৫১. মহান সাকির

৫১.

“আপনিই তাহলে মহান সাকির?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“মহান? হুম। শুনতে তো ভাললাই লাগছে।” ওপাশ থেকে জবাব এলো।

কার্ট এখনো তাকে পরিষ্কার দেখতে পায়নি। শুধু বোঝা যাচ্ছে লোকটা লম্বা। একহারা আর পাশে রাইফেল হাতে দুজন দাঁড়ানো।

“আপনি উঠে দাঁড়াতে পারেন,” সাকির বললো।

 “সেটা না করাই ভালো। দাঁড়ালে গুলি করা সহজ হবে।” কার্ট জবাব দিল।

কাটের কাছে একটা পিস্তল আছে কিন্তু ও এই মুহূর্তে মাটিতে শুয়ে আছে। আর ওর দিকে তাক করা দুটো রাইফেল। তাই কষ্টে-মষ্টে দু-একটা গুলি করতে পারলেও ওর পক্ষে জ্যান্ত ফেরা কখনোই সম্ভব হবে না।

“আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। আপনি এখন যেখানে আছেন সেখানেও সহজেই গুলি করা যাবে। এখন ভালো ছেলের মতো পিস্তলটা এদিকে ছুঁড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ান।”

কার্ট সাবধানে ভায়ালগুলো হাতের মধ্যে মুড়ে এমনভাবে পকেটে ঢোকালো যে ওর পিস্তল বের করতে পকেটে হাত দিচ্ছে। ভায়ালগুলো ওর ওয়াটার প্রুফ ব্যাগে ঢুকিয়ে পাশ থেকে পিস্তলটা বের করে আনলো। ও পিস্তলটা মেঝেতে রেখে একদিকে ঠেলে দিল। পিচ্ছিল মেঝেতে বেশ জোরেই ছুটে গেল ওটা। সাকির পা দিয়ে আটকালো ওটা।

ওটা হাতে তুলে নিয়ে আবার বলল, “উঠে দাঁড়ান।”

কার্ট আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। এখনো গুলি খায়নি দেখে অবাক হচ্ছে। সম্ভবত ও কীভাবে এখানে আসলো তা জানতে চায় আগে।

“আপনার বন্ধুরা কোথায়?” সাকির জিজ্ঞেস করলেন।

“বন্ধু? আমার কোনো বন্ধু নেই। খুব করুণ কাহিনী বুঝলেন? সেই ছোট্টবেলার কথা- “কার্ট বলতে গেলো কিন্তু সাকির থামিয়ে দিলেন,

“আমরা জানি আপনার সাথে আরো দুজন এখানে ঢুকেছে। ঐ দুজনকেই সবসময় আপনার সাথে দেখা গিয়েছে।”

সত্যিকথা হচ্ছে কার্টের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই জো আর রেনাটা কোথায়। সাকিরও ওদের খুঁজে পায়নি দেখে মনে মনে দারুণ খুশি হলো। ওরা সম্ভবত বিপদ টের পেয়ে কোথাও লুকিয়েছে। আবার হয়তো ওরা নির্দেশ মোতাবেক নিরাপদ জায়গায় সরে যাচ্ছে। তবে সে সম্ভাবনা কম। কার্ট সাকিরকে ওদের থেকে মনোযোগ সরাতে চাইলো, “শেষবার যখন দেখলাম তখন ওরা বাথরুম খুঁজছিল। বেশি বেশি কফি খাওয়ার ফল। জানেন-ই তো কি অবস্থা হয়।”

সাকির তার বাম দিকের লোকটার দিকে ঘুরে বলল, “পাশগুলো চেক করো হাসান। ওগুলোর কাজে সমস্যা হোক এমন কিছু যেন না হয়।”

“ও, হ্যাঁ।” কার্ট বলল। আপনি আর আপনার পাম্প। বুদ্ধিটা কিন্তু দারুণ। নকল পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প বানিয়ে তার আড়ালে যা ইচ্ছে তা করছেন। যদিও খুব বেশি দিন বুদ্ধিটা খাটবে না। মাথার ঘিলওয়ালা যে কোনো ইঞ্জিনিয়ারই আপনার ঐ প্রণালিটা দেখলে বুঝতে পারবে যে যতটানা পানি ঢুকছে তার চাইতে অনেক বেশি পানি বের হচ্ছে।”

“কিন্তু এখনও কেউ এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেনি। সবই আপনার অনুমান।”

কার্ট কাঁধ ঝাঁকালো, “বললাম-ই তো যে মাথায় ঘিলু থাকতে হবে। আমার চেয়ে হাজার গুণ বেশি বুদ্ধিমান লোক পৃথিবীতে আছে।”

সাকির কার্টকে সামনে এগুতে ইঙ্গিত করল, “তাতে কিছুই যায় আসে না। আর বেশিদিন এটা করা লাগবে না। তখন পানি উঠানোও বন্ধ হয়ে যাবে। তখন পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো তার আসল কাজটাই করবে। কেউ জানতেও পারবে না যে এটা আর কোনো কাজে ব্যবহৃত হতো। আর ততোদিন আপনিও মরে ভূত হয়ে যাবেন। আর আফ্রিকার বাকি অংশগুলোর মতো লিবিয়াও আমার অধীনে চলে আসবে।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও কার্ট সামনে বাড়লো।

“হাত”

কার্ট হাত নামিয়ে দুই কবজি এক করে ধরলো। সাকির ইঙ্গিত করতেই হাসান এসে ওর হাতে একটা চেনওয়ালা প্লাস্টিকের হাতকড়া পরিয়ে দিল।

“এত কিছু কেন করছেন?” ইনকিউবেশন রুমটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল কার্ট।

“ক্ষমতা। বহুদিন ধরেই জিনিসটা ব্যবহার করে অভ্যাস আমি তাই খুব ভালো মতোই জানি ক্ষমতাহীনতা কতটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। সে জন্যেই আমি আর আমার মতো কয়েকজন মিলে আবারো পুরো জিনিসটা শৃঙ্খলায় আনতে চাচ্ছি। আপনার তো কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত যে, কয়েকটা জংলী কুকুরের বদলে আমার সাথে এরপর থেকে আপনার দেশের লোকেরা সব কিছু করবে। আপনাদের মর্জি মতো কাজ করাও তখন অনেক সহজ হয়ে যাবে।”

কার্টরা ততোক্ষণে প্রথম দরজাটার কাছে পৌঁছে গিয়েছে, “মর্জিমতো কাজ? মানে কী ল্যাম্পেডুসার মতো পাঁচ হাজার লোককে একসাথে মেরে ফেলা? নাকি হাজার হাজার নিরীহ লিবিয়ানকে পানির অভাবে বা গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে মেরে ফেলা?”

 “ল্যাম্পেডুসার পুরো ব্যাপারটাই একটা দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা। দুর্ভাগ্যজনক আপনার জন্য কারণ ওটাই আপনাকে আমার কাছে টেনে এনেছে। আর লিবিয়ার গণহত্যা একটা তাড়না হিসেবে কাজ করবে। যতবেশি মানুষ মরবে তত দ্রুত এটা শেষ হবে। আর ইতিহাস গড়তে হলে কিছু রক্তপাত হয়ই। উন্নতির চাকায় সেটা গ্রিজের মতো কাজ করে।” সন্তুষ্টির সুরে বললেন সাকির।

শেষ দরজাটা দিয়ে বের হতেই দেখা গেল আরো কয়েকজন কালো পোশাক ধারী গার্ড দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। একজন সামনে এগিয়ে এসে কার্টকে কবজিতে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে একটা ATV-এর পিছনে আছড়ে ফেলল। সামনের সিটে দুজন গার্ড বসা।

“ওদেরকে

সাকিরের কথা শেষ হওয়ার আগেই ইঞ্জিন গর্জে উঠল তাই বাকিটা আর শোনা গেল না। এদিকে ড্রাইভারের সিটে বসা গার্ডটা গাড়ি চালু করেই গ্যাস পোেল চেপে ধরেছে।

বাই বাই করে ATv-টা উল্টোদিকে ঘুরে গেল। কার্ট ওটা থেকে ছিটকে পড়তে পড়তে সামলালো। মুহূর্ত পরেই সবাইকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে সুড়ঙ্গ দিয়ে ওটা হারিয়ে গেল।

“আটকাও ওদের।” কেউ একজন চিৎকার দিল।

সুড়ঙ্গের ভেতর গুলির আওয়াজ ভেসে এলো সাথে বুলেটগুলো এখানে সেখানে লেগে ফুলকি ছুটাতে লাগল। তবে ওদের গায়ে লাগলো না। কার্ট যতদূর সম্ভব নিজেকে ATv-র মেঝের সাথে মিশিয়ে রাখলো। খানিকক্ষণ পরে একটা মোড় পার হওয়ার পর গুলির শব্দ থামলে তারপর ও মাথা উঠালো।

সামনের সিটে জো আর রেনাটা সাকিরের গার্ডদের পোশাক পরে বসে আছে। রেনাটা ওর চুল একটা ক্যাপের নিচে ঢেকে রেখেছে।

“কেমন বাঁচা বাঁচলাম?” জো চিৎকার করে বলল।

“ শুরু হিসেবে ভালোই,” কার্ট জবাব দিল।

ব্যাপারটা আসলেই শুরু ছিল কারণ কয়েক সেকেন্ড পরেই দেখা গেল ও রকমই এক জোড়া ATV ওদের পিছু নিয়েছে।

“একটু অপেক্ষা করো বাছারা। এখুনি ব্যাটাদের দেখাবো কীভাবে আমরা ইতালির পাহাড়গুলোতে গাড়ি চালাই।” রেনাটা বলল।

ওর হাত আর পা দুটোই গাড়ি চালানোয় দারুণ দক্ষ। ও প্রথমে ATv টাকে একেবারে এক কোণায় নিয়ে গেল। এক চুলের জন্য লাগালো না দেয়ালে তারপর ঘুরে অন্য কোণার দিকে গিয়ে একটা সোজা সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে গেল।

কিন্তু পিছনের গাড়ি দুটো মোড়টা এতো দ্রুত ঘুরতে পারলো না। ফলে কার্টরা এগিয়ে গেল অনেক দূর। পিছনের ওরা তাই গুলি ছোঁড়া শুরু করল। কার্ট মাথা নিচু করে ফেলল। তবে রাস্তা এতো উঁচু-নিচু যে ওদের দিকে তাক করে লাগানো প্রায় অসম্ভব। ভাগ্য খুব খারাপ না হলে ওদের চিন্তা নেই। এই জিনিস যোগাড় করলে কীভাবে? আমিতো ভেবেছি তোমরা চলে গিয়েছে।” কার্ট বলল।

 “আমাদের কাপড় বদলানো শেষ হতেই বাইরে শব্দ শুনতে পাই। উঁকি দিয়ে দেখি সাকির কালো পোশাক পরা ওদেরকে কি সব আদেশ দিচ্ছে। আমরাও চুপি চুপি দলটার পিছনে গিয়ে দাঁড়াই।” জো বলল।

“জিনিয়াস। আরো একবার ঋণী করলে তুমি।” বলল কার্ট।

সামনে সুড়ঙ্গটা সরু হয়ে এসেছে। চারপাশের দেয়াল এখন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। হঠাৎই কিছু একটা লেগে ঝাঁকি খেয়ে ATV একেবারে শূন্যে উঠে গেল। ওরাও যার যার সিট ছেড়ে উঠে গেল ওপরে।

ঝাঁকি খেয়ে মাটিতে নামতেই দেখা গেল সামনে রাস্তা নেই।

 “সাবধান।”

রেনাটা সর্বশক্তি দিয়ে ব্রেক চেপে ধরলো আর ATv-টা মাটি ঘষে খানিকটা সামনে গিয়ে থামল। ও রিভার্স গিয়ার দিয়ে যেদিক দিয়ে এসেছে সেদিকে এগুলো আবার তারপর পাশের একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকে পড়ল। আসার সময় দেখেছিল এটা। ঢুকে প্রথমে একবার থামল, তারপর আবার গ্যাস পেডালে চাপ দিল। সুড়ঙ্গটা ক্রমেই নিচের দিকে নামছে। রাস্তা ভরা অসংখ্য নুড়ি পাথর।

সুড়ঙ্গটা আসলে বিশাল বড় একটা গুহা। সম্ভবত দীর্ঘদিন খোঁড়াখুড়ি করা হয়েছে এটায়। এটারও বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই।

“আমাদেরকে আবারো ওপরে উঠতে হবে।” সামনের এবড়োখেবড়ো দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল রেনাটা।

 ও গাড়ির মুখ ঘোরাতেই দেখা গেল সুড়ঙ্গের মুখটা দিয়ে ওদের পিছনের গাড়ি দুটোর হেড লাইট দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে।

“সম্ভব হবে না।” জো বলল।

রেনাটা গাড়িটা একপাশে নিয়ে হেডলাইট অফ করে দিল। প্রথম ATv-টা পাথর ভরা রাস্তাটা দিয়ে নেমে এলো। কিন্তু ওটার লাইট সোজা তাক করা থাকায় রেনাটা, জো বা কার্টকে দেখতে পেল না।

 দ্বিতীয় গাড়িটাও নেমে এলো। গাড়িটা সুড়ঙ্গ মুখ থেকে নিচে নেমে আসতেই রেনাটা গ্যাস পেডাল চেপে ধরে গাড়ি সুড়ঙ্গ মুখের দিকে ছোটালো। অর্ধেক রাস্তা পেরোতে ও আবার লাইট জ্বেলে দিল।

বার বার দিক বদল করায় মাটিতে টায়ার ঘষার অদ্ভুত শব্দ হতে লাগল তবে শেষমেশ ওরা আবারো আগের সুড়ঙ্গটায় ফিরে এলো। আবার আগের দিকেই ফিরছে।

পিছনের গাড়ি দুটোও হাল ছেড়ে দিল না। ওরাও পিছু নিলো দ্রুতই।

“জো, আমার হাত খুলে দাও।” কার্ট চেঁচালো।

জো পিছনে ফিরে কার্টের হাত টেনে ধরলো। তারপর প্লাস্টিকের হাতকড়াটার নিচে ছুরি বাঁধিয়ে দিল টান। প্লাস্টিক কেটে কার্টের হাত মুক্ত হয়ে গেল।

কার্ট পকেটে হাত ঢুকিয়ে ওয়াটার প্রুফ ব্যাগ থেকে ব্লাকমিস্ট ভরা প্যাকেটটা বের করল। তারপর সেটা খুলে একটা ভায়াল বের করল।

“আমি যা ভাবছি এটা কী সেই জিনিস?” জো জিজ্ঞেস করল।

“ব্লাক মিস্ট।” কার্ট জবাব দিল।

 পিছন থেকে আবার গুলির শব্দ পাওয়া গেল।

 “এখন কী করবো?” জো বলল।

“আমাদেরকে যারা ধরতে আসছে ওদেরকে ঘুম পাড়াবো।”

কার্ট ওদের গাড়ির যতদূর সম্ভব দূরের একটা দেয়ালে ভায়ালটা ছুঁড়ে মারলো। দেয়ালে লেগে এটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল আর ওর ভেতরের সবকিছু ছড়িয়ে পড়ল বাইরে। কয়েক মুহূর্ত পরেই দেখা গেল ওদের ধাওয়া করা গাড়ি দুটোর আলো আর সামনে এগুচ্ছে না।

 ভায়াল ভাঙ্গা এলাকাটা পেরুতেই প্রথম গাড়িটার মুখ একদিকে ঘুরে গিয়ে দেয়ালের গায়ে আছড়ে পড়ল। সাথে সাথে ওটা উল্টে একপাশে কাত হয়ে পড়ে গেল। দ্বিতীয় গাড়িটা সরাসরি এটার গায়েই বাড়ি খেলো আর সিটে থাকার লোকগুলো ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। আর উঠল না। রেনাটা তাতে বিন্দুমাত্র গতি না কমিয়ে আরো দূরে সরে গেল।

“ভালোই তো জিনিসটা।” জো বলল।

“আমার এটার সবটা ব্যবহার করতে পারবো না। যতদ্রুত সম্ভব এটা কোনো ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে” কার্ট জবাব দিল।

“সে জন্যই কি বরফে ঢাকা নাকি?”

“লোকটা বলেছে আট ঘণ্টার মধ্যে কাজে লাগাতে না পারলে এটা নষ্ট হয়ে যাবে।”

“এজন্য তার ধন্যবাদ প্রাপ্য।” জো বলল।

“লোকটা খারাপ ছিল না। বাধ্য হয়ে করেছে এসব।” কার্ট জবাব দিল।

সামনেই দেখা গেল সুড়ঙ্গ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। বাম পাশেরটার বাঁক দিয়ে আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে।

“শালার ব্যস্ততা থাকলে রাস্তায় জ্যাম লাগবেই।” বলল রেনাটা। তারপর ডানদিকে ঢুকে গেল। সুড়ঙ্গটা ধরে এগোতেই দেখা গেল এটাও দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে। রেনাটা বেশি চওড়া যেটা সেটা দিয়ে ঢুকে গেল। যাওয়ার পথে ছোট বড় আরো অনেক সুড়ঙ্গ পেরুতে হলো। কোনটা চলে গেছে ওপরে, কোনোটা নেমেছে নিচের দিকে।”

“প্রধান সুড়ঙ্গ থাকবে নিশ্চয়ই একটা।” জো বলল।

 “আমার মনে হয় আমাদের ওপর দিকেই যাওয়া উচিত। খনিটার একটা না একটা বের হওয়ার রাস্তা নিশ্চয়ই আছে।” কার্ট বলল।

“পাইপের ওখানে ফিরবো না?” রেনাটা বলল।

“ওদিকটায় এখন পাহারা থাকবে। হয় আমাদেরকে আরেকটা রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে। নয়তো ফারাওদের মতো অনন্তকাল এখানেই থেকে যেতে হবে।” বলল কার্ট।

.

৫২.

ইদো ছোট নৌকাটার গলুইতে দাঁড়িয়ে আছেন। একটা নাইট ভিশন গগলস দিয়ে নীলনদের চারপাশটা দেখছেন। জো আর ওর বন্ধুরা ওসাইরিস বিল্ডিংটায় ঢুকেছে কয়েক ঘণ্টা হয়ে গিয়েছে।

 পয়তাল্লিশ মিনিট আগে হেলিকপ্টারটাও চলে গিয়েছে। পানি বিদ্যুতের প্রণালিটার পানি এখন আর স্থির নেই। ভীষণ স্রোত ওখানে, কিন্তু ওদের এখনো দেখা নেই।

একেকটা সেকেন্ড যাচ্ছে আর ইদোর দুশ্চিন্তা ততোই বাড়ছে। জোর জন্য তার দুশ্চিন্তা হচ্ছে অবশ্যই, তবে সাবেক মিলিটারির মানুষ হিসেবে তিনি ভালোই জানেন ব্যর্থ অভিযানের বিপদটা কি। এতে করে পাল্টা আঘাত খাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় বহুগুণ।

যদি ওদের কেউ ধরা পড়েই যায় তাহলেই সর্বনাশ। যতক্ষণ পর্যন্ত না সব স্বীকার করবে ততোক্ষণ ওরা অত্যাচার করতেই থাকবে। ইদোর নামও বলে দেবে নিশ্চয়ই। ওদের জন্যেই তার আজ এই বিপদ। খুন, গ্রেপ্তার, জেন যেকোনো কিছুই হতে পারে তার। আর যদি এমন কিছু নাও হয় তাহলেও তো যেই লাউ সেই কদুই থেকে যাবে। তাকে আবার তার দুলাভাইয়ের ডেরায় ফিরে গিয়ে চামচাগিরি করতে হবে। মনে হচ্ছে এই চক্র থেকে তার মুক্তি নেই।

ভাগ্যটা তার অন্য সবার চাইতেই খারাপ।

হঠাৎই তার মনে হলো আর দেরি করা যাবে না। উনি বিভিন্ন জায়গায় ফোন করা শুরু করলেন। ফোনগুলো জো যখন প্রথম এসেছিল তখনি করা উচিত ছিল। কিন্তু তার পুরনো বন্ধুরা তাকে প্রথমে পাত্তা দিল না।

“বোঝার চেষ্টা করো, “মিসরের সন্ত্রাসবিরোধী ব্যুরোয় কর্মরত এক বন্ধুকে বোঝনোর চেষ্টা করছেন উনি। “আমার কাছে খোঁজ-খবর আসে এখনো। আমার পরিচিত অনেকেই আছে যারা তোমার মতো লোকদের সাথে কথা বলতে ভয় পায়। আমার কাছে খবর আছে যে সাকির ইউরোপের দেশগুলোতে হামলা চালাবে।

ল্যাম্পেডুসার ঘটনাটাও সে-ই ঘটিয়েছে। লিবিয়াতে যা হচ্ছে তার পিছনেও সাকির আর ওসাইরিস দায়ী। এখনি কিছু না করতে পারলে মিসরও ওদের হাত থেকে রক্ষা পাবে না।”

নানান পদের লোকদের সাথে ইদো কথা বলতে লাগলেন। প্রাক্তন গেরিলা, বা বর্তমান সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, রাজনীতিবিদ কেউই বাদ গেল না। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো তাদের সবার প্রতিক্রিয়া হলো একই।

“সাকির আর ওসাইরিস যে বিপদজনক তা আমরা জানি, কিন্তু কী করার আছে?”

“আমাদেরকে ঐ প্লান্টে ঢুকতে হবে। যদি আমরা প্রমাণ করতে পারি যে আসলেই ওরা কি করছে, তাহলে সবাই আমাদের পক্ষে চলে আসবে, আর সেনাবাহিনী আরো একবার দেশটাকে রক্ষা করতে পারবে।”

কথা শুনে ওপাশ নীরব হয়ে গেল। তবে ইদো হাল ছাড়লেন না। আবার পুরো ব্যাপারটা ধৈর্য নিয়ে বোঝানো শুরু করলেন। কাজ হলো তাতে। সবাই তার কথার গুরুতু ধরতে পারলো।

“যা করার এখনি করতে হবে। সূর্য ওঠার আগেই। সকাল হতে হতে দেরি হয়ে যাবে।” ইদো জোর করলেন। একে একে তারা রাজি হতে লাগল।

স্পেশাল কমান্ডো দলের দায়িত্বে থাকা এক কর্ণেল ওকে সাহায্য করতে রাজি হলেন। কয়েকজন রাজনীতিবিদ প্রতিশ্রুতি দিলেন তারা কাজটাকে সমর্থন দেবেন। আভ্যন্তরীণ সিকিউরিটিতে কর্মরত এক বন্ধু কমান্ডো দলটার সাথে আরো কয়েকজন এজেন্টকে পাঠাবে বলে কথা দিল।

সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পেয়ে ইদের মন ফুর্তিতে ভরে গেল। যদি ব্যাপারটায় কাজ হয়। যদি ওনি এই অভিযানের নেতৃত্ব দিতে পারেন তাহলে নতুন মিসরের তিনিই হবেন হিরো। আর যদি লিবিয়ার সংঘাতটাও এতে থামে তাহলে পুরো উত্তর-আফ্রিকাতেই তার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। কিংবদন্তী হয়ে যাবেন তিনি। কে জানে হয়তো দেশের পরবর্তী নেতাও হয়ে যেতে পারেন।

“জায়গামতো এসে আমাকে জানাবেন। আমি নিজে অভিযানে নেতৃত্ব দেবো।” ইদো বললেন ফোনে।

 এদিকে পাঁচ মাইল দূরেই মাটির নিচে তারিক সাকির তার রাগ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। মাত্রই ঘটে যাওয়া ঘটনাটায় তিনি ভয়ানক ক্রোধান্বিত হয়ে আছেন। নিজের লোকের সামনে অপমানিত হয়েছেন। তিনি রাগটা ঝাড়ার জন্য হাসানকেই বেছে নিলেন।

একবার ভাবলেন গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেবেন। ওর কিন্তু কার্টদেরকে খোঁজার জন্যে হাসানকে দরকার।

হাসান স্প্রিং লাগানো গাড়ির মতো ছুটে গেল। কয়েকজনকে খুঁজতে পাঠিয়ে আরো লোক জোগাড়ের ব্যবস্থা করতে লাগল। কয়েকটা ATv সাথে সাথে ছুট দিল সুড়ঙ্গের ভেত। আরো লোকজন আসামাত্র হাসান তাদেরকেও বিভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দিল।

কয়েক মিনিট পর এক ATuর ড্রাইভার ফিরে এসে হাসানকে কিছু একটা বলে আবার বিদ্যুৎবেগে সুড়ঙ্গ দিয়ে ফিরে গেল।

“কি হয়েছে? কী বলল?” সাকির জিজ্ঞেস করলেন।

“ওদের দেখা পাওয়া যায়নি তবে আমাদের দুটো ATv বিধ্বস্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। কীভাবে ও দুটো অ্যাকসিডেন্ট করল তা বোঝা যাচ্ছে না। অন্য দুটো দল ওদেরকে উদ্ধার করতে গেলে সে দুটোও বিধ্বস্ত হয়েছে।”

“রাক মিস্ট, শয়তানগুলো ব্লাকমিষ্ট নিয়ে পালিয়েছে। ঘটনাটা ঘটেছে কোথায়?” সাকির জিজ্ঞেস করলেন।

“এখান থেকে মাইল তিনেক দূরে। উনিশ নম্বর সুড়ঙ্গে।”

সাকির ম্যাপে তাকালেন। “উনিশ নম্বরে তো বের হওয়ার রাস্তা নেই।”

হাসান মাথা ঝাঁকালো, ড্রাইভার ওকে আগেই বলেছে সে কথা।” বিধ্ব ATv-গুলোর মুখ এদিকেই ঘোরানো। ওটার একটু পরেই সুড়ঙ্গটা দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে। যেহেতু ওরা এদিক দিয়ে আসেনি, তার মানে ঐ সুড়ঙ্গটা ধরেই উঠে গিয়েছে। সুড়ঙ্গটা মেইন হলে গিয়ে মিশেছে।”

“মেইন হল? ওটাতো একটা ওক গাছের কাণ্ডের মতো। ওটা থেকে কমপক্ষে পঞ্চাশটা সুড়ঙ্গ বেরিয়েছে। প্রতিটা শাখা থেকে আবার কয়েক ডজন উপ-শাখাও আছে।” সাকির বললেন।

হাসান মাথা ঝাঁকালো আবার, “ওরা এখন কোথায় আছে বলা সম্ভব না।”

সাকির আর সামলাতে পারলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে হাসানের কলার টেনে উ করে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরলেন, “তিনবার! তিন তিনবার তুমি ওদেরকে মেরে ফেলার সুযোগ পেয়েছিলে। তিন বারই তুমি ব্যর্থ হয়েছ।”

‘সাকির। আমার কথাটা শোনেন।” হাসান মিনতি করল।

“এখুনি ওদের খুঁজে বের করো। প্রতিটা লোককে ওদের পিছনে পাঠাও।”

 “ওদেরকে খুঁজে বের করা সম্ভব না।” হাসান বলার চেষ্টা করল।

 “আমি কিছু শুনতে চাই না।”

“খামাখা লোকজন মারা পড়বে। আপনি খুব ভালো মতোই জানেন যে সুড়ঙ্গগুলো কতটা লম্বা। আপনিই একটু আগে পিওলাকে বললেন যে শতশত সুড়ঙ্গ আর গুহা এখনও আবিষ্কারই করা সম্ভব হয়নি।” হাসান বলল।

“আমাদের প্রায় দুশো লোক আছে।” সাকির বললেন।

“কিন্তু প্রতিটা দলই একা একা খুঁজবে। এখানে রেডিও কাজ করে না। ওরা নিজেরা বা আমাদের কারো সাথেই যোগাযোগ করতে পারবে না। ফলে কাজ কতটুকু হলো বা ওদের পাওয়া গেল কি-না কিছুই জানা সম্ভব হবে না।

“তুমি কি বলতে চাইছ যে আমরা ওদেরকে কিছু না করেই ছেড়ে দেবো?” সাকির কাটা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।

“হ্যাঁ।” হাসান বলল।

ভেতরে ফুঁসতে থাকা প্রচণ্ড রাগ সত্ত্বেও সাকির বুঝলেন হাসান আসলে অন্য কিছু একটা বোঝাতে চাচ্ছে। “তোমার মতলবটা কী বলো?”

“এখান থেকে বের হবার মাত্র পাঁচটা রাস্তা আছে। এর মধ্যে দুটো আমাদের পাম্পিং স্টেশনের নিচে কানো আর সে দুটোতে যথেষ্ট পাহারা আছে। বাকি তিনটার পাহারা বসালেই হয়ে যাবে। এই গোলোক ধাঁধার মতো ওদেরকে ধাওয়া করার চেয়ে সব অস্ত্রধারী লোককে বের হওয়ার রাস্তাগুলোর মুখে বসিয়ে দিলে ওরা নিজে থেকে এসে আমাদের জালে ধরা পড়বে। চাইলে একটা মিসাইল ওয়ালা হেলিকপ্টারও পাহারায় বসাতে পারেন।”

পরিকল্পনাটা সাকিরের কাছে যৌক্তিক মনে হওয়ায় তিনি হাসানকে ছেড়ে দিলেন। আর যদি দেখা যায় আরো কোনো রাস্তা আছে। যেসব সুড়ঙ্গ আমরা এখনও পরীক্ষা করিনি সেগুলো দিয়ে যদি থাকে কোনোটা?”

হাসান মাথা নাড়লো, “গত এক বছর ধরে আমরা এসব সুড়ঙ্গ চষে বেড়াচ্ছি। আমরা যা খুঁজে পাইনি তা ওদের পক্ষে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বরং পথ হারিয়ে এদিকে সেদিকে ঘুরে সুড়ঙ্গের ভেতরেই পড়ে থাকার সম্ভাবনা বেশি। আর যদি তারপরও ওরা এমন কোনো রাস্তা পায় যেটা আমরা খুঁজে পাইনি তাহলে নিশ্চয়ই ওরা হোয়াইট ডেজার্টে গিয়ে পড়বে। আর তাহলে ওদেরকে খুঁজে পাওয়া তো হবে আরো সহজ। আর আমাদের বের করা কোনো রাস্তা দিয়ে বের হলে তো কথাই নেই। সাথে সাথে ধরা পড়বে।”

 “না। আমি ওদেরকে আর জ্যান্ত দেখতে চাই না। আমি স্বচক্ষে ওদের বুলেটে বিদ্ধ লাশ দেখতে চাই।” সাকির বললেন।

“আমি এখুনি ব্যবস্থা করছি।” হাসান নিজের জ্যাকেট ঠিক করতে করতে বলল।

“ঠিক আছে। তবে একটা কথা হাসান। এবার যদি কোনো গড়বড় হয়। তাহলে যা হবে তা কিন্তু তোমার ভালো নাও লাগতে পারে।” বললেন সাকির।

.

৫৩.

রেনাটা একেবারে ফর্মুলা ওয়ান ড্রাইভারের মতো গাড়ি চালাতে লাগল। কিন্তু কিছুদূর পরেই আবার সুড়ঙ্গ সরু হয়ে আসায় গতি কমাতে বাধ্য হলো। নানান জলে রাস্তাটা ভরা। ওগুলোর ওপর দিয়েই যাওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু মেঝে আর ছাদের মধ্যে ফাঁক এতোটা কমে এসেছে যে আর এগুতে পারলো না।

পিছনে তাকিয়ে ATv-টা আবার সরিয়ে আনলো ওখান থেকে।

“আমার মনে হয় ওরা আর আমাদের পিছু নিচ্ছে না। কার্ট বলল। রেনাটা ততোক্ষণে আবার আরেকটা পথে সামনে এগুচ্ছে। ওর কথা শুনে একবার পিছনে তাকাল। পিছনে কোনো লাইট দেখা যাচ্ছে না। রেনাটা ইঞ্জিন বন্ধ করতেই অন্ধকার আর নীরবতা এক হয়ে মিশে গেল।

“শুধু ওরাই পথ হারায়নি আমরাও। মনে হয় না জীবনেও আর কোনোদিন এখান থেকে বের হতে পারবো না। কোথায় যে আছি সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই।” বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল রেনাটা।

“আমরা পথ হারাইনি, শুধু অবস্থান সম্পর্কে অবগত না এই যা।” কৌতুকের সুরে বলল কার্ট।

রেনাটা ওর দিকে তাকিয়ে থাকল এক সেকেন্ড তারপর ফেটে পড়ল হাসিতে।

 “অবস্থান গতভাবে?” জো বলল।

“হ্যাঁ, সুন্দর না শব্দটা?’ কার্ট জবাব দিল।

রেনাটা ATV-টা ঢালু জায়গাটা থেকে সমতলে নামিয়ে আনলো। জো লাফ দিয়ে নামলো গাড়ি থেকে, “ঐ পাথরের ওপাশে কী আছে দেখে আসি।” কার্টও নেমে সামনের দিকে চলে এলো, “দারুণ গাড়ি চালান তো আপনি! কোত্থেকে শিখেছেন?”

“আমার বাবা শিখিয়েছেন। লাইসেন্স পাওয়ার আগেই যেসব পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে আমি গাড়ি চালিয়েছি তা যদি আপনি দেখতেন!” জবাব দিল রেনাটা।

 কার্ট হাসলো, “এই ঝামেলাটা শেষ হলেই আপনার সাথে গিয়ে দেখে আসবো।” জো ততোক্ষণে পাথরের স্তূপটার ওপরে পৌঁছে গিয়েছে। ওটার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে লাইট মেরে ওপাশটা দেখছে। “দারুণ জিনিস তো”, বলল ও।

“বের হওয়ার কোনো রাস্তা পাওয়া গেল নাকি না?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

 “সম্ভবত মোটর পুলটা খুঁজে পেয়েছি।”

কার্টের ভ্রু কুঁচকে গেল। “কি বলছে বুঝলাম না।”

“নিজেই দেখে যাও। না দেখলে জীবন বৃথা।” জো জবাব দিল।

কার্ট আর রেনাটাও স্তূপটার ওপর উঠে জোর পাশে উপুড় হয়ে শুলো। তারপর নিচে আলো ফেলতেই দেখে সেখানে নানান জাতের গাড়ি দিয়ে ভরা। সেগুলোর ওপর লম্বা লম্বা কাপড় দিয়ে ঘেরা, কোনো ছাদ নেই। আর চাকাগুলো এতো বড় যে প্রায় গাড়িরই সমান উঁচু। দুই পাশে নানান ধরনের যন্ত্রপাতি লাগানো। আর সামনের আর পেছনের দুই সিটের মাঝখানেই দুটো ভারি মেশিনগান বসানো।

“কি এগুলো হামভি (High Mobility Multipurpose Wheeled Vehicle) নাকি?” জিজ্ঞেস করল রেনাটা। | ওটার সাথে মিল কিছুটা আছে।” হামভির পূর্বপুরুষ। দেখে মনে হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পাওয়া গনীমতের মাল।” বলল জো।

সবার আগেই কাটই সামনে বাড়লো। হামাগুড়ি দিয়ে স্তূপটা পেরিয়ে গুহার অপর পাশে নেমে এলো, “দেখে আসা যাক।”

খোলা জায়গাটা প্রায় একটা বিমানের হ্যাঁঙ্গারের সমান বড়। ভেতরে সাতটা কিম্ভুত দর্শন গাড়ি। দেয়ালের জায়গায় জায়গায় সিমেন্টের পট্টি মারা। আর ছাদকে ধসে পড়া থেকে রক্ষা করার জন্য এখানে সেখানে স্টিলের খুঁটি গাড়া।

গাড়িগুলো দেখে কেমন যেন যুদ্ধংদেহী মনে হয়। বিশাল চাকা আর ঢালু চাদোয়া দেখেই বোঝা যায় যে এগুলো রাস্তা না, বরং নরম বালির ওপর দিয়ে চলার উপযোগী করে বানানো হয়েছে। বন্ধ অবস্থায়ও বোঝা যাচ্ছে যে এগুলোর গতি ভালোই। ইঞ্জিন পিছনের দিকে। সেদিকের ধাতব পাতের জায়গায় জায়গায় ছিদ্র করা, যাতে বাতাস ঢুকে এটাকে ঠাণ্ডা রাখতে পারে।

কার্ট একটা গাড়ির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে হাত দিয়ে ঘষে এটার গায়ের ধুলো সরিয়ে ফেলল। কেমন তামাটে একটা রঙ নিচে। ঠিক মরুভূমির রঙ যেমন হয় সেরকম। আরো খানিকটা ঘষতেই ওটার নাম্বার আর একটা ছোট পতাকা দেখা গেল একপাশে। সবুজ, সাদা আর লাল, মাঝখানে একটা রুপালি ঈগল। রঙটা ইতালির পতাকার রঙ। আর মাঝখানের ঈগলটার মানে হলো যুদ্ধের পতাকা।

“গাড়িগুলো ইতালিয়ান।” কার্ট বলল।

 “তাই নাকি?” অবাক হয়ে বলল রেনাটা।

“আরো একটা পতাকা চোখে পড়ল কার্টের। কালো জমিনের মাঝখানে অদ্ভুত একটা নকশা। কয়েকটা কাঠি আর তার সাথে একটা কুঠার। কুঠারের ঠিক মাথায় একটা সিংহের মাথা।

রেনাটাও ওর পাশে বসে ওটার ওপর আলো ফেলল, “ফ্যাসিবাদীদের পতাকা। মুসোলিনি ব্যবহার করতো এটা।” চিনতে পেরে বলল রেনাটা।

“ব্যক্তিগত পতাকা?” কার্ট বলল।

“না, এরা ইতালিয়ান সৈন্য বাহিনীরই একটা অংশ আর জোর কথা মতো কাজ করতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়।”

“সাহারিয়ানাস, জো গাড়ির অন্যপাশ থেকে চিৎকার করে বলল।

“গেসুন্ধতি,” বলল কার্ট।

“না ওটা বাহিনীর নাম না। এই গাড়িগুলোকে এই নামে ডাকতো ওরা। লম্বা দূরত্বে সামরিক অভিযান চালানোর জন্যে ব্যবহৃত হতো এগুলো। পুরো উত্তর-আফ্রিকাতেই চলছিল এগুলো। তোবক থেকে এল আলামিন পর্যন্ত সব জায়গাতেই।” বলল জো।

“তা এত পূর্বে এগুলো কীভাবে আসলো? ইতালিয়ন সৈন্যদল কখনো কায়রোর আশেপাশে এসেছে বলে তো শুনিনি।”

“হতে পারে যে অগ্রবর্তী কোনো বাহিনীর অংশ ছিল এটা। এগুলোর কাজই ছিল এটা। আগে আগে গিয়ে রেকি করা আর শত্রুদের অবস্থা যাচাই করা। “জো বলল।

 ওরা পুরো রুমটা ভালো করে খুঁজে দেখলো। কিছু খালি ক্যান, স্পেয়ার পার্টস, অস্ত্রপাতি আর খুচরো যন্ত্রাংশ খুঁজে পেল।

“এ দিকে” রেনাটা ডাক দিল।

এক কোণায় দুটো গাড়ির পেছনে আছে ও। ইতালিয়ান সেনাবাহিনীর পোশাক পরা একটা লাশ পড়ে আছে সেখানে। একটা নোংরা বিছানার চাদরের ওপর শোয়ানো ওটা। মরুভূমির পরিবেশের কারণে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। মুখটা বীভৎসভাবে হা হয়ে আছে। হাড্ডিসার আঙুলগুলোর ওপর চামড়া আছে এখনও, সেটায় আবার একটা পিস্তল ধরা। লাশটার পাশেই খানিকটা ছাই আর অর্ধেক পোড়া একটা কাগজ পড়ে আছে।

কার্ট অর্ধেক পোড়া কাগজটা পরীক্ষা করল। খানিকটা পড়া যাচ্ছে এখনও। তবে ভাষাটা ইতালিয়ান। তাই ওটা রেনাটার দিকে বাড়িয়ে ধরলো।

“আদেশপত্র, সম্ভবত একে এগুলো ধ্বংস করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।” বলল রেনাটা।

“কিছু পড়া যাচ্ছে না?” রেনাটা ওর আলোটা আরো ভালো করে কাগজটার ওপরে ফেলল, “জড়ো করে ধ্বংস করো…তার আগেই ঝামেলাটা শেষ… “আর পড়তে পারছি না।”

“যুদ্ধের আদেশ।”

রেনাটা কাগজগুলো কার্টকে ফেরত দিয়ে পাশেই পড়ে থাকা একটা বই তুলে নিলো। খুলতে দেখা গেল ওটা আসলে বই না। ব্যক্তিগত ডায়রি। বেশির ভাগ পাতাই ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। শুধু শেষ পাতায় আনা-মেরি নামে একজনকে লেখা একটা বিদায় সম্ভাষণ বাদে আর কিছুই নেই।

 “পানি প্রায় শেষ। তিন সপ্তাহ হলো এখানে এসেছি। যদিও কোনো খবর পাইনি তবে ধারণা করছি যে ইংরেজরা রোমেলকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য এত কিছুর পরও যুদ্ধ করতে চাচ্ছিলো। কিন্তু আমি ওদেরকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। খামাখা মরে কোনো লাভ নেই। সৈন্যরাতো তাও আত্মসমর্পণ করার সুযোগ পায়। আমরা ধরা পড়লে গুপ্তচর হিসেবে সাথে সাথে গুলি করা হবে।”

 “এনাকে দেখে তো সাধারণ সৈন্য বলেই মনে হচ্ছে। দেখামাত্র গুলি করা হবে কেন?” জো মন্তব্য করল।

“হয়তো বা শসীমানার অনেক বেশি ভেতরে চলে এসেছিলেন তাই।” জবাব দিল কার্ট।

“তাহলে বাকিদের বাড়ি পাঠালেন কীভাবে? গাড়িগুলোই বা এখানে কেন?” জোর প্রশ্ন।

রেনাটা বাকি পাতাগুলোও উল্টেপাল্টে দেখলো। এই প্রশ্নের জবাব ওখানে লেখা নেই।

“আর কিছু লেখা নেই?”

“হাতের লেখা পড়া যাচ্ছে না ঠিক মতো। প্রতিদিনই আশপাশে সাজোয়া গাড়ি বহরের আওয়াজ পাই। তবে এখনো আমাকে খুঁজে পায়নি কেউ। তবে শেষ পর্যন্ত ধরা না পড়েই পালাতে পারবো কি-না জানিনা। আমি সুড়ঙ্গটা ধসিয়ে দিয়েছি। ইংরেজদেরকে আমাদের গাড়িগুলো পেতে দেবো না। যতই ভাবছি ততোই খারাপ লাগা বাড়ছে। আমাদের পক্ষেই কিছু করা সম্ভব ছিল। শুধু যদি তেল কম এনে বেশি বেশি পানি আনতাম তাহলেই হতো। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকে সারাক্ষণ। নাক আর কান দিয়ে রক্ত পড়ে। মাঝে মাঝে ভাবি পিস্তলটা দিয়ে এই যন্ত্রণার অবসান ঘটাই কিন্তু তাতেও তো পাপের বোঝা আরও বাড়বে। এমন যদি হতো যে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, আর জাগলাম না। কিন্তু প্রতিবারই চোখ বুজলেই একটা স্বপ্নই শুধু দেখি–ঠাণ্ডা পানি। সাথে সাথে ঘুম ভেঙে দেখি এই শুষ্ক বিরান ভূমিতে পড়ে আছি। আমি এখানেই মরবো। তৃষ্ণায় ধুকে ধুকে মরে যাবো আমি।”

“এরপর আর লেখা নেই।” ডায়রিটা বন্ধ করতে করতে বলল রেনাটা।

কার্ট একটা লম্বা শ্বাস নিলো। এই গোপন আস্তানা আর অদ্ভুত গাড়িগুলোর রহস্য আপাতত আর জানা যাবে না। ওদের নিজেদেরই এখন ঝামেলার শেষ নেই। আর এই চিঠিটা পড়ে ওদের সমস্যার রূপটা কার্টের মনে আরো নগ্নভাবে ধরা দিল।

“খুশির খবর হচ্ছে, আশেপাশে নিশ্চয়ই বের হওয়ার কোনো রাস্তা আছে। না হলে গাড়িগুলো এখানে আনতে পারতো না। আর খারাপ খবর হচ্ছে। আমাদের এই নির্ভীক যোদ্ধা বন্ধুটা সেই রাস্তাটা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে যাতে করে ইংরেজরা সেটা খুঁজে না পায়।” কার্ট ঘোষণা দিল।

 “রাস্তাটা খুঁজে বের করতে পারলেও হয়। একটা না একটা উপায় বের হবেই।” বলল রেনাটা।

“হয়তো, তবে কেন যেন মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হবে না।” বলল কার্ট। বাকি দুজনই কার্টের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন ওর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। কার্ট ইতালিয়ান সৈন্যটার লাশটাকে ইঙ্গিত করে বলল, “উনি কিন্তু গোলাগুলির ভয় করছিলেন। আমাদেরও একই জিনিস নিয়ে চিন্তা করা উচিত। খেয়াল করে দেখেছ, আমাদের ধাওয়াকারীরা যেন ইচ্ছে করেই আমাদের পিছু আসা বন্ধ করে দিয়েছে। এটার শুধু দুটো কারণ হতে পারে। হয় এদিক দিয়ে বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই, না হয় রাস্তা আছে আর সাকিরের লোকজন সেখানে অস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছে। ঠিক খরগোশের গর্তের বাইরে বসে নেকড়ে যেমন ঠেটি চাটে সেরকম “।

 জো একটা সমাধান দিল, “এখানে তো যথেষ্ট অস্ত্র আর গোলাবারুদ আছে। যদি এগুলোর কোনোটাকে আবার চালু করা যায় তাহলে বোমা মেরেই তো আমরা ওদেরকে উড়িয়ে দিতে পারবো। ওরা যদি বাইরে অপেক্ষা করেই তাহলে ওরা আশা করছে একটা ATV। এরকম একটা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত গাড়ি ওদের কল্পনারও বাইরে।”

‘বুদ্ধিটা অবশ্যই দারুণ। তবে আমরা কিন্তু এর মধ্যেই ওদের যথেষ্ট ক্ষতি করেছি। ওরা ইতোমধ্যেই জানে যে আমাদের কাছে ব্লাক মিস্ট আছে। তার মানে ওরা ওদের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে আমাদেরকে আটকানোর। ওদের অবশ্য আর কোনো উপায়ও নেই। তোমার বন্ধু ইদো তো বলেছেনই যে ওদের নিজস্ব সেনাবাহিনী আছে। তার মানে হয়তো ওদের ট্যাঙ্ক, হেলিকপ্টার, বিমান সবই আছে। তাই এরকম একটা অস্ত্রসজ্জিত গাড়ি দিয়েও আমাদের তাই কোনো লাভ হবে না।”

জো চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালো। কার্ট বলে চললো।

“তার ওপর আমি লিবিয়ার ব্যাপারটা নিয়েও ভাবছি। পুরো শহরের পানি নেই। হাজার হাজার মানুষ পানির অভাবে ভুগছে। এই সৈন্যটার মতো ওরাও পানির অভাবে ধুকে ধুকে মরবে।”

“কোনো মৃত্যুই আরামের না। কিন্তু পানির অভাবে মারা যাওয়াটা সম্ভবত সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম। অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দেয়। চোখ অন্ধকার হয়ে যায়। কিন্তু মানুষটা মরেও না। কষ্ট পেতেই থাকে।”

কার্ট মাথা ঝাঁকালো। “আমরা যে দিক দিয়ে এসেছি সেদিকে ফিরে যাই আর সাথে কয়েকটা বোমা নিয়ে যাই। তাহলে ঐ পাইপ লাইন বা পাম্পগুলো উড়িয়ে দিতে পারবো।”

 জো’র বুদ্ধিটা পছন্দ হলো। তবে ও কার্টের পিছু পিছু জাহান্নামে যেতেও রাজি।

“ওরা কোনোদিন চিন্তাও করবে না যে আমরা এদিক দিয়ে আসবো।”

“আর এগুলো কোনো ল্যাবে নিয়ে যাওয়ার কী হবে?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল। কার্ট জবাব দিল, “ব্রাড গোলনার আরো একটা ল্যাবের কথা বলেছিল। তাই যদিও আমরা বের হওয়ার রাস্তাটা খুঁজে পাই। আর বোমা মেরে সাকিরের সব সৈন্যকে উড়িয়ে দিয়ে পালাতেও পারি তার পরেও এটাকে আমাদেরকে একটা মেডিকেল টীমের কাছে এটা নষ্ট হওয়ার আগেই পৌঁছে দিতে হবে।”

রেনাটা বাকিটা বলল, “যদি আমরা সময়মতো এটা পৌঁছাতে পারি। এমন কোনো গ্যারান্টি নেই যে ওরা সাথে সাথে এটার প্রতিষেধক বের করে ফেলতে পারবে। সর্বোচ্চ যেটা হতে পারে তা এটার উপাদানগুলো সনাক্ত করে গবেষণা শুরু হবে। আর তা থেকে ফলাফল পেতে কয়েক মাস অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকবে না।”

“আর আপনিই-ই বলেছেন ল্যাম্পেডুসার ওরা আর মাত্র কয়েকদিনই বাঁচবে।” বলল কার্ট।

রেনাটা মাথা ঝাঁকানো, “কয়েকজন হয়তো মারাও গিয়েছে।”

কার্টও সেটাই ভেবেছিল। বাচ্চা, বৃদ্ধ আর যারা অসুস্থ ছিল আগেই তাদের বেশিদিন টিকে থাকার কথা না।

“তার মানে আবারও সিংহের খাঁচাতেই?” জো বলল।

 কাট মাথা ঝাঁকালো।

 “তো যাওয়া যাক।” বলল জো।

“ঝুঁকিটা অনেক বেশি। কিন্তু ঝুঁকি নিলে এটাই নেয়ার মতো মনে হচ্ছে। আমার কাছে।” বলল রেনাটা।

কার্ট অবশ্য এটাকে ঝুঁকি নেয়া না ভেবে হিসেবী পদক্ষেপ ভাবছে।”

“আমাদের পক্ষে কিন্তু একটা জিনিস আছে। ওরা যদি বেশির ভাগকেই বের হওয়ার রাস্তায় পাহারা বসায় তাহলে নিচে এখন সামান্য কিছু লোকই থাকবে।”

“আমাকে কয়েক ঘন্টা সময় দিলেই আরো একটা জিনিস আমাদের পক্ষে এনে দিতে পারবো।”

“কি জিনিস?”

 “আমাদের নিজস্ব সাহারিয়ানা।”

কার্ট দাঁত বের করে হাসলো। জো জাভালো বাদে অন্য কেউ কথাটা বললে কার্ট তাকে সময় নষ্ট করতে মানা করতো। কিন্তু কারিগরি ব্যাপার স্যাপারে জোর দক্ষতা একজন শিল্পীর মতোই। যদি সাহারিয়ানাকে আবার চালু করা যায়, তাহলে জো-ই পারবে।

.

৫৪

ভূমধ্যসাগরের কোথা

কার্টের নির্দেশ পাওয়ার পরও পল আর গামায়ের বেনগাজী থেকে রওনা দিতে আরো চব্বিশ ঘণ্টা দেরি হয়ে যায়। কারণ অব্যাহত সংর্ঘষের কারণে এয়ারপোর্টে বিমান ওঠা-নামা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। পাইলটরা জালে আটকানো ট্রাউট মাছের মতোই পালানোর জন্য হাশফাস করছিল। বিমানে তেল-টেল ভরে শুধু ওড়ার অপেক্ষা। শেষমেশ এক ঘণ্টা হয় ওরা উড়তে পেরেছে। এখন বিমানটা ভূমধ্যসাগরের ওপরে। পানি থেকে প্রায় সাইত্রিশ হাজার ফুট ওপরে।

চ্যালেঞ্জার ৬৫০ বিমানটার কেবিনটা অনেক বড়, ইদানীংকালের বিমানগুলোতে এ রকমটা দেখা যায় না। দেখতে তাই বিমানটাকে বেশ বেটপই দেখায়, তবে পল-এর মতো লম্বা মানুষের জন্য বিমানটা বেশ মানানসই।

“ঐ ভাঙ্গা চোরা DC-3’র চাইতে এই বিমানটাই বেশি ভালো।” ঘোষণা করল পল।

“কি জানি। ঐ বিমানটায় অন্য রকম একটা আকর্ষণ আছে। কেমন একটা প্রাচীন আবহ।” গামায় জবাব দিল।

“প্রাচীন আবহ না ওটা হবে আবহ।”

ওরা এখন মুখোমুখি ক্রীম রঙের দুটো সোফায় বসে আছে। পায়ের কাছে বিচিত্র নকশা কাটা। পুরু একটা কার্পেট। সেটা এতোই নরম যে ওরা জুতো পর্যন্ত খুলে ফেলেছে।

 ওরা নিজেদের ল্যাপটপ খুলে সামনের ট্রে টেবিলে রাখলো, তারপর NUMA’র গোপন ওয়েব সাইটে প্রবেশ করল।

পল বলল, “আমি ভিয়েনেভের ইতিহাস নিয়ে ঘেটে দেখি। কোনো সূত্র-টুত্র পাই কি-না সে দ্য শ্যাম্পেনদের পাঠানো কাগজগুলো দিয়ে কি করেছিল।”

গামায় মাথা ঝাঁকালো, “আর আমি এদের মধ্যে যেসব চিঠিপত্র চালাচালি বা যোগাযোগ কি কি হয়েছিল খুঁজে দেখি। আশা করি কলেজে পড়া ফ্রেঞ্চ দিয়েই কাজ চলে যাবে, না হলে ট্রান্সলেশন প্রোগ্রাম ব্যবহার করতে হবে।”

নীরব কেবিন আর তিন-চার ঘন্টার ফ্লাইট ওদেরকে টানা কাজ করার ভালোই সুযোগ করে দিল। কাজের মাঝামাঝি গামায় ওর দু পা-ই সিটের ওপর ভাজ করে বসে চুল টেনে পিছন দিকে বেঁধে নিলো, ঠিক যেন কেউ তার ফাইনাল পরীক্ষার জন্য কোমর বেঁধে পড়তে বসেছে।

 পলও ওর ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে তাকাল। “এরকম ঘটনাবহুল একটা জীবন আর ইতিহাস বদলে দেয়ার মতো বিভিন্ন ভূমিকার পরও অ্যাডমিরাল ভিয়েনেভ সম্পর্কে কোথাও খুব বেশি কিছু লেখা নেই।”

“কি কি জানতে পারলে?”

“অভিজাত পরিবারের সন্তান। মেরি আন্তোইনেট আর বাকিদের সাথে গিলোটিনে কাটা পড়ার কথা ছিল কিন্তু উনি আগে আগেই বিপ্লবের সমর্থন দেয়ায় বেঁচে যান আর নৌবাহিনীতেও তার অবস্থান অক্ষুণ্ণ থাকে।”

“মানুষ পটানোর ওস্তাদ ছিলেন সম্ভবত।” গামায় মত দিল।

“সম্ভবত। আবুকির উপসাগরের ঘটনাঘটার পর ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়েন। তারপর তাকে ফ্রান্সে ফেরত পাঠানো হয় আর তার বিরুদ্ধে কাপুরুষতার অভিযোগ আনা হয়। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে নেপোলিয়ন তার পক্ষ নেন। তাকে ভাগ্যবান বলে অভিহিত করেন আর কোর্ট মার্শালের পরিবর্তে তাকে ভাইস অ্যাডমিরাল পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।”

গামায় সিটে হেলান দিল, “ভাগ্য একেই বলে!”

“হ্যাঁ, চিন্তা করো শুধু তার চুপচাপ বসে থাকার কারণেই কিন্তু মিসরে এভাবে নেপোলিয়নের পরাজয় ঘটে।”

“সম্ভবত তার হাতে এই অস্ত্রটা থাকার কারণেই তার ভাগ্যটা এত ভালো ছিল। তুমিতো জানোই আবুকির উপসাগরের পাশের একটা শহরেই কিন্তু রোসেটা পাথরটা উদ্ধার হয়। দ্য চ্যাম্পিয়নের চিঠিতে বেশ কয়েকবার উদ্ধার করা পুরাকীর্তিগুলোর কথা উল্লেখ আছে। সেগুলোর বর্ণনায় প্রায়ই তিনটা ভাষার শিলালিপির কথা জানা যায়। ঠিক রোসেটার মতোই। দ্য শ্যাম্পেন প্রথম যে জিনিসটা অনুবাদ করার চেষ্টা করেছিলেন সেটায় কিন্তু ওসাইরিসের মৃত দেহ আবার জীবিত করার ক্ষমতার কথা সম্পর্কে লেখা ছিল। এমনওতো হতে পারে যে প্রথমবার ছাড়া পাওয়ার পর থেকেই ভিয়েনেভ নেপোলিয়নকে এই “অস্ত্রটার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিল।” গামায় বলল।

পলও ব্যাপারটায় সম্মত হলো, “তবে শুধু প্রতিশ্রুতি দেয়া পর্যন্তই। ভাইস অ্যাডমিরাল পদে উন্নীত হবার পর আবার আরেক যুদ্ধে গিয়ে আবারও শোচনীয় পরাজয় করলেন। তারপর আবারো নেপোলিয়নের কাছে ফিরে বললেন যে, এবার “অস্ত্রটা তাকে দেবেন-ই।”

“মিথ্যেবাদী রাখালের মতো। গামায় বলল।

 “হ্যাঁ, সেজন্যেই নেপোলিয়ন আর তার কথায় কান দেননি।”

গামায় মাথা ঝাঁকালো। “কিন্তু ভিয়েনেভ কিন্তু হাল ছেড়ে দেননি এরপরও। তার চিঠিতে বারবার ভাগ্য আর নিয়তির কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। কেমন বেপরোয়া কথাবার্তাও আছে। শেষবারের মতো নিজের কাহিনী নতুন করে লেখার এটাই ছিল সুযোগ। কিন্তু একদম শেষ চিঠিটায় দেখা যায় ভিয়েনেভ প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে নেপোলিয়ন আর তাকে বিশ্বাস করেন না।”

“সেটা কবে পাঠানো হয়েছিল?”

 “উনিশশো জার্মিনাল, ১৪। তার মানে হলো ৯ এপ্রিল ১৮০৬।”

 “মরার মাত্র দুই সপ্তাহ আগে।”

“নেপোলিয়নের এ ধরনের কাজ করতে আটকাতো না। যাকেই তার মনে হতো তার ক্ষমতার জন্যে হুমকিস্বরূপ তাকেই তিনি সরিয়ে দিয়েছেন। ইংল্যান্ড দখল করা যখন সম্ভব হলো না তখন তিনি রাশিয়া দখল করার চেষ্টা করছিলেন। কোনো কারণ ছাড়াই। ইচ্ছে হয়েছে তাই। সেখানেও তাঁর শোচনীয় পরাজয়ই হয়। কিন্তু শুধু ভিয়েনেভের এই “অস্ত্রের ব্যাপারটাই সম্ভবত নেপোলিয়ন সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সহ্য করে আসছিলেন।”

বলে গামায় নিজের ঘড়ি দেখলো, “নামার সময় হয়ে এসেছে। কোত্থেকে শুরু করলে ভালো হয় বলে তোমার মনে হয়?”

পল জোরে শ্বাস ফেলল, “ভিয়েনেভের কাগজপত্র কোনো লাইব্রেরিতে রাখা নেই। তার নামে কোনো জাদুঘর বা স্মৃতিস্তম্ভও নেই। শুধু বিশ বছরের পুরনো কয়েকটা পেপার কাটিং পেয়েছি। ক্যামিলা ডুশেনে নামের এক মহিলার বিজ্ঞাপন সেটা। সে তার গ্রামের বাড়িতে কিছু চিত্রকর্ম আর কাগজপত্র খুঁজে পেয়ে বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপনটা দিয়েছিল। ওগুলো নাকি ভিয়েনেভ আর আরো কয়েকটা সম্ভ্রান্ত পরিবারের সাথে সম্পর্কিত।”

“ওগুলোর কী হয়েছে?” গামায় জিজ্ঞেস করল।

“সবাই ভুয়া বলেই উড়িয়ে দিয়েছে। কারণ ভিয়েনেভ যে ছবি আঁকতে পারেন। এ কথা কারো জানা নেই। তবে মজার ব্যাপার হলো ডিয়েনেভ মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত যে বোর্ডিং হাউজে থাকতেন সেটার মালিক হচ্ছে ঐ মহিলার পূর্বপুরুষ।” পল জবাব দিল।

গামায় কিছু বলার আগেই ইঞ্জিনের আওয়াজ বদলে গেল আর বিমান নিচে নামা শুরু করল। পাইলটের গলার আওয়াজ শোনা গেল স্পিকারে, “আমরা রেনে’র কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি। আর ১৫ মিনিটের মাঝেই আমরা ল্যান্ড করবো।”

“তার মানে ম্যাডাম ডুশেনেকে খুঁজে বের করার জন্য আমাদের হাতে সময় আছে পনের মিনিট।” পলই প্রস্তাব দিল।

“আমিও ঠিক এটাই ভাবছিলাম।”

.

৫৫.

সূর্য ওঠার কিছু পরেই পল আর গামায় একটা গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিল। বিভিন্ন ডাটাবেস ঘেটে ওরা ক্যামিলা ডুশেনের ঠিকানা খুঁজে বের করেছে। এখন পল গাড়ি চালাচ্ছে আর গামায় ম্যাপ দেখে বলে দিচ্ছে কোন দিকে যেতে হবে। কারণ রাস্তাটা ভয়ানক রকম আঁকাবাকা আর সরু।

এমনিতেই এরকম একটা প্যাচানো রাস্তায় গাড়ি চালানো মুশকিল, তার ওপর আবার চারপাশে কুয়াশা। হঠাৎ উল্টোপাশ থেকে একটা ট্রাক ওদের পাশ কাটাতে যেতেই পল ভয় পেয়ে পাশের জমিতে নামিয়ে দিল।

গামায় পারলে ওকে দৃষ্টি দিয়েই ভস্ম করে দেয়।

“ওদিকটা একটু দেখে আসলাম আরকি!” দেঁতো হাসি হেসে বলল পল। শেষমেশ ওরা শহরের মাঝামাঝি পৌঁছালো। পল তাড়াতাড়ি গাড়ি পার্ক করে বলল, “বাকি পথটা হেঁটেই যাই চলল।”

 গামায়ও নেমে বলল, “সেটাই ভালো। নিরাপদে পৌঁছাতে পারবো তাহলে।” ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে ওরা একটা ভেজা নুড়ি পাথর বিছানো রাস্তায় এসে উপস্থিত হলো। ওটার শেষ মাথায় একটা ছোটখাটো দুর্গের মতো বাড়ি। রাস্তার দুপাশে দুটো বাঁকানো টাওয়ার। সেটা আবার একটা দেয়াল দিয়ে যুক্ত। তার মাঝে একটা ছোট দরজা। সেটা দিয়েই চলাচল করতে হয়।

“পাটের্স মরডেলাইসেস, দেয়ালের লেখা পড়তে পড়তে বলল গামায়। দরজাটা পার হতেই ওদের মনে হলো ওরা বোধহয় মধ্যযুগীয় কোনো শহরে এসে পড়েছে। অবশ্য একদিক দিয়ে সেটা সত্যিও বলা যায়। ওরা এখন আছে রেনের সবচেয়ে প্রাচীন অংশে। আর পোর্টেস মরডেলাইসেস হচ্ছে এখানকার শহরটার গুটিকয়েক টিকে থাকা ধ্বংসাবশেষের একটি।

সরু রাস্তাটা ধরে হেঁটে হেঁটে ওরা ওদের ঠিকানা মতো এসে পৌঁছালো। মাত্র ভোর হয়েছে। কিন্তু দরজায় নক করতেই পল সদ্য বানানো পাউরুটির ঘ্রাণ পেল। তার মানে বাড়িতে কেউ না কেউ জেগে আছে।

“পেট তো মোচড় দিয়ে ওঠলো। গত বারো ঘণ্টায় কিছু খাইনি।” বলল পল। দরজা খুলে দিলেন এক বৃদ্ধা-মহিলা। সব চুল সাদা হয়ে গিয়েছে। সম্ভবত নব্বই এর ঘরে বয়স। পরিপাটি পোশাক পরনে। গায়ে একটা শাল জড়ানো। ঠোঁট গোল করে ওদেরকে দেখতে লাগল।

“বনজোর, পুইস-জে ডৌস আইদ্যর?” মহিলা জিজ্ঞেস করলেন।

 জবাব দিল গামায়, “বনজোর, এতেস-ভৌস মাদাম ডুশেনে?”

 “ওই। পোরকুয়োই?” মহিলা বললেন।

গামায় অ্যাডমিরাল ভিয়েনেতের চিঠি সম্পর্কে আগে থেকেই ফ্রেঞ্চ ভাষায় কি বলবে ঠিক করে এসেছে। সেটাই বলল ধীরে ধীরে।

ম্যাডাম ডুশেনে মাথা কাত করে ওর কথা শুনলেন, “আপনি তো ভালোই ফ্রেঞ্চ বলেন। আমেরিকানদের মাঝে এমনটা দেখিনি। আপনারা তো আমেরিকান তাই না?” ইংরেজিতেই বললেন উনি।

“হ্যাঁ।” ইউরোপে আমেরিকানদের খুব একটা সুনজরে দেখা হয় না, সেটা গামায় জানে। কিন্তু ওদের বিদেয় না করে মাদাম ডুশেনে হেসে ওদেরকে ভেতরে যেতে বললেন।

“আসেন ভেতরে। আমি মাত্রই নাস্তা বানানো শেষ করলাম।”

গামায় পল-এর দিকে তাকাল, ওর হাসি দুকান ছাড়িয়েছে। আপনার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক।”

ম্যাডাম ডুশেনের রান্নাঘর থেকে যে সুবাস ভেসে আসছে তা অতুলনীয়। মাত্র সেকা পাউরুটি ছাড়াও তাজা এপ্রিকট, কালোজাম আর ভ্যানিলা শোভা পাচ্ছে টেবিলের ওপর।

“প্লিজ বসুন। আমার কাছে খুব একটা কেউ আসে না এখন। আপনাদেরকে দেখে ভালো লাগছে।” ম্যাডাম ডুশেনে বললেন।

ওরা রান্নাঘরেই ছোট একটা টেবিলে বসলো। আর ম্যাডাম ডুশেনে চুলার কাছে এগিয়ে ডিম ফেটা আরম্ভ করলেন। কাজের ফাঁকেই কথা বলছেন টুকটুক করে।

“আমার প্রথম স্বামীও ছিলেন আমেরিকান। সৈন্য। তার সাথে যখন দেখা হয় তখন আমার বয়স পনের। জার্মানিদের উচ্ছেদ করতে এসেছিল সে সৈন্য দলের সাথে…কালো জাম?”

“ম্যাডাম ডুশেনে। একটু অদ্ভুত শোনালেও আসলে হয়েছি কি আমরা খুব তাড়াহুড়ার মধ্যে আছি” গামায় বাধা দিল ওনার কথায়।

“কালোজাম অবশ্যই খাবো।” পল আবার বাধা দিল গামায়কে। আরো একবার পলকে ভস্ম করল গামায়। কিন্তু পলের মধ্যে এবার কোনো বিকার দেখা গেল না, “এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই।” নিচু স্বরে বলল পল। তা শুনে ম্যাডাম ডুশেনে কাজে ফিরে যেতেই আবার বলল, “নাস্তা তো করা লাগতোই। তাই না? এখানেই না হয় করলাম।”

গামায় কিছু না বলে চোখ সরিয়ে নিলো।

“কালো জাম স্বাস্থ্যের জন্যে খুবই ভালো। দীর্ঘ আয়ুর জন্যে কালোজাম খুবই উপকারী।” ম্যাডাম ডুশেনে বললেন।

“হুম! তবে যদি বৌ আগেই খুন করে ফেলে সেটা ভিন্ন কথা।” উনি না শোনার মতো করে বলল গামায়।

পল দাঁত বের করে হাসলো তারপর ম্যাডাম ডুশেনেকে বলল, “আপনার স্বামী সম্পর্কে কী যেন বলছিলেন?”

“ওহ! উনি ছিলেন সম্বা, দেখতেও বেশ! আপনার মতোই।” পলের দিকে ঘুরে বললেন ম্যাডাম ডুশেনে। কণ্ঠস্বর ছিল গ্যারি কুপারের মতো। অবশ্য আমার মতো এতোটা ভারি ও না।”

গামায় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিন্তু কিছু বলল। কেউ যদি তার স্বামীকে তেল দিতেই চায়, তাহলে নব্বই বছরের এক ফ্রেঞ্চ বৃদ্ধা হওয়াই নিরাপদ। তাছাড়া গামায় নিজেও ক্ষুধার্ত। আর মহিলা যদি পলকে পছন্দ করেই তাহলে আরো ভালো। সহজেই ওরা যেটা জানতে এসেছে সেটা বের করতে পারবে।

নাস্তার পর গামায় আসল কথাটা পাড়লো।

“আমার দাদার কাছে ছিল চিঠিগুলো। উনি অবশ্য ওগুলো সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলেননি…” ম্যাডাম ডুশেনে বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। অবশ্য নিজের বাড়িতে কাউকে যদি ছুরি দিয়ে মারা হয় তাহলে সে কথা কে-ই বা বলতে চায় বলুন। আর ভিয়েনেভেরও সুখ্যাতির চেয়ে কুখ্যাতিই ছিল বেশি।”

 “কিন্তু আপনি তো ওগুলো বেচতে চেয়েছিলেন, তাই না?” গামায় জিজ্ঞেস করল।

“অনেক বছর আগে। টাকা-পয়সার দরকার পড়েছিল খুব। আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর ভয়ানক দুদর্শায় পড়ে যাই আমরা। তখনকার দিনে ঐতিহাসিক জিনিসের খুব কদর ছিল। নেপোলিয়নের সাথে সম্পর্কিত যে কোনো কিছুরই তখন খুব চাহিদা। এমনকি নেপোলিয়নের মাত্র একবার ব্যবহৃত ছুরিও দশ হাজার ফ্রান্তে বিক্রি হতো।”

“আর সেজন্যেই আপনি চিঠিগুলো বেচতে চান?” পল অনুমান করল।

“ওই। আমি ভেবেছিলাম। নিলামে সেগুলো বিক্রি করতে পারলে আমরা বেঁচে যাবো। কিন্তু তা আর হলো না। সবাই বলল আমরা নাকি ভণ্ড আর এসব কিছুই ভুয়া। একবার কেউ পরীক্ষা করেও দেখলো না।”

“দ্য চ্যাম্পিয়নের কাছে লেখা ভিয়েননেভের অন্য আরো চিঠি আমাদের কাছে আছে। যদি হাতের লেখা মিলে যায় তাহলেই প্রমাণ হবে যে আপনার চিঠিগুলো আসল।” পল বলল।

ম্যাডাম ডুশেনে হাসলেন, “এখন আর এ দিয়ে কি হবে বলুন। আমি তো ওগুলোকে দিয়ে দিয়েছি।”

গামায়ের বুকটা ধড়াস করে উঠল, “কাকে?”

“একটা লাইব্রেরিকে। সাথে কয়েকটা পুরনো বই আর ছবিও দিয়েছি।

 “ পল ঘড়ির দিকে তাকাল, “লাইব্রেরিটা কী খুলেছে এতক্ষণে?”

ম্যাডাম ডুশেনে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন, “খোলার সময় হয়ে গিয়েছে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “একটু বসুন আপনাদেরকে দুপুরের খাবার প্যাকেট করে দেই।”

ক্যামিলা ডুশেনে যে লাইব্রেরিটার কথা বলেছেন সেটা চারতলা। ফ্রেঞ্চ ইতিহাসের ওপর দুষ্প্রাপ্য বইগুলোর সংগ্রহ হচ্ছে এটার বিশেষত্ব। লাইব্রেরির পাশেই একটা খাল। রেনের মাঝ বরাবর চলে গিয়েছে খালটা। তবে ওটা একসময় প্রমত্তা নদী ছিল। নিয়মিত বন্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য দুপাড়ে বাঁধ দেয়া। সেটাও কয়েকশো বছর আগে। ইউরোপের অনেক পুরাতন শহরের মতোই এখানেও নদীর প্রাকৃতিক পাড়ের কিছু অবশিষ্ট নেই বললেই চলে।

লাইব্রেরির লোকেরা মিশুক না হলেও সাহায্য করল যথাসম্ভব। এদের সাহায্য করার জন্য আলাদা একজন লোকই দিয়ে দেয়া হলো। সে ওদেরকে লাইব্রেরির একদম পিছনের একটা অংশে নিয়ে এলো। ম্যাডাম ডুশেনের দান করা জিনিসগুলো এখানেই রাখা।

 “কাগজগুলোর তাও কিছুটা দাম আছে, ছবিগুলোর দাম একদমই নগণ্য। ওগুলো একদমই আনাড়ি হাতের কাজ। যুদ্ধক্ষেত্রের দৃশ্য। কেউই বিশ্বাস করে না যে ওগুলো ভিয়েনেভের আঁকা। কারণ তিনি ছবি আঁকতে পারতেন না। আর ওগুলোতে কোনো স্বাক্ষরও নেই।” বলল লোকটা।

“তাহলে ওগুলো রেখেছেন কেন?” জিজ্ঞেস করল গামায়।

“কারণ দান করার সময় এই শর্তটাই দেয়া হয়েছিল। আমাদেরকে ওগুলো কমপক্ষে একশো বছর সংরক্ষণ করতে হবে না হয় ম্যাডাম ডুশেনে বা তার উত্তরাধিকারীকে ফেরত দিতে হবে। আর যেহেতু ওগুলো আসলে কারা তা পুরোপুরি প্রমাণ হয়নি তাই ওগুলো দেয়াটাই সমীচীন মনে হয়েছে আমাদের কাছে। লোকটা বলল।

“হ্যাঁ, পুরনো ভাঙ্গারির দোকানেও মাঝে মাঝে দামি জিনিস পাওয়া যায়।” মন্তব্য করল পল।

“ভাঙ্গারির দোকান” নাক সিটকে বলল লোকটা। তার উচ্চ শিক্ষার সাথে সম্ভবত শব্দটা যায় না।

“কেন? আপনাদের দেশে বাতিল ভাঙ্গা-চোরা জিনিসপত্র কোথায় কেনা বেচা করেন? আমেরিকায় তো অনেক আছে।”

“তা তো থাকবেই।”

গামায় বহু কষ্টে হাসি আটকে বইগুলো দেখায় মনোযোগ দিল। টলেমিক গ্রিক ভাষার একটা রেফারেন্স বই দেখা গেল। মিসরের বহু ত্ৰিভাষীয় শিলালিপিতে এই ভাষাটা পাওয়া গিয়েছে। ব্যাপারটা বেশ আশার, কারণ ভিয়েনোত আর দ্য শ্যাম্পেন মিসরীয় ভাষা অনুবাদ করার চেষ্টা করছিলেন। পরের বইটা এক ফ্রেঞ্চ লেখকের যুদ্ধের ওপর লেখা প্রবন্ধ সংকলন। এই লেখকের নাম গামায় জীবনেও শোনেনি। বইটা উল্টেপাল্টে দেখলো কিন্তু ভেতরে কোনো হাতের লেখা বা কোনো আলগা কাগজ পাওয়া গেল না।

 “চিঠিগুলো কোথায়? বাকি কাগজপত্র” গামায় জিজ্ঞেস করল। লোকটা আরেকটা বই বের করল। এই বইটা পাতলা আর ওপরের কাভারটা বেশ আধুনিক। অনেকটা ফটো অ্যালবামের মতো। তবে প্রাস্টিকের ভেতর ছবির বদলে প্রায় দুইশো বছরের পুরাতন চিঠিপত্র রা। ওগুলোর কালি শুকিয়ে মলিন হয়ে গিয়েছে। ঝরনা কলম বা কে জানে পালকের কলম দিয়ে হয়তো লেখা হয়েছে এগুলো।

“মোট পাঁচটা চিঠি–সতেরো পাতা। সবই আছে এখানে। লোকটা ব্যাখ্যা করল।

গামায় একটা চেয়ার টেনে বসে লাইট জ্বেলে দিল। তারপর একটা নোটপ্যাড আর কলম বের করে পড়া শুরু করল। ফ্রেঞ্চ ভাষায় লেখা থাকার কারণে পড়তে . বেশ সময় লাগছে। আর বাক্যগুলোও কেমন যেন বড় বড়। অনেক অসংলগ্ন কথাবার্তা ভেতরে যেগুলো হয়তো তখনকার দিনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল। গামায় ওটা পড়া শুরু করতেই পল বলল, “ছবিগুলো কী আমি দেখতে পারি?”

“অবশ্যই।” বলল লোকটা।

আরো খানিকটা সামনে এগিয়ে লোকটা বিশাল একটা আলমারির সামনে এসে দাঁড়ালো। চাবি দিয়ে দরজা খুলতেই ভেতরে বিভিন্ন সাইজের অনেক ছবি দেখা গেল। লম্বাভাবে তাকের ওপর জড়ো করে রাখা।

“সব ভিয়েনেভের আঁকা?”

“না, তিনটা। তবে আবারো বলছি তার কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই।”

 পলের ব্যাপারটা মনে আছে। তবুও সে ভিয়েনেভের আঁকা হতেও পারে’ ছবিগুলো দেখতে ইচ্ছুক।

লোকটা প্রথম তিনটা ছবিই তুলে আনলো। সাধারণ কাঠের ফ্রেমের মাঝে বসানো। সব ফ্রেমই পুরাতন আর রং চটা।

“এগুলোই আসল ফ্রেম?” পল জিজ্ঞেস করল।

“অবশ্যই। ছবির চাইতে সম্ভবত ওগুলোর দামই বেশি।” লোকটা বলল।

 পল একটা লাইট জেলে ওগুলো দেখতে লাগল। তেল রঙ দিয়ে আঁকা ছবিগুলো, মোটা ব্রাশ দিয়ে আঁকা তবে রঙের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। এলোমেলো।

প্রথম ছবিটায় একটা কাঠের যুদ্ধজাহাজের তিন-চতুর্থাংশ দেখা যাচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শিল্পীর ছবি আঁকায় কোনো দক্ষতাই নেই। ছবিটা পুরো দ্বি-মাত্রিক লাগছে।

পরের ছবিটা একটা রাস্তার। কুয়াশা আর ধুলোয় ঢাকা একটা গলির রাতের বেলার ছবি। তার দুপাশে অদ্ভুত রঙের কয়েকটা দরজা। সবই বন্ধ। কোন জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। ওপরের ডান দিকের কোণায় তিনটা ত্রিভুজ দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হয় দূরের কোনো দ্বীপ।

তৃতীয় ছবিটা সাম্পানের ওপর কয়েকজন লোকের। সবাই প্রাণপণ নৌকা বাইছে।

ছবিগুলো মিনিটখানেক দেখার পরই পল বুঝলো আনাড়ি বলতে আসলে লোকটা কী বুঝিয়েছে। হঠাৎ সামনে কোথাও থেকে লোকটাকে কেউ ডাক দিল।

“আমি এখানে মাতিল্ডা।” লোকটা জবাব দিল। তারপর পলের দিকে ফিরে বলল, “আমি এখুনি আসছি।”

 পল মাথা ঝাঁকালো। লোকটা চলে যেতেই ও গামায়ের কাছে চলে এলো, “চিঠিগুলোয় কিছু পেলে নাকি?”

“তেমন কিছু না। এগুলো আসলে চিঠি কি-না সেটাই বুঝতে পারছি না। তারিখ আছে কিন্তু কে কাকে পাঠাচ্ছে কিছু লেখা নেই। এমনকি আমার এইটুকু ফ্রেঞ্চ ভাষার জ্ঞান নিয়েও বুঝতে পারছি এগুলো আসলে এলোমেলো কিছু লেখা ছাড়া কিছুই না।”

“ডায়রির মতো?” পল মত দিল।

“আমার কাছে পাগলের প্রলাপের মতো লাগছে। যেন নিজের সাথে নিজেই কথা বলছে। একই কথা বারবার।

 গামায় এখন যে চিঠিটা পড়ছে সেটা দেখিয়ে বলল, “এই চিঠিটায় শুধু নেপোলিয়নের সমালোচনা আর গালাগালি। উনি নাকি রিপাবলিককে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে ফেলছেন।”

আগের কয়েকপাতা উল্টিয়ে আরেকটা চিঠি দেখিয়ে বলল, “এই চিঠিটায় উনি নেপোলিয়নকে বলছেন, “আন পেটিট হোমে সার আন গ্রান্ড শেভাল মানে হলো বিশাল ঘোড়ার পিঠে এক তালপাতার সেপাই।”

“খামাখা তো আর সাতবার তাকে ছুরি মারা হয়নি।” পল বলল।

“আমিও সেটাই ভাবছি।” গামায়ও সম্মত হলো। তারপর আরেকটা চিঠি বের করে বলল, “এটায় লেখা নেপোলিয়ন নাকি ফ্রান্সের চরিত্র নষ্ট করছেন। আর উনি নাকি একটা বুদ্ধ। আরও লেখা, “আমি তার জন্য এতো কিছু করলাম আর তার বদলে উনি আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আমি কি দিতে পারি তা কি উনার জানা নেই? খোদর গযবের মতোই সত্যটা সবাই দেখতে পাবে।”

“খোদার গযব?” পল বলল আবার।

গামায় মাথা ঝাঁকালো। “খারাপ কাজ করার জন্য। ঠিক যেমন একজন বৃদ্ধাকে তার প্রয়াত স্বামীর কথা মনে করিয়ে দিয়ে চামে তার কাছ থেকে নাস্তা আদায় করা।”

“তাতে আমার কোনো আফসোস নেই। গত কয়েক সপ্তাহের ভেতর সেরা খাবার ছিল ওটা। কিন্তু আমার মাথায় অন্য জিনিস ঘুরছে। এদিকে দেখে যাও।”

পল গামায়কে ছবিগুলোর কাছে নিয়ে আসলো। “দেখো।”

গামায় ছবিগুলো এক নজর দেখে বলল, “দেখলাম।”

“খোদার গযব।”

“ওটা কি কোনো জাহাজের নাম? আমি বুঝতে পারছি না তুমি কী বলতে চাচ্ছ।”

পল রাস্তার ছবিটা দেখালো। “গযব।” তাওরাতে এমনটাই আছে। ঐটা হলো মিসর। তিনটা ঘোট ঘোট ত্রিভুজ হলো তিনটা পিরামিড। দরজাগুলো লাল রঙ করা। সম্ভবত রঙের প্রতীক হিসেবে ওগুলো আঁকা। ভেড়ার রক্ত। আর রাস্তার এগুলো ভেবেছিলাম ধুলো। এগুলো আসলে ধুলো না। এটা হলো মহামারী। ফারাওরা যখন ইসরায়েলীদের মুক্তি দিতে অস্বীকার জানালো তখন এই মহামারী দেখা দেয়। এই মহামারীতে মিসরের প্রতিটা পরিবারের প্রথম সন্তান মারা যায়। শুধু যারা দরজায় ভেড়ার রক্ত লেপে দিয়ে ছিল তারা বাদে।” তারপর নিচের দিকে দেখিয়ে বলল, “এখানে দেখো। ব্যাঙ। এটা সম্ভবত ছিল দ্বিতীয় মহামারী। আর এখানে দেখ পঙ্গপাল। এটাও একটা মহামারী।”

পল কি বলছে বুঝতে পেরে গামার-এর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ও চিঠির বইটা নিয়ে এসে জোরে জোরে পড়তে আরম্ভ করল। “লা ভেরিটে সেরা রিভিলি–সত্যটা সবাই দেখতে পাবে- “আ লুই কমে লা কলেরি ডি ডিউ-খোদার গযবের মতোই।”

 “উনি কি যা আঁক ছিলেন তাই লিখছিলেন? নাকি যা লিখছিলেন তাই আঁকছিলেন।” পল জিজ্ঞেস করল।

“কি জানি! তবে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে!” গামায় বলল ও আবার বইটা থেকে একটা চিঠি বের করতে আরম্ভ করল, “এই নৌকাই সব শক্তির উৎস। এই জাহাজটাই স্বাধীনতার চাবিকাঠি।” বলে সে যুদ্ধ জাহাজের ছবিটা দেখালো তারপর আর একটা চিঠি বের করল, “এই চিঠিটাই সবচেয়ে ভালোবোঝা যাচ্ছে। আর তারিখ অনুযায়ী এটাই সর্বশেষ চিঠি। পড়ে মনে হচ্ছে এটা দ্য শ্যাম্পেনকে উদ্দেশ্য করে লেখা, তবে কোনো প্রাপক বা প্রেরকের নাম নেই।”

গামায় চিঠির ওপর আঙুল চালিয়ে একটা জায়গা বের করল তারপর পড়া আরম্ভ করল, “উনি বলছেন যে এরকম কোনো অস্ত্র কি হতে পারে নাকি? পুরো ব্যাপারটাই বুজরুকি। নিজে মনে না করলেও তার চামচারা নিশ্চয়ই তাকে এসব কথা লাগিয়েছে। তারপরও উনি আমাকে প্রমাণ হাজির করতে বলেছেন। কিন্তু তার চাহিদা মতো জিনিসটা তাকে এনে দিলেও তিনি তার প্রতিদান সম্ভবত দেবেন না। উনার মতে আমিই নাকি ঋণী। আর এই ঋণ শোধ করতেই হবে। আমার তাই ব্যাপারটা চেষ্টা করে দেখাও নিরাপদ মনে হচ্ছে না। কিন্তু আমি আর কার কাছে যাবো? আর সম্রাট একবার হাতে অস্ত্রটা পেলে যে কি করবেন সে ব্যাপারেও ভয় লাগছে আমার। পুরো দুনিয়া দখল করেও সম্ভবত থামবেন না তিনি। সম্ভবত সত্যটা প্রকাশিত না হওয়াটাই মঙ্গল। ওটা আপনার কাছে আপনার ঐ ছোট্ট নৌকাটাতেই লুকানো থাক। যে নৌকাটায় করে আপনি গুইলামে টেল-এ আশ্রয় নিতে ছুটেছিলেন।”

গামায় মুখ তুলে তৃতীয় ছবিটার দিকে তাকাল, “ছোট্ট একটা নৌকা প্রাণপণে কোথাও ছুটছে।”

“কি বোঝাতে চাচ্ছ?” পল জিজ্ঞেস করলো।

“দ্য চ্যাম্পিয়ন তাকে যেটা পাঠিয়েছিলেন সেটা তার লুকিয়ে রাখার দরকার ছিল, আবার জিনিসটা খুব বেশি দূর কোথাও রাখা সম্ভব ছিল না। যাতে করে চাইলেই ওটা আবার উদ্ধার করতে পারেন।”

 পল ধরতে পারলো ব্যাপারটা, “একটা লোক যে জীবনে কোনোদিন ছবি আঁকেনি সে তাড়াহুড়ো করে কয়েকটা ছবি এঁকে ফেলল। তোমার কী মনে হয় উনি ছবিগুলোর মধ্যেই ওটা লুকিয়ে রেখেছেন?”

“না। ছবিগুলোর ভেতরেই না।” গামায় বলল।

ও মহামারীর ছবিটা হাতে নিয়ে উল্টে দিল। পিছনে একটা মোটা কাগজ ফ্রেমের সাথে আঠা দিয়ে আটানো। ছবিটা নামিয়ে ব্যাগ থেকে একটা সুইস আর্মি নাইফ বের করল। “এটা শক্ত করে ধরো।”

“পাগল হলে নাকি? খারাপ কাজ করলে যে খোদার গযব পড়ে ভুলে গিয়েছ?” নিচু স্বরে বলল পল।

“আমি সে ব্যাপারে ভাবছি না। মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্যে করছি এটা।” বলল গামায়।

 “আর ঐ লোকটা যদি রাগ করে?”

 “যা সে জানে না তা নিয়ে ওর কোনো ঝামেলাও হবে না। আর ওর কথা তো শুনেছেই। এ ছবিগুলোর কোনো দামই নেই ওদের কাছে। যদি অনুমতি পেতো তাহলে একটা গান গাইলেই এটা আমাদের কাছে বেচে দিতো।”

গামায় সতর্কতার সাথে পিছনের শক্ত কাগজটা তুলতে লাগল। খুব সাবধানে যাতে ছুরিটা বেশিদূর ঢুকে না যায়। একটা পাশ পুরো ভোলা হতেই তার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল।

“কী”

গামায় পুরো পিছন দিকটাই হাতড়ে কিছু ধরতে না পেরে ছবিটা নামিয়ে কাগজটা ফাঁক করে ভেতরে দেখার চেষ্টা করল। “নাহ কিছু নেই। বাকিগুলো দেখা যাক।”

পল শক্ত করে ধরতেই ও যুদ্ধজাহাজের ছবিটার পিছনটাও খুলে ফেলল। ওটার মাঝেও কিছু নেই।

“তার মানে যুদ্ধ জাহাজটা চাবিকাঠি নয়।” পল মন্তব্য করল।

“মজা পেলুম।”

সব শেষে ও সাম্পানওয়ালা ছবিটা তুলে নিলো।

 “তাড়াতাড়ি। কেউ আসছে।” পল বলল।

টাইলসের মেঝের ওপর জুতোর খটখট শব্দ এগিয়ে আসছে দ্রুত। গামায় দ্রুত ওর ছুরি চালালো।

“তাড়াতাড়ি।”

রুমের শেষ মাথায় সেই লোকটাকে দেখা গেল। পল দ্রুত ছবিটা গামায় এর কাছ থেকে টান দিয়ে তাকের ওপর রেখে দিল। কিন্তু লোকটা তাতে হতভম্ব হওয়া তো দূরে থাক সামান্য অবাক পর্যন্ত হলো না। স্থির দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইল।

হঠাই পল বুঝতে পারলো লোকটাকে কেমন টলতে টলতে সামনের দিকে এগুচ্ছে। ওদের দিকে তাকায়ই নি। তারপর সামনের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মেঝেতে। পিঠে একটা ছুরি গাঁথা।

পিছনেই আর একটা লোককে দেখা গেল। লোকটার বয়স কম। কপাল আর গালে দগদগে ক্ষত। সে পড়ে থাকা লোকটার পিঠ থেকে ছুরিটা খুলে নিয়ে ঠাণ্ডা চোখে মুছতে লাগল। একটু পর আরো দুজন লোক এসে তার পাশে দাঁড়ালো।

“আপনাদের আর কষ্ট না করলেও চলবে। এখন যা করার আমরাই করবো।” ঘাওয়ালা লোকটা বলল।

.

৫৬.

“কে আপনি?” পল জিজ্ঞেস করল।

“আপনি আমাকে স্করপিয়ন ডাকতে পারেন। লোকটা জবাব দিল।

লোকটাকে নামটার জন্য কেমন গর্বিত মনে হলো। কারণটা পলের জানা নেই।

“আমাদেরকে কীভাবে খুঁজে পেলেন?” পল জানে যে এসব প্রশ্নের কোনো মানে নেই। সে শুধু সময় ক্ষেপণের চেষ্টা করছে। ও জীবনেও এই স্করপিয়নকে দেখেনি। যদিও ও অনুমান করতে পারছে ও কার হয়ে কাজ করে কিন্তু ওর পক্ষে তো পল আর গামায়-এর পরিচয় জানা সম্ভব না।

“আমাদের কাছে দ্য চ্যাম্পিয়নের ডায়রি আছে। সেখানে বেশ কয়েকবার ভিয়েনেভের কথা লেখা আছে। সেখান থেকেই রেনে বা ক্যামিলা ডুশেনেকে খুঁজে বের করা কোনো ব্যাপার না।”

“যদি ওনার কোনো ক্ষতি হয়…”গামায় হুমকি দিল।

“ওনার ভাগ্য ভালো যে আমরা যাওয়ার আগেই আপনারা ওনার কাছে গিয়েছিলেন। তাই একজন বৃদ্ধাকে হেনস্থা করার চাইতে আপনাদেরকে অনুসরণ করাটাই যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। এখন চিঠির বইটা দিয়ে দিন।”

গামায় আর পল বিষণ দষ্টি বিনিময় করল। ওদের আর কিছুই করার নেই। পল গামায় এর সামনে এসে দাঁড়ালো যাতে করে ও সুইস নাইফটা আবার হাতে নিতে পারে। তবে ঐ লোকগুলোর হাতের নয় ইঞ্চি ছুরির তুলনায় এটা নিতান্তই খেলনা ছাড়া কিছু না।

অ্যালবামটা বন্ধ করে সামনে ঠেলে দিয়ে পল বলল, “এই যে।” মসৃণ টেবিলের ওপর পিছল খেয়ে সেটা সোজা স্করপিয়নের পাশে গিয়ে থামল। ও সেটা তুলে নিয়ে এক নজর দেখে হাতের নিচে চেপে ধরলো।

“পুলিশ আসার আগেই আপনাদের কেটে পড়া উচিত।” গামায় বলল।

“পুলিশ আসবে না।” স্করপিয়ন বলল।

“কে জানে। কেউ নিশ্চয়ই আপনাদের দেখেছে– পল বলতে গেল। স্করপিয়ন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আপনারা ছবিগুলো দিয়ে কি করছিলেন?”

“কিছু না।” বলল পল। বলে নিজেই বুঝলো বেশি তাড়াতাড়ি বলে ফেলেছে। মিথ্যে ও বলতেই পারে না।

“দেখান দেখি।”

পল লম্বা একটা দম নিয়ে তাকটার দিকে এগিয়ে গেল। একটা ছবি টেনে বের করতেই বুঝলো ও আসলে ভুল ছবি টেনে বের করেছে। ওটা ছিল যুদ্ধ জাহাজের ছবিটা।” এটাই বোধ হয় ভালো হল।” মনে মনে ভাবলো পল। এটাকেও টেবিলের ওপর রেখে স্করপিয়নের দিকে ঠেলে দেয়ার মুহূর্তে পল এর মনে হলো তার হাতে এটাতো আসলে একটা অস্ত্র। ও শরীরটা বাকিয়ে ফ্রেমওয়ালা ছবিটা ফ্রিসবির মতো করে স্করপিয়নের দিকে ছুঁড়ে দিল। সোজা পেটে গিয়ে লাগল ওটা স্করপিয়নের।

সামনের দিকে কুঁজো হয়ে গেল স্করপিয়ন। তারপর কাত হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। সাথে সাথেই পল সামনে এগিয়ে কয়েকটা লাথি হাকালো তার গায়ে।

“পালাও।” গামায়-এর দিকে চিৎকার করে ডাকলো ও।

পল-এর লম্বা সাইজের সুবিধা-অসুবিধা দুটোই আছে। বেশি লম্বা হওয়ার কারণে ওর সাথে ঘুষাঘুষি করে না কেউ। কারণ হাতাহাতি করার জন্য ছয় ফুট আট ইঞ্চির কেউ খুব একটা সুবিধাজনক না। ঠিক এজন্যেই হাতাহাতি লড়াইতেও খুব একটা দক্ষ ও না।

কিন্তু যুতমতো পেলে ও খুব শক্তিশালী ঘুসি বা লাথি মারতে পারে। এখন যেমন এক লাথিতে স্করপিয়ন উড়ে ওর দুই সাঙ্গাতের কাছে গিয়ে পড়ল। তিনজনই এই হঠাৎ আক্রমণে কেমন দিশেহারা হয়ে গিয়েছে আর এই লম্বুটাকে আক্রমণ করবে কী করবে না বুঝতে পারছে না।

পল অবশ্য সেজন্য বিন্দুমাত্র অপেক্ষা করল না। ও ঘুরেই উল্টো দিকে দৌড় দিল। কোণায় পৌঁছতেই দেখে গামায় দরজার কাছে পৌঁছে গিয়েছে।

‘ধর ওদের,” স্করপিয়ন আদেশ দিল।

গামায় দরজার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে পল ওকে ধরে ফেলল। গামায়ের হাতে সাম্পানের ছবিটা।

“আমি আরও ভাবলাম তুমি বুঝি আস্তে দৌড়াচ্ছ।” পল বলল।

 “এটা হাতছাড়া করলে সব যেত।” হাফাতে হাফাতে বলল গামায়।

“আশা করি হাতছাড়া করতে হবে না।” দরজা খুলতে খুলতে বলল পল। সামনে এগুতেই একটা সিঁড়ি চোখে পড়ল। সম্ভবত ফায়ার এস্কেপ। পল ভারি স্টীলের দরজাটা টেনে খুলে ফেলল।

“ওপরে না নিচে?” গামায় জিজ্ঞেস করল।

“নিচে সম্ভবত বেসমেন্ট। ওপরে যাওয়াই ভালো।

ওরা দৌড়ে একতলা উঠে দেখে এখানেও দরজা। কিন্তু ধাক্কা দিতে বোঝা গেল যে তালা মারা।

“আরো ওপরে চলল,” পল চিৎকার দিল।

ওপরের দিকে দৌড়ালো আবার। সাথে সাথেই নিচের দরজাটা দড়াম করে খুলে গেলো। গামায় ওপরে উঠেই দরজাটায় ধাক্কা দিল। ওটার পাশে লেখা L3।

 “এটাও দেখি বন্ধ। জরুরি অবস্থায়ই দরজা খোলা না পেলে ফায়ার এস্কেপের দরকারটা কী?” গামায় বলল।

পল দরজা খোলার চেষ্টা করল কিন্তু এটাও বন্ধ। গামায় ছবির ফ্রেমটা দিয়ে বাড়ি মেরে জানালার কাঁচ ভেঙে ফেলল। তারপর ওটা দিয়েই ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো সরিয়ে ওদিক দিয়ে উঠে গেল।

পলও সেদিক দিয়ে গিয়ে লাইব্রেরির ছাদে লাফ দিয়ে পড়ল। ওরা যেখানে নেমেছে সেই জায়গাটা সমতল আর আলকাতরা লেপা। কিন্তু বাকিটা ঢালু আর টাইলস বসানো। “আরেকটা রাস্তা নিশ্চয়ই আছে।”

ঢাল অংশটার পরেই আরেকটা সমতল জায়গা। সেখানে ছোট্ট একটা ঘরের মতো বসানো। ওরা যেরকম সিঁড়ি বেয়ে উঠেছে ওটাও ঠিক একইরকম সিঁড়ি ঘর।

“ঐ তো,” পল বলল।

গামায় সাথে সাথেই ছুটলো। আর পল চারপাশে তাকাল লাঠি-সোটা কিছু পাওয়া যায় কি-না তা দেখতে। কিন্তু কিছুই নেই। তাই ও আর দেরি না করে গামায় এর পিছু নিলো। টাইলস বসানো ছাদটা প্রায় খাড়াভাবে ঢালু তার ওপর শ্যাওলা জমে পিছল হয়ে আছে মারাত্মক।

 একদম ঢালুটার মাথায় এক চিলতে সমতল জায়গা। দাড়ি পাল্লার লোহার রড়টার সমান হবে প্রস্থ। একবার পা হড়কালেই প্রপাত ধরণীতল।

ওরা ধীরে-সুস্থেই জায়গাটা পার হলো। তারপর সমতল আল কাতরামত জায়গাটায় লাফিয়ে নেমেই দরজার দিকে ছুটলো। যথারীতি এটাও বন্ধ। এবার অবশ্য জানালা ভাঙতে দেরি করা লাগল না।

এদিকে ওদের ধাওয়াকারীরাও ছাদে চলে এসেছে।

“তুমি যাও। আমি ওদেরকে আটকাচ্ছি।” বলল পল।

 “উঁহু! এসব চলবে না। একটু আগে যা করেছ সেটা তাও মানা যায়।

কিন্তু তুমি তো আর লম্বা ব্রুস লি না। আমরা এক সাথেই থাকবো।”

 “ঠিক আছে। তাহলে তাড়াতাড়ি করো।”

গামায় পলকে ছবিটা ধরিয়ে দিয়ে জানালার ধারে হাত দিতেই চেঁচিয়ে উঠল। পল ঘুরে দেখে ভেতর থেকে কেউ ওর হাত ধরে টানছে। পল গামায় এর পা ধরে টান দিল। কয়েক মুহূর্ত টানাটানির পর গামায় মুক্ত হলো। মুখ ভরা রক্ত।

“ঠিক আছ তুমি?” পল জিজ্ঞেস করল।

“বাড়িতে ফিরলে টিটেনাস টিকা দিতে হবে মনে করিয়ে দিও তো।”

“কামড় খেলে টিকা দিতে হয়। কাউকে কামড়ালে না।” বললো পল।

“তাহলে দরকার নেই।” বলল গামায়।

ওদের অবস্থা এখন ফাঁদে আটকানো কোনো প্রাণীর মতো। পল ছাদ থেকে টাইলসের কয়েকটা ভাঙা টুকরো তুলে নিলো। এদিকে দ্বিতীয় সিঁড়ির ভেতরের লোকটা দরজার গায়ে আঘাত করা শুরু করেছে। ভেঙে ফেলবে দরজা।

“এখন কী করবো?”

 “খালে ঝাপ দেবো।” বলল পল।

আবার ওরা ঢাল বাওয়া শুরু করল। তবে এবার নিচের দিকে। গামায় একটা পাহাড়ি ছাগলের মতো তরতর করে নামতে লাগল। কিন্তু পল বার বার পিছলে যেতে লাগল। ওর অতিরিক্ত উচ্চতা-ই এবার ওর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ভারসাম্য রাখতে মাথা বেশি ঝোকালেই মনে হচ্ছে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়বে।

শেষমেশ পিঠ ঠেকিয়ে পিছলা খেয়ে নামা শুরু করল। গামায়ও একই কাজ করল। শেষ মাথায় পৌঁছাতে তাই আর কোনো সমস্যা হলো না। নিচের খালটার প্রস্থ আট ফুটের মতো হবে। আর ওরা এখন চার তলা ওপরে।

“যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে তো অনেক বেশি নিচে।” বলল পল।

 “আর কোনো উপায়ও তো নেই,” বলল গামায়।

“ওরা হয়তো পিছু নেয়ার সাহস করবে না।”

কিন্তু পিছু ফিরে দেখে ওই দুজনও আসছে, “উঁহু! সাহস ওদের ভালোই দেখা যাচ্ছে। তুমি প্রথমে লাফ দাও।”

গামায় ছবিটা নিচে ছুঁড়ে মারলো। খালের পাশের পাথুরে রাস্তাটায় পড়ল ওটা।

“ছবিটা দিয়ে দাও। আমরা শুধু ওটাই-ই চাই। ধাওয়াকারী একজন চেঁচালো।

“এতোক্ষণে এই কথা বলছে।” বলল গামায়।

 “রেডি?” জিজ্ঞেস করল পল।

 গামায় মাথা ঝাঁকালো।

“দাও লাফ।”

গামায় হাঁটু গেড়ে বসে, সামনে ঝুঁকে দিল লাফ। তারপর দুহাত ছড়িয়ে দেয়াল পেরিয়ে খালটার কালো জলে গিয়ে আছড়ে পড়ল।

পলও একই কাজ করল। গামায়-এর ঠিক পাশেই পড়ল ও।

পতনের ধাক্কায় পানির ভেতর ডুবে গেলেও মুহূর্ত পরেই ওপরে মাখা তুললো। পানি খানিকটা ঠাণ্ডা কিন্তু খুব আরাম। ওরা তীরে সাঁতরে গেল। তারপর পল গামায়কে নিচ থেকে ঠেলা দিয়ে ওপরে তুলে দিলো। তারপর নিজেও উঠে এলো। গামায় ছবিটার কাছে গিয়ে ফ্রেমে হাত দিতেই পিছনে ঝুপ করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখে এক ধাওয়াকারী ঝাঁপ দিয়েছে। সেকেন্ড পরে বাকি দুজনও লাফিয়ে পড়ল পানিতে।

“এই শালারা দেখি একেবারে নাছোড় বান্দা,” বলল গামায়।

“আমরাও।”

লোকগুলো সাঁতরে তীরের দিকে রওনা দিতেই পল আর গামায় দৌড় লাগালো। কিন্তু এগুতেই দেখে রাস্তার শেষ মাথায় দুই গুণ্ডামতো লোক দাঁড়িয়ে।

“আবার ধরা খেলাম।”

খালের ধারেই ছোট্ট একটা স্পিডবোট বাঁধা। উপায় এই একটাই। পল লাফিয়ে উঠল ওটায়। নৌকাটা প্রায় উল্টে গিয়েও উল্টালো না। গামায়ও লাফিয়ে উঠে দড়ি খুলতে খুলতে বলল, “স্টার্ট দাও।”

পল চাল করায় দড়িটা ধরে টান দিতেই ভটভট করে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে ওটা চালু হয়ে গেল। সামনে থ্রটল ঠেলতেই আরো কয়েক দমক ধোয়া বেরুলো পুরনো বোটটা থেকে তবে চলতে আরম্ভ করল ঠিকই।

পল সামনে থেকে নজর সরাতে পারছে না। কারণ খালের ধারে ডজন ডজন নৌকা আর বজরা বাধা। সেগুলো পেরিয়ে যেই মাত্র পল নিজেদেরকে নিরাপদ ভাবা শুরু করেছে তখনই কুয়াশা ভেদ করে আরো একটা স্পিডবোটের শব্দ পাওয়া গেল। আবার পিছু নিয়েছে ধাওয়াকারীরা।

.

৫৭.

“জোরে চালাও।” চেঁচিয়ে বলল গামায়।

ছোট্ট নৌকাটা তার সর্বোচ্চ গতিতেই ছুটছে। তবে সেটা উল্লেখযোগ্য এমন কোনো গতি না।

পল আরো কয়েকবার গিয়ার টানাটানি করল যে, যদি গতি কিছুটা বাড়ে। কিন্তু কোনো কাজ হলো না, উল্টো মোটর আরো জোরে ভটভট করা আরম্ভ করল।

“এটাকে জোরে বলে না,” গামায় বলল।

“এই বোট এরচেয়ে বেশি জোরে আর চলে না।” বলল পল। তারপর আবার সামনের দিকে মনোযোগ দিল।

 পিছনের নৌকাটা ধীরে ধীরে দূরত্ব কমিয়ে আনছে। একটা জায়গায় ডান দিকে মোড় নিতে গিয়েই ধাওয়াকারীদের নৌকা পল আর গামায়দের নৌকার পিছনে বাড়ি দিল। ধাক্কার চোটে ওরা সামনের পাথরের দেয়ালে ঘষা খেলো।

এরপর নদীটা সোজা এগিয়েছে। ফলে পিছনের নৌকাটা ওদের পাশাপাশি চলে এলো। ওদের একজন হাতে ছুরি তুলে নিয়েছে পলের দিকে ছুঁড়ে মারবে বলে কিন্তু সেই মুহূর্তে গামায় ওর দিকে নৌকায় থাকা একটা দাঁড় তুলে নিয়ে বাড়ি মারলো। দাঁড়টা সোজা লোকটার মাথার একপাশে লাগল আর সে ঝপ করে পানিতে পড়ে গেল। তবে অন্য আরেকজন, যার নাম স্করপিয়ন, সে দাঁড়টাকে ধরে ফেলল। আর নিজের দিকে টান দিল।

গামায় টানের চোটে পাশের নৌকাটায় পড়েই যেতো কিন্তু শেষ মুহূর্তে ও ছেড়ে দিল। স্করপিয়ন দাঁড়টা একপাশে ছুঁড়ে ফেলল।

নৌকা দুটো আবারও দূরে সরে গেল তবে এবার স্বরপিয়ন লোকটা ছুরি বের করল, তারপর অন্যজনের দিকে ফিরে বলল, “কাছাকাছি নাও।”

“ওদের নৌকার সাথে ধাক্কা লাগাও। ট্রাফিক জ্যামের সময় যেভাবে গাড়ি চালাও এটাও সেভাবেই চালাও।” গামায় বুদ্ধি দিল।

পল বুদ্ধিটা গ্রহণ করল আর নৌকা দুটো পরপর দুবার পরস্পরের গায়ে সজোরে ধাক্কা দিল আর কাত হয়ে দূরে সরে গেল আবার। সামনেই হঠাৎ উল্টোদিকে থেকে একটা বজরা চলে আসায় ওরা আবার আলাদা হয়ে গেল। কিন্তু এটা পার হতেই ধাওয়াকারীরা আবার ওদের দিকে ছুটে এলো। কিন্তু এবার আঘাতের পর নৌকাদুটো আলাদা না হয়ে অদ্ভুতভাবে আটকে রইল। ধাওয়াকারীদের নৌকা বেশি বড় আর গতিশীল হওয়ায় ওরাই জিতলো আর পল আর গামায়-এর ছোট নৌকাটাকে পাড়ের দিকে ঠেলে নিয়ে চললো। দেয়ালে বাড়ি লেগে ওটার সাথে ঘষে ঘষেই সামনে এগুতে লাগল নৌকা জোড়া। আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ল চার পাশে।

দেয়ালের কাছ থেকে সরে আসতেই স্করপিয়ন পলদের নৌকায় লাফিয়ে এসে গামায়-এর পায়ের কাছ থেকে ছবিটা তুলে নিলো। গামায়ও অন্য প্রান্তটা ধরে টানা আরম্ভ করল। কিন্তু স্করপিয়ন একটু জোরে টানদিতেই পুরনো কাঠের ফ্রেমটা রণে ভঙ্গ দিল। গামায়ের হাতে ধরা রইল লাল এক কাঠের ভাঙ্গা একটা টুকরো আর স্করপিয়ন বাকিটা নিয়ে নিজের নৌকায় ফিরে গেল। ওর সঙ্গী সাথে সাথে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে খালের অন্যদিকে ছুটলো।

“ও ওটা নিয়ে গেল!” গামায় চিৎকার করে উঠল।

 এখন ওদের ভূমিকা পুরো উল্টো হয়ে গিয়েছে। পল আর গামায়ই এখন ধাওয়াকারী। পল যতটা সম্ভব দ্রুত নৌকার মুখ ঘুরিয়ে দিল। আরও একবার নৌকা দুটোর মধ্যে সংঘর্ষ হলো। এবার আর নৌকা দুটো একসাথে তো লেগে থাকলোই না উল্টো ধাক্কায় পল-এর হাত নৌকার প্রটল থেকে ফসকে গেল।

আবার ধরতে যেতেই দেখে ইঞ্জিনের ভটভটানি আরো বেড়ে গিয়েছে। ও আবার গিয়ার বদলালো। ইঞ্জিনে তেলের বন্যা বয়ে গেল কিন্তু ফল হলো উল্টো। নৌকার গতি একদমই কমে গেল, যে কোনো মুহূর্তে ডুবে যেতে পারে।

 “তাড়াতাড়ি, গামায় চেঁচালো।

অন্য নৌকাটা ভালোই দূরে চলে গিয়েছে ততোক্ষণে। পল আরো দুবার রশিটা ধরে টান দিল। নৌকাটা আবার চালু হয়ে চলতে আরম্ভ করল কিন্তু সামনের নৌকাটাকে আর ধরা সম্ভব না। কিছুক্ষণ পরই ওটা কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে গেল।

“দেখা যায় নাকি?” জিজ্ঞেস করল পল।

“না।” কুয়াশার ভেতর দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে করতে বলল পল।

কয়েক মিনিট পর আবার নৌকাটা দেখতে পেল। তবে ওটা তখন খালি। নদীর ডান তীরে ভাসছে শূন্য অবস্থায়।

“ওরা পালিয়ে গিয়েছে।” বলল পল।

গামায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পলকে বলল, “পুলিশ আর প্যারামেডিক কে ফোন করে লাইব্রেরিতে যেতে বলতে হবে।”

“ম্যাডাম ডুশেনের খবরও নিতে বলতে হবে।” বলল পল।

আরো কিছুদূর এগুনোর পর খালের ধারে একটা সিঁড়ি বাঁধানো ঘাট দেখতে পেয়ে পল সেখানে নৌকা থামালো। তারপর ডাঙ্গায় নেমে প্রথম দোকানটাতেই ঢুকে পড়ল। গামায় দ্রুত পুলিশকে ফোন করে দিল।

এখন ওদের কাজ শুধু অপেক্ষা করা।

.

৫৮.

কায়রো

তারিক সাকির অন্ধকার কন্ট্রোল রুমে বসে আছেন। খবরের আশায় উদগ্রীব। কিন্তু এখনও রেডিও বা ওয়াকিটকি কিছুতেই কোনো খবর আসেনি। শুধু ওসাইরিস পানি বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের সাথে যোগাযোগকারী ফোনটা আর পাইপলাইনের ডাটা ওঠে যে কম্পিউটারে সেটাই সচল। তার পরিকল্পনা যে সফল হতে চলেছে সেই খবর তিনি এ দুটোর মাধ্যমেই পেয়েছেন।

লিবিয়ায় জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। বিরোধীদলীয় নেতা যে কি-না সাকিরের লোক সে প্রচুর সমর্থন পাচ্ছে সবার। টাকা দিয়েই সেটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে বর্তমান সরকারের ওপর আর কারো আস্থা নেই। আর সেই জিনিস টাকা দিয়ে কেনা সম্ভব না। দেশের প্রতিটা শহরে দাঙ্গা চলছে। নেতারা সব পানির প্রতিশ্রুতি দিয়েই যাচ্ছে। তবে সাকিরের পাম্পগুলো বলছে যে সেটা কখনোই ঘটবে না। এই সরকার আর চব্বিশ ঘণ্টাও টিকবে কি-না সন্দেহ।

এদিকে ভূমধ্যসাগরের অপর প্রান্তে আলবার্তো পিওলা রোমে বসে এই মাঝ রাতেও নানান জনের সাথে সাক্ষাৎ করে করে ইতালির রাজনীতিবিদদেরকে নিজের দলে ভেড়াচ্ছে। ওর দেয়া তথ্য মতে ইতালিয়ান সরকার এখন লিবিয়ায় নতুন সরকার গঠন হওয়া মাত্র পূর্ণ সমর্থন দিতে প্রস্তুত। সেই সাথে ওখানে শান্তি ও স্থিতি আনতে মিসরের হস্তক্ষেপেও ওরা বিন্দুমাত্র আপত্তি করবে না। ফ্রেঞ্চরাও একই কাজ করবে। ফলে আলজেরিয়া আর লিবিয়া দুই জায়গাতেই সাকিরের চাল বৈধতা পেয়ে যাবে।

তাই এখন একমাত্র চিন্তার বিষয় হলো NUMA’-র এজেন্ট ঐ দুই আমেরিকান আর ইতালিয়ান ইন্টেলিজেন্স-এর ঐ মহিলা। পাঁচ ঘণ্টা আগে ওরা পালিয়েছে। তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই।

হঠাৎ দরজায় শব্দ হওয়ায় চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল তার।

 “ভেতরে এসো,” আদেশ দিলেন সাকির।

দরজা খুলতেই হাসান প্রবেশ করল ঘরে।

 “সুখবর শোনার জন্যে বসে আছি।” বললেন সাকির।

“স্করপিয়ন মাত্র ফ্রান্স থেকে ফিরেছে। ওদের সাথে নাকি এক আমেরিকান দম্পতির ঝামেলা হয়েছিল। কয়েকটা লাশ ফেলতে হয়েছে তবে আমেরিকান দুটো যা খুঁজছিল সেটা ও উদ্ধার করেছে ওদের কাছ থেকে।”

“জিনিসটার কী কোনো দাম আছে?

“কিছুটা তো আছেই। ভিয়েনেভের লেখাগুলো পড়লে পাগলের প্রলাপ বলে মনে হয়। ছবিগুলোও খুব বাজে। স্করপিয়ন বলল আমেরিকানরা নাকি ছবিগুলোয় কিছু একটা খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু ওরা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পায়নি। এমনকি ওগুলো ছিঁড়ে পর্যন্ত ফেলেছে। ভেতরেও কিছু নেই। কোনো গোপন কাগজ বা সংকেত কিছুই না। যদি ভিয়েনেভ আর দ্য শ্যাম্পেন ব্লাক মিস্ট-এর রহস্য উদঘাটন করেও থাকেন সেটা ইতিহাসের গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছে।” বলল হাসান।

সাকির ব্যাপারটায় পুরোপুরি খুশি হতে পারলো না, “আমেরিকানগুলোর কী অবস্থা?”

“কোনো খবর পাওয়া যায়নি। পালিয়েছে সম্ভবত।” জবাব দিল হাসান।

 “ওদেরকে খুঁজে বের করে সরিয়ে দাও।” আদেশ দিলেন সাকির।

 “আমার মনে হয় ওদের সাথে ঝামেলা করতে গেলে আমাদের পরিচয়–

“তোমার মনে হওয়া না হওয়ায় কিছু আসে যায় না। এখন এখানকার খবর দাও। ঐ তিনজনের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল?”

“এখনও না। বললামই তো যে ওদের পথ হারিয়ে ওটার ভেতর ঘুরে মরার সম্ভাবনাই বেশি,” জবাব দিল হাসান।

“সবাইকে ভালো করে নজর রাখতে বলো। আমার এই বসে থাকতে ভালো লাগছে না। এর চেয়ে বরং

হঠাৎ কন্ট্রোল রুমের লাইটগুলো পিট পিট করে ওঠায় কথা থেমে গেল সাকিরের। কম্পিউটারের স্ক্রিনগুলোও কালো হয়ে গেল। অবশ্য এক সেকেন্ড পরেই আবার আলো ফিরলো এগুলোয়। সাকির উঠে দাঁড়িয়ে কান পেতে আশে পাশে শোনার চেষ্টা করলেন। পাম্পের শব্দগুলো কেমন পাল্টে গিয়েছে বলে মনে হলো তার।

টেকনিশিয়ান আর তার সহযোগীরাও শুনেছে শব্দটা। সাথে সাথে কম্পিউটারের কীবোর্ডে ঝড় উঠল। কি হয়েছে বোঝার চেষ্টা করছে তারা। স্ক্রিনের সবুজ পতাকাগুলো বদলে হলুদ হয়ে গিয়েছে ততোক্ষণে।

“হচ্ছেটা কী?” জানতে চাইলেন সাকির।

“এক সেকেন্ডের জন্যে কারেন্ট চলে গিয়েছিল। তবে দ্বিতীয় লাইনটা দিয়ে আবার কারেন্ট এসেছে।”

“এরকম হওয়ার কারণ কী?”

“সম্ভবত প্রধান লাইনটা কেটে গিয়েছে বা সার্কিট ব্রেকার খুলে গিয়েছে।” একজন টেকনিশিয়ান জানালো।

“আরে এসব আমি জানি। এ রকম হলো কেন সেটা বলল।” বললেন সাকির। কিন্তু জবাবে পেলেন প্রচণ্ড একটা আওয়াজ। সেটার ধাক্কা একেবারে গুহার ভেতরটা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল। কম্পনের মাত্রা শুনে বোঝা গেল একটা জিনিসের পক্ষেই এটা তৈরি করা সম্ভব। তা হলো একটা বিস্ফোরণ।

 টেকনিশিয়ানদের কথাকে পাত্তা না দিয়ে সাকির বাইরে বের হয়ে আসলেন। অর্ধেকের বেশি লাইট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শুধু জরুরি অবস্থার বাতিগুলো কাজ করছে। খানিক দূরেই কেমন একটা গম গম আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। যেন একটা বড় ট্রাক এদিকেই আসছে। সুড়ঙ্গ ধরে তাকালেন সাকির। কিছু একটা আসছে নিশ্চিত। বড়সড় কিছু। সম্ভবত পুরো সুড়ঙ্গটাই দখল করে ফেলেছে সেটা। আরো ভালো করে তাকাতেই হঠাৎ এক জোড়া হেডলাইটের আলো সরাসরি তার চোখে পড়ে তাকে অন্ধ করে দিল।

 পুরনো, হলদেটে একটা কাঠামো সামনে। তার নিজের এরকম কোনো গাড়ি নেই। তার বেশ কয়েকটা লোক গাড়িটাকে আটকাতে সামনে ছুটে গেল, কিন্তু ভারি মেশিন গানের গুলির শব্দ পেয়ে আর সামনে এগুলো না।

বন্দুকটা তার দিকে ঘুরতেই সাকির কট্রোল রুমে ঝাঁপ দিলেন আবার। পিছনেই বন্দুকের নল ঝলসে উঠল আবার, আর দেয়াল থেকে পলেস্তারা খসিয়ে ছুটে গেল গুলি।

হাসানের দিকে চিৎকার করে বললেন, “সব লোককে নিচে আসতে বলো তাড়াতাড়ি। ঐ তিনজন তোমার কথামতো পালানোর চেষ্টা করেনি উল্টো ফিরে এসেছে আবার।”

 হাসান দ্রুত দৌড়ে ফোন তুললো আবার, “সেকশন ওয়ান, হাসান বলছি। সবাইকে নিয়ে নিচে চলে এসো। হ্যাঁ এক্ষুনি। আমাদেরকে আক্রমণ করা হচ্ছে।” কথা শেষ না হতেই কন্ট্রোল রুমের বাইরে তুমুল গুলি বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল। হাসান সাথে সাথে মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আড়ালে চলে গেল। পর মুহূর্তেই ভাঙ্গা কাঁচ আর পাথরের টুকরোয় ভরে গেল চারপাশ।

সাকিরের দুজন লোক জবাব দেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই ধরাশায়ী হলো।

“ওটা তো আমাদের কোনো গাড়ি না। এটা একটা মিলিটারি গাড়ি।” বলল হাসান।

“আসলো কোত্থেকে ওটা?” সাকির জিজ্ঞেস

“খোদা-ই জানে।”

সাকির আর দেরি না করে পাশেই একটা দরজার দিকে দৌড় দিলেন। এটা ধরে সোজা প্রধান সমাধি কক্ষে যাওয়া যায়।

 হাসানও সেদিকে ছুটলো। ততোক্ষণে একটা দল পৌঁছে গিয়েছে কন্ট্রোল রুমে। হাসান নিজের নাইন এমএম পিস্তলটা তুলে নিলো হাতে। যে জিনিসটা পিছনে গুলি ছুড়ছে সেটার মুখোমুখি হওয়ার কোনো ইচ্ছেই ওর নেই। তবে অস্ত্র হাতেই দৌড়ানোটা ভালো দেখায় তাই হাতে অস্ত্র তুলে নেয়া।

.

এদিকে সুড়ঙ্গের ভেতরে কার্ট, জো আর রেনাটার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ উল্টো। আজ, এখানেই ওরা এটার শেষ দেখে ছাড়বে।

জো একটা AS-42 সাহারিয়ানকে ঘষে মেঝে আবার চালু করে ফেলেছে। যতটা ভেবেছিল তার চেয়ে সহজ হয়েছে কাজটা। তার অন্যতম কারণ হলো আগের কালের ইঞ্জিনগুলো শুধু ইঞ্জিন-ই ছিল। হাল আমলের ইঞ্জিনগুলোর মতো এয়ার কন্ডিশন সিস্টেম, এমিশন কন্ট্রোল ইত্যাদি হাবিজাবি আগডুম। বাগডুম কিছু নেই। গাড়ির হুড খুলতেই শুধু দুটো সমস্যা পাওয়া গেল। ইঞ্জিনে ময়লা জমে আছে আর কোনো তেল নেই। তাই কাজ করাও সহজ হয়ে গেল। মরুভূমির বাতাসে বাষ্প কম, তাই মরীচা পড়েনি কিছুতেই। তবে সবচেয়ে সুবিধা হলো যখন দেখা গেল গাড়ির ট্রাঙ্কে একটা ফুল সেট অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ আর সারাইয়ের জিনিসপত্র পড়ে আছে।

তাই শেষমেশ একমাত্র সমস্যা হলো তেল। গাড়ির তেলের পুরোটাই বাষ্প হয়ে গেছে আরো বহু বছর আগেই। যে পাত্ৰেই রাখা হোক তাতে কোনো লাভ নেই। অবশ্য থাকলেও খুব একটা লাভ হতো না, নষ্ট হয়ে যেতে এতো দিনে।

তবে ATv-টার ট্যাঙ্ক ভরা তেল। দ্রুতই ওটা থেকে তেল এনে ভরে ফেলা হলো এটার ট্যাঙ্ক। ওটার ব্যাটারিটাও খুলে এনে এটায় লাগানো হলো। তারপর চাবি দিতেই যখন সাহারিয়ানটা প্রাণ ফিরে পেল জো-এর খুশি তখন দেখে কে! ইঞ্জিনের গমগম আওয়াজ ওদের আত্মবিশ্বাসও বাড়িয়ে দিল বহুগুণ! এখন ওরা প্রায় একটা ট্যাঙ্ক নিয়ে যুদ্ধে নামবে আর ওদের প্রতিপক্ষের। সবাই-ই পদাতিক।

জো যতক্ষণ গাড়ি ঠিক করেছে, কার্ট আর রেনাটা ততোক্ষণ সুড়ঙ্গের মুখের জঞ্জাল পরিষ্কার করেছে। প্রথমে ওরা বড় বড় পাথরের টুকরোগুলো ATv-টার সাথে বেঁধে সরিয়ে ফেলল তারপর বাকিটা একটা শাবল দিয়ে সরিয়েছে। তবে AS-42 এর উচ্চতা খুব বেশি না হওয়ায় সামান্য খোঁড়াখুড়িতেই কাজ হয়ে গেল।

তবে তাতেই কাজ শেষ না। পিঠের ব্যথা নিয়েই লেগে পড়তে হলো গোলাবারুদের সংস্থানে। জো যে গাড়িটা ঠিকঠাক করেছে ওতে একটা ব্রেডা মডেল ৩৭ ভারি মেশিন গান বসানো। চব্বিশ রাউন্ডের কাটিজ থেকে বড় বড় গুলি ছুঁড়তে পারে ওটা। সাথে একটা বিশ মিলিমিটারের ট্রাঙ্কবিধ্বংসী বন্দুকও আছে একটা। পিছন দিকে আলাদা প্লাটফর্মে বসানো। প্রচুর গোলাবারুদ এখনও রয়ে গিয়েছে তবে বেশিরভাগই নষ্ট। বেছে বেছে ভাললাগুলো জড়ো করল গাড়ির পিছনে। সাথে নিয়ে এলো দুটো বেরেটা মডেল ১৯১৮। পুরনো মডেল। এগুলোয় গুলির ম্যাগাজিন ওপর দিয়ে ভরতে হয়, ইদানীংকালের অটোমেটিকগুলোর মতো নিচ দিয়ে না।

আর সর্বশেষ অস্ত্র হিসেবে কার্টের কাছে তখনও দুই ভায়াল ব্লক মিস্ট আছে। এগুলো যদি ব্যবহার করা লাগেই সেজন্য তিনটা গ্যাস মান্সও নিয়ে নিয়েছে।

 সবকিছু ঠিকঠাক মতো নিয়ে ফিরতি পথ ধরলো ওরা। প্রধান সুড়ঙ্গে সহজেই আসতে পারলো কিন্তু এরপর কোন দিকে যাবে সেটা নিয়ে ঝামেলা বেধে গেল। বহুবার এই সুড়ঙ্গ সেই সুড়ঙ্গ ঘুরে ঘুরে শেষমেশ যেখানে সেই ATv দুটো উল্টে পড়েছিল সেখানে এসে উপস্থিত হলো।

 হাসান বুদ্ধি করে ওখানে আগেই পাহারার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু ওরা এরকম কিছু কল্পনাতেও আনেনি। তাই জিনিসটা কী বুঝে উঠার আগেই ব্রেডা’র গুলিতে ওদের ভবলীলা সাঙ্গ হলো।

সেখান থেকে ওরা গুহার একদম মাঝের দিকে রওনা দিল। যাত্রাপথেই বিদ্যুতের মোটা মোটা তারগুলো চোখে পড়ল। একটা বোমা বসিয়ে এক জায়গায় সার্কিট উড়িয়ে দিলো জো। ভেবেছিল একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবে চারপাশ কিন্তু পিট পিট করে কয়েকটা বাতি জ্বলতেই লাগলো।

“অন্য কোথাও থেকে কারেন্ট পাচ্ছে,” বলল জো।

“ওটা নিয়ে আর ভাবতে হবে না। আমরা যে এসে পড়েছি সেটা ওরা টের পেয়ে গিয়েছে এতোক্ষণে। তারমানে আর লুকোছাপা করে লাভ নেই পালিয়ে যাওয়ার আগেই সাকিরকে ধরতে হবে।

সামনে এগোতেই সাকিরের আরেকদল লোক পড়ল সামনে। কট্রোল রুমের ঠিক বাইরে সাকিরকে দেখা গেল। কার্ট গুলি চালালো সেদিকে। সাকিরকে মারার জন্যে না, সে যাতে আবার ভেতরে ঢুকতে বাধ্য হয় সে জন্যে। তারপর ভেতর থেকে ধরবে তাকে। কিন্তু ভেতরে যে বের হওয়ার আরেকটা রাস্তা থাকতে পারে সেটা ওর মাথায় আসেনি।

কট্রোল রুমের সামনে গাড়িটা থামতেই কার্ট একটা বেরেটা হাতে লাফ দিয়ে নেমে ঘরে প্রবেশ করল। ভেতরে ঢুকে দেখে কম্পিউটার টেবিলের নিচে দুজন ইঞ্জিনিয়ার মাথা নিচু করে বসে আছে তবে সাকির নেই কোথাও।

“চিড়িয়া তো উড়ে গেছে। নিশ্চিত পিছনের দরজা দিয়ে ভেগেছে,” চিৎকার করে জো’কে বলল কার্ট।

“দেখি তাহলে ঘুরে গিয়ে ব্যাটাকে ধরা যায় কি-না,” বলল জো।

কার্ট সম্মতি দিতেই AS-42 আবার সামনে চলা আরম্ভ করল। সাকির যাতে আবার এদিক দিয়ে পালাতে না পারে তাই কার্ট পাহারায় থাকল এখানে। ও ইঞ্জিনিয়ারগুলোর দিকে বন্দুক তাক করে রেখেই কম্পিউটারের স্ক্রিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সেখানে উত্তর আফ্রিকার মানচিত্র দেখা যাচ্ছে। তাতে লাইন টেনে সাকিরের পানির পাইপগুলো দেখানো। এগুলো দিয়েই জলাধারের পানি তুলছে ও।

“ইংরেজি জানেন?”কার্ট জিজ্ঞেস করল।

একজন মাথা নাড়লো। কার্ট বেরেটাটা নাড়িয়ে বলল, “পাম্পটা বন্ধ করুন।”

কিন্তু তারপরও ওদের নড়ার কোনো লক্ষণ দেখা না যাওয়ায় কার্ট ওদের ঠিক পাশেই মেঝেতে এক ঝাঁক গুলি করল। সাথে সাথে লোক দুজন লাফ দিয়ে উঠে কাজে লেগে পড়ল। কী বোর্ডে কি সব টেপাটেপি আর সুইচ টেপা চলতে থাকল। কার্ট পাম্প আর প্রেসার গজ সম্পর্কে আগে থেকেই জানে। যতবারই কোনো জাহাজডুবি উদ্ধার করতে গিয়েছে বা পানির মধ্যে যেকোনো ধরনের কাজ কর্মেই এই জিনিস বারবার ব্যবহার করা লেগেছে। সবকিছু দেখে শুনে হঠাৎই এর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।

“থামেন, পাম্প বন্ধ করতে হবে না। আমার মত বদল করেছি। বলল কার্ট। লোক দুজন ওর দিকে তাকাল।

“এগুলো উল্টো দিকে চালান।”

 “পাম্পগুলো উল্টো দিকে চালালে কী হবে আমাদের জানা নেই। একজন বলল।

“দেখাই যাক কি হয়।” আবারো সাব মেশিন গানটা খানিক ওপরে তুলে বলল কার্ট।

টেকনিশিয়ানরা আবার কাজ শুরু করল। কার্ট সন্তুষ্ট চিত্তে খেয়াল করল স্ক্রিনে দেখানো পানির প্রবাহ আস্তে আস্তে কমতে কমতে একেবারে শূন্যে নেমে এলো। তারপর একটু থেমে আবার শুরু হলো প্রবাহ। তবে এবার সেটা লাল কালিতে, আর সামনে একটা বিয়োগ চিহ্ন।

কয়েক সেকেন্ড পর সব পাইপের পাশের তীর চিহ্নগুলো ঘুরে গেল, যার মানে হচ্ছে পানি এখন উল্টো দিকে বইছে। নীল নদ থেকে পাইপে করে আবার জলাধারগুলোয়ই ফেরত যাবে বলে আশা করল কার্ট।

.

এদিকে জো AS-42 টা নিয়ে সামনে এগুচ্ছে। কিন্তু পুরাতন গাড়িটার গতি অত বেশি না। ইঞ্জিন ঠিক আছে তবে টায়ারগুলোর অবস্থা সঙ্গিন। শুকিয়ে চিমসে হয়ে গিয়েছে আর ভেতরে বাতাস নেই একফোঁটা। মনে হচ্ছে যেন একগাদা নুড়ি পাথরের ওপর গাড়িটা চলছে। তবে অতো বেশি গতিরও ওদের দরকার নেই। শুধু সামনে যা পাচ্ছে সেগুলো উড়িয়ে দিয়ে এগোতে পারলেই হবে। ব্ৰে মেশিনগান হাতে রেনাটা কাজটা বেশ দক্ষতার সাথেই সারছে।

সামনের সুড়ঙ্গটা T-আকৃতিতে দুই দিকে চলে গিয়েছে। জো ওখানে গাড়িটা ঘোরাতে যেতেই AS-42-টা একেবারে কোণার দিকে চলে এলো। সুড়ঙ্গটার একটু সামনেই একটা ATv-র আড়ালে সাকিরের লোকজন এতোক্ষণ ওঁত পেতে বসে ছিল। সাহারিয়ানটা দেখা যাওয়া মাত্রই ওরা গুলি করা শুরু করল।

 জো গিয়ার রিভার্সে নিয়ে খানিকটা পিছনে সরে আসলো। শুধু নাকটা বেরিয়ে থাকল সুড়ঙ্গে। সেখানেই চলতে লাগনো গুলি বর্ষণ। তবে ভাগ্য ভাল যে ইঞ্জিনে লাগলো না।

“ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী গোলা বের করুন তো একটা রেনাটাকে বলল জো।

রেনাটা একটা ছোট গ্রেনেডের সমান গোলা বের করল। এগুলো সাধারণত বাজুকা-র মতো একটা অস্ত্র থেকে ছোঁড়া হয় তবে ওরা যে দুটো পেয়েছিল সে দুটোই ছিল নষ্ট। জো তারপরও নিয়ে এসেছে যদি কাজে লাগে তাই।

“কি করবো এটা দিয়ে?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

“প্রথমে এটা সুড়ঙ্গ দিয়ে ছুঁড়ে মারবেন। তারপর আমি গাড়িটা ওদের দিকে চালানো শুরু করবো আর ওরা আমার দিকে গুলি করতে থাকবে। আর আপনি সেই ফাঁকে ওটার গায়ে গুলি করে ফাটাবেন। তবে এক গুলিতেই ফাটাতে হবে।” বলল জো।

“আমার নিশানা খুব একটা মিস হয় না।” বলল রেনাটা।

 “খুব ভালো।”

গোলাটা এক হাতে আর বেরেটা সাবমেশিনগানটা আরেকটা কাঁধে ঝুলিয়ে রেনাটা গাড়ি থেকে নেমে এলো। তারপর টুক করে এক কোণা দিয়ে গোলাটা সাকিরের লোকগুলোর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আবার সুড়ুৎ করে সরে এলো পিছনে।

জোও সাথে সাথে ইঞ্জিন চালু করে সামনে বাড়লো। নষ্ট টায়ারের ওপর দিয়ে একে বেঁকে এগুতে লাগল গাড়িটা। মূহর্তে আবার শুরু হলো গুলি বর্ষণ। জো মাথা নিচু করে ফেলল। খানিকটা এগিয়ে ও ফিরে তাকাল।

 রেনাটাকে দেখা গেল, সামনে এগিয়ে গুলি করল। বুবম্ করে কানে তালা লাগিয়ে প্রচণ্ড শব্দে ফাটলো গোলাটা। চারপাশে উঠল ধুলোর ঝড়। সেটা কমতেই দেখা গেল ATv-টা একপাশে কাত হয়ে আছে। পাশে কয়েকটা পড়ে আছে। বাকিরা পালিয়েছে। সাকির আর ওর লোকেরা সম্ভবত পাহাড়ের দিকে এগুচ্ছে।

“আমি আর একবার ল্যাবটা দেখে আসি। দরকারি কিছু যদি পাই।” রেনাটা চেঁচিয়ে বলল। তারপর জবাবের অপেক্ষা না করেই দৌড় দিল সেদিকে। আপাদমস্তক ধুলোয় ঢেকে আছে। দারুণ ক্যামেফ্লেজের কাজ দিচ্ছে ওটা। জো-ও AS-42 টা ঠিকমতো সোজা করে সামনে এগুতে লাগল। এক হাত স্টিয়ারিং-এ অন্য হাত ব্রেডায়। কাউকে চোখে পড়লেই গুলি চালাচ্ছে।

.

কার্ট খেয়াল করল হঠাৎই স্ক্রিনে কিছু একটা ভেসে উঠছে।

“কী এটা?” জিজ্ঞেস করল ও।

“এলিভেটর। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় এটা। সোজা পাম্প হাউজে ওঠা যায় এটা দিয়ে। একজন টেকনিশিয়ান জবাব দিল।

 ডিসপ্লেতে দেখা যাচ্ছে প্রায় চারশো ফুট ওপর থেকে ওটা নামছে।

 “এলিভেটর? আগে বলবেন না। থামাতে পারবেন ওটাকে?” লোক দুজন মাথা নাড়লো।

“আপনাদের হাতে কোনো অস্ত্র নাই। তাই আপনাদের ছেড়ে দিচ্ছি। আপনাদের জায়গায় আমি থাকলে কোনো দিকে না তাকিয়ে এখান থেকে ভাগতাম।”

লোক দুজন উঠে দাঁড়ালো। একজন আবার কার্টকে ধন্যবাদ দেয়ার চেষ্টা করল।

“ধুর, যান তো।”

আর দেরি না করে তারা প্রধান সমাধি ক্ষেত্রটার দিকে দৌড় শুরু করল। ওরা আর ফিরে আসবে না নিশ্চিত হয়ে তারপর পাশের দরজাটা দিয়ে ঢুকে পড়ল। অন্যপাশ দিয়ে দেখে জো আসছে গাড়িটাতে করে।

“ঝামেলা আরেকটা বেঁধেছে।” জো-কে বলল কার্ট।

 “কি ঝামেলা?”

‘এই সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় একটা এলিভেটর আছে।”

“এলিভেটর” জো জিজ্ঞেস করল।

“তাইতো দেখছি। ওটা নেমে আসার আগেই আটকাতে হবে।” বলল কাট।

“আমাদের লাগবে না ওটা?”

 “আরে ওটায় করে ওপর থেকে সাকিরের লোক নামছে।”

“তাহলেতো হলোই।”

 কার্ট গাড়িতে উঠতে গিয়ে আবার থেমে গেল। “রেনাটা কোথায়?”

 “ল্যাবে আবার দেখতে গিয়েছে।” জবাব দিল জো।

“আমিও তাহলে ওখানেই যাই। তুমি কাজটা শেষ করে আসো ওখানে। এদের লেজে এর মধ্যে আগুন ধরে গেছে।”

কার্ট চলে যেতেই জো আবার সামনে বাড়লো। ওর অবশ্য এলিভেটরটা উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। কারণ এখান থেকে বের হওয়ার এটাই সবচেয়ে সহজ উপায়। কিন্তু এটা করা ছাড়া উপায়ও নেই।

.

৫৯.

সাকির আর হাসান দৌড়ে সেই স্ফিংস ওয়ালা রুমটায় হাজির হলো আবার। কিন্তু সেই পাথরের কফিনগুলোর ধারে পৌঁছাতেই পায়ের কাছে পানি ছিটকে উঠল।

“আবার পানি ঢুকছে ভেতরে,” বললেন সাকির।

“এরকম তো হওয়ার কথা না। পাম্পগুলোতে এখনও চলছে। শব্দ পাচ্ছি আমি।” জবাব দিল হাসান।

পানির জায়গায় জায়গায় বুদবুদ উঠছে। সাকির বুঝে গেলেন কি হচ্ছে, “ওরা পাম্প উল্টো দিকে চালাচ্ছে। পানি এখন আর আসছে না উল্টো জলাধার গুলোয় ফেরত যাচ্ছে।”

“তাহলে তো ঝামেলা হয়ে গেল। এই রুমটাতো আগের মতো আবার পানি দিয়ে ভরে যাবে। তাড়াতাড়ি সরে যেতে হবে এখান থেকে।” বলল হাসান। সাকির কথা শুনে খুব বিরক্ত হলেন, “তুমি আসলেই একটা ভীতুর ডিম, হাসান। ওরা মাত্র তিনজন। ওদেরকে মেরে পাম্পগুলো আবার ঘুরিয়ে দিলেই হবে।”

“কিন্তু ওরা তো একটা টাঙ্ক নিয়ে এসেছে।”

“ওটা শুধু একটা বন্দুক বসানো গাড়ি। কোত্থেকে পেয়েছে জানিনা। তবে সেটাও ধ্বংস করা যাবে না এমন কিছু না। কয়েকটা ভালো অস্ত্র আর যুতসই একটা ফাঁদ পাততে পারলেই কাজ হয়ে যাবে। যাও তাড়াতাড়ি কয়েকটা RPG নিয়ে এসো।”

হাসান রুমটার চারদিকে তাকাল। তারপর ওদের সাথে আসা সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে চেঁচালো, “তাড়াতাড়ি আসো।”

ওরা দুজন যেতেই সাকির ঘরটার মাঝামাঝি চলে এলো। সেখান থেকে চোখে পড়ল তার একজন লোক বাইরের সুড়ঙ্গ দিয়ে পালাচ্ছে, “যাচ্ছ কোথায়? এদিকে এসো, হাক ছাড়লেন উনি।

কিন্তু লোকটা তার ডাকে কর্ণপাত না করে বের হওয়ার সুড়ঙ্গের দিকে দৌড়ে চলে গেল। সাকির রেগে মেগে পিস্তল বের করে বেশ কয়েকটা গুলি করলেন একসাথে। লোকটা শেষ মাথায় পৌঁছতেই একটা লাগল গায়ে। লোকটা কাত হয়ে কুমিরের গর্তে পড়ে গেল। ক্ষুধার্ত কুমিরগুলো এক সেকেন্ডের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর।

.

হাসান অস্ত্রাগারে পৌঁছে নিজের কোড দিয়ে দরজা খুললো। ভেতরে তাক ভরা রাইফেল আর গোলা-বারুদ। শেষ মাথায় এক সেট রাশিয়ান RPG দেখা গেল। ও সেটা সাথের সৈন্যটাকে দিয়ে বলল, “সাকিরের কাছে নিয়ে যাও।”

 বিনা বাক্য ব্যয়ে লোকটা সেটা নিয়ে ছুটলো।

হাসান পাশের RPG (Rocket Propelled Grenade)-টা দেখার ভান করল কিছুক্ষণ। তারপর যখন নিশ্চিত হলো যে ও একা তখন একটা ফোন তুলে নিলো। ফোনটা ওপরের কন্ট্রোল রুমের সাথে যোগাযোগের জন্য ব্যবহার হয়। আশা করল যে লাইনটা এখনও কেটে দেয়া হয়নি।

কয়েক সেকেন্ড রিং হওয়ার পর সেকশন লিডারের গলা পাওয়া গেল।

 “স্করপিয়নকে দাও।” বলল হাসান।

স্করপিয়ন এসে বলল, “আমিতো দুই স্কোয়াড লোক নিয়ে এলিভেটরের দিকে যাচ্ছিলাম।”

“ওদেরকে একাই যেতে দাও। তুমি আমার সাথে তিন নম্বর বের হওয়ার রাস্তায় দেখা করো। লবণের খনির সুড়ঙ্গ যেটা। একটা ল্যান্ড রোভার নিয়ে এসো। আমাদেরকে তাড়াতাড়ি ভাগতে হবে।”

স্করপিয়ন কোনো প্রশ্ন করল না। হাসান রেখে দিল ফোন। পানি এখন ওর গোড়ালি ছাড়িয়েছে। গুহার হাজার হাজার ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি উঠছে। ও অস্ত্রাগার থেকে বেরিয়ে যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে তাকাল, তারপর ঘুরে উল্টোদিকে দৌড় দিল।

 বেঁচে থাকলে আরেকদিন যুদ্ধ করা যাবে।

.

সাকির সমাধি কক্ষে অপেক্ষা করছেন। প্রথম সৈন্যটা একটা RPG কাঁধে দৌড়ে এলো। কিন্তু হাসান কোথায়?

কিন্তু সে কথা জিজ্ঞেস করার আগেই উল্টো দিক থেকে আরেকজন রুমে প্রবেশ করল। সেই ইতালিয়ান মহিলাটা। সে রুমটার ভেতর দিয়ে ল্যাবরেটরির সুড়ঙ্গের দিকে ছুটছে। সারা গায়ে ধুলো মাখা। সেজন্যে কম আলোতে সাকির প্রথমে ওকে খেয়াল করেনি। রুমের ভেতর পুরো ঢোকার পর টের পেয়েছে। তবে এতে মহিলারই ক্ষতি হলো বেশি।

সাকির মাথা নিচু করে অপেক্ষা করতে লাগল। একে ধরতে পারলেই দারুণ কাজ হবে। আমেরিকানগুলোর দিল নরম। এরকম একটা সুন্দরীকে বাঁচানোর জন্য বলা মাত্র আত্মসমর্পণ করবে ওরা।

 মেয়েটা রুমের মাঝামাঝি পৌঁছতেই কুমিরগুলো ওদের গর্ত থেকে ডেকে উঠল। হঠাৎ পাওয়া খাবার নিয়ে মারামারি করছে ওরা।

শব্দটা শুনে মেয়েটার মনোযোগ ছুটে গেল আর সাকির সেই সুযোগে সামনে ঝাঁপ দিয়ে ওকে জাপটে ধরলেন আর আরেক হাত দিয়ে মেশিন গানটা ফেলে দিলেন।

রেনাটাও দ্রুত সামলে নিলো। একটা পাক খেয়ে সাকিরের চোয়াল বরাবর একটা ঘুসি বসিয়ে দিল। কিন্তু সাকির উল্টো হেসে দিলেন। উনি রেনাটাকে পাশের কফিনটার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। রেনাটা উঠে দাঁড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করল কিন্তু সাকির তাকে টেনে তুলে ঠাস করে সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা চড় বসালেন গালে।

“যেখানে আছ সেখানেই থাক।” আদেশ করলেন উনি।

কিন্তু রেনাটা আবার ওঠার চেষ্টা করতেই ওর পাজর লক্ষ্য করে লাথি হাকালেন এবার। ফুসফুসের সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেল রেনাটার। সাকির নিজের পিস্তল বের করে রেনাটার দিকে তাক করে ওর ওপর একটা পা তুলে দাঁড়ালেন।

রেনাটা আর নড়লো না।

ও যে একটা বুলেটের অপেক্ষা করছে বুঝলেন সাকির। কিন্তু ওকে নিয়ে ওনার পরিকল্পনা আলাদা।

“চিন্তা করবেন না। আপনাকে তাড়াতাড়িই ওপারে পাঠাবো, তবে সেটা আপনাদের বন্ধুদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে। একেবারে কাছ থেকে।” তারপর RPG কাঁধে সৈনিকটার দিকে ফিরে বললেন, “স্ফিংসটার ওপর গিয়ে দাঁড়াও। ওখান থেকে গুলি করা সহজ হবে।”

“হাসানের কী হলো?”

 “ওর সাহস আপাত তো শেষ।”

.

৬০

জো এলিভেটরের কাছে গিয়ে দেখলো ওটা আসলে গুহার পাথর কেটে বানানো। তার ওপর ধাতব একটা খোল বসিয়ে বানানো হয়েছে এলিভেটর। খোলটা অনেক প্রশস্ত আর মোটা কারণ এলিভেটরে করে ভারী ভারী যন্ত্রাংশ আর একসাথে অনেক মানুষ উঠা-নামা করাতে হয়। পৃথিবীর যে কোনো খনিতেই এমন ব্যবস্থা থাকে।

এলিভেটরটা এখনও নিচে নামেনি। তবে চাকাগুলো ঘুরছে দেখা যাচ্ছে। জো ঠিক ওটার সামনে গিয়ে থামল। কমপক্ষে বিশ থেকে ত্রিশজন অস্ত্রধারী মানুষ নামছে ওতে করে বলে জো’র অনুমান।

দুর্ভাগ্যক্রমে বেশিরভাগ এলিভেটরের মতোই এটাও ওপর থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এর সাথে একটা ভারী কিছু লাগানো সেটাই ওঠা-নামা করে এটাকেও ওঠায় আর নামায়। জো’র তাই করার মতো একটাই কাজ তা হলো যে লাইনের ওপর দিয়ে এলিভেটরটা নামছে সেটাকে বাঁকিয়ে দেয়া। হয়তো তাতে আটকে গিয়ে এলিভেটরটা আর নামবে না।

ও সাহারিয়ানটাকে জায়গামত এনে ইঞ্জিন চালু করল। তারপর যেই মাত্র সামনে বাড়বে তখনি খেয়াল হলো যে রুমে পানি ঢুকছে। পানিটা আসছে প্রধান সুড়ঙ্গটা দিয়ে। এখানে এসে আঙুলের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।

“হায় হায় ফুটো করে ফেলেছি দেখি!” নিজেকেই নিজে বলল জো।

এলিভেটরটা পালানোর জন্যে ওদের কাজে লাগবে। এই চিন্তা থেকে জো ওটাকে নষ্ট করার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে প্ল্যান-বি অনুযায়ী কাজ করবে বলে ঠিক করল। ও AS-42-টার পিছনে গিয়ে যেখান থেকে গুলি করতে হয় সেখানে দাঁড়ালো, তারপর সামনের ধাতব পাতটাও তুলে দিল আত্মরক্ষার জন্য। তারপর ব্রেডা মেশিন গান আর ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী বন্দুক দুটোতেই গুলি ভরে অপেক্ষা করতে লাগল। এলিভেটর নামার।

কিছুক্ষণ পরই এলিভেটরের ছায়া চোখে পড়ল, তার পরেই ওটার নিচটা দেখা গেল। ধাতব বক্সটা নিচে নামতেই দেখা গেল ওতে কোনো দরজা নেই শুধু একটা খাঁচা। তার ভেতর কমপক্ষে বিশজন লোক।

এরকম বন্ধ অবস্থায় বিশজন মানুষকে গুলি করে মারার কোনো ইচ্ছাই জোর নেই। তবে একজনও যদি গড়বড় করে তাহলে ও বন্দুক খালি হওয়ার আগ পর্যন্ত গুলি চালাবে।

ঝনাৎ শব্দ করে এলিভেটরটা মাটি স্পর্শ করল।

“তোমাদের জায়গায় আমি হলে আবার ওপরেই ফিরে যেতাম।” চিৎকার করে বলল জো। দুটো হাতই দুই বন্দুকের ট্রিগারে। ধাতব আবরণটার মাঝখানের ছোট্ট ফোকরটা দিয়ে তাকিয়ে আছে। সাহারিয়ানার লাইট দুটো এলিভেটরের লোকগুলোর চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে।

এলিভেটরের খাঁচাটার বাইরের দরজা খুলে গেল। ভেতরের লোকগুলো যার যার বন্দুক তোলার চেষ্টা করল কিন্তু গাদাগাদি করে থাকার কারণে পারলো না।

“আজকে তোমাদের না মরলেও চলবে!” জো চেঁচালো আবার।

ভেতরের দরজাটাও খুলে গেল। জো ভেবেছিল কেউ না কেউ কিছু একটা করার চেষ্টা করবে আর ওর গুলিতে কচু কাটা হবে। কিন্তু কেউ লড়লো না।

ওরা ওর দিকে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু অতিরিক্ত আলোর কারণে পারলো না। শেষমেশ ওদেরই কেউ একজন সুইচটা দিল। আবার গেটগুলো বন্ধ হয়ে গেল আর এলিভেটরটা ওপরে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওটার সাথে সাথে জো’র হাতের বন্দুক দুটো ওপরের দিকে বাঁকাতে লাগল। খোলের ভেতর অদৃশ্য হওয়ার পর থামল। তারপর গাড়ি থেকে নেমে উঁকি দিয়ে দেখলো ওটা ওপরে উঠছে কি-না। আরো তিরিশ সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর বুঝলো যে ওরা আর ফিরবে না। তখন ও আবার এসে ড্রাইভারের সিটে চড়ে বসলো।

কার্টের ধারণা মতে এটা প্রায় চারশো ফুট লম্বা। তার মানে কমপক্ষে দুই মিনিট লাগবে ওপরে পৌঁছাতে। আসা-যাওয়া চার মিনিট। এইটুকুই ওদের জন্যে যথেষ্ট।

ও আবার ইঞ্জিন চালু করে কন্ট্রোল রুমের দিকে ছুটলো। ওখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পানি এক ফুট সমান উঁচু হয়ে গেল।

মাঝপথেই কার্টকে দেখতে পেল। সাকিরের কয়েকজন লোক ওকে ঘিরে ধরেছে। ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী বন্দুকটা থেকে একটা গোলা ছুড়লো জো। গোলাটা দেয়ালে বিশাল একটা ছিদ্র তৈরি করল আর লোকগুলোও চারদিকে ছিটকে পড়ল।

কার্ট গাড়িটার দিকে দিল দৌড়…। “এক্কেবারে সময়মতো চলে এসেছে। এলিভেটরের কী হল?”

“বুঝিয়ে-শুনিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি।” জবাব দিল জো।

“আবার ফেরত আসবে নাতো?”

জো চারদিকে তাকাল। চারপাশে ধুলো আর ধোয়ার গন্ধ। আলো কমে এসেছে আরও। পানিও বাড়ছে দ্রুত। “তুমি কী আসতে?”

“জান বাঁচাতে চাইলে আসতাম না।” উঠতে উঠতে বলল কার্ট।

“রেনাটার সাথে তো মনে হচ্ছে তোমার দেখা হয়নি।” বলল জো। কার্ট মাথা নাড়লো। “এই ব্যাটাদের হাতে ধরা খেয়ে গেলাম। ওকে খুঁজে বের করে এখান থেকে তাড়াতাড়ি ভাগি চলো। নাহলে আঁতরে পার হতে হবে।”

জো আবারো সামনে বাড়লো। সামনের দিকে পা ছপাৎ শব্দ তুলে সাহারিয়ানটা এগুচ্ছে। পিছনে লম্বা একটা ধারা সৃষ্টি হচ্ছে। সুড়ঙ্গের মাঝখানের একটা নিচু জায়গায় ওরা প্রায় ডুবেই গিয়েছিল তবে খুব দ্রুত ঢালটা পার হয়ে আবার উঠে আসায় বেঁচে যায় কোনো মতে।

“পানি আসছে কোত্থেকে?” জিজ্ঞেস করল জো।

“নীল নদ। আমি পাম্পগুলো উল্টোদিকে চালিয়ে দিয়েছি। এখন ওগুলো নদী থেকে পানি আবার জলাধারে ফেরত পাঠাচ্ছে। সেজন্যেই ফুটোফাটা দিয়ে আবার ফেরত আসছে পানি। জবাব দিল কার্ট।

“আর লিবিয়া আর তিউনিসিয়ার শুকনো লেকগুলো আবার পানিতে ভরে উঠছে।”

কার্ট দাঁত বের করে হাসলো, “আমিতো ভাবছি বেনগাজীর শহরতলীর গরম পানির ঝরনায় গোসল করতে যাবো।

সামনেই সাকিরের লোকের দুটো লাশ ভাসতে দেখা গেলো।

 “রেনাটা এই দিকে গিয়েছে সম্ভবত।” কার্ট অনুমান করলো।

ওরা আরো এগুতে লাগলো। পানি ততোক্ষণে গাড়ির অর্ধেক উচ্চতায়। উঠে এসেছে।

“এই গাড়ি কী পানিতে চলে?” জিজ্ঞেস করলো কার্ট।

জো মাথা নাড়লো, “আর এক-দুই ফুট পানি উঠলেই আর চলবে না।”

ওরা সুড়ঙ্গ পার হয়ে সমাধি ক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হলো।

 “ল্যাব ঐ পাশে।” বলল কার্ট।

কার্ট রুমের চারপাশ খেয়াল করতে লাগল আর জো গাড়িটা রুমের মাঝখানে নিয়ে এলো। রুমের ভেতরে কেউ নেই কিন্তু মাঝামাঝি জায়গায় হুউশ করে একটা শব্দ ওর দৃষ্টি কাড়লো।

চোখের কোণা দিয়ে কার্ট দেখতে পেল একটা আগুন ধোয়া ছড়াতে ছড়াতে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে। কিছু করা তো দূরে থাক চিৎকার করার সময় পর্যন্ত ছিল না। RPG-টা ওদের কয়েকফুট সামনে একপাশে আছড়ে পড়ল। সাথে সাথে পানিতে বিশাল একটা ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হলো। বিস্ফোরণের ধাক্কায় গাড়ির সামনের দিকটা দুমড়ে মুচড়ে ওটা একপাশে কাত হয়ে পড়ে গেল।

কার্ট জ্ঞান হারায়নি কিন্তু ওর কান ভোঁ ভোঁ করছে। মাথাতেও ভোতা যন্ত্রণা। গাড়ি থেকে পানিতে পড়ে গিয়েছে।

সামনে ড্রাইভারের সিটের দিকে তাকালো, “তুমি ঠিক আছ?”

 “পা আটকে গিয়েছে। তবে সম্ভবত কিছু ভাঙ্গেনি।” জবাব দিল জো।

পা টানাটানি করে ছোটানোর চেষ্টা করছে। কার্ট ড্যাশবোর্ডের সামনে বাঁকা হয়ে যাওয়া ধাতব দণ্ডটায় কাঁধ ঠেকিয়ে ঠেলে দিল। জোর পা মুক্ত হয়ে ও পানিতে গিয়ে পড়ল।

“ভাগ্য ভালো যে ওটা সরাসরি আমাদের ওপর পড়েনি। নইলে এতোক্ষণে ছাতু হয়ে যেতাম।” জানা কথাটাই মুখে বলল জো।

“এটার মানে হচ্ছে এখানে আরো কেউ আছে।” কার্ট বলল।

“হ্যাঁ, আছে।” ভাঙ্গা গাড়িটার অপর পাশ থেকে ভেসে এলো কণ্ঠটা কার্ট চিনতে পারলো। সাকিরের কণ্ঠ ওটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *