৩১.
টু শব্দটিও না করে কার্ট সামনে এগুলো। ওর প্রপালসন-ইউনিটের মৃদু ঘূর্ণের শব্দ শোনা যায় না বললেই চলে। ধ্বংসাবশেষের বাম দিকেই কাজ চলছে বেশি। এদিকে কমপক্ষে পাঁচটা লাইট জ্বলছে। সাথে ভ্যাকুয়ামের কাজ করা। ডুবুরিগুলো তো আছেই। ডানদিকে মাত্র দুটো লাইট দেখে ও সেদিকেই এগুলো।
চারদিকে ঘোলা পানি দেখেই বুঝলো যে ডুবুরিরা জাহাজটার ফসিল হয়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ ফুটো করে কিছু একটা বের করতে চাচ্ছে। NUMA-র অভিযানগুলো বাদে অন্যসব পানির নিচের অভিযানের মতোই এরা জাহাজটাকে আক্ষরিক অর্থেই কোপাচ্ছে। ভেঙে টুকরো টুকরো করে সেগুলো পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে।
“মাথায় বন্দুক ধরা থাকলে অবশ্য এতো সব সংরক্ষণ-টংরক্ষণ মাথায় থাকে না।” ভাবলো কার্ট।
এতোদূর থেকে কার্ট জোকে রেডিওতে কোনো খবর পাঠাতে পারবে না। তার মানে এখন যা করার ওকে একাই করতে হবে।
“লিখিত কথোপকথন চালু করো।” ফিস ফিস করল কার্ট।
হেলপেটের ডিসপ্লেতে একটা সবুজ বক্স আবির্ভূত হলো। এক কোণায় T অক্ষরটা জ্বলছে নিভছে।
অনেক কথাই মাথায় আসছে। কি লিখবে কি লিখবে করে শেষমেশ সবচেয়ে সহজ কথাটাই লিখলো। “আমি এসেছি তোমাদের সাহায্য করতে।”
ওর হাতের স্ক্রীনটা জ্বলে উঠতেই ও আবার সামনে বাড়লো। কাছে পৌঁছে ও সবচে কাছের ডুবুরিটার কাঁধে টোকা দিল। ভেবেছিল লোকটা ভয় পেয়ে বা অবাক হয়ে ফিরে তাকাবে। কিন্তু এদিকে ভ্রূক্ষেপ-ই না করে ও নিজের কাজই করতে লাগল।
কার্ট আরো জোরে টোকা দিল এবার। তাও কিছু হলো না। তখন কার্ট ডুবুরিটার ঘাড় ধরে জোর করে নিজের দিকে ফিরালো।
এবার ডুবুরিটার চোখে দেখা গেল নিখাদ বিস্ময়। কার্ট দেখলো লোকটার চেহারা নীল হয়ে গিয়েছে। চোখ অর্ধেক বোজা। তার মানে লোকগুলো পানির নিচে দীর্ঘক্ষণ ধরে কাজ করছে।
কার্ট নিজের হাতের স্ক্রিনটা দেখালো।
লোকটা লেখাটা পড়ে ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকালো। তারপর ওর কাছে থাকা একটা সাদা বোর্ড তুলে নিয়ে তাতে লিখলো, “যত দ্রুত সম্ভব খোঁড়ার চেষ্টা করছি।” তারপর আবার কাজে মন দিল।
“লোকটা আমাকে শয়তানগুলোর একজন ভাবছে। তার মানে ওদের কাজ কর্মে খেয়াল রাখার জন্যে এখানে কেউ আছে।” ভাবলো কার্ট। তারপর আবার লোকটাকে ধরে লিখলো, “আমি আপনাদের উদ্ধার করতে এসেছি। লোকটা চোখ পিটপিট করে দেখলো লেখাটা। চোখটা আগের চেয়ে খুললো আরো একটু। এতোক্ষণে সম্ভবত ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। লোকটা হঠাৎ এতোটা ক্ষেপে গেল যে কার্টের তাকে চেপে ধরে রাখতে হলো।
“কয়জন লোক ওদের?” কার্ট লিখলো।
লোকটা লিখলো ৯।
“সবাই কি নিচে?”
৫ …….৪।
তার মানে পাঁচ জন ওপরে আর চারজন পানির নিচে। ঝামেলা হয়ে গেল তাহলে। নিচে এতোজন থাকবে কার্ট সেটা চিন্তা করেনি।
“কে কে দেখিয়ে দিন।” কার্ট লিখলো।
কিন্তু লোকটা কার্টকে কিছু দেখানোর আগেই ওদের ওপর আলো এসে পড়ল। ডুবুরিটার চোখ দেখেই কার্ট বুঝে ফেলল লাইটটা কোন পক্ষ ফেলেছে। ও ঘুরতেই দেখে বর্শা বাগিয়ে একটা লোক ওদের দিকেই আসছে।
.
৩২.
কার্ড ডুবুরিটাকে একপাশে ঠেলে দিয়ে নিজের পিকাসো তুলে ধরলো। কিন্তু আক্রমণকারী ডুবুরিটা খুবই কাছে চলে এসেছে ততোক্ষণে তাই কেউই বর্শা ছুঁড়তে পারলো না। তার বদলে দুজন দুজনকে জাপটে ধরে একদিকে কাত হয়ে গেল।
লোকটার মাথায় পুরো মুখ ঢাকা হেলমেট। গায়ের স্যুটটাও বেশ শক্ত। নাহলে কার্ট শুধু টান দিয়ে লোকটার মুখোশ খুলে দিতে। কিন্তু তার বদলে ওরা মোচড়া-মুচড়ি করে গড়ান দিতে লাগল একজন আরেকজনের ওপর। শেষমেশ কার্ট লোকটার মাথা চেপে ধরতে পারলো। তারপরই প্রপালশন চালু করে সোফি সি এর ভাঙ্গা কাঠামোর দিকে চলা শুরু করল।
আক্রমণকারী লোকটা স্পিয়ারগান ফেলে একটা ছুরি বের করল। কিন্তু সেটা ব্যবহারের আগেই কার্ট ওকে জাহাজের কাঠামোর ওপর তুলে ওর মাথার পিছন দিকটা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে একটা বের হওয়া অংশের গায়ে বাড়ি দিল। সাথে সাথে লোকটার হাত থেকে ছুড়ি খসে পড়ল আর দুহাত ছড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল বালির ওপর। মারা না গেলেও অজ্ঞান হয়েছে নিশ্চিত।
অন্যপাশ থেকে আরো দুজন লোককে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। প্রথম জনের মতো এদেরও মুখ ঢাকা হেলমেট পরা তবে এদের পিঠে প্রপালশসন ইউনিট লাগানো। ফলে গতি তুলনামূলক দ্রুত।
কার্টের পাশ কেটে একটা বর্শা চলে গেল। বুদবুদ ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। কার্ট একপাশে লাফ দিয়ে পড়ল, তারপর লাথি দিয়ে বালি ছড়িয়ে পানি ঘোলা করে দিল যাতে ওকে দেখা না যায়।
তারপর ও নিজের প্রপালসন ইউনিট ঠিকঠাক করে ফুল স্পিডে চালানো শুরু করল। ফলে বালির মেঘে ঢেকে গেল চারপাশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক পাইলটের কাছ থেকে শোনা একটা কথা মনে পড়ল কার্টের : “আকাশ বা পানি যেখানেই ঘোলা হোক না কেন সব সময় বামে ঘুরবে।” কেন বামে বা কেন ডানে না সে কথা ও জানে না। তবে কথাটা যদি দুপুর বেলার আকাশের ক্ষেত্রে খাটে, তাহলে সমুদ্রের নিচেও খাটবে।
ও প্রপালশনের গতি একটুও না কমিয়ে বামে ঘুরলো, পা বালিতে বাধানো যাতে বালি আরো ওড়ে। কিছুক্ষণের জন্যে কৌশলটা ভালোই কাজে দিল। কিন্তু একটু পরেই ধুলোর মাঝেও এক জনের লাইটের আলো পৌঁছে গেল লোকটা কার্টকে দেখে অস্ত্র তুললো।
কার্ট আবারো ঘুরলো। কিন্তু আরেকটা বর্শার হুশ শব্দের বদলে কেমন ভোতা একটা আওয়াজ শুনতে পেল। যেন রাইফেলের গুলি। শব্দটা অনেকটা একে-৪৭-এর মতো লাগল ওর কাছে।
ওর কাঁধে লাগানো একটা পাখা ভেঙে গুড়ো হয়ে গেল। তবে কার্ট সামনে এনো থামল না। প্রাণপণে বালিতে লাথি দিচ্ছে যাতে ওকে ঠিকমতো খেয়াল না হয়।
প্রপালসনের ধাক্কায় অল্প পরেই ও ধ্বংসাবশেষের পিছনে চলে এলো। “জো, আমার কথা কী শুনতে পাচ্ছ? যদি শুনতে পাও তাহলে শোনো আমার জরুরি সাহায্য দরকার এখুনি। ওরা তিনজন, আমি একা। আর ওরা আন্ডার ওয়াটার রাইফেল ব্যবহার করছে। ওদের প্রপালসন ইউনিটগুলো দেখলাম রাশিয়ান, তার মানে রাইফেলগুলোও সেরকমই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”
কার্টের যতদূর মনে পড়ে রাশিয়ানরা ওদের ডুবুরি আর স্পোজ (রাশিয়ান স্পেশাল ফোর্স) কমান্ডোদের জন্য দুই ধরনের রাইফেল বানিয়েছিল। একটাকে বলা হয় APS. এগুলো বোল্ট নামের বিশেষ স্টিলে বানানো গুলি ছুঁড়তে পারে। গুলিগুলো একেকটা পাঁচ ইঞ্চি করে লম্বা। এগুলো সীসার তৈরি বুলেটের চেয়ে পানির ভেতর অনেক ভালো কাজ করতে পারে। তবে তারপরও পানির ঘনত্বের কারণে এগুলোর পাল্লা খুব বেশি না। কার্ট যে গভীরতায় আছে সেখানে সর্বোচ্চ পঞ্চাশ থেকে ষাট ফুট হবে। কিন্তু কার্টের পিঠের ব্যথাই প্রমাণ করছে নির্দিষ্ট দূরত্বের বাইরে মেরে ফেলতে না পারলেও আঘাত ভালোই করতে পারে।
“জো, শুনতে পাচ্ছ? জো?”
আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে পানির ঘনত্ব পৃথিবীর সর্বাধুনিক কমিউনিকেশন সিস্টেমকেও অকেজো করে দিতে পারে। জো ওর কাছে-পিঠে নেই। কার্ট সোফি সেলিন-এর পিছনের দিকে তাকাল। সেদিক থেকে আলো এগিয়ে আসছে। ডানে তাকিয়ে দেখে সেদিকেও একই অবস্থা।
“তিনজন আসছে আমাকে মারতে, আর আমার হাতে বর্শা মাত্র দুটো। পরের বার বস্তা ভরে স্পিয়ার গান নিয়ে আসবো।” কার্ট বিড়বিড় করল।
কার্ট স্পিয়ার গানটা দুহাতে ধরে ডান দিকে এগুলো। আবছায়ার ভেতর থেকে ডুবুরিটার আলো স্পষ্ট হলো। কার্ট সেদিকে তাক করে বর্শা ছুঁড়লো। বর্শাটা লোকটার কলার বোনের ঠিক নিচ দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
বঁড়শিতে গাঁথা টুনা মাছের মতো লোকটা মোচড়ানো শুরু করল। আশপাশটা ভরে গেল বুদবুদ আর ঘূর্ণিতে। কিন্তু মাটিতে পড়ার বদলে লোকটা ক্ষতস্থান চেপে ধরে রাইফেলটা ফেলে দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।
কার্ট লোকটাকে যেতে দিল। ওর লক্ষ্য রাইফেলটা। কিন্তু নিচে পড়ে অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছে।
“লাইট অন করো।” কার্ট বলল।
বাম কাঁধেরটা তো আগেই ভেঙে চুরে গিয়েছিল তবে ডান কাঁধেরটা সাথে সাথেই জ্বলে উঠল। আলোতে রাইফেলটা যেমন দেখলো কার্ট, ঠিক তেমনি ওর শত্রুরাও ওর অবস্থান জেনে গেল।
কার্ট সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপ দিল সাথে সাথেই শুনলো আরেকটা রাইফেলের আওয়াজ। ওর ঠিক সামনের বালিতে বোল্ট বিধতে লাগলো। এখন হয় কার্টকে ফিরতে হবে না হয় বোল্ট খেয়ে মরতে হবে।
বাকি ডুবুরি দুজন এগিয়ে আসছে। কার্ট নিজেকে সুস্থির করে শেষ বর্শাটা ছুড়লো। লক্ষ্য যে লোকটার হাতে রাইফেল আছে সে। একেবারে সরাসরি গলা ভেদ করে চলে গেল বর্শাটা। মুহূর্তে লোকটা হাত-পা ছড়িয়ে নিজের রক্তে নিজেই ডুবতে আরম্ভ করল।
কার্ট আবার রাইফেলটা যেদিকে পড়েছে মনে হয়েছিল সেদিকে ঝাঁপ দিল। কিন্তু ও পৌঁছতেই দেখে বাকি ডুবুরিটাও সেখানে পৌঁছে গিয়েছে।
দুইজনেই রাইফেলটা চেপে ধরলো। কার্ট ধরেছে হাতলের দিকের অংশটা, আর ওর প্রতিপক্ষ ধরেছে নলের অংশটা। ফলে টানাটানিতে কাটই জিতলে শেষমেশ।
কার্ট ওটাকে টেনে এনে গুলি করার চেষ্টা করল কিন্তু অন্যজন একেবারে ওর সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আছে। সে কার্টের হেলমেটের পিছনদিকটা হাতড়াতে লাগল। বাতাসের পাইপটা টেনে খোলার ইচ্ছা।
কার্ট হাঁটু দিয়ে লোকটার পেটে গুঁতো দিল। লোকটা ওর বাতাসের পাইপ ছেড়ে দিল কিন্তু আরো মারাত্মক একটা জিনিস বের করল হাতে। একটা বিস্ফোরকের কাঠি। এগুলো সাধারণত হাঙ্গর মারতে ব্যবহার হয়। এর গায়ে স্পর্শ লাগলেই বিস্ফোরণ ঘটে। কার্ট লোকটার হাত আটকে কবজি চেপে ধরলো যাতে কাঠিটার মাথা ওর গায়ে লাগতে না পারে। যেখানেই লাগবে সেখানেই ফুটো হয়ে যাবে। এগুলোর একবার মাত্র স্পর্শে পনের ফুট লম্বা হাঙ্গর পর্যন্ত ধরাশায়ী হয়ে যেতে দেখছে কার্ট। ওর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। এভাবে মরার–বা কোনোভাবেই মরার ইচ্ছে নেই।
দুজন দুজনকে চেপে ধরে গোত্তা খেতে লাগল শুধু। কার্টের কাঁধের আলো লোকটার মুখোশে প্রতিফলিত হচ্ছে। ফলে দুজনের কেউই চোখে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু তারপরও কেউ কাউকে ছাড়ছে না।
কার্ট এতোক্ষণে টের পেয়েছে যে লোকটা আকারে ওর চেয়ে কত বড়। কার্টের কাঁধ চেপে ধরতে পারায় লোকটা কিছুটা সুবিধা পেয়ে গেল। আর কার্টের প্রাণপণ চেষ্টার পরও ইঞ্চি ইঞ্চি করে কাঠিটা ওর পাজরের দিকে এগুতে লাগল। কার্টের মৃত্যু এখন সময়ের ব্যাপার। লোকটাও সেটা টের পেয়েছে। কার্ট লোকটার মুখে কেমন একটা অপ্রকৃতিম্ভের মতো হাসি দেখতে পেল। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাকি কার্টের আয়ুর। ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ ওদেরকে আলোর বন্যায় ভাসিয়ে একটা ঝাপসা হলুদ মতো জিনিস ছুটে এলো। আর একটা প্রচণ্ড গতির বাসের মতো কার্টকে আক্রমণকারী লোকটাকে আঘাত করল।
কার্ট পাক খেয়ে সরে গেল একদিকে। ঘুরে তাকিয়ে দেখে জো টার্টলের নাকে লোকটাকে বাধিয়ে ঠিক একটা উন্মত্ত ষাড়ের মতো ছুটে যাচ্ছে।
লোকটাকে সমদ্র তলে আছড়ে ফেলে তারপর জো থামল। তারপর টার্টল দিয়ে চাপা দিয়ে বালির ভেতর অর্ধেক গেঁথে দিল।
কার্ট নিচু হয়ে রাইফেলটা তুলে নিয়ে জোর অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই টার্টল কার্টের পাশে এসে থামল। হেলমেটের ভেতর দিয়েই জো’র হাসিমুখ দেখা যাচ্ছে। “আচ্ছা টাৰ্টলের গায়ে একটা কঙ্কালের মাথা একে দিলে কেমন হয়?”
আমি থাকতে সেটা হবে না, এতোক্ষণ লাগলো কেন তোমার?” কার্ট বলল। জো দাঁত বের করে হাসলো, “ওখানে বসে আসলে বোঝা যাচ্ছিলো না যে তুমি আসলেই বিপদে পড়েছ নাকি মজা নিচ্ছ। তবে যখন রাইফেলের শব্দ পেলাম তখন বুঝলাম কুছ তো গাড়বাড় হ্যায়।”
মজার ব্যাপার হলো, পানির নিচে গুলি বা রেডিও তরঙ্গের চেয়ে শব্দ অনেক দ্রুত যায়।
কৃতিত্ব পুরোটাই রাশিয়ানদের। ওরা বেশ মজার মজার অস্ত্র বানায়।” কার্ট জবাব দিল।
“হুম! তোমার কালেকশনের জন্যে দারুণ হবে এটা।” জো বলল।
কার্ট বন্দুক সগ্রহ করতে পছন্দ করে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ওগুলো যোগাড় করে। ওর কাছে ভুয়েলিং পিস্তল আছে, দুপ্রাপ্য কয়েকটা অটোম্যাটিক বোয়েন রিভলভার আছে। সম্প্রতি পশ্চিম থেকে একটা সিক্স শুটার জোগাড় করেছে। সাথে একটা কোল্ট পয়েন্ট ফোর ফাইভ। এটা দিয়েই ও ওর সর্বশেষ ভিলেনকে মেরেছে।
“তা তো অবশ্যই। তবে আমার মনে হচ্ছে। শো-কেসে জায়গা পাওয়ার আগে এটার আরো কিছু কাজ বাকি আছে।”
“আমরা যে কাজটা উল্টো দিক থেকে করছি সেটা কী বুঝতে পারছো? আমরা মাটির নিচে সব সাফ করে ফেলেছি। কিন্তু ওপরে কিন্তু রয়েই গিয়েছে। যুদ্ধের কৌশল কিন্তু এরকমটা হয় না।”
“তবে ভাগ্য কিছুটা ভালো। ওরা এখনো আমাদের কথা জানে না।” কার্ট প্রপালসন ইউনিট চালু করে আবার ধ্বংসস্তৃপের দিকে এগিয়ে গেল। কর্মরত সাধারণ ডুবুরিদের দেখা গেল আরো কয়েকটা অক্সিজেন ট্যাঙ্ক বের করছে। ওদেরকে দেখেই কেমন কুকড়ে গেল ওরা।
“সাবটাইটেল দেয়া শুরু করে দাও।” জো বলল।
ডিসপ্লেটা চালু করে কার্ট লিখলো, “সব ঠিক আছে। গার্ডরা মারা গিয়েছে, আমরা আপনাদেরকে এখান থেকে নিয়ে যাবো।”
একজন আঙুল দিয়ে ওপরে দেখিয়ে হাতের বোর্ডে খুব কষ্টে কিছু আঁকিবুকি কাটলো। এমন কাকের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং লেখা কার্ট জীবনেও দেখেনি।
“আপনারা কতক্ষণ ধরে পানির নিচে?” কার্ট জিজ্ঞেস করল। চার আঙুল দেখালো একজন।
“নব্বই ফুট পানির নিচে চার ঘণ্টা।” জো বলল।
ওরা নিশ্চয়ই শুধু অক্সিজেনের বদলে নাইট্রক্স বা টাইমিক্স ব্যবহার করছে। তার পরও এতোক্ষণ পানির নিচে থাকার কারণে ওপরে ওঠার জন্যে ওদেরকে কমপক্ষে কয়েক ঘন্টা ডিকমপ্রেস করতে হবে। দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে বুঝলো যে পর্যাপ্ত ট্যাঙ্ক নেই। পর্যাপ্ত কি নেই-ই বলা চলে। তার মানে অন্য কোনো উপায় বের করতে না পারলে এরা সবাই মারা পড়বে।
কার্ট সবার সামনের ডুবুরির কাঁধে হাত রেখে মাথা নাড়লো, “আপনারা ওপরে যেতে পারবেন না।”
ডুবুরিটাও মাথা নেড়ে আবার ওপরের দিকে দেখালো।
“আপনারা তাহলে মারা পড়বেন।”
লোকটা লেখাগুলো পড়ে আবার ওপর দিকে ইঙ্গিত করল। তারপরই হাত দিয়ে অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করল।
“আপনারা কী বলতে চাইছেন তা বুঝতে পারছি না।” কার্ট লিখলো।
ডুবুরিটাকে হতবুদ্ধি দেখালো। কার্ট ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল। তারপর ডুবুরিটার বোর্ড দেখিয়ে বলল, “আস্তে আস্তে লেখেন।” লোকটা বোর্ডটা নিয়ে আগের সব লেখা মুছে ফেললো। তারপর এবার আরো ভালো করে লেখার চেষ্টা করতে লাগল। ঠিক যেন একটা বাচ্চা ছেলে ধৈর্য ধরে তার হাতের লেখা সুন্দর করার চেষ্টা করছে।
শেষ করে বোর্ডটা ঘুরিয়ে ধরলো সে। এবার পড়া যাচ্ছে একটা মাত্র শব্দ লেখা তাতে।
বোমা!
.
৩৩.
ডুবুরিটা আতঙ্কের সাথে অর্ধেক উদ্ধার করা ধ্বংসাবশেষটা দেখালো। তারপর আবার কিছু লিখলো বোর্ডে।
“আপনারা যখন আক্রমণ করেন–তখন ওরা বোমা পেতেছে।”
কার্ট হঠাৎ ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। লোকগুলো এই ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করতে চেয়েছিল। কিন্তু যদি ওরা নিজেরা না পায় তাহলে ওরা ওটা কাউকেই পেতে দেবে না। “দেখান তো কোথায়?”
লোকটা ইতস্তত করতে লাগল।
দেখান!”
নিতান্ত অনীহায় লোকটা সাতরানো শুরু করল সেদিকে। খুবই ধীরে এগুচ্ছে। কাছে পৌঁছাতেই লোকটা নিজের লাইট ফেলে বোমাটা দেখালো। ওরা ভ্যাকুয়ামটা দিয়ে টনকে টন বালি সরিয়েছে। তারপর জিনিসপত্র যেগুলো পেয়েছে তার মধ্যে যেগুলো মিসরীয় মনে হয়নি সেগুলো সব ফেলে দিয়েছে। তরবারি, শেওলাপড়া কামানের নল, জুতা হাবিজাবি চারপাশে ডাস্টবিনের মতো করে পড়ে আছে।
জাহাজটা দেখতে এখন কঙ্কালের মতো লাগছে। বাইরের কাঠ-তক্তা সবই খুলে ফেলা হয়েছে। শুধু তুলনামূলক সরু কাঠের তৈরি ভেতরের কাঠামোটা রয়ে গিয়েছে। ওটার ওপর ভেসে গেল কার্ট। তারপর ডুবুরির আলো ফেলার জায়গাটা দেখতে লাগল। বোমা একটা না, দুটো। কয়েক তাল C-4-কে দেখা গেল টাইমারের সাথে লাগানো। ঠিক গোডাউনটায় যে রকমটা ব্যবহার করতে চেয়েছিল সেরকম। সমস্যা হলো বোমাটা এমনভাবে জাহাজের খোলে পড়ে আছে ঠিক যেন বাঘের খাঁচার মধ্যে মাংস দেয়া হয়েছে।
কার্ট আরো একটু কাছে গেল। তারপর জাহাজের ছাতাপড়া কাঠ চেপে ধরে কাছ থেকে দেখতে লাগল। বোমার ডিজিটাল ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে ২.৫১। সেকেন্ড সেকেন্ড করে কমছে সময়টা।
কার্ট চেষ্টা করল ভাঙ্গাচোরা জিনিসগুলোর ভেতর দিয়ে বোমাটা টেনে আনতে, কিন্তু ওর হাত অতদূর গেল না। ওর হাত থেকে আরো দুয়েক ফুট দূরে বোমাটা।
“জো! একটু সাহায্য দরকার।” কার্ট বলল।
জো আর টার্টল আসতে আসতে ঘড়ির কাটা ২.০০-তে পৌঁছে গেল। Roy- টায় একটা ভাজকরা লাঠি ছিল। জো সেটা দিয়ে চেষ্টা করল। কিন্তু কাজ হলো না। এটাও ছোটো।
“আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়া দরকার। আমি এই লোকগুলোকে নিয়ে যেতে পারবো।” জো বলল।
দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন গেলেও বেশিদূর যেতে পারবে না। আর যে পরিমাণ C-4 ব্যবহার করা হয়েছে তাতে শক ওয়েভেই চ্যাপ্টা হয়ে মরবো। অন্য বুদ্ধি বের করতে হবে।”
হঠাৎই ওর গায়ে সামান্য ঝাঁকুনি অনুভূত হওয়ায় পাশ ফিরে দেখে ডুবুরি লোকটার হাতে ভ্যাকুয়াম পাইপটা ধরা।
“দারুণ বুদ্ধি!” বলল কার্ট।
ভ্যাকুয়ামটা তখনো চালু। কার্ট সেটাকে ভাঙ্গা জাহাজের কাঠের দিকে তাক করে ভালভ খুলে দিল।
প্রথমবারেই ওটা অনেকখানি বিস্ফোরক তুলে আনলো। কিন্তু ওটা নজেলের কাছে আটকে গেল। ও ভ্যাকুয়ামটা আবার উঠিয়ে নিয়ে আসলো আর জো ওটাকে ওখান থেকে খুলে নিলো। তারপর তারগুলো খুলে ফেলতেই বোমাটা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল। তারপরও সাবধানতাস্বরূপ জো টাইমারটাও খুলে দিল।
“চল্লিশ সেকেন্ড আছে আর। তাড়াতাড়ি। বাকিটাও উঠিয়ে আনো।” থেমে যাওয়া টাইমারটা দেখে বলল জো।
কার্ট ইতোমধ্যে ভ্যাকুয়ামটা আবার আগের জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে প্রায়। দ্বিতীয় বোমাটার দিকে তাক করতেই বোমাটা উঠে এলো। কিন্তু প্রথমটার মতো আটকে যাওয়ার বদলে বেসবলের মতো বড় বোমাটা ভ্যাকুয়ামের পাইপ বেয়ে ওপরে চলে গেল।
কার্ট আর জো দুজনেই ওপরে তাকাল। পানির ওপরে টিউবের মাথাটা দেখার চেষ্টা করছে।
“জিনিসটা কোথায় গিয়ে থামবে বলে মনে হয়?” জো জিজ্ঞেস করল। কার্ট জবাব দিল না, কারণ উত্তরটা দুজনেরই জানা। তবে কথা হচ্ছে বোমাটা কি চল্লিশ সেকেন্ডে পুরো পাইপ পার করতে পারবে নাকি কোথাও আটকে যাবে? কার্ট ভ্যাকুয়াম পূর্ণ গতিতেই চালাতে লাগল। আশা করছে বোমাটা শেষ পর্যন্তই পৌঁছতে পারবে।
.
এদিকে পানির ওপরে ভ্যাকুয়ামের কমপ্রেসরটা এতোক্ষণ অলস ভঙ্গিতে আস্তে আস্তে চলছিল। হঠাৎ সেটা পূর্ণ শক্তিতে গর্জন করা শুরু করল। ফারুক নামে একটা লোক এটার দায়িত্বে ছিল। হঠাৎ এই পরিবর্তনে খুশি হলো সে। কারণ সে ভাবছিল নিচে বোধহয় কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
এখন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি। যা পেয়েছে সবই ফালতু জিনিস। এদিকে টেনশন হচ্ছে খুব। প্রতিবারই আশপাশে কোনো জাহাজ দেখা গেলেই ওর বুকটা কেঁপে উঠছে। এই বুঝি NATO বা মাল্টার কোস্ট গার্ডের পেট্রোল বোট ধেয়ে এলো। ও আবার সেই ধাতুর জালটার দিকে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানির ক্ষীণ ধারাটা উনাত্ত স্রোতে রূপ নিলো। অবশ্য ওটায় পানি-ই বেশি। বালি বা অন্য জিনিস খুব একটা নেই। তবে সেটা যে কোনো মুহূর্তে পাল্টে যাবে। শেষমেশ একদলা বালি নলের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। তারপরই ওঠে এলো শক্ত একটা জিনিস। জিনিসটা জালের ওপর পড়তেই একজন ওটা কি দেখার জন্যে এগুলো।
“না।” ফারুক চিৎকার করে উঠল।
তবে ওর চিৎকার ঢাকা পড়ে গেল বিস্ফোরণের শব্দে। অন্য লোকটা আর ফারুক দুজনেই ছাতু হয়ে গেল মুহূর্তেই। জাল, কমপ্রেসর আর বজরাটার বেশির ভাগ অংশও উড়ে গেল সাথে সাথে। যেটুকু বাকি ছিল সেটুকুও টুপ করে ডুবে গেল পানিতে।
বজরা থেকে একজন মাত্র লোক বেঁচে ফিরতে পারলো। একেবারে নৌকার শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলো সে। বিস্ফোরণের পরে নৌকাটা ভোবা আরম্ভ করতেই সে লাফ দিয়ে অন্য নৌকটার দিকে সাঁতার দিলো। অন্য কারো খোঁজ নেয়ার কথা মাথাতেই নেই।
লোকটা অন্য নৌকাটার সিঁড়িতে পৌঁছাতেই একজন এসে তাকে উঠতে সাহায্য করলো কিন্তু সিঁড়িতে পা দেয়ার আগেই তীক্ষ্ণ কিছু একটা তার পা ভেদ করে ঢুকে গেলো। তারপর তাকে টেনে আবার পানিতে এনে ফেললো।
প্রথমে লোকটা ভেবেছিল হাঙ্গর বোধহয়। কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে পানিতে অস্পষ্ট হলুদ কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। পানিতে ডুবন্ত কিছু একটা। উল্টোদিকে যাচ্ছে এখন। সাথে তাকেও টেনে নিয়ে যাচ্ছে পানির নিচে।
যে মুহূর্তে মনে হলো যে লোকটা জ্ঞান হারাবে তখনই তার পায়ের বাঁধন খুলে গেল আর সে মুক্ত হয়ে গেল। হাড়ে পাঁচড়ে পানির ওপর উঠে দেখে ডুবুরি নৌকাটা থেকে প্রায় একশো গজ দূরে সরে এসেছে। এদিকে পানির ওপরে উঠামাত্র শুরু হলো কাশি। কোনোমতে সেটা সামলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে হলুদ জিনিসটা আর নেই।
ডুবুরি নৌকায় থাকা দুজন এদিকেই অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। আশে পাশের পানিতে গুলি করার মতো কিছু খুঁজছে ওরা যে আক্রমণের শিকার এতক্ষণে তা টের পেয়েছে।
“কিছু দেখা যায়?” একজন চিৎকার করে জানতে চাইলো।
“না”
“আরেক দিকে দেখো।”
“ঐ তো ঐ যে!” নৌকায় থাকা দ্বিতীয় জন চেঁচালো।
লোকটা ভেবেছিল জিনিসটা একটা ডুবো জাহাজ। ওর বুলেটগুলো পানি ছিটকাতে ছিটকাতে চিরে দিল সমুদ্রের বুক। কিন্তু জিনিসটা উধাও হয়ে গেল আবার।
“এদিকে।” এবার প্রথম লোকটা হলুদ জিনিসটা দেখতে পেয়েছে।
জিনিসটা এবার সোজা ওদের দিকে এগুচ্ছে। পানির ঠিক নিচে। সূর্যের আলোয় ওটার চকচকে গা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। দুজনেই সেদিকে বন্দুক তাক করে গুলি করা শুরু করল। আশে পাশে পানি ছিটকে ফোয়ারার মতো হয়ে গেল।
কিন্তু হলুদ জিনিসটা তাতে থামল না। কয়েক মুহূর্ত পরেই সেটা পানির ওপর উঠে এলো। গুলি বষ্টিতে ভরিয়ে দিল জিনিসটাকে, কিন্তু জিনিসটা এক মুহূর্ত না থেমে ওদের নৌকায় এসে ধাক্কা দিল।
ধাক্কায় নৌকা দুলে উঠল। লোক দুটো ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে বন্দুক দুটো ঘুরিয়ে নিতে হলো। আর জিনিসটা ওদের নৌকার পাশ কাটিয়ে দূরে সরে গেল।
এতক্ষণে ওরা বুঝলল যে ওটার ভেতর আসলে কেউ নেই।
হঠাৎ পিছনে শিসের শব্দে ধারণার সত্যতা প্রমাণ হলো। ঘুরতেই দেখে রূপালি চুলের, ডুবুরিদের পোশাক পরা এক লোক ওদের দিকে একটা APS তাক করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ওরা যতক্ষণ হলুদ জিনিসটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলা তখন কার্ট নৌকার পিছন দিক দিয়ে উঠে এসেছে।
“বন্দুকগুলো পানিতে ফেলে দাও।” আদেশ দিল কার্ট।
লোকদুটো আদেশ মেনে হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
“হাত পাছার পিছনে নিয়ে, মাথা নিচু করে বসে পড়ো।”
বিনা বাক্য ব্যয়ে এটাও মেনে নিলো তারা।
ওদের দিকে বন্দুক তাক করে রেখেই ও নৌকার ক্যাপ্টেনের হাত-পায়ের বাঁধন কেটে দিল। তারপর মুখের ভেতর থেকে কাপড়টা সরাতেই ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বলে উঠল, “পানির নিচেও আমার লোক আছে।”
“চিন্তা করবেন না, ওরা ঠিক আছে।” কার্ট বলল।
ক্যাপ্টেন মাথা নাড়লল, “ঐ লোকগুলো ভোরের পর থেকে পানির নিচে। আর আমাদের ডিকমপ্রেশন ট্যাঙ্ক ঐ বজরাতে ছিল।”
“আমাদের জাহাজে একটা আছে। ওটা আনিয়ে নিচ্ছি।” বলে ও সী ড্রাগনকে রেডিওতে খবর দিল।
“দ্য চ্যাম্পিয়নদের কি হবে? ওরা এই কনসারভেন্সিটা চালায়। ক্যাপ্টেন বলল।
“ওদের কি হবে মানে?”
‘লোকগুলো ওদেরকে ধরে নিয়ে গিয়েছে।”
“আগেই বোঝা উচিত ছিল।” কার্ট বলল, তারপর পড়ে থাকা দুজনের দিকে ফিরে বলল, “রেডিও না ফোন?”
“ফোন, ব্যাকপ্যাকে আছে।” লোকটা জবাব দিল।
কার্ট লোকটাকেই আদেশ দিল ফোন বের করে নাম্বার টিপতে।
“কি খবর বলো? কাজ কতদূর এগুলো?” কর্কশ একটা কণ্ঠ শোনা গেল। কার্ট ফোনটা ওর হাত থেকে নিয়ে নিলো, “আপনারাই কি দ্য শ্যাম্পেনদের আটকে রেখেছেন?”
“কে?”
“আমার নাম অস্টিন। কার সাথে কথা বলছি জানতে পারি?”
“আপনি যদি আমার নাম না জানেন, তাহলে সেটা না জানানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।” লোকটা বলল।
“সমস্যা নেই। আপনার লোকদের একটু কড়কে দিলেই সব জানা যাবে।” লোকটা জবাব না দিয়ে হাসতে লাগল। “লোকগুলো আমার ব্যাপারে বিন্দু বিসর্গও জানেনা। যা খুশি করুন ওদেরকে নিয়ে। আপনি যা জানেন এর বেশি একটা তথ্যও ওদের কাছে নেই।”
এই মুহূর্তে কার্ট পিছিয়ে আছে। তবে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।
“হতে পারে। তবে ওরা যে পুরাকীর্তিগুলো উদ্ধার করেছে সেগুলো থেকে অনেক কিছুই জানা যাবে আশা করি। মিসরীয় ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ করা দারুণ একটা শখ। বিশাল সবুজ দানবটার রহস্যটা কি তা আমার জানার খুব আগ্রহ। সম্ভবত লোকটার মানুষকে শূন্যে ভাসাবার ক্ষমতা ছিল।
আন্দাজের ওপর বাজি ধরেছিল কার্ট কিন্তু লেগে গেলো সেটা। হাসির বদলে ওপাশে এবার নীরবতা নামলো। “যাক এবার কাজ হয়েছে।” ভাবলো কার্ট। “খোঁচাটা জায়গা মতোই লেগেছে।”
“আপনার কাছে শিলালিপিটা আছে?”
“সত্যি কথা হলো আমি তিনটা শিলালিপি পেয়েছি।” মিথ্যে বলল কার্ট। “আমি আপনাকে একটা প্রস্তাব দিতে চাই।” লোকটা বলল ফোনের অপর প্রান্ত থেকে।
“শুনছি আমি।”
“ট্যাবলেটগুলো আমাকে ফেরত দিন বদলে দ্য শ্যাম্পেনদের জীবিত ছেড়ে দেবো।”
“হুম! আচ্ছা ঠিক আছে। কোথায় আসতে হবে বলুন।”
.
৩৪.
“এই লোকগুলোকে নিয়ে আসা কি বুদ্ধির কাজ হয়েছে?” বেঁধে রাখা লোকগুলোকে দেখিয়ে বলল রেনাটা। ওরা এখন পূর্ণ গতিতে ফোনের লোকগুলোর বলে দেয়া জায়গাগুলোর দিকে ছুটছে।
“ওদের সাথে আমাদের একটা ব্যবসা করার কথা। অন্তত আমাদের মালগুলো তো দেখাবো।” কার্ট বলল।
“যখন ওরা দেখবে আপনি শিলালিপির বদলে তিনটা গুণ্ডা নিয়ে এসেছেন তখন কি হবে বলে মনে হয়?” জো জিজ্ঞেস করল।
“গোলাগুলি, বিস্ফোরণ আর লোকজনের চেঁচামেছি।” কার্ট জবাব দিল।
“তার মানে…সেই আগের মতোই।” জো হতাশ হলো।
“যা করি সবসময় তা-ই।” কার্ট বলল। শুনে রেনাটা আর জো দুজনেই হাসলো তবে রেনাটার হাসিটা বিষণ্ণ দেখালো।
“আসল সমস্যা অন্য জায়গায়,” বলল রেনাটা। “আমাদের কাছে যদি শিলালিপিগুলো আসলেও থাকতো তাহলেও ওরা দ্য শ্যাম্পেনদের ছাড়তে বলে মনে হয় না। তার ওপর এরা জানে যে এই লোকগুলো কি খুঁজছে। জাদুঘরের ঐ জিনিসগুলোও দ্য ‘চ্যাম্পিয়নদের কালেকশন থেকেই আসা। কয়েক বছর আগে ওরা সোফি সি.তে উদ্দার কাজ চালায়। এর মানে হচ্ছে দ্য শ্যাম্পেনরা পুরাকীর্তিগুলোর চেয়ে কম বিপদে নেই।” কার্ট তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। সূর্যের আলো চোখে পড়ায় চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। যততই মজা করুক যে কাজটা করতে যাচ্ছে সেটা দারুণ কঠিন। “আমাদেরকে প্রথম সুযোগেই ওদেরকে ভড়কে দিতে হবে। অস্ত্রপাতি আর লোকজন কেমন আছে আমাদের?”
জো লোকদের কাছ থেকে নেয়া বন্দুক আর ওগুলোর গোলাবারুদ দেখে টেখে বলল, “দুটো একে-৪৭ আর একটা APS রাইফেল। গুলি আছে তিনটা বন্দুক মিলায়ে নব্বই রাউন্ডের মতো। এক্সট্রা কোনো ম্যাগজিন নেই।”
“আমার একটা গুলি ভরা বেরেটা নাইন মিলিমিটার আছে। মোট আঠারোটা গুলি আছে ওটায়।” রেনাটা বলল।
“আমার কাছে খানিক C-4 আছে।” কার্ট বলল।
“অস্ত্রপাতির ব্যবস্থা তো হলো, ঘাবড়ানোর ব্যবস্থা কী হবে?”
রেনাটা ওর ফোনে এলাকাটার একটা ছবি ডাউনলোড করে বলল, “এখানে আমাদেরকে দেখা করতে বলেছে।”
জায়গাটা উপসাগরের ভেতর। অশ্রুর মতো আকৃতি আর চারপাশে চুনাপাথরের ছোট ছোট পাহাড়ে ভরা। সাগরটার মুখেই এক চিলতে বেলাভূমি। বৈকালিক সূর্যের আলোয় সামনের পরিষ্কার পানি ফিরোজা রঙে ঝলমল করছে। “এটা কী?” ছবিটার একটা কোণা দেখিয়ে কার্ট জিজ্ঞেস করল।
রেনাটা ছবিটা আরো বড় করে বলল, “দালানকোঠা।” চুনাপাথরের পাহাড়গুলোর ওপরে ওগুলো বানানো। কয়েক তলা উঁচু, বারান্দাও আছে। উপসাগরের প্রান্তে ছোট্ট একটা ব্রিজও আছে।
“পরিত্যক্ত হোটেল।” রেনাটা বলল। তারপর বিল্ডিংটা সম্পর্কে কিছু তথ্য। বের করে জানালো, “এটা হলো মূল ভবন। আর এই ব্রিজটা বানানো হয়েছিল হোটেল থেকে সরাসরি সমুদ্র তটে যাওয়ার জন্য।”
“বালি’র (ইন্দ্রোনেশিয়ার দ্বীপ) রিসোর্টগুলোর মতো? পানির ওপর ব্রিজ?” জো জিজ্ঞেস করল।
“সেরকম মনে হচ্ছে না। এগুলো অনেক উঁচু। নিচু দিয়ে নৌকা যেতে পারবে। এখানকার দেয়া তথ্যমতে জিনিসটা বানানো হয়েছিল ‘অ্যাজউর উইন্ডো’-এর মতো করে। আশেপাশেই নাকি এরকম দেখতে প্রাকৃতিক একটা ব্রিজ আছে।” রেনাটা জবাব দিল।
কয়েক বছর আগে কার্ট অ্যাজিউর উইন্ডোটা দেখেছে। দুর্দান্ত সুন্দর জিনিসটা। প্রায় একশো ষাট ফুট উঁচু হয়ে সমুদ্র থেকে বেরিয়ে এসেছে। ও যাদের সাথে ঘুরতে গিয়েছিল ওরা তো ওখান থেকে লাফ দিয়ে সমুদ্রে পড়বে বলে ঠিক করে ফেলল। কার্ট আগাম ওদের চল্লিশার দাওয়াত চেয়ে বসায় শেষমেশ ওরা নিবৃত হয়।
“ব্রিজটা ঝামেলা করবে। সাগরের পাশের ঐ পাহাড়গুলোও সমস্যা। কার্ট বলল। “স্নাইপারদের লুকানোর জন্য আদর্শ জায়গা ওগুলো। আর এর মধ্যেই ওরা একবার তাকে ব্যবহারও করেছে।”
“আমরা ওদের পিছন দিক দিয়ে আসতে পারি। আমি বলি কি এবার আর নিচে না গিয়ে মাটির আরো উঁচু দিয়েই যাওয়া যাক।” জো বলল।
রেনাটা ছবিটা ছোট করে আশেপাশের জায়গাগুলো দেখতে লাগল। হোটেলটার আশেপাশে কিছু নেই। সবচে কাছের লোকালয়টাও অনেক দূর। একটা মাটির রাস্তা চলে গিয়েছে ওখান থেকে হোটেল পর্যন্ত। আর সমুদ্র থেকে ঐ রাস্তায় পৌঁছার রাস্তা একটাই। সেটা হলো হোটেল থেকে রাস্তা পর্যন্ত একটা আঁকাবাঁকা সিঁড়ি।
“আমরা ওই ব্যাটাদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারি।” ঠাণ্ডা স্বরে বলল রেনাটা। “করতে পারলে খুশি-ই হতাম। কিন্তু এই লোকগুলো নিজেদের লোকদেরকেও মারতে আটকায় না। এই কাজ করলে বরং ওরা খুশি-ই হবে।”
“তাহলে তো হয় দ্বীপে নামামাত্রই গুলি খেয়ে মরতে হবে আর ভাগ্য আরো খারাপ হলে RPG দিয়ে নামা জাহাজটাই উড়িয়ে দেবে। আমরা কিছুই করবো না?”
“কিছুই করার নেই। সত্যি কথাই বলল কার্ট। “তার ওপর এই কাল্পনিক পুরাকীর্তিগুলো থাকা না থাকায় ওদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। ওদের লক্ষ্য শুধু ওগুলো যাতে কারো হাতে না পড়ে। তবে আমার মনে হচ্ছে ওরা অন্তত একবার হলেও জিনিসগুলো দেখতে চাইবে। কারণ দেখার আগেই আমাদের ডুবিয়ে দিলে ওরা নিশ্চিত হতে পারবে না যে আসলেই ওগুলো আমাদের কাছে ছিল কি-না। আমাদের শুধু রেডি থাকতে হবে যখন ওরা ব্যাপারটা টের পাবে সেই সময়টার জন্য।”
“কোনো বুদ্ধি পেয়েছ?” জো জিজ্ঞেস করল।
“তুমি হচ্ছো মেকানিক্যাল জিনিয়াস। এসব দিয়ে তুমি কী করতে পারবে বলো?” কার্ট বলল।
জো ডেকের ওপর নজর বুলালো। সেখানে স্কুবা ট্যাঙ্ক, পাইপ, নৌকার আংটা আর কিছু দড়ি পড়ে আছে। “যা আছে তা দিয়ে খুব বেশি কিছু হয়তো করা যাবে না। তবে একটা কিছুতো বের করে ফেলবই।” জবাব দিল জো।
.
৩৫.
ডুবুরির নৌকাটা নিয়েই যাচ্ছে ওরা। চালাচ্ছে কার্ট। সমুদ্রের নীল-সবুজ পানিতে লম্বা একটা সাদা দাগ পড়ে যাচ্ছে তাতে। এদিকে জো বসে বসে খালি স্কুবা ট্যাঙ্কগুলো জোড়া দিয়ে একটা বাংকার বানাচ্ছে।
“এগুলোর গায়ে গুলি লাগলে ফুটে যায় না?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।
“সিনেমাতে ফোটে। তবে সাবধানের মার নেই বলে আগেই ফুটো করে নিয়েছি গায়ে। এখন এগুলো পুরু দুই স্তরবিশিষ্ট স্টীলের প্রতিরক্ষা ঢাল হিসেবে কাজ করবে। আড়ালে লুকানোর জন্যে চমৎকার কাজে দেবে।” জো জবাব দিল।
“আপনি খুব সাহসী। আপনারা দুজন-ই” রেনাটা বলল।
“এই কথাটা দয়া করে আপনার সব বান্ধবীকে বলবেন যে কীভাবে আমরা মানবতার স্বার্থে জীবন বাজি রেখে পৃথিবীকে রক্ষা করেছি।”
রেনাটা হেসে দিল।
“আমার বান্ধবী আছেই মাত্র কয়েক জন। তবে ওরা আপনার সাথে পরিচিত হতে পারলে খুশিই হবে।”
“মাত্র কয়েকজন?”
“তিন চারজন আর কি। ওরাই আপনার জন্যে মারামারি লাগিয়ে দেবে।” রেনাটা জবাব দিল।”
“ইশ। ভালোই মজা হতো তাহলে, কিন্তু বেঁচে ফিরতে পারবো কি-না কে জানে।” করুণ একটা হাসি হেসে বলল জো। তারপর কার্টের দিকে ফিরে বলল।
“আশা করি এতে কাজ হবে। এখন আর আমার মরতে একদমই ইচ্ছে করছে না।”
জো শেষ ট্যাঙ্কটা জোড়া দেয়া শেষ করতেই ওরা গোজো দ্বীপের ধারে পৌঁছে গেল।
“তোমার জিনিস রেডি। যতটা পারি করেছি। আমি নিচে যাচ্ছি।” বলল জো। কার্ট মাথা ঝাঁকিয়ে রেনাটার দিকে ফিরলো। “আপনার লুকিয়ে থাকা দরকার। ওরা এখনো আপনার কথা জানে না।”
“আপনারা আমার দেশের শত্রুর সাথে লড়বেন আর আমি পাটাতনের নিচে লুকিয়ে থাকবো?” রেনাটা প্রতিবাদ করল।
“হ্যাঁ। সেটাই করবেন। সবার পেছনের কামরাটায় একটা জানালা আছে। ওটার ছিটিকিনি খুলে যথা সময়ের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকেন।”
“পেছনের কেবিনে কেন?”
“কারণ আমাদের খুব দ্রুত পালানোর প্রয়োজন পড়তে পারে।”
মুখ দেখে বোঝা গেল রেনাটা ব্যাপারটা মানতে পারছে না, কিন্তু কিছু বললও না। “আচ্ছা ঠিক আছে, শুধু এবার-ই।”
ওরা কানে লুকানো মাইক্রোফোন লাগাল। রেনাটা নিজেরটা পরীক্ষা করে নিয়ে নিচের ডেকে নেমে গেল। তারপর পেছনের কেবিনে চলে গেল। তারপর জানালার ছিটকিনি খুললেও জানালা না খুলে হাতে বেরেটা নিয়ে বসে থাকল।
চুনাপাথরের পাহাড়গুলোর কাছে পৌঁছাতেই কার্ট নৌকাটা এক টানে পুরো ঘুরিয়ে ফেলল। তারপর পিছন ফিরে এগুতে লাগল। পাহাড়গুলো পার হতেই ও সুড়ৎ করে অক্সিজেন ট্যাঙ্কগুলোর পিছনে ঢুকে গেল। হাতে রাইফেল। চোখ সামনের পাথরগুলোর ওপর। যে কোনো মুহূর্তে গুলির জন্য প্রস্তুত।
“আমরা এখনো বেঁচে আছি,” পাথরগুলো পেরিয়ে আসতেই বলল কার্ট।
“আপাতত, “ ক্ষুব্ধ স্বরে নীচ থেকে বলল জো।
কাৰ্ট চোখে একটা দূরবীন লাগিয়ে সামনেটা দেখতে লাগল। “ব্রিজের পাশের পাকা ঘাটলাটায় তিনজনকে দেখা যাচ্ছে। হাতে বন্দুক। রাস্তার মাথায় কয়েকটা গাড়িও দেখছি। কোনো নৌকা নেই।”
“তার মানে ওরা গাড়ি চালিয়ে এসেছে।” রেনাটা বলল, “এতে কী আমাদের কোনো সুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা আছে?”
“হ্যাঁ। যদি ওরা খুব জোরে সাতরাতে না পারে, তাহলে পালানোর সময় আমাদেরকে ধরতে পারবে না।” জো বলল।
“আড়ালে থেকো সবাই। হোটেলের ছাদে সম্ভবত একজন স্নাইপার আছে। একটা প্রতিফলন দেখলাম বলে মনে হলো।” কার্ট বলল।
“একমাত্র আপনিই নৌকার ওপরে।” রেনাটা মনে করিয়ে দিল।
“আমার সামনে প্রোটেকশন আছে। কিছু হবে না। আর ওরা ওদের জিনিস পাওয়ার আগ পর্যন্ত কিছু করবে বলে মনে হয় না।”
কার্ট নৌকাটাকে আস্তে আস্তে থামিয়ে দিল। তারপর সেটা একা একাই ভাসতে ভাসতে পাকা ঘাটলাটায় গিয়ে আটকালো। সেখান থেকে একটা রাস্তা ব্রিজের সিঁড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছে। আরেকটা রাস্তা চলে গিয়েছে একটা ভাঙ্গা-চোরা চালা ঘরের দিকে। ওটাই সম্ভবত ব্রিজ আর ঘাটের মেরামত ঘর।
তিনজনের একজন সামনে এগিয়ে এলো, হাতে একটা দড়ি।
স্কুবা ট্যাঙ্কগুলোর পেছন থেকে চেঁচালো কার্ট। বাধতে হবে না। আমরা বেশিক্ষণ থাকবো না। তোমাদের বস কোথায়?”
চালাঘরটা থেকে একজন গাট্টাগোট্টা ছোটোখাটো গড়নের মানুষ বের হয়ে এলো। চোখে সানগ্লাস, মাথায় মিলিটারি ছাট চুল।
“এই যে আমি।” বলল লোকটা।
“আপনি নিশ্চয়ই হাসান।” কার্ট বলল।
লোকটাকে কেমন বিরক্ত দেখালো।
“আপনার লোকগুলোকে পিটিয়ে এটুকু বের করা গিয়েছে। টুকটাক আরও কিছু জানা গিয়েছে।” কার্ট বলল।
“তাতে আখেরে কোনো লাভ হবে না। তবে আপনি চাইলে আমাকে এই নামে ডাকতে পারেন। লোকটা বলল।
“জায়গাটা অনেক সুন্দর।” বলল কার্ট। এখনো স্কুবা ট্যাঙ্কগুলোর পিছনেই ঘাপটি মেরে আছে। “তবে ভিলেনদের আস্তানা হিসেবে মানাচ্ছে না।”
“আপনার এসব সস্তা রসিকতায় মোটেও হাসি পাচ্ছে না। সাহস থাকলে উঠে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি কথা বলুন।” লোকটা বলল।
“অবশ্যই। তবে তার আগে আপনার স্নাইপারকে বলুন রাইফেলটা সাগরে ফেলে দিতে।”
“কোন স্নাইপার?”
“হোটেলের ছাদে যে আছে।”
ট্যাঙ্কগুলোর ফাঁকের সরু ফাঁক দিয়েও কার্ট লোকটার চেহারা কালো হয়ে যাওয়া দেখতে পেল।
“নাও অর নেভার।” বলতে বলতে কার্ট আবার ইঞ্জিন চালু করল। চলে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে।
লোকটা ঠোঁটের সামনে রেডিও তুলে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল। সম্ভবত ওপাশে না-বোধক উত্তর পাওয়ায় আবার জোর দিয়ে কথাটা বলল। এবার কাজ হলো। ছাদের ওপর স্নাইপারটা উঠে দাঁড়ালো তারপর ভারী রাইফেলটা তুলে নিয়ে নিচে ছুঁড়ে মারলো। পাক খেতে খেতে সেটা সাগরের পানিতে আছড়ে পড়ল।
“খুশি?” হাসান বলল।
“ব্যাটার কাছে আরো একটা রাইফেল আছে কি-না কে জানে? বা আরেকজন স্নাইপারও থাকতে পারে।” জো বলল নিচু স্বরে।
“সাহস দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ।” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল কার্ট। তারপর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল। “দেখা যাক ভাগ্যে কি আছে।”
কার্ট APS রাইফেলটা হাতে উঠে দাঁড়ালো। তিনটা একই অস্ত্র ওর দিকেও তাক করে ধরা। হাসানের কাছেও একটা পিস্তল আছে। তবে সেটা হাতে নেই। শোল্ডার হোলস্টারে।
“দ্য শ্যাম্পেনরা কোথায়?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।
“আগে শিলালিপিগুলো দেখান।” হাসান দাবি করল।
কার্ট মাথা নাড়লো, “উঁহু! সত্যি কথা হলো, ওগুলো যে কোথায় রেখেছি মনে পড়ছে না।”
বিরক্তি ভাবটা আবার ফিরে এলো হাসানের চেহারায়। হাসান শিস দিতেই ব্রিজের ওপরে নাড়াচাড়া দেখা গেল। এক জোড়া মানুষকে ধাক্কিয়ে ব্রিজের কিনারের দিকে নিয়ে আসা হয়েছে। দ্য শ্যাম্পেন দম্পতি। মোটামুটি বৃদ্ধই বলা চলে তাদেরকে। দুইজনই একসাথে বাঁধা। ব্রিজের ঠিক যেখানে রেলিং নেই সেখানে এনে দাঁড় করানো হলো তাদের। আর এক পা এগুলেই সোজা নিচে। দ্য চ্যাম্পিয়নের হাতে একটা গোলমতো জিনিস। একটা দড়ি দিয়ে ওটা তার পায়ের সাথে বাধা।
“ঝামেলা হয়ে গেল। বিড়বিড় করে বলল কার্ট।
“কেন? কি হয়েছে?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।
‘বন্দী দুজন একসাথে বাধা আর তারপর একটা নোঙ্গরের সাথে পা বেঁধে রেখেছে।”
“নোঙ্গর?”
“ওরকম-ই তো লাগছে। অবশ্য অতবড় না। বিশ পাউন্ডের মতো ওজন হবে। তবে একজন নিরীহ মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। একজন নিরীহ মানুষ আর তার স্ত্রী।
হাসান অধৈর্য হয়ে উঠল, “দেখতেই পাচ্ছেন, ওরা বেঁচে আছে। তবে আপনি যদি জিনিসগুলো না দেন তাহলে বেশিক্ষণ থাকবে না। আমি আমার মাত্র দুজন লোককে দেখতে পাচ্ছি।”
“বাকিরা এতোক্ষণ হাঙ্গরের পেটে চলে গিয়েছে। কার্ট বলল। কথাটা অর্ধেক সত্য। দুজন আহত বন্দীকে সী ড্রাগনে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ওরা বন্দরে পৌঁছলেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়া হবে।
“আর শিলালিপি!” হাসান চিৎকার দিল।
“দ্য শ্যাম্পেনদের বাঁধন খুলে দিন। সতোর নিদর্শন হিসেবে।” কার্ট দাবি করল।
“সততা ধুয়ে আমি পানি খাই।”
কার্টেরও অবশ্য এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। “আচ্ছা, ঠিক আছে, দেখাচ্ছি।” বলে কার্ট একটা নাইলনের রশি ধরে টান দিল। দিতেই নৌকার পিছন দিকে থাকা একটা ক্যানভাস কাপড়ের পর্দা সরে গেল। সরতেই দেখা গেল একটা বিশাল ট্যাঙ্ক। সাধারণত ডুবুরিদের যন্ত্রপাতি রাখা হয় ওটায়।
“ওটার ভেতর আছে এগুলো।” কার্ট জানালো।
হাসানকে দেখে মনে হলো কথাটা বিশ্বাস করছে না।
“আমি ওগুলো আপনার কাছে এগিয়ে দেবো না।” কার্ট আবার বলল। হাসানের কণ্ঠে নিখাদ সন্দেহ। “আপনার তরবারিওয়ালা বন্ধুটা কোথায়?” কার্ট প্রায় হেসে-ই দিয়েছিল।
“এই যে আমি, কেবিনের জানালা খুলে জো চিৎকার করে জবাব দিল।” কার্টের মতো জো’র সামনেও একটা ছোট স্কুবা ট্যাঙ্কের দেয়াল। তবে জোর সামনের দুটো ট্যাঙ্ক খনও ভরা আর একটা পাইপ দিয়ে ওপরের ট্যাঙ্কের সাথে লাগানো।
“খুব ভালো।” হাসান বলল, তারপর তার দুজন লোককে হাত নেড়ে ইশারা করল। ওরা রাইফেল হাতেই লাফ দিয়ে নৌকায় নামলো, তারপর ট্যাঙ্কটার দিকে এগুলো।
“যদি এটা কোনো চালাকি হয়” হাসান বলা শুরু করল।
কিন্তু কার্ট কথা কেড়ে নিয়ে বলল, “জানি, জানি। আপনি আমাদের দুজনকেই মেরে ফেলবেন তারপর দ্য শ্যাম্পেনদেরও ডুবিয়ে দেবেন। আগেও শুনেছি এই বক্তৃতা।”
বন্দুকধারী দুজন এমনভাবে ট্যাঙ্কটার দিকে এগোতে লাগল, যেন এটা একটা হিংস্র জন্তু, আর যে কোনো সময় ওটা গর্জন করে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। কার্ট এমনভাবে মুখ টিপে হাসতে লাগল খুব মজা পাচ্ছে ব্যাপারটায় আর অলস ভঙ্গিতে লোকগুলোর দিক থেকে রাইফেলটা ঘুরিয়ে নিলো।
ট্যাঙ্কের কাছে পৌঁছে একজন হাটু গেড়ে বসে পড়ল ওটা খুলতে। বাকিজন পাহারা দিতে পাশেই রইল দাঁড়িয়ে।
এদিকে কেবিনের ভেতর জো অক্সিজেন ট্যাঙ্কের ভালভে হাত দিল, ওটা অবশ্য আগে থেকেই সামান্য ভোলা ছিল আর একটু একটু করে ট্যাঙ্কটাতে চাপ বাড়াচ্ছিলো। তবে একজন লোক ট্যাঙ্কের দিকে ঝুঁকতেই ও ভালভ দুটো পুরো খুলে দিল।
সাথে সাথে ট্যাঙ্কের ঢাকনা দড়াম করে খুলে গিয়ে বসা লোকটার মুখে বাড়ি দিল। জো আগে থেকেই ট্যাঙ্কের ভেতর খানিকটা গ্যাসোলিন আর ট্যাঙ্কের কবজার সাথে সিগারেটের লাইটারের আগুন জ্বালানোর চকমকি পাথরটা টেপ দিয়ে আটকে রেখেছিল। অক্সিজেনের ধাক্কায় ট্যাঙ্কটা খুলতেই গ্যাসেলিনটা বাতাসে বেরিয়ে এলো আর চকমকি পাথরটাতেও ঘষা লেগে তাতে আগুন ধরে গেল। হলিউডের সিনেমাগুলোতে এরকম কৌশল ব্যবহার হয়। আগুনটা বিশাল তবে তেমন ক্ষতি করে না কোনো। এখানেও কাজ হলো, লোকটা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল আর সবার দৃষ্টিও এদিকে ফিরে গেল। কমলা রঙের আগুনটা কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে পরিণত হয়ে উড়ে চলে গেল।
কার্ট সাথে সাথে তার রাইফেল আগের পজিশনে নিয়ে এসে ঘাটে দাঁড়ানো বাকি দুই গুণ্ডার দিক গুলি করল। দুটো গুলিই অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ করল। ফিরতি কোনো গুলি করার আগেই তোক দুটো ঢলে পড়ল মাটিতে।
কার্ট বন্দুক ডানে ঘুরিয়ে হাসানকে লক্ষ্য করে তৃতীয় গুলিটা ছুড়লো, কিন্তু সে ততোক্ষণে একদিকে ঝাঁপ দিয়ে চালা-ঘরটার দিকে দৌড় লাগিয়েছে।
কার্ট এবার বামে ঘুরলো, ব্রিজের ওপরের গুণ্ডাগুলোকে গুলি করবে। কিন্তু গুলি করার আগেই ওর চারপাশে গুলিবর্ষণ শুরু হলো। ফলে ও মাথা নিচু করে আত্মরক্ষা করতে বাধ্য হলো।
অক্সিজেনের ট্যাঙ্কতগুলোয় শব্দ করে করে বুলেট এসে বিধতে লাগল। ট্যাঙ্কগুলোতে বিশাল বিশাল টোল পড়তে লাগল। নরম ধাতুতে হাতুড়ির উল্টো পাশ দিয়ে বাড়ি দিলে যেরকম হয় সেরকম। কার্ট গড়ান দিয়ে একপাশে সরে গেল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে উপর্যপুরি গুলির আঘাত সইতে না পেরে এর সবচে কাছের ট্যাঙ্কটা ভেঙে চুরমার হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে।
“জো, আমি মাথা তুলতে পারছি না।”
“গুলি হচ্ছে হোটেলের ছাদ থেকে।” জো জবাব দিল। তারপর দালানটার ছাদের দিকে এক পশরা গুলি ছুড়লো।
ছাদ থেকে গুলি থামল কয়েক মুহূর্তের জন্য, সেই সুযোগে কার্ট দেখলো স্নাইপারটা ছাদের নিচু দেয়ালের আড়ালে শুয়ে শুয়ে গুলি করছে। হাতে সাধারণ একটা রাইফেল, কোনো বীক্ষণ যন্ত্র নেই তাতে।”
“শালার নিশানা তো মারাত্মক।” আরেকদিকে হামাগুড়ি দিতে দিতে বলল কার্ট। তারপরও ও সেদিকে গুলি ছুড়লো কয়েকটা।
এদিকে ট্যাঙ্কের বাড়ি খেয়ে যারা উল্টে পড়েছিল তারা উঠে দাঁড়িয়েছে। একজন রাইফেল তুলে জো যেদিকে লুকানো সেদিকে এগুলো। তবে গুলি করার আগেই রেনাটা জানালা খুলে দুবার গুলি করল। দুটোই লোকটার বুকে লাগল। আর লোকটা সোজা পানিতে গিয়ে পড়ল।
বাকিজন দিল দৌড়।
রেনাটা লোকটার পা লক্ষ্য করে গুলি করলো। গুলিটা লাগল হাঁটুর ঠিক পিছনে। সাথে সাথে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। মরেনি। পরে দরকার পড়বে লোকটা।
এদিকে ছাদ থেকে আবার শুরু হয়েছে গুলিবর্ষণ। আর যে গুণ্ডা দুটো। নৌকায় বাঁধা অবস্থায় ছিল তারা বোলিং পিন-এর মতো উল্টে পড়ল। কার্টের অবশ্য এক ফোঁটাও খারাপ লাগল না তাতে, এই শালারাই ডুবুরিগুলোকে তিলে তিলে মারতে গিয়েছিল।
“ধাক্কা দাও ওদের, এখনই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দাও।” হাসানের চিৎকার শোনা গেল।
ব্রিজের ওপর থেকে দ্য শ্যাম্পেনদেরকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়া হলো। তিরিশ ফুট ওপর থেকে সোজা ঝপাশ করে পানিতে পড়েই মিলিয়ে গেল নিচে।
“ওদেরকে পানিতে ফেলে দিয়েছে।” কার্ট চিৎকার করে বলল। এদিকে ওর দিকে গুলির পরিমাণ এখনো কমেনি, “আমি মাথা তুলতে পারছি না। ওদিকে যাওয়া সম্ভব না। জো, তুমি কী যেতে পারবে?”
“আমি দেখছি ব্যাপারটা। জো চিৎকার করে বলল।
জোর দায়িত্ব ছিল গাড়িগুলোর পেছন থেকে বা চালাঘরের ওদিক থেকে যদি কেউ গুলি করে তবে তাদেরকে সামলানো। ও একটা অক্সিজেনের ট্যাঙ্কের ভালভ বন্ধ করে ট্যাঙ্কের সাথে লাগানো পাইপটা কেটে দিল। তারপর ট্যাঙ্কটা হাতে করে নিয়ে কেবিনের শেষ মাথায় জানালা ভেঙে সেদিক দিয়ে পানিতে ফেলে দিল।
“জাভালা বিদায় নিচ্ছে।” চিৎকার করে বলল ও।
তারপর সামান্য দৌড়ে ভাঙ্গা জানালা গলে নিখুঁতভাবে ঝাঁপ দিল পানিতে। তবে ওর দিকে কেউ গুলি করল না।
পানিতে পড়েই জো নিচের দিকে সাঁতরে গেল অক্সিজেনের ট্যাঙ্কটা ধরতে। তারপর ভালভটা খুলে প্রথমে খানিকটা বুদবুদ বের করে দিল, তারপর পাইপটা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। খুব ভালো উপায় না হলেও কাজ চলে যায়।
তারপর ঘুরে ও নৌকাটার নিচে দিয়ে সাঁতরে গেল অপরপাশে। ব্রিজের গোড়ার দিকে যাচ্ছে। এখানকার পানি একেবারে পুলের পানির মতোই স্বচ্ছ। ফলে সামনেই দেখা গেল দ্য শ্যাম্পেন দম্পত্তি পানির ভেতর ছটফট করছেন। ট্যাঙ্কটা বগলের নিচে চেপে ধরে বাকি হাতে সাঁতরে এগুলো সামনে জো। তবে সব সময় ডুবুরির পোশাক পরে সাতরানোর অভ্যাস থাকায়, গতি খুবই ধীর। পনের ফুট গভীরতায় ও পায়ের নিচে বালির টের পেল। তারপর তাতে পা বাঁধিয়ে নিজেকে ঠেলে দিল সামনে। প্রায় ব্রিজের কাছাকাছি পৌঁছাতেই ওর দিকেই শুরু হলো গুলিবষর্ণ। লম্বা বুদবুদের সারি তুলে ছুটে আসতে লাগল বুলেট।
নৌকার ওপর থেকে কার্টও খেয়াল করেছে ব্যাপারটা। ঝকঝকে কাঁচের মতো স্থির পানিতে জোকে দেখতে মোটেও সমস্যা হচ্ছে না ওপরের লোকগুলোর। এখন তা-ও একটু দূরে আছে, কিন্তু দ্য শ্যাম্পেনদের কাছে পৌঁছলেই একেবারে সরাসরি বন্দুকের নিচে চলে আসবে।
দ্য শ্যাম্পেনরা ডুবে মরুক এটাও চায় না কার্ট আবার বন্ধুও গুলি খেয়ে মোরাব্বা হোক সেটাও ওর কাম্য নয়। তাই এমন পরিস্থিতিতে ওর কাছে একমাত্র যুক্তিযুক্ত মনে হলো যে কাজটা সেটাই করল ও। ও আক্রমণ চালালো।
এক টুকরো c-4 তুলে নিয়ে টাইমার ৫ সেকেন্ডে ঠিক করে ENTER টিপে দিল। তারপর সেটা চালাঘরটার দিকে ছুঁড়ে দিল। ঘরের কাছাকাছিই পড়ল বোমাটা। চালের অর্ধেকটা উড়ে গেল সাথে সাথে আর ধাক্কায় বাকিটুকুও দেয়ালসুদ্ধ তাসের ঘরের মতোই লুটিয়ে পড়ল। হাসান ভেতরে ছিল না। সে তখন গাড়িগুলোর দিকে দৌড়াচ্ছে।
বিস্ফোরণের কারণে গোলাগুলিতে কিছুক্ষণের জন্যে ছেদ পড়ল। সেই সুযোগে কার্ট দ্রুত নৌকাটার ইঞ্জিন চালু করে মুখটা ব্রিজের দিকে ঘুরিয়ে দিল।
.
বিশ ফুট নিচে জো উল্টো হয়ে সাঁতার কাটছে অক্সিজেনের ট্যাঙ্কটা এখনও বুলেটগুলোর বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।
ও মুখ থেকে পাইপটা খুলে পানিতে ধরলো, যাতে বুদবুদ বের হয়ে ওর আসল অবস্থান কিছুটা ঢেকে যায়। কিন্তু তাতেও বুলেট বৃষ্টি থামলো না। একটা বুলেট ওর বাহুতে ঘষা দিয়ে চলে গেল। সাথে সাথে রক্তাক্ত হয়ে গেল জায়গাটা। আরেকটা লাগল ট্যাঙ্কের গোড়ায় তবে ভাগ্য ভালো যে ট্যাঙ্কটা ফুটো হলো না।
সাতরে দ্য শ্যাম্পেনদের কাছে পৌঁছে গেল জো, তারপর পাইপটা দিয়ে তাদেরকেও অক্সিজেন নেয়ার সুযোগ করে দিল।
এদিকে ব্রিজের ওপরের বন্দুকধারী কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। হাসান আর বাকিরা চলে যাচ্ছে। “যাওয়ার আগে ওদেরকে শেষ করে আসবে।” হাসান আদেশ করে গিয়েছে ওকে।
সে পিছু হটে খালি ম্যাগাজিনটা খুলে নতুন একটা লাগালো। তারপর ফুল অটো টিপে ব্রিজের পাটাতনের একটা ছিদ্র দিয়ে রাইফেলটা তাক করল। বুদবুদের কারণে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না, তবে যখনই ওর শিকার শ্বাস নেয়ার জন্যে পানির পাইপটা মুখে নিচ্ছে তখনই মোটামুটি দেখা যাচ্ছে ওদের। ও শান্তভাবে তাক করে বুদবুদ আবার পরিষ্কার হওয়ার অপেক্ষায় রইল।
হঠাই একটা লাল আর ধূসর অবয়ব ঝলসে উঠে ব্রিজের খুটির গায়ে আছড়ে পড়ল। ক্যাচকোচ শব্দ করে পুরনো ব্রিজটা কেঁপে উঠল মারাত্মকভাবে।
প্রথমে লোকটা ভেবেছিল ব্রিজটা বুঝি হেলে পড়বে। কিন্তু এটা স্থির হয়ে গেল আর ধুলোবালিও পরিষ্কার হলো দ্রুতই। সে আবার তার গুলি করার ছিদ্রটার দিকে মনোযোগ দিল।
সোনালি চুলের আমেরিকানটার হাসিমুখ দেখা গেল সেদিক দিয়ে। হাতে APS রাইফেল।
“উঁহু!” আমেরিকান বলল।
লোকটা তাও চেষ্টা করল। যতদূর সম্ভব নিজের রাইফেলের ব্যারেলটা নিচে নামাতে। কিন্তু যথেষ্ট দ্রুত হলো না সেটা। একটা অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল নিচে। লোকটা শব্দটা চিনতে পারলো। APS রাইফেলের বোল্টের শব্দ। যদিও এটা পানিতে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু এখন বাতাসেই গুলি করা হয়েছে। তবে চিন্তাটা মুহর্তের বেশি স্থায়ী হলো পাঁচ ইঞ্চি ধাতব খণ্ডটা সেটা সেখানেই থামিয়ে দিল চিরতরে।
.
৩৬.
দক্ষিণ লিবিয়া
পলের ছুটি শেষ হয়েছে দুই দিন হয়। কিন্তু এখনই ওর দম ফেলবার ফুরসত নেই। এই ভূতাত্ত্বিক গবেষণার ফলাফল দেখছে, আবার কম্পিউটারে NUMA থেকে ডাউনলোড করা একটা সফটওয়ারে শব্দ তরঙ্গ বিশ্লেষণ করছে। আর তার সাথে কফি বানানো আর খাওয়া তো চলছেই। রেজা’র আসল যে ভূতাত্ত্বিক ছিল সে কয়েকদিন ধরে লাপাত্তা। হয় সে কিডন্যাপ হয়েছে নয়তো নিজেই পালিয়ে গিয়ে বিদ্রোহীদের দলে যোগ দিয়েছে। সেই থেকে সব হ্যাপা পল একাই সামলাচ্ছে।
“এটা দেখুন। শেষমেশ শব্দ তরঙ্গগুলোর একটা অর্থ কম্পিউটার বের করতে পেরেছে। সেটার একটা প্রিন্ট আউট বের করে ও ডাকলো সবাইকে। গামায় ফিরে তাকাল, চোখ ঝাপসা দেখাচ্ছে। “কি এটা, আরো বেশ আঁকাবাঁকা লাইন? দারুণ!”
“তোমার আগ্রহে দেখি ভাটা পড়েছে,” পল জবাব দিল।
“আমরা এসব হাবিজাবি কয়েক ঘণ্টা ধরে দেখছি।” গামায় বলল। “একের পর এক খালি আঁকাবাঁকা দাগ। তথ্য উপাত্ত যা পাচ্ছি সেগুলো ঘাটাঘাটি করে বা কম্পিউটারে চালিয়ে দেখে পৃথিবীর অন্য কোথাওকার এসব আঁকাবাঁকা দাগের সাথে মিলাচ্ছি। এখন মনে হচ্ছে তুমি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছ। মানসিক সুস্থতার কথা বাদই দিলাম।”
“হুম! তবে পরীক্ষায় যে পাস করছে না বোঝাই যাচ্ছে, খোঁচা মেরে বলল পল।
“তাহলে আমি তোমাকে খুন করলেও দোষ হবে না। বলবো মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলাম। যাই হোক, কি দেখাতে ডাকলে?”
“এটা হলো বেলে পাথর, প্রিন্ট আউটটার এক জায়গা দেখিয়ে বলল পল। “কিন্তু এটা হলো তরল পদার্থের একটা স্তর। বেলেপাথরের ঠিক নিচেই। নিচে এখনো পানি আছে।”
“তাহলে পাম্পে পানি উঠছে না কেন?”
“কারণ পানিটা স্থির না। এটা সরে যাচ্ছে। আরো নিচে নেমে যাচ্ছে। পানির স্তর।”
“মানে?”
“যদি আমার ধারণা ঠিক হয়, তাহলে নুবিয়ান জলাধারের নিচে আরো একটা জলাধার আছে।”
“আরেকটা জলাধার?”
পল মাথা ঝাঁকালো। “মাটির সাত হাজার ফুট নিচে। এই দাগগুলোতে বোঝা যাচ্ছে যে জলাধারটা পানি দিয়ে ভরা, তবে এখানে আর এখানে বিচ্যুতি থেকে বোঝা যায় যে পানিটা স্থির না, নড়ছে।”
“মাটির নিচের নদীর মতো?”
“হতে পারে। কম্পিউটারের তথ্য অনুযায়ী ওটা পানি এটা শুধু নিশ্চিত।” পল বলল।
“তা আপনি যাচ্ছে কোথায়?” গামায় বলল। ক্লান্তি নেই চোখে মুখে আর। “জানি না।”
“তা এটা নড়ছে কেন?”
পল কাঁধ ঝাঁকালো, “এসব আঁকাবাঁকা লাইন থেকে শুধু নড়ছে যে সেটাই জানা যায়, আর কিছু না।”
হঠাৎ প্রচণ্ড একটা শব্দে ওদের কানে তালা লেগে গেল। আকস্মিকতায় দুজনই দাঁড়িয়ে পড়ল।
“মরুভূমিতে কখনো বজ্রপাত হয় না,” ঠাণ্ডা স্বরে বলল গামায়।
“মনে হয় প্লেনের শব্দ। বিমান ঘাটির কাছে যখন থাকতাম তখন প্রায়ই এরকম শুনতাম।” পল বলল।
আরো দুবার হলো শব্দটা। তারপরই শোনা গেল মানুষের চিৎকার আর বন্দুকের আওয়াজ।
পল হাতের কাগজটা নামিয়ে জানালার কাছে ছুটে গেল। মরুভূমির ভেতর আরেকটা ঝলক দেখা গেল আর আরেকটা পাম্পিং টাওয়ার কমলা আগুনে ঢাকা পড়ল। তারপর একপাশে হেলে পড়ে গেল।
“হচ্ছে কি?” গামায় জিজ্ঞেস করল।
“বিস্ফোরণ।” পল জবাব দিল।
এক সেকেন্ড পরই হন্তদন্ত হয়ে রেজা প্রবেশ করলেন ঘরে। “পালাতে হবে এক্ষুণি! বিদ্রোহীরা হামলা করেছে।”
কিন্তু পল আর গামায়ের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।
“তাড়াতাড়ি। বিমানে উঠতে হবে আমাদের।” পাশের রুমে দৌড়ে যেতে যেতে বলল রেজা।
পল আর গামায় প্রিন্ট আউটগুলো তুলে নিয়ে রেজার পিছু পিছু ছুটলো। সবাই একসাথে হতেই সিঁড়ির দিকে এগুলো সবাই। রাস্তার ওপাশেই DC-3 কে স্টার্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ওটার বুড়ো ইঞ্জিন কাশছে আর ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে চালু হলো অবশেষে।
“বিমানে সবারই জায়গা হবে, তবে আমাদেরকে যেতে হবে খুব দ্রুত।” রেজা বললেন।
সবাই দৌড়ে রাস্তাটা পার হয়ে DC-3’র মাল ওঠানোর দরজাটা দিয়ে ঢুকে পড়ল। সাথে সাথে বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা গেল কাছে। রকেটের আঘাতে কন্ট্রোল সেন্টারটা উড়ে গিয়েছে।
“চালানো শুরু করুন।” সবার ওঠা শেষ হওয়া মাত্র পল চিৎকার করে বলল। রেজা মাথা গুনলেন। মোট একুশজন সাথে পাইলট। এর মধ্যে পল আর গামায় বাদে সবাই এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারী।
“চালাও!” আদেশ দিলেন তিনি।
পাইলট থ্রটল সামনে ঠেলে দিতেই প্লেন রানওয়ে ধরে ছুটলো। এদিকে ওদের পিছনে বোমা ফুটেই চলেছে।
পল রেজার দিকে তাকাল, “আপনি না বললেন বিদ্রোহীদেরও পানি খেতে হয়?”
“সম্ভবত আমার ধারণা ভুল।”
ইঞ্জিন ততোক্ষণে পূর্ণ শক্তিতে গর্জাতে আরম্ভ করেছে। রাতের ঠাণ্ডা বাতাসে সহজেই হর্স পাওয়ার বেড়ে যাচ্ছে। গতি বেশি থাকলেও বিমানটা এখন পুরো ভরা। আর বিমানের ওজন বেশি হলে টেক অফের জন্যেও বেশি সময় লাগা। তাই রানওয়ের শেষ মাথায় পৌঁছে পাইলটের আর কিছু করার ছিল না।
বিমানটা আকাশে উঠানোর জন্যে যতদূর সম্ভব সে থ্রটলটা টেনে উঠাল, তারপর বিমানের নাকটা নিচু করে, বিমানের চাকা ঢুকিয়ে ফেলল। পরবর্তী তিরিশ সেকেন্ড ওরা বিশ ফুট মতো ওপরে ভেসে রইল। পাইলটরা একে বলে “গ্রাউন্ড ইফেক্ট” মাটির কাছাকাছি থাকলেই মনে হয় ওড়ার সময় খানিকটা ধাক্কা দেয় মাটি। ফলে পুরো স্পিড় তোলার জন্যে বিমান কিছুটা সময় পায় আর উচ্চতা বাড়াতেও খুব কাজে লাগে জিনিসটা। কিন্তু আজকের গ্রাউন্ড ইফেক্ট ওদের বিমানকে সরাসরি মেশিনগান বসানো একগাদা পিক-আপ ট্রাকের ওপর নিয়ে এলো।
“সাবধান,” পাইলট চিৎকার করে বিমানটা ডানে ঘুরিয়ে দিল, সেই সাথে ওপরে তোলার চেষ্টা তো আছেই।
ওরা কোনো গুলির আওয়াজ পায়নি, অবশ্য প্লেনের ইঞ্জিনের যে গর্জন তাতে পাওয়ার কথাও না। কিন্তু হঠাৎ করেই কেবিনের ভেতরটা ধাতব তারা। বাতি আর জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গে ভরে গেল।
“পল।” গামায় ডাক দিল।
“আমি ঠিক আছি, তুমি?” পল জবাব দিল।
গামায় নিজেকে দেখে-টেখে বলল, “লাগেনি কোথাও।” pc.3’র গতি বাড়ছে ধীরে ধীরে। এতে ওপরে আর গুলি পৌঁছবে না। কেবিনের সবাই ভয়ে কাঁপছে, তবে একজন বাদে কারো কিছু হয়নি।
“রেজা!” কেউ চিৎকার করে উঠল।
রেজা দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন।
পল আর গামায়-ই তার কাছে প্রথম পৌঁছলো। পা আর পেট থেকে রক্ত পড়ছে।
“রক্তপাত থামাতে হবে।” পল বলল।
সবাই চিৎকার করে উঠল।
গামায় বলল, “আমাদেরকে ওনাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। কাছে। পিঠে কোনো শহর আছে?”
সবাই মাথা নাড়লো।
বেনগাজী, বেনগাজী যেতে হবে।” বহু কষ্টে রেজা-ই বললেন।
পল মাথা ঝাঁকালো। নব্বই মিনিট লাগবে। হঠাৎ এটাকে এক অপরিমেয় সময় বলে মনে হলো পলের কাছে।
“ধৈর্য ধরুন।” গামায় রেজার হাত ধরে অনুরোধ করল, “প্লিজ আর একটু সহ্য করুন।”
.
৩৭.
গোজো দ্বীপ, মালটা
অগভীর উপসাগরটার তলায় বসে জো ওর ট্যাঙ্ক থেকে দ্য চ্যাম্পিনদের অক্সিজেন আর নানানভাবে তাদেরকে ঠাণ্ডা রাখছিল। শেষমেশ রেনাটা আর কার্ট বহু কষ্টে ওদের পানির ওপর তুলে আনলো।
ওদেরকে ডুবুরি নৌকায় তুলে আনাটাই ছিল বেশি কষ্ট, কারণ ওদের হাত পা সবই ছিল বাঁধা। তবে শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় সবাই-ই উদ্ধার হলো। কিন্তু তখনই দেখা গেল আরেকটা সমস্যা।
“নৌকা ডুবে যাচ্ছে।” জো বলল।
নৌকাটায় যথেষ্ট গুলি লেগেছে আজ। সবচে বেশি আঘাত লেগেছে কার্ট যখন এটা দিয়ে ব্রিজটায় ধাক্কা দেয় তখন।
“সামনের দিকটা পুরো পানিতে ভরে গিয়েছে।” রেনাটা জানালো।
“ভাগ্য ভালো যে আমরা তীরের খুব কাছেই।” কার্ট বলল।
তারপর তীরের উদ্দেশ্যে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে দিল। সামান্য পরেই ফুটো নৌকাটা তীরের বালির ওপর উঠে এলো। সবাই তীরের অগভীর পানিতে নেমে বালিয়াড়িতে উঠে এলো।
“রাস্তাটা ধরে যাই চলল, গাড়ি-ঘোড়া একটা পেয়েও যেতে পারি।” কার্ট প্রস্তাব দিল।
ওরা বালি পেরিয়ে উঠে এলো। আশেপাশেই পরাজিত গুণ্ডার দল পড়ে আছে।
“সবাই মারা গিয়েছে। যেটার পায়ে গুলি করলাম সেটাও।” রেনাটা বলল।
“কেউ পিছনে পড়ে থাকবে না।” লোকগুলো এই মতবাদে বিশ্বাসী। জো বলল, “তবে কথাটার অর্থ এদের কাছে ভিন্ন।”
কার্ট পায়ে গুলি করা লোকটাকে ভালো করে দেখলো। মুখ ভরা ফেনা।
“সায়ানাইড। এরা তো দেখি একেকটা উন্মাদ। সম্ভবত আদেশ দেয়া-ই আছে যে ধরা পড়া চলবে না।”
“এরকম নির্দেশ দেয়া তো সহজ কিন্তু পালন করা তো চাট্টিখানি কথা নয়।” দ্য শ্যাম্পেন বললেন।
“সাধারণ মানুষের কাছে হয়তো কঠিন। কিন্তু এরা যে কোন ধরনের সংগঠন কে জানে?” কার্ট বলল।
“আতঙ্কবাদী?” মি, দ্য শ্যাম্পেন বললেন।
“আতঙ্ক এরা ভালোই ছড়াতে সক্ষম, তবে আমার মনে হয় শুধু আতঙ্ক ছড়ানোই এদের উদ্দেশ্য না।” রেনাটা বলল।
কার্ট লাশটা পরীক্ষা করল, পরিচয় পাওয়া যায় এমন কিছুই নেই। কোনো তাবিজ কবজ, গয়না বা ট্যাটু বা কাটা দাগ কিছুই নেই। লোকটা কে বা কার হয়ে কাজ করতো জানার কোনো উপায়ই নেই।
“মাল্টা সরকারকে একটা খবর দিন। ওরা গোয়েন্দা সংস্থা বা সেনাবাহিনী থেকে এ ব্যাপারে সাহায্য নিতে পারে। লোকে বলে “মৃত মানুষ মুখ খোলে না।” কথাটা সম্পূর্ণ ভুয়া। এদের অস্ত্র, কাপড়, আঙুলের ছাপ এসব থেকেও অনেক কথা জানা যায়। এসব লোক মাটি খুঁড়ে উদয় হয়নি। ভালো মতো খুঁজলে কোনো না কোনো পরিচয় বেরুবেই। আর যেভাবে ওরা লড়ছিল তাতে স্পষ্ট যে এরা অতীতে ধোয়া তুলসী ছিল না। কোথাও না কোথাও রেকর্ডে নাম থাকবেই।”
রেনাটা মাথা ঝাঁকালো, “সোফি সি. থেকে যে দুটোকে ধরা হয়েছে ওদের কাছ থেকেও কিছু জানা যাবে।”
“ওরাও এতক্ষণে বিষ খেয়েছে কি-না কে জানে।” কার্ট বলল।
দলটা ধীরে ধীরে রাস্তাটায় উঠে এলো, পিছনে পড়ে থাকল পরিত্যক্ত হোটেল, আর ব্রিজ।
.
কয়েক ঘণ্টা পর ওদেরকে দেখা গেল দ্য শ্যাম্পেনদের বাড়ির বসার ঘরে। সবাই গোসল-টোসল সেরে পরিষ্কার জামা পরেছে। সন্ধ্যা তখন ছুঁই ছুঁই। ঘর জুড়ে দামি আর কারু কার্যে ভরা আসবাব, দেয়ালটা চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য আর একটা লাইব্রেরি সমান বই দিয়ে ঠাসা। বামদিকে একটা ব্যালকনি। এক পাশের দেয়ালের ঠিক মাঝখানে একটা ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে।
তবে এই মুহূর্তে ঘর আর লাইব্রেরি দুটোরই তছনছ অবস্থা। দ্য শ্যাম্পেনদের ভয় দেখাতে এই কাজ করেছে আক্রমণকারীরা।
নিকোল দ্য শ্যাম্পেন এসেই এগুলো পরিষ্কার করা শুরু করলেন কিন্তু তার স্বামী বাধা দিলেন। “এখন না, ডিয়ার। আগে পুলিশ আর ইস্যুরেন্সের লোকজন আসুক, তারপর।”
“তা ঠিক, তবে অগোছালো দেখলে আমার ভালো লাগে না।” তারপর সোফায় বসে কার্ট, জো আর রেনাটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমাদেরকে উদ্ধার করার জন্যে অন্তরের অন্তস্থল থেকে কৃতজ্ঞ আমি।”
“আমিও।” তার স্বামী বললেন।
“আসলে এটা আমাদেরই দায় ছিল। আমরা এখানে আসাতেই আপনারা বিপদে পড়েছেন। কার্ট জবাব দিল।
“না, আপনারা আসার দুদিন আগেই এই লোকগুলো এসেছিল।” ইটিয়েন বললেন। তারপর একটা রূপার ট্রে থেকে একটা স্ফটিকের পাত্র তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কগন্যাক (ফরাসি মদ) চলবে?”
কার্ট না করল।
তবে জো আগ্রহ নিয়ে বলল, “হাত-পা গরম করা দরকার।”
একটা টিউলিপ আকৃতির গ্লাসে সোনালি তরলটা ঢাললেন এটিয়েন তারপর জোকে এগিয়ে দিলেন। জো তাকে ধন্যবাদ দিয়ে গ্লাসে চুমুক দিল তারপর চোখ বন্ধ করে আমেজটা উপভোগ করতে লাগলো। স্বাদ আর গন্ধ দুটোই অতুলনীয়। মুখেও সেটাই বলল ও, “অসাধারণ।”
“সেরকমই হওয়ার কথা,” পাত্রটার দিকে তাকিয়ে কার্ট বলল, “যদি ভুল না হয়, তাহলে এটা একটা ডেলামে লি ভয়াজ। এক বোতলের দাম আট হাজার ডলার।”
জো হঠাৎ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কিন্তু ইটিয়েন সেটাকে পাত্তা দিলেন না। “যে আমার জীবন বাঁচিয়েছে তার জন্য এইটুকু আর এমন কি।”
“একদম ঠিক,” নিকোল সমর্থন দিলেন।
আসলেই একদম ঠিক। কার্ট তার বন্ধুর জন্যে গর্বিত। সামান্য পরিচয়েই জো ওর হৃদয় খুলে দিতে পারে।
ইটিয়েন নিজের গ্লাস ঢেলে নিয়ে পাত্রটা আবার ট্রেতে রেখে দিলেন। তারপর আগুনের সামনে বসে তারিয়ে তারিয়ে সেটা উপভোগ করতে লাগলেন।
“এত সুন্দর মুহূর্তটা নষ্ট করার জন্যে দুঃখিত।” কার্ট বলল। কিন্তু ঐ লোকগুলো আপনাদের কাছে চাচ্ছিলো কী? ঐ মিসরীয় পুরাকীর্তিগুলোয় কী এমন আছে যে এতোগুলো মানুষ মারতেও ওদের আটকালো না?”
দ্য শ্যাম্পেন দম্পত্তি দৃষ্টি বিনিময় করলেন, “ওরা আমার পড়ার ঘর তছনছ করে ফেলেছে, লাইব্রেরি ভেঙে চুরে খান খান করে দিয়েছে।”
কার্ট বুঝলো দ্য শ্যাম্পেনরা আসলে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছেন না। “মাফ করবেন, কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব তাতে পাইনি। জবাবটা আমাদের দরকার। আমরা আপনাদের জীবন বাঁচিয়েছি এজন্য না, দয়া করে মানবতার স্বার্থে আমাদেরকে ব্যাপারটা জানান। হাজার হাজার মানুষের জীবন মরণ নির্ভর করছে এর ওপর। হয়তো আপনারাই বাঁচাতে পারবেন তাদের। প্লিজ সত্যিটা বলুন।”
ইটিয়েনকে দেখে মনে হলো কথাটায় তিনি আহত হয়েছেন। পাথরের মতো মুখ করে বসে রইলেন। নিকোল জামার কোণা ধরে পাচাতে আর খুলতে লাগলেন।
কার্ট উঠে ফায়ারপ্লেসের পাশে একটা জায়গায় গিয়ে বসলো। বুড়োবুড়ি ভাবুক কি বলবে। আগুনের ঠিক পাশেই একটা বড় চিত্রকর্ম। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ব্রিটিশ নৌবহর বন্দরে নোঙ্গর করা একটা ফরাসি যুদ্ধ জাহাজের ওপর আক্রমণ করছে।
কার্ট নীরবে ছবিটা দেখতে লাগল। বর্তমান পরিস্থিতি আর ইতিহাস মিলিয়ে হঠাৎ-ই বুঝে ফেলল কিসের ছবি এটা : নীলনদের যুদ্ধ।
“The boy stood on the burning deck,
whence all but he had fled;
The flame that lit the battle’s wreck
Shone round him o’er the dead.”
কার্ট ফিসফিস করেই চরণগুলো আবৃত্তি করল, কিন্তু রেনাটা শুনে ফেলল।
“কি এটা?”
“কাসাবিয়াঙ্কা” কার্ট বলল। “ইংরেজ কবি ফেলিসিয়া হেমানস-এর বিখ্যাত কবিতা। কবিতাটা ১২ বছরের এক ছেলেকে নিয়ে। সে ছিল লরিয়েন্টের কমাণ্ডারের ছেলে। যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সে নিজের জায়গা ছেড়ে একচুলও নড়েনি। শেষমেশ গানপাউডারে আগুন লেগে জাহাজটা বিধ্বস্ত হয়।”
কার্ট ইটিয়েনের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, “এটা আবু বকর বন্দর তাই না?”
“হ্যাঁ, আপনি আপনার ইতিহাস জানেন। কবিতাও।” ইটিয়েন জবাব দিলেন। “একজন ফরাসি অভিজাতের বাসায় ছবিটা ঠিক মানানসই না। আমাদের মাঝে বেশির ভাগই আমাদের পরাজয়গুলোকে স্মরণ করতে চাই না।” কার্ট বলল।
“আমার করার কারণ আছে।”
ছবিটার নিচের কোণায় আঁকিয়ের নাম স্বাক্ষর করা : এমিল দ্য শ্যাম্পেন।
“আপনার পূর্ব-পরুষ?”
“হ্যাঁ, উনি নেপোলিয়নের বিজ্ঞসভার সদস্য ছিলেন। উনিই মিসরীয় রহস্য সমাধানের আশায় নেপোলিয়নের সাথে এসেছিলেন।”
“যদি উনি এটা এঁকে থাকেন, তাহলে উনি যুদ্ধের পরও বেঁচে ছিলেন। উনি নিশ্চয়ই বেশ কিছু ভনিয়ার এনেছিলেন সাথে।” কার্ট বলল। দ্য শ্যাম্পেন দম্পতি আবার দৃষ্টি বিনিময় করলেন। শেষমেশ নিকোল মুখ খুললেন, “ওদের বলে দাও ইটিয়েন। আমাদের আর কিছু লুকানোর নেই।”
ইটিয়েন মাথা ঝাঁকালেন, তারপর হাতের গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে সেটা নামিয়ে রাখলেন। “এমিল যুদ্ধটা থেকে বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন আর সেটা স্মরণ করেই ছবিটা আঁকেন। কোণায় উনার স্বাক্ষরের ঠিক উল্টো পাশেই একটা ছোট সাম্পান দেখা যাচ্ছে। ওটাতেই ছিলেন উনি। যুদ্ধ শুরুর পর তারা লরিয়েন্টে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।”
“আমার ধারণা তারা শেষ পর্যন্ত লরিয়েন্টে পৌঁছতে পারেন নি।” কার্ট বলল।
“না। তারা আরেকটা জাহাজে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এটার নাম আপনাদের ভাষায় উইলিয়াম টেল বা ফরাসি ভাষায় গুইলামো টেল।”
কার্ট তার জীবনের অর্ধেকটাই নৌ-যুদ্ধ সম্পর্কে পড়াশোনা করে কাটিয়েছে। নামটা ওর পরিচিত, “গুইলামো টেল হচ্ছে অ্যাডমিরাল ভিয়েনেভ-এর জাহাজ।”
“রিয়ার অ্যাডমিরাল পিয়েরে-চার্লস ভিয়েনেভ ছিলেন নৌ-বহরের সেকেন্ড ইন কমান্ড। সেদিন তার দায়িত্বে ছিল চারটা জাহাজ। কিন্তু যুদ্ধে তার সঙ্গীদের অবস্থা সঙ্গিন হয়ে পড়লেও তিনি যুদ্ধে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান।”
এটিয়েন সামনে এগিয়ে এসে অন্য জাহাজগুলো থেকে দূরবর্তী একটা জাহাজ দেখিয়ে বলেন, “এটা হলো ভিয়েনেভের জাহাজ। সব দেখেও চুপচাপ বসেই আছে। সকাল হতেই যুদ্ধের গতি তাদের প্রতিকূলে থাকলেও স্রোতের গতি তাদের অনুকূলেই ছিল। ভিয়েনেভ তাই নোঙ্গর তুলে জাহাজ সেদিকে ভাসিয়ে দেন। তার চারটা জাহাজ আর আমার পর-দাদার পর-দাদাকে নিয়ে পালিয়ে আসেন।”
এতটুকু বলে তিনি চিত্রকর্ম থেকে মুখ ঘুরিয়ে কার্টের দিকে তাকালেন, “সত্যি কথা হলো সব সময়ই আমার ভেতর ভিয়েনেভের কাজটার ব্যাপারে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করে। একদিকে তার কাজটার কারণেই ফরাসিদের সাহস আর esprit de corps যেমন হাসির পাত্র হয়েছে। আবার উনি সেদিন পালিয়ে আসলে হয়তো আমি আজ পৃথিবীতে থাকতাম না।”
“অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি না নেয়াটাই সাহসের পরিচয়।” রেনাটা বলল কথাটা। “তবে আমি নিশ্চিত যে বহরের বাকিরা ব্যাপারটা এভাবে ভেবে দেখেননি।”
“না, তারা ব্যাপারটা সহজভাবে নেয়নি।” ইটিয়েন বললেন।
কার্ট মনে মনে খণ্ডগুলো জোড়া দিচ্ছে। মনের ভাবনাকেই জোরে জোরে বলল, “যুদ্ধের পর ভিয়েনেভ মাল্টা ফিরে আসেন। আর তারপর ব্রিটিশরা যখন দ্বীপটা দখল করে তখন তাদের হাতে বন্দী হন।”
“ঠিক।” ইটিয়েন বললেন।
“আমি সাধারণত এসব নৌ-বিজয় গাথা শুনতে খুবই পছন্দ করি।” জো বলল, “কিন্তু আপনার পূর্বপুরুষের কথাটা আর একটু বলা যায়? মিসরে উনি কী খুঁজতে গিয়েছিলেন?”
“অবশ্যই।” ইটিয়েন জবাব দিলেন, “তার ডায়রি থেকে যতটুকু জেনেছি তা হলো উনি মিসরের বেশ কিছু মন্দির আর স্থাপনায় অভিযান চালান। বিশেষ করে ফারওদের যেখানে সমাহিত করা হয় সেসব জায়গায়। আর উদ্ধার অভিযান মানে হলো। নেপোলিয়নের লোকজন বহনযোগ্য যা কিছু পেতো সব কিছু তুলে নিয়ে আসতো : চিত্রকর্ম, লিপি, ওবেলিস্ক খোদাই কর্ম, সব। দরকার হলে দেয়াল থেকে খুলে খুলে আনতে। তারপর সেগুলো পাঠিয়ে দিতে লরিয়েন্টে। দুর্ভাগ্যক্রমে উদ্ধার করা জিনিসের প্রায় সবই লরিয়েন্টেই ছিল। সেগুলো সহ-ই ওটা বিস্ফোরিত হয়।”
“প্রায় সব, তবে সব না।” কার্ট বলল।
“অবশ্যই ঠিক ধরেছেন,” ইটিয়েন বললেন। “শেষ চালানটা আমার দাদার সাথেই ছিল। সাম্পানের মাঝির সাথে তার এনিয়ে ঝগড়াও হয়। দাদা চাচ্ছিলেন আদেশ মতো লরিয়েন্টের কমান্ডার অ্যাডমিরাল ব্রুয়েসের কাছে সব পৌঁছে দিতে। তবে ততোক্ষণে তিনটা ব্রিটিশ জাহাজ ওটাকে ঘিরে ফেলে, তাই সেটা আর সম্ভব হয়নি।”
ইটিয়েন রেনাটার দিকে তাকালেন, “আবারো অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি না নেয়াটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, তাই তারা সবচেয়ে কাছের নিরাপদ জাহাজগুলোর দিকে ছুটে যান আর মিসরীয় পুরাকীর্তি ভরা শেষ ট্যাঙ্কটা ভিয়েনেভের হাতে পড়ে যায়। আর তিনি মাল্টায় পালিয়ে আসায় এগুলো তখনকার মতো ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায়।”
“আর তারপর সেগুলো কয়েক মাস পর সোফি সি.-তে তুলে দেয়া হয়।” কার্ট বলল।
“সেরকমই ধারণা করা হয়। তবে আসল ঘটনা কেউ জানেনা। আর এসব জিনিসপত্রই আমাদের মারমুখী বন্ধুরা যে কোন মূল্যে দেখতে চাচ্ছিলো। মিসর থেকে এমিল যা যা এনেছে সব। বিশেষ করে অ্যাবাইতোস বা সিটি অফ ডেড থেকে আনা জিনিসগুলো।”
“সিটি অফ ডেড।” আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কার্ট বলল, তারপর জোর দিকে ফিরলো। ল্যাম্পেড়সাকেও জো ঠিক এই নামেই ডেকেছিল। অবশ্যই ওটা ছিল মৃতদের দ্বীপ বা প্রায় মরাদের দ্বীপ। “আচ্ছা এই পুরাকীর্তি গুলোর সাথে কী প্রাণঘাতি কোনো রহস্যময় কুয়াশার কোনো সম্পর্ক আছে?”
ইটিয়েন কেমন হতভম্ব হয়ে গেলেন সেটা শুনে। “সত্যি কথা হলো, জিনিসগুলো ব্লাক মিস্ট নামের একটা জিনিসের সাথে সম্পৃক্ত।”
কার্টও তেমনটাই ভেবেছিল।
“কিন্তু এখানেই শেষ না।” ইটিয়েন বললেন, “এমিলের অনুবাদে আরও একটা জিনিস পাওয়া যায়। ওটাকে বলে অ্যাঞ্জেলস ব্ৰেথ, নামটা অবশ্যই পশ্চিমারীতিতে করা। মিসরীয় ভাষায় এটাকে বলে মিস্ট অফ লাইফ : কুয়াশাটার উৎস এই জগৎ না, অন্য কোনো জগৎ-পরজগৎ। সেখানে দেবতা ওসাইরিস এটা যাকে ইচ্ছা আবার বাঁচিয়ে তুলতেন। আক্ষরিক অর্থে দাঁড়ায়। এই অ্যাঞ্জেল ব্রেথ মৃতদেহে আবার জীবন সঞ্চার করতে পারে।”
.
৩৮.
“মৃতদেহে জীবন সঞ্চার করতে পারে?” কার্ট আবার বলল কথাগুলো। ও সাথে সাথে বুঝে গিয়েছে পুরো ব্যাপারটা। এটাই হলো ব্লাক মিস্টের প্রতিষেধক। এটার কারণেই হ্যাগেন আর ঐ আক্রমণকারী লোকটার কোনো ক্ষতিই হয়নি। আর সবাই কোমায় চলে গেলেও।
“এটাই সেই প্রতিষেধক।” এবার মুখে বলল ও।
“প্রতিষেধক কিসের প্রতিষেধক? মরার কোনো প্রতিষেধক নেই।” ইটিয়েন বললেন।
“এক ধরনের মরার আছে।” কার্ট বলল।
“বুঝলাম না।” ইটিয়েন বললেন।
কার্ট ওনাকে ল্যাম্পেডুসার সব ঘটনা খুলে বলল। কীভাবে ওখানকার সব অধিবাসী সবাই কোমায় চলে গেছে ও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর কীভাবে ওরা একজনের মোকাবেলা করে যায় এতে কিছুই হয়নি।
“তার মানে ওরা এই প্রতিষেধকটা চায়?” নিকোল জিজ্ঞেস করলেন।
“না।” কার্ট বলল, “ওদের কাছে এটা আছে। ওরা চায় যাতে এটা আর কারো হাতে না ক। কারণ এতে ওদের অস্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়বে। আর তাই এই কাজটাই আমাদেরকে করতে হবে।”
কার্ট চারদিকের ক্ষয়ক্ষতির দিকে আরেকবার তাকাল, “আপনারা যদি আমার চেয়ে বহুগুণ বেশি সাহসী না হন–আর অবশ্যই ভালো পোকার খেলোয়াড় না হন—তাহলে আমার ধারণা পুরাকীর্তিগুলো এখানে নেই।”
“জাহাজ থেকে যা পাওয়া গিয়েছিল তার কিছুই নেই”, ইটিয়েন বললেন। “আমরা উদ্ধারকৃত জিনিসের বেশিরভাগই জাদুঘরকে দিয়ে দিয়েছি। বাকি যা ছিল তা ঐ লোকগুলো নিয়ে গিয়েছে। ওরা এমিলের ডায়রিটাও নিয়ে গিয়েছে; মানে মিসরের নাম-গন্ধ পেলেই ওরা সেটা নিয়ে নিয়েছে, ছবি, নোট সব।”
“তার মানে তো সোফি সি-তে কিছুই ছিল না।” জো বলল।
“একদম ঠিক। আমি সেকথাও ওদেরকে বলেছি।” ইটিয়েন বললেন। “জাহাজটা আবিষ্কারের পর এ-মাথা থেকে ও-মাথা খুব ভালো করেই খোঁজা হয়েছে। মূল্যবান যা কিছু ছিল সবই উদ্ধার হয়ে গিয়েছে।”
“এমন কি হতে পারে যে সব পুরাকীর্তি আসলে জাহাজে ছিল না। আপনিই তো বললেন যে আসল কথা কেউ জানে না। এটার মানে কি?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।
“রেকর্ড-পত্র থেকে জানা যায় যে সোফি সি, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত মালপত্র বহন করছিল।” ইটিয়েন ব্যাখ্যা করলেন।
“কেন?”
“আসলে সেটা ছাড়া উপায়ও ছিল না। ভিয়েনেভ এখানে এসে পৌঁছতেই আবুকির এর দুর্যোগের কথা চারদিকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। প্রতিটা ফরাসি তখন নিজেকে আর নিজের সম্পদ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠল। ফলে সবার একটাই ইচ্ছা এখান থেকে ফ্রান্সে ফিরে যাবে। সেটা সম্ভব না হলেও অন্তত তাদের অস্থাবর সম্পত্তিগুলো আগে পাঠিয়ে দেবে। আশা করি বুঝতে পারছেন অবস্থাটা কেমন ছিল। ফ্রান্সের দখলে থাকার সময়েই মাল্টার বেশির ভাগ সম্পদই ফরাসিদের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। ফলে সব জাহাজ-ই কানায় কানায় ভরে যায় মালপত্রে। একেবারে জাহাজ ছাড়ার আগ মুহূর্তেও মাল ভরা চলতো জাহাজে। কখনো কখনো জায়গা না পাওয়ায় ঘাটেই পড়ে থাকতে মাল বা অন্য কোনো জাহাজে তুলে দেয়া হতো। এসব ঝামেলার জন্যেই ধারণা করা হয়। হয়তো পুরাকীর্তিগুলো সোফি সি.-তে তোলা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু রেকর্ড করা হয়নি, আবার এটাও সম্ভব যে ওগুলো আসলে জাহাজে ভোলা-ই হয়নি। অথবা অন্য কোনো জাহাজেও তুলে দেয়া হতে পারে। রেকর্ড-পত্র অনুযায়ী ঐদিনই আরো দুটো জাহাজ বন্দর ছেড়ে যায়। একটা সোফি সি. সাথেই ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। আরেকটা ব্রিটিশরা দখল করে নেয়।”
জো বলল, “ব্রিটিশরা পুরাকীর্তিগুলো পেলে এটা এতোদিনে রোজেটা স্টোন বা এলজিন মার্বেলগুলোর পাশে কোনো না কোনো জাদুঘরে শোভা পেতো।”
“আর যদি এগুলো জাহাজেই না ভোলা হতো বা মাল্টাতে লুকানো থাকতো, তাহলে এতোদিনে ওগুলো উদ্ধার হয়ে যেতো। আমার মনে হয় এই সম্ভাবনা দুটোকে বাদ দেয়া যায়। আমার মনে হয় সবচেয়ে বেশি যেটা হওয়ার সম্ভাবনা সেটা হলে ঐ পুরাকীর্তিগুলো ঐ ডুবে যাওয়া জাহাজ দুটোর কোনো একটাতেই ছিল। কিন্তু আপনি তো বললেনই যে সোফি সি.-তে আর কিছুই নেই।”
“আমরা অন্য জাহাজটায় খুঁজে দেখতে পারি।” রেনাটা প্রস্তাব দিল।
ইটিয়েন মাথা নাড়লেন, “আমি বহু বছর ধরে ওঠা খুঁজছি।”
“যে কোনো ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া সহজ, কিন্তু নির্দিষ্ট একটা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া সহজ না।” জো ব্যাখ্যা করল। “ভূমধ্যসাগরের তলদেশ ডোবা জাহাজ দিয়ে ভরা। সাত হাজার বছর ধরে এই সাগরটায় মানুষ চলাচল করছে। ঐ রোমান জাহাজটা খুঁজে পাওয়ার মাসখানেক আগে আমরা যখন সম্ভাব্য অবস্থান খুঁজছিলাম তখন প্রায় চল্লিশটা জায়গা পেয়েছিলাম যেগুলোকে সম্ভাব্য বলে অভিহিত করা হয়েছিল।”
“আমাদের হাতে অতসময় নেই।” রেনাটা বলল।
কার্ট ওদের কথা মন দিয়ে শুনছিল না, ওর দৃষ্টি ছবিটার দিকে। কি যেন একটা ওর কাছে অসামঞ্জস্যশীল লাগছে। ধরি ধরি করেও ধরতে পারছে না। “আবুকির-এর যুদ্ধটা হয় ১৭৯৯ সালে।” কার্ট বলল।
“ঠিক!” ইটিয়েন বললেন।
“সতেরোশো নিরানব্বই…হঠাৎ-ই ও ব্যাপারটা ধরতে পারলো। “আপনি বললেন এমিলের লেখায় আপনি এই ব্লাক মিস্টের ব্যাপারটা পেয়েছেন। কিন্তু রোজেটা স্টোন (যে পাথর থেকে প্রথম মিসরীয় লিপির পাঠোদ্ধার করা হয়) আর ঈজিলিয়ান হায়ারোগ্লিফের অর্থ আবিষ্কার তত আরো প্রায় পনের বছর পরে হয়।”
ইটিয়েন থেমে গেলেন। দেখে মনে হলো চিন্তাটা তাকে দারুণ দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে, “কি বলতে চাচ্ছেন আপনি?–এমিলের অনুবাদের ব্যাপারটা ভুয়া?”
“খোদা করুন, সেটা যেন না হয়। কিন্তু রোজেটা স্টোন আবিষ্কারের এতো দিন আগেই যদি পুরাকীর্তিগুলো ডুবে যায়, তাহলে ওতে কি লেখা ছিল সেটা জানা সম্ভব কি করে?” কার্ট বলল।
এমিলকে দেখে মনে হলো তিনি বলবেন কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেটা চেপে গেলেন, “এটা…এটা সম্ভব না। কিন্তু…আমি শুধু জানি এমনটাই হয়েছে।”
.
৩৯.
দ্য চ্যাম্পিয়নের পড়ার ঘরের দরজাটা ভেঙে একপাশে ঝুলছে। উনি সেটাকে পাত্তা না দিয়ে ঢুকে পড়লেন ভেতরে। বাকিরাও ঢুকলে পিছু পিছু।
ইটিয়েন ভেতরে ঢুকেই এক কোণায় একটা ছোট আলমিরার দিকে এগিয়ে গেলেন। কাত হয়ে পড়ে আছে সেটা।
“এখানে।” ডাকলেন সবাইকে। “হঠাৎ করেই একটা জিনিস আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। বহুদিন ধরে ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে মরেছি।”
কার্ট আর জো ওনাকে সাহায্য করল ভারি আলমিরাটা সোজা করতে। সাথে সাথেই দ্য চ্যাম্পিয়ন ওটার ভেতর ঘাটাঘাটি আরম্ভ করলেন।
“ওরা এটা থেকে তেমন কিছু নেয়নি।” সাবধানে একটা একটা কাগজ বের করতে করতে বললেন ইটিয়েন। উনি একটা একটা কাগজ বের করছেন তারপর এক নজর দেখেই পাশে রেখে দিচ্ছেন। “ওদের লক্ষ্য ছিল শুধু পুরাকীর্তিগুলো ও এমিলের মিসরে থাকাকালীন আঁকা ছবি আর নোটপত্র। বাকিগুলোর প্রতি ওদের তেমন আগ্রহ ছিলো না। কারণটা কী বলেন তো?”
বিদ্রূপের একটা হাসি হেসে বললেন ইটিয়েন, “কারণ ওরা ফ্রেঞ্চ পড়তে পারে না। বেকুবের দল!”
কার্ট আর জো পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করল। ওরাও ফ্রেঞ্চ পড়তে পারে না। তবে সেকথা মুখে বলল না।
ইটিয়েন তখনো খুঁজেই চলেছেন। তারপর একটা ফাইল মতো বের করলেন। ভেতরে এক তাড়া পুরনো কাগজপত্র।
“পেয়েছি।” উনি কাগজগুলো নিয়ে টেবিলে আসতেই কার্ট মেঝে থেকে একটা ল্যাম্প তুলে এনে জ্বেলে দিল। তারপর পুরো দলটাই হামলে পড়ল কাগজগুলোর ওপর। জিনিসটা একটা হাতে লেখা চিঠি।
ইটিয়েন সবার জন্যে অনুবাদ করে শোনালেন সেটা। “প্রিয় বন্ধু এমিল, আপনার চিঠি পেয়ে খুব ভাল লাগছে। ট্রাফালগারের সেই দুর্দশা আর ব্রিটিশদের কাছে বন্দী থাকার পর আমি আবার আমার সম্মান ফিরে পাবো ভাবিনি।”
“ট্রাফালগার?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।
কার্ট ব্যাখ্যা করল, “আবুকির বন্দর ছাড়াও, ভিয়েনেভ ট্রাফালগারের যুদ্ধেও ফ্রেঞ্চ নৌ-বহরের দায়িত্বে ছিলেন। সেখানে নেলসন ফ্রান্স আর স্পেনের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে প্রমাণ করেন ইংল্যান্ডকে দখল করার ক্ষমতা কারো নেই। এরপর নেপোলিয়নের ইংল্যান্ড আক্রমণের যেটুকু ইচ্ছা ছিল সেটুকুও চলে যায়।”
ব্যাপারটায় রেনাটা দারুণ চমৎকৃত হয়েছে বোঝা যায়। আমি যদি ভিয়েনেভ হতাম তাহলে ব্রিটিশদের সাথে বিশেষ করে নেলসনের সাথে যেকোনো যুদ্ধ আমি এড়িয়ে চলতাম।”
জো হাসলো, “লোকটা নিশ্চয়ই নেলসনকে মারাত্মক ঘৃণা করতো।”
“আসলে তিনি ইংল্যান্ডে বন্দী থাকা অবস্থায় নেলসনের শেষকৃত্যেও যোগ দিয়েছিলেন।” ইটিয়েন বললেন।
“সম্ভবত আসলেই মরেছে কি-না সেটা দেখতে গিয়েছিলেন।” রেনাটা বলল। ইটিয়েন আবার চিঠি পড়ায় মন দিলেন, “আপনি প্রায়ই বলেন যে, জাহাজ নিয়ে নীল নদ থেকে পালিয়ে আসার মাধ্যমে আমি আপনার জীবন বাঁচিয়েছি। একথা বললেও ভুল হবে না যে আপনিও একই কাজের মাধ্যমে তার প্রতিদান দিয়েছেন। এই সুযোগে আমি আরো একবার নেপোলিয়নের সাথে দেখা করবো। আমার বন্ধুরা অবশ্য বলেছে যে নেপোলিয়ন নাকি আমাকে জীবিত দেখতে চান না। কিন্তু আমি যখন এই মহা অস্ত্র-মৃত্যুর কুয়াশা–তার হাতে তুলে দেবো তখন তিনি আমার দুই গালে চুমু খেয়ে পুরস্কৃত করবেন। আর আমি পুরস্কৃত করবো আপনাকে। তবে সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার হলো আমরা বাদে কথাটা যেন আর কেউ না জানে। তবে আমি আমার ইজ্জতের কসম খেয়ে বলছি, বিজ্ঞ হিসেবে আপনার পাওনা আপনি পাবেন এবং বিপ্লব আর সাম্রাজ্যের দুটোরই নায়ক হিসেবে প্রাপ্য সম্মানও আপনাকে দেয়া হবে। আপনার পাঠানো আসল আর সামান্য রূপান্তরিত দুটোই আমার কাছে আছে। দয়া করে দ্রুত অ্যাঞ্জেলস ব্রেথ বানানো শেষ করে আমাকে পাঠান যাতে করে আমাদের শত্রুরা এই বিষে আক্রান্ত হলেও আমরা নিরাপদ থাকি। বসন্তের দিকে সম্রাটের সাথে দেখা করবে বলে আশা রাখি। এবার পাওনা শোধ করবো। ২৯ থার্মিডোর, সাল 13, পিয়েরে চার্লস ভিয়েনেভ।”
“রূপান্তরের আরেক অর্থ কিন্তু অনুবাদও হয়।” রেনাটা বলল। “এই ঘটনাটা কখনকার?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।
রেনাটা বের করার চেষ্টা করল সালটা। নেপোলিয়নের অদ্ভুত ক্যালেণ্ডারটার পুরোটা মনে আসছে না। তার শাসনামলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডারের বদলে এই ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হতো। “১৩ সালের ২৯ থার্মিডর মানে হলো…”
ইটিয়েন এর আগে বের করে ফেললেন, “১৭ আগস্ট, সালটা হলো ১৮০৫।”
“সেটাও তো রোজেটা স্টোনের রহস্যভেদের এক যুগ আগে।” কার্ট বলল।
“অবিশ্বাস্য জো বলল। “আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে, কিছু কিছু লোক শব্দটার অর্থ বোঝে হলো বিশ্বাসযোগ্য না।”
“এমিলের ডায়রিটা পাওয়া গেলেই সব প্রমাণিত হয়ে যেতো।” ইটিয়েন বললেন, ভেতরে অনেক ছবি, হায়ারোগ্লিফ আর সম্ভাব্য অনুবাদ লেখা ছিল। এমনকি একটা ছোট ডিকশনারীর মতোও বানিয়েছিলেন উনি। কিন্তু এই সময়ের আগে পরের ব্যাপারটা কখনো আমি ধরতে পারিনি।”
কার্ট জানে যে এরকমই হয়। ইতিহাস যুগে যুগে বদলে যায়। একসময় চোখ বুজে সবাই মানতো যে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু এখন স্কুলে পড়ানো হয় যে ভাইকিংসরা তার বহু আগেই কাজটা সেরে ফেলেছিল।
“তাহলে এই ব্যাপারে ওনার কোনো নাম শোনা যায় না কেন?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।
“সম্ভবত ভিয়েনেভ তাকে এটা গোপন রাখতে বলছিলেন।” কার্ট অনুমান করল। “এটা নতুন একটা অস্ত্র আবিষ্কার সংক্রান্ত ব্যাপার। এসব ব্যাপার ফাস হোক তা কেউই চাইবে না।”
“তার ওপর তখন ব্রিটিশরা মিসরের নিয়ন্ত্রণে ছিল আর একজন ফ্রেঞ্চ অ্যাডমিরালের সাথে এমিলের বন্ধুত্ব নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ করতো ওরা।” ইটিয়েন বললেন। “আসল ব্যাপারটা…” উনি অন্য চিঠিগুলোও ঘাটা শুরু করলেন।
“এখানেই কোথাও আছে।”
“কি আছে এখানে?”
“এটা…” আরেকটা কাগজ তুলে বললেন ইটিয়েন, “এটা হলো ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক এমিলের বিদেশ ভ্রমণের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা। ১৮০৫ সালের শুরুর দিকে তিনি আবারো মিসর ফিরে গিয়ে গবেষণা শুরু করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। মাল্টার প্রাদেশিক গভর্নর সেটা অনুমোদন করলেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সেটা নাকচ করে দেয়।”
কার্ট চিঠিটা দেখলো। দেখেই বোঝা যায় অফিসিয়াল চিঠি, “আমরা এই মুহূর্তে মিসরের ভেতরে আপনার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারবো না।” পড়ল কার্ট। “উনি যেতে চাচ্ছিলেন কোথায়?”
“জানি না।” ইটিয়েন বললেন।
“ইশ! জানতে পারলে কাজে দিতো,” রেনাটা বলল।
“উনি আর কখনো চেষ্টা-চরিত্র করেননি।” কার্ট জিজ্ঞেস করল।
“না, দুঃখের বিষয় হলো সেই সুযোগই পাননি। এর কিছুদিনের মাঝেই তিনি আর ভিয়েনেভ দুজনেই মারা যান।”
“দুজনেই?” সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করল জো, “কীভাবে?”
“এমিল স্বাভাবিকভাবেই মারা যান। মাল্টাতেই। ঘুমের মাঝে মারা যান তিনি। ধারণা করা হয় তার হার্টে সমস্যা ছিল। রিয়ার অ্যাডমিরাল ভিয়েনেভ মারা যান একমাস পর ফ্রান্সে। তার মৃত্যুটা অবশ্য এরকম স্বাভাবিক ছিল না। তার বুকে সাতবার ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। সেটাকে আত্মহত্যা বলে রায় দেয়া হয়।”
‘আত্মহত্যা? সাতবার ছুরি মেরে? আমি বহু সন্দেহজনক রিপোর্ট পড়েছি কিন্তু এটা তো পুরোই হাস্যকর।” রেনাটা বলল।
ইটিয়েনও সম্মতি জানালেন, “বিশ্বাস করা শক্ত। এমনকি সেই সময়েও এটা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে।
“ভিয়েনেভের না বসন্তে সম্রাটের সাথে দেখা করার কথা ছিল?”
ইটিয়েন মাথা ঝাঁকালেন, “হ্যাঁ। আর বেশির ভাগ ইতিহাসবিদেরই ধারণা অ্যাডমিরালের মৃত্যুর পিছনে নেপোলিয়নের হাত আছে। হয় তিনি ভিয়েনেভের কথা বিশ্বাস করেননি। অথবা হয়তো তাকে শেষ পর্যন্ত ক্ষমা করতে পারেননি।”
দুটোই হতে পারে বলে কার্টের মনে হলো। তবে ওর দরকার হচ্ছে মিসরীয় লিপির সেই আনুবাদগুলো। “যদি ভিয়েনেভের কাছে তখন অনুবাদটা থেকে থাকে তাহলে তার মৃত্যুর পর সেগুলোর কী হয়? উনার সহায় সম্পত্তির কী করা হয়েছিল জানেন নাকি?”
ইটিয়েন কাধ নাচালেন। “আমি আসলে নিশ্চিত না। ফরাসি নৌবাহিনীর বেইজ্জত অ্যাডমিরালদের কোনো জাদুঘর নিশ্চয়ই নেই। আর শেষ দিকে এসে ভিয়েনেভ একেবারেই কপর্দকহীন হয়ে পড়েন। বেনের একটা বোর্ডিং-এ থাকতেন। সম্ভবত মারা যাওয়ার পর বাড়িওয়ালাই সবকিছুর দখল নিয়ে নেয়।”
“এমনও তো হতে পারে যে ভিয়েনেভ নেপোলিয়নকে অনুবাদটা দেয়ার পরই তাকে খুন করা হয়। রেনাটা বলল।
“কেন যেন আমার সেটা মনে হয় না। কার্ট বলল, “ভিয়েনেভ খুবই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন লোক ছিল। জীবনের প্রতিটা বিপদ সে দক্ষতার সাথে কাটিয়ে এসেছে।”
“শুধু যখন ট্রাফালগারে নেলসনের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল তখন বাদে।” জো মনে করিয়ে দিল।
“হ্যাঁ, তবে সেখানেও কিন্তু তার সব পদক্ষেপ মাপা-ই ছিল।” কার্ট জবাব দিল, “যতদূর মনে পড়ে উনার কাছে খবর পৌঁছেছিল যে নেপোলিয়ন তাকে আর চাচ্ছেন না। আর সম্রাটের কাছে গেলেই তাকে গ্রেফতার, জেল এমনকি গিলেটিনে পর্যন্ত দিতে পারেন। এতকিছু বিবেচনা করেই কিন্তু ভিয়েনেভ তার শেষ চালটা চালেন। তিনি যুদ্ধ করতে গেলেন। খুব ভালোই জানতেন যদি যুদ্ধে জয় হয় তাহলে তিনি বীর হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং বাকি সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবেন। আর যদি তিনি হারেন তাহলে হয় মারা যাবেন না হয় ব্রিটিশদের হাতে বন্দী হবেন। সেক্ষেত্রে তাকে নিরাপদে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হবে। সেটাই কিন্তু হয়েছিল।”
“সর্বস্ব দিয়ে বাজি ধরা। জিতলে সব ফেরত পাবে, হারলে সব যাবে।” জো বলল। “চালটা কিন্তু ভালোই খেলেছিলেন। ব্রিটিশরা আবার তাকে ফ্রান্স ফেরত পাঠিয়েই গোলমালটা বাধালো।” রেনাটা মন্তব্য করল।
“সব চাল তো আর জেতা যায় না। তবে লোকটার চিন্তাধারা আর প্রতি পদক্ষেপে যে ধূর্ততা উনি দেখিয়েছেন। তাতে আমার মনে হয় না যে নেপোলিয়নের সাথে দেখা করেই ওনার একমাত্র বাঁচার অবলম্বনটা তার হাতে তুলে দেবেন। বরং নেপোলিয়নকে জিনিসটার সামান্য অংশ দেখিয়ে লোভ লাগাবেন আর বাকিটা কোথাও লুকিয়ে রাখাটাই তার সাথে যায়। কারণ একমাত্র এটাই তার জীবন রক্ষা করতে পারতো।” কার্ট বলল।
“তাহলে নেপোলিয়ন ওনাকে মারলেন কেন?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।
“কে জানে? হয়তো ভিয়েনেভের কথা তার বিশ্বাস হয়নি। হতো প্রতিবার অ্যাডমিরালের এসব বকোয়াজ শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। ভিযেনেভের কারণে তাকে বহুবার বেইজ্জত হতে হয়েছে। আর হয়তো সহ্য হয়নি।” কার্ট অনুমান করল।
জো পুরো ব্যাপারটা সংক্ষেপে একবার বলল, “তাই ভিয়েনেভের হাত থেকে বাঁচার জন্যে নেপোলিয়ন তাকে মেরে ফেললেন। ভিয়েনেজের প্রস্তাবটা ভেবেও দেখলেন না বা বিশ্বাস করলেন না। আর তার ফলে ঐ ভাষান্তর আর মিস্ট অফ ডেথ আর মিস্ট অফ লাইফের সব কিছু হারিয়ে গেল। তারপর আর এই শয়তানগুলো সেগুলো কোথাও থেকে বের করেছে।”
“সেরকমটাই ধারণা আমার।” কার্ট বলল।
পরের প্রশ্নটা করল রেনাটা, “তাহলে যদি ভিয়েনেভ নেপোলিয়নকে ভাষান্তরটা না-ই দিয়ে থাকে তাহলে ওটা গেল কোথায়?”
“সেটাই আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে।” বলল কার্ট। তারপর ইটিয়েনের দিকে ফিরলো। “কোথা থেকে খোঁজা শুরু করলে ভালো হয় বলতে পারেন?” ইটিয়েন চুপচাপ কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর বললেন, “রেনেস?”
যদিও কথাটা প্রশ্নবোধক সুরে বলা, তবে কার্টের মাখাতেও এটার কথাই ঘুরছিল। তাই ও মাথা ঝাঁকালো। তারপর বলল, “আমাদের সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। আমাদেরকে তাই ভাগ ভাগ করে একেক জায়গায় খুঁজতে হবে। দক্ষিণ মিসরে খুঁজতে হবে এই মিস্ট অফ লাইফের কোনো হদিস পাওয়া যায় কি-না আর ফ্রান্সে খুঁজতে হবে ভিয়েনেভ এমিল দ্য চ্যাম্পিয়নের ভাষান্তরটা কোথাও লুকিয়ে রেখেছিলেন কি-না।
“আমরা ফ্রান্সে যেতে পারি।” ইটিয়েন বললেন।
“স্যরি, আমরা আর আপনাদেরকে কোনো বিপদে জড়াতে পারবো না। রেনাটা আপনি-ই এ কাজটা ভালো পারবেন।” কার্ট বলল।
রেনাটা ঐ মুহূর্তে ওর ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল। মাত্র একটা মেসেজ এসেছে সেটা পড়ছে। সেখান থেকে মুখ তুলে বলল, “মোটও না। আমি জানি আপনি শুধু আমাকে ঝামেলা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছেন। তবে আসল ব্যাপার হলো, আমার কাছে নতুন খবর আছে : AISE আর ইন্টার পোল মিলে এ সায়ানাইড খাওয়া লোকটার পরিচয় বের করেছে। লোকটা মিসরীয় গোয়েন্দা বাহিনীর এক দল ছুট রেজিমেন্টের সদস্য। এরা হচ্ছে মোবারক সরকারের সমর্থক এবং অনেক অপরাধের জন্য সন্দেহ ভাজন।”
“তার মানে মিসর-ই হচ্ছে আসল জায়গা।” কার্ট বলল।
“আরো একটা সুখবর আছে।” রেনাটা বলল, “মাল্টায় থাকার সময় লোকগুলো যে স্যাটেলাইট ফোনে কথা বলেছিল সেটার সিগনাল ট্রাক করা গিয়েছে। কলটা করা হয়েছিল ঠিক এখান থেকে। আর দুর্গে আপনারা মারামারি করার সময় করা হয়েছিল বন্দর থেকে। ফোনটা এখন আছে কায়রো। আর আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে ফোনটা যার কাছে আছে তাকে খুঁজে বের করতে।”
“কার্টের ধারণা ফোনটা থাকে হাসানের কাছে।” ঠিক আছে। “আমি যাবো আপনার সাথে।”
“তার মানে আমাকেই যেতে হচ্ছে ফ্রান্সে। জো বলল, “ব্যাপার না। ঐ দেশে ঘুরতে যাওয়ার শখ বহুদিন ধরেই। ওখানকার ওয়াইন আর পনির খেয়ে দেখতে হবে।”
“স্যরি, প্যারিসে গ্রীষ্ম যাপন পরের বারের জন্যে তুলে রাখো। তুমিও আমাদের সাথেই যাচ্ছ।” কার্ট বলল।
“তাহলে ফ্রান্স যাবে কে?”
“পল আর গামায়। ওদের ছুটি আরো দুদিন আগে শেষ হয়েছে। কাজে যোগদানের সময় এখন।”
.
৪০
বেনগাজী, লিবিয়া
সারা শহর জুড়েই চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। এদিকে পানিও কমে এসেছে। মারাত্মকভাবে। আরেকটা গৃহযুদ্ধ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ওরা যখন পৌঁছুলো তখন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তিল ধারণের জায়গা নেই। কেউ ছুরি খেয়েছে কেউ খেয়েছে পিটুনি। আর গুলি খাওয়ারা তো আছেই।
পল আর গামায় বহুকষ্টে এক কোণে একটু জায়গা বের করে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরই লিবিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার এক লোক ওদের সাথে যোগ দিল। পরের এক ঘন্টা ওদের জেরা করা হলো। ওরা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করল যে ওরা ওখানে কি করছিল আর ওদের লক্ষ্য ছিল জলাধারের পানির কি হচ্ছে সেই রহস্য উদ্ধারে রেজাকে সাহায্য করা। শেষমেশ কেন ওরা পালিয়েছে সেই ঘটনাও বলল।
তবে লোকটা ওদের কথা বিশ্বাস করছে বলে মনে হলো না। সে শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে আর হুম হুম করে নোট নিয়েই গেল। যদিও স্টেশনের বাকি কর্মচারীরাও ওদের কথার সমর্থনই দিয়ে গেল। লোকটার মূল আগ্রহ ছিল বিদ্রোহীদের আক্রমণের ধরন আর ওদের পালানো নিয়ে।
চারপাশে অস্বস্তিকর নীরবতা। মাঝে মাঝে শুধু আরেকদল আহত লোককে যখন রাস্তা থেকে তুলে আনা হয় তখন-ই একটু হট্টগোল হচ্ছে। সরকারি লোকটা ওদের দিকে শুরু থেকেই কেমন সাবধানী চোখে তাকিয়ে আছে।
“এই সব শুরু হলো কখন?” গামায় জিজ্ঞেস করল। হাসপাতালের এই ভরপুর দশা দেখে অবাক হয়েছে খুব। হাসপাতালের এই ভরপুর দশা দেখে অবাক হয়েছে খুব।
“সরকার শহরের কয়েকটা জায়গায় পানির সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়েছে। তারপর থেকেই শুরু হয় আন্দোলন। শুরুতে শান্তভাবে হলেও আজ বিকেলে এরা ভাঙচুর শুরু করে। ভাগ করে করে পানি বিতরণ শুরু হয় কিন্তু তাতে কি আর হয়। মানুষও তখন বেপরোয়া। আর একজন আছে যে এই সব কিছু উস্কে দিচ্ছে।”
“একজন?” পল জিজ্ঞেস করল।
“লিবিয়া এখন বাইরের লোক দিয়ে রা। আমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ আছে যে আমাদের দেশে এখন মিসরীয় গুপ্তচর দিয়ে গিজগিজ করছে। কিন্তু কেন? তার উত্তর আমাদের জানা নেই। দিনকে দিন এটা বাড়ছেই।” এজেন্টটা জানালো।
“আচ্ছা, এজন্যই আপনি আমাদেরকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। আপনার ধারণা আমরাই রেজাকে কিছু করেছি?” গামায় বলল।
“গত মাসেও একবার তাকে মারার চেষ্টা করা হয়। তার অবশ্য কারণও আছে। পানির অবস্থা যদি কেউ আবার আগের মতো করতে পারে তো রেজা-ই পারবে। দেশের ভূতত্ত্ব আর এসব সিস্টেম সম্পর্কে ওনার চেয়ে ভালো কেউ জানেনা। উনি না থাকলে আমাদের কি হবে তা শুধু খোদাই-ই জানে।” এজেন্ট বলল।
“আমরা শুধু ওনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি।” গামায় বলল।
“দেখা যাবে সেটা।” এজেন্ট জবাব দিল। এখনো সন্দিহান সে।
ওর কথা শেষ হতেই অপারেশন রুম থেকে একজন সার্জন বের হয়ে ওদের দিকে তাকালো। তারপর মুখোশ খুলতে খুলতে ক্লান্ত পদক্ষেপে ওদের দিকে এগুলো। তার চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে টানা কাজ করেই যাচ্ছেন ডাক্তার।
“প্লিজ একটা ভালো খবর শোনান।” গামায় বলল।
“রেজার বিপদ আপাতত কেটে গিয়েছে। উনার উরুতে একটা বুলেট বিধেছিল আর একটা লিভারে আচড় কেটে বেরিয়ে গিয়েছে। ভাগ্য ভালো যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গে কিছু হয়নি। সৌভাগ্য ক্রমে অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে বলাই ভালো–আমাদের সার্জনরা এসব সামলাতে সামাতে দক্ষ হয়ে গিয়েছে। গৃহযুদ্ধে ভালো বলতে এই একটা কাজ হয়েছে।” বললেন সার্জন।
“ওনার সাথে কথা বলা যাবে কখন?” গামায় জিজ্ঞেস করল।
“মাত্রই জ্ঞান ফিরেছে। কমপক্ষে আধাঘণ্টা তো অপেক্ষা করুন।”
এজেন্ট লোকটা নিজের আইডি কার্ড বের করে বলল, “আমি এখুনি ওনার সাথে দেখা করবো।”
“ঠিক হবে না কাজটা।” ডাক্তার বললেন।
“উনার চেতনা কী পুরোপুরি আছে?
“হ্যাঁ।”
“তাহলে আমাকে নিয়ে চলুন।”
সার্জন হতাশ হয়ে একটা শ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে আসুন। তবে তার আগে একটা গাউন পরতে হবে।”
সার্জন আর এজেন্ট চলে যেতেই গামায় এর ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে নামটা দেখেই বলল, “কার্ট ফোন করেছে। ছুটি শেষ হলেও অফিসে যাইনি কেন সেই কৈফিয়তই চাইবে মনে হয়।”
পল চারদিকে একবার তাকিয়ে ব্যালকনির দিকে হাঁটা দিল, “একটু বাতাস খেয়ে আসি চলল।”
বাইরে এসেই গামায় ফোন রিসিভ করল।
“কি খবর? ছুটি কেমন কাটচ্ছে? কাৰ্ট জিজ্ঞেস করল।
রাতের বাতাস হালকা আর উষ্ণ। ভূমধ্যমাগরের সুবাস মিশে আছে তাতে। কিন্তু হেলিকপ্টর আর দূরের গোলাগুলির শব্দই পুরো পরিবেশটা নষ্ট করে দিচ্ছে।
“যতটা ভেবেছিলাম ততোটা মজা হচ্ছে না।” গামায় বলল।
“আহারে।” তা ফ্রান্সে আরেকবার হানিমুনে যাবে নাকি? টাকা-পয়সা যা লাগে NUMA দেবে।” কার্ট বলল।
“শুনতে তো ভালোই লাগে। তবে তার সাথে একটা কিছু নিশ্চিত আছে।” “একটা কিছু তো সব সময়ই থাকে।”
পল সেটা শুনে বলল, “ওকে বলল যে আমাদের ওখানে থাকা দরকার।” গামায় মাথা ঝাঁকালো, “আচ্ছা কয়েকদিন পরে গেলে হবে না? আমরা এখানে একটা কাজে জড়িয়ে পড়েছি। এই ব্যাপারটাও আর একটু ঘেটে দেখা দরকার।”
“কোন ব্যাপার?”
“উত্তর আফ্রিকার খরা।”
কার্ট এক মুহূর্ত চুপ থাকল, “সাহারাতে তো খরা-ই থাকার কথা।” “না। এটা সেটা না। বৃষ্টি হচ্ছে না বলে যে খরা হয় এটা সেরকম না। মাটির নিচের পানি শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে ধরা। এদিককার সব লেক কাদা ভরা ভোবায় পরিণত হয়েছে। যুগ যুগ ধরে যেসব পাম্প চলছিল যেসব হঠাৎ করে পানি পাচ্ছে না আর।”
“এরকম তো কখনো শুনিনি।” কার্ট বলল।
“এটার জন্যে দেশে এর মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে গিয়েছে। সামনে আরো কি হবে কে জানে। গামায় বলল।
“শুনে খারাপ লাগছে। তবে অন্য কাউকে পাঠাতে হবে ওখানে। ফ্রান্সে তোমাদেরকে দরকার। বেনগাজী থেকে রেনে পর্যন্ত একটা ফ্লাইট চাটার্ড করা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব চলে আসো।”
“এত তাড়া কেন জানতে পারি?”
“বিমানে ওঠা মাত্র সব জানিয়ে দেয়া হবে।” কার্ট বলল।
ফোন হাত দিয়ে ঢেকে গামায় পলকে বলল, “বড় কোনো ঝামেলা বেঁধেছে বোধ হয়। কার্ট তো কখনো এতো জোরাজুরি করে না।”
পল ওদের জেরা হওয়ার জায়গাটার দিকে একবার তাকাল, “এখন আমাদেরকে শহর ছাড়ার অনুমতি দিলে হয়।”
গামায়ও সেটাই ভাবছিল। আবার ফোন কানে লাগালো, “এখানে সরাসরি লোকজনের সাথে একটু ঝামেলা হচ্ছে। লম্বা কাহিনী। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা চলে আসছি।”
“কি হয় জানিও। কারণ তোমরা আসতে না পারলে অন্য কাউকে পাঠাতে হবে।” কার্ট বলল।
কার্ট ফোন কেটে দিতে গামায় ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে বলল, “ঝামেলা শুরু হলে তো দেখি থামতেই চায় না। একটার পর একটা লাগতেই থাকে।”
কিছুক্ষণ পরেই গোয়েন্দা লোকটা অপারেশন রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ওদেরকে দেখতে পেয়ে বেলকনিতেই এগিয়ে এলো সে।
“আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি। রেজা সব বলেছেন আমাকে। উনার জীবন বাঁচানোর জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।” লোকটা বলল।
“শুনে ভালো লাগল।” পল বলল।
হঠাৎ শহরের দূরের কোথাও বিশাল এক অগ্নিকুণ্ড ঝলসে উঠল কয়েক সেকেন্ড পরেই ভেসে এলো শব্দ। বোমা-টোমা ফেটেছে কোথাও।
“হ্যাঁ আপনাদের প্রতি আর কোনো অভিযোগ নেই। রেজা বেঁচে আছেন তবে ক্ষতি যা হওয়ার হয়েই গিয়েছে। আরো দুটো পাম্পিং স্টেশনে হামলা হয়েছে। আর বাকিগুলোও দরকারের তুলনায় সামান্য পানিই তুলতে পারছে। রেজাকে আরো কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হবে। আর সুস্থ হতেও লাগবে আরো কয়েক সপ্তাহ। আর ততোদিনে দেশটা আবার খণ্ড খণ্ড হয়ে যাবে। গত পাঁচ বছরে এ নিয়ে তিনবার হবে।
“আমরা হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারবা।” পল বলল।
এজেন্ট দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। বিস্ফোরণ হল থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। তাদের আলো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে তাতে। “আমার পরামর্শ হচ্ছে। আপনারা সময় থাকতে চলে যান। কারণ কয়েকদিন পরেই আর এদেশ থেকে কেউ বের হতে পারবে কি-না সন্দেহ। আর আমার মতো সবাই হবে না। সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত কারো হাতে পড়লে আপনাদেরই ঝামেলা হবে। শেষে বলির পাঠা হতে হবে। আশা করি বুঝতে পারছেন?”
“আচ্ছা। তবে রেজাকে একবার বিদায় বলে যাই।” গামায় বলল।
“আর তারপর এয়ারপোর্ট পৌঁছাবার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন প্লিজ।” পল যোগ করল সাথে।