৫৬.
খাটিয়ায় শুয়ে তাঁবুর পর্দা সরিয়ে একফালি চাঁদ দেখে হানিফ। নিঃসঙ্গ মানুষ প্রকৃতি থেকেও যে সুখ পায়, এমন নয়। সারাদিন যে মানুষ কাজের ভিড়ে অন্য অনেকের মাঝখানে থাকে, রাত হলে তার নিজের কথা মনে পড়ে। তখন সে পর্দা সরিয়ে চাঁদ দেখে, চাঁদ না থাকলে অন্ধকার আকাশের তারা আর ছায়াপথ দেখে হয়ত আরো একাকী হয়ে যায়।
তখন তার দাঙ্গার কথা মনে হয়, মা ও ভাইয়ের মৃত্যুর কথা মনে হয়, মনে হয় বোনের নিখোঁজ হওয়ার কথা। তখন চাঁদ থেকে হিম ঝরে, তারা থেকে বরফের কণা যেন ছিটকে এসে তার গায়ে লাগে। আলো কিংবা অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ যদি কোনো পেঁচা ঝাঁপিয়ে পড়ে মাঠের আলে, কর্কশ চিৎকার করে, তখন তার চমক ভাঙতে পারে।
কিন্তু চাঁদ তাকে আবিষ্ট রাখে। সে আয়নার খাঁড়িতে দেখা জলপরির কথা ভাবে। ভাবতে ভাবতে অদ্ভুত সব পরিকল্পনা করতে থাকে সে, যা তার আয়ত্তের এবং সামর্থ্যের বাইরে। পলবির কথা ভাবতে তার ভালো লাগে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে তার বিষণ্ণ মুখ, তার চিবুকের উপরের উল্কি। একসময় নিজের অজান্তেই সে ঘুমিয়ে পড়ে তারপুর
ঘুম ভেঙে গেলে অন্ধকারে নিজেকে মনে হয় ছায়ার শরীর। এতক্ষণ অন্য কোনো জগতেই সে ছিল। আদিনার মিনা করা সুসজ্জিত মসজিদ, তার পিছনে উঁচু এবং চওড়া মাটির জাঙ্গাল। মসজিদের উপর চঁদ। কোনো মানে হয়? ঠিক যেন ক্যালেন্ডারের ছবি।
সেই জাঙ্গাল, যার অবস্থিতি এখন প্রশস্ত ধানখেত, আর মাঝে মাঝে অকারণ মাটির টিলা, সেই জাঙ্গালই তো! একজন ঘোড়সওয়ার, সে হানিফ নয় কিছুতেই অথচ হানিফ ছাড়া আর কে-ই বা? পাশে যে ইরানি বেদেনি-হলুদ রুমালে বাঁধা চুল, সে তো পলবি নয়। কি আশ্চর্য, স্বপ্ন এমনই বিস্ময়! পলবিই বটে! আদিনার ধ্বংসস্তুপ কোন্ মায়াবলে হয়ে যায় সুসজ্জিত মিনার। দুই ঘোড়া পাশাপাশি হাঁটে, দুই সওয়ারে প্রাণবন্ত প্রেমের সংলাপ বলে।
তারপর উল্টোদিক থেকে ঘড় ঘড় শব্দ আসে। অশ্বারূঢ় হানিফ দেখে জাঙ্গালের উপর দিয়ে রোড রোলার আসছে। খাকি শার্ট, খাকি প্যান্ট পরা ড্রাইভার তো হানিফই বটে। মাডগার্ডের উপর আড় হয়ে বসে কে ও? পলবি? নীলের উপরে সাদা ডুরে পালপাড়ার তাঁতের শাড়ি পরে গেরস্থ মেয়েটি।
ঘুম ভেঙে যায় তার। কী যে মানে হয় এসব স্বপ্নের! তবু দীর্ঘক্ষণ অন্ধকারে ভেসে থাকে বিষণ্ণ ভালো লাগা। বার বার মনে আসে খুন হওয়া মা আর ভাই, নিখোঁজ বোনের কথা। অথচ বাজিকরেরা মুসলমান হবে শুনে সে কেন উল্লসিত বোধ করে না? সে কি এইজন্য যে সে হাজারে হাজারে ছিন্নমূল মানুষকে ওপার থেকে এপারে আসতে দেখেছে? অথবা, সে কি এইজন্য যে শহরের বিজনবাবু, মতিবাবু, শহিদুল ভাই তাকে কিছু বই পড়িয়েছে, কিছু কাণ্ডজ্ঞান দিয়েছে?
এখন আর এরকম মনে হয় না। এখন মনে হয় যে তার বাপ ছিল একজন নির্ভেজাল মানুষ। যেমন গাই-বলদের মুখের মধ্যে একবার হাত ঢুকিয়েই যে তাদের নির্ভুল বয়স বলে দিতে পারত, তেমনি ব্যক্তিজীবন ও জগৎ সম্বন্ধে তার ধারণাগুলোকে অতি দ্রুত সিদ্ধান্তে আনতে পারত সে। এতে তার বিশেষ ভুলও হতো না। কাজেই দাঙ্গার গল্পে যে অর্থ বিভ্রান্ত হয়নি। আবার ওপারে গেলে অনেক বেশি জমি পাবে তার এখানকার অল্প জমির পরিবর্তে, এই লোভের ফাদেও সে পা দেয়নি! শুধু সেইসব অবিশ্বাস্য ঘটনা সংঘটনের দিনে যখন তখন বিরক্ত হয়ে উঠত আর বিড়বিড় করত—জানোয়ার সব, সব জানোয়ার!
অথচ সে ছিল এক নিষ্ঠাবান মুসলমান। নিয়মিত গরুর জাবনা দেওয়া, মাঠে হাল নামানো ও নামাজ পড়া, এই তিন কাজের কোনোটার গুরুত্বই তার কাছে কম ছিল না। আবার দেখ, সেই মানুষটা যখন পেটের শূল ব্যথায় মরে, তার আগে হানিফকে বলেছিল, দেখ হানিফ, কেউ যদি বলে, তুমি হারাম খাও তবে তোমার ই বেথা কমবে, তবে তাই খাই! তবে তাই খাই!
সুতরাং বিজয়বাবু, মতিবাবু কিংবা শহিদুল ভাই নয়—হানিফ এখন বোঝে সেই মরা বাপ এখনো তার বিবেকের উপরে পাহারা দেয়, অথবা সেই বাপ তাকে যা দিয়ে গেছে তাই সত্য, আর কিছু নয়।
তারপর আবার তার ঘুম আসে। ঘুমের মধ্যে হানিফ রোলার চালায়।
৫৭.
ইংরেজি ছেষট্টি সালে এ অঞ্চলে অস্পষ্ট দুর্ভিক্ষ যেন। আশ্বিন-কার্তিকের অভাব এমনই তো, আবার এমন কখনো নয়। একথা গ্রামের মানুষের কাছে প্রতিবছরই মনে হয়। বাজিকর রমণীদের আমানির বাটি ফুল্লরার গর্তের মতোই অকরুণ! এখন প্রত্যেকের দৃষ্টি কার্তিকের মহরমের দিনটির প্রতি। কি এক পরিত্রাণ যেন সেই দিনটি নিয়ে আসবে। কেননা এ সময়ের একমাত্র আশা পাট অতিবৃষ্টিতে সম্পূর্ণ বিনষ্ট।
প্যাটের সঙ্গে বাজিকরের সম্পর্ক কি? তাদের জমি না থাকলেও পাট গরিবের বড় সহায়। পাট পচানো ও পাট ধোয়ার ভীষণ কষ্টসাধ্য কাজটা এ সময়ে তার এক কাজ। সারাদিন ভাদ্র-আশ্বিনের গুমোট গরম ও চড়া রোদের মধ্যে কোমর সমান জলে দাঁড়িয়ে পাট ধুতে হয়। আর সেই বিষাক্ত পচা জলে না আছে কি? কিন্তু এবার সে কাজ নেই। বৃষ্টি শুরু হয়েছিল বৈশাখ থেকেই, নাগাড়ে বৃষ্টি। পাট-চারার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘাস বেড়েছে, খেতের মাটিতে সারা সময়টাই ছিল থকথকে কাদা। কাজেই পাট নিড়ানির কাজের সময়ও মার খেয়েছে জল-পাট, এখন শুধু মহরমের দিনটির জন্য পেটের ক্ষুধা ও বুকের আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করা।
কিন্তু শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা ভবিষ্যতের জন্য এভাবে বুক বাঁধতে রাজি নয়। যে-কোনো মূল্যে ক্ষুন্নিবৃত্তির বন্দোবস্ত তারা করে যায়, তোক সে চুরি, ভিক্ষা বা অন্য কোনোরকম অস্বাভাবিক উপায়।
মুরগি চুরি করতে গিয়ে শা-জাদির দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান মহিন ধরা পড়ে যায় নমোশূদ্রপাড়ায়। এ সময় গেরস্থরা সজাগ থাকে। তাছাড়া মহরমের দিনের বিশেষ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাও অঞ্চলে গোপন ছিল না।
ইয়াসিনের নমোশূদ্র সমাজে অন্তর্ভূক্তির আবদারে যদিও ভায়রোর কিছু করার ছিল না, তবুও বাজিকরদের সদলে মুসলমান হওয়ার পরিকল্পনায় আর দশজন হিন্দুর মতোই সে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বামুন-কায়েতরা এ বিষয়ে পরামর্শ করতে তার কাছেই আসে। কিন্তু শক্তিশালী ভায়রোও একেবারে দরজার সামনে দাঁড়ানো বিপদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থার বিধান দিতে পারছে না। ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ভারসাম্য আছে, বাজিকরদের সদলে মুসলমান হওয়ার ঘটনায় তা ভীষণভাবে বিপর্যস্ত হবে। এতে সবাই চিন্তিত। সবচেয়ে বড় কথা, রেশারেশিতে হাজিসাহেবের দলবল জিতে যাচ্ছে, এর থেকে অপমানকর উত্তেজনা ভায়রোদের কাছে আর কি আছে?
খবরটা শেষপর্যন্ত শহরে গিয়েও পৌঁছায়। সাতষট্টির নির্বাচনের ডামাড়োল তখন শুরু হয়ে গেছে। সর্বত্র চরম অবস্থা ও বিশৃঙ্খলা। সামগ্রিক বিচারে থানায় এই মুহূর্তে কোন্ সম্প্রদায় অধিক, তা বলা কঠিন। কিন্তু বিধানসভার আসনটি তপশীল জাতি ও উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। কাজেই শহরের রাজনৈতিক নেতারা এই মুহূর্তে মুসলমান সমাজকে চটাতে কোনোরকমেই রাজি নয়। কিন্তু সঙ্কট উভয়ত। সরকারি হিসাবে যেহেতু এককভাবে তপশীল জাতি ও উপজাতির স্থান এ থানায় প্রথম, রাজনৈতিক নেতারা তাদের তুষ্ট করার জন্য সবচেয়ে বেশি ভাবেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক কারণে ভোটের যে ভাগাভাগি হয়, তাতে মুসলমান সমাজকে উপেক্ষা করলে ভরাডুবি হবার সম্ভাবনা প্রবল থাকে। কেননা মুসলমানের সংখ্যা এ থানায় তপশীল জাতির পরেই এবং জয়-পরাজয়ের নির্ধারক বিন্দুটি তাদের ভোটেই স্থিরীকৃত হয়। ভীষণ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। বিষয়টির সমর্থন কিংবা বিরোধিতা উভয় ঘটনাই যে এবার নির্বাচনে ব্যাপক ভূমিক্ষয় ঘটাবে এ বিষয়ে কারো কোনো সংশয় থাকে না।
অথচ এ ঘটনা নিয়ে চুপ করে বসে থাকা যায় না। ভায়রো তার সদরের উকিলবাবুকে দিয়ে বয়ান লিখিয়ে স্থানীয় অবস্থাপন্ন ও প্রতিপত্তিশালী হিন্দুদের দিয়ে সই করায় ও প্রশাসনের কাছে প্রতিকার দাবি করে। তাদের অভিযোগ, জোর করে ও লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তকরণ সনাতন ধর্মের প্রতি অবমাননা।
এর পাল্টা হাজিসাহেবের ভাগ্নে মালদা জেলা কোর্টের অত্যন্ত প্রভাবশালী জনৈক আমিনুল হক ছুটি নিয়ে এসে বাদা-কিসমতের আসর জমিয়ে বসে।
ফলে এস. ডি. ও-কে একদিন তদন্তে আসতে হয়। ভোটের আগে, বিশেষ করে সাতষট্টির ভোটের আগে, প্রশাসন যেমন চতুর নিরপেক্ষতা নেয়, তদন্ত রিপোের্টও তেমনি হয়।
সুতরাং ভায়রো, আজুরা কিংবা অঞ্চলের বামুন-কায়েতদের উপলক্ষ্য তৈরি করা ছাড়া উপায় থাকে না। প্রথমে বাজিকরদের মজুরের কাজ দেওয়া বন্ধ হয়। কিন্তু সেখানে হাজিসাহেবের দলবল যথেষ্ট উদারতা আগে থেকেই দেখাতে শুরু করেছে।
যখন আর কিছুই হাতে থাকে না, তখন তোর বাবা জল ঘোলা করেছে’ থাকে। কিন্তু বাজিকর স্ত্রী-পুরুষ হঠাৎ নিজেদের গুরুত্ব বুঝতে পেরে সহজেই আর ব্যাপারগুলো মেনে নিচ্ছে না। তাছাড়া যাযাবর জাত হিসাবে তাদের স্বাভাবিক উপস্থিত কূটবুদ্ধির তুলনা নেই।
সেই সময় মহিন নমোশূদ্রপাড়ায় মুরগি চুরি করে ধরা পড়ে ও তার সমুচিত শিক্ষা পায়।
ক্রোধে ক্ষোভে দিশাহারা ইয়াসিন পাঁজাকোলে মহিনকে কোলে তুলে নিয়ে ভায়রোর দাওয়ায় শুইয়ে দেয়। মহিন রক্তাক্ত, অচৈতন্য।
ইয়াসিন বাজপাখির মতো যাযাবরী চোখে তাকায় ভায়রোর দিকে। মুখে বলে, মালিক এলা কি বিচার?
তার পিছনে বাজিকরপাড়ার অর্ধেক মানুষ। ভায়রোর চোখ ঘোরে। ক্রোধে রক্তবর্ণ চোখ। এত সাহস!
মুখে বলে, চোরের বিচার। তা এঠি নিয়া আসিছিস ক্যান?
ইয়াসিন বলে, তুমু দশের মাথা, দিগরের মাথা। ক্ষেতি কিছু হামার বেটা করে, জরিমানা দিমো। কেন্তু দশবছুরা চ্যাংড়ার উপর ইকী অবিচার?
ছেষট্টি সালেও ভায়রোর কাছে এসব অবিশ্বাস্য ঘটনা। ভিখ-মাঙ্গা বাজিকর সোজা চোখে তাকিয়ে বিচার চায়! সারাদেহে কম্প ওঠে তার, খোঁপা খুলে গিয়ে ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে পড়ে। ভায়রো আওয়াজ তোলে, যে আওয়াজে গোয়ালের গাই পাল ঝেড়ে ফেলে, এমন জনশ্রুতি। আয়রো সেরকম আওয়াজ তোলে। আজ তার তেজারতির সেই বিশাল সাজ্য নেই, নেই অফুরন্ত ধানের উৎস জমি। বিভিন্ন কারণে এসব তার কমিয়ে আনতে হয়েছে, করতে হয়েছে নানা ঢাকচাপ গোপন বন্দোবস্ত। কিন্তু এখনো তার দিগর আছে, আছে তাকে জড়িয়ে ক্ষমতার নানা কিংবদন্তি।
তার লোকজন তৈরিই ছিল। তারা কয়েক পা এগিয়ে আসে।
ভায়রো দ্বিতীয়বার কিছু আদেশ দেবার আগে হঠাৎ শারিবা এগিয়ে আসে। কেমন নির্ভীক অকুতোভয় শারিবা। বলে, মালিক হামারও এটা নালিশ আছে। ওমর নামে আমাদের জুয়াটা কেংকা হাওয়া হেই গেল, সিটা আমি স্বচক্ষে দেখিছিলাম।
শারিবা সোজা তাকিয়ে থাকে ভায়রোর চোখে। ভায়রো স্তব্ধ, ভীষণ। বলে, দেখিছিলা? মোনে আছে?
শারিবা আর কোনো কথা বলে না, নিচু হয়ে মহিনকে পাঁজাকোলে তুলে নেয়। ইয়াসিনকে বলে, ওঠেক মামা। মালিকের কাছে বিচার নাই।
ভায়রোর কাছে এ সমস্তই অসহ্য। অপমানকর। এখন যদি এত সাহস হয়, আর কদিন পরে কী অবস্থা হবে? সে আবার গর্জন করে এবং সমবেত নমোশূদ্রদের কিছু আদেশ করে।
অনেকগুলো উল্লসিত কণ্ঠে পেশাদারি হামলার আওয়াজ ওঠে—‘মারো শালোদের’ ‘খুন করি ফালামো’। কয়েকজন লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে আসে।
পাঁজাকোলে মহিনকে নিয়ে শারিবা সবার সামনে। স্বতন্ত্র যাযাবরী বৈশিষ্ট্যে সে চেহারা অনেক বেশি আকর্ষণ দাবি করে। সবার উপরে চিৎকার করে শারিবা বলে, থামেন তুমরা, থামেন! কথা শুনেন হামার!
যেসব বাজিকরেরা ছুটে পালাচ্ছিল তারাও থমকে দাঁড়ায়। শারিবা বলে, আজ বাদে কালই মানুষগুলা মোছলমান হবে সেলা তুমরা জানেন? আজই মানুষগুলার মাথাৎ ডাং মারলে, কাল সারা থানায় আগুন জ্বলি উঠবার পারে, কি উঠবেই। হাজিসাহেবের ভাগ্না হকসাহেব হেথায় হাজির আছেন, তাকে তুমরা না চিনেন তুমাদের মালিক চিনেন। দাঙ্গার আগুন কি জিনিস, তুমরা জানেন। তাৎ কার ঘর পুড়ে, আর কার মাথা ভাঙ্গে, আর কার বইন-বিটির ইজ্জত লুট হয়, সি তুমাদের দেখা আছে। ই মানুষগুলা তুমাদের সাথ দাঙ্গা করবা আসে নাই, আসিছিল মালিকের কাছে বিচার চাইতে। কিন্তু মালিকের বিচার নাই। ই মানুষগুলা যাবার দেন।
শারিবা ঘুরে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করে। অন্যেরা তাকে অনুসরণ করে। প্রতিপক্ষ কী এক দ্বিধায় কর্তব্য স্থির করতে পারে না। বাজিকরেরা চোখের আড়াল হয়ে যায়।
৫৮.
মহরমের তিন দিন আগে গভীর রাতে ভায়রোর বাড়ির পিছনে দু-টি ছায়া কী যেন চক্রান্তে অস্থির হয়ে ওঠে। দু-টি নিঃশব্দ ছায়া মাত্র। একজন বলিষ্ঠ দীর্ঘদেহী, অন্যজন ক্ষীণাঙ্গ কিন্তু অত্যন্ত ক্ষিপ্র।
একটা চাকা-খোলা গরুর গাড়ির মাচান, যা যে-কোনো গৃহস্থের উঠানেই পড়ে থাকে, এনে মাটির উঁচু পাঁচিলের সঙ্গে মইয়ের মতো দাঁড় করিয়ে দেয় তারা। বলিষ্ঠ ব্যক্তির হাতে একটা মোটা বাঁশ, যার দৈর্ঘ্য হাত পনেরো হবে। যদি ভালো করে দেখা সম্ভব হতো তাহলে দেখা যেত বাঁশটি নিপুণ মসৃণ।
ক্ষিপ্র ব্যক্তি মাচানের মই বেয়ে পাঁচিলের উপর উঠে দুই পাশে পা ঝুলিয়ে সওয়ার হয়ে বসে। স্থানটি তারা নির্বাচন করেছে একটা গাছের অন্ধকার নিচে। পাঁচিলের উপরে বসা ব্যক্তি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভিতরের সব কিছু দেখতে থাকে।
কেননা শারিবা একদল মারমুখী মানুষকে ভয়ঙ্কর একটা পরিণতির অশুভ ও নির্বোধ দিক দেখাতে সমর্থ হলেও, একজন কিংবা দু-জন অন্ধকারে এগিয়ে আসা ঘাতককে আটকাতে পারেনি। ভায়রো সম্পূর্ণ বিষয়টি তার পরাজয় ও দিগরপতি হিসাবে অপমানকর বলেই গ্রহণ করেছিল। এই ঘটনার কোনো পূর্ব নজির নেই, তার ষাট বছরের জীবনে এ অত্যন্ত নতুন ও ভীষণ।
সন্ধ্যার পরে হানিফকে তাঁবুতে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে শারিবার মাথায় লাঠির বাড়ি পড়ে। হয়ত আঘাত অন্ধকারে তেমন জুৎসই হয়নি। শারিবা চিৎকার করে দৌড়ায়, ঘাতকরা তার পিছনে ছোটে, আবার আঘাত করে। শারিবার চিৎকারে রাস্তা তৈরির মজুররা সোরগোল করে লাঠিসোটা নিয়ে দ্রুত এসে পড়ে। তাদের সঙ্গে হানিফ। অচৈতন্য শারিবাকে রূপার ঘরে নিয়ে আসে হানিফ।
রক্তাক্ত ও জ্ঞানহীন শারিবাকে দেখে রূপা উন্মত্ত হয়ে যায়। শারিবা তার একমাত্র জীবিত সন্তান। শরমী এখন পর্যন্ত তাকে কোনো সন্তান দিতে পারেনি। রূপা, ভয়ঙ্কর রূপা, প্রকাশ্যেই সব প্রতিজ্ঞা করে, বিষহরির নামে কিরা কাটে।
শারিবা সারারাত অচেতন থাকে। পরদিন সকালে পাথরকুচি ফেলতে আসা একটা ট্রাকে করে হানিফ তাকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যায়। রূপা যায় তাদের সঙ্গে ও হাসপাতালের দরজায় বসে থাকে।
ডাক্তাররা কোনো অভয় দেয় না। মাথায় আঘাত ও অচৈতন্য। জ্ঞান ফিরে না আসা পর্যন্ত কিছুই বলা যাবে না। রূপা পুরো দু-দিন দু-রাত অন্নজল ত্যাগ করে হাসপাতালের দরজায় বসে থাকে।
তৃতীয় দিনে শারিবার জ্ঞান ফেরে। বিহুল দৃষ্টিতে ঝাপসাভাবে সে প্রথমে দেখে রূপা ও হানিফকে। কিছুটা আশ্বাস পাওয়া যায়।
আরো তিন-চার দিন পরে শারিবা সঙ্কটমুক্ত হয়। ডাক্তারদের অভয় পেয়ে রূপা ফিরে আসে। তারপর সে আকালুকে বলে একটা মোটা বাঁশ যোগাড় করে আনতে। সে ভীষণ গম্ভীর, তার চোখে যাযাবরী আগুন।
আকালু বাঁশ নিয়ে এলে রূপা গভীর অধ্যবসায়ে কাজে লেগে যায়। আকালুকে কাছে কাছে রাখে। প্রথমে কুড়োলের পিছন দিক দিয়ে বাড়ি মেরে বাঁশটাকে ফাটিয়ে চৌচির করে সে। দরমার বেড়া বানাতে হলে যেমনভাবে বাঁশ ফাটাতে হয়, তেমনিভাবে। তারপর ধারালো কাতা দিয়ে বাঁশের ভেতরের গাঁটগুলোকে চেঁছে পরিষ্কার করে। বার বার বাঁশের ভেতরের ব্যাস মেপে দেখে সে। সবশেষে, উপকরণটি তার পছন্দ অনুযায়ী হলে পাটের সুতলি দিয়ে আগাগোড়া জড়িয়ে সে বাঁধে ওটাকে। তারপর আকালুর উপর আদেশ হয় জলা থেকে একটা সোলার টুকরো নিয়ে আসার।
আকালু সোলা আনলে বাঁশের চোঙার দু দিকে সে দুটো ছিপি মাপমতো কেটে লাগায়। তারপর একদিকের ছিপ্তি বিশেষ প্রক্রিয়ায় একটা লম্বা শক্ত সুতোর সঙ্গে এমনভাবে আটকায়, যাতে বাঁশের গোড়ার দিক ধরে সুতোয় টান দিলে সামনের ছিপি খুলে চোঙার মুখ উন্মুক্ত হয়। পদ্ধতিটি বার বার পরীক্ষা করে সে সন্তুষ্ট হয় ও পূর্ণ দৃষ্টিতে আকালুর দিকে তাকায়।
আকালু রূপার বিশাল রক্তাভ চোখ দেখে ও নিমেষেই এই সমস্ত পরিকল্পনা ও তার পিছনের যাবতীয় উদ্দেশ্য তার কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তার চোখ ক্রমেই বিস্ফারিত হতে থাকে।
রূপা চাপা ব্রাসে বলে, আকালু, হারামজাদা, কাইটে ফালামো, কয়া দিলাম বুঝলু?
আকালু ঘাড় নাড়ে, অর্থাৎ সে বুঝেছে। কাইটে ফালামো’, এই কথাটা কাজ শুরুর প্রথমেই রূপা শরমীকেও বলেছিল। শরমী প্রথম থেকেই বিষয়টা ধরতে পেরেছিল ও সভয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, এটা হচ্ছেটা কি?
আকালুর প্রাথমিক বিহ্বল ভাবটা কেটে যাওয়ার সেও সমান উৎসাহিত হয়। তারপর রূপা বেছে বেছে একটি কঁপি বের করে। ঝাঁপির উপর দু-তিনবার টোকা দেয় সে। ঝাঁপির মুখ একটু ফাঁক করে রূপা শব্দ করে ফু দেয় দু-তিনবার। ভিতর থেকে সমান জোরে সাপ গর্জন তোলে। রূপা তারপর ঝাঁপির ঢাকনা সরিয়ে নিতে কালো বিদ্যুতের মতো ঝলসে ওঠে একটা সাপের দেহের উপরিভাগ। রূপা ডান হাত সামনে মুঠো করে ধরে সাপকে বারকয়েক দুলিয়ে বাঁ হাতে চট করে সাপের মাথা ধরে ফেলে ও সাথে সাথেই সাপের লেজ ডান হাতের আঙুলে আটকায়। বাঁশের চোঙাটা ইঙ্গিতে আনতে বলে সাপের মুখটা সে চোঙার পিছনের মুখে ঢুকিয়ে দেয়। সাপ অক্লেশে চোঙার ভিতরে ঢুকে যায়। সুতোয় টান দিয়ে এবার চোঙার সামনের ছিপি খুলে দেয় রূপা। বাঁশের উপর দু-একবার চাপড় মারতে সাপ বেরিয়ে আসে সামনের দিক থেকে। তারপর রূপা সাপকে আবার ঝাঁপিতে বন্ধ করে রাখে।
সব কাজ শেষ হলে রূপা আকালুকে আরেকবার সতর্ক করে ও বলে, সময় মতো আততাৎ ডাকি নিব, চ্যাতনে থাকিস!
তারপর এই মধ্যরাত্রির অভিযান। রূপা স্থির, কিন্তু আকালুর সর্বাঙ্গে উত্তেজনা। পাঁচিলের উপর ঘোড়ার মতো চেপে বসে দম নেয় আকালু। পরে মাচান বেয়ে উঠে আসে রূপা। দীর্ঘ বাঁশটিকে টেনে উপরে তোলে সে। আকালু বাঁশ হাতে নিয়ে ভিতরের গাছের ডালের উপর উঠে পড়ে। একটা নির্দিষ্ট ডালে সে অবলীলায় এগোতে থাকে। রূপা পাঁচিলে বসে নজর রাখে। আকালুর ডালটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে একটু চেষ্টাতেই সে ভায়রোর গোলাঘরের চালায় উঠে পড়ে। টিনের চালায় মাটির দোতলা বাড়ি।
গোলার চালা বেয়ে আরো খানিকটা এগিয়ে আকালু দোতালার একটা জানলা ধরে ফেলে। আবছা চাঁদ আকাশেপর্কেট থেকে রূপার দেওয়া টর্চ বের করে সে। পাকা কাজ রূপার। টর্চের আলোয় দেখা যায় হাতদশেক দূরে ভায়রোর মশারি ঢাকা বিছানা। এসব হিসাব রূপা আগে থাককেই রেখেছিল। এখন ধীরে ধীরে জানলা দিয়ে বাঁশটা বিছানায় ঢোকায় আকালু। হাত কাঁপে তার। বাতানো মশারী বাঁশ দিয়ে সরানো মুশকিল। একমাত্র নির্ভরতা ভায়রোর প্রচণ্ড নাকের গর্জন। বড় খাট, মশারি ফঁকা করতে অসুবিধা হয় না আকালুর। তারপর সুতোর টানে ছিপি খুলে বাঁশের উপর আলতো চাপড় মারে সে। বাঁশ হালকা হয়ে যায়। আন্দাজে বাঁশ দিয়ে একটা খোঁচা মারে সে সাপকে। সাপের ক্রুদ্ধ গর্জন দশ হাত দুর থেকেও সে পরিষ্কার শোনে।
অকল্পনীয় ক্ষিপ্রতায় আকালু ফিরে আসে। পাঁচিল থেকে নেমে দু-জনে প্রথমেই মাচান সরায়। পঞ্চাশ হাত যাওয়ার আগেই ভায়রোর চিৎকার শোনে তারা, কিসি কাটল হামাক্! ওরে পুষ্পর মাও-বিপিনা-এনা আলো আন, ওরে হামা বুঝি সাপে খালো–
দুজনে একটু থমকে দাঁড়ায়, তারপর নিঃশব্দে মাঠে নেমে ছুটতে শুরু করে। সকাল হতে তখনো ঘন্টাতিনেক বাকি।
পরদিন রোদ ওঠা পর্যন্ত রূপা জেগে থাকে ও নেশা করে তারপর ভায়রো ও সাপ উভয়েই মরেছে এ খবর শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে যায়।
৫৯.
তার মা শা-জাদি এবং ইয়াসিনকে শারিবাই সুখবরটা দেয়। অবিশ্বাস্য এই প্রস্তাব ইয়াসিনকে দিশাহারা করে। হানিফ বিয়ে করতে চায় পলবিকে। সে দীর্ঘ সময় রুদ্ধবাক হয়ে থাকে। তার ভিতরে আনন্দ, বেদনা, উচ্ছ্বাস, অনেক না-বলা কথা একসঙ্গে কোলাহল করে ওঠে। সে কিছু বলতে পারে না। এইসব অনুভূতি স্তিমিত হয়ে এসে ইয়াসিনের মনের ভেতরে একটা অদ্ভুত ভয় এসে বাসা বাঁধে। শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে তো?
কেননা তার অভিজ্ঞতায় বাজিকরদের জীবনে এ ধরনের সৌভাগ্য কখনো হয়নি। যতদিন তারা পুরোপুরি যাযাবর ছিল, ততদিন সমাজের কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা তারা করেনি। এখন এই দীর্ঘদিন ধরে গৃহস্থ হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতে কিছু কিছু প্রত্যাশা সে করে বটে, কিন্তু দাবি হিসাবে এখনো সে কিছুই প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। কাজেই হানিফের প্রস্তাব ইয়াসিনকে খুবই বিভ্রান্ত করে দেয়।
সে বারবার শারিবাকে জিজ্ঞেস করে নিজের সংশয় দূর করতে চেষ্টা করে। বিয়ে করবে হানিফ সাহেব? আর কিছু নয়ত? এর মধ্যে অন্য কোনো দুরভিসন্ধি নেই তো?
পাঁচবিবি থেকে পালিয়ে আসার সময় পলবির কারণে গভীর ক্ষতটা ছিল বুকের মধ্যে। একটা দগদগে ঘা, যা দীর্ঘকাল তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে। সময়ে সবকিছুই ঠিক হয়ে যায়, ঘা-ও শুকায়। জীবন এরকম স্বার্থপরই বটে। ইয়াসিন কি হাসেনি? ইয়াসিন কি স্বাভাবিক হয়ে যায়নি? সবই আবার যেমনকার তেমন বিস্মৃতিতে হারিয়ে গেছে।
তারপর পলবি যখন ফিরে আসে, ইয়াসিন দেখেছিল ঘা উপরে শুকোলেও ভিতরের ক্ষত এখনো আছে। যেন কেউ কেউ পুরানো ক্ষত আবার খুঁচিয়ে দিয়েছিল। পলবি যখন আবার কাঙালপনা শুরু করল, আর তা নিয়ে গোষ্ঠীতে সাতকথা হতে থাকে, তাতে সে দুঃখ পেয়েছিল। শা-জাদি তাকে অনুযোগ করেছে, মেয়েকে শাসন করতে বলেছে, সেসব কিছুই পারেনি। সে অনেকদিন আগে থেকেই জানত জামিরের মতো ক্ষমতাশালী মণ্ডল বা সদার সে নয়। আবার সে ভাবত, জামির অত শক্ত মানুষ হয়েও কী করল বাজিকরদের জন্য? কিন্তু তবুও তার আকাঙ্ক্ষা ছিল, ছিল প্রচুর ইচ্ছাশক্তি যা বাজিকরদের নতুন করে বাঁচতে হয়ত তৈরি করেছে। ইয়াসিন এসব পারে না। সে শুধু দুঃখ পেতে জানে। মেনেও নেয় এই সেই দুঃখ।
পলবি শুধু দুঃখ দেবে এ সে মেনেই নিয়েছিল, আর এখন শারিবার কাছ থেকে এরকম একটা প্রস্তাব শুনে সে দিশেহারা না হয়ে থাকে কী করে? হানিফ, যাকে কিসমতের অবস্থাপন্ন চাষি মুসলমানরাও কন্যা সম্প্রদান করতে পারলে বর্তে যায়, সে কিনা পলবিকে বিয়ে করতে চায়! সেই অল্পবয়সে দেখা একটি একই রকম ঘটনার কথা কি অসংখ্যবার ভাবেনি? সোজন বাজিকর ও পাখির কাহিনী বাজিকরদের কাছে উপাখ্যান হয়ে আছে। অল্পবয়সে ইয়াসিনদের কাছে সোজন ও পাখি এক বিয়োগান্ত বিষাদের আকর্ষণ। কতবার কতভাবে তারা এসব আলোচনা করেছে। সেই পাখির পরিণতিও মানুষ দেখেছে। পলবির জন্য ইয়াসিন কি এরকম কোনো পরিণতি আশঙ্কা করেনি? পাখির পচা ফুলে ওঠা শব সমস্ত যুবক বাজিকরদের চোখের সামনে চিরকাল পুকুরের জলে ভাসে।
কাজেই ইয়াসিন বিশ্বাস করতে চায় না এসব কথা। শুধু তার জীবনে কেন, সমস্ত বাজিকরের অস্তিত্বকালে এরকম অসাধারণ ঘটনা কখনো ঘটেনি। বাজিকর এতে অভ্যস্ত নয়।
পনেরো-ষোল বছর আগে একবার সরকারি লোক এসেছিল তাদের পাড়ায় লোকগণনার কাজে। তারা দেখেচ্ছিল তখন চাষিগেরস্থরা কেউ কেউ অপেক্ষাকৃত কম দামে কনট্রোলের কাপড় কিনে আনত। ইয়াসিন ভেবেছিল, হয়ত কনট্রোলের কাপড় কেরোসিন ইত্যাদির জন্য সরকারি লোক নাম লিখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এরকম একটা কথা জিজ্ঞেস করে সে সবার কাছেই বোকা হয়ে গিয়েছিল। কেননা, সবাই জানত কনট্রোলের কাপড়, কেরোসিন এসব কখনোই বাজিকরদের জন্য নয়। তারও কয়েক বছর পর আজুরা মণ্ডলের সাথে একজন নেতা এসেছিল। খুব কালো একজন প্রৌঢ় মানুষ, ভীষণ রোগা রোগা হাত পা। মানুষটার মাথায় একটা সাদা টুপি ছিল। পরে বাজিকরেরা শুনেছিল, মানুষটা একজন কংগ্রেসি নেতা। সেই মানুষটা তাদের কিছু কথা বলেছিল। তার মধ্যে কংগ্রেস, কমুনিস্ট, সোস্যালিস্ট, ভোট, গান্ধীজি এইসব শব্দ ছিল। এই শব্দগুলো বাজিকর বয়স্কদের কাছে ভীষণ অপরিচিত ছিল না, কিন্তু খুব একটা বোধগম্যও ছিল না। মানুষটি তাদের জিজ্ঞেস করেছিল, গান্ধীজির নাম তারা শুনেছে কি না।
ইয়াসিন মাথা নেড়ে বলেছিল, হ্যাঁ শুনেছে।
কে সে?
ইয়াসিন এর কোনো নির্ভরযোগ্য জবাব দিতে পারেনি। তেমনি অন্য শব্দগুলোর মধ্যেও কিছু কিছু চলতে ফিরতে অবশ্যই শুনেছিল তারা, কিন্তু সে সম্বন্ধে কোনো বিশেষ ধারণা তাদের ছিল না।
তখন আজুরা মণ্ডল বলেছিল, দাদা, হেথায় অপিক্ষে করে লাভ নেই। ইয়ারা হামার লোক, হামার কথা শোনে। এর আগে একবার আজুরা তাদের বুঝিয়ে ভোট দিতে নিয়ে গিয়েছিল। ইয়াসিন বোঝে এবারও সেই ভোটের ব্যাপার। হাটে বাজারে চলতে ফিরতে এমন কথাই শুনছে তারা।
সেবার অবশ্য ইয়াসিন আজুরাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, এলা কি বেপার? কাগজে ছাপা দিলে কি হবে?
আজুরা তাদের খুব পণ্ডিতের ভঙ্গিতে, অনেক কিছু বোঝাবার ভঙ্গিতে বোঝাতে শুরু করে দু-চার কথার পর খেই হারিয়ে বলেছিল, ওলা তুমাদের বুঝবা হোবে না বাপু। ওলা মেলাই কঠিন বেপার, রাজনীতি। যেথায় মারবা কলাম ওঠি মাইরে দিবেন, বাস!
পাঁচ বছর পরের ভোটে তারা অন্য আরো দু-একজন নেতাকে দেখেছিল। তারা দেখেছিল আলাদা আলাদা ঝাণ্ডা এবং আলাদা দল। কেন এতসব পৃথক ব্যবস্থা, এই প্রশ্ন আর তার উত্তরের বীজ তাদের মস্তিষ্কে সেই সময় রোপিত হয়েছিল। এর জন্য কোনো কারণ নেই, শুধু তাদের প্রয়াসলব্ধ সামাজিক স্থিতি মস্তিষ্কে তাদের এই উপলব্ধিটুকু জাগিয়েছিল। খুব ক্ষীণভাবে হলেও এই দুইবারের অভিজ্ঞতায় বাজিকরেরা বুঝতে পেরেছিল, আজুরা, আজুরার প্রতিপক্ষ এবং আশপাশের অন্য আর কিছু মানুষের হয়ত তাদের কাছে কিছু গূঢ় প্রয়োজন আছে। এই বোধ আবার আত্মপ্রসাদ লাভ করার মতো যথেষ্ট ছিল না, কিংবা এই প্রয়োজনকে যে কাজে লাগানো যায় এমনও ইয়াসিন অথবা তার নেতৃত্বাধীন বাজিকরদের মনে হয়নি। কাজেই পরবর্তীকালে কনট্রোল, রেশনকার্ড, চিনি, কেরোসিন ইত্যাদি যেসব বন্দোবস্তগুলো বাদা-কিসমতের মতো গ্রামেও হয়েছিল, বাজিকরেরা তার ভাগিদার কিংবা দাবিদার হওয়ার কথা চিন্তাও করেনি। সামাজিক বিবর্তনের যে স্তরে এলে এইসব বন্দোবস্তের অংশীদার হওয়া যায়, বাজিকর যে কারণেই হোক নিজেকে সেখানে উত্তীর্ণ করতে পারেনি। সম্ভবত, ভীতিই ছিল এর প্রধান কারণ।
তারপর এবারে বাজিকরদের মুসলমান হওয়ার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব অসাধারণ কাণ্ডকারখানা ঘটছে বাজিকর তার দশা সবসময় ঠিক করতে পারছে না।
প্রথমে হাজিসাহেবের নির্দেশমতো সোনামিয়া যখন একগোছা কাগজ ইয়াসিনের হাতে দেয় তখন ইয়াসিন জানত না এগুলোর মূল্য কী। ছক কাটা কাগজে ক্ষুদে ক্ষুদে ছাপা লেখা, তার পাশে অথবা নিচে পেন্সিল দিয়ে সোনামিয়া কি সব লিখে দিয়েছে। সোনামিয়া বলেছিল এর নাম চেক। এ নাকি ভীষণ দরকারি দলিল। এখন তুমি মালিক হলে এই বসত জমির ভিটার। কেউ তোমাকে আর উচ্ছেদ করতে পারবে না, এমনই ক্ষমতা এই কাগজের। হবে না? ছাপা কাগজ, তাতে সরকারের লেখা। সে লেখার ক্ষমতা কি আজুরা মণ্ডলের থেকে বেশি? নিশ্চয়ই বেশি, না হলে হাজিসাহেব এমন নিশ্চিন্ত অভয় দেয় কি করে?
তারপরে আবার ভোটর হাওয়া বইতে শুরু করে। আজুরা এবার আর তাদের কাছে আসে না। তার এক ভাইপো এবার তার বিপক্ষ দলে যায়। সেই আসে, বাজিকরদের বোঝায় অনেক কিছু। মোহরের হাটে মাঝে মধ্যে বাজিকরেরা সভাসমিতি দেখে, আদিবাসীরা সেইসব মিছিলে মাদল ও ডুগডুগি নিয়ে সামিল হয়। নতুন নতুন মানুষ বাজিকরদের ভোট সম্বন্ধে বোঝাতে আসে।
তৃতীয়ত, ভায়রো সাপের কামড়ে মরে যাওয়ার পর বাজিকরদের ধর্মান্তরের বিষয়ে বিরোধের উত্তাপও কমে যায়। অবশ্য এজন্য ভায়রোর অনুপস্থিতিই প্রধান কারণ নয়। মানুষ এখানে এইরকমই। কিছু অপাঙক্তেয় বাজিকর মুসলমান হল কি খৃস্টান হল এতে কারোই বিশেষ কিছু যায় আসে না। তবুও বিষয়টা হাজি সাহেব ও তার সম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, সেইজন্য বাজিকরেরা তাদের কাছে সমাদর পায়।
আর সবশেষে হানিফের এই প্রস্তাব ইয়াসিন ও সমস্ত বাজিকর গোষ্ঠীকে ভূমিকম্পের আন্দোলনের মতো নাড়া দেয়—গোরখপুরের শনিবারের ভূমিকম্পও এত শক্তিশালী ছিল বলে মনে হয় না।
কাজেই ইয়াসিনের মতো দুর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষ একেবারেই দিশাহারা ও বিহ্বল হয়ে যায়। সে শুধু শারিবাকে বলতে পারে, দেখ শারিবা, বেবাক দিন যেন ঠিক থাকে।
৬০.
মহরমের দিন বাদা-কিসমতের মসজিদে ব্যান্ড-পার্টি আসে শহর থেকে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের গণ্যমান্য মুসলমানেরা হাজিসাহেবের অতিথি হয়। প্রায় দুশো জন শিশু, যুবা, বৃদ্ধ নরনারী মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হয় কলমা পড়ে। একসাথে নামাজ হয়। সম্রান্ত মুসলমানেরা বাজিকর মুসলমানদের সঙ্গে পান তামাক বিনিময় করে। প্রত্যেকের নামের মধ্যে কিছু নতুনত্ব আসে। যাদের আগে থেকেই মুসলমানি নাম ছিল, তাদের পদবি বাজিকরের বদলে মণ্ডল হয়। যাদের নামে হিন্দুয়ানির ছোঁওয়া ছিল তাদের নতুন নামকরণ হয়। নতুন লুঙ্গি এবং গেঞ্জি পরা নতুন মুসলমানদের কিরকম বিহুল আর নির্বোধ দেখায়। তারা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু উপহার পায়। ভোজের প্রস্তুতি চলে। বেশ কয়েকটি গরু কাটা হয়েছে। মসজিদের প্রাঙ্গণ লাল নীল কাগজের পতাকায় সাজানো। চতুর্দিকে মুসলমানি উৎসবের হুল্লোড়। তার মধ্যে ম্রিয়মাণ লাজুক তিনজন মানুষ, যারা এই মুহূর্তে পুরানো অভ্যাস, পুরানো জীবন, পুরানো স্বজনদের ছেড়ুে চলে এসেছে। কেননা ছয় ঘর বাজিকর এখনো আগের জীবনকেই শ্রেয় মনে করছে। তারা চোখের জলে বিদায় দিয়েছে স্বজনদের। এরাও চোখের জল মুছেই এখানে এসেছে।
গতকাল সন্ধ্যায় শা-জাদি কপার অন্ধকার ঘরে গিয়েছিল। অন্ধকারে রূপা ঘরের দাওয়ায় বসেছিল। শা-জাদি শরমীকে আড়ালে যেতে বলেও অনেকক্ষণ চুপ থাকে। তারপর একসময় ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বলে, জেবনে চাই নাই কেছু, বাজিকর। খালি পর করি দিলা হামাক্! বার বার হামাক্ পর করি দিলা।
শা-জাদি ডুকরে কেঁদে ওঠে। রূপা বলে, শারিবার মাও, বাজিকরের জেবনে দেওয়ার কেছুই নাই। বেবাক ছাড়ি যাবার হয়। বাপ-দাদা-নানা হামরাদের থিতু করবার চালো, থিতু হবার পারি কই হামরা? এক দেশ থিকা আন্ দেশেৎ, এক সমাজ থিকা আন্ সমাজে হামরা যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। হামি ভাবি হামি হিন্দু, তুই ভাবো তুই মোছলমান। আসলে আমরা বেবাকেই সিই বাদিরা বাজিকরই আছি। দুঃখু করিস না শারিবার মাও, ই হামরাদের পাপের ফল।
শা-জাদি আরো কাঁদে। শেষে বলে, এটা কথা দেও বাজিকর—
কী কথা? শারিবাক যাতে দিবা হামার কাছেৎ?
এলা এটা কথা! তোর বেটা তোর কাছে যাবে না?
ছাবালের বিহা দিবা তাড়াতাড়ি?
দিমো। দূরে সরি গেলাম বলে মনে দুঃখ রাইখবে না তো?
দূরে ক্যান্? কাছেই তো আছি। দেখিস, পর হয়ে যাবে না কেউ।
কি গভীর অন্ধকার। রূপা স্পর্শ করে শা-জাদির হাত। দু-জনে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে অনেকক্ষণ।