৪৫. হে আমার দোসর পাঠক

হে আমার দোসর পাঠক, মান্টো এবার তার কলম বন্ধ করবে। মির্জাসাব গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছেন। আর কীই বা বলবার আছে তাঁর? শাহজাহানাবাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যে-তজীবের মৃত্যু তা একইসঙ্গে মির্জা গালিবেরও মৃত্যু, পরবর্তী বারো বছর তো জীবন্মাতের মতো থেকে যাওয়া। রোগ আর জরার আক্রমণ, হাঁটতে পারেন না, কানে শুনতে পান না, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা, স্মৃতিও দিনে-দিনে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। এই ধ্বংসস্তূপের কাহিনী আমি আর লিখতে চাই না। এখন শুধু অপেক্ষা সামনের সেই দিনটার জন্য; সেদিন খুদা হাফিজ বলে আমি আপনার কাছ থেকে বিদায় নেব।

তবে কাল রাতের স্বপ্নটা আপনাদের বলে যেতে চাই। আমি জামা মসজিদের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ কে যেন এসে আমার হাত চেপে ধরল। মুখ তুলে দেখলাম, কাল্লু।

-এখানে কী করছেন মান্টোভাই?

-তুমি আমাকে চেনো?

-চিনব না? কাল্লু হাসে, কবরে শুয়ে শুয়ে এতদিন মির্জাসাব আর আপনার কত কিস্স শুনলাম

-কবরে?

-আপনিও তো কবরে ছিলেন, মনে নেই?

-আমি তো এখনও মরি নি কাল্লু।

-তাই? কাল্লু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে, তা হলে হয়তো স্বপ্ন দেখেছি।

-স্বপ্নে! তুমি তো মরে গেছ কাল্লু।

-তাতে কী মান্টোভাই?

-মরা মানুষ স্বপ্ন দেখে?

-আলবাত দেখে। দুনিয়াময় তামাম খোয়াব ঘুরে বেড়াচ্ছে জানেন? যত মানুষ আছে দুনিয়ায়, খোয়াব তার চেয়ে অনেক বেশী। মুর্দাদের ঘাড়েও ওরা চেপে বসে। আপনি কি কিস্সা শুনতে চান, মান্টোভাই?

-কিস্সা? কে শোনাবে?

-আরে আমি তো রোজই একবার এখানে আসি। একজন না একজন দস্তানগোকে ঠিক পেয়ে যাই। ওই যে দেখুন।

-কে?

-ওই যে লোকটা, কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছে, ও ঘুরে ঘুরে তো সবাইকে কিস্মাই শোনায়।

-তুমি কী করে বুঝলে কাল্লু?

-দেখুন না-লোকটা আপন মনে হেসেই যাচ্ছে। কেন জানেন? যাদের পেটে কিস্সা গিজ গিজ করে তারা কিছুতেই হাসি থামাতে পারে না। আসুন-আমার সঙ্গে আসুন।

 কাল্লু লোকটার সামনে গিয়ে বসে পড়ে।-মিঞা—

-কে? লোকটা কাল্লুর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে।-আরে কাল্লু মিঞা—

-তুমি আমাকে চেনো মিঞা?

-তামাম দুনিয়ায় কে তোমাকে চেনে না। শালা কাল্লু কিস্সাখোর।

কাল্লু হা-হা করে হেসে ওঠে। আমার হাত ধরে টানতে টানতে বলে, বসে পড়ন, মান্টোভাই, বসে পড়ন।

-তুমি তো বিখ্যাত দেখছি, কাল্লু। আমি হেসে ফেলি।

কম্বল মুড়ি দেওয়া লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলে, কিস্সা শোনার মতো কটা লোক আছে, জনাব? শুনতে শুনতে কেউ কান চুলকায়, পোঁদ চুলকোয়, এদিক-ওদিক তাকায়। কিস্সা শোনারও তজ্জীব আছে। খোদাকে যেমন বিশ্বাস করেন, কিস্সাকেও তেমনি বিশ্বাস করে শুনে যেতে হবে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই -মানুষ খুঁজি- আজকাল কারুর কিস্সা শোনার অবসরই নেই। দুনিয়াটা বড় অশান্ত হয়ে গেছে, জনাব। কেউ বোঝে না, কিস্স শুনতে-শুনতে মনে শান্তি ফিরে আসে।

-মিঞা, তা হলে শুরু করো। কাল্লু উত্তেজিত হয়ে বলে।

-অত তাড়াহুড়ো করো না কাল্লু মিঞা। দিলকেতাবটা একটু উল্টোনোর সময় তো দাও। মন যদি না-ভরে, তেমন কিস্যা শুনিয়ে আমিই বা খুশ হব কী করে?

লোকটা অনেকক্ষণ মাথা নীচু করে বসে থাকে, নিজের মনে বিড় বিড় করে কথা বলে, অস্ফুট গান গায়, তারপর একসময় হাসতে-হাসতে বলে, আজ শেখের কিস্সাটাই জমবে ভাল। এ হচ্ছে হৃদয়ের ভিতরে যে চোখ আছে, তাকে খোঁজার গল্প।

কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে থাকে সে, তারপর গল্প শুরু করে।

এক শেখের দুই ছেলেই অসুখে ভুগে মারা গিয়েছিল। কিন্তু তাকে কখনও কেউ কাঁদতে দেখেনি, সন্তানদের জন্য বিলাপ করতেও শোনেনি। সে রোজ সময়মত ব্যবসার কাজে যেত, কাজ করতে করতে গানও গাইত, বাড়ি ফিরে সবার সঙ্গে হাসি ঠাট্টাও করত। শেখের মা-বিবি তাকে এইরকম দেখে দিনে দিনে অবাক হয়ে যাচ্ছিল। একদিন শেখ যখন সকালের খাবার খাচ্ছিল, মা হঠাৎ বলে উঠল, বেটা বাড়ির তাজা দুটো ছেলেকে হারিয়ে আমাদের কী অবস্থা তুমি বুঝতে পারো? সবসময় বুকের ভেতরে রক্ত ঝরছে। খেতে পারি না, ঘুমোতে পারি না। বিবির দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছ? দিনে দিনে চুলের মতো হয়ে যাচ্ছে। তুমি রোজ ঠিকমতো কাজে যাচ্ছ, যেন কিছুই হয় নি..। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে শেখের মা।

তার বিবিও রাগে ফেটে পড়ে, আপনার হৃদয় বলে কিছু আছে? একফোঁটা জলও দেখিনি আপানার চোখে। বাচ্চাদের ভালবাসলে আপনি এইরকম থাকতে পারতেন? যেন কিছুই। বদলায়নি…যেন ওরা এখনও বেঁচে আছে…

-কিছুই বদলায় নি বিবি। ছেলেরা আমার ভেতরেই বেঁচে আছে। আমি তো সবসময় ওদের দেখতে পাই।

-আর আমি ওদের সব জায়গায় খুঁজি। রাতে ঘুমোতে পারি না। ওরা কাঁদতে কাঁদতে বলে, আম্মা, বড় শীত লাগে, বড় খিদে পায়। আমাদের ভেতরে নিয়ে চলো। আমি কেন ওদের দেখতে পাই না?

-বিবি, হৃদয়ের চোখ দিয়ে ওদের খোঁজো, ঠিক দেখতে পাবে।

-আপনার ওই চোখটা অন্ধ। আপনি কিছু দেখতে পান না।

-না, অন্ধ নয়। আমাদের দুটো চোখ দিয়ে আমরা ভুল দেখি। দুরকম দেখি। আমার কাছে সব একাকার। আমি আমার সন্তানদের সবসময় দেখতে পাই। ওরা আমার চারপাশেই খেলাধুলা করে।

-কোথায়? আমাকে দেখান। আমি তো ওদের দেখতে পাই না।

-আমাদের চোখ দিয়ে ওদেরে দেখা যায় না। জলের ওপর জংলা গাছ দেখেছ? আমাদের। অনুভূতি সেই জংলা গাছের মতো। ওগুলো সরাতে সরাতে এগোলেই তুমি দেখতে পাবে। চোখ বুজে কল্পনা করো তাকে, যা দেখা যায় না। তোমার সন্তানরা তখন তোমাকে এসে জড়িয়ে ধরবে, বিবি।

-আমার বুক খালি হয়ে গেছে শেখ। আপনার সুন্দর সুন্দর কথায় তা ভরবে না। শেখের বিবি কাঁদতে কাঁদতে নিজের বুকে আঘাত করতে থাকে।

শেখের মা বলে, তুমি যে চোখের কথা বলছ, আমরা তা বুঝি না, বেটা, কথা দিয়ে আমাদের ভুলিও না। শেখ অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। মা-বিবির প্রতি প্রাথমিক বিরক্তি কেটে গিয়ে দুঃখে মন ভরে উঠল তার মন। ওদের শোক দূর করার ক্ষমতা তার নেই। ওরা তো বিচ্ছেদকেই সত্য। বলে মেনে নিয়েছে। শেখ তখন একটা গল্প বলতে শুরু করল।-একটা মেয়ের কথা শোনো। তার যত সন্তান জন্মেছিল, জন্মের কয়েকমাস পরেই তারা মারা গিয়েছিল।

-আমাদের ছেলেরা তো কয়েক বছর বেঁচে ছিল। তার মা বলে ওঠে।

-আর মেয়েটা? শেখের বিবি জিজ্ঞেস করে।-ও নিশ্চয়ই শোকে মারা গিয়েছিল। আমিও তো মরতে চাই-কেন তবু মৃত্যু আসে না।

-মেয়েটার কুড়িটা বাচ্চা মারা গিয়েছিল। দুটো নয়, কুড়িটা। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত আর খোদাকে অভিশাপ দিত। একদিন রাতে আশ্চর্য ঘটনা ঘটল।

-কী?

-স্বপ্নের ভেতর মেয়েটা মরুভূমি পেরিয়ে যাচ্ছিল। ওর পেট থেকে রক্ত ঝরছে, রক্তে ভিজে যাচ্ছে বালি। ও একটা ছোট্ট দরজার কাছে এসে পৌঁছল। দরজা পেরিয়ে মাতৃগর্ভের মতো সরু পথ ওকে পৌঁছে দিল এক আশ্চর্য দুনিয়ায়। সেখানে অনন্ত জীবনের ঝরনা আর বাগানের মধ্য দিয়ে বইছে জন্নতের নদী। সেই বাগানের গাছেরা কখনও মরে না। বাগানটা কেউ কখনও চোখে দেখেনি। যারা বিশ্বাস করে, এমন বাগান আছে, তারাই শুধু দেখতে পায়। সব আনন্দের উৎসব এই বাগানেই।

শেখের বিবির চিৎকার করে ওঠে, সব আপানার খোয়াব, এমন বাগান কোথাও নেই।

-এই বাগানের কোন নাম নেই, তার রূপ বর্ণনা করা যায় না। তবু সে এই দুনিয়াতেই আছে, বিবিজান।

-মেয়েটার কী হল, বলুন। এতগুলো সন্তান হারিয়ে বাগানে গিয়ে সে কী পেল?

-জন্নতের নদীতে গিয়ে সে নামল। সঙ্গে তার সব দুঃখ, সন্দেহ ময়লার মতো মিলিয়ে গেল। স্নান করতে-করতে সে তার সন্তানদের হাসি শুনতে পেল। সত্যিই, বিশ্বাস করো, কুড়িটি সন্তান তার চারপাশে সাঁতার কাটছিল, হাসছিল। আনন্দে উৎসব জেগে উঠল মেয়েটির হৃদয়ে।

-তাহলে আমাকে নিয়ে চলুম সেখানে। বলুন, কী করে যাব?

-ফকিরদের কথা ভাবো, বিবিজান। তাদের জীবনে যা ঘটে, তা নিয়ে কোনও অভিযোগ তাদের নেই। আল্লা যা নিয়েছেন, তার চেয়েও অনেক বেশী দেবেন। ফকিররা আল্লার কাছে কিছু চান না। তিনি যে পথে নিয়ে যাবেন, সেই পথেই যেতে হবে।

-আমরা কী করে এই কঠিন পথে যাব?

-সহজ নয়। এমনকি দাকুকিরও সন্দেহ হয়েছিল।

-দাকুকি কে?

-তবে সেই পথিকদের গল্প শোনো, যারা পথের সব ঘটনাকেই মেনে নেয়।

-বলো বেটা, তোমার গল্প শুনে বুকের ভিতরটা অনেক হাল্কা লাগছে। শেখের মা বলতে বলতে রুটি খেতে শুরু করল।

-দাকুকি এক তীর্থযাত্রী। সবসময় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলেছে, কারুর কাছে, কোনও জায়গায় সে আটকে পড়ত না।

-আশ্চর্য! এমন মানুষ হয় না কি?

-তবে একটা টান তার ছিল।

-সন্তানদের প্রতি? শেখের স্ত্রী বলে ওঠে।

-না। ফকিরদের প্রতি। সে যে কী অমোঘ টান। ফকিরদের মধ্যেই সে বিন্দুতে সিন্ধু দেখতে পেত। মানুষের মধ্যে লুকিয়ে আছেন খোদা, ফকিররাই তাকে জানিয়েছিল। ফকিরদের খোঁজে কোথায় কোথায় না ঘুরে বেড়াত দাকুকি। পথ চলতে চলতে তার পা থেকে রক্ত ঝরত। কেউ যখন বলত, এমন রক্তাক্ত পায়ে তুমি মরুভূমিতে হেঁটে যাবে কীভাবে, দাকুকি হেসে বলত, ও কিছু নয়।

-তারপর?

-একদিন সন্ধেবেলা দাকুকি এক সমুদ্রসৈকতে এসে পৌঁছল। দাকুকি দেখল, অনেক দূরে তাল গাছের চেয়েও লম্বা সাতটা মোমবাতি জ্বলছে। আলোয় ভরে গেছে চারদিক। দাকুকি সেই মোমবাতির দিকে হাঁটতে হাঁটতে একটা গ্রামে গিয়ে পৌঁছল। গ্রামের মানুষরা হাতে আলোহীন প্রদীপ নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

-কী হয়েছে তোমাদের? দাকুকি একজনকে জিজ্ঞেস করল।

-দেখতে পাচ্ছ না? আমাদের প্রদীপে তেল নেই, পলতে নেই। পেট ভরানোর মতো খাবারও আমাদের গ্রামে নেই।

-আরে ভাই, তাকিয়ে দেখো। আকাশ তো আলোয় ভরে আছে।সাতটা মোমবাতি দেখতে পাচ্ছ না? খোদা তো এমনি-এমনিই আমাদের আলো দেন।

-আলো কোথায়? সারা আকাশ অন্ধকার, আর তুমি আলো দেখেতে পাচ্ছ? পাগল কাহিঁ কা।

দাকুকি লোকটার দিকে তাকিয়ে দেখল, ওর চোখ খোলা হলেও আসলে তা সেলাই করা। চারপাশের সবার চোখ একইরকম। ভোলা কিন্তু বন্ধ।

সকাল হতেই সাতটা মোমবাতি হয়ে গেল সবুজ সাতটা গাছ। মরুভূমি যখন উত্তপ্ত হয়ে উঠল, দাকুকি গাছেদের ছায়ায় গিয়ে বসল, ফল পেড়ে খেল। সে দেখল, গ্রামের লোকেরা সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে ছেড়া জামাকাপড় দিয়ে শামিয়ানা বানিয়েছে। দাকুকি চিৎকার করে গ্রামবাসীদের ডেকে বলল, আরে তোমরা গাছের ছায়ায় এসে বসো। কত ফল হয়েছে, দেখতে পাচ্ছ না? ফল খেলেই তো তৃষ্ণা মিটে যাবে।

-আমরা কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় গাছ? সব তো মরুভূমি। আমাদের বুরবাক বানাচ্ছ? আমরা আজই এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাব।

-কোথায় যাবে?

-ওই যে সমুদ্রে জাহাজ নোঙর করা আছে, আমরা সবাই সেই জাহাজে চেপে যেখানে খুশি চলে যাব।

-আমার কথা শোনো বন্ধুরা। তোমরা সবাই সবাইকে মিথ্যে দিয়ে ভোলাচ্ছ।

-চুপ করো। বাজে কথা বলে আমাদের ভুলিও না। গাছ আমরাও দেখেছি, কিন্তু সব স্বপ্ন। ওতে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা বাস্তবে ফিরতে চাই।

-বাস্তব? কী বাস্তব? খিদে, তৃষ্ণা, প্রখর রৌদ্র? গাছে এত ফল ফলে আছে, তোমরা দেখতে পাচ্ছ না?

-না সমুদ্রের ওপারে ভালো জায়গা আমরা নিশ্চয়ই খুঁজে পাব।

দাকুকি বিহ্বল হয়ে বসে রইল। সে ভাবছিল, আমিই কি তা হলে পাগল? এতগুলো লোক তো ভুল কথা বলতে পারে না। তারপর সে একটা গাছকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। তার কানে কানে বলল, আমি কুরবাক, তুমি তো জানো। শুকনো বুদ্ধির চেয়ে আমার সজল পাগলামি তোমার ভাল লাগে না?

হঠাৎ ছটি গাছ এক সারিতে এসে দাঁড়াল আর একটি গাছ তাদের সামনে যেন ইমামের মতো প্রার্থনায় মগ্ন হল। ধীরে ধীরে সাতটি গাছ মানুষ হয়ে গেল। তারা সমস্বরে ডাকল, দাকুকি।

-আমার নাম আপনারা জানলেন কী করে?

-যে হৃদয় আল্লাকে খোঁজে, তার কাছে কিছু গোপন থাকে না দাকুকি। আমাদের একটাই হৃদয়। আল্লার হৃদয়। আলাদা করে কোন হৃদয় খুঁজো না দাকুকি। এসো, এবার আমাদের নামাজ পড়াও।

-আমি কিছু জানি না। গাধারও অধম আমি।

-তোমার মতো পবিত্র গাধা সবার চেয়ে ওপরে।

শেখের স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়ল, আমার বেটাদের সঙ্গে কোথায় আমার দেখা হবে, বলুন।

-আরও অপেক্ষা করো বিবিজান।

-দাকুকির কী হল বেটা? শেখের মা জিগ্যেস করে।

-নামাজ পড়তে পড়তে দাকুকির কানে ভেসে আসছিল বহু মানুষের আর্ত চিৎকার। দাকুকি চোখ খুলে দেখল, চাঁদের আলোয় উত্তাল হয়ে উঠেছে সামনের সমুদ্র। ঢেউয়ের ওপর খড়কুটোর মতো উথালপাথাল খাচ্ছে সেই জাহাজ। গ্রামের সব মানুষরা রয়েছে জাহাজে। তারা চিৎকার করছে, বাঁচাও…রহম করো খোদা..আমাদের বাঁচাও..। হঠাৎ জাহাজ দু-ভাগ হয়ে ভেঙে গেল

-সবাই মরে গেল বেটা?

-দাকুকির চোখ থেকে তখন অঝোর ধারায় জল ঝরছে। সে আকাশের দিকে দু-হাত তুলে প্রার্থনা করছিল, খোদা, ওদের বাঁচাও, ওদের অজ্ঞানতাকে ক্ষমা করো, ওদের চোখ খুলে দাও, তোমার জন্নতের পথে নিয়ে চলো।

বলতে বলতে শেখ কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার মা পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করল, মানুষগুলো বেঁচেছিল তো, বেটা?

-হ্যাঁ, সমুদ্র শান্ত হল। ওরা সাতার কাটতে কাটতে তীরে এসে পৌঁছল।

অনেকদিন পর শেখের বউ এক টুকরো রুটি চিবোতে চিবোতে জল খেল।

-তারপর? শেখের মা জিগ্যেস করল।

-সেই সাতজন মানুষ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। খোদার ওপর খোদকারিটা কে করল হে? দাকুকি ছাড়া তো আর কেউ নয়। সঙ্গে সঙ্গে তারা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

দাকুকিও আবার পথে পথে ঘুরতে শুরু করল, তার এতদিনের সাতজন সঙ্গীকে খুঁজে পেতে।

পথ চলতে চলতে একদিন কুয়োর ভিতরে তাকিয়ে পূর্ণচন্দ্রের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল সে। আমন্দে আত্মহারা হয়ে সে গান গাইতে লাগল, নাচতে শুরু করল। হঠৎ মেঘ এসে ঢেকে দিল চাঁদকে। হারিয়ে গেল প্রতিবিম্ব। কুয়োর পাশে অনেকক্ষণ শুয়ে থেকে দাকুকি উঠে বসল। চিৎকার করে বলতে লাগল, আহম্মক! আমি একটা আহম্মক। এখনও প্রতিবিম্ব দেখে ভুলে। যাই। আল্লা তো বাতি ছাড়াও আলো দেন। সাতটা লোককে কেন এখনও খুঁজছি আমি? আর কতদিন বাইরের রূপ আমাকে ভুলিয়ে রাখবে? খোদা একমাত্র তোমাকে স্মরণ করার শক্তি দাও আমাকে।

দস্তানগোর নীরবতা ভেঙে কালু উত্তেজিত হয়ে বলে, তারপর?

-তারপর আবার কী?

-দাকুকির কী হল?

-শেখের বাড়িতে সবাই নিজের নিজের কাজে ফিরে গেল। দাকুকি আবার হাঁটতে শুরু করল।

-দাকুকি এবার কোথায় যাবে?

-কোথায় আবার যাবে? আমার ঝোলায় ছিল, ঝোলাতেই আবার ফিরে এসেছে। বলতে বলতে দস্তানগো তার কাঁধের ঝোলা থেকে একটা কাঠের পুতুল বের করে আনে। দ্যাখো মিঞা, এই হল দাকুকি।

-আর কে কে আছে তোমার ঝোলায় মিঞা?।

-দ্যাখো তবে-এটা কে, চিনতে পারো?

-হুজুর-মির্জাসাব—

-আর একে চিনতে পারো?

-জাঁহাপনা বাহাদুর শাহ।

-এইটে?

কাল্লু লাফিয়ে ওঠে, মান্টোভাই-আপনি-আপনি-আপনিও কাঠপুতলি হয়ে গেছেন?

দস্তানগো তার ঝোলা থেকে একের এক কাঠের পুতুল বের করে মসজিদের চত্বরে সাজিয়ে দিতে থাকে। আমি অবাক হয়ে দেখি, এরা সবাই আমার দোজামা উপন্যাসের চরিত্র। রঙিন পুতুলগুলো আলোয় ঝলমল করতে থাকে। ইতিহাসের ধুলোবালিতে ওরা মলিন হয়ে যায়নি।

হে আমার দোসর পাঠক, এবার মান্টোকে বিদায় দিন। খুদা হাফিজ।

.

তবসুম, মান্টোর উপন্যাস শেষ হওয়ার পর থেকে মিঞা তানসেনের জীবনের একটা আশ্চর্য ঘটনা মনে পড়ছে। মিঞা ছিলেন ভৈরব রাগে সিদ্ধ। শুধু জাঁহাপনা আকবরের ঘুম ভাঙার সময় এই রাগ আলাপ করতেন। জাঁহাপনার কাছে তানসেনের জায়গা ছিল সব উস্তাদের ওপরে। অন্যান্য উস্তাদরা তাই তানসেনকে ঈর্ষা করতেন। একবার তারা যুক্তি করে। তানসেনের জীবননাশের উপায় ভাবলেন। তারা বাদশাকে গিয়ে বললেন, জাঁহাপনা, আমরা কখনও দীপক রাগ শুনিনি। এবার শুনতে চাই। মিঞা তানসেন ছাড়া এই রাগ তো কেউ জানেন না। বাদশা তো আর উস্তাদদের অভিসন্ধি জানেন না। তিনি তানসেনকে বললেন, মিঞা, আমার দীপক রাগ শোনার খুব ইচ্ছে হয়েছে। আপনি শোনাবেন? তানসেন বললেন, জাঁহাপনা ওই রাগ শোনালে আমার মৃত্যু হবে।

-কেন?

-আপনি তা বুঝবেন না।

-একটা রাগ গাইলে কখনও মৃত্যু হতে পারে?

-আমি সত্যি বলছি জাঁহাপনা।

-তা হতে পারে না, মিঞা। আপনি আমাদের দীপক শোনান।

তানসেন অনেক ভেবে পনেরো দিন সময় চাইলেন। তিনি জানতেন রাগের তেজে-সুরের আগুনে-মর্ত্য –গায়কের শরীর পর্যন্ত জ্বলে যায়। তাই সঙ্গে কাউকে সুরের শীতল ধারায় সেই আগুন নেভাতে হবে। তিনি যখন দিপক গাইবেন, তখনই কোনও শিল্পী মেঘ রাগকে আবাহন করবেন। তা হলেই তানসেন বাঁচবেন। এরপর তানসেন পনেরো দিন ধরে তাঁর কন্যা সরস্বতী ও স্বামী হরিদাসের শিষ্যা রূপবতীকে মেঘ রাগ শেখালেন।

নির্দিষ্ট দিনে সকালে তানসেন দরবারে এলেন। সভায় লোকে লোকারণ্য। তানসেন দীপক রাগের যজ্ঞ শুরু করলেন। অন্যদিকে সরস্বতি এবং সরস্বতী এবং রূপবতীও নিজেদের ঘরে মেঘ রাগের যজ্ঞ শুরু করেছে। তানসেন তাদের বলে এসেছিলেন, দীপক রাগের অর্চনা শেষ করে যখনই তিনি গাইতে আরাম্ভ করবেন, সরস্বতী-রূপবতীও যেন মেঘের আলাপ শুরু করে।

যজ্ঞ ও পূজা শেষ হওয়ার পর জাঁহাপনা আকবর দরবারে এলেন। বাদশার অনুমতি নিয়ে তানসেন দীপক রাগ শুরু করলেন। সভার চারদিকে বহু প্রদীপ সাজানো ছিল। তানসেন বলেছিলেন, প্রদীপগুলি জ্বলে ওঠা মাত্র তিনি গান বন্ধ করবেন। আলাপ শুরু করতেই সভার সকলের মনে হল, প্রখর গ্রীষ্মের দিন এসে গেছে। তানসেনও ঘামতে লাগলেন। ধীরে ধীরে তাঁর দুই চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। তারপর তানসেনের শরীর জ্বলতে লাগল, সভার সব প্রদীপ জ্বলে উঠল-আগুন ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। যে যেদিকে পারল সভা ছেড়ে পালাল। অর্ধদগ্ধ তানসেনও নিজের বাড়ির দিকে দৌড়তে লাগলেন।

আর তখনই সরস্বতী ও রূপবতী মেঘের রাগালাপ শুরু করেছে। গানের সঙ্গে সঙ্গে দিল্লির আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেল, ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করল, তারপর শুরু হল অঝোর ধারায় বৃষ্টি। তানসেনের দগ্ধ শরীর শীতল হল।

তবসুম, মান্টোর এই উপন্যাস যেন মিঞা তানসেনের গাওয়া দীপক রাগ। একের পর এক অগ্নিচক্র পেরিয়ে এলাম আমরা। সরস্বতী-রূপবতীরা আজ কোথায়? যারা মেঘ রাগ গেয়ে মির্জা আর মান্টোর দগ্ধ শরীরমন বর্ষাস্নাত করবে? তাদের খুঁজতে আমি নতুন উপন্যাসের দিকে এগিয়ে চলেছি। সেই উপন্যাসে নাম নায়িকা-রহস্য।

.

সহায়ক গ্রন্থ

১. গালিবের গজল থেকে, চয়ন ও পরিচিতিঃ আবু সয়ীদ আইয়ুব, দেজ পাবলিশিং।

২. মীরের গজল থেকে, চয়ন ও পরিচিতিঃ আবু সয়ীদ আইয়ুব, দেজ পাবলিশিং।

৩. হাফিজের কবিতা, অনুবাদ; সুভাষ মুখোপাধ্যায়, আনন্দ।

৪. মির্জা গালিব, সঞ্চারি সেন, উর্বী প্রকাশন

৫. গালিবের স্মৃতি, মৌলানা আলতাফ হুসেন আলি, অনুবাদঃ পুষ্পিত মুখোপাধ্যায়, সাহিত্য আকাদেমি।

৬. গঞ্জে ফেরেশতে, সাদাত হোসেন মান্টো, অনুবাদঃ মোস্তাফা হারুন, প্রতিভাস।

৭. কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত, সারানুবাদঃ রাজশেখর বসু, এম.সি সরকার।

৮. কবির, ক্ষিতিমোহন সেন, আনন্দ।

৯. কবীর, প্রভাকর মাচওয়ে, সাহিত্য আকাদেমি।

১০. কবীর বীজক, রঞ্জন বন্দোপাধ্যায়, সাহিত্য আকাদেমি।

১১. কুট্টনীমত, দামোদর গুপ্ত, সম্পাদনা ও ভাষান্তরঃ চৈতালি দত্ত, নবপত্র প্রকাশন।

১২. রামপ্রসাদী, সম্পাদনাঃ সর্বানন্দ চৌধুরী, সাহিত্য আকাদেমি।

১৩. নিধুবাবুর গান, বিভাব, শীত-বর্ষা সংখ্যা ১৪১৬।

১৪. মধ্যযুগের ভারতীয় শহর, অনিরুদ্ধ রায়, আনন্দ।

১৫. কবিজীবনী, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, ভবতোষ দত্ত সম্পাদিত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি।

১৬. হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে তানসেনের স্থান, বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, থীমা।

১৭.কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড, বিনয় ঘোষ, বাকসাহিত্য।

১৮. কলকাতার রাস্তায় ফিরিওলার ডাক, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, আনন্দ।

১৯. বাংলা ভাষায় আরবী, ফার্সী, তুর্কী, হিন্দি, উর্দু শব্দের অভিধান, সংকলন ও সম্পাদনাঃ কাজী রফিকুল হক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

২০. চলিত ইসলামি শব্দকোষ, মিলন দত্ত, গাঙচিল।

২১. The Oxford India Galib, Ed by Ralph Russel, Oxford University Press (OUP)

২২. Ghalib, Life and Letters, Translated and Ed by Ralph Russel, and Khurshidul Islam, OUP.

২৩. Ghalib, Tha man The Times, Pavan K. Varma. Penguin books.

২৪. Mirza Ghalib, Selected Lyrics and Letters, K. C. Kanda, Sterling Paperbacks.

২৫. Glimpses of Urdu Poetry, K. C. Kanda, Lotus Press.

২৬. Ghalib, Epistemologies of Elegance, Azra Raza and Sara Suleri Goodyear, Penguin Viking.

২৭. A Moral Reckoning, Muslim Intelectuals in 19th Century Delhi, Mushirul Hasan. OUP.

২৮. Private Life of the Mughals of India, R. Nath, Rupa & Co.

২৯. The Penguin 1857 Reader, Ed by Pramod K. Nayar, Penguin Books.

৩০. The Trial of Bahadur Shah Jafar, H. L. O Garret, Roli Books.

৩১. City of Djinns, William Dalrymple, Penguin Books.

৩২. City of Sin and Splendour, Writings on Lahore, Ed by Bapsi Sidhwa, Penguin Books.

৩৩. Manto Nama, Jagdish Chander Wadhawn, Roli Books.

৩৪. Black Margins, Stories of Sadat Hasan Manto, Selected by M. Asaduddin Katha.

৩৫. Bitter Fruit, The very best of Sadat Hasan Manto, Ed and translated by Khalid Hasan, Penguin Books.

৩৬. Naked Voices, Sadat Hasan Manto, translated by Rakhshanda Jalil, Indiaink.

৩৭. Manto, Selected Stories, translated by Aatish Taseer, Random House India.

৩৮. Life and Works of Sadat Hasan Manto, Ed by Alok Bhalla, Indian Institute of Adavanced Studies. Shimla.

৩৯. Lifting the Veil, Ismat Chugtai, Penguin Books.

৪০. Parttion dialogues, Memories of a Lost Home, Alok Bhalla, OUP.

৪১. Tha Long Partition, Vazira Fazila-Yacoobali Zamindar, Penguin Viking.

৪২. Three Mughal Poets, Khursidul Islam and Ralph Russel, OUP.

৪৩. Zikr-i-Mir, translated with introduction by C.M.Naim, OUP.

৪৪. Sufism, Tha Heart of Islam, Sadia Dehlvi, Harper Collins.

৪৫. The Essence of Sufism, John Baldock, Chartwell Books.

৪৬. Tales from the land of the Sufis, Mojdeh Bayat and Mohammad Ali Jamnia, Shambala.

৪৭. The Conference of the Birds, Farid ud-in Attar, Penguin Books.

৪৮. The Way of the Sufi, Idries Shah, Rupa & Co.

৪৯. Pilgrimage to Paradise, Sufi tales from Rumi, Kamla K. Kapur, Penguin Books.

৫০. Couplets from Kabir, G. N. Das Motilal Banarasidass Publishers.

৫১. The Rubaiyat of Omar Khayyam, Peter Avery and John Heath Stubbs, Penguin Books.

৫২. Internet edition of Annual Urdu Studies.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *