শারিবার যখন বছর বারো বয়স, তখন নানি লুবিনির সঙ্গে তার সখ্য গভীরতর হয়। কেননা তখন শারিবা সব বুঝতে শিখেছে, নিজের এবং নিজের লোকজনের চতুষ্পার্শ দেখতে শিখেছে। আর সেই সঙ্গে নানির কাছে শুনে শুনে বর্তমানের সাথে অতীতের যোগসূত্র রচনা করার চেষ্টাও সে করতে পারে তার অপুষ্ট বুদ্ধিতে।
এইভাবে শারিবা বড় হয়। নিচু দাওয়া, তালপাতার বেড়া দেওয়া ঘর, সরকারি ফরেস্ট থেকে চুরি করে আনা শনের চালা। সেই নিচু গুহার মতো ঘরের মধ্যে সন্ধ্যার পর স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘন তরলতায় জমে থাকে। লুবিনি তখন কাঁপা কাপা গলায় প্রাচীন কথা বলে।
লুবিনি বলে এক অজ্ঞাত দেশের কথা। সি দ্যাশ হামি নিজেই দেখি নাই, তোক আর কি কমো। সি দ্যাশের ভাষা বাজিকর নিজেই বিসসারণ হোই গিছে, তোক আর কি শিখামো!
সে এক অপরিচিত দেশ। যেখানে ঘর্ঘরা নামে এক পবিত্র নদী বয়ে যায়। সেখানে নাকি কবে এক শনিবারের ভূমিকম্পে সব ধূলিসাৎ হয়েছিল। ঘর্ঘরার বিশাল এক তীরভূমি ভূ-ত্বকে বসে গিয়ে নদীগর্ভের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আর তাতে মিশে গিয়েছিল গোরখপুরের বাজিকরদের জীর্ণ বাড়িঘর। ধ্বংস হয়েছিল বাজিকরদের প্রধান অবলম্বন অসংখ্য জানোয়ার।
সে এক কালো অন্ধকারের শনিবার, যা লুবিনি নিজে দেখেনি, যা সে তার নানাশ্বশুরের কাছে থেকে শুনেছে। তারপর যাযাবর বাজিকরের দল ঘর্ঘরার উত্তর তীরে আরো উত্তরে সরে গিয়ে নতুন বসতি তৈরি করে। নতুন করে ভাল্লুক বাঁদর সংগ্রহ করে, দূরবর্তী গ্রাম-শহরে গিয়ে গেরস্থ বাড়ি থেকে ‘ভঁইস’ চুরি করে আনে। আবার বছরের আট মাস দশ মাস দুনিয়া ঘুরে বেড়াবার নেশায় বেরিয়ে পড়ে তারা। তখন গলা লম্বা করে বাড়িয়ে দিয়ে মোষের সারি চলত রাস্তা দিয়ে, গ্রাম-শহরের ভিতর দিয়ে। সেই মোষের পিঠে থাকত বাচ্চারা আর বুড়ো-বুড়িরা। আর থাকত মাল। কোথাও গিয়ে তারা থামত। নদীর পাড়ে, শহরের বাইরের মাঠে, গ্রামের প্রাচীন বটের তলায়। ডুগডুগ করে ঢোলকে কাঠি পড়ত। জনপদের কুকুরগুলো তেড়ে তেড়ে আসত। বাজিকরদের কুকুরগুলো উত্তেজনায় শিকল ছিঁড়ে ফেলতে চাইত। চৌকিদার এসে সর্দারকে থানায় ডেকে নিয়ে যেত।
জী হুজুর, আমরা বাউদিয়া-বাজিকর বটি। জী মালিক, হামার নাম পীতেম বাজিকর। দলে পাঁচকুড়ি পাঁচজনা আদমি আছে। উসমে শোচ লিজিয়ে দেড়কুড়ি মরদ, দেড়কুড়ি আওরৎ, আর বাকি সব চেংড়া-বাচ্চা।
থানাঘরের বউ-বিবি-বাচ্চারা ভিড় করত। অসীম কৌতূহল সবার চোখে। কি খেলা আছে তোমাদের?
বান্দর আছে, ভাল্লু আছে, দড়ির খেলা আছে, ভান্মতি আছে, বহুৎ কিসিমের খেলা আছে।
সাপ নেই, সাপ?
নেহি মালকিন, বাজিকর সাপ ধরা জানে না।
দশ-পাঁচ টাকা থানাবাবুকে জল খেতে দিতে হয়। তারপরে ছাড়পত্র মেলে। ঠিক আছে, থাকো, কিন্তু কোনো নালিশ যেন না আসে।
নেহি জী, নালিশ কেন আসবে? হামার দলের কোনো বদনাম নেই, হুজুর। সেলাম মালিক, বান্দার নাম পীতেম বাজিকর। কোই দরকার লাগলে চৌকিদারকে ভেজে দেবেন।
কেমকা বুলি ক-ছেন তুই নানি, বুঝা পারি না। ওলা কি হামরাদের আগলা দ্যাশের বুলি?
না রে, শরিবা। এলা বুলি বাজিকর দ্যাশ দ্যাশ ঘুরে শিখা লয়। যেথায় ঘুরে সিথাকার বুলি ধরে লয়, সিথাকার ধরমকরম শিখ্যে লয়। সিটা তার আপন বুলিতে মিশাল করে লয়। বাজিকরের আপন কুনো ধরম নাই। করম এ্যাটা আছে বটে, তো সিটা হোল ভি-মাঙ্গার কাম। মুলুক মুলুক ঘুর্যে বান্দর লাচানো, ভাল্লু লাচানো, পিচ্লু-বুঢ়া পিচ্লু-বুঢ়ির কাঠের পুতলা লাচানো, ভান্মতির খেলা, বাঁশবাজি, দড়িবাজি, নররাক্ষস হয়া কঁচা হাঁস, কাঁচা মুরগা কড়মড় কড়মড় করে খাওয়া, নাচনা গাহানা–এলা সব বাজিকরের কাম। এলা সব ভিখ-মাঙ্গার কাম।
ভিখ-মাঙ্গার কাম!
হাঁ, ভিখ-মাঙ্গার কাম।
যাঃ।
শারিবার বিশ্বাস হয় না। অথবা, ভিখ-মাঙ্গা কথাটা যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য হয় না। খেলা দেখিয়ে পয়সা রোজগার, সেটা ভিখ-মাঙ্গা হবে কেন?
হাঁ, হামরা বলি ভি-মাঙ্গা। তোর নানা বলত ভিখ-মাঙ্গা। কাম হইল খেতির কাম, কলের কাম, কামার কুমার, চাষি, মজদুরের কাম। হামরা তো ওলা কাম কদাপি করি নাই। আমরা তো ওলা কাম জানি না।
তুই খেলা দেখাতিস, নানি?
দেখাতাম তো। পিচ্লু-বুঢ়া পিচ্লু-বুঢ়ির পুতলা তুই দেখিস নাই, শারিবা? হাতের উপর গামছা ঢাকা দিয়া সি পুতলা লাচাতাম। কাঠের ময়ুর লাচাতাম।
আর বাঁশবাজি, দড়িবাজি?
হাঁ, সিগ্লাও করতাম। বিশ হাত উঁচা বাঁশের মাথাৎ সিধা দাঁড়ায়া ছুঁচে সূতা পরাতাম। দুইধারে ঊইসের সিংএ দড়ি বাইন্ধে বাঁশ দিয়া ঠেল্যে সি দড়ি টনটনা হতো। ভুঁই থিকা বিশ হাত উঁচাতে বাঁশ হাতে হাঁটা চলা, লাচ দেখানো—সি ভয়ানক কঠিন খেলা রে, শারিবা!
শরিবা মনশ্চক্ষে নানির দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া দেখে, দোল দেওয়া দেশে, তারপরেই তার চমক ভাঙে।
ওয়ে হাটবা পারিস না তুই, দড়িতে হাঁটতি কো!
কল্পনায় সে এই লোলচর্ম কানিপরা নানিকেই দড়ির উপরে হাঁটতে দেখে, তাতেই চমক খায়। অথচ অবিশ্বাসও করতে পারে না। নানিকে তার প্রগাঢ় বিশ্বাস।
নানি ফোকলা দাঁতে প্রচুর হাসে।
হয় বাপু, নানি তোর এংকা বুঢ়াই আছিল নাকি চেরদিন। বাজিকরের বেটা, শারিবা, এংকা বেহেশই হয়। তোর দোষ নাই।
শারিবা লজ্জা পায়। দেওয়ালে, নিচু চালায় ছায়া কাপে। লক্ষ্যের আলো থেকে ধোয়া হয় বেশি। নানির শীর্ণ কুৎসিত অবয়ব দেয়ালে ভয়াবহ দেখায়, প্রেতিনীর মতো। বুড়ো কুকুরটা গুড়ি মেরে পায়ের কাছে শুয়ে আছে। বুড়ির কুকুর গোকো। গকোন বয়স বুঝি শারিবার মতোই। দীর্ঘ দেহ আর ঝোলানো কান নিয়ে গোকো অতীতকে পরে আছে। নাকি গোকোর মাথায় হাত রাখে। গোকো বুঢ়াটা হোই গলি, গোকা!’ গোকো হাই তোলে ও গুরগুর করে আদর উপভোগের স্বীকৃতি জানায়।
তারপর রাত বাড়ত। পাঁচবিবি গ্রামের বাইরে নদীর ধারে কুঁড়েঘরগুলোয় হঠাৎ দমকা হাওয়া লাগত। গোকোর কান খাড়া হতো। শারিবা নানির কোলের আরো কাছে ঘন হয়ে আসত। বাজিকর বোকা বটে। আশপাশের হিন্দু-মুসলমান সবার কাছে বাজিকর বোকা, বাজিকর বজ্জাত। ঘুমে ঢুলে পড়তে পড়তে শারিবা এসব চিন্তা করত বারো বছর বয়সে।
তারপর নদীর পাড়ে দুই কুন্ঠিবাড়ির কোনো একটার হাতি নামত জল খেতে। দুই জমিদারের কুন্ঠি ছিল পাঁচবিবিতে। লালকুন্ঠির হাতিটা ছিল মাকনা আর চৌধুরীকুন্ঠির হাতিটা দাঁতাল। দুই হাতি একসঙ্গে যদি কোনোদিন এসে পড়ত, তাহলেই সর্বনাশ হতো।
মরণবাঁচন লড়াই লাগত মানা আর দাঁতালে। আশপাশের গাছপালা ভাঙত। বাড়িঘর ভাঙত। মানুষ মরত। গ্রামে মানুষ মশাল জ্বেলে, টিন বাজিয়ে হাতিকে ভয় সেখাত। এপারের মানুষ, ওপারের মানুষ সবাই সন্ত্রস্ত এবং সজাগ থাকত। ভীষণ চিৎকার উঠত। গোকোকে তখন বেঁধে রাখতে হতো।
গোকো সেভাবেই মারা যায় হাতির পায়ের নিচে পড়ে। কেননা সবাই তখন পালিয়েছিল। দুটো মত্ত হাতি কোনো বাধাই মানছিল না। গোকো বাঁধা ছিল, ত্রাসে সে খেয়াল কারোই ছিল না, নানিরও না। হাতি ঘর ভাঙছে, শনের ঘর, তালপাতার বেড়া, বাঁশের খুঁটি। গোকো মারা পড়ে।
এভাবে তিনবার ঘর ভাঙার স্মৃতি শারিবার সারাজীবন থাকে। কেননা, তার নানা জামির বাজিকর স্থিতিবান হতে চেয়েছিল। জামিরের পিতামহ পীতেম পুবের এই দেশটাকে বোধহয় ভালোবেসেই ফেলেছিল। সে তার দলবল নিয়ে শেষবারের মতো গোরখপুর ত্যাগ করার পর এদিকেই এসেছিল।
পীতেমের আগেও বাজিকরেরা এদেশে আসত, কিন্তু সে করতে চাইল চিরস্থায়ী গৃহস্থী। পীতেমের পরে বালি, তারপর জামির দলের সর্দারি পায়। জামিরের বাপ ধন্দু অল্প বয়সে খুন হয়। কাজেই লুবিনির স্মৃতিতে সে খুব উজ্জ্বল নয়। বাজিকর এমন অঢেল জমি, ধান এবং জল তার পরিচিত ভূমণ্ডলে কোথাও দেখেনি, যদিও বাজিকরের পরিচিত ভূমণ্ডল খুব ছোট ছিল না।
কিন্তু সেই ভূমণ্ডলে শস্যদানার বড় অভাব। বিশেষত বাজিকরের সারা দিনমান জন্তু-জানোয়ার নাচাও, দড়িবাজি, বাঁশবাজি কর, সন্ধ্যায় সেই ভিমেঙ্গে পাওয়া (‘হাঁ, শারিবা, ভিখ্-মাঙ্গা’) শস্যদানা ছাইপাশ সব মিলিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসে ফুটিয়ে নেও। এই হল ধার্জিকরের খাওয়া। এসব নানির বলবার দরকার ছিল না, এসব শারিবা তখন নিজেই বুঝতে শিখেছে।
আর এজন্যই এর কিছুদিন পরেই শারিবা বুঝতে পারবে বাজিকর বাউদিয়ার স্বর্গে কেন এত অঢেল খাবার বন্দোবস্ত। নানি বলত, স্বর্গ শারিবা, সি এক আশ্চর্য জায়গা।
শারিবা বলবে, স্বর্গ কুনঠি?
নানি বলবে, সিটা তো জানা নাই, বাপ। জানা থাকলি তো কবিই চলি যাতাম। মরার পরে সেটি যাওয়া যায়।
তখন শারিবা একটা কথা বলবে, যা কোনদিন আর কোনো বাজিকর বাউদিয়া বলেনি।
শারিবা বলবে, তবি হামার ওঠি যাবার দরকার নাই, নানি। মরার পর আমার অঢেল খাবার খায়্যে কি হোবে?
এসব কথা অনেক পরের। তখনো গোকো মরেনি। তখনো চৌধুরী সাহেব “তুমরা হিন্দু না মোছলমান” এ প্রশ্ন তোলেনি। হিন্দুস্থান-পাকিস্তান হয়নি। তখনো লালকুন্ঠির ম্যানেজার মহিমবাবু “হাঁই বাপু, তোরা গরুও খাস, শুয়ারও খাস, ই কেম্কা জাত রে বাপো!” বলে আঁতকে ওঠেনি।
০২.
শনিবারের ভূমিকম্পের পর ঘর্ঘরার উত্তর তীরে সরে গিয়ে পীতেম আবার তার দলবল নিয়ে ডেরা তোলে। সে গ্রামটা ছিল গোয়ালাদের। তারা এসে বলে, বাজিকর, হেথায় থাকা চলবে না। তাদের হাতে মোটাসোটা বাঁশের লাঠি। সেই লাঠি দিয়ে তারা খেপা ষাঁড় ঠাণ্ডা করে, জঙ্গলের জানোয়ার তাড়ায়।
পীতেম বলে, বাজিকর তো স্থায়ী বসবাস করে না। দু-চার মাস থাকব, ফের ঠে যাব। তোমাদের জমি তো দখল হয়ে যাচ্ছে না।
সে কথা কেউ শুনল না। তারা বাজিকরদের তিনদিনের মধ্যে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিল। পীতেম বলল, ঠিক আছে, যাব। সারা দুনিয়া বাজিকরের। জায়গার অভাব?
কিন্তু অন্যরা বলল, কিন্তু ভঁইস? কিন্তু ঘোড়া? খাব কি? যাব কি করে?
পীতেম ভাবতে থাকে, কিন্তু ভঁইস। কিন্তু ঘোড়া? খাব কি? যাব কি করে দেশ-দেশান্তর? শনিবারের ভূমিকম্প কিছুই অবশিষ্ট রেখে যায়নি। দলকে এখন বাঁচানোই মুশকিল।
দু-রাত্তির ঘুম হল না পীতেমের। দৈবদুর্বিপাক তার মনটাকে দুর্বল করে দিয়েছিল। তৃতীয় রাতে অচেতুনের মতো ঘুমায় পীতেম। ঘুমের মধ্যে তার মরা বাণ দনু আসে তার কাছে।
শীতে হে, পীতেম?
বাপ?
চোখত্ পানি ক্যান বাপ?
পথেত্ যামো কেংকা বাপ? দল নষ্ট হোই যাবে, বাপ।
ক্যানে বাপ, তোর দুষ্টু কিসের?
ভঁইস কোই বাপ? ঘোড়া কই বাপ?
হাঁই দেখ, জঙ্গলের ধারে কত গাবতান ভৈঁসী ঘুরে বেড়ায়। হাঁই দেখ, কত জায়ান টাট্ট ঘুরে বেড়ায়। ওলা সব তুমার। দুনিয়ার বেবাক মাঠে চরা জানোয়ার তুমার।
বাপ!
পীতেম হে, পীতেম, পুবের দেশে যাও, বাপ। সিথায় তুমার নসিব।
পুবের দেশেত্?
পীতেম, হে পীতেম, রহু তুমার সহায় থাকুক।
পরদিন পীতেমের দল জঙ্গলের পথ ধরে দিগন্তের দিকে মিলিয়ে গেল। সঙ্গে গেল পাঁচটি গাবতান মোষ, পাঁচটি বাছাই টার্টু। পথে সেই মোষদের নধর বাছুর হল। দুধের বান ডাকল। সেই দুধ-ঘি বাজিকরের মেয়েরা রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করতে করতে চলল। সেইসব জানোয়ারের বংশ বাড়ল। বাজিকর তখন জানোয়ারও বেচত।
এইভাবে শারিবা, গোরখপুর থিকা, ডেহরিঘাট, সিথায় ক-বছর, তা-বাদে সিওয়ান, সিথায় ক-বছর, তা-বাদে দানাপুর, পাটনা, মুঙ্গের, কত দেশে তোর নানার নানা বসত করার চেষ্টা করল, হল না। তারপর এই পুবের দেশ। তা এখানেও কি স্বস্তি আছে? মানুষ চায়, বাউদিয়া বাউদিয়াই থাকুক, বাজিকর বাজিকরই থাকুক। তার আবার ঘর-গেরস্থালি কি? রাজমহল, মালদা, নমনকুড়ি, রাজশাহী, আমুনাড়া, পাঁচবিবি। সব শেষে এই পাঁচবিবি। আরো কত দ্যাশ ঘুরলো সি বাজিকরের দল, তোক আর কি কমো। সব কি কারো স্মরণ আছে?
বাউদিয়া-বাজিকর পিছনে যা ফেলে যায় তা জানোয়ারের বিষ্ঠা, কে তার কথা স্মরণ করে? যা পরিত্যাজ্য তাই পিছনে ফেলে যেতে হয়। তার কথা মনে রাখার কোনো কারণ নেই। তবুও পীতেম বৃদ্ধ বয়সে নাতবউ লুবিনির কাছে এসব কথা বলত। কেননা ধন্দু জোয়ান বয়সে খুন হয়েছিল। জামিরের বিয়ে হয়েছিল সতেরো বছর বয়সে, তখন লুবিনির বয়স দশ বছর। সেই দশ বছরের মেয়েকে সামলানোর দায় ছিল পীতেমের। বাজিকরের তাঁবুতে এত কম বয়সে বিয়ের রেওয়াজ ছিল না। কিন্তু এই পুবের দেশে সাহেবদের তখন বড় হাঁকডাক। কিভাবে যেন রটে গিয়েছিল, মহারানির রাজত্বে সোল বছরের ঊর্ধ্বে ছেলেমেয়েদের আর বিয়ে দেওয়া যাবে না। দিলে বে-আইনি হবে। এরকম গুজব হামেশাই রটত তখন। কেউ তলিয়ে ভাবত না, ভয় পেত। কাজেই একদিন পনেরো জোড়া বাজিকরের ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। তার মধ্যে জামির আর লুবিনিও ছিল।
তাই পীতেম সামলাত লুবিনিকে। পীতেম বলত শনিবারের ভূমিকম্পের কথা। পীতেম বলত ডেহরিঘাট, সিওয়ানের কথা। তারপর রাজমহলের কথা।
০৩.
রাজমহলের গঙ্গার ধারে বাজিকরের ছাউনি পড়ল সারি সারি। রাজমহল তখন গমগমা জায়গা। এখানে সেখানে রেলের লাইন বসছে। গঙ্গায় শয়ে শয়ে মহাজনি নৌকো। গোছগাছ হয়ে গেলে দলের লোকদের ডেকে পীতেম বলে, এ জায়গা মনে হচ্ছে পয়সার জায়গা। যে যার মতো কাজে লেগে পড়। বাপ আমাকে বলেছিল পূবের দেশে আসতে। এ হল সেই পুবের দেশ। গোরখপুরের ঠিকানা তো উঠেছে। নতুন ঠিকানা বানাতে হবে। এখন পয়সা কামাও।
কদিনের মধ্যেই খবর পেয়ে দারোগা এসে হাজির হয়। পীতেম বলে, চৌকিদার দিয়ে খবর পাঠালেই হতো, হুজুর। কষ্ট করলেন।
দারোগা প্রতি ছাউনিতে উঁকি দিয়ে দেখল। তারপর বলে, কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
পীতেম মিথ্যা কথা বলে, কেননা, এরকমই নিয়ম।
দারোগা বলে, কতদিন থাকা হবে?
পীতমের অনির্দিষ্ট উত্তর, কেননা, এরকমই নিয়ম।
দারোগা তারপর জন্তু জানোয়ার দেখে এবং সবচেয়ে দামাল ঘোড়াটি পছন্দ করে।
পীতেম একটু বিপদে পড়ে, কারণ ঘোড়াটা ধন্দুর বড় আদরের এবং ধন্দুকেই সে সওয়ার হিসাবে সহ্য করে। সে বলে, হুজুর, ও বজ্জাতকে নিয়ে পোষাতে পারবেন না। ও হুকুম মানে না, পোষ মানে না। নিয়ে গেলেও পালিয়ে আসবে।
দারোগা এসব অজুহাত মনে করে। তাছাড়া ঘোড়াটা তার পছন্দ হয়েছে এবং ছেলের জন্য একটা তার দরকারও।
দারোগা বলে, দেখ, বাজিকর, জানোয়ারটা আমার চাই। পরে পাঠিয়ে দিও।
পীতেম তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে নানাভাবে। বলে, হুজুর, ও জানোয়ার অবাধ্য। আপনি আর চারটার মধ্যে যেটা হয় একটা বেছে নিন। না হলে পরে আমায় দোষী করবেন।
পীতেম এসব কথা বলছিল, এবং ধন্দুর দিকে নজর রাখছিল। ধন্দু গম্ভীর মুখে একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
দারোগা কথা না বাড়িয়ে লাফ দিয়ে নিজের ঘোড়ায় উঠে টাপটাপ শব্দে সামনে এগোয়। সঙ্গের চৌকিদার বলে, বাজিকর, ঘোড়া কাল সকালের মধ্যে পৌঁছায় যেন, না হলে তোর কপালে দুঃখ আছে।
ধন্দু হঠাৎ লাফ দিয়ে তার আদরের ঘোড়ায় উঠে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যেই সে গঙ্গার বালিয়াড়িতে নেমে পড়ে সামনের দিকে ঘোড়া হাঁকাতে থাকে পাগলের মতো। পীতেম শুধু তাকিয়ে থাকে, কিছু বলে না। ধন্দু দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে। গঙ্গার বালিয়াড়িতে ধুলো ওড়ে, তার মধ্যে ধন্দুর মাথার লাল ফেট্টির ঝলক দেখা যায় শুধু। কিন্তু পীতেম জানে ঘোড়াটা দিতে হবে।
অনেক রাত হয়ে যাওয়ার পরেও ধন্দু ঘোড়া নিয়ে ফিরল না। বাজিকরদের খোলা আকাশের নিচের রাত্রিবেলার আহার শেষ। সব তাঁবুর সামনের আগুনই প্রায় নিবে এসেছে, কিন্তু ধন্দু ফিরল না।
মাঝরাতে পীতেম আরো তিন জোয়ান বাজিকরকে ডেকে ওঠাল। ধন্দুকে খুঁজে বের করতে হবে, কাল সকালে ঘোড়াটা দারোগাকে দিয়ে আসতে হবে।
চারটি টাটুতে চারজন সওয়ার হয়ে গঙ্গার পলি ভাঙতে থাকে।
পীতেম বলে, আমার বাপ বলেছিল, দুনিয়ার সব মাঠে-চরা জানোয়ার তোমার।
বালি নামে এক যুবক বলে, কিন্তু তার মধ্যের ভালোটা দারোগার।
জ্যোৎস্নালোকিত বালির চড়ায় চারজুন ঘোড়সওয়ার হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠে স্তব্ধতা ভাঙে।
পীতেম বলে, ধন্দুটা বোকা। ভালো ঘোড়া মাঠে আরো চরবে।
চাঁদের আলোয় বাঁ পাশে রুপোর মতো চঞ্চকে গঙ্গা রেখে দু ক্রোশ মতো পলি ভাঙে তারা। তারপর ধন্দুকে পায়। গঙ্গার দিকে পিছন দিয়ে সে বসেছিল। সামনে ঘোড়াটা দাঁড়িয়েছিল ছবির মতো।
এদের আসতে দেখে ধন্দু উঠে দাঁড়ায়। কোনো কথা না বলে নিজের ঘোড়ায় উঠে তাঁবুর দিকে চলতে শুরু করে। এরা চারজন নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করে।
কিছু সময় পরে পীতেম বলে, তোর নানা বলত, মাঠে যত জানোয়ার চরে তার সবই বাজিকরের।
আর ধন্দুও প্রায় বালির কথাটাই বলে। বলে, কিন্তু এটা দারোগার।
কিন্তু দারোগার মান তো রাখতেই হবে।
আজ রাতেই তো এখান থেকে চলে গেলে হয়।
পাগল!
তাহলে দারোগাকে তোমার অনেককিছু দিতে হবে, শুধু ঘোড়ায় হবে না।
পীতেম বলেছিল, এ দেশে পয়সা আছে। ভিখ-মাঙ্গা বাজিকরের কাছ থেকে আর কি নেবে দারোগা!
পরদিন দারোগার ছেলে এসে হাজির হয়েছিল সকাল-সকালই। বিশ-বাইশ বছরের ছোকরা। পীতেম বলেছিল, আসুন, ছোট হুজুর, বসুন।
ছোকরা বলে, বসতে আসিনি। কোথায়, আমার ঘোড়া কোথায়?
বালি ঘোড়াটার লাগাম ধরে কাছে নিয়ে আসে। ধন্দু সেই একই গাছের নিচে তির্যকভাবে দাঁড়িয়ে।
পীতেম বলে, ছোট হুজুর, ঘোড়াটা বড় বজ্জাত, ভয় হয়, আঘাত না করে। দারোগার ছেলে বলে, আমিও বজ্জাত। দেখা যাক কে বেশি বজ্জাত।
সে অত্যন্ত অভিজ্ঞ দাম্ভিক ভঙ্গিতে হাসে, যা দেখে পাতেম অবাক হয়।
ছোকরা লাগামটা হাতে নিয়ে হাতের চাবুকে হাওয়ায় আওয়াজ তোলে। ঘোড়াটা চমকে ওঠে। সব তাঁবু থেকে মানুষ বেরিয়ে এসেছে দারোগার ছেলেকে দেখতে। ছোকরা হঠাৎ লাফ দিয়ে নাঙ্গা পিঠে সওয়ার হয়।
ঘোড়াটা অবশ্যই বজ্জাত। ভীষণ ডাক ছেড়ে সে পিছনের পা জোড়া শূন্যে ছুঁড়তে থাকে। পরিষ্কার সওয়ারকে ফেলে দেওয়ার বাসনা। কিন্তু সওয়ার সহজে পড়ে না। দক্ষতায় সে আঁকড়ে থাকে ঘোড়ার পিঠ এবং শূন্যে চাবুকের শিস তোলে। জানোয়ারটা পরিত্রাহি চেঁচায় এবং এমনভাবে পিছনের পা ঘেঁড়ে যেন মনে হয় পায়ে তার সাপ জড়িয়েছে।
দারোগার ছেলে এবার ঘোড়াকে আঘাত করে। তাতে জানোয়ারটা আরো ক্ষিপ্ত হয়। যুবকের চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে উত্তেজনায়। সে আবার লাফ দিয়ে নামে ঘোড়া থেকে। লাগাম তার হাতেই থাকে। ধন্দু শব্দ করে হাসে। পীতেম কিছু বলতে যায়। যুবক লাগামে বারবার ঝটকা মেরে ঘোড়াটাকে আহত করার চেষ্টা করে, তারপর উন্মাদের মতো চাবুক চালাতে থাকে।
ঘোড়া প্রথমে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু দারোগার ছেলে গায়ে শক্তি রাখে। সে নিমর্মভাবে চাবুক চালায়। ঘোড়া এবার সামনের দু-পা তুলে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। ধন্দু চিৎকার করে ওঠে। বালি এবং আর একজন যুবক ধন্দুকে দুদিকে ধরে টেনে হিঁচড়ে তাঁবুর পিছন দিকে নিয়ে যায়।
সমস্ত শরীর রক্তাক্ত করে দিয়ে যুবক তার চাবুক থামায়। ঘোড়াটা সতর্ক স্থির হয়ে থাকে। তার সমস্ত শরীর থির থির করে। তার চোখ বিস্ফারিত। পীতেম নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকে।
যুবকটি আচমকা আবার লাফ দিয়ে ঘোড়ায় ওঠে। জানোয়ারটা এবার আর লাফায় না। শুধু পিছনের পা দুটো একটু নিচু করে সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে।
যুবক পা দিয়ে তলপেটে তো মারে। ঘোড়া চলতে শুরু করে। লাগাম টেনে দারোগার ছেলে ঘোড়ার মুখ ঘোরায়। তারপর পীতেমের দিকে তাকিয়ে হাত তোলে। বলে, চলি সর্দার।
ঘোড়া অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাস্তায় উঠে যায়।
০৪.
রাজমহল, বারহেট, তিনপাহাড়, সাহেবগঞ্জের হাটেবাজারে পীতেমের দল রঙিন কামিজ আর ঘাঘরা উড়িয়ে নতুন বিহ্বলতা আনে। মোষের শিঙে বাঁধা দড়ি দুপাশে বাঁশ দিয়ে ঠেলে টনটনা করা হয়। তার উপরে লম্বা বাঁশ হাতে যে রমণী চলে ফিরে আগুপিছু করে তার শরীর বড় টান টান, তার চোখমুখে আগুনে মসৃণতা, তার গায়ের চামড়া পাকা গমের রঙের। নিচের যে মানুষটা ঢোলক বাজায় তার মাথায় রঙিন ফেট্টি। আর একজন উপরআলির চলার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে বিচিত্র গান গায়, যে ভাষা কেউ বোঝে না, কিন্তু সুরের মাদকতা এড়াতে পারে না।
মাধোয়া ধাইর্ যারে
মাধোয়া ধাইর্ যারে
ছোটি ঘোটানি মাধোয়া ধাইর যা
তিলেক্ পঢ়োরে তিলে পঢ়োরে
ছোটি ছোটানি মাসোয় ধাইর যা
হেরছি ফকড়িয়ে হেরছি ফকড়িরে
ছোটি ছোটানি হেরছি ফক্ড়ি।
নতুন নতুন বসতি সব, নতুন নতুন মানুষ, উঠতি বড়লোক, জাঁকজমক, ঠাট, সবই নতুন। বাজিকর ভাবে, হ্যাঁ, এমন জায়গাই বাজিকরের উপযুক্ত বটে। সাহেব, পুলিশ, মুন্সি, মহাজন, শুড়ি, কয়াল, দোকানদার, মোদক, দালাল সব মিলে একটা ব্যাপক লুঠের বন্দোবস্ত। প্রথমে বোঝা যায় না কে লুঠ করে আর কে লুঠ হয়। এ ভারি মজার ব্যাপার। যে লুঠ করে তার উল্লাস বোঝা যায়। কিন্তু যে মানুষটা লুঠ হচ্ছে সে কেমন করে দিনের শেষে শুড়ির দোকানে হুল্লোড় করে? মোরগা-লড়াইয়ে বাজি রাখে হাটে আনা শেষ সম্বল?
পীতেম বলে, বাজিকরের বেটারা, চোখ কান খোলা রেখে চল। দেখেবুঝে চল। পয়সা তোমাদের হাতে আসবে। দুঃখ তোমাদের ঘুঁচবে।
হাটের মাঝখানে বাজিকর খেলোয়াড়ের খেলার আসর যখন জমে ওঠে তখন পীতেম তার কিছু লোককে ছড়িয়ে দেয় হাটের মধ্যে। তারা নানারকম মনোহারি জিনিস বিক্রি করে অবিশ্বাস্য বিনিময়-মাধ্যমে। একটা রঙিন পুঁতির মালার বদলে একঝুড়ি চাল পাওয়া যায়, একখানা গালার চিরুনিতে পাওয়া যায় পাঁচ সের সরষে, নেশার জিনিষের বদলে সর্বস্ব দিতেও মানুষ রাজি থাকে।
এসব দেয় কারা? এসব দেয় যারা দুর দূর গ্রাম থেকে গরুর গাড়িতে অথবা পিঠের বাঁকে শস্য নিয়ে আসে। যাদের কাখে গোঁজা একটি বাঁশি অবশ্যই হাত খালি হওয়ার অপেক্ষায় থাকে, যখন সে সমস্ত গ্লানি এবং শ্রমকে ভুলে সেই বাঁশিতে ফুঁ দেয়।
এই মানুষগুলো চকচকে কালো, উজ্জ্বল দাঁত তাদের, অফুরন্ত তাদের আনন্দ। পীতেম তাদের দেখেছিল বিস্ময়ের সঙ্গে। এরা বাদিয়া বাজিকরের মতো নয়, আবার এরা সাধারণ গৃহস্থের মতোও নয়। এরা পণ্ডিতও নয়, মূখও নয়। প্রকৃতির সছে একাত্ম, খেটে-খাওয়া মানুষ এরা। পাহাড় ভেঙে, জঙ্গল পরিষ্কার করে অবিশ্বাস নিষ্ঠায় তারা ফসলের জমি তৈরি করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা পরিশ্রম করে, তার পরেও গান গায় এবং নাচে, জীবনকে উপভোগ করে।
এই মানুষ হড়, এই মানুষ সাঁওতাল। পীতেম দেখেছিল রাজমহল, বারহেট, আমগাহিয়া, পিপড়া ইত্যাদি শহর-গ্রাম-হাটে এইসব মানুষ দ্রব্য বিক্রয় এবং বিনিময় যাই করুক না কেন, প্রায় সবসময়ই অর্তে প্রকারান্তর থাকে। যখন বেচে জন শতি থাকে একরকম, যার নাম ‘হাচ্কা’, অর্থাৎ ঝুড়িশুদ্ধ অথবা গাড়িশুদ্ধ, কখনোই ওজনের নয়। আর যখন ক্রয় করে, তখন গোলাদার, মহাজন অথবা যে-কোনো ক্রেতাই হোক না কেন, পদ্ধতিটা হয় ওজনের। সে সময় যে বাটখারা ব্যবহার করা হয় তার কোনো নির্দিষ্ট ওজন-মান নেই, নেই কোনো সাধারণ সর্বজনীতাও। যে যেমনভাবে পারে এই জটিলতাবর্জিত হড়কে বুঝ দিচ্ছে, তা ওজনে হোক কিংবা পয়সায় হোক। আর কী আশ্চর্য, এরা বুঝে যাচ্ছে, মেনে নিচ্ছে, খুব যে অখুশি তাও মনে হচ্ছে না।
সুতরাং পীতেম মনোযোগ দেয় কিছু সঞ্চয়ের দিকে। তার বহুদেশদর্শী ইন্দ্রিয় বলছিল, এ অবস্থা বেশিদিন চলবে না। কাজেই যতদিন চলে, যতদিন বাজার গরম থাকে, তার মধ্যেই তারা যাযাবরী ব্যবসায় অর্থোপার্জন করতে থাকে।
সে পরতাপ এবং জিল্লু এই দুই বাজিকরকে ঘোড়ায় করে মুর্শিদাবাদে পাঠায় সওদা আনতে। রূপা, তামা, পেতল, রাঙ এবং গালার নানান ধরনের গহনা এবং অন্যান্য মনোহারী জিনিসের চলন খুবই বেশি। এসবের বিনিময়ে পাওয়া যায় খাদ্যশস্য এবং তৈলবীজ। যা আবার গোলদার কিংবা যে-কোনো ব্যবসায়ীর কাছে নগদ টাকায় বেচা যায়। দাম ইদানীং খুবই ভালো। বিশ সের গম, পনেরো সের চাল অথবা দশ সের তৈলবীজের বদলে এক থেকে দেড় টাকা পাওয়া যায়। আর এইসব চাল, গম কিংবা তৈলবীজ চতুর মানুষের পক্ষে সংগ্রহ করা মোটেই কঠিন।
পীতেম বলে, উঁইসের বাচ্চাগুলোকে ভালো করে ঘাসজল দেও তোমরা। ওগুলোকে এবার হাটে তুলতে হবে।
বস্তুত পাঁচটি গাবতান ভঁহী পাঁচটি নধর শাবক দিয়েছিল। সেইসব শাবকেরা যথাসময়ে আবার বংশবৃদ্ধি করেছিল। বাজিকরেরা নিজেরাই এঁড়েগুলোকে খাসি করত। কেননা, বলদ-উঁইসের বাজার সব দেশে এবং সবসময়ই ভালো। এখন বাজিকরের তাঁবুতে অনেকগুলো বলদ-ইস আছে, যারা উঠতি জোয়ান। এক বছর শিক্ষিত মোষ কিংবা বলদের পিছন পিছন নবিশি করলে পরের বছর স্বাধীনভাবে কাজ করানো যাবে।
বাজিকরের ছাউনিতে জানোয়ার কিনতে মানুষ হামেশাই আসে। দয়ারাম ভকত নামে এক মহাজন মোষ কিনতে এসে পীতেমের সঙ্গে আলাপ জমায়। বাজিকরের হালচাল, ব্যবসাবাণিজ্য এবং ওষুধপত্তরের খোঁজ নেয়। প্রচুর সম্পত্তির মালিক দয়ারামের দেহে সুখ নেই। পীতেম জানে, দয়ারামের যা বয়েস তাতে দেহে নতুন করে সুখ আসা সম্ভব নয়। কিন্তু ঝানু মহাজন সমস্ত কিছু বুঝেও এ জিনিসটা বুঝতে পারবে না, এও পীতেম জানে। আর বুঝলে পরে বাজিকরেরই বা চলে কিসে?
কিন্তু দয়ারাম ব্যবসাদার, কাজেই মোষ কেনার ব্যাপারটাই সে প্রথমে উত্থাপন করে। গুহ্য ব্যাপার, যার সঙ্গে দুর্বলতা জড়িত, তা পরে প্রসঙ্গ হিসাবে রেখে দেয়। আবার পীতেমও জাত বাদিয়া। সেও জানে, এরপরে দয়ারামের কাছ থেকে কী প্রস্তাব স্বাভাবিকভাবে আসতে পারে। সে সালমাকে কাছাকাছি রাখে। সালমা প্রৌঢ়া, কিন্তু তার শরীর কোনো অজ্ঞাত কারণে টনটান এবং স্তনদ্বয় এখনো উদ্ধত।
দয়ারাম বলে, বাজিকর, তোমার এ দাফার উইসের দাম আশি টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।
পীতেম বলে, মহাজন আদমি আপনি, জানোয়ারের দাম আপনার থেকে ভালো জানবে কে? তবে কিনা মুঙ্গেরি ভঁইস, পুরা জোয়ান হলে একটা হাতির কাজ করবে।
মুঙ্গের? মুঙ্গেরে কি ভালো ভঁইস হয়! আমার জানা নেই, বাজিকর। তোমার দামটা শুনি।
মালিক, ঠিকঠাক যদি বলতে দেন, তো বলি, তিনশ’ টাকা এর দাম হয়।
বেচার দাম বল, বাজিকর। দয়ারাম ভকতকে এ তল্লাটে সবাই চেনে। জানোয়ার কিনব বলেই তোমার কাছে আসা। আর দশটা বাজে লোকের মতো তোমার ছাউনির আওরত দেখতে ছল করে আসিনি।
সুযোগ পেয়ে পীতেম একটু গম্ভীর হয়। বলে, মালিক, বাজিকরের আওরত হাটেবাজারে ঘুরে বেড়ায়, খেলা দেখায়, হাজার দ্রব্যের বেসাতি করে। তাকে দেখার জন্য ছাউনিতে আসতে হয় না। কিশনজির নাম নিয়ে বলেন যে দাম বললেন, তা নিয়ে আজকাল একটা ধাড়ি শুয়োরও কেনা যাবে কিনা?
আরে রাম, রাম! সকালবেলাটা ওই জানোয়ারের নাম নিয়ে দিনটা মাটি করলে আমার? ও জিনিস কখনো কিনিনি, তাই তার দামও জানি না। তবে এ কথা জানি বাজিকর, ও দাম দিয়ে একটা মানুষ কেনা যায়।
হাঁ, জংলি আদমি একটা কিনতে পারেন বটে, কিন্তু মুঙ্গেরি ভঁইস হবে না।
তবেই দেখো, একটা আদমির থেকে একটা ভঁইসের দাম তুমি বেশি বলছ, এটা কি ঠিক হচ্ছে?
সুযোগ বুঝে সালমা আসল জায়গায় ঘা মারে দয়ারামের। বলে, আদমির থেকে জানোয়ারের দাম সব সময়ই বেশি থাকে, জনমভর এমনই তো দেখে আসছি, ভকতজি। যেমন ধর, রাতের বেলা কোনো আওরতের কাছে তোমার দাম কী হবে?
দয়ারাম কথাটা গায়ে না মেখে রঙ্গচ্ছলে নেয়। বলে, সাবাস বলেছ, ভান্মতি। অস্বীকার করি না, আক্ষেপ কিছু আছে বটে দয়ারামের। জড়িবুটি, গুণ-তুকে তোমার নামও শুনেছি। দরকার আমার তোমার সঙ্গেও। আরো বলি, ভান্মতি, তুলনাটা তোমার লাগসই হল না।
তারপর মোষের দাম নিয়ে একটা ক্লান্তিকর টানাটানি করে শেষপর্যন্ত উভয়ে (পৌনে ৭শ টাকায় রাজি হয়।
ততক্ষণে সালমা উঠে চলে গেছে। দয়ারাম তার ছাউনি খুঁজে বার করে নেয়। সালমা তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। অথচ সে ভাব মুখে প্রকাশ করে না।
দয়ারাম বলে, ভাতি, তোমার গুণের কথা শুনেছি দু-চারজনের কাছে, তার মধ্যে জানকীরাম দারোগাও আছে। দারোগা আমার বন্ধুলোক।
তবে তো তোমাকে খাতির করতেই হয়, মালিক। সালমা বলে। সালমা এভাবেই কথা বলে। সব কথাতেই উদ্দিষ্ট একটা সরস তাচ্ছিল্য টের পেয়ে যায়।
বস্তুত, সালমা মানুষের অন্তরঙ্গ জীবন বড় বেশি দেখেছে, বিশেষ করে গৃহস্থ মানুষের। গৃহস্থ মানুষের যেসব বিচিত্র গোপনতা আছে, বাজিকরের মিল নেই তার সঙ্গে কিছুই। অথচ, সালমার কালো চোখের তারায় সামনে-বসা মানুষটির অনেক কিছুই ধরা পড়ে। সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে তার রহস্যময় মনের অন্ধকারে যেসব আকাঙ্ক্ষাগুলো নড়াচড়া করে।
দয়ারাম বলে, সময় যখন আছে, হাতটা তোমাকে দেখিয়ে যাই, ভান্মতি।
সালমা তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাতটা টেনে নেয়। নরম চর্বিযুক্ত হাত। তিনটে পাথর বসানো আংটি আঙুলে। কব্জির হাড় নরম। বাহুতে বিশেষ কোনো শিরা দেখা যায় না।
সালমা আবার তার মুখের দিকে, চোখের দিকে এবং দেহের অন্যত্র দ্রুত দৃষ্টিপাত করে দেখে নেয়। গলায় তুলসীর মালা। দয়ারামের দেহে অধিক মেদ নেই। মুখে আবছা লেগে থাকা কর্কশ বিরক্তি, লোভ, দাপট এবং দম্ভ।
সালমা তার হাত ছেড়ে দিয়ে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রইল। তীক্ষ অথচ অনির্দিষ্ট দৃষ্টি তার। তারপর দয়ারামের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়, কি জানতে চাও মালিক?
সবই তো জানতে চাই, ভাতি, ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান—
আগে টাকা দেও।
দয়ারাম হেসে কোমরের গেঁজে থেকে দুটি টাকা বের করে সালমার হাতে দেয়।
সালমা বলে, দু-টাকায় হবে না, আরো দু-টাকা বের করো।
দয়ারাম তাই করে।
সালমা বলে, শোনো মালিক, দিন তোমার ভালো যাচ্ছে এখন, পয়সাও আসছে প্রচুর। কিন্তু মন ঠিক নেই, কারণ, শরীর আর কথা শুনছে না। একটি আদরের জিনিস অথবা জনকে হারিয়েছ সদ্য,শোক ভুলতে পারছ না। আবার কিছু করারও নেই, মেনে নিতে হচ্ছে। কি তাই নয়?
দয়ারাম সালমার হাত চেপে ধরে।
ঠিক বলেছ, ঠিক বলেছ তুমি, ভান্মতি।
সালমা হাত ছাড়িয়ে নেয়।
অন্যদিকে তাকিয়ে আবার বলে, দু-বছরের মধ্যে তোমার আরো দুর্দিন আসছে। তোমার এই ধনসম্পত্তি আর কোনো কাজে নাও লাগতে পারে।
দয়ারামের নাকের পাশে ঘাম জমে। আঁতকে উঠে সে বলে, কেন? কেন, ভাতি?
তা আমি বলতে পারব না। তবে আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার সুদিন স্থায়ী হবার নয়।
দুর্দিন কি করে কাটবে?
সালমা চোখ বুজে বসে থাকে।
তার পর বলে, আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না, আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
দয়ারাম অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে খাটিয়ায়। প্রকাশ্যেই ভয়ানক ঘাবড়ে গেছে সে। আঁতিপাঁতি করে নিজের অভ্যন্তরে এবং পারিপার্শ্বিকে খুঁজে কোনোরকম অদৃশ্য শত্রুকে আবিষ্কার করতে পারে না। কোম্পানির আমলে বাঘ-বকরি একত্রে জল খায়, আর সে-কোম্পানির থানা, পুলিশ, সাহেব হাকিম, সবই তার হাতে। সাহেবি আইনের বাইরে সে কিছু করেও না। তবে?
ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে তার। সে ভাবে বাজিকর রমণীর এ এক রকমের বুজরুকি। সে বলে, ভান্মতি, সে যা হবার তা হবে। এখন কিছু দাওয়াইয়ের ব্যবস্থা কর। জানকীরাম দারোগা তোমার দাওয়াইয়ের কথা আমাকে বলেছে।
সালমা উঠে যেতে যেতে বলে, দাওয়াই বানাতে হবে। দু’দিন বাদে লোক পাঠিয়ে দিও দু’টাকা দিয়ে।
সালমা উঠে চলে যায়। দয়ারামও ওঠে। তার চাকর মোষের দড়ি হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছিল তার জন্য। একজন সাঁওতাল। অদ্ভুত শান্ত আর নিরীহ দেখতে মানুষটাকে। এতক্ষণে কারুর সঙ্গে একটাও কথা বলেনি। লোকটা জোয়ান এবং বিষণ্ণ।
দয়ারাম গাছে বাঁধা ঘোড়ার কাছে গেলে সেই সাঁওতাল মোষের দড়ি ছেড়ে দিয়ে ঘোড়ার পায়ের কাছে উবু হয়ে বসে। দয়ারাম তার ঘাড়ের উপর পা দিয়ে ঘোড়ায় উঠে আড় হয়ে বসে। সে দু-দিকে পা ঝুলিয়ে বসতে পারে না।
দয়ারাম চলে গেলে সালমা পীতেমের কাছে আসে। পীতেম সালমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট। কিন্তু উভয়ের মধ্যে কিছু গোপনীয়তা আছে। ধন্দু, পেমা এবং পরতাপের মা যতদিন বেঁচে ছিল, ততদিনই ব্যাপারটা সত্যিকার গোপনীয়তার পর্যায়ে ছিল। কিন্তু সেই রুগ্ন স্ত্রীলোকটি পীতেমকে সময় থাকতেই রেহাই দিয়ে গিয়েছে। যক্ষ্মা রোগে অনেক অল্প বয়সেই সে মরেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সালমা-পীততমের সম্পর্ক স্বাভাবিকতার পর্যায়ে আসেনি। এর মধ্যেও কিছু অতীত কারণ বিদ্যমান।
কোন এক দূর অতীতে বাজিকর এবং বানজারা এই দুই যাযাবর গোষ্ঠী একই জায়গায় ছাউনি ফেলে। সেই সময়ে পীতেমের বাপ দনুর জোয়ান বয়স ছিল। দনু বানজারা যুবতীদের পাগল করেছিল। তারপর দুই দল যখন দু-দিকের রাস্তার ধরে, তখন দেখা গিয়েছিল বানজারাদের দলে এক যুবতী কম এবং বাজিকরের দলে এক যুবতী বেশি।
সেই যুবতী সালমার মা। দনুর নিজস্ব স্ত্রী-সন্তানাদি থাকতেও অতিরিক্ত হিসাবে সেও ছিল। সালমা তার প্রথম সন্তান। এ সন্তানের পিতৃত্বের দাবিদার কে, এ সম্পর্কে সালমার মায়েরই সংশয় ছিল। পরবর্তীকালে সেই যুবতী আরো দু-বার গর্ভবতী হয় দনুর সহায়তায়। প্রথমবারে সে মৃত সন্তান প্রসব করে আর দ্বিতীয়বারে সন্তানসহ নিজেই মারা যায়।
কাজেই দনুর সংসারে সালমা মানুষ হয়। কালক্রমে যৌবনবতী হয় এবং কোনো এক সময়ে তার থেকে পাঁচ বছরের ছোট পীতেমের উপরে দুর্বার আকর্ষণ বোধ করতে থাকে।
এর আগেই অবশ্য পীতেমের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সালমার তখনো বিয়ে হয়নি। কারণ সালমা তখনো মনস্থির করতে পারেনি। বাজিকরের দলে এবং দলের বাইরেও তার পাণিপ্রার্থীর সংখ্য ছিল ভারি। ফলে সালমা হয়েছিল দাম্ভিক। এই ধরনের সুন্দরীদের স্তুতি করার জন্য অনেক মানুষ থাকে বলে অনেক সময় সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়।
যেমন সালমার। তার সারাজীবনে সিদ্ধান্ত নেওয়াই হল না।
শেষে ক্রমশ তার প্রেমিকরা হতাশ হতে হতে সংখ্যায় কমতে লাগল। সালমার দম্ভ তাকে সময় থাকতে এ-ব্যাপারে সতর্ক করেনি। তারপরে একসময় সে নিজেকে দেখেছিল নিঃসঙ্গ।
সেই সময়ই পীতেমের বিয়ে হয়, পীতেম তার স্ত্রীকে নিয়ে সালমার চোখের সামনে সারাক্ষণ মশগুল থাকে। সেই পীতেম, যার সঙ্গে সালমা একসঙ্গে বড় হয়েছে এবং চিরকাল জ্যেষ্ঠা হিসাবে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে, সেই পীতেম। এখন দু-জনে সম্পূর্ণ আলাদা জগতের হয়ে গেছে সালমার একাকিত্বকে আরো ভারি করে।
প্রথমত সালমার একটা অস্বস্তি ছিল, পরে সেই অস্বস্তি ঈর্ষায় পরিণত হয় এবং কখন নিজের অজান্তেই পীতেমের স্ত্রীকে সে প্রতিদ্বন্দ্বী করে ফেলে। শুরু হয় এক বিচিত্র অধ্যায় যা বাজিকরদের মধ্যেই সম্ভব।
পীতেমের স্ত্রী ছিল নরম চেহারার মানুষ, হয়ত যাযাবরী জীবনের উপযুক্ত নয়। ধন্দু জন্মাবার পরই তার শরীর ভাঙতে শুরু করে, পেমার জন্মের পর সে দীর্ঘদিন রোগভোগ করে, তারপর পরতাপ যখন তার পেটে তখনই ধরা পড়ে তার ক্ষয়রোগ।
এর উপরে ছিল সালমার কর্তৃত্বের যন্ত্রণা, যা সালমাকে তৃপ্তি দিত, পীতেমকে আহত করত এবং ধন্দুর মাকে জীবন সম্বন্ধে হতাশ করত। ক্রমশ রুগ্ন স্ত্রী যাযাবরের জীবনে অসহ্য হয়ে ওঠাতে পীতেম সালমার কাছে ধরা দেয়। যেহেতু তারা একসঙ্গে বড় হয়েছে তাই পরস্পরকে ভালো বুঝত। পীতেম সালমার কর্তৃত্বে শৈশব থেকে অভ্যস্ত, তাই এখন দলের সর্দার হয়েও সালমার কোনো কাজ কিংবা সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ করে না। আর এখন দীর্ঘকালের অভ্যাসবশত প্রায় সব বিষয়েই সালমার পরামর্শও নেয় পীতেম।
ধন্দুর মায়ের মৃত্যুর পর তাদের সম্পর্ক যখন বিশেষ কারো কাছেই অপ্রকাশ্য থাকে না, তখন দলে কথা ওঠে। দল মূলত এ বিষয়ের নীতির দিকটাই বিচার করছিল। দনু আবার পীতেমকে বিয়ে করার কথা বলেছিল, পীতেম রাজি হয়নি। রাজি হয়নি এ জন্য নয় যে, সালমা তার কাছে অপরিহার্য ছিল। রাজি হয়নি, কারণ শালমার নিঃসঙ্গতা তাকে ব্যথিত করত।
আবার সালমা এবং পীতেম উভয়ের মধ্যে যখন বিয়ের প্রসঙ্গ ওঠে তখন। দু-জনেই এ ব্যাপারে শিউরে উঠেছিল, কেননা দূ-জনের ধমনীতে একই রক্ত বইছে কিনা এ সম্পর্কে তারা নিঃসংশয় ছিল না।
কেননা, হাজার বছর আগে যখন তারা কোনো এক বিশাল নদীর ধারে স্থায়ী বসবাস করত, সেই সময়কার পৌরাণিক স্মৃতি তাদের ভারাক্রান্ত করত। যখন তাদের কোনো প্রাচীন পুরুষ পুরা এক নর্তকীর প্রতি আসক্ত হয় এবং তাকে বিয়ে করতে চায়। তারপর শুরু হয় সেই অন্তর্কলহ, যা তাদের স্থায়ী বসবাসকে ছিন্নভিন্ন করে। মানুষ তখন দুই দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। পুরার বিরুদ্ধবাদীরা দাবি তুলেছিল, এ বিয়ে হতে পারে না, কেননা পালি নামের সেই নর্তকী নাকি তার বোন। সুতরাং এ বিয়ে হবে অসামাজিক এবং অমঙ্গলময়।
পুরার সমর্থকরা বলেছিল, এ বিয়ে হবেই, কেননা পালি যে পুরার বোন এর কোনো প্রমাণ নেই।
তারপর পুরা ও পালির বিয়ে হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে দেবতার অভিশাপ নেমে আসে তাদের উপর। অন্তর্কলহে সমস্ত মানুষ নষ্ট হয়। পুরা ও পালি দেশ-দেশান্তরে পালিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। তারা কোথাও আশ্রয় পায় না এবং দেবতা তাদের অভিশাপ দিয়ে সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় করে দেয়। তোমরা এক বৃক্ষের ফল দু-বার খেতে পারবে না, এক জলাশয়ের জল দু-বার পান করতে পারবে না, এক আচ্ছাদনের নিচে একাধিক রাত্রি বাস করতে পারবে না এবং সব থেকে ভয়ানক—এক মৃত্তিকায় দু-বার নৃত্য করা দূরে থাকুক, দু-বার পদপাত পর্যন্ত করতে পারবে না। এই ছিল দেবতার অভিশাপ।
সেই থেকে বাজিকর পথেপ্রান্তরে ঘুরছে। সেই থেকে সে দেবতা থেকে বঞ্চিত। গৃহস্থের গৃহের নিকট পর্যন্ত সে যায়, কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না।
সুতরাং বাজিকর এক ভিন্ন জীবন, এক অস্থির চলমান জীবনকে আশ্রয় করে আছে। সে নিজেকে ভুলিয়েছে নাচ গান এবং চিন্তাহীন সরল জীবনযাত্রায়। সে শিখেছে মানুষকে ঠকাতে এবং তা নিয়েই তার অহংকার। সে গ্রহণ করেছে বিচিত্র ভিক্ষাবৃত্তি, যার জন্য কোনো সংকোচ তার নেই।
তবুও প্রাচীন কিছু স্মৃতি কিংবা পাপবোধ কিংবা নিতান্তই বিশ্বাস তাকে এখনো চালিত করে, এখনো নিযুক্ত রাখে কিছু আস্তিক চিন্তায়। কিছু ভীতি অথবা দারুণ দুর্দিনের আশংকা তাদের সমস্ত বিধিহীন জীবনযাত্রাকেও বেঁধে রাখে নিয়মের নিগড়ে।
কিন্তু এই নিয়মের নিগড় থেকে বেগবান অন্য কিছু তাদের একজনকে অন্যের সঙ্গে যুক্ত রাখত। পীতেম কিংবা সালমা কেউ জানবে না তাদের পরবর্তী তৃতীয় এবং চতুর্থ পুরুষেই বিষয়টি নিয়মে পরিণত হবে বাধ্য হয়ে, যে বাধকতায় পুরা ও পালি আনীত অভিশাপ মূল্যহীন হয়ে যাবে।
সালমা বলে, মানুষটা লোভী ও বজ্জাত।
পীতেম বলে, তাতে তোর কি? তাতে বাজিকরের কি আসে যায়? পয়সা তো রোজগার হচ্ছে!
তুই আজকাল খুব পয়সা চিনেছিস। ভকত আর বেনিয়াদের মতো খালি পয়সার চিন্তা তোর।
পয়সা ছাড়া দল বাঁচবে না, তুই আমিও বাঁচব না।
ভয় হয়, এর পরে তুই কবে আবার ঘর-গেরস্থালির কথা ভাবতে শুরু করবি দলের জন্যে?
ঘর-গেরস্থালি? বাজিকরের?
নয় কেন? পয়সা চিনছিস না?
কি জানি? বাজিকর কেন পথে ঘোরে? বাজিকর কেন ঘর বাঁধে না? এসব আমার মাথায় আজকাল আসে মাঝে মাঝে।
আসে, না?
আসে।
ঘর বাঁধবি? তারপর রাতের পর রাত, সারাজীবন সেই এক ছাউনির নিচে থাকবি?
থাকলাম।
এক পুকুরের জল খাবি সারাজীবন?
খেলাম।
চেনা পথ হাঁটবি সারাজীবন?
হাঁটলাম।
কোন মানুষটা হবি তুই? দয়ারাম ভকত, না তার ঐ বাঁধা চাকরটা যার ঘাড়ের উপর পা রেখে ভকত ঘোড়ায় উঠল?
সালমা!
হাঁ, হাঁ, বল?
এত ভাবি নাই।
দলের সর্দার তুই, পীতেম, তোর ভাবা দরকার। বাদিয়া, বাজিকর, বানজারার জীবনে তো সবার জন্য একই রকম রাস্তা। কিন্তু এই গেরস্থের রাস্তা সবার আলাদা।
হাঁ, সেটাই ভয়। গেরস্থ হওয়া মানে বাঁধা জানোয়ার। আর জানোয়ার বাঁধা থাকতে তাকে দোয়ানো সোজা। দুইয়ে তার শেষ বিন্দু রক্তও বের করে নেওয়া যায়।
তবুও তুই বাঁধা জানোয়ার হওয়ার কথা ভাবছিস?
ভাবছি।
কেন?
বাজিকর-বাদিয়ার দিন বোধহয় শেষ হয়ে আসল। পশ্চিম থেকে পুবে এই যে ক্রমান্বয়ে হেঁটে যাওয়া, সেই পুবদিকের সীমানা বোধহয় অন্য কোনো পশ্চিমে গিয়ে ঠেকে যাবে।
কিন্তু দেখ, বাজিকরের পালাবার রাস্তা থাকবে না, সব রাস্তা সাহেবরা রেল দিয়ে বেঁধে ফেলেছে, দেখছিস না?
দু-জনেই খুব সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। দু-জনের ঝোক দুই বিপরীত মেরুতে, কিন্তু মজা এই, কারো কেঁকই খুব দৃঢ় নয়। শীতেম স্পষ্টত মানুষগুলোর অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নটি নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু সালমার তেমন কিছু নেই। তার কাছে স্থায়িত্ব খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়, আবার চলমানতাও এখন আর খুব ছন্দময় মনে হয় না।
অতঃপর তারা তাদের এই বহির্জগৎ সম্বন্ধে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়। যদিও বাজিকরের জীবন পরিশ্রমহীন নয়, তবুও সতত উৎপাদনশীল জীবনযাত্রা তার অপরিচিত না হলেও, তার বিধি-উপকরণ সম্বন্ধে তার কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই।
যেমন পীতেম বলেছিল বাঁধা জানোয়ারকে দোয়ানো সহজ, এই বিষয়টা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত দশ বছরের মধ্যে দোহকের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারে হাটে বাজিকরে সামান্য পণ্য বিক্রির সময়ও ভাগিদার এসে উপস্থিত হয়। দালাল যেন মাটি খুঁড়ে বের হয়। এমনকি নিতান্ত খেলা দেখিয়ে যে ভিক্ষাবৃত্তি, যা বাজিকরের একান্ত নিজস্ব, সেখানেও ভাগ দিতে হয়। ভাগ দিতে হয় দারোগা পুলিশকে, ভাগ দিতে হয় স্থানীয় বদমাশদের।
যেমন বাজিকর ভাবে, কেবলমাত্র যাযাবরই জীবনকে সঠিক জানে বা জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করে। এ ভাবনা ঠিক কিনা, এখন এরকম সমস্যা কারো কারো মগজে আসতে পারে। বেশ কয়েক বছর আগে সালমাকে এক সন্ন্যাসী বলেছিল, ঈশ্বরের শরণাপন্ন হও, কেননা পাপ অধিক হলে এই দৃশ্যমান পৃথিবী ধ্বংস হবে। তখন পুণ্যাত্মারাই রেহাই পাবে, পাপীরা নয়।
সালমার ধারণা হয়েছিল, এ লোকটা তার রূপে মজেছে, তাই এসব তাকে দলে ভেড়াবার ফন্দি। সে হেসেছিল এবং অবজ্ঞা দেখিয়ে চলে এসেছিল। অথচ পরে অনেক চিন্তা করেও বুঝতে পারেনি, কী আকর্ষণে ঐ লোকটার কাছে সে গিয়েছিল। সে নিজে মানুষের হাত দেখে এবং ভূত-ভবিষ্যৎ বলে, ছক পেতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে, নিদান দেয় শুভ এবং অশুভের, কিন্তু এসবের সঙ্গে বাজিকরের কোনো সম্পর্ক নেই। অন্তত এতকাল তো ছিল না।
এই চমৎকার নিসর্গ, পিছনের গঙ্গা, যেখান থেকে বছরের এই সময় যখন খুশি দমকা হাওয়া উঠে এসে আছড়ে পড়তে পারে, নিয়ত-সঞ্চরণশীল নৌকোগুলোকে সন্ত্রস্ত করতে পারে। অথবা দুরের ঐ পাহাড়, এখন কী চমৎকার ঝকমকে, সবুজ মুহূর্তে তার রঙ বদল করতে পারে সম্পূর্ণ বিপরীতে। তবুও এই মুহূর্তে প্রাণবন্ত ও রঙিন এইসব প্রাকৃতিক দৃশ্য। আর যদি উঠে দাঁড়ানো যায়, তাহলেই ডান পাশের আমবাগানটার ভেতরেই চোখে পড়বে কুৎসিত বিবর্ণ সব মালখানা, আড়ত ও অস্থায়ী চালার সারি। যেখানে হরদম মাল এবং মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে, কুৎসিত আওয়াজ, ঝগড়া, হাসি ও কখনো কখনো দাঙ্গা এইসব প্রবহমানতায় মিশছে। অথবা, আরো একটু এগিয়ে, যেখানে ভারি মহাজনি ও গয়নার নৌকোয় মাল উঠছে। বিচিত্র সব পণ্য। খেত থেকে আসা, মানুষের উদ্ভাবনীতে ও নৈপুণ্যে বাস্তবায়িত শ্রম—ধান, তৈলবীজ, পাট অথবা, বস্ত্র, শিল্পসামগ্রী, অথবা আধারে আবদ্ধ পণ্য, এমনকি বধের জন্য নীত পশুর দঙ্গল এবং ক্রীতদাস ও বেশ্যা হওয়ার জন্য ক্রীত ও সংগৃহীত মানুষ। এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত মানুষ, যে ঘাম ফেলছে, যে হিসাব রাখছে, যে মস্তিঙ্কে লাভের অঙ্ক কষছে। এই যাবতীয় চাঞ্চল্য নিয়ে এক পৃথক জীবনযাত্রা। কোথায় অধিক উত্তাপ, জীবন, মুক্তি?
যেমন ধন্দুর মা বলেছিল, তোমাকে এর শাস্তি পেতে হবে। অথচ পীতেম অন্যদের সহায়তায় বাজিকর রীতিতে গর্ত খুঁজে শুধুমাত্র মানুষটাকে সমাহিত করেছিল। মাটি দিয়ে গর্ত বোঝাই করেছিল। তারপর দল নিয়ে আবার পথে বেরিয়ে পড়েছিল। সবকিছুই যেমনকার তেমন ছিল, তেমনিই চলছিল।
দয়ারামের সেই ভৃত্য যে নিজের ঘাড় পেতে দেয় প্রভুকে ঘোড়ায় উঠতে সাহায্য করার জন্য এবং সালমার নতুন পরিচিত সেই ক্রীতদাসী রমণী যাকে প্রতিরাতে আবিষ্কার করতে হয় তার প্রভুকে উত্তেজিত করবার পদ্ধতি, অথবা রাজমহল বাজারের গোলাদার, মহাজনের ঘরে ঘরে ঋণজালে আবদ্ধ কৃষ্ণকায় সাঁওতাল, অথবা সাহেবগঞ্জের রেলের রাস্তা পাতার কাজে নিযুক্ত শয়ে শয়ে কুলি—যারা কঠিন প্রহরায় পালাতে পর্যন্ত সাহস করে না ও অজ্ঞাত এক জ্বরের প্রকোপে মরে।
আবার দেখ, আদিম রক্ষণশীলতায় সমস্ত সামাজিক বন্ধনহীন বাজিকরও নিয়মবদ্ধ থাকে। যেমন সালমা আর পীতেমের পরিণতি।
এই যাবতীয় বিভ্রান্তির বিষয় পীতেমকে পীড়িত করে। শেষবারের মতো আসার আগে নানা একবার তার বাপের সঙ্গে এদেশে এসেছিল। সে সম্ভবত তার শৈশব কিংবা কৈশোরের কথা, এখন থেকে ষাট-সত্তর বছর আগের ঘটনাই হবে। সেবার বাজিকরের দল এখান থেকে পালিয়েছিল। কেননা তারা দেখেছিল মানুষ তখন যেভাবে মরে, তাতে পতঙ্গের মৃত্যুর মর্যাদাও সে পায়নি। অথচ, সেই মানুষই ফসল ফলিয়েছিল, যে যার নির্দিষ্ট নিয়মমতো শ্রম দিয়েছিল। আর সেইসব মানুষ, যারা এইসব শ্রমদায়ী মানুষের সর্বস্ব লুঠ করেছিল, তাদের মতো হৃদয়হীন যন্ত্র বাজিকর সমস্ত পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়বার দেখেনি। দেখতে চায় না। কে তখন বাজিকরের ভান্মতি দেখবে? তখন বাজিকর দেখেছে খাজনা না দিতে পারার জন্য গাছে ঝোলানো মানুষ, চুনের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ মানুষ, বিষ্ঠা ভক্ষণে বাধ্য মানুষ, বস্তাবন্দী জলমগ্ন মানুষ, আরো অসংখ্য অশ্লীল কদাচার যার নাম শাস্তি, যার নাম প্রজাকে শায়েস্তা করা। পৃথিবীর যাবতীয় ইন্দ্রজাল কিংবা ভানুমতির খে থেকে অনেক বেশি উত্তেজক ও বিস্ময় উদ্রেককারী এইসব ঘটনা। তখন পীতেমের নানার নানা বলেছিল, এ দেশের মানুষগুলোকে অবশ্যই দানোয় পেয়েছে, না হলে এমন হয় না, সুতরাং পালাও এখান থেকে।
আবার বাপ না বলল তাকে পূবের দেশে যাও, পীতেম?
পুবের দেশে জল আছে, ফল আছে, মানুষ আছে, জানোয়ার আছে।
তবে যে নানা বলেছিল, সেখানে দুর্ভিক্ষে আধা মানুষ মরে যায়?
আধ মানুষ থাকে, তারা আবার নতুন মানুষ বানায়।
কিন্তু আমার ভান্মতি দেখে কে? কে দেখে ভালুক আর বাঁদরের নাচ? কে কেনে সালমার ভবিষ্যৎবাণী? টোটকা, মাদুলি, কুহক বিদ্যা?
দৈত্যের মতো রেলের গাড়ি ভীষণ গতিতে শ’য়ে শ’য়ে মাইল ছুটে যায়। জলের উপর দিয়ে অতবড় লোহার নৌকো মালবোঝাই হয়ে দ্রুত এগোয়। টেলিগ্রাফের তার শহর ছেড়ে গ্রাম পেরিয়ে নতুন শহরের দিকে ছোটে।
বাপ, হে বাপ, আমার সওদা কে নেবে?
অত সময়ও নেই মানুষের। সাহেবরা নিত্য নতুন উত্তেজনার আমদানি করছে। সদাচঞ্চল, সদাকর্মব্যস্ত মানুষ। কেউ কি দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে বাজিকরনির নাচ দেখবে? দেখবে কি ঘাঘরার উপরে কাচ আর পুঁতির কারুকার্য?
দেখ, সালমা, কেউ তোকে না বাঁধলেও তুই বাঁধা পড়বি। যেন সারা দুনিয়া জুড়ে ফঁদ পাতা। সেই ফাঁদে অজস্র ফঁাক, তবু তুমি যেতে পারবে না, এমনই মজা। তোমাকে থাকতেও কেউ বলে না, যেতেও কেউ বলে না। মানুষ শুধু দুঃখ পায়।
সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যায় পীতেমের। অতি পরিচিত এবং অপরিচিত সমাজ, নিয়মশৃঙ্খলা, লোভ, পাপ, ক্ষুধা, ঘাম, রক্ত, ব্যক্তি, গোষ্ঠী কোন নিয়মে চলে! কেনই বা চলে! এসব বাজিকর বুঝতে চায় না, বোঝার দরকারও বোধ করে না। কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিহাসের মতো যে বিষয় তা হল, বাজিকরের অস্তিত্ব নির্ভর করে যেসব মানুষের উপর তারা বাজিকর নয়। তারা সব যুথবদ্ধ, শ্রেণীবদ্ধ, আপন আপন অঙ্গীকারে বদ্ধ মনুষ্যকুল। সেই মানুষের সময় আর অঞ্জ? নয়, সেই মানুষের উপকরণ আর যথেষ্ট নয়। যে মানুষ সারাদিনের শ্রমে শুধু অন্নবস্ত্রের সংস্থান করে তার অপরিহার্য বিষয়গুলো স্পষ্ট। কিন্তু যার গুদামে মালের পাহাড়, যার সিন্দুকে টাকার উপরের চাপে নিচের অংশের ধাতব বিকৃতি হয়, তার অভাববোধ অস্পষ্ট অথচ বাস্তব। আর এই যাবতীয় বিষয়ই এখন সমাজগ্রাহ্য নিয়মের অংশ।
এই নিয়মকেই যত ভয় পীতেমের। দেবতার অভিশাপে শিকড়হীন জীবনে অভ্যস্ত বাজিকর এখন সবদিকে বিস্তারী এক বৃক্ষের অজস্র শিকড়কে ঝুরির মতো নেমে পথরোধ করতে দেখে। যার বাইরে তার অস্তিত্ব বিপন্ন এবং ভিতরে অনিশ্চিত। সেজন্যই সম্ভবত সে শুনেছিল তার বাপকে বলতে, পীতেম হে, পুবের দেশে যাও।
০৫.
এইভাবে শীত পার হয়ে সূর্য উত্তপ্ত হতে থাকে। গঙ্গার পাড়ের বালি হল্কা হাওয়ায় দিগ্বিদিকে উড়তে থাকে। তারপর ক্রমশ গঙ্গার উপরে হঠাৎ হঠাৎ টুকরো মেঘের আবির্ভাব হয় এবং অচিরে তা ঝঞ্ঝার আকাশে ফেটে পড়ে, তাঁবুগুলোকে ছিঁড়ে উড়িয়ে নিয়ে যায়।
একসময় সবাই বোঝে গঙ্গাপাড়ে থাকা সম্ভব নয়। তখন পীতেম শহরের সংলগ্ন মাঠে তাঁবু ফেলে। তার জন্য আবার দারোগার অনুমতি নিতে হয়।
হাটে ও বাজারে এবারে শীতের মাঝ থেকেই অপর্যাপ্ত শস্য আসতে শুরু করেছে। সেইসব পণ্য বৃহদাকার জলযানে ও রেলগাড়িতে চেপে যায় মুর্শিদাবাদ, সিউড়ি ও কলকাতা নামক শহরগুলোতে। এই সময় হাটবাজার প্রাণবন্ত হয়।
এইসব প্রাণবন্ত হাটে পীতেমের দল বাঁদর ও ভালুক নাচায়, রহু চণ্ডালের হাড়ের ভেলকি দেখায়, বাঁশবাজি, দড়িবাজি দেখায়। কিন্তু সবাই টের পায় মানুষ আর আগের মতো বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায় না। বাজিকর রমণীরা চলতে ফিরতে বিচিত্র হিল্লোল এবং কটাক্ষ ছুঁড়ে যেসব পুরুষকে ঘায়েল করে—যা তাদের স্বভাবের অঙ্গ, যা সৎ-অসৎ কিংবা অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে না—সেইসব মানুষেরা কেউ কেউ বলদর্পী ও বেপরোয়া। কখনো কখনো তারা হামলা করে। তাতে কিছু অশান্তি হয় এবং পীতেমকে দলের মধ্যে কিছু নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রবর্তন করতে হয়, যা একান্তই নতুন।
তারপর ধন্দুর ছোট বোন পেমা একদিন দড়ির উপর থেকে ভিড়ের মধ্যে সওয়ারসহ ধন্দুর সেই ঘোড়াটাকে দেখে এবং উৎসাহে দুই আঙুল মুখে দিয়ে নিতান্তই যাযাবরী শিসধ্বনি বাতাসে ছুঁড়ে দেয়। ঘোড়াটি তাকে দেখে এবং সওয়ারের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে তোয়াক্কা না করে একটি উল্লাস-হ্রেষা তুলে পেমার দিকে ধাবমান হয়।
আরোহী দারোগাপুত্র আনন্দরাম কৌতুক বোধ করে ও ঘোড়াকে ইচ্ছামতো চলতে দেয়। ঘোড়া এসে বাজিকরের জটলার কাছে থামে এবং চঞ্চল হর্ষ প্রকাশ করে।
পেমা দড়ি থেকে নেমে এসে বলে, এ বাবু, ঘোড়া তোমার কথা শোনে?
আনন্দ হেসে বলে, না শুনলে মার খায়।
ঘোড়াটির দেহ আরো উজ্জ্বল হয়েছে। বোঝা যায় সে আদরযত্ন ভালোই পাচ্ছে। এত সুন্দর ঘোড়া এ অঞ্চলে দেখা যায় না। পেমা এবং অন্য মেয়েরা ঘোড়াকে ঘিরে ধরে এবং আনন্দর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের লঘু কৌতুক করে। কলহাস্য ওঠে।
এতগুলো রহস্যপ্রিয় উচ্ছল যুবতীর সান্নিধ্যে আনন্দ গর্ব বোধ করে। এইসব মেয়েদের চলতে ফিরতে সে অনেকবার দেখেছে বটে কিন্তু কখনো মনোযোগ দেয়নি। এখন কাছে থেকে ভালো করে এদের উদ্দামতা দেখে এবং নেশাগ্রস্ত হয়।
আনন্দ ফিরে যায়, কিন্তু মস্তিষ্কে পেমার যুবতী-শরীরের জন্য আক্ষেপ নিয়ে যায়। অবশ্য এই আক্ষেপ নিতান্তই আকাঙ্ক্ষার নামান্তর, কেননা তখন সময়টা ছিল দারুণ উত্তেজক ও আকাঙ্ক্ষিত বস্তু সমর্থ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে।
সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শ্রমদায়ী মানুষ তখন ছিল একেবারেই দুরভিসন্ধিহীন। এই জন্য অঘ্রান মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চতুর মানুষ, যারা দয়ারাম ভকতের গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, তারা ঘোড়া, বলদ ও মোষে টানা গাড়ি নিয়ে রাজমহল পাহাড়ের উত্রাইতে বসতি গ্রামগুলোতে হাজির থাকত। এর আগে শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন মাসে প্রয়োজনে ওকৌশলে তারা যে দাদন করে রেখেছিল সাঁওতাল গ্রামগুলোতে, এখন তার বহুগুণ তারা প্রাপ্য হিসাবে ফেরত পায়। আর তাদের পাল্লা ও বাটখারা দাদন এবং পরিশোধ এই দুই উপলক্ষে দু-রকম ব্যবহার করে। ফলে খাতকের দেনা শোধ একটা দর্শনীয় ব্যাপার। আবার প্রায়ই তা খাতকের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। তখন খাতক নিজেকে বাঁধা রেখে, অথবা স্ত্রী-পুত্র-কন্যা বাঁধা রেখে সেই দেনা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার প্রয়াস পায়। বস্তুত, ক্ষমতাশীল মানুষের কাছে সমস্ত বস্তু ও ব্যক্তি যে-কোনো উপায়েই তোক প্রাপ্য।
কাজেই আনন্দ নেশাগ্রস্ত হয় এবং পেমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে সার্থক করার চেষ্টা করতে থাকে। যে যেমন বাজিকরের ছাউনিতে গেল এবং বাছাই ঘোড়াটি নিয়ে এল, এই দ্বিতীয় ব্যাপারটি যে তেমনই হবে, এতে তার সামান্য সংশয় ছিল। একটা মাদি ঘোড়া আর এক বাজিকর যুবতী তার কাছে এই মুহূর্তে এক নয়।
তবে আনন্দ নিজের দৈহিক সৌন্দর্য ও ক্ষমতার উপরে যথেষ্ট আস্থাবান। আর এই ধরনের যুবকেরা প্রথমেই বলপ্রয়োগটা লজ্জাজনক মনে করে।
দু-একদিনের মধ্যে আনন্দের ঘোড়া বাজারে সওদা নিতে আসা পেমার রাস্তা আটকায়। পেমা আনন্দর আশানুরূপ ঝিলিক দিয়ে হাসে। আনন্দ এই যাযাবরীর চোখে আহ্বান দেখে এবং ভাবে এ কি যাযাবরী চোখের স্বাভাবিক দ্যুতি, না বিশেষ কম্পন?
পেমা অবশ্যই শহরের সেরা যুবকটির মনোহরণ করার কৃতিত্ব জাহির করে সঙ্গিনীদের কাছে। বিষয়টা যাযাবরীদের চিরকালের দম্ভ। কিন্তু রাজমহল পাহাড়ের উপত্যকায় তখন শুকনো পাতা বড় বেশি ঝরছিল, হাওয়া ছিল উদ্দাম। আর পীতেমেরও দল নিয়ে অন্যত্র সরে যাওয়ার ইচ্ছা বা পরিকল্পনা এত তাড়াতাড়ি ছিল না। কাজেই বাজিকর ছাউনিতে পেমা সমস্যা সৃষ্টি করে যখন সালমার কাছে সে আসে তার ভাগ্য গণনা করতে।