১. বাপে মরলে পোলায় রাজ্য পায়

০১

বাপে মরলে পোলায় রাজ্য পায়। বড়ো পোলা আঁতুড় ল্যাংড়া আন্ধা লুলা হইলে পায় ছোট পোলায়। কিংবা বাপের ইচ্ছা হইলে অন্য পোলা কিংবা অন্য কারো পোলারে রাজ্য দিয়া যায়। তারপর সেই রাজায় লাঠি দাবড়াইয়া- মাইনসের চামড়া ছিলা- খাজনাটাজনা নিয়া-মুকুট-সিংহাসন বানাইয়া রাজত্ব করে। কারো হেডম থাকলে নিজের পোলা শালা ভাই ভাতিজা নিয়া আশপাশের রাজ্য দখল কইরা মহারাজা হয়; না হইলে অন্যের ঠেলায় নিজের ঘটিবাটি হারাইয়া জীবিত থাকলে বনে গিয়া হয় জটাজুটধারী সন্ন্যাসী…

রাজা শান্তনু পর্যন্ত মহাভারতে রাজাদের ইতিহাস এমনই। হাজারে হাজার রাজা। কাঠুরের দলনেতাও সেইখানে যেমন রাজা; গোষ্ঠীর বুড়াও তেমন রাজা; শিকারি দলের প্রধানও রাজা; আবার বহু বলবান ইন্দ্রও সেইখানে একজন রাজা। মহাভারতে রাজার কোনো সংজ্ঞাও নাই; মাপজোকও নাই; সীমাপরিসীমাও নাই। এক্কেবারে বাংলাদেশের গ্রামের মতো। গ্রামেরও কোনো মাপজোক নাই; সীমা-সংজ্ঞাও নাই। দুই ঘর মানুষ নিয়া যেমন বাংলাদেশে গ্রাম আছে; তেমনি লাখের উপর মানুষ নিয়া বাইন্যাচঙ্গও বাংলাদেশে একটা গ্রাম…

মাঝে মাঝে মনে হয় সেই কালে গ্রামবুড়াদেরই অন্য নাম আছিল রাজা। তো জোয়ান পোলার বাপ বুইড়া রাজা শান্তনু পর্যন্ত মহাভারতের রাজনীতিবিহীন রাজারা ওইরকমই ছোটতে-বড়োতে মিলামিশা ছিল। তারপরেও ওইরকমই থাকার কথা ছিল; কেননা সকলেই জানত শান্তনু মইরা গেলে জোয়ান একমাত্র পোলা দেবব্রতই পাইব হস্তিনাপুরের গদি। শান্তনু নিজেও তা জানত; তাই পোলার হাতে রাজ্য দেখাশোনা দিয়া সে এদিক-সেদিক চক্কর মাইরা কাটাইত সময়। আর এই ঘুর-চক্করের ভিতরেই সে মহাভারতীয় রাজাগো মইদ্যে পয়লাবারের মতো পইড়া গেলো রাজনীতির খপ্পরে…

সেই বুড়া রাজা শান্তনুর ঘরে তখন আর বৌ নাই। তার পোলা দেবব্রতের মায়ের নাম গঙ্গা। যারা তারে দেবী মানে তারা বলে দেবী গঙ্গা শান্তনুরে পোলা দিয়া আবার ফিরা গেছে গাঙ্গে; মানে সে থাকলেও শান্তনুর সংসারে নাই। সাদা চোখে মনে হয় শান্তনুর বৌ গাঙপাড়ের মাইয়া গঙ্গা তখন মইরা গেছে অথবা হইলেও হইতে পারে গঙ্গা তখনো জীবিত; কিন্তু শান্তনুর বাড়িতে না থাইকা দূরে কোথাও নিজের বাপের বাড়িতে থাকে। কারণ মহাভারতে পোলা দেবব্রতের লগে মাঝে মাঝে তার মায়ের সাক্ষাতের সংবাদ পাওয়া যায়। যদিও শান্তনুর লগে তারে আর কোনোকালে কোনো কথাবার্তা কইতে দেখে নাই কেউ…

তো সেই বুড়িগঙ্গা কিংবা মরাগঙ্গার পোলার বাপ রাজা শান্তনু এক দিন হাঁটতে হাঁটতে যমুনার তীরে গিয়া আছড়াইয়া পড়ে তরতাজা মাইমলকন্যা সত্যবতীর সামনে। ওরে বাপরে বাপ; কী মাইয়াখান। দেখল রে রাজা। যেমন তার তেজ তেমন তার ধার। বয়স আর রূপের কথা তো বলারই উপায় নাই কারণ সেই যে চিত হইয়া পড়ছিল রাজা; মণিমুক্তা মাখানো পোশাক কাদায় ছ্যারাবেরা তবু সে ভুইলা গেছে হামাগুড়ি দিয়া উঠবার কথা…

বুইড়া আর চিতপটাং হইলেও সে একজন রাজা আর কইন্যা যেহেতু তারই রাজ্যে বৈঠা ধরে মাইনসেরে নদী পারাপার করে সেহেতু এই মাইয়া নিশ্চিত তার কোনো মাইমল প্রজার মেয়ে। মানে কাদাকুদা মাইখাও রাজা তারে যেকোনো কিছু কইতেই পারে। তো রাজা শান্তনু কয়-  আমি তোমারে বিয়া করবার চাই…

এক রাজার পক্ষে মাইমল কইন্যারে এর থিকা ভালো কইরা কওয়ার কিছু নাই। রাজায় তারে বিয়া করতে চায় এইটা শুনলে তার গুষ্টিসুদ্ধা খুশিতে বগবগা হইবার কথা। কিন্তু এই পাটনি সত্যবতী কিছুটা ভিন্ন রকম। ন্যাড়া হইয়া সে একবার বেলতলায় গিয়া বহুত হ্যাপা ঘাঁটাইছে। তার যখন বয়স আরো কম; বুদ্ধিশুদ্ধিও অতটা পাক্কা হয় নাই। তখন এরকমই আরেকজন তার ঘাটে আইসা কইছিল- শোনো কইন্যা মুই বাঁশিষ্ঠ পরাশর। মুই তুমার লগে শুইবার চাই…

জটাজুটধারী সেই লোক জাতে ব্রাহ্মণ। এক হাতে লোটা অন্য হাতে ত্রিশূল; মুনি বশিষ্ঠের নাতি এইরকম একখান আব্দার করছে যা নমশূদ্র মাইমল গোষ্ঠীর উপর তার জাত আর ধর্মের অধিকার। নৌকার লোক আর ঘাটের মানুষ মুনির কথা শুনে থ মাইরা যায়। মাইয়া তাগোর দিকে চায় কিন্তু নিরুপায় সকলেই যেন কিছু শোনে নাই ভান কইরা এদিকে-সেদিকে হাঁটে আর নদী পার হইতে সত্যবতীর নৌকায় যারা উঠছিল তারা ভ্যাবাচেকা খাইয়া নৌকাতেই থাকে। কারণ নৌকার এক দিকে তখন নদী অন্য দিকে কামার্ত ব্রাহ্মণ পরাশর…

আশেপাশে তাকাইয়া পরাশর বুঝে বাতাস তার অনুকূলে আছে। নৌকার যাত্রীগো সে নাইমা যাইতে আদেশ করে গম্ভীর গলায়- আমি একলাই যাত্রী হমু আজ এই নৌকায়…

হুড়মুড় কইরা সত্যবতীর নৌকা থাইকা পাব্লিক নাইমা গেলে পরাশর উইঠা নৌকা ছাড়তে কয়। আর হতভম্ব সত্যবতীর নৌকা যখন মাঝ নদী বরাবর তখন পরাশর কয়-  কাছে আসো কইন্যা। নৌকা ভাসুক গাঙ্গে…

পাটনিবিহীন নৌকা ভাসে জলে আর পাটনির গাঙ্গে সাঁতরায় পরাশর। তারপর দুইখান বাণী আর ভংচং আশীর্বাদ দিয়া পরাশর চইলা যায় কিন্তু সেই দিন মাঝ নদীতে গর্ভবীজ নেওয়া সত্যবতীরে লোকলজ্জার ভয়ে কিছু দিন পর দূরের চরে গিয়া জন্ম দিয়া আসতে হয় নিজের মতো এক কাইল্যা রঙ্গের পোলা…

পরাশর তো গেছে। কিন্তু বিয়ার বাজারে সত্যবতীর দামও সে নামাইয়া দিয়া গেছে এক্কেবারে তলায়। এক পোলার মায়েরে বুড়াধুড়া ছাড়া কেউ বিয়া করতে নারাজ। যে দুয়েকজন রাজি তারা কন্যাপণ দিতে রাজি না। কারণ তারে বিয়া করলে তার পোলারেও খাওন পরন দেওয়া লাগব সেই স্বামীটার…

বুইড়াদের কামচক্ষু পড়া সে শিখছে পরাশর দেইখা। শান্তনুর চোখ ঘোরে তার শরীরের ভাজে। পার্থক্য শুধু এই ব্রাহ্মণেরা কাম ছাড়ে হাটে-মাঠে-ঘাটে আর ক্ষত্রিয়েরা কাম ফলায় ঘরে নিয়া গিয়া। খারাপ না। এক পোলার মায়েরে যেখানে কোনো জোয়ান মরদ বিয়াই করতে চায় না সেইখানে শান্তনু বুইড়া হইলেও তো রাজা। কিন্তু তবুও এক বাক্যে রাজি হওয়া ঠিক না মোটেও…

শরীরে হুমড়ি খাওয়া শান্তনুর চোখে চোখ রাখে সত্যবতী-রাজার বিয়ার প্রস্তাব কি নদীঘাটে দেওয়া মানায়? বাড়িতে আমার বাপে আছে। কইন্যার বিয়ার প্রস্তাব তার কাছে দেওয়া যেমন রাজার উপযুক্ত তেমনি কন্যাদানের অধিকারও তার…

ঠিক কথা। ঠিক কথা। মাইলের মাইয়া হইলেও বুদ্ধিশুদ্ধি যেমন আছে তেমনি রাজার সম্মানও সে বোঝে ষোলো আনা। বাপের কাছেই গিয়া তবে কন্যাপ্রার্থনা উপযুক্ত কাজ…

শান্তনু সত্যবতীর বাপের কাছে যাবার আগেই নিজের বাপেরে সে সকল বিত্তান্ত বুঝায়ে ফালায়। পরে মাইমল পাড়ায় আইসা রাজা যখন সত্যবতীর বাপের কাছে বিয়ার প্রস্তাব রাখেন তখন জোড়হাত কইরা মাইমল হাসে- মহারাজ। আপনার তো একখান জোয়ান পোলা আছে ঘরে। হ্যায় যুদি ঝামেলা করে?

ধুবাল বইলা এইখান থেকে যেমন চইলা আসা যায়; তেমনি চুলের মুঠা ধইরা সত্যবতীরেও নিয়া আসা যায়। কিন্তু সত্যবতীর রূপে শইল যেমন উচাটন তেমনি মান-সম্মানের কথাখানও ফালান দেওয়া যায় না। মাইমল বেটারে পাত্তা না দিলেও নিজের জোয়ান পোলার ভাবসাব একবার যাচাই করা দরকার। পোলায় যদি সৎমা মাইনা না লয় তবে তো সত্যিই ঝামেলার কথা…

বাড়ি গিয়া শান্তনু নিজের পোলার সামনে আনচান করে। পোলায় জিগায়-কী হইল বাপ? আবার কেউ তোমার জমি লুটের ধামকি দিছে নাকি? বাপে কয়-  তুই যে দেশের যুবরাজ সেই দেশেরে হুমকি দিবার সাহস আছে কার? পোলায় জিগায়- তবে ক্যান মন বেচইন বাজান? বাপে কয়-  মনটা বেচইন কারণ তুই আমার একটামাত্র পোলা। শাস্ত্রে কয় এক পোলা থাকা আর না থাকা পিরায় সমান। বড়োই চিন্তিত আছি রে বাপ; যদি তোর কিছু হইয়া যায় তো আমার পিণ্ডি দিবারও যে থাকব না কেউ…

বুদ্ধিমান পোলায় বোঝে বাপের গতর টাডাইছে তাই পোলা বাড়াইবার নামে বিয়া করতে চায়। পোলায় ভাবে অসুবিধা কী? করুক না বিয়া। বুইড়া মানুষ মরার আগে একটু রং-তামাশা করলে সমস্যা তো নাই। তাই সে গিয়া বাপের ইয়ারদোস্তগো জিগায়-কারে দেইখা আমার বাপে উতলা কন তো চাচা-জ্যাঠা মুরব্বিগণ?

সত্যবতীর নামধাম জাইনা পোলায় নিজেই মিত্র-অমাত্য নিয়া গিয়া মাইমলের উঠানে খাড়ায় শোনো মাইমল। আমার পিতা হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু তোমার মাইয়ারে বিবাহ করতে চান। আমি তার প্রস্তাব নিয়া আসছি তোমার নিকট…

দেবব্রতের এই কথায়ও মাইমল হাসে- শোনো যুবরাজ। সন্দেহ নাই যে রাজরানি হইবার এই প্রস্তাব আমার মাইয়ার লাইগা সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু তোমার বাপের লগে আমার মাইয়ার শাদি হইলেও যে মোর নাতিপুতিরা কেউ রাজা হইতে পারব না তোমার মতো বড়ো ভাইজান থুইয়া। এখন তুমিই বলো; বাপ হইয়া কেমনে আমি নিজের কইন্যার এমন অধস্তন ভবিষ্যৎ মাইনা নিতে পারি?

দেবব্রত পড়ে ফাঁপরে। বাপেরে বইলা আসছে সত্যবতীর লগে তার বিয়া সে করাইয়া দিবে। পাত্র অমাত্যদেরও ভড়ং দেখাইয়া কইছে-বুইড়া বাপের লাইগা আমার এইটুকু তো অবশ্যই করা উচিত। কিন্তু এখন যদি তার কারণেই বাপের বিয়া ভাইঙ্গা যায় তয় কেমনে সে মুখ দেখায় সকলের কাছে?

আশপাশ তাকাইয়া সে মাইমলের হাত ধরে- আমি তোমারে কথা দিলাম ভবিষ্যৎ নানা। যদিও আমি বাপের পরে রাজা হইবার দাবিদার। তবু আমি সকলরে সাক্ষী রাইখা সেই রাজত্বের দাবি ছাইড়া দিলাম। তোমার মাইয়ার গর্ভে আমার যে ভাইয়েরা হবে; তারাই পিতার পরে হবে রাজা। এইবার তুমি রাজি হও…

মাছেরে নিয়া কারবার যার; সে ঠিকই বোঝে মাছে টোপ গিললেই সুতায় টান দিতে নাই; তারে নিয়া কিছুটা খেইলা বঁড়শিখান বিধাইতে হয় মাংসের ভিতর। সে কয়-  অতীব খুশির কথা যুবরাজ। নিজের পিতার একটা খায়েশ পূরণের লাইগা রাজত্ব ছাইড়া দিবার মতো তোমার যে ত্যাগ; তা ইতিহাস স্মরণ রাখব আমি বইলা দিতে পারি। কিন্তু তুমি তো একটা জোয়ান মানুষ। সামনে বিয়াশাদি করবা। তোমারও পোলাপান হইব বিস্তর; কিন্তু কে কইতে পারে যে সকল পোলাই বাপের

মতো ত্যাগ আর উদারতা পায়? তো তুমি রাজত্বের দাবি ছাইড়া দিলেও তোমার পোলাপান তা মানব তার গ্যারান্টি কই? তারা যদি আমার ভবিষ্যৎ নাতিগো লগে রাজ্য নিয়া কাইজা বাঁধায়? সেইটাও তো একখান চিন্তার বিষয়; নাকি কও?

কী কুক্ষণে যে বাপের বিয়ার ঘটকালি করতে আসছিল দেবব্রত এইবার মনে মনে ভাবে। বাপের দোস্তবন্ধুরা তার দিকে তাকাইয়া আছে। হিরা মণি মাণিক্য কিংবা কইন্যাপণ নিয়া কথা হইলে তারা কিছু কইবার পারে। কিন্তু হালার মাইমল যা কয় সবকিছু যুবরাজরে পঁাচ দিয়া কয়। এই সব কথার উত্তর তো যুবরাজ ছাড়া তার বাপেরও দিবার সাধ্যি নাই…

যুবরাজ দেবব্রত পড়ে মাইনকার চিপায়। সক্কলের চোখে সে দেখে একটাই ভাষা- বাপধন। বাপের বিয়াটা যদি হয়; তবে একমাত্র তুমিই তা করায়া দিবার পারো। আর যদি ভাঙ্গে তবে সেইটাও একমাত্র তোমার লাইগা ভাইঙ্গা যাইতে পারে। এইবার দেখো বাপধন। কী করবা না করবা তুমিই বুইঝা লও…

দায়িত্ব নিয়া পিছানোর থাইকা মইরা যাওন ভালো। সব দিক ভাইবা-চিন্তা দেবব্রত আগায় মাইমলের দিকে- আমি গঙ্গার পোলা দেবব্রত। তোমার গুষ্টিগাড়া এবং আমার বাপের এই সঙ্গীসাথিগো সামনে প্রতিজ্ঞা করতাছি যে; বাপের খায়েশ পূরণ আর তোমার ডর ছাড়াইবার লাইগা আমি সারা জীবন ব্রহ্মচারী হইয়া থাকব। জীবনে বিয়াশাদি যেমন করব না তেমনি বিবাহের বাইরেও জন্ম দিব না পোলাপান। আর আমার পোলাপান না হওয়া মানে তোমার ভবিষ্যৎ নাতিপুতিগো কাইজাবিহীন সিংহাসনের উত্তরাধিকার। এইবার তুমি রাজি? |||||||||| — হ রাজি

বাপের লাইগা ভীষণ কঠিন প্রতিজ্ঞা করায় দেবব্রতরে সক্কলে ভীষ্ম খেতাব দিয়া ধন্যধন্য করে আর নিজের পোলাপানের রাজত্ব আর শান্তনুর বড়ো পোলারে নির্বংশ রাখা নিশ্চিত কইরা সত্যবতী রাজনীতি নিয়া আসে শান্তনুর ঘরে কিংবা মহাভারতের পাতায়…

ঔরসধারী পরাশরের আশ্রমে বিদ্যাশিক্ষা কইরা সত্যবতীর বিবাহপূর্ব পোলায় হইছে ব্রাহ্মণ। এই ছুডুকালেই জ্ঞানগম্যির লাইগা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন কইয়া তার বেশ নামডাক। পরের ঘরে আরেক পোলা যদি রাজা হয় তবে তা দারুণই হয় বটে…

সত্যবতীর গর্ভে দুইখান পোলা জন্ম দিয়া রাজা শান্তনু মইরা গেলে দেবব্রত সত্যবতীর বড়ো পোলা চিত্রাঙ্গদরে বসায় ক্ষমতায়। কিন্তু কী সব যুদ্দমুদ্দ করতে গিয়া বিয়াশাদির আগেই চিত্রাঙ্গদ মারা গেলে সত্যবতীর ছোট পোলা নাবালক বিচিত্রবীর্যই হয় রাজা আর সতিনের পোলা ভীষ্ম থাকে উপদেষ্টা। তো সেই ভাই বড়ো হইলে ভীষ্ম ছোট ভাইরে একসাথে করাইয়া দেয় দুইখান বিয়া। কিন্তু সত্যবতীর কপালটা খারাপ। দুই পোলাই রাজা হইল কিন্তু রাজত্ব করতে পারল না কেউ। বড়োটা মরল বিয়াশাদির আগে আর ছোটটা বিয়াশাদি করলেও দুইটা বৌ রাইখা কী জানি কী অসুখে মইরা গেলো পোলাপান জন্ম দিবার আগে…

সত্যবতী পড়ল ঝামেলায়। নিজে রানি হইল; তার বুদ্ধিতে বড়ো ভাইরে বাদ দিয়া ছোট ভাইরা রাজাও হইল; কিন্তু এখন তো শান্তনুর ঘরে তার আর কোনো পোলাও নাই: নাতিপুতিও নাই। সিস্টেমমতো চললে তার বিবাহপূর্ব পোলা দ্বৈপায়ন কিন্তু মায়ের বিবাহসূত্রে শান্তনুর পোলা আর উত্তরাধিকার গণ্য হইবার কথা। কিন্তু সেই পোলা তো আবার ঋষিমানুষ। সিস্টেম মানে না; সিস্টেম ভাঙ্গে আর বানায়। রাজবাড়িতে মায়ের বিয়া হইলেও সে যেমন রাজবাড়িতে আসে নাই তেমনি রাজা তার মায়ের স্বামী হইলেও সে বদলায় নাই নিজের পিতৃপরিচয়। এখন তো সেই ভীষ্মই আবার শান্তনুর একমাত্র বংশধর। নিয়মমতো ভাইয়ের বিধবাগো গর্ভে সন্তান জন্ম দিয়া বংশরক্ষার দায়িত্ব আর অধিকার তারই…

নিরুপায় সত্যবতী যাইয়া ভীষ্মরে তেলায় কিন্তু ভীষ্ম নিজের ব্রহ্মচারিত্বের প্রতিজ্ঞা মনে কইরা ভাইয়ের বিধবাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের লাইগা শাস্ত্রমতে কোনো ব্রাহ্মণ ভাড়া করবার কথা কয়। আর তখনই সত্যবতীর মনে হয় নিজের ঋষিপুত্র রাইখা বাড়তি ব্রাহ্মণ ভাড়া করতে সে কোন দুঃখে যাবে? তার ঋষিপোলার রাজপুত্র হইতে আপত্তি থাকলেও রাজবংশ উৎপাদন করায় তো কোনো অসুবিধা নাই। তাই সত্যবতী তার বিবাহপূর্ব কানীন সন্তান দ্বৈপায়নরেই ডাকে…

দ্বৈপায়নের ঔরসে ছোট ভাইর দুই বিধবার গর্ভে জন্ম নেয় দুইটা পোলা। ছোট ভাইয়ের দাসীর গর্ভেও তিনি জন্ম দেন আরেক সন্তান। সত্যবতীর বড়ো নাতি ধৃতরাষ্ট্র আন্ধা বইলা গদিতে বসতে পারব না; মাইজা নাতি পাণ্ডুই হইব রাজা আর দাসীর গর্ভে জন্মাইছে বইলা ছোট নাতি বিদুর সর্বদাই থাকব উত্তরাধিকার লিস্টির বাইরে…

সত্যবতী শান্তি পায়। শান্তনুর রাজত্ব নিজের পোলাদের পরে আবারও নিশ্চিত হয় তার নাতিদের হাতে…

.

বাচ্চা পয়দার ক্ষেমতা যার নাই সেই ব্যাডায় আবার করছে দুইখান বিয়া। রাজরানি হইবার লোভে নামৰ্দ স্বামীরে মাইনা নিলেও আঁটকুড়া ব্যাডার ঘরে সতিনের সংসার কেমনে মানা যায়?

কিন্তু সতিন হজম না কইরাও কোনো উপায় নাই কুন্তীর। পাণ্ডুর দ্বিতীয় বৌ আনছেন ভীষ্মদেব নিজে। নিজে তিনি বিয়াশাদি না করলেও শান্তনু বংশে গত তিন প্রজন্মের বিবাহকর্তা তিনি। তার উপরই নির্ভর করছিল তার নিজের বাপের দ্বিতীয় সংসার। এর পরে তো ছোট ভাই কিংবা বড়ো ভাতিজার বিয়ার সিদ্ধান্তে কাউরে জিগানও নাই তিনি। পাত্রী ধইরা আইনা জানাইয়া দিছেন- আইজ তোর বিয়া। কিন্তু ঝামেলা বান্ধাইল তার মাইজা ভাতিজায়। কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ এক দিন স্বয়ংবর সভায় গিয়া কুন্তীরে নিয়া আইসা খাড়াইল তার সামনে- আমি বিয়া কইরা ফালাইছি জ্যাঠা…

ভাতিজাবধূরে ঠিকঠাক আশীর্বাদ করলেও তিন জেনারেশন ধইরা তার ঘটকালির অধিকার নষ্ট করায় মনে মনে ভীষ্ম ভালোই খ্যাপেন। কিন্তু তার খ্যাপাটা যে অত বেশি তা অনুমান করতে পারে নাই কুন্তী। হঠাৎ এক দিন তিনি মাদ্ৰীরে আইনা খাড়া করেন পাণ্ডুর সামনে- তোর বৌটা আঁটকুড়া। তাই তোর লাইগা আরেকটা বিয়ার আয়োজন করছি আমি…

তিন প্রজন্মের ঘটকালিতে সংসারহীন ভীষ্মের ঘটকালিচক্র পুরা হয় এইবার। বাপের ঘটকালি তিনি করছেন পাত্রীর বাপের শর্ত মাইনা; ভাইয়ের ঘটকালি করছেন পাত্রী ছিনাইয়া; বড়ো ভাতিজার ঘটকালি করছেন পাত্রীর বাপরে ধামকি দিয়া আর ছোট ভাতিজার লাইগা পাত্রী আনলেন নগদ পয়সায় কিনে…

কিন্তু এক পোলার মা কুন্তীরে আঁটকুড়া কইল নির্বংশ বেটায়। কথাখান মনে মনে কইলেও বাইরে কুন্তী স্বাভাবিক থাকে। কুন্তীর বহু আগে থাইকা সংসার করা নিঃসন্তান ভাসুরবধূ গান্ধারীরে তিনি কিছু কন না ক্যান; এই প্রশ্নও সে ভীষ্মরে করে না। রাজ্যের সমস্ত সৈনিক যার অধীন; সেই ভীষ্মরে খ্যাপাইয়া পাণ্ডুর জীবনটা কঠিন কইরা তোলার কোনো ইচ্ছা তার নাই। তবে পাণ্ডুরে দিয়া কিছু হইব কি হইব না মাদ্রী সেইটা বুঝবার আগেই যেন কুন্তীর পোলাপান হস্তিনাপুর দাবড়াইতে পারে সেইটা নিশ্চিত করতে হইব এখন…

কিন্তু কোনোকিছু ফাইনাল করার আগে সত্যবতীরে একটু বাজানো দরকার। তাই কুন্তী গিয়া বুড়িরে খোঁচায়- আমারে আঁটকুড়া বইলা নাতিরে তো আরেকখান সংসার করাইলেন দাদি। কই? আপনের নতুন নাতবৌয়ের শইলেও তো গর্ভের কোনো লক্ষণ নাই…

সত্যবতী বুদ্ধিমান আর নির্বোধের পার্থক্য বোঝেন দিন আর রাইতের মতো পরিষ্কার। বড়ো নাতিবৌ গান্ধারী বহুত আদব-কায়দা জানে; ধর্মকর্ম করে; সত্য কথা বলে; স্বামী কিংবা গুরুজনে ভক্তির অভাব নাই তার। কিন্তু খালি ধর্ম আর সত্য কইয়া সংসার চলে না। সব যোগ্যতাই আছিল ভীষ্মের; শুধু জানা ছিল না সময়ে সময়ে সত্যরে কেমনে নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে হয় কিংবা দরকার। মতো সত্য বানাইতে হয়। এই কারণেই সে রাজা বানায় তবু রাজা হইতে পারে না নিজে। কিন্তু যাদব বংশের মাইয়া কুন্তীর তো এই সমস্যা থাকার কথা না…

দাদি সত্যবতী সরাসরি কুন্তীর চোখে তাকান-নাতির আমার সমস্যা আছে জানি। কিন্তু আমি তার ঘরে পোলাপান দেখতে চাই। কথাটা বুঝতে পারছ তুমি?

কুন্তীর না বোঝার কারণ নাই। কিন্তু বুড়িরে আরেকটু নাড়ানো দরকার-দাদিজান। আপনি যা কইলেন তা মানলাম। কিন্তু ভীষ্মদেবেরে কথাটা কে বুঝাইব কন? অবস্থা দেইখা তো মনে হয় বছর না ঘুরতেই তিনি আরো দুই-চাইরটা সতিন আইনা আমার ঘাড়ে তুলবেন…

সত্যবতী এইবার কুন্তীরে নিশ্চিন্ত করেন। এই বিষয়ে ভীষ্ম আর কিছু করব না সেইটা তোমারে কইয়া দিতে পারি। কিন্তু আমার কথাটা মনে রাখবা তুমি। নাতি আমার অক্ষম হইলেও তার ঘরে আমি পুতাদের মুখ দেখতে চাই। শাস্ত্রে বহুত বিকল্প আছে; খালি সমাজের চোখে কিছু ধুলা দিতে হয়; আমার মনে হয় সেই বুদ্ধি তোমার ভালোমতেই আছে…

সবকিছু জাইনাও কুন্তীরে সতিনের ভাত খাওয়াইছে বুড়ি। বুড়ির কইলজায় একটা খোঁচা মারতে না পারলে কুন্তীর জান ঠান্ডা হইব না। কুন্তী এইবার বেক্কলের মতো চেহারা নিয়া জিগায়-হ দাদিজান। শাস্ত্রে তো মুনিঋষি ব্রাহ্মণ ডাইকা বৌয়ের গর্ভে পোলাপান জন্ম দিবার বিধান আছে। আপনে তো ছোট পোলার বিধবাগো গর্ভে সন্তান জন্ম দিবার লাইগা আপনের বড়ো পোলা ঋষি দ্বৈপায়নরে পাঠাইছিলেন ছোট ভাইয়ের বৌদের ঘরে। এখন কি আপনি তিনারেই আবার পাঠাইতে চান পুতের বৌয়ের বিছানায়?

খিটখিট কইরা উঠেন সত্যবতী-বেশরমের মতো কথা কবা না কলাম। দ্বৈপায়ন তোমার স্বামীর সাক্ষাৎ পিতা। আর কোনো বিকল্প দেখো না তুমি? তুমি ভালো কইরাই জানো যে এই বাড়িতে দ্বৈপায়ন খালি ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডুরে জন্ম দেয় নাই। তোমার দেবর বিদুরও দ্বৈপায়নের পোলা। দাসীর গর্ভে জন্মাইছে বইলা রাজবাড়িতে সে একটু লঘু-তাচ্ছিল্যে আছে। হ রাজবাড়ি। বোঝোই তো; পাটনি মায়ের পোলা দ্বৈপায়নের ঘরে জন্ম নিয়া দুইজন হয় রাজপুত্তুর আর একজন অচ্ছুত। এইটাই সিস্টেম শান্তনু বংশের। তা যাই হোক; বিদুর বুদ্ধিমান পোলা। শান্তনু রাজ্যের নিয়ম যেমন সে জানে; ধর্মটর্মের নিয়মকানুনও তার ভালোমতো জানা। কথাটা কি বুঝতে পারছ তুমি?

প্রকাশ্যে লজ্জা দেখাইলেও কুন্তী মনে মনে হাসে- তুমি কি মনে করো তোমার বুদ্ধির লাইগা আমি বইসা আছি? আমি বিদুরের শরণাপন্ন হইছি কি না সেইটা তোমার ছানিপড়া চোখে ধরা পড়ার কথা না। বিয়ার আগের পোলারে লুকাইতে পারো নাই বইলা বুইড়া বিয়া করতে হইছে তোমার। কিন্তু এক পোলা জন্ম দিবার পরেও কুমারী সাইজা স্বয়ংবরা পর্যন্ত করছি আমি। আমার ঘরে পোলাপান হইলে মাইনসের চোখ টাটানি তুমি সামলাইবা কি না তা আমার জানা দরকার ছিল। আর তুমি যেখানে আছ সেইখানে ভীষ্মদেব যে ভেড়া সেইটা সক্কলেই জানে…

বুড়া শান্তনুর জোয়ান পোলার সমবয়সী তরুণী বিমাতা সত্যবতী। কে জানে তাগো মধ্যে অন্য কিছু আছিল কি না। কুন্তীর মাঝে মাঝে মনে হয় বুড়িরে গিয়া জিগায়-ও দাদি। দাদারে তো মজাইছিলা রূপরস দিয়া। কিন্তু সতিনের জোয়ান পোলারে ব্রহ্মচারী কইরাও ঘরে বাইন্ধা থুইছ কোন মন্ত্র দিয়া কও তো শুনি?

গঙ্গার নন্দন ভীষ্ম। নিজে সংসারী না হইলেও সংসার তিনি বোঝেন সকলের থিকা বেশি। নির্বংশ। পাণ্ডুরাজা যদি হস্তিনাপুরেই মারা যায় তবে বড়োই কলঙ্ক হবে বংশের মুখে। ভীষ্ম তাই বিধান দিছেন পশু শিকারের নামে পাণ্ডু বনবাসে যাবে দুই বৌ নিয়া। সেইখানে গিয়া সে শিকারের লগে ধম্মকম্ম করে মুনিঋষি দেবতার দয়ায় চেষ্টা করব সন্তান পাবার…

কুন্তী জানে জীবন্ত পাণ্ডু আর হস্তিনাপুরে ফিরতে পারব না কোনো দিন। ভীষ্ম তারে নির্বাসনে মৃত্যুর বিধানই দিছেন। পাণ্ডু মরার পর যদি কোলে পোলাপান নিয়া আসতে পারে তবে পাণ্ডুর বৌরা ফিরতে পারব হস্তিনাপুর। না হইলে এইটা তাদেরও শেষ যাত্রা…

ভীষ্মের বিধানে এখন আন্ধা বড়ো ভাই ধৃতরাষ্ট্র ভারপ্রাপ্ত রাজা। এর অর্থ পাণ্ডু বোঝে। ভারপ্রাপ্ত না ভীষ্ম তার গদিটা বড়ো ভাইরে দান কইরা দিছেন। কিন্তু ভীষ্মের কথা অমান্য করার সাহস তার নাই। আন্ধা হইবার কারণে বড়ো ভাই হইয়াও যে রাজ্য ধৃতরাষ্ট্র হারাইছেন; এখন সুযোগে সেই রাজ্য পাইয়া ধৃতরাষ্ট্রও চান পাণ্ডু দূরে গিয়া মরুক। যত দিন পর্যন্ত না পাণ্ডুর পোলাপান রাজা হইবার যোগ্য হয় তত দিন পর্যন্ত ধৃতরাষ্ট্র অনির্দিষ্টকালের লাইগা হস্তিনাপুরের রাজা…

বনে ঢুইকাই কুন্তী পাণ্ডুরে ডর দেখায়-পুত্রহীনের স্বর্গে যাওয়ার নিয়ম নাই এইটা তো আপনি জানেন মহারাজ? পাণ্ডু কয়-  হ তা তো জানি বৌ কিন্তু কেমনে কী করি?

কুন্তী এইবার তারে শাস্ত্রের কাহিনি শোনায়- বৌয়ের গর্ভে অন্য কেউ সন্তান দিলেও সেইটা তার পোলা বইলাই সকলে জানে। এই যেমন; আপনে তো আসোলে পাটনিপুত্র দ্বৈপায়নের পোলা। কিন্তু রাজার বৌয়ের গর্ভে জন্মাইছেন বইলা রাজপুত্র হইছেন। তো আপনেরে আমি একখান ঘটনা কই মহারাজ; আমি কিন্তুক কুমারী আছিলাম না বিয়ার সময়। এর আগেই আমার একটা পোলা। আছিল। সেই পোলা কিন্তু কোনো মাইনসের পোলা না। দেবতা সূর্যের পোলা। তো কেমনে সেই পোলা পাইলাম সেই কাহিনি কই; পোলা পাওনের আগে আমি আছিলাম মুনি দুর্বাসার সেবিকা।

মুনি দুর্বাসারে সেবা কইরা কেউ খুশি করতে না পারলেও আমি কিন্তু পারছিলাম। সেই খুশিতে তিনি আমারে একটা মন্ত্র দিয়া যান। মন্ত্রটার জোরে নিজের গর্ভে সন্তান জন্ম দিবার লাইগা আমি যেকোনো দেবতারে ডাকতে পারি। তো মন্ত্রের ক্ষমতা পরীক্ষার লাইগা আমি এক দিন হঠাৎ সূর্যরে ডাইকা বসলাম। তারপর দেখি আমার ডাক শুইনা সত্যি সত্যি সূর্যদেব চইলা আসলেন আর আমারেও একটা পোলা দিয়া গেলেন। পরে অবশ্য তারে আমি গাঙ্গে ভাসাইয়া দিছিলাম রাজকন্যার এমন পোলা থাকা উচিত না দেইখা। তো সেই মন্ত্র কিন্তু এখনো আমার আছে। আমি কিন্তু দেবতাগোরে ডাইকা আইনা আপনারে পোলাপান দিতে পারি মহারাজ…

দুর্বাসা থাইকা দ্বৈপায়ন কোনো অংশে ছোট ঋষি না। মন্ত্র দিয়া দেবতা ডাইকা মানুষের গর্ভে সন্তান পয়দা করা গেলে নিজে গিয়া দ্বৈপায়ন উঠতেন না ছোট ভাইয়ের বৌদের বিছানায়। কুমারী সেবিকা কুন্তীরে দুর্বাসা মন্ত্র দিছে না পোলা দিছে সেইটা পাণ্ডু ঠিকই বোঝে। কিন্তু রাজি না হইয়াই বা তার কী উপায়? কারণ সমাজে বিবাহিত আঁটকুড়ার কোনো জায়গা নাই…

আগের কালে বৌয়ের কুমারীকালের পোলাপানরেও তার স্বামীর সন্তান বইলা ধরা হইত; সেই হিসাবে কুন্তীর গাঙ্গে ভাসান পোলাটা হইতে পারত নিঃসন্তান পাণ্ডুর পোলা। কিন্তু দ্বৈপায়ন থাইকা সেই সিস্টেমও বন্ধ। পুরানা সিস্টেমে দ্বৈপায়ন তার মায়ের স্বামী রাজা শান্তনুর পোলা হিসাবে গণ্য হইবার কথা; কিন্তু তিনি নিজেই প্রতিষ্ঠা কইরা দিছেন যে তিনি মুনি পরাশরের সন্তান। অবশ্য অন্য সিস্টেমটা তিনি নিজেই চালু রাখছেন মৃত ভাইয়ের বৌদের গর্ভে পোলাদের জন্ম দিয়া। বংশরক্ষার লাইগা সেইটাই এখন পাণ্ডুর একমাত্র উপায়; অন্যরে দিয়া নিজের বৌয়ের গর্ভে সন্তান জন্মদান।

সেই ক্ষেত্রে যদি দেবতার নামে পোলা পাওয়া যায় তবে সম্মানটা অবশ্য কিছু বাড়েই বলা যায়…

পাণ্ডুরে সিস্টেম কইরা কুন্তী তার কোলে একটা পোলা তুইলা দেয়- দেখেন দেখেন রাজা। দুর্বাসার দেওয়া মন্ত্রের ক্ষমতায় ধর্ম দেবতার ঔরসে এই সন্তান জন্মাইছে আমার গর্ভে। এই পোলা কিন্তু আপনার প্রথম সন্তান। আপনের পরে এই পোলাই হইব হস্তিনাপুরের রাজা। এর নাম রাখছি যুধিষ্ঠির…

দেবতার নাম কইরা কুন্তী আরো দুইটা পোলা দেয় পাণ্ডুর কোলে; পবন দেবতার নামে আসে ভীম; দেবরাজ ইন্দ্রের নামে অর্জুন। পাণ্ডু খুবই খুশি। এখন আর তারে নিঃসন্তান কইতে পারব না কেউ। কিন্তু মাদ্রী খেইপা উঠে কুন্তীর উপর-দেবতারে ডাক দিলা আর তারা আইসা তোমারে পোলা দিয়া গেলো। সাদা সাদা দেবতারা আইসা তোমারে দিয়া গেলো ভীম আর অর্জুনের মতো কালা কালা পোলা? আমারে অত নাদান ভাইব না তুমি। বনবাসে আইসা পোলা জন্মানোর নর্মাল সময়কাল পূরণ হইবার আগেই প্রথম পোলা হইছে তোমার। তুমি যদি মনে করো যে হস্তিনাপুরে বিদুরের লগে তোমার ঢলাঢলি আমার চোখে পড়ে নাই তবে তুমি ভুলের মইদ্যে আছ। তুমি যে পয়লা পোলার বীজ বিদুরের ঘর থাইকা নিয়া আসছিলা সেইটা তোমার পোলার চেহারাতেই পরমান। আর তোমার দ্বিতীয় পোলা ভীমের চেহারা এইখানকার যেকোনো পাহাড়ি মানুষের লগে খাপে খাপে মিল; সেইটা কি অস্বীকার করবা তুমি? আর এইখানকার নিষাদ পোলাপানের লগে তোমার তিন নম্বর পোলা অর্জুনরে ছাইড়া দিলে তো তুমি নিজেই তারে আলাদা করতে পারবা না। আমারে ওইসব মন্ত্রফল্ট বুঝাইও না। আমি কিন্তু সবাইরে কইয়া দিমু তুমি কেমনে কী করছো এইখানে…

কুন্তী হাসে-বেক্কল নারী। বুদ্ধি থাকলে কি নিজের মায়ের পেটের ভাই তোরে নামর্দের কাছে বিক্রি কইরা দেয়? তুই বুদ্ধিমান হইলে তো ভাইয়ে তোর লাইগা স্বয়ংবরা করত…

মাদ্রীও ঝটকানি দেয়-ভাইয়ে বিক্রি করুক আর দান করুক। এখন আমি পাণ্ডুর রানি। চোখের সামনে তুমি ভংচং কইরা পোলা বিয়াইবা আর আমি আঁটকুড়া হইয়া বইসা থাকুম?

-তোরে পোলা বিয়াইতে নিষেধ করছে কেডায়? সবকিছুই যখন বুঝস তখন যা না; দুই-চারটা পোলাপান তুইও পয়দা কর…

মাদ্রী দইমা যায়- বাচ্চা পয়দা করার সিস্টেম তো জানি। কিন্তু তুমি যেমনে দেবতা-টেবতার নাম দিয়া সেইগুলা জায়েজ করতে পারো সেইটা তো পারি না আমি…

কুন্তী হিসাব করে; এখন মাদ্রীর পোলাপান হইলে তারা সকলেই হইব কুন্তীর তিন পোলার বয়সে ছোট। সিংহাসন দাবি করার দিকে তারা থাকব পিছনে। তাছাড়া তার তিন পোলার আরো দুয়েকটা ভাই থাকলে হাতের শক্তি বাড়ে। হউক তাইলে। মাদ্রীরও তাইলে পোলাপান হউক। তাতে নিজের ছিদ্র ঢাকার লাইগা সে কুন্তীর ছিদ্রও ঢাইকা রাখব আজীবন। কুন্তী আস্তে গিয়া মাদ্ৰীরে কয়- তুই গর্ভধারণের সিস্টেম কর। মন্ত্র দিয়া তোর গর্ভ জায়েজ করার দায়িত্ব আমার। তুই খালি গিয়া পাণ্ডুরাজারে কবি যে- আমিও পোলার মা হইতে চাই। দিদিরে কও তার দেবতা ডাকার মন্ত্রটা আমারে ধার দিতে। তাতে সকলেই জানব যে একই সিস্টেমে দেবতাগো ডাইকা পাণ্ডুরাজার বংশ বাড়াইছস তুই…

মাদ্রী গিয়া পাণ্ডুর কাছে কয় কুন্তীরে কইতে মন্ত্রখান তারে ধার দিতে। পাণ্ডু কুন্তীরে অনুরোধ করলে অনুরোধ রাইখা সে মাদ্রীর পোলাপানের সীমাসংখ্যা একটু বাঁইধা দিতে চায়- তারে আমি মন্ত্র দিমু। কিন্তু একবারের বেশি কইলাম দিমু না। এতে আমার অসুবিধা আছে…

কিন্তু একবারেই মাদ্রী জন্ম দিয়া ফালায় যমজ সন্তান। সে যাতে আর পোলা জন্ম দিবার চেষ্টা না করতে পারে সেই জন্য কুন্তী গিয়া স্বামীরে বোঝায়-কইছিলাম না আপনের ছুডু বৌ একটা হারামজাদি? দেখছেন কী করছে সে? সে একবারে যমজ দেবতা অশ্বিনীকুমারগো ডাইকা দুইটা পোলা জন্মাইছে। এইটা কিন্তু মন্ত্রের শর্তের পরিষ্কার লঙ্ঘন। আপনে আমারে আর কইয়েন না মাদ্ৰীরে মন্ত্র ধার দিতে…

মাদ্রী আর মন্ত্রও পায় না; ছেলেও নিতে পারে না আর। তার থাকে দুইটাই ছেলে; নকুল আর সহদেব; কুন্তীর তিন; আর সব মিলে পাণ্ডুরাজা পায় পাঁচখান পাণ্ডব…

এর মাঝে ধৃতরাষ্ট্রের বৌ গান্ধারী জননী হইছে একশো পোলার। কুন্তী হাসে। গাঞ্জাগপ্পের আর জায়গা পায় না। বিয়ার অত বছর পার হইলেও যে একটা পোলার জন্ম দিতে পারে নাই; কুন্তী বনে আসার পর এক লগে সেই গান্ধারী জন্ম দিয়া ফালাইল একশোটা পোলা আর একখান মাইয়া। পোলা-মাইয়া জন্মানো যেন নদীতে জাল ফেইলা ছোট মাছ ধরা। জাল ফেললাম আর গুইনা কইলাম একশো একখান হইছে। আসোলে রাজ্যের সেনাবাহিনী ভীষ্মের হাতে; তাই ধৃতরাষ্ট্র ধান্দা কইরা একশো পোলার গল্প বানাইছে। সকল সৈনিক ভীষ্মের কথা শুনলেও বড়ো হইয়া এই। একশোটা পোলা চলব ধৃতরাষ্ট্রের ইচ্ছায়। কী একখান গল্প বানাইছে তারা; গান্ধারী নাকি কুমড়া বিয়াইছে পয়লা। তারপর সেই কুমড়ারে কাইটা টুকরা কইরা ঘিয়ে ভিজাইয়া থুইছেন শ্বশুর দ্বৈপায়ন। সেই ঘিয়ে ভিজানো কুমড়ার টুকরা থাইকা একশো একটা পোলা-মাইয়ার মা হইছে গান্ধারী…

কিন্তু কাহিনিটা না মাইনাও কুন্তীর উপায় নাই। কারণ কাহিনির সাথে গান্ধারী শ্বশুর দ্বৈপায়নের নামখানও জড়াইয়া নিছে। দ্বৈপায়নের অতই কেরামতি; তিনি কুমড়া কাইট্টা ঘিয়ে ভিজাইয়া থুইলে সেইখান থাইকা মানুষ পয়দা হয়। তার যদি এতই ক্ষমতা তবে ছোট ভাইয়ের বৌগুলার বিছানায় না গিয়া ঘিয়ের মধ্যে কুমড়া ভিজাইয়াই তো তিনি ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডু আর বিদুরের জন্ম দিতে পারতেন। কিন্তু উপায় নাই; দ্বৈপায়ন নিজেও এই কাহিনির বিরোধিতা করেন নাই। মুনিঋষিগো নামের লগে এইরকম কিছু অলৌকিক ক্ষমতার কাহিনি থাকতে হয়। ঋষিরা বহুত কষ্ট কইরা এই সব কাহিনি বানায়। দ্বৈপায়ন যদি এইরকম একটা ফাও কাহিনি পাইয়া যান তো ছাড়বেন ক্যান? এইটা একটা সুবিধাও। ঋষিরা নিজের নামে ফাও কাহিনি চালায় বইলাই অন্যের ফাও কাহিনিগুলা তারা মাইনাও নেয়। এই যেমন কুন্তীর দেবতাকাহিনি। এই কাহিনিটাও তো দ্বৈপায়ন মাইনা নিছেন; স্বীকৃতিও দিছেন; এমনকি কুন্তীর পয়লা পোলা যুধিষ্ঠির যে ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডু দুই ভাইর পোলাপানগো মইদ্যে সবার বড়ো এবং রাজ্যের পরবর্তী উত্তরাধিকার সেইটাও তিনি নিজের মুখে প্রচার কইরা দিছেন সর্বখানে…

থাউক। নিজের কাহিনির খাতিরে গান্ধারীর চালকুমড়া কাহিনিটাও কুন্তীরে মাইনা নিতে হবে। যদিও কুন্তীর সন্দেহ হয়; বোধ হয় দ্বৈপায়নই নিজেই এক বয়সের একশো একটা পোলাপান আইনা গান্ধারীরে দিছেন। হইতেও পারে; আন্ধা ধৃতরাষ্ট্র তার বড়ো পোলা। তার লাইগা তার সব সময়ই আলাদা একটা মায়া; পোলাটা সব সময় ভীষ্মের ডরে কুঁকড়াইয়া থাকে। যদি একশোটা পোলা পাইয়া তার বুকে একটু বল বাড়ে তাতে অসুবিধা কী?

কিন্তু ভীষ্মদেব কি মাইনা নিছেন গান্ধারীর একশো পোলার কাহিনি? ভিতর থাইকা না মানলেও অবশ্য বাইরে না মাইনা তার উপায় নাই। কারণ দ্বৈপায়ন এই কাহিনির সাথে সরাসরি যুক্ত আর দ্বৈপায়নরে ঘাঁটাইবার শক্তি তার নাই…

গান্ধারীর এখন একশোটা পোলা। তাই নিজের পোলাদের আরেকটু শক্তপোক্ত কইরা হস্তিনাপুর না যাওয়াই ভালো। নিজের পোলাদের সুবিধার লাইগাই পাঁচ ভাইরে একমুঠায় কইরা বড়ো করা দরকার। পাঁচ ভাই এক থাকলে হিসাব মতো বড়ো ভাই হিসাবে কুন্তীর পোলারা মাদ্রীর পোলাগো সেবাযত্ন পাইব। তাই কুন্তী একলাই পাঁচটা পোলার দেখাশোনা করে আর মাদ্রী সেবা করে। পাণ্ডুরাজার। এর মধ্যে এক দিন পাণ্ডুরাজা যায় মইরা। মরা স্বামীর লাশ সামনে রাইখা কুন্তী আগুন হইয়া উঠে মাদ্রীর উপর-হারামজাদি। নিজের গতর ঠান্ডা করার লোভে স্বামীরে মাইরা ফালাইলি তুই?

এমন অভিযোগ মাদ্রী কল্পনাও করে নাই। বনের ভিতরে স্বামীরে নিয়া ঘোরাঘুরি করার সময় তার প্রতি স্বামীর হঠাৎ খায়েশ জাগো না না কইরাও আর শেষ পর্যন্ত সে না করতে পারে না। কিন্তু স্বামী তার দুব্বল হার্টের মানুষ। উত্তেজনায় শরীর টানটান হইয়া উঠলে ধুম কইরা তার হৃৎপিণ্ডখান বন্ধ। হইয়া যায়। মাদ্রী অতটা বোঝে নাই। তয় কামোত্তেজনার সময় যে পাণ্ডুরাজা মরছে সেইটা তো আর অস্বীকার করতে পারে না। সে মুখ নত কইরা রাখে। কিন্তু কুন্তী আগে বাড়ে আরো বেশরম বেহায়া নারী। পোলাপানগো কী বলবি তুই তাদের বাপের মৃত্যুর কারণ? তুই কি তাগো বলতে পারবি যে। যৌনখেলা খেলাইতে নিয়া তাগো বাপেরে খাইছস তুই? কোন মুখে তুই এখন হস্তিনাপুর যাবি? নগদ পয়সা দিয়া কিনা ভীষ্মের দাসী তুই। এখন হস্তিনাপুর গেলে সন্তান দুইটারে কাইড়া নিয়া তোরে আবার কারো কাছে বিক্রি করবেন না ভীষ্ম; তার কি গ্যারান্টি? আর তোর দোষে আমারেও মানতে হইব নির্বাসনের বিধান; কারণ অসুস্থ রাজা পাণ্ডুরে দেইখা রাখার ভার আমার উপরেই দিছিলেন গঙ্গার নন্দন আর পাটনি সত্যবতী। থাক তুই। তুই থাক তোর কামবাসনা নিয়া। এখন স্বামীও নাই। এদিক সেদিক যেদিক ইচ্ছা গিয়া তুই তোর কাম বাসনা কর। নিজের পেটের পোলাগো সামনে যৌনখেলায় পিতার মৃত্যু বর্ণনা দিবার থাইকা আমার মইরা যাওয়াই ভালো। পোলাগোর সামনে তাগো অসুস্থ পিতার লগে যৌনকর্মের কাহিনি বলার লাইগা বাঁইচা থাক তুই। আমি বরং আত্মঘাতী হয়ে সহযাত্রী হই নিহত স্বামীর। কারণ আমার কাছে অসম্মানে বাঁইচা থাকনের চেয়ে মৃত্যুই ভালো; বিশেষ কইরা যারে শতশত পাত্রের সামনে স্বামী হিসাবে মালা দিয়া বরণ করছি আমি। তোর তো ওই সব কিছু না। সম্মান তোর কোনো কালেই ছিল না; বাকি জীবনও তুই কাটায়ে দিতে পারবি দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা কিংবা দাসীগিরি কইরা। নিজের পোলাদের ভবিষ্যৎ নিয়া আমার চিন্তা নাই। বংশের বাত্তি পাণ্ডবগো বুকে তুইলা রাখবেন ভীষ্ম আর সত্যবতী। স্বামীর মৃত্যুর সংবাদটা শুইনাই আমি স্বামীর লগে সহমরণ করার লাইগা সাথে কইরা নিয়া আসছি বিষ…

বিষপাত্র তোলে কিন্তু মুখে দেয় না কুন্তী। আড়চোখে দেখে মাদ্রী কী করে। মাদ্রী ভাইঙ্গা পড়ে। কুন্তী অপেক্ষা করে। আঘাতখান জায়গা মতোই লাগছে মাদ্রীর। মাদ্রী দৌড়াইয়া আইসা কুন্তীর বিষের পাত্র কাইড়া নেয়- দিদি গো। জীবনে আমার কোনো দিনও সম্মান আছিল না সত্য। কিন্তু নিজের পোলাগো কাছে এই কাহিনি আমারে বলতে কইও না তুমি। দোষ আমারই। যিনি এই দোষ থাইকা আমারে খাইতে পারতেন তিনি এখন মৃত। আমি আর নিজের পোলাগো সামনে যাইতে চাই না। তুমি যা হয় একটা কিছু তাগোরে বুঝাইয়া কইও আর নিজের পোলাগো লগে আমার দুইটা পোলারেও একটু জায়গা দিও দিদি…

বিষ খাইয়া মাদ্রী পাণ্ডুর সহগামী হয় আর প্রায় সতেরো বছর পরে পাণ্ডু আর মাদ্রীর লাশ নিয়া হস্তিনাপুরে পা দেয় কুন্তী। সাথে তার পাঁচ-পাঁচটা তরুণ পাণ্ডব। যুধিষ্ঠির ষোলো- ভীম পনরো অর্জুন চৌদ্দ-নকুল সহদেব তেরো। কুন্তী জানে এখন রাজা পাণ্ডুর সৎকার আর শোকেই ব্যস্ত থাকব সবাই। এই শোকসময়েই দাদি সত্যবতীরে ম্যানেজ কইরা রাজবাড়িতে জায়গা নিতে হবে। পাঁচ নাতির দায়িত্ব সঁইপা দিতে হবে কুরুবুড়া ভীষ্মের হাতে। আর বিদুরের লগে বুইঝা নিতে হইব রাজ্যের বাতাস…

সৎকারের শেষ দিনই দ্বৈপায়ন আইসা সত্যবতীর হাত ধরেন- চলো মা। এইবার রাজবাড়ি ছাইড়া তুমি আমার লগে আশ্রমে চলো। বহুত করছ তুমি এই বংশের লাইগা। এইবার তাগোর ভবিষ্যৎ তাগোরে দেখতে দেও…

বনবাসের পথে নিজের কানীন পুত্র দ্বৈপায়নের হাত ধরেন সত্যবতী। নিজেগো পোলার ঔরসদাতা দ্বৈপায়নের লগে চলেন রাজমাতা অম্বিকা-অম্বালিকা। পেছনে পইড়া থাকে গান্ধারী-কুন্তীর সংসার আর সংসারে আটকা পড়া নিঃসঙ্গ গঙ্গার নন্দন ভীষ্ম…

.

০৩

ভাসুরের ভাত খাইতে হস্তিনাপুর আসে নাই কুন্তী; যদিও আগে যিনি ছিলেন পাণ্ডুর পোষ্য তার পোষ্য এখন পাণ্ডুর বৌ-পোলাপান। বনবাসের আগে যিনি আছিলেন নিঃসন্তান মানুষ; তিনি এখন শত পোলার অহংকারী বাপ ধৃতরাষ্ট্র মহারাজ…

কুন্তীর পোলারা এখনো বেশ জংলি; যাদের রাজ্যশিক্ষা অস্ত্রশিক্ষা কিংবা বুদ্ধি কোনোটাই নাই। অন্য দিকে রাজনীতির ঘনিষ্ঠ থাইকা ধৃতের পোলা দুর্যোধন প্রায় প্রস্তুত বাপের পরে সিংহাসনে বসার; যদিও কুরুবুড়া ভীষ্ম দেখতে পারেন না তারে। কিন্তু ধৃতের পোলারা বড়ো হইবার পরে ভীষ্ম এখন শুধুই বংশের এক বৃদ্ধ মানুষ। এখনো তিনি সেনাবাহিনী প্রধান; কিন্তু তরতর করে বাড়া ধৃতের পোলারা যেখানে সারা দেশ দাবড়াইয়া বেড়ায় সেইখানে বাড়িতে বইসা তিনি জানেনও না তার সৈন্যসংখ্যা কত আর হাতিঘোড়াই বা আস্তাবলে আছে কি নাই…

ভীষ্মের সেই দিন আর নাই। যারে তিনি ছোট ভাইয়ের রাজ্যের ভার দিছিলেন; পোলারা বড়ো হইবার পর এখন সে সার্বভৌম রাজা। বাড়ির মুরব্বি আর সাক্ষাৎ জ্যাঠা বইলা এখনো ভীষ্মরে সে উপদেষ্টা আর সেনাপতির পদ থাইকা বরখাস্ত করে নাই; কোনোকিছু কইলে প্রকাশ্যে বিরোধিতাও করে না সত্য; কিন্তু আড়ালে গিয়া সে সকল সিদ্ধান্তই নেয় বড়ো পোলা দুর্যোধনের লগে। ধৃতের এই পোলাটা বড়োই বেয়াদব। প্রকাশ্যেই সে কয় শান্তনু থাইকা শুরু কইরা কুরু বংশের সব রাজাই নাকি আছিল মেরুদণ্ডহীন; তাই ইচ্ছামতো রাজাগোরে ভীষ্ম কান ধইরা উঠাইছেন বসাইছেন। কিন্তু দুর্যোধনের উপরে সেইটা চলব না। কারণ দুর্যোধন তার বাপের মতো আন্ধাও না; পাণ্ডু কাকার মতো অথর্বও …

দুর্যোধনটা বড়ো তরতর কইরা বাড়তাছে। মাত্র পনেরো বছর বয়সেই এই পোলা বুদ্ধিতে-রাজকাজে আর জনপ্রিয়তায় শান্তনু বংশের যেকোনো রাজার থাইকা বহু গুণ উপ্রে উইঠা গেছে। তার উপরে কাটা কাটা সত্য চোখের দিকে তাকাইয়া কইয়া দিতে পারে বইলা সত্যবাক নামেও তার বহুত সুখ্যাতি। ভীষ্মের লাইগা এইটা মাইনা নেওয়া কঠিন হইলেও তার বেশি কিছু বলবার নাই। ব্রহ্মচারী হইয়াও সারা জীবন রাজপুত্তুরের মতো মাখন-ঘি খাইছেন তিনি; এখন ভাতিজার চাকরি ছাইড়া দিয়া শেষ জীবনে তার পক্ষে জঙ্গলে তপস্যা করাও কঠিন। তাই কুন্তী তার পোলাগো নিয়া ফিরা আসায় ভীষ্মের ছানিপড়া চোখে একটু ঝিলিক লাগে। দুর্যোধনরে এইবার একটু টাইট দেওয়া যাবে…

ভীম মারে পাইকারি হারে। অর্জুন মারে বাইছা। নকুল সহদেব বড়ো দুই ভাইরে লাঠিসোঁটা আগাইয়া দেয় আর যুধিষ্ঠির আড়ালে খাড়াইয়া ভান করে গাছ পাতা লতা ফুল আকাশ প্রকৃতি দেখার। যদি দেখে ভীম ধৃতের পোলাগোরে শোয়াইয়া ফালাইছে তাইলে আড়ালে থাইকা মুচকি হাসে। আর যদি দেখে ধৃতের পোলারা ভীমেরে চাইপা ধরছে তয় দৌড়াইয়া গিয়া মারামারি ভাঙ্গায়- আরে করো কী করো কী? আমরা সবাই ভাই ভাই। ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি করলে বাইরের শত্তুরে সুযোগ পায়…

কুন্তীর পোলাগো এই কৌশল ভীষ্মের খুব পছন্দ হয়। ভীমের লাইগা ধৃতের পোলার বেশ চাপের মইদ্যে থাকে। কিন্তু খালি ভীমের কিলাকিলি দিয়া তো পুরাটা হইব না। তাই তিনি কৌশলে কুন্তীর বড়ো পোলা যুধিষ্ঠিরের উপর গুরুত্ব বাড়াইয়া দেন। পাণ্ডুর এই পোলা ধৃত-পাণ্ডু দুইজনের পোলাগো মইদ্যে বড়ো; সুতরাং আইনত সেই হইব পরবর্তী রাজা। অবশ্য ধৃতরাষ্ট্রের আপাতত এই সব নিয়া মাথাব্যথা নাই। রাজাগোজা হইবার বয়সে যাইতে পোলাপানের এখনো অনেক দেরি। বুড়া জ্যাঠার আপাতত যা ভাল্লাগে তাই সে করুক; সে আর বাঁচবেই বা কত দিন?

কুন্তী এই বিষয়ে এক্কেবারে চুপচাপ থাকে। যত দিন তার পোলাগো উপর ভীষ্মের নেকনজর আছে আর যত দিন না তারা আরেকটু শক্তপোক্ত হইয়া উঠছে তত দিন প্রকাশ্যে কিছু বলা ঠিক না। পোলাদের খালি সে বলে মুরব্বিদের একটু বেশি দাম দিতে। দাম কইমা যাওয়া বুড়ারা কারো কাছে দাম পাইলে তার লাইগা জান দিয়া দেন। তয় ভীমের লাইগা সে কিছুটা চিন্তায়ও থাকে। পোলাটার মাথা মোটা; মাইর খাইব না দিতে পারব সেই হিসাব না কইরাই সে কিলাকিলি শুরু কইরা দেয়। বহুবার ধৃতের পোলারা তারে মাইরা চ্যাপটা বানাইছে। এর উপরে আছে তার খানাপিনার লোভ। যার লগে অত মারামারি সেই দুর্যোধনই যখন তারে কইল-আয় ভাই খাবি? তোর লাইগা বহুত খানাদানা রেডি করছি আমি…

আগামাথা না ভাইবাই ভীম গিয়া শুরু করল খাওয়া। বিষ মিশানো খাবার খাইয়া সে বেহুঁশ হইয়া পড়লে দুর্যোধন তারে গঙ্গায় ভাসাইয়া দিছিল। পরে কুন্তী বিদুরের লগে গিয়া বেশ ভীমেরে তুইলা আনে ঘরে। ওষুধপত্র দিবার পরেও বিষের ঘোরে টানা আট দিন কোনো হুঁশবুদ্ধি আছিল না তার…

মুরব্বি হিসাবে মারামারি করার লাইগা মাঝে মাঝে ধৃতরাষ্ট্র অবশ্য তার পোলাগো বকাঝকা করেন। কিন্তু কুন্তী জানে ধৃত চান তার পরে দুর্যোধনই হউক রাজা। বড়ো ভাই হইয়াও তিনি আন্ধা বইলা। রাজা হইতে পারেন নাই; বড়োই সম্মানহীন তার রাজত্ব জীবন। তিনি রাজা না; ছোট ভাইর আসনে ভীষ্ম তারে বসাইছেন ভারপ্রাপ্ত কইরা। সকলে মহারাজ কইলেও এইটা কেউ ভোলে না যে পাণ্ডুর পোলারা বড়ো হইলে রাজ্যটা তাগো ফিরাইয়া দিতে বাধ্য থাকবেন তিনি। তাই কুন্তীর পোলাগো বড়ো হওয়া দেখলে বড়ো ডর লাগে তার কোন দিন না তারা বাপের গদিটা দাবি কইরা বসে…

রাজপুত্রদের শিক্ষাদীক্ষার মতো নিরীহ বিষয়গুলাতে এখনো ভীষ্ম একলাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

কুরু-পাণ্ডবগো অস্ত্র শিক্ষার দায়িত্ব আছিল কুলগুরু কৃপাচার্যের। বড়োই শান্তশিষ্ট এই মানুষটা বেদবিদ্যার গুরু হিসাবে ঠিকাছেন। কিন্তু অস্ত্রবিদ্যার গুরু হিসাবে একটু হিংসুটে অহংকারী আর লোভী মানুষ বেশি উপযোগী। কারণ ভিতরে হিংসা অহংকার আর লোভই যদি না থাকে তয় অস্ত্র দিয়া মানুষ মাইনসেরে মারবই বা কেন?

দ্রোণ। জাতে ব্রাহ্মণ কিন্তু ধর্ম না কইরা করেন অস্ত্রের চর্চা। ছোটকালের বন্ধু পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কাছে ব্রাহ্মণ দক্ষিণা না চাইয়া চাইছিলেন তার রাজ্যের অর্ধেক। ক্ষত্রিয়রা ব্রাহ্মণরে খানাপিনা দিতে পারে; কিন্তু চাইলেই রাজ্য দিয়া দিব এইটা কি হয়? কিন্তু রাজ্য দিলো না বইলা পাঞ্চাল রাজারে দেখাইয়া দিবার প্রতিজ্ঞা কইরা দ্রোণ এখন আইসা উঠছেন তার বৌয়ের ভাই কৃপাচার্যের ঘরে। কুন্তীর পোলাগো লাইগা লোভী আর হিংসুটে এই দ্রোণই হইতে পারে উপযুক্ত শিক্ষক। সে গান্ধারীর পোলাদেরও অস্ত্র শিক্ষা দিব কারণ তার বেতনটা তো যাইব আবার ধৃতরাষ্ট্রের কোষাগার থাইকা…

কুন্তীর সময় এখনো আসে নাই। সে মাঝে মাঝে খালি ভীষ্মরে গিয়া কয়-  আপনের নাতিগো কেমনে ভালো হইব সেইটা আপনেই ভালো বুঝেন জ্যাঠা। আমি এক বিধবা নারী; স্বামীও নাই যে তার লগে পরামর্শ করতে পারি পোলাগো ভবিষ্যৎ নিয়া। তাই আপনেই আমার এতিম পোলাগো একমাত্র ভরসা…

কুন্তী ধৃতরাষ্ট্রের কাছেও যায়-মরহুম ছোট ভাইয়ের পোলাগো অভিভাবক তো আপনেই মহারাজ। বাপের অবর্তমানে আপনিই তাগোর বাপ। ওদের ভুলত্রুটি হইলে ক্ষমা কইরা সংশোধন কইরা দিয়েন…

সিংহাসন বিষয়ে টু শব্দ না কইরা হস্তিনাপুরে আট বচ্ছর পার কইরা দেয় কুন্তী। এখন তার পোলারা বেশ শক্তপোক্ত হইছে। অস্ত্রশিক্ষা যুদ্ধশিক্ষার লগে রাজনীতির হালচালও ভীম ছাড়া বাকিরা ভালোই বোঝে। যত দূর পারা যায় কৌরবগো লগে ভীমের কিলাকিলিরে কিলাকিলি হিসাবেই রাখতে পারছে সে; যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াইতে দেয় নাই। তবে কিছু কিলাকিলিও দরকার আছিল; না হইলে নরম পাইয়া অত্যাচার বাড়াইয়া দিত ধৃতের পোলারা। কিন্তু বিদুর কিছুটা হতাশ যুধিষ্ঠিররে নিয়া আমাগো পোলাটা যে রাজা হইবার তুলনায় একটু বেশিই বেকুব…

বিদুরের কথায় কুন্তী হাসে- ভীষ্মের আশীর্বাদ পাওয়ার লাইগা বেকুবই তো সবথিকা উপযুক্ত বিদুর। যার উপ্রে তিনি লাঠি ঘুরাইতে পারবেন না তারে সমর্থন দিবেন ক্যান?

এইবার কুন্তী আরেকটু আগায়। ভীষ্মের সামনে গিয়া পেন্নাম কইরা খাড়ায়- জ্যাঠা। আপনের বড়ো নাতির চব্বিশ বচ্ছর বয়স হইব অতি শিগ্নির। এখন তো আস্তে আস্তে তার রাজকার্যও বুইঝা নিবার সময়। খালি কি অস্ত্র আর ধর্মশিক্ষা কইরা দিন যাইব তার?

ভীষ্মও অঙ্ক করেন। একধাপে কিছু করতে গেলে সামলানো নাও যাইতে পারে। বিদুরেরও সেই মত। সকল কিছু ভাবনা-চিন্তিয়া তিনি প্রকাশ্য রাজসভায় প্রস্তাব তোলেন যুধিষ্ঠিররে যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করার…

সামনে যার আইনত রাজা হইবার কথা তারে যুবরাজ করার লাইগা কুরুবুড়ার যুক্তিসংগত প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী বিদুরও যা সমর্থন করেন; ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষে তা অস্বীকার করা মানে পাত্র-অমাত্য প্রজাগো কাছে নিজেরে লোভী হিসাবে চিহ্নিত করা। হউক তাইলে সে যুবরাজ। যদিও যুবরাজ পদটা রাজা হইবার প্রস্তুতিমূলক পদ; তবু যুবরাজ হইলেই যে সবাই রাজা হইতে পারে না তার উদাহরণ তো ভীষ্মদেব নিজেই আছেন…

যুধিষ্ঠিরের লাইগা আপাতত যুবরাজ পদই ভালো। এক লাফে রাজা হইলে সব বিপদ-আপদ সামাল দিতে হইব; যার লাইগা এখনো সে উপযুক্ত না। তার চেয়ে ধৃতরাষ্ট্রের ছাতার তলে থাইকা সব ঝামেলা তার ঘাড়ে ফালাইয়া নির্ঝঞ্ঝাট সময়ে পরে রাজা হওয়া যাবে। কিন্তু তার পাঁচ পোলার মধ্যে কারোই একসাথে সৈন্য আর রাজ্য চালানোর বুদ্ধিটা নাই; যেইটা আছে দুর্যোধনের। তাই কুন্তী যা ভাবছিল তাই ঘটে দুর্যোধন খেইপা উঠে যুধিষ্ঠিরের যুবরাজ হওয়ার কথা শুনে…

ধৃতরাষ্ট্র প্রকাশ্যে দুর্যোধনরে কিছু বকাঝকা করলেও কুন্তী জানে আড়ালে গিয়া আন্ধা রাজা তার এই পোলার বুদ্ধিতেই চলেন। এই ক্ষেত্রেও তাই হয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ধৃতরাষ্ট্র বিধান পাঠান শান্তনু বংশের সকলেই জীবনে একবারের লাইগা হইলেও বারণাবতে গিয়া পশুপতি শিবের উৎসব দর্শন করা নিয়ম। যেহেতু পঞ্চপাণ্ডব ছাড়া বংশের সকলেই বারণাবতে শিবের উৎসবে গেছে; আর। যেহেতু যুবরাজ যুধিষ্ঠির রাজকার্যে ব্যস্ত হইয়া পড়লে তার পক্ষে আর অত দূর গিয়া তীর্থদর্শন সম্ভব না; তাই এখনই তার উপযুক্ত সময় ভাইগোরে নিয়া বারণাবতে যাইয়া পশুপতির উৎসব দেইখা আসা…

তিনি শুধু বিধানই দেন নাই; বারণাবতে যুবরাজের থাকার ব্যবস্থা করতে রাজকর্মচারী পুরোচনরে আদেশ দিয়া বিদুররে দিছেন তীর্থযাত্রা আয়োজনের ভার…

কুন্তীর মনে হয় ভাইদের লগে যুধিষ্ঠিররে সরানোর লাইগা ধৃতরাষ্ট্র কোনো একটা চিরস্থায়ী উপায় ভাবতাছেন তীর্থযাত্রার নামে। কিন্তু তীর্থযাত্রার কথা বইলা ধৃত যে যুক্তি বাইর করছেন তাতে যুবরাজের না করার সুযোগ নাই। বারণাবতে যাইতেই হইব তাদের। কুন্তী সিদ্ধান্ত নেয়- চল আমিও যামু তোগো লগে…

বিদুরের লগে দ্রুত কিছু কথাবার্তা বইলা নেয় কুন্তী। তারপর রাস্তায় নাইমা যুধিষ্ঠিররে ডাকে- শোনো পোলা। তিন দিনের যুবরাজ হইয়া নিজেরে বুদ্ধিমান আর অভিভাবক ভাইব না তুমি। আমি যা বলি তা মনোযোগ দিয়া শুনবা। হইলে এমনও হইতে পারে যে হস্তিনাপুরে আর কোনো দিনও ফিরা আসা হইব না তোমার…

যুধিষ্ঠিরের একটা বড়ো গুণ হইল ডর দেখাইলে সে ডরায়। এই একই কথা যদি কুন্তী ভীমরে কইত তবে সে এখনই গদা নিয়া হস্তিনাপুর ফিরা যাইত ধৃতরাষ্ট্র আর তার পোলাগো মাইরা ভর্তা বানাইতে। তাতে কী ফল হইত সে ভাবত না। অর্জুনরে কইলে জায়গায় খাড়াইয়া কারে কোন অস্ত্র দিয়া মারব সেইটা বর্ণনা করতে করতে ফেনা তুইলা ফালাইত মুখে…

যুধিষ্ঠিরের বুদ্ধি আছে কি নাই বোঝা না গেলেও তার কোনো ভড়ং নাই এইটা পরিষ্কার। সে হাত-পা গুটাইয়া মায়ের কাছে আইসা খাড়ায়-তুমি যা কও তাই হবে মা…

আর কোনো কথা হয় না। সকলে আগায়। ভীম সর্বদাই কুন্তীর পাশে। ভীমটা তার সংসারী পোলা। ধর্মকর্ম রাজনীতি কোনোটাই বোঝে না বা বুঝতে চায় না। কিন্তু কুন্তীর সংসারে তার একমাত্র সহকারী হাত এই মাইজা পোলা ভীম। মায়েরে যেমন সে আগলাইয়া রাখে তেমনি ভাইদের লাইগাও সর্বদা ভীমের বুকটা খোলা…

যুবরাজ আর তার ভাইগো লাইগা পুরোচন শিব নামে যে ঘরটা বানাইতাছে তা বড়োই মনোহর শণের চাল দেয়া কাঠের চারচালা ঘর। কিন্তু ঘরটার কাজ এখনো পুরাপুরি শেষ হয় নাই তাই পয়লা দশ দিন যুবরাজরে মা-ভাইদের নিয়া অন্য একটা ঘরে থাকতে হয়। দশ দিন পর যুবরাজের বাড়ি নির্মাণ শেষ হইলে কুন্তী তার পোলাগো নিয়া সেই ঘরে গিয়া পুরোচনরে জানায়ে দেয়-মহারাজ পাণ্ডুর রানি যেই ঘরে থাকেন সেই ঘরে আত্মীয়-স্বজন ছাড়া অন্য কোনো রাজকর্মচারীর প্রবেশ নিষেধ। কিছু দরকার পড়লে তুমি বাইরে খাড়াইয়া আওয়াজ দিবা…

বিদুরের পাঠানো লোকটা ঠিক সময়েই আইসা পৌঁছায়। নতুন ঘরে উইঠা কুন্তী পুরোচনরে কিছু কাজ দিয়া বাড়ির বাইরে পাঠাইয়া লোকটারে ভিতরে নিয়া আসে। এই লোকটা মাটির গুহার ভিতরে ঘরবাড়ি বানানোর কাজে ওস্তাদ। কুন্তীর পোলারা তারে জোগালি দেয় আর লোকটা দ্রুত ঘরের মেঝে খুঁইড়া একটা গুপ্ত গুহাঘর বানাইয়া তার সুড়ঙ্গমুখ বাইর কইরা দেয় বাড়ির পিছনে জঙ্গলের ভিতর। দুর্যোধন যদি এই বাড়ি আক্রমণ করে কিংবা শণ-কাঠের ঘরে আগুন ধরাইয়া দেয় তবে কুন্তী তার পাঁচ পোলাসহ নিশ্চিন্তে সুড়ঙ্গ দিয়া পলাইতে পারব জঙ্গলের দিকে…

কুন্তীর পোলারা দিনে শিকার-টিকার করে আর রাইতে মাটির নিচে গুহার মধ্যে ঘুমায়। এর মধ্যে কুন্তীর কাছে পাঠানো বিদুরের সংবাদ সুবিধার না। হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্র তার পোলারেই যুবরাজ করার আয়োজন করতাছেন। তার মানে যুবরাজ হইবার আগেই কুন্তীর পোলাগো সরাইয়া দিব দুর্যোধন। বারণাবত থাইকা পোলাগো নিয়া এখন সইরা যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু এমনি পলাইয়া গেলে তাদের খুঁইজা বাইর করতে দুর্যোধনের বিন্দুমাত্র কষ্ট হওয়ার কথা না। তাই পলাইতে হবে অন্য উপায়ে…

কুন্তী গিয়া পুরোচনরে কয়-  জানো তো বাপ। আমাগো লগে আছেন হস্তিনাপুরের যুবরাজ যুধিষ্ঠির। রাজপদে থাকা মানুষের দায়িত্ব হইল মাঝেমধ্যে লোকজনরে খাইদাই করানো। আমরা এক বচ্ছর ধইরা এইখানে আছি কিন্তু প্রজাদের এক দিনও নিমন্ত্রণ করি নাই; এতে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের বদনাম। তো বাপ তুমি আশপাশের সবাইরে মহারাজ পাণ্ডুর মহিষী কুন্তী আর হস্তিনাপুরের যুবরাজ যুধিষ্ঠিরের পক্ষে আগামীকাইল ভোজনের নিমন্ত্রণ কইরা আসো। আর শোনো; সবাই যেন তৃপ্তি ভইরা পান করতে পারে সেই জন্য বেশি বেশি মদও সংগ্রহ করতে যেন ভুল না হয়…

পাণ্ডবেরা হরিণ মাইরা আনে। ভীম রান্না করে কুন্তীর লগে। খানাপিনা শুরুর আগে কুন্তী যুধিষ্ঠিররে ডাকে- আমার বয়সী এক নারী আর তোগো পাঁচ ভাইয়ের মতো দেখতে পাঁচটা জোয়ান পোলারে আলাদা কইরা চিনা রাখ। এই ছয়জনরে বেশি বেশি খাতির-যত্ন কইরা মাতাল বানাইবি যাতে বেশি নড়তে-চড়তে না পারে। আর পুরোচনরেও মদ গিলাইবি গলা পর্যন্ত…

বনের আশপাশের বহু মানুষ আসে। কিছু ব্রাহ্মণ বাদে বাকিরা কাঠুরে চাষি আর গোয়ালা পরিবার। সকলেই পেট পুরে মাংস খায় আর গলা পর্যন্ত টানে মদ। কুন্তী নির্বাচিত পাঁচ তরুণ আর এক নারীর কাছে গিয়া বারে বারে মদ আর মাংস তুলে দেয়- খাও খাও। তুমি দেখতে আমার বড়ো পোলা যুধিষ্ঠিরের মতো। তুমি আরেক ঘড়া খাও। তোমার শইলডা তো এক্কেবারে ভীমের মতো। তুমি অত কম খাও ক্যান? আরে বেটা বড়ো শইলে দানাপানি দুইটাই যদি বেশি বেশি না দেও তবে তা টিকব। কেমনে? আরে খাও; তুমি তো আমার বইনের মতো। তোমার বইনপুতেরা নিমন্ত্রণ করছে তোমারে। বাড়িতে যাইতে হইব এমন কী কথা? পাণ্ডুরাজার বৌ-পোলাপান যেইখানে থাকে; সেইখানে থাকার অধিকার তোমারও আছে। তুমি থাকো আইজ আমাগো লগে। সকালেই না হয় ধীরেসুস্থে যাবা…

পুরোচনরেও গলা পর্যন্ত খাওয়ায় কুন্তী আর যুধিষ্ঠির। খাওয়া-দাওয়া শেষে বাকিরা বিদায় হইলে মাতাল হইয়া ঝিমায় কুন্তীর বয়সী এক চাষি বৌ আর পাঁচটা জোয়ান মানুষ। দরজার সামনে পুরোচনও ঝিমায়। আশপাশ ভালো করে দেইখা কুন্তী ভীমেরে ইশারা করে। ভীম একজন একজন কইরা তুইলা আইনা ঘরের মধ্যে শোয়ায়- ঘুমাও ভাই। ঘরের ভিতরে ঘুমাও; বাইরে মশায় কামড়াইতে পারে…

তারপর তারা নিশ্চিন্তে ঘুমাইলে একেকটা হেঁচকা টানে ভীম তাগো ঘাড়ের ঘেটি ভাইঙ্গা উপরে কথা টাইনা দেয়। কেউ কোনো শব্দ করে না। শুধু ভীমের হাতে মট মট শব্দ হয় একটার পর একটা। মায়ের বয়সী সেই নারীরেও ভীম নিয়া আসে ঘরে- আইস মাসি। নিশ্চিন্তে ঘুমাও…

পঞ্চপাণ্ডব ঘুমাইত সারি হইয়া। কুন্তী ঘুমাইত তাদের শিয়রের কাছে। ঠিক সেই মতো পাঁচ মাতাল তরুণ আর চাষি নারীর লাশ সাজাইয়া থুইয়া ভীম গিয়া মট কইরা ভাইঙ্গা দেয় টাল পুরোচনের ঘাড়। তারপর বাকি পাণ্ডবগো মালপত্র গোছানো শেষ হইলে ভীম বড়ির চাইরপাশে লাগাইয়া দেয় মশালের আগুন…

অমাবস্যার রাইতে কুন্তীরে কান্ধে নিয়া গঙ্গার দিকে দৌড়ায় ভীম। তার লগে দৌড়াইতে গিয়া নকুল সহদেব হুমড়ি খাইয়া পড়লে দৌড়াইতে দৌড়াইতেই তাগোরে সে টান দিয়া তোলে। আরো কিছুদূর গিয়া যুধিষ্ঠির আর অর্জুন উস্টা খাইয়া পড়লে থাবা দিয়া ভীম তাদেরও তুইলা নিয়া দৌড়ায় নৌকার দিকে। বিদুরের পাঠানো নৌকা নিয়া একজন মাঝি লুকাইয়া আছে গঙ্গার তীরে…

অন্ধকারে পাল তোলা নৌকায় পোলাগো নিয়া কুন্তী ভাসে পুবদিক বরাবর। পরের সন্ধ্যায় গঙ্গার দক্ষিণ তীরে এক জঙ্গলের কাছে তাদের নামাইয়া দিয়া ফিরা যায় বিদুরের মাঝি। ওই দিকে বারণাবতের লোকজন সকালে আইসা দেখে যেই ঘরে কুন্তী আর তার পাঁচ পোলা ছিল সেইখানে পাঁচটা পুরুষ মাইনসের পোড়া লাশ আর তার পাশে একজন মাইয়া মানুষ। পুরোচনের পোড়া লাশও পইড়া আছে ঘরের দাওয়ায়…

হস্তিনাপুরে সংবাদ যায়। ভাতিজাগো মৃত্যুর সংবাদ শুইনা কান্দেন ধৃতরাষ্ট্র মহারাজ। বুক বাইন্ধা করেন শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান- তোগোরে ক্ষমতা দিবার চাই নাই ঠিক; কিন্তু এমন মরণ তো চাই নাই কারো…

শুধু কুন্তীর বাপের বাড়ি দ্বারকায় কোনো শেষকৃত্য করে না কেউ। কুন্তীর ভাই বসুদেবের মাইজা পোলা কৃষ্ণ তার শিষ্য সাত্যকিরে নিয়া আইসা বারণাবতের পোড়া ঘরবাড়ি দেখে। আশপাশের মানুষের লগে কথা কয় আর দ্বারকায় ফিরা গিয়া বাপেরে কয়-  আমাগো শোক কিংবা শেষকৃত্য করার মতো কিছু ঘটে নাই সেইখানে…

গঙ্গাপারের জঙ্গলের ভিতর দিয়া দক্ষিণ দিকে আউগায় কুন্তী আর তার পোলাপান। কিছু কিছু যায়; তারপর কিছু দিন থামে। তারপর আবার সামনে আগায়। রাস্তাঘাটে ভীম বরাবরের মতো কিছু মারামারিও করে। কিন্তু হঠাৎই এক দিন সে অন্যরকম একটা ঘটনা ঘটায়; নিজের পঁচিশ বছর বয়সে কাউরে কিছু না কইয়া সাঁওতাল দুহিতা হিড়িম্বারে সে সাঙ্গা কইরা ফালায়…

ভীম তো ঘটাইয়া ফালাইছে ঘটনা। কুন্তী যখন ঘটনা জানল তখন হিড়িম্বা রীতিমতো গর্ভবতী। এখন কেমনে কী করে? তার পোলা পাঁচটা ঠিক; কিন্তু অবলম্বন একলাই ভীম। বিপদের বিষয় হইল; মায়ের ভক্ত পোলারা বৌরেও আন্ধাভাবে আগলাইয়া রাখে। এরা মা আর বৌ দুইজনরে একলগে সামলাইতে গিয়া একবার এই দিক আরেকবার ওই দিকে যায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনোদিকই আর পারে না সামলাইতে। শেষকালে হয় তারে মা ছাড়তে হয়; না হইলে বৌ তারে ছাইড়া পলায়…

কিন্তু এইটা হইতে দেওয়া যাবে না। ভীম ছাড়া পাণ্ডবেরা অচল। বাকি চাইরজনরে ধৃতরাষ্ট্রের পোলারা পাছা দিয়াও পুছব না যদি ভীম না থাকে লগে। কুন্তীর সংসারও অচল হইয়া পড়ব ভীম যদি ছাইড়া চইলা যায়। কিন্তু পাঁচটা জোয়ান পোলার মইদ্যে একজন বৌ নিয়া মাস্তি করব আর বাকি চাইরজন থাকব ব্রহ্মচারী; এইটাও একটা অস্বাভাবিক বিষয়। দুই মায়ের পাঁচ পোলারে কুন্তী অত দিন এক হাতের পাঁচ আঙ্গুলের মতো একলগে বড়ো করছে; কাউরে বেশি সুবিধা দেয় নাই যাতে না অন্য কেউ কম সুবিধার লাইগা মন খারাপ করে। এখন এক মাইয়ার লাইগা কোনোভাবেই পোলাগো সে আলদা হইতে দিতে পারে না…

কুন্তী ভীমের সংসার মাইনা লয়। কিন্তু তারে জানাইয়া দেয়- মনে রাখিস তোগোরে গেরস্ত করার লাইগা আমি বনে আসি নাই। আমি বনবাসী হইছি তোগোরে তোগোর পিতার রাজ্য ফিরাইয়া দিবার প্রতিজ্ঞায়। বিয়া করছো ঠিকাছে। কিন্তু আপাতত তোমার বৌরে নিজের লগে রাখতে পারবা না তুমি। আমরা রাজ্য ফিরা পাইলে তোমার লগে সে সংসার করব হস্তিনাপুর গিয়া। তবে যেহেতু তোমার বৌ এখন গর্ভবতী। সেহেতু বাচ্চা জন্মানো পর্যন্ত আমরা এইখানে থাকব; যাতে বাচ্চার মুখ তুমি দেইখা যাইতে পারো…

ভীমের মতোই দেখতে ভীমের একটা পোলা জন্মায়। হিড়িম্বা তার নাম রাখে ঘটোৎকচ। ভীম পোলারে কোলে নিয়া কুন্তীর সামনে খাড়ায়-মা। তোমার পয়লা নাতি…

ভীমের হাত থাইকা নাতিরে কোলে নিয়া কুন্তী হিড়িম্বার দিকে তাকায়- ভীমের বড়ো ভাই এখনো আবিয়াইত্যা। কিন্তু তার পরেও আমি ভীমের বিবাহ মাইনা নিছি খালি এই নাতির কথা ভাইবা। পাণ্ডব বংশের বড়ো পোলা হিসাবে বাপ-চাচার পরে এই ঘটোৎকচই হইব হস্তিনাপুরের রাজা। কিন্তু পোলাগো যদি এখনই আমি বনে-জঙ্গলে নিজেগো মতো সংসার পাইতা বসতে দেই তবে আর হস্তিনাপুরে রাজা হইবার স্বপ্ন দেখতে হইব না কারো। সেই সাথে তোমার পোলারেও সারা জীবন থাকতে হইব কোনো কাঠুরের পোলা হইয়া। তাই আমার সিদ্ধান্ত শোনো; যদি রাজ্য উদ্ধার হয় তবে যুবরানি হইয়া তুমি হস্তিনাপুর যাইবা পাণ্ডব বংশের জ্যেষ্ঠ পোলারে নিয়া। আপাতত তুমি তোমার। বাপের ঘরে থাইকা ঘটারে মানুষ করো…

কুন্তী ঘটোৎকচের কপালে চুমু খায়-বড়ো হইলে হতভাগী দাদির বিপদে তুই সহায় হইস দাদুভাই। এখন মায়ের পোলা মায়ের কাছে থাক…

হিড়িম্বার কোলে ঘটোৎকচরে ফিরাইয়া দিয়া কুন্তী ভীমের দিকে তাকায়- চল বাপ। সামনে আগাই…

.

০৪

তার পোলা যদি তার নিজের পোলার মায়ায় আটকাইয়া যায় তবে সবকিছু ভাইসা যাবে তার। তাই ভীমেরে সংসারছাড়া কইরা কুন্তী পলায়। কই যাবে কোথায় যাবে কিছু ভাবে নাই। বিদুরের লগেও যোগাযোগ নাই বহু দিন। কিন্তু কোনো একজন মানুষের পরামর্শ এখন দরকার তার। আর এই জঙ্গলে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ছাড়া কোনো বান্ধবও নাই কুন্তীর…

বন বদলাইয়া কুন্তী গিয়া হাজির হয় শ্বশুর দ্বৈপায়নের ডেরায়- পিতা। বড়ো বেশি বেচইন আছি সবকিছু নিয়া…

সবকিছু শুইনা দ্বৈপায়ন চোখ পিটপিট করেন-বনে-বাদাড়ে ঘুইরা কেমনে রাজ্য পাইবা তুমি? রাজ্য পাইবার লাইগা কোনো না কোনো রাজ্যের লগেই থাকতে হবে তোমার। আহো আমার লগে…

কুন্তী আর তার পোলাদের ব্রাহ্মণের বেশ দিয়া কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন নিজে নিয়া রাইখা আসেন একচক্রা নগরে তার এক শিষ্য ব্রাহ্মণের ঘরে- তোরা এইখানে থাইকা চেষ্টা কর পাশের দেশ পাঞ্চালের লগে মিত্ৰতা করার…

জটাজুটধারী ব্রাহ্মণ সাইজা একচক্ৰায় কুন্তীর পোলারা পাঞ্চালের সংবাদ দুঃসংবাদে কান খাড়া কইরা দশগ্রামে ভিক্ষা মাইগা খায় আর একটা উপযুক্ত দিনে সংবাদ পায় যে পাঞ্চাল রাজা দ্রুপদ ঘোষণা দিছেন তার মাইয়া দ্রৌপদীর বিয়া হইব স্বয়ংবরা দিয়া…

নিজের পোলার লগে দ্রুপদের মাইয়ার বিবাহ; দ্রুপদের লগে খাতির জমানোর লাইগা এর থিকা সহজ পন্থা আর কী হইতে পারে? এর মইদ্যে আরোও সুখের সংবাদ হইল; দ্রুপদকন্যার স্বয়ংবরা হইব তির-ধনুকের কম্পিটিশন দিয়া। তাও আবার গাণ্ডিব ধনু; যা গন্ডারের পঞ্জরের হাড় দিয়া। তৈয়ার হয় বইলা এই নাম। এই ধনু দিয়া তির মারা তো দূরের কথা; গন্ডারের হাড্ডি নুয়াইয়া এই ধনুতে গুন পরাইতেই বেশির ভাগ পাব্লিকের নাকের বাতাস শইলের তল দিয়া নির্গত হয়; কিন্তু দ্রোণের শিষ্য অর্জুন আবার এই গাণ্ডিবে মহাধনুর্ধর। ধইরা নেওয়া যায় তার জিতার সম্ভাবনা পুরাটাই আছে…

কিন্তু কুন্তীর সংকট তো সেইখানে না। হিড়িম্বার বেলায় সে যা করছে তা যদি দ্রুপদের মাইয়ার লগেও করে; মানে বিয়ার পরে মাইয়ারে যদি বাপের বাড়িতেই থুইয়া আসা লাগে তাইলে তো আর সম্পর্কের উন্নতি হইল না দ্রুপদের লগে। আবার যদি মাইয়ারে ঘরে আইনা অর্জুনের লগে সংসার করতে দেয় তাইলে তো আবারও এক পোলা সংসারী; বাকিরা বিরান। তাছাড়া অর্জুনরে সংসার। করতে দিলে ভীম যদি খেইপা গিয়া আবার নিজের বৌ-পোলারে নিজের কাছে নিয়া আসে তখন? তখন তো বাকি পোলাগো বিয়াশাদি করাইয়া কুন্তীর নাতিপুতি নিয়া বনবাসে সংসার করা ছাড়া আর বিকল্প থাকে না কিছু। কিন্তু তা হইতে দেওয়া যাবে না। কুন্তী এইখানে পোলাগো সংসার করাইতে নিয়া আসে নাই। কুন্তীর অন্য কোনো বুদ্ধিমান সমাধান চাই যা একমাত্র শ্বশুর দ্বৈপায়নই পারেন দিতে…

বিস্তারিত সংকট বুইঝা দ্বৈপায়ন কুন্তীরে অভয় দেন- তুমি খালি মাইয়াডারে ঘরে আনার ব্যবস্থা করো; বাকিটা দেখব নে আমি। আমি তোমার পাঁচ পোলারেই এই মাইয়ার লগে বিবাহ দিমু। তখন কাউরে যেমন ব্রহ্মচারী হইতে হইব না তেমনি কেউই সুযোগ পাইব না বৌ নিয়া মইজা থাকার। দুই মায়ের পাঁচ পোলা এক বৌয়ের পাঁচ স্বামী হইলে আরো ঘনিষ্ঠ হইব নিজেদের…

শ্বশুরের বিধান কুন্তীর পছন্দ হইলেও সে ছটফট করে- আব্বাজান। বোঝেনই তো; আপাতত জঙ্গলে থাকলেও পোলাবৌ আর পোলাগো নিয়া আমার সমাজে ফিরতে হবে। পাঁচ পোলার ঘরে এক বৌ তোলার লাইগা সমাজে একটা কঠিন ধর্মব্যাখ্যা লাগব আমার। আপনি যা কইলেন; তার পক্ষে যদি আমারে একটা ধমকাহিনি রচনা কইরা শোনান তাইলে বুকে বল পাই…

কুন্তীর মুখে দুশ্চিন্তা দেইখা কালা মুখে হলুদ দাঁত খুইলা হাসেন দ্বৈপায়ন- ধর্মকাহিনি কোনো বিষয় হইল? মাইয়ার জন্মকাহিনি আমি পাল্টাইয়া দিমু। কইয়া দিমু পূর্বজন্মে শিব তারে বর দিছেন। পঞ্চস্বামীর। আর শিব একবার যে বর দিছেন সেইখানে সমাজ তো নস্যি; স্বয়ং শিবেরও শক্তি নাই সেই বর ফিরাইয়া নিবার…

কথাখান ঠিক। শিব কারে কী বর দিছেন না দিছেন সেইটা তো দ্বৈপায়ন থাইকা বেশি জানার কথা নয় কারো। কারণ শিব পুরাণখান তো লেখছেন তিনিই। যদিও দ্বৈপায়নের মুখে শিবের বন্দনা শুনলে কুন্তীর হাসি পায়। একসময় বিষ্ণুভক্ত এই দ্বৈপায়নের কামই আছিল নেংটুভেংটু জংলি বইলা শিবেরে গালাগাল দেওয়া। তার কথায় বহু শিবভক্ত হর ছাইড়া হরির ভক্ত হইছে। কিন্তু এক দিন এক পুঁচকা ঋষি শৌনিক তারে কয়-  আপনে যদি বারাণসী যাইয়া শিবের নিন্দা করতে পারেন তয় আমিও আপনের লগে হরিভক্ত হমু…

-বারাণসী আবার কোন ছার? লও যাই। তোমার কাশীতীর্থে গিয়াই তবে শিবেরে এক হাত লই…

চুল-দাড়ি ঝাঁকাইয়া দলবল আর পুঁথিপুস্তক নিয়া বারাণসীর কাশীতীর্থে আইসা হুংকার দেন দ্বৈপায়ন- আসো আসো। নেংটুভেংটু তাড়িখোর জংলি শিবেরে ছাইড়া আসো সুশীল বিষ্ণুর পদতলে…

বারাণসী হইল শিবভক্ত নন্দী বংশের বাস। দ্বৈপায়ন ভাবছিলেন বোধ হয় শৌনিকের মতো কোনো চ্যাংড়া ঋষি আইসা তার লগে শিবের গুণ গাইয়া তক্কমক্ক করব। কিন্তু নন্দীরা কোনো তর্কেমর্কে নাই। শিবনিন্দা শুইনা হর হর মহাদেব কইয়া কিলাইতে কিলাইতে তারা দ্বৈপায়নরে শুয়াইয়া ফালায়। তারপর তুইল্লা নিয়া একটা গাছের লগে পিছমোড়া কইরা থুয় বাইন্ধা…

এত বড়ো ঋষি; যার অলৌকিক ক্ষমতা-কাহিনিরও অভাব নাই; সেই দ্বৈপায়নরে এমন পঁাদানি খাইতে দেইখা চ্যালা চামুণ্ডারা যে যেদিকে পারে পালায় আর খানিক দূরে খাড়াইয়া শৌনিক কয় হর হর মহাদেব…

দ্বৈপায়ন কান্দেন। নারায়ণ নারায়ণ বিষ্ণু ডাইকা দাড়ি ভিজাইয়া কান্দে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন- এমন বিপদের দিনে তুমি ছাড়া হরি মোর কেউ নাই…

দ্বৈপায়নের কান্দন শুইনা নাকি স্বয়ং বিষ্ণু হাজির হইছিলেন সেদিন। কিন্তু আইসা তিনি কইয়া গেছেন নন্দীর বান্ধন খুইলা দিবার ক্ষমতা তার নাই। তার মুক্তির একমাত্র উপায় হইল শিবের বন্দনা করা…

কী আর করেন দ্বৈপায়ন। যে শিবেরে তিনি অত গালাগালি দিছেন; এখন চিপায় পইড়া চোখ বন্ধ কইরা সেই দ্বৈপায়নই শুরু করেন শিব পুরাণের শোলোক রচনা- সকল দেবতার যে দেব; তারে কয় মহাদেব; বুড়াশিব আদি অধীশ্বর; পশুপতি নটরাজ ভোলানাথ নীলকণ্ঠ ডট ডট ডট…

সেই থাইকা দ্বৈপায়নের কাম হইল শিবের গীত গাওয়া আর শিবেরে নিয়া কাব্য করা। যদিও নন্দীর উপরে ঝাল মিটাইতে গিয়া শিব পুরাণে তিনি লেইখা থুইছেন- নন্দী কোনো মাইনসের জাত; ওইটা একটা ষাঁড়। ষাঁড় হউক আর বলদাই হউক। কিলাইয়া গুতাইয়া তো হরিভক্ত দ্বৈপায়নরে হরভক্ত বানাইছিল তারা। আর এই দ্বৈপায়নের কৃপায় শিবের ভক্ত এখন বেশির ভাগ মানুষ। তিনি যদি শিবের নাম ধইরা একখান কাহিনি রচেন তো দ্রৌপদীর বাপেরও সাধ্য নাই কুন্তীরে ঠেকায়। কিন্তু তার কথার মইদ্যে একখান যদি রাইখা দিছেন তিনি-যদি তুমি মাইয়াটারে নিজের ঘরে আনবার পারো…

দ্রুপদের মাইয়ারে আনতে হইলে তার দেশের আরো কাছাকাছি যাওয়া লাগে তাই ব্রাহ্মণবেশী পাঁচ পোলারে নিয়া এক দিন এক রাত্রি হাইটা কুন্তী আইসা পৌঁছায় দ্রোণাচার্যের দখল কইরা নেওয়া

দক্ষিণ পাঞ্চালের অহিচ্ছত্র দেশে। কুরু-পাণ্ডবের শিক্ষা শেষে দ্রোণাচার্য গুরুদক্ষিণা হিসাবে শিষ্যদের কাছে আব্দার করছিলেন দ্রুপদরে ধইরা আনার। গুরুদক্ষিণা মিটাইবার লাইগা কুরু পাণ্ডব মিলা হঠাৎ আক্রমণ কইরা সেদিন জেন্দা দ্রুপদরে ধইরা নিয়া দ্রোণের কাছে দেয়। আর তিনি দ্রুপদরে ছাইড়া দেওয়ার বিনিময়ে সেদিন মুক্তিপণ হিসাবে রাইখা দেন দ্রুপদের রাজ্যের অর্ধেক। সেই থাইকা চর্মন্বতী নদী পর্যন্ত উত্তর পাঞ্চাল অংশটা মাত্র আছে দ্রুপদের অধীন…

স্বয়ংবরার ষোলো দিন আগে দক্ষিণ পাঞ্চালে আইসা যাদব বংশজাত কুন্তী ব্যবহার করে তার বংশের পূর্বপরিচয়। নিজেরে ভার্গব বংশজাত ব্রাহ্মণ পরিচয় দিয়া আশ্রয় নেয় আরেক ভার্গব বংশজাত কুমারের ঘরে। এইখানে তারা থাকে; ভিক্ষাটিক্কা করে আর সংবাদ সংগ্রহ করে প্রতিযোগিতায় কারা কারা আছে আর আসার সম্ভাবনা আছে কার…

ধৃতের পোলা দুর্যোধন আসব ভাইবেরাদর নিয়া। অসুবিধা নাই। গদার লড়াই হইলে তারে ভয় পাওয়া লাগে কিন্তু তির-ধনুকে তারে পাত্তা দিবার কিছু নাই। আর ধৃতের বাকি পোলারা স্বয়ংবরা সভায় দর্শকের সংখ্যা বাড়ান ছাড়া করতে পারব না কিছুই; সুতরাং ওইগুলাও বাদ। দ্রোণের পোলা অশ্বত্থামাও আসছে। খড়গ চালানোয় সে কঠিন মানুষ হইলেও তির-ধনুকে সে অর্জুন থাইকা কম। আর দ্রুপদের মাইয়া নিশ্চয়ই মালা ঝুলাইতে যাইবা না শত্রু-পোলার গলায়। সুতরাং এইটাও বাদ। কিছু বুড়াধুড়া আর বিয়াইত্তা রাজা আছে। তাগো পয়সাপাতি আর বাহাদুরি দুইটাই বেশি কিন্তু মনে হয় না বুইড়া রাজার আঠারো নম্বর বিবি হইতে রাজি হইব দ্রুপদের মেয়ে; যদিও এর মাঝে দুয়েকজন তির-ধনুকে অর্জুনরেও কাবু কইরা ফালাইতে পারে…

রাজপুত্র না হইলেও তার দুই ভাতিজা কৃষ্ণ আর বলরামও নাম লেখাইছে রাজকন্যার স্বয়ংবরায়।

বলরামরে নিয়া চিন্তার কিছু নাই। কৃষ্ণরে নিয়া তির-ধনুকে চিন্তার বেশি কিছু না থাকলেও প্রতিযোগিতায় যখন আইসাই পড়ছে তখন খালি হাতে যাইবার মানুষ না সে। দ্রুপদের মাইয়ারে সে তুইলাও নিয়া যাইতে পারে…

রাজকার্যে দূতিয়ালির লাইগা একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত লাগে। নিজেরা ফকির সাইজা থাকলেও পাঞ্চালে আসার পথে পাণ্ডবেরা উৎকোচক তীর্থ থাইকা ধৌম্যরে নিজেগো পুরোহিত বানাইয়া আনছে। কুন্তী গিয়া ধৌম্যরে কয়- তোমারে এইখানে কেউ চিনে না। এইখানে তোমার পয়লা কাম হইল কৃষ্ণ আর বলাইরে গিয়া কওয়া যে তাগো বাপের বইন কুন্তীপিসি পোলাগো নিয়া পলাইয়া আছে পাঞ্চাল দেশে। আর এইটাও জানাইয়া দিবা যে তাগোর ছোট ভাই অর্জুন দ্রৌপদীরে পাইতে চায়। আর যেহেতু ওরা দুইজন আগেই বহুত বিয়াশাদি করছে আর ছুডু ভাই এখনো আবিয়াইত্যা; তাই পিসি তাদের কোনো ঝামেলা করতে নিষেধ করছে স্বয়ংবর সভায়। ওগোরে ভালো কইরা বুঝাইয়া আসবা দ্রুপদের সভায় পাণ্ডবগো দেখলে যেন তারা কোনো সাড়াশব্দ না করে। কারণ ছদ্মবেশ ধইরাই অর্জুন তার ভাইগো লগে স্বয়ংবরায় যাবে। আর দুই ভাতিজারে কইবা যেন কাজকর্ম শেষে তারা অবশ্যই পিসির লগে দেখা কইরা যায়; তাগো লগে বহুত কথা আছে কুন্তীপিসির…

ধৌম্যরে কৃষ্ণের কাছে পাঠাইয়া মোটামুটি নিশ্চিন্ত হইলেও একজনের বিষয়ে দুশ্চিন্তায় কুন্তী ছটফট করে। কুন্তীর সংবাদ পাইলে কৃষ্ণ ঝামেলা করব না। বাকিদের বেশির ভাগই প্রতিযোগিতায় টিকব। না। কাউরে কাউরে দ্রুপদই খেদাইয়া দিব। বুড়াধুড়াগুলারে দ্রৌপদী মালা দিবার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু তার পরেও বাকি থাইকা যায় একজন; যারে দ্রুপদের না আছে খেদানোর কোনো কারণ; না আছে দ্রৌপদীর অপছন্দ করার কোনো কারণ; না আছে তার প্রতিযোগিতায় হাইরা যাওয়ার কোনো কারণ। সে কর্ণ। কুন্তীর প্রথম সন্তান…

কুন্তীর কষ্টের জায়গাটা এখানেই। ধৃতের পোলাগো মুখামুখি হইতে গিয়া বারবারই তার নিজের পোলারা মুখামুখি হয় নিজেরই অন্য এক পোলার। এখন কী করে কুন্তী? হস্তিনাপুরে কুরু-পাণ্ডবগো অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শনীর দিন কৃপাচার্যের সাহায্যে সে আটকাইতে পারছিল অর্জুন কর্ণের যুদ্ধ কোনো। ছোটলোকের পোলার লগে লড়াই করে না রাজপুত্র অর্জুন। কৃপের এই কথায় লড়াই থাইকা ঠিকই বাদ পড়ছিল কর্ণ। কিন্তু সকলে যেখানে ভাবছিল ছোটলোকের পোলা হইবার লজ্জায় মাটির সাথে মিশা যাইব সে; সেইখানে ঘটল তার উল্টা ঘটনা। কম্পিটিশন থাইকা বাদ পড়ার পর সবার সামনে কর্ণ তার পালকপিতা অধিরথের পায়ে পেন্নাম কইরা উইঠা খাড়াইল মাথা উঁচা কইরা। যেন কইতে চায়- রাজকূলনারী কুন্তী না; নমশূদ্র অধিরথ আর রাধার সন্তান হিসাবেই গর্বিত আমি। এমন অহংকার শুধু দুর্বাসার রক্ত আর পরশুরামের শিক্ষাতেই মানায়…

তবে কি কুন্তী কর্ণের কাছেও ধৌম্যরে পাঠাবে? নাকি নিজেই যাবে? ভিক্ষা চাইলে কর্ণ দেয় সকলেই জানে। নাকি গিয়া তারে মায়ের পরিচয় দিয়া বলবে আয় বাপ ঘরে আয়?

কিন্তু কর্ণ বড়ো ভাই হইয়া খাড়াইলে তো রাজা হইতে পারব না যুধিষ্ঠির। তাইলে কর্ণের সিংহাসনের লাইগা যুধিষ্ঠির ক্যান কষ্ট করব? আর কর্ণ যদি আইসা যোগ হয় কুন্তীর ঘরে তবে যুধিষ্ঠিরের ধর্মের গর্ব ভীমের গদার বড়াই আর অর্জুনের ধনুকের খ্যাতি তিনটাই বড়ো বেশি ম্লান হইয়া পড়ব এক কর্ণের কাছে। দুর্যোধন ঠিকই কইছিল অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শনীর দিন- সমস্ত দুনিয়ারই রাজা হইবার যোগ্য এই কর্ণ…

– নাহ। যারে ফালাইয়া দিছি তারে আর না কুড়ানোই ভালো। সইরা থাক বাপ…

কুন্তী আবার ধৌম্যরে ডাকে- এইবার তুমি রাজা দ্রুপদের কাছে যাবা ব্রাহ্মণ হিসাবে তার মাইয়ারে কিছু উপদেশ দিতে। তুমি দ্রুপদরে বলবা যে পুরাকালের মহান নারীগণের স্বয়ংবরার ইতিহাস তুমি তার কইন্যারে শুনাইতে চাও তার স্বয়ংবরার আগে। এইটা স্বয়ংবরা করতে যাওয়া নারীর লাইগা পুণ্যের কাম। তারপর কাহিনি শুনাইবার ফাঁকে তুমি তারে সব প্রতিযোগী সম্পর্কে ভালো কইরা বুঝাবা। কইবা তার মতো রাজকইন্যা যদি বিয়াইত্যা রাজাগো বিয়া করে তবে সারা জীবন তারে

অন্য রানিদের দাসীবান্দি হইয়া কাটাইতে হবে। তার পোলাপানও রাজা হওয়ার সিরিয়াল পাইব না কোনোদিন। যাদব বংশের পোলারে বিশ্বাস নাই; তাই কৃষ্ণের বিষয়েও তারে একটু ধারণা দিবা। কইবা এর শতে শতে বৌ আর পুরা বংশটাই মাতাল আর গোঁয়ার। এরা রাজা না; এরা বিভিন্ন জাগায় ভাড়াটিয়া সৈনিক হিসাবে খাটে। এদের কোনো আদব-কায়দা মায়াদয়া নাই। এই কৃষ্ণ বড়ো হইছে যে মামার ভাত খাইয়া; সেই মামারেই সে খুন করছে তুচ্ছ একটা কারণে। এমন পোলারে বর হিসাবে চিন্তা করার আগে যেন ভালো কইরা সে ভাবে। আর অশ্বত্থামা যে তার বাপের শত্রুর পোলা সেইটা বোধ হয় এক কথাতেই বুঝব সে…

ফাঁকেফুকে একটু অর্জুনের কথাও কইবা। কইবা সকলে যদিও জানে যে অর্জুন মা-ভাইয়ের লগে আগুনে পুইড়া মরছে। কিন্তু তোমার মনে হয় সে বাঁইচা আছে আর স্বয়ংবরায়ও আসতে পারে ব্রাহ্মণ কিংবা ফকিরের সাজে। তবে সবচে বড়ো কথা। অন্য কিছু কও না কও। তুমি পরিষ্কার কইরা কর্ণের পরিচয় দিয়া আসবা তারে। কইবা সে বীর তাতে সন্দেহ নাই। প্রতিযোগিতাও সে হয়ত টপকাইয়া যাবে। কিন্তু সে এক নমশূদ্র গাড়োয়ানের পোলা। এখন সে যদি দ্রৌপদীরে জয় কইরা নেয় তবে পাঞ্চাল রাজকইন্যার বাকি জীবন কাটাইতে হবে গাড়োয়ান পাড়ায়। কথাটা যেন সে ভাইবা দেখে। কইবা কর্ণরে যদি বাদ দিতে হয় তবে প্রতিযোগিতার আগেই বাদ দেওয়া ভালো। প্রতিযোগিতার পরে উল্টাসিধা কিছু করতে গেলে ভয়ানক হাঙ্গামা হইতে পারে। আর সেই ক্ষেত্রে হয়ত সভা থাইকা ছিনাইয়া নিয়া তারে বুড়া রাজা জরাসন্ধই বিবাহ কইরা ফালাইতে পারে…

– কোনো গাড়োয়ানের পোলারে বিবাহ করব না আমি…

দ্রৌপদীর এক কথায় তির মারতে গিয়াও কম্পিটিশন থাইকা বাদ পড়ে কর্ণ। কৃষ্ণ সইরা যায়। বলরামরে নিয়া। অন্যরা গাণ্ডিবে গুন পরাইতে গিয়া হুড়িমুড়ি খাইয়া পড়ে। আর সবাইরে বেক্কল বানাইয়া এক ব্রাহ্মণ জিতা নেয় দ্রৌপদীর মালা…

নকুল আর সহদেবরে নিয়া যুধিষ্ঠির দৌড় লাগায় মায়েরে সংবাদ দিতে। অর্জুনের লগে থাকে ভীম। রাজা বাদ দিয়া ফকির ব্রাহ্মণরে মালা দিবার কারণে কিছু রাজা কিছু ঝামেলা করে; কিন্তু ভীম গদা আর অর্জুন তির দিয়া ঠিকই পাঞ্চালীরে নিয়া কুমারের বাড়ি যাইবার পথ তৈয়ার কইরা নেয়…

ভীম আর অর্জুন আসতাছে পাঞ্চালী নিয়া। এইবার কুন্তীর পালা কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের বিধান বাস্তবায়ন। যুধিষ্ঠির আগেই রেডি। নকুল সহদেবও জানে। ভীম অর্জুনেরও জানা আছে তাগো ভূমিকা। এখন খালি দরকার দ্রৌপদীরে সিস্টেমে ফেলা…

কুন্তী ঘরের ভিতরে চইলা যায়। নিত্য দিন পোলারা ভিক্ষা শেষে ফিরা আসার সময় সে যেমন টুকটাক কাজে থাকে তেমনি সে ঘটমটো কিছু কাজ শুরু করে। যুধিষ্ঠির নকুল সহদেবও ঘরে গিয়া ঘাপটি দিয়া বসে। এমন সময় প্রতি দিন বাড়ির উঠানে আইসা ভীম যেমন চিক্কর দেয়- তোমার পোলারা ফিরা আসছে মা; আইজও ঠিক সেরকমই চিক্কর দেয়। কিন্তু আইজ কুন্তী একটা ব্যতিক্রম ঘটায় নিত্য দিনের। আইজ সে ভিতর থাইকাই চিক্কর দিয়া কয়-  যা কিছু নিয়া আসছ বাপধন তা সুমান ভাগে ভাগ কইরা নেও পঞ্চ ভ্রাতায়…

এইটা কুন্তীর কওয়ার কথা না। কারণ ভিক্ষা কইরা পোলারা যা পায় বরাবর তা দুই ভাগ কইরা একলাই এক ভাগ খায় ভীম। বাকি অর্ধেক খায় কুন্তী আর বাকি চাইর পাণ্ডব। কিন্তু ভাগাভাগির সেই হিসাব আইজ করতে গেলে তো দ্রৌপদীর অর্ধেক পাবে ভীম আর অর্ধেক বাকি চাইর ভাই। তাই আইজ ভাগাভাগির এই সাম্যবাদী নিয়ম…

ভিতরে আওয়াজ দিয়া বরাবরের মতো আইজকেও পোলারা কী আনছে তা দেখতে বাইরে আসে কুন্তী। যদিও অন্য দিন পাঁচ পোলাই একলগে বাড়ি আসে। আইজ তিন পোলায় আগেই বাড়িতে বইসা আছে। মায়ের লগে লগে তারাও আইসা উঠানে খাড়ায়। কিন্তু বাইরে আইসাই কুন্তী ভীম আর অর্জুনের লগে দ্রৌপদীরে দেইখা জিবে একটা কইসা কামড় দেয়। যুধিষ্ঠির নকুল সহদেবও কামড়াইয়া জিব লাল কইরা ফালায়- হায় হায়…

ভীম আর অর্জুন খাড়াইয়া থাকে বটগাছের মতো। কুন্তী অস্থির হইয়া দ্রৌপদীর হাত টাইনা লয় আমারে তুই মাপ কইরা দে মা। আমি একটা ভুল কইরা ফালাইছি। আমি মনে করছি ওরা ভিক্ষা নিয়া ফিরছে… কিন্তু… কিন্তু আমার পোলারা তো আবার আমার সকল কথাই সত্য বইলা মানে। এখন কী করি? এক মাইয়ারে পাঁচ ভাই ভাগ কইরা নেওয়া তো অধর্মের কাজ। আবার মায়ের কথা রাখলেও পোলাগো অধর্ম হয়। তুমি চলো আমার বড়ো পোলার কাছে। সে ধর্মকর্ম খুব বেশি কইরা বুঝে। সে কইতে পারব কী করলে ধর্মও থাকে আবার মায়েরও না কোনো অসম্মান হয়…

দ্রৌপদীরে নিয়া কুন্তী যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়া কাইন্দা পড়ে-বাজান রে। তোর দুই ছুডু ভাই এই মাইয়ারে আমার কাছে নিয়া আসছে আইজ। কিন্তু আমি ভুল কইরা কইয়া দিছি- তোমরা পাঁচ ভাইয়ে এরে ভাগ কইরা লও। এখন বাজান ধর্মের বিধান তুমিই ভালো জানো। তুমিই কও এখন কী করলে তোমার মায়েরও মিথ্যা কওয়ার পাপে না পড়তে হয়; আবার মায়ের কথা না শোনার পাপে তোমার ভাইয়েগো না কোনো অধর্ম হয়…

যুধিষ্ঠির স্বয়ংবর সভাতেই দ্রৌপদীরে দেখছিল। এইবার আগাগোড়া আরেকবার ভালো কইরা দেইখা ধর্মের উপযুক্ত বিধান সন্ধান করে। মনে মনে হিসাব করে পাঁচ ভাইয়ে বিয়া করলে বড়ো ভাই হিসাবে দ্রৌপদী সর্বাগ্রে তার নিজের ভাগেই যাবে। বহুক্ষণ এইভাবে দ্রৌপদীসন্ধান কইরা যুধিষ্ঠির উচ্চারণ করে ধর্মের বিধান- মায়ের বাণীর স্থান হইল হগগল ধর্মের উপরে। মায়ে যেহেতু কইছে সবাইরে ভাগ কইরা নিতে সেহেতু এই নারী আমাগের সবারই বৌ হবেন। ধর্মেও এর কোনো বিরোধ নাইইতিহাসেও এমন উদাহরণ কিছু কিছু আছে…

দ্রৌপদী অর্জুনের দিকে তাকাইয়া দেখে সে তাকাইয়া আছে আকাশে। কুন্তী পাইয়া গেছে ধর্মের ব্যাখ্যা। এবার সে দ্রৌপদীরে ঘরের ভিতরে টাইনা নিয়া সরাসরি জিগায়- তুমি কার গলায় মালা দিছো জানো? মালা দিছো এক ফকিন্নির পোলারে। ধনুক চালাইতে পারে ঠিক; কিন্তু কোনো। চালচুলা নাই; দেশে দেশে ভিক্ষা কইরা খায়। এখন তুমি যদি খালি অর্জুনরে চাও তবে তারে নিয়া সংসার পাইতা তোমারে সারা জীবন ফকিরার বৌ হইয়া কাটাইতে হবে। আর যদি আমার পাঁচ পোলার বৌ হইয়া তাগোরে একলগে রাখবার পারো। তা হইলে হস্তিনাপুরের মহারানি হইতেও পারো তুমি…

একটু পরেই আইসা হাজির কুন্তীর দুই ভাতিজা কৃষ্ণ আর বলাই। ঘরে নতুন বৌ বেক্কল হইয়া আছে পাঁচ স্বামী নিয়া। কুন্তী বেশি কিছু কয় না। সংক্ষেপে বিত্তান্ত বয়ান কইরা কয়-  ধৃতরাষ্ট্রেরে জানান দেওয়া দরকার যে পাঁচ পোলা নিয়া কুন্তী খালি বাঁইচাই নাই; পাঞ্চাল রাজা দ্রুপদ এখন তার পাঁচ পোলার শ্বশুর আর যাদব গোষ্ঠীও এখন আছে কুন্তীর লগে…

কৃষ্ণও কথা বাড়ায় না। কয়-  তোমাগো পরিচয় প্রকাশ এখনো সুবিধার হইব না পিসি। এক মাইয়ার পাঁচ স্বামী কেমনে হয় সেইটা দ্রুপদরে আগে না বুঝাইয়া আউগানো যাবে না। দ্রুপদ রাজা আমারে খাতির করেন কিন্তু এই বিষয়ে যুক্তি দিয়া আমি তারে পটাইতে পারব না। যুধিষ্ঠিরের বিধান ছোট ভাইগো লাইগা ঠিকাছে। কিন্তু পাঁচ পোলার এক বৌ জায়েজ করার লাইগা দ্বৈপায়নের মতো একজন শক্ত ঋষির সাপোর্ট লাগব তোমার…

কুন্তী হাসে-কী মনে করছ তুই পিসিরে? কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন আমার সাক্ষাৎ শ্বশুর আর আমার পোলারা তার নাতি। মাইনসে যত দেবতার কাহিনি জানে সবই জানে তার কলমের কৃপায়; তোর কি মনে হয় নাতিগো বিয়া জায়েজ করার লাইগা তারে দিয়া কোনো কাহিনি না করাইয়াই অত বড়ো কাম করছি আমি? ওইটা নিয়া তুই ভাবিস না। তিনি নিজে খাড়াইয়াই নাতিগো বিবাহ দিবেন। আমি তরে ডাকছি অন্য কারণে। সেইটা হইল; তোর ভাইয়েরা একটু নাদান কিসিমের; তুই তাগো লগে থাকলে তারা একটু বুকে বল পায়…

কর্ণরে যেমন পাঞ্চালী সরাইয়া দিছে সূতপুত্র কইয়া। তেমনি পাঁচ ভূতের ভাগে পড়ব জানলে হয়ত অর্জুনরেও সরাইয়া দিত ভিক্ষুক বিয়া করব না কইয়া। কিন্তু এখন বহু দেরি হইয়া গেছে। এখন সে অর্জুনের সম্পত্তি। অর্জুন তারে এখন যার কাছে ইচ্ছা দান কইরা দিতে পারে। দেখা যাক…

প্রতিযোগিতার নামে কি মাইয়াডারে কোনো ছোটলোকের হাতে তুইলা দিলাম? এই চিন্তায় বেক্কল বইনা গেছিল দ্রুপদ আর তার পোলা ধৃষ্টদ্যুম্ন। তাই পাঞ্চালপুত্র আড়ালে তার যমজ বোন পাঞ্চালীর পিছনে ধাওয়া দিছিল অর্জুনের সাকিন-সাবুদ জাইনা নিতে। কিন্তু সংবাদ নিয়া বাপের কাছে গিয়া মাথায় হাত দিয়া বইসা পড়ে পাঞ্চাল যুবরাজ- এইটা কী দেখলাম বাজান। পাঞ্চালীরে একলগেই বিয়া করছে সেই পোলা আর তার বাকি চাইর ভাই। কৃষ্ণ বলাইরেও দেখলাম তাগো মায়ের লগে কী যেন ফুসুর ফুসুর করে। আমার কেমন যেন সন্দেহ হয়…

এক মায়ের পাঁচ পোলা। তার মাঝে একটা তিরন্দাজ আরেকটা গদাধর; তার উপরে যাদবগো লগে কানেকশন। দ্রুপদেরও সন্দেহ হয় এরাই মনে লয় নিখোঁজ পাঁচ পাণ্ডব। সেইটা হইলে তো ভালোই। কিন্তু কথা হইল এক মাইয়ারে পাঁচ ভাইয়ে বিবাহের বিধানটা কী?

পরের দিনই দ্রুপদ নিজের পুরোহিতরে পাণ্ডবগো কাছে পাঠায় খাওনের নিমন্ত্রণ দিয়া। তার সাথে কইয়া দেয়- আমি চাই আমার মাইয়ারে যে পোলায় জয় করছে ধর্মের বিধান মতে সে একলাই আমার জামাতা হউক। যুধিষ্ঠির নিমন্ত্রণ রাইখা বাকি বিষয়ে কিছু না কইয়া কয়-  আইচ্ছা তাই হবে…

দ্রুপদ নিশ্চিত হইছেন এরাই পাণ্ডুরাজার পাঁচ পোলা। কিন্তু তিনি এদের বেশি বিশ্বাস করতে পারেন নাই। তাই নিমন্ত্রণের দিন কন্যার আনুষ্ঠানিক বিয়ারও আয়োজন কইরা রাখছেন তিনি। কিন্তু যখন তিনি যুধিষ্ঠিররে কইলেন- আসেন আপনের যে ভাই আমার মাইয়ারে জিতা নিছে তার লগে তার আনুষ্ঠানিক বিবাহটা সাইরা ফালাই। তখন যুধিষ্ঠির কয়-  মহারাজ আপনের মাইয়ার লগে তো। আমাগো পাঁচ ভাইয়েরই বিবাহ হইয়া গেছে। এখন অনুষ্ঠান করতে হইলে সিরিয়াল মতো পয়লা আমার লগে তারপর ভীমের লগে তারপর অর্জুন আর তারপর নকুল সহদেবের লগে করা লাগে…

পাঞ্চাল রাজা খেইপা উঠে যুধিষ্ঠিরের কথায়-ফাইজলামি করো মিয়া? পরিচয় দিতাম তুমি পাণ্ডুর পোলা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির আর কথা কইতাছ অধর্মের? এক মাইয়ার লগে পাঁচ ভাইয়ের বিবাহ?

যুধিষ্ঠির যতই বোঝাইতে চায় যে দ্রৌপদীরে বিয়া করার কোনো ইচ্ছাই তার নাই কিন্তু সেইটা সে করতে বাধ্য মায়ের সম্মান রাখতে গিয়া। আর এই সম্পর্কে ধর্মের ব্যাখ্যা আর উদাহরণ দুইটাই ইতিহাসে আছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সারা রাজবাড়ি পুরা হাউকাউ। একদিকে পাঁচ পাণ্ডব আর অন্য দিকে দুনিয়ার সব পাব্লিক। একজন ব্যাখ্যা চায় তো আরেকজন যায় থাপড় বাগাইয়া। এই দিকে দ্বৈপায়নের আসার কথা থাকলেও তিনি এখনো আইসা পৌঁছান নাই। কুন্তীর ভয় লাগে দ্রুপদ না তার মাইয়ারে ঘরে আটকাইয়া কয়- যা বেটা ভাগ তোরা ফকিন্নির পুত। আমার মাইয়ার বিয়া দিমু না আমি…

কুন্তী একবার মাইনসের হাউকাউ শোনে; আরেকবার তাকায় রাস্তায়। কুন্তীর সন্দেহ হয় একবার নন্দীর হাতে মাইর খাওয়া দ্বৈপায়ন ঋষি আইজ না আবার পাব্লিকের অবস্থা বুইঝা কাট মাইরা দিলেন। কিন্তু না। তিনি আসতাছেন…

হেইলা-দুইলা দাড়ি নাচাইয়া চুল ঝাঁকাইয়া দ্রুপদের আঙিনায় আইসা খাড়ান ঋষি দ্বৈপায়ন। কুন্তী দৌড়াইয়া গিয়া পড়ে তার পায়- আব্বাজান অবস্থা তো খুবই খারাপ। এক মাইয়ার পাঁচ স্বামী কেউ মানে না। এখন পাঞ্চালী যদি এক পোলারে বিবাহ করে তবে তো আমার কথা মিথ্যা হইয়া যায়।

আমারে কি তবে মিথ্যা বলার পাপে পাপী হইতে হবে পিতা? দ্বৈপায়ন একটু বিরক্ত হন- তোমারে পাপপুণ্য বিচারের দায়িত্ব দিছে কেডা?

ঋষি দ্বৈপায়নরে দেইখা দ্রুপদ পেন্নাম দিয়া তার সামনে খাড়ায়- দেখেন তো ঋষি। এইডা কোন ধরনের কথা? পাঁচ ভাইয়ে একটা মাইয়ারে বিবাহ করতে চায়?

–তুমি কেডা?

উত্তর না দিয়া দ্বৈপায়নের উল্টা প্রশ্নে দ্রুপদ হাত জোড় কইরা কয়-  আমি মাইয়ার বাপ। পাঞ্চাল দেশের রাজা…

দ্বৈপায়ন হাত তুইলা তারে থামান-রাজপরিচয় লাগব না। মাইয়ার বাপ কইছ সেইটাই যথেষ্ট। তুমি আমার নিকটে খাড়াও; আমি দেখতাছি…

দ্বৈপায়নরে দেইখা অন্যরাও আইসা তারে ঘিরা ধরে। ধৃষ্টদ্যুম্ন নমস্কার কইরা কয়-  আমি পাত্রীর যমজ ভাই কবি…

— আইচ্ছা ঠিকাছে। তা কোনো বক্তব্য আছে তোমার?

ধৃষ্টদ্যুম্ন হাত কচলায়। তারপর যুধিষ্ঠিররে দেখাইয়া কয়-  কবিবর। আমার বইনের বিবাহ ঠিক হইছে এই বেডার ছোড় ভাইয়ের লগে। এই বেডা নিজেরে ধার্মিক হিসাবে পরিচয় দেয়; অথচ নিজের ছোট ভাইয়ের বৌয়েরে সে নিজেই বিবাহ করতে চায়। এইডা কেমন কথা বলেন তো?

দ্বৈপায়ন তারেও থামাইয়া দেন- বাপবেটা দুইজন দুইভাবে কইলা; কিন্তু কথা তো সেই একই হইল।

তা এর বাইরে আর কোনো কথা আছে কারো?

ধৃষ্টদ্যুম্ন চুপসাইয়া গেলে যুধিষ্ঠির পেন্নাম কইরা খাড়ায়-দাদাজান। আমি কতভাবে এগোরে বুঝাইতে চাইলাম যে পুরাণে জটিলা নামে একজন নারীর সাতজন পতি আছিল। মুনিকইন্যা বাক্ষীর আছিল একলগে দশজন পতি; আর আমরা তো সাতও না; দশও না; মাত্র পাঁচখান ভাই পাঞ্চালীরে বিবাহ করতে চাই…

— তোমারে অত বকবক করতে কইছে কেডায়? কথা কম কইয়া চুপচাপ খাড়াইয়া থাকো। আর মাইয়ার ভাই তোমার লোকজনরে কও চিল্লাচিল্লি বন্ধ করতে। আমি মাইয়ার বাপের লগে একটু নিরালায় কথা বলতে চাই। মাইয়ার বাপ এই দিকে আসো। কী যেন নাম তোমার?

— আইজ্ঞা দ্রুপদ। পৃষতের পোলা।

— ঠিকাছে। পৃষৎরে আমি ভালো কইরা চিনতাম।

— আইজ্ঞা হ। তিনি আপনের ভক্ত আছিলেন। এই দিকে আসেন…

হাতে ধইরা দ্রুপদের নিয়া অন্যদিকে চইলা যান দ্বৈপায়ন। আড়ালে নিয়া কন- আমি এইখানে কেন আসছি তুমি জানো?

— না গুরুদেব

— আমি আসছি তোমার মাইয়ার বিবাহে পুরোহিত হইতে

দ্রুপদ এইবার আভূমি প্রণাম কইরা কয়-  এইটা খালি আমার মাইয়ার সৌভাগ্য না গুরুদেব। আমার বংশেরও সাত জন্মের সৌভাগ্য যে মহাঋষি দ্বৈপায়ন আমার মাইয়ার বিবাহে পুরোহিত হইবেন…

দ্বৈপায়ন দাঁত বাইর কইরা হাসেন- তোমারে সৌভাগ্য দিবার লাইগা আমি আসি নাই। আমি আসছি শিবের নির্দেশে নিজের দায়িত্ব পালন করতে

— শিবের নির্দেশ?

— হ শিবের নির্দেশ। কারণ তুমি যে মাইয়ারে নিজের মাইয়া বইলা জানো; সে আসোলে তোমার মাইয়া না। পূর্বজন্মে সে আছিল এক ঋষির মাইয়া যারে একলগে পাঁচ স্বামী পাওয়ার বর দিছিলেন শিব। সেই কারণেই তিনি আমারে দর্শন দিয়া কইলেন- তুই যা; পাঞ্চালীর বিবাহে পুরোহিত হ। অন্য কোনো ঘটি বামুন তার বিবাহ পড়াইলে আমার বর মিথ্যা হইয়া যাইতে পারে। আর সেই কারণেই আমি এইখানে আসলাম বুঝলা? আর আরেকখান কথা। তুমি যদি মনে করো যে স্বয়ংবরায় তোমার মাইয়াই তার স্বামী নির্বাচন করছে; তাইলে সেইটাও কিন্তু ভুল। তোমার মাইয়ার বিবাহের ঘটক স্বয়ং মহাদেব শিব। তিনিই পূর্বজন্মে তোমার মাইয়ার লাইগা তার স্বামীগো ঠিক কইরা রাখছিলেন। ওরাও আছিল দেবতা; খালি তোমার মাইয়ারে একলগে বিবাহ করার লাইগা শিবের নির্দেশে তারা মর্তে মানুষ হইয়া জন্মাইছে। এক নারীর একাধিক স্বামীর বিধান প্রচলিত না থাকলেও বিশেষ ক্ষেত্রে কিন্তু তা হইতেই পারে। বিশেষত শিব আগেই যে বিবাহ ঠিক কইরা রাখছেন। এখন শিবের কথার উপ্রে আর কোনো কথা আছে তোমার?

— আইজ্ঞা না। ঋষি দ্বৈপায়নের কথার উপ্রে আবার কীসের কথা?

বেদ ভাইঙ্গা যিনি চাইর টুকরা করছেন তিনিই কইতাছেন এই বিধান বৈদিক। শিবের জীবনী যিনি লিখছেন; তিনিই কইতাছেন এই বিবাহ শৈব। সুতরাং দ্বৈপায়নের কথার পরে আর কোনো টু শব্দ করে না কেউ। দ্রুপদও বাঁইচা যায় নিজের ঘাড় থাইকা এমন ঝামেলা নামায়। তারপর দ্বৈপায়ন নিজে পুরোহিত হইয়া পাঁচ নাতির লগে পরপর পাঁচ দিন ধইরা বিবাহ পড়াইয়া দেন পাঞ্চালকন্যা দ্রৌপদীর…

সংবাদ পৌঁছাইয়া যায় ধৃতরাষ্ট্রের কানে। এখন কী করা যায়?

ধৃতরাষ্ট্রের এমন বেচইন প্রশ্নে ভীষ্ম নইড়াচইড়া আবার তার তামাদি হিসাব খোলেন-করার তো কিছু নাই। বংশের নিখোঁজ পোলাগো আবার খোঁজ পাওয়া গেছে। তাগোরে বাড়ি আসতে কও…

দ্রোণের অঙ্কটা একটু বেশি জটিল। ধৃতরাষ্ট্রের লগে যদি পঞ্চ পাণ্ডবের গিয়াঞ্জাম হয় তবে দুর্যোধন আর কর্ণ ব্যস্ত থাকব পাণ্ডবগো আক্রমণ থাইকা হস্তিনাপুর বাঁচাইবার ধান্দায়। ধৃতের চাকুরিজীবী হিসাবে দ্রোণেরেও তখন থাকতে হইব হস্তিনাপুর। আর সেই সুযোগে এক ধাক্কাতেই দ্রুপদ উদ্ধার কইরা নিব দ্রোণের হাতে বেদখল হইয়া যাওয়া তার দক্ষিণ পাঞ্চাল। তাই সবচে বুদ্ধিমানের কাম হইল যুদ্ধমুদ্ধ এড়াইয়া যাওয়া। ধৃতের ভাতিজারা হস্তিনাপুর আইসা তার পোলাগো লগে কিলাকিলি করুক তাতে তার কী? কিন্তু কোনোভাবেই দ্রুপদরে যুদ্ধের সুযোগ দিয়া নিজের রাজ্য হারানোর ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হইব না। তাই সবকিছু ভাইবা-চিন্তা দ্রোণও সিদ্ধান্ত জানায়- মুরব্বি ভীষ্মের কথাই আমার কথা মহারাজ। বিদুরও ভীষ্মরে সমর্থন জানায়- জ্যাঠায় যা কইছে সেইটাই আমার মত। ওগোরে ফিরা আসতে কন…

তিনজনের কথাই এক লাইনে যাওয়ায় ধৃতরাষ্ট্র কর্ণের দিকে তাকান। কর্ণের সোজাসাপ্টা কথা- অত দিন যারা মরার ভান কইরা লুকাইয়া আছিল; এইবার আদেশ করেন ওগোরে সত্যি সত্যি মাইরা ফালাই…

ধৃতরাষ্ট্র কর্ণের টোপ গিলা ফালাইতে পারেন দেইখা বিদুর রাজারে ভয় দেখাইতে শুরু করে- ওগোর লগে কিন্তু এখন জাউরা যাদব বংশের প্যাক্ট হইছে মহারাজ। বলরাম আর সাত্যকির শক্তির কথা তো আপনি জানেন। যুদ্ধ জিতার বিষয়ে কৃষ্ণের বুদ্ধির কাহিনিও তো আপনি বহুত শুনছেন মহারাজ। আর পাণ্ডবগো শ্বশুর রাজা দ্রুপদরে আপনি কোন যুক্তি দিয়া দুব্বল কইবেন; যেইখানে ধৃষ্টদ্যুম্ন আর শিখণ্ডীর মতো দুইটা পোলা আছে তার? বুইঝা দেখেন মহারাজ একলা কর্ণরে দিয়া অত কিছু সামলানো যাইব কি না? তাই আমার পরামর্শ হইল অভিভাবক হিসাবে নিজের পজিশন ঠিক রাখার লাইগা বৌসহ পিতৃহীন ভাতিজাগোরে আপনি সাদরে গ্রহণ কইরা লন। তাতে আপনার সম্মান বৃদ্ধি হবে…

বিদুরের কথায় ধৃতরাষ্ট্ররে ভয় খাইতে দেইখা ভীষ্ম গলা খাঁকারি দেন- আমি কই কি; যুবরাজ টুবরাজ পদ দিয়া এখন আর তুমি ঝামেলা মিটাইতে পারবা না। তুমি বরং তাগোরে অর্ধেক রাজ্য দিয়া দেও। তাতে তোমার পোলাগো লগে তাগো দেখা-সাক্ষাৎও হইব না; রেষারেষিও থাকব না…

যারা মইরা যাওয়ার পরে কাইন্দা ধৃতরাষ্ট্র শেষকৃত্য কইরা ফালাইছেন বহু দিন আগে; এইবার তাগোর কাছেই তিনি সংবাদ পাঠান- ভাতিজাগণ। ছোট ভাইয়ের পোলা হিসাবে তোমরা আমারও পোলাপান। অত দিন কই ছিলি বাপ? আয় বাপ আয়। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরা আয় বৌ আর মায়েরে নিয়া…

দ্রুপদ আর কৃষ্ণের লগে শলা কইরা পাঁচ বছর পর কুন্তী আবার আইসা পাণ্ডুর প্রাসাদে ঢোকে তার পোলা আর পোলাবৌ নিয়া…

কয়েক দিনের মধ্যেই ভীষ্মের সালিশে ভাগাভাগি হইলে পাণ্ডবরা পায় রাজ্যের আকাটা জঙ্গলের অংশ খাণ্ডবপ্রস্থ। তাতেই সই। তারা কৃষ্ণরে নিয়া সেই বনে গিয়া লোকাল পাব্লিকরে মাইরা ধইরা আগুন দিয়া খেদাইয়া বানায় ইন্দ্রপ্রস্থ নগর। তারপর হাইলা জাইলা প্রজাগোর সম্পদে-ফসলে ছয় ভাগের এক ভাগ খাজনা বসাইয়া যুধিষ্ঠির হয় সেই রাজ্যের রাজা; যুবরাজ ভীমের দায়িত্বে থাকে রাজ্যের কল্যাণ আর অর্থকড়ির হিসাব; যুদ্ধ আর বিদেশ বিষয় থাকে অর্জুনের হাতে; আর বড়ো তিন ভাইর সার্বক্ষণিক অ্যাসিস্ট্যান্ট হয় নকুল সহদেব এবং সবার উপরে থাকে মামাতো ভাই কৃষ্ণের উপদেষ্টা পদ…

এর মাঝে দ্রৌপদীর গর্ভে পাঁচ পোলার ঘরে পাঁচটা নাতিও পাইছে কুন্তী; প্রতিবিন্ধ্য- সুতসোম শ্রুতকর্মা-শতানীক আর শ্রুতসেন। পাঁচ পাণ্ডবের চাইরজন আরো একটা কইরা বিয়াশাদিও করছে এর মাঝে। অর্জুন কৃষ্ণের বইন সুভদ্রাসহ বিয়া করছে আরো তিনখান; সেই সব ঘরে অর্জুনের পোলাপানও আছে; উলুপীর ঘরে ইরাবান; চিত্রাঙ্গদার ঘরে বভ্রুবাহন; সুভদ্রার ঘরে অভিমন্যু…

সতিনের লগে ঘর করব না বইলা বংশের বড়ো বৌ হিড়িম্বা তার পোলারে নিয়া সেই জঙ্গলেই থাকে। উলুপী আর চিত্রাঙ্গদারে অর্জুন ঘরে উঠায় নাই বইলা তারাও তাগো পোলাদের সাথে নিজের বাপের ঘরে থাকে। আর পোলাদের সংসারে না থাইকা কুন্তী থাকে তার স্বামীর ঘরে; হস্তিনাপুর…

বড়ো নাতি ঘটোৎকচও বিয়াশাদি কইরা এখন দুই পোলার বাপ। ছোট পোলারে ঘাড়ে নিয়া এক হাতে বড়ো পোলার হাত ধইরা বৌরে নিয়া কুন্তীর কাছে আসছিল ঘটা- দেখো দাদি। পয়লা নাতির। ঘরে তোমার পয়লা নাতিবৌ অহিলাবতী। আর এই অঞ্জনপর্বা হইল তোমার পয়লা পোতা; পাণ্ডবগো পরথম নাতি আর এই ল্যাদা পোলাটা হইল তোমার দুই নম্বর পোতা বর্বরীক…

ঘটোৎকচের বৌটা খুবই চটপটা আর বুদ্ধিমান। পয়লা দিন আইসাই সে কুন্তীরে কয়-  রাজনীতির লাইগা শ্বশুররে যেমন তার সংসার থাইকা তুমি কাইড়া নিছিলা; আমার স্বামীরে নিয়া সেই রকম ঘিরিঙ্গি করলে আমি কিন্তু তোমারে খাইয়া ফালামু বুড়ি। মনে রাইখ আমি নাগ বংশের মাইয়া…

ঘটার পোলাগো কোলে নিয়া কুন্তী হাসে- আমার যখন করার সময় আছিল তখন ভালোমন্দ নিজের বুদ্ধিতে যা কুলায় পোলাপানগো লাইগা তা করছি। এখন নাতিপুতিগো লগে সময় কাটান ছাড়া আমার তো আর কিছু করার দরকার দেখি না বইন। এখন তোগো সময়; ভালোমন্দ যা করার করবি তোরাই…

অহিলা কয়-  আমিও আমার পোলাগো ভালোমন্দ ঠিক কইরা ফালাইছি দাদি। বড়ো পোলাটা দিয়া দিছি ওর বাপেরে। বাপ দাদার মতো সে মাইর দাঙ্গা করব। আর ওই ল্যাদা পোলাটা আমার। ওরে

আমি পড়ালেখা করাইয়া ঋষি বানামু। বংশের সকলে খালি মারামারি করলে হবে? দুই একজনের তো বিদ্যা শিক্ষা কইরা মগজের কারবারও করা লাগে; নাকি কও দাদি?

কুন্তী কয়-  তা তো লাগবই। আমার শ্বশুর হইলেন ঋষি দ্বৈপায়ন; নাতিপুতিগো মাঝে একজনও ঋষি হইব না তা কি হয়? তয় আমার নাতি ঘটারেও কিন্তু তুমি খালি দাঙ্গাবাজ কইতে পারো না। সে কিন্তু অস্ত্র কম্পিটিশন দিয়া স্বয়ংবরায় তোমারে বিয়া করে নাই; বুদ্ধির কম্পিটিশন কইরাই তোমারে বিয়া করছে…

অহিলা কয়-  হ। বুদ্ধি তো আছিল ভালোই কিন্তু সব বুদ্ধি তো খর্চা কইরা ফালায় মায়াযুদ্ধের কৌশল খাটাইতে গিয়া…

কুন্তী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে- কী আর করব কও। একলা একলা বড়ো হইছে; মায়ের সংসার সামলাইতে হইছে। লাঠিসোঁটা ধরতে না জানলে তো মাইনসে তারে পায়ে পিসা যাইত…

অহিলা কয়-  হ দাদি। এর লাইগাই তো বড়োটারে বানামু যোদ্ধা। বাপে আর ভাইয়ে সামলাইব সংসার আর ছোটটায় করব বিদ্যাশিক্ষা…

নাগ বংশজাত মুরুর মাইয়া এই মৌরবি অহিলাবতী। বিদ্যাশিক্ষার লাইগা তার টানের কথা কুন্তী জানে। দুনিয়ার সকলে যেখানে স্বয়ংবরায় নিজের বর বাইছা নিতে যায় যোদ্ধা কিংবা কোনো বীরেরে; সেইখানে অহিলাবতী ঠিক করছিল তার স্বয়ংবরা হইব বুদ্ধির কম্পিটিশন দিয়া। সেই কম্পিটিশনে সে নিজেই জটিল কতগুলা প্রশ্ন করব আর যে সবগুলা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব; সেই হইব তার স্বামী…

কুন্তী মনে মনে ভাবে; এমন কম্পিটিশনে খাড়াইবার মতো তার নিজের একটাও পোলা নাই। কিন্তু হিড়িম্বার পোলা ঘটোৎকচ ঠিকই গিয়া হাজির হইছিল এমন স্বয়ংবরায় আর বুদ্ধি দিয়া সবাইরে হারাইয়া বিবাহ করছিল এই অহিলাবতীরে। কুন্তীর মনে বহুত খেদ আছিল নাতিটার শিক্ষাদীক্ষার কোনো ব্যবস্থা করতে না পাইরা। কিন্তু যেদিন শুনল ভীমের পোলা বুদ্ধির দৌড়েও সবাইরে পিছনে ফালাইয়া দিছে; সেই দিন মনে মনে একখান ধন্যবাদ দিছিল হিড়িম্বারে…

পাণ্ডুর গলায় মালা পরাইয়া যে কুন্তী একলা আসছিল হস্তিনাপুর; সেই কুন্তীর এখন নাতিপুতি নিয়া বিশাল বাজার। আশপাশের ছোটখাটো সব রাজারে কায়দা-কানুন কইরা ভীম আর অর্জুনে মিলা।

এই কয় দিনে বিশাল এক অর্থের ভাণ্ডারও গইড়া তুলছে ইন্দ্রপ্রস্থ দেশে। বিপদে আপদে কৃষ্ণ ছায়ার মতো আছে পাণ্ডবগো লগে। এখন ধনে জনে বুদ্ধিতে ভরাট কুন্তীরে হুমকি দিবার মতো সত্যিই আর কেউ নাই…

কথাটা সবার আগে যুধিষ্ঠিরের মাথাতেই খেলে- কই? কাউরে তো দেখি না আমার সমান। তাইলে আমি কেন খালি রাজা হইয়া বইসা থাকুম? সম্রাট হইতে অসুবিধা কই আমার?

–অসুবিধা নাই। কিন্তু মনে রাইখেন আপনি যা দেখেন না সেইখানেও গনার মতো বহুকিছু আছে। আশেপাশের বহুত ছোট রাজারে ভীম অর্জুনে মিলা বশ করছে সত্য; কিন্তু জরাসন্ধ বাঁইচা থাকতে আপনি সম্রাট হইবেন কেমনে? সে যেমন আপনের বশ মানব না তেমনি টানা তিন শো বছর যুদ্ধ করাইও তারে হারাইতে পারব না কেউ…

কৃষ্ণ জরাসন্ধের কথা কওয়ায় নিজের খায়েশ বিসর্জন দিয়া যুধিষ্ঠির চুপসাইয়া যায়- আইচ্ছা তাইলে থাক। সম্রাট হইয়া কাম নাই আমার…

জরাসন্ধ সত্যিই কঠিন সম্রাট। আশপাশের ছিয়াশিজন রাজারে সে বন্দি কইরা রাখছে নিজের কারাগারে। ভোজ বংশের সকল রাজাই জরাসন্ধের অনুগত। তার উপরে কৃষ্ণের উপর যারা যারা নাখোশ তারা সবাই আইসা যোগ দিছে জরাসন্ধের দলে। এই দলে সবার আগে আছে জরাসন্ধের প্রধান সেনাপতি শিশুপাল; যে কৃষ্ণের আরেক পিসি শ্রুতস্রবার পোলা; যার প্রেমিকা রুক্মিণীরে তুইলা আইনা বিয়া করায় কৃষ্ণের উপর মহান খ্যাপা সর্বদাই। মাইয়ারে তুইলা নিয়া আসায় রুক্মিণীর বাপ ভীষ্মক স্বাভাবিকভাবেই জরাসন্ধের পক্ষে। কৃষ্ণের প্রতিদ্বন্দ্বী বঙ্গ পৌ কিরাতের রাজা পৌকি বাসুদেবও জরাসন্ধের দোস্ত। নাগরাজ মুর; যে ঘটোৎকচের শ্বশুর হইলেও খাণ্ডবপ্রস্থ থাইকা কৃষ্ণ অর্জুনে তাগোরে উচ্ছেদ করায় যাদব-পাণ্ডব বিদ্বেষী আর জরাসন্ধের বন্ধু জরাসন্ধের বন্ধুর দলে আছে দুর্যোধনের শ্বশুর নরকরাজ ভগদত্ত; যার বাপেরে কৃষ্ণ হত্যা করায় কৃষ্ণবিদ্বেষী সে; আর সবচে বড়ো কথা কৃষ্ণের মামা কংস আছিলেন জরাসন্ধের দুই মাইয়ার জামাই। মাইয়ার জামাই হত্যার প্রতিশোধ নিতে জরাসন্ধ যাদব আর বৃষ্ণিগো বহুত তাড়াইছেন। জরাসন্ধের ভয়েই কৃষ্ণের গোষ্ঠী এখন পর্বতের নিকট দুর্গ বানাইয়া বসবাস করে। জরাসন্ধরে যদি দমন করা যাইত তবে কি আর কৃষ্ণের বংশ তার ডরে পলাইয়া বেড়ায়?

কিন্তু যুধিষ্ঠিরের সম্রাট হইবার খায়েশ শুইনা হঠাৎ কৃষ্ণের মনে হয়-যার লগে যুদ্ধে পারা যাইব না তার লগে যুদ্ধ করারইবা কী দরকার? তারে অন্যভাবেও তো সরানো যায়। একবার দেখি না একটা টেরাই দিয়া…

ব্রাহ্মণভক্ত বৃদ্ধ জরাসন্ধের বাড়িতে ব্রাহ্মণ সাইজা ভীমরে নিয়া হাজির হয় কৃষ্ণ। তারপর জরাসন্ধ করে ব্রাহ্মণ সেবা আর কৃষ্ণ ভীমেরে বুঝায় কীভাবে মারতে হবে তারে। ভীম তারে মাথায় তুইলা মাটিতে আছড়াইয়া ফালায় আর এক পায়ে পা চাইপা ধইরা আরেক পায়ে হ্যাঁচকা টান দিয়া জরাসন্ধের দেহখান আলগা কইরা ফালায়…

জরাসন্ধরে মাইরা ফালানের পর পয়লা যে জিনিসটা ঘটে তা হইল কৃষ্ণের বিষয়ে সকলে সতর্ক হইয়া উঠে। এই যাদব পোলা রাজাও না সম্রাটও না; রাজা বাদশা হইবার কোনো ইচ্ছা তার আছে বইলা মনেও হয় না কারো। যুদ্ধে তার অস্ত্র চালানোর সুখ্যাতি আছে; নিজের মামারে মাইরা ফালানোয় তার চোখের পর্দা না থাকার বদনামও আছে। কিন্তু একইসাথে শত্রুদমনে তার পিছনদুয়ারি বুদ্ধিটা সকলের চোখে পড়ে সকলের চেয়ে আলাদাভাবে। যেইখানে জরাসন্ধের সামনে খাড়ানোর সাহস করত না কেউ; সেই জরাসন্ধরে মাত্র এক ভীমরে নিয়া কেমনে সে সরাইয়া দিলো। একইসাথে কৃষ্ণের আশীর্বাদ পাওয়া যুধিষ্ঠিরের সামনেও আর তেমন কেউ থাকে না যে তারে সম্রাট হইতে বাধা দিতে পারে। ভাইঙ্গা পড়ে জরাসন্ধের শক্তির ভীত আর খুচরা-খাচরা বাকিদের অল্প দিনেই বশ কইরা সম্রাট হইবার লাইগা রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করে যুধিষ্ঠির…

এইখানে অবশ্য একটু ঝামেলা হয়। কৃষ্ণের দাবি আছিল যজ্ঞের অর্ঘ্যটা তারেই দিতে হবে; যদিও যজ্ঞের অর্ঘ্য পাইবার জন্য যোগ্য হইল ছয় দল মানুষ; গুরু- পুরোহিত- সম্বন্ধী- স্নাতক- সুহৃদ এবং রাজা। গুরু পুরোহিত স্নাতক এবং রাজা; এই চাইর দলের কোনো দলেই কৃষ্ণ নাই। তারে পাণ্ডবগো সম্বন্ধী এবং সুহৃদ কওয়া গেলেও এই দলে এখনো তার থাইকা বেশি অগ্রাধিকারী মাইনসের অভাব নাই…

কিন্তু যুধিষ্ঠিরের তাতে কোনো অসুবিধা নাই। নিয়মে পড়ুক না পড়ুক কৃষ্ণ যখন চাইছে তখন সেইটা তারে দিতে হবে। ভীষ্মও তা মাইনা লন কারণ কৃষ্ণের বিরোধিতা কইরা শেষ বয়সে অপমান হইতে চান না তিনি। শুধু তাই না; আরেক ধাপ আগাইয়া যুধিষ্ঠিরের পক্ষে কুরুবুড়া ভীষ্ম নিজেই যজ্ঞের।

অর্ঘ্য নিবেদন করেন কৃষ্ণের পায়। কিন্তু অনেকেই খেইপা উঠে এই আচরণে। কৃষ্ণরে কেন দেয়া হবে যজ্ঞের পূজা? সব থিকা বেশি খেইপা উঠে জরাসন্ধের সেনাপতি এবং কৃষ্ণের শ্রুতবা পিসির পোলা শিশুপাল; যার প্রেমিকা রুক্মিণীরে ছিনতাই কইরা বিবাহ করছিল কৃষ্ণ। কিন্তু এইরকম পতঙ্গের আস্ফালন পছন্দ হইবার কথা না যজ্ঞের পূজা পাইয়া দেবতার মর্যাদায় উইঠা যাওয়া কৃষ্ণের; হোক তার ভাই কিন্তু চক্র ছুঁইড়া ভরা সভায় তার মাথা নামাইয়া দিতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করে না সে…

কৃষ্ণের আরেকটা চেহারা দেইখা আরো বেশি সতর্ক হয় আর্যাবর্তের মানুষ। আর কেউ কোনো শব্দ করে না। শুধু কুন্তীর মনে হয়; যে কৃষ্ণ এক পিসির পোলারে মারতে পারে সে অন্য পিসির পোলাগোরে মারতেও দেরি করব না; যদি তারা তার কথার অন্যথা করে। আপাতত অবশ্য সেই আশঙ্কা নাই; কারণ শক্তিমান মাইনসেরে কেমনে চালাইতে হয় তা যুধিষ্ঠির খুব ভালো কইরাই জানে…

রাজসূয় যজ্ঞ কইরা কুন্তীর পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী পোলা যুধিষ্ঠির এখন সম্রাট। কুন্তীর সত্যই এখন নাতিপুতি নিয়া খেলা করা ছাড়া আর কিছুই করার দরকার নাই। কিন্তু ঝামেলাটা আসে যুধিষ্ঠিরের সম্রাট হইবার সূত্র থেকেই। যুধিষ্ঠিররে সম্রাট হইতে দেখে গায়ে জ্বলা দুর্যোধন গিয়া তার মামা শকুনির লগে শলা কইরা যুধিষ্ঠিররে শকুনির লগে পাশা খেলার আমন্ত্রণ পাঠায়। পাশা খেলায় গান্ধারীর ভাই শকুনির দ্বিতীয় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নাই। যুদ্ধটুদ্ধের থাইকা বুদ্ধি দিয়া রাজনীতি করতে পছন্দ করে সে। যুধিষ্ঠিরের রমরমা রাজ্য দেইখা ভাগিনা দুর্যোধনরে সে বুদ্ধি দিছে যে যুদ্ধ ছাড়াও যুধিষ্ঠিরের রাজ্য নিজের দখলে নিয়া আসা সম্ভব পাশার দানে তুইলা; বিশেষত যেখানে যুধিষ্ঠিরও পাশার নেশায় আক্রান্ত…

পাশা খেলায় বাজি রাখা হইল রাজ্য। যুধিষ্ঠির জিতলে সে পাইব দুর্যোধনের রাজ্য আর হাইরা গেলে তার রাজ্য পাইব দুর্যোধন…

যুধিষ্ঠির খালি জুয়াড়িই না; মারাত্মক লোভীও বটে। পাশা খেইলা দুর্যোধনের রাজ্য পাইবার লোভে সে নিজের রাজ্য তো হারাইলই; তার সাথে পাশায় হাইরা তার সব ভাই; সে নিজে এবং দ্ৰৌপদীরেও বানাইয়া ফেলল দুর্যোধনের দাস। রাজসভায় দ্রৌপদীর মতো মাইয়ার নগ্ন হইবার মতো অপমানও সহ্য করতে হইল এই এক মূখের কারণে…

বিপদটা অবশ্য তখনো অত বেশি বড়ো হয় নাই। খেলায় হাইরা যাবার পরেও কুরুবুড়াদের কথায় ধৃতরাষ্ট্র নিজের ক্ষমতা খাটাইয়া সবকিছুই তাদের ফিরাইয়া দিছিলেন। কিন্তু মূর্খটা আবারও পরের দিন শকুনির লগে পাশা খেলতে গেলো নতুন এক বাজি নিয়া- খেলায় হাইরা গেলে চার ভাই আর দ্রৌপদীরে নিয়া তারে যাইতে হইব বারো বচ্ছর বনবাস আর এক বচ্ছরের অজ্ঞাতবাসে…

যা হওয়ার তাই হইল। যারে নিজের আঁচলে আগলাইয়া উনত্রিশ বছর বয়সে রাজা বানাইছিল কুন্তী। তারপর ষোলো বছর ধইরা তিল তিল করে চাইর ভাই আর কৃষ্ণ যারে পৌঁছাইয়া দিছিল সম্রাটের সিংহাসন পর্যন্ত। সেই সম্রাট যুধিষ্ঠির নিজের লোভ আর বেকুবির লাইগা হাইরা বসল শকুনির কাছে। এখন? এখন এই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের পোলা আর তার পোষ্যদের আরো তেরো বছর বনে-জঙ্গলে আগলাইয়া রাখার শক্তি কি কুন্তীর অবশিষ্ট আছে?

ক্ষতি যা হইবার তা হইয়া গেছে। এখন বাকিটা সামলানো দরকার। বহু বছর পর আবার নিজের মেরুদণ্ড সোজা কইরা খাড়ায় কুন্তী- পাঁচ পাণ্ডবের লগে শুধু দ্রৌপদীই যাইব বনে। বাকি বৌবিনিরা নিজেগো পোলা-মাইয়া নিয়া নিজের বাপের বাড়ি গিয়া থাকো। দ্রৌপদীর পাঁচ পোলারেও পাঠাইয়া দাও নানাবাড়ি পাঞ্চাল দেশে…

এই প্রথমবার কুন্তীর নিজেরে এক ভাইঙ্গা পড়া বৃদ্ধ মানুষ মনে হয়। সে অতি ধীরে দ্রৌপদীরে ধইরা নিজেরে খাড়া রাখে-বনে জঙ্গলে থাইকা; পথে পথে ভিক্ষা কইরা যে পোলারে রাজা বানাইছিলাম আমি। নিজের কর্মদোষে সেই পোলা এখন সবাইরে নিয়া পথের ফকির। তোরে আমার কিচ্ছু কওয়ার নাই রে মা। শুধু কই; যদি পারিস পাঁচটা পোলারে এক মুঠায় রাইখা দেখ কিছু করতে পারস কি না…