১১.
রোগী পরিবাহী জাহাজ নাটাল
ভূমধ্যসাগর
কার্ট, জো আর উদ্ধারকৃত বাকিরা একটা ইতালিয়ান মালবাহী জাহাজের ডেক এ বসে আছে। এটার মাস্তুলে একটা বিশাল লাল রঙের ক্রস আঁকা। ওদেরকে রাসায়নিক প্রতিরোধী সুট পরিয়ে একটা মিলিটারি হেলিকপ্টারে করে পূর্ব দিকে নিয়ে আসা হয়েছে। সবচে কষ্ট হয়েছে জো-কে MRI মেশিনটা থেকে ছোটাতে। কিন্তু ওর কাপড়ের সাথে লাগানো ধাতব অংশগুলো কেটে ফেলতেই সহজে ওকে ছুটিয়ে ফেলা যায়।
তারপর বিশেষ সাবান দিয়ে গোসল করে দূষণমুক্ত হয়ে, কয়েকটা মেডিকেল টেস্ট করার পর এখন স্বাভাবিক কাপড় পরার সুযোগ পেয়েছে। তারপর থেকেই ডেক-এ বসে আছে আর কফি খাচ্ছে। এতো ভালো এসপ্রেসো শেষ কবে খেয়েছে কার্ট মনে করতে পারে না।
দ্বিতীয় কাপ খাওয়ার পর কার্টের কেমন যেন অস্থির লাগতে লাগলো। আক্ষরিক অর্থেই বসে থাকতে পারছে না।
“তোমাকে কেমন যেন লাগছে।” জো বলল।
“মনটা কেমন খুঁতখুঁত করছে।”
“ক্যাফেইনের জন্যে এমন হচ্ছে। এত কফি খেলে তো হাতীও শুয়ে পড়বে।”
কার্ট একবার ওর হাতের খালি কাপটার দিকে নজর বুলিয়ে আবার জো এর দিকে তাকাল, “আশেপাশে ভালো করে দেখতে একবার। অন্যরকম কিছু চোখে পড়ছে?”
“আচ্ছা বলছি।” জো জবাব দিল। তারপর চারপাশে একবার মাথা ঘুরিয়ে বলল, “নীল আকাশ, ঝিকিমিকি পানি। নতুন জীবন পাওয়ায় সবাই খুশি। তবে আমি নিশ্চিত এর মধ্যেও তুমি কোনো একটা ঘাপলা ঠিকই খুঁজে পেয়েছ।”
“হুম। আমরা সবাই এখানে। ওখান থেকে বেঁচে আসা সবাই। কিন্তু একজন নেই। আমি যার সাথে সবচে বেশি কথা বলতে চাচ্ছি সেই মানুষটাই নেই : ড. আমব্রোসিনি।”
“জাহাজে ওঠার সময় দেখলাম মহিলাকে।” কফিতে চিনি ঢালতে ঢালতে বলল জো। “তার সাথে দেখা করার জন্য উতলা হওয়ায় তোমাকে দোষ দেয়া যায় না। এমন ডাক্তারের রোগী হতে কে না চায়।”
মহিলা যে দারুণ আকর্ষণীয় সে কথা কার্ট অস্বীকার করে না মোটেও, তবে ওর দেখা করতে চাওয়ার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। “বিশ্বাস করবে না জানি, তবে আমার আগ্রহ অন্য কারণে।”
জো একটা ভ্রূ সামান্য তুলে এমন ভঙ্গিতে কফিতে চুমুক দিল, যার অর্থ দাঁড়ায়, বুঝেছি! বুঝেছি!’
“সত্যি! আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দরকার,” কার্ট বলল।
“তা তো বটেই। প্রথম প্রশ্ন হলো আপনার নাম্বারটা? তারপরই জিজ্ঞেস করবে আপনার কেবিনে যাবেন নাকি আমারটায় আসবেন?” জো ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল।
কার্ট হেসে দিল। “আরে ধুর! আমি অপারেশন রুমে যাওয়ার পর উনি এমন কিছু কথা বলেছে যেগুলো খুবই গোলমেলে। যে লোকটা আমাদেরকে মারতে চেয়েছিল মহিলা তার সম্পর্কে কিছু একটা জানে। আর খেয়াল করেছে ভদ্র মহিলা একদম শুরু থেকেই এই ঘটনাটাকে আক্রমণ… আক্রমণ বলে আসছে। একদম সেই রেডিও কল থেকেই।”
জো’র চেহারা থেকে রসিকতা মুছে গেল, “কি বলতে চাচ্ছ তুমি?”
কার্ট কাঁধ ঝাঁকালো, “সমুদ্রতীরে একটা জাহাজ পুড়ছে, সেখান থেকে রহস্যময় কালো ধোঁয়ায় শহর ছেয়ে গেল, টপটপ মানুষসহ সব প্রাণী জায়গায় পড়ে মরতে লাগল। তুমি এটাকে একটা বিপদ বলতে পারো, দুর্ঘটনা বলতে পারো বা দুর্যোগও বলা চলে। কিন্তু আক্রমণ বলো কোন হিসাবে?”
“কথাটা কিন্তু মারাত্মক।” জো বলল।
“এই কফিটার মতোই মারাত্মক।” কার্ট বলল।
জো কিছুক্ষণ দূর দিগন্তে তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছ তা একটু একটু ধরতে পারছি। সে কথা ভাবতে ভাবতেই আরেকটা কথা মাথায় এলো। সে এত দ্রুত কীভাবে জানালো যে বাঁচতে হলে সবাইকে নিয়ে রুম সিল করে থাকতে হবে। আর কেউ তা জানে না। ডাক্তার হোক আর যা ই হোক এত দ্রুত তো এটা জানার কথা না।”
কার্ট মাথা ঝাঁকালো, “যদি কেউ আগে থেকেই জানে যে এ ধরনের বিপদ আসছে শুধু তখনই এটা সম্ভব।”
“জরুরি অবস্থা মোকাবেলা।”
“কিংবা সবসময় এভাবেই ওরা অপারেশন চালায়।”
কার্ট চারদিকে তাকাল। তিনজন ইতালিয়ান সৈন্যকে রাখা হয়েছে ওদেরকে খেয়াল করার জন্য। দায়সারা একটা কাজ। কারোর-ই তাই ওদের দিকে মনোযোগ নেই। দুজন একদম শেষ মাথায় রেলিং-এ ত্র দিয়ে ঝুঁকে গল্প করছে। তৃতীয়জন অবশ্য কাছেই। একটা ক্রেন-এর পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। “গার্ডগুলোর মনোযোগ একটু অন্যদিকে সরাতে পারবে?”
“পারবো, তবে কথা দিতে হবে যে তুমি ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এমন কোনো গোলমাল পাকাবে যাতে আমরা মহা বিপদে পড়ি আর ওরা আমাদেরকে জাহাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, জো বলল।
কার্ট শপথ করার ভঙ্গিতে হাত তুলে বলল, “তোমার নামে শপথ করলাম।”
“ঠিক আছে তাহলে। শুরু করা যাক।” কফির মগে শেষ চুমুকটা দিয়ে বলল জো।
কার্ট দেখলো জো অলস ভঙ্গিতে তৃতীয় সৈন্যটার দিকে এগিয়ে গেল। এই একজনের মনোযোগ সরাতে পারলেই হবে। বাকিরা অনেক দূরে। জো কিছু একটা নিয়ে কথা বলা শুরু করল। কিছুক্ষণ পরেই তুমুল আলোচনা জমে উঠল। জো কথা বলার সাথে সাথে প্রচুর হাত নাড়ছে। ফলে সৈন্যটার পুরো মনোযোগ জো-এর দিকে।
কার্ট উঠে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ সামনে বাড়লো। তারপর একটা বন্ধ হ্যাঁচওয়ের পাশে বসে পড়ল। কথা বলতে বলতে জো আকাশের দিকে কিছু একটা দেখলো আর সৈন্যটা সেদিকে তাকাতে গিয়ে সূর্যের আলোর কারণে চোখের ওপর হাত দিল। এই সুযোগে কার্ট ঝট করে হ্যাঁচটা খুলে ভেতরে ঢুকে আবার নীরবে লাগিয়ে দিল।
ভাগ্য ভালো যে সামনের বারান্দাটা খালি। অবাক হলো না কার্ট। জাহাজটা ভালোই বড়। ছয়শো ফুট লম্বা কিন্তু ক্রুসহ আরোহী মাত্র দুশো জনও হবে না। তাই জাহাজের বেশিরভাগ জায়গা খালিই পড়ে থাকে। এখন ওকে রোগী রাখার জায়গাটা খুঁজে বের করতে হবে। সম্ভবত ওখানেই পাওয়া যাবে ডা. আমব্রোসিনিকে।
ও প্রথম বারান্দাটা ধরেই এগুলো। জাহাজের সামনের দিকে যাচ্ছে। ওখানেই ওদেরকে গোসল আর মেডিকেল টেস্ট করা হয়েছে। রোগী রাখার জায়গাটাও ওটার কাছেই হওয়ার কথা। যদি খুঁজে পায় তাহলে কোনো একটা অসুখের ভান করে ঢুকে পড়তে হবে। কাশি বা পেট ব্যথা কিছু একটা বলতে হবে। ক্লাস এইটে স্কুল পালানোর পর এমন অজুহাত আর কোথাও দেয়ার প্রয়োজন পড়েনি।
রাস্তার পাশেই একটা জিনিসপত্র ঠাসা বক্স পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিলো কার্ট। নৌবাহিনী আর তারপর NUMA-তে কাজ করার সুবাদে ও জানে, যদি তুমি চাও যে যাত্রাপথে তোমাকে কেউ না আটকাক, তাহলে হাঁটতে হবে দ্রুত, কারো চোখের দিকে তাকানো যাবে না আর সবচে ভালো হয় হাতে কিছু একটা নিয়ে এমনভাবে হাঁটো যে জিনিসটা যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছে দিতে হবে।
কৌশলটা এখানেও দারুণভাবে খেটে গেল। একটু পরই একদল নাবিক ওকে পাশ কাটালো কিন্তু দ্বিতীয় বার ফিরেও তাকাল না। কার্ট কিছুদর এগোতেই দেখে নিচে নামার সিঁড়ি। কি মনে করে নেমে এলো নিচে।
নিচে এসে এদিক সেদিক ঘুরে-টুরে টের পেল ও রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। মেডিকেল সেন্টারের নাম গন্ধও নেই আশে পাশে। এদিকে শুধু স্টোর রুম আর তালাবদ্ধ কেবিন।
“সাব্বাস ব্যাটা।” নিজেকেই নিজে শোনালো কার্ট। এবার কোন দিকে যাবে ভাবতে ভাবতেই ও দেখে সামনে দিয়ে ল্যাব কোট পরা দুজন নেমে আসছে। একজন পুরুষ অপরজন মহিলা। নিজেদের মধ্যে আলাপে মগ্ন।
কার্টকে পাশ কাটাতেই পিছু নিলো। “রাস্তা খুঁজে পাওয়ার ১০১টি উপায়ের প্রথম উপায় হলো : জায়গাটা চেনে এমন কারো পিছু পিছু যাওয়া।” নিজেকেই বলল আবার কার্ট।
আরো দুটো সিঁড়ি আর বেশ কিছু গলি-ঘুপচি পেরিয়ে সামনের দুজন একটা হ্যাঁচের আড়ালে অদৃশ্য হলো।
কার্টও দরজাটার পাশে দাঁড়ালো। বাইরে থেকে দেখে তো এটাকেও একটা স্টোর রুম মনে হচ্ছে ওর কাছে। ভেতরে কি আছে দেখার জন্য। দরজাটা একটু ফাঁক করতেই বুঝতে পারলো ওর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।
সামনে গুহার মতো বিশাল একটা রুম। ওপরে সারি সারি বাতি জ্বলছে। এটা সম্ভবত জাহাজের মালপত্র রাখার জায়গা তবে এখন এখানে কোনো মালপত্র নেই। তার বদলে শত শত লাশ শুয়ে আছে মেঝেতে। খাটের ওপরও দেখা গেল কয়েক জনকে। কারো পরনে বেদিং স্যুট, যেন সমুদ্রের তীর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ওগুলো। অন্যদের পরনে সাধারণ পোশাক। কারো কারো পরনে একেবারে অফিসিয়াল পোশাক। যেন অফিসে এসে ঘুমিয়ে পড়েছে।
কার্ট দরজাটা পুরো খুলে ভেতরে পা দিল। এতো লাশ দেখে অবশ্য যতটা অবাক হওয়ার কথা ও ততটা হয়নি। কারণ লাশগুলোকে সরাতেই হতো। আর সারাদিনই দেখেছে জাহাজ থেকে হেলিকপ্টার দ্বীপটায় যাচ্ছে আর আসছে। বেশ কয়েকজনের হাতে-পায়ে দেখা গেল তার-টার হাবিজাবি লাগানো। সেগুলো আবার লাগানো একগাদা মনিটর আর অন্যান্য যন্ত্রপাতিতে। কারো কারো হাতে স্যালাইন লাগানো। কাউকে কাউকে খোঁচাখুঁচি করছে ডাক্তাররা। একজনের শরীরে কারেন্টের লাইন দিতেই কাঁপাকাপি শুরু হয়ে গেল। কিন্তু কারেন্ট থামাতেই আবার যেই কে সে-ই। নড়াচড়া নেই।
প্রথমে কেউ-ই কার্টকে খেয়াল করল না। কারণ ওর পরনে এই জাহাজের ক্রুদের মতো পোশাক আর সবাই যার যার কাজে ভীষণ ব্যস্ত। আরো সামনে এগোতেই ওর চোখে পড়ল কডি উইলিয়াম আর আরো দুজন NUMA-র লোকের লাশ। কার্ট সামনে এগিয়ে গেল। একজনকে একটা ইনজেকশন দেয়া হচ্ছে। তার মাথাতেও তার লাগানো কাউকে কারেন্টের শক দেয়া হচ্ছে।
“আরে আরে করছেন কি?” কার্ট চেঁচিয়ে উঠল।
ঘরের বেশিরভাগ চোখ ওর দিকে ঘুরে গেল। মুহূর্তেই সবাই বুঝে গেল যে ও এখানকার কেউ না। “কে আপনি?” একজন জিজ্ঞেস করল।
“তার আগে বলেন আপনারা কারা? আর লাশের ওপর এসব কি শুরু করেছেন?” আগের চেয়েও জোরে চেঁচালো কার্ট।
কার্টের চড়া আওয়াজ পুরো রুম জুড়ে প্রতিধ্বনিত হলো। হঠাৎ এর এমন রাগে বাকি সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে। শুধু দু-একজনকে দেখা গেল ফিসফিস করে পাশের জনের সাথে কথা বলছে। কেউ মনে হলো জার্মান ভাষায় কি বলছে। হঠাৎ একজন চেঁচালো, “সিকিউরিটি?”
সাথে সাথে কয়েকজন মিলিটারি পুলিশ চলে এলো।
“আপনি যে-ই হন, এখানে থাকতে পারবেন না,” একজন ডাক্তার বলল। অদ্ভুত উচ্চারণে ইংরেজি বলছে লোকটা। তবে টানটা ইতালিয়ান না, ফ্রেঞ্চ সম্ভবত।
“ওনাকে এখান থেকে নিয়ে যান।” আরেকজন বলল। এর উচ্চারণ শুনেও অবাক হলো। মনে হচ্ছে এর বাড়ি কানসাম বা আইওয়া।
কিন্তু কার্ট এসব কথাকে পাত্তা না দিয়ে NUMA-র লোকটার দিকে এগুলো। কি করছে আসলে ওরা কাছে থেকে দেখতে চায়। কিন্তু সিকিউরিটিরা বাধ সাধলো। ওদের হাতে লাঠি। কোমরে গোজা টীজার (কারেন্টের শক দেয়ার যন্ত্র)।
“বের করে ব্যাটাকে। আর দয়া করে একটু পাহারা দেয়ার দিকে মন দাও। এরকম হতে থাকলে কাজ করবো কীভাবে?” বলল আরেকজন।
কার্ট যাওয়ার জন্যে ফিরতেই একটা মহিলা কন্ঠে বলে উঠল, “আরে করেন কি? হিরো-কে কেউ এভাবে সম্ভাষণ জানায়?”
কথাগুলো ইংরেজিতে বলা কিন্তু ইতালিয়ান টান আছে। ব্যঙ্গ করে বলা হলেও কথাটায় কর্তৃত্বের সুর স্পষ্ট। কথাগুলো বলেছে ডা. আমব্রোসিনি। সামান্য ওপরে একটা মঞ্চমত জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সে।
একজন নর্তকীর মতো মোহনীয় ভঙ্গিমায় সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো রেনাটা।
“কিন্তু ভা, আমব্রোসিনি…” বিদেশি একজন ডাক্তার বাধা দিতে গেলেন।
“কিন্তু কিছু না ডা. রবিশ্ব। লোকটা আমার জীবন বাঁচিয়েছে, আমি বাদে আরো আঠারো জনের জীবন বাঁচিয়েছে আর আমাদের তদন্তের শুরু থেকে এই সমস্যার উৎস সম্পর্কে সবচে বড় কু-ও সে-ই দিয়েছে।”
“আজকের পরিস্থিতিটা কিন্তু সম্পূর্ণ অন্যরকম।” ডা. রবিশ্ব বললেন।
“হ্যাঁ, আমি জানি।” ডা. আমব্রোসিনি জবাব দিলেন।
কার্ট ব্যাপারটায় মজা পেল। ডা. রেনাটা পুরোপুরি সিঁড়ি থেকে নামতেই দেখা গেল রুমের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে খাটো। কিন্তু সে-ই যে বস সেটাও বোঝা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে কার্টকে দেখে আসলেই খুশি হয়েছে। তবে এই সামান্য মুচকি হাসি আর কটাক্ষে কার্টের মন গলবে না।
“এখানে আসলে হচ্ছেটা কি?” জিজ্ঞেস করল কার্ট।
“একা একা কথা বলি চলুন।” ডা. আমব্রোসিনি প্রস্তাব দিল।
“সেটাই ভালো। চলুন।”
ডা. আমব্রোসিনি কোণার একটা অফিস রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। কার্টও গেল পিছনে। রুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিল।
রুমটা আসলে জাহাজের কোয়ার্টার মাস্টারের জন্যে বানানো। এখন সেটা ডাক্তারদের ব্যবহার উপযোগী বানানো হয়েছে।
“প্ৰথমত, আমি আপনাকে আমার জীবন বাঁচানোর জন্যে ধন্যবাদ দিতে চাই।” ডা. আমব্রোসিনি শুরু করলেন।
“এই মাত্র আপনিও একই কাজ করেছেন।”
ডা. আমব্রোসিনি হাসলো। তারপর মুখের সামনে এসে পড়া এক গোছা অবাধ্য চুল কানের পিছনে খুঁজে বলল, “আমি আপনাকে কিছু থেকেই বাঁচাইনি। আমার ধারণা আমি ওই পুলিশগুলোকে বরং মার খেয়ে অপমান হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছি।”
“আপনি আমার সম্পর্কে বেশি উঁচু ধারণা করে ফেলছেন।” কার্ট বলল।
“আমার তা মনে হয় না।” হাত দুটো বুকে ভাজ করে সামনে ঝুঁকে বলল রেনাটা।
সত্যি হোক আর না থোক প্রশংসাটা আন্তরিক। তবে কার্ট এখানে সৌজন্য বিনিময় করতে আসেনি। “দয়া করে মূল কথায় আসুন। ঐ হাতুড়ের দল আমার বন্ধুদের লাশের ওপর কী সব করছে?”
“ঐ হাতুড়েগুলো আমার বন্ধু।” আহতস্বরে বলল ডা. আমব্রোসিনি। “ওরা অন্তত বেঁচে আছে।”
ডা. আমব্রোসিনি একটা বড় শ্বাস নিলো, সে ঠিক করছে কতটুকু বলবে। তারপর শ্বাস ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ। আমি বুঝতে পারছি যে আপনার মন অনেক খারাপ। আপনার বন্ধুরা আর দ্বীপের সবাই মারা গেছে। কিন্তু আমাদেরকে তো খুঁজে দেখতে হবে”।
“কোন ধরনের বিষ সবাইকে মেরেছ?” বাক্যটা শেষ করল কার্ট।
“খুব ভালো প্রস্তাব। বুঝলাম সেটা। কিন্তু আমি যদূর জানি সেগুলো করা হয় রক্ত বা কোষ পরীক্ষা করে। আর সবচে বেশি দরকার হলো ঐ পোড়া জাহাজটা থেকে আসা ধোয়াটা পরীক্ষা করা। আসল ব্যাপারটা পরিষ্কার করুন। নাহয় ওসব ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো যে চিকিৎসা আপনারা দিচ্ছেন তা বন্ধ করুন।”
“ডা. ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের চিকিৎসা! আরে আমরা তো সেটাই করার চেষ্টা করছি।”
কার্ট ধরতে পারলো না কথাটা, “মানে? কেন?”
“কারণ, আমরা আবারো আপনার বন্ধুদেরকে জীবিত করে তোলার চেষ্টা করছি।” শান্তস্বরে জবাব দিল ডা. আমব্রোসিনি।
.
১২.
কার্ট এতোই অবাক হয়েছে যে কিছুক্ষণ কথা বের হলো না মুখ দিয়ে। “কি বললেন?” কোনোমতে বলল ও।
“আপনার বিস্ময় দেখে অবাক হচ্ছি না। ডা. রাবিশ্ব কি বললেন খেয়াল নেই! আজকের ব্যাপারটা একদমই আলাদা। রেনাটা বলল।
“এ তো স্রেফ পাগলামি। ওঝাদের মতো মন্ত্র পড়ে নিশ্চয়ই আপনারা আবার এতোগুলো মানুষকে জীবন দান করবেন না।” কার্ট জবাব দিল।
“আমরা পিশাচ না। ব্যাপারটা হলো এখানকার লোকগুলো এখনও মারা যায়নি। অন্তত এখনও না। তাই আমরা কোমর বেঁধে চেষ্টা করছি লোকগুলোর জ্ঞান ফেরানোর জন্য।”
কার্ট কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখলো কথাটা। তারপর বলল, “আমি নিজে কয়েজনকে পরীক্ষা করে দেখেছি।” ওরা কেউ নিশ্বাস নিচ্ছিলো না। আর ইতালিয়ান মিলিটারি আসার আগে আমি হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঢু মেরেছিলাম। অনেক রোগীর গায়েই EKG মেশিন লাগানো ছিল কিন্তু কোনোটাতেই হার্ট বীট দেখাচ্ছিলো না।”
“হ্যাঁ আমি জানি। সত্যি কথা হলো তারা নিশ্বাস নিচ্ছে, তাদের হার্টও সচল। ব্যাপার হলো তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস এখন মারাত্মক রকম হালকা আর ধীর। নিশ্বাস পড়ছেও অনেকক্ষণ পরপর। দুই মিনিটে হয়তো একবার শ্বাস নিচ্ছে। হার্ট রেট কমে এসেছে এক অঙ্কের ঘরে। আর নিলয়ের সংকোচন এতোই দুর্বল যে কোনো সাধারণ মনিটরে সেটা ধরা পড়বে না।”
“সেটা কীভাবে সম্ভব?”
“এরা আসলে এক ধরনের কোমায় চলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে এই ধরনের কোমা চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য সম্পূর্ণ নতুন। এমনিতে কোমা হলে ব্রেনের কয়েকটা অংশের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। শুধু একদম ভেতরের দরকারি অংশগুলো সক্রিয় থাকে। ধারণা করা হয় যে শরীর নিজেকে রক্ষা করতে কাজটা করে। রোগী যেহেতু সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকে, তাই শরীর বা ব্রেন যেখানেই সমস্যা থাকুক সেটা একা একাই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এই লোকগুলোর ব্রেন বন্ধ হয়নি। সব অংশই কাজ করছে কিন্তু কোনো ওষুধ বা উদ্দীপনা কোনো কিছুতেই সাড়া দিচ্ছে না।”
“আরেকটু সহজভাবে বলা যাবে?”
“মানে তাদের ব্রেনে কোনো ক্ষতি হয়নি, কিন্তু তারা জেগে উঠতে পারছে না। ধরেন একটা কম্পিউটারকে কেউ স্টান্ড বাই বা স্লীপ মুড-এ রেখে দিল কিন্তু আবার চালু করার জন্য যত টেপাটিপিই করুক, কম্পিউটার অন হলো না। এদের অবস্থা ঠিক সে রকম।”
কার্ট মানব শারীরতত্ত্বের খুব সামান্যই জানে। তাই নিজে নিজেই কোনো উপসংহারে পৌঁছার ঝুঁকি নিলো না। আগে ব্যাপারটা পুরোপুরি পরিষ্কার হতে চায়। “যদি ওদের হার্ট এতো আস্তেই চলে আর ঠিকমতো রক্ত সরবরাহ করতে না পারে আবার নিশ্বাসও প্রায় বন্ধই বলা যায়, তাহলে কি ওদের শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হবে না? এতে তো ব্রেন ড্যামেজ হওয়ার কথা।”
“হতেও পারে। তবে আমাদের ধারণা ওরা আসলে জীবন আর মৃত্যুর মাঝ খানে ঝুলে আছে। শরীরের তাপমাত্রা খুবই কম, শরীরের বিপাকীয় হারও কম তার মানে তাদের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খুবই কম মাত্রায় অক্সিজেন ব্যবহার করছে। এজন্যেই এত ধীর নিশ্বাস বা দুর্বল হার্ট-বীটেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। অক্সিজেন যেটুকু আছে তাতেই চলে যাচ্ছে, ব্রেনেরও ক্ষতি হচ্ছে না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পানিতে ডুবন্ত কোনো মানুষকে উদ্ধারের পর তাকে দেখেছেন কখনো?”
কার্ট মাথা ঝাঁকালো, “বছরখানেক আগে আমি একটা ছেলে আর ওর কুকুরকে বরফ হয়ে যাওয়া একটা লেক থেকে উদ্ধার করেছিলাম। কুকুরটা একটা কাঠবিড়ালিকে তাড়া করে বরফের ওপর উঠতেই পা আটকে যায়। ছেলেটা কুকুরটাকে উদ্ধার করতে গেলে বরফ ভেঙে দুজনেই পড়ে যায়। উদ্ধার করার পর দেখি ছেলেটার সারা শরীর নীল হয়ে গেছে। সাত মিনিটের মতো পানির নিচে ছিল সে। এতোক্ষণ পানিতে থাকলে তো বাঁচার কথা না। কুকুরটাও মারা যাওয়ার কথা। কিন্তু প্যারা মেডিকগুলো দুজনকেই সুস্থ করে ফেলেছিল। ছেলেটা পুরো সুস্থ হয়ে গিয়েছিল। ব্রেন-ট্রেন কিছুই ড্যামেজ হয়নি। এখানেও কি একই ব্যাপার নাকি?”
“আমাদের ধারণা সেরকমই। তবে পুরোপুরি ওরকম না। ছেলেটার বেলায় যা হয়েছে তা হলো ঠাণ্ডা পানি ওর শরীরে যে প্রভাব শুরু করেছিল, সাধারণ তাপমাত্রায় ফিরতেই তা আবার চলে যায়। কিন্তু এই লোকগুলোর তো আর তাপমাত্রা পরিবর্তন হয়নি, এটা হয়েছে কোনো একটা বিষের প্রভাবে। আর, এতক্ষণ পর্যন্ত গরম করা বলেন, ঠাণ্ডা করা বলেন, কারেন্ট থেকে শুরু করে এড্রেনালিন কোনো কিছুই বিষটার প্রভাব কাটাতে পারছে না।”
“বিষটা কোন ধরনের সেটা কি জানা গেছে?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।
“না।”
“জিনিসটা নিশ্চয়ই ঐ জাহাজটার ঐ ধোয়া থেকে এসেছে।”
“সেরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আমরা ধোয়াটা নিয়ে পরীক্ষা করেছি। পোড়া জ্বালানি বাদে ওতে আর কিছুই নেই। সামান্য সীসা আর অ্যাসবেসটস অবশ্য আছে। কিন্তু যে কোনো জাহাজে আগুন লাগলেই এগুলো পাওয়া যায়।” রেনাটা জবাব দিল।
“তার মানে জাহাজে আগুন লাগা আর ঘন ধোয়ার আস্তরণে পুরো দ্বীপ ঢেকে যাওয়া একটা কাকতাল মাত্র? আমার বিশ্বাস হয় না। কার্ট বলল।
“আমারও না। কিন্তু ঐ মেঘটাকে দোষ দেয়ার মতো কিছু সেটার মধ্যে পাওয়া যায়নি। এটা বড়জোর চোখের জ্বলুনি, কাশি বা হাপানির সৃষ্টি করতে পারে।”
“যদি জাহাজের ধোয়া-ই না হয়, তাহলে কি?”
রেনাটা প্রথমেই জবাব দিল না। থেমে কিছুক্ষণ কার্টকে দেখলো ভালো করে। তারপর বলল, “আমাদের ধারণা এটা একটা নার্ভ টক্সিন। বিস্ফোরণটার সময় কোনোভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সেটা ইচ্ছাকৃত কি-না তা বলা যাচ্ছে না। অনেক নার্ভ গ্যাসই খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ঝামেলাটা হলো আমরা মাটি, বাতাস বা রক্ত বা কোষ কোথাও বিষটার কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাইনি। তার মানে জিনিসটা যা-ই হোক সেটার আয়ু মাত্র কয়েক ঘণ্টা।”
কার্টের যুক্তিটা মনে ধরল, কিন্তু তারপরও কিছু জিনিসের ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু ল্যাম্পেডুসায় কেন?”
“কেউ জানে না, এ কারণেই ব্যাপারটাকে দুর্ঘটনা বলতেই আমরা বেশি আগ্রহী।” রেনাটা জবাব দিল।
কার্ট ভাবতে ভাবতে রুমের চারপাশে চোখ বুলালো। রেনাটার ডেস্কের পেছনেই দুটো সাদা বোড়। তাতে নানান মেডিকেলের কঠিন কঠিন শব্দ লেখা। পাশে একগাদা ওষুধের নাম। যেগুলো ইতোমধ্যে ব্যবহার করে দেখা হয়েছে সেগুলো কেটে দেয়া। পাশেই ভূমধ্যসাগরের একটা মানচিত্র। সেটার বিভিন্ন জায়গায় পিন গোঁজা। একটা পিন লিবিয়ার, একটা পিন উত্তর সুদানের একটা জায়গায়। মধ্যপ্রাচ্য আর পশ্চিম ইউরোপেও অনেক পিন দেখা গেল।
বোর্ডের দিকে ইঙ্গিত করে কার্ট বলল, “রেডিও মেসেজে আপনি একটা আক্রমণের কথা বলেছিলেন। আমার ধারণা এরকম ঘটনা আরো ঘটেছে। এবারই প্রথম না।”
রেনাটা দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো। “আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা একটু বেশি-ই ভালো। উত্তর হচ্ছে~~ হ্যাঁ। ছয় মাস আগে লিবিয়ার একদল প্রগতিবাদী বিদ্রোহীরও একই অবস্থা হয়। কেউ জানে না কীভাবে হয়েছে। তারা মারা যায় আট দিন পর। ইতালির সাথে লিবিয়ার সুসম্পর্ক থাকায় ইতালি ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে রাজি হয়। তদন্ত করতে গিয়েই দেখা যায় যে লিবিয়ার আরো কিছু জায়গায় একই ঘটনা ঘটেছে। তারপর খোঁজ পাওয়া যায় যে শুধু লিবিয়া না ম্যাপের এসব জায়গাতেও একই অবস্থা। প্রতিটা ক্ষেত্রেই হয় কোনো, বিদ্রোহী দল বা কোনো শক্তিশালী ব্যক্তি এরকম আজব কোমায় চলে যায় আর মারা যায়। আমরা একটা টাস্কফোর্স গঠন করি। তারপর এই জাহাজটায় আমাদের ভাসমান ল্যাব বানিয়ে উত্তর খোঁজা শুরু করি।”
কার্ট মনে মনে ব্যাপারটার প্রশংসা না করে পারলো না। এসব কিছুতে আপনার ভূমিকা কি?”
“আমি একজন ডাক্তার।” আহতস্বরে বলল রেনাটা। “আমি একজন নিউরোবায়োলজী বিশেষজ্ঞ। কাজ করি ইতালিয়ান সরকারের হয়ে।”
“তাহলে আক্রমণটা যখন হলো তখন-ই আপনি ল্যাম্পেডুসায় ছিলেন কেন?” রেনাটা শব্দ করে শ্বাস ফেলল, “আমি ওখানে ছিলাম আমাদের একমাত্র সন্দেহভাজনকে চোখে চোখে রাখতে। ঐ হাসপাতালেরই একজন ডাক্তার।
“হুম! তাইতো বলি, আর কেউ জানে না কিন্তু আপনি কীভাবে জানেন যে কীভাবে বাঁচতে হবে।”
রেনাটা মাথা ঝাঁকালো। “আমার মতো যদি আপনিও সিরিয়া, ইরাক এসব জায়গায় ঘুরতেন আর দেখতেন কীভাবে চোখের সামনে মানুষ ঠাসঠাস করে মরে যাচ্ছে, যদি সারাক্ষণই ভয় লাগতো যে এক অদৃশ্য গ্যাস আপনাকে শেষ করার জন্য বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে তাহলে আপনিও আমার মতো অতি সতর্ক হয়েই থাকতেন সারাক্ষণ। সারাক্ষণ ভয়। প্রায় পাগলের মতো অবস্থা। তাই যখনই দেখলাম যে ঐ কালো মেঘটা যার কাছেই যাচ্ছে সে-ই জায়গায় পড়ে যাচ্ছে তখনই বুঝলাম যে কী হচ্ছে। বহুবার এসব দেখা আমার।”
কার্ট আবারো মনে মনে মহিলার সাহস ও বুদ্ধির প্রশংসা করল। “তা ঐ যে ঐ লোকটা যে আমাদেরকে মারতে চেয়েছিল, সে-ই কি আপনার সন্দেহভাজন?”
“না। আসলে আমরা জানি না কে সে। তার কোনো পরিচয়ই বের করা যায়নি। তার কোনো সনাক্তকরণ চিহ্ন আমরা পাইনি। সমস্ত ফিঙ্গার প্রিন্ট মুছে ফেলা। সম্ভবত ইচ্ছাকৃত কাজ সেটা। শুধু ক্ষত থেকে কিছু কোষ পেয়েছি। দ্বীপে আগত কোনো লোকের বর্ণনার সাথেই তার দৈহিক গঠনের মিল নেই। আপনি হয়তো ভাবছেন এটাতো হওয়ারই কথা, কিন্তু ল্যাম্পেডুসায় বেড়াতে বা থাকতে যে-ই আসুক প্রত্যেকেরই পুংখানুপুংখ বর্ণনা লিপিবদ্ধ থাকে। এয়ারপোর্ট, বন্দর বা কোনো ভাঙ্গা কাঠে করেও যদি দ্বীপে এসে ওঠেন এটা করা হবে।”
“তাহলে ঐ লোকটা সন্দেহ ভাজন না হলে কে?”
“হ্যাগেন নামের একজন ডাক্তার। লোকটা হাসপাতালে পার্ট টাইম কাজ করতো। হ্যাগেন-এর অতীত ইতিহাস বিশেষ সুবিধার না। আমাদের কাছে খবর ছিল যে আজই ওর কাছে একটা ডেলিভারি আসবে। শুধু জানতাম না কোত্থেকে এটা আসছে। কে ডেলিভারি দিচ্ছে বা কি জিনিস সেটাও ঠিকমতো জানা ছিল না। তবে এর আগেও এরকম ঘটনা ঘটেছে এরকম তিনটা জায়গাতেই তার উপস্থিতি ছিল। সে জন্যেই ধারণা করা হয় যে লোকটা ওর সাথে সম্পৃক্ত।”
কার্ট ছেঁড়া সুতোগুলো জোড়া দেয়ার চেষ্টা করল, তার মানে পিস্তল হাতে লোকটা-ই জিনিসটা নিয়ে আসছিল সম্ভবত। ডা, হ্যাগেনকে পৌঁছে দেয়ার কথা ছিল যা শেষমেশ আক্ষরিক অর্থেই তার কপালেই জুটলো।
“আমাদেরও সেরকমটাই ধারণা, রেনাটা জবাব দিল।
“হ্যাগেনের কি অবস্থা?”
ডা, রেনাটার চেহারা কঠোর হয়ে গেল, “ল্যাম্পেডুসার পাঁচ হাজার মানুষের মধ্যে শুধু হ্যাঁগেনের-ই কোনো খোঁজ নেই। ওকে আমরা সর্বক্ষণ নজরদারিতে রেখেছিলাম কিন্তু গ্যাসের প্রভাবে আমাদের দলটাও কোমায় চলে গেছে। কার্ট চেয়ারে হেলান দিয়ে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে রইল। ছাদে দুই টা রঙ করা। মাঝামাঝি একটা জায়গায় একটা রঙ অন্যটার ওপরে উঠে গেছে। ফলে সেখানে গাঢ় তৃতীয় একটা রঙের সৃষ্টি হয়েছে। তার মানে এই প্রাণঘাতী মেঘের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ মাত্র দুজন। একজন আপনাদের সন্দেহভাজন, অন্য হলো যে আমাদেরকে মারতে চেয়েছিল।”
ডা. রেনাটা মাথা ঝাঁকালো। “ঠিক। এ থেকে কি আপনি কিছু ধরতে পারছেন?”
“তাদের কাছে নিশ্চয়ই কোনো ধরনের প্রতিষেধক আছে। এমন কিছু যা এই আজব টক্সিনের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।”
“এটাও আমাদের সাথে মিলে গেল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা হ্যাঁগেনের অফিসে কিছুই খুঁজে পাইনি। তার বাসা আর গাড়িতেও খোঁজা হয়েছে। কিছু নেই। এমনকি আমরা এই লোকটার রক্তেও কিছু পাইনি যাতে প্রতিষেধকটা বের করে ফেলবো।
“ব্যাপারটা কি অবাক করার মতো?”
“পুরোপুরি না। যেহেতু বিষটার আয়ু কম, ওটার প্রতিষেধকেরও আয়ু কমই হওয়ার কথা।”
কার্ট ব্যাপারটা ধরতে পারলো, “তার মানে প্রতিষেধক নষ্ট হয়ে গেছে। তবে যদি ডাক্তারটাকে খুঁজে পান তাহলে ব্যাটাকে ডলা দিলেই সুড়সুড় করে বলে দেবে প্রতিষেধক কোথায়।”
কান পর্যন্ত হাসি দিল ডা. রেনাটা, “আপনার মাথা আসলেই শার্প মি. অস্টিন।”
“মিস্টার বলা বন্ধ করুন প্লিজ। নিজেকে কেমন বুড়ো বুড়ো লাগে।”
“আচ্ছা কার্ট ডাকবো, আমাকেও রেনাটা বলে ডাকবেন।”
কার্টের প্রস্তাবটা পছন্দ হলো, “লোকটা কোথায় লুকাতে পারে কোনো ধারণা আছে?”
রেনাটা বাঁকা চোখে তাকাল, “কেন? সেটা জেনে আপনি কি করবেন?”
“এমনি?”
“আপনি নিশ্চয়ই লোকটাকে ধরতে যাওয়ার ধান্দা করছেন না?”
“আরে নাহ! কাজটা তো মারাত্মক বিপজ্জনক। কোন দুঃখে সেধে বিপদে পড়তে যাবো,” কার্ট জবাব দিল।
“কি জানি, মনে হলো তাই বললাম।” হালকা লজ্জা পেয়েছে রেনাটা। সেটা সামলে বলল, “আপনাকে যেটুকু দেখেছি আর NUMA-র অ্যাসিসন্ট্যান্ট ডিরেক্টরের সাথে কথা বলে আপনাকে ওরকম মনে হয়েছে তাই।”
কার্ট অবাক চোখে তাকাল, “আপনি আমার বসের সাথে কথা বলেছেন?”
“হ্যাঁ, রুডি গান। চমৎকার মানুষ। এখানে আসার আগে ওনার সাথেই কথা বলছিলাম। উনি বলেছেন যে আপনি সাহায্য করতে চাইবেন। আর যদি আমি সাহায্য না নেই তাহলে জোর করে হলেও সাহায্য করতে গিয়ে সবকিছু লেজে-গোবরে অবস্থা করে ফেলবেন।”
রেনাটার মুখে চওড়া হাসিটা ফিরে এসেছে। কথোপকথন এই প্রসঙ্গে চলে আসায় খুব খুশি। কার্ট এখন সহজেই বুঝতে পারছে যে কেন ওকে ডেকে এনে সব খুলে বলছে রেনাটা।”
“তা আমাকে বিক্রি করে কত পেল তারা?”
“বেশি না। বিনিময়ে একটা গান গেয়ে শোনাতে হয়েছে।”
“ওরে নীল দরিয়া?”
“শুধু নীল দরিয়া না। বোনাস হিসেবে মি. জাভালাকেও দিয়ে দিয়েছেন।” শুনে প্রচণ্ড আহত হয়েছে ভাব ধরলেও, মনে মনে কার্ট প্রচণ্ড খুশিই হয়েছে ব্যাপারটায়।
“তা বেতন কি ইউরোতে পাব নাকি”
“টাকা পাবেন না, মজা পাবেন। আমরা এই ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী লোকটাকে খুঁজে বের করব। আর যদি ভাগ্য ভালো হয়, তাহলে হ্যাগেন বা ঐ লোকটা যে প্রতিষেধক ব্যবহার করেছে ওটা খুঁজে বের করে এই লোকগুলোকে আবার জ্যান্ত করে তুলবো।” রেনাটা কথাটা শেষ করল।
“এরকম প্রস্তাব ফেরানো মুশকিল। কোত্থেকে শুরু করবো আমরা।” কার্ট বলল সিরিয়াস ভঙ্গিতে।
“মাল্টা। গত মাসে হ্যাগেন তিনবার সেখানে গিয়েছে।” রেনাটা জানালো। তারপর ড্রয়ার খুলে একটা ফোল্ডার বের করে সেখান থেকে কয়েকটা ছবি বের করে কার্টের হাতে দিল। ছবিগুলো দূর থেকে গোপনে তোলা।
“হ্যাগেন এই লোকটার সাথে বেশ কয়েকবার দেখা করেছে। গত সপ্তাহে একবার কথা কাটাকাটিও হয়েছে ওদের মধ্যে।” রেনাটা জানালো।
কার্ট ছবিটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলো। ছবিটার লোকটার পরনে টুইডের জ্যাকেট, কনুইয়ের কাছে অন্য কাপড় দিয়ে তালি মেরে ডিজাইন করা। দেখে মনে হয় খুব পড়াশোনা জানা লোক। বসে আছে একটা ক্যাফেতে, আরো জনা তিনেক লোকের সাথে কথা বলছে। যেন ঐ তিনজন তাকে ঘিরে রেখেছে।
“মাঝখানের এটা হ্যাগেন। বাকি দুজন কারা আমরা জানি না। ওর সঙ্গী সাথী হবে হয়তো।” রেনাটা বলল।
“আর এই প্রফেসরের মতো দেখতে লোকটা কে?”
“মাল্টা সামুদ্রিক যাদুঘরের কিউরেটর।”
“বুঝলাম না। যাদুঘরের কিউরেটররা কখনো সন্ত্রাসীদের সাথে হাত মিলিয়ে নার্ভ গ্যাস আমদানি করছে এমনটা কখনো শুনিনি। আপনি কি ওনার ব্যাপারে নিশ্চিত?”
“আমরা কোনো ব্যাপারেই নিশ্চিত না।” রেনাটা স্বীকার করল। শুধু এটুকু জানি যে হ্যাগেন লোকটার সাথে নিয়মিত দেখা করে আসছে। আর যাদুঘর থেকে একটা পুরাকীর্তি কেনার চেষ্টা করছে। জিনিসটা দুদিন পরেই একটা গালা পার্টিতে নিলামের জন্য ভোলা হবে।”
কার্টের ব্যাপারটা যুক্তিসঙ্গত লাগছে না, “প্রত্যেকেরই শখের কিছু ব্যাপার-স্যাপার থাকে। সন্ত্রাসী হোক আর যা-ই হোক।”
“কিন্তু প্রাচীন-পুরাকীর্তি সংগ্রহ হ্যাঁগেনের বাতিক না। তাকে এর আগে কখনোই এসবের প্রতি আগ্রহী দেখা যায়নি।”
“বুঝলাম। কিন্তু লোকটা নিশ্চয়ই এতটা বোকা না যে, এই ঘটনার পর আবার মাল্টায় গিয়ে উঠবে।” কার্ট বলল।
“আমিও সেটা ভেবেছিলাম। কিন্তু খবর পাওয়া গেছে কেউ একজন সম্প্রতি হ্যাঁগেনের অ্যাকাউন্টে দুই লাখ ইউরো জমা দিয়েছে। অ্যাকাউন্টটা খোলা হয়েছিল কিউরেটর লোকটার সাথে দেখা করার পরদিন। আর টাকা জমা হয়েছে ল্যাম্পেডুসার ঘটনাটা ঘটার কয়েক ঘণ্টা পর। ইন্টার পোল টাকা জমার ব্যাপারটা নিশ্চিত করেছে।”
এবার কার্টের কাছে ব্যাপারটা গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে। ডা. হ্যাগেন বেঁচে আছে। আর ঘটনার পর সে ল্যাম্পেডুসা থেকে পালিয়ে গিয়েছে এবং মাল্টায় নিজের অ্যাকাউন্টে টাকা সরিয়ে ফেলেছে। কারণটা যা-ই হোক, পলাতক ডাক্তার যে মালটা সামুদ্রিক যাদুঘরের কিউরেটরের সাথে আরো একবার দেখা করবে সেটা নিশ্চিত।
রেনাটা ফাইলটা বন্ধ করে পায়ের ওপর পা তুলে বলল, “কথা হচ্ছে যে আপনি কি কষ্ট করে একবার মাল্টায় যাবেন ব্যাপারটা দেখতে?”
“দেখার চেয়েও বেশি কিছু করবো।” কার্ট কথা দিল।
রেনাটা খুশি হলো কথাটা শুনে। “আমি এখানকার সব রোগীর পর্যাপ্ত সেবার ব্যবস্থা করেই আপনার সাথে এসে দেখা করবো। একটা অনুরোধ, দয়া করে আমি আসার আগ পর্যন্ত কিছু করবেন না।”
কার্টের মুখেও এখন চওড়া হাসি, “শুধু দেখবো আর বলে যাবো, ওয়ান টু-র কাজ।”
ওরা দুজনেই জানে কার্ট মিথ্যে বলছে। হ্যাগেনকে পেলে কার্ট যে ছেড়ে দেবে না এটা নিশ্চিত। তাতে ঝামেলা যতই বাঁধুক না কেন।
.
১৩.
মিসরের হোয়াইট মরুভূমি, পিরামিডের সাত মাইল পশ্চিম
সকাল ১১ : ৩০ মিনিট
একটা ফ্রান্সে বানানো SA1342 গ্যাজেল হেলিকপ্টার মরুভূমির পাঁচশো ফুট ওপর দিয়ে উড়ে গেল। ওটার আওয়াজে মরুভূমির স্বাভাবিক নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে গেছে।
কপ্টারটা মরুভূমির ক্যামোফ্লেজে রঙ করা। মডেলটা অবশ্য পুরনো। এক সময় এটা মিসরীয় সেনাবাহিনীর ছিল। তাদের কাছ থেকে বর্তমান মালিক কিনে নিয়েছে।
মরুভূমির সবচে উঁচু বালিয়াড়িটা পার হতেই ওটা গতি কমিয়ে দিক পরিবর্তন করল। হঠাৎ বাক পরিবর্তনের কারণেই দূরের মরুভূমির মধ্য দিয়ে ধেয়ে আসা গাড়ির বহরটা তারিক সাকির-এর চোখে পড়ল। গাড়ি মোট সাতটা কিন্তু চলছে পাঁচটা। বাকি দুটো একটা আরেকটার সাথে বাড়ি খেয়ে ভচকে গেছে। ফলে আর চলার ক্ষমতা নেই। দুটো বালিয়াড়ির মাঝে আটকে আছে।
সাকির ওর দামি সানগ্লাসটা খুলে চোখে একটা বাইনোকুলার ধরলো। “দুটো অলরেডি গেছে। উদ্ধার করতে লোক পাঠাও। বাকিগুলো ঠিক আছে।” পাশের আরেকজনকে বলল সাকির।
বাকি গাড়িগুলো বালিয়াড়ি পেরিয়ে আসছে। পিছনে টায়ারের লম্বা দাগ পড়ে আছে। বালিতে টায়ার ঠিকমত কামড় বসাতে না পারায় ইঞ্জিন মারাত্মকভাবে গো গো করছে।
একটা গাড়িকে দেখা গেল অন্যদের চেয়ে এগিয়ে গেছে। সম্ভবত শক্ত কোনো বালির চাপড়ার খোঁজ পেয়েছে।
“চার নাম্বার। আগেই বলেছিলাম এই লোক নাছোড়বান্দা।” সাকিরের হেডফোনে কেউ বলল কথাটা।
সাকির হেলিকপ্টারের পেছনের কেবিনটার দিকে তাকাল। কালো রঙের সামরিক পোশাক পরা এক খাটো লোক বসা সেখানে। দাঁত বের করে হাসছে।
“এখনই এতো নিশ্চিত হয়ো না হাসান। শুধু গতি বেশি হলেই সবসময় রেস জেতা যায় না।” ভর্ৎসনার সুরে বলল সাকির।
তারপর রেডিওর সুইচটা টিপে বলল, “সময় হয়েছে। পিছনেরগুলোকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দাও তারপর সবটাকেই বন্ধ করে দাও। দেখি কার কত সাহস।”
কলটা রিসিভ করল গাড়িগুলোর ঠিক পেছনেই আসতে থাকা একটা গাড়ি। কথা শুনেই গাড়িতে বসা টেকনিশয়ান তার ল্যাপটপে দ্রুত কয়েকটা বোতাম টিপে ENTER চাপলো।
সাথে সাথে সবার সামনে থাকা SUv-টার ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া বেরুনো শুরু হলো। কয়েকবার বালিতে ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল পুরোপুরি। অন্যরা পিছন থেকে দেখে একপাশে সরে গেল তারপর ওটাকে পাশ কাটিয়ে বালিয়াড়ির অপর পাশ দিয়ে ছুটলো, এটাই শেষ বালিয়াড়ি। এটার পরেই ফিনিশিং লাইন। গত কয়েক মাস ধরে চলা কঠিন কঠিন সব পরীক্ষার এটাই শেষ ধাপ। পরীক্ষায় উত্তীর্ণরাই সাকিরের দলের উচ্চপদ লাভ করবে।
“এটা কিন্তু দুই নম্বুরী।” পিছন থেকে হাসান চেঁচালো।
“জীবনটাই একটা দুই নম্বুরী।” “আমি শুধু একটু বাটপারি করলাম। এখন দেখা যাবে কে আসলেই উপযুক্ত, কার বুকের পাটা কত চওড়া।”
বাকি গাড়িগুলোও দেখা গেল একইভাবে বন্ধ হয়ে গেল। আর কিছুক্ষণ আগেই যেখানে ইঞ্জিনের গো গো আর টায়ার বালির ঘর্ষণের শব্দে ভরা ছিল, সেটাই এখন ধুপধাপ বন্ধ দরজা, গালাগাল আর অভিসম্পাতে ভরে গেল। ড্রাইভারগুলো সবার-ই ঘামে ভিজে গোসল হয়ে গেছে; গায়ে রঙচঙে পোশাক। দেখে মনে হচ্ছে মাত্র যুদ্ধ থেকে ফিরেছে, বা নরকের দুয়ার থেকে ঘুরে এসেছে। হঠাৎ গাড়িগুলোর এহেন আচরণে সবাই হতবুদ্ধি হয়ে গেছে।
একজন গাড়ির সামনের ইঞ্জিনের হুড তুলে বোঝার চেষ্টা করল সমস্যাটা কি। আরেকজন সজোরে লাথি হাকালো নিজের গাড়ির গায়ে। দামি মার্সিডিজ SUv-এর গা ডেবে গেল খানিকটা। অন্যরাও হতাশ হয়ে একই কাজ করল। ক্লান্তি আর অবসন্নতায় তাদের বুদ্ধি লোপ পেয়েছে।
“ওরা হাল ছেড়ে দিচ্ছে।” সাকির বলল।
“সবাই না,” হাসান জবাব দিল।
একজন লোককে দেখা গেল সাকিরের মন মতো কাজ করছে। সে প্রথমে অন্যদের দিকে তাকাল তারপর সেখান থেকে বালিয়াড়ির মাথায় শেষ প্রান্তটা একবার পরখ করল তারপরই আচমকা দিল দৌড়।
লোকটা কি করতে চাচ্ছে সেটা বুঝতে বুঝতে বাকিদের কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল। সে দৌড়ে রেস শেষ করে পুরস্কার জিততে চায়। ফিনিশিং লাইন এখান থেকে মাত্র পাঁচশো গজ আর একবার বালিয়াড়ির মাথায় উঠতে পারলেই হবে, বাকিটা ঢালু রাস্তা।
অন্যরাও ঝেড়ে দৌড় দিল পিছু পিছু। কিছুক্ষণ পরই দেখা গেল পাঁচজন লোক পড়িমড়ি করে বালিয়াড়ি ভেঙে ছুটছে।
কিন্তু বালি বেয়ে ওঠার চেয়ে নামা আরো কঠিন। বাতাসে বাতাসে ধাক্কা খেয়ে বালিয়াড়ির ধারটা একেবারে খাড়া হয়ে গেছে। দুজন লোক সেটা বেয়ে নামার চেষ্টা করতেই মুখ থুবড়ে পড়ল, তারপর গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। একজন টের পেল যে পিছলে পিছলে নামলে আরো দ্রুত নামা যাবে। সে বালিয়াড়ির ধারে পৌঁছতেই লাফ দিল সামনে তারপর বুকে পিছল খেয়ে ষাট গজ মতো এগিয়ে গেল।
“যাক, শেষ পর্যন্ত একজন বিজয়ী পাওয়া যাবে তাহলে।” সাকির হাসানকে বলল। তারপর পাইলটকে বলল, “ফিনিশিং লাইনের কাছে নিয়ে চলো।”
হেলিকপ্টার আবারো ঘুরে নিচে নামতে শুরু করল। একটা বিশাল লম্বা রেখার দিকে এগুলো। রেখাটা মরুভূমিকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। ওটার নাম “জানদ্রিয়ান পাইপ লাইন।” ওটার কাছেই একটা তেলের পাম্পকে ফিনিশিং লাইন হিসেবে ঠিক করা হয়েছে।
গ্যাজেলটা ওটার ঠিক পাশেই নামলো। মুহূর্তেই একটা ছোটখাটো ধূলি ঝড় উঠে গেল চারপাশে। সাকির ওর কান থেকে হেডসেট খুলে দরজা খুললো। তারপর মাথা নিচু করে সামনে বাড়লো। সামনেই হাসানের মতোই পোশাক পরা কয়েকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
সাকির চাইলে অনায়াসে একজন মুভি স্টার হতে পারতো। লম্বা একহারা গড়ন। রোদে পোড়া চামড়া, ঘন বাদামি চুল আর চৌকো থুতনি। দেখে মনে হয় থুতনিতে উটের লাথি খেলেও কিছু হবে না। রোদে পোড়া মানুষদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হলে ওযে পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন মানবের খেতাব জিতবে তাতে সন্দেহ নেই। ওর চেহারা দেখেই বোঝা যায় দারুণ আত্মবিশ্বাসী ও। আর যদিও ও বাকি লোকগুলোর মতো একই পোশাক পরা, কিন্তু ওর আর ওদের মধ্যে তফাত বিস্তর। রাজা আর প্রজার মধ্যে তফাত যতটুকু ততটুকু।
বহুদিন ধরে সাকির মিসরীয় গোয়েন্দা পুলিশ বাহিনীর হয়ে কাজ করেছে। মোবারকের শাসনামলে সে ছিল এই বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড। দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে অবিরাম লড়ে গেছে আর সমস্ত ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছে একের পর এক। তারপর হোসনী মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হলো। লোকেরা এটাকে বলে “আরব বসন্ত।” দেশ জুড়ে শুরু হলো একের পর এক পরিবর্তন, ঘটনা দুর্ঘটনা। সাকির আর ওর মতোই আরো কয়েকজন আড়ালে থেকে কলকাঠি নেড়ে গেল। ওরা এখনো শিল্পপতির ছদ্মবেশে দেশের সকল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে।
গোয়েন্দা পুলিশে কাজ করার সময় অর্জিত দক্ষতা দিয়ে সাকির একটা সংস্থা গড়ে তুলেছে। নাম ওসাইরিস। অল্প সময়েই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে সে। কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে এটার বিন্দুমাত্র নাম গন্ধ নেই এবং সম্মান এবং সুখ্যাতির সাথে ওসাইরিস কাজ করে যাচ্ছে। সাকিরের ধারণা যদি ঠিক হয় তাহলে অচিরেই ওসাইরিস শুধু মিসর না, বরং পুরো উত্তর-আফ্রিকাই নিয়ন্ত্রণ করবে।
আপাতত ওর মনোযোগ পুরো এই রেসের দিকে। মারাত্মক কষ্টকর এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল বিশ জনকে নিয়ে। একে অপরের সাথে লড়াই করে টিকে থাকবে একজন। তাকেই সাকির নিজের দলে নেবে। ইতোমধ্যে তার কয়েক ডজন তোক উত্তর-আফ্রিকা আর ইউরোপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু সফল হওয়ার জন্যে তার আরো লোকবল দরকার। নতুন নতুন, তরুণ উদ্যোমী লোক দরকার ওর, যারা আসলেই বুঝবে ওর সংগঠনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য।
এদিকে বালিয়াড়িতে এক আর চার নাম্বার ড্রাইভারকে দেখা গেল অন্য তিনজনের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছে। বালিয়াড়ি পেরিয়ে সমতলে আসতেই সবাই পাম্পটার দিকে ছুটলো। এক নম্বর ড্রাইভারই তখনো এগিয়ে। কিন্তু হাসানের ব্যক্তিগত পছন্দের চার নাম্বার ওকে প্রায় ধরেই ফেলেছে। মনে হচ্ছিলো শেষ পর্যন্ত হাসানের কথা-ই ঠিক হবে। কিন্তু চার নম্বর একটা মারাত্মক ভুল করে বসলো। সে আসলে এই প্রতিযোগিতার আসল ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। এখানে জেতার জন্য সবকিছু করা জায়েজ। এমনকি অন্যকে খুনও করা যাবে।
চার নম্বর এগিয়ে গেল, কিন্তু এগিয়ে যেতেই অন্য ড্রাইভারটা পেছন থেকে ওকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিল। লোকটা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল আর পিছনের লোকটা ওর পিঠের ওপর পাড়া দিয়ে সামনে চলে গেল।
চার নম্বর আবার উঠতে উঠতে খেলা শেষ। এক নম্বর ড্রাইভার জিতে গিয়েছে। বাকিজনও ওকে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে চলে গেল কিন্তু সে তিক্ত মন নিয়ে সেখানেই বসে রইল।
সবাই ফিনিশিং লাইন পার হলে সাকির একটা ঘোষণা দিল,
“তোমরা সবাই বিজয়ী। এ থেকে একটা শিক্ষা কিন্তু সবাই পেয়েছে, তা হলো কখনো হাল ছাড়া যাবে না। তোমাকে যে কোনো মূল্যে জিততে হবে। এক্ষেত্রে দয়ামায়া দেখালে চলবে না।”
“বাকিদের কী হবে?” হাসান জিজ্ঞেস করল।
সাকির ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। দুজন ড্রাইভার তখনো বালিয়াড়িতে রয়ে গেছে। আছাড় খাওয়ার পর তারা আর উঠে দৌড়ায়নি। আর সেই ভচকে যাওয়া গাড়ি দুটোর ড্রাইভারেরাও বাকি আছে।
“ওদেরকে হটিয়ে সবচে কাছের চেকপয়েন্টে নিয়ে যাও।”
“হাঁটিয়ে? সবচে কাছেরটাও এখান থেকে তিরিশ মাইল।” অবাক হয়ে বলল হাসান।
“সেক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি রওনা দিলেই ভালো হবে।”
“এখান থেকে চেক পয়েন্ট পর্যন্ত বালি বাদে আর কিছু নেই। এরাতো সবাই মারা পড়বে।” হাসান বলল।
“গেলে যাক। তবে যদি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়, তাহলে তারা একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাবে আর তখনই আমি ভেবে দেখবো ওদেরকে দলে নেয়া যায় কি-না।”
হাসান হলো সাকিরের ঘনিষ্ঠতম সহচর। সিক্রেট সার্ভিসে চাকরির সময় থেকেই দুজনের সখ্যতা। মাঝে মাঝে হঠাৎ তাই সাকির হাসানের পরামর্শ কানে তোলে কিন্তু আজ না, “যা বলেছি করো।”
হাসান রেডিও তুলে কথাটা জানিয়ে দিল। সাকিরের কালো পোশাক পরা একদল সৈন্যকে দায়িত্ব দেয়া হলো ঐ চারজনকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার। এতোক্ষণ পরে চার নম্বর ড্রাইভার তার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ফিনিশিং লাইনের দিকে এগুলো।
হাসান ওকে পানি দিতে গেল কিন্তু সাকির বাধা দিলো, “না, ওকেও হাঁটতে হবে।”
“কিন্তু ওতো জিতেই গিয়েছিল,” হাসান আপত্তি করল।
“হ্যাঁ, আর সে ফিনিশিং লাইনের এতো কাছে থেকেও হাল ছেড়ে দিয়েছে। আমার কোনো লোকের এমন স্বভাব আমি বরদাশত করবো না। ও বাকিদের সাথে হেঁটে যাবে। আমি যদি খবর পাই যে, কেউ একে সাহায্য করেছে। তাহলে ঐ লোকের উচিত হবে আত্মহত্যা করা নাহলে আমি এমন সাজা দেবো, যা হবে মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর।”
চার নম্বর ড্রাইভার অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সাকিরের দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু ওর দৃষ্টিতে ভয় নেই। কেমন অবজ্ঞা।
সাকিরও ওর দৃষ্টির রাগটাকে পছন্দ করল। একবার তো ভেবেই বসলো যে শাস্তি মওকুফ করে দেবে। পরমুহূর্তেই আবার সিদ্ধান্তে ফিরে এসে বলল,
“হাটা শুরু করো।”
চার নম্বর হাসানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা এগিয়ে হাঁটা শুরু করলো। একটা কথাও বলল না বা একবার ফিরেও তাকাল না।
লোকটা হাঁটা শুরু করতেই একজন এসে সাকিরকে একটা সরকারি ঘোষণা পত্র ধরিয়ে দিল। সেটা পড়ে সাকির স্বগোক্তি করল, “খবর তো খারাপ।”
“কি হয়েছে?” হাসান জিজ্ঞেস করল।
“আম্মন তা মারা গেছে। দুজন আমেরিকান নাকি ওকে মেরেছে। ইতালিয়ান ডাক্তারের কাছে যেতেও পারেনি।”
“আমেরিকান?”
সাকির মাথা ঝাঁকালো, “NUMA” নামের একটা সংস্থার সদস্য।
“NUMA!” হাসানও নামটা একবার বলল।
দুজনেই নামটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উচ্চারণ করল। সিক্রেট সার্ভিসে থাকার সময় এই সংস্থা সম্পর্কে নানান গুজব ওরা শুনেছে। ওরা হচ্ছে সমুদ্রবিদ বা এই ধরনের কিছু একটা।
“ব্যাপারটা তো ভালো মনে হচ্ছে না, এরা তো CIA-র চেয়েও খারাপ।” হাসান-ই বলল আবার।
সাকির মাথা ঝাঁকালো, “যদূর মনে পড়ে NUMA-র একজন সদস্য-ই কয়েক বছর আগে আপ্যান বাধ ধসে পড়া আটকিয়ে মিসরের মস্ত উপকার করেছিল।
“তখন তো আমরা সবাই একই দলে ছিলাম। ওরা কি কিছু বের করতে পেরেছে?”
সাকির আত্মবিশ্বাসের সাথে মাথা নাড়লো।” জাহাজ বা আম্মন তা কোনো কিছুতেই ওরা কোনো কিছুর হদিস পাবে না দিয়ে আমাদের সন্দেহ করতে পারে।”
“হ্যাগেনের কি অবস্থা? আম্মন তার তো ওর কাছেই ব্লাক মিস্ট ডেলিভারি দেয়ার কথা ছিল। পরে ইউরোপের কিছু সরকারের সাথে ওটা দিয়ে বোঝাঁপড়া করা যেতো।”
সাকির তখনও কাগজটা পড়ছে, “হ্যাগেন পালিয়ে মাল্টা চলে গেছে। ও নিলামের আগেই আরো একবার পুরাকীর্তিটা কেনার চেষ্টা করবে। যদি না পারে তো চুরি করবে। দুদিনের মধ্যেই বিস্তারিত জানাবে বলেছে।
“একমাত্র হ্যাগেন-ই আমাদের কথা জানে। ওকে এখুনি সরিয়ে দেয়া দরকার।”
“হ্যাঁ, তবে আগে পুরাকীর্তিগুলো জোগাড় করুক। আমি ঐ শিলালিপি দুটো হয় আমার হাতের মুঠোয় চাই নাহলে ধ্বংস করে দিতে চাই যাতে আর কেউ ওটা আবার জোড়া দিতে না পারে।”
“আসলেই কি জিনিসটার গুরুত্ব আছে? আমরা তো জানিও না যে ওটায় কি আছে।” হাসান বলল।
হাসানের এতো বেশি প্রশ্নে সাকির বিরক্ত হয়ে গেল, রাগতস্বরে বলল, “আমার কথা মন দিয়ে শোনো। আমরা ইউরোপের সব নেতাদের এমনভাবে ঘুম পাড়িয়ে দেবো যে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া ছাড়াই এই মহাদেশের সব গুরুত্ব পূর্ণ অংশ আমরা দখল করে ফেলতে পারবো। যদি কেউ ঐ শিলালিপি থেকে কোনো প্রতিষেধক বানানোর সূত্র পেয়ে যায়–যদি কেউ ব্লাক মিস্ট এর প্রভাব নষ্ট করে দেয়ার উপায় বের করে ফেলে–তাহলে আমাদের পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। এই সহজ কথাটা তোমার মাথায় ঢোকে না কীভাবে?
“তা তো বুঝেছিই। কিন্তু ঐসব পুরাকীর্তিতেই যে প্রতিষেধক বানানোর সূত্র আছে এ তথ্য আপনি কোথায় পেলেন?” হাসানও পাল্টা জবাব দিল।
“কারণ নেপোলিয়নও এই জিনিসটাই খুঁজছিল। উনি এই ব্লক মিস্টের খবর শুনেছিলেন তখন “সিটি অফ ডেড”-এ লোক পাঠান খুঁজে দেখার জন্য। তারা যা যা পেয়েছিল সব ওখান থেকে নিয়ে যায়। এটা আমাদের ভাগ্য যে যেটুকু ছিল সেটুকু দিয়েই আমরা প্রতিষেধকটা বের করে ফেলতে পেরেছি। এটার মানে হলো বেশিরভাগ শিলালিপি-ই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাদের পর দাদাদের কাছ থেকে ইউরোপিয়ানরা চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। এখন আবার আমাদের বিরুদ্ধেই সেটাকে আমি ব্যবহার করতে দেবো না। যদি ঐ শিলালিপিগুলোয় প্রতিষেধকটা বের করার সামান্যতম কোনো সূত্র থেকে থাকে তা হলেও এগুলোকে ওদের হাতে পড়ার আগেই ধ্বংস করতে হবে। আর সেটা করা হয়ে গেলে হ্যাগেনকেও সরিয়ে দেয়া হবে।
“কিন্তু ও একা তো এটা পারবে না।” হাসান বলল।
সাকিরও ব্যাপারটা ভেবে দেখলো, “ঠিক বলেছ। নতুন এজেন্টদের একটা গ্রুপ ওর কাছে পাঠিয়ে দাও। ওদেরকে বলে দিও কাজ শেষে হ্যাগেনকেও সরিয়ে দিতে।”
হাসান মাথা ঝাঁকালো। “ঠিক আছে। আমি নিজেই দেখছি ব্যাপারটা। আর এদিকে উনারা চলে এসেছেন। নিচে বাঙ্কারে বসে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
সাকির শব্দ করে শ্বাস ছাড়লো। এখনও তাকে কারো কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হয় ভাবতেই বিরক্ত লাগে। ওসাইরিস হলো একটা প্রাইভেট সামরিক দল। লক্ষ্য এমন এক সাম্রাজ্য গড়ে তোলা যারা কোনো সরকারকে কৈফিয়ৎ দেবে না, বরং সরকারগুলোকেই নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু সেটা এখনও বাস্তবায়নের পথে। আর ওসাইরিস এখনও একটা সংস্থা। সাকির একই সাথে এটার প্রেসিডেন্ট আর সিইও।
আর উনারা হলো, স্টকহোল্ডার আর বোর্ড মেম্বার। এদের প্রত্যেকেরই লক্ষ্য অনেক বড় বড়। বেহিসেবি ধন-সম্পদেও এদের মন ভরেনি। এখন তাদের চোখ পড়েছে ক্ষমতার দিকে। সবাই নিজের সাম্রাজ্য গড়তে চায় আর একমাত্র সাকির-ই তাদেরকে সেটা এনে দিতে পারবে।
.
১৪.
রোদ পড়ে পাইপগুলো ঝিকমিক করছে। পাশেই একটা লম্বা, কালো রঙের কাঠামো। সাকির সেদিকেই এগুলো। ওর অনেক পাম্পিং স্টেশনগুলোর মধ্যে এটা একটা। দুজন লোক দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। সাকিরকে দেখামাত্র দরজা খুলে ধরলো। চোখ সোজা সামনে। সাকিরের চেহারার দিকে তাকানোর দুঃসাহস ওদের নেই। ভেতরে ঢুকে সাকির সোজা ভবনের পিছন দিকে চলে গেল। একটা খনির কাজে ব্যবহৃত এলিভেটরের দরজা খুলে তাতে চড়ে বসলো। এটায় একই সাথে অনেক মানুষ আর ভারী মালামাল বহন করা যায়। সাকির নিচে নামার বোতামে চাপ দিল।
দুই মিনিট পর প্রায় চারশ ফুট নামার পর এলিভেটরের দরজা আবার খুলে গেল এবং সাকির নিচে নেমে এলো। সামনেই মাটির নিচে গুহার মতো একটা ঘর। দেয়াল আর মেঝে জুড়ে অসংখ্য লাইট লুকানো। গুহাটার অর্ধেকটা প্রাকৃতিক। বাকিটা সাকিরের মাইনিং টীম আর ইঞ্জিনিয়ারেরা বানিয়েছে।
লম্বায় প্রায় দুইশো ফুট। বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে আছে প্রকাণ্ড কয়েকটা পাম্প। ছোটখাটো একেকটা ঘরের সমান ওগুলো। সেগুলো থেকে ডজন ডজন পাইপ বের হয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে মাটির ওপরে।
সাকির সানগ্লাস খুললো। বরাবরের মতোই আবারও জিনিসটা দেখে মুগ্ধ হলো। ও এসব বিশাল যন্ত্রগুলো পার হয়ে একটা রুমে এসে ঢুকলো। এটা হলো কন্ট্রোল সেন্টার। বিশাল স্ক্রিনে মিসর আর উত্তর আফ্রিকার বেশির ভাগ অংশের মানচিত্র দেখা যাচ্ছে। সেখানে বেশ কয়েকটা সমান্তরাল দাগ টানা। সব দেশের ভেতর দিয়েই দাগটা গিয়েছে। প্রতিটা দাগের পাশে চাপ, প্রবাহমাত্রা, আয়তন সব উঠে আছে। সব লাইনের পাশেই ছোট্ট ছোট্ট সবুজ পতাকা জ্বলছে নিভছে। দেখে সন্তুষ্ট হলো সাকির।
তারপর সে ঢুকলো কনফারেন্স রুমে। রুমটা যে কোনো আকাশচুম্বী ভবনের ওপর বানানো কর্পোরেট অফিস টাওয়ারকে হারিয়ে দিতে পারবে। রুমের মাঝখানে একটা সেগুন কাঠের টেবিল। চারপাশ ঘিরে আছে মখমলে মোড়া চেয়ার। সেগুলোতে বসে আছে হোকা সাইজের কয়েকজন মানুষ। দেয়ালের স্ক্রিনে ওসাইরিসের লোগো ঝুলছে।’
সাকির টেবিলের মাথায় একটা চেয়ারে বসলো, তারপর বাকিদেরকে এক নজর দেখলো ভালো করে। পাঁচজন মিসরীয়, তিনজন লিবিয়ান, দুজন আছে আলজেরিয়ান, আর সুদান আর তিউনিসিয়ার প্রতিনিধি আছে একজন করে। মাত্র কয়েক বছরেই সাকির ওসাইরিসকে শূন্য থেকে এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ আন্ত র্জাতিক সংস্থায় রূপায়িত করেছে। সাফল্যের জন্যে কয়েকটা জিনিস লাগে : পরিশ্রম, ধূর্ততা, যোগাযোগ আর অবশ্যই টাকা। অন্য লোকের টাকা।
সাকির আর ওর সিক্রেট সার্ভিসের সাঙ্গাত্র প্রথম তিনটা জিনিসের যোগান দিয়েছে, আর শেষেরটার যোগান দিয়েছে এই লোকগুলো। এরা সবাই প্রচণ্ড ধনী এবং একসময় অনেক ক্ষমতাবানও ছিল। ছিল। কারণ আরব বসন্তে সাকির-এর চেয়েও এরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত তিউনিসিয়ায়। সেখানে এক গরিব হকার পুলিশ কর্তৃক বছরের পর বছর নিগৃহীত হওয়ার পর একদিন সহ্য করতে না পেরে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
কেউ হয়তো বিশ্বাসই করবে না যে এই ঘটনার এতো বড় প্রভাব পড়বে। এরকম কত জনই তো প্রতিদিন পুড়ে বা গুলি খেয়ে মরছে। কিন্তু দেখা গেল লোকটা শুধু নিজের গায়েই আগুন ধরায়নি, পুরো আরব বিশ্বের গায়েই আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। প্রায় অর্ধেক আরব জ্বালিয়ে তারপরেই থেমেছে ওটা।
প্রথমেই পতন হয় তিউনিসিয়ার। আর ওখানকার শাসকরা পালিয়ে যায় সৌদি-আরবে। এরপর শুরু হয় আলজেরিয়ায়। তারপর আগুন ছড়িয়ে পড়ে লিবিয়ায়। মুয়াম্মার গাদ্দাফি সেখানে ৪২ বছর ধরে কঠিন হাতে শাসন করে আসছিলেন। তার কাছের লোকজন সবাই তেল বেচে কোটিপতি হয়ে গিয়েছিল। গৃহযুদ্ধ বাধার পরে আর তারা জীবন বাঁচাতে পারেনি। তবে বুদ্ধি করে অনেকেই আগে আগে টাকা আর পরিবার পরিজনকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তারা বেঁচে গেছে। তবে তারপরও দেশ না ছেড়ে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যেই তারা উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে।
এরপরে মিসর হয়ে জাগরণের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে ইয়েমেন, সিরিয়া আর বাহরাইনে। আর এই বিশাল অগ্নিকুন্ত্রে সূচনা হয়েছিল এই সামান্য স্ফুলিঙ্গ থেকে।
এখন আবার উত্তেজনা থিতিয়ে এসেছে। পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত। যারা বেঁচে গেছে তারা আবার চাইছে হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে।
“আশা করি রাস্তায় কারো কোনো কষ্ট হয়নি। সাকির বলল।
“এসব সৌজন্যতার সময় নেই এখন। অপারেশন শুরু হবে কখন বলুন। আমরা সবাই-ই খুব টেনশনে আছি।” কথাটা বলল একজন মিসরীয়। মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে তার। পরনে ওয়েস্টার্ন স্যুট, হাতে ব্রিটলিং ঘড়ি। লোকটা মিসরীয় বিমান বাহিনীর কাছ থেকে পানির দামে বিমান কিনে সেগুলো বাইরে বেচে বেচে এত টাকা কামিয়েছে।
সাকির একজন কর্মচারীর দিকে ফিরে বলল, “পাম্পিং স্টেশনগুলো রেডি?” লোকটা মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল, তারপর সামনের কি-বোর্ডে চাপ দিতেই স্ক্রিনে কন্ট্রোল রুমে দেখা আফ্রিকার ম্যাপটা ফুটে উঠল।
“আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, নেটওয়ার্ক গঠন পুরো শেষ,” শাকির বলল। “আমাদের কাজকর্ম কেউ টের পায়নি তো?” লিবিয়ার সাবেক একজন জেনারেল প্রশ্ন করলেন।
‘না! তেলের পাইপ বসানোর কাজ করার হুঁতো ধরার কারণে কেউ সন্দেহও করেনি যে আমরা সাহারার তলদেশের জলাধারের গভীর আর গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় হাত দিচ্ছি। এখান থেকে শুরু করে পশ্চিম আলজেরিয়ার শেষ মাথা পর্যন্ত সব মরুদ্যান আর গাছপালার জীবনের উৎস এটাই।”
“অগভীর জলাধারগুলোর কি হবে? আমাদের দেশের লোকেরা তো ওগুলোর ওপরই নির্ভরশীল।” লিবিয়ার দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল কথাটা।
“আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে মিষ্টি পানির সব উৎস-ই এসব গভীর জলাধারের ওপর নির্ভরশীল। যদি আমরা ওগুলো থেকেই প্রচুর পরিমাণ পানি তুলে নেয়া শুরু করি তাহলে ওগুলোও টিকবে কি-না সন্দেহ।” সাকির বলল।
“আমি চাই ওগুলো একেবারেই শুকিয়ে যাক।” তিউনিসিয়ার প্রতিনিধি বলল।
“পুরোপুরি শুকিয়ে ফেলা অসম্ভব। তবে এটা হচ্ছে মরুভূমি। যখন হঠাৎ করেই একদিন তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া আর লিবিয়া দেখবে যে তাদের পানির সংগ্রহে টান পড়েছে তখনই তারা আমাদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আশি-নব্বই ভাগ ঘাটতি হলেই হবে। পুরোটা শুকোতে হবে না। বিদ্রোহীদেরও পানির প্রয়োজন হয়। পানির সরবরাহ তখনই আবার নিশ্চিত করা হবে যখন আবার আপনারা ক্ষমতা ফিরে পাবেন। তারপর সবাই একসাথে মিলে ওসাইরিসের মাধ্যমে আমরা সমগ্র উত্তর-আফ্রিকাকে নিয়ন্ত্রণ করবো।
“আচ্ছা পানিটা তুলে রাখবেন কোথায়? আপনি দিনে দুপুরে বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালন পানি তুলবেন আর কারো চোখে পড়বে না তা-তো হয় না।” আলজেরিয়ান লোকটা বলল।
“পানি আসবে এসব পাইপের ভেতর দিয়ে।” সাকির মানচিত্রের লাইনগুলো দেখিয়ে বলল।” তারপর এসব চ্যানেল দিয়ে সোজা গিয়ে পড়বে নীল নদে। তারপর সেখান থেকে চলে যাবে সাগরে।”
রুমের সবাই একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। “দারুণ!” প্রশংসা করল একজন।
“আর যেসব ইউরোপিয়ান আর আমেরিকান আমাদের বিরোধিতা করবে?” লিবিয়ান জিজ্ঞেস করলেন।
সাকির হাসলো, “ইতালিতে আমাদের লোক সেটার ব্যবস্থা করছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এরা কোনো সমস্যা-ই করবে না।”
“খুব ভালো। তা সেটা কখন শুরু হচ্ছে? আর আপনার কি আর কিছু লাগবে?” লিবিয়ান-ই বললেন আবার।
এদের এই প্রবল আগ্রহই শাকিবের প্রধান পুঁজি। ক্ষমতার স্বাদ একবার পাওয়ায়, এরা সেটা ফিরে পেতে এতোটাই মরিয়া যে যা খুশি করতে রাজি। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সাকির যথেষ্ট টাকা আর সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। এবার তার প্রতিদান দেয়ার পালা।
“বেশির ভাগ পাম্প-ই কয়েক মাস ধরে চলছে। পানি তোলার কাজও খুব দ্রুত শুরু হয়ে যাবে। তারপরই বাকি সবই হবে পরিকল্পনা মতো।” সাকির সবার উদ্দেশ্যে বলল। তারপর টেকিনিশিয়ানের দিকে ফিরে বলল, “অন্যান্য স্টেশনকে খবর দাও। সব পাম্প চালু করতে বলো।”
টেকনিশিয়ান কয়েকটা বোম চাপতেই পাম্পগুলো জ্যান্ত হয়ে উঠল। ঘড় ঘড় শব্দে ভরে গেল চারপাশ। কয়েক মুহূর্ত পরেই শব্দ এতো বেড়ে গেল যে মুখের কথা আর শোনা-ই যায় না। সাকির তাই দ্রুত সভার শেষ টানলো।
“মরুভূমিতে গরম বাতাসকে বলে সিরোক্কো। আজ আমরা নিজেরাই গরম বাতাসের সৃষ্টি করলাম। এই বাতাস সমগ্র আফ্রিকা জুড়ে ভেসে ভেসে আরব বসন্তের সমাপ্তি ঘটাবে। তারপরই শুরু হবে সবচেয়ে দীর্ঘ আর সবচেয়ে জ্বলন্ত গ্রীষ্ম।
.
১৫.
গাফসা, তিউনিসিয়া
পল ট্রাউট দরদর করে ঘামছে। আজ বিকেলে প্রচণ্ড গরম পড়েছে। মাথায় বিশাল একটা সময়েরা (দক্ষিণ আমেরিকার চওড়া কিনারওয়ালা টুপি), তারপরও মনে হচ্ছে মুখটা ঝলসে যাচ্ছে। সূর্য আরেকটু নিচে নামতেই এবার সূর্যের রশ্মি সরাসরি ওর মুখে পড়ে চামড়ায় কামড় বসাতে লাগল। যেন বলতে চাইছে সাদা চামড়ায় ইংলিশ লোকজনের এদিকে থাকার যোগ্যতা নেই।
পলের উচ্চতা ছয় ফুট আট। এই দলটার মধ্যে ওই সবচে লম্বা। ওরা হচ্ছে একটা হাইকারের দল। একটা পাথুরে পাহাড় বেয়ে উঠছে ওরা। পথের ধারে একটা আগাছা পর্যন্ত নেই। দলের মধ্যে ও-ই অবশ্য সবচেয়ে হ্যাংলা। কয়েক কদম সামনেই হাঁটছে ওর স্ত্রী গামায়। সে এমন দক্ষতায় পাহাড় বেয়ে উঠছে যেন কুকুর নিয়ে বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছে। তার পরনে দৌড়বিদদের পোশাক আর একটা চামড়া রঙের গোল ক্যাপ। লাল চুল পনিটেইল করে পেছনে বাধা। সেটা আবার ক্যাপের ছিদ্র দিয়ে বাইরে বের করা। গামায় সামনে বাড়লেই ওটা এপাশ ওপাশ দুলছে।
পল কাধ ঝাঁকালো। পরিবারের কাউকে তো অন্তত শক্তিশালী হতেই হবে। আর কাউকে হতে হবে বাহানা বাজ। “আমার মনে হয় আমাদের একটু রেস্ট নিলে ভালো হয়।” বলল ও।
“কাম অন পল। আর অল্প একটু আছে। আর একটা পাহাড় পার হলেই তুমি পৃথিবীর সবচে নতুন লেকের অলৌকিক পানিতে গোসল করতে পারবে আর গাফসা বীচে রেস্ট নিতে পারবে।”
রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকেই গাফসা আর এর আশপাশের এলাকাটা ভ্রমণকারীদের জন্য তীর্থ স্থান। ঝরণা, হাম্মামখানা, আর আয়ুর্বেদিক পুকুরে এলাকাটা ভর্তি। বেশির ভাগই নানান ধরনের আজব আজব চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়। পল আর গামায়ও এখানকার প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ নিয়ে গবেষণা আর বিখ্যাত কাসাবাহ খোঁজার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ঝরণা আর পুকুরে রিলাক্স করেছে।
“হোটেলেও যথেষ্ট অলৌকিক পানি ছিল।” পল মজা করল।
“হ্যাঁ, তবে ওসব লেকের পানি হাজার বছর ধরে ওখানে আটকে আছে। আর এই লেকটা মাত্র ছয় মাস আগে মাটি খুঁড়ে উদয় হয়েছে। তাতেও তোমার একটু কৌতূহল হচ্ছে না?”
পল একজন ভূতত্ত্ববিদ। বড় হয়েছে ম্যাসাচুসেটস-এ। সেখানে ওর প্রচুর সময় কেটেছে পানিতে সাঁতার কেটে আর বিখ্যাত উডস হোল সমুদ্রতত্ত্ব ইনস্টিটিউট এর আশেপাশে ঘুরঘুর করে। শেষমেশ ও স্ক্রিপস সমুদ্রতত্ত্ব ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়। আর মেরিন জিওলজিতে পি. এইচ ডি, লাভ করে। ওর গবেষণার বিষয় ছিল গভীর সমুদ্র তলের গঠন। সমুদ্র তলার ভূতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করার জন্য বেশ কিছু প্রযুক্তিও আবিষ্কার করেছে ও। তাই স্বাভাবিকভাবেই হঠাৎ করে বলা নেই কওয়া নেই মাটি খুঁড়ে একটা লেক উদয় হওয়ার ঘটনা তাকে কৌতূহলী করছে বটেই। কিন্তু ঘণ্টাখানেক রাস্তা নামক খানাখন্দে গাড়ি চালানোর পর তিরিশ মিনিট এই জ্বলন্ত সূর্যের তাপেই সে কৌতূহল উবে গেছে।
“এই তো চলে এসেছি।” গামায় চিৎকার করে বলল সামনে থেকে। পল বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ওর স্ত্রীর দিকে তাকাল। ক্লান্তি বলে যে কোনো কিছু নেই ওর। সব সময় কিছু না কিছু করছেই। এমন কি বাসায়ও ওকে কখনো স্থির দেখা যায় না। ও ডক্টরেট করেছে মেরিন বায়োলজিতে। তবে এর বাইরে ও আরো অনেক বিষয়ে ওর ডিগ্রি আছে। বহু দিনের পরিচয়ের কারণে পল জানে, কোনো কিছুতে দক্ষতা এসে গেলেই গামায় এর কাছে সেটা আর ভালো লাগে না। তাই নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ খুঁজে বেড়ায়।
একবার পলকে চোখ টিপে বলেছিল, পলকে নাকি বহু চেষ্টা করে যাচ্ছে সোজা করার। কিন্তু পল ওকে বারবার হতাশ করেই আছে। এটাই নাকি ওদের দীর্ঘ আর সুখী দাম্পত্য জীবনের রহস্য। আর দুজনেই অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। এ কারণেই NUMA’র অ্যাডভেঞ্চারের পাশাপাশি নিজেরাও ছুটিছাটা পেলেই বেরিয়ে পড়ে কোথাও না কোথাও।
গামায় গাইডেরও আগে চূড়ায় পৌঁছে গেল। পৌঁছে থেমে কিছুক্ষণ চারপাশ দেখলো তারপর নিতম্বে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকল।
গাইডও সেখানে পৌঁছালো এক সেকেন্ড পর। কিন্তু তার চোখে প্রশংসার বদলে কেমন যেন সন্দেহ। মাথায় হ্যাট নামিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা চুলকাতে লাগল।
পলও চুড়াটার কাছে পৌঁছাতেই কারণটা ধরতে পারলো। যা ছিল পাথরে ঘেরা বিশাল একটা লেক, সেটা এখন প্যাঁচপেচে কাদায় ভর্তি ছোট্ট একটা ডোবায় পরিণত হয়েছে। মাঝখানে মাত্র দশ ফুট ব্যাসার্ধের একটা বৃত্তাকার জায়গায় কালচে একটু পানি জমে আছে। শুধু চারপাশের পাথরের গায়ে একটা মলিন দাগ দেখে বোঝা গেল পানি ঐ পর্যন্ত ছিল।
পলের পরেই আরো কিছু পর্যটক ওখানে পৌঁছালো। ওর মতো তারাও বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। এখানে আসার আগে এই জায়গাটার দুর্দান্ত কিছু ছবি দেখেছিল সবাই। মূলত সেটা দেখেই মরুভূমি পেরিয়ে এখানে আসা। সেই জিনিসের এই দশা কেউ আশা করেনি।
“কি বিশ্রী। আমাদের এলাকায় তো কেউ এখানে মাছও ধরবে না।” এক মহিলা বলল। কণ্ঠে দক্ষিণাঞ্চলের টান।
স্থানীয় যে গাইডটা ওদের নিয়ে এসেছে তাঁকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। “কিছুই তো বুঝতে পারছি না। এটা কীভাবে সম্ভব? দুদিন আগেও লেকের পানি ঐ পর্যন্ত ছিল।” পাথরের দাগ দেখিয়ে বলল লোকটা।
“বাষ্প হয়ে গেছে সব পানি। যা গরম এখানে।” স্কটল্যান্ডের এক পর্যটক বলল কথাটা।
কাদার দিকে তাকাতেই পল ওর সব ব্যথা বেদনা ভুলে গেল। ও জানে যে ওরা এক রহস্যের দিকে তাকিয়ে আছে। লেক হঠাৎ গজিয়ে ওঠাকে তাও মেনে নেয়া যায় কারণ আশে পাশে প্রচুর ঝরণা আছে। ঝরণার পানির ধাক্কায় প্রায়ই দেখা যায় এখানে সেখানে মাটি সরে পানি জমে যাচ্ছে। কিন্তু এক রাতে পুরো লেকই আবার উধাও হয়ে যাওয়া…সেটা সম্পূর্ণ আরেক জিনিস।
আশে পাশে ভালো করে দেখে লেকটার আয়তন আর গভীরতা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে নিলো। “এতোখানি পানি দুই দিন তো দূরে থাক দুই মাসেও বাষ্প হওয়া সম্ভব না।”
“তাহলে গেল কোথায়?” দক্ষিণী মহিলাটি জিজ্ঞেস করল।
“বোধহয় কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। এই এলাকায় এখন খরা চলছে।” স্কটিশ লোকটা জবাব দিল।
লোকটার কথা সত্য। উত্তর আফ্রিকার মধ্যে তিউনিসিয়ার অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ। কিন্তু এক হাজার ট্যাংকার ট্রাক আসলেও তো এতো বড়ো লেকের পানি ফুরোনোর কথা না। পল লেকের দেয়ালে কোথাও ফাটল আছে কি-না খুঁজতে লাগল। কিন্তু সেরকম কিছুই চোখে পড়ল না।
কোত্থেকে কিছু মাছি উড়ে এসে ভো ভো করতে লাগল চারপাশে। এর বাইরে আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না আশে পাশে। শেষমেশ দক্ষিণী মহিলা আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলেন না। গাইড লোকটার কাঁধে টোকা দিয়ে ফেরার পথে হাঁটা দিলেন। তবে তার আগে বললেন, “মনে হয় কেউ বোধহয় এটার প্লাগ খুলে দিয়েছে। তাই এই অবস্থা।”
অন্যরাও তাদের অনুসরণ করল। কাদা ভরা গর্ত দেখার কারোর-ই খুব বেশি আগ্রহ নেই। গাইড পুরো বকবক করে বোঝানোর চেষ্টা করল দুইদিন আগেও লেকটা কিরকম পানিতে টইটম্বুর ছিল। আর তাই যদিও এখন এটা আর নেই কিন্তু পয়সা ফেরত দেয়া হবে না। পল অবশ্য ফিরতে একটু দেরি করল। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে। হঠাৎ একদল বাচ্চাকে দেখা গেল কাদা মাড়িয়ে লেকের শেষ পানিটুকু সংগ্রহের জন্য।
আর থেকে লাভ নেই, তাই পা চালিয়ে ফিরতি পথ ধরলো ও। গামায় এর কাছে এসে বলল, “মহিলার কথা কিন্তু ঠিক।”
“কোন কথা?”
“ঐ যে কেউ যেন প্লাগ খুলে দিয়েছে মনে হচ্ছে সেটা। এই ধরনের ঝর্ণাগুলো প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন জলাধার থেকে সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত মাটির নিচের পাথরগুলো যখন ভেঙে সরে যায় তখন ওটার মাঝে পানি আটকা পড়ে আর একটা লেক সৃষ্টি হয়। এখানেও সম্ভবত একই ব্যাপার ঘটেছিল। কখনো কখনো পানির প্রবাহ চলতেই থাকে অবিরাম আবার কখনো একবার পানি জমেই পানি আসা বন্ধ হয়ে যায়। তবে যদি এমন হয় যে পাথর আবারো সরে গিয়ে ঝর্ণার মুখ বন্ধ হয়ে গেছে তখনও সাধারণত পানি সেখান থেকে সাথে সাথে উধাও হয় না। আস্তে আস্তে সূর্যের তাপে পানি বাষ্প হয়ে লেকটা শুকিয়ে যায়। কিন্তু সেও কয়েক মাসের ব্যাপার। যেহেতু এই লেকটা হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে, তার মানে পানি আসলে অন্য কোথাও সরে গিয়েছে। কিন্তু জায়গাটা একটা বাটির মতো। এটার সাথে অন্য কোনো কিছুর সংযোগ নেই।”
“তার মানে যেহেতু একটা বাষ্প হয়নি বা আশে পাশে চলে যায়নি, সেহেতু এটা আসলে মাটির ভেতর ঢুকে গেছে। এটাই আপনার মত, তাই না মি. ট্রাউট” গামায় বলল।
পল মাথা ঝাঁকালো, “যেখান থেকে এসেছিল, সেখানেই ফিরে গেছে।“ “এরকম কখনো হয় নাকি? শুনেছো কখনো?”
“না। এরকম হতে কখনো শুনিনি আমি।” পল জবাব দিল।
হঠাৎ ওদের দিকে একটা লোককে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। লোকটাকে ওরা লেকের পাড়ে দেখেছিল। তবে ওদের পাড়ে না, অন্য পাশে। ওদের মতোই ছবি তুলছিল লেকটার। লোকটা কিছুটা খাটো। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতা। মাথায় একটা দোমড়ানো ক্যানভাসের হ্যাট। মুখে কয়েক দিনের না কামানো দাড়ি। কাঁধে ব্যাকপ্যাক, হাতে লাঠি আর গলায় ঝোলানো বাইনোকুলার দেখেই বোঝা যাচ্ছে ইনিও হাইকার। কিন্তু হাতে একটা হলুদ কালো চিহ্ন পলের নজর এড়ালো না। চিহ্নটা জরিপকারীদের প্রতীক।
কাছে এসে ক্যাপটা একটু ওপরে ঠেলে দিয়ে বলল, “হ্যালো। আমি পাশ থেকে লেকের পানি উধাও হওয়া সম্পর্কে আপনার মন্তব্যটা শুনে ফেলেছি। সারাদিন দেখলাম লোকজন আসছে, আর হতাশ হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে ফিরে যাচ্ছে। আপনাকেই প্রথম দেখলাম যে কি-না কি হয়েছে আর পানি কোথায় গিয়েছে তা নিয়ে ভাবতে। আপনি কি ভূতাত্ত্বিক নাকি?”
“ভূতত্ত্ব নিয়ে কিছু পড়াশোনা আছে। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, “পল ট্রাউট। এই হলো আমার স্ত্রী গামায়।”
লোকটা পল আর গামায় দুজনের সাথেই হ্যান্ডশেক করল। তারপর বলল, “আমার নাম রেজা আল-আগ্রা।”
“কেমন লাগছে এখানে?” গামায় জিজ্ঞেস করল।
“খুব বেশি ভালো না।” স্বীকার করল রেজা।
পল জরিপকারীদের প্রতীকটা দেখিয়ে বলল, “আপনি কী লেকটার মাপজোক নিতে এসেছেন নাকি?
“সেরকম কিছু না আসলে। আপনার মতো আমিও চেষ্টা করছিলাম লেকের পানি কীভাবে আর কোথায় উধাও হলো বের করতে। তাই প্রথমেই চেষ্টা করছিলাম এখানে কতটুকু পানি ছিল সেটা খুঁজে বের করার।”
“আমরা অবশ্য মনে মনেই অনুমান করেছিলাম খানিকটা।” পল বলল। কাদা নিয়ে জরিপ ওর কাছে বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে।
“হ্যাঁ,…কিন্তু আমার আসলে শুধু অনুমান করে বলার সুযোগ নেই। আমি লিবিয়া সরকারের পানি সম্পদ বিভাগের পরিচালক। আমার তাই কাটায় কাটায় আসল হিসাব দরকার।”
“কিন্তু এটা তো তিউনিসিয়া।” গামায় ভুলটা ধরিয়ে দিল।
“জানি। কিন্তু আমিও সরেজমিনে দেখতে এসেছি। আমার পেশার দিক থেকে পানি উধাও হয়ে যাওয়া খুব খারাপ লক্ষণ।” রেজা জবাব দিল।
“মরুভূমির মধ্যে এটাতো একটা ছোট্ট লেক।” গামায় বললো আবার।
“হ্যাঁ, কিন্তু এটাই উধাও হওয়া একমাত্র লেক না। আমাদের দেশে প্রায় একমাস ধরে পানির পরিমাণ শুধু কমছেই। ঝর্ণা বাহিত লেকগুলো সব শুকিয়ে গিয়েছে। নদীর ধারাও শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছে। দেশের সব মরুদ্যান শুকিয়ে কাঠ। কার্থেজদের আমল থেকে যেসব মরুদ্যান সতেজ ছিল সেগুলোও আজ শুকিয়ে গেছে। এত দিন ধরে তাও মাটি থেকে পানি পাম্প করে চালাচ্ছিলাম, কিন্তু ইদানীং পাম্পেও বেশি পানি আর উঠছে না। প্রথমে ভেবেছিলাম এটা বুঝি শুধু আমাদেরই সমস্যা কিন্তু এই লেকটার কথা শুনলাম সেদিন, তারপর আজ দেখে বিশ্বাস হলো যে যা ভেবেছিলাম ব্যাপারটা তার চেয়েও আরো অনেক বেশি জটিল। সম্ভবত ভূগর্ভস্থ পানির স্তর মারাত্মক নিচে নেমে গিয়েছে।”
“সেটা কীভাবে সম্ভব?” গামায় জিজ্ঞেস করল।
“কেউ জানে না। কিছু মনে না করলে এব্যাপারে আপনাদের সাহায্য কী পেতে পারি?” রেজা জিজ্ঞেস করল।
পল একবার তার স্ত্রীর দিকে তাকাল। চোখে চোখে কথা হলো দুজনের। “অবশ্যই। সাহায্য করতে পারলে খুশি-ই হবে। যদি আপনি আমাদেরকে হোটেলে পৌঁছার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারেন, তাহলে আমরা ওখান . থেকে আমাদের জিনিস পত্র নিয়ে আপনার সাথে যোগ দিতে পারি।”।
“চমৎকার। এই রাস্তার মাথাতেই আমার ল্যান্ড রোভারটা আছে।” হাসি মুখে বললেন রেজা।
.
১৬.
ভ্যালেটা বন্দর, মাল্টা
ভ্যালেটা বন্দরে আসলে মনে হবে যেন ভুল করে অতীতে চলে আসা হয়েছে। যখন মাল্টা শাসন করতে বেশ কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আর এটার মতো একটা ক্ষুদ্র বন্দরও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য আর ভূমধ্যসাগর নিয়ন্ত্রণের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সী ড্রাগন বন্দরের মুখে ঢুকতেই দেখলো এটার চেহারা এখনো সেই স্বর্ণালি অতীতের মতোই ঝলমল করছে। উনিশ শ আশি, নব্বই, এমনকি সত্তরের দশকে জন্ম নিলেও কার্টের এখানে থাকতে কোনো আপত্তিই থাকতো না। সামনে তাকাতেই কার্থেলাইট গীর্জার গম্বুজ চোখে পড়ল। ওটার পিছনেই সূর্য ডুবছে। ওটার চারপাশ জুড়ে আরো অনেক প্রাচীন ভবন আর গীর্জা দাঁড়িয়ে আছে। শুধু এই বন্দরের নিরাপত্তার জন্যেই আলাদা রক্ষীদল আর চার চারটা দুর্গ তৈরি করা হয়েছিল। এখান থেকে এখনও চোখে পড়ে সেগুলো।
ফোর্ট মানোয়েল বানানো হয়েছে লম্বা খাড়িটার একটা বাকের মুখে। আর ফোর্ট সেইন্ট এলমো উপদ্বীপটার একদম মাথায় অবস্থিত। পাঁচ হাজার বছর বয়স হয়ে গিয়েছে এগুলোর। বাইরের পাথরের দেয়াল ক্ষয়ে গেছে, দেখতে ভয়ঙ্কর লাগে। ঠিক এটার উল্টোদিকে বন্দরের ডান দিকে হলো ফোর্ট রিকাসোলি। এই দুৰ্গটা দেখতে অন্যগুলোর চেয়ে কিছুটা আলাদা। আকারেও ছোটখাটো। এটার দেয়াল একেবারে বন্দরে ঢোকার মুখ পর্যন্ত বিস্তৃত। একটা ছোট বাতিঘরও আছে দেয়ালের শেষ মাথায়। আর একেবারে বন্দরের ভেতরের দিকে আছে ফোর্ট সেইন্ট অ্যাঞ্জেলো। একদম পানির কিনার থেকে সোজা ওপরে উঠে গেছে।
শুধু দুর্গগুলোই না এখানকার বাঁধ, দালালনকোঠা, বা প্রাকৃতিকভাবেই দুকূলে সৃষ্ট খাড়া তীর সবই একই রকম তামাটে পাথরে তৈরি। এ থেকেই বোঝা যায় মাল্টা একসময় শৌর্যে বীর্যে কতটা এগিয়ে ছিল।
এজন্যেই দেখে মনে হয় পুরো দ্বীপটাই বোধহয় একই সাথে একটাই পাথর কেটে কেটে বানানো হয়েছে। সবকিছুতে এতো মিল।
চারপাশ দেখতে দেখতে জো বিস্মিত হয়ে বলল, “ভেবে পাচ্ছি না বাইরের কারো পক্ষে এই দ্বীপ দখল করা কীভাবে সম্ভব?”
“নির্বোধ লোকদেরকে বোকা বানিয়ে। আর সেজন্য লাগে বিভ্রান্ত করা আর শয়তানি চাল। নেপোলিয়ন মিসর যাওয়ার পথে রসদপত্র কেনার উদ্দেশ্যে এই দ্বীপে আসেন। স্থানীয়রা দেখলো টাকা কামানোর এই সুযোগ, তাই তাঁকে বাধা দিল না। যেই না তার জাহাজ এই দুর্গের আওতার বাইরে চলে গেল ওমনি উনি মাটিতে সৈন্যবাহিনী নামিয়ে লোকদের ঘরে ঘরে আক্রমণ শুরু করলেন।” কার্ট বলল।
“এতো দেখি ট্রয়ের ঘোড়ার মতো অবস্থা, শুধু ঘোড়ার বদলে এখানে জাহাজ।” জো মন্তব্য করল।
সী ড্রাগন ইতোমধ্যে বন্দরের ভেতরের দিকে চলে এসেছে। নোঙ্গর করার জায়গা খুঁজছে। বন্দরের এই দিকটা অবশ্য বেশ আধুনিক। ছোট ঘোট ট্যাংকার থেকে তেল নামানো হচ্ছে, পাশেই কয়েকটা প্রমোদরী আর বিশাল দুটো মালবাহী জাহাজ। সী ড্রাগনও এগুলোর পাশেই থামল।
ঘাটে পুরোপুরি লাগার আগেই কার্ট আর জো লাফ দিয়ে জাহাজ থেকে নেমে তড়িৎ নেমে পড়ল রাস্তায়।
“দুজন লোককে সব সময় পাহারায় রেখো। আশেপাশে বিপজ্জনক লোকে ভরা।” যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলল কার্ট।
“তোমাদের মতো নাকি সবাই?” রেনল্ডসও জবাব দিল চিৎকার করে। কার্ট হাসলো।
“বেশি ঝামেলা করো না। পুলিশে ধরলে জামিন করানোর টাকা কিন্তু নেই।” রেনল্ডস আবারও বলল।
কার্ট জবাবে কিছু না বলে হাত নাড়লো। ও আর জো যাচ্ছে মাল্টা সমুদ্ৰতাত্ত্বিক যাদুঘরের কিউরেটরের সাথে দেখা করতে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।
“কিউরেটর সাহেব কি এখনও আছে বলে মনে হয়?” জো জিজ্ঞেস করল। একটা ট্যাক্সি ধরার চেষ্টা করছে।
কার্ট আকাশের দিকে তাকাল। সন্ধ্যা হতে দেরি নেই। “বলতে পারছি না। থাকতেও পারে।”
ক্যাব ড্রাইভার দেখা গেল দারুণ পটু। গিজগিজে সরু সরু গলি ধরেও সবচে কম সময়ে ওদেরকে যাদুঘরের সামনে এনে নামিয়ে দিল। গেটের পাশেই গ্রিক সমুদ্র দেবতা পসাইডনের একটা মূর্তি।
ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে কার্ট আর জো সামনে বাড়লো। একপাশে নতুন কি যেন বানানো হচ্ছে। সেদিকটা ঘেরা। ওরা সেটা পেরিয়ে যাদুঘরের মূল ভবনের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো।
মূল ভবনটা এক কথায় দুর্দান্ত। দুপাশেই পাথরের সিংহ মূর্তি। সামনেটা দেখেই কাটের নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির কথা মনে পড়ে গেল। দরজার কাছে পৌঁছাতেই সিকিউরিটি আটকালো ওদের। কার্ট আর জো নিজেদের পরিচয় আর আসার উদ্দেশ্য বলতেই সিকিউরিটি ভেতরে ফোন করল ওদের কথা জানানোর জন্যে।
কিছুক্ষণ পরেই দুই কনুইতে ছাপ্পাওয়ালা টুইডের জ্যাকেট পরা রাশভারী একজন লোককে দেখা গেল দরজায়।
কার্ট হাত বাড়িয়ে বলল, “ড. কেনসিংটন?”
.
“উইলিয়াম বললেই খুশি হবো,” হ্যান্ডশেক করতে করতে লোকটা বলল। লোকটা জাতিতে ইংরেজ তবে এখন এখানকার-ই নাগরিক। ব্রিটিশদের দখলকৃত সব এলাকাতেই এরকম অসংখ্য মানুষ দেখা যায়। দেরি করার জন্য দুঃখিত। আসলে হঠাৎ বাতাস পড়ে যাওয়ায় দ্বীপে পৌঁছাতেই দেরি হয়ে গিয়েছিল।” কার্ট বলল।
কেনসিংটন পেঁতো হাসি হাসলেন, “বাতাস সবসময়ই পড়ে যায়। এজন্যেই সম্ভবত মোটর বোট আবিষ্কার করা হয়েছে।”
কথাটায় সবাই হেসে দিল। কথা বলতে বলতে ওরা ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ল। কেনসিংটন পিছনের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। তবে ফেরার আগে আবারও তিনি দরজায় লাগানো ফিনিশীয় জানালার একটা পাত টেনে সরিয়ে, বাইরের দিকটা দেখতে লাগলেন। তারপর সন্তুষ্ট হয়ে ওদেরকে মেইন হলে নিয়ে আসলেন। মেইন হলটাও দারুণ। অনেক খরচ করে বানানো বোঝ যায়। আগামী পরশু নিলামের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে দেখা গেল। সেটা ছাড়িয়ে ওরা কেনসিংটনের অফিসে চলে এলো। তৃতীয় তলার শেষ মাথায় একটা ছোট চারকোণা রুমে ওনার অফিস। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বিভিন্ন পুরাকীর্তি ম্যাগাজিন হাবিজাবি গাদাগাদি হয়ে আছে। ছোট্ট একটা জানালা একপাশে। তাতে গাটু কাঁচ বসানো।
“আঠারো শতকে এটা একটা আশ্রম হিসেবে ব্যবহৃত হতো।” কেনসিংটন ব্যাখ্যা করলেন।
তিনজন বসতেই বাইরে ফ্লাডলাইট জ্বলে উঠল। সাথে শোনা গেল যন্ত্রপাতির আওয়াজ। হাতুড়ি পিটানোর শব্দ আর মানুষের চিৎকার।
“এই রাতের বেলাও কাজ চলছে?” কার্ট প্রশ্ন করল।
“আসলে দিনে পর্যটকরা আসে। তাদের যাতে সমস্যা না হয় তাই রাতেই কাজ করা হয়। পুরো চত্বরটাই সংস্কার করা হচ্ছে।”
“সংস্কারটা রাস্তায় করলে আরো ভালো হতো। আরাম করে চলাচল করতে পারতাম।” জো বলল।
কার্ট কেনসিংটনকে ওর একটা কার্ড দিল।
“NUMA” কার্ডটা পড়তে পড়তে উচ্চারণ করলেন কেনসিংটন। “আপনাদের সাথে তো আগেও কাজ করেছি। এখনও মনে পড়ে মাঝে মাঝে। এবার কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”
“আমরা আসলে নিলামের আগে যে একটা পার্টি হবে ওটা সম্পর্কে জানতে চাই।” কেনসিংটন কার্ডটা নামিয়ে রাখলেন, “হ্যাঁ। ব্যাপারটা দারুণ মজার হবে। পরশু রাতে নিলাম অনুষ্ঠান। তার আগে ক্রেতা আকর্ষণ করার জন্যে জিনিসগুলো ঝেড়ে মুছে সবাইকে একবার দেখানো হবে। আপনাদেরকে দাওয়াত দেয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু এটা আসলে আগে থেকেই নির্ধারিত কিছু মানুষের জন্যে।”
“এই পার্টিতে হবে টা কি?”
“এখানে আসলে অতিথিরা ঠিক করতে পারবেন তারা কোনটা কিনবেন, আর একে অন্যের সাথে পরিচিতও হতে পারবেন, তাতে জানা হয় যে কার সাথে প্রতিযোগিতা করে তাকে জিনিসটা কিনতে হবে।” বলতে বলতে দাঁত বেরিয়ে গেল কেনসিংটনের, “একবার যদি দুজনের মধ্যে অহংবোধের লড়াই বেধে যায়, তাহলে আর ভাবতে হবে না। যে কোনো পুরাকীর্তির-ই আকাশচুম্বী দাম উঠে যায়।
“বুঝতে পারছি।” কার্ট বলল।
“শোনেন, একটা জিনিস গত একশো বা হাজার বছরেও কেউ দেখেনি, সেই জিনিস এক নজর দেখার জন্যে পকেটের পয়সা খরচ করতে কারো আপত্তি নেই।”
“হুম, আর যদি সেটা বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে তো পুরো পকেট উপুড় করে দিতেও আপত্তি হবে না।”
“ঠিক। আর এটা অবৈধ কোনো কাজও না। আর এটা যাদুঘরের উন্নতির স্বার্থেই করা হচ্ছে। আমাদের যাদুঘরটা ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। শুধু টিকিট বেচা টাকায় আমাদের পোষায় না। তাই সবকিছু চালাতে টাকা লাগবেই।” কেনসিংটন বললেন।
“যা যা জিনিস বেচবেন তার কি কোনো লিস্ট আছে?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ। কিন্তু আসলে আপনাকে দেখানো যাবে না। নিয়ম নেই। আর কিছু ঝামেলাও আছে।”
“নিয়ম?”
“আর কিছু ঝামেলা।” কেনসিংটন আবার বললেন।
“বুঝলাম না।”
কেনসিংটনের কপালে ঘাম জমেছে। আপনি তো সমুদ্রের নানা জিনিস উদ্ধার করেন। আপনি বুঝবেন। কিছু একটা উদ্ধারের ঘটনা জানাজানি হলেই জিনিসটা আসলে কার তা নিয়ে টানাটানি লেগে যায়। মনে করেন একটা
স্প্যানিশ জাহাজ থেকে স্বর্ণ উদ্ধার হলো। তাহলে সেটা আসলে কার হবে? উদ্ধারকারী দল বলবে এটা তাদের। স্প্যানিশরা বলবে ওদের জাহাজ অতএব ওদের। ইনকাদের বংশধররা বলবে আমরা মাটি খুড়ে এই স্বর্ণ বের করেছিলাম, এটা আমাদের। স্বর্ণ নিয়েই এতো গ্যাঞ্জাম, আর পুরাকীর্তির কথা বাদই দিলাম। শুনেছেন নাকি যে মিসর নাকি ইংল্যান্ডের কাছ থেকে রোজেটা পাথর ফেরত নেয়ার জন্য মামলা করবে? রোমের কাছে ল্যাটেরান ও বেলিস্কটাও ফেরত চাইবে। এটা আসলে ছিল কর্ণাক-এর আমুন এর মন্দিরের বাইরে। দ্বিতীয় কনস্টানটিয়াস ওটা নিয়ে যায়। তাঁর ইচ্ছা ছিল কনস্টানটিনোপল-এ নিয়ে যাওয়া। কিন্তু শেষমেশ রোমেই থেকে যায়।”
“তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন…”।
কেনসিংটন ভনিতা বাদ দিয়ে সরাসরিই বলে দিলেন, “জিনিসগুলোর অস্তিত্ব প্রকাশিত হবার সাথে সাথে কাড়াকাড়ি শুরু হবে। দুনিয়া ব্যাপী মামলা লড়ার আগে অন্তত একটা রাত আমরা আরামে থাকতে চাই।”
গল্পটা ভালোই। অর্ধেকটা সত্যি হলেও হতে পারে। তবে কেনসিংটন কিছু লুকাচ্ছেন। “মি, কেনসিংটন,..” কার্ট বলতে গেল।
“উইলিয়াম বলবেন প্লিজ।”
“এসব করার কোনো ইচ্ছে ছিল না কিন্তু আমার আর কোনো উপায় নেই।” কার্ট বলে ডা. আমব্রোসিনির দেয়া ছবিগুলো বের করে ডেস্কের ওপর ফেলল।
“কি আছে এই ছবিতে?”
“আপনি আছেন। আপনাকে অতটা ভালো দেখাচ্ছে না, তবে এটা যে আপনি তা পুরোপুরিই বোঝা যাচ্ছে। আজকেও একই জ্যাকেটটা পরে আছেন আপনি।”
“হ্যাঁ, এটা আমি, তো?”
“ছবিতে বাকি যাদেরকে দেখা যাচ্ছে, এরা যে ধরনের মানুষ, তাতে এদের সাথে তো আসলে আপনার ঘোরাঘুরি করার কথা না। আর আমার ধারণা এই ধরনের মানুষরাই আপনার পার্টিতে আসবে।”
কেনসিংটন ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
“কাউকে কি চিনতে পারছেন?” জো জিজ্ঞেস করল।
“এনাকে।” ডা. হ্যাগেনকে দেখিয়ে বললেন কেনসিংটন। “লোকটা নাকি সংগ্রাহক। বেশি বড় না, ছোট খাটো। যতদূর মনে পড়ে পেশায় ডাক্তার। আর এই দুজন ওনার সহকর্মী। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এর সাথে
কার্ট কথা কেড়ে নিলো, “উনি একজন ডাক্তার সেটা ঠিক। তবে লোকটাকে গতকালের ল্যাম্পেডুসার সন্ত্রাসী হামলাটার জন্যে দায়ী হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে। বাকি দুজনও সম্ভবত এটার সাথে সম্পৃক্ত।”
কেনসিংটনের মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। ঘটনাটা ঘণ্টায় ঘন্টায় টিভিতে দেখানো হচ্ছে। ভোপালের দুর্ঘটনার পর এটাই সবচেয়ে বড় বিপর্যয় নাকি এটা। “আমিতো সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারে কিছু জানিনা। আমিতো ভেবেছি যে জাহাজটা বিধ্বস্ত হয়েছে ওটার থেকে বের হওয়া কোনো রাসায়নিক পদার্থের কারণেই বোধ হয় এরকম হয়েছে।”
“বাইরের সবাইকে এ কথাই জানানো হয়েছে, তবে আসল ঘটনা সেটা না।” কার্ট বলল।
কেনসিংটন গলা খাকারি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করলেন। ডেস্কের ওপর আঙুল বাজালেন, তারপর অযথাই একটা কলম নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। প্রচণ্ড অস্থির হয়ে গেছেন বোঝাই যাচ্ছে।
“আমি…আমি আসলে বুঝতে পারিছ না আপনারা কি জানতে চাচ্ছেন?” কথা আটকে যাচ্ছে তার। “লোকটার নামও আমার মনে নেই।”
“হ্যাগেন।” পাশ থেকে জো বলল।
“হা হা…হ্যাগেন।”
“আপনার দেখছি ভালোই ভুলো মন। এই ছবিটা যারা তুলেছে তারা আপনাকে তিনবার হ্যাঁগেনের সাথে দেখা করতে দেখেছে। লোকটা কি চায় সেটা কি অন্তত মনে আছে?”
কেনসিংটন জোরে নিশ্বাস ফেললেন তারপর এমনভাবে চারপাশে তাকাতে লাগলেন যেন সাহায্য খুঁজছেন। “লোকটা পার্টিতে আসার দাওয়াত চায়। কিন্তু আমি বলেছি পারবো না।”
“কেন?”
“বললামই তো এটা খুবই প্রাইভেট একটা বিষয়। শুধু কয়েক ডজন ধনকুবেরকে দাওয়াত দেয়া হয়। এরা সবাই যাদুঘরের পৃষ্ঠপোষক। ডা. হ্যাঁগেনের এখানে আসার যোগ্যতা নেই।”
কার্ট চেয়ারে হেলান দিল, “দুই লাখ ইউরো দিলেও না?”
কেনসিংটন অবাক হয়ে চাইলেন। মুহূর্তেই সেটা সামলে বললেন, “দশ লক্ষ হলেও না।”
কার্ট ভেবেছিল টাকাটা বোধ হয় পুরাকীর্তিটা কেনার উদ্দেশ্যেই পাঠানো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অন্য উদ্দেশ্য আছে। “যদি লোকটা আপনাকে ঘুষ হিসেবে টাকাটা সেধে থাকে তাহলে একটা কথা মনে করিয়ে দেই, এই ধরনের লোকেরা সাধারণত শেষমেশ টাকাটা দেয় না। কাজ শেষে প্রমাণ রাখা এদের স্বভাব না। ওরা আপনাকে টাকাটা দেখাবে। হয়তো আগাম হিসেবে খানিকটা দিতেও পারে। কিন্তু যখনই তাদের কাজটা উদ্ধার হয়ে যাবে, টাকাটা খরচ করার জন্যে আপনাকে আর বাঁচিয়ে রাখবে না।”
কেনসিংটন কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলেন। যেন কার্টের কথাগুলো ভাবছেন। নীরবতা ভেঙে কার্টই কথা বলল আবার, “আর কথাটা আপনি নিজেও জানেন। এ কারণেই আপনি দরজা লাগিয়েও আবার উঁকি মেরে দেখছিলেন যে আযরাইল আশেপাশে আছে নাকি।”
“আমি…”
“আপনি আসলে ভাবছিলেন ওরা আবার আসবে। আপনি ওদেরকে ভয় পাচ্ছেন। বিশ্বাস করুন, ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।”
কেনসিংটন কৈফিয়তের সুরে বললেন, “আমি ওদেরকে কিছুই বলিনি। বলেছি চলে যেতে। কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না, ওরা…”
কেনসিংটন চুপ মেরে গেলেন আর আবারো অস্থির হয়ে এটা ওটা করতে লাগলেন। তারপর নিচু হয়ে একটা ড্রয়ার খুলতে গেলেন।
“কি করেন?” কার্ট বলল।
“আমি বন্দুক বের করছি না।” কেনসিংটন বললেন। তারপর এন্টাসিডের একটা বোতল বের করলেন। প্রায় খালি হয়ে এসেছে সেটা।
“আমরা আপনাকে বাঁচাতে পারবো। আপনার যাতে কিছু না হয় সে ব্যবস্থাও করতে পারবো। কিন্তু সেজন্যে তো আগে আপনাকে আমাদেরকে সাহায্য করতে হবে।
কেনসিংটন বোতলটা থেকে কয়েক ঢোক ওষুধ খেয়ে নিলেন। এখন একটু সুস্থির লাগছে তাকে।
“আমাকে কিছু থেকেই বাঁচাতে হবে না। এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? কোথাকার কোন সংগ্রাহক একটা পুরাকীর্তি কেনার জন্য আমার কাছে এসে কয়দিন ঘ্যান ঘ্যান করল আর আমি হয়ে গেলাম মস্ত বড় সন্ত্রাসী? গণ হত্যাকারী?”।
“আপনাকে কেউ সেই দোষ দিচ্ছে না। কিন্তু এই লোকগুলো এতে জড়িত। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক আপনাকে ওদের সাথে দেখা গিয়েছে। দুই দিক দিয়েই আপনি বিপদে যাকে বলে মাইনকার চিপায়।”
কেনসিংটন কিছু না বলে কপাল ডলতে লাগলেন। বাইরে আরো একটা যন্ত্র চালু হলো। সারা ভবনে ছড়িয়ে পড়ল আওয়াজ।
কার্ট কেনসিংটনের মনের অবস্থা বুঝতে পারলো। কি করবে বুঝতে পারছে না লোকটা। এই শব্দ, এই টেনশন সবকিছু চেষ্টা করছে কপাল ঘষে তুলে ফেলতে।
“আমি আপনাকে সত্যি বলছি। আমি ঐ লোকগুলো সম্পর্কে কিছুই জানিনা। আপনাদের মতো ওরাও নিলামের কয়েকটা জিনিসের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিল। কিন্তু এ সম্পর্কে মুখখোলা নিষেধ, তাই আমি না করে দেই। আপনি কি ভাবছেন জানিনা, তবে ওরা যেসব জিনিসের খোঁজ করছিল সেসব যে খুব আলাদা কিছু তেমন কিন্তু না। একদমই সাধারণ জিনিস।”
বাইরের যন্ত্রটা অবশেষে থামল। কেনসিংটনের হাত কাঁপছে। উনি একটা কলম চেপে ধরে তা থামানোর চেষ্টা করছেন।
কাগজে এলোমেলো দাগ দিতে দিতে বললেন, “খুব দামি কিছুও না। প্রাচীন মিসরের কিছু পুরাকীর্তি। এগুলো কি আসল না নকল তা-ও পরীক্ষা করা হয়নি।”
বাইরে এবার একটা ইঞ্জিন চালু হলো। খুব জোরে আর মারাত্মক শব্দ করছে ইঞ্জিনটা। শিরশিরানিতে কার্টের ঘাড়ের কাছের চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেল। সেগুলো নামানোর জন্যে মাথাটা বাঁকিয়ে হাত দিতেই দেখে জানালার পাশ থেকে একটা ছায়া সরে গেল।
“মাথা নামাল।” চিৎকার দিয়ে মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল কার্ট। একপাশের দেয়াল ভেঙে ভেতরে একটা ক্রেনের মাথা ঢুকে গেল। কালো আর হলুদ রঙ করা দণ্ডটা আরেকটু সামনে বাড়তেই কেনসিংটনসহ ওনার ডেস্কটা গিয়ে আটকালো পেছনের দেয়ালে। সাথে ভাঙ্গা কাঁচ আর তুলোয় ভরে গেল ঘর। দণ্ডটা কয়েক ফুট পিছনে ফিরতেই কার্ট কেনসিংটনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে টেনে ক্রেনের সামনে থেকে সরিয়ে আনলো। পর মুহূর্তেই ক্রেনটা সেই জায়গায় পেছনের দেয়ালে একটা ফুটো করে দিল।
আরো একবার আঘাত করলো ক্রেন। মনে হলো ওপর থেকে ছাদ ভেঙে পড়বে।
“কেনসিংটন?” কার্ট ডাকলো লোকটাকে।
কেনসিংটনের চেহারা ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছে। নাক ভেঙে গিয়েছে, ঠোঁট আর দাঁত গেছে থেতলে। দষ্টার মাথা সরাসরি লেগেছে মুখে। কার্টের ডাকে সাড়া না দিলেও শ্বাস পড়ছে বোঝা গেল।
কার্ট ওনাকে মাটিতে শুইয়ে দিতেই খেয়াল হলো হাতের মধ্যে মুচড়ে আছে একটা কাগজ। কাগজটা হাতে নিতেই শোনে জো চিৎকার দিল,
“মাথা নামাও।”
দণ্ডটা এবার পাশের দিকে আসছে। কার্ট কেনসিংটনকে আড়াল করে যতটা সম্ভব মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করল। দণ্ডটা ওদের ওপর দিয়ে গিয়ে পাশের দেয়ালটা ভেঙে ফেলল।
কিন্তু এবার দণ্ডের মাথাটা দেয়ালের একটা পাথরে আটকে গেল। কয়েকবার টানাটানি করল ছোটানোর জন্যে কিন্তু কাজ না হওয়ায় হাল ছেড়ে দিয়ে পুরো ক্রেনটাই বন্ধ হয়ে গেল।
কার্ট সাথে সাথে ভাঙ্গা দেয়াল থেকে নিচে উঁকি দিল। ক্রেনের ছোট গাড়িটায় একজন লোককে দেখা গেল ক্রেনটা আবার চালু করার চেষ্টা করছে, আর আরেকজনকে দেখা গেল সাব মেশিনগান হাতে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। কার্টকে দেখতে পেয়ে লোকটা বন্দুক তুলে দ্রুত কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়লো। কার্টও সাথে সাথে মাথা সরিয়ে নেয়ায় বুলেটগুলো পাথরে লেগে ছিটকে গেল।
এদিকে জো ফোন করে সাহায্য চাচ্ছে। ফোন কানে থাকতেই আবারো শুনলো গুলির শব্দ।
শব্দ শুনে বোঝা গেল যে, গুলি এবার এদিকে করা হয়নি, অন্যদিকে। আবারো বাইরে তাকিয়ে দেখে আততায়ীরা পালাচ্ছে। ওপরের দিকে ফাঁকা গুলি ছুড়ছে যাতে লোকজন পথ থেকে সরে যায়।
“কেনসিংটনের খেয়াল রেখো। আমি দেখি ঐ ব্যাটাদের ধরা যায় কি না।” বলেই কার্ট ভাঙ্গা জানালাটা টপকে ক্রেনের দণ্ড বেয়ে নিচে নামতে লাগল। জো বাধা দেয়ার জন্যে কিছু বলতে গেলো কিন্তু তার আগেই কার্ট নেমে গেছে অনেকখানি।
.
১৭.
ক্রেনের দণ্ডটায় যে গোল গোল ছিদ্রগুলো ছিল ওগুলো ধরে ধরে কার্ট নেমে এলো নিচে। তিনজন লোক তখনও দৌড়াচ্ছে। হাতে বন্দুক। রাস্তার শেষ মাথায় একটা মাইক্রো ভ্যান দেখা যাচ্ছে। ওটাতেই উঠবে সম্ভবত। লাফ দিয়ে মাটিতে নামতেই বেশ কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে পড়ে আছে। সম্ভবত এরাই ক্রেনের আসল কর্মচারী।
এদিকে লোকগুলো ভ্যানে উঠে পড়েছে।
কার্ট এদিক ওদিক তাকাল পিছু নেয়ার মতো কিছু পাওয়ার আশায়। কাছেই একটা সিট্রোয়েন কোম্পানির মাটি টানা ট্রাক দেখা গেল। ট্রাকটার শরীর বেশ সরু কিন্তু লম্বায় বড়। আমেরিকায় হয়তো গাড়িটা অদ্ভুত লাগবে কিন্তু এখানকার চিকন চিকন রাস্তার জন্যে এটাই মানানসই।
দৌড়ে গাড়িটায় উঠল ও। ভাগ্য ভালো যে চাবি ওখানেই লাগানো আছে। ইঞ্জিন চালু হতেই বিন্দুমাত্র দেরি না করে গিয়ার তুলে ওটাকে নামিয়ে আনলে রাস্তায়। উদ্দেশ্য ভ্যানটার সামনে গিয়ে রাস্তা আটকাবে।
কিন্তু ছোট্ট গাড়িটাকে আটকানো গেল না কোনো মতেই। ওটা কার্টের ট্রাকটাকে পাশ কাটিয়ে ফুটপাতে ওঠে গেল তারপর আবার একশ ফুটের মতো গিয়ে রাস্তায় মেনে এলো।
কার্ট দ্রুত গাড়ি রিভার্স গিয়ারে দিয়ে উল্টোদিকে সরিয়ে নিলো। তারপর দ্রুত ঘুরিয়ে ভ্যানটার পিছু নিতে যেতেই দেখে যাদুঘরের গেটে জো।
“উঠে পড়ো!” চেঁচালো কার্ট।
জো উঠতেই কার্ট গ্যাস পেডাল একেবারে ফ্লোর বোর্ডের সাথে চেপে ধরলো। “আরও ছোট কিছু ভাড়া পাওনি?” জো জিজ্ঞেস করল।
“পেয়েছিলাম কিন্তু ওরা বোনাস হিসেবে এটাই দিল। বহুত পুরনো মেম্বার তো, ভালোই সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়।”
“তা পুলিশ ধরলে কি সুযোগ সুবিধাগুলো কাজে লাগাবে?”
“সেটা নির্ভর করছে একটা জিনিসের ওপর।” কার্ট বলল।
“কোন জিনিসের ওপর?”
“আমরা ঐ শয়তানগুলোকে ধরতে পারবো কি পারবো না তার ওপর।” যত গর্জে ততত বর্ষে না’ প্রবাদটা প্রমাণ করতেই যেন, ট্রাকটা শব্দ করছে ভীষণ কিন্তু সেই তুলনায় বেশি একটা আগাচ্ছে না। মাইক্রো ভ্যানটার গতিও এমন আহামরি কিছু না কিন্তু জিনিসটা খুব সহজে রাস্তার এপাশ ওপাশ করতে পারছে। দূরতু তাই ক্রমশ বাড়ছেই। এই সামান্য গতির তুলনাতেই ট্রাকটাকে গদাই লশকর মনে হচ্ছে।
হঠাৎ রাস্তায় জটলা লেগে যাওয়ায় কার্টের ট্রাক ভ্যানটার প্রায় কাছেই চলে এলো কিন্তু ছোট ভ্যানটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁক-ফোকর গলে বেরিয়ে গেল। কার্ট আর কি করে। গাড়ির সব বাতি জ্বেলে হর্ণ চেপে ধরেই রইল যতক্ষণ পারে।
ওর অস্থির হর্ণ শুনে চলমান গাড়িগুলো রাস্তা ছেড়ে দিল, কিন্তু রাস্তার পাশে দাঁড় করানো গাড়িগুলোই বাধালো ঝামেলা। কার্ট প্রায় সবটাতেই ঢুশ মেরে মেরে এগুতে লাগল। একটারও আয়না আস্ত থাকল না।
টানা পাঁচটা আয়না ভাঙ্গার পর জো বলল, “আরে শেষেরটা তো মিস করলে।”
“ফেরার পথে ভাঙ্গবো ওটা।”
ফাঁকা রাস্তা পেয়ে আবারও গতি বাড়ালো কার্ট। তারপর জোকে জিজ্ঞেস করল, “তোমাকে না কেনসিংটনের সাথে থাকতে বললাম?”
“ওর সাথেই তো ছিলাম,” জো জবাব দিল।
“আমি বলেছিলাম সাহায্য আসার আগ পর্যন্ত থাকতে।”
“পরের বার তাহলে স্পষ্ট করে বলবে।”
আবারও ভ্যানটার কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। সামনের রাস্তাটা একেবারে সমুদ্রের কিনারে গিয়ে থেমেছে। তারপর বেঁকে বন্দরের ধার ঘেষে ঘাটের দিকে চলে গিয়েছে। ভ্যানের একজনকে দেখা গেল গুলি করে ভ্যানের পেছনের কাঁচ ভেঙে ফেলল, তারপর ভাঙ্গা জানালা দিয়ে ট্রাকের দিকে গুলি করতে লাগল।
কার্ট বন্দুকের নল দেখা মাত্র মাথা নিচু করে ফেলেছে। পর মুহূর্তেই সামনের কাঁচ চুরচুর হয়ে ছিটকে পড়ল চারপাশে। গুলি থেকে বাঁচতে ও রাস্তার পাশের একটা গলিতে ঢুকে পড়ল। গলিটা আবার মূল শহরের দিকে ফিরে গিয়েছে।
“আমরা কিন্তু উল্টো দিকে যাচ্ছি।” জো মনে করিয়ে দিল। কার্ট সে কথা পাত্তা না দিয়ে গাড়ির স্পিড় আরো বাড়িয়ে দিল।
“এখন আমরা আরো দ্রুত উল্টো দিকে যাচ্ছি।” জো বলল আবার।
“শর্টকাট মারছি। এখানকার সমুদ্র তীরটা একেবারে হাতের পাঞ্জার মতো। এই শালারা যাচ্ছে আঙুলের ধার ঘেষে। আর আমরা এতো ঝামেলায় না গিয়ে সরাসরি তালু বরাবর যাবো।” কার্ট ব্যাখ্যা করল।
“অথবা হারিয়ে যাবো। তোমার কাছে কোনো ম্যাপ নেই।”
“ম্যাপ লাগবে না। বন্দরটা বামে রাখতে হবে শুধু।” কার্ট জানালো।
“হুম। ব্যাটারা এখন উল্টোদিকে না ঘুরলে হয়।”
বন্দরের আশেপাশের সব দুর্গ বা গুরুত্বপূর্ণ ভবনের ছাদেই ফ্লাডলাইট লাগানো। ফলে বন্দরটা নজরে রাখতে কোনো সমস্যাই হয় না, আর আলোর কারণে নিচের রাস্তাগুলো ভালোই দেখা যায়।
.
“ঐ যে।” একদিকে আঙুল তুলে দেখালো জো।
কার্টও দেখেছে। মাইক্রো ভ্যানটা তখনও ছুটছে। এখন আরও দ্রুত গতিতে। ড্রাইভারের ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই।
ঢালু রাস্তা বেয়ে নামা শুরু করতেই ট্রাকটা ভয়ানক বেগে ছুটতে আরম্ভ করল। সাথে শুরু হলো ঝাঁকুনি। ঝকির চোটে পিছনে লেগে থাকা সব কীটের গুঁড়ো আর ধুলোবালি সব উড়া আরম্ভ করল। সেই সাথে ইঞ্জিনের ভো ভে তো আছেই।
গাড়িটা সামনের চৌরাস্তার দিকে ছুটছে। ভ্যানটাও এই চৌরাস্তাতেই আসবে একটু পর।
“কি করতে চাচ্ছ?” জো জিজ্ঞেস করল।
“রোমানদের মতো বায়স বিদ্ধ করবো।”
জো ব্যস্ত হয়ে সিটবেল্ট খুঁজতে গিয়ে দেখে নেই সেটা।
“লাগালোও ও…।”
ট্রাকটা প্রচণ্ড বেগে সমতল রাস্তায় এসে উঠল কিন্তু ভ্যানটার গায়ে লাগল না। নামার সময় ট্রাকটার গতি বেশিই বেড়ে গিয়েছিল, ফলে কার্টের হিসেবে গরমিল হয়েছে। এখন ওরাই উল্টো ভ্যানের আগে চলে এসেছে।
“আমরা তো এখন সামনে চলে এসেছি দেখি। আমাদের তো ধাওয়া দেয়ার কথা।” জো বলল।
“তো কিছু একটা করো।”
ঐ মুহূর্তে জো এর মাথায় একমাত্র যুক্তিসঙ্গত যে চিন্তাটা আসলো, ও সেটাই করল। ট্রাকের পিছনের অংশটা আটকানোর যে হাতলটা ছিল সেটা টেনে দিল। সাথে সাথে অংশটা কাত হয়ে গেল আর পুরো কয়েক হাজার পাউণ্ড ভাঙ্গা ইটের টুকরো, মাটি, লোহালক্কর রাস্তায় গড়িয়ে পড়ল।
ভাঙ্গাচোরা জিনিসের স্রোত সরাসরি দ্রুত গতিতে ছুটে আসা ভ্যানটার গায়ে গিয়ে পড়ল আর সামনের দিকটা ছাড়িয়ে একেবারে ভ্যানের ছাদে গিয়ে উঠল। সামনের গ্রিল আর রেডিয়েটর ভেঙে গেল সাথে সাথেই। সামনের কাঁচও ভেঙে ঢুকে গেল ভেতরে। আর ভ্যানটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে একদিকে কাত হয়ে রাস্তার পাশে উল্টে গেল।
কার্ট এবার সমগ্র শক্তি দিয়ে ব্রেক চেপে ধরলো আর ট্রাকটা কয়েক ফুট পিছলে গিয়ে তারপরে থামল। কার্ট লাফিয়ে নেমেই উল্টানো গাড়িটার দিকে ছুটলো। জোও নামলো পিছু-পিছু হাতে একটা বাঁকানো লোহার দণ্ড।
গাড়িটার কাছে গিয়ে দেখে রেডিয়েটর দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আর গাড়ির একটা অংশও আস্ত নেই। পুরোটা এবড়োখেবড়ো হয়ে গিয়েছে। বাতাসে গ্যাসোলিনের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।
একবার ভেতরে তাকাতেই বুঝলো পিছনের সিটে বসা লোকটা মারা গিয়েছে। জানালা গলে ইটের বড় একটা টুকরা মাথাটা থেতলে দিয়েছে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো ভেতরে আর কেউ নেই।
“বাকিরা গেল কোথায়?” জোর জিজ্ঞাসা।
অনেক সময় এভাবে গাড়ি উল্টে গেলে গাড়ি থেকে শরীর ছিটকে বের হয়ে যায়। কিন্তু আশেপাশে তাকিয়েও কার্ট কাউকে দেখতে পেল না। তারপর কিছু দূরেই দেখা গেল দুটো অবয়ব ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। ফোর্ট সেইন্ট এঞ্জেলোর দিকে এগুচ্ছে।
‘কেডস পরে এসেছ তো? দৌড় কিন্তু শেষ হয়নি।” লোক দুটোর দিকে দৌড় দিয়ে জো’কে বলল কার্ট।
.
১৮.
ডা. হ্যাগেন প্রাণপণে দুর্গের দিকে ছুটছে। আতঙ্ক গ্রাস করেছে তাকে। সবকিছুই আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছে। কেনসিংটনের অফিসে লাগানো লুকানো মাইক্রোফোনে NUMA’র লোকটার সাথে আলাপচারিতার সবটাই শোনে ও। ভয় পেয়ে যায় যে কেনসিংটন সব ফাস করে দেবে। তাই ওসাইরিস থেকে লোকগুলোকে বলে বেশি কিছু ফাস করার আগেই কেনসিংটনকে সরিয়ে দিতে হ্যাগেন নিশ্চিত ছিল যে কাজটা হবেই। কিন্তু সেটা করতে যেতেই শুরু হলো একের পর এক ঝামেলা : ধাওয়া খেয়ে পালানো, দুর্ঘটনা, গাড়ি উল্টানোর সময় বন্দুক হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া।
“আমাদের সাহায্য দরকার। কাউকে ফোন দাও।” চেঁচিয়ে বলল হ্যাগেন। ভাগ্য ভালো যে অন্য লোকটার কাছে এখনো একটা রেডিও রয়ে গেছে। সে ওটা কোমর থেকে খুলে দৌড়াতে দৌড়াতেই কথা বলতে লাগল।
“শ্যাডো, ট্যালন বলছি। একটা ঝামেলা হয়েছে। আমাদেরকে উদ্ধার করার জন্যে লোক পাঠাও।
“কি হয়েছে ট্যালন?” অপর প্রান্তের লোকটা বিরক্ত হয়েছে বোঝা গেল।
“কেনসিংটন আমেরিকার দুটোর সাথে দেখা করেছে। ওসব ফাস করে দিচ্ছিলো। তাই ওকে সরিয়ে দিয়েছি। এখন আমেরিকান দুটো আমাদের ধাওয়া করছে।”
“তো ওদেরকেও সরিয়ে দাও।”
“সম্ভব না। ওদের কাছে অস্ত্র আছে।” কথাটা মিথ্যা কিন্তু এখন মিথ্যা বলা ছাড়া উপায় নেই। “আমরা আহত। একজন মারা গিয়েছে। আমাদেরকে নিতে কাউকে পাঠাও।”
ফোর্ট সেইন্ট অ্যাঞ্জেলো কাছিয়ে এসেছে। চারপাশের উজ্জ্বল স্পট লাইটগুলোর কারণে ওটার গা থেকে কেমন কমলা আভা বেরুচ্ছে। যতই ওরা দুৰ্গটার কাছে যাচ্ছে ওদের নিচের মাটির রঙ আরো বেশি উজ্জ্বল হচ্ছে। ঠিক যেন টাইমস স্কয়ারের ভেতর দিয়ে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু ওদের এখন এসব খেয়াল করার সময় নেই। বাঁচতে হলে দ্রুত দুর্গের দেয়ালের ভেতর ঢুকতে হবে।
“কি বলল ও?” হ্যাগেন আবার চেঁচালো।
“শ্যাডো, শুনতে পাচ্ছ?”
কিছুক্ষণ বিরতির পর আবার শোনা গেল কণ্ঠস্বর। “খাড়ির মুখে নৌকা থাকবে। যারা ধাওয়া করছে ওদের ব্যবস্থা করে তারপর সাঁতরে এসে নৌকায় উঠবে। এবার যেন আর ভুল না হয়। হলে কি হবে তা খুব ভালো করেই জানো।”
হ্যাগেনও কথাটা শুনেছে। এমনটা ও আশা করেনি। তবে নাই মামার চেয়ে কানা মামা তো অন্তত ভালো। দুর্গে ঢোকার ঢালু পথটায় ওঠার পর ওর গতি কমে গেল। হাফাচ্ছে। ট্যালন সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই দৌড়ে চলে গেল। ওর স্বাস্থ্য হ্যাঁগেনের চেয়ে ভালো। আর হ্যাগেন ধরা পড়ল কি পড়ল না তাতে ওর কিছুই যায় আসে না।
.
১৯.
কার্ট আর জো-ও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে আততায়ী দুজনকে ধরে ফেলার। কিন্তু ওরা দুজন আগেই অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। এবং দুর্গে পৌঁছেই ভেতরে উধাও হয়ে গিয়েছে।
কার্ট ঢালু পথটা পর্যন্ত ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পার হলো। পাশেই জো।
কিন্তু দুর্গের আলোর কাছে আসতেই গতি কমিয়ে দিল। কমলা আভা আর ছায়ার কারণে আশপাশটা ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার থেকে কেউ ওর ওপর ঝাঁপ দেয় এটা কার্ট চাচ্ছে না।
এই পাশ থেকেও দুর্গটাকে দারুণ জমকালো মনে হচ্ছে। পুরো দালানটা তৈরি ভ্যালেটা বন্দরের ভেতর ঢুকে পড়া এক ফালি জমিতে। দেখতে অনেকটা বিয়ের কেক-এর মতো। কিন্তু দেয়ালগুলো গোল না বরং বিভিন্ন দিকে বাঁকানো। ফলে কেউ যখন আক্রমণ করতে চাইতো তখন বুঝে পেতো না ঠিক কোথায় গুলি করবে।
কার্ট গতি আরও কমালো। ওর ডানেই দুর্গ আর বামে বন্দর। ওর একটা তালামারা দরজা চোখে পড়ল। তারপাশেই একটা সরু সিঁড়ি একটা চিকন নালার মতো করে দুর্গের ভেতর ঢুকে গিয়েছে। সিঁড়ির মুখেও গেট আছে। তবে কার্ট এক নজর দেখেই বুঝলো যে লোক দুটো এদিকেই গিয়েছে।
“তালা ভেঙে ঢুকেছে।”গেটটা খুলতে খুলতে বলল কার্ট। তারপর ওপরে এক ঝলক তাকিয়েই ওঠা শুরু করল। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে এগুচ্ছে। কিন্তু একদম শেষ মাথায় একজন ওকে আক্রমণ করে বসলো। হাতে তরবারি।
কার্ট একপাশে ঝাঁপ দিয়ে আঘাতটা এড়ালো। তারপর গড়ান দিয়ে সোজা হতেই দেখে জো চলে এসেছে। তরবারিওয়ালা এক কদম পিছিয়ে গেল তারপর একবার জো আর ওর হাতের বাঁকানো লোহাটা আরেকবার কার্টের দিকে তাকাতে লাগল।
কার্টের নজরে পড়ল দুর্গের ইতিহাসের প্রদর্শনীর অংশ হিসেবে দেয়ালের পাশেই ধাতব বর্ম আর অস্ত্রপাতি রাখা। লোহার একজোড়া দস্তানা পড়ে আছে। মাটিতে। তরবারিটা ওটার ভেতরেই ছিল।
লোকটা তরবারিটা একবার কার্ট আরেকবার জোর দিকে তাক করতে লাগল। কার্ট ওকে চিনতে পারলো।
“আরে! এ যে দেখছি ডা. হ্যাগেন। এমন বীরপুরুষ যে কি-না এক দ্বীপ ভরা লাশ ফেলে পালিয়েছে।”
“তুই আমার সম্পর্কে কিছুই জানিস না।” ঘোত ঘোত করে বলল হ্যাগেন।
“এইটুকু জানি যে তোর কাছে একটা প্রতিষেধক আছে যেটা দিলে। ল্যাম্পেডুসার লোকজন ভালে হয়ে যাবে। যদি সময় মতো বলিস তাহলে অন্তত ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচতে পারবি।”
“চোপ।” চিৎকার করে উঠল হ্যাগেন। তারপর কার্টের দিকে আক্রমণ করার ভান করে জো-এর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিশাল একটা অর্ধবৃত্ত রচনা। করে চালালো তরবারি।
বাতাসে শিষ কেটে ফলাটা জোর দিকে ধেয়ে গেল। কিন্তু জো দারুণ দক্ষতায় সেটা পাশ কাটিয়ে লোহার দণ্ডটা দিয়ে বাড়ি দিল। ঝনাৎ করে শব্দ হয়ে আশে পাশে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল।
“এতো দেখি পুরো মধ্যযুগীয় বর্বরতা।” জো বলল।
হ্যাগেন আবারো সামনে বাড়লো। জোর দিকে তরবারি চালিয়েই যাচ্ছে যাতে ও সিঁড়ির দিকে হেলে গড়িয়ে পড়ে যায়। কিন্তু জো সব আঘাতই ফিরিয়ে দিল। শেষমেশ হ্যাঁগেনের তরবারিতে জোরে একটা বাড়ি দিয়ে ওর বুকে একটা লাথি কষালো। হ্যাগেন উল্টে পড়ে গেল কিন্তু সাথে সাথেই উঠে দাঁড়িয়ে গেল। আবার লড়াই করতে প্রস্তুত।
“তুমিতো দেখি এই জিনিস ভালোই চালাতে পারো।” কার্ট বলল, “প্রতিটি স্টার ওয়ার্সের সিনেমা কয়েকবার করে দেখা আমার।” গর্ভ ভরে বলল জো।
“তারমানে এটাকে তো তুমি একলাই সামলাতে পারবে?”
“তা আর বলতে। তুমি এর সাথেরটাকে খুঁজে বের করো। ততোক্ষণে আমি এটাকে প্যাকেট করে ডেলিভারির জন্য রেডি করে ফেলি।”
কার্ট চলে যেতেই জো এবার ওর শত্রুর মুখোমুখি মোকাবেলা করতে দাঁড়ালো। এখন আর দণ্ডটা ও তরবারির মতো এক হাতে ধরে নেই। বরং দুই হাতে ধরে রেখেছে।
হ্যাগেন আবারো তরবারি চালালো কিন্তু জো এক প্রান্ত দিয়ে সেটাকে ঠেকিয়ে অন্য প্রান্ত দিয়ে সজোরে মুখে মারলো হ্যাঁগেনের। নাক ফেটে রক্ত বেরুলো সাথে সাথে।
“ডাক্তাররা ইঞ্জেকশন দেয়ার সময় কি বলে বলোতো? বলে যে “একটুও ব্যথা লাগবে না।” জো বলল, “তবে আজকে কিন্তু সেরকম কিছু হবে না, আজকে ভালোই ব্যথা লাগবে।”
হ্যাগেন সামনে এগিয়ে পাগলের মতো তরবারি নাড়তে লাগলো। সাথে গালাগালি এমনকি থুতু মারছে জোর উদ্দেশ্যে।
এদিকে জো একদমই ঠাণ্ডা আর ধীরস্থির। একজন প্রশিক্ষিত যোদ্ধার মতোই ওর নাড়াচাড়া। প্রতিটা পদক্ষেপ মাপা আর নিখুঁত। ফলে হ্যাঁগেনের তরবারির একটা আঘাতও জো-র শরীরে লাগল না। জো শান্তভাবে প্রতি আক্রমণ করল, দণ্ডটার এক প্রান্ত দিয়ে মারার ভান করে অন্যপ্রান্ত দিয়ে মারলো।
“আমি শুধু স্টার ওয়ার্স-ই দেখি না। এরল ফ্লিন-এরও বড় ভক্ত।” সাবধান করল জো।
“এরলল ফ্লিনটা কে?” হ্যাগেন বলল।
“এরলকে চেনো না?”
হ্যাগেন জবাব দিল না তবে জো আবার আক্রমণ করল। দণ্ডের একপ্রান্ত দিয়ে ডাক্তারকে খোঁচা দিয়ে পেছনে ঠেলে তারপর অন্যপ্রান্তটা সজোরে নামিয়ে আনলো ওর কাঁধে। হাড্ডি ভাঙ্গার মট আওয়াজ পাওয়া গেল আর প্রচণ্ড ব্যথায় ডাক্তার ঝাঁকিয়ে উঠল।
“আমি নিশ্চিত এটা হিউমেরাস (বাহুর হাড়)। আর এটাও নিশ্চিত যে খুব বেশি মজা লাগেনি তোমার।”
হ্যাগেন ঘোঁত ঘোত করে উঠল, “বলদ, এটা আমার ক্লাভিকন।” ডানা ভাঙ্গা পাখির মতো একদিকে হেলে পড়েছে হ্যাগেন।
“হায় হায়! আচ্ছা আরেকবার চেষ্টা করি।” বলে আবার মারার জন্যে দণ্ডটা তুললো জো।
“না না! আমি হার মানছি। আর মেরো না।” তরবারি ফেলে দিয়ে বলল হ্যাগেন।
হ্যাগেন হাঁটু মুড়ে বসে ওর কাধ চেপে ধরে হাঁপাতে লাগল। ব্যথায় গোঙ্গাচ্ছে। কিন্তু জো সামনে আসার চেষ্টা করতেই আরেকবার শয়তানি করার চেষ্টা চালালো। পকেট থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে জোর পায়ে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল হ্যাগেন সেটা দেখতে পেয়ে সজোরে লাথি চালালো আর সেটা উল্টো ডাক্তারেরই উরুতে গিয়ে বিধলো।
সিরিঞ্জে যা-ই থাক সেটা একদম সাথে সাথে কাজ করা আরম্ভ করল। হ্যাগেন চোখ উল্টে ওঠে ভাঙ্গা কাঁধের দিকেই ধপাস করে পড়ে গেল।
“ধুর! এখন শলাকে আবার ঘাড়ে নিতে হবে।” জো বলল নিজেকেই। পাশে বসে হাতের পালস চেক করল। আছে পালস। ও ঊরু থেকে সিরিঞ্জটা খুলে সুই ভেঙে ফেলল। তারপর পকেটে রেখে দিল। পরে পরীক্ষা করে দেখা যাবে ভেতরে কি আছে।
.
এদিকে কার্ট সতর্ক পদক্ষেপে বাকি লোকটাকে খুঁজছে। ওর ধারণা লোকটার হয় গুলি শেষ হয়ে গেছে না হয় অস্ত্রটাই হারিয়ে ফেলেছে। কারণ এতোক্ষণ হয়ে গেল একটা গুলিও করেনি। তারপর মানে এই না যে লোকটা কোথাও ওঁত পেতে নেই।
সামনে বাড়তেই আরেকটা সিঁড়ি থেকে হালকা পদশব্দ শুনতে পেল। কার্ট সাথে সাথে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে কোণা দিয়ে উঁকি দিল। কিন্তু সিঁড়িটা প্যাচানো। সিঁড়িগুলো লম্বা হলেও পাথরের দেয়ালের কারণে একবারে কয়েকটার বেশি সিঁড়ি চোখে পড়ে না।
কার্ট নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। শোনার চেষ্টা করছে। প্রথম কয়েক সেকেন্ড কিছুই শোনা গেল না। তারপর হঠাৎই কেউ হুড়মুড় করে শেষ কয়েকটা ধাপ উঠে গেল।
কার্ট ডিগবাজি দিয়ে সিঁড়ির সামনে পড়ে ওপর দিকে উঠে গেল। তিরিশটা ছোট ছোট সিডি প্যাঁচ খেয়ে ওপরে উঠে গিয়েছে। আঠারো শতকের মানুষজনের জন্য বানানো এগুলো লম্বায় আর বহরে দুদিকেই ছোট ছিল তারা। কার্ট যতটা সম্ভব দ্রুত সিঁড়িটা পার হয়ে এসে দেখে একজন লোক দুর্গের বারান্দা ধরে সোজা দৌড়ে যাচ্ছে।
লোকটা বারান্দার শেষ মাথার দিকে দৌড়াচ্ছে। যেখানে একসারি প্রাচীন আমলের কামান বসানো। মুখগুলো সব সাগরের দিকে। কার্টও সাথে সাথে পিছু ধাওয়া করল। মাঝখানে একটা ছোট দেয়াল লাফিয়ে পার হলো। তারপর বিশাল বড় একটা সভাকক্ষ। সেটা পার হতেই লোকটাকে আবার দেখা গেল। কার্ট প্রায় কাছাকাছি পৌঁছেই গিয়েছিল, কিন্তু লোকটা দেয়াল থেকে প্রায় আট ফুট নিচে লাফিয়ে পড়ল।
কার্টও দেয়ালটার কাছে পৌঁছে ওটা থেকে লাফিয়ে পড়ল। পতনের ধাক্কা সামলে উঠে দাঁড়িয়ে লোকটা ইতোমধ্যে চল্লিশ ফুটের মতো এগিয়ে গিয়েছে পরের দেয়ালটা থেকে লাফ দিচ্ছে। কার্ট দেয়ালের কাছে পৌঁছে দেখে এটার উচ্চতা প্রায় দশ ফুট।
“ধুর। শেষমেশ এই পাহাড়ি ছাগলটাই কপালে জুটলো।”
এখান থেকে লাফ দিলে একটা ঢালু জায়গায় নামতে হবে। কার্ট একপা পিছিয়ে এসে লাফ দিল। নিরাপদেই অবতরণ করে, আবার শুরু করল ধাওয়া।
লোকটাও দৌড়াচ্ছে। সামনেই আরেকটা দেয়াল। এটা একদম দুর্গের সবচেয়ে সামনের দেয়াল। এরপরই বন্দর। এখন পর্যন্ত ওরা বিয়ের কেকটার একদম চূড়া থেকে দুটো ধাপ নেমে এসেছে। এটাই শেষ ধাপ। তার মানে এই দেয়ালটার ওপাশে মাটি কমপক্ষে সতুর-আশি ফুট নিচে হবে। আর সেখানে শুধু হা করা পাথর।
লোকটাও সম্ভবত ব্যাপারটা ধরতে পারলো। তাই দেয়াল বেয়ে উঠে যাওয়ার আগ মুহূর্তে থমকে দাঁড়ালো। একমুহূর্ত কার্টকে দেখলো, তারপর কি ভেবে আবার দেয়াল বেয়ে উঠে দিল নিচে ঝাঁপ। কার্ট জীবনে প্রথম কাউকে এভাবে আত্মহত্যা করতে দেখলো।
কার্টও দ্রুত পৌঁছে গেল দেয়ালে। আশা করেছিল নিচে তাকিয়ে দেখবে যে পাথরের ওপর একটা ফেলানো লাশ পড়ে আছে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলো দেয়ালের ওপাশে পাথরের মধ্যে চৌকো একটা নালার মতো আছে। আর লোকটা শুধু যে বেঁচে আছে তাই না। এই মুহূর্তে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের মতো দূরের একটা ট্রলারের দিকে সাঁতরে যাচ্ছে।
চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া ওর আর কিছুই করার ছিল না। লোকটা ট্রলারের কাছে পৌঁছামাত্র কয়েকজন তাকে টেনে তুললো আর সাথে সাথে ট্রলারটা রাতের আঁধারে হারিয়ে গেল।
“কি হয়েছে?” এক স্তর ওপর থেকে একটা কণ্ঠ ডাকলো ওকে। কার্ট দেখলো জো ডা. হ্যাঁগেনের ঘাড় ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
“লোকটা পালিয়ে গিয়েছে। কিছুই করার ছিল না।” কার্ট বলল।
“অন্তত এই ব্যাটাকে তো আটকানো গিয়েছে।” জো জবাব দিল। জোর কথা শেষ না হতেই তীক্ষ্ণ একটা শব্দ হলো কোথাও আর ডা. হ্যাগেন হাঁটু ভেঙে কাত হয়ে পড়ে গেল। কার্ট আর জো দুজনই লাফ দিয়ে আড়ালে সরে গেল কিন্তু আর কোনো গুলির শব্দ পাওয়া গেল না।-কার্ট আড়ালে থেকেই উঁকি মেরে বাইরে দেখার চেষ্টা করল। ও আর জো আড়াল থেকে বের না হয়েই চিৎকার করে কথা বলতে লাগল।
“জো, ঠিক আছো তুমি?”
“হ্যাঁ, কিন্তু ডা. হ্যাগেন মারা গিয়েছে।” জো’র কণ্ঠ মনমরা।
“কার্টও সেরকম-ই ভেবেছিল, “ধ্যাৎ, এতো কষ্ট বৃথা গেল।”
“গুলি কোত্থেকে করেছে দেখেছো নাকি?”
জো যেহেতু ওপরের তলায় ছিল, আর শব্দের প্রতিধ্বনিটার ধরন শুনে মনে হয় গুলিটা করা হয়েছে পানির দিক থেকে। সে হিসেবেই বলল, “বন্দরের ওপাশ থেকে সম্ভবত।”
তারপর ঝুঁকি নিয়েই মাথা উঁচিয়ে চট করে সেদিকে একবার নজর বুলালো। ট্রলারটা নেই। আর ওটার ওপর দাঁড়িয়ে এত দূর গুলি করাও যেতো না। ওপাড়ে কিছু দালানকোঠা আছে। অন্য দুৰ্গটার কামানগুলোও এ মুখো করা।
“ওপাড় তো কমপক্ষে এক হাজার ফিট।” জো বলল।
“একে অন্ধকার, তার সাথে বাতাসও কম। দারুণ নিশানা।” কার্ট বলল।
“তাও একেবারে প্রথমবারেই।” জো যোগ করল।
ব্যাপারটা এমন না যে ওরা ভয় পাচ্ছে, ওরা আসলে ওদের শত্রুর প্রকৃতিটা বের করতে চাচ্ছে।
“আর আমাদের বদলে ওদের নিজেদের লোককেই গুলিটা করেছে।” কার্ট বলল এবার।
“তুমিও কি আমার মতোই ভাবছো নাকি? এরা কী পেশাদার খুনি?” জো জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, ভাড়াটে খুনি। হ্যাগেন ছিল আস্ত একটা গাধা।
পুলিশ ইতোমধ্যে দুর্গের দিকে রওনা দিয়েছে। বন্দর থেকেও লাল নীল বাতি জ্বালিয়ে একটা পুলিশের স্পিডবোট এদিকেই আসছে।
“খেলা তো শেষ এখন এসে কী হবে। এক বদমায়েশ ভেগেছে, আরেকটা মরে পড়ে আছে।” কার্ট ভালো মনে মনে। স্নাইপার এখনো জায়গা থেকে সরেছে কি-না জানে না, তাই শুয়ে শুয়েই কার্ট কেনসিংটনের হাতের কাগজটা বের করল। কেনসিংটন কিছু একটা লিখার চেষ্টা করছিলেন। রক্তে ভিজে গেছে কাগজটা, তবে একটা পাশ পড়া যাচ্ছে। একটা নাম মনে হচ্ছে। “সোফি স…
এরকম কোনো কিছু বা কাউকে কার্ট চেনে না। তবে এই মুহূর্তে আসলে কোনো কিছুকেই আর ওর মাথায় খেলছে না। ও কাগজটা রেখে পুলিশের অপেক্ষা করতে লাগল আর ভাবতে লাগল কবে ওদের ভাগ্য খুলবে।
নদীর অপর পাড়েই ফোর্ট সেন্ট অ্যাঞ্জেলোর শতাব্দী প্রাচীন পাথুরে মেঝেতে শুয়ে শুয়ে আরেকটা অবয়ব ভাবছিল যে তার ভাগ্যটা আজ খুবই ভালো। উঠে দাঁড়িয়ে তার গুলির ফলাফল কি হলো তা দেখতে লাগল।
সে শত্রুকে দেখলো, তারপর বাতাসের সাথে সমন্বয় করে যেই গুলি করতে যাবে ওমনি ঝাপসা দেখা শুরু করল। তারপর বহু কষ্টে দুটো প্রতিবিম্বকে এক করে তারপর ট্রিগার টিপেছে। মুখের ফোস্কা আর ঘা-গুলো হওয়ার পর থেকেই চোখের সমস্যাটা শুরু। এখন অবশ্য কমছে ধীরে ধীরে।
তবে চার নাম্বারের কাছে এই দাগগুলো গর্বের। সেদিন সে ঠিকই ঐ মরণ হন্টন শেষ করে বেঁচে গিয়েছিল। তার পুরস্কারস্বরূপ ওসাইরিসের হয়ে কাজ করার জন্যে তাকে আরেকটা সুযোগ দেয়া হয়েছে। আর মাত্র একটা গুলি করেই সে নিজের যোগ্যতা বুঝিয়ে দিয়েছে।
সে ঝটপট নিজের লম্বা ব্যারেলের রাইফেলটা গুটিয়ে ফেলল। তারপর মনোযোগ দিয়ে মাত্র খুন করা লোকটার ছবি দেখতে লাগল। একবার মনে হলো ওর কি আসলে আমেরিকানগুলোকে মারা উচিত ছিল কি-না। কিন্তু কাউকে টের না পাইয়ে একটার বেশি গুলি করা সম্ভব না। আর হ্যাঁগেনের মুখ বন্ধ করাটাই সবচেয়ে জরুরি ছিল।
রাইফেল গুছিয়ে নিয়ে সাবধানে ও মুখের চারপাশে একটা স্কার্ফ জড়িয়ে নিলো কাঁধের ওপর জড়ানো অ্যান্টিবায়োটিক মিশ্রিত গজটাও তাতে ঢাকা পড়ে যায়। তারপর লম্বা পদক্ষেপে রাতের সাথে মিশে গেল।
.
২০.
“আপনাকে আমি আসার আগ পর্যন্ত কিছু করতে নিষেধ করেছিলাম।” কথাগুলো রেনাটা আমব্রোসিনির।
মাল্টার সবচে দামি হোটেলের সবার ওপরের তলার বিলাসবহুল একটা স্যুইটে বসে আছে ওরা। ওরা মানে আমব্রোসিনি, কার্ট আর জো। কার্ট ওর কপালের ফোলা জায়গাটায় একটা স্কচের বোতল চেপে ধরে রেখেছে। জো হাত-পা ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গার চেষ্টা করছে।
ওরা যে জেলে যায়নি সেটাকে ভাগ্যই বলা চলে। গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র আর ইতালিয়ান সরকারের ফোন, তার ওপর আবার ওদের বীরত্বের একটা ভিডিও প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ওদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। মাত্র আধা-ঘন্টা আগেই যেখানে ওদের মাথার ওপর পঞ্চাশ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের খড়গ ঝুলছিল, এখন সেখানে ওদেরকে অর্ডার অফসেইন্ট জন-এর নাইটহুডের জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে।
“বিশ্বাস করুন, সে চেষ্টাই করেছিলাম। কিন্তু চোখের সামনে যখন ওরা দেয়াল ভেঙে দিয়ে পালানো শুরু করল তখন কীভাবে চুপচাপ বসে থাকি?” কার্ট জবাব দিল। *
রেনাটা গ্লাসে নিজের জন্য পানীয় ঢেলে নিয়ে কার্টের পাশে বসলো। “তাও ভালো যে আপনাদের অন্তত কিছু হয়নি। কেনসিংটন আর হ্যাগেন দুজনেই মারা গিয়েছে।”
জো’র চেহারা কালো হয়ে গেল, “আমার ওকে আসলে শুইয়ে রাখাই উচিত ছিল। ওর চেতনা খানিকটা ফেরায় উঠিয়ে দেয়ালের পাশে বসিয়ে দিয়েছিলাম।”
“নিজেকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তুমি তো আর জানতে না যে ওরা একজন স্নাইপার বসিয়ে রেখেছে ওখানে।” কার্ট বলল।
জো মাথা ঝাঁকালো। “সিরিঞ্জে কি ছিল তা কি জানা গিয়েছে?”
“কেটামাইট। দ্রুত কার্যকরী চেতনানাশক। ল্যাম্পেডুসার ওটা না।”
“এটাই আবার প্রতিষেধকটা না তো?” কার্ট আশা ভরা চোখে জিজ্ঞেস করল।
“ডা, রবিশ্বকে পরীক্ষা করতে দিয়েছিলাম। কিন্তু নাহ! কোনো কাজ হয়নি। আমরা এখনো শূন্যেই পড়ে আছি।”
কার্ট এক চুমুক স্কচ গলায় ঢাললো, তারপর কেনসিংটনের দেয়া দোমড়ানো কাগজটা আবার দেখতে লাগলো।
“এখানে এসে কি নাম আর ফোন নাম্বার জোগার করা শুরু করেছেন নাকি?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।
‘দেয়ালটা ভেঙে পড়ার আগ মূহর্তে কেনসিংটন এটা লিখছিলেন।” কার্ট বলে কাগজটা রেনাটার হাতে ধরিয়ে দিল।
“সোফি স… কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ছে না।”
“আমরাও না। কিন্তু উনি আমাদেরকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলেন।” কার্ট বলল।
“হয়তো কেনসিংটন চায় আমরা এই লোকটাকে খুঁজে বের করি। “হয়তো এই মহিলা আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে। হয়তো সোফিস-ই হলো সেই রহস্যময় পৃষ্ঠপোষক যিনি তার সব সংগ্রহ নিলামের জন্যে দান করে দিচ্ছেন।” জো বলল।
“লেখাটা শেষ করতে পারলেই সব বোঝা যেতো।” কার্ট বলল।
“লেখালেখির ঝামেলাই বা করতে গিয়েছিলেন কেন? মুখে বললেই তো হতো।” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।
কার্টও সে কথাটাই ভাবছিল। “উনি যেভাবে কথা বলছিলেন আর রুমের চারপাশে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিলেন তার মনে হয় রুমে লুকানো মাইক্রোফোন ছিল। না হয় অন্তত কেনসিংটনের ধারণা ছিল যে মাইক্রোফোন আছে।”
রেনাটা গ্লাস থেকে চুমুক দিল। “তাই উনি লিখে আপনাকে তথ্য দেয়ার চেষ্টা করছিলেন, আর মুখে বলছিলেন যে কিছুই জানেন না?”
কার্ট মাথা ঝাঁকালো। “ওনার ধারণা ছিল ওরা ওনার কথা শুনলেও দেখতে পাবে না। উনি একদিকে চাইছিলেন আমাদেরকে সাহায্য করতে আবার অন্যদিকে ধরা পড়ার ভয়ও ছিল।”
“তাহলে খামাখা উনাকে মারলো কেন? উনি তো ওদের কথা মতোই চলছিলেন।” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাগেনকে যে কারণে মেরেছে, সেই একই কারণে। প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করতে।”
ওরা বুঝতে পেরেছিল যে কেনসিংটন একসময় না একসময় সব ফাঁস করেবন-ই। এর মধ্যে আবার আমরা এসে পড়ায় তাড়াতাড়িই কাজটা সারতে হয় ওদের।” কার্ট ব্যাখ্যা করল।
“ওরা তো চাইলে আপনাদেরকেও মারতে পারতো।” রেনাটা বলল।
“সম্ভবত।” কার্ট বলল।
কি করতে পারতো সেটা আর এখন বড় কথা না, কি করেছে সেটাই আসল ব্যাপার। আর এখন পর্যন্ত ওদের প্রতিপক্ষই ওদের চেয়ে এগিয়ে আছে। যেটুকু সূত্র হাতে পেয়েছিল তার দুটোই আবার হাত ছাড়া হয়ে গিয়েছে। অন্তত খেলা তো জমেছিল।
“এখন এই সোফিকে খুঁজে বের করতে হবে।” রেনাটার দিকে ফিরে বলল কার্ট।” “এসব নাম-ধামের ব্যাপারে আমাদের চেয়ে আপনার নাড়াচাড়া বেশি। আপনার ইন্টারপোলের বন্ধুরা কি কোনো সাহায্য করতে পারবে? হয়তো মেয়েটা কেনসিংটনের বন্ধু বা জাদুঘরের পরিষদের সদস্য বা পৃষ্ঠপোষক।”
“হয়তো ঐ পার্টিতে দাওয়াত পাওয়া একজন।” জো বলল।
রেনাটা মাথা আঁকালো, “আমি ইন্টারপোল আর AISE (ইতালির বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা)-কে অনুরোধ করবো নামটা একটু চেক করতে। ছোট একটা দ্বীপ এটা। এখান থেকে একজনকে খুঁজে বের করা কঠিন কিছু হবে না। তাও যদি না পাওয়া যায় তাহলে আরো বিস্তারিত খুঁজবো। হতে পারে এটা একটা কোর্ড নেম বা কোনো অ্যাকাউন্টের পরিচিতি বা কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রাম যে কোনো কিছু হতে পারে।
“মহিলা ঐ স্নাইপারটাও হতে পারে। কার্ট বলল।
“হতেই পারে। আধুনিক যুগ এটা। মেয়েরাও চাইলে যা খুশি হতে পারে।” কাৰ্ট চোখ মুখ শক্ত করে মাথা নাড়লো আর গ্লাসে আরেক চুমুক দিল। লিকারের ঠাণ্ডা আগুন তার সাথে কপালের সাথে ঠাণ্ডা গ্লাস চেপে রাখার কারণে ব্যথাটা এখন মোটামুটি সয়ে এসেছে। মাথাটাও পরিষ্কার লাগছে এতোক্ষণে।
“সব সমস্যার গোড়া কিন্তু ঐ জাদুঘর। কেনসিংটন বলেছেন যে লোকগুলো কি সব মিসরীয় পুরাকীর্তি খুঁজছে। ওগুলো নাকি একদমই ফালতু। কিন্তু সত্যি কথা বলছিলেন কি-না কে জানে। একবার আমাদের দেখা দরকার। তার মানে আমি আর জো পার্টিতে যাচ্ছি।”
“সাজুগুজু করলে আমাকে ভালোই লাগে।” জো বলল।
“আস্তে। এখনি সেলুনে দৌড়াতে হবে না। আমরা খুব বেশি সেজেগুজে যাবো না। আর আজকের ঘটনার পর সরাসরি নিজেদের চেহারা আর কোথাও না দেখানোই ভালো হবে।”
“তার মানে ছদ্মবেশ?”
“তার চেয়েও ভালো। কার্ট এটুকু বলেই থেমে গেল।
“পার্টি এখনও হবে নাকি? আমিতো ভাবলাম বাদ হয়ে গিয়েছে।” রেনাটা বলল অবাক হয়ে।
কার্ট মাথা নাড়লো, “আমিও তা-ই ভেবেছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু কিছু ব্যাপার বুমেরাং হয়ে যায়। শুনলাম এই ঘটনার কারণে নাকি সবার আগ্রহ কমা তো দূরে থাক আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গিয়েছে। বিপদের আশংকা সবাইকে আরো বেশি উত্তেজিত করে তুলছে। তাই পার্টি বাতিল না করে ওরা নিরাপত্তা তিনগুণ করেছে, সেই সাথে আরো কয়েকজনকে দাওয়াত দিয়েছে।”
“আর আমরাও নাচতে নাচতে গেলেই ঢুকতে দেবে? ঐ তিন স্তরের নিরাপত্তা রক্ষীদের যদি ব্যাপারটা পছন্দ না হয়?” জো বলল।
“শুধু পছন্দই করবে না, সেই সাথে ওরা নিজেরা আমাদেরকে পাহারা দিয়ে ভেতরে নিয়ে যাবে। রহস্যের হাসি হেসে কার্ট জবাব দিল।