৪৪. লাহোরে পৌঁছনোর পর

মেহ্ লাশ-এ বেকফান অসদ খুস্ত জাঁ-কী হৈ;
হক মগিফরৎ করে, অজব আদাজ মর্দ যা।
(এই কফনহীন মৃতদেহ ভগ্নহৃদয় আসাদেরই;
ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করুন, বড়ো স্বাধীনচিত্ত পুরুষ ছিলো।)

লাহোরে পৌঁছনোর পর তিন মাস যেন আমার ভিতরে একটা ঘূর্ণিঝড় চলছিল, মির্জাসাব। কখনও মনে হত বম্বেতেই আছি, কখনও করাচিতে দোস্ত হাসান আব্বাসের বাড়িতে, আবার কখনও মনে হত, লাহোরেই তো আছি। তখন লাহোরের হোটেলে হোটেলে কয়েদ-এ-আজম জিন্নার তহবিলের জন্য নিয়মিত নাচ-গানের আসর বসানো হত। কী করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না; মাথার ভিতরের মরুভূমিতে বালির ঝড়। যেন সিনেমার একটা বিরাট পর্দায় জটপাকানো সব দৃশ্য ভেসে উঠছে। বম্বের বাজার, রাস্তাঘাট দেখতে পাচ্ছি; তার সঙ্গেই মিশে যাচ্ছে করাচির পথের ছোট ছোট ট্রাম আর গাধায় টানা গাড়ি; পরক্ষণেই ভেসে উঠছে লাহোরের কোন উদ্দাম পানশালার ছবি। আমি তাহলে কোথায় আছি? মমির মতো চেয়ারে বসে বসে ভাবনার ঢেউয়ে লুটোপুটি খেতাম। শফিয়া প্রায়ই বলত, এভাবে কতদিন ঘরে বসে থাকবেন মান্টোসাব?

-কোথায় যাব বলো তো?

-একটা চাকরি বাকরির তো ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে সংসারটা চলবে কী করে?

-কে আমাকে চাকরি দেবে শফিয়া?

-ইন্ডাস্ট্রিতে যাওয়া আসা শুরু করলে ইন্ডাস্ট্রি মানে লাহোরের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। শফিয়া তো জানত না, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বলে লাহোরে তখন কিছু নেই বলতে গেলে। অনেক ফিল্ম কোম্পানির নাম শোনা যেত বটে, তাদের ছোটখাটো অফিসও ছিল, কিন্তু বাইরে সাইনবোর্ডের শোভা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

প্রযোজকরা লাখ-লাখ টাকার ছবির কথা বলত, অফিস তৈরি করত, ভাড়া করে অফিসের জন্য আসবাব আনাত, তারপর অফিসের কাছাকাছি ছোট ছোট রেস্তোরার টাকা না মিটিয়েই চম্পট দিত। এরা সবাই এক-একটা জোচ্চোর। যারা নিজেরাই ধার করে জীবন চালায়, তারা দেবে চাকরি? কিন্তু সত্যিই তো আমার কিছু কাজ করা দরকার। বম্বে থেকে যেটুকু টাকা নিয়ে এসেছিলাম, তা ফুরিয়ে এসেছে। শুধু সংসার খরচ নয়, ক্লিফটন বার-এ আমার মদের বিলও মেটাতে হয়েছে। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, আমি লাহোরেই আছি আর এই ছন্নছাড়া। লাহোরেই আমাকে বাকি জীবনটা থেকে যেতে হবে। মোহাজিররা তো বটেই, যারা উদ্বাস্তু নয় তারাও নানা ফিকিরে কোনও দোকান বা কারখানা বানিয়ে নেওয়ার ধান্দায় ব্যস্ত। আমাকেও সবাই বলেছিল, এই সুযোগে কিছু গুছিয়ে নাও। লুঠেরাদের দলে গিয়ে আমি ভিড়তে পারি নি, মির্জাসাব একটা ভুল রাজনীতির জন্য দেশভাগ আর তার সুযোগ নিয়ে একদিন বড়লোক হয়ে যাব আমি? নিজেকে এত দূর নীচে নামানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। চারপাশে এত বিভ্রান্তি আমি আর কখনও দেখিনি। একজন মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে তো আরেকজন হতাশ্বাসে ডুবে গেছে। একজনের বেঁচে থাকার মূল্য অন্যজনের মৃত্যু। যেন এক মৃত্যু উপত্যকায় আমরা বেঁচে আছি। রাস্তার রাস্তার স্লোগান পাকিস্থান জিন্দাবাদ, কয়েদ-ই-আজম জিন্দাবাদ; আর স্লোগানের ভেতরে আমি শুনতে পেতাম গুমরে ওঠা কান্না। শুধু তো মানুষের নয়; গাছেদের, পাখিদের কান্না। যে-সব মোহাজিরের রাস্তা ছাড়া আশ্রয় জোটেনি, তারা বড়-বড় গাছের বাকল খুলে শীতের রাতে আগুন জ্বালাত; নইলে ওরা বাঁচবেই বা কী করে? উনুন। জ্বালানোর জন্যও কত যে গাছ আর গেছের ডাল-পালা কাটা হয়েছিল। লাহোরের পথে পথে শুধু নগ্ন গাছ-গাছেদের কান্না একটু খেয়াল করলেই শোনা যেত। বাড়িগুলো যেন শোকে অন্ধকার হয়ে আছে। মানুষের মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, কেউ তাদের শরীর থেকে রক্ত শুষে নিয়েছে-সবাই যেন কাগজে তৈরি মানুষ।

হয় বাড়িতে একটা কাঠের পুতুলের মতো চেয়ারে বসে থাকতাম, না হলে ভবঘুরের মতো লাহোরের পথে পথে ঘুরে বেড়াতাম। মানুষের মুখ চোখের হাবভাব দেখতাম, কথাবার্তা শুনতাম, হ্যাঁ মন দিয়ে শুনতাম, তারা কী পেয়েছে, কী পায়নি, স্বপ্নগুলো কীভাবে চুরমার হয়ে গেছে, এমনকী আলতু ফালতু কথাও গোগ্রাসে গিলতাম। হাঁটতে হাঁটতে, মানুষের কথা শুনতে শুনতে আমার মাথায় জমে থাকা ধোঁয়াশা কেটে যাচ্ছিল। রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো কথারা, তাদের গায়ে জড়িয়ে থাকা উত্তাপ, দীর্ঘশ্বাস শুকিয়ে যাওয়া কান্না আমার ভিতরে ঢুকে পড়ছিল; বাড়িতে ফিরে যখন চুপচাপ বসে থাকতাম, তখন কথাগুলো বেরিয়ে আসতে চাইত, মনে হত, আমার প্রতিটি রোমকূপ যেন ফেটে যাবে-ওরা-কথারা বেরিয়ে আসতে চাইছে ক্ষোভে-ঘৃণায় দুঃখে; রাস্তায় হারিয়ে যাওয়া কথারা তো কারও না কারও কাছে পৌঁছতে চায়, মির্জাসাব। তারা যেন আমাকে খুঁজে পেয়েছে-আমার ভিতরেই কথারা মেলে ধরতে চায় তাদের উদ্বাস্তু জীবন।

আমি আস্তে আস্তে লিখতে শুরু করলাম। এছাড়া তো করারও ছিল না। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নেই। তাদের জন্য গল্প লিখে রোজগার করব। তাই কাগজে পত্রিকায় লিখেই যেটুকু পাওয়া যায়। আমি সারাদিনের জন্য একটা টাঙ্গা ভাড়া করে বেরিয়ে পড়তাম। গল্পের ফিরিওয়ালা বলতে। পারেন। কাগজের অফিসের সামনে টাঙ্গা দাঁড় করিয়ে রেখে ভিতরে গিয়ে গল্প লিখতে বসে যেতাম। গরামাগরম গল্প নাও, হাতে-হাতে টাকা দাও। তারপর চলো আরেক পত্রিকার। দফতরে। এরা চায় আমার ব্যঙ্গরচনা; বসে গেলাম লিখতে। টাকা পকেটে খুঁজে টাঙ্গায় চেপে আবার ছুট। টাকা পয়সা কোন দিনই গুনিনি; ও সব আমার ধাতে ছিল না। মোটামুটি রোজগার হলেই প্রথমেই চাই মদ, তারপরের সংসারের জন্য খরচ।

লাহোরে এসে আমার মদ্যপান অসম্ভব বেড়ে গেল, মির্জাসাব। চারপাশে বন্ধুবান্ধব কেউ নেই, সামনের দিনগুলো একেবারে অন্ধকার, আমি মরে গেলে বিবি-বাচ্চারা একেবারেই পথে গিয়ে বসবে-মাঝে মাঝেই ওই এক ঘোর-আমি তো বম্বেতেই আছি-ভেবেছিলাম, পাকিস্থান আমাকে লেখক হিসেবে মর্যাদা দেবে, আমি তো নিজের দেশ মনে করেই এখানে এসেছি, কিন্তু কিছুদিন পরেই বুঝতে পারলাম, আমাকে ওরা রাস্তার কুকুর ছাড়া আর কিছুই মনে করে না। সবসময় নেশার ঘোরের মধ্যেই থাকতে ইচ্ছে করত, যেন কুয়শাচ্ছন্ন এক টিলায় একা একাই বসে আছি। লিখে রোজগার করার জন্য যেটুকু সময় জেগে থাকা, তা ছাড়া নেশার ঘুমঘোরে ডুবে থাকার মত শান্তি আর কিছুতেই নেই। সেই ঘোরের ভিতরে কত যে মানুষ এসে হানা দিত-ছায়া ছায়া, অস্পষ্ট তাদের চেহারা-আমি যেন একটা ভুতে পাওয়া বাড়ির মতো বেঁচে আছি। ছায়া মানুষগুলোর সঙ্গে আমি অনর্গল কথা বলে যেতাম। শফিয়া এসে আমাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ঘোর ভেস্তে দিত। ঘোর কেটে যেতেই শরীর তার নিজের নিয়মে মদের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠত। আমার উন্মাদনা আরও বেড়ে যেত। নেশার এই চক্র থেকে বের করে আনার জন্য শফিয়া তো কম চেষ্টা করেনি। আমি ততই নতুন ফন্দি-ফিকির বার করে ঘোরের জগতে ঢুকে পড়তাম। কয়েকজন স্যাঙাত জুটেছিল; আমি জানতাম, লেখক মান্টোকে ওরা চেনে না-জানে না; আমরা শুধু এক গ্লাসের ইয়ার; হাতে পয়সা না থাকলে ওরাই তো আমাকে বাঁচাত, তাই ওদের ছাড়ব কী করে বলুন? মদ খেতে খেতে শরীর-মনের এমন একটা অবস্থা, কেউ ভাল। কথা বলতে এলেও আমি ক্ষেপে উঠতাম। আহমদ নাদিম কাসিমি কতবার আমাকে বুঝিয়েছে; কিছুদিন চুপ করে শুনেছিলাম, তারপর একদিন ক্ষিপ্ত হয়ে বলেই ফেললাম, কাসিমি তুমি আমার দোস্ত। মসজিদের মোল্লা নও যে আমার চরিত্র দেখভাল করার ভার তোমার উপর দেওয়া হয়েছে। কাসিমি এর পর থেকে আর কিছু বলেনি। লাহোরের পুরনো যে দু-একজন বন্ধু ছিল, তারাও দূরে সরে যেতে থাকল। আত্মীয়রাও কেউ আর কথা বলত না। সবাই আমাকে দেখে পালায়। আরে ওই যে মান্টো-পালাও, পালাও-শালা আবার টাকা ধার চাইবে। হ্যাঁ, এতটাই নীচে নেমে গিয়েছিলাম আমি। লিখে আর কটা টাকা রোজগার হত বলুন? রোজ নেশা করার জন্য তো টাকা চাই। হাতের কাছে যাকেই পেতাম, তার কাছেই ধার চাইতাম। কখনও শফিয়ার শরীর খারাপ, কখনও মেয়েরা অসুস্থ-এইসব মিথ্যা কথা বলে। মির্জাসাব নেশা যে আমাকে কোন অতল সুড়ঙ্গের ভিতরে নিয়ে চলেছে, বুঝতে পারতাম, কিন্তু সেই অন্ধ প্রবৃত্তি তখন আমার হাতের বাইরে চলে গেছে। পেটে মদ না পড়লে স্থির থাকতে পারি না, হাত-পা-কাঁপে, মেজাজ আরও তিরিক্ষে হয়ে যায়।

সবচেয়ে নোংরা কাজটা করে বসলাম বড় মেয়ে নিঘাতের টাইফয়েডের সময়। ওর ওষুধ কেনার জন্য এক আত্মীয়ের কাছ থেকে টাকা ধার করে মেয়ের ওষুধের বদলে হুইস্কির বোতল নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। রোজ এত চিৎকার চেঁচামেচি করে, কিন্তু শফিয়া সেদিন আর একটাও কথা বলল না। অনেকক্ষণ আমার দিকে শূণ্য চোখে তাকিয়ে রইল, তারপর একগ্লাস জল রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে নিঘাতের জ্বরে আছন্ন গোঙ্গানি। জল না মিশিয়ে কিছুটা খেতেই বমি করে ফেললাম। পাশের ঘরে গিয়ে দেখি নিঘাতের মাথার কাছে বসে ওর কপালে জলপট্টি দিচ্ছে শফিয়া। আমি শফিয়ার পা জড়িয়ে ধরে বললাম, আমাকে ক্ষমা করো।

-ওর খুব জ্বর। আপনি ও ঘরে যান মান্টোসাব।

-না, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। নিঘাতের কসম, আমি আর মদ ছোব না।

-আর কত কসম খাবেন আপনি মান্টোসাব?

-বিশ্বাস করো-এবার সত্যিই- আবার সব নতুন করে শুরু করব শফিয়া।

শান্ত গলায় শফিয়া বলল, আমার যে দম ফুরিয়ে গেছে মান্টোসাব।

-শফিয়া, শেষ বার আমাকে বিশ্বাস করো। তুমি তো আমার মনের জোর জানো। চেষ্টা করলে আমি সব পারি।

শফিয়া হাসে, ঠিক আছে। আপনি এবার শুয়ে পড়ুন গিয়ে।

আমি নিঘাতের পাশে গিয়ে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। ওকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছিল। আমি মরমে মরে যাচ্ছিলাম, এ কীরকম পিতা আমি, মেয়ের ওষুধের টাকায় মদ কিনে আনি। নিঘাত, বেটি, আমাকে ক্ষমা করো। আমি ওকে কোলে তুলে নিতে চাইছিলাম, কিন্তু সেই শক্তি তখন আমার শরীরে নেই। শফিয়া এক সময় চিৎকার করতে করতে আমার হাত ধরে টানতে শুরু করল, যা করেছেন তো করেছেনই। এবার মেয়েটাকে শান্তিতে থাকেত দিন, মান্টোসাব।

-না, আজ রাতে আমি ওর পাশে থাকব।

-আপনি এইরকম করলে নিঘাত আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে।

-ও আমার মেয়ে-আমি ওর পাশে—

-দয়া করুন মান্টোসাব। আমরা আপনার খেলার পুতুল নই। কী ভাবেন নিজেকে? তার চেয়ে নিজের হাতে আমাদের চারজনকে খুন করে ফেলুন।

চিৎকার-চেঁচামেচিতে কারা যেন ঘরে এসে ঢুকেছিল। হামিদের বিবি শুধু বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলল, বহুৎ হো গিয়া চাচাজি। ইয়ে দারুখানা নেহি হ্যায়। আপনি ও ঘরে যান।

জীবনে প্রথম কেউ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে এভাবে কথা বলতে পারল, মির্জাসাব। আমি কোনও উত্তর দিতে পারলাম না। একটা শামুকের মতো খোলায় গুটিয়ে গিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। উত্তর দেবার মতো মনের জোরই আমার ছিল না। অপমান নয়, নিজের ওপর ঘৃণাও নয়, মনে হচ্ছিল, আমার আর কোনও অবলম্বন নেই। আমাকে আঘাত করার অস্ত্র আমিই অন্যদের হাতে তুলে দিয়েছি। ঠিক করলাম, এবার সত্যিই মদ নয়; বম্বেতে যেমন সাজিয়ে গুছিয়ে সংসার করতাম, লাহোরেও আবার তা নতুন করে শুরু করতে হবে।

পরদিন সকাল থেকেই ঘরের কাজে লেগে গেলাম। প্রত্যেকটা ঘর নিজের হাতে ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করলাম, দেওয়ালের-আসবাবপত্রের ঝুল ঝাড়লাম। একটা চেয়ারের পায়া ভেঙে গিয়েছিল, বসে বসে সেটার মেরামতি করলাম। পুরনো কাগজপত্র, জমে ওঠা মদের বোতল বিক্রি করে দিলাম। বাচ্চাদের জন্য বারান্দায় টানিয়ে দিলাম দোলনা। বাজার থেকে বড় খাঁচাভর্তি এক ঝাঁক রংবেরংয়ের পাখি কিনে নিয়ে এলাম। নজত আর নসরত-নিঘাতের পরের দুই মেয়ে আমার-এসে জড়িয়ে ধরল আমাকে। তারার মতো জ্বলজ্বল করছিল ওদের চোখ। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম, মির্জাসাব; দুটো ছোট ছোট মেয়ে কত ছোট কিছু পেয়েই খুশি হয়ে ওঠে, নেশার ঘোরে ডুবে থেকে আমি দেখতেই পাইনি।

শফিয়া এসে গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল, এ আবার নতুন কী পাগলামি মান্টোসাব?

-পাখি ছাড়া সংসার সুন্দর হয় না শফিয়া।

-কোন সংসারের কথা বলছেন,মান্টোসাব?

-কেন, আমাদের-আমাদের ছাড়া আর কোন সংসার আমি সাজাতে যাব শফিয়া?

-আবার সাজাবেন? নতুন করে ভাঙার জন্য?

শফিয়ার হাত চেপে ধরে বললাম, আমাকে এই শেষবার বিশ্বাস করো শফিয়া। আর আমাকে একটু সাহায্য করো। আমি সব নতুন করে সাজিয়ে তুলব।

-মান্টোসাব, শুধু আপনার ওপর বিশ্বাস নিয়েই আমি এতদিন বেঁচে আছি। নইলে কবেই খুদকুশি করতাম।

-ছিঃ শফিয়া, তোমার তিনটে মেয়ে আছে ভুলে যেও না।

-তারা আপনার মেয়ে নয়?

-আমাকে বিশ্বাস করো শফিয়া। দুঃস্বপ্নের দিনগুলো আর ফিরে আসবে না। কয়েকটা দিন একেবারে নতুন জীবন। মদ না খাওয়ার জন্য শরীর খুব দুর্বল লাগত, তার জন্য এল ভিটামিন ট্যাবলেট, টনিক। শধু আমার সংসারই নয়, চারপাশের আত্মীয় পরিজনরা মিলে যেন একটা উৎসব শুরু হয়ে গেল। মান্টো মদ ছেড়ে দিয়েছে-এর চেয়ে সুখবর তাদের কাছে আর কিছুই হতে পারে না। তবে পুরোপুরি কেউই বিশ্বাস করে উঠতে পারত না। আগেও তো কতবার এরকম হয়েছে। এবারও একইভাবে সকলের বিশ্বাস ভেঙে দিল মান্টো। দিন কয়েক পরেই। ইয়ারদের সঙ্গে জুটে গেল সে। আবার বোতল এল বাড়িতে। আমি বুঝতে পারছিলাম, মদের ওপর আমার নির্ভরতা চরম সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে। যে কদিন মদ খেতাম না, একটা শব্দও লিখতে পারতাম না। না-লিখলে সংসার খরচের টাকা আসবে কোথা থেকে? বাঁচি বা মরি, মদই আমার শেষ আশ্রয় হয়ে গেল মির্জাসাব।

অনেক আশা নিয়ে তো আমি পাকিস্থানে এসেছিলাম। সেই আশার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল অনেক প্রশ্নও। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্থানের সাহিত্য কী আলাদা হবে? যদি হয়, তবে তার রূপ কেমন। হবে? অবিভক্ত ভারতে যে সাহিত্য রচিত হয়েছে, কারা তার যথার্থ অধিকারী? সেই সাহিত্যও কি দুভাগ হয়ে যাবে? ওপারে কি উর্দুকে একাবারে ধ্বংস করে দেওয়া হবে? পাকিস্থানেই বা উর্দু ভাষা কী চেহারা নেবে? আমাদের রাস্ট্র কি ইসলামি রাস্ট্র হবে? রাস্ট্রের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেও আমরা সরকারকে সমালচনা করতে পারব? ইংরেজ শাসনে যে অবস্থায় আমরা ছিলাম, তার চেয়ে কি ভালভাবে থাকতে পারব? এসব প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাইনি, মির্জাসাব। গল্প ফিরি করে যে সংসার চালায়, এত বড় বড় প্রশ্ন নিয়ে ভাবার সময় কোথায় তার? তার ওপর পাকিস্থান সরকার তো সব সময় আমার পিছনে লেগেই ছিল। ঠাণ্ডা গোস্ত আর উপর, নিচ অওর দরমিয়াঁ গল্পের জন্য অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা, জরিমানা। পাকিস্থানের বহু। লেখক বুদ্ধিজীবী চাইছিল, আমাকে জেলে ভরে খুব এক চোট শিক্ষা দেওয়া হোক। প্রায়ই আদালতে হাজিরা দেওয়া, জেরার পর জেরা-এত মানসিক চাপ আমি আর বইতে পারছিলাম না মির্জাসাব। মদ খেলেও কষ্ট, না-খেলেও কষ্ট। ডাক্তার বলে দিয়েছে, আমার লিভার শেষ হতে বসেছে-মাথাও আর ঠিকঠাক কাজ করে না-একমাত্র আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও পথ আমার সামনে খোলা ছিল না। তবু কতবার যে মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি! তখন আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছি। একবার শফিয়া বলল, মান্টোসাব আপনি সত্যিই মদ খাওয়া ছেড়ে দিতে চান?

-শফিয়া, এর চেয়ে বড় মুক্তি আমার জীবনে নেই।

-তা হলে আমার কথা শুনবেন!

-বলো।

-কিছুদিন চিকিৎসা প্রয়োজন আপনার।

-কোথায়?

-পাঞ্জাব মেন্টাল হসপিটালের অ্যালকোহলিক ওয়ার্ডে ভর্তি হতে হবে আপনাকে। ওরা ঠিক আপনাকে সারিয়ে তুলবে। আর মদ খেতে ইচ্ছে করবে না।

-ঠিক বলছ?

-অনেকে সুস্থ হয়ে গেছে মান্টোসাব।

-ঠিক হ্যায়। আমি ভর্তি হব। হামিদকে ডাক।

হামিদ এলে ওকে বললাম, আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করো হামিদ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

পরদিন হামিদ সব ব্যবস্থা করে ফেলল। ওরা যখন হাসপাতালে নিয়ে যাবে, তার কিছু আগে অবশ্য আমাকে পালাতে হয়েছিল। শুনেছিলাম, হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্টের ফি নাকি বত্রিশ টাকা। টাকাটা তো জোগাড় করতে হবে। হাসপাতাল থেকে ফিরে লেখা দিয়ে ধার মিটিয়ে দেব বলে দু-একটা পত্রিকা থেকে টাকা পাওয়া গেল। আরও দুয়েকজনের কাছে ধার করে টাকা নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম। ওরা ভেবেছিল, আমি হাসপাতালে ভর্তি হব না বলে পালিয়ে গেছি। হাসপাতালে ভর্তিও হলাম। প্রথম কয়েকটা দিন খুব কষ্ট পেয়েছি। শরীরের ভিতরে একটা দৈত্য নড়েচড়ে উঠত, তার খাবারের জন্য। ছয় সপ্তাহ পরে এক অন্য মান্টো বেরিয়ে এল হাসপাতাল থেকে। শরীর ভেঙে গেছে ঠিকই, তবু যেন পুরনো জেল্লা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বাস করুন, ভাইজানেরা, এর পর আট মাস মদ খাইনি। একের পর এক গল্প ছাড়াও কতরকম লেখা লিখেছি।

একদিন শফিয়াকে বললাম, আমি তো ভাল হয়ে গেছি। চলো এবার পাকিস্থান ছেড়ে চলে যাই।

-কোথায় যাবেন, মান্টোসাব?

-বম্বে।

-বম্বের কথা ভুলতে পারেন না?

-বম্বে আমার দ্বিতীয় জন্মস্থান শফিয়া।

-কে আপনাকে চাকরি দেবে বম্বেতে?

ইসমতকে চিঠি লিখি-ও নিশ্চয় একটা ব্যবস্থা করবে।

ইসমত বহিন আপনার কোনও খোজ নেয় না, মান্টোসাব।

-ও একটা পাগলি। আমি বম্বে ফিরতে চাইলে ও ঠিক সাড়া দেবে। তুমি যেতে রাজি তো?

-আপনি যেখানে যাবেন, আমি সেখানেই যাব।

-ইসমতকে সঙ্গে সঙ্গে চিঠি লিখে ফেললাম।-আমি বম্বেতে ফিরতে চাই। ভারতেই থাকতে চাই। কিছু একটা ব্যবস্থা করো ইসমত। যাতে আমরা সবাই যেতে পারি। আমি এখন একেবারে সুস্থ। কোনও স্টুডিওতে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলে আমরা সবাই একসঙ্গে জীবন কাটাতে পারব।

এরও দু-তিনবার ইসমতকে চিঠি লিখেছিলাম। ও কোনো উত্তর দেয় নি। ইসমত কি তা হলে শেষ জীবন পর্যন্ত মনে করত, আমি বিশ্বাসঘাতক, নিজের আখের গোছানোর জন্য পাকিস্থানে চলে গেছি? বা ও হয়তো জেনে গিয়েছিল, মদ আমাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিয়েছে, আমার ফেরার আর কোন পথ নেই। কিন্তু আমি ওর চিঠির জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করে গেছি। আমার মদ খাওয়ার মাত্রাও তত বেড়ে গেছে। নেশার ঘোরের ভিতরে আমার গল্পের চরিত্রের সঙ্গে কথা বলে কেটে যায় দিনের পর দিন।

হ্যাঁ, আমি মরছিলাম, মির্জাসাব, সচেতনভাবেই একটু একটু করে মরছিলাম। গলায় দড়ি দিয়ে, বিষ খেয়ে বা হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করার মতো সাহস আমার ছিল না। নিজেকে, শফিয়াকে, তিন মেয়েকে-আমি পাগলের মতো ভালবাসতাম। তাই শরীরে ধীরে। বিষক্রিয়া চালিয়ে আমি মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছিলাম। যে দেশ আমাকে শুধু অপমান আর। ধিক্কার দিয়েছে, সেখানে বেঁচে ইচ্ছে আমার ছিল না। আর আমি বুঝতে পারছিলাম, দিনে দিনে পরিবারের কাছেও আমি বোঝা হয়ে উঠছি। ঘৃণা নয়, অনুকম্পাও নয়, ওরা তখন আমাকে। মানুষ বলেই মনে করে না।

একদিন রাতে ঘুমের ঘোরে শুনতে পেলাম, কে যেন ফিসফিস করে ডাকছে, মান্টোভাই মান্টোভাই-।

তাকিয়ে দেখি আমার মাথার পাশে বসে আছে ইসমত। কড়মড় করে আইসক্রিম খাচ্ছে আর হাসছে।

-ইসমত বহিন,তুমি কখন এলে?

-অনেকক্ষণ-কখন থেকে ডাকছি।

-শহিদ কোথায়? শহিদ আসেনি?

-এসেছে তো। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।

-কেন?

-তুমি বম্বে যাবে।

-বম্বে! আমি লাফিয়ে উঠলাম।-আমার চাকরি পাকা করে এসেছ তো?

-আলবৎ?

-শফিয়া-শফিয়া-। আমি চিৎকার করে উঠলাম।-তাড়াতাড়ি এসো শফিয়া। আমি তোমাকে বলেছিলাম না, আমার চিঠি পেলে ইসমত চুপ করে বসে থাকতে পারবে না।

শফিয়া এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল।-কী হয়েছে, মান্টোসাব? কোনও খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন?

ইসমতকে নাস্তা-পানি দাও। শহিদ কোথায়-ডাকো ওকে—

ইসমত কোথায়, মান্টোসাব?

-এই তো-এই তো ইসমত-কোথায় গেল ইসমত? ও নিশ্চয়ই তোমার ঘরে গিয়ে লুকিয়েছে শফিয়া।

শফিয়া ওর বুকের ভিতরে আমাকে শিশুর মতো আঁকড়ে ধরে। আমার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বিছানায় শুইয়ে দেয়।-ঘুমিয়ে পড়ুন মান্টোসাব, ঘুমিয়ে পড়ুন। আমার সারা শরীরে তার আঙুলগুলি পালকের মতো খেলতে থাকে।

ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল। কবেকার শোনা একটা পাঞ্জাবি লোকগানের সুর যে কোথা থেকে ভেসে আসছিল। দেখলাম শফিয়া আমার পায়ের কাছেই ঘুমিয়ে রয়েছে। যেন এই ভোরেই সদ্য জন্ম হয়েছে শফিয়ার এমনই দীপ্তিময় হয়ে আছে তার মুখ। সেই মুখে দেশভাগের ছায়া নেই, দাঙ্গার রক্তের ছিটে লাগেনি। পাহাড়ি ছবিতে আঁকা ঘুমন্ত নায়িকা সে, তাকে ঘিরে জন্ম নিচ্ছে নতুন পৃথিবী। আকাশ, জল, বাতাস, মেঘ, উড়ন্ত সারসদল, হরিণ হরিণী-আমার ঘর যেন হয়ে উঠেছে এক উৎসব।

হঠাৎ পেট মুচরে বমির দমক উঠে এল। বাথরুমের বেসিনে নীলচে-হলুদ জলের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল রক্ত। তারপর শুধু রক্ত আর রক্ত। মুখ ধুয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম, মির্জাসাব। এ কে? সাদাত হাসান মান্টো? না, স্বয়ং মৃত্যু? আমি তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললাম, এবারের মতো জিতে গেলে মান্টো। শুধু আর কয়েকটা দিন দাঁতে দাঁত চিপে পড়ে থাকো।

1 Comment
Collapse Comments

Marvelous

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *