরে নিয়া আইসা ঘনিষ্ঠ হিসাবে অনুভব করানোর কৌশল। এই ভগবান বৈদিক লুজ কারেক্টার দেবতা না; যারে চাইলেই মাইর দেয়া যায়। আবার উপনিষদের নিরাকার ব্রহ্মাও না; যারে দেখাও যায় না ছোঁয়াও যায় না; অনুভব তো দূরের কথা…

উপনিষদের নিরাকার ব্রহ্ম কিন্তু কোনো বামুনের উদ্ভাবন না; একজন রাজার উদ্ভাবন। ক্ষত্রিয় রাজা প্রবাহণ তার নিরাকার ব্রহ্মারে পরিচয় করানোর লাইগা শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করেন ঋষি উদ্দালক আরুণীরে। প্রবাহণের ব্রহ্মতত্ত্বরে প্রচার করার লাইগাই ঋষি উদ্দালক তার পোলা শ্বেতকেতুরে নিয়া শুরু করেন উপনিষদ রচনা। উপনিষদ রচনা কিন্তু চলতে থাকে মোটামুটি খিপূ তৃতীয় শতক পর্যন্ত। মানে বৌদ্ধ ধর্ম আর বৈষ্ণব ধর্মের সমান্তরালে বহু বছর। কিন্তু এর মইদ্যেই বৈষ্ণব ধর্ম ছাপাইয়া উঠে বৈদিক-উপনিষেদিক কিংবা শৈবধর্মসহ বর্তমান হিন্দুবাদী অন্য সকল ধর্মের উপরে। আত্মা কর্মফল ভক্তি এই উপাদানগুলারে মিলায়া মিশায়া গেরস্থ কিংবা সন্ন্যাসী সকল ভক্তের কাছে ফলাফলহীন ভক্তি প্রত্যাশা কইরা কৃষ্ণ নিজেরে স্থাপন কইরা দেন স্বয়ং ভগবানের স্থানে; নারায়ণ; বিষ্ণু…

কৃষ্ণর ধর্মপ্রতিষ্ঠায় কৃষ্ণউত্তরকালে মূল কামটা করেন ভার্গববংশজাত তার আত্মীয়েরা। যে দ্বৈপায়ন গীতার বিরোধীতা করছেন; ভার্গবরা সেই গীতারেই নিয়া ঢুকাইয়া দেয় দ্বৈপায়নের মহাভারতের ভিতর। রচনা করে কুরুযুদ্ধের আখ্যান। আগাগোড়া বদলাইয়া দেয় মহাভারতের অধ্যায় কাহিনি এবং পুরা মহাভারতটারেই পরিণত করে কৃষ্ণ কাহিনিতে…

বেদ ছাইড়া কৃষ্ণরে স্বয়ং ভগবানের আসন দিয়া বৈষ্ণব ধর্ম ছড়াইয়া পড়ে বেদোত্তর কালে।

অবতারবাদীরা অবশ্য কৃষ্ণরে ভগবান না বইলা সিরিয়ালি অবতারগো মাঝে সব শেষে রাইখা বৈষ্ণব ধর্মরে পোক্ত করেন। কৃষ্ণরে আইসা পড়া নয় অবতারের শেষে রাখার উদ্দেশ্য হইল এর পরে যাতে আর কেউ কৃষ্ণকথার উপর খবরদারি করতে না পারে। অনেকটা নবী মোহাম্মদের পুরানা সকল নবীরে একটা কইরা সালাম দিয়া নিজেরে শেষ নবী ঘোষণা কইরা নতুন নবী আসার দরজায় পেরেক মাইরা দিবার মতো। তবে মোহাম্মদ যেমন ভবিষ্যতে একজন ইমাম মেহদি আসার একটা চিপা রাস্তা খোলা রাখছেন; তেমনি অবতারবাদীরাও একটা চিপা রাস্তা খুইলা রাখছে ভবিষ্যতে একজন কল্কি অবতার আসার লাইগা। কিন্তু এইটাও নিশ্চিত যে এখন কল্কি অবতার কইয়া কারো আর খাড়াইবার প্রায় কোনো চান্স নাই এই জটিল মনস্তাত্ত্বিক যুগে…

প্রশ্ন হইল অবতার হিসাবে কৃষ্ণের পরে রামের দরকার হইল ক্যান? অবতারের তালিকার দিকে তাকাইলে একটা জিনিস পরিষ্কার হইয়া যায় যে সেই তালিকায় কৃষ্ণের আগে যাগো নাম পাওয়া যায় তাগো মাঝে কৃষ্ণ ছাড়া কেউই কীর্তিমান না। সিরিয়ালি পয়লা চাইর জন এমনকি মানুষও না; বরং তারা মাছ কচ্ছপ শুওর আর সিংহ। অবতারের তালিকায় পয়লা যে মানুষের দেখা মিলে সে আবার বামন কিংবা অপূর্ণ মানুষ। তালিকার ছয় নম্বরে একজন পূর্ণ মানুষের নাম পাইলেও সেই পরশুরামের আদৌ কী বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে তা খুইজা বাইর করা মুশকিল। পরশুরামের যা গল্প পাওয়া যায় তার মইদ্যে আছে বাপের মরার প্রতিশোধ নিতে একুশখান বেহুদা হত্যাযজ্ঞের কাহিনি। আর আছে অস্ত্র শিক্ষার ইস্কুল চালানো। আর তার লগে আছে নিজের মায়েরে খুন করার মতো মাতৃঘাতী অপবাদ। বৌ নাই; পোলাপান নাই; সমাজ নাই; মানবজাতির উপকারের কোনো রেকর্ডও নাই…

সুকুমারী ভট্টাচার্যের ভাষায় অবতারগো মাঝে কৃষ্ণই একমাত্র ত্রাতা। তার সকল কাজই অন্যের লাইগা। শিশুপালের বাগদত্তা রুক্মিণীরে জোর কইরা বিবাহ করা ছাড়া নিজের শক্তি দিয়া নিজের লাইগা আর কিছু করেন নাই তিনি। বাকি সব কাজ অন্যের লাইগা। রাজা বানাইছেন কিন্তু রাজা হন নাই…

কিন্তু কৃষ্ণ এক নিম্নবর্গের চাষী পরিবারের কালা রংয়ের মানুষ। কোনোভাবেই কোনো রাজবংশের মানুষ না। একজন যোদ্ধা আর বড়োজোর দার্শনিক মাত্র। সবচে বড়ো বিষয় হইল কৃষ্ণের যুদ্ধটা পুরাপুরি বৈদিক সমাজেরই বিপক্ষে বামুনগো সম্মান টম্মান দেখানোর তেমন কোনো উদাহরণ নাই তার। বড়ো বেঘোরে নির্বংশ হইতে হইছে মানুষটারে। তার উপরে তার প্রকাশিত যোদ্ধা আর কূটনীতিবিদের জীবন; যেইখানে ভালো কাম করার থাইকা ভালো কইরা কাম করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ আছিল; যার লাইগা সততা ফততারে কূটনৈতিকের মতো হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করলেও কৃষ্ণের পক্ষে সেইগুলারে মাইনা চলা সম্ভব আছিল না…

কৃষ্ণ সত্যের কথা কইতেন; সততারে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতেন; কিন্তু কোনোভাবেই বলা যাবে যে তিনি আগাগোড়া আছিলেন একজন সৎ মানুষ। এর সাথে আছে তার বেহদ্দ মাতাল বংশের বদনাম; পরের বাগদত্তা টাইনা আনার দুর্নাম; নিজের মামারে খুন করার দুর্নাম; আছে ঘাটে ঘাটে বিবাহের ইতিহাস; পরিবারে নিজের পোলার লগে সৎমায়ের পরকীয়ার কেলেংকারি…

এইসব ঘটনার লগে গোয়ালা আয়ন ঘোষের ভাইগ্নার মামীরে লইয়া টানাটানি আর কদম ডালের বানরামিও যখন এই কৃষ্ণের ঘাড়েই মূর্খ বৈষ্ণব কবিরা চাপায়া দিলো তখন বৈষ্ণব ভার্গবগো দরকার পড়ল নারায়ণের বিতর্কহীন একজন রাজবংশীয় অবতার…

বিষয় হইল ততদিনে ললিত বিস্তারের কল্যাণে গৌতম বুদ্ধের ক্লিন ইমেজ কিন্তু বিশাল ফ্যাক্টর হইয়া উঠছে। বৌদ্ধ বিপ্লবে বামুনধর্মের অবস্থা পুরাই নাজুক। কোথাও কোথাও হিন্দু পণ্ডিতেরা ঘর সামলাইতে গিয়া স্বয়ং বুদ্ধরেই অবতার হিসাবে গ্রহণ কইরা ফালাইছেন। যদিও তখন পর্যন্ত ‘হিন্দু ধর্ম’ কথাটা চালু হয় নাই…

সমস্যা হইল বুদ্ধরে অবতার স্বীকার কইরা হিন্দুধর্ম প্রচার আর প্রচলিত হিন্দু ধর্মের বিপক্ষে বৌদ্ধ ধর্মের অবস্থান দুইটা সম্পূর্ণ দুই মেরুর জিনিস। বৌদ্ধরে হিন্দু অবতার কইলেও বৌদ্ধ ধর্মরে হিন্দু ধর্ম কওয়া সম্ভব না। বরং বৌদ্ধ ধর্ম হিন্দু ধর্মের বিপরীতেই অবস্থান করে। বিশেষত চতুবর্ণ কিংবা জাতপাত কিংবা মাইনসের ঘাড়ে বামুনদের ভূত হইয়া চইড়া বসা; যেইগুলা তখন মাইনসের জীবনরে নরক বানায়া রাখছে। তো এই অবস্থায় বুদ্ধরে পকেটে ঢুকানোর পরেও একজন সম্ভ্রান্ত খাঁটি হিন্দু বা বৈষ্ণব অবতার খুব বেশি জরুরি হইয়া পড়ল; যারে গৌতম বুদ্ধের মতো যেমন সম্ভ্রান্ত বংশের পোলা হইতে হবে; তেমনি তার থাকতে হবে বুদ্ধের কাছাকাছি রাজ্য ত্যাগের ইতিহাস; থাকতে হবে সহজ সরল জীবন যাপন; থাকতে হবে নির্লোভ জীবনী। তবে তারে শেষকালে রাজাও হইতে হবে একটা উপযুক্ত হিন্দুরাষ্ট্রের উদাহরণ প্রতিষ্ঠার লাইগা…

অবতারবাদীরা সম্ভ্রান্ত সেই সম্ভাব্য অবতারের সন্ধান পাইয়া যান বাল্মিকীর পুলস্ত্যবধ কাব্যে। রাজা দশরথের পুত্র রাম। বাপের কথা রাখতে গিয়া রাজ্য ত্যাগ কইরা বনে বনে ত্যাগি চেহারা নিয়া ঘোরে। পাশাপাশি পুলস্ত্য বা রাবণরে হত্যা কইরা পুলস্ত্যবধ কাব্যের বিজেতা নায়ক। চরিত্রখানও বহুত নিষ্কলুষ। বাপের সাড়ে তিনশোটা বৌ থাকার পরেও তার মাত্র এক বৌ। পরবর্তীকালে একজন রাজা। বামুনগো তাবেদার; আদিবাসী মাইরা বামুনের যজ্ঞ করার ব্যবস্থা কইরা দেয়। বামুনগো গ্রামের শত্রু নিধন কইরা দেয়। শূদ্র বেদ পইড়া যাতে বামুনগো ফাঁকি ধরতে না পারে তার লাইগা বিনা প্রশ্নে শূদ্রের মাথা নামায়া ফেলে কোপ দিয়া…

বাল্মিকীর পুলস্ত্যবধ কাব্যের বিজেতারে ধইরা বামুনগো লাইগা দরকারি সকল গুণই চাপানো হয় রামের উপর; অথবা কিছু কিছু আগে থাইকাই থাকে। পয়লা ধাক্কাতেই বাল্মিকীর পুস্তকখানের নাম পুলস্ত্যবধ কাব্য থাইকা বদলাইয়া করা হয় রামায়ণ। মানে পরাজিতের নামে লেখা কাব্যখান এইবার লেখা হইতে থাকে বিজেতা নায়কের নামে। আর নায়কের উপর ক্রমাগত চাপানো হইতে থাকে বৈষ্ণবগো লাইগা দরকারি সকল উপাদান; এমন কি বৌদ্ধ বিরোধিতাও…।

অবতার তালিকায় রাম আর কৃষ্ণের সিরিয়ালের বিষয়ে পৌরাণিক কালচক্রের আরেকটা যুক্তি হাজির করা হয়। বলা হয় রাম তো ত্রেতা যুগের আর কৃষ্ণ দ্বাপর যুগের অবতার। এই যুগ হিসাবটা বড়োই গোলমেলে; এইটা রৈখিক ক্যালেন্ডার না; কালের চক্র। এইসব দ্বাপর ত্রেতা কলি দিয়া কোনো সময়কাল বোঝানো হয় না। কবে থাইকা শুরু আর কবে কোন কালের শেষ তার হিসাব পুরাই ঝাপসা। এই যেমন কোনো এক অতীত কাল থাইকা এখনো চলতে আছে কলিকাল; কিন্তু তার কোনো হিসাব নাই। এইটা নিয়া বেশি ব্যাখ্যায় না যাইয়া খালি কই যে কৃষ্ণভক্ত বঙ্কিমচন্দ্রও এই কালচক্রের হিসাব উড়াইয়া দিছেন; কারো আগ্রহ থাকলে তিনার কৃষ্ণচরিত্র পুস্তকখান দেইখা নিতে পারেন…

রাম আর কৃষ্ণরে যে কালেই অবতার তালিকায় ঢোকানো হউক না ক্যান; মূল বিষয়টা হইল রাম আর কৃষ্ণের সিরিয়াল ঠিক করা হইছে তাগো সময়ের কমপক্ষে হাজার বছর পরে। অবতারের তালিকায় যেই আগে আর যেই পরে থাকুক না ক্যান; ঐতিহাসিক হিসাবে দেখা যায় যে অবতারবাদ জিনিসটাই আবিষ্কার হইছে খ্রিষ্টিয় তৃতীয়-চতুর্থ শতকের দিকে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়। এই

অবতারবাদ ধারণাটা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের জাতক কাহিনির একটা রূপান্তর। বৌদ্ধগোরে গাইল্লাইতে গাইল্লাইতে পৌরাণিকেরা কিন্তু ক্রমাগতভাবে নিজেগো ধৰ্মরে বৌদ্ধ ধর্মের উপাদানের লগে এডজাস্ট কইরা গেছে। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়- মহাভারত বা রামায়ণে নাস্তিক বলতে সর্বদাই চার্বাকপন্থী বা বৌদ্ধ বোঝানো হইছে। মহাভারতে চার্বাক আছে। কন্ব মুনী কিন্তু চার্বাকপন্থী। আর রামায়ণে আছে বৌদ্ধ; রাজা দশরথের উপদেষ্টা জাবালি বৌদ্ধপন্থী মানুষ…

রামায়ণের সমাজ পুস্তকের লেখক কেদারনাথ মজুমদার পরিষ্কার কইরা কন যে; অবতার তালিকায় রামের অন্তর্ভুক্তি হইছে অবতার হিসাবে গৌতম বুদ্ধের অন্তর্ভুক্তির পরে। গুপ্ত যুগে অবতারের যা ইতিহাস পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে সেইখানে অবতার হিসাবে শুধুই বরাহ বা শূকর আর কৃষ্ণের পূজার নিদর্শন আছে; অন্য কেউ না…।

উপনিষদের মতো ব্রহ্মবাদী বা গীতার মতো ভক্তিবাদী দর্শনের মিশ্রণে যে বৈষ্ণব ধর্ম বা পরবর্তীকালে হিন্দুধর্ম তৈয়ারি হইছে; সেইটাতে চার্বাকপন্থা কিন্তু কট্টর নাস্তিক্যবাদ হিসাবে বাদই পইড়া গেছে। ভৃগু মুনীর শালা কপিলের বেদবিরোধী দর্শন ত্যাজ্য হইছে। হীনযান যুগের নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মও পুরা সাংঘর্ষিক আছিল উপনিষদ আর গীতার উত্তরাধিকারীগো কাছে। কিন্তু কালে কালে বৌদ্ধ ধর্মও সইরা আসে হিন্দুধর্মের কাছাকাছি। বুদ্ধের নাস্তিক্যবাদরে চাপাইয়া থুইয়া স্বয়ং বুদ্ধরে বানায়া ফালানো হয় ভগবান…

এই পুরা প্রক্রিয়াটা; মানে নারায়ণরে ভগবান হিসাবে প্রতিষ্ঠা- কৃষ্ণর প্রতিষ্ঠা-গীতা- অবতারবাদ চতুবর্ণ-বর্ণাশ্রম- মনু সংহিতা এবং মহাভারত- রামায়ণ সম্পাদনা দিয়া আধুনিক হিন্দু ধর্মের সূচনাটা ঘটে মূলত ভার্গব বংশ এবং তাগো আত্মীয় স্বজনের হাতে। মহাভারতকাল পর্যন্ত জাতে ব্রাহ্মণ নামে কিছুর অস্তিত্ব আছিল না। জন্মসূত্রে কেউ বামুন হইত না। কামে হইত। জন্মসূত্রে বামুন হইবার সিস্টেমটাও চালু করে এই ভার্গবেরা; যারা আবার নিজেরাই বামুন আছিল না সকলে; এখনো নাই…

আমরা যে মহাভারত এখন পড়ি; সেইটা এমন এক অজ্ঞাত ব্যক্তির মুখ থাইকা শুনি যিনি উগ্রশ্রবা সৌতির মুখে শুইনা শুইনা আমাদের বর্ণনা করতে আছেন ঘটনাখান- সৌতি আইলেন; পান তামুক খাইলেন তারপর কইলেন যে জন্মেজয়ের যজ্ঞে এই কাহিনি তিনি শুইনা আসছেন; তারপর তিনি কইতে শুরু করলেন সেই কাহিনি। তা তিনি যা কইলেন তা হইল…

এই সৌতি একজন ভার্গব বংশজাত মানুষ। সৌতিরে বলা হয় সূত; যাগো পেশা আছিল পুরাণ কথন অথবা রথ নির্মাণ; ভার্গবেরা প্রায় সকলেই কিন্তু আছিলেন সূত। ভার্গব বংশের প্রতিষ্ঠাতা ভৃগু মুনি স্বয়ং আছিলেন একইসাথে ঋষি-ধনুর্ধর-আর রথের মিস্ত্রি; মানে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় আর শূদ্র তিনটাই। মজার জিনিস হইল মহাভারত পড়লে মনে হয় ভৃগুমুনি বোধহয় ভারতে আসা আর্যগো এক্কেবারে পয়লা প্রজন্মের ঋষি। কিন্তু ঋগবেদ রচয়িতাগো মাঝে ভৃগু হইলেন এক্কেবারে শেষের দিকের ঋষি। আদি বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রগো থাইকা বহুত প্রজন্ম পরের মানুষ…

বৈদিক আর ভারতীয় পুরাণ এবং সাহিত্য বিষয়ে সুকুমারী ভট্টাচার্যের অতিমানবিক বিশাল গবেষণার মইদ্যে একটা ছোট্ট প্রবন্ধ হইল ‘ভার্গব প্রক্ষেপণের প্রেক্ষাপট’। যাগো বেশি আগ্রহ আছে তারা পইড়া নিতে পারেন; ভৃগুর বংশধররা কেমনে মহাভারতরে কাটাছিড়া করছে। এমনকি কেউ কেউ বলেন আদতে দশ বিশজন মানুষের মাঝে লাঠালাঠি কিলাকিলির যে কুরু-পাঞ্চাল যুদ্ধ হইছিল সেইটাতে জয়ী হইছিল কুরুরাই। পরে সেইটারেই ভার্গবরা কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধর আকার দিয়া পাণ্ডবগো জিতায়া দিয়া আজকের কুরুযুদ্ধের আখ্যান তৈয়ারি করছে কৃষ্ণরে স্থাপন করার লাইগা। সুকুমারী ভট্টাচার্যের হিসাবে এই ভার্গব বামুনরাই হইলেন আজকের হিন্দু ধর্মের উদ্ভাবক; শুধু মহাভারত দিয়া না; রামায়ণ এবং মনু সংহিতা দিয়াও। কারণ রামায়ণের বাল্মিকী যেমন ভার্গব; তেমনি মনু সংহিতার রচয়িতাও ভার্গব ঘরানার মানুষ…

দুর্বল হাতে; নিম্নমানের সাহিত্য দক্ষতা আর উচ্চমানের মূর্খতা নিয়া শত শত বছর ধইরা মহাভারত রামায়ণ সম্পদনা পরিবর্তন আর পরিবর্ধনের লাইগা যে বংশটারে সুকুমারী ভট্টাচার্য দায়ী গোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত করেন; সেই ভার্গব বংশের কিছু কাহিনি আলাপ না করলে ভারতীয় পৌরাণিক আখ্যান তৈরির পিছনের একটা বড়ো বিবেচ্য যেমন বাদ থাইকা যাবে; তেমনি বাদ পইড়া যাবে আধুনিক হিন্দুধর্মের উৎপত্তির বহুত উপাদান…

খিপূ ২০০০ সালের দিকের ঘটনা। তখনো ইরানি বা আর্য মানুষেরা ভারতে ঢোকে নাই। তাগো একটা দল তখন বাস করত বর্তমান তাজাকিস্তানের পশুরজন আর নিম্ন মাদ্ৰজন অঞ্চলে। এই গোষ্ঠীটারে আরেকটা যাযাবর আর্যগোষ্ঠী ইন্দ্র নামে এক সেনাপতির নেতৃত্বে পিটায়া ভিটামাটি থাইকা খেদাইয়া ভূমি-সম্পত্তি আর নারীগো দখল কইরা নেয়। ইন্দ্র কিন্তু তখনো সেনাপতির পদ কিংবা নাম। মাইর খাইয়া পশুরজন থাইকা পলানো মানুষগুলা পরবর্তীকালে পরিচিত হয় পারস্য পারসিক বা পার্সিয়ান নামে…

খুব সম্ভবত সেনাপতি ইন্দ্রের নেতৃত্বে পশুরজনবাসীগো মাইর দেওয়া আর্যরাই পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ভারতের মূল দখলটা নেয় আর ধীরে ধীরে এককালের সেনাপতি ইন্দ্রর নামটা কালে কালে পরিণত হয় দেবতাগো রাজার নাম হিসাবে। অন্যদিকে মাইর খাওয়া পশুরজনের লোকজন বা পার্সিয়ানরা দুইদিকে ছড়ায়; একদল আফগানের ব্যাকট্রা বা বহ্বীক থাইকা ইরানের মূল ভূখণ্ড। আরেকদল ব্যকট্রা থাইকা ভারতের মূল ভূখণ্ড…

ভারতে কিংবা ইরানে; কোথাও এই মানুষগুলা কিন্তু ইন্দ্র বাহিনীর হাতে নিজেগোভিটা হারানোর ইতিহাস ভুলতে পারে নাই। ভূমি থাইকা উচ্ছেদ হওয়া এই পশুরজন বা পার্সিয়ানগো স্পিতামা গোত্রের মানুষ হইলেন মুনি ভৃগু; যিনি ভারতভূমিতে ভার্গব বংশের প্রতিষ্ঠাতা। এক হিসাবে বেদের অবহেলিত দেবতা বরুণের পুত্র হইলেন এই ভৃগু মুনি; অন্য দিকে এই বরুণই হইলেন জেন্দাবেস্তার প্রধান দেবতা আহুর মাজদা…

ভৃগুমুনির বড়ো মাইয়া লক্ষ্মী; আখ্যানমতে নারায়ণের স্ত্রী; আইজ পর্যন্ত তিনি দেবী হিসাবে পূজিত হন। তার বড়োপোলা পুলমাগর্ভজাত চ্যাবন মুনি; যিনি ভেষজ-বিদ্যার বিশেষজ্ঞ আছিলেন। আখ্যান বিশ্লেষণ করলে এই চ্যাবনরেই ধইরা নিতে হয় ফুল-ফল-ফসল গ্যাজাইয়া চোয়ানি মদের আবিষ্কারক বা ঋষি সুরা হিসাবে। যিনি মদ বানায়া দুই শিষ্য অশ্বিনীকুমারগো দিয়া ঘোড়ায় দূর দুরান্ত পর্যন্ত চোয়ানি মদের বাণিজ্য করতেন। আরেক হিসাব মতে এই চ্যাবনই আদি বাল্মিকী; রামায়ণের আদি রচনাকার। আদি কবি। তবে অশ্বঘোষের মতে রামায়ণের আদি বাল্মিকী এই চ্যাবনমুনির পোলা…

ভৃগুমুনির দ্বিতীয় পোলা ঋচীক; নিজে তেমন বিখ্যাত ঋষি না; বিবাহসূত্রে তিনি বিশ্বামিত্রের বড়ো বইন সাবিত্রীর স্বামী। তবে ঋচীকের পোলা আর নাতি কিন্তু আবার বিখ্যাত মানুষ। তার পোলা জমদগ্নি আর নাতি পরশুরাম। পরশুরাম অস্ত্রবিদ্যার একটা স্কুলিং এর যেমন প্রতিষ্ঠাতা তেমনি বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার হিসাবেও গণ্য…

ভৃগুমুনির ছোটপোলা উশনা গর্ভজাত শুক্রাচার্য; ভারতীয় পুরাণে সব থিকা বড়ো যুদ্ধ বিশারদ আর শল্য-বিদ্যার বিশেষজ্ঞ। শুক্রাচার্যের আরেক উপাধী কিন্তু কবি…

অঙ্গিরা বংশ সর্বদাই ইন্দ্রের দলে থাকত বইলা ভার্গব শুক্রাচার্য সব সময় থাকতেন অপজিশন; মানে অসুর রাক্ষস আর দানবগো লগে। বেদের কোনো তোয়াক্কা করতেন না তিনি। একলার বুদ্ধি আর কৌশলেই তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলারে টিকাইয়া রাখতেন দেবতাগো আক্রমণের মুখে। তিনি নিজে ব্রাহ্মণ হইয়া; সংহিতামতে নিষিদ্ধ হইবার পরেও নিজের মাইয়া দেবযানীর বিবাহ দেন ক্ষত্রিয় রাজা যযাতির লগে। আর সেই ঘটনার ফল হিসাবেই শুক্রচার্যের মাইয়া দেবযানীর বংশধারায় জন্ম নেন। বাসুদেব কৃষ্ণ…

আবার এই শুক্রাচার্যই নিজের জামাই যযাতিরে ধামকি দিয়া বাধ্য করেন রাক্ষসবংশজাত দাসী শর্মিষ্ঠারে রানির মর্যদা দিতে; যার ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় মহাভারতের শান্তনু পরিবার…

চতুবর্ণের শ্রষ্ঠা মনুও জন্ম নেন এই একই ভার্গব বংশের শাখায়। ভৃগু বংশের আত্মীয়গো মাঝে ভৃগুমুনির শালা কপিল কঠিন বেদবিরোধী হিসাবে পরিচিত। ঋচীকের শালা বিশ্বামিত্র বংশ আগাগোড়াই বশিষ্ঠ ও দ্বৈপায়ন গোত্রের বিরোধী মানুষ…

ভারতের বাইরে এই স্পিতামা গোত্রের আরেকজন মানুষ হইলেন পার্সিয়ান ধর্মের প্রবর্তক জরথুস্ট। জেন্দাবেস্তা আর ঋগবেদ শুধু সমসাময়িক গ্রন্থই না বহুত ভাষা আর শ্লোকও এক। মূলত দুইটারই আদিসূত্র বা আদিবাস একই অঞ্চলে হইবার কারণেই এইটা ঘটছে। কিন্তু জেন্দাবেস্তা বর্ধিত হইছে ইন্দ্র এবং ইন্দ্রসহচরগো নেতিবাচকভাবে চিহ্নিত কইরা। পার্সিয়ানরা আগুনরে খুব পবিত্র মনে করত আর মরা লাশেরে অপবিত্র; কিন্তু ঋষি অঙ্গিরা লাশ পোড়াইবার বিধান দিবার কারণেই ইন্দ্রের লগে লগে তাগো রাগ গিয়া পড়ে অঙ্গিরার উপর। অঙ্গিরার বংশধররা মোটামুটি আগাগোড়াই আছিলেন দেবরাজের রাজকীয় পুরোহিত। আর ভৃগুবংশ অপজিশন। অঙ্গিরা আর ভৃগু এক্কেবারে সমবয়েসি মানুষ…

মাইর খাওয়া একটা গোষ্ঠি যে হাজার বছর ধইরা মাইরের প্রতিশোধ নিয়া বেড়ায় সেইটা এই ভার্গব বংশটার ইতিহাস না পড়লে বোঝা অসম্ভব। বংশটায় এক পাশে যেমন যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কার আর যুদ্ধের ইস্কুল চালাইছেন ভৃগু-শুক্রাচার্য-পরশুরামেরা এবং তাগো আত্মীয় বিশ্বামিত্র কিংবা কপিলেরা; তেমনি অন্যদিকে বিদ্যালয় খুইলা বুদ্ধির যুদ্ধ চালাইছেন জরথুস্ট- চ্যাবন- সৌতি-বাল্মিকী- মনু আর হাজারে হাজার নাম না জানা ভার্গব সন্তান…

ভার্গবগো কোনো অস্ত্রের নিদর্শন আইজ আর নাই। ভার্গব বংশের একটা শাখা; ভিল উপজাতি ছাড়া ভার্গবগো অস্ত্রের কথা আইজ আর স্মরণও করে না কেউ। কিন্তু তাগো বিদ্যার প্রভাবে দুনিয়াতে দুই দুইটা ধর্ম তৈরি হইয়া টিকা আছে আইজ; হিন্দু আর পার্সিয়ান। এই দুইটা ধর্মই সেই ভূমিহারা স্পিতামা গোত্রের ভার্গব মানুষগো অবদান কিংবা আকামের ফল। এরাই লিখছে জেন্দাবেস্তা। লিখছে মনু সংহিতা। লিখছে রামায়ণ আর পুরাই বদলাইয়া দিছে বশিষ্ঠ বংশের হাতে রচিত মহাভারতের ঘটনা এবং কাহিনি…

কাকের বাসায় কোকিলের ছানা পয়দা করার আদর্শ উদাহারণ বোধহয় মহাভারতের থাইকা বড়ো কিছু নাই। বশিষ্ঠগোত্ৰজাত দ্বৈপায়ন পুস্তকখান লিখছিলেন বেদের শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে আর ভার্গবেরা সেইটা এডিট কইরা বানাইয়া থুইছে বেদ বিরোধী ভগবদগীতার ভাণ্ডার…

তবে একটা কথা মাথায় রাখা দরকার। তা হইল ভারতীয় পুরাণের ফেমিলি ট্রি নিশ্চিত কইরা বলা বোধহয় সম্ভব না। ‘ফেমিলি নেট’ হইতে পারে। কারণ এইখানে যে বংশের পরিচয় দেয়া হইছে তাতে একশোটা চ্যালেঞ্জ করা যাইতে পারে। চ্যাবন আদি ভৃগুর পোলা না হইয়া অন্য ভৃগুর পোলাও হইতে পারেন। আবার ঋচীক হইতে পারেন আরেক ভৃগুর পুত। শুক্রাচার্য চ্যাবন বা ঋচীকের ভাই না হইয়া ভাতিজাও হইতে পারেন। ভৃগুরে কবিও বলা হইত। সেই হিসাবে শুক্রাচার্য কবিপুত্র। আবার ভৃগুরে কবিপিতাও বলা হয়। সেই হিসাবে শুক্রাচার্য ভৃগুর নাতি। আবার শুক্রাচার্য নিজেই কবি। সেই হিসাবে…

আবার পরশুরাম ঋচীকের নাতি না হইয়া অন্য কোনো জমদগ্নির পোলাও হইতে পারেন। একইভাবে কপিল মুনি এক হিসাবে যেমন শুক্রাচার্যের মামা; মানে তার সৎভাই চ্যাবনের মামা; ভৃগুর শালা; অন্যদিকে কিন্তু শুক্রাচার্যের এক শিষ্যর নামও চ্যাবন মুনি। এখন কোনজন কেডা?

একইভাবে কোন বিশ্বামিত্র কোন ঋচীকের শালা; সেইটা কিন্তু বাইর করা অসম্ভব। কারণ ঋগবেদের আদি রচয়িতাগো মইধ্যে আছেন আদি বিশ্বামিত্র; যিনি ঋচীকের বাপ ভৃগুরও বহুত পূর্ব প্রজন্মের মানুষ; সুতরাং আদি বিশ্বামিত্র ভৃগুপুত্র ঋচীকের শালা হইবার কথা না। আবার আদি বিশ্বামিত্রের সমসাময়কি বশিষ্ঠ কিন্তু দ্বৈপায়নের বাপের ঠাকুরদা না; দ্বৈপায়নের বাবা পরাশর যেমন অন্য বশিষ্ঠের নাতি তেমনি রামায়ণের বশিষ্ঠ আরেকজন…

হইলে হইতে পারে দ্রোণাচার্যের বাপ ভরদ্বাজ বৃহস্পতি-মমতার সন্তানই না। না হইবারই সম্ভাবনা বেশি। হইলে হইতে পারে দ্রোণপিতা মূলত কোনো ভরদ্বাজী টোলে পড়া বামুন মাত্র; বৃহস্পতির লগে যার কোনো সম্পর্কই নাই। অবশ্য বৃহস্পতি বলতে কোন বৃহস্পতি সেইটাও একটা প্রশ্ন। হাজারো বৃহস্পতির মাঝে ঠিক কোনজন যে অঙ্গিরার মাইজা পোলা সেইটা কিন্তু বাহির করা মুশকিল…

মূলত যারা নিজের নামে ঘরনা তৈরি করতে পারে নাই তারা সকলে আগের বিখ্যাত ফ্যামিলি নেম বা ঘরানার নামে পরিচিত আছিল। বহুত লোক আছিল বৃহস্পতি ভৃগু বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র বাল্মিকী দ্বৈপায়ন জমদগ্নি ভরদ্বাজ নামে পরিচিত। বহুত লোক শুক্রাচার্য চ্যাবন পরশুরাম কপিল নামে পরিচিত। আর ব্যাস বা বশিষ্ঠ নামে পরিচিত লোকজন তো দিব্যি এখনো আছে…

. বেদবিরোধী গীতার বৈদিকায়ন এবং রামায়ণের অতীতযাত্রা

ভারতীয় পুরাণ ঘাইটা ইতিহাস খুঁজতে যাওয়ার সব থিকা বড়ো ঝামেলাটা হইল এইসব পুরাণের রচয়িতা ঋষি কিংবা কবিদের অন্য কোন বিষয়ে কোন জ্ঞান আছিল আর কোন বিষয়ে আছিল না সেইটা নিশ্চিত না হইলেও একটা বিষয় পরিষ্কার যে তাগো মধ্যে বিন্দুমাত্র সময়-সংখ্যা কিংবা ইতিহাস জ্ঞানের কোনো অস্তিত্ব আছিল না; অথবা অদরকারি মনে কইরা তারা এই তিনটা জিনিসের লগে বাচ্চাপোলাপানের মতো খেলানেলা কইরা গেছেন। সময় মাপতে গিয়া তারা ষাইট বচ্ছর আর ষাইট হাজার বচ্ছরে যেমন কোনো ফারাক করেন নাই; তেমনি সৈন্যসংখ্যা একশোরে একশো কোটি কইতেও আপত্তির কিছু দেখেন নাই। একইভাবে নতুন কবিরা যখন সাহিত্য রচনা করছেন কিংবা পুরানা সাহিত্য সম্পাদনা করছেন তখনো কিন্তু আশপাশের ঐতিহাসিক উপাদানগুলারে বাদ দিয়া কোন কালের সেই কল্পিত ঐতিহ্যর লোকস্মৃতি ঢাইলা সাজাইছেন নিজের পুস্তকের সমাজ বাস্তবতা। যার লাইগা দুই হাজার বছর আগের আর পরের সাহিত্যের সমাজচিত্র মূলত কপিপেস্ট ছাড়া কিছু না…

ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইতিহাস চর্চার মূল কনসেপ্টাই হইল কাল্পনিক এক সমৃদ্ধ অতীতের কাবিক্য চিত্রকল্প নির্মাণ। অনেকটা শাহ আবদুল করিমের গানের মতো আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম-এর নস্টালজিয়া অথবা জীবনানন্দের মতো কোনো এক শ্রাবস্তির কারুকার্য কল্পনা কইরা তাব্দা খাইয়া বইসা থাকা। সকলেই মনে করে আগের দিনগুলা আছিল বড়োই দারুণ। মূলত এইটা একটা নতুনত্বভীতি আর বুড়ামির প্রতীক। এর লাইগা সকলেই খালি কল্পিত এক আগিলা দিনের সাধনা করে; আর কবিরা সেইটা নতুন কইরা রচনা কইরা আবার প্রচারও করেন নতুনের মতো। কল্পিত রঙিন অতীত নির্মাণের এই বাজে অভ্যাসটা এখনো আছে আমাগো সংস্কৃতির মাঝে। বর্তমান সময়ে রচিত আমাগো গানগুলায় এখনো নদীর পাড়ে বইসা রাখাল বাঁশি বাজায় আর মেয়েরা কলসি নিয়া পানি তুলতে নদীঘাটে যায়। অথচ গত তিন দশক ধইরা যেমন রাখাল পেশাটাই বাংলাদেশ থাইকা নাই হইয়া গেছে আর চল্লিশ বছর ধইরা বাংলাদেশের মানুষ নদীর পানি খাওয়া বন্ধ কইরা দিছে সেইটার কোনো সংবাদ নাই এইসব লোক সাহিত্যের পাতায়…

পুরাণগুলার মইদ্যে যে টুকটাক ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায় সেইগুলা পাওয়া যায় মূলত সাহিত্যে ছড়ানো ঘিন্নার বাক্য কিংবা লেখকের মূর্খতার ফাঁক ধইরা। রামায়ণে যখন রামের মুখ থাইকা জাবালিরে বৌদ্ধ কইয়া গালি শুনি তখন আমাদের বুইঝা নিতে হয় যে; যেই সমাজে বইসা রামায়ণ লেখা হইছে সেই সমাজে তখন বৌদ্ধ বিপ্লবের ঠেলায় বামুনধর্ম বিপন্ন। আবার বিশ্বামিত্রের লগে যুদ্ধ করতে গিয়া যখন বশিষ্ঠের কামধেনুরে যবন সৈন্য উৎপাদন করতে দেখি তখন আমাদের ধইরা নিতে হয় যে মহাভারতের এই বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র যুদ্ধটা হয় হইছে ভারতে গ্রিকদের আগমণের পর না হয় যারা এই গল্পটা মহাভারত-রামায়ণে ঢুকাইছেন তারা ভারতে গ্রিক অভিবাসনের পরের মানুষ। অথচ ঘটনার বর্ণনাগুলা কিন্তু সেই আদি কাল্পনিক। বশিষ্ঠ সেইখানে যেমন তার আদি কাল্পনিক অলৌকিকত্ব নিয়া বইসা আছেন তেমনি তার কামধেনুও কাল্পনিক; তার অস্ত্রপাতিও কাল্পনিকতার কপি পেস্ট…

মহাভারতে কুরুযুদ্ধ হউক বা না হউক; যুদ্ধ শেষে পাণ্ডবপক্ষ জিতুক বা কুরুপক্ষ জিতুক; যুধিষ্ঠিরের কিন্তু ঐতিহাসিকতা আছে। আর সেই ঐতিহাসিকতার হিসাবে যুধিষ্ঠির ভারতে লোহার ব্যবহার শুরু হইবার আগের যুগের মানুষ। কিন্তু যুধিষ্ঠিররে ঘিরা কবিরা যে কুরুযুদ্ধ রচনা করছেন তাতে পুরা লোহার খনি ঢাইলা দিছেন। পুরা কুরুযুদ্ধখানই লোহার অস্ত্রে ঝনঝন। অথচ যুধিষ্ঠিরের সমসাময়িক মানুষ মইরা গেছে লোহা আবিষ্কাররে বহুত বহুত যুগ আগে; সেই হিসাবটা আছিল না কবিগো মাথায়…

ভারত অঞ্চলে পয়লা শকাব্দ ক্যালেন্ডারটা বহিরাগত কুশানদের দান। আর্যগো কোনো ক্যালেন্ডার জ্ঞান আছিল না। বছর মাস এবং সপ্তা গণনার কোনো ধারণা আছিল না তাগো। সপ্তার সাত দিনের নাম জানত না তারা। কিন্তু সংখ্যা আর গণিতের ধারণা ভারতে বহুত প্রাচীন। তাইলে আর্যগো সাহিত্যে সংখ্যার অত ঘাপলা কেন?

এইটার একটা কারণ হইতে পারে যে আর্যভট্ট সংখ্যা এবং গণিতের যে হিসাব দিয়া বিজ্ঞান চর্চা করতেন কিংবা বরাহমিহির অপবিজ্ঞান চর্চা করতেন; সেইগুলা মূলত সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে আছিল। মানে শতকিয়া সাধারণ লোকজন জানত না। সাধারণ লোকজনের হিসাবের মাধ্যম আছিল গণ্ডাকিয়া; যেইটা মূলত হাত পায়ের আঙুলের সর্বোচ্চ চাইর কি পাঁচ গুণিতকের হিসাব; দশক বা শতকের না; হালি-কুড়ি-গণ্ডা-পণ…

সুকুমারী ভট্টাচার্যের কথা যদি মানি তবে স্বীকার কইরা নিতে হয় যে পুরাণ লেখক বা সম্পাদক কেউই উচ্চ শিক্ষিত মানুষ আছিলেন না; এরা বরং কম শিক্ষিত শ্রেণির পেশাদার দুর্বল লেখকই আছিলেন। বিভিন্ন স্থানীয় সামন্তগো পৃষ্ঠপোষকতায় সেই সামন্তের পূর্ব পুরুষের ইতিহাস রচনা করতে গিয়া কিংবা সেই সামন্তের বিধি বিধানরে ধর্মশাস্ত্রর চেহারা দিতে গিয়া নিজস্ব মূর্খতা আর দুবর্লতা নিয়াই তারা পেশাজীবী হিসাবে এইসব পুরাণ রচনা কইরা গেছেন। এবং তারা নিজেরাও নিজেদের অতই নগণ্য আর ক্ষুদ্র মনে করতেন যে কোনো রচনাতেই নিজের নাম পর্যন্ত দিতেন না; নিজের রচনাগুলারে আগের কোনো বিখ্যাত লেখকের নামে চালায়া দিতেন। পুরাণগুলারে ভজঘট করার লাইগা মূলত দায়ী এইসব দায়িত্বহীন আর অস্তিত্বহীন পেশাদার লেখকের দল। এদের না আছিল ভূগোল জ্ঞান; না সংখ্যা; না ইতিহাস। এগোর থাকার মধ্যে আছিল শুধুই দুর্বলভাবে কিছু একটা কল্পনা করা আর স্থানীয় সামন্তরে খুশি করার ক্ষমতা…

রামায়ণের ঘটনা ঘটছে মহাভারতের পরে; এই কথাটা প্রচলিত যুক্তি আর পৌরাণিক বিশ্বাসের সরাসরি বিরুদ্ধে যায়। প্রচলিত যুক্তি আর বিশ্বাসরে এক্কেবারে উড়ায়া না দিয়া রমিলা থাপার একটা শর্ত জুইড়া দিছেন। তিনি কন- যদি রামায়ণের ঘটনারে মহাভারতের আগে বইলা মাইনা নিতে হয় হয় তবে কিন্তু ধইরা নিতে হবে যে রাম-রাবণের যুদ্ধ আছিল গাঙ্গেয় উপত্যকার কৃষিজীবী আর বিন্ধ্য অঞ্চলের আদিবাসী শিকারী মানুষের যুদ্ধ। পরে কেউ এইটারে আরো দক্ষিণে সরায়া লঙ্কা জুইড়া দিছে। মানে রমিলা থাপারের এই শর্ত মাইনা রামায়ণরে মহাভারতের আগে কইতে গেলে পয়লাই রামায়ণ থাইকা অত ঘটনার লঙ্কাখানই বাদ দিয়া দিতে হয়। আর পণ্ডিতগো কথামতো রামায়ণের আদি রচনাকাল খিপূ৪র্থ শতক ধইরা নিলে লেখক বাল্মিকী আর তার পোলার বয়েসি রামরে কোনোভাবেই গৌতম বুদ্ধের পরের যুগের মানুষ ছাড়া অন্য কিছু ভাবা অসম্ভব…

বাল্মিকীরে চতুর্থ শতাব্দির মানুষ ধইরা নিবার পক্ষে আরো বহুত যুক্তি আছে। এর পয়লাটা হইল রামায়ণের ভাষা। রামায়ণের ভাষা যে আধুনিক সেইটার বিষয়ে বহুত আলোচনা আছে। কারো কারো মতে খিপূ ৪র্থ শতকে পাণিনি যে সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ সংগঠিত করছিলেন; রামায়ণ রচিত হইছে সেই ব্যাকরণ মাইনা। মানে বাল্মিকী পাণিনির পরের মানুষ; যেইটার লগে আবার মিলা যায় বিপ্লব মাজীর দাবি-বাল্মিকী কালিদাসেরও পরের কবি…

অন্য অনেকের মতো কেদারনাথ মজুমদারও কন- রামায়ণের ভাষা মহাভারতের থাইকা অনেক আধুনিক। ছন্দগুলাও আধুনিক। রামায়ণের অনুষ্টুপ ছন্দ বয়সে প্রাচীন হইলেও রামায়ণে ব্যবহৃত অনুষ্টুপ আধুনিক ফর্মে গাঁথা। এই কথা বলার লগে লগে কেদারনাথ মজুমদার বাল্মিকীর আদি কবিত্বের দাবি এক টোকায় উড়ায়া দেন। এক্কেবারে সোজা বাংলায় কইয়া দেন যে বাল্মিকী আদি কবি নহেন। শিকারিতে পক্ষি মাইরা ফালানোয় যে শ্লোকটা তিনার মুখ থাইকা বাইর হইছিল; যেইটারে কওয়া হয় আদি কবিতা। সেইটার ছন্দ বিশ্লেষণ কইরা কেদারনাথ সোজা কন- যে ধরনের অনুষ্টুপ ছন্দে ওই শ্লোকটা লেখা; সেই ছন্দে ঋগবেদ ভরপুর। অনুষ্টুপ ছন্দটা বাল্মিকীর আবিষ্কার। এইটাও ফালতু কথা। তাছাড়া বিষ্ণু পুরাণ রামায়ণের পরে হইলেও সেইখানে কিন্তু কেউ বাল্মিকীরে আদি কবি না কইয়া ব্রহ্মারে কইতেছে আদি কবি। সুতরাং বাল্মিকীর আদি কবিত্ব সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য না…

এই কয়েকটা যুক্তি দিয়া কিন্তু রামায়ণরে মহাভারতের আগে দাবি করার সবগুলা দাবি উড়ায়া দেয়া সম্ভব না। বিষয়গুলা ডিম আগে না মুরগি আগের মতো জট পাকায়া আছে দুইটা পুস্তকে। খোদ রামায়ণের ভিতরেই এমন কিছু উপাদান আছে যেইগুলারে যুক্তিতে গেলে অবশ্যই প্রাচীন উপাদান কইতে হয়…

প্রায় একশো বছর আগে ১৯২৭ সালে অমানবিক পরিশ্রমের গবেষণা কইরা কেদারনাথ মজুমদার রামায়ণের সমাজ নামে একটা বই প্রকাশ করেন ময়মনসিংহ থাইকা। রামায়ণ সোসাইটিরে ধইরা ধইরা সহজ ভাষায় এত ভালো বিশ্লেষণ খুব কমই পাইছি আমি। কেদারনাথ রামায়ণরে মহাভারতের পরের ঘটনা কইতে রাজি না। তিনি বরং মহাভারতরেই রামায়ণের পরের ঘটনা বলেন। তিনি বৈদিক ঘটনার উত্তরাধিকারগুলারে আলোচনা করার লাইগা ঋষি যুগ আর লৌকিক যুগ নামে ক্যালেন্ডাররে দুইটা ভাগে ভাগ করেন…

কেদারনাথের ভাগ অনুযায়ী খিপূ ১০০০ সালের আগের সময় ঋষি যুগ আর খিপূ ১০০০ সালের পর; তার মতে ভারতে গ্রিকদের আগমনের পরের সময়কালরে তিনি বলেন লৌকিক যুগ। তো রামায়ণের সময়কাল আলোচনা করতে গিয়া তিনি রামায়ণের মইদ্যে ঋষি আর লৌকিক দুই যুগের উপাদান নিয়াই আলোচনা করেন। তিনি যদিও রামায়ণের নতুন ঘটনা চিহ্নিত কইরা বলেন যে সেইগুলা পরে প্রক্ষিপ্ত; মানে আদি কাণ্ড আর উত্তরকাণ্ড যখন যোগ হয় তখনকার সংযোজন। তবুও তার তালিকা দুইটা নিরপেক্ষভাবেই খুব সমৃদ্ধ…

তিনি রামায়ণরে মহাভারতের আগে কইতে গিয়া যেইসব যুক্তি দেখান তার মধ্যে তিনি কন যে রাম হইলেন ভারতে লিপি বা লেখা প্রচলিত হইবার আগের যুগের মানুষ। রামায়ণে রামের লেখাপড়া শিক্ষার কোনো বিবরণ নাই। অথচ বুদ্ধদেবের শিশুকালে তার পড়ালেখা শিখার বিবরণ আমরা পাই। অবশ্য মহাভারতেও কারো লেখাপড়া শিখার কোনো উদাহরণ নাই। তিনি বলেন যে রামায়ণে লৌকিক দেবতা; মানে বাল্মিকী রামায়ণে ব্রহ্মা-বিষ্ণু- শিব কিংবা আরো পরের নারী দেবীরা নাই; রামায়ণে আছে খালি বেদের ৩৩ দেবতার কথা। রামায়ণে লিঙ্গপূজা-মূর্তিপুজা নাই। রাময়ণে ৪ বেদের কথা নাই; আছে ৩টা বেদের কথা। মানে লৌকিক যুগে তৈরি হওয়া অথর্ববেদের কথা রামায়ণে নাই। তিনার আরেকটা যুক্তি হইল রামায়ণকালে সপ্তা এবং বারের নাম এবং মাসের গণনা পদ্ধতি চালু হয় নাই। ধাতুর রাসায়নিক বা যৌগ ব্যবহার শুরু হয় নাই তখনো…

রামায়ণের লঙ্কায় গাদা গাদা স্বর্ণের বিষয়ে তিনি সন্দেহ করেন। তিনি কন যে সেইকালে কবিরা স্বর্ণ বস্তুটাই চিনত না। কারণ তারা যদি স্বর্ণ চিনত তাইলে হনুমান পুরা লঙ্কা পুড়াইয়া দিবার পরে আবার অক্ষত স্বর্ণ লঙ্কার বর্ণনা দিত না। স্বর্ণ চিনলে তারা নিশ্চয়ই জানত যে আগুনে পুড়লে স্বর্ণের কী অবস্থা হয়। এর থাইকা তিনি সিদ্ধান্ত করেন যে; হয় সেইযুগে অন্যকিছুরে কবিরা স্বর্ণ কইত; যেইটা আগুনে পুড়লেও গলে না বা বদলায় না; অথবা খাপছাড়াভাবে এইগুলা পরে কেউ ঢুকাইয়া দিছে লঙ্কায়। অবশ্য এর লগে তিনি এইটাও বলেন যে বর্তমান রামায়ণে রাবণের যে দানবীয় চেহারা আমরা দেখি; সেইটা আদৌ বাল্মিকী রামায়ণের রাবণ না। বাল্মিকী রামায়ণের রাবণ এক সাধারণ রাজা…

কেদারনাথ বলেন রামায়ণ সমাজে মেয়েরা সিঁন্দুর পরত না। সকলেই বেদ পড়তে পারত। তখন পর্যন্ত কাঁচ আর পারদের সংমিশ্রণে আয়না প্রস্তুতি শুরু হয় নাই। কোনো ধরনের মুদ্রা আবিষ্কার হয় নাই এবং সমাজে গোত্রপ্রথা চালু হয় নাই…

রামায়ণ সমাজে গোত্র প্রথা চালু হয় নাই এই কথাটার লগে কিন্তু আমার ব্যক্তিগত দ্বিমত যেমন আছে তেমনি সুকুমারী ভট্টাচার্যের গবেষণাও এই বিষয়ে দ্বিমত করে। রামায়ণের সময়কালে বরং ব্রাহ্মণ শূদ্র ক্ষত্রিয় এইগুলা বড়োই প্রকট আছিল…

রামায়ণের প্রাচীনত্বের পক্ষে তিনার আরো যেইসব যুক্তি আছে তার মইদ্যে আছে-কৈকেয়ীরে রাজা দশরথ বর দিতে চাইলে তিনি বহুত দেবতারে ডাইকা সাক্ষী মানেন কিন্তু ব্রহ্মা বিষ্ণু শিবের মতো কোনো দেবতারে ডাকেন না। তেমনি পোলার বিদায়ের সময় মা কৌশল্যা দেবতাগো নাম ধইরা ডাইকা পোলারে রক্ষা করার লাইগা প্রার্থনা করেন; সেইখানে তিনি বহু দেবতা এমনকি বনের পশু পাখির পর্যন্ত শরণাপন্ন হইলেও ব্রহ্মা বিষ্ণু শিবের মতো পৌরাণিক দেবতার নাম নিবার ধারে কাছেও যান না…

রামের বিদায়ের সময় কৌশল্যার বিষ্ণু পূজার একটা বিবরণ বর্তমান রামায়ণগুলায় আছে; কেদারনাথ সরাসরি এইটারে প্রক্ষিপ্ত কইয়া ফালায়া দেন। কেদারনাথ পরিস্কার বইলা দেন যে বুদ্ধদেব যখন হিন্দুর চিন্তায় অবতার তালিকার মইদ্যে ঢোকেন; সেই সময়েই মূলত রামও অবতারের মর্যাদা পান। বৌদ্ধ যুগের পূর্বে রাম বা বৌদ্ধ কেউই হিন্দু সাহিত্যে অবতার বইলা গৃহীত হন নাই; মানে কেদারনাথের হিসাব আর ভবানীপ্রসাদ সাহুর হিসাব প্রায় একই; আর্যগো দাক্ষিণাত্য বিজয়ের কাছাকাছি সময়…

রামায়ণের প্রাচীনত্বের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়া কেদারনাথ কন যে রামায়ণ সমাজে কোনো ঈশ্বর ধারণার অস্তিত্ব নাই। যেইটা বেদেও আছিল না। হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর ধারণাটা মূলত রাজা প্রবাহণের উপনিষদভিত্তিক ব্রহ্মতত্ত্বরে ধইরা গীতায় দানা পাকাইছে। এইটা তুলনামূলক নতুন জিনিস। তাছাড়া রামায়ণে আমরা দেখি রাজা জনক নিজে মন্ত্র পইড়া নিজের মাইয়ার বিবাহ সম্পন্ন করতেছেন। এইটা আগের যুগের নিদর্শন; পরবর্তী যুগে এইসব কাম চইলা গেছিল বামুনগো হাতে…

চতুরাশ্রম ধারণার একটা অংশ হইল বাণপ্রস্থ। যেইটা বৌদ্ধ বিপ্লব পরবর্তী একটা সংযোজন। মহাভারতে আমরা এই বাণপ্রস্থের দেখা পাই; যা কোনোভাবেই কিন্তু রামায়ণে নাই। তবে এইটাও ঠিক যে সব নিয়ম একই লগে সব অঞ্চলে চালু হয় নাই বা মানা হয় নাই; হইতও না। মহাভারত আর রাময়ণের রচনাকাল খালি আলাদা না; বরং মানুষগুলার ঐহিত্যও আর ব্যকগ্রাউন্ডও আলাদা। কোনোভাবেই বলা যাবে না যে মহাভারতের সামাজিক নীতি আর রামায়ণের সামাজিক রীতি এক…

কেদারনাথ নিজে রামায়ণরে মহাভারতের আগের ঘটনা হিসাবে সমর্থন করলেও যেইসকল উপাদানের কারণে রামায়ণরে মহাভারতের পরের ঘটনা বইলা সন্দেহ হয় সেইগুলারও একটা বিশাল তালিকা করেন। যেইগুলার মইদ্যে তিনি এইটাও উল্লেখ করেন যে রামায়ণের বিবাহ পদ্ধতি অনেক আধুনিক। মহাভারতে উত্তরার বিবাহের লগে রাম সীতার বিবাহের কিছু মিল আছে। এর বাইরে মহাভারতে বেদ নির্দিষ্ট প্রাচীন পদ্ধতির দেবর-ভাসুর দ্বারা ভাইবৌর গর্ভে সন্তান উৎপাদন এবং এক নারীর একাধিক স্বামী দুইটাই আছে; যা কি না রামায়ণ সমাজে নাই…

বাল্মিকীরে আদি কবি হিসাবে চিহ্নিত করাটা বেশ ঝাপসা বিষয়। কোনোভাবেই মিলে না যে বাল্মিকী আদি কবি। হইলে হইতে পারে রামায়ণের উত্তর কবি; যিনি রামায়ণ এডিট করছেন তিনি রামায়ণ বা পুলস্ত্য বধ কাব্যের প্রথম রচনাকার বুঝাইতে গিয়া বাল্মিকীরে রামায়ণের আদি কবি কইছেন। যেইটা পরে সংক্ষিপ্ত হইয়া খালি আদি কবি হিসাবে টিকা আছে এখন…

রামায়ণ বহুত এডিট হইছে। হইতে হইতে রামায়ণে অবতারবাদ ঢুকছে। ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব ঢুকছে। নারায়ণ পূজার কথা ঢুকছে। লক্ষ্মী মূর্তির বর্ণনা আছে। মনুস্মৃতি আর গৌতম বুদ্ধের কথা ঢুকছে। রাশিচক্র এমনকি মাসের নামও ঢুকছে রামায়ণে। নাম খোদাই করা আংটির কথাও আছে। সমুদ্র বিদ্যার বর্ণনা আছে। বৌদ্ধ যুগের শ্রমণী বা ভিক্ষুণিগো কথাও আছে…

আরো অনেকের মতো এইগুলাও কেদারনাথ তালিকাবদ্ধ করেন। তবে এইগুলা যে আরোপিত আর বহুত পরে ঢোকানো জিনিস সেই বিষয়ে তর্ক করার কোনো যুক্তি নাই। রামায়ণ আর মহাভারত যত আধুনিকই হউক না কেন এইগুলা যে লৌকিক ধর্ম শুরু হইবার পরে কিংবা সংস্কৃত লিপি আবিষ্কার হইবার পরে রচিত হয় নাই সেইটা নিশ্চিত। তবে রামায়ণে বৌদ্ধ বিরোধীতার ঢং দেইখা একটা কথা ফালায়া দেয়া যায় না যে; হইলে হইতে পারে বৌদ্ধ বিপ্লবে হিন্দু ধর্মরে দুরবস্থা থাইকা উদ্ধারের যে সকল প্রচেষ্টা নেয়া হইছিল; তারই একটা ধাপ হইল রামরে অবতার বানানোর লগে লগে এই আধুনিক রামায়ণ রচনা…

রামায়ণের ভাষা মহাভারতের ভাষা থাইকা বহুত আধুনিক। এই একটা বিশ্লেষণ থাইকাই মহাভারতরে রামায়ণ থাইকা পুরানা বইলা ধইরা নেয়া যাইতে পারে; যদি না আরো কিছু ফ্যাক্টর এইখানে হিসাবে আনা হয়…

কথা হইল সংস্কৃত ভাষার কোনো লিখিত রূপ আছিল না বহুত শতাব্দি। মাত্র খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে পাওয়া যায় প্রাচীনতম ভারতীয় লিখিত ভাষার ইতিহাস। তবে সেইটা সংস্কৃত না; পালি ভাষার লিখিত ফর্ম ব্রাহ্মী লিপি; যেইটা দিয়া বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার হইছে; মৌখিকভাবে আবার লিখিতভাবেও। তামিল ব্রাহুই ভাষার লিখিত ইতিহাসও প্রায় সমান। কিন্তু সংস্কৃত ভাষার দেব নাগরী আসে আরো পরে। মূলত বৌদ্ধ ধর্মের লিখিত রূপ দেইখাই সংস্কৃত সাহিত্য কিংবা যোগাযোগে লিখিত ফর্ম ব্যবহার করার লাইগা শুরু হয় দেব নাগরী বা সংস্কৃতের লিখিত ফর্মের যাত্রা। যার মূল কিন্তু গুপ্তযুগের গুপ্ত লিপি। মানে গুপ্ত লিপি থাইকাই উৎপত্তি হইছে সংস্কৃতের লিখিত ফর্ম দেব নাগরির। আর সেইটা পয়লা দিকে আবোল তাবোল চলার পর সংস্কৃতের ব্যবহারিক ব্যকরণ সংগঠিত করেন পাণিনি। এর পর থাইকাই মূলত সংস্কৃত একটা সংগঠিত ভাষা…

কথা হইল সংস্কৃত লিপি আবিষ্কার এবং পাণিনি দ্বারা সংগঠিত হইবার পরেই এই গুপ্ত যুগে লিখিত হইতে থাকে প্রাচীন সব পুস্তকবাবলী; ঋকবেদ থাইকা শুরু কইরা সর্ব সাম্প্রতিক পুরাণ উপখ্যান পর্যন্ত…

এই যুক্তিটারে স্বীকার কইরা রামায়ণের প্রাচীনত্বের পক্ষের লোকজন বলেন- যে রামায়ণ লিখিত হইবার সময় লেখকরা ভাষা বদলাইয়া নতুন নতুন সাম্প্রতিক শব্দবন্ধ ব্যবহার করায় রামায়ণ প্রাচীন হইবার পরেও এর ভাষা নবীন হইয়া গেছে। কিন্তু কথা হইল এই একই সময়ের লেখকরা তো একই সময়ে বইসা স্মৃতি থাইকা ঋকবেদসহ সকল বেদ এবং মহাভারতেরও লিখিত রূপ দিছেন। সেইখানে তো তারা সাম্প্রতিক নতুন শব্দ দিয়া ঋকবেদের ভাষাও পাণিনির ব্যাকারণ অনুযায়ী কইরা দেন নাই। তাইলে শুধু রামায়ণের ক্ষেত্রে এইটা ঘটল কেমনে?

রামায়ণও তো তারা লিখছেন স্মৃতি থাইকা। অবশ্যই কিছু কিছু বাক্য শব্দ তারা বদলাইছেন; কিন্তু এক্কেবারে পুরা কাহিনিটা তারা নতুন ভাষায় অনুবাদ করছেন তা কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য না। সবচে বড়ো কথা রামায়ণ তো একজন কবির একটা কাব্য; মহাভারতের মতো জনজাতির আখ্যানও না; বেশিরভাগ গদ্যও না; যেইখানে যার ইচ্ছা সে কাহিনি ঢুকাইতে পারে। একটা সম্পূর্ণ কাহিনি কাব্যে নতুন শব্দ ঢোকানো অত সহজ না। পুরা নতুন অনুবাদ তো দূরের কথা। আমার হিসাবে লিখিত রূপ পাইবার সময় রামায়ণ নতুন ভাষায় লিখিত হইছে এইটা একটা ল্যাংড়া যুক্তি। মূলত এইটা রচিতই হইছে বহুত পরের সংস্কৃত ভাষায়…

আরেকটা বিষয়; মহাভারতের মূল কাহিনিতেই একটা কথা পরিস্কার যে মহাভারতকার দ্বৈপায়ন লিখতে পারতেন না। তার কোনো শিষ্যর লেখার ইতিহাসও নাই। বহুদিন মুখে মুখে চলার পর। মহাভারতের লিখিত রূপ দিবার লাইগা তাগোরে গিয়া আদিবাসী গণেশরে তেলাইতে হইছে। যে গণেশরে আগে সিদ্ধি-নাশক কওয়া হইত শেষ পর্যন্ত তারে দেবতার স্থান দিয়া; সিদ্ধিদাতা উপাধি দিয়া; সকলের আগে তার পূজা করার নিশ্চয়তা দিয়া মহাভারত লেখানো হইছে। কিন্তু রামায়ণে দেখেন; শিকারি পক্ষী মারায় বাল্মিকী দুঃখু পাইয়া কাব্য করলেন আর লগে লগে তার শিষ্য ভরদ্বাজ তা লেইখা ফালাইলেন। তার মানে রামায়ণ রচনার যুগে বাল্মিকী এবং তার শিষ্যগো মাঝে লেখার চর্চা আছিল; সময় হিসাবে যেইটা কোনোভাবেই খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতকের আগে না। গুপ্ত যুগেই। এবং মহাভারতের লিপিকার গণেশ দেবতা হইছেন এই গুপ্ত যুগেই; এই সময়েই মহাভারতে ঢুকছে গণেশ আখ্যান। শিবপুত্র-টুত্রের কাহিনি এই সময়কারই। অবশ্য শিবও মহাদেব বেশি আগে হন নাই…

কেদারনাথ একটা কঠিন প্রশ্ন করেন- রাবণ কি বৌদ্ধ আছিল? রামের অভিযানটা কি মূলত আছিল বৌদ্ধ খেদানোর উদ্যোগ?

এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেয়া না গেলেও এইটা ভোলা সম্ভব না যে বৌদ্ধ রামায়ণ কাহিনি অনুযায়ী রাবণ কিন্তু বৌদ্ধ। আবার বিশ্বামিত্রের লগে গিয়া তাড়কা তাড়ানো থাইকা রাবণ হত্যা; রামের সব কামের লগেই কিন্তু আদিবাসী আর স্থানীয় মানুষ তাড়ানো-খেদানোর পাশাপাশি সাম্রাজ্য বিস্তার কিংবা শাসন পোক্ত করার একটা বিষয় আগাগোড়াই অতিশয় প্রকট…

কেদারনাথের বইটা অসাধারণ। তিনি উপাদানগুলা তুইলা ধইরা তিনার মতামত দিছেন। একমাত্র রামায়ণে গরু খাওয়ার ইসু ছাড়া কোথাও কোনো কিছুরে তিনি টুইস্ট করেন নাই তার পুস্তকে…

কেদারনাথের অসাধারণ বিশ্লেষণের বাইরেও আরো কিছু উপাদান শেষ পর্যন্ত মহাভারতরেই প্রাচীনত্বের দিকে নিয়া যায়। মহাভারতে বৈদিক দেবতারা তাগো বৈদিক চরিত্র নিয়াই প্রায় সবাই উপস্থিত; মানে মাইনসের লগে মারামারি করা- এর তার বৌর ঘরে ঢুইকা যাওয়া কিংবা মাইর খাইয়া নতি স্বীকার করা; বৈদিক দেবতাগো এইসব চরিত্রই কিন্তু মাহভারতে উপস্থিত। রামায়ণে কিন্তু তিনাগো তেত্রিশজনের কথা শোনা গেলেও বড়োই নিষ্ক্রিয় তারা। মেঘনাদের হাতে কোনো এক কালে ইন্দ্রের মাইর খাওয়া ছাড়া বৈদিক দেবতাগো সক্রিয় সংশ্লিষ্টতার কোনো সংবাদ নাই রামায়ণে। মানে তিনারা তখন রিটায়ার বা পরিত্যক্ত হইয়া গেছেন প্রায়। মহাভারতে কিন্তু বৈদিক দেবতাগো থাইকা শৈব ঘরানায় ট্রানকিজশনের একটা ট্র্যাক পাওয়া যায়। মহাভারতে শেষ পর্যন্ত বড়ো দেবতা হইলেন শিব। বৈষ্ণব সেইখানে শুরু হইছে মাত্র। অন্যদিকে রামায়ণ প্রায় পুরা বৈষ্ণব…

মহাভারতের যুগে মানুষের গুহাতে বাস করার প্রচলনও আছিল। যেইটা অনেক প্রাচীনতার সন্ধান দেয়। বিদুর বারণাবতে একটা মিস্ত্রি পাঠায় পাণ্ডবগো লাইগা গুহা খুইড়া ঘর বানাইবার লাইগা। গুহা খুইড়া ঘর বানাইবার এক্সপার্ট মিস্ত্রির অস্তিত্ব যেই যুগে আছিল সেই যুগে নিশ্চয়ই গুহার মইদ্যে বসবাসের প্রচলনও আছিল। পোশাক আশাকের দিকেও মহাভারত অনেক প্রাচীন। পাণ্ডবরা যখন বনে যায় তখন ছাল বাকলা পইরাই গেছিল। এবং বনবাসের সময় ছাল বাকলাই পরছিল। কিন্তু রাম বনে যাইবার সময় সীতার অতি রাজকীয় পোশাক ছাড়াও রাম লক্ষ্মণ যে দরিদ্র পোশাক পইরা গেছে; সেইটাও কিন্তু তাঁতে বোনা সুতার কাপড়। আরো সোজা কইরা কইলে কইতে হয় রাম লক্ষ্মণের পরনের পোশাকটা আছিল বৌদ্ধ চির অজীন। মহাভারতের সময় কাপড়ের প্রচলন নিঃসন্দেহে আছিল; কিন্তু একই সাথে পশুর চামড়া বা গাছের ছাল পরার অভ্যাস বা প্রচলনও আছিল নিশ্চিত। একটা জায়গায় এমনো দেখা যায় যে গাছের ছাল তুইলা অর্জুন পোশাক বুনতাছে। মানে জীবনের পয়লা চৌদ্দ পনেরো বছর বনে কাটানো পাণ্ডবরা গাছের ছালের পোশাক বানাইতেও জানতো ঠিকমতো। আশপাশে এইটার প্রচলন না থাকলে কিন্তু অত সহজে তা বানাইয়া পরতে পারার কথা না…

মহাভারতে রাজপুত্ররা প্রাচীন গদাযুদ্ধ মল্লযুদ্ধই শিখত রামায়ণে গদার উল্লেখ নাই। তীর ধনুকের ব্যবহারই বেশি। মহাভারতে চতুবর্ণ আছিল না। কিন্তু রামায়ণে তা পরিষ্কার। ভীম রাক্ষস বিবাহ করে। কুন্তীসহ পাণ্ডবেরা সকলের ঘরে খায়। কুমারের বাড়ি থাকে। নিজেগোরে ব্রাহ্মণ বইলাও পরিচয় দেয়; কিন্তু রামায়ণ সমাজে বর্ণ বিভাজনটা পরিষ্কার। রাম কিন্তু বালি কিংবা বিভীষণের ঘরে কিছুই মুখে দেয় না। শূদ্র রাজা গুহকের দেওয়া খাবার নিজে না খাইয়া ঘোড়ারে খাওয়ায়। আবার বেদ পড়ার অপরাধে শূদ্র শম্ভুকরে মাইরা ফালায়। মানে রাম পুরাই চতুবর্ণী রাজা…

হরপ্পায় পাথরের দালান ছিল; খ্রিপূ ২৫০০ সালে। আর্য প্রভাবিত ভারতীয়রা স্থাপনা বানাইতে শুরু করে খ্রিপূ ২৫০ সালে; তবে সেইটা কাঠের দালান; পাথর না। ভারতে আর্যগো হাতে পয়লাবারের মতো পাথরের দালান বানানো শুরু হয় গুপ্ত যুগে; ৩৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। তাইলে রাবণের বাড়িতে অত দালান আসে কেমনে?

রামায়ণে ইটের দালানের কথা আছে কিন্তু মহাভারতের পুরোচন বারণাবতে সম্রাজ্ঞী আর যুবরাজের লাইগা যে ঘরটা বানায় সেইটা কিন্তু বাঁশ-বেত শনের ঘর। অন্যদিকে রামায়ণে স্থপতিরা বেশ উপস্থিত। তবে লঙ্কায় ইটের দালান আছিল বইলা মনে হয় না। লঙ্কার সবগুলা বাড়িঘর আর প্রাচীরই আছিল সাধারণভাবে দাহ্য; মানে কাঠ বাঁশের স্থাপনা। যদিও রাবণের দশটা গুণ বা দক্ষতার মইদ্যে একটা আছিল বাস্তশিল্প বা আজকের যুগের স্থাপত্যশিল্প…

ময় দানব নামে মাত্র একজন স্থপতির কথা মহাভারতে শোনা যায়; কাব্যিক বর্ণনায় ময় দানবের তৈরি ইন্দ্রপ্রস্থের প্রাসাদ অনেক বিশাল আর উজ্জ্বল বইলা মনে হইলেও আসলে কিন্তু তা না। কারণ যুধিষ্ঠির সম্রাট হইবার পরে কিন্তু এই প্রসাদে থাকে নাই। আবার বলা হয় দুর্যোধন এই প্রাসাদ দেইখা হিংসায় জ্বইলা গেছিল; অথচ পাশা খেইলা জিতার পর কিন্তু প্রাসাদটা দিয়া দিছে দ্রোণাচার্যরে।

ইন্দ্রপ্রস্থের দালান যদি অতই আকর্ষণীয় হইত তবে তা দুর্যোধন নিজেই রাখত। কিন্তু তা হইল না…

এক নারীর একাধিক স্বামী- আনুষ্ঠানিকতা বর্জিত বিবাহ-বরের বাড়ি পাত্রী আইনা বিবাহ; এইগুলা যেমন পুরানা প্রথা তেমনি সন্তানের মায়ের নামে পরিচিতি বহুত প্রাচীন প্রথা। এইগুলা সবই মহাভারত সোসাইটির উপাদান। মহাভারত সোসাইটিতে লোকজনরে আমরা মাত্র বাপের নামে পরিচিত হইতে শুরু হওয়া দেখি। সেইখানে বলতে গেলে মাত্র একজন মানুষই মোটামুটি বাপের নামে পরিচিত। তিনি কৃষ্ণ। কৃষ্ণরে মহাভারতে খুব অল্প ক্ষেত্রে তার মায়ের নামে ডাকা হইছে। পাণ্ডবগো বাপের নামে ডাকা হইলেও বহুবার আমরা কৌন্তেয়- মাদ্রেয় কথাগুলা শুনি। মানে দুইটাই প্রচলিত আছিল। অন্যদিকে ভীষ্ম পুরাই গাঙ্গেয়…

রামায়ণ পুরাই বাপকেন্দ্রিক। বাপের নামে সন্তানের পরিচয় তুলনামূলক বহুত আধুনিক বিষয়। মূলত নারীর সারা জীবন এক স্বামীর লগে থাকার বিধান প্রচলিত হইবার পরেই বাপের নামে পরিচিতিটা প্রতিষ্ঠিত হয়। বলা হয় ঋষি উদ্দালক আরুণি; যিনি পাঞ্চাল রাজা প্রবাহণের শিষ্য হইয়া ব্রহ্মের তত্ত্ব প্রচার করছিলেন; তার ক্ষেত্রজ পুত্র শ্বেতকেতুই হইলেন নারীদের এক স্বামীর অধীন করার পয়লা প্রচেষ্টাকারী। পরে সেইটারে মোটামুটি পাকাপোক্ত করেন অঙ্গিরা বংশের আন্ধা ঋষি দীর্ঘতমা…

সন্তানের পিতার নামে পরিচিত হইবার লগে লগে রামায়ণে নারীর এক স্বামী- আড়ম্বরপূর্ণ বিবাহ অনুষ্ঠান- পাত্রীর বাড়িতে বিবাহ এই সকলই আছে। পাশাপাশি মরার লগে শবানুগমন জিনিসটা আর্য সমাজে আছিলই না; মহাভারতেও নাই। শবানুগমনের মতো এই নতুন সিস্টেমটাও কিন্তু রামায়ণ সমাজে আছে…

বলা হয় বেদ আগে বামুন ছাড়া শূদ্র আর নারীগো লাইগা নিষিদ্ধ আছিল। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তার মহাভারতের ছয় প্রবীণ গ্রন্থে কন যে দ্বৈপায়নই পয়লা ব্যক্তি যিনি নারী আর শূদ্রগো লাইগা বেদ উন্মুক্ত কইরা দেন। রামায়ণে আমরা অনার্য বংশজাত বালির স্ত্রী তারারে বেদ পড়তে দেখি। এই হিসাবে তো অবশ্যই এগোরে দ্বৈপায়ন পরবর্তী মানুষ বইলা ধইরা নিতে হয়। আবার রামায়ণের শেষ দিকে খালি বেদ পড়ার অপরাধে রাজা রামরে আমরা দেখি এক শূদ্রবংশজাত শম্বুকের মাথা কাইট্টা ফালইতে। তবে কি বেদ শূদ্রগো লাইগা আবার নিষিদ্ধ হইছিল রামের হাত ধইরা?

চতুর্বেদ কথাটা দ্বৈপায়ন থাইকা শুরু। বলা হয় অগোছালো বেদের মন্ত্রগুলারে তিনি চাইর ভাগে ভাগ করেন বিষয় অনুযায়ী। যদিও বেদগুলার মইদ্যে প্রচুর রিপিটেশন আছে আর অথর্ব বেদরে ঠিক অন্য তিনটা বেদের সম পর্যায়ে ধরা হয় না। তবুও আমরা রামায়ণে কিন্তু বিভাজিত বেদের রেফারেন্সই শুনি। অন্তত তিন বেদ সেইখানে পরিষ্কারভাবে উল্লিখিত। আখ্যানমতে দ্বৈপায়নের পুত্র শুকদেবই হইলেন দুনিয়ার পয়লা চতুর্বেদী মানুষ। বাকি যারা ত্রিবেদী বা চতুর্বেদী তারা সকলেই হয় শুকদেবের শিষ্য না হয় তস্য শিষ্য। কিন্তু রামায়ণে আমরা দেখি সুগ্রীবের মাইয়ার জামাই আর মন্ত্রী হনুমান একজন ত্রিবেদী বা চতুর্বেদী পর্যায়ের মানুষ। যদিও হনুমানের শিক্ষা বিষয় রামায়ণে পরিষ্কার নাই; তবু এই অনার্য মানুষটার মুখে নির্ভুল সংস্কৃত আর বৈদিক বিষয়ের উল্লেখ শুইনা রাম পর্যন্ত লক্ষ্মণের কাছে বিস্ময়ে হনুমানের বিদ্যার প্রশংসা করে। সারা রামায়ণে আমরা রামরে কি অন্য কারো গুণের প্রশংসা করতে শুনি? মনে হয় না…

কেউ কেউ মহাভারতে কুরুপক্ষে যুদ্ধ করা বৃহদ্বলরে রামের উত্তর পুরুষ কইয়া যুক্তি দেখান যে মহাভারত রামায়ণের পরে। কারো যুক্তিতে রামপুত্র কুশের ধারায় বৃহদ্বল রামের ১৫তম আর কারো তালিকায় ২৮তম উত্তর পুরুষ। কিন্তু রামায়ণের সমাজ বইয়ের লেখক কেদারনাথ মজুমদার পরিষ্কার কইয়া দেন যে লব কিংবা কুশ আদৌ রামের কেউ না; পুত্র তো দূরের কথা। মূলত উত্তরকাণ্ড যারা লেখছে; তারাই রামায়ণ গানের কথক লব আর কুশেরে রামের পুত্র বানায়া দিছে। মানে লব আর কুশ সম্পর্কে সেই ছোটবেলার গ্রামের ধাঁধা আরকি- ছেলের যখন জন্ম হলো মা ছিল ঘরে/ জন্মদাতা জন্ম দিলো না জন্ম দিলো পরে…

মানে লব আর কুশের জন্ম বাপেও দেয় নাই; মায়েও না; জন্ম দিছে কবিরা। মূলত রাম আর সীতা নিঃসন্তানই ছিলেন। বৃহদ্বলের কাশি নিবাসী পরবর্তী কোনো বংশধর বোধহয় বংশ গৌরব বাড়াইবার লাইগা বৃহদ্বলরে মহাভারতে ঢুকাইছে পরে। কারণ তখনকার দিনে রাজা বাদশাগো নিজের বংশ গৌরব বাড়াইবার লাইগা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পূর্ব পুরুষরে ঢোকাইয়া মাইরা ফালানো থাইকা সহজ কোনো পদ্ধতি আছিল না। বৃহদ্বলের লগে আসলে রামায়ণ মহাভারতের আগে-পরের কোনো সম্পর্ক নাই…

একইভাবে বিশ্বামিত্র-মেনকার মাইয়া শকুন্তলার স্বামী রাজা দুষ্মন্তর পোলা ভরত হইল মহাভারতের শান্তনু কিংবা কুরু বংশের পূর্ব পুরুষ; এইটা দিয়া রামায়ণরে আগের ঘটনা কইতে যাওয়া একটা ফালতু বিষয়। কারণ বেদে রাজা সুদাসের পুরোহিতের চাকরি হারায়া সুদাসের রাজ্য দখল করার লাইগা যে বিশ্বামিত্র আক্রমণ কইরা বসছিলেন তিনি যেমন বিশ্বামিত্র; তেমনি ঋগবেদের গায়ত্রী বা সাবিত্রী মন্ত্রসহ বহুত শ্লোক; বিশেষত তৃতীয় মণ্ডল এর রচয়িতাও বিশ্বামিত্র; আবার গৌতম বুদ্ধের জীবনী ললিত বিস্তারেও কিন্তু দেখা যায় যে তিনি যার কাছে লেখাপড়া শিখছেন তার নামও বিশ্বামিত্র…

ঋগবেদে বিশ্বামিত্রের চাকরি খাইয়া রাজা সুদাসের পুরোহিতের চাকরি যে বশিষ্ঠ নিছিলেন তিনি হইলেন মিত্রবরুণের ঔরসে উর্বসীর পোলা বশিষ্ঠ। আর রামায়ণের বশিষ্ঠের বাপের নাম ব্রহ্মা।

অন্যদিকে মহাভারতের বশিষ্ঠ কিন্তু বিশ্বামিত্রের লগে যুদ্ধে নির্বংশ হইয়া যান; তার পোলার পোয়াতি বৌর গর্ভে একমাত্র বংশ টিকা থাকে পরাশর; যে কি না দ্বৈপায়নের পিতা। অন্যদিকে রামায়ণের বশিষ্ঠের পোলা রীতিমতো এক চ্যাংড়া পুরোহিত; যে রাম বনবাসে যাইবার আগে তার সমস্ত দান খয়রাতের তদারকি করে…

বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠ এইগুলা মূলত গোষ্ঠী নাম; আইজকার যুগের চৌধুরী কিংবা ব্যানার্জিগো মতো। ঋগবেদে যত জায়গায় এইসব ঋষির নাম আছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা বহুবচনে আছে; মানে বশিষ্ঠগণ বিশ্বামিত্রগণ আর যজুর্বেদে ভৃগুগণ অঙ্গিরাগণ এই রকম। মানে ঋগবেদের কালেই এরা বংশ বা গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত আছিলেন। সুতরাং এইসব ঋষি পুরোহিতগো নাম দিয়া ইতিহাস বাইর করার কোনোই সুযোগ নাই। এবং তা অর্থহীনও…

একইভাবে রামায়ণে জন্মেজয় আর পরীক্ষিতের উল্লেখ আছে; পরীক্ষিৎ হইল অর্জুনের নাতি; এইরকম রেফারেন্স দিয়া আসলে রামায়ণ মহাভারত আলোচনা করার সুযোগ নাই। কারণ একই নামের ব্যক্তি হাজারে হাজার থাকে। বর্তমানে খুঁজলেও কয়েক লক্ষ রাম আর কৃষ্ণ পাওয়া যাবে দুনিয়ায়…

গীতায় কিন্তু বেশ কয়েকটা শ্লোকে বেদ বিরোধীতা বা বেদনিন্দা আছে। মহাভারতেও আছে বেদবিরোধীতা এবং বেদনিন্দা। তো বঙ্কিমচন্দ্র তার ভগবৎগীতায় গীতার সেই বেদবিরোধী। শ্লোকগুলার মইদ্যে ৪২-৪৬; তিনটা বেদ বিরোধী শ্লোকরে বহুত ঘুরাইয়া প্যাচাইয়া মুচড়াইয়াও বেদের পক্ষে আনতে না পাইরা বেশ চমৎকার একটা কথা কইছেন অপারগ হইয়া। সেইটা হইল “ভারতবর্ষ এই উনবিংশ শতাব্দিতে বেদ শাসিত। আজিও বেদের যে প্রতাপ, ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের তাহার সহস্রাংশের এক অংশ নাই। সেই প্রাচীনকালে বেদের আবার ইহার সহস্রগুণ প্রতাপ ছিল। সাংখ্যপ্রবচনকার ঈশ্বর মানেন না- ঈশ্বর নাই, এ কথা তিনি মুক্তকণ্ঠে বলিতে সাহস করিয়াছেন, তিনিও বেদ অমান্য করিতে সাহস করেন না-পুনঃ পুনঃ বেদের দোহাই দিতে বাধ্য হইয়াছেন। “শ্রীকৃষ্ণ মুক্তকণ্ঠে বলিতেছেন, এই বেদবাদীরা মূঢ়, বিলাসী; ইহারা ঈশ্বর আরাধনার অযোগ্য”…

এর পরেও তিনি বহুত পৃষ্ঠা খর্চা করছেন জোর কইরা এই শ্লোকগুলারে বেদের লগে লাইনআপ করতে। কিন্তু তিনি একটা কথা পরিষ্কার কইরা কইয়া দিছেন যে গীতায় যে বেদ বিরোধীতা আছে সেইটা পণ্ডিতেরা কিন্তু চাইপা গেছেন জানের ডরে; কিলের ভয়ে। হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর না মানলে সমস্যা নাই কিন্তু বেদ না মানলে বহুত ঝামেলা…

তিনটা শ্লোকরে বেদের পক্ষে আনার বহু চেষ্টা করার পর ৫৩ শ্লোকে গিয়া বঙ্কিম পড়েন আবার বিপদে। আবারো বহুত প্যাচাল পাড়েন এইগুলারে বেদের পক্ষে আনতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবার অপারগ হইয়া ফট কইরা বইলা দেন- “এখন বেদে কিছু প্রয়োজন নাই, এমন কথা, আমরা ঊনবিংশ শতাব্দির ইংরেজ শিষ্য, আমরা না হয় সাহস করিয়া বলিতে পারি, কিন্তু শঙ্করাচাৰ্য্য কি শ্রীধর স্বামী এমন কথা কি বলিতে পারিতেন? প্রাচীন ভারতবর্ষীয়েরা বেদকেই একটা ঈশ্বররূপে খাড়া করিয়া তুলিয়াছেন। কপিল ঈশ্বর পরিত্যাগ করিতে পারিয়াছিলেন, কিন্তু বেদ পরিত্যাগ করিতে পারেন নাই। বৃহস্পতি বা শাক্যসিংহ প্রভৃতি যাঁহারা বেদ পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, তাহারা হিন্দু-সমাজচ্যুত হইয়াছিলেন। অতএব শঙ্করাচার্য্য, কি শ্রীধর স্বামী হইতে এমন উক্তি কখন সম্ভব না যে, ব্রহ্মজ্ঞানী হউক বা যেই হউক, কাহারো পক্ষে বেদ নিষ্প্রয়োজনীয়। কাজেই তাহাদিগকে এমন একটা অর্থ করিতে হইয়াছে যে, তাহাতে বুঝায় যে, ব্রহ্মজ্ঞানেও যা, বেদেও তা, একই ফল। তাহা হইলে বেদের মর্যাদা বহাল রহিল।”

এক্কেবারে পরিষ্কার। শঙ্কাচার্য কিংবা শ্রীধরের মতো মানুষেরা সাহস কইরা কইতে পারেন নাই যে গীতায় বেদনিন্দা বা বেদ বিরোধিতা আছে। তাগো ডর আছিল; সমাজচ্যুত হইয়া একঘরে হইবার। ডর আছিল মাইর খাইবার। যেমন ঘটছিল বৃহস্পতি বা শাক্যসিংহের বেলায়…

তো কেদারনাথ মজুমদার পুরা রামায়ণখান দুর্ধর্ষভাবে বিশ্লেষণ কইরা সাইরা একটু মিন মিন কইরা যুক্তি দেখান যে; রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে রামের গোসব যজ্ঞের কথা আছে কিন্তু গরু খাওয়ার কথা তো পাই নাই। মনে হয় এইটা বঙ্কিমের সেই বিশ্লেষণের ধাচেই পড়ে। আমরা বুঝতে পারি কেদারনাথ কেন সেইটা পাশ কাইটা যান বা কমজোর গলায় কন- না তো। নাই তো। গোসব যজ্ঞের কথা আছে কিন্তু গরুর মাংস দিয়া মাখাইয়া ভাত খাইবার কথা তো নাই। যাউকগা। রামায়ণ সমাজে গরু খাওয়ার প্রচলন তো আছিলই উল্টা গরুর মাংসটাই আছিল শ্রেষ্ঠ মাংস বইলা গণ্য। গরু খাওয়া বন্ধ হয় মূলত বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে…

রামায়ণ সমাজে গরু খাওয়া হইত না; গোসব যজ্ঞ কইরা মূলত মধু দিয়া রান্না করা গরুর মাংস গাঙে ফালায় দেয়া হইত দেবতাগো খাইবার লাইগা; এইসব কথা কেউ কইলে অন্যদিকে ধইরা নিতে হইব যে তিনি বা তিনারা রামের বয়স বুদ্ধদেবের থাইকা কমাইয়া নিয়া আসছেন। আর রামায়ণরেও কইরা দিতে চাইছেন বৌদ্ধ উত্তর সাহিত্য…

মাহবুব লীলেন
সেপ্টেম্বর ২০১৬