৫১.
আজুরা মণ্ডলের স্বভাবটা কিছু অদ্ভুত। কিন্তু এখানে কারো চোখেই সেটা বিশেষ লাগে না। প্রচুর জমিজমা আছে অথচ শিক্ষাদীক্ষা কিছু নেই এরকম মানুষের সংখ্যা এ অঞ্চলে কম নয়। এইসব মানুষের জীবনে সম্ভোগের উপকরণও খুব প্রাচীন ও গুটিকয়েক মাত্র। বিরাট ভোজ অর্থাৎ এক বা একাধিক খাসি কেটে লোকজন খাওয়ানো, স্ত্রীলোকের প্রতি আসক্তি এবং তার জন্য প্রচুর সময় ও অর্থব্যয়, মদ্যপান আর যাত্রা গান। এর বাইরে ভোগের জীবনের যেসব উপকরণ আছে, আজুরার মতো জোতদারদের কাছে তার কোনো আকর্ষণ নেই। দু-তিনশো একর জমির মালিক আব্দুল্লার ঘরবাড়ির সঙ্গে দশ-পনেরো বিঘার মালিকের ঘরবাড়ির তফাত মাঘ-ফাল্গুন মাস ছাড়া বোঝা যায় না। ঐ সময় আজুরার বাড়িতে ধানের মরাই-এর সংখ্যা থাকে অনেক, দশ-পনেরো বিঘার মালিকের পক্ষে যা কখনোই সম্ভব নয়। তেমনি পোশাক-আশাক, ছেলেমেয়েদের চেহারা, আচার-আচরণ ইত্যাদি কোনো দিক দিয়েই এই সম্পত্তির ফারাক ধরবার উপায় থাকে না।
আর ব্যবধান থাকে এইসব ভোগের ব্যাপারে। আজুয়ার যদি কোনো স্ত্রীলোককে নজরে লাগে ও সে যদি সহজলভ্য হয়, তবে আজুরা সরাসরি তার ঘরেতেই উঠে আসে। একমাসুদেড়মাস সেখানে থাকে, প্রচুর মদ আর চালডাল মুরগা আনায়। বন্ধু-বান্ধবও দু-চারজন জুটে যায়। তাস খেলা হয়। আজুরা এইভাবে একমাস-দেড়মাস একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। এই সময় তার গোলার ধান ক্রমান্বয়ে বিক্রি হতে থাকে, ধার বাড়তে থাকে, চাই কি দু-এক বিঘা জমিও বিক্রি হয়ে যায়। যদি সেই স্ত্রীলোক যথেষ্ট লোভনীয় হয় ও যথেষ্ট টাকা-পয়সা খরচ করেও না পাওয়া যায়, আজুরা নিজের লোকজন দিয়ে সে বাড়িতে ডাকাতি করাবে এবং লুঠ করে নিয়ে আসবে সেই মেয়েকে। গোপন জায়গায় রাখবে, নিজের ইচ্ছা পূর্ণ করবে।
কিন্তু পলবির ব্যাপারে এত সহজে নিস্পত্তি হয় না। শারিবার প্রত্যাখ্যানের পর পলবি শান্ত হয়ে গিয়েছিল। কাজেই নিজের চোখে নিজের ক্ষমতার সীমানা সে দেখতে পায়। তার ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের জীবনে সে পুরুষমানুষ কম দেখেনি। কিন্তু গত কয়েক মাসে সে যে অসামান্য স্বাধীনতার স্রোতে গা ভাসিয়েছিল, এখন তাকে তার বিকার মনে হয়। এই কয় মাসের জীবন যেন পাঁচবিবির জীবনের থেকেও ঘৃণ্য। আজুরা মণ্ডলকে প্রতিহত করার ইচ্ছা থাকলেও এখন সে বোঝে, বাজিকর গোষ্ঠীতে সে ক্ষমতা কারোই নেই।
কাজেই সে নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করে। সে একেবারে শীতল হয়ে যায়। এর জন্য তাকে চেষ্টাও করতে হয় না। শারিবা, প্রত্যাখ্যান তার ভিত পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়েছে।
আজুরা তিন দিনে ছ-টা মুরগি আনে, এক বস্তা চাল আনে ও চোলাইয়ের বোতলও আনে গোটা কয়েক। কিন্তু এতেও পলবির চোখে মুখে কোনো উল্লাস সে ফোটাতে পারে না। আজুরা যেহেতু মনে করে মুরগি, চাল ও টাকার বিনিময়ে এসব তার স্বাভাবিকভাবেই প্রাপ্য। না পেয়ে বিরক্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এ অত্যন্ত বেয়াদপি তার কাছে।
চতুর্থ দিনেও একই অবস্থা দেখে নেশার ঘোরে পলবির মাজায় একটা লাথি মারে আজুয়া।
পলবি নিমেষে জ্বলে ওঠে ও ত্বরিতে উপরের মাচায় আটকানো হেঁসোখানা টেনে নামায়। মুখে কিছু না বলে ভীষণ দৃষ্টিতে আজুয়ার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে সে। আজুরার ভীষণ মুখ ভীষণতর হয়। সে নড়তে পর্যন্ত সাহস পায় না। মুহূর্তগুলোকে মনে হয় অনন্ত। পলবির চোখের পাতা পড়ে না। তার যাযাবরী রক্তের আগুন ক্ষণে ক্ষণে ঝলসে ওঠে চোখের তারায়।
খানিকক্ষণ পরে হেঁসো ঘুরিয়ে দূরজার দিকে ইঙ্গিত করে পলবি। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, বারাই যান, মণ্ডল। মায়ামানুষ জানোয়ার লয়। আর কুনোদিন বাজিকরপাড়ায় সেঁধাবেন না।
এসব ঘটনা কোনোকালেই দীর্ঘস্থায়ী সুফল আনে না। বরং বিপদ আরো বাড়িয়ে তোলে। দিনসাতেক পরে ইয়াসিনকে ডেকে পাঠায় আজুরা। প্রায় একঘন্টা অপেক্ষা করিয়ে তারপর ঘর থেকে বের হয় সে। ইয়াসিন দেখে আজুরার ভয়ঙ্কর আকৃতির মুখ।
আজুরা বলে, রোডের পাশের জমিগুলান হামি বেইচে দিমো হয়, তুমাদের বসত ইবার তুলবা লাগে।
ইয়াসিন এতটা আশা করেনি। সে ভেবেছিল, আজুরা কিছুটা হম্বিতম্বি করবে, ইয়াসিন ক্ষমা চেয়ে নেবে। কিন্তু সেসবের কোনো সুযোেগই থাকে না।
এত্তোগুলা জীবন নিয়া কুন্ঠি যামা, মালিক?
সিটা হামার দেখার কথা নয়। দশ দিনের সময় দিলাম। জমির খরিদ্দার ঠিক হইছে, বায়নানামা হইছে, কেন্তু তুমরা উচ্ছেদ না হলে জমি বেচা যাবে না। কাজিই তুমারদের উচ্ছেদ হবার লাগে।
আবার সেই দিন ক্ষণ তারিখের নির্দেশ, বাজিকরের জীবনে যা বড়ই অমোঘ। কাজেই আজুরার পা ধরতে যায় সে।
মালিক, এভোগুলা যেবন, বালবাচ্চা বুঢ়াবুঢ়ি। ক্ষমা দেন, মালিক। কুন্ঠি যামো মালিক?
পা ধরতে দেয় না আজুরা। সারে সরে যায়। বলে, এসব কথা হামা বলে লাভ নাই। টাকার দরকার, জমি হামার বেচবার হবে।
ইয়াসিনের চোখ থেকে জল গড়ায়।
হাজার বছরের অবহেলিত যাযাবর। সেই প্রাচীন পাপের কথা স্মরণ করে হামাগুড়ি দিয়ে আজুরার পা ধরার চেষ্টা করে। ক্ষমা কইরে দেন মালিক। হারামজাদীরে আমি চুলের গোছা ধইরে আপনার পায়ে আনে ফেলাব। কেবল একটিবার কহেন যি মসকরা করেছেন হামার সাথ।
আজুরা তার খর্বাকৃতি পায়ের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ইয়াসিনকে। বলে, অ্যাতক্ষণ বেবাক মজা আর মসকরা মোনং হইল তুমার? ভাল। কেন্তু সময় ওই দশ দিন। তার মধ্যে যা করার প্রবা।
আজুরা ভিতরে ঢুকে যায়। ইয়াসিন অনেকক্ষণ বসে থাকে সেখানে। চিৎকার করে বলবার ইচ্ছা হয়, জামির বাজিকর, থিতু হবা না, গেরস্থ হবা না। কি দায় চাপায়া গেলা মোর ঘাড়েৎ? মোরাদের পাপের কি শ্যাষ নাই!
৫২.
ওমর খুন হবার পর ওমরের মা পাগল হয়ে যায়। তিন দিন সে ঘরে চুপচাপ বসে ছিল। চতুর্থ দিন বিচিত্র বেশে সে রাস্তায় বের হয়। ঘাগড়ার মতো কুঁচি দিয়ে শাড়ি জড়ানো তার কোমরে। একটা কাপড়ের বোঁচকা তার পিঠে ঝোলানো। হাতে একখানা ঝাটা। দু-পা এগিয়ে আবার সে পিছন ফিরে আঁটা দিয়ে পায়ের দাগ মোছে। ঘন ঘন মাথার উপরে তাকায়, চোখের উপর হাত রেখে। মাঝে মধ্যে হাত ঘুরিয়ে গোল হয়ে নাচে, গান গায় অবোধ্য ভাষায়।
ওমরের মাকে এ অবস্থায় দেখে শারিবা থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। বুড়ি তার কাছে দ্রুত আসে। ফিসফিস করে বলে, শারিবা আটা কথা বলি তোক শোন। ‘তরক’ যখন মাথার উপরে থাকে তখন মানষের হেঁয়া মাটি পড়ে না, তখনই রাস্তাৎ বেবি। তার আগে না। আর সাঁঝ হলে, তখন তো বেবাক আন্ধার হোই যায়, তখন বেরাবি, বুঝলু?
ক্যান্ চাচি, ক্যান্?
আঃ, আহাম্মকটা! না-লে জেতের মানষের গাঁয়েৎ হেঁয়া পইড়বে না হামাদের? সিটা বড় অমঙ্গল রে, বেটা।
শারিবার নানির কথা মনে পড়ে। নানি বলত, হামরা তো অজুতের জাত রে, শারিবা। গোরখপুরে হামরা অদ্ভুৎ ছিলাম। তার আগেৎ যেথায় ছিলাম, সেথা তো হামারদের ছেয়া মাড়ানো পাপ! সেথায় অছুৎ জাতকে রাস্তাৎ যাতে হলে ক্যানেস্তারা বাজায়ে যাতে হয়। লয়তো, জেতের মানষের গায়েৎ হাওয়া লাগে, হেঁয়া লাগে। সি বড় পাপ!
পাপ! কার পাপ, নানি?
অছুৎদের পাপ।
ক্যান্?
পাপ লয়? তারা জি অছুৎ!
অদ্ভুৎ ক্যান?
সি-ই যি পাপ! পিত্তিপুরুষের পাপ। তাতেই তারা অচ্ছুৎ।
পিত্তিপুরুষের কী পাপ নানি?
জানি না, শারিবা। তুই এখন ঘুম যা।
শারিবা তাকিয়ে দেখে ওমরের মা গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে, গান গাইছে, হাতে তালি দিয়ে তাল দিচ্ছে—
দেও আওয়ে তো দেওরে ভাই
বান্ধনা তো সারিমাদে
দেও আওয়ে তো দেওরে ভাই
মাকারানা সারিমাদে
দেও আওয়ে তো দেওরে ভাই
সাপনারা সারিমাদে।
শারিবার আবার নানির কথা মনে পড়ে। দুই হাতের আঁজলায় যৌতুক দেওয়ার ভঙ্গি করত নানি। এই তোর ‘ইওয়া’ হইছে রে, শারিবা। ইবার তোর ‘নওরিঁ’ হালদি মাখামু–।
শারিবা আর সহ্য করতে পারে না। দ্রুত সেখান থেকে সরে যায়। ইয়াসিনকে নিয়ে হাজির কাছে যেতে হবে। পরামর্শ করে এর থেকে বেশি কিছু আর মাথায় আসেনি কারো। তবু ঐ একটা মানুষ তাদের কিছু অন্য কথা বলেছিল।
আজুরা মণ্ডলের দশ দিনের তিন দিন পার হয়ে গেছে। সমস্ত লোক তাকিয়ে আছে ইয়াসিনের দিকে, শারিবার দিকে রূপা-শরমী সাপের ঝাঁপি নিয়ে বেরিয়েছে মাসখানেক হল। শীত নামার আগেই তাদের ফিরে আসার কথা। হয়ত, দু-এক দিনের মধ্যেই তারা ফিরে আসবে।
হাজি বলে, বসো ইয়াসিন মণ্ডল। বসেক শারিবা। ইসব কথা তো হামি জানতামই। আজুরা মণ্ডলরে তো আইজ লতুন চিনি না। কথা আরো একবার চিন্তা করেন তুমরা। মোছলমানের সাথই তুমাদের মিল বেশি। নাম হয় ইয়াসিন, জামির, ওমর। খাদ্যাখাদ্যে হিদুর সাথ মেলে না। গরুর গোস্ত খাও। হ, হারামও খাও বটে, তবি সিটা শুদ্ধ করি লওয়া যাবে। আবার দেখ, মরার পরে আমার যা তুমারও তা। সিই সাড়ে তিনহাত মাটি। নাই বা থাক কাফনের কাপড়, নাইবা রইল মোল্লা নাইবা করলা কব্বরের নিচে বাঁশের মাচান, তবু গোর তো বটে, আগুনের সাথতো সম্পর্ক নাই। ইবার বুঝ করে অ্যাটা কোট ধইরে লেও। বাঁচাবার বুদ্ধি অ্যাটা বার হোবেই।
ইয়াসিন বলে, সিগ্লা তো পরের চিন্তা, হাজিসাহেব। ইদিকে যে দশ দিনের কড়ার পার হয়। মাগ, ছোল পোল, বুঢ়া বুড়ি নি যামো কুন্ঠি?
তাদের কথার মাঝখানে আরেক ব্যক্তি এসে বসেছিল। সে ব্যক্তি সোনা মিয়া নামে এ অঞ্চলে পরিচিত। বাজিকরদের সাথে তার যোগাযোগের কোনো কারণ নেই। কেননা, সোনামিয়া এ অঞ্চলের তশিলদার। যারা পরের জমিতে বাস করে তশিলদারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থাকে না। এতক্ষণ শুনে সে উৎসাহিত হয়। হাজিসাহেবের পাকা মাথার তারিফ করে মনে মনে। প্রকাশ্যে বলে, কেন্তু বেপারটা কি? তুমাদের উচ্ছেদ করে কেয়?
আজুরা মণ্ডল।
কেংকা।
তার জমিতে যি বসত করি, সাহেব?
তার জমি? বলিছে বুঝি?
তার লয়?
তারও বটে, আবার তার লয়ও বটে।
হেয়লি রাখেক, সোনামিয়া। এটু পস্কের করে কন। এবার হাজিসাহেবও উত্তেজিত হয়।
আরি, তবি আর কই কি। উ জমি বেবাক ভেস্ট। বেবাক সরকারি জমি হোই গিছে।
তোব তোবা। এমন খবরটা অ্যাৎক্ষণ চাপি রাখে দম ফাটাচ্ছেন। তবিই দেখো শারিবা, আল্লা কত মেহেরবান!
ইয়াসিন বিষয়টা পরিষ্কার বুঝতে পারে না। সে আবেগে কাঁপতে থাকে।
পস্কের করি কহেন, মিয়া সাহেব। ঠিক বুঝ পারি না। সরকার ভেস্ট মানে কি?
সরকার ভেস্ট মানে সরকার ভেস্ট। উ জমিতে আজুরা মণ্ডলের আর মালিকানা নাই। উ জমি এখন সরকারের।
তবি তো সরকারে হামারদের উচ্ছেদ করবে!
পাগল! হামি আছি না?
তারপর বুদ্ধি পরামর্শ হয় হাজিসাহেব ও সোনামিয়ার মধ্যে। যত শিগগির পারা যায় দাগ খতিয়ান দেখে প্রতি বাজিকর পরিবারের নামে একটা করে খাজনার রসিদ কেটে দেবে সোনা মিয়া। হাজি বলে, দেখো মিয়া, নেংটা গরিব সব। গলা কাটবা পারবা না তুমরা। ঘর প্রতি দশ টাকা দিবে। তাও কম হবে না, একশত বাইশ ঘর আছে। ওই দিয়া সাহেব আর আপিস তুষ্ট করবা। ফির, ই কথাটাও মোনৎ রাখেক, ইয়ারা বেবাক আল্লার বান্দা হবার যাছেন।
সোনামিয়া বলে, ঠিক আছে, কথা দিলাম। সাত দিনের মধ্যে বেবাক কাম শেষ করমো। আর ইয়াসিন মণ্ডল, তুমরা আরেক কাম করেন। কালই থানায় যান, অ্যাটা ডাইরি করেন যি, ভেস্ট জমি থিকা আজুরা মণ্ডল তুমাদের বলপূর্বক তছেদ করবা চাছে, ভয় দেখাছে, তারসাছে, ইসব।
থানাৎ যামো!
ইয়াসিনের মনে পড়ে অনেক কাল আগের রাজশাহির থানা, জামিরের বিচার ও জেল, সেই ভীতি।
ক্যান্, ভয় কিসের?
ভয় লয়।
আরি, সদরোৎ তো আসেন, হামি আছি না?
শারিবা ধীরে ধীরে বিষয়গুলো বুঝবার চেষ্টা করে। জমি-জমার বৃত্তান্ত খুবই জটিল, এই ব্যক্তি সেই জটিল জগতের একজন। ইয়াসিন কিছুই বোঝে না, তাই সব কিছু জেনে বুঝে নিতে চায় একবারেই।
সে বলে, কিন্তু খাজনার আসিদে হামরার কী হবে, সাহেব? আরি, খাজনার অসিদ হইল চেক। চেক-ফড় ইসব বুঝা আছে?
না, সাহেব।
চেক কাটলা এর মানে হইল, তুমার নামে সরকারি জমা হইল, তাথে তুমার দাবি হইল।
জমি সরকারের, তবি হামার দাবি কেংকা হয়?
আরি আহাম্মক, সরকার ওই জমির পত্তনি দিবে তো, এখুন তুমার নামে চেকফড় থাকলে, আর তুমার দখল বলবৎ থাকলে পাট্টার দাবি তুমার আগে। তখুন তোমা উচ্ছেদ করে কোন্
অনেক নতুন শব্দ শোনে তারা, বোঝে বা বোঝার চেষ্টা করে অনেক নতুন বিষয়ের। দখল, উচ্ছেদ, বলবৎ, চেক-ফড়, পাট্টা, এইসব শব্দ এই দুই বাজিকরই প্রথম শোনে। এখন পর্যন্ত অন্য কোনো বাজিকরের সৌভাগ্য হয়নি এসব শোনার বা এইসব জটিল বিষয় নিয়ে চিন্তা করার।
হাজি সাহেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসেই তারা রাস্তা তৈরি করার রোলারের শব্দ শোনে, একটানা ঘরঘর শব্দ। ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা এখন পি. ডবলিউ. ডি-র রাস্তা হয়ে গেছে। যে রাস্তার পাশে বাজিকরদের বসতি, সেই রাস্তা পাকা হচ্ছে। সদর শহর থেকে রাস্তা বেরিয়ে সোজা এগিয়ে আসছে। এখন বাজিকরপাড়ার কোনো উঁচু জায়গায় দাঁড়ালে মাইলখানেক দূরেই কালো ফিতের মতো পিচের রাস্তা দেখা যায়। এই রাস্তায় নাকি মোটর-বাসও চলবে।
৫৩.
ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা পি. ডবলিউ. ডি-র হাতে এসে পাকা হয়। সদর শহর থেকে বেরিয়ে এসে বাদা-কিসমতের মাঝখান দিয়ে, মোহরের পাশ দিয়ে, ব্লক অফিসের দিকে রাস্তা এগোয়। সেখানে থানাও আছে। সেখান থেকে রাস্তা আরো পারো-চোদ্দ মাইল এগিয়ে বড় হাই রোডে গিয়ে পড়বে।
মোহর হাটখোলার মোড়ে চার-পাঁচখানা স্থায়ী দোকান গজিয়ে ওঠে। সকালে একবার এবং বিকালে একবার চায়ের দোকানের উনুনে আগুন জ্বলে। সবাই আশায় থাকে কবে বাস-যাতায়াত শুরু হবে। এখন শুধু মোহরের হাটের দিনে সদর শহর থেকে একখানা হাট-বাস সপ্তাহে দু-দিন যাতায়াত করে।
রাস্তা তৈরির কাজে প্রচুর মজুর খাটে। অধিকাংশই সাঁওতাল ও ওরাওঁ। ঠিকাদারের লোকের সঙ্গে একদিন কথা বলে আসে শারিবা। বাজিকরপাড়ার কয়েকজন রাস্তা তৈরির কাজে নিযুক্ত হয়। অবশ্য ব্যাপারটা এত সহজে হয় না। সাঁওতাল, ওরাওঁ মজুরকে সবাই চেনে। তাদের দিয়ে কতটা কাজ ও কিভাবে কাজ পাওয়া যায়, ঠিকাদার জানে। কিন্তু বাজিকর? এ জাতের নামই শোনেনি সে কোনোদিন। প্রথমে শারিবাকে রাসুন্ধি না-ই করে দেয়। পরে রোড-রোলারের ড্রাইভার হানিফের কথাতে ঠিকাদারের ম্যানেজার পরীক্ষামূলকভাবে দশজনকে কাজে নিতে রাজি হয়। তবে বাজিকর মজুররা আপাতত রেজার রেটে কাজ পাবে, এমনই শর্ত হয়।
শারিবা রাজি হয়ে যায়। নতুন শেখা পাটোয়ারি বুদ্ধিতে হানিফকে কৃতজ্ঞতা জানায়। বলে, আপনার জন্যই কামটা হোল। চলেন, এটু চা খাই।
হানিফ হাসে। বলে, চা খিলাবেন আমা? হা-হা-। চলেন, চলেন।
এর মধ্যে হাসির কী আছে শারিবা ববাঝে না। হানিফের উচ্চারণে কিছুটা শহরে বুলির মিশ্রণ আছে। তার চেহারাটা বড়সড়, পরনে খাকি রঙের প্যান্ট শার্ট।
মোহরের চায়ের দোকানে চা খেয়ে যখন তারা বের হল তখন সন্ধ্যা হয়ে গছে। হানিফ বলে, চা খায়ে জুৎ হোল না। চোয়ানি পাওয়া গেল না তোমাদের ( দেশ?
শারিবা বলে, হাটের দিন ছাড়া চোয়ানি পাওয়া কঠিন।
হানিফ একটু হতাশ হয়। বলে, সারাদিন রোদে পোড়া কাম। নেশা না হলে রক্ত সব জল হোই যাবে। তাড়ি পাওয়া যাবে না?
তাড়িও ভাল পাবেন না এ সময়। তালের তাড়ির সময়তো ইটা লয়। খেজুরের তাড়ি পিইবেন তো বলেন, বেবস্থা করি।
খেজুরের তাড়ি? খাই নাই কখনো। কেমন হয়?
তালের মতো অত ভালো স্বোয়াদ হয় না, এটু তিত্কুটি হয়।
নেশা হয় তো?
হুঁ, নিশা হয়।
চলো তবে।
তাড়ির জন্য শারিবাকে চেষ্টা করতে হয় না। আকালু আজকাল আর হাপু গায় না। সে এখন পাশীর কাজ করে। তার হালকা ক্ষিপ্র শরীরে কাজটা সে ভালোই পারে। এ দেশে নেশা প্রায় প্রত্যেকটি মানুষই করে। কাজেই তালের তাড়ি যখন নামতে থাকে তখন তার রোজগার খারাপ হয় না। এ ছাড়াওসে মাঝে মধ্যে খড়ের ব্যবসা করার চেষ্টা করে। কারো গরুর গাড়ি ভাড়া করে খড় কিনে নিয়ে সারারাত গাড়ি চালিয়ে শহরে যায়। শহরে খড়ের ভালো দাম পাওয়া যায়।
শারিবা হানিফকে নিয়ে নিজের ঘরে আসে। মানুষটা বেশ প্রাণখোলা, বেশ ভালো লাগে তার। আকালু তাড়ি আনে। মুড়ি পিঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা সংগ্রহ করে আনে। হানিফ নেশা করে। শাবিবা অতিথির সম্মান রাখতে আধা গেলাস নিয়ে চুমুক দেয়।
হানিফ বলে, ও কি খাওয়া? চ্যাংড়ার মতন ঠোঁট ছোঁয়াছ!
হামার নিশা খাওয়া অভ্যাস নাই, হানিফ সাহেব।
কেন?
নিশা খালে মাথাটা জুতে থাকে না, পরে খুব বে-আক্কেল লাগে নিজেকে।
আরে, সি জন্যই তো মানুষ নিশা খায়! আজব মানুষ!
শারিবা হাসে। বলে, আপনে খান সাহেব।
হানিফ তাকে ধমকে ওঠে। বলে, ধেত্, সাহেব সাহেব করছ কেন বল তো? বয়সে তুমার থিকা পাঁচ-সাত বছর বড়ই হব। ভাই বলে ডাক। তুমার নামটা জানা হয় নাই।
আমার নাম শারিবা।
শারিবা কি?
শারিবা বাজিকর।
কোন জাত?
শারিবা চুপ করে থাকে। সেই প্রাচীন প্রশ্ন হানিফও করে।
হিন্দু, না মোছলমান?
হামরা বাজিকর, হানিফ ভাই।
বাজিকর কোনো জাত নয়।
তবে হামারদের জাত নাই।
জাত নাই এমন মানুষ নাই। হয় হিন্দু, নয় মোছলমান, নয় খৃস্টান—
ইয়ার এটাও মোরা লই।
আধশোয়া অবস্থা থেকে হানিফ উঠে বসে। তার মাথায় তখন নেশা ধরে এসেছে। সে বলে, তাজ্জব! এমন কদাপি শুনি নাই। গরু খাও?
খাই।
হারাম-শুয়ার?
খাই।
তাজ্জব! তুমি আমার নিশা কাটাই দিলা হে!
সে আবার তাড়ি নেয়। অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ নেশা করে। শেষে আবার বলে, তাজ্জব! এমন মানুষও এ দেশে আছে যার কোনো জাত নাই।
অন্ধকারে পাতালুর বাঁওড়ের দিক থেকে উত্তরের প্রথম হাওয়া এসে গ্রামে ঢোকে। গাছের পাতা কাঁপায়। খড়ের চালুর পুরানো খড় বর্ষায় পচে, এখন শুকনো হওয়া পাতার গুঁড়ো উড়ে নিচে পড়ে। অন্ধকার ঘন হয়। ওমরের মা বিনিয়ে বিনিয়ে গান গায়, এ সে হাদি লাগিরে এতো মায়েরি-পলবি কোনো দুঃসাহসী প্রেমিককে নোংরা গালাগাল দেয়। কাছেই একটা কুকুর ডেকে উঠেই থেমে যায়। ওপাশের ঘরের কাছ থেকে প্রথমে পুরুষ ও পরে নারীকণ্ঠের ‘জয় মা মনসাশুনে শারিবা বোঝে রূপা-শরমী ফিরে এল। আকালু হাঁড়ির গায়ে নেকড়া লাগিয়ে তারি ঢালে। এতক্ষণ যে অনর্গল কথা বলছিল, সেই হানিফ এখন কোন অজ্ঞাত কারণে যেন থম্ ধরে থাকে ও মাঝে মাঝে গেলাসে চুমুক দেয়।
শেষ গেলাসের নিচে ঘন তলানিটুকু হানিফ বাইরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে গেলাসটা সামনেই উপুড় করে রাখে, অর্থাৎ আর নয়। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, জাত থাকলে বেজাতও আছে। যার জাত নাই, বেজাতও নাই। তুমরাই ভালো আছেন গো। তুমাদের জাতও নাই, বেজাতও নাই। এই মনে করেন, হামি হলমা মুসলমান জাত, হামার চোখে হিন্দু হলেন বেজাত। আমি বলব, মার শালা হিঁদুকে। ফির হিঁদুর চোখে আমি হলাম বেজাত। মার শালা বেজাত মোছলাকে। তাই, মনে করেন তুমরা, হামার মা আর ভাই খুন হয় আর বুন নোপাট হয়া যায়। আর হামি তকন রোলার গড়ায়ে রাস্তা বানাই। আর সি রাস্তায় বেবাক জাত হাঁটে যায়। তুমরাই ভালো আছেন, তুমাদের জাত নাই, তুমাদের বেজাতও নাই।
লক্ষের আলোয় হানিফের নেশায় ভারি চোখ চিকচিক করে। তার গলার স্বর জড়ানো এবং দুরবর্তী। শারিবা তার কথার কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না। কিন্তু কোথাও কোনো ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে, তা বোঝে। ব্যাপারটা এত আকস্মিক যে সে কিছু বলতে পারে না।
খেজুরপাতার মাদুরের উপরে হানিফ গড়িয়ে পড়ে পুরোপুরি। হাত-পা আলগা হয়ে যায় তার। আকালু তার পা দুটো টেনে সোজা করে দেয়। হানিফ কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে।
৫৪.
পরদিন রূপাকে সঙ্গে করে ইয়াসিন যখন থানায় যায় তখন দশজন বাজিকর পায়ে মোটা করে বস্তা বেঁধে পাথরকুচির উপর গলানো পিচ ঢালে। তার মধ্যে শারিবা একজন। বাজিকরের ইতিহাসে এই প্রথম একজন থানায় নালিশ করতে যায় অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য। ওমর যখন খুন হয়, আজুবা তখন ভায়রোর বিরুদ্ধে থানায় ডায়েরি করতে বলেছিল ইয়াসিনকে। ইয়াসিন রাজি হয়নি। আজুরার সঙ্গে ভায়রোর নিজস্ব কিছু বিরোধ আছে। তাছাড়া খুনের কোনো প্রমাণ ছিল না। শারিবা চাঁদের আলোয় সবই দেখেছে বটে, কিন্তু কাকে দেখেছে, এ প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না।
এক এক সময় ইয়াসিনের মনে হয় চতু আর আনোয়ার বাজিকরই ঠিক বলত। বলত বানজারা বাজিকরের সারা দুনিয়াটাই ছিল, সে ছিল সারা দুনিয়ার রাজা। কি যায় আসে তার ছেড়া তাঁবু, শতচ্ছিন্ন জামাকাপড়, রুগ্ন পশুর দল? তার ছিল ভরপুর জীবন, বিশাল বিস্তৃতি। চতু আর আনোয়ার তাদের পূর্বজীবন ভুলতে পারেনি। পাঁচবিবিতে থাকতে হরদম ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ত তারা। তিনবার লালামিয়ার ঘোড়া চুরি করে উধাও হয়ে গিয়েছিল তারা। ধলদিঘি কিংবা খাগড়ার মেলায় নিয়ে বেচে দিয়ে দীর্ঘদিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু দল না থাকলে যাযাবরের কিছু নেই। প্রতিবারই ফিরে আসতে হতো তাদের। প্রতিবার জামির তাদের শাসন করত, রক্তাক্ত করত মেরে।
এখন ইয়াসিন থানায় যাচ্ছে। থানা-পুলিশ থেকে বাজিকর চিরকাল দুরে থাকে। পুলিশ তার শত্রু। পুলিশকে সে ঘাটায় না। ইয়াসিন প্রথম বাজিকর যে নিজের প্রয়োজনে পুলিশের কাছে যাচ্ছে।
সোনামিয়া ঠিকমতো শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়। সঙ্গে একজন মুহুরি দেয় ডায়েরির বয়ান ঠিকঠাক যাতে এরা বলতে পারে সেজন্য।
থানা অফিসার বলে, বাদিয়া মুসলমান, বাজিকর আর পাখমারা নলুয়া এই তিনজাত বহুত হারামি। তবে থানায় এসেছ, এটা ভালো লক্ষণ।
মুহুরি বলে, না স্যার এরা গেরস্থ লোক। চাষবাস আর পাইট খাটে খায়। ঝামেলা তো কদাপি করে না। কেন্তু এদানি বড় ঝামেলায় পড়ি গেছে, আপনি যদি না দেখেন—
কেন? আমি দেখব কেন? আমি কোন্ শালা?
ইয়াসিন আর রূপা হাতজোড় করে থাকে শেখানো কথা কিছুই মুখে আসে। মুহুরি বোঝে, বড়বাবু কিছু স্তুতি শুনতে চায়।
সে বলে, হুজুর, আপনি হলেন দণ্ডমুণ্ডের কত্তা। রাখলেও আপনি, মরলেও আপনি। বাদা-কিসমতের হাজিসাহেব আপনার কথা কয়ে আমাক পাঠালো আপনার কাছে। হাজিসাহেবের বাপের সিই হাতির বেপারটা এখুনো তিনি মোনেৎ রাখেন। ফির হজে যাওয়ার আগে পাঁচফোটের বেপারে আপনার কেরামতিও স্মরণে আছে তার! ওঃ ভালো কথা, একেদিন দাওয়াতের অনুমতি চায়ে পাঠাছেন। যদি অনুমতি করেন, হাজিসাহেব নিজে এসবে আপনাকে দাওয়াত জানাতে।
মুহুরি পাকা লোক। বড়বাবুও কঁচা নয়। কিন্তু তোষামোদের মজা এই পাথরও গলে, আর এ তো বড়বাবু!
হাজিসাহেবের বাপের আমলে হাতি ছিল। সে আমলে অবস্থাপন্নদের হাতি রাখাটা একটা বিশেষ বড়লোকি ও সম্মানের ব্যাপার ছিল। হাতিটা ছিল বুড়ো। মরার আগে হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে দু-দু-জন মানুষকে খুন করে। হাজিসাহেব বড় বিপদে পড়েছিল। এই বড়বাবু তখন এখানকার মেজবাবু ছিল। হাজিসাহেবের হেপাটা তখন সেই সামলায়।
স্তুতিতে বড়বাবু কানে আরাম পায়। বলে, হাজিসাহেবকে আমার সেলাম জানাবে। যাব একদিন আমি নিজেই। তা এদের জন্য আমি কী করতে পারি?
মুহুরির আর বিশেষ বেগ পেতে হয় না। বিষয়টা পরিষ্কার করে বোঝায়। দারোগা বলে, ঠিক আছে, আমার জানা রইল। জেনারেল ডাইরি একটা দিয়ে যাও। কিছু ঝামেলা হলে আগেভাগে খবর দিও।
কাজ শেষ হলে ইয়াসিন আর রূপা নিচু হয়ে সেলাম করে। মুহুরি বলে, বাইরে গিয়ে দাঁড়াও, আমি আসি।
ইয়াসিন খুব কৃতজ্ঞ বোধ করে। হাজিসাহেব আর সোনামিয়ার মতো মুরুব্বি হলে এ যাত্রা বাঁচা যেত না। ইতিমধ্যে ধর্মান্তর গ্রহণের ব্যাপারটা সে পাকা করেছিল হাজিসাহেবের সঙ্গে। রূপা এখনো সেকথা জানে না। ব্যাপারটা গোপনেই আছে। হাজিসাহেব তাকে জানিয়েছে, অঞ্চলের তাবৎ অবস্থাপন্ন মুসলমান এ উৎসবে বাজিকরদের সঙ্গে থাকবে। মোলই কার্তিক মহরমের দিন বাদা-কিসমতের মসজিদে বাজিকররা সদলে মুসলমান হবে। বাজিকররা জাত পাবে, পাত পাবে, পোশাক পাবে, আর যাতে থিতু হতে পারে তার জন্য মুসলমান জোতদাররা তাদের নিজ নিজ জমি থেকে বাজিকরদের আধি দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।
ইয়াসিন মজলিশ না ডেকে প্রতি ঘরে গিয়ে গোপনে শলাপরামর্শ করছে। সামনে দিশেহারা অন্ধকার। কোথায় যাবে মানুষ? রাজশাহি, আমুনাড়া, পাঁচবিবির তাড়া খাওয়া বাজিকর এবার যে-কোনো মূল্যে স্থিতি চায়। আপত্তি বিশেষ কেউ করেনি। দু-চার ঘর যারা নিজ পরিচয় গোপন রেখে বাইরে থেকে হিন্দু মেয়ে ধরে এনেছে, তারাই কেবল আপত্তি করছে। কিন্তু ইয়াসিনের বড় ভয় রূপাকে। রগচটা রূপা কিভাবে এই সিদ্ধান্ত নেবে ভাবতে সে ভিতরে ভিতরে দুর্বল হয়ে যায়। তবুও ঘরে ফেরার পথে রূপাকে বোঝাতে হবে ব্যাপারটা, এরকমই তার
পরিকল্পনা।
সোনামেলা ছাড়িয়ে এসে ইয়াসিন বলে, উপা বাজিকর, এটা কঠিন গপপো WICI
তার বাচনভঙ্গিতে রূপা থমকে থেমে যায়। ইয়াসিন নরম মনের মানুষ, সে এত গম্ভীর কথা বলে কেন?
উপা বাজিকর, তুমু জামির বাজিকরের ছেলা। বাজিকরের বিপদটা তুমার বুঝা লাগে।
বুঝলাম। সি-ই তাল। মোছলমান হোবার তাল।
হাঁ, মোছলমান হোবার তাল! বাজিকরের বেটা তুমু, সব থিকা বড় কথা, জামির বাজিকরের বেটা। জামির বাজিকর গোরৎ যাওয়ার আগে হামা মণ্ডল করি দিয়া যায়। আর লিয়মমতো বাজিকরের তাবৎ বোত্তান্ত হামাকেই বলে। সে কথা তুমার আইজ শুনা লাগে।
বল, শুনি।
গোরখপুরের কথা কেছু জানেন তুমু। কেন্তু তার আলা কথা জানেন না।
না, জানি না।
সি আলা দেশে হামরা আছিলাম এদেশের ডোম আর চাঁড়ালদের সমান অছুৎ জাত। জাতের মানুষ হামারদের হেঁয়া মাড়াত না। দিনেমানে আস্তাৎ যাওয়া নিষেধ ছিল। গেলে কেনেস্তারা বাজাবার হোত। পাছায় বাঁধতে হোত বারুন। হামারার কাজ ছিল। ভিখ মাঙ্গা, ঘোড়া, গরু আর ভঁইসের পায়েৎ নাল লাগানো, জানোয়ার খাসি-বলদ করানো, শ্মশানে, কব্বরখানায় অদ্ভুৎ কাম। খালি আজায় আজায় যুদ্ধ হলে হামরাদের কেছু কাম বাড়ত, কেছু কাম পাতাম আমরা। লড়াইতে হাজার কাম থাকে। শতেক ময়লা কাম, অছুৎ কাম। সিগলা হামরা করতাম। আর হামরা গান গাইতাম, লাচতাম, হামরাদের বিটিগুলা ভালো নাচনি আছিল। আর সি সব দিনে খালি লড়াই আর লড়াই। সি লড়াইয়ে আমরা মরতাম দলে দলে। লড়াই শেষে শিকলবন্দি গোলাম হয়া চালান যাতাম দূর দূর দেশেৎ। ই ভাবে আমরা জাতের হুজ্জতি আর লড়াইয়ের দাপটে ছাড়েখাড় হোই গিলাম। মান নাই, ইজ্জৎ নাই, জমি নাই, ঘর নাই। নাচ আছে, জানা আছ হরেক হাতের কাম। ই সব কথা হামাক, বালি বুঢ়াও কহিছিল।
ইয়াসিন চুপ করে। দুই বাজিকরের চোখে বংশপরম্পরায় শোনা ধূসর রক্ত, ঘাম আর অবিচারের ছবি এখন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। কেননা এসব এখনো সত্য।
রূপা বলে, আমার পিত্তিপুরুষ জানত, বাজিকর হাল ধইল্পে মাটি ফালা হয়। বালি বেরোবে, জল দাঁড়ায় জল দাঁড়াবে না, বীজ ফেলে বিছন গজাবে না। হামার বাপ ইসব কথা বিশ্বাস যাতেন না। তাই তিনি হামরাদের থিতু করবা চালেন। ইয়াসিন বলে, থিতু হোবার বাস্লা হামার সাত পুরুষের মগজেৎ আছিল, কেন্তু সুবিধা হচ্ছিল না, তাই। এখুন দেখ, জামির বাজিকর মরি গেলেন, আর হামার মাথাৎ কি দায় চাপায়া গেলেন। সি দেশ নাই, সি দুনিয়া নাই, সি ভাষা নাই, সি নাচ গান ভুলি গিছি হামরা, নাটুয়া বাজিকর, ভাতির বাজিকর, ভাল্লুকুকুর-বান্দর লাচানো বাজিকর কোথায় হারাই গিছে, কেন্তু দুন্নাম পুরাই আছে। ঠগ জোচ্চোর বাজিকর, কামচোর বাজিকর, অজাত বাজিকর, জড়িবুটি হাতসাফাইএর বাজিকর, গুণতুক মানুষ ভুলানো বাজিকর, ই বেবাক বদনাম হামরার থাকি গিছে।
রূপা বলে, সর্দার, মালদা টাউনোৎ কাপড়পট্টিতে গুজরাটি দোকানদারের বুলি আর হামরার বুলিতে মিল আছে। ও
আছে। বালি বুঢ়ার কাছে শুনেছি, হামরা উসব দিকেরই মানুষ। এখুন আসল কথা শোন। হাজিসাহেব হামরার মুরুব্বি হইছেন। বাজিকরের ধরম নাই, জাত নাই। কালীমাই, বিগামাই, ধরভিমাইয়ের কথা মানষে ভুলে গেছে। এখুন হামার পরামর্শ হয়লো এটা কোট ধইরে লওয়া। হাজিসাহেব শক্ত মানুষ। মোছলমান সমাজে উঁচা-নিচার বাচ-বিচার নাই, ছোঁওয়া-ছানির বিচার নাই। একে আরেকের সাথ একসাথ ওঠবস করে, খানাপিনা করে, বিহা সাদি করে, সব থিকা বড় কথা হামরার জমি হবে। হাজিসাহেব ইসব বাত করিছেন হামার সাথ। হামার বিশ্বাস, তুমার বাপ বাঁচে থাকলে ইতে সায় দিতেন। তুমু না করেন না, উপা বাজিকর।
রূপা দীর্ঘ সময় চুপ করে থাকে। অনেক আগেই সে এসব চিন্তা করে রেখেছে। হিন্দু ঘরের মেয়েকে সে ঘরে এনেছে। শরমীর ভিতরে হিন্দু সংস্কার প্রবল। সেই সংস্কার রূপার ভিতরে শিকড় গেড়ে বসেছে। শরমীর হাতে শাঁখা তার চোখে নতুন অভিজ্ঞতার পবিত্রতা আনে। তার ঘরে আছে মা মনসার ঘট। তারা আবেগে বিষহরির পালা গায়। এখন আর তার পক্ষে মুসলমান হওয়া সম্ভব নয়। এবং শারিবাকেও সে পৃথক হতে দিতে পারে না। ধর্মের বিরোধ সে জানে। রূপা বলে, সদার রূপায় যখুন আর কেহ নাই, বাঁধা হামি দিমো না। তবি হামা জোরাজোরি করেন না। হামার ঘরণী হিদু। হামার ঘর বাদ দেন, শারিবা বাদ দেন।
ইয়াসিন আশ্বস্ত হয়। তবুও গভীর বিষাদ দু-জনকেই আচ্ছন্ন করে। সারা জীবনের জন্য পৃথক হওয়ার প্রস্তুতি নেয় তারা।
রূপা বলে, আরেক কথা মোনেৎ রাখেন। বাদিয়া মোছলমান, দাই, পাখমারা ইরা সব হামরার বাজিকরের মতন জাত। এখুন মোছলমান। কেন্তু মোছলমান সমাজ তারাদের নেয় না। একসাথ ওঠবস পর্যন্ত করে না, বিহাসাদি দূরের কথা।
ইয়াসিন বলে, ঠিক কথা। ওলা খোঁজখবর করিছি হামি। ইয়ারা শুন্যা মোছলমান। কোরানশরীফ ছুঁয়া, কাৰ্মা পড়া মোছলমান হয় নাই। মোছলমান সামাজের সাথ সাথ থাকতে থাকতে মোছলমান হয়াছে। জাতপাতের বিচার নাই, কিরাকাম করে না, নামাজ-রোজা, জুম্মা-জিয়াপৎ কেছুই মানে না। হামরা সিভাবে মোছলমান হচ্ছি না। ষোলই কার্তিক মহরমের দিনে আমরা কলমা পড়ব, মোছলমান হব। তা-বাদে একসাথ নামাজ পড়া হবে, একসাথ খানাপিনা হবে। হাজীসাহেব হামরাদের সাথ পাত পাড়বে, আর আর মোছলমান ইমানদার মানুষ হামরাদের সাথ পাত পাড়বে। হামরা উঁচা হব, হামরাদের জাত হবে।
রূপা বিড়বিড় করে বলে, হামরাদের জাত হবে! কি হবে তা মাও বিষহরিই জানে। হামি হিন্দু হলাম, তুমু মোছলমান হলেন। হিন্দু হামা জাতে লেয় না, মোছলমান তুমায় জাতে লিবে, সি বিশ্বাস হামরি নাই। বহুৎ দেশ দেখা আছে মোর। তবু রূপায় যখুন নাই, যান তুমরা, হর্ন মোছলমান। এখন তো বাঁচেন, দলকে বাঁচান। তা-বাদে মাও বিষহরিব মানৎ যা আছে, তাই হবে। কেবা জানে, হয়ত একদিন তুমার বেটা হাম মাথাৎ ডাং মারবে ‘শালে হিন্দু বলে, আর হামার বেটা তুমার বুকে ফাল্লা বিধবে ‘শালা মোছলমান’ বলে। জয়, মাও বিষহরি। সন্তানরে দেখেন, মাও।
রূপা কপালে হাত ঠেকায়। দেখাদেখি ইয়াসিনও। দুই প্রৌঢ় যেন শেষবারের মতো একত্রে হাঁটে। যেন পৃথিবীর শেষ প্রান্ত দিয়ে দুই যাযাবর গোধূলিতে নিজেদের তাঁবুতে ফিরছে। আর কোনোদিন সেই তাঁবু থেকে সূর্যোদয় দেখতে বেরোবে না। দুজনের কেউ আর কথা বলে না। মাঠের ওপারে সূর্য ঢলে পড়ে। গভীর রক্তাক্ত যাযাবরী ‘তরক। দুইজনে সেইদিকে তাকায়। দু-জনে দু-জনের মুখের দিকে তাকায় তারপর। সত্যিই কি ঘরে ফিরতে পারবে বাজিকর? পথ তাকে অভিশাপ দেবে না? প্রান্তর তাকে ঝোড়ো হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে anTT?
দু-জনে একটা গাছের নিচে বিশ্রামের জন্য বসে সুর্যাস্ত দেখে। সূর্য ডুবে গেলে তারা যেন জামির বাজিকরের কণ্ঠস্বর শোনে, ‘বাপাসকল, জানবার হয়ো না। চেষ্টা লাখ, যাতে বিটিয়া দূরে যায় আর বেটারা দূর থিকা আনে। শোগর, মরি আর ওয়া—জন্ম, মৃত্যু আর বিহা—এই তিনকে হিসাবের মধ্যে রাখ, নিয়মের মধ্যে রাখ।
৫৫.
আয়নার খাঁড়িতে স্নান করতে গিয়ে হানিফ জলপরি দেখে। সে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে পড়ে। চারদিকে জঙ্গল, কয়েকটা তালগাছ এবং দুটো খুব উঁচু মাদার গাছ। জঙ্গল বলতে ভাট আর আসশ্যাওড়ার ঝোপ! তার মধ্যে দিয়ে আয়নার খাঁড়ি বয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে স্নান করার মতো গভীরতা আছে। হয় মানুষ নিজের প্রয়োজনে করে নিয়েছে, নয়তো বাঁকের জন্য হয়েছে। এই সময় জল থাকে ভালোই, মানুষের প্রয়োজনে লাগে। ভারি নির্জন জায়গা।
জলে ডুব দিতে গিয়ে পলবি খেলা পেয়ে যায়। কাপড়ের মধ্যে ঢুকে থাকা হাওয়া বেলুনের মতো ফুলে ওঠে জলের চাপে। পলবি থাবড়ে থাবড়ে সেই হাওয়ার বেলুন ফাটায়। তার যা বয়স, তাতে এ ধরনের ছেলেমানুষি মানায় না। কিন্তু এই নির্জন খাঁড়ির ঘাটে কেইবা দেখে। সব বয়সের মানুষেরই পুতুলখেলা থাকে। সব বয়সের মানুষেরই থাকে নির্ভার মধুর অথবা বেদনার শিশুসুলভ একাকিত্ব। সেখানে সে নিজের সঙ্গে কথা বলে, নিজের সঙ্গে খেলে।
হানিফ একটু আড়ালে সরে আসে, আবার চুরি করে দেখে। লোভ সামলাতে পারে না। পলবি ডুব দেয়, গা মাজে, উদ্দেশ্যহীনভাবে একদিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবে। তার পুষ্ট ঠোঁটে একটু বাঁকা শিহরণ বয়ে যায়, অথচ তার চোখ থাকে বিষণ্ণ। হানিফের কাছে মনে হয়, মেয়েটি হাসতে গিয়ে হাসতে পারল না। সেইসময় সে মেয়েটির নিচের ঠোঁটের নিচে চিবুকের উপর দিকে একটি উল্কি দেখে। মেয়েটি কোনো একটা বিশেষ চিন্তায় অবশ্যই বিভোর। হানিফ আবার চোখ ফেরায় ও পরক্ষণেই ফিরে তাকায়। শরীরের ভার একটু ছেড়ে দেওয়া গোছের হলেও ভীষণ আকর্ষণ করে হানিফকে। কেন যেন হঠাৎ মনে হয়, এরকমই একজনকে খুঁজছিলাম।
পলবি শেষবারের মতো ডুব দিয়ে উঠে আসে। হানিফ এবার পিছন ফিরে দাঁড়ায়। পলবি যতটা সম্ভব কাপড়ের জল হাত দিয়ে চিপে এগিয়ে আসে।
হানিফ বলে, মাফ করবেন, আপনার গোসলের সময় না বুঝে এসে পড়েছিলাম। গলায় কিছুটা শহুরে সৌজন্য আনার চেষ্টা করে সে।
পলবি থেমে যায়। পুরুষমানুষ তার কাছে নতুন ব্যাপার নয়। কিন্তু জীবনে সে এই প্রথম শুনল ‘আপনি’ সম্বোধন এবং ‘মাফ করবেন। সে ভীষণ লজ্জা পায়। যতটা সম্ভব ভিজা কাপড় টেনে গা ঢাকে সে। বলে, তাৎ কি হয়াছে, ইটা তো সোব্বারই গোসল করার জায়গা। আপনি তো হামরাদের শারিবার বন্ধু হানিফ সাহেব?
হানিফ খুব অবাক হয়ে যায়। বলে, চিনেন আমাকে?
খুব চিনি। আপনি তো রোড ডেরাইভার। দেখিছি কদিন শারিবার ঘরোৎ যাবা-আসবা।
হানিফ কেমন আবেগরুদ্ধ হয়ে যায়। শহুরে সপ্রতিভতা নষ্ট হয়ে যায় তার। শুধু অনেক চেষ্টায় বলতে পারে, খুব মেহেরবানি আপনার।
দু-জনেই দু-জনার দিকে খুব নির্জলা দৃষ্টিতে তাকায়। শেষে পলবি বলে, হামার নাম পলবি। ইয়াসিন বাজিকর হামার বাপ। যান, আপনার বেলা হোই যায়। নাহেন গিয়া।
পলবি চলে যায়। হানিফ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে দিকে। এই তাহলে পলবি। এর কথা সে শুনেছে কিছু কিছু।
সারাদিন রাস্তার রোলার চালানোর সময় পলবির কথা চিন্তা করে হানিফ। বাজিকরের বেটি, কেমন বা হবে কে জানে। তারপরে যা সব শুনেছে তার সম্পর্কে, সে তো একখানা পুরো কিসা। তবুও প্রথম দর্শন থেকেই তার যেন মনে হতে থাকে, একেই তো খুঁজছিলাম। প্রাণখো মানুষ সে। কোনো ব্যাপারেই দেরি সয়
সন্ধ্যাবেলা শারিবার ঘরে বসে তাড়ির গেলাস হাতে নিয়ে বলে, নিশা খাওয়ার আগেই একটা কথা বলি, নালে পরে বলবা যে নিশার খোয়রা বেচাল বলি।
শারিবা বলে, কি কথা?
তুমাদের ঐ কী য্যান বলে, ঐ পলবি নামের মেয়েটা—
হাঁ, কী করিছে সি আপনাক্?
শারিবা শঙ্কিত হয়।
মারে ফালাছে। একদম সাবাড়।
মানে?
আচ্ছা গাড়োল তো! আরি, উ মেয়াটার কথা আমি কেছু শুনবার চাছি।
শারিবা একটু দ্বন্দ্বে পড়ে। পলবির কথা এ অঞ্চলে সবাই জানে। কাজেই তাকে মানুষের প্রয়োজনের কথা মনে হয় একটা কারণেই। কিন্তু হানিফকে তো এ পর্যন্ত তার সেরকম বেচাল কেছু মনে হয়নি। সে একটু গম্ভীর হয়ে বলে, কি কবার চাছেন হানিফ ভাই, এটু পস্কার করি কহেন।
উয়ার কথা আন লোকের কাছে কেছু শুনিছি। কিন্তু এখন তুমার কাছ থিকা কেছু শুনবার চাছি।
ক্যান্?
আরি, আচ্ছা ঝামেলা তো! আরি, আমি এটা তাব্বিয়াত্ পুরুষমানুষ, এটা মেয়ার খোঁজ নিবার পারব না?
পলবিরে আপনে–!
ক্যান বিয়া করবার চাইতে পারি না?
না, তা লয়। তবি পলবি—
ক্যান, খুব খারাপ মেয়া?
না, মানে—
হানিফ এবার গেলাসে চুমুক দেয়। বলে, শোন শারিবা, আমি হানিফ মহম্মদ, অনেক ঘাটের পানি খায়া এখন সরকারি চাকরি করি। রোড রোলার চালাই। দুনিয়াটা আমার কেছু দেখা আছে। আমি এমন কিছু সাধু ফকির নই যি ব্যালপাতা আর কোরানশরিফ খায়া থাকি। তুমিই বলিছিলা যে, বাজিকরের জাতফাত নাই। আমারও এখন এটা সংসার করা দরকার। হা-ঘরে মোছলমানের ছেলা আমি। আমাদের মালদা জিলায়, মনে কর সব শালাই নাকি নবাব বাদশার ঘর। বিহাসাদির কথা ওঠলেই সব পক্ষ গৌর আর আদিনায় পুরান ইমারগুলা দেখায়। মনে কিনা, সব ঐসব বংশ। এছাড়া আর যা জোটে ভাতে আমার মন টানে না। তোমাদের পলবিরে চোখে লাগিছে। তবে সূর্য কর্থার আগে তোমার কাছ থিকা শুনতে চাই।
শারিবা একটু চিন্তায় পড়েহানিফের মতো সমর্থ পুরুষমানুষ বাজিকর মেয়ের কাছে রাজপুত্র। হানিফ কি সব শুনেছে? সব শুনেও সে কি পলবিকে গ্রহণ করতে পারবে? যদি পারে, শারিবার বুকের উপর থেকে একটা পাথর নেমে যাবে। বাজিকর পুরুষ হিসাবে পলবির এই অবস্থার জন্য সে কি নিজেকেও অপরাধী মনে করে না? সে বলে, দেখেন হানিফ ভাই, পলবি বাজিকরের সোন্দরী মেয়া।
লুট হয় পাঁচ হাতে নাড়াচাড়া পড়িছে। ইসব তো আগে জানা লাগে।
ওসব আমি জানি, শারিবা। যিটা জিজ্ঞাসা করি সিটার জবাব দেও। আগে বল মানুষটা কেমন? ঘর করবা চায়?
চায়। খুব বেশি করিই চায়। আমি মোছলমান বলে তোমাদের আপত্তি হবে না?
এটা গোপন কথা কহি, হানিফ ভাই। মহরমের দিন বাজিকরপাড়ার তিন ভাগ মানুষ মোছলমান হবে।
কী?
হাঁ। আপনার মালদা থিকা মোগ্লা এবেন। বাদা-কিসমতের মসজিদে কলমা পড়া হবে। তা-বাদে একত্তরে খানাপিনা হবে।
তোমরা মোছলমান হবা?
তিন ভাগ ঘর বাজিকর মোছলমান হবে, এক ভাগ ঘর হবে না।
তুমি কোন্ দলে?
এক ভাগের দলে।
এ বুদ্ধি কার?
বিপদের, পেয়োজনের।
হানিফ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে গুম হয়ে। শেষে আবার বলে, তুমি ক্যান হবা না?
হামার বাপ নিজেরে হিন্দু ভাবে। তুমি কী ভাব? হামি ভাবি বাজিকরের কোনো জাত নাই।
হানিফ আবার চুপ হয়ে যায়। শারিবা বলে, পলবিরে যদি সত্যিই আপনি সাদি করেন তবিতো জাতের সমস্যা আর থাকল না।
হাঁ, তা থাকে না বটে—তবে আমার বিচার শোন, হিন্দু মুসলমান বেবাক জাত যদি বাজিকরের মতন, মনে কর, বেজাত হয়া যায়, তবে সিটাই ভালো হতো।
শারিবা বলে, যাক সি কথা। তবি কথাটা গোপন রাখেন। পলবির ফয়সালা আগে করি।
কর।
হামি কই, আপনে দু-চারদিন আরো ভাবেন। নিজে ভালো করি বুঝ করেন নিজের সাথ। তা-বাদে কথাৎ আগান।
হানিফ একটু ভেবে বলে, বেশ তেমনি কর। কিন্তু শারিবা, আমি তোমাদের মোছলমান হবার কথা ভাবতেছি। এতে কি বা লাভ হবে? হিঁদুরই বা কী লাভ? মোছলমানেরই কী লাভ? আর বাজিকরেরই বা কী লাভ?
মোছলমানের লাভ হাজিসাহেব জানে। হিদুর লাভ জানি না। কেন্তু বাজিকরের লাভ আছে।
আছে?
নাই! বাজিকর যবে থিকা থিতু হাওয়ার বান্না করল, তবে থিকাই সে সমাজের মানুষের কাছে আপন হবার চায়। কেউ তা আপন করে না। আজ যদি হাজিসাহেব তা আপন করার চায় তো সি যাবে না?
তুমি ঠিক জানো, হাজিসাহেব তোমাদের আপন করবা চায়?
মোছলমান তো করবা চায়।
মোছলমান করলে তোমরা থিতু হবার পারবা?
হামার নানি বুড়ি বলত, শারিবা, পিত্তিপুরুষের পাপে বেবাক বাজিকর ঘরছাড়া। অভ্যাসে ঘর তারে আর টানে না। কারণ কী, পথেই তার সব, জনম মরণ হাসি কাঁদা। শয় শয় বছর এংকাই চলি গেল। তা-বাদে দুনিয়ার রাস্তা এক দিন শ্যাষ হয়া গেল। রাস্তাৎ আর সুখ নাই, স্বস্তি নাই। পথে বিপদ আগেও আছিল, বাদে তা হোল সীমাছাড়া। সমাজের মানূষে নানা কারণে বাজিকর বাদিয়াকে ছিড়া খায়। তাই আজ তিন-চার পুরুষ ধর হামরা থিতু হবার চাছি। কেন্তু থিতু হবার আগেই বাজিকর থিতু হবার পারে না। কারণ কী, তার কি ধরম নাই।
ধরম থাকলিই তুমরা থিতু হবার পারবা?
বাজিকরের কাছে হানিফ ভাই, আইজের দিনটা সব থিকা বড় কথা এখুন পয্যন্ত। আইজকার দিনেৎ হামি মোছলমান হয়া বাঁচব। ইয়ার বেশি কেছু জানা aiz
বাঁচার রাস্তা ইটাও লয়, শারিবা। আমার সাথ শহর চল, বাঁচার রাস্তা তোমারে দেখায়া দেব।
নি যাবেন হানিফ ভাই, হামারে শহরেৎ নি যাবেন?
যাব। কিন্তু থাকতে পারবা সেথায়? তোমরা গেরামের ছেলা।
খুব পারমো। আপনার জল তুলা দিমো, পাক করি দিমো!
তবে পলবি করবো কি?
অ্যাঁ! ওঃ হো হো, সিটা তো ভুলেন না!
হাঁ, সিটা ভুলি না, সিটাই ঠিক।