১৭. পয়গম্বর, হৃদয়, পথ হৃদয়, খুদাও হৃদয়

তরীক-এ ইশ মেঁ হ্যয় রাহনুমা দিল
পয়ম্বর দিল হ্যয় কিবলহ্ দিল খুদা দিল।।
(প্রেমধর্মে পথপ্রদর্শক এই হৃদয়,
পয়গম্বর, হৃদয়, পথ হৃদয়, খুদাও হৃদয়।)

মুনিরাবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেল, আমার উর্দু গজলের প্রথম দিবান সংকলন করলুম, সেই সঙ্গে ঠিক করলুম, এখন থেকে ফারসিতেই লিখব, ফারসি ছাড়া গজলের রোশনাই তো খোলে না, কিন্তু কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল, মান্টোভাই, শুরু হল আমাকে নিয়ে নসিবের খেলা। হৃদয়ের সঙ্গে আনন্দের যে সম্পর্ক ছিল, তা ভেঙে গেল, শুধু গোপনে, কোথায় যেন টুপ টুপ ফোঁটায় রক্ত ঝরতে লাগল। খুশির সঙ্গে আমাদের যে-সম্পর্ক, তা তো খুব জোরদার, না। মান্টোভাই? খুশি ছাড়া আমরা আর কী চাই জীবনে? আরও কত জোরালো শক্তি এসে এই স্বাভাবিক সম্পর্কটাকে ভেঙে দেয় ভাবুন। একদিন রাতে আমি আমার দিল্কে বললুম, হ্যাঁ হৃদয়কেই তো একমাত্র বলা যায়, সে-ই তো আমাদের এবাদত-গাহ্, আমি তাঁকে বললুম, আমাকে কথা বলার শক্তি দাও, আমি যেন জাঁহাপনার কাছে গিয়ে বলতে পারি, হুজুর, আমিই সব রহস্যের আয়না, আমাকে ঝকমকে করে তুলুন; কবিতা আমার ভেতর থেকে জন্ম নেয়। আমাকে একটু আরাম দিন। হৃদয় আমাকে মুচকি হেসে বলল, বুরবাক কাহিকা, এসব কথা বলার সময় এখন পেরিয়ে গেছে। যদি কিছু বলারই থাকে, তবে শুধু এটুকুই বলল, আমি আহত, আমার ক্ষতের জন্য মলম দিন; আমি মৃত, আমাকে আবার বাঁচিয়ে তুলুন। আমি যেন কারো হাতে আঁকা, বিবর্ণ বুলবুল হয়ে গেলুম; শত গোলাপের গন্ধেও তো সেই বুলবুলের হৃদয় গান গেয়ে উঠবে না।

না, না, ভাইজানেরা, অমন মলিন মুখে শুয়ে পড়বেন না, দুই বদনসিব আত্মার কিস্সা যখন শুনতে শুরু করেছেন, তা শেষতক শোনার দায় তো আপনাদের নিতেই হবে। কিন্তু এতক্ষণ। ধরে আমাদের মহব্বতের কথা শুনতে শুনতে যে -খোঁয়াড়ির ভেতরে আপনারা ডুবে গেছেন, সে -খোঁয়াড়িটা এখনই ভেঙে দিতে চাই না। আর কথা দিচ্ছি, আমার এই অন্ধকারের কিস্সা যতদিন চলবে, মাঝে মাঝে আপনারা আলো-হাওয়া পাবেন ভাইজানেরা, আমি আপনাদের মাঝে মাঝে এমন সব কিস্সা -হিকায়ৎ শোনাব, এমন সব দস্তানগোদের কাছে নিয়ে যাব যে এই জীবনটাকে ভারী পাথরের মতো মনে হবে না। হ্যাঁ, উঠে বসুন সবাই, মহব্বতের নানা কথা – কিস্লাই এখন আপনাদের শোনাতে চাই। সত্যি বলতে কী, জীবনে আমি যতই দোজখের গভীর থেকে গভীরে ঢুকেছি, ততই ইশক – এর স্মৃতিই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই যে জীবন আমাদের, এই যে পয়দা হওয়া, এও ইঙ্ক ছাড়া কী? এ হল ইশক -এ মজাজি, এই দুনিয়ার প্রেম। আর আমরা যতই মৃত্যুর দিকে এগোই, ইশক-এ-হকিকির পথ খুলে যায়। আমাদের সামনে। ইশক-এ-হকিকি তো খোদার জন্যই তুলে রাখতে হয়। তখন আপনার। সামনে আর বেগম ফলক আরা নেই, মুনিরাবাই নেই, মান্টোভাইয়ের বেগু নেই, ইসমত নেই, আছেন শুধু তিনি, অহুমদুলিল্লা। কিন্তু ইশক-এ হকিকির পথে কজন আর যেতে পারে বলুন? পেরেছিলেন মওলা রুমি। আমরা তো এক একটা পতঙ্গ, ইশক-এ-মজাজির ফাঁদেই ঘুরপাক খাই। মজাটা খেয়াল করেছেন, মান্টোভাই? এই দুনিয়ার প্রেম হচ্ছে ই-এ-মজাজি, যেন একটা ছবিকে ভালবাসা, প্রতীককে ভালবাসা; আর ইশক-এ-হকিকি, যা শুধু আল্লার জন্য, তা-ই সত্যিকারের প্রেম। এর মানে কী দাঁড়ায়, বলুন? আমরা সব ছায়াপুতুল, ভালবাসার প্রতিকী অরণ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। ইঙ্ক-এ-হকিকির পথে যদি নাও যেতে পারি, এই বা কম কী, মান্টোভাই? একটা ছবিকে ভালবাসতে পারাও কি কম কথা? এই দুনিয়াদারির জীবন তো ওটুকুতেই ধন্য হয়ে যায়। ছবিকে ভালবেসে তো কেউ মৃত্যুকেও বেছে নেয় -সেই মৃত্যু কি ইশক-এ-হকিকির পথের দিকে তাকিয়ে থাকে না?

তা হলে ভাইজানেরা, আমি না হয় মীরসাবের একটা মনসবির কথা বলি। ইশকের কথা বলতে গেলে মীরসাবের কথাই বারবার বলতে হবে আমাদের। ভালবাসায় আহত, নুয়ে পড়া মানুষ ছিল তাঁর কাছে খাঁচায় বন্দি বুলবুলের মতো, আর সেই বুলবুলের বিলাপ শুনতে শুনতে তার মনে হয়েছিল, আসলে তিনিই ওই খাঁচায় বন্দি পাখি। মান্টোভাই, আপনি কি কখনও দরিয়া-এ-ইশ পড়েছেন? ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন কেন? আরে, আমি তো জানি, আপনি পড়েননি। আমি তো দিল্লিতে কত কত লোককে দেখেছি, কলকাতায় দেখেছি, তাঁরা হিন্দুস্থানের লেখাজোখা পড়তই না, গোরাদের লেখাই ছিল তাদের কাছে শেষ কথা। তা সাদা চামড়া আর ওঁদের তমদুনের প্রতি আমারও একসময় খুব মোহ ছিল। তাঁদের বন্ধু বলেও ভাবতুম, কিন্তু ১৮৫৭ আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। তমদুনের নামে ওরা যে এই দেশে একের পর এক কারবালা তৈরি করতে এসেছে, বুঝতে পারলুম।

না, না, উত্তেজিত হবেন না ভাইজানেরা, দরিয়া-এ ইশক-এর কিস্সাটা এবার আপনাদের শোনাব। এই কিস্সা শোনবার কথা নয় আপনাদের। যদি অন্য কোনও জন্মে যান এই কিস্সার স্মৃতি নিয়ে যেতে পারবেন। যতই বদনসিব হই, আমার আবার এই দুনিয়ায় জন্মাতে ইচ্ছে করে। কেন জানেন? আমরা হলুম আসরাফ-উল-মশ্লাকাৎ, আল্লার তৈরি সেরা জীব, আদম; জিব্রাইলরাও আমাদের সামনে মাথা নুইয়েছিল, ইবলিশ তা করেনি বলে তাঁকে বেহস্ত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আমরা এক-একটা আয়না, ভাইজানেরা, যার ভেতরে খোদা নিজেকে দেখতে পান। আর ইক্ষ হচ্ছে আয়নার গভীরে লুকিয়ে থাকা সেই ছায়া, আপনারা কখনও তাকে দেখতে পাবেন না।

মাঝে দু-একটা কথা বলে নিতে দিন। ভাববেন না, বুড়োহাবড়া গালিব যা মনে আসছে তা-ই বলছে। কিস্স বলারও তো একটা তরিকা আছে। তরিকার প্রথম কথাটা হচ্ছে এই, যে কিস্সার মধ্যে আপনি নেই, তা আপনি বলতে পারেন না। তো কীভাবে থাকেন আপনি একটা কিস্সার মধ্যে? আপনার বাগানের যে-গাছটার কথা আপনি মন দিয়ে বলেন, তা তো বলতে পারেন, গাছটাকে ভালবাসেন বলেই। এই ভালবাসার মধ্যেই আপনি থাকেন; আপনি মানে তো শুধু রক্তমাংসের একটা শরীর নয়, আপনার কত রহস্য, যা দিয়ে আপনি গাছটাকে ভালবাসেন। তাই এত কথা বলছি। মীরসাবের মনসিবগুলো আমি লিখিনি, কিন্তু পাঠক হিসাবে কোথাও তো আমি তাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছি, সেটাই তো থাকা; এভাবেই একজন কবিও তার কবিতার। মধ্যে থাকেন। বাজপাখিটা যখন ওড়ে আকাশে, তার ছায়া পড়ে মাটির বুকে; থাকাটা এইরকম, ছায়ার মতো; আমি নেই, কিন্তু আমি-ই আছি অন্য চেহারায়।

আশিকও সেভাবেই থাকে। সারাজীবন তো সে থাকে না, এমনকী পাশে পাশে থাকলেও সে আসলে পাশে থাকে না। শুধু তার একটা ছায়া থেকে যায়, যাকে আমরা সারাজীবন ভালবাসি। দীর্ঘদিন ধরে চুইয়ে চুইয়ে পড়া রক্তের মতো সেই ছায়া; নগ্ন বালিকার মতো, কোমল, যেন এই মাত্র সে ঘুমিয়ে পড়বে।

দরিয়া-এ-ইশক এমনই এক ঘুমিয়ে পড়ার কিস্সা। ভালবেসে, সেই ছেলেটি, এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি? কে জানে! মেয়েটাও তো জানেনি, ইকের কাছেই একদিন ঘুমোতে যেতে হবে তাকে। ছেলেটি বড় সুন্দর ছিল, ভাইজানেরা। সাইপ্রেস গাছের মতো দীর্ঘ, হৃদয় তার মোমের চেয়ে কোমল, প্রত্যেক শিরা-ধমনীতে ভালবাসার স্রোত। এইরকম পুরুষ পৃথিবীতে মরার জন্যই জন্মায়। না-হলে তাদের জেলখানায় বেগার খাটানো হয়, পাগলাগারদে পাঠিয়ে মারা হয়। মীরসাবেকে মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখতুম আমি, সেই কুঠুরিতে, যেখানে তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কুকুরের মতো গুটি পাকিয়ে শুয়ে আছেন। একদিন তাঁর সামনে মেহর নিগার ফুটে উঠলেন।

-তুমি? মীরসাব অস্ফুটে বললেন।

-এভাবে বেঁচে থাকবে?

-খোয়াব-এ-খেয়াল বেগম।

-শুধু আমার জন্য?

-না।

-তা হলে?

-মেহর নিগার। বেগম, একটা নাম আমাকে ভালবেসেছিল। আমি তার জন্যই এভাবে বেঁচে আছি।

-আর আমি?

-তুমি কেউ নও, তুমি তো ভয় পেয়েছিলে। সবাইকে সব কথা বলে দিয়েছিলে।

-আমাকে কেউ বাঁচতে দিত না, মীর। ওরা আমাকে গোরে পাঠিয়ে দিত।

-জানি।

-তুমি আমাকে নফরৎ কর?

-না। মেহর নিগারকে আমি এখনও দেখতে পাই। সে এখনও আমার দিলমঞ্জিলে বেঁচে আছে। যখন সে আমার জীবনে এসেছিল, সে তো অনেক পুরনো দিকের কথা।

-বলল, আমাকে ঘেন্না করো।

-না।

-কেন?

-তুমি আজ আর আমার জীবনে নেই, বেগম। একটা নাম পড়ে আছে। খোদার দেওয়া একটা নাম, আমি তাকেই ভালবাসি।

ভালবাসার নদীতে খোদার দেওয়া কত নাম যে এভাবে ভেসে যায়।

না, আমি আপনাদের ঠকাব না। সেই সুন্দর ছেলেটার কিস্সাতেই ফিরে আসছি, দরিয়া-এ ইশক-এ ডুবে যার মৃত্যু হয়েছিল। তার নামও ছিল ইউসুফ। খোদা কী যে এক দিন আনলেন তার জীবনে, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার চোখ আটকে গেল এক মহলের জানলায়। কে। ছিল সেই জানলায়? নিয়তি বলুন, আর আশিকই বলুন, তারই মুখ সে দেখতে পেল জানলায়। শিকারীর মতো দুটি চোখ যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে, ইউসুফের মনে হল, মরার জন্যই সে ওই চোখের দিকে তাকিয়ে প্রেমে পড়ে গেল। ইউসুফ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল রাস্তায়। মেয়েটি তোয়াক্কাও করল না, ওড়নায় মুখ ঢেকে জানলা থেকে হারিয়ে গেল। কিন্তু ইউসুফ তো দিওয়ানা বেতাব। হাফিহসাব যেন তার মনের নাগাল পেয়েছিলেন!

দস্ত অয তলব ন দারম
তা কামে মন রব আয়দ
য়া জাঁ রসব ব জানা
যা জাঁ যূ তন বর আয়।

বু কুশাএ তুরবতমরা
বাদ অয বফাৎ ব বনিগর
কয আতিশে দরম
দূদ অয কফন বর আয়দ
(আকাঙ্খ থেকে সরাব না হাত
বাসনা আমার সিদ্ধ না হলে;
হয় পাবে প্রাণ বধূর নাগাল,
নয়ত যাবে সে দেহ ছেড়ে চলে।

মরলে আমার কবরটা খুঁড়ে,
দেখো তুমি, গেছে অন্তরে রয়ে
যেহেতু আগুন, কাফন আমার
রয়েছে ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার হয়ে।)

সেই দিন থেকে ইউসুফ পাথরের মূর্তির মতোই সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইল জানলার দিকে তাকিয়ে, কখন আবার সেখানে পূর্ণিমার চাঁদ দেখা দেবে। রাস্তা দিয়ে লোকজন যায়, ইউসুফের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, ভাবে এ ছোকরা নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছে। কারোর কারোর কষ্টও হয়, ইউসুফকে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে ভাই, কোন দুঃখে এমন পাথর হয়ে আছ? ইউসুফ কথা বলে না, শধু জানলার দিকে আঙুল তুলে দেখায়। একদিন সবাই রহস্যটা বুঝতে পারল। আরে, এ ছেলে তো বিলকিসের জন্য দিওয়ানা হয়ে গেছে। বলতে ভুলেছি, ভাইজানেরা, মেয়েটির নাম ছিল বিলকিস। তো তার বাপ-ভায়েরা প্রথমে ভাবল, এ ছোকরাকে নিকেশ করে দিতে হবে; পরে মনে হল, খুনের দায়ে ধরা পড়লে তাদের মহলে কাক-চিলও এসে বসবে না। কী করল জানেন? রটিয়ে দিল, ইউসুফ পাগল। কেউ পাগল হয়ে গেছে, কথাটা রটিয়ে দেওয়ার জন্য তো কোনও দায় নিতে হয় না। একজন মানুষের জীবন নরক। করে দেওয়ার জন্য তো কোনও দায় নিতে হয় না। একজন মানুষের জীবন নরক করে দেওয়ায় জন্য এর চেয়ে ভাল উপায় আর কী আছে? ও পাগল? বেশ, তা হলে এবার ওর গায়ে। থুতু ফ্যালো, পাথর ছোঁড়ো, ওকে শেকল দিয়ে বাঁধ, কুঠুরিতে আটকে ফেলো। কিন্তু ইউসুফের গায়ে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়েও কিছু হল না, রক্তাক্ত হয়েও সে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল।

হযার দুশ্মনম অর
মী কুনন্দ ক হনাক
গরম তু দোস্তী অয
দুশ্মনাঁ ন দদারম বাক।

মরা উম্মীদে বিসালে-তু
যিন্দা মীদারদ
বগরনা হরদমম অয
হিজতস্ত বীমে হলাক।
(আমার হাজারো দুশমন যদি
আঁটে মতলব আমাকে মারার,
আমি একটুও ভয় করব না
যদি কাছে থাকো, বন্ধু আমার।

মিলবেই সান্নিধ্য তোমার–
বাঁচায় আমাকে এই আশ্বাস;
তুমি কাছে নেই অহরহ তাই
দেখাচ্ছে ভয় সমূহবিনাশ।)

বিলকিসের বাপ-মা তখন ঠিক করল, নদীর ওপারের শহরে তার চাচার বাড়িতে বিলকিসকে রেখে আসাই ঠিক হবে। গোপন পালকিতে চাপিয়ে বের করা হল বিলকিসকে, সঙ্গে তার পুরনো দাসী। ইউসুফ যেন আশিকের গন্ধ পেয়েছিল, সে পালকির সঙ্গে দৌড়তে লাগল, আর চিৎকার করছিল, রহ করো মেরি জান, একবার মুঝসে বাত করো। বিলকিস কোনও কথা বলেনি, কিন্তু সেই দাসীর মন উথালপাথাল করে উঠেছিল। পালকি থেকে মুখ বের করে সে বলেছিল, আরও কিছুদিন অপেক্ষা করো, আমার বেটির সঙ্গে তোমার দেখা হবেই। পালকি নদীর ঘাটে গিয়ে পৌঁছল, বিলকিস নৌকায় উঠে গেল, ইউসুফ নৌকার দিকে তাকিয়ে ঘাটেই বসে রইল, নৌকো যখন মাঝদরিয়ায়, দাসী বিলকিসের একপাটি চটি নদীতে ছুঁড়ে দিয়ে ইউসুফকে চেঁচিয়ে বলল, আমার বেটিকে সত্যিই ভালবাসলে চটিটা ফিরিয়ে এনে দাও। দাসী সত্যিই চেয়েছিল, ইউসুফ আর বিলকিসের যেন মিলন হয়, সে তো জানত না ইউসুফ সাঁতার জানে না। ইউসুফ কিন্তু জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তার পর খাবি খেতে খেতে তলিয়ে গেল। বিলকিস নৌকায় দাঁড়িয়ে ইউসুফের মৃত্যু দেখতে পেল। এ কে? বেহস্তের কোন ফুল? তাঁকে। এত ভালবাসত? বিলকিস কোনও কথা বলতে পারেনি, তার হয় তো মনে হয়েছিল, বাহার তো এসে গেছে, ফুলও ফুটেছে গাছে গাছে, তবু হে প্রিয় বাগান আমার, তাঁকে কেন এভাবে কেড়ে নিলে?

বাহার অওর বাগ। এই দুটো শব্দ বলতে গেলে আমার গলা কেন এমন ধরে আসে, বলুন তো মান্টোভাই? শব্দ দুটো যখন উচ্চারণ করি, মনে হয়, মুখের ভেতরে গোলাপের পাপড়ি পাখনা মেলেছে। তবু এই দুটি শব্দ মৃত্যুর কুয়াশায় ঢাকা কেন বলুন তো? ও বাহার, ও বাগ। বসন্ত আর বাগান কেন আমাকে বারবার মৃত্যুর কথাই বলে?

ভয় পাবেন না, ভাইজানেরা, কিস্যার কথা আমি ভুলিনি। শুধু বলতে বলতে এক একটা শব্দের জন্য এত কষ্ট হয়, মনে হয় তাদের জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। তো যে কথা বলছিলুম, ইউসুফ তো জলে ডুবে মারা গেল। বিলকিস কিছুদিন চাচার বাড়িতে থাকার পর তার বাপ-মা ভাবল, ছোঁড়াটা তো মরেইছে, এবার মেয়েকে ফিরিয়ে আনাই যায়। সেই নদীপথেই তো ফিরে আসা। বিলকিস নৌকায় উঠে দাসীকে বলল, খানম, একবার এই নদীকে দেখতে দেবে? আমি তো এমন নদী কখনও দেখিনি।

-দেখো না বেটি, মন ভরে দেখ। একবার নদিকে যদি দেখতে থাকো, তোমার দেখা আর ফুরোতে চাইবে না।

নদীর সম্পর্কে কত কথাই না জানতে চাইল বিলকিস, নদীর পাড়ে পাড়ে যত বসতি, সেখানে কারা থাকে, কেমন মানুষ তারা, কী করে-কথা যেন তার ফুরোতেই চায় না। শেষে সে জিজ্ঞেস করল, খানম, সে কোথায় ডুবেছিল বল তো, চিনতে পারো?

-কেন বেটি?

-সেখানে কি খুব জল?

-মাঝদরিয়া যে।

-আমায় দেখাবে।

-কী দেখবে বেটি?

-মাঝদরিয়ায় কত জল।

-দেখাব বেটি। মাঝদরিয়ায় কত জল, কত স্রোত, অতচ কী যে শান্ত। খোদা জানেন, কেন এমন হয়!

বিলকিস আপন মনে বিড়বিড় করে কথা বলছিল, খানম তা শুনতে পায়নি। বিলকিস কী বলছিল জানেন?-সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা একা কথা কয়! এসব কথা মীরসাব যে কোথায় পেলেন, আর বিলকিসের মুখে বসিয়ে দিলেন, খোদাই জানেন। মান্টোভাই, আপনি কি শেরটা কোথাও শুনেছেন?

নৌকো মাঝদরিয়ায় পৌঁছলে খানম বিলকিসকে বাইরে ডেকে আনল।- ওই যে বেটি, ওই ওখানে ইউসুফ ডুবে গেছিল। বিলকিস কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, খানম কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে নদীর বুকে ঝাঁপ দিল। তারপর অনেক খুঁজে খুঁজে নদীর গভীর থেকে তুলে আনা হল ইউসুফ-বিলকিসের মৃতদেহ। একে অন্যের হাত জড়িয়ে তারা জলের তলায় শুয়েছিল। জীবনে যা পায়নি, মৃত্যু তাদের সেই দান দিয়ে গেল। এরই নাম ইঙ্ক -এ-মজাজি থেকে ইক -এ হকিকির দিকে যাওয়া ভাইজানেরা।

আমাদের জীবনে ইউসুফের মতো শহাদাৎ আসে না। কেন জানেন? সারা জীবন প্রতীকের অরণ্যে পথ হারিয়ে আমরা ঘুরপাক খাই। জীবনকে যে বাজি ধরতে পারে, একমাত্র সেই পৌঁছতে পারে ইশক-এর কাছে। তার কোনও নাম নেই, সে অনাদি, অনন্ত এই বিশ্বসংসারের সৌন্দর্য। আমরা কাকে সৌন্দর্য বলি? সুরা, বাহার, যৌবন, ইক। এরা বড় তাড়াতাড়ি ঝরে যায়। যে গোলাপের রূপ আপনারা দেখেছেন, সে হয়তো কোনও সুন্দরীর কবরের মাটি খুঁড়ে জন্মেছিল। সুন্দরীও একদিন কবরে গেছিল, গোলাপও একদিন ঝরে গেছে। যে বুলবুল গান গায়, তার গানে হয়তো কোনও মৃত শায়রের কবিতা লুকিয়ে থাকে। কিন্তু সেই বুলবুলও তো একদিন মরে যায়। এই দুনিয়া সৌন্দর্য বেশীদিন বাচে না ভাইজানেরা; গোলাপের গন্ধ, বুলবুলের গান আর আমাদের জীবন কত তাড়াতাড়ি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আর যৌবন, এ জীবনের বাহার, আরও তাড়াতাড়ি ঝরে যায়। শুধু খোদার দুনিয়াদারির সৌন্দর্যই অবিনশ্বর।

সে সৌন্দর্য পথের ধুলোয় দেখতে পাবেন, মান্টোভাই। এই ধুলো থেকেই আদমের জন্ম, আর ধুলোতেই সব মানুষ একদিন মিশে যায়। আমি একটা কথাই বুঝেছি, ভাইজানেরা, যদি খোদার পথেও আমরা না যেতে পারি, তো ঠিক হ্যায়, কিন্তু আতরের শিশিটাকে কষ্ট দিও না। কী মান্টোভাই, অমন জুলজুল করে তাকিয়ে আছেন কেন? আরে, এই সামান্য কথাটা বুঝলেন না? দিল-এর কথাই তো বলছি। দিল একটা আতরের শিশি কি না, বলুন? মীরসাবকে কথাটা। একজন পীর বলেছিলেন, বেটা, কারোর আতরের শিশিটা কখনও ভেঙে দিও না। সেখানেই তো খোদাতালার ঘর। এই খাঁচার ভেতরে কতটুকু ছোট সে, তবু তারই মধ্যে মহাসাগর, তারই ভেতরে লুকিয়ে আছে মরুভূমি। এই কথা যে জানে, সেই তো বলতে পারে, কে তুমি নবাব, কে তুমি উজির, আমি কি পরোয়া করি, দ্যাখো, আমি কি ফকির নই?

আমি তো যমুনার জল থেকে উঠে আসা দরবেশবাবার হাত ধরেই একদিন চলে যেতে চেয়েছিলুম অজানার পথে। তিনি আমাকে সঙ্গে নিলেন না, বললেন, আয়নাটাকে বারবার মোছ, তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে শব্দের কুহক, নিশিডাক। তারপর একদিন ভেঙেই গেল, আমি কী দেখতে পেলুম জানেন? আরে, যে -ফকির হয়ে জন্মেছিলুম, আমি তো সেই ফকিরই আছি, মাঝখানে একটু মদ-মেয়েমানুষ-নবাবের দেওয়া খেতাব। এসব ঝরে যেতে আর কদিন সময় লাগল?

১৮৫৭-র বেশ কয়েক বছর পরের কথা। একজন ফকিরসাব এসে আমার দরজার সমানে গান গাইতে গাইতে ভিক্ষা চাইছিলেন। আমি চমকে উঠলাম। এ তো আমার লেখা গজল। ফকিরসাব কোথায় পেলেন? আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলুম, এই গান কার লেখা?

-এসব তো পথেই লেখা হয়, হুজুর।

আমি ফকির হতে পেরেছি কি না জানি। মান্টোভাই, আমার গান তো ফকিরির পথে চলে যেতে পেরেছে। ধূলায় ধূলায় যাঁর চরণ পাতা, সেই চরণের আলপনায় মাথা রাখতে পেরেছে। কবির কাছে এই তো তার রিজবানের বাগিচা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *