মহাভারতের বিয়াশাদি ঘরসংসার

মহাভারতের বিয়াশাদি ঘরসংসার

অভাজনের মহাভারত প্রথম প্রকাশের পাঁচ বছর পার হইছে। এই সময়কালে সমালোচনা পাইছি; প্রশংসা পাইছি; পরামর্শ পাইছি আবার কিছু কিছু দাবিও আইসা জমা হইছে আমার কাছে। মহাভারতের কাহিনীগুলার হাজারো ভার্সনের ভিতর অভাজনের মহাভারত একটা। অন্যগুলার মতোই এই বইয়ে কিছু জিনিস আসছে যা অন্য কোথাও নাই; আবার অন্য কোথাও আছে এমন বহুত জিনিস বাদ গেছে… অনেকের দাবি; প্রচলিত কাহিনীগুলায় বর্ণিত বিয়াশাদি ঘরসংসার সম্পর্ক বিষয়ে একটা অধ্যায় সংকলন করার। এই অধ্যায়টা সেই দাবিরই একটা জোগান… এই অধ্যায়ের উপকরণগুলা প্রচলিত মহাভারতীয় আখ্যান-উপাখ্যান নির্ভর একটা সংকলন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রসঙ্গিক অন্য আখ্যানও উইঠা আসছে। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন বিবরণও পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন কাহিনীতে…

. মহাভারতের বিয়াশাদি

মহাভারত মূলত একখান গেরস্থালি উপখ্যানের সমাহার। জমিজমা নিয়া মারামারি কামড়াকামাড়ির লগে লগে এই পুস্তকটা বিয়াশাদি-জন্মদান কিংবা পোলাপানের লগে সম্পর্কের বিবরণেও রীতিমতো বিচিত্র-ব্যাপক…

কৃষ্ণ উপাখ্যানের কারণে এক বেটার একাধিক বৌ থাকার কথা সকলেই জানে; দ্রৌপদীর কারণে জানে এক নারীর বহুপতির কথা। কুন্তীর কারণে একাধিক পুরুষ দিয়া নারীর গর্ভসঞ্চার কিংবা দ্বৈপায়নের কারণে ভাইয়ের বৌরে গর্ভবতী করার কথাও সকলের জানা…

অন্যদিকে কর্ণ কিংবা দ্বৈপায়নের জন্মঘটনার কারণে যে কোনো তরুণীরে চাইপা ধইরা গর্ভবতী করায় বামুনগো অধিকারের স্বীকৃত প্রচলনগুলা মহাভারতের প্রাথমিক পাঠ্য উপাদান। তাই এইসব বিষয়ে কথা না বাড়াই…

দ্রৌপদী আর উত্তরার বিবাহ দুইটা রীতির দিক থাইকা মহাভারতের অন্যসব বিবাহ থাইকা ভিন্ন। প্রথমতো; এই দুইটা বিবাহই ঘটছে কইন্যার বাড়িতে। মহাভারতের বাকিসব বিবাহ ঘটছে হয় বরের বাড়ি না হয় কোনো নিরপেক্ষ স্থানে…

সময়কালের হিসাবে উপমহাদেশে কইন্যার বাড়িতে বিবাহের আয়োজন তুলনামূলক নতুন সংযোজন। পুরানা সিস্টেমে বিয়া হইত বরের বাড়ি। রামায়ণে রাম-সীতার বিবাহও ঘটে কইন্যার বাড়িতে; আরো কিছু উপাদানের লগে রামায়ণরে মহাভারতের পরের ঘটনা হিসাবে যারা দেখাইতে চান তারা এই কইন্যা-বাড়ির বিবাহের কথাটাও খাড়া করেন যুক্তি হিসাবে…

কুন্তীরও স্বয়ংবরা হইছে বাপের বাড়ি কিন্তু পাণ্ডু তারে বিবাহ করছে নিজের বাড়ি আইনা। স্বয়ংবরায় দ্রৌপদীরে জিতার কালে নিজের বাড়ি নামে অন্তত একখান কুড়েঘর আছিল অর্জুনের; রাজকইন্যা দ্রৌপদী বিয়ার আগে-পরে সেইখানেই থাকে। কিন্তু তার বিবাহটা সেইখানে না হইয়া হইছে বাপের বাড়ি…

উত্তরার বিবাহের সময় পাণ্ডবরা বৈতল হইলেও বিবাহের পাত্র অভিমন্যুর কিন্তু থান আছিল; মামার বাড়িই আছিল তার বাড়িঘর; কিন্তু বিয়াটা সেইখানে হয় নাই; হইছে পাত্রীর বাপের বাড়ি…

দ্রৌপদী-উত্তরার বিবাহগুলা আরেকটা কারণে অন্যগুলা থাইকা আলাদা; সেইটা হইল পাত্রীপক্ষ কইন্যাদান করার পর কার লগে কইন্যার বিবাহ হবে সেইটা ঠিক করে পাত্রের পরিবার…

দ্রুপদ অর্জুনের হাতে মাইয়া দিবার পর দ্রৌপদীর বিবাহ করতে হবে পাঁচ জনরে; এই সিদ্ধান্ত করে কুন্তী আর যুধিষ্ঠির। এইটা নিয়া পরে দ্রৌপদীর বাপ-ভাই বহুত মুলামুলি করলেও সিদ্ধান্ত কিন্তু বদলায় না…

অন্যদিকে মৎস্যরাজা বিরাট কইন্যাদান করে অর্জুনরে; আর অর্জুন ঠিক করে উত্তরারে বিবাহ করব তার পোলায়…

এই ঘটনায় মনে হয় বাপের পাত্রীরে পুতের বিবাহ করতে কোথাও কোনো সামাজিক খচখচানির অস্তিত্ব আছিল না তখন…

মহাভারতে ভীম-হিড়িম্বার বিবাহটা প্রেমের…

অর্জুন-সুভদ্রার বিবাহ ভাগল দিয়া। এইটা কাজিন বিবাহ। সুভদ্রা অর্জুনের মামাতো বইন। সহদেবের বৌ দ্যুতিমৎ বা বিজয়া আছিল তার মামাতো বইন; মদ্ররাজ শল্যর মাইয়া। কৃষ্ণের এক বৌ মিত্ৰবিন্দও আছিল তার ফুপুতো বইন…

মহাভারতে চাচাতো ভাই-বইনের ভিতর বিবাহেরও একটা উদাহরণ আছে। সেইটা হইল ভীমের পোলা ঘটোৎকচের লগে অর্জুন-সুভদ্রার মাইয়া ভার্গবীর বিবাহ…

মহাভারতে কুমারীমাতার বিবাহের দুইখান বিখ্যাত উদাহরণ সত্যবতী আর কুন্তী। এর ভিতর সত্যবতীর কুমারীকালের সন্তানের ঘটনা আছিল প্রকাশ্য; অন্যদিকে কুন্তীর কুমারীকালের সন্তানের কথা সম্পূর্ণ চাইপা যাওয়ার চেষ্টা হইছে আগাগোড়া…

মহাভারতে বিধবা বিবাহের ঘটনা আছে একখান; উলুপী। অর্জুনরে বিবাহের আগে উলুপীর আরেকটা বিবাহ হয়; কিন্তু স্বামী মইরা যায়…

স্বামী থাকা অবস্থায় নারীরে বিবাহ করতে চাওয়ারও উদাহরণ আছে মহাভারতে…

ধৃতরাষ্ট্রের মাইয়া দুঃশলার স্বামী জয়দ্রথ একবার দ্রৌপদীর তুইলা নেওয়ার চেষ্টা চালায়। দ্রৌপদীর স্বামীরা জ্যান্ত জাইনাও সে কয় বিবাহ কইরা রানির মর্যাদা দিব তারে…

এতে মনে হয় বিবাহের পাত্রী হইবার যোগ্যতার ক্ষেত্রে নারীর বিবাহিত-অবিবাহিত-কুমারী কিংবা বিধবা কোনো বিষয় আছিল না ওই সমাজে…

বিবাহ কিংবা যৌনতার লাইগা পটানোর উদাহরণ মহাভারতে আছে প্রচুর। চিত্রাঙ্গদা অর্জুনরে পটায়। পরে আরেক অপ্সরা অর্জুনরে পটানোর চেষ্টা করে; অর্জুন রাজি হয় না। তবে পটানো চেষ্টার কারণে ক্ষ্যাপার কোনো ঘটনা মহাভারতে নাই; রামায়ণে আছে। রামায়ণে রাবণের বইন সুপর্ণখা লক্ষ্মণরে পটাইতে চায়। এর লাইগা লক্ষ্মণ রীতিমতো তারে শাস্তি দেয়; তার নাক-কান কাইটা ফালায়…

মহাভারতে বেশ কয়েকটা স্বয়ংবরার উদাহরণ আছে। সেইগুলাতে পাত্রীরা পাত্র পছন্দ করত হয় তার শান শওকতের বিবরণ শুইনা; না হয় পাত্র নির্বাচনের লাইগা থাকত বিভিন্ন রকমের যুদ্ধকৌশল কিংবা লড়াই কিংবা খেলার প্রতিযোগিতা। যে জিতত সেই পাইত মালা। আবার স্বয়ংবরা থাইকা প্রতিযোগিতার আগেই কোনো প্রার্থীরে অযোগ্য ঘোষণা করার ঘটনা আমরা দ্রৌপদীর স্বয়ংবরায় পাই…

কিন্তু মহাভারতে একটা স্বয়ংবরা কিঞ্চিত ভিন্ন রকমের। সেইটা হইল নাগ বংশজাত কইন্যা অহিলাবতীর স্বয়ংবরা। এই স্বয়ংবরাটায় প্রতিযোগিতা আছিল বুদ্ধি পরীক্ষার। পাত্রী অহিলাবতী নিজেই পাত্রগো কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে আর সেইসব কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিয়া তারে জিতা নেয় ভীম-হিড়িম্বার পোলা ঘটোৎকচ…

সাধারণ বিবরণে ঘটোৎকচরে নির্বোধ একটা গতরসর্বস্ব রাক্ষস হিসাবে বর্ণনা দিলেও এই ঘটনা থাইকা তার বুদ্ধিরও কিছু ঝিলিক পাওয়া যায়। আর তার চাইতেও বড়ো কথা হইল শান্তনুর আস্ত বংশধারায় একজন মাত্র মানুষ পরবর্তীতে ঋষি হয়; সেইটা হইল ঘটোৎকচ-অহিলাবতীর পোলা বর্বরীক। তার মানে হিড়িম্বার এই গোষ্ঠীরে লঘুতুচ্ছ করলেও এই বংশে যে জ্ঞান-বিদ্যা চর্চার অভ্যাস আছিল তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায়…

ঘটোৎকচের পোলা অঞ্জনপর্বা বেশ প্রশিক্ষিত যোদ্ধা হিসাবেই কুরুযুদ্ধে অংশ নেয়। ঘটোৎকচের বাহিনীটাই আছিল কুরুযুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষের প্রথম বাহিনী। আবার বাপ কাকারা সৎমায়রে নিয়া বনবাসে গেলে সেইখানে গিয়া তাগো মালপত্র টানার কামও করতে দেখি ঘটোৎকচেরে। এমনকি সৎমা দ্রৌপদীর কান্ধে কইরা পাহাড়ে পর্যন্ত বইয়া নিয়া যায় সে…

উল্টা দিকে রাজসূয় যজ্ঞে দ্রৌপদী হিড়িম্বারে অপমান করলে একেবারে রাক্ষসের মতো হুংকার ছাইড়া সামনে খাড়ায় ঘটোৎকচ…

হিড়িম্বার মতো পরিবারগুলাতে সম্ভবত পারিবারিক বন্ধনের কাঠামো কিঞ্চিত ভিন্ন রকমের আছিল; বাপ মায়ের প্রতি পোলাপাইনের নির্ধারিত কিছু দায়িত্ব আছিল। যেইটা দ্রৌপদীর পোলাগোরে কিছুই করতে দেখা যায় না…

মহাভারতে অন্তত একটা পরকীয়া কাহিনী আছে। আবার বিবাহিত বৌ ভাইগা গিয়া অন্যের লগে সংসার কইরা বাচ্চাকাচ্চা জন্মদিবার পরে ফিরা আইসা সংসার করার ঘটনাও এইটা…

দেবগুরু ঋষি বৃহস্পতির বৌ তারা তার ছাত্র সোমের লগে ভাইগা যায়। এইটা নিয়া দেবতাপক্ষ আর বৃহস্পতি বহুত চোটপাট এমনি লাঠিসোটাও আয়োজন করেন। কিন্তু সোমরে প্রশ্রয় দিয়া বসেন অসুরগুরু শুক্রাচার্য। ফলে দেবতারা আর তারে নাড়াইতে সাহস করে না। সোমের লগে সংসার করতে থাকে তারা। তাগো একটা পোলাও হয়…

এই দিকে বৌ ফিরত পাইবার লাইগা বৃহস্পতি শুরু করেন কাকুতি মিনতি। পরে শুক্র সোমরে বলেন তারারে তার স্বামীর কাছে ফিরত দিয়া আসতে। সোম তার পুতেরে রাইখা তারারে তার আগের স্বামী বৃহস্পতির কাছে ফিরায়া দেয়…

এইখানে তারার মতামতের বিষয়ে কিছু জানা যায় না। তারা নিজেই পলাইছিল সোমরে পটায়া। পরবর্তীতে তারারে বৃহস্পতির লগেই সংসার করতে দেখা যায়। বড়োই মায়া দিয়া মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই তারার মনের কথাগুলা আঁকছেন তার বীরাঙ্গনা কাব্যে…

খুব সম্ভবত কচ তারারই গর্ভজাত সন্তান; যারে কৌশলে শুক্রের গোপন বিদ্যা শিখার লাইগা পাঠান বৃহস্পতি। রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপ কাহিনী কাব্যের কারণে বড়োই আবেগের সহিত এই কচ বিখ্যাত বাঙালির মনে…

পৌরাণিক ঋষিগো ভিতর কচই সম্ভবত প্রথম এবং একমাত্র তাত্ত্বিক গুরু বা প্রফেসর। অন্যসব গুরুরা বিদ্যা শিখাইতেন এবং নিজেও প্রয়োগ করতেন। কিন্তু কচ কোনোদিন নিজের বিদ্যা নিজে প্রয়োগ করত না; খালি ছাত্রগো পড়াইত। যেইটারে রবীন্দ্রনাথ দেবযানীর মুখ দিয়া অভিশাপ আকারে ‘শিখাইবে, করিতে পারিবে না প্রয়োগ’ বইলা কচের ভাণ্ডারে জমা করেন বাঙালির আবেগ…

অন্য দিকে দেবগুরু বৃহস্পতিরই আরেকটা পরকীয়া কিংবা ধর্ষণের ঘটনায় জন্ম নেওয়া শিশুর বিষয়ে মা বা বাপ দুই জনরেই দায়িত্ব অস্বীকার করতে দেখা যায়…

একবার দেবগুরু বৃহস্পতি তার বড় ভাই উতথ্যের বৌ মমতারে ধর্ষণ করেন; অথবা মমতার লগে পরকীয়া যৌনতা করেন। সেই ঘটনায় জন্মায় শিশু ভরদ্বাজ…

নিজের স্বামীর পোলা না দেইখা ভরদ্বাজরে মমতা পাঠায়া দেন বৃহস্পতির কাছে। কিন্তু বৃহস্পতি ভরদ্বাজের দায়িত্ব নেন না; ফলে ভরদ্বাজরে পালা খাইতে হয় গ্রামবাসীর কাছে…

বৃহস্পতির এই মমতা-ধর্ষণ কিংবা মমতা-যৌনতার লগেই সম্পর্কিত আছে নারীগো স্বামীর অধীন করার আরেকটা সমীকরণ…

মমতার লগে যখন বৃহস্পতি যৌনতা করতেছিলেন; তখন তা দেইখা ফালায় মমতার কিশোরপুত্র দীর্ঘতমা। সে আইসা কাকুরে শুরু করে কিল লাথি মারা। এতে ক্ষেইপা গিয়া বৃহস্পতি দীর্ঘতমার দুই চোখ অন্ধ কইরা দেন…

পরে আন্ধা হিসাবেই বড়ো হয় দীর্ঘতমা। ঋষি হিসাবেও বেশ নামডাক হয় তার। সে বিবাহ করে প্রদ্বেষা নামে এক নারীরে। কিন্তু নিজে চোখে দেখত না বইলা যৌনতার ক্ষেত্রে কোনো চক্ষুলজ্জা আছিল না দীর্ঘতমার। যখন তখন যেইখানে সেইখানে সে বৌরে চাইপা ধইরা শুরু করত কাপড় টানাটানি…

প্রদ্বেষা এইটাতে আপত্তি জানায়। বিষয়টা সহ্যের সীমা পার হইয়া গেলে এক পর্যায়ে প্রদ্বেষা লোকজন দিয়া পিটায়া গাঙে ভাসায়া দেয় দীর্ঘতমারে…

গাঙে ফালাইলেও মরে না দীর্ঘতমা। বাইচা উইঠা আরো ঋষিগিরি করে আর ধর্মীয় মোড়কে বিধান দেয়; বিবাহিত নারীরে যে কোনো অবস্থাতেই থাকতে হবে স্বামীর ইচ্ছার অধীন। মানে স্বামী যা চায় তা যে কোনো অবস্থাতেই সে করতে বাধ্য…

নারীগো স্বামীমুখী করার পয়লা বিধানিক উদ্যোগটা অবশ্য আসে আরেকটু আগে ঋষি শ্বেতকেতুর হাতে। সেইটা আছিল বিবাহিত নারীর বহুগামিতা নিয়ন্ত্রণের বিধান…

উপনিষদের প্রথম দিককার প্রচারক শ্বেতকেতু ঋষি উদ্দালকের ক্ষেত্রজ পুত্র। মানে উদ্দালকের বৌর গর্ভে অন্য কোনো পুরুষের ঔরসে জন্মানো পোলা। শ্বেতকেতুর তরুণ বয়সে তার এবং উদ্দালকের সামনে এক ব্রাহ্মণ আইসা শ্বেতকেতুর মায়েরে যৌনতার লাইগা নিয়া যায়। এতে বিস্মিত শ্বেতকেতু উদ্দালকরে জিগায়- এইটা কী হইল বাজান?

উদ্দালক কন- এইটা বিধানের মইধ্যেই পড়ে। কোনো ব্রাহ্মণ কিংবা অতিথি যৌনতার লাইগা ঘরের বৌরে চাইলে তা পাওয়ার অধিকার তিনি রাখেন…

এইটা শ্বেতকেতু মানতে পারে না। পরে বড়ো হইয়া সে বিবাহিত নারী স্বামী ছাড়া আর কারো লগে যৌনতা করতে পারব না বইলা বিধান প্রচার করে। যদিও তা কার্যকর হয় আরো বহু বহু পরে…

তবে অন্তত কুন্তী আর দ্রৌপদী পর্যন্ত এক নারীর চাইর পুরুষ পর্যন্ত যৌনতা গ্রহণযোগ্য আছিল। চাইরের অধিক পুরুষের লগে কোনো নারী যৌনতা করলে তারে বলা হইত বেশ্যা। এই সূত্র ধইরাই কুরুসভায় দ্রৌপদীরে বেশ্যা কইয়া ডাকে কর্ণ…

অন্যদিকে বিবিধ যুক্তিমতে নকুল-সহদেব কুন্তীর গর্ভজাত পোলা হইবার সম্ভাবনাই বেশি। তাগো লাইগা কুন্তীর অনুভূতি; মাদ্রীর লগে তাগো বিচ্ছিন্ন সম্পর্কবড়ো তিন ভাইর লগে সম্পর্কের গভীরতা; শল্যর লগে তাগো স্বাভাবিক মামা-ভাগিনা সম্পর্ক না থাকা; সব কিছুতেই ওই জমজরে কুন্তীর পোলা হিসাবেই ভাবতে প্ররোচনা দেয়…

অনেকের মতে কুন্তী এই দুই জমজরে মাদ্রীর পোলা কইয়া পরিচয় করাইছে শুধু নিজে বেশ্যা খেতাব এড়াইতে। কারণ কর্ণ থাইকা নকুল-সহদেব পর্যন্ত জন্ম দিতে তারে নিতে হইছে পাঁচ পুরুষের ঔরস। এর লগে আছে তার স্বামী পাণ্ডুর বিছানা; সব মিলা জানামতে অন্তত ছয় পুরুষের যৌনসঙ্গী হইছে কুন্তী…

ফলে প্রথম আর শেষ গর্ভ অস্বীকার কইরা স্বামীসহ স্বীকৃত চাইর পুরুষের যৌনসঙ্গই প্রতিষ্ঠা করতে হইছে কুন্তীরে; যাতে কেউ তারে বেশ্যা না কইতে পারে…

তবে পরপুরুষের দিকে নজর দিবার কারণে বৌ হত্যা এমনকি মাতৃহত্যার ঘটনাও আছে মহাভারতে তাও ঋষি পরিবারে…

ঋষি জমদগ্নির বৌ রেণুকার নজর পড়ছিল চিত্ররথ নামে এক রাজার উপর। রেণুকার গর্ভের পাঁচ পোলা তখন বড়ো। এর মাঝে সবার ছোট হইল পরশুরাম…

পরপুরুষের উপর বৌর নজর পড়ছে দেইখা জমদগ্নি বৌর মৃত্যুদণ্ড দেন; আর তা কার্যকর করতে বলেন নিজের পোলাদের। বড়ো চাইর পোলা সেইটাতে অস্বীকৃতি জানাইলেও বাপের আদেশে কুড়াল দিয়া মায়ের মাথা কাইটা ফালায় পরশুরাম…

তবে জমদগ্নি-পরশুরামের বংশে আরো আগের প্রজন্মে পরপুরুষে বৌ ছোঁয়ার বিষয়ে খুঁতখুঁতানি থাকলেও অত উগ্রতা দেখা যায় নাই…

জমদগ্নির বাপ ঋচিক। ঋচিক ভৃগু মুনীর দ্বিতীয় পোলা। ভৃগুর অন্য দুই পোলার মাঝে বড়োজন চ্যাবন মুনি আর ছোটপোলা শুক্রাচার্য। তিন পোলারই মা আলাদা আলাদা…

বিবাহের আগে চ্যাবনের মা পুলমার প্রেম আছিল গরিব এক সাধারণ তরুণের লগে। এর মাঝে পুলমারে দেইখা পছন্দ হওয়ায় ভৃগুমুনি গিয়া তার বাপের কাছে দিয়া বসেন বিবাহ প্রস্তাব। লগে লগে ভালো মূল্যের কইন্যাপণ…

ভালো কইন্যাপণ পাইয়া ভৃগুর কাছে মাইয়া দিয়া দেয় পুলমার বাপ। পরে এই ঘটনা জাইনা পুলমার প্রেমিক আইসা তারে স্বামীর বাড়ি থাইকা উঠায়া নিয়া গিয়া সংসার শুরু করে। আরো পরে চ্যাবন বড়ো হইয়া মায়ের প্রেমিকরে খুন কইরা মায়েরে ফিরায়া নিয়া আসে বাপের ঘরে। কিন্তু ভৃগু তারে আবার সংসারে নিতে রাজি হন না। পরে বহুত কান্নাকাটি আর সালিশের পরে ভৃগু আবার পুলমারে সংসারে গ্রহণ করেন…

পৌরাণিক কাহিনীমতে স্বামীর ঘরে ফিরার লাইগা পুলমা এমন কান্দনটা কানছিল যে সেই চোখের পানির স্রোতে বধূসরা নামে আস্ত একখান নদীই তৈরি হইয়া যায়…

কারো কারো যুক্তিতে আফগানিস্তানের বলখ নিবাসী চ্যাবন মুনীই হইলেন রামায়ণের আদি ভার্সন পুলস্ত্যবধ কাব্যের রচয়িতা বা আদি বাল্মিকী বা রামায়ণের আদি কবি। আর পুলস্তবধ্য কাব্যের মূল ঘটনাটা তার নিজের মায়ের অপহরণ ও উদ্ধার ঘটনারই কাব্যিক উপস্থাপন…

পরকীয়ার অবশ্য একটা বেশ সহিংস ঘটনা চলতি রামায়ণে আছে। ঋষি গৌতমের বৌ অহল্যা তার ছাত্র ইন্দ্রের লগে যৌনতায় ধরা পইড়া যায় স্বামীর হাতে। গৌতম ইন্দ্ররে ধইরা দুইটা বিচি গাইলা দেন। আর বৌরে শুকায়া মরার লাইগা বাইন্ধা রাখেন পাথুরে পাহাড়ে। পরে অবশ্য রাম অহল্যারে মুক্ত করে আর বিশ্বামিত্রের শালিসে গৌতম আবার অহল্যারে সংসারে ফিরায়া নেন…

স্বামীর একাধিক বিবাহে বৌর মাত্র একটা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় মহাভারতে। সেইটা সুভদ্রারে বিয়া করার পর অর্জুনের উপর দ্রৌপদীর ক্ষেইপা উঠা। দ্রৌপদী নিজের পাঁচ স্বামী থুইয়া অর্জুনের আরেক বৌ মানতে পারে না…

অন্যদিকে একাধিক বিবাহ করা স্বামীরে নিজের বশে রাখা না রাখা নিয়া টেনশনের ঘটনাও মাত্র একটা মহাভারতে। কৃষ্ণের বৌ সত্যভামা একবার দ্রৌপদীরে জিগায়- স্বামীরে কেমনে বশে রাখা যায়…

আস্ত মহাভারতে স্বামী ধইরা রাখা বিষয়ে আর কোনো টেনশনের ঘটনা নাই; স্বামীর অন্য বিবাহে গোস্বা করারও ঘটনা নাই…

.

. ভীষ্মের মহাভারতীয় ঘটকালি

মহাভারতের দীর্ঘজীবী চিরকুমার দেবব্রত ভীষ্ম নিজের পরিবারে তিন প্রজন্মের লাইগা ঘটকালি করছেন মোট পাঁচখান। বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়া পাঁচটা বিয়াই একটা থাইকা আরেকটা সম্পূর্ণ আলাদা…

তার পয়লা ঘটকালি বাপের বিয়ার। বাপ শান্তনুর বিবাহের প্রস্তাব নিয়া তিনি গিয়া হাজির হন সত্যবতীর বাপের বাড়ি…

আবিয়াইত্যা সত্যবতীর একটা বারো বছরের পোলা থাকায় বিয়ার বাজারে তার অবস্থা আছিল খুবই খারাপ। তারে বিয়া করলে তার পোলারেও খাওয়াইতে হইবে চিন্তায় জোয়ান-তাগড়া কোনো বেটায় বিবাহের প্রস্তাব দিত না তারে। যে দুই একটা প্রস্তাব আসত সেইগুলা হয় বুড়াধুড়া না হয় এমন হাভাইত্যা যে কইন্যাপণ দিবারও ক্ষমতা নাই; ফলে প্রস্তাব ফিরায়ইয়া দিতো সত্যবতীর বাপ…

কইন্যাপণ জিনিসটা শুনতে পাত্রীপক্ষের নেওয়া যৌতুকের মতো মনে হইলেও জিনিটা ভিন্ন। মূলত মাইয়ারে লালন-পালন করতে বাপের যে খর্চা হইছে সেইটার প্রতীকী মূল্য কইন্যাপণ। কেউ কইন্যাপণ দিয়া মাইয়া নিয়া গেলে তার উপর বাপের আর কোনো অধিকার বর্তায় না। সে হইয়া পড়ে পাত্রপক্ষের মানুষ। পাত্রপক্ষ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে সেই মাইয়ারে নিয়া। অনেকটা মাইয়ারে বেইচা দিবার মতো…

তবে সাময়িক বিবাহে ছোট অংকের কইন্যাপণজাতীয় মূল্য পরিশোধের একটা প্রচলন আছিল। সেইটা কইন্যার বাপ-ভাই-পরিবার পাইত না; সেইটা নিত পাত্রী নিজে…

এইটা অনেকটা ভাড়াটিয়ার বৌর ভাড়ামূল্যের মতো; চুক্তির মেয়াদ শেষ হইবার পর পাত্রী আবার স্বাধীন হইত। তবে চুক্তিকালীন সময়েও পাত্ৰীরে শাসন-টাসন কিংবা অন্য কোথাও বরাদ্দ দিবার অধিকার থাকত না স্বামীর। এইটা মূলত আছিল সন্তান জন্মদানের চুক্তি; সাধারণ বিবাহের মতো ঘর-সংসার করার চুক্তি না…

মারাত্মকভাবে জনসংখ্যার সংকটে আছিল মহাভারত সমাজের মানুষেরা; বিশেষত আর্য ঘরানার পরিবারগুলা। গেরস্থালির লাইগা বিশেষত বেটা মানুষ লাগত প্রচুর কিন্তু শিশু মৃত্যু আর রোগ বালাইয়ে মানুষের মরার হারও আছিল অতি উচ্চ। ফলে প্রতিটা পুরুষের অন্তত একটা পোলা জন্মদান প্রায় বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি যেকোনোভাবে মানবজন্ম; বিশেষত পুরুষজন্মরে স্বাগত জানানোর সংস্কৃতি গইড়া উঠছিল সেইসব সমাজে। একইভাবে পুত্র জন্মাইতে না পারা নারীরেও দেখা হইত অভিশাপের চোখে…

পুত্র জন্ম না দিয়া মইরা গেলে স্বর্গে যাওয়া অসম্ভব; এইটা মোটামুটি ধর্ম বিশ্বাসের মতোই আছিল সেইসব সমাজে…

কিন্তু হেডম ছাড়া বিয়াশাদি করাও কঠিন। মাত্র অল্প কিছু বেটায়ই পারত মাইয়া পটায়া-ভাগায়া উঠায়া কিংবা স্বয়ংবরায় গিয়া বিবাহ করতে। সাধারণ মানুষের মূল বিবাহপন্থাটা আছিল কইন্যাপণ দিয়া বৌ আনা…

আবার কইন্যাপণ দিবার সামর্থ্যটাও আছিল না বহুতের; বিশেষ কইরা তরুণ মুনি-ঋষিগো। একদিকে চালচুলা পয়সাপাতি নাই; অন্যদিকে পোলা জন্মাইতে না পারলে স্বর্গের রাস্তা যেমন বন্ধ তেমনি পুত্রহীন ঋষির পক্ষে বাজারে প্রতিপত্তি জমানোও কঠিন…

ফলে গরিব আর তরুণ ঋষিরা পুত্র জন্মানোর লাইগা বাইছা নিত কম খর্চার সাময়িক বিবাহের পথ।

এই সিস্টেমে বাচ্চা জন্মায়া দিবার লাইগা রীতিমতো মাইয়াগো একটা সম্প্রদায় গইড়া উঠছিল। এদের বলা হইত অপ্সরা…

অপ্সরাগো লগে চুক্তিতে পাত্র-পাত্রীর পরিবারের উপস্থিতি কিংবা অংশগ্রহণের প্রমাণ নাই। পাত্র নিজেই দরদাম কইরা নিতো পাত্রীর লগে…

চুক্তির মেয়াদ নির্ভর করত একেকটা জন্মদানের হিসাবে। মানে তুমি আমারে একটা পোলা জন্মায়া দিবা; এর বিনিময়ে আমি তোমারে দুইটা বা দশটা গরু দিব; লগে দিব এইটা আর সেইটা…

চুক্তির শর্ত শেষ হইবার পর একই অপ্সরা দিয়া আরেক বাচ্চা পয়দা করতে হইলে চুক্তি নবায়ন লাগত। আর চুক্তি নবায়ন না হইলে অপ্সরা আবার অন্য কারো কাছে যাইত ভাড়া খাটতে…

এই সিস্টেমেই অপ্সরা ঘৃতাচীর গর্ভে পোলা শুকদেবের জন্ম দেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন… তবে মুনিঋষি ছাড়া গেরস্থগোও মাঝে মাঝে অপ্সরার গর্ভে বাচ্চা জন্মাইতে দেখা যায়। তেমনই একটা উদাহরণ হইল ভীষ্মের জন্মঘটনা…

বেশিরভাগ কাহিনীমতে ভীষ্মের মা গঙ্গাও আছিলেন একজন অপ্সরা। কোনো একটা কারণে বাচ্চা টিকাইতে পারত না রাজা শান্তনু। ফলে এক বাচ্চার চুক্তি কইরা গঙ্গারে পরপর আটটা বাচ্চা জন্মাইতে হয়। পয়লা সাতটাই মরে শান্তনুর হাতে; পরে ক্ষেইপা শান্তনুরে আর আট নম্বর পোলা দেবব্রত বা ভীষ্মরে ছুঁইতেও দেয় না গঙ্গা। নিজেই নিয়া গিয়া বড়ো কইরা বাপের কাছে পাঠায়…

অন্য কাহিনীমতে শান্তনুর লগে গঙ্গার আনুষ্ঠানিক বিবাহ হয়। পয়লা সাত পোলা মরে। অষ্টম পোলা জন্মের পর সে শান্তনুরে তালাক দিয়া পোলা নিয়া বাপের বাড়ি চইলা যায়। পরে পোলায় বড়ো হইয়া বাপের কাছে আসে…

উপাখ্যানগুলার বিবরণমতে এইটাই মহাভারতে একমাত্র তালাকের ঘটনা; যেইখানে স্ত্রী স্বামীরে তালাক দিছে বা ত্যাগ কইরা গেছে। মহাভারতের কাহিনীগুলাতে অন্য কোনো তালাকের ঘটনা আমার স্মৃতিতে নাই…

অবশ্য রামায়ণে স্বামীরা স্ত্রীরে তালাক দিবার অন্তত তিনটা ঘটনা আছে। আবার তালাক দেওয়া বৌ নিয়া ঘর করারও উদাহরণ আছে… রামায়ণে কেকয়রাজ অশ্বপতি তার পোলা মাইয়া যুধাজিৎ আর কৈকেয়ীরে রাইখা দিয়া বৌ তালাক দেন। এর পরে কৈকেয়ীর মায়ের আর পোলামাইয়ার লগে দেখা করারও কোনো ঘটনা পাওয়া যায় না…

অশ্বপতির মাইয়া কৈকেয়ীরে রাজা দশরথ পুত্রসমেত ত্যাগ করেন প্রকাশ্যে। কিন্তু এর পরে দশরথ যান মইরা; কৈকেয়ীর পুত ভরত হয় রাজা ফলে কৈকেয়ীরে আর অযোধ্যা ত্যাগ করতে দেখা যায় না; বরং দশরথের বিধবার মর্যাদা নিয়াই কৈকেয়ী অযোধ্যায় থাকে। যদিও দশরথ তার তালাক প্রত্যাহার করেন নাই…

রাম পয়লা লঙ্কায় সীতারে তালাকের ঘোষণা দেয় কিন্তু হনুমান আর বিভীষণ সীতারে আবার রামের কাছে গছায়া দেয়। আর রামও হাসতে হাসতে বৌ নিয়া বাড়ি আইসা ঘরসংসার করে। কিন্তু পরে তারে দ্বিতীয়বার তালাক দিবার পর আর ঘরে তোলে না…

মহাভারতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন স্বামী-স্ত্রীর অনেক উদাহরণ থাকলেও শান্তনু-গঙ্গা ছাড়া তালাক হওয়া বা সম্পর্ক ছিন্ন স্বামী-স্ত্রীর অন্য কোনো উদাহরণ নাই…

দ্রৌপদী ছাড়া পঞ্চপাণ্ডবের সবারই সংসার করার লাইগা অন্তত একটা কইরা বাড়তি বউ আছিল। এই বৌরা তাগো লগেই ইন্দ্রপ্রস্থ বা হস্তিনাপুর থাকত। কিন্তু এর বাইরে সংসার না করা বৌ অর্জুনের আছিল দুইটা; ভীমের একটা…

ভীমের সংসার বিচ্ছিন্ন বৌ হিড়িম্বা কিংবা অর্জুনের সংসার বিচ্ছিন্ন দুই বৌ উলুপী আর চিত্রাঙ্গদা থাকত তাগো বাপের বাড়ি। কিন্তু বৈবাহিক বা পারিবারিক সম্পর্ক ছিন্ন হয় নাই তাগো। রাজসূয় যজ্ঞের সময় পাণ্ডবগো নয় বৌরেই বিশেষ রাজকীয় আসনে আইসা বসতে দেখা যায়। এর মাঝে বংশের পয়লা বউ হিসাবে ভীমের সংসার বিচ্ছিন্ন বৌ হিড়িম্বারে কুন্তী নিয়া বসায় সকলের মধ্যিখানে… কারো কারো যুক্তিতে পাণ্ডব পরিবারে পয়লা বিবাহ আছিল যুধিষ্ঠির-দেবীকার। যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের যুবরাজ থাকতেই নাকি এই বিবাহ হয়। কিন্তু পরিবারের বড়ো বৌ হিসাবে হিড়িম্বারে কুন্তী নিজে আইনা নয়জন বৌর মাঝখানে বসানোর ঘটনায় মনে হয় পাণ্ডব পরিবারে দেবীকার বড়ো বৌ হইবার দাবিটা ঠিক না। হিড়িম্বাই পাণ্ডব পরিবারে পয়লা বৌ। হিসাবে বরং কয় ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা হইবার পরেই বরং স্বয়ংবরায় গিয়া দেবীকারে বিবাহ করে অলরেডি বিয়াইত্তা যুধিষ্ঠির…

সেই কালে বিবাহ যে প্রকারেই হউক না ক্যান; নারীরা স্বামীর সম্পত্তি বইলাই গণ্য হইত; যেই কারণে যুধিষ্ঠির সম্পত্তি বিবেচনায় দ্রৌপদীরেও ধইরা বসে জুয়ার দানে; যেইটা নিয়া কোনো প্রশ্নও উঠায় না দ্রৌপদীর বাপ-ভাই…। একই কারণে কুরুযুদ্ধের আগে কর্ণরে পটাইতে গিয়া কৃষ্ণ বলছিল পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিলে সেও দ্রৌপদীর ভাগ পাবে। মানে দ্রৌপদীর স্বামীপক্ষ হিসাবে এগারো সন্তানের মায়েরেও কৃষ্ণ আরেক বেটার বিছানায় বরাদ্দ দিবার অধিকার রাখত…

বাপের বিবাহের লাইগা ভীষ্মের পয়লা ঘটকালিতে দেখা যায় সকল শর্ত চাপাইতেছে পাত্রীপক্ষ আর জি হ ঠিক ঠিক কইয়া পাত্রপক্ষ সব মাইনা নিতাছে বিনাতর্কে। সত্যবতীর মাইমল বাপ বুইঝা ফালাইছিল রাজা শান্তনু তার মাইয়ার পাঁকে পইড়া গেছেন আর শান্তনুপুত বাপেরে কথা দিয়া আসছে যেমনে হউক এই মাইয়ার লগে বিবাহ ঠিক কইরা দিব তার…

স্বয়ং রাজায় পাঠাইছে বিবাহ প্রস্তাব তাই সত্যবতীর বাপ কইন্যপণ নিয়া বেশি কথা না বইলা চাপাইতে থাকে ভবিষ্যতের শর্ত; তার মাইয়ার গর্ভের পোলাপানরে রাজা বানাইতে হবে। ভীষ্ম কয় ঠিকাছে আমি রাজা হমু না। তোমার নাতিরাই হবে। মাইমল কয়-  তুমি ঠিকাছে কইলে হবে না। কয়দিন পর তুমি বিবাহ করবা; তখন তোমার পোলাপান করব গ্যাঞ্জাম। ভীষ্ম কয়-  ঠিকাছে তাইলে আমি আর বিয়াই করব না। এইবার রাজি হও…

এইটা পরিষ্কার যে এইখানে খেলার বলটা পাত্রীপক্ষের নাগালে আছিল দেইখা মাইমলে খেলাইছে দারুণ। তবে বিবাহ নিয়া দরদামের ঘটনা আস্তা মহাভারতে কিন্তু এইটাই একমাত্র। আর কোনো ক্ষেত্রেই বিবাহের আগে শৰ্তমর্ত নিয়া কোনো কথাবার্তা পাওয়া যায় না কোথাও…

রামায়ণে শর্তের ঘটনা আছে একটা। কেকয়রাজ অশ্বপতি মাইয়া বিয়া দিবার আগে দশরথরে শর্ত দিছিলেন তার মাইয়ার গর্ভজাত পোলা সিরিয়ালে যত নম্বরেই থাকুক না ক্যান; তারেই বানাইতে হবে অযোধ্যার পরবর্তী রাজা। এই শর্তের কারণেই দশরথের বড়োপোলা রামের সিংহাসন দাবি থাকে না অযোধ্যায়; বৈধ দাবিদার হয় ভরত…

ভীষ্ম দ্বিতীয় ঘটকালিটা করেন তার ছোট ভাই সত্যবতীপুত্র বিচিত্রবীর্যের লাইগা। এইখানে কোনো কথাবার্তা নাই। সরাসরি কাশীরাজের বাড়িতে গিয়া তার তিন মাইয়ারে উঠায়া আইনা কন- আমার ছোট ভাইরে তুমগো বিয়া করা লাগব…

মাইয়া ধইরা আইনা বিয়া করার আরো ঘটনা আছে মহাভারতে। এর মাঝে আলোচিত অন্যটা হইল রুক্ষ্মিণীরে উঠায়া কৃষ্ণের বিবাহ; যদিও কেউ কেউ রুক্ষ্মিণীরে কৃষ্ণের প্রেমিকা বানায়া মাইয়া ছিনতাইর দায় থাইকা কৃষ্ণরে সাফাই দিতে চান…

বিচিত্রবীর্যের বিবাহ আয়োজনের ঘটনায় একটা ভিন্ন রীতির উপস্থিতি পাওয়া যায় মহাভারত সমাজে। সেইটা হইল বিবাহে পাত্রীর আপত্তি করার অধিকার…

ভীষ্ম উঠায়া আনেন কাশীরাজের তিন মাইয়া। এর মাঝে বড়ো কইন্যা অম্বা বিচিত্রবীর্যরে বিবাহ করতে অস্বীকার যায়। তারে জোর কইরা ধইরা আনলেও; বিচিত্রবীর্যরে বিবাহ করতে কেউ তার উপরে জোর খাটায় না; তারে ছাইড়া দেওয়া হয়…

আবার পাত্রের পক্ষে বিবাহে অস্বীকৃতি জানানোর ঘটনাও অম্বার কাহিনীতেই পাওয়া যায়। ভীষ্ম ছাইড়া দিবার পর অম্বা ফিরা যায় তার প্রেমিক শান্বর কাছে। কিন্তু ভীষ্ম তারে ছুঁইছে এই দোহাই দিয়া বিবাহে আপত্তি জানায় শাল্ব। এই আপত্তির লাইগা শাল্বর উপর অম্বারে জোরাজুরি করতে দেখা যায় না। তবে অম্বা বিয়ার লাইগা জোরাজুরি করে ভীষ্মরে…

শাল্বর কাছ থিকা ফিরা আইসা অম্বা ভীষ্মরেই প্রস্তাব দেয় তারে বিবাহ করতে। ভীষ্ম বিবাহ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে না; বরং নিজের কুমারব্রতের কথা জানায়া বিবাহে অপারগতা প্রকাশ করে। এইখানে বিয়াতে রাজি করানোর লাইগা জোরাজুরির ঘটনাও ঘটে। অম্বা ভীষ্মরে খালি চাপাচাপিই করে না; বিবাহে রাজি করাইতে এক পর্যায়ে সে লোকলস্কর নিয়া ভীষ্মের লগে রীতিমতো লাঠালাঠি করে। শেষে ভীষ্মের লগে কুলায়া উঠতে না পাইরা আত্মহত্যা করে সে…

বিবাহের লাইগা ভীষ্মরে অম্বার জোরাজুরিটা প্রচলিত রীতির চাইতে জেদ বা ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টাই বেশি মনে হয়। রীতি অনুযায়ী অম্বা চাপাচাপি করলে শাল্বরে করার কথা। কিন্তু সে সেইটা না কইরা করে ভীষ্মরে। হয়ত তারে উঠায়া আইনা জীবন ছানামাখা কইরা দিবার কারণ অম্বার সকল রাগ গিয়া পড়ে ভীষ্মের উপর। ভীষ্মের উপর অম্বার সেই রাগের ঘটনা নিয়া পরে বহুত কাহিনীও তৈরি হইছে মহাভারতে…

রামায়ণে এর উল্টা একটা ঘটনা আছে। সেইখানে পুরুষ নারীরে চাপাচাপি করে বিবাহের লাইগা।

সীতারে উঠায়া আনার পর দেখা যায় রাবণ তারে চাপাচাপি করতে আছে বিবাহের লাইগা…

কাশীরাজের অন্য দুই মাইয়া অম্বিকা আর অম্বালিকার বিবাহে কোনো আপত্তি না থাকায় বিচিত্রবীর্যের লগে তাগো বিবাহ হয়; এই দুই বইন ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডুর মা…

এর দুই প্রজন্ম পরে বিবাহে কইন্যার আপত্তির আরেকটা উদাহরণ পাওয়া যায় দ্রৌপদীর স্বয়ংবরায়। সেই স্বয়ংবরায় বহু জাতের বহু কিছিমের প্রার্থী থাকলেও কর্ণরে বিবাহ করতে অনিচ্ছার কথা দ্রৌপদী প্রকাশ্যে ঘোষণা করে। ফলে প্রতিযোগিতা থাইকা কর্ণ বাদ যায়। এইটা নিয়া তখন কাউরে কোনো হাউকাউ করতে দেখা যায় না। মনে হয় কোনো এক উপায়ে কইন্যার এই অধিকারটা স্বীকৃতি আছিল তখন…

চিরকুমার ভীষ্ম তৃতীয় প্রজন্মে ঘটকালি করেন তিনখান। একখান বড়ো ভাতিজা ধৃতরাষ্ট্রের লাইগা; একখান ছোট ভাতিজা পাণ্ডুর লাইগা। আরেকখান বিদুরের লাইগা; ভীষ্ম অবশ্য বিদুররে ভাতিজা গণ্য না কইরা গণ্য করতেন বিচিত্রবীর্যের দাসীপুত্র হিসাবে…

ভাতিজা ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহের লাইগা ভীষ্ম গান্ধারীর বাপ সুবলের কাছে দৃশ্যত বেশ আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব নিয়া যান। কিন্তু লগে নিয়া যান সেনাবাহিনী…

বিয়ার প্রস্তাব দিতে সেনাবাহিনী নিয়া যাওয়া বেশ বিকট। ভীষ্ম জানতেন তার আন্ধা ভাতিজার লাইগা সুবলে মাইয়া দিতে রাজি হইব না। তাই মূলত ধামকি দিয়াই সুবলরে বিয়াতে রাজি করান ভীষ্ম। কোনো কোনো কাহিনীমতে সুবলরে বাইন্ধা থুইয়া মাইয়ার বিবাহে রাজি করান ভীষ্ম…

শান্তনু পরিবারে ভীষ্মের তিন প্রজন্মের ঘটকালির ঐতিহ্য ভাইঙা ফালায় পাণ্ডু। নিজে নিজে স্বয়ংবরায় গিয়া নিয়া আসে কুন্তীরে। ভীষ্ম ক্ষ্যাপেন। পরে যখন দেখা যায় কুন্তীর ঘরে বাচ্চাকাচ্চা হয় না; তখন তিনি আবার পাণ্ডুর দ্বিতীয় বিবাহের ঘটকালির দায়িত্ব নিজে নিয়া নেন। আইনা হাজির করেন মাদ্রীরে…

মাদ্ৰীরে কিন্তু ভীষ্ম পয়সা দিয়া কিনা আনেন তার ভাই শল্যর কাছ থিকা। কারণ কইন্যাপণ নিয়াও পাণ্ডুর ঘরে মাইয়া দিতে রাজি হয় নাই কেউ…

কুন্তীর বিবাহপূর্ব সন্তান কর্ণের কথা মোটামুটি সকলেই জানত। পাণ্ডুর ঘরে কুন্তীর বাচ্চা না হওয়ার মূল কারণ যে পাণ্ডুর আটকুরামি সেইটা বুঝত সকলেই। ফলে নিশ্চিত আটকুরার ঘরে মাইয়া বিবাহ দিতে রাজি হয় নাই কেউ। বরং বহুত টেকা পয়সা নিয়া বইনরে বেইচা দেয় মদ্ররাজ শল্য…

শল্যের নীতি-নৈতিকতার মান আছিল নিচা। খালি টেকার লাইগা আটকুরার কাছে বইন বেইচা দেওয়ার ঘটনাই না; বরং কুরুযুদ্ধে সে আসছিল পাণ্ডবদলে যোগ দিয়া ভাইগ্নাগো পক্ষে যুদ্ধ করতে।

আইসা দেখে এগো পয়সা পাতি নাই; উল্টা দিকে দুর্যোধন দেখাইছে বেশি পয়সার লোভ; ব্যাস সে চইলা গেছে ভাইগ্নাগো শক্রশিবির কুরুপক্ষে…

গড় হিসাবেই মনে হয় মদ্র লোকজনরে কিছুটা খাইস্টা কিসিমের ভাবত অন্যরা। যেই কারণে কুরুযুদ্ধের শেষ দিকে আস্তা জাতবংশ তুইলা শল্যরে ধুমায়া গাইলাইতে দেখা যায় কর্ণের…

তবে পয়সা দিয়া কিনা আনলেও মাদ্রী কিন্তু দাসী আছিল না। পাণ্ডুরাজার স্বাধীন বৌই আছিল সে…

অন্য কোনো বিবাহের ক্ষেত্রে জাতপাত মানার ঘটনা না থাকলেও বিদুরের বিবাহে দেখা যায় ভীষ্ম জাতপাত গুনতেছেন…

বিদুরের মা আছিলেন পাণ্ডুর দাসী। এই কারণে বিদুর দাসীপুত্র হিসাবেই গণ্য। বিদুর কুরুরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হইলেও বিবাহের সময় ভীষ্ম তার লাইগা পাত্রী ঠিক করেন রাজা দেবকের শূদ্রা স্ত্রীর গর্ভজাত মাইয়া…

এই ঘটনা মহাভারতে কোন স্তরের সংযোজন ঠিক নিশ্চিত না। কারণ ভীম-অর্জুন দুইজনেই সরাসরি রাক্ষস নামে পরিচিত স্থানীয় শূদ্রেতর শ্রেণিতে বিবাহ করে। সত্যবতীও একজন শূদ্ৰাণি; সেইগুলাতে সমস্যা দেখা যায় না। কিন্তু বিদুরের লাইগা ক্যান বাইছা বাইছা শূদ্রকইন্যা আনা হইল বুঝি নাই…

মহাভারতে জাতপাতের বিষয়টা এক্কেবারে গুজামিল কইরা ঢোকানো। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে ভীষ্মের মুখ দিয়া শ্রেণি বিভাজনের যেই সূত্রগুলা বাইর করা হইছে; সেই সূত্র অনুযায়ী ভীষ্মর নিজের ক্ষত্রিয়ত্ব বাতিল হইয়া হইবার কথা উগ্র নামে একটা নিচু জাতের মানুষ। কৃষ্ণের ক্ষত্রিয় না হইয়া হইবার কথা সূত; মানে যেই সূত জাতীয় পরিচয়ের লাইগা কর্ণরে অপমানিত হইতে হইছে বারবার…

ভীষ্মের বিবরণমতে বাপ ক্ষত্রিয় আর মা ব্রাহ্মণ হইলে পুত হয় সূত। কৃষ্ণের পূর্বপুরুষ যদ্দুর বাপ যযাতি ক্ষত্রিয় আর মা দেবযানী ব্রাহ্মণ; সেই হিসাবে যদ্দুর বংশধর কৃষ্ণ সূতজাতীয় মানুষ…

আবার যযাতির ছোটপোলা পুরু হইল শান্তনু বংশের পূর্বপুরুষ। পুরুর বাপ ক্ষত্রিয় আর মা শর্মিষ্ঠা শূদ্রেতর রাক্ষসবংশজাত নারী। সেই হিসাবে শান্তনুপুত্র ভীষ্মের বয়ানমতে যযাতি-শর্মিষ্ঠার বংশধর হইবার কারণে তার নিজেরই জাত নাইমা যায় নিচে…

দাসীপুত্র হইবার কারণে মহাভারতে দুইটা মানুষরে বেশ লঘুতুচ্ছ হইতে দেখা যায়। এর একজন বিদুর আর আরেকজন ধৃতরাষ্ট্রের পুত যুযুৎসু…

কর্মের দিক দিয়া বিদুর কুরুরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী; ক্ষত্রিয় পদ। আবার বিদ্যায় বিদুর ঋষিতুল্য; ব্রাহ্মণ মর্যাদা পাইবার দাবিদার। বাপের দিক দিয়া মহাঋষি দ্বৈপায়নপুত্র; কিন্তু কী কারণে যেন তার শূদ্র পরিচয়টা কোনোদিনও মোছে নাই…

ধৃতরাষ্ট্রের দাসীগর্ভজাত পুত্র যুযুৎসু। যোগ্যতার দিক দিয়া মহারথ মর্যাদার যোদ্ধা। কিন্তু খালি মায়ের দিক দিয়া শূদ্রাণীপুত্র হইবার কারণে এই ক্ষত্রিয় যোদ্ধারে গণ্য করা হইত শূদ্র হিসাবে। এই জ্বালায় সে কুরুযুদ্ধকালে আইসা যোগ দেয় পাণ্ডবপক্ষে। শেষককালে শিশু পরীক্ষিৎরে অভিষিক্ত কইরা পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানে যাবার পর বহু বছর পাণ্ডব রাজ্যের তত্ত্বাবধায়কও আছিল এই যুযুৎসু। কিন্তু তার শূদ্র পরিচয় খণ্ডায় নাই…

কিন্তু খালি দাসীপুত্র হিসাবে কাউরে ছোটজাত হিসাবে গণ্য করা হইলে ভীষ্মগো পূর্বপুরুষ পুরুরও ছোটজাত গণ্য হইবার কথা। পুরুর মা শর্মিষ্ঠা খালি রাক্ষসবংশজাতই না; বরং আছিল রাজা যযাতির বৌ দেবযানীর দাসী। সেই হিসাবে ভীষ্মসহ পুরা কুরু-পাণ্ডবই দাসীগর্ভজাজতের বংশধর…

শুকদেব-ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ড-বিদুর চাইরজনই কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের ঔরসজাত সন্তান। আজব বিষয় হইল একই দ্বৈপায়নের পোলাগো মাঝে শুকদেব ব্রাহ্মণ; ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডু ক্ষত্রিয় আর বিদুর শূদ্র…

অনেকে বলেন সেইকালে কর্মের উপর ভিত্তি কইরা শ্রেণি নির্ধারণ হইত। সেইটা দ্বৈপায়নের ক্ষেত্রে হইছে; শূদ্রাণীর সন্তান কর্মগুণে ব্রাহ্মণ। শুকদেব চতুর্বেদী ঋষি; ব্রাহ্মণ ঠিকাছে। কর্ণরে পয়লা শূদ্র বলা হইলেও যখন দুর্যোধন তারে অঙ্গরাজ্যের রাজা ঘোষণা করে; তার পর থাইকা তারে ক্ষত্রিয় গণ্য করা হয়; ঠিকাছে। কিন্তু এই কর্মগুণে শ্রেণি নির্ধারণের বিষয়টা কোনো এক কারণে বিদুর বা যুযুৎসুর বেলায় প্রযোজ্য হয় নাই…

.

. মহাভারতের পোলাপান

মাইয়ার লাইগা বাপের কিংবা পরিবারের কিছু করার উদাহরণ মহাভারতে মাত্র দুইটা। এর মাঝে একটা দ্রৌপদীর বাপ দ্রুপদের। দৃশ্যত মাইয়ার পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়া ঝাড়ে বংশে উজাড় হয় দ্রুপদ…

কিন্তু কুরুযুদ্ধে দ্রুপদের এই অংশগ্রহণ কতটা তার মাইয়ার লাইগা আর কতটা কুরুরাজ্য-সমর্থিত দ্রোণাচার্যের কব্জা থাইকা তার হারানো অর্ধরাজ্য উদ্ধার করার লাইগা; সেইটা বোঝা মুশকিল…

কারণ দ্রৌপদীরে পাঁচ ভাইয়ে ভাগ কইরা নেওয়া কিংবা তার কোনো অপমান যন্ত্রণায়ই দ্রুপদরে আগাইয়া আসতে দেখা যায় নাই কোনোদিন…

আস্তা মহাভারতে; এবং জানামতে আস্তা ভারতীয় পুরাণে; যে কোনো অবস্থায় মাইয়ার পক্ষে খাড়াইতে দেখা যায় মাত্র একটা বাপরে; তিনি শুক্রাচার্য নামে পরিচিতি ঋষি উশনা…

মাইয়া দেবযানীর আব্দারে তিনি রাজি হইয়া যান শত্রুপক্ষের পুরোহিত বৃহস্পতির পোলা কচরে তার শল্যাবিদ্যা আর এন্টিসেপটিকের ফর্মুলা শিখাইতে। শুক্রাচার্যের এই ফর্মুলাগুলা আছিল মৃতসঞ্জিবনী নামে পরিচিত। শুক্ৰ আছিলেন এক ছোট এক দ্বীপরাজ্যের রাজা বৃষপর্বার পুরোহিত। সেইখানেই তিনি চালাইতেন নিজের যুদ্ধ আর চিকিৎসাবিদ্যার ইস্কুল…

তির-বর্শা-কুড়ালে যুদ্ধের সেইকালে বেশিরভাগ সৈনিকই যুদ্ধের মাঠে লগে লগে মরত না। বরং যুদ্ধে আহত হইয়া ক্ষত বিষয়া মরত গিয়া পরে। শুক্রাচার্য এই ইনফেকশন ঠেকাইবার সূত্র জানতেন। একই লগে শইলে গাঁথা তির-বর্শার ফলা তিনি অপারেশন কইরা বাইর কইরা সৈনিকগো সুস্থ কইরা তুলতে পারতেন। ফলে তিনি যেই পক্ষে থাকতেন সেই পক্ষের যুদ্ধে ফাইনালি মানুষ মরত খুবই কম। পুরাণের ভাষায় তাগো আবার জীবনদান কইরা দিতেন ভার্গব ঋষি শুক্রাচার্য…

অন্যদিকে তার প্রতিপক্ষ; দেবতাগো শল্যবিদ্যা কিংবা এই এন্টিসেপটিকের ফর্মুলা জানা না থাকায় যুদ্ধে আহত বেশিরভাগ সৈনিকই আর টিকত না পরে…

বৃহস্পতি তার পোলা কচরে পাঠান শুক্রের কাছ থিকা এই ফর্মুলা শিখা আসতে। কচ আইসা পটায়া ফালায় শুক্রের মাইয়া দেবযানীরে। আর মাইয়ার আব্দারে শুক্র রাজি হইয়া যান শত্রুপক্ষের প্রতিনিধি করে তার গোপন ফর্মুলা শিখাইতে…

রাজা বৃষপর্বা; এমনকি তার শিষ্যরা পর্যন্ত আপত্তি করে; কিন্তু পাত্তা দেন না শুক্র। তার একটাই কথা-মাইয়ারে আমি কথা দিছি; সুতরাং কচরে মূতসঞ্জিবনী বিদ্যা শিখাইতেই হবে…

শুক্রের কালে কোনো দিক দিয়াই তারে চ্যালেঞ্জ করার কেউ আছিল বইলা মনে হয় না। মাইয়ার এক গোস্বা নিবারণ করতে গিয়া যে রাজ্যে তিনি থাকতেন সেই রাজ্যের রাজকইন্যারে পর্যন্ত নিজের মাইয়ার দাসী বানায়া ফেলার ক্ষমতা আছিল তার…

শুধু মাইয়ায় পাত্র পছন্দ করছে বইলা সমস্ত শাস্ত্রের বিধান অমান্য কইরা তিনি দেবযানীর বিয়া দেন। এই বিষয়ে টু শব্দ করার সাহস করে না কোনো শাস্ত্রকার…

দেবগুরু বৃহস্পতির বৌরে তার ছাত্র সোম ভাগায়া আইনা আশ্রয় নেয় শুক্রাচার্যের কাছে। সোমরে ধরা-মারার লাইগা রীতিমতো যুদ্ধের আয়োজন কইরা বসে দেবতাকূল। কিন্তু সে শুক্রের আশ্রয়ে আছে শোনার পর হাত-পা গুটায়া ফেলে দেবতাকূল; বৌ ফিরত পাইবার লাইগা কান্নাকাটি ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না বৃহস্পতির…

রাজা বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠা দেবযানীর সমবয়েসি এবং বান্ধবী। একদিন কোনো এক কথা কাটাকাটিতে শর্মিষ্ঠা টিটকারি মাইরা দেবযানীরে কয়-  খাটাখাটনি যা করার তা তো করে আমার বাপ। তোর বাপ তো আমার বাপের ঘাড়ে বইসা খায়…

শুক্রের অপমানে দেবযানী কাইন্দা বাপেরে জিগায়- আমি কি তবে এক পরখাউকির মাইয়া? যদি সেইটা হয় তবে অন্য কোথাও চলো যেইখানে তুমি খাটনি দিয়া খাওয়াবা আমারে…

মাইয়ার হাত ধইরা শুক্র গিয়া হাজির হন বৃষপর্বার কাছে- গ্রাম উঠায়া নিতাছি আমি; উস্টা মারি তোমার ভাতে। আমি গেলাম…

এইখানে বইলা যাওয়া ভালো যে আদিতে গ্রাম বলতে স্থির কোনো স্থান বুঝাইত না। বরং একজন ব্রাহ্মণের পরিবার-পরিজন গরুবাছুর দাসদাসী চ্যালা-শিষ্য মিলা যে লটবহর; সেইটারে বলত গ্রাম…

গ্রাম আছিল ভ্রাম্যমাণ। গ্রামপ্রধান ব্রাহ্মণ সেইটারে সুবিধামতো এক জায়গা থাইকা তুইলা অন্য জায়গায় নিয়া বসাইতেন। অথবা বলা যাইতে পারে নিজের গ্রাম নিয়া ঘুইরা বেড়াইতেন ব্রাহ্মণেরা। সম্ভবত এই কারণেই এখন পর্যন্ত যেমন গ্রামের কোনো পরিস্কার সংজ্ঞা নাই তেমনি সীমানা কিংবা বৈশিষ্ট্যের কোনো সাধারণ মানদণ্ডও নাই…

যাউকগা; পোলাপাইনের কাইজায় তার উপর রাগ না করতে বৃষপর্ব কাকুতি মিনতি করেন শুক্রর কাছে। শুক্ৰ কন- আমার মাইয়ারে যদি তুমি খুশি করতে পারো; তবেই তোমার রাজ্যে গ্রাম বহাল রাখব আমি…

রাজা বৃষপর্ব দেবযানীরে জিগান- কী করলে খুশি হইবা তুমি? দেবযানী কয়-  আপনের মাইয়া শর্মিষ্ঠারে আমার দাসী বানায়া দিলে আমি খুশি হব…

বিনা তর্কে রাজা তার নিজের মাইয়ারে পুরোহিতের মাইয়ার দাসী বানায়া দেন। মাইয়া খুশি তো শুক্রও খুশি; গ্রামও নড়ান না; টোলও চালাইতে থাকেন…

এই দিকে দেবযানী পইড়া গেছিল বৃহস্পতির পুত কচের প্রেমে। কিন্তু শুক্রর কাছে বিদ্যাশিক্ষা শেষ হইবার পর কচ দেয় ভাগল। ফলে রীতিমতো পুরুষ-পাগলি হইয়া উঠে ছ্যাকা খাওয়া দেবযানী…

এর মাঝে একদিন শিকারের কালে রাজা যতাতিরে দেখে দেবযানী। যযাতি তখন খুবই প্রতাপী রাজা; বিবরণমতে সুপুরুষও বটে। সোজা গিয়া দেবযানী তারে কয়-  আমারে বিবাহ করো…

দেবযানীর পরিচয় শুইনা শইলের লোম খাড়ায় যযাতির। পয়লা কথা ক্ষত্রিয় হইয়া ব্রাহ্মণ কইন্যা বিবাহ নিষিদ্ধ; বিধানমতে ক্ষত্রিয়গো কাছে ব্রাহ্মণ কইন্যা মায়ের সমান। এই রকম কিছু ঘটাইলে সিংহাসন টইলা উঠব তার…

আবার অন্যদিকে শুক্রের মাইয়ারে ক্ষ্যাপাইলে কপালে কী গর্দিশ নাজেল হয় কে জানে। তাই পিছলা বুদ্ধি করে যযাতি। সে দেবযানীরে কয়-  এই বিষয়ে আমি শুক্রাচার্যরেই সালিশ মানলাম। তিনি যা কন তাই হবে…

শুইনা শুক্ৰ কন- আমার মাইয়ায় তোমারে পছন্দ করেছ। এইখানে আবার কথা কীসের? তুমি তারে বিবাহ করো। যযাতি মিনমিনায়- আচার্য ধর্মের বিধান যে বাধা দেয়। শুক্র ধামকি লাগান-ধর্মের বিধান কি আমার থাইকা বড়ো?

যযাতি দেবযানীরে বিবাহ করায় বিধানমতে দেবযানীর দাসী শর্মিষ্ঠার লগেও যৌনতার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় তার। কিন্তু শুক্র শাসায়া দেন যযাতিরে-ওর দিকে নজর দিবা না কলাম…

এই দিকে জনসংখ্যা আকালের যুগে প্রতিটা নারীর প্রতিটা ঋতুস্রাবরে গণ্য করা হইত একেকটা জন্মের সম্ভাবনা হিসাবে। ঋতুমতি কোনো নারী কোনো পুরুষের কাছে আইসা সন্তানের বীজ চাইলে যদি পুরুষ সেইটা ফিরায়া দিত তবে বলা হইত মরার পরে নির্ঘাত নরকে হইব তার গতি…

ফলে শর্মিষ্ঠা ঋতুবতী হইলে বিধানমতে এর প্রতিকার চায় যযাতির কাছে। আর যযাতিও দেবযানীরে লুকায়া পুরুসহ দুইটা পোলা জন্মায় শর্মিষ্ঠার গর্ভে…

এই সংবাদ শুইনা শুক্র যযাতির উপর ক্ষেপলেও পরে তিনিই শর্মিষ্ঠারে দাসত্ব থাইকা মুক্তি দিয়া যযাতিরে বলেন তারেও রানির মর্যাদা দিতে…

শর্মিষ্ঠার গর্ভে দুই পোলা আর দেবযানীর গর্ভে দুই; মোট চাইর পোলার বাপ আছিলেন যযাতি। অসুখের কালে বড়ো তিন পোলা ঠিকমতো বাপের যত্ন না করায় ক্ষেইপা শর্মিষ্ঠা গর্ভজাত ছোটপোলা পুরুরেই সিংহাসন দিয়া যান যযাতি। এই পুরুরই বংশধর ভীষ্মের বাপ রাজা শান্তনু…

শুধু মহাভারত না; আস্তা ভারতীয় পুরাণের অন্য কোথাও মাইয়ার আব্দার মিটাইবার লাইগা বাপের পুরা ধর্ম এবং রাজশাসনের বিরুদ্ধে খাড়াইবার এমন দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ আমি পাই নাই…

মাইয়ারা বরং অনেকটা বিনিময়যোগ্য সম্পদের মতোই গণ্য হইত। কুন্তীরেও তার বাপে ছোটবেলা দোস্তর বাড়িতে দান কইরা দেয়। কোনো কারণ ছাড়াই। আবার অবলীলায় শত্রুপক্ষেও মাইয়া দিয়া দিবার ঘটনা আছে। দুর্যোধনের মাইয়া লক্ষ্মণার বিবাহ হয় কৃষ্ণের পোলা শাম্বর লগে। কুরুযুদ্ধে সে শ্বশুরের বিপক্ষেই যুদ্ধ করে; আবার ভীমের হাতে মরা জরাসন্ধের মাইয়া করেণুমতি আছিল নকুলের বৌ…

কোনো এক অদ্ভুত কারণে স্বামীপক্ষের লগে পিতৃপক্ষের বিরোধে কোনো কথা কইতে দেখা যায় না মহাভারতীয় নারীদের। আস্তা ভারতীয় পুরাণে সম্ভবত শুধু শিবের বৌ সতী স্বামীরে শ্বশুরবাড়ি নিমন্ত্রণ খাইতে না ডাকায় বাপের লগে কাইজা করছিল…

মহাভারতে মা-পুতের সম্পর্কের কড়া উদাহরণ আছে দুইটা। এর একটা কুন্তীর পরিবার; আরেকটা সত্যবতী-দ্বৈপায়নের সমীকরণ…

কুন্তীরে আগাগোড়াই তার পোলাগো কেয়ার করতে দেখি। বুড়া বয়স পর্যন্ত কুন্তী তাগোরে আগলাইয়া রাখে। যুদ্ধের আগে যখন কুন্তীর পোলাগো নাতি নাতনি পর্যন্ত হইয়া গেছে তখনো তারে দেখি পোলাগো জীবন বাঁচাইতে কর্ণের কাছে গিয়া মিনতি করতে…

কিন্তু কোনো এক কারণে পোলারা রাজা হইবার পর কুন্তী তাগো লগে থাকে না। সে থাকে হস্তিনাপুর তার শ্বশুর বাড়িতে। এমনকি শেষ বয়সে পোলাগো থুইয়া সে ধৃতরাষ্ট্র আর বিদুরের লগেই বানপ্রস্থে গিয়া মরে…

কুন্তীর আরেকটা বিষয় বেশ বিস্ময়কর। তার পোলাগো শত্রুতা ধৃতরাষ্ট্রপক্ষের লগে থাকলেও সে আগাগোড়াই বসবাস করে ভাসুর ধৃতরাষ্ট্রের হস্তিনাপুর রাজবাড়িতে। এইখানে বইসাই সে পোলাগো পক্ষে কাজ করে। এইটা নিয়া কুন্তীর নিজের যেমন কোনো মানসিক বিকার দেখা যায় না; তেমনি তারে কেউ কোনো খোটা দিতেও দেখা যায় না…

এই রকম একটা পরিস্থিতি রামায়ণেও আছে। বিভীষণ রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কিন্তু তার বৌ সরমা আগাগোড়াই স্বাধীন-সাবলীল মানুষ হিসাবে থাকে ভাসুর রাবণের বাড়িতে…

বর্তমান নৈতিকতায় শত্রুতা আর না-শত্রুতার এই সমীকরণগুলা মিলানো কঠিন। হইলে হইতে পারে নারীরে কেউ গণায় ধরত না দেইখা কুন্তী কিংবা সরমার শত্রুপক্ষে থাকারে পাত্তা দেয় নাই কেউ। আবার এমনো হইতে পারে যে শ্বশুর বাড়িতে থাকা বিবাহিত নারীর স্বাভাবিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত আছিল যার লাইগা এই বিষয়ে প্রশ্ন উঠায় নাই কেউ। আবার হইলে হইতে পারে সেইসব সমাজে শত্রুতার নৈতিকতাগুলা এমন আছিল যে স্বামী বা পোলার লগে শত্রুতা থাকলেও মা কিংবা বৌরে শত্রু ভাবত না কেউ; যদিও এইটা প্রকাশ্যই আছিল যে কুন্তী ধৃতরাষ্ট্ররে ক্ষমতাচ্যুত করতে কাজ করতেছে আর সরমা সক্রিয়ভাবেই যুক্ত আছে রাবণরে টাইনা নামানোয়…

তবে স্বামীরে কাবু করার লাইগা বৌ ধর্ষণের ঘটনা নারায়ণী উপাখ্যানগুলাতে পাওয়া যায়। কাহিনীমতে স্বয়ং নারায়ণ জলন্ধর নামের এক অসুররে কাবু করতে তার বৌ বিন্দারে ধর্ষণ করেন…

একইভাবে স্বামীরে কাবু করতে বৌরে আক্রমণের একটা ঘটনা আছে রামায়ণে। রাবণরে উদভ্রান্ত কইরা তুলতে হনুমান রাবণের বৌ মন্দোদরীরে প্রকাশ্যে লাঞ্ছনা করে; কোনো কোনো কাহিনীমতে মন্দোদরীরে ধর্ষণ করে হনুমান…

মহাভারতে মাতৃত্ব-পিতৃত্ব কিংবা মা বাপের লাইগা সন্তানের আবেগ কিংবা পোলাপানের লাইগা মা বাপের আবেগের বিষয়গুলা খুব কমই উপস্থিত। দুর্যোধনের প্রতি ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষপাত বাপ হিসাবে খুবই পরিষ্কার কিন্তু আবেগটা সেইখানে নাই; স্নেহ আছে; প্রশ্রয় আছে; সমর্থন আছে…

মহাভারতের কাহিনীমতে গান্ধারী একশো পুতের জননী। কিন্তু আজব বিষয় হইল গান্ধারী চরিত্রটার ভিতর বিন্দুমাত্র মাতৃত্বের আবেগ নাই। এইটা হইতে পারে ধৃতরাষ্ট্রের একশো পোলার একটাও তার গর্ভজাত না বইলা। আবার কুরুযুদ্ধের শেষে লাশ দেখতে গিয়া গান্ধারী খালি কয়েকটা নাম নিয়া কিছু আনুষ্ঠানিক বিলাপ করেন; কেউ কেউ কন গান্ধারীর মূলত দুযোর্ধন-দুঃশাসনসহ মাত্র পাঁচ ছয়টা গর্ভজাত পোলা আছিল…

গান্ধারী কিন্তু তার কথিত পোলাগো লাইগা যতটা আবেগ দেখান তার চাইতে বেশি আবেগ দেখান কর্ণের লাশ দেইখা। কর্ণের বিচ্ছিন্ন পচাগলা মাথাটা তিনি তুইলা আইনা দেহের পাশে রাখেন। কিন্তু এর বিন্দুমাত্রও আবেগও তিনি নিজের কথিত পুত্রগো লাইগা দেখান না…

কর্ণের লাইগা কুন্তীর আবেগটা গর্ভধারিণীরই আবেগ। কর্ণের লাইগাই কুন্তী শেষ পর্যন্ত রাজবাড়ি ছাইড়া বনে গিয়া মরে। কর্ণের শেষকৃত্যের লাইগা সে টেকা চাইছিল; কিন্তু পাণ্ডবগো অর্থমন্ত্রী ভীম সেইটা দিতে রাজি হয় নাই; এইটাই কুন্তীর রাজবাড়ি ছাইড়া দিবার সিদ্ধান্তের কারণ…

সম্পর্কের আবেগের দিক দিয়া কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন অনন্য। মা কিংবা সন্তানদের গর্ভধারণীগণ কিংবা পোলাগো লাইগা তার দায় মিটানো আগাগোড়াই মানবিক আবেগে ভরপুর…

মহাভারতে সবচে ব্যক্তিত্ববান আর অভিজাত সম্পকটা সত্যবতী আর তার পুত্র দ্বৈপায়নের। কথাবার্তা খুব কম। রাজবাড়িতে মায়ের বিবাহ হইলেও কোনোদিন রাজভোগ খাইতে আসে না পুত। কিন্তু যখনই মায়ের দরকার তখনই গিয়া আগলাইয়া খাড়ায়…

এবং শেষ বয়সে রাজবাড়ির গ্যাঞ্জাম থাইকা সত্যবতীরে নিজের কাছে নিয়া যান দ্বৈপায়ন। তার দুই সন্তানের দুই গর্ভধারিণী অম্বিকা-অম্বালিকারেও শেষকালে নিজের কাছে নিয়া যান দ্বৈপায়ন; মাঝে মাঝে মনে হয় অম্বিকা-অম্বালিকার জীবনে একমাত্র সম্মানপ্রাপ্তি এই ঘটনাটাই…

পুতের লাইগা দ্বৈপায়নের আবেগের সর্বোচ্চ দেখা যায় যখন শুকদেব নিজের নামে টোল খোলার লাইগা পিতার আশ্রম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। বর্ণনামতে দ্বৈপায়ন জঙ্গলের গাছে গাছে ধইরা বুক ভাসায়া কান্দেন-পুত যাইও না…

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তার মহাভারতের ছয় প্রবীণ পুস্তকে এই ঘটনাটার বড়ো অদ্ভুত একট উপসংহার টানছেন। তিনি কন-বৃদ্ধ পিতার কানের মূল্য বোঝেন নাই বইলাই শেষ পর্যন্ত শুকদেব শুধুই এক চতুর্বেদী ঋষি। আর পুতের বিদায়ে বুক ভাসায়া কানতে পারছিলেন বইলাই দ্বৈপায়ন হইলেন গিয়া মহাকবি…

দ্বৈপায়ন আগাগোড়াই আছিলেন তার পোলাগো পিছে। ঘুইরা ফিরাই দেখা যায় তিনি আইসা উপস্থিত তার লোভী আর আন্ধাপোলা ধৃতরাষ্ট্রর কাছে। আবার রাজনৈতিক গ্যাঞ্জামে রাজ্যহারা মৃত মাইজম পোলার ঘরের নাতিগো বনবাসকালে তিনিই আছিলেন প্রধান আশ্রয়; শিষ্যের বাড়িতে তাগোরে লুকায়া রাখার ব্যবস্থা করা থাইকা দ্রৌপদীর লগে পাঁচ ভাইর বিবাহ সিস্টেম করা সবখানেই দ্বৈপায়ন…

বিদুররে তিনি বরাবরই পুত্র বইলা সম্বোধন করতেন। শেষকালে যুধিষ্ঠিররেও দ্বৈপায়ন মনে করায়া দেন- তুমি কিন্তু বিদুরেরই অংশ…

শ্বশুর হিসাবে পুত্রবধু কুন্তীর বেলাতেও দ্বৈপায়নরে দেখি দায়িত্বশীল। কুরুযুদ্ধ শেষের যজ্ঞে ব্রাহ্মণ হিসাবে তিনি যে টেকাপয়সা পান; সবগুলাই তিনি কুন্তীরে দিয়া দেন। কোনো এক কারণে হয়তো তিনি বুঝতে পারছিলেন যে সম্রাট যুধিষ্ঠিরের কোষাগারে হাত পাততে কুন্তীর ব্যক্তিত্বে লাগবে…

দ্বৈপায়নের এই অনুমান সঠিকই হইছিল শেষ পর্যন্ত। পাণ্ডবেরা রাজকোষ থাইকা কুরুপাণ্ডব অনেকেরই শেষকৃত্য করে। কুন্তী কর্ণের শেষকৃত্য করার প্রসঙ্গ তুললে অর্থমন্ত্রী ভীম কর্ণের লাইগা টেকা দিতে অস্বীকার করে। আর এই একটা ঘটনাতেই রাজমাতা কুন্তী পোলাগো রাজবাড়ি ছাইড়া বনে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়া বসে…

মা-পুতের সম্পর্কের অন্য কিছু উদাহরণ হিড়িম্বাঘটোৎকচের উপকাহিনীগুলাতে পাওয়া যায়; বাকি কাহিনীগুলায় মায়েরা কেমন যেন অনুল্লেখে হারায়া যায় ঘটনার ভিড়ে…

মাতৃভক্তির বিষয়টা ঘটোৎকচের ভিতর খুবই পরিস্কার। পাণ্ডবগো রাজসূয় যজ্ঞে হিড়িম্বার অপমানে ঘটোৎকচ যেমন হামলায় পড়ে তেমনি বনবাসকালে সম্মা দ্রৌপদীরে পর্যন্ত কান্ধে কইরা পাহাড়। পার কইরা দেয় ঘটা…

মা-পুতের আরেকটা ঘটনা হইল ঘটোৎকচ-অহিলাবতীর পোলা ঋষি খাটোশ্যাম বর্বরীকের। মা অহিলাবতী পুতেরে বলছিল সর্বদা দুর্বলের পক্ষে থাকতে; সেই কথা মাইনা বর্বরীক ঋতিমতো ঋষি হারুকি সহায় নামে বিখ্যাত হইয়া উঠছিল…

কাহিনীগুলা পইড়া মনে হয় আর্য ঘরানার পরিবারগুলার চাইতে সম্ভবত অনার্য পরিবারগুলায় মায়ের অবস্থান কিছুটা মর্যাদাময় আছিল পোলাগো কাছে। কুন্তী সারা জীবন পোলাদের পাইলা পুইষা বড়ো করলেও শেষকালে পোলাগো পরিষ্কার অবহেলার শিকার হয় সে…

অম্বিকা-অম্বালিকা মহাভারতের বড়োই নীরব নারী। তাগো গর্ভের সন্তানেরা রাজা-বাদশা কিন্তু তাগো কোনো কথা নাই। একেবারে নীরব। একেবারে নগণ্য মানুষ তারা। এইটার কোনো মানে বুইঝা উঠতে পারি নাই আমি…

মহাভারতে দ্রৌপদী হইল এক স্রোতে ভাসা মানুষ। নিজে কোনো ঘটনারই জন্ম দেয় না; মোড়ও বদলায় না কোনো ঘটনার। কর্ণরে বিবাহ করতে রাজি না; এই কথাটা বলা ছাড়া আস্তা মহাভারতের কোনো ঘটনা সংগঠনেই দ্রৌপদীর প্রায় কোনো অবদান নাই; সবখানে সে থাকলেও; সবখানেই সে স্রোতে ভাইসা যাওয়া নারী…

গর্ভজাত ছয় মাইয়া আর পাঁচ পোলার লগেও দ্রৌপদী-জীবনের কোনো বিবরণ মহাভারতে প্রায় নাই…

কুরুযুদ্ধে পাঁচ পাণ্ডবই পোলাপান হারায়। এর মাঝে ঘটোৎকচ মরায় জেঠা যুধিষ্ঠিররে কিছুটা আবেগি হইতে দেখা যায়; কিন্তু ভীমের তেমন কোনো নড়ন চড়ন নাই। অভিমন্যু মরায় অর্জুন কিছু ঝিমায়; কিন্তু তাও খুবই সামান্য মনে হয়। অন্য পোলাগো মরণে অর্জুনের কোনো বিকার পাওয়া যায় না মহাভারতে… আরো অনেকেরই পোলাপাইন মরে কুরুযুদ্ধে; কিন্তু খুব একটা আবেগ দেখা যায় না কোথাও…

পাণ্ডবগো পোলাপানের হিসাব নিয়া বহুত গড়বড় আছে মহাভারতের কাহিনীগুলায়…

দ্রৌপদীর ঘরে পাঁচ পাণ্ডবের আছিল পাঁচ পোলা; বয়সের দিক দিয়া পয়লা যুধিষ্ঠিরের পুত প্রতিবিন্ধ্য; তারপর ভীমের পুত সুতসোম; তারপর নকুলের পুত শতানীক; তারপর সহদেবের পুত তসেন এবং সর্বশেষ অর্জুনের পুত শ্রুতকর্মা…

এই পাঁচ পোলাই কুরুযুদ্ধ করে আর যুদ্ধের শেষ দিকে অশ্বত্থামার তলোয়ারে ঘুমের মইদ্যে মারা যায়; এগো মরণে বুক চাপড়ায়া কান্দে দ্রৌপদী; এই কাহিনী মোটামুটি মহাভারতের মূল কাহিনীর অংশ; সকলেই জানে… কিন্তু দ্রৌপদী একই লগে আছিল অন্তত পাঁচটা মাইয়ার মা। কারো কারো হিসাবে অর্জুনের ঔরসে তার যমজ মাইয়া জন্মায়; সেই হিসাবে ছয় মেয়ের মা সে; মহাভারতের কাহিনীগুলায় এই মাইয়ারা প্রায় অনুপস্থিত…

দ্রৌপদীর প্রথম সন্তান যুধিষ্ঠিরের ঔরসে জন্মানো মাইয়া সুতনু। সুতনুর বিবাহ হয় কৃষ্ণ-সত্যভামার পোলা ভানুর লগে…

ভীমের ঔরসে দ্রৌপদীর মাইয়া সংযুক্তা। অর্জুনের ঔরসে দ্রৌপদীর মাইয়ার নাম প্রগতি; কেউ কেউ বলেন প্রগতির আছিল প্রজ্ঞা নামে আরেকটা জমজ বইন… নকুলের ঔরসে দ্রৌপদীর মাইয়া প্রিনতা; সহদেবের ঔরসে সুমিত্রা…

সুতনু ছাড়া দ্রৌপদীর বাকি মাইয়াদের অন্য কোনো তথ্যের অস্তিত্ব প্রায় নাই…

দক্ষিণ ভারতীয় কাহিনীমতে দ্রৌপদী-সুভদ্রা-উলুপী-চিত্রাঙ্গদা বাদেও আরো তিনটা বৌ আছিল অর্জুনের। মানে মোট সাতটা বিবাহ করছিল অর্জুন…

সুভদ্রার ঘরে অর্জুনের পোলা অভিমন্যুর কথা সকলেই জানে। সুভদ্রার একটা মাইয়াও আছিল ভার্গবী নামে; যার বিবাহ হয় ভীমের পোলা ঘটোৎকচের লগে…

পাণ্ডবগো বৌদের মাঝে ভীমের বৌ হিড়িম্বা আর অর্জুনের দুই বৌ উলুপী-চিত্রাঙ্গদা থাকত তাগো নিজ নিজ বাপের বাড়ি…

পাণ্ডবগো অন্য বৌদের ঘরেও পোলাপান জন্মাইছিল। যুধিষ্ঠির-দেবীকার পোলা আছিল যৌধেয়। যৌধেয় কুরুযুদ্ধে অংশ নিবার কোনো নিশ্চিত বিবরণ নাই। তবে কুরুযুদ্ধে তার নানা গোবাসন মইরা গেলে নানার সিংহাসনে সে শিবির রাজা হয়…

ভীম-বলন্ধরার পোলা সবগ। হিড়িম্বা আর দ্রৌপদী গর্ভজাত ভীমের দুই পোলা কুরুযুদ্ধে মারা গেলেও সর্বগ কুরুযুদ্ধে যোগ দেয় নাই এইটা নিশ্চিত। তার জীবনী সম্পর্কেও আর কোনো তথ্য নাই…

নকুল-করেণুমতীর পোলা নিরমিত্র আর সহদেব-বিজয়ার পোলা সুহোত্রর নাম পাওয়া যায়…

কুরুযুদ্ধে সুহোত্র কর্ণের হাতে মারা যায়; নিরমিত্রের কুরুযুদ্ধে যোগ দেয়া কিংবা অন্য কোনো সংবাদ বিশেষ নাই…

অন্যদিকে পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানে যাবার আগে অভিমন্যুর পোলা পরীক্ষিৎরে যখন রাজা বানায়া দিয়া যায় তখন তাগো অন্য বৌদের ঘরে জন্মানো পাণ্ডব পোলাপানের সেই রাজ্যে কোনো হিস্যা আছিল কি না তার বিবরণ মহাভারতে নাই…

ভীম-হিড়িম্বার পুত ঘটোৎকচের দুই বৌ নাগকইন্যা অহিলাবতী আর অর্জুন-সুভদ্রার মাইয়া ভার্গবী। অহিলাগৰ্ভজাত ঘটোৎকচের দুই পোলা অঞ্জনপৰ্বা আর বর্বরীকের বেশ বিস্তারিতই পাওয়া যায়; কোনো কোনো কাহিনীমতে তার তৃতীয় পুতের নাম আছিল মেঘবর্ণ…

ভার্গবীর কোনো সন্তানের সন্ধান পাই নাই আমি…

কিছু আখ্যানমতে যুদ্ধজয়ের আশায় কুরুযুদ্ধ শুরুর আগে ঘটোৎকচের ছোটপোলা বর্বরীকরে বলি দেয় কৃষ্ণ; আর কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ কইরা মরে অর্জুন-উলুপীর পোলা ইরাবান; যে কিনা দক্ষিণ ভারতে ইরাবত নামে পরিচিত। অন্য আখ্যানগুলায় দেখা যায় ইরাবান কুরুযুদ্ধ করে না বরং বর্বরীকের স্থলে সেই বলি হইতেছে কৃষ্ণের হাতে…

তবে ঘটনা হইল বর্বরীক আর ইরাবানের পূজা এখনো প্রচলিত আছে; মন্দিরও আছে। বর্বরীক পূজিত ঋষি ও বীর হিসাবে ইরাবান পূজিত বীর ও দেবতা হিসাবে…

অর্জুন-চিত্রাঙ্গদার পোলা বভ্রুবাহন কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ কইরা মরছে এবং যুদ্ধে আসে নাই; দুইজাতের কাহিনীই আছে…

দ্রৌপদী আর সুভদ্রা গর্ভজাত পাণ্ডব পোলপান ছাড়া অন্যরা পরবর্তী জীবনে পাণ্ডবগো পরিচয় দিছে কি না তারও খুব একটা বিবরণ পাওয়া যায় না…

পালক বাপের আদেশে ঋষি দুর্বাসার সেবা করতে গিয়া গর্ভবতী হয় কিশোরী কুন্তী; জন্ম হয় কর্ণের…

কর্ণ তার জন্মঘটনা জানত। কিন্তু নিজেরে সে বরাবরই পরিচয় করাইত সূতবংশজাত পালক মাতা পিতা রাধা-অধিরথের সন্তান হিসাবে। কুন্তীই তারে তেলাইছে ফিরা আসতে কিন্তু কোনোদিনও সে ছাড়তে চায় নাই তার সূত পরিচয়…

কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের জন্মটা হইছে পরাশর দ্বারা সত্যবতী ধর্ষিতা হইবার ফলে। ধর্ষণ শেষে কিশোরী সত্যবতীর হাতে কিছু বখশিশ রাইখা গেছিলেন পরাশর। আর পোলা জন্মের পর তার পড়াশোনার ভার নিছিলেন তিনি…

বাপের টোলে পড়লেও দ্বৈপায়ন পিতার বংশপরিচয় ব্যবহার করেন নাই কোনোদিন। বরং দ্বীপবাসী মায়ের পরিচয়ে দ্বৈপায়ন নামেই নিজেরে পরিচয় করাইছেন গায়ের রংয়ের কারণে কৃষ্ণ নামের এই ঋষি…

মাহবুব লীলেন
জুলাই ২০২০