হর কদম দূরী-এ মঞ্জিল হৈ
নুমায়াঁ মুঝসে,
মেরী রফ্তার-সে ভাগে হই বয়াবাঁ মুঝ সে।।
(প্রতি পদক্ষেপে গন্তব্যে সুদূরতা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে,
আমার চলাকে পিছনে ফেলে জনশূন্য বনভূমি এগিয়ে চলে আরও জোরে।)।
কেয়া বাত মির্জাসাব, একেবারে নরক গুলজার করে দিলেন। কিন্তু বেনজির ও বদর-ই মুনিরদের গল্পরা সব কোথায় হারিয়ে গেল বলুন তো? দেখছেন, আমাদের ভাইজানেরা একসাথে কেমন সব চনমনে হয়ে উঠেছেন, যেন আজিজের হোটেলে আমাদের টেবিলে প্লেটে প্লেটে শাহি কাবাব এল, এবারই তো জমবে মজা, কাবাবে-গাঁজায়, রঙ্গরসিকতায়। সেই সময় আমাদের ক্যাপ্টেন ওয়াহিদ যেন কোন একটা মেয়ের পেছনে পড়ে গিয়েছিল, ভাল কথা, কিন্তু একটা মেয়ের জন্য সব সময় দিবানা ভাব করে বসে থাকার কোনও মানে আছে, মির্জাসাব?। ক্যাপ্টেনের সব সময় ভয়, মেয়েটা যদি অন্য কারও সঙ্গে ভেগে যায়। আরে যায় তো যাবে, দুনিয়ায় মাগী কি কম আছে? মাফ করবেন মির্জাসাব, কখন যে মুখ ফসকে কোন শব্দ বেরিয়ে যায়। এই রকম বেফাঁস শব্দ বেরিয়ে পড়লেই, ইসমত সামনে থাকলে চোখ বড় বড় করে তাকাত, ইসমতই ছিল সেই মেয়ে, যে আমার পাঞ্জাবি ঝাঁকিয়ে বলতে পারত, আরে শালা, মাগী কাকে বলছিস রে? তুই কোন মাগীর পেট থেকে পড়েছিস? এ সব অবশ্য কখনও বলেনি। ইসমতের আখলাকির তো তুলনা ছিল না, শুধু ওই চোখ বড় বড় করে তাকানো, তাতেই যা বোঝার বুঝে নাও। যাকগে, ইসমতের কথা বাদ দিন, এরা আবার সবাই আজিজের জাহান্নামের কিস্স শোনার জন্য চুলবুল করছে দেখতে পাচ্ছেন তো?
তো, একদিন আমাদের ক্যাপ্টেন ঝড়ে ভাঙা লতার মতো টেবিলে এলিয়ে পড়ে আছে, কয়েক দিন ধরে নাকি মেয়েটার সাথে দেখা হচ্ছে না। কত চাঙ্গা করার চেষ্টা করি, তবু সে শালা কেন্নোর মত গুটিয়ে পড়ে থাকে, হাসি-মস্করা-খিস্তি কিছুই তাকে ছুঁতে পারে না। এ কোন মজনু রে বাবা, অথচ নাম দেখো, ক্যাপ্টেন ওয়াহিদ। অনেক চেষ্টার পর কাঁদো কাঁদো মুখে জিজ্ঞাসা করল, সাদাতভাই, মেয়েরা কেমন হয় গো?
-মানে?
-ওরা কি ভালবাসতে জানে?
-তার আমি কী জানি? আমার মেজাজ চরে গেল।
-আরে ইয়ার বলই না। আশিক আমার পিঠে চাপড় মেরে বলল, তোমার সেই বেড়ালের গপ্পোটা ক্যাপ্টেন কে বলে দাও। তাহলে আর সারা জীবন একটা মেয়ের পিছনেই ল্যাং ল্যাং করবে না।
আশিকের কথায় আমাদের টেবিলে হাসির হল্লা উঠল। ক্যাপ্টেন ছলোছলো চোখে বলল, আমি তো মেয়েদের কথা জিজ্ঞেস করেছি। বেড়ালের কথা আসছে কোথা থেকে?
-মান্টোর কাছেই শোনা। আশিক আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মারে। মানে, বলো, তাড়াতাড়ি বলো। শালা ক্যাপ্টেনের আশনাই-এর ঝাড়ে বাঁশ যাক। আশিক ছিল সবার পেছনে লাগতে ওস্তাদ।
ক্যাপ্টেনের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বললাম, দ্যাখো ক্যাপ্টেন, আল্লার কসম খেয়ে বলছি বেড়াল আর মেয়েদের আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না।
-কেন? বেড়াল তো বেড়াল আর মেয়েতো মেয়েই। না-বোঝার কী আছে এতে?
-আমাদের বাড়িতে একটা বেড়াল ছিল, বুঝলে। বছরে একবার করে সে যে কী কান্না জুড়ে দিত, কী বলব ভাই। বেড়ালের কান্না শুনেছ তো? মনে হয় যেন পৃথিবীটাই কারবালা হয়ে গেছে। তার কান্না শুনে কোথা থেকে হাজির হত এক হুলো। তার পর দুজনের ঝগড়া, মারামারি, রক্তারক্তি পর্যন্ত হয়ে যেত।
-তারপর?
-তারপর আবার কী? বেড়াল এরপর চারটে বাচ্চার মা হয়ে যেত। এত কান্না, মারামারির নিট ফল ওই চারটে বাচ্চা।
-তুমি শালা একটা হারামির বাচ্চা। বলতে বলতে ক্যাপ্টেন আবার টেবিলের ওপর এলিয়ে পড়ল। আজিজের হোটেল তখন হাসি-সিটিতে ফেটে পড়ছে।
কিন্তু মির্জাসাব, যতই এই সব টিকরমবাজি করি না কেন, আমার আর ভালো লাগছিল না। জুয়া খেলতে খেলতে যেমন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম আজিজের হোটেলের সকাল-সন্ধেগুলোও আমাকে আর কিছু দিতে পারছিল না। কী মনে হত জানেন? আমার তো আসলে অন্য কিছু করার কথা। কিন্তু কী করব? আমি বুঝতে পারতাম না মির্জাসাব। একদিন হঠাৎই ঘড়ির পেন্ডুলামটা উল্টোদিকে ঘুড়ে গেল। জীবন হয়ত এভাবে না চাইতেই আমাদের অনেক কিছু দেয়, যদি অবশ্য নেওয়ার মতো ক্ষনতা থাকে।
আজিজের হোটেলেই আমার নসিব অন্য দিকে মোড় নিল, ভাইজানেরা। আলাপ হল বারি আলিগ ও আতা মহম্মদ চিহাতির সঙ্গে। আমার চেয়ে বয়েসে বড় ছিলেন এঁরা। মাঝে মাঝে আজিজের ওখানে চা খেতে আসতেন। আবদুল রহমান সাহেব তখন মাসাওয়াৎ নামে একটা কাগজ শুরু করেছেন, বারিসাহেব সেই কাগজেই কাজ করেন। একদিন আজিজের হোটেলে। বারি আলিগ সাবের সঙ্গে এক টেবিলে বসে ছিলাম। আরও অনেকেই ছিল। হঠাৎ কী প্রসঙ্গে যেন মৃত্যুদণ্ড নিয়ে কথা উঠল। মৃত্যুদণ্ড ঠিক, না ভুল? একজন অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার অধিকার কী কারও আছে? আমি বারিসাবকে অনুরোধ করলাম, স্যর, আপনি এ-ব্যাপারে। আমাদের একটু বুঝিয়ে বলুন। আমি যদি আপনাকে খুন করি, তা হলে কেন আমাকে হত্যা করা যাবে না? অনেক যুক্তি তর্ক দিয়ে তিনি বোঝালেন, হত্যার বদলে হত্যা কোনও পথ হতে পারে না। শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ডের কোনও নৈতিক ভিত্তি নেই। আর এই সব কথার মধ্যেই এসে পড়ল ভিক্টর উগোর দ্য লাস্ট ডেজ অফ দ্য কনডেমড বইয়ের কথা। ভিক্টর উগোর নাম আপনার শোনার কথা নয়, মির্জাসাব। ফ্রান্সের একজন সেরা কবি, ঔপন্যাসিক ছিলেন ভিক্টর উগো। আমি তো চমকে উঠলাম। আরে, বইটাতো আমার বাড়িতে আছে। সঙ্গে সঙ্গে বারিসাবকে বললাম, বইটা আমার কাছে আছে। আপনি কি আর একবার পড়তে চান?
বারিসাব অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কী দেখছিলেন, কে জানে! তারপর বললেন, কাল বইটা নিয়ে আমার অফিসে এসো।
সেদিন সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি, মির্জাসাব। কেমন গর্ব হচ্ছিল। উগোর যে-বইয়ের কথা বারিসাব বলেছেন, বইটা আমার কাছেই আছে আর কাল আমি আমি বইটা ওনাকে দিতে পারব। আচ্ছা, বই তো না হয় দেব, কিন্তু তারপর কী কথা বলব অমন মানুষের সঙ্গে? তিনি কি আমার সঙ্গে কথা বলবেন? ভাবতে ভাবতে আমাদের দুজনের কত সংলাপই যে তৈরি করে ফেললাম। গল্পও তো এভাবেই আমার ভেতরে জন্ম নিত, মির্জাসাব। এক একটা মুখ ভেসে উঠত, আর তাদের কথাগুলো আমি বুনে যেতাম। কথা বলতেই চরিত্রগুলো আমার সামনে ফুটে উঠত।
বারিসাব আমাকে একেবারে আপন করে নিলেন। আমি রোজ পত্রিকার অফিসে যাতায়াত শুরু করলাম। তাঁর কথায়, পাণ্ডিত্যে, রসবোধে আমি একেবারে মজে গেলাম। বারিসাবের কথা পরে আমি গঞ্জে ফেরেস্তে বইতে লিখেছিলাম। অমন একটা মানুষকে তো সারা জীবনেও ভোলা যায় না। একই সঙ্গে বড় ভীরুও ছিলেন মানুষটা। কিন্তু তাঁর কথা আর হাসির সামনে একবার পড়লে, জমে যেতে হত। আমার ভেতরের অস্থিরতা বুঝতে পারতেন বারিসাব। আমাকে উর্দু সাহিত্য পড়তে বললেন। তাঁরই কথায় আমি গোর্কি, গোগোল, পুশকিন, চেখভ, অস্কার ওয়াইল্ডের লেখা পড়তে শুরু করলাম। এঁরা সব দুনিয়ার বড় বড় লেখক। মির্জাসাব, এঁদের লেখা পড়তে পড়তেই আমি যেন আমার সামনের পথটাকে দেখতে পেলাম-আমিও লিখব, লেখাই আমার একমাত্র কাজ হতে পারে। একবার বারিসাব কী করলেন জানেন? আমাকে দিয়ে উগোর দ্য লাস্ট ডেজ অফ দ্য কনডেমড উর্দুতে অনুবাদ করালেন। দুসপ্তাহ টানা লেগে থাকলাম, এক ফোঁটা মদ ছুঁইনি। তারপর লাহোরের উর্দু বুকস্টল থেকে অনুবাদের বইও বেরিয়ে গেল-আসির কিয়ে শরগুজস্ত। আমায় দেখে কে? শালা, ফালতু নাকি? এই দ্যাখ, দ্যাখ শালারা, সাদাত হাসান মান্টোর নামে ছাপা বই।
মাসাওয়াৎ-এ আমি নিয়মিত সিনেমার রিভিও লিখতে শুরু করলাম। বারিসাবের মতে, ওই রিভিউ লেখার মধ্যে দিয়েই নাকি গল্পলেখক মান্টোর জন্ম। মির্জাসাব, আমি তখন একসঙ্গে অনেক কাজ করতে চাইছিলাম। হাসান আব্বাসের সঙ্গে মিলে অস্কার ওয়াইল্ডের নাটক ভেরা অনুবাদ করে ফেললাম। এক বোতল মদ নিয়ে গেলাম আখতার শেরানির কাছে। সারা রাত ধরে শেরানিসাব মদ খেলেন আর আমার পাণ্ডুলিপি সংশোধন করলেন। সেই সময় অনেক রাশীয়ান গল্পও অনুবাদ করেছিলাম। হুমায়ুন আর আলমগীর পত্রিকায়।
একদিন হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল মাসাওয়াৎ। বারিসাব লাহোরের একটা কাগজে কাজ নিয়ে চলে গেলেন। এর মধ্যে আরও কত কিছুই না ঘটেছিল। আমি, আবু সইদ কোরেশী, আব্বাস, আশিক বারিসাবকে নিয়ে অমৃতসরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতাম। আমাদের দলটার নাম দিয়েছিলাম ফ্রি থিংকার গ্রুপ। আমরা যা খুশি তা-ই করতে পারি, ভাবতেও পারি। বিপ্লব করার কথাও ভেবেছিলাম। আমি আর আব্বাস ম্যাপ দেখে সড়ক পথে রাশিয়াতে যাবার প্ল্যানও করেছিলাম। আমি বারিসাব লাহোর চলে যাওয়ার পর, আমি তো আবার বেকার।
লেখাতেও আর মন বসাতে পারি না। এক এক সময় মনে হয়, দূর শালা, জুয়ার ঠেকেই চলে যাই, সময়টাতো কেটে যাবে। কিন্তু জুয়া খেলার আগ্রহ আর তখন আমার ছিল না মির্জাসাব।
খবর এল, বারিসাব খুল নামে নতুন সাপ্তাহিক পত্রিকা শুরু করেছেন। আমি আর হাসান আব্বাস গিয়ে তাঁর সঙ্গে কাজে জুতে গেলাম। পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই বেরোল বারিসাবের প্রবন্ধ ফ্রম হেগেল টু মার্ক্স।…কী হল? আপনার সবাই এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? চোখ দেখে মনে হচ্ছে ঘুম পেয়েছে আপনাদের সকলের? মির্জাসাব, আপনারও? মাফ কিজিয়ে ভাইজানেরা, আমার বলার কথা কিস্মা, আর আমি কখন যে ইতিহাসের খপ্পরে পড়ে গেছি, বুঝতেও পারিনি। এখন আমারই হাসি পাচ্ছে। শালা, এ যেন আত্মজীবনী লিখতে বসেছি আমি। এই জন্য মাঝে মাঝে নিজেকে গালাগালি দিতে ইচ্ছে হয়, শালা শুয়ার কাঁহি কা, কবরে এসেছ তুমি আত্নজীবনী মারাতে! কিন্তু একটা কথা বলে নিতে দিন।খুলক-এর ওই সংখ্যাতেই কিন্তু আমার প্রথম গল্প তামাশা বেরিয়েছিল। গল্পতা নেহাতই কাঁচা ভেবে নিজের নাম দিইনি। সেই গল্পের বিষয় ছিল একটা সাত বছররে ছেলের চোখে দেখা ১৯১৯-এর মার্শাল আইনের দিনগুলো। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯১৯-এ আমার বয়সও ছিল সাত। আমার আফসানার ভেতরে এভাবেই আমি বারবার মিলেমিশে গেছি।
আচ্ছা, আমাদের মদের আড্ডার কিছু কিস্সা না হয় বলা যাক। দেখুন, দেখুন, মির্জাসাব, সবার চোখ কেমন চক চক করে উঠেছে। লাভ কী ভাই? এই কবরে দারু কোথায় মিলবে? গোরু যেমন জাবর কাটে, নেশ-ভাঙের দিনগুলো নিয়েই জাবর কাটুন, তাতে একটু নেশাও হতে পারে। বারিসাব বলতেন, আব্বাস আর আমার মতো মাতাল নাকি হয় না। সত্যি বলতে কী, খারাপ কথার জন্য মাফ করবেন, যাকে বলে পোঁদ উল্টে খাওয়া, আমি আর আব্বাস সে ভাবেই মদ খেতাম। মদের ছিপি সবসময় খুলত আবু সয়ীদ কোরেশি। তারপর আর দেখে কে? আর বারিসাব? এমনিতেই তো সবসময় কথা বলেন, একগ্লাস পেটে পড়লেই যেন ফোয়ারা ছুটত কথার। আমি আর আব্বাস তো হারামি, মনে মনে বলতাম, বলুন যত খুশি কথা বলুন হুজুর, কিন্তু আমরা তো মাল মেরে ফাঁক করে দিই। বারিসাবের তো বক্তৃতা দিতে পারলেই নেশা হত। কিন্তু সভাসমিতিতে বক্তৃতা করার সাহস তার ছিল না। সব আমাদের সামনে, মাল টানতে টানতে।
তবে মজার মানুষ তো, বারিসাব না থাকলে ঠেক যেন জমত না। একদিন সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। আমি জানলার পাশে বসে আছি। বারিসাব হেসে বললেন, কী, মিঞা, হাল কেমন?
-পানি কোথায়, যে হাল কেমন বুঝব?
তিনি দুচোখে দুষ্টু হাসি ছড়িয়ে বললেন। দাঁড়াও, দাঁড়াও এখুনি আসছি। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এলেন। কাপড়ে জড়ানো মদের বোতল। আমি কিছু বলার আগেই ছিপি খোলা হয়ে গেছে। ততক্ষণে আব্বাসও হাজির। সব জানলা-দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল। আব্বাস বাইরের কুয়ো থেকে লোটায় জল নিয়ে এল। তারপর আসর জমজমাট। একসময় বারিসাবকে খেপানোর জন্য আব্বাস বলল, এ-বাড়িতে সবাই আপনাকে সম্মান করে। আপনি নামাজি মানুষ বলে বিবিজানও আপনাকে শ্রদ্ধা করেন। তিনি হঠাৎ এসে পড়লে কী হবে?
বারিসাব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি তা হলে জানলা দিয়ে পালিয়ে যাব, আর কোনও দিন তাঁকে মুখ দেখাব না।
বারিসাবের যে ভীরুতার কথা বলছিলাম, তা এইরকম। আর এই ভীরুতার জন্যই বারিসাবের মতো মানুষ যা করতে পারতেন, তার কিছুই তিনি করেননি। ব্রিটিশ হাই কমিশনারের অফিসে চাকরি নেবার পর তো আমাদের থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন। মাঝে মধ্যে রাস্তায় দেখা হয়ে যেত। তিনি আমাদের চিনতেই পারতেন না। তার মৃত্যুর দুদিন আগে জোহরাচকে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সমঝোতা করতে করতে একটা মানুষ কতটা ভেঙে পড়তে পারে, তাঁকে দেখে বুঝেছিলাম। আমার সত্যিই দুঃখ হয়েছিল। এই সে-ই বারিসাব, যাঁর হাত ধরে মান্টোর নতুন জন্ম হয়েছিল?
ভাইজানেরা একটু ধৈর্য ধরে শুনুন। বারিসাব সম্পর্কে গঞ্জে ফেরেশ্তে-তে আমি স্পষ্টই লিখেছিলাম, সমাজসংস্কারক হওয়ার খুবই সাধ ছিল বারিসাবের। ইচ্ছে ছিল গোটা দেশ এক ডাকে তাঁকে চিনবে। তিনি হবেন জাতির বরেণ্য পথিকৃৎ। সব সময় ভাবতেন, এমন কিছু। করবেন, যাতে আগামী প্রজন্ম তাঁকে মনে রাখবে। কিন্তু সেজন্য যে তাকৎ-এর প্রয়োজন হয় তা ছিল না বারিসাবের। তিনি শুধু দুচার পেগ খেয়ে হিরামান্ডির মেয়েদের সঙ্গে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে যেতেন। তারপর ফিরে এসে অজু করে নামাজ পড়তেন। আমার সত্যিই দুঃখ হয় মির্জাসাব, মানুষ নিজের পিঠের চামড়া বাঁচাতে এতটাই নীচে নামতে পারে? কবরের কোথাও তো বারিসাবও শুয়ে আছেন, হয়তো আমার কথাও শুনছেনও। কিন্তু এখানে তো পালিয়ে যাবার জন্য জানলা নেই। পালিয়ে যাওয়ার জন্য কোনও জানলা খোলা থাকে না, তাই না, মির্জাসাব? এই জীবনের দাম সুদে আসলে মিটিয়ে যেতে হবে এখানেই। মাফ করবেন ভাইজানেরা, আবার কয়েকটা বড় বড় কথা বলে ফেললাম। কথা কী জানেন, বারিসাবকে যে আমি মনে প্রাণে ঘৃণাও করতে পারলাম না, শুধু অনুকম্পা ছাড়া আর কিছু নেই। আমার কী মনে হয় জানেন, যে অনুকম্পা পায়, তার চেয়েও খারাপ মানুষ যে অনুকম্পা করে।
না, আর এই সব নৌটঙ্কিবাজি নয়, তার চেয়ে হিরামান্ডি নিয়ে কথা বলা ভাল। দেশভাগের আগে লাহোরকে কী বলা হত জানেন তো? প্রাচ্যের প্যারিস। আর হিরামান্ডি হচ্ছে তার জান। অনেকে বলত টিব্বি।
টিব্বি মে চল কে জলবা-ই-পরওয়ার দিগর দেখ
আরে য়ে দেখনে্ কি চিজ হ্যয় ইসে বার বার দেখ
দেওয়ালে ঘেরা পুরনো লাহোরের রোশনির আর এক নাম হিরামান্ডি। এখানেই তো আমি সুলতানা, সৌগন্ধী, কান্তাদের খুঁজে পেয়েছিলাম ভাইজানেরা। হিরামান্ডি মানে যদি ভাবেন, শধু কতগুলো মেয়ের মাংসের স্তৃপ তা হলে ভুল করবেন। একসময় হিরামান্ডি বায়েফদের কাছে। আদাব আর তহজিব শিখতে আসত নবাব-বাদশা, রাজা-মহারাজাদের ছেলেরা। তাবায়েফরাই তো শেখাতে জানত আদব কায়দা। নাচে-গানে-কটাক্ষে গুগু-তে। মির্জা রুশোয়ার উমরাও জান যারা পড়েছেন, তাঁদের কাছে আর নতুন করে কিছু বলার নেই। আর আমাদের মির্জাসাব তো সবই জানেন। কত মশহুর তবায়েফের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে মির্জাসাবের। তবায়েফদের কোঠা তো শুধু মস্তি লোটার জায়গা নয়, সেই মহফিলে যেতে হলে তার তরিকাও শিখতে হবে। যার তার গায়ে কেউ হাত দিতে পারত নাকি? আশনাই-এর ব্যাপার ছিল। দিল এ রং ধরাতে পারলে, তবেই না তার সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার কথা ওঠে। না হলে ঠুংরি, দাদরা, গজল শোনো, কখক দেখো, তারপর টাকা ফেলে ঘরে ফিরে যাও।
হ্যাঁ, আপনি হিরামান্ডির কোনও কোঠার সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। সেখানে দালাল আছে, ফুলওয়ালা আছে। দালালের সঙ্গে কথা বলে তবেই না আপনি কোঠায় পৌঁছাতে পারবেন। কিন্তু কোঠায় যাওয়ার আগে ফুলওয়ালার কাছ থেকে মালা কিনে কবজিতে জড়িয়ে নিতে হবে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে আপনি রংমহলে এসে পৌঁছালেন। ঝাড়বাতির আলো, দেওয়ালে দেওয়ালে আয়না, খান্দানি সব ছবি, ফুল আর আতরের সুবাসে আপনার মন এক নিমেষে যেন একটা বাগান হয়ে গেল, আর গাছে গাছে ডেকে উঠল কোকিলেরা। মেঝেতে কার্পেটের ওপর পাতলা সাদা চাদর পাতা আছে, তাকিয়াও মজুত, আপনি ঠেস দিয়ে বসুন। বাইজি এসে বসবেন একেবারে মাঝখানে। তাঁর পিছনে সারেঙ্গি, বীণা, তবলার শিল্পীরা। ওই যে, বয়স্ক মহিলাটি একটু দূরে বসে আছে দেখছেন, তিনি এই কোঠির মালকিন। একসময় নিজেও তবায়েফ ছিলেন, এখন সব দেখভাল করেন। নতুন নতুন তাবায়েফদের রেওয়াজ করিয়ে খুবসুরত করে তোলেন। মালকিনের পাশেই রাখা আছে সোনালি ও রুপালি তবক দেওয়া পানের খিলি-ভরা রুপোর খাসদান। শ্বেতপাথরের জলচৌকির ওপর সোনার কাজ করা গোলাপপাশ। একটা পাত্রে দেখবেন জাফরানমেশানো কুচো সুপুরি, মশলা, জর্দা। মালকিনের প্রথমে সবার সঙ্গে বাতচিত করবেন, বুঝে নেবেন কোন মেহমানের তারিকা কেমন। এরপর এক তরুনী সারা ঘর ঘুরে ঘুরে সবার হাতে পানের খিলি তুলে দেবে। তখন কী করতে হবে আপনাকে? অন্তত একটা রুপোর মুদ্রা তার হাতে দিতেই হবে। এবার বাইজি এলেন সিল্কের সালোয়ার-কুর্তা পরে, কুর্তার বুকে সোনা বা রুপার জরির কাজ করা বাহারি নকশা। মুখ ঢাকা আছে হালকা ওড়নায়, যেন একখণ্ড কুয়াশা ছড়িয়ে রেখেছেন মুখের ওপর। গয়নাগুলো ঝলসাচ্ছে আলোয়।
বাইজি এবার গান ধরবেন, প্রত্যেক মেহমানের জন্য আলাদা আলাদা গান, গাইতে গাইতে আপনার দিকে তাকিয়ে চোখ ঠারবেন, মৃদু হাসবেন। গান শেষ হলে আপনি তাকে কাছে ডাকুন, টাকার তোড়া তুলে দিন হাতে। এবার অন্য মেহমানদের দিকে তিনি নজর ফেরাবেন। গানের সঙ্গে নাচও দেখার ইচ্ছে হতে পারে আপনার। তখন ঘুঙুরের মুখে বোল ফুটবে, গান বাজনা নাচের ছন্দের সঙ্গে মিলেমিশে আওয়াজ উঠচে, ওয়া-ওয়া, বহুৎ খুব, মারহাব্বা, মারহাব্বা। ব্রিটিশরা আসার পর হিরামান্ডির পুরনো জৌলুস চলে গেলেও সূর্যাস্তের আভাটুকু লেগেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে হিরামান্ডি যেন মাংসের কারাগার হয়ে উঠল। কারা আসত তখন? নতুন গজিয়ে-ওঠা ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, যুদ্ধের বাজারে ফোকটে পয়সা করা। লোচ্চারা, যারা তরিকা শব্দটার মানেই জানে না। এই দুই হিরামান্ডিই আমি দেখেছি। ভাইজানেরা। কোঠার বাইজিদের কল-গার্ল হয়ে যেতে দেখেছি, যারা টাকা হাতে পেলেই যে কোনও হোটেলের বিছানায় আপনার সঙ্গে গিয়ে শুয়ে পড়বে। কিন্তু আমার কাছে তো হিরামান্ডি মানে সোনার জলে করা মিনে করা একটা ছবি।
মাংস নয়, মহব্বত-এর জন্যই এখানে আমি মানুষকে ফতুর হয়ে যেতে দেখেছি। তার নাম আমি বলব না; সে ছিল পাঞ্জাবের এক জমিদার। হিরামান্ডির জোহরাজানের প্রেমে পড়েছিল সে। প্রায়ই সে হিরামান্ডিতে এসে জোহরাজানের সঙ্গে থাকত। লোকে বলত, জোহরাজানের যৌবন নাকি তার হাতেই তৈরি। মানেটা বুঝতে পারছেন তো ভাইজানেরা? হঠাৎ একদিন জমিদারের শখ হল, সে গাড়ি কিনবে, আর গাড়িতে চড়িয়ে জোহরাকে নিয়ে লাহোরের পথে পথে ঘুরে বেড়াবে। জমিদার হলে কী হবে, টাকাপয়সা বেশী জমাতে পারেনি; জোহরার পরিবারের পিছনেও দেদার টাকা খরচ করেছিল সে। কিন্তু গাড়ি যে কিনতেই হবে। শেষে। একটা গাড়ির কোম্পানির কাছ থেকে ধারে গাড়ি কিনে ফেলল সে। খেতির ফসল বিক্রি করে ছমাস অন্তর টাকা দিয়ে ধার শোধের কড়ার করেছিল, তাতে তিন বছরেই সব টাকা শোধ হয়ে যাওয়ার কথা। গাড়ির কোম্পানী দুবার সময় মত টাকা পেল। কিন্তু তারপর থেকে আর জমিদারের পাত্তা নেই। সে যে কোথায় গেছে, কেউ জানে না। শুধু জানা গেল, জমিজিরেত বেছে জোহরাজানকে সঙ্গে নিয়ে সে কলকাতায় চলে গেছে। গাড়িটা দেশের বাড়িতেই রাখা ছিল, তাই কোম্পানি গাড়িটা অন্তত ফেরত পেল।
এরপর বছর দশেক কেটে গেছে, সেই গাড়ির কোম্পানির ম্যানেজার তাঁর কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে হিরামান্ডিতে এসেছেন রঙিন সন্ধ্যা কাটাবেন বলে। একটা কোঠার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি সেই পালিয়ে যাওয়া জমিদারকে দেখতে পেলেন; তার চেহারা তখন একেবারে ভেঙে গেছে, চোখে ঘোলাটে দৃষ্টি।
-জোহরাজানের গান শুনবেন হুজুর? জমিদার এগিয়ে এসে ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করল।
-আপনার এ কী অবস্থা হয়েছে? কোথায় ছিলেন এতদিন?
-সব নসিবের লিখন হুজুর। জোহরাকে নিয়ে আমি কলকাতায় গিয়েছিলাম। কত চেষ্টা করলাম, যাতে ওকে ফিল্মে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।
-তারপর?
-কিছু হল না। আমার যেটুকু টাকা পয়সা ছিল, তাও উড়ে গেল। ফিলিমে ওরা কিছুতেই জোহরাকে জায়গা দিল না।
-তাই আবার ফিরে এলেন?
-কী করব বলুন? জোহরার জীবনটা তো চালাতে হবে। আমিই বা ওকে ছেড়ে যাব কী করে? তাই এখন ওর জন্য খদ্দের ধরে আনার কাজটা আমাকেই করতে হয় হুজুর।
হিরামান্ডিতে যেমন অনেক রোশনাই, তেমনি এভাবে অন্ধকারও আসে মানুষের জীবনে। ভাইজানেরা, এই অন্ধকারের ভিতরেও আমি একটা জোনাকি জ্বলতে দেখেছি। মহব্বতের জোনাকি। ফতুর হয়ে গিয়েও লোকটা জোহরাজানকে ছেড়ে যায়নি। আশিক থেকে দালাল হয়ে গেছে। কিন্তু তার প্রেম মরে নি। বারিসাবের মতো মানুষেরা হিরামান্ডিতে ওসব দেখতে পান নি। আর আমি হিরামান্ডিতে যেতাম মাংসের ভেতরে লুকানো রত্নের খুঁজতে, এইরকম জোনাকির আলো দেখতে। আল্লার কসম, মান্টো কখনও ওদের সঙ্গে শোয়ার কথা ভাবেনি। সত্যিই কি? নাকি এটাও মিথ্যে বললাম?