৩১-৩৫. লুবিনি সেই পুবের দেশের কথা

৩১.

লুবিনি সেই পুবের দেশের কথা শারিবাকে বলে, যে পুবের দেশের কথা দনু পীতেমকে বলেছে, পীতেম বলেছে পরতাপ, জামির আর লুবিনিকে, জামির বলেছে রুপাকে, আর এখন এই সমুদয় পুবের দেশের বৃত্তান্ত লুবিনি শোনায় শারিবাকে। কিন্তু কোথায় যে সেই স্থির দেশটি, যেখানে আছে বাজিকরের স্থিতিস্থায়িত্ব, সেকথা কেউই জানে না। প্রতিবারই মনে হয়েছে এই বুঝি সেই দেশ। প্রতিবারই কোনো না কোনো আঘাত, সে আঘাত মানুষের সৃষ্ট হোক কিংবা প্রকৃতির সৃষ্ট হোক, বাজিকরকে দিশাহারা করেছে।

নমনকুড়ি থিকা কোথায় গেলি, নানি?

লুবিনি চুপ করে থাকে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টাই পথে প্রান্তরে কেটেছে। কোন তাড়নায় জামির নিত্য নতুন দেশের সন্ধান করেছে, তা আর কারো কাছেই বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল না। আবার এ ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহও আর কেউ বোধ করত না। কেননা, মালদা শহরে তারা থাকতে পারত, যেভাবে অন্য চারঘর থেকে গেছে। থাকতে পারত রাজশাহি শহরেও। কিন্তু জামির এমন একটি স্থান খুঁজছে যেখানে নমনকুড়ির মতো অজস্র ফসল সে ফলাতে পারবে, অথচ জলে ডুবে সর্বনাশ হবে না। সে যেন একটা পরিচয় চাইছিল নিজের দলের জন্য।

বালি বৃদ্ধ হওয়াতে দলের পরিচালনভার তার হাতেই এসেছিল। আর জামির দেখেছিল মাসখানেক এদিক সেদিক চলার পর মানুষগুলো জানোয়ারের মতো হাঁটছে। তারা অল্পেতেই পড়ছে ক্লান্ত হয়ে, তাদের কোমর বেঁকে যাচ্ছে, হাত ঝুলে পড়ছে সামনের দিকে। সেই রাজমহলের আমল থেকে একটানা পথে চলার অভ্যাস চলে গেছে।

এখানে সেখানে ঘুরে ফিরে শেষপর্যন্ত জামির রাজশাহি শহরের বাইরে পদ্ম নদীর ধারে নামালো তাদের মোটঘাট। সুখস্বপ্নের স্মৃতির মতো নমনকুড়ি রয়ে গেল এক বিস্ময়! সেই ধান-চাল, গরু-মোষের গেরস্থালি, সে কি এই জীবনেরই কোনো ঘটনা! এই বাজিকরের জীবন

বছর দুয়েক বাদে জামির একবার গিয়েছিল খোঁজ নিতে, কেননা নমনকুড়ি তাকে ভীষণভাবে পিছনে টানছিল। দেখে হতাশ হয়েছিল। নমনকুড়ি আবার তার আদিমতায় ফিরে গিয়েছে। বছরের ছ-মাস সম্পূর্ণই জলের তলায় থাকে। সাঁওতাল ওরাওঁরা অধিকাংশ বিভিন্ন দিকে ছিটকে পড়েছে। যারা আছে, তারা হিঙ্গল, জামিলাবাদ ইত্যাদি গ্রামগুলোর সম্পন্ন চাষী-জোতদারের চাকর, মহিন্দর কিংবা নিতান্তই কেনা গোলাম হয়ে অসম্ভব দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছে।

বৃদ্ধ বালি তখন বলেছিল, এখন তাহলে কি করবে বাজিকর?

জামির কি একথার উত্তর জানে? তবুও বালি তাকেই প্রশ্নটা করে। দলের দায়িত্ব যখন তার উপর, উত্তর তাকেই খুঁজে বের করতে হবে।

যুদ্ধে যাওয়া পাঁচ যুবকের মধ্যে এখন তিনজন আছে, পরতাপ, বাল এবং জিল্লু। এখন তারা বৃদ্ধ। তারা এখন জামিরের দিকে তাকায়, এই বৃদ্ধ বয়সে জামিরের কাছেই তারা আশ্বাস খোঁজে। আর তখন বালির ছেলে ইয়াসিন কিংবা জিল্লুর ছেলে সোজন যদি ঝুলি ঘাড়ে করে ক্লান্ত হয়ে আস্তানায় ফেরে, জামির হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে যায়। বলে, কোথায় গিয়েছিলি? ভিখ মাঙতে? কেন আর কোনো কাজের খোঁজ করতে পারিস না?

সোজন খুব চালাক ছেলে। খেলা দেখাতে যখন শহরের রাস্তায় কিংবা গ্রামে গ্রামে ঘোরে, সঙ্গে রূপাকে নেয়। রূপাও সোজনের সঙ্গে ঘুরতে ভালোবাসে, খেলা শেখে।

সে বলে, কোথায় যাব কাজ খুঁজতে? গঞ্জের ঘাটে মাল তোলা-নামার কাজে কাল গিয়েছিলাম, তো এখানকার লোকেরা তাড়িয়ে দিল।

কেন?

ভিড় বেশি হলে তাদের কােজগার কমে যাবে না?

তাও তো বটে। কিন্তু জামিরের মাথা থেকে চিন্তাটা যায় না। তাহলে গঞ্জের ঘাটে কাজ আছে। সেখানে তাহলে চেষ্টা চালাতে হবে।

পরদিন সে ঘাটে যায়। নানাধরনের দেশি-বিদেশি মহাজানি নৌকোয় ঘাট ভরা। প্রচুর মাল ওঠানামা হয়। ভিড়, ধুলো, চিৎকার-চেঁচামেচি মিলে জায়গাটা অদ্ভুত রকমের ব্যস্ত ও সরগরম। জামির একটা গাছের নিচে বসে অলসভাবে দেখতে থাকে সবকিছু।

ছোট বড় অজস্র নৌকোর মধ্যে অনেকে উঁচুতে মাথা তুলে ভেসে আছে। তিনখানা বাষ্পচালিত নৌকো। এগুলো এদেশে নতুন এসেছে। মাঝে মাঝে কোনো কোনোেটা তীব্র ভো দিচ্ছে। কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে লাইন দিয়ে মাথায় করে, পিঠে করে কুলিরা নৌকোয়, স্টিমারে মাল তুলছে। বেশির ভাগ বস্তাতেই ধান কিংবা চাল। মানুষগুলোর সর্বাঙ্গ বেয়ে ঘাম ঝরছে। রোদ যত বাড়ছে, পরিশ্রম যত বাড়ছে, ততই মানুষগুলো এতে অন্যের সঙ্গে অসংযত ব্যবহার করছে। একের গায়ে অন্যের ধাক্কা লাগলে পরস্পরকে খেকিয়ে উঠছে। খাটনির চাপে সব মানুষগুলো যেন ক্রমশ মারমুখী হয়ে উঠছে। অসংখ্য পাতিকাক সমস্ত বন্দর এলাকা ছেয়ে আছে এবং বিরক্তিকর একঘেয়ে চিৎকার করছে।

জামির এইসব দেখছে ও চিন্তা করছে, এইসব জাগতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বাজিকরের কোনো সম্পর্ক নেই। একথা অবশ্যই সত্যি যে, যে মানুষগুলো ঐ নৌকো ও স্টিমারের জঠর ভরছে খাদ্যশস্যে, তারা প্রতিদানে পাচ্ছে শুধু নিজেদের জঠরের জন্য ঐ খাদ্যশস্যই দু-এক মুঠো। তবু এই ব্যস্ততার মধ্যে আনা কিছু আছে, যা বাজিকরের জীবনে নেই।

চেহারা দেখে জামির অনুমান করতে পারে এখানে মূলত দুই জাতের মানুষ আছে। স্থানীয় কুলিদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যাই বেশি। বহিরাগত মানুষও আছে, তারা বিহারি ও হিন্দিভাষী। ক্রমশ বেশি বেশি বিহার অঞ্চল থেকে এদিকে মানুষ আসছে। বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে খরা হয়েছে এবং তার জন্য দুর্ভিক্ষের অবস্থা চলছে। মানুষ তাই দলে দলে এসে কুলির কাজে এদিকের গঞ্জ, বন্দর ও রেলস্টেশনে লেগে পড়ছে। জামির চিন্তা করে এই স্রোতের সঙ্গে আপাতত মিশে যাওয়া ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো রাস্তা নেই। যে করেই হোক এদের সঙ্গেই মিশে যেতে হবে।

সে যেখানে বসেছিল তার কাছেই বিরাট একটা নৌকায় মাল বোঝাই হচ্ছে। দুখানা কাঠের পাটাতনে উঠতে গিয়ে হঠাৎ একজনের পা বেকায়দায় পড়ে পিছলে যায়। লোকটা অদ্ভুতভাবে পড়ে। তার মাথায় কম করেও চার-পাঁচ মণ ওজনের বোঝা ছিল। পা পিছলে সামনের দিকে চলে যেতে সে সোজা চিৎ হয়ে পড়ে যায় এবং মাথার ভারি বোঝা সশব্দে বুকের উপর পড়ে তাকে পিষ্ট করে। সামনে এবং পিছনে তার ভারবাহী মানুষ, তারা কেউ সাহায্য করতে পারছে না। জামির লাফ দিয়ে উঠে গিয়ে লোকটার বোঝাটা অমানুষিক শক্তিতে তুলে একপাশ করতে যেতেই সেটা গড়িয়ে জলে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই কোলাহল উঠেছিল। এখন একজন গোমস্তা ও জনা দুই-তিন পাহারাদার ছুটে আসে। জামির শুধু দেখল লোকটির মুখে এক ঝলক রক্ত উঠে এল। সে তাকে দু’হাতে তুলে গাছের তলায় নিয়ে এসে শুইয়ে দিল।

মুহূর্তে ভিড় হল। কেউ একজন চেঁচালো, রমজান চাচারে ডাক গোলাম পড়েছে। জামিরের থেকে বয়সে কিছু বড় একজন প্রৌঢ় মুসলমান দৌড়ে আসে।

হায় আল্লা, এ কী হল?

জামির রমজানকে জায়গা দেয়। রমজান দু-হাতে গোলামের রক্তাক্ত মুখ ধরে নাড়া দেয়, ডাকে।

নাড়া লেগে নাকমুখ দিয়ে আবার রক্ত ওঠে। গোলামের জ্ঞান নেই। রমজান বিহুলের মতো এদিক ওদিকে তাকায়, কি করবে বুঝতে পারে না। কেউ একজন গামছা ভিজিয়ে নিয়ে এসে নিঙড়ে গোলামের মুখের উপরে দেয়। জামির রমজানের পিঠে হাত দেয়। রমজান তাকে দেখে, সেই একই বিহুল চাউনি।

জামির বলে, ঘরে নিয়ে যেতে হবে।

ঘরে?

ঘর কত দূরে?

ঘর?

জামির পাশের আর দু’একজনকে বলে, ধর তো ভাই। রমজানের ঘর বেশি দূর নয়। সবাই মিলে ধরাধরি করে সেখানে নিয়ে আসে। সকালে যে মানুষটা তাজা ছিল দুপুরে এ অবস্থায় সে ফিরে এলে সে বাড়িতে যা হবার এখানেও তাই হয়। জামির রমজানকে থম দিয়ে বসে থাকতে দেখে, গোলামের মাকে বুক চাপড়ে কাঁদতে দেখে, দেখে গোলামের বউকে জালার মতো পেট নিয়ে উঠোনে অজ্ঞান হয়ে পড়তে।

কেননা বাড়িতে আনার আগেই গোলাম মারা গিয়েছিল। জামির হতবুদ্ধি প্রৌঢ় মানুষটির পাশে সারাক্ষণ বসে থাকে অন্যদের শোক, ব্যস্ততা, কবর দেওয়ার ব্যবস্থাপত্র ইত্যাদি দেখতে থাকে।

 

এইভাবে রমজানের সঙ্গে জামিরের যোগাযোগ হয়। শহরের উপকণ্ঠে রমজানদের গ্রাম। জমি থেকে বিভিন্ন কারণে উৎখাত হওয়া কয়েক ঘর মানুষের বসতি এখানে। প্রায় সবারই জীবিকাগঞ্জের ঘাটের কুলিগিরি। গোলাম ছাড়াও আরো তিনটি সন্তান আছে রমজানের, তাদের মধ্যে বড়টি মেয়ে ও বিয়ের উপযুক্ত।

স্বাভাবিক মানুষের জীবনে শোক কখনো স্থায়ী হয় না। প্রাথমিকভাবে শোক আসে প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস নিয়ে, তখন মনে হয়, কী হবে আর? কী করব এই জীবন নিয়ে? তারপর একসময় শোক ভীষণভাবে চেপে বসে। সে চাপ এমন পাশবিক যে, মানুষ অন্য আর সব শারীরিক কষ্টের মতোই তা থেকে নিষ্কৃতি পেতে চায়। শরীরের একেবারে নিজস্ব কারখানায় তখন সজ্ঞানে অথবা অবচেতনে তৈরি হয় আশ্চর্য প্রতিরোধ, নিজের কাছে এবং অন্যের কাছে কখনো কখনো ভীষণ মর্মান্তিক বোধ হয়। তবুও এই নিয়ম ভারি অমোঘ। শোকের শুরু থেকেই মানুষ নিজের অজান্তে এই প্রতিরোধ তৈরি করতে শুরু করে, পরে মানসিক চেষ্টা তাকে আরো শক্তিশালী করে।

জামির দেখে মূহ্যমান রমজান ধীরে ধীরে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। প্রথমে যে মানুষ বলেছিল, ‘মুই কি পাগল হোই যামো?’ এখন সে বলে, বসি থাকলে চলবে বাজিকর? এবং গঞ্জের ঘাটে স্টিমারের ভোঁ শুনে দশদিনের মাথায় সে উঠে দাঁড়ায়।

কোনো এক অজ্ঞাত সহমর্মিতায় জামির প্রতিদিন এই মানুষটার কাছে আসে। অধিকাংশ সময়ই দু-জনে চুপচাপ বসে থাকে। সুখদুঃখের কোনো কথাই হয় না। যখন কথা হয়, তার বিষয়বস্তু তাদের নিজস্ব দার্শনিক বোধবুদ্ধির লেনদেন। যেমন, রমজান বলে, দ্যাখেক বাজিকরের পো, খোদাতালার কাছে মোর কিছু নালিশ নাই, তবু যে মনটা পোড়ে কান।

তখন জামির বলে, আঃ হা, সিটা ভারী আচ্চয্যের কথা বটে এবং জামির শুধু কথার কথা বলে, যেমন কথার পিঠে কথা বলতে হয়। আবার যেমনি নিজের কথা নিজের কানে যায়, তখন ভাবতে বসে যে কথাটা ঠিক হল কিনা।

সত্যিই আশ্চর্যের কথা এবং জামির ভেবে দেখে সে ঠিকই বলেছে। কেননা, একজন আছে, যার কাছে সব নালিশ অভিযোগ বোষ দুঃখ ইত্যাদি নির্দ্বিধায় প্রকাশ করা যায়, এসব সে অভিজ্ঞতায় জানে না, জানে বুদ্ধিতে। সে জানে রমজানদের এই একজন আছে, তাই কখনো কখনো একটা বিরাট আশ্রয়ের মতো তা কাজ করে। এ আশ্রয় শুধু সমর্পণের জন্য নয়, এ এমন একটা আধার, যেখানে তুমি তোমার যাবতীয় ক্লেদ, ক্রোধ এবং ঘৃণাও নিক্ষেপ করতে পার। এই আশ্চর্য ঈশ্বর কিংবা খোদাতালা রমজান কিংবা তার সগোত্রীয় সামাজিক জীবদের এমন আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে যেখানে চাই না তোমাকে, মানি না তোমাকে, বললেও সেই নিরীশ্বর ঘোষণা আসলে এক পরম আস্তিক্যের অভিমানে আবদ্ধ থাকে। কাজেই গোলামের মা স্বাভাবিকভাবেই বক্সতে পারে, নাথি মারি তুমার মসজিদ আর জুম্মা আর নেমাজেৎ, খোদাতলা নাই, খোদাতালা নাই। থাকলি মোর কপালেং এমুন হয়! আল্লা রসুল! আল্লা রহমানের মহিম! দুনিয়ার বেবাকে হাসির ধামার মতো প্যাটটা দেখবা পালো, আর সি পালো না!

আর তখনি রমজান বলে, না, তার কোনো নালিশ নেই।

হাসি গোলামের বউ। জামির এই দু-জনের কথাই শোনে, হাসির কথা কিছু শোনে না। না শুনলেও সে তার শূন্যদৃষ্টি দেখে, যেখানে সেই একই আস্তিক্যের ভাষা।

তাই সে আশ্চর্য হয় এই ভেবে যে, যদি নালিশই না থাকে তবে রমজানের বুক পোড়ে কেন? নমনকুড়ির বানের মতো সর্বনাশ বাজিকরের আর কী হয়েছে? কিন্তু সে একটা লোকসান। তার সঙ্গে আছে নিতান্তই নিরুপায় দুর্ভাগ্য। কোনো বাজিকর রমণী আকাশের দিকে তাকিয়ে গোলামের মায়ের মতো কাউকে গাল পাড়েনি। কোনো বাজিকর এমন কথাও বলেনি, না আমার কোনো নালিশ নেই। তারা জেনেছিল যে, ক্ষতি যা হয়েছে, তার আর আসান নেই। তাই এমন কারো কাছে আশ্রয় চায়নি যার কোনো জৈব অস্তিত্ব নেই। যে আছে তার নাম রহু। কিন্তু সে কি এমন অমোঘ? পীতেমের মতো জামিরেরও মনে হয়, না, তা কখনোই নয়। আসলে রহু, দনু, পীতেম কিংবা জামির মূলত প্রায় একই। আর বিগামাই, কালীমাই, কি ওলামাই? সেও তো শুধু পথের সংগ্রহ, তার বেশি কিছু নয়।

 

৩২.

লুবিনি জামিরের ভেতরে পুবের এই দেশটার যাবতীয় রীতিনীতি, আচার-আচরণ আত্মস্থ হতে দেখে। সবকিছুই বসলে যাচ্ছিল, বদলাচ্ছিল না শুধু বাজিকরের কপাল। না হলে কোথাকার কোন ভিনদেশি বাজিকর, এখন তার মুখে পর্যন্ত এদেশি ভাষা। শিশুরা এখন যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই এই দেশের ভাষাতেই কথা বলতে চায় বেশি সময়।

এতে জামির এক ধরনের আশ্বস্ত হয়। কেননা, অভিজ্ঞতায় বুঝেছে অস্তিত্ব রক্ষায় এই পরিবর্তন ভালো। কারণ পৃথক গোষ্ঠী হিসাবে বাজিকর এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবে না, একথা পীতেই বুঝেছিল। এখন জামির বোঝে এই পরিবর্তনের মধ্যে যদি মিশে যাওয়া যায়, সেটাই হবে মঙ্গলের।

কাজেই স্বার্থপরের মতো রমজানের সঙ্গে সম্পর্ককে সে আঁকড়ে ধরে থাকে ও ব্যবহার করে। রমজানের সহায়তায় গঞ্জের ঘাটে কুলির কাজ পেতে এখন আর বাজিকর যুবকের অসুবিধা হয় না।

লুবিনি নদীর পাড়ে বসে কিংবা গঞ্জের হাটে এই দেশটাকে আরো গভীরভাবে বুঝতে শুরু করে। সারাদিন সারারাত এই বিশাল নদী দিয়ে অসংখ্য ছোট বড় নৌকো যায়। সেইসব নৌকোয় জীবনের বিচিত্র সব রঙ ধরা পড়ে যার সঙ্গে বাজিকরের কোনো মিল নেই। কোনো নৌকোয় নতুন বউ শ্বশুরবাড়ি যায়। নৌকোর আয়তন দেখে বুঝতে হবে, কেমন ঘরের মেয়ে আর কেমন ঘরের বউ। কী করে বুঝবে যে শ্বশুরবাড়ি যায়, না বাপের বাড়ি যায়? দেখ, মেয়ের মাথায় ঘোমটা আছে কিনা, তার পরে দেখ, সে মেয়ের চোখ ছলোছলো, না হাসিহাসি।

আবার সাহেব-মেম, বাবু-বিবিদের নৌকো কত বড় ও বাহারি। তিন কামরা, bার কামরার নৌকো সব। কোনো নৌকোয় তাকিয়ায় হেলান দেওয়া গেলাস হাতে সাবুদের সামনে বাই নাচ হয়। কোনো নৌকোয় সাহেব-মেম হৈ-হল্লা করে। খানাপিনা করে। আবার জেলে নৌকোই বা কত ধরনের। পদ্মাপারে জেলেরা সর্বত্রই খুব দাপটের।

লুবিনি যখন আবার গঞ্জের হাটে অন্য বাজিকর মেয়েদের সাথে কুহক, ভান্‌মতি, ওষুধ, শিকড়, তাবিজ ফিরি করে, তখনো তো মানুষের কত বিচিত্র জীবনপ্রণালী দেখে।

জামির ধীর স্থির মানুষ। এই ধরনের মানুষ বিবেচক হয়। যে মানুষের ধার ধরতে হয় না কাউকে, তার আত্মসন্তুষ্টি ঠেকায় কে? কিন্তু এমন মানুষ জামির নয়। নমনকুড়ির স্মৃতি অন্য অনেকের কাছে বহু দূরের হয়ে গেলেও জামিরের কাছে নয়। মাথায় বোঝা নিয়ে সে যখন স্টিমার কিংবা নৌকোয় ওঠে, তখন নিরুপায় ঘাম মাথা ও কানের পাশ বেয়ে মুখের উপরে, ঠোঁটে ও জিভেও এসে পড়ে। এই ঘামের নোনতা স্বাদ তাকে এখনো নমনকুড়ির ফসলের মাঠে নিয়ে যায়।

লুবিনিকে সে বলে, এংকাই মিলমিশ হোই যাবে, লয়?

কার সাথ?

ইখানকার মানুষজনের সাথ।

তাই ভাবেন তুমু?

তাই চাই মুই।

জামির এমনই চায়। কিন্তু এ শুধু তার ইচ্ছাই, আর ব্যাপারটা এত সহজ নয়।

লুবিনি বলে, কেন্তু দেখেক, মানুষ হেথায় দু-রকম আছে। আছে হিন্দু, আছে মোছলমান।

সিতে সব্বত্তই আছে।

হাঁ সিটা ঠিকেই। তবি দেখে, ইয়ার সাথ উয়ার মিল নাই, আবার উয়ার সাথ ইয়ার মিল নাই। এ দুজাতের কেরো সাথ বাজিকরের মিল নাই।

এসব কি জানে না জামির? খুবই জানে। তবুও লুবিনির সাথে অলস সংলাপ হিসাবে এই প্রিয় বিষয়টাই সে বেছে নিয়েছিল। আর এখন দেখে কী নির্দয় যুক্তিতে লুবিনি তার ইচ্ছাগুলোকে ভাঙে। তবুও সে কথা চালিয়ে যায়, এ যেন তার নিজের সঙ্গেই দ্বন্দ্ব, হয়ত ভাবে এভাবে একটা সমাধানের রাস্তা নিজের ভেতর থেকেই বেরিয়ে আসবে।

সে বলে, মিল নাই? দেখ না ক্যান্ রমজান মিয়া মোক্ কত খাতির করে, তার বেটাবিটিয়া মোক চাচা কয়, তোক কয় চাচি। তবি?

ইস্টিমারে যখুন দুফরের ভোঁ পড়ে রমজান মিয়া নাইমে অজু করে, তুমারে ডাকে তখুন?

মোক ডাকপে কান? মুই কি নমাজ পড়মো?

লুবিনি যুক্তি দিয়ে বোঝায় যে বাজিকর নমাজও পড়বে তা আবার হিন্দুদের মতো পুজো-আচ্চাও করবে না। যেসব মালোরা দুর্দিনে গঞ্জের ঘাটে এসে কুলিগিরি করে সুযোগ আসা মাত্র নৌকা পাড়ে টেনে তুলে উপুড় করে গাব আর আলকাতরা লাগায়, নিজেরা গায়ে মাথায় তেল মেখে চকচকে হয়। তারপর একদিন গলুইয়ের উপর ফুল পাতা সিঁদুর ধূপ দিয়ে ‘জয় মা গঙ্গা’ বলে নদীতে ভেসে পড়ে। আবার বড় বড় সাঁইদারদের দেখ, ব্রাহ্মণ পুরোহিত এনে পুজো করে, সাঁই সাজায়, কত আর অনুষ্ঠান। সেসব ব্যাপারে কেউ কি বাজিকরকে ডাকে?

না, ডাকে না।

তবি মিল হয় কেংকা?

নিজের মনের সংশয়ের কথাগুলোই জামির লুবিনির কাছ থেকে শোনে। তবু লুর ছেলে সোজন যখন জেলেদের ঘরের একটি মেয়েকে বিয়ে করে আনে, খন সে খুশি হয়।

 

কিন্তু এই খুশি হওয়া দীর্ঘস্থায়ী হয় না। জামিরের অভিজ্ঞতায় গোরখপুরের কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু বালি ও আরো দু-চারজন বেঁচে থাকা বৃদ্ধের স্মৃতিতে পোরখপুর এখনো জীবন্ত। এদেশের মানুষের জাত-পাত সম্বন্ধে সহনশীলতা গোরখপুরের থেকে অনেক বেশি, এ তারা দেখেছে। কিন্তু তবুও বিয়ে এমন একটি ব্যাপার যার শিকড় সমাজের গভীরতম স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত। সাধারণভাবে যা চোখে পড়ে না, এইসব গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সম্পর্কের সূম্ভাবনায় তা উপরে উঠে আসে।

সোজন যাকে বিয়ে করে এনেছে, অথবা যাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছে, সেই মেয়েটি পাখি। পাখি ঝালোদের মেয়ে।

জামির বলে, ঝালো কি? ঝালে আবার কোন জাত? মালো চিনি, ঝালো চিনি না।

লুবিনি চেনে। দুপুরে যখন ঘরে পুরুষমানুষ থাকে না, তখনই তো বাজিকরের মেয়েরা পাড়ায় পাড়ায় ঘোরে। লোকজন, দেশবিদেশ দেখা পুরুষমানুষ বাজিকর মণীদের বুজরুকিতে ভোলে না, দূর দূর করে। কিন্তু মেয়েদের তো অসীম কৌতূহল ঐ পুঁটুলির ভিতরে বাজিকর মেয়েরা, না জানি কি আশ্চর্য সম্ভাবনাময় জিনিসপত্র রেখে দিয়েছে ওর মধ্যে।

লুবিনি বলে, মালো আর ঝালোর ভেতরে তফাত আছে। সে জনা গাঙ্গে শায় বড় জাল নিয়া, নাও নিয়া, সি হোল মালা। সি জালের ফাঁস থাকে। টানা হাক, কি খেল্লা হোক, তাথে অনেক পয়সা লাগে। আরো লাগে নাওয়ের মালিকানা।

আর ঝালো? তার জানে ফঁস নেই। লম্বা লাঠির ভেতরে গলানো কয়েক হাত মাএ সুতোর কারিগরি, বা তিন কাঠির ভিতরে মৌচাকের মতো ঝুলে পড়া নিতান্ত আটপৌরে জাল। সেইসব দিয়ে পুকুর, নালা, বর্ষার খেত কি নয়ানজুলিতে মাছ মারা। পুরুষের পরনে অধিকাংশ সময়ই কোমরের ঘুনসিতে এক ফালি ত্যানা, পেছন ঘুরে ফের কোমরে ওঠার আগে পশ্চাৎকে দ্বিখণ্ডিত করে প্রকট করে। আর মেয়েদের খাটো শাড়ি, যা ঝোলো কন্যার জীবনে একসঙ্গে একাধিক জোটে না।

কিন্তু জামিরের এই সুখী উত্তেজনা খুব স্থায়ী হয় না। পাখির বাপ নীলু হালদার গঞ্জের, ঘাটে মাল বওয়ার কাজও করে। যেহেতু পাখি বয়স্থা হলেও সে বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেনি, তাতে তার লোকনিন্দা ছিল। কাজেই পাখি যখন নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নেয়, তাতে সে স্বস্তি বোধ করে।

কিন্তু তার স্বজনরা তাকে ছাড়বে কেন? তারা নীলুর কাছে কৈফিয়ৎ চায়। কে না জানে বাজিকর বেজাত। ঝালো বলে কি শেষমেশ বাজিকরের হাতে মেয়ে দিতে হবে? একটা সমাজ নেই।

গঞ্জের ঘাটে মানুষজন এ নিয়ে নীলুকে ঠাট্টা করতেও ছাড়ে না। কয়েকদিনের মধ্যে নীলু অতিষ্ঠ হয়ে যায়। মাতব্বরদের সে বলে, তবে কি করবা কও মোক্?

চৈত্র মাসে সব মাছমারাদের চড়কের উৎসব হয়। তাতে বেশ কয়েক বছর ধরে নীলুই হয় প্রধান সন্ন্যাসী। তাকে নিয়মকানুন মানতে হয়। উপোস করতে হয় এবং ঠাকুরের কাঠ ঘাড়ে নিয়ে এক মাস বাড়ি বাড়ি পথ পরিক্রমা করে ভিক্ষা করতে হয়। সেই ঠাকুর বড় সুন্দর। মসৃণ ও চকচকে কালোকাঠের নৌকো, তার উপরে একদিকে খোদাই করা শিবের ও তার বাহন ষাঁড়ের মূর্তি। অন্য পাশে হাত জোড় করা দুই ভক্ত। মাঝখানে একটি শঙ্খ। এহেন কাঠের ঠাকুর নিয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করতে হয় সারা মাস। সঙ্গে থাকে ঢোল, ঢাক, ও কাসি। বাড়ি বাড়ি গান করতে হয়। গান করে হেমন্ত। গান করাই তার নেশা ও পেশা।

হেমন্ত বলে, হল না হয় ঝজিকর। মানুষ তো, জন্তু-জানোয়ার তো নয়। পাখির মনেৎ লাগিছে, ব্যাস, আর কথা কি?

এরকম কথা হেমন্তই বলতে পারে। সে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ায়, সম্বলের মধ্যে একটা দোতারা যন্ত্র। সে যন্ত্রে কত বিচিত্র সুরই বাজায় সে, আর সব সুরই যে-কোনো মাত্রা থেকে সমে এনে ফেলতে পারে হেমন্ত, এমনই ওস্তাদি তার। একজন মাতব্বর তুমি কি বুঝবা, হে! ঘর কর না, সমাজ কর না। মালো গুষ্ঠি পয়সার দেমাকে উচ্চশ্নে যাচ্ছে, ঝালোরা নিজ সমাজে সেটি হবার দিবে না।

নীলু বলে, ঠিক কথা, এলা ঠিক লয়।

হেমন্ত হাসে। বলে, মালো গুষ্টির পয়সাটা তুমি কুনঠি দেখলা, মাতব্বর? দু-চারজন সাঁইদারের কথা বাদ দিলে, আর বেবাকে তো নেংটা, জালের ফান্দি আটকাবার সূতা কিনার পয়সাও তো আজকাল আর জোটে না দেখি।

তমো কি তাদের গরম কমে?

গরম তোমরা দেখ, তাই তাদের গরম। মোক তো কেউ গরম দেখায় না।

ওই আবার! আরি, তুমার কথা আসে কিসে?

হেমন্ত বলে, বেশ তবি তোমরাই কও, মুই শুনি।

বলে সে তার দোতারার কানে মোচড় দিয়ে টুং টাং করে সুর বাঁধতে শুরু সবাই মিলে ঠিক করে পাখিকে ছাড়িয়ে আনতে হবে। ছাড়িয়ে এনে তাকে আবার বিয়ে দিতে হবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয়, এমন কুলত্যাগী মেয়েকে আবার বিয়ে করবে কে, এই প্রশ্নে।

সবার পিছনে বসে বৃদ্ধ পতিতপাবন ঝিমায়। এই প্রসঙ্গে সে মাতব্বর খগেনকে বলে, খগা মোর কথাটা মনে রাখিস, বাপ।

খগেন বলে, আর তুমি থামো তো। সেই সকাল থিকা খালি এক ট্যাক ট্যাক লাগাইছে। বলিছি তো, এ্যাটা বিহিত করে দিব।

হুঁ, দিস বাপ, ভুলিস না।

পতিত এই ঝালোদের মধ্যে ধনী লোক। সামান্য দু-চারশো টাকার সুদের কারবার সে করে, তারও গণ্ডি এই জালো সমাজ। এই পরিণত বয়সে বিপত্নীক হয়ে সে বড় বিপাকে পড়েছে। মাতব্বর খগেনের সঙ্গে তাই সে সকাল থেকেই লেগে আছে। কাজটা যদি খগেন করে দিতে পারে, তাহলে তার পুরনো নোটার কথা না হয় সে আর তুলবেই না। আর কাজটা হল, যদি পাখিকে খুলে আনা যায় তাহলে সে-ই বিয়ে করতে রাজি তাকে।

খগেন এক মুমূর্ষ গোষ্ঠীর মাতব্বর। যখন কোনো সমাজ লক্ষ্মীছাড়া হয়, তখন আর কার মাতব্বরি কে শোনে। কিন্তু মাতব্বরির মজা এই, একবার দায় চাপলে তাকে আর ঘাড় থেকে নামানো মুশকিল। কেউ চাক আর নাই চাক, মাতব্বরির নেশা তাকে মাতব্বরি করাবেই। এইসব সামাজিক সমস্যায় খগেন তাই যেচেই মাতব্বরি করে। দু-একজনকে উসকায়, দলে টানে, তারপরে তার নিজস্ব রায় দেয়। পতিতকে সে আশা দিয়ে রেখেছে দুই কারণে। প্রথমত, পুরনো দেনাটা পতিত তামাদি করে দেবে বলেছে। আর দ্বিতীয়ত, সামাজিক কর্তৃত্ব জাহির করার বেশ জোরদার একটা সুযোগ এই সমস্যা। পাখিকে খুলে আনা ও পতিতের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া, এই দুই কাজে তার কর্তৃত্ব নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু অধৈর্য এই বৃদ্ধের উপর এখন তার রাগ ধরে। সব ব্যাপারটা বেশ হিসাবমতো এগোচ্ছিল, মাঝখানে কথা তুলে সব বেচাল করে দেবে হয়ত।

নীলুকে সে বলে, শোনেক, নীলুদাদা, ইসব অনাচার সমাজের বুকে মুই হবার দিবা পারি না। তুমুও কি পারেন?

লুকে বলতে হয় না, তা পারি কেংকা?

ফির দেখেক, তুমু হলেন তামাম মালো-ঝোলোদের চড়কের পেধান সন্ন্যাসী। বেবাক মানুষ জানে তুমু পেধান থাকলি বাবার পূজাৎ কোন তুরুটি থাকে না। বেবাক মানুষ জানে তুমার মন্তর পড়া হাজরা আগুন, জল, মায় পদ্মা পার হয়া শশানমশানে ঘুরি মড়ার খুলি আনবে ঠিকই।

এসব কথায় নীলুর বুক ফোলে। হাজরা ছাড়ার মন্ত্র এখন একমাত্র সেই জানে। সংক্রান্তির আগের রাত্তিরে মন্ত্রপড়া তেল সিঁদুর দেওয়া খঙ্গ দিতে হয় কোনো ভক্তকে। ভক্ত তখন দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে সেই খঙ্গ হাতে ছুটে যায়। শ্মশান মশানে ঘোরে সারারাত্তির। সেই সময় তার সামনে পড়া খুব বিপদের। বাবার নামে সে তখন যা খুশি তাই করতে পারে। ভূতপ্রেতেরা তখন তার সঙ্গী। ভোের হওয়ার আগে মড়ার মাথার খুলি নিয়ে তাকে হাজির হতে হয়। এর নাম হাজরা ছাড়া।

মাতব্বর আবার বলে, বাবার পূজা তো আর একটা মাস গেলেই। রীতকরম সব তো তুমারই হাতে। এখন তুমুই বল যে কি করা হবে?

কি করবা কও?

পাখিরে তুলি আনবা হবে।

আনলাম, তা-বাদে? কেডা বিয়া করবে তারে?

সি ভাবনাও মুই ভাবি রাখিছি। মামার ঘর খালি। ছোলগুলা তো বেবাক পিরথগান্ন। দেখেক, বুড়া বয়সে মানুষটা বড় কষ্ট পায়। দুডা ফুটায়া দেবার লোকওনাই। অস্বীকার করবা পার না, আপদ বিপদে পতিত হালদারই আমাগোরে দেখে। পাখিরে মামার হাতেই দেও। অনেক বলি কয়ে রাজি কইরেছি মামাক।

হেমন্ত সশব্দে হেসে বলে, অ, তাই কও। তাই মুই ভাবি গাই বিয়ায়, আর যাঁড়ের ইয়া ফাটে ক্যান্।

মাতব্বর খগেন খুব রেগে ওঠে। বলে, হেমন্ত তুমু থামব কিনা? সব কথার মাঝে তুমু এ্যাটা হাসিঠাট্টা আনে ফালাবার চাও। বেপারটা কত গুরুতর সে খ্যাল তুমার নাই।

হেমন্ত হাসতে হাসতেই বলে, খুবই গুরুতর। কি গুরুতর? না, এটা জুয়ান চ্যাংড়ি এটা জুয়ান চ্যাংড়ার ঘরে গিয়া উঠিছে। মাতব্বরের কথা শুনে এটা বুড়ার ঘরেৎ উঠে নাই।

হেমন্তের ইঙ্গিতে পতিতপাবনও উত্তেজিত হয়। বলে, কি মোক বুড়া কইলি, হেমন্ত! মুই বুড়া! জানিস, তোর বাপের কাছে এখনো আটগণ্ডা পয়সা পাই। সি পসা না নিয়াই তোর বাপ মরিছে, তোর কাছেৎ কুনোদিন সে পয়সা চাইছি?

টিকিট তো কাটি রাখিছ মামা। ওপারে গিয়া বাপের কাছ থিকা সি পয়সা নেও গা। আর ক্যান মায়া বাড়াও?

গণ্ডগোলও হয়, হাসিঠাট্টাও হয়। কিন্তু উপস্থিত সকলে শেষপর্যন্ত খগেনের কথাতেই সায় দেয়। না দেওয়ার কোনো কারণ নেই, কেননা, যে যার নিজের সমস্যা নিয়েই এত ব্যতিব্যস্ত যে অন্যের ব্যাপারে চিন্তা করার সময় কিংবা আগ্রহ কারোই বিশেষ থাকে না। কাজেই সমাজে মিলমিশটা অন্তত থাকুক, এটুকু নিশ্চিত হতে পারলেই সবাই খুশি।

কিন্তু পাখি যদি না আসতে চায়, তবে? বাজিকরেরা যদি না আসতে দেয়? আসবে না। তার ঘাড়ে কয়টা মাথা? আসতে তাকে হবেই।

আর বাজিকরেরা যদি তাকে আটকে রাখার মতো দুঃসাহস করে তবে তার প্রতিফলও তারা পাবে।

এসব কথায় হেমন্ত ভয় পায়। সে তার নিজ গোষ্ঠীর এইসব হা-ঘরে মানুষগুলোকে ভালোই চেনে। ঝড়ে ভাঙা, বৃষ্টিতে ধোওয়া কুঁড়েঘরগুলোর ভেতরে যে এত রকমের সড়কি, বল্লম, হেঁসে থাকতে পারে, একথা আর কেউ না জানুক হেমন্ত জানে। আর নিস্তরঙ্গ দুঃখপীড়িত জীবনে, যে কোনো কারণেই বিরোধ হোক না কেন প্রতিপক্ষকে মনে হয় যাবতীয় দুর্দশার কারণ। ভীষণ আক্রোশ তখন রক্ত ছুটবে ফিনিক দিয়ে, লাশ পড়বে, পদ্মাচরের উদ্দাম হাওয়ার মতো ছুটে চলে যাবে মানুষ রক্ত দর্শন করতে? উত্তেজনা আর উত্তেজনা। এইসব সময়ে পনেরো-বিশ বছরের পুরানো ঘরণীকেও নতুন ও উত্তেজক মনে হয়। হেমন্ত এসব জানে।

সে বলে, দেখেক, দাঙ্গা যায়া লাভ নাই। ফির সি থানা পুলিসের ঝামেলি, শেষমেশ তিষ্টোবার জাগা পাবা না কোথাও। সিৰ্বারকার মালোদের সাথে বিবাদের কথাটা ভাবে।

তবি তুমুই দায়িত্ব নেও, মায়া খুলে নিয়ে আসে।

খগেন হেমন্তকেই দায়িত্ব দিতে পায়। হেমন্ত অবশ্যই এসব কাজে উপযুক্ত ব্যক্তি। সর্বত্র তার যাতায়াত, সব মানুষের সঙ্গেই তার খাতির। নীলুও বলে, হ্যাঁ, ভাই, তুমুই যাও, মাথা ঠাণ্ডা লোক তুমু, তাথে ঝামেলি কম হবে।

হেমন্ত বলে, নীলুদাদা, তুমার মনের কথাও কি এড়া? নীলু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দেয়, মোরে শুধায়ো না, জবাব পাবা। বিটির বে দিবার পারি না, খোওয়াবার পারি না, আর এখনও ভাবারও পারি না কিছু।

তরুণ বয়সের একজন বলে, কাকা, গান শউনি না অনেকদিন, এট্টা গান করেক। গানের জন্য হেমন্তকে পেড়াপেড়ি করতে হয় না কখনো। সে আনমনে দোতারার কান মুচড়ে সুর বাঁধতে থাকে। তারপর ভারি সময়োপযোগী একটি গান ধরে সে।

উজানী নগরের কাটা জলে ভেসে যায়,
কাহারো বসনে লাগে কাহারো হিয়ায়।
আশ্বিনে অনাবৃষ্টি যদি
ফলন নাই পোয়ালের গাদি,
ভরা যৌবনের কালে বাপ ভাই হইল বাদী।
উজানী নগরে যাব,
পিরিতের ধন চিনে নিব,
যে করে সে করুক মানা,
কারো কথাই শুনিব না।
গাঙ্গের জোয়ার নিশিদিনই বয়—
শরীলে যৌবন দুটি দিন বইতো নয়।

 

তার পরের দিন হেমন্ত জামিরের কাছে এসেছিল। বাজিকরেরা তাকে চেনে ও পছন্দ করে। সেখানেও সে এই গানটিই প্রথম করে। তারপরে গল্পকথার মাঝেমধ্যে সে বারবার বিষয়টা উত্থাপন করার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। খবর পেয়ে একসময় পাখি আসে, তার সাথে সোজনও আসে। পাখির দেখাদেখি সোজনও তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। তখন হেমন্ত একেবারে বিহ্বল হয়ে যায়। বেশ মানিয়েছে দু-টিকে। আর কি খুশির ভাব দু-জনের! কি করে আর সে এখন ওসব কথা তোলে?

সবাই চলে গেলে জামিরকে হেমন্ত কথাটা বলে। শুনে জামির কিছু সময় গুম হয়ে থাকে। শেষে বলে, তুমাদের স্বার্থ মোদের সম্পর্ক হবার পারে না?

হেমন্ত বলে, বুঝি না বাজি মোর তো কেরো সাথই সম্পর্ক আটকায় না।

ঠিক আছে, তুমাদের মেয়াকে ডাকি। তুমু নিজে মুখেৎ তা বলে যাও। জামির বহুদিন পরে রাধার কথা ভাবে। সময় সবাইকে সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু জামির নিজেকে এখনো অপরাধী করে রেখেছে। তাছাড়া এতদিন এদেশে বাস হয়ে গেছে। জামির ভেবেছিল, হয়ত মানুষ গ্রহণ করবে তাদের আস্তে আস্তে। কিন্তু হচ্ছে না, কিছুতেই শিকড় গাড়া যাচ্ছে না।

পাখি এলে সোজনও সঙ্গে আসে। জামির অন্যদিকে তাকিয়ে পরিষ্কার গলায় বলে, তোমা ফিরা যাবার হবে।

পাখি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

সোজন বলে, ক্যান?

ঝালোরা চায় না তাদের বিটি মোদের ঘরে থাকে।

কেন্তু তা তো মুই বিহা করি আনিছি।

সি বিহা তারা মানে না।

পাখি বলে, মুই যামো না, কাকা। বাপেরে বুঝাও তুমরা।

হেমন্ত অধোবদন হয়ে বসে থাকে।

কাকা তুমার দুটি পায়ে পড়ি, মোক্ নিবার চায়ো না।

মুই নিবার চাই না মাও, চায় না তোর বাপও, কেন্তু সমাজ চায়। তারা তুমাকেও ছাড়বে না, তুমার বাপেরেও ছাড়বে না।

পাখি এতক্ষণে নিজেকে শক্ত করে। বলে, বেশ, গেলাম মুই, তা-বাদে তুমার মাতব্বরেরা মোর কি গতি করবে?

ফির বিয়া দিবে তুমাক্‌।

কেডা বিয়া করবে মোক্ এরপরে?

লোক আছে।

কেডা সে লোক?

হেমন্ত মনেপ্রাণে চাইছিল পাখি বিদ্রোহ করুক। এই দৌত্য করতে রাজি হয়ে সে কি আহাম্মকি করেছে। এখন তাই সে মনেপ্রাণে চাইছিল মেয়েটা অস্বীকার করুক ঝালোদের মাতব্বরদের নির্দেশ, পালিয়ে যাক এখান থেকে, যা খুশি তাই করুক। তাই সে নির্দ্বিধায় বলে, সি লোক হইল পতিত হালদার।

কাকা! ইসব থালে তুমাদের মোর বাপেক বেকায়দা করার চাল, নয়?

যা বলো।

মুই যামো না, যা পারো করেন তুমরা।

পাখি হন হন করে হেঁটে চলে যায়। সোজন দাঁড়িয়ে থাকে। খানিকক্ষণের স্তব্ধতা। সোজন ফিরে যাওয়ার জুনা সুরে দাঁড়াতেই জামির আদেশের গলায় বলে, সোজন দাঁড়া। সোজন আবার ঘুরে দাঁড়ায়।

জামির বলে, ও মেয়া ঘুরাই দিবার হবে।

সোজন ভয়ে ভয়ে বলে, না।

জামির চিৎকার করে তাকে সতর্ক করে, সো-জ-ন!

সোজন বেশ কিছু সময় চুপচাপ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর ধীর পায়ে চলে যায়।

জামির হেমন্তকে বলে, কাল তুমাদের মেয়াক্‌ ফিরত পাবা, হালদার। আজ যাও।

হেমন্ত যেমন চেয়েছিল তেমন হয় না। সে ভারি দুঃখ পায়। একসময় চক্রান্ত করার ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বলে, বাজিকর উয়াদের কহেক পালাই যাবার।

জামির একটু হাসে। বলে, তা হয় না হালদার। তুমু তো বাজিকরের তাম্বুতে জম্মাও নাই, তুমু ইসব বোঝবা না।

 

পরদিন পাখি ফেরত চলে এসেছিল। সোজন তার পাশাপাশি অনেকদূর পর্যন্ত এসেছিল। তারা কোনো কথা বলেনি, তবুও তাদের উভয়ের মনই প্রচণ্ড বাঙময় হিল। সেখানে ছিল অজস্র কথা। ঝালোপাড়ায় ঢোকার বেশ খানিকটা দূরে একটা গাছের নিচে পাখি দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে, আর নয়, বাজিকর, ইবার ঘুরে যাও।

সোজন তার চোখে চোখ রাখে। চারদিকে গ্রীষ্মের দুপুরের স্তব্ধতা। সামনে কিছু দূরে পদ্মার বালিয়াড়ি, তারপরে পদ্ম। পাখি সেদিকে তাকিয়ে ঘূর্ণি হাওয়ায় খড়কুটো ঘুরপাক খেয়ে ছুটে যেতে দেখে। কিন্তু সোজনের চোখ তার মুখে।

সোজন তার মুখ দু-হাতে তুলে ধরে। পাখি দুর্বল হাতে সোজনের হাত সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে। বলে, লোভ কোরো না বাজিকর, এ লোভের তো শেষ নাই।

অথচ সোজনকে সে সত্যিই বাধা দিতে পারে না। সোজন তাকে বুকের মধ্যে পিষ্ট করে। বলে, আর দেখা হবে না, পাখি? পাখি কষ্টে নিজেকে মুক্ত করে। বলে, এক দেশে বাস, দেখা তো হতেই পারে। কেন্তু তাতে লাভ? সি তো খালি কষ্ট, বাজিকর!

দু-টি অল্প বয়সের তরুণ-তরুণী শিশুর মতো কাঁদে পরস্পরকে ধরে। তারপর একসময় হাত ছাড়িয়ে পাখি দৌড়ে খানিকদূর এগিয়ে যায়। আকুল আগ্রহে সোজনের দুই হাত তাকে ধরবার আগ্রহে সামনে বাড়ানো অবস্থায় থমকে থেকে যায়। পাখি ছুটতে থাকে, মাটির ঢেলার আঘাত লেগে একবার পড়ে, আবার সে উঠে ছোটে। তার আঁচল মাটিতে লুটোয়। সে ভ্রুক্ষেপ করে না। সোজন সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে।

 

৩৩.

গঞ্জের ঘাটে রমজান এবং তার গ্রামের বেশ কয়েকজন হঠাৎ অনুপস্থিত হতে শুরু করল। জামির বিষয়টা প্রথমে স্বাভাবিক অনুপস্থিতি বলে ভেবেছিল। কিন্তু পাঁচ-ছ-দিন পর পর না আসতে দেখে সে খবর নিতে একদিন দুপুরে রমজানদের গ্রাম মামুদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। মামুদপুর পর্যন্ত তার যেতে হয় না, তার আগেই পদ্মার একটা নতুন চরে সে রমজানকে অন্য অনেকের সঙ্গে ব্যস্ত দেখে। সময়টা শীতের শেষ, কিন্তু পদ্মার উন্মুক্ত করে রোদের তাপ বেশ চড়া। জামিরকে দেখে রমজান এগিয়ে এসে একপাশে বসে।

হাওয়ায় মিহি বালি উড়ছে। সেই হাওয়া রমজানের চুল-দাড়িকে এমনভাবে বিশ্বস্ত করছে যে তাকে প্রায় অপরিচিত মনে হচ্ছে এখন। কাছেই নদীর জল, ক্রমশ প্রশস্ততায় যেন দিগন্তের সঙ্গে মিলেছে, সেখানে নদীর রঙ ঘন নীল।

জামির বলে, এসব হচ্ছেটা কি? ক-দিন কামে যাবার দেখনো না?

রমজান সলজ্জ হাসে। বলে, লেও, তামুক খাও। আর কহেন ক্যান, চাষার ছেলে, গোরে না গেলে তো নেশা কাটবে না।

চাষার ছেলে, তো এই মরুভূমিতে কি?

সেটাই তো কছি রে, ভাই নিজের তো আর জমি-জিরাত নাই। জমি নাই তো চাষও নাই, কিন্তু হাত যে নিশপিষ করে, বুক যে ফঁফড় করে। তাই পোতি বছর চরের এই পলি বন্দোবস্ত করি কাছারির সাথ।

কী চাষ হবে এখানে?

তরমুজ, তরমুজের চাষ।

তরমুজের চাষ এই বালিতে হয়?

হ্যাঁ, দেখ নাই তরমুজের খেত কোনোদিন?

দেখেছে নিশ্চয়ই, খেয়াল করে দেখেনি। বাজিকর কী দেখেনি এই দুনিয়ার? রমজানের বুকের ফাফর জামিরের বুকে সংক্রমিত হয়। সে বলে, কেমন লাভ থাকে তরমুজের চাষে?

ফসল যদি ভালো হয়, লাভ তোমার ভালোই থাকবে। তবে তরমুজের লতা আর কোলের ছাওয়াল মানুষ করা এক কথা কিনা।

জামির তখন আরো সবকিছু জানতে চায়। কী করে চাষ করতে হয়? কাছারিতে গেলে আরো বন্দোবস্ত পাওয়া যাবে কিনা? পেলে কিসের বিনিময়ে পাওয়া যাবে? চাষের পদ্ধতি রমজান শিখিয়ে দেবে কিনা?

রমজান বলে, কেন, বাজিকর, নেশা লেগে গেল নাকি? বাজিকরের চাষের নেশা!

জামির দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নমনকুড়ির ধানের সুবাস নাকে এখনো লেগে আছে। পথচলতি মানুষের ধানের খেতে হাওয়ার দোলা দেখলে এখনো বুকে তুফান তোলে। দেখতে দেখতে হল তো বেশ কয়েক বছর, তবুও।

সে রমজানকে বলে, চাষের কাম কিছু জানা আছে, রমজান ভাই। তাই চাষের কথায় মন মোরও পোড়ে।

সে সংক্ষেপে নমনকুড়ির কথা বলে, নানা পীতেমের কথা বলে, যাযাবর জীবনের থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তারা যা যা করেছে সেসব বলে, বলে তার আশা-আকাঙ্খার কথা।

রমজান বলে, তাই বল, বাজিকরের এত চাষের কামের খোঁজ ক্যান।

ফেরার পথে কোনো নতুন উদ্যম জামিরকে পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। তার মনের ভেতরে তরমুজের চারা তখন অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছে। সে তাড়াতাড়ি ফিরে পরতাপের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে চায়। পরতাপই চাষবাসের বাপারে তার পথপ্রদর্শক।

কিছুদূর এগিয়ে নদীতীরে একটা গাছের নিচে জামির এই নির্জন দুপুরে সোজনকে একাকী বসে থাকতে দেখে। সোজনের দুই হাঁটুর উপরে দুই হাত আড়াআড়ি রাখা। সেই দুই হাতের উপরে চিবুকের ভর রেখে সে দিগন্তজোড়া নদীর বাঁকের দিকে তাকিয়ে। এখান থেকে পদ্মার বুকের মধে দেখা যায় দুটি দিয়াড়া। দ্বীপ দুটিতে সবে মনুষ্য বসতি শুরু হয়েছে। সমস্ত চর দখলের ইতিহাসে রক্তপাতের ঘটনা থাকে। এই দুটি দ্বীপের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একটি দাঙ্গা তো বাজিকরেরা নিজেরাই প্রত্যক্ষ করেছে। স্থানীয় মুসলমান চাষিদের সঙ্গে হালদার জেলেদের সংঘর্ষ হয়েছে বারবার। বস্তুত দ্বীপ দুটি জেগে ওঠার সময় থেকেই জেলেরা এদের ব্যবহার শুরু করে। অবশ্য যেহেতু জীবনের অধিকাংশ সময়ই তারা জলে কাটায়, সেজন্য দ্বীপ দুটিতে তাদের স্বাভাবিক অধিকার ধরে নিয়েছিল এবং নদীপথে চলাচল করার সময় মাছ ধরা ও পোতাশ্রয় হিসাবে এগুলিকে তারা ব্যবহার করত।

যতদিন পর্যন্ত এই দিয়াড়া দু-টি উলঙ্গ ছিল, ততদিন কোনো ঝামেলা হয়নি। এই শিশু অবস্থা খুব কমদিনের নয়। তারপর ক্রমে দিয়াড়া আরো উঁচু হয় এবং সবুজের সাজপোশাক পরে মনোরম হয়। আর তখনি শুরু হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা। স্থানীয় অবস্থাপন্ন মুসলমান চাষিরা দ্বীপ দুটির দখল নেওয়ার জন্য আশপাশের জমিদার কাছারিতে চক্রান্ত করতে থাকে। হালদাররা জালিক কৈবর্ত হলেও যাদেরই সামান্য সহায় সম্বল আছে, তারাই চাষের সময়ে মাঠে নামত। দ্বীপ দুটি তাদের আয়ত্তের মধ্যে থাকায় তারা অবসরমতো কিছু-কিছু ধান ও কলাই ছড়াত এখানে। পলির প্রলেপ পড়া দ্বীপে বিনা আয়াসেই ফসল হচ্ছিল ভালো।

দিয়াড়া ও চর দখল কিংবা বেদখলের কৌশল একটাই। হঠাৎ প্রচণ্ড শক্তি প্রদর্শন করে জানান দিয়ে হয় দখল। আর বেদখলে শক্তিপ্রদর্শন হয় নির্মম ও চরম। ফলে লাশ পড়া একটা প্রায় নিয়মের ঘটনা। এতে অন্য কোনোরকম বোঝাপড়ার অবকাশ নেই।

মুসলমান জোতদাররা এক সিকস্ত জমির ক্ষতিপূরণ হিসাবে এই দিয়াড়া দুটি প্রায় দাবির আকারে উপস্থিত করে। পদ্মায় যেহেতু সিকস্ত তটের অভাব নেই, কাজেই দাবিদারেরও অভাব হয় না। সিকস্ত জমির একটা গ্রহণযোগ্য মানবিক আবেদন থাকে যার সঙ্গে আইনের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও মানুষের সমর্থন পাওয়া কঠিন নয়।

কিন্তু হালদাররাও ছাড়ার পাত্র নয়। এই কুমারী দ্বীপ দুটির মালিকানা যেন তাদের প্রকৃতিদত্ত। কাজেই বেদখলের লড়াই দীর্ঘদিন যাবৎ ক্ষেপে ক্ষেপে এবং বেশ তীব্র আকারেই হয়। বেশ কয়েকটি লাশ পড়ে। শেষপর্যন্ত একটা অঘোষিত চুক্তিতে উভয়পক্ষ কিছুকাল স্থির থাকে। এই চুক্তির কারণ মুসলমান জোতদাররা হালদারদের হাত থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট দ্বীপটি ছিনিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছিল। তারা অবশ্য আপাতত কিছুটা দম নেবার জন্যই থেমে গিয়েছিল। কিন্তু হালদাররা নিজেদের স্তোক দিয়েছিল এই ভেবে যে, প্রতিপক্ষ যদি ছোট ভূখণ্ডটি নিয়ে শান্ত হয়, তত খারাপ কি? বড়টা তো রইল নিজেদের দখলে। সুতরাং একটা অস্বস্তিকর শান্তি বিরাজ করে যার আড়ালে গোপন প্রস্তুতি চলে।

দূর থেকে দ্বীপ দুটিকে ভারি চমৎকার সবুজ দেখায়। জামির দ্বীপ দেখতে দেখতেই সোজনকে দেখে। সোজনকে দেখে তার মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। দ্বীপ এবং সোজন, এই দুই বিষয়ই তাকে এক নিমিষে নমনকুড়িতে নিয়ে যায়। দ্বীপ দুটির ফসলের প্রাচুর্য তার মনে নমনকুড়ির স্বল্পস্থায়ী কৃষকজীবনের মধুর স্মৃতিতে আলোড়ন করে, আর সোজন তাকে স্বার্থপর বেদনায় নিষিক্ত করে। সে সোজনের উপর নিষেধ আরোপ করেছে, অথচ রাধার ব্যাপারে নিজেকে শাসন করতে পারেনি।

সোজনের পিছনে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ে, সোজন টের পায় না। একটু ইতস্তত করেসে স্নেহের কণ্ঠে বলে, সোজন

সোজন ফিরে তাকায় না।

জামির পিছন থেকে তার মাথায় হাত রাখে। সোজন মুখ ঘোরায়, তারচোখের বেদনার সঙ্গে বিরক্তি মিশ্রিত হয়। সে কিছু বলে না, জামিরের চোখে বিষণ্ণ স্নেহ। সোজন আমল দেয় না। সে হঠাৎ উঠে নদীর ঢালের দিকে নেমে যায়, পিছনে ফিরে তাকায় না।

জামির অপমান বোধ করে না, দুঃখ পায়। আহা, ছেলেটাকে দিওয়ানা করে দিলাম, সে ভাবে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে সোজনের চলে যাওয়া দেখে। সূর্য হেলে পড়েছে, বালির উপর দীর্ঘ ছায়া ফেলে সোজন জলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দমকা ঘূর্ণি হাওয়া ‘ডানের কুটো’ উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে নাচের ভঙ্গিতে। জামির আরো বেশি করে চিন্তা করে, সোজন ও সমস্ত বাজিকর সন্তানদের স্থিতি দিতে হবে। স্থায়িত্ব একান্তই দরকার। আর সেজন্য পদ্মার বালিয়াড়িতে তরমুজের চাষ দিয়েই শুরু হোক না নতুন করে।

ফিরে যাওয়ার আগে জামির দেখল নদীর পাড়ে বাঁধা অনেকগুলো জেলে নৌকোর একটা গলুইয়ের উপর উঠে সেজন আবার একই ভঙ্গিতে বসে পড়েছে।

 

৩৪.

মাতব্বর খগেন পতিতের দেনার দায় থেকে মুক্ত হয় না। পাখি ফেরত এলেও পতিতের বউ হতে তার ঘোরতর আপত্তি। একথা একবার তার বাপ বলতে গিয়ে মেয়ের কাছে এমন চোপা শোনে যে দ্বিতীয়বার এ প্রসঙ্গ ওঠাতে আর সাহস পায় না।

পতিত বলে, খগেন, হয় টাকা ফেরত দে, না হয়তো পাখিরে এনে দে।

কেননা পাখির টোপে খগেন আরো কিছু টাকা নিয়েছিল পতিতের কাছ থেকে। সে বলে, ভালো মুশকিল! তুমি এটু ধৈর্য ধরবা পারেন না? এ কি এক কথার কাম?

ধৈর্য! ধৈর্য কি রে শালো? আমগাছটা কাটার সময় পর্যন্ত তুমি আমারে ধৈর্য ধরাবার চাও, না? তোমার মতলব বুঝি না। আমার ধৈর্য ধরার সময়ে আছে রে হারামজাদা?

তবে কি ভাবিছেন, পাখি এক্কেরে নাপাতে নাতে আসে তোমার গলায় মালা দিবে?

ও-রে-স-শালা! ও-রে-স-শা। তুই তো মানুষ জ্যান্ত খুন করবি। আঁ! এই কদিন আগেই কলি সব ঠিকাক?

হবে, হবে এত ব্যস্ত হয়েন না দেখি।

কিন্তু হয় না। পাখির যা মুখচোখের ভাব, খগেন তার কাছে ভিড়তেই সাহস পায় না। তার বাপকে বললে উল্টো দু-কথা এখন শুনিয়েই দেয় নীলু। কাজেই খগেন এখন পালিয়ে বেড়াতে থাকে পতিতের কাছ থেকে।

শেষপর্যন্ত পতিত তাকে ও অন্য সবাইকে রেহাই দিয়ে যায়। এসব ঘটনার মাস দুয়েকের মধ্যে সে মরে। এমন কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। বয়স তো ষাটের উপর হয়েছিলই, কয়েকদিনের জ্বরে সে মরে যায়।

আমগাছটা কাটার সময় তার ছেলেদের কাছে এসে খগেন হা-হুতাশ করে, আহাহা, কি মানুষটাই ছেল! পুণ্যিমান লোক, তাই ভোগান্তি বেশি হোল না, যেমন পড়া তেমন মরা।

তারপর অন্যদের কাছে বলে, এজন্যিই বিয়া বিয়া বাই উঠিছিলি, কী যে মানুষের লোভ!

পাখি অন্য সবার সঙ্গে পতিতপাবনের শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন খেয়ে আসে এবং এজন্য কোনো হীনম্মন্যতায় ভোগে না। সে বরং হেসে হেসেই সবার সঙ্গে কথা বলে। এতে অন্যেরা, বিশেষ করে পুরুষেরা তার দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়। কেননা পতিতের শ্রাদ্ধে পাখির খেতে আসা ও তার হাসাহাসি পুরুষেরা বেহায়াপনা বলেই ধরে নেয়। আর রসিক মানুষ যদি কোনো স্ত্রীলোককে বেহায়া ধরেই নেয়, তাহলে তার বিপদের অন্ত থাকে না। তার থেকেও বড় কথা, পাখি হাতফেরতা স্ত্রীলোক। কোনো রমণী হাত-ফেরতা হলে লোভী মানুষ তাকে খুবই সহজলভ্য বলে ধরে নেয়। এতে ইদানীং পাখির বড় বিপদের আশঙ্কা হয়। তাকে অনাবশ্যক সতর্ক থাকতে হয়।

সতর্ক থাকতে হয় বয়স্ক মানুষদের কাছ থেকেও। যেমন খগেন, সে অবান্তর ঘনিষ্ঠতা করতে এসে বলে, খুব যাহোক সিদিন বুড়ার ছেরাদ্দ খায়ে আলি। কা-আনডো!

খগেন দাওয়ার উপর উঠেই বসে। অযাচিতভাবে আবার বলে, বুড়ার সাথ বিয়া না বসে ভালোই করিছিস, না হলে দেখ খামোকা অকালে বিধবা হবার হোত।

পাখি তাকে একেবারেই উসকাবার সুযোগ দেয় না। দেয়ালের মতো মুখে বলে, বাবা বাড়িত নাই, কিছু কথা থাকলে পরে আসবা পারেন।

বেহায়া খগেন হাসে। বলে, নীলাদার কাছে আসিছি আমি? যাছিলাম রাস্তা দিয়া, ভারি জল তেষ্টা পায়লো। এক ঘটি জল দে পাখি, খাই।

জল চাইলে আর মানুষ না করে কি করে! পাখি ভিতর থেকে জল এনে দাওয়ার উপরে রাখে।

খগেন পাখির মুখের দিকে তাকিয়ে নির্লজ্জের মতো হাসে, তারপর চোখ মটকায়, বলে, খালি জলই খোয়াবি? আর কিছু খোয়াবি না?

পাখির চোখ মুহূর্তে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। এই লোকটা প্রতিবন্ধক না হলে হয়ত সোজনকে ছেড়ে আসতে হতো না তাকে। আর এখন এ জানোয়ার

সে মুখে বলে, খোয়াচ্ছি দাঁড়ান।

সে ভিতরে যায়। বেড়ার পাশে দাঁড় করানো আছে তিন নলা মাছ-ধরা কোচটা। মোটা লোহার তিনটে শলাকা ত্রিভুজের আকৃতিতে লম্বা বাঁশের হাতলে আটকানো। তিনটা ফলাতেই বর্শির মতো উল্টো দিকে টানা আ। সে কোচটা হাতে নিয়ে বাইরে আসে।

এডা দেখিছেন?

খগেন লাফ দিয়ে দাওয়া থেকে নিচে নামে। ওরে বাপরে, এ যে একেবারে আলাদ সাপ, যেন এখুনি ছোবলাবে।

সে শুধু মুখে বলে, অ্যাই, অ্যাই, পাখি—আরি না, সি কথা লয়-আরি!

পাখি তার পিছনে পিছনে দাওয়া থেকে নামে ও বোঝে, এই তার মওকা। এ সময় চেঁচাতে হয় ও গালিগালাজ করতে হয়। এবং সে তা করেও। ভর দুপুরের সময় এমন কাণ্ড। পাখির গলা শুনে মানুষজন ঘরের থেকে বের হয়, এদিক সেদিক থেকে এগিয়ে আসে।

পাখির চিল্কার আরো বাড়ে, মাতব্বর, ঝালোর মাতব্বর। বড় জলের তিয়াস মাতব্বরের! আগো, তোমরা জল দেন মাতব্বরকে। আবার কথা কি, খালি জল খোয়াবি? দেখিছ এই ট্যাডা? নাড়িভুড়ি বার করি দিমো, তবে আমি এক বাপের বেটি!

খগেন পালাতে পারে না। তোতলাতে তোতলাতে সে যা বলে, তা হল, অ্যাই দেখ আরি, আমি একটু জল খাবার চালাম, তা দেখ—ইসব কিসব আকথা-কুকথা? আঁ? আমি

অর্থাৎ খগেন এখন আত্মরক্ষার ভূমিকায়। ছোরারা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে টিটকারি দেয়। খগেন সরে পড়ে। তারপরেও পাখি বেশ খানিকক্ষণ চেঁচায়।

নীলু এরপরে আসে, ভিড় দেখে, পাখির চিৎকার শোনে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে। তারপর যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে একপাশে রাখা মাটির কলসি থেকে জল ঢেলে পা ঘোয়, মুখ হাত পোয় এবং গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে ভিতরে ঢুকে যায়। এসবে তার কিছু যায় আসে না।

 

কিন্তু পাখির দিন এভাবে যায় না। অন্য সবার মতোই নদীর তীরে সে সোজনকে নিঃসঙ্গ বসে থাকতে দেখত। তার বুক খাক হয়ে যেত, কিন্তু তবুও সবকিছু ভাসিয়ে দিয়ে, অস্বীকার করে সোজনের কাছে যেতে পারত না। সে সবসময়ই বাজিকর বৃদ্ধদের আকুল আবেদনের কথা মনে রাখত। কেননা তারা সব ঘরপোড়া গরু এবং পাখি সোজনের সম্পর্কের মধ্যে দেরিতে হলেও সিদুরে মেঘ দেখতে পেয়েছিল ঠিকই।

তারপর সোজন একদিন হারিয়ে গেল। নদী পার হয়ে দশ-পনেরো জনের একটা নলুয়া বাদিয়ার দল এপারে এসেছিল। এদের মূল জীবিকাই হল পাখি ধরা ও পাখি মারা। নানারকম কৌশল তাদের পাখি মারবার। তার মধ্যে সবচেয়ে বিচিত্র পদ্ধতি হল বাঁশের নল দিয়ে মারা। এক গোছা বাঁশের নল থাকে এদের প্রত্যেকের হাতে। প্রথম নলটির মাথায় থাকে একটা লোহার ছুঁচলো কাটা। গাছের পঁচিশ ত্রিশ হাত উঁচুতে পাখি থাকলেও এই নল দিয়ে অদ্ভুত নিপুণতায় তারা পাখি মারতে পারে। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে একটা নলের পিছনে আরেকটা নলকে জোড়া দিয়ে দীর্ঘ করে। পাখি উপরের নলটির কাছাকাছি হলে আচমকা গেটের নিচ থেকে খোঁচা মেরে পাখিকে বিদ্ধ করে। এভাবে নল দিয়ে পাখি শিকার করে বলে তাদের নাম নলুয়া বাদিয়া। পাখির মাংস ও নানারকম পোমানা পাখিও এরা বিক্রি করে।

নিঃসঙ্গ সোজন নলুয়াদের পাখি শিকার ও পাখি ধরার পদ্ধতিতে প্রথমে আকৃষ্ট হয়। তার সামনে একদিন নলুয়ারা কয়েকটি টিয়াপাখি ধরল অদ্ভুত কায়দায়। তীব্র আঠা মাখা একটা পাখির দাঁড় দড়ি দিয়ে গাছের ডালে প্রথমে তারা ঝুলিয়ে দেয়। তারপর সময় বুঝে একটা পোষা টিয়াকে ছেড়ে দেয়। টিয়া গিয়ে ঝাঁকে বসে, ভাব আদান প্রদান করে বনের পাখির সঙ্গে। তারপর একসময় শেষে এসে সেই আঠা লাগানো দাঁড়ে বসে। বনের পাখিরা এই নতুন সঙ্গীর চালাকি ধরতে পারে না, তারাও এসে দাঁড়ে বসে ও আঠায় পা আটকে ফেলে। নলুয়া তখন দড়িতে ঢিল দিয়ে দাঁড় নামায় ও পাখি ধরে।

সোজন তারপর তাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ঘুঘুর ফাদে ঘুঘু ধরতে দেখে। এইভাবে নলুয়াদের সাথে ঘুরতে ঘুরতে সোজন একদিন তাদের সঙ্গেই কোথায় চলে যায়। জামির অনেক খোঁজ করেও তাদের হদিস করতে পারে না। শুধু জানতে পারে নদীর ওপারে মুর্শিদাবাদে কোথায় যেন গিরিয়া প্রান্তর আছে। বর্ষার সময় সব নলুয়ারাই সেখানে আশ্রয় নেয়। গিরিয়াই তাদেরনির্দিষ্ট ঠিকানা, কিন্তু বছরের এই সময় তাদের খোঁজ করা বৃথা। জামির, জিল্লুর কাছে মুখ দেখাতে পারে না।

পাখি আর নদীতীরে সোজনকে দেখে না। পরে সে সব শোনে এবং এতদিনে যথার্থই নিরাশ্রয় হয়ে যায়। প্রচণ্ড হতাশা তাকে কুরে কুরে খায়। কেননা সে পুরুষমানুষের দেহের স্বাদ পেয়েছিল, আর সে পুরুষ ছিল সোজনের মতো সুদর্শন জোয়ান। যে কারণে খগেনের মতো বয়স্ক মানুষও তাকে প্রলুব্ধ করার সাহস পায় সে কারণ এটাই। খগেন এবং খগেনের মতো অভিজ্ঞ আরো অনেকে জানত পাখির পক্ষে সতীসাধ্বী হয়ে থাকা সম্ভব নয়। কাজেই সন্ধ্যার পরে তার ঘরের পিছনে শিসের ঝড় উঠত কিংবা কাশি শোনা যেত। চলতে ফিরতে একাকী বহু সময়ই মানুষ তাকে প্রকাশ্যে ইঙ্গিত ছুঁড়ে দিত কিংবা সরাসরি প্রস্তাব করত খগেনের পদ্ধতিতে।

পাখি প্রথম প্রথম রাগলেও, পরে আর রাগে না এবং একসময় আবিষ্কার করে যে সে এসব উপভোগ করতে শুরু করেছে। তার অভ্যন্তরের চাহিদা ও দহন তাকে নিরুপায় এক ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বুঝে সে শেষ চেষ্টা করে। অর্থাৎ সে চেষ্টা করে ও প্রস্তাব করে দেখে এসসব মানুষের মধ্যে কেউ তাকে বিয়ে করে মর্যাদা দিতে রাজি আছে কিনা। কিন্তু এমন কাউকে সে পায় না। আর তার বিয়ের ব্যাপারে তার বাপেরও কোনো মাথাব্যথা নেই।

ফলে পদ্মাপারের মালো এবং ঝালোদের পাড়ার স্ত্রীলোেকদের কাছে অচিরেই সে এক রাক্ষসীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ও ঘরে ঘরে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এতে সে প্রতিহিংসা চরিতার্থতার তীব্র আনন্দও পায়।

 

৩৫.

রমজানের সহায়তায় শেষপর্যন্ত তরমুজের চাষ করে জামির ও আরো দু-জন বাজিকর। কিন্তু সে বড় সহজে হয় না। প্রথম দিন রমজানের সঙ্গে কথাবার্তা শল সে এসেছিল পরতাপের কাছে পরামর্শ করতে। চাষের কাজে পরতাপই তো তার শিক্ষাদাতা। কিন্তু যা এতদিন লক্ষ্য করেনি, চাষের কথায় এখন জামিরের নজরে আসে। হায়, পরতাপ এখন এক অতিবৃদ্ধ, রুগ্ন অথর্ব। নমনকুড়ির সেই কর্মী মানুষটা কোথায় হারিয়ে গেছে। জামিরের প্রস্তাবে তার চোখ এখন আর লিক দিয়ে ওঠে না। জামির দেখতে পায়, আর সব দরিদ্র বৃদ্ধের মতো পরতাপ গগন দিন গুনছে।

জামির তবুও আরো দু-একজনের সঙ্গে কথা বলে, তারপর রমজানের সঙ্গে কাছারিতে গিয়ে চাষের ইজারা নেয়। কিন্তু তরমুজের চাষে এত ঝামেলা সে কি নিত? অথবা জানলে কি এ কাজে এগোত? হয়ত, এগোত। জামিরের স্বভাবই এই, একবার কোনো কাজ করবে স্থির করলে শেষপর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে। কিন্তু একথা তাকে ভাবতেই হয় যে, পুরো ব্যাপারটা সে আগেভাগে ভালো করে বোঝেনি এবং এ কাজের বিভিন্ন দিক ঠিকভাবে ভেবে দেখেনি।

কেননা রমজানের যাহোক রকমের ঘর-গেরস্থালি ছিল। কাজেই সার, গোবর, চাষের আনুষঙ্গিক শতেক জিনিসের, যা আপাতদৃষ্টিতে খুবই নগণ্য, আয়োজন ছিল। জামিরের সেসব ছিল না। তাছাড়া তরমুজ দীর্ঘ সময়ের চাষ, এই দীর্ঘ খরার সময় নদী থেকে অব্রিাম জল টেনে আনা ও গাছের গোড়ায় ঢালাতে যে কি ধরনের ধৈর্য ও পরিশ্রমের দরকার, একথা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।

তবুও বীজ থেকে যখন তরমুজলতার প্রাথমিক পাতা দু-টি বের হয়, তখন আমিরের বড় উত্তেজনা হয়। সেই নবীন পাতাকে সূর্যের উত্তাপ থেকে বাঁচানোর এনা পাততে হয় খড়ের বিছানা, কলাগাছের খোলের ঢাকনা। সে যেন শিশু মানুষ করা। যতদিন না লতা বহমান হয়, ততদিন বড় তিতিক্ষা। তারপরেও কি রেহাই আছে? লতা যখন বালির উপর দিয়ে পল্লবিত হয়, ফুল-জালি আসে তখন আরম্ভ এ রোগ আর পোকার আক্রমণ। ধসা হল লতার কুষ্ঠ, যাতে গাছের গোড়া থেকে পচতে শুরু করে। তাছাড়া আছে কাটাপোকা যা লতার যে কোনো জায়গা কেটে দু-টুকরো করে দিতে পারে।

রমজানের নির্দেশে জামির লড়াই করে। পেটে খোরাক জোটে না সবদিন। তরমুজের খেতে কাজ করতে হয় বলে গঞ্জের ঘাটে কুলির কাজে যেতে পারে না। লুবিনির সামান্য রোজগারের উপর নির্ভর করে থাকতে হয়।

তারপর সেইসব জালিতে ফল আসে, ফল ক্রমশ বড় হয়। নতুন জালি আসে, ভ্রমর আর মৌমাছি সারা খেতে উড়ে বেড়ায়, প্রজাপতি লতার উপর দোল খায়। তারপর ফলের রঙ সাদা থেকে হালকা সবুজ হয়, তারপরে গাঢ় সবুজ, তারপরে ক্রমে কালো রঙের বৃহৎ আকারের তরমুজ খড়ের বিছানায় চুপচাপ শুয়ে থাকে।

এসব দেখে রমজানের মতো জামিরের কলিজা ঠাণ্ডা হয়, খিদের পোকা আর পেটের ভেতর মোচড় মারে না, অথবা মোচড় মারলেও, আর তেমন করে মালুম হয় না জামিরের।

তারপর চৈত্রের শেষে যখন তরমুজ হাটে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়, তখন তরমুজ খেতের আসল দুশমনেরা এসে হাজির হয়। এরা ধসা রোগ বা কাটাপোকার থেকেও ভয়ঙ্কর। এদের বাগ মানানোর কোনো উপায় রমজানের জানা নেই।

এরা সব শহর ও আশপাশের বাবুঘরের জোয়ান ছেলে। দূরের থেকে তাদের আসতে দেখে রমজান বলে, পতিবার ভাবি আর তরমুজের চাষে যাব না, এত উৎপাত আর সহ্য হয় না। কিন্তু মন যে মানে না। এত পরিশ্রমের ফসল, দেখ, এখন কেমন নিজের হাতে লুটেরার কাছে তুলে দিতে হয়।

জামির বলে, কেমন?

নিজেই দেখতে পাবা।

উৎপাত করবে?

উৎপাত। না দিলে বুকে ছুরি বসাবার পারে। সুলতানপুরের আখের চাষই উঠে গেল এই উৎপাতে। একশো বিঘার খেত এরা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে, সে জানো?

পুলিশে খবর দেয় না মানুষ?

পুলিশে খবর দেবে? যাবার হবে না তোমারে গঞ্জের হাটে, টাউনের বাজারে? সেথায় এরাই তোমার জীবনমরণের হকদার।

বেশি অপেক্ষা করতে হয় না। নৌকা করে ছোকরারা এসে খেতের কাছে। নামে। রমজান গম্ভীর হয়ে থাকে। দলের মাতব্বর ছোকরা এগিয়ে এসে বলে, চাচা, তরমুজ খাব। রমজান বলে, আলবাৎ খাবা। তবে গাছেৎ কেহ হাত দিয়েন না, বাপেরা। দুটো ছিড়া দিছি, খুশি মনেৎ চলি যান।

দুটা! আমি দশজনা, চাচা। কম করে পাঁচটা তো চাইই।

অত খাবার পাবেন না বাপেরা। এক একটার ওজন দেখিছেন পাঁচ সের, ছয় সের। লষ্ট করার সামগগিরি লয়, বাপ। ওরে আবু দুডা তরমুজ ছিড়া দে, বাবুগেরে।

ছোকরারা উচ্চ হাসে। কেউ মন্তব্য করে, দুটা? আঁ? মগের মুলুক।

একজন ততক্ষণে খেতের ভেতর থেকে একটা তরমুজ ছিঁড়ে ফেলেছে। গাছটার দফা শেষ। মাঝামাঝি জায়গায় লতাটা ছিঁড়ে গেল। তার মানে বাকি ফলগুলোর দফা শেষ।

আবু লাফ দিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে, এডা কি করলেন? গাছটার শব্বেনাশ করলেন?

ছোকরা পাত্তা দেয় না। বলে, আবিদ্বাপ, লাপাচ্ছে দেখো, যেন মারবে!

রমজান উঠে দাঁড়ায়। কাছে এসে বলে, আগেই আপনাগেরে নিষেধ করলাম, গাছেৎ হাত দিবেন না, শুনলেন না কথাটা?

মাতব্বর ছোকরা বলে, বেকুব, অতি বেকুব এই ছোকরা, বুঝলে চাচা? তা যাকগে, অঢেল হয়েছে এবার তোমার, দু-চারটা নষ্ট হলে গায়ে বাজবে না। এই, পাচটার বেশি তুলো না।

দলপতির নির্দেশ ছোকরারা খেতের মধ্যে ঢোকে। জামির ভাল করে দেখে এদের। বিশ বাইশ বছরের বাবুঘরের ছেলে সব, কেউই শিশু নয়। আর দেখ, কী অত্যাচার।

রমজান হাঁ-হাঁ করে ওঠে, আরে করেন কি? করেন কি?

দলপতি ছোকরা রমজানের দুই ঘাড়ের উপর হাত দিয়ে চেপে বসিয়ে দেয়। মুখে বলে, একদম কথা নয় চাচা। ভালোমুখ করে খেতে চাইছি, ভালোমুখে দিয়ে দেও।

রমজান হতভম্ব হয়ে যায়। আবু, রমজানের দ্বিতীয় ছেলে, লাফ দিয়ে গিয়ে খেতের মাঝখানে দাঁড়ায়। বলে, খবরদার খেতের বাইরে যান সব। তার হাতে একটা হেঁসো।

জামির দেখে, যে খেতের মধ্যে ছোরারা ঢুকেছে সেটা তারই। সে এবার তার বিশাল দেহটি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কটিদেশের সামান্য বস্ত্রখণ্ড ছাড়া তার সারা শরীরই উলঙ্গ। সে ধীর পদক্ষেপে তার খেতের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়। ছোকরারা তাকে দেখে গাছ থেকে হাত সরিয়ে নেয়। জামির শান্ত অথচ স্থির যায় বলে, খেতের বাইরে যান, বাবুরা।

এ কথায় কাজ হয়।

সব ক-জন গিয়ে মাতব্বরের পাশে দাঁড়ায় এবং ক্ষুব্ধ চোখে জামিরকে দেখে।

জামির নিজে খেতের বাইরে এসে বলে, রমজান ভাই দুডা দিবার চায়েছেন, সাথে আপনাগেরে হবে?

জামিরের হাত দুটি বড় বেশি লম্বা, আর তার উপরে মোটাসোটা শিরাগুলো ঈষৎ আন্দোলনেই সাপের মতো কিলবিল করে ওঠে।

জামির হাতের তালু দু-টিকে হতাশায় ভঙ্গিতে উল্টে দেয়। বলে, তবে লাচার। মেহন্নতের ফসল, বাবুরা, হারামের না। আর এটটা কথা, এই বুড়া মানুষটাকে অপমান করে ঠিক করলেন না। আপনার বাপের বয়সী লোক।

কি অপমান করলাম?

ওনারে ঘাড়ে হাত দিয়ে সালেন না আপনি? ইটা ঠিক লয়।

এতে অপমান হোল?

হোল। আর এতে মানে হয়, ওই বুড়ার থিকা আপনার গায়েৎ জোর বেশি। বুড়ার থিকা যে জোয়ানের গায়েৎ জোর বেশি, ইটা দেখাতে কি পোরমানের দরকার হয়? খ্যামতা থাকে আপুনি ওই বুড়ার বেটার ঘাড়ে হাত দেন।

জামির ইঙ্গিতে আবুকে দেখায়।

সর্দার ছোকরা চাপা ক্রুদ্ধ নিশ্বাস ছাড়ে। বলে, দরকার হলে তাও পারি।

আরেকজন এগিয়ে এসে বলে, তুমি কে চাঁদ? তোমাকে তো চিনলাম না?

আমি এক চাষা, দেখবাই পাচ্ছেন।

কথাটা বলতে পেরে এই স্থির সময়েও জামিরের বুকটা ভরে ওঠে। চাপা উত্তেজনার কম্প তার ভিতর থেকে যেন কেটে যেতে থাকে। সে বলে, দুডা লয়, তিনডা তরমুজ নিয়া চলি যান বাবুরা।

দলপতি পিছন ঘুরে দাঁড়ায়। জামিরের উদারতায় কান দেয় না। তারপর মুখ ঘুরিয়ে বলে, চাষা তুমি নও। তবে তুমি কে সে খোঁজ করব।

দলটা গিয়ে আবার নৌকায় ওঠে। জামির নৌকাটাকে চলে যেতে দেখে রমজানের পাশে এসে বসে। কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ বসে থাকে। রমজান বলে, কাজটা খারাবি হোল।

আবু বলে, ভালো কোন্ কামটা? খ্যাতটা নকরা-ছকরা করবা দিলে সিডা ভালো হোত?

রমজান বলে, এরা ঝামেলি পাকাবে।

জামির এতক্ষণের ঘটনা থেকে স্থির মাথায় সারসংক্ষেপ করে। শেষে বলে, রমজান ভাই, গরিবের সবেতেই ঝামেলি। এসব ঝামেলি নিয়াই বাঁচবা হবে, নচেৎ ভিখ মেঙ্গে খাওয়া লাগে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *