৪১. রোম

৪১. রোম

ভাইস প্রেসিডেন্ট জেমস স্যান্ডেকার ইতালিয়ান পার্লামেন্ট বিল্ডিং-এর একটা কনফারেন্স রুমে বসে আছেন। অনেক লোকজন রুমটায়। তার সাথেও বেশ কয়েকজন পরামর্শক আছেন আর টেরি কারুথার্স তত আছেই। সারা রুম জুড়েই ইউরোপের সব দেশ থেকে আসা প্রতিনিধি দল বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে।

এই মুহূর্তে নতুন একটা ব্যবসায়িক চুক্তি নিয়ে আলোচনা করার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ-ই সেটা মোড় পাল্টে লিবিয়া, তিউনিসিয়া আর আলজেরিয়ার ঘটনাগুলোর দিকে চলে গেল।

 মাত্র বারো ঘন্টার ব্যবধানে তিউনিসিয়া আর আলজেরিয়ার সরকার ক্ষমতা চ্যুত হয়েছে। নতুন জোট গঠন করা হচ্ছে। ক্ষমতা সম্ভবত আবারো আরব বসন্তের আগের লোকগুলোর হাতেই ফিরে যাচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে চলে আসা দাঙ্গা আর ক্রমবর্ধমান খরার কারণে এটা যে হবে সেটা অনুমেয়ই ছিল কিন্তু আরো কয়েকদিন হয়তো টিকতো সরকারগুলো। তবে এক সাথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পদত্যাগ করায় সেটা আর হয়নি।

বিশেষ করে আলজেরিয়ার ঘটনায় সবাই অবাক হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী ওখানে পদত্যাগ করেছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন মন্ত্রণালয় নাকি বিশ্বাস ঘাতকে ভরে গিয়েছে।

“কেউ একজন পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে” স্যান্ডেকার কারুথার্সকে বললেন।

“CIA’র উত্তর আফ্রিকা নিয়ে রিপোর্টটা কাল পড়েছি। এসব ঘটার কোনো ইঙ্গিতও ছিল না তাতে।” কারুথার্স জানালো।

 স্যান্ডেকার বললেন, “এজেন্সীর লোকজন মাঝে মাঝে ভালোই কাজ দেখায় কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় দড়িকে সাপ ভেবে বসে আবার মাঝে মাঝে হাতিকে ভাবে সাকার্সের জিনিস।”

“আপনার কি মনে হয়? পরিস্থিতি কতটা খারাপ?” কারুথার্স জিজ্ঞেস করল।

“আলজেরিয়া আর তিউনিসিয়ারটা হয়তো সামলে যাবে তাড়াতাড়ি কিন্তু লিবিয়ায় অবস্থা খুবই খারাপ, একটা সুতোয় ঝুলছে এখন ওদের ভাগ্য।”

“এজন্যেই কি ইতালিয়ানরা লিবিয়ায় পরিবর্তন আনার জন্য এতো চেঁচামেচি করছে।” প্রশ্নটা চমৎকার। লিবিয়া এখন একটা গৃহযুদ্ধের দ্বার প্রান্তে। আর হঠাৎ-ই ইতালিয়ান একজন আইন প্রণেতা আলবার্তো পিওলা এক অদ্ভুত প্রস্ত বি দিয়েছেন। ইতালির বর্তমান সরকারের এক প্রভাবশালী নেতা উনি। আজকের সম্মেলনেরও সভাপতি উনি। কিন্তু ব্যবসায়িক আলাপ-চারিতা বাদ দিয়ে উনি লিবিয়ায় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সকলের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

“আমার মনে হয়, পতনের আগেই আমাদের উচিত লিবিয়ার সরকারকে পদত্যাগের জন্যে অনুরোধ করা।” পিওলা বললেন।

“তাতে লাভ কী?” কানাডিয়ান রাষ্ট্রদূত জিজ্ঞেস করলেন।

“আমরা তাহলে নতুন একটা শাসন ব্যবস্থা সমর্থন করতে পারবো যেটা জনগণের সমর্থনেই ক্ষমতায় আসবে।” পিওলা বললেন।

 “কিন্তু তাতে পানির সমস্যা সমাধান হবে কীভাবে?” প্রশ্নটা জার্মান ভাইস চ্যান্সেলরের।

“এতে অন্তত হানাহানি তত বন্ধ হবে।” পিওলা বললেন।

 “আর আলজেরিয়ায় কী হবে?” ফ্রেঞ্চ প্রতিনিধি জিজ্ঞেস করলেন।

“আলজেরিয়ায় নতুন করে নির্বাচন হবে। তিউনিসিয়াতেও। নতুন সরকারই ঠিক করবে তাদের কি করতে হবে আর তারা পানির সমস্যা কীভাবে সামলাবে। কিন্তু লিবিয়া একেবারে পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে।”

স্যান্ডেকার মোটামুটি চুপচাপই ছিলেন পুরোটা সময়। পিওলার এই অপ্রাসঙ্গিক লিবিয়া-প্রীতি তাকে অবাক করেছে। বিশেষ করে ইতালি যখন এখনো ল্যাম্পেডুসার ব্যাপারটা সামলে উঠতে পারেনি। NUMA আর বর্তমানের দায়িত্ব তাকে শিখিয়েছে যে, একবারের জন্য একটা সংকটই বেশি, দুটো ঝামেলা ঘাড়ে নেয়ার তো কথাই আসে না।

কারুথার্স ঝুঁকে তার কানে কানে বলল, “উনি যা বলছেন সেটা তো সম্ভব না। এখানকার সবাই রাজি হয়েও তো লাভ নেই। আমাদেরকে আগে আমাদের নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে আমাদের নেতাদেরকে রাজি করাতে হবে।”

স্যাভেকার আনমনে মাথা ঝাঁকালেন, “আলবার্তো সেটা ভালোই জানে।”

“তাহলে খামাখা এসব বলে সময় নষ্ট করছেন কেন?”

স্যান্ডেকারও বসে বসে পিওলার ব্যাপারটাই ভাবছেন। তার কাছে সবচে যুক্তিসঙ্গত যা মনে হয়েছে সেটাই বললেন, “যা কখনো হবে না সেটা নিয়ে ভোট চাওয়ার মতো বোকা পিওলা না। সে আসলে ইতোমধ্যে হয়ে গিয়েছে এমন ঘটনাকে সবার সামনে তুলে এনে সেটাকে গ্রহণযোগ্য বানানোর মঞ্চ সাজাচ্ছে।

কারুথার্স পিছনে সরে এসে অবাক চোখে ভাইস প্রেসিডেন্টের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ লাগল ওর ব্যাপারটা বুঝতে, “তার মানে…”।

 “লিবিয়ান সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর ও যেভাবে আচরণ করছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে যে সে এটাই আশা করছে।” স্যান্ডেকার বললেন।

কারুথার্স আবার মাথা ঝাঁকালো। তারপর ও এমন একটা কাজ করলেন যেটায় স্যান্ডেকার খুশি হয়ে গেলেন, “আমি CIA-র সাথে যোগাযোগ করছি। দেখি ওরা এই হাতিটা সম্পর্কে আর কি জানে।”

স্যান্ডেকারের দাঁত বের হয়ে গেল, “দারুণ বুদ্ধি!”

.

৪২.

কায়রো

কার্ট একটা ভাড়া করা কালো গাড়ি চালাচ্ছে। পিছনে বসে আছে জো। পাশেই রেনাটা। হাতে একটা শটগান আর কোলের ওপর একটা আইপ্যাড। স্যাটেলাইট থেকে বিভিন্ন তথ্য আসছে ওটায়।

“ও সোজা সামনে এগুচ্ছে।” বলল রেনাটা।

“অথবা ওর ফোন এগুচ্ছে”, কার্ট জবাব দিল। একে তো রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। সেগুলো আবার ঠিকমতো এগোয়ও না। আবার এদিকটায় রাস্তা ভরা খানাখন্দ। পুরোটাই চন্দ্র পৃষ্ঠের মতো অবস্থা।

 মাল্টা থেকে যে স্যাটেলাইট ফোনটার হদিস ওরা পেয়েছিল সেটাই অনুসরণ করছে ওরা। ওদের ধারণা ওঠা হাসানের। কিন্তু চোখে দেখার আগ পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারছে না।

“আচ্ছা আমরা ওর ফোনটার সিগন্যাল ধরছি কীভাবে? আমিতো ভাবতাম স্যাটেলাইট যোগাযোগ বেশ নিরাপদ।” জো বলল।

রেনাটা ব্যাখ্যা করল, “আমরা যে স্যাটেলাইটটা অনুসরণ করছি ওটা আসলে সৌদি আর মিসরের যৌথ প্রকল্প। দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থাই এটা ব্যবহার করে। আর এটা মহাকাশে পাঠায় ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সী। উৎক্ষেপণের আগে স্যাটেলাইটটা একটা বিশেষ জায়গায় রাখা ছিল। সেখানে ওটাকে একটা রকেটের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। আর তারও আগে ইউরোপের কোনো এক দেশের এক এজেন্ট বিনা অনুমতিতে যোগাযোগ ব্যবস্থাটায় সামান্য কারিগরি ফলায়।”

“এজন্যেই নিজেদের স্যালেটাইট নিজেদেরই উৎক্ষেপণ করা উচিত।” জো বলল।

“সবচেয়ে ভালো হয় সেই আগের মতো টিনের কৌটা আর তার ব্যবহার করলে, কার্ট বললো।

“এত হ্যাপা না করে ওকে ফোন করে থামতে বললেই তো হয়।” জো বলল।

“তাহলে লোকটা কোথায় যাচ্ছে কোনোদিন জানা হবে না। রেনাটা বলল।

“তা অবশ্য ঠিক।”

 “বামে যান। ওটার গতি কমে আসছে।” রেনাটা বলল।

“কার্ট ঘুরতেই কারণটা বুঝতে পারলো। রাস্তার দুধারে লাইন ধরে দোকান আর রেস্তোরাঁ। পথচারীরা ফুটপাতে জায়গা না পেয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। গাড়ি-ঘোড়া তাই এখন শামুকের গতিতে এগুচ্ছে।

ওরাও সেভাবেই ধীরে এগুলো। ফুটপাত জুড়ে নানান রকম বিজ্ঞাপন, ফলের দোকান, গয়না, ইলেকট্রনিক্স থেকে শুরু করে বালিশ, কাথা কম্বলের দোকান পর্যন্ত আছে। রাস্তাটা পেরুতেই ওরা নীল নদের পূর্ব তীরের একটা ঘাটে এসে পৌঁছুলো।

ঘাটের একপাশে ক্রেন দিয়ে বজরা নৌকা থেকে ধান-চালের বস্তা খালাস করা হচ্ছে। পাশেই ফেরিতে গাড়ি আর লোজন উঠছে আরেকটু পরেই বেশ কয়েকটা মাছ ধরার নৌকা আর একটা প্রমোদ তরী দেখা গেল।

“নীল নদকে স্বাগতম!” কার্ট বলল, “কিন্তু ঐ ব্যাটা গেল কই?” রেনাটা আইপ্যাডের ডিসপ্লেতে স্পর্শ করে জুম করল। চলন্ত সংকেতটা তখনও ওই এলাকার মধ্যেই আছে। “দেখে তো মনে হচ্ছে নদীর দিকে যাচ্ছে।” বলল রেনাটা। তারপর নদীর দিকে নেমে যাওয়া একটা সিঁড়ির দিকে দেখালো। ওরাও নামলে সাথে সাথে। রেনাটা আইপ্যাডটা নিতে ভোলেনি। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামলো ওরা। কার্ট ঘাটলাটার এদিক ওদিক তাকিয়ে একদিকে দেখিয়ে বলল, “ঐ তো, ওটা নিশ্চিত হাসান।”

হাসান একটা গাঢ় ধূসর রঙের স্পিড বোটে চড়ে বসলো। দেখে মনে হচ্ছে দুনিয়ায় কোনো কিছুকেই সে আর পরোয়া করে না। ও বসতেই বোটটা চালু হয়ে ঘাট থেকে সরে গেল।

“আমাদেরও একটা নৌকা লাগবে।” রেনাটা বলল।

ওরাও একটা রঙচঙা পর্যটকদের নৌকার দিকে এগুলো। একপাশে লেখা “ওয়াটার ট্যাক্সি”। মাঝখানে থেকে শুরু করে পেছনের দিকটা পর্যন্ত একটা ক্যানভাস কাপড়ে ঢাকা। বোটের পাইলট পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে।

জো-ই এগুলো কথা বলার জন্যে। লোকটা ইংরেজি জানে।

 “আমাদের একটা নৌকা দরকার।” বলল জো।

পাইলট ঘড়ি দেখে বলল, “সময় শেষ। বাড়ি যাবো এখন।”

কার্ট একতাড়া টাকা হাতে সামনে এগুলো, “আজ না হয় ওভার টাইম করেন।” লোকটা সাবধানে টাকাটার দিকে তাকাল। সম্ভবত ওখানে কতটাকা আছে গোনার চেষ্টা করছে। তারপর এক মুহূর্ত ভেবে সিগারেটটা পানিতে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে আসুন।”

ওরাও নৌকায় ওঠে ক্যানভাসের ছাউনির নিচে বসলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল।

“উজানে চালান।” কার্ট বলল।

 ড্রাইভার মাথা ঝাঁকালো তারপর নৌকার মুখ ঘুরিয়ে গতি বাড়িয়ে দিল। নৌকার গতি দ্রুতই বেড়ে গেল। যদিও স্রোতের প্রতিকূলে চলছে। কার্ট, জো আর রেনাটা পুরোদস্তুর পর্যটকের অভিনয় করছে। ছবি তুলছে, নদীর দুই তীরের বিভিন্ন জিনিস একজন আরেকজনকে দেখাচ্ছে। কার্টতো একটা বাইনোকুলার পর্যন্ত চোখে লাগালো। তবে এর ফাঁকে ফাঁকেও আইপ্যাডে নজর ঠিকই রাখছে। সিগনালটাও ধীরে ধীরে নদীর উজানেই চলছে।

“কতদূর যাবেন আপনারা? লুক্সর?” মাঝি জিজ্ঞেস করল।

“যেতে থাকেন। কতদূর যাবো জানিনা। যখন মন চাবে তখন থামবো।” কার্ট জবাব দিল।

মাঝি আর কিছু বলল না। আশে পাশে প্রচুর বজরা নৌকা। একটা ফেরি দেখা গেল। বিনা কারণে হর্ণ বাজিয়েই যাচ্ছে।

নদীর দুধারে প্রাণের চিহ্ন মাত্র নেই। খালি সারি সারি দালান-কোঠা। অ্যাপার্টমেন্ট, হোটেল, অফিস দিয়ে ভরা।

একটু পরেই ওরা সিক্স অক্টোর ব্রিজ পেরিয়ে আসলো। ওপরে গাড়ি ঘোড়ার প্রচণ্ড আওয়াজ। হর্ণ বাজছে। গাড়ির ধোঁয়া ব্রীজ থেকে নিচে নেমে আসছে।

“নাহ! নৌ-বিহারটা ঠিক রোমান্টিক হলো না।” রেনাটা বলল, “আমি ভেবেছিলাম মাছ ধরার কাঠের নৌকা দেখবো, পালতোলা নৌকা দেখবো। লোকজনকে ছোট ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরতে দেখবো।”

“একবার ম্যানহাটনের কাছে হাডসন নদীতেও সেটাই ভেবেছিলাম আমি। কায়রো শুধু মিসরের না, মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় শহর। আশি লক্ষ মানুষের বাস এখানে।

“যাই হোক, ভালো লাগল না।” রেনাটা জানালো।

“সামনে অবশ্য এতোটা আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। শুনেছি নাসের হ্রদে নাকি কুমিরও দেখা যায় আজকাল। তবে এতদূর যাওয়া লাগবে না আশা করি।” কার্ট কথা দিল।

“রোমান্স চান? তাহলে এদিকে দেখুন।” জো ডাক দিল।

একটু দূরেই শহরের কোলাহলের ওপর দিয়ে গিজার পিরামিডটা দেখা যাচ্ছে। বিকেলের আকাশে তখন কমলা রঙ ধরেছে আর পিরামিডগুলো দেখাচ্ছে চকচকে রুপালি। এই অনুজ্জ্বল আলোতেও ওটা জ্বলজ্বল করছে।

দৃশ্যটা দেখে রেনাটার দুঃখ আরো বাড়লো। “সবসময় ইচ্ছে ছিল কাছে থেকে পিরামিড দেখবো। বিল্ডিংগুলোর ওপর দিয়ে তো ঠিকমতো দেখাই যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে স্ফিংস-এর নাকের গোড়া থেকেই ওরা শহরটা বানানো শুরু করেছে।”

কার্টও অবাক হয়েছে ব্যাপারটায়, “ছোটবেলায় যখন এখানে এসেছিলাম, তখন বেয়ে বেয়ে একেবারে খুফু’ পিরামিডের মাথায় উঠে গিয়েছিলাম। তখন তো ওখান থেকে নদী পর্যন্ত কিছুই ছিল না। শুধু সারি সারি খেজুর গাছ দেখেছিলাম। আর ফসলের মাঠ।”

কার্টের মাঝে মাঝেই অবাক লাগে যে কখনো যদি এমন হয় যে পৃথিবীর প্রতি ইঞ্চি মাটি ইটের নিচে চাপা পড়ে গেল। ও বেঁচে থাকতে যেন এমনটা না হয়। প্রসঙ্গ বদলাতে জিজ্ঞেস করল, “আমাদের বন্ধুর কি অবস্থা?”

“এখনো দক্ষিণ দিকেই যাচ্ছে। তবে এখন সম্ভবত নদী পার হচ্ছে। অন্য পাড়ে যাবে।” রেনাটা নিচু স্বরে জানালো।

কার্ট শিস বাজিয়ে মাঝিকে ডাকলো তারপর আঙুল দিয়ে অপর পাড় দেখিয়ে বলল, “ঐ পাড়ে নিয়ে যান।”

 মাঝি নৌকা ঘুরিয়ে সোজা অন্যপাড়ের দিকে রওনা দিল। দেখে মনে হবে ওরা সরাসরি পিরামিডের দিকে ছুটছে। পশ্চিম পাড়ের কাছাকাছি পৌঁছতেই প্রাচীন ধ্বংসাবশেষটার আড়ালে আকাশ ঢাকা পড়ে গেল। তবে আরো একটা নতুন জিনিস চোখে পড়ল। নদীর ধারেই বিশাল কিছু একটা বানানো হচ্ছে। ক্রেন, বুলডোজার, সিমেন্ট ট্রাকে এলাকাটা গিজগিজ করছে।

তীরের লম্বা একটা অংশ পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে।

কয়েকটা ভবন, পার্কিং স্পেস আর সামনে একটা পার্ক মতো এর মধ্যেই বানানো শেষ। পুরো জায়গাটা বেড়া দিয়ে ঘেরা। তাতে আরবি আর ইংরেজি দুই ভাষাতেই লেখা “ওসাইরিস কন্সট্রাকশন।”

মাটিতে যা বানানো হয়েছে সেটা অবশ্যই দারুণ সুন্দর, তবে কার্টের মনোযোগ কাড়লো নদীর একটা জিনিস।

 ওরা যেখানে আছে ওখান থেকেই দেখা যাচ্ছে নদী থেকে ছোট্ট একটা খাল কাটা হয়েছে। খালটা কমপক্ষে একশো ফুট চওড়া আর আধা মাইল লম্বা। রেনাটার আইপ্যাডের স্যাটেলাইট ছবি দেখে আরো নিশ্চিত হওয়া গেল। খালটার দুপাশেই কংক্রিটের দেয়াল সেটাকে নদী থেকে আলাদা করে রেখেছে। দূর থেকেই তাতে পানির কলকল শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

“এটা আবার কী?” জো জিজ্ঞেস করল।

 “দেখে তো মনটানার পানি শোধনাগারের মতো লাগছে।” কার্ট বলল।

“সঠিক উত্তরটা দিল নৌকার মাঝি। “পানি বিদ্যুৎ। ওসাইরিস পাওয়ার এন্ড লাইট বানাচ্ছে এটা।”

রেনাটা সাথে সাথেই নেটে সেটা নিয়ে ঘাটা শুরু করল। “মাঝি ঠিকই বলেছে। নেটে বলা হচ্ছে যে পানি নদী থেকে এই প্রণালিটায় জোর করে প্রবেশ করানো হয়। তার ফলে পানির নিচের টারবাইনগুলো ঘোরে আর বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম এটা। ওদের ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে এরকম আরো ১৯টা প্রকল্প আছে ওদের। সবই নদীর তীরে। ভবিষ্যতে মিসরের বিদ্যুৎ নিয়ে আর সমস্যা হবে না।”

“বুদ্ধিটা খারাপ না। বড় বড় বাধ দিলেই আনুষঙ্গিক সব ঝামেলা কমে যায়। আর নদীর ক্ষয়ক্ষতিও তখন আর চোখে পড়ে না।” জো বলল।

কার্টও একমত। দ্রুত একবার নজর বুলাতেই ওর মনে হলো ওরা রোমান জাহাজটা উদ্ধারের সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে উপায় অবলম্বন করেছিলো এটা অনেকটা সেরকম-ই। কিন্তু কিছু একটা ঘাপলা আছেই। মিনিট খানেকের মধ্যেই সেটা ধরতে পারলে ও, “কিন্তু তাহলে প্রণালির শেষে জল প্রপাতের দরকারটা কী?”

“আমি কোনো জলপ্রপাত দেখতে পাচ্ছি না।” রেনাটা বলল।

“নায়াগ্রা ফলস খুঁজলে তো পাবেন না। ভালো করে দেখুন। নদীর পানির উচ্চতা আর প্রণালি থেকে বেরিয়ে আসা পানির উচ্চতায় ফারাক আছে। কমপক্ষে কয়েক ফুট।” রেনাটা আর জো দুজনেই চোখ বড় বড় করে দেখার চেষ্টা করল ব্যাপারটা।

 “তোমার কথাই ঠিক। পানি নিচে নামছে। ওই প্রণালির ভেতরে ঢোকার পর মনে হচ্ছে যে পানির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।” জো বলল।

“বাধ দিলে কী এরকম হয় নাকি?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

“আমার ধারণা এখানে কোনো বাঁধই নেই। কার্ট জবাব দিল। “প্রবাহী পদার্থের ধর্ম অনুযায়ী ঐ প্রণালি আর নদীর পানির উচ্চতা একই হওয়ার কথা। শুধু সেটাই না, প্রণালির পানির স্রোত নদীর স্রোতের চেয়ে কম হবে। কারণ প্রণালির পানিকে বিশাল বিশাল টারবাইনে বাধা পেয়ে পেয়ে তারপর আসতে হচ্ছে। এত বড় প্রকল্পে সাধারণত দেখা যায় পানি উল্টো দিকে বইছে। এরকম এতো বেশি পানি আসে না কখনো।

“হতে পারে যে ওরা হয়তো পানির গতি বাড়ানোর কোনো উপায় বের করেছে”, জো বলল।

“হতে পারে। যাই হোক সেটা আমাদের সমস্যা না।” বলে কার্ট রেনাটার দিকে ফিরলো। “আমাদের বন্ধু এখন কোথায়?”

“আমার মনে হচ্ছে এটাই আমাদের সমস্যা। ও ঠিক নির্মাণাধীন ভবনটার পাশেই নেমেছে। সম্ভবত মেইন বিল্ডিংটায় ঢুকবে।” রেনাটা ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে বলল।

কার্ট একটা ছোট্ট বাইনোকুলার চোখে তুললো। এতো দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে যে, এলাকাটার সিকিউরিটি খুব কড়া। কুকুর হাতে গার্ডরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। গেট দিয়ে ঢোকার সময় প্রতিটা গাড়ি তল্লাসী করা হচ্ছে। দেখে তো মনে হচ্ছে আর্মি ক্যাম্প।”

“হুম, যেন, একটা দুর্গ। আর আমাদের বন্ধু হাসান ওতেই আশ্রয় নিয়েছে।” জো বলল।

“এখন?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

“ওসাইরিস ইন্টারন্যাশনাল সম্পর্কে যতটা সম্ভব জানতে হবে। আর হাসান যদি শীঘ্রই ফিরে না আসে তাহলে আমাদেরকেই ভেতরে ঢোকা লাগতে পারে। কার্ট বলল।

 “এটা কিন্তু মাল্টার জাদুঘরে ঢোকার মতো অতো সহজে হবে না।” সাবধান করল রেনাটা।”

“আমাদের ওখানে ঢোকার জন্যে শুধু একটা অফিসিয়াল অজুহাত দরকার। সরকারি কোনো কিছু হলে ভালো হয়। আপনার AISE-এর বন্ধুরা একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে নাকি?” কার্ট বলল।

 রেনাটা মাথা নাড়লো। “আপনাদের দেশের ইরানে যেটুকু প্রভাব আছে আমাদেরও এখানে সেরকম-ই। হবে না।”

“তাহলে আর কি। বরাবরের মতো আমরা আমরাই।”

“সম্ভবত না।” জো দাঁত বের করে বলল, “আমার পরিচিত একজন বোধহয় সাহায্য করতে পারবে। মিসরের সরকারি আমলা একজন। একবার তার বড় উপকার করেছিলাম।”

“আশা করি, বড় কিছুই করেছিলেন।” রেনাটা বলল।

 “শুধু বড় না, সবচেয়ে বড়।” জো বলল।

রেনাটা কিছুই বুঝলো না কিন্তু কার্ট ধরতে পেরেছে জো-এর কথা। ও ভুলেই গিয়েছিল যে জো মিসরের একজন জাতীয় বীর। অর্ডার অফ নাইল খেতাব প্রাপ্ত গুটি কয়েক বিদেশিদের একজন। ও সম্ভবত যা চাবে তা-ই পাবে। “মেজর ইদো।” কার্ট বলল। এই লোকটাকেই জো সাহায্য করেছিল।

“ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে প্রমোশন হয়েছে তার। আমার জন্যেই।” জো বলল।

“এজন্যই কী উনি আপনাকে সাহায্য করবেন?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

জবাব দিল কার্ট। “আরে উনি তো উনি। আপনি এখন যার দিকে তাকিয়ে আছেন সে আস্বান বাধকে রক্ষা করে পুরো মিসরকে ডুবে মরার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।”

“ওমা! ওটা আপনি?” রেনাটা হতবাক। ঘটনাটা তখন সারা বিশ্বেই আলোড়ন তুলেছিল।

“একা একা তো আর পারিনি। কিছুটা সাহায্য তো লেগেছিলই। জো বলল।

রেনাটা হাসল, “কিন্তু আপনিই ছিলেন আসল।”

 জো মাখা ঝাঁকালো।

“আমি আসলেই কি বলবো বুঝতে পারছি না। আশা করি এ যাত্রায় আমরা আপনার কিছুটা সাহায্য’ হতে পারবো।” রেনাটা বলল।

কার্টও সেটাই ভাবছিল। তারপর নৌকার মাথায় মাঝির কাছে গিয়ে বলল, “আমাদের ঘোরা শেষ। ফিরে চলেন।”

নৌকা ঘুরে গেল। এখন হাসান বিল্ডিংটা থেকে বের হওয়ার আগেই ওদেরকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইদোকে খুঁজে বের করতে হবে।

.

৪৩.

জো বসে আছে এক গদি-আটা নরম চেয়ারে। শহরতলীতেই একটা অফিসে এসেছে ও। আধুনিক সাজসজ্জা। ঝলমলে আলো আর হাল্কা সংগীত থেকেই বোঝা যায় অফিসের মালিক সফল একজন মানুষ। ওর মেজর ইদোর সাথে প্রথম সাক্ষাতের কথা মনে পড়ল। সেটা ছিল বেশ কয়েক বছর আগে, এক ইন্টারোগেশন রুমে। আর ভাগ্যটাও সেদিন ওর পক্ষে ছিল না।

“হুম, দেখে মনে হচ্ছে আপনি আর সেনাবাহিনীতে নেই।” জো বলল।

ইদোর চুল এখন আগের চেয়ে লম্বা। সামরিক পোশাক ছেড়ে কেতাদুরস্ত জামাকাপড় পরায় ওর ক্লার্ক গ্যাবেল-এর মতো চেহারাটা আরো খোলতাই হয়েছে।

“বিজ্ঞাপন। এখন আমি এই জগতের লোক। এটাই আরো বেশি মজার। আর আমার সৃজনশীলতা প্রকাশের এটাই সবচেয়ে বড় সুযোগ করে দিচ্ছে।” শিল্পীর তুলি চালানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল ইদো।

“সৃজনশীলতা?”–জো জিজ্ঞেস করল।

“অবাক হওয়ারই কথা। মিলিটারি লোকজনের মধ্যে এই জিনিসটা থাকে বললেই চলে।”

 জো দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “যাই হোক। যা করছেন তাতেই আমি খুশি। শুধু অবাক হলাম এই যা। কিন্তু হয়েছিল কী? আপনি জেনারেল হয়েছিলেন শুনেছিলাম?”

 ইটো চেয়ারে হেলান দিয়ে কাঁধ ঝাঁকালো, “পরিবর্তন, বড় সড় কয়েকটা পরিবর্তন হয়ে গেল। প্রথমে হলে আন্দোলন। তারপর মারামারি, তারপর বিপ্লব। আমাদের সরকার পতন হলো। নতুন সরকার আসলো। তারপর আবার বিক্ষোভ শুরু হলো আর এই সরকারের পতন হলো। তারপরে মিলিটারিতে শুদ্ধি অভিযান চালানো হলো। আমাকে পেনশন ছাড়াই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।”

“আর আপনি তখন বিজ্ঞাপন ব্যবসা শুরু করেছেন?”

“আমার দুলাভাই এই ব্যবসা করে ভালোই কামিয়েছেন। অবস্থা এমন সবাই-ই কিছু না কিছু বিক্রি করতে চায়।”

জো ভাবছে ইদো কি এখনও ওদেরকে সাহায্য করতে পারবে কি-না।

“আমি আরো ভাবছিলাম আপনি আমার সাথে ওসাইরিস কন্সট্রাকশনের হোমরা-চোমরা কারো সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারবেন।”

ইদো সামনে ঝুঁকে এলো। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে গিয়েছে, “ওসাইরিস?” খুব সাবধানতার সাথে উচ্চারণ করল শব্দটা। “নতুন কী ঝামেলায় জড়িয়েছেন আপনি?”

“আসলে বলাটা মুশকিল।” জো বলল।

ইদো ড্রয়ার খুলে এক প্যাকেট সিগারেট বের করলো। তারপর সেটা ধরিয়ে হাতে রেখেই এদিক সেদিক নাড়তে লাগল কিন্তু টান দিল না। আগেও এই অভ্যাসটা ছিল তার।

“আপনার জায়গায় আমি থাকলে ওসাইরিসকে নিয়ে ঘাটাঘাটি করতাম না।” ইদো সাবধান করলেন।

“কেন? কারা ওরা?” জো বলল।

“ওরা কারা না, সেটা হচ্ছে কথা। ওরা হলো গুরুত্বপূর্ণ সবাই।” ইদো জবাব দিলেন।

“আরেকটু খোলাসা করে বললে ভালো হয়।” ভজা বলল।

“আগের বিপ্লবের সময় যাদেরকে সেনাবাহিনী থেকে ছাটাই করা হয়েছিল তারা মিলে বানিয়েছে এটা। সেই ১৯৫২ সাল থেকে সেনাবাহিনীই মিসরের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। ওরাই ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের ডান হাত। নাসের ছিল মিলিটারি, সাদাত ছিল মিলিটারি, মুবারকও মিলিটারি। তাঁরাই সব চালাচ্ছে। তবে ভেতরের কাহিনী আরো গভীর। মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স বলে একটা কথা আছে শুনেছেন তো? মিসরে সেই ব্যাপারটাকে একটা নতুন রূপ দেয়া হয়েছে। এখানকার বেশির ভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরই মালিক ছিল মিলিটারির লোক। তারাই ঠিক করতো কাকে চাকরি দেবে। ওরাই বন্ধুদের পুরস্কার দিত। শত্রুদের সাজা দিতো। কিন্তু বিপ্লবের পর থেকে ব্যাপারগুলো অনেকটাই বদলে যায়। ফলে চাইলেও আর আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। সেখান থেকেই ওসাইরিসের জন্ম। তারেক সাকির নামের এক লোক চালায় এটা। উনি আগে গোয়েন্দা পুলিশের কর্ণেল ছিলেন। বর্তমানে দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখেন উনি। কিন্তু উনি জানেন যে ওনার অতীত সেটা হতে দেবে না। তাই অন্যদের সহায়তা নিয়ে এই বাঁকা রাস্তা ধরেছেন। ওসাইরিস মিসরের সবচেয়ে শক্তিশালী সংস্থা। সব কাজের ঠিকাদারি ওরা পায়। শুধু সরকারি না বেসরকারিগুলোও। সবাই ওদেরকে ভয় পায়। এমনকি ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরাও।”

“তার মানে সাকির রাজা বানায় কিন্তু নিজে রাজা না।” জো বলল।

ইদো মাথা ঝাঁকালো। “সে কখনোই আড়াল থেকে সামনে আসবে না কিন্তু এর মধ্যেই দেশে বা দেশের বাইরে তার ব্যাপক ক্ষমতা। লিবিয়া, তিউনিসিয়া আর আলজেরিয়াতে কি হয়েছে তা তো দেখেছেনই।”

“হ্যাঁ।” জো বলল।

“ওসব দেশের নতুন সরকারের সব লোকই সাকিরের বন্ধু। ওর সহচর।” ইদো বললেন।

“শুনেছি ওরাও নাকি বিপ্লবের আগে যার যার দেশে ক্ষমতাসীন ছিল।” জো বলল।

“হ্যাঁ। দুয়ে দুয়ে চারটা কীভাবে মিলছে বুঝছেন আশা করি।”

জো স্পষ্ট বুঝতে পারছে প্রতি পদক্ষেপে ওরা ওদের ধারণার চেয়েও গভীর কিছু একটায় ঢুকে পড়ছে। ঠিক যেন ওরা ছোট একটা মাছ বঁড়শিতে গেঁথেছে আর সেটা আবার খেয়েছে আরেকটু বড় একটা মাছ। এখন বিশাল একটা হাঙ্গর বড় মাছটাকে তাড়া করছে।

ইদো-ই কথা বললেন আবার, “ওসাইরিসের নিজস্ব সেনাবাহিনী আছে। মিসরের সেনাবাহিনী বা স্পেশাল ফোর্স বা গোয়েন্দা পুলিশের গুপ্তঘাতকদের মধ্য থেকে তাদের বাছাই করে নেয়া হয়। সরকারি মিলিটারিতে যারা ব্রাত্য হয়ে পড়ে তারা সবাই যোগ দেয় ওসাইরিসে।”

 জো কপাল ঘষলো। “কিন্তু আমাদের ঐ বিল্ডিংটার ভেতরে যাওয়াটা জরুরি। আর আমন্ত্রণ পেয়ে ওটার ভেতর যাওয়ার মতো সময়ও নেই। হাজার হাজার মানুষের জীবন-মরণ নির্ভর করছে এর ওপর।”

 ইদো অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি শুরু করলেন। জো’র মনে হলো ইদো’র দৃষ্টিতে কেমন একটা পরিবর্তন হয়েছে। অনেক হিসেবী সে দৃষ্টি। ইদো দেয়ালে হাত রেখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দেখে মনে হচ্ছে এই অফিসের চার দেয়ালের মধ্যে উনি আটকা পড়ে গিয়েছেন। কিন্তু তার মতো মানুষকে শুধু চার দেয়ালের মাঝে মানায় না।

 দীর্ঘক্ষণ পর তিনি জোর দিকে ফিরলেন, “ওসাইরিসের শত্রুদের সাহায্য করা আর নিজের পায়ে কুড়াল মারা একই কথা। তবে আপনার কাছে আমি ঋণী। মিসর আপনার কাছে ঋণী।” তারপর সিগারেটের গোড়াটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে বললেন, “আর তাছাড়া এই ব্যবসাটা আমার পোষাচ্ছে না। দুলাভাইয়ের অধীনে কাজ করাটা যে কত ঝামেলার তা আপনাকে বলে বোঝানো যাবে না। আর্মির চেয়েও খারাপ।”

জো হাসলো, “সাহায্যের জন্যে চির কৃতজ্ঞ থাকব।”

ইদো মাথা ঝাঁকালেন, “তা কীভাবে আপনারা ওসাইরিসের বিল্ডিংয়ে ঢুকতে চাচ্ছেন? সরাসরি আক্রমণ বা হেলিকপ্টার থেকে লাফিয়ে নামা নিশ্চয়ই সম্ভব না।”

জো রিসেপশনে বসা কার্ট আর রেনাটার দিকে ইঙ্গিত করল। ওরা কম্পিউটারে ডাউনলোড করা ম্যাপ আর নকশায় চোখ বুলাচ্ছে। “আমি এখনো জানিনা, আমার বন্ধুরা নিশ্চয়ই এতোক্ষণে কিছু একটা উপায় বের করে ফেলেছে। শুনে দেখি আগে।”

ইদো হাত নেড়ে ওদেরকে ডাকলো। পরিচিতি পর্বের পরেই ওরা আসল কথায় চলে এলো।

“আমার সহকর্মীরা আমাকে ওসাইরিস প্লান্টের একটা নকশা পাঠিয়েছে।” রেনাটা বলল। তারপর সামনে এগিয়ে আইপ্যাডটা ডেস্কের ওপর রাখলো যাতে সবাই দেখতে পায় ঠিক মতো। “যদি এই নকশাগুলো ঠিক হয় তাহলে একটা পথ বোধহয় পাওয়া গিয়েছে।”

কয়েকবার স্ক্রিনে স্পর্শ করতেই একটা হাই-রেজুলুশন ছবি ফুটে উঠল। নদীসহ বিল্ডিংটার আশপাশ দেখা যাচ্ছে তাতে। “রাস্তার দিকে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় আছে। ওদিক দিয়ে ঢাকা তাই মোটামুটি অসম্ভব। তার মানে আমাদের একমাত্র উপায় হলো নদীর দিক থেকে ঢোকা। আমাদের একটা নৌকা লাগবে। সাথে তিনজনের জন্য ডুবুরির সরঞ্জাম আর একটা মধ্যম তরঙ্গের লেজার গান–সবুজ হলে সবচেয়ে ভালো হয়। তবে মিলিটারীরা টার্গেটিংয়ের জন্যে যে লেজার ব্যবহার করে সেরকম হলেই চলবে।”

ইদো মাথা ঝাঁকালো, “আমি ওগুলো ব্যবস্থা করতে পারবো। তারপর?”

কার্ট বলা শুরু করল এরপর, “আমরা নৌকায় করে এই জায়গাটায় যাব। এটা হচ্ছে বিল্ডিংটার প্রায় আধা মাইল দক্ষিণে। আমি, রেনাটা আর জো পানিতে নেমে পশ্চিম তীর ঘেষে এগুবো। তারপর প্রণালিটায় ঢুকে, প্রথম ধাপের টারবাইনগুলো পার হয়ে, দ্বিতীয় স্তরের টারবাইনগুলোর ঠিক আগে… এখানে এসে পৌঁছুবো।”

“শুনতে তো সহজ-ই লাগছে, ইদো বলল।

 “আমি নিশ্চিত ঝামেলা বাধবেই।” জো বলল।

“অবশ্যই।” বলল কার্ট। তারপর রেনাটার দিকে ফিরলল, “নশাটা আর একবার বের করুন তো।”

রেনাটা আবারও ফোনে স্পর্শ করতে পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্লুপ্রিন্টটা দেখা গেল।

“এই প্রণালিটায় ঢুকতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই আমাদেরকে এই টারবাইনগুলো পার হতে হবে। যেহেতু তখন রাত। তাই ধারণা করছি যে তখন ওরা খুব বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করবে না, তবে সেটা যে কোনো মুহূর্তেই পরিবর্তন হতে পারে। আর যদিও স্টেশনটা থামানো থাকবে, টারবাইনগুলোর ঘোরা কিন্তু থামবে না।”

“ওগুলোর গায়ে লাগা চলবে না, তাই তো?” জো বলল।

“হ্যাঁ। আর সেটা করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ভেতরের দেয়ালের দিকে থাকা। প্রথম টারবাইনের আশেপাশে অনেক ফাঁক আছে। একবার ওগুলোকে পেরুতে পারলেই আমরা পরের টারবাইনগুলোর দিকে এগুবো। তারপরেই শুরু হবে আসল খেলা।”

নকশাটা দেখে জো দুটো জিনিস খেয়াল করেছে। দুই নম্বর টারবাইনটা প্রথমটার চাইতে বড়। আর ওটার কিনার বরাবর দেয়াল থেকে খানিকটা অংশ বের হয়ে আছে। দেশে অনেকটা পিনবল মেশিনের ফ্লিপারের মতো মনে হয়। ও ওগুলোর দিকে দেখালো।

“ডিফ্লেকটর গেট। এগুলো থাকলে টারবাইনের দিকে আরো বেশি পানি প্রবাহিত হয়। যখন বেশি বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় তখন এগুলো কাজে লাগে।” বলল কার্ট। যখন ভেতরে ঢোকানো থাকে তখন এগুলো দেয়ালের সাথে মিশে থাকে আর তখন খানিকটা পানি দেখা যায় টারবাইনের পাখায় না লেগেই চলে আসে। আর যখন ওগুলো ভোলা থাকে তখন ওগুলোর প্রান্ত একেবারে টারবাইনের মাঝ পর্যন্ত চলে আসে। এগুলো ছাড়া ঐ টারবাইনের কাছে যাওয়া সম্ভব না। তবে পাখার কাছে যাওয়ার আগেই আমরা পানি থেকে বের হয়ে আসবো।” তারপর নকশার একটা জায়গা দেখিয়ে বলল, “এখানে একটা মেইনটেন্যান্স সিঁড়ি আছে। গেটের একপাশে ঝালাই করে লাগানো। আমরা দেয়ালের ধার ঘেষে সাঁতরাবো তারপর এটা ধরে উঠে যাবে।”

“যতক্ষণ গেটটা বন্ধ থাকছে, ততোক্ষণতো কোনো ঝামেলা নেই কিন্তু যদি ওটা সামনে বেরিয়ে আসে তখন পানির স্রোতের কী হয়?” জো জিজ্ঞেস করল।

“পুরোটা খোলা থাকলে পানির স্রোত দ্বিগুণ হয়ে যায় আর আর মোট শক্তির পরিমাণ নির্ভর করে নদীতে পানির পরিমাণের ওপর। বছরের এই সময়টায় সাধারণত এটা দুই নটের মতো হয়।”

“দুই নটে সমস্যা হবে না, তবে চার নটে হবে।” জো বলল।

কার্ট মাথা ঝাঁকালো। এটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে।

জো ব্যাপারগুলো আবার চিন্তা করল। মাঝরাতে কোনো স্টেশনে পূর্ণ শক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোনো কারণই নেই। সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা লাগে বিকেল বেলায়।

 টারবাইনে কাটা পড়ে ভর্তা না হয়ে যদি পানির ওপরে উঠতে পারি, তাহলে শুরু হবে আসল সমস্যা।” কার্ট বলল।

 “চারপাশে অবশ্যই ক্যামেরা থাকবে।” ইদো মনে করিয়ে দিল। রেনাটা জবাব দিল এবার, “হ্যাঁ আছে। এখানে আর ওখানে। কিন্তু এই ক্যামেরা দুটোর মুখ আরেক দিকে ঘুরানো। কেউ বিল্ডিংটার দিকে আসছে কি-না সেটা দেখার জন্য। একবার প্রথম টারবাইনগুলো পার হতে পারলেই মাত্র একটা ক্যামেরা নিয়েই চিন্তা থাকবে। এটা এখানে লাগানো।” আরেকটা জায়গা দেখালো রেনাটা। এটায় দেওয়ালের পাশের পুরো ফুটপাতটাই দেখা যায়। আর এই ফুটপাতটাই আমাদেরকে ব্যবহার করতে হবে।”

“আর এজন্যেই লেজারটা দরকার।” ইদো বললেন।

“হ্যাঁ। একটা লেসারই পারে সেন্সরগুলোকে ওভারলোড করতে। আর এটা হবে আপনার দায়িত্ব। নদীর ওপাড়েই সামান্য উজানে একটা বালিয়াড়ি আছে। ওখান থেকেই সবচে ভালো পারবেন। একবার ঠিকমতো লেজারটা তাক করতে পারলেই সেন্সরগুলো ঠিকমত সংকেত দিতে পারবে না। আর ওরা একটা খালি স্ক্রিন বাদে আর কিছু দেখবে না।” ওর কথার খেই ধরলো কার্ট। “আর একবার ক্যামেরা কাজ করা বন্ধ হলেই আমরা পানি ছেড়ে উঠে যেতে পারবো। তারপর এই ফুটপাত ধরে এই দরজা দিয়ে ঢুকবো।”

“লেজারটা কতক্ষণ ধরে রাখতে হবে?”

“দুই মিনিটেই কাজ হয়ে যাবে।” রেনাটা জবাব দিল।

“আর ভেতরের সিকিউরিটি ক্যামেরা বা অ্যালার্মের কী হবে?” ইদো জিজ্ঞেস করলেন।

“ভেতরে ঢুকলে আমি ওগুলোর ব্যবস্থা করতে পারবো।” রেনাটা বলল। “ক্যামেরা আর অ্যালার্ম দুটোই হালিফ্যাক্স নামের একটা সফটওয়্যার দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আমাদের টেকনিক্যাল সেকশনের লোকজন আমাকে ওটা হ্যাঁক করা শিখিয়ে দিয়েছে।”

রেনাটা এবার ভেতরের বিল্ডিংয়ের নকশাটা বের করল, “হাসান এই দরজাটা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছে। এই করিডোরে আসার আগ পর্যন্ত ভালোই সিগনাল পাচ্ছিলাম, তারপর সম্ভবত এই এলিভেটরে ওঠে। তারপরই সিগনাল দুর্বল হতে হতে একসময় আর পাওয়া যায়নি। এ থেকে ধারণা করছি যে সে নিচের দিকে নামে, ওপরে না। তার মানে সম্ভবত ও এখন এই পাওয়ার জেনারেশনের কন্ট্রোল রুমে আছে।”

“আপনি কী নিশ্চিত যে এটা একটা ফাঁদ না?” ইদো জিজ্ঞেস করলেন। “এখানে একবার ঢুকলে কিন্তু দুনিয়ার কারো পক্ষেই আর আপনাদের সাহায্য করা সম্ভব হবে না।”

“জানি।” বলল কার্ট। “তবে বিশ্বাস করুন আমি বহু ভেবেও বের করতে পারছি না। কেন হাসান ওখানে বসে বসে কতখানি বিদ্যুৎ উৎপাদন হলো সেটা দেখছে। কিন্তু সিগনাল আসা বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত ওখান থেকেই সর্বশেষ সিগনালটা আসে। আর যদি ওখানে ও নাও থেকে থাকে ওসাইরিসের অবশ্যই ওখানে কিছু একটা আছে। তার মানে একবার জায়গাটা ঘুরে আসলে ক্ষতি নেই।”

“বলিহারি সাহস আপনাদের! তা আপনারা ভেতরে ঢোকার পর আমি কী করবো?” ইদো জিজ্ঞেস করলেন।

 “নদীর ভাটিতে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবেন। যদি আমরা হাসানকে খুঁজে পাই তাহলে তাকে ধরে আনবো, আর যদি না পাই জায়গাটা ঘুরে টুরে দেখে বাড়ি ফিরে আসবো।”

.

৪৪.

কয়েক ঘণ্টা পর আবার ওরা নীলনদে নৌকা ভাসালো। নৌকাটা ইদোর এক বন্ধুর। তিন জনের জন্য ডুবুরির সরঞ্জাম আর একটা ট্রাইপডে বসানো লেজারও জোগাড় হয়েছে।

ইতোমধ্যে চারদিকে আঁধার জেকে বসেছে ভালোভাবেই। তাই নদীর দুধারে দিনের মতো একদমই ভিড় নেই। আকাশে চাঁদ নেই তবে দুধারের উঁচু উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের আলো পড়ে নদীর পানি ঝিকমিক করছে।

ওসাইরিস কর্পোরেশনের কাছাকাছি পৌঁছতেই কার্ট নদীর ভাটিতে তাকাল। “প্রণালির শেষ মাথায় এখন পানি আস্তে আস্তে বইছে।”

“তার মানে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে।” রেনাটা বলল।

“যাক বাচলাম।” বলল জো।

“যদি এখনো একটা ব্যাপার বুঝে আসছে না। তবে পানি শান্ত থাকায় প্রণালিতে ঢোকা আর বিল্ডিংটার ভেতরে অনুপ্রবেশ সহজ হবে। কার্ট বলল।

জো একটা নাইট ভিশন স্কোপ দিয়ে প্রণালিটা পরীক্ষা করে বলল, “সম্ভবত গেটগুলো এখন বন্ধ-ই আছে।”

ইদে নৌকাটা আরো উজানে নিয়ে আসলেন তারপর দিক বদলে পশ্চিম তীরের দিকে এগোলেন। নৌকাটা জায়গা মতো পৌঁছতেই কার্ট, জো আর রেনাটা পানিতে নামার জন্য রেডি হয়ে গেল।

আসার আগেই ওরা কাপড়ের নিচে কালো রঙের ডুবুরির পোশাক পরে নিয়েছিল। ঝটপট তাই ওপরের কাপড় খুলে প্লবতা প্রতিরোধী কমপ্রেসর। BCD (Buayancy Control Device); অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ইত্যাদি জায়গা মতো পরে নিলো। তারপর সব চেক করে দেখলো ঠিকঠাক চলছে কি-না। অক্সিজেনের সিলিন্ডারগুলো বেশি চকচকে না, তার ওপর রঙ করা আছে। তাই ওটায় বেশি পানি প্রতিফলিত হবে না। মাছের লেজের মতো ফিন পরেছে পায়। কয়েকটা ওয়াটার প্রুফ ব্যাগও নিয়েছে আর আছে কয়েকটা লাইট। পানির নিচে কে কোথায় আছে তা দেখতে কাজে লাগবে এটা।

.

৪৫.

রাতের বেলা পানিতে ডুব দেয়া খুবই কঠিন কাজ। এমনকি সর্বোচ্চ অনুকূল পরিস্থিতিতেও। আর যদি তীব্র স্রোত, পাথর আর বালির চাকা ভরা একটা নদীর তল দিয়ে সাঁতরানো লাগে তাহলে তো কথাই নেই। তবে যতক্ষণ ওরা পশ্চিম তীরের কাছাকাছি আছে ততোক্ষণ ওদের রাস্তা হারানোর ভয় নেই।

কার্ট শুধু ওর পা ব্যবহার করে সাঁতরাচ্ছে। তাও খুব আস্তে আস্তে। হাত দুটো শরীরের দুপাশে স্থির। স্রোতের অনুকূলে থাকায় ওদের গতি এখন মোটামুটি তিন নটের মতো। তার মানে প্রণালিটার মুখে পৌঁছাতে দশ মিনিটের মতো লাগবে। কাট ধীরে ধীরে পানির গভীরে নেমে যাচ্ছে। এক সময় ওর আশপাশের পানি আলকাতরার মতো কালো হয়ে এলো ওপরে তাকালে হালকা দু-এক ঝলক ঝিকিমিকি বাদে আর কিছুই দেখা যায় না। নদীর পাড় থেকে তাকালে ওকে আর দেখতে পাবে না। তবে এইটুকু আলোও না থাকলে ওর পক্ষে আশপাশের কিছু ঠাহর করা সম্ভব হবে না।

ও সামান্য বামে ঘুরে পিছনে তাকাল। অন্ধকারের ভেতরেই দুটো LED লাইট জ্বলজ্বল করছে। জো আর রেনাটার কবজিতে ওগুলো বাধা। ওরা দুজন পাশাপাশি সাঁতরাচ্ছে। আর কাটের লাইটের মুখ ওদের দিকে যাতে ওরা ওটা দেখে এগুতে পারে।

সামনেই একটা হালকা আলোর রেখা দেখা গেল। কন্সট্রাকশন সাইটের ফ্লাডলাইট এগুলো। নদীর পানির ওপর পড়ছে। তার মানে ঠিক পথেই আছে ওরা। নদীর পানি ভেদ করে এতো নিচেও আলো চলে আসছে দেখে কার্ট আরো একটু গভীরে চলে গেল।

আলোকিত এলাকাটা পার হতেই প্রণালির মুখের কংক্রিটের পিলারটা চোখে পড়ল। এরপর থেকেই প্রণালির দেয়াল শুরু আর এটাই নদী থেকে আলাদা করেছে প্রণালিটাকে। ওকে এখন বামে ঘেষে থাকতে হবে, না হলে পানির চোরা স্রোতে পড়ে আরেকদিকে চলে যেতে পারে।

একটা জিনিসই নেই, তা হলো ওদের প্রপালসন ইউনিট আর পানির নিচের কমিউনিকেশন সিস্টেম। ঐ বাতি জ্বেলে সংকেত দিতে হবে।

“চলে এসেছি।” ইদো বললেন।

কার্ট মাথা ঝাঁকালো, তারপর ও আর জো পানিতে নেমে নৌকার এক পাশ ধরে ভেসে রইলো। রেনাটা আরো একবার ও আইপ্যাড চেক করে যোগ দিল ওদের সাথে।

“এখনও সময় আছে। ফিরে যাবেন?” কার্ট বলল।

“না। একবার শুধু দেখে নিলাম যে হাসান ঐ বিল্ডিং ছেড়ে বের হয়েছে কি-না?”

“সিগনাল পাওয়া যাচ্ছে না নিশ্চয়ই?”

 রেনাটা মাথা ঝাঁকালো।

“তাহলে আর দেরি কিসের। চলুন যাই।” কার্ট বলল। তারপর ওর মুখোশ টেনে জায়গামতো পরে নিলো। রেগুলেটরটা জায়গামতো কামড়ে ধরে ডুব দিল পানিতে।

প্রণালিতে ঢুকতে ওর কোনো সমস্যা হলো না। সোত তেমন নেই এর ভেতরে তবে চারপাশের পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা। খানিক সামনেই আবার আলোকিত একটা জায়গা পড়ল। আর তাতে কার্ট ওর ডানপাশের দেয়াল আর নিচের পাকা মেঝে স্পষ্ট দেখতে পেল।

 প্রণালির মেঝেতে তিনকোণা উঁচু উঁচু বেশ কিছু জিনিস দেখা গেল। ওগুলো বসানো হয়েছে স্রোতের জোর বাড়ানোর জন্যে। ও ওগুলো পার হয়ে ভেতরের দেয়ালের দিকে এগুলো। তারপর পা নাড়ানোও বন্ধ করে দিল পুরোপুরি। এখন শুধু স্রোতের টানে ভাসছে। পাশের দেয়ালের ছায়ায় পৌঁছার আগ পর্যন্ত নিশ্বাস পর্যন্ত নিলো না। কারণ নিশ্বাসের বুদবুদ ওপর থেকে কেউ দেখে ফেলতে পারে।

প্রথম ধাপের টারবাইনগুলো দেখা গেল এরপরেই। হঠাৎ এমনভাবে উদয় হলো যেন কুয়াশা ভেদ করে কোনো জাহাজ এগিয়ে আসছে। হালকা ধূসর আর কেমন অস্পষ্ট দেখাচ্ছে দেখে কার্টের 747 বিমানের ইঞ্জিনের কথা মনে পড়ল। টারবাইনের ব্যাস প্রায় ১৫ ফুট। আর তাতে প্রায় কয়েক ডজন পাখা। দেখতে অনেকটা ফ্যানের মতোই। পাখাগুলো অলস ভঙ্গিতে হালকা হালকা ঘুরছে আর একটা টিক টিক শব্দ হচ্ছে।

কার্ট ভেতরের দেয়ালটার দিকে আরো খানিকটা সরে এলো আর দেয়াল আর টারবাইনের মাঝখানের ফাঁক গলে টারবাইনের অপর পাশে চলে এলো। ঘুরে বাঁকিয়ে দেখে জো আর রেনাটাও সেটা পেরিয়ে এসেছে নিরাপদেই।

প্রণালিটার মাঝামাঝি পৌঁছাতেই দ্বিতীয় ধাপ শুরু হলো অভিযানের। কার্ট গতি আরো কমিয়ে আনলো। মাঝে মাঝে পানিতে হালকা লাথি মারছে যাতে করে দেয়ালের ধার ঘেষে থাকতে পারে। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে ঐ মইটা পার হয়ে যেতে চায় না।

খানিক পরেই আরো একটা শব্দ শোনা যেতে লাগল। এবারের কম্পনটা অবশ্য আরো তীব্র আর ভয় ধরানো। ঠিক দূরবর্তী কোনো জাহাজের প্রপেলারের ধপ ধপ শব্দ।

 আসল টারবাইনটা সামনেই আছে তা বোঝা গেল। এটার আয়তন আগেরটার প্রায় দ্বিগুণ। প্রণালির প্রায় পুরোটা দখল করে ফেলেছে। এটার পাখাগুলো পুরো দেখা না গেলেও শব্দ পাওয়া যাচ্ছে ভালোই। একটু পরেই ডিফ্লেকটর গেটের কিনারটা দেখা গেল।

যেমনটা আশা করেছিল তেমনটাই হয়েছে। গেটটা বন্ধ, মানে ভেতরে ঢোকানো। দেয়ালের সাথে মিশে রয়েছে। ক্ষয় এড়ানোর জন্য ওটার ধাতব মুখে হলুদ রঙ করা। যদিও পানির ভেতরে রঙটা কেমন মরা দেখাচ্ছে কিন্তু পাশের দেয়ালের সাথে তুলনা করলে যথেষ্ট উজ্জ্বল।

ওটার পাশে ভাসতে ভাসতে কার্ট মইটা খুঁজতে লাগল। আরেকটু সামনে এগুতেই চোখে পড়ল ওটা। দেরি না করে দুহাতে আকড়ে ধরলো মইটা। মইয়ের ধাপগুলো কালো স্টিলে বানানো। প্রতিটাই ঝালাই করে গেটের সাথে বসানো। মজবুত, তাই ধরাও সহজ।

কার্ট নিচু হয়ে ওর পায়ের ফিনগুলো খুলে ফেলে স্রোতে ভাসিয়ে দিল। টারবাইনের ওপাশে হারিয়ে গেল ওগুলো।

নদী আর এখানকার পানির গতি একই রকম তবে পানির ঘনত্ব বাতাসের চেয়ে অনেক বেশি। তাই স্রোতের বিপরীতে এভাবে নিজেকে ধরে রাখা অনেকটা প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাসে পড়ার মতোই।

মুহূর্ত পরে জো আর রেনাটাও চলে এলো সেখানে। প্রথমে পৌঁছুলোনা রেনাটা। কার্ট যে ধাপটা ধরেছে, সেটা ধরেই থামালো নিজেকে। জো এসে ধরলো ঠিক নিচের ধাপটা। কার্টের মতো ওরাও দ্রুত পায়ের ফিন খুলে ফেলল তারপর পাও ঢুকিয়ে দিল মইয়ের ভেতর যাতে স্থির থাকতে পারে।

জো বুড়ো আঙুল তুলে দেখালো। কাট রেনাটার মুখোশের দিকে তাকাল। খুশিতে জ্বল জ্বল করছে। রেনাটা আঙুল দিয়ে ওকে দেখালো।

নিজের ডক্সা ঘড়িটার সময় পরীক্ষা করে বুঝলো বেশ তাড়াতাড়িই পৌঁছে গিয়েছে। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। আরো তিন মিনিট পর ইদো লেসার দিয়ে ক্যামেরাকে অকেজো করে দেবেন।

.

ইদো ততোক্ষণে জায়গামতো পৌঁছে গিয়েছেন। ব্যাগ থেকে ট্রাইপডটা বের করে জায়গামতো বসিয়েও ফেলেছেন। এটা আসলে জরিপের কাজে ব্যবহারের জন্যে বানানো। তবে মিলিটারির টার্গেটিং সিস্টেমের চেয়ে খুব বেশি আলাদা না।

লেজারটা ঠিকমতো বসানোর পর ওটার দূরবীন দিয়ে তাকিয়ে ক্যামেরাটা খুঁজে বের করলেন, তারপর ওটার লেন্স বরাবর লেন্সটা তাক করে দাঁড়ালেন।

ঘড়িতে দেখলেন আরো দুমিনিট বাকি। এখন শুধু সুইচ টেপার অপেক্ষা। সিগারেটের তেষ্টা পাচ্ছে তার। সময় কাটছে না তাই। নদীটা এখন পুরো খালি কিন্তু হঠাৎ একটা শব্দ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে এগিয়ে আসতে লাগল। শব্দটা একটা হেলিকপ্টারের।

একটু পরই দেখা গেল আকাশ হতে এক টুকরো আলো ওসাইরিস বিল্ডিং এর দিকে যাচ্ছে। ইদো আরো কিছুক্ষণ দেখে নিশ্চিত হলেন যে ওটা ওসাইরিসেই নামছে। এতো রাতে ওসাইরিসে কার কি কাজ থাকতে পারে ভেবে পেলেন না তিনি।

তবে পানির তিরিশ ফুট নিচে মইতে ঝুলতে ঝুলতে জো, কার্ট বা রেনাটা কেউই হেলিকপ্টার আগমন টের পেল না। এদিকে ওদের ওখানেও ঝামেলা লেগে গিয়েছে একটা। হঠাৎ করে পানির স্রোতও বেড়ে গিয়েছে। ওদের অবস্থান থেকে একটু সামনেই দেওয়ালে বসানো একটা পোর্টের মুখ খুলে গেল। সুয়ারেজের পাইপগুলোর মতোই বড় ওটার মুখ। মুখটা খুলতেই ওটা দিয়ে হুড়মুড় করে পানি বেরিয়ে এলো আর স্রোতের বেগ বেড়ে গেল বহুগুণ।

ওরা মইটাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে থাকল। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে তাতে। টান লেগে মনে হচ্ছে হাতটা ছিঁড়েই যাবে। ওর মাঝেও কার্ট এক ঝলক দেখলো ঘড়িটা, আরো এক মিনিট।

হঠাৎ আরেকটা ঝাঁকুনি ওদের কাঁপিয়ে দিল পুরোপুরি। ওদের ধরা মইটা জুড়েই শুরু হয়েছে কম্পন। ডিফ্লেক্টর গেটটা নড়া শুরু করেছে।

কার্ট রেনাটার দিকে তাকাল। ভয় পেয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। অবশ্য পাওয়ার-ই কথা। আসলেই মারাত্মক বিপদে পড়তে যাচ্ছে ওরা। গেটটা আস্তে-আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। তার মানে পানির স্রোত এখন আরো বাড়বে।

 টারবাইনটা আরো জোরে ঘোরা আরম্ভ করেছে। ধপ ধপ শব্দটাও বেড়ে গিয়েছে অনেক। গেটটা পুরো খুলে গেলে ওদের আর মই আকড়ে থাকা সম্ভব হবে না। টারবাইনের পাখায় ঢুকে কুচি কুচি হয়ে যাবে।

 কার্ট ওপরে ইঙ্গিত করতেই রেনাটা মাথা ঝাঁকালো। কার্ট ওর BCD-গুলো খুলে স্রোতের দিকে পাশ ফিরলো তারপর টান দিয়ে কাঁধ ওপরে তুলে এনে সিঁড়িতে উঠে গেল। BCD, অক্সিজেন ট্যাঙ্ক আর মুখোশটা সাথে সাথে স্রোতের টানে গা থেকে খুলে ভেসে গেলো। তারপর একটা একটা করে ধাপ বেয়ে উঠতে লাগল। প্রতিটা ধাপেই উঠতে প্রচুর শক্তি ব্যয় করা লাগছে। প্রতিবার হাত বা পা বাড়ানো মানেই হচ্ছে প্রচণ্ড পানির ওজনের বিরুদ্ধে লড়াই করা।

 কার্ট সিঁড়ির ওপরে পৌঁছে নিচে তাকাল। রেনাটা আর জোও চলে এসেছে প্রায়। আরেকবার তাকাল ঘড়ির দিকে। দশ সেকেন্ড বাকি।

গোনা শুরু করল কার্ট।

 তিন…দুই…এক।

এবার বের হওয়া যায়।

পানির ওপরে মাথা তুলেই ডিফ্লেকটর গেটের একেবারে ওপরে এলো কার্ট। পানির কবল থেকে মুক্তি পেয়ে ভালোই লাগছে তবে আসল বিপদ সামনেই। গেটটা মাত্র তিন ফুট চওড়া আর পানিতে থাকতে থাকতে ওটার গা একদম পিছল হয়ে আছে।

কার্ট হামাগুড়ি দিয়েই পড়ে রইল কিছুক্ষণ। একদম স্থির। গেটের পাশে পানির উচ্চতা আরো খানিকটা বাড়লো কারণ পানি এখানে টারবাইনে বাড়ি খেয়ে বেঁকে যাচ্ছে। আবার গেটের পিছনেই পানির উচ্চতা কয়েক ফুট কম। ফেনা আর ঘূর্ণি দেখা যাচ্ছে সেখানে। গেটের মুখটার একটু পরেই পরিষ্কার পানি প্রচণ্ড বেগে ঘুরছে। আর ওটার ভয়ানক শব্দ সারা প্রণালি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।

এতো বেশি শব্দ যে চিৎকার করেও লাভ নেই। তাই রেনাটা পানি থেকে মাথা তুলতেই কার্ট ইঙ্গিতে দেখালো। ওর মতো রেনাটাও ডুবুরির মতো যন্ত্রপাতি যা ছিল সব খুলে ফেলেছে। রেনাটা মাথা ঝাঁকিয়ে গেটের ওপরে উঠে এলো। এরপর এলো জো। ওরও ঝাড়া হাত-পা। তারপর রেনাটার নেতৃত্বে ওরা গেটটার মাথা বেয়ে ফুটপাথের কাছে চলে এলো। তারপর সেটা ঘেষে দরজার দিকে এগুলো।

দূরে কোথাও থেকে একটা সবুজাভ রশ্মি চোখে পড়ল কার্টের। ক্যামেরার লেন্সে লেজার প্রতিফলিত হয়ে আসছে আলোটা।

“সাবাস, ইদো। মনে মনে বলল ও।

“গেটটা ওরকম হঠাৎ করে খুলে যাবে চিন্তাও করিনি।” জো বলল।

“আমার বেশি অবাক লেগেছে ঐ পানি বের হওয়া দেখে। নকশায় কিন্তু ওরকম কোনো বাইপাস পাইপ চোখে পড়েনি।” কার্ট জানালো।

“আমারো না। কিন্তু এটা যদি বাইপাস টানেল না হয়, তাহলে ঐ পানি আসছে কোত্থেকে?” জো জিজ্ঞেস করল।

“ওটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে।” ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল কার্ট। তারপর রেনাটার দিকে ফিরলো। “ইদোর লেজার বন্ধ করতে আর এক মিনিট বাকি।”

রেনাটা অবশ্য ইতোমধ্যেই নিজের কাজ শুরু করে দিয়েছে। “যথেষ্ট সময়।” জবাব দিল ও।

ওয়াটার প্রুফ ব্যাগটা খুলে কয়েকটা তালার কাঠি বের করল। তারপর সেগুলো দিয়ে তালায় খানিক কারিগরি ফলাতেই সেটা খুলে গেল।

দরজার দশ ফুট দূরেই অ্যালার্ম সিস্টেমের একটা প্যানেল পাওয়া গেল। ও সেটার ঢাকনা খুলে ডাটা স্লটে ছোট একটা ডিভাইস ঢুকিয়ে দিল। প্যানেলের ডিসপ্লেতে হাজার হাজার সংখ্যা আর বর্ণ দেখা গেল বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চলেছে। কয়েক মিলিয়ন কোড চালানোর পর অ্যালার্ম ডি-অ্যাকটিভেট হয়ে গেল। পাঁচ সেকেন্ড পরেই প্যানেলের বাতি সবুজ হয়ে গেল।

“হয়ে গিয়েছে। অ্যালার্মও বন্ধ আর ভেতরের ক্যামেরাগুলোও কাজ করবে না আর। পরের পঁচিশ মিনিট আগের রেকর্ড করা একটা ভিডিও চলবে ওগুলোয়। ততোক্ষণে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না।” রেনাটা বলল।

“গত বসন্তে বেশ টাকা খরচ করে এরকম অ্যালার্ম সিস্টেম লাগিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে টাকাটা জলে গেল।” কার্ট বলল।

“কুকুর কিনতে হবে একটা। সেটাই ভালো কাজে দেবে।” জো বলল।

রেনাটা মাথা ঝাঁকিয়ে জিনিসপত্র আবার ওর ব্যাগে ভরে রাখলো।

 “যাওয়া যাক।” কার্ট বলল।

রাস্তা ধরে সামনে এগুতেই একটা সিঁড়ি খুঁজে পেল। তিন ধাপ নামার পরেই গমগমে একটা আওয়াজ ভেসে এলো।

“জেনারেটর রুম” জো বলল।

কার্ট দরজাটা ফাঁক করে ভেতরে তাকাল। ওরা তখনো সর্বশেষ তলা থেকে এক তলা ওপরে। এই রুমটাও বিশাল বড়। লম্বায় কয়েকশো ফুট তো হবেই। আর উচ্চতায়ও ষাট ফুট। ঘরের ঠিক মাঝখানে এক সারি গোল গোল থাম দেখা গেল। প্রজেক্টার ব্যাস কমপক্ষে তিরিশ ফুট আর লম্বাও ওটার অর্ধেক মতো হবে।

“হুভার বাঁধের ভেতরটা দেখতে এরকম।” জো বলল। “এটা তো দেখি আসলেই একটা পাওয়ার স্টেশন।” কার্ট বলল।

“আপনি কী আর কিছু ভেবেছিলেন নাকি?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

“কি জানি। কেন যেন মনে হচ্ছিলো হাসান যখন এটায় ঢুকেছে তার মানে অন্য কিছুও হতে পারে।” কাট জবাব দিল।

“আমার কাছে অবশ্য অন্যরকম লাগছে না।” বলল জো, “পানির স্রোতের সাহায্যে ঐ টারবাইনগুলো ঘোরে, ওগুলো আবার এই ডায়নামোগুলোর সাথে লাগানো।”

“আমি জানি।” কার্ট বলল। “কিন্তু এটা একদমই খালি। হাসান কেন কেউই তো নেই। সম্ভবত ও ফোনটা বন্ধ করে চলে গিয়েছে। আমরা যে ওকে অনুসরণ করছিলাম সেটা কী ওরপক্ষে জানা সম্ভব?”

“মনে হয় না।” রেনাটা জবাব দিল।

দরজাটা বন্ধ করে এবার ওরা হামাগুঁড়ি দিয়ে সামনে এগুলো।

রুমের শেষ মাথায় এলিভেটরের দরজাটা খুলে গেল। একদল শোক নামলো ওটা থেকে। তিনজনের পরনে কালো ইউনিফর্ম। বাকি তিনজনের পরনে আলাদা ধরনের পোশাক। দেখতে অনেকটা আরবদের পোশাকের মতো। আর সর্বশেষ লোকটার পরনে শার্ট আর বিজনেস স্যুট। অবশ্য টাই নেই সাথে।

লোকগুলো হেঁটে একটা জেনারেটরের শেষ মাথায় গিয়ে থামল। একই সময়ে গমগমে শব্দটাও কমতে শুরু করল।

“কেউ একজন উৎপাদন বন্ধ করছে।” জো বলল।

“আর পাঁচটা মিনিট আগে করলেই তো আমাদের এতো ভয় পাওয়া লাগতো না।” কার্ট বলল।

 জেনারেটরের গুঞ্জন কমতে কমতে একসময় থেমে গেল। ডায়নামোগুলোর ওপর জ্বলতে থাকা সবুজ বাতিগুলো প্রথমে হলুদ, তারপর লাল হয়ে গেল। আর লোকগুলো একেবারে শেষ মাথায় দেয়ালের কাছে গিয়ে থামল। ওখানে একটা কম্পিউটার প্যানেল বসানো।

“আমরা কীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করি তা তো দেখলেই।” একজন লোক বলল। শব্দহীন খালি রুমে এতোদূর চলে আসছে কথাগুলো। আর এখন আপনি দেখবেন। কেন আমাদের দাবিগুলো মেনে নেয়া ছাড়া আপনার কোনো উপায় নেই।”

“এসব বন্ধ করুন।” আরবদের একজন বলল, “আমরা এসেছি সাকিরের সাথে দেখা করার জন্যে।” অদ্ভুত টানে ইংরেজি বলছে সে। মাথা নাড়া আর হাত নাড়া থেকে বোঝা যাচ্ছে বাকি দুজনও ওর সাথেরই।

“দেখা তো করবেনই।” স্যুট পরা লোকটা বলল। “উনিও আপনাদের সাথে আলাপ করার জন্যেই অপেক্ষা করছেন।” এই লোকটার টানে মনে হলো ইউরোপিয়ান।

 হয় ইতালিয়ান না হয় স্প্যানিশ। তবে এরা সবাই ইংরেজি জানে তাই এই ভাষাতেই কথা বলছে।

“আলোচনা? আমাদেরকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। আপনি কী চালাকি করার চেষ্টা করছেন নাকি পিওলা?” আরব লোকটা বলল। কার্ট টের পেল নামটা শুনেই রেনাটা কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল।

“আরে কিসের চালাকি! তবে তার আগে আপনাদের আসল অবস্থানটা আপনাদের বোঝা দরকার। না হয় কোনো বোকামি করে বসবেন।” পাশেই ইউনিফর্ম পরা একটা লোক একটা সুইচ টিপ দিল। সাথে সাথে পাশের দেওয়ালটা ওপরে উঠে গেল, ঠিক একটা গ্যারেজের দরজার মতো। পিছনেই একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গ দেখা গেল। এতদূর থেকে কার্ট শুধু একজোড়া রেল লাইন আর একটা বিশাল ব্যাসের পাইপের বাক খাওয়া প্রান্ত দেখতে পেল। ওটা দেখে কার্টের বিভিন্ন এয়ারপোর্টে দেখা চালকবিহীন স্কাই ট্রেন এর কথা মনে পড়ল।

“দেখে তো মনে হচ্ছে এই পাইপটা দিয়ে বের হওয়া পানিই আমাদেরকে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিল।” জো বলল।

রেনাটাও এদিক সেদিক তাকিয়ে চারপাশটা দেখছিল। আমি কোনো জল বিদ্যুৎ ইঞ্জিনিয়ার না। কিন্তু নদীর স্রোতের সাথে নব্বই ডিগ্রি বরাবর একটা পাইপাস টানেল থাকার কোনো দরকার আমি বুঝতে পারছি না।”

“না। আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার। আমি বলছি ঐ পানি নদী না অন্য কোথাও থেকে আসছে।” জো বলল।

“এদিকে লোকগুলোর মধ্যে আবার তর্ক লেগে গিয়েছে। কিন্তু এবার ওরা কথা বলছে অনেক নিচু স্বরে আর দ্রুত। ফলে ওরা ধরতে পারলো না কি নিয়ে লেগেছে ঝগড়া।

 “সম্ভবত ট্রামে উঠবে কি উঠবে না তা নিয়ে তর্ক করছে। আমি হলে উঠতাম না।” জো বলল।

“কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেটাই আমাদেরকে করতে হবে।” বলতে বলতে কার্ট উঠে দাঁড়িয়ে ওর ব্যাগটা খুলে একটা নাইন মিমি বেরেটা বের করে সিঁড়ি দিয়ে নামা শুরু করে বললো। “চলে যাওয়া যাক।”

.

৪৬.

ওসাইরিস পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের সিকিউরিটি সেন্টারে একটা কাজ না করা ক্যামেরা ধরা পড়েছে। দায়িত্বে থাকা একজন সিকিউরিটি গার্ড অনেক চেষ্টা করল ক্যামেরাটা আবার চালু করার। ক্যামেরায় কন্ট্রাস্ট পরিবর্তন করা থেকে শুরু করে ব্রাইটনেস সেটিংস পরিবর্তন করা বা ক্যামেরা জুম করা, কয়েকবার এদিক ওদিক ঘুরিয়েও দেখেছে কিন্তু কাজ হয়নি। তারপর সে তার সুপারভাইজারকে ফোন দিয়ে সব জানায়।

“কি হয়েছে বলে মনে হয়?”

“সম্ভবত সেন্সর স্কুলে গিয়েছে। আমরা কোণার দিকে খানিকটা জায়গা দেখতে পাচ্ছি কিন্তু মাঝখানটা ফকফকা। ওটা সরিয়ে আরেকটা লাগাতে পারবে?” সুপারভাইজার বলল।

“আরেকটা সেন্সর থাকলে পিরবো না কেন।” বলল টেকনিশিয়ান লোকটা। তারপর সাপ্লাই কেবিনেটে গেল জিনিসটা খুঁজতে। কয়েকটা বক্স খোঁজার পর পেল জিনিসটা। “পেয়েছি।”

“কতক্ষণ লাগবে সারাতে?”

“মিনিট বিশেকের বেশি লাগার কথা না।”

“তাড়াতাড়ি করো তাহলে।” সুপারভাইজার বলল। তারপর কম্পিউটারের সামনে চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলল, “আমি এখানেই আছি। কাজ শেষ করে জানাও। টেস্ট করে দেখবো।”

টেকনিশিয়ানটা যন্ত্রপাতি হাতে বাইরে বের হতেই ক্যামেরাটা আবার ঠিক হয়ে গেল।

 “অদ্ভুত তো!” সুপারভাইজার বলল। সাথে সাথে সে আগের ভিডিওগুলো চালিয়ে দেখলো। সবকিছুই ঠিক আছে। কিন্তু কতক্ষণ ধরে?

“যাই হোক পাল্টেই দাও। যদি সেন্সরটা খারাপ হয়। তাহলে আবারো নষ্ট হয়ে যেতে পারে।” সুপারভাইজার বলল আবার।

 টেকনিশিয়ান মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল। সুপারভাইজার দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটার দিকে চাইলো। তার শিফট শেষ হতে ঘণ্টাখানেকের ওপর বাকি।

ওসাইরিস ভবনের মাইলখানেক দূরে ইদো আবার সবকিছু ব্যাগে ভরছেন। ট্রাইপড়টা ভাজ করে লেসারের ওপরে ক্যাপ লাগালেন তারপর সেটাকে একটা বক্সের ভেতরে ভরলেন। তারপর সেটা পাশের সিটেই রেখে দিলেন। যাতে কেউ তাকে থামালেই ওটা বাইরে ফেলে দিতে পারেন।

তারপর নৌকাটাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে তাতে চড়ে বসলেন। ইঞ্জিন চালু হতেই খুব আস্তে সামান্য গতি বাড়ালেন। অযথা কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান না। আর তাড়াহুড়াও নেই।

ওসাইরিস প্লান্টের এক মাইল ভাটিতে তার অপেক্ষা করার কথা। নোঙ্গর ফেলে সব বাতি জ্বেলে পশ্চিম তীরে বসে থাকতে বলেছে তাকে কার্ট। যদি ওরা কোনো ঝামেলায় না জড়িয়ে সুস্থ দেহে ফিরতে পারে তাহলে সহজেই ওকে খুঁজে পাবে।

 পরিকল্পনাটা খুবই সাদামাটা। এরকম পরিকল্পনাই কাজে লাগে সবসময়। বিপদে পড়া বা ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু মনের কোণে খানিকটা খুঁত খুঁত করছে তার। খুবই কম হলেও সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।

শোল্ডার হোলস্টার থেকে একটা রাশিয়ান পিস্তল বের করে আনলেন, তারপর সুট টেনে একটা গুলি চেম্বারে ঢুকিয়ে রাখলেন। আশা করছেন এটা ব্যবহার করতে হবে না। তবে প্রস্তুত থাকতে দোষ নেই।

.

৪৭.

জো আর রেনাটাও কার্টের পিছু পিছু সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। দ্রুত কিন্তু নীরবে এগোচ্ছে ওরা। একসারি করে ও জেনারেটর রুমটা পার হয়ে খোলা দেয়ালটার কাছে চলে এলো। ওটা ওর মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া শুরু করেছে।

“ভেতরে ঢোকো।” মাথা নিচু করে অন্ধকারে ঢুকতে ঢুকতে বলল কার্ট। জো আর রেনাটাও বিনা বাক্য ব্যয়ে আদেশ পালন করল। তিনজন ঢোকা মাত্র দরজা বন্ধ হয়ে গেল পিছনে।

দরজাটা বন্ধ হতে আলোর শেষ রেখাটাও মিলিয়ে গেল। দূরেই ট্রামের আলো চোখে পড়ল তবে সেটাও মিলিয়ে গেল একটু পর।

পাশের লাইনেই আরেকটা ট্রাম খালি পড়ে আছে।

“এটা চালু করার চেষ্টা করবো নাকি হেঁটে যেতে চাচ্ছ?” জো বলল।

কার্ট সামনে তাকাল। সামনের গাড়িটার ছোটার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, এখনো থামার নাম নেই।

ওটার ইঞ্জিনের শব্দে দেওয়াল পর্যন্ত কাঁপছে। অদ্ভুত ঘট ঘট শব্দ আর তার প্রতিধ্বনির কারণে দূরত্বটা ঠিক আন্দাজ করা যাচ্ছে না। তবে এই আওয়াজের কারণেই ঐ গাড়ির লোকজন টের পাবে না যে ওদেরকে অনুসরণ করা হচ্ছে।

“গাড়িতেই চল। আজ যথেষ্ট পরিশ্রম হয়েছে।” কার্ট বলল।

জো ট্রাম গাড়িটায় উঠে চালানোর জায়গাটা দেখতে লাগল। রেনাটা গাড়িতে উঠতেই কার্ট গিয়ে সামনের লাইটগুলো ভেঙে দিয়ে গেল।

“অফ সুইচ বলে একটা জিনিস আছে কিন্তু।” জো বলল। “একবার সেটা দিয়ে চেষ্টা করা যেতো।”

কার্ট থেমে গেল, “বুদ্ধিটা খারাপ না।”

জো কয়েকটা সুইচ টিপে লাইট বন্ধ হওয়া নিশ্চিত করলো। একটা ফিউজও কেটে দিল সাবধানতার জন্য। তারপর চালু করলো গাড়িটা। থ্রটল ঠেলতেই সামনে বাড়লো ওটা।

“উঠে পড়ুন সবাই।”

শুনে কার্টও উঠে গেল গাড়িতে। সামান্য গুঞ্জন তুলে গাড়িটা অন্ধকারে ঢুকে পড়ল। ধীরে ধীরে সামনের গাড়িটা থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেই এগুচ্ছে ওটা।

টানেলটা সোজা এগিয়েছে আর তার সাথে সাথে বামদিকে এগিয়েছে এক সারি পাইপ।

“পাইপটা কিসের?” নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল রেনাটা। এটা তো নদী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।”

 “হয়তো জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্যে বসিয়েছে। অতিরিক্ত পানি যাতে বের হয়ে যেতে পারে।” জো বলল।

“এখানে তো ঠিকমতো বৃষ্টিই হয় না। জলাবদ্ধতা আসবে কোত্থেকে? আর হলেও এত বড় পাইপ কেন? রেনাটাই বলল আবার।

 “হতে পারে সমস্ত শহরের সব পাইপ এক জায়গায় এসে মিলে তারপর এই বড় পাইপ দিয়ে নদীতে পড়েছে।”

“এটা কোনো জলাবদ্ধতার পাইপ না। গত কয়েক সপ্তাহে মিসরে বৃষ্টি হয়নি। অথচ এটা দিয়ে ঠিকই পানি আসছে।” বলল কার্ট।

“তাহলে পানি আসছে কোথা থেকে?” জো জিজ্ঞেস করল।

 “জানিনা।”

 “হয়তো অন্য কোনো ওসাইরিস প্রজেক্ট থেকে,” বলল রেনাটা।

“হতে পারে।” বলে কার্ট প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল। “স্যুট পরা লোকটাকে আরব একজন পিওলা বলে ডাকলো। আপনি সম্ভবত ওনাকে চেনেন। কে উনি?”

“সম্ভবত, আলবার্তো পিওলা আমাদের একজন সংসদ সদস্য। উনি মিসরে বিশেষ করে লিবিয়ায় আমেরিকার নাক গলানোর কঠোর সমালোচনাকারী। লিবিয়া উনার কাছে শুধু উনি না আমাদের অনেকের কাছেই খুব স্পর্শকাতর একটা বিষয়। একসময় আমাদের কলোনী ছিল তো তাই।”

“উনি এখানে কি করছেন? বিশেষ করে অর্ধেক মহাদেশ পতনের দ্বার প্রান্তে। কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“যা শুনলাম তাতে তো মনে হলো কি নিয়ে আলোচনা করতে এসেছেন। কিন্তু আসল ব্যাপারে কিছু বলতে পারছি না। আপনি যা জানেন আমিও তা।”

“আমার মনে হয় উনি এখানে এসেছেন ওসাইরিসের হয়ে দালালি করতে।” কার্ট বলল।

“দালালি?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

“ভেবে দেখুন, কর্ণেল ইদো আমাদেরকে বলেছিলেন মনে আছে? ওসাইরিস একেবারে শূন্য থেকে এসে এখন মহাশক্তি ধর হয়ে বসেছে। এটার পরিচালক সাকির নিজেকে রাজা তৈরির কারিগর ভাবা শুরু করেছে। সে আবার গোয়েন্দা পুলিশে ছিল একসময়। মাত্র কয়েক বছর হয় বরখাস্ত হয়েছে। সে কি-না এখন এই সব দেশের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করছে। আর সে এতো দ্রুত এতো ওপরে উঠেছে যেটা কেউ কল্পনাও করেনি। আর এই সবকিছুকেই মদদ দিচ্ছে হঠাৎ দেখা দেয়া খরা। যার ব্যাখ্যা কারো কাছে নেই।”

 কার্ট বাকি দুজনের দিকে তাকাল। ওরা আরো শোনার জন্যে লুকিয়ে আছে।

“পল আর গামায় ওদের ছুটিতে একজন লিবিয়ান পানি উন্নয়ন বিশারদের সাথে কাজ করছিল। এখানে আসার পথে ওদের রিপোর্টটা পড়েছি। কিন্তু পলের করা কিছু টেস্ট বলছে যে লিবিয়াতে যে জলধারগুলো আছে তার নিচে আরো একটা বিশাল জলাধার আছে। মূলত ওটা থেকেই ওপরেরগুলোতে পানি আসতো। কিন্তু হঠাৎ অজানা কোনো কারণে ওটার পানি সরে যাওয়া আরম্ভ করে। আর তার ফলে ওপরের জলাধারগুলোর পানি শুকিয়ে যায়। আর এই মুহূর্তে আমরা এমন এক সারি পাইপের পাশে বসে আছি যার ভেতর দিয়ে একটা ট্রাক পর্যন্ত চলে যেতে পারবে। আর যেটার পক্ষে প্রতি মুহূর্তেই টনকে টন পানি উঠিয়ে নীল নদে এনে ফেলা সম্ভব।”

“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে ওসাইরিস এই কৃত্রিম পানি সংকট সৃষ্টি করেছে, যাতে করে একটা অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে?” রেনাটা বলল।

“যদি কারণটা মানব সৃষ্ট হয় তাহলে আমার চোখে এমন কাজ করার ইচ্ছা বা সামর্থ্যওয়ালা আর কেউ পড়ছে না।” কার্ট জবাব দিল।

“আর পিওলা?”

“উনি লিবিয়ায় আবার প্রভাব বিস্তার করতে চান। তার জন্য প্রচুর টাকার দরকার হবে। হয় উনি এখানে ঋণ শোধ করতে এসেছেন না হয় পাওনা টাকা বুঝে নিতে এসেছেন। যেভাবেই হোক উনিও এর সাথে জড়িত। আর খরা হওয়ায় ওনার সুবিধাই হচ্ছে।”

 জো এতোক্ষণ পাইপটা দেখছিল। “পল যা বলল তেমনটা করতে হলে ঠিক কতখানি পানি উত্তোলন করতে হবে কে জানে।”

“পাইপটা কিন্তু অনেক বড়।” কার্ট মনে করিয়ে দিল।

 “অবশ্যই! কিন্তু অতো বড় না।” জো বলল।

“এরকম উনিশটা যদি হয়? ওসাইরিসের এরকম আরো আঠারোটা পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। সবই চালু আর নীলনদের ঠিক পাশে। যদি ওগুলোর সব একসাথে জলাধার থেকে পানি ভোলা শুরু করে?” কার্ট বলল।

জো মাথা ঝাঁকালো, “নদীর পানিতেই যেটুকু কারেন্ট দরকার তা পেয়ে যাচ্ছে। জিনিয়াস।”

“তার মানে এই সবকিছুই এক সুতোয় গাঁথা। ব্লাক মিস্ট, খরা–সব কিছুরই পিছনে.ওসাইরিস।”

আরো দশ মিনিট পরে গিয়ে আশেপাশের চেহারা খানিকটা পরিবর্তন হলো। “সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় আলো দেখা গেল অবশেষে।” নিচু স্বরে বলল রেনাটা। কার্টের কেন যেন মনে হলো, এটা আসলে সুড়ঙ্গের শেষ মাথা না। সুড়ঙ্গের মাঝখানের একটা জায়গা মাত্র।

প্রায় বিশ মিনিট ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে পথ চলছে ওরা। আলো বলতে ছিল কন্ট্রোল প্যানেল আর সামনের গাড়ির পিছনের লাইটের টিমটিম আলো।

“ওরা থামছে।” জো বলল।

“বেশি কাছে যেও না। ওরা থেমে গেলে আমাদের ব্রেকের শব্দ কানে যেতে পারে। কার্ট সাবধান করল।

জো গাড়ির গতি একদমই কমিয়ে আনলো। ওদের সামনের গাড়ির গতি আরো কমেছে। আরেকটু সামনে এগিয়ে ওটা সুড়ঙ্গ ছেড়ে পাশের দিকে ঢুকে গেল।

জো প্রায় একশো গজ দূরে গাড়ি থামালো। তারপর ওরা তিনজন নেমে পায়ে হেঁটে এগুতে লাগল।

সুড়ঙ্গের ধারে পৌঁছে কার্ট উঁকি মেরে দেখলো জায়গাটা। যা দেখলো তাতে অবাক হলো খুব। তারপর ঘুরলো বাকি দুজনের দিকে।”

“কি দেখলে? কেউ কী আছে?” জো জিজ্ঞেস করল।

“যদি একজোড়া শেয়াল মুখো আট-ফুটি দানবকে বাদ দাও তাহলে কেউ নেই।” কার্ট বলল।

“মানে? মিসরীয় দেবতা আনুবিস নাকি?”

“হ্যাঁ”

কার্ট একপাশে সরে গিয়ে বাকি দুজনকেও ঘরের ভেতরেরটা দেখার সুযোগ করে দিল। বিশাল বড় একটা গুহা ওটা। দেয়ালটা বালির রঙের পাথরে তৈরি। তাতে অসংখ্য বাতি জ্বলছে। একদিকে প্রাচীন মিসরীয় চিত্রকর্ম আর হায়ারোগ্লিফ দেখা গেল। অন্য পাশটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। একটু দূরেই একটা মানুষ নির্মিত সুড়ঙ্গের প্রবেশ মুখে বিশাল মূর্তি দুটো বসানো।

“আমরা কোথায়?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

“কোথায় না বলে কখন বলা উচিত না? আমরা একটা আধুনিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে যাত্রা শুরু করলাম আর এসে নামলাম প্রাচীন মিসরে। আমার তো মনে হচ্ছে সময় ভ্রমণ করে চার হাজার বছর পিছনে চলে এসেছি।” বলল জো।

পাইপের সারি আর সুড়ঙ্গ দুটোই দেখা গেল পশ্চিম দিকে এগিয়েছে। কার্ট স্যাটেলাইটে তোলা ওসাইরিস প্লান্টের ছবিটা মনে করার চেষ্টা করল। ওর মনে পড়ল যে প্লান্টের পশ্চিমে শুধু কিছু সরু রাস্তা, দোকান পাট, গোলাঘর আর অফিস বাদে কিছুই নেই। আরো পশ্চিমে আসলে শুরু হয় অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং আর ঘোট ঘোট ঘর-বাড়ির সারি, তারপরেই মরুভূমি, যেখানে…

“তোমার ধারণা কিন্তু কাছাকাছিই গিয়েছে।” কার্ট বলল।

 “আরে ওটুকুই বা কজনে পারে।” জো জবাব দিল।

“ট্রামের যে গতি ছিল তাতে আমরা নদীর পশ্চিমে পাঁচ কি ছয় মাইল। এসেছি।” তারপর ও রেনাটার দিকে ঘুরলো। “সম্ভবত আপনার আশা পূরণ হচ্ছে।”

“কোন আশা?”

“কাছ থেকে পিরামিড দেখার আশা। হিসাব বলছে আমরা এখন ঠিক ওগুলোর নিচে।”

.

৪৮.

“পিরামিডের নিচে?” প্রশ্ন করল রেনাটা।

“বা অন্তত গিজা মালভূমি।” কার্ট বলল।

 “কত নিচে?”

“বলা সম্ভব না। তবে আমরা আসার পথে আস্তে আস্তে নিচেই নামছিলাম আর গিজা নদী থেকে প্রায় দুইশ ফুট ওপরে। আমরা সম্ভবত পাঁচশো ফুট বা এর আশে পাশের গভীরতায় আছি এখন।”

“তাহলে আর পিরামিড দেখা হলো কোথায়?”

কার্ট রুমের চারপাশে তাকাল। ওরা যে সুড়ঙ্গটা দিয়ে এসেছে সেটা বাদে ওখানে ঢোকা বা বের হওয়ার জন্যে আর একটাই রাস্তা আছে। সেটা হলো ঐ আনুবিসের পাহারা দেয়া সুড়ঙ্গটা।

“ট্যুরের বাকিদেরকে দৌড়ে ধরতে পারলেই দেখার সুযোগ পাওয়া যেতেও পারে।”

“অবাক লাগছে কোনো গার্ড নেই দেখে।” রেনাটা বলল।

“গার্ডরা পাহারা দেয় বাইরে। আমরা তো একেবারে ওদের খাঁচার ভেতরেই ঢুকে পড়েছি।” কার্ট জবাব দিল।

 সুড়ঙ্গটায় আলো নেই বললেই চলে। সত্তর ফুট পরপর অল্প ওয়াটের একটা বাল্ব লাগানো। জায়গায় জায়গায় সুড়ঙ্গটাকে প্রাকৃতিক মনে হচ্ছে, আবার জায়গায় বোঝাই যাচ্ছে যে সেই আগের আমলের হাতুড়ি-ছেনী দিয়ে কেটে বসানো, আবার কোথাও দেখে মনে হলো আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সুড়ঙ্গটা বানানো।

 সুড়ঙ্গটা প্রথমে ঢালু হয়ে কিছুদূর নেমে গিয়ে তারপর সমতল হয়ে সোজা চলে গিয়েছে সামনে। মাঝে মাঝেই দেওয়ালের খানিকটা অংশ ভেতরে ঢোকানো। দেখে রোমের ভূগর্ভস্থ সমাধির কথা মনে পড়ে যায়। তবে এখানে কোনো মানুষের মৃতদেহ নেই। আছে মমি করা বিভিন্ন প্রাণীর দেহ। কুমির, বিড়াল, পাখি, ব্যাঙ। শত শত ব্যাঙ।

“মিসরীয়রা সব কিছুকেই মমি করে ফেলতো।” জো বলল। “কুমির তো অনেক বড়। প্রায় সামাধিতেই পাওয়া যায়। কারণ সে নাকি ওদের দেবতা সোবেক-এর বাহক। বিড়াল দেখা যায়। কারণ ওরা অশুভ আত্মা তাড়াতে পারে। পাখিও একই কাজ করে। পিরামিডগুলোর পাশেই মাটির নিচে বিশাল একটা ঘর আছে। নাম পাখির সমাধি। ওর ভেতর শত শত পাখির মমি। কোনো মানুষের নেই।”

কার্ট একটা অর্ধেক খোলা ব্যাঙ দেখতে দেখতে বলল, “ব্যাঙ কিসের জন্য? ব্যাঙ দেবতা বা এরকম কিছু আছে নাকি?”

জো কাঁধ ঝাঁকালো, “আমার জানা নেই।”

আর কিছুদূর পরই ওরা আলোকিত একটা ঘরের দরজায় এসে পৌঁছুলো। কার্ট আস্তে সেদিকে উঁকি দিল। ওর কাছে মনে হচ্ছে ও একটা অপেরা হাউজের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। অডিটোরিয়ামের ঠিক মাঝ ওপরে আর মঞ্চের একপাশে। নিচের গুহাটা অনেক বড়। ছোট খাটো একটা সম্মেলন চালিয়ে দেয়া যাবে অনায়াসেই। শুধু লাইটগুলোই আধুনিক। বাকি সব কিছু প্রাচীন আমলের।

দেওয়াল মসৃণ আর বিভিন্ন চিত্রকর্ম ও হায়ারোগ্লিফে ভরা। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক আনুবিস এক ফারাওয়ের সেবা করছে। আরেকটায় দেখা গেল সবুজ চামড়ার এক দেবতা এক মৃত ফারাওকে শূন্যে উঠিয়ে আনছে। পরের ছবিটায় একদল মানুষ দেখা গেল যাদের মাথা কুমিরের মতো। তারা ব্যাঙ বা কচ্ছপ ধরছে।

 কার্ট জোকে ইশারা করল, “তুমি হলে উপস্থিত মিসর বিশেষজ্ঞ। এগুলো কী বল দেখি?”

 “জাদুঘরে যেমন দেখেছিলাম এই সবুজ চামড়ার লোকটা সেটাই। ও হলো ওসাইরিস। পরকালের দেবতা। কে মরে যাবে আর কে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসবে সেই সিদ্ধান্ত ও-ই নেয়। মাঠের ফসলের ফলন আর মৌসুম শেষ সেগুলো পাকবে কি-না সেটাও ওরই এখতিয়ার।”

“ওসাইরিস মৃতকে আবার জীবিত করে। একেবারে খাপে খাপ।” কার্ট বলল।

“ওই কুমির মানবগুলো হলো সোবেক-এর প্রতিনিধি। সোবেকও মৃত্যু আর পুনর্জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। একবার ওসাইরিসকে বাঁচিয়ে ছিল ও। ওসাইরিসকে ধোঁকা দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল ওর শক্ররা।” জো বলল।

 কার্ট মাথা ঝাঁকিয়ে আবার ঘরটায় মন দিল। একবারে মাঝ বরাবর অনেক পাথরের কফিন সারি করে রাখা। একদম শেষ মাথায় ছোট্ট একটা স্ফিংস মূর্তি। স্বর্ণের পাতা আর জ্বলজ্বলে একটা নীলকান্তমণি দিয়ে ঢাকা। অন্য পাশে মানে ওদের ঠিক নিচে একটা ছোট্ট জলামত। কয়েক ফুট পানি তাতে। আর তার মধ্যে আছে সত্যিকার চার পেয়ে কুমির।

“কেন যেন এগুলোর চেয়ে মমিগুলোকেই বেশি ভালো লেগেছে আমার।” কার্ট বলল।

“ওগুলো আরো ছোট ছিল।” জো বলল।

দেখে মনে হচ্ছে এটাও একটা সমাধিই ছিল তবে আরো কয়েক ফুট খোঁড়া হয়েছে যাতে কুমিরগুলোর থাকতে কোনো সমস্যা না হয়। কারণ একটা লোক ওদের পাশ দিয়ে হেঁটে পাশের আরেকটা সুড়ঙ্গে ঢুকে গেল কিন্তু ওগুলো সামান্য নড়লোও না।

 “আপনি নিশ্চিত যে আমরা একটা পিরামিডের ভেতরে না?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

জো মাথা নাড়লো, “আমি তিনবার গিজায় এসেছি। কোনো বারই এরকম কোনো রুমে আসিনি।”

“আমার কিন্তু দারুণ লাগছে।” কার্ট বলল। “সবসময় টিভিতে এসব পিরামিডের নিচের গুপ্ত গুহা আর ঘরের কথা শুনে এসেছি। এখানে অবশ্য বলে যে এলিয়েনরা নাকি এসে এসে এসব বানিয়ে রেখে গিয়েছে।”

 “আচ্ছা বানিয়েছে কীভাবে এই জিনিসটা? অন্ধকারে কাজ করতে কীভাবে?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

 জো নিচু হয়ে মাটি থেকে কয়েকটা ঝামা পাথর তুলে নিলো। গুহার বেশিরভাগটাই এই পাথরে ঢাকা। এটা হলো সোডিয়াম কার্বনেট। মিসরীয়রা এটাকে বলে ন্যাট্রন। জিনিসটা মমি শুকানোর কাজে ব্যবহার করা হতো, কিন্তু একটা বিশেষ তেলের সাথে মিশালে ধোয়াহীন আগুন তৈরি হয় এটা থেকে। এটা দিয়েই মশাল বানিয়ে ওরা খনি বা সমাধিতে খোঁড়াখুড়ি করতো। এই জায়গাটা সম্ভবত দুটোই।”

“সমাধি আবার খনি?”

জো মাথা ঝাঁকালো, “সচরাচর এমনটা অবশ্য দেখা যায় না। ন্যাট্রন সাধারণত এমন জায়গায় পাওয়া যায় যেখানে পানি ঢুকে পরে শুকিয়ে যায়।”

“হয়তো পাম্প করে বের করে ফেলা হয়েছে।” রেনাটা বলল।

“এটাকে একটা সমাধি বানানোর কারণ কী?” কার্ট বলল।

“এক ঢিলে দুই পাখি মারা আরকি। এখানেই সমাধি বানানোয় ওরা প্রথমেই লবণ আর ন্যাট্রন উত্তোলন করল আর তারপর মৃতদেহ এনে এখানকার জিনিস দিয়েই আবার সেগুলো মমি করে ফেলল।”

“চিন্তা করেছেন। তুতেন খামেনের সমাধির চাইতেও সমৃদ্ধিশালী একটা সমাধি। অথচ কেউ এটার কথা জানেনা।” রেনাটা বলল।

“কারণ ওসাইরিস ইন্টারন্যাশনাল এটা। প্রথম খুঁজে পেয়েছে। ব্লাক মিস্টের সাথে এই জায়গাটার কোনো না কোনো সম্পর্ক না থেকে পারে না।” কার্ট বলল।

“ওরা হয়তো এখানেই দ্য শ্যাম্পেন আর ভিয়েনেভ যেটা খুঁজছিলেন সেটা পেয়েছে।”

“হতেই পারে। আর যখনই ওরা ব্যাপারটা জানলো আর নিশ্চিত হলো যে আসলেই কাজ করে তখন ওরা জায়গাটা ঢেকে দিল আর অন্য দিক থেকে একটা সুড়ঙ্গ খুড়ে নিশ্চিত করল যাতে আর কেউ এটার খোঁজ না পায়।” বলল কার্ট।

হঠাৎ নিচ থেকে একটা ইঞ্জিনের শব্দ ভেসে এলো। কার্ট আবার দ্রুত পিছনে সরে ছায়ায় ঢুকে গেল। একটু পরেই একটা বড় চাকার ATV (All terain Vehicle) আসতে দেখা গেল। সামনে দুটো সিট ওটায়। আর পিছনেই একটা তাক মতো বসার জায়গা। সামনের দুই সিটে কালো ইউনিফর্ম পরা দুজন বসা। তাদের পিছনেই ল্যাব কোট পরা দুজন লোক বসা দেখা গেল। দুজনেই এক হাত দিয়ে পাশের হাত চেপে ধরে আছে যেন স্থির হয়ে বসতে পারছে না।

 ATv-টা ওদের নিচের রুমটা পার হয়ে সোনার স্ফিংসটার পাশ দিয়ে আর একটা সুড়ঙ্গে ঢুকে গেল।

“যদি না এই ব্যাটারা এখানে একটা পার্ক খুলে থাকে, আমি বলবো যে এটা একটা ওষুধের কারখানা।” কার্ট বলল।

“আমিও সেটাই ভাবছি।” রেনাটা বলল।

কার্ট লোকগুলোর পিছু নেয়ার জন্য এগোতে যাবে তখনই আবার লোকজনের কণ্ঠ শোনা যেতে লাগল। স্ফিংস এর পাশের সুড়ঙ্গটা দিয়েই কয়েকজন লোককে বের হয়ে আসতে দেখা গেল। হেঁটে হেঁটে পাথরের কফিনগুলো পার হয়ে কুমিরের গর্তটার কাছে চলে এলো তারা।

ওখানেই দাঁড়ালো সবাই। একটু পর আরও দুজন লোককে দেখা গেল আসতে।

“হাসান।” নিচু স্বরে বলল কার্ট।

 “পাশের জন কে?” জিজ্ঞেস করল জো।

 “আমার মনে হচ্ছে ওটা সাকির।” জবাব দিল কার্ট।

.

৪৯.

“আপনারাই পারবেন লিবিয়াকে আবার নতুন করে গড়ে তুলতে।” সাকির বলল অতিথিদেরকে।

“কি হিসেবে? আপনার প্রতিনিধি?” তিনজনের একজন বলল, “আর তারপর কী হবে? আপনার আদেশ পালন করতে হবে? ইংরেজরা যেভাবে মিসর শাসন করতো আমরাও সেভাবেই লিবিয়া চালাবো, তাই তো? আর পিওলা? আপনার লাভটা কী এখানে? নতুন করে উপনিবেশ শুরু করতে চান নাকি?”।

 “আমার কথা শোনেন—” পিওলা বলা শুরু করল। কিন্তু সাকির ওকে থামিয়ে দিল।

“কেউ না কেউ আপনাদের ওপর ছড়ি ঘুরাতেই। ইউরোপ বা আমেরিকার না হয়ে সেটা এই আরবের-ই কেউ হওয়া ভালো না?”

“সেটা আমরা-ই ঠিক করবে।” লিবিয়ান লোকটা বলল।

“আর কতবার বোঝাতে হবে? পানির অভাবেই আপনারা সবাই মরবেন। একেবারে সবাই। যদি দরকার হয় আপনাদের প্রত্যেকটা লোককে মেরে মিসরীয় লোজন দিয়ে আপনাদের দেশ ভরে দেব।”

লোক তিনজন চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ পর দুজন নিজেদের মধ্যে আলাপ শুরু করল। তারপর তারা সাকিরের প্রস্তাবই মেনে নেবে ঠিক করল।

করছেন টা কী আপনারা?” নেতা মতো লোকটা বলল।

“আমরা এদের সাথে পারবো না। আমরা ওদের কথায় রাজি না হলে, অন্য কেউ হবে। এখন হয়তো খানিকটা ক্ষমতা হারাবো কিন্তু তখন একদমই আর কোনো ক্ষমতা থাকবে না আমাদের।”

“আপনার জায়গায় আমি থাকলে ওদের কথা মেনে নিতাম। ঠিক কথাই বলছে ওরা।” সাকির বললেন।

“না। আমি আপনার প্রস্তাবে সম্মত না।” নেতা বললেন।

প্রচণ্ড আক্রোশে তিনি সাকিরের দিকে তাকালেন। কিন্তু সাকির শান্তভাবে তার দিকে একটা নল তাক করে ওপরের বোতামটা টিপে দিলেন। ছোট্ট একটা তীর বের হয়ে লিবিয়ান বিরোধী দলের নেতার বুকে আঘাত করল।

লোকটার মুখ যে বিস্ময়ে ঝুলে পড়ল তারপর সাদা হয়ে গেল। সাথে সাথেই হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলেন উনি। সাথের দুজন তাকে ধরতে গিয়েও আবার হাত ফিরিয়ে নিয়ে মাথার ওপর তুলে দাঁড়িয়ে থাকল। তারা এই মারামারিতে অংশ নিতে চায় না।

 “ভালোই। বুদ্ধির কাজ করেছেন। আমি আপনাদেরকে দেশে ফেরত পাঠাবো। সেখানেই আমার পরবর্তী আদেশের অপেক্ষা করবেন। সরকারের পতন ঘটলে আলবার্তো নতুন কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্যে মনোনীত করবে। আর আপনাদের কাজ হবে তার সাথে অতীতের সমস্ত দ্বন্দ্ব ভুলে সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা করা।”

“তারপর?” একজন সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেলল।

“তারপর আপনারা আপনাদের পুরস্কার পাবেন। আবারো দেশে পানি পাওয়া যাবে। আগের চাইতে আরো বেশি। আর আপনাদেরও আজকের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে গর্ববোধ হবে।”

 ওরা পরস্পর কয়েকবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে মাটিতে পড়ে থাকা তাদের নেতার দিকে তাকাল, “ওনার কী হবে?”

 “উনি মারা যাননি। আমার সবচেয়ে নতুন অস্ত্রটার যন্ত্রণা উপভোগ করছেন। এটা হচ্ছে ব্লাক মিস্ট-এর নতুন সংস্করণ। এটা মানুষকে প্যারালাইজড করে দেয়। আগের চাইতে কম শক্তি এটার। এর ফলে মানুষ কোমায় যায় ঠিক। তবে চেতনা পুরোপুরি থেকে যায়। ডাক্তারি ভাষায় বলে “লকড-ইন সিনড্রোম।” একজন সাধারণ মানুষের মতোই উনি সব দেখবেন, শুনবেন বা বুঝবেন কিন্তু কিছু বলতে বা করতে পারবেন না। এমনকি কাঁদতেও পারবেন না।”

সাকির নিচে ঝুঁকে পড়ে থাকা লিবিয়ান নেতার কপালে তর্জনী ঠেকিয়ে। ধাক্কা দিয়ে বললেন, “কি? ঠিক বলেছি না?”

“এটা কখনো ভালো হবে না?”

 “হবে। তবে ততোক্ষণে দেরি হয়ে যাবে।”

সাকির আঙুলে ইশারা করতেই গার্ডরা ছুটে এলো তারপর বিন্দুমাত্র ইতস্তত করে লোকটাকে তুলে নিয়ে কুমিরের গর্তে ফেলে দিল।

 কুমিরগুলো এবার সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া দেখালো। মুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়ল অবশ শরীরটার ওপর। একটা হাত ছিঁড়ে নিলো, একটা পা ছিঁড়ে নিলো। তৃতীয় একটা এসে ধড়ের একপাশ ধরে গর্তটার ভেতরের দিকে টেনে নিয়ে গেল।

 “কুমিরগুলোকে আমরা খুব একটা খেতে দেই না।” দাঁত বের করে বলল হাসান।

বাকি লিবিয়ানরা আতঙ্কিত চোখে দৃশ্যটা দেখতে লাগল।

“কুমিররা দয়া-মায়ার ধার ধারে না। আমিও না। এখন আমার সাথে আসুন।” সাকির বলল হাঁটতে হাঁটতে।

পুরো দলটাও তার পিছু পিছু কাছের সুড়ঙ্গটায় ঢুকে গেল।

কার্ট, জো আর রেনাটা পুরো ঘটনাটাই ওপর থেকে দেখেছে। ওরা যে একটা উন্মাদ আর বিকারগ্রস্ত একটা লোকের সাথে লেগেছে সে ব্যাপারে ওরা নিশ্চিত।

“এই লোকটার মতো ভাগ্য না হলেই হয়। জো বলল। “হুম, কুমিরের খাবার হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই।” কার্টও সম্মত হলো।

“যাই হোক, ATV-তে করে যারা আসলো, তাদেরকে দেখে ডাক্তার বা ওরকম মনে হলো। তার মানে এখানে অবশ্যই একটা ল্যাবরেটরি আছে। ওটা খুঁজে বের করতে হবে।”

“আর ওরা উল্টোদিকের ঐ সুড়ঙ্গ দিয়ে গিয়েছে।” জো বলল।

কার্ট ইতোমধ্যে রওনা দিয়ে ফেলেছে। “দেখা যাক ধরা না খেয়েই ওদেরকে খুঁজে বের করতে পারি কি-না।”

.

৫০.

ওসাইরিস পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের সিকিউরিটি সুপারভাইজার তখনো কন্ট্রোল রুমেই বসে আছেন। কিছুক্ষণ পরপর ঘড়ি দেখছেন। সামনে রাখা টিভি স্ক্রীনগুলো কেঁপে উঠল। ক্যামেরাগুলো আবার ঘুরতে শুরু করেছে। সেই একঘেয়ে বিরক্তিকর ছবিই আবার দেখা যাবে। চোখ খুলে রাখতে রীতিমত যুদ্ধ করতে হচ্ছে তার। মেইন বিল্ডিং। তার পাশের বিল্ডিং, উত্তর দিক, দক্ষিণ দিক, তারপর দালানের ভেতরের ক্যামেরা–সবটাতেই কিছুক্ষণ পর পরই হুবহু একই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত এই সিকিউরিটি ভিডিও দেখার চেয়ে একঘেয়ে চাকরি আর নেই। সব সময়ই একই জিনিস।

হঠাৎ এই চিন্তাটা মাথায় আসতেই সুপার ভাইজারের ঘুম কিছুটা চটে গেল। কোত্থেকে যেন ক্ষীণ একটা সন্দেহ উঁকি দিল মাথায়।

“সব সময়-ই এক।”

আসলেই তো, সবসময়ই এক হয় কীভাবে? তা তো হওয়ার কথা না। মাত্রই টেকনিশিয়ানটা প্রণালির ক্যাটওয়াকের ক্যামেরা ঠিক করতে গেল। তাকে তত কমপক্ষে তিনটা ক্যামেরায় দেখা যাওয়ার কথা।

রেডিওটা হাতে নিয়ে সুইচ টিপে বললেন, “কায, কন্ট্রোল রুম থেকে বলছি। কোথায় তুমি?”

একটু বিরতি দিয়েই কাযের কণ্ঠ শোনা গেল। “আমিতো ক্যাটওয়াকে। ক্যামেরা ঠিক করছি।”

“কোন দিক দিয়ে গিয়েছে ওখানে?”

 “মানে?”

 “যা শুনতে চেয়েছি বলো।”

“বারান্দা দিয়ে বেরিয়ে পূর্বদিকের সিঁড়ি দিয়ে নেমেছি। রাস্তা তো একটাই।” কায জবাব দিল।

কিন্তু একবারের জন্যেও ওকে ক্যামেরায় দেখা যায়নি।

“আবারো সিঁড়িতে আসো তো৷ এখুনি।” সুপারভাইজার আদেশ দিল।

“কেন?”

“আসতে বলেছি আসো।”

সুপারভাইজার টেবিলে আঙুল দিয়ে টোকা দিতে শুরু করলেন। ঘুম পুরোপুরি চটে গিয়েছে তার। রক্তে ভরে গিয়েছে অ্যাড্রেনালিন।

 “আচ্ছা। আমি এখন সিঁড়িতে। কি হয়েছে?”

সুপারভাইজার ক্যামেরাগুলো ঘুরিয়ে আবার পূর্বদিকের সিঁড়িতে তাক করল। সাথে সাথে দশ্যটা চার ভাগে ভাগ হয়ে গেল। প্রতিটা ক্যামেরা প্রতিটা তলার সিঁড়ি দেখাচ্ছে। কোনো পরিবর্তন নেই। “তুমি কয় তলায়?”

“তিন তলায়। আমিতো দাঁড়িয়েই আছি। দেখতে পাচ্ছেন না?”

সুপারভাইজার ওকে দেখতে পাচ্ছে না। ওনার কেন যেন মনে হচ্ছে বিশাল কোনো ঘাপলা আছে ব্যাপারটায়। সাধারণ কোনো কারিগরি ত্রুটি এটা না।

“না, তোমাকে দেখা যাচ্ছে না। ওখানকার ক্যামেরাটা নষ্ট না তো?”

 “না, ঠিকইতো আছে দেখা যাচ্ছে।” কায জবাব দিল।

সুপারভাইজার পুরো ব্যাপারটা মিলানোর চেষ্টা করতে লাগল। প্রণালির একটা ক্যামেরা হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেল, সেই সাথে ভেতরের ক্যামেরাগুলোর সব দৃশ্যও একই দৃশ্যে আটকে দেয়া হয়েছে। তার মানে তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কেউ ঢুকে পড়েছে এখানে।

সুপারভাইজার সাথে সাথে সাইলেন্ট অ্যালার্ম টিপে দিল। এটায় শুধু গার্ডেরা সতর্ক হবে। তারপর রেডিও হাতে নিয়ে সবদিকে নির্দেশ পাঠালো, “পুরো বিল্ডিং লক করে দাও। কেউ যেন ঢুকতে বা বের হতে না পারে। এখনি সার্চ করতে বের হও সবাই। বিল্ডিংয়ের প্রতি ইঞ্চি তল্লাসী করতে হবে। সম্ভবত কেউ বিল্ডিংয়ের ভেতরে অবৈধভাবে ঢুকে পড়েছে। একের বেশিও হতে পারে। ক্যামেরা বা অন্য কোনো কিছুর ওপর ভরসা করা যাবে না। সশরীরে প্রত্যেকটা অংশ চেক করবে সবাই।”

.

সিকিউরিটি সেন্টার থেকে বহু দূরে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা এখন সেই দুই সিটের ATV গাড়ির সামনে বসা কালো পোশাক পরা দুজনকে নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ ওদেরকে মাটি খুঁড়ে উদয় হতে দেখে আক্ষরিক অর্থেই চোয়াল ঝুলে পড়েছিল লোক দুটোর। তবে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। ধাতস্ত হওয়ার আগেই জো আর কার্টের ঘুসিতে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়েছে একপাশে। তারপর একপাশে টেনে সরাতেই দেখে ল্যাবরেটরির দরজা।

ল্যাবরেটরির দরজা কাঁচের তৈরি। চারপাশে রাবার দিয়ে মোড়া। কার্ট ধাক্কা দিয়ে দেখে দরজা খোলা। ঢুকে পড়ল ভেতরে। জো আর রেনাটাও ঢুকলো পিছু পিছু। ভেতরে দুজন কাজ করছে। এদের দুজনেরও ওদেরকে দেখে চোয়াল স্কুলে গেল।

পিস্তল তুললো জো। “নো নড়ন-চরন।”

পুরুষ লোকটা হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকল কিন্তু মহিলাটা অ্যালার্ম বা ইন্টারকমের সুইচ টিপ দেয়ার জন্য এগুলো। রেনাটা মাঝপথেই তাকে ঘাড়ের নিচে একটা মেরে ঠাণ্ডা করে দিল।

 লোকজনের যে কি হলো। নড়তে না করলাম আর তাতেই কি-না লাফ ঝাঁপ শুরু করল।” জো বলল।

কার্ট রেনাটার দিকে ফিরে বলল, “পরের বার বারে মারামারির সময় আপনি আমার সাথে থাকবেন।”

পুরুষ লোকটা তখন হাত উঁচিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। কোনো ধরনের প্রতিরোধের কোনো ইচ্ছেই তার নেই।

“আপনি একজন বিজ্ঞানী?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“বায়োলজিস্ট।” লোকটা বলল।

 “আমেরিকান নাম কি আপনার?”

 “ব্রাড গোলনার।”

“আপনি ওসাইরিসের হয়ে কাজ করেন। সবাই যেটাকে ওসাইরিসের ফার্মাসিউটিক্যাল ডিভিশন হিসেবে জানে।” কার্ট বলল।

“আমাকে কায়রোর একটা ল্যাবে কাজ করার কথা বলে চাকরি দেয়া হয়। আলেকজান্দ্রিয়াতেও একটা ল্যাব আছে। জিয়া আমার সাথে কাজ করে।” অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা মহিলাকে ইঙ্গিত করল ব্রাড।

 “কিন্তু এই ল্যাবে কিছু বিশেষ জিনিস বানানো হয়, তাই না?” কার্ট বলল।

“আমাদের কিছুই করার নেই। আমরা শুধু আদেশ পালন করি মাত্র।”

“হুম! নাজীদেরও কিছু করার ছিল না। যাই হোক, আশা করি বুঝতে পারছেন যে আমরা কেন এসেছি আর কি খুঁজছি?” বলল কার্ট।

গোলনার আস্তে মাথা ঝাঁকালো। “হ্যা! আপনারা যা চান তা দিচ্ছি।”

জীববিজ্ঞানী ওদেরকে ল্যাবের অন্য পাশে নিয়ে গেলেন। পুরো টানেলটার সাথে এই অংশটার কোনো মিলই নেই। চারপাশে উজ্জ্বল আলো সাথে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি–সেন্ট্রিফিউজ, ইনকিউবেটর, মাইক্রোস্কোপ। মেঝে, দেয়াল, সিলিং সবই চকচকে অ্যান্টিসেপটিক প্লাস্টিকে মোড়া। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলেও খুব সহজেই জীবাণু মুক্ত হওয়া যায়। এককোণে একটা কাঁচে ঘেরা বায়ুরোধী ছোট্ট ঘর। ল্যাবের অন্য অংশ থেকে আলাদা।

গোলনার সেটার কাছে এগিয়ে কাঁচের গায়ে লাগানো কীপ্যাডের দিকে হাত বাড়ালো।

“সাবধান।” লোকটার পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে বলল কার্ট।” লিভার ছাড়াই বাঁচতে না চাইলে কোনো চালাকি করা ঠিক হবে না।

জীববিজ্ঞানী হাত তুললো আবার, “আমি মরতে চাই না।”

“তার মানে আজকের সফরে আপনিই প্রথম যাকে দেখে উন্মাদ মনে হচ্ছে না।”

কার্ট ঘাড় ঘুরিয়ে জো আর রেনাটার দিকে ফিরে বলল। “গার্ডগুলোকে বেঁধে রেখে ওদের পোশাকগুলো পরে নাও। কেন যেন মনে হচ্ছে এখান থেকে খুব তাড়াতাড়ি আমাদের ভাগতে হবে। নিজেদেরকে এখানকারই একজন বানিয়ে ফেলতে পারলে কাজটা সহজ হবে।

ওরা মাথা ঝাঁকিয়ে জিয়া আর বাকি দুজনকে ল্যাবের আরো ভেতরে নিয়ে গেল। কার্ট আবার জীববিজ্ঞানীর দিকে ফিরে বলল, “ঠিক আছে। এবার আপনি শুরু করুন।”

 লোকটা একটা কোড টিপতেই হিসস করে দরজাটা খুলে গেল। তারপর সে ভেতরে পা দিল, কার্টও ঢুকলো পিছনে।

কার্ট ভেবেছিল যে ভেতরে দেখবে বিশাল বিশাল রেফ্রিজারেটর। তাতে থাকবে বায়োহ্যাজার্ড চিহ্ন যুক্ত সারি সারি ঘোট ঘোট বোতল আর টেস্ট টিউব। কিন্তু ওরা আরেকটা দরজা পেরিয়ে ধুলো-ময়লা রা আরেকটা বড় রুমে চলে এলো। প্রচণ্ড গরম এখানে। চারপাশের সবই কেমন রসকষহীন ছিবড়ে দেখাচ্ছে। চারপাশে লাল রঙের হিট ল্যাম্প জ্বলছে। তাতে রুমটাকে মঙ্গলের পৃষ্ঠের মতো মনে হয়।

 ল্যাবের কিছু দূরেই প্রধান কন্ট্রোল রুমে সাকির, হাসান আর আলবার্তো পিওলা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনের দেয়াল জুড়ে অনেক কম্পিউটারের স্ক্রিন। ওগুলোতে গভীর জলধারা থেকে পানি তুলে নীল নদে ফেলছে যেসব পাম্প, কৃপ আর পাইপ সেগুলো দেখা যাচ্ছে।

পাশের আর এক দেয়ালে অন্য আর একটা প্রকল্পের নানান ছবি, নকশা, মানচিত্র ইত্যাদি ঝোলানো। এটার জন্য সাকিবের লোকজনকে ওদের চারপাশের গোলক ধাঁধার মতো সুড়ঙ্গের সবটাকে এখানে দেখাতে হয়েছে।

“জায়গাটা দেখে তো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সুড়ঙ্গগুলো কত বড়?” পিওলা জিজ্ঞেস করল।

 “আমাদের ঠিক জানা নেই। আমরা যতদূর খুঁড়েছি তার পরও ওটা শেষ হয়নি। ফারাওয়েরা এখান থেকে স্বর্ণ আর রুপা উত্তোলন করতো। তারপর লবণ আর ন্যাট্রন। এখনও শত শত টানেল খুঁজে দেখা বাকি রয়ে গিয়েছে। আর ঘোট ঘোট গুহা আর ফাটলের কথা বাদই দিলাম।” জবাব দিলেন সাকির।

পিওলা এর আগে এখানে আসেনি। সাকির ওকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য দেবে বলে কথা দিয়েছেন। তবে পুরো ব্যাপারটাই বিশ্বাসের ওপর। লিখিত কিছু নেই। আপনারা যখন এটা খুঁজে পান তখন পুরোটাই পানির নিচে ডুবে ছিল?”

“নিচের দিকটা ছিল। আমরা পানি পাম্প করে সরিয়ে ফেলতেই দেখি প্রাচীন কিছু চিত্র কর্মে দেখানোই আছে যে, নির্দিষ্ট সময় পরপর জায়গাটা এ রকম পানি দিয়ে ডুবে যায়। জলাধারটাও এভাবেই খুঁজে পেয়েছিলাম। এই জায়গাটায় জলাধারাটা মাটির খুব কাছে। কিন্তু পশ্চিম দিকে আস্তে আস্তে এটা গভীরে নেমে গিয়েছে। সাকির জবাব দিলেন।

 পিওলার চোখ সরু হয়ে এলো, “তার মানে জলাধারটা পুরো সাহারা জুড়েই বিস্তৃত?”

“ওটার চেয়ে সাহারা পুরো জলাধারটা জুড়ে বিস্তৃত বলাটা বেশি যুক্তিযুক্ত। তবে হ্যাঁ, জলাধারটা একেবারে মরোক্কোর সীমানা পর্যন্ত চলে গিয়েছে।”

“অন্য কোনো দেশ যে এটা খুঁজে পাবে না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে? অন্যদের চাইতেও আরো গভীরে খুঁড়ে দেখেছেন, তাই?”

 “ভূতাত্ত্বিক কারণেই এটা খুঁজে পাওয়া কষ্ট হবে। তবে এক সময় না একসময় তো খুঁজে পাবেই।” বললেন সাকির। তারপর কাঁধ উঁচিয়ে এমন একটা ভাব করলেন যে তাতে তার কিছুই যায় আসে না।” তবে ততোদিনে ওসব দেশের ক্ষমতা আমাদের হাতেই থাকবে। লোহিত সাগর থেকে আটলান্টিক পর্যন্ত সেই সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ আর পরিচালনা করবো আমি। এমনকি মরক্কোও আমরা দখল করে নেবে। পুরো উত্তর আফ্রিকা আমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আর উপযুক্ত মূল্য দিলে আপনি আর আপনারা যা চান তা-ই পাবেন।”

“অবশ্যই।” খুশিতে দাঁত বেরিয়ে গেল পিলার। বেশ কয়েকটা মাইনিং আর তেল কোম্পানিতে শেয়ার আছে তার। তবে সেটা কেউ জানে না। কিন্তু একবার ঠিকঠাক ঠিকাদারি পেলেই আঙুল ফুলে কলা না একেবারে বটগাছ হয়ে যাবে সে।

“আচ্ছা এই সমাধিটাই বা খুঁজে পেলেন কীভাবে? গত কমপক্ষে একশো বছর ধরে এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান তো কম হয়নি।” জিজ্ঞেস করল পিওলা।

“ঠিক, তবে এই জায়গাটার কথা কোথাও উল্লেখ নেই। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এক লোক কয়েক টুকরো ছেঁড়া প্যাপিরাস কোত্থেকে আনার পর আমরা জায়গাটা সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। ব্রিটিশ আর ফ্রেঞ্চ যেসব জিনিস নিয়ে গিয়েছিল। আমরা সেগুলো খোঁজা শুরু করি, তবে আসল জিনিসটা আমরা খুঁজে পাই আবুকির উপসাগরের তলদেশে। ওখানে লেখা ছিল কীভাবে আখেন আতেন সমাধিক্ষেত্র থেকে প্রথম দিকের ফারাওদের লাশ সারিয়ে আর এক জায়গায় নিয়ে যায়। সেখানে নাকি তারা উদয়রত সূর্যের আলোয় আলোকিতত হতো। আর কীভাবে ওসাইরিসের পুরোহিতরা এটাকে খুবই খারাপ কাজ বলে গণ্য করল। ওরা আখেন আতেনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বারোজন রাজার কফিন সেখান থেকে চুরি করে এখানে নিয়ে আসে।”

“আর ব্লাক মিস্ট খুঁজে পেলেন কীভাবে?”

“আবুকির উপসাগরে পাওয়া শিলালিপিতেই পাই এটার সন্ধান। ওখানে পাওয়া লেখাগুলোই আমাদের ব্লাক মিস্টের রহস্যের খোঁজ এনে দেয়। ওখানে লেখা ছিল কীভাবে ওসাইরিসের পুরোহিতরা প্রতি বছর একবার ল্যান্ড অব পুনট-এ গিয়ে ঐ সিরামটা বানাতে যা যা লাগতো তা নিয়ে আসতো। আমাদেরকে অবশ্যই এটা সংস্কার করতে হয়েছে, তবে তাতে জিনিসটা আরো আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে।” সাকির ব্যাখা করলেন।

“কি উন্নতি?”

সাকির মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করলেন, “ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিন, আলবার্তো, যে আমি আপনাকে ভুল করেও সেটা বলে ফেলিনি। কারণ বলে ফেললে এখন আপনাকে কুমিরের গর্তে ছেড়ে মারা ছাড়া উপায় থাকতো না।”

পিওলা এক হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করলেন, “থাক থাক! যা বলেছেন তা-ই যথেষ্ট। আর আমাদের অতিথিরাও একটু আগের ঘটনায় স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন যে বিরোধিতা করলে শুধু নিজের মরণ-ই ডেকে আনা হবে।”

 “অবশ্যই বুঝতে পেরেছে।” আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন সাকির। কিন্তু প্রশ্ন হলো এরপর কী হবে? লিবিয়ার অবস্থা এখন গনগনে উনুনের মতো। সবচেয়ে ভালো হয় আপনারা যদি সরকারের পতনের পরপরই দেশে একটা প্রতিনিধিত্বমূলক তত্ত্বাবধায়ক অস্থায়ী সরকার গঠন করার ব্যাপারে সংসদে একটা আইন পাস করতে পারেন। মিসর-ইতালির যৌথ উদ্যোগে-ই পারবে দেশে আবার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে।”

“বিল পাস করতে আমাদের আরো অনেক ভোট লাগবে। আর কিছু না দিলে তো আমি ভোট পাবে না। ল্যাম্পেড়সায় যেটুকু নষ্ট হলো তার বদলে আমি আরো এক চালান ব্লাক মিস্ট চাই। আমরা যদি আর মাত্র দশজন মন্ত্রীকে বশে আনতে পারি তাহলেই ভোটের ফলাফল আমাদের পক্ষে চলে আসবে। এমনকি আমাকে প্রধানমন্ত্রী করে নতুন সরকার গঠনও সম্ভবপর হবে যাবে।”

হাসান কথা-বলল এবার, “নতুন একটা চালান তৈরি হচ্ছে। কিন্তু লিবিয়ানরা যদি আমাদের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে তাহলে এটা কোনো কাজেই আসবে না। অবস্থা টালমাটাল হলেও এখনো কিন্তু হাল ছাড়েনি ওরা।”

 সাকির মাথা ঝাঁকালো, “অবস্থা আরো খারাপ করে দেবো।”

“পারবেন?” পিওলা জিজ্ঞেস করল। আমি বুঝেছি যে পানির প্রধান উৎসটাই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কয়েকটা ছোট ছোট স্টেশনে কিন্তু এখনো পানি ওঠছে। আর ত্রিপলির কাছেই কিন্তু একটা পানি লবণমুক্তকরণ প্রাষ্ট পূর্ণ শক্তিতেই চলছে।”

“ঐ প্লান্টটা বন্ধ করার ব্যবস্থা করছি। আর আমাদের পাম্পগুলো থেমে থেমে না চালিয়ে একটানা চালালেই ছোট স্টেশনগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে অচিরেই। চব্বিশ ঘণ্টা পর লিবিয়ানরা এক কাপ পানিও পাবে না আর।”

“তাহলে তো কাজ হয়েই যাবে।” পিওলা সম্মত হলো।

হাসানও সময় দিল ব্যাপারটার, আর তাতে আমরাও নাক গলানোর একটা অজুহাত পেয়ে যাবো। সবচেয়ে ভালো হয় আমাদের সৈন্যরা যদি বন্দুকের বদলে ঘরে ঘরে পানির বোতল পৌঁছে দেয়।”

সাকির মাথা ঝাঁকালেন। আরো কয়েক হাজার মানুষ হয়তো মারা যাবে। হয়তো দশ হাজার। কিন্তু ফলাফল একই থাকবে। মিসরই লিবিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবে। মিসরের প্রতিনিধিরাই আরজেরিয়া, তিউনিসিয়া শাসন করবে। আর সাকির নিয়ন্ত্রণ করবে এদের সবাইকে।

“ঠিক আছে, এই কথাই রইল। আমি তাহলে যত তাড়াতাড়ি পারি ইতালি ফিরে যাই।” পিওলা বলল।

কেউ কিছু বলার আগেই একটা ফোন বেজে উঠল। হাসান ধরলো সেটা। দুয়েকটা হু-হুঁ করেই রেখে দিল। মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে।

“পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের সিকিউরিটি থেকে ফোন করেছিল। কেউ সম্ভবত ভেতরে অবৈধভাবে ঢুকে পড়েছে। ওরা লোকটাকে খুঁজছে কিন্তু এখনো পায়নি। আর একটা ট্রামকারও নাকি পাওয়া যাচ্ছিল না। সেটা নাকি আনুবিসের মূর্তির একশো ফুট দূরে পাওয়া গিয়েছে।”

সাকির ঠোঁট গোল করে শিস দিয়ে বললেন, “তার মানে অনুপ্রবেশকারী ওদের ওখানে নেই, আমাদের এখানে।”।

হীট ল্যাম্পগুলোর তাপের প্রবাহ উপেক্ষা করে কার্ট মঙ্গল সদৃশ্য জায়গাটা দিয়ে এগুলো।”

“এটা আমাদের ইনকিউবেটর।” গোলনার বলল।

 “কাজ কী এটার?” চারপাশে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল কার্ট।

চারদিকে শুধু শুকনো মাটির স্তূপ। আর ওটা থেকে নির্দিষ্ট নকশা করে করে অনেক মাটির ঢিবি মতো উঁচু হয়ে আছে। “কিছু চাষ করছেন নাকি এখানে?”

“চাষ হচ্ছে না কিছুই। ঘুমাচ্ছে। শীত নিদ্রা যাপন করছে।”

 “দেখান দেখি।”

 গোনার কার্টকে রুমের এক কোণায় নিয়ে গেল। তারপর একটা ঢিবির পাশে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। তারপর একটা ছোট নিড়ানি দিয়ে আলগা মাটি সরিয়ে একটা সফট বলের সাইজের মাটির দলা তুলে আনলো। গোলনার তারপর ঘষে ঘষে ওটার ওপরের মাটি সরাতে লাগল।

কার্ট একবার ভেবেছিল কিলবিলে কোনো এলিয়েন হয়তো দেখতে পাবে। কিন্তু বাইরের আবরণটা সরাতেই দেখা গেল একটা চিমসানো। আধা মমি করা ব্যাঙ।

“এটা হচ্ছে একটা আফ্রিকান কোলা ব্যাঙ।” গোলানার বলল।

 “এরকমই কয়েকশো তো ঐ সমাধিগুলোয় দেখলাম।”

 “এটা জীবিত, তবে ঘুমাচ্ছে। শীত নিদ্রা।”

কার্ট ব্যাপারটা ভেবে দেখলো। শীতপ্রধান এলাকায় প্রাণীরা সাধারণত শীতকালে শীত নিদ্রায় যায়। তবে আফ্রিকায় এটা খরা থেকে বাঁচার একটা উপায়। তার পর বলল, “এটা এখন শীত নিদ্রার কারণ আপনি এটাকে মাটিতে পুঁতে তারপর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাই না?”

“হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। অতিরিক্ত তাপ আর আর্দ্রতার ঘাটতির সময় ব্যাঙেরা টিকে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তখন ওরা কাদার ভেতর ঢুকে পড়ে আর ওদের আরো কয়েক স্তর অতিরিক্ত চামড়া গজায়। ওটা শুকিয়ে গেলে ঠিক একটা রেশমের গুটির মতো হয়ে যায়। শরীরের সব কার্যক্রম থেমে যায়। হৃদপিণ্ডটাও বলা যায় বন্ধই হয়ে যায় শুধু ওদের নাকের ছিদ্র দুটোই ভোলা থাকে যাতে নিশ্বাস নিতে পারে।”

কার্ট অবাক হয়ে গেল শুনে, “এগুলো থেকেই ব্লাক মিস্ট বানানো হয়? ঘুমন্ত কোলা ব্যাঙ থেকে?”

“হ্যাঁ।”

 “জিনিসটা কাজ করে কীভাবে?”

“শুষ্ক আবহাওয়ার জন্য ব্যাঙটার শরীরের গ্রন্থিগুলো এনজাইমের একটা মিশ্রণ উৎপন্ন করে। জিনিসটা একটা জটিল রাসায়নিক দ্রবণ। এটা একেবারে প্রতিটা কোষকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। শুধু ব্রেইনের নিচের অংশটা কর্মক্ষম থাকে।” গোলনার ব্যাখ্যা করল।

“ঠিক কোমায় থাকা একটা মানুষের ব্রেইনের মতো।”

 “হ্যাঁ, দুটো জিনিস প্রায় একই।”

“তো আপনার কাজ হচ্ছে ব্যাঙগুলো থেকে এই রাসায়নিক পদার্থটা বের করে মানুষের শরীরে ব্যবহার উপযোগী করে তৈরি করা তাই তো?”

“আমরা শুধু আরো বড় বড় প্রাণীতে ওষুধটা ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরি করি। তবে সমস্যা হচ্ছে এতে জিনিসটার আয়ু কমে যায়। হিমাঙ্কের নিচে আপনি এটাকে অনন্তকাল সংরক্ষণ করতে পারবেন। কিন্তু কক্ষ তাপমাত্রায় মাত্র আট ঘণ্টাতেই এটা অকার্যকর হয়ে যায়। বাতাসে ছেড়ে দিলে মাত্র দুই থেকে তিন ঘণ্টাতেই মিলিয়ে যায় আর ভেঙে সাধারণ জৈব যৌগে পরিণত হয়।”

“সেজন্যেই ল্যাম্পেডুসায় এটার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।” কার্ট বললো, গোলনার মাথা ঝাঁকালো।

“খুবই স্বল্প আয়ুর অস্ত্র।” কার্ট বললো।

“এটা শুরুতে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কথা ছিলো না। এটা ছিল একটা ওষুধ। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ।”

কার্ট কথাটা বিশ্বাস করল না কিন্তু ব্যাখ্যাটা শুনতে আগ্রহী। তাই জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে?”

“ডাক্তররা প্রায়ই চিকিৎসা হিসেবে রোগীকে কোমায় পাঠিয়ে দেয়। অ্যাকসিডেন্ট বা পোড়া রোগী যারা বিভিন্ন ভয়াবহ আঘাত প্রাপ্ত হয় তাদেরকে এই কাজ করা হয়। এর ফলে শরীর নিজেই নিজকে সারিয়ে তোলে। কিন্তু এটার ওষুধগুলো ছিল খুবই মারাত্মক। লিভার আর কিডনী নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু এই ওষুধটা একেবারেই প্রাকৃতিক, তাই ক্ষতির পরিমাণ একদমই কম।

 গোলনারের কথা শুনে মনে হলো সে নিজেই নিজেকে কথাটা বলে বুঝ দেয়ার চেষ্টা করছে।

“কথাটা না বলে পারছি না গোলনার।”

“আমি জানি। আমার ব্যাপারটা বোঝা উচিত ছিল। ওরা শুধু এটা ডেলিভারির উপায় জানতে চাইতো। এটা কী পানিতে গোলানো যাবে কি-না? বাতাসে মিশানো যাবে কি-না? কথাগুলো জিজ্ঞেস করার কোনো ডাক্তারি কারণ নেই। শুধু জীবাণু অস্ত্রেরই এভাবে ছড়িয়ে দেয়া লাগে।”

“তাহলে কেন এটা করছেন?”

“কয়েকজন এর আগে এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল তারপর থেকেই তারা উধাও হয়ে গিয়েছে। গোলনার বলল।

কার্ট বুঝলো ব্যাপারটা, “কথা না শুনলে সাকির কি করে তা আমি দেখেছি। আমি ওর এসব কাজকর্ম থামাতে চাই।”

 “অত সহজ না কাজটা।” বিমর্ষ মুখে বলল গোলনার। “খুব শীঘ্রই পুরো প্রক্রিয়াটাই স্বয়ংক্রিয় করে ফেলা হবে। তখন এমন কি আমাকেও লাগবে না।” তারপর ব্যাঙটা আবার ওর গর্তে রেখে বলল, “আমার সাথে আসুন।”

ওরা আরো একটা দরজা পেরিয়ে সাধারণ একটা ল্যাবরেটরীতে এসে ঢুকলো। পরিষ্কার, শান্ত আর অন্ধকার। চারপাশে রেফ্রিজারেটর আর টেবিল। ওগুলোর ওপর ছোট ছোট কিছু সেন্ট্রিফিউজ ধীরে ধীরে ঘুরছে।

ব্রাড গোলনার প্রথমটা চেক করল, তারপর দ্বিতীয়টা, “নতুন চালানটা এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি।”

তারপর ও একটা স্টীলের রেফ্রিজারেটরের দিকে এগুলো। তারপর ওটা খুলে ভেতর থেকে কয়েকটা ভায়াল বের করে আনলো। তারপর সেটাকে একটা ফোমের বাক্সে রেখে একটা কোল্ড বক্সে ঢুকিয়ে দিল।

“জিনিসটা গরম হওয়ার আগেই মানে আট ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহার করতে হবে। এরপর আর কাজ হবে না।”

“এটা ব্যবহার করব কীভাবে?” কার্ট বলল।

 ‘ব্যবহার করবেন মানে?”

“ল্যাম্পেডুসার লোকগুলোকে আবার সুস্থ করতে। সাকির যাদেরকে কোমায় পাঠিয়ে দিয়েছে।”

গোলনার মাথা নাড়লো, “না না! এটা অ্যান্টিভোট না। এটা ব্লাক মিস্ট।”

“আমার অ্যান্টিভোট দরকার। আমি লোকজনকে ঘুম থেকে জাগানোর চেষ্টা করছি। ঘুম পাড়ানোর না। কার্ট বলল।

 “অ্যান্টিভোট তো এখানে বানানো হয় না। ওরাই বানাতে দেয় না, কারণ তাহলে আমরা আর ওদের ভয় পেতাম না। কথাও শুনতাম না।”

এটা নিজের লোকদের বশে রাখতে সাকিরের আরেকটা চাল। ভাবলো কার্ট। মুখে বলল, “কিন্তু জিনিসটা কী তাতো জানেন।”

গোলনার আবারো মাথা নাড়লো।

 “না জানতে পারেন তবে অনুমান তো করতে পারবেন, নাকি?”

“এটাকে অবশ্যই কোনো ধরনের—

জীববিজ্ঞানী আর কিছু বলার আগেই পিছনের দরজা খুলে গেল। ইনকিউবেশন রুমের লালা আভা ছড়িয়ে পড়লো এই রুমেও। কার্ট জানে এটা জো বা রেনাটা না। সাথে সাথে ও গোলনারকে ধরে একপাশে ঝাঁপ দিল।

সেকেন্ডের ভগ্নাংশ দেরি হয়ে গেল কার্টের। বেশ কয়েকটা বন্দুক একসাথে গর্জে উঠল। একটা বুলেট কার্টের বাহুতে আচড় কেটে বেরিয়ে গেল। দুটো আঘাত করল জীববিজ্ঞানীর বুকে।

কার্ট গোলনারকে টেনে একটা টেবিলের পিছনে নিয়ে এলো। শ্বাস প্রশ্বাস ধীর হয়ে এসেছে ওর। কিন্তু কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। কার্ট ওর মুখের কাছে কান নিয়ে গেল।

“…চামড়া… বায়ুরোধী একটা কৌটায় রাখবেন…তিনদিন পরপর তুলে আনা হয়…” এটুকু বলেই ব্যথার দমকে চেহারা কুঁচকে গেল ওর। তারপরই শরীর ঢিল হয়ে স্থির হয়ে গেল গোলনার।

“কাট অস্টিন।” গমগমে একটা গলা শোনা গেল খোলা দরজা পথে। কার্ট টেবিলের পেছনে মাটিতেই পড়ে রইল। ওকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু টেবিলের পাতলা কাঠ বুলেট আটকাতে পারবে না। যে কোনো মুহূর্তে গুলি খাবে এই আশংকায় পড়ে রইল ও। কিন্তু কেউ গুলি করল না। সম্ভবত লোকগুলো এই বিষাক্ত পদার্থ ভরা ল্যাবে খুব বেশি গোলাগুলি করতে চায় না।

“আপনি তো আমাকে বেকায়দায় আক্রমণ করেছেন। কার্ট চেঁচিয়ে বলল।

 “আর ওখানেই আপনি থাকবেন।” কণ্ঠটা জবাব দিল।

কার্ট টেবিলের কোণার দিকে তাকাল। দরজার কাছে তিনটা আবছায়া দেখা যাচ্ছে। ওর ধারণা ঠিক মাঝখানের আবছায়াটা সাকিরের। কিন্তু পিছনের ঘরের লাল আলোয় তিনজনকেই শয়তানের প্রতিমূর্তি বলে ভ্রম হলো ওর। যেন বহুদিনের পাওনা আদায় করতে এসেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *