১৬-২০. যে গাছের নিচে পীতেম প্রতিদিন বসে

১৬.

যে গাছের নিচে পীতেম প্রতিদিন বসে, সে গাছটি তার তাঁবুর সামনেই। পীতেম সেখানে সারাদিন, এমনকি অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকে। বস্তুত সে সেখান থেকে উঠতেই চায় না। একসময় সালমা এসে তাকে হাত ধরে ওঠায় এবং সে আর আপত্তি করে না। কারণ সে কোনোদিনই সালমার কোনো আচরণের জন্য প্রশ্ন কিংবা বিরোধিতা করে না। তার ইচ্ছা অবশ্য সারা দিন-রাতই সে ঐখানে গাছের নিচে থাকে, কিন্তু সালমার জন্যই তা পারে না। কাজেই গভীর রাতে কখনো সুযোগ পেলে সে উঠে এসে গাছতলায় বসে থাকে।

এভাবে বসে থাকলে তাকে একজন সন্তের মতো দেখায়। অচেনা ভিনদেশি মানুষ অনেক সময় কৌতূহল প্রকাশ করে, অথবা কাছে এসে শ্রদ্ধা জানায়, প্রণাম করে। কখনো কখনো কেউ কোনো অভীপ্সা পূরণের জন্য তার কাছে প্রার্থনাও করে। পীতেম সবার মুখের দিকেই নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে এবং কারো কোনো কথারই উত্তর দেয় না। এসব সময়েও সালমাকে এসে ভিড় হঠাতে হয়।

এক চাঁদনী রাতে পীতেম তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এসে একেবারে হতবাক হয়ে যায়। এতকাল যে গাছটার নিচে সে একান্তে বসে কাটালো, সে গাছটা কই? গাছটা যেখানে থাকার কথা, সেখানে নেই। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে পীতেমের বাপ দনু। পীতেম তার কাছে যায়।

দনু বলে, পীতেম, পশ্চিমে যেও না, পুবে যাবে।

পীতেম দনুর পায়ের কাছে বসে, যেমন সে গাছের নিচে বসত, তেমনি নিশ্চিন্তে।

দনু বলে, পীতেম, ঐ দেখ, রহু তোমায় দেখে।

পীতেম দূরে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে বাতাসে অনেক ধরনের ছায়া দেখে। সঞ্চরণশীল ছায়া! পাতলা গভীর ঘন ছায়া। পীতেম দেখে আকৃতিবিশিষ্ট একটি বিষঃ ছায়া চাঁদের আলোয় চলমান।

দনু বলে, পীতেম, রহু সব বাজিকরকে দেখে।

পীতেম বলে, হ্যাঁ বাপ।

দনু বলে, পীতেম, রহু দেখে, কবে বাজিকরের পথ চলা শেষ হয়। পীতেম বলে, হ্যাঁ বাপ।

দনু বলে, পীতেম, কারণ কি, রহু তার হাড় দিয়েছিল বাজিকরকে, যেন সে এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে।

পীতেম বলে, হ্যাঁ, বাপ।

দনু বলে, পীতেম, তেমন নদী কেউ দেখেনি যে নদীতে তোমার পিতৃপুরুষ তৃষ্ণা মেটাত। তেমন দেশ কেউ দেখেনি যে দেশে তোমার পিতৃপুরুষ বাস করত। তেমন জাত আর কোথাও নেই যে জাতে তোমার জন্ম। আর সেই জাতের মানুষ যে গান গাইত, যে সম্পদ উৎপাদন করত, যে জীবন যাপন করত, তার তুল্য আর কিছু নেই।

পীতেম বলে, হ্যাঁ, বাপ।

দনু বলে, পীতেম, রহু তার স্বজাতির জন্য এমন সুন্দর জীবন করে দিয়েছিল। কিন্তু সে জীবন তো স্থায়ী হল না।

পীতেম বলে, কেন, বাপ?

দনু বলে, সে তো এক বিরাট গল্প, পীতেম।

রহু তার মানুষ নিয়ে সেই ভূখণ্ডে থাকত, যেখানে জীবন ছিল নদীর মতো, নদীতে ছিল অফুরন্ত স্রোত, বনে অসংখ্য শিকারের পশু এবং মাঠে অজস্র শস্য। মানুষ ছিল স্বাধীন, সুখী।

তারপর সেই মানুষটা এল। তার চোখ স্থির, তাতে পলক পড়ে না। সে এসে প্রথমেই মাঠ থেকে রহুর সেরা ঘোড়াটি ধরে নিল।

–এই ঘোড়া আমার।

কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি। সবাই তাকিয়ে দেখছিল তাকে। সে কিছু স্বতন্ত্র, বহুর মানুষদের সঙ্গে তার মিল নেই।

সে ঘোড়াটা ধরে নিল এবং তাতে সওয়ার হল। কিন্তু ঘোড়াটা তাকে সওয়ার করতে রাজি হল না। তাকে ছিটকে ফেলে দিল। সে ক্রুদ্ধ হল এবং আবার সওয়ার হল। ঘোড়া আবার তাকে ধুলোয় ফেলল।

ক্ষিপ্ত মানুষটা তখন কোষ থেকে খঙ্গ নিষ্কাশন করল। ঘোড়া তার সামনে ঘাড় সোজা করে বেয়াড়া ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। ক্ষিপ্ত ও ক্রুদ্ধ মানুষটা এক কোপে সেই দুর্বিনীত স্বাধীন ঘোড়ার মস্তক দ্বিখণ্ডিত করল।

সব মানুষ হতবাক হয়ে গেল। এমন পাশবিক হত্যা সেখানে কেউ কোনোদিন দেখেনি। সবাই স্তব্ধ।

তখন সে মানুষটা হা-হা করে হাসল। তাতে সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়ালো এবং তাকে শাস্তি দিতে চাইল।

অদ্ভুত! সেই মানুষটার চোখে মুখে কোনো আতঙ্ক নেই।

রহু তখন নিরস্ত করল তার মানুষদের! রহু সেই স্কন্ধহীন ঘোড়াটা দেখালো সবাইকে। সেই দুর্বিনীত ঘোড়াটা তখন সমস্ত মাঠ বৃত্তাকারে ঘুরছে। বৃত্ত ক্রমশ বড় হয়, ক্রমশ আরো বড়। ঊর্ধ্বমুখে উৎক্ষিপ্ত রক্ত সেই বৃত্ত তৈরি করে।

সব মানুষ সভয়ে সেই দৃশ্য দেখছিল। রহু তখন সেই আগন্তুককে বলে, তুমি ওকে মারলে কেন?

ও আমার অবাধ্য হয়েছিল। কিন্তু ও তো তোমার পশু নয়।

সে হা-হা করে হাসে। সে বলে, আমি যা চাই, তাই পাই! তুমি পরিশ্রম করে অর্জন কর না?

সবাই অবাক হল তার উত্তর শুনে। সে বলল, আমি অর্জন করি আমার এই খগের সাহায্যে।

তারপর সে চলে গেল। যুবকেরা তাদের ধনুকে শরসন্ধান করছিল তাকে বিদ্ধ করার জন্য। রহু তাদের নিষেধ করল। কেননা, সে এই অদ্ভুত মানুষটাকে বুঝতে চেষ্টা করছিল। সে অমঙ্গল আশঙ্কা করছিল।

যুবকেরা বলেছিল, ওকে হত্যা করাই ঠিক ছিল, প্রবীণেরা বলেছিল, ওকে হত্যা করলে ওর স্বজাতির সৈনিকেরা এসে আমাদের হত্যা করত। রহু বলেছিল, ও এবার ওর স্বজাতীয়দের নিয়ে আসবে। ওকে হত্যা করা, না-করাতে কিছুই যায় আসে না। ওকে হত্যা করলে সৃণিত মানুষকে হত্যার কদর্যতা আমাদের গায়ে লাগত।

রহু ঠিক বলেছিল। সে আবার এল। এবার অনেক লোক-লস্কর নিয়ে। এবার রহু তার পথ আটকাল।

সে বলল, চণ্ডাল, পথ ছেড়ে দাও।

–কোথায় যাবে তোমরা?

–আমরা ঐ পবিত্র নদীর কাছে যাব।

রহু বলেছিল, ওই পবিত্র নদীর কাছে যাও, পবিত্র হও।

সে আবার হা-হা করে হেসেছিল। তারপর তারা সেই নদীর পথে এগিয়ে গিয়েছিল।

তারা সেই নদীর তীরে তাদের দেবতার মন্দির নির্মাণ করেছিল, তারপর ফিরে গিয়েছিল। ফেরার পথে তারা রহুর জনপদকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেছিল, শস্য নষ্ট করেছিল, রমণীদের ধর্ষণ করেছিল এবং বাধাদানকারীদের হত্যা করেছিল। তারা ছিল মদমত্ত ও স্বেচ্ছাচারী।

তৃতীয়বার সে আসে আরো বলশায়ী হয়ে। এবার তার সঙ্গে ছিল তার পুরোহিতগণ। তারা সেই মন্দিরে তাদের দেবতা স্থাপন করল এবং তাদের বিচিত্র রীতিপদ্ধতির অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করল।

তারা তৃষ্ণার্ত রহুর স্বজাতিদের নদীর জল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করল। তখন রহু করল তার প্রতিবাদ।

একি স্বেচ্ছাচার তোমার?

চণ্ডাল, এই পবিত্র নদী তোমরা স্পর্শ করতে পারবে না। এই মন্দিরের ত্রিসীমানায় আসতে পারবে না।

তোমার মন্দিরে আমাদের প্রয়োজন নেই, কিন্তু এই নদী এতকাল আমাদের fati

এখন আর নেই। এখন এ নদী আমাদের, তোমাদের স্পর্শে অপবিত্র হবে।

এই বলশালীর বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ করার মতো শক্তি কিংবা আয়োজন কিছুই ছিল না। রহুর জনপদের যাবতীয় সম্পদ, শস্য, পশু, এমনকি স্ত্রীদেরও আগন্তুকরা বলপ্রয়োগে দখল করল। তারা ক্রমশ হীনবল হয়ে দখলকারীদের বিধিনিষেধের মধ্যে অভিশপ্ত জীবন যাপন করতে লাগল।

অবশেষে, রহু একসময় আবিষ্কার করল, বহিরাগতদের যাবতীয় ভ্ৰষ্টাচার তার নিজ গোষ্ঠীতে অনুপ্রবেশ করেছে। সে তখন গোষ্ঠীর সবাইকে নিজের কাছে ডাকল।

আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারিনি। আমি হিংসাকে নির্দিষ্ট করেছিলাম খাদ্য সংগ্রহের নিমিত্ত পশু শিকারের মধ্যে। কিন্তু এই জনপদের বাইরেও পৃথিবী আছে, সেখানকার বিধিনিয়ম পরিবর্তিত হয়েছে, সে খবর আমি রাখিনি। সেখানে হিংসা শুধু পশু শিকারের জন্য নয়। আমি তোমাদের শিখিয়েছিলাম যে, মানুষ মাত্রেই তোমাদের ভাই, কিন্তু এ শিক্ষা ভুল। এই নবাগত মানুষেরা কখনো আমাদের ভাই হতে পারে না। এরা আমাদের অন্ত্যজ করেছে, আমাদের পবিত্র নদীর স্পর্শ থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছে, আমাদের মধ্যে ভ্রষ্টাচারকে প্রবেশ করিয়েছে।

প্রবীণেরা, বলল, রহু, কেন আমাদের এমন হল?

রহু বলে, সমৃদ্ধি আমাদের বড় বেশি আত্মসন্তুষ্ট রেখেছিল। আমরা অসতর্ক হয়ে পড়েছিলাম। প্রাচীনদের অর্জিত জ্ঞানকে আমরা ধারাবাহিক করিনি। তাই আমাদের এ হেন দুর্গতি।

রহু, এই অসম্মান এবং অধঃপতন থেকে রক্ষার উপায় কি?

রহু বলে, এই অসম্মান এবং অধঃপতন থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের প্রাচীন অধিকার এবং সমৃদ্ধিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তার জন্য আমাদের ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। অনেক রক্ত দিতে হবে আকাশের দেবতাকে।

গোষ্ঠীর মধ্যে প্রবল আত্মকলহ শুরু হল। কেননা ভ্ৰষ্টাচারে নিমগ্ন জাতি রক্তদানের মতো পবিত্র কর্মে কখনো একমত হতে পারে না।

রহু বলে, যারা আমাকে অনুসরণ করবে না তারা চিরকাল এই বহিরাগতদের কাছে অন্ত্যজ এবং দাস হয়ে থাকবে। যারা আমাকে অনুসরণ করবে তারা অবশ্যই একদিন আবার পুরনো সমৃদ্ধি খুঁজে পাবে।

এই বলে সে প্রবল শিঙ্গাধ্বনি করে এগিয়ে চলল। গোষ্ঠীর এক অংশ তাকে অনুসরণ করল, অন্যেরা উপহাস করতে লাগল। কিন্তু রহু এগিয়ে চলল। নদীর কাছে এসে স্বজনদের সে বলল, আমি চিরকাল তোমাদের সহায় থাকব। এখন এস, এই নদীকে আমরা পুনরায় অধিকার করি।

কিন্তু বহিরাগতদের সৈনিকেরা তাদের পথ আটকাল। প্রথমদিনের সেই পুরুষ এসে প্রতিরোধ করল রহুকে। বলল, চণ্ডাল, এ নদী স্পর্শ করলে তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য।

রহু বলল, তোমার স্পর্ধা থাকে প্রতিহত করো আমাদের।

সেই ব্যক্তি প্রবল অঙ্গাঘাত করল ব্লহুর বক্ষদেশে। তার দেহ ছিটকে পড়ল সেই নদীতেই এবং প্রবল গর্জন করে তার অনুগামীরা একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে তার দেহকে অধিকার করতে।

রহুর ক্ষত থেকে জলস্তম্ভের মতো উদ্ভুিত হতে লাগল রক্ত এবং সেই রক্তের প্রবল বন্যায় নদীর জলে উঠল কেঁপে। সেই রক্তের নদী বহিরাগতদের নগরী, দলত্যাগীদের ভূখণ্ড সব গ্রাস করে ধ্বংস করল। কেবল রহুর অনুগামীরা তার দেহকে আশ্রয় করে ভেসে গেল দূর দূরান্তে।

অবশেষে বন্যার বেগ মন্দীভূত হলে তারা একদিন তীর খুঁজে পেল এবং রহুর দেহের অস্থির কয়খানি আশ্রয় করে নতুন পথে পা বাড়াল।

দনু বলে, পীতেম, রহু আমাদের সঙ্গে থাকেন, আমাদের রক্ষা করেন, নতুন ভূখণ্ডে আমাদের সুস্থিতি না করিয়ে তার তো মুক্তি নেই।

 

১৭.

পরদিন গাছতলায় পীতেমের কাছে সালমা আসে। তার হাতে নেকড়ায় জড়ানো ধন্দুর নবজাত পুত্র।

ধন্দুর ছেলে, দেখ পীতে।

পীতেম হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, হাসে, তার চোখ চিকচিক করে। রহু! রহু!

পীতেম আঙুল দিয়ে শিশুর অধর স্পর্শ করে। বিড়বিড় করে বলে, রহু রহু! পীতেম যেন তার গহ্বর থেকে আবার বেরিয়ে আসে। যদিও তার নিঃসঙ্গতা কাটে না তবুও সে দু-একটা কথা বলে অন্যদের সঙ্গে এবং মাঝে মধ্যে ধন্দুর ছেলেকে তাঁবুর ভিতরে গিয়ে দেখে এবং আদর করে। সে সালমার কাছে যায় ও অত্যন্ত আস্তে আস্তে বলে, নাতির দু-মাস বয়স হলে চলে যাব এখান থেকে, বুঝলি?

সালমা এখন আর তাকে তির্যক ইঙ্গিত করে না। এর আগের স্থানত্যাগের সিদ্ধান্তগুলো বিফল হয়েছে, তার জন্য পীতেমকে দায়ী করা চলে না। একটার

পর একটা বিপদ এসেছে। পরিকল্পনা ভেসে গেছে।

পীতেম বলে, যাব পুবে, কি যাব কোন জায়গায় সেটা তুই স্থির করবি।

পীতেম যেন আস্তে আস্তে নিজের মধ্যে ফিরে আসছে। ধন্দুর ছেলের জন্ম অবশ্যই এর প্রধান কারণ। জন্ম এমন একটি বিষয়ে যে মৃত্যুপথযাত্রীকেও অন্তত কিছু সময়ের জন্য উজ্জীবিত করতে পারে, আর পীতেম তো ছিল শুধু বিস্মরণের মধ্যে।

সালমা বলে, যাব তো, কিন্তু ছেলেরা?

আত্মবিস্মৃত পীতেম ছেলেদের কথা কিছুই মনে করতে পারে না।

ছেলেরা?

ছেলেদের তো দারোগা যুদ্ধে নিয়ে গেছে।

যুদ্ধ?

সাহেবদের সঙ্গে সাঁওতালদের যুদ্ধ হচ্ছে। ঘোড়ার খিদমৎ খাটার জন্য ছেলেদের নিয়ে গেছে দারোগা।

তবে?

এ তবের উত্তর সালমার কাছেও নেই। সে শুধু কিছুদিন অপেক্ষা করার পরামর্শ দেয়। পীতেম মাথা নাড়ে।

কিন্তু অপেক্ষা বেশিদিন করতে হল না। দিন চারেক পরে জানকীরাম সিপাই পাঠিয়ে পীতেমকে ধরে নিয়ে গেল।

পীতেম আবার বিহ্বল হয়। আবার তার চোখে মুহূর্তের জন্য অনির্দিষ্ট দৃষ্টি ফিরে আসে।

আবার কি কসুর, বড় হুজর? যে পাঁচজন লোককে তোদর কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলাম, তারা কোথায়? সালমা বলে, এসবের মানে কি? তারা কোথায় তা তো তুমিই বলবে আমাদের।

আমি বলব, না? এই বাঁধ এই বুড়োকে। সালমা আতঙ্কগ্রস্ত হয়। এগিয়ে এসে হাত তুলে দারোগাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করে। বলে, থামো, বড় হুজুর। ব্যাপার কি হয়েছে আগে জানতে দাও।

দারোগার এখন আর কোনো কিছু বিশ্লেষণ করার দরকার ছিল না। এই মানুষগুলোর কারণে সে অপরিমেয় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পাঁচজন অশ্ব তদারককারী বাজিকর বন্দীকে মুক্ত করেছে, চারজন সৈনিককে হত্যা করেছে এবং পালিয়েছে। ব্যাপার কি হয়েছে, এ মুহূর্তে এ ব্যাখ্যা দেওয়া তার কাছে অবান্তর। ক্ষমতাশালী মানুষের ক্রোধ অনেক সময় রক্তদর্শন না করে তৃপ্ত হয় না। যুক্তিতে হয় না, বুদ্ধিতে হয় না, ক্ষতিপূরণে হয় না, ক্ষমাতেও হয় না।

এরকম বিধ্বংসী ক্রোধ এখন জানকীরামের মস্তিষ্কে। রক্তদর্শন করতে চায়। সে হুংকারে, দাপটে ক্রোধ বৃদ্ধি করে এবং প্রহারের উদ্যম ও শক্তি বাড়ায়।

ব্যাপার কি হয়েছে আঁ? অ্যাই, এ মাগিকে হঠা এখান থেকে।

পীতেমকে বাঁধা হয়েছে একটা থামের সঙ্গে। সালমাকে একজন হাত ধরে হ্যাচকা টান দেয়।

সালমা ভুল করে। আকর্ষণকারী সেপাইয়ের কাছ থেকে সে হাত ছাড়িয়ে নেয় আচমকা শক্তিপ্রয়োগ করে। একেবারে দারোগার মুখের কাছে হাত নাড়ায় সে। কুদ্ধ সাপের মতো সশব্দে শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলে।

কি করবে একে? মারবে? মারো, তোমার ক্ষমতা দেখি? দেখো, দারোগাবাবু, আমরা বাদিয়া জাত, আসমানের দেবতা আমাদের সহায় থাকে। অন্যায় কিছু করবে, প্রতিফল মিলে যাবে হাতে হাতে। তোমার ব্যাটার মরার কথা ভেবেছ? দয়ারাম ভকতের লাশে পিঁপড়ে ধরেছিল, মনে আছে?

ফলে দারোগা আরো উত্তেজিত হয়। প্রতিপক্ষ যদি উত্মা দেখায় প্রহারের যৌক্তিকতা জোরদার হয়। সে লাথি মারে সালমার গায়ে। এত দুঃসাহস, দারোগার মুখের সামনে হাত নাড়ায়।

সালমা ছিটকে পড়ে। একজন সিপাই তার কেশাকর্ষণ করে। সালমা উন্মাদ হয়ে যায়। যে করেই হোক বাঁচাতে হবে পীতেমকে। এই অসুস্থমস্তিষ্ক মানুষটাকে যদি অত্যাচার সহ্য করতে হয় পাগল হয়ে যাবে সে। তীক্ষ্ণ, অপরিচিত চিৎকার করে সে।

খবরদার দারোগা, সাবধান করে দিচ্ছি তোমাকে। সর্দারের গায়ে হাত দেবে। সর্বনাশ হয়ে যাবে তোমার।

এক থাবা ধুলো নিয়ে সালমা তাতে থুথু ছিটায় এবং বিড়বিড় করে। টানা-হেঁচড়াতে তার উড়নি খসে পড়েছে, চোলি ছিঁড়ে দৃশ্যমান তার দুই পীনস্তন। ভয়ংকর দেখাচ্ছে তাকে। সিপাইরা ভয় পেয়ে তাকে ছেড়ে দেয়।

কিন্তু দারোগা এত সহজে ভয় পেল না। সাহেবদের সঙ্গে ওঠাবসা তার। তার উপরে যথার্থই ক্ষিপ্ত সে। আর এইসব উত্তেজক নাটকে ক্ষিপ্ততা তার বেড়েছে আরো।

সে নিজে এবার উঠে এসে সালমাকে আঘাত করল। অনাবৃত স্ত্রীশরীরে আঘাত ছিল এই অনাবশ্যক ঝামেলাটাকে একটা,খুপরিতে আপাতত বন্ধ করে রাখা। সেই উদ্দেশ্যেই সে সালমাকে আঘাত করতে করতে পাশের একটা কুঠুরির দিকে আকর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু কুঠুরিতে ঢুকিয়েও সে তার হাতকে থামাতে পারে না। মারতেই থাকে।

সালমা শুধু তার মুখকে আঘাত থেকে আড়াল করার চেষ্টা করছিল। তারপর যখন সে দেখে দারোগা তাকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করার প্রয়াস পাচ্ছে, সে আর বাধা দিল না। সে বুঝতে পারে, এবার জানকীরামের নেশা ধরে গেছে। পুরুষ চরিত্র সম্বন্ধে তার অভিজ্ঞতা গভীর। সে এই ভেবে স্বস্তি পায় যে আপাতত এই ক্রুদ্ধ দানবীয় মানুষটাকে পীতেমের উপরে আঘাত করা থেকে নিরস্ত করতে পেরেছে।

সালমা এখন বুঝতে পারে, মানুষটা যতটা না পরিশ্রান্ত তার থেকে বেশি হাঁপাচ্ছে। মিশ্র উত্তেজনা তাকে ক্লান্ত করছে। ক্রমশ তার হাত শ্লথ হয়ে আসতে থাকে এবং একসময় থেমে যায়। ক্লান্ত, ক্রুদ্ধ, ঘর্মাক্ত জানকীরাম তখন আবিষ্কার করে তার সামনে এক অসামান্য রমণীশরীর, বয়স যাকে স্পর্শ করতে পারেনি, জীবনযাত্রার কঠোরতা যাকে কর্কশ করতে পারেনি। সে অসহায় বোধ করে নিজের অভ্যন্তরে এবং পা দিয়ে পিছনের দরজা ভেজিয়ে দেয়। সালমা আপত্তি করে না।

 

১৮.

আষাঢ় শ্রাবণ ভাদ্র আশ্বিন, এই চার মাস সাঁওতাল বাহিনীর সঙ্গে পরতাপ, বালি, জিল্লু এবং পিয়ারবক্স এই চারজন বাজিকর যুবক পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগল। লোহার কাজে ছিল তাদের স্বাভাবিক দক্ষতা। সেই দক্ষতা এখন প্রয়োজনে লাগে। অস্থায়ী শিবির যেখানেই হয় প্রথমেই কামারের হাপর বসে সেখানে। তীরের ফলা, বল্লম, তরোয়াল ইত্যাদি লোহার অস্ত্র তৈরি হয় সেখানে। অস্ত্রের প্রয়োজন দিনদিন বাড়ছে। নিত্যনতুন সাঁওতাল দল গ্রাম ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে।

পীরপৈঁতি পাহাড়ে অনেক চমক হয়েছিল। ইংরেজদের অতবড় বাহিনীর পরাজয় এবং পলায়ন, ডুমকার সঙ্গে বাজিকর যুবকদের মিলন, তাদের সাহায্যে চেতন মাঝির উদ্ধার—এসব ঘটনায় শিবিরে সেই ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও প্রাণবন্ত উৎসব চলে।

তারপর যুদ্ধ আর যুদ্ধ। গ্রামের পর গ্রামে সাঁওতাল বাহিনী জমিদার, পুলিশ, মহাজন এবং ঘাটোয়ালদের কচুকাটা করে ‘ফারকাটি’ অর্থাৎ সর্বস্ব শোধ দিল। মুক্ত হল তাদের সব ঋণ থেকে। শোষণে ও অত্যাচারে তারা নির্মম হয়েছিল। কোথাও কোথাও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকেও তারা রেহাই দেয়নি। নারায়ণপুরের জমিদারকে তারা হত্যা করেছিল নৃশংসভাবে।

সাঁওতাল পরগণা, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চল সাঁওতাল বিদ্রোহীদের দখলে এল। তারপর দানাপুরের সামরিক ঘাঁটি থেকে সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী নিয়ে ইংরেজরা সাঁওতাল গ্রামগুলোর উপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর যা শুরু হল তা যুদ্ধ নয়, নিতান্তই গণহত্যা। পাহাড়ে ও জঙ্গলে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মধ্যে সাঁওতালরা অসহায়ের মতো মরছিল। মাথার উপরে ছিল না কোনো আচ্ছাদন, কিছু না খাদ্যের কোনো জোগান।

আশ্বিন মাসে সংগ্রামপুরের কাছে পাহাড়ে সাঁওতালরা শিবির স্থাপন করল। একটা মরিয়া ভাব সবার মধ্যেই তখন তীব্র হয়ে উঠেছে। বিদ্রোহের নেতারা দিনেরাতে আলোচনায় বসছে, সভা করছে, সৈন্যদের মনোবল বাড়াচ্ছে। বন্দুককামানের বিরুদ্ধে তিরধনুক, বল্লম, তরোয়ালের যুদ্ধ। কাজেই তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও অসাধারণ মানসিক শক্তি ছাড়া এরকম যুদ্ধের মোকাবিলা করা সাঁওতালদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

পরতাপ, বালি ইত্যাদি বাজিকরেরা ইতিমধ্যেই যুদ্ধের পরিণতি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছে। বস্তুত, যে কারণে তারা পীরপৈতির ইংরেজ ঘাঁটি ত্যাগ করে সাঁওতালদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তার মধ্যে মহত্তর কিছু সেই মুহূর্তে ছিল না। ডুমকা সোরেনের পরিবার ও অন্য সাঁওতালদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশার ফলে একটা আকর্ষণ তাদের জন্মেছিল। কিন্তু সাঁওতালরা যে শোষণে নিপীড়িত, সে ধরনের শোষণের সঙ্গে বাজিকরেরা অভ্যস্ত নয়। কাজেই এ ব্যাপারে কিছুটা সহানুভূতি ছাড়া তাদের ভিতরে অন্য কিছু ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, চতুর বাজিকরেরা সবসময়ই তাৎক্ষণিক লাভালাভকেই বেশি মূল্য দিতে অভ্যস্ত। পীরপৈতির ইংরেজদের আধুনিক রণসজ্জা ও আগ্নেয়াস্ত্র দেখেও তাদের মনে হয়েছিল যে ইংরেজরা হারবে। এর সমর্থনে তারা ইংরেজ বাহিনীর মনোবল ও সাঁওতালদের তুলনায় তাদের সৈন্যসংখ্যার অপ্রতুলতার কথাই হিসাবের মধ্যে এনেছিল। এর সমর্থনে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পীরপৈতিতে ইংরেজ বাহিনীর পরিণতি তারা তাদের হিসাবের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। সুতরাং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে তারা সাঁওতালদের সঙ্গে যোগ দেয়।

তারপর ঘটনা যত এগোতে থাকে নানারকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। বহেরা গ্রামের রণকৌশলগত অবস্থান ইংরেজদের অনুকূলে ছিল। এই গ্রাম থেকে সন্নিহিত অনেকগুলো গিরিসংকট ও বিস্তীর্ণ জলের উপর আধিপত্য সহজতর। ফলে ইংরেজ বাহিনী আচমকা আঘাত করে গ্রামটির দখল নেয় ও ঘাঁটি স্থাপন করে।

বহেরার লক্ষ্মণ সোরেনের আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। শোনা যায় যে যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই মহেশপুর থানায় তাকে হত্যা করা হয়। বহেরা যখন ইংরেজদের দখলে আসে তখন সেখানে প্রতিরোধ করার মতো বিশেষ কেউ ছিল না। শিশু বৃদ্ধ ও মেয়েরা সেই গ্রামে অত্যন্ত আতঙ্কের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছিল। ইংরেজরা যেসব গ্রাম দখল করেছে, সেখানে নির্বিচারে হত্যা এবং ধর্ষণ চালিয়েছে। কিন্তু বহেরার সৌভাগ্য, সেখানে পিয়ারসন নামে একজন ম্যাজিস্ট্রেট সেনানায়ক হিসাবে আসে। পিয়ারসন তার বাহিনীর উচ্ছলতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়। ফলে বহেরাতে হত্যা ও ধর্ষণ একেবারেই হয়নি। বরং পিয়ারসন বৃদ্ধ ও রমণীদের অভয় দিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে না যেতে অনুরোধ করছিল। সুতরাং একটা চাপা ভীতি ছাড়া বহেরাতে সাঁওতালদের অন্য কোনোরকম অস্বস্তি ছিল না।

বহেরা দখল হয়েছে শুনে ডুমকো তিন হাজার সাঁওতাল বিদ্রোহী নিয়ে ঝটিকা আক্রমণে পিয়ারসনের ঘাঁটি বিধ্বস্ত করে। পিয়ারসন বন্দী হয়। বন্দীদের নির্বিচারে হত্যা করা তখন দুই বাহিনীর কাছেই অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার। ডুমকা তার সহকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করে পিয়ারসন সহ ধৃত পাঁচজন অফিসারকে পরদিন হত্যা করা হবে।

এ খবরে বহেরার সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। ডুমকার মা পীথা মুর্মু এবং আরো চার-পাঁচজন রমণী সেইদিনই ডুমকা ও তার সহকারীদের কাছে এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণ জানতে চায়।

ডুমকা বলে, এসব ব্যাপারে নেতাদের যা নির্দেশ আছে তার অন্যথা করা যাবে না।

কিন্তু পিয়ারসন সাহেব এখানে কোনো অত্যাচার করেনি। বরং তার যেসব বদমাইস সৈন্য সেরকম করার চেষ্টা করেছিল, সাহেব তাদের শাস্তি দিয়েছে।

তবুও কিছু করার নেই। অন্যান্য জায়গায় যেসব ঘটনা হয়েছে তার বদলা হিসাবে পিয়ারসনকে মরতে হবে।

পীথা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়। সে চিৎকার করে বলে, যতবড় বীরই হোস না কেন, মনে রাখিস, এখনো ধুতি-পাঞ্চি তুলে পানটির বাড়ি মারতে পারি, কেননা, আমরা মা।

নেতারা বিরক্ত হয়, ডুমকা সেখান থেকে উঠে অন্যত্র চলে যায়।

পীথা আহত ও অপমানিত বোধ করে। উপস্থিত সকলকে শুনিয়ে সে বলে, তোদের সর্বনাশ হবে। তোরা কোনো নিয়মকানুন মানছিস না! সাঁওতালদের রীতি-নীতি এমন নয়। আমি দেখতে চাই, আমাদের নিষেধ সত্ত্বেও এই ডুমকা সোরেন কিভাবে পিয়ার সাহেবকে খুন করে!

গ্রামের কাছে টিলার নিচে বধ্যভূমি স্থির হয়। পিয়ারসন সহ চারজন সাহেবকে সেখানে পিছনে হাত বেঁধে নিয়ে আসা হয়। পিয়ারসনের মুখ ভাবলেশশূন্য, অন্যরা কাদছিল, দয়া ভিক্ষা চাচ্ছিল।

পীথা ভাবতে পারেনি ডুমকা তার নির্দেশ অমান্য করবে। কিন্তু ডুমকা তার পিতৃহন্তাদের ক্ষমা করতে পারে না। যুদ্ধে এ-ধরনের দয়ারও কোনো দাম নেই।

আর পীথা ভাবছিল সে মানুষটা থাকলে এমন কখনোই হতে পারত না।

বহেরায় পিয়ারসন সহ চারজন সাহেবক হত্যা করা হয় কুড়াল দিয়ে মাথায় আঘাত করে। চারজন পাশাপাশি হাঁটু গেড়ে বসেছিল পাহাড়ের দিকে মুখ করে। ঘাতক পিছন থেকে সোজাসুজি কুড়াল দিয়ে মাথায় আঘাত করে।

মানুষ দেখছিল এই হত্যাদৃশ্য। যারা স্বজন হারিয়েছিল তারা প্রতিশোধের আনন্দে চিৎকার করছিল। উল্লাস অনেকক্ষণ ধরে গ্রামটাকে গমগম ধ্বনিতে পূর্ণ রেখেছিল। পীথা উচ্চস্বরে অভিশাপ দিচ্ছিল ডুমকা ও তার সহকারীদের।

অনেকক্ষণ ধরে পাহাড়ের উপর থেকে প্রহরীরা নাকাড়া বাজাচ্ছিল। শুনতে পায়নি কেউ সেই বিপদ-সংকেত। যখন সকলের খেয়াল হয় তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

ইংরেজ বাহিনীর কামানের প্রথম গোলাটা এসে পড়ে বধ্যভূমির জমায়েতের উপর। ফাঁকা জায়গায় কামান ও বন্দুক নিয়ে আক্রমণ। সুতরাং ব্যাপক ও নির্বিচার হত্যা।

সাঁওতাল বাহিনী জঙ্গল ও পাহাড়ের আড়ালের জন্য প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল। সঙ্গে গ্রামের অবশিষ্ট মানুষ। পিছনে পড়ে রইল পঞ্চাশ-ষাটজনের মৃত ও অধমৃত দেহ। তার মধ্যে ডুমকা সোরেন একজন।

সংগ্রামপুরের ঘাঁটিতে ডুমকা ছিল না। সংগ্রামপুরে সাঁওতালরা বিশাল বাহিনীর সমাবেশ করেছিল। সংগ্রামপুরে সর্বাধিনায়ক ছিল কানু মুর্মু এবং সিদু মুর্মু, চাঁদরাই ছিল দ্বিতীয় সারির নেতা।

পরতাপ, জিল্লু ইত্যাদি তখন গভীরভাবে যুদ্ধের প্রকৃতি এবং পরিণতি বুঝবার চেষ্টা করছে, এই মানুষগুলোকে আরো ভালোভাবে বুঝবার চেষ্টা করছে।

কেননা অনেক ঘটনা ঘটছিল যা তাদের হিসাবের মধ্যে ছিল না। পীথা মুমুর মৃত্যু তার মধ্যে একটি। তাছাড়া সাঁওতাল বাহিনীতে তাদের থাকার প্রধান আকর্ষণ ডুমকা আর ছিল না। সেটা একটা চিন্তার বিষয়। এই মানুষগুলোকে যে তারা সম্পূর্ণ চেনে না, এ বোধ এতদিনে তাদের হয়েছিল।

ডুমকার মৃত্যুর পর বহেরার মানুষেরা পীথা ও অন্য তিনজন স্ত্রীলোককে ডাকিনী মনে করেছিল।

কাজেই গুনিনের বিচারে তারা স্থান সাব্যস্ত হয়। যাবতীয় দুর্ভাগ্যের জন্য উন্মত্ত মানুষ তাদেরই দায়ী করে এবং হাত-পা বেঁধে এ চার রমণীকে কুপিয়ে মারে।

বাজিকরেরা এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করে নিজেদের ভবিষ্যৎ গোপনে স্থির করে। তারা বুঝেছিল এমন কোনো জায়গায় পালাতে হবে যেখানে এ আগুনের ছোঁয়া লাগেনি। একজন বিশ্বস্ত লোহারকে তারা গোপনে রাজমহলের খবর আনতে পাঠিয়েছিল। নির্দেশমতো সেই লোহার সালমার সঙ্গে দেখা করেছিল। মৃত্যু তখন বাজিকর ছাউনিতে কারোরই অজানা ছিল না। শুধু এই চারজনের কথা চিন্তা করেই সালমা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। পীতেম আবার নির্বাক হয়ে গেছে, কাজেই দলের সম্বন্ধে সামান্য যেটুকু চিন্তা করার তা সালমাকেই এখন করতে হয়।

সালমা সেই লোহারকে বলেছিল, দল কার্তিকের গোড়াতেই এখানকার ছাউনি তুলবে। গঙ্গা পার হয়ে প্রথমে যাবে মালদা। সেখানে কিছুদিন শহরের কাছাকাছি থাকবে, তারপর আরো পুবে সরে যাবে।

সুতরাং জিষ্ণু পরতাপ, বালি, পিয়ারবক্স দলের গতিপথ সম্বন্ধে আগাম একটা ধারণা করতে পেরেছিল। আর গঙ্গার ওপারে সাঁওতাল বসতি খুবই কম, সেখানে ঝামেলাও নেই। সালমার সিদ্ধান্তে তারা খুশি হয় এবং ঠিক করে প্রথম সুযোেগেই সাঁওতাল দল ছেড়ে পালাতে হবে।

সংগ্রামপুরের যুদ্ধের পর তাদের হাতে সেই সুযোগ এসে যায়। কৌশলে ইংরেজরা পাহাড় ও জঙ্গলের ভেতর থেকে সাঁওতাল বাহিনীকে ফঁকা মাঠে নামিয়ে আনে। তারপর কামান-বন্দুকের সঙ্গে তিরধনুকের বেমানান লড়াই।

সংগ্রামপুরের যুদ্ধে নেতাদের মধ্যে প্রথমে নিহত হয় চাঁদরাই। চাঁদরাইয়ের মৃত্যুর পর আহত বাঘের মতো সাঁওতাল বাহিনী পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে নেমে আসে। সেদিন ইংরেজ বাহিনী একটা কালো জঙ্গলকে সচল হয়ে নেমে আসতে দেখেছিল। নাকাড়ার শব্দ হয়েছিল মেঘগর্জনের মতো। উন্মাদ লড়াইতে শ’য়ে শয়ে সাঁওতাল মাটি নিচ্ছে, তবুও এগিয়ে আসা দীর্ঘক্ষণ অব্যাহত ছিল।

তারপর সিদু মুর্মু এবং কানু মুর্মু দু-জনেই আহত হতে সাঁওতালরা পিছোতে শুরু করে। নাকাড়া ধামসায় অন্য শব্দ বাহিনীকে পিছিয়ে আসতে ইঙ্গিত করে। ছিন্নভিন্ন সাঁওতাল বাহিনী গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যেতে থাকে দুই আহত নেতাকে বহন করে। জয়ের আশা তখন আর তাদের ছি না। সুতরাং মানুষ দল ছেড়েও পালাতে থাকে।

এই সুযোগ বাজিকরেরা ছাড়ে না। প্রথম সুযোগেই এই যুদ্ধে দ্বিতীয়বারের মতো তারা পালায়। চারটি ঘোড়ার গায়ে হেঁড়া কাপড় জড়িয়ে গভীর রাত্রে তারা উত্তরমুখে যাত্রা শুরু করে। উত্তরে গঙ্গাকে পাওয়া যাবে এটুকু ভৌগোলিক জ্ঞান তাদের ছিল, কেননা মানুষের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করা, এমনকি মানুষের কাছাকাছি আসাও তাদের পক্ষে বিপজ্জনক। ধরা পড়লে ইংরেজ কিংবা সাঁওতাল কোননা পক্ষই তাদের খাতির করত না।

পাঁচ-ছ’ রাত্রি চলার পর তারা গঙ্গার দেখা পায়। সাহেবগঞ্জের থেকে পাঁচ-সাত ক্রোশ পুবে তারা গঙ্গা পার হয় এবং অপেক্ষাকৃত নিরুপদ্রব পূর্ণিয়া জেলায় প্রবেশ করে।

এইভাবে চার যুবক কখনো ভিক্ষা করে, কখনো চুরি করে, কখনো লোক ঠকিয়ে তাদের ক্ষুগ্নিবৃত্তি করল। যুদ্ধের পর পথশ্রম ও অনাহারে এই চার অশ্বারোহী কৃশকায় ও দুর্বল হয়ে পড়ল। আরোহীদের থেকে ঘোড়াগুলোর অবস্থা হল আরো করুণ। শেষপর্যন্ত তারা আর সওয়ার বহন করতে পারছিল না।

এইভাবে মনিহারিঘাট, হরিশ্চন্দ্রপুর, সামসি এবং গাজোল হয়ে তারা মালদা আসে। তারপর বাদিয়ার মধ্যযুগীয় ছেড়া তাঁবু খুঁজে নিতে তাদের অবশ্য আর অসুবিধা হয় না।

 

১৯.

হাঁ শারিবা, তোর নানার নানা পীতেম, তার বাপ দনু, তো সি কহিল, পীতে, তুমু পচ্ছিমে লয়, পুবে যাবা। কেন কি, পুবেৎ তরক উঠে আর পচ্ছিমে ডুবে যায়। বাউদিয়া বাজিকর কতদিন দিশাহারা, ততদিন তারা তরককে পাছুতে রাখে, ততদিন তারা খালি পচ্ছিমে যায়। তয় দনু কলেন, পীতেম হে, পীতেম, তুমু পুবে যাও, বাপ। রহু তুমার সহায় হবেন।

শারিবা বলে, তো পুবের দেশেৎ সুখ কই, নানি? রাজমহেলৎ সুখ জুটে নাই, সুখ জুটে নাই এই তাবৎ পুবের দেশে ঘুরে।

হাঁ, শারিবা, সুখ জুটে নাই। শ-বছর পার হই গেল, তাও তত সুখ জুটে। নাকি, সুখ বলে কিছু নাই, নাকি খালি দুর্কের পাথারে সাঁতার খায় বেবাক মানুষ।

সুখ না থাকুক নানি, সোয়াস্তি আছে। তো বাজিকরের কপালে কি তাও বহু লিখে নাই?

লুবিনি কঁপা কাঁপা হাতে শারিবার মুখ চাপা দেয়। ওলা কথা কহে না, শারিবা। ওলা কথা পাপ।

শারিবা বলে, পাপ! নানি, যার সমাজ নাই, তার পাপ নাই। রহু কি হামরাদের ভগবান?

আঃ হা?

হিন্দুর ভগবান আছে, মোছলমানের আছে আল্লা, খিস্টানের যেশু। তো হামরার বাজিকরের রহুই সি ভগবান, কি আল্লা, কি যেশু। লয়?

শারিবা যেন পরখ করে তার নানিকে। যেন শুনতে চায়, বৃদ্ধা এ প্রশ্নের কী উত্তর দেয়।

নানি এ কথার উত্তর খুঁজে পায় না। প্রশ্নটা তার নিজের কাছেই। চতুষ্পর্শের সমাজবদ্ধ মানুষের কাছে এটা কোনো সমস্যাই নয়। সর্বশক্তিমান এক বা একাধিক অস্তিত্বের উপস্থিতি যেখানে জন্মের পরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো সাধারণ বিষয়, সেখানে বাজিকর নামক সম্প্রদায়ের এ ধরনের কোনো আশ্রয় নেই—একথা অন্য কারো বোধগম্য নয়। অন্য কারো সমস্যাও নয়।

সমস্যা ছিল পীতেমের, সমস্যা ছিল জামিরের, সমস্যা লুবিনির, শারিবার, সমস্যা কিছু বাজিকরের। রহু ঈশ্বরের মতো সর্বশক্তিমান নয়। সে এক প্রাচীন দলপতি। সে এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নীতি নির্ধারণ করত তার জীবদ্দশায়। কিন্তু লুবিনি কিংবা কোনো বাজিকর তাকে ভগবান, আল্লা ইত্যাদির সমগোত্রীয় ভাবতে পারে না। এই অমোঘ শক্তিধরদের যে পরিচয় বৃহত্তর সমাজের কাছ থেকে সে পায়, রহুকে তার সমগোত্রীয় ভাবতে তার শুধু ভয় নয়, অনিচ্ছাও বটে। কাজেই তার বোধের মধ্যেও বহু বেঁচে থাকে এক মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী দলপতির মতো। তার উপরে সে দেবত্ব আরোপ করতে পারে না, কারণ দেবত্ব আরোপ করতে পারার সামাজিক স্থিতি তার নেই। সে সমাজচ্যুত। সে ভ্রাম্যমাণও। পথই তার যাবতীয় নীতিনির্ধারক।

লুবিনি বলে, না শারিবা, রহু রহুই। সি হামরার মঙ্গল চায়। সি চায় বাজিকর সুখে থাকুক; থিতু হোক সে।

শারিবার কাছে তবু বিষয়টার জট খোলে না। লুবিনি যত বৃদ্ধ হচ্ছে ততই সে সারাজীবনের অভিজ্ঞতার, শোনা কথার সারসংকলন করছে। পার্শ্ববর্তী সমাজের কোনো বৃদ্ধার সঙ্গে তার পার্থক্য হচ্ছে এই যে, তার কাছে নেই এমন একখানা আধার যার নাম ঈশ্বর, যার উপরে সে তার অভিজ্ঞতা, বোধবুদ্ধি সঁপে দিয়ে নিজেকে নিমিত্ত মাত্র মনে করতে পারে।

তাই শারিবা, সি বাজিকর রাজমুহল ছাড়ি আবার রাস্তা ঘুরবা বারালো। পথে পথে ফিরা বাজিকরের কুত্তা ভুকে, জানোয়ার চিল্লায়। পুরনিয়া, কাটিহার, কিশনগঞ্জ, দিনাজপুর, রঙপুর, ফির মালদা, রহুর ঘোড়ার অক্তের দাগ, ঘুর, ঘুর, ঘুররে বাজিকর, দেখ, খুঁজি দেখ, কুথায় তোর থিতু, কুথায় তুর সোয়াস্তি। আর মাথার উপর তক জ্বলে, শীতের হিম, বর্ষার জল। বাজিকরের গেঁহুর পারা অঙ তামার বন্ন হোই গিল।

 

একসময় যে মানুষগুলোর দেহের রঙ ছিল সোনালি গমের মতো, এখন তা হল শ্যাওলাধরা তামার মতো। পুরুষদের ঘাড় পর্যন্ত কেশরের মতো চুল একসময় ছিল অহংকারের প্রতীক, এখন দীর্ঘ দুর্বিপাকের পর শুধু পাটের ফেঁসোর মতো মিয়মাণ। মাথায় রুমাল কিংবা উড়নি বাঁধা মেয়েরা একসময় কলহাস্যে শহরের রাজপথ মুখরিত করত, এখন ক্ষুধায় কাতর ধূর্ত দৃষ্টি তাদের, চোখে নেই সেই তীব্র সম্মোহনী। অনেকের দেহেই আর তাদের প্রাচীন নুগরু, কুর্তি, ঘাগরা নেই, নেই কাচের কাজকরা বস্ত্র, গলায় পাথর। সেখানে স্থান নিয়েছে ধুতি, লুঙ্গি, এইসব এদেশীয় বস্ত্র। গলার মালাকরা মুর্শিদাবাদী সিক্কাগুলো এখন শ্যাওলাধরা। কেউ আর সেগুলো ঘসে চাকচিক্য করে না। শুধু রাস্তা দিয়ে যখন তারা চলে অথবা থামে, মনে হয় এক হাজার বছরের ধূসরতা তাদের দেহে, তাদের উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে।

এক শতাব্দী ধরে তারা তাদের রক্তে জেনেছিল যে তারা ক্লান্ত হয়ে গেছে। পথ চলায় ক্লান্ত হলে থামতে হয়। কিন্তু সে নিয়ম সাধারণ পথিকের। বাজিকরের নয়। যার পথের শেষ আছে, সে ক্লান্তিতে উপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু বাজিকরের পথের শেষ নেই। তাই ক্লান্তির বোঝা তার কাছে একসময় বড় বেশি ভারি হয়ে ওঠে।

পীতেম স্থিতি চেয়েছিল। রাজমহলে দীর্ঘদিনের উপস্থিতি তার অভিজ্ঞতায় একটা ক্ষতিকর স্থিতি। তবুও দাঁতে দাঁত কামড়ে তাকে থাকতে হয়েছিল। যদিও সেজন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, তবুও।

লুবিনি পাতালু নদীর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঘরের দাওয়ায় জমাট অন্ধকার, বাইরের স্বচ্ছ চাঁদের আলো। আকাশে হালকা মেঘ ভেসে যাচ্ছে, তার ছায়া পড়ছে নিচে গাছের পাতায়। এ দৃশ্যে সব কিছুই কেমন আদিম দেখাচ্ছে।

লুবিনি বলে, শারিবা, তুই এমন তরতাজা জুয়ান পুরুষ, তুই ক্যান্ নাচগান হাল্লা করিস না?

ভালো লাগে না।

তুই তোর নানার থিকাও বুঢ়া, য্যান তোর নানার নানা সিই পীতেম বুঢ়ার মতো। এমন জন্মবুঢ়া হওয়া ঠিক নয়রে।

 

২০.

মালদা শহরে মহানন্দা নদীর তীরে বাজিকররা তাদের অস্থায়ী গেরস্থালি শুরু করে নতুন করে। গঙ্গার ওপারের উপদ্রবের কোনো আভাস এদিকে নেই। কিন্তু তাতেও কোনো স্বস্তি নেই। ভগ্ন জীর্ণ সহায়হীন মানুষগুলো এখন আরো ধূর্ত ও ঠগ হয়। ঢোলকে ডুগডুগ শব্দ শোনা যায় ঠিকই। কিন্তু তার সঙ্গে সমান তালে থাকে চুরি, বেশ্যাবৃত্তি, হাত দেখা ও ভবিষ্যৎবাণী। কেননা রাজমহল তাদের সবই কেড়ে রেখে দিয়েছে। দলের কাছে এখন পশু বলতে কিছু নেই, সঞ্চিত অর্থও অনেক আগেই নিঃশেষ। তবুও এখানেই থাকতে হবে। কেননা চারজন নিরুদ্দিষ্ট যুবকের প্রতি নির্দেশ ছিল। এখানে আসার। এখানেই তারা মিলিত হবে, নোকমুখে এমন সংবাদই সালমা পাঠিয়েছিল।

মাঘ মাসের প্রথম দিকে পরতাপ, জিল্লু, বালি এবং পিয়ারবক্স ফিরে আসে। ক্রমান্বয়ে পলায়নে ক্লান্ত চার যুবক এবং তাদের শীর্ণকায় ঘোড়া।

বাজিকর ছাউনিতে উল্লাস ওঠে না, আবার শোকও তেমন চোখে পড়ে না। গিয়েছিল তারা পাঁচজন, এসেছে চারজন। শব্দ করে একজনই কাঁদে কিছু সময়, সে ধন্দুর বউ রোহীন। যদিও ছ-মাস আগেই ধন্দুর মৃত্যুর খবর সবাই জানতে পেরেছিল এবং এখন বিষয়টা পুরনো হয়ে গেছে, তবুও এই মুহূর্তে সবাই ধন্দুর কথা ভাবছে। রোহীন শব্দ করে কাঁদে, এর মধ্যে কেউ আতিশয্য কিছু দেখে না। এখন তার কোলে ধন্দুর ছেলে এবং রাত্রে তার শয্যায় দ্বিতীয় একজন পুরুষ শোয়। এসব কথা কারো অজানা নয়। এসব সত্ত্বেও তার কান্না অস্বাভাবিক লাগে

করোর কাছে। রোহীন কিছু সময় কাঁদে, পরতাপ তার ছেলেকে কোলে নিয়ে কিছু সবয় বসে তার কাছে।

দিনতিনেক পরে পীতেম চারজনকে তার কাছে ডাকে। চার যুবক নিঃশব্দে তার কাছে বসে থাকে অনেক সময়। পীতেম কিছু বলতে চায়, অথচ পারছে না, এটা সবাই বোঝে। তারা অপেক্ষা করে। শীতের শীর্ণ গাছের মতো পীতেমের চেহারা রিক্ত।

অনেক সময় পরে পীতেম বলে, দুনিয়ার অনেক কিছু দেখে এলে তোমরা। বয়সের থেকেও অভিজ্ঞতা তোমাদের অনেক বেশি হয়েছে। যা গেছে তার জন্য কেঁদে লাভ নেই। এখন বোধহয় আমাদের গেরস্ত হওয়ার চেষ্টা করা উচিত।

চার যুবক মাথা নাড়ে। পীতেম বলে, রহু তেমনই চান। তবে আমার শরীর আর মন দুইই ভেঙে গেছে। আমাকে দিয়ে আর নতুন করে কিছু হওয়ার নয়। তোমরা দলের সেরা ছেলে। তোমরাই এবার চেষ্টা কর।

বালির নেতৃত্বে তারপর দল আবার নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করে। চারটি ঘোড়াকে যথাসম্ভব যত্ন নেওয়া হয়। বাজিকর এ কাজে অভ্যস্ত। মাসদুয়েকের মধ্যেই তাদের চেহারাতে আবার চিক্কণতা আসে। তৈরি হয় চারটি টাঙ্গা।

মালদা শহরে টাঙ্গার প্রচলন আছে। মুসলমানদেরই এই কাজ প্রায় একচেটিয়া। বাজিকরেরা এবার তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে নামে। বালি আগেই সাবধান করে দেয়, টাঙ্গাওয়ালাদের সঙ্গে ঝামেলা বাধাতে যেও না কেউ। মনে রেখো, আমাদের এখানে বেঁচে থাকতে হবে।

এক মাসের মধ্যে বাজিকর যুবকেরা টাঙ্গা চালাবার পেশাদারি হাঁকডাক, নিয়মকানুন শিখে যায়। দীর্ঘ রাস্তা পরিক্রমা করে মাল ও যাত্রী আনে। মানিকচক, কালিয়াচক, খেজুরিয়া ঘাটের ধর্গ রাস্তা পাড়ি দেয়, পথচারীকে সচকিত করে চাকার গায়ে চাবুকের হাতল ঢুকিয়ে খখ শব্দে। রাস্তায় ধুলো ওড়ে, টাঙ্গাওয়ালা ছুঁড়ে দেয় বিদ্রুপ রসিকতা কিংবা নিতান্তই খিস্তি।

বালি নিজে টাঙ্গা চালায় না। বাজারের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট স্থানে সে তার মেরামতির সরঞ্জাম আর হাপর নিয়ে বসে। কর্মকারের কাজে সে খুবই সিদ্ধহস্ত। এ ছাড়া ঘোড়ার পায়ে কিংবা গরু-মোষের পায়ে নাল পরাবার জন্য দরকার হয় তাকে। জানোয়ারকে খাসি-বলদ করানোর জন্যও ডাক পড়ে তার।

পীতেম আফিঙের পরিমাণ বাড়ায় এবং রাজমহলের গাছটির অনুরূপ আরেকটি গাছ খুঁজে বের করে। সেখানে সারাদিনরাত বসে ঝিমায় সে এবং দনুর নির্দেশের আরো কোনো গুঢ় নিহিতার্থ খুঁজে বের করবার প্রয়াস পায়।

সালমা ঘুরে বেড়ায় পাড়ায় পাড়ায়। মালদার মুসলমান সমাজ বর্ধিষ্ণু। সালমা তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আলাপ জমায়। নিজের অভিজ্ঞতা ও বিদ্যাকে কাজে লাগায় সে। মধ্যবয়সী পুরুষ ও রমণী এই দুই জাতই তাকে সমাদর করে। কেননা এই উভয় শ্রেণীর মানুষের কাছে সম্পূর্ণ বিপরীত কারণে তার আকর্ষণ। তার সবচেয়ে বড় সম্পদ শরীর মধ্যবয়সী পুরুষকে উত্তেজনা জোগায় আর স্ত্রীলোকদের মধ্যে ঈর্ষার বীজ বপন করে। তবুও কেউই তার আকর্ষণ এড়াতে পারে না।

মাঝে মাঝে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বেরিয়ে পড়ে তারো। আটজন দশজনের দল হয়। বড় দল করতে হলে সামর্থ্যের জোর চাই, জানোয়ার চাই। সেসব এখন কিছুই নেই।

ছোট ছোট দল এখন যায় রাজশাহি রংপুর, দিনাজপুর, আবার কখনো কখনো পূর্ণিয়া, কাটিহার, বারাউনি পর্যন্ত। কিন্তু পশ্চিমে তার বেশি আর যায় না। পশ্চিমের ভীতি এখনো তাদের মারাত্মক। কারণ পশ্চিমে একসময় ধ্বংস এসেছিল, জলস্তম্ভ হয়েছিল যা রহুকে ভাসিয়ে নিয়েছিল। পশ্চিমে গোরখপুরে ভূমিকম্পে বিশাল ভূ-খণ্ড মাটিতে বসে গিয়েছিল।

পনেরো বছর মালদা শহরকে কেন্দ্র করে বাজিকরেরা থাকল। মহানন্দায় প্রতিবছর বর্ষার সময় জল উপচে পড়ত। কোনো কোনো বছর বন্যা আসত। উত্তরের সমস্ত জল নিয়ে গঙ্গা আসত উঁচু হয়ে। মহানন্দার জল ঢালার জায়গা থাকত না, কাজেই সে দু-কুল ভাসাত। শহরও তা থেকে নিস্তার পেত না। বাজিকরেরা দলবল নিয়ে পিছিয়ে আসত।

এভাবে প্রতিবছর তারা পরের জমিতে অস্থায়ী বাসা বাঁধত। ক্রমে জীর্ণ তাঁবুগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, আর নতুন করে তৈরি হল না। তখন তারা থাকত খোলা মাঠে অথবা খড় এবং তালপাতার ছাউনির নিচে।

যারা টাঙ্গা চালাত তারা দেখেছিল গঙ্গা পার হয়ে অনর্গল মানুষ আসছে। কালো রঙের মানুষ, তারো সাঁওতাল। তামার মতো রঙের মানুষ, তারো ওরাও। আসত আরো নানা জাতের মানুষ, যাদের পরিচয় কেউ জানত না। তাদের নিয়ে আসত সাহেবদের আড়কাঠিরা। তারা যেতে উত্তরের জেলাগুলোতে। সবাই জানত, ভীষণ খাটিয়ে মানুষ তারা। তারা জঙ্গল পরিষ্কার করত, পাথর চটাত, নদীর পাড়ের বাঁধ বানাত, চা-বাগানের নতুন পত্তনিতে কুলি হতো। সবাই জানত তারা বড় অল্পে সন্তুষ্ট। সবাই জানত রাঁচি, হাজারিবাগ, দামিন-ই-কোতে সাহেবরা তাদের মাজা ভেঙে দিয়েছে। তাই তারা ঘরছাড়া হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে যে-কোনো মূল্যে।

জিল্লু, পরতাম, বালি এবং পিয়ার, এই চার বাজিকর দূরের থেকে সারিবদ্ধভাবে চলা এইসব কালো মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকত। কখনো চকিতে মনে হতো, আরে, এই মানুষটা তো চেনা! হায়রে, এই সেই মানুষ? হায়রে!

 

শহরে জমিদার বদিউল ইসলামের বিরাট বড় বাড়ি। তার আস্তাবলে বেশ কয়েকটি ভালো জাতের ঘোড়া ছিল। ভালো জাতের ঘোড়া বাজিকরের চোখে পড়বেই। তারা সবাই জানত বদিউল ইসলামের ঘোড়াগুলো ভালো। কিন্তু বালি বলে, ভালো তো কি? ওগুলো তো মাঠে চরে না।

আর মাঠে চরলেই বা কি? কোথায় যাবে বাজিকর? আর কোথায় যাবে?

কিন্তু বদিউলের ঘোড়াগুলো ভালো, একথা বাজিকর জানত। তার মধ্যেও সবচেয়ে সেরা সাদা রঙের একটা আরবি মাদি ঘোড়া। এ ঘোড়ার জন্য বদিউলের সবই পৃথক বন্দোবস্ত ছিল। ঘোড়ার নাম দুলদুলি।

কেউ চড়ত না এ ঘোড়ায়, এমনকি বদিউল নিজেও নয়। গাড়িও টানত না সুন্দরী এই ঘোড়া। তবে কেন তাকে এত আদর, এসব প্রথম প্রথম ভেবে অবাক হত বাজিকর। এখন আর হয় না। এটি বদিউলের সৌভাগ্যদায়ী জিনের মাদার। জিন তুষ্ট থাকে এই ঘোড়ার আশ্রয়ে। অথবা, ঘোড়া তো স্বয়ং জিন। তাই তার এমন বন্দোবস্ত।

অবশ্য এত সমাদরের কারণ আছে। বদিউল অত্যন্ত নিষ্ঠাবান মুসলমান। দোষের মধ্যে আমোদ-প্রমোদে একটু বেশি মগ্ন থাকত। খবর রাখত না নায়েব শোভারাম মজুমদার কিভাবে জমিদারি চালাচ্ছে।

শোভারাম ছিল শিক্ষিত, কিন্তু বদিউল সম্পূর্ণ অশিক্ষিত। শোভারামের গোপন উচ্চাভিলাষ ছিল স্বয়ং জমিদার হওয়ার। এটা এমন কিছু দোষের ব্যাপার নয়। নায়েবরা জমিদার হামেশাই হয়।

ফলে রাজস্ব বাকি পড়তে থাকে, যদিও বদিউল ছিল অত্যন্ত রাজভক্ত। শোভারাম সাহেবদের খুশি রাখত প্রচুর খানাপিনা এবং উৎকোচ দিয়ে।

কিস্তির তাগিদ এলে শোভারাম আর্জি জানাতো অত্যন্ত বিনীতভাবে। হুজুরের এখন বড় দুর্দিন চলছে, আরো কিছুদিন সময় দিতে সরকারের আজ্ঞা হয়। এভাবে একজন কালেক্টর পার করে দিল শোভারাম।

কিন্তু দ্বিতীয় কালেক্টরের বেলায় বিষয়টা এত সহজ হল না। রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশে বদিউলের জমিদারি খাসে নিয়ে আসার নির্দেশ দিল কালেক্টর।

কালেক্টর বদল হলেও সহকারীরা দজ হয়নি। তারা অনেক পয়সা খেয়েছে শোভারামের। তাদের পরামর্শে কালেক্টর রাজস্ব-বোর্ডের কাছে বদিউলকে অন্তত এবারের মতো ক্ষমা করবার জন্য আবেদন করল। কালেক্টরের কথামতো বদিউল নিজে খাজনার টাকার সংগ্রহ করে রাজসরকারে জমা করল। তাছাড়াও, শোভারামকে মৃদু তিরস্কার করে এবারের মতো ক্ষমা করে দিল বদিউল।

কিন্তু শোভারাম তখন তিরস্কার কেন গাল খেতেও রাজি ছিল। জমিদারির তছরূপ করা টাকায় পুর্ণিয়ায় তার ছোটখাটো একখানা জমিদারি তখন কেনা হয়ে গেছে। বদিউলকে খুব বেশি আমল দেওয়া এখন আর তার দরকারও ছিল না। ফলে পরের বছরই আবার কিস্তির টাকা বাকি পড়ল।

কালেক্টরের সহকারীরা এবারও টাকা খেয়ে শোভারামকে সাহায্য করছিল। কিন্তু রাজস্ব-রোর্ডের উত্তপ্ত চিঠি পেয়ে কালেক্টর এবার আর কারো কথায় কর্ণপাত করল না। শোভারাম ও বদিউল দুজনকেই কারারুদ্ধ করল সে।

এই অপমানকর বন্দীত্ব বদিউলের কাছে মৃত্যুসম হয়েছিল। কদিন আগেই ছেলেকে বদিউল খাগড়ার মেলায় পাঠিয়েছিল ঘোড়া আর একটি উট কিনতে। ঘোড়া জিনকে তুষ্ট করার জন্য, আর উট কুরবানির জন্য। গ্রেপ্তারের সময় ছেলের সঙ্গে দেখা হল না। বদিউল একেবারে ভেঙে পড়ল।

এসব ঘটনার আগেই অবশ্য বদিউলের বৈঠকখানায় সালমার যাতায়াত শুরু হয়েছিল। বদিউলের ইয়ারেরা এই আশ্চর্য রমণীর খোঁজ পেয়েছিল যথাসময়েই। তাদের আবদারে শোভারাম সালমাকে ডেকে এনেছিল। মাঝেমধ্যেই বদিউলের বৈঠকখানার সালমার ডাক পড়ত।

বয়স্ক ইন্দ্রিয়পরায়ণ মানুষগুলোর মাঝখানে সালমা যেন ইন্দ্রাণী। বদিউলের ইয়ারেরা তার সঙ্গে নানা গোপন বিষয়ে আলোচনা করত, পরামর্শ নিত, ভাগ্যগণনা করাত এবং যৌবনকে ধরে রাখার পদ্ধতি-প্রক্রিয়া জানতে চাইত। এইসব সময় বদিউল ফরাসির নল নিয়ে চুপচাপ বসে মৃদু, মৃদু হাসত। নিজে কখনো ইয়ারদের সমক্ষে এসব লঘু বিষয় নিয়ে আলোচনায় যেত না। তীক্ষ্ম বুদ্ধি সালমার আলাপ করার ভঙ্গি, প্রতিপক্ষকে বোকা বানাবার কৌশল সে মনে মনে খুবই তারিফ করত।

ক্রমে সালমার সঙ্গে বদিউলের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়। বদিউল সালমার সাহচর্য ভালোবাসত এবং দু-জনে নিরালায় গল্পগুজব করে দীর্ঘ সময় কাটাত। এ ছিল নিতান্তই দু-জন বয়স্ক মানুষের আলাপ।

যেমন বদিউল বলত, কি আক্ষেপ বিবি, বয়সের সময় তোমার দেখা পেলাম at

সালমা, কেমন, মিয়া, বয়সের সময় পেলে কি সাদি করতে আমাকে?

সাদি বড় ছোট কথা বিবি, তাতে মম ভরে না।

বয়সটা কি এমন বেশি হয়েছে মিয়া? দেখই না একবার চেষ্টা করে এ বয়সেও প্রেম জমে কিনা।

হ্যাঁ, সেকথা তুমিই বলতে পারো, সালমা বিবি। বয়স তোমার পোষা পাখি, তুমি ডাক না দিলে আসবে না। নাকি, যৌবন তোমার পোষা পাখি, সদাই তোমার অঙ্গে লেপ্টে আছে?

কি কথাই শোনাও মিয়া। ধর একটু পান খাও।

এ অভ্যাসটি বদিউলের দান। বদিউল সালমাকে পানে তাম্বুলে জড়িয়েছে।

সালমা বলে, দেখ সাহেব, যৌবন বুড়োতেও চায়, যৌবন শিশুতেও চায়। কিন্তু বয়স্ক মানুষ যদি পিছন ফিরে নিজের যৌবনের দিকে তাকায় তো কি দেখে?

কি দেখে?

দেখে, সেথায় খালি ভুল আর চুক। খালি দুঃখ। সে দুঃখের আসান হওয়ার আগেই বয়সে টান ধরে ভাটির। সে ভুল শোধরাবার আগেই দেখ বয়স তোমাকে পৌঁছিয়ে দিয়েছে এমন জায়গায় সেখানে শোধরাও আর না শোধরাও তো বয়েই গেল।

আরে সেই তো মজা। সেই তো যৌবনের আসল জিনিস।

কি জানি, তোমরা সোনার পালঙ্কে শুয়ে মানিকের দানা খাও। তোমাদের কাছে বয়স বোধহয় এমনই মজার ছিল।

কি আক্ষেপ বিবি, বয়সের কালে তোমায় পেলাম না। এই তো পেয়েছ মিয়া, নেও না লুটে।

হাঃ, হা, ভালো বলেছ, এই তো পেয়েছি, নিই না লুটে, না? আরে এখন লুটবে কে? সে লুটেরার হদিশ পাই না বহুকাল।

এরকম সম্পর্ক হয় বদিউলের সঙ্গে। বালি বলেছিল, পিসি, এই সুযোগে বুড়োকে বলে কিছু জমিজমার সুরাহা করে নাও না আমাদের জন্যে। তোমার কথা তো শোনে বলে শুনেছি।

সালমা সম্পূর্ণ নিরাসক্তের মতো বলেছিল, বলে দেখব।

পরের দিন নিরালায় বদিউলকে সে বলেছিল, সাহেব, কিছু কাজের কথা আছে।

কাজের কথা? কী ভীষণ! সালমা বিবি–তুমি যে কাজের লোক একথা জানা ছিল না।

ঠাট্টা রাখ, সাহেব। সত্যিই কাজের কথা আছে।

কাজের কথা শুনে বদিউল গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। শেষে বলেছিল, দেখ তুমি আমাকে ভালো কাজের কথা আর কাজের লোক এই দুই ব্যাপার থেকে আমি সবসময় দূরে থাকি। সেজন্যই তো শোভারামের মতো কাজের লোক নায়েব রেখেছি। এখন তুমি যে সমস্যায় ফেললে এ নিয়ে অমাকে ভাবতে হবে, শোভারামের কাছে খোঁজখবর নিতে হবে, ভালোমন্দ বিচার করতে হবে, এত সব ব্যাপার। তার থেকে তোমার যদি কিছু টাকা পেলে চলে তো বল, এক্ষুনি তার বন্দোবস্ত করছি।

সালমা বলেছিল, আমার কিছু দরকার নেই, মিয়া। আমি যেমন আছি তেমনই থাকতে চাই। দরকার বাজিকরদের। তাদের মাথা গোঁজার ঠাই নেই, সারা দুনিয়ায় দাঁড়াবার মতো জায়গা নেই।

বদিউল তারপরে সায় দিয়েছিল। বলেছিল, ঠিক আছে, শোভারামের সঙ্গে কথা বলে যা হোক একটা ব্যবস্থা করব।

কিন্তু এসব কিছু করার আগেই বদিউল গ্রেপ্তার হয়ে যায় শোভারামের সঙ্গে। তার দিনকতক পরে খাগড়ার মেলা থেকে ঘোড়া আর উট নিয়ে ফেরে তার ছেলে। তিনটি সুদর্শন ঘোড়ার মধ্যে একটি এই দুলদুলি, ভারি লক্ষ্মীমন্ত এবং তেজি চেহারা।

ছেলে জামাল ফিরে এসে ভালো মুরুব্বি দিয়ে কলকাতায় বদিউলের মামলায় তদ্বির শুরু করল ভালোভাবে। রাজস্ব-বোর্ড কালেক্টরের কাজ অনুমোদন করল না। কেননা লাটসাহেবের বিরক্তিজ্ঞাপক চিঠি পেল কালেক্টর। বদিউল মুক্তি পেল সসম্মানে, কিন্তু শোভারাম মুক্তি পেল না। তার নিজস্ব সম্পত্তি নিলাম করে কালেক্টর বদিউলের বকেয়া কিস্তি পরিশোধ করে নিল।

জেল থেকে ফিরে আসার পর বদিউল কয়েকদিন বিশেষ কারো সঙ্গেই দেখা করল না। তার বন্ধুবান্ধবরাও এসে ঘুরে যেতে থাকল। কিন্তু সালমা আসে প্রতিদিন। সামান্য দু-চারটে কথা বলে বদিউল, অধিকাংশ সময়টাই দু-জনে চুপচাপ বসে থাকে।

সালমা বলে, সাহেব, নতুন সাদা ঘোড়াটা খুব পয়মন্ত ঘোড়া।

বদিউল তার বিশ্বাসমতো কথাটা সায় দেয়। বলে, হ্যাঁ, সেটা আমিও ভেবেছি। দেখ, ঘোড়াটা বাড়ি আসল, আর আমার উপর থেকে জিনের কুদৃষ্টি কেটে গেল। ও ঘোড়ার ইজ্জত দিতে হবে।

তারপর দুলদুলির জন্যে সমস্ত রাজকীয় ব্যবস্থা হয়।

বদিউল বলে, বাজিকরদের জমির ব্যাপারটা আমার মনে আছে। দু-একদিনের মধ্যেই নতুন নায়েবের সাথে কথা বলব ও নিয়ে।

সালমা বাধা দেয় তাকে। বলে, ওসব এখন থাক, মিয়া। আগে সামলে ওঠো, তারপরে দেখা যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *