০১. নীল নদের মোহনা

NUMA ফাইলস/কার্ট অস্টিন অ্যাডভেঞ্চার – দ্য ফারাও’স সিক্রেট / মূল : ক্লাইভ কাসলার ও গ্রাহাম ব্রাউন / অনুবাদ : অসীম পিয়াস / প্রথম প্রকাশ আগস্ট ২০১৬

পূর্বকথা – মৃতদের শহর

অ্যাবাইডোস, মিসর
খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫৩
 ফারাও আখেন আতেন-এর রাজত্বের সপ্ত
দশ বর্ষ

পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় মিসরের বালুকণা সব এক নীলাভ দ্যুতিতে ঝিকিমিক করছে। দেখে মনে হয় কেউ যেন বালির ওপর রঙ লেপে দিয়েছে। দূরের পাথুরে মন্দিরগুলোও মার্বেল পাথরে তৈরি বলে ভ্রম হয়। চাঁদের আলোর বিপরীতে সেগুলোর লম্বা ছায়া পড়েছে। এই আলো-আঁধারির ফাঁক দিয়েই একদল লোক চুপিসারে অনুপ্রবেশ করল মৃতদের শহরে’।

 মোটমাট তিরিশজন পুরুষ এবং মহিলা। সবার চেহারা চাদরে ঢাকা, তবে দৃষ্টি আটকে আছে সামনের রাস্তায়। কেমন একটা ক্লান্ত, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হাঁটছে সবাই। ইতোমধ্যেই তারা পেরিয়ে এসেছে প্রথম রাজবংশের ফারাওদের সমাধিক্ষেত্র আর দ্বিতীয় যুগের দেবতাদের সম্মানে তৈরি বিভিন্ন মন্দির আর সৌধ।

কিছুদূর এগুতেই দেখা গেল পাথুরে রাস্তাটার ওপর বালু জমে তূপ হয়ে আছে। অভিসারী দলটা নীরবে দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে। তাদের দলনেতা মানু-হটেপ অন্ধকারে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ওপাশে কিছু আছে কি-না। তারপর মাথা বাঁকিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করল, আত্ম রক্ষায় বর্শায় চেপে বসেছে আঙুল।

 এক মহিলা এগিয়ে এলো ওর দিকে, “কিছু শুনতে পেলে?” মহিলাটি মানু-হটেপ-এর স্ত্রী। আর পিছনে যারা দাঁড়ানো, তারা কয়েকটা পরিবারের সদস্য। সাথে আছে ডজন খানেক চাকর-বাকর, তাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে খাঁটিয়া। আর খাঁটিয়াতে একটা করে শিশুর লাশ প্রত্যেকটা শিশুই একই রকম অদ্ভুত এক রোগে মারা গেছে।

“একটা ফিসফিসানি শুনলাম মনে হলো, মানু-হপেট জবাব দিল।

“কিন্তু এই শহরে তো কেউ থাকে না। এসব সমাধি ক্ষেত্রে প্রবেশ তো একেবারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমরা নিজেরাই এসেছি মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে।” মহিলা বলল।

“সে কথা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না,” বলতে বলতে লোকটা তার মাথার ওপর থেকে কাপড়টা নামালো। মাথায় চুল নেই। কামানো, গলায় একটা স্বর্ণের নেকলেস। আখেন আতেন-এর পরিষদের সদস্যরাই এরকম নেকলেস পরিধান করে।

শত শত বছর ধরেই এই অ্যাবাইডোস বা মৃতদের শহর ‘ওসাইরিস’ এর পুরোহিত পূজারি আর ভক্তদের জন্য পুণ্যভূমি হিসেবে বিবেচ্য। ওসাইরিস’ হলো পরলোকের শাসক আর উর্বরতার দেবতা। প্রথম দিকের রাজবংশের সকল ফারাওকেই এখানেই সমাহিত করা হয়েছে। ইদানীংকালের ফারাওদের অবশ্য অন্যত্র কবর দেয়া হয়। তবে এখনও এখানে ওসাইরিস-এর সম্মানে মন্দির বা সৌধ নির্মাণ করেন সবাই।

তবে আখেন আতেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ফারাও হবার কিছুদিন পরেই আখেন আতেন ঘোষণা দেন যে তিনি আর পুরাতন দেবতাদের পূজা করবেন না। যুগ যুগ ধরে চলা আসা সমস্ত দেবতাদের ওপর ডিক্রি জারি করেন এবং নির্দেশ দেন এখন থেকে শুধু একজন দেবতার-ই পূজা করবে সবাই। সেটা হলো সূর্য দেবতা-আতেন।

এরপর থেকেই অ্যাবাইভোস শহর তার শৌর্য হারানো শুরু করে। ভক্ত পুরোহিত সবাই চলে যায় শহর ছেড়ে। এখন এটা পুরোপুরি পরিত্যক্ত। এর সীমানার ভেতরে কাউকে পাওয়া গেলে তার মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। আর মানু হটেপ-এর মতো খোদ ফারাও-এর পরিষদের কোনো সদস্য যদি ধরা পড়ে। তবে তার শাস্তি হবে আরো ভয়ংকর। মারার আগে তার ওপর এমন অত্যাচার চালানো হবে যে তার চেয়ে মৃত্যুও শ্রেয়।

মানু-হটেপ কিছু বলার জন্যে মুখ খুললো, কিন্তু তার আগেই একটা নড়াচড়া টের পেয়ে থেমে গেল। তিনজনের একটা দল অন্ধকার কুঁড়ে ওদের দিকেই দৌড়ে আসছে। হাতে উদ্যত অস্ত্র। মানু-হটেপ তার স্ত্রীকে পিছনে ঠেলে দিয়ে বর্শা বাগিয়ে সামনে এগুলো। সবার সামনের লোকটা জায়গায় গেঁথে গেল এফোঁড় ওফোঁড়। আর নড়লো না। কিন্তু লাশটার বুক থেকে বর্শা বের করার আগেই দ্বিতীয় লোকটা পৌঁছে গেল সেখানে। বিন্দুমাত্র দেরি না করে আততায়ী তার তরবারি চালালো।

আঘাত এড়াতে গিয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে গেল মানু-হটেপ। তবে ততোক্ষণে মুক্ত হয়েছে তার বর্শা। দ্বিতীয় আততায়ী আবার আঘাত করার আগেই তার দিকে ছুঁড়ে দিল বর্শা। দ্বিতীয় আততায়ী শুয়ে থাকায় নিশানা ঠিক মতো হয়নি, লাগল না। আততায়ী এবার নিরস্ত্র মানু-হটেপের দিকে এগুতে চাইলো। কিন্তু পিছন থেকে একটা বর্শা তার পেট ভেদ করে বেরিয়ে গেল। মানু-হটেপের এক চাকর ছুঁড়েছে সেটা। দ্বিতীয় আততায়ী হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল, হাসফাস করছে বাতাসের জন্য। এ দিকে তৃতীয় আততায়ী আর দাঁড়ালো না। উল্টো দিকে ঘুরেই দিল ভো দৌড়।

মানু-হটেপও সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে বর্শা ছুড়লো সেদিকে। এক ইঞ্চির জন্য লক্ষ্য ভ্রষ্ট হলো সেটা। রাতের আঁধারে ছুটন্ত পদশব্দ মিলিয়ে গেল কিছুক্ষণ পরেই।

“লাশ চোর নাকি?” কেউ জিজ্ঞেস করল।

“গোয়েন্দাও হতে পারে”। মানু-হটেপ জবাব দিল। “আর গত কয়েকদিন ধরেই মনে হচ্ছে কেউ আমাদের চোখে চোখে রাখছে। দ্রুত পা চালাও সবাই। লোকটা ফারাওয়ের কানে কথাটা লাগালে কাল সকালে সূর্যের মুখ আর দেখা লাগবে না।”

“আমার মনে হয় আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত। কেন যেন মনে হচ্ছে ভুল করছি আমরা।” মানু-হটেপের স্ত্রী বলল।

“আখেন আতেনের সব কথা মেনে নেয়াটা ছিল ভুল।” মানু-হটেপ জবাব দিল। “ফারাও একজন ধর্মদ্রোহী। আর তার সাথে তাল মিলানোর কারণেই আজ ওসাইরিস আমাদের শাস্তি দিচ্ছেন। শুধু আমাদের আমরা যারা আখেন আতেনকে সমর্থন দিয়েছি তাদের প্রত্যেকের সন্তান মারা পড়ছে, আমাদের গবাদি পশু সব মরে সাফ হয়ে যাচ্ছে। আমাদেরকে ওসাইরিসের কাছে মাফ চাইতে হবে। আজই। এক্ষুনি। আর দেরি করা যাবে না।”

 কথাগুলো বলতে বলতে মানু-হটেপের সংকল্প আরো দৃঢ় হলো। এতদিন আখেন আতেনের বিরুদ্ধে কেউ বলতে গেলেই তাকে জোর করে থামিয়ে দেয়া হয়েছে, চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে তাদের কণ্ঠ। কিন্তু দেবতারাও ক্ষেপে গেছে। ফলে দেশ জুড়ে এখন নিষ্ঠুর গজব চলছে। এর মধ্যে যারা আখেন আতেনের সহযোগী ছিল তারা ভুগছে সবচে বেশি।

“এদিক দিয়ে।” বলে মানু-হটেপ পা বাড়ালো।

কিছুক্ষণ পরেই দলটা শহরের আরো ভেতরে সবচেয়ে বড় দালানটার সামনে এসে পৌঁছুলো। এটাই ওসাইরিসের মন্দির।

 মন্দিরের ছাদটা বিশাল, অবশ্য কোনো গম্বুজ নেই, সমতল। বিশাল বিশাল গ্রানাইটের পাথর থেকে লম্বা লম্বা থাম উঠে গেছে ওপরে। তার মাঝ দিয়ে চওড়া একটা সিঁড়ি। একটা নকশা কাটা পাথরে গিয়ে সেটা থেমেছে। পাথরটায় ইথিওপিয়ার লাল মার্বেল, আর ইরানের নীলকান্তমণি বসিয়ে পাথরটায় নকশা করা হয়েছে। তার পরেই ব্রোঞ্জের তৈরি দৈত্যাকৃতির দুটো দরজা।

 মানু-হটেপ দরজার কাছে পৌঁছে ঠেলে খুলে ফেলল। কেমন শান্তি-শান্তি লাগছে তার। তবে দরজা খোলামাত্র একটা পুঁতি গন্ধ এসে নাকে লাগতেই শান্তি উবে গেল। মানু-হটেপ আরা অবাক হলো যখন দেখলো মন্দিরের বেদি আর দেয়াল জুড়ে মশাল জ্বলছে। মশালের মিটিমিটি আলোয় চোখে পড়ল মন্দিরের মাঝে অর্ধবৃত্তাকারে কিছু বেঞ্চ জড়ো করে রাখা। তার ওপর মৃত লাশ রাখা। পুরুষ, মহিলা আর শিশুর লাশ, সবই আছে। আর তার চারপাশে মৃতদের পরিবারের লোকেরা দাঁড়ানো। থেমে থেমে ফেঁপাচ্ছে আর বিড় বিড় করে প্রার্থনা করছে।

 “তার মানে শুধু আমরাই আখেন আতেনের ফরমান ভঙ্গ করে এখানে আসিনি।” মানু-হটেপ বলল।

মন্দিরের ভেতরের মানুষগুলো ওর দিকে তাকাল, কিন্তু কারো মধ্যে কোনো ভাবান্তর লক্ষ করা গেল না।

“তাড়াতাড়ি করো” হটেপ ভৃত্যদের আদেশ দিল।

একে একে সব ভৃত্য লাশগুলো সারি করে সাজিয়ে রাখলো। আর মানু হটেপ ওসাইরিসের প্রকাণ্ড বেদিটার সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। তারপর মাথা নিচু করে শুরু করল প্রার্থনা। চাদরের ভেতর থেকে দুটো উটপাখির পালক বের করল মানু-হটেপ। তারপর ফিসফিস করে বলল, “হে মৃতদের প্রভু! হে মহানুভব, আমরা বড় বিপদে পড়ে আপনার দ্বারস্থ হয়েছি। আমাদের পরিবারের সদস্য সকলে জরাগ্রস্ত হয়ে গিয়েছে, আমাদের ঘরবাড়িগুলো অভিশপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে, আমাদের ফসলের জমিগুলো বিরান হয়ে গিয়েছে। আজ শুধু একটাই প্রার্থনা, আমাদের মধ্যে যারা মৃত, তাদের আত্মাকে আপনি গ্রহণ করুন, তাদের পরকালকে আপনার আশীর্বাদে ধন্য করুন। আপনিই জীবন মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক, আপনার আদেশেই মৃত বীজ থেকে আবার জীবন উৎসরিত হয়। আমরা আপনার কাছে কড়জোরে মিনতি করছি, আমাদের মাঠকে আবার ফসলে ভরিয়ে দিন, আমাদের বাড়িগুলোকে অভিশাপ মুক্ত করুন।”

তারপর বিনম্রভাবে পালক দুটোকে নামিয়ে রাখলো আর তার চারপাশে স্বর্ণমিশ্রিত বালু ছড়িয়ে দিয়ে বেদি থেকে নেমে এলো।

হঠাৎ দমকা বাতাস বয়ে গেল মন্দিরের ভেতর। মশালের আগুন তাতে একদিকে কাত হয়ে গেল। সাথে সাথেই বুম করে একটা শব্দ মন্দিরের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে ছড়িয়ে পড়ল।

মানু-হটেপ সাথে সাথেই পিছনে ঘুরলো। দূরে দেখা যাচ্ছে প্রকাণ্ড দরজা দুটো বন্ধ হয়ে গেছে। তাতেই শব্দটা হয়েছে। ও নার্ভাস ভঙ্গিতে চারপাশে একবার তাকাল। মশালের আলো একদমই কমে এসেছে। যে কোনো সময় নিভে যাবে। তবে সেই আলো চোখে সয়ে আসতেই মানু-হটেপ খেয়াল করল বেদির ঠিক পিছনেই বেশ কয়েকটা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। মুহূর্ত আগেও সেখানে কেউ ছিল না।

চারজনের পরনে স্বর্ণখচিত কালো পোশাক–ওসাইরিসের কাল্টের পুরোহিত এরা। পঞ্চমজনের পোশাক সম্পূর্ণ আলাদা। ভাবগাম্ভীর্যে মনে হচ্ছে, সে-ই বুঝি পরকালের দেবতা স্বয়ং। পা আর কবজির চারপাশে মমি করার কাপড় দিয়ে মোড়া গলা আর হাত ভর্তি স্বর্ণের অলঙ্কার আর মাথায় উটপাখির পালক খচিত একটা মুকুট।

অবয়বটার ডান হাতে একটা ভেড়া তাড়ানোর ছড়ি অপর হাতে একটা স্বর্ণের কস্তনি। যে এখুনি সেটা দিয়ে ধান মাড়াই আরম্ভ করবে। “আমি ওসাইরিসের দূত। পরকালের মহান প্রভুর অবতার।” পুরোহিতটা বলল অবশেষে।

গমগমে কণ্ঠস্বরটা শুনলেই বোঝা যায় যে সেটা পার্থিব দুনিয়ার কারো না। মন্দিরের ভেতরকার সবাই মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানালো। তারপর পুরোহিতবৃন্দ একসাথে সামনে এগুলো। মৃতদের পাশে এসে তারা পাতা, ফুলের পাপড়ি আর কি একটা ছিটাতে লাগল। শেষ জিনিসটা মানু-হটেপের কাছে মনে হলো কোনো ধরনের সরীসৃপ বা উভচরের শুকনো চামড়ার ফালি।

“তুমি ওসাইরিসের কাছে আশ্রয় চেয়েছ?” অবতার বলল।

“আমার সব সন্তান মারা গেছে। আমি পরকালে তাদের জন্যে ওসাইরিসের আশীর্বাদ চাই।” মানু-হটেপ জবাব দিল।

 “কিন্তু তুমি ঐ বিশ্বাসঘাতকদের হয়ে কাজ করো। তুমি ওসাইরিসের আশীর্বাদের যোগ্য নও।” জবাব দিল অবতার। মানু-হটেপ মাথা না তুলেই বলল, “আমার কৃতকর্মের সমস্ত দায় আমার। আখেন আতেনের কথা আমি মেনেছি। তার জন্য আমাকে যা খুশি শাস্তি দিন। কিন্তু যারা মারা গেছে তারা সম্পূর্ণ নির্দোষ। দয়া করে তাদেরকে মুক্তি দিন। আখেন আতেনের অনাচার শুরু হওয়ার আগে এমনটাই করার কথা ছিল।”

 বেশ কিছুক্ষণ নীরবেই কাটলো চারপাশ। মানু-হটেপ সাহস সঞ্চয় করে মাথা তুলে তাকাতেই দেখে অবতার তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার কালো চোখে পলক পড়ছে না।

 ‘না। ওসাইরিস তোমার মুখের কথায় আর গলবেন না। তোমাকে প্রমাণ করতে হবে যে তুমি আসলেই অনুতপ্ত।” শেষমেশ বলল অবতার।

তারপর হাড্ডিসার আঙুল তুলে বেদির ওপর থাকা একটা মাটির পাত্র দেখিয়ে বলল, “ঐ পাত্রে আছে মারাত্মক এক বিষ। কিন্তু এর কোনো স্বাদ নেই। ওটা নিয়ে আখেন আতেনের পানীয়ের সাথে মিশিয়ে দেবে। বিষের প্রভাবে সে অন্ধ হয়ে যাবে। আর কোনোদিন সে চোখ তুলে তার পরম পূজনীয় সূর্যদেবের দিকে তাকাতে পারবে না, ফলে ওর রাজত্বও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।”

“আমার সন্তানদের কী হবে? আমি এই কাজ করলে কী পরকালে ওদেরকে মুক্তি দেয়া হবে?” মানু-হটেপ জিজ্ঞসে করল।

“না” অবতার জবাব দিল।

“কিন্তু কেন? আমিতো ভাবলাম-”

“তুমি যদি এই কাজ করো তাহলে ওসাইরিস আবার তোমার সন্তানদের জীবন ফিরিয়ে দেবেন। তিনি নীল নদকে আবার পুনরুজ্জীবিত করবেন আর তোমাদের ফসলের মাঠ আবার শস্যে ভরে যাবে। বলল, তুমি কী এই প্রস্তাবে রাজি?”

 মানু-হটেপ ইতস্তত করতে লাগল। ফারাওয়ের অবাধ্যতা এক জিনিস কিন্তু তাকে হত্যা করা…

ওর দোদুল্যমান অবস্থা দেখে অবতারটা ক্ষেপে গিয়ে হাতের কস্তনিটা বেদির পাশের আগুনে ঠেসে ধরলো। মুহূর্তে অস্ত্রটার চামড়ার ফিতেয় আগুন ধরে গেল। যেন আগে থেকেই তেল মাখানো ছিল ওতে। আগুনটা ভালো মতো ধরতেই হাতের এক মোচড়ে সেটাকে আশে পাশে ছড়িয়ে থাকা শুকনো ভুসি আর পাতার দিকে ছুঁড়ে দিল। সাথে সাথেই সেগুলোয় আগুন ধরে গেল আর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরেই ঘরের জীবিত বা মৃত প্রতিটা মানুষের চারপাশে দেখা গেল আগুন।

তাপের হলকায় মানু-হটেপ পিছু হটলো। ধোঁয়া আর গন্ধে তার চোখে পানি চলে এলো। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে ওর। বহু কষ্টে যখন চোখ খুলল ততোক্ষণে চারপাশে আগুনের উচ্চতা আরো বেড়েছে। আর আগুনের ওপাশেই পুরোহিতবৃন্দ মন্দির ত্যাগ করছে।

“এ তুমি কী করলে?” মানু-হটেপের স্ত্রী বিলাপ করে উঠল।

পুরোহিতরা বেদির অপর পাশের একটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছেন। আগুনের উচ্চতা এখন প্রায় বুক সমান। আর জীবিত বা মৃত সবাইকে ঘিরেই আগুনের শিখা লক লক করছে।

“আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমার ভয় লাগছিল।” বিড়বিড় করে বলল মানু-হটেপ।

ওসাইরিস তাদেরকে একটা সুযোগ দিয়েছিল আর সে কি-না সেটাকে এভাবে পায়ে ঠেললো। প্রচণ্ড মানসিক কষ্ট নিয়ে মানু-হটেপ বেদির ওপরের বিষের পাত্রটার দিকে তাকাল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। ফলে পাত্রটাও চোখের সামনে থেকে আড়াল হয়ে গেল।

 চোখে আলো এসে পড়তেই মানু-হটেপের ঘুম ভেঙে গেল। ছাদের ফুটো দিয়ে আলোটা আসছে। আগুন নিভে গেছে তবে চারপাশে গোল হয়ে পড়ে আছে পোড়া ছাই। বাতাসে ধোয়ার গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। মেঝের অন্যান্য জায়গাতেও ছাইয়ের পাতলা স্তর দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। কিছুক্ষণ।

কোনোমতে উঠে বসলো ও। মাথাটা টলছে। বহু কষ্টে চারপাশে তাকাল মাথা ঘুরিয়ে। মন্দিরের দরজা খোলা। সকালের মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা বাতাস আসছে সেদিক দিয়ে। পুরোহিতরা ওদেরকে হত্যা করেনি, কিন্তু কেন?

কারণটা ভাবতে ভাবতেই ছোট ছোট আঙুল ওয়ালা একটা ছোট্ট হাত তার পাশে কাঁপতে দেখা গেল। মাথা ঘুরাতেই দেখলো ওর মেয়ে। ডাঙ্গায় ভোলা মাছের মতো তড়পাচ্ছে। সাথে মুখ একবার খুলছে আর বন্ধ করছে যেন বাতাস ওর ফুসফুসে প্রবেশ করছে না, সেই সাথে হচ্ছে খিচুনি।

মানু-হটেপ ওকে ধরার জন্যে হাত বাড়ালো। অবাক করা ব্যাপার হলো মেয়েটার শরীর আর ঠাণ্ডা নেই, উষ্ণ। শরীরটাও আর শক্ত হয়ে নেই। নরম হয়ে গেছে, সেই সাথে হাত-পা ছুড়ছে। মানু-হটেপের ব্যাপারটা বিশ্বাস হতে চাইলো না। পাশে তাকিয়ে দেখে ওর ছেলেটাও নাড়াচাড়া করছে। যেন স্বপ্নের ভেতর খেলাধুলা করছে।

মানু-হটেপ চেপে ধরে ওর বাচ্চাদের ঝাঁকুনি থামাতে চাইলো কিন্তু কাজ হলো না। ওদের নাম ধরে ডাকলো কিন্তু ওরা সাড়া দিল না।

ওদের আশে পাশের বাচ্চারাও একই দশা নিয়ে জেগে উঠতে লাগল।

“সবার হলোটা কি?” ওর স্ত্রী জিজ্ঞেস করল।

“সম্ভবত ওরা এখন জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি আটকা পড়েছে। কে জানে কতটা কষ্ট হচ্ছে ওদের।” মানু-হটেপ অনুমান করল।

“কী করবো এখন আমরা?”

মানু-হটেপের মাঝে আর কোনো দোটানা নেই, নেই কোনো ইতস্ততবোধ। “আমরা এখন ওসাইরিসের নির্দেশ পালন করবো। ফারাওকে অন্ধ করে দেবো আমরা।”

মানু-হটেপ উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় দৌড়ে গিয়ে বেদিটার কাছে পৌঁছুলো। লাল রঙের বিষের পাত্রটা এখনও আছে। যদিও ওটার রঙ এখন কালো হয়ে গেছে। ও হাত বাড়িয়ে ওটা তুলে ধরলো। এটাই এখন ওর বিশ্বাস আর প্রত্যয়ের একমাত্র অবলম্বন। সমস্ত আশার একমাত্র আধার।

 ওরা সবাই মন্দির ত্যাগ করল। বাচ্চাগুলোর তখনও খিচুনি চলছে। কবে থামবে কে জানে। হয়তো কয়েক সপ্তাহ। এরপর হয়তো আরো কয়েক মাস লেগে যাবে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার ধকল সামলাতে। তবে তততদিনে আখেন আতেনের চোখের জ্যোতি কমতে থাকবে আর ধর্মদ্রোহী ফারাওয়ের রাজত্বও প্রায় শেষ হয়ে যাবে।

.

০১.

আবুকির উপসাগর, নীল নদের মোহনা
১ আগস্ট ১৯৭৮, সন্ধ্যার ঠিক আগে

কামানের গোলার আওয়াজ গমগম করে আবুকির উপসাগরের বিশাল বিস্তৃতি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। আলোর ঝলকানিতে গোধূলি লগ্নটাও আরেকবার আলোকিত হয়ে উঠল। কিন্তু গোলার একটাও জায়গা মতো লাগল না। গরম পানির একটা ঝাঁপটা তুলে তলিয়ে গেল পানিতে। তবে আক্রমণকারী জাহাজগুলো এগিয়ে আসছে দ্রুত পরেরবারের গোলগুলো জলে যাবে না নিশ্চিত। আক্রমণের লক্ষ্য একটা নোঙ্গর ফেলা জাহাজ।

নৌবহরের কিছু সামনেই একটা সাম্পান। ছয়জন সুঠামদেহী ফরাসি নাবিক দাঁড় বাইছে সেটার। যুদ্ধের ঠিক মাঝখানের জাহাজটা লক্ষ করছে ছুটছে সাম্পানটা। অবস্থা দৃষ্টে এটাকে ‘সুইসাইডাল মিশন’ বললেও ভুল হবে না।

“দেরি হয়ে গেছে।“ একজন মাল্লা চেঁচিয়ে বলল।

“বাইতে থাকো। পুরো বহরটাই ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধ শুরু করার আগেই আমাদেরকে লরিয়েন্ট-এ পৌঁছাতে হবে। নাইলে সর্বনাশের বাকি থাকবে না।” দলটার মধ্যে একমাত্র অফিসার আদেশ দিল।

যে নৌবহরটার কথা আলোচনা হচ্ছে সেটা হলো নেপোলিয়নের প্রকাণ্ড ভূমধ্যসাগরীয় নৌ-বহর। সতেরোটা জাহাজ আছে বহরে। এর মধ্যে তেরটাই যুদ্ধ জাহাজ। ইংলিশদের গোলাবর্ষণের বিপরীতে ওরাও জবাব দেয়া শুরু করল। ফলে সূর্য ডোবার আগেই চারপাশ গোলাগুলির ধোঁয়ায় ভরে গেল।

 সাম্পানের ঠিক মাঝখানে এক ফরাসি সামরিক ব্যক্তি, নাম এমিল দ্য শ্যাম্পেন। এই মুহূর্তে তাকে হেঁকে ধরেছে মৃত্যু ভয়। লোকটা একজন নামকরা আঁকিয়ে।

 যে কোনো মুহূর্তে মারা পড়ার আশংকা না থাকলে দ্য শ্যাম্পেন বর্তমান পরিস্থিতির আনকোরা সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতো নিশ্চিত। তার মতো দক্ষ শিল্পীই পারতে বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে নিশ্চল ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে। কীভাবে সামান্য স্কুলিংগ থেকে যুদ্ধের আগুন লাগতে পারে তার পরিপূর্ণ চিত্রায়ণ তার পক্ষেই সম্ভব। কামানের গোলার ভীতিকর আওয়াজ বাতাস কেটে ছুটে যাচ্ছে লক্ষ্য পানে। লম্বা লম্বা মাস্তুলগুলো সেগুলোর আঘাতে কাটা গাছের মতো হেলে পড়ছে। সাদা পানির ধারা কালো আকাশের সাথে গিয়ে মিশেছে। সেখানে হালকা গোলাপি আর নীল রঙের আভা। এই জায়গাটুকু আঁকতে বিশেষ যত্নের দরকার হবে। কিন্তু দ্য শ্যাম্পেন এই মুহূর্তে মাথা থেকে পা পর্যন্ত থরথর করে কাঁপছে। নৌকার একটা পাশ ধরে কোনো মতে কাঁপুনি থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।

 হঠাৎই একটা গোলা তাদের ঠিক একশো গজ দূরে এসে পড়ল। দ্য চ্যাম্পিয়ন আর চুপ থাকতে পারলো না, “আমাদের দিকে কেন বোমা মারছে?”

“আমাদের দিকে মারছে না।” অফিসার জবাব দিল।

 “তাহলে আমাদের এতো কাছে বোমা পড়ছে কেন?”

“ইংরেজ গোলন্দাজ। পশ্চিমে বোমা মারলে পূর্বে গিয়ে পড়ে। এদের নিশানা এতোই খারাপ।”

নাবিকেরা হেসে উঠল। দ্য চ্যাম্পিয়নের অবশ্য হাসি পেল না। নাবিকেরাও ভয় পাচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরেই ওরা ব্রিটিশদের সাথে লুকোচুরি খেলছে। মাস্টার মাত্র এক সপ্তাহ আগু-পিছুর কারণে ধরা পড়েনি, আর আলেকজান্দ্রিয়ার তো মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্যে বেঁচেছে। আর এখন নেপোলিয়নের সৈন্য বাহিনীকে ডাঙ্গায় নামিয়ে দিয়ে যেই বহরটা নীল নদের মোহনায় নোঙ্গর ফেলেছে, তখুনি ইংরেজরা আর তাদের আস্থাভাজন হোরাশিও নেলসন শেষমেশ ওদের সন্ধান পেয়ে গেছে।

“আমার ভাগ্যে যে এরকম শনি আছে, কে জানতো?” দ্য শ্যাম্পেন নিজেকেই নিজে শোনালো। তারপর বাকিদের উদ্দেশ্যে বলল, “আমার মনে হয় আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত।”

 অফিসার মাথা নাড়লো, “আমাকে আপনাকে আর এই ট্রাংকগুলোকে লরিয়েন্টের অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েস-এর কাছে পৌঁছে দেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে।

“আমি জানি আপনাকে কী আদেশ করা হয়েছে। নেপোলিয়ন আদেশটা দেয়ার সময় আমিও সেখানেই ছিলাম।” দ্য শ্যাম্পেন বলল। “কিন্তু এই ভয়ানক গোলাগুলির মাঝে দাঁড় বেয়ে লরিয়েন্টে পৌঁছার বহু আগেই মারা পড়বো সবাই। আমাদের এক্ষুনি ফিরে যাওয়া উচিত। হয় তীরের দিকে না হয় অন্য কোনো জাহাজে।”

অফিসার মাথা ঘুরিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে তাকাল। লরিয়েন্ট বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর শক্তিশালী যুদ্ধ জাহাজ। এটাকে জলদুর্গ বললেও অত্যুক্তি হবে না। প্রায় একশো তিরিশটা কামান আছে এর পাটাতনে। ওজন প্রায় ৫ হাজার টন। হাজার খানেক মানুষ অনায়াসে থাকতে পারে এতে। এটার দুই পাশে সবসময় আরো দুটো ফরাসি যুদ্ধ জাহাজ থাকে। অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েসের মতে এই নিরাপত্তা ব্যুহ ভাঙা অসম্ভব। কিন্তু ব্রিটিশরা সম্ভবত এ খবর জানে না। ওরা ছোট ছোট কয়েকটা যুদ্ধ জাহাজ নিয়েই পূর্ণোদ্যমে বোমা মেরেই যাচ্ছে।

লরিয়েন্ট আর একটা ব্রিটিশ জাহাজ বেলেরফোন একেবারে কাছাকাছি এসে গোলাবর্ষণ করল কিছুক্ষণ। ছোট ব্রিটিশ জাহাজটা প্রায় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। স্টারবোর্ডের রেলিং ভেঙে ঝুলে পড়েছে একপাশে। তিনটা মাস্তুলের মধ্যে দুটোই উপরে পড়েছে। কোনো মতে দক্ষিণে পালিয়ে বাঁচলো সেটা, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আরেকটা জাহাজ এসে বেলেরফোনের শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলল। এর মধ্যেই ব্রিটিশদের ছোট ছোট কয়েকটা রণতরী কম পানির দিকে এগিয়ে গিয়ে (ফরাসি নৌ-বহরের ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগল।

দ্য চ্যাম্পিয়নের কাছে মনে হলো দাঁড় বেয়ে এই দোযখের মধ্যে গিয়ে পড়া আর পাগলামি একই কথা। তার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এসেছে, “আচ্ছা ব্রিটিশ জাহাজগুলোকে তো অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েস ভাগিয়ে দেবেন-ই। তখনই শুধু এই ট্রাংকগুলো তাকে পৌঁছে দিলে হবে না?”

এই প্রস্তাবে অফিসার মাথা ঝাঁকালো। তারপর নিজের লোকদের দিকে ফিরে বলল, “দেখলে তো? এজন্যেই জেনারেল এনাকে পণ্ডিত বলে ডাকেন।”

অফিসার বহরের পিছনের একটা জাহাজের দিকে ইঙ্গিত করল। এই জাহাজটা এখনো যুদ্ধ শুরু করেনি। “গুইলাম টেল-এর দিকে যাও। রিয়ার অ্যাডমিরাল ভিয়েনেভ আছেন ওখানে। কি করা উচিত উনিই ভালো বলতে পারবেন।”

নৌকা বাওয়ায় আবার পূর্ণোদ্যম ফিরে পেল সবাই। যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে সাম্পানটা সরে গেল বেশ দ্রুতই। চারপাশে অন্ধকার আর ধোঁয়ায় ভরা থাকলেও নিরাপদেই মাল্লারা সাম্পানটা নৌ-বহরের পিছনের দিকে নিয়ে এলো। চারটা জাহাজ দাঁড়ানো সেখানে। সামনে স্থলস্তুল যুদ্ধ চলছে আর এগুলো এখানে পড়ে আছে। ব্যাপারটা আশ্চর্যজনকই বটে।

 সাম্পানটা গুইলাম-টেল’-এর গায়ে ভিড়তেই দড়ির মই নেমে এলো নিচে। দ্রুততার সাথে মানুষ আর মালপত্র সবই তুলে নেয়া হলো জাহাজে।

দ্য শ্যাম্পেন ডেকে পৌঁছে দেখলেন যুদ্ধের অবস্থা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তার কল্পনাতেই কখনো এমন কোনো দৃশ্য ছিল না। ব্রিটিশগুলো সংখ্যায় কমে গেলেও কৌশলগত দিক দিয়ে ওরাই এগিয়ে আছে এখন। ফরাসি জাহাজগুলোর সাথে মুখোমুখি আক্রমণ বন্ধ করে দিয়েছে। পিছনের জাহাজগুলোকেও আর আক্রমণ করছে না, তার বদলে একযোগে সামনের সারির জাহাজগুলোর দিকে গোলা বর্ষণ করছে। ফলে প্রতিটা ফরাসি জাহাজকে এখন দুপাশে দুটো করে ব্রিটিশ জাহাজের সাথে লড়তে হচ্ছে। ফলাফলও অনুমেয়। অজেয় ফরাসি নৌ-বহর আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

 “অ্যাডমিরাল ভিয়েনেভ আপনার সাথে দেখা করতে চান।“ একজন স্টাফ অফিসার বলল দ্য শ্যাম্পেনকে। তারপর রাস্তা দেখিয়ে রিয়ার অ্যাডমিরালের কাছে নিয়ে গেল। অ্যাডমিরালের মাথা ভরা সাদা চুল, কেমন চ্যাপটা মুখ, লম্বা কপাল আর নাকটা রোমানদের মতো লম্বা। নিখুঁত একটা ইউনিফর্ম পরনে তার। গাঢ় নীল শার্ট, সেটার এখানে সেখানে সোনালি সুতোর কারুকাজ। বুকে একটা লাল রঙের স্যাশ। দ্য চ্যাম্পিয়নের কাছে মনে হলো যুদ্ধ না, বরং প্যারেড় করতে বেরিয়েছেন অ্যাডমিরাল।

ভিয়েনেভ কিছুক্ষণ ট্রাঙ্কের তালাটা নিয়ে তোণ্ডতি করল। তারপর দ্য শ্যাম্পেনকে বলল, “আপনি সম্ভবত নেপোলিয়নের পণ্ডিতদের একজন।”

পণ্ডিত শব্দটা নেপোলিয়ন ব্যবহার করেন। দ্য শ্যাম্পেন এবং আরো কয়েকজনকে এটা বলে ক্ষেপিয়ে মজা পান তিনি। তারা প্রত্যেকেই বিজ্ঞানী এবং বিদ্বান ব্যক্তি। নেপোলিয়নই তাদের জড়ো করে মিসরে নিয়ে এসেছেন। উদ্দেশ্য এমন কোনো গুপ্তধন খুঁজে বের করা, যা দেহ ও মন দুটোকেই প্রশান্ত করবে।

দ্য শ্যাম্পেন প্রাচীন ভাষার পাঠোদ্ধারের ব্যাপারে একজন উঠতি বিশেষজ্ঞ। আর প্রাচীন ভাষার ব্যাপারে পিরামিড আর স্ফিংস এর দেশের তুলনা আর কোনটা আছে?

আর দ্য শ্যাম্পেন শুধু একজন পণ্ডিত-ই না। নেপোলিয়ন ব্যক্তিগতভাবে তাকে এই অভিযানের জন্যে বাছাই করেছেন। এখানকার সব পৌরাণিক কাহিনীর পিছনের আসল সত্যটা তিনি জানতে চান। বিনিময়ে মোটা পুরস্কারের ওয়াদা করেছিলেন। এতো টাকা দেয়ার কথা ছিল যা দ্য শ্যাম্পেন দশ জনমেও আয় করতে পারতো না। সাথে জমি-জমার প্রতিশ্রুতি তো ছিলই। ধন, দৌলত, সম্মান সবই দ্য শ্যাম্পেন পাবে, তবে তার জন্যে শর্ত একটাই। তাকে খুঁজে বের করতে হবে মৃত্যু থেকে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার উপায়। আর সেই কৌশল ফারাওদের দেশেই পাওয়া সম্ভব।

গত মাস খানেক ধরে দ্য’ শ্যাম্পেন আর ওর ছোট্ট দলটা “মৃতদের শহর” নামে জায়গাটা চষে ফেলছে। এর মাঝে যা কিছু দরকারি মনে হয়েছে সংগ্রহ করেছে-প্যাপিরাসের ওপর লেখা, পাথরে খোদাই বা লিপি যা পেয়েছে সব। যেগুলো সংগ্রহ করতে পারেনি সেগুলো খাতায় এঁকে নিয়েছে।

“আমি বিজ্ঞান ও কলা পরিষদের একজন সদস্য,” দ্য শ্যাম্পেন জবাব দিল। এই পদবীটাই তার পছন্দ।

ভিয়েনেভের তাতে কোনো ভাবান্তর হলো না, “তা আপনি এটা সাথে করে কী নিয়ে এসেছেন, কমিশনার?”

দ্য শ্যাম্পেন নিজেকে সামলালো, “বলা যাবে না, অ্যাডমিরাল। নেপোলিয়নের নির্দেশ ছাড়া এটা ভোলা নিষেধ। ভেতরে কী আছে সেটা নিয়েও আলোচনা করা যাবে না।”

ভিয়েনেভের এবারও কোনো ভাবান্তর নেই। “চাইলেই আবার এগুলো সিল করা যাবে। ঝপপট চাবিটা দিন।”

“অ্যাডমিরাল, জেনারেল কিন্তু ক্ষেপে যাবেন।” সতর্ক করল দ্য শ্যাম্পেন।

“জেনারেল এখানে নেই।” মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল ভিয়েনেভ। নেপোলিয়ন ঐ সময়টাতে খুবই ক্ষমতাধর লোক কিন্তু তখনো সম্রাটের আসনে বসেননি। পাঁচ জনের যে দলটা বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিল, তারাই তখন দেশ চালাচ্ছিল। আর বাকিরা ক্ষমতার লোভে ছোঁক ছোঁক করে বেড়াচ্ছিলো চারপাশে।

কিন্তু তারপরও দ্য শ্যাম্পেন ভিয়েননেভের এমন আচরণের মানে খুঁজে। পেল না। নেপোলিয়ন বা অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েস কেউই হেলাফেলার লোক না। ব্রুয়েস ভিয়েনেভের সরাসরি ওপরওয়ালা বলা যায়। মাত্র আধা মাইল দূরেই তিনি জীবনবাজি রেখে লড়ছেন। আর ভিয়েনেভ এমন নাজুক পরিস্থিতিতে যুদ্ধে যোগ দেয়ার পরিবর্তে এই সামান্য ব্যাপারে কেন মাথা ঘামাচ্ছে?

“চাবিটা!” ভিয়েনেভ আবার হাত বাড়ালো।

দ্য শ্যাম্পেন আর কি করে। কথা না বাড়িয়ে গলা থেকে চাবিটা খুলে ভিয়েনেভের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “ট্রাংকের সব দায় দায়িত্ব এখন থেকে আপনার অ্যাডমিরাল।”

“সেটাই ভালো। আপনি এখন যেতে পারেন।” ভিয়েনেভ বলল।

দ্য শ্যাম্পেন ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হয়েও আবার ফিরে তাকাল। সাহস করে প্রশ্নটা করেই ফেলল, “আমরা কি যুদ্ধে যোগ দিচ্ছি?”

অ্যাডমিরালের ভ্রূ একটু উঁচু হলো। যেন অবাস্তব কোনো প্রশ্ন করেছে দ্য শ্যাম্পেন।

“এখনো সে রকম কোনো নির্দেশ আসেনি।”

“নির্দেশ?”

 “অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েস বা লরিয়েন্টের কোনো পাত্তা নেই অনেকক্ষণ।”

“অ্যাডমিরাল! ইংলিশরা দুপাশ থেকে আক্রমণ করছে। নির্দেশের জন্যে বসে থাকলে তো সব শেষ হয়ে যাবে।” দ্য শ্যাম্পেন বলল।

ভিয়েনেভ চকিত উঠে দাঁড়িয়ে একটা ক্ষ্যাপা ষাড়ের মতো দ্য শ্যাম্পেনকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “তোর এতো বড় সাহস আমাকে কথা শোনাস?”

“না, অ্যাডমিরাল, আমি শুধু–”।

“বাতাস বইছে উল্টো দিকে। ওখানে পৌঁছুতে চাইলে পুরো উপসাগর ঘুরে তারপর যাওয়া লাগবে। এরচেয়ে অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েস পিছু হটে আমাদের কাছাকাছি চলে আসলেই আমরা তার সাথে যোগ দিতে পারতাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তার সে রকম কোনো ইচ্ছা-ই নেই।”

“তাই বলে এখানে চুপচাপ বসে থাকবো?”

ভিয়েনেভ তার ডেস্কের ওপর থেকে একটা ছুরি তুলে নিয়ে বলল, “জায়গায় খুন করে ফেলবো, আর যদি একবার আমার সাথে এভাবে কথা বলিস। পণ্ডিত মশাই! যুদ্ধ বা জাহাজ সম্পর্কে কি জানিস তুই, অ্যাঁ?”

দ্য শ্যাম্পেন বুঝলো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে! “মাফ করবেন অ্যাডমিরাল। আজ দিনটাই আসলে খারাপ।”

“ভাগ এখান থেকে। আর ভাগ্যকে ধন্যবাদ দে যে আমাদের এখনো যুদ্ধে যেতে হচ্ছে না। যদি হয় তাহলে তোকে জাহাজের মাস্তুলে গলায় বেল বেঁধে ঝুলিয়ে রাখবো। যাতে ব্রিটিশরা প্রথমেই তোকে নিশানা করতে পারে।”

দ্য শ্যাম্পেন এক কদম পিছিয়ে মাথাটা হালকা ঝুঁকিয়েই উল্টো দিকে হাঁটা দিল। ওখান থেকে বেরিয়ে ওপরে উঠে এলো ও। জাহাজের সামনের দিকে গিয়ে দূরের ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে লাগল।

এত দূর থেকেও যুদ্ধের ভয়াবহতা ওকে কাঁপিয়ে দিল। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিলো। দূরে দেখা যাচ্ছে দুটো জাহাজ গা ঘেষাঘেষি করে গোলা বর্ষণ করছে। মাস্তুল থেকে মাস্তুল, গলুই থেকে গলুই কিংবা ডেকের ওপর যে যেখান থেকে পারছে উন্মত্তের মতো গুলি করে যাচ্ছে।

“কী সাহস!” দ্য শ্যাম্পেন তন্ময় হয়ে ভাবতে লাগল।

কিন্তু শুধু সাহস থাকলেই হয় না। এই মুহূর্তে ফরাসি বাহিনীর একটা গুলির বিপরীতে প্রায় তিন থেকে চারগুণ বেশি গুলি করছে ব্রিটিশ বাহিনী। আর ভিয়েনেভের অনীহার কারণেই তাদের যুদ্ধরত জাহাজের সংখ্যা এখন বেশি।

যুদ্ধ ক্ষেত্রের ঠিক মাঝে নেলসনের তিনটা জাহাজ মিলে লরিয়েন্টকে আক্রমণ চালাচ্ছে। চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে এখন ওটাকে আর চেনাই যায় না। সুন্দর চকচকে কাঠামো বা বিশাল মাস্তুল বহু আগেই ভেঙে পড়েছে। পুরু কাঠামোর পুরোটাই এখানে সেখানে খাবলা খাবলা উঠে গেছে। কোথাও কোথাও ভেঙে গেছে। যদিও তখনো কয়েকটা কামান অবশিষ্ট আছে, কিন্তু দ্য শ্যাম্পেন, বিশেষজ্ঞ না হয়েও বলতে পারে লরিয়েন্টের সময় শেষ।

হঠাৎ জাহাজটায় আগুন ধরে গেল। দাবানলের মতোই সেটা মেইন ডেকে ছড়িয়ে পড়ল। এখানে সেখানে দেখা গেল ঘন ধোয়ার কুণ্ডলি। দুরন্ত গতিতে আগুনটা সব পালে আর ভাঙা মাস্তুলে ছড়িয়ে পড়ল। তারপর খোলা হ্যাঁচ বেয়ে নিচের খোলেও ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তেই।

হঠাৎ প্রচণ্ড আলোর ঝলকানি। দ্য শ্যাম্পেন সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করেছে কিন্তু তারপরও অন্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্যে। পরমুহূর্তেই শোনা গেল বিকট আওয়াজ। দ্য শ্যাম্পেন জীবনেও এতো জোরালো কোনো শব্দ শোনেনি। শক ওয়েভের প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়ল ও। মাথার চুল পুড়ে গেছে, একটুর জন্যে মুখে লাগেনি।

ও কোনোমতে চিৎ থেকে কাত হলো। বাতাসের জন্যে হাসফাস করছে। কয়েকবার গড়াগড়ি করে কোটের আগুন নেভালো। বহু কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে আবার যুদ্ধের দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেল ওর।

লরিয়েন্ট নেই।

পানির মধ্যে বিশাল একটা এলাকা জুড়ে আগুন জ্বলছে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আশেপাশের ছয়টা জাহাজেও আগুন ধরে গেছে। তিনটা ব্রিটিশ আর তিনটা ফরাসি জাহাজ। যুদ্ধ আপাতত থেমে গেছে। সবাই নিজ নিজ জাহাজের আগুন নেভাতে ব্যস্ত। লরিয়েন্টের পরিণতি কেউ চায় না।

“আগুন নিশ্চয়ই ওটার গোলা রাখার ঘরটায় ঢুকে পড়েছিল।” পাশ থেকে একজন ফরাসি নাবিক বলল দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে।

প্রতিটা জাহাজের খোলেই শত শত ব্যারেল গান পাউডার রাখা। আগুনের একটা স্ফুলিঙ্গও সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে।

 ফরাসি লোকটার গাল বেয়ে অশ্রুর ধারা নামল। কিন্তু দ্য চ্যাম্পিয়নের গা গোলাচ্ছে। এসব আবেগ অনুভূতি ওকে আর স্পর্শ করল না।

লরিয়েন্ট যখন আবুকির বন্দরে পৌঁছায় তখন এতে প্রায় হাজারখানেক মানুষ ছিল। দ্য শ্যাম্পেন নিজেও জাহাজটায় চড়েছে। অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েসের সাথে খাবার খেয়েছে। এই অভিযাত্রায় ও যতজনকে চিনতে তাদের সবাই ছিল ঐ জাহাজটাতে। এমনি অফিসারদের বৌ-বাচ্চারাও ছিল ওতে। তাদের মধ্যের কেউ-ই যে আর বেঁচে নেই, কেউ না বলে দিলেও দ্য শ্যাম্পেন সেটা জানে।

সেই সাথে শেষ হয়ে গেল গত একমাসে ওদের এতো পরিশ্রম। সাথে হাত ছাড়া হয়ে গেল জীবনের শ্রেষ্ঠতম সুযোগ। শুধু ভিয়েনেভের দখল নেয়া ট্রাঙ্কটাই সম্বল এখন।

দ্য চ্যাম্পিয়ন ধপ করে ডেকের ওপর বসে পড়ল, “মিসরীয়রা আমাকে আগেই বলেছিল।” বলল ও।

“আগেই বলেছিল?” জিজ্ঞেস করল নাৰিক।

মৃতদের শহর থেকে কিছু নিতে নিষেধ করেছিল। তাহলে নাকি অভিশাপ লাগবে। বার বার একটা অভিশাপের কথা বলছিল….কুসংস্কার ভেবে তখন হেসেই উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন,…”

দ্য শ্যাম্পেন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু আবার পড়ে গেল। নাবিকটা এসে ওকে ধরে নিচে নিয়ে গেল। তারপর সেখানে বসে বসে ইংরেজদের আগমনের অপেক্ষা করতে লাগল।

আক্রমণটা এলো ভোরের দিকে। ব্রিটিশরা আবার জড়ো হয়ে বাকি ফরাসি জাহাজগুলো ঘায়েল করতে বেরিয়েছে। কিন্তু মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি বা গোলার আঘাতে কাঠের মড়মড় শব্দের পরিবর্তে দ্য শ্যাম্পেন বাতাসের শব্দ শুনতে পেল। তার মানে শুইলাম টেল চলতে আরম্ভ করেছে।

দ্য শ্যাম্পেন ওপরে উঠে এসে দেখে জাহাজ পূর্ণ গতিতে উত্তর-পূর্ব দিকে ছুটছে। ব্রিটিশরাও ধাওয়া করছে কিন্তু ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। দূর থেকেই আলোর ঝলকানি দেখে বোঝা গেল গোলা ছুড়ছে। কিন্তু কোনোটা ধারে কাছেও এলো না। কিছুক্ষণ পর ওদের জাহাজগুলোর পালও হারিয়ে গেল দিগন্তের ওপারে।

 দ্য’ শ্যাম্পেন ভিয়েনেভের সাহসের ব্যাপারে সন্দিহান, তবে লোকটা যে ধূর্ত সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আজও বেঁচে থাকার জন্যে ভিয়েনেভের কাছে ঋণী।

সকাল পড়ে আসতেই শুইলাম টেল আর ভিয়েনরে অধীনে থাকা বাকি তিনটা জাহাজও নেলসন আর ওর সাঙ্গপাঙ্গদের বহুদূর ফেলে এগিয়ে গেল। সেখান থেকে তারা মাল্টায় পৌঁছায়। দ্য শ্যাম্পেন তার বাকিটা জীবন সেখানেই অতিবাহিত করে। গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত ছিল বেশির ভাগ সময়। ভিয়েনেভ আর নেপোলিয়নের সাথে চিঠি চালাচালিও হয়েছে কয়েকবার। তবে কী রহস্য সে মিসর থেকে উদ্ধার করে এনেছিল সেটার হদিস বের করতে না পারার আক্ষেপ তার আমৃত্যু ছিল।

.

০২.

এম. ভি. তোরিনো, মাল্টার পশ্চিমে সত্তর মাইল দূরে
 বর্তমান সময়

এম. ভি. তেরিনো একটা তিনশ ফুটি মালবাহী জাহাজ। পুরো কাঠামোটাই স্টিলের তৈরি। ১৯৭৩ সালে প্রথম পানিতে ভাসানো হয় জাহাজটা। কালের থাবায় আগের জৌলুস আর নেই জাহাজটার। স্পিডও তুলতে পারে না বেশি, তাই এখন আর বেশি দূরত্বে যায় না। ভূমধ্যসাগরের হোট ছোট কিছু দ্বীপ বা কালেভদ্রে লিবিয়া, সিসিলি, মাল্টা আর গ্রিসেই এটার যাত্রা এখন সীমাবদ্ধ।

 ভোর হতে আর এক ঘণ্টা বাকি। মাল্টা থেকে সত্তর মাইল দূরে এখন জাহাজটা। যাচ্ছে পশ্চিমে ছোট্ট একটা ইতালি নিয়ন্ত্রিত দ্বীপ ল্যাম্পেডুসাতে।

এই শেষ রাতেও জাহাজের ওপর বেশ কয়েকজন মানুষের ভিড়। প্রত্যেকেই খুব নার্ভাস। অবশ্য সেটা হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। গত এক ঘণ্টা ধরে একটা নামহীন জাহাজ ছায়ার মতো ওদের জাহাজকে অনুসরণ করছে। জাহাজটার বাতি নিভানো। ধীরে ধীরে দূরত্ব কমছে।

“ওটা কী আরো কাছে চলে এসেছে নাকি?”

চিৎকার করে জাহাজের মাস্টার প্রশ্নটা করল, নাম কনস্ট্যানটিন ব্রাকো। গাট্টাগোট্টা গড়ন, পাকানো পেশি, মাথায় লাল-সাদা চুলে ভরা। তিনদিন দাড়ি না কামানোয় মুখটা দেখাচ্ছে সিরিষ কাগজের মতো।

এই মুহূর্তে জাহাজের হুইল ধরে আছে সে। জবাব না পেয়ে আবার হাক ছাড়লো, “কি হলো?”

“জাহাজটা এখনো দেখা যাচ্ছে। আমাদের দিকেই ঘুরছে। গতিও বাড়ছে বোঝা যাচ্ছে।” ফাস্ট মেট জবাব দিল।

“সব লাইট নিভিয়ে দাও।” ব্রাকো নির্দেশ দিল।

একজন ক্রু মাস্টার সুইচ টিপে দিতেই পুরো তোরিনো আঁধারে ডুবে গেল। সেই সুযোগে ব্রাকো আবারো জাহাজের মুখ আরেকদিকে ঘুরিয়ে দিল।

“ওদের কাছে রাডার বা নাইট ভিশন গগলস থাকলে কিন্তু এসব করে কোনো লাভ হবে না।” ফাস্ট মেট বলল আবার।

“কিছুটা সময় তো অন্তত পাওয়া যাবে।” ব্রাকো জবাব দিল।

“এরা বোধহয় কাস্টমসের লোক বা ইতালিয়ান কোস্ট গার্ডং” আরেকজন ক্রু জিজ্ঞেস করল।

ব্রাকো মাথা নাড়লো, “তা হলে তো ভালোই হয়। বেঁচে যাবে।”

ফার্স্ট মেট ইঙ্গিতটা ধরতে পারলো, “মাফিয়া?”

ব্রাকো মাথা ঝাঁকালো, “আমাদের আগেই বখরা দিয়ে আসা উচিত ছিল। ওদের এলাকায় চোরাচালান করছি। ভাগ তো চাইবেই।”

ব্রাকো ভেবেছিল অন্ধকারে হয়তো ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে, কিন্তু একটু পরেই বুঝলো যে চালে ভুল হয়ে গেছে।

“অস্ত্রপাতি বের করো। লড়াই করা ছাড়া উপায় নেই।” আদেশ করল সে।

“কিন্তু কনস্ট্যানটাইন, গোলাগুলি হলে কিন্তু গোলাগুলির সময় কন্টেইনারগুলোতে গুলি লাগলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”

তেরিনোর ডেক ভরা অনেক ভিন্ন মালবাহী কন্টেইনার। কিন্তু এগুলোর বেশিরভাগের ভেতর-ই তরল পোপেনের একেকটা ট্যাঙ্ক লুকানো। একেকটা ট্যাংক প্রায় একেকটা বাসের সমান বড়। আরো কিছু চোরাচালান সামগ্রীও এর সাথে আছে। মিসরের এক লোক বিশটা ব্যারেল ভরে অজানা এক জিনিস তুলে দিয়েছে। তবে ইউরোপ জুড়ে মাত্রাতিরিক্ত ট্যাক্সের কারণে প্রোপেন চোরাচালানে ব্যাপক লাভ হচ্ছে বর্তমানে।

“শালার চোরাকারবারীদের আজকাল ট্যাক্স দেয়া লাগে,” ব্রাকো নিজেই নিজেকে শোনালো। নিরাপত্তার জন্য টাকা দাও, কারো এলাকা দিয়ে যেতে হলে টাকা দাও, কোথাও জাহাজ ভিড়ালে টাকা দাও। এই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সরকারের চেয়ে কোনো অংশে কম না।

“এখন দ্বিগুণ খেসারত দিতে হবে। টাকাও যাবে, মালপত্রও যাবে। আবার যদি আমাদেরকে মেরে অন্যদেরকে শিক্ষা দিতে চায় তাহলে তো হয়েছেই।”

 ফার্স্ট মেট মাথা ঝাঁকালো, আরেকজনের তেল বাঁচাতে নিজের জান খোয়াতে মোটেও রাজি নয় সে। “আমি বন্দুক বের করছি।” বলল সে।

 ব্রাকো তার দিকে একটা চাবি ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা। হয় মারো নয় মরো পরিস্থিতি এখন।”

 ফার্স্ট মেট অস্ত্রাগারের দিকে ছুটলো। তার আগে নিচের ডেকের সবাইকে ঘুম থেকে তুলবে। সে বের হতেই হুইল হাউজে আরেকজনকে দেখা গেল। একজন যাত্রী। অদ্ভুত নাম তার আম্মন তা। ব্রাকো আর ওর লোকেরা মিসরী বলে ডাকে।

লিকলিকে গড়ন লোকটার। চোখ জোড়া গভীর, মাথা কামানো। গায়ের রং গাঢ় বাদামি। চেহারায় উল্লেখযোগ্য কোনো বৈশিষ্ট্য লোকটার নেই। ব্রাকো ভেবে পায় না কোন দুঃখে লোকটা মাত্র কয়েক ব্যারেল হাশিস/(ভভাংগাঁজার শরতে) বা অন্য কোনো সস্তা মাদক নিয়ে এই ভয়ানক রাস্তায় ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

 “জাহাজের বাতি সব নিভানো যে? আর আমরা আরেক দিকে যাচ্ছি কেন?” কোনো ভনিতা না করেই আম্মান তা জিজ্ঞেস করল।

“সেটাও কী বুঝিয়ে বলতে হবে?”

কিছুক্ষণ চিন্তা করেই মিরীয় দুয়ে দুয়ে চার মিলাতে পারলো। তারপর কোমর থেকে একটা নাইন মি. মি. পিস্তল বের করে হাতে ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল। জাহাজের কিনারে গলা লম্বা করে অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করতে লাগল।

“এদিকে না, পিছন দিকে,” ব্রাকো বলল।

বলামাত্রই ব্রাকো বুঝলল ওর ধারণা ভুল। কারণ সামনে থেকে দুটো লাইট এসে পড়েছে তেরিনোর ওপর। একটার ঝলকে ব্রিজে দাঁড়ানো সবার চোখ ধাধিয়ে গেল, অপরটা জাহাজের রেলিং ধরে ঘুরতে লাগল।

দুটো রাবারের ডিঙ্গিও দেখা গেল পানিতে। ব্রাকো সাথে সাথে জাহাজের মুখ সেদিকে ঘুরিয়ে দিল। কিন্তু কাজ হলো না। তারা দূরে সরে গিয়ে আবার জাহাজের পিছু নিলো। ধরে ফেলবে সহসাই। ডিঙ্গি থেকে হুক বাঁধা দড়ি ছুঁড়ে মারলো কেউ। জাহাজের রেলিং-এ সেটা আটকাতেই কয়েক সেকেন্ড পরই দুই দল অস্ত্রধারী লোক উঠে এলো তোরিনোর ডেকে।

“মাথা নামান,” ব্রাকো চিৎকার করে উঠল।

সাথে সাথে শুরু হলো গুলি। ব্রিজের জানালা আর দেয়াল ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেলো মুহূর্তেই। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো মিসরীয় লোকটা একচুলও নড়েনি। এমনকি কোনো কিছুর আড়ালও নেয়নি। গুলি থামতেই সে হুইল হাউজের আড়ালে সরে গেল, তারপর হাতের পিস্তল তুলে পরপর কয়েকটা গুলি করল।

ব্রাকো অবাক হয়ে দেখে একটাও মিস হয়নি। ঢেউয়ের তালে জাহাজ দুলছে, তারপরও আম্মন তা দুরূহ কোণ থেকে গুলি করে দুজন লোকের একেবারে ঘিলু বের করে দিল। তৃতীয় গুলিতে ওদের দিকে তাক করা একটা স্পটলাইট ভেঙে চুর চুর হয়ে গেল।

গুলি করেই মিসরীয়টা পিছনে সরে দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল। পরমুহূর্তেই সেদিকে অটোমেটিক পিস্তল গর্জে উঠল।

ব্রাকো তখনও মেঝের ওপরেই পড়ে আছে। কারণ গুলি হুইল হাউজের দিকেও করা হচ্ছে। একটা বুলেট ওর বাহু ছুঁয়ে চলে গেল। আরেকটা মামবুকার একটা বোতল গড়িয়ে দিল। সৌভাগ্যের জন্য ব্রাকো রেখে দিয়েছিল ওটা। কিন্তু ভাঙ্গা বোতল থেকে তরল গড়িয়ে পড়তেই ব্রাকো বুঝলো আজ ভাগ্য বেশি সুবিধার না। বোতলে তিনটা কফি বীজ ছিল। একটা হলো উন্নতি, একটা স্বাস্থ্য আরেকটা শান্তির বাহক হিসেবে। কিন্তু তিনটার কোনোটাই এখন চোখে পড়ল না।

রেগেমেগে ব্রাকো ওর পিস্তল বের করল। একবার মিসরীয়টার দিকে তাকাল। এখনও বহাল তরিয়তে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার সাহস আছে বটে। আর নিশানাও মারাত্মক। লোকটার সম্পর্কে ধারণা আমূল পাল্টে গেছে ব্রাকোর। লোকটা যে কে তা ব্রাকো জানে না, তবে মিসরীয় লোকটা-ই যে এই জাহাজের সবচেয়ে মারাত্মক লোক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভাগ্য ভালো। লোকটা আমাদের দলেই আছে। মনে মনে ভাবলো ব্রাকো।

“ফাটাফাটি শুটিং। আপনি যে এই জিনিস, আগে বুঝিনি।”

 “আমি বুঝতে দেইনি তাই,” মিসরীয় বলল।

আবার ভেসে এলো গুলির শব্দ। এবার জাহাজের পিছন দিক থেকে। জবাবে ব্রাকোও সেদিকে গুলি ছুড়লো এক পশলা।

“খামাখা গুলি নষ্ট করছেন, মিসরীয় বলল।

“হোক, কিছুটা সময় তো অতিরিক্ত পাবো,” ব্রাকো জবাব দিল।

“সময় সব ওদের হাতে। ওদের কমপক্ষে এক ডজন লোক আছে এখন জাহাজে। আরো একটা রাবারে ভিঙ্গি এদিকেই আসছে।” মিসরীয় জানালো।

পিছন দিকে আরো এক পশলা গুলি বিনিময়ের শব্দে বোঝা গেল যে মিসরীয়র কথা মিথ্যা নয়।

 “ঝামেলা হয়ে গেল দেখছি। পিস্তল-টিস্তল তো সব পিছন দিকেই রাখা। আমার লোকেরা যদি ওগুলো আনতে না পারে তাহলে তো খেলা এখানেই শেষ।” ব্রাকো বলল।

 মিসরীয় হুইল হাউজের দরজার দিকে এগিয়ে বাইরে তাকাল। তারপর ঘুরে বলল, “আপনার আশংকাই সত্যি।”

 বাইরে ভারি পদশব্দ শোনা গেল। ব্রাকো পিস্তল হতে গুলি করার জন্যে রেডি হয়ে গেল। কিন্তু মিসরীয় দরজা খুলতেই কাঁপতে কাঁপতে এক আহত ক্রু মুখ থুবড়ে পড়ল ঘরটায়।

“ওরা নিচের ডেকের দখল নিয়ে নিয়েছে। কোনো মতে উঠে বসে বলল সে।

“রাইফেলগুলো কই?”

ক্রু মাথা নাড়লো, “ওগুলোর কাছেও যেতে পারিনি।”

লোকটা পেট চেপে ধরে আছে। বুলেটে ফুটো হয়ে গেছে জায়গাটা। রক্ত পড়ছে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। কাত হয়ে পড়ে গেল একদিকে, নড়ছে না।

এদিকে আততায়ীর দলও এগিয়ে আসছে বোঝা যাচ্ছে, সামনে যা কিছু পড়ছে, তাতেই গুলি করছে। ব্রাকো এগিয়ে ওর কুটাকে সাহায্য করার চেষ্টা করল।

ওকে ছাড়ুন। আমাদেরকে এখান থেকে সরতে হবে। মিসরীয় বলল, ব্রাকোর মোটেও সে-ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু লোকটার সময় শেষ, ও থেকেও কিছু করতে পারবে না। ভয়ানক রেগে গেছে সে, এখন কারো খুন ঝরাতে না পারলে মাথা ঠাণ্ডা হবে না। পিস্তল বাগিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো সে। সামনে যাকেই পাবে তাকেই পরপারে পাঠাবে বলে সংকল্প করেছে মনে মনে। কিন্তু মিসরীয় লোকটা ওকে টেনে ধরলো।

“আমাকে ছেড়ে দিন।” ব্রাকো আদেশ দিল।

 ‘খামাখা মরার ইচ্ছে হচ্ছে কেন?”

“শুয়োরের বাচ্চারা আমার লোকজনকে মারছে আর আমি আঙুল চুষবো। উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো ওদের।”

“আপনার লোকজনের কোনো দাম নেই। ওরা যায় যাক। আমাদেরকে আমার মাল পৌঁছাতে হবে জায়গা মতো।” ঠান্ডা স্বরে বলল আম্মন তা।

ব্রাকো হতভম্ব হয়ে গেল। “আপনার মাথা কি খারাপ? আপনার কি মনে হয় আপনি জীবন নিয়ে এই জাহান্নাম থেকে পালাতে পারবেন?”

“ঐ ব্যারেলগুলোতে যা আছে তা বহুগুণে শক্তিশালী। সময় মতো পৌঁছাতে পারলে ঐ বেকুবগুলোর হাত থেকে আপনার জাহাজ বাঁচানো কোনো ব্যাপারই হবে না। এখন দেরি না করে আমাকে ওগুলোর কাছে নিয়ে চলুন।”

ব্রাকো খেয়াল করল কথাগুলো বলতে বলতে মিসরীয় লোকটার চোখ কেমন অদ্ভুত এক উজ্জ্বলতায় ভরে উঠল। সম্ভবত লোকটা মিথ্যা বলছে না। “ঠিক আছে, আসুন।”

 ব্রাকো সামনে এগিয়ে ভাঙ্গা জানালাটা দিয়ে লাফিয়ে কাছের কন্টেইনারটার ওপর গিয়ে পড়ল। মিসরীয়ও এলো তার পিছু পিছু।

 জানালা থেকে ডেকের উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট কিন্তু অন্ধকার থাকায় ব্রাকো তাল সামলাতে পারলো না। অদ্ভুত শব্দ করে আছড়ে পড়লো। হাঁটু ছিলে গেছে।

 মিসরীয়ও ওর পাশেই লাফিয়ে নামল। তারপর হামাগুঁড়ি দিয়ে এক পাশে সরে গেল।

 “আপনার মাল কন্টেইনারের প্রথম সারিগুলোর মধ্যেই আছে। এদিক দিয়ে আসুন।” ব্রাকো বলল।

দুজন প্রায় দৌড়ে কন্টেইনারগুলো পার হলো। একদম সামনের সারিতে পৌঁছে ব্রাকো কন্টেইনার বেয়ে নিচে নেমে এলো তারপর মেঝেতে শুয়ে পড়ল।

 মিসরীয়ও একই কাজ করল। দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ লুকিয়ে থাকল সেখানে। থেকে থেকে বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে দূরে। যুদ্ধ প্রায় শেষ।

“এটাতেই আছে আপনার জিনিস।” ব্রাকো বলল।

“খোলেন তাড়াতাড়ি।” মিসরীয় তাড়া দিল।

ব্রাকো ওর মাস্টার কী বের করে তালা খুলে ফেলল। তারপর দরজা ধরে টান দিতেই প্রাচীন কাগুলো তীক্ষ্ণ ক্যাচ ক্যাচ শব্দে করে উঠল। ব্রাকো শিউরে উঠল তাতে।

“ভেতরে যান।” মিসরীয় আদেশ করল।

ব্রাকো ভেতরে ঢুকে একটা টর্চ জ্বাললো। প্রায় পুরো কন্টেইনার জুড়েই আছে একটা প্রোপেন ভরা সিলিন্ডার। তার পিছনেই দেখা গেল সাদা রঙের কয়েকটা ব্যারেল।

ব্রাকো আম্মন তাকে সেদিকে নিয়ে গেল।

“এখন?” ব্রাকো জিজ্ঞেস করল।

 কিন্তু মিসরীয় কোনো জবাব দিল না। চুপচাপ একটা ব্যারেলের ওপরে চাপ দিয়ে খুলে ফেলল। ব্রাকো অবাক হয়ে দেখলো সাদাটে ধোয়া মতো কিছু জিনিস ব্যারেলের কিনার বেয়ে উপচে পড়ল। আশপাশটাও কেমন শীতল হয়ে গেল। “কি এর ভেতর? তরল নাইট্রোজেন?” আম্মন তা এ কথারও কোনো জবাব দিল না। হিমাঙ্কের নিচে সংরক্ষিত একটা বোতল তুলে আনলো ব্যারেলের ভেতর থেকে। একপাশে আজব একটা চিহ্ন।

চিহ্নটা কি সেটা ব্রাকো না বুঝলেও ধরন দেখে মনে হচ্ছে এটা কোনো ধরনের নার্ভ গ্যাস বা সেরকম কিছু।

 “ওরা এই জিনিসটাই খুঁজছে।” হঠাৎ বুঝতে পেরে বলে উঠল ব্রাকো। “এসব প্রোপেন বা টাকার ধান্দায় ওরা আসেনি। ওদের দরকার আপনাকে আর এই জিনিসটাকে। আপনার জন্যেই শয়তানগুলো আমার লোকদের মেরে শেষ করেছে।” বলতে বলতে আম্মন তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ব্রাকো।

ঘটনার আকস্মিকতায় মিসরীয় এক মুহূর্তের জন্যে থমকে গিয়েছিল কিন্তু সামলে নিলো দ্রুত। ব্রাকোর উদ্যত হাত একপাশে ঠেলে দিল, তারপর বাহু ধরে একটা মোচড় দিয়ে আছড়ে ফেলল মাটিতে।

মাটিতে পড়ামাত্র ব্রাকোর বুকের ওপর চড়ে বসলো মিসরীয়। ব্রাকো ওর চোখের দিকে তাকাল। দয়া-মায়ার লেশমাত্র নেই সেখানে।

“আপনাকে আর কোনো দরকার নেই।” মিসরীয় বলল।

তিনকোণা ছুরিটা পেটে ঢুকতেই ব্রাকোর সারা শরীরে প্রচণ্ড একটা যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল। মিসরীয় ছুরিটা একটা মোচড় দিয়ে বের করে নিলো।

ব্যথার চোটে ব্রাকোর শরীর কুঁকড়ে এলো। পেট চেপে ধরে আছে। কিন্তু স্রোতের মতো গল গল করে রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না মোটেও।

ধীরে ধীরে যন্ত্রণাদায়ক এক মৃত্যু হচ্ছে ব্রাকোর। মিসরীয় পাশে দাঁড়িয়ে ধীরে সুস্থে ছুরির রক্ত মুছে আবার ঢুকিয়ে রাখলো খাপে। যেন কোনো তাড়া নেই, ব্যাপারটা উপভোগ করছে। তারপর একটা স্যাটেলাইট ফোন বের করে একটা বোতামে টিপ দিল।

“আমাদের জাহাজে কারা যেন আক্রমণ করেছে। সম্ভবত স্থানীয় সন্ত্রাসী।” লাইনের অপর প্রান্তে থাকা কাউকে বলল সে।

দীর্ঘকাল আর কোনো কথা হলো না। তারপর মিসরী নিজের মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “ওরা সংখ্যায় অনেক জন… হ্যাঁ, আমি জানি কি করতে হবে….’ডার্ক মিস্ট’ অন্য কারো হাতে পড়া চলবে না। ওসাইরিসকে আমার কথা বোলো। পরকালে তোমার সাথে দেখা হবে।”

লাইনটা কেটে প্রোপেন ট্যাঙ্কের দিকে এগুলো ও। তারপর একটা বাঁকা রেঞ্জ দিয়ে ট্রাঙ্কের ভালভ খুলে দিল। হিসস শব্দ করতে করতে বেরিয়ে এলো গ্যাস।

তারপর পকেট থেকে একটা ছোেট্ট বিস্ফোরক চার্জ বের করে টাইমার সেট করল। তারপর সেটা লাগিয়ে দিল ট্যাঙ্কটার গায়ে। তারপর কন্টেইনারের দরজা দিয়ে বেরিয়ে অন্ধকারে মিশে গেল।

নিজের রক্তের পুকুরে শুয়ে থাকলেও ব্রাকো পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি। কি হতে যাচ্ছে পুরোটাই বুঝেছে সে। তবে যেটাই হোক মরার হাত থেকে তার বাঁচা নেই। তবে চেষ্টা করলে বিস্ফোরণটা থামাতে পারবে সে। সেই সিদ্ধান্তই নিলো মনে মনে।

গড়িয়ে উবু হলো ব্রাকো। ব্যথায় গোঙ্গাচ্ছে। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে কীভাবে ও ট্রাঙ্কের কিনারে পৌঁছালো তা ও বলতে পারবে না। লাল গালিচার মতো লম্বা লাল রঙের দাগ হয়ে আছে পুরোটা। প্রথমে ও রেঞ্চটা দিয়ে ভালভটা লাগানোর চেষ্টা করল কিন্তু শক্তিতে কুলালো না। রেঞ্চটাই ঠিকমতো তুলতে পারছে না।

সেটা ফেলে তাই আবার ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগুনো শুরু করল। প্রতিবারই গঙ্গিয়ে উঠছে অমানুষিকভাবে। প্রোপেনের গন্ধে বমি বমি লাগছে ওর, আর পেটের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। চোখে ঝাপসা দেখছে বিস্ফোরকটা দেখতে পাচ্ছে কিন্তু টাইমারে লাগানো বোতামগুলোর একটাও পড়তে পারছে না। ও হাত বাড়িয়ে ওটা টান দিয়ে খুলে নিলো আর সেই মুহূর্তে আবার কন্টেইনারের দরজা শব্দ করে খুলে গেল।

ব্রাকো ঘুরে তাকাল। দুজন লোক দৌড়ে এলো, হাতে অস্ত্র, ওর দিকেই তাক করা। ওর কাছে পৌঁছাতেই ওর হাতের টাইমারটা নজরে এলো।

টাইমারের সব ডায়াল সেই মুহূর্তে ‘জিরো’-তে পৌঁছে গেছে।

ব্রাকোর হাতেই সেটা বিস্ফোরিত হলো আর গ্লোপেনে আগুন ধরে গেল। চোখ ধাঁধানো আলোয় কন্টেইনারটাও উড়ে গেল একপাশে।

বিস্ফোরণের ধাক্কায় সামনের সারির সব কন্টেইনার জায়গা থেকে নড়ে গেল, তারপর রেলিং ভেঙে গড়াতে গড়াতে সাগরের পানিতে পড়ে গেল।

 ব্রাকো আর সেই দুজন লোক যেন বাষ্প হয়ে গেছে, কোনো অস্তিত্বই নেই। তবে ব্রাকো কিন্তু মিসরীর পরিকল্পনা ঠিকই ভেস্তে দিতে পেরেছে। সাথে লাগানো না থাকায় বিস্ফোরণ পুরু প্রোপেন সিলিন্ডারের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। শুধু প্রোপেনে আগুন লেগে গেছে আর হিস হিস করে প্রোপেনের সাথে আগুন বেরিয়েই যাচ্ছে।

আগুনের লকলকে শিখার সামনে যা পড়েছে তাই গলে পড়ে যাচ্ছে। এদিকে অবলম্বন না থাকায় সিলিন্ডারটা নাড়াচাড়া করতে করতে মুখটা একসময় ডেক-এর দিকে ঘুরে গেল।

 প্রচণ্ড তাপে স্টিলের মেঝেও গলা আরম্ভ হলো। কয়েক মিনিট পরই সিলিন্ডারের একটা কোণা মেঝেতে দেবে গেল। আগুনের শিখা এখন আরো ভালোভাবে মেঝের দিকে ঘুরে গেল। পুরো মেঝেটাই গলে পড়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

আরো বিশ মিনিট ধরে জাহাজটা জ্বলতে লাগল। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন একটা ভাসমান আগুনের গোলা। পশ্চিমে ভাসতে ভাসতে ভোরের ঠিক আগে ওটা একটা শৈল শ্রেণিতে বাড়ি খেয়ে থামল। ল্যাম্পেডুসা থেকে মাত্র আধা মাইল দূরে সেটা।

দ্বীপের সকাল বেলার পাখিরা আগুন দেখে এগিয়ে এলো, এবং ছবি তুলতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রোপেনের ট্যাঙ্কগুলোর কাছে আগুন পৌঁছে গেল আর পনের হাজার টন ঘনীভূত জ্বালানি বিস্ফোরিত হলো সবার চোখের সামনে। দূর দিগন্তের সূর্যের চেয়েও এটার উজ্জ্বলতা বেশি।

বিস্ফোরণের দমক কমতেই দেখা গেল এম. ভি. তেরিনোর পাটাতন বলে কিছু নেই। খোলটা একটা ভোলা টিনের ক্যানের মতো পড়ে আছে। তার ওপরেই কালো ধোঁয়ার একটা আস্তরণ। বাতাসে সেটা দ্বীপের দিকে ভেসে যাচ্ছে। দেখে মনে হয় হাজার বছর ধরে বৃষ্টি জমানো কোনো মেঘ বুঝি ভেসে আসছে।

কিছুক্ষণ পরই মৃত সামুদ্রিক পাখিরা আকাশ থেকে খসে পড়তে লাগল বালিতে আর সমুদ্রের পানিতে।

যারা দেখতে এসেছিল তারা প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দিল কিন্তু তার আগেই কুয়াশা তাদের ঘিরে ফেলল আর পাখিগুলোর মতো তারাও ধুপধাপ আছড়ে পড়তে লাগল।

বাতাসে ভেসে ভেসে সেই কুয়াশা দ্বীপকে উজাড় করে আরো পশ্চিমে চলে গেল। পেছনে পড়ে থাকল নিঃসীম শূন্যতা আর লাশ ভরা এক খণ্ড ভূমি।

.

০৩.

ভূমধ্য সাগর, ল্যাম্পেডুসা দ্বীপের তের মাইল দক্ষিণপূর্ব

একটা ঝাপসা অবয়ব আলতো করে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগরের বুকে। বোঝাই যায় লোকটা এতে অত্যন্ত দক্ষ এবং অভ্যস্ত। নিচ থেকে দেখলে লোকটাকে মানুষ না বরং কেমন স্বর্গীয় দূত বলে ভ্রম হয়। শরীরের দুপাশে দুটো স্কুবা টাঙ্ক ঝোলানো, পিঠে পেটমোটা একটা ব্যাগ মত জিনিস, একটা প্রপালশন ইউনিটও বাধা পিঠের সাথে। তাতে এক জোড়া ছোট্ট পাখা। কাঁধে দুটো লাইট ঝোলানো। ওটার হলদেটে আলো ভৌতিক আবহ ছড়িয়ে আশেপাশের অন্ধকারকে চিরে দিছে।

প্রায় একশো ফুট নিচে সমুদ্রের তলের কাছাকাছি পৌঁছে লাইটটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিচটা দেখতে লাগল সে। কমলা রঙের পোশাক পরা কিছু ডুবুরি সেখানে কিছু একটার ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারে ব্যস্ত। জিনিসটা উদ্ধার হলে রোম আর কার্থেজদের মধ্যকার ঐতিহাসিক পিউনিক যুদ্ধের ইতিহাসের নতুন একটা দিক উন্মোচিত হবে।

 লোকগুলোর থেকে প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূরে সমুদ্র তলে নেমে দাঁড়ালো লোকটা, তারপর বাম বাহুতে ঝোলানো ইন্টারকমের সুইচ টিপে দিল।

 “অস্টিন বলছি। তলায় পৌঁছে গেছি, এখন উদ্ধার কাজের দিকে এগুবো।” হেলমেটের সাথেই লাগানো মাইক্রোফোনে বলল লোকটা।

“রজার দ্যাট। জা-ভালা আর উডসন তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।” কাঁপা কাঁপা একটা কণ্ঠ জবাব দিল।

কার্ট অস্টিন প্রপালসন ইউনিটটা চালু করে দিল, তারপর পা দিয়ে মাটিতে হালকা ধাক্কা দিতেই সে এগিয়ে গেল উদ্ধার কাজটার দিকে। যদিও বেশিরভাগ ডুবুরি-ই স্টান্ডার্ড ড্রাই-স্যুট-ই পরে আছে, তবে কার্ট আর আরো দুজনের পরনে নতুন এক ধরনের হার্ড স্যুট। এটা নিয়ে অবশ্য এখনও পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। এই স্যুটগুলোর সুবিধা হলো এতে চাপের কোনো হেরফের হয় না, ফলে পানিতে ওঠানামার সময় ডিকমপ্রেশনের জন্যে থামতে হয় না।

এখন পর্যন্ত কার্টের কাছে স্যুটটা ভালোই লাগছে। শুধু একটু বড়, এই যা। উদ্ধারকর্মের কাছে পৌঁছাতেই কার্টের হাতে একটা ট্রাইপড ধরিয়ে দেয়া হলো। ওটার মাথায় একটা আন্ডারওয়াটার ফ্লাডলাইট বসানো। পুরো জায়গাটাতেই এরকম আরো অনেক লাইট বসান। একটু দূরেই একটা টারবাইনের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, সেটা দিয়েই জ্বলছে এগুলো।

স্রোতের ধাক্কায় টারবাইনের পাখাগুলো ঘোরে আর বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। ফলে আলো পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর, উদ্ধার কাজও চলছে দ্রুত গতিতে।

কার্ট প্রাচীন বিধ্বস্ত জাহাজটার পিছনের দিকে চলে এলো।

“আরে দেখো দেখো কে এসেছে!” হেলমেটের ইন্টারকমে বলে উঠল একজন।

“আমাকে তুমি চেনো। আমার কাজই হলো কাজ শেষে এসে সব ক্রেডিট নিজের করে নেয়া।” কার্ট বলল।

অন্যজন হেসে দিল। কথাটায় সত্যের লেশমাত্র নেই। কার্ট অস্টিন হলো সবার আগে এসে সবার পরে যাওয়া মানুষ। ওর মতো ঘাড় ত্যাড়া মানুষও কম-ই আছে। কোনো প্রজেক্ট আর সবাই বাতিল করে দিলেও ও লেগে থাকবেই। থাকতে থাকতে হয় সত্যিই নতুন কিছু বের করে আনে নয়তো শেষ উপায়টাও কাজে লাগিয়ে তার পরেই থামে।

“জাভালা কই?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

অন্যজন দূরে এক দিকে ইঙ্গিত করল। জায়গাটা একদমই অন্ধকার।

“কি যেন গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস দেখানোর জন্যে খুঁজছে তোমাকে। পুরনো এক বোতল জিন (মদ) খুঁজে পেয়েছে মনে হয়।”

কাট মাথা ঝাঁকিয়ে আবারো প্রপালসন চালু করল। তারপর জো জাভালা যেখানে কাজ করছে সেদিকে এগুলো। ওখানে আরো একজন আছে, নাম মিশোলি উডসন। ধ্বংসস্তূপের সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা খুড়ছে ওরা।

কিছু একটা বের করে প্লাস্টিকে মুড়ে রেখেছে, যাতে করে বালি ঢুকতে না পারে।

কার্টকে দেখে জো একটু সিধে হলো তারপর ইন্টারকমে দুষ্টুমির সুরে বলল, “এই ব্যাটা হাত চালিয়ে কাজ কর, এল জেফে আমাদের দেখতে আসছেন।”

একদিক দিয়ে কথাটা সত্য, কারণ কার্ট এখন ন্যাশনাল আন্ডারওয়াটার এন্ড মেরিন এজেন্সী (NUMA)’র স্পেশাল এসাইনমেন্ট ডাইরেক্টর। NUMA হলো স্বায়ত্তশাসিত একটা সরকারি প্রতিষ্ঠান। সমুদ্রের গহীনে লুকানো রহস্য নিয়ে এদের কারবার। তবে কার্ট ঠিক অন্যান্য বসের মতো না। ওর কাছে দলগত প্রচেষ্টাটাই আসল। তবে বিপজ্জনক কোনো কিছু করার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ওর নীতি আলাদা। ওসব কাজে ও নিজেই এগিয়ে যায়। ওর মতে, এসব কাজ করা একজন দলপতির-ই দায়িত্ব।

আর জো জাভালা কার্টের অধীনস্থ হলেও দুজনের সম্পর্কটা আরও অনেক বেশি গাঢ়। বহু বছর ধরে দুজন একসাথে এসব ভাঙ্গাচোরা জিনিস নিয়ে কারবার করছে। এইতো গত বছরই ওরা ১৯০৯ সালে ডুবে যাওয়া জাহাজ এস, এস, ওয়ারাথ উদ্ধার করেছে, একসাথে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যবর্তী DMZ (দুটো দেশের মধ্যবর্তী জায়গা যেখানে সামরিক অভিযান নিষিদ্ধ) এর নিচের একটা টানেলে আটকা পড়েছে; পৃথিবীর ভয়ংকরতম টাকা জালকারী দলটাকে আটকেছে। এরা শুধু কম্পিউটার ব্যবহার করতে, ছাপাখানার ধারে কাছেও যেতো না।

এরপর দুজনেরই ছুটিতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। ভূমধ্যসাগরের নিচে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারের খবর শুনে তাই আর দেরি করেনি।

“তোমরা দুজন নাকি এখানে ফাঁকিবাজি করছো? তোমাদের আজকের বেতন কাটা।” কার্টও রসিকতা করল।

 জো হাসলো, “কাটলে কাটো, তবে বাজির টাকাটা পেলেই সব উসুল হয়ে যাবে।”

“বাজি জিতেছ? তুমি? সূর্য কি পশ্চিমে ওঠলো নাকি আজ?”

জো প্রাচীন জাহাজটার ভাঙাচোরা কাঠামোটা দেখলো, “এটার সোনার স্ক্যান দেখার পর তুমি কি বলেছিলে মনে আছে?”

“বলেছিলাম এটা কার্থেজদের জাহাজ, আর তুমি বাজি ধরেছিলে যে এটা একটা রোমান জাহাজ। আর এখন পর্যন্ত যা কিছু উদ্ধার হয়েছে, তা থেকেই বলে দেয়া যায় না যে আমার কথা-ই ঠিক।”

“কিন্তু আমার কথা যদি অর্ধেক সত্যি হয়?”

“তাহলে তো তোমার ভাগ্যটা অন্য দিনের চেয়ে ভালোই বলতে হবে আজ।”

জো আবারো হেসে মিশেলির দিকে ফিরে বলল, “ওকে জিনিসিটা দেখাও।”

 মিশেলি হাত নেড়ে কার্টকে এগিয়ে আসতে ইঙ্গিত করে সদ্য উদ্ধার করা একটা অংশের দিকে লাইট তাক করে ধরলো। লম্বা-কাটার মতো একটা জিনিস দেখা গেল সেখানে। এই ধরনের কাটাগুলো আগের কালের পালতোলা জাহাজের সামনে লাগানো থাকতো অন্য জাহাজের খোল ফুটো করার কাজে লাগতো এটা। জিনিসটা একটা কাঠের মধ্যে গাঁথা। ওখানকার বালি সরিয়ে ফেলায় এখন সেখানে সম্পূর্ণ আলাদা আরেকটা জাহাজের ভাঙ্গা কাঠামো দেখা যাচ্ছে।

“জিনিসটা কি?” কার্ট জিজ্ঞেস করল। “ওটা হলো একটা বায়স, জো বলল।

বায়স মানে হলো কাক। লোহার কাটাটা প্রায় হুবহু দেখতে কাকের ঠোঁটের মতো। নামকরণও তাই এরকম।

 জো আবার শুরু করল, “ইতিহাস নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি। রোমানরা খুবই দক্ষ যোদ্ধা হলেও পানির কাছে এরা ছিল অসহায়। অপর দিকে কার্থজিনিয়ানরা ছিল এদিক দিয়ে রোমানদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে। রোমানরা তাই বিকল্প চিন্তা করল। জাহাজের সামনের দিকে এই রকম কাটা লাগিয়ে নিলো যাতে প্রতিপক্ষের জাহাজকে ফুটো করে আটকে ফেলা যায়। আটকে গেলেই ওরা দড়ি বেয়ে বা লাফিয়ে অন্য জাহাজে চড়ে বসতো, তারপর শত্রুদেরকে কচুকাটা করতো। এই কৌশলে ওরা প্রায় প্রত্যেকটা সামুদ্রিক যুদ্ধকেই শেষ পর্যন্ত সম্মুখ যুদ্ধে পরিণত করতে সক্ষম হয়।”

“তার মানে এখানে জাহাজ দুটো?”।

জো মাথা ঝাঁকালো, “একটা রোমান যুদ্ধ জাহাজ আর একটা কার্থেজনিয়ান জাহাজ। বায়স দিয়ে এখনো গাথা। প্রায় দুহাজার বছর আগে এখানে একটা যুদ্ধ হয়েছিল। ভাবা যায়!”

কার্ট এই নতুন আবিষ্কারে চমৎকৃত হলো, “কিন্তু ডুবলো কীভাবে?”

“সংঘর্ষের আঘাতে সম্ভবত। এতো জোরে ধাক্কা লেগেছিল যে দুটোর কাঠামোতেই চিড় ধরে যায়।” জো অনুমান করল। “আর রোমানরাও বোধহয় ওদের বায়স সময়মতো খুলে নিতে পারেনি। ফলে দুই শত্রু গলাগলি করে পানিতে ডুবে মরলো, এখনো সেভাবেই আছে।”

 “তার মানে আমরা দুজনেই ঠিক। তোমার একশ টাকা বেঁচে গেল।”

“একশ টাকা?” বিস্ময় ঝরে পড়ছে মিশেলির কণ্ঠে। “তোমরা দুজন প্রায় গত একমাস ধরে এই বাজির কথা বলে বলে কানের পোকা নাড়িয়ে দিয়েছ। আর সেই বাজি কি-না মাত্র একশ টাকার?”

“টাকাটাইতো সব না। কার কথা ঠিক হয় সেটাই আসল।” কার্ট বলল।

“আর ও আমার বেতন কেটে রেখেছে। সম্বল বলতে ঐ বাজির টাকাটাই ছিল,” জো বলল।

“তোমাদের দুজনেরই মাথার স্ক্রু ঢিলা,” মিশেলি বলল।

কার্ট এই কথার সমর্থনে গর্ব করে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তার আগেই ইন্টারকমে আরেকটা কণ্ঠ শোনা গেল।

হেলমেটের সামনের ডিসপ্লে থেকে জানা গেল কণ্ঠটা ‘সী ড্রাগন থেকেই আসছে। তবে ডিসপ্লের নিচে ছোট্ট একটা তালা আর তার পাশে নিজের আর জো-এর নাম দেখে বুঝলো ওরা দুজন বাদে কথাটা আর কেউ শুনতে পাচ্ছে না।

 “কার্ট, গ্রে বলছি। তুমি আর জাভালা শুনতে পাচ্ছ?” কণ্ঠটা বলল। গ্যারি রেনল্ডস হলো সী ড্রাগনের ক্যাপ্টেন।

“পরিষ্কার। শুধু আমাদের দুজনের সাথেই কথা বলছে দেখছি। কোনো সমস্যা?”

“সম্ভবত, রেডিওতে একটা সাহায্যের আবেদন ধরা পড়ছে। কি করব বুঝতে পারছি না।”

“কেন?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“কারণ, আবেদনটা কোনো জাহাজ থেকে আসছে না। আসছে ল্যাম্পেডুসা থেকে।”

“ঐ দ্বীপটা থেকে?”

ল্যাম্পেডুসা দ্বীপটা ছোট। মাত্র পাঁচ হাজার লোকের বাস সেখানে। যদিও এটি ইতালির অধীনে, কিন্তু লিবিয়া থেকেই বেশি কাছে। সী ড্রাগন প্রতি সপ্তাহে একবার সেখানে গিয়ে তেল আর রসদপত্র নিয়ে আসে। এখনও এখানে NUMA-র পাঁচজন লোক আছে। উদ্ধারকৃত জিনিসগুলো দেখভালের জন্য।

কার্টের মনের ভেতরের প্রশ্নটা জো-ই করল : “দ্বীপে ঝামেলা তো এই মেরিন চ্যানেলে সাহায্যের আবেদন পাঠাচ্ছে কেন?”

“জানিনা। বুদ্ধি করে রেডিও অপারেটরেরা ওটা রেকর্ড করে ফেলেছে। বেশ কয়েকবার শুনেছি আমি। কলটা ভুয়াও হতে পারে, তবে ঐ দ্বীপ থেকে যে এসেছে সেটা নিশ্চিত।”

“আমাদেরকে শোনানো যাবে?”

“সেজন্যেই তো ফোন দিলাম। দাঁড়াও।” রেনল্ডস বলল। কয়েক সেকেন্ড পরেই একটা গুনগুন শোনা গেল তারপরেই শোনা গেল একজনের কণ্ঠস্বর। প্রথম কয়েকটা কথার কিছুই বোঝা গেল না। তারপর কণ্ঠটা পরিষ্কার হলো। একজন মহিলা কথা বলছে। কণ্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে মহিলা মারাত্মক বিপদে পড়েছে কিন্তু খুব কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখেছে। প্রথম বিশ সেকেন্ড ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলল, তারপর ইংরেজিতে।

“….আবার বলছি, আমি ড. রেনাটা অ্যামব্রোসিনি….কারা যেন আক্রমণ করছে…..আমি হাসপাতালে আটকা পড়েছি…..কেউ সাহায্য করুন…আমরা বের হতে পারছি না। অক্সিজেনও কমে আসছে। প্লিজ কেউ সাড়া দিন।”

কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে আবার শুরু হলো একই কথা।

“ইমার্জেন্সি লাইনগুলো চেক করেছ? ওখানে কেউ কিছু বলছে?” জো জিজ্ঞেস করল।

 “নাহ। তবে আমি ওখানকার আমাদের লোকগুলোকে ফোন করেছিলাম। কেউ ধরেনি।” রেনল্ডস বলল।

“এ রকম তো হওয়ার কথা না। আমরা সমুদ্রে যতক্ষণ থাকি ততোক্ষণতো সবসময়ই রেডিওর পাশে কারো না কারো থাকার কথা। জো বলল।

কার্টও সায় দিল তাতে। “অন্য কাউকে ফোন দাও। বন্দরের কাছেই একটা ইতালিয়ান কোস্ট গার্ডের অফিস আছে। ওদের কমান্ডারের সাথে কথা বলা যায় কি-না দেখো।”

“চেষ্টা করেছি। রেডিওগুলোতে কিছু হলো কি-না ভেবে, স্যাটেলাইট ফোনেও চেষ্টা করেছি। কাজ হয়নি। আমার কাছে ল্যাম্পেডুসার যতগুলো নাম্বার ছিল সবটাতে ফোন দিয়েছি। পুলিশ স্টেশন এমনকি পিজ্জার দোকানেও, কিন্তু কেউই ফোন ধরেনি। সামান্যতেই ঘাবড়ানোর লোক আমি না, কিন্তু তবুও কেন যেন মনে হচ্ছে পুরো দ্বীপটাই একসাথে চুপ মেরে গেছে।”

এত সহজেই উপসংহারে পৌঁছানোর লোক কার্ট না, যদিও মহিলাটা বলেছে যে তাদেরকে আক্রমণ করা হয়েছে। “পালের্মোতে ইতালিয়ান কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করো। জাহাজ থেকে আসুক না আসুক, সাহায্যের আবেদন মানে সাহায্যের আবেদন। ওদেরকে জানাও যে কি হয়েছে সেটা দেখতে আমরা ওখানে যাচ্ছি।

“আগেই ভেবেছিলাম যে তুমি যাবে। ডাইভ কেবলগুলো চেক করে দেখেছি। তুমি, জো আর মিশেলি উঠে আসতে পারো ওপরে। বাকিদের ডিপ্রেশন ট্যাংক হয়ে আসতে হবে।” রেনল্ডস বলল।

‘কার্টও সেটাই ভেবেছিল। ও খবরটা বাকি সবাইকে জানিয়ে দিল। সবাই দ্রুত লাইটগুলো নিভিয়ে, জিনিসপত্র রেখে ধীরে ধীরে পানির ওপরে উঠতে লাগল। দড়ি দিয়ে ডিপ্রেশন ট্যাংকটা নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। সেটাতে করেই তাদেরকে ওপরে তুলে আনা হলো।

 কার্ট, জো আর মিশেলি প্রপালসন ইউনিট ব্যবহার করে ওপরে উঠে এলো। ওপরে উঠে স্যুট খুলতে না খুলতেই রেনল্ডস আবারো খারাপ খবর দিল, ল্যাম্পেডুসার থেকে আর একটা শব্দও শোনা যায়নি। কোনো সামরিক বা কোস্টগার্ড বাহিনীর কাছ থেকেও কোনো সাড়া নেই।

“সিসিলি থেকে দুটো হেলিকপ্টার পাঠাবে বলেছে। তবে আরো আধাঘণ্টার আগে ওরা রওনা দেবে না। আর এখানে আসতে আরও ঘণ্টাখানেক লাগবে।”

“ততক্ষণে আমরা দ্বীপে পৌঁছে, নাস্তাপানি সেরে বোতল নিয়ে বসে পড়তে পারবো।” জো বলল।

“সে জন্যেই ওরা আমাদেরকেই একটু দেখতে বলছে যে কি হয়েছে। কারণ এই এলাকায় আমরাই একমাত্র সরকারি লোক। যদিও আমাদের সরকার আটলান্টিকের ঐ পাশে।” রেনল্ডস বলল।

 “সেটাই ভালো। আমাদের কারো কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হবে না। চাইলেই ভেগে যেতে পারবো।”

“আমি তাহলে জাহাজ ছেড়ে দিচ্ছি।” রেনল্ডস বলল।

কার্ট মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল।

.

০৪.

সী ড্রাগন ল্যাম্পেডুসার কাছে পৌঁছাতেই প্রথমে যে জিনিসটা নজরে পড়ল তা হলো ঘন, কালো তৈলাক্ত ধোঁয়ার একটা স্তর। দ্বীপের অনেক ওপরে স্থির হয়ে আছে। কার্ট শক্তিশালী একটা বাইনোকুলার দিয়ে সেটা দেখার চেষ্টা করল।

“কি দেখা যায়?” জো জিজ্ঞেস করল।

“জাহাজ মতো মনে হচ্ছে। তীরের কাছেই।” কার্ট বলল।

 “ট্যাঙ্কার (তেলবাহী জাহাজা?)”

“বোঝা যাচ্ছে না। ধোঁয়ায় ঘিরে আছে চারপাশ। শুধু মোচড়ানো একটা ধাতব কাঠামো মতো দেখা যাচ্ছে।” কার্ট জানালো। তারপর রেনল্ডসের দিকে ফিরে বলল, “ওটার দিকেই যাও তো আগে। দেখে আসি।”

সী ড্রাগন দিক বদলে সেদিক এগুলো। যতই কাছে যাচ্ছে ধোয়ার আস্তরণ ততোই পুরু হচ্ছে।

“বাতাসে ভেসে ভেসে জাহাজের ধোয়াটা সোজা দ্বীপের দিকে উড়ে যাচ্ছে।” জো বলল।

“খোদা-ই জানে ওটায় কি আছে। বিষাক্ত কিছু হলে….রাক্যটা শেষ করল না কার্ট। তবে বাকিরা ভাবার্থ ঠিকই বুঝতে পেরেছে।

“ডাক্তার মহিলাটা বলছিল যে তারা আটকা পড়েছে আর অক্সিজেনও শেষ হয়ে আসছে। আমি ভেবেছিলাম কোনো ভূমিকম্প বা বিস্ফোরণে হয়ত হাসপাতাল ভবনটা ধসে পড়ছে, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি মহিলা সম্ভবত এই ধোয়ার হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে।” জো বলল।

 কার্ট আবারো বাইনোকুলারে চোখ পাতলো। জাহাজের সামনেটা দেখে মনে হচ্ছে বিশাল কোনো আংটা দিয়ে বোধহয় টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। ভালো করে তাকাতেই বোঝা গেল যে জাহাজের অর্ধেকটাই নেই। বাকিটুকুও কালি-ঝুলিতে ঢাকা পড়েছে।

“কোনো ডুবো পাহাড়ে আটকা পড়েছে বোধহয়। নাহলে তো ডুবে যাওয়ার কথা।” কার্ট বলল। “নাম-ধামও চোখে পড়ছে না। কেউ একজন পালের্মোতে ফোন দিয়ে ব্যাপারটা জানাও। ওরা যদি জাহাজটার হদিস বের করতে পারে তাহলেই জানা যাবে এটায় কি ছিল।”

“ঠিক আছে, জানাচ্ছি।” রেনল্ডস বলল।

“আর গ্যারি।” কার্ট ডাক দিল বাতাসের উল্টোদিকে থেকো।”

রেনল্ডস মাথা ঝাঁকালো, “সেটা আর বলতে হবে না।” তারপর গতি কমিয়ে খবরটা জানাতে ফোন করল। জাহাজটা থেকে পাঁচশো গজের মতো দূরে থাকতেই সী ড্রাগনের একজন ক্রু চেঁচিয়ে উঠল, “আরে আরে দেখে যাও সবাই।”

রেনল্ডস থ্রটল ঠেলে সী ড্রাগনকে থামিয়ে দিল পুরোপুরি। কার্ট বেরিয়ে এলো ব্যাপার কি তা দেখতে। কুটা ওকে পানির দিকে আঙুল তুলে দেখালো। সেখানে আধা-ডজন অদ্ভুত আকৃতির কিছু একটা ভাসছে। জিনিসগুলো ১৫ ফুটের মতো লম্বা, দেখতে অনেকটা টর্পেডোর মতো, গায়ের রঙ কুচকুচে কালো।

 “পাইলট তিমি, চারটা বড়, দুটো বাচ্চা।” –টা বলল। প্রজাতিটা চিনতে পেরেছে।

“এদিকে তো এরা আসে না, তার মানে দ্বীপে যা হয়েছে তাতে সাগরের পানিতেও তার প্রভাব পড়েছে। কার্ট বলল।

আসলেও তাই, তিমিগুলোর চারপাশে গাদা গাদা সামুদ্রিক আগাছা, মরা মাছ, স্কুইড বা প্রাণী ভাসছে। এগুলোর লোভেই ওরা এদিকে এসেছে।

“আমি নিশ্চিত ঐ জাহাজটার জন্যেই এসব হয়েছে। কেউ একজন বলল। কাটেরও সে রকই-ই ধারণা, কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করল না। ও তাকিয়ে তাকিয়ে ভাসমান মৃতদেহগুলো দেখছে। হঠাৎ শুনতে পেল জো রেডিওতে ইতালিয়ান কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলছে। ওরা কি কি দেখেছে। সেসব জানাচ্ছে। কার্ট খেয়াল করল সব স্কুইড-ই মারা যায়নি। কয়েকটাকে দেখা গেল একসাথে গুড় দিয়ে একে অন্যকে পেচিয়ে রেখেছে।

 “আমাদের মনে হয় এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।” একজন ক্রু বলে উঠল। বলতে বলতে সে পরনের গেঞ্জি টেনে তুলে নাক-মুখ ঢেকে দিলো। ভাবটা এমন যে বাতাসে যে বিষ-ই ভেসে আসুক ওর নাকে আর ঢুকতে পারবে না।

 কার্ট জানে যে এখানে ওদের কোনো সমস্যা নেই। ওরা এখন বাতাসের উল্টো দিকে প্রায় সিকি মাইল দূরে। আর বাতাস একেবারেই নির্মল, এক ফোঁটা গন্ধ পর্যন্ত নেই। তারপরও সাবধানের মার নেই।

ও আবার কেবিনের ভেতরে ঢুকে বলল, “আরো মাইলখানেক পিছনে চলে যাও, আর ঐ ধোয়াটার দিকে নজর রেখো। যদি বাতাসের দিক বদল হয় তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাগতে হবে।”

রেনল্ডস মাথা ঝাঁকালো। থ্রটল ঠেলে হুইলে হাত দিল আবার। জাহাজটা গতি পেতে পেতে রেডিওতে জো-এর কথাও শেষ হলো।

“কি খবর?”

“ওদেরকে বললাম যে আমরা কি দেখেছি। গত রাতের AIS (Autometic Identification System) ডাটা অনুসারে ওদের ধারণা এটা একটা মালবাহী জাহাজ। নাম এম. ভি. তোরিনো।”

“ছিল কি ওটায়?”

“এই যন্ত্রপাতি আর কাপড়-চোপড়-ই ছিল বেশিরভাগ। বিপজ্জনক কিছু ছিল না।”

“কাপড়-চোপড়? তোমার মাথা।” ঐ হেলিকপ্টারগুলো কদ্দূর?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“দুঘণ্টা তো লাগবেই আরো। তিন ঘণ্টাও লাগতে পারে।”

 “আধা ঘন্টার মধ্যে না রওনা দেয়ার কথা ছিল?”

রওনা দিয়েছিল কিন্তু আমাদের রিপোর্ট পেয়ে আবার ফেরত গেছে। দরকারি রসদপাতি আর মানুষজন নিয়ে ফেরত আসবে।”

“ওদের আর কি দোষ দেবো।” কার্ট মুখে বলল। কিন্তু ওর মন পড়ে রয়েছে NUMA-টীমের সদস্য আর ঐ ডাক্তার মহিলার কি হলো সেই চিন্তায়। আর ওরা কেউই আর সাড়াশব্দ করেনি। আর বাকি পাঁচ হাজার মানুষের কথা নাহয় বাদই দিল। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো কার্ট, এই মুহূর্তে ওর বিবেকে এটাই একমাত্র সমাধান মনে হচ্ছে।

“জোডিয়াকটা (রাবারের তৈরি এক ধরনের স্পিড বোর্ড। সশস্ত্র বাহিনীতে ব্যবহৃত হয়।) “রেডি করো। আমি দ্বীপে যাব কি হয়েছে দেখতে। পাশ থেকে রেনল্ডস শুনতে পেয়ে সাথে সাথে বলে উঠল, “মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে নাকি?”

 “হলে হয়েছে। আমাদের লোকেরা কেউ এখনো বেঁচে আছে কি-না জানিনা। কিন্তু আরো তিন ঘণ্টা বসে থাকলে যে কেউ আর থাকবে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। সেই ঝুঁকি আমি নিতে পারবো না। হয়তো ওরা সাহায্যের আশাতেই বসে আছে এখন।”

“আমি যাব তোমার সাথে।” জো বলল।

রেনল্ডস পরাজিত চোখে ওদের একবার দেখে বলল, “তা যে বিষে দ্বীপের সবাই মারা পড়ল সেটা থেকে বাঁচবে কীভাবে?”

“হেলমেটগুলো পরে নিলেই হবে। সাথে অক্সিজেন সিলিন্ডার তো আছেই। সমস্যা হবে না।”

“কিছু কিছু নার্ভ টক্সিন কিন্তু চামড়ার ওপরেও কাজ করে।” রেনল্ডস মনে করিয়ে দিল।

 “ওয়াটার প্রুফ স্যুটগুলো পরে নিলেই হবে। চামড়াতেও কিছু লাগবে না।” কার্টও সাথে সাথে সমাধান দিয়ে দিল।

“হুম। হাতে গ্লোভস আর টেপ দিয়ে বাকি জায়গাগুলো মুড়ে দিলেই হয়ে যাবে।” জো বলল পাশ থেকে।

“টেপ? একটা টেপের ওপর তুমি তোমার জীবন বাজি ধরতে চাও?”

“এবারই প্রথম না। এর আগে একবার টেপ দিয়ে বিমানের পাখা আটানোর চেষ্টা করেছিলাম। অবশ্য সেবার জিনিসটা ঠিকমতো কাজ করেনি।” জো স্বীকার করল।

“ফাজলামো না। খামাখা তোমরা তোমাদের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছ। ওখানে কেউ বেঁচে আছে কি-না সে কথা-ই কেউ জানে না।” বিরক্ত মুখে বলল রেনল্ডস।

“উঁহু। একটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছ তুমি। রেডিও কলের ব্যাপারটা। কলটা অবশ্যই ঘটনাটা ঘটার পরে করা হয়েছিল। তার মানে ঐ ডাক্তার আর আরো কয়েকজন অন্তত তখন পর্যন্ত বেঁচে ছিল। কোনো একটা হাসপাতালেই সম্ভবত। অক্সিজেন কমে আসছিল বলেছে। তার মানে কোনো বদ্ধ জায়গাতে নিজেদের আটকে রেখেছিল যাতে বিষ তাদের কাছে না পৌঁছায়। অন্যরাও হয়তো একই কাজ করেছে। আমাদের লোকেরাও হয় এভাবে কোথাও লুকিয়ে আছে। তার ওপর পানিতে দেখলাম কয়েকটা স্কুইড এখনো মরেনি। ওগুলো শুড় নাড়ছে, জড়াজড়ি করছে, হালকা হালকা নড়ছেও।” কার্ট বলল।

“যা-ই বলল, এসব সম্ভাবনা একদমই ক্ষীণ।” রেনল্ডস বলল।

কিন্তু কার্টের জন্য এতটুকু সম্ভাবনা-ই অনেক। “আমি এখানে এখন বসে থাকবো আর পরে দেখবো যে আমি সময়মতো কিছু একটা করলেই লোকগুলোকে বাঁচানো যেতো তা আমি মেনে নিতে পারবো না।”

রেনল্ডস মাথা নাড়লো। ও আগে থেকেই জানতো যে কার্টকে ফেরাতে পারবে না, “আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা নাহয় গেলে, আর আমরা কি করবো?”

 “রেডিওতে কান পেতে বসে থাকো। আর ঐ বয়াগুলোর ওপর বসা পেলি-কানগুলোর ওপর নজর রেখো।” ইঙ্গিতে চ্যানেলের প্রবেশপথ দেখানো বয়ার ওপর বসা পাখি দেখলো। “যদি ওগুলো মরে ওখান থেকে মরে নিচে পড়ে যায় তাহলে এক মুহূর্ত দেরি না করে এখান থেকে চলে যাবে।”

.

০৫.

কয়েক মাইল দূরেই একটা ছোট জোডিয়াক নৌকায় ডিমে তা দেয়ার ভঙ্গিতে একজন বসে আছে। লোকটা আম্মন তা–জোডিয়াকটা এম, ভি. তোরিনোর। পালানোর সময় জাহাজের পিছন দিকে এটা পেয়েছে সে। একটা রেডিও আছে এটায়। তোরিনোর কু-রা জাহাজের পাশের কাঠামো পরীক্ষা করার জন্য। এটা ব্যবহার করতো। যখন বিস্ফোরণটা হয় তখন সে জাহাজটা থেকে মাত্র একশো ফুট দূরে ছিল। খুবই কাছে, বিস্ফোরণের দমকে ছাই না হলেও শক ওয়েভের ধাক্কায় মারা পড়ার কথা অন্তত। কিন্তু বিস্ফোরণের শব্দে চমকে ওঠা ছাড়া তার আর কিছুই হয়নি। ও যেভাবে চেয়েছিল সেভাবে জাহাজটা ধ্বংস হয়নি।

কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। সাথে সাথেই আবার জাহাজে উঠে দেখতে চেয়েছিল ব্যাপারটা। কিন্তু জাহাজটা তখনো পূর্ণ গতিতে চলছিল। ফলে তার এই স্বল্প গতির রাবারের নৌকায় সেটাকে ধরা সম্ভব ছিল না। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া লোকটা তাই আর কিছুই করতে পারেনি। তবে কিছুক্ষণ পরেই তার আশা পূরণ হয়। সে যেভাবে চেয়েছিল সেভাবেই জাহাজটা বিস্ফোরিত হয়।

তবে আসল ঝামেলা শুরু হয় ঠিক এর পরেই। বিস্ফোরণে ধ্বংস হওয়ার বদলে হিমাঙ্কের নিচে থাকা ঠাণ্ডা তরলটা উল্টো একটা নার্ভ গ্যাসের ধোয়া সৃষ্টি করে বসেছে। লোকটা অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখলো প্রাণঘাতী কুয়াশাটা ধীরে ধীরে পশ্চিমে এগিয়ে পুরো দ্বীপটাই ছেয়ে ফেলল। সে আর তার উচ্চপদস্থরা যে জিনিসটা গোপন রাখার এতো চেষ্টা করছিল সেটাই এখন সারা দুনিয়ায় জানাজানি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

রেডিওর সাহায্যের আবেদনটা সে-ও শুনেছে। কলটা করেছে দ্বীপের একজন ডাক্তার। সে এবং কয়েকজন রোগী একটা হাসপাতালে আটকা পড়েছে। পরিষ্কার শুনেছে মহিলা একটা গ্যাসের মেঘের কথা বলছে।

 তখনই চরম সিদ্ধান্তটা সে নিয়ে নিয়েছে। ডাক্তারকে বেঁচে থাকতে দেয়া চলবে না। সেই সাথে নষ্ট করতে হবে তার উদ্ধার করা সমস্ত প্রমাণাদি।

পকেট থেকে একটা হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ বের করল সে। ওতে আগে থেকেই ওষুধ ভরা। দাঁত দিয়ে সুঁইয়ের ক্যাপ খুললো, তারপর আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে নিশ্চিত হলো যে সিরিঞ্জে কোনো বুদবুদ নেই। তারপর পায়ে ইঞ্জেকশনটা ঢুকিয়ে দিল। এটা একটা প্রতিষেধক। সারা শরীরে একটা ঠাণ্ডা স্রোত ওষুধটার সাথে সাথে উঠে এলো। হাত-পা কেমন অবশ হয়ে এলো।

 কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার সব স্বাভাবিক হয়ে এলো। লোকটা জোডিয়াকটার মোটর চালু করে দ্বীপের দিকে রওনা দিল। তারপর সুবিধামতো একটা জায়গায় সেটাকে আটকে রেখে নেমে এলো বালিয়াড়িতে।

কিছুক্ষণের মাঝে ও বালিয়াড়ি ছাড়িয়ে একটা পাথরের সিঁড়ির গোড়ায় এসে পৌঁছুলো। সিঁড়ির শেষ মাথা থেকে শুরু হয়েছে একটা পাকা রাস্তা।

হাসপাতাল এখান থেকে দুই মাইল দূরে। এয়ারপোর্টের কাছেই। লোকটার পরিকল্পনা হলো, সে ডাক্তার আর বাকি জীবিত লোকদের খুন করবে, তারপর এয়ারপোর্টে গিয়ে একটা ছোট বিমান চুরি করে তিউনিসিয়া বা লিবিয়া বা পারলে মিসরে পালিয়ে যাবে। কাক পক্ষীতেও ওর কথা জানতে পারবে না।

.

০৬.

“নাহ! জিনিসটা তো শান্তি দিচ্ছে না একদমই,” জো বলল।

জিনিসপত্রসহ একেবারে পুরো ডুবুরির পোশাকটাই ওর পরনে। ওপরে জ্বলছে কড়া সূর্য। ফলে গরমে ঘেমে চরম অস্বস্তিকর একটা অবস্থায় পড়ে গেছে ওরা। কেমন একটা দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছে ওদের। বাতাস আছে। কিন্তু স্যুটের পুরু কাপড় ভেদ করে সেটা চামড়ায় পৌঁছুতে পারছে না।

“বিষাক্ত ধোয়া খেয়ে মরার চেয়ে অন্তত ভালো। কার্ট বলল।

জো মাথা ঝাঁকিয়ে আবার সামনে নজর দিল। এই মুহূর্তে ওরা ল্যাম্পেডুসা বন্দর রক্ষা বাঁধ পার হচ্ছে। কয়েক ডজন ছোট ছোট নৌকা এখানে সেখানে বাঁধা। অপরূপ নৈসর্গিক পরিবেশ চারপাশে।

“একটা নৌকাতেও কেউ নেই।” জো বলল।

কার্ট পানি ছাড়িয়ে রাস্তা আর দালানগুলোর দিকে তাকাল, “সামনের রাস্তাও জনমানব শূন্য। গাড়ি তত দূরে থাক একটা পথচারীও নেই।”

ল্যাম্পেডুসার জনসংখ্যা মাত্র পাঁচ হাজার, কিন্তু কার্ট খেয়াল করেছে এর মধ্যে অনেককেই পাওয়া যাবে মেইন রোডে। বিশেষ করে যখনই ওর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হয়। স্কুটার আর ছোট ছোট গাড়ি ভটভট করতে করতে বিভিন্ন দিকে ছুটছে, এদের সাথে ছোট ছোট ডেলিভারি ট্রাকগুলো আবার প্রতিযোগিতায় নামে। শশা শো করে কারো তোয়াক্কা না করে পাশ কাটাচ্ছে। ভাবটা এমন যে এখানকার কমপক্ষে অর্ধেক মানুষ ফর্মুলা ওয়ানের ড্রাইভার হওয়ার যোগ্য।

এ রকম সরগরম একটা দ্বীপের এরকম নিস্তব্ধতায় ওঁর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। “ডান দিকে যাও। ঐ মাছধরা নৌকাটার পাশ দিয়ে। তাহলে শর্টকাটে যাওয়া যাবে।” কার্ট বলল।

“শর্টকাট?”

“ওদিকে একটা প্রাইভেট সিঁড়ি আছে। ওটা আমাদের বিল্ডিং-এর আরো কাছে। আমি কয়েকবার ওখানে মাছ ধরেছি। ওটা দিয়ে উঠলে অনেকখানি কম হাঁটা লাগবে।” কার্ট ব্যাখ্যা করল।

জো দিক পাল্টে কার্টের দেখানো দিকে এগুলো। মাছ ধরা নৌকাটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দুটো অবয়ব চোখে পড়ল। ডেকের ওপর দলা হয়ে পড়ে আছে। প্রথমজন পুরুষ। আছড়ে পড়ে হাত নৌকার পাশ দিয়ে বের হয়ে আছে। অপরজন মহিলা।

“একবার কি…”।

 “এরা সাহায্যের বাইরে। সামনে আগাও” কার্ট বলল।

জো কিছু বলল না। তবে নৌকাও ঘোরালো না। একটুপরই কার্টের বলা কাঠের সিঁড়িটা দেখা গেল।

নৌকাটা বাঁধতে বাঁধতে জো বলল, “নৌকাটা চুরি করার মতো কেউ বোধহয় আর বেঁচে নেই।”

 দ্রুত সিঁড়ি টপকে ওঠার চেষ্টা করল ওরা কিন্তু ভারী স্যুটের কারণে পারছে না। ওপরের ধাপে পৌঁছে আরো কিছু লাশ চোখে পড়ল। এক মধ্যবয়সি দম্পতি। সাথে একটা বাচ্চা আর একটা কুকুর। রাস্তার পাশের গাছগুলোর নিচে অনেক মরা পাখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

কার্ট পাখিগুলো পেরিয়ে দম্পতির পাশে হাঁটু মুড়ে বসলো। পড়ার পরে লাগা আঘাত বাদে শরীরের আর কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।

“দেখে মনে হচ্ছে মারা যে যাচ্ছে সেটা এরা টেরও পায়নি। একেবারে সোজা মাটিতে আছড়ে পড়েছে।”

“হুম! যা-ই এটার জন্যে দায়ী, সেটা খুব দ্রুত কাজ করে।” জো বলল। কার্ট উঠে দাঁড়িয়ে জিনিসপত্র তুলে নিয়ে পরের গলিটা দেখিয়ে বলল,

“এদিক দিয়ে।”

দুই ব্লক হাঁটার পর এরা ওদের বিল্ডিংটার কাছে পৌঁছালো। বিল্ডিংটা বেশি বড় না। আপাতত NUMA তাদের অফিস হিসেবে ব্যবহার করছিল। সামনেই একটা ছোট্ট গ্যারেজ। এখন অবশ্য সাগর থেকে ওদের উদ্ধারকৃত জিনিসপত্রগুলো রাখা হয়েছে এখানে। এর পিছনেই চারটা রুম। এগুলোই ওদের অফিস আর ঘুমানোর জায়গা।

দরজার হাতল মুচড়ে জো বলল, “তালা মারা।”

কার্ট এক কদম পিছিয়ে দাঁড়ালো তারপর সজোরে সামনে এগিয়ে লাথি চালানো কাঠের দরজায়। দরজা ভেঙে একপাশে ছুটে গেল।

জো সাথে সাথেই ভেতরে ঢুকে চেঁচালো, “লারিসা? কডি?”

কার্টও চেঁচালো। তবে এই পুরু হেলমেট ভেদ করে কতটা আওয়াজ বের হচ্ছে সন্দেহ। ওর কানেই আর ফিরে আসছে বলে মনে হচ্ছে।

“পিছনের ঘরগুলোতে চলো। যদি ওরা টের পায় যে বিপদটা আসছে এক রাসায়নিক বাষ্প থেকে, তাহলে সবচে বুদ্ধিমানের কাজ হলো সবচে ভেতরের রুমে ঢুকে দরজা জানালা বন্ধ করে লুকিয়ে থাকা।”

ওরা ত্রস্ত পায়ে পিছনের দিকে ছুটে গেল। প্রথম রুমটা খালি। জো দৌড়ে অফিস রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। কিছু একটা দেখতে পেয়ে চেঁচালো, “এখানে।”

কার্ট জো-এর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। এখানে থাকা পাঁচজনের মধ্যে চারজনকেই দেখা গেল টেবিলের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সামনে একটা ভোলা ম্যাপ। মারা যাওয়ার আগ মুহূর্তে হয়তো এটা নিয়েই গবেষণা করছিল ওরা। একটু দূরেই কাত হয়ে পড়ে আছে কডি উইলিয়াম। যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। কড়ি ছিল রোমান পুরাকীর্তি বিশেষজ্ঞ। এই গবেষণা দলের প্রধান।

“সকালের মিটিং।” কার্ট বলল। “একবার চেক করে দেখতে বেঁচে আছে কি-না।”

 “কার্ট, ওরা কেউ….”

“তাও দেখো একবার। সিওর হয়ে নাও।” গম্ভীর মুখে বলল কার্ট। জো টেবিলের কয়জনকে চেক করল আর কাট চেক করল কডিকে। তারপর চেয়ার থেকে নামিয়ে মেঝেতে শুইয়ে দিল। প্রচণ্ড ভারি লাগছে শরীরটা। কার্ট শরীরটা ধরে বহুক্ষণ ঝাঁকাঝাঁকি করল। কিন্তু কাজ হলো না কিছুই। “পালস্-টালস তো কিছুই টের পাচ্ছি না। অবশ্য এই মোটা গ্লোভস পরা থাকলে পাওয়ার কথাও না।” বলে জো গ্লোভস খুলতে গেল।

 “উঁহু!” কার্ট মাথা নেড়ে নিষেধ করল।

তা দেখে জো থেমে গেল। কার্ট উঠে একটা ছুরি নিয়ে এসে ফলাটা কডির সামনে ধরলো। “নাহ! ওরা নিশ্বাস নিচ্ছে না।”

ও ছুরিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল, “শালার জাহাজটায় ছিলটা কি?” প্রচণ্ড রাগে গজরাতে গজরাতে বলল কার্ট।.”কি এমন জিনিস যে পুরো একটা দ্বীপের প্রতিটা প্রাণীকে মেরে ফেলতে পারে। সৈন্যবাহিনীর কাছে এরকম কিছু নার্ভগ্যাস আছে বলে শুনেছি। কিন্তু এরা পাবে কোথায়?”

 জোর মাথাতেও এসব চিন্তাই ঘুরছিল। “ধরলাম তুমি একজন সন্ত্রাসী আর তোমার কাছে এরকম কোনো গ্যাস আছে। কিন্তু কোন দুঃখে তুমি সেটা এই দ্বীপে ছড়াতে যাবে? সমুদ্রের মাঝের এই দ্বীপটা তো ম্যাপেও দেখা যায় না। এখানে থাকে কিছু মাঝি, ডুবুরি আর ছুটি কাটাতে আসা মানুষ।”

 কার্ট আরো একবার মৃত সহকর্মীদের দিকে তাকাল, “জানিনা। তবে আমি এর পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করবোই। আর যখন করবো, এমন ছাচা দেবো শালাদের যে এই জায়গার নামও কোনোদিন মুখে আনতে চাইবে না।

জো কার্টের এই কণ্ঠটাকে খুব ভালো মতোই চেনে। এটা হলো সদাহাস্য, সদাচঞ্চল কার্টের ঠিক উল্টো রূপ। অন্যভাবে বলা যায় মুদ্রার অপর পিঠ, কার্টের অন্ধকার চরিত্র। সোজা বাংলায় যাকে বলে, ধরে নারে ধরে না, ধরলে কিন্তু ছাড়ে না।

অন্য সময় হলে জো হয়তো কার্টকে এসব জেদ থেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করতো, কিন্তু এই মুহূর্তে ওর নিজেরও ঠিক একই ইচ্ছে করছে।

“সী ড্রাগনে খবর দাও। আমি গাড়ির চাবিটা খুঁজে বের করি। হাসপাতালটায় যেতে হবে। আর হাঁটতে পারবো না।” বলে কার্ট চাবির খোঁজে বেরিয়ে গেল।

.

০৭.

জিপ গাড়ির ভি-এইট ইঞ্জিন গর্জে উঠল। নিস্তব্ধ দ্বীপে সেই শব্দটাই কানে লাগল।

কার্ট চাবি মুচড়ে বার কয়েক গাড়ি চালু বন্ধ করল। যে মায়ার প্রভাবে ওদের চারপাশের সবকিছু ঘুমিয়ে পড়েছে, সেটা যদি ভাঙ্গে সেই আশায়।

গিয়ার বদলে জিপ চালানো আরম্ভ করল কার্ট, জো একটা ম্যাপের দিকে তাকিয়ে। হাসপাতাল খুব বেশি দূর না কিন্তু রাস্তায় ডজনকে ডজন গাড়ি এলো-মেলো হয়ে থেমে আছে, কোনোটার রেডিয়েটর থেকে এখনও ধোয়া বেরুচ্ছে। স্কুটারগুলো কাত হয়ে পড়ে আছে, সেগুলোর আরোহী পড়ে আছে আরো কয়েক হাত দূরে। প্রতি রাস্তার মোড়ে গাড়িগুলো একটার ওপর অন্যটা উঠে তূপ হয়ে আছে। পথচারীরাও যেখানে ছিল সেখানেই মরে পড়ে আছে।

“দেখে মনে হচ্ছে কেয়ামত হয়ে গেছে। এতে পুরো মৃতদের শহর।” জো বলল শুকনো মুখে।

হাসপাতালের কাছেও বিশাল একটা স্তূপ দেখা গেল। পুরো রাস্তাই আটকে ফেলেছে। একটা ট্রাক উল্টে ওটার সমস্ত মালামাল রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে। উপায় না দেখে কার্ট গাড়ি রাস্তার পাশের একটা বাগানে নামিয়ে দিল। তারপর ঘুরে মেইন গেটে পৌঁছালো।

“হাসপাতালটাতে ভালোই আধুনিক,” ছয়তলা দালানটার দিকে তাকিয়ে বলল জো।

“লিবিয়া আর তিউনিসিয়া থেকে আসা রিফিউজিদের জন্য এটা বড় করা হয়ছে।”

কার্ট জিপ বন্ধ করে নেমে এগুতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ালো। ওর কিছু একটা চোখে পড়েছে।

“কি হল?” জিজ্ঞেস করল জো।

কার্ট আবার গাড়ির কাছে ফিরে গেল, “কি যেন নড়তে দেখলাম।”

“কি সেটা?”

“জানিনা, ভাঙ্গা গাড়িগুলোর ওপরে।”

কার্ট আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, কিন্তু কিছুই দেখা গেল না।

 “চলো দেখে আসি।”

কার্ট মাথা নাড়লো, “থাক। চোখের ভুল সম্ভবত। ছায়া-টায়া হবে।”

 “কে জানে, জম্বিও হতে পারে।”

 “তাহলে তো আর তোমার চিন্তা করার কিছু নেই। জম্বিরা শুধু ঘিলু খায়।” কার্ট বলল।

“মজা পেলুম, তবে সত্যি কথা হলো যদি কেউ সত্যিই বেঁচে থাকে আর আমাদেরকে এই অবস্থায় দেখে তাহলে সামনে আসার আগে দশবার ভাববে।” জো বলল।

“হতে পারে। তবে সম্ভবত আমার মনেরই ভুল। বাদ দাও। ভেতরে চলো,” কার্ট সামনে এগুলো।

ঢোকার দরজার কাছে পৌঁছাতেই অটোমেটিক দরজা সুউ-শ করে খুলে গেল। ওয়েটিং রুমে প্রায় ডজন খানেক লাশ পড়ে আছে। বেশির ভাগই যে চেয়ারে বসে ছিল সেখানেই কাত হয়ে আছে। ফ্রন্ট ডেস্কে একজন নার্স এলিয়ে পড়ে আছে।

“সবাইকে তো চেক করার দরকার আছে বলে মনে হচ্ছে না।” জো বলল।

“চেক করবোও না। আমার ট্যাঙ্কের অক্সিজেন তিনভাগের একভাগ কমে গেছে। তোমারটারও একই অবস্থা হওয়ার কথা। জায়গাটাও অনেক বড়। প্রতিটা রুমের সবাইকে ধরে ধরে চেক করা সম্ভব না।”

কার্ট একটা ডাইরেক্টরি খুঁজে পেল। খুলে নামগুলোর ভেতর খুঁজতে লাগল। প্রথম পাতাতেই পাওয়া গেল অ্যামব্রোসিনির নাম। তবে বাকি সব নাম টাইপ করা হলেও এই নামটা হাতে লেখা। “মহিলা সম্ভবত নতুন জয়েন করেছে। কোনো অফিস নাম্বার বা কয়তলায় বসে কিছুই লেখা নেই।”

“এটা ব্যবহার করলে কেমন হয়?” একটা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে জো বলল। জিনিসটা সম্ভবত একটা PA (Public address : মাইক) সিস্টেমের সাথে লাগানো।

“ডাক শুনলে সাড়া দিতেও পারে।”

 “ভালো বুদ্ধি।”

জো সিস্টেমটা চালু করে। “অল কল’ লেখা বোতামটা টিপে দিল। সম্ভবত এটা দিলেই সারা হাসপাতালে আওয়াজ পৌঁছায়।

কার্ট মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে হেলমেটের কাঁচের সাথে চেপে ধরলো। তারপর যথাসম্ভব পরিষ্কার আওয়াজে বলার চেষ্টা করল, “ড, অ্যামব্রোসিনি অথবা জীবিত আর কেউ যদি বেঁচে থাকে তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, আমি কার্ট অস্টিন। আমরা আপনার সাহায্যের আবেদন শুনে এসেছি। যদি আপনি এই মেসেজটা শুনতে পান তাহলে ফ্রন্ট ডেস্কে ফোন করুন। আমরা আপনার খোঁজে এসেছি কিন্তু কোথায় খুঁজবো বুঝে পাচ্ছি না।”

মেসেজটা PA সিস্টেম হয়ে সারা হাসপাতালেই ছড়িয়ে পড়ল। কিছুটা কাঁপা কাঁপা তবে পরিষ্কার বোঝা যায়। কার্ট আবারো বলতে যাবে কিন্তু তার আগেই অটোমেটিক ডোরটা আবারো সুউশ করে খুলে গেল।

 জো আর কার্ট চকিতে ঘুরে গেল, কিন্তু দরজা খালি কেউ নেই ওখানে। দুই সেকেন্ড পরে আবার বন্ধ হয়ে গেল সেটা।

“যত তাড়াতাড়ি পারি এখান থেকে ভাগতে চাই বাবা।” জো বলল।

 “আমিও।”

ডেস্কের ফোনটা বাজতে আরম্ভ করল আর একটা সাদা বাতি জ্বলতে আর নিভতে শুরু করল।

“লাইন ওয়ানে আপনার জন্য একটা ফোন এসেছে ড. অস্টিন।” জো বলল। কার্ট স্পিকার লেখা বোতামটা টিপে দিল।

 “হ্যালো, একজন মহিলার কণ্ঠস্বর,” কেউ আছেন? আমি ড, অ্যামব্রোসিনি।” কার্ট স্পিকারের একদম কাছে হেলমেট ঠেকিয়ে বলল, “আমার নাম কার্ট অস্টিন। আপনার রেডিও কল শুনে সাহায্য করতে এসেছি।”

“ওহ! থ্যাঙ্ক গড! আপনার কথা শুনে আমেরিকান মনে হচ্ছে। আপনি কি NATO-র কেউ?”

 “না। আমি আর আমার বন্ধু NUMA নামের একটা প্রতিষ্ঠনে কাজ করি। পানির নিচে ডুবে যাওয়া জিনিসপাতি উদ্ধার করি আরকি।”

কিছুক্ষণ নীরবতা। “আপনাদের কিছু হয়নি কীভাবে? যারা-ই বিষটার সংস্পর্শে এসেছে তার-ই তো মারা পড়েছে। আমি নিজ চোখে দেখেছি।”

“বলতে পারেন আমরা ঠিকঠাক কাপড় পরেছি, তাই কিছু হয়নি।”

“একটু বেশিই কাপড় পরা হয়ে গেছে।” জো ফোড়ন কাটলো।

“ঠিক আছে। আমরা চার তলায় আটক পড়েছি। প্রাস্টিকের শীট আর সার্জিক্যাল টেপ দিয়ে রুমের দরজা সীল করে রেখেছি। কিন্তু আর বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না। অক্সিজেন ফুরিয়ে আসছে।”

“ইতালিয়ান সৈন্যবাহিনীর একটা ইউনিট ঝুঁকিপূর্ণ পদার্থ নিষ্ক্রিয়কারী টীম নিয়ে রওনা দিচ্ছে। আপনাদের আরো দুয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।” কার্ট জানালো।

“সম্ভব না। এখানে আমরা উনিশজন আছি। তাজা বাতাসের দরকার সবার যত দ্রুত সম্ভব। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে।”

কার্ট সাথে করে দুটো অতিরিক্ত স্যুট আর একটা অক্সিজেন ট্যাঙ্ক নিয়ে এসেছে। পরিকল্পনা ছিল প্রথমে যাকে পাবে তাকে সী ড্রাগনে নিয়ে যাবে, তারপর বাকিদেরকে নিতে আসবে। কিন্তু এখানে প্রায় বিশজন লোক আটকা…

“কি বলছেন?” ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন।

 “আমরা আপনাদেরকে বের করতে পারবো না।” কার্ট জবাব দিল।

“আমরা এখানে আর বেশিক্ষণ টিকবো না, কয়েকজন বয়স্ক রোগী এর। মধ্যেই জ্ঞান হারিয়েছে।” জবাব দিল ডাক্তার।

“হাসপাতালে কি ঝুঁকিপূর্ণ দ্রব্য নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা আছে? ওখানে খুঁজলে কিছু স্যুট পাওয়া যেতে পারে।” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“না, এরকম কিছুতে নেই।”

“অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই। সব হাসপাতালেই তো থাকার কথা।” জো বলল পাশ থেকে।

কার্ট মাথা নাড়লো, “এই সপ্তাহে তোমার বেতন কাটা মাফ করলাম যাও।”

“এ আর নতুন কি?”

কার্ট এক হাত উঁচু করে তর্জনী নেড়ে না করল।

তা দেখে জো মারাত্মক কষ্ট পাওয়ার ভান করল আর কার্ট আবার স্পিকারের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “সাপ্লাই রুম কয় তালায়? আমরা আপনাদেরকে কিছু অক্সিজেনের বোতল এনে দিচ্ছি। আশা করি ইতালিয়ান সৈন্যবাহিনী আসার আগ পর্যন্ত থাকতে পারবেন।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাহলে চলবে। মেডিকেল সাপ্লাই তিন তলায়। প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি করুন।”

কার্ট ফোন কেটে এলিভেটরের দিকে এগুলো। দরজা খুলতেই দেখা গেল একজন ডাক্তার আর নার্স কাত হয়ে পড়ে আছে।

 জো তাদেরকে তুলে বসাতে গেল কিন্তু কার্ট হাত তুলে না করল, “সময় নেই।” ৩ লেখা বোতামটা টিপতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে পিং করে আওয়াজ হতেই দরজা খুলে গেল আর কার্ট নেমে গেল। আর জো ডাক্তারটাকে টেনে অর্ধেক দরজার বাইরে এনে রেখে দিল।

“দরজায় ঠেকা দিলে?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“আশা করি লোকটা কিছু মনে করবে না, জো জবাব দিল।

 “নাহ! কি আর মনে করবে।”

শেষ মাথায় ওরা সাপ্লাই রুমটা খুঁজে পেল। দরজা ভেঙে ঢুকতেই দেখে পিছনে মেডিকেল অক্সিজেন লেখা এক খাঁচা অক্সিজেনের বোতল। কার্ট গুনে দেখলো আটটা বোতল। আশা করল এতেই কাজ হয়ে যাবে।

জো একটা ট্রলি এনে বলল, “এর ওপর উঠিয়ে দাও। তাহলে আর আমাদেরকে টানতে হবে না।”

কার্ট বোতলগুলো ট্রলিতে তুলতেই জো সেগুলো বেঁধে ফেলল যাতে গড়িয়ে না পড়ে।

তারপর ঠেলে দরজা দিয়ে বের করার চেষ্টা করল কিন্তু মাথাটা বেঁকে দেয়ালে গিয়ে ঠেকলো।

“গাড়ি চালানো শিখেছ কোত্থেকে?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“আরে এগুলো দেখতে সহজ হলেও চালানো আসলে অনেক কঠিন।”

জো জবাব দিল।

আবার সোজা করে আবার ঠেলা দিল। এটুকুতেই একেবারে ঘাম ছুটে গেল ওদের।

কিছুদূর এগুতেই শোনে এলিভেটরের পিংশব্দ। বিঙ্কিয়ের দ্বিতীয় এলিভেটরের দরজাটা খুলে যাচ্ছে।

“আমি নিশ্চিত এই হাসপাতালে ভূতের আসর আছে।” জো বলল। “পুরা বিল্ডিংয়ে থাকলেও কারেন্টের লাইনে আছে সিওর।” কার্ট জবাব দিল।

এলিভেটরের কাছে পৌঁছাতেই, রোদে পোড়া চামড়ার একটা মানুষ দ্বিতীয় এলিভেরটা থেকে বের হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

“বাচান” হাসফাস করতে করতে বলল লোকটা, “প্লিজ…”

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কার্ট দ্রুত ট্রলিটা ছেড়ে লোকটার পাশে বসে পড়ল। লোকটার চোখ এতোক্ষণ বন্ধ ছিল। কিন্তু কার্ট তার মুখের কাছে ঝুঁকতেই লোকটার চোখ খুলে গেল তারপর অপলক তাকিয়ে থাকল কার্টের চোখের দিকে। সেই চোখে কোনো মৃত্যুভয় বা ঘোর নেই, শুধুই জিঘাংসা। সেটা প্রমাণ করতেই লোকটা ছোট্ট পিস্তলটা বের করেই গুলি করল।

.

০৮.

গুলির শব্দ ফাঁকা করিডোরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে গেল চারপাশে, আর কার্ট পিছন দিকে উল্টে পড়ে গেল। বেকায়দাভাবে মুচড়ে আছে শরীর। যেভাবে পড়েছে ওভাবেই পড়ে থাকল আর নড়লো না।

 অবাক হলেও রিফ্লেক্সের বশেই জো সামনে ঝাঁপ দিল। অর্ধেক জীবন বক্সিংয়ের রিং-এ কাটানোর সুফল। জো-র হাতের ধাক্কায় লোকটার হাত ঘুরে গেল আরেকদিকে। ফলে পরের গুলি দুটো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গিয়ে লাগলো দেয়ালে। জো হেলমেট পরা মাথা দিয়ে লোকটার মাথায় একটা গুতো দিল, সাথে সাথে লোকটা চিৎপটাং। হাতের পিস্তলও ছিটকে পড়ল দূরে।

দুজনেই হামাগুড়ি দিয়ে পিস্তলের দিকে এগুলো। জো-ই আগে পৌঁছুলল। হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু ঝামেলা পাকালো হাতের গ্লোভস। কিছুতেই আঙুল ট্রিগারে ঢোকে না। এই সুযোগে আততায়ী লোকটা ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আর দুজনেই পাশের দরজাটায় আছড়ে পড়ল, দরজার ওপরে লেখা সাবধান MRI.

দুজনেই শক্ত মেঝের ওপর পতিত হলো আর ধাক্কায় একজন আরেকজনের কাছ থেকে ছুটে গেল। হেলমেট পরে থাকার কারণে জো দুইপাশে ঠিকভাবে দেখতে পারছে না, ফলে বন্দুক আর আততায়ী দুটোর হদিসই ও হারিয়ে ফেলল। আশেপাশে ঘুরে ঘুরে তাকাতে বন্দুকটা কোথাও দেখতে পেল না তবে লোকটাকে দেখলো বিশ ফুটের মতো দূরে পড়ে আছে। সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে গেছে।

 জো ওঠে দাঁড়িয়ে এক পা আগে বাড়াতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। মনে হচ্ছে কেউ যেন ওকে পিছন থেকে টেনে শুইয়ে দিতে চাচ্ছে। আরেক পা আগে দিতেই প্রায় উল্টেই পড়ে গেল। প্রথমে ভাবলো সম্ভবত বিষাক্ত গ্যাস ওর ফুসফুসে গেছে। কারণ আসলেই ও সামনে এগোতে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন কেউ ওর কাঁধে রশি বেঁধে টানছে।

তবে খুব দ্রুতই কারণটা ধরতে পারলো। ওরা এখন আছে হাসপাতালের MRI-রুমে। ওর বিশ ফুট পেছনেই একটা ছোট গাড়ির সমান একটা মেশিন। ওটার ভেতর আছে খুবই শক্তিশালী চুম্বক। চুম্বকগুলো সব সময়ই ক্রিয়াশীল একবার কয়েকমাস হাসপাতালে কাজ করেছিল জো। ফলে MRI মেশিন সম্পর্কে ভালোই জানা আছে ওর। ওটার আশেপাশে লোহা নির্মিত কিছু আসলেই হয়। সোজা টেনে নিয়ে আটকে ফেলবে। আর জোর পিঠে স্টিলের ট্যাংক, মাথায় স্টিলের হেলমেট। ওকেতো আটকাবেই। জো তিরিশ ডিগ্রি কোণে সামনের দিকে বাঁকা হয়ে গেল। প্রাণপণ চেষ্টা করছে চুম্বকের টান উপেক্ষা করতে। ওভাবেই কয়েক পা এগুলো দেখে মনে হচ্ছে কেউ বুঝি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের বিপরীতে হাঁটছে। কিন্তু এগুতে পারছে না।

জোর প্রতিপক্ষ মাত্র দশ ফুট দূরে পড়ে আছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি। কিন্তু এত চেষ্টা করেও জো তার কাছে পৌঁছুতে পারছে না।

জো আরো খানিকটা বাঁকা হলো, আরেক পা আগালো কিন্তু পা পড়ল মেঝের পিচ্ছিল একটা অংশে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। ওর পা পিছলে পিছনে সরে গেল আর সমস্ত প্রতিরোধ এক মুহূর্তে গেল হারিয়ে। ব্যস! পরের মুহূর্তেই সে বাতাসে উড়ে MRI মেশিনটার দিকে ধেয়ে গেল।

 জো-র পিছন দিকটা দড়াম করে বাঁকানো মেশিনটার মুখে গিয়ে বাড়ি খেলো আর মাথা বাড়ি খেলো ওপরের অংশে।

চুম্বক ওকে সেখানেই আটকে রাখলো, ফলে ও এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঝুলে রইল সেখানে। এমনকি ওর পা-ও এটে আছে মেশিনের সাথে। পায়ের বুটে স্টিলের কাটা এজন্যে দায়ী। বাম হাতে স্টীলের ঘড়ি। সেটাও এটে আছে। কোনো মতে শুধু ডান হাতটাই মেশিনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। শরীরের বাকি কোনো অংশই ও নাড়াতে পারছে না।

এর মধ্যেই আততায়ী জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে জো-কে দেখে এমনভাবে মাথা নাড়তে লাগল যেন খুব মজা পাচ্ছে। তারপর হাসতে হাসতে পিস্তল তুললো গুলি করার জন্যে। কিন্তু সেটা ওর হাত থেকে ছুটে উড়ে গিয়ে জো-এর পাশে গিয়ে আটকে গেল।

 জো মোচড়া মুচড়ি করে বন্দুকটা হাতানোর চেষ্টা করল কিন্তু হাত পিস্তল পর্যন্ত পৌঁছালোই না।

 লোকটা প্রথমে অবাক হলেও দ্রুত সামলে নিলো। ওর হাতে উঠে এলো আরেকটা অস্ত্র। একটা ছোট ত্রিকোণাকায় ছুরি। সেটাকে মুঠো করে ধরেও এগুলো জো-এর দিকে।

“আরে আরে কথা শোনেন। আপনার বোধহয় কোনো সাহায্য দরকার, তাই না? আরেকটু ভালো চিকিৎসা, আরেকটু ভালো পাগলা গারদে থাকলেই আপনি ঠিক হয়ে যাবেন।” জো বলল।

“নিজের ভাগ্যকে মেনে নাও। কষ্ট কম পাবে।” লোকটা বলল।

 “নিজের চরকায় তেল দাও বাছা।”

লোকটা সামনে এগুলো আর জো হঠাৎ এক টানে ওর পা ছুটিয়ে দিল এক লাথি। মুখের একপাশে লাগল সেটা।

লাথি খেয়ে লোকটা পিছিয়ে গেল খানিকটা। মারাত্মক রেগে গেল সে। গজরাতে গজরাতে ছুরিটা ওপরে তুলে সোজা জো-র বুক বরাবর এগোতে যাবে, তখনই পিছনের দরজাটা খুলে গেল। কার্ট সেখানে দাঁড়ানো হাতে একটা স্যালাইন ঝুলানোর রড। ও ওটা ছেড়ে দিতেই ধাতব দণ্ডটা প্রচণ্ড বেগে MR মেশিনের দিকে ছুটলো। যাত্রা পথে ওটা লোকটার শরীরকে একটা বর্শার মতো ফুটো করে ওর লাশটা নিয়েই জোর পাশে মেশিনের গায়ে গিয়ে পড়ল।

জো সেদিকে তাকাতেই দেখলো লোকটার চোখের আলো নিভে যাচ্ছে। তারপর কার্টের দিকে ফিরে বলল, “সময় মতই এসেছ। আমিতো ভাবতাম তুমি বুঝি সারাদিনই মরার ভান করে উল্টে পড়ে থাকবে।”

জো খেয়াল করল কার্টের হেলমেটের ওপর দিকটা দেবে গেছে। আর সেই জায়গা থেকে চেহারা বেয়ে রক্ত পড়ছে। হেলমেটের সামনের কাঁচেও ফাটল ধরেছে।

“আসলাম ধীরে সুস্থে। জানতাম-ইতো যে এসে তোমাকে কোথাও না কোথাও ঝুলতেই দেখবো।”

জো’র চেহারায় একটা আত্মতৃপ্তির হাসি…

“যাই হোক, আর কাছে এসো না, নাহলে তোমাকে আমার পাশেই রেফ্রিজারেটর হয়ে ঝুলে থাকতে হবে।”

কার্ট দরজার ওখানেই দরজার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। যাতে টান পড়লে আটকাতে পারে। আশেপাশে তাকাল ও। বাম দিকেই প্লোক্সি গ্লাসে ঘেরা MRI কনট্রোল রুম।

“এটা অফ করবো কীভাবে?”

“অফ করা যায় না। চুম্বকগুলো সবসময়ই ক্রিয়াশীল। আমি এল পায়ের যে হাসপাতালে কাজ করতাম সেখানে একবার একটা হুইল চেয়ার আটকে গিয়েছিল। ছয়জন লোক লেগেছিল সেটা ছাড়াতে।

কার্ট মাথা ঝাঁকিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তবে তাকিয়ে আছে আততায়ী লোকটার দিকে।

“কিছু প্রশ্ন হলো এই ব্যাটার সমস্যা কী?”

 “আমিতো বুকের মধ্যে গাথা বর্শাটা বাদে আর সমস্যা দেখছিনা।”

“ওটা বাদে।” কার্ট বলল।

“জানিনা। তবে এটাই আমাকে অবাক করছে যে এই দ্বীপের একমাত্র নড়নক্ষণ জিনিস হলো এক বদ্ধ উন্মাদ যে কি-না কোনো দৃশ্যত কারণ ছাড়াই আমাদের খুন করতে চাচ্ছিলো।” জো জানালো।

“তুমি এখনও অবাক হও। আমার তো এখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। সবসময়ই এমনটা হয়। আমি অবাক হচ্ছি ব্যাটার পোশাক পরিচ্ছদ দেখে। বা বলতে পারো নেই দেখে। আমরা ঘেমে গোসল করে ফেলছি আর লোকটার নাকে একটা মুখোস পরারও দরকার হয়নি।”

 “হয়তো বাতাস পরিষ্কার হয়ে গেছে। তার মানে আমি এখন…. জো বলল।

“ঝুঁকি নেয়ার দরকার নেই।” হাত বাড়িয়ে নিষেধ করল কার্ট।” “সিওর হওয়ার আগ পর্যন্ত এসব খোলার দরকার নেই। আমি অক্সিজেনের বোতলগুলো ড, অ্যামব্রোসিনিকে দিয়ে আসি। উনি হয়তো কিছু বলতে পারবেন।”

“আমি তোমার সাথে আসতাম। কিন্তু….”।

 কার্ট হাসলো। “বুঝেছি। আমি জানি তুমি আটকা পড়েছে।”

“হুস। এর কারণ হলো আমার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব।” জো বলল। কার্ট হাসলো। তবে কিছু না বলেই ঘুরে বেরিয়ে এলো রুমটা থেকে।

.

০৯.

রেনাটা অ্যামব্রোসিনি অপারেশন রুমের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে আছে। নড়াচড়ার শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই। জীবনেও সে এরকম কোনো পরিস্থিতিতে পড়েনি আগে। যদি বেঁচে থাকে তাহলে আর পড়তেও চায় না।

 খুবই ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। যতটা সম্ভব কম অক্সিজেন খরচ করতে চায়, অস্থির লাগছে খুব। প্রচণ্ড ইচ্ছে করছে দরজার প্লাস্টিক সিলের বাইরে বেরিয়ে বুক ভরে অক্সিজেন নিতে। মরলে মরুক আর সহ্য হচ্ছে না। মনোযোগ সরাতে চুলে হাত বুলালো, পনিটেল করা চুলের ব্যান্ড খুলে আবার রাখলো। তারপর গায়ের ল্যাব কোট প্রথমে ভাজ করে আবার সোজা করতে লাগল। আর কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে তা জানেনা।

অক্সিজেনের প্রভাব কমে গেলে শরীর-মন দুটোর ওপরই প্রভাব পড়ে। কোনোটাই নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না, তারপরও রেনাটা সহ্য করে আছে কারণ এখানে কষ্ট হলেও বেঁচে আছে। বাইরে বেরুলেই স্রেফ মারা পড়বে।

 রেনাটার বাড়ি টুসকানি-তে। তবে ইতালির অনেক জায়গাতেই ওর থাকা পড়েছে। বাবা ছিলেন ইতালির মিলিটারি পুলিশ দলের একজন বিশেষজ্ঞ। তার সাথেই সারা দেশ ঘুরেছে। এক সন্ত্রাসী হামলায় মা মারা যান। রেনাটার বয়স তখন মাত্র পাঁচ। তারপরই তার বাবা সারা দেশ ঘুরে ঘুরে সংগঠিত সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশেষ বাহিনী তৈরির কাজে মনোযোগ দেন।

বাবার কাছ থেকে পেয়েছে সাহস আর জেদ এবং মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে সৌন্দর্য। রেনাটা বৃত্তি পেয়ে মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হয় এবং প্রথম স্থান নিয়েই পড়াশোনা শেষ করে। সাথে পার্টটাইম পেশা হিসেবে ছিল মডেলিং। তবে শেষ পর্যন্ত বিলবোর্ডের চেয়ে ইমার্জেন্সি রুমই বেশি মনে ধরে যায়। কারণ মডেল-এর জীবন হলো অন্যদের কাছ থেকে সমালোচনা পেয়ে পেয়ে বেঁচে থাকা, যেটা ওর খুব একটা পছন্দ না। আর তাছাড়া চেহারা ভালো হলেও অন্যান্য মডেলদের তুলনায় রেনাটা কিছুটা খাটো। মাত্র পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি।

অন্যরা যাতে তাকে সিরিয়াসলি নেয় তাই রেনাটা চুল সবসময় কালো রঙ করে রাখতে, বেশি একটা মেক আপ দিতো না, এমনকি মাঝে মাঝে গাম্ভীর্য আনার জন্য চোখে একটা চশমাও লাগাতো। তারপরেও এই চৌত্রিশ বছর বয়সেও জলপাই তেলের রঙের মসৃণ চামড়া আর সোফিয়া লরেনের মতো দেহ সৌষ্ঠবের কারণে তার পুরুষ সহকর্মীরা সুযোগ পেলেই আড়ালে আবডালে তার দিকে তাকিয়ে থাকতো।

সে কারণে ও সিদ্ধান্ত বদল করে ঠিক করে ডাক্তারিই করবে। এ কারণেই ল্যাম্পেডুসাতে আগমন। আর এখানেই ও আবিষ্কার করে ওর আসল সত্তা, ও আসলেই কি চায়। তবে এখন অবশ্য ও জানে না এখান থেকে বেঁচে আর ফিরতে পারবে কি-না।

“আরেকটু ধৈর্য ধরো।” নিজেকেই বলল রেনাটা।

ও আরো একবার কার্বন-ডাই-অক্সাইড দূষিত বাতাসে শ্বাস গ্রহণ করল। বুকে মনে হলো আগুন ধরে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকাল একবার। আমেরিকান লোকটার সাথে কথা হয়েছে এখনো দশ মিনিট হয়নি।

“এতক্ষণ লাগছে কেন?” রেনাটার পাশ থেকে তরুণ একজন ল্যাব সহকারী জিজ্ঞেস করল।

“এলিভেটর নষ্ট হয়ে গেছে বোধহয়।” ব্যঙ্গ করে বললে রেনাটা। তারপর বহু কষ্টে নিজেকে টেনে তুললো। অন্যদের চেক করবে।

আক্রমণটা শুরু হতেই ওরা এই রুমের কজন-ই শুধু বাঁচতে পেরেছে। এখানে আছে একজন নার্স, একজন ল্যাব-সহকারী, চারটা বাচ্চা আর বারোজন বয়স্ক রোগী। এর মধ্যে তিনজন বিদেশি। তিউনিসিয়া থেকে একটা ভাঙ্গচোরা নৌকায় করে এখানে চলে এসেছে। আসার পথে জ্বলন্ত সূর্যের তাপে গায়ে ফোস্কা পড়েছে, একটা ঝড়ের কবল থেকে বেঁচেছে। দ্বীপের কাছে পৌঁছে শেষ মুহূর্তে হাঙ্গরের আক্রমণ থেকে বাঁচতে পাঁচশো গজ সাঁতরে তীরে এসে উঠেছে। এতো মারাত্মক সব জিনিস থেকে বেঁচে এসে এখন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বিষক্রিয়ায় মারা যাচ্ছে। ভাগ্য! তাও একটা হাসপাতালের রুমে যেখানে তাদের অক্সিজেন আরো বেশি পাওয়ার কথা।

 বেশ কয়েকজন রোগী-ই ইতোমধ্যে অচেতন হয়ে গেছে। সর্বশেষ অক্সিজেনের বোতলটা নিয়ে খুললো রেনাটা। কিন্তু কিছুই বেরুলো না। খালি।

বোতলটা হাত থেকে ফেলে দিল ও। প্রচণ্ড শব্দ করে সেটা একদিকে গড়িয়ে দেয়ালে গিয়ে থামল। কেউ একবার চোখ ঘুরিয়েও দেখলো না। বাকিরাও জ্ঞান হারাচ্ছে। জ্ঞান আর ফিরবে কি-না জানা নেই। আর কিছুক্ষণ। অক্সিজেন না পেলেই ব্রেইন ড্যামেজ হয়ে পুরোপুরি চিরনিদ্রায় ঢলে পড়বে সবাই। রেনাটা দরজার কাছে গিয়ে হেলান দিল। আর পারছে না। টেপ ধরে টান দিল। কিন্তু এতোটাই দুর্বল যে টেপটাও খুলতে পারলো না। “শক্ত হও রেনাটা, শক্ত হও।” নিজেকেই নিজে আদেশ দিল রেনাটা।

ঘরের ভেতর মনে হলো একটা কমলা রঙের অস্পষ্ট কিছু বোধহয় পিছনের ঘরটায় ঢুকেছে। একটা মানুষ। আজব একটা পোশাক পরনে। রেনাটার মনে হলো লোকটা নভোচারী। নাকি লোকটা এলিয়েন? নাকি পুরোটাই চোখের ভুল? হঠাৎ লোকটা চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার মানে ওটা চোখের ভুল।

আবার টেপের কোণাটা ধরলো রেনাটা। টান দেবে তখনি শোনে কেউ বলছে, “না।”

 রেনাটা ছেড়ে দিল টেপ। সাথে সাথেই হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল, তারপর কাত হয়ে গেল একপাশে। শুয়ে শুয়েই দেখলো দরজার নিচের পাস্টিক ফুটো করে সরু একটা নল ঢুকে গেল। তারপর সেটা সাপের মতো হিসহিস করে উঠল। প্রথমে ভাবলো এটা বুঝি সাপ-ই কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরই ওর মাথা পরিষ্কার হয়ে এলো। অক্সিজেন-তাজা অক্সিজেন টুকছে ভেতরে।

প্রথমে ধীরে ধীরে তবে তারপরই আচমকা সব জড়তা কেটে গেল রেনাটার। মাথাটা অবশ্য টনটন করে উঠেছে, তবে ও এতেই খুশি। বুক ভরে নিশ্বাস নিলো ও। ঠাণ্ডা অক্সিজেন একেবারে শরীরের সবচে ভেতরের কোষটা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। রক্তে আবারো বইতে শুরু করেছে অ্যাড্রেনালিন, ঠিক একজন দৌড়বিদের সমান।

আরেকটা নল ঢুকতে দেখা গেল পাশেই। রেনাটা একপাশে সরে গেল যাতে অন্যদের কাছে দ্রুত অক্সিজেন পৌঁছায়। শরীরে কিছুটা শক্তি ফিরে পেতেই রেনাটা উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে চোখ রাখলো। কমলা রঙের নভোচারীকে দেখা গেল। ইন্টারকমের দিকে যাচ্ছে। এক সেকেন্ড পরই রেনাটার ঠিক পাশেই ঝোলানো স্পিকারটা জ্যান্ত হয়ে উঠল, “সবাই ঠিক আছে তো?”

“আশা করি ঠিক থাকবে। আপনার মাথায় কি হয়েছে? রক্ত পড়ছে।”

“গুতো খেয়েছি।” কার্ট বলল।

রেনাটার মনে পড়ল ও গুলির শব্দ শুনেছিল। কিন্তু তখন ভেবেছিল কল্পনা বোধহয়।

“গুলির শব্দ শুনেছিলাম। কেউ কী আপনাদের আক্রমণ করেছিল?”

কার্টের চেহারা কঠোর হয়ে গেল, “সত্যি কথা হলো, হ্যাঁ।”

“দেখতে কেমন? একা-ই ছিল?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

 কার্ট ডান-পা থেকে বাম-পায়ে দেহের ভার বদল করল। তারপর বলল, “এখন পর্যন্ত একজনকেই দেখেছি। আপনারা কী কোনো ঝামেলা আশা করেছিলেন?” কণ্ঠে বিন্দুমাত্র কোমলতা নেই এখন আর।

রেনাটা কেমন ইতস্তত করল। ইতোমধ্যেই অনেক বেশি বলে ফেলেছে ও। আর যদি বিপদ হয়ও তাহলে এই লোকটাই সম্ভবত ওদের একমাত্র ভরসা। অন্তত ইতালিয়ান বাহিনী আসার আগ পর্যন্ত একে দরকার।

 “আমি আসলে…” বলতে গিয়ে থেমে গেল রেনাটা। তারপর কি মনে করে বলল, “পুরো ব্যাপারটাই আসলে খুব গোলমেলে।”

 রেনাটা দেখলো লোকটা সরাসরি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। যদিও লোকটার হেলমেটের কাঁচ ফাটা আর মাঝখানে দরজার কাঁচও আছে, কিন্তু তারপরও ও বুঝলো লোকটা ওকে আপাদমস্তক মেপে দেখছে। ঠিক যেন ওর ভেতরটা পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে। রেনাটাও চেষ্টা করল কিন্তু লোকটার মুখের ভাব ঠিক মতো বোঝা গেল না।

“ঠিক বলেছেন। খুবই গোলমেলে। একেবারে শুরু থেকেই।” অবশেষে বলল লোকটা। কণ্ঠটা শুনেই রেনাটা বুঝলো, লোকটা আসলে তার দিকেই ইঙ্গিত করছে। কিন্তু চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া ওর আর কিছুই করার নেই। লোকটা ওর জীবন বাঁচিয়েছে ঠিক। কিন্তু এখনো তার পরিচয় সে জানে না।

.

১০.

রিগ্যান ন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, ওয়াশিংটন ডি.সি.
ভোর ৫:৩০ মিনিট

ভাইস প্রেসিডেন্ট জেমস স্যান্ডেকার নিজের রুপালি ‘জিপো’ লাইটারটা দিয়ে। ঠোঁটে ধরা সিগারেটটা জ্বাললেন। চল্লিশ বছর আগে হাওয়াই থেকে লাইটারটা কেনা। আরো বেশ কয়েকটা লাইটার আছে তার। এর মধ্যে কয়েকটা বেশ দামি। কিন্তু দীর্ঘ দিনের সঙ্গী এই মলিন হয়ে ক্ষয়ে যাওয়া লাইটারটাই তার সবচে প্রিয়। যতবারই হাতে নেন ততবারই মনে পড়ে যে কিছু কিছু টিকে থাকার জন্যেই তৈরি হয়।

বুক ভরে ধোয়া টেনে গলগল করে ছেড়ে দিলেন। সিগারের গন্ধটা বেশ ভালো। আশেপাশের সবাই তাকে আড়চোখে দেখছে। এয়ারফোর্স টু’তে (ভাইস প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান) ধূমপান নিষেধ। কিন্তু কেউই তাকে এটা বলার সাহস পাচ্ছে না। এই মুহূর্তে তাদের যাওয়ার কথা ছিল রোমে। একটা অর্থনৈতিক সম্মেলনে যোগ দেয়ার কথা। কিন্তু তারা অলস বসে আছে রানওয়েতেই।

সত্যি কথা হলো, মাত্র দশ বা পনের মিনিট বিলম্ব হয়েছে তাদের। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটি না হলে এয়ারফোর্স ওয়ান বা টু কখনোই রওনা দিতে দেরি করে না। আর সেরকম কিছু হলে সিক্রেট সার্ভিসের লোকজন ভাইস প্রেসিডেন্টকে বিমান থেকে নামিয়ে নিয়ে যায়। তারপর ঠিক হলে আবার নিয়ে আসে বিমানে। আজ তা হয়নি।

 স্যান্ডেকার মুখ থেকে সিগার নামিয়ে পাশেই তার সহকারী টেরি কারুথার্সের দিকে তাকালেন। টেরির জন্য প্রিন্সটনে। মাথায় তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। আদেশ পালনে সদা তৎপর। তাকে বলা হয়েছে কিন্তু কাজটা বাস্তবায়িত হয়নি এমন নজির নেই। এই ব্যাপারে তার কোনো জুড়ি-ই নেই। কিন্তু নিজ থেকে সে কিছুই করতে পারে না।

“টেরি,” স্যান্ডেকার ডাকলেন।

“জী, মি, ভাইস প্রেসিডেন্ট।”

“টিকিট কেটে বিমানে চড়া বাদ দেয়ার পর থেকে আর কোনোদিন আমাকে রানওয়েতে এতোক্ষণ বসে থাকতে হয়নি। শেষবার যখন এমন হয়, তখন এই বিমানবন্দর বানানোই হয়নি।”

স্যান্ডেকার কাটা কাটাভাবে বললেন। “তাই নাকি?” টেরি বলল।

“হ্যাঁ।” স্যান্ডেকারের গলার সুরেই বোঝা গেল যে তিনি যেটা বোঝাতে চেয়েছেন টেরি সেটা বোঝেনি। “আরে ব্যাটা আমাদের দেরি হচ্ছে কেন? আবহাওয়া খারাপ?”

“না, না! আবহাওয়া একদম ঠিক! আমি একটু আগেই চেক করেছি।”

কারুথার্স জবাব দিল।

 “তো কি? পাইলটরা চাবি ভুলে বাসায় ফেলে এসেছে?”

 “সেরকম তো মনে হয় না।”

 “তাহলে…মনে হয় ওরা ইতালি যাওয়ার রাস্তা ভুলে গেছে?”

কারুথার্স হেসে ফেলল, “ওদের কাছে তো ম্যাপ আছে স্যার।”

“তাই? তাহলে বলো দেখি আমেরিকার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কেন বসে বসে রানওয়েতে হাওয়া খাচ্ছে যেখানে তার এতোক্ষণ উড়াল দেয়ার কথা?”

“এ্যা….আমি কীভাবে বলবো স্যার, আমিতো শুরু থেকে আপনার সাথেই বসে আছি।” কারুথার্স বলল।

“হুম, বসেই আছো। খুব ভালো।”

স্যান্ডেকার কি বুঝাচ্ছেন সেটা বুঝতে কারুথার্সের আরো কিছুক্ষণ লাগল। বুঝতেই লাফ মেরে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আমি এক্ষুনি ককপিট থেকে খবর নিয়ে আসছি।”

ককপিটেই যাও। নাহয় আমি এতোটা রেগে যেতে পারি যে তোমাকে দেশের সব অভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহন সিস্টেমের সমীক্ষা করতে পাঠিয়ে দেবো।

গুলির বেগে ছুটে গেল কারুথার্স। স্যাস্তেকার আরো একবার ধোঁয়া টেনে ছাড়লেন। ধোঁয়া সরতেই দেখেন রুমের সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্ট দুজন হাসি চাপার চেষ্টা করছে।

“এটা হলো ফার্স্ট ক্লাস পাঠদান পদ্ধতি।” স্যান্ডেকার বললেন।

কিছুক্ষণ পরেই স্যান্ডেকারের চেয়ারের হাতলে লাগানো ফোনের বাতি জ্বলা-নেভা শুরু করল।

ফোনটা ধরতেই শোনেন কারুথার্সের গলা, “মি. ভাইস প্রেসিডেন্ট। ভূ মধ্য সাগরে নাকি একটা ঝামেলা হয়েছে। ওখানকার ইতালির একটা ছোট্ট দ্বীপে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। তার জন্য নাকি এলাকায় কি একটা বিষ ছড়িয়ে পড়েছে। তাই ওখান দিয়ে বিমান চলাচল পুরো বন্ধ।”

 “হুম।” স্যান্ডেকার জবাব দিলেন। এখন আর কণ্ঠে রসিকতা নেই। কারুথার্সের স্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছে ঘটনা এখানেই শেষ নয়। “আর কিছু?”

“তেমন কিছু না তবে ঘটনাটা জানিয়েছে আপনার সাবেক প্রতিষ্ঠান NUMA”। স্যান্ডেকার NUMA-র প্রতিষ্ঠাতা। ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি-ই প্রতিষ্ঠানটা পরিচালনা করতেন। “NUMA? ওরা কীভাবে এ ব্যাপারে প্রথম জানলো?”

“আমি সবটুকু জানি না, মি. ভাইস প্রেসিডেন্ট।”

 “ধন্যবাদ টেরি। তুমি চলে আসো।” স্যান্ডেকার বললেন।

কারুথার্স ফোন রাখতেই স্যান্ডেকার বিমানের কমিউনিকেশন অফিসারকে ফোন করলেন, NUMA হেড কোয়ার্টারের সাথে কথা বলবো, লাইন লাগাও।”

কয়েক সেকেন্ডেই কলটা চলে গেল NUMA’র বর্তমান সহকারী পরিচালক রুডি গান-এর কাছে।

“রুডি, স্যান্ডেকার বলছি। ভূ-মধ্যসাগরে কি নাকি হয়েছে?”

 “হ্যাঁ।”

“কার কাণ্ড এটা? ডার্ক?”

ডার্ক পিট NUMA’র বর্তমান পরিচালক। স্যান্ডেকার যতদিন পরিচালক ছিলেন পিট ছিল তার এক নাম্বার এজেন্ট। পরিচালক হওয়ার পরও অফিসের চাইতে সরাসরি অভিযানে নেমে পড়তেই বেশি ভালো লাগে পিটের।

“না। ডার্ক এখন সাউথ আফ্রিকায়। ঘটনা ঘটিয়েছে অস্টিন আর জাভালা।” রুডি বলল।

“জানতাম। একজন না হলে অন্যজন হবেই। খুলে বলো তো ঘটনাটা।”

রুডি যেটুকু জানে বিস্তারিত বলল। যা যা জানে না তা-ও বললো। ও ইতোমধ্যে ইতালিয়ান কোস্ট গার্ডের একজন অফিসার আর ইতালিয়ান ইন্টেলিজেন্স এজেন্সীর একজন পরিচালকের সাথেও করা বলেছে। এর বাইরে আর কিছু জানা নেই।

“কার্ট বা জো-এর সাথে সরাসরি কথা হয়নি আমার। সী ড্রাগনের ক্যাপ্টেন বলে যে ওরা না ঘণ্টা খানেক আগে তীরে উঠেছে কেউ বেঁচে আছে কি-না দেখতে। তারপর আর খোঁজ নেই।” রুডি বলল।

 অন্য কেউ হলে অবাক হতো যে লোক দুটো কি পাগল নাকি যে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এরকম বিষাক্ত একটা এলাকায় গেল। কিন্তু স্যান্ডেকার অস্টিন আর জাভালার ভেতর এই গুণটা ধরতে পেরেছিলেন বলেই ওদেরকে দলে নিয়েছিলেন।

“হুম। ওরাই পারবে যদি কেউ বেঁচে থাকে তত তাদের উদ্ধার করতে।” স্যান্ডেকার বললেন।

“জ্বী। আপনি চাইলে আপনাকে নিয়মিত খবর পাঠাতে পারি।” রুডি প্রস্তাব দিল।

“তাহলে তো ভালোই হয়।” স্যান্ডেকার কথাটা বলামাত্র ইঞ্জিন গর্জে উঠল।” বিমান ছেড়ে দিচ্ছে। কার্ট আর জো-এর সাথে কথা হলে বোলো আমি ওদিকেই আসছি। পিঠে ছালা বেঁধে রাখে যেন, নইলে চামড়া আর থাকবে না।”

ব্যাপারটা নিছকই ঠাট্টা, অবশ্যই। কিন্তু অন্যকে চাঙ্গা করতে জুড়ি নেই। স্যান্ডেকার এই ব্যাপারটা খুবই ভালো পারেন।

“অবশ্যই বলবো, মি. ভাইস প্রেসিডেন্ট।” স্পষ্ট বোঝা গেল রুডি এখন আগের চেয়ে বেশ খানিকটা প্রফুল্ল।

 স্যান্ডেকার ফোন রাখতেই বিমান দৌড়ানো শুরু করল। মাইল দেড়েক পরই নাক উঁচু করে এয়ারফোর্স টু উঠে এলো আকাশে। যাবে রোমে। স্যান্ডেকারের মাথায় অবশ্য নোম নেই। তিনি তখন ভাবছেন কার্ট আর জো আবার নতুন কি ঝামেলায় জড়ালো। কিন্তু কল্পনাও করেননি যে সশরীরে তার উত্তর খুঁজে পাবেন।

1 Comment
Collapse Comments

খুব সুন্দর!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *